৪. জ্ঞান (c. ৭০০-৬০০ )

. জ্ঞান (সি. ৭০০ থেকে ৬০০ বিসিই

বেদান্ত বা ‘বেদের শেষ’ হিসাবেও আখ্যায়িত উপনিষদ নামে পরিচিত ধর্মশাস্ত্রে বৈদিক ধর্ম পূর্ণতা লাভ করে। অন্তহীন অভিবাসন আর নতুন নতুন এলাকা দখলের ভেতর দিয়ে প্রাচীন বৈদিক ধর্ম অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এক সংঘাতময় বিরোধপূর্ণ বিশ্ব থেকে এর আবির্ভাব ঘটেছিল। উপনিষদগুলোয় একদল অতীন্দ্রিয়বাদী অন্তস্থঃ জগতের শান্তিপূর্ণ অধিকারের কাজে নেমেছিলেন। ধর্মীয় ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অগ্রযাত্রাকে চিহ্নিত করেছে এটা। প্রবল অন্তবীক্ষণ বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের জায়গা দখল করেছিল, কিন্তু তারপরেও উদ্ভাবন হিসাবে বিবেচনা না করে একে বরং প্রাচীন ঐতিহ্যের পূর্ণায়ণ মনে করা হয়েছে। সপ্তম ও দ্বিতীয় শতাব্দী সময়কালে সৃষ্ট তেরটি ধ্রুপদী উপনিষদকে ঋণ বেদের মতো সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। এগুলো ছিল শ্রুতি, ‘প্রত্যাদিষ্ট’; অনন্য- সাধারণ ধর্মশাস্ত্র হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। এগুলো ব্যাখ্যা করা সহজ না হলেও অন্য যেকোনও বৈদিক সাহিত্যের চেয়ে হিন্দু আধ্যাত্মিকতাকে আকার দানে ঢের বেশি প্রভাব রেখেছে। 

প্রথম দুটো আদি উপনিষদ ব্রাহ্মণার জগৎ থেকে অখণ্ডভাবে আবির্ভূত হয়েছিল। আরণ্যক বা বনের টেক্সটের মতো এগুলো বিভিন পৌরহিতিক মতবাদে ব্রাহ্মণা ধারাভাষ্যে যুক্ত হওয়া নিগূঢ় অংশ ছিল। খোদ প্রথম উপনিষদ আসলে আরণ্যক নামে পরিচিত। বৃহদারণ্যক উপনিষদ হলো শুক্লা যজুর বেদ বেদ মতবাদের ‘মহান বনের টেক্সট’। শুক্লা যজুর বেদ মতবাদের বিশেষত্ব ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় অনুষ্ঠান বৈদিক ঘোড়া উৎসর্গের আলোচনা দিয়ে শুরু হয়েছে এর। উপনিষদ লেখকরা প্রাকৃতিক জগতের সঙ্গে ঘোড়ার বিভিন্ন অংশ একাত্ম করে প্রচলিত ধারায় বন্ধুর (‘সংযোগ:) ধারণা উল্লেখ করেছেন। মদ্দা ঘোড়ার মাথা হলো ভোর, তার চোখজোড়া সূর্য, আর শ্বাসপ্রশ্বাস হাওয়া। কিন্তু উপনিষদে আচার-অনুষ্ঠানগুলো মানসিকভাবে পালন ও সম্পাদন করা সম্ভব ছিল। দৈহিক, বাহ্যিক উৎসর্গের সঙ্গে আর এর সম্পর্ক ছিল না, বরং তা সম্পূর্ণ সাধুর (ঋষি) অন্তরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

মন্ত্র পাঠের দায়িত্ব পাওয়া উদগাতর পুরোহিতদের বৈদিক টেক্সট ছিল ছান্দোগ্য উপনিষদ, পবিত্র শব্দাংশ ‘ওম’-এর উপর ধ্যানের ভেতর দিয়ে সঠিকভাবেই এর সূচনা ঘটেছিল। এর সাহায্যেই উদগাতর পুরোহিতরা প্রতিটি মন্ত্র শুরু করতেন। ভারতে শব্দ বরাবরই স্বর্গীয় ছিল; এটাই ছিল আদি বাস্তবতা, কারণ, বলা হয়ে থাকে, সবকিছুর আবির্ভাব হয়েছে এর ভেতর থেকে। এখন ছান্দোগ্য উপনিষদ একক শব্দকেই সকল শব্দ আর গোটা মহাবিশ্বের ধারকে পরিণত করেছিল। ওম ছিল অস্তিত্ববান সমস্ত কিছুর-সূর্য, চন্দ্র, তারা- মূল সত্তা। শব্দের প্রতিমূর্তিতে এটাই সবকিছুকে একসঙ্গে ধারণকারী পরম শক্তি ব্রাহ্মণ: ‘গাছের কাণ্ড যেমন করিয়া পাতা সকল ধরিয়া রাখে, ঠিক সেইরূপ ওম ধারণ করে বাণী সকল। নিশ্চয়ই সমগ্ৰ বিশ্ব ওম ব্যতিত আর কিছুই নহে।” কিন্তু মন্ত্র স্রেফ জপকারী পুরোহিতের বাহ্যিক দুয়ে কোনও বাস্তবতা ছিল না। মানব দেহ, তার শ্বাসপ্রশ্বাস, কথা, চোখ, কান আর মনেরও সাথেও একাত্ম ছিল। ছান্দোগ্য উপনিষদ দর্শকের মনোযোগ অন্তরের দিকে চালিত করেছে। পুরোহিত তাঁর মনে দৃঢ়তার সাথে এইসব সংযোগ ধারণ করে এই পবিত্র শব্দাংশ উচ্চারণ করার সময় আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের লক্ষ্য অর্জন করতেন, কারণ ওম-ই ব্রাহ্মণা হওয়ায় ‘অমর ও নির্ভীক’। এই অমর ও ভয়হীন শব্দ উচ্চারণকারী কোনও ব্যক্তি এই বন্ধুদের কথা ধ্যান করার সময় নিজেই অমর ও ভীতি মুক্ত হয়ে যাবে। 

এটাই আমাদের উপনিষদের দর্শনের মূল বিষয়ে নিয়ে আসে। আচারের বাহ্যিক পালনের দিকে মনোযোগ স্থির ছিল না, বরং তার অন্তস্থঃ তাৎপর্যের দিকে চালিত হয়েছিল। আচার ও মহাবিশ্বের মাঝে সংযোগ (বন্ধু) স্থাপন করা যথেষ্ট সহজ ছিল না; কি করছেন জানা দরকার ছিল আপনার এবং এই জ্ঞান আপনাকে সত্তার ভিত্তি ব্রাহ্মণের কাছে নিয়ে যাবে। উপাসকও আর তার বাইরের দেবাদের উদ্দেশে মনোযোগ পরিচালিত করছিল না; ‘প্রকৃতপক্ষে এইসকল দেবতার প্রত্যেকে তাহারই নিজস্ব সৃষ্টি, কারণ স্বয়ং সেই সকল দেবতা” হওয়ায় নিজের অন্তরে চোখ ফিরিয়েছে। উপনিষদের মুল বিষয় ছিল আত্মা, সত্তা, যা ব্রাহ্মণারই অনুরূপ। সাধু নিজের সত্তার অন্তস্থঃ হৃদয় আবিষ্কার করতে পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পরম বাস্তবতায় প্রবেশ ও নৈতিকতার ত্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে। 

বাহিরাগত কারও চোখে এসব সত্যি বলতে অবিশ্বাস্য ঠেকে-সত্যতা প্রমাণ করা অসম্ভব এমন কিছু বিমূর্ত বিবৃতি। এবং সত্যিই উপনিষদের শিক্ষা অনুসরণ করা বেশ কঠিন। সাধুরা তাদের ধারণার কোনও যৌক্তিক প্রদর্শনী আমাদের দেখাননি। টেক্সটের কোনও পদ্ধতি নেই, যুক্তিগুলোকে প্রায়শঃই অদ্ভুত ঠেকে। যুক্তিপূর্ণ বিতর্কের জায়গায় অভিজ্ঞতা ও দিব্যদর্শন, উপমা আর হেঁয়ালির দেখা পাই আমরা, যেগুলো বোঝা বেশ কঠিন। পাশ্চাত্য পাঠক সহজে বুঝতে পারবেন না, স্পষ্টতই এমন এক অর্থ ধারণ করা নির্দিষ্ট কিছু বাগধারার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ‘এই সত্তাই ব্রাহ্মণ’- আয়াম আত্মা ব্রাহ্মণ আমাদের বলেন সাধু। “ইহাই শিক্ষা।” ছান্দোগ্য আরও বেশি ঘোরানো: ‘ইহাই তো তুমি!’ ছেলেকে বলছেন সাধু। তাত তভাম অসি। এগুলোই ‘মহান বাণী’ (মহা-বাক্য), তবে আমরা কেন এগুলো মেনে নেব বোঝা মুশকিল। পদ্ধতিগতভাবে যুক্তি গড়ে তোলার বদলে সাধুরা প্রায়শঃই শ্রোতাদের কতগুলো আপাত সম্পর্কহীন দর্শনের কথা বলেন। অনেক সময় আমাদের কোনটা আসল ব্যাপার নয় জানিয়ে নেতিবাচক তথ্য দিতে পছন্দ করতেন তাঁরা। এভাবে বৃহদারণ্যক উপনিষদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঋষি জ্ঞানবাক্য আত্মা দিয়ে কি বোঝায় তার ব্যাখ্যা দিতে অস্বীকার গেছেন: 

এই সত্তা সম্পর্কে [আত্মা] কেউ কেবল বলিতে পারে ‘না…না’ [নেতি…নেতি]। তিনি অধরা, কারণ তাঁহাকে ধরা যায় না। তিনি পচনের অতীত, কেননা তিনি পচনের বিষয় নহেন। তাহার সঙ্গে জড়িত হইবার মতো কিছু নেই, কেননা তিনি কোনও কিছুর সহিত জড়িত নহেন। তাঁহাকে বাঁধা যায় না; কিন্তু তথাপি তিনি ভয়ে কম্পিত হন না কিংবা আহত হন না। ৭

প্রায়শঃই আর আগে বাড়তে না পারায় প্রতিযোগিদের কোনও একজনের মৌনতায় পর্যবসিত হওয়ার ভেতর দিয়ে শেষ হতো বিতর্কের এবং এটা আমাদের একটা সূত্র দেয়। সাধুরা ব্রাহ্মোদ্য পরিচালনা করছেন, এমন এক প্রতিযোগিতা যেখানে প্রতিযোগিদের ব্রাহ্মণার রহস্য গঠন করতে হতো। বাস্তবতা আসলে বাণী ও ধারণার অতীতে অবস্থান করেন ইঙ্গিত দিয়ে প্রতিযোগিতা সবসময় মৌনতার ভেতর দিয়ে শেষ হতো। ‘মহান বাণী’ স্বাভাবিক, সেক্যুলার চিন্তাভাবনার ধরাছোঁয়ার আয়ত্তাধীন নয়। যুক্তি বা ইন্দ্ৰিয়জ ধারণা থেকে এগুলো আসে না, তবে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ, ধ্যান এবং আমাদের দেখার পদ্ধতিকে আমাদের ও জগৎকে দেখার উপায়কে বদলে দেওয়া অন্তর্মুখীনতার চর্চার ভেতর দিয়ে উপলব্ধি করা যেতে পারে। উপনিষদের কৌশলের সঙ্গে অভ্যস্থ নয় এমন কোনও পাঠক এর উপসংহারগুলো উপলব্ধি করতে পারবেন না। 

‘উপনিষদ’ কথাটার মানে ‘নিকটে উপবেশন করা’। অতীন্দ্রিয়বাদী সাধুদের পায়ের কাছে বসে থাকা মুষ্টিমেয় আধ্যাত্মিক প্রতিভাধর শিষ্যদের তালিম দেওয়া নিগূঢ় বিদ্যা ছিল এটা। সর্বজনীন ছিল না তা। এই দীর্ঘ ও কষ্টকর অনুসন্ধান বেছে নেওয়ার মেধা বা ইচ্ছা কোনওটাই ছিল না বলে বেশির ভাগ আর্য প্রথাগত উপায়ে উপাসনা ও উৎসর্গ চালিয়ে গেছে। ধার্মিক হওয়ার এক নতুন পথের খোঁজ করছিলেন সাধুরা। মননের অজানা বিশ্বে অনুপ্রবেশ করে তাঁরা ছিলেন অগ্রগামী, এবং কেবল অল্প কিছু প্রতিভাধরই তাদের সহযাত্রী হবেন। তবে জীবন পাল্টে যাচ্ছিল, এর মানে ছিল যে কারও কারও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। প্রথম উপনিষদগুলো নগরায়নের একবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা একটি সমাজের পটভূমিতে রচিত ছিল।” এইসব টেক্সটে সামান্য কৃষিবিষয়ক চিত্রকল্পের অস্তিত্ব আছে, কিন্তু বুনন, মাটির পাত্র তৈরি আর ধাতু বিদ্যা সম্পর্কে প্রচুর উল্লেখ রয়েছে। লোকে এইসব সাধুর সঙ্গে পরামর্শ করতে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে যেত। যার মানে, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটছিল। অনেক বিতর্কই কোনও রাজার দরবারে অনুষ্ঠিত হতো। জীবন আরও স্থির হয়ে আসছিল, ধ্যানের জন্যে কেউ কেউ অনেক বেশি অবসর পাচ্ছিল। বৃহদারণ্যক প্রায় নিশ্চিতভাবেই সপ্তম শতাব্দীতে আর্য সম্প্রসারণের একেবারে পূর্বাঞ্চলীয় বিন্দু বিদেহা রাজ্যে রচিত হয়েছিল। বিদেহা পশ্চিমে ‘আর্যভূমিতে’ ব্রাহ্মণদের কাছে অনাধুনিক, আনকোরা জায়গা হিসাবে ভ্রূকুটির শিকার হতো, তবে পুবের এইসব অঞ্চলে অভিবাসনের আদি স্রোতের সঙ্গে ইরান থেকে আসা গোত্রগুলো (পরে মাল্লা, ভাজ্জি ও সামক্ষ্য) ইন্দো-আর্য বসতিকারীরাসহ নানা ধরনের লোকের বসবাস ছিল, এবং স্থানীয় ভারতীয়রাও ছিল। সংসারত্যাগীরাও তাদের নতুন নিগূঢ় জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা লাভের সময় নতুন নতুন ধারণার যোগান দিচ্ছিল। 

নিশ্চিতভাবেই আদিমতম দুটি উপনিষদই নিবিড় বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক উত্তেজনা প্রতিফলিত করে। বৃহদারণ্যক বা ছান্দোগ্যের কোনওটাই কোনও একজন লেখকের হাতে লেখা হয়নি। এগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন টেক্সটের সংকলন, পরে একজন সম্পাদক একসঙ্গে করেছেন। লেখক ও সম্পাদক নির্বিশেষে গ্রামে আর দরবারে চালু থাকা একই গল্পকাহিনী ও ধারণার উপর নির্ভর করেছেন। সেকালের বিশিষ্ট কোনও গুরুর সঙ্গে পরামর্শ করার জন্যে লোকে হাজার মাইল দূরে থাকা গান্ধারা থেকে বিদেহায় যেতে কিছু মনে করত না: সান্দিল্য, যিনি আত্মার প্রকৃতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন; বিদেহার রাজা জানকা; কুরু পাঞ্চলার রাজা প্রবাহনা জয়বেলি; কাশির রাজা অজাতশত্রু; ও চিরকুমার ব্রতের জন্যে বিখ্যাত সনৎকুমার।° নতুন নতুন ধারণা হয়তো বা ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের হাতে গড়ে উঠে থাকতে পারে, কিন্তু ক্ষত্রিয় ও রাজারাও বিতর্ক ও আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। যেমন করেছে নারীরা-বিশেষ করে গরগি বাকানবি ও জ্ঞানবাক্যের স্ত্রী মৈত্রয়ী। দুজন মহিলাকেই যেন ব্রাহ্মোদ্যের প্রতিযোগিরা মেনে নিয়েছিলেন বলে মনে হয় এবং সাধারণভাবে ঋষি ও সম্পাদকরা তাঁদের অবদান অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে আদি উপনিষদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুজন ঋষি হলেন বিদেহার জ্ঞানবাক্য ও কুরু পাঞ্চলা অঞ্চলের বিখ্যাত গুরু উদ্দলক অরুণি। উভয়ই সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে সক্রিয় ছিলেন।১১ 

জ্ঞানবাক্য বিদেহার রাজা জানকের ব্যক্তিগত দার্শনিক ছিলেন। তিনি স্বয়ং নতুন আধ্যাত্মিকতার একজন প্রবক্তা ছিলেন। সকল উপনিষদ সাধুর মতো জ্ঞানবাক্য বিশ্বাস করেছিলেন যে, যেমন বলা হয়েছে, ব্যক্তি মানুষের একেবারে অন্তরের অন্তস্তলে গোটা বিশ্বজগৎকে অস্তিত্বদানকারী ও টিকিয়ে রাখা অমর ব্রাহ্মণে অংশ নেওয়া একই প্রকৃতির এক অমর স্ফুলিঙ্গের অস্তিত্ব রয়েছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার ছিল এটা এবং প্রতিটি প্রধান ধর্মীয় ঐতিহ্যের মূল দর্শনে পরিণত হবে। পরম বাস্তবতা প্রতিটি মানুষের পক্ষে সর্বব্যাপী উপস্থিতি ছিছল। সুতরাং, একে সত্তা, আত্মার গভীরে আবিষ্কার করা সম্ভব। ব্রাহ্মণাগুলো আগেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে, মানুষের অন্তস্তল-বিভিন্নভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস, পানি বা আগুন হিসাবে শনাক্তকৃত-উৎসর্গের অনুরূপ এবং উৎসর্গের মূলের শক্তিই অস্তিত্ববান সমস্ত কিছুর মুল ব্রাহ্মণ। জ্ঞানবাক্য এবং উপনিষদের অন্য সাধুরা এই ধারণা গড়ে তুলেছেন ও একে বাহ্যিক আচার থেকে মুক্ত করেছেন। আত্মা আর কেবল মানুষকে জীবন দেওয়া শ্বাসপ্রশ্বাস ছিল না, বরং যা গ্রহণ ও বর্জন করা হয় তাই; সকল ইন্দ্রিয়র অতীত হওয়ায় এটা ছিল বর্ণনার অতীত। ‘যিনি দেখেন, সেই দর্শককে তুমি দেখিতে পাইবে না,’ ব্যাখ্যা করেছেন জ্ঞানবাক্য। ‘যিনি শ্রবণ করেন, সেই শ্রবণকারীকে তুমি শুনিবে না; যিনি ভাবেন সেই ভাবুককে তুমি ভাবিতে পারিবে না; আর যিনি উপলব্ধি করেন তুমি তাঁহাকে উপলব্ধি করিতে পারিবে না। সকলের অন্তস্থঃ সত্তা [ব্রাহ্মণ]ই তোমার আত্মা। ১২ প্রথমবারের মতো মানবজাতি পদ্ধতিগতভাবে নিজেদের মানব চেতনার গভীরতর স্তর সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠছিল। তারা হয়ে উঠছিল সম্পূর্ণ ‘আত্ম-সচেতন।’ 

সত্তা অমর, অপরিবর্তনীয় ব্রাহ্মণের অনুরূপ হওয়ায় ‘ক্ষুধা, তৃষ্ণা, বিষাদ ও বিভ্রান্তি, জরা ও মৃত্যুরও অতীত।১৩ এটা, স্ত্রী মৈত্রয়ীকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন জ্ঞানবাক্য, ‘পচনের অতীত…ধ্বংসের অতীত।’ কিন্তু খোদ ব্রাহ্মণের মতো এটা দুয়ে, ‘ধারণাতীত’। কেবল দ্বৈততা থাকলেই কোনও কিছুকে সংজ্ঞায়িত বা উপলব্ধি করা সম্ভব। একজন ব্যক্তি তার থেকে ভিন্ন ও আলাদা কোনও কিছু দেখতে পারে, স্বাদ নিতে পারে, বা গন্ধ নিতে পারে। কিন্তু যখন ‘সমগ্র [ব্রাহ্মণ] ব্যক্তির খোদ সত্তায় [আত্মা] পরিণত হইয়াছেন, তখন আর তাঁকে দেখিবার ন্যায় কে থাকে? কিভাবে?’১৪ কারও অভ্যন্তরে বাস করা উপলব্ধিকারীকে উপলব্ধি করা অসম্ভব। তো আপনি কেবল বলতে পারেন নেতি (‘ইহা নহে’)। সাধু আত্মার অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছেন, আবার একই সময়ে ইন্দ্রিয়ের পরিচিত কোনও কিছুর সঙ্গে এর মিল থাকার কথা অস্বীকার গেছেন। 

তারপরেও নতুন আধ্যাত্মিকতার লক্ষ্য ছিল জ্ঞানের অতীত আত্মা। কিভাবে এটা অর্জন করা যেতে পারে? জ্ঞানবাক্য কোনও বাস্তব তথ্য বিলি করেননি, বরং ঐতিহ্যবাহী ব্রাহ্মোদ্য বিতর্কের কৌশল প্রয়োগ করে তাঁর আলোচকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে ব্রাহ্মণ বা আত্মার কথা ভাবতে গিয়ে তিনি সাধারণ চিন্তা প্রক্রিয়া কার্যকরভাবে যা করতে পারে তার শেষসীমায় পৌঁছে গেছেন। পরে সক্রেটিস উদ্ভাবিত দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির অনুরূপ ছিল এটা। বিপক্ষের আত্মা সংক্রান্ত অপর্যাপ্ত সংজ্ঞাগুলোকে বাতিল করে, সেগুলোকে একের পর এক ছিন্নভিন্ন করে, জ্ঞানবাক্য ধীরে ধীরে তাকে বাহ্যিক ঘটনাপ্রবাহের বিবেচনা থেকে অন্তস্থঃ জগতের অধিকতর অধরা বাস্তবতার দিকে পরিচালিত করতেন। উদাহরণ স্বরূপ, রাজা জানকা আত্মা সম্পর্কে অন্য ব্রাহ্মণরা তাঁকে কি বলেছেন তার তালিকা তৈরি করলে-যেমন এটা বাণী, চোখ, শ্বাসপ্রশ্বাস, বাতাস বা হৃদয়-জ্ঞানবাক্য জোর দিয়েছেন যে, এসব উত্তর অর্ধসত্যমাত্র।” তাঁরা যে বাস্তবতার সন্ধান করছেন তা এইসব বস্তুর ভিত্তিতে অবস্থান করে কোনও বাড়ির ভিত্তির মতো এগুলোকে সমর্থন যোগায়। এগুলো অধিকতর মৌলিক বাস্তবতাকে সংজ্ঞায়িত করতে পারে না, তবে তাতে অংশ নিতে পারে, অনেকটা বাড়িতে থাকার মতো বাস করতে পারে। পদ্ধতিগতভাবে পরতের পর পরত উপরিগত বিদ্যাকে উন্মোচিত করে জ্ঞানবাক্য তাঁর শিষ্যদের প্রতিদিনের বাস্তবতাকে পরমের প্রকাশ এবং ব্যক্তির অন্তস্থঃ সত্তা আমাদের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনাকারী দৈহিক চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা আর ভীতিতে প্রোথিত ‘আমি’ নয়, বরং নিজস্ব অধিকার বিশিষ্ট একটি পরম বাস্তবতা হওয়ার বিষয়টি উপলব্ধি করতে ও বুঝতে চালিত করেছেন। আত্ম-আবিষ্কারের জন্যে অবশ্যই একটি ধীর, দীর্ঘ অনুসন্ধানে নামতে হবে তাদের। এটাই অ্যাক্সিয়াল যুগের মৌলিক নীতিমালার স্পষ্টতম প্রকাশ। আলোকিত ব্যক্তিরা নিজেদের অন্তরেই জাগতিক বিশ্বের ঊর্ধ্বে ওঠার উপায়ের খোঁজ পেয়েছেন; স্রেফ জাদুকরী আচারে অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে নয়, বরং আপন প্রকৃতির বিভিন্ন রহস্যকে উন্মোচিত করে দুর্ভেয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তাঁরা। 

শাস্ত্রজ্ঞ সংস্কারকদের মতো প্রথার বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে আলোচনার বদলে জ্ঞানবাক্য আমাদের জাগতিক অভিজ্ঞতার ‘আমি’-কে চালিত ও নিয়ন্ত্রণকারী অন্তস্থঃ সত্তা প্রকৃত সত্তার অবস্থান জানার লক্ষ্যে মানবজাতির মনস্তাত্ত্বিক গঠন অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে কাজ শুরু করেছেন। আমাদের উপলব্ধির শক্তি, কাণ্ডজ্ঞান ও যৌক্তিক চিন্তায় নিয়ন্ত্রিত এই ‘আমি’-র ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের স্বাভাবিক সচেতনতা থেকে ভিন্ন সত্তার ধরন আবিষ্কার করতে হবে। শিষ্যদের তাদের স্বপ্নের অবস্থার কথা বিবেচনা করতে বলেছেন জ্ঞানবাক্য, যখন তারা স্থান ও সময়ের সীমায় সীমাবদ্ধ থাকে না। আমাদের স্বপ্নে আমরা বাহ্যিক জগৎ-কে ছিন্ন করে আমাদের নিজস্ব আনন্দ, ফূর্তি সৃষ্টি করি। প্রজাপতির মতো স্রষ্টায় পরিণত হই আমরা, পুকুর, ঠেলাগাড়ি, রাস্তা আর ষাঁড়ের পালের অস্তিত্ব দিই, ‘আমাদের অন্তরের অন্তস্থঃ আলোর সাহায্যে’১৬ সম্পূর্ণ নতুন এক জগৎ গড়ে তুলি। স্বপ্নে আমরা স্বল্প সময়ের জন্যে আমাদের দেহের সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে চলে যাই বলে অপেক্ষাকৃত মুক্ত ও উচ্চতর সত্তা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠি। অবশ্য প্রবলভাবে আমাদের বেদনা, ভীতি ও আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে সজাগ হলে তখন আমরা দুঃস্বপ্নও দেখি। কিন্তু স্বপ্নহীন গভীর ঘুমে সত্তা এমনকি এইসব কর্মকাণ্ডের মানসিক আবির্ভাব থেকেও মুক্তি পায়। ব্যক্তি ‘ভয়ের ঊর্ধ্বে’ উঠে যায়। গভীর ঘুম অস্তিত্বহীনতা নয়, বরং ঐক্যবদ্ধ সচেতনতা বলে বিশ্বাস করতেন জ্ঞানবাক্য। একে যৌন মিলনের সঙ্গে তুলনা করেছেন তিনি, যখন ‘পুরুষ তাহার ভালোবাসার নারীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়, তখন ভিতর বাহিরের সকল কিছুই সে বিস্মৃত হইয়া যায়।’ সে দ্বৈততার বোধ হারিয়ে ফেলে: ‘দ্বিতীয় আর কোনও সত্তা নাই যে তাহার চাইতে ভিন্ন ও আলাদা কিছু সে দেখিতে পাইবে।১৭ কেবল একত্বের সচতেনতা, সত্তা আনন্দ, ব্রাহ্মণের সুখ বোধ করে। 

কিন্তু স্বপ্ন বা তুরীয় পুলকের সময় আমরা যে সাময়িক মুক্তির অভিজ্ঞতা লাভ করি সেটা কেবল আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের মূল লক্ষ্য চিরস্থায়ী স্বাধীনতা, মুক্তি ও প্রশান্তির পূর্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতার পূর্বস্বাদ মাত্র। সাধু আত্মার অভিজ্ঞতা লাভ করলে আলোকিত অবস্থার আবির্ভাব ঘটে। সত্তার অন্তস্থঃ অস্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তখন ‘প্রশান্ত, স্থির, শীতল, ধৈর্যশীল ও সংহত হইয়া উঠেন’ তিনি, কারণ তাঁর ব্রাহ্মণের জগতে তিনি ‘অশুভ হইতে মুক্ত, ভীতি হইতে মুক্ত, কলঙ্ক হইতে মুক্ত, সন্দেহ হইতে মুক্ত।’ তিনি জরাহীন, অমর, অমৃত এবং ভীতি হইতে মুক্ত মহা ও অজন্ম সত্তাকে জানেন,’ বলিয়া ব্রাহ্মণকে চিনিতে পারেন এবং স্বয়ং ত্রাস ও উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তি লাভ করেন এভাবে সত্তার জ্ঞান ছিল পরম সুখের অনুভূতি, এক ধরনের একতাসিস। এই জ্ঞান ধারণার অতীতে অবস্থান করে এবং যৌক্তিক বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করে না। এটা বরং এক ধরনের ‘অন্তরের অন্তস্তলের আলো’ সম্পর্কে সচেতনতার মতো ছিল, সাধারণ কোনও আনন্দের চেয়ে ভিন্ন এক প্রত্যক্ষ ও একান্ত অন্তজ্ঞান। এই ‘জ্ঞান’ ব্যক্তিকে বদলে দেয়। অন্তর্মুখীনতার দীর্ঘ প্রশিক্ষণের পরেই কেবল এটা অর্জন করা সম্ভব, যা দীক্ষা লাভকারী জ্ঞানবাক্যের দ্বান্দ্বিক কৌশলের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করতে পারত: পদ্ধতিগতভাবে চিন্তার স্বাভাবিক অভ্যাস বিনাশ করে তাদের স্বপ্ন ও অবচেতন পর্যায় অন্তস্থ জগতের সচেতনতা চর্চা করে; এবং নিজেদের অব্যাহতভাবে একথা মনে করিয়ে দিয়ে যে তাদের কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান শব্দের অতীতে অবস্থান করে এবং তা সেক্যুলার চিন্তাধারা ও অভিজ্ঞতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যবস্থা। জ্ঞানবাক্য এই জ্ঞানকে একেবারেই সাধারণ জ্ঞানের মতো বাস্তবভিত্তিক তথ্য হিসাবে তালিম দিতে পারেননি। তিনি কেবল শিষ্যদের এই পর্যায়ে উন্নীত হতে সাহায্য করা পদ্ধতির শিক্ষা দিতে পেরেছেন। 

জ্ঞানবাক্য বিশ্বাস করতেন যে এইভাবে যে ব্যক্তি জানে যে ব্রাহ্মণের সঙ্গে নিজের একাত্মতার কথা জানে-মৃত্যুর পর সঙ্গে করে তার ‘জ্ঞান’ নিয়ে যাবে ব্রাহ্মণের কাছে যাবে সে। প্রথাগত বৈদিক আচারে ব্যক্তি শাস্ত্রীয় কর্মতৎপরতার (কর্ম) মাধ্যমে দেবতাদের জগতে বেঁচে থাকার উপযোগি এক সত্তা গড়ে তুলত। কিন্তু জ্ঞানবাক্যের বেলায় বাহ্যিক আচারের ভেতর দিয়ে অর্জিত হয় না বরং এই সযত্ন লাভ করা জ্ঞানের মাধ্যমেই অমর সত্তার সৃষ্টি হয়। নিখুঁতভাবে সম্পাদিত কতগুলো উৎসর্গের মাধ্যমে সত্তা গঠিত হয় বলে শাস্ত্রজ্ঞরা বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু জ্ঞানবাক্যের বিশ্বাস ছিল যে, আমাদের সকল তৎপরতা ও অভিজ্ঞতা দিয়েই চিরন্তন জীবন গঠিত হয়। ‘একজন মানুষ কি রূপ হইবে তাহা নির্ভর করে সে কিভাবে কর্ম সম্পাদন করিতেছে এবং কেমন করিয়া নিজেকে পরিচালিত করিতেছে তাহার উপর। তাহার কর্মকাণ্ড ভালো হইলে সে ভালো কিছুতে পরিণত হইবে আর তাহার কর্মকাণ্ড মন্দ হইলে খারাপ কিছুতে।’ জ্ঞানবাক্য স্রেফ বাহ্যিক কর্মকাণ্ডের কথা বলছিলেন না। আমাদের মানসিক তৎপরতা, যেমন আমাদের আকাঙ্ক্ষার তাড়না, সম্পর্কের বোধ, এসবও গুরুত্বপূর্ণ। যার আকাঙ্ক্ষাগুলো এই জগতের বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট ছিল মৃত্যুর পর স্বর্গে সংক্ষিপ্ত অবস্থানের পর আবার এই জগতেই ফিরে যাবে সে। তার মন ও চরিত্র তখনও এই জগৎ-কে আঁকড়ে থাকবে এবং সেজন্যে সে আবার মর্ত্যে ‘এই জগতে, কর্মকাণ্ডে’ নতুন জীবন কাটাতে ফিরে আসবে। কিন্তু যে ব্যক্তি কেবল অমর সত্তার আকাঙ্ক্ষা করে আর এই জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, সে ব্রাহ্মণের অংশ: ‘যাহার আকাঙ্ক্ষা নাই-আকাঙ্ক্ষাহীন, যে আকাঙ্ক্ষা হইতে মুক্ত, যাহার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হইয়াছে, যাহার আকাঙ্ক্ষা তাহার সত্তা-তাহার গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা বিচ্ছিন্ন হইবে না। সে-ই ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণের নিকটে যাইবে সে-ই।’১৯ বেদনা ও মৃত্যুর এই জীবনে আর কখনও ফিরে আসবে না। 

এই প্রথমবারের মতো ভারতীয় আধ্যাত্মিকতায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা ‘কর্মকাণ্ডে’র (কর্ম) মতবাদের কথা জানতে পারি আমরা। জ্ঞানবাক্যের সময়ে এটা অবশ্য নতুন ও বিতর্কিত ধারণা ছিল। ব্রাহ্মণ বন্ধু আতভাগ জ্ঞানবাক্যকে জিজ্ঞেস করেছিলেন মৃত্যুর পরে মানুষের কি হয়, তিনি জবাব দিয়েছেন, প্রকাশ্যে আমাদের পক্ষে ইহা লইয়া আলাপ করা সম্ভব নহে। আমার হস্ত ধরো, আতভাগ, চলো, একান্তে কথা বলা যাক। ২০ নতুন কর্মের মতবাদকে দাসত্বমূলক মনে হয়েছে। উৎসর্গের স্বর্গে চিরস্থায়ী আবাসের নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কেউ কেউ আচারের কার্যকারিতায় বিশ্বাস হারাতে শুরু করেছিল। জ্ঞানবাক্য ও অন্য উপনিষদ সাধুরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, যত বেশি নিখুঁত উৎসর্গের আয়োজনই করুক না কেন কেউ, একজন ব্যক্তিকে বারবার বেদনা আর মৃত্যুর পৃথিবীতে ফিরে আসতে হতে পারে। তাকে মাত্র একবারই যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর ভেতর দিয়ে যেতে হবে না, বরং চিরমুক্তির কোনও আশা ছাড়াই বারবার রোগ-বালাই, জরা ও মৃত্যুর ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কেবল তাকে মর্ত্য জগতের ক্ষণস্থায়ী বস্তুসামগ্রীর আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি দেওয়া সত্তার জ্ঞান দিয়েই পুনর্জন্ম ও পুনমৃত্যুর এই অন্তহীন চক্র (সামসারা) থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবে। 

কিন্তু আকাঙ্ক্ষা ও সংশ্লিষ্টতা থেকে মুক্তি পাওয়া দারুণ কঠিন। সহজাত প্রবৃত্তিবশেই আমরা এই জীবন ও আমাদের ব্যক্তিগত টিকে থাকাকে আঁকড়ে থাকি। আমরা আমাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য টিকিয়ে রাখার উপযুক্ত মনে করি, কিন্তু সাধুরা জোর দিয়ে বলেছেন, এটা বিভ্রম মাত্র। ব্যক্তি তার সত্তা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধারণকারী ব্রাহ্মণের সঙ্গে একাত্ম আবিষ্কার করার পর স্ফটিকের মতো এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এই বর্তমান, সীমিত অস্তিত্বকে আঁকড়ে থেকে কোনও ফায়দা নেই। সাধুদের কেউ কেউ সংসারত্যাগীতে পরিণত হওয়া, জাগতিক লাভ বিসর্জন দান ও কৃচ্ছ্রতার জীবন যাপন করে আকাঙ্ক্ষাকে বিনাশ করাই এই মুক্তিদায়ী জ্ঞান লাভের সবচেয়ে সেরা উপায় বলে বিশ্বাস করেছেন। তখনও একে বাধ্যতামূলক মনে করা হয়নি। তবে শেষপর্যন্ত জ্ঞানবাক্য ‘উদ্দমী’তে (শ্রামণ) পরিণত হন, স্ত্রীকে ছেড়ে দরবার ত্যাগ করে বনের ‘গৃহহীনতায়’ যোগ দেন। ২১ 

কিন্তু ছান্দোগ্য উপনিষদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাধু উদ্দলক অরুণি সারা জীবন কুরু পাঞ্চলা এলাকায় ব্রাহ্মণ গৃহস্থ রয়ে গেছেন। পৃথিবীতে ধর্মপ্রাণ অস্তিত্বের মূল্য নিশ্চিত করে এই উপনিষদ শেষ হয়েছে। একজন গৃহস্থ ব্ৰহ্মাচার্য হিসাবে পাঠের কাল শেষ করার পর তাকে অবশ্যই ঘরে ফিরে গুরুর কাছে শেখা সমস্ত কিছুর চর্চা চালাতে হবে। তাকে অবশ্যই বেদের পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করতে হবে, সন্তান পালন করতে হবে, ধ্যান করতে হবে এবং অহিংসার চর্চা করতে হবে, সহিংসতা থেকে বিরত থেকে অন্যের প্রতি দয়ার্দ্র আচরণ করতে হবে। ‘যিনি যাবজ্জীবন এই রকম আচরণ করেন,’ টেক্সট শেষ হয়েছে এভাবে, “তিনি (মৃত্যুর পর) ব্রহ্মলোকে যান, তাঁহাকে আর (জন্মলাভের জন্য) ফিরিয়া আসিতে হয় না।২২ ভদ্র, দয়ালু ব্যক্তি, উদ্দলক মৌলিক বিষয়ে জ্ঞানবাক্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। মানুষের আত্মার সঙ্গে পরম বাস্তবতা ব্ৰাহ্মণকে এক করে দেখেছেন তিনি, কর্মের নতুন মতবাদ শিক্ষা দিয়েছেন এবং আলোকনের পূর্বস্বাদ হিসাবে ঘুমকে অনুভব করেছেন। জ্ঞানবাক্যের মতো তিনি বিশ্বাস করতেন, বেদনাদায়ক মৃত্যু ও পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি লাভ (মোক্ষ) আধ্যাত্মিক জীবনের লক্ষ্য, বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে নয় বরং অন্তস্থঃ জ্ঞানের অনুসন্ধানের ভেতর দিয়েই এটা অর্জন করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করেছেন। 

ছান্দোগ্যের ষষ্ঠ অধ্যায়ে আমরা দেখি, ছেলে শ্বেতকেতুকে নতুন আধাত্মিকতার নিগূঢ় কাহিনী শিক্ষা দিচ্ছেন উদ্দলক, এই শিক্ষা হস্তান্তরের উপায়ের এক মূল্যবান ঝলক। শ্বেতকেতু শেষপর্যন্ত তাঁর আপন বলয়ে একজন গুরুত্বপূর্ণ সাধুতে পরিণত হবেন, কিন্তু এই অধ্যায়ে তিনি কেবল ব্রহ্মাচারী হিসাবে বার বছরের মেয়াদ শেষ করে ‘পাণ্ডিত্যাভিমানী ও অবিনীত,’ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন, ভেবেছিলেন বৈদিক ধর্ম সম্পর্কে যা জানার সবই তিনি জানেন।২৩ উদ্দলক সধৈর্যে ছেলেকে জগৎ, নিজেকে আর পরমকে দেখার ভিন্ন উপায় শিক্ষা দিয়ে এই অযাচিত আস্থা গুড়িয়ে দেন। যে কোনও বস্তু-কাদামাটি, তামা, বা লোহা-সেটা যে উপাদান দিয়ে তৈরি তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য, এই ব্যাখ্যা দিয়ে শুরু করেছিলেন তিনি। মূলত খোদ সত্তা দিয়ে তৈরি পরম, অখণ্ড সারল্য মহাবিশ্বের বেলায়ও একই কথা খাটে: ‘কেবল একটি, দ্বিতীয়টি ছিল না। ২৪ প্রজাপতির মতো এক নিজেকে তাপের (তাপস) মাধ্যমে প্রচার করেছেন, শেষপর্যন্ত যা এর থেকে সকল সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দিয়েছে। এভাবে এক পরিণত হয়েছেন মূলে, মূল সত্তায় এবং সুতরাং, প্রতিটি সৃষ্টির সত্তায়: ‘এটাই এখানে সূক্ষ্মতম মূল—যা এই গোটা বিশ্বের সত্তাকে গড়ে তুলেছে,’ আবার ব্যাখ্যা দিয়েছেন উদ্দলক, বারবার। ইহাই সত্যি; ইহাই সত্তা [আত্মা]। আর তুমিই সেই, শ্বেতকেতু। গোটা অ্যধ্যায় জুড়ে মূল শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে জলধারার মতো এগিয়ে গেছে বাক্যটা। শ্বেতকেতু ছিলেন মহাবিশ্বের নৈর্ব্যক্তিক মূলসত্তা ব্রাহ্মণ, অন্য সাধুদের মতো উদ্দলক যাকে নিরপেক্ষ, হেঁয়ালিময় ‘ইহা” বলে উল্লেখ করেছেন। 

কিন্তু কেবল অধিবিদ্যিক দীক্ষাই যথেষ্ট ছিল না। অন্তর দিয়ে শ্বেতকেতুকে এই জ্ঞানকে উপলব্ধি করতে হয়েছে, একে আপন করে নিতে হয়েছে এবং এইসব বাহ্যিক শিক্ষাকে একান্ত মানসিক বিস্তারের সঙ্গে সংশ্লেষ ঘটাতে হয়েছে। পরবর্তীকালের চিন্তাবিদগণ যেমন উল্লেখ করবেন, তাঁকে এসব ‘উপলব্ধি’ করতে হয়েছে, নিজের জীবনে বাস্তবতায় পরিণত করতে হয়েছে, এবং উদ্দলককে তাঁর ধাত্রীর ভূমিকা পালন করতে হয়েছে, ছেলের অন্তরে ধীরে ধীরে সযত্নে এই নতুন দর্শনকে জন্ম দিতে হয়েছে। সম্পূর্ণ প্রথাগত (একাডেমিক) বিমূর্ত শিক্ষা ছিল না এটা। শ্বেতকেতু কেবল বাবার অধিবিদ্যিক ব্যাখ্যাই শোনেননি, বরং তাঁকে এমন সব কাজ করতে হয়েছে যা জগৎ-কে ভিন্নভাবে দেখতে সাহায্য করেছে। উদ্দলক প্রতিটি উদাহরণ তুলে ধরেছেন, নানা ধরনের পরীক্ষায় সক্রিয় অংশ নিতে বাধ্য করেছেন শ্বেতকেতুকে। এসবের ভেতর সবচেয়ে বিখ্যাতটিতে ছেলেকে সারারাত একপাত্র পানিতে লবনের টুকরো ফেলে রাখতে বলেন তিনি। পরদিন সকালে টুকরোটা সম্পূর্ণ গলে যায়, কিন্তু বাবা তাঁকে পাত্রের বিভিন্ন জায়গায় চুমুক দেওয়ানোর সময় প্রতিবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রকম?’ শ্বেতকেতু জবাব দিয়েছিলেন: ‘লবণাক্ত।’ তখনও পাত্রের প্রতিটি অংশে লবন ছিল। ‘হে সৌম্য, (জলে সর্বদা বিদ্যমান লবণকে যেমন তুমি দেখিতে পাও নাই, তেমনি) এই দেহে সৎস্বরূপ আত্মা নিত্য বর্তমান আছেন, কিন্তু তুমি দেখিতে পাইতেছ না। ঠিক তেমনি অদৃশ্য গোটা বিশ্বের মূল সত্তা ব্ৰাহ্মণ। ‘হে শ্বেতকেতু, তুমিই তিনি। ১২৬ 

লবণের মতো ব্রাহ্মণকে দেখা সম্ভব নয়, তবে এঁকে অনুভব করা যেতে পারে। প্রতিটি জীবন্ত প্রাণের ভেতর এঁর প্রকাশ। এটা বট গাছের বীজের সূক্ষ্ম সত্তা, যা থেকে মহীরুহের সৃষ্টি হয়, কিন্তু তারপরেও শ্বেতকেতু এই বীজ ব্যবচ্ছেদ করে কিছুই দেখতে পান না। ব্রাহ্মণ হচ্ছেন গাছের সকল অংশে বিরাজ করা রস যা তাকে জীবন দেয়, ব্যাখ্যা করেছেন উদ্দলক 1২৭ সুতরাং, এটা গাছের আত্মা, ঠিক যেভাবে প্রতিটি মানুষের আত্মা; সকল বস্তু একই মূল সত্তার অংশীদার। কিন্তু বেশিরভাগ লোক তা বুঝতে পারেনি। তারা নিজেদের বিশেষ কেউ, অনন্য, বলে কল্পনা করেছে, পৃথিবীর বুকের আর সবকিছুর চেয়ে ভিন্ন। নিজেদের গভীরতম সত্যি উপলব্ধি না করে তাদের মূল্যবান ও কৌতূহলী করে তুলেছে বলে মনে করা নির্দিষ্ট বস্তুসমূহ আঁকড়ে থেকেছে। কিন্তু বাস্তবে এইসব পৃথকীকারী বৈশিষ্ট্য সাগরের দিকে বয়ে চলা নদীসমূহের চেয়ে বেশি স্থায়ী বা তাৎপর্যপূর্ণ নয়। সাগরে মিশে যাওয়ার পর ওগুলো ‘ঠিক সাগরে’ পরিণত হয়, জোরের সঙ্গে আর নিজেদের স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরে না, চিৎকার করে বলে না, ‘আমি ওই নদী,’ ‘আমি সেই নদী।’ ‘তেমনি, সৌম্য,’ লেগে থাকেন উদ্দলক, ‘জীবগণ সৎস্বরূপ হইতে আসিয়া জানিতে পারে না যে-’আমরা সৎস্বরূপ হইতে আসিয়াছি’। তারা আর তাদের স্বাতন্ত্র্যকে আঁকড়ে থাকে না। “বাঘ, সিংহ, বৃক, কীট, পতঙ্গ, ডাঁশ বা মশক-ইহারা ইহলোক সুযুপ্তির পূর্বে যে যে ভাবে ছিল সুষুপ্তির জাগ্রত হইলেও সে সেই ভাবই পায়। কারণ সবসময় তাহাই ছিল তারা, আর তাহাই হওয়া সম্ভব। সুতরাং, জাগতিক সত্তাকে আঁকড়ে থাকার মানে বেদনা ও বিভ্রান্তি থেকে পরিত্রাণের অতীত করে তোলা এক বিভ্রম। লোকে কেবল ব্রাহ্মণই তাদের আত্মা, তাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সত্যি বস্তু, গভীর মুক্তিদায়ী এই জ্ঞান অর্জন করেই এ থেকে মুক্তি পেতে পারে।২৮ 

কিন্তু এই জ্ঞান লাভ সহজ ছিল না। আপনি কিভাবে জ্ঞানের অতীত আত্মাকে চিনবেন? পাশ্চাত্যবাসীরা যাকে ‘সৌল’ বা মনন বলে আত্মা তা নয়।২৯ উপনিষদ দেহকে আত্মা থেকে আলাদা করেনি, বরং মানুষকে বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয় সমগ্র হিসাবে দেখেছে। উদ্দলক তাঁর ছেলেকে পনের দিনের জন্যে উপবাস করিয়েছেন, ইচ্ছামতো পানি পান করতে দিয়েছেন তাকে। এর শেষে শ্বেতকেতু এত দুর্বল ও স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি আর গুরুর সঙ্গে দুরন্তভাবে মুখস্থ করা বৈদিক টেক্সট আবৃত্তি করতে পারছিলেন না। তিনি শিখেছিলেন যে, মন খাঁটি বুদ্ধিবৃত্তি নয়, বরং ‘সৌম্য, মন অন্নময়, প্রাণ জলময় আর বাক তেজোময়। আত্মা ছিল ভৌত ও আধ্যাত্মিক; হৃদয়ে উপস্থিত আবার দেহেও, সকল বাস্তব আর ক্ষণস্থায়ী বস্তুর পরম, অননুকরণীয় অন্তস্থঃ সত্তা। কোনও একটা বিশেষ ঘটনার সঙ্গে একাত্ম করা বা তুলনা করা সম্ভব নয়। এটা ‘কিছুই নহে’, আবার সবকিছুর গভীরতম সত্যি। ১ দীর্ঘ শৃঙ্খলাপূর্ণ অনুশীলনের পর কেবল মানুষের মাঝেই একে আবিষ্কার করা যেতে পারে। 

দীক্ষিতকে কেবল ক্ষণস্থায়ী বস্তুসমূহ আকাঙ্ক্ষা করার অপ্রয়োজনীয়তা এবং শেষ অবধি এক ভাণ্ড মধু সৃষ্টিকারী ফুলের রেণুর চেয়ে খুব বেশি গুরুত্ব না থাকা ব্যক্তিগত গুণাবলীকে তোয়াজ করা বোকামি উপলব্ধির দিকে পরিচালিতকারী উপলব্ধির দিকে পরিচালিতকারী মৌনতা ও আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলার মাধ্যমে সত্তার গভীরতাকে উন্মুক্ত করতে বহু বছর লেগে যেত।৩২ শিষ্যকে অবশ্যই ধৈর্য ধরে গুরুর সঙ্গে কাজ করতে হবে যিনি তাকে সত্য বস্তু চিনতে, কোনটা গুরুত্বপূর্ণ বুঝতে সাহায্য করবেন। 

প্রাথমিক পর্যায়ের উপনিষদগুলো প্রাচীন বৈদিক আচারবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিল না বরং এগুলোকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল। একজন সাধু বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান ভেদ করে সেগুলোর অন্তস্থঃ অর্থ উপলব্ধি করতে না পারা পর্যন্ত কখনওই সেগুলোর মূলে বিরাজ করা ব্রাহ্মণের পরম বাস্তবতা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠতে পারবেন না। ছান্দোগ্য বলেছে, অমোনোযোগ আর যান্ত্রিকভাবে ওম মন্ত্র জপা পুরুত খাবারের জন্যে চিৎকার করে চলা কুকুরের মতো। দেবতারা পটভূমিতে সরে গেছেন। এইসব প্রাথমিক উপনিষদে ব্রাহ্মণের ব্যক্তিরূপ প্রজাপতি আর সুউচ্চ অবস্থানের স্রষ্টা ঈশ্বর ছিলেন না, বরং শিষ্যদের অবশ্যই তারা তাঁকে-প্রজাপতি-পরম বাস্তবতা হিসাবে শ্রদ্ধা করবে না, বরং নিজেদের আত্মার খোঁজ করবে বলে শিক্ষা দিয়ে সাধারণ গুরুতে পরিণত হয়েছেন: যে আত্মা পাপরহিত, জ্বরা মৃত্যু-শোকরহিত, ভোজনেচ্ছা এবং পিপাসারহিত, যিনি সত্যকাম সত্যসঙ্কল্প, তাদের বলেছেন তিনি, তাহাকেই অন্বেষণ করিতে হইবে, তাহাকেই বিশেষরূপে জানিতে হইবে। ৩৪ 

দেবা ও আসুরাদেরও এই গুরুত্বপূর্ণ সত্যি শিখতে হয়েছে, মানুষের মতোই অন্তর্মুখীনতার কঠোর প্রশিক্ষণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। ছান্দোগ্য এমন এক মুহূর্তের গল্প বলছে যখন দেবা ও আসুরারা প্রথম আত্মার কথা জানতে পারেন। ‘এসো,’ পরস্পরকে বলেন তাঁরা, ‘সারা বিশ্ব কে অধিকার করিয়া আর আবিষ্কার করিয়া আমরা সেই আত্মাকে খুঁজিয়া বাহির করি আর সকলের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পাক। তো ইন্দ্র তাঁর দেবতাদের প্রতিনিধি হয়ে এবং অন্যতম নেতৃস্থানীয় আসুরা বিরোচনা গুরুর জন্যে আগুন বহন করে বিনয়ী বৈদিক শিষ্য হিসাবে প্রজাপতির দোরগোড়ায় হাজির হলেন। প্রজাপতির সঙ্গে বত্রিশ বছর ধরে শিক্ষা লাভ করলেন তাঁরা, কিন্তু তারপরেও আত্মার খোঁজ পাওয়ার ধারে-কাছে পৌঁছাতে পারলেন না। প্রজাপতি সেরা পোশাকে সাজতে বললেন তাঁদের, তারপর জলের পাত্রে নিজেদের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাতে বললেন। কি দেখিতে পাইলে? চমৎকার কেতাদুরস্ত পোশাকে সাজানো, নিজেদের প্রতিরূপ, জবাব দিলেন তাঁরা। ‘ইহাই আত্মা; উহাই অমর,’ তাঁদের বললেন প্রজাপতি, “ইহাই ভীতি হইতে মুক্ত, ইহাই ব্রাহ্মণ। খুশি হয়ে বিদায় নিলেন তাঁরা, বিরোচনা তাঁর জ্ঞান নিয়ে আসুরাদের কাছে ফিরে গেলেন। দেহই আত্মা, তাদের বললেন তিনি; একজন ব্যক্তি কেবল তার দৈহিক চাহিদার দিকে খেয়াল রেখেই এই জীবনে ও পরকালে মনের আশা পূরণ করতে পারে: উৎসর্গ বা আচারের কোনওই প্রয়োজন নেই। 

কিন্তু স্বর্গে ফিরে যাওয়ার আগে থমকে দাঁড়ালেন ইন্দ্র। এমনকি কেতাদুরস্ত দেহও তো, ভাবলেন তিনি, জরাগ্রস্ত হবে, অসুস্থ হবে এবং শেষপর্যন্ত মারা যাবে। তো জ্বালানি কাঠ বহন করে ফের প্রজাপতির কাছে ফিরে গেলেন তিনি, আরও উনষাট বছর শিক্ষা নিলেন, আপন সত্তার গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করলেন। প্রজাপতি তাঁকে বললেন, স্বপ্নের পর্যায়ে যখন সত্তা দৈহিক বাধা থেকে মুক্ত থাকে তখন আত্মার দেখা মেলে। এই ব্যাখ্যায় প্রথমে খুশি হয়ে উঠেছিলেন ইন্দ্ৰ। কিন্তু পরে ভেবে দেখলেন ঘুমের ভেতর ব্যক্তি ভয় পেতে পারে, মৃত্যু ভয় জাগতে পারে, এমনকি সে কাঁদতেও পারে। ফের প্রজাপতির কাছে গেলেন তিনি। এইবার প্রজাপতি তাঁকে বললেন, এই যে প্রসুপ্ত জীব (নিদ্রিতাবস্থায়) একীভূত হন, প্রসন্নতা লাভ করেন এবং স্বপ্ন দর্শন হইতেও বিরত হন, ইতিই আত্মা, ইতিই অমৃত ও অভয়, ইনিই ব্রাহ্মণ।৩৭ ফের এই ধারণায় আকৃষ্ট হলেন ইন্দ্র, কিন্তু কিছু সময় বাদে হতাশাব্যাঞ্জক আবিষ্কার করলেন একে; এমনি গভীর অসচেতনতায় ব্যক্তি তো মারাও যেতে পারে। তো সত্যি শোনার জন্যে তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আরও পাঁচ বছর প্রজাপতির সঙ্গে থাকলেন তিনি। অবশেষে প্রজাপতি ইন্দ্রকে বললেন, আলোকিত জনকে তার দৈহিক ও মানসিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত অশুস্থঃ সত্তাকে আবিষ্কারের আগে মন ও দেহের ঊর্ধ্বে তাকানো শিখতে হয়। আত্মা তাই যা মানুষকে গন্ধ নিতে, দেখতে ও ভাবতে সক্ষম করে তোলে: 

চক্ষু কেবল দেখিবার জন্য (অর্থাৎ পুরুষই দেখেন, চক্ষু কেবল দেখিবার যন্ত্রমাত্র)। দেহের মধ্যে থাকিয়া যিনি জানেন ‘আমি অঘ্রাণ লইতেছি,’ তিনি আত্মা, নাসিকা কেবল গন্ধ নিবার জন্যে। যিনি জানেন, ‘আমি বাক্য উচ্চারণ করি,’ তিনিই আত্মা; বাগিন্দ্রিয় কেবল বাক্য উচ্চারণ করিবার জন্য। যিনি জানেন, ‘আমি শুনিতে পারি,’ তিনিই আত্মা, কর্ণ কেবল শুনিবার জন্য। আর যিন জানেন যে ‘আমিই মনন করিতেছি,’ তিনিই আত্মা, মন তাহার, দৈব চক্ষু, তিনি মনোরূপ দৈব চক্ষু দ্বারা সমস্ত কাম্য বস্তু দর্শন করিয়া আনন্দ লাভ করেন। ৩৮ 

গল্পটি আত্ম-আবিষ্কারের দীর্ঘ প্রক্রিয়া তুলে ধরেছে। গুরু স্রেফ শিষ্যকে উত্তর জানাতে পারেন না, বরং তাকে অন্তর্মুখীনতার বিভিন্ন পর্যায়ের ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। যখনই মনে হয়েছে যে তারা বিষয় বস্তুর মূলে পৌঁছে গেছে, শিষ্য নিজেই আবিষ্কার করেছে যে এটাই অনুসন্ধানের শেষ নয়, আরও গভীরে যেতে হবে তাকে। এমনকি শক্তিধর ইন্দ্রের পর্যন্ত দেবতাদের অমরত্ব দেওয়া আত্মা আবিষ্কারে বহু বছর সময় লেগেছে। 

উপনিষদের সাধুরা সত্তার মূল খোঁজার প্রয়াস পাচ্ছিলেন, এই প্রক্রিয়ার ভেতর অনির্বচনীয় আনন্দ ও শান্তির অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন কেউ কেউ। এই অন্তস্থঃ যাত্রায় অংশগ্রহণকারীকে গুরু প্রজাপতি, আপন চেহারায় আবির্ভূত হওয়া ‘গভীর প্রশান্ত জন’ বলেছেন।৪০ বিশেষ তথ্য পেয়ে নয়, বরং ভিন্নভাবে জীবন যাপন করে কোনওভাবে নিজের কাছে ফিরেছেন তিনি। চূড়ান্ত মোক্ষ লাভের মতো প্রক্রিয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কেবল ছান্দোগ্যের টেক্সট পাঠকারী কেউ অবশ্য এই অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবে না। শিষ্য সত্যি সত্যি ধ্যানে না বসলে ও অন্তর্মুখীনতার দীর্ঘ ও কষ্টকর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে না গেলে সত্যিকার অর্থে আলোকনের ব্যাপারটা ঘটবে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, অধিবিদ্যক ধ্যান দীক্ষার সামান্য একটা অংশ ছিল মাত্র। ব্রহ্মাচারীর মতো উপনিষদ ছাত্রদের সহজ, আত্ম-সংযমী উপায়ে জীবন যাপন করতে হতো, অনুসন্ধানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা। নিজের বীরত্বের কথা বলে বেড়াতে কখনওই পিছ পা না হওয়া দেবতা ইন্দ্রকে গুরুর জন্যে জ্বালানি যোগাড় করতে হয়েছে, আগুন পাহারা দিতে হয়েছে, প্রজাপতির ঘর পরিষ্কার করতে হয়েছে, পবিত্র হতে হয়েছে, যুদ্ধ বর্জন করতে হয়েছে, চর্চা করতে হয়েছে অহিংসার। মানব সাধু ও দেবতারা লোকে কেবল আগ্রাসীভাবে আত্ম-প্রতিষ্ঠার অহম বর্জন করলেই কার্যকর হওয়ার মতো এক আধ্যাত্মিক কৌশল আবিষ্কার করছিলেন। 

.

এদিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ বেছে নিচ্ছিল গ্রিকরা। অ্যাক্সিয়াল যুগের ভারতীয় সাধুরা যেখানে বীরের নীতি ছেড়ে আদিআদর্শ আর্য যোদ্ধা ইন্দ্রকে একজন বিনয়ী বৈদিক শিষ্যে পরিণত করছিলেন, সেখানে গ্রিকরা গোটা পোলিসকেই সামরিকীকরণ করছিল। ভারতের দেবতারা সংসারত্যাগীর মানসিক প্রক্রিয়ায় মিশে যাচ্ছিলেন, কিন্তু গ্রিকরা আগের চেয়ে অনেক বেশি করে তাদের দেবতাদের সংজ্ঞায়িত করে তুলছিল। এক অর্থে সপ্তম শতাব্দীতে হেলেনিক বিশ্ব সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। এই পর্যায়ে অ্যাথেন্স অন্যান্য পোলিস থেকে পিছিয়ে ছিল, কিন্তু কোনও কোনও নগরী, বিশেষ করে পেলোপোনেসাস উন্নত হয়ে উঠেছিল। ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যে দারুণভাবে অবস্থান করা কোরিন্থের শতক ছিল এটা, মিশরের প্রভাবে সমৃদ্ধিশীল কুটির শিল্প ছিল এখানে, বিশালাকার স্থাপত্য শিল্প নিয়ে চলছিল গবেষণা। অবশ্য সবচেয়ে চরমপন্থী শহর ছিল স্পার্টা, সমগ্র পোলিসের কাছে ব্যক্তির স্বার্থ অধীন করে নেওয়া এক অনন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল এখানে ৪২ নাগরিকরা হোমোইও (‘সমান’ বা ‘অনুরূপ’ জন) হিসাবে পরিচিত ছিল। অহিংসা নয় বরং সামরিক দক্ষতার প্রতি স্পার্টার কেনোসিস ছিল বলে কোনও কোনও দিক থেকে এই ব্যবস্থা অ্যাক্সিয়াল যুগের আত্ম-সমর্পণের দুর্বল অনুকরণ ছিল। তাছাড়া, স্পার্টার নাগরিকদের সাম্য অন্যদের নিষ্ঠুর বশ্যতার উপর নির্ভরশীল ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে স্পার্টা দক্ষিণ পশ্চিমের মেসিনা দখল করে নেয়, এখানে জমি অধিকার করে এবং স্পার্টার হোমোইও-দের ভেতর বিলিবণ্টন করে দেয়। মেসিনার স্থানীয় জনগণ হিলোতরা পরিণত হয় দাসে। এমন একটি ব্যবস্থা টানোপোড়েন সৃষ্টি করতে বাধ্য। ৬৭০ সালে কেবল আবার এক নিষ্ঠুর লড়াইয়ের পর পুনর্দখল হওয়ার জন্যেই মেসিনা স্পার্টা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। 

কিন্তু স্পার্টাই একমাত্র গোলমেলে জায়গা ছিল না। নতুন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সত্ত্বেও গ্রিক বিশ্ব সংকটাপন্ন ছিল ৪৩ প্রথমে উপনিবেশবাদ ছিল পোলিসগুলোর অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান; ঝামেলাবাজদের স্রেফ ভিন্ন বসতি খুঁজে বের করা জন্যে বহিষ্কার করে দেওয়া হতো। কিন্তু সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ পুবের আরও উন্নত সমাজগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করে। লোকে বিদেশে দেখা বস্তুগত বিলাসিতা উপভোগ করতে চাইছিল, কিন্তু চাহিদার তুলনায় যোগান ছিল অপ্রতুল। কিছু পরিবার ধনী হয়ে ওঠে, অন্যদিকে অন্যরা বেহিসেবি চলতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ৬৫০ সাল নাগাদ বিভিন্ন নগর-রাষ্ট্রে বিভিন্ন গোত্রের ভেতর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রক্তাক্ত বিবাদ আর উপদলীয় সংঘাত দেখা দিয়েছিল। সঙ্কটের বিস্তারিত অস্পষ্ট রয়ে গেছে, তবে মনে হয় আর্থিক সমস্যা মেটাতে অভিজাতদের কেউ কেউ দরিদ্র কৃষকদের শোষণ করে নিজেদের ব্যবহারের জন্যে সরকারি জমিন দখলের চেষ্টা করেছিল। কোনও কোনও প্রজা স্থানীয় অভিজাতদের হাতে তাদের উৎপন্নের ছয় ভাগের এক ভাগ তুলে দিতে বাধ্য ছিল। অভিজাতরা দরবার নিয়ন্ত্রণ করত বলে এর সমাধানের তেমন কোনও আশা ছিল না তাদের। অভিজাত ও অর্থনীতির মুলধারা গরীবদের ভেতর এক বিপজ্জনক ফারাক সৃষ্টি হচ্ছিল। 

কৃষকদের নিজস্ব সমস্যারও অন্ত ছিল না। গ্রিকরা পুব থেকে কৃষিকাজের নতুন কৌশল আয়ত্ত করেছিল, ভবিষ্যতে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছিল তারা, আঙুর বাগান আর জলপাই ক্ষেত তৈরি করছিল, ফসল ফলতে যার দশ মাস লাগে। দীর্ঘ মেয়াদী উৎপাদনের জন্যে গবাদিপশুও বাড়াচ্ছিল তারা। কিন্তু মাঝখানের সময়টুকুতে অনেকেই বেঁচে থাকা কঠিন আবিষ্কার করছিল, হয় তাদের পুঁজিতে হাত দিতে হয়েছে কিংবা অর্থ যোগানোর জন্যে জমিন বিক্রি করতে হয়েছে। ঋণের বিশ্রী ঘটনা ঘটেছে, ঋণগ্রহীতার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা দাসত্বের পরিণতিতে পর্যবসিত হয়েছে। এইসব অস্থিরতা আরও বৃহত্তর সামাজিক সমস্যার দিকে টেনে নিয়ে গেছে। পুরোনো মূল্যবোধ যেন ক্ষয়িষ্ণু ঠেকেছে। সপ্তম শতাব্দীর গোড়ার দিকে রচনায় ব্যস্ত কবি হেসিওদ উল্লেখ করেছেন যে কোনও কোনও পোলিসে শিশুরা আর বড়দের মানছিল না, প্রজন্মগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং প্রবীণরা আর তরুণদের দিক নির্দেশনা দিতে পারছিলেন না। তাঁর কবিতা ছিল নৈতিক শূন্যতা পূরণের প্রয়াস। 

হোমারের চেয়ে ভিন্ন ধরনের কবি ছিলেন হেসিওদ, সঙ্কট মূল্যায়নের মতো নিখুঁত অবস্থানে ছিলেন তিনি ৪ অভিজাত যোদ্ধা সমাজের সদস্য ছিলেন না, এসেছিলেন বোয়েতিয়ার কৃষক ছিলেন। পুব থেকে আসা বহু নতুন নতুন ধারণায় অনুপ্রাণিত ছিলেন। এশিয়া মাইনর থেকে গ্রিক মূল ভূখণ্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন তাঁর বাবা; কোনওভাবে হেসিওদ যেন গ্রিক বীরত্বের ঐতিহ্যের চেয়ে নিকট প্রাচ্য, হুরিয় বা হিট্টাইট পুরাণে বেশি অনায়াস ছিলেন। নিশ্চিতভাবেই নিজেকে গ্রিক চারণ কবি মনে করতেন তিনি এবং একবার এমনকি কবিতার জন্যে পুরস্কারও পেয়েছিলেন, কিন্তু বীরের কেতা বিব্রতকরভাবে ব্যবহার করতেন এবং সম্ভবত মৌখিক নয় বরং লিখিত কবিতাই রচনা করেছিলেন ৪৫ তিনিই নিজের বক্তব্য লিপিবদ্ধকারী ও রচনায় নিজের নাম লেখা প্রথম গ্রিক কবি ছিলেন। কোনওভাবে হেসিওদ হোমারিয় চারণ কবির চেয়ে বরং হিব্রু পয়গম্বরদের মতো ছিলেন। আমোসের মতো ‘ভেড়া চরানোর সময়’ প্রথম স্বর্গীয় অনুপ্রেরণার আলোড়ন অনুভব করেছেন তিনি। যিউসের মেয়ে মুসেস সত্যি উচ্চারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁকে, তারপর 

আমাকে তুলে দিলেন একখানা ছড়ি,
ফুল ফোটা লরেলের একটা কিশলয়, খুবই সুন্দর,
ভবিষ্যতের ঘটনা আর যেসব
ঘটনা অতীত হয়ে গেছে,
যাপন করার জন্যে।
পবিত্র কণ্ঠস্বর ফুঁকে দিলেন আমার কণ্ঠে। ৪৬

কবিতাকে অনুপ্রেরণা হিসাবে উপলব্ধি করেছেন তিনি; এটা মানুষের হৃদয়কে শান্ত করে তুলতে পারে এবং দেবতাদের সঙ্গে গড়ে তুলতে পারে সেতুবন্ধ। 

সামাজিক ন্যায়বিচারের চর্চাও তাই করেছিল। এই ভাবনা হেসিওদকে আমোসের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। পবিত্র কৃষি কাজ ও প্রাজ্ঞ গৃহস্থলীর উপর লেখা দীর্ঘ স্তোত্রগীত ওয়ার্কস অ্যান্ড ডেজ-এ হেসিওদ ভাই পেরেসের সঙ্গে তাঁর বচসা চলছে বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পৈত্রিক সম্পত্তি তাঁদের ভেতর বণ্টন করা হয়েছে, কিন্তু প্রাপ্যের চেয়ে বেশি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন পেরেস, স্থানীয় বেসিলিসে আর্জি পেশ করেছেন তিনি। আইনি প্রক্রিয়ায় তেমন একটা অস্থা ছিল না হেসিওদের। কেবল পথে বসানোর মতো মাশুল আরোপ করার ক্ষমতাবান আভিজাতরাই এই আইনি ব্যবস্থা থেকে ফায়দা নিতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন পেরেসকে। হেসিওদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাঁকে সারা গ্রিসে একটা প্রধান রাজনৈতিক সঙ্কটে পরিণত হতে চলা কৃষিখাতের সঙ্কট সম্পর্কে বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছিল। একজন পয়গম্বরের মতো বেসিলিদের সতর্ক করে হেসিওদ বলেছেন: 

হে ভূস্বামীগণ, এই সাজার কথা মনে রাখবেন
মৃত্যুহীন দেবতাগণ কখনওই দূরে নন…
যিউসের চোখ সব দেখে, বোঝে,
একটা শহর কতটা ন্যায়নিষ্ঠ
তিনি যখন ইচ্ছা করবেন, লক্ষ করেন,
কিছুই তাঁর নজর এড়ায় না। ৪৭

দেবী দাইক (বিচার) থেকে আসত একক আইনি সিদ্ধান্তগুলো (দিকাই), রায় বিকৃত হলে আহত হতেন তিনি; সঙ্গে সঙ্গে বাবা যিউসকে জানাতেন, কোনও বেসিলিয়াস ঘুষ নিলে বা নিজের স্বার্থ আদায়ের জন্যে মিথ্যা শপথ উচ্চারণ করলে প্লেগ, দুর্ভিক্ষ আর রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে অপরাধী পোলিসকে শাস্তি দিতেন সমাজের রক্ষক যিউস ৪৮ প্রত্যক্ষ স্বর্গীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আনাড়ী সামাধান ছিল এটা, যা সব সময় পাওয়া যেত না বলেই ধরে নেওয়া যায়। তবে একটা পরিবর্তনের চিহ্ন ছিল এতে। প্রাচীন অভিজাত বিধিবিধান আবিশ্যিকভাবে আত্ম-মর্যাদাপূর্ণ ছিল। বেসিলি ও কৃষকদের ভেতর নিবিড় সহযোগিতা বীরের আদর্শকে সাধারণ মানুষের ন্যায্য ও সমান সুযোগ পাওয়ার চাহিদার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে আসা পোলিসগুলোর উন্নতির জন্যে প্রয়োজন ছিল। হেসিওদ বিশ্বাস করেছিলেন যে, তাঁর প্রজন্ম এক কঠিন সিদ্ধান্ত মোকাবিলা করছে। ন্যায় বিচার (দাইক) নাকি বীরত্বপূর্ণ যোদ্ধার স্বার্থপর বাড়াবাড়ি (হুব্রিস) গ্রিক সমাজকে বৈশিষ্ট্যায়িত করবে? 

এই বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলতে মানুষের চতুর্কালের পুরাণের ইন্দো- ইউরোপিয় নতুন ভাষ্য সৃষ্টি করেন হেসিওদ। প্রথাগতভাবে চারটি উপর্যুপরি কাল পর্ব ছিল, প্রতিটি আগেরটির চেয়ে ক্ষয়িত এবং কোনও ধাতুর নামে প্রতিটির নামকরণ করা হয়েছে: স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র ও লৌহ। কিন্তু এদের সঙ্গে বীরের কাল যোগ করে কাহিনী পাল্টে দিয়েছেন হেসিওদ, তাম্র-যুগ আর সবচেয়ে খারাপ সময় চলমান লৌহ যুগের মাঝে স্থাপন করেছেন একে। স্বর্ণযুগে মানব ইতিহাসের সূচনা লগ্নে মানুষ ও দেবতাদের ভেতর কোনও দূরত্ব ছিল না; মানবজাতি সুখে দিন কাটাত, অসুস্থতা আর জরার সঙ্গে পরিচিত ছিল না তারা। স্বাভাবিক ও শান্তিতে ঘুমের ভেতর মৃত্যু হাজির হতো তাদের কাছে। উর্বর ভূমি না চাইতেই তার ফল তুলে দিত [৫০] বলে বেঁচে থাকার জন্যে পরিশ্রম করতে হতো না তাদের। সেই জাতি হারিয়ে গেলে অলিম্পিয়ান দেবতারা মানুষের এক রৌপ্য জাতি গড়ে তোলেন, যাদের সাবালক হয়ে উঠতে অনেক সময় লেগে যায়, কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা পরিপক্ক হয়ে উঠলে হুব্রিসের আধিপত্যে ‘সংক্ষিপ্ত, কষ্টের জীবন যাপন করে। ‘নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি’ তারা এবং পরস্পরকে নিষ্ঠুর ও বেপোয়াভাবে শোষণ ও আহত করেছে, দেবতাদের উপাসনাকে উপেক্ষা করেছে। সক্রোধে যিউস তাম্র যুগের মানুষ দিয়ে তাদের প্রতিস্থাপিত করেন, তারা ছিল আরও খারাপ। যুদ্ধের আর্তনাদ আর সহিংসতায় আসক্ত,’ ‘অদ্ভুত আর শক্তিতে ভরা’ ‘ভয়ঙ্কর মানুষ,’ ছিল তারা। ‘পাথরের মতো কঠিন’, তাদের হৃদয়, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিশাল, অপরাজেয়। এই সমাজ এতটাই স্বার্থপর আর আগ্রাসী ছিল যে তাম্র যুগের মানুষ শেষপর্যন্ত পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলে। ফলে বীরদের জাতি সৃষ্টি করেন যিউস। এরা ছিল পূর্বসুরিদের হুব্রিসের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ‘ন্যায়নিষ্ঠ ও ভালো’ আধা দেবতা, কিন্তু তারপরেও শেষপর্যন্ত তাদের ধ্বংস করে দেওয়া ভয়ঙ্কর ট্রোজান যুদ্ধে লড়াই করেছে।এখন বীররা পৃথিবীর একেবারে প্রান্তে অশীর্বাদপ্রাপ্ত দ্বীপে বাস করছে। 

এই বীরের যুগের পরে এসেছে সমসাময়িক যুগ, লৌহ যুগ। আমাদের এই বিশ্ব ওলটপালট হয়ে গেছে, ছুটে যাচ্ছে অনিবার্য বিনাশের দিকে। জীবন কঠিন, হতাশাময়। ‘দিনে লোকে কাজ করে, অবিরাম শোকে ভোগে,’ লক্ষ করেছেন হেসিওদ, ‘রাতে ক্রমে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরে যায়।*° কিন্তু দেবতারা এখনও মানুষকে কিছু আশীর্বাদ দেন। লৌহ যুগে ভালো ও খারাপ, দুঃখ ও সুখ অবিচ্ছেদ ছিল কেবল কঠোর পরিশ্রম করলেই লোকে খেয়ে পরে বেঁচে থেকে সমৃদ্ধ হতে পারে। এটা ছিল দ্ব্যর্থবোধকতা আর অস্পষ্টতার কাল। সবকিছু মিলেমিশে একাকার। তবে লৌহ যুগের মানুষের একটা পছন্দ ছিল। তাদের হয় ন্যায়বিচারের চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে নইলে নিজেদের হুব্রিসের অভিজাত পাপের হাতে তুলে দিতে হবে। দাইক-কে অবহেলা করলে অশুভের বিজয় প্রত্যক্ষ করবে, যেখানে জোর যার মুল্লুক তার, যেখানে বাবারা ছেলেদের জন্যে কোনও অনুভূতি বোধ করে না, ছেলেরা প্রবীণ অভিভাবকদের ঘৃণা করে এবং প্রাচীন ভ্রাতৃসুলভ ভালোবাসা হারিয়ে যাবে। ‘কোনও কিছুই আর অতীতের মতো থাকবে না। ১৫১ 

এখানে গল্পের নীতিবাক্য পরিষ্কার। সামাজিক ন্যায়বিচারের চর্চাকারী জাতি দেবতাদের ভালোবাসা আর সম্মান পায়। তাম্র যুগের সহিংস যোদ্ধারা নিহত হয়েছে; এক সুখী বেপরোয়া জীবনে চলে গেছে তাদের বীররা। ন্যায় বিচার মরণশীলদের দেবতাদের কাছাকাছি নিয়ে গেছে, তো তাদের অবশ্যই পরস্পরের সঙ্গে শোভন আচরণ করতে হবে, এবং উৎসর্গে অলিম্পিয়ানদের সম্মান দেখাতে হবে। তাদের অবশ্যই নিজেদের অবস্থানও জানতে হবে। বীরদের যুগের অবসান ঘটেছে। সুতরাং, হেসিওদ বুঝিয়েছেন—যদিও স্পষ্ট করে বলেননি-পুরোনো, আত্মবিধ্বংসী যোদ্ধার রীতি নীতি বিসর্জনের সময় হয়েছে। লৌহ যুগের মানুষরা অ্যাকিলিস বা অদিসিয়াসের মতো আচরণ করতে পারে না; তারা কৃষক মাত্র, জমিনের হালচাষী, কষ্টের তুচ্ছ কাজে (এরিস) জমিনের সঙ্গে সংগ্রামে নিয়োজিত। প্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক শক্তির অনুকরণের বদলে ভালো ফসল উৎপাদনকারী পড়শীর সঙ্গে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় নামা উচিত তাদের। এই সংগ্রামই কৃষকদের দেবতাদের আপন করে তোলে। ইতিহাসের এই কাল স্বর্ণ যুগ থেকে ভিন্ন ছিল, যখন জমিনে চাষের কোনও প্রয়োজন ছিল না। লৌহ যুগে মানুষ কেবল গৃহস্থলীর কঠিন শৃঙ্খলাপূর্ণ কাজে সফল হলেই টিকে থাকতে পারবে বলে ঘোষণা করেছিলেন যিউস, যা ছিল এক ধরনের উৎসর্গ, দেবতাদের ভক্তির এক দৈনন্দিন কাজ।৫২ 

হেসিওদ তাঁর থিওগোনি-তে আরও বিস্তারিতভাবে এসব ধারণা পরীক্ষা করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে অলিম্পিয়ান দেবতাদের বিজয়ের কথা বর্ণনা করা হয়েছে এখানে।৫৩ গ্রিক ধর্মের টেক্সট বইতে পরিণত হয়েছে এটা। অন্ধকার যুগের অস্পষ্টতা থেকে আবির্ভূত পুরাণটির কিছু কিছু বর্ণনায় অনেকেই বিভ্রান্ত বোধ করেছেন। ঠিক কিভাবে বিভিন্ন চথোনিক শক্তিগুলো পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল? টাইটানরা যিউসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেলি কেন? মেসোপটেমিয় ও অন্যান্য নিকট প্রাচ্যীয় পুরাণ কাজে লাগিয়ে এইসব ফাঁক পূরণ করেন হেসিওদ। তিনি এমনভাবে প্রচলিত কাহিনীগুলো বলেছেন যার ফলে ভয়ঙ্কর যুদ্ধগুলো থিওগোনির সংগ্রামকে-আদিম আকৃতিহীনতা থেকে দেবতাদের আবির্ভাব-বৃহত্তর স্পষ্টতা, শৃঙ্খলা আর সংজ্ঞার প্রয়াস হিসাবে তুলে ধরেছে। বিশৃঙ্খলার তলাহীন মহাগহ্বর গাইয়া ও ইউরেনাসের অধিকতর নিরেট বাস্তবতায় পূরণ দিয়ে এর শুরু হয়েছিল, শেষ হয়েছে আইনের শাসনের বিরোধিতাকারী টাইটানদের বিরুদ্ধে অলিম্পিয়ানদের বিজয়ের ভেতর দিয়ে। হেসিওদ চেয়েছিলেন স্বর্গীয় পিতা ও পুত্রদের পরস্পরকে ছিন্নভিন্ন করার এইসব ভীতিকর কাহিনী যেন বিভিন্ন পোলিসে গ্রিকদের অভ্যন্তরীণ বিবাদের বিপদ সম্পর্কে সজাগ করে তোলে। তাঁর কলমে যিউস প্রতিষ্ঠিত ন্যায়বিচার ভিত্তিক ও শৃঙ্খলাপরায়ণ শাসকগোষ্ঠী তার আগের অস্বাভাবিক বিশৃঙ্খলার দারুণ বিপরীত ছিল। হেসিওদের থিওগোনি পরে গ্রিক দার্শনিকদের ভাবিত করে তোলা প্রশ্ন ও উত্থাপন করেছে: মহাবিশ্বের উৎস কোথায়? শৃঙ্খলা কিভাবে বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে জয়ী হলো? কিভাবে এক থেকে অনেক সৃষ্টি হতে পারে? আকারহীন কিভাবে যা স্পষ্ট ছিল তার সঙ্গে মিলতে পারে? 

টাইটান প্রমিথিউসের কাহিনী বর্ণনা করে স্বর্গীয় পরিকল্পনায় মানুষের অবস্থানও স্থির করে দিয়েছেন হেসিওস। ৪ স্বর্ণযুগে দেবতা ও মানুষ সমতার সঙ্গে বাস করেছেন এবং একসঙ্গে নিয়মিত ভোজে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু স্বর্ণ যুগের শেষে দেবতারা মানুষের জগৎ থেকে সরে যেতে শুরু করেন। এখন অলিম্পিয়ানদের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বজায় রাখার একমাত্র উপায় পশু বলীর আচার, যখন দেবতা ও মানুষ বলীর নির্ধারিত অংশ ভোগ করে থাকেন। কিন্তু এই ব্যবস্থাকে অন্যায় মনে করলেন প্রমিথিউস, মানুষের অবস্থা উন্নত করতে সাহায্য করতে চাইলেন তিনি। এমনি এক উৎসর্গের পর মানুষ যাতে খাবার উপভোগ করতে পারে সেজন্যে কৌশলে যিউসকে পশুর অখাদ্য হাড় গ্রহণে রাজি কারানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু চাতুরিটা ধরে ফেলেন যিউস : দেবতাদের খাবারের প্রয়োজন হয় না; বেদীতে পশুর হাড় পোড়ানোর সময় উঠে আসা ধোঁয়ায়ই বেঁচে থাকতে পারেন। সুতরাং, কেবল নিহত পশুর মাংস খাওয়ার উপরই বেঁচে থাকা নির্ভর করা মরণশীলদের তুলনায় দেবতাদের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে উৎসর্গ। প্রমিথিউসের চাতুরিপূর্ণ কৌশলে ক্ষিপ্ত হয়ে খাবার রান্নার জন্যে প্রয়োজনীয় আগুন থেকে বঞ্চিত করে মানুষকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান নিলেন যিউস। প্রমিথিউস আবারও তাঁকে উপেক্ষা করে আগুন চুরি করে ফের মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিলেন। প্রমিথিউসকে একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে শাস্তি দিলেন যিউস। এবং এবার স্বর্গীয় কারিগর হেফিয়াস্তাসের তৈরি এক নারীকে পাঠিয়ে মানবজাতিকে সাজা দিলেন। স্বর্ণ যুগে লিঙ্গের কোনও পার্থক্য ছিল না; মানবজাতি তখনও লিঙ্গ দিয়ে শনাক্ত হয়নি। প্রথম নারী পান্দোরা ছিলেন ‘সুন্দরী অশুভ’। ‘সঙ্গে করে আনা একটা পাত্র উন্মুক্ত করে দেন’ তিনি, ‘মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেন বেদনা আর কষ্ট। পুরুষরা ভয়ঙ্করভাবে তাদের জগতে অসুস্থতা, জরা আর ভোগান্তি বয়ে আনা নারীদের সঙ্গে জুটিবদ্ধ হয়। 

অ্যাক্সিয়াল যুগের কিছু নারী বিদ্বেষী মুহূর্তের অন্যতম ছিল এটা। দয়া থেকে মানবজাতির পতন তুলে ধরে লৌহ যুগে জীবনের দুর্বোধ্য রূপ তুলে ধরতে চেয়েছিলেন হেসিওদ।৫৫ এরপর থেকে ভালো-মন্দ অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে গেছে। উৎসর্গ মানুষ এবং দেবতাদের একসঙ্গে করেছে, কিন্তু তাদের ভেতর চরম দুরত্বও তুলে ধরেছে। অ্যাক্সিয়াল যুগের প্রধান থিম-দুর্ভোগ-এখন জীবনের অনিবার্য সত্যে পরিণত হয়েছে। ভারতে সাধুরা মানুষের বেদনা ও মৃত্যুকে অতিক্রম করে যাওয়ার আধ্যাত্মিক ধর্মতত্ত্ব নির্মাণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। হেসিওদের তেমন কোনও লক্ষ্য ছিল না। মানুষের সত্যিই স্বর্গীয় জগতে উত্থান করতে চাওয়া উচিত নয় বলে নিশ্চিত ছিলেন তিনি। প্রমিথিউসের কাহিনী দৃঢ়তার সঙ্গে দেবতা ও পশুর মাঝামাঝি জায়গায় চারাদিকে পান্দোরার মুক্তি দেওয়া অশুভে ঘেরাও অবস্থায় মানুষের স্থান স্থির করে দিয়েছে। লৌহ যুগের মানুষ দুর্ভোগ থেকে বাঁচতে পারেনি। তারা প্রমিথিউসের মতো বিদ্রোহ করতে চেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু হুব্রিস ছিল আত্ম-ধ্বংসী: প্রমিথিউসের বিদ্রোহ কেবল তাঁর পক্ষে বেদনা ও মানবজাতির পক্ষে অন্তহীন দুর্ভোগই বয়ে এনেছে। 

অন্য গ্রিকরা ভেবেছে হাল ছেড়ে দেওয়া সমাধান হতে পারে না। ক্রমবর্ধমানহারে রাজনৈতিক সংকট আরও তীব্র হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কৃষক ক্ষেতমজুরের দল অর্থনৈতিক স্বস্তি, বাজেয়াপ্তকৃত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ ও আইনের কাছে নিরাপত্তা দাবি করছিল; এই জনপ্রিয় দাবি কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে চাওয়া যেসব অভিজাত তাদের লক্ষ্যকে মূল্য দিয়েছে তাদেরই সমর্থন করেছে তারা।৫৬ ৬৫৫ সালে প্রথম টাইরানোস করিন্থের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন, অন্যান্য পোলিসও এর অনুসরণ করে। আমাদের আধুনিক কালের বিচারে এই নতুন শাসকরা ‘স্বৈরাচারী’ ছিলেন না, বরং স্রেফ অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করে জনগণের উপকারের স্বার্থে প্রথাগত আইনের আওতার বাইরে থেকে শাসন করেছেন। ন্যায়বিচারের প্রবক্তা হিসাবে গোড়ার দিকে শ্রদ্ধা পেয়েছেন স্বৈরাচারী, কিন্তু স্বৈরাচার স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল না। স্বৈরাচার কর্তৃক শক্তিশালী করে তোলা জনগণ অনিবার্যভাবে আরও আস্থাশীল হয়ে উঠেছিল। তিনি মারা যাওয়ামাত্র তাঁর অসাংবিধানিক শাসন নিষ্ঠুর ও খামখেয়ালিপূর্ণ মনে হতে শুরু করেছিল, তো লোকে সাধারণত তাঁর উত্তরাধিকারীর বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে, ঘৃণার সঙ্গে স্মরণ করেছে স্বৈরাচারীকে। কিন্তু ঠিকমতো সংগঠিত হতে পারলে মানুষ যে শাসক শ্রেণীর শোষণ ছিন্ন করে নিজের হাতে নিয়তি তুলে নিতে পারে এই পরীক্ষা সেটাই দেখিয়ে দিয়েছিল। 

স্বৈরাচারের আবির্ভাবের সমসাময়িক সামরিক উদ্ভাবন আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অষ্টম শতাব্দীর শেষদিকে অস্ত্র নির্মাতারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে, পোলিসগুলোর রথচালকদের একটা ছোট অভিজাত অশ্বারোহী বাহিনীর উপর নির্ভর করে থাকার চেয়ে বড় আকারের সেনাবাহিনী সজ্জিত করার মতো সামরিক প্রযুক্তি ছিল ৫৮ ৭০০ থেকে ৬৫০ সালের ভেতর নগর-রাষ্ট্রগুলো প্রবল সশস্ত্র পদাতিক বাহিনীর উপর নির্ভর করতে শুরু করে এবং মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হওয়া পুরোনো কায়দার হোমারিয় ধরনের যোদ্ধারা ক্রমে হারিয়ে যায়। লোকবল গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যুদ্ধবিগ্রহ আর অভিজাতদের একচেটিয়া অধিকার ছিল না। এখন থেকে নিজেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রে (হোপলা) সজ্জিত করার সামর্থ্য রাখে এমন যেকেউই–হোক সে জমিদার বা কৃষক-অবস্থান বা জন্মপরিচয় নির্বিশেষে এই মর্যাদাকর বাহিনীতে যোগ দিতে পারত। হোপলাইট সেনাবাহিনীর কারণে এক নতুন সাম্যের জন্ম হয়েছিল। 

হোপলাইট লড়াই প্রতি সারিতে আট জন করে নিবিড়ভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো সারি-ফ্যালাংক্স-নিয়ে ভিন্ন ছিল। প্রত্যেক সৈনিক তার পাশের জনের ডান কাঁধ আঁকড়ে থেকে বাম পাশ রক্ষার লক্ষ্যে বৃত্তাকার বর্ম ধরে রাখত। শত্রুর বিরুদ্ধে এককভাবে আগে বাড়ত ফ্যালাংক্স, বর্মের দেয়ালের উপর নিচে আঘাত হানত তারা। শেষপর্যন্ত এক পক্ষ দল ভেঙে সটকে পড়ত। অসাধারণ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল ফ্যালাংক্স, তবে শত্রুর উপর মারাত্মক ক্ষত চাপিয়ে দিত। আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে পুরুষদের বৃহত্তর অংশ থেকে সদস্য সংগ্রহ করে হোপলাইট সেনাবাহিনী ছিল গণবাহিনী। এবং বিপরীত দিক থেকে এর মানে ছিল যে, জনগণ, অর্থাৎ দেমোরা এখন সেনাবাহিনীর পক্ষে আবশ্যক হয়ে উঠেছিল। ভারতে যুদ্ধ ক্ষত্রিয় শ্রেণীর একচেটিয়া অধিকারে পরিণত হয়েছিল; যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিণত হয়েছিল বিশেষ তৎপরতা, অন্য তিন শ্রেণীর এতে অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এভাবে একে সীমিত ও সামাল দেওয়া হয়েছিল, অহিংসার আদর্শ শেকড় গেড়ে বসায় একে ক্রমবর্ধমানহারে দূষিত, করুণ ও অশুভ মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু গ্রিসে তেমনটা ছিল না, উল্টোদিকে যাচ্ছিল দেশটি। সপ্তম শতাব্দীতে গোটা পোলিস সমরায়িত হয়ে যায়। নাগরিকরা পরিণত হয়েছিল সেনাদলে, অল্প সময়ের নোটিসেই সমবেত করা যেত তাদের। 

অতীতের সঙ্গে চরম বিচ্ছেদ ছিল এটা। ঐতিহ্যবাহী বীরের আদর্শ ত্যাগের সময় এসেছে বলে পরামর্শ দিয়েছিলেন হেসিওদ; হোপলাইট সেনাবাহিনী এই বিচ্ছেদ কার্যকর করে। নিজস্ব মাহাত্ম্যকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি যোদ্ধা পরিণত হয়েছিল পশ্চাদপদতায়: নতুন আদর্শ ছিল সমবেত। হোপলাইট সৈনিক আবিশ্যিকভাবে দলেরই একজন ছিল। হোপলাইটরা একসাথে, সম্মিলিতভাবে সফল হয়েছে; ব্যক্তিগত মাহাত্ম্যের কোনও অবকাশ ছিল না। গোটা সেনাদলকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া একজন অ্যাকিলিসের হুব্রিস এখন অপ্রয়োজনীয়। ‘শ্ৰেষ্ঠত্ব’- -কে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা হয়: এখন তা দেশপ্রেম ও সাধারণ কল্যাণের প্রতি আনুগত্য। সপ্তম শতাব্দীর শেষদিকে রচনাকারী স্পার্টান কবি তিতাইওস নতুন বীরের বর্ণনা দিয়েছেন: 

এটাই মাহাত্ম্য, পুরুষের এই চমৎকার পেশা,
তরুণের প্রাপ্য সব-সেরা পুরস্কার:
এটাই সমস্ত শহর আর সব মানুষের সাধারণ কল্যাণ;
একজন মানুষ দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে সামনের সারিতে অবস্থান নেয়
যখন অমর্যাদাকর পলায়নের কথা বিস্মৃত হয়
সহ্য করার জন্যে আপন হৃদয়কে অবিচল রাখে
আর পাশের মানুষটিকে কথায় সাহস যোগায়। ৫৯ 

আগ্রাসীভাবে নিজের খ্যাতি আর মাহাত্ম্য না খুঁজে হোপলাইট গোটা সারির মঙ্গলের স্বার্থে নিজের চাহিদা দমন করে। কেনোসিসের অ্যাক্সিয়াল আদর্শের মতো নিঃস্বার্থ মানসিকতা ও অন্যের প্রতি আনুগত্যের নীতির পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে এটা। পার্থক্য ছিল এই আত্মসমর্পণ যুদ্ধক্ষেত্রে বর্বরভাবে কার্যকর মারণযন্ত্রের ভেতর পালিত হয়েছে। 

হোপলাইট সংস্কার গ্রিসকে বদলে দিয়েছে এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছে। ফ্যালাংক্সে অভিজাতের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছে যে কৃষক সে আর কখনওই আভিজাত্যকে আগের মতো দেখবে না। সমীহের পুরোনো অভ্যাস মেনে চলা আর সম্ভব ছিল না। নিম্ন শ্রেণীর নিজস্ব সংগঠন-জনগণের সংসদ-নগরের সরকারে কেন্দ্রীয় ভুমিকা নেওয়ার দাবি তোলার বিষয়টি আর দূরের ছিল না। হোপলাইট সংস্কার পোলিসের আত্ম-প্রতিকৃতি বদলে দিয়েছিল। শান্তিপূর্ণ বিপ্লব ছিল তা; উচ্চ শ্রেণীকে ধ্বংস করার বদলে কৃষক ও ক্ষেতমজুররা অভিজাত রীতি আয়ত্ত করে নিয়েছে, ফলে গোটা নগরী কার্যত ভদ্রলোক যোদ্ধার শ্রেণীতে পরিণত হয়েছিল। 

বাক স্বাধীনতা আদিতে অভিজাত বীরের অধিকার ছিল। হোমারে গ্রিক সেনাবাহিনীর বেসিলিস জোরের সঙ্গে রাজা আগামেননের কাছে মনের কথা খুলে বলার স্বাধীনতা পেয়েছিল। এবার সেই অধিকার ফ্যালাংক্সের সব সদস্যের প্রতি প্রসারিত হলো। নতুন সেনাবাহিনী ভিন্ন ভাষায় কথা বলত। লোগোস (‘ডায়ালোগ স্পিচ’) হোমার ও বীরের যুগের উপমাশ্রিত ভাষার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।৬০ পৌরাণিক ডিসকোর্স অধিকতর অধরা সত্যিকে প্রকাশ করার প্রয়াস পেয়েছে, বাহ্যিক জগতের বস্তুগত বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যাবে বলে আশা করা হয়নি। অবশ্য লোগোস-কে বাস্তববাদী, কার্যকর ও নিখুঁত হতে হয়ে হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্র ও যুদ্ধ সভায় সৈনিকরা জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নের মুখোমুখি হতো। ‘এই ঘটনার পরম অর্থ কি?’ জিজ্ঞেস করার বদলে লোগোসের পুরুষ জানতে চাইত, ‘কি হয়েছে?’ আর ‘আমরা কি করব?’ জরুরি, বাস্তব চাহিদায় পরিচালিত হতো লোগোস এবং দলের সবরকম অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল বলে সবাইকে প্রভাবিত করবে এমন যুদ্ধ পরিকল্পনাকে কোনও সৈনিকের চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হোপলাইটদের লোগোস কখনওই কবিদের মিথোসকে প্রতিস্থাপিত করতে পারবে না। যার যার নিজস্ব উপযোগিতার বলয়ে এ দুটি সহঅবস্থান করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ নাগরিক হোপলাইটে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বতন্ত্র ভাষা ও সরকারের ভাবনা চিন্তার উপায়ে পরিণত হয় লোগোস। 

সপ্তম শতাব্দীতে স্পার্টা ছিল হোপলাইটদের নিখুঁতভাবে মূর্ত করে তোলা রাষ্ট্র।৬১ ৬৫০ সাল নাগাদ সব পুরুষ নাগরিক হোপলাইটে পরিণত হয় এবং দোমো অর্থাৎ জনগণ ছিল সার্বভৌম। অরিথিয়ার প্রাচীন উর্বরতার আচারে তরুণ ছেলেরা আর্তেমিসের বেদী থেকে পনির চুরি করার প্রয়াস পেত, অন্য তরুণরা তাদের মেরে তাড়িয়ে দিত। হোপলাইট স্পার্টায় তরুণ যোদ্ধাদের যুদ্ধের দক্ষতা শেখানোর কাজে এই আচারটি ব্যবহার করা হয়েছে। এটা আর তখন যুদ্ধের মহড়া ছিল না, বরং সত্যিকারের যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল। ঝর্নার মতো রক্ত ঝরেছে। নাগরিক জীবনের দীক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে সাহস ও আত্ম-নির্ভরতা শেখার জন্যে তরুণদের বনে পাঠানোর বদলে স্পার্টানরা উদীয়মান হোপলাইটদের বিশেষ ভ্রাতৃসংস্থার জন্যে নির্বাচিত করত। দিনের বেলায় চোখের আড়ালে রাখা হতো ওদের, কিন্তু রাতে হাতের কাছে মেলা যতজন সম্ভব ক্ষেতমজুরকে মেরে আসতে পল্লী অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। ভারতে অ্যাক্সিয়াল যুগের উদীয়মান নীতিবোধ প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠান থেকে সহিংসতাকে মুছে দিয়েছিল; গ্রিসে সেনাবাহিনীর চাহিদা মোতাবেক পুরোনো আচারগুলোকে বদলে ফেলা হচ্ছিল। 

চীনারা অবশ্য আচারের সৌন্দর্যের কাছে বাস্তব উপযোগিতাকে গৌণ করে যুদ্ধবিগ্রহকে সীমিত করার প্রয়াস পাচ্ছিল। ইয়েলো রিভার এলাকায় সপ্তম শতাব্দী এক উত্তাল সময় ছিল, তবে বিভিন্ন ক্ষুদেরাজ্যের ভেতর লাগাতার লড়াই সত্ত্বেও সহিংসতাকে সাফল্যের সঙ্গে সীমিত রাখা হয়েছিল। লু-র শিক্ষিত সমাজ- সূচিত সংস্কার কর্মকাণ্ডের ফলে কিছুটা অল্প মাত্রায় এটা সম্ভব হয়েছিল। সপ্তম শতাব্দীর দিকে ক্ষুদেরাজ্যগুলোয় জীবন যাপন লি দিয়ে এত প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো যে সামজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক জীবন ঝোউ দরবারের জাঁকাল আচরিক অনুষ্ঠানের চেহারা পেতে শুরু করেছিল। তবে প্রথম দর্শনে এই নিয়ন্ত্রিত সমরূপতাকে অ্যাক্সিয়াল যুগের চেতনা থেকে দুরস্ত মনে হয়েছে। এইসব আচারের কোনও কোনওটার উল্লেখযোগ্য আধ্যাত্মিক সম্ভাবনা ছিল। তারপরেও চীনারা এটা উপলব্ধি করতে পারেনি; অ্যাক্সিয়াল যুগ শুরু করতে করতে তাদের আরও দুশো বছর লেগে যাবে, কিন্তু তারপরেও সপ্তম শতাব্দীতে তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল মিতাচার ও আত্ম-সংযমের মহান জীবন যাপনকারী ভদ্রলোকদের একটা সমাজ গড়ে তোলা। 

ঝোউ রাজা কার্যত রাজকীয় বলয়ে অবসরে চলে গিয়েছিলেন, তিনি আর রাজনৈতিক জীবনের সামনের কাতারে অবস্থান করছিলেন না। সমবেতভাবে জাং কুয়ো বা ‘কেন্দ্রের নগরী’ নামে পরিচিত প্রাচীন শহরগুলোর শাসক রাজকুমাররা তাঁর স্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন। রাজকুমার রাজার বহু আচরিক গুণাবলী গ্রহণ করেছিলেন। তিনি পরিণত হয়েছিলেন পবিত্র সত্তায়। পৃথিবীতে স্বর্গের প্রতিভু হিসাবে তাঁকে দূষণ ও অশুদ্ধতা থেকে রক্ষা করতে হবে বলে তাঁর সান্নিধ্যে আসার আগে প্রজাদের উপবাস পালন ও পবিত্র হয়ে নিতে হতো। তিনিও রাজার কাছ থেকে বিচ্ছুরিত শক্তির অধিকারী, কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-এই দাওদে প্রজার দরবারী আচারের বিশ্বস্ত প্রতিপালনের উপর নির্ভরশীল ও পুষ্ট হয়ে ওঠে। লু-র আচরিক সংস্কার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যের নীতির উপর নির্ভরশীল ছিল: লি কেবল আচার পালনকারী ব্যক্তিকে পরিবর্তনই করেনি, এই আনুষ্ঠানিক মনোযোগ লাভকারীর পবিত্রতাকেও বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা মূলত জাদুকরী ধারণা হলেও গভীর মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি ভিত্তিক ছিল। মানুষের সঙ্গে অবিরাম চরম সম্মানের সঙ্গে আচরণ করা হলে তারা সম্মানের অধিকারী বলে ভাবতে শেখে; তারা বুঝতে পারে যে, তাদের পরম মূল্য রয়েছে। তো চীনে লি সম্পর্ককে পবিত্রায়িত করেছে ও অন্য লোকদের উপর পবিত্ৰতা আরোপ করেছে। প্রজারা রাজকুমারের নির্ধারিত ভঙ্গিতে শরীর বাঁকা করে, স্যাসে জমিনে লোটানো অবস্থায়, যথাসম্ভব নিচু হয়ে বাড়ির কোণে গরগোয়েলের মতো চিবুক সামনে বাড়িয়ে আর হাত ‘একসঙ্গে মিলিয়ে যতদূর সম্ভব নিচু করে,’-সামনে এসে দাঁড়ালে তাদের সমীহের প্রবণতা রাজকুমারের মূল্য রক্ষা ও বৃদ্ধি করত।৬৩ 

কিন্তু রাজকুমারের নিজের জীবনও নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। ক্ষমতার জোর তাঁকে যাচ্ছেতাই করার একচেটিয়া অধিকার দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে তাঁর আচরণ উ ওয়েই (‘কিছু না করা’) দিয়ে বৈশিষ্ট্যায়িত হওয়ার কথা ছিল। দেশের পরিকল্পনাকে তুলে ধরা নীতিমালা ও লক্ষ্য নির্মাণ করার দায়িত্বে থাকা আধুনিক রাষ্ট্রপ্রধানের মতো ছিলেন না তিনি। রাজকুমারকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় থাকতে হতো। তিনি প্রশাসন পরিচালনা করতেন না; কোনও হুকুম জারি করতেন না। নিজের ভেতরের শক্তিকে একত্রিত করে তাঁর পক্ষে ভূমিকা পালনকারীদের কাছে হস্তান্তর করাই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। এটা অর্জনের জন্যে কঠোরভাবে নিয়ম মেনে চলতে হতো তাঁকে। তিনি ভুল করলে তাঁকে ঠিক করা প্রজাদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াত। একজন বিশ্লেষক তাঁর প্রতিটি কথা ও ভঙ্গি নথিবদ্ধ করে রাখত। খেলা বা রসিকতা করার অধিকার ছিল না তাঁর। কেবল সযত্নে নির্বাচিত সঙ্গীত শুনতে পারতেন তিনি, আচরিক নীতি মেনে তৈরি নির্ধারিত খাবার খেতেন।৬৪ তাঁর কাছ থেকে বিচছুরিত শক্তিতে তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে বোঝাতে তাঁর উপস্থিতিতে প্রজাদের প্রাণবন্তভাবে চলাফেরা করতে হতো। ‘পাখির ডানার মতো দুই হাত মেলে’ দ্রুত হাঁটতে হতো তাদের, যেখানে রাজকুমারকে মাপা মাপা পদক্ষেপে হাঁটতে হতো বা একেবারে ‘অচল’, নিষ্ক্রিয় ও প্রায় বোবা হয়ে থাকতে হতো। সভায় রাজকুমার কোনও বাঙ্ময় ভাষণ দিতেন না। মন্ত্রীরা কোনও নির্দিষ্ট ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার অনুমতি চাইলে কেবল সামান্য ‘হ্যাঁ’ বলে উত্তর দিতে পারতেন তিনি, কিন্তু নির্দেশ দেওয়া হয়ে গেলেই মুহূর্তে নতুন নীতি কার্যকর হয়ে যেত: প্রাচীন গান যেমন প্রকাশ করেছে, ‘তিনি ঘোড়ার কথা ভাবলেই তারা ঝড়ের বেগে দৌড়াতে শুরু করে।’ লু-র শাস্ত্রজ্ঞরা দাবি করেছিলেন যে প্রাচীন সাধু রাজা শান নিজের মাঝে এত নিখুঁতভাবে শক্তি জড়ো করেছিলেন যে বলতে গেলে কেবল সঠিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করেননি তিনি। তাঁর দাওদে এত বিরাট ছিল যে, তাঁর প্রজাদের পরিবর্তন করার জন্যে তাই যথেষ্ট ছিল। ‘নিষ্ক্রিয়তার সাহায্যে’ (উ ওয়েই) শাসন করেছেন তিনি।…”কারণ কি কাজ করেছিলেন তিনি? কেবল গম্ভীরভাবে ও সম্মানের সঙ্গে দক্ষিণে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন; ব্যস, আর কিছু না।৬৬ 

জুনযি- ‘ভদ্রলোকদের’-মর্যাদা ও সম্মান বাড়ানোর লক্ষ্যে আচারগুলো স্থির করা হয়েছিল। কিন্তু সঠিক চেতনায় পালন করা হলে সেগুলো সরকারের ভেতর থেকেও অহমবাদ দূর করে দিত। একটা বৈপরীত্য রয়েছে এখানে, রণক্ষেত্রের লি-তেও এটা স্পষ্ট ছিল। সপ্তম শতাব্দীতে ক্ষুদেরাজ্যগুলো মিতাচারের নতুন চেতনায় নিয়ন্ত্রিত এক ধরনের দরবারী যুদ্ধ শুরু করেছিল। “ আচার যুদ্ধক্ষেত্রে অনুমোদিত সহিংসতাকে কঠোরভাবে সীমিত রেখেছে ও যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিণত হয়েছিল সৌজন্য ও সংযমে নিয়ন্ত্রিত জাঁকাল প্রতিযোগিতায়। অভিজাত সমাজে অভিজাত পরিবারগুলো যেখানে সম্মানের প্রশ্নে আচ্ছন্ন ছিল, সেখানে প্রতিশোধ ছিল স্থায়ী বিপদ। লি এই প্রবণতাকে সংযত করে যোদ্ধারা যাতে ভদ্রলোকের মতো লড়ে সেটা নিশ্চিত করেছে। যুদ্ধগুলোও দারুণ সংক্ষিপ্ত ছিল। ব্যক্তিগত লাভালাভের উদ্দেশ্যে নয় বরং কেবল বর্বরোচিত আগ্রাসন ঠেকাতে বা বিদ্রোহী নগরীকে আবার নিয়ন্ত্রণে এনে স্বর্গের পথ পুনঃস্থাপন করার জন্যেই যুদ্ধ করা যেত। যুদ্ধবিগ্রহকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা মনে করা হতো; দোষী সাব্যস্ত অপরাধীদের প্রয়োজনে যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন দেওয়ার শপথ নিলে ক্ষমা করা হতো। কেবল লি অনুযায়ী সেই যুদ্ধ পরিচালিত হয়ে থাকলেই বিজয় বিজয়ী পক্ষের ন্যায়নিষ্ঠতা প্রকাশ করত। 

রাজকুমার সৈনিকদের সঙ্গ দিতেন, কিন্তু অবশ্যই যুদ্ধ মন্ত্রীই সব সিদ্ধান্ত নিতেন। নিয়ন্ত্রণে থাকা অস্ত্র ও লোকবলের হিসাব নেওয়ার জন্যে শুমারীর ব্যবস্থা নিতেন তিনি, খোদ এই ব্যবস্থাই এক ধরনের উপেক্ষা হওয়ায় ঔদার্যের এক ধরনের তৎপরতার ভেতর দিয়ে অবিলম্বে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হতো। “মহান শুমারীর ব্যবস্থা করার সময়,’ স্প্রিং অ্যান্ড অটাম অ্যানালসের উপর এক ধারাভাষ্যে ব্যাখ্যা করেছেন যুওঝুয়ান-এর রচয়িতা, ‘ঋণগ্রহীতারদের মুক্তি দেওয়া হয়, দরিদ্র ও বিধবাদের ভিক্ষা দেওয়া হয়, দোষীদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’৬৮ এরপর পূর্বপুরুষের মন্দিরে সমবেত হয় সেনাবাহিনী, অস্ত্রশস্ত্র বণ্টন করা হয়। এসব অস্ত্র বৈরী প্রভাব বিস্তার করে মনে করা হতো বলে সাধারণত নিরাপদ স্থানে রাখা হতো, ওগুলো হাতে নেওয়ার আগেযোদ্ধাদের উপবাস পালন করতে হতো। সবশেষে রাজকুমার তখন উৎসর্গ সম্পাদন করার সময় পুরুষরা পৃথিবীর বেদীর চারপাশে জড়ো হতো। 

সেনাবাহিনী দক্ষিণে মুখ করে কুচকাওয়াজ করে যতদূর সম্ভব দূরে চলে যেত। বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা ক্ষেতমজুরদের দিয়ে পদাতিক বাহিনী গঠন করা হতো, ফিরে আসার আশা ছাড়াই ক্ষেত থেকে জোর করে ধরে নিয়ে আসা হতো ওদের; অনীহ সৈনিক হওয়ায় তারা এত জোরে আর অবিরাম বিলাপ করে চলত বলে কুচকাওয়াজের সময় তাদের মুখে কাপড় গুঁজে দেওয়া হতো। অবশ্য তাদের ভূমিকা ছিল একেবারেই প্রান্তিক। যুদ্ধে অংশ নিত না তারা, স্রেফ বাহক, পরিচারক আর ভৃত্য ছিল। মূল সেনাদল থেকে দূরে থেকে কুচকাওয়াজ করত, বনের কিনারে শিবির খাটাত। বিপরীতে অভিজাতরা থাকত শান্ত, প্রফুল্ল, বাঁশির সুরে রথে চেপে এগিয়ে যেত; প্রতিটি রথ বাহিনীতে একজন করে তীরন্দাজ, বর্শাধারী, একজন চালক থাকত। তাদের অস্ত্র উজ্জ্বল রঙে রাঙানো ফিতেয় বাঁধা থাকত। পশম আর চামড়ায় ঘোড়াগুলো সাজানো থাকত, কথিত আছে, হার্নেসের ঘণ্টা গানের তালে তালে বাজত। 

প্রতিপেক্ষর দিকে মুখ করে তাঁবু খাটানোর সময় শিবিরের নকশা ঠিক শহরের নকশার মতো হতো। যুদ্ধ ছিল ধর্মীয় আচার; বিশ্রাম দিয়ে শুরু হতো, প্রার্থনা ও পুর্বসুরীদের নামে উৎসর্গ দেওয়া হতো। এই সময় সমর মন্ত্রীকে শত্রুর উদ্দেশ্য আঁচ করতে হতো: তারা কি সত্যিই যুদ্ধ করত চায়?” বর্বর গোত্র বা পথের দিশা হারানো কোনও রাজকুমার হলে যুদ্ধ হতো মরণপণ: এমনি খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনার ক্ষেত্রে সমর মন্ত্রী আত্মঘাতী বাহিনী ক্ষমাপ্রাপ্ত অপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে শত্রুপক্ষের দিকে এগিয়ে যেতেন, রক্ত পানি করা চিৎকারে প্রথম মোকাবিলাতেই একসঙ্গে নিজেদের গলা দুফাঁক করে ফেলত এরা, তারপর শুরু হতো লড়াই। অবশ্য, যোদ্ধাদের সাধারণত ভদ্রভাবে যুদ্ধ করতে হতো, যুদ্ধ পরিণত হয়েছিল সৌজন্যের প্রতিযোগিতায়। উভয় পক্ষের জুনযিরা ঔদার্য্য ও উচ্চমর্যাদার দায়িত্ব আরোপকারী ব্যাপক তৎপরতায় পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠত। 

লি শত্রুর কাছে ‘নতি স্বীকারের’ (রাং) বাহ্যিক প্রবণতা দাবি করেছে, কিন্তু গর্ব আর সাহসিকতার চেতনার ভেতর দিয়ে এসব পালিত হতো। এই সৌজন্যের খেলায় শত্রুকে ঔদার্যের কর্মকাণ্ড দিয়ে নাস্তানাবুদ করাই ছিল আসল আনন্দ। যুদ্ধ শুরুর আগে যোদ্ধারা জোর গলায় তাদের শক্তি নিয়ে গর্ব প্রকাশ করত, শত্রুর দিকে পাত্রের পর পাত্র মদ পাঠাত, রাজকুমারের চেহারা দেখলেই শিরস্ত্রাণ খুলে ফেলত। চালক নিমেষে মুক্তিপণ মেটালে সত্যিকারের জুনযি সবসময় শত্রুর রথকে চলে যেতে দিত। চু আর জিনের মধ্যে এক যুদ্ধের সময় এক চু তীরন্দাজ রথের পথ আগলে দাঁড়ানো একটা মদ্দা হরিণ মারতে তার তীর ছুঁড়েছিল, তার বর্শাধারী সঙ্গে সঙ্গে সেটা ওদের দিকে ধেয়ে জিনদের রথের দলকে উপহার দেয়। নিমেষে হার স্বীকার করে নেয় জিনরা, সম্মানের সঙ্গে চিৎকার বলে: ‘এই তো উপযুক্ত তীরন্দাজ ও সুভাষী যোদ্ধা! এরাই সুজন!” 

বেশি মানুষ হত্যা করলে একজন অভিজাত মর্যাদা হারাত। ছয়জন শত্ৰু সৈন্যকে হত্যা করার কথা বলে অহঙ্কার প্রকাশকারী এক যোদ্ধাকে ভর্ৎসনা করেছেন রাজকুমার: ‘দেশের জন্যে নিদারুণ অসম্মান ডেকে আনবে তুমি। আগামী কাল মারা যাবে তুমি-তোমার নৈপুণ্যের শিকার!’ বিজয়ের পর একজন জুনযিকে বহন করে নিয়ে যাওয়া জরুরি ছিল। সত্যিকারের অভিজাত যোদ্ধা কখনওই তিনজনের বেশি ফেরারীকে হত্যা করতে পারে না, এবং আদর্শগতভাবে তার চোখ বন্ধ করে তীর ছোঁড়ার কথা। সৌজন্য সবসময়ই নৈপুণ্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে। একবার দুজন রথচালক মল্লযুদ্ধে চালানোর সময় একজন একপাশে সরে দাঁড়ায়, সে পালাবে বলে মনে হচ্ছিল। বিজয়ী হতে চলা রথের তীরন্দাজ তীর ছুঁড়ে বসে। সেটা ফসকে গেলে ফের নিশানা স্থির করতে যায় সে, তখন শত্রু পক্ষের তীরন্দাজ চিৎকার করে ওঠে: তোমার সঙ্গে আমাকে তীর বিনিময় করতে দিতে হবে, নইলে এটা অশুভ কাজ হয়ে যাবে!’ তো আর কোনও হৈচৈ ছাড়াই প্রথম তীরন্দাজ ধনুক থেকে তীর খুলে নিয়ে শান্তভাবে মৃত্যুর অপেক্ষায় ছিল।৫ যুদ্ধ ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী সম্মানের বিরোধ, অস্ত্রের সংঘাত ছিল গৌণ। 

৬৩৮ সালে ক্ষুদেরাজ্য সং-এর ডিউক চু সেনাবাহিনীর আগমনের অপেক্ষা করছিলেন, তাঁর সৈন্য সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি ছিল ওদের সংখ্যা। চু-রা কাছের এক নদী পার হচ্ছে জানতে পেরে ডিউকের প্রজারা সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ চালানোর তাগিদ দিল, কিন্তু প্রত্যাখ্যান করলেন তিনি। চু-রা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় হামলা চালানোর প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিলেন। শেষে যুদ্ধ যখন শুরু হলো, সং-রা পরাস্ত হলো, মারাত্মক আহত হলেন ডিউক, কিন্তু সেজন্যে তাঁর কোনও অনুশোচনা ছিল না। ‘জুনযি নামের যোগ্য কেউ শত্রুর দুর্ভাগ্যের সুযোগ নিয়ে জয় লাভের চেষ্টা করে না,’ বলেছেন তিনি। সৈনিকরা তৈরি হওয়ার আগেই ঢাক বাজায় না সে।’৭৬ কয়েক বছর পরে জিনদের বিশাল রাষ্ট্র ওয়েই উপত্যকার এক প্রান্তিক রাষ্ট্র কিনের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ভোরে লড়াইয়ের জন্যে তৈরি হওয়ার খবর দিয়ে জিনের কাছে একজন বার্তাবাহক পাঠাল কিনরা, কিন্তু জিন অধিনায়ক খেয়াল করলেন লোকটি খুব সন্ত্রস্ত হয়ে আছে। তাঁর কয়েকজন কর্মকর্তা প্রফুল্ল হয়ে উঠেছিল: কিন ভয় পেয়েছে! এখুনি তাকে নদীর দিকে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত! কিন্তু যুদ্ধ-বিধি থেকে উদ্ধৃতি দিলেন অধিনায়ক: ‘মৃত বা আহতকে তুলে না নেওয়া অমানবিক। নির্ধারিত সময়ের জন্যে অপেক্ষা না করা বা বিপজ্জনক পথে শত্রুকে চাপ দেওয়া কাপুরুষতা! 

বিজয়ে অবশ্যই কোনওরকম অশোভন আত্মতৃপ্তি থাকতে পারবে না। একজন বিজয়ী রাজকুমার বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে সৌধ নির্মাণে অস্বীকার গেছেন: ‘আমার কারণেই দুটো দেশ তাদের যোদ্ধাদের হাড় সূর্যের কাছে উন্মুক্ত করেছে! এটা নিষ্ঠুরতা!’ চিৎকার করে বলেছেন তিনি। যারা মন্দ কাজ করেছে সেইসব লোকের বিরুদ্ধে প্রথম ঝোউ রাজাদের যুদ্ধের মতো ছিল না এটা। ‘এখানে কোনও অপরাধী নেই,’ উপসংহারে পৌঁছেছেন রাজকুমার, ‘কেবল শেষপর্যন্ত বিশ্বস্ত থাকা প্রজাসাধারণ। ক্ষমা ও করুণা দেখানোর বেলায় একজন জুনযি ক্ষিপ্র ছিল, কারণ তাতে তার মর্যাদা বাড়ত। বেশিরভাগ মন্ত্রীই ভবিষ্যতের প্রতিশোধের ভয়ে কঠোর শর্ত আরোপে অনীহা দেখাতেন। অনেকেই চরম সাফল্যের চেয়ে বরং শর্তসাপেক্ষ বিজয়ই পছন্দ করতেন, আবার অনেকে ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সাময়িক পরাজয়ই পছন্দ করতেন। বিজিত এলাকা কোনও প্রজাকে দিয়ে দিতে হতো রাজকুমারকে, এইসব অতিরিক্ত সম্পদের সাহায্যে তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে প্ররোচিত হতে পারত সে। সামন্তবাদী ব্যবস্থা প্রত্যেকের যার যার ভূমিকা পালনের উপর নির্ভরশীল ছিল। কোনও একটি করদ রাজ্য অতিরিক্ত ক্ষমতাবান হয়ে উঠলে রাষ্ট্রের নাজুক ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারত। 

দরবারের জীবনেও জুনযিকে অবশ্যই তাকে দেওয়া ভূমিকা পালন করে রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য ও জাঁকজমকের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হতো। একজন ভদ্রলোককে সবসময় কেতাদুরস্ত থাকতে হতো; তার আচরণ হতে হতো ‘গম্ভীর, রাজকীয়, মুগ্ধকর ও মর্যাদাকর, এবং তার অভিব্যক্তি ‘মিষ্টি ও শান্ত, শাসনের ক্ষেত্রে স্বস্তিকর ধরন ও অবস্থা।৮১ নিজস্ব ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রকাশের বদলে প্রজাকে তার গোটা সত্তাকে মর্যাদার আদিআদর্শ রূপের কাছে সমর্পণ করতে হতো। এই ‘নিবেদন’ সামগ্রিক হওয়া জরুরি ছিল। একজন জুনযির মূল দায়িত্ব ছিল চেং, ‘আন্তরিকতা’। অগভীর, ক্ষুব্ধ ও কপট আচরণের ভেতর দিয়ে তার পক্ষে লি-র সঙ্গে মানানো সম্ভব ছিল না; তার লক্ষ্য ছিল এমন সামগ্রিকভাবে নিজেকে সৌজন্যের বিধির কাছে বিলিয়ে দেওয়া যেন সেগুলো তার ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে ওঠে। আদর্শ জুনযির সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলিত হয়ে সম্পূর্ণ মানবীয় সত্তা হয়ে উঠতে পারত সে। এই দক্ষতার ভেতর দিয়ে তার ব্যক্তিত্ব নিপুণ হয়ে উঠত, ঠিক যেভাবে এক টুকরো অকাট জেডে কোনও শিল্পীর হাতে অনন্য সুন্দর আচরিক পাত্রে পরিণত হয়। এভাবে দারবারের জীবন সত্যিকারের মানবতার শিক্ষা ছিল। ‘লি আমাদের,’ ব্যাখ্যা করেছেন লু-র শাস্ত্রজ্ঞ, ‘কারও আবেগের লাগাম মুক্ত করদে দেওয়া, তাদের নিজের ঝোঁক মতো চলতে দেওয়া বর্বরদের রীতি বলে শিক্ষা দেয়। লি-র পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আনুষ্ঠানিকতা মাত্রা ও সীমা স্থির করে দেয়।৮২ আচার-আনুষ্ঠান সত্তার প্রকৃত অংশে পরিণত হলে ভদ্রলোক মিতাচার, আত্মসংযম আর ঔদার্যের শিক্ষা লাভ করে, কারণ লি-র পরিকল্পনাই করা হয়েছিল সহিংসতা ও হুব্রিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে: ‘আচার বিশৃঙ্খলা দূর করে, ঠিক যেভাবে বাঁধ বন্যা দূর করে।৮৩ 

তীর ছোঁড়ার প্রতিযোগিতা জুনযির গুণ তুলে ধরত। এটা কেবল দক্ষতা ও সামরিক নৈপুণ্যের পরীক্ষা নয় বরং শান্তি ও মতৈক্য প্রসারের লক্ষ্যে পরিকল্পিত সঙ্গীত অনুষ্ঠানও ছিল। যেকোনও বর্বরের পক্ষেই লক্ষ্য ভেদ করা সম্ভব, কিন্তু জুনযি লক্ষ্য স্থির করত আভিজাত্যের জন্যে। আসলে জয় লাভ করতে চাইত না সে, কেননা পরাজয়ই অনেক বেশি মর্যাদাকর ছিল। তাকে ভান করতে হতো যে জিততে চাইছে, কিন্তু সেটা আসলে এক ধরনের বিনয়ের প্রকাশ ছিল, কারণ নগ্ন অভিলাষ ছিল অশ্লীল, হীন ব্যক্তিত্বের লক্ষণ। সুতরাং পরাজিত প্রতিযোগির হাতে শিরোপা তুলে দেওয়া ছিল আসলে এক ধরনের শ্রদ্ধার ব্যাপার। তীর তুলে নেওয়ার আগে প্রতিযোগিকে মনের আন্তরিক (চেং) প্রবণতা ও সেই সঙ্গে ঋজু (চে) দৈহিক ভঙ্গি গড়ে তুলতে হতো, নইলে রাজকুমারের ক্ষমতাকে সে কলুষিত করবে।৮৪ সঙ্গীতের তালে তাল মিলিয়ে ঠিক একই সময়ে উভয়কেই যার যার তীর ছুঁড়তে হতো। ধনুক ছেড়ে সাঁই করে উড়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেকটা তীরকে সঠিক সুর তুলতে হতো। লক্ষ্য ভেদ করার বদলে তীরগুলোর মাঝপথে শূন্যে মিলিত হওয়ার কথা ছিল: সহিংসতা ও বিরোধকে মতৈক্য ও ছন্দে পরাস্ত করা হয়েছে। প্রতিযোগিতার শেষে উভয় তীরন্দাজই কাঁদত: বিজয়ী পরাস্ত প্রতিযোগির প্রতি করুণা থেকে, আর পরাস্তজন অবশ্যই তার বিজয়ীর প্রতি সহানুভূতি থেকে, আসলে যে কিনা সত্যিকারের পরাজিত ব্যক্তি। দুই যোদ্ধা হাঁটু গেড়ে এরপর থেকে বাবা-ছেলের মতো জীবন যাপন করার প্রতিজ্ঞা করত। 

খুব সহজেই প্রতিশোধে উস্কে দেওয়ার সম্ভাবনাযুক্ত আগ্রাসী পৌরুষকে ঠেকানোর জন্যে লি-র পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ‘পরাজয়ের’র চেতনারও রাজনৈতিক জীবনকে বৈশিষ্ট্যায়িত করার কথা ছিল।৮৫ জোরালভাবে নিজেদের মত প্রকাশ ও মর্যাদার জন্যে ঠেলাঠেলি করার বদলে রাজকুমারের পরামর্শকরা আনুষ্ঠানিকতার ভেতর দিয়ে তাঁর সঙ্গে ও পরস্পরের সঙ্গে মতের ভিন্নতা প্রকাশ করতেন। যেহেতু তাদের সমস্ত অন্তর্দৃষ্টিই রাজকুমারের কাছ থেকে পাওয়া ছিল, তাই মারাত্মক বিরোধিতা সহজাতভাবে স্ববিরোধিতা ছিল। কোনও নীতির প্রশ্নে মতানৈক্য বোধ করলেও রাজকুমার হ্যাঁ বলে ফেললে প্রজাকে অবশ্যই সেটা তার সাধ্যমতো পালন করতে হতো। সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান দরবারকে সজীব করে তোলা শক্তিকে অগ্রাহ্য করার সামিল হতো বলে তাকে দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলত। রাজকুমার স্বর্গীয় পথ থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন, এটা নিশ্চিত হলে তাকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনাই ছিল পরামর্শকের দায়িত্ব। কিন্তু ন্যায়সঙ্গত ক্রোধের চেতনায় সেটা করতে পারতেন না তিনি। নিজের প্রতিবাদের কথা উল্লেখ করার পর জায়গিরদারকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হতো, ছেড়ে যেতে হতো দেশ—এটা ছিল তার খোদ সত্তা খেয়ানো—কারণ দরবারের দাওদের সঙ্গে সম্পর্ক চ্যুতি ঘটিয়েছে সে। তিন মাস বাধ্যতামূলকভাবে নির্বাসনে থাকতে হতো তাকে, আচারের এই কর্মের ভেতর দিয়ে রাজকুমার আবার সত্যি পথে ফিরে আসবে আশা করে তার উপর চাপ সৃষ্টি করা হতো। 

পারিবারিক জীবনও একই চেতনায় নিয়ন্ত্রিত হতো। বাবা ও ছেলের সম্পর্ক স্বাভাবিক মমতা ভিত্তিক নয়, বরং রাজকুমার ও প্রজার সম্পর্ক ভিত্তিক ছিল।৮৬ চীনা আচার-অনুষ্ঠান সবসময় জৈবকে পরিশুদ্ধ ও উন্নত করার চেষ্টা করেছে। লি বাবা ও ছেলের চূড়ান্ত সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে, ছেলের জন্মের মুহূর্তে যার অস্তিত্ব ছিল না। জীবনের প্রথম তিরিশ বছর বাবাকে ছেলে বলতে গেলে দেখতেই পেত না। ছোট শিশু হিসাবে মেয়ে-মহলে জীবন কাটাত সে, তারপর পড়াশোনার জন্যে মামাদের বাড়িতে চলে যেত। কেবল শিক্ষা শেষ হওয়ার পরেই তাকে বাবার সঙ্গে সম্পর্কিত করা এবং তাদের ভেতর পবিত্র সম্পর্ক সৃষ্টিকারী বিভিন্ন সেবা কাজ শুরু করা সম্ভব ছিল। স্নেহ বা আন্তরিকতার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সমীহ ও শ্রদ্ধা। রাজকুমারের মতো বাবা ছিল স্বর্গের প্রতিনিধি; দুজনের ভেতরের বাঁধন জোরাল ও কঠিন হওয়ার কথা ছিল। একজন রাজকুমারের প্রজাদের সঙ্গে পরিহাস করে চলার মতো হতো বলে ছেলেদের সঙ্গে পরিচিত, বন্ধুসুলভ সম্পর্কে বজায় রাখা তার পক্ষে অসঙ্গত হয়ে দাঁড়াত। 

বাবাকে ভবিষ্যৎ পূর্বসুরি হিসাবে শ্রদ্ধা করত ছেলে। সন্তান বাৎসল্যের আচারের পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ প্রতিপালন তার বাবা-মায়ের ভেতর এমন এক পবিত্রতা সৃষ্টি করত যা মৃত্যুর পর তাকে স্বর্গীয় সত্তায় পরিণত করবে। আচার শেন অর্থাৎ প্রতিটি মানুষকে অনন্য করে তোলা স্বর্গীয়, ঐশ্বরিক গুণের চর্চা করত। শেন শক্তিশালী হলে পবিত্র ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতা দেহের মৃত্যুর পরেও টিকে থাকবে। বাবাকে পরম শ্রদ্ধা করে জ্যেষ্ঠ্য ছেলে মনুষ্যত্ব পূরণে ক্ষমতাবান করে তুলত তাকে। প্রতিদিন সকালে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সযত্নে আনুষ্ঠানিক পোশাক পরত সে, তারপর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বাবা-মায়ের অপেক্ষায় থাকত। বাবার মতো একই সিঁড়িতে কখনওই পা রাখে না সে, কখনওই বাবার থালা বা পেয়ালা বা ছড়ি ব্যবহার করেনি। বাবা-মায়ের কাপড়চোপড় সেলাই ও ধোয়ার কাজ করেছে, আচরিকভাবে নির্দিষ্ট আটটি খাবার তৈরি করেছে, বাবা-মা খাওয়ার সময় তাদের সেবা করেছে, সমীহের সঙ্গে তাদের মন ভরে খেতে বলেছে। বাবার সঙ্গে ছেলে সবসময় নীচু, বিনয়ী কণ্ঠে কথা বলত। নিজের কাছে পথ হারাচ্ছে বলে মনে হলে, তাকে সে ভর্ৎসনা করতে পারে, কিন্তু অবশ্যই ভদ্রভাবে ও সৌজন্যের সঙ্গে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে হবে। বাবা ভুল করার দিকে জোর দিতে থাকলে ছেলের ব্যবহার অবশ্যই আরও সৌজন্যপূর্ণ হতে হবে, এবং অবশ্যই ক্রোধ বা অসন্তোষ প্রকাশ করা চলবে না তার। সত্তর বছর বয়সে বাবা সরকারি পদ থেকে অবসরে চলে যেত। এই শেষ পর্যায়ে ছেলের দায়িত্ব ছিল তার সবরকম মেজাজের সঙ্গে সহানুভূতি প্রকাশ করা; বাবা সুস্থ থাকলে তাকে অবশ্যই খুশি থাকতে হবে, সে অসুস্থ থাকলে বিষণ্ন; বাবার ক্ষিধে থাকলে খাবে, আবার বৃদ্ধ অসুস্থ হলে উপবাস পালন করতে হবে।” এভাবে সে চৈনিক অ্যাক্সিয়াল যুগের মূল বিষয়ে পরিণত হওয়া গু(‘নিজেকে পছন্দ করা’)-র সহানুভূতির গুণের শিক্ষা লাভ করত। 

বাবার মৃত্যুর পর ছেলের পক্ষে যতদূর সম্ভব মৃত্যুর অভিজ্ঞতার অংশীদার হতে হতো। পারিবারিক আবাস থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে কুঁড়ে ঘরে গিয়ে উঠত সে, এক টুকরো মাটি বালিশের মতো ব্যবহার করে মাটিতেই ঘুমাত, নীরবতা বজায় রেখে উপবাস পালন করত, নিজেকে এভাবে দুর্বল করে তুলত যে কেবল ছড়িতে ভর দিয়েই উঠে দাঁড়ানো সম্ভব হতো। তিন বছর ছেলে শোকের আচারের পৌরহিত্য করত যার ফলে বাবার প্রেতাত্মা শেনে পরিণত হতো, এই সময় মৃত ব্যক্তি ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত অমরত্ব অর্জন করা পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতো। শোকের কালের শেষে বাবা দেবত্ব অর্জন করলে কাল্টের নেতৃত্ব পেত ছেলে। আধ্যাত্মিক নির্জনবাসের ভেতর দিয়ে টানা দশ দিন বিন-এর (‘মেজবান’) আচারের আয়োজন করে এই সময় উপবাস পালন করত সে, কেবল বাবার আচরণ, হাসি আর কথা বলার ভঙ্গির কথা ভাবত। বিন অনুষ্ঠানে তার আপন ছেলে সদ্য মৃতের ভূমিকা পালন করত এবং আচার পালনের সময় তার দাদার আত্মাকে তার ভেতর জীবন্ত মনে করত। অবশেষে ‘বাবা’-কে ভোজসভায় হাজির হতে দেখে পিতৃহীন ছেলে প্রণত হতো, পথ দেখিয়ে খাবারের টেবিলে নিয়ে যেত তাকে, জানত যে তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। রেকর্ডস অভ রাইস যেমন উল্লেখ করেছে, ‘পূর্বপুরুষের চোখ ধাঁধানো শেন-এর সঙ্গে মিলিত হয়েছে সে, এবং ‘পরিপূর্ণ আলোকনের ‘ দেখা পেয়েছে। 

এমনকি বাবার মৃত্যুর পরেও ছেলে নিজের জীবনের অধিকার পায়নি, বরং বাবার সম্মানের চর্চা করার পেছনে সমস্ত মেধাকে কাজে লাগিয়েছে, ঠিক যেভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে রাজকুমারের শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল। তার শরীর পরিবারের সম্পত্তি হওয়ায় নিজের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা তার দায়িত্ব ছিল। কোনওভাবেই অনর্থক ঝুঁকি নিতে পারবে না সে, বরং যত দীর্ঘদিন সম্ভব ‘তার স্বভাবকে অটুট’ রাখতে হবে, নিজেকে বাঁচাতে হবে-এমন এক প্রবণতা যা চৈনিক অ্যাক্সিয়াল যুগে নতুন রূপে আবির্ভূত হবে। অনেকদিক থেকেই বাৎসল্যের দার্শনিকতার রীতি আধুনিক অনুভূতির পক্ষে ঘৃণিত, কারণ এখানে যেন ছেলে তুচ্ছ প্রতীকে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে পৈতৃক স্বেচ্ছাচার ঠেকানোর লক্ষ্যেই চৈনিক পরিবার সংগঠিত হয়েছিল। বাবার কৃর্তত্ব অন্যান্য চরিত্র দিয়ে সীমাবদ্ধ। সবচেয়ে বড় চাচার অধিকার বাবার সমান, এমনকি তাকে ছাড়িয়েও যেতে পারে। ছেলে স্বয়ং অভিভাবকে পরিণত হতো এবং বাবার সেবা করার সময়ই নিজের ছেলে সন্তানদের কাছ থেকে সম্মান পেত। বিন-এর অনুষ্ঠানে নিজের ‘বাবা’র শেন-কে স্বাগত জানানোর সময় আসলে নিজের ছেলের সামনেই নত হতো সে। সুতরাং, এটা ছিল সম্মানের লেনদেন। ছোট ছেলের দায়িত্ব বাবার সেবা নয়, বরং বড় ভাইকে শ্রদ্ধা ও সমর্থন জানানো। অনেকেরই বড় ও ছোট ভাই থাকত। এমনভাবে ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছিল যেন পরিবারের প্রতিটি সদস্য এক ধরনের পরম সম্মান লাভ করত। লি যেখানে বাবার প্রতি ছেলের পূর্ণাঙ্গ সমর্পণ দারি করত, বাবার দায়িত্ব ছিল ন্যায়সঙ্গতভাবে, দয়ার সঙ্গে ও সৌজন্যের সঙ্গে সন্তানদের সঙ্গে আচরণ করা। চীনারা কতটা নিষ্ঠার সঙ্গে এইসব লি-র চর্চা করত, আমাদের ধারণা নেই। তাসত্ত্বেও সপ্তম শতাব্দী নাগাদ এই আদর্শ সত্যি যেন ঝোউ চৈনিক সমাজকে কর্কশ অতিরঞ্জনে আসক্ত সমাজ থেকে মিতাচার ও আত্ম-সংযমকে মূল্য দেওয়া সমাজে বদলে দিয়েছিল। এই আদর্শ চৈনিক অ্যাক্সিয়াল যুগকে গতি দেবে ও অনন্য দিক নির্দেশনা যোগাবে। 

এই পর্যায়ে বিশাল প্রান্তরের উপকণ্ঠের অপেক্ষাকৃত কম প্রথাগত রাষ্ট্রগুলো-কি, জিন, চু ও কিন–আচরিক দায় গ্রহণ করে নিয়েছিল। কিন্তু সময় পাল্টে যাচ্ছিল। সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে উত্তরের বর্বর গোত্রগুলো আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে অধ্যবসায়ের সঙ্গে আক্রমণ শানাতে শুরু করেছিল। দক্ষিণের নতুন রাষ্ট্র চু-ও মারাত্মক সমস্যায় পরিণত হচ্ছিল। সম্প্রসারণে উদগ্রীব চু ক্রমবর্ধমানহারে দরবারী যুদ্ধবিগ্রহের নিয়মনীতি উপেক্ষা করতে থাকে এবং ক্ষুদেরাজ্যগুলোকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। ঝোউ রাজারা চু-দের বিরুদ্ধে কার্যকর নেতৃত্ব দেওয়ার বেলায় দারুণ দুর্বল ছিলেন, সুতরাং ৬৭৯ সালে রাজকুমার হুয়ান নিজেকে চীনের ‘প্রথম অভিজাত’ (পা) অভিহিত করে একটি প্রতিরক্ষা দল (লীগ অভ ডিফেন্স) গঠন করেন 

এই পর্যায়ে কি ছিল সবচেয়ে ক্ষমতাধর চৈনিক রাষ্ট্র, রাজকুমার হুয়ান ঝোউ সম্পর্ক নিয়ে আলোকিত শাসক ছিলেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভেতর সহযোগিতার নীতিমালা বিষয়ে সম্মেলনের আয়োজন করেন তিনি; দলে যোগ দেওয়া বিভিন্ন রাষ্ট্র ও ক্ষুদেরাজ্য এক শপথের মাধ্যমে নিজেদের অঙ্গীকারাবদ্ধ করে এবং তা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ধর্মীয় চরিত্র দেয়। একটি ষাঁড় বলী দেওয়া হয়, শিকারের রক্তে প্রতিনিধিদল ঠোঁট ভেজান এবং উপস্থিত প্রত্যেকে স্থানীয় দেবতা, পাহাড়পর্বত, নদী ও পূর্বসূরিদের নামে চুক্তির শব্দসমূহ উচ্চারণ করেন: 

আমরা যারা একসঙ্গে এই চুক্তির শপথ গ্রহণ করেছি, আমরা ফসল মওজুদ করব না, একচেটিয়া মুনাফা লুটব না, অপরাধীদের প্রশ্রয় দেব না বা ঝামেলাবাজদের আশ্রয় দেব না; বিপর্যয় বা দুর্যোগের শিকারদের সাহায্য দেব। যারা দুর্দশাগ্রস্ত বা বিপদগ্রস্ত তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি থাকবে। আমাদের বন্ধু ও শত্রু একই। আমরা রাজপ্রাসাদকে সাহায্য করব। ৯১ 

উদ্দেশ্য ছিল সংহতি সৃষ্টি করা। মৈত্রীর এইসব আচার বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজকুমারদের ভেতর পারিবারিক বাঁধন সৃষ্টি করে, যারা এমনকি নতুন ‘আত্মীয়’-দের জন্যে শেষকৃত্যের আয়োজনেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা যে কেউই দেবতা ও পূর্বসুরিদের যার অনুমোদিত ভীতিকর শাস্তির ঝুঁকি নিতঃ ‘সে তার জাতিকে হারাবে, তার নিয়োগ বাতিল হবে, তার পরিবার ধ্বংস হবে এবং তার রাষ্ট্র ও গোত্র সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হবে। প্রথম অভিজাত সদস্য রাষ্ট্রসমূহের কাছ থেকে কর আদায় করে সাধারণ প্রতিরক্ষার তত্ত্বাবধান করেছেন; ঝোউ রাজতন্ত্রের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিলেও আসলে রাজাকে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন তিনি। সংঘ টেকেনি অবশ্য। ৬৪৩ সালে রাজা হুয়ানের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেরা উত্তরসুরি হতে লড়াইতে জড়িয়ে পড়েন, কি আর কখনওই গৃহযুদ্ধ থেকে উদ্ধার পায়নি। চু আবার আগ্রাসন শুরু করে ও জিনের রাজকুমার এক নতুন কনফেডারেশন সংগঠিত করেন, কিন্তু ৫৯৭ সালে চু সংঘকে পরাজিত করে। 

মিতাচারের বিরুদ্ধে যেন নিষ্ঠুর শক্তি বিজয়ী হয়েছে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু চু-র ক্রমবর্ধমান ত্রাসের মুখে প্রাচীন ক্ষুদেরাজ্যগুলো আরও নিবিড়ভাবে আচার ও প্রথাকে আঁকড়ে ছিল। নতুন রাষ্ট্রগুলোর সমর-শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না তারা, তাই কূটনীতি ও আলোচনার পথ বেছে নেয়। কিন্তু বৃহত্তর প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলো মতৈক্য ও ‘পরাজয় স্বীকারের’ প্রাচীন আদর্শ থেকে সরে যাচ্ছিল। লোকে লক্ষ করেছিল যে, রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের ভয়ঙ্কর শপথে সংঘে আবদ্ধ করলেও চেতনা দলত্যাগীদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে চুক্তির প্রতি নিষ্ঠাবান রাষ্ট্রগুলোই বরং বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।” ক্রমবর্ধমান সংশয় প্রাচীন অনুমানকে খাটো করে দিচ্ছিল। ইসরায়েলে সপ্তম শতাব্দী ইহুদি ধর্মের সূচনা প্রত্যক্ষ করা এক সন্ধিক্ষণ ছিল। এক নির্মম উত্তারাধিকার রেখে গিয়েছিলেন হেযেকিয়া। বাবার ভুলের পুনরাবৃত্তি না করার পক্ষে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তাঁর ছেলে মানাসে (৬৮৭-৬৪২) অসিরিয়ার অনুগত জায়গিরদার রয়ে যান, তাঁর দীর্ঘ রাজত্বকালে জুদাহ সমৃদ্ধি লাভ করে। ৪ মিত্ররা তাদের জাতীয় দেবতা আশুরের উপাসনা করবে, এমনটা আশা করেনি অসিরিয়রা, তবে অনিবার্যভাবে তাদের কিছু কিছু ধর্মীয় প্রতীক বেশ ভালোভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। মানাসে কেবল ইয়াহওয়েহর পূজা-অর্চণার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। হেযেকিয়ার ধ্বংস করে দেওয়া গ্রামীণ মন্দিরগুলো পুনর্নির্মাণ করেন তিনি, বা’লের উদ্দেশে বেদী স্থাপন করেন, জেরুসালেম মন্দিরে আশেরার প্রতিমার আমদানি করেন এবং জেরুসালেমের বাইরে শিশুবলী চালু করেন। ৫ এইসব ঘটনায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন বাইবেলিয় ইতিহাসবিদরা, কিন্তু মানাসে’র খুব অল্প সংখ্যক প্ৰজাই তাতে বিস্মিত হয়েছিল, কারণ প্রত্নতাত্ত্বিকদের আবিষ্কার মোতাবেক অনেকেরই বসতবাড়িতে একই রকম প্রতিমার অস্তিত্ব ছিল ৯৬ তাসত্ত্বেও অসিরিয় আগ্রাসনে বিধ্বস্ত পল্লী এলাকায় ব্যাপক বিস্তৃত অসন্তোষ কাজ করছিল।৭ হেযেকিয়ার জাতীয়তাবাদী নীতিমালা ধ্বংসাত্মক হয়ে থাকলেও কেউ কেউ হয়তো শত্রুপক্ষের আগ্রসনের লাগাতার হুমকি আর বিদেশী শক্তির আধিপত্যের ভীতি থেকে মুক্ত অবস্থায় পূর্বপুরুষদের সুখে দিন কাটানোর স্বর্ণ-যুগের কল্পনা লালন করেছে। মানাসের মৃত্যুর পর এমনি ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা অসন্তোষ বিস্ফোরিত হয়। গ্রামীণ অভিজাত গোষ্ঠীর-বাইবেল যাদের বলছে আম-হা- আরেত্য (‘ভূমিপূত্র’)-নেতৃত্বে পরিচালিত প্রাসাদ বিদ্রোহে নিহত হওয়ার আগে মাত্র দুই বছর রাজত্ব করেছিলেন তাঁর ছেলে আমোন 

অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব আমোনের আট বছর বয়সী ছেলে জোসিয়াকে সিংহাসনে বসান, কারণ জুদিয় পর্বতমালার পাদদেশের ছোট একটি গ্রাম বোযকাস থেকে এসেছিলেন তাঁর মা, তাদেরই একজন ছিলেন তিনি। ৯ শহুরে অভিজাত গোষ্ঠী থেকে ক্ষমতা চলে গিয়েছিল পল্লী এলাকার নেতাদের হাতে; প্রথম প্রথম সবকিছু ঠিকঠাক চলছে বলে মনে হয়েছিল। ইতিমধ্যে অসিরিয়ার পতন শুরু হয়েছিল, উত্থান ঘটছিল মিশরের। ৬৫৬ সালে ছাব্বিশতম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ফারাও প্রথম সামেতিকাস অসিরিয় বাহিনীকে লাভান্তে থেকে প্রত্যাহৃত হতে বাধ্য করেন। বিস্ময় ও আনন্দের সঙ্গে জুদাহবাসীরা প্রত্যক্ষ করে যে অসিরিয়রা উত্তরের প্রাচীন ইসরায়েল রাজ্যের এলাকা খালি করে দিচ্ছে। জোসিয়া এই সময় মিশরের অনুগত দাসে পরিণত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু ফারাও তখন কানানীয় নিম্নভূমির বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে জুদাহ নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসত ছিল না তাঁর -কিছু সময়ের জন্যে নিজের নিয়তি হাতে তুলে নিতে পেরেছিল রাজ্যটি। 

জোসিয়ার বয়স যখন ষোল বছর, এক ধরনের ধর্মীয় পরিবর্তন ঘটে তাঁর, সম্ভবত যার মানে ছিল যে কেবল ইয়াহওয়েহরই উপাসনা করতে চেয়েছিলেন তিনি ১০০ জাতীয় দেবতার প্রতি এমনি নীতিগত ভক্তি আবার রাজনৈতিক স্বাধীনতা ঘোষণারও শামিল হয়ে থাকতে পারে। আনুমানিক দশ বছর পর, ৬২২ সালে জুদাহর স্বর্ণযুগের মহান স্মৃতিসৌধ সোলোমনের মন্দিরের ব্যয়বহুল নির্মাণ কাজ শুরু করেন জোসিয়া। নির্মাণ কাজ চলার সময় এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে বসেন প্রধান পুরোহিত হিলকিয়া, এই উত্তেজনাকর খবর নিয়ে রাজকীয় লিপিকার শাফানের কাছে ছুটে যান তিনি: ‘আমি সদাপ্রভুর গৃহে ব্যবস্থাপুস্তকখানি [সেফার তোরাহ] পাইয়াছি। ১০১ এটাই, বলেন তিনি, সিনাই পাহাড়ে মোজেসকে দেওয়া ইয়াহওয়েহর প্রকৃত আইন। সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রোল নিয়ে রাজার কাছে হাজির হন শাফান, তাঁর সামনে জোরে জোরে পাঠ করেন। 

বেশির ভাগ পণ্ডিত এই লিপিটি মৃত্যুর অল্প আগে ট্রান্সজর্দানের নেবো পাহাড়ে মোজেসের লোকজনকে সমবেত করে একটি ‘দ্বিতীয় আইন’ (গ্রিক: দিউরোনোমিয়ন) প্রদানের বর্ণনা করা ডিউটেরোনমির আদি ভাষ্য ধারণ করে বলে বিশ্বাস করেন। কিন্তু শাফান ও হিলকিয়ার দাবি মোতাবেক প্রাচীন রচনা হওয়ার বদলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই নতুন ধর্মশাস্ত্র ছিল এটা। অষ্টম শতাব্দীর আগপর্যন্ত ইসরায়েল বা জুদাহয় আসলে ধর্মীয় টেক্সট পাঠ বা লিখে রাখার খুব কমই নজীর ছিল। ইয়াহওয়েহর শিক্ষা লিখে রাখা হয়েছে, এমন কোনও প্রাচীন ঐতিহ্য নেই। J ও E-তে মোজেস মৌখিকভাবে ইয়াহওয়েহর নির্দেশ প্রচার করেছেন, লোকেও মুখে মুখে সাড়া দিয়েছে: ‘সদাপ্রভু যে যে কথা কহিলেন, আমরা সমস্তই পালন করিব। ১০২ ] ও E দশ নির্দেশনার কথা উল্লেখ করেননি; মূলত ঈশ্বরের আঙ্গুলি দ্বারা লিখিত’১০৩ প্রস্তর ফলকগুলো সম্ভবত বুনো এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর সময় হায়াহওয়েহর তাঁর জাতির সঙ্গে অবস্থান করার ট্যাবারন্যাকলসের স্বর্গীয় নির্দেশিত পরিকল্পনা ধারণ করেছে।১০৪ অনেক পরেই ডিউটেরোনমিস্ট লেখকরা মোজেস ‘সদাপ্রভুর সমস্ত বাক্য লিখিলেন’ ও ‘নিয়মপুস্তকখানি [সেফার তোরাহ] লইয়া লোকদের কর্ণগোচরে পাঠ করিলেন ব্যাখ্যা দিয়ে J E বিবরণে যোগ করেছেন। মন্দিরে হিলকিয়ার আবিষ্কৃত এই লিপিটিই সেই ধর্মশাস্ত্র বলে এবার ব্যাখ্যা করলেন শাফান। শত শত বছর ধরে এই মূল্যবান দলিলটি নিখোঁজ ছিল, এর শিক্ষা কখনওই কাজে লাগানো হয়নি। এবার নিয়মপুস্তক-এর খোঁজ মেলায় ইয়াহওয়েহর জাতি আবার নতুন করে সব শুরু করতে পারবে। 

এটা অবশ্য কোনও নৈরাশ্যজনক জালিয়াতি ছিল না। এই সময় যারা নতুন ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার করতে চাইত তাদের বাণীকে অতীতে প্রক্ষিপ্ত করার রেওয়াজ ছিল। জাতীয় এক গভীর সঙ্কটময় মুহূর্তে মোজেসের হয়ে কথা বলছেন বলে বিশ্বাস ছিল ডিউটেরোনমিস্টদের। অভিবাসনের পর থেকে পৃথিবী দারুণ পাল্টে গিয়েছিল, ইয়াহওয়েহর ধর্ম বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছিল। ৭২২ সালে উত্তরের ইসরায়েল রাজ্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কোনও চিহ্ন না রেখেই উধাও হয়ে গিয়েছিল এর হাজার হাজার নাগরিক। রাজা হেযেকিয়ার আমলে অল্পের জন্যে নিশ্চিহ্নতার হাত থেকে রক্ষা পায় জুদাই রাজ্য। কেবল ইয়াহওয়েহ-মানাসে যাদের কাল্ট পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন সেইসব দেবতা নন-তাঁর জাতিকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন। পয়গম্বরদের অনেকেই জাতিকে কেবল ইয়াহওয়েহর উপাসনা করার তাগিদ দিয়েছিলেন; অবশেষে এবার জুদাহ এমন একজন রাজা পেয়েছে যিনি অতীতের মহিমা আবার ফিরিয়ে আনতে পারবেন। আজকের দিনে ‘দ্বিতীয় বিধান’ দিলে জোসিয়া ও তাঁর জাতিকে মোজেস ঠিক একথাই বলতেন। 

লিপির বাণী শোনামাত্র জোসিয়া দারুণ যন্ত্রণায় পরনের পোশাক ছিঁড়ে ফেলেন। ‘আমাদের পিতৃপুরুষরা এই পুস্তকের কথায় কর্ণপাত করেন নাই,’ চিৎকার করে বলে ওঠেন তিনি, ‘এই জন্যে আমাদের বিরুদ্ধে সদাপ্রভুর অতিশয় ক্রোধ প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে।১০৬ মৌখিক প্রচারণা থেকে ধর্মগ্রন্থের লিখিত রূপে পরিবর্তন ছিল প্রবল ধাক্কা। এখানে বাইবেলের অন্যান্য জায়গার মতো-এক ধরনের হতাশা, অপরাধবোধ ও অপর্যাপ্ততার বোধ তুলে ধরে এটা। ১০৭ ধর্মীয় সত্য এভাবে উপস্থাপন করা হলে একেবারেই ভিন্ন শোনায়। সবকিছু স্পষ্ট, চাঁছাছোলা-মৌখিকভাবে হস্তান্তরিত ‘জ্ঞানের’ চেয়ে ভিন্ন। ভারতে লোকে লেখার মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষা দান সম্ভব বলে বিশ্বাস করত না; যেমন স্রেফ টেক্সট পড়ে উপনিষদের সম্পূর্ণ অর্থ উপলব্ধি করতে পারবেনা না আপনি। কিন্তু ডিউটেরোনমিস্টরা ইয়াহয়েহবাদকে কিতাবি ধর্মে পরিণত করেছিলেন। এরপর থেকে লিখিত ধর্মশাস্ত্র পশ্চিমে ধর্মীয় মূল বিশ্বাসের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়াবে। 

অবিলম্বে নারী পয়গম্বর হিলদার সঙ্গে পরামর্শ করলেন জোসিয়া, তাঁর কাছে নিয়ম পুস্তকের [সেফার তোরাহ] একটাই মানে ছিল। ইয়াহওয়েহর কাছ থেকে দৈববাণী পেয়েছিলেন তিনি: ‘আমি এই স্থানের ও এই এইখানকার নিবাসীদের উপরে অমঙ্গল আনিব, যিহুদা রাজ যে পুস্তক পাঠ করিয়াছে তাহাতে লিখিত সকল বাক্য বর্ত্তাইব। কারণ তাহারা আমাকে ত্যাগ করিয়াছে, এবং অন্য দেবগণের উদ্দেশে ধূপ জ্বালাইয়াছে। ১১০৮ স্পষ্টই সংস্কার জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। লিপির স্পষ্ট নির্দেশনা শোনানোর লক্ষ্যে জনগণকে তলব করলেন জোসিয়া: 

পরে রাজা মঞ্চের উপরে দাঁড়াইয়া সদপ্রভুর অনুগামী হইবার, এবং সমস্ত অন্তঃকরণের ও সমস্ত প্রাণের সহিত তাঁহার আজ্ঞা, সাক্ষ্যকথা ও বিধি পালন করিবার জন্য, এই পুস্তকে লিখিত এই নিয়ম বাক্য সকল অটল রাখিবার জন্য সদাপ্রভুর সাক্ষাতে নিয়ম স্থির করিলেন, এবং সমস্ত লোক সেই নিয়মে সায় দিল। ১৯৯ 

অবিলম্বে অক্ষরে অক্ষরে ইয়াহওয়েহর তোরাহ পালন করা একটি কর্মসূচির সূচনা ঘটালেন জোসিয়া। 

প্রথমে দাদা মানাসের সূচিত গোত্রীয় ঐতিহ্য ধ্বংস করেন তিনি, বা’ল ও আশেরার প্রতিমা পুড়িয়ে দেন, গ্রামীণ উপাসনালয়গুলো নিশ্চিহ্ন করেন ও ইসরায়েলিরা যেখানে মোলোখের উদ্দেশে শিশুদের বলী দিত সেই মন্দিরের পুরুষ পতিতা ও সূর্যের অসিরিয় অশ্বের পবিত্র আবাস ধ্বংস করে দেন। পড়ার সময় একে ধ্বংসলীলার এক লাগামহীন উৎসবের মতো মনে হয়। অবশ্য ইসরায়েল রাজ্যের পুরোনো এলাকার দিকে যখন দৃষ্টি ফেরান, তখন আরও নির্দয় হয়ে ওঠেন তিনি। এখানে কেবল বেথেল ও সামারার ইয়াহওয়েহর প্রাচীন মন্দিরই ধ্বংস করেননি, বরং গ্রামীণ উপাসনালয়ের পুরোহিতদেরও হত্যা করিয়েছেন, তাঁদের বেদী অপবিত্র করেছেন তিনি। ১১০ 

ইসরায়েল ও জুদাহর রাজারা শত শত বছর ধওে আগাগোড়া ইয়াহওয়েহর নিষিদ্ধ ঘোষিত আচার অনুমোদন দিয়ে এসেছে বলে প্রকাশ করেছিল সেফার তোরাহ। ইয়াহওয়েহ এখানে কঠোরভাবে একক আনুগত্য দাবি করে এসেছেন বলে দেখানো হয়েছে: ‘হে ইস্রায়েল শুনো,’ নেবো পাহাড়ে তাঁর জাতির উদ্দেশে বলেছিলেন মোজেস। ‘আমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভু একই সদাপ্রভু [ইলোহিম)’ তাহাদের অবশ্যই সমস্ত হৃদয়, সমস্ত প্রাণ, ও সমস্ত শক্তি দিয়া আপন ঈশ্বর সদাপ্রভুকে প্রেম করিতে হইবে।১১১ ইয়াহওয়েহকে প্রেম করার অর্থ ছিল ইসরায়েলিরা ‘অন্য দেবগণের, চারিদিকের জাতিদের দেবগণের অনুগামী [১১২] হতে পারবে না। মোজেস জোরের সঙ্গে বলেছিলেন যে, লোকে প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রবেশ করার সময় তাদের অবশ্যই কানানের স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কোনওরকম লেনদেন থাকতে পারবে না। তাদের সঙ্গে কোনও চুক্তি করতে পারবে না, কোনওরকম করুণা দেখানো যাবে না; তাদের ধর্ম নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে: ‘তোমরা তাহাদের প্রতি এইরূপ ব্যবহার করিবে: তাহাদের যজ্ঞবেদীসকল উৎপাটন করিবে, তাহাদের স্তম্ভ সকল ভাঙ্গিয়া ফেলিবে, তাহাদের আশেরা মূর্ত্তি সকল ছেদন করিবে; তাহাদের খোদিত প্রতিমা সকল অগ্নিতে পোড়াইয়া দিবে। ১১৩ এই সংস্কারে ইয়াহওয়েহর নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন জোসিয়া। 

ডিউটেরোনমিস্টরা নিজেদের ইসরায়েলের আদি বিশ্বাসে ফেরা রক্ষণশীল হিসাবে দাবি করেছেন। আসলে তাঁরা প্রবলভাবে উদ্ভাবনী শক্তি সম্পন্ন ছিলেন। বরাবর গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়ে আসা পবিত্র খুঁটি (আশেরা) এবং ‘দণ্ডায়মান স্তম্ভ’ (মাসেবোদ)-এর মতো প্রতীক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন তাঁরা।১১৪ কিছু নতুন চমকপ্রদ বিধি যোগ করেন তাঁদের আইনি বিধানে। ১১৫ প্রথমত, ইসরায়েলের উপাসনাকে কঠোরভাবে সমালোচনা করা হয়: কেবল একটিমাত্র উপাসনালয়ে ও স্থানে উৎসর্গ করা যেতে পারে, ইয়াহওয়েহ ‘যেখানে আপন নাম স্থাপন ১১৬ করেছেন। স্পষ্টভাবে জেরুসালেমের নাম উল্লেখ করা না হলেও সপ্তম শতাব্দী নাগাদ এই ভূমিকা পালন করার একমাত্র উপযুক্ত মন্দির ছিল এটাই। দ্বিতীয়ত, পশুর অসাম্প্রদায়িক হত্যার অনুমোদন দিয়েছেন ডিউটেরোনমিস্টরা ১১৭ প্রাচীন বিশ্বে কোনও পবিত্র এলাকায় আনুষ্ঠানিকতার ভেতর দিয়ে উৎসর্গ করা পশুর মাংসই খাওয়ার অনুমোদন ছিল। কিন্তু এখন স্থানীয় মন্দিরগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় জেরুসালেম থেকে অনেক দূরে বাস করা লোকজনকে যার যার নিজস্ব শহরে পশু জবাই করার অনুমতি দেওয়া হয়, যদি জীবনীশক্তি ধারণ করা রক্ত পান না করে সমীহের সঙ্গে জমিনে ঢেলে দেয়। 

ডিউটেরোনমিস্টরা প্রথার পাশাপাশি ক্রিয়াশীল নিজস্ব নিয়ম ও অখণ্ডতাসহ একটি অসম্প্রদায়িক আবহ গড়ে তুলেছিলেন।১১৮ ডিউটেরোনমিস্টদের বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের ক্ষেত্রেও একই নীতিমালা অনুসৃত হয়েছিল। প্রথাগতভাবে স্থানীয় উপাসনালয়ে গোত্রীয় প্রবীণদের হাতে বিচার কাজ সম্পাদিত হতো, কিন্তু এখন ডিউটেরোনমিস্টরা প্রতিটি শহরে রাষ্ট্রীয় বিচারকদের নিয়োগ দিয়েছিলেন, সমস্যাসঙ্কুল মামলা সমাধানের জন্যে জেরুসালেমে একটি সুপ্রিম কোর্ট ছিল। ১১৯ সবশেষে ডিউটেরোনমিস্টরা রাজার ঐতিহ্যগত ক্ষমতা কেড়ে নেন। ১২০ তখন আর পবিত্র সত্তা ছিলেন না তিনি। নিকট প্রাচ্যের রেওয়াজ থেকে বিস্ময়কর বিচ্যুতিতে ডিউটেরোনমিস্টরা সার্বভৌমের এখতিয়ার মারাত্মকভাবে ছেঁটে দেন। তাঁর একমাত্র কর্তব্য ছিল লিখিত তোরাহ পড়া ‘আর স্বীয় রাজ্যের সিংহাসনে উপবেশনকালে সে আপনার নিমিত্তে একখানি লেবীয় পুস্তকে লেবীয় যাজকদের সম্মুখস্থিত এই ব্যবস্থার অনুলিপি লিখিবে। তাহা তাহার নিকটে থাকিবে, এবং সে যাবজ্জীবন তাহা পাঠ করিবে; যেন সে আপন ঈশ্বর সদাপ্রভূকে ভয় করিতে ও এই ব্যবস্থার সমস্ত বাক্য ও এই সকল বিধি পালন করিতে শিখে;…এই রূপে যেন ইস্রায়েলের মধ্যে তাহার ও তাহার সন্তানদের রাজত্ব দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। ১২১ রাজা আর ঈশ্বরের পুত্র, ইয়াহওয়েহর বিশেষ ভৃত্য বা স্বর্গীয় সভার সদস্য ছিলেন না। কোনও বিশেষ অধিকার ছিল না তাঁর, বরং প্রজাদের মতো আইনের অধীন ছিলেন তিনি। ডিউটেরোনমিস্টরা কিভাবে শত শত বছরের পবিত্র ঐতিহ্যকে উল্টে দেওয়া এইসব পরিবর্তনকে জায়েজ করেছিলেন? ডিউটেরোনমিস্টরা আসলে কারা ছিলেন ঠিক জানি না আমরা। লিপি আবিষ্কারের কাহিনী বোঝায় এদের ভেতর পুরোহিত, পয়গম্বর ও লিপিকাররা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। উত্তরের রাজ্যে সূচিত হয়ে ৭২২ সালে ইসরায়েল রাজ্যের ধ্বংসের পরপর এই আন্দোলন দক্ষিণের জুদাহ রাজ্যে এসে থাকতে পারে। আবার জোসিয়াকে সিংহাসনে বসানো অধিকার বঞ্চিত আম হা-আরেতখ-দের দৃষ্টিভঙ্গিও প্রকাশ করে থাকতে পারেন তাঁরা। 

ডিউটেরোনমিস্টদের কাছে জোসিয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। নতুন মোজেস হিসাবে তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন তাঁরা, তিনি রাজা ডেভিডের চেয়েও মহান ছিলেন বলে বিশ্বাস করেছেন।১২২ শাস্ত্রের সংস্কার ছাড়াও ইসরায়েলের ইতিহাসও নতুন করে লিপিবদ্ধ করেছিলেন ডিউটেরোনমিস্টরা, জোসিয়ার আমলে তা পূর্ণতা লাভ করেছে বলে বিশ্বাস করতেন তাঁরা। প্রথমত, J ও E-র আদি বিবরণকে সপ্তম শতাব্দীর অবস্থার উপযুক্ত করে সম্পাদনা করেন। ১২৩ গোষ্ঠীপিতা আব্রাহাম, ইসাক, জাকবদের কাহিনীতে নতুন কিছু যোগ করেননি তাঁরা, কারণ তাঁরা সেভাবে আগ্রহী করে তোলেননি তাঁদের, বরং মোজেসের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন-যিনি মিশরে দাসত্বের হাত থেকে তাঁর জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন-ঠিক যখন ফারাও’র কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের আশা করছিলেন জোসিয়া। এরপর, বুক অভ জোশুয়া ও তাঁর উত্তরাঞ্চলীয় উঁচু এলাকা দখল করার কাহিনী যোগ করার জন্যে অভিবাসনের ক্রমপঞ্জীকে প্রসারিত করেন তাঁরা। ডিউটেরোনমিস্ট ইতিহাসবিদরা জোওয়ার আমলকে স্বর্ণযুগ বিবেচনা করেছেন, যখন লোকে সত্যিকার অর্থেই ইয়াহওয়েহর প্রতি অনুগত ছিল, এবং ইসরায়েল আবারও এক মহান যুগে পা রাখতে যাচ্ছে বলে বিশ্বাস করতেন। মোজেসের মতো জোসিয়াও ফারাও’র জোয়াল ছুঁড়ে ফেলবেন; জোশুয়ার মতোই অসিরিয়ার ছেড়ে দেওয়া এলাকা অধিকার করেবেন এবং ইয়াহওয়েহর সত্য ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন। সবশেষে শমুয়েল ও রাজাবলী পুস্তকে ডিউটেরোনমিস্টরা ইসরায়েল ও জুদাহ রাজ্যের ইতিহাস লিখেছেন, যা কঠোরভাবে উত্তরের রাজ্যের নিন্দা করেছে এবং জুদাহর ডেভিডিয় রাজারাই গোটা ইসরায়েলের বৈধ শাসক বলে যুক্তি তুলে ধরেছে। এভাবে ডিউটেরোনমিস্ট গ্রন্থাবলী জোসিয়ার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রতি জোরাল সমর্থন দিয়েছে। 

তবে এটা কোনও সস্তা প্রচারণা ছিল না। ডিউটেরোনমিস্টরা শিক্ষিত মানুষ ছিলেন এবং তাঁদের সাফল্য ছিল লক্ষণীয়। প্রাচীন ঐতিহ্যকে জোসিয়ার শাসনাধীন ইসরায়েলের সম্পূর্ণ নতুন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সম্পূর্ণ নতুন ভাষ্য তৈরি করার উদ্দেশ্যে অতীতের উপাদান–প্রাচীন রাজকীয় মহাফেজখানা, আইনি বিধিমালা, গাথা ও শাস্ত্রীয় টেক্সট-এর সাহায্য নিয়েছেন তাঁরা! কোনও কোনও দিক দিয়ে ডিউটেরোনমি পড়ে কোনও আধুনিক দলিলের মতো মনে হয়। সেক্যুলার পরিবেশ, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে এর দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বর্তমান কালমুখী। বহু প্রাচীন মিথ ছেঁটে ফেলে ডিউটেরোনমিস্টরা আরও বেশি যৌক্তিক ধর্মতত্ত্ব গড়ে তুলেছিলেন।১২৫ কিছু সংখ্যক ইসরায়েলি যেমন বিশ্বাস করত, সিনাই পাহাড়ে মোজেসের সঙ্গে কথা বলার জন্যে স্বর্গ থেকে নেমে আসেননি ঈশ্বর; আপনি আসলে ঈশ্বরকে দেখতে পাবেন না; উৎসর্গ দিয়ে তাঁকে ইচ্ছামতো কাজেও লাগাতে পারবেন না। ঈশ্বর অবশ্যই মন্দিরে বাস করেননি: মন্দির উৎসর্গ করার পর সলোমনের কণ্ঠে দীর্ঘ প্রার্থনা জুড়ে দিয়েছেন লেখকরা, উপাসনালয়টি স্বর্গ ও মর্ত্যের কোনও সংযোগ নয়, স্রেফ একটি প্রার্থনা-ঘর, এটা তাই স্পষ্ট করে দিয়েছে। ‘কিন্তু ঈশ্বর কি সত্য সত্যই পৃথিবীতে বাস করিবেন?’ অবিশ্বাসের সঙ্গে চিৎকার বলেছেন সলোমন, ‘দেখ স্বর্গ ও স্বর্গের স্ব তোমাকে ধারণ করিতে পারে না, তবে আমার নির্ম্মিত এই গৃহ কি পারিবে? ১২৬ প্রাচীন পুরাণ যেমনটা দাবি করেছে, ইয়াহওয়েহ যায়ন পাহাড়ে অবস্থান করেন বলে নয় বরং লোকে ইয়াহওয়েহর বিধিবিধান পালন করেছে বলেই ইসরায়েল তার ভূমি অধিকার করেছে এবং কেবল তাঁকেই উপাসনা করাতেই এটা সম্ভব হয়েছে। 

পরস্পরের সঙ্গে ন্যায়বিচার ও দয়ার ভেতর দিয়ে আচরণ করাও ইসরায়েলিদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেবল আয়ের একটা অংশ এতিম ও বিধবাদের বিলিয়ে দিলে বা ফসল ঘরে তোলার পর আঙুর, জলপাই বা ক্ষেতের গম আলাদা করে রাখলেই ভূমির অধিকার লাভ ও উদ্যোগে সাফল্য লাভ করতে পারবে। তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, মিশরে নিপীড়িত ছিল তারা এবং তাদের খোদ ইয়াহওয়েহর বদান্যতার অনুকরণ করতে হবে।১২৭ ‘তুমি আপন হৃদয় কঠিন করিও না, দরিদ্র ব্রাত্যের প্রতি আপন হস্ত রুদ্ধ করিও না,’ তাঁর জাতিকে বলেছিলেন মোজেস, কিন্তু তাহার প্রতি মুক্তহস্ত হইয়া তাহার অভাব জন্য প্রয়োজন অনুসারে তাহাকে অবশ্য ঋণ দিও। ১২৮ ইসরায়েলিদের অবশ্যই স্বামী পরিত্যক্ত স্ত্রীদের উত্তরাধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে, আবাসী বিদেশীদের (গের) অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, ও ছয় বছর সেবা দানের পর দাসদের মুক্তি দিতে হবে।১২৯ ন্যায়বিচার, সাম্যতা ও সহানুভূতি নিশ্চিত করার প্রতি ডিউটেরোনমিস্টদের আবেগময় জোর দান আমোস ও হোসিয়ার শিক্ষাকেও ছাপিয়ে গেছে। 

তাঁদের সংস্কার পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে ডিউটেরোনমিস্টরা হয়তো ইসরায়েলের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও বিচারিক জীবন সম্পূর্ণ পাল্টে দিতে পারতেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। ডিউটেরোনমিস্ট আইনজ্ঞ ও ইতিহাসবিদরা লিখিত টেক্সটের প্রতি সম্পূর্ণ নতুন কেন্দ্রিকতা দিয়েছেন। আজকের দিনে লোকে প্রায়শঃই পরিবর্তনের বিরোধিতা করতে ও অতীতকে ধরে রাখতে শাস্ত্র কাজে লাগায়। কিন্তু ধর্মশাস্ত্রীয় গাঁড়া বিশ্বাসের পুরোধা ডিউটেরোনমিস্টরা মৌলিক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যেই উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া টেক্সট ব্যবহার করেছেন। নবম শতাব্দীর কোভেন্যান্ট বিধির প্রাচীন আইনকানুন নতুন করে লিখেছেন তাঁরা, বিভিন্ন বাগধারা যোগ করেছেন, অসাম্প্রদায়িক পশু হত্যা, কেন্দ্রীয় স্যাঙ্কচুয়ারি ও ধর্মীয় পঞ্জিকা সংক্রান্ত তাঁদের নয়া বিধানকে জায়েজ করার জন্যে বিভিন্ন শব্দ পাল্টে দিয়েছেন।১৩০ প্রাচীন বিধান, মৌখিক গাথা বা কাল্টিক রেওয়াজ যাতে তাঁদের সংস্কারে বাধা দিতে বা সংকীর্ণ করে দিতে না পারে সেজন্যে এইসব ঐতিহ্যকে সৃজনশীলভাবে কাজে লাগিয়েছেন। অতীতের পবিত্র কাহিনী পাথরে খোদাই করা ছিল না; ডিউটেরোনমিস্টরা একে তাঁদের বর্তমান পরিস্থিতিতে আলো ফেলতে পারবে এমন সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করেছেন। 

ডিউটেরোনমিস্টরা ইহুদিবাদকে কিতাবি ধর্মে পরিণত করেছেন। কিন্তু এই বিকাশের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য বিরোধিতা ছিল বলে মনে হয়। সাক্ষরতা ঐতিহ্যের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পাল্টে দিয়েছিল, সেটা যে সবসময় ভালোর জন্যে তা কিন্তু নয়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে মৌখিক হস্তান্তরে দীর্ঘ শিক্ষানবীশী, ক্যারিশম্যাটিক গুরুর সঙ্গে গতিশীল বিনিময়, এবং শৃঙ্খলিত, আত্ম-বিলোপকারী জীবনযাত্রার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু একাকী পাঠ অধিকতর স্বতন্ত্র্য ও স্বাধীন শিক্ষাকে অনুপ্রাণিত করেছে। ছাত্র আর তার শিক্ষকের উপর নির্ভরশীল ছিল না, বরং নিজেই টেক্সট পাঠ করে নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারত, তার জ্ঞান অগভীর হতে পারত, তবে তার কাছে শব্দের গভীরে কি আছে তা জানার প্রয়োজন অনুভূত নাও হতে পারত বা শব্দ ও ধারণার অতীতে নিয়ে যাওয়ার মতো ঐশ্বরিক নীরবতার অভিজ্ঞতারও দরকার হতো না। 

মোটামুটিভাবে হেযেকিয়া স্ক্রোল আবিষ্কার করার সেই সময়েই পয়গম্বর জেরেমিয়া তাঁর যাজকজীবন শুরু করেছিলেন। আপন আহ্বানকে সেফার তোরাহর সঙ্গে সম্পর্কিত করেন তিনি এবং এমনকি তিনি স্বয়ং লিপিকার না হলেও তাঁর শিষ্য বারুচ তাঁর বাণীগুলো লিপিবদ্ধ করেন। জোসিয়াকে দারুণ শ্রদ্ধা করতেন জেরেমিয়া, সম্ভবত হিলকিয়া ও শাফানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। জেরেমিয়ার পুস্তক বিভিন্ন জায়গায় ডিউটেরোনমির ধরন ও দৃষ্টিভঙ্গি অংশীদার।১৩১ তারপরেও লিখিত তোরাহর প্রতি বিরাগ ছিল তাঁর: ‘তোমরা কেমন করিয়া বলিতে পার, আমরা জ্ঞানী, এবং আমাদের কাছে সদাপ্রভুর ব্যবস্থা আছে?’ প্রতিপক্ষকে প্রশ্ন করেছেন তিনি। ‘দেখ, অধ্যাপকদের মিথ্যা লেখনী তাহা মিথ্যা করিয়া ফেলিয়াছে!’ কলমের এক খোঁচাতেই লিখিত টেক্সট সনাতন বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দিতে পারে, জ্ঞানের চেয়ে বরং তথ্য যোগান দিতে গিয়ে ঐতিহ্যকে বিকৃত করতে পারে। অধ্যাপকরা, জেরেমিয়া সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, ‘হতাশাক্রান্ত ও হতবুদ্ধি’ হয়ে যাবেন। তাঁরা ‘সদাপ্রভুর বাক্য [ দাবার] অগ্রাহ্য করিয়াছে, তবে তাহাদের জ্ঞান কি প্রকারের? ১৩২ বাইবেলিয় হিব্রুতে দাবার ছিল পয়গম্বরদের কণ্ঠে উচ্চারিত ঈশ্বরের ভবিষ্যদ্বাণী, আর ‘জ্ঞান’ (মিশপাত) বলতে সম্প্রদায়ের মৌখিক ঐতিহ্যকে বোঝাত। এই প্রাথমিক কালেই ইতিমধ্যে লিখিত ধর্মশাস্ত্রের আধ্যাত্মিক মূল্য নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল। আধুনিক ইহুদি আন্দোলনের এক গবেষণায় বিখ্যাত পণ্ডিত হাইম সলোভেইতচিক মৌখিক ঐতিহ্য থেকে লিখিত টেক্সটে সরণ ছাত্রদের আবিশ্যিকভাবে অধরা ও অনির্বচনীয় বিভিন্ন বিষয়ে ভ্রান্ত স্পষ্টতা ও নিশ্চয়তা দিয়ে ধর্মীয় কঠোরতার দিকে চালিত করতে পারে১৩ বলে যুক্তি দেখিয়েছেন। ডিউটেরোনমিস্টরা সাহসী ও সৃজনশীল চিন্তক ছিলেন, কিন্তু তাঁদের ধর্মতত্ত্ব প্রায়শঃই কঠোর ছিল। ‘যে যে স্থানে আপন আপন দেবতাদের সেবা করিয়াছে সে সকল স্থান তোমরা একেবারে নষ্ট করিবে,’ জনগণকে নির্দেশ দিয়েছেন মোজেস। ‘তাহাদের স্তম্ভ সকল ভগ্ন করিবে, তাহাদের আশেরা মূর্ত্তি সকল অগ্নিতে পোড়াইয়া দিবে, তাহাদের খোদিত প্রতিমা সকল ছেদন করিবে এবং সেই স্থান হইতে তাহাদের নাম লোপ করিবে। ১৩৪ ইয়াহওয়েহ ইসরায়েলিদের পরস্পরের প্রতি দয়াশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু বিদেশীদের প্রতি তাদের কোনও দয়া থাকতে পারবে না। ডিউটেরোনমিস্ট ইতিহাসবিদ আপাত অনুমোদনের সাথেই জোশুয়া কর্তৃক আই-এর বাসিন্দাদের হত্যালীলার বিবরণ দিয়েছেন: 

এই রূপে ইসরায়েল তাহাদের সকলকে ক্ষেত্রে, অর্থাৎ যে প্রান্তরে অয়নবাসীগণ তাহাদের পশ্চাতে ধাবমান হইয়াছিল, সেখানে তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে সংহার করিল; তাহারা সকলে নিঃশেষে খড়গাধারে পতিত হইল, পরে সমস্ত ইসরায়েল ফিরিয়া অয়ে আসিয়া খড়গাধারে তথাকার লোকদিগকেও আঘাত করিল। সেই দিবসে অয়নিবাসী সমস্ত লোক অর্থাৎ স্ত্রী, পুরুষ সর্ব্বশুদ্ধ বারো সহস্র লোক পতিত হইল। ১৩৫ 

অতিরিক্ত নিশ্চয়তা ও স্পষ্টতা নিষ্ঠুর অসহিষ্ণুতার পথে চালিত করতে পারে। 

ডিউটেরোনমিস্ট সম্ভবত জেরুসালেমে এযাবৎ অনুষ্ঠিত প্রথম পাসওভারের বিবরণ দিয়ে তাঁর ইতিহাসের সমাপ্তি টেনেছেন। জোশুয়া সামারিয়ার মন্দির ধ্বংস ও তাদের পুরোহিতদের হত্যা করার পর পীস্যাচ পালনের জন্যে সমস্ত লোকজনকে তলব করেছিলেন, ‘কোভেন্যান্টে যেমন ব্যবস্থা দেওয়া হইয়াছিল। এটাও আরেকটি ডিউটেরোনমিস্ট উদ্ভাবন। এর আগপর্যন্ত পাসওভার বাড়ির ভেতরে অনুষ্ঠিত একান্ত, পারিবারিক উৎসব ছিল, এখন তা জাতীয় সম্মেলনে পরিণত হলো।১৩৬ অবশেষে, ইতিহাসবিদ মত দিচ্ছেন, লোকে ইয়াহওয়েহর ইচ্ছা অনুযায়ী পীস্যাচ পালন করছে। 

বিচারপতিগণ ইসরায়েল শাসনকালে বা ইস্রায়েল রাজ্য ও জুদাহর রাজাগণের সমগ্র শাসনামলেও এইরূপে পাসওভার পালিত হয় নাই। রাজা জোসিয়ার অষ্টাদশই বৎসরই একমাত্র সময় যখন জেরুসালেমে ইয়াহওয়েহর সম্মানে এইরূপ পাসওভার পালিত হইয়াছে।১৩৭ 

এটা ছিল এক নতুন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় যুগের সূচনা। এক নতুন স্বর্ণযুগ অতিক্রম করতে যাচ্ছিল জুদাহর ক্ষুদ্র রাজ্য। কিন্তু জোসিয়ার মহান পরীক্ষা শেষ হয়েছিল চোখের জলে। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পাল্টে যাচ্ছিল। পতনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল অসিরিয় সাম্রাজ্য, বাবিলনের উত্থান ঘটছিল। ৬১০ সালে ফারাও সামেতিকাস মারা যান, তৃতীয় নেচো তাঁর উত্তরাধিকারী হন, পরের বছর অবরুদ্ধ অসিরিয় রাজার সাহায্যে প্যালেস্তাইন পাড়ি দেন তিনি। মেগিদ্দোয় মিশরিয় সেনাবাহিনীকে বাধা দেন জোসিয়া এবং প্রথম মোকাবিলাতেই প্রাণ হারান তিনি ১৩৮ তাঁর মৃত্যুর পর কোনও সংস্কারকর্মই টিকে থাকেনি। রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়, জুদাহ পরিণত হয় মিশর ও নতুন বাবিলোনিয় সাম্রাজ্যের সংগ্রামের ঘুঁটিতে, তার অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দেয় এটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *