১০. গৃহযুদ্ধের দাবানল

পরদিন সকালে এলেনা এলো এক দুঃসংবাদ নিয়ে। ফাদার তয়েকশকে নাকি ভোরবেলা তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে পুলিশ। আকাশ মনে মনে প্রমাদ গুণলো। কাল ও ওয়াশিংটনে খবর পাঠিয়েছে সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে ফাদারের প্রার্থনা সভায়। উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো, তার মানে বিকেলে কোনো সভা হচ্ছে না?

শুকনো গলায় এলেনা বললো, ফাদারকে জেলে রেখে কিসের সভা হবে?

আমি কি একবার ফাদার স্টেফানের সঙ্গে দেখা করতে পারি?

কেন পারবে না! তিনিই তো তোমার জন্য এ পোশাকগুলো পাঠিয়েছেন। এগুলো পরে আমার সঙ্গে চলো।

বড় একটা শপিং ব্যাগের ভেতর থেকে পুরোনো রঙচঙে জিপসিদের এক প্রস্থ পোশাক বের করে দিলো এলেনা। সঙ্গে আধময়লা জুতোও রয়েছে। দশ মিনিটের ভেতর পোশাক পাল্টে তৈরি হয়ে ও যখন বসার ঘরে এলো তখন সবাই রীতিমতো অবাক হলো। দয়না বললেন, তোমাকে বাছা একেবারেই চেনা যাচ্ছে না। সত্যি সত্যি নোংরা জিপসি মনে হচ্ছে।

আয়নায় নিজের চেহারা দেখে আকাশেরও তাই মনে হয়েছিলো। বললো, দয়না চাচির এখানে মনে হচ্ছে আরও কয়েক রাত কাটাতে হবে।

তোমার যতদিন ইচ্ছে থাকবে। ব্যস্ত গলায় দয়না বললেন, তোমার মতো একজন অতিথি আমার বাড়িতে থাকবে এটা তো ভাগ্যের ব্যাপার।

ইরে তখন ঝড়ো বাতাস থেমে গেলেও আকাশে মেঘ ছিলো। কালো রাস্তাটুকু ছাড়া সব কিছু বরফে ঢাকা। গাড়ি চলার জন্য সকালে রাস্তার বরফ সরানো হয়েছে। এলেনা এসেছিলো বাসে। ওদের যেতেও হলো বাসে। আকাশ যখন বাসে উঠলো তখন কয়েকজন যাত্রী নড়েচড়ে বেশি জায়গা দখল করে বসলো যাতে হতচ্ছাড়া জিপসিটা ওদের পাশে বসতে না পারে। মনে মনে খুশি হলো আকাশ। ওরা দুজন একেবারে পেছনের দুটো খালি সিটে বসে পড়লো।

বাসের বেশির ভাগ যাত্রীর পোশাকই মলিন, বুখারেস্টের রাস্তায় যা দেখা যায় না। কারো কারো কোটে–কয়েকটা তালিও পড়েছে। চেহারা দেখলেই বোঝা যায় গরিব । শীতে কষ্ট পাচ্ছে। আকাশ মনে মনে ভাবলো সুজনকে একবার গ্রামের এসব মানুষদের দেখালে ওর ধারণা বদলাতো। বড়লোক এক বান্ধবীর সঙ্গে মিশে ও ভেবেছে রুমানিয়ার সব মানুষই বুঝি ওরকম সুখে আছে। পাইওনিয়ার লীগের ক্যাম্পে যখন এসেছে নিশ্চয় ও রাজনীতি করে। এসব ওর দেখা উচিৎ।

তিমিশোয়ারায় বাস থেকে নেমে ওরা সোজা পাদ্রী স্টেফানের কাছে গেলো। তিনি তখন হন্তদন্ত হয়ে কোথাও বেরোচ্ছিলেন। আকাশকে দেখে বললেন, ভালোই হলো, তোমাকে পেয়ে। এক্ষুণি চলো আমার সঙ্গে।

ট্যাক্সি দাঁড়ানো ছিলো। ওরা তিন জন উঠে বসতেই ওটা ছাড়লো। আকাশ একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলে আমরা কোথায় যাচ্ছি?

পুলিশের সদর দফতরে। কয়েক হাজার মানুষ দফতর ঘেরাও করে চিৎকার করছে–ফাদার তয়েকশকে ছেড়ে দাও।

পুলিশ কি করছে?

ওরা নাকি গুলি করার জন্য তৈরি হয়ে আছে। মানুষ একটু উশৃঙ্খল হলেই গুলি চালাবে।

দশ মিনিটের ভেতর ওরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলো। দফতর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ট্যাক্সি ছেড়ে দিতে হলো। আকাশ চারপাশে তাকিয়ে দেখলো পাদ্রী স্টেফান এতটুকু বাড়িয়ে বলেন নি। কম করে হলেও হাজার তিনেক মানুষ জড় হয়েছে পুলিশের সদর দফতরের চারপাশে। রাস্তাগুলো মানুষের ভিড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। এলোমেলোভাবে শ্লোগান দিচ্ছে। চসেস্কু আর তয়েকশ শব্দ দুটো শুধু চেনা মনে হলো। এলেনাকে জিজ্ঞেস করলো, কি বলছে ওরা?

বলছে, তয়েকশকে মুক্তি দাও। চসেস্কু গদি ছাড়।

এরা কি সব কালো গোলাপের দল?

শুধু কালো গোলাপ হবে কেন, সব রকম মানুষই আছে এখানে। বললেন পাদ্রী স্টেফান–আমি তো কমিউনিস্ট পার্টিরও কয়েকজনের চেহারা দেখতে পাচ্ছি।

তাহলে তো বলতে হবে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।

আকাশরা বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়েছিলো। এমন সময় রাইফেলের গুলির শব্দ হলৈ পর পর চার বার। এলেনা চিৎকার করে উঠলো–ওরা নিরীহ মানুষদের গুলি করে মারছে।

সামনের দিকে মানুষ কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। কিন্তু পেছনে যারা ছিলো তারা–চসেস্কুর দালালরা নিপাত যাক, বলে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। জনতা আরও উত্তেজিত হয়ে উঠলো। আকাশ বললো, বোকার দল, গুলি করে মানুষকে আরও ক্ষেপিয়ে দিচ্ছে।

জটলার ভেতর থেকে কারা যেন ঢিল ছুঁড়ে মারলো পুলিশের সদর দফতরের দিকে। ঝন ঝন করে জানালার কাঁচ ভাঙতে লাগলো। আকাশ লক্ষ্য করলো মানুষের ভিড় আরো বড় হচ্ছে। বেশির ভাগই গরিব, খেটে খাওয়া মানুষ। কারখানার ইউনিফর্ম পরা মজুরও রয়েছে। বয়স্ক মহিলাও আছে। তবে সামনের দিকে বেশির ভাগ কম বয়সী যুবক। ক্রমশঃ মারমুখো হয়ে উঠছে তারা। ঢিল ছোঁড়ার পরিমাণ বেড়ে গেলো। ক্রুদ্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুঁড়লো কয়েক রাউন্ড। একটা আকাশদের খুব কাছেই ফাটলো। চোখে রুমাল চেপে ওরা পেছনের দিকে সরে এলো।

দুপুর একটা পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে জনতার খণ্ড খণ্ড লড়াই চলছিলো। ছেলেরা পুলিশের দিকেও ঢিল ছুঁড়ছিলো। পুলিশ পিছু হটতে হটতে সদর দফতরের ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। হঠাৎ সামনের দিকে উত্তাল আনন্দধ্বনি শোনা গেলো। শ্লোগান উঠলো–ফাদার তয়েকশ দীর্ঘজীবী হোন।

একটা মাইক্রোবাসের ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখলো, ফাদার তয়েকশকে মাথায় তুলে নাচছে ছেলেরা। এলেনা চিৎকার করে বললো, ওরা ফাদারকে ছেড়ে দিয়েছে।

ভিড় ঠেলে ওরা কাছে যেতে চাইলো, পারলো না। পাদ্রী স্টেফান বললেন, চলো আমরা গির্জায় যাই। ফাদার তয়েকশ তো ওখানেই যাবেন।

ভিড়ের ভেতর হেঁটে হেঁটে ওরা গির্জায় গেলো। যাওয়ার পথে আকাশ দেখলো, কয়েক জায়গায় আগুন জ্বলছে। ছেলেরা চসেস্কুর ছবি আগুনে পোড়াচ্ছে। আগুনে দেয়ার আগে ছবি পা দিয়ে মাড়াচ্ছে। আকাশ মনে মনে বললো, শেষ পর্যন্ত রুমানিয়াতেও শুরু হয়ে গেলো।

বিকেলে ফাদার তয়েকশ এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিলেন। চসেস্কুর দুর্নীতির বিরাট ফিরিস্তি দিয়ে বললেন, চসেস্কুর গদি না ছাড়া পর্যন্ত আমরা গির্জায় ফিরে যাবো না। তিমিশোয়ারায় বড়দিনের উৎসব হবে না।

লোজন হইহই করে সমর্থন জানালো তয়েকশকে। মিটিঙের পর আকাশ সুযোগ পেলো ফাদারের সঙ্গে দেখা করার। ফাদার তখন ওঁর ঘরে বসে কফি খাচ্ছিলেন। গির্জার আরও পাদ্রীরা ছিলো সেখানে। পাদ্রী স্টেফান ওকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তয়েকশ তাকালেন ওর দিকে। মৃদু হেসে বললেন, এই জিপসিটাকে চিনি মনে হচ্ছে! আশা করি আপনি ওয়াশিংটন পাঠাবার মতো প্রচুর খবর পেয়েছেন। এই বলে অন্যদের সঙ্গে আকাশকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

একজন চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে তয়েকশের পাশে বসতে দিলো আকাশকে। সবাই বেশ সম্ভ্রমের চোখে দেখছিলো ওকে। আকাশ বললো, আমি কি আজ ফিরে যাবো বুখারেস্ট, নাকি আপনারা আরো কিছু ঘটাবেন?

এখনো তো কিছুই ঘটাইনি। দু চারদিন থাকুন। দেখুন তিমিশোয়রা থেকে আমরা চসেস্কুর নাম কিভাবে মুছে ফেলি।

তাহলে আমাকে একজন তোক দিতে হবে কালকের মতো। অফিসে খবর পাঠাবো।

লোক যখন চান তখনই পাবেন। এ ব্যাপারে ফাদার স্টেফান আপনাকে ভালো সাহায্য করতে পারবেন।

ফাদার স্টেফানের ঘরে বসে আকাশ ডেসপাঁচ তৈরি করে যখন ডিকের কাছে লোক পাঠালো তখন রাত প্রায় আটটা। লোকটা ছিলো এক লরির ড্রাইভার বললো, রাত বারোটার মধ্যে খবর চলে যাবে।

লোকটাকে পাঠিয়ে দিয়ে আকাশ স্টেফানের ওখান থেকে ডিককে ফোন করে বললো, বিস্তারিত খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। এখানকার পরিস্থিতি খুবই উত্তপ্ত। ফাদার তয়েকশকে গ্রেফতার করেও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। তিন হাজার লোক সদর দফতর ঘেরাও করেছিলো। চসেস্কুর ছবি পোড়ানো হচ্ছে।

এইটুকু বলার পরই খুট করে লাইন কেটে গেলো। আকাশ বার বার নম্বর ঘুরিয়েও লাইন পেলো না। তবে যতটুকু পাঠিয়েছে ভয়েস অব আমেরিকার ইস্ট ইউরোপিয়ান ডেস্ক নিশ্চয় চমকে উঠবে। স্টেফানকে ও বললো, আমি কি এখানে থাকবো না গ্রামে ফিরে যাবো?

স্টেফান বললেন, রাতে এখানে থাকা ঠিক হবে না। গুপ্ত পুলিশ হামলা করতে পারে। এলেনা তোমাকে দয়নার ওখানে পৌঁছে দেবে। সকালে আবার নিয়ে আসবে।

তিমিশোয়ারায় আর দেরি না করে এলেনাকে নিয়ে আকাশ বেরিয়ে পড়লো। খুবই । কাজের মেয়ে এলেনা। কার একটা গাড়ি জোগাড় করেছে। বললো, তোমাকে। পিশিয়ায় রেখে আমাকে আবার ফিরে আসতে হবে। হাতে অনেক কাজ।

আকাশ বললো, তোমাকে দোভাষী হিসেবে কাছে না পেয়ে খুব মিস করছি।

দয়না চাচির সঙ্গে কথা বলার জন্য নিশ্চয় দোভাষী লাগবে না। গাড়ি চালাতে চালাতে মুখ পিটে হাসলো এলেনা।

আকাশ নিরীহ গলায় বললো, ফোতার সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধে হয়।

আকাশের কথা শুনে এলেনা শব্দ করে হাসলো। বললো, চসেস্কু যেদিন গদি ছাড়বে সে দিন থেকে আমাকে সারাক্ষণ তোমার কাছে পাবে।

ঈশ্বর তোমার ইচ্ছা পূরণ করুন।

বড়ো পাদ্রী স্টেফানের গলা নকল করে কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে এলেনা হেসে খুন হলো। ঘরে ফিরে আকাশ দয়নাকে বললো সারাদিন তিমিশোয়ারায় কী ঘটেছে। মির্চাগিন্নি রাতের খাবার টেবিলে সাজাচ্ছিলেন। বললেন, মির্চা সন্ধ্যায় ফিরেছে। ফাদার তয়েকশের বক্তৃতা ও শুনেছে। বললো এবার নাকি একটা কিছু হবে।

পরদিন সকাল নয়টায় এলো এলেনা। আকাশ তখন বেরোবার জন্য জিপসি সেজে তৈরি হয়ে বসে আছে। বললো, আজ কোনো দুঃসংবাদ নেই তো?

এলেনা বললো, এখন পর্যন্ত কিছু ঘটে নি। তবে যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো কিছু ঘটতে পারে।

দয়না ওকে বললেন, শহরে যাই ঘটুক, এই জিপসি ছোঁড়াটাকে রাতে ঠিক মতো পৌঁছে দিয়ে যেও। কাল মির্চার কাছে গন্ডগোলের কথা শুনে ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম।

আকাশ দয়নাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বললো, তুমি ঠিক আমার মার মতো। আমার জন্য ভেবো না। আমার কিছুই হবে না।

তাই যদি ভাবো তাহলে ঘরে ফিরতে বেশি রাত কোরো না। ভেজা গলায় দয়না বললেন, আমার এক ছেলেকে সিকিউরিতা ধরে নিয়ে গেছিলো, সে আর ফেরে নি।

গাড়িতে যেতে যেতে আকাশ এলেনাকে বললো, পৃথিবীর সব দেশে সব মায়েরা একই রকম।

এলেনা কোনো কথা বললো না।

তিমিশোয়ারায় যখন ওদের গাড়ি ঢুকলো তখন শহরটাকে মনে হলো থমথম করছে। বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ। টাউন হলের কাছে আসতেই চোখে পড়লো লোকজনের জটলা। অনেকে উত্তেজিত হয়ে ছুটোছুটি করছে। কয়েকজন মিলে একটা দোকান ভাঙছে। রুমানিয়ান ভাষায় সাইনবোর্ড পড়তে না পেরে আকাশ বললো, এলেনা গাড়ি থামাও। কিসের দোকান ওটা?

এলেনা রাস্তার কিনারে গাড়ি থামিয়ে বললো, বইয়ের দোকান। তুমি কি নামতে চাও?

প্লীজ এলেনা। পাঁচ মিনিট। দেখতে চাই কেন ভাঙছে।

আকাশের কথা শেষ না হতেই নোকজন তালা ভেঙে দোকানের ঝপ তুলে ফেললো। ভেতরে গিয়ে গোছ গোছা বই এনে রাস্তায় স্তূপ করলো । গাড়ি থেকে নেমে আকাশ একটু কাছে গিয়ে দেখলো, সব চসেস্কুর লেখা বই। একজন দেয়াশলাই জ্বেলে বইয়ের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিলো। অল্প কিছুক্ষণের ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন। আকাশ গাড়িতে উঠে বললো, চলো এলেন, যাওয়া যাক।

এলেনা বললো, গির্জায় যাওয়ার আগে তোমাকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখাই।

তিমিশোয়রা প্রথম যেদিন এলো সেদিনই শহরে ঘুরেছিলো আকাশ। আজকের অবস্থা একেবারেই অন্য রকম। অনেকগুলো বইয়ের দোকানের সামনে আগুন জ্বলতে দেখলো সে। সবখানে চসেস্কুর বই পোড়ানোর মহোৎসব চলছে।

গির্জার আঙিনায় ব্যস্ত হয়ে পায়চারি করছিলেন পাদ্রী স্টেফান। আকাশ তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, আজ আপনাদের কি প্রোগ্রাম ফাদার?

টাউন হলের সামনে জমায়েত। সেখান থেকে মিছিল করে পার্টি অফিসে গিয়ে ঘেরাও করা হবে। এই বলে স্টেফান একটু থামলেন। পকেট হাতড়ে একটা চিঠি বের করে বললেন, তোমার চিঠি, ভোরে ট্রাক ড্রাইভার মিহাইল দিয়ে গেছে।

খাম খুলে আকাশ দেখলো ইফতি মামার চিঠি। ওপরে ডিকের নোট। বাংলায় লেখা চিঠিকে ডিক ভেবেছে বাংলাদেশের কাউন্সিলার বুঝি সাংকেতিক হরফে জরুরি কোনো নোট পাঠাচ্ছেন। ইফতি মামা লিখেছেন, আকাশ, তোমার স্বাস্থ্য নিবাসে দিন কাটাবার গল্প আমরা কেউ বিশ্বাস করি নি। তিমিশোয়ারায় গণ্ডগোল হচ্ছে এ খবর আমরা পেয়েছি। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। বুখারেস্টের অবস্থাও থমথমে। কাল তোমার মা ফোন করেছিলেন। সুজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তুমি গণ্ডগোলের ঠিক মাঝখানে বসে আছো বলে তার উদ্বেগ বাড়াতে চাই নি। তবে আমরা জানি বলে সবাই তোমার জন্য ভীষণ উদ্বিগ্ন। আমার অফিসে ফরেন অফিসের একজন ডিরেক্টর এসে জানতে চেয়েছিলেন, তোমার সঙ্গে আমার কতদিনের পরিচয়, তোমার সম্পর্কে কি জানি–এসব। মনে হয় তুমি চসেস্কুর সাক্ষাৎকার নিতে যাচ্ছো, সেজন্যে খোঁজখবর নিচ্ছে। যদি আসতে না পারো ডিকের খামে চিঠি দিও। ইতি ইফতি মামা।

পাদ্রী স্টেফান বললেন, বিকেলে মনে হয় গণ্ডগোল হবে। পার্টি অফিসের চারপাশে ওরা সৈন্য মোতায়েন করেছে।

আকাশ বললো, লোকের হাতে খবর পাঠাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। টেলিফোনও নিরাপদ নয়। আপনাদের এখানে ওয়ারলেস থাকলে ভালো হতো।

নেই কে বললল! রহস্যময় হেসে স্টেফান বললেন, গির্জার ছাদের ঘরে রেডি আছে। যখন খুশি ব্যবহার করতে পারো।

তাহলে তো খুবই ভালো। আমি এক্ষুণি গিয়ে ডিককে বলছি ও যেন সন্ধ্যার পর সেটের কাছে থাকে।

ফাদার স্টেফান যা আশঙ্কা করছিলেন শেষ পর্যন্ত তাই ঘটলো। পার্টি অফিস যারা ঘেরাও করতে গিয়েছিলো তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হলো। ছত্রিশ জন মারা গেলো সঙ্গে সঙ্গে। পরদিন সকাল নাগাদ হাসাপাতালে মারা গেলো আরো এগারো জন। লাশ নিয়ে শহরে মিছিল বেরোলো। দোকান পাট, কলকারখানা সব বন্ধ করে শ্রমিক কর্মচারীরা রাস্তায় নেমে এলো। আকাশ ডেসপাঁচ পাঠালোচসেস্কুর পতন যে কোনো সময়ে ঘটতে পারে।

কোনো কিছুর পরোয়া না করে চসেস্কু সেদিনই তাঁর পূর্ব নির্ধারিত সফরে তেহরান চলে গেলেন। যেন দেশের কোথাও কিছু ঘটে নি। অয়ারলেসে ডিক খবর পাঠালো, বুখারেস্টে বিদেশী সাংবাদিকদের চলাফেরার উপর নাকি সাংঘাতিক রকম বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বলে দেয়া হয়েছে কেউ যেন শহর ছেড়ে বাইরে না যায়।

ডিকের পাঠানো খবর শুনে আকাশের মনে হলো গণ্ডগোল নিশ্চয়ই অন্যান্য শহরেও হচ্ছে। নইলে বিদেশী সাংবাদিকদের চলাফেরা ওরা এভাবে নিয়ন্ত্রণ করতো না। ভালোই হলো। তিমিশোয়ারার খবরের জন্য ওদের এখন অন্য কারো ওপর নির্ভর করতে হবে না।

চসেস্কুর তেহরান যাওয়ার খবর শুনে তিমিশোয়ারার মানুষ আরো ক্ষেপে গেলো। পাল্লা দিয়ে সরকারী বাহিনীও ক্ষেপলো। বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করার জন্য পরদিন ওরা নির্বিচারে গুলি চালালো। লাশ গুম করে ফেললো। তাৎক্ষণিকভাবে আকাশরা খবর পেলো না কতজন মারা গেছে।

দুদিন ধরে আকাশ পিশিয়ায় যায় নি। পাদ্রী স্টেফানের ঘরটাকে ওর অফিস বানিয়ে ফেলেছে। এলেনা কখনো ওর সেক্রেটারির কাজ করছে, কখনো সংবাদ সংগ্রাহকের কাজ করছে। এর ভেতর খবর পেলো প্রধানমন্ত্রী নাকি তিমিশোয়ারা এসেছেন। স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে তিনি আলোচনায় বসতে চেয়েছিলেন, কেউ তার ডাকে সাড়া দেয় নি। রাতের অন্ধকারে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী, ভোর হওয়ার আগেই চলে গেলেন!

আকাশ হেনরী পেপার্সের জন্য খবর পাঠালোলা-মনে হচ্ছে আমার বরাতে চসেস্কুর সাক্ষাৎকার নেই। ফাদার তয়েকশ ঠিকই বলেছেন, বড়দিন পর্যন্ত চসেস্কু গদিতে টিকে থাকতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে।