৯. তিমিশোয়ারার রহস্যময় পাদ্রী

তিমিশোয়ারা শহরের বাইরে গ্রামের এক কৃষকের বাড়িতে পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো আকাশের। আগের দিন দুপুরে ও এসে পৌঁছেছে তিমিশোয়ারায়। এলেনার কথা মতো কালো গোলাপের ঠিকানায় ঠিক মতোই এসেছিলো ও। ফুলওয়ালা ছেলেটা ওকে পুরোনো গির্জার ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পর পাদ্রী স্টেফান ওকে স্বাগত জানিয়েছেন। পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা ঘরে। হাসি মুখে বুড়ো পাদ্রী বললেন, এলেনার কাছে তোমার কথা শুনে ভাবলাম তোমাকে কিছু খবর দেয়া দরকার।

এলেনার জন্য খুবই চিন্তিত ছিলো আকাশ। বললো, আপনারা কি খবর পেয়েছেন এলেনাকে যে গুপ্ত পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে?

খবর পাবো না কেন? মুখ টিপে হাসলেন পাদ্রী স্টেফান-খবর যে আমরাই তৈরি করেছি।

তার মানে এলেনা নিখোঁজ হয় নি?

অফিসিয়ালি ও কয়েকদিন নিখোঁজ থাকবে। তবে এখন ও আমাদের সঙ্গেই আছে।

পাদ্রীর রহস্যজনক কথাবার্তায় খুবই অবাক হলো আকাশ–দয়া করে সব কথা খুলে বলুন তো ফাদার। এলেনা কেন নিখোঁজ থাকবে? আপনারাই বা কারা?

আগে তোমাকে কফি খাওয়াই। ঠাণ্ডার ভেতর এতটা পথ এসেছো। ফেরার নিশ্চয় তাড়া নেই। এই বলে গুটিগুটি পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন বুড়ো পাদ্রী।

এলেনার জন্য উদ্বেগ কেটে যাওয়ার পর আকাশের মনে হল শুধু কফি নয়, ওর কিছু খাওয়ার দরকার। বেশ খিদে পেয়েছে। সকালে শুধু এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস আর দুটো আধসেদ্ধ ডিম খেয়ে বেরিয়েছে। গাড়ি আনে নি ও। কারো নজরে পড়তে চায় না বলে বেরিয়েছিলো হোটেলের পেছনের রাস্তা দিয়ে। ট্রেনে ছঘন্টা লেগেছে আসতে।

আকাশের চেহারা দেখেই বুড়ো পাদ্রী টের পেয়েছিলেন ওর কিছু খাওয়া দরকার। মিনিট পনেরো পর ঘরে ঢুকলেন ট্রে হাতে। আকাশের সামনে ছোট্ট টেবিলে রাখলেন একটুকরো বাদামী রুটি, দুটো সসেজ ভাজা আর ধোঁয়া ওঠা এক কাপ কফি। বললেন, তুমি খেতে থাকো, আমি বলছি।

দেয়াল ঘেষে রাখা সাদা চাঁদরে ঢাকা সরু বিছানায় বসে স্টেফান বললেন, এলেনাকে আমরা লুকিয়ে রেখেছি সরকারকে জব্দ করার জন্য। তোমার মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ লোকের দোভাষী দিনে দুপুরে নিখোঁজ হয়ে যাবে আর এটা বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকায় খবর হবে না তা কি হয়! আজ সকালে আরও পাঁচজন দোভাষী নিখোঁজ হয়েছে। ফ্রান্স আর ইটালী থেকে দুটো ট্রেড ডেলিগেশন এসেছে পরশু। ওদের চারজন দোভাষী নিখোঁজ। কানাডিয়ান এ্যাম্বাসাডরের দোভাষীও নিখোঁজ।

এরা সবাই কি আপনাদের লোক? খেতে খেতে জানতে চাইলো আকাশ।

অবশ্যই। একটু থেমে স্টেফান ধীরে ধীরে বললেন, চসেস্কুর সিকিউরিতায় দুটো গ্রুপ হয়ে গেছে। এক গ্রুপ চসেস্কুর পক্ষে, আরেক গ্রুপ বিপক্ষে। বিপক্ষের গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে রাশানরা। জানো নিশ্চয়, রাশানরা চসেস্কুকে মোটেই সহ্য করতে পারছে না। যে কোনো সময় ওরা একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে।

আপনারা কারা? আপনারা কি চান?

আমরা নিরীহ ধর্মপ্রচারক। একগাল হেসে পাদ্রী স্টেফান বললেন, ঈশ্বরের নাম আর মহিমা প্রচার করি। যিশুর শান্তির বাণী শোনাই। আত্মার স্বাধীনতার কথা বলি। ওরা আমাদের ধর্ম প্রচার করতে দেয় না। আমরা ওদের কথা মতো চলতে রাজি নই। ঈশ্বরের পৃথিবীতে কারো অধিকার নেই ঈশ্বরের নাম প্রচারে বাধা দেয়।

আপনারাও তাহলে চান না চসেস্কু ক্ষমতায় থাকুক।

চসেস্কুর মতো স্বৈরাচারী, নাস্তিককে যত শিগগির গদি থেকে নামানো যায় দেশের জন্য ততই মঙ্গল।

আপনাদের সঙ্গে সিকিউরিতার বিপক্ষ গ্রুপের যোগাযোগ আছে?

না, না! ওরাও তো কমিউনিস্ট, নাস্তিক! তবে কমিউনিস্ট হলেও গর্বাচেভ আমাদের চসেস্কুর চেয়ে অনেক ভালো। রাশিয়াতে স্টালিনের আমলে ছাড়া কখনো গির্জার কাজে ওরা বাধা দেয় নি। গর্বাচেভ তো পুরোনো গির্জাগুলো সংস্কার করার জন্য অনেক টাকা দিয়েছে। অথচ এখানে দেখো, গির্জার এত সব দামি পাথর খসে পড়ছে, আইকন চুরি হয়ে যাচ্ছে, সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই।

আমার সঙ্গে চসেস্কুর ইন্টারভিউ ঠিক হয়েছে ক্রিসমাসের দিন। আপনার কি বিশেষ কোনো প্রশ্ন আছে তাকে করতে পারি?

নিজের চোখেই তো সব দেখছে। জিজ্ঞেসা করতে পারো রুমানিয়ার সংবিধানে ধর্মপ্রচারের অধিকার দেয়া হলেও কেন আমাদের ধর্মযাজকদের এত হয়রানি করা হচ্ছে। যাকে যেখানে খুশি যখন তখন বদলি করে দিচ্ছে, সরকারি অনুদান বন্ধ করে দিয়েছে–এ নিয়ে প্রশ্ন করতে পারো।

তাঁকে কি প্রশ্ন করতে পারি, সোভিয়েতপন্থী কোনো সামরিক অভ্যুত্থান তিনি আশঙ্কা করছেন কিনা?

দয়া করে এ প্রশ্নটি কোরো না। ওর গোয়েন্দা বিভাগ অসম্ভব শক্তিশালী। এতটুকু আঁচ করতে পারলে সিকিউরিতায় যারা বিপক্ষ দলে আছে তারা বিপদে পড়ে যাবে। আমরা চাই না তাদের কোনো বিপদ হোক।

আকাশের খাওয়া ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। বললো, এলেনার সঙ্গে একবার কি দেখা হতে পারে?

এলেনাকে একটু শহরের বাইরে পাঠিয়েছি। রাতে এখানে থাকা তোমার জন্য নিরাপদ হবে না। তোমাকে রাত কাটাতে হবে গ্রামে।

আকাশ একটু অবাক হয়ে বললো, কথা তো হয়েই গেলো। আমি ভাবছি এখনই বুখারেস্ট ফিরে যাবো। দোভাষীদের অন্তর্ধানের খবরটাও তো পাঠাতে হবে।

এত সামান্য খবর পাঠানোর জন্য তোমাকে কেন বুখারেস্ট যেতে হবে! চিঠি দিয়ে দাও। আমি লোক মারফত পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমাদের অফিসে। ওখানে তো তোমাদের আরও স্টাফ আছে।

কিন্তু আমাকে রাতে থাকতে হবে কেন? আর কোনো কথা আছে?

কথা তো কিছুই বলা হয় নি। ফাদার তয়েকশ তোমার সঙ্গে কথা বলবেন। আজ তিনি শহরের বাইরে থাকবেন। কাল সন্ধ্যায় ফিরবেন।

কাল সন্ধ্যায় হলে তো আমি আজ বুখারেস্ট গিয়ে কাল আবার আসতে পারি।

এত বুখারেস্ট, বুখারেস্ট করছো কেন? কদিনের জন্য তুমিও গা ঢাকা দাও না। ভয়েস অব আমেরিকার বিশেষ প্রতিনিধিকে সিকিউরিতা গুম করে দিয়েছে কি সাংঘাতিক খবর হবে বলো তো?

পাদ্রী স্টেফানের কথা আকাশকে গভীর চিন্তায় ফেলে দিলো। এরা চাচ্ছে সরকার বিরোধী আন্দোলনে ওকে কাজে লাগাতে। একজন সৎ সাংবাদিক হিসেবে ওর কি উচিত হবে এভাবে চসেস্কু বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হওয়া? মন থেকে কোনো সমর্থন পেলো না আকাশ। ওর কাজ হচ্ছে খবর সংগ্রহ করা। অন্য দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া নয়। বললো, আমার কাছে চসেস্কুর সাক্ষাৎকার নেয়াটা খুবই জরুরি ফাদার। আমার সম্পর্কে এ ধরনের খবর প্রচার হলে আপনাদের সুবিধে হলেও আমার জন্য অসুবিধে হবে।

বুড়ো পাদ্রী মাথা নেড়ে সায় জানালেন–তোমার কথা ফেলতে পারছি না। যে কোনো সাংবাদিকের জন্য চসেস্কুর সাক্ষাৎকার পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে হয়তো এটাই হবে ওর শেষ সাক্ষাৎকার। একটু থেমে মুচকি হেসে পাদ্রী বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে আমরা গুম করবো না। তবে ঘন ঘন এখানে যাওয়া আসাটা তোমার জন্য বা আমাদের জন্য ভালো হবে না। চসেস্কুর গুপ্তচর সবখানে নজর রাখছে। আমার পরামর্শ হচ্ছে তুমি ফাদার তয়েকশের সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকো। তারপর না হয় বুখারেস্ট যেও।

স্টেফানের পরামর্শ আকাশের অপছন্দ হলো না। ডিককে ও চিঠিতে লিখে দিলো । কীভাবে ওয়াশিংটনে ডেসপ্যাঁচ পাঠাতে হবে। নিজের ব্যাপারে লিখলো, এখানকার এক স্বাস্থ্যনিবাসে এলেনাকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে। দুদিন পর ফিরবে। কথাটা যেন ও বাংলাদেশের কাউন্সিলার আর আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে জানিয়ে দেয়। এটাও লিখলো, এলেনা নিখোঁজ–এ খবরটি যেন চালু থাকে।

এলেনার সঙ্গে বিকেলেই ওর দেখা হয়েছে। কালো গোলাপ আন্দোলনের অনেক তথ্যই দিয়েছে এলেনা। আকাশ যখন বললো, আমাকে জানিয়ে নিখোঁজ হলে কি ক্ষতি হতো! এলেনা শুনে হাসলো। বললো, শুধু মাকে বলেছি। কাউন্সিলারের ডিনারে এত সব বিশিষ্ট অতিথিদের ভেতর খবর পেয়ে তুমি যেভাবে রিএ্যাক্ট করেছিলে, ঘটনাটা তোমার আগে জানা থাকলে ততটা রিএ্যাকশন হতো না!

আমি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। গম্ভীর হয়ে বললো আকাশ।

আমি জানি। নরম গলায় এলেনা বললো, তার জন্য আমি খুবই দুঃখিত আকাশ। তোমার এই উদ্বেগ বুখারেস্টে যে আলোড়ন তুলেছে সে খবরও আমরা পেয়েছি।

এলেনার সঙ্গে আরো অনেক কথা হয়েছে আকাশের। রাতে এলেনাই ওকে এ বাড়িতে এনে রেখে গেছে। বলেছে দুপুরের পর আসবে।

পিশিয়া ঠিক গ্রাম নয়, তিমিশোয়ারা থেকে পনের কিলোমিটার উত্তরে পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট এক জনপদ। ইলেকট্রিসিটি আছে, পাকা রাস্তা আছে, ঘরবাড়িও বেশির ভাগ পাকা। তবে আকাশকে রাখা হয়েছে একেবারে পাহাড়ের গায়ে লাগানো মির্চা নাস্তাসেস্কুর কাঠের খামার বাড়িতে। খামারে গরু-শুয়র, হাঁস-মুরগি সবই আছে। খামারের পরই পাইন আর ফারের গভীর বন।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ কাঁচের বন্ধ জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলো আল্পস এর চূড়া বরফে ঢেকে গেছে। নিচের দিকে সাদার ভেতর মাঝে মাঝে কিছু সবুজ ছোপ চোখে পড়ছে। কাল রাতে লক্ষ্য করেছে এদিকে শীত কিছুটা কম। অবশ্য আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলে শীত একটু কমই লাগে। কাল বিকেল থেকে আল্পস পর্বতের মাথার ওপর কালো মেঘ জমে আছে। মেঘ থাকার জন্য বোঝা যাচ্ছে না সূর্য এখন কোথায়। বিষণ্ণ ঘোলাটে একটা আলো ছড়িয়ে ছিলো চারপাশে। মাঝে মাঝে অলস গলায় ডাকছে খামারের নধর গাইগুলো।

দরজায় টোকা দিয়ে কাপড় ঢাকা ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলেন মির্চা নাস্তাসেস্কুর মাঝবয়সী মোটসোটা হাসিখুশি বউ দয়না। ভাঙা ভাঙা ফরাশিতে বললেন, সুপ্রভাত। ভালো ঘুম হয়েছিলো তো!

সুপ্রভাত দয়না চাচি। চমৎকার ঘুম হয়েছে। ঘুম থেকে উঠে ভাবছিলাম এক কাপ কফি পেলে মন্দ হতো না। আপনি ঠিক মনের কথা টের পেয়ে যান।–আকাশের কথায় বিগলিত হয়ে দয়না বললেন, তোমরা হলে ধনী দেশের ধনী লোক। আমাদের মতো গরিবদের ঘরে একটু যদি আরাম পাও সেটাই তো ভাগ্য।

গরম কফির কাপে চুমুক দিয়ে আকাশ বললো, এত শান্তি আর এত আরামের জন্য ধনী দেশের বহু লোক আপনার অতিথি হওয়ার জন্য উদগ্রীব হবে এ আমি হলপ করে বলতে পারি।

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে দয়না বললেন, গ্রামে আছি বলে রক্ষা। রুটি মাখনের জন্য ভাবতে হয় না। অতিথি এলে জায়গা দিতে পারি। আমার দুই ছেলে শহরে থাকে। বিদেশী কোনো অতিথিকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করা দূর থাক, ওদের সঙ্গে কথা বললেও একশ রকমের জেরায় পড়ে।

ওরাও কি কালো গোলাপের দলে নাম লিখিয়েছে?

কেন লেখাবে না বাছা! দেশটাকে যে এরা জেলখানা বানিয়ে রেখেছে। কবে যে একবার বাপের বাড়িতে যেতে পারবো তাই ভাবি। বুড়ো বাপটা মরে গেলো, খবর পেলাম তিন মাস পর।

আপনার বাপের বাড়ি কোথায়?

হাঙ্গেরির মাকো-তো। টিসা নদীর ঠিক ওপরে। গাড়ীতে গেলে বেশি হলে ঘন্টা দেড়েক লাগে।

ওখানে কে কে আছে আপনার?

সবাই তো ওখানে। মা, তিন ভাই আর আমার যমজ বোন। ওরা তো দিব্যি স্বাধীন হয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে, আর আমরা এখানে ধুকে ধুকে মরছি। কবে পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করেছি কোনো খবর নেই।

আকাশের নাশতা করা শেষ হলে দয়না বললেন, ইচ্ছে করলে ফোতার সঙ্গে বনের ভেতর খানিকটা ঘুরে আসতে পারো। বেশি দূরে যেও না। আকাশের অবস্থা ভালো নয়।

ঠিক আছে দয়না চাচি, ওকে পাঠিয়ে দিন।

আকাশ পোশাক পরে তৈরি হতে হতেই দয়না চাচির ছেলে পনেরো মোল বছর বয়সী ফোতা এসে হাজির। মায়ের মতো ফর্শা গোল গাল মুখ, গালে চিতে পড়া, কটা চোখ দুটো দুষ্টুমিতে চকচক করছে। কাল রাতে খাওয়ার টেবিলে ফোতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ওর বাবা মা ফরাসী খানিকটা বুঝলেও ও নিজে হ্যাঁ না ছাড়া বেশি কিছু বলতে পারে না। একটা ফরাশি শব্দ বলে পুরো কথা শেষ করে রুমানিয়ান ভাষায়। হাত আর মুখ নাড়া দেখে বুঝে নিতে হয় কি বলছে।

দুপুর পর্যন্ত ওরা দুজন বনের ভেতর ঘুরে বেড়ালো। ফোতার সঙ্গে কাঠবেড়ালি খরগোশ আর প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটি করে কিছু সময়ের জন্য রুমানিয়ার ভয়ানক সব রাজনৈতিক সমস্যা ভুলে গিয়ে নিজের কৈশোরে ফিরে গেলো আকাশ। ক্লান্ত হয়ে ঝর্ণার ধারে একটা বুড়ো ফার গাছের নিচে চিৎ হয়ে শুয়ে গাছের শুকনো ডালের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে ভাবলো, জীবনটা এরকম সহজ সরল হলে কতই না আনন্দের হতো!

বিকেলে এলেনার সঙ্গে ফাদার তয়েকশ নিজেই চলে এলেন। আকাশ তখন নিরিবিলিতে বসে ডায়রি লিখছিলো। গত দুদিনের ছুটোছুটিতে কিছুই লেখা হয় নি।

মাঝবয়সী সাদাসিধে চেহারার তয়েকশ মৃদু হেসে বললেন, রুমানিয়ায় এবার কেমন লাগছে আপনার?

আকাশ হাসি বিনিময় করে বললো, তেমন কিছু এখনো চোখে পড়ে নি।

অপেক্ষা করুন। বারুদের মতো খবর পেয়ে যাবেন।

এক্ষুণি কি জানা যায় না?

জানাতে পারলে আমি খুশি হতাম। তয়েকশের মুখে মৃদু হাসি–ফাদার স্টেফান বললেন, আপনি নাকি আমাদের কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চান না পেশাগত সততা নষ্ট হবে বলে। আপনার সতোকে আমি শ্রদ্ধা করি। যে কারণে কাল কি ঘটবে আমাদের লোক ছাড়া কেউ সেটা জানবে না।

আকাশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, আসলে চসেস্কুর সাক্ষাৎকারটা আমি মিস করতে চাই না বলে ফাদার স্টেফানের প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারি নি।

আমার সন্দেহ আছে আপনাকে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য চসেস্কু বড়দিন পর্যন্ত গদিতে টিকে থাকতে পারবে কি না।

আমি এতটা ভাবি নি।

পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে।

এরকম একটা গুরুতর পরিস্থিতিতে চসেস্কু ইরান সফরে কেন যাচ্ছেন?

বাইরের পৃথিবীকে ধারণা দেয়ার জন্য–রুমানিয়ার সব কিছু ঠিক মতো চলছে। আমরা দেখাতে চাই রুমানিয়ায় কিছুই ঠিক নেই।

দারুণ একটা খবর পেয়ে গেলো আকাশ। কিন্তু কাল তিমিশোয়ারায় কী ঘটতে পারে এটা জানার জন্য মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগলো। বললো, ফাদার, কাল আপনার প্রোগ্রাম কি জানতে পারি?

তয়েকশ কয়েক মুহূর্ত আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হা হা করে হেসে উঠলেন–আপনি খুব চালাক। ঠিক আছে শুনুন, কাল বিকেলে আমি গির্জার ভেতরে নয়, গির্জার বাইরে সভা ডেকেছি। সেই সভায় আমি চসেস্কুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবো। তাকে পদত্যাগ করতে বলবো।

এ খবরটা কি আমি ওয়াশিংটনে জানাতে পারি?

জানাতে পারেন, তবে কালকের আগে প্রচারের জন্য নয়।

আমি থাকছি। আপনি দয়া করে আমার দুটো চিঠি–একটা আমাদের অফিসে, আরেকটা আমেরিকান এ্যাম্বাসাডরকে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করুন।

ঠিক আছে, লিখে দিন। আপনি আমাদের সাহায্য না করলেও আমরা আপনাকে ঠিকই সাহায্য করবো।

আপনারা জানেন আমার কোনো কাজ আপনাদের বিরুদ্ধে যাবে না। আর তিমিশোয়ারায় কিছু ঘটলে বুখারেস্ট সে ঘটনা চাপা দিতে চাইবে। আমি নিশ্চয় তা হতে দেবো না। এই বলে আকাশ চিঠি লিখতে বসলো।

দুটো চিঠি প্রায় একই রকম হলো। একটা হেনরী পেপার্সের জন্য, আরেকটা লিংকন গর্ডনের জন্য। ডিকের পক্ষে প্রফেসরের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে না। ওটা শুধু রাষ্ট্রদূতই পারবেন।

চিঠি দুটো পকেটে পুরে এলেনাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন ফাদার তয়েকশ। যাবার সময় বললেন, এলেনা আজ আপনাকে সঙ্গ দিতে পারছে না বলে আমি দুঃখিত। কাল ও এসে আপনাকে নিয়ে যাবে। ভালো হয় আপনার ধোপদুরস্ত পোশাক পাল্টে যদি জিপসিদের আধময়লা পোষাক পরে শহরে আসেন। আপনার মতো চেহারা জিপসিদের ভেতর অনেক পাওয়া যাবে। একজন জিপসিকে কেউ সন্দেহ করবে না।

ফাদার তয়েকশ চলে যাবার পর আকাশ ফোর্তাকে বললো, কি, বনের ভেতর আরেক চক্কর ঘোরা হবে নাকি!।

ফোতার কোনো আপত্তি নেই। মাকে জিজ্ঞেস করতেই ধমক খেলো। দয়না ঘরে এসে আকাশকে বললেন, আবহাওয়া ভালো নয়। বনের ভেতর এ সময়ে অনেক অশুভ শক্তি ঘুরে বেড়ায়। রাতেও সাবধানে থেকো।

সারা বিকেল ফোতার সঙ্গে বসে বসে খাতায় কাটাকুটি খেলে সময় কাটালো আকাশ। সন্ধ্যের আগেই ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করলো। দয়না ফোতাকে ডাকলেন গরুদের গোয়ালে তোলার জন্য। গোয়ালগুলোর দরজা জানালা ভালোভাবে বন্ধ করার কাজে আকাশ ফোতাকে সাহায্য করলো।

সন্ধ্যার পর শুরু হলো ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে তুষারপাত। কিছুক্ষণের মধ্যে সব কিছু তলিয়ে গেলো পুরু বরফের নিচে। একটু পরে বিদ্যুৎও চলে গেলো। বসার ঘরে দয়না একটা বড় লণ্ঠন জ্বালিয়ে দিলেন। অন্য ঘরে দিলেন মোমবাতি। মির্চা নাস্তাসেস্কু সকালে শহরে গেছেন, কাল ফিরবেন।

আকাশ লক্ষ্য করলো ঘরগুলো কাঠের হলেও খুব শক্তভাবে বানানো। কাঁচের জানালা দিয়ে ও বাইরে তাকিয়ে দেখছিলো ফার বনে ঝড়ের তাণ্ডব বয়ে যাচ্ছে অথচ ঘরের ভেতর কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না। তুষার ঝড় শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি নিচে নেমে গেছে। বসার ঘরের ফায়ার প্লেসে শুকনো পাইন কাঠের গনগনে আগুন জ্বলছে। ঘরের ভেতর পাইনের মিষ্টি গন্ধ। ওরা সবাই ঝড় শুরু হওয়ার আগেই খেয়ে নিয়েছে। দয়না ফায়ার প্লেসের সামনে রকিং চেয়ারে বসে উল বুনছেন। বুড়ো গ্ৰেহাউণ্ডটা ওর পায়ের কাছে শুয়ে আছে। ফোতা একটা কমিক নিয়ে বসেছে লণ্ঠনের কাছে। নাকি ওর মামাতো ভাই পাঠিয়েছে। এখানে কমিক পাওয়া যায় না।

ফাদার তয়েকশের কথা ভাবছিলো আকাশ। কাল তিনি কি ঘটাতে চলেছেন? কথা বলার সময় তাঁকে আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিলো।