৯.
টেলিভিশনে হিন্দি সিনেমার নাচ দেখতে দেখতে হঠাৎ করে দবির চাচার মনে হলো ঘরের ভেতর কিছু একটা ঘটছে। তার মনে হতে থাকে ঘরটা শীতল হয়ে আসছে। শুধু যে শীতল হয়ে আসছে তা নয়, মনে হচ্ছে অনেকে ফিসফিস করে কথা বলছে। হঠাৎ করে দবির চাচার কেমন জানি ভয় ভয় করতে থাকে। সে উঠে দাঁড়াল, তার কী মনে হলো কে জানে, সে নীতুর ঘরটা দেখতে গেল। দরজার ছিটকিনি খুলে সে দরজাটা খোলার চেষ্টা করতে গিয়ে হঠাৎ করে আবিষ্কার করল দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। কী আশ্চর্য।
দবির চাচা আবার দরজাটা ধাক্কা দিল, অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। যার অর্থ নীতু নিজেকে মুক্ত করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব। মানুষকে কেমন করে শক্ত করে বাঁধতে হয় সে খুব ভালো করে জানে, তার বাঁধন থেকে ছাড়া পাওয়া রীতিমতো অসম্ভব। দবির চাচা এবারে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, দরজাটা খোলো৷
কেউ দরজা খুলল না। খুলবে সেটা দবির চাচা আশাও করেনি। দবির চাচা অবশ্যি মোটেও ঘাবড়ে গেল না, বলা যেতে পারে একটু বিরক্ত হলো। দরজা যদি না খোলো তাহলে দরজাটা ভাঙতে হবে। দরজা ভাঙা এমন কোনো কঠিন ব্যাপার না। সে আগে অনেকবার দরজা ভেঙে মানুষের বাড়িতে ঢুকেছে। একটু দূর থেকে ছুটে এসে হাত আর ঘাড়ের মাঝখানের জায়গাটা দিয়ে ধাক্কা দিতে হয়। দরজা ভাঙার আগে আরেকবার চেষ্টা করল, হুঙ্কার দিয়ে বলল, দরজা খোলো, না হলে কিন্তু খুন করে ফেলব।
কেউ দরজা খুলল না।
.
ঘরের ভেতরে ঠিক সেই সময় অবশ্যি কারো দরজা খোলার মতো অবস্থা ছিল না। ঠিক তখন পুরো ঘরটা হিমশীতল হয়ে এসেছে। ঘরের ঠিক মাঝখানে কুয়াশার মতো কিছু একটা পাক খেয়ে ধীরে ধীরে মানুষের রূপ নিয়েছে। নীতু, মিতি, সজল আর সজীব অবাক হয়ে দেখল তাদের মাঝখানে ধবধবে সাদা শাড়ি পরা একটি নারী মূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠছে, বাতাসে তার চুল উড়ছে, মুখটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, শুধু দুটো চোখ ধক ধক করে অঙ্গারের মতো জ্বলছে। নারী মূর্তিটি এসে খাঁচার দিকে তার হাতটা বাড়িয়ে দিতেই একটা বিদ্যুৎ ঝলকের সঙ্গে সঙ্গে খাঁচার দরজাটা সশব্দে খুলে যায়। ভেতর থেকে ভূতের বাচ্চা সোলায়মান বের হয়ে এলো। সে নারী মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, মা, তুমি কেন এত দেরি করে এসেছ? আরো আগে কেন এলে না?
সাদা শাড়ি পরা নারী মূর্তিও ফিসফিস করে দুর্বোধ্য কণ্ঠে কিছু একটা বলে শিশুটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। তার যাওয়ার সময় হয়েছে। শিশুটি একবার তার মায়ের দিকে তাকাল, তারপর নীতুর দিকে তাকাল। মায়ের সঙ্গে চলে যাওয়ার আগে সে নীতুকে একবার গভীরভাবে আলিঙ্গন করল, তার গালে চুমু দিয়ে বলল, নীতু আপু আমি যাই?
নীতু ফিসফিস করে বলল, যাই বলতে হয় না। বলল আসি।
সোলায়মান বলল, আমি আসি?”
এসো সোনা।
সোলায়মান তার মায়ের কাছে চলে যাওয়ার আগে মিতি, সজল আর সজীবের দিকে তাকাল তারপর তাদেরকেও একবার করে আলিঙ্গন করল। তারপর কেমন যেন বাতাসে ভেসে ওপরে মায়ের কোলে উঠে গেল।
সজীব ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, আমরা কী চক্র এখন ভাঙব?
নীতু বলল, না। সবাই চলে যাক তারপর ভাঙব।
ঠিক তখন তারা শুনতে পেল দবির চাচা বাইরে থেকে চিৎকার করে বলছে, দরজা খোলো, না হয় দরজা ভেঙে ফেলব।
ভেতর থেকে তারা কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল। দবির চাচা তখন সত্যি সত্যি দরজা ভাঙার জন্যে দুর থেকে ছুটে এসে তার পুরো শরীর দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল। পুরো দরজা থরথর করে কেঁপে উঠল কিন্তু দরজাটা ভাঙল না।
দবির চাচা তখন আবার দরজা ধাক্কা দেয়ার জন্যে দূরে সরে গেল, যখন সে দরজার দিকে ছুটে আসতে শুরু করল অশরীরী নারী মূর্তি তখন দরজাটি খুলে দিল এবং দবির চাচা প্রচণ্ড জোরে যেন এসে ঘরের ভেতর খাঁচার ওপরে আছড়ে পড়ল।
নীতু, মিতি, সজল আর সজীব দেখল অশরীরী নারী মূর্তিটি তার হাত বাড়িয়ে দবির চাচাকে শূন্যে ঝুলিয়ে নিয়েছে, তারপর তাকে আছাড় দিয়ে নিচে ফেলেছে। দবির চাচা কাতর গলায় যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল, অশরীরী নারী মূর্তি তখন আবার তাকে শূন্যে তুলে নিল, তারপর প্রচণ্ড শক্তিতে খাঁচার ভেতর ছুঁড়ে দিল। নীতু, মিতু, সজল আর সজীব অবাক হয়ে দেখল সশব্দে খাঁচার দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে ঘরের ভেতর বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ হলো এবং হঠাৎ করে তারা দেখতে পেল ঘরে কেউ নেই। শুধু দবির চাচা খাঁচার ভেতরে আটকা পড়ে যন্ত্রণার মতো শব্দ করছে।
নীতু বলল, এখন আমরা চক্র ভেঙে দিই।
সবাই তখন হাত সরিয়ে নিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। নীতু গিয়ে ঘরের আলো জ্বালাল, তার ঘরটা মোটামুটি লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। খাঁচার ভেতরে গুটিশুটি মেরে দবির চাচা আটকা পড়ে আছে, কী অবাক লাগছে দেখতে।
দবির চাচা চিঁ চিঁ করে বলল, নীতু মা। খাঁচার দরজাটা খুলে দেবে?
নীতু খাঁচার কাছে গিয়ে আবিষ্কার করল সেটা খোলার কোনো উপায় নেই। সোলায়মানের মা যাওয়ার সময় দরজাটা পাকাপাকিভাবে লাগিয়ে দিয়ে গেছে। ওয়েল্ডারের কাছে নিয়ে যেতে হবে এটা কেটে খোলার জন্যে। নীতু বলল, দবির চাচা এটা খোলার কোনো উপায় নাই। আপনাকে ওয়েল্ডারের দোকানে নিতে হবে।
নিয়ে যা মা। তাড়াতাড়ি নিয়ে যা।
আমি কেমন করে নিব। বড় মানুষ কেউ একজন আসুক। ঠিক তখন দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল। নীতু বলল, এই যে কেউ একজন এসেছে। নীতু হাসি হাসি মুখে বলল, দবির চাচা, মনে হয় আপনার বস লোক পাঠিয়েছে খাঁচাটাকে নিয়ে যেতে।
খাঁচার ভেতরে আটকে থাকা দবির চাচা চি চি করে বলল, বিদায় করে দাও মা। কিছু একটা বলে বিদায় করে দাও।
নীতু বলল, আমি কী বলে বিদায় করব? আপনি ওদের সঙ্গে কথা বলেন।
নীতু গিয়ে দরজা খুলে দিল, দুজন মুসকো জোয়ান মানুষ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সারা শরীরে মাংসপেশী কিলবিল কিলবিল করছে। একজন মেঘের মতো শব্দ করে বলল, দবির মিয়া আছে?
জি আছে।
বল বড় স্যার লোক পাঠিয়েছে।
নীতু বলল, বরং আপনিই দবির চাচাকে বলেন।
আমি?
হ্যাঁ।
ডাকো দবির মিয়াকে।
নীতু মাথা নাড়ল, বলল, ডাকার উপায় নাই। আপনি বরং ভেতরে এসে কথা বলেন।
মানুষটা নীতুর কথা শুনে অবাক হলো। তারা প্রথমে ভেতরে ঢুকতে চাচ্ছিল না। তখন একজন আরেকজনের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলল, তারপর দুজনে ভেতরে ঢুকল। নীতু মানুষ দুজনকে তার ঘরে নিয়ে যায়।
মুসকো জোয়ান মানুষ দুজন নীতুর ঘরে ঢুকে চমকে ওঠে। একজন অবাক হয়ে বলল, আরে! দবির মিয়া তুমি খাঁচার ভেতরে কেন?
আরেকজন বলল, তুমি না বলেছিলে খাঁচার ভেতরে ভূতের বাচ্চা থাকবে। তুমি কেন খাঁচায় ঢুকেছ?”
দবির চাচা চিঁ চিঁ করে বলল, সেইটা অনেক লম্বা স্টোরি। ভাইজান আমারে একটু বের করবেন?
মানুষ দুজন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তারপর খাঁচাটা ভালো করে দেখল, তারপর নীতুর দিকে তাকাল, তারপর জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা কী?
নীতু বলল, আমরা জানি না। দবির চাচাকে জিজ্ঞেস করেন। সবচেয়ে ভালো হয় আপনারা দবির চাচাকে সঙ্গে নিয়ে যান। দবির চাচা তখন তার অনেক লম্বা স্টোরিটা আপনাদের ঠিক করে বলতে পারবে।
মানুষ দুজন তখন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, একজন বলল, এই মেয়ে ঠিক কথাই বলেছে। দবির মিয়া মহা ধুরন্ধর, তার মাথায় কী মতলব কে জানে! তারে বসের কাছে নিয়া যাই।
বস বলেছে অর্ধেক টাকা অ্যাডভান্স করেছে, টাকা নিয়ে পালিয়ে না যায়।
নীতু বলল, মনে হয় না এখন দবির চাচা পালাতে পারবে। তাই না দবির চাচা?
দবির চাচা কোনো কথা না বলে বেলুন থেকে বাতাস বের হওয়ার মতো এক ধরনের শব্দ করল।
মানুষ দুজন তখন খাঁচার দুই পাশে ধরে দবির চাচাকে নিয়ে যেতে লাগল। নীতু বলল, একটা চাদর দিই। ঢেকে নিয়ে যান, মানুষজন দেখলে সন্দেহ করতে পারে।
মানুষ দুজনের একজন বলল, সেটা ঠিকই বলেছ। দাও একটা চাদর। পরে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।
নীতু বলল, ফিরিয়ে দিতে হবে না। ধরে নেন এই চাদরটা দবির চাচার জন্যে গিফট। এই চাদরটা নিয়ে দবির চাচার অনেক স্মৃতি আছে। তাই না দবির চাচা?
দবির চাচা আবার বেলুন থেকে বাতাস বের হওয়ার মতো একটা শব্দ করল।
আব্বু আম্মুর রাত দশটার দিকে ফিরে আসার কথা ছিল কিন্তু তারা অনেক আগে ফিরে এলেন। প্রথমত দবির চাচার ওপর বিশ্বাস করে নীতুকে বাসায় একা রেখে গিয়ে তাদের খুব অশান্তি লাগছিল। মাঝখানে বাসায় ফোন করে যখন তারা দেখলেন কেউ ফোন ধরছে না তখন নীতুর আব্বু-আম্মু খুব ভয় পেয়ে গেলেন, তারা সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে বাসায় চলে এলেন।
বাসায় এসে জানতে পারলেন তাদের সন্দেহটি খুব ভুল ছিল না, সত্যি সত্যি নীতুকে খুব বিপদের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। ভাগ্যিস মিতি, সজল আর সজীব তাকে উদ্ধার করার জন্যে চলে এসেছিল তা নাহলে কী হতো তারা চিন্তাও করতে পারেন না।
তবে ভূতের বাচ্চা সোলায়মানের ঘটনাটা বিশ্বাস করাতে তাদের খুব কষ্ট হলো। শেষ পর্যন্ত নীতুর আব্বু-আম্মু মেনে নিয়েছেন কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস করেছেন বলে মনে হলো না।
মিতি, সজল আর সজীবকে নীতুর আম্মু সেই রাতে আর বাসায় যেতে দিলেন না। তারা নীতুর সঙ্গে থেকে গেল। নীতুর বিছানায় সজল আর সজীবের ঘুমানোর ব্যবস্থা হলো। ফ্লোরে একটা তোষক বিছিয়ে নীতু আর মিতি শোয়ার আয়োজন করে ফেলল।
ঘুমাতে ঘুমাতে অবশ্যি তাদের অনেক রাত হয়ে গেল। ভূতের বাচ্চা সোলায়মানের গল্প কিছুতেই শেষ হয় না।
অনেক রাতে শেষ পর্যন্ত যখন তারা ঘুমাতে গেল তখন সজীব বলল, আচ্ছা নীতু আপু। ভূতের বাচ্চা সোলায়মান কী আর কখনো আসবে?
মিতি বলল, এখন তো আর সে আটকা পড়ে নেই। সে তো ছাড়া পেয়ে গেছে। এলেও তো আমরা দেখতে পাব না।
নীতু হি হি করে হেসে বলল, কে জানে! সে হয়তো এখানেই বসে আমাদের গল্প শুনছে। আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছি না!
ঠিক তখন ভূতের বাচ্চা সোলায়মান আলমারির ওপর পা ঝুলিয়ে বসে ছিল, সে চিৎকার করে বলল, এই যে দেখো! আমি এখানে!
নীতু, মিতি, সজল আর সজীব কেউ অবশ্যি তার কথা শুনতে পেল না!
পড়ে অনেক মজা পেলাম কিন্তু জাফর ইকবাল বইটিতে সোলায়মান এর জায়গায় অন্য নাম ব্যবহার করলে খুশি হতাম।