অবাধ অনুষঙ্গ
যে কায়দাটি হলো ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের প্রধান কেন্দ্র তার নাম দেওয়া হয় free association method বা অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতি। ফ্রয়েড নিজে এই পদ্ধতিটির উপর কতোখানি জোর দিতে চান তা বোঝা যাবে তাঁর অকুণ্ঠ ঘোষণা থেকে। তিনি বলছেন,—একাধিকবার বলছেন,—সম্মোহন বা hypnotism-এর উপর নির্ভরতা ছেড়ে যখন থেকে তিনি এই অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতির উপর নির্ভর করতে শিখলেন তখন থেকেই মনঃসমীক্ষণ প্রকৃত অর্থে বিজ্ঞানের মর্যাদা পেলো, বা, যা একই কথা, জন্ম হলো মনঃসমীক্ষণ-বিজ্ঞানের। তাই, যে স্তম্ভের উপর ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের চরম নির্ভরতা তা ওই অবাধ অনুযঙ্গ পদ্ধতিই। আর, প্রথম নজরে এই পদ্ধতিকে সত্যিই বিজ্ঞান-প্রাণ বলে মনে হয়। কেননা সমস্ত বিজ্ঞানের পিছনেই যেটা মূল স্বীকৃতি আপাত-নজরে মনে হয় তাই হলো এই অবাধ অনুষঙ্গের প্রাণবস্তু। সেই মূল স্বীকৃতিটা কী রকম? কার্যকারণবাদের উপর একান্ত নিষ্ঠা। অর্থাৎ কিনা, কোনো ঘটনাই অকারণে ঘটতে পারে না, দৈবাৎ বলে শব্দটি সত্যিই অর্থহীন। নিউটন যদি মনে করতেন, পাকা ফলটা মাটির দিকে অকারণেই পড়ে, কিংবা পাস্তুর যদি মনে করতেন শক্তির রস কখনো দৈবাৎ গেঁজে যায় আবার কখনো দৈবাৎ গেঁজে না—তাহলে নিশ্চয়ই নিউটন বা পাস্তুরের পক্ষে অমন আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কোনো দিনই সম্ভব হতো না। সমস্ত বিজ্ঞানের বেলাতেই, প্রত্যেক আবিষ্কারের পেছনেই, তাই কার্যকারণবাদের উপর অকুণ্ঠ আস্থা। অবশই অতি-আধুনিক যুগে গভীর সমাজ সংকটের প্রতিবিম্ব যখন বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিকে আবিল করছে তখন তাঁরা, বা তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ, এই দার্শনিক মতবাদের দিক থেকে এই কার্যকারণবাদটি সম্বন্ধেই আস্থা হারাবার উপক্রম করছেন। কিন্তু ওই লক্ষণটা হলো বিজ্ঞানের উপরই আস্থা হারাবার লক্ষণ, সামাজিক অনিশ্চয়তার প্রতিবিম্বই। মার্কসবাদের তরফ থেকে এই আলোচনা ইতিপূর্বে যোগ্যতর সমালোচকেরা সমাধা করেছেন। তাই তার পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন হবে। আপাতত, ওই কার্যকারণবাদকেই বিজ্ঞানের স্থিতিস্তম্ভ হিসেবে গ্রহণ করেই দেখা যাক, ফ্রয়েডীয় অবাধ অনুষঙ্গ কৌশলটির পিছনে কীভাবে এই কার্যকারণবাদের উপর অকুণ্ঠ নিষ্ঠা-স্থাপনের চেষ্টা, অথচ শেষ পর্যন্ত ঠিক কেমনভাবে বিজ্ঞানবিরোধী কল্পনার খাল খুঁড়ে এই কার্যকারণবাদকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবার আয়োজন। অর্থাৎ কিনা এই দিক থেকেও ফ্রয়েডবাদকে বুর্জোয়া অন্তর্দ্বন্দ্বে কণ্টকিত বলে চিনতে ভুল হয় না। কেননা, বিজ্ঞানের প্রতি বুর্জোয়ার যে-ভঙ্গি তার স্বরূপটাও কি এই রকমই: একদিকে সমাজ-ব্যবস্থার কাঠামো চূর্ণ করে উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণী যখন নতুন আর উন্নত সমাজ ব্যবস্থা গড়তে আগুয়ান হয়েছে, তখন এই বিজ্ঞানই তার হাতে সবচেয়ে বলিষ্ঠ হাতিয়ার। আবার অপর দিকে এই বিজ্ঞানই যখন এমন এক প্রচণ্ড শক্তির রূপ নিলো যে-শক্তিকে ওই বুর্জোয়া-ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে পুরে রাখা অসম্ভব, তখন রহস্যবাদ আর অনির্দেশ্যবাদের জঞ্জাল চাপিয়ে দিয়ে তার শক্তিকে খর্ব করবার ব্যর্থ আয়োজন। ফ্রয়েডীয় অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতির বেলাতেও ঠিক এরই প্রতিবিম্ব: মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক সংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পটভূমিকায় মনঃ সমীক্ষণ-পদ্ধতি কার্যকারণবাদকে মজবুত হাতিয়ার হিসেবেই গ্রহণ করতে চেয়েছে, অথচ মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই কার্যকারণবাদে বিশ্বাস যখন এমন এক তাৎপর্য নিয়ে প্রতিভাত হতে চায়, যা কিনা বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থারই চরম সমালোচনা হয়ে দাঁড়াবার উপক্রম করে, তখন ভাববাদী দর্শন আর আদিম পৌরাণিক কল্পনা ঝেঁটিয়ে অজস্র জঞ্জাল সংগ্রহ করে আনে তাকে রহস্যবাদের রূপে রূপান্তরিত করবার আয়োজনে।
তাই, অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতিকে খুঁটিয়ে বিচার করা দরকার: ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের ওই চরম ভিত্তিটুকুর মধ্যেই তার অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রকটতম বিকাশ। প্রথমে দেখা যাক, এই অনুষঙ্গ পদ্ধতিটির পিছনে বিজ্ঞান-নির্ভরতার পরিচয়টা ঠিক কী রকম। তার থেকেই বোঝা যাবে সত্যিকারের প্রগতিশীল কোনো কোনো প্রগতিশীলকেও ফ্রয়েডবাদ কীভাবে ভ্রান্তির পথে আকর্ষণ করছে—-আলেয়ার মতো। তারপর দেখা যাবে, এর মূলে ভ্রান্তিটা ঠিক কোথায়: কেমনভাবে এরই মধ্যে বিজ্ঞানকে বিসর্জন দেবার আয়োজন!
অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতিটা হলো : আপনি চোখ বুজে বিনাবিচারে কথা বলে যাবেন—যে-কোনো কথা আপনার মনে আসবে তাই, আপাতদৃষ্টিতে সে-সব কথা আপনার কাছে যতো অবান্তর, যতো আজগুবি, যতো অশ্লীল বা যতো এলোমেলোই মনে হোক না কেন। এক ফ্রয়েডপন্থী আপনার এই সব কথাগুলি থেকেই আপনার মানসিক অবস্থার হদিস বার করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অমন অবান্তর ও অর্থহীন শব্দরাশি থেকে আপনার মানসিক অবস্থার হদিশটা কেমন করে পাওয়া সম্ভব? উত্তরে ফ্রয়েডপন্থী বলবেন, প্রথম ঝোঁকে কথাগুলোকে যতোই অর্থহীন বা আজগুবি মনে হোক না কেন দুনিয়ার কোনো কিছু তো সত্যিই অকারণে ঘটতে পারে না। অর্থাৎ কিনা, আপনার এই এলোমেলো কথাগুলোর পেছনেও একটা নির্দিষ্ট কারণ থাকতে বাধ্য আর সেই কারণটাই হলো আপনার মানসিক অবস্থা।
একটা খুব সাদা-মাটা নমুনা নেওয়া যাক। ধরুন, চোখ বুজে কথা বলতে বলতে আপনার মনে পরের পর দুটো চিন্তা উঠলো:—ক বাবুর কথা—শ্মশানের কথা—। ফ্রয়েডপন্থী বলবেন, এই যে দুটো কথা আপনার মনে পরের পর জাগলো এ-ব্যাপারকে তো আর অকারণ বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। কেন জাগলো? তার একটা নির্দিষ্ট কারণ থাকতে বাধ্য। ক—বাবুর কথার পর শ্মশানের কথা কেন? শ্মশানের কথা না হয়ে অন্য কিছুর কথা হলো না কেন? তারও নিশ্চয়ই কোনো নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট কারণ থাকতে বাধ্য। ফ্রয়েডপন্থী তাই বলবেন, শ্মশানের চিন্তাটা তো অভ্রান্তভাবেই মৃত্যুবাচক এবং ক—বাবুর কথা মনে ওঠবার পরই এই মৃত্যুবাচক চিন্তা মনে জাগবার একমাত্র অর্থ হলো ক—বাবুর মৃত্যুকামনা করা। আপনি হয়তো তর্ক তুলে বলবেন, ক–বাবু আপনার বিশেষ বন্ধুলোক, অত্যন্ত প্রিয়জন; তাঁর মৃত্যুকামনা তাই আপনার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ও এমন কি অত্যন্ত পীড়াদায়ক। ফ্রয়েডপন্থী জবাব দেবেন, আপনার নিজের মন সম্বন্ধে কতোটুকু খবর বা আপনি নিজে রাখেন?—আসলে মৃত্যুকামনাটা রয়েছে আপনার নির্ব্বানে আর তাই জন্যেই ও সম্বন্ধে আপনার কোন হুস নেই। আপনার সজ্ঞানে ক—বাবু সম্বন্ধে যে-প্রীতি সেটাই তো আর আপনার মনের আসল খবর নয়। যে-নিজ্ঞান মনের দিক থেকে আপনার আসল পরিচয় সেই নিজ্ঞান যে ঘোরতর অসামাজিক আর অন্ধ যৌন তাড়না-মাত্র। যৌন তাগিদ আবার এর মধ্যে কোথায়? ফ্রয়েডপন্থী হয়তো আপনাকে দেখাবার চেষ্টা করবেন, ক—বাবুর পত্নীর প্রতি আপনার এক গোপন আকর্ষণ আছে আর তাই ওই মৃত্যু-কামনা দিয়েই আপনি আপনার যৌন আকর্ষণকে নিষ্কণ্টক করতে চান।
এইখানে পাঠককে অনুরোধ করবো দুটো আলাদা-আলাদা কথার মধ্যে পার্থক্য সম্বন্ধে সজাগ থাকতে। একটা কথা হলো, ফ্রয়েডপন্থীর মনে সাধারণভাবে কার্যকারণবাদে বিশ্বাস—প্রত্যেকটি মানসিক ঘটনার একটা কারণ থাকতে বাধ্য, সে ঘটনাটা আপাতত যতো তুচ্ছ বা যতো অর্থহীনই হোক না কেন। আর একটা কথা হলো, মানসিক ঘটনাগুলির নির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় করার আশায় ফ্রয়েডপন্থীর বিশিষ্ট ব্যাখ্যা। দুটো কথা একেবারে আলাদা কথাস্ত্র। এবং এমন কি এই দুয়ের মধ্যে একটা অন্তর্বিরোধও বর্তমান। কেননা, প্রথম কথাটির মধ্যে বিজ্ঞান-নিষ্ঠার পরিচয়, দ্বিতীয়টি কিন্তু বিজ্ঞান-বিরোধী কল্পনার দাসত্ব-মাত্র এবং ভবিষ্যতে স্পষ্টভাবে দেখাবার চেষ্টা করবো, বিজ্ঞান-বিরোধী ওই কল্পনাকে ফ্রয়েড ধার করছেন প্লেটোর ভাববাদ থেকেই।
ওই কার্যকারণবাদের উপর সাধারণ আস্থাপ্রচারের ভিতর দিয়ে কীভাবে ফ্রয়েড বৈজ্ঞানিক মেজাজকে আকর্ষণ করেছেন, প্রথমে তারই আলোচনা তোলা যাক।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ফ্রয়েডের আগে পর্যন্ত মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ছিলো সামন্ততান্ত্রিক কুসংস্কারের একচ্ছত্র আধিপত্য। স্বপ্নাদির তাৎপর্য নির্ণয় ব্যাপারে এই কথাটা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। কেননা ফ্রয়েডের আগে পর্যন্ত স্বপ্নাদিকে একান্তভাবেই আধ্যাত্মিক জগতের প্রভাব হিসেবে, অদৃশ্য আর অলৌকিক শক্তির ক্রিয়া হিসাবে—দেখবার চেষ্টা করা হতো। এবং এই সামন্ততান্ত্রিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ফ্রয়েডের প্রতিবাদই প্রথম এবং অত্যন্ত বলিষ্ঠ। তিনি ঘোষণা করলেন, প্রত্যেক ব্যাপারেই জাগতিক ও সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। তাই মানবমনের যে-কোনো ক্রিয়াকেই বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা কর সম্ভব। আপাতদৃষ্টিতে এই সব মানস ক্রিয়াকে অকারণ, অর্থহীন ও রহস্যময় মনে হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানের আলোকপাত করতে পারলে প্রত্যেক মানস ক্রিয়ার নির্দিষ্ট কারণ ও নির্দিষ্ট অর্থ আবিষ্কার করা সম্ভব, সম্ভব তার উপরকার রহস্যজালকে বিদীর্ণ করা। আপনার এলোমেলো চিন্তা আপনার দৈনন্দিন খুচরো, ভুলচুক, আপনার স্বপ্ন ও এমন কি খুটিনাটি প্রত্যেকটি আচরণেই নির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট ও লৌকিক কারণ থাকতে বাধ্য। তাই কোনো কিছুকেই অর্থহীন বা অলৌকিক মনে করা চলবে না। এ-কথা ফ্রয়েডের আগে পর্যন্ত আর কেউ অমন জোর দিয়ে ঘোষণা করতে পারেননি। তাছাড়া, মনে রাখা দরকার ফ্রয়েড যে-যুগে এই ঘোষণা করছেন সেই যুগটার কথা। স্বপ্ন প্রভৃতির কথা তো দূরের কথা এমন কি হিস্টেরিয়া প্রভৃতি স্থূল মানসিক রোগকেও তখন পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ ভূতে পাওয়া বা দেবতা-অপদেবতার ভর হওয়া বলে গণ্য করতো। অর্থাৎ এক কথায় সামন্ততান্ত্রিক কুসংস্কারেরই প্রতিপত্তি। আর তারই বিরুদ্ধে বুর্জোয়া বৈজ্ঞানিক প্রতিবাদ ফ্রয়েডের কণ্ঠে!
স্বভাবতই, তখনকার কালে সামন্ততান্ত্রিক মতাদর্শের প্রভাব ফ্রয়েডের বিরুদ্ধে দারুণ বাধা সৃষ্টি করতে চেয়েছে, আর এই বাধা দেখে ফ্রয়েড মনে করেছেন তাঁর দাবির বিরুদ্ধে সাধারণভাবে মানবসমাজেরই স্বাভাবিক প্রতিবন্ধ। অথচ, ভুললে চলবে না তখনকার যুগেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির শক্তিতে বলিষ্ঠ বিশ্বাস নিয়ে যে বৈজ্ঞানিক অপর এক দৃষ্টিকোণ থেকে মানস সত্তার প্রকৃত অর্থ অন্বেষণ করেছিলেন তিনি নিজে ফ্রয়েডের ওই সাধারণ দাবিটায় ঔৎসুক্য বোধ না করে পারেননি। তিনি হলেন স্বয়ং পাভলভ। স্বপ্নাদি মানস ব্যবহারের বৈজ্ঞানিক অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে ফ্রয়েডের যে চেষ্টা পাভলভের কাছে সেই চেষ্টা অত্যন্ত জরুরী ও চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছিলো। ফ্ৰলভ লিখেছেন:
In dealing with the subject of dreams it is necessary to point out Pavlov’s attitude to the theory of the Viennese psychiatrist Freud, that talented investigator and interpretor of dreams. We have in mind here only the first period of the activity of this scientist, viz. the time when he was interested in “the psychopathology of everyday life”…We speak here of the early views of Freud, who observed and attempted to comprehend many extremely interesting characteristics of the laws of human behaviour. Notably, he collected a wealth of data for the study of so-called involuntary mistakes: forgetting of proper names, slips of the tongue and of the pen, etc. Pavlov was very fond of putting forward Freud’s first and clearest example, the forgetting of proper names even of close acquaintances, as a proof of the law of negative induction analysed by us above… Pavlov raised on objection either to Freud’s conception of the forgetting of painful impressions, which nature endeavours to eliminate as it were by developing an inhibitory state in the parts of the brain concerned, sometimes of a very intense character. Freud, however goes much further … (Pavlov and his School : Frolov p. 170-72).
অবশ্যই, ফ্রয়েড সম্বন্ধে এই উৎসাহ প্রদর্শন করা সত্ত্বেও পালভ মুহূর্তের জন্যেও ফ্রয়েডের মূল ভ্রান্তিকে প্রশ্রয় দিতে প্রস্তুত হননি। আর, আজকের দিনেও প্রত্যেক প্রগতিপন্থীর এই কথাটি স্পষ্টভাবে মনে রাখা খুবই প্রয়োজন। অর্থাৎ কিনা, অবাধ আনুষঙ্গ পদ্ধতি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহের বশে ফ্রয়েডীয় কলাকৌশল সম্বন্ধে অতিশয়োক্তি করে বসাটা নেহাতই ভুল হবে। দুঃখের বিষয়, প্রগতি শিবিরের কোনো চিন্তাশীলও এই রকমের ভুল সত্যিই করে বসেছেন। তাই বলছিলাম, ফ্রয়েডের এই অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতি আলেয়ার মতো আমাদের যেন ভুল পথে ভুলিয়ে নিয়ে যেতে চায়। অনেককে ইতিপূর্বেই ভুলিয়েছে বলেই এই সম্ভাবনা সম্বন্ধে অনেক বেশি হুঁশিয়ার থাকা দরকার। নমুনা হিসেবে এখানে বিশেষ করে একজনের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা দরকার। তাঁর নাম লুরীয়া (A. R. Luriaa); তিনি ছিলেন মস্কো-এর মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক। ফ্রয়েডীয় অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতিতে উৎসাহী হয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, মনঃসমীক্ষণ আসলে বস্তুবাদী বিজ্ঞানই এবং ফ্রয়েডীয় মতবাদগুলিকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করবার প্রচেষ্টায় তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। (তাঁর রচনা The Nature of Human Con—flicts দ্রষ্টব্য)। অবশ্যই উত্তরকালে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং ফ্রয়েডবাদের তীব্র সমালোচনায় নিরত হন। কিন্তু আমাদের পক্ষে আপাতত যে-কথা বিশেষ মনে রাখা দরকার—পরীক্ষামূলকভাবে ফ্রয়েডীয় মতবাদকে প্রমাণ করবার
ওই যে-প্রচেষ্টা ওর পেছনে আসল কারণ হলো ফ্রয়েডীয় অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক মর্যাদা নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ। আর এই মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহের বশে ভুলে যাবার সম্ভাবনা যে অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতির মূলে সাধারণভাবে কার্যকারণবাদের উপর বিশ্বাস যতোটাই বিজ্ঞানমুখিতার পরিচয় হোক না কেন, ফ্রয়েড যখন মানস ঘটনাগুলির নির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় করবার চেষ্টা করেন তখন তিনি বিজ্ঞান-বিরোধী পৌরাণিক উপাখ্যানেরই দাস হয়ে পড়েন। মনে রাখতে হবে, ফ্রয়েডীয় প্রচেষ্টায় ওই বিজ্ঞানের অঙ্কুর পালভের চোখে পড়া সত্ত্বেও তিনি নিজে ফ্রয়েডের তীক্ষ্ণ সমালোচনা করতে বিরত হননি এবং সে-সমালোচনার প্রধান কথা হলো ফ্রয়েডের পক্ষে পৌরাণিক কল্পনার কাছে করুণ আত্ম-নিবেদন। ফ্রলভ লিখছেন:
The later productions of Freud, “the Ego and the Id” etc. in which he began to work out his new theory of the unconscious in the spirit of Hartmann, encountered the most energetic resistance and rejection on the part of Pavlov. This was only to be expected, since Pavlov and Freud were, as regards their interests, their views on life and on the tasks of the science of behaviour, two opposites who could hardly be combined. While Freud made use of intuition and mythology, and with progress of time buried himself ever more deeply in the mysteries of the “unconscious”, even declining to employ modern objective methods of research, Pavlov, in accordance with his unvarying character as a scientist concerned himself for the universal spread of the bright light of knowledge even where it was a question of the depths of pathological personality. And it is not to be wondered at that in so doing he sometimes had to shatter a mass of accumulated superstitions and prejudices, the development of which Freud’s successors have done not a little to foster…Freud, however, goes much further; from his point of view human personality is the scene of a collition between on the one had obscure instincts, our unconscious desires that the chiefly of a sexual character, and on the other hand the inclination of our consciousness, of our “Ego”, the letter being the result of education and the development of man in society… There is nothing to object to in the view that dreams may in some measure present a picture of unfulfilled wishes, perhaps even unknown to the subject himself, i.e. existing below the threshold of consciousness or, in Pavlov’s terminology, inhibited and occuring outside the limits of the “illuminated” portion of the brain.
But this recognition..by no means signifies that the “complexes” thrust the unconscious sphere must neccessarily belong to sexual reflexes or ideas, as Freud imagines.
Here Pavlov energetically opposed Freud’s Views pointing out that any complex of stimuli under appropriate conditions can become inhibitory, and as much essentially influence the activity of the brain while itself remaining in the back ground or outside the main path of the usual working of the brain. (Pavlov and his School : Frolov, pp. 170-173).
উদ্ধৃতি দীর্ঘ হলো। কিন্তু পাভ্লভের দৃষ্টিকোণ থেকে ফ্রয়েডকে যাচাই করবার এমন স্পষ্ট উদাহরণকে উদ্ধৃত করবার লোভ সংবরণ করা কঠিন। অবশ্যই এখানে স্বপ্নাদি সম্পর্কে পালভের বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করবার অবসর নেই, কেননা তাহলে পালভের মূল আবিষ্কার নিয়ে অত্যন্ত দীর্ঘ আলোচনা তুলতে হয় এবং সে-আলোচনার জন্যে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার প্রয়োজন। আপাতত যে-আলোচনা হচ্ছিল। ফ্রয়েড যখন সাধারণভাবে বলেন, প্রত্যেক মানসিক ঘটনার নির্দিষ্ট কারণ থাকতে বাধ্য এবং ঘটনাটি আপাতদৃষ্টিতে যতো তুচ্ছ বা অকারণই মনে হোক না কেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে তার নির্দিষ্ট কারণটি আবিষ্কার করা নিশ্চয়ই সম্ভব, – তখন ফ্রয়েডের দাবিটা নিশ্চয়ই বিজ্ঞানের দাবি। কিন্তু ওই নির্দিষ্ট কারণটির স্বরূপ নির্ণয় করবার আশায় তিনি যে-কাহিনী রচনা করছেন তার প্রাণবস্তু হলো পৌরাণিক কল্পনাই।
ওই সব পৌরাণিক কল্পনার রকম-সকম ঠিক কী রকম,—কেন আমরা ওগুলিকে বিজ্ঞান বলে স্বীকার না করে নিছক পৌরাণিক কল্পনা বলতে বাধ্য, – তার আলোচনা পরে তোলা যাবে। কেননা সেটা ঠিক ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের আলোচনা হবে না, তার বদলে হবে ফ্রয়েডীয় সিদ্ধান্তের ও মূল প্রতিজ্ঞার আলোচনা—যে প্রতিজ্ঞাগুলি তিনি আহরণ করেছেন য়ুরোপীয় দর্শনের সবচেয়ে বড়ো ভাববাদী দার্শনিক প্লেটোর কাছ থেকেই আপাতত দেখা যাক, তাঁর কলাকৌশলের মধ্যে ঠিক কেমনতরো ফাঁকির সুযোগ থেকে গিয়েছে বলেই ওই জাতীয় পৌরাণিক কল্পনার প্রবেশটা সুগম হলো।
ফাঁকিটা হলো, কার্যকারণবাদেরই বিসর্জন। যে-কার্যকারণবাদের উপর বলিষ্ঠ আস্থা ঘোষণা করেই তাঁর মনোবিজ্ঞানের শুরু সেই কার্যকারণবাদকেই করুণভাবে ফ্রয়েড বর্জন করলেন, আর বর্জন করলেন মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরী মোড়ের কাছে পৌঁছে। কীভাবে? কোথায়? ওই মানস সত্য ও বাস্তব সত্যের মধ্যে চরম পার্থক্য কল্পনার ব্যাপারেই। কেননা, যাকে তিনি মানস সত্য বা Psychical reality বলছেন সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখলে তারও নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট কারণ থাকতে বাধ্য এবং সেই কারণটা বাস্তব সত্য বা mate—rial reality ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। কেননা, মানুষের মন এই পৃথিবীরই একটা অংশ—বাস্তব দুনিয়া ছাড়া তো সত্যিই কোনো রকম অপরূপ পদার্থ হতে পারে না। অথচ, ফ্রয়েডের কল্পনায় তাইই। অর্থাৎ কিনা, বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন স্বাধিকারমত্ত এক সত্তা। তার মানে, এই মানস সত্যের স্তরে যে-সব নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটছে ফ্রয়েডীয় মতবাদ অনুসারে সেগুলির প্রত্যেকটিরই নির্দিষ্ট কারণ আছে—অকারণে কেউ স্বপ্ন দেখে না, ভুলে কেউ ভুল করে না, আপনার মনে যতোই এলোমেলো চিন্তার উদয় হোক না কেন, তার পেছনে নির্দিষ্ট কারণের প্রভাব থাকতে বাধ্য। কিন্তু ফ্রয়েডকে যদি প্রশ্ন করেন, একজন মানুষের ওই যে মানস সত্তা সমগ্রভাবে দেখলেন তার কারণটা ঠিক কী? তাহলে ফ্রয়েডের তরফ থেকে সত্যিই কোনো জবাব নেই—কিংবা যে-জবাব তাঁর আছে সেই জবাবের মধ্যে বাস্তব পৃথিবীর সত্যিই কোনো স্থান নেই। তার মানে ফ্ৰয়েড কি এ-কথা মানেন না যে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের উপর আমাদের মনোভাবটা নির্ভর করছে। নিশ্চয়ই জানেন। আজকের যুগে কোনো বৈজ্ঞানিকের পক্ষেই এ-কথা না মানবার প্রশ্ন ওঠে না, ফ্রয়েড নিজে বহুবার, বহুপ্রসঙ্গে অন্তত মৌখিকভাবে এ-কথা স্বীকার করেছেন। মৌখিকভাবে বলছি এই কারণে যে, ব্যাপারটাকে সত্যি বলে মানলেও এই দিকে বেশি উৎসাহ দেখানোয় ফ্রয়েডের বিশেষ আপত্তি, কেননা তাঁর মতে সে-উৎসাহ বড়ো জোর স্নায়ুতন্ত্রের উপর মানসিক অবস্থাবলীর স্থান-নিৰ্ণয় (localiza—tion) করতে পারে, কিন্তু এই স্থান-নির্ণয় থেকে মানস সত্তার নিজস্ব রূপকে আবিষ্কার করবার সত্যিই কোনো হদিস পাওয়া যাবে না। (Outlines of Psychoanalysis দ্রষ্টব্য)। তাই, স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে মানস সত্তার সম্পর্ক স্বীকার করলেও সে নিয়ে আলোচনা তোলায় ফ্রয়েডের সত্যিই কোনো উৎসাহ নেই। আর যদিই বা থাকতো তাহলেও শুধু সেইটুকুর গুণেই ফ্রয়েড প্রকৃত অর্থে বস্তুনিষ্ঠ—তাই বৈজ্ঞানিক——মনস্তাত্ত্বিকের মর্যাদা পেতেন না। কেননা শুধুমাত্র ওইটুকু স্বীকৃতিই বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানের মূল কথা নয়। কেননা, মানবমনের জন্ম, স্থিতি ও লয় সব কিছুই একান্তভাবে স্নায়ুতন্ত্রের উপর নির্ভর করছে—শুধু এইটুকু বললে মনোবিজ্ঞানে বাস্তববাদী হওয়া যায় না। তার প্রমাণটা খুব কঠিন কথা নয়। সে-প্রমাণের আসলে দুটো কথা। এক হলো, ক্রমবিকাশের দিক থেকে দেখলে স্পষ্টই চোখে পড়ে যে গত তিন-চার হাজার বছরের মধ্যে মানব-স্নায়ুতন্ত্রের গড়ন ইত্যাদির দিক থেকে খুব কিছু জরুরী তফাত তো সত্যিই ঘটেনি। অথচ, এই তিন-চার হাজার বছরের মধ্যেই আদিম সাম্যতন্ত্র থেকে শুরু করে আধুনিক সমাজতন্ত্র পর্যন্ত মানুষের যে-জয়যাত্রার ইতিহাস তার মধ্যে মানুষের মানসিক অদলবদলটা কতো দ্রুত আর কী গভীর! তাই শারীরতত্ত্বের দিক থেকে শুধুমাত্র স্নায়ুতন্ত্রের খবর কুড়িয়ে কারুর পক্ষেই প্রকৃত মনোবিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব নয়, কিংবা, যা একই কথা, বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানীর মুখে শুধু এইটুকু কথাই যথেষ্ট নয় যে, মানুষের মন একান্তভাবে তার স্নায়ুতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে। কথাটার আর একটা দ্বিতীয় প্রমাণ আছে। ধরুন, আপনি বাংলাদেশের এক মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মেছেন, বড়ো হয়েছেন ঔপনিবেশিক পরিবেশে। কিন্তু জন্মাবার পরেই আপনাকে যদি সোভিয়েট দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতো আর আপনি যদি বড়ো হতেন ওই সমাজতান্ত্রিক পরিবেশে? তাহলে নিশ্চয়ই আপনার মনের গড়নটা অন্যরকমের হতো। কিন্তু তার মানেই কি এই যে আপনার মগজের গড়নটা যেতো বদলে? নিশ্চয়ই নয়। অমনতরো কথা অবশ্যই হাস্যকর। কিন্তু তার মানেই কি এই দাঁড়ায় না যে, শুধুমাত্র স্নায়ুতন্ত্রের বিশ্লেষণের মধ্যেই মানস সত্তার পূর্ণ পরিচয় পেতে চাওয়াটা মনোবিজ্ঞানে বাস্তব-বোধের পরিচয় নয়?
কিন্তু তার মানে কি এই যে বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানী স্নায়ুতন্ত্রের কথা ভুলে মনোবিজ্ঞানের ভিত গাঁথতে চাইবেন? তাও নয় নিশ্চয়ই। মানবমনের ভিত্তিতে যে স্নায়ুতন্ত্রই, সেই কথাই হবে বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানীর মূলসূত্র। কিন্তু শুধু ওইটুকু কথাই নয়। কেননা, তাঁর পক্ষে ভোলা চলবে না যে এই স্নায়ুতন্ত্রের আসল কাজ হলো বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে মানুষের ভারসাম্য বজায় রাখবার কাজ, বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে মানুষকে খাপ খাওয়াবার কাজ। আর তাই, ওই স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যস্থতাতেই আমাদের বাস্তব পরিবেশ প্রতিবিম্বিত হয় আমাদের মধ্যে—সেই প্রতিবিম্বেরই নাম হলো আমাদের মন। ফলে পরিবেশের পরিবর্তন ঘটে আমাদের মনের গড়নেও। অবশ্যই, প্রতিবিম্ব অর্থে এখানে নিশ্চল ও নিষ্ক্রিয় ছবিমাত্র মনে করলেও ভুল করা হবে। কেননা, মানুষের মন পরিবর্তনশীল পরিবেশের প্রতিবিম্ব হয়েও এই পরিবেশকে পরিবর্তন করবার ব্যাপারে অত্যন্ত জরুরী শক্তির কাজ করতে পারে।
এই কথাই হবে বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানের মূলসূত্র। প্রসঙ্গত, পালভের গবেষণাও এই মূলসূত্রের উপরই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ফ্রয়েড যখন মানস সত্য আর বাস্তব সত্যের মধ্যে তফাত করতে বলেন, যখন বলেন মানস সত্যকে বুঝতে গেলে শুধুমাত্র মানস সত্যের ভাষাতেই বোঝবার চেষ্টা করতে হবে,—তখন তিনি ভুলে যান তাঁর কার্যকারণবাদের কথা। মানস সত্যেরও যে একটা কারণ থাকতে বাধ্য এবং সেই কারণ যে তাঁর পরিভাষার ওই বাস্তব সত্যই—এই মূল কথাটিকে তিনি ভুলে যান বলেই তাঁর ওই বিস্মৃতির সুযোগ নিয়ে নানা রকম বিজ্ঞান-বিরোধী কল্পনা তাঁর মতবাদকে আচ্ছন্ন করবার অবকাশ পায়। আর তা তো হবার কথাই। কেননা ফ্রয়েড নিজেই স্বীকার করেছেন, মানস সত্য আর বাস্তব সত্যের মধ্যে তিনি যে-রকমের তফাত করতে বলেন সেই রকমের তফাত একবার মেনে নিলে পর fact আর fancy—-বাস্তব ঘটনা আর কল্পনা—এ-দুয়ের মর্যাদা-বিচারেও কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ, তাঁর মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে ঐতিহাসিকভাবে যা সত্য তার মূল্য, আর যা কিনা নিছক কল্পনামাত্র তার মূল্য একেবারে সমান! ফ্রয়েড বলছেন, তাঁর কলাকৌশলের প্রয়োগ-প্রসঙ্গে রোগীকে একটা কথা খুব স্পষ্টভাবে বোঝানো দরকার, কথাটি হলো phantasy and reality are to be treated alike (General Introduction, p. 322)। অর্থাৎ কিনা রোগীর বাস্তব জীবনে যে অভিজ্ঞতা ঘটেছে তার সঙ্গে রোগীর পক্ষে যেটা নিছক খেয়াল-খুশীর কল্পনা তার কোনো তফাতই নেই। বাস্তবের প্রতি শ্রদ্ধাকেই বৈজ্ঞানিকেরা চিরকাল বিজ্ঞানের মূল নিষ্ঠা বলে মেনে নিয়েছেন, অবিদ্যার পথে অগ্রসর হয়ে ফ্রয়েড এই বাস্তবকে একেবারে তুচ্ছজ্ঞান করতে বাধ্য হলেন। আর বাস্তবের মূল্য যদি ওইভাবে বর্জন করা হয় তাহালে সেই অবসরে পৌরাণিক কল্পনা আসর জমাবেই বা না কেন? ঈগো, ঈড়, সুপার-ইগো, লিবিডো, ঈডিপাস্ কমপ্লেক্স্—আরো কতো রকম। আর তাই ফ্রয়েড যখন বলেন, তাঁর কলাকৌশষল দীক্ষিত হতে গেলে দেশ-বিদেশের পৌরাণিক উপাখ্যানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটা দরকার, এবং তিনি নিজেই যখন আলোচনা-প্রসঙ্গে কথায় কথায় পৌরাণিক উপাখ্যানের দোহাই পাড়েন তখন তার ফ্রয়েডীয় তাৎপর্য ছাড়াও একটা অন্য তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। তবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই অন্য তাৎপর্যটা পরিহাসের মতোই। কেননা এই অন্য তাৎপর্যটা হলো ফ্রয়েডবাদের সঙ্গে পৌরাণিক কল্পনার ঘনিষ্ঠ মিতালি। ঈগো, ঈড্, সুপার-ঈগো, লিবিডো, ইডিপাস, ঈরস্—এগুলির প্রকৃত পুরাণসর্বস্বতা নিয়ে একটু পরেই আলোচনা তোলা যাবে।
আপাতত দেখুন, তার কলাকৌশলের ক্ষেত্রে fact আর fancy-র মধ্যে, বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে—তফাতটা ওইভাবে উড়িয়ে দেবার দরুন যে জরুরী ফল ফলেছে সেই ফলটার কথা। ফলটা হলো, প্রতীকতা বা symbolism-এর দিকে ফ্রয়েডবাদের একটা একরোখা ঝোঁক। মনঃসমীক্ষকের সামনে আপনি যে-কোনো রকমের আচরণ করুন, যে-কোনো কথা বলুন, তিনি তার কোনো রকমের বাস্তব অর্থ গ্রহণ করতে নারাজ হবেন। কেননা, তার কাছে প্রত্যেক কথার একটা না একটা প্রতীকী অর্থ আছে—এবং এই প্রতীকী অর্থটাই আসল অর্থ, বাস্তব অর্থটা মোটেই কোনো অর্থ নয়। আর ওই প্রতীকী অর্থ, ওর প্রাণবস্তু হলো এক অন্ধ ও নির্বিচার যৌন-ক্ষুধা। একটা নমুনা দেখুন। ধরুন খবরের কাজে ছবি বেরিয়েছে, চীনের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কামান নিয়ে আগুয়ান হয়েছে মার্কিন আক্রমণের প্রতরোধে আর ওই ছবি দেখে আশায় আনন্দে টলমল করে উঠেছে আপনার মন। এর বাস্তব অর্থটা ঠিক কি তা নিশ্চয়ই আমাদের সকলের কাছেই সুস্পষ্ট। কিন্তু ফ্রয়েডপন্থীর কাছে যান, তিনি বলবেন আপনার মনস্তত্ত্বের দিক থেকে ওই বাস্তব অর্থটা একেবারেই অর্থহীন। আশায় আনন্দে আপনার মন যে কেন দুলে উঠেছে তার কোনো রকম হদিস ওই বাস্তব অর্থের কাছ থেকে পাবার আশা নেই। কেননা, সমস্ত ব্যাপারটারই একটা প্রতীকী অর্থ আছে আর সেইটেই হলো আসল অর্থ। প্রতীকী অর্থটা কী রকম? ফ্রয়েডপন্থী খুব সম্ভবত বলবেন, মুক্তি ফৌজের প্রতীকী অর্থ হলো পিতৃশাসনে নির্যাতিত ভ্রাতৃদল, কামানের প্রতীকী অর্থ হলো জনন-অঙ্গ এবং মার্কিন আক্রমণকারীর প্রতীকী অর্থ হলো নির্যাতক পিতামাত্র। তার মানে আপনি যে-ছবিতে আবেগ-উত্তেজনার সন্ধান পেয়েছেন, তার আসল কারণ হলো আপনার নিজ্ঞান মন ওই ছবির তর্জমা করে অর্থ নির্ণয় করেছে যে আপনার ভ্রাতৃদল নির্যাতক পিতাকে এবার যৌনভাবে বিধ্বস্ত করতে এগিয়েছে!
এইখানে আমি বিশেষ করে যে-প্রশ্ন তুলতে চাই সেটা নিশ্চয়ই এই নয় যে প্রতীকী অর্থ বলে একান্তই কিছু আছে কিনা। কেননা, আমাদের মন যে অনেক কিছুই প্ৰতীকী অর্থে গ্রহণ করে তা তো আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতারই অন্তর্গত। তাছাড়া, শিল্পে-সাহিত্যেও প্রতীকের ব্যবহার এতো প্রচুর যে প্রতীক বলে ব্যাপারকেই একেবারে উড়িয়ে দিতে যাওয়াটা বাস্তববোধের কথা নিশ্চয়ই হবে না। কিন্তু ফ্রয়েডপন্থীর দাবি তো শুধু ওইটুকুই নয়। যদি তাই হতো তাহলে খুব কিছু তর্কের থাকতো না। কিন্তু ফ্রয়েডপন্থী বলবেন, প্রথমত প্রতীকগুলো সনাতন, কেননা মানুষের নিজ্ঞান মনের গড়নটাই হলো সনাতন। দ্বিতীয়ত, সমস্ত প্রতীকেরই একটা যৌন তাৎপর্য বর্তমান, কেননা, নিজ্ঞান মন বলতে অন্ধ আর আদিম যৌন ক্ষুধা ছাড়া কিছুই বোঝায় না। আর তৃতীয়ত, মানব-মনস্তত্ত্বের দিক থেকে সব কিছুরই বাস্তব ও ব্যবহারিক অর্থটা একেবারে অবান্তর। কেননা, সব কিছুরই একটা প্রতীকী অর্থ আছে আর সেই প্রতীকী অর্থটাই হলো আসল অর্থ। তাহলে ফ্রয়েডীয় প্রতীকবাদের একদিকে দেখা যায় তাঁর নিজ্ঞান ও যৌনতত্ত্ব আর একদিকে বাস্তববিমুখতা। তাঁর নিজ্ঞান ও যৌনতত্ত্বের সংক্ষিপ্ত আলোচনা একটু পরেই তুলবো। আপাতত ওই বাস্তববিমুখতার দিকে নজর রাখা যাক। কেননা, এর মধ্যেই ফ্রয়েডীয় অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতির চরম বিফলতা প্রকট হয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতি অনুসারে ফ্রয়েডপন্থী যখন রোগীর সমস্ত এলোমেলো কথার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেন তখন প্রতিটি কথার বাস্তব অর্থকে সযত্নে বিসর্জন দিয়ে তার প্রতীকী অর্থের দিকে রোগীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান। আর তাই, অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতির একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় রোগীর মন থেকে বাস্তবকে মুছে ফেলবার চেষ্টা, রোগীকে এক আত্মকেন্দ্রিক ভাবলোকের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আর ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের চরম ব্যর্থতাও ঠিক এই কারণে। বাস্তবকে কোনোমতে ভুলতে পারবার মধ্যেই যদি মানুষের প্রকৃত মুক্তির সন্ধান থাকতো, তাহলে অবশ্যই অন্য কথা হতো। কিন্তু তা তো আর সত্যিই সম্ভব নয়। ওটা হলো, খরগোসের মতো ঝোপের মধ্যে মুখ গুঁজে দিয়ে বিপদ থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা। মুক্তির আসল পথ হলো মুখ গুঁজে দিয়ে বিপদ থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা। মুক্তির ‘আসল পথ হলো বাস্তবকে স্পষ্টভাবে চিনতে পারবার পথ Fredom is the recognition of necessity একমাত্র বিজ্ঞানের পথেই মানুষের প্রকৃত মুক্তি। অথচ, ফ্রয়েডপন্থীর পথ হলো বিপরীত পথ—বাস্তবকে ভুলতে শেখবার পথ। ও-পথটা তাই বিজ্ঞানের পথ নয়। ওই পথে এগিয়ে তাই মানসিক গ্লানির যন্ত্রণাটা ভোঁতা হয়ে যায়। ধর্মের মতো। মাদকের মতো।