২.
দবির চাচা নীতুদের বাসায় এসেছে চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি। এর মাঝে নীতুর মানুষটিকে এক্কেবারে অসহ্য মনে হতে লাগল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নীতু শুনতে পেল গেস্ট বাথরুমের ভেতর থেকে বিকট একটা ঘরঘর শব্দ বের হচ্ছে। গরু জবাই দেয়ার সময় মনে হয় এ রকম শব্দ শোনা যায়। কোথা থেকে শব্দটা আসছে দেখার জন্যে নীতু বাথরুমে উঁকি দিতে গেল, তার অবশ্যি কোনো দরকার ছিল না, কারণ বাথরুমের দরজা হাট করে খোলা রেখে দবির চাচা বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে তার জিব পরিষ্কার করছিল। গলার ভেতর প্রায় পুরো হাতটা ঢুকিয়ে দবির চাচা ঘষে ঘষে তার জিব পরিষ্কার করতে করতে এই বিকট শব্দটি করছিল। প্রকাশ্যে সবাইকে দেখিয়ে যে এ রকম একটা কাজ করা যায়, নিজের চোখে না দেখলে নীতু বিশ্বাসই করতে পারত না। দবির চাচা তাকে দেখার আগেই নীতু সেখান থেকে সরে এলো।
কিছুক্ষণ পর বাইরের ঘর থেকে টেলিভিশনের শব্দ শোনা যেতে থাকে, তাদের বাসায় এত সকালে কেউ কখনো টেলিভিশন দেখে না। নীতু বুঝে গেল নিশ্চয়ই দবির চাচা টেলিভিশন দেখছে। যদি বসে বসে খবর শুনত তাহলেও একটা কথা ছিল। নীতু তার ঘরে বসে হিন্দি গানের শব্দ শুনতে পায়। গানের ধরন দেখেই বুঝতে পারে এগুলো নিশ্চয়ই হিন্দি সিনেমার নাচের দৃশ্য! বিষয়টা নিশ্চিত করার জন্যে সে একবার বসার ঘরে গিয়ে উঁকি দিল, যা সন্দেহ করেছিল তাই, দবির চাচা মুখ হাঁ করে টেলিভিশনে হিন্দি সিনেমার নাচ দেখছেন। চোখ দিয়ে যদি কোনো কিছু গিলে খাওয়া সম্ভব হতো তাহলে দবির চাচা নিশ্চয়ই নাচতে থাকা মেয়েগুলোকে গিলে খেয়ে ফেলত।
একটু পর আম্মু সবাইকে নাশতা খেতে ডাকলেন। দবির চাচাও তাদের সঙ্গে নাশতা খেতে এলো। দবির চাচা তার চেয়ারে পা তুলে বসল, নীতু সেটা মাফ করে দিতে রাজি ছিল কিন্তু যখন চামুচ থাকার পরও খাবলা দিয়ে সবজির বাটি থেকে সবজি নিতে লাগল, সেটা কিছুতেই মাফ করতে পারল না। পরোটা খেতে খেতে হঠাৎ দবির চাচা মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে মাড়ির ফাঁকে আটকে থাকা খাবার বের করে সেটা চেটে চেটে খেতে লাগল তখন নীতুর মনে হলো সে বমি করে দেবে।
খাওয়া শেষে দবির চাচা শব্দ করে চুমুক দিয়ে চা খেতে খেতে রাজনীতির আলোচনা শুরু করে দিল। দবির চাচার রাজনীতির আলোচনা খুব সোজা, একজন একজন করে দেশের সব মানুষকে গালাগাল করা। কিছুক্ষণের মাঝেই নীতু ক্লান্ত হয়ে পড়ল, সে তখন ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে নিজের রুমে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পর সে আবার টেলিভিশনে হিন্দি গান শুনতে পায়, যার অর্থ দবির চাচা আবার হিন্দি সিনেমার নাচ দেখতে শুরু করেছে।
কিছুক্ষণ পর নীতু বাইরের ঘরে গেছে সেলফ থেকে একটা বই আনতে, তখন দেখল দবির চাচা সোফায় দুই পা তুলে বসে বসে টেলিভিশনে নাচ দেখতে দেখতে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার নাকের নোম ছিঁড়ছে। খুব সাবধানে একটা লোম ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে সেটা ছিঁড়ে এনে চোখের সামনে সেটাকে ধরে রেখে লোমটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ।
টেলিভিশনে নাচ শেষ হয়ে যখন কথাবার্তা শুরু হয়ে গেল তখন দবির চাচা সোফাতে বসেই ঘুমিয়ে গেল। মুখ হাঁ করে ঘুমাচ্ছে, বিচিত্র শব্দ করে নাক ডাকছে, মনে হচ্ছে ঘরের ভেতর বুঝি একটা জেট ইঞ্জিন চলছে। শুধু তা-ই নয়, হঠাৎ করে নাক ডাকা বন্ধ হয়ে একটা ঘরঘর শব্দ হতে থাকে, মনে হয় কেউ বুঝি দবির চাচার গলা চেপে ধরেছে। বেশ কিছুক্ষণ দম বন্ধ করে বসে থেকে হঠাৎ করে দবির চাচা ধড়ফড় করে জেগে ওঠে তারপর আবার মুখ হাঁ করে ঘুমিয়ে যায়, দুই মিনিট পর আবার জেট ইঞ্জিনের মতো নাক ডাকতে থাকে।
নীতু কিছুক্ষণ দবির চাচার দিকে তাকিয়ে রইল, তার কাছে একেবারে অসহ্য মনে হয়। এই মানুষটা তাদের বাসায় থাকতে থাকতে আর প্রতি মুহূর্তে তাকে দেখতে হবে চিন্তা করেই নীতুর দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কী করবে বুঝতে না পেরে সে ভেতরে গেল, কারো সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে না পারলে মনে হয় সে শান্তি পাবে না। আব্বু-আম্মুর বেডরুমে মাথার কাছে রাখা টেলিফোনটা নিয়ে সে তার চাচাতো বোন মিতির কাছে ফোন করল। মিতি বড় চাচার মেয়ে, দুজনে প্রায় সমবয়সী। কিছু একটা হলেই একজন আরেকজনকে জানায়। দবির চাচার কথাটা মিতিকে না জানানো পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না।
ফোনে কয়েকবার রিং হওয়ার পর অন্য পাশে মিতিই টেলিফোনটা ধরে। নীতু বলল, এই মিতি তুই কী করছিস?
মিতি বলল, কিছু করছি না। তুই কী করছিস?”
আমি নাকের ডাক শুনছি। কার নাকের ডাক শুনছিস?
দবির চাচার।
দবির চাচা? সেটা আবার কে?
নীতু বলল, আমি বলে বোঝাতে পারব না। যদি দবির চাচা কে জানতে চাস তাহলে সেটা তোর নিজের চোখে দেখতে হবে।
মিতি জানতে চাইল, কেন? কী করে দবির চাচা?
অনেক কিছু করে। এই যেমন ধর একটু আগে দেখলাম সোফায় পা তুলে বসে টান দিয়ে পটাং করে একটা নাকের নোম ছিঁড়ে ফেলল। তারপর সেই লোমটা এমনভাবে পরীক্ষা করল যেন নাকের নোম না সিংহের কেশর ছিঁড়ে এনেছে, সেটা দেখে মনে হয় গর্বে তার বুক একশ হাত ফুলে উঠেছে!
নীতুর কথা শুনে মিতি হিহি করে হাসতে থাকে। নীতু বলল, তুই হাসছিস? এটা হাসির কথা হলো? দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা বসে বসে এই মানুষটাকে দেখতে হবে তুই সেটা চিন্তা করতে পারিস?
মিতু বলল, দেখবি। সমস্যা কোথায়? মনে কর সার্কাস দেখছিস।
সার্কাস দেখার সময় তো কথা শুনতে হয় না। খালি লাফ-ঝাঁপ দেখতে হয়। এই লোকের কথাও শুনতে হয়। কী বলে জানিস?
কী বলে?
নীতু বলল, বলে মেয়েদের লেখাপড়া হচ্ছে সময় নষ্ট। মেয়েদের কাজ হচ্ছে হাজব্যান্ডের জন্যে ভাত রান্না করা আর শ্বশুর-শাশুড়ির পা টিপে দেয়া।
মিতি এবারে গরম হয়ে গেল, বলল, এটা বলে? এত বড় সাহস?
শুধু এটা বলে না, আরো অনেক কিছু বলে। আরো খারাপ খারাপ কথা বলে। তুই এসে একবার শুনে যা, দেখবি তোরও ব্লাড প্রেশার উঠে যাবে। দিন-রাত বসে বসে হিন্দি সিনেমা দেখে। এত বয়স হয়েছে তারপরও ড্যাব ড্যাব করে হিন্দি সিনেমার মেয়েদের নাচ দেখতে থাকে। দেখে মনে হয় চোখ দিয়ে মেয়েগুলোকে গিলে খাবে। ছিঃ! এসে দেখে যা।
মিতি বলল, এইরকম একটা মানুষকে দেখার আমার কোনো শখ নাই।
নীতু বলল, ঠিক আছে তোর দেখতে হবে না। তুই এসে বেড়িয়ে যা।
মিতি বলল, ঠিক আছে আসব দুপুর বেলা । অনেকদিন তোর সঙ্গে দেখা হয় নাই।
নীতু বলল, আসলে সজল আর সজীবকেও নিয়ে আসিস।
ঠিক আছে নিয়ে আসব।
নীতু টেলিফোনটা রেখে নিজের ঘরে গেল। অন্যদিন হলে বাইরের ঘরের সোফায় বসে পত্রিকা পড়ত, দুই-একটা ম্যাগাজিন উল্টে-পাল্টে দেখতে ইচ্ছে হলে পাঁচ-দশ মিনিট টেলিভিশন দেখত, কিন্তু আজকে বসার ঘরে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। তাই সে টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে বিছানায় বসে তার পাতা ওল্টাতে থাকে। বইটার নাম ভৌতিক রহস্য। গতকাল স্কুল থেকে আসার সময় রাস্তার পাশে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কিনে এনেছে।
নীতু বইটা পড়তে পড়তে চমৎকৃত হয়ে যায়। ভূত বিষয়টা কী সেটা খুবই যত্ন করে লেখা আছে। কয় রকমের ভূত আছে এবং কোন ভূতের চরিত্র কেমন সেটাও খুব ভালো করে বলা আছে। ভূত নামানোর নানারকম উপায় আছে, কোনো কোনোটা বেশ ভয়ঙ্কর- অমাবস্যার রাতে একটা কালো বিড়াল আছাড় দিয়ে মারতে হয়, বাদুড়ের রক্ত আর শকুনের চোখ দরকার হয়। কোনো কোনোটা খুবই সহজ, হাত ধরে বসে একমনে মন্ত্র পড়লেই হয়। ভূত নামানো এত সহজ হলে কেন মানুষ ভূত নামিয়ে বোতলে ভরে রেখে দেয় না কে জানে?
ভূতের বইটা পড়তে পড়তে নীতু ঘুমিয়েই পড়েছিল, আম্মু তাকে ডেকে ওঠালেন খাওয়ার জন্যে। দবির চাচার সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেতে হবে চিন্তা করেই তার শরীরে জ্বর এসে যাচ্ছিল। কিন্তু আম্মু বললেন দবির চাচা এখন খাবেন না, সকালে বেশি খেয়ে ফেলার কারণে তার পেট ভুটভাট করছে। সেটা শুনে নীতু আর দেরি করল না। তাড়াতাড়ি খেতে বসে গেল।
খাওয়া শেষ হতে হতেই কলিংবেল বেজে উঠল, নীতু লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুলে দেয়। মিতি আর সজল, সজীব এসেছে। নীতু এমনভাবে মিতিকে জড়িয়ে ধরে লাফালাফি শুরু করে দিল যে দেখে মনে হলো দুজনের বুঝি বছরের পর বছর দেখা হয়নি।
সজল বলল, নীতু আপু শুধু আপু আসে নাই আমরা দুজনও এসেছি। আমাদেরকে দেখেছ? এই যে আমরা।
নীতু হেসে ফেলল, তারপর সজল আর সজীবকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোরা এত ছোট যে তোদেরকে চোখেই পড়ে না।
সজল বলল, নীতু আপু গত মাসে আমার বারো বছর হয়েছে। নীতু বলল, আরো এক বছর অপেক্ষা কর, তারপর টিনএজার হয়ে যাবি। তখন তোকে না দেখে উপায় থাকবে না।
সজীব সবচেয়ে ছোট ভাই, বয়স দশ, সে জিজ্ঞেস করল, নীতু আপু তখন না দেখে উপায় থাকবে না কেন?
ওমা! জানিস না? টিনএজ হচ্ছে সবচেয়ে ডেঞ্জারাস। যখন ছেলেমেয়েরা টিনএজার হয় তখন তাদের বাবা-মায়ের সব চুল দুশ্চিন্তায় পেকে যায়।
কেন দুশ্চিন্তায় সব চুল পেকে যায়?
নীতু বলল, আর তিন বছর অপেক্ষা কর তখন নিজেই টের পাবি।
আম্মু কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেন, অনেক হয়েছে। আর জ্ঞান দিতে হবে না। তোরা আয়, খেতে বসে যা।
মিতি বলল, আমরা খেয়ে এসেছি চাচী।
দুপুর বেলা আসবি, খেয়ে আসবি মানে? আবার একটু খানি খা নীতুর সাথে ।
না চাচী আর খেতে পারব না।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে যখন এসব কথাবার্তা হচ্ছে, তখন দবির চাচা চোখ পাকিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আম্মু তখন দবির চাচার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন, বললেন, দবির ভাই, এরা হচ্ছে নীতুর বড় চাচার ছেলে-মেয়ে।
শফিকের ছেলে-মেয়ে?
হ্যাঁ, শফিক ভাইয়ের ছেলে-মেয়ে। তারপর মিতিকে দেখিয়ে বললেন, এ হচ্ছে মিতি–
দবির চাচা কেমন যেন আঁতকে উঠল, মিতি? মিতি আবার কী রকম নাম?
নীতু মিতির দিকে তাকাল, চোখ নাচিয়ে বুঝিয়ে দিল দবির চাচা মানুষটা কী রকম। মুখে বলল, মিতি খুব সুন্দর নাম। খুবই সুইট নাম।
সুইট নাম? নাম আবার সুইট হয় কেমন করে? নাম কী চেটে চেটে খায় যে সুইট হবে? মিতি ফিতি নামের মাঝে কোনো বরকত নাই। এই রকম নাম রাখা ঠিক না।
নীতু মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, তাহলে কী রকম নাম রাখতে হবে?”
গুলবদন, মেহেরজান, বরকাতুন্নেসা এইগুলো হচ্ছে সলিড নাম।
আম্মু নাম নিয়ে আলোচনায় যোগ দিলেন না, সজল আর সজীবকে দেখিয়ে বললেন, এরা দুইজন হচ্ছে সজল আর সজীব।
দবির চাচা চোখ কপালে তুলে বলল, হায় হায়! এদের নামে দেখি আরো সমস্যা।
নীতু বলল, কোনো সমস্যা নাই। কী সুন্দর বাংলা নাম। দবির চাচা স্থির দৃষ্টিতে নীতুর দিকে তাকিয়ে আম্মুকে জিজ্ঞেস করল, শফিক এখন কী করে?
আম্মু বললেন, ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।
দবির চাচা চোখ কপালে তুলে বলল, ইউনিভার্সিটির প্রফেসর! এমনভাবে বলল যে শুনে মনে হলো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর কথাটা মাস্তান কিংবা সন্ত্রাসীর মতো খারাপ একটা শব্দ।
আম্মু বললেন, হ্যাঁ। ইংলিশের প্রফেসর।
তার মানে মাস্টার? শফিক নাকি লেখাপড়ায় ভালো ছিল। এত লেখাপড়া করে শেষে মাস্টার হলো? পুলিশে না হলে কাস্টমসে চাকরি পেল না?
নীতু বলল, আপনি কী বলছেন চাচা? ইউনিভার্সিটি প্রফেসরের চাকরি ভালো না?
ইউনিভার্সিটির মাস্টারদের কয় পয়সা বেতন আমি জানি না মনে করছ? এ তো রীতিমতো না খেয়ে থাকার অবস্থা।
মিতি বলল, আমরা ঠিক না খেয়ে নেই। আম্মুও চাকরি করেন তাই বেশ ভালোই চলে যায়।
দবির চাচা আবার চমকে উঠল, বলল, শফিকের বউও চাকরি করে? কী সর্বনাশ! দবির চাচা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, মেয়ে লোকের চাকরি করা ঠিক না। মেয়ে লোক থাকবে ঘরে। রান্নাবান্না করবে। সংসার দেখবে।
মিতি কিছু একটা বলতে চাইছিল, নীতু তখন মিতির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, আয় আমরা যাই। এইখানে বসে এই রকম কথা শুনলে ব্লাড প্রেশার হাই হয়ে যাবে।
সবাই মিলে নীতুর ঘরে ঢোকার পর নীতু দরজা বন্ধ করে বলল, এই মানুষটা এসেছে মিডল ইস্ট থেকে। কতদিন যে এইখানে থাকবে!
মিতি বলল, আব্বু শুনেই বলেছে তোদের কপালে অনেক দুঃখ আছে।
সজীব জানতে চাইল, কেন আপু? দুঃখ আছে কেন?
নীতু বলল, দেখছিস না কেন দুঃখ আছে? কথাবার্তার ঢংটা দেখিস না?
মিতি বলল, শুধু কথাবার্তার ঢং না নীতু, আব্বু বলেছে এই মানুষটা নাকি ক্রিমিন্যাল। কী একটা দুই নম্বরী কাজ করে ঝামেলায় পড়েছিল। অ্যারেস্ট হওয়ার ভয়ে মিডল ইস্টে পালিয়ে গিয়েছিল।
নীতু বলল, এখন নিশ্চয়ই মিডল ইস্টে কোনো একটা দুই নম্বরী কাজ করে অ্যারেস্ট হওয়ার ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে!
মিতি বলল, খুব সাবধান থাকবি।
বাসার ভেতরে আস্ত একটা মানুষ বসে একটা একটা করে নাকের লোম ছিঁড়ছে তার মাঝে সাবধানটা থাকব কেমন করে?
সবাই তখন মাথা নাড়ল, মানুষটা যদি বাসার ভেতরে থাকে তখন সাবধান থাকার বিশেষ কোনো উপায় নাই।
.
চারজন তখন নীতুর বিছানায় বসে গল্পগুজব করে। তাদের আব্বু-আম্মুরা কীভাবে তাদের জ্বালাতন করে সেটা নিয়ে আলোচনা করে। স্কুলে কী হচ্ছে সেগুলো নিয়ে কথা বলে। স্কুলের কোন ছেলে-মেয়ে কী কী দুষ্টুমি করছে সেটা নিয়ে হাসাহাসি করে। সব ভাই-বোনেরা মিলে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়া যে কত দরকার সেটা মনে কওে লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বার্স ফেলে।
একসময় সবচেয়ে ছোটজন সজীব বলল, চল আমরা পিকশনারি খেলি।
নীতু বলল, পিকশনারি? সেটা আবার কী রকম খেলা?
সজীব উৎসাহ নিয়ে বোঝাতে শুরু করে, প্রথমে দুইটা টিম বানাতে হবে। মনে করো একটা টিম হচ্ছে আমি আর নীতু আপু। আরেকটা টিম হচ্ছে আপু আর ভাইয়া। আমাদের টিম তখন অন্য টিমের একজনকে একটা জিনিসের নাম বলতে বলবে। এমনভাবে বলবে যেন অন্যজন শুনতে না পারে। তখন সে ছবি এঁকে অন্যজনকে জানানোর চেষ্টা করবে জিনিসটা কী।
নীতু বলল, কিন্তু আমি যে ছবি আঁকতে পারি না?
সজীব বলল, ভালো আঁকতে না পারলেও ক্ষতি নাই নীতু আপু। শুধু একটু বোঝা গেলেই হলো।
নীতু বলল, আমি যদি কলা আঁকি সেটা দেখাবে জাহাজের মতো। আর যদি জাহাজ আঁকি সেটা দেখাবে লাউয়ের মতো।
মিতি বলল, আর যদি লাউ আঁকিস?
সেটা দেখাবে কলার মতো।
তাহলে তো হয়েই গেল, কলা আঁকতে শুরু করে আবার কলা হয়ে গেল!
সবাই তখন কিছুক্ষণ হি হি করে হেসে খেলা শুরু করল। সজীব খুব ভালো করে ছবি আঁকতে পারে, তাই যতবার তার ছবি এঁকে কিছু বোঝাতে হয়েছে সে সঙ্গে সঙ্গে বুঝিয়ে দিতে পেরেছে। কিন্তু যতবার নীতুর ছবি আঁকতে হচ্ছে, তখন যেটাই আঁকে সেটা কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং হয়ে যায়! কেউ আর বুঝতে পারে না সেটা নিয়ে হাসাহাসি হয়, আসল খেলার থেকে সেই হাসাহাসিটাই বেশি মজার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
একবার নীতুর ভাগে পড়ল রাজাকার। সে রাজাকার আঁকার চেষ্টা করল আর সেটা দেখে সজীব বলল, ভূত!
তখন হঠাৎ করে নীতুর ভৌতিক রহস্য বইটার কথা মনে পড়ে গেল। নীতু খেলা থামিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, আয় অন্য একটা খেলা খেলি।
মিতি জিজ্ঞেস করল, কী খেলা?
ভূত আনার খেলা।
সেটা আবার কী রকম?
এই দেখ–বলে সে টেবিল থেকে ভৌতিক রহস্য বইটা নিয়ে দেখাল, বলল, এই বইটা আমি রাস্তা থেকে কিনে এনেছি। একেবারে ফাটাফাটি বই। কেমন করে ভূত আনতে হয় সেটা এখানে লেখা আছে।
সজীব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ভূত? মানে সত্যিকারের ভূত?
হ্যাঁ।
সজীব মাথা নাড়ল, বলল, না বাবা। আমার ভয় করে!
সজল বলল, ধুর গাধা ভয় কিসের? পরিষ্কার দিনের বেলা, চারিদিকে ফকফকা আলো আমরা এতজন মানুষ!
মিতি বলল, ভূত আনা এত সোজা? আমরা ডাকব আর সুড়সুড় করে ভূত আসতে থাকবে? ভূতের আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নাই?
সজীব বলল, যদি সত্যি সত্যি এসে যায়?
নীতু বলল, সত্যি সত্যি এসে গেলে আমরা একটা বয়মের ভেতর ভরে আটকে রাখব। স্কুলে নিয়ে যাব, সবাইকে দেখাব।
সজীব বলল, নীতু আপু তুমি খালি ঠাট্টা করো!
মিতি বলল, ঠাট্টা করবে না তো কী করবে? কখনো শুনেছিস যে কেউ ভূত ডেকেছে আর ভূত চলে এসেছে?
সজল বলল, বইটা দাও। দেখি ভূত কেমন করে আনতে হয়! সবাই তখন বইটার ওপর ঝুঁকে পড়ল।