৩. ভূত আনতে হয় রাতের বেলা

৩.

ভূত আনতে হয় রাতের বেলা অন্ধকারে কিন্তু এখন ঝকঝকে দিন। তাই প্রথমে তারা দরজা-জানালা বন্ধ করে পর্দাগুলো ভালো করে টেনে দিল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার না হলেও ঘরটা মোটামুটি অন্ধকার হয়ে গেল। তখন একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে সেটাকে ঘিরে চারজন মেঝেতে গোল হয়ে বসল, একজন ছেলে তার পাশে একজন মেয়ে এভাবে। তারপর একজনের হাতের ওপর আরেকজন তার হাত রাখল, নীতু তখন গলার স্বর গম্ভীর করে বলল, আমরা এখন চক্র বেঁধেছি। এই চক্র কিন্তু ভাঙা যাবে না।

সজল বলল, ভাঙলে কী হবে?

তাহলে ভূত আসতে পারবে না। যদি এসে যায় তাহলে যেতে পারবে না।

মিতি বলল, ঠিক আছে আমরা চক্র ভাঙব না।

নীতু বলল, এখন সবাই বসে বসে মৃত মানুষের কথা ভাবতে শুরু কর।

সজীব বলল, মৃত মানুষ? আমি কোনো মৃত মানুষকে চিনি না।

মৃত মানুষকে না চিনলে মানুষ মরে গেলে তার আত্মা কোথায় যায় সেটা ভাবতে থাক।

সজীব জানতে চাইল, কোথায় যায়?

সজল তখন একটা ধমক দিল, বলল, তুই চুপ করবি? মনে মনে কিছু একটা ভাবতে থাক দেখি। এত কথা বললে ভূত আসবে? সজীব তখন আপাতত চুপ করে গেল। নীতু বলল, এখন সবাই আমার সঙ্গে সঙ্গে ভূত আনার মন্ত্রটা বল, তারপর সে ভূত আনার মন্ত্রটা জপ করতে লাগল, ওরোন ওরাহ হিরাক্ট গিম্বা লান…অন্য সবাই তার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্র জপ করতে লাগল, ওয়োন ওরাহ হিরাক্ট গিম্বা লান।

ঠিক তখন আম্মু দরজার কাছে দিয়ে যাচ্ছিলেন, শুনতে পেলেন ভেতর থেকে বিচিত্র একটা মন্ত্রের শব্দ আসছে। দরজাটা ধাক্কা দিয়ে দেখলেন, ভেতর থেকে বন্ধ। জিজ্ঞেস করলেন, এই নীতু

তোরা ভেতরে কী করছিস?

নীতু বলল, ভূত আনছি আম্মু।

ভূত আনছিস?”

হ্যাঁ আম্মু। এখন ডিস্টার্ব করো না।

কতক্ষণ লাগবে?

কেন?

বাচ্চাগুলোকে কিছু খেতে দিবি না? কেক, আইসক্রিম।

নীতু বলল, ভূতটাকে এনে নিই। তারপর একসঙ্গে খাব।

আম্মু হেসে ফেললেন, বললেন, ঠিক আছে। ভূতের জন্যে আমি কিন্তু আলাদা করে কিছু বানাতে পারব না। অন্যেরা যেটা খায় ভূতকেও সেটা খেতে হবে।

নীতু বলল, ঠিক আছে।

আম্মু চলে গেলেন আর ভেতরে আবার ভূত আনার কাজ শুরু হয়ে গেল। নীতু গম্ভীর গলায় মন্ত্রটা কয়েকবার উচ্চারণ করে কাঁপা গলায় বলল, হে বিদেহী আত্মা। আপনারা মাটির পৃথিবীতে নেমে আসেন। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আপনারা এই চক্রে প্রবেশ করুন। আমরা আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছি। আসুন। দেখা দিন। আপনারা চলে আসুন। হে বিদেহী আত্মা। হে অশরীরী আত্মা। হে মহাত্মন। আসুন। আপনারা আসুন। আমরা আকুলভাবে আপনাদের ডাকছি।

সজীব ফিসফিস করে বলল, নীতু আপু।

নীতু বিদেহী আত্মাকে ডাকা বন্ধ করে বলল, কী হলো?

তুমি ভূতকে আপনি আপনি করে বলছ কেন?

সম্মান করে কথা বলতে হবে না? না হলে কী আসবে?

সজীব কাচুমাচু করে বলল, নীতু আপু, ছোট একটা ভূতকে ডাকো না প্লিজ। বড় ভূত আমার ভালো লাগে না।

ছোট ভূত?

হ্যাঁ। বাচ্চা একটা ভূত।

ঠিক আছে। নীতু তখন আবার ভূতকে ডাকতে লাগল, যদি আমাদের কাছাকাছি ছোট কোনো ভূত থেকে থাকো তাহলে তুমি চলে আস। আমরা তোমাকে ডাকছি। তুমি এসো। আমাদের সঙ্গে একটু সময় কাটাও। আমরা তোমাকে অনেক আদর করব। মায়া করব। তুমি এসো। যদি ছোট কোনো ভূত থেকে থাকে তাহলে এসো। আমাদের কাছে এসো। পিচ্চি কোনো ভূত থেকে থাকো তাহলে এসো। চলে এসো। ভূতের বাচ্চা চলে এসো।

নীতুর সঙ্গে সঙ্গে তখন অন্যেরাও ডাকতে লাগল। মাঝে মাঝে সবাই মিলে ভূত আনার মন্ত্রটা পড়তে লাগল। তারপর মন্ত্র থামিয়ে আবার ভূতের বাচ্চাকে ডাকতে লাগল। বলতে লাগল, এসো। তুমি এসো এসো । তুমি এসো।

তখন খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল, হঠাৎ করে মনে হলো ঘরের ভেতর একটা দমকা বাতাস ঘুরপাক খেয়ে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে মোমবাতিটা দপ করে নিভে গেল। সজীব ভয় পেয়ে বলল, কী হয়েছে নীতু আপু?”

নীতু নিজেও জানে না কী হয়েছে, ভয় পাওয়া গলায় বলল, মনে হয় কিছু একটা এসেছে।

মিতিও বলল, হ্যাঁ, আমারও মনে হচ্ছে ঘরের ভেতর কেউ একজন এসেছে।

নীতু বলল, ভয় পাবি না। কেউ চক্র ভাঙবি না। ঠিক তখন আম্মু ডাইনিং টেবিলে কেক আর আইসক্রিমের সঙ্গে ডালপুরি আর কাবাব এনে রেখেছেন। পেট ভুটভাট করছে বলে দুপুরে দবির চাচা কিছু খাননি। ডাইনিং টেবিলে এত রকম নাশতা দেখে দবির চাচা চলে এসেছেন। ছুটির দিন বলে আব্বুও বাসায় আছেন, আব্বুও চা খেতে চলে এসেছেন।

.

এদিক-সেদিক তাকিয়ে আল্লু জিজ্ঞেস করল, ছেলেমেয়েরা কোথায়?

আম্মু বললেন, নীতুর ঘরে।

আব্বু নীতুর ঘরের দিকে তাকালেন। দরজা বন্ধ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, দরজা বন্ধ করে কী করে?

আম্মু বললেন, এদের কাজকর্মের কোনো ঠিক আছে নাকি? আমাকে তো বলল ভূত আনছে।

আব্বু বললেন, ভূত?

হ্যাঁ। তাই তো বলল, ভূত আনছে।

দবির চাচা কেমন জানি চমকে উঠে বলল, আস্তাগফিরুল্লাহ। ভূত আনছে মানে? এইগুলা তো কুফুরি কাজ। বলো কী?

আম্মু হাসতে হাসতে বললেন, ওসব কিছু না। ছেলেমানুষী পাগলামি। এক ধরনের খেলা।

দবির চাচা মুখ শক্ত করে বলল, না, না, না। এগুলো ঠিক না। তোমরা পুলাপানরে বেশি লাই দাও। এত লাই দেওয়া ঠিক না। পুলাপানদের শাসন করতে হয়। মাইরের ওপর রাখতে হয়। তা না হলে পুলাপান নষ্ট হয়ে যায়।

আব্বু বললেন, নষ্ট হয়ে আর যাবে কেথায়? এতদিন যখন নষ্ট হয় নাই, আর নষ্ট হবে বলে মনে হয় না।

দবির চাচা এবারে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, না না, এদের এসব কুফুরি কাজ বন্ধ করতে হবে। এক্ষুনি বন্ধ করতে হবে। বলে দবির চাচা নীতুর ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

.

ঠিক তখন চারজন একজন আরেকজনের হাত ধরে বসে আছে। সবার মনে হচ্ছে ঘরের ভেতর একটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ একটা শীতল বাতাস তাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। নীতু ফাঁকা গলায় বলল, তুমি কী এসেছ? আমাদের ডাক শুনে ভূতের বাচ্চা কী এসেছ?

কোনো শব্দ নেই। সবাই শুধু নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দটা শুনতে পাচ্ছে, ধক ধক করে সেটি শব্দ করছে। নীতু আবার বলল, তুমি কী এসেছ? এসে থাকলে তুমি একটা শব্দ করো। যে কোনো রকম শব্দ।

ঠিক তখন প্রচণ্ড শব্দে দরজা কেঁপে উঠল মনে হলো পুরো দরজাটি বুঝি ভেঙে ফেলবে। ঘরের ভেতর চারজন আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। হাত ছেড়ে দিয়ে তারা লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। তখন আবার দরজায় প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পেল, এবারে শুধু শব্দ না। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে গলার স্বরও শুনতে পেল, দবির চাচা চিৎকার করে বলছে,

এই ছেলে-মেয়েরা দরজা খুলল। এক্ষুনি দরজা খুলো।

নীতু এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, দবির চাচার জন্যে চক্রটা ভেঙে গেছে।

সজীব বলল, তাহলে কী ভূতেরা আটকা পড়েছে?

নীতু বলল, সেটা তো জানি না। আসলে ভূত এসেছিল কী না সেইটাই তো জানি না।

আবার দরজায় শব্দ হলো। দবির চাচা মনে হয় দরজাটা ভেঙে ফেলবে। নীতু বলল, আমি দরজা খুলছি।

নীতু গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দবির চাচা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বলল, তোমরা কী কর ভেতরে?

নীতু বলল, কিছু করি না। খেলছি।

আর খেলতে হবে না। উঠো, দিনের বেলা ঘর অন্ধকার করে এটা কী খেলা? বের হও।

সজীব ফিক ফিক করে বলল, আপনিই তো সব নষ্ট করে দিলেন।

দবির চাচা শুনতে পায়নি, গলা লম্বা করে বলল, কী বলেছ? কী?

নীতু বলল, কিছু বলেনি। তারপর অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, চল সবাই। কিছু একটা খাওয়া যাক।

.

কেউ কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

ঠিক তখন ঘরের ঠিক মাঝখানে সূক্ষ্ম সুতার মতো একটা ধোয়া এসে ঘুরপাক খেতে থাকে। খুব ধীরে ধীরে ধোঁয়াটা জমাট বেঁধে একটা ছোট শিশুর রূপ নিতে থাকে। দেখতে দেখতে শিশুটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ঘরে কেউ ছিল না বলে দেখতে পেল না চার-পাঁচ বছরের একটা শিশু ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাটার চোখে-মুখে এক ধরনের ব্যাকুলতা। এক ধরনের আতঙ্ক। বাচ্চাটি ব্যাকুল হয়ে চারপাশে তাকায়, দেখে মনে হয় সে বুঝি কাউকে খুঁজছে। ঘরের ভেতরে সে এদিক-সেদিক হাঁটে। ডাইনিং টেবিল থেকে ছেলে মেয়েদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে এবং সেগুলো শুনে সে কেমন যেন ভয় পেয়ে চমকে ওঠে। সে ঘরের এক পাশে আলমারিটার দিকে ছুটে যায়। টান দিয়ে আলমারিটা খুলে ভেতরে তাকায়। নিচের তাকে খানিকটা খালি জায়গা আছে, শিশুটা ভেতরে উঠে গিয়ে আলমারির দরজাটা বন্ধ করে দেয়।

কেউ দেখতে পায় না সে সেখানে গুটিশুটি হয়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *