১১. চসেস্কুর পতন এবং

চসেস্কু ভেবেছিলেন তেহরান থেকে ফিরে এসে দেখবেন তাঁর অনুগত বাহিনী সব কিছু সামলে ফেলেছে। তেহরান থেকে প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করে বললেন, তিমিশোয়ারা থেকে ঘুরে আসতে। বদমাশ হাঙ্গেরিয়ান পাদ্রীটা বেশি বাড়াবাড়ি করছে। কয়েকটাকে ধরে জেলে পুরে দিলে সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। সামনে বড়দিন। কারখানা বন্ধ রেখে কদ্দিন থাকতে পারবে মজুররা? উৎসব করার জন্য টাকা লাগবে না?

প্রধানমন্ত্রী তিমিশোয়ারা থেকে ফিরে এসে চসেস্কুকে জানালেন, অবস্থা খুবই খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট চসেস্কুর এ সময় দেশে থাকা দরকার। প্রধানমন্ত্রীর অযোগ্যতায় ভীষণ রেগে গেলেন চসেস্কু। তেহরান সফর শেষ না করেই বড় দিনের পাঁচ দিন আগে দেশে ফিরে এলেন তিনি।

সুজনরা টেলিভিশনে দেখলো চসেস্কুকে। কড়া এক ভাষণ দিলেন তিনি। বললেন, কিছু দুষ্কৃতকারী রুমানিয়ায় একটা গণ্ডগোল বাঁধাতে চাইছে। মানুষের সুখ শান্তি নষ্ট করতে চাইছে। তিনি এসব সহ্য করবেন না।

পরদিন তিনি বিরাট এক জনসভা ডাকলেন। বিভিন্ন কলকারখানা থেকে পার্টির কর্মীদের আনা হলো। চসেস্কু আরো কড়া ভাষায় ভাষণ দিলেন জনসভায়। তাঁর ভাষণের দশ মিনিটের ভেতরই শুরু হলো গণ্ডগোল। চসেস্কুর বাইশ বছরের ক্ষমতা থাকার ইতিহাসে কখনো কেউ যা স্বপ্নেও ভাবেনি–তাই ঘটলো। কিছু লোক শ্লোগান দিলো চসেস্কুকে চাই না। চসেস্কুর পতন হোক।

সিকিউরিতার লোকজনরা তৈরি ছিলো। শ্লোগানওয়ালাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে চাইলো ওরা। যারা শ্লোগান দেয় নি তারা বাধা দিলো। সঙ্গে সঙ্গে চসেস্কু বিরোধী শ্লোগানের তোড়ে ভেসে গেলো গোটা জনসভা। কেউ কেউ বক্তৃতামঞ্চ আক্রমণ করতে চাইলো। টেলিভিশনে এ দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠলেন ইফতি চাচা। উত্তেজিত গলায় বললেন, সর্বনাশ! অবস্থা যে এত খারাপ হয়েছে বুঝতেই পারি নি। আকাশ ঠিকই খবর দিয়েছিলো। ক্রিসমাসের আগেই গভর্মেন্ট ফল করবে।

বাইরে তখন প্রচণ্ড শীত। সবাই ড্রইংরুমে বসেছিলো টেলিভিশনের সামনে। চাচি কফি এনে বললেন, আকাশের জন্য চিন্তা হচ্ছে। আসল গণ্ডগোল তো ওখানে।

ইফতি চাচা বললেন, ওর মতো কাজ পাগল ছেলে আমি আর দেখি নি। ফরেন করেসপন্ডেন্ট তো অনেকই আছে। সব বসে আছে বুখারেস্টে। পরশু ডিক বললো, ও নাকি জিপসি সেজে ঘুরছে ওখানে।

আকাশের জন্য কবিতারও মন ভালো ছিলো না। বললো, ওই এলেনাই যতো নষ্টের গোড়া। ওরই জন্যে আকাশ ভাইকে তিমিশোয়রা যেতে হয়েছে। যেন এখান থেকে ওয়াশিংটনে খবর পাঠানো যায় না!

সুজনের খুব গর্ব হচ্ছিলো আকাশের জন্য। রুমানিয়ায় চসেস্কুর পতন হওয়া মানে বিরাট ঘটনা। আকাশ ঘটনার একেবারে মাঝখানে বসে সব দেখছে। রোজ রিপোর্ট পাঠাচ্ছে, রাতে ভয়েস অব আমেরিকাতে সেই খবর ওরা শুনছে, এর চেয়ে উত্তেজনাকর

অভিজ্ঞতা আর কি হতে পারে। নিজের পেশা নিয়ে সৃজন আগে কখনো মাথা ঘামায়। নি। বাবা সাংবাদিক ছিলেন বটে তবে এখানে এসে আকাশকে দেখে বুঝেছে সাংবাদিকতা আসলে কি। ওর মনে হয়েছে এর চেয়ে রোমাঞ্চকর কাজ আর কিছু হতে পারে না। বিপদের ঝুঁকিও কম নয়। অথচ কত বড় দায়িত্ব। সুজন ঠিক করেছে ও পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকেই বেছে নেবে। মা আর ফুপু শুনলে নিশ্চয় খুশি হবেন।

সকালে ফুপু ফোন করে জানতে চেয়েছেন বৃটিশ এয়ারওয়েজ ওকে টিকেট পৌঁছে দিয়েছে কিনা। বার বার বলেছেন ও যেন অবশ্যই আকাশের সঙ্গে চলে আসে। মাকেও তিনি নিয়ে আসবেন। মার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সুজন জামাল আহাদের ফোন নম্বর দিয়েছিলো ফুপুকে।

এখানে আসার পর ওর সঙ্গে ফোনে দুবার কথা বলেছেন জামাল ভাই। পরশু ও ফোন করেছিলো। ও আমেরিকা যাচ্ছে শুনে মা খুব খুশি হয়েছেন। জামাল ভাই নিজেও কম খুশি হন নি। বললেন, তোর জন্য খুব গর্ব হচ্ছে রে সুজন। তোদের দুঃখের দিনও শেষ হতে যাচ্ছে। ফুপু তো আছেনই। তবু কখনো কোনো দরকার হলে জামাল ভাইকে একটা ফোন করে দিবি, নয়তো চিঠি লিখবি।

ওয়াশিংটনে ভয়েস অব আমেরিকার ইউরোপিয়ান ডেস্কে আকাশের পাঠানো ডেসপাঁচগুলো রীতিমতো ঝড় তুলেছে। অন্য যে কোনো মিডিয়ার চেয়ে আকাশ কয়েক ঘন্টা এগিয়ে রয়েছে। ষ্টেট ডিপার্টমেন্ট, সি আই এ আর হোয়াইট হাউস থেকে দিনের ভেতর দশ বারোটা ফোন আসছে হেনরী পেপার্স-এর কাছে রুমানিয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার জন্য। আকাশের রিপোর্টের ভিত্তিতে সি আই এ বুখারেস্টে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছে ফাদার তয়কশের সঙ্গে জরুরী ভিত্তিতে কথা বলার জন্য। ব্রুকিং-এর লিংকন গর্ডন ফোন করে হেনরী পেপাসকে বললেন, তোমার ছেলেটা তো সাংঘাতিক কাজ করে ফেলেছে! গির্জার কানেকশন সম্পর্কে আমাদের কোনো তথ্যই ছিলো না! আবারও বলছি হেনরি, ছেলেটাকে আমাদের হাতে দাও। ওর যা মেধা আমার বিশ্বাস শিগগিরই ও আমাদের সেরা এজেন্টদের র‍্যাঙ্কে উঠে যেতে পারবে।

হেনরী পেপার্স গলাটাকে যতদূর সম্ভব মোলায়েম করে বললেন, ওর মেধা সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ নেই লিংকন। তোমাকে আগেও বলেছি ওকে আমি হারাতে চাই না। তুমি তো জানো ববকে আমি সেভেন্টি ওয়ানে হারিয়েছি ভিয়েতনাম ওয়ারে। আকাশ আমার কাছে ববের মতো। দ্বিতীয়বার সন্তানহীন হতে চাই না।

এ বয়সে, এতখানি দায়িত্বপূর্ণ পোস্টে থেকে তোমার এ ধরনের ইমোশন মানায় না হেনরী। এই বলে বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিয়েছেন লিংকন গর্ডন। সিআইএর এজেন্ট হওয়া যে কোনো আমেরিকান যুবকের জন্য স্বপ্নের মতো কিছু। তিনি ঠিক করলেন আকাশ ফিরে এলে ওকে সরাসরি অফার দেবেন। হেনরী মনক্ষুণ্ণ হতে পারে, হোক গে। তার কাছে বন্ধুর মনোবেদনার চেয়ে দেশের স্বার্থ অনেক বড়।

হেনরী পেপার্স কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করলেন আকাশের সম্মানে উনত্রিশ তারিখে একটা বড় সংবর্ধনা সভার আয়োজন করবেন। নবেম্বরের উনত্রিশেই তাকে এই এ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছিলো। ভয়েস অব আমেরিকায় সর্বোচ্চ সম্মান পদক দেয়া হবে ওকে। সিদ্ধান্তটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন আকাশের মাকে। আমন্ত্রণ জানালেন গোটা পরিবারকে ওয়াশিংটনে আকাশের সংবর্ধনা সভায় আসার জন্য।

তিমিশোয়ারায় বসে এসব আয়োজনের কিছুই জানে না আকাশ। চসেস্কু বিরোধী আন্দোলনের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে ও। এরই ভেতর দুজন জেনারেলের সঙ্গেও কথা বলছে। সামরিক বাহিনীর একটা বড় অংশ যে কোনো দিন বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে এ খবর আকাশ পেয়ে গেছে চসেস্কু তেহরান থাকতেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন মলদোভিয়ার সীমান্তে নতুন দুই ডিভিশন সৈন্য জড় করেছে।

একুশ তারিখে আকাশ যখন শুনলো বুখারেস্টে চসেস্কুর জনসভা ভণ্ডুল হয়ে গেছে তখনই পাদ্রী স্টেফানকে গিয়ে বললো, এখন থেকে বুখারেস্টেই থাকবো আমি। নাটকের শেষ দৃশ্য তো সেখানেই অভিনীত হবে।

পাদ্রী স্টেফান হেসে ওকে বিদায় দিয়েছেন। এখান থেকে আকাশের পাঠানো রিপোর্ট যে অখ্যাত তিমিশোয়ারাকে বিখ্যাত করে দিয়েছে এ কথা জানাতে ভুললেন না।

এলেনা আকাশের সঙ্গেই এসেছে। তবে কিছুটা ছদ্মবেশ নিতে হয়েছে ওকে। আকাশ যেভাবে ওর জন্য সারা বুখারেস্ট তোলপাড় করেছে বলা যায় না হয়তো গুপ্ত পুলিশ ওকে খুঁজছে। ওর ববছাটা কালো চুল ঢাকা পড়েছে ঝাঁকড়া সোনালি চুলের উইগে। চোখে দিয়েছে সোনালি ফ্রেমের চশমা। এতেই বদলে গেছে ওর চেহারা।

এলেনাকে নিয়ে আকাশ সোজা গিয়ে উঠলো আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে। শহরে রীতিমতো গৃহযুদ্ধের মহড়া চলছে। হোটেলে থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। বাইশ তারিখ রাতে ও সুজনের সঙ্গে দেখা করতে গেলো ইফতি মামার বাড়িতে। যাবার সময় এ্যাম্বাসাডর হোণ্ডেন বললেন, এ সময় তোমার জন্য ট্যাক্সিতে চলাফেরা করা মোটেই নিরাপদ নয়। যখন যেখানে যাও আমার গাড়ি নিয়ে যাবে।

বুখারেষ্টের রাস্তায় তখন সৈন্যরা টহল দিচ্ছিলো। কূটনীতিকের গাড়ি দেখে আকাশকে কেউ কিছু বলে নি।

রাত সাড়ে দশটায় ওকে দেখে ইফতি মামারা সবাই হইচই করে উঠলেন। মামি বললেন, সাত দিন হলো তুমি তিমিশোয়রা গেলে। মনে হচ্ছে সাত মাস দেখি নি।

ইফতি মামা হেসে বললেন, কবিতাকে দেখে মনে হবে সাত বছর আমরা আকাশকে দেখি নি।

কবিতা লজ্জা পেলো। রাগও হলো ওর, বাবাকে বললো, তুমি দিনের মধ্যে দশবার ডিককে ফোন করো নি?

আহা, ফোন করবো না কেন! এমন একটা গণ্ডগোলের জায়গায় আছে। খোঁজ খবর নেবো না?

সুজন বললো, তুমি ফিরে এসেছে আকাশ ভাই। আমার দারুণ ভালো লাগছে। ফুপু আজ সকালেও ফোন করে জিজ্ঞেস করছিলেন, তুমি আমার সঙ্গে যাচ্ছে কি না।

সামান্য পরিচিত এই পরিবারের সবাই ওকে নিয়ে এতটা ভাবে দেখে অভিভূত হয়ে গেলো আকাশ। সুজনকে বললো, আমার যাওয়াটা আনসার্টেন হয়ে গেলো যে! তোকে একাই যেতে হবে।

তুমি কেন যাচ্ছো না? জানতে চাইলো কবিতা।

আজ সকালে হোম মিনিস্টারকে ফোন করেছিলাম। চসেস্কুর সঙ্গে ইন্টারভিউ বাতিল হয়ে গেছে। বললো, আমার রিপোর্টে তারা নাকি খুবই অসন্তুষ্ট। ছাব্বিশ তারিখ যাবো ভেবেছিলাম চসেস্কুর ইন্টারভিউ পেলে। পাচ্ছি না যখন–আর কিছুদিন থেকে বরং শেষটা জেনে যাই। এই বলে সুজনের দিকে তাকালো–একা যেতে পারবি তো?

কেন পারবো না!

সুজনের আত্মবিশ্বাস আকাশের ভালো লাগলো। বললো, তোর হাতে কিছু রেয়ার ছবি পাঠাবো। আমাদের আর্কাইভে রাখার মতো ছবি। মামের ওপর তোর রাগ পড়েছে?

সুজন লজ্জা পেলো–ফুপুর ওপর কখন আবার রাগ করলাম?

তোর প্রথম দিনের টেলিফোনেই টের পেয়েছিলাম।

ফুপু বলেছেন আমাকে ওখানকার কলেজে ভর্তি করে দেবেন। মাকেও ওঁর কাছে রেখে দেবেন।

তুই কি বলেছিস?

আমি মাস্টার্স শেষ করে যেতে পারি। মা মনে হয় না আমেরিকায় গিয়ে থাকতে পারবেন।

মামের কাছে জাফর মামার এত গল্প শুনেছি তোর মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। খুব।

মা তো বলেছেন বেড়াতে আসবেন তোমাদের ওখানে। ফুপু টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছেন। জামাল ভাই পাসপোর্ট ভিসা সব করে দেবেন।

হঠাৎ দূরে কোলাহলের শব্দ শুনে সবাই কান খাড়া করলো। কয়েক রাউণ্ড গুলির শব্দও শোনা গেলো। আকাশ বললো, আমাকে এক্ষুণি বেরোতে হবে। সুজন শোন, শহরের অবস্থা খারাপ হলে এর মধ্যে নাও আসতে পারি। ইফতি মামা তোকে ছাব্বিশ তারিখ প্লেনে তুলে দেবেন। কিসসু ভাবিস না। মা এয়ারপোর্টে থাকবেন। লণ্ডনে প্লেন বদল করে সোজা সেইন্ট লুইস গিয়ে নামবি।

তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। আকাশকে গাড়িতে তুলে দিয়ে বললো সুজন।

বাইরে এসে আকাশ দেখলো কয়েকশ বিক্ষুব্ধ লোক পার্টি অফিসে হামলা চালিয়েছে। রাস্তায় লোকজন সব বেরিয়ে পড়েছে। ভিড়ের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো ওকে।

এ্যাম্বাসাডর হোণ্ডেন ওর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, শহরের পরিস্থিতি কেমন দেখলে?

আর্মিদের একটা অংশ সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছে। পার্টি অফিসে যারা হামলা চালিয়েছে তাদের ভেতর আর্মিও রয়েছে।

রাষ্ট্রদূতের বাড়ি থেকে আকাশ ফোন করলো ওয়াশিংটনে হেনরী পেপার্সকে। ফোন ধরলো ওঁর সেক্রেটারি মার্থা। বললো, বসকে হোয়াইট হাউসে ডেকে পাঠানো হয়েছে। কারণ অবশ্য তুমি। তোমার ওপর বুড়ো বেজায় খুশি। মনে হচ্ছে ওর সম্পত্তি-টম্পত্তি সব তোমাকে দিয়ে যাবে। সারাক্ষণ বলছে আমার ছেলে।

মার্থার কথা শুনে আকাশ রোমাঞ্চিত হলো। হেনরি পেপার্সের সম্পত্তির জন্য অবশ্যই নয়, ওর ভালো লাগলো চির দুঃখী এই মানুষটাকে সামান্য সুখী করতে পেরেছে বলে।

মার্থা বললো, তুমি আটাশ তারিখে অবশ্যই অফিসে আসবে। তোমার জন্য দারুণ এক সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।

আকাশ কয়েকটা প্রয়োজনীয় খবর দিয়ে ফোন রাখলো । মিসেস হোণ্ডেন এসে নরম গলায় বললেন, আমি লক্ষ্য করেছি গত দু রাত তুমি একেবারেই ঘুমোও নি। এরকম অনিয়ম করলে শরীর যে ভেঙে যাবে।

আকাশ মৃদু হেসে বললো, ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে সব ঘুম একেবারে ঘুমিয়ে নেবো। সারা পৃথিবীর মনোযোগ এখন বুখারেস্টের ওপর। এখন চেষ্টা করলেও ঘুম আসবে না।

বুখারেস্টের সবাই উদগ্রীব ছিলো চসেস্কুর খবর জানার জন্য। কিছু অনুগত সৈন্য ছাড়া সামরিক বাহিনী পুরোটাই তাঁর বিরুদ্ধে চলে গেছে। পরদিন চসেস্কু হেলিকপ্টার নিয়ে রাজধানী থেকে চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। বিদ্রোহী সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে গেলেন। বিদ্রোহীরা তাকে গ্রেফতার করেছে এ খবর জানাজানি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুখারেস্টে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। বিদ্রোহীরা পার্টির নেতাদের খোঁজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালাতে গিয়ে জিনিসপত্র তছনছ করলো, লুটপাটও করলো।

সকাল থেকে ক্যামেরা আর টেপ রেকর্ডার কাঁধে ঝুলিয়ে বুখারেস্টের রাস্তায় ঘুরছিলো আকাশ। ওর চোখের সামনে গুপ্ত পুলিশের প্রধানের বাড়িতে আগুন দেয়া হলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি লুট হলো। এলেনাকে এক ঝলক দেখেছিলো ট্রাকে চেপে কোথাও যাচ্ছে। দুহাত তুলে চেঁচিয়ে শ্লোগান দিচ্ছে। তখন আর আকাশকে দেখার সময় নেই ওর। এ নিয়ে আকাশেরও মাথাব্যথা ছিলো না। চসেস্কুর অনুগত বাহিনী যেভাবে লড়াই চালাচ্ছে ওর ভয় হচ্ছিলো এলেনাদের এই উল্লাস বেশি দিন স্থায়ী হবে না। রাতে ও ডেসপাঁচ পাঠানোর সময় লিখলো, পূর্ব ইউরোপের অন্য সব দেশের পরিবর্তনের সঙ্গে রুমানিয়ার পার্থক্য রয়েছে। এখানে বিদ্রোহীদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছে। চসেস্কু বেঁচে থাকলে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটতে পারে যে কোনো সময়।

বিদ্রোহীদের আশঙ্কাও তাই ছিলো। তড়িঘড়ি তারা চসেস্কুর বিচারের ব্যবস্থা করলো সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে।

বুখারেস্টে উনআশি সালের বড়দিন এলো ধোয়ামলিন অনিশ্চিত এক পরিবেশে। সকাল থেকে এখানে সেখানে আগুন জ্বলছে, পার্টির লোকজনদের বাড়ি যথারীতি লুটপাট হচ্ছে, পার্টি অফিসের ভেতর থেকে সিকিউরিতা প্রচণ্ড প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে। গোটা এলাকা অবশ্য ট্যাঙ্ক দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। চসেস্কুর অনুগত বাহিনী জানে জয়ের সম্ভাবনা নেই, তবু লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

বেলা তখন সাড়ে বারোটা। মেঘলা আকাশ। রাস্তাঘাট সব নোংরা কাদামাখা। পার্টি অফিসের দিকে যাওয়ার জন্য একটা গলির ভেতর দিয়ে শর্টকাট রাস্তা ধরেছিলো আকাশ। হঠাৎ শুনলো মেয়ের গলায় চিৎকার-বাচাও। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ব্রেক চাপলো আকাশ।

পুরোনো আমলে বনেদি ধাচের বাড়ি। চিৎকারটা এই বাড়ির ভেতরে থেকে আসছিলো। গাড়ি থেকে নেমে আকাশ কয়েক পা এগিয়ে যেতেই আলুথালু বিধ্বস্ত চেহারার একটা মেয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো বাড়ির ভেতর থেকে। আকাশকে সামনে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর বুকে। জার্মানি আর ফরাশি ভাষায় চিৎকার করে বললো, বিদেশি, আমাকে বাঁচাও। ওরা আমার বাবা আর ভাইকে হত্যা করেছে। আমাকেও হত্যা করবে।

ভয় পেয়ো না। তুমি কে, কোথায় যেতে চাও?

আমার নাম মারিয়া। দয়া করে তুমি আমাকে চাইনিজ এ্যাসিতে পৌঁছে দাও। আমার বাবা ছিলেন ফরেন মিনিষ্ট্রির ডিরেক্টর জেনারেল।

মারিয়াকে আকাশ আগে কখনো দেখে নি। মনে পড়লো সুজন ওকে ওর বান্ধবী মারিয়ার কথা বলেছিলো, তুমি বাংলাদেশের সুজনকে চেনো?

মারিয়া চিৎকার করে বললো, সুজন আমার বন্ধু। তুমি কে? আমাকে ওর কাছে নিয়ে চলো।

আমার নাম আকাশ। সুজন আমার ভাই। ওর কাছে তোমার কথা শুনেছি। চলো, তোমাকে ওর কাছে পৌঁছে দেবো।

মারিয়ার কাঁধে হাত রেখে আকাশ গাড়ির দিকে এগুতেই বাড়ির ভেতর থেকে দুজন বিদ্রোহী সৈন্য বেরিয়ে এলো। একজন এগিয়ে এসে ধমকের গলায় বললো, এই মেয়েকে কোথায় নিচ্ছো? কে তুমি?

আমি ভয়েস অব আমেরিকার বিশেষ প্রতিনিধি। ফাদার তয়েকশ আর জেনারেল আয়নেষু আমাকে ভালোভাবেই চেনেন। শান্ত গলায় আকাশ বললো, এই মেয়ে আমার দোভাষী। ওকে নিয়ে আমি জেনারেলের কাছে যাচ্ছি।

আকাশের কথা শুনে বিদ্রোহী সৈন্যরা প্রমাদ গুণলো। আকাশ যদি সত্যি সত্যি জেনারেল আয়নের কাছে যায় তাহলে ওরা বিপদে পড়বে। মেয়েটা ওদের পরিচয় জানে। আজ সকালেই জেনারেল আয়নেস্কু রেডিওতে বিদ্রোহীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, হত্যা আর লুটপাট বন্ধ করতে। একজন সৈন্য কর্কশ গলায় বললো, তুমি যেই হও, এই মেয়েকে নিয়ে যেতে পারবে না। ওকে আমরা গ্রেফতার করেছি। ওর বাবা চসেস্কুর দালাল ছিলো।

তোমরা ওকে গ্রেফতার করতে পারো না। ওর বাবা কি করেছে আমার জানার দরকার নেই। মারিয়া কোনো অপরাধ করে নি। ওকে আমি নিয়ে যাবোই।

সৈন্যটা এক পা এগিয়ে এসে আকাশের বুকের ওপর রিভলবার উঁচিয়ে ধরলো। ভয়ে রাগে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, প্রাণের মায়া থাকলে এক্ষুণি চলে যাও। নইলে তোমাকে গুলি করবো।

সৈন্যটা এতই কাঁপছিলো যে তার হাতে ধরা রিভলবারটাও স্থির ছিলো না। এক ঝটকায় আকাশ কেড়ে নিলো ওর রিভলবার। ধমক দিয়ে বললো, আমার পথ না ছাড়লে তোমাকেই আমি কুকুরের মতো গুলি করে মারবো।

বাড়ির দরজার পাশে যে সৈন্যটা ছিলো আকাশ ওকে লক্ষ্য করে নি। সে ছিলো রাইফেল তাক করে। আকাশকে রিভলবার ছিনিয়ে নিতে দেখে সে আর দেরি করলো না। আকাশের বুকে তাক করে ট্রিগার টিপে দিলো।

প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলো আকাশ। পড়তে গিয়ে সামলে নিলো। বুকের ভেতর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। বুঝলো ও মারা যাচ্ছে। দুহাতে রিভলবার উঁচিয়ে ধরে পর পর দুটো গুলি করলো। স্যুটিং-এ ওর নিশানা বরাবরই নিখুঁত ছিলো। দুটো সৈন্যই কপালের মাঝখানে গুলি খেয়ে পড়ে গেলো।

আকাশ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। চোখের সামনে ঘর বাড়ি, গাছপালা, আকাশ আর মাটি একসঙ্গে দুলে উঠলো। বুকের ডানপাশটা দু হাতে চেপে ধরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লো ও। মারিয়া পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলো, তোমাকে আমি মরতে দেবো না আকাশ।

দুহাতে আকাশকে জড়িয়ে ধরে ও গাড়িতে তুললো। রক্তে ওর সারা শরীর ভিজে গেলো। ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে আকাশকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো মারিয়া। ইমার্জেন্সিতে আকাশের পরিচয় দিয়ে বললো, জেনারেল আয়নেস্কু এক্ষুণি আসবেন একে দেখতে।

জেনারেলের কথা শুনে ডাক্তারদের ভেতর চাঞ্চল্য পড়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে আকাশকে নিয়ে যাওয়া হলো অপারেশন থিয়েটারে। হাসপাতালে বসেই মারিয়া ফোন করলো আমেরিকান রাষ্ট্রদূত আর সুজনকে। তারপর বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অপারেশন থিয়েটারের সামনের বারান্দায়।

পনেরো মিনিটের ভেতর এসে গেলেন আমেরিকান রাষ্ট্রদূত, ম্যাডাম হোল্ডেন, বাংলাদেশে কাউন্সিলার, তার স্ত্রী ও মেয়ে এবং মারিয়ার বন্ধু সুজন। মারিয়া ওদের দেখতে পায় নি। ও তাকিয়েছিলো বুখারেষ্টের ধোয়া মলিন বিষণ্ণ আকাশের দিকে। ওর বাবা আর ভাইকে ওরই চোখের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এক ঘন্টা আগে। ওকে বাঁচাতে গিয়ে বুকে গুলি খেয়েছে সুজনের ভাই। মারিয়া কি করবে? এ পৃথিবীর কোথাও কি ওর জন্য এতটুকু আশ্রয় আছে?

সুজন ওর কাছে এসে হাত ধরলো। আর্ত গলায় বললো, আকাশ কেমন আছে মারিয়া?

সুজনকে সামনে দেখে মারিয়া নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না। ওর বুকে মাথা রেখে বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লো আমাকে বাঁচাতে গিয়ে গুলি খেয়েছে আকাশ। ওরা আমার বাবা আর ভাইকেও মেরে ফেলেছে।

মারিয়াকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে সুজনও কান্নায় ভেঙে পড়লো। ইফতি চাচা এসে ওদের দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আস্তে আস্তে বললেন, কেঁদো না তোমরা। আকাশের জন্য প্রার্থনা করো।

ম্যাডাম হোল্ডেন অল্প দূরে দাঁড়িয়ে রুমালে ঘন ঘন চোখ মুছছিলেন। আকাশের সঙ্গে তাঁর মাত্র চার দিনের পরিচয়। এই কদিনে এত মায়া পড়ে গিয়েছিলো কাজ পাগল এই ছেলেটার ওপর। এ্যাম্বাসাডর হোন্ডেন তার কাছে এসে ভারি গলায় বললেন, আজ ক্রিসমাস ডে। আমরা কি ঈশ্বরের কাছে আকাশের প্রাণ ভিক্ষা চাইতে পারি না।

দু ঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুললো। গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এলেন দুজন ডাক্তার। এ্যাম্বাসাডর হোল্ডেন এগিয়ে গিয়ে ডাক্তারের চোখের দিকে তাকাতেই ডাক্তাররা মাথা নাড়লেন–হাসপাতালে যখন আনা হয়েছে তখনই বুঝেছিলাম ওকে বাঁচানো যাবে না। তবু আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।

ডাক্তারদের পেছন পেছন ট্রলিতে শোয়ানো সাদা চাঁদরে ঢাকা অকাশকে নিয়ে বেরিয়ে এলো দুজন নার্স।

আকাশ মারা গেছে পঁচিশ ডিসেম্বর বিকেল তিনটায়। কথা ছিলো ঠিক এই সময়ে প্রেসিডেন্ট চসেস্কুর সাক্ষাৎকার নেবে ও। মারা যাওয়ার আগে আকাশ জানতে পারে নি চসেস্কুকে ঠিক তিনটার সময়ই ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

ওয়াশিংটন ডিসিতে নিজের দফতরে বসে তখনই চসেস্কুর মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলেন হেনরী পেপার্স। চসেস্কুকে এভাবে হত্যা করা হবে এটা তিনি ভাবতে পারেন নি। একেবারেই বর্বরদের মতো কাজ হয়েছে ভাবলেন তিনি। চসেস্কুর জন্য দুঃখ পেলেও আকাশের কথা ভেবে তিনি আশ্বস্ত হলেন। ইন্টারকমে তার সেক্রেটারিকে বললেন, মার্থা, চসেস্কুর খবর তো শুনলে। আমার মনে হয় আকাশের আর বুখারেস্টে থাকার প্রয়োজন নেই। তুমি এখনই এ্যাম্বাসাডর হোন্ডেনের বাড়িতে লাইন দাও আমাকে। পরশু আকাশের কথা শুনে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, আটাশ তারিখের অনুষ্ঠান না আবার পিছিয়ে দিতে হয়! আকাশের সঙ্গে কথা বলে আমি ওর মার সঙ্গেও কথা বলবো। সবাইকে জানিয়ে দাও আকাশের সংবর্ধনা আগের তারিখ মতোই হবে।