৬.
দবির চাচা যখন টের পেয়েছে নীতু কীভাবে কীভাবে জানি একটা ভূতের বাচ্চাকে হাজির করে ফেলেছে এবং সেটা বাসায় ঘোরাঘুরি করে বেড়াচ্ছে, তখন তার উত্তেজনার সীমা নেই। প্রথমে গেস্টরুমে বসে খুবই ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করেছে। মিডলইস্টে সে সোনা চোরাচালানির কাজ করত, যে মানুষগুলোর সঙ্গে কাজ করত তার একজন ধরা পড়ে গেছে খবর পেয়ে পরের দিন প্লেনে করে দেশে পালিয়ে এসেছে। বুদ্ধি করে সে পালিয়ে এসেছিল, যারা সেখানে হাজির ছিল তারা সবাই ধরা পড়ে গেছে। দেশে কী করবে এখনো ঠিক করতে পারেনি, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় এক-দুইদিন থাকতে পারবে কিন্তু পাকাপাকি থাকা-খাওয়ার একটা ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত সে আসল কাজে মন দিতে পারবে না।
নীতুর ঘরে ভূতের বাচ্চাটা দেখে সে বুঝতে পেরেছে সে যদি পুরো ব্যাপারটা ঠিক করে সামলাতে পারে তাহলে তার কপাল খুলে যাবে। মানুষ জিন-ভূতের গল্প পড়ে সিনেমা দেখে কিন্তু সত্যি সত্যি একটা ভূতের বাচ্চা কেউ ধরে ফেলতে পারবে সেটা কল্পনারও বাইরে। অথচ সেই জিনিসটাই ঘটতে যাচ্ছে।
কীভাবে ভূতের বাচ্চাটাকে ধরবে সেইটাও মনে মনে ঠিক করে রেখেছে। অজ্ঞান পার্টিরা গুমের এক ধরনের ওষুধ ব্যবহার করে, এটার কোনো রং, স্বাদ আর গন্ধ নাই। তার কয়েক ফোঁটা নীতুকে খাইয়ে দিতে হবে। তাহলে নীতুকে নিয়ে তার বাবা-মা নিশ্চয়ই হাসপাতালে দৌড়াবে, বাসা পুরোপুরি খালি হয়ে যাবে তখন ভূতের বাচ্চাটাকে ধরে ফেলতে হবে। বাচ্চাটা দেখা যায় না সেটা খুবই ভালো। একটা খাঁচার ভেতরে ঢুকিয়ে সবার চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। বলতে হবে কুকুরের জন্যে খাঁচা, বিদেশি অ্যালসেশিয়ান কুকুর। ভূতের বাচ্চাটাকে নিজের কাছে রেখে লাভ নেই। সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে দিতে হবে। কত টাকায় বিক্রি করতে পারবে সেইটা হচ্ছে কথা। মানুষজনকে বিশ্বাস করানো নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। বিষয়টা এতই অবিশ্বাস্য যে কাউকে বিশ্বাস করানো কঠিন হবে। কিন্তু একবার ভূতের বাচ্চাটাকে ধরে নিতে পারলে তখন আর সমস্যা নাই। বিশ্বাস না করে যাবে কোথায়?
দবির চাচা তার ঘরে বসে ঠাণ্ডা মাথায় পুরোটা চিন্তা করল, নিখুঁত একটা পরিকল্পনা করতে হবে। প্রথমে তৈরি করতে হবে খাঁচা, খাঁচায় ভূতের বাচ্চাটাকে ভরে সেটাকে একটা ভ্যানে করে নিয়ে যেতে হবে বিশ্বাসী কারো বাসায়। দেরি করা যাবে না, তাই তখনই দবির চাচা বাসা থেকে বের হয়ে গেল।
বাইরে থেকে সে বাসাটা একটু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, একতলা বাসা, পুরনো ধাঁচের বিল্ডিং, জানালায় শিক দেয়া, কাঠের জানালা। নীতুর ঘরটা এক পাশে, জানালার পাশে একটা গাছও আছে। বাইরে থেকে কেউ একজন বাসায় ঢুকেছে সেইরকম একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সেটা এমন কিছু কঠিন হবে না।
দবির চাচা রাস্তার পাশে দিয়ে হাঁটতে থাকে। খাঁচা তৈরি করতে হবে এ রকম একটা ওয়েল্ডারের দোকান দরকার।
দবির চাচা খুঁজে এ রকম একটা ওয়েল্ডারের দোকান বের করে মালিকের সঙ্গে কথা বলল। ছোটখাটো একটা খাঁচা তৈরি করে দিতে হবে। তিনফুট উঁচু, দেড়ফুট চওড়া আর দেড় ফুট লম্বা। খাঁচার একটা দরজা থাকবে, সেই দরজায় কড়া লাগানো থাকবে যেটাতে তালা লাগানো যাবে। সবকিছু শুনে মালিক একটা টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, কোনো সমস্যা নাই। বানিয়ে দেব। জিআই পাইপ দিয়ে তৈরি হবে, লোহার অ্যাঙ্গেলে ওয়েল্ডিং হবে। ফার্স্ট ক্লাস ফিনিশিং।
দবির চাচা বলল, কতক্ষণ লাগবে বানাতে?
দুই দিন সময় দেন।
দবির চাচা চোখ কপালে তুলে বলল, দুই দিন? অসম্ভব। দুই ঘন্টার মাঝে তৈরি করে দিতে হবে।
মালিক টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, আমার মালামাল কিনতেই আধা দিন বের হয়ে যাবে। পাইপ কিনব, সাইজ মতো কাটব, ওয়েল্ড করব–
দবির চাচা মাথা নাড়ল, বলল, আমার এত কিছু জানার দরকার নাই। কোনখান থেকে পাইপ কিনবেন, কী করবেন সেইটা আপনার মাথা ব্যথা! আমার খাঁচা দরকার। দুই ঘণ্টার মাঝে করে দিতে পারলে বলেন, না হলে অন্য কারো কাছে যাই।
মালিক আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর পিচিক করে দেওয়ালে থুথু ফেলল, তারপর বলল, ডাবল খরচ দিতে হবে। আর ফিনিশিং বেশি ভালো হবে না।
দবির চাচা বলল, ফিনিশিংয়ের খেতা পুড়ি। আমার দরকার একটা সলিড খাঁচা। খরচের ব্যাপার পরে মাল ডেলিভারি দিতে পারবেন কী না সেইটা বলেন।
দোকানের মালিক বলল, না পারার কী আছে? টাকা ঢাললে এই দেশে বাঘের দুধ পর্যন্ত পাওয়া যায়।
দবির চাচা বলল, টাকা নিয়ে চিন্তা করবেন না। কত লাগবে বলেন।
দোকানের মালিক একজন মিস্ত্রিকে ডাকল, বলল, কালু, একটা ইস্টিমেট দে।
কালু মিস্ত্রি একটা লোহার পাইপ কাটছিল, কাজ বন্ধ করে বলল, কিসের ইস্টিমেট?”
তিন ফুট খাঁচা। চার ইঞ্চি ফাঁকা। আধা ইঞ্চি জিআই পাইপ। তলা দেড়ফুট বাই দেড় ফুট। দুই ঘণ্টায় ডেলিভারি। ইমার্জেন্সি অর্ডার।
কালু মিস্ত্রি লেখাপড়া জানে না তাই তার সব হিসাব মাথার ভেতরে করতে হয়। সে উপরের দিকে তাকিয়ে হিসাব করতে শুরু করে। দোকানের মালিক দবির চাচাকে জিজ্ঞেস করল, খাঁচার মাঝে কী রাখবেন?
দবির চাচা দুলে দুলে হাসল, বলল, সেইটা আপনার জানার দরকার নাই! এমন এক জিনিস যেটা জীবনেও কোনো মানুষ আগে দেখে নাই। ভবিষ্যতেও দেখবে না!
দোকানের মালিক ভ্রু কুঁচকে দবির চাচার দিকে তাকাল, বলল, বেআইনি মাল?
দবির চাচা হাঁ হাঁ করে হাসল, বলল, আইনি বেআইনি জেনে আপনি কী করবেন? কত লাগবে বলেন, অর্ধেক অ্যাডভান্স করে যাব। বাসার ঠিকানা দিয়ে যাব, ডেলিভারির সময় বাকি অর্ধেক পাবেন। ঠিক আছে?
দোকানের মালিক পিচিক করে দেওয়ালে আরেকবার থুতু ফেলে বলল, ঠিক আছে।
.
ওয়েল্ডারের দোকান থেকে বের হয়ে দবির চাচা কিছু মানুষকে ফোন করল। মিডল ইস্টে পালিয়ে যাওয়ার আগে সে এখানে যাদের সঙ্গে কাজ করত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে বড় একজন গডফাদারের সঙ্গে অ্যাপয়েনমেন্ট করল। বাসার ঠিকানা বের করে সে দশতলা একটা বিল্ডিংয়ের নিচে হাজির হয়। লিফটের কাছে একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল, দবির চাচাকে সে লিফটে করে আটতলায় নিয়ে গেল। সেখানে একটা খুপচি অফিস, বাইরে একটা ইনডেন্টিং অফিসের সাইনবোর্ড। দরজায় টোকা দিতেই একজন সাবধানে দরজা একটু ফাঁক করে তাকালো, তারপর দুইজনকে ভেতরে নিয়ে গেল। দুইটা ঘর পার হয়ে তারা বড় একটা ঘরে হাজির হলো, সেখানে একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের পেছনে একজন থলথলে মোটা মানুষ বসে আছে। দবির চাচাকে দেখে বলল, আরে দেখো কে এসেছে! আমাদের দবির মিয়া।
দবির চাচা মাথা নুইয়ে সালাম করে বলল, ভালো আছেন বস।
থলথলে মোটা মানুষটা সবসময়েই ঘামছে, রুমাল দিয়ে ঘাড় মুছে বলল, কেমন করে ভালো থাকি বল। কথা নাই বার্তা নাই তুমি মিডল ইস্ট চলে গেলা। এখন আবার কথা নাই বার্তা নাই দেশে ফিরে আসলা। ব্যাপারটা কী?
দবির চাচা বলল, বস, আপনার সঙ্গে খালি হাতে দেখা করি কীভাবে। সেইজন্যে অপেক্ষা করছিলাম। এখন হাতে একটা জিনিস আছে ভাবলাম বসকে সুযোগটা দেই।
কী জিনিস? ড্রাগস নাকি জাল নোট?
দবির চাচা মাথা নাড়ল, বলল, না বস। আপনার কাছে এই রকম ছোট জিনিস নিয়ে আসি নাই। এর চাইতে অনেক বড় জিনিস নিয়া আসছি।
কী আনছ? খোলাসা করে বল।
দবির চাচা মাথা নিচু করে বলল, যদি অনুমতি দেন তাহলে একটু বসি? বসে ব্যাপারটা বলি?
থলথলে মোটা মানুষটা তোয়ালের মতো একটা রুমাল দিয়ে ঘাড় মুছে বলল, বসো। তারপর তাড়াতাড়ি যা বলার বলে ফেলল।
দবির চাচা সামনে একটা চেয়ারে বসে বলল, সব, আপনারে আমি যেটা বলব সেটা আপনি বিশ্বাস করবেন না। আমি যদি নিজের চোখে না দেখতাম আমি নিজেও বিশ্বাস করতাম না। আপনাকে আমি এমন একটা জিনিস দিতে পারি যেটার মূল্য কত হতে পারে সেটা আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না।
থলথলে মোটা মানুষটা দবির চাচাকে একটা ধমক দিয়ে বলল, ধানাই-পানাই না করে যেটা বলতে চাও বলে ফেলো।
দবির চাচা তখন থলথলে মানুষটাকে ভূতের বাচ্চা সোলায়মানের কথা বলল। ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে তার যথেষ্ট ঝামেলা হলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তাকে বিশ্বাস করাতে পারল। সবকিছু শুনে থলথলে মোটা মানুষটা বলল, এখন বল, আমার কী করতে হবে
বিনা নোটিশে চলে এসেছি বস, হাতে কোনো টাকা-পয়সা নাই। দশ লাখ টাকা যদি দেন আপনার হাতে ভূতের বাচ্চা সোলায়মানকে তুলে দেই। সেইটা দিয়ে আপনি কী করবেন কয় কোটি টাকা বানাবেন সেটা আপনার ব্যাপার।
থলথলে মোটা মানুষটা বলল, টাকা গাছে ধরে? তোমার মুখের কথায় আমি তোমাকে দশ লাখ টাকা দিয়ে দেব?
দবির চাচা বিনয়ে একেবারে গলে গিয়ে বলল, আমাকে মুখের কথার কেন দেবেন? মাল ডেলিভারি দেব, আপনি পরীক্ষা করে দেখবেন সব ঠিক আছে কীনা তারপর দেবেন।
তাই বলে দশ লাখ? টাকা কী বাতাসে ওড়ে। পাঁচ লাখে রাজি থাকো মাল নিয়ে আসো।
দবির মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, মাত্র পাঁচ লাখ? বস আপনাদের দয়াতে বেঁচে থাকি।
থলথলে মোটা মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, উহ। পাঁচের বেশি সম্ভব না। তুমি যেটা বলছ সেটা সত্যি হলে পুলিশের ঝামেলা হতে পারে, পত্রিকাওয়ালারা পেছনে লেগে যাবে। পাঁচ লাখে রাজি থাকলে মাল নিয়ে আসো নাহলে অন্য কোথাও যাও।
অন্য কোথায় যাব বস? সবসময় আপনার নিমক খেয়ে বড় হয়েছি। আপনি যদি বলেন পাঁচ তাহলে পাঁচই রাজি। তবে?
তবে কী?
যদি দুই লাখ অ্যাডভান্স দিতেন?
থলথলে মানুষটা শীতল চোখে দবির চাচার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, আমারে বিশ্বাস করো না?
বিশ্বাসের ব্যাপার না বস। আমার নিজের একটু খরচপাতি আছে, জোগাড়যন্ত্র আছে। হাতে ক্যাশ নাই।
ঠিক আছে, তোমারে দুই লাখ অ্যাডভান্স দিচ্ছি কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখবা।
বলেন বস কী মনে রাখতে হবে? যদি দেখা যায় এইখানে কোনো গোলমাল আছে, আসলে কোনো ভূতের বাচ্চা নাই পুরোটা একটা ভুয়া ঘিরিঙ্গীবাজি তাহলে কিন্তু তুমি শেষ বুঝেছ?
জি বুঝেছি।
যাও। বিদায় হও।
দবির চাচা দাঁড়ালো কিন্তু বিদায় হলো না। মাথা নিচু করে হাত কচলাতে লাগল। থলথলে মোটা মানুষটা তখন ড্রয়ার খুলে সেইখান থেকে এক লাখ টাকার দুইটা বান্ডিল বের করে ছুঁড়ে দিল।
দবির নোটের বান্ডিল দুটি নিয়ে পকেটে রেখে বলল বস, আমি একটা ফোন দিব। আপনি তখন খালি একটা পিকআপ ট্রাক পাঠাবেন, বাকি দায়িত্ব আমার।
ঠিক আছে যাও।
দবির চাচা একেবারে নিচু হয়ে সালাম দিয়ে বের হয়ে এলো। যে মানুষটা তাকে নিয়ে এসেছিল সে লিফটে করে একেবারে নিচে এসে তাকে নামিয়ে দিয়ে গেল। বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময় বলল, মনে আছে তো? ভুয়া মাল দিলে তোমার
মানুষটা কথা বন্ধ করে হাত দিয়ে গলায় পোঁচ দেওয়ার একটা ভঙ্গি করল।
দবির চাচা শুকনো ঠোঁট দুটো জিব দিয়ে ভিজিয়ে বলল, জে, মনে আছে।