৫. ফী এবং সংক্রমণ

ফী এবং সংক্রমণ 

চিকিৎসার সময় চিকিৎসককে পারিশ্রমিক দিতে হবে। কথাটা এমন কিছু নতুন নয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে একে অস্বাভাবিক বা অসঙ্গতও মনে হয় না। তা না হলে, সত্যিই তো, চিকিৎসকের সংসারই বা চলবে কেমন করে? তাই গ্রাম অঞ্চলে ডাক্তার—হাসপাতালের নাগাল না পেয়ে ওঝা-নাপিতের শরণাপন্ন হওয়া থেকে শুরু করে শহরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নাগাল পেতে গিয়ে ভিটেমাটিটুকুও বন্ধক দেবার অভিজ্ঞতা পর্যন্ত সর্বত্রই আমরা স্বীকার করে নিই যে বৈদ্য-বিদায়ের পালা না চুকিয়ে যমের সঙ্গে যোঝবার বুঝি কোনো কায়দাই হয় না। অবশ্য, সমাজ ব্যবস্থার রকমফের হলে চিকিৎসকের সংসার চালাবার দায়টা রাষ্ট্রই গ্রহণ করতে পারে। রোগী তখন ব্যক্তিগতভাবে শুধু রোগ যন্ত্রণাই নয়, দক্ষিণা সংগ্রহের যন্ত্রণা থেকেও মুক্তি পেতে পারেন। কথাটা এমন কিছু অসম্ভব কল্পনা নয়। সোবিয়েট য়ুনিয়নের মতো উন্নততর সমাজ ব্যবস্থায় সত্যিই তো এই ব্যাপার ঘটেছে। এমন কি বিলেত যে বিলেত, সেখানকার তথাকথিত শ্রমিক সরকারের আমলেও সত্যিই এই রকমের একটা পরীক্ষা চলেছিলো, যদিও অবশ্য রক্ষণশীল দল রাষ্ট্রশক্তি হাতে পেয়েই দেখিয়ে দিলো ধনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক কোনো পরীক্ষা নিয়ে ছেলেখেলা করতে যাওয়াটা মারাত্মক ব্যাপার—শুনেছি ইতিমধ্যেই অনেক রকম সংশোধনাদির সাহায্যে বিলেত দেশে এই ব্যবস্থাটিকে পঙ্গু করবার আয়োজন শুরু হয়েছে। 

যাই হোক, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা একটু পরেই তুলতে হবে। তবুও উপস্থিত না হয় ধরেই নেওয়া যাক যে চিকিৎসার বিনিময়ে রোগীর তরফ থেকে চিকিৎসককে উপযুক্ত পারিশ্রমিক যোগাবার ব্যবস্থায় আমরা এতদিন ধরে এবং এমনভাবে অভ্যস্ত হয়েছি যে শুধু এইটুকুর মধ্যে অস্বাভাবিক বা অসঙ্গত কিছু আমাদের চোখে পড়ে না। তাই মনোবিকারের রোগীও ফ্রয়েডপন্থী চিকিৎসককে দৈনিক ফী দেবেন—এ তো খুব সহজ কথাই। এবং ফ্রয়েডপন্থী নিশ্চয়ই বলবেন, সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে যে-সমালোচনা তা যদিও বা সঠিক হয় তাহলেও সে তো একটা সমাজ-ব্যবস্থার সমালোচনাই। তাকে চিকিৎসা-জীবিকার বিরুদ্ধে – বিশেষ করে একটি নির্দিষ্ট চিকিৎসাকৌশলের বিরুদ্ধে—সমালোচনা হিসেবে প্রচার করবার অবসর কোথায়? 

উত্তরে বলবো, এ-কথা অবশ্যই ঠিক যে চিকিৎসা-ব্যবসায়ের বর্তমান নিন্দনীয় পরিস্থিতি প্রধানতই একটা বিশেষ সমাজ-ব্যবস্থার পরিণাম। তাই জনগণের বিরাট অংশ চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে যদি ব্যক্তিগত চিকিৎসকের উপর আক্রোশ প্রকাশ করে তাহলে সেটা ভুলই হবে; কেননা আক্রোশটা সমাজ-ব্যবস্থার দিকেই নির্দিষ্ট হওয়া উচিত। তবুও কিন্তু, এই দিক থেকেই ফ্রয়েডীয় কৌশলের বিরুদ্ধে সমালোচনার অবসর আছে। প্রথমত, বাস্তব অবস্থার কথাটা ভেবে দেখুন। একজন সাধারণ চিকিৎসকের পক্ষে একই দিনে বহুসংখ্যক রোগকে পরীক্ষা করা সম্ভব, কিন্তু ফ্রয়েডীয় চিকিৎসকের পক্ষে তা সম্ভব নয়, কেননা তাঁর পদ্ধতিটা খুবই সময়সাপেক্ষ। প্রত্যেক রোগীর জন্যে প্রায় ঘণ্টাখানেক করে সময় দিতে হয়। ফলে সাধারণ চিকিৎসার তুলনায় ফ্রয়েডপন্থী কী-এর হার বাড়িয়ে পুষিয়ে নিতে চান। তার উপর তাঁর পদ্ধতিটা দারুণ দীর্ঘমেয়াদী—কম পক্ষে দু-তিন শো দিনের ব্যাপার। ফলে রোগীর তরফ থেকে মোট যে-পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা শুধু এই সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণীর লোকের পক্ষেই যোগানো সম্ভব। অর্থাৎ, বাস্তবভাবে ফ্রয়েডীয় কৌশলের ফলাফলটুকু শুধুমাত্র ধনিকশ্রেণীর পক্ষেই উপভোগ করা সম্ভব, এ পদ্ধতি জন-সাধারণের কল্যাণপ্রয়াসী হতেই পারে না। 

ফ্রয়েডপন্থী নিশ্চয়ই জবাব দিয়ে বলবেন (ফ্রয়েড নিজে যে রকম বলেছেন), এক্ষেত্রে যদি অপবাদের ভাগী কাউকে করতেই হয় তাহলে তো ব্যারামটাকেই করা উচিত। কতকগুলো অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা তো সত্যিই ভয়ানক ব্যয়সাপেক্ষ ও সময়সাপেক্ষ। যেমন ধরুন, ক্যানসার রোগ। এ-জাতীয় রোগভোগের চিকিৎসা গরিব লোকদের সাধ্যাতীত। কিন্তু এ নিয়ে চিকিৎসা কৌশলের নিন্দা করে লাভ কি? 

ফ্রয়েড যে ক্যান্সার-জাতীয় দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসার সঙ্গে নিজের চিকিৎসা-পদ্ধতির তুলনা করেছেন আপাতত তা যুক্তিসহ মনে হলেও আসলে কিন্তু এর মধ্যে একটা দারুণ ফাঁকি আছে। ফাঁকিটার বর্ণনা এই বলে শুরু করতে পারি যে ক্যান্সারে চিকিৎসা ব্যয়সাপেক্ষ হলেও এ রোগের দাতব্য চিকিৎসা হতে পারে না। চিকিৎসক যদিই বা খুব সহৃদয় ব্যক্তি হন এবং অর্থাগমের উপায়ান্তরের নির্ভরে যদিই বা তাঁর মনে নিছক জনহিতার্থে চিকিৎসা করবার সাধু ইচ্ছে ঠাঁই পেতে পারে, তাহলেও কিন্তু বিনা পয়সায় চিকিৎসা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। তার কারণ, এই চিকিৎসার সময় রোগীর কাছ থেকে অর্থগ্রহণ শুধুমাত্রই চিকিৎসকের উপার্জনের খাতিরে নয়, এটা হলো চিকিৎসা-পদ্ধতির একটা অনিবার্য অঙ্গই। ফ্রয়েড নিজেই স্বীকার করেছেন, শুরুর দিকে বৈজ্ঞানিক তথ্য আহরণের আশায় তিনি কিছু কিছু দাতব্য চিকিৎসার চেষ্টা করে দেখেছেন যে তাতে সত্যিই চিকিৎসা চলে না। এবং এই অভিজ্ঞতা একা ফ্রয়েডের নয়। যে-কোনো ফ্রয়েডপন্থী নিশ্চয়ই মানবেন যে বিনা পয়সায় এ চিকিৎসা করতে গেলে শেষ পর্যন্ত ঠকে যেতে হয়। তাই চরক-সুশ্রুত বা হিপোক্রেটিসের সময় থেকে শুরু করে একেবারে অতি-আধুনিক লবোটমি-লিউকোটমি পর্যন্ত চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ইতিহাসে যত অজস্র রকমের কায়দা-কানুনই আবিষ্কৃত হোক না কেন, তার মধ্যে একমাত্র ফ্রয়েডীয় কায়দারই বৈশিষ্ট্য হলো রোগীর সঙ্গে আর্থিক আদায়ের সম্পর্ক স্থাপনের অনিবার্যতা। আর এই অনিবার্যতাকেই ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের মধ্যে বুর্জোয়া ভাবাদর্শের প্রকটতম প্রকাশ বলেই উল্লেখ করতে চাই। 

ফ্রয়েডীয় চিকিৎসা-প্রসঙ্গে রোগী যদি চিকিৎসককে প্রশ্ন করেন, ফী-টা কেন এই চিকিৎসা কৌশলের অনিবার্য অঙ্গ? তাহলে, প্রথম দিকে চিকিৎসক কিছু কিছু আপাত-যুক্তিযুক্ত উত্তর দেবেন। হয়তো বলবেন, এই চিকিৎসায় তো ওষুধপত্তরের ব্যাপার নেই, শুধু কথাবার্তার ব্যাপার। তার ওপর যদি ফী-ও না থাকে তাহলে রোগী তো চিকিৎসা পদ্ধতিকে তেমন পাত্তা দিতে চাইবেন না। কিংবা, চিকিৎসক হয়তো বলবেন, মনোবিকার থেকে রোগী যে একরকম বিকৃত সুখ পেয়ে থাকে; তাই দৈনিক খেসারত-এর মাথায় পড়লে রোগীর হুঁশ হবে রোগটা লাভের ব্যাপার নয়, লোকসানের ব্যাপার। অবশ্যই চিকিৎসকের এই যুক্তিগুলিই তাঁর আসল যুক্তি নয়। আর তা যে নয় তার একটা প্রমাণ হলো, ফী দেবার রীতিনীতি সম্বন্ধে তিনি রোগীর উপর কতকগুলি কড়াকড়ি শর্ত ধার্য করে দেন: দৈনিক ফী দিতে হবে, মাস গেলে পুরো মাসের ফী দেওয়া এমন কি আগামও দেওয়া চলবে না। তাছাড়া, কাঁচা টাকায় ফী দিতে হবে—চেক নয়, এমন কি কাগজের নোটও নয়। ব্যাপারটা একেবারে সোনারুপোর ব্যাপার হওয়া চাই। কিন্তু তা কেন? চিকিৎসার প্রথম অবস্থায় রোগী এই প্রশ্ন তুললে চিকিৎসক বলবেন, আসল তাৎপর্যটা শুরুতে দেখানো সম্ভব নয়, পরে দেখতে পাওয়া যায়। তার মানে, কাঁচা টাকায় ফী দেবার একটা গূঢ় তাৎপর্য আছে। 

গূঢ় তাৎপর্যটা কী? ফ্রয়েডপন্থী হয়তো সাধারণ সামাজিকভাবে তা নিয়ে আলোচনা তুলতে চাইবেন না, তাঁর মতে মনঃসমীক্ষণের পটভূমির (psychoanalytical situation-এর) বাইরে মনঃসমীক্ষণের আসল বক্তব্যগুলো খাপছাড়া আর আজগুবি শোনাতে পারে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, দিনের পর দিন ধরে বন্ধ ঘরের কৃত্রিম পরিস্থিতিতে একজাতীয় আলোচনা হতে হতে যে-আবহাওয়া গড়ে ওঠে সেই আবহাওয়াটুকু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সিদ্ধান্তটুকুর কথা শুনলে সাধারণের পক্ষে খুবই খাপছাড়া আর আজগুবি লাগবার সম্ভাবনা। কিন্তু, ফ্রয়েডপন্থীর কথা যদি বৈজ্ঞানিকভাবে বাস্তব হবার দাবি করে তাহলে দিনের আলোর আলোচনা তাঁকে সহ্য করতেই হবে। ফ্রয়েডীপন্থী যদি তাতে রাজী না হন তাহলে তাঁকে মানতেই হবে যে তাঁর দাবিটুকু আর যাই হোক বৈজ্ঞানিক নয়, ধর্মতত্ত্বের মতো ‘নিহিতং গুহায়াং” কোনো রহস্যই। আশা করি ফ্রয়েডপন্থী তাতে রাজি হবেন না। 

ফী-সংক্রান্ত তাঁদের ওই গূঢ় সমাচারটি ঠিক কী? ফ্রয়েডপন্থী বলবেন, অচেতন মনের কাছে কাঁচা টাকা বলে জিনিসটার একটা প্রতীকী মূল (symbolic value) আছে। অর্থাৎ, আমাদের সচেতন সংসারী মনের কাছে টাকার যে সাংসারিক মূল্য, অচেতন মনের কাছে তা নয়। অন্য একটা ব্যঞ্জনাগত মূল্য। কেননা টাকা হলো যৌনবস্তুর প্রতীক—অর্থাৎ অচেতন মন টাকাকে যৌনবস্তুর শামিলই মনে করে। ফলে, চিকিৎসক-রোগীর মধ্যে এই বস্তুর আদান-প্রদান ক্রমশই দুজনের মধ্যে একটা হৃদয়গত সম্পর্ক স্থাপন করে: সেই সম্পর্কের নামই হলো সংক্রমণ বা transference। এবং ফ্রয়েডপন্থী বলেন, এই সংক্রমণ বলে হৃদয় সম্পর্কটাই চিকিৎসার সময়ে সবচেয়ে কার্যকরী শক্তি। যে-ক্ষেত্রে সংক্রমণ সম্ভব নয়, সে-ক্ষেত্রে ফ্রয়েডীয় চিকিৎসাই সম্ভব নয়। 

অচেতন মন বা যৌন-প্রতীক সম্বন্ধে ফ্রয়েডীয় সিদ্ধান্তগুলির কথা স্বতন্ত্র ভাবে আলোচনা দরকার। কেননা এইগুলি ফ্রয়েডীয় সিদ্ধান্তের স্তম্ভবিশেষ। আপাতত তাই বিচার—সাপেক্ষ এই ধারণাগুলির কথা বাদ দিয়েই ফী সম্বন্ধে ফ্রয়েডীয় বক্তব্যের বিশ্লেষণ করা যাক। তাহলে মোদ্দা কথাটা এই দাঁড়ায় যে রোগী-চিকিৎসকের মধ্যে একটা হৃদয়ের সম্পর্ক (সংক্রমণ) গড়ে না উঠলে এ-পদ্ধতিতে চিকিৎসা সম্ভব নয় এবং কাঁচা টাকার লেনদেন বাদ দিয়ে সম্ভব নয় মনের সম্পর্ক গড়ে তোলা। 

একমাত্র কাঁচা টাকাই পারে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পাতাতে। মিথ্যে কথা নয়। তবু কিন্তু চিরন্তন কোনো সত্যও তো নয়। একমাত্র বিশেষ এক সভ্যতার বেলাতেই কথাটা সত্যি। সে-সভ্যতা শুরু হবার আগে পর্যন্ত মানুষের সম্পর্ক এমন নির্লজ্জ নির্মমভাবে কাঁচা টাকার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সে-সভ্যতার পরমায়ু ফুরোলে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এমন এক অমানুষিক বস্তুর শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবে না। সেই সভ্যতারই নাম হলো বুর্জোয়া সভ্যতা। The bourgeoisie…has left no nexus between man and man than naked self—interest, than callous ‘cash payment’। নগ্ন স্বার্থপরতা, হৃদয়হীন “নগদ বিদায়” ছাড়া বুর্জোয়া শ্রেণী মানুষ আর মানুষের মধ্যে অন্য কোনো সম্পর্ক বাকি রাখেনি। এটা মিথ্যে কথা না হলেও নিশ্চয়ই কোনো গৌরবের কথা নয়। বরং এই কথাটাকে ভালো করে চেনার মধ্যেই বুর্জোয়া সভ্যতার একটি চরম সমালোচনা খুঁজে পাওয়া যায়। তাই বুর্জোয়া সভ্যতার মনের কথাটুকু প্রচার করাই যাঁর মূল উদ্দেশ্য, তাঁর পক্ষে এই কথাটির নগ্ন ও নির্মম রূপকে হরেক রকম রঙিন বুদ্ দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে তবেই প্রচার করতে হয়। টাকা বলে জিনিসটা আসলে টাকা নয়, যৌনবস্তুর প্রতীক। টাকার লেনদেনটা আসলে টাকার লেনদেন নয় নিজ্ঞান মনের সহবাস-বিশেষ। তাই টাকা দিয়ে পাতানো মানুষে মানুষে সম্পর্কটা আসলে এক রকম প্রেমের সম্পর্কই। এই হলো ফী-সংক্রান্ত ফ্রয়েডীয় বক্তব্যের আসল চেহারা। বুর্জোয়া সভ্যতার মনের কথাটিই পেশ করা গেলো, কিন্তু এমনই কায়দায় যে ব্যাপারটা বুর্জোয়া সভ্যতার চরম সমালোচনা না হয়ে বেশ মজাদার রহস্যের রূপ ধরে সাধারণের কাছে সহজে স্বীকৃত হতে পারে! 

আন্তর্জাতিক সাইকোএ্যানালিটিক্যাল সোসাইটির সভাপতি আর্নস্ট জোন্স ১৯৩৬ সালে তাঁর সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, “রাশিয়া থেকে আবার কোনো প্রত্যক্ষ খবর (সাইকো—এ্যানালিটিক্যাল আন্দোলনের খবর) আসছে না; কিন্তু সে-দেশে বিজ্ঞান সম্বন্ধে সহিষ্ণুতা শুরু হবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে এবং তার থেকেই আশা করা সম্ভব যে ও-দেশে সাইকোএ্যানালিটিক্যাল কাজকর্ম আবার শুরু হবে।” 

বলাই বাহুল্য, সভাপতি মহাশয়ের এই “আশা”টি শেষ পর্যন্ত সফল হয় নি। তার কারণ নিশ্চয়ই এই নয় যে সোভিয়েট রাশিয়ায় “বিজ্ঞানকে সহ্য করতে পারার” লক্ষণ ফুটি-ফুটি করেও শেষ পর্যন্ত আর ফুটলো না। আসল কারণটা বরং একেবারে উল্টোটাই: সোভিয়েটের নতুন সভ্যতা দিনের পর দিন যতই মজবুত বনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ততোই সম্ভব হয়েছে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্র থেকে বিজ্ঞানবিরোধী সব কিছুকে নির্মমভাবে ঝেঁটিয়ে বাদ দেওয়া। মতবাদ আর প্রয়োগ—থিয়োরি আর প্রাক্‌টিস—দুদিক থেকেই। প্রয়োগের দিক থেকে কথাটা সত্যি, কেননা ফলিত বিজ্ঞানকে মুষ্টিমেয় মুনাফালোভীর মুঠো থেকে মুক্ত করে কী ভাবে মানবকল্যাণের সুবিস্তীর্ণ পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার প্রথম ও বাস্তব পরিচয় সোভিয়েট রাশিয়াতেই। মতবাদের দিক থেকে সত্যি, কেননা সোভিয়েট বিজ্ঞানীরাই প্রথম দেখালেন কী রকম সমবেত ও সচেতন ভাবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্র থেকে বিজ্ঞানবিরোধী মতবাদের উর্ণাজালকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে বাস্তব সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। আর, একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশের বৈজ্ঞানিকের পক্ষেই বিজ্ঞানের এই মুক্তি কায়েম করা সম্ভব: কেননা অন্যান্য দেশের মতো তাঁদের দেশে তাঁদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক বিবেকের উপর কোনো মনিবের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মনিবানার চাপ নেই। তাই। 

আর তাই জোন্স-এর ওই “আশাটা সফল হওয়া সোভিয়েটের পটভূমিতে সম্ভবই নয়। কেননা, এটা তো সত্যিই বিজ্ঞানের সফলতা কামনা করা নয়, বিজ্ঞানের নামে নির্লজ্জ বুর্জোয়া-প্রচারের সফলতা কামনা করা। ফী এবং সংক্রমণ – দুই দিক থেকেই বিচার করে দেখুন। 

স্বয়ং ফ্রয়েড এবং ফ্রয়েডপন্থীরা বারবার বলছেন, সংক্রমণই হলো তাঁদের চিকিৎসা-পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে জোরদার শক্তি। তার মানে কি এই যে চিকিৎসক-রোগীর মধ্যে একটা মনের সম্পর্ক স্থাপিত না হলে মানসিক চিকিৎসা (psycotherapy) সম্ভব হয় না? মানেটা যদি তাই হয়, তাহলে কিন্তু মানতেই হবে বুর্জোয়া সভ্যতার কাঠামোর মধ্যে মানসিক চিকিৎসা-পদ্ধতি বলে বিজ্ঞানের কোনো শাখাকে গড়ে তোলবার চেষ্টাটাই অনেকাংশে ব্যর্থ হতে বাধ্য! কেননা, এই সভ্যতায় একটি কৃত্রিম বস্তুর শক্তিই মানুষে-মানুষে সম্পর্ক স্থাপন করার সবচেয়ে জরুরী জায়গাটা দখল করে রয়েছে। 

কৃত্রিম বস্তুটির নাম কাঁচা টাকা। আর তাই যদি হয় তাহলে বাস্তব অর্থে সংক্রমণ—সত্যিকারের মনের সম্পর্ক—এই কাঠামোর মধ্যে সম্ভব হবে কেমন করে? যতোদিন কাঁচা টাকার আদান-প্রদানই মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নির্ণয় ব্যাপারে চূড়ান্ত ও চরম শক্তি হয়ে থাকে, ততোদিন পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটাও কৃত্রিম ও মিথ্যা হতে বাধ্য। তাই নিজেরই প্রতিজ্ঞা থেকে শুরু করে ফ্রয়েডপন্থীর পক্ষে শেষ পর্যন্ত একটা অসহায় স্বীকৃতিতে না পৌঁছে আর উপায়ই থাকে না। ফ্রয়েডবাদ মনোবিকারের আদর্শ চিকিৎসা-কৌশল হতে চেয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে মানুষের একটা বিকৃত সম্পর্ককে আঁকড়ে ধরেই ফ্রয়েডপন্থীকে রোগমুক্তির রাস্তা খুঁজতে হলো! 

রোগীর পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসককে কাঁচা টাকায় ফী না দিলে-এ চিকিৎসার কায়দা নেই। এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক সময় অনেক রকম জল্পনা-কল্পনা করা হয়। প্রশ্নটা হলো, উন্নততর সমাজ-বাস্তবে দেশবাসীর চিকিৎসার খরচটা যদি রাষ্ট্রব্যবস্থাই গ্রহণ করে, কিংবা আজকের দিনে কাঁচা টাকার যে মূল্য ও শক্তি তা যদি উন্নততর সমাজ ব্যবস্থায় একেবারে বদলে যায়, তাহলে তখন এই চিকিৎসা কৌশলটির কী হবে? কেউ বা আন্দাজ করে বলতে চান, রোগী তখন চিকিৎসককে অন্যভাবে অন্য উপঢৌকনের সাহায্যে তৃপ্ত করে মনের সম্পর্ককটা পাতাতে চাইবেন। যেমন ধরুন, আসবাবপত্র বা বই উপহার দিয়ে ফী-এর কাজ চালানো। কিন্তু এ-জাতীয় জল্পনা-কল্পনা নেহাতই ভিত্তিহীন ও ভাসাভাসা ব্যাপার। সমস্যাটাকে তলিয়ে দেখলে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জবাব পাওয়ার কথা। 

কথা হলো, টাকা-কড়ির ব্যাপারটা ঠিক কেন? কেননা, বুর্জোয়া-সভ্যতার এইই তো নিয়ম। এ-সভ্যতার মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পাতাবার আর কোনো কায়দা নেই যে! কিন্তু কেন? কেন এই বুর্জোয়া সভ্যতায় হৃদয়বৃত্তিহীন নগদ টাকার বিনিময় ছাড়া মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আর কোনো রকমেই হওয়া সম্ভব নয়? মার্কসবাদী দেখান, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা নির্ভর করে সমাজের মূলে যে উৎপাদন-পদ্ধতি তারই উপর। বুর্জোয়া সভ্যতায় যে উৎপাদন-পদ্ধতি তার বৈশিষ্ট্য হলো প্রধানত দুটো। এক, পণ্য উৎপাদনই উৎপাদনের একমাত্র রূপ হয়ে দাঁড়ালো। দুই, মানুষের মেহনত-শক্তিও এই সভ্যতায় আর পাঁচ রকম পণ্যের মতো এক রকমের পণ্য হয়ে দাঁড়ালো। দুটো কথা ভালো করে বিচার করলেই বুঝতে পারা যাবে এই সভ্যতায় মানুষের মনের উপর নগদ টাকার অমন অসীম প্রভাবটা ঠিক কেন। 

নিজে ব্যবহারের জন্যে তৈরি না করে কেনা-বেচার জন্যে কোনো কিছু তৈরি করলে তার নাম দেওয়া হয় পণ্য। বুর্জোয়া সভ্যতার আওতায় পণ্য উৎপাদনই উৎপাদনের একমাত্র রূপ হয়ে দাঁড়ালো। আর তাই মানুষের সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে প্রাথমিক কার্যকলাপের উপর নগদ টাকায় লেনদেনটার প্রভাবই সবচেয়ে অমোঘ, সবচেয়ে চূড়ান্ত প্রভাবে পরিণত হলো। কোনো রকম আদর্শের প্রেরণায়, কোনো রকম—হৃদয়বৃত্তির খাতিরে মানুষের পক্ষে কোনো কিছু করবার অবকাশ আর রইলো না। তাই বুর্জোয়া সভ্যতার আওতায় পৌঁছেই মানুষ দেখলো কাঁচা টাকার প্রভাবটা কী গভীর, কী রকম সার্বভৌম! এই প্রভাব তার সমস্ত সত্তাকে আচ্ছন্ন করে দেয়। 

নগ্ন স্বার্থপরতা, হৃদয়বৃত্তি-বিহীন কাঁচা টাকার লেন-দেন ছাড়া বুর্জোয়া শ্রেণী মানুষের সঙ্গে মানুষের আর কোনো সম্পর্ক বাকি রাখেনি। 

কিন্তু এ-হেন অবস্থাটা এমন কিছু চিরন্তন হয়ে থাকবে না। কেননা মার্কস্বাদী বিশ্লেষণ করে দেখান, বুর্জোয়া শ্রেণীর অবস্থাটা হয়েছে গল্পে-পড়া সেই যাদুকরের মতো, যে কিনা মন্ত্রবলে এমন এক দৈত্যশক্তিকে মর্তে আনলো যে-দৈত্যশক্তিকে আয়ত্তে রাখা তার নিজের পক্ষেই আর সম্ভব নয়। তাই শেষ পর্যন্ত ওই দৈত্যশক্তির হাতেই যাদুকরের মৃত্যু। বুর্জোয়া সভ্যতার উৎপাদনের শক্তি বাড়তে বাড়তে শেষ পর্যন্ত এমন একটা অবস্থায় পৌঁছলো, যে তারই চাপে এ-সভ্যতার কাঠামো চিড় খেয়ে চৌচির হয়ে যায়। উৎপাদনের উপায়গুলোর উপর ব্যক্তিগত মালিকদের মালিকানা আর তাই টিকে থাকতে পারবে না, তার বদলে ঘনিয়ে আসতে চায় পুরো সমাজের, পুরো রাষ্ট্রের মালিকানা। তারই নাম হলো সমাজতন্ত্র। আর এই মালিকানার রকম-ফেরের দরুনই উৎপাদনের উদ্দেশ্যও অনিবার্যভাবেই বদলে যেতে বাধ্য: লাভের আশায় নগদ পয়সায় বিক্রি করবার জন্যে উৎপাদন নয় আর, তার বদলে মানুষের অভাব মোচন, মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে উৎপাদন। অর্থাৎ কিনা পণ্য উৎপাদনের যুগ শেষ হওয়া। আর তাই, শেষ হওয়া মানুষের সমগ্র সত্তার উপর কাঁচা টাকার অমন চূড়ান্ত প্রতিপত্তি। তাই আগামীকালের সমাজতান্ত্রিক সভ্যতায় মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পাতাবার ভিত্তিটা একেবারেই অন্য রকম। 

কী রকম? তার জবাব পাওয়া যায় সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির দিক থেকে; সমবেত মানুষের অভাব মোচন, সমবেত মানুষের কল্যাণ সাধন – সমাজতন্ত্রের আওতায় উৎপাদনের এই হলো একমাত্র আদর্শ। আর তাই, নগ্ন স্বার্থপরতা বা হৃদয়হীন কাঁচা টাকার লেনদেনের জন্যে কোনো অবকাশ নেই। তার বদলে সহযোগিতার সম্পর্ক—সামাজিক উৎপাদনের কাজে সহযোগিতা। 

সংক্রমণ। রহস্যঘন ভাষায়, রহস্যঘন আরো পাঁচ মতবাদের কুয়াশায় আচ্ছন্ন না করে, সংক্রমণের মূল কথাটা যদি বলবার চেষ্টা করা যায় তাহলে বলতে হবে, মানুষের সঙ্গে মানুষের মনের সম্পর্ক স্থাপন করা গেলে মনোবিকারের রোগীকে রোগমুক্তির দিকে এগুতে সাহায্য করা যায়। এই কথাটা তো এমন কিছু জটিল, দুরূহ বা অসম্ভব কোনো কথা নয়। 

কিন্তু কথা হলো, আজকের ইতিহাসে আসন্নপ্রায় নতুন সভ্যতায় মনোবিকারের মানসিক চিকিৎসা (Psychotherapy) কোন্ পথে এগুবে? প্রশ্নটার বাস্তব জবাব পাওয়া যায় সমাজতান্ত্রিক সমাজে মনোবিকারের মানসিক চিকিৎসার পদ্ধতি কোন্ পথে সত্যিই এগুচ্ছে তার পরিচয় থেকে। অর্থাৎ কিনা সোভিয়েট সমাজে মনোবিকারের চিকিৎসা-সংক্রান্ত যে-ব্যবস্থা তার থেকেই। অবশ্যই এ-পরিচয় দেওয়া পরিসরসাপেক্ষ। আপাতত তার পূর্ণ পরিচয় সম্ভব নয় নিশ্চয়ই। কিন্তু যে কথাটা এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক অন্তত সেইটুকুর উল্লেখ প্রয়োজন। 

আজকের দিনে সোভিয়েট চিকিৎসাবিজ্ঞানে মনোবিকারের যে চিকিৎসাপদ্ধতি তার একটা প্রধান অঙ্গ হলো সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে আর পাঁচজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের সঙ্গে সহযোগী কর্মী হিসেবে রোগীকে পুনঃস্থাপিত করা। সমাজের বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষা বাদ দিয়ে বন্ধ ঘরের কৃত্রিম আবহাওয়ায় কাঁচা টাকার সাহায্যে রোগী চিকিৎসকের মধ্যে একটা কৃত্রিম সম্পর্ক পাতাবার চেষ্টা নয়। সোভিয়েটের সমাজের গড়নের সঙ্গে সে-চেষ্টা খাপ খেতেই পারে না। তার বদলে, নতুন সমাজব্যবস্থায় মানুষের সঙ্গে মানুষের যে নতুন ও উন্নততর সম্পর্ক তারই দিকে নজর রেখে মনোবিকারের চিকিৎসা প্রয়াস। তাই, সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে স্বাভাবিক ও সুস্থ সহযোগিতার সম্পর্ক সেই সম্পর্কই গড়ে তুলতে সাহায্য করা। 

অতএব, সমাজতন্ত্রের আওতায় বুর্জোয়া অভ্যাসেরই একটি আপাত পরিশোধিত সংস্করণ নয়—কাঁচা টাকায় ফী দেওয়াকে শুধরে উপহার জাতীয় কিছু দেবার ব্যবস্থা নয়—একবারে মৌলিকভাবে ভিন্ন এক ব্যবস্থাই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *