৪. সুজনের আরেক পৃথিবী

সুজনের জীবনে একসঙ্গে অনেক কিছু ঘটলো প্রথমবারের মতো। প্রথমবারের মতো প্লেনে চড়লো ও। দেশ ছেড়ে প্রথমবার বাইরে এলো। মাকে ছেড়ে প্রথমবার একা হল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে নিত্য গালমন্দ শোনা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো ওর। প্রথমবার এসবের হাত থেকে রেহাই পেলো। নতুন এক জগৎ দেখার উত্তেজনা, মুক্তির আনন্দ আর মাকে ছেড়ে আসার কষ্ট একসঙ্গে অনুভব করলো সুজন।

প্লেনে ওর পাশের সিটের যাত্রী ছিলো এক বাঙালি। বয়স চল্লিশের নিচে। গম্ভীর সৌম্য চেহারা দেখে মনে হয় লেখক অথবা অধ্যাপক। আকাশে ওড়ার কিছুক্ষণ পরই ওর সঙ্গে আলাপ জমে গেল। তার নাম জামাল আহাদ, ঢাকার এক নামকরা দৈনিকের সাংবাদিক। রোম যাচ্ছে কোনো এক কনফারেন্সে। যখন শুনলো সুজন হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সাংবাদিক জাফর চৌধুরীর ছেলে, তখন তার চেহারা থেকে গাম্ভীর্য খসে পড়লো। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, আমি তখন জগন্নাথ কলেজে পড়ি, সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। আমাদের একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিলো, চারণিক নাম। তার এক অনুষ্ঠানে জাফর ভাইকে প্রধান অতিথি করে এনেছিলাম। কী দারুণ বলতে পারতেন! আমার স্পষ্ট মনে আছে অনুষ্ঠানের শেষে ওকে যখন বিদায় দিতে যাচ্ছিলাম আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, লেখাপড়া শেষ করে কি হতে চাও। তার ব্যক্তিত্ব আর খ্যাতি দেখে সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বললাম, সাংবাদিক হবো। তিনি বললেন, এত সব পেশা থাকতে সাংবাদিক কেন? বললাম, যদি আপনার মতো হতে পারি। শুনে তিনি হাসলেন। পিঠ চাপড়ে বললেন, আমি চাই আমার চেয়ে অনেক বড় সাংবাদিক হও তুমি! আজ আমার খ্যাতি, অর্থ সবই আছে কিন্তু তিনি নেই, যার জন্য আমি এতদূর আসতে পেরেছি।

কথা বলতে গিয়ে জামালের গলা ভারি হয়ে এলো। সুজন ম্লান হাসলো, আপনি তবু বাবাকে দেখেছেন। আমার যখন জন্ম হয়েছে বাবা তখন আর এ পৃথিবীতে নেই।

জামাল ওকে নিজের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললো, তোমার ঢাকা ফেরার আগেই আমি রোম থেকে ফিরবো। দেশে ফিরে তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।

সুজন মাথা নেড়ে সায় জানালো–ঠিক আছে।

শুধু ঠিক আছে বললে হবে না সুজন। আজ থেকে তুমি আমাকে তোমার বড় ভাই ভাববে। তোমার যখন যা দরকার নিঃসঙ্কোচে বলবে আমাকে। তোমার জন্য কিছু করতে পারলে খুশি হবো আমি।

সুজন আগের মতো সায় জানালো। জামাল আবার বললো, তুমি কি আমাকে বড় ভাই হিসেবে গ্রহণ করেছো?

সুজন মৃদু হেসে বললো, করেছি জামাল ভাই।

বরুণ না আসাতে প্লেনে ওঠার সময় ওর বুকের ভেতর এক ধরনের অস্বস্থি বাসা বেঁধেছিলো। কোনো কিছুর দরকার হলে কি করবে, রোমে ঠিকমতো প্লেন বদলাতে পারবে কিনা–এমনি ধরনের অনেক ভয় বুকে চেপে বসেছিলো। জামালের কথা শুনে সব ভয় কর্পূরের মতো উবে গেলো।

মাঝরাতে দুবাইতে দুঘন্টার জন্য থেমেছিলো সুজনদের প্লেন। জামাল ওকে নিয়ে এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি শপে চলে গেলো। এখানে নাকি সব কিছু দারুণ সস্তা। সুজনের জঘন্য সুন্দর একটা চামড়ার জ্যাকেট কিনে ফেললো জামাল। ওকে নাকি খুব মানাবে। ভির্মি খাওয়ার দশা হল সুজনের। বললো, এটা কিছুতেই হতে পারে না জামাল ভাই। আমার জন্য তিনশ ডলার দিয়ে জ্যাকেট কিনবেন আমি ভাবতেও পারছি না।

জামাল বিষণ্ণ গলায় বললো, তার মানে তুই আমাকে বড় ভাই ভাবতে পারছিস, আপন ভাবতে পারছিস না।

না জামাল ভাই, বিব্রত গলায় সুজন বললো, বড় ভাই নিশ্চয় ভাবছি। কিন্তু এত দামি জ্যাকেট আমি আপনার কাছ থেকে নিতে পারি না।

বড় ভাইর এই সামান্য উপহারটুকু তুই যদি না নিস আমি ভীষণ কষ্ট পাবো। এই বলে জামাল ওকে জ্যাকেটটা পরিয়ে দিলো। সুজনকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মস্ত এক আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো–তাকিয়ে দেখ সুজন। তোকে ঠিক রূপকথার রাজপুত্রের মতো লাগছে।

লজ্জায় লাল হয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে সুজনের মনে হল সামনে দামি জ্যাকেট পরা যে সুদর্শন ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে সেটা ও নয়, অন্য কেউ। ওর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলো জামাল। জাফর চৌধুরীর কাছে ওর অনেক ঋণ। সুজনের হাসি ঝলমলে চেহারা দেখে জামালের মনে হল ঋণ শোধ করার সুযোগ এসেছে।

পরদিন বিকেলে সুজনদের প্লেন রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এয়ারপোর্টে নামলো। সুজনের টিকেট আর লাগেজ ট্যাগ নিয়ে গিয়ে কয়েকশ সুটকেসের ভেতর থেকে ওরটা বের করে আনলো জামাল। ট্রলিতে মালপত্র সব তুলে একে ওকে জিজ্ঞেস করে রুমানিয়ান এয়ারলাইন্স ট্যারম-এর কাউন্টার খুঁজে বের করলো। প্লেন ছাড়তে এখনো তিন ঘন্টা দেরি। সুজন বললো, আপনি চলে যান জামাল ভাই আমি এখানে আছি। ডাকলে চলে যাবো।

জামাল মৃদু হেসে বললো, আমি থাকলে কি তোর খারাপ লাগবে সুজন?

লজ্জা পেয়ে সুজন বললো, আপনি না থাকলে যে আমার কি হতে ভাবতেই ভয় লাগছে জামাল ভাই। হয়তো আমার সুটকেসটা অন্য কোনো প্লেনে চলে যেতো। এত বড় এয়ারপোর্টে হয়তো আমি নিজেই বুখারেষ্টের প্লেন হারিয়ে বসে থাকতাম।

সুটকেস আমারও বার তিনেক হারিয়েছে। ওটা হতেই পারে। চল কফি খাই।

ট্যারম কাউন্টার থেকে বেশ কিছুটা দূরে কফি কর্ণার। কফির সঙ্গে স্যাণ্ডউইচের অর্ডার দিলো জামাল। গত রাত থেকে জামালকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে সুজন। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মা ছাড়া ওর জন্য যা কিছু করেছে আসিফ। আসিফের করার পেছনে কারণ আছে। সুজনের মতো দেখতে ওর ছোট ভাই ছিলো, যে পানিতে ডুবে মরেছে। তাছাড়া ওরা এক সংগঠন করে, এক আদর্শে বিশ্বাসী। কোনো অনুষ্ঠানে সুজন ভালো করলে আসিফ সেজন্যে প্রশংসা পায়। কিন্তু জামালের সঙ্গে ওর সে রকম কোনো সম্পর্ক নেই। বাবার পরিচিত, বাবা তার আদর্শ ছিলেন–এই তো! এতটুকু পরিচয়ে ওর জন্যে কেউ এতখানি করতে পারে এটা সুজনের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিলো। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জামাল বললো, খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে তোকে। কি ভাবছিস?

একটু ইতস্তত করে সুজন বলেই ফেললো, আমার খুব খারাপ লাগছে, আপনি আমার জন্য এত কিছু করছেন অথচ আমি আপনার জন্য কিছু করতে পারছি না।

কিছুক্ষণ সুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো জামাল। তারপর আস্তে আস্তে বললো, আমার বয়স এক সময় তোর মতো ছিলো। তোর সঙ্গে কথা বললে মনটা পবিত্র হয়ে যায়। মনে হয় আমি সেই বয়সটাতে ফিরে গেছি।

জামালের কথা পুরোপুরি বোধগম্য হল না সুজনের। কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলো। জামাল বললো, এ পৃথিবীটা অনেক কঠিন জায়গা সুজন। আমি জানি তোকে অনেক ঝড়ঝাপ্টা সইতে হয়েছে। তারপরও তোর মনটা স্বর্গের মতো পবিত্র। আমি অনেক কিছু দেখেছি। অনেক মানুষের সঙ্গে মিশেছি। তোর মতো সরল নিষ্পাপ মানুষ আমি কখনো দেখি নি। তোকে আমি আর কষ্ট পেতে দেবো না সুজন। এখন থেকে তোর সকল ভার আমার।

সুজন কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। বুকের ভেতর কেমন যেন করতে লাগলো। দুচোখে কান্না জমলো। ধরা গলায় বললো, আপনি খুব ভালো জামাল ভাই।

জামালের স্নেহভরা হাসি সুজনের মন ভরিয়ে দিলো।

দু ঘন্টা পরে টেলিভিশনের পর্দায় ট্যারম-এর যাত্রীদের প্লেনে ওঠার জন্য বলা হলো। জামাল ওকে নিয়ে কাস্টমস চেকিং পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। বিদায় নেয়ার সময় জোর করে ওর পকেটে পঞ্চাশ ডলারের একটা নোট গুঁজে দিলো। বললো, এটা রাখ, আপদে-বিপদে কাজে লাগতে পারে। সুজন চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত জামাল দাঁড়িয়ে রইলো কাঁচের দরজার এপাশে। ভাবলো, মাথার ওপর ওর মতো একজন থাকলে সুজন জীবনে অনেক বড় হতে পারবে। ঠিক করলো ঢাকায় ফিরে গিয়েই ওর মার সঙ্গে দেখা করবে।

পুরোনো দিনের প্রপেলারওয়ালা ট্যারম-এর প্লেনখানা যখন বুখারেস্টে নামলো রাত তখন প্রায় বারটা। প্লেনে থাকতেই সুজনের ভয় হচ্ছিল, যদি বুখারেস্টের এয়ারপোর্টে নেমে দেখে ওকে কেউ নিতে আসে নি তাহলে কি হবে! ওর কাছে অবশ্য ঠিকানাসহ পাইওনিয়ার লীগের প্যাডে একখানা চিঠি আছে, যেখানে বলা হয়েছে ৩০ নবেম্বর বুখারেষ্টে স্বাগত জানানো হবে বাংলাদেশের দুজন ছাত্র প্রতিনিধিকে। পকেটে জামাল ভাইর দেয়া পঞ্চাশ ডলারের নোট আছে। কাউকে না পেয়ে ট্যাকসি নিয়ে চলে যাবে পাইওনিয়ারদের অফিসে। বুদ্ধিটা অবশ্য কফি শপে বসে জামাল ভাই দিয়েছিলো।

বুখারেস্টে প্লেন থেকে নেমে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে আসতেই সুজনের চোখে পড়লো, কয়েকটা ছোট ছোট প্ল্যাকার্ডে বিভিন্ন দেশের নাম উঁচু করে ধরে কয়েকজন তরুণী কাউকে খুঁজছে। সেনেগালের প্ল্যাকার্ডের পেছনে বাংলাদেশের নাম দেখে সুজন এগিয়ে গেলো সোনালি চুলওয়ালা চমৎকার চেহারার মেয়েটির দিকে। কাছে যেতেই মেয়েটি মিষ্টি হেসে ইংরেজিতে বললো, তুমি নিশ্চয় বাংলাদেশের। তোমার আরেক বন্ধু কই? রুমানিয়ায় স্বাগত জানাচ্ছি। আমার নাম মারিয়া।

মারিয়ার বাড়িয়ে দেয়া হাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সুজন বললো, ধন্যবাদ মারিয়া আমার আরেক বন্ধুর বাবা অসুস্থ থাকার জন্য আসতে পারে নি।

সেনেগালের প্ল্যাকার্ড হাতে মেয়েটা মারিয়ার দিকে তাকিয়ে রুমানিয়া ভাষায় কি যেন বললো। হেসে ওর কথার জবাব দিয়ে মারিয়া সুজনকে বললো, তোমার পাসপোর্ট আর লাগেজ ট্যাগ দাও। এখানে দু মিনিট বসো। আমি এক্ষুণি আসছি।

গদিআটা একটা চেয়ারে সুজনকে বসিয়ে রেখে মারিয়া ব্যস্ত পায়ে ভিড়ের ভেতর হারিয়ে গেলো। সুজন চারপাশে তাকিয়ে দেখলো অন্যান্য দেশ থেকে ওর মতো অনেকে এসেছে। বেশির ভাগই ওর কাছাকাছি বয়সের।

নাক বোঁচা ছোট চোখের চীনা না জাপানি একটা মেয়ে সুজনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। সুজন অপ্রস্তুত হয়ে ওর দিকে তাকাতেই মেয়েটা এগিয়ে এসে ইংরেজিতে বললো, আমার নাম শেন, চীন থেকে এসেছি। তুমি নিশ্চয় ইণ্ডিয়ান, পাইওনিয়ার ক্যাম্পে এসেছে।

সুজন হেসে ওর নাম বলতেই শেন হাত বাড়িয়ে বললো, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। আমার ধারণা তাহলে মিথ্যে নয়।

পুরোপুরি সত্যিও নয়। সুজন হেসে জবাব দিল–ক্যাম্পে এসেছি ঠিকই, তবে আমি ইণ্ডিয়ান নই, বাংলাদেশী।

শেন শব্দ করে হাসলো–ইণ্ডিয়া, চীন, বাংলাদেশ যাই হোক না কেন আমরা সবাই পাইওনিয়ার। আমরা সবাই এক। ঠিক কিনা বলো?

সুজন সায় জানাতেই হন্তদন্ত হয়ে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে ছুটে এলো মারিয়া। বললো, শিগগির চললো, আরেকটা প্লেন এসে পড়েছে। ভিড় আরও বাড়বে।

শেনের দিকে তাকিয়ে সুজন বললো, বিদায় শেন, আশা করি ক্যাম্পে দেখা হবে।

শেন হেসে হাত নাড়লো। মারিয়া বললো, এরই মধ্যে বন্ধু পেয়ে গেছো!

লাজুক হেসে সুজন বললো, না, ঠিক বন্ধু নয়। এখনই পরিচয় হল।

মারিয়া চোখ টিপে বললো, বন্ধু না হলেও হতে বেশিক্ষণ লাগবে না। তোমার। মতো হ্যান্ডসামের সঙ্গে অনেক মেয়ে বন্ধুত্ব করতে চাইবে।

মারিয়ার কথা শুনে লজ্জায় সুজনের কান-টান সব লাল হয়ে গেলো। ভিড়ের ভেতর দিয়ে ট্রলি ঠেলে এগোতে এগোেতে মারিয়া বললো, ইচ্ছে করছে অন্য কোনো মেয়ে তোমার বন্ধু হওয়ার আগে আমিই বন্ধু হয়ে যাই, যদি কিছু মনে না করো।

আরো লাল হয়ে সুজন কোনো রকমে বললো, আমার জন্য সেটাই খুবই আনন্দের হবে মারিয়া।

লাউঞ্জের বাইরে লম্বা দুই বগিওয়ালা বাস দাঁড়িয়েছিলো। সামনের বগি ভর্তি হয়ে গেছে। সুজনকে নিয়ে পেছনের বগিতে উঠলো মারিয়া। সুজনের কাছাকাছি বয়সী বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েতে এই বগিটাও ভরে গেলো। একসঙ্গে অনেকগুলো দেশের ভাষা শুনলো সুজন। বাসের দরজার কাছে একজন মাঝবয়সী লোক ড্রাইভারকে কি যেন বললো। বাস ততক্ষণে চলা আরম্ভ করেছে।

রাস্তায় যথেষ্ট আলো না থাকাতে সুজন বুঝতে পারলো না ওরা কোনিদিকে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মারিয়াই বললো, আমরা ঠিক শহরের উল্টোদিকে যাচ্ছি। দুঘন্টার ভেতর ক্যাম্পের জায়গায় পৌঁছে যাবো আমরা। একদিকে কার্পেথিয়ান পর্বত, আরেক দিকে চমৎকার এক হ্রদ। আমার ধারণা জায়গাটা তোমার ভালো লাগবে।

ঢাকা থেকে প্লেনে ওঠার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত সুজনের সারা মন ভালো লাগার রোমাঞ্চকর আমেজে ভরেছিলো। যখন থেকে ওর জ্ঞান হয়েছে, ভালো-মন্দ বোঝার বয়স হয়েছে, তখন থেকে জেনে এসেছে ওর পৃথিবীটা তিন বাই দুই নন্দলাল দত্ত লেনের পুরোনো এক বাড়ির শ্যাওলা ধরা দেয়ালের ভেতর চিরকালের মতো আটকা পড়ে আছে। সেই সুজন এখন ইউরোপের চমৎকার সুন্দর এক দেশে বেড়াতে এসেছে মনে হয় পুরো ব্যাপারটাই বুঝি শেষরাতের স্বপ্ন। একটু পরেই বড় চাচার বকুনি শুনে ঘুম ভাঙবে। শীতের কামড় খেতে খেতে বাগানের কাজ করতে হবে। তারপর ছোটদের পড়ানো, বাজারে যাওয়া–গত কয়েক বছর ধরে ঘড়ির কাঁটা ধরে যেসব কাজ করে এসেছে সবই করতে হবে।

সুজনকে চুপচাপ দেখে মারিয়া নরম গলায় বললো, তুমি এত চুপচাপ কেন সুজন? আগে কখনো দেশের বাইরে যাও নি?

সুজন একটু অপ্রস্তুত হল–দেশের বাইরে আমি প্রথম এসেছি?

বাড়ির জন্য মন খারাপ লাগছে?

সুজন ম্লান হাসলো। কোনো কথা বললো না।

মারিয়া আবার প্রশ্ন করলো–বাড়িতে কে কে আছে তোমার?

মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই।

তোমার বাবা?

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মারা গেছেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

মারিয়া লক্ষ্য করলো সুজনের কথায় গর্ব আর বেদনার সুর। ওর হাতের ওপর নিজের হাত রেখে বললো, আমি তোমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা পড়েছি। একাত্তর সালে তোমরা স্বাধীন হয়েছিলে।

মাথা নেড়ে সায় জানালো সুজন–তুমি ঠিক বলেছো মারিয়া।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মারিয়া আস্তে আস্তে বললো, দেশের জন্য মরতে পারাটা বিরাট গর্বের ব্যাপার জান। আমার বাবার দুই ভাই মারা গেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, আমাদের দেশ থেকে হানাদার জার্মান নাজী বাহিনীকে তাড়াতে গিয়ে।

মারিয়ার সমবেদনা সুজনের হৃদয় স্পর্শ করলো। কিছুক্ষণ কোনো কথা বললো না ওরা। মারিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো, আমরা কেউ যুদ্ধ চাই না অথচ যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়।

বাসের জানালা দিয়ে সুজন বাইরে তাকিয়ে দেখলো পাহাড়ের গায়ে পাইন আর বার্চ বনের মাথার ওপর কৃষ্ণপক্ষের আধখানা চাঁদ উঠেছে। বাসের জানালা দরজা সব বন্ধ। ভেতরে হিটিং-এর কারণে বেশ গরম। বড় বড় কাঁচের জানালার বাইরে হু হু করে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। নরম বার্চ গাছগুলো এলোমেলো দুলছে। চাঁদের হলদেটে স্নান আলোয় সব কিছু রহস্যময় মনে হচ্ছিলো ওর।

রুমানিয়া যাচ্ছে শুনে দুদিন বৃটিশ কাউন্সিলে গিয়ে এদিককার ইতিহাস ভূগোল নিয়ে যে কটা বই পেয়েছে চোখ বুলিয়ে নিতে ও ভোলে নি। রাজাকে আর জার্মান হানাদারদের হটিয়ে কমিউনিস্টরা কি করে দেশটাকে শত্রুমুক্ত করেছে কোনো কিছুই সুজনের অজানা নয়। একটা ভয়ের উপন্যাস পড়েছে-ড্রাকুলা নাম। কার্পেথিয়ান পর্বতের এক দুর্গম জঙ্গলের ভেতর কাউন্ট ড্রাকুলার দুর্গ। এক ভয়ঙ্কর পিশাচ, মরে গেছে কয়েকশ বছর আগে অথচ তার লাশ এখনো কফিনের ভেতর তাজা রয়েছে। রোজ রাতে কফিনের ভেতর থেকে সেই লাশ জ্যান্ত হয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর কালো বাদুড়ের রূপ ধরে উড়ে বেড়ায় জঙ্গলের ভেতর আর আশে পাশের গ্রামে। সুযোগ মতো একা কাউকে পেলে গলায় দাঁত বসিয়ে রক্ত টেনে নেয়। গ্রামের মানুষেরা ঘরের জানালা দরজায় রসুন ঝুলিয়ে রাখে। নাকি রসুনের গন্ধ পিশাচ সহ্য করতে পারে না। কী করে ড্রাকুলাকে হত্যা করা হল সে কথাও উপন্যাসে বলা হয়েছে। তবু মাঝ রাতে গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সুজনের একবার মনে হল বাদুড়ের রূপ ধরে কোনো পিশাচ উড়ে বেড়াচ্ছে কিনা কে জানে।

বাসের যাত্রীদের দুএকজন মাত্র জেগে আছে। বাকিরা গভীর ঘুমে অচেতন। সুজন পাশে তাকিয়ে দেখলো মারিয়াও ঘুমিয়ে পড়েছে। মারিয়াকে একদিন ড্রাকুলার কথা জিজ্ঞেস করতে হবে।

ঘুমের ভেতর মারিয়ার মুখটাকে মনে হচ্ছে ঠিক পুতুলের মতো সুন্দর। রুমানিয়ায় পা দেয়ার প্রথম দিনই এত সুন্দর একটা মেয়ে ওর বন্ধু হতে চেয়েছে কালই আসিফকে চিঠি লিখে জানাতে হবে। বাংলাদেশে বোধ হয় এখন ভোর হচ্ছে। বাড়িতে থাকলে বড় চাচার ধমক খেতে হতো ঘুম থেকে না ওঠার জন্য। অথচ এখন এতটুকু ঘুম পাচ্ছে না ওর। অবশ্য রোম থেকে বুখারেস্ট আসার সময়ও প্লেনে কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছিলো। তারপরও বাংলাদেশের সময়ে যখন রাত হওয়ার কথা সে সময় বেশিরভাগ ও না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে।

বড় চাচার কথা ভাবতে গিয়ে তার জন্য মায়া হলো সুজনের। ফিরে গিয়ে পরিষ্কার জানিয়ে দেবে দাদার বাড়িতে ওঁদের যতটুকু দাবি আছে ওর দাবি কোনো অংশে কম নয়। দরকার হলে উকিলের সঙ্গে কথা বলবে। বাবা নেই বলে মা চিরকাল চাচাঁদের সংসারে চাকরানী হয়ে থাকবেন এটা হতে পারে না। আর কিছুদিন পর ওর বয়স আঠার বছর হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সময় হয়েছে। প্লেনে জামাল আহাদের সঙ্গে কথা বলার পর সুজনের সাহস আর বয়স দুইই বেড়ে গেছে অনেক। ও আর এখন পুরোনো ঢাকার বদ্ধ গলির সেই মুখচোরা ছেলেটি নয়।