৯. বিজ্ঞান, সহজবৃত্তি আর ঈডিপাস্ কমপ্লেক্স

বিজ্ঞান, সহজবৃত্তি আর ঈডিপাস্ কমপ্লেক্স 

ফ্রয়েড-প্রসঙ্গ হয়তো এইখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু পাঠকসাধারণ নিশ্চয়ই ফ্রয়েডের কয়েকটি মূল সূত্রের উপর স্পষ্ট উক্তি দাবি করবেন। ফ্রয়েডের কলাকৌশলের মূলে ভাববাদ ও ধর্মের প্রেরণা, তাঁর মূল প্রকল্পের মধ্যে প্লেটনিক দর্শনের ছাপ—যদিই বা তা মেনে নেওয়া হয় তাহলে প্রশ্ন থেকে যাবে ফ্রয়েডীয় নিজ্ঞান, সহজবৃত্তি ও যৌনতাগিদ এবং ঈডিপাস্ কম্প্লেক্‌স্‌ প্রভৃতি সম্বন্ধে সমালোচকের মন্তব্য কী হবে। 

বলাই বাহুল্য, ফ্রয়েডের কলাকৌশলই ফ্রয়েডবাদের আসল ভিত্তি। তারই মধ্যে যদি অমন গলদ থেকে যায় তাহলে ফ্রয়েডবাদের ইমারতটিও ঠুনকো হতে বাধ্য। অর্থাৎ, যে-অর্থে তিনি নিজ্ঞান, সহজবৃত্তি ইত্যাদির কথা তোলেন তা বৈজ্ঞানিক সত্য নয়, কল্পনাবিলাস-মাত্র। এই আলোচনা সংক্ষেপে করবার চেষ্টা করা যাক। 

প্রথম ধরা যাক নিজ্ঞানের কথা। যদি প্রশ্ন ওঠে, আমাদের মানস সত্তার সবটুকু সম্বন্ধেই আমরা সবসময় সচেতন কিনা, তাহলে নিশ্চয়ই এবার জোর দিয়ে বলতে হবে তা নয়। নিছক শারীরতত্ত্বের দিক থেকেই তা সম্ভব নয়। কেননা, আমাদের মানস সত্তার শারীরিক ভিত্তি হলো আমাদের মস্তিষ্ক, মস্তিষ্কের উদ্দীপনার নামই চেতনা আর এই মস্তিষ্কের সবটুকু সবসময় সমানভাবে উদ্দীপ্ত নয়। এ বিষয়ে পালভের উক্তি মনে রাখা দরকার : 

…consciousness appears as a nervous activity of a certain part of the cerebral hemispheres, possessing at the given moment under the present conditions certain optimal (probably moderate) excitability. At the same time all the remaining of the parts hemispheres are in a state of more or less diminished excitability. …The area of optimal activity is, of course, not fixed; on the contrary it is perpetually migrating over the whole extent of the hemispheres, being dependent on the relations which exist between the different centres as well as on the influence of external stimuli. The borders of the region of lowered irritability obviously change in conformity with those of the area of excitaion. 

If we could look through the skull into the brain of a consciously thinking person, and if the place of optimal excitability were luminous, then we should see playing over the cerebral surface, a bright spot with fantastic, waving borders constantly fluctuating in size and form, surrounded by a darkness more or less deep, covering the rest of the hemispheres. Lectures on Conditioned Reflexes, pp, 221-222). 

মস্তিষ্কের যে-অংশকে পালভ্ “in a state of more or less diminished excitability” বলে বর্ণনা করছেন তার ফলাফলকে মানস সত্তার দিক থেকে যদি অবচেতন বা unconscious বলে বর্ণনা করা হয় তাহলে হয়তো বিজ্ঞান-বিচ্যুতির সম্ভাবনা নেই। ফ্রয়েড বলেন, ওই নিজ্ঞান আমাদের মনের এক অন্ধকার প্রদেশের মতো, তার মধ্যে যেন ওত পেতে রয়েছে রকমারি দৈত্যদানো—যেন এক রূপকথার গল্প। আর ওইটেই হলো ফ্রয়েডবাদের কল্পনা। আর ওটা যে কল্পনাই তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ হলো মানস সত্তার ওই তথাকথিত অন্ধকার প্রদেশটির ভিত্তি ঠিক কী – স্নায়ুতন্ত্রের বর্ণনায় তার রূপটা কী রকম হবে—এ প্রশ্নের কোনো জবাব ফ্রয়েডীয় সাহিত্যে নেই। শুধু তাই নয়, ফ্রয়েডীয় মতে ওই নিজ্ঞান মনই আমাদের সমস্ত রকম সচেতন আচরণ-বিচরণ, চিন্তা-বিচারকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। পুতুলনাচের কলকাঠি নাড়া যেন। এই কথা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হতো যদি পালভের পরীক্ষায় দেখা যেতো মস্তিষ্কের অপেক্ষাকৃত দুর্বলভাবে উদ্দীপিত অংশগুলি যে-সব conditioned reflex-এর কেন্দ্র সেই conditioned reflexই মস্তিষ্কের প্রবলতর উদ্দীপিত কেন্দ্রের conditioned reflex কে নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু পরীক্ষায় তা কখনো ধরা পড়েনি :

In the region of the brain where there is optimal excitability, new conditioned reflexes are easily formed, and differentiation is successfully developed. That area is at the given moment the creative part of the hemispheres. The outlying parts with their decreased irritability are incapable of such performance, and their functions at best concern the perviously elaborated reflexes arising in astereotyped manner. In the presence of the corresponding stimuli. The activity of these areas is subjectively described as unconscious, automatic. (Ibid, p. 221 ) 

গবেষণাগারে পরীক্ষামূলকভাবে এই তথ্য প্রতিষ্ঠিত হবার পরও যদি কেউ দাবি করেন সচেতন মন একান্তভাবেই নিজ্ঞানের নির্দেশ মেনে চলে তাহলে সে দাবির বৈজ্ঞানিক মূল্য স্বীকার করবার প্রশ্নই ওঠে না। 

ফ্রয়েডীয় নিজ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে সহজবৃত্তি সম্বন্ধে তাঁর মতামতের গভীর যোগাযোগ। তিনি মনে করেন, আমরা জন্মাবার সময়েই কতকগুলি সহজবৃত্তি নিয়ে জন্মাই। নমুনা হিসেবে ফ্রয়েড যৌনবৃত্তি, জিঘাংসাবৃত্তি ইত্যাদি রকমারি সহজবৃত্তির উল্লেখ করেছেন। ফ্রয়েডের মতে, আমাদের মনের গড়ন একান্তভাবেই এই সহজবৃত্তিগুলির উপর নির্ভর করে। তাই, বাস্তব পরিবেশ আমাদের মানসিক গড়নের উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। শুধু তাই নয়, এই সহজবৃত্তিগুলি ফ্রয়েডের মতে একান্তই সনাতন ও অপরিবর্তনীয়। আদিম যুগেও যে-রকম ছিলো আজকের দিনেও ঠিক সেই রকমই। এবং জীবতত্ত্বের দিক থেকে ফ্রয়েড এই সহজবৃত্তিগুলির সনাতনত্ব ব্যাখ্যা করবার একটা চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই সহজবৃত্তিগুলির বাস্তব ভিত্তি হলো ক্রোমোসোমের ভিতরকার ওই জিন। অর্থাৎ, সাবেকী জীববিজ্ঞানের ক্রোমোসোমবাদের দোহাই দিয়ে বহির্বাস্তবের প্রভাবকে অস্বীকার করবার এবং মানব-মনস্তত্ত্বের সনাতনত্ব প্রমাণ করবার চেষ্টা। তাই, সাম্প্রতিক কালে ওই সাবেকী ক্রমবিকাশবাদের ভিত্তি যে-ভাবে টলেছে তার উল্লেখই এই প্রসঙ্গে ফ্রয়েডবাদের একটা মূল সমালোচনা হতে পারে: বংশগতসূত্রে পাওয়া জন্মগত লক্ষণগুলি পারিপার্শ্বিকের প্রভাব-উত্তীর্ণ সনাতন কিছু নয়। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আরো একটি জরুরী কথা মনে রাখা দরকার। কথাটা হলো, instinct—সহজবৃত্তি সম্বন্ধে পালভের মন্তব্য। পালভ দেখাচ্ছেন, সাবেকী মনোবিজ্ঞানে যাকে instinct বলে স্বীকার করা হয়েছে তা আসলে unconditioned reflex, আর কিছুই নয়। এই মন্তব্য কিন্তু অত্যন্ত জরুরী, একে শুধুমাত্র পরিভাষার তফাত বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। কেননা, সমস্ত reflex,-—তা সে conditionedই হোক আর unconditionedই হোক-বহির্বাস্তবের সঙ্গে প্রাণিদেহের এক রকম না এক রকম আদান-প্রদান। Reflex এর একটা প্রান্ত যে বহির্বাস্তবেরই উদ্দীপনা! তাই তথাকথিত instinct বা সহজবৃত্তিগুলিকে unconditioned reflex বলে দেখানো মানেই হলো তাদের মানসসর্বস্বতা খণ্ডন করা, বহির্বাস্তবের সঙ্গে যোগসূত্রের উপর জোর দেওয়া। ফ্রলভ তাই বলছেন: 

Hence, an instinct is an effect and not an internal impulse as was believed by the Stoics, who first introduced the word. (Pavlov and his School, pp. 34-35 ) 

তাছাড়া ফ্রয়েড যে-ভাবে সহজবৃত্তিকে সনাতন মনোময় আভ্যন্তরিক তাগিদ বলে প্রচার করবার চেষ্টা করেছেন, সেটা যে নেহাতই তাঁর মনগড়া ব্যাপার এ-কথা তাঁর সহজপ্রবৃত্তির তালিকা থেকে প্রধানতম নমুনাটিকে বিশ্লেষণ করলেই দেখতে পাওয়া যাবে। ধরা যাক, ওই জিঘাংসা-বৃত্তি বা aggression instinct এর কথা। এ-বিষয়ে গবেষণার ভিত্তিতে Maslow ফ্রয়েডের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত প্রমাণ উদ্ধৃত করেছেন: 

(১) প্রাণিজগতে ওই জিঘাংসাবৃত্তিকে কোনো সার্বভৌম নিয়ম মনে করাটা নেহাতই ভুল। প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যেই ধ্বংসের নেশা নেই। বরং, ক্রমবিকাশের পথ ধরে যে-প্রজাতি যতোদূর এগিয়েছে ততোই দেখা যায় তার মধ্যে ওই জিঘাংসাবৃত্তির অভাব। যেমন ধরুন, সিমপান্জীর কথা—ক্রমবিকাশের ধারায় মানুষের ঠিক নিচেই তার স্থান। এই প্রাণীর মধ্যে জিঘাংসার চেয়ে সহযোগিতার বিকাশ অনেক প্রবল। (অথচ, জিঘাংসা—বৃত্তিকে সনাতন সহজবৃত্তি বলে প্রমাণ করবার আশায় ফ্রয়েড জোরালো যে-যুক্তি দিতে চান তা হলো প্রাণিজগতে তার সার্বভৌম লীলা)। 

(২) শিশুদের ব্যবহার সংস্কারমুক্তভাবে বিচার করলে স্পষ্টই দেখা যায় তাদের মধ্যে জিঘাংসার তুলনায় স্নেহ, মমতা ও প্রীতির বিকাশ খুব কম নয়। 

(৩) পর্যটকেরা বহু আদিম কোমের মধ্যে ঘুরে দেখেছেন তাদের জীবন যাত্রার মধ্যে জিঘাংসাবৃত্তির প্রায় সম্পূর্ণ অভাব। (A. B. Maslow : A Comparative Approach to the Problem of Destructivencess Psychiatry, Vol. 5, 1942) 

ফ্রয়েডের তথাকথিত Oedipus Complex সম্বন্ধেও প্রায় একই কথা, ফ্ৰয়েড নিজে যদিও মনে করেন এই রকম মানসিক জটিলতা সমস্ত যুগের সমস্ত মানুষের মধ্যেই সমানভাবে বর্তমান তবুও কিন্তু নৃতত্ত্বের আধুনিক গবেষণায় সে-কথা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকৃত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে Ruth Benedict এর Patterns of Culture, Margaret Mead-43 From the South Seas, Abram Kardiner-The Individual & His Society, ইত্যাদি রচনা বিশেষ করে দ্রষ্টব্য। আর তা হবে নাই বা কেন। ওই তথাকথিত Oedipus Complex-এর মধ্যে পিতৃপ্রধান আধুনিক বুর্জোয়া-পরিবারেরই অভ্রান্ত প্রতিবিম্ব। ফ্রয়েড তাকে সর্বকালীন মানবচরিত্র বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করলে কেমন করে চলবে? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *