অনুবন্ধ – ফ্রয়েড প্রসঙ্গে
ফ্রয়েডীয় মতবাদের সমর্থনে ফ্রয়েডপন্থীদের পক্ষে এমন এক সুবিধে আছে যা বিজ্ঞানের কোনো ক্ষেত্রে, এমন কি দার্শনিক মতবাদের বেলাতেও, আর কখনো চােখে পড়েনি। সুবিধেটা হলো, বিপক্ষ-সমালোচনার মধ্যে মনোবিকারের লক্ষণ আবিষ্কার করবার দাবি। বিশেষ করে সে-সমালোচনার সঙ্গে যদি কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের যোগাযোগ থাকে তাহলে তো কথাই উৎসাহের পেছনে মানসিক গরমিলের পরিচয় থাকা সম্ভব, —এবং রাজনীতিটা যদি বৈপ্লবিক হয় তা হলে তার মতে এই সম্ভাবনা প্রায় সুনিশ্চিয়ের কোঠায় পৌঁছোবার কথা।
অথচ, এই বইতে ফ্রয়েডীয় মতবাদের বিবরণ-মাত্র দিতে বসিনি। সমালোচনা করবার প্রয়াসীই হয়েছি। সে-সমালোচনার সঙ্গে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের যোগাযোগও থাকবে। রাজনীতিটা অহিংস নয়, বৈপ্লবিক। এক কথায় মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মতবাদের দিক থেকে এ-সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করবার যে-দুটি প্রাথমিক দাবি হবে, শুরুতে পূর্বপক্ষ হিসেবে সেই দুটি দাবির জবাব দেওয়া দরকার।
একে একে দুটি কথার আলোচনা করা যাক।
প্রথমত, বিরুদ্ধ সমালোচনার মধ্যে মনোবিকারের লক্ষণ আবিষ্কার করবার দাবি। মনে রাখতে হবে, এ-দাবি একমাত্র ফ্রয়েডবাদেরই। তার মানে, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং দার্শনিক মত পেশ করবার পর বিরুদ্ধ সমালোচনা—তুমুল সমালোচনা —বহুবারই শোনা গিয়েছে। কিন্তু তার জবাবে এ-কথা। আর কখনো শোনা যায়নি যে, সমালোচকদের এতো যে সোরগোল তা শুধু তঁদের মানসিক গণ্ডগোলেরই পরিচয়। কোপার্নিকাস। যখন প্রথম ঘোষণা করলেন সূর্যের চারপাশেই পৃথিবীর আবর্তন, পৃথিবীকে ঘুরে সূর্যের আবর্তন নয়, তখন কোপার্নিকাসের বিরুদ্ধে সোরগোল খুব কম হয়নি। কিংবা জীবজগতে বিবর্তনের কথা পেশ করবার পর ডারউইনের বিরুদ্ধে তীব্র আর তুমুল সমালোচনার তুফান নিশ্চয়ই উঠেছিল। আজো, লাইসেনকো জীববিজ্ঞানে যে-বিপ্লব, ঘোষণা করেছেন তার বিরুদ্ধে সমালোচনার অন্ত নেই। দার্শনিক মতবাদের বেলাতেও অনেক সময়ই এই রকম। দিদারো, ফয়ারবাখ, এঙ্গেলস—অনেক দার্শনিকের নাম মনে পড়ে। অনেকের বিরুদ্ধেই তীব্র তুমুল সমালোচনা। কিন্তু উত্তরে এ-পর্যন্ত আর কাউকে দাবি করতে দেখা যায়নি যে সমালোচনাগুলি আসলে এক রকমের পাগলামি বিশেষ। বাস্তব দৃষ্টান্ত, বাস্তব অভিজ্ঞতা আর যুক্তিতর্ক দিয়েই বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক সমস্যার কিনারা করবার প্রথা। কিন্তু ফ্রয়েডপন্থীরা শুধু এইটুকুকেই পূর্বপক্ষ-খণ্ডনের একমাত্র পন্থা বলে স্বীকার করতে সম্মত হবেন না। যেমন ধরুন, কেউ হয়তো যে সহজ বৃত্তির কথা উল্লেখ করেন সেটা আসলে অতিকথা মনে এই সহজবৃত্তির উৎপাত নিশ্চয়ই বেশি, তা নইলে একে অস্বীকার করবার এমন উৎসাহ আসবে কোথা থেকে? ঠাকুর ঘরে কে রে-না, আমি তো কলা খাইনি! তর্ক করে সমালোচক হয়তো বলবেন, তা কেমন করে হবে ? নিজের মনেই যদি এ-হেন সহজবৃত্তির উৎপাত থাকতো তাহলে অন্তত নিজে তো তার কথা টের পেতুম! উত্তরে শোনা যাবে, তা হয় না; কেননা, নিজের মনের পুরো খবরটা নিজে নিজে পাওয়া যায় না।
ফ্রয়েদীয় মতবাদের এই বিশেষ সুবিধেটার ভিত্তি ঠিক কী, এইবারে তা স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যাবে। ভিত্তিটা হলো, আলোচ্য বিষয়ের এক বিশেষ সংজ্ঞা-নিরূপণ। ফ্রয়েড বলেন, নিৰ্জান মন নিয়ে তার আলোচনা, নিজৰ্ত্তান বলতে তিনি বোঝেন মানব-মনের অজানা আর গভীর এক প্রদেশ। তার মানে, ফ্রয়েডের মতে আমরা নিজেরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে নিজেদের মন সম্বন্ধে মাত্ৰ সামান্য আর ভাসাভাসা খবর জোগাড় করতে পারি, সেটুকু তাই আমাদের মনের আসল পরিচয় নয়। কেননা আমাদের মনের আসল দিকটার কথা আমরা নিজেরা সব সময় নিজেদের কাছ থেকেই লুকোতে ব্যস্ত। ওই ভাগটারই নাম হলো নির্জন। এবং ফ্রয়েডের মতে আমাদের যা-কিছু চিন্তা, যা-কিছু সচেতন ব্যবহার তার সবটুকুই ওই নির্জনের নিয়ন্ত্রণ মেনে চলে। অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে, নিজৰ্ত্তান মনটা কেন নির্জান ? আমাদের মনেরই প্ৰধান দিক অথচ আমরাই তার খবর পাইনে-এমন ব্যাপার সম্ভব হয় কেমন করে? উত্তরে ফ্রয়েড বলবেন। আমাদের মনের মধ্যে সদা-সর্বদা একটা চেষ্টা রয়েছে ওই নিৰ্ত্তানকে চেপে রাখবার, ওর বিরুদ্ধে বাধা সৃষ্টি করবার। সেই বাধা উত্তীর্ণ হয়ে নির্জনের বিষয়টুকু সজ্ঞানের স্তরে উঠে আসতে পারে না—দেউড়ির পাহারাদারকে পেরিয়ে যে-রকম মুক্ত রাজপথে বেরিয়ে আসতে পারে না কয়েদখানার বাসিন্দারা। কিংবা পাহারাদারকে ফাকি দিয়ে কয়েদীরা যদি একান্তই বেরিয়ে আসতে চায়, তাহলে তাদের পক্ষে ছদ্মবেশ পরিবার দরকার। আমাদের মনের বেলাতেও ওই রকম : সজ্ঞান সমাজ-বোধের পাহারাদারি পেরিয়ে নিৰ্ভৰ্ত্তানের কথা যদি সজ্ঞানের স্তরে উঠে আসতে চায় তাহলে ছদ্মবেশ ছাড়া গতি নেই। এই-জাতীয় হরেক রকম ছদ্মবেশের বর্ণনা ফ্রয়েডীয় গ্রন্থাবলীতে। দৈনন্দিন খুঁটিনাটির ভুলচুক আর হাসিতামাসা থেকে শুরু করে স্বপ্ন এবং মনোবিকারের লক্ষণ পর্যন্ত কতোই না।
ফ্রয়েডীয় মতবাদের এই মূল দাবি মনে রাখলে বুঝতে পারা যাবে, বিপক্ষ আলোচনার মধ্যে মনোবিকারের লক্ষণ খোঁজবার ব্যাপারে ওঁদের সঙ্গতিটা ঠিক কোথায়। ওই নির্জন মনের কথা যদি বৈজ্ঞানিক বাস্তব হয়, এবং ফ্রয়োভীয় আলোচনার প্রধান উৎসাহ যদি ওই নিজৰ্দ্ধানের উপর আলোকপাত করবার চেষ্টাই হয়, তাহলে সে-আলোচনার বিরুদ্ধে আমাদের তরফ থেকে প্রতিবন্ধ জাগা তো স্বাভাবিকই; সভ্যমানুষ সদাসর্বদা নিজের সম্বন্ধে যে-কথা এমন কি নিজের কাজ থেকেও গোপন করতে চায়, সেই কথা প্ৰকাশ করে দেবারই প্রধান তাগিদ ফ্রয়েডের, ফলে ফ্রয়েডের বিরুদ্ধে সভ্যমানুষের স্বাভাবিক। আপত্তি। এবং তার আপত্তিই ততো বেশি যার নিজের মনে নিৰ্ত্তান মনের উৎপাত যতো প্রবল। কেননা, তার মনে সজ্ঞানে-নির্জনে রফা হয়নি, দুয়ের মধ্যে প্রবল দ্বন্দু। অতএব, ফ্রয়েডবাদের বিরুদ্ধে আপত্তির বহর দেখেই আন্দাজ করা চলে কার মনে সজ্ঞানে-নির্জনে দ্বন্দুটা কী রকম। ফ্রয়েডীয় মতে এই দ্বন্দুের নামই হলো মনোবিকার। তাই বিপক্ষ সমালোচনার মধ্যে মনোবিকারের লক্ষণ।
অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে, বিরুদ্ধ সমালোচনা যদি একান্তই প্রতিবন্ধ-প্রসূত হয় তাহলে কি ফ্রয়েডবাদকে ধ্রুব সত্য বলে সোৎসাহে মেনে নেওয়াই সুস্থ ও বৈজ্ঞানিক মনের একমাত্র পরিচয় ? ফ্রয়েড বলবেন, তাও নয়। অতিভক্তিটা আবার যে চোরের লক্ষণ! মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ নিয়ে ফ্রয়েডবাদের কাছে আত্মনিবেদন করবার ভঙ্গিটাও ফ্রয়েডের মতে ওই একই প্ৰতিবন্ধের উলটো দিক মাত্র, কেবল এর মধ্যে এমন এক চালাকি আছে যে প্ৰতিবন্ধের পরিচয়টা চট করে চোখে পড়ে না। দৈনন্দিন ব্যবহারের মধ্যেও এ-রকম চালাকির নমুনা দুর্লভ নয়। যেমন ধরুন, একজন কেউ এমন সব কথা বলছে বা এমন মত প্ৰকাশ করছে যা আমার কাছে একেবারে বিরক্তিকর মুখতার সামিল। আমি তার সঙ্গে জোর গলায় তর্ক করতে পারি। কিন্তু যদি চালাকি করতে চাই তাহলে হয়তো খুব সোজাসুজি—এমন কি সোৎসাহ বিস্ময়ের অভিনয় করে-তার সব কথা সরাসরি মেনে নিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দেবো। তার কথা তখন আর আমার স্পর্শও করবে না, বিব্রতও করবে না।
প্রশ্ন হলো, তাহলে? যদি বিরূপ সমালোচনা আর সোৎসাহ স্বীকৃতি দুয়ের পিছনেই মানসিক গণ্ডগোলের পরিচয় থাকে তাহলে কি ফ্রয়েডীয় মতে ফ্রয়েডবাদকে যাচাই করবার-এমন কি সম্যকভাবে চেনবার আর বোঝাবার-কোনো পথই নেই ? উত্তরে ফ্রয়েড যে-কথা বলছেন তা সত্যিই অতি-দুরূহ এক দাবি: বই পড়ে বা মাথা ঘামিয়ে এ-মতবাদকে চেনা-জানা যায় না, এর যাথার্থ্য-বিচার তো দূরের কথা। (১) ফ্রয়েড বলছেন, একে চেনবার-জানবার একমাত্র পথ হলো সহাদয়-সংশয়ের (benevolent scepticism-এর) মনোভাব নিয়ে কোনো এক ফ্রয়েডপন্থীর কাছে আত্মনিবেদন করতে হবে। (২) তিনি জানেন, মনের প্রতিবন্ধ ভাঙবার কৌশলটা ঠিক কী, যদিও অবশ্য দুঃখের বিষয় এ-ব্যাপারে সহজ আর সিধে কোনো পথ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। সাধারণত ফ্রয়েডীয় কৌশলে পারদর্শী ফ্রয়েডপন্থীর পক্ষে কাজ সমাধা করবার জন্যে একটানা দু-তিনশো দিন ধরে দৈনিক একঘণ্টা করে চেষ্টার আয়োজন। তাছাড়া, এই কলাকৌশলেরই একটা অঙ্গ হলো নগদ-দক্ষিণা (রুপোর টাকায়) গ্ৰহণ করা। তা নইলে কাজ করে না। ফলে, ব্যাপারটা শুধু সময়-সাপেক্ষই নয়, ব্যয় সাপেক্ষও। তবু ফ্রয়েডীয় মতে এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এইভাবে নিজের উপর একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োগ না দেখলে ফ্রয়েডের মতে তার মতবাদ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পাওয়াই সম্ভব নয়, সমালোচনার অধিকার তো দূরের কথা। মনে রাখতে হবে, ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলে শিক্ষা লাভ করবার ব্যাপারেও প্রথমে নিজের উপর এর প্রয়োগ করানোর নির্দেশ। অর্থাৎ, সাধারণ রোগীর চিকিৎসা করবার সময় ফ্রয়েডপন্থী যেমনভাবে দীর্ঘদিন ধরে রোগীর উপর তার পদ্ধতির প্রয়োগ করেন, ঠিক তেমনিভাবেই শিক্ষার্থীর উপরও প্রয়োগ করবেন। ওই একই পদ্ধতি। (৩) তাঁর যুক্তিটা সহজ: এইভাবে শিক্ষার্থীর পক্ষে শুধুই যে ফ্রয়েডীয় কলাকৌশল সম্বন্ধে অপরোক্ষ পরিচয় পাবার আশা তাই নয়, ফ্রয়েডবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীর সভ্য মনে যে স্বাভাবিক প্রতিবন্ধ তা দূর করবারও এই হলো একমাত্র পথ।
ফ্রয়েডীয় কলাকৌশল এবং তার মতবাদের বিভিন্ন দিকগুলি নিয়ে পরে খুঁটিয়ে আলোচনা তুলবো। কিন্তু তার আগে যে-কথা শুরু করেছিলাম।–অর্থাৎ ওই সমালোচনার অধিকার নিয়ে কথা। স্পষ্টই দেখা যায়, অধিকারভেদের কথা তুলে ফ্রয়েডপন্থী ব্যাপারটাকে একান্ত ব্যক্তিগত এক স্তরে নিয়ে যেতে চান। এ দাবির বৈজ্ঞানিক তাৎপৰ্য যাই হােক না কেন, সমালোচককে বিব্রত করবার ব্যাপারে। এর ব্যবহারিক মূল্য আছে। কেননা, এর প্রকৃত বৈজ্ঞানিক উত্তর দিতে গেলে বস্তুনিষ্ঠ প্ৰমাণ-অপ্রমাণের নির্ভরে দেখানো দরকার যে, যে-মূলসূত্রগুলির উপর এ-দাবি প্রতিষ্ঠিত সেগুলিই সংশয়াত্মক বা ভ্ৰান্ত। অথচ, সেই প্ৰচেষ্টাকেই সুযোগ পাবেন। তাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্তরেই সমালোচকের পক্ষে যদি কোনো জবাব দেবার অবসর থাকে তাহলে অন্তত কৌশল হিসেবে তার উল্লেখ। অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কৌশল হিসেবে বলছি, কেননা বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানসম্মান্য মতবাদের বিচারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-অনভিজ্ঞতার সাক্ষ্য তো সত্যিই সংকীৰ্ণমূল্য; তবুও তার উল্লেখ অন্তত ফ্রয়েডপন্থীকে সস্তুষ্ট করবে—নইলে তো। তিনি স্বপক্ষাদোষে দুষ্ট হবেন। প্রসঙ্গত বলে রাখা যায় যে সমালোচনা-সূত্রে আরো অগ্রসর হলে আমরা দেখতে পাবো ফ্রয়েডের এই দাবি এক বিশেষ সামাজিক দৃষ্টিকোণের অনিবার্য পরিমাণ মাত্র। সমাজতত্ত্বের প্রচলিত পরিভাষায় তার নাম বুর্জোয়া শ্রেণীর দৃষ্টিকোণ—যা কিনা, একান্তই আত্মকেন্দ্রিক ও ব্যষ্টিকেন্দ্রিক (subjective s individualistic) হতে বাধ্য। তাই, সমালোচনার যথার্থ্য তাঁর কাছে শুধুমাত্র বস্তুনিষ্ঠ প্ৰমাণ-অপ্ৰমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়-অধিকারভেদের, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মুখাপেক্ষী।
সামাজিক দৃষ্টিকোণের কথা পরে তোলা যাবে। আপাতত, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার এজলাসে আমার জবানবন্দিন্টুকু পেশ করা যাক—যদিও স্পষ্ট ভাবেই বলে রাখতে চাই যে পূর্বপক্ষ-খণ্ডনের এক কৌশল হিসেবেই এই প্রচেষ্টা, অর্থাৎ কিনা বস্তুনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক বিচারের এজলাসে এই জবানবন্দির মূল্য সত্যিই সংকীর্ণ। জবানবন্দিটা হলো, শিক্ষার্থী হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে দৈনিক একঘণ্টা করে ফ্রয়েড-গোষ্ঠী-স্বীকৃত সুকৌশলী ফ্ৰয়েডপন্থীর কাছে আমি আত্মনিবেদন করেছিলাম এবং অপরোক্ষভাবে ফ্রয়েডীয় পদ্ধতির প্রয়োগ ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজের উপর হতে দেখেছি এবং শেষ পর্যন্ত ফ্রয়েডসমাজ আমাকে জানিয়েছিলেন যে শিক্ষার্থীর পক্ষে যতোখানি গভীরভাবে এই পদ্ধতির সাহায্যে আত্মোপলব্ধির প্রয়োজন আমার ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, ফ্রয়েডপন্থীর মতেই সাধারণ রোগীর রোগলক্ষণ নিবারণের জন্যে যতোখানি গভীর মনঃসমীক্ষণ প্রয়োজন, শিক্ষার্থীর পক্ষে প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি। আশা করি এই আত্মকাহিনীর নজির তোলবার পর ফ্রয়েডপন্থীরা আমার সমালোচনায় যুক্তিতর্ক ও বাস্তব দৃষ্টান্তর দোষক্ৰটি অন্বেষণ করবেন—আমার ব্যক্তিগত আবেগঅনুভূতিতে গরমিল আছে, এমনতরো দাবি করে আমার সমালোচনার জবাব দেবেন না। বলাই বাহুল্য, এই কৈফিয়তটা শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে, প্রতিবন্ধ-সংক্রান্ত ফ্রয়েডীয় সমালোচনা নয়। সে-সমালোচনা পরে তোলা হবে।
কিন্তু রাজনৈতিক উৎসাহ ? রাজনৈতিক মতবাদ? বিশেষ করে বৈপ্লবিক রাজনীতি ? ফ্রয়েডপন্থীর কাছে যে এ-জাতীয় উৎসাহের অন্তত চোদ আনা প্রেরণাই হলো নির্জন মনের সমীক্ষণ-সাপেক্ষ পিতৃদ্রোহ। এখানে ফ্রয়েডীয় বক্তব্যটার সঙ্গে সাধারণের অভিজ্ঞতা এবং ধারণার এতো তফাত যে সে-বক্তব্যের জবাব দেবার আগে বক্তব্যটা একটু বিশদ করা দরকার। ফ্রয়েডের মতে নিতান্ত শৈশবদশা থেকেই মানুষের মনে—পিতৃশাসনের বিরুদ্ধে একটা তীব্র আপত্তি আর বিদ্বেষ জমা হতে থাকে। তার কারণ, ফ্রয়েড বলেন, শিশুর কাছে অবাধ সুখভোগের আকাঙ্ক্ষাই জীবনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষণ, অথচ শিশুর ক্ষুদ্র জগৎটুকুর মধ্যে পিতৃশাসনই এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো বাধা। তাই বিদ্বেষ, পিতৃদ্রোহ। অবশ্যই বয়স বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে জাগতিক অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক নীতি-শিক্ষার চাপে এই বিদ্বেষ, এই বিদ্রোহ, আমরা মনের গোপনে লুকিয়ে ফেলবার চেষ্টা করি। অর্থাৎ ফ্রয়েডের পরিভাষায়, নির্জ্ঞানের মধ্যে একে নির্বাসনে পাঠাই। কিন্তু নির্জ্ঞানে নির্বাসিত হলেও ওই পিতৃদ্রোহ মরে না, উপে যায় না। বয়ঃপ্ৰাপ্তির পরেও মনের মধ্যে টিকে থাকে। আর যদি টিকেই থাকে তাহলে তার পক্ষে চরিতার্থতা খোঁজবার পথই হবে একমাত্র পথ। কিন্তু সোজাসুজি চরিতার্থতার পথে বাধা দেখে ছদ্মবেশী চরিতার্থতার পথ খুঁজতে চায়। ছদ্মবেশী চরিতার্থতা নানান রকমের। তার মধ্যে এক রকম হলো বৈপ্লবিক রাজনীতি। কিন্তু কেন? কেমন করেই বা? ফ্রয়েডপন্থী বলবেন, পরিণত বয়সে আমরা যখন পারিবারিক অভিজ্ঞতার ক্ষুদ্র গণ্ডিটুকু থেকে
আমাদের কাছে পিতাই আর একমাত্র শাসক—একমাত্র কর্তৃপক্ষ—নন। শাসক বলতে—কর্তৃপক্ষ বলতে—তখন সরকার, সরকারী ব্যবস্থা, আমলা, রাজপুরুষ। ফ্রয়েডীয় পরিভাষায় এ-সবই হবে পিতৃ-প্রতীক, ‘ফাদার-ইম্যাগো’। অর্থাৎ শিশুমনের কাছে পিতা যেভাবে শাসকের জায়গা জুড়ে ছিলেন পরিণত মনের কাছে এইগুলিই সেই রকম জায়গা জুড়ে থাকে। তাই, শৈশবের ওই সঞ্চিত পিতৃ-বিদ্বেষ পরিণত বয়সে এই পিতৃ-প্রতীকগুলির উপর গিয়ে পড়ে। অর্থাৎ বিপ্লবের মনোভাব। বৈপ্লবিক রাজনীতি। অবশ্যই, দায়িত্বশীল ফ্রয়েডপন্থী স্বীকার করবেন যে রাজনীতির মধ্যে ষোলো আনাই এই রকম নির্জন মনের পিতৃ-বিদ্বেষ নয়। অর্থাৎ, রাজনীতির মধ্যে কিছুটা শুদ্ধ ও নির্মল রাজনৈতিক হিসেবা-নিকেশের পরিচয় থাকতে পারে। কিন্তু রাজনীতির মধ্যে আবেগ-উত্তেজনার যে-দিক সেটা নিজ্ঞানের পিতৃদ্রোহই। এবং অনেকের ক্ষেত্রে, ফ্রয়েডপন্থী বলবেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই—নির্জনের জটিলতা, সচেতন মনের তথাকথিত নির্মল হিসেবা-নিকেশকে অজুহাত হিসেবে হালের ইতিহাসে সাধারণ মানুষ “বন্দেমাতরম” বলে বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠেছিলো। এর পিছনে কি শুধুই নির্মল রাজনৈতিক চেতনার পরিচয়? ফ্রয়েডপন্থী নিশ্চয়ই তা স্বীকার করবেন না। তিনি বলবেন: মানুষের মনের কাছে জননী আর জন্মভূমি এক জিনিস। অর্থাৎ মাতৃভূমি হলো মাতৃপ্রতীক, ‘মাদার-ইম্যাগো’। এবং ফ্রয়েডীয় মতে শিশুমনের সবচেয়ে বড়ো চাহিদা মাকে ভোগ করবার আকাঙ্ক্ষণ (ইডিপাস কমপ্লেংকস)। আসলে ওই পিতৃ-বিদ্বেষের মূলেও রয়েছে এই ভোগাকাঙ্ক্ষা : মাকে একান্তভাবে পাবার সবচেয়ে বড়ো বাধা হলো বাবা, অবাধ উপভোগের যে-চাহিদা তার বিরুদ্ধে পিতার শাসনই সবচেয়ে কঠিন। এখন, মাতৃভূমি যদি মাতৃ-প্রতীক হয়। আর মানুষ যদি দেখে তার এই মাতৃ-প্রতীককে বিদেশী শাসকের দল এমনভাবে উপভোগ করছে, যে তার নিজের পক্ষে উপভোগের সম্ভাবনা বন্ধ—অথাৎ বিদেশী শাসকের দল হয়ে দাঁড়িয়েছে নিখুঁত পিতৃ-প্রতীক—তাহলে দেশের মানুষ তো মায়ের নামে ক্ষেপে উঠবেই। “বন্দেমাতরম” বলে ওই ছোট্ট আওয়াজটুকুর মধ্যে আমন অদ্ভুত যাদুশক্তির যোগানটা ঠিক কোথা থেকে তার হদিস দিয়ে ফ্রয়েডপন্থী তাই বলতে চাইবেন, এর ভিতর একটি গুঢ় মানসিক তত্ত্বকে সর্বাঙ্গীণভাবে ব্যবহার করবার নিপুণ আয়োজন রয়েছে যে।
তর্ক তুলে আপনি হয়তো বলবেন, বাস্তব পৃথিবীর চাক্ষুষ অভাব-অভিযোগগুলো তাহলে কি কিছু নয়? শিশুমনের একটা আজগুবি আক্রোশই সব হলো ? পলাশীর প্রাঙ্গণ থেকে জালিয়ানওয়ালাবাগ, জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে সাতচল্লিশের দেশ-ভাগ—সব কিছুই হলো গৌণ, নিমিত্তমাত্র? ফ্রয়েডপন্থী বলবেন, তাই-ই। তা নইলে আমন আক্রোশের ভাবটা আসে কোথা থেকে? আবেগ-উত্তেজনায় আমন আত্মহারা হয়ে পড়া কেন ? রাজনীতির প্রেরণাটা যদি নিছক বাস্তববোধ থেকেই সঞ্চারিত হতো। তাহলে রাজনীতির আবহাওয়াটা হতো শান্ত, নির্লিপ্ত-বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের আবহাওয়াটা যে-রকম। আঁকি কষবার সময় আমরা যে-রকম স্থির অবিচলিত, বৈপ্লবিক আওয়াজ তোলবার সময় তো আর তা নাই। তার কারণ, গণিতের হিসেবা-নিকেশের খুঁটি হলো বাস্তববােধ, আর বৈপ্লবিক চেষ্টার ভিত্তিতে নির্জনের আবেগ।
এর পরও যদি আপনি নেহাত নাচার না হন তাহলে হয়তো প্রশ্ন তুলবেন: তাহলে সব দেশে সব যুগে তুমুল বৈপ্লবিক আন্দোলন চলছে না কেন ? বিদেশী শাসক না থাকলেও অন্তত স্বদেশী শাসক তো সর্বত্রই; বিদেশী শাসকের তবে দিন কাটে এমন দৃষ্টান্তও তো কম নয়। অর্থাৎ, ফ্রয়েডীয় পিতৃ-প্রতীক তো সর্বত্রই এবং ফ্রয়েডীয় মতে নির্জনের অন্ধ পিতৃদ্রোহটাও এমন কিছু একটা বিশেষ কালের মানব মনস্তত্ত্বের লক্ষণ নয়! অথচ, ইতিহাস-বিচারে দেখতে পাওয়া যায় যখন—তখন বিপ্লব হয় না, বৈপ্লবিক আন্দোলনের জন্যে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির প্রয়োজন। এবং বৈপ্লবিক পরিস্থিতি বলতে একান্ত বাস্তব, একান্ত পার্থিব জিনিস বোঝায়-মোহমুক্ত সমাজতত্ত্ববিদ নিখুঁত বৈজ্ঞানিক হিসেব করে তার নিভুল রূপ নিৰ্ণয় করতে পারেন। এই যুক্তি ফ্ৰয়েডপহীকে হয়তো কিছুটা টলাতে পারে। তবুও তিনি নিশ্চয়ই আত্ম-প্ৰকল্প-ভ্ৰষ্ট সহজে হবে না। হয়তো জবাব দিয়ে বলবেন, এ-কথা অস্বীকার করে কী হবে যে বৈপ্লবিক পরিস্থিতি ছাড়া বৈপ্লবিক আন্দােলন হয় না। তবুওই পরিস্থিতিটুকুকেই বৈপ্লবিক আন্দোলনের মূল কারণ বলা চলবে না। মূল কারণ নির্জন আবেগের গরমিল, যে-গরমিল অন্য বাস্তব পরিস্থিতি পেলে তাকে আশ্রয় করে রাজনৈতিক বিপ্লব সৃষ্টি করে, বাস্তব পরিস্থিতি না পেলে অন্য কিছুকে অবলম্বন করে অন্য পথে আত্মচরিতার্থতা অন্বেষণ করে। উপমা দিয়ে ফ্রয়েডপন্থীর বক্তব্যটুকু ব্যাখ্যা করা যায়: অন্ধকার পথে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে কেউ হয়তো একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। অন্ধকার না থাকলে বা হাতে গাড়ি না থাকলে দুর্ঘটনা ঘটতো না নিশ্চয়ই। কিন্তু এগুলিই তো দুর্ঘটনার কারণ নয়। আসল কারণ হলো, চালকের মত্ত অবস্থা। হাতে গাড়ি না পেলে অন্য কিছুকে অবলম্বন করে অন্য কোনোভাবে তার মাতলামি আত্মপ্ৰকাশ করতে হয়ত! (৪)
এ কথা অবশ্যই স্পষ্ট যে বৈপ্লবিক রাজনীতি সম্বন্ধে ফ্রয়েডীয় মন্তব্যগুলি তার কয়েকটি মূল প্রকল্পের নিগমন-বিশেষ। ফলে সেই মূল প্রকল্পগুলি নিয়ে আলোচনা তোেলবার আগে রাজনৈতিক উৎসাহ সম্বন্ধে ফ্রয়েডীয় মতবাদের পূর্ণাঙ্গ জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। এবং আত্ম-অভিজ্ঞতার পুনরুল্লেখ-প্রচেষ্টা জবাবদিহির মতো শোনাবে, জবাব হবে না। আপাতত তাই পূর্ণাঙ্গ জবাব দেবার চেষ্টাও করবো না, জবাবদিহির চেষ্টাও নয়। কিন্তু এখানে ফ্রয়েডপন্থীদের আত্মপক্ষ-দোষটুকু বৰ্ণনা করা অন্তত চিত্তাকর্ষক হবে। আত্মপক্ষ-দোষ বলতে বোঝাতে চাই, রাজনৈতিক উৎসাহের এই বিশ্লেষণকে যদিও আপাতত রাজনীতি-নিরপেক্ষ হবার ডাক বলে ভ্রম হতে পারে, তবুও প্রকৃতপক্ষে এর অর্থ দাঁড়ায় এক নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতী হবার উমেদারিই। আর তাছাড়া যতো দিন যাচ্ছে ততোই বাস্তব রাজনীতিতে ফ্রয়েডপন্থীরা পক্ষপাতটুকু প্রকট থেকে প্রকটতর। হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ, মতবাদগত তাৎপর্যের দিক এবং বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিক—দুদিক থেকেই ফ্রয়েডপন্থীরা রাজনৈতিকভাবে মোটেই অনাসক্ত এবং অপক্ষপাতী নন, এক সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক পক্ষের apologists মাত্র। এই কথাটি মনে না রাখলে ফ্রয়েডতত্ত্বের স্বরূপ স্পষ্টভাবে বুঝতে পারাই সম্ভব হবে না।
মতবাদগত তাৎপর্যের দিক থেকে ফ্রয়েডবাদের রাজনৈতিক পক্ষপাতটা কীট-রকম প্ৰথমে তার আলোচনা করা যাক।
ফ্রয়েডপন্থী বলছেন, রাজনীতি নিয়ে উৎসাহটা সুস্থ আর স্বাভাবিক মনের পরিচয় নয়। কিন্তু এ-কথায় তো কোনো সন্দেহ নেই যে বাস্তব সমাজে, বাস্তব পৃথিবীতে, রাজনীতি বলে ব্যাপারটা একটা ধ্রুব সত্য। ফ্রয়েডীয় মতে, রাজনীতির মধ্যে সুস্থ মনের পরিচয় থাক আর নাই থাক বাস্তবভাবে প্রত্যেক যুগের মতো আজকের দিনেও একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবার আয়োজন করছে। এ-ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে রাজনৈতিক নিরুৎসাহের একমাত্র অর্থ কী হবে ? বাস্তবভাবে আমাদের জীবনের উপর যে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বর্তমান তাকেই মাথা পেতে মেনে নেওয়া, তাকে বদল করবার বা উচ্ছেদ করবার আয়োজনে যোগ না দেওয়া। অর্থাৎ, রাজনীতি সম্বন্ধে নিরপেক্ষ হবার প্রসঙ্গটা শেষ পর্যন্ত বর্তমান শাসক সম্প্রদায়ের রাজনীতিটাকে মাথা পেতে স্বীকার করে নেয়ার নির্দেশই। মেনে নিতে যদি আপনি অস্বীকার করেন, তাহলে ফ্ৰয়েডপন্থী এই অস্বীকারকে আপনার শৈশবের অন্ধ পিতৃদ্রোহের বিকাশ বলে বর্ণনা করবেন। তাই, দেশটাকে যে রাজনৈতিক দল যেমনভাবেই শাসন করুক না কেন, আপনি শুধু সে-সম্বন্ধে উদাসীন থাকুন, তাদের দিন ঢালাও সুযোগ।
তার মানে, রাজনীতি সম্বন্ধে আপাত-নিরপেক্ষতাটুকু নির্দিষ্ট এক রাজনৈতিক শাসনকে স্বীকার করে নেবার উমেদারি ছাড়া আর কী? দেশের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণটা তো আর ফ্রয়েডীয় ভাষায় মানসিক যাথার্থ্য (psychical reality) নয়, এক অতি Kot o ostoj-šPGC53 vrst: material reality ভূতের ভয়ের মতো শুধুমাত্র মানসিকভাবে যদি যথার্থ হতো তাহলে না হয় মনস্তত্ত্বমূলক কোনো পদ্ধতিতে তার সঙ্গে বুঝবার অন্তত আশ্বাসটুকুও পাওয়া যেতো। কিন্তু বাস্তব যথার্থ সম্বন্ধে অপক্ষপাতী হবার একমাত্র তাৎপর্য হলো তাকে স্বীকার করে নেওয়া, বড় জোর এই স্বীকৃতির দুর্ভোগকে ভুলে থাকবার একটু-আধটু আয়োজন করা।
সদরদের দিয়ে রাজনৈতিক উৎসাহ-মাত্রকে নির্বাসন দেবার যে-আয়োজন তারই বাস্তব পরিণতি হলো খিডকিদোর দিয়ে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমর্থনকে গোপন আমন্ত্রণ পাঠানো। তার মানে, রাজনীতি বিষয়ে এই নিরুৎসাহ-প্রচারটা আসলে এক সুনির্দিষ্ট রাজনীতির পক্ষে উৎসাহ-প্রচারেরই পরিণতি। প্রসঙ্গত বলা যায়, আজকের দিনে মতবাদগত সংগ্রামের ক্ষেত্রে অনুরূপ দৃষ্টান্ত দুর্লভ নয়। বুর্জেয়া শ্রেণীর পোষকতা-পরিপুষ্ট দার্শনিকেরা বুর্জোয়া-দর্শনেরই অনিবার্য প্রচারক, তবুও প্রচার কাজের কায়দা-কানুনটা আজ অভিনব। বুর্জোয়া জীবনাদর্শকে গ্ৰহণ করবার কথাটা তারা আর জোর গলায় বলছেন না, তার বদলে বলছেন সংশয়বাদের কথা: মানুযের সত্যান্বেষণ নিস্ফলতায় পর্যবসিত, জীবনের কোনো রকম মূল্য নির্ণয় করতে যাওয়াটাই আত্মপ্ৰবঞ্চনার নামান্তর। হালের তথাকথিত ‘পসোটিভিস্ট” থেকে শুরু করে “এক্সিসটেনসিয়ালিস্ট’ দৰ্শন পর্যন্ত সর্বত্রই এই কথা। যুক্তিতর্কের এতো রকম আর এতো সংকীর্ণ সব অলিগলি ঘুরিয়ে পাঠক-সাধারণকে এক অর্থহীনতার মুখোমুখিনিয়ে যাবার এমন কায়দা, সহজবুদ্ধিকে বিপর্যন্ত করবার এমন অপরূপ আয়োজন, যে দেখে তাক লেগে যায়। এতো মার্জিত, এমন সূক্ষ্ম, এমন নির্লিপ্ত যুক্তিতর্কের পেছনে যে কোনো রকম স্থূল শ্রেণীস্বর্থ লুকোনাে থাকতে পারে তা সন্দেহ করতে যাওয়াই যেন সন্দেহ-বাতিকের পরিচয়। অথচ, শ্রেণী:স্বার্থ একটা রয়েছেই।-যদিও প্রকটভাবে নয়, প্রচ্ছন্নভাবে। এবং এই শ্রেণী:স্বার্থকে দেখতে না পাওয়া অন্ধতারই প্ৰমাণ। কেননা, আজকের দিনে বাস্তব পরিস্থিতিটা ঠিক কী রকম তা একবার ভেবে দেখুন। বুর্জেয়া শাসনের কৃপায় বুর্জোয়া জীবন-দর্শন আজকের আকাশে বাতাসে মিশে রয়েছে; ইস্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে ছাপাখানা-সিনেমা রেডিও পর্যন্ত সবকিছুর মাধ্যমে এই দর্শনকে প্রচার করবার প্রকট বা প্রচ্ছন্ন আয়োজন। এ-হেন পরিস্থিতিতে আপনাকে যদি বুঝিয়ে দেওয়া যায় দার্শনিক প্রচেষ্টাটুকু পণ্ডশ্রমেরই নামান্তর-মাত্র তাহলে কি ওই বুর্জেয়া দর্শন আরো নিষ্কণ্টক, আরো নিরাপদ হবার সুযোগ পাবে না? আপনি তো হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন, দার্শনিক বিচারের চেষ্টা আর করবেন না। আর এই বিচার-বিতৃষ্ণার সুযোগে আপনার মনে আপনার পারিপাশ্বিকে প্রচলিত জীবনদর্শনটি নিরুপদ্রবে। বাসা বাঁধতে পারবে।
রাজনীতি সম্বন্ধে ফ্রয়েডপন্থীর যে-ভঙ্গি তার বাস্তব পরিণতিও এই রকমই নয় কি?
কিন্তু শুধু ওইটুকুই নয়। শুধু যে ওই রকম খিড়কিদের দিয়ে বর্তমান শাসনব্যবস্থার সমর্থনকে গোপনে আমন্ত্রণ জানানো তাই নয়। বাস্তবভাবে দেখলে দেখা যায়। যতোই দিন যাচ্ছে ততোই ফ্রয়েডপন্থীরা সোজাসুজিভাবে, স্পষ্টাস্পষ্টিভাবে, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করছেন। ফ্রয়েডীয় মতবাদের মূল কথাগুলি আলোচনা করলে দেখতে পাবো কেমনভাবে তার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির প্রচ্ছন্ন সমর্থন। কিন্তু সে-আলোচনা পরে তোলা যাবে। আপাতত দেখা যাক ফ্রয়েড এবং ফ্রয়েডপন্থীদের স্পষ্ট এবং সোজাসুজি রাজনৈতিক উক্তিগুলির কথা। এই উক্তিগুলি মোটেই রাজনীতি নিরপেক্ষতার পরিচয় নয়। তার বদলে, স্পষ্টাক্ষরে পুঁজিবাদী রাজনীতির সমর্থনমাত্র, কিংবা, যা একই কথা, মেহনতকারী জনগণের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রচার মাত্র।
অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বাস্তব পৃথিবীতে দিনের পর দিন পুঁজিবাদের পরমায়ু নিঃশেষ হয়ে আসছে। তার মানে, উলটো দিক থেকে বললে বলা যায়, দিনের পর দিন সমাজতন্ত্রের শক্তি হয়ে উঠছে দুর্বার, দুৰ্জয়। বছর বিশেক আগেকার পৃথিবীর অবস্থার সঙ্গে আজকের পৃথিবীর অবস্থােটা তুলনা করুন, এই বাস্তব সম্বন্ধে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। আর তাই, পুঁজিবাদের যাঁরা প্রচারক তাদের অবস্থা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া, মরিয়া। ফলে তারই অপর পিঠে সমাজতন্ত্রের সমালোচনাটা পরিণত হচ্ছে নোংরা খিস্তি-খেউড়ে।
প্ৰায় বিশ বছর আগে স্বয়ং ফ্রয়েড সমাজতন্ত্র এবং মার্কসবাদের যে-সমালোচনা করেছেন তাঁর সঙ্গে আজকের দিনের ‘আন্তর্জাতিক সাইকো এ্যানালিটিক্যাল সোসাইটির’ সভাপতি আর্নসট জোনস-এর উক্তির তুলনা করুন।
প্ৰায় বিশ বছর আগে (১৯৩২-এ) ‘জীবনের দর্শন’ শীৰ্ষক প্ৰবন্ধ (৫) লেখবার সময় ফ্রয়েড বলছেন তাঁর–মনঃসমীক্ষণ বা সাইকোএ্যানালিসিসের–দার্শনিক মত (weltanschauung) আর কিছুই নয়—বৈজ্ঞানিক বিশ্বালোচনের নামান্তরমাত্র। এই বিশ্বালোচনের সমর্থন করতে গেলে বিপরীত বিশ্বালোচনের দাবি-অর্থাৎ, বিজ্ঞান বিরোধী বিশ্বালোচনের দাবি-খণ্ডন করা দরকার। এবং আধুনিক যুগে প্রচলিত বিজ্ঞান-বিরোধী বিশ্বালোচনের দাবি বলতে ফ্রয়েড প্রধানত দুটি মতের আলোচনা তুলছেন। এক হলো, “থিয়ােরি অফ রিলেটিভিটি’, যা কিনা ফ্রয়েডের মতে বিজ্ঞানের ঘরে জন্মেও বিজ্ঞানকে ধবংস করবার কাজে এক-রকম কালাপাহাড়ী উৎসাহে মেতে উঠেছে, প্রচার করতে শুরু করেছে বাস্তব বিশ্ব সম্বন্ধে সুনিশ্চিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সম্ভব নয়। রাজনীতিতে নৈরাজ্যবাদের মতোই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই ‘থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির’ অনাচার! এবং বিজ্ঞান-বিরোধী দ্বিতীয় মতবাদ হিসেবে তিনি উল্লেখ করছেন মার্কসবাদের। অবশ্যই বিনয়ের অভাব নেই। তিনি বলেছেন “এ-বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত জ্ঞানের যে-অভাব সে-সম্বন্ধে আমি গভীরভাবে দুঃখিত।” এবং এক আধা-অভিনন্দনের ভঙ্গিতেই স্বীকার করেছেন, “মার্কস্বাদের আসল যেটা জোর সেটা অবশ্যই তার ইতিহাস সম্বন্ধে মতবাদ নয়, কিংবা এই মতবাদের ভিত্তিতে মার্কসবাদ যে-ভবিষ্যদ্বাণী করে তাতেও নয়; আসলে সেই জোরটা হলো, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমনভাবে তার বুদ্ধিগত, নীতিগত এবং শিল্পগত প্ৰতিক্রিয়াগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে সে-বিষয়ে স্পষ্ট অন্তদৃষ্টি। মার্কসবাদ আবিষ্কার করলো পারস্পরিক সম্বন্ধ এবং কার্যকারণ সম্বন্ধের এমন একটি গুচ্ছ যাকে ইতিপূর্বে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই অগ্রাহ্য করা হয়েছে।” (স্বাধীন তর্জমা, আক্ষরিক নয়)। কিন্তু, ফ্রয়েড বলছেন, মার্কস-এর কয়েকটি বক্তব্য আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়, মনে হয় এগুলি বস্তুবাদী তো নয়ই, বরং কুট হেগেল-দর্শনের অবশেষমাত্র। যেমন সামাজিক গড়নের বিবর্তন প্রাকৃতিক ইতিহাসের পরিণামমাত্র, কিংবা সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধারা ডায়ালেকটিক পদ্ধতি মেনে চলে। তাছাড়া মার্কসবাদে শ্রেণী সংগ্রামের যে-কথা তাও ভ্রান্ত। কেননা ফ্রয়েডের মতে ইতিহাসের শুরু থেকেই বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে যে-সংঘাত তারই ফলে সামাজিক শ্রেণীর জন্ম হয়েছে এবং এই সংঘাতে যে-গোষ্ঠী বিজয়ী হয়েছিলো তার সম্পদ ছিলো দুরকম। এক হলো মানসিক সম্পদ; যেমন, জন্মগত আক্রমণ-বৃত্তি। আর দুই, পার্থিব সম্পাদ: যেমন ভালো অস্ত্রশস্ত্র। তাছাড়া মার্কসবাদের বিরুদ্ধে ফ্রয়েডের মূল আপত্তি হলো অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দিতে গিয়ে মার্কসবাদ অন্যান্য বিষয়ের কথা ভুলে যায়, ভুলে যায় মনস্তত্ত্বের কথা, ঐতিহ্যের কথা। ইত্যাদি।
মার্কসবাদের বাস্তব প্রয়োগ রুশ বলশেভিজম-এ। ফ্রয়েড তাই বলশেভিজম-আলোচনাও তুলছেন। বলছেন, বলশেভিজম-এর উৎসে বিজ্ঞানের প্রেরণা, কিন্তু তার বাস্তব পরিণতি হলো বিজ্ঞানবিরোধে, ধর্মমোহে। ধর্মমোহের লক্ষণটা কী? এক হলো, স্বাধীন চিন্তার বিরুদ্ধে কড়া রকম হুকুমজারি: ইসলাম ধর্মের কাছে কোরান যে-রকম, বলশেভিকদের কাছে সেই রকমই মার্কসীয় গ্রন্থ। দুই হলো, দীনদরিদ্রের কাছে সোনালী ভবিষ্যতের আশ্বাস। ধর্মের মতোই বলশেভিজম বলে, জনগণের উপস্থিত (অর্থাৎ পূর্ণ সাম্যব্যবস্থা প্রবর্তিত হবার আগে পর্যন্ত) যতো অভাব, যতো দুঃখকষ্ট, তা দুদিন পরে শেষ হবে— ইহকালের মতো পরকালে আর অপূর্ণ বাসনার তাড়না থাকবে না। তর্ক তুলে বলশেভিকরা হয়তো বলবেন, আমরা তো আর ইহলোক-পরলোকের তফাত করি নে-আমরা বলি ইহলোকেই, এই পৃথিবীতেই, জনগণের সুদিন আসন্ন হয়েছে। উত্তরে ফ্রয়েড বলছেন, এহেন কথাও নতুন কথা নয়। মনে রাখতে হবে ইহুদীদের ধর্মে পরকালের যে সোনালী ছবি তাও কোনো পরলোকের কথা নয়—ইহলোকেই, এই পৃথিবীর বুকেই। অবশ্যই ফ্রয়েড বিনয় করে বলছেন, বলশেভিজম-এর সব কথা তার ভালো করে জানা নেই, এবং এই তথ্যাভাবের জন্যে তিনি বিশেষ দুঃখিত।
সমাজতন্ত্রের মতবাদ এবং বাস্তব প্রয়োগ-থিয়োরি এবং প্র্যাকটিস সম্বন্ধে এই হলো স্বয়ং ফ্রয়েডের সমালোচনা! নজর করলে দেখা যায়। এ-সমালোচনায় নতুন কথা একটিও নেই। বুর্জোয়া মহলের পণ্ডিতেরা মার্কসবাদের মধ্যে কুট হেগেল-দর্শনের ভগ্নাবশেষ থেকে শুরু করে সোভিয়েট সমাজে নব্য ধর্মমোহের অভু্যত্থান পর্যন্ত প্রত্যেকটি কথাই বহুবার বলেছেন। এবং এই সব সমালোচনার অন্তঃসারশূন্যতা বহুবারই দেখানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সমাজতন্ত্রবাদী গ্রন্থাবলীর সঙ্গে যার কিছুটাও পরিচয় আছে তার কাছে এই সব সমালোচনার প্রত্যুত্তর পুনরুক্তি-মাত্র হবে। আপাতত তাই সে-চেষ্টা করবো না। তার বদলে, ফ্রয়েডীয় সমালোচনার একটি বৈশিষ্ট্যের নজর দিতে বলবো ।
কি-রকম একটা উদার দরাজ আর বিনয়ী ভাব দেখুন: মার্কসবাদ তো সব একেবারে মিছে কথা নয়, এর মধ্যে কিছু কিছু সত্যি কথাও তো আছে। অবশ্যই, যে-সব কথায় বুর্জোয়া-শ্রেণীর আশু সর্বনাশ-সম্ভাবনা সেগুলির প্রতি একটুও দরাজ ভােব নয়: শ্রেণী-সংগ্রামটা ভুল, ইতিহাসের বিচারটা ভুল, আগামীকাল ইতিহাস কোন রূপ নেবে তার হিসেবটাও ভুল। মেজাজ যতোই উদার আর দরাজ হোক না কেন, বুর্জোয়াশ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে এই কথাগুলোর সংঘর্ষ যে বড়ো প্রকট। তাই মার্কসবাদের আপাত-নিরীহ কিছু দাবিকে সত্যের সম্মান দেওয়া যায়: মূল কথাগুলিকে মিথ্যা বলে বিষদাঁতটা ভেঙে দেওয়া গেলো, তারপর ওই ভদ্রলোক সাপটািকে কিছুটা দুধকলা খাইয়ে উদার মনোভাবের পরিচয় দেওয়া হলো।
স্বয়ং ফ্রয়েডের রচনায় এই উদার দরাজ ভাবটার দিকে বিশেষ করে নজর রাখতে বলছি, তার কারণ পুঁজিবাদের তরফের পণ্ডিতদের পক্ষে বিশ বছর আগে এমনতরো একটা ভঙ্গির অবকাশ তবু ছিলো। আজকের দিনে আর তা নেই। কেননা, প্রথম মহাযুদ্ধের পরেও বুর্জোয়াদের মনে টিকে যাবার যেটুকু ক্ষীণ আশা ছিলো। আজ তাও শেষ হয়েছে। অপর পক্ষে, বুজোয়াদের চােখে সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ তখনও পর্যন্ত অল্পবিস্তর অনিশ্চিত ছিলো: কিন্তু যতোই দিন যাচ্ছে ইতিহাস ততোই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতরভাবে প্রমাণ করছে, এই অনিশ্চয়তার উপর নির্ভর করতে যাওয়াটা অলীক আত্মপ্ৰবঞ্চনাকে আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা মাত্র। আজকের দিনে বুর্জেয়া তরফের প্রচারে তাই এমন উদার দরাজ আর বিনয়ী ভাবের বদলে বেপরোয়া আর মরিয়ার ভাব ।
বিশ বছর আগের মতোই-স্বয়ং ফ্রয়েডের মতোইআজকের দিনের ফ্রয়েডপন্থীরাও বুর্জেয়া রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরতে চান। কিংবা, যা একই কথা, সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচারে যোগ দিতে চান। কিন্তু সেকালের ছকে বাধা আপাত মোলায়েম বুর্জেয়া সমালোচনাগুলির পুনরুক্তি করার মতো মনের সম্পদটুকু ফুরিয়ে গিয়েছে। তাই সোজাসুজি গালাগালির পথ! প্রায় খিস্তি-খেউড়ের পথ। সেকালের মতো। আপাত-নিরপেক্ষতার ভঙ্গি কিসের সাহসে পাওয়া যাবে? তাই সোভিয়েটের মানুষদের নেহাত পাগল-ছাগল প্ৰতিপন্ন করবার চেষ্টা, সমাজতন্ত্রের নেতাদের মনে কোন মনোবিকারের তাড়না তারই কল্পিত বৰ্ণনা দেবার চেষ্টা, এবং সমাজতন্ত্রের প্রভাব থেকে পৃথিবীকে (অর্থাৎ বুর্জোয়াকে) বাঁচাতে গেলে কোন ধরনের কায়দা-কানুন অনুসরণ করতে হবে তাই নিয়ে মাথা ঘামানো।
নমুনা তোলা যাক।
বর্তমানকালে, ফ্রয়েডপন্থীদের মহাগুরু হলেন আর্নস্ট জোন্স। সম্প্রতি “আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য সম্মেলনে” বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রুশ জনসাধারণের মনে এমন যে উৎকণ্ঠার জের (উৎকণ্ঠােটা সোভিয়েট জনগণের মনে, না বুর্জেয়া প্রচারকের মনে ? সাইকো এ্যানালিসিসের ভাষায় এর নাম projection নয় তো?) তার কারণ হলো, ওদের মনে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে এক পাপবোধের উৎপাত। পাপবোধটা এলো কোথা থেকে? কিসের পাপ ? জোন্স বলছেন, পিতৃহত্যার মহাপাপ। ওরা ওদের ছোট্ট পিতা জারকে খুন করেছে যে!(৬)
বলাই বাহুল্য, আপাত-বৈজ্ঞানিক শব্দ-সম্ভার সত্ত্বেও এ-জাতীয় উক্তির বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব নেহাতই শূন্য। এমন কি পাল্টা প্রশ্ন করে এ-কথা তোলাও পণ্ডশ্রম যে চার্লসকে হত্যা করার ফলে ইংরেজ জনসাধারণের মনে পাপবোধ আর উৎকণ্ঠার তাড়না দেখা দেয়নি কেন, কেন দেখা দেয়নি ওই পাপবোধ আর উৎকণ্ঠা ফরাসীদের মনে-তারাও তো বিপ্লবের সময় তাদের “ছোট্ট পিতা”-কে খুন করতে কসুর করেনি!! মুসোলিনীকে হত্যা করবার দরুন ইতালির জনগণও কি ওই ফ্রয়েডীয় পাপবোধের বোঝায় পাগল হয়ে যাবে? পাগল হয়ে যাবে কি চীনের জনগণ চিয়াংকাইশোককে নির্বাসনে পাঠিয়ে ? এ-সব প্রশ্ন তোলা সত্যিই পণ্ডশ্রম। কেননা জোন্স-এর উক্তি বিজ্ঞানের ধারকছে ঘেঁষে। না, ইতিহাস বা সমাজতত্ত্ব নিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার পরিচায়কও নয়—খোলাখুলি রাজনৈতিক অপপ্রচার মাত্র, কেবল আপাত বৈজ্ঞানিক কিছুটা রঙ চড়িয়ে প্রচারটাকে চটকদার করবার চেষ্টা। আর, রাজনৈতিক প্রচার হিসেবে কতোখানি খেলো, কী রকম শাস্তা! ওর মধ্যে মোদ্দা কথা দুটাে। প্রথমত, রুশ বিপ্লব পিতৃহত্যার মতোই মহাপাতক। আর দুই হলো, সোভিয়েটের মানুষগুলো নেহাতই যেন পাগল-ছাগল; তারা যে আজ দুনিয়ার মেহনতকারী মানুষকে অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যুদ্ধ-চক্রান্তের বিরুদ্ধে আগুয়ান হবার নেতৃত্ব দিচ্ছে তার আসল কারণ, তাদের মনের কোণায় মনোবিকারের তাড়না।
নিজের প্রিয়তম শিষ্যকে এমন খোলাখুলিভাবে একটা বিশেষ রাজনীতি নিয়ে কোমর বাঁধতে দেখলে স্বয়ং ফ্রয়েড হয়তো লজ্জিতই হতেন; তার কারণ এই নয় যে ফ্রয়েড নিজে এই রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করেননি। তার কারণ হলো এই যে, ফ্রয়েডের সময় দিনকাল এমন ‘খারাপ’ হয়ে পড়েনি। তখনও পর্যন্ত একটা উদার, দরাজ ভাব, একটা মোলায়েম আপাত-নিরপেক্ষ মুখোশ পরা সম্ভব হতো—ওই নির্দিষ্ট রাজনীতির প্রচারক হওয়া সত্ত্বেও সম্ভব হতো। আজকের দিনে তা আর চলছে না। এ-কথায় তো কোনো সন্দেহ নেই যে জোন্স-ই আজকের দিনে সবচেয়ে প্ৰবীণ এবং সবচেয়ে সৌম্য-শান্ত ফ্রয়েডপন্থী। তাঁরই এই দশা।
তাঁরই যখন এই দশা তখন ছোটোখাটো ফ্রয়েডপন্থীদের রাজনৈতিক তাণ্ডব যে অনেক বেশি বীভৎস হয়ে দাঁড়াবে তাতে আর সন্দেহের অবকাশ কোথায়? এই তাণ্ডবের লীলাভূমি আজ মার্কিন মুলুকে। ফ্রয়েডপন্থীদের পক্ষে এতো পত্রিকা প্রকাশ করবার, এতো বই লেখবার ধূম কোথাও নেই। সেই সব পত্রিকার পাতাগুলি উল্টে যান, উল্টে দেখুন বইগুলির আলোচ্য বিষয়। দেখবেন, কোনো অজ্ঞাতকুলশীল ফ্রয়েডপন্থী হয়তো মলটভ-এর মানসিক রোগটা নির্ণয় করবার চেষ্টা করছেন, কেউ বা স্টালিনের। পৃথিবীর বুক থেকে সাম্যবাদের উপদ্রব কেমন করে দূর করা যায় তার আলোচনাও কম নয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজ যুদ্ধ না বাধিয়ে টিকতে পারে না, তাই ফ্রয়েডপন্থীদের লেখায় যুদ্ধবাদের প্রচার। মনে রাখতে হবে, সাম্প্রতিক ফ্রয়েডবাদের আজ প্রথম ও মূল আলোচ্য বিষয় হলো মানবমনের জিঘাংসা (aggression)। এই জিঘাংসাই নাকি মানুষের সবচেয়ে প্রাথমিক সহজবৃত্তি। (৭)
তর্ক তুলে কেউ হয়তো বলবেন, যদিই বা মেনে নেওয়া যায় আজকের দিনে মার্কিন মুলুকে রাজনৈতিক উৎসাহে ফ্রয়েডবাদের ব্যবহারটা খুব বেড়েছে, তাহলেই তো সেটা ফ্রয়েডবাদের কোনো নিজস্ব দোষ হবে না। যুদ্ধবাদীরা আণবিক বিজ্ঞানকে যুদ্ধের কাজে নিয়োগ করতে চাইছে, কিন্তু অপরাধটা কি আণবিক বিজ্ঞানের? পূর্বপক্ষ হয়তো বলবেন, ফ্রয়েডবাদ একটা বৈজ্ঞানিক মতবাদ মাত্র; সেটা ভুল হতে পারে, ভুল না। হতেও পারে। কিন্তু তার প্রয়োগ-অপ্ৰয়োগের কথাটা একেবারেই স্বতন্ত্র। সে-কথা তুলে এই মতবাদকে সমালোচনা করতে যাওয়া বৈজ্ঞানিক মেজাজের পরিচয় নয়।
উত্তরে বলবো, এ-তুলনাটা ঠিক হলো না। কেননা ফ্রয়েডবাদের নিজস্ব ধর্মই এমন যে ওই নির্দিষ্ট রাজনীতির সঙ্গে তার নাড়ির যোগ। এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা, এমন সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌছানো, যে এই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ব্যবহারের জন্যে তৈরি জমি যেন। তার মানে ফ্রয়েডবাদ এবং ফ্রয়েডবাদের রাজনৈতিক প্রয়োগকে আলাদা করা যায় না, যেমন হয়তো আণবিক বিজ্ঞানের বেলায় অন্তত চেষ্টা করা যেতে পারে। অবশ্য এই কথা স্পষ্টভাবে প্ৰতিপন্ন করবার জন্যে ভবিষ্যতে ফ্রয়েডবাদের মূলসূত্রগুলির আলোচনা তোলা দরকার হবে।
কিন্তু আপাতত যে-আলোচনা হচ্ছিলো: রাজনৈতিক উৎসাহের বিরুদ্ধে যুক্তি নিয়ে আলোচনা। উত্তরে স্বপক্ষ-দােষের কথা তুলেছি: ফ্রয়েডবাদের নিজস্ব রাজনৈতিক উৎসাহ। এই উৎসাহের প্রকাশ দুদিক থেকেই। ব্যঞ্জনার দিক থেকে এবং সোজাসুজি রাজনৈতিক পক্ষপাতের দিক থেকে। কেবল, রাজনীতিটা একটা নির্দিষ্ট রাজনীতি—বুর্জোয়া রাজনীতি—এই যা বৈশিষ্ট্য।
আমাদের দেশে চলতি কথায় বলে: পাঁচ কড়ায় গণ্ডা গুনছিস কেন ? না, আমি যে ন্যাকা। তিনি কড়ায় গোন না! —না, আমার যে কম হবে!