৬. উপযোজন

উপযোজন 

ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের যেটা চরম উদ্দেশ্য তার নাম দেওয়া হয় adjustment বা উপযোজন আর আমি বলতে চাই, উপযোজন বলে এই ব্যাপারটিকে ফ্রয়েড এমনই এক অর্থে গ্রহণ করতে বাধ্য হন যার দরুন বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর সবটুকু প্রকট উৎসাহই শেষ পর্যন্ত ধর্মমোহের কাছেই প্রচ্ছন্ন আত্মনিবেদনে পরিসমাপ্ত। 

বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের আসল তফাতটা মনে রাখতে হবে। 

মানুষ যদি মূক পশুর মতো শুধুই প্রকৃতির মুখ চেয়ে বেঁচে থাকতো তাহলে তার পক্ষে ধর্ম বা বিজ্ঞান দুয়ের কোনোটাই সৃষ্টি করবার প্রশ্ন উঠতো না। কিন্তু জীবজগতে ক্রমবিকাশের পথ ধরে মানুষ যে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। তাই তাকে আর শুধু পশু বলা হয় না – অসহায়ের মতো সে বেঁচে নেই প্রকৃতির মুখ চেয়ে। কিন্তু এই কারণেই, মানুষের সামনে যে সমস্যা তা অতি কঠিন ও কঠোর। কেননা, বিরাট আর বিশাল এই শক্তি অতি প্রচণ্ড শক্তির লীলাভূমি। বিপর্যয়ের পর বিপর্যয়ের ঢেউ—সে ঢেউ কাটানোর ওপরেই মানুষের জীবন-মরণের নির্ভর। শুধু যদি প্রকৃতির মুখ চেয়ে বেঁচে থাকবার কথা হতো তাহলে বিপর্যয়রাশি নিয়ে এই যে সমস্যা এই কিনারা খোঁজবার কোনো তাগিদের কথাই উঠতো না। কিন্তু মানুষের বেলায় সে-তাগিদ উঠেছে আর মানুষ চেয়েছে মোটের ওপর দু’রকমের কিনারা—দুটো কিন্তু একেবারে আলাদা পথে এগিয়ে। একটা হলো, প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব স্থাপন করবার—প্রকৃতিকে জয় করবার পথ। আর একটা হলো, নিজের ভাব-আবেগকে এমন কায়দায় বদল করার পথ যাতে বিপর্যয়ের ওই বোধটাই ভোঁতা হয়ে যায়: বাস্তব বিপর্যয় থেকে নিস্তার পাওয়া নয়, তবু বিপর্যয়-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া বই কি। 

প্রথম পথের নাম বিজ্ঞান। দ্বিতীয়র নাম ধর্ম। দুটোর কিন্তু একেবারে দুরকমের পথ। আকাশ-পাতাল তফাত দুয়ের মধ্যে। 

বিজ্ঞান চেয়েছে প্রকৃতিকে বদল করতে, প্রকৃতির শক্তিকে স্ববশে এনে মুক্তি পেতে ওই বিপর্যয়ের হাত থেকে। তাই সুদূর অতীতে ভোঁতা পাথরের হাতিয়ার বানিয়ে মানুষ প্রথম যখন প্রকৃতি-জয়ের অভিযান শুরু করলো, তখন থেকেই বিজ্ঞানের বীজ শুরু। পশুর স্তরে এ-চেষ্টা দেখা দেয়নি। পশুজগৎ আর মানবজগতের আসল সীমানায় তাই ওই হাতিয়ারেরই ফলক। আর নিতান্ত নিরভিমান এই আরম্ভটুকু থেকে শুরু করে মানুষের ওই অভিযান আজ তাকে সাফল্যের কোন্ হিমাদ্রি শিখরে পৌঁছে দিয়েছে! উড়োজাহাজের গতি বাড়িয়ে দেশ-কালকে মুঠোর মধ্যে পাওয়া, মুঠোর মধ্যে পাওয়া কোন্ অবিশ্বাস্য দৈত্যশক্তি পরমাণুকে চূর্ণ করে! বিজ্ঞানের এই বিজয়বার্তাকে ভুল বুঝলেও চলবে না কিন্তু। মানুষের পক্ষে প্রকৃতিকে জয় করবার এই কায়দাটা তো কোনো আগন্তুক আক্রমণকারীর মতো নয়, যে চায় বিজিত দেশের ওপর নিজের আইনকানুন চাপিয়ে দিয়ে দেশটাকে দখলে রাখতে। মানুষের পক্ষে প্রকৃতির উপর এইভাবে আপন-গড়া আইন-কানুন চাপিয়ে দেবার প্রশ্নই ওঠে না। কেননা, রক্তমাংসে গড়া মানুষ তো আর পৃথিবীছাড়া কোনো বাইরের জিনিস নয়। মানুষের পক্ষে তাই প্রকৃতিকে জয় করবার কায়দাটা হলো অন্য রকম—প্রকৃতির নিয়মকানুনকে, প্রকৃতির শৃঙ্খলাকেই, স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতরভাবে চিনতে শেখা। এই জ্ঞানের মধ্যেই তার আসল শক্তির রহস্য। প্রকৃতির শৃঙ্খলাকে যতো স্পষ্টভাবে চিনতে পারা আর মানতে পারা ততোখানিই দাসত্বমুক্তি। এইখান থেকে কিন্তু বিজ্ঞানের স্বরূপকে ভুল বোঝবার আর এক সম্ভাবনা। অনেক চিন্তাশীল যেরকম মনে করেছেন, বিশুদ্ধ জ্ঞান অন্বেষণেই বুঝি বিজ্ঞানের চরম পরিচয়। কিন্তু বিজ্ঞান তো সত্যিই বন্ধ্যা জ্ঞানের উপাসনা নয়। মনে রাখতে হবে, প্রকৃতিকে চেনবার উলটো পিঠেই প্রকৃতিকে জয় করবার কথা—কিংবা যা একই কথা—প্রকৃতির উপর প্রভুত্বে পরিণত বলেই বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের আসল মর্যাদা। তাছাড়া, মানুষ যেহেতু অনিবার্যভাবে প্রকৃতির অঙ্গ-বিশেষ, সেইহেতু মানুষে-মানুষে যে সম্পর্ক তাও আর পাঁচ-রকম প্রাকৃতিক বিষয়ের মতোই একটি বিষয়-মাত্র। প্রকৃতি-জয়ের পটভূমি থেকে তাই মানুষে-মানুষে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গও বাদ দেওয়া চলে না। নইলে প্রাকৃতিক শক্তির উপরে অনেকখানি প্রভুত্বের মালিক হয়েও মানুষের পিঠ কুঁজো হয়ে থাকবে পরাজয়ের বোঝায়—মানুষে-মানুষে সম্পর্কের নিয়মকানুনকে জয় করবার ব্যর্থতা থেকেই ওই পরাজয়ের উৎস। পরমাণু ভেঙে পাওয়া দৈত্যশক্তিই কিনা রচনা করলো হিরোসিমা-নাগাসাকির কাহিনী : মানুষের কী আশ্চর্য আবিষ্কার, অথচ কী দারুণ অপমানের ঝলকে মানুষের মুখ একেবারে কালো করে দিলো! প্রকৃতির শক্তিকে জয় করবার উলটো পিঠেই পরাজয়ের কী নির্মম গ্লানি! দেখা গেলো, মানুষ প্রকৃতির শক্তিকে যে-অনুপাতে জয় করতে শিখেছে সেই অনুপাতে জয় করতে শেখেনি মানুষে-মানুষে সম্পর্কের নিয়ম-কানুনকে জয় করতে। তাই যে-কোনো বিজ্ঞানের চরিতার্থতা নিয়ে হিসেব নিকেশ করবার সময় সমাজবিজ্ঞানের পটভূমি থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না। 

আর ধর্ম। আদর্শের দিক থেকে ধর্মের চেষ্টাটা একেবারেই বীপরিত। ধর্ম চেয়েছে মানুষের ধ্যান-ধারণা আর আবেগ—অনুভূতিকে এমনভাবে বদল করতে যাতে বিপর্যয়ের ওই বার্তাটাই ভুলে থাকা যায়। অবশ্যই, বিপর্যয়ের বোধটুকু নষ্ট হওয়া মানেই বাস্তব বিপর্যয় থেকে নিস্তার পাওয়া নয়। তবু, বিপর্যয়ের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া বই কি! আর ওই মুক্তির বাণীই হলো ধর্মের আসল বাণী। ধর্ম আর মাদকদ্রব্য তাই সত্যিই সমতুল্য: পরকালের পরমান্ন স্বপ্ন ইহকালের অন্নাভাবের যন্ত্রণাকে অনেকখানিই লাঘব করতে পারে, বিচারে আসীন বিধাতায় বিশ্বাস সমাজ-বাস্তবের অবিচার পেরিয়ে আশ্বাসের বাণী আনে না কি? তার মানে অবশ্যই অন্নাভাব বা অবিচারের বাস্তব সমাধান নয়। তাই পথ এক ও অদ্বিতীয়, তার নাম বিজ্ঞানের পথ। 

ধর্ম ও বিজ্ঞানের এই পার্থক্য-নির্ণয়ে স্বয়ং ফ্রয়েডও খুব বেশি দ্বিমত হবেন না। কেননা, যে-গ্রন্থে তিনি বিশেষ করে ধর্ম-রহস্য উদ্ঘাটনের প্রয়াসী হয়েছেন (The Future of an Illusion) তাতে তিনি স্পষ্টই ঘোষণা করেছেন যে ধর্ম ইচ্ছাপূরণের এক তন্ত্রবিশেষ (পৃ: ৭৬)—অর্থাৎ কিনা নেহাতই অলীক সান্ত্বনার ব্যাপার। তর্ক তুলে কেউ যদি বলেন, ধর্ম নামের ওই অলীক সান্ত্বনাটুকু বাদ দিয়ে মানুষের পক্ষে জীবনের দুর্যোগ আর বাস্তবের নিষ্ঠুরতা সহ্য করাই সম্ভব নয়, তাহলে ফ্রয়েড সাফ জবাব দিয়ে বলবেন—এ-দাবির সঙ্গে তিনি মোটেই একমত নন (পৃ: ৮৫)। ফ্রয়েড বলেছেন, এমনতরো কথা শুধু তার বেলাতেই খাটবে যার মধ্যে কিনা অত্যন্ত শৈশবদশা থেকে এই মিষ্টি বিষ (ধর্ম) ফুঁড়ে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু মানুষ যদি শান্ত সুস্থির পরিবেশে বড়ো হতে পারে তাহলে তার পক্ষে এ-জাতীয় মনোবিকারের ভোগবার কথা নয় আর তাই মনোবিকার-যন্ত্রণাকে ভোঁতা করবার জন্যে ধর্মের মতো ওই রকম মাদকদ্রব্যের চাহিদাও তার থাকবে না। ফ্রয়েড বলছেন, পরলোক থেকে প্রত্যাশা এইভাবে প্রত্যাহার করে মানুষ এমন এক পরিবেশে পৌঁছতে পারে, যেখানে জীবন কারুর পক্ষেই আর অসহ্য নয়, কেউ নিপীড়িত নয় সংস্কৃতির হাতে (পৃ: ৮৭)। কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন: বিজ্ঞানও কি শেষ পর্যন্ত এক রকমের ভ্রান্তিবিলাসই নয়? ফ্রয়েড জোর গলায় জবাব দিয়ে বলেন, নিশ্চয়ই নয়। কেননা, ‘we believe that it is possible for scientific work to discover something about the reality of the world throuth which we can increase our power and according to which we can regulate our life.’ (পৃ: ৯৫) এবং এই গ্রন্থের শেষ কয়েকটি পংক্তিতে ফ্রয়েডের বলিষ্ঠ ঘোষণা : না বিজ্ঞানকে অলীক বলা চলবে না। বরং বিজ্ঞানের কাছ থেকে যা পাওয়া যায় না তা আর কোথা থেকে পাওয়া সম্ভব—এমনতরো কল্পনাই  হবে আসলে অলীক (পৃ: ১৮)। 

অথচ, বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গির এমনই অন্তর্দ্বন্দ্ব যে, বিজ্ঞানে ওই প্রকট বিশ্বাস, ধর্ম সম্বন্ধে এমন বলিষ্ঠ মোহমুক্তি, মানুষের ভবিষ্যতে এমন আশ্চর্য আস্থা—সব কিছুই শেষ পর্যন্ত তাঁকে ধর্মমোহের মূল কথাটির কাছে আত্মনিবেদনেরই পথ প্রদর্শন করলো। কেবল মনে রাখতে হবে, এই ধর্মমোহ নবকলেবরের। তার মানে, চেহারার দিক থেকে মামুলি ধর্মমোহের সঙ্গে নিশ্চয়ই তফাৎ আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তফাতটা ধর্মমোহ হিসেবে। 

ধর্মমোহের কাছে ফ্রয়েডের যে-আত্মনিবেদন তার পরিচয় তার কলাকৌশলের চরম উদ্দেশ্যটুকুর মধ্যে। তারই নাম হলো উপযোজন। উপযোজন বলে ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করা যাক। 

প্রশ্ন হলো, ফ্রয়েডপন্থীর ওই সুদীর্ঘ কলাকৌশল মানবমনের ঠিক কোন্ পরিবর্তন সাধন করতে চায়? অল্প কথায় উত্তর দিতে অনুরোধ করলে তিনি হয়তো বলবেন, মনের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা। কিন্তু প্রশ্ন উঠবে, মনের স্বাভাবিক অবস্থা বলতে ঠিক কী বোঝায়? কিংবা, যা একই কথা, স্বাভাবিক-অস্বাভাবিকের মধ্যে সীমারেখাটা ঠিক কোথায়? দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যাপারে, বা এমন কি সাধারণ চিকিৎসা প্রসঙ্গে এ-প্রশ্নের একটা কাজ চালানো মোটা জবাব পাওয়া হয়তো কঠিন ব্যাপার নয়। কেননা, এদিক থেকে অস্বাভাবিক বলতে অত্যন্ত স্থূল রকমের বিকৃতকেই বোঝা হয় এবং মোটের ওপর চলনসই হলেই স্বাভাবিক বলে স্বীকৃত হয়। যেমন ধরুন, আমি যদি নিরুপদ্রবে ঘরসংসার করি, তাহলে আমাকে স্বাভাবিক মানুষ বলেই স্বীকার করা হবে। কিন্তু কেউ যদি পথে-ঘাটে অনর্থক অসংলগ্ন চীৎকার করে, কিংবা নিজের মনগড়া এক জগতের কল্পনায় বিভোর হয়ে অকারণে হাসে, অকারণে কাঁদে, কিংবা কারুর মাথায় যদি বদ্ধমূল ধারণা দেখা দেয় যে আসলে সে অমুক দেশের রাজা, আর তমুক দেশের রানী তার সঙ্গে প্রণয়ে লিপ্ত বলেই সে-দেশের গুপ্তচরেরা তার আত্মীয়ের ছদ্মবেশ ধরে তার বিরুদ্ধে কূট চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে—তাহলে তাকে স্বাভাবিক বলা হবে না অস্বাভাবিক বলা হবে, এ নিয়ে তর্কের অবসর থাকবে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না হলেও আপনি অনায়াসে বলতে পারবেন এগুলো সবই পাগলামির লক্ষণ। 

কিন্তু দুঃখের বিষয়, যেখানে মনোবিকারের এমন স্কুল বিকাশ সেখানে ফ্রয়েডপন্থীর কলাকৌশল নেহাতই নিরুপায়। স্বয়ং ফ্রয়েডও সবিনয়ে স্বীকার করেন এ-জাতীয় মনোবিকারের (Psy—choses, বা ফ্রয়েডীয় পরিভাষায় Narcessistic Neuro—ses) চিকিৎসায় তাঁর পদ্ধতি কোনো হদিস দিতে পারে না। চিকিৎসা-বিজ্ঞানে যে-সব পদ্ধতি এখন পর্যন্ত এ-জাতীয় রোগ সম্বন্ধে আপেক্ষিকভাবে সফল হয়েছে সেগুলির ধরন-ধারণ অন্যরকমের। অবশ্য তাই বলে, ফ্রয়েডপন্থীরা নিজেদের কলাকৌশলকে মোটেই তুচ্ছ জ্ঞান করেন না। কেননা, স্বাভাবিক-অস্বাভাবিকের সীমারেখার সমস্যাটা তাঁদের কাছে মোটেই সহজ সমস্যা নয়। এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার স্তরে যাঁরা কোনোমতে তরে যাচ্ছেন—অর্থাৎ চলিতভাবে আমরা যাঁদের স্বাভাবিক বলে স্বীকার করে নিই—তাঁদের সবাইকার মানসিক সুস্থতা ফ্রয়েডপন্থীর কাছে স্বীকৃত নয়। বস্তুত, যাঁদের ওপর ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের প্রয়োগকে সার্থক বলে দাবি করা হয়, তাঁদের মধ্যে একটা বিরাট অংশই এই রকমের সাধারণ চোখে তরে-যাওয়া মানুষই। 

তাহলে? সুস্থ বা স্বাভাবিক মন বলতে ওঁরা ঠিক কী বলতে চান? এই প্রশ্ন নিয়ে অবশ্য ওঁদের নিজেদের মধ্যেই অনেক রকমের জটিল আলোচনা আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্তত চিকিৎসা-প্রসঙ্গে বাস্তব পরিবেশটুকুর মধ্যে সুস্থ বা স্বাভাবিক বলতে তাঁরা বোঝেন এমন এক মানসিক অবস্থা যা লাভ করলে পর মূর্ত পারিপার্শ্বিককে—এবং বিশেষ করে বর্তমান সমাজ-সম্পর্ককে—সম্পূর্ণ নিরুৎপাতে ও নির্বিবাদে স্বীকার করে নেওয়া যায়। অর্থাৎ কিনা, পারিপার্শ্বিককে বদল করবার দিকে, সমাজ-সম্পর্কের বর্তমান অনাচার বদলে তাকে সুস্থ ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করবার দিকে, ঝোঁক একেবারেই নয়। তাই, আদর্শের দিক থেকে বা উদ্দেশ্যের দিক থেকে, বিজ্ঞান নয়। তার বদলে ধর্ম—অভ্রান্তভাবেই ধর্ম। কেননা, ঝোঁকটা একান্তই হলো সহ্য করবার দিকে, কিংবা, আরো খুঁটিয়ে বললে বলা উচিত, সহ্য করবার যে কষ্ট তা ভুলতে শেখার দিকেই। 

বিষয়টিকে আরো খুঁটিয়ে বিচার করতে হলে ফ্রয়েডবাদের একটি বক্তব্য বিশ্লেষণ করা দরকার। বক্তব্যটি শুধুই যে ফ্রয়েডবাদের একটি স্থিতিস্তম্ভ তাই নয়, সুস্থ মন বা উপযোজন বলে ব্যাপারকে ফ্রয়েডপন্থীরা এই মূল বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষায়ই বিচার করতে বাধ্য হন। ফ্রয়েড বলছেন, বাস্তব সত্য (matrial reality) মানস সত্য (Psychical reality)—এই দুয়ের মধ্যে তফাত করতে হবে: এবং স্বাভাবিক মনের সংজ্ঞা খুঁজতে এগিয়ে ডাঃ আর্নস্ট জোন্স প্রথমেই বলে রাখছেন: By reality, we can in this connection only mean psychological reality, and this in its turn may be reduced to mental contact with the individuals comprising the particular environment of the subject. (Papers on Psychoanalysis: Concept of a Normal Mind. p. 204). অর্থাৎ কিনা, এই প্রসঙ্গে বাস্তব বলতে শুধুমাত্র মানসিকভাবে বাস্তবকে বুঝতে হবে, যা আবার শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিটির নিজস্ব পারিপার্শ্বিকের লোকজনের সঙ্গে মানসিক সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। 

কিন্তু ব্যাপারটা কী? বাস্তব সত্য আর মানসিক সত্যের মধ্যে তফাত মানে কি? সুস্থ মনের ফ্রয়েডীয় সংজ্ঞাটা শুধুমাত্র মানসিক সত্যের পটভূমিকাতেই বা কেন? 

বাস্তব দুনিয়ায় যা রয়েছে, যা ঘটছে, তা সবই হলো বাস্তবভাবে সত্য—ফ্রয়েডের পরিভাষায় material reality । কিন্তু ফ্রয়েড বলেন, আমরা আমাদের মানস সত্তার দিক থেকে এগুলিকে নিছক বাস্তব বস্তু যা বাস্তব ঘটনা বলে গ্রহণ করি না। অর্থাৎ কিনা, আমাদের মনোজগতের কাছে এগুলির তাৎপর্য সম্পূর্ণ অন্য রকমের। একটা নমুনা নেওয়া যাক। ইতিপূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি—টাকার কথা। নগদ টাকার নিছক টাকা হিসেবে যে মূল্য সেটা হবে বাস্তব সত্যের ব্যাপার—material reality। কিন্তু আমাদের সজ্ঞানে বা সচেতন মনের কাছে কাঁচা টাকা বলে এই জিনিসটা তার বাস্তব সত্যের রূপে প্রতিভাত হলেও আমাদের সমগ্র মানস সত্তার তুলনায় ওই সজ্ঞানের স্থান ফ্রয়েডীয় মতে তো নেহাতই সংকীৰ্ণ। মানবমন বলতে আসলে যা কিছু তা তো প্রধানতই হলো নির্ব্বান বা unconcious আর যদি তাই হয় তাহলে নিজ্ঞান মন বাস্তব বস্তু বা বাস্তব ঘটনাগুলিকে যেভাবে চিনতে চায়, যে অর্থে গ্রহণ করে, মানস সত্তার দিক থেকে সেইটেই হবে তার আসল রূপ। অর্থাৎ কিনা, মানস সত্য। মানস সত্য হিসেবে ফ্রয়েডপন্থীর কাছে তাই কাঁচা টাকার অন্য একটা তাৎপর্য আছে আর ফ্রয়েড মনে করেন, আমাদের ওই নিজ্ঞান মন এক অন্ধ ও প্রাকৃত যৌন ক্ষুধা-মাত্র। তাই, এই নির্ব্বান মনের সামনে যা কিছুই উপস্থিত হোক না কেন, আমাদের নিজ্ঞান মন তার একটা যৌন তাৎপর্য খুঁজে বের করে। ফলে মানস সত্যের দিক থেকে ওই তাৎপর্যটাই হয়ে দাঁড়ায় আসল কথা। যেমন ধরুন, বাস্তব সত্যের দিক থেকে যার নাম কাঁচা টাকা মানস সত্যের দিক থেকে তাই হয়ে দাঁড়ায় শুক্রবস্তু বা seminal matter । 

মানুষে-মানুষে যে সামাজিক সম্পর্ক তার বেলাতেও ফ্রয়েডপন্থীর এই কথাই। বাস্তব দুনিয়ায় তার একটা বাস্তব তাৎপর্য নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ফ্রয়েড বলবেন, তার ওই তাৎপর্যটাই একমাত্র তাৎপর্য নয়। অর্থাৎ কিনা আমাদের মানস সত্য এই সমাজ-সম্পর্কের মানস সত্য বা psychical reality আর ফ্রয়েড বলবেন, মনস্তত্ত্ববিদ্ হিসেবে–বা মনোবিকারের চিকিৎসক হিসেবে—তাঁর একমাত্র দায়িত্ব হবে শুধুমাত্র এই মানস সত্যটুকুর ওপরে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখা। 

প্রথমে, ফ্রয়েডের নিজের তরফের কথাটা দেখা যাক। বিজ্ঞানের তো অন্যান্য নানান শাখা আছে। বাস্তব যাথার্থ্যের নানান দিক নিয়ে মাথা ঘামানোর দায়িত্ব এই সব নানান শাখার। ও-সব দায়িত্বের কোনোটাই নিশ্চয়ই মনোবিজ্ঞানের নিজস্ব দায়িত্ব হবে না। তার একমাত্র দায়িত্ব হবে মানসিক সত্য বা psychi—cal reality নিয়ে মাথা ঘামানোর। যেমন ধরুন, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন-বিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানের নানা শাখা নানান দিক থেকে বাস্তব দুনিয়ার বাস্তব অর্থ সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। ওই অর্থ সংগ্রহ অবশ্যই মনোবিজ্ঞানের কাজ হবে না। আকাশের মহাশূন্যে বাস্তব গ্রহতারার বাস্তব রূপ আর গতিপথ কী রকম তার রহস্য আবিষ্কার করবার দায়িত্ব জ্যোতির্বিজ্ঞানের, মনোবিজ্ঞান এই প্রসঙ্গে শুধু প্রশ্ন তুলবে ওই গ্রহতারার দল মানবমনে ঠিক কোন্ ধরনের আবেগ-অনুভূতি জাগায়। সমাজ-সম্পর্কের বেলাতেই বা এই কথার কোনো ব্যতিক্রম কেন হবে? মানুষে-মানুষে যে সম্পর্ক তার বাস্তব রূপটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী নিশ্চয়ই নন। মানসিক সত্যের দিক থেকে এর যেটুকু তাৎপর্য শুধু তারই সন্ধান মনোবিজ্ঞানে। তাই, মনোবিজ্ঞানীর কাছে প্রধান প্রশ্ন হলো: ওই তাৎপর্যটা ঠিক কেমনতরো? ফ্রয়েডপন্থী বলবেন, মানস সত্যের স্তরে সব কিছুই যেহেতু নির্ব্বান মনের চাহিদা অনুসারে এক রকমের তর্জমামাত্র, আর নিজ্ঞান মনের চাহিদাটা যেহেতু শুধুই এক অন্ধ আর প্রাকৃত যৌন ক্ষুধা, সেইহেতু মানস সত্যের দিক থেকে মানুষে-মানুষে সব রকমের সম্পর্ক শেষপর্যন্ত সাবেকী অর্থ বদল করে তাকে অনেক ব্যাপক এক অর্থে গ্রহণ করতে চান; কিন্তু তাই বলে এই ব্যাপকতর অর্থের মধ্যেও কোনো রকমের সামাজিক সত্য প্ৰবেশ করতে পারেনি। কেননা, এই অর্থব্যাপ্তি-প্রসঙ্গে তাঁর মূলসূত্র হলো রকমারি কাম বিকারের দৃষ্টান্তই (Three Contributions)। ফলে যৌন-সম্পর্কের অজস্র রকমারিত্ব স্বীকার করে নিয়ে মানুষে-মানুষে যে-কোনো রকম বাস্তব সম্পর্ককে মানস সত্যের দিক থেকে কোনো না কোনো রকমের যৌন-সম্পর্ক বলে বর্ণনা করা ফ্রয়েডপন্থীর কাছে একটুও কঠিন কথা নয়। 

ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে পৌঁছয় তা আলোচনা করতে হলে একটা চূড়ান্ত নমুনা নেওয়াই ভালো। ধরুন, আপনি মিছিলে যোগ দিয়েছেন, পুলিশে লাঠি চালালো সেই মিছিলের ওপর। এখানে, আপনার সঙ্গে পুলিশের একটা সম্পর্ক ঘটলো। বাস্তবের দিকে থেকে এই সম্পর্কের কী রকম বর্ণনা হবে তা আমরা সহজবুদ্ধির সাহায্যেই বুঝতে পারি। আপনি হয়তো বলবেন: এ সম্পর্ক হলো নির্যাতক-নির্যাতিতের সম্পর্ক। অবশ্যই, কর্তৃপক্ষের ফতোয়ায় এর বর্ণনাটা অন্য রকমের হবে। তাঁরা একে বলবেন, এ-সম্পর্ক হলো উচ্ছৃঙ্খল ও শৃঙ্খলতার প্রতিনিধির সম্পর্ক। কিন্তু ফ্রয়েডপন্থী কী বলবেন? তিনি বলবেন, সম্পর্কটা আসলে আপনার বর্ণনা-অনুমোদিত না কর্তৃপক্ষের বর্ণনা-অনুমোদিত সে-তর্কে তাঁর মন নেই। কেননা, এই দুই বর্ণনার মধ্যে যে-দ্বন্দ্ব তা আসলে বাস্তব সত্যের বাস্তব বর্ণনা নিয়ে দ্বন্দ্ব। সে-দ্বন্দ্বে ফ্রয়েডপন্থীর মত নেই সে-চর্চা তাঁর কাছে পরধর্মের চর্চা। মনোবিজ্ঞানীর নির্দিষ্ট আদর্শ অনুসারে বাস্তব সত্যের বাস্তব বর্ণনা নিয়ে মাথা ঘামানোটাই যে অবান্তর ব্যাপার! তাই মনোবিজ্ঞানী বিশেষ করে ভাবছেন, নিজ্ঞান মনের চাহিদা মেনে মানুষের মন এই সম্পর্কটাকে কি কীভাবে বুঝতে চায়? অর্থাৎ কিনা, বাস্তব সম্পর্কটা যে-রকমেই হোক না কেন, নিজ্ঞানের তর্জমা অনুসারে তার কী রূপ দাঁড়ালো? কিন্তু নির্জ্ঞান মনের কাছে নিছক যৌন ছাড়া আর কোনো রকমের ভাষা জানা নেই। তাই নিজ্ঞান মন এই সম্পর্ককেও যৌন-সম্পর্কের অর্থেই বুঝতে চায়। কী ধরনের যৌন-সম্পর্ক? ফ্রয়েডপন্থী বলবেন, সমকামী বা hotnosexual যৌন-সম্পর্ক: সেপাইয়ের পক্ষ থেকে কর্মবৃত্ত বা active, আপনার তরফ থেকে ভোগবৃত্ত বা passive। আ আপনি যদি ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের সাহায্যে স্বাভাবিক মানুষ হবার চেষ্টা করেন তাহলে ফ্রয়েডপন্থী আপনার মানসিক সমস্যাটা আপনাকে কীভাবে বোঝাতে চাইবেন? তিনি বলবেন, প্রথমত কর্তৃপক্ষের শাসন অমান্য করে এভাবে মিছিলে যোগ দেবার মানসিক তাৎপর্য হলো পিতৃদ্রোহের ভাব প্রকাশ করা: অবশ্য এই রকমের পিতৃদ্রোহেরও একটা যৌন তাৎপর্য আছে, কিন্তু সে-কথা আপাতত থাক। দ্বিতীয়ত, ফ্রয়েডপন্থী বলবেন, আপনার নিজ্ঞান মনের যৌন তাগিদ (libido) যদি সত্যিই দ্বন্দ্বমুক্ত হয় তাহলে ওই ভোগবৃত্ত সমকামী চরিতার্থতার পক্ষেও সুখভোগ্য হবার পথ খুলে যাবে। অর্থাৎ কিনা, পুলিশের কাছ থেকে লাঠির বাড়ি খেয়ে শারীরিক যন্ত্রণা সত্ত্বেও মোট অভিজ্ঞতাটাকে আপনি সুখভোগ্য বলেই গ্রহণ করতে পারবেন। বস্তুত, সেইটেই হবে স্বাভাবিক বা সুস্থ মনের লক্ষণ। কেননা, সুস্থ বা স্বাভাবিক অবস্থা বলতে মনের সেই অবস্থাই বোঝায় যা লাভ করলে পর সমস্ত রকমের সম্ভবপর যৌন আকাঙ্ক্ষা বাধামুক্ত ও দ্বন্দ্বমুক্ত হয়ে যায় আর তাই সমস্ত রকমের সম্পর্কই হয়ে পড়ে মধুময়। আর তা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ নানান রকম পরিস্থিতিতে নানা রকমের উত্তেজনা-উৎকণ্ঠার দুঃখ ভোগ করে থাকে। যেমন ধরুন, আপনার নিজ্ঞানের ভোগবৃত্ত সমকামী যৌন চাহিদা যদি বাধামুক্ত ও দ্বন্দ্বযুক্ত না হয় তাহলে এই জাতীয় পরিস্থিতি বা পরিস্থিতির কল্পনাও আপনার পক্ষে অত্যন্ত ক্লেশকর হবে, কিংবা যা একই কথা, পরিস্থিতিটা গ্লানিকর হচ্ছে কিনা তাই দেখেই অনুমান করা চলবে আপনার নিজ্ঞান মনে ভোগবৃত্ত সমকামের চাহিদা দ্বন্দ্বমুক্ত হয়েছে কিনা। আপনি হয়তো ঘোরতর নাস্তিকের মতো বলবেন: এ একেবারে আষাঢ়ে কথা, মার খেতে কি সত্যি কারুর ভালো লাগতে পারে নাকি? ফ্রয়েডপন্থী হেসে জবাব দেবেন: তা পারে বই কি? “মারো মারো প্রভু, আরো মারো”–এ গানও তো মানুষের গলাতেই শোনা গিয়েছে, আর ভোগবৃত্ত সুখানুভূতির পথ একেবারে বাধামুক্ত না হলে পর এই গানের পেছনে যে-আবেগ তার উৎস কেমন করে ব্যাখ্যা করবেন বলুন? 

দৃষ্টান্তটা অবশ্যই একেবারে চরম দৃষ্টান্ত হলো। কিন্তু কোনো একটি মতবাদকে বিচার করতে হলে, তার আসল দাবিটা ঠিক কী রকম তা স্পষ্টভাবে চিনতে হলে, একেবারে চরম দৃষ্টান্তের শরণাপন্ন হওয়াই সবচেয়ে সুবিধের। তাই এই দৃষ্টান্তটিকে বিচার করেই উপযোজন কথাটির প্রকৃত তাৎপর্য আপনি সহজে চিনতে পারবেন। ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের আসল চেষ্টাই হলো, রোগীর সামনে তার নিজ্ঞান মনের সমস্ত চাহিদাগুলিকে ধীরে ধীরে উদ্ঘাটন করে এগুলিকে বিনা দ্বন্দ্বে গ্রহণ করতে শেখানো; এইভাবে যৌন পরিস্থিতির সমস্ত সম্ভাবনা বাধামুক্ত হলে পর জীবনের সমস্ত পরিস্থিতিই তার কাছে মধুময় হয়ে উঠবে—কোনো অবস্থাই তাকে আর পীড়িত করবে না, উৎকণ্ঠিত করবে না। 

ওই অন্ধ যৌন তাগিদের কথা কতোখানি বাস্তব সে-আলোচনা স্বতন্ত্র; এখানে তার অবতারণা করতে গেলে মূল আলোচনা ছেড়ে অন্যদিকে অনেকখানি এগিয়ে যেতে হবে। আপাতত দেখুন, ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের এই আদর্শটিকে ধর্মের আদর্শ বলবেন না, বিজ্ঞানের আদর্শ বলবেন। এর পেছনে যদি বহির্বাস্তবকে বদল করবার, প্রকৃতিকে জয় করবার এতোটুকুও আগ্রহ থাকতো তাহলে একে বিজ্ঞানের সমগোত্র বলবার সুযোগ হয়তো পাওয়া যেতো। কিন্তু যেহেতু এই কৌশল বহির্বাস্তবকে সবচেয়ে নিরুপদ্রবে সহ্য করবার উদ্দেশ্য ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যকে আমল দিতে পারে না সেইহেতু একে একান্তভাবেই ধর্মপদবাচ্য বলতে হবে। আর ওই হলো ফ্রয়েডের অন্তর্দ্বন্দ্ব: ধর্মকে তিনি বলছেন পাঁচ রকম palliative remedy—মাদকদ্রব্যের মতোই জীবনের জ্বালা ভোলবার একটা উপায়। অথচ, তাঁর নিজের এই কলাকৌশলও শেষ পর্যন্ত একরকম palliative remedy ছাড়া আর কিছুই হতে পারলো না! তাহলে, পরলোক থেকে প্রত্যাশা প্রত্যাহার করে বিজ্ঞান-নির্ভর সুস্থ পরিবেশে সুখের জীবন নিয়ে তিনি যে-উক্তি করেছিলেন তা কি নেহাতই কথার কথা হয়ে দাঁড়ালো? 

অবশ্যই, ধর্মের মামুলি রূপ এটা নয়। তাহলে তো সহজেই ধর্ম বলে চিনতে পারা যেতো। তার বদলে ধর্মের নবকলেবর—অনেক সূক্ষ্ম, অনেক সভ্য, অনেক মার্জিত এর রূপ, তাই বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে চলে যায়, খটকা লাগে না। বিশেষ করে বিজ্ঞানস্তুতির আড়ালে পেশ করলে পর একে ধর্ম বলে চিনতে পারাই কঠিন। কিন্তু তবু কলেবরের তফাত হলেই তো আর মৌলিক তফাত হয়ে যায় না। লেনিন যেমন গোর্কিকে লিখেছিলেন, ধর্মের সেকেলে স্থূল রূপটার সঙ্গে গণতন্ত্র-স্বীকৃত সুক্ষ্ম রূপটার তফাতটা আসলে হলুদ-বরন ভূত আর নীল-বরন ভূতের মধ্যেকার তফাতের মতোই। ভূতুড়ে গল্প হিসেবে ধর্মের স্থূল রূপটার চেয়েও সুস্থ ও মার্জিত রূপটাই অনেক বেশি বিপজ্জনক: প্রথমটিকে আপনি এক-নজরেই ধর্ম বলে চিনতে পারবেন, তার স্থুল কদর্যতায় বিরূপ হবে আপনার মন: কিন্তু সুক্ষ্ম রূপে ধর্মের যে-বিকাশ তার বিপদ সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকা অনেক বেশি কঠিন। লেনিন বলেছেন: The crowd is much more able to see through millions of Physical sins, dirty tricks, violences and infections which are therefore much less dangerous than is the subtle spiritual idea of the little god arrayed in the smartest of “ideological” costumes. A Catholic priest who violates young girls (about whom I happened to read just now in a German newspaper) is much less dangerous to “democracy” than are priests who do not wear surplices, priests without vulgar religion, ideolocial and democratic priests, who preach the creation, and making of little gods. The first type of priests can be early exposed, condemmed and driven out but the second cannot be driven out so simply. It is a thousand times more difficult to expose him since not a single “frail and pitifully weak” philistine will agree to “condemn” him. Religion : Lenin, p. 70 ). 

বাস্তব জগতের বাস্তব সমাজ-সম্পর্কের পরিবর্তন প্রসঙ্গ এড়িয়ে ফ্রয়েডপন্থীও যখন অতিপ্রাকৃত এক অন্ধ যৌন তাড়নার গল্প শুনিয়ে এই বাস্তব পরিবেশকেই কোনোমতে সইতে শেখবার পথনির্দেশ করেন তখন তাঁর ওই বন্ধ ঘরের রহস্যঘন কায়দাকানুনকে আপাতত যতোই রোমাঞ্চকর বিজ্ঞান বলে ভ্রম হোক না কেন, ভুললে চলবে না তিনি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সমাজের ধড়াচূড়োহীন পুরুতঠাকুরই—পুরোহিতের আদর্শের সঙ্গে তাঁর প্রকৃত আদর্শের তফাত নেই যে! 

অবশ্যই ফ্রয়েডপন্থী তর্ক তুলে বলতে পারেন, এমনতরো আপত্তির কোনো অর্থ হয় না। মনোবিজ্ঞানীর সমস্যাটা মানস সত্য ছাড়া আর কিসের সমস্যা হতে পারে? বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সমস্ত কর্মীর কাজই তো আর এক নয়। পদার্থবিজ্ঞানী কেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের সমস্যা সমাধান করছেন না—এমনতরো আপত্তি নিশ্চয়ই মূর্খতাবাচক। তেমনি, মনোবিজ্ঞানী শুধুমাত্র মানস সত্য নিয়ে মাথা ঘামান বলে তাঁর চেষ্টাকে ধর্মপদবাচ্য বলে ঘোষণা করাটাও শিক্ষিত মনের পরিচয় নয়। ফ্রয়েডপন্থী নিশ্চয়ই বলবেন, মনোবিজ্ঞানী যদি মনোবিজ্ঞানী না হতেন তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর পক্ষেও সমাজ-সম্পর্ক ও বাস্তব পরিবেশকে বদল করবার প্রশ্ন উঠতে পারতো। কিন্তু সে-কথা তুলে তো আর লাভ নেই। বরং মনোবিজ্ঞানী যদি ওই ধরনের ভয়াবহ পরধর্মচর্চা করতে যেতেন তাহলেই তাঁর বিরুদ্ধে আদর্শ বিচ্যুতির অভিযোগটা প্রাসঙ্গিক হতো। তাছাড়া, ফ্রয়েডপন্থী হয়তো আরো বলবেন, উপরোক্ত আপত্তিটা যদি ঠিক হয় তাহলে তো মনোবিজ্ঞান কোনোকালেই বিজ্ঞান হতে পারবে না। কেননা, বহির্বাস্তবের পরিবর্তন-প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু মানস সত্তার পরিবর্তন-প্রসঙ্গ উত্থাপন করাই যদি ধর্মমোহের লক্ষণ হয়, তাহলে স্বধর্ম বর্জন ছাড়া মনোবিজ্ঞানীর পক্ষে যে এই তথাকথিত ধর্মমোহের পথ থেকে ফিরে আসবার কোনো উপায়ই নেই। কেননা, মনোবিজ্ঞান যেহেতু নেহাতই মনোবিজ্ঞান সেইহেতু শুধু মানস সত্তার আলোচনাই তার পক্ষে স্বধর্ম। 

এই আপত্তির পুরো জবাব দিতে হলে মনোবিজ্ঞানের প্রকৃত রূপ নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা তুলতে হয়। আর সেই আলোচনা-প্রসঙ্গে যে মূল প্রশ্ন ওঠে, সেটা হলো: মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসে কি সত্যিই বিজ্ঞানের পথ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, সম্ভব হয়েছে কি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ? অর্থাৎ কিনা, মনোবিজ্ঞান কি সত্যিই পেয়েছে বিজ্ঞানের মর্যাদা? যদি খাপছাড়াভাবে ঘোষণা করা হয় যে মনোবিজ্ঞান এখানো প্রকৃত বিজ্ঞানের মর্যাদা সত্যিই পায়নি, তাহলে নিশ্চয়ই অর্বাচীনতার অপবাদ জুটবে, বাস্তব পরিস্থিতিটা সত্যিই এর চেয়ে খুব কিছু আশাপ্রদ নয়। ধর্মমোহ আর দার্শনিক কল্পনার গণ্ডি পেরিয়ে মনোবিজ্ঞান প্রকৃত বিজ্ঞানের পর্যায়ে পৌঁছতে পেরেছে কিনা তা সত্যিই আজো বিচার সাপেক্ষ প্রশ্নই। গ্রন্থান্তরে এই প্রশ্ন নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা তুলেছি (“পুরোনো প্রশ্ন আর নতুন পৃথিবী” দ্রষ্টব্য)। আর সেই প্রসঙ্গেই দেখাবার চেষ্টা করেছি, মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পালভের আবিষ্কার যে বৈপ্লবিক পথ খুলে দিয়েছে, একমাত্র সেই পথ অনুসরণ করলেই মনোবিজ্ঞানের পথে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক মর্যাদা পাবার আশা। আর মনোবিজ্ঞানে এই যে বিপ্লব এর মূল কথা হলো, মানস সত্তাকে বাস্ব পরিবেশ নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক রূপে চিনতে যাওয়াটাই ভুল, কেননা রক্তমাংসে গড়া এই মানুষ একান্তভাবেই বাস্তব পৃথিবীর অঙ্গ এবং তার স্নায়ুতন্ত্রের উপর বাস্তব প্রকৃতির নিয়ত প্রভাবই তার মানস সত্তার প্রকৃত রূপ! অথচ, প্রাক্-পালভ মনোবিজ্ঞানের মূল কথাটা একেবারে অন্য—মানস সত্তাকে বাস্তব-নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ সত্তা বলে চেনবার চেষ্টা। কেননা, প্রাক্-পালভ মনোবিজ্ঞানের চোদ্দ আনা প্রেরণাই হলো প্লেটনিক ভাববাদের প্রেরণা। অবশ্য এইখানে ওই আলোচনার পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন, তাছাড়া তাতে মূল আলোচনার খেই হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা। কেবল, অর্বাচীনতা-অপবাদের প্রতিবাদে বৃদ্ধসম্মতি হিসেবে পালভের নিজের উক্তি উদ্ধৃত করা যায়: 

At the beginning of our work and for a long time afterwards we felt the compulsion of habit in explaining our subject by psychological interpretation. Every time the objective interpretation met an obstacle…there arose quite naturally misgivings as to the correctness of our new method. Gradually with the progress of our research these doubts appeared more rarely, and now I am deeply irrevokably convinced that along this path will be found the final triumph of the human mind over its uttermost and supreme problem-the knowledge of the mechanism and laws of the human nature…Let the mind rise from victory to victory over surrounding nature, let it conquer for human life and activity not only the surface of the earth but all that lies between the depths of the sea and the outer limits of the atmosphere, let it command for its service prodgious energy to flow from one part of the universe to the other, let it annihilate space for the transference of its thought, yet the same human creature, led by dark powers to works and revolutions and their horrors, produces for itself incalculable material losses and inexpressible pains and reverts to bestial conditions. Only science, exact science about human nature itself, and the most sincere approach to it by the aid of the omnipotent scientific method, will deliver man from its present gloom, and will purge him from his contemporary shame in the sphere of inter—human relations (Lectures on Conditioned Reflexes, p. 41 ). 

মনে রাখতে হবে, objective method বলতে এইখানে পালভ তাঁর conditioned reflex পদ্ধতির উল্লেখ করেছেন, যে-পদ্ধতির মূল কথাই হলো: মানস সত্তাকে বাস্তব পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করবার চেষ্টাটাই ভ্রান্ত। আর এইদিক থেকেই স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় ফ্রয়েডবাদের মূল প্রতিজ্ঞা হলো মানস সত্যকে বাস্তব সত্য থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করে নিতে হবে এবং মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকে একান্তভাবেই নিবদ্ধ রাখতে হবে ওই মানস সত্যটুকুর উপরে। ঠিক এইখানেই, ফ্রয়েডবাদের বিজ্ঞান-বিরোধী উৎসাহের আসল বীজ! আর বিজ্ঞানের ভিত্তি হারিয়ে ফ্রয়েডবাদের বিজ্ঞান-বিরোধী উৎসাহের আসল বীজ! আর বিজ্ঞানের ভিত্তি হারিয়ে ফ্রয়েডবাদ শুধুই যে রকমারি পৌরাণিক কল্পনায় বিভোর হয়েছে তাই নয়, মানুষের ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে দেখেছে শুধুই গভীর অন্ধকার। বিজ্ঞানের উপর দৃঢ় আস্থা পাভ্লভের কণ্ঠে যে আশার বাণী জাগিয়েছে তার পাশাপাশি ফ্রয়েডের কথাগুলি তুলনা করে দেখুন। ফ্রয়েড বলছেন : 

…What would be the use of the most acute analysis of social neuroses, since no one possesses the power to compel the community to adopt the therapy? … My courage fails me, therefore, at the thought of rising up as a prophet before my fellow-men, and I bow to their reproach that I have no consolation to offer them. (Civilization and its Discontents. pp. 142-143). 

অর্থাৎ কিনা, পুরো সমাজটা যে-মনোবিকারে ভুগছে তার চরম বিশ্লেষণ করেও কোনো লাভ নেই, কেননা এই রোগের যে-চিকিৎসা তা সমাজকে গ্রহণ করতে বাধ্য করবার মতো শক্তি কারুরই নেই। অতএব, আবার স্বজনদের সামনে কোনো এক অবতারের মতন উঠে দাঁড়াবার সাহস আমার হয় না এবং তাঁদের কোনো সান্ত্বনার বাণী শোনাতে আমি সত্যই অসমর্থ—এর দরুন যে-নিন্দা তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করছি। 

মানুষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে এই হলো ফ্রয়েডের চরম কথা। আর এই হতাশাকে যে-কোনো আখ্যা দিন না কেন, একে বিজ্ঞান কিছুতেই বলা চলে না। কেননা, বিজ্ঞানের আসল আদর্শটাই যে একেবারে অন্য আদর্শ : মূর্ত পৃথিবীর সঙ্গে সংগ্রামে এগিয়ে মানুষের জন্যে শান্তি আর স্বাচ্ছন্দ্য: অর্জনের আদর্শ। অবশ্যই এ-কথা ঠিক যে শুধু মাত্র জড়জগৎকে জয় করতে পারইে মানুষের সুখ শান্তি পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। তাই ফ্রয়েড যখন শুধু এ-কথাটা বলেন তখন তাঁকে বিজ্ঞান-বিরোধী বলবার তাগিদ থাকে না। এ-কথা পালভও স্বীকার করেন এবং কেন যে তা সত্যি তার ব্যাখ্যা দিয়ে এঙ্গেলস্ বলেন, মানুষের সমস্যা তো শুধুই জড়জগতের প্রাকৃতিক শক্তিকে জয় করবার সমস্যাটুকু নয়, এই প্রকৃতিরই অন্তর্গত মানুষে মানুষে যে সমাজ-সম্পর্ক তার আইনকানুনও স্পষ্টভাবে চিনতে পারা এবং ওই জ্ঞানের ভিত্তিতে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা। নিছক বহিঃপ্রকৃতির আইনকানুনকে অনেকখানি চিনতে, ও চেনবার ভিত্তিতে জয় করতে শিখেও মানুষ এখনো সেই অনুপাতেও সুখের আনন্দের অধিকারী হতে পারেনি, কেননা সমাজ-সম্পর্কের আইনকানুন সম্বন্ধে মানুষের চোখ ফোটেনি সেই অনুপাতে। 

But even in this sphere, by long and often cruel experience and by collecting and analysing historical material, we are gradually learning to get a clear view of the indirect, more remote, social effects of our productive activity, and so the possibility is afforded us mastering and controlling these effects as well. (Engels: Dialectics of Nature, p. 294). 

সমাজ-সম্পর্কের মৌলিক পরিবর্তন যে মানবচরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন সাধন করবে এবং তারই ফলে মানুষের সামনে যে খুলে যাবে অসীম ভবিষৎ-এ বিশ্বাস থেকে পালভের পক্ষে বিচ্যুত হবার প্রশ্ন ওঠেনি, কেননা মানবচরিত্রকে বা মানস সত্যকে তিনি বাস্তব-নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ কিছু বলে কল্পনা করেননি। তাই দেশের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে অমন বলিষ্ঠ অভিনন্দন জানানো তাঁর পক্ষেই সম্ভব হলো: 

As you know, I am an experimenter from head to foot. Our government is also an experimenter. only on an incomparably higher plane. I passionately desire to live in order to see the victorious completion of this historical social experiment. (Conditioned Reflex and psychiatry, p. 33). 

ফ্রয়েডের পক্ষে কিন্তু অতো বড়ো বৈজ্ঞানিক মহাপরীক্ষা থেকেও বিশেষ কিছু আশা-ভরসা পাবার প্রশ্ন ওঠে না, কেননা, মানব-স্বভাবটা তাঁর কাছে এক নিরবলম্ব মানস সত্যমাত্র আর তাই বাস্তব সমাজ-সম্পর্কের কোনো রকম পরিবর্তনই এই বিশুদ্ধ মানস সত্যটির উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। 

I too think it unquestionable that an actual change in men’s attitude to property would be of more help in this direction than any ethical commands: but among the socialists this proposal is obscured by new idealistic expectations disregarding human nature which detract from its value in actual practice (Civilization and its Discontnts. pp. (140-41). 

ফ্রয়েডীয় মতে, সমাজতান্ত্রিক কর্মী যে-মানবপ্রকৃতির কথা ভুলে যাচ্ছেন তার স্বরূপটা কী রকম? ফ্রয়েড বলবেন, মূলতই জিঘাংসাময় তার রূপ আর বাস্তব পরিবেশের কোনো রকম অদল-বদল করেই মানবপ্রকৃতির এই রূপটাকে বদল করবার সম্ভাবনা নেই। কেননা, মানবপ্রকৃতি তো ফ্রয়েডীয় মতে বাস্তব পরিবেশের ওপর একটুও নির্ভর করে না। তাই পরিবেশকে বদল করা গেলে সনাতন মানবপ্রকৃতি নবরূপে আত্ম-চরিতার্থতা খুঁজবে মাত্র। ফ্রয়েড যে-রকম বলছেন: 

…the attempt to establish a new communistic type of culture in Russia should ।find psychological support in the persecution of the bourgeois. One only wonders with some concern, however, how the Soviets will manage when they have exterminated their bourgeois entirely. (Ibid. p. 91 )

বলাই বাহুল্য, আজকের দিনে বিশ্বশান্তি-শিবিরের অমন বলিষ্ঠ নেতৃত্ব যার উপর তার সম্বন্ধে ফ্রয়েডের এই কল্পনা শুধুই হাস্যের উদ্রেক করে। কার উপর রুশদের তার জিঘাংসা প্রবৃত্তি চরিতার্থ করবে? কারুর উপরই নয়, কেননা ওই জিঘাংসা প্রবৃত্তির কথাটাই যে অতিকথা-মাত্র! তার বদলে আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি গঠনমূলক পরিকল্পনায় রুশ সমাজের আজ কী অদম্য উৎসাহ, কী অপরূপ অবদান; তুষারঢাকা মরুভূমির উপর ওরা সোনালী ফসলের বন্যা বওয়াচ্ছে, ভল্গা-ডন খাল খুঁড়ে ওরা বদলে দিচ্ছে দেশের ভৌগোলিক লক্ষণ! অথচ, ওই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে পর্যন্ত ওদের মানসিক সত্তা মোটেই এ-রকমের ছিলো না। কিন্তু পাভলভের মনোবিজ্ঞান অনুসারে, মানসিক সত্তাটা নির্ভর করে বাস্তব পরিবেশের ওপর আর তাই প্রাক্-বিপ্লবী নিরন্ন ও গ্লানিময় রুশ চরিত্রের দিকে চেয়েও পালভ দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করতে পেরেছিলেন : 

When the negative features of the Russian character-laziness, lack of enterprise, and even slovenly relations to every vital work-provoke melancholy moods, I say to myself, No, these are not real qualities, the are only the veneering, the damning inheritance of Slavery. It made a parasite of the master… and it left the reflex of purpose without exercise in the fundamental habits of living. Of the slave it made a completely passive creature, without any vital perspective: for continually in the way of his most natural aspirations arose an insurmountable obstacle in the form of the powerful egoism and caprice of his master. But I venture further: a spoiled appetite and poor nutrition may be restored by careful regime and special hygiene. The same can and should happen with the reflex of purpose which has been suppressed during Russia’s history. (Lectures on Conditioned Reflex, PP. 280-81). 

এই আলোচনা অবশ্যই দীর্ঘতর হতে পারে। পাভলভের বিপ্লবীপন্থা অনুসরণ করে মনোবিজ্ঞানকে প্রকৃত বিজ্ঞানের মর্যাদা দিতে পারলে মানবকল্যাণ সাধনে তার অবদান কী অসীম হওয়া সম্ভব তারই আলোচনা। আপাতত সে-আলোচনা স্থগিত থাক; পুরোনো প্রশ্ন আর নতুন পৃথিবী বলে বইতে এ-আলোচনা খুঁটিয়ে করেছি। 

উপস্থিত, ফ্রয়েডীয় উপযোজন বলে ব্যাপারটির বিশ্লেষণ শেষ করা যাক। ধর্মের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভাববাদী গণ্ডির মধ্যে অমন একান্তভাবে আবদ্ধ থেকে ফ্রয়েডের অমন জমকালো কলাকৌশল কি মানবপ্রকৃতির কোনো বাস্তব পরিবর্তন সাধন করতে সত্যিই অক্ষম হয়? কেমন করে হবে? বাস্তব সত্য থেকেই যে মানস সত্যের জন্ম, বাস্তব সত্যের ওপরই যে মানস সত্যের নির্ভর, বাস্তব সত্যের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে তাই, শুধুমাত্র মানস সত্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাবার চেষ্টাটাই যে গোড়া কেটে আগায় জল ঢালবার মতো। কিংবা, বলা যায়, যেন ভিত্তি বাদ দিয়ে বাড়ি গড়বার চেষ্টা। সে বাড়ি স্বভাবতই তাসের ঘরের মতো। ফুঁ দিলে পড়ে যায়, এমন দুর্বল। কেবল হয়তো ধ্বসে পড়বার যন্ত্রণাটা টের পাওয়া যায় না। ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের ওইটুকুই হলো আসল কথা। কিন্তু তার মানে palliativeremedy ই। আফিমের মতো, কোকেনের মতো। 

তাসের বাড়িটা যে কী রকম তার একটা নমুনা দেখা যাক। ১৯৩১ সালে আর্নস্ট জোন্স-এর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তার শিরোনাম হলো: The Concept of a Normal Mind । অর্থাৎ কিনা, স্বাভাবিক মন বলতে কী বোঝায় ফ্রয়েডীয় দৃষ্টি-কোণ থেকে তারই আলোচনা। মনে রাখা দরকার, স্বয়ং ফ্রয়েডকে বাদ দিলে ফ্রয়েড-গোষ্ঠীর কাছে জোন্স হলেন মনঃসমীক্ষণের মহাগুরু এবং স্বাভাবিক মনের সংজ্ঞা-নিরূপণ-ব্যাপারে এই প্রবন্ধই মনঃসমীক্ষণ-সাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। আর এই প্রবন্ধে জোন্স নিজেই স্বীকার করছেন: “we have no experience of a completely normal mind”– সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মনের পরিচয় ওঁরা কোথাও পাননি (Papers on Psychoanalysis. p. 216 )। ইতরসাধারণের কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেলো, কিন্তু জোন্‌স্‌ বলছেন, মহাপুরুষদের মধ্যেও নয়। ডারউইন, ফ্যারাডে, ফ্রয়েড, গেটে, হাক্‌স্মি, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, নেপোলিয়ান, শেক্সপীয়র, ওয়াশিংটন—জোন্স-এর মতে কারুর চরিত্রেই সম্পূর্ণ স্বাভাবিকত্বের পরিচয় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো মনঃসমীক্ষণের ওই “আশ্চর্য” কৌশল, ওর সাহায্যেও কি মানুষের মনকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক করে তোলবার কোনো কায়দা হয় না? আর এই প্রশ্নটা খুবই জরুরী প্রশ্ন না হয়ে পারে না। কেননা, পদ্ধতিটা তো সত্যিই ছেলেখেলার ব্যাপার নয়। অত্যন্ত দীর্ঘ আর অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ এক পদ্ধতি। সময় এবং অর্থব্যয়ের দিক থেকে রোগীকে তো প্রায় দেউলে করে দেবার জোগাড়। আর অতো করেও যদি মনটা প্রকৃত স্বাভাবিকের মর্যাদা না পেলো তাহলে কিসের অমন ঢাকঢোল, অতো জাঁকজমক? অথচ জোন্স হতাশকণ্ঠেই স্বীকার করেছেন—impartial observer cannot fail to be struck by the disconcerting fact that analysed people, including psychoanalysts, differ surprisingly little from unanalysed people in the use made of their intelligence. (Papers on Psy—choanalysis. p. 207 ). 

বিচারবুদ্ধির উপযুক্ত প্রয়োগশক্তিকে, রাগদ্বেষহীন, নির্মল বিবেচনা-শক্তিকে নিশ্চয়ই সুস্থ মনের পরিচয় বলে মানতে হবে। তা যদি মানতেই হয় তাহলে স্বীকার না করে উপায় কি যে ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের সাহায্যে মন সত্যিই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে না—অর্থাৎ ওই কলাকৌশল নিয়ে যতোই রহস্যসৃষ্টি করা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত ওর দশা তাসের ঘরের মতো। জোন্স নিজেই স্বীকার করছেন : 

Analysts and other analysed persons often continue to hold heartedly the same convictions and to employ in support of them the same rationalized arguments as unanalysed people in such matters of political controversy: the sacrosanctity of private property and the capitalistic system, or, on the other hand. the panacea of communism; the relative advantages of free trade and tariffs; … in varying attitudes towards the manifold fields of art; in feelings about fashions and differences in social class; in the conventional estimates of historical and political personages and events; in the important spheres of national prejudices and convictions; in views about foreign problems (the relation of one’s own country to others). Ibid, p. 208 ) . 

—অর্থাৎ, এককথায়, ফ্রয়েডীয় কলাকৌশল যাঁরা প্রয়োগ করে থাকেন এবং যাঁদের উপর এ-কৌশল প্রয়োগ করা হয় তাঁরা সকলেই ‘ইতর-সাধারণের” মতোই রাজনীতি, শিল্প, সমাজতত্ত্ব প্রকৃতি বিষয়ে নিজেদের রাগদ্বেষ ও সংস্কার অনুসারেই উত্তেজিত তর্ক-বিতর্ক করে থাকেন এবং গোঁড়ামি পোষণ করে রাখেন। 

অবশ্যই, ফ্রয়েডবাদীরা এই নিরুপায়ত্বেরও এমন এক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেন, যাতে তাঁদের নিজেদের গায়ে কোনো আঁচড় না পড়ে। জোন্স যেমন বলছেন, এ-পর্যন্ত কারুর উপরই যে একেবারে মনের সাধ মিটিয়ে ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ কিনা, ওঁদের ভাষায়, কোনো ব্যক্তিকেই একেবারে গভীরতর স্তর পর্যন্ত মনঃসমীক্ষণ করা যায়নি। তা যদি যেতো তাহলে তিনি কতোখানি পর্যন্ত রাগদ্বেষ এবং মোহ-সংস্কার থেকে মুক্তি পেতেন তা দেখতে পাওয়া নিশ্চয়ই চিত্তাকর্ষক হতো। কিন্তু, হায়, ফ্রয়েডপন্থীর নিজের স্বীকৃতি অনুসারেই যে তা সম্ভব নয়! জোন্স বলেছেন: But who would bell the cat? Who is himself sufficiently objective and well-informed to undertake such a task? অর্থাৎ, ও কথা ভেবে লাভ নেই। কেননা, মনঃসমীক্ষণ—পদ্ধতির অমন আদর্শ প্রয়োগ করতে পারবেন এমনতো কোনো যোগ্য ব্যক্তির কথাই ভাবা যায় না। 

তার মানে, মোদ্দা কথায় ফ্রয়েডপন্থীর নিজস্ব স্বীকৃতি অনুসারেই ফ্রয়েডীয় কৌশলের সাহায্যে সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক মানসিক অবস্থা পাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর, তাঁদের এই স্বীকৃতিকে জরুরী করা হিসেবে উল্লেখ করতে চাই—অসম্ভাবনার একটা জুতসই কারণ কল্পনা করে তাঁরা যেভাবে নিজেদের চামড়া বাঁচাতে চান সেইটাই আসলে বড়ো কথা নয়। কেননা আসল কারণটার কথা তো আমরা আগেই আলোচনা করেছি: বাস্তব সত্য থেকে তথাকথিত মানস সত্যকে অমনভাবে ছিঁড়ে নিয়ে যে-ঘর বাঁধবার চেষ্টা সে-ঘর যে তাসের ঘরের মতোই। গোড়া কেটে আগায় জল ঢেলে লাভ নেই বনিয়াদ বাদি দিয়ে ইমারত গাঁথবার চেষ্টায়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *