৫.
নীতু হঠাৎ ঘুম থেকে ধড়মড় করে জেগে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে সে এদিক-সেদিক তাকাল। ভূতের বাচ্চা সোলায়মান কোথাও নেই। নীতু তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নামতে নামতে আব্বুর গলার স্বর শুনতে পেল, আব্বু অবাক হয়ে বলছেন, বাথরুমের কমোড নিজে নিজে ফ্লাশ হচ্ছে, ব্যাপারটা কী?
আম্মু কিছু একটা বললেন, নীতু সেটা শুনতে পেল না, তখন আবার আব্বুর গলার স্বর শুনতে পেল, না, না, এটা মিস্ত্রি ডাকার ব্যাপার না! শুধু কমোড ফ্লাশ না, ট্যাপটাও হঠাৎ করে খুলে যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!
নীতুর আর বুঝতে বাকি থাকল না কী হচ্ছে, নিশ্চয়ই ভূতের বাচ্চা সোলায়মান বাথরুমে গিয়ে এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। সে তড়াক করে প্রায় ফাঁক দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আব্বুদের বাথরুমে গেল। আব্বু শেভ করছেন এবং খুব কাছে দাঁড়িয়ে সোলায়মান সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। নীতু এখন কীভাবে সোলায়মানকে বের করবে সেটা ভেবে পেল না। বিস্ফারিত চোখে দেখল বাথরুমে বেসিনের ওপর রাখা টুথপেস্টটা নিয়ে তার মুখটা খুলে সে টেপাটেপি করছে এবং হঠাৎ করে অনেকখানি টুথপেস্ট বের হয়ে এলো। সোলায়মান সঙ্গে সঙ্গে সেটা বেসিনের ওপর রেখে দেয়, আব্বু তখন চমকে উঠে বললেন, আরে! আরে! টুথপেস্ট বের করেছে কে?
নীতু এবারে বাথরুমে ঢোকার একটা সুযোগ পেল, বলল, কোথায় আব্বু? কোথায় টুথপেস্ট?
সে ভেতরে ঢুকে খপ করে সোলায়মানকে ধরল। সোলায়মান নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, নীতু তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। আব্বু যেহেতু ভূতের বাচ্চা সোলায়মানকে দেখছেন না, শুধু নীতুকে দেখছেন তার কাছে বিষয়টা খুবই অদ্ভুত মনে হলো, অবাক হয়ে বললেন, আরে! নীতু তুই এ রকম করছিস কেন? কী হয়েছে তোর?
কিছু হয়নি আব্বু! সে শান্ত হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল আর এই সুযোগে সোলায়মান নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে গেল।
নীতুও তার পিছু পিছু গেল, সোলায়মান তখন রান্নাঘরে ঢুকে গেছে। আম্মু ডিম ভাজার জন্যে ডিম ভেঙে বাটিতে রাখছেন, সোলায়মানও আম্মুকে সাহায্য করার জন্যে একটা ডিম নিয়ে ভাঙার চেষ্টা করল। আম্মু সোলায়মানকে দেখছেন না তাই হঠাৎ খুব অবাক হয়ে দেখলেন কথা নেই বার্তা নেই একটা ডিম সশব্দে ফেটে গিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আম্মু অবাক হয়ে বললেন, আরে! ডিমটা নিজে নিজে ফেটে গেল কেমন করে? কী আশ্চর্য!
নীতু রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চোখের ইশারায় সোলায়মানকে ডাকল, সোলায়মান সেটা না দেখার ভান করে নীতুর হাত গলিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বাইরের ঘরে হাজির হলো। দবির চাচা সেখানে সোফায় আধশোয়া হয়ে টেলিভিশনে হিন্দি সিনেমায় নাচ দেখছে। সোলায়মান দবির চাচার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নাচ দেখল কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝে নাচ দেখার উৎসাহ চলে গেল এবং বসার ঘরে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
এ রকম সময় নাচটা শেষ হয়ে গেল। তখন দবির চাচা রিমোটটা হাতে নিয়ে চ্যানেল পাল্টাতে থাকে এবং একটা চ্যানেলে কুস্তির একটা প্রোগ্রাম পেয়ে যায়। দবির চাচা খুবই উৎসাহ নিয়ে দুজন মোটা মোটা মানুষের কুস্তি দেখতে থাকে এবং যখনই একজন আরেকজনকে নিচে ফেলে পেটাতে থাকে তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজের উরুতে থাবা দিতে থাকে।
.
সোলায়মান রিমোট দিয়ে চ্যানেল পাল্টানোর বিষয়টা লক্ষ্য করল, তখন সে দবির চাচার কাছে গিয়ে টেবিল থেকে রিমোট কন্ট্রোলটা হাতে নিয়ে চ্যানেল বদলাতে থাকে। দবির চাচা অবাক হয়ে দেখল হঠাৎ করে নিজে নিজে টেলিভিশনের চ্যানেল পাল্টাতে শুরু করেছে, সে খুবই অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। তারপর রিমোট কন্ট্রোলটা খুঁজতে থাকে কিন্তু সোলায়মান সেটা নিজের হাতে নিয়েছে তাই সে কোথাও এটাকে খুঁজে পেল না।
সোলায়মান চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে হঠাৎ করে একটা কার্টুনের চ্যানেল পেয়ে গেল। তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে রিমোটটা টেবিলে রেখে দবির চাচার পাশে বসে কার্টুন দেখতে থাকে।
দবির চাচা হঠাৎ করে টেবিলের ওপর রিমোটটা দেখতে পেয়ে খুব অবাক হয়ে যায়, সেটা হাতে নিয়ে চ্যানেল পাল্টে আবার কুস্তির চ্যানেলে দিয়ে গেল।
সোলায়মান খুবই বিরক্ত হলো। সে দবির চাচার হাত থেকে রিমোটটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চ্যানেল পাল্টে আবার কার্টুনের চ্যানেলে ফিরে গেল।
দবির চাচা অবাক হয়ে এদিক-সেদিক তাকায় সে বুঝতে পারে না তার হাত থেকে হঠাৎ করে রিমোট কন্ট্রোলটা কেমন করে অদৃশ্য হয়ে গেল। সোলায়মান রিমোটটা টেবিলে রাখার পর হঠাৎ করে সেটা খুঁজে পেল। দবির চাচা খুবই অবাক হয়ে মাথা চুলকান, তার মনে হতে থাকে বুঝি তার মাথার মাঝে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কখনো দেখছে কখনো দেখছে না। ব্যাপারটা কী?
দবির চাচা আবার রিমোটটা হাতে নিয়ে আবার তার কুস্তির চ্যানেলে ফিরে গেল। সোলায়মান খুবই বিরক্ত হয়ে আবার রিমোটটি নেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু দবির চাচা এবারে সেটা শক্ত করে ধরে রেখেছে বলে নিতে পারল না, দুজনে টানাটানি করতে থাকে। দবির চাচা প্রায় আর্তনাদের মতো করে বলল। আরে । আরে। এই রিমোট কন্ট্রোলটা নিজ থেকে ছুটে যাচ্ছে কেন? কী আশ্চর্য! এটা কোন কোম্পানির রিমোট?
নীতু এতক্ষণ পুরো ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল, এখন বুঝতে পারল তার ভূতের বাচ্চা সোলায়মানকে থামানো দরকার, তা না হলে কিছু একটা ঝামেলা হয়ে যেতে পারে। সে গিয়ে সোলায়মানকে ধরে তাকে টেনে সরিয়ে নিল। দবির চাচা সোলায়মানকে দেখছে না তাই তার কাছে নীতুর ভঙ্গিটাকে খুবই বিচিত্র মনে হলো, অবাক হয়ে বলল, আরে! তুমি কী কর?
নীতু বলল, এক্সারসাইজ করি। এভাবে এক্সারসাইজ করলে শরীর ভালো থাকে। বলে সে এক হাতে সোলায়মানকে ধরে রেখে অন্য হাতে এবং শরীর দুলিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে ব্যায়াম করার ভঙ্গি করল। তারপর রীতিমতো হিড়হিড় করে সোলায়মানকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গেল।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সোলায়মানকে ফিসফিস করে বলল, কী করছ তুমি?
কিছু করছি না।
টেলিভিশনের রিমোট নিয়ে টানাটানি করছ।
ওই মানুষটা পচা। আমাকে কার্টুন দেখতে দেয় না। নীতু মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ ওই মানুষটা আসলেই সুবিধার । কিন্তু তাই বলে তার রিমোট নিয়ে টানাটানি করবে? যদি তোমার কথা জেনে যায় সর্বনাশ হয়ে যাবে।
কী সর্বনাশ?
তোমাকে তাহলে তোমার আম্মুর কাছে ফিরিয়ে দিতে পারব?
নীতুর কথা শুনে সোলায়মান ভয় পেয়ে গেল, বলল, ঠিক আছে আর রিমোট নিয়ে টানাটানি করব না।
হ্যাঁ। এই ঘরে চুপচাপ বসে থাকো। ঘর থেকে বের হবে না। কী করব ঘরের ভেতর বসে থেকে?
নীতু এদিক-সেদিক তাকাল তারপর কয়েকটা রঙিন ছবির বই বের করে দিয়ে বলল, এই যে বসে বসে এই বইগুলোর ছবি দেখ।
তারপর একটা খাতা আর কয়েকটা রং পেন্সিল আর ক্রেয়ন। দিয়ে ফিসফিস করে বলল, এগুলো দিয়ে ছবি আঁকো। আমি তোমার জন্যে খাবার নিয়ে আসি।
সোলায়মান বলল, আমার জন্যে খাবার আনতে হবে না।
কেন? তোমার খিদে পায় না?
পায়।
তখন কী খাও।
জোছনার আলো খাই।
সর্বনাশ! ঢাকা শহরে আমি জোছনার আলো কোথায় পাব?
সোলায়মান বলল, জোছনার আলো না থাকলে দরকার হলে টিউব লাইটের আলোও খেতে পারি।
নীতু মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে, এটার ব্যবস্থা করে দিতে পারব।
ঠিক তখন আম্মু ডাকলেন, এই নীতু, খেতে আয়।
নীতু বলল, আসছি আম্মু।
.
সে সোলায়মানকে বসিয়ে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ডাইনিং টেবিলে সবাই খেতে বসেছে, আম্মু সবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন। দবির চাচা তার অভ্যাসমতো চেয়ারে পা তুলে বসেছে এবং বিচিত্র একটা শব্দ করে খাচ্ছে। খেতে খেতে দবির চাচা কুৎসিৎ একটা ভঙ্গিতে ঢেকুর তুললেন এবং সেই ঢেকুরের শব্দ শুনে নীতুর গা ঘিন ঘিন করে উঠল।
নীতু খেতে খেতে আব্বুকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আব্বু তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?
আব্বু বললেন, কী জিনিস?
মনে করো একটা ভূত তোমার কাছে চলে এসেছে।
আব্বু হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ভূত?
হ্যাঁ ভূত। কিংবা ভূতের বাচ্চা।
ভূতের বাচ্চা?
নীতু মাথা নাড়ল, হ্যাঁ ভূতের বাচ্চা। মনে করো সে তোমার কাছে সাহায্য চাইছে।
আমার কাছে সাহায্য চাইছে?”
হ্যাঁ।
কী রকম সাহায্য?
নীতু বলল, মনে করো। সে তার দেশে ফিরে যেতে সাহায্য চাইছে।
ঠিক আছে। বলতে থাক।
তাহলে মনে কর, তোমার কী করা উচিত?
আম্মু এবারে বিরক্ত হয়ে বললেন, এবারে তোর বাজে বকবকানি থামিয়ে খাবি? নীতু তুই দেখেছিস তুই যে দিন-রাত সারাক্ষণ কথা বলিস?
নীতু অবাক হওয়ার ভান করে বলল, আমি? আমি কখন কথা বললাম?
আর কথারও যদি কোনো মাথা মুণ্ডু থাকত তাহলেও একটা কথা ছিল। ভূতের বাচ্চা দেশে ফিরে যেতে চাইছে তাহলে কী করা উচিত! এটা কী রকম প্রশ্ন?
নীতু বলল, আব্বু, তুমি আম্মুর কথা শুনো না। তুমি বল কী করা উচিত।
আব্বু খেতে খেতে বললেন, সেটা নির্ভর করে ভূতের বাচ্চার বাড়ি কোথায় তার ওপর। তাদের দেশে যেতে পাসপোর্ট ভিসা লাগে কিনা সেটাও একটা ইস্যু। যদি সেখানে বাস-ট্রেন যায় তার খোঁজ নিতে হবে। তারপর টিকেট কিনে সেই বাস কিংবা ট্রেনে তুলে দিতে হবে। কিংবা কিংবা?
কিংবা তাদের দেশে যদি পত্রিকা থাকে তাহলে সেই পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দিতে হবে, একটি ভূতের বাচ্চা পাওয়া গেছে, সেই ভূতের বয়স আট বছর, উচ্চতা চার ফুট দুই ইঞ্চি, গায়ের রং শ্যামলা, সে ভৌতিক ভাষায় কথা বলে-
নীতু এবারে একটু রেগে গিয়ে বলল, আব্বু তুমি সবকিছু নিয়ে শুধু ঠাট্টা করো। আমি সিরিয়াসলি একটা কথা বললাম
আব্বু বললেন, আমি কখন ঠাট্টা করলাম? তুই ভূতের মতো একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেছিস, আমিও ঠিক সেই রকম সিরিয়াসভাবে তার উত্তর দিলাম।
নীতু কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল কারণ সে দেখল সোলায়মান তার ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে এসেছে। সে হেঁটে হেঁটে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে সেখানে গালে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। খুবই মনোযোগ দিয়ে সবাইকে খেতে দেখে। নীতু চোখের ইশারায় নানাভাবে বাচ্চাটাকে এখানে আসতে নিষেধ করে কিন্তু কোনো লাভ হলো না। বাচ্চাটা বেশ শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখতে থাকে।
আব্বু নীতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী হলো? এতক্ষণ টানা বক বক করতে করতে হঠাৎ একেবারে চুপ করে গেলি? ব্যাপারটা কী? কী হয়েছে?
নীতু মাথা নেড়ে বলল, না, না, কিছু হয় নাই।
দবির চাচা বলল, ভূতের বাচ্চা দেখেছে মনে হয়।
তারপর হা হা করে হাসতে থাকে তখন তার মুখের ভেতর থেকে খাবার ছিটকে বের হয়ে টেবিলে পড়ল। নীতুর মনে হলো সে ঘেন্নায় বমি করে দেবে।
দবির চাচা হাসি থামিয়ে বলল, আমি তোমাকে বলি তুমি যদি একটা ভূতের বাচ্চা পাও তাহলে কী করতে হবে।
দবির চাচা কী বলবে সেটা তার শোনার কোনো আগ্রহ নাই কিন্তু দবির চাচা সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। বলল, প্রথমে খপ করে তার ঘ্যাটি ধরে ফেলবে। নীতু জিজ্ঞেস করল, ঘ্যাটি মানে কী?
ঘ্যাটি মানে হচ্ছে ঘাড়। দবির চাচা তখন কেমন করে ঘ্যাটি কিংবা ঘাড় ধরতে হবে সেটা অভিনয় করে দেখাল। তারপর বলল, ঘ্যাটি ধরে গলার মাঝে একটা চেন দিয়ে বাঁধবে। কুত্তাকে যেভাবে বান্ধে সেইভাবে। তারপর রাস্তায় যেভাবে বান্দরের খেলা দেখায় সেইভাবে ভূতের বাচ্চার খেলা দেখাবে। সার্কাসে বিক্রি করে দিলে সবচেয়ে ভালো। তখন মানুষজন সার্কাসে ভূতের বাচ্চার খেলা দেখতে আসবে। একটা চাবুক বানিয়ে শপাং করে ভূতের বাচ্চার পেছনে মারবে আর ভূতের বাচ্চা তিড়িং করে লাফ দেবে। কী মজার খেলা!
নীতু নিঃশ্বাস বন্ধ করে সোলায়মানের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে দেখছে দবির চাচার কথা শুনে ভূতের বাচ্চা সোলায়মান কী রকম রেগে উঠছে। সে কটমট করে দবির চাচার দিকে তাকিয়ে আছে এখন কিছু একটা না করে ফেলে!
নীতুর সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হলো, আব্বু যখন তার প্লেটে বুটের ডাল নিচ্ছেন ঠিক তখন সোলায়মান সেই ডালের বাটি থেকে এক খাবলা ডাল নিয়ে দবির চাচার মুখে ছুঁড়ে মারল।
কেউ সোলায়মানকে দেখছে না, সবাই ভাবল আব্বু ডাল নেয়ার সময় একটু জোরে বাটিতে চামুচ ঢুকিয়েছেন আর ডাল উপচে উঠে দবির চাচার মুখে লেগেছে। আব্বু এত অপ্রস্তুত হলেন সেটা আর বলার মতো না, বললেন, সরি দবির ভাই সরি। তারপর একটা ন্যাপকিন এগিয়ে দিলেন দবির চাচা কিছু না বলে মুখ গম্ভীর করে উঠে গেলেন মুখ ধোয়ার জন্যে।
নীতু শুধু চোখ পাকিয়ে সোলায়মানের দিকে তাকিয়ে রইল। সে তখন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে যদিও আর কেউ তাকে দেখছে না, তার হাসির শব্দ শুনছে না।
দবির চাচা যখন বাথরুম থেকে ফিরে আসছে তখন সোলায়মান দ্বিতীয় ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটাল। সবাই যখন দবির চাচার দিকে তাকিয়ে আছে সেই সুযোগে সোলায়মান ডাইনিং টেবিল থেকে পায়েশের বাটিটা নিয়ে সেখান থেকে খানিকটা তার চেয়ারে ঢেলে দিল। নীতু তাকে থামানোর জন্যে কিছুই করতে পারল না।
নীতু নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখল দবির চাচা গম্ভীর মুখে এসে তার চেয়ারে পায়েশের ওপর বসল এবং সঙ্গে সঙ্গে গরম পায়েশের ঘঁক খেয়ে, আউ বলে উঠে দাঁড়াল। দবির চাচা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার চেয়ারের দিকে তাকাল, তারপর সবার দিকে তাকাল।
আব্বু বললেন, কী হয়েছে?
দবির চাচা বলল, তোমরা যদি না চাও আমি তোমাদের বাসায় থাকি তাহলে সেটা সোজাসুজি আমাকে বলে দাও। আমি চলে যাই। এ রকম জ্বালাতন করছ কেন?
আব্বু চোখ কপালে তুলে বললেন, কী রকম জ্বালাতন করছি?
চেয়ারের মাঝে গরম পায়েশ ঢেলে রাখলে!
আম্মু প্রায় আর্তনাদ করে বললেন, চেয়ারের মাঝে গরম পায়েশ ঢেলে রেখেছি? আমরা?।
আর কে ফেলবে? আমাকে নিয়ে আর কে ইয়ারকি করবে?
আব্বু বললেন, এটা আপনি কী বলছেন দবির ভাই? আমরা আপনার সঙ্গে ইয়ারকি করে চেয়ারে গরম পায়েশ ফেলে রাখব? নিশ্চয়ই আপনি উঠে যাওয়ার সময় হাতের সঙ্গে পায়েশের বাটির ধাক্কা লেগে পায়েশ পড়েছে।
দবির চাচা কোনো কথা না বলে তার কাপড় বদলানোর জন্যে ঘরে গেল, পেছন পেছন সোলায়মান লাফাতে লাফাতে যেতে লাগল, বলতে লাগল, উচিত শিক্ষা হয়েছে! উচিত উচিত উচিত শিক্ষা! ভূতকে নিয়ে খারাপ খারাপ কথা বললে আরো উচিত শিক্ষা দেব! আমাকে চেনে না? আমি হচ্ছি ভূতের বাচ্চা সোলায়মান! ভূতের বাচ্চা সোলায়মান!
নীতু বিস্ফারিত চোখে সোলায়মানের দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে কেমন করে থামাবে সে বুঝতে পারল না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল ভূতের বাচ্চা সোলায়মান হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে সারা বাসায় দাপাদাপি করছে!
ব্রেকফাস্ট শেষ করে সবাই উঠে যাওয়ার পর নীতুও উঠল এবং সোলায়মানকে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে এলো। চাপা গলায় বলল, সোলায়মান, তুমি এসব কী করছ?
সোলায়মান বলল, এই পচা মানুষটা আমাকে নিয়ে এসব খারাপ খারাপ কথা বলছে কেন?
খারাপ কথা বললেই তুমি এ রকম করবে? মুখে ডাল ছুঁড়ে দেবে? চেয়ারে পায়েশ ঢেলে রাখবে? যদি তোমাকে ধরে ফেলত?
সোলায়মান বলল, আমাকে ধরলে আমি খ্যাচ করে তার নাক কামড়ে ধরব।
নীতু মাথা নাড়ল, বলল, না, না। ছি! এভাবে কথা বলে না। একজনের নাক কামড়ে দেবে এটা কী রকম কথা? মানুষ এভাবে কথা বলে না।
আমি তো মানুষ না। আমি ভূত। ভূত সবসময় এভাবে কথা বলে।
নীতু বলল, কিন্তু তুমি এখন মানুষের সঙ্গে আছ। তোমাকে এখন মানুষের মতো ব্যবহার করতে হবে। বুঝেছ?
সোলায়মান মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।
নীতু গলার স্বর নরম করে বলল, তুমি যদি দুষ্টুমি কর আর যদি দবির চাচা বুঝে যায় তুমি এখানে আছ আর যদি তোমাকে ধরে ফেলে তখন কী সর্বনাশ হবে চিন্তা করতে পার?
তখন কী হবে?
তখন তোমার গলায় শিকল দিয়ে বেঁধে সার্কাসে বিক্রি করে দেবে। আমি তখন তোমাকে তোমার আম্মুর কাছে ফিরিয়ে দিতে পারব না।
সোলায়মানের তখন তার আম্মুর কথা মনে পড়ে গেল আর মন খারাপ হয়ে গেল। সে তখন হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে, আমি আম্মুর কাছে যাব। আম্মুর কাছে যাব।
নীতু সোলায়মানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, একশবার তুমি আম্মুর কাছে যাবে। আমি তোমাকে তোমার আম্মুর কাছে পাঠাবই পাঠাব। শুধু তোমাকে শান্ত থাকতে হবে। এই বিছানায় বসে বসে তুমি বইয়ের ছবি দেখ। খাতায় ছবি আঁকো। শুধু ঘর থেকে বের হতে পারবে না। ঠিক আছে?
সোলায়মান মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।
নীতু চাপা গলায় বলল, যদি কোনোভাবে দবির চাচা টের পায় তুমি এখানে আছ, তাহলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে।
.
নীতু তখনো জানত না যে ততক্ষণে সর্বনাশ হয়ে গেছে। দবির চাচার কিছু একটা সন্দেহ হয়েছে তাই নীতুর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরে কী কথাবার্তা হচ্ছে শোনার চেষ্টা করেছে।
যদিও সোলায়মানের একটি কথাও শুনতে পায়নি কিন্তু নীতুর কিছু কিছু কথা, হাত নাড়ানোর ভঙ্গি এসব দেখে বুঝে গেছে সত্যি
সত্যি একটা ভূতের বাচ্চা এই বাসায় চলে এসেছে!
যে ভূতের বাচ্চা রিমোট নিয়ে টানাটানি করে, মুখে ডাল ছুঁড়ে দেয়, চেয়ারে পায়েশ ঢেলে রাখে!
দবির চাচার চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে, সাত রাজার ধন এখন তার হাতের কাছে, শুধু মুঠোর মাঝে নিতে হবে।