বন্ধ ঘর
খোলা জায়গায় সাইকোএ্যানালিসিস্ চলবে না। তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি এ-পদ্ধতির পরিপন্থী। তার মানে, চিকিৎসার সময় সামাজিক পটভূমিকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা দরকার, সমাজ-জীবনকে একান্তভাবে পিছনে ফেলে আসা দরকার। বন্ধ ঘর: রোগীর পক্ষে নিজের হাতে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেওয়াই ভালো, কেননা তাতে সমাজ-জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবার প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। চিকিৎসকও ক্রমাগতই চেষ্টা করেন রোগী যেন তাঁর ভাব-আবেগকে নিছক, নিরবলম্ব ভাব-আবেগ হিসেবে দেখবার পথে এগুতে পারেন। অর্থাৎ কিনা রোগীর চেতনাকে, রোগীর চিন্তাপদ্ধতিকে, ক্রমাগতই এমন দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা যে-দিকে কোনো রকম সামাজিক বিচার-বিশ্লেষণ নেই, কোনো রকম সমাজ সংস্কার নেই। কিন্তু সমাজ-চেতনাটুকুকে মন থেকে একেবারে মুছে ফেলা তো সহজ কথা নয়। চিকিৎসক তাই একটি কাল্পনিক উদাহরণের সাহায্য নিতে বাধ্য হন: রোগীকে ভেবে দেখতে বলেন, রবিনসন ক্রুশোর মতো রোগী যদি কোনো নির্জন দ্বীপের একমাত্র অধিবাসী হতেন তাহলে তাঁর পক্ষে অমুক কাজ করায় বা তমুক ব্যবহার করায় সত্যিই কি কোনো বাধা থাকতো?
তার মানে ফ্রয়েডীয় পদ্ধতির প্রথম ধাপ হলো রোগীর মন থেকে সমষ্টিচেতনা বিনাশ করে নির্জলা ব্যষ্টিচেতনাকে জাগিয়ে তোলা। রোগীর পারিপার্শ্বিকে যে সমাজ, তার আইন-কানুনে, সংস্কার-বিচারে গ্লানি আছে। সেই গ্লানিগুলি সম্বন্ধে রোগীকে সচেতন করে উন্নততর ও গ্লানিমুক্ত সামাজিক পরিকল্পনার দিকে এগিয়ে যেতে রোগীকে সাহায্য করা নয়, সেই উন্নততর আদর্শের প্রেরণায় রোগীর মনকে সঞ্জীবিত করবার চেষ্টা নয়। সেটা বাস্তবের পথ হতে পারতো, হতে পারতো প্রকৃত বিজ্ঞানের পথ—দুনিয়াকে বদল করবার পথ। কিন্তু সে পথ ফ্রয়েডীয় পদ্ধতির পথ হতে পারে না। কেননা, উপযোজন বা এ্যাডজাস্টমেন্ট নিয়ে আলোচনা করবার সময় স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যাবে এ-পদ্ধতির চূড়ান্ত আদর্শ হলো বর্তমান বাস্তবটা যতই গ্লানিময় হোক না কেন, কোনোমতে রোগীর চেতনাকে তারই সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা। অর্থাৎ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে রোগী যাতে বিনা দ্বন্দ্বে সহ্য করতে পারেন তারই আয়োজন। এবং রোগীর মানসিক চাহিদাকে শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া বাস্তবের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে বলেই ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের প্রথম ধাপে বুর্জোয়া আদর্শের মূল ভ্রান্তিকে আশ্রয় করবার ব্যবস্থা। ব্যক্তির মধ্যে যেটা নিছক নিজস্ব দিক, স্বতন্ত্র দিক, ব্যষ্টির দিক, সেই দিকটুকুর উপর দৃষ্টি আবদ্ধ করতে শেখানো, সমাজকে ভুলতে শেখানো, সমষ্টিগত চেতনার সঙ্গে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে শেখানো। সমাজকে ভুলতে পারলেই—সমাজের বন্ধন ছিঁড়ে পালিয়ে যেতে পারলেই—বুঝি সমাজের গ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে! এইটেই হলো বুর্জোয়া ভাবাদর্শের মূল ভ্রান্তি, রুশোর রচনায় যে-ভ্রান্তির চরম প্রচার! রুশো বললেন, ফিরে চলো প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে, স্বাভাবিক মানুষের মতো। দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর। কিন্তু মার্কস্বাদ নির্ভুল হিসেব করে দেখায় এইভাবে সমাজ-চেতনা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবার চেষ্টাটুকু আর কিছুই নয়, বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থার যে-গ্লানি তারই ফাঁদে পা দেবার ওজুহাত মাত্র। অর্থাৎ সামাজিক চেতনা থেকে যতোই আপনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবার চেষ্টা করবেন আপনার বর্তমান সমাজ ততোই আপনাকে পেয়ে বসবে, ততোই আপনার ঘাড় ধরে এই সমাজ-ব্যবস্থা আপনাকে দিয়ে তার নিজের চাহিদা মিটিয়ে নেবে। কেননা, এই সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তর আনার ব্যাপারে অনিবার্যভাবেই প্ৰয়োজন হলো সংঘবদ্ধ হওয়া, সমষ্টির মধ্যে ব্যক্তির পক্ষে আত্মসমর্পণ। তা না হলে, বদল হবে না এই সমাজ-বাস্তবের এবং সমাজ-বাস্তবের বদল যদি না হয় তাহলে আপনি নিজের কল্পনায় যেমনভাবেই এ থেকে মুক্ত হতে চান না কেন এই সমাজ-ব্যবস্থা জোর করে তার ষোলো আনা চাহিদা আপনার কাছ থেকে আদায় করে নেবে।
তাই-সমাজ-চেতনা থেকে বিমুক্ত হবার উপদেশটুকু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার ফাঁদে পা দেবার আমন্ত্রণই। ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলের প্রথম ধাপে এই আমন্ত্রণেরই পরিচয়: দরজা বন্ধ করে সমাজের কথাটা আড়াল দিয়ে সাইকোএ্যানালিসিস্ শুরু এবং সাইকোএ্যানালিস্ট-এর ক্রমাগত চেষ্টা হলো রোগীর মন থেকে সমষ্টি চেতনাকে লোপ করে দেবার, যাতে তার চিন্তার পদ্ধতিটা হয় রবিনসন ক্রুশোর মতো, রুশোর ওই বুনো মানুষের মতো—নিঃসঙ্গ, একক, অতএব অসহায়, নিরুপায়: সামাজিক বাস্তবের সামনে মাথা নোয়াতে সে বাধ্য হবেই, বাধ্য হবেই সমাজের সব রকম গ্লানি মাথা পেতে মেনে নিতে। অর্থাৎ কি না ফ্রয়েডীয় পরিভাষার উপযোজন বা এ্যাডজাস্টমেন্ট।