৬. মারিয়ার জন্য ভালোবাসা

কার্পেথিয়ান পর্বতের এক চমৎকার স্বাস্থ্য নিবাস তুশনাদে ছিলো সুজনদের ক্যাম্প। তিনদিকে উঁচু পর্বতের সারি একদিকে হ্রদ। পর্বতের চূড়ো থেকে হ্রদ পর্যন্ত সব কিছু সাদা বরফে ঢাকা। পর্বতের গায়ে চাদর জড়ানো পাইন গাছগুলো সারি সারি বর্শাফলকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বাকি সব বরফে এমনভাবে চাপা পড়েছে যে বোঝার উপায় নেই কোথায় কি ছিলো। মারিয়া ওকে বলেছে গরমের সময় বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা এখানে আসে বেড়াতে। সারাদিন জঙ্গলে ছুটোছুটি করে, হ্রদের স্বচ্ছ নীল পানিতে হুটোপুটি করে, কেউ বারণ করে না।

মাঝখানে মস্ত বড় একটা মাঠের চারপাশে গোটা বার তিনতলা ইমারত। বাইরে থেকে দেখতে আহামরি কিছু নয়, ভেতরে আরামের সব ব্যবস্থা আছে। নিচের তলায় অফিস, ডাইনিং রুম আর ইনডোর গেমস-এর ব্যবস্থা, দুই আর তিন তলায় থাকার জায়গা। সবগুলো ইমারতের তিনতলার ছাদে কাঁচ দিয়ে ঘেরা চমৎকার একটা বসার জায়গা রয়েছে। প্রত্যেকটা ঘরের সঙ্গে এটাচড বাথরুম। ঘরে দুটো করে বিছানা, দুটো দেয়াল আলমারি, দুটো পড়ার টেবিল, টেলিভিশন, টেলিফোন আর ছোট্ট একটা রেফ্রিজারেটর। সুজনের ঘরে বরুণের থাকার ব্যবস্থা ছিল। ও না আসাতে সুজন একা এক ঘরে থাকে। মারিয়া অনেক রাত পর্যন্ত ওর সঙ্গে গল্প করে। ফ্রিজ ভর্তি আপেল, আঙ্গুর আর অরেঞ্জ জুস। গত দশ দিনে কার্পেথিয়নের তাজা বাতাস আর সব ভালো খাবার খেয়ে চেহারা আরো উজ্জ্বল হয়েছে ওর, ওজনও বেড়েছে। সকালে মারিয়া ওকে বলছিলো, আর কদিন এখানে থাকলে তোমাকে তোমার মাও চিনতে পারবেন না।

সুজন আর মারিয়া কফি খেতে খেতে ছাদের কাঁচঘরে বসে গল্প করছিলো। সেদিন বিকেলে ওদের কোনো অনুষ্ঠান ছিল না। ক্যাম্প শুরু হওয়ার চতুর্থ দিন সকালে ছিলো বাংলাদেশের অধিবেশন। সুজনকে একঘন্টা বলতে হয়েছে বাংলাদেশের ছাত্র ও যুব আন্দোলন আর দেশের পরিস্থিতির ওপর। এক ঘন্টা শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। ও বলেছে ইংরেজিতে। মাঝে মাঝে মারিয়া দোভাষীর কাজ করেছে। হল ভর্তি ওর বয়সী বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েদের বাংলাদেশ সম্পর্কে কৌতূহলী প্রশ্ন শুনতে দারুণ ভালো লেগেছিলো সুজনের। মনে হয়েছিলো ও বুঝি সেই মুহূর্তে রুমানিয়ার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।

কালো কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মারিয়া ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলো। গত তিন বছর ধরে মারিয়া পাইওনিয়ার ক্যাম্পে দোভাষীর কাজ করছে। আগে কখনো ওর এমন হয় নি। গত দশ দিনে ওর চেয়ে চার বছরের ছোট বাংলাদেশের এই ছেলেটার জন্য অদ্ভুত এক ধরনের মায়া জন্মে গেছে। বাইরে বরফ ঢাকা কার্পেথিয়ান পর্বতমালার দিকে তাকিয়ে সুজন সুখকর কোনো কিছু ভাবছিলো। ওর দু চোখে স্বপ্ন, ঠোঁটের ফাঁকে হাসির রেখা। মারিয়ার মনে হল সুজন যদি থেকে যেতো তাহলে বেশ হতো। সুজন বলেছে ওর বেড়াতে খুব ভালো লাগে। মারিয়ার বাবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন আমলা। কয়েক বছর রাষ্ট্রদূত ছিলেন এশিয়ার কয়েকটি দেশে। বাংলাদেশে না থাকলেও মারিয়ার বাবা সেখানকার অনেক খবর জানেন। বাবার কাছে শুনে ছোট্ট গরিব এই স্বাধীনতা প্রিয় দেশ সম্পর্কে মারিয়ার কৌতূহল জন্মেছিলো। ওর ইংরেজি জানা বন্ধুরা জাপান, কোরিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভারত আর ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধিদের দোভাষী হতে বেশি আগ্রহী ছিলো। ওদের বলা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে মাত্র দুজন প্রতিনিধি আসবে। সবচেয়ে ছোট দল। এই দলের দোভাষী হওয়ার জন্য মারিয়ার আগ্রহে বান্ধবীরা অবাক হয়েছিলো। ওরা জানে না বিপ্লবের জন্য মারিয়ার দুই চাচা জীবন দিয়েছেন।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মারিয়া সুজনকে জিজ্ঞেস করলো, কি ভাবছো?

সুজন মারিয়ার দিকে ঘুরে তাকালো। ও ভাবছিলো কীভাবে স্বপ্নের ঘোরে কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। গত দশ দিনে এত সব অভিজ্ঞতা ওর হয়েছে, যেন ওর বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে। কতজনের সঙ্গে পরিচয় হল! এই ক্যাম্পে এসেও কত বন্ধু হল, উপহার বিমিনয় হল–পৃথিবী যে এত বড় জানা ছিলো না সুজনের। চীনের শেন, মিশরের আব্দুল্লাহ, ইন্দোনেশিয়ার ফাতিমা, ইরানের গুলরুখ ওর কাছ থেকে কথা

আদায় করে নিয়েছে দেশে ফিরে মাসে কম পক্ষে একটা চিঠি লিখবে। গত চার সন্ধ্যায় ওকে নাচ শিখিয়েছে বুলগেরিয়ার নিনা। কাল রাতে নাচ শেষ করে সবার সামনে ওর গালে চুমু খেয়েছে। যদিও এতে কেউ কিছু মনে করে নি, এসব দেশে বন্ধুদের চুমা খাওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা, কিন্তু সুজন লজ্জায় আপেলের মতো লাল হয়ে গিয়েছিলো।

ক্যাম্পে আসার দুদিন পর ওকে দারুণ এক সারপ্রাইজ দিয়েছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলার ইফতেখার হোসেন। যদিও তার দায়িত্বের ভেতর পড়ে না, খবর পেয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তিনি। সুজন তখন ব্রেকফাস্ট সেরে ওর ঘরে এসেছে কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে লেকচার হলে যাওয়ার জন্য। সেদিন সকালে পরপর ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম আর কোরিয়ার সেশন। এমন সময় ওর ঘরে টেলিফোন বাজলো। তুলতেই অফিস থেকে বললো, তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য বাংলাদেশ এম্ব্যাসির কাউন্সিলার অপেক্ষা করছেন রিসেপশনে।

সুজন একটু ঘাবড়ে গেলো। বুঝে উঠতে পারলো না কাউন্সিলার কেন ওর সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। রিসেপশনে যেতেই ছোটখাট গড়নের হাসিখুশি চেহারার মাঝবয়সী ভদ্রলোক ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন–তুমি তাহলে সুজন। তোমার কাগজপত্র দেখেই তোমাকে চিনে ফেলেছি, আমার নাম ইফতেখার। কখনো মার কাছে শুনেছো আমার কথা।

সুজন অবাক হল। মনে করতে পারলো না মা কখনো এ নামের কারো কথা বলেছেন। অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নাড়তেই কাউন্সিলার গলা খুলে হাসলেন–তোমার মার রাগ তাহলে এখনো পড়ে নি। আমি জাফরের বন্ধু ছিলাম। সত্তর সালে তোমার বাবা মার শেষ বিয়ে বার্ষিকীতে যেতে পারি নি বলে তোমার মা রাগ করে বলেছিলো আর কোনোদিন নাকি আমার সঙ্গে কথা বলবে না। বাহাত্তরে তোমার জন্মের পর একবার তোমাদের দেখতে গিয়েছিলাম। তারপর থেকেই দেশের বাইরে। প্রথম দিকে চিঠিপত্র লিখতাম। তোমার মা উত্তর দিতে না দেখে তাও বন্ধ হয়ে গেছে অনেক বছর।

সুজন মনে মনে বললো, চাচাঁদের সংসারে ঝি গিরি করে মা সময় পান কখন যে কারো চিঠির উত্তর দেবেন।

ওকে চুপ থাকতে দেখে কাউন্সিলার বললেন, কি বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি আমি যে তোমার বাবার বন্ধু ছিলাম? আমার বাসায় গেলেই দেখতে পাবে তোমার বাবা মার সঙ্গে আমার অনেক ছবি আছে। কখন যাবে বলো?

সুজন বললো, ক্যাম্প যদ্দিন চলবে বাইরে যাবো কীভাবে? সব প্রোগ্রাম তো। এদের হাতে। ক্যাম্প শেষ হলে সোজা নিয়ে প্লেনে তুলে দেবে।

কাউন্সিলার ওর কথার কোনো গুরুত্ব দিলেন না–বললেই হল প্লেনে তুলে দেবে? ক্যাম্প শেষ হওয়ার পর দু সপ্তাহ তুমি আমাদের সঙ্গে কাটাবে। তোমাকে বুলগেরিয়া থেকেও ঘুরিয়ে আনবো।

বাবার বন্ধুর প্রস্তাব সুজনের খুবই ভালো লাগলো। তবু বললো, মা জানেন আমি দু সপ্তাহ পরে ফিরবো। এখান থেকে ঢাকায় চিঠি লিখলে নাকি চোদ্দ দিন লাগে যেতে।

আমাকে তুমি ইফতি চাচা ডেকো। তোমার বাবা মা আমাকে ইফতি নামে ডাকতো। খবর দেয়ার জন্য ভেবো না। আমি ফোনে কথা বলবো তোমার মার সঙ্গে।

আমাদের বাসায় ফোন নেই ইফতি চাচা।

তাহলে আমি ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে তোমার মার নামে চিঠি পাঠিয়ে দেবো।

আমার ভিসা যে পনের দিনের।

পাগল ছেলের কথা শোন! হেসে সুজনের সব কথা উড়িয়ে দিলেন ইফতেখার হোসেন। বললেন, ফরেন মিনিষ্ট্রি আর হোম মিনিষ্ট্রি সবজায়গাতেই আমার বন্ধু আছে। তোমার পনের দিনের ভিসাকে এক মাসে বানানো কোনো সমস্যাই না।

মাত্র আধঘন্টা ছিলেন সুজনের হঠাৎ পাওয়া ইফতি চাচা। সারাক্ষণ ওকে মাতিয়ে রাখলেন, বাবা আর ওঁর ছেলেবেলার সব মজার মজার কথা বলে।

তিন দিন পর আবার এসেছিলেন ইফতি চাচা। এবার সঙ্গে চাচি আর ওঁদের একমাত্র মেয়ে কবিতাও ছিলো। ওর চেয়ে এক বছরের ছোট কবিতা, অথচ ওর গম্ভীর চেহারা দেখলে মনে হয় চার পাঁচ বছরের বড়। চাচা-চাচি দুজনেই বললেন বার তারিখে ক্যাম্প শেষ হওয়ার পর ওকে এসে নিয়ে যাবেন।

আগামী কাল ক্যাম্প শেষ হয়ে যাচ্ছে। দুপুরের পর থেকে সবাই যাওয়া আরম্ভ করবে। ইফতি চাচার ওখানে না গেলে সুজনকেও বিকেলে মস্কোর ফ্লাইট ধরতে হতো। ওকে যেতে হবে এ্যারোফ্লোটে মস্কো হয়ে।

মারিয়া আবার জিজ্ঞেস করলো, এত কি ভাবছো জন?

সুজন মৃদু হেসে বললো, তোমার কথা ভাবছি।

কি ভাবছো আমার কথা? জানতে চাইলো মারিয়া।

এখানে এসে তোমার মতো একজন বন্ধু পাবো আমি স্বপ্নেও ভাবি নি।

আমি ছাড়াও এখানে অনেকের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব হয়েছে। কাল যে তোমাকে চুমু খেলো–নীনা কি আমার চেয়ে দেখতে খারাপ?

তোমার কি ধারণা চেহারা সুন্দর হলেই ভালো বন্ধু হয়?

কি হলে ভালো বন্ধু হওয়া যায়?

সুন্দর একটা মন থাকলে। অবশ্য তুমি দেখতেও সুন্দর। তার চেয়ে বেশি–তুমি হচ্ছে সুন্দর মনের বন্ধু।

সুজনের কথা শুনে মারিয়ার চোখ ছলছল করে উঠলোকালই তো চলে যাবে তুমি। তোমাকে আমি খুব মিস করবো।

আমিও তোমাকে মিস করবো মারিয়া। চিঠি লিখলে জবাব দেবে?

নিশ্চয়ই দেবো। তুমি যদি কখনো ভুলে যাও লিখতে তবু আমি লিখবো।

তোমাকে লিখতে আমার কখনো ভুল হবে না।

তুমি তো আরো কিছুদিন থাকবে রুমানিয়ায়?

হ্যাঁ, তুমি তো দেখেছো আমার বাবার বন্ধুকে।

চমৎকার ভদ্রলোক। রাতে আমাকে ফোন করো।

বলতে হবে না মারিয়া। ফোন করে সারারাত জাগিয়ে রাখবো তোমাকে।

রাত জাগতে আপত্তি নেই যদি ফোনে গান শোনাও।

গান গাইবো ফোনে! কী সর্বনাশ! আমার চাচার মেয়েটাকে দেখেছো? কী রকম পুলিশের মতো দেখতে।

ধ্যেত! কবিতা পুলিশ হতে যাবে কেন! হেসে ফেললো মারিয়া–ওকে আমি ফরেন মিনিস্ট্রির একটা ফাংশনে দেখেছি। কি চমঙ্কার গিটার বাজিয়ে গাইলো–কান্ট্রি রোড টেক মি হোম। গানটা এখনো মনে আছে আমার।

কবিতা গান গায়! বলো কি! আমি তো ভেবেছিলাম গান শুনলে ওর কপালে ভাঁজ পড়বে।

না, না। কবিতা খুব ভালো মেয়ে। তোমার ভালো বন্ধু হবে।

আমার বেশি বন্ধু দরকার নেই মারিয়া। তুমি যতদিন বন্ধু আছো ততদিন আর কোনো বন্ধুর কথা আমি ভাববো না।

মারিয়া মিষ্টি হাসলো। বললো, আরেক কাপ কফি আনবো? আমার ইচ্ছে করছে তোমার সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ বসি।

আমারও তাই ইচ্ছে। সুজনও হাসলো।

মারিয়া টেবিলে রাখা কাগজের কাপ দুটো তুলে নিয়ে নিচে গেলো কফি আনতে। ঢাকায় থাকতে আসিফ ওকে তিন চারদিন কফি খাইয়েছিলো। এখানে মারিয়ার সঙ্গে কফি খেতে খেতে রীতিমতো নেশা ধরে গেছে। মারিয়া শুনে কালই ওর সুটকেসে এক কৌটা কফি গুঁজে দিয়েছে। ভাগ্যিস আসিফ ওকে কিছু হ্যাঁন্ডিক্রাফট কিনে দিয়েছিলো বন্ধুদের উপহার দেয়ার জন্য। মারিয়াকে ও দিয়েছে হাড়ের নকশা করা বালা। মারিয়া ওকে দিয়েছে ফারের এই কোটটা, যেটা পরে ও এখন বসে আছে। অন্য সব বন্ধুর দেয়া উপহারে বোঝাই হয়ে গেছে ওর সুটকেস।

মারিয়া দু কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি এনে টেবিলে রাখলো। সুজন বললো, আজ আমাদের ব্লকটা বেশি চুপচাপ কেন মনে হচ্ছে বলো তো?

জানো না বুঝি! মারিয়া হেসে বললো, নিচে অডিটোরিয়ামে সিনেমা দেখাচ্ছে। সবাই সেখানে। যাবে নাকি।

না মারিয়া, সিনেমা দুটো দেখেছি আর নয়। আমার খুব ভালো লাগছে তোমার সঙ্গে গল্প করতে।

মারিয়াকে ওর সব কথাই বলেছে সুজন। এমন কি রোম আসার পথে জামাল আহাদের সঙ্গে যে পরিচয় হয়েছে সে কথাও বলেছে। মারিয়া বলেছে, তোমার মিষ্টি স্বভাবের জন্য সবাই তোমার বন্ধু হতে চাইবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

এখানে আসার পর নিজেকেও ভালোভাবে চিনতে পেরেছে সুজন। মারিয়ার সঙ্গে পরিচয় না হলে অনেক অভিজ্ঞতা ওর অজানা থেকে যেতো।

পরদিন বিকেলে ক্যাম্প যখন ফাঁকা হতে শুরু করেছে ইফতি চাচা এলেন ওকে নিতে। দুপুরের পর থেকে মারিয়া ছিলো ওর সঙ্গে। বিদায় নেয়ার সময় সুজন খুব স্বাভাবিকভাবে মারিয়ার গালে চুমু খেলো। হাত মেলাতে গিয়ে মারিয়া বেশ কিছুক্ষণ ওর হাত চেপে ধরে রাখলো নিজের হাতের মুঠোয়। সুজনের বুঝতে অসুবিধে হল না মারিয়া ওর ভালোবাসার উত্তাপ ছড়িয়ে দিতে চাইছে।

সুটকেসটা পেছনের সিটে রেখে সুজন মারিয়াকে বললো, আজ রাতেই ফোন করবো। মন খারাপ করো না।

মারিয়া হাসার চেষ্টা করলো-তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকলাম।

সুজনের জন্য একটি রুমানিয়ান মেয়ের ভালবাসা ইফতি চাচার হৃদয় স্পর্শ করলো। মারিয়াকে বললেন, কাল রাতে আমার বাড়িতে সুজনের অনারে ডিনার দিচ্ছি। আমি খুব খুশি হবো তোমার বাবা মার সঙ্গে যদি তুমি আসো। তোমার বাবার সঙ্গে কাল অফিসে গিয়েই কথা বলবো।

মারিয়া অভিভূত হয়ে বললো, ডিনার নিমন্ত্রণের জন্য অনেক ধন্যবাদ আঙ্কেল। আমার মনে হয় না বাবা আপত্তি করবেন।

ইফতি চাচা নিজেই চালাচ্ছিলেন গাড়ি। সুজন ওঁর পাশের সিটে বসেছিলো। গাড়ি ছাড়ার পর ও বললো, আমার অনারে ডিনার আর আমিই জানি না। এটা কি রকম হলো ইফতি চাচা? এখানে আসর পর ওর কথার ধরণও বদলে গেছে।

তোকে সারপ্রাইজ দেবো বলে বলি নি।

সুজন হেসে ফেললো–জেনেই তো গেলাম। সারপ্রাইজ আর থাকলো কোথায়?

তোর বান্ধবীর কান্না দেখে মনটা কেমন করে উঠলো। তাই ওকে কান্না ভোলাবার জন্য তোর সামনে কথাটা বলে ফেললাম।

সুজন লজ্জা পেয়ে কথা ঘুরিয়ে বললো, ডিনারে আর কে আসবেন?

আমাদের এ্যাম্বাসাডর আসবেন ম্যাডামসহ, ইণ্ডিয়ান এম্ব্যাসির কাউন্সিলার আসবেন আর ভয়েস অব আমেরিকার বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে এসেছে আমাদের দেশী এক ছেলে, সে আসবে।

আমাদের দেশী ছেলে, কি করে ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি হল?

দেশী নামেমাত্র। জন্মেছে আমেরিকায়, পড়ালেখা ওখানেই করেছে। মেরিট ভালো, তাই ভয়েস অব আমেরিকা ওকে ইস্ট ইউরোপিয়ান ডেস্কে বসিয়েছে। রুমানিয়ায় আগেও দুবার এসেছে। এবার চসেস্কুর ইন্টারভিউ নেয়ার চেষ্টা করছে।

আপনার সঙ্গে পরিচয় হলো কীভাবে?

গতবার ও যখন এখানে ছিলো তখন আমেরিকান এম্ব্যাসির এক পার্টিতে পরিচয় হয়েছিলো। জন্মগতভাবে আমেরিকার নাগরিক হলেও বাঙালি রান্না ওর খুব পছন্দ, তাই সেবারও ওকে বাড়িতে একদিন নেমন্তন্ন করে খাইয়েছিলাম।

আপনি খুব অতিথিপরায়ন, তাই না ইফতি চাচা?

বুঝিস তো, এমন এক জায়গায় থাকি, দেশের মানুষের চেহারা দেখা, দেশী কথা শোনার সুযোগ খুব কমই হয়। তাই তোর চাচি আর আমি সুযোগ পেলে ছাড়ি না।

মা শুনলে খুব অবাক হবেন আপনার সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে গেলো।

অবাক হলে ক্ষতি নেই, তোকে আটকে রাখার জন্য রেগে না গেলেই বাঁচি।

রাগবেন কেন, মা জানেন বেড়াতে আমি কত ভালবাসি। জীবনে প্রথম এত বড় একটা সুযোগ পেয়েছি। রুমানিয়া যাবো শুনে মা খুশিতে কেঁদে ফেলেছিলেন।

ইফতি চাচা চিন্তিত গলায় বললেন, ডিনারের ব্যাপারটা যে জেনে ফেললি, তোর চাচি জানলে আমাকে বকবে। ও ঠিক করেছিলো সারপ্রাইজটা ও-ই তোকে দেবে।

সুজন একটু ভেবে বললো, ঠিক আছে ইফতি চাচা। আমি সারপ্রাইজড হবো। ধরে নিন কথাটা আমি শুনি নি। মারিয়াকে আপনি আড়ালে ডেকে বলেছেন।

তোর মাথায় খুব বুদ্ধি আছে। এই বলে হা হা করে গলা খুলে হাসলেন ইফতি চাচা। তারপর বললেন, ডিনারে যখন সারপ্রাইজ দেয়া গেলো না দেখি তোকে আর কীভাবে সারপ্রাইজ দেয়া যায়।

ইফতি চাচাকে এ নিয়ে বেশি ভাবতে হয় নি। পরদিন ডিনারে আকাশ ওদের। এমন এক সারপ্রাইজ দিয়েছিলো যে সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলো।