৮. ঝড়ের সংকেত

কোনো সমস্যা দেখা দিলে মাথা ঠাণ্ডা রাখা আর দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজে নেমে পড়ার অভ্যাস অল্প বয়স থেকে রপ্ত করেছে আকাশ। এলেনাকে খুঁজে বের করতে হবে। যেখানে যত যোগাযোগ আছে সব কাজে লাগাতে হবে। সেই রাতেই ও দেখা করলো আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে।

প্রথমবার বুখারেস্টে এসেই তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো। এবার এসে যখন দেখা করতে গেছে তখন রাষ্ট্রদূতকে আগের চেয়ে অনেক আন্তরিক মনে হয়েছে। কারণ আর কিছুই নয়–প্রফেসর গর্ডন। আকাশের বুখারেস্ট আসার আগেই তিনি রাষ্ট্রদূতকে ফোন করে বলেছেন, ওর যখন যা প্রয়োজন সবরকম সহযোগিতা যেন করা হয়। প্রফেসর গর্ডনের ফোন করার গুরুত্ব বোঝেন রাষ্ট্রদূত। যে কারণে আকাশকে বলেছিলেন, যখনই দরকার হবে সোজা চলে আসবে। ফোনে এ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হবে না।

রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আকাশের দেখা হল রাত দশটায়। সব শুনে বললেন, তোমার সঙ্গে আমি একমত আকাশ। কাজটা গুপ্ত পুলিশের। তোমার সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য হয়তো ওকে জেরা করার জন্য ধরেছে। তুমি চসেস্কুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছো। তোমার আদ্যপান্ত ওদের ভালোভাবে জানতে হবে।

আকাশ চিন্তিত গলায় বললো, ঘটনা যদি তাই হয় আমি ভাবনার কিছু দেখি না। আমার ভয় হচ্ছে–এলেনা সম্ভবত সরকার বিরোধী কোনো তৎপরতার সঙ্গে জড়িত। এটা যদি ওরা জানতে পারে তাহলে ওর তো বিপদ হবেই, আমাকেও সন্দেহ করতে পারে।

তুমি নিশ্চিত থাকো আকাশ। শান্ত গলায় রাষ্ট্রদূত বললেন, তোমার মতো একজন আমেরিকান নাগরিককে হয়রানি করার আগে চসেস্কুর গুপ্ত পুলিশকে দুবার ভাবতে হবে।

হয়রানি না করুক চসেস্কুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার বাতিল করে দিতে পারে।

তা পারে। আকাশের সঙ্গে একমত হলেন রাষ্ট্রদূত। একটু ভেবে বললেন, কাল আমি ফরেন মিনিস্ট্রির সঙ্গে কথা বলবো। তুমিও হোম মিনিস্টারকে জানিয়ে রাখো। তবে তোমার জন্য এই মুহূর্তে এলেনার চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে চসেস্কুর সাক্ষাৎকার পাওয়া। এলেনাকে নিয়ে তোমার হৈচৈ করা ওরা পছন্দ করবে বলে মনে হয় না।

রাষ্ট্রদূতের কথায় সায় জানিয়ে আকাশ বলল, কাল সকালে আমি তিমিশোয়রা যাচ্ছি। এলেনা বলেছে ওখানে নাকি কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর রয়েছে আমার জন্য।

সাবধানে থেকো। এখানে এসে আমি দেখেছি গুপ্ত পুলিশের চর সব মহলে আছে। ওপর মহলে ওরা যখন চসেস্কুর সমালোচনা করে তখন আমি সাবধান হয়ে যাই। অনেক লোকের দেখা পাবে যারা ভাব দেখাবে চসেস্কুর ওপর ভীষণ বিক্ষুব্ধ, আসলে ওরা গুপ্তচর। তোমার মনোভাব জানার জন্য এরকম করবে।

আমি জানি। তবে এলেনার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে, ও চসেস্কুর চর নয়।

আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হোটেলে ফেরার সময় আকাশের মনে হল, ওর পরিকল্পনার কথা ইফতি মামাকে বলা দরকার। বাংলাদেশের দূতাবাসের কাউন্সিলার কূটনীতিক হিসেবে ততটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও আজ সন্ধ্যার পর থেকে ওঁকে মনে হচ্ছে ওর খুবই আপনজন।

আকাশ যখন কাউন্সিলারের বাড়িতে এলো তখন পার্টি শেষ হয়ে গেছে। অতিথিরা সবাই চলে গেছেন। বাড়ির সবাই ড্রইংরুমে বসে সুজনের কথা শুনছিলো।

ডোরবেলের শব্দ শুনে কবিতা উঠে গিয়ে দরজা খুলে আকাশকে দেখে চমকে উঠলো। ওর মা বললেন, এসো আকাশ, চেহারা দেখে বুঝতে পারছি কিছু খাও নি। কবিতা, ওকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসো। আমি খাবার গরম করে আনছি।

ইফতি মামা বললেন, একটু ব্র্যান্ডি নেবে আকাশ? আজ ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে।

আকাশ সায় জানালে গ্লাসে ব্র্যাণ্ডি ঢেলে নিয়ে তিনি আর সুজন গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলেন। ব্রাণ্ডির গ্লাসে চুমুক দিয়ে আকাশ বললো, গুপ্ত পুলিশের প্রধান আর ওদের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ওর কি কথা হয়েছে।

সুজন বললো, এলেনার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে আমি মারিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পারি। ওর বাবা ফরেন মিনিষ্ট্রির ডিরেক্টর জেনারেল।

কবিতা সায় জানালো–সুজন ঠিক বলেছে। মারিয়ার বাবাকে আমি চিনি। আমার মনে হয় তিনি কিছু করতে পারবেন?

খেতে খেতে আকাশ বললো, আমি কাল তিমিশোয়ারা যাচ্ছি। পরশু ফিরবো। তোমরা এদিকে দেখো কি করতে পারো। ইফতি মামা আপনিও দেখুন, ডিপ্লোম্যাটিক সার্কেলে কিছু করা যায় কিনা। আমি বেশি হৈচৈ করতে চাই না। হুট করে হয়তো বলে দেবে তিন দিনের ভেতর রুমানিয়া ছাড়ো।

সুজন বললো, আমি কি মারিয়াকে ফোন করবো।

আকাশ বললো, এত রাতে ফোন করা কি ঠিক হবে?

মারিয়া আমাকে রাতেই ফোন করতে বলেছে। বলতে গিয়ে সুজন লাল হল।

ঠিক আছে। আকাশ বললো, আমি তাহলে উঠছি। ভোরে বেরোতে হবে।

আকাশকে সবাই ওর গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। ইফতি মামা কয়েকবারই বললেন, সাবধানে থেকো আকাশ।

সামান্য পরিচয়ে এই পরিবারটির আন্তরিকতায় অভিভূত হলো আকাশ। সুজনকে বললো, মা হয়তো কালই তোকে ফোন করবেন। বলিস তিমিশোয়ারা থেকে ফিরে এসে আমি ফোন করবো।

গাড়িতে ওঠার পর বিদায় জানাতে গিয়ে সুজন আর কবিতা দুজনেই বললো, ভালো থেকো আকাশ ভাই।

হাত নেড়ে গাড়ি নিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেলো আকাশ।

সুজন ঘরে এসে মারিয়াকে ফোন করলো। বললো, তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম। ডিনারে আসতে পারি নি বাবা এক মিটিঙে আটকে পড়েছেন বলে।

সুজন বললো, তোমাকে আমরা মিস করেছি।

সবাই, না তুমি একা?

সবাই। মারিয়া শোন, আমার ভাই ভয়েস অব আমেরিকার বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে দুসপ্তাহ আগে বুখারেস্ট এসেছে। ওর দোভাষী এলেনাকে আজ সকালের পর থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।

ওর বাড়ির লোকেরা জানে না কোথায় গেছে?

ওরাইতে বলেছে আমার ভাইকে।

পুলিশ স্টেশনে খবর নিয়েছে?

সিক্রেট পুলিশের চীফকে চেনে আমার ভাই। তার সঙ্গে কথা বলেছে। ওরা কিছু বলতে পারছে না।

রাতে কিছু করা যাবে বলে মনে হয় না। মিটিঙ থেকে বাবা এখনো ফেরেন নি। কাল তোমার কি প্রোগ্রাম?

কোনো প্রোগ্রাম নেই।

কবিতাকে নিয়ে সকালে আমাদের বাসায় চলে এসো। বাবার সঙ্গে এলেনার ব্যাপারে আমি কথা বলে রাখবো। তোমরা এলে সবাই মিলে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবো।

ঠিক আছে। রাখি তাহলে।

শুভরাত্রি।

শুভরাত্রি জানিয়ে সুজন রিসিভার রেখে কবিতাকে বললো, মারিয়ার বাবা এখনো বাড়ি ফেরেন নি। কাল সকালে ও তোমাকে আর আমাকে যেতে বলেছে ওদের বাসায়।

মুখ টিপে হেসে কবিতা বললো, বলেছে তো তোমাকে। আমাকে জড়াচ্ছো কেন?

তোমাকেও বলেছে। বিশ্বাস না হলে ফোন করতে পারো।

ইফতি চাচা বললেন, আমি অফিসে যাওয়ার সময় তোমাকে নামিয়ে দেবো।

চাচি বললেন, তাহলে তো তোমাদের রাত জাগা চলবে না। কবিতা, সুজনের বিছানা করে দিয়েছো?

কবিতা মাথা নেড়ে সায় জানালো।

গেস্ট রুমে এক হাত পুরু ফোমের গদির বিছানায় শুয়ে সুজন ভাবছিলো, এক মাস আগেও কি ও ভাবতে পেরেছিলো এরকম এক পরিবেশে কখনো ওর দিন কাটতে পারে! বাবার ভাইদের কাছ থেকে যে পরিমাণ দুর্ব্যবহার ও পেয়েছে বাবার বন্ধু ইফতি চাচা কিংবা বাবার গুণগ্রাহী জামাল ভাইর কাছ থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসা পেয়েছে। শুধু ইফতি চাচা কেন, চাচি কবিতা এরা কি ওর কম যত্ন নিচ্ছে! কবিতার চেহারা দেখে ভেবেছিলো ও বুঝি খুব রাগী হবে, ওকে পাত্তা দেবে না, অথচ এ বাড়িতে আসার পর যা করছে মনে হয় আপন বোনও এতখানি করে না। আর ভাই হলে কি হবে, কোনো দিন নামও তো শোনে নি আকাশের। চাচাঁদের সংসারের এত সব খুঁটিনাটি কাজ নিয়ে ওকে ব্যস্ত থাকতে হয় যে কোনো দিন ভাববার সময়ও পায় নি ফুপুর ছেলেমেয়েদের নিয়ে। বাংলাদেশে এখন হয়তো ভোর হচ্ছে। মা রান্নাঘরে ঢুকেছেন সকালের নাশতা বানাবার জন্য। বড় চাচার জন্য তিন দফা চা বানাতে হয়। নাশতাও তো সবাই একরকম করে না। বড় চাচার ছেলেমেয়েরা খাবে বাটার টোস্ট, ছোট চাচার ছেলেমেয়েরা আটা রুটির সঙ্গে ভাজি খাবে না, ওদের জন্য সুজির হালুয়া করতে হয়। সুজনের ভাগ্য ভালো থাকলে কখনো ভাজি জোটে, নইলে চা দিয়ে রুটি খেতে হয়। ওর মনে পড়লো না বাড়িতে চাচারা কেউ কোনোদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছে কি দিয়ে ও নাশতা করে। সুজন ভাবলো ও আমেরিকা যাচ্ছে বেড়াতে, মা যদি তখন সঙ্গে থাকতো কি মজাই না হতো!

জানালায় কাঁচের বাইরে তাকিয়ে দেখলো ঝুর ঝুর করে তুলোর মতো বরফ পড়ছে। সকালে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, গাছপালা সব বরফে ঢাকা পড়ে যায়। বিকেলে কবিতা বলছিলো, এবার বড়দিনের আগেই বরফ পড়া আরম্ভ হয়েছে। বড়দিন নাকি খুব জমবে। এরই মধ্যে ও সাত বন্ধুর কাছে থেকে নেমন্তন্ন পেয়েছে। যারা আজ নেমন্তন্ন করেছে কবিতা তাদের সুজনের কথা বলেছে। ওরা সবাই সুজনকেও নেমন্তন্ন করেছে। বড়দিনের পরদিনই আকাশের সঙ্গে ও রওনা দেবে আমেরিকা। এসব কথা ভাবতে গিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত উত্তেজনায় ঘুমোতে পারলো না সুজন।

পরদিন সকাল নটায় সুজন আর কবিতাকে মারিয়াদের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেলেন ইফতি চাচা। কবিতাকে বললেন, গাড়ি দরকার হলে অফিসে ফোন করার জন্য। কবিতা অবশ্য ওর বাবার অফিসের গাড়ির চেয়ে বাসে চলাফেরা বেশি পছন্দ করে।

এলেনার ব্যাপারে আকাশ কি কি করেছে শুনে মারিয়া মুখ শুকিয়ে বললো, বাবার সঙ্গে আমি কথা বলেছি। বাবা বলেছেন, খোঁজ নিশ্চয় পাওয়া যাবে, তবে গুপ্ত পুলিশের হাতে পড়লে সহজে ছাড়া পাবে না।

কবিতা বললো, তোমার বাবা পার্টির এত বড় একজন নেতা, এলেনার ব্যাপারে চেষ্টা করলে নিশ্চয় তিনি কিছু করতে পারবেন।

মারিয়া একটু হাসলো। বললো, বাবার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব সবই করা হবে। বাবা আমাকে কথা দিয়েছেন। এ নিয়ে তোমরা ভেবো না।

সুজন বললো, তোমার ভাইকে দেখছি না যে! আমরা বেরোচ্ছি কখন?

লুপানকে একটু বাইরে পাঠিয়েছি। ও তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে আছে।

কবিতা উদাস গলায় বললো, ঈশ্বর জানেন, ভাই বেশি অস্থির থাকে না বোন–

কবিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই লুপান ঘরে ঢুকলো। মারিয়ার চেয়ে বয়সে তিন বছরের ছোট হলেও লম্বায় ওর মাথা ছাড়িয়ে গেছে। হাসিখুশি উজ্জ্বল চেহারা,

সুজনকে হ্যালো জন, আমি লুপান, বলে হাত বাড়িয়ে দিলো।

সুজন হাত মিলিয়ে বললো, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হয়েছি লুপান।

লুপান হেসে বললো, আশা করি আমরা ভালো বন্ধু হতে পারবো, কি বলল কবিতা?

আমার বলার কিছু আছে বলে তো মনে হয় না। বরং মারিয়াকে জিজ্ঞেস করো।

মারিয়া মিষ্টি হেসে বললো, দেখো কবিতা, তুমি সারাক্ষণ আমাকে খোঁচাচ্ছো।

লুপান ওদের থামিয়ে দিয়ে বললো, মনে হয় আমাদের এখনই বেরোনো দরকার।

এক মিনিট। বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মারিয়া।

লুপান কবিতাকে বললো, আমি তোমার সঙ্গে বাজি ধরতে পারি, পোশাক পাল্টাতে মারিয়া কম পক্ষে দশ মিনিট সময় নেবে।

কবিতা হেসে বললো, নিজে তো খুব সেজেছো, মিছেমিছি মারিয়ার পেছনে লাগছো কেন?

লুপান লাজুক হেসে বললো, মেলায় যাবো যে। এটা হচ্ছে আমাদের ট্রাডিশনাল ড্রেস।

সুজন লক্ষ্য করলো, এ ধরনের পোষাক ও ক্যাম্পের পাশের গ্রামে বুড়োদের পরনে দেখেছে এক বিয়ের উৎসবে। লুপানকে রীতিমতো জমকালো মনে হচ্ছিলো।

মারিয়ার তৈরি হতে দশ মিনিট নয়, পুরো বারো মিনিট লাগলো। কবিতা বললো, তুমি বাজি হেরে গেছে লুপান!

মারিয়া অবাক হয়ে জানতে চাইলো, কিসের বাজি?

লুপান বললো, আমি বোঝাতে চেয়েছি মারিয়ার এক মিনিটের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগবে।

কথা ঘোরালে চলবে না। কবিতা গম্ভীর হওয়ার ভান করলোতুমি বলেছো দশ মিনিট লাগবে। মারিয়ার লেগেছে বারো মিনিট।

সুজন কোনো কথা না বলে মুগ্ধ চোখে মারিয়াকে দেখছিলো। ওকে মনে হচ্ছিলো ঠিক পরিদের মতো। মারিয়া হেসে বললো, বাদ দাও ওসব বাজির খেলা। আমাকে কেমন দেখাচ্ছে জন?

অপূর্ব! এক কথায় জবাব দিলো সুজন।

ওরা চারজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাস ধরলো। এদেশের বাসগুলো খুবই আরামের। সুজন ভাবলো, কবে আমাদের দেশে এরকম বাস হবে, মানুষ এত হাসিখুশি হবে! ছেলেমেয়ে সবার স্বাস্থ্য ভালো, পরণের পোষাক ভালো, অনেক খুঁজেও বুখারেষ্টের রাস্তায় কোনো ভিখিরি দেখতে পায় নি সুজন।

বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে খোলা মাঠে বড় মেলা বসেছে। খুচরো দোকানদাররা প্রায় সবাই জিপসি, নানারকমের হাতের কাজের জিনিষ বিক্রি করছে। সুজনকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে মারিয়া, লুপান, কবিতা সবাই ওর জন্য উপহার কিনলো। মারিয়া কিনেছে লোমের টুপি, লুপান কিনেছে চামড়ার দস্তানা আর কবিতা কিনেছে জিপসিদের এম্ব্রয়ডারি করা কাঁধে ঝোলানোর ব্যাগ। বিব্রত সুজন বার বার শুধু ধন্যবাদ দিলো। ওর কাছে রুমানিয়ার টাকা না থাকাতে কিছুই কিনতে পারলো না। ভাবলো লুপানকে সাপের চামড়ার একটা মানিব্যাগ উপহার দেবে। ওর সুটকেসে এখনো গোটা দুই রয়ে গেছে।

অনেকক্ষণ মেলায় ঘুরে ওরা পুরোনো একটা ওক গাছের নিচে বসলো। মারিয়া আর কবিতা নিজেদের জন্যেও জিনিস কিনেছে। দাম নিয়ে ওরা দুজন নিজেদের মধ্যে তর্ক করছিলো, কে বেশি জিতেছে এ নিয়ে। লুপান এক ফাঁকে উঠে গিয়ে চারটা বড় পেস্ট্রি আর কাগজের গ্লাসে করে কফি আনলো।

সুজন লক্ষ্য করছে রুমানিয়ানরা চমৎকার পেস্ট্রি বানায়। ঢাকায় আসিফ ওকে কয়েকবার খাইয়েছিলো, এগুলোর তুলনায় কিছুই না। পান পেস্ট্রি খেতে খেতে বললো, মারিয়া লক্ষ্য করেছিস, আজকাল নতুন এক ফ্যাশন বেরিয়েছে?

মারিয়া একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলো, কিসের ফ্যাশন?

ছেলে মেয়ে অনেককেই দেখছি বুকের কাছে কালো গোলাপ সেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক বুড়ো বুড়িও তাই করছে।

কবিতা একটু হেসে বললো, আমারও চোখে পড়েছে। পোশাকের সঙ্গে কালো গোলাপটা মানাচ্ছে কিনা সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।

মারিয়া ঠোঁট উল্টে বললো, নিশ্চয় ইয়াস্কিদের কোনো পপ গ্রুপকে টেলিভিশনে দেখেছে ওরকম পরতে। হুজুগে লোকের কি অভাব আছে দেশে?

সুজন কফির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে মারিয়াকে বললো, দেশে থাকতে খবরের কাগজে পড়েছি পূর্ব ইউরোপের কয়েকটা দেশ সমাজতন্ত্রকে বাতিল করে দিয়েছে। ওরা গণতন্ত্রের কথা বলছে। রুমানিয়াতে ওরকম কোনো দল আছে যারা সমাজতন্ত্র চায় না?

প্রশ্নই উঠে না। সুজনের প্রশ্ন হেসে উড়িয়ে দিলো মারিয়া–রুমানিয়ার অবস্থা ওদের সবার চেয়ে ভালো। সমাজতান্ত্রিক শিবিরে আমরাই একমাত্র দেশ যাদের বিদেশের কাছে কোনো ঋণ নেই। মানুষের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছো। আমাদের দেখে কি মনে হয় আমরা খারাপ আছি?

মারিয়ার কথা কবিতার পছন্দ হল না। একবার ভাবলো বলবে, তোমাদের বাবা পার্টির নেতা, তোমরা তো ভালো থাকবেই। আমি বহু রুমানিয়ান দেখেছি এই শীতে যাদের বাড়িতে হিটিং সিস্টেম নেই, রুটির জন্য তিন চার ঘন্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়।

কথাগুলো বলতে গিয়েও বললো না কবিতা। জানে গুপ্ত পুলিশের কাছে খবর চলে যাবে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলার সন্দেহজনক লোক, তার মেয়ে বিপজ্জনক কথা বলে। ভাবলো, সুজনকে বাড়িতে এক সময় সব বুঝিয়ে বলবে।

সন্ধ্যায় কবিতার সঙ্গে ওদের বাড়ির বারান্দায় বসে সুজন এসব কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। বললো, মানুষের অবস্থা এত খারাপ, এরা প্রতিবাদ করে না কেন?

প্রতিবাদ করে না গুপ্ত পুলিশ সিকিউরিতার ভয়ে। কবিতা বললো, চসেস্কুর বাহিনী যখন তখন লোকজনদের ধরে নিয়ে গুম করে ফেলে। এলেনা ফিরে আসবে কিনা আমার সন্দেহ আছে।

ইফতি চাচা যে বললেন, এলেনাকে গুম করা সহজ কাজ হবে না। ভয়েস অব। আমেরিকার বিশেষ প্রতিনিধির দোভাষী, বিদেশে জানাজানি হয়ে যাবে না?

এরা এসব কেয়ার করে না। তবে মানুষ যে তৈরি হচ্ছে না তা নয়। মারিয়ার কথা বিশ্বাস কোরো না। ও একটা পাঁড় কমিউনিস্ট। আমাদের বাড়িতে যে বুড়ো মহিলা কাজ করতে আসেন তাঁকে তো দেখেছো। একবার তার স্বামীর অসুখ হল। হাসপাতালে নেয়ার পর বললো, বয়স হয়েছে, আজ বাদে কাল মরবে, খামখা ওষুধ দিয়ে কি হবে!

কবিতার কথা শুনে আঁতকে উঠলো সুজন–বলে কি?

কাষ্ঠ হেসে কবিতা বললো, এরকম আরও আছে। মহিলার ছেলে ইরিম মাঝে মাঝে আসে এখানে। ও বলেছে শিগগিরই একটা কিছু হবে। মেলাতে পান যে কালো গোলাপের কথা বললো, কিছু বুঝেছো?

হ্যাঁ, নতুন ফ্যাশন হয়েছে, তাই তো বললো।

ওটা ফ্যাশন নয়। ইরিম আমাকে বলেছে যারা যারা এ ব্যবস্থাকে মানে না তারা কালো গোলাপ পরে নীরবে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

গুপ্ত পুলিশ এ খবর জানে না?

মারিয়ার কথা তো শুনেছো। পার্টির লোকেরা ওরকমই ভাবছে। তাছাড়া এরা কোনো মিটিং মিছিল করছে না। এমনিতে বোঝার উপায় নেই ওরা কারা। বড় জোর মনে হতে পারে হুজুগে।

কবিতার কথা ভাবনায় ফেলে দিলো সুজনকে। তবে একটা কথা ওর ভালো লাগে নি। মারিয়া সম্পর্কে বললো, পাঁড় কমিউনিস্ট। কথাটা এমনভাবে বললো, যেন কমিউনিস্ট হওয়াটা খারাপ কিছু।

চাচি ওদের জন্য চা আনলেন। বললেন, বারান্দায় বেশিক্ষণ বোসো না। রেডিওতে বলেছে আবহাওয়ার অবস্থা ভালো নয়। তুষার ঝড় হতে পারে।

সুজন বাইরে তাকিয়ে দেখলো বাইরে কোথাও এক ফোঁটা বাতাস নেই। পশ্চিমের আকাশে স্লেটের মতো ধুসর কালো মেঘ। তুষার ঝড়ের কথা ভেবে ও প্রথমে উত্তেজিত হলো। এতদিন বইয়ে শুধু পড়েছে, চোখে দেখে নি। এবার তাহলে দেখা যাবে। পরেই ওর মন খারাপ হয়ে গেলো। কবিতা বলেছে বহু লোকের বাড়িতে হিটিং সিস্টেম নেই। তুষার ঝড় হলে ওদের নিশ্চয় খুব কষ্ট হবে।