৮. সবাই এক (c. ৪০০-৩০০ বিসিই)

. সবাই এক (সি. ৪০০ থেকে ৩০০ বিসিই

চতুর্থ শতাব্দী নাগাদ চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন বিস্ময়কর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। যুদ্ধ চলছিল এবং রাজকুমারদের ব্যয়বহুল অভিযানের খরচ মেটানোর প্রয়োজন থাকায় নতুন বাণিজ্যিক অর্থনীতির বিকাশে উৎসাহ দিচ্ছিলেন তাঁরা। পঞ্চম শতাব্দীতে চীনারা লোহা ঢালাইয়ের কৌশল শিখে গিয়েছিল এবং শক্তিশালী ইস্পাতের সরঞ্জামের সাহায্যে বিশাল বনভূমি পরিষ্কার করতে পেরেছিল। চতুর্থ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ওয়েই উপত্যকা, চেংদু বেসিন এবং কেন্দ্রীয় সমতল ভূমি অবিরাম চাষাবাদের অধীনে ছিল। কৃষকরা সারের ব্যবহার, বিভিন্ন ধরনের মাটির পার্থক্য আর লাঙ্গল চালানো, বীজ বপন বা ভূমি পানি মুক্ত করার সেরা সময় চিনতে শিখেছিল। ফসল তোলার কাজের উন্নতি হয়েছিল, বিধ্বংসী যুদ্ধবিগ্রহ সত্ত্বেও জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটেছিল। বণিকদের এক নতুন শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটেছিল, রাজকুমারদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে ফাউন্ড্রি নির্মাণ ও খনির উন্নয়ন ঘটাচ্ছিল এরা। সবচেয়ে উৎসাহী উদ্যোক্তারা বস্ত্রশিল্প, সেরেয়ালস, লবন, ধাতু, চামড়ার বাণিজ্য এবং বিপুল সংখ্যক চিত্রশিল্পী, এজেন্ট এবং বাহন ও নৌকার বিশাল বহর গড়ে তুলে বিশাল বাণিজ্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে, কোরিয়া, স্তেপ এবং এমনকি সুদূর ভারত পর্যন্ত তাদের পণ্য নিয়ে যাচ্ছিল। 

শহরগুলো আর স্রেফ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় রাজধানীতে সীমিত ছিল না বরং বাণিজ্য ও শিল্পের কেন্দ্রে পরিণত হয়ে হাজার হাজার নাগরিকের স্থান সংকুলান করছিল। সামন্ত আমলে ছোট প্রাসাদ শহরের দেয়ালের মাপ ছিল সামান্য পাঁচ শো গজ; এখন কোনও কোনও দেয়াল দুই মাইলেরও বেশি লম্বা ছিল। চতুর্থ শতাব্দীতে তিন হাজার বাসিন্দা নিয়ে কি-র রাজধানী লিনযি ছিল চীনের বৃহত্তম শহর। কারুশিল্পী ও চিত্রকরদের একটি শহুরে শ্রেণী আবির্ভূত হয়েছিল সেখানে এবং সম্পদশালীরা নতুন বিলাসিতা ও প্রসারমান বিনোদন শিল্প উপভোগ করছিল; তারা আর রাজ-প্রাসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না। কি-র রাজকুমাররা চীনের নেতৃস্থানীয় পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিলেন এবং ৩৫৭ সালে লিনযির পশ্চিম তোরণের কাছে জিক্সিয়া একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন তারা যেখানে শি শিক্ষিত জনরা উদার ভাতার উপর নির্ভর করে বিলাসি অ্যাপার্টমেন্টে বাস করত। 

অনেকেই এইসব পরিবর্তন উপভোগ করেছে, কিন্তু অন্যরা অস্বস্তিকরভাবে তাদের জীবন পূর্বপুরুষের আচরিত জীবন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সজাগ হয়ে উঠছিল। বড়, সফল রাজ্যের রাজকুমাররা আর আনুষ্ঠানিকতার নিগড়ে বন্দী ছিলেন না। রাজকীয় লি-র জন্যে প্রয়োজনীয় ‘কিছুই না করার’ বদলে শাসকরা সোৎসাহে তাঁদের নিজস্ব উচ্চাভিলাষী নীতি বাস্তবায়ন করেছেন এবং ক্ষমতাকে একচ্ছত্র করার দিকে মনোযোগী ছিলেন। চতুর্থ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ওয়েইর রাজা বেতনভুক কর্মকর্তাদের সিভিল সার্ভিসের সাহায্যে বংশ পরম্পরার ব্যারন ও মন্ত্রীদের প্রতিস্থাপিত করেন। প্রাচীন প্রশাসনিক দপ্তরগুলো মহান পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল, কিন্তু এখন রাজার পক্ষে তাঁর নিজস্ব কর্মকর্তা বেছে নেওয়া সম্ভব ছিল; অবাধ্য হলে স্রেফ তাদের বিদায় করে দিতে পারতেন তিনি। অসন্তোষজনক রাজনীতিকদের পাইকারীভাবে নির্বাসনে পাঠানো হতো কিংবা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হতো। অন্য রাজ্যগুলো ওয়েই-র নজীর অনুসরণ করলে রাজনীতি দারুণ বিপজ্জনক খেলায় পরিণত হয়। রাজকুমাররা অনেক সময় শিনীতিবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করলেও বণিকদের দিকেই বেশি মনোযোগ দিতেন। ক্রমবর্ধমানহারে নতুন বাণিজ্যিক রীতিনীতির চতুর বাস্তববাদ ও হিসাবের প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁদের নীতিতে। 

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৈষম্যকে প্রকট করে তুলেছে এবং ব্যাপক সামাজিক ব্যাঘাতের কারণ হয়েছে। ক্ষেতমজুরদের নিয়মিত জোর করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হতো, কিন্তু অন্যরা ঋণে জর্জরিত হয়ে জমি ছেড়ে দিয়েছিল। ক্ষেতমজুররা যেসব জলাভূমি ও বনভূমিতে মাছ ধরত বা শিকার করত বা জ্বালানি যোগাড় করতে শাসকরা সেসব কুক্ষিগত করে নিয়েছিলেন। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল গ্রামের সমাজ, বহু ক্ষেতমজুর ফ্যাক্ট্ররি ও ফাউন্ড্রির শ্রমিকে পরিণত হতে বাধ্য হয়েছে। কোনও কোনও অভিজাত পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ছোট প্রাচীন ধরনের ক্ষুদেরাজ্যগুলো নিশ্চিহ্নতার অব্যাহত হুমকির মুখে ছিল। বহু মানুষের জীবনে এক মহাশূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল। ‘কোনটা আইনি, কোনটা বেআইনি?’ প্রশ্ন করেছেন চু-র রাজকুমার ও কবি কু ইউয়ান। ‘এই দেশ নৈরাশ্যের আবাস ছাড়া আর কিছু নয়! কিছুই আর বিশুদ্ধ নেই! গুপ্তচরেরা সম্মানিত! ভদ্রঘরের বিজ্ঞ মানুষগুলো অখ্যাত!” রাজকুমারের কাছে পবিত্র পুরুষের সঙ্গে পরামর্শ করে আবার পথ-এ ফিরে আসার আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু নাকচ করে দেওয়া হয়েছে তাঁকে, নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ২৯৯ সালে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। 

অন্যরা এই সাহসী নতুন বিশ্বের সঙ্গে তেমন কোনও সম্পর্কই রাখতে চাননি, বনে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। বেশ কিছুদিন ধরেই নগর জীবন ছেড়ে যাচ্ছিলেন তপস্বীরা; কনফুসিয়াস তাঁর সমাজ সংস্কারের প্রয়াসকে পরিহাস করা এইসব দরবেশদের কারও কারও দেখা পেয়েছিলেন। নিঃসঙ্গ এই মানুষগুলো ভারতের সাধুদের মতো ছিলেন না। স্রেফ নিরিবিলি জীবন কাটাতে চেয়েছেন তারা। কেউ কেউ অবশ্য চলমান রাষ্ট্রীয় ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে ‘সমালোচনামূলক ও অবজ্ঞা সূচক’ কথা বলে দারুণ উঁচু নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। কৃষিকাজের উদ্ভাবক কিংবদন্তীর সাধু রাজা শেন নোঙ ছিলেন তাদের আদর্শ। নিজেদের কালের উচ্চাভিলাষী শাসকদের বিপরীতে শেন নোঙ তাঁর সাম্রাজ্যকে কেন্দ্রীভূত করতে চাননি, বরং প্রতিটি জায়গিরকে স্বায়ত্তশাসিত থাকতে দিয়েছেন; মন্ত্রীদের ত্রস্ত করে তোলেননি তিনি এবং ফসলের নিয়মিত পরিদর্শন ছাড়া ‘কিছুই না করে’ (উউ ওয়েই) শাসন করেছেন। অন্য তপস্বীরা বন আর জলাভূমিতে মাছ ধরে বা শিকার করে অলস জীবন কাটিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন, কিন্তু চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ তারাও একটি দর্শন গড়ে তুলেছিলেন, যার কৃতিত্ব তারা গুরু ইয়ঙকে নামে একজনকে দিয়ে থাকে। 

ইয়াংযি কোনও বই রেখে না গেলেও অন্যান্য টেক্সটে তাঁর ধ্যান-ধারণা সংরক্ষিত হয়েছে। কনফুসিয়বাদী ও মোহিস্টদের উদ্দেশ্যে প্রত্যক্ষ ও অস্বস্তিকর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তিনি। ঈশ্বর মানুষকে একটি নির্দিষ্ট আয়ু দিয়েছেন, সুতরাং আপনি নিজের জীবনকে বিপদাপন্ন করলে ঈশ্বরের আদেশকেই লঙ্ঘন করলেন। এখন রাজদরবারের জীবন এতই বিপজ্জনক হয়ে গেছে যে রাজনৈতিক দায়িত্ব চাওয়া স্পষ্টতই ভ্রান্তি। সুতরাং, ইয়াংবাদীরা নীতিগতভাবে প্রকাশ্য জীবন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। কনফুসিয়াসের বিশ্বাসমতে বিনয়ের কারণে নয় বরং নিজেদের ও অন্যের জীবন বিপন্ন করতে চাননি বলেই ইয়াও ও শান সরে দাঁড়িয়েছেন বলে যুক্তি দেখিয়েছে তারা। ইয়াংবাদীরা এক আগ্রাসী সোনাবাহিনীর মোকাবিলার বদলে সিংহাসনই ছেড়ে দেওয়া ঝোউ রাজাদের এক পূর্বসুরি তান ফু-র নজীর টানতে পছন্দ করত: ‘যাদের সঙ্গে বাস করে এসেছি তাদের ছেলে আর ভাইদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া আমার সহ্যের অতীত, ‘ ক্ষমতা ছাড়ার ভাষণে বলেছিলেন তিনি। 

রেন বা ‘সকলের জন্যে উদ্বেগে’র কোনও অবকাশ ছিল না ইয়াংবাদীদের। তাদের দর্শন ছিল ‘যার যার তার তার।১১ কনফুসিয়বাদীদের কাছে চরম স্বার্থপর ঠেকেছিল এটা; তারা অভিযোগ করেছে যে, ইয়াংযি ‘এত বয়স্ক না হলে একটা চুল ছিঁড়ে সাম্রাজ্যকে সাহায্য করতে পারলেও সেটা করতেন না। কিন্তু ইয়াংবাদীরা জোর দিয়ে বলেছে, অন্য লোক বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়া দায়িত্বহীন; নিজের জীবন বাঁচানো এবং স্বাভাবিকভাবে যা হাতে আসে সেটা করাই তোমার প্রধান দায়িত্ব। ১৩ ইয়াংবাদীরা অবশ্যই তাদের মানবিক প্রকৃতি নিয়ে অনধিকার চর্চা করবে না, বরং ঈশ্বর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পথই অনুসরণ করবে। আমোদকে অস্বীকার করা বা মানবীয় সম্পর্ককে বিকৃত করা দরবারী জীবনের কৃত্রিম আচারে আত্মসমর্পণ করা ভুল। নিজের অনুভূতির বদলে লি অনুসরণ করলে মানুষের সঙ্গে প্রকৃত সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে না। জীবন হতে হবে স্বতঃফুর্ত ও আন্তরিক। 

চীনের বহু লোকই ইয়াংবাদী আদর্শে আকৃষ্ট হলেও অন্যরা একে অস্বস্তিকর আবিষ্কার করেছে।” তারা সবসময় বিশ্বাস করে এসেছে যে, আচারই পৃথিবীতে স্বর্গীয় পথের প্রতিষ্ঠা করেছিল। এইসব লি কি তবে ক্ষতিকর? ইয়াংযির কথা ঠিক হলে যেসব সৎ রাজা প্রজাদের মঙ্গলের স্বার্থে নিজেদের ভোগবিলাস বিসর্জন দিয়েছিলেন তাঁরা সবাই তবে নির্বোধ ও একগুঁয়ে ছিলেন, আর নিজেদের নিয়ে মেতে থাকা নীতিহীন স্বেচ্ছাচারীরাই স্বর্গের নিকটবর্তী ছিলেন। মানবজাতি কি তবে মূলত স্বার্থপর? তাই যদি হয়, পৃথিবীকে আরও ভালো জায়গায় পরিণত করার জন্যে কি করতে হবে? নৈতিকতার ভিত্তি কি? কনফুসিয়াসের আত্ম-পরিচর্যার আদর্শ কি তবে বিকৃত? আর ‘মানব প্রকৃতিই বা আসলে কি, ইয়াংবাদীরা যাকে এত উঁচুতে স্থান দিয়েছে? জিক্সিয়া একাডেমির পণ্ডিতদের ভেতর এইসব প্রশ্ন অলোচিত হতো, তাঁদের একজন শাসকদের দিক- নির্দেশনার জন্যে ইনওয়ার্ড ট্রেইনিং (যিনণ্ড শ্যাঙ) নামে এক মরমী নিবন্ধে ইয়াংবাদীদের উদ্দেশে পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন। 

রেন মানবিয় প্রকৃতির বিকৃতি নয়, বরং এর পূর্ণতা ছিল বলে যুক্তি দেখিয়েছেন লেখক; প্রকৃতপক্ষে খোদ রেন শব্দটি মানবতারই সমার্থক। কোনও রাজকুমার সত্যিকার অর্থে ‘মানবিক হৃদয়ের’ হতে চাইলে তাঁকে অবশ্যই তাঁর নিজের সত্তার মূল আবিষ্কার করতে হবে। শান্তি ও নিরাপত্তার খোঁজে বনে পালানোর বদলে তাঁকে অবশ্যই ধ্যানের মাধ্যমে অন্তস্থঃ নীরবতার চর্চা করতে হবে। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ, আকাঙ্ক্ষাকে স্থির এবং বিচ্যুতকারী ভাবনা থেকে মনকে মুক্ত করে প্রকৃত ও আসল সত্তার দেখা পাবেন আলোকিত রাজকুমার। নিজের মানসিক শক্তিকে স্পষ্ট করবেন তিনি, তাঁর দৈহিক স্বস্থ্যের উন্নতি ঘটবে এবং ভিন্ন কোনও প্রয়াস ছাড়া ‘স্বাভাবিকভাবেই’ রেন-এর মানুষে পরিণত হয়েছেন বলে আবিষ্কার করবেন। চীনারা অন্তর্মুখীনতা আবিষ্কার করেছিল এবং চতুর্থ শতাব্দী নাগাদ যোগের নিজস্ব ভাষ্য নির্মাণ করেছিল। এইসব প্রাথমিক ধ্যানের ধরন সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না আমরা, তবে এসবে মনোযোগ আর নিয়ন্ত্রিত শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যাপার জড়িত ছিল বলে মনে হয়। প্রাচীনকালে রাজারা সঠিক দৈহিক নির্দেশনা গ্রহণ করে পথ-এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন, অন্তর্মুখী প্রশিক্ষণ অনুযায়ী একজন যুবরাজ নিজের অভ্যন্তরে প্রকৃত কেন্দ্র আবিষ্কার করে বিশ্বকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে পারেন। 

চৈনিক ধ্যান কির ব্যবস্থাপনা ভিত্তিক ছিল, এই শব্দটির তর্জমা করা কঠিন। কি জীবনের কাঁচামাল, এর মূল শক্তি এবং এর আদিম আত্মা। এটা সকল সত্তাকে সজীব করে ও প্রতিটি বস্তুকে ভিন্ন আকার ও রূপ দেয়। বাসবতবতার গতিশীল, অবিরাম সক্রিয় উপরিকাঠামো কি দেমোক্রিতাসের অণুর চেয়ে ঢের বেশি অতীন্দ্রিয়বাদী হওয়া ছাড়া অন্য ছিল না। পরম নিয়ন্ত্রক শক্তি পথ-এর নির্দেশনায় এটা সময়ান্তরে বিভিন্ন মিশ্রণে পাথর, গাছ বা মানব সত্তা গঠনের লক্ষ্যে মিলিত হয়। কিন্তু এই সৃষ্টির কোনওটাই স্থায়ী নয়। শেষপর্যন্ত কি অদৃশ্য হয়ে যাবে: ব্যক্তি বা গাছ মারা যাবে এবং পাথর ক্ষয় হয়ে যাবে। কিন্তু কি তখনও জীবিত থাকবে; অনন্ত পরিবর্তনের পাত্রে আলোড়িত হয়ে চলবে এটা এবং শেষপর্যন্ত আবার মিলিত হয়ে ভিন্ন রূপ নেবে। সুতরাং প্রাবল্যের দিতে থেকে সামান্য ভিন্নতা থাকলেও মহাবিশ্বের সমস্ত কিছু একই জীবনের অংশীদার। 

বাস্তবতার ‘মূলসুর’ (জিং) খোদ সত্তা কি-র সবচেয়ে খাঁটি ও সবচেয়ে নিবিড় আকার। ধ্যানে ধ্যানী তার কি-কে মুক্ত করা শেখে। পদ্ধতিগতভাবে স্বাভাবিক ধারাকে বিঘ্নিত করা সব আকাঙ্ক্ষা, ঘৃণা এবং অস্থির মানসিক তৎপরতাকে দূর করে ধ্যানী ঠিক ঈশ্বর যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে নিজের কি- কে তার হৃদয়, মন ও দেহের ভেতর দিয়ে অবিরাম প্রবাহিত হতে সক্ষম করে তোলে। পথ-এর সঙ্গে সামগ্রিক বিন্যাসে আসার পর ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে এবং অন্তর থেকে এক পবিত্র শান্তি উৎসারিত হয়; এটাই বাস্তবতার মূলসুরের (জিং) অনুরূপ গভীরতম ও স্বর্গীয় সর্বোচ্চ সত্তা শেন সুতরাং, ধ্যানের ভেতর দিয়ে আলোকিত রাজকুমার তাঁর প্রকৃত স্বাভাব আবিষ্কার করতেন। তাঁর ভাবনার অঙ্গ ‘হৃদয়’ (জিং)-ই কেবল নিখুঁত হয়ে উঠত না, বরং তাঁর শ্রবণশক্তি, দৃষ্টি আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গও স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠত।” এভাবে জীবনের বরাদ্দকৃত অংশ সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হতেন তিনি। জিং-সমস্ত কিছুর ‘মুলসুর’- এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন বলে সমগ্র বাস্তবতার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার অনুভূতি লাভ করেছেন তিনি এবং সকল বস্তুই আমার আয়ত্তে, আমার অন্তরেই আছে’১৬ বলতে পেরেছেন। 

ভয়ঙ্কর যুদ্ধবিগ্রহে চীন যখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, এমন একটা সময়ে চীনা অতীন্দ্রিয়বাদীরা নিজেদের ভেতরই সবকিছুকে একত্রিত করে চলা এক ধরনের প্রশান্তি আবিষ্কার করছিলেন। একাত্ম হওয়ার এই আকাঙ্ক্ষা দ্বান্দ্বিকতা ও বিতর্কের এক নতুন ধারাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। মোহিস্ট, কনফুসিয়বাদী ও ইয়াংবাদীদের ভেতর প্রবল আলোচনা বিতর্কের প্রক্রিয়ার প্রতি মুগ্ধতার দিকে চালিত করেছিল। গ্রিক সোফিস্টদের মতো বিয়ানযেহ (‘তার্কিকরা’) কোনও একটি বিষয়ের উভয় দিকই প্রমাণ করে ও গৃহীত ধারণাকে হেয় প্রমাণ করতে পেরে আনন্দিত হতেন। অনেকেই তাদের তুচ্ছ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে করেছে, কিন্তু তার্কিকরা নিজেদের কাজকে আপাত বিভিন্ন ভিন্ন বিষয়কে একত্রিত করে অন্তস্থঃ ঐক্য তুলে ধরা অসাঞ্জনশীল শক্তি হিসাবে দেখেছেন। তাদেরই একজন বলে উঠেছিলেন: ‘আমি মিল আর অমিলকে একসঙ্গে করেছি, কাঠিন্য আর শাদাত্বকে, নিশ্চিত আর অনিশ্চিতকে, সম্ভব আর অসম্ভবকে করেছি আলাদা।১৭ 

এই আদি দ্বান্দ্বিকদের সবচেয়ে বিখ্যাত জন ছিলেন একজন অসাধারণ মানুষ: যুদ্ধমান রাজ্যগুলোর ভেতর অন্যতম অগ্রসরমান দেশ ওয়েই-র প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হুইযি।১৮ তাঁর রচনার সামান্যই রক্ষা পেয়েছে, তবে মোহিবাদের প্রতি তাঁর জোরাল দুর্বলতা ছিল বলে মনে হয়। আমাদের হাতে পৌঁছানো তাঁর একমাত্র রচনাটি হলো অস্তিত্বের মুলে তাঁর আবিষ্কৃত অস্থিতিশীলতা তুলে ধরা দশটি প্যারাডক্সের একটি সেট।১৯ হুইযি দেখাতে চেয়েছিলেন, ভ্রান্ত স্থায়িত্ব এবং সংহতির আভাস দেয় বলে শব্দ বিভ্রান্তিকর। আজ আমি ইইয়েহ পথে রওয়ানা দিলাম,’ বলেছেন তিনি, ‘গতকাল পৌঁছেছি।’ সময় পুরোপুরি আপেক্ষিক: আজকের ‘গতকাল’ গতকালের ‘আজ’ এবং আজকের ‘আজ’ আগামীকালের ‘গতকালে’ পরিণত হবে। অন্য একটি প্যারাডক্সে স্থান সংক্রান্ত আমাদের ধারণার আপেক্ষিতা তুলে ধরেছেন তিনি: ‘গোটা বিশ্বের কেন্দ্র কোথায় আমি জানি: ইয়েনের উত্তরে আর উইয়েহর দক্ষিণে।’ ইয়ান চীনের উত্তরে আর ইউই চীনের দক্ষিণে হওয়ায় যৌক্তিকভাবে এই দুটো প্রান্তের মাঝখানেই ‘কেন্দ্ৰ’ হওয়ার কথা। কিন্তু আপনি যখন কঠোর চীনা দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে অবস্থান করবেন, এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে যেকোনও বিন্দুই বিশ্বের কেন্দ্র হতে পারে, ঠিক যেমন রেখার উপরের যেকোনও বিন্দুই একটি বৃত্তের সূচনা বিন্দু হতে পারে। 

এই তত্ত্বগুলো আমরা যে পার্থক্য দেখি বলে কল্পনা করি সেটা যে বিভ্রান্তি বলে দেখানোর জন্যে প্রণীত বাস্তবিকই ধ্যানের বিন্দু ছিল। এমনকি জীবন ও মৃত্যুও একটি অন্যটির বৈশিষ্ট্য: সূর্য যখন শীর্ষে থাকে, তখনই তা পতনোন্মুখ, ‘ বলেছেন হুইযি। ‘যে জন্ম নিয়েছে সে মরতে চলেছে। সবকিছুই পরিবর্তনের ভেতর রয়েছে, সুতরাং, অস্তিত্বের একেবারে প্রথম ক্ষণ থেকেই যেকোনও প্রাণীর জীবনের পচন শুরু হয়ে যায়। কোনও একটা জিনিস কেবল অন্য কোনও জিনিসের সাপেক্ষেই উঁচু, এটা না বুঝেই লোকে পরম অর্থে ‘উঁচু’ আর ‘নিচু’ কথাগুলো ব্যবহার করে থাকে; সুতরাং ‘স্বর্গ আর মর্ত্য একই পর্যায়ের এবং পাহাড়পর্বত জলাভূমির মতোই।’ প্রতিটি জিনিসই, এমনকি যেসব বস্তু উপরিগতভাবে একই রকম সেগুলোও, অনন্য বলে বস্তুকে কঠোর শ্রেণীকরণ করা ভুল: যা সংযুক্ত তাই ভিন্ন।’ সুতরাং স্বর্গ ও মর্ত্য, জীবন ও মৃত্যু, উঁচু ও নিচু, রাজনীতিক, কর্মী, এবং মোহিস্ট সবই সমান; হুইযি হয়তো সকল মানুষের সমান মূল্য আছে এবং সামাজিক সৌভাগ্যও পরিবর্তনশীল হওয়ার কথা বোঝাতে চেয়েছিলেন, ২০ 

প্রথম থিসিসে সাধারণ জীবনে আমাদের অভিজ্ঞতার অতীতে অবস্থান করা এক বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন হুইযি। ‘মহত্তম বস্তুর তার বাইরে কিছু নেই এবং আমরা এই মহানকে এক বলি, সবচেয়ে ছোট জিনিসের ভেতরে কিছু নেই, একে আমরা বলি ক্ষুদ্রতম এক। কেবল অন্য কিছুর চেয়ে বড় বলেই আমরা কোনও বস্তুকে ‘বড়’ বলি; কিন্তু আসলে সবকিছুই ‘মহান’, কারণ পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা অন্য কিছুর চেয়ে বড় নয়। তারপরেও আমাদের মনে ‘মহান’ আর ‘ক্ষুদ্রতম’-এর শ্রেণী অস্তিত্ববান, এটা আমাদের পরমকে কল্পনা করার শক্তি থাকার বিষয়টি দেখিয়ে দেয়। ভাষা আমাদের মনের কাঠামোতে নির্মিত এক দুয়েকে উন্মুক্ত করে। হুইযি’র প্যারাডক্সগুলোর আধ্যাত্মিক ও সামাজিক অনুরণন ছিল যা যেনোর ছিল না, এবং দুর্জ্ঞেয় ও আবেগের দ্যোতনায় তাঁর দশটি প্রস্তাব গঠিত হয়েছিল। প্রথম থিসিসে হুইযি মহান একের তাঁর বাইরে কিছু নেই বলে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দশম ও শেষ থিসিসটি মোহিস্ট ছিল : ‘ভালোবাসা প্রাণের সকল রূপকে আলিঙ্গন করে এবং স্বর্গ ও মর্ত্য একই।’ যার উপর ভিত্তি করে আমরা পার্থক্য করে থাকি সেটা বিভ্রম বলে আমাদের সকল সত্তার প্রতি সমান সহানুভূতি বোধ করা উচিত। শেষ থিসিস প্রথমটির শরণাপন্ন হয়েছে, কারণ ‘মহান জন’ গোটা বাস্তবতাকে ধারণ করেন: স্বর্গ ও মর্ত্য ভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী নয়, বরং একই।২১ সুতরাং, সবকিছুই আমাদের ভালোবাসা ও উদ্বেগের দাবিদার। 

এই আধ্যাত্মিক দর্শন চীনা অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ঝুয়াংঝির (সি. ৩৭০-৩১১) সঙ্গে হুইযির বেমানান বন্ধুত্বের বিষয়টি ব্যাখ্যায় সাহায্য করে।২২ প্রথম দর্শনে মনে হবে ওয়েইর সম্মানিত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইয়াংযিবাদী ও তপস্বী ঝুয়াংঝির তেমন মিল নেই। সারা জীবন বহিরাগত রয়ে গিয়েছিলেন তিনি। একবার জীর্ণ, তাপ্পি মারা জোব্বা গায়ে সুতোয় বাঁধা জুতো পায়ে ওয়েইর রাজার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি, এবং কয়েক বছর বস্তিতে থেকে স্যান্ডেল সেলাই করে জীবীকা নির্বাহ করেছেন। কিন্তু ঝুয়াংঝির উচ্ছ্বসিত, আদি ও মেধাবী মন ছিল, কখনওই ধনী ও ক্ষমতাবানদের সামনে নিজেকে দিশাহারা মনে করেননি। হুইযির সঙ্গে তর্ক করতে ভালোবাসতেন তিনি, তাঁর মৃত্যুর পর এখন আর কথা বলার মতো কোনও সঙ্গী নেই বলে অভিযোগ করেছিলেন, কিন্তু শেষ অবধি সেই দ্বান্দ্বিকতা হুইযির কাছে বড্ড বেশি সংকীর্ণ মনে হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, হুইযি মোহিস্ট ছিলেন, কিন্তু কনফুসিয়বাদীরাও কি ঠিক হতে পারে না? হুইযির কথামতো সবকিছুই আপেক্ষিক হয়ে থাকলে তবে কেন কেবল একটি দর্শনই সঠিক হবে? তাঁর চোখে দার্শনিকদের ঠোকাঠুকি আর পয়েন্ট লাভ স্রেফ অহমবাদ ছিল: পথ ছিল ন্যায়- অন্যায়, ভালো-খারাপের মানবীয় ধারণার অতীত। 

ঝুয়াংঝির নামে চালু গ্রন্থ আসলে চতুর্থ ও তৃতীয় শতকের শেষের দিকে গড়ে তোলা কতগুলো টেক্সটের সংকলন। প্রথাগতভাবে কেবল প্রথম সাতটি অধ্যায়ই ঝুয়াংঝির নিজস্ব শিক্ষা ধারণ করে বলে বিশ্বাস করা হয়, কিন্তু আধুনিক বিশ্লেষণ এইসব ‘অন্তস্থঃ অধ্যায়’ পরবর্তী কালের উপাদান অন্তর্ভুক্ত করার কথা আবিষ্কার করেছে, এবং অন্যান্য অংশের কিছু কিছু বিষয় ঐতিহাসিক ঝুয়াংঝির ধরনের কাছাকাছি। ব্যক্তিগত জীবনের সাফাই হিসাবে শুরু হয়েছে বইটি। নিশ্চিত আত্ম-গুরুত্বে ফেটে পড়া এবং সগর্বে বিশ্বকে রক্ষার তাদের একটা ব্রত রয়েছে বলে মনে করা মোহিস্ট ও কনফুসিয়বাদীদের প্রতি বিরক্ত ছিলেন ঝুয়াংঝি। রাজনীতি মানুষের প্রকৃতিকে বদলাতে পারে না: রাজা ও রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষের জীবনে হস্তক্ষেপ করলে অনিবার্যভাবে অবস্থার আরও অবনতি ঘটান। ঝুয়াংঝি সরকারহীনতায় বিশ্বাস করতেন। সাধারণ মানুষকে মানবসৃষ্ট আইন মানতে বাধ্য করা অস্বাভাবিক ও বিকৃতি; এটা অনেকটা বকের পা ছেঁটে ছোট করে দেওয়া, ঘোড়ার ঘাড়ে দড়ি পরানো কিংবা ষাঁড়ের নাকে দড়ি ঢোকানোর মতো।২৩ 

শাস্তি ও নিরাপত্তার খোঁজে প্রথম প্রকাশ্য জীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার সময় ইয়াংবাদী ছিলেন ঝুয়াংঝি। কিন্তু একদিন উপলব্ধি করেছিলেন যে কোনও প্রাণের পক্ষে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবন কাটানো অসম্ভব। গোটা কয় পাখী চুরি করবেন বলে শিকারের আস্তানায় অনুপ্রবেশ করার পর একটা বিরাট দোয়েল পাখি দেখার পর পাখিটা টের পেয়ে উড়ে যাবে ভেবে সাবধানে লক্ষ্য স্থির করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারে নির্বিকার একটা দারুণ ছায়াময় জায়গায় আরামে নিমগ্ন একটা সুস্বাদূ ঝিঁঝি পোকার দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ থাকায় দোয়েলটা এমনকি ঝুয়াংঝির উপস্থিতি টেরই পায়নি। একটা শিকারী কীট ঝিঁঝির উপর হামলে পড়তে তৈরি ছিল, ধাওয়ার দিকে এতই নিমগ্ন ছিল যে, চরম উত্তেজনায় সেটাও নিজের শিকারের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সেগুলোকে তুলে নেওয়া দোয়েলকে উপেক্ষা করেছে-তখনও ঝুয়াংঝি ও তাঁর তীর-ধনুকের প্রতি নির্লিপ্ত ছিল সেটা। ‘আচ্ছা, তাহলে এভাবেই একটা জিনিস আরেকটার উপর বিপর্যয় ডেকে এনে শেষে নিজেই আক্রান্ত হয়।’ এই প্রাণীগুলোর প্রত্যেকেই অন্যকে শিকার করার জন্যে নির্ধারিত ছিল বলে কোনওটাই নিজের উপর এগিয়ে আসা বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিল না। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, তারা সবাই এক পরস্পরিক ধ্বংসের ধারায় সংশ্লিষ্ট ছিল। কেউই সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে পারে না-এমনকি তপস্বীও না: ঝুয়াংঝি স্বয়ং দোয়েলের দিকে নিশানা স্থির করতে এতই মগ্ন ছিলেন যে তিনিও অকুস্থলে পশুপাখির পাহারাদারের আগমন টের পাননি, রাগের সঙ্গে উদ্যান থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছে সে। ঘটানাটি ঝুয়াংঝির মনে দারুণ রেখাপাত করেছিল। তিন মাস বিষণ্নতায় ডুবেছিলেন তিনি। এখন বুঝতে পারছিলেন বিভ্রমের উপর ভিত্তি করে ইয়াংবাদী বিশ্বাস প্রণীত: ইয়াংযি যেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন সেভাবে নিজেকে রক্ষা করা অসম্ভব। আমরা ধ্বংস করা ও ধ্বংস হওয়ার, খাওয়া ও খাবারে পরিণত হওয়ার শর্তাধীন। নিয়তিকে আমরা ফাঁকি দিতে পারব না। আমরা অন্তহীন ধ্বংস আর বিলুপ্তির প্রক্রিয়ায় সমন্বিত না হতে পারা পর্যন্ত আমাদের কোনও শান্তি নেই। 

উদ্যানের ওই ঘটনার পর ঝুয়াংঝি ভিন্নভাবে জগৎ দেখছেন বলে আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি বুঝতে শুরু করেছিলেন যে সবকিছুই পরিবর্তনশীল এবং ভিন্ন কিছুতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে-কিন্তু তারপরেও আমরা আমাদের চিন্তা ও অভিজ্ঞতাকে রুদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করে চলছি এবং তাদের পরমে পরিণত করছি। স্বর্গীয় পথ এভাবে কাজ করে না। কোনও কিছু জীবনের অন্তহীন পরিবর্তন থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে স্বায়ত্তশাসিত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রয়াস পেলে তার মানে হবে মহাবিশ্বের স্বাভাবিক ছন্দের বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করা। কথাটা পুরোপুরি বোঝার পর ঝুয়াংঝির মনে উৎফুল্লকারী মুক্তির বোধ জেগে উঠেছিল। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে, জীবনকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত টিকিয়ে রাখার ইচ্ছা নিষ্ফল বলে মৃত্যুকে আর ভয় পাচ্ছেন না। জীবন ও মৃত্যু, আনন্দ ও বেদনা দিন আর রাতের মতো একে অন্যকে অনুসরণ করে। তিনি মারা যাওয়ার পর যখন আর ‘ঝুয়াংঝি’ থাকবেন না, তখন কোনও কিছুই বদলাবে না। আবিশ্যিকভাবে যা ছিলেন ঠিক তাই রয়ে যাবেন তিনি: মহাবিশ্বের জাঁকাল প্রদর্শনীর ক্ষুদ্র একটা অংশমাত্র। 

অনেক সময় বন্ধু ও শিষ্যদের একথা বোঝাতে ধাক্কা দেওয়ার কৌশল প্রয়োগ করতেন ঝুয়াংঝি। ঝুয়াংঝির স্ত্রীর মৃত্যুর পর সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন হুইযি, কিন্তু তাঁকে পায়ের উপর পা তুলে বসে বেসুরো কণ্ঠে গান গেয়ে একটা পুরোনো থ্যাবড়ানো টব দোলাতে দেখে অবাক হয়ে গেছেন-শোকের কালের মর্যদাপূর্ণ আচারের লঙ্ঘন করছেন তিনি। ‘তোমার স্ত্রী ছিলেন তিনি! তোমার সন্তানদের ধারণ করেছেন!’ প্রতিবাদ করেছেন হুইযি। ‘আর কিছু না হোক ওর জন্যে একটু চোখের পানি তো ফেলতে পার!’ হেসেছেন ঝুয়াংঝি। প্রথম বার মৃত্যুর পর অন্য সবার মতোই স্ত্রীর জন্যে কেঁদেছেন তিনি। কিন্তু তারপর তাঁর জন্মের আগের মুহূর্তে চলে গেছেন, যখন অন্তহীনভাবে চলমান মহাবিশ্বের কাঁচামাল কি-র অংশ ছিলেন। একদিন এক চমৎকার পরিবর্তন ঘটেছিল : কি নতুনভাবে মিশে গিয়েছিল, এবং সহসা জন্ম হয়েছিল তাঁর প্রিয় স্ত্রীর! এখন তিনি মারা গেছেন এবং স্রেফ ভিন্ন এক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছেন। ‘তিনি একদিক থেকে একে অন্যকে অনুসরণ করা চার ঋতু বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ আর শীতের মতো,’ বলেছেন ঝুয়াংঝি। এখন তিনি সবচেয়ে মহান অট্টালিকা দাও এর মাঝে শান্তিতে শুয়ে আছেন। তিনি কাঁদলে, অভিযোগ করলে সেটা বস্তুর প্রকৃত ধারার বিরোধিতা করা হবে। 

ঝুয়াংঝি ও তাঁর বন্ধুরা এবং অ্যাক্সিয়াল যুগের আরও অনেক সাধুকে হতাশায় পরিপূর্ণ করে রাখা পরিবর্তন, মৃত্যু ও বিলুপ্তির প্রতি এক ধরনের আমোদিত, নির্লিপ্ত আনন্দ প্রকাশ করতেন। একদিন ঝুয়াংঝির অন্যতম শিষ্য গুরু লি এক মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলেন। বিতৃষ্ণার সঙ্গে তিনি লক্ষ করেন তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা বিছানার পাশে বসে কাঁদছেন। ‘বেরিয়ে যাও! ভাগো!” চিৎকার করে উঠলেন তিনি। ‘পরিবর্তনের পথে বাধা দিয়ো না!’ তারপর অসুস্থ বন্ধুর শোয়ার ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে খেয়ালি কণ্ঠে মন্তব্য করেছেন: ‘বিস্ময়কর ব্যাপার- সবকিছুর স্রষ্টা! এরপর তোমাকে কি বানাবেন তিনি? তোমার কাছে কি পাঠাবেন? তোমাকে ইঁদুরের কলজে বানাবেন তিনি? ছারপোকার পা?’ ‘আমাদের বাবা-মা আমাদেরই অংশ,’ জবাব দিলেন বন্ধুটি। 

পূর্ব ও পশ্চিম, উত্তর আর দক্ষিণ-যেখানেই যাই, আমরা তাদের ইচ্ছা অনুসরণ করি। আর আমরা আরও সম্পূর্ণভাবে ইন ও ইয়াংকে মানি। তাঁরা আমাকে এভাবে মৃত্যুর উপান্তে এনেছেন, তাদের ইচ্ছা প্রতিহত করার মানে হবে তেমনি অবাধ্যতা। 

আমরা আমাদের জীবনকে বলি আশীর্বাদ, তো আমাদের মৃত্যুও আশীর্বাদ হতে বাধ্য। ধরা যাক এক শক্তিমান কামার এক টুকরো ধাতু গলাল, তখন সেটা লাফিয়ে বলে উঠল, ‘না, না-আমাকে অবশ্যই কিংবদন্তীর সেই মায়েহ তলোয়ার হতে হবে!’ কামার তখন একে অলুক্ষণে ধাতু মনে করবে না? আর ধরা যাক, মানুষের চোহারা পাওয়ায় আমি জোর করলাম, ‘মানুষ, মানুষই, মানুষ ছাড়া আর কিছু না!’ তখন কি পরিবর্তনের কারিগর আমাকে অশুভ ব্যক্তি মনে করবেন না? আমি স্বর্গ ও মর্ত্যকে পরিবর্তনের নির্মাতার এক বিশাল ফাউন্ড্রি আর নির্মাতাকে মনে করি মহান কামার-তো আমাকে তারা যেখানেই পাঠান, কিভাবে তাতে আপত্তি তুলতে পারব? আমি শান্তিতে ঘুমাব—তারপর সহসা জেগে উঠব। ২৬ 

নিজেদের যেকোনও মূল্যে সংরক্ষণ করার মতো অনন্য ও মূল্যবান ব্যক্তি ভাবা বাদ দেওয়ার পর থেকে ঝুয়াংঝি ও তাঁর বন্ধুরা তাঁদের বিপদকে আমোদিত আগ্রহ ও নিস্পৃহতার সঙ্গে জরিপ রতে পেরেছেন, থাকতে পেরেছেন শান্ত, সন্তুষ্ট।২৭ নিজেকে সম্পূর্ণ স্বর্গীয় পথের সঙ্গে সমন্বিত করতে পারলে বাস্তবতার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠায় শান্তিতে থাকতে পারবেন আপনি। 

পথ-টা আসলে কি ছিল? সময়ে সময়ে ঝুয়াংঝি জোর দিয়ে বলেছেন যে, পথ অচিন্তনীয়, ব্যাখ্যার অতীত এবং একে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব। এর কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, আকার নেই; একে উপলব্ধি করা যেতে পারে, কিন্তু কখনও দেখা যায়নি। এটা দেবতা নয়; স্বর্গ ও মর্ত্যের আগেও এর অস্তিত্ব ছিল, ঐশ্বরিকতার অতীত; প্রাচীন থেকেও প্রাচীনতর-কিন্তু তারপরেও প্রবীণ নয়। এটা একাধারে সত্তা ও অসত্তা।২৮ এটা প্রকৃতি যেমন আছে সেরকম করে তোলা সকল অগণন নকশা, রূপ আর সম্ভাবনা তুলে ধরে।২৯ ‘পথ’ রহস্যময়ভাবে কি-র পরিবর্তনশীল পরিবর্তনগুলোকে সাজিয়েছে, কিন্তু এমন এক জায়গায় অবস্থান করেছে যেখানে আমাদের স্বাভাবিক চিন্তার ধারাকে চিহ্নিকারী পার্থক্যগুলো ঘুঁচে যায়। এইসব অনির্বচনীয় বিষয়ে অভ্রান্ত হওয়ার যেকোনও প্রয়াসই স্রেফ অশোভন, অহমবাদী কূটতর্কের দিকে ঠেলে দেবে। আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা কিছুই জানি না। আমরা কোনও একটি তত্ত্ব বেছে নিয়ে অন্যগুলোকে প্রত্যাখ্যান করলে, জীবনের সৃজনশীল প্রবাহকে জোর করে আমাদের নিজেদের সৃষ্টিতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে বাস্তবতাকে বিকৃত করব। আমাদের সন্দেহ ও এক ধরনের আলোকিত অজ্ঞতার বোধে নিক্ষেপ করা একটি জিজ্ঞাসাই একমাত্র ও বৈধ নিশ্চয়তা। দ্বিধা আমাদের পথের দিকে চালিত করতে পারে বলে নিশ্চয়তা বলে কিছু নেই জানতে পেরে আমাদের হতাশ হওয়া অনুচিত হবে না। 

অহমবাদই আলোকনের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা। এটা আমাদের কোনও একটি মতের বদলে ভিন্ন একটি মতের সঙ্গে একাত্ম হতে বাধ্য করা সত্তার স্ফীত বোধ; আমরা নিজেদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অন্য ব্যক্তিদের পাল্টে নিতে চাই বলে অহম আমাদের বদরাগী ও কর্তৃত্বপরায়ণ করে তোলে। ঝুয়াংঝি প্রায়শঃই নিজের কিছু ধারণা তুলে ধরার জন্যে পরিহাসছলে কনফুসিয়াসের চিত্র তুলে ধরতেন। একদিন, বলেছেন তিনি, ইয়ান হুই কনফুসিয়াসকে বললেন, সহিংস, বেপারোয়া ও দায়িত্বজ্ঞানহীন তরুণ ওয়েই-র রাজাকে সংস্কার করতে যাচ্ছেন তিনি। দারুণ, বিরস কণ্ঠে বললেন কনফুসিয়াস, কিন্তু ইয়ান হু‍ই নিজেকে ঠিকমতো বুঝতে পারেননি। কেমন করে তিনি অন্য কাউকে বদলাতে পারেন? তিনি কেবল হুকুম জারি করে কয়েকটা কনফুসিয় নিয়ম ব্যাখ্যা করতে পারেন মাত্র। এইসব বাহ্যিক নির্দেশনা কিভাবে রাজার নিষ্ঠুরতার উৎস অস্পষ্ট অবচেতন ঝোঁককে প্রভাবিত করবে? একমাত্র যেকাজটি ইয়ান হুই করতে পারতেন সেটা হলো, নিজের মনকে শূন্য করে ফেলা; সকল আত্মগুরুত্বের ব্যস্ততা ঝেড়ে ফেলে অন্তস্থঃ অস্তিত্ব আবিষ্কার করা। 

‘তোমার মনোযোগকে একাত্ম করো,’ শুরু করেছেন কনফুসিয়াস। ‘কান দিয়ে শোনা বন্ধ করে মন দিয়ে শোনো। তারপর মন দিয়ে শোনা বাদ দিয়ে তোমার আদিম আত্মা [ কি] দিয়ে শোনো। শ্রবণ কানে সীমাবদ্ধ। মন বিভিন্ন বিষয়কে মেলানোর কাজে সীমিত। কিন্তু আদিম আত্মা শূন্য: এটা কেবল বস্তুর অপেক্ষায় থাকে। তাও হচ্ছে মিশে যাওয়া শূন্যতা ও শূন্যতা হচ্ছে মনের উপবাস।৩০ 

অহমকে খাবার যোগানোর প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগানোর বদলে একে আমাদের উপোস রাখতে হবে। এমনকি আমাদের সেরা শুভেচ্ছাও স্বার্থপরতার যাঁতাকলে পড়ে গুঁড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু কি-র কোনও এজেন্ডা নেই; এটা স্রেফ পথ-এর দরুণ নিজেকে বদলে যেতে দেয়, পরিবর্তিত হতে দেয়, ফলে সবকিছু শুভ পরিণতির দিকে যায়। ইয়ান হুই কি-কে বাধা দেওয়া বন্ধ করলে, একে স্বাভাবিক পথ থেকে বিচ্যুত না করলে, পথ তাঁর ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে। কেবল তখনই তিনি বিশ্বে শুভের শক্তিতে পরিণত হতে পারবেন। আলাপচারিতার শেষ পর্যায়ে অবশ্য ইয়ান হুই যেন এই প্রকল্পে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। 

লোকে মতবাদ ও তত্ত্ব নিয়ে কুটতর্কে বিরতি দিলে ঝুয়াংঝি যাকে মহাজ্ঞান বলছেন সেটা আয়ত্ত করতে পারবে। এটা দিয়ে ওটা বোঝানো যায় না, তাই তর্ক না করে আপাত বিরোধিতা এক রহস্যময়, ঐশ্বরিক ঐক্য সৃষ্টি করছে বলে আবিষ্কার করবে তারা। কোইন্সিদেন্সিয়া অপোসিতোরিয়াম চাকার কেন্দ্রে, পথ- এর অক্ষে, ‘বৃত্তের কেন্দ্রে মূল স্থানে নিয়ে এসেছে তাদের, কারণ এটা যা আছে আর যা নেই তার সঙ্গে সমানভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। ৩১ অনালোকিত পর্যায় কুয়োয় বাস করা ব্যাঙের দৃষ্টির মতো, কেবল এক চিলতে আকাশ দেখে সেটাকেই গোটা বিশ্ব ভেবে ভুল করে সে। গোটা বাস্তবতা দেখার পর চিরকালের জন্যে তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়।৩২ মহাজ্ঞান হয়তো কখনওই সংজ্ঞায়িত করা যাবে না; ঝুয়াংঝি কেবল এর প্রভাব বর্ণনা করতে পারেন। সাধুকে তা আবির্ভূত প্রতিটি পরিস্থিতির প্রতি সংবেদী ও বুদ্ধিদীপ্ত প্ৰতিক্ৰিয়া দেখাতে সক্ষম করে তোলে। সময়ের আগেই নিজের প্রতিক্রিয়া কি হবে তার পরিকল্পনা করে রাখেননি তিনি, বিকল্প কর্মপরিকল্পনাগুলোকে বৈরী করে তোলেননি বা কতগুলো নির্দিষ্ট বিধান আঁকড়ে বসে থাকেননি। একবার পথ-কে বাধা দেওয়া বন্ধ করার পর একজন মেধাবী চিত্রশিল্পীর ঝোঁকের সঙ্গে মিল আছে, এমন স্বতঃস্ফুর্ততা অর্জন করবেন তিনি 

কনফুসিয়াস সম্পর্কে আরেকটি গল্প বলেছিলেন ঝুয়াংঝি। শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচিছলেন তিনি; পথে এক কুঁজোর সঙ্গে তাঁর দেখা; একটা আঁঠাল কাঠি দিয়ে ঝিঁঝি পোকা ধরছিল সে। কনফুসিয়াস অবাক হয়ে দেখলেন তার হাতে থেকে একটা পোকাও রেহাই পাচ্ছে না! কিভাবে এটা পারছে সে? মনোযোগের শক্তিকে এমন পরিষ্কারভাবে নিখুঁত করেছে সে, নিজের কাজে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে, তাকে পথ-এর সঙ্গে নিখুঁত ছন্দ এনে দেওয়া এক ধরনের একতাসিস, এক ধরনের আত্মবিস্মৃতি অর্জন করেছে। ‘তোমার কি পথ জানা আছে?’ তাকে জিজ্ঞেস করলেন কনফুষিয়াস। ‘আলবৎ আছে!’ জবাব দিল কুঁজো। কাজটা কিভাবে করছে কোনও ধারণা ছিল না তার! কিন্তু মাসের পর মাস চর্চা করে নিজেকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছে যখন ঝিঁঝি পোকা ধরার কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারছে: ‘কখনও ক্লান্ত হইনি, আরাম করিনি, কেবল ঝিঁঝি পোকা বাদে জীবিত প্রাণীর বিপুল সংখ্যা সম্পর্কে কখনও সচেতন ছিলাম না। এই কায়দা অনুসরণ করলে ব্যর্থ হব কিভাবে?’ নিজের সচেতন সত্তাকে পেছনে ফেলে কি-কে কর্তৃত্ব তুলে নিতে দিয়েছে সে, শিষ্যদের কাছে ব্যাখ্যা করেছেন কনফুসিয়াস: ‘নিজের ইচ্ছা অখণ্ড, চেতনাকে সজীব রেখেছে সে,’ ফলে তার হাতজোড়া নিজের ইচ্ছাতেই নড়ছে বলে মনে হয়েছে। সচেতন পরিকল্পনা বিচ্যুতকারী ও উল্টোফলদায়ী হতো। কুঁজোকে দেখে ছুঁতোর মিস্ত্রী বিয়ানের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল ঝুয়াংঝির। সে ব্যাখ্যা দিয়েছিল যে, “আমি চাকার কাজ করার সময় সেটাকে এখনকার মতো কোমলভাবে মৃদু টোকা দিলে চাকা ভালো হয় না। ভীষণ জোরে আঘাত করলে, ক্লান্ত হয়ে পড়ি, কাজ হয় না! সুতরাং বেশি আস্তেও না, আবার বেশি জোরেও না, ওটাকে হাতে মুঠি করে ধরে মন দিয়ে আঁকড়ে ধরি। মুখের কথায় একে বোঝাতে পারব না। ছেলেকে এটা শেখাতে পারব না। আমার ছেলেও আমার কাছ থেকে শিখতে পারবে না।’ একইভাবে, বিশ্লেষণ করতে শেখেনি, পার্থক্য করে না এবং বিকল্প বিচার না করা একজন সন্ন্যাসী ‘অহম নীতিকে’ পেছনে ফেলে এসেছেন, স্বাভাবজাত কাজই করেছেন এবং মহাবিশ্বের গভীরতম ও সবচেয়ে স্বর্গীয় ছন্দের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। 

কেমন অনুভূতি জাগিয়েছে সেটা? শিষ্যদের ধ্যানী যিকির কথা বলেছেন ঝুয়াংঝি, যাঁর বন্ধুরা একদিন তার কাছে এসে তাঁকে ‘আকাশের দিকে তাকিয়ে, অগভীর শ্বাস ফেলে, ফাঁকা চেহারায়,’ তাকিয়ে থাকতে দেখলেন ‘যেন নিজের মাঝেই হারিয়ে গেছেন।’ আগে কখনও এমন ঘটেনি। সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ মনে হচ্ছিল যিকিকে। কি হয়েছে? ‘তোমরা কি এসব বুঝতে পারো?’ জিজ্ঞেস করলেন যিকি। ‘ঠিক তখন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।’ কোনও চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্মে হারিয়ে যাওয়ার মতোই ‘হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আমরা নিজেদের সত্তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করার সময় ‘পথ’-এর ‘মহা-পরিবর্তন’ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। নিজেকে হারিয়ে ফেলার কারণেই স্বার্থপরতার বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন যিকি। এখন আগের চেয়ে ঢের স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। ‘সম্ভবত তোমরা মানুষের গান শুনতে পেয়েছ,’ বন্ধুদের বলেছেন তিনি, ‘কিন্তু পৃথিবীর গান শোননি। কিংবা তোমরা পৃথিবীর গান শুনে থাকলে স্বর্গের গান শুনতে পাওনি।’ আপনি যখন বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ লাভ করেন, তখন সবকিছুকে একসঙ্গে গান গেয়ে উঠতে শোনেন কিন্তু তারপরেও প্রতিটি জিনিসকে আলাদা করতে পারেন। এটাই মহাজ্ঞান; এটা ‘প্রসারিত ও শিথিল’, অন্যদিকে ‘ক্ষুদ্র উপলব্ধি দোমড়ানো ও ব্যস্ত। 

অতীতের সকল ভাবনার অভ্যাস ছাড়তে না পারলে এই আলোকন লাভ করতে পারবেন না। প্রকৃত সন্ন্যাসী জ্ঞানকে পুঞ্জীভূত করেনি বরং নিজেকে বিস্মৃত হয়ে মহানন্দে পথ-এর সঙ্গে মিশে না যাওয়া পর্যন্ত একের পর এক অন্য জিনিস ভুলে যেতে শিখেছে। কনফুসিয়াস ও ইয়ান হুইকে নিয়ে আরেকটি গল্প বলেছিলেন ঝুয়াংঝি। 

‘আমি জিতে যাচ্ছি!’ একদিন দাবি করলেন ইয়ান হুই। 

‘কি বলতে চাও?’ জিজ্ঞেস করলেন কনফুসিয়াস। 

‘আমি মানবতা [রেন] আর দায়িত্ব [ইই] পুরোপুরি ভুলে গেছি,’ জবাব দিলেন হুই। 

‘খারাপ না!’ স্বীকার গেলেন কনফুসিয়াস। “কিন্তু এটাই শেষ নয়।’ 

কয়েক দিন পরে চিৎকার করে উঠলেন ইয়ান হুই, ‘আমি আচার আর সঙ্গীত পুরোপুরি ভুলে গেছি।’ 

‘এটাও যথেষ্ট নয়,’ বললেন কনফুসিয়াস। 

কিন্তু সবশেষে গুরুকে অবাক করে দিলেন ইয়ান হুই। ‘আমি আগে বাড়ছি!’ উজ্জ্বল চেহারায় বললেন তিনি। ‘চুপচাপ বসে থেকে ভুলে গেছি।’ 

অস্বস্তির সঙ্গে নড়ে চড়ে বসলেন কনফুসিয়াস। ‘কি বোঝাতে চাইছ?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি। 

‘শরীরটাকে লুটিয়ে যেতে দিয়েছি, আর বুদ্ধি হারিয়ে গেছে,’ বললেন ইয়ান হুই। ‘আমি আকার ছুঁড়ে দিয়েছি, উপলব্ধি ত্যাগ করেছি-এবং তারপর মহা পরিবর্তনে মিশে গিয়ে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি। নীরবে বসে ভুলে গেছি বলে এটাই বুঝিয়েছি আমি।’ 

ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন কনফুসিয়াস। শিষ্য তাঁকে ছাড়িয়ে গেছেন। 

‘এভাবে মিশে গিয়ে থাকলে তুমি পছন্দ-অপছন্দ থেকে মুক্ত,’ বলেছেন তিনি, তুমিই পরিবর্তন, তুমি স্থায়িত্ব থেকে মুক্ত। সুতরাং শেষে এখানে তুমিই আসল সন্ন্যাসী! এখন থেকে তোমাকে অনুসরণ করলে কিছু মনে করবে না তো? ৩৫

কোনও কিছু ‘জানা’ মানে একে অন্য সবকিছু থেকে আলাদা করা। এইসব পার্থক্য ভুলে যাওয়ার মানে বৈষম্যহীন ঐক্য সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠা ও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি সত্তা হিসাবে সকল বোধ হারানো। 

ঝুয়াংঝির আলোকন বুদ্ধের আলোকন থেকে ভিন্ন ছিল; একবারেই চিরকালের জন্যে তা হয়েছিল বলে মনে হয় না। তিনি চিরস্থায়ী ঘোরের ভেতর হেঁটে বেড়াতে পারতেন না; কখনও স্বাভাবিক জীবনে কাজ করার জন্যে বিভিন্ন জিনিসের বিশ্লেষণ করে সেগুলোর ভেতর পার্থক্য করতে হয়েছে তাঁকে। অনেক সময় ‘স্বর্গের সাথে’ থাকতেন তিনি, এবং অন্য সময় ‘মানবজাতির সাথে’। কিন্তু জীবনের একেবারে কেন্দ্রে সকল বস্তু যে ‘শেকড়’ বা ‘বীজ’ থেকে উদ্ভুত হয়েছে, যে কক্ষের চারপাশে সেগুলো আবর্তিত হয় সেই পথ-এর সঙ্গে একাত্ম বোধ করতেন তিনি। 

‘ভালোবাসা’ বা ‘উদ্বেগ’ সংক্রান্ত মোহিস্ট আদর্শে ঝুয়াংঝি পুরোপরি সন্তুষ্ট ছিলেন না, কারণ এক্ষেত্রে এই মাত্রার মনোযোগ পাওয়ার পক্ষে মানুষকে একেবারেই ক্ষণস্থায়ী নির্দিষ্ট বস্তুর উপর মনোযোগ মনোযোগ স্থির করার দরকার ছিল। একজন সন্ন্যাসী অবিশ্যিকভাবেই স্বার্থহীন বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। ‘সম্পূর্ণ পুরুষের কোনও সত্তা নেই,” ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। অন্য লোকদের ‘আমি’ মনে করতেন। ‘লোকে কাঁদে, তাই সে কাঁদে-সবকিছুকে নিজের সত্তা মনে করে,’ কেননা বিচ্ছিন্ন ও নির্দিষ্ট হিসাবে নিজের সকল বোধ হারিয়ে ফেলেছে সে। স্রেফ অহমের বিকৃতকারী লেন্স বিহীন আয়নার মতো অন্য সত্তাদের অখণ্ড রূপে প্রতিবিম্বিত করে তাঁর হৃদয় ‘শূন্য’ হয়ে গেছে। একজন প্রকৃতর রেন সংক্রান্ত নিয়মের দরকার ছিল না। নিজেকে অন্যের জন্যে দারুণভাবে ভাবিত মনে না করেই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অন্যের মঙ্গল কামনা করেন তিনি ৪১ মহাজ্ঞান অর্জিত হয়ে যাওয়ার পর অ-আত্মসচেতন ঔদার্যের দক্ষতা লাভ করেন। 

ঝুয়াংঝি সম্ভবত তাঁর সমসাময়িক পাশ্চাত্যে মেনসিয়াস নামে পরিচিত অহমবাদী ব্যস্ত মানুষ মেং কে-কে (৩৭১-২৮৮) মনে রেখেছিলেন, কারণ জনজীবনে ভূমিকা রাখার জন্যে দারুণ ব্যতিব্যস্ত ছিলেন তিনি। নিবেদিতপ্রাণ কনফুসিয়বাদী মেনসিয়াস জিক্সিয়া একাডেমির পণ্ডিতে পরিণত হয়েছিলন, কিন্তু সরকারে দায়িত্ব পালন করাই ছিল তাঁর আসল লক্ষ্য। তবে কনফুসিয়াসের মতো সফল হতে পারেননি তিনি। কি-র রাজা যুয়ান বা লিয়াংয়ের রাজা হুইয়ের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এদের দুজনই তাঁর ধ্যান-ধারণাকে হাস্যকর অবাস্তব মনে করেছিলেন। কিন্তু সহজে হাল ছাড়েননি মেনসিয়াস। অনেক বছর এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়ে রাজকুমারদের আবার পথ-এ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। ঝুয়াংঝির মতো পৃথিবীর দিকে পিঠ ফেরাতে পারেননি, বরং স্বর্গ কর্তৃক একে রক্ষা করার দায়িত্ব লাভ করেছেন বলে বিশ্বাস করতেন। 

ইতিহাসে নকশা লক্ষ করেছিলেন মেনসিয়াস। প্রতি এক শো বছর বা এমনি বিরতিতে একজন সান্ন্যাসী রাজার আবির্ভাব ঘটে এবং মাঝের সময়টুকুতে লোকে সাধারণ ‘খ্যতিসম্পন্ন মানুষে’র হাতে শাসিত হয়। আদি ঝোউ রাজাদের শাসনের পর সাত শো বছর পেরিয়ে যাওয়ায় নতুন সাধু রাজার আবির্ভাবের সময় দুঃখজনকভাবে পেরিয়ে গেছে। চীন বদলে গেছে—তাঁর চোখে খারাপের দিকে—বলে তীব্রভাবে সজাগ ছিলেন মেনসিয়াস। স্বৈরাচারী সরকারের অধীনেও জনগণ এতবেশি দুর্ভোগ পোহায়নি,’ বিলাপ করেছেন তিনি। ‘এমন হতে পারে যে স্বর্গ হয়তো আর পৃথিবীতে শান্তি আনতে চান না।’ কিন্তু স্বৰ্গ বিশ্বকে বাঁচাতে চেয়ে থাকলে তিনি ছাড়া আর কেই বা এই কাজ করতে পারেন? ৪৩ একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে তিনি সাধু রাজা হতে পারেন না, তবে স্বর্গ তাঁকে রাজকুমারদের কাছে স্বর্গীয় বার্তাবাহক হিসাবে মনোনীত করেছেন বলে বিশ্বাস করতেন। সাধারণ মানুষ ভালো নেতৃত্বের জন্যে কাঁদছিল। তাদের সঙ্গে উদারতা ও ন্যায়বিচারের ভেতর দিয়ে আচরণকারী যেকোনও শাসকের পেছনেই ভিড় করবে তারা। 

রাজকুমাররা কখনওই তাঁকে গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন না, এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর হাল ছেড়ে দিয়ে তিনি যেসব শাসকের সেবা করার চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের বর্ণনা তুলে ধরে একটি বই লিখেন মেনসিয়াস। শক্তি দিয়ে শাসন করা অসম্ভব বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। উপায়ন্তর থাকে না বলেই জনগণ অত্যাচরী সরকারের কাছে মাথা নত করে, কিন্তু একজন শান্তিপ্রেমী রাজা ক্ষমতায় এলে ভালোত্বে এক ধরনের ‘পরিবর্তনকারী শক্তি৪৪ রয়েছে বলে ‘হৃদয়ের শ্রদ্ধা নিয়ে’ তার পেছনে ভীড় জমাবে তারা। সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করার বদলে, রাজা হুইকে বলেছিলেন তিনি, “তাঁর উচিত শাস্তি ও করের পরিমাণ কমানো এবং মানুষকে গভীরভাবে লাঙ্গল চালাতে ও দ্রুত আগাছা উপড়ে ফেলতে অনুপ্রাণিত করা। অবসর সময়ে শক্ত-সমর্থ তরুণদের অবশ্যই পারিবারিক লি অনুযায়ী চলা শিখতে হবে এবং ভালো ভাই ও ভালো সন্তানে পরিণত হতে হবে। একবার এই নৈতিক ভিত্তি পাওয়ার পর ঘটনার নিয়ন্ত্রক হিসাবে অনুগত প্রজা ও বিপুল শক্তির উৎসে পরিণত হবে তারা। এমনকি তাদের কাছে ঢাল ছাড়া অন্য কিছু না থাকলেও বৃহত্তর রাষ্ট্রের ‘আরও শক্তিশালী বর্ম ও তীক্ষ্ণ অস্ত্রের বিরুদ্ধেও পরাজয় চাপিয়ে দিতে পারবে।’৪৫ কেন? কারণ একজন ন্যায়বিচারক ও সহানুভূতিশীল রাজার সকল মন্ত্রীই তাঁর প্রশাসনে সেরা কাজ করবেন। কৃষকরা তাঁর জমিতে চাষ করতে আগ্রহী হবে; বণিকরা তাঁর নগরীতে ব্যবসা করতে চাইবে। “শাসকের বিরুদ্ধে যাদের ক্ষোভ আছে তারা এসে মহামান্যের কাছে অভিযোগ করবে,’ রাজা হুইকে বলেছেন মেনসিয়াস। ‘সেটা ঘটলে, ঠেকাতে পারবে কে?’৪৬ 

কেবল আচারই সমাজকে বদলে দিতে পারে বলে বিশ্বাস করতেন কনফুসিয়াস, কিন্তু মেনসিয়াস যুদ্ধমান রাজ্যগুলোর কালের অর্থনৈতিক ও কৃষিখাতের বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আচরিক দক্ষতার তারিফ করার বদলে ইয়াও ও শানকে প্রকৌশলী, বাস্তববাদী সক্রিয় মানুষ হিসাবে দেখেছেন তিনি। ইয়াও-এর আমলে চীন এক ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গিয়েছিল, এবং এত লোক থাকতে ইয়াও ‘উদ্বেগে ভারাক্রান্ত ছিলেন।৪৭ জল যাতে সাগরে প্রবাহিত হতে পারে সেজন্যে খাল খনন করেছেন তিনি, এবং লোকে জমি সমান করে একে বাসযোগ্য করে তুলতে পেরেছিল। ইউ-কে পূর্ত মন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন শান; দীর্ঘ আট বছর নদী খনন করেছেন ইউ, তলদেশ গভীর করেছেন, নতুন ডাইক নির্মাণ করেছেন। এই পুরো সময়টায় শহরের বাড়িতে একরাতের জন্যেও ঘুমাননি তিনি। কৃষির জন্যে দেওয়ার মতো সময় ছিল না বলে হাও চি-কে মানুষকে শস্য রোপণের কৌশল শিক্ষা দেওয়ার জন্যে নিয়োগ দিয়েছিলেন শান। কিন্তু লোকের যখন পেট ভরে গেল, নৈতিক মানের অবনতি ঘটল, এবং শানকে দারুণ অশান্তি দিয়েছিল সেটা। সুতরাং মানুষকে মানবীয় সম্পর্কের লি শেখানোর জন্যে ফ্যাঙ যুনকে শিক্ষা মন্ত্রী নিয়োগ করেন তিনি। ৪৮ 

সাধু রাজাদের সাধারণ মানুষের প্রতি অনভূত প্রেমময় উদ্বেগের প্রতি জোর দিয়েছেন মেনসিয়াস। তাঁর হিসাবে ইয়াও শানের ভেতর ভবিষ্যৎ ঋষিত্বের লক্ষণগুলো ছিল, জনগণের জন্যে উদ্বেগ বোধ করেছেন তাঁরা, তাদের ভোগান্তিতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন এবং উৎকণ্ঠা ও যন্ত্রণায় পূর্ণ হয়ে উঠেছেন। একজন সন্ন্যাসী অন্য একজন মানুষের দর্ভোগ সহ্য করতে পারেন না। প্রত্যেকেরই ‘অন্যের বেদনার প্রতি স্পর্শকাতর হৃদয় ছিল…সহানুভূতিশীল সরকারের ভেতরই তার প্রকাশ ঘটেছিল,’ যুক্তি দেখিয়েছেন মেনসিয়াস। সাধু রাজারা প্রজাদের জন্যে কেবল দুঃখ বোধ করেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, বরং উদ্যম আর সৃজনশীলভাবে তাঁদের উদ্বেগকে কার্যকর কর্মতৎপরতায় পরিণত করেছিলেন। তাঁদের ভালো, বাস্তসম্মত সরকার সহানুভূতি (রেন)-আপন স্বার্থ থেকে উর্ধ্বে উঠে দেখার ক্ষমতা, ‘অন্যকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে কারও তৎপরতাকে প্রসারিতকরণ-থেকে উদ্ভুত হয়েছিল। ৪৯ 

যুদ্ধমান রাজ্যগুলোর সময়ের রাজকুমারদের ইয়াও শানের ব্যতিক্ৰমী মেধা না থাকতে পারে, তবে তাঁরা তাঁদের পরার্থপরতার অনুকরণ করতে পারেন, করা জরুরি। স্বর্গীয় রেনকে অস্বীকার করেছিলেন কনফুসিয়াস; মেনসিয়াস স্পষ্ট, সংকীর্ণ অর্থ দিয়েছিলেন একে: জগতের প্রতি পেছন ফেরা অসম্ভব করে তোলা আবিশ্যিক গুণ: হিতাকাঙ্ক্ষা’। মোজি’র ‘সবার জন্যে উদ্বেগের’ ধারণাকে এই সরলীকৃত শুভেচ্ছা সমাজের জন্যে আবিশ্যিক পারিবারিক বাঁধনকে হেয় করবে ভেবে অবিশ্বাস করেছেন তিনি, যদিও কেবল পরিবারের ভেতরই উদ্বেগ সীমিত হতে পারবে না বলে সায় দিয়েছিলেন। রাজা হুয়ানকে নিজের পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের প্রতি সমীহপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে শুরু করার জন্যে বলেছিলেন তিনি। একবার সম্মান দেখানোর এই অভ্যাসে দক্ষতা অর্জন করার পর স্বাভাবিকভাবেই অন্য পরিবারের প্রবীন সদস্যদের প্রতিও তাকে বিস্তৃত করবেন। সবশেষে, তাঁর সকল প্রজাকেই ‘হিতাকাঙ্ক্ষা’র ভেতর দিয়ে শাসন করতে পারবেন, তারা তখন খুশিমনে তাঁর শাসনের কাছে নতি স্বীকার করবে।৫১ 

রেন-এর নিয়মকানুন কৃত্রিম বলে মানতে রাজি হননি মেনসিয়াস, আবেগের সঙ্গে দুর্ভোগের প্রতি সাড়া দেওয়াই মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক, বিশ্বাস করতেন তিনি। রাজা যুয়ানকে তাঁর সম্প্রতি বলী দেওয়ার লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া একটা ষাঁড়ের জীবন বাঁচানোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। নিরীহ পশুটাকে দরবারের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় সেটার করুণ আর্তনাদ শুনে পরিচারকের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠেছিলেন তিনি: ‘ছেড়ে দাও ওটাকে! ওটার ভীত আর্তনাদ করা সহ্য করতে পারছি না, যেন নিষ্পাপ কোনও লোক ফাঁসি কাঠের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।৫২ ভালো প্রবণতা, কিন্তু সেটা ছিল শুরুমাত্র। এরপর রাজার উচিত হবে সহজাত এই সহানুভূতিকে প্রজাদের প্রতি আরোপ করে তাদের সঙ্গে আরও দয়াময় আচরণ করা, এবং সবশেষে অন্য রাজ্যগুলোর প্রতিও সহানুভূতি প্রসারিত করা। মানবীয় প্রকৃতি মূলত ভালো- সেটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রেনমুখী বলে বিশ্বাস করতেন মেনসিয়াস। মোহিস্টদের বিশ্বাস ছিল মানুষ কেবল আত্ম-স্বার্থের চালিত হতে পারে, এবং শুভেচ্ছা জোর করে তাদের ভেতর প্রবেশ করাতে হবে, কিন্তু মেনসিয়াস আমাদের দেহের স্বাভাবিক মানবীয় রূপ ধারণ করার মতোই স্বাভাবিক নৈতিক আচরণ করা আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক বলে যুক্তি দেখিয়েছেন। খারাপ অভ্যাস দিয়ে আমরা দৈহিক ও নৈতিক উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারি, কিন্তু ভালোর প্রতি সহাজাত প্রবণতা থেকেই যায়। 

সবারই চারটি মৌলিক ‘প্রবণতা’ (তুয়ান) রয়েছে; সঠিকভাবে চর্চা করা হলে এগুলো চারটি প্রধান মূল্যবোধে উন্নতি লাভ করবে: হিতাকাঙ্ক্ষা, ন্যায় বিচার, সৌজন্য এবং ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য করার ক্ষমতা। এগুলোর একদিন মহীরুহ হয়ে ওঠার সম্ভাবনাময় অঙ্কুরের মতো। “ এই ‘অঙ্কুরগুলো’ আমাদের হাত-পায়ের মতোই স্বাভাবিক জিনিস। অন্যের প্রতি সহানুভূতিহীন কোনও মানুষ নেই। কেউ একটা শিশুকে দেয়ালের কিনারে হামা দিতে দেখলে যেকোনও মুহূর্তে উল্টে পড়ে যেতে পারে বলে নিমেষে তাকে বাঁচাতে ঝাপিয়ে পড়বে-নিজেকে বাবামায়ের সঙ্গে নিবিড় করে তুলতে, বন্ধুদের তারিফ পেতে বা বাচ্চাটির সঙ্কটে তাড়িত হওয়ার কারণে নয়। সহানুভূতির সহজাত প্রবণতা থেকেই আলোড়িত বোধ করবে সে। বাচ্চাটিকে নির্বিকারভাবে মৃত্যুর মুখে লুটিয়ে পড়তে দেখা কোনও লোকের ভেতর এক ধরনের মৌলিক ভ্রান্তি থাকতে বাধ্য। একইভাবে লাজ-হায়ার বালাই নেই বা ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা রাখে না এমন কেউ মানুষ হিসাবে ত্রুটিপূর্ণ হবে। আপনি এইসব ‘অঙ্কুর’ পিষে ফেলতে পারেন—ঠিক নিজেকে বিকৃত বা পঙ্গু করার মতো-কিন্তু সঠিকভাবে চর্চিত হলে এগুলো নিজস্ব প্রাণবন্ত, গতিশীল শক্তি অর্জন করে। একবার সক্রিয় হয়ে ওঠার পর সেগুলো কেবল যে চর্চা করেছে তাকেই নয়, বরং সে যাদের সংস্পর্শে আসবে তাদেরও বদলে দেবে রাজার ক্ষমতার মতো। সফলভাবে চারটি ‘অঙ্কুরের’ সবকটির পরিচর্যাকারী বিশ্বকে বাঁচাতে পারবে। ৫৪ 

যুদ্ধমান রাজ্যগুলোর ঝামেলাময় সময়ের বাসিন্দা ছিলেন মেনসিয়াস। তিনি জানতেন ভালোত্বের ভ্রূণকে সহজেই বিনাশ করা যেতে পারে। যেদিকে তাকিয়েছেন সেদিকেই লোভ আর স্বার্থপরতার নজীর দেখতে পেয়েছেন, এগুলো কি-র প্রবাহকে বিঘ্নিত করে ভালোত্বের স্বাভাবিক প্রবণতাকে বিকৃত করেছে বলে বিশ্বাস করেছেন। ‘অঙ্কুর’ স্বাভাবিকভাবেই চিন্তাশীল, সংবেদনশীল অঙ্গ ‘হৃদয়ে’র মাঝে বাস করে, কিন্তু অনেকেই স্রেফ তাদের হৃদয়কে পরিত্যাগ করে। সাধারণ মানুষ নিষ্ঠুরতা, ক্ষুধা আর শোষণের কারণে কলুষিত হয়ে গিয়েছিল। উচ্চবিত্ত শ্রেণী বিলাসিতা, ভোগবিলাস, ক্ষমতা আর খ্যাতির জন্যে এতটাই লালায়িত ছিল যে, ‘অঙ্কুর’-কে অবহেলা করে শুকিয়ে মরে যেতে দিয়েছে। কেবল পরিপক্ক মানুষ জুনযিই তার হৃদয়কে সজীব রেখেছে। বেশির ভাগ মানুষের হৃদয়ই এককালে যা রসাল পাতাময় বনে ঢাকা কিন্তু বেপারোয়া, নিষ্ঠুর বনবিনাশের ভেতর দিয়ে নগ্ন করে ফেলা অক্স মাউন্টেনের মতো ছিল। একসময় অক্স মাউন্টেনে কোনও গাছপালা ছিল, একথা যেমন বিশ্বাস করা কঠিন, ঠিক যেভাবে কোনও পাশব, স্বার্থপর লোকের কখনও ভালো গুণ থাকতে পারার কথা কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু সম্ভাবনা রয়ে গেছে। সঠিক পুষ্টি যোগালে, আবার না গজানোর মতো কিছু নেই। এথেকে বঞ্চিত হয়ে শুকিয়ে যাবে না এমন কিছু নেই। ৫৬ 

মেনসিয়াস আশাবাদী ছিলেন। আপনি হৃদয় হারিয়ে ফেললেও সবসময় আবার সেটা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। উউ ওয়েই (‘কিছুই না করা’) এর জবাব নয়; প্রয়োজনীয় শব্দটা হলো মানুষকে স্বর্গের সঙ্গে একই ছন্দে নিয়ে আসা ইউ ওয়েই (‘আত্ম-প্রয়াস’)। ভুল পথে চলে যাওয়া সহানুভূতিশীল হৃদয়ের অনুসন্ধানই ছিল কনফুসিয় শিক্ষার উদ্দেশ্য। অদ্ভুত ব্যাপার মানুষ তাদের মানবতার এই ক্ষয়ে নির্লিপ্ত রয়েছে! তারা হারানো মুরগী বা কুকুরের খোঁজে অনেক সময় নষ্ট করে, কিন্তু নিজেদের হৃদয়কে উদ্ধারের জন্যে কিছুই করে না। প্রত্যেকেরই ব্যতিক্রমহীনভাবে-চারটি অবিশ্যিক গুণের চর্চা করে ইয়াও বা শানের মতো সন্ন্যাসী হয়ে ওঠার শক্তি রয়েছে। একটি সহানুভূতি সম্পন্ন হৃদয় পাওয়ার পর সেটাকে সারিয়ে তোলামাত্র এমনভাবে সেটা তৈরি থাকে যে সেটা দাবানলের মতো ধেয়ে যাবে বা পৃথিবীর গভীর থেকে উঠে আসা ঝর্নার মতো হাওয়ায় বিস্ফোরিত হবে। সাধু আসলে পুরোপুরিভাবে নিজের মানবিক পরিচয় উপলব্ধি করে স্বর্গের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া একজন মানুষ। আমরা বেশিরভাগই সহানুভূতিকে প্রথমে কঠিন ভাবি; ক্রমাগত পুনরাবৃত্তির ভেতর দিয়ে আমাদের সহজাত গুণাবলী হিতাকাঙ্ক্ষা, ন্যায়বিচার ও সাম্যতার পরিচর্যা করতে হবে। যতবার সঠিক আচরণ করব, ততবারই ‘অঙ্কুরগুলোকে শক্তিশালী করে তুলব, যতক্ষণ না প্রধান গুণগুলো স্বভাবজাত হয়ে উঠছে। ইউ ওয়েই-র জোরাল প্রয়াস নিষ্ঠুর আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো ‘অটল’ বা ‘দৃঢ়’ হৃদয়ের জন্ম দিতে পারে। 

ভালোত্ব অর্জনের এই সংগ্রামের প্রয়াসী কোনও ব্যক্তি মেনসিয়াসের ভাষায় ‘প্লাবনস্বরূপ কি (হাও জান চি কি) তে পৌছাতে সক্ষম হবে: তিনিই এই বাগধারা সৃষ্টি করেছিলেন এবং ব্যাখ্যা করা কঠিন বলে আবিষ্কার করেছেন। এটা মানুষকে স্বর্গে উন্নীতকারী এক বিশেষ ধরনের কি :

এটি এমন চি’ই* সর্বোচ্চ স্তরে যা বিশাল, অটল (হাও জান)। সততার সঙ্গে এর পরিচর্যা করো, এর পথে কোনও বাধা আরোপ করো না, তাহলে তা স্বৰ্গ আর মর্ত্যের মাঝের স্থানটুকু পূরণ করবে। এটা এমন এক টি ই যা ন্যায় ও পথ-কে একত্রিত করে। একে সেসব থেকে বঞ্চিত করলে তা ধ্বংস হয়ে যাবে। পুঞ্জীভূত ন্যায় থেকে এর জন্ম, বিক্ষিপ্ত ভালোত্বের প্রদর্শনের ভেতর দিয়ে কারও পক্ষে একে আত্মস্থ করা যাবে না।৫

[* লাউ তাঁর লেখায় চীনা হরফের অনুবাদে এই গ্রন্থে ব্যবহৃত পিনিয়ান পদ্ধতির বদলে প্রাচীন ওয়েড-জাইলস পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন; এই কারণে কি চিই হিসাবে অনুবাদ করা হয়েছে।] 

রেন-এর চর্চা সাধারণ, নাজুক মানুষকে পথ-এর সঙ্গে ছন্দে স্থাপন করবে। ঝুয়াংঝি এর মতো একটা কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, কিন্তু আত্ম- সচেতনতা কেবল কি-র প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বলে দাবি করেছিলেন তিনি। আসলে তা নয়, জবাব দিয়েছেন মেনসিয়াস; শৃঙ্খলিত ও স্থিতিশীল নৈতিক প্রয়াসের ভেতর দিয়ে পথ-এর সঙ্গে ঐক্য অর্জন করা যেতে পারে। 

স্বর্ণবিধি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই গুণই জুনযিকে সত্যিকার অর্থে মানবিক করে তুলত এবং ব্যক্তিকে গোটা মহাবিশ্বের সঙ্গে এক অতীন্দ্রিয় সম্পর্কে স্থাপন করত। ‘দশ হাজার জিনিসের সবই আমার মাঝে,’ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনায় বলেছেন মেনসিয়াস। 

‘আত্ম-সমালোচনার ভেতর দিয়ে আমি নিজের প্রতি সৎ, এটা জানার চেয়ে বড় আনন্দের বিষয় আর কিছু নেই। অন্যের কাছ থেকে তুমি যেমন আচরণ পাওয়ার আশা করো অন্যের প্রতি সাধ্যমতো ঠিক সেই রকম আচরণ করার চেষ্টা করো, তাহলে একেই হিতাকাঙ্ক্ষার [রেন] সংক্ষিপ্ততম রাস্তা বলে জানতে পারবে।’ অন্য মানুষও ঠিক আপনার মতোই গুরুত্বপূর্ণ, এইরকম আচরণের ভেতর দিয়ে আপনি সবার সঙ্গে এক ধরনের তুরীয় আনন্দসুলভ ঐক্য বোধ করতে পারেন। একজন জুনযি আর নিজের সঙ্গে অন্য প্রাণীর কোনও পার্থক্য আছে বলে ভাবতে পারে না। এমন একজন মানুষ এক ঝামেলাময় বিশ্বে ভালোর জন্যে স্বর্গীয় শক্তিতে পরিণত হয়। 

সামন্তবাদী আমলের কথা ভাবতে গিয়ে, এমন একটা সময় যখন লি দিয়ে রাজার অহমবাদ দমন করা হয়েছিল, তাঁর প্রজারা সন্তুষ্ট ছিল বলে বিশ্বাস করেছেন মেনসিয়াস। যুদ্ধমান রাজ্যগুলোর সময়ের তুলনায় সুদূরের সেই দিনগুলোকে স্বর্ণযুগের মতো মনে হয়েছে। রাজা পথ-এর শক্তির বিচছুরণ ঘটিয়েছিলেন এবং প্রজাদের উপর গভীর নৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করেছেন; ‘সুখী’, ‘উচ্ছল ও সন্তুষ্ট’ ছিল তারা। ‘কে এনে দিয়েছে না জেনেই প্রতিদিন ভালোর দিকে’ এগিয়ে গেছে তারা। আজকের দিনে অমন মেধার কোনও রাজা নেই, তবে যেকেউই জুনযিতে-একজন সম্পূর্ণ পরিপক্ক ব্যক্তি-পরিণত হতে পারে এবং তার পরিবেশের উপর কিছুটা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। ‘জুনযি যেপথ দিয়ে যায় সেটাকে বদলে দেয় এবং যেখানে বাস করে সেখানে অলৌকিক ঘটনা ঘটায়। উপরের স্বর্গ ও নিচের মর্ত্যের সঙ্গে একই ধারায় অবস্থান করে সে। তাকে কি তুচ্ছ সুবিধা বয়ে আনার কথা বলা যাবে? ৬১ 

.

চীনে অ্যাক্সিয়াল যুগ দেরিতে শুরু হলেও এখন সম্পূর্ণ বিকশিত হয়ে উঠেছিল। অন্যান্য অঞ্চলে এটা হয় পতনের দিকে যাচ্ছিল কিংবা ভিন্ন কিছুতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিল। ভারতের মহাকাব্য মহাভারতে পরিষ্কারভাবে এই জিনিসটি লক্ষ করি আমরা।২ রাষ্ট্র ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের আগে ব্রাহ্মণার আমলে কুরু-পাঞ্চলা এলাকা এই কাহিনীর পটভূমি, কিন্তু মহাকাব্যের মৌখিক প্রচলন শুরু হয়েছিল ৫০০ সালের দিকে; বর্তমান সাধারণ যুগের প্রথম শতকগুলোয় চূড়ান্ত রূপ লাভ করার আগে একে লিখিত রূপ দেওয়া হয়নি। সুতরাং মহাভারত একটি জটিল, বহুস্তর বিশিষ্ট টেক্সট, বহু বিচ্ছিন্ন লোককথার সংকলন। অবশ্য সম্ভবত চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে কাহিনীর সাধারণ রূপরেখা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। পুরোহিত বা সন্ন্যাসীদের বলয়ে রচিত অ্যাক্সিয়াল যুগের নির্দেশক বিভিন্ন টেক্সটের বিপরীতে এই মহাকাব্যটি ক্ষত্রিয় যোদ্ধা জাতের রীতিনীতি তুলে ধরেছে। অ্যাক্সিয়াল যুগের ধর্মীয় বিপ্লব বিভ্রান্তিকর দোলুলতানতার ভেতর ঠেলে দিয়েছিল তাদের। অহিংসার আদর্শকে সম্মান করেন একজন রাজা বা যোদ্ধা কিভাবে তার নিজের সম্প্রদায়কে রক্ষার স্বার্থে যুদ্ধ ও হত্যা করার দাবি করা তার পেশার সঙ্গে নিজেকে সমন্বিত করতে পারেন? 

প্রতিটি শ্রেণীর দায়িত্ব ছিল পবিত্র। প্রত্যেকেরই নিজস্ব অলঙ্ঘনীয় ধর্ম, স্বর্গীয় নির্দেশিত জীবন ধারা ছিল। ব্রাহ্মণের দায়িত্ব ছিল বেদের নৈপুণ্য অর্জন করা; আইন, শৃঙ্খলা আর প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল ক্ষত্রিয়, বৈশ্যকে সম্পদের উৎপাদনে তার সামর্থ্যকে নিয়োগ করতে হতো। সন্ন্যাসীরা যোদ্ধা ও বণিকদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন, এরা তাদের ধর্মীয় অনুসন্ধানে পূর্ণ সময় মনোযোগ দিতে সক্ষম করে তোলার জন্যে খাবার, ভিক্ষা ও নিরাপত্তা যোগাত। কিন্তু যার যার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করার জন্যে রাজা, যোদ্ধা ও বণিকরা এমন আচরণে বাধ্য হতেন—বুদ্ধ ধর্মীয় বুলিতে-যা ‘অদক্ষ’ বা এমনকি সরাসরি পাপময় ছিল। বাজার এলাকায় সঠিকভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনার লক্ষ্যে বৈশ্যদের উচ্চাভিলাষী হওয়ার, জাগতিক সম্পদ আকাঙ্ক্ষা করার, প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে আগ্রাসীভাবে প্রতিযোগিতা করার দরকার ছিল এবং এই ‘আকাঙ্ক্ষা তাদের অপ্রতিরোধ্যভাবে মৃত্যু ও জন্মের চক্রে বন্দী করে ফেলত। তবে ক্ষত্রিয়দের পেশা বিশেষভাবে সমস্যাসঙ্কুল ছিল। কোনও সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে অনেক সময় সত্যির সঙ্গে আপোস করতে হতো তাকে বা এমনকি মিথ্যাও বলতে হতো। তাকে হয়তো সাবেক বন্ধু বা মিত্রদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা এবং নিরীহ মানুষ হত্যা করতে হতো। সহিংসাহীনতা ও সবসময় সত্যির প্রতি কঠোর আনুগত্যের দাবিদার যোগীয় রীতিনীতির সঙ্গে এইসব কাজের কোনওটাই মানানসই ছিল না। ক্ষত্রিয়রা কেবল পরবর্তী জীবনেই সন্ন্যাসী হওয়ার আশা করতে পারত, কিন্তু তার দৈনন্দিন কর্মের প্রকৃতির কারণে সে এমনকি এই সামান্য লক্ষ্যও অর্জন করতে পারবে কিনা সন্দেহ ছিল। তাহলে কি কোনও আশাই ছিল না? এইসব প্রশ্ন নিয়ে আলোড়িত হয়েছে মহাভারত, কিন্তু কোনও সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে পায়নি। 

মহাভারতের কোনও একটি বিশেষ অনুচ্ছেদের সঠিক সময় কাল স্থির করা বা এমনকি মূল কাহিনী বিচ্ছিন্ন করা খুবই কঠিন। লোকমুখে প্রচলনের দীর্ঘ সময় জুড়ে প্রাচীন ও নতুন উপাদান ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে এবং সাধারণ কালের প্রথম শতকগুলোয় মহাকাব্যটি পুরোহিতগোষ্ঠীর পণ্ডিতদের হাতে নতুন করে ব্যাখ্যাত হয়েছে। তারপরেও বর্ণনার সাধারণ প্রবাহ থেকে অ্যাক্সিয়াল যুগ শেষ হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষত্রিয়দের চিন্তাধারা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা লাভ করা যায়। মহাভারত কুরু-পাঞ্চলা এলাকার নিয়ন্ত্রণ লাভের জন্যে যুদ্ধরত কৌরব ও পাণ্ডবদের দুটি চাচাত-মামাত ভাইয়ের গোষ্ঠীর ভেতর বিপর্যয়কর সংঘাতের কথা বর্ণনা করেছে। যুদ্ধের ফলে গোটা মানবজাতি নিশ্চিহ্নতার মুখোমুখি হয়ে পড়ে। সেই যুদ্ধ বীরের কালের সমাপ্তি ডেকে এনেছিল এবং আমাদের নিজস্ব গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ কলি যুগের সূচনা ঘটিয়েছে। 

এটা ছিল প্রলয়বাদী যুদ্ধ, কিন্তু তারপরেও মহাভারতে একে ভালো ও মন্দের লড়াই হিসাবে তুলে ধরা হয়নি। পাণ্ডবরা অনিবার্যভাবেই জয় লাভ করতেন, কিন্তু কেবল বন্ধু ও মিত্র যাদব গোত্রের প্রধান কৃষ্ণের যোগানো সন্দেহজনক কৌশলের মহড়ার আশ্রয় নিয়েই কৌরবদের পরাজিত করতে পেরেছিল। তারা যেমন আচরণ করেছিল তেমন না করার কোনও উপায় না থাকলেও পাণ্ডবরা তাদের অমর্যাদাকর আচরণের কারণে গভীরভাবে হেয় বোধ করেছে এবং যুদ্ধ শেষে বিধ্বস্ত, বিরান পৃথিবীর দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকিয়েছে, বিজয়কে মনে হয়েছে ফাঁপা। বিপরীতে কৌরবদের অনেককেই অভিজাত, নজীরসৃষ্টিকারী যোদ্ধা মনে হয়েছে। যুদ্ধে তাদের নেতা দুর্যোধন নিহত হওয়ামাত্র তাঁর আত্মা স্বর্গে আরোহণ করেন, তাঁর শবদেহের উপর স্বর্গীয় ফুলের পাঁপড়ি বর্ষিত হয়! 

কোনও কোনও দিক থেকে মহাভারতের ধর্মীয় জগৎ অ্যাক্সিয়াল যুগের স্পর্শবর্জিত মনে হয়। মহাকাব্য আমাদের কেবল একটি অভিজাত গোষ্ঠীরই মহাপরিবর্তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার কথা মনে করিয়ে দেয়। বেশিরভাগ মানুষ পুরোনো ধর্মীয় অনুশীলন আঁকড়ে ছিল এবং অন্তত উপরিগতভাবে-নতুন পরিবর্তনের প্রভাবের বাইরে রয়ে যাওয়ার ধারণা দিয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, মহাভারতে ইন্দ্র তখনও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেবতা রয়ে গেছেন-আধুনিক পুরোহিত ধ্যানধারণা থেকে হারিয়ে যাওয়ার অনেক পরেও ক্ষত্রিয়দের মাঝে জনপ্রিয় রয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এই মহাকাব্যে প্রাচীন বৈদিক মিথের স্বর্গীয় ঘটনাপ্রবাহকে ঐতিহাসিক পটভূমিতে স্থাপন করা হয়েছে: পাণ্ডব ও কৌরবদের যুদ্ধ দেবা ও অসুরাদের ভেতরের যুদ্ধের প্রতিরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং প্রতিটি পাণ্ডব ভাই ছিলেন বৈদিক দেবতার পার্থিব প্রতিরূপ। প্রাথমিক বৈদিক যুগের ধর্মতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে মহাকাব্যটি রচিত। যুদ্ধে নিহত একজন যোদ্ধা সরাসরি দেবতাদের জগতে চলে যায়; তাঁকে আবার ফিরে এসে ভোগান্তি সহ্য করে আবার মরতে হবে, এমন কোনও আভাস নেই। এই কাব্যে কোনও আধুনিক গৃহত্যাগী নেই, কেবল বনের ভেতর উৎসর্গের অগ্নিকুণ্ডের পরিচর্যাকারী প্রাচীন কেতার তপস্বী। মহাভারতে অল্প কিছু যোগী আছে, কিন্তু সাধারণত অহমকে অতিক্রম করার চেয়ে বরং উন্নত মানসিক শক্তি দিয়ে জাদুকরি ক্ষমতা দেখানোর ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী ছিল তারা। অ্যাক্সিয়াল যুগ ব্যক্তির ব্যক্তিগত দায়িত্বের প্রতি জোর দিয়েছে, কিন্তু এই মহাকব্যে প্রধান চরিত্রগুলোর কোনও পছন্দই নেই, তাঁরা প্রায়শঃই দেবতাদের হাতে নিজেদের বিবেচনার বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রাচীন উৎসর্গের কাহিনীর প্রতি দুর্বলতা থেকে মহাভারতের প্রাচীন চেতনা বিশেষভাবে স্পষ্ট। উদাহরণ স্বরূপ, পঞ্চপাণ্ডবদের সবাইই বোন দ্রৌপদীকে বিয়ে করেছেন। স্পষ্টই এটা দারুণভাবে রেওয়াজের বাইরে, কিন্তু এই বিয়ে রাজাকে সার্বভৌমত্ব এনে দেওয়া ঘোড়ার বিসর্জন অর্থাৎ অশ্বমেধের আচারের কথা মনে করিয়ে দেয়: এই আচারের সময় বলীর ষাঁড়ের সঙ্গে রানীর এক ধরনের যৌন সম্পর্কের অভিনয় করতে হতো এবং এভাবে এর তুলে ধরা কর্তৃত্বকে স্বামীর কাছে প্রেরণ করতে পারতেন। এই মহাকাব্যে দ্রৌপদী রাজকীয় কর্তৃত্ব তুলে ধরেছেন, ভাইদের কাছে চালান করেছেন সেটা। 

কিন্তু শাস্ত্রজ্ঞদের হাতে পরিমার্জিত হওয়ার আগে মহাভারত আবার উৎসর্গের প্রতিযোগিতায় প্রতিফলিত ত্রাসকেও তুলে ধরেছে। গল্পের শুরুতে সবচয়ে বড় পাণ্ডব ভাই যুধিষ্ঠির অস্ত্রের জোরে রাজ্যের অধিকার লাভ করে তাঁর পুরোহিতদের রাজকীয় উৎসর্গে (রাজাসুয়ো) তলব করেন। নিজেকে আচারের চ্যালেঞ্জ ও বিপদে সমর্পণ করে তাঁর ভেতর বাহ্মণের অস্তিত্ব থাকার বিষয়টি প্রমাণ করার দরকার ছিল তাঁর। যথার্থভাবেই পবিত্রে পরিণত করে রাজা হিসাবে মনোনীত করা হয় তাঁকে, কিন্তু রাজাসুয়োর পরিণতি ছিল ভয়াবহ। ঈর্ষান্বিত হয়ে আচারের সময় বাধ্যতামূলক পাশা খেলায় যুধিষ্ঠিরকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন দুর্যোধন, কিন্তু দেবতারা যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে পাশার ছক পূরণ করলে খেলায় হেরে স্ত্রী, সম্পদ ও রাজ্য খোয়ান তিনি। বার বছরের জন্যে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয় পাণ্ডবরা, আর অনিবার্য হয়ে ওঠে পৃথিবীকে প্রায় ধ্বংস করে দেওয়ার মতো যুদ্ধ। এই কাহিনীর উৎসর্গের প্রতিযোগিতার বিপর্যয়কর দৃশ্য ব্রাহ্মণার আচিরক সংস্কারে অনুপ্রাণিতকারী উদ্বেগ সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়। 

যুধিষ্ঠিরের দুর্দশা দেখায় যে, মহাভারত অন্তত হাজার হোক অ্যাক্সিয়াল যুগের ছোঁয়া থেকে দূরে ছিল না। যেন নতুন আদর্শে দারুণ প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। ভাইদের পৌনঃপুনিক ধৈর্যচ্যুতি সত্ত্বেও তিনি ছিলেন ভদ্র, সহিষ্ণু এবং এককভাবে তাঁর ভেতর কোনও যুদ্ধবাজ নীতি ছিল না। নিজেকে সংহত করার কোনও ইচ্ছাই ছিল না তাঁর, প্রচলিতভাবে নিজের অহমকে প্রকাশও করতে চাননি, বরং সেটা করা যারপরনাই অসম্ভব মনে করেছেন এবং যুদ্ধকে অশুভ, বর্বর এবং নিষ্ঠুর মনে করেছেন তিনি। যুধিষ্ঠির অ্যাক্সিয়াল যুগের মানুষ ছিলেন এবং সেটা প্রায় অসহনীয় অক্ষমতা হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। জীবনকে সম্ভব করে তোলা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত কারী বরুনের অবতার ধর্মের পুত্র ছিলেন বলে বনবাসে গিয়ে অহিংসার অনুশীলন করতে পারেননি তিনি। তাঁর পার্থিব প্রতিনিধি হিসাবে পৃথিবীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার সেই সার্বভৌমত্ব অর্জন করা যুধিষ্ঠিরের অনিবার্য দায়িত্ব ছিল। ধর্মপুত্র হিসাবে পরম সত্যবাদীতার প্রচলিত অনুশীলন ও প্রতিজ্ঞার প্রতিও আনুগত্য দেখাতে হয়েছে তাঁকে, যেটা ছাড়া সামাজিক শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তারপরেও যুদ্ধের সময়-দারুণ অসম্মানজনকভাবে-মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যুধিষ্ঠির। 

আঠার দিন মেয়াদের যুদ্ধে পাণ্ডবরা কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধরত দুজন সমর নেতাকে হত্যা করতে বাধ্য হয়। বীরের কালে মহাকাব্যের পটভূমি হওয়ায় এরা কেউই সাধারণ মরণশীল ছিলেন না; অতিপ্রাকৃত শক্তিসহ নরদেবতা ছিলেন তাঁরা। পাণ্ডবরা যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সময় তাঁদের রথগুলো পৃথিবীর জমিন স্পর্শ করেনি। যোদ্ধারা আমাদের অধঃপতিত কলিযুগের সাধারণ মানুষদের মতো একই রকম সীমাবদ্ধতার অধীন ছিলেন না; কৌরব বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা ভীষ্ম ও দ্রোনকে প্রচলিত উপায়ে হত্যা করা সম্ভব ছিল না। পাণ্ডব বাহিনীর উপর তাঁরা এত অসংখ্য ক্ষতি চাপিয়ে দিয়েছিলেন যে, বিজয়ের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন ভাইয়েরা। যুধিষ্ঠির সার্বভৌমত্ব লাভে ব্যর্থ হওয়ায় মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল, স্বর্গ ভীষণভাবে উপেক্ষিত হতে যাচ্ছিল। এমনি ভয়ঙ্কর মুহূর্তে ভাইদের হতাশায় ভরিয়ে তোলা পরামর্শ নিয়ে হাজির হন কৃষ্ণ। 

পাণ্ডবরা অনন্য সাধারণ বীরত্ব আর সম্মানের মানুষ সেনাপতিদের কথা জানতেন, তাঁদের শ্রদ্ধা করতেন। ছোটবেলায় পাণ্ডবদের ক্ষত্রিয় রীতিনীতির দীক্ষা দিয়েছিলেন ভীষ্ম, যুদ্ধ বিদ্যা শিখিয়েছিলেন। বিবেকবান সত্যকথনের জন্যে বিখ্যাত সত্যিকারের যোদ্ধা ছিলেন তিনি। পাণ্ডবদের তীরন্দাজি ও রথ চালনা শিখিয়েছিলেন দ্রোন, ব্রাহ্মণ হিসাবে নিবেদিত প্রাণ ধার্মিক ছিলেন তিনি। এদের কেউই শপথভঙ্গ বা মিথ্যা বলার কথা ভাবতেও পারতেন না, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির মিথ্যা বলবেন বা তাঁদের প্রতারিত করার চেষ্টা করবেন, এটা বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি তাঁরা। কিন্তু তারপরেও কৃষ্ণই উপুর্যুপরি দুটো যুদ্ধ সভায় ঠিক তাই করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ভীষ্ম যাতে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসেন সেজন্যে যুধিষ্ঠিরকে অবশ্যই তাঁকে ফাঁদে ফেলতে হবে, যুক্তি তুলে ধরেছিলেন তিনি। তাঁর স্বভাবজাত নিষ্ঠ সত্যবাদিতার সুবাদে তাঁকে হত্যা করা সম্ভব হবে। দ্রোনকে জানাতে হবে তাঁর ছেলে অশ্বত্থামা মারা গেছেন, তাহলে যুদ্ধের ভেতরই অস্ত্র রেখে নিজেকে আক্রমণের কাছে উন্মুক্ত করে দেবেন তিনি। 

কুৎসিত ভঙ্গিতে কৃষ্ণ এই রণকৌশলের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন পাণ্ডব ভাইরা। দুঃখ আর গ্লানিতে দগ্ধ হয়ে সবার সেরা যোদ্ধা অর্জুন প্রথমে কৃষ্ণের পরিকল্পনায় যেকোনও ধরনের অংশগ্রহণে অস্বীকার গেছেন। ক্ষতস্থানে আরও জ্বালা দিতেই অন্য জীবনে নারী থাকা এক যোদ্ধার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে ভীষ্মের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন তাঁকে কৃষ্ণ। ইন্দ্রের ছেলে ছিলেন অর্জুন: কিভাবে এমন কাজ করতে পারেন তিনি? কিন্তু কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন ভীষ্মকে হত্যার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়েছেন আর কেবল এভাবেই তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারবেন। ইন্দ্রের ছেলে কিভাবে শপথ ভঙ্গ করতে পারেন?৬৪ 

কৃষ্ণের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভীষ্ম নিহত হলে সবাই যে যার সাধ্যমতো ভালো মানুষের আচরণ করলেন। পুরোনো গুরু যাতে তৃষ্ণা মেটাতে পারেন এবং ক্ষতস্থান ধুয়ে নিতে পারেন সেজন্যে তীরের সাহায্যে পৃথিবীর গভীর থেকে জল তুলে আনলেন অর্জুন; মৃত্যুপথযাত্রী ভীষ্ম’র দেহ জমিন স্পর্শ করেনি: এক বীরসুলভ ও নৈতিক উন্নত অবস্থানে রয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু দ্রোনের মৃত্যু অনিবার্যভাবে পাণ্ডবদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। অর্জুনকে কৃষ্ণ বলেছিলেন যে, বিশ্বকে রক্ষা করার জন্যে তাঁদের অবশ্যই ‘সততা একপাশে ছুঁড়ে ফেলতে’ হবে এবং অনীহার সঙ্গে ‘বেশ কষ্টকরভাবে’ দ্রোনকে নিষ্ঠুর মিথ্যা বলার শপথ নিয়েছিলেন যুধিষ্ঠির। ‘অসত্য হয়তো সত্যের চেয়ে শ্রেয়,’ যুক্তি দেখিয়েছেন কৃষ্ণ। ‘জীবন বাঁচাতে মিথ্যা বলা হলে অসত্য আমাদের স্পর্শ করে না কিন্তু কৃষ্ণের আশ্বাস সত্ত্বেও কলঙ্কিত হয়েছিলেন যুধিষ্ঠির। সাধারণত তাঁর রথ সবসময় জমিন থেকে চার আঙুল উপরে ভেসে থাকত, কিন্তু দ্রোনকে ছেলের মৃত্যুর মিথ্যা খবর দেওয়ামাত্র ধপ করে জমিনে আছড়ে পড়েছিল সেটা। দ্রোন অবশ্য পবিত্রতম মৃত্যু বরণ করেন, সরাসরি স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। যুধিষ্ঠির তাঁকে ছেলে অশ্বত্থামা মারা যাওয়ার কথা বলার পর প্রথমে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন দ্রোন, কিন্তু দিব্যদর্শনে আবির্ভূত ঋষিদের একটি দলের চাপাচাপির কারণে অস্ত্র নামিয়ে রাখতে বাধ্য হন। এই ঋষিরা তাঁকে বলেছিলেন যে, তিনি মারা যেতে বসেছেন; ব্রাহ্মণ হিসাবে শেষ মুহূর্তগুলো যুদ্ধ করে কাটানো ঠিক হবে না। সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র রেখে নিজের রথে যোগাসনে বসে পড়েন দ্রোন, হারিয়ে যান ঘোরের ভেতর; তারপর শান্তিতে আরোহণ করেন দেবতাদের জগতে। পাণ্ডবদের মিত্ররা তাঁর শিরোচ্ছেদ করার আগেই দেহ ছেড়ে বিদায় নিয়েছিল তাঁর আত্মা। মহান অবস্থান থেকে যুধিষ্ঠিরের পতন ও দ্রোনের নিগূঢ় ঊর্ধ্বারোহণের বৈপরীত্য তাৎপর্যগতভাবে বিপর্যয়কর ছিল। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ভীষণ বিশ্বাসঘাতকতা করেন অর্জুন: তাঁর জঘন্য মিথ্যাচারের ফলে সবাই কলঙ্কিত হবে।৬৭ 

কৃষ্ণের দ্ব্যর্থক ভূমিকার কি অর্থ করতে পারি আমরা? পাণ্ডবদের পাপের পথে প্রলুব্ধকারী শয়তান ছিলেন না তিনি। ভাইদের মতো বৈদিক দেবতার সন্তান ছিলেন। উৎসর্গের দেবতা বিষ্ণু ছিলেন তাঁর পিতা। ব্রাহ্মণায় বিষ্ণুর দায়িত্ব ছিল আচারের সময় ভুলের কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া কোনও উৎসর্গকে ‘ঠিক’ করা যাতে তা নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করে স্বর্গীয় শৃঙ্খলাকে নবায়িত করতে পারে। মহাভারতে কৃষ্ণ ছিলেন বিষ্ণুর পার্থিব প্রতিরূপ। বীরের যুগের সহিংস অবসান ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিরাট উৎসর্গের আচার দিয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। যুদ্ধই ছিল উৎসর্গ; এর শিকার-যুদ্ধের সময় নিহত যোদ্ধারা-যুধিষ্ঠিরের সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দিয়ে ইতিহাসকে আবার ঠিক পথে ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু সাধারণ উপায়ে যুদ্ধে জেতা সম্ভব ছিল না: দ্রোন ও ভীষ্ম ছিলেন অতিমানব, ‘ন্যায় যুদ্ধে নিহত হওয়ার মতো নন’৬৯ বলে যুক্তি দেখিয়েছিলেন কৃষ্ণ। উৎসর্গকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে তাঁর মরিয়া কৌশল পুরোহিতের কাজে লাগানো বিশেষ আচরিক প্রক্রিয়ার মতো ছিল। 

প্রাচীন বৈদিক রীতি অনুযায়ী কৃষ্ণের যুক্তি অকাট্য ছিল; এমনকি ভিত্ৰা দানবকে হত্যা করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার সময় একই রকম কৌশলের আশ্রয় নেওয়া ইন্দ্রের নজীরও টানতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু যুধিষ্ঠির অ্যাক্সিয়াল যুগ পুরুষ ছিলেন, এই প্রাচীন আচরিক কাহিনীতে স্থির হতে পারেননি তিনি। তিনি ছিলেন সান্ত্বনার অতীত। গোটা কাব্য জুড়ে হতাশার কান্নায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন : ক্ষত্রিয়র ধর্মের চেয়ে অশুভ আর কিছু নেই। যুদ্ধবিগ্রহ দেবতাদের কাছে গ্রহণীয় রক্তউৎসর্গ ছিল না; এটা ছিল নিষ্ঠুরতা। মহাকাব্য দেখায়, সহিংসতা কেবল আরও সহিংসতারই জন্ম দেয়; আর একটি অমর্যাদাকর বিশ্বাসঘাতকতা আরও বিশ্বাসঘাতকতার দিকে নিয়ে যায়। 

শোকে উন্মাদ হয়ে দ্রোনের ছেলে অশ্বত্থামা বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ নেন, ‘আত্ম-উৎসর্গ’ ( আত্মযজ্ঞ) হিসাবে নিজেকে ভারতীয় স্থানীয় জনগণের প্রাচীন দেবতা শিবের কাছে সমর্পণ করেন। তাঁর আত্মত্যাগ সন্ন্যাসীদের অনুসৃত অহিংস গৃহত্যাগের ভয়ঙ্কর প্যারোডি ছিল। অশ্বত্থামার হাতে চকচকে তলোয়ার তুলে দেন শিব, অধিকার করে নেন অপার্থিব ঔজ্জ্বল্যে ঝলমল করা তাঁর দেহ। স্বর্গীয় উন্মাদনায় পাণ্ডবদের শিবিরে ঢোকেন অশ্বত্থামা, তখন ঘুমে বিভোর ছিল সবাই; পাইকারী হারে শত্রুদের হত্যা করতে শুরু করলেন তিনি; তাঁর বাবার সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের বিশ্বাসঘাতকতার মতোই অসম্মানজনক ছিল সেটা। অশ্বত্থামা ব্রাহ্মণ ছিলেন বলে হত্যাকাণ্ডকে পবিত্র আচার মনে করেছেন, কিন্তু আসলে নিয়ন্ত্রণের অতীত একটা উৎসর্গ ছিল এটা। বৈদিক আচারে পশুকে দ্রুত ও বেদনাহীনভাবে হত্যা করার বিধান ছিল। কিন্তু প্রথম শিকার-তাঁর বাবাকে দ্বিখণ্ডিতকারী-বেছে নেওয়ার সময় অশ্বত্থামা লাথি মেরে হত্যা করেছিলেন তাকে, দ্রুত হত্যা করতে চাননি; এবং ‘পশুর মতো মরতে বাধ্য করেছেন…তার মাথা গুড়িয়ে দিয়েছেন। ১৭১ 

কৃষ্ণ তাঁদের রাতে শিবিরে বাইরে ঘুমোনোর পরামর্শ দেওয়ায় হামলা থেকে রেহাই পেয়েছিলেন পাণ্ডব ভাইরা, কিন্তু তাঁদের পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যই-শিশুসহ-কচুকাটা হয়েছিল। পাণ্ডবরা অবশেষে অশ্বত্থামার নাগাল পাওয়ার পর গঙ্গার ধারে একদল সন্ন্যাসীর সঙ্গে আচরিক পোশাকে ধ্রুপদী ব্রাহ্মণ্য আসনে প্রশান্তভাবে বসে থাকতে দেখতে পেলেন তাঁকে। পাণ্ডবদের দেখেই ঘাসের ডগা ছিঁড়ে সেটাকে ব্যাপকবিধ্বংসী অস্ত্র ব্রহ্মাস্ত্রে পরিণত করেন অশ্বত্থামা, ‘অপাণ্ডভাগ! ‘পাণ্ডবদের বিনাশের জন্যে!’-চিৎকার ছেড়ে ছুঁড়ে মারলেন সেটা। অমনি ভীষণ লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে গেল, যাতে গোটা বিশ্ব গ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিল। অশ্বত্থামার ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তি নাকচ করার জন্যে নিমেষে নিজের ব্রহ্মাস্ত্র থেকে অগ্নি নিক্ষেপ করলেন অর্জুন, এবং কোনও যুগের অবসানের মতো অগুন হয়ে জ্বলে উঠল সেটাও ভয়ঙ্কর অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, এবং আরও একবার অনিশ্চিত হয়ে উঠেছিল বিশ্বের নিয়তি। কিন্তু অশ্বত্থামার সঙ্গের দুজন সন্ন্যাসী প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ত্রের মাঝখানে অবস্থান গ্রহণ করলেন। অ্যাক্সিয়াল চেতনায়- ‘সকল সৃষ্টি ও সকল জগতের মঙ্গল কামনা’—উভয় পক্ষকে অস্ত্র সংবরণ করতে বললেন তাঁরা। যোদ্ধা হিসাবে ‘পবিত্র জীবন’ যাপন করেছিলেন অর্জুন: এক ধরনের যোগ সাধনা করেছিলেন, সতর্কভাবে সত্য ও আনুগত্যের প্রকৃত ক্ষত্রিয় গুণ প্রত্যক্ষ করলেন তিনি। নিজের রাগ সামাল দিতে পারতেন তিনি; এবং ক্রোধবশতঃ নিজের অস্ত্র চালাননি বলে সেটা ফিরিয়ে নিতে পারলেন। অবশ্য ক্রোধবশতঃ ব্রহ্মাস্ত্ৰ নিক্ষেপ করেছিলেন অশ্বত্থামা; নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি, কেবল সেটার পথ বদলাতে পারছিলেন: অস্ত্র চলে যাবে পাণ্ডবদের স্ত্রীদের জঠরে; তাঁরা আর সন্তান ধারণ করতে পারবেন না, এবং পাণ্ডবদের বংশ-ধারা বন্ধ হয়ে যাবে। তাঁকে অভিশাপ দিলেন কৃষ্ণ: তিন হাজার বছর পৃথিবীময় নিঃসঙ্গ ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হবেন ব্যর্থ সাধক অশ্বত্থামা, বনে বাদারে আর বসতিহীন জায়গায় বাস করবেন। 

পনের বছর শাসন করেছেন যুধিষ্ঠির, কিন্তু জীবন থেকে আলো হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর। কোনওদিনই নিজের হৃদয়ে আবিষ্কার করা অহিংসার ধর্মের সঙ্গে ক্ষত্রিয় সহিংস ব্রতকে মেলাতে পারেননি। মহাভারতে যোদ্ধার ব্রত এবং যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ডের পূলকের বর্ণনা দেওয়া অসংখ্য অনুচ্ছেদ আছে, কিন্তু মৌলিক সন্দেহ রয়েই গেছে। মহাকাব্য ভারতে নিজেদের নিরলম্ব অবস্থায় আছে মনে করা কিছু সাধারণ মানুষের উপর অ্যাক্সিয়াল আধ্যাত্মিকতার অস্বস্তিরকর প্রভাব দেখায়। পার্থিব ধর্মের ফাঁদে পড়ে সন্ন্যাসী ও যোগীদের দলে নাম লেখাতে পারছিল না তারা, বরং জানতে পেরেছিল যে প্রাচীন বৈদিক ধর্মবিশ্বাস তাদের আর বাঁচাতে পারছে না। প্রকৃতপক্ষে, একে অনেক সময় দানবীয় মনে হয়েছে। রাতের হামলার কাহিনী-হত্যালীলার স্মৃতিচারণ, ক্রমবৃদ্ধিশীল প্রতিশোধ এবং অস্ত্রের বেপরোয়া নিক্ষেপ- আমাদের জন্যে যেন প্রায় ভবিষ্যদ্বাণীসুলভ অনুরণন জাগায়। সহিংসতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও সত্যের সঙ্গে আপোসের বিধ্বংসী চক্র নিশ্চিহ্নতার দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে : 

মর্ত্য দেবী কেঁপে উঠেছেন আর পাহাড়-পর্বত টলে উঠেছে। বাতাস রুদ্ধ হয়ে গেছে, উস্কে দেওয়া হলেও আগুনও জ্বলেনি। এবং তাড়িত হয়ে দূরে সরে গেছে আকাশের নক্ষত্ররাজি। সূর্য ওঠেনি; ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে চাঁদের গোলক। হতবাক হয়ে গেছে সবাই, অন্ধকারে ভরে গেছে জমিন। তারপর, অভিভূত দেবতাদের তাদের রাজ্যের কথা জানা ছিল না, উৎসর্গ এগিয়ে আসেনি, এবং বেদ তাদের পরিত্যাগ করেছে। 

কেবল ‘সকল প্রাণী ও সকল জগতের মঙ্গল কামনা’কারী দুজন সাধুর অ্যাক্সিয়াল চেতনা পৃথিবীকে ধ্বংস থেকে বাঁচিয়েছিল। কোনওভাবে আত্মাকে সাধারণ যোদ্ধা ও গৃহস্থদের কাছে আরও বোধগম্য হয়ে ওঠার প্রয়োজন ছিল, যাদের কেউ কেউ হতাশায় ডুবে যাওয়ার বিপদে ছিল। 

৩৯৯ সালে অ্যাথেন্সে ডেমোক্র্যাসি সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা সময় তাঁর শিষ্য প্লেটোর বয়স ছিল তিরিশ বছর। করুণ এই ঘটনাটি তরুণের মনে অনেপনীয় প্রভাব সৃষ্টি করেছিল, এটা তাঁর দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ৭৫ রাজনীতিকে পেশা হিসাবে নেওয়ার আশা করেছিলেন প্লেটো। আদর্শ সক্রেটিসের বিপরীতে তিনি ছিলেন ধনী, অভিজাত পরিবারের ছেলে: তাঁর বাবা অ্যাথেন্সের শেষ রাজার বংশধর ছিলেন; সৎপিতা ছিলেন পেরিক্লেসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু; পেলোপোনেসিয় যুদ্ধে অ্যাথেন্সের পরাজয়ের পর তিরিশজন স্বৈারাচারের সরকারে সক্রিয় ছিলেন দুজন চাচা। প্লেটোকে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁরা। দারুণ সুযোগ মনে হয়েছিল একে, কিন্তু এই বিপর্যয়কর প্রশাসনের ভ্রান্তিগুলো বুঝতে পেরেছিলেন প্লেটো। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে খুশি হয়েছিলেন তিনি, তাঁর সময় এসেছে বলে বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু সক্রেটিসের বিচার ও মৃত্যুদণ্ড তাঁকে এতটাই আশাহত করে যে, বিতৃষ্ণায় প্রকাশ্য জীবন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন তিনি। যেকোনও পোলিসের যেদিকেই তাকাতেন, সরকারের পদ্ধতি ছিল খারাপ: 

ফলে আমি একথা বলতে বাধ্য হয়েছিলাম…যে মানবজাতি এরচেয়ে শুভ দিন আর দেখবে না, যতক্ষণ না সঠিকভাবে পুঙ্ক্ষানুপুক্ষভাবে দর্শন অনুসরণকারীরা ক্ষমতায় আসছে বা যাদের হাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তারা কোনও এক অলৌকিক ক্ষমতার নেতৃত্বে দার্শনিকে পরিণত হচ্ছে।৭৬ 

অ্যাক্সিয়াল যুগের দর্শনকে কিভাবে সহিংস ও অসৎ রাজনীতির বিশ্বে সমন্বিত করা যেতে পারত? প্লেটোর দর্শনকে প্রায়শঃই অপার্থিব এবং ইহজগৎ থেকে বিমূর্তের শীতল শুদ্ধতায় পলায়নে ব্যস্ত মনে হয়। কিন্তু তারপরেও প্লেটো চাননি যে তাঁর দার্শনিকরা জগৎ-সংসার ত্যাগ করুন। কনফুসিয়দের মতো তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সাধু কর্মতৎপর মানুষ হবেন এবং রাষ্ট্রীয় নীতিতে তাঁর প্রভাব থাকবে। আদর্শগতভাবে একজন দার্শনিক স্বয়ং দেশ পরিচালনা করবেন। বুদ্ধের মতো প্লেটো জোরের সঙ্গে বলেছিলেন যে, আলোকন লাভের পর সাধুকে অবশ্যই আগোরায় ফিরে মানবজাতির মঙ্গলের লক্ষ্যে সেখানে থেকেই কাজ করতে হবে। 

সক্রেটিসের মৃত্যুর পর অনুপ্রেরণার আশায় পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় ভ্রমণ করেন প্লেটো। কিছু দিন সক্রেটিসের একজন শিষ্য ইলিয়ার অন্যতম দার্শনিক ইউক্লিডের সঙ্গে মেগারায় ছিলেন। পারমেনাইদসের প্রতি প্লেটোর দুর্বলতার অংশীদার ছিলেন তিনি। আবার পিথাগোরিয় গোষ্ঠীর প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিলেন প্লেটো, তাদের সঙ্গে আজীবন বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন। তাদের মনকে নির্দিষ্টের বিভ্রান্তিকর ঝামেলা থেকে বিশুদ্ধ সংখ্যা ও জ্যামিতিক আকারের এক জগতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া গণিতের প্রতি তাদের প্রবল আকর্ষণে বিশেষ করে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মিশর ও লিবিয়া সফর করেছেন তিনি, সিরাক্রুজের স্বৈারাচারী প্রথম দিওনিসাসের দরবারে দিওনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়; প্লেটোর বিভিন্ন ধ্যান-ধারণায় বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দিওন সিসিলিতে একজন রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত হবেন বলে হয়তো আশা করে থাকতে পারেন প্লেটো, কিন্তু সিরাক্রুজে তাঁর প্রথম সফর বিশ্রীভাবে শেষ হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে যে, দিওনিসাস প্লেটোকে দাস হিসাবে বিক্রি করে দিয়েছিলেন এবং একেবারে শেষ মুহূর্তে বন্ধুদের কল্যাণে রেহাই পেয়েছিলেন তিনি। এমনি অভিজ্ঞতার ধাক্কায় ৩৮৭ সালে আবার অ্যাথেন্সে ফিরে আসেন তিনি। 

এখানে তাঁর খুশি হওয়ার মতো তেমন কিছু ছিল না। স্পার্টার বিরুদ্ধে থেবসের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তোলার ভেতর দিয়ে পেলোপোনেসিয় যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে অ্যাথেন্স। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী কোনও শান্তি ছিল না। পরবর্তী তিরিশ বছরের ঘটনাপ্রবাহ গ্রিক মূল ভূখণ্ডের আন্তনগরী রাজনীতির অব্যাহত অস্থিতিশীলতাই তুলে ধরেছে। বিভিন্ন পোলিস যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছিল, কোনও নগরীই একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন করতে পারছিল না, বিরামহীন বিরোধে সবগুলোই অবনতির শিকার হচ্ছিল। বাণিজ্যে নিম্ন গতি দেখা দিয়েছে; ধনী ও দরিদ্রের ভেতর নতুন করে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। এইসব অভ্যন্তরীণ বিরোধ অনেক সময় নিষ্ঠুরতায় বিস্ফোরিত হয়েছে। ৩৭০ সালে আরগোর ডেমোক্র্যাটরা নিষ্ঠুরভাবে বার শো অভিজাতকে পিটিয়ে মেরে ফেলে, আর তেগিয়ায় অলিগার্কির নেতৃবৃন্দকে জবাই করে হত্যা করে সহিংস জনতা। 

গণিতবিদ ও দার্শনিকদের জন্যে একটি পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এইসব রক্তপাতের বিরুদ্ধে প্লেটোর সাড়া। পণ্ডিতরা অ্যাথেন্সের উপকণ্ঠে বীর একাদেমিয়াসের সঙ্গে নিবেদিত এক পবিত্র উদ্যানে মিলিত হতেন বলে এক একাডেমি বলা হতো। লেকচারের বদলে বরং সক্রেটিসিয় কায়দায় আলোচনার ভেতর দিয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো। এই প্রাথমিক পর্যায় প্লেটো শিষ্যদের উপর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দিতে চাননি, বরং স্বাধীন চিন্তভাবনাকে উৎসাহিত করেছেন। একই সময়ে লেখালেখিতে ব্যক্তিগত ধারণার বিকাশ ঘটিয়েছেন তিনি, পরিণত হয়েছেন প্রথম দার্শনিকে যার রচনাবলী সম্পূর্ণই রক্ষা পেয়েছে। ডগমার মতো নিজের অন্তর্দৃষ্টি লিখে যাওয়ার বদলে বরং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পাওয়া সংলাপের ধরন ব্যবহার করেছেন তিনি। সক্রেটিস এসব সংলাপের আদর্শ ছিলেন বলে নিরেট কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতেন না তাঁরা। প্লেটোর সংলাপ নির্দিষ্ট তর্ক ছিল না, বরং পাঠকদের আলোচিত বিভিন্ন বিষয়ের জটিলতার গভীরতম উপলব্ধির দিতে টেনে নিয়ে আসার জন্যে আরও চিন্তার প্রতি আমন্ত্ৰণ ছিল। আধুনিক পণ্ডিতদের মতো ছিলেন না প্লেটো। গুরুগম্ভীর কায়দা আর যুক্তির সাহায্যে নিজের ধারণাকে ব্যাখ্যা করার বদলে খেলাচ্ছলে এবং আভাসে উপকথা বর্ণনার ভেতর দিয়ে পরোক্ষে মৌলিক সত্যি উল্লেখ করে অস্পষ্টভাবে সেগুলোকে তুলে ধরতেন। সত্যিতে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া খুবই কঠিন বলে বিশ্বাস করতেন তিনি, এর জন্যে প্রয়োজন দ্বান্দ্বিকতার দীর্ঘ, কঠোর প্রশিক্ষণ, কিন্তু নিজের লেখায় মৌখিক শিক্ষার প্রাচীন পদ্ধতিও রক্ষা করেছেন তিনি, যেখানে একথা মেনে নেওয়া হয়েছে যে, তথ্যের সাধারণ শিক্ষার মাধ্যমে সত্যি শেখানো যাবে না, বরং কল্পনা ও সেইসঙ্গে বাস্তব পর্যবেক্ষণ ও শৃঙ্খলিত যুক্তিরও প্রয়োজন রয়েছে। 

প্লেটোর দর্শন সাধারণভাবে ‘আকারের মতবাদে’ প্রভাবিত, যদিও তা কখনওই একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ তত্ত্বে পরিণত হয়নি। তাঁর চিন্তাধারায় আধুনিক পণ্ডিতরা এক ধরনের বিকাশ লক্ষ করেছেন এবং জীবনের শেষদিকে তিনি আকারকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়েছিলেন বলে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, তবে প্লেটোর রচনায় স্পষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক বিবর্তন খোঁজা ভুল হবে। সম্ভবত রচনাধীন। একটি সংলাপ বাদ দিয়ে নতুন আরেকটি সংলাপ শুরু করেছিলেন তিনি, একসঙ্গে বেশ কয়েকটি সংলাপের কাজ করছিলেন। অনেক সময় এক ধরনের কৌশল অনুসরণ করতেন, আবার আরেক সময় ভিন্ন কৌশল, অনেক সময় আকারকে স্বর্গীয় রূপ হিসাবে অতীন্দ্রিয় বলে বর্ণনা করতেন; অন্য সময় বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতেন এগুলোকে। প্রতিটি সংলাপে ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে কঠিন ধারণার দিকে অলক্ষে এগিয়ে গেছেন তিনি, ফলে যা রক্ষিত হয়েছে সেটা বিভিন্ন দার্শনিক জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে যুক্তিতর্কের একটি জটপাকানো ধারা তুলে ধরা আকারকে চিন্তার বিমূর্ত বিষয় হিসাবে তুলে ধরা সাধারণ একটি ধারণা হাজির করেছে তবে সবসময়ই চতুর্থ শতাব্দীর একটি আপাত অস্থিতিশীল ও অস্বস্তিকর বিশ্বে কিভাবে এই বিমূর্ত ধারণার বাস্তব প্রাসঙ্গিকতা থাকতে পারে সেটা বের করার চেষ্টা করেছেন। 

ভালোত্বের প্রকৃত চরিত্র আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছিলেন সক্রেটিস, কিন্তু কাউকে সন্তুষ্ট করার মতো উপায় রূপ দিতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না-হয়তো নিজেকেও না। প্রাথমিক সংলাপে প্লেটো সম্ভবত গুরুর প্রক্রিয়াই কঠোরভাবে অনুসরণ করেছেন। আমরা যেমন দেখেছি, সক্রেটিসের জবানীতে আলোচকদের একটি সাধারণ মাণদণ্ড খুঁজে পাওয়ার আশায় সাহসের মতো একটি গুণের বিভিন্ন নজীর বিবেচনার জন্যে বলেছেন তিনি। এক ধরনের আচরণ সাহস হয়ে থাকলে আর অন্য ধরনের আচরণ সাহস না হলে কিভাবে আদৌ তা আমাদেরকে সাহসের প্রকৃতি জানাতে পারে? গুণ কি তাই যদি না জানেন, আপনি সাহসিক ভূমিকা পালন করবেন কিভাবে? তাঁর সময়ের রাজনৈতিক টালমাতাল অবস্থায় যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রব্যবস্থার সমর্থকরা-ডেমোক্র্যাসি, অলিগার্কি, স্বৈরাচার, অভিজাততন্ত্র, রাজতন্ত্র-জোরের সঙ্গে যার যার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছিল, ভালো সরকারের সুপ্ত নীতিমালা খোঁজ পাওয়াই সমাধান পাওয়ার একমাত্র আশা ছিল বলে বিশ্বাস করেছিলেন প্লেটো। সক্রেটিসের মতো সোফিস্টদের আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন তিনি। ধ্রুব ও অপরিবর্তনীয় কিন্তু যৌক্তিক ভাবনার স্থিতিশীল প্রয়াসে আয়ত্ত করা সম্ভব বাস্তবতার একটি মাত্রা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। 

তারপরেও একটি অসাধারণ প্রস্তাবনা রাখার ভেতর দিয়ে সক্রেটিসের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন প্লেটো। গুণ দৈনন্দিন জীবনের আচরণের পুঞ্জীভূত উদাহরণ দিয়ে নির্মাণ করার মতো বিষয় নয় বলে যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি। এটা স্বাধীন অস্তিত্ব, বস্তুগত মাত্রার চেয়ে উচ্চতর মাত্রায় অবস্থানকারী বাস্তব সত্তা। ভালোত্ব, ন্যায়বিচার বা সৌন্দর্যের মতো ধারণাগুলো ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব যোগ্য নয়, আমরা এগুলো ছুঁতে, শুনতে পারি না বা দেখতে পাই না, কিন্তু প্রতিটি মানুষের আত্মায় (সাইকি) বিরাজ করা যুক্তিপ্রয়োগের ক্ষমতা থেকে এগুলোকে উপলব্ধি করা যায়। আমাদের বস্তুগত বিশ্বের সমস্ত কিছুরই-সাহস, ন্যায় বিচার, বিশালত্ব—এমন কি একটি টেবিলেরও-একটি চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় রূপ রয়েছে। আমাদের মনে নদীর আকার রয়েছে বলে কোনও নদীর তীরে দাঁড়ালে আমাদের সামনের ওই জলাধারটি যে নদী, পুকুর বা সাগর নয়, আমরা সেটা বুঝতে পারি। কিন্তু চিরন্তন এই ধারণা আমাদের নিজেদের সুবিধার জন্যে সৃষ্টি করা কিছু নয়। আপনা থেকেই অস্তিত্ববান। উদাহরণ স্বরূপ, এই জগতে দুটি জিনিস সমানভাবে সত্যি নয়, তারপরেও আমাদের ভেতর পরম সাম্যের ধারণা রয়েছে, যদিও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এর কোনও অভিজ্ঞতাই নেই। ‘বস্তুসমূহের কোনও কোনও না কোনও স্থির সত্তা বা তাদের নিজস্ব মূল রূপ রয়েছে,’ সক্রেটিসকে দিয়ে বলিয়েছেন প্লেটো। ‘এগুলো আমাদের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এবং আমাদের কাছে উপস্থিত হওয়ার ধরনে পরিবর্তিত হয় না। এগুলো স্বভাবজাতভাবেই তাদের নিজস্ব সত্তা বা মূল রূপের সাপেক্ষে স্বয়ংসম্পূর্ণ।৭৮ 

গ্রিক শব্দ আইডিয়া দিয়ে আধুনিক ইংরেজি ভাষা অনুযায়ী ‘আইডিয়া’ বোঝায়নি। আইডিয়া বা এদোস কোনও একান্ত, মনোগত সৃষ্টি নয়, বরং একটি ‘আকার,’ ‘নকশা’, বা ‘মূলসত্তা’। আকার বা আইডিয়া একটি আদিআদর্শ, প্রতিটি বিশেষ বস্তুকে স্পষ্ট রূপ ও অবস্থা দেওয়া আদি নকশা। প্লেটোর দার্শনিক ধারণাকে প্রতিটি পার্থিব বস্তু বা অভিজ্ঞতার স্বর্গীয় বলয়ে একটি প্রতিরূপ থাকার প্রাচীন চিরন্তন দর্শনের একটি যৌক্তিক ও আত্মস্থঃ প্রকাশ হিসাবে দেখা যেতে পারে।” অ্যাক্সিয়াল-পূর্ব কালে এই ধারণা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তো মর্ত্য জগতে অপরিণতভাবে প্রকাশিত পরমের জগৎ সংক্রান্ত প্লেটোর ধারণা আধুনিক পাঠকদের চেয়ে তাঁর সমসাময়িকদের কাছে কম বিচিত্র মনে হয়েছে। সময়ের জগতে আকারগুলো নিজেদের প্রকাশ করে, কিন্তু সেগুলো উন্নত, ঐশ্বরিক ও সময়হীন। এগুলো আমাদের জীবনকে আকার দেয়, তবে তাকে ছাপিয়ে যায়। এখানকার সবকিছুই অবিরাম বদলে যাচ্ছে, মারা যাচ্ছে। সুন্দরী কোনও নারী তার সৌন্দর্য হারালেও খোদ সৌন্দর্য অস্তিত্ববান থাকে বলে যুক্তি দেখিয়েছেন প্লেটো। তার কাছে পরম সৌন্দর্য ছিল না-পার্থিব কোনও সত্তারই তা নেই-কিন্তু সৌন্দর্যে অনুপ্রাণিত ছিল সে এবং এই চিরন্তন গুণে অংশ নিয়েছে। তার সৌন্দর্য তার বোন বা কোনও কবিতা, পাহাড় বা ভবনের সৌন্দর্য সৌন্দর্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু আমাদের সবারই চিরন্তন আকার সম্পর্কে সহজাত জ্ঞান থাকায় লোকে একে চিনতে পারে। সুন্দরীর প্রেমে পড়লে আমরা তার ভেতর প্রকাশিত সৌন্দর্যের কাছে আত্মসমর্পণ করি। সৌন্দর্যের পার্থিব ত্রুটিপূর্ণ প্রকাশের ভেতর দিয়ে আড়ালে অবস্থিত চিরন্তন আকারকে দেখার জন্যে আলোকিত পুরুষ বা নারী (মেয়েরাও এই জ্ঞান উপভোগ করতে পারে বলে প্লেটো বিশ্বাস করতেন) নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তুলবে। 

এভাবে আকারের বলয় ছিল মুখ্য এবং আমাদের বস্তু জগৎ গৌণ ও উদ্ভুত, ঠিক চিরন্তন দর্শনে পার্থিব জগতের তুলনায় স্বর্গীয় বলয় যেমন উন্নত ও দীর্ঘস্থায়ী ছিল। আকারের এক ধরনের বাস্তবতার প্রাবল্য আছে যা ক্ষণস্থায়ী বিষয় ধারণ করতে পারে না। আমরা কোনও ব্যক্তি, কাজ, বা কোনও বস্তুতে ত্রুটিপূর্ণভাবে প্রকাশিত আকারের দর্শন পেলে তার সুপ্ত মূল সত্তাকে দেখি এবং তার পার্থিব প্রকাশ থেকে ঢের বেশি খাঁটি এক সত্তার স্তরের মুখোমুখি হই। ঝুয়াংঝি আর বুদ্ধের মতোই প্লেটো উপলব্ধি করেছিলেন যে, আমরা এই মর্ত্যে যা কিছু দেখি সবই অবিরাম ভিন্ন কিছুতে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু আকারসমূহ পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় জড়িত নেই। এগুলো স্থির, পরিবর্তনহীন ও অমর। সবসময় সহজাতভাবেই অসন্তোষজনক-বা যেমনটা বুদ্ধ হয়তো বলতেন, দুঃখ-দার্শনিক ইন্দ্রিয়জ তথ্যের উপর ভিত্তি না করে খাঁটি যুক্তির চর্চার সাহায্যে জ্ঞানের অনুশীলনের মাধ্যমে অর্থের গভীরতর অর্থের খোঁজ করেন দার্শনিক। 

প্লেটো হয়তো প্রাচীন পৌরাণিক ধারণায় ফিরে গিয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু আবার তাঁর কালের গণিতবিদদের দ্বারাও অনুপ্রাণিত ছিলেন। একাডেমির দরজার মাথায় এই লক্ষ্যটি খোদাই করা ছিল: ‘জ্যামিতির সঙ্গে পরিচয়হীন কেউ যেন এখানে প্রবেশ করতে না পারে।’ গণিতের উপর প্রশিক্ষণ অবিশ্যিক ছিল। পিথাগোরিয়দের মতো মহাবিশ্ব সংখ্যা ও জ্যামিতির মৌলিক ধারণার ভিত্তিতে বিন্যস্ত হয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন প্লেটো। প্রাকৃতিক বস্তুতে আমরা কখনওই একটি বৃত্ত বা ত্রিভুজ দেখি না, কিন্তু এইসব আকার বাস্তবে দেখা সব বস্তুকে ভিত্তি দিয়েছে। আমাদের চারপাশের গোছাল বিশ্বের উপর বিন্যস্ত ‘মন এগুলো আরোপ করেনি বরং স্বাধীনভাবে এগুলোকে অনুভবকারী বুদ্ধিবৃত্তিকে অতিক্রম করে অস্তিত্ববান রয়েছে বলে বিশ্বাস ছিল প্লেটোর। সুতরাং, চিন্তার সাধারণ ধারায় নয় বরং প্রশিক্ষিত বুদ্ধিমত্তার সাহায্যেই এগুলো পাওয়া গেছে বা আবিষ্কৃত হয়েছে। এমনকি গণিতবিদরা আজও তাদের শাস্ত্র নিয়ে প্লেটোর কায়দায় কথা বলে থাকেন। ‘কেউ যখন কোনও গাণিতিক সত্য “দেখে”,” বলেছেন রজার পেনরোজ, “তার চেতনা ধারণার জগতে প্রবেশ করে এবং তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। ১ 

কিন্তু কেবল বেদনাদায়ক ও পরিশ্রমের ভেতর দিয়েই এই জ্ঞান পাওয়া গেলেও সেটা একজন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষের আওতাধীন বলেই বিশ্বাস করতেন প্লেটো। এটা নিয়েই আমরা জন্ম নিয়েছি। একে কেবল জাগিয়ে তুলতে হবে। বাইরে থেকে সত্যির সঙ্গে মনের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় না, বরং জন্মপূর্ব অস্তিত্ব থেকে তাকে ‘স্মরণ’ করতে হয়, যখন প্রতিটি নারী বা পুরুষ আকারের প্রত্যক্ষ জ্ঞান উপভোগ করেছিল। প্রতিটি আত্মা (সাইকি) বহুবার জন্ম নিয়েছে, ব্যাখ্যা করেছেন প্লেটোর সক্রেটিস, এবং এখানকার ও পাতালের সমস্ত ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছে। তার শেখার বাইরে কিছুই নেই, সুতরাং, গুণ ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আগে থেকে জানা বিষয় স্মরণ করতে পারার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই… কারণ সামগ্রিকভাবে অনুসন্ধান ও শিক্ষা তো স্মৃতিচারণই।”২ এক দাস বালককে কাছে ডেকে একটা জটিল জ্যামিতি সমস্যার সমাধান বের করার কাজে সাহায্য করতে বলে এর উদাহরণ দিয়েছেন তিনি। তিনি দাবি করেছেন, তিনি কেবল ছেলেটিকে তার অতীত অস্তিত্ব থেকে জানা কিন্তু বিস্মৃত জিনিস মনে করিয়ে দিয়েছেন। 

আমাদের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতাকে অতিক্রম করে যাওয়া কিন্তু আমাদের বোধগম্য ও মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক বাস্তবতার একটা মাত্রা থাকার বহু অ্যাক্সিয়াল যুগ দার্শনিকের বিশ্বাসটুকু ধারণ করতেন প্লেটো। কিন্তু তবু অন্যরা যেখানে ন্যায়-ভিত্তিক যুক্তি প্রয়োগ করে এই অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করা সম্ভব নয় বলে বিশ্বাস করতেন প্লেটো সেখানে সম্ভব মনে করতেন। কিন্তু জ্ঞানকে আবিশ্যিকভাবে স্মৃতিচারণ বলে তাঁর জোর আরোপ এই কঠোর দ্বান্দ্বিকতা শীতলভাবে বিশ্লেষণমূলক নয়, বরং স্বজ্ঞাপ্রসূত; সহজাত এই জ্ঞানের পুনরুদ্ধার খোদ মনকে যেন বিস্মিত করে তুলেছে বলে মনে হয়েছে। এটা ঠিক, কোনও একটি ধারণার অনুসন্ধান করতে বা সমস্যার মূলে প্রবেশ করার জন্যে কিছু কিছু সংলাপ ব্যবহার করেছেন প্লেটো।” কিন্তু একথাও ঠিক যে, প্লেটোর যৌক্তিক অনুসন্ধান আবেগময় ও রোমান্টিক ছিল। প্রাচীন গ্রিসে যুক্তি অর্থ ও মূল্যের খোঁজে ‘শীতল’ নয় বরং ‘তপ্ত’, আধ্যাত্মিক অন্বেষা ছিল। এটা সাইকিকে লক্ষ্য শনাক্ত করতে সাহায্য করত এবং তা অর্জন করার লক্ষ্যে আকাঙ্ক্ষাকে সামাল দিতে শেখাত। টিকে যাওয়া বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন টেক্সট থেকে আমরা যতটা বলতে পারি, এর আগপর্যন্ত গ্রিক দার্শনিকরা প্রায়শঃই নিজেদের অভিজ্ঞতার মতবাদগত, বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যায় বন্দী করে রেখেছিলেন। একাডেমিতে গ্রিক শিক্ষা অধিকতর আধ্যাত্মিক হয়ে উঠেছিল। 

প্লেটো প্রায়শঃই আলোকন ও পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া বর্ণনা করতে গিয়ে ইউলিসিনিয় ও দিনোসিনিয় শব্দমালা ব্যবহার করতেন। অবশ্য, আচার ও নাটকীয় নিবেদনের সাহায্যে অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের বদলে তাঁর শিষ্যরা অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টসাপেক্ষ এক দ্বান্দ্বিকতার চর্চার ভেতর দিয়ে তাদের চেতনার বিকল্প মাত্রায় ঠেলে দিয়েছে বলে মনে হওয়া আকারের দর্শনে প্রবেশ করতেন। সত্তার উচ্চতর মাত্রায় অতীন্দ্রিয় আরোহণ হিসাবে এই প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করা হয়েছে, যে দীক্ষা অভিকাঙক্ষীকে পুলকের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এলিউসিসের মিস্তাই-এর অভিজ্ঞতার চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন ছিল না। সিম্পোজিয়ামে সক্রেটিসকে দিয়ে অন্বেষণকে অনুসন্ধানীকে স্বাভাবিক ধারণার ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া এক ধরনের একতাসিস লাভ না করা পর্যন্ত তার গোটা সত্তাকে অধিকার করে নেওয়া প্ৰেম বলে বর্ণনা করিয়েছেন প্লেটো। দিওতিমা নামে পরিচিত এক পুরোহিতনীর কাছ থেকে এই তথ্য পেয়েছেন বলে ব্যাখ্যা করেছেন সক্রেটিস; যিনি তাঁর মিস্তাই-কে সুন্দর দেহের প্রতি তাদের ভালোবাসাকে পরিশুদ্ধ করে কিভাবে আদর্শ সৌন্দর্যের তুরীয় আনন্দের ধ্যানে (থিয়োরিয়া) পরিণত করা সম্ভব সেটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথমে দার্শনিক শিক্ষাব্রতী স্রেফ তার দয়িতের দৈহিক পূর্ণতায় পরম আনন্দে ফেটে পড়ে, তারপর আবিষ্কার করতে শুরু করে যে এই মানুষটি অন্যান্য সত্তায়ও অস্তিত্ববান সৌন্দর্যের একটি প্রকাশমাত্র। দীক্ষার পরের পর্যায়ে সে বুঝতে পারে, দৈহিক সৌন্দর্য এমনকি শারীরিকভাবে কুৎসিত ব্যক্তির ভেতর অস্তিত্ববান হতে পারে এমন অধিকতর অধরা সৌন্দর্যের কাছে গৌণ। সবশেষে ব্যাখ্যা করেছেন দিওতিমা, ‘দীক্ষার সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যার দেখা পেতে সে এত কঠোর পরিশ্রম করেছিল সেই সৌন্দর্যের খোদ আত্মা, হতবুদ্ধিকর দর্শন তার উপর বিস্ফোরিত হয়। এই সৌন্দর্য চিরন্তন; একে আর কোনও বিশেষ বস্তুতে বন্দী করে রাখা যাবে না, বরং ‘পরম, অনন্য, চিরন্তন হিসাবে নিজের মাঝেই অস্তিত্ববান। অন্য সবকিছুই এর মাঝে অংশ নেয়, কিন্তু সেটা এমনভাবে যে সেগুলো অস্তিত্ব পেয়ে ফের বিলীন হয়ে যাওয়ার সময় যেমন বৃদ্ধি পায় না তেমনি কোনও পরিবর্তনও ভোগ করে না। সাইকি ‘ভালোবাসার রহস্যের দীক্ষা’ পেয়েছে এবং এই বস্তুগত জগৎ পেছনে ফেলে এসে খোদ সৌন্দর্যের পরম জ্ঞান অর্জন করেছে। 

আমরা আধুনিক মানুষরা ভাবনাকে আমরা কিছু করছি বলে মনে করি। কিন্তু প্লেটো একে মনের মাঝে ঘটে যাওয়া কিছু ভেবেছেন: চিন্তার বিষয়বস্তু যে তাদের দেখতে শেখে তার সাইকিতে সজীব বাস্তবতা। সৌন্দর্যের দর্শন কেবল নান্দনিক অভিজ্ঞতা নয়। একবার এর অভিজ্ঞতা লাভ করার পর লোকে এক গভীর পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে বলে আবিষ্কার করে এবং তখন আর জীর্ণ অনৈতিক পথে জীবন যাপন করতে পারে না। এই জ্ঞান অর্জনকারী কেউ ‘কেবল ভালোত্বের প্রতিফলিত ইমেজই সৃষ্টি করতে পারে না, বরং সত্যিকারের ভালোত্ব আনতে পারে, কারণ তখন সে ভালোত্বের ইমেজের সঙ্গে নয় বরং সত্যির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে উঠবে। এক মৌলিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছে সে: ‘সত্যিকারের ভালোত্বের সৃজন ও চর্চা করে ঈশ্বরের ভালোবাসার পাত্রে পরিণত হতে পারবে সে, মানুষের পক্ষে কখনও অমর হওয়া সম্ভব হলে অমর হতে পারবে।৮৭ প্লেটোর সৌন্দর্যের বর্ণনা অন্যরা যাকে ঈশ্বর বা পথ বলে তার স্পষ্ট অনুরূপ:

এই সৌন্দর্য চেহারা বা হাতের সৌন্দর্যের মতো বা বাস্তব কোনও কিছুর মতো, কিংবা কোনও ভাবনা বা বিজ্ঞানের সৌন্দর্যের মতো, বা নিজে ছাড়া অন্য কোনও জীবিত প্রাণী হোক বা পৃথিবী বা আকাশ বা অন্য যেকোনও কিছুর মাঝে অবস্থানকারী কোনও সৌন্দর্যের মতো উপস্থিত হবে না। 

ঈশ্বর, ব্রাহ্মণ বা নিব্বানার মতোই এটা চরম দূয়ে: ‘পরম, নিজের মাঝেই একাকী অবস্থানকারী, অনন্য, চিরন্তন।৮৮ 

কিন্তু সৌন্দর্যের দর্শনই অন্বেষার শেষ ছিল না। এটা নিরন্তর মানবজাতি আকাঙ্ক্ষা করে এমন সমস্ত কিছুর মূল সত্তা, ভালোর দিকে ইঙ্গিত করে চলে। অন্য সমস্ত আকার ভালোর ভেতর বিলীন এবং তার কাছে পুষ্টি লাভ করে। ভালোর ভেতর সব কিছু এক হয়ে যায়। ভালো বর্ণনার অতীত; প্লেটোর সক্রেটিস দ্য রিপাবলিকের গুহার উপমায় কেবল রূপক কাহিনীর সাহায্যেই সবচেয়ে সুন্দরভাবে এর কথা বলেন। এখানে সারা জীবন এক গুহায় বন্দীদের মতো শেকলে বাঁধা একদল লোকের কথা কল্পনা করেছেন সক্রেটিস। সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখা হয়েছিল তাদের, বাইরে থেকে পাথুরে দেওয়ালে প্রতিফলিত ছায়াই শুধু দখতে পেত তারা। অনালোকিত মানবীয় অবস্থার একটা ইমেজ ছিল এটা যেখানে প্রত্যক্ষভাবে আকার দেখা ছিল অসম্ভব। আমরা আমাদের বঞ্চিত অবস্থায় এমনভাবে শর্তাধীন যে এসব ক্ষণস্থায়ী ছায়াকেই বাস্তব ধরে নিই। এই বন্দী দশা থেকে মুক্তি পেলে উজ্জ্বল সুর্যালোক আর গুহার বাইরের সদাপ্রাণচঞ্চল জীবনের অস্তিত্ব দেখে আমরা রীতিমতো হতবাক হয়ে যাব। আমাদের পক্ষে হয়তো সেটা অসহনীয় হয়ে উঠবে। তখন আমাদের পরিচিত আলোআঁধারির অস্তিত্বেই ফিরে চাইব আমরা। 

সুতরাং, সক্রেটিস ব্যাখ্যা করেছেন, আলোর দিকে উর্ধ্বারোহণ অবশ্যই ধীরে স্থির হতে হবে। সূর্যালোক ভালোকে প্রতীকায়িত করেছে। ঠিক বাস্তব আলো যেমন আমাদের স্পষ্ট করে দেখতে সক্ষম করে তোলে তেমনি ভালোই সত্যিকারের জ্ঞানের উৎস। আমরা মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তির মতো ভালোকে প্রত্যক্ষ করার সময় বুঝতে পারি আসলে কি আছে সেখানে। সূর্য বিভিন্ন বস্তুকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে, পুষ্টি যোগায়; ভালোর মতো এটাই অস্তিত্বের কারণ এবং এভাবে আমাদের সাধারণ জীবনে আমরা যা কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করি তার পটভূমিতে অবস্থান করে। অন্বেষার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শেষে আলোকিত আত্মা সাধারণ মানুষ যেমন স্পষ্টভাবে সূর্যকে দেখে ঠিক সেভাবে ভালোকে দেখতে পাবে। কিন্তু এখানেই যাত্রার শেষ নয়। মুক্তিপ্রাপ্ত লোকেরা হয়তো বাইরে থেকেই রোদ পোহাতে চাইতে পারে-ঠিক বুদ্ধ যেভাবে নিব্বানার প্রতুল শান্তি উপভোগ করতে চেয়েছিলেন—কিন্তু গুহার সতীর্থদের সাহায্য করার জন্যে আবার তাদের গুহায় ফিরে যাওয়ার দায়িত্ব রয়ে গেছে। ‘সুতরাং তোমাদের প্রত্যেককেই পালা করে অন্যদের সাধারণ বসবাসের জায়গায় বাস করার জন্যে ফিরে যেতে হবে,’ জোর দিয়েছেন সক্রেটিস। ‘ওখানকার লোকদের চেয়ে ঢের ভালোভাবে দেখতে পাবে তোমরা। এবং চমৎকার, ন্যায্য এবং ভালো জিনিসের সত্যি জানতে পেরেছ বলে প্রতিটি ইমেজ আসলে কি বুঝতে পারবে। তারা হয়তো বা বৈরী সম্বর্ধনা পেতে পারে। এখন অন্ধকারের কারণে বিস্মিত হবে তারা; সাবেক সঙ্গীরা তাদের উদ্দেশ্যে হাসতে পারে, বলতে পারে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে ওরা। একজন আলোকিত মানুষ ‘ছায়াকে শনাক্ত করার বেলায় চিরস্থায়ী বন্দীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে?’৯১ কিভাবে। বন্দীরা এমনকি মুক্তিদাতার উপর হামলেও পড়তে পারে, তাকে হত্যা করতে পারে, ঠিক যেভাবে, বোঝাতে চেয়েছেন প্লেটো, অ্যাথেনিয়রা ঐতিহাসিক সক্রেটিসকে হত্যা করেছে। 

প্লেটোর আদর্শ প্রজাতন্ত্রের রাজনৈতিক বর্ণনার ক্ষেত্রে গুহার রূপক গুরুত্বপূর্ণ। অনালোকিতদের অপরিপক্ক দর্শন বর্ণনা করার পাশাপাশি সবসময় তাঁর মতাদর্শের বাস্তব প্রয়োগ দেয়ালের বুকে ছায়ার দিকে ফিরে এসেছেন তিনি, আবার নিপীড়ন ও আত্ম-সন্তুষ্টির কল্পনাকে ঘিরে আবর্তিত সমসাময়িক রাজনীতির ক্ষণস্থায়ী কুহকও প্রকাশ করেছেন। দ্য রিপাবলিকে প্লেটো দেখাতে চেয়েছিলেন যে ন্যায়বিচার যৌক্তিক এবং শাসকরা যুক্তি দিয়ে পরিচালিত হয় এমন একটি শোভন সমাজে বেড়ে উঠলেই কেবল যেভাবে বাঁচা উচিত মানুষ সেভাবে বাঁচতে পারে। এই টেক্সটে বিতৃষ্ণা জাগানো ও অভিজাতপন্থী অনেক কিছু আছে। উদাহরণ স্বরূপ, প্লেটোর ইউটোপিয় নগরগুলোয় জেনেটিক এঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে: কম ক্ষমতার অধিকারী নাগরিকদের প্রজনন থেকে নিরুৎসাহিত করা হবে; ত্রুটিপূর্ণ নবজাতকদের গোপনে মেরে ফেলা হবে এবং অধিকতর প্রতিশ্রুতিশীলদের বাবা-মার কাছে থেকে সরিয়ে নিয়ে রাষ্ট্রীয় নার্শারিতে পোলিসের বিচ্ছিন্ন ক্ষেত্রে বড় করা হবে। সবচেয়ে প্রতিভাবানদের গুহা থেকে ঊর্ধ্বরোহণে শেষ হওয়া দীর্ঘ কষ্টকর শিক্ষা কার্যক্রমের অধীনে নিয়ে যাওয়া হবে। আলোকিত নাগরিক জীবনে দীক্ষা লাভের শেষ পর্যায়ে ভালো কি নিজেরাই দেখতে পাবে তারা এবং এভাবে প্রজাতন্ত্রে শান্তি ও ন্যায় বিচার নিয়ে আসা অন্তস্থঃ স্থিতিশীলতা অর্জন করবে। 

এভাবে, এখনকার অধিকাংশ শহরের মতো যারা ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং শাসন ক্ষমতার জন্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইতে লিপ্ত-যেন এটা বিরাট ভালো কাজ—সেইসব মানুষের হাতে নয়, বরং তোমাদের ও আমাদের জন্যে সেইসব লোকের হাতে নগরী পরিচালিত হবে শাসিত হবে যারা স্বপ্ন দেখে না, বরং সজাগ, কারণ নিশ্চয়ই সত্য হচ্ছে: এমন এক শহর যার শাসকগণ অন্তত গৃহযুদ্ধ থেকে মুক্ত থাকার প্রয়োজন থেকেই শাসন করতে উদগ্রীব। ১২ 

প্লেটো প্রায় নিশ্চিতভাবেই তাঁর কাল্পনিক প্রজাতন্ত্রকে প্রকৃত রাষ্ট্রের নীলনকশা ভাবেননি এবং সম্ভবত স্রেফ আলোচনাকে প্রাণবন্ত করতেই একে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তাঁর ইউটোপিয়ার সহজাত নিষ্ঠুরতা অ্যাক্সিয়াল যুগের সমমর্মিতার রীতি থেকে বিচ্যুতি ছিল। 

দ্য রিপাবলিক কর্তৃত্ববাদী ছিল। এটা অন্যের উপর নিজের দর্শন চাপিয়ে দেয়-যে কৌশলকে, উদাহরণ স্বরূপ, বুদ্ধ ‘অদক্ষ’ বলে আবিষ্কার করতেন। জনকল্যাণের ফুরসত ছিল না প্লেটোর। কবিতা ও সঙ্গীতের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করা প্রচলিত গ্রিক শিক্ষা পদ্ধতিকে তীর্যক দৃষ্টিতে দেখেছেন তিনি, শিল্পকলা অযৌক্তিক আবেগকে উস্কে দেয় বলে বিশ্বাস করতেন। প্লেটোর প্রজাতন্ত্র ব্যক্তিগত সম্পর্ককে উৎসাহিত করবে না: যৌনতা স্রেফ বংশগতি অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নাগরিক জন্ম দেওয়ার লক্ষ্যে পরিণত হবে। প্লেটো তাঁর আদর্শ পোলিস থেকে ট্র্যাজিডি বাতিল করে দিতে চেয়েছিলেন। চতুর্থ শতাব্দীতে নতুন নতুন ট্র্যাজিডি সারা অ্যাট্টিকায় বিশাল দর্শকগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করে চলছিল। কিন্তু অ্যাথেনিয়রা দারুণ নষ্টালজিয়া নিয়ে অ্যাচিলাস, সফোক্লিস এবং ইউরিপিদিসের কথা ভাবত এবং তাদের ট্র্যাজিক দর্শনের আকাঙ্ক্ষা করত।৯৪ কিন্তু ট্র্যাজিডির দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন প্লেটো। এর নৈরাশ্যবাদিতা ও মানবীয় সম্ভবনার নেতিবাচক মূল্যায়ন অপছন্দ করতেন তিনি, দেবতাদের ব্যাপারে এর সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি মারাত্মক নাস্তিবাদের জন্ম দিতে পারে বলে বিশ্বাস করতেন। ট্র্যাজিক নায়কদের সঙ্গে সহানুভূতি বোধ করার মানে স্রেফ পরোক্ষে জীবনের ম্লান মূল্যায়নকেই সমর্থন করা এবং সান্ত্বনার অতীত শোক ও সামালের অতীত ক্রোধকে উৎসাহিত করা। ট্র্যাজিডির এমনকি গুণবান নাগরিকদের আত্মাকেও ‘বিবশ’ ও জীবনকে ‘আরও খারাপ ও করুণ’ অবস্থার প্রতি উন্মুক্ত করে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। সবার উপরে ট্র্যাজিডি বিষণ্ণ হওয়ার সাধারণ প্রবণতাকে পুঞ্জীভূত করে এবং তার ফলে ‘আবেগীয় আত্মসমৰ্পণ’ অনুপ্রাণিত হতে পারে। ৫ নিজের জন্যে শোক ও অন্যের প্রতি করুণাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ও সামলে রাখতে হবে। প্রকৃতপক্ষে অন্যের সঙ্গে সহানুভূতি প্রকাশ করা এবং তাদের দুর্ভোগের ভাগ নেওয়া, কোরাস যেভাবে দর্শকদের করতে বলেছে, ভালো মানুষের মিতাচার ও আত্মসংযমকে বিপজ্জনকভাবে খাটো করে। গুণের সঙ্গে বেমানান বলে সমাজকে অবশ্যই এই স্বাভাবিক সহানুভূতিকে দমন করার সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ৬ 

মেনসিয়াসের মতো সহানুভূতির ‘অঙ্কুর’-এর পরিচর্যার বদলে প্লেটো একে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছেন। তাঁর পরবর্তী সময়ের রচনায় দ্বিতীয় সিসিলিয় অভিযানের কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে এমন এক ধরনের কঠোরতা লক্ষ করি আমরা। সিরাক্রুজের স্বৈরাচারী প্রথম দিওনিসাসের মৃত্যুর পর বোকার মতো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েন প্লেটো যার ফলে ৩৫৪ সালে তাঁর পুরোনো অনুগ্রহভাজন দিওন আততায়ীর হাতে নিহত হন। এক পর্যায়ে প্লেটোকে গৃহবন্দী রাখা হয়, অল্পের জন্যে মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রেহাই পান তিনি। তাঁর দার্শনিক ধ্যানধারণা শুধু সম্পূর্ণ অকার্যকর প্রমাণিত হয়নি, বরং তিনি স্বয়ং ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন এবং এর পর থেকে কঠোর পথ অনুসরণ করেছেন। 

প্লেটোর আকারের দর্শন গ্রিক ধর্মে এক নতুন গতিময়তা যোগ করেছিল। হোমারের আমল থেকে গ্রিকদের বাস্তবতাকে স্বরূপেই মেনে নিতে উৎসাহিত করে আসা হয়েছিল, একে অতিক্রম করার বা নিজেদের অবস্থার খোলনলচে পাল্টে ফেলার কোনও ইচ্ছা তাদের ছিল না। কবি, বিজ্ঞানী এবং ট্র্যাজিডিয়ানরা অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী, মূমুর্ষু এবং প্রায়শঃই নিষ্ঠুরভাবে বিধ্বংসী বলে জোর দিয়ে এসেছিলেন। মানুষের জীবন স্রেফ দুঃখ, এমনকি দেবতারাও এই অসন্তোষজনক অবস্থা বদলাতে পারেন না। এটাই আসল বাস্তবতা; একজন পরিপক্ক মানুষকে অবশ্যই বীরের মতো অগ্রাহ্যের ঢঙে বা ট্র্যাজিক কিংবা দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে এর মোকাবিলা করতে হবে। প্লেটো এটা উল্টে দেন। আমাদের পার্থিব, জাগতিক জীবন প্রকৃতপক্ষেই কষ্টকর ও ভুল, কিন্তু এটাই প্রকৃত বাস্তবতা নয়। আকারের অপরিবর্তনীয়, চিরন্তন জগতের তুলনায় এটা অবাস্তব। এবং এই নিখুঁত জগৎ মানুষের বোধগম্য। এক দীর্ঘ কষ্টসাপেক্ষ দার্শনিক দীক্ষা লাভে তৈরি থাকলে দেবতাদের কোনও সাহায্য ছাড়াই তাদের আত্মা স্বর্গীয় জগতে আরোহণ করতে পারবে এবং এক সময় অলিম্পিয়দের অধিকারে থাকা এক ধরনের অমরত্ব অর্জন করবে। প্লেটোর পর দেবতাদের অতীতে অবস্থানকারী এক অনির্বচনীয় বাস্তবতার জন্যে আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়েছিল। 

অবশ্য পরের বছরগুলোতে জগৎ হতে মুখ ফিরিয়ে নেন প্লেটো, ফলে তাঁর ধর্মতত্ত্ব আরও কঠিন হয়ে ওঠে। তিমাকাসে প্লেটো বলেছেন যে বিশ্বজগৎ চিরন্তন ও সম্পূর্ণ ভালো, কিন্তু সর্বশক্তিমান নন, এমন এক ঐশী কারুশিল্পীর (দেমিওরগোস) হাতে সৃষ্টি হয়েছে; বেছে নেওয়া মহাবিশ্বের ধরন থেকে স্বাধীন নন তিনি, বরং আকারের উপর ভিত্তি করে সৃষ্টিতে বাধ্য হয়েছেন। মানুষের ব্যাপারে তাঁর কোনও আগ্রহ না থাকায় এই কারুশিল্পী ধর্মীয় অন্বেষার সূচনাকারীর মতো কোনও সত্তা নন। তিনি পরম ঈশ্বর নন: তাঁরচেয়েও উচ্চতর ঈশ্বরের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু তিনিও মানবজাতির দুঃখদুর্দশার বেলায় অপ্রাসঙ্গিক ছিলেন। ‘এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও পিতাকে পাওয়া যথেষ্ট কঠিন,’ মন্তব্য করেছেন প্লেটো, ‘এমনকি আমি সফল হলেও সবার কাছে তাঁকে তুলে ধরা অসম্ভব। প্লেটোর লক্ষ্য ধর্মীয় ছিল না। তিনি কেবল যৌক্তিক সৃষ্টিতত্ত্ব খাড়া করতে চেয়েছিলেন: ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবে অনুসন্ধান করা সম্ভব যুক্তিতে অনুপ্রাণিত আকার অনুযায়ী সৃষ্টি তাঁর মহাবিশ্বের বোধগম্য নকশা ছিল। খেয়ালি অলিম্পিয়ান হস্তক্ষেপের আর সুযোগ ছিল না। মহাবিশ্ব একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা অনুযায়ী শাসিত হয়ে থাকে, যৌক্তিকভাবে নিজেদের এর প্রতি প্রয়োগ করলে মানুষ একে উপলব্ধি করতে পারবে। 

প্রকৃতপক্ষেই, যৌক্তিক মন (নাউস) আর আত্মা (সাইকি) সহ এভাবে সৃষ্ট মহাবিশ্ব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গাণিতিক অনুপাত ও স্বর্গীয় বস্তুনিচয়ের নিয়মিত আবর্তন থেকে উপলব্ধি করা সম্ভব খোদ জীবিত সত্তা। খোদ নক্ষত্রমণ্ডলী স্রষ্টার ঐশী সত্তায় অংশ নেয়; তারা ‘দৃশ্যমান ও সৃষ্ট দেবতা,’ গাইয়া, অর্থাৎ পৃথিবী ‘সবচেয়ে জ্যেষ্ঠত্ব নিয়ে সবার আগে’; তাকেও নিখুঁত মডেল অনুয়ায়ী সৃষ্টি করা হয়েছে।১৮ একইভাবে প্রতিটি মানুষের নাউস ঐশ্বরিক; প্রত্যেকের ভেতরই স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গ দায়মন রয়েছে, ‘মর্ত্য থেকে উর্ধ্বে উঠে স্বর্গে আমাদের স্বগোত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া”“ যার উদ্দেশ্য। সুতরাং, মানবজাতি একটি সম্পূর্ণ যৌক্তিক বিশ্বে বাস করে, যার অনুসন্ধান একাধারে বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক উদ্যোগ ছিল। আলোকিত দার্শনিকের ধর্মবিশ্বাসে পরিণত অলিম্পিয়ান দর্শনকে অতিক্রম করে যাওয়া নতুন স্বর্গীয় ধর্মের সৃষ্টি করেছিলেন প্লেটো। ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হলেও প্লেটোর সব শিষ্য এটা গ্রহণ করেছিলেন এবং একেশ্বরবাদী দর্শনের সঙ্গে মিশে যাওয়ার পর দ্বাদশ শতক পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপের সৃষ্টিতাত্ত্বিক দর্শন হয়ে থাকবে। 

দার্শনিকদের পক্ষে প্লেটোর পবিত্র মহাবিশ্ব অনুপ্রেরণা ছিল: এটা প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করার জন্যে মহাবিশ্বকে ইন্দ্রিয়জভাবে পরখ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। পবিত্রের একটা অংশ ধারণ করে থাকা তাদের মন এই কাজের উপযুক্ত বলে এটা তাদের আশ্বস্ত করেছে। এটা ঐশীকে মানবীয় কাঠামোতে নিয়ে এসে একে বোধগম্য করে তুলেছে। দেবতাদের দেখা সত্যিই সম্ভব-সূর্য, চাঁদ আর তারা-রোজ আকাশের বুকে জ্বলজ্বল করে। পৃথিবীকে বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করার সময় স্বর্গীয় রহস্যে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু দার্শনিক শিক্ষা বিহীন সাধারণ মানুষের কাছে প্লেটোর স্বর্গীয় ধর্ম অর্থহীন ছিল। মানবজাতির প্রতি উদাসীন একজন উপাস্য তাদের জীবনের কোনও অর্থ যোগাতে পারেন না। প্লেটো এর সমাধান যোগানোর চেষ্টা করেছিলেন। অলিম্পিয়ান দেবতা ও বীরেরা এখন দায়মন অনুগত আত্মার ভূমিকা পালনকারী ও অনির্বচনীয় স্বৰ্গীয় জগতের খবর আদান প্রদানকারী-উপদেবতা-হিসাবে বিবেচিত হচ্ছিলেন। 

কেউই কখনও চরমভাবে দুর্বোধ্য ঈশ্বরের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক তৈরি করতে পারবে না, তবে তারা নগর সীমানার অভিভাবক আগন্তুকদের দিকে লক্ষ রাখা যিউস, বিয়ের পৃষ্ঠপোষক হেরা, এবং অভিযানের সময় হোপলাইটদের প্রতি খেয়াল রাখা অ্যাথেনা ও আরেসের প্রতি সম্মান দেখাতে পারবে।১০ অলিম্পিয়দের প্রকৃতি আত্মার মতো অ্যাক্সিয়াল ধর্ম থেকে ক্রমে বাদ পড়ে যাওয়া গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলে পর্যবসিত করা হয়েছিল* অলিম্পিয়রা মর্যাদা হারিয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু তাঁদের প্রথা কাল্ট পোলিসের পক্ষে আবশ্যিক ছিল বলে জোর দিয়েছেন প্লেটো। শেষ রচনা দ্য লজ-এ প্রাচীন উপাসনা গুরুত্বপূর্ণ রয়ে যাওয়া অন্য একটি ইউটোপিয় পোলিস তুলে ধরেছেন তিনি। যুক্তি ও প্রথাগত গ্রিক ধার্মিকতার ভেতর কোনওরকম বিরোধের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন তিনি। অলিম্পিয়ান দায়মনদের অস্তিত্বের পক্ষে কোনও জোরাল প্রমাণের অস্তিত্ব ছিল না, কিন্তু রূপকথার গল্পের মতো এক ধরনের সত্য ধারণ করে বলে প্রাচীন মিথ অস্বীকার করা অযৌক্তিক ও নির্বোধের কাজ ছিল। প্লেটো প্রথাকে সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, উৎসর্গ বা প্রার্থনা দিয়ে অলিম্পিয়ানদের প্রভাবিত করা যাবে না, তবে অনির্বচনীয়, স্বর্গীয় জগতের সঙ্গে এইসব মধ্যস্ততাকারীর সম্পর্কের জন্যে মানুষকে তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে।১০১ তাঁর আদর্শ শহরের অ্যাক্রোপোলিসে অবশ্যই হেস্তার, যিউস এবং অ্যাথেনার উপাসনালয় থাকতে হবে। 

[* গ্রিক অ্যাঞ্জেলস ও লাতিন অ্যাঞ্জেলাস শব্দ দুটির মানে ‘বার্তাবাহক’ আত্মা, আধ্যাত্মিক সত্তা যা মানুষের চেয়ে উন্নত, উপাস্যের পরিচারক।]

এর আগোরা মন্দিরে ঘেরাও হয়ে থাকবে এবং উৎসব, মিছিল, উৎসর্গ, ইত্যাদি অবশ্যই নিয়মনিষ্ঠভাবে পালন করতে হবে। অনেক আগে থেকেই সূর্যের সঙ্গে একাত্ম করে আসা এবং প্লেটোর স্বর্গীয় ধর্মতত্ত্বে সহজেই একীভূত করা সম্ভবপর অ্যাপোলো ও হেলিও তাঁর কাল্পনিক নগরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাস্য ছিলেন। প্রাচীন ও নতুনকে একীভূত করতে চেয়েছিলেন প্লেটো। তাঁর পোলিসের উৎসবের সময় দেবতা ও দায়মনরা অদৃশ্যে থেকে মানুষ অংশগ্রহণকারীদের মাঝে নাচবেন। প্রকৃতপক্ষে এইসব আচারের উদ্দেশ্য ছিল [দেবতাদের সঙ্গে] উৎসবে অংশ নেওয়া। ১০২ এই উৎসবে অতীন্দ্রিয়বাদী রহস্য উদযাপন বোঝাতে ব্যবহৃত শব্দ অরগিয়াজিন সম্পর্কিত ছিল।১০৩ উৎসর্গ অলিম্পিয়ানদের প্রসন্ন করতে পারত না, কিন্তু আত্মাকে উজ্জীবিত করে মানুষকে দুর্জ্জেয়ের একটা অনুভুতি যোগাতে পারত। প্রাচীন ধর্মের প্রতি প্লেটোর স্বীকৃতি সত্ত্বেও একে দর্শনের চেয়ে নিম্নস্তরের মনে করেছেন তিনি। এর পক্ষে সত্যিকারের আলোকন বয়ে আনা সম্ভব নয়: পুরাণ বা আচারের পবিত্র নাটকের ভেতর দিয়ে নয়, কেবল মনের যৌক্তির শক্তির ভেতর দিয়েই আকারকে উপলব্ধি করা সম্ভব। প্রচলিত ধর্মকে অবদমিত করা হয়েছিল: প্লেটোর নিগূঢ় লোগোসের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছিল মিথোসকে। 

দ্য লজ-এ অ্যাক্সিয়াল যুগ থেকে প্লেটোকে আরও দূরে সরিয়ে নেওয়া এক অশুভ নির্দেশনা ছিল।১০৪ তাঁর কল্পিত নগরী ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল। ‘দেবতাদের সম্পর্কে সঠিক ভাবনা প্রতিষ্ঠিত করা এবং তারপর সেই অনুযায়ী সঠিক বা বেঠিকভাবে জীবন যাপন করা’ই১৫ পোলিসের প্রথম দায়িত্ব ছিল। সবার আগে ছিল সঠিক বিশ্বাস; নৈতিক আচরণ দ্বিতীয় পর্যায়ের। প্রচলিত ধর্মতত্ত্ব নৈতিকতার আবিশ্যিক পূর্বশর্ত ছিল। ‘আইন মোতাবেক দেবতায় বিশ্বাসী কেউ কোনওদিন কখনও স্বেচ্ছায় কোনও অপিবত্র কাজ করতে বা বেআইনি কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। ১০৬ অ্যাক্সিয়াল চিন্তকদের কেউই অতীন্দ্রিয়বাদের প্রতি খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করেননি। কেউ কেউ এমনকি এধরনের আঁচ- অনুমানকে ভ্রান্তিপূর্ণ মনে করেছেন। সবার আগে ছিল নৈতিক কর্মকাণ্ড; গোঁড়া বিশ্বাস নয়, বরং সহানুভূতিপূর্ণ কাজই মানুষকে পবিত্রকে উপলব্ধিতে সক্ষম করে তুলেছে। কিন্তু প্লেটোর কাছে বিশ্বাস ছিল বাধ্যতামূলক, এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, একটি ‘নিশি পরিষদকে’ অবশ্যই সাধারণ মানুষের ধর্মতাত্ত্বিক মতামতের তত্ত্বাবধান করতে হবে। বিশ্বাসের তিনটি বাধ্যতামূলক ঘোষণা ছিল: দেবতাদের অস্তিত্ব আছে, তাঁরা মানবজাতির প্রতি খেয়াল রাখেন এবং উৎসর্গ বা প্রার্থনা দিয়ে তাঁদের প্রভাবিত করা যাবে না। রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে পারে বলে নাস্তিক্যবাদ ও আচারের বাস্তব ফলপ্রসূতার উপর কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস হবে প্লেটোর আদর্শ পোলিসে শাস্তিযোগ্য গুরুতর অপরাধ। নাগরিকদের অলিম্পিয়ান দেবতাদের অস্তিত্বে সন্দেহ প্রকাশ বা তাঁদের সম্পর্কে অনুসন্ধানী প্রশ্ন তোলারও অনুমতি দেওয়া হবে না। কবিরা তাঁদের গল্পকাহিনীকে সাধারণ মানুষকে নির্দেশনা দেওয়ার কাজে লাগাতে পারবেন, কিন্তু তাঁদের কাহিনীগুলো অবশ্যই উদ্ভট কল্পনা হতে পারবে না। এগুলোকে অবশ্যই ন্যায়-বিচার, আত্মার পরিবর্তন আর পরকালে অপরাধীদের উপর আরোপিত শাস্তির দিকে নজর দিতে হবে। এভাবে এইসব মতবাদ অশিক্ষিতদের ভালো আচরণের নিশ্চয়তা দিতে পারবে। প্লেটো জানতেন যে কোনও কোনও নাস্তিক উদাহরণ সৃষ্টির মতো জীবন যাপন করতে পারে। তাই একজন অপরাধী অবিশ্বাসীকে আবার দলে ফিরে আসার জন্যে পাঁচ বছর সময় দিয়েছিলেন তিনি। এই সময়ে চিন্তাভাবনার জন্যে নির্জন স্থানে বন্দী করে রাখা হবে তাকে। তারপরেও সে প্রকৃত বিশ্বাসে ফিরতে অস্বীকার করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।১০৭ 

দার্শনিক অন্বেষার শুরুতে সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডে ভীতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন প্লেটো, মিথ্যা ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার অপরাধে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। জীবনের শেষদিকে সেই তিনিই যারা তাঁর সঙ্গে একমত প্রকাশ করবে না তাদের জন্যে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে ওকালতি করেছেন। প্লেটোর দর্শনের কটু দিক ছিল। নিপীড়ক, অসহিষ্ণু ও শাস্তিমূলক হয়ে দাঁড়িয়েছিল এটা। বাইরে থেকে গুণের আরোপ করতে চেয়েছিলেন তিনি, সহানুভূতিমূলক প্রবণতাকে অবিশ্বাস করেছেন এবং নিজের দার্শনিক ধর্মকে সম্পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক করে তুলেছেন। গ্রিসের অ্যাক্সিয়াল যুগ গণিত, দ্বান্দ্বিকতা, ওষুধবিজ্ঞান আর বিজ্ঞানে অসাধারণ অবদান রাখবে, কিন্তু আধ্যাত্মিকতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। 

প্লেটোর সবচেয়ে মেধাবী শিষ্য এই পার্থক্যকে আরও চরম করে তোলেন। অ্যারিস্টটল (সি. ৩৮৪-৩২২) স্থানীয় অ্যাথেনিয় ছিলেন না। চ্যালসিদাইস পেনিনসুলার এক গ্রিক উপনিবেশ থেকে এসেছিলেন তিনি। মেসিদোনের রাজা দ্বিতীয় আমিস্তাসের বন্ধু ও চিকিৎসক ছিলেন তাঁর বাবা। আমিস্তাসের ছেলে ফিলিপের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন অ্যারিস্টটল। অবশ্য আঠার বছর বয়সে অ্যাথেন্সে আসেন তিনি এবং এর পর বিশ বছর একাডেমিতে প্লেটোর অধীনে শিক্ষা নেন। জীবনের এই পর্যায়ে প্লেটোর শিষ্য ছিলেন তিনি এবং তাঁর আকার সংক্রান্ত তত্ত্ব মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আকারের স্বাধীন ও বস্তুগত অস্তিত্বহীনতায় বিশ্বাস করতে শুরু করেন। সৌন্দর্য, সাহস, গোলাকৃতি বা শাদাত্ব কেবল সহজাতভাবে যেসব নিরেট বস্তুতে দেখা যায় সেগুলোতেই অবস্থান করে। আদর্শ জগতের বাস্তব মহাবিশ্বের চেয়ে আরও নিখুঁত হওয়ার ধারণার প্রতি দারুণ সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছিলেন অ্যারিস্টটল। কোনও কোনও বস্তু চিরন্তন অবশ্যই, স্বর্গীয় ও পচনশীল বস্তুর চেয়ে উন্নততর। কিন্তু আমাদের জ্ঞানের আওতার বাইরে অবস্থান করায় সেগুলো সম্পর্কে কোনও নিখুঁত জ্ঞান লাভ খুবই কঠিন। বরং আমাদের আওতার ভেতর যা আছে, যেমন গাছপালা ও পশুপাখির কাঠামোর দিকে মনোযোগ দেওয়াই ভালো। 

৩৪৭ সালে প্লেটো মারা যাওয়ার সময় অ্যাথেন্স ত্যাগ করেন অ্যারিস্টটল। হয়তো একাডেমির প্রধান হিসাবে নিয়োগ না পাওয়ায় হতাশ হয়ে থাকতে পারেন তিনি, কিন্তু আবার মেসিদোনিয় সম্পর্কের কারণে অ্যাথেন্সে পারসোনা নন প্রাতাতেও পরিণত হয়ে থাকতে পারেন। বন্ধু ফিলিপ ৩৬০ সালে তাঁর বাবার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। সৈনিক ও রাজনৈতিক প্রতিভা ফিলিপ পতন্মোন্মুখ পশ্চাদপদ ও বিচ্ছিন্ন মেসিদোনিয়াকে এলাকার একটি পরাশক্তিতে পরিণত করার ফলে এখন সেটা অ্যাথেনিয়দের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছু সামরিক পরাজয়ের পর অ্যাথেন্স ৩৪৬ সালে মেসিদোনিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হলেও ক্রমেই নিজের এলাকা বাড়িয়ে মূলভূখণ্ডের দিকে অগ্রসর হতে থাকা এই গতিশীল নতুন রাষ্ট্রের প্রতি বৈরী ও ক্ষুব্ধ রয়ে গিয়েছিল। 

৩৪২ সালে ফিলিপ অ্যারিস্টটলকে মেসিদোনিয়ায় বাস করে তাঁর ছেলে অ্যালেক্সান্দারকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানান। অন্তত তিন বছর আলেক্সান্দারের শিক্ষক ছিলেন অ্যারিস্টটল, এই সময়ের ভেতর গ্রিসের অধিপতিতে পরিণত হয়েছিলেন ফিলিপ। ৩৩৮ সালে অ্যাথেন্সের উপর চূড়ান্ত পরাজয় চাপিয়ে দেওয়ার পর এই অঞ্চলে নতুন স্থিতিশীলতা নিয়ে আসেন তিনি। অধিকতর শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির সুবাদে সকল পোলিসই লাভবান হয়েছিল। বিশেষ করে অ্যাথেন্স সমৃদ্ধির নতুন কাল উপভোগ করেছে। পারস্য আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন ফিলিপ, কিন্তু ৩৩৬ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন তিনি, ছেলে আলেক্সান্দার তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। পরের বছর অ্যারিস্টটল অ্যাথেন্সে ফিরে এসে নিজস্ব স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, অ্যাপোলো লাইসিয়াসের মন্দিরের কাছেই অবস্থান থাকায় এটা লাইসিয়াম নামে পরিচিত ছিল। 

এই সময় নাগাদ একজন জীববিজ্ঞানীতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। পশু ও গাছপালা ব্যাবচ্ছেদ এবং নিজের অনুসন্ধানের বিবরণ লেখার কাজে কয়েক বছর এশিয়া মাইনরে কাটিয়েছিলেন। দর্শনকে মর্ত্যে নামিয়ে এনেছিলেন অ্যারিস্টটল। বিশেষ করে বিকাশ ও ক্ষয়ের প্রক্রিয়ায় আগ্রহী ছিলেন তিনি: রোজ একটি করে ডিম ভেঙে ভ্রূণের বৃদ্ধি লিখে রাখতেন। প্লেটো ও অন্য অ্যাক্সিয়াল যুগ দার্শনিকরা যেখানে পরিবর্তন ও পরিবর্তনশীলতায় অস্বস্তি বোধ করেছেন, অ্যারিস্টটল সেখানে সমগ্র ‘হয়ে ওঠার’ প্রক্রিয়ায় কৌতূহলী ছিলেন। পরিবর্তন দুঃখ নয়; সব জীবিত প্রাণীর বেলাতেই এটা স্বাভাবিক। অবস্তুগত জগতের অর্থ খোঁজার বদলে অ্যারিস্টটল একে পরিবর্তনের ভৌত আকারে আবিষ্কার করেছেন। তাঁর চোখে কোনও ‘আকার’ ইন্দ্রিয়ের বলয়ের বাইরের চিরন্তন কোনও বাস্তবতা ছিল না। এটা প্রতিটি বস্তু পরিপক্কতা লাভ না করা পর্যন্ত তাকে নিয়ন্ত্রণকারী বস্তুর অন্তর্নিহিত কাঠামো। প্রতিটি ব্যক্তি বা বস্তুর তাকে এর আকারের ভেতর বেড়ে উঠতে বাধ্যকারী একটি গতিশীলতা রয়েছে, যেমন ওকের বীজ এর ভেতরে একটি ওক গাছে পরিণত হওয়ার ‘সম্ভাবনা’ ধারণ করে। পরিবর্তনকে ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই, বরং একে উদযাপন করতে হবে; এটা পরিপূর্ণতার এক সর্বজনীন সংগ্রাম তুলে ধরে। 

কিন্তু এটা ছিল একেবারেই পার্থিব সাফল্য। প্লেটোর গুহা ছেড়ে বেরিয়ে আসার কোনওই ইচ্ছা অ্যারিস্টটলের ছিল না। কোনও দার্শনিকের যুক্তিকে কিভাবে কাজে লাগাতে হবে জানা থাকলে বস্তু জগতেই দেখার মতো অনেক সৌন্দর্য ছিল। অ্যাথেন্সে ফেরার পর অ্যারিস্টটল অধিবিদ্যিক ও নৈতিক বিষয়ে মনোযোগ দিতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু যুক্তির শক্তি ও চর্চার প্রতি তাঁর গুরুত্ব অব্যাহত রয়ে গিয়েছিল। অ্যারিস্টটল ছিলেন লোগোসের মানুষ। যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা মানুষকে অন্য পশুপাখি থেকে আলাদা করেছে। প্রতিটি সৃষ্টিই তার অভ্যন্তরের আকার অর্জনে প্রয়াস পেয়ে থাকে। কেবল সত্যির খাতিরেই সত্যি অনুসন্ধানের চেষ্টা, থিওরিয়াই পুরুষের চুড়ান্ত ‘আকার’ বা লক্ষ্য (অ্যারিস্টটল মেয়েদের নিয়ে তেমন মন্তব্য করেননি, এদের মানবজাতির ত্রুটিযুক্ত রূপ মনে করেছেন তিনি।) সুতরাং পুরুষের ইউদামোনিয়া (‘ভালো থাকা’) তার বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করে। তার ‘ভালোত্ব’ স্পষ্ট ও কার্যকরভাবে চিন্তা করা ও সবকিছু পরিকল্পিত হিসাব ও গবেষণা করে সমাধানের মিশেল। লোগোসেরও উপরও একজন পুরুষের নৈতিক ভালো অবস্থা নির্ভর করে, কারণ সাহস বা ঔদার্যের মতো গুণাবলী-কে যুক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। যুক্তিমাফিক জীবনই সেরা ও সবচেয়ে প্রীতিকর,’ পরবর্তীকালের নিবন্ধে লিখেছেন তিনি, ‘কারণ অন্য যেকোনও কিছুর চেয়ে যুক্তিই পুরুষ।১৮ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি (নাউস) স্বর্গীয় এবং অমর; এটা তাকে দেবতাদের সঙ্গে সম্পর্কিত করে এবং পরম সত্যি ধরার ক্ষমতা দেয়। ইন্দ্রিয়জ সুখের বিপরীতে থিওরিয়ার পুলকের উত্থান-পতন থাকে না, বরং এটা চিন্তককে সর্বোচ্চ জীবনে বৈশিষ্ট্যায়িত আত্মসম্পূর্ণতা দেওয়া এক অবিরাম সুখ। আমাদের ‘অবশ্যই যতদূর সম্ভব আমাদের মাঝে সেরা যা কিছু আছে তার মতো জীবন যাপনের সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে,’ জোর দিয়েছেন অ্যারিস্টটল। দেবতাদের মতো আমরা নিজেদের সম্পূর্ণভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্যানে মগ্ন করতে পারব না, তবে সেটা যখন করি, তখন নিজেদের ভেতর স্বর্গীয় নীতি সক্রিয় করে তুলতে পারি। একজন পুরুষ কেবল ‘তার মাঝে উপস্থিত স্বর্গীয় কোনও কিছুর মাত্রা অনুযায়ীই’১০৯ এই স্বৰ্গীয় গুণের দিকে হাত বাড়াতে পারে। 

কোনও কোনও দিক থেকে থিওরিয়া মানবীয় পূর্ণাঙ্গতার সন্ধানী কোনও কোনও অ্যাক্সিয়াল সাধুর অর্জিত ঘোরের মতো ছিল, ওঠা-নামাহীন এক ধরনের সুখ এবং পরম স্বয়ংসম্পূর্ণতার খোঁজ করেছেন তারা। কিন্তু যুক্তি ও লোগোসকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। অ্যারিস্টটলের থিওরিয়ায় কি জড়িত ছিল আমরা জানি না।১১০ তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন কিনা? নাকি অধিকতর ধ্যানমূলক, দুর্জ্ঞেয় তৎপরতায় মগ্ন ছিলেন? নিশ্চিতভাবেই অ্যারিস্টটলের কাছে নোতন (‘চিন্তা’) ছিল সত্তার সর্বোচ্চ আকার। নোসিস নোসিওস (‘চিন্তা সম্পর্কে চিন্তা করা’) ছিল খোদ সত্তা; এটাই সকল বস্তুর উৎস এবং ঈশ্বরের সুপ্ত জীবন দিয়ে বৈশিষ্ট্যায়িত। 

প্লেটোর মতো সত্তার সর্বোচ্চ কারণের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় ঈশ্বরের গবেষণা থিওলোজিয়া ‘প্রধান দর্শন’ বলে বিশ্বাস করতেন অ্যারিস্টটল। মহাবিশ্বকে স্বর্গীয়, তারামণ্ডলীকে জীবিত দেবতা ও স্বর্গীয় কারুশিল্পী ও তাঁর সৃষ্টির অতীতে অবস্থিত একজন পরম সত্তাকে প্রত্যক্ষ করে প্লেটোর স্বর্গীয় ধর্ম পুরোপুরি মেনে নিয়েছিলেন তিনি। মহাবিশ্ব স্বর্গীয় ও চিরন্তন হওয়ায় অ্যারিস্টটলের ঈশ্বর প্রথম কারণ ছিলেন না। তার বদলে ঈশ্বরকে অটল চালক (আনমুভড মুভার) হিসাবে দেখেছেন তিনি। চলমান সবকিছুই অন্য কিছুর কারণে সক্রিয় হয়েছে বলে লক্ষ করেছেন তিনি। নক্ষত্রমণ্ডলী এবং অন্যান্য স্বর্গীয় বস্তুনিচয়কে পৃথিবীর চারপাশে অপরিবর্তনীয় আবর্তনে স্থির করে দিয়েছেন কে? এগুলোকে সক্রিয়কারী অবশ্যই নিশ্চল, নইলে আবার এই তৎপরতা চালুর জন্যে আরও উঁচু স্তরের সত্তার কথা ভাবতে হতো আমাদের। যুক্তি কার্য ও কারণের ধারাবাহিকতার অবধারিতভাবে একটা সূচনা বিন্দু থাকার দাবি করে। সুতরাং অ্যারিস্টটলের ঈশ্বর অতীন্দ্রিয়ভাবে অনুভূত কোনও বাস্তবতা নন বরং তাঁর সৃষ্টিতেত্ত্বের যৌক্তিক পরিণতি ছিলেন। আকাঙ্ক্ষা পশুরাজ্যে গতি অনুপ্রাণিত করতে পারে বলে যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি। একটি ক্ষুধার্ত সিংহ খাবারের জন্যে আকাঙ্ক্ষার কারণে ভেঁড়ার উপর ঝাপিয়ে পড়বে। এ থেকে বলা যায় নক্ষত্রমণ্ডলীও আকাঙ্ক্ষার তাড়নাতেই চলমান হয়েছে। এগুলো নিজেই এত নিখুঁত যে পরম কর্মতৎপরতায় ব্যস্ত সত্তার প্রতি বুদ্ধিবৃত্তিক ভালোবাসায় বাধ্য হয়ে কেবল আরও শুদ্ধতার দিকে চালিত হতে চাইতে পারে। অ্যারিস্টটলের ঈশ্বর নোয়েসিস নোসিয়াস, খোদ নিজের ধ্যানে নিমগ্ন। 

এই কারণে অ্যারিস্টটলের অটল চালক (অনমুভড মুভার) ছিলেন চিরন্তন; বস্তু থেকে আলাদা হয়ে অবস্থানে সক্ষম একমাত্র আকার হওয়ায় এটাই ছিল পরম আকার। নিজের চেয়ে হীন কোনও কিছুর দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারে না বলে সর্বোচ্চ স্বর্গীয় হিসাবে এটা ছিল খাঁটি নাউস, আত্ম-মগ্ন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। ঈশ্বর হলেন শুদ্ধ থিওরিয়া। আবার, প্লেটোর ধর্মতত্ত্বের মতো এখানে সাধারণ মানুষের জন্যে কিছুই ছিল না।১১১ অটল চালক শুধু মানবজাতির ব্যাপারেই নির্লিপ্ত নন, বরং নিম্নতর অলিম্পিয়ানদেরও মানবজাতির প্রতি কোনও রকম আগ্রহ থাকার ব্যাপারে সন্দেহ ছুঁড়ে দিয়েছেন অ্যারিস্টটল। প্লেটোর কাছে অলিম্পিয়দের মানবীয় কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা বিশ্বাসের অংশ ছিল; অ্যারিস্টটলের কাছে এটা ছিল স্রেফ প্রকল্পমাত্র ১১২ তারপরেও প্লেটোর মতো অ্যারিস্টটল প্রচলিত প্রথাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাননি। লোকে সবসময় উচ্চতর সত্তার আকাঙ্ক্ষা করে। দেবতাদের সম্মান দেখানোই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক এবং বাস্তবতা হিসাবেই এই ধরনের উপাসনাকে নেওয়া উচিত। প্রাচীন মিথসমূহ দারুণ সন্দেহজনক, কিন্তু এগুলো সম্ভবত স্বগীয় বস্তুর প্রতি ঐশ্বরিকতা আরোপ করার মতো প্রাচীন প্রজ্ঞার কিছু ফসিল ধারণ করে। পোলিসের বিভিন্ন আইনকানুনকে স্বর্গীয় অনুমোদন দেওয়ানোর কাজেও ধর্মকে ব্যবহার করা যেতে পারে। ১১৩ 

দর্শন এক নতুন ঈশ্বরের জন্ম দিয়েছিল, কিন্তু ইয়াহওয়েহর সঙ্গে তাঁর কোনও মিলই ছিল না। আকস্মিক বিশ্ব সৃষ্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও মানবীয় বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একজন ঈশ্বরের ধারণা দারুণ হাস্যকর মনে করতেন অ্যারিস্টটল। একেশ্বরবাদীরা পরে অ্যরিস্টটলের অটল চালকের সন্দেহজনক ‘প্রমাণ’-কে তাদের ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করলেও দার্শনিকদের ঈশ্বর শেষপর্যন্ত দিউস ওতিওসাস-এর মতো অধিকতর প্রাজ্ঞ কিছুর কাছে খাটো হয়ে উঠবেন ও আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবেন।১১৪ অ্যারিস্টটল সম্মত হতেন হয়তো। তাঁর অধিবিদ্যায় পবিত্র কিছু ছিল না। বিচ্ছিন্ন রচনা ও টীকাটিপ্পনী একসূত্রে গাঁথা সম্পাদক ও গ্রন্থগারিকরা খোদ পারিভাষাটি সৃষ্টি করেছেন। তারা স্রেফ সম্পর্কহীন বিষয়ে রচিত চৌদ্দটি নিবন্ধ একটি সংকলনে সন্নিবেশিত করে তার নাম দিয়েছেন মেতা তা ফিজিকা: ‘আফটার দ্য ফিজিক্স’। 

কোনও কোনও ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলের যেন প্লেটোর চেয়ে প্রচলিত আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে বেশি উপলব্ধি ছিল বলে মনে হয়। সত্য ও মতবাদ শেখার জন্যে নয়, বরং ‘বিশেষ কিছু আবেগ অনুভব করতে ও বিশেষ অবস্থায় স্থাপন করার জন্যে’১১৫ শিক্ষাথীরা রহস্যে অংশগ্রহণ করে থাকে বলে যুক্তি তুলে ধরে সনাতনী বিশ্বাসে ভাবিত ছিলেন না তিনি। এই ধরনের ধর্ম ছিল প্রায় অনুভব (প্যাথিয়েন) সংক্রান্ত, চিন্তা নয়। আবেগের ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটল যেন প্লেটোর চেয়ে ঢের বেশি স্বস্তিতে ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, যতক্ষণ আপনার ক্ষোভকে চরমে পৌঁছতে দিচ্ছেন ততক্ষণ রাগ করা ভালো। প্লেটো যেখানে তাঁর আদর্শ পোলিস থেকে ট্র্যাজিডিকে বিদায় করে দিতেন, অ্যারিস্টটল সেখানে এখনও তার একটা ভূমিকা রয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করতেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে করুণা ও ভয় অনুভব করা ঠিকই আছে এবং ট্র্যাজিডি আবেগের শিক্ষা দিয়ে মানুষকে সঠিকভাবে সেটা বুঝতে সাহায্য করে।১১৬ উদাহরণ স্বরূপ, ঈদিপাসের দুর্ভোগ লক্ষ করার সময় একজন দুর্বল-চিত্ত মানুষ বুঝতে পারবে যে, তার সমস্যাগুলো আসলে তত খারাপ না, আর কোনও উদ্ধত ব্যক্তি তারচেয়ে দুর্বলদের প্রতি সহানুভূতি বোধ করতে শিখবে। মারাত্মক ও ভয়ঙ্কর ঘটনার অনুকরণের ভেতর দিয়ে ট্র্যাজিডি এই ধরনের অনুভূতির সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।১১৭ আবেগসমূহ সেগুলোর বিপজ্জনক সম্ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে ব্যক্তি ও সমাজের পক্ষে লাভজনক হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে তাদের অনুভূতিগুলো ট্র্যাজিডির নির্দিষ্ট আনন্দের পক্ষে আবিশ্যিক ছিল। শাস্ত্রজ্ঞরা সবসময় যা অনুভব করেছেন অ্যারিস্টটল সেটাকেই যৌক্তিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন: দৈনন্দিন জীবনে অসহনীয় হয়ে উঠবে এমন ঘটনাপ্রবাহের একটি প্রতীকী, পৌরাণিক বা আচরিক পুনরাভিনয় আমাদের গভীরতম ভীতিকে শুদ্ধ, দুর্জ্ঞেয় এবং এমনকি প্রীতিকর করে তুলতে পারে। কিন্তু তারপরেও অ্যারিস্টটল ট্র্যাজিডিকে একান্তে পাঠযোগ্য সাহিত্যিক টেক্সট মনে করেছেন। ট্র্যাজিডি সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি নাগরিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে বরং ব্যক্তির উপর এর প্রভাবের দিকেই জোর দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যিক সমালোচনা মানবমুখী এবং তাঁর দর্শনের মতোই সম্পূর্ণ জাগতিক বিশ্বের অনুবর্তী ছিল। এক সময়ের গভীর ধর্মীয় অভিজ্ঞতাই ‘খুব সূক্ষ্মভাবে অ্যারিস্টটলের যৌক্তিক বুদ্ধিমত্তার হাত ধরে অধিকতর বাস্তবতায় পরিণত হয়েছিল। অ্যারিস্টটল মহান মেধার অগ্রদূত ছিলেন। প্রায় একক প্রয়াসে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, যুক্তি ও দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন তিনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাশ্চাত্য ক্রিশ্চান ধর্মেও অনেপনীয় প্রভাব রেখে গেছেন। ইউরোপিয়রা সাধারণ কাল দ্বাদশ শতাব্দীতে তাঁর রচনাবলী আবিষ্কার করার পর থেকে অনেকেই তাঁর অটল চালক যৌক্তিক প্রমাণে অনুরক্ত হয়েছে—প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল তাঁর অন্যতম কম অনুপ্রাণিত সাফল্য। অ্যারিস্টটলের ঈশ্বরের ধর্মীয় মূল্য থাকার কথা ছিল না, পরম বাস্তবতা অনির্বচনীয়, অবর্ণনীয় এবং বোধের অতীত বলে জোর দেওয়া অ্যাক্সিয়াল যুগের মুল প্রবণতার কাছে তিনি অচেনা ছিলেন-কিন্তু তারপরও যুক্তি দিয়ে না হলেও অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে মানবজাতির উপলব্ধি করার মতো কিছু ছিলেন। তবে প্রথম অ্যাক্সিয়াল যুগের প্রায় দুই হাজার বছর পরে দ্বিতীয় পরিবর্তনের সূচনা ঘটাবে পশ্চিমের এমন বৈজ্ঞানিক পথে স্থির করে দিয়েছিলেন অ্যারিস্টটল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *