৯০. গান্ধারীর রণক্ষেত্র দর্শন

৯০
গান্ধারীর রণক্ষেত্র দর্শন

শোকার্তা কুন্তী ও দ্রৌপদী, কুরুক্ষেত্র প্রান্তরের সম্মুখে শতপুত্রহারা জননী গান্ধারীর সঙ্গে সম্মিলিত হলেন। ব্যাসদেব গান্ধারীকে দিব্যদৃষ্টি দান করেন। ক্রমে সেই ভরতবংশীয় স্ত্রীলোকেরা অদৃষ্টপূর্ব রণস্থল দর্শন করে দুঃখার্ত হয়ে কয়েকজন অপরের দেহের উপর পতিত হলেন, অন্যেরা ভূতলে পড়ে গেলেন। অন্য কয়েকজন শোকাকুলা নারীর কোনও চৈতন্যই ছিল না; সুতরাং পাঞ্চাল ও কৌরবস্ত্রীগণের সে সময়ে অত্যন্ত দুরবস্থা হয়েছিল। সকল দিকেই দুঃখাকুলচিত্ত নারীগণের ক্রন্দন-কোলাহল হতে লাগল, এহেন অতিভীষণ রণস্থল দেখে এবং কৌরবগণের মহাক্ষয় দেখে ধর্মজ্ঞা গান্ধারী পুরুষোত্তম কৃষ্ণকে সম্বোধন করে বললেন, “কৃষ্ণ, দেখো আমার বিধবা পুত্রবধূরা আলুলায়িত কেশে কুররী-পক্ষিগণের মতো উচ্চ স্বরে ক্রন্দন করছে। সেই নারীরা দলে দলে পুত্রগণ, ভ্রাতৃগণ, পিতৃগণ এবং পতিগণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রজ্বলিত অগ্নির মতো পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, অভিমন্যু, দ্রুপদ ও শল্য প্রভৃতি বীরগণের দেহে রণস্থল শোভিত হয়েছে। উত্তম কবচ, মহাত্মাদের স্বর্ণময় রত্ন, অঙ্গদ, কেয়ূর ও মালায় রণস্থল অলংকৃত হয়ে আছে। বীরবাহু নিক্ষিপ্ত শক্তি, পরিঘ, তরবারি, নানাবিধ তীক্ষ্ণ বাণ ও ধনু পড়ে আছে। মাংসভোজী জন্তুগণ কোথাও একত্রে দাঁড়িয়ে আছে, কোনও স্থানে নৃত্য করছে, কোনও স্থলে তৃপ্ত হয়ে শুয়ে আছে, সহস্র সহস্র সুপর্ণ ও গৃধ্র সেইসব মৃত বীরগণকে ভক্ষণ করছে। যে সকল বীর পূর্বে চন্দন ও অগুরুলিপ্ত দেহে কোমল শয্যায় শয়ন করতেন, তাঁরাই আজ ধূলির উপর শয়ন করে আছে। গদা আলিঙ্গন করে দীর্ঘবাহু পুরুষ প্রিয়তমা নারীকে আলিঙ্গন করার মতো সুখে শায়িত আছেন। কতগুলি বীর নির্মল অস্ত্র ধারণ করে শুয়ে আছেন, তাতে তাঁরা জীবিত আছেন মনে করে মাংসভোজী জন্তুগণ ভয়ে তাঁদের আক্রমণ করছে না। অন্যান্য মহাত্মারা ভূতলে পতিত আছেন, মাংসভোজী জন্তুগণ তাঁদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। শৃগালেরা ভূতলে পতিত বীরগণের কণ্ঠহার টানছে।

“বহুতর নারী আত্মীয়জনের দেহগুলি দেখে তাঁদের ডাকছেন ও বিলাপ করছেন এবং অন্য কোমলপাণি রমণীরা পাণিতলদ্বারা মস্তকে আঘাত করছেন। স্তূপীকৃত ও পরস্পর সংলগ্ন পতিত মস্তক, হস্ত, অন্যান্য সর্বপ্রকার অঙ্গে সমরভূমি আকীর্ণ হয়ে গেছে। অনভ্যস্ত নারীরা মস্তকশূন্য এই সকল সুন্দর দেহ এবং দেহশূন্য মস্তক সকল দেখে মূর্ছিত হয়ে পড়ছেন। শোকবিকলচিত্ত কয়েকজন নারী মস্তককে কতকগুলি দেহের সঙ্গে মিলিত করে ‘এই মস্তক তো এই দেহের নয়’—এই ভেবে এবং অপর মাথা দেখতে না পাওয়ায় দুঃখে আকুল হচ্ছেন। অন্য নারীরা শত্রুনিহত ভ্রাতা, পিতা, পুত্র ও পতিদের দেখে মস্তকে করাঘাত করছেন। এই অনিন্দ্যসুন্দরী রমণীরা পূর্বে দুঃখ ভোগে অভ্যস্ত ছিলেন না; অথচ এখন ভ্রাতৃগণ, পিতৃগণ ও পুত্রগণের শবে পরিপূর্ণ সমরভূমিতে দুঃখে অবগাহন করছেন। কেশব, আমি নিশ্চয় পূর্বজন্মে গুরুতর পাপ করেছিলাম যে আমি বর্তমান সময়ে পুত্র, পৌত্র, ভ্রাতৃগণকে নিহত দেখছি।” শোকার্তা গান্ধারী এই কথা বলে বিলাপ করতে থেকে নিহত দুর্যোধনকে দেখতে পেলেন। গান্ধারী দুর্যোধনের দেহ দেখে শোকে মূৰ্ছিত হয়ে বনমধ্যে ছিন্ন কদলীবৃক্ষের মতো তৎক্ষণাৎ ভূতলে পতিত হলেন। ক্রমে তিনি চৈতন্য লাভ করে, বার বার উচ্চ স্বরে রোদন করে, রক্তসিক্ত দেহ ও ভূতলে শায়িত দুর্যোধনের দিকে দৃষ্টিপাত করে তাকে আলিঙ্গন করে কাতরভাবে বিলাপ করলেন। তখন তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয়ই শোকে বিহ্বল হয়ে গেল; সেই অবস্থায় তিনি ‘হাহা পুত্র’ বলে বিলাপ করতে থাকলেন। কৃষ্ণের স্কন্ধসন্ধি মাংসে আবৃত থাকায় তাঁর দেহটিকে বিশাল দেখা যাচ্ছিল; সেই অবস্থায় তিনি তখন গান্ধারীর কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন গান্ধারী নয়নজলে বক্ষঃস্থল সিক্ত করতে করতে কৃষ্ণকে বললেন, “প্রভাবশালী বৃষ্ণিনন্দন! এই যুদ্ধ ও জ্ঞাতিক্ষয় উপস্থিত হলে, এই রাজশ্রেষ্ঠ দুর্যোধন আমার কাছে এসে বলেছিলেন—

অস্মিন্ জ্ঞাতিসমুদ্ধর্ষে জয়মস্ব! ব্রবীতু মে।

ইত্যুক্তে জানতী সর্বমহং স্বব্যসনাগমম্॥

অব্রুবং পুরুষব্যাঘ্র! যতো ধর্মস্ততে জয়ঃ॥ স্ত্রী : ১৭ : ৬ ॥

“মা! এই জ্ঞাতিসংঘর্ষে আমার জয় হোক বলে আপনি আশীর্বাদ করুন।” পুরুষশ্রেষ্ঠ! দুর্যোধন একথা বললে, তার বিপদ আসছে জানতে পেরে আমি বলেছিলাম, “যে পক্ষে ধর্ম আছেন, সেই পক্ষে জয় হবে।” আমি আরও বলেছিলাম, “প্রভাবশালী বৎস! তুমি যুদ্ধ করতে থেকে যাতে অসাবধান না হও, তা কোরো। তারপর তুমি নিশ্চয়ই শস্ত্রজিৎ লোক লাভ করবে।”

গান্ধারী বললেন যে তিনি পূর্বে দুর্যোধনকে একথা বলেছিলেন। সুতরাং এখন তাঁর জন্য শোক করেন না; কিন্তু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের বন্ধুগণ নিহত হয়েছেন এবং তিনিও অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছেন; সুতরাং তাঁর জন্যই গান্ধারী শোক করছেন। গান্ধারী কৃষ্ণকে বললেন, “কৃষ্ণ দেখো—অসহিষ্ণু স্বভাব, যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ, সমস্ত্র অস্ত্রে সুশিক্ষিত ও যুদ্ধদুধর্ষ আমার পুত্র দুর্যোধন বীরশয্যায় শয়ন করে আছেন। যে শত্ৰুসন্তাপ রাজা সর্বাগ্রে গমন করতেন, তিনি আজ ধূলিতে শয়ান। তিনি নিশ্চয়ই দুর্লভ গতি লাভ করেছেন। উত্তম রমণীরা তাঁকে সেবা করত, আজ শৃগালেরা তাঁকে ভক্ষণ করছে। পূর্বে জ্ঞানীগণ যাঁর উপাসনা করতেন, আজ শকুনেরা তাঁকে সেবা করছে। রমণীরা পূর্বে ময়ূরপুচ্ছ দ্বারা তাঁকে ব্যজন করত, আজ মাংসাশী পাখিরা তাঁকে ব্যজন করছে। সিংহ নিপাতিত হস্তীর মতো, ভীম-নিপাতিত দুর্যোধন গদা আলিঙ্গন করে রক্তসিক্ত গাত্রে শায়িত আছেন। পিতাকে ও বিদুরকে অবজ্ঞা করে অল্প বয়সে দুর্যোধন মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। নিষ্কণ্টক সমগ্র পৃথিবীর ত্রয়োদশ বৎসরের অধিপতি দুর্যোধন নিহত হয়েছে, অথচ আমি এখনও জীবিত আছি। কৃষ্ণ দেখো, আলুলায়িত কুন্তলা ও সুনিতম্বা, লক্ষ্মণের মাতা (দুর্যোধনের ভার্যা) পূর্বে দুর্যোধনের সুলক্ষণসম্পন্ন ক্রোড়ে অধিষ্ঠান করে এখন এই রণস্থলে স্বর্ণময় বেদির মতো অবস্থান করছেন। পূর্বে মহাবাহু দুর্যোধন জীবিত থাকতে নিশ্চয়ই এই মনস্বিনীবালা সুদরবাহু দুর্যোধনের বাহুযুগল অবলম্বন করে আনন্দ অনুভব করতেন। হায়, পুত্র লক্ষ্মণের সঙ্গে নিহত দুর্যোধনকে দেখেও আমার হৃদয় শতধা বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে না! সুন্দর ঊরুযুগল সমন্বিতা, অনিন্দ্যসুন্দরী দুর্যোধনভার্যা, রক্তসিক্ত পুত্র লক্ষ্মণের মস্তক আঘ্রাণ করছেন এবং দুর্যোধনের গাত্র পরিষ্কার করছেন এবং করযুগলদ্বারা মস্তকে আঘাত করে পতির বক্ষঃস্থলে পতিত হচ্ছেন।

“কৃষ্ণ দেখো, আমার ক্লান্তিহীন একশত পুত্রের মধ্যে অনেককেই একা ভীমসেন গদাদ্বারা নিহত করেছেন। আমার বালিকা ও হতপুত্রা পুত্রবধূরা আলুলায়িত কেশে রণস্থলে ছুটোছুটি করছেন। এই নারীরা পূর্বে নানা অলংকারে অলংকৃত চরণদ্বারা অট্টালিকার ভিতরে বিচরণ করতেন। তাঁরা এখন গৃধ্র, শৃগাল ও কাকগণকে অপসরণ করছে। সুন্দর বাহুযুক্ত এই রমণীগণের মধ্যে কেউ কেউ নিহত ভ্রাতৃগণের, কেউ কেউ পিতৃগণের, কেউ কেউ নিহত পুত্রগণের বাহু ধারণ করে তাঁদের উপর পতিত হচ্ছেন। আবার কেউ সুন্দর কুণ্ডল ও উন্নত নাসিকাসমন্বিত কোনও আত্মীয়জনের দেহবিচ্ছিন্ন মস্তকটি নিয়ে দেখছেন। এই অনিন্দ্যসুন্দর নারীরা এবং অল্পবুদ্ধিশালিনী আমি পূর্বজন্মে অনেক পাপ করেছিলাম বলে মনে করি। যুধিষ্ঠির ধর্মরাজ হয়েও যখন আমাদের এই সমগ্র সৈন্যই নিপাত করেছেন। আমার ধারণা এই যে, ফলভোগ ব্যতীত পুণ্য ও পাপের ধ্বংস হয় না। কৃষ্ণ তরুণীগণকে দর্শন করো— এদের স্তন ও মুখমণ্ডল সুদৃশ্য এবং অক্ষিপক্ষ, নয়নের মণি ও কেশকলাপ কৃষ্ণবর্ণ; বিশেষত এরা সৎকুলে উৎপন্ন ও লজ্জাশীল। হায়, বাসুদেব, মত্ত হস্তীর মতো দর্পশালী ও ঈর্ষান্বিত আমার পুত্রদের অন্তঃপুরের নারীদের আজ সাধারণ লোকেরাও দেখছে। কৃষ্ণ দেখো— দ্রৌপদীর অপমানকারী দুঃশাসন শয়ন করে রয়েছেন। শত্ৰুহন্তা ভীমসেন তাঁকে যুদ্ধে নিপাতিত করেছেন এবং সমস্ত অঙ্গ থেকে তাঁর রক্ত পান করেছেন। দুঃশাসন কর্ণ ও দুর্যোধনের প্রিয়কার্য করবার ইচ্ছা করে সেই দ্যূতসভায় দ্যূতনিৰ্জিতা দ্রৌপদীকে বলেছিলেন, ‘পাঞ্চালী এখন তুমি দাসগণের ভার্যা হয়েছ; অতএব তুমি এখনই যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেবের সঙ্গে আমাদের গৃহের ভিতরে প্রবেশ করো।’

“কৃষ্ণ তারপর আমি রাজা দুর্যোধনকে বলেছিলাম, ‘পুত্র! তুমি ক্রোধপাশে বদ্ধ শকুনিকে বর্জন করো। তুমি চিন্তা করে দেখো, তোমার এই মাতুল অতি দুর্বুদ্ধি ও কলহপ্রিয়। তুমি একে পরিত্যাগ করে, পাণ্ডবদের সঙ্গে সৌহার্দ্য স্থাপনে শান্ত হও। দুর্বুদ্ধি দুর্যোধন তুমি বুঝতে পারছ না, মশাল যেমন হস্তীকে আঘাত করে, তুমিও তেমনই বাক্যরূপ নারাচদ্বারা কোপন স্বভাব ভীমসেনকে আঘাত করছ।’ ভীমসেন এইভাবে সেই সকল বাক্যশল্য স্মরণ করে নির্জনে ক্রুদ্ধ হয়ে থেকেছিল; সিংহ যেমন মহাহস্তীকে নিহত করে, সেইরকম ভীমসেন দুঃশাসনকে হত্যা করেছে; সুতরাং দুঃশাসন বাহুযুগল প্রসারিত করে শয়ন করে আছেন। অতিশয় কোপনস্বভাব ভীমসেন গুরুতর ভীষণ কার্য করেছে। সে ক্রুদ্ধ হয়ে দুঃশাসনের রক্তপান করেছে। মাধব, আমার পুত্র প্রাজ্ঞজন প্রিয় বিকর্ণ ভীমকর্তৃক নিহত ও ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ হয়ে ভূতলে শয়ন করে রয়েছেন। শরৎকালে নীলমেঘ পরিবেষ্টিত চন্দ্রের ন্যায় বিকর্ণ নিহত হস্তী সমূহের মধ্যে শায়িত আছেন। শোকার্তা ও বালিকা ওই বিকর্ণের ভার্যা মাংসলোভী এই গৃধ্রগণকে অনবরত বারণ করছেন। কিন্তু বারণ করে উঠতে পারছেন না। যুবক, সুন্দরাকৃতি, বীরসুখে অবস্থিত ও সুখভোগের যোগ্য বিকর্ণ ধূলির উপর শয়ন করে আছেন। তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ, কিন্তু বীরশ্রী এই ভরতশ্রেষ্ঠকে পরিত্যাগ করছে না।

“সমরবীর ভীমসেন প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য শত্ৰুহন্তা দুর্মুখকে নিহত করেছে। হিংস্র জন্তুগণ তাঁর মুখের অর্ধাংশ ভক্ষণ করেছে। তবুও মুখের অর্ধাংশ সপ্তমীর চাঁদের মতোই লাগছে। বীরপুত্র দুর্মুখ ধূলি ভক্ষণ করছেন। সৌম্য কৃষ্ণ, এই দুর্মুখ যুদ্ধে দেবসৈন্য বিজয়ী ছিলেন। তাঁর মৃত্যু কীভাবে সম্ভব? যিনি ধনুর্ধরদের উপমাস্থল ছিলেন, সেই ধৃতরাষ্ট্রনন্দন চিত্রসেন নিহত হয়ে ভূতলে শয়ন করে আছেন। শোকার্ত যুবতীরা মাংসভোজী জন্তুগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে সেই চিত্রসেনের সেবা করছেন। স্ত্রীলোকের ক্রন্দন ও মাংসভোজী প্রাণীর গর্জন এক বিচিত্র ধ্বনির সৃষ্টি করছে। যুবক, সুন্দর ও সর্বদা উত্তম স্ত্রী-সেবিত বিবিংশতি নিহত হয়ে ধূলিতে শয়ান রয়েছেন। বাণে বাণে তাঁর বর্ম ছিন্ন হয়েছিল। তিনি নিহত হওয়ার পর এখন গৃধ্রগণ এঁকে ঘিরে রেখেছে। কৃষ্ণ তুমি বিবিংশতির মুখখানি দেখো—তা এখনও মৃদু হাস্যযুক্ত, সুন্দর নাসিকা ও ভ্রূযুগল সমন্বিত অত্যন্ত নির্মল ও চন্দ্রের তুল্য। সহস্র সহস্র দেবকন্যা যেমন ক্রীড়াপ্রবৃত্ত গন্ধর্বের সেবা করে; সেইরকম উত্তম রমণীরা বহুপ্রকারে বিবিংশতির সেবা করতেন। দুঃসহ বীর ছিলেন, বীরশোভায় রণস্থল শোভিত করতেন, বীরসৈন্য সংহার করতে পারতেন এবং শত্রুপক্ষকে দমন করতে সমর্থ ছিলেন। কোনও ব্যক্তি দুঃসহকে সহ্য করতে পারত না। পর্বত আপন শরীরে উৎপন্ন প্রস্ফুটিত কর্ণিকার পুষ্পদ্বারা যেমন আবৃত হয়ে শোভা লাভ করে, সেইরকম বাণে বাণে আবৃত দুঃসহের এই শরীরটি শোভা পাচ্ছে। কৈলাস পর্বত অগ্নিদ্বারা যেমন প্রকাশ পায়; তেমনই দুঃসহ গতাসু হয়েও স্বর্ণময়ী মালা ও উজ্জ্বল কবচদ্বারা প্রকাশ পাচ্ছেন।

“কেশব, বল ও বীরত্ব বিষয়ে যিনি পিতা অৰ্জুন বা তোমার থেকেও দেড়গুণ অধিক ছিলেন, সেই দর্পিত সিংহের মতো অসংখ্য সৈন্য বধ করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, দেখো, এখনও তাঁর মুখশ্রী অবিকৃত আছে। বিরাটরাজকন্যা, অর্জুনের পুত্রবধূ, অনিন্দ্যসুন্দরী উত্তরা হস্তদ্বারা মৃত স্বামীর অঙ্গ মার্জনা করে দিচ্ছেন, তাঁর কণ্ঠ আলিঙ্গন করে, মুখমণ্ডলের ঘ্রাণ নিয়ে লজ্জিতভাবে অভিমন্যুর রুধিরলিপ্ত ও স্বর্ণখচিত কবচটি খুলে ফেলে তাঁর দেহের প্রতি দৃষ্টিপাত করছেন। তিনি সেই অভিমন্যুর মুখের দিকে তাকিয়ে আর্তস্বরে বলছেন, ‘যার মুখমণ্ডল, নয়নশ্রী কৃষ্ণের মতো সুন্দর ছিল, যিনি বল, বীর্য, তেজে কৃষ্ণের তুল্য ছিলেন, এই দু’হাত প্রসারিত করে ভূমিতে শয়ন করে আছেন।’ তারপর উত্তরা অভিমন্যুকে প্রশ্ন করলেন, ‘নাথ! কঠিন যুদ্ধ ব্যায়াম করে পরিশ্রমবশত আপনি কি নিদ্রারত? আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন না কেন? আমি তো আপনার কাছে কোনও অপরাধ করিনি। আপনি বালক এবং একাকী ছিলেন। তখন দ্রোণ প্রভৃতি নিষ্ঠুর রথীরা আপনাকে বধ করেছিল। এখন আপনি স্বর্গে গিয়ে অপ্সরাদের সঙ্গে সম্মিলিত হবেন। আমার কথা তখন আপনার মনে পড়বে? মাত্র ছ’মাস আপনি আমার সঙ্গে সহবাস করেছিলেন।’ উত্তরা যখন এইসব বলেছিলেন তখন বিরাটরাজার কুলবধূরা উত্তরাকে আকর্ষণ করে নিয়ে যাচ্ছেন।

“মাধব, ওই দেখো দ্রোণের অস্ত্রাঘাতে ক্ষতবিক্ষত বিরাটরাজার দেহ। তাঁর ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর গৃধ্র, শৃগাল ও কাকেরা চিৎকার করছে। বিরাটরাজার পুত্র উত্তর, অভিমন্যু, কম্বোজরাজ সুদক্ষিণ, প্রিয়দর্শন লক্ষ্মণ—এঁরা রণস্থলে শয়ন করে আছেন, মহাধনুর্ধর ও মহাবল এই কর্ণ যুদ্ধে অর্জুনের তেজে প্রজ্বলিত অগ্নির ন্যায় নির্বাপিত হয়ে শয়ন করে আছেন। বৈকর্তন কর্ণ যুদ্ধে বহুতর অতিরথকে বধ করে রক্তাক্ত দেহে ভূতলে পতিত হয়ে শায়িত আছেন। অসহিষ্ণু, চিরকাল কোপন স্বভাব, মহাধনুর্ধর, মহারথ ও বীর কর্ণ যুদ্ধে অর্জুন কর্তৃক নিহত হয়ে ভূতলে শয়ন করে আছেন। এখন কর্ণের ভার্যারা এসে রোদন করতে থেকে যুদ্ধে নিহত ওই বীরের সেবা করছেন। মাধব, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যার ভয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আত্মরক্ষার চিন্তা করতে থেকে, এই তেরো বৎসর যাবৎ নিদ্রা যেতে পারেননি, ইন্দ্রের ন্যায় যুদ্ধে শত্রুপক্ষের অজেয়, প্রলয়াগ্নির মতো তেজস্বী, হিমালয়ের মতো স্থির সেই কর্ণ দুর্যোধনের রক্ষক হয়ে, বায়ুভঙ্গ বৃক্ষের মতো নিহত হয়ে ভূতলে শয়ন করছেন। কৃষ্ণ দেখো—কর্ণের পত্নী ও বৃষসেনের মাতা অনবরত বিলাপ ও রোদন করতে করতে ভূতলে পতিত হয়ে আছেন। মহাবীর কর্ণ, নিশ্চয়ই তার গুরু পরশুরামের অভিসম্পাত তাঁর অনুসরণ করেছিল। রণভূমি সেই কারণে তাঁর রথচক্র গ্রাস করেছিল। সেই সময়ে অর্জুন বাণদ্বারা রণস্থলে শত্রুগণমধ্যে তাঁর মস্তক অপহরণ করতে সমর্থ হয়েছিল। হায়! হায়! এই সুষেণের মাতা (কর্ণের পত্নী) স্বর্ণকবচাবৃত, মহাধ্যবসায়ী ও মহাবাহু কর্ণকে নিহত দেখে অত্যন্ত শোকার্ত হয়ে রোদন করতে থেকে অচৈতন্য অবস্থায় ভূতলে পতিত হয়েছেন। মাংসভোজী জন্তুগণ কর্ণের দেহের সামান্য মাত্র অবশিষ্ট রেখেছে।

“বহুতর বন্ধু থাকলেও বন্ধুহীনের মতো অবন্তিরাজ বীর বিন্দকে ভীমসেন নিহত করেছেন। শৃগালগণ, কঙ্কগণ তাঁকে নানাদিকে আকর্ষণ করছে। তাঁর ভার্যারা সম্মিলিত হয়ে রোদন করতে থেকে তাঁর সেবা করছেন। প্রতীপনন্দন বাহ্লিক ভল্লের আঘাতে নিহত হয়ে, ব্যাঘ্রের ন্যায় শায়িত আছেন। ইনি মৃত হলেও পূর্ণচন্দ্রের মুখশ্রীর মতো এর মুখবর্ণ এখনও উজ্জ্বল আছে। পুত্রশোকে সন্তপ্ত অর্জুন আপন প্রতিজ্ঞা রক্ষায় যুদ্ধে জয়দ্রথকে নিপাতিত করেছেন। দ্রোণ প্রভৃতি মহাত্মাদের আশ্বাস সত্ত্বেও অর্জুন আপন প্রতিজ্ঞা সত্য করেছেন। গৃধ্র ও শৃগালগণ দর্পশালী জয়দ্রথের দেহ ভক্ষণ করেছে। জয়দ্রথের ভার্যারা তাঁর দেহের অবশিষ্টাংশ রক্ষা করার চেষ্টা করছে, কম্বোজ ও যবনদেশীয় রমণীরা সেই দেহের শুশ্রূষা করছেন। জয়দ্রথ যখন কেকয়গণের সঙ্গে মিলিত হয়ে দ্রৌপদীকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই তিনি পাণ্ডবগণের বধ্য হয়েছিলেন। পাণ্ডবেরা তখন দুঃশলার কথা চিন্তা করেই তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার সেই কন্যা দুঃশলা অত্যন্ত দুঃখিতা হয়ে বিলাপ করতে থেকে আত্মহত্যার জন্য বক্ষে করাঘাত করছেন এবং পাণ্ডবদের গালি দিচ্ছেন। এর থেকে গুরুতর দুঃখ আর কী আছে; যেহেতু বালিকা কন্যা ও হতস্বামিনী পুত্রবধূরা বিধবা হয়েছেন। জয়দ্রথের মাথা খুঁজে না পেয়ে দুঃশলা পাগলিনীর মতো ছুটে বেড়াচ্ছে।

“কৃষ্ণ, নকুলের সাক্ষাৎ মাতুল শল্য যুদ্ধে ধর্মজ্ঞ ধর্মরাজের হস্তে নিহত হয়ে এই শয়ন করে আছেন। যিনি সর্বদা তোমার সঙ্গে স্পর্ধা করতেন, সেই মহারথ শল্য নিহত হয়ে শয়ন করে আছেন। যিনি কর্ণের সারথ্য গ্রহণ করেও পাণ্ডবগণের জয়ের জন্য তখন সেই কর্ণের তেজক্ষয় করেছিলেন। শল্যের মুখখানিকে কাকেরা দংশন করছে, শল্যের তপ্তকাঞ্চনবর্ণ জিহ্বাটি মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং পাখিরা তা ভক্ষণ করছে। অত্যন্ত সূক্ষ্মবসন-ধারিণী ক্ষত্রিয়রমণীরা ক্ষত্রিয়প্রধান শল্যের কাছে গিয়ে তাঁকে আহ্বান করতে থেকে, ঋতুমতী ধেনুগুলি যেমন কর্দমমগ্ন বৃষকে পরিবেষ্টন করে তার সকল দিকে অবস্থান করে, শল্য-রমণীরা সেইভাবে অবস্থান করছেন।

“পর্বতাধিপতি, প্রতাপশালী, গজাঙ্কুশধারীশ্রেষ্ঠ এই রাজা ভগদত্ত অর্জুন কর্তৃক নিপাতিত হয়ে ভূতলে শায়িত আছেন। হিংস্র জন্তুরা তাঁকে ভক্ষণ করছে, কিন্তু তাঁর মাথার স্বর্ণময়ী মালা এখনও কেশশোভা বর্ধন করছে। অর্জুনের সঙ্গে এর ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে ইনি অর্জুনের জীবন সন্দেহাপন্ন করে তুলে, পরে তাঁরই হাতে নিহত হয়েছেন।

“জগতে শৌর্য ও বীর্যে যিনি অতুলনীয়, এই সেই যুদ্ধে ভীষণ কার্যকারী ভীষ্ম আহত হয়ে শয়ন করে আছেন। ঊর্ধ্বরেতা ও সত্যপ্রতিজ্ঞ ভীষ্ম বীরসেবিত বীরশয্যায় পতিত হয়ে শরশয্যাতে শয়ন করে আছেন। বেদব্যাসের মত অনুসারে যিনি ধর্মাত্মা ও সর্বজ্ঞ বলে বিখ্যাত ছিলেন, এই সেই ভীষ্ম মানুষ হয়েও দেবতার মতো প্রাণ ধারণ করে আছেন। যুদ্ধে যাঁর তুল্য নিপুণ, অভিজ্ঞ ও পরাক্রমশালী কেউ নেই, সেই ভীষ্ম বাণে বাণে আহত হয়ে শয়ন করে আছেন। পাণ্ডবেরা জিজ্ঞাসা করলে, সত্যবাদী, ধর্মজ্ঞ ও বীর এই ভীষ্ম নিজেই নিজের মৃত্যুর উপায় বলে দিয়েছিলেন। মাধব, দেবতুল্য ও নরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম স্বর্গে গমন করলে, কৌরবেরা ধর্ম বিষয়ে কার কাছে প্রশ্ন করবেন?

“অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষক, সাত্যকির গুরু এবং অন্যান্য সকল কৌরবগণের শিক্ষাদাতা দ্রোণ পতিত হয়েছেন। স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র অথবা মহাবীর পরশুরাম যেমন চতুর্বিদ অস্ত্র জানেন, তেমন দ্রোণও চতুর্বিদ অস্ত্র জানতেন। কৌরবেরা যাঁকে অগ্রবর্তী করে যুদ্ধে পাণ্ডবগণকে আহ্বান করেছিল, সেই অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ দ্রোণ অস্ত্র দ্বারাই ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। দ্রোণ নিহত হলেও জীবিতের ন্যায় তাঁর ধনুর মুষ্টি ও হস্তাবরণ অশিথিলই রয়েছে। সেই দ্রোণাচার্যের বন্দনযোগ্য, বন্দিগণ প্রশংসিত, সুন্দর ও শিষ্যগণ সেবিত চরণ দু’খানি শৃগালেরা আকর্ষণ করছে। দ্রোণভার্যা কৃপী দুঃখে অচেতনপ্রায় হয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্বারা নিহত দ্রোণের কাছে অবস্থান করছেন। কৃষ্ণ দেখো—সেই কৃপী মুক্তকেশী, অধোমুখী ও ভূতলে পতিত হয়ে অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ দ্রোণের শুশ্রূষা করছেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন বাণদ্বারা দ্রোণের বর্ম বিদীর্ণ করেছিলেন, জটাধারী শিষ্যেরা এসে রণস্থলে তাঁর শুশ্রূষা করছেন, কৃপী যথানিয়মে সামবেদীয় ব্রাহ্মণদের সঙ্গে অগ্নি আনয়ন, চিতা প্রজ্বলন, তাতে দ্রোণকে স্থাপন করে, চতুর্দিকে ঘুরতে থেকে সামবেদের প্রাথমিক তিনটি মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। দ্রোণশিষ্য অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা চিতাটিকে প্রদক্ষিণপূর্বক কৃপীকে অগ্রবর্তিনী করে গঙ্গার অভিমুখে গমন করছেন।

“কৃষ্ণ নিকটে তাকিয়ে দেখো সোমদত্ত পুত্র ভূরিশ্রবা সাত্যকির হস্তে নিহত হয়ে পতিত আছেন। বহুতর পক্ষী তাঁকে ক্রমাগত চঞ্চু প্রহার করছে। নিহত সোমদত্ত সর্বতোভাবে পুত্রশোকে সন্তপ্ত থেকে মৃত অবস্থাতেও যেন পুত্রহস্তা সাত্যকিকে তিরস্কার করছেন। প্রথমে অর্জুন ভূরিশ্রবার বাহুছেদন করেছেন, পরে সাত্যকি তাঁকে নিপাতিত করেছেন। এখন হিংস্র জন্তুগণ তাঁর দেহ ভক্ষণ করছেন। বিধবা পুত্রবধূরা যুদ্ধে নিহত শল ও ভূরিশ্রবার উদ্দেশে শোক করছেন। ক্ষীণমধ্য ভূরিশ্রবার ভার্যা ভর্তার ছিন্ন বাহুখানিকে ক্রোড়ে তুলে নিয়ে কাতরভাবে বিলাপ করছেন, ‘এই সেই আমার মেখলাপসারী, স্থূলস্তনমর্দনকারী, নাভি, ঊরু ও জঘনস্পর্শী এবং কটিদেশের বস্ত্রবন্ধনস্খলনকারী হাত।” অনায়াসে কার্যকারী অর্জুন কৃষ্ণের নিকটেই অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে রত এবং অসাবধান ভূরিশ্রবার এই বাহুখানিকে ছেদন করেছিলেন। জনার্দন আপনি লোকসভায় কিংবা লোকের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে অর্জুনের এই মহৎ কর্মের বিষয়ে কী বলবেন এবং স্বয়ং অর্জুনই বা কী বলবেন।

“ভাগিনেয় সহদেব, বলবান ও যথার্থবিক্রমশালী গান্ধারাধিপতি মাতুল শকুনিকে নিহত করেছেন। পূর্বে রমণীরা স্বর্ণদণ্ডব্যজনদ্বারা যাঁর উপর বায়ুসঞ্চালন করত, এখন পক্ষীরাই পক্ষদ্বারা বায়ু সঞ্চালন করছে। যে শকুনি মায়াবলে শত শত সহস্র সহস্র রূপ ধারণ করত, পাণ্ডবদের তেজে তাঁর সমস্ত মায়াই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। শঠতানিপুণ শকুনি মায়ার প্রভাবে যুধিষ্ঠিরের বিশাল রাজ্য জয় করেছিলেন, তাঁর জীবনই সহদেব জয় করে নিয়েছেন। শকুনিই আমার পুত্রগণের ও অনুচরদের সঙ্গে নিজের বিনাশের জন্য পাণ্ডবগণের সঙ্গে আমার পুত্রগণের গুরুতর শত্রুতা ঘটিয়েছিল। অস্ত্রাঘাতে মৃত্যু হওয়াতে শকুনিও আমার পুত্রদের সঙ্গে স্বর্গে গিয়েছে। সে স্বর্গেই আবার পাণ্ডব কৌরবদের মধ্যে ভেদ ঘটাবে কি না তাই আমি ভাবছি।

“বীর কম্বোজদেশের রাজা, কলিঙ্গদেশের রাজা, মগধদেশের রাজা জয়ৎসেন ভূতলে রক্তসিক্ত হয়ে পড়ে আছেন, তাঁদের রমণীরা তাঁদের পরিবেষ্টন করে হাহাকার করছে।” এইভাবে কুরুক্ষেত্র প্রান্তরের সমস্ত দিক পর্যবেক্ষণ করে, সর্বত্রই রক্তাক্ত দেহ, মাংসভোজী প্রাণীদের উল্লাসমুখর গর্জন, রমণীদের হাহাকার ধ্বনি শুনতে শুনতে গান্ধারী অচেতন হয়ে ভূমিতে পড়ে গেলেন।

*

‘স্ত্রী-পর্ব’ মহাভারতের সংক্ষিপ্ততম পর্ব। কিন্তু করুণ রসের বর্ণনায় এখানে মহাকবি অনন্যসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। বস্তুত করুণ রস যে কত ভয়ংকর হতে পারে, যুদ্ধশেষে কুরুক্ষেত্র প্রান্তরের চিত্র যে কত ভয়ানক ব্যাসদেব তার বর্ণনা দিয়েছেন। এ পর্বে বক্তা গান্ধারী, শ্রোতা কৃষ্ণ। গান্ধারীর বক্তব্যে যেমন ভীষ্ম, দ্ৰোণ সম্পর্কে শ্রদ্ধা প্রকাশিত হয়েছে, তেমনই তাঁর অবচেতন মনে দুর্বুদ্ধি জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধন এবং তাঁর দুরাত্মা সঙ্গী কর্ণ সম্পর্কে গোপন স্নেহও ছিল। লক্ষ্মণ ও অভিমন্যু সম্পর্কে তাঁর স্নেহমিশ্রিত শ্রদ্ধা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গান্ধারী তাঁর ভ্রাতা শকুনিকে অত্যন্ত অপছন্দ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর পুত্র দুর্যোধন সুবুদ্ধি মানুষ ছিল না, কিন্তু শকুনি ও কর্ণ মিলে তাঁকে আরও খারাপ করে দিয়েছে। শকুনি সম্পর্কে গান্ধারীর প্রত্যেকটি কথায় অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা ফুটে উঠেছে।

অন্তঃপুরিকাদের বর্ণনায় গান্ধারীর সমবেদনার সঙ্গে মাতৃ হৃদয়ের যন্ত্রণাটিও সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এঁরা অন্তঃপুরিকা ছিলেন। রাজপথের জনসাধারণ দেখতে পেতেন না এঁদের। প্রতিটি রমণীর হাহাকারের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। দুঃশলা ছিলেন পাণ্ডব-কৌরবদের একমাত্র ভগিনী। দ্রৌপদী হরণের পর যে কারণে যুধিষ্ঠির ভীমকে ভগিনীপতি জয়দ্রথের জীবনদান করতে বলেছিলেন। তাই দুঃশলার আর্তনাদের মধ্যে রয়েছে পাণ্ডবদের প্রতি তীব্র ভর্ৎসনা ও গালিগালাজ। আবার অভিমন্যু-পত্নী উত্তরা সদ্য বালিকা, অতি অল্পদিন বিবাহ হয়েছে তাঁদের। তিনি এখনও সহবাস তৃপ্ত নন। তবুও চারপাশের পরিণতা নারীদের মধ্যে তিনি শোকপ্রকাশের ক্ষেত্রে অতি চুপিচুপি স্বামীর সঙ্গে কথা বলেছেন। আবার ভূরিশ্রবার স্ত্রী পরিণতা। দীর্ঘদিন স্বামী সহবাসে অভ্যস্তা। তাঁর রোদনের সঙ্গে তাঁর স্বামী-সুখের স্মৃতি ফুটে উঠেছে। ভূরিশ্রবার কর্তিত দক্ষিণ বাহু নিয়ে তাঁর আর্তনাদ পড়তে পড়তে অতি স্বাভাবিকভাবেই আধুনিক যুগের একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক-এর ‘প্রাচেতস’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে। প্রাচেতস এক সদ্য বিবাহিত নারীর সামনেই তাঁর স্বামীর দক্ষিণ বাহু তরবারি দিয়ে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। সেই নববধূর হাহাকার আর ভূরিশ্রবার পত্নীর হাহাকারের বিষয় এক। তবে ভূরিশ্রবার পত্নী পরিণতা, তাঁর আক্ষেপও কুণ্ঠাহীন।

রণক্ষেত্রে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, উত্তমৌজা ও যুধামন্যুর উল্লেখ নেই। কারণ, তাঁরা রণক্ষেত্রে নিহত হননি, সুপ্তিমগ্ন অবস্থায় শিবিরে নিহত হয়েছিলেন। সুভদ্রা দ্রৌপদীর উল্লেখও এখানে নেই, কারণ দ্রৌপদী সুভদ্রা উপপ্লব্য নগরেই থেকে গিয়েছিলেন। কুন্তী ছিলেন হস্তিনানগরে।

বনপর্বে কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে বলেছিলেন, যারা তোমার এই লাঞ্ছনার জন্য দায়ী, তাদের ভার্যাদেরও চরম হাহাকারে এর মূল্য দিতে হবে। কৃষ্ণের কথা ফলেছিল। সমস্ত অংশটির বক্তা গান্ধারী, শ্রোতা কৃষ্ণ। পুত্ৰতুল্য বয়সের কৃষ্ণের অলৌকিক ক্ষমতা গান্ধারী জানেন, তাই দুঃখ বর্ণনায় তিনি এত অকুণ্ঠিতা। এত সাংঘাতিক হাহাকার মহাভারতের আর কোথাও নেই। একদিকে রমণীর হাহাকার, অন্যদিকে মাংসভোজী প্রাণীর উল্লাস। এ বর্ণনা বিশ্বসাহিত্যেও দ্বিতীয় রহিত।

৯১
কৃষ্ণকে গান্ধারীর অভিশাপ

কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে মৃত পুত্র, জ্ঞাতি, আত্মীয়বর্গের শোচনীয় মৃত্যু, গৃধ্র, শৃগাল ও মাংসভোজী প্রাণীদের উল্লাসের সঙ্গে তাঁদের দেহ-ভক্ষণ, কন্যা, পুত্রবধূদের আর্ত বিলাপ ও হাহাকার গান্ধারী ব্যাসদেবের বরে দেখতে পেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি চেতনা হারিয়ে ভূতলে পতিত হন। পুনরায় চেতনা লাভ করে তিনি কৃষ্ণকে বলেন, “কৃষ্ণ, তুমি এবং পাণ্ডবেরা সকলে অবধ্য। কারণ যে তোমরা—ভীষ্ম, দ্রোণ, বৈকর্তন, কর্ণ, কৃপ, দুর্যোধন, অশ্বত্থামা, মহারথ জয়দ্ৰথ, সোমদত্ত, বিকর্ণ, এবং বীর কৃতবর্মার হাত থেকে মুক্ত হয়েছ। যে নরশ্রেষ্ঠরা অস্ত্রের বেগে দেবগণকে পরাজিত করতে পারতেন, তাঁরা সকলেই নিহত হয়েছেন। অতএব কৃষ্ণ কালের পরিবর্তন দেখো। নিশ্চয়ই দৈবের কোনও বিষয়েই অত্যন্ত দুষ্কর নয়। যেহেতু, ক্ষত্রিয়েরাই এই ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠদের বধ করেছেন। কৃষ্ণ তুমি যখন সন্ধি করতে না পেরে ভগ্ন-মনোরথ হয়ে পুনরায় উপপ্লব্য নগরে ফিরে গিয়েছিলে, বলবান হলেও তখনই আমার পুত্রেরা নিহত হয়েছিল।

“বুদ্ধিমান ভীষ্ম ও বিদুর তখনই আমাকে বলেছিলেন, ‘দেবি! আপনি আপনার পুত্রদের উপর স্নেহ রাখবেন না।’ বৎস জনার্দন তাঁদের ভবিষ্যৎ দৃষ্টি মিথ্যা হতে পারে না। তাতেই আমার পুত্রেরা অচিরকালের মধ্যেই বিনষ্ট হয়েছে।” এই কথা বলে গান্ধারী ধৈর্য পরিত্যাগ করে শোকে মূৰ্ছিত ও অচেতন হয়ে ভূতলে পতিত হলেন। ক্রমে তিনি চৈতন্যলাভ করে পুত্রশোকে ব্যথিত চিত্ত ও আকুল এবং ক্রোধে অধীর হয়ে, কৃষ্ণের অনিষ্ট করবার জন্য তাঁকে বললেন, “কৃষ্ণ! জনার্দন! পাণ্ডবেরা ও ধার্তরাষ্ট্ররা পরস্পর ক্রুদ্ধ হয়ে বিনষ্ট হতে উদ্যত হলে, তুমি কেন তাদের উপেক্ষা করলে? মহাবাহু মধুসূদন! তুমি সমর্থ ছিলে, তোমার ভৃত্য ছিল অসংখ্য, তুমি বিশাল সৈন্যমধ্যে অবস্থান করছিলে, উভয়পক্ষেই তোমার সমান প্রয়োজন ছিল এবং উভয়পক্ষই তোমার কথা শুনত; এই অবস্থায় তুমি ইচ্ছা করেই যখন কুরুকুলের ধ্বংস উপেক্ষা করেছ, তখন তুমি এই উপেক্ষার ফল ভোগ করো।

“চক্রগদাধর কৃষ্ণ, আমি পতির শুশ্রূষা দ্বারা যা কিছু তপস্যা অর্জন করেছি, সেই দুর্লভ তপস্যার বলে তোমাকে অভিসম্পাত করব। তুমি যখন পরস্পর বিনাশে প্রবৃত্ত ও পরস্পর জ্ঞাতি কৌরব ও পাণ্ডবগণকে উপেক্ষা করেছ, তখন তুমিও তোমার জ্ঞাতিগণকে বিনাশ করবে।”

হতজ্ঞাতির্হতামাত্যো হতপুত্রো বনেচরঃ।

কুৎসিতেনাভ্যুপায়েন নিধনং সমবাপ্স্যসি॥ স্ত্রী : ২৫ : ৪৪ ॥

“মধুসূদন! তুমিও আজ থেকে ছত্রিশ বৎসর সময়ে (বর্ষে ষট্ত্রিংশে মধুসূদন! ৪৩), হতপুত্র, হতজ্ঞাতি, হতামাত্য ও বনচারী অবস্থায় কোনও কুৎসিত উপায়ে নিধন প্রাপ্ত হবে।”

“এবং আজ ভরতবংশীয় স্ত্রীলোকেরা যেমন শোকে ভূতলে লুণ্ঠিত হচ্ছেন, তেমন তোমার স্ত্রীগণও সেই সময়ে এইরূপই হতপুত্র, হতজ্ঞাতি ও হতবান্ধব হয়ে শোকে সকল দিকে ভূতলে লুণ্ঠিত হবেন।” এই কথা শুনে মহামনা কৃষ্ণ ঈষৎ মৃদ্যুহাস্য করেই যেন গান্ধারী দেবীকে বললেন, “সুব্রতে! এই বিষয়টা আমিও জানি; অতএব অন্যকর্তৃক কার্যকে আপনি শাপ দ্বারা সম্পাদন করছেন। বৃষ্ণিবংশীয়গণ দৈববশতই বিনষ্ট হবেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শুভে! আমি ভিন্ন অন্য কোনও লোকই যদুবংশ ধ্বংস করতে সমর্থ হবে না। কারণ, তাঁরা অন্য মানুষ এমনকী দেব-দানবগণেরও অবধ্য; সুতরাং যাদবেরা যখন পরস্পর ধ্বংসপ্রাপ্ত হবেন, তখন আপনার এই অভিসম্পাত নিরর্থক।”

কৃষ্ণ একথা বললে, পাণ্ডবেরা ভীত, উদ্বিগ্ন এবং আপন আপন জীবনে নিরাশ হয়ে পড়লেন। কৃষ্ণ বললেন, “গান্ধাররাজনন্দিনী! উঠুন, উঠুন; শোকের দিকে মন দেবেন না। আপনার অপরাধেই বহুলোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। দুরাত্মা, ঈর্ষান্বিত, অত্যন্ত অভিমানী, নিষ্ঠুরস্বভাব, সজ্জনের সঙ্গে শত্রুতাকারী ও বৃদ্ধ লোকের উপদেশ অগ্রাহ্যকারী পুত্র দুর্যোধনকে প্রশংসা করে, তার দুর্ব্যবহারকে আপনি ভাল বলে মনে করতেন, আপনার সেই দোষ ছিল। এখন সেই আত্মকৃত দোষকে আমার উপর আরোপ করার ইচ্ছা করছেন কেন? যে লোক মৃত বা নিরুদ্দিষ্ট রূপ অতীত বিষয় নিয়ে শোক করে, সে লোক দুঃখের উপর দুঃখভোগ করে বলে, দুটি অনর্থই অনুভব করতে থাকে। পুত্র তপস্যা করবে ভেবে ব্রাহ্মণী গর্ভ ধারণ করেন; সন্তান ভার বহন করবে মনে করে গোরু গর্ভ ধারণ করে; পুত্র দৌড়বে এই চিন্তা করে অশ্বী গর্ভ ধারণ করে; পুত্র ভৃত্যের কার্য করবে ভেবে শূদ্রের স্ত্রী গর্ভধারণ করে, পুত্ৰ পশুপালন করবে ভেবে বৈশ্যস্ত্রী গর্ভধারণ করে এবং পুত্র যুদ্ধে নিহত হবে ভেবেই আপনার মতো ক্ষত্রিয়রমণী গর্ভধারণ করেন।”

কৃষ্ণের সেই অপ্রিয় বাক্য শুনে গান্ধারী শোকাকুল চিত্তে নীরব হয়ে রইলেন।

*

‘গান্ধারীর অভিশাপ’ মহাভারতের এই দুর্লভ মুহূর্তটি পাঠ করতে করতে ‘মহামনা কৃষ্ণের মৃদু ঈষৎ হাস্য’ স্মরণ করলেই গীতার শ্রীকৃষ্ণ আর একবার আমাদের সামনে ঝলক দিয়ে দেখা দেন। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, “আমি লোকক্ষয়কারী বৃদ্ধ কাল, অধুনা লোকসংহারে প্রবৃত্ত হয়েছি” (গীতা: ১১ : ৩২)। কৃষ্ণ জানেন, তাঁর হাতেই ধ্বংস হবে যদুবংশ। মহাভারতে প্রায় প্রতিটি ঘটনার সমান্তরাল অন্য একটি কাহিনি আছে। দুর্যোধনের একশো ভাইকে হত্যার পূর্বে ভীম কীচকের একশো পাঁচ ভ্রাতা হত্যা করেছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দ্বিতীয় সংস্করণ ঘটবে দ্বারকায়—ঈশ্বর কৃষ্ণ ধ্বংস করবেন যদুবংশ। কৃষ্ণ সব জানেন, যা কিছু ঘটবে, সবই তিনি জ্ঞাত আছেন।

কিন্তু এই অংশটিতে গান্ধারীর চরিত্রের সামনে পড়ে বিমূঢ় হয়ে পড়তে হয়। পুত্রহারা রাজ্যহারা, সর্বস্বহারা গান্ধারীকে দেখে আমাদের মনে পড়ে, বিবাহের পর দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডবেরা প্রবেশ করে গান্ধারীকে প্রণাম করতে এলে, দ্রৌপদীকে আলিঙ্গন করেই গান্ধারী শিউরে উঠেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, এই নারীর জন্য তাঁর পুত্রদের মৃত্যু হবে। গান্ধারী পতিব্রতা, গান্ধারী ধর্মপরায়ণা। কিন্তু কুন্তীর সন্তানের জন্ম হয়েছে শুনে তিনি আপন উদরে আঘাতের দ্বারা গর্ভপাত করেছিলেন। শতশৃঙ্গ পর্বত থেকে পাণ্ডু-মাদ্রীর দেহ নিয়ে কুন্তী হস্তিনাপুরে গেলে গান্ধারী কোনও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেননি। রাজসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার সময়েও গান্ধারী নিবারণ করেননি—পাণ্ডবেরা বনবাসে গেলে কুন্তী বিদুরের গৃহে ছিলেন, তখনও গান্ধারী কুন্তীকে সান্ত্বনা দিতে যাননি—সম্ভবত জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ড সম্পর্কে যে ঈর্ষাপপাষণ করতেন, তা গান্ধারীর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল।

কৃষ্ণ গান্ধারীকে বলেছিলেন, “আপনার অপরাধেই বহু লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন…এখন সেই আত্মকৃত দোষকে আমার উপর আরোপ করার ইচ্ছা করছেন কেন?” দুর্যোধনকে অন্যায় প্রশংসা করতেন গান্ধারী, পুত্রের কুৎসিত আচরণ নিবারণের চেষ্টা করেননি তিনি। এই কারণেই ভারতীয় আদি নারী সমাজের শ্রদ্ধেয়া নারী হিসাবে গান্ধারীকে গ্রহণ করা হয়নি। এই কারণেই প্রাতঃস্মরণীয়া পঞ্চকন্যার মধ্যে গান্ধারীকে ঋষিরা গ্রহণ করেননি।

৯২
কর্ণের জন্মরহস্য প্রকাশ ও যুধিষ্ঠিরের নারীজাতির প্রতি অভিশাপ

ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করলেন, “পাণ্ডুনন্দন, যাদের অভিভাবক ছিল না কিংবা যাদের অভিভাবক ছিল; তাদের শরীরগুলিও তো যথাবিধানে দগ্ধ করা হবে?” যুধিষ্ঠির বললেন, “তাত, যাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অধিকারী নেই, এবং যাঁরা সাগ্নিক নন, আমরাই তাঁদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করব। কারণ, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অধিকারী শাস্ত্রে বহুপ্রকার নির্দিষ্ট আছে। সুপর্ণগণ ও গৃধ্রগণ ইতস্তত যাঁদের টেনে নিয়ে গেছে, তাঁদের সঙ্কর্ষণলোক লাভ হবে। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”

মহাপ্রাজ্ঞ, কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির এই কথা বলে সুধর্মা, ধৌম্য, সূতবংশীয় সঞ্জয়, মহাবুদ্ধি বিদুর, কুরুবংশীয় যুযুৎসু, ইন্দ্রসেন প্রভৃতি ভৃত্যগণ ও সমস্ত সূতগণকে আদেশ করলেন, “আপনারা এঁদের সমস্ত প্রেতকার্য সম্পাদন করান। যাতে অনাথের ন্যায় কোনও ব্যক্তির শরীরই বিনষ্ট না হয়।” তখন যুধিষ্ঠিরের আদেশক্রমে ধৌম্যের সঙ্গে সুধর্মা, বিদুর, সূতবংশীয় সঞ্জয় ও ইন্দ্রসেন প্রভৃতি ভৃত্যগণ চন্দন, অগুরুকাঠ, কালীয়ক, ঘৃত, তৈল, অন্যান্য গন্ধদ্রব্য, মহামূল্য পট্টবস্ত্র, রাশি রাশি কাঠ, ভগ্ন রথ ও নানাবিধ অস্ত্র আহরণ করে যত্নে বহু চিতা নির্মাণ করে প্রধানক্রমে সকলকে দাহ করালেন।

সুধর্মা ও ধৌম্য প্রভৃতি লোকেরা সেই সেই জাতীয় লোকদ্বারা ঘৃত নিক্ষেপে প্রজ্বলিত অগ্নিতে রাজা দুর্যোধন, তাঁর অপর ভ্রাতৃগণ, শল্যরাজা, শল, ভূরিশ্ৰবা, রাজা জয়দ্ৰথ, অভিমন্যু, দুঃশাসনের পুত্র, লক্ষ্মণ, রাজা ধৃষ্টকেতু, বৃহদ্বল, সোমদত্ত, শতাধিক সৃঞ্জয়, রাজা ক্ষেমধম্বা, বিরাট, দ্রুপদ, পাঞ্চাল রাজপুত্র শিখণ্ডী, পৃষৎপৌত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিক্রমশালী যুধামন্যু, উত্তমৌজা, দ্রৌপদীর পুত্রগণ— এদের দেহ দাহ করার জন্য শিবির থেকে কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে নিয়ে আসা হল। কোশলরাজ, সুবলনন্দন শকুনি অচল বৃষক, রাজা ভগদত্ত, পুত্রদের সঙ্গে বৈকৰ্তন কৰ্ণ, মহাধনুর্ধর কৈকেয়গণ, মহারথ ত্রৈগর্তগণ, রাক্ষসশ্রেষ্ঠ ঘটোৎকচ, বকের ভ্রাতা রাক্ষসপ্রধান অলম্বুষ ও রাজা জলসন্ধ এবং অন্যান্য শত শত ও সহস্র সহস্র রাজাকে দগ্ধ করালেন। কয়েকজন রাজার বৃষোৎসর্গ প্রভৃতি কার্য হতে লাগল, অনেকে সামগান করতে লাগলেন, সমস্ত আকাশ স্ত্রীলোকের ক্রন্দনধ্বনিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। বিদুর যুধিষ্ঠিরের আদেশে নানাদেশ থেকে আগত সৈন্য, যারা অভিভাবকশূন্য, তাঁদের সহস্র সহস্র কাষ্ঠে ঘৃত প্রদান করে দাহ করালেন। দাহকার্য সম্পাদন করে কুরুরাজ যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রকে অগ্রবর্তী করে গঙ্গার অভিমুখে যাত্রা করলেন।

যুধিষ্ঠির প্রভৃতি সেই ধর্ম লোকেরা শুভজনিকা, পবিত্রজলযুক্তা, আহ্লাদকারিণী, নির্মলা, বিশালা ও তীরদেশে বিশাল বনসমন্বিতা গঙ্গানদীতে আগমন করে অলংকার, উত্তরীয় বস্ত্র ও উষ্ণীষ খুলে ফেলে পিতৃগণ, ভ্রাতৃগণ, পুত্রগণ, পৌত্রগণ, জ্ঞাতিগণ, অন্যান্য সজ্জনগণ ও সুহৃদগণের উদ্দেশে তর্পণ করলেন এবং কৌরব-স্ত্রীরা অত্যন্ত দুঃখিতা হয়ে রোদন করতে থেকে পতিগণের উদ্দেশে তর্পণ করলেন। বীরপত্নীরা বীরগণের তর্পণ করতে থাকলে গঙ্গাজল প্রবেশের ও অবতরণের পথগুলি প্রশস্ত হল এবং গঙ্গানদী যেন আরও বিস্তৃত হয়ে গেল।

ততঃ কুন্তী মহারাজ! সহসা শোককর্ষিতা।

রুদতী মন্দয়া বাচা পুত্ৰান্‌ বচনমব্রবীৎ॥

যঃ স শূরো মহেষ্বাসো রথযূথপযূথপঃ।

অর্জুনেন হতঃ সংখ্যে বীরলক্ষণলক্ষিতঃ॥

যং সূতপুত্রম্‌ মন্যব্ধং রাধেয়মিতি পাণ্ডবাঃ।

যো ব্যরাজচচমূমধ্যে দিবাকর ইব প্রভুঃ॥

প্রত্যযুধ্যত যঃ সর্বান্ পুরা বঃ সপদানুগান।

দুর্যোধনবলং সর্বং যঃ প্রকর্ষণ ব্যরোচিত॥

যস্য নাস্তি সমো বীর্যে পৃথিব্যামপি কশ্চন।

যো বৃণীত যশঃ শূরঃ প্রাণৈরপি সদা ভুবি॥

কর্ণস্য সত্যসন্ধস্য সংগ্রামেষ্ব পলায়িনঃ।

কুরুধবমুদকং তস্য ভ্রাতুরক্লিষ্টকর্মণ॥

স হি বঃ পূর্বজো ভ্রাতা ভাস্করান্মায্য জায়ত।

কুণ্ডলী কবচী শূরো দিবাকরসমপ্রভঃ॥ স্ত্রী: ২৭: ৬-১২ ॥

—মহারাজ! তারপর কুন্তী দেবী সহসা আকুল শোকে রোদন করতে করতে বাষ্পগদগদ বাক্যে পুত্রগণকে বললেন— “মহাধনুর্ধর, রথসমূহরক্ষকগণেরও রক্ষক ও বীরলক্ষণলক্ষিত সেই যে বীরকে অর্জুন যুদ্ধে বধ করেছেন; পাণ্ডবগণ, তোমরা যাঁকে সূত্রপুত্র ও রাধার গর্ভজাত বলে মনে করতে; যে প্রভাবশালী বীর সৈন্যমধ্যে সূর্যের মতো দীপ্তি পেতেন; যিনি পূর্বে অনুচরগণের সঙ্গে তোমাদের সকলের সঙ্গে প্রতিযুদ্ধ করতেন; যিনি দুর্যোধনের সমস্ত সৈন্য আকর্ষণ করতে থেকে প্রকাশ পেতেন; পৃথিবীর মধ্যে কোনও ব্যক্তি বলে যাঁর সমান নেই এবং যে বীর পৃথিবীতে সর্বদাই প্রাণদ্বারা যশ বরণ করে নিতেন; যুদ্ধে অপলায়ী, অনায়াস কার্যকারী ও সত্যপ্রতিজ্ঞ তোমাদের ভ্রাতা সেই কর্ণের উদ্দেশেও তোমরা তর্পণ করো। কারণ, তিনি সূর্য থেকে আমার গর্ভে কুণ্ডল ও কবচধারী এবং সূর্যের তুল্য তেজস্বী হয়ে জন্মেছিলেন; সুতরাং তিনি তোমাদের জ্যেষ্ঠভ্রাতা ছিলেন।”

তখন পাণ্ডবেরা সকলে মাতা কুন্তী দেবীর সেই অপ্রিয় বাক্য শুনে, কর্ণের উদ্দেশেই শোক করতে লাগলেন এবং শোকে আরও গুরুতর পীড়িত হতে থাকলেন। তখন পুরুষশ্রেষ্ঠ ও বীর কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির সর্পের মতো নিশ্বাস ত্যাগ করতে থেকে মাতাকে বললেন, “অর্জুন ছাড়া কোনও ব্যক্তি যার বাণাঘাত সহ্য করে যুদ্ধে অবস্থান করে থাকতে পারত না, দেবতা থেকে উৎপন্ন সেই কর্ণ পূর্বে কীভাবে আপনার পুত্র হয়েছিলেন এবং সেই বীর কী প্রকারেই বা কুণ্ডল ও কবচধারী এবং সূর্যের তুল্য তেজস্বী অবস্থায় জন্মেছিলেন। দেবী! যাঁর বাহুর প্রতাপে আমরা সর্বপ্রকারেই তাপিত হতাম; বস্ত্র দ্বারা অগ্নির ন্যায় কেন আপনি তাঁকে আবৃত রাখলেন। আমরা যেমন অর্জুনের বাহুবলের উপাসনা করেছি, তেমনি ধার্তরাষ্ট্ররা যাঁর বাহুবলের উপাসনা করতেন। কর্ণ ভিন্ন অন্য কোনও বলিশ্রেষ্ঠ রথী রথারোহী সমস্ত রাজার সৈন্যগ্রহণ করতে সমর্থ হতেন না। সর্বশস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ সেই কর্ণ আমাদের জ্যেষ্ঠভ্রাতা ছিলেন? আপনি প্রথমে সেই অদ্ভুতবিক্রমশালী মহাপুরুষকে কী প্রকারে প্রসব করেছিলেন? হায়! আপনি এই বিষয় গোপন করায় আমরা নিহত হয়েছি; কর্ণের নিধনে বন্ধুবর্গের সঙ্গে আমরা সকলেই শোকে পীড়িত হয়েছি। অভিমন্যুর বিনাশ, দ্রৌপদীর পুত্রগণের বধ, পাঞ্চালদের সংহার এবং কৌরবগণের বিধ্বংসে বন্ধুগণের সঙ্গে আমরা সকলেই অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করছি। কর্ণের নিধনে সে সকল অপেক্ষা শতগুণ অধিক দুঃখ আমাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছে। হায়! কর্ণের জন্য শোক করতে থেকে আমি অগ্নিতে স্থাপিত লোকের ন্যায় গুরুতর দগ্ধ হচ্ছি। আজ কর্ণ জীবিত থাকলে এবং তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে পারলে, এ জগতে কোনও বস্তুই আমার অপ্রাপ্য হত না। এমনকী, স্বর্গেরও রাজত্বপদে থাকতে পারতাম এবং কুরুবংশের ধ্বংসকারী এই ভয়ংকর যুদ্ধও হত না।” এই রকম বহুতর বিলাপ করে প্রভাবশালী রাজা যুধিষ্ঠির উচ্চ স্বরে রোদন করতে করতে, কর্ণের উদ্দেশে তর্পণ করলেন। সেই তর্পণ কার্যের সময়ে সকল দিকে যে সমস্ত স্ত্রীলোক ছিল, তারা সকলে উচ্চ স্বরে রোদন করতে লাগল। তখন যুধিষ্ঠির কর্ণের পরিচ্ছদগুলির সঙ্গে তাঁর স্ত্রীদের সেখানে আনালেন, এবং সকলে একত্রিত হয়ে কর্ণের উদ্দেশে তর্পণ সাঙ্গ করলেন। মহাত্মা পাণ্ডবেরা সকলেরই শুদ্ধি (অশৌচনিবৃত্তি) সম্পন্ন করবেন বলে রাজধানীর বাইরে সেই গঙ্গাতীরেই একমাস অবস্থান করলেন। ক্রমে বেদব্যাস, নারদ, দেবল, দেবস্থান ও কণ্ব এবং তাঁদের প্রধান শিষ্যেরা, অন্যান্য বেদবিদ, লব্ধজ্ঞান ব্রাহ্মণগণ, গৃহস্থগণ ও ব্রহ্মচারীগণ এসে কৌরবশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তখন যুধিষ্ঠির যথাবিধানে মহর্ষিদের সম্মান জানিয়ে দেবর্ষি নারদকে বললেন, “ভগবন্ নারদ। মাতা কুন্তী দেবী কর্ণের উৎপত্তিবৃত্তান্ত গোপন করে আমাকে গুরুতর দুঃখিত করেছেন। সেই যাঁর দশ সহস্র হস্তীর তুল্য দৈহিক বল ছিল এবং যিনি জগতে অপ্রতিরথ, সিংহের মতো সবেগগতি, বুদ্ধিমান, দয়ালু, দাতা, যথাবিধানে শাস্ত্রোক্ত নিয়মপালনকারী, ধার্তরাষ্ট্রগণের আশ্রয়, অভিমানী, তীক্ষ্ণপরাক্রমশালী, অসহিষ্ণু, সর্বদা কোপনস্বভাব, প্রত্যেক যুদ্ধে আমাদের পরাজয়কারী, দ্রুত অস্ত্র নিক্ষেপী, চিত্রযোধী, যুদ্ধনিপুণ এবং অদ্ভুত বিক্রম যুক্ত ছিলেন। সেই কর্ণ গোপনে কুন্তী দেবীর গর্ভে উৎপন্ন হয়েছিলেন; সুতরাং তিনি আমাদের ভ্রাতাই ছিলেন।

“আমি যখন তৰ্পণ করি, সেই সময়ে মাতা কুন্তী দেবী বলেছিলেন, ‘সর্বগুণসম্পন্ন কর্ণ সূর্য থেকে আমার গর্ভে উৎপন্ন হয়েছিলেন, আমি ওকে পূর্বে জলে নিক্ষেপ করেছিলাম।’ মাতৃদেবী তাঁকে মঞ্জুষাতে (পেটিকার ভিতরে) রেখে গঙ্গার স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সমস্ত লোকই যাঁকে রাধার গর্ভজাত সূতপুত্র বলে মনে করত, তিনি কুন্তীর জ্যেষ্ঠপুত্র এবং আমাদের শুধুমাত্র মাতৃজাত ভ্রাতা ছিলেন; কিন্তু আমি এই বৃত্তান্ত না জেনে রাজ্যলোভী হয়ে যুদ্ধে সেই ভ্রাতাকে বধ করেছি। আগুন যেমন তুলারাশি দগ্ধ করে, তেমনই কর্ণের নিধনই আমার সর্বাঙ্গ দগ্ধ করছে; পৃথানন্দন অর্জুনও তাঁকে ভ্রাতা বলে জানতেন না। আমি, ভীমসেন, নকুল এবং সহদেব আমরা কেউই কর্ণকে ভ্রাতা বলে জানতাম না; পরে একদা কুন্তী দেবী আমাদের মঙ্গলকামনা করে কর্ণের কাছে গিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘কর্ণ, তুমি আমার পুত্র। অতএব তুমি যুধিষ্ঠিরের পক্ষ অবলম্বন করো।’ কিন্তু মহাত্মা কুন্তী দেবীর সেই অভিলাষও পূর্ণ করেননি। আমরা শুনেছি, তারপর কর্ণ মাতৃদেবীকে বলেছিলেন, ‘মা, আমি যুদ্ধে রাজা দুর্যোধনকে ত্যাগ করতে পারব না। আপনার মত অনুসারে আমি যদি এখন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সন্ধি করি, তা হলে আমার নীচতা, নৃশংসতা, কৃতঘ্নতা করা হয় এবং আমি যুদ্ধে অর্জুনের থেকে ভীত হয়েছি, লোকে একথা মনে করবে; অতএব আমি যুদ্ধে কৃষ্ণের সঙ্গে অর্জুনকে জয় করে পরে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সন্ধি করব।’ এই কথাও কর্ণ বললেন। তখন কুন্তী দেবী সেই বিশালবক্ষা কর্ণকে বললেন, ‘তবে তুমি অর্জুন ভিন্ন আমার অপর চারটি পুত্রকে অভয় দাও এবং অর্জুনের সঙ্গে ইচ্ছানুসারে যুদ্ধ করো’— এই কথা বলে কুন্তী উদ্বেগে কাঁপতে লাগলেন। তখন বুদ্ধিমান কর্ণ কৃতাঞ্জলি হয়ে সেই মাতৃদেবীকে বললেন, ‘দেবি! আমি যুদ্ধে অর্জুন ভিন্ন আপনার অপর চারটি পুত্রকে পেলেও এবং তাদের পরাজয় করতে পারলেও তাদের বধ করব না। অতএব আপনার পাঁচটি পুত্রই থেকে যাবে। যুদ্ধে কর্ণ নিহত হলে অর্জুন থাকবেন, আবার অর্জুন নিহত হলে কর্ণ থাকবেন (অতএব অর্জুন অথবা কর্ণকে নিয়ে আপনার পাঁচ পুত্রই থাকবেন।’ তখন পুত্ররক্ষার্থিনী মাতা কুন্তী দেবী পুনরায় সেই পুত্র কর্ণকে বললেন, ‘কর্ণ! তুমি যুদ্ধে যে যে ভ্রাতার মঙ্গল করবার ইচ্ছা সেই সেই ভ্রাতার মঙ্গলই করবে।’ এই বলে কুন্তী দেবী কর্ণকে পরিত্যাগ করে গৃহে চলে গেলেন।

“ভগবন্! ভ্রাতা অর্জুন যুদ্ধে সেই সহোদর ভ্রাতা কর্ণকে নিপাতিত করেছেন। কিন্তু কুন্তী দেবী তাঁর এবং কর্ণের যে সম্বন্ধ ছিল, তা পূর্বে প্রকাশ করেননি। প্রভাবশালী ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ! প্রথমে অর্জুন সেই মহাধনুর্ধর বীরকে যুদ্ধে নিপাতিত করেছেন; পরে আমি কুন্তীর বাক্য অনুসারে জেনেছি যে, কর্ণ আমাদের অগ্রজ ভ্রাতা ছিলেন। সেই জন্যেই আমি ভ্রাতৃঘাতী হয়েছি এবং আমার হৃদয় গুরুতর অনুতপ্ত হচ্ছে। হায়! কর্ণ ও অর্জুন আমার সহায় থাকলে আমি ইন্দ্রকেও জয় করতে পারতাম। সেই দ্যূতসভায় দুরাত্মারা যখন আমার ক্লেশ উৎপাদন করছিল; তখন হঠাৎ আমার ক্রোধ জন্মেছিল; কিন্তু কর্ণকে দেখেই তা নিবৃত্তি পেয়েছিল। তারপর, সেই দ্যূতসভায় দুর্যোধনের হিতৈষী কর্ণ যখন আমাকে অশ্রাব্য ও রুক্ষ বাক্য সকল বলছিলেন এবং আমি শুনছিলাম, তখন কর্ণের চরণযুগল দেখেই আমার ক্রোধ নিবৃত্তি পেয়েছিল। আমার ধারণা ছিল যে, কর্ণের চরণযুগল কুন্তী দেবীর চরণযুগলের তুল্যরূপ ছিল। কিন্তু কুন্তী দেবীও কর্ণের চরণযুগলের সাদৃশ্যের কারণ কী তা অন্বেষণ ও চিন্তা করেও আমি তৎকালে কোনও প্রকারে বুঝতে পারিনি। দেবর্ষি যুদ্ধের সময়ে পৃথিবী কর্ণের রথচক্র গ্রাস করেছিলেন কেন? এবং কর্ণের প্রতি অভিশাপই বা হয়েছিল কেন, তা আপনি বলুন। ভগবন্! আমি এই বিষয়টি আপনার কাছ থেকে যথাযথভাবে শুনতে ইচ্ছা করি। কারণ, আপনি সর্বজ্ঞ, তত্ত্বজ্ঞানী এবং জগতে লোকের কৃত ও আবৃত সমস্ত বিষয়ই জানেন।”

যুধিষ্ঠির এই কথা বললে, বাগ্মীশ্রেষ্ঠ নারদমুনি— যে কারণে কর্ণের প্রতি অভিশাপ হয়েছিল, সেই সমস্ত বৃত্তান্ত বললেন। নারদ বললেন, “মহাবাহু ভরতনন্দন, তুমি যা বললে তা সত্য। কর্ণ ও অর্জুন মিলিত হলে যুদ্ধে তাঁদের শক্তির অসাধ্য কোনও বিষয়ই থাকত না। নিষ্পাপ মহাবাহু, দেবগণের নিকটেও গোপনীয় আমি এই বিষয়টি তোমার কাছে বলব। পূর্বে কেন এ ঘটনা ঘটেছিল, শোনো। রাজা ক্ষত্রিয়েরা অস্ত্রসংস্পর্শে পবিত্র হয়ে কী করে স্বর্গে যেতে পারে, এই ভেবে বিধাতা সংঘর্ষের উৎপাদক কুন্তী দেবীর কন্যা অবস্থায় গর্ভ সৃষ্টি করেছিলেন। তেজস্বী সেই বালক ক্রমে সূতপুত্র হয়ে ভরদ্বাজগোত্র শ্রেষ্ঠ দ্রোণাচার্যের কাছে ধনুর্বেদ শিক্ষা করেছিল। কালক্রমে সেই কর্ণ তোমার বুদ্ধি, ভীমের বাহুবল, অর্জুনের দ্রুতাস্ত্ৰক্ষেপে যোগ্যতা, নকুল ও সহদেবের বিনয়, বাল্যকালেই কৃষ্ণের সঙ্গে অর্জুনের সখিত্ব এবং তোমার উপর প্রজাগণের অনুরাগের বিষয় চিন্তা করতে থেকে ঈর্ষানলে দগ্ধ হতেন। কর্ণ বাল্যকালেই রাজা দুর্যোধনের সঙ্গে সখিত্ব করেছিলেন এবং তোমরাও দৈববশত ও তাঁর স্বভাবে তাঁকে সর্বদা বিদ্বেষ করতে। ক্রমে অর্জুনকে ধনুর্বেদে সর্বশ্রেষ্ঠ দেখে কর্ণ একদা নির্জনে দ্রোণের কাছে বললেন, আচার্য! মন্ত্র ও নির্মাণের উপায় এবং উপসংহারের সঙ্গে ব্রহ্মাস্ত্র আমি শিক্ষা করতে ইচ্ছা করি। আপনার স্নেহ নিশ্চয়ই সমস্ত শিষ্য ও পুত্রের প্রতি সমান থাকে। আর আপনার অনুগ্রহে অস্ত্রবিশারদেরা আমাকে ‘অশিক্ষিত সর্বশাস্ত্র’ না বলেন। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব, এই আমার ইচ্ছা।

“কর্ণ সেকথা বললে, দ্রোণ অর্জুনের প্রতি কর্ণের দারুণ বিদ্বেষ আছে জেনে নিন্দার সঙ্গে তাঁকে বললেন, ‘যথানিয়মে ব্রতচারী ব্রাহ্মণ অথবা তপস্বী ক্ষত্রিয়ই কেবল ব্রহ্মাস্ত্র শিক্ষা করতে পারেন। কিন্তু অন্য কোনও জাতি কোনও প্রকারেই পারে না।’ দ্রোণ এই কথা বললে, কর্ণ সেই ভরদ্বাজগোত্রশ্রেষ্ঠ দ্রোণকে প্রণাম করে এবং তাঁর অনুমতি নিয়ে, সত্বরই মহেন্দ্রপর্বতবাসী পরশুরামের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। পরশুরামের কাছে উপস্থিত হয়ে, মস্তকদ্বারা তাঁকে প্রণাম করে, আমি ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণ, এই কথা বলে তাঁকে গুরুত্বে বরণ করবার অভিপ্রায় করলেন। তখন পরশুরাম কর্ণের গোত্র প্রভৃতি সমস্ত বিষয় জিজ্ঞাসা করে তাঁকে গ্রহণ করলেন এবং অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘বৎস! তোমার আসার পথে কোনও অসুবিধা হয়নি তো? তুমি এইখানেই থাকো।’ সেই সময় থেকে কর্ণ স্বর্গতুল্য সেই মহেন্দ্র পর্বতে বাস করতে লাগলেন। ক্রমে রাক্ষস, যক্ষ, দেবগণের সঙ্গে তাঁর সম্মেলন হতে লাগল। কর্ণ সেইভাবে বাস করে পরশুরামের কাছে যথাবিধানে বাণ ও অন্যান্য অস্ত্র শিক্ষা করতে লাগলেন। সেই সময়ে তিনি দেব, দানব ও রাক্ষসগণের বিশেষ প্রীতির পাত্র হয়ে উঠলেন। পরে একদিন কর্ণ তরবারি ও ধনু ধারণ করে দক্ষিণ সমুদ্রের উপকূলে কোনও আশ্রমের কাছে একাকী বিচরণ করার সময় ঈশ্বরের ইচ্ছাক্রমে অগ্নিহোত্রী ও বেদবক্তা কোনও ব্রাহ্মণের একটি হোমধনুকে অজ্ঞানত হত্যা করে ফেললেন। তখন কর্ণ সেই ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে বললেন, ‘ভগবন্! আমি অজ্ঞানবশত এই কার্য করে ফেলেছি’ এবং তাঁকে প্রসন্ন করবার ইচ্ছায় বললেন, ‘আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আপনি প্রসন্ন হোন।’ তখন সেই ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণকে তিরস্কার করে বললেন, ‘দুরাচার! দুর্মতি! তুমি বধের যোগ্য, অতএব তুমি হোমধনু হত্যার ফল ভোগ কর। পাপাত্মা। তুই সর্বদা যার সঙ্গে স্পর্ধা করে থাকিস এবং সর্বদা যাকে জয় করবার চেষ্টা করিস, তার সঙ্গে তুই যখন যুদ্ধ করবি, সেই রণভূমিতে তোর রথের চাকা গ্রাস করবে। নরাধম! তারপর তুই যখন সেই রথচক্র উত্তোলন করবার জন্য চেষ্টা করবি, তখন তোর সেই শত্রু বিক্রম প্রকাশ করে তোর মস্তকচ্ছেদন করবে। তুই এখন যা।” ব্রাহ্মণ কর্ণকে এই অভিসম্পাত করলে, কর্ণ গোরু, ধন ও রত্ন দেবার অঙ্গীকার করে সেই ব্রাহ্মণকে প্রসন্ন করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। তখন সেই ব্রাহ্মণ পুনরায় কর্ণকে বললেন, ‘সমস্ত লোক একত্র হয়েও আমার কথার অন্যথা করতে পারবে না। অতএব তুই এখন যা, অথবা থাক, কিংবা তোর যা কর্তব্য, তা কর।’ ব্রাহ্মণ এই কথা বললে, কর্ণ বিষাদে অধোমুখ ও ভীত হয়ে মনে মনে সেই বিষয়েই চিন্তা করতে করতে পরশুরামের কাছে চলে এলেন।

কর্ণের বাহুবল, ভক্তি, ইন্দ্রিয়দমন ও শুশ্রূষার গুণে ভৃগুবংশ শ্রেষ্ঠ পরশুরাম সন্তুষ্ট হলেন। সুতরাং তপস্বী পরশুরাম তপস্বী কর্ণকে অঙ্গ ও প্রত্যঙ্গের সঙ্গে উপসংহারের উপায়যুক্ত সমগ্র ব্রহ্মাস্ত্র ধীর-স্থিরভাবে ও যথাবিধানে শিক্ষা দিলেন। অদ্ভুত বিক্রমশালী কর্ণ ব্রহ্মাস্ত্র শিক্ষা করে আনন্দিত হয়ে গুরুর আশ্রমে থেকে ধনুর্বেদ শিক্ষায় বিশেষ যত্ন করতে লাগলেন। তারপর কোনও সময়ে উপবাসক্লিষ্ট পরশুরাম কর্ণের সঙ্গে আশ্রমের কাছে বিচরণ করছিলেন। কর্ণের উপরে পরশুরামের শুশ্রূষাকারী বলে বিশ্বাসী ছিল এবং কর্ণের উপর তাঁর বিশেষ স্নেহও জন্মেছিল; সুতরাং পরশুরাম তত্ত্বচিন্তায় ক্লান্তচিত্ত হয়ে কর্ণের জানুর উপরে মস্তক রেখে নিদ্রিত হয়ে পড়লেন। সেই সময় ভীষণমূর্তি, ভীষণস্পর্শ এবং শ্লেষ্মা, মেদ, মাংস ও রক্তভোজী একটি কীট কর্ণের কাছে আসল। রক্তপায়ী সেই কীটটি কর্ণের কাছে এসে তাঁর ঊরু বিদীর্ণ করল; কিন্তু কর্ণ গুরুর নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে সেই কীটটিকে তাড়িয়ে দিতে বা হত্যা করতে পারলেন না। সেই কীটের দংশনের দারুণ যন্ত্রণাও উপেক্ষা করতে লাগলেন। রামের মস্তকটি তিনি যথাস্থানেই ধারণ করলেন। যখন কর্ণের রক্ত নির্গত হয়ে রামের অঙ্গ স্পর্শ করল, তখন তেজস্বী রাম জেগে উঠলেন এবং সন্তপ্ত হয়ে এই কথা বললেন, ‘হায়! আমি অপবিত্র হয়েছি; কর্ণ! তুমি একী করছ; তুমি নির্ভয়ে সমস্ত ঘটনাটি আমাকে বলো।’

তখন কর্ণ রামের কাছে বললেন, ‘এই কীটটি আমাকে দংশন করেছে।’ তখন রাম সেই কীটটিকে দেখতে পেলেন— তার আকার শূকরের তুল্য, আটখানা পা, দাঁতগুলি তীক্ষ্ণ এবং সুচের মতো রোমে তার অঙ্গ আবৃত ছিল এবং ভয়ে সে সমস্ত অঙ্গ সংকুচিত করেছিল; তার নাম— অলর্ক। রাম দর্শন করা মাত্র সেই রক্তসিক্ত কৃমি প্রাণ পরিত্যাগ করল; তা যেন অদ্ভুত বলে বোধ হল। তারপর রাম ও কর্ণ দেখলেন— কামরূপী, ভীষণমূর্তি, রক্তবর্ণকষ ও কৃষ্ণবর্ণ দেহ, এক রাক্ষস মেঘের উপর অবস্থান করছে। সেই রাক্ষস অভিলাষপূর্ণ হওয়ায় কৃতাঞ্জলি হয়ে রামকে বললেন, ‘ভৃগুবংশশ্রেষ্ঠ! আপনার মঙ্গল হোক, আমি যেখান থেকে এসেছিলাম, সেখানেই চললাম। মুনিশ্রেষ্ঠ আপনি আমাকে এই নরক থেকে মুক্ত করেছেন। আপনার মঙ্গল হোক। আপনাকে নমস্কার করি, আপনি আমার প্রিয়কার্য করেছেন।’ তখন মহাবাহু ও মহাপ্রতাপশালী রাম সেই রাক্ষসকে বললেন, ‘তুমি কে? কেনই বা এই নরকে পতিত হয়েছিলে?’

সেই রাক্ষস বলল, ‘মহাত্মা রাম, আমি পূর্বে দেবগণের অত্যন্ত বিরোধী ‘দংশ’ নামক রাক্ষস ছিলাম; পূর্বে, সত্যযুগে আমি আপনার প্রপিতামহ ভৃগুর সমবয়স্ক ছিলাম। সেই রাক্ষস আমি বলপূর্বক ভৃগুর প্রিয়তমা ভার্যাকে অপহরণ করার সময় সেই মহর্ষিরই অভিশাপে কীট হয়ে ভূতলে পতিত হয়েছিলাম। আপনার প্রপিতামহ সেই ভৃগু ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে বলেছিলেন, পাপাত্মা! তুই মূত্র ও শ্লেষ্মাভোজী কীট হয়ে নরকদুঃখ ভোগ করবি।

‘আমি প্রতিকারের উপায় জানতে চাইলে ভৃগু আমাকে বলেছিলেন, আমারই বংশসম্ভূত রাম থেকে তোর অভিশাপের অবসান হবে। ভৃগুর অভিশাপে আমার কীটদশা হয়েছিল। কিন্তু আপনার দর্শনে আমি সেই শাপযোনি থেকে মুক্তি পেলাম।’ এই বলে সেই রাক্ষস রামকে নমস্কার করে চলে গেল।

“পরে রাম ক্রোধের সঙ্গে কর্ণকে বললেন, ‘মূঢ় কর্ণ! ব্রাহ্মণ কখনও এই দারুণ-বেদনা সহ্য করতে পারেন না; কিন্তু তোমার এই ধৈর্য ক্ষত্রিয়ের মতোই দেখছি। অতএব আমার ইচ্ছানুসারে সত্য বিষয় বলো।’ তখন কর্ণ রামের অভিশাপের ভয়ে তাঁকে প্রসন্ন করার ইচ্ছা করে বললেন, ‘ভৃগুনন্দন। আপনি অবগত হোন যে, আমি ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যবর্তী সূতজাতিতে জন্ম গ্রহণ করেছি। জগতের লোক আমাকে রাধার পুত্র কর্ণ বলে। ভৃগুনন্দন ব্রাহ্মণ! আমি ব্ৰহ্মাস্ত্র লাভ করার জন্য আপনার কাছে এসেছি, আপনি আমার উপর অনুগ্রহ করুন। বেদবিদ্যাপ্রদাতা ও প্রভাববান গুরু মানুষের পিতাই বটেন, এতে কোনও সন্দেহ নেই। এই কারণে আমি আপনার কাছে পূর্বে বলেছিলাম, ‘আমি ভৃগুগোত্র ব্রাহ্মণ।’

“এই বলেই কর্ণ শাপের ভয়ে, কাঁপতে থেকে, কৃতাঞ্জলি হয়ে ভূতলে নিপতিত হলেন। তখন ভৃগুবংশশ্রেষ্ঠ রাম হাসতে হাসতেই যেন ক্রোধের সঙ্গে তাঁকে বললেন, ‘মূর্খ! তুমি ব্রহ্মাস্ত্র লাভের লোভে আমার কাছে যখন মিথ্যা ব্যবহার করেছ; তখন অন্য সময়ে এই ব্রহ্মাস্ত্র তোমার মনে পড়বে বটে, কিন্তু তুমি যখন নিজের তুল্য শত্রুর সঙ্গে মিলিত হবে, সেই বধের সময়ে তোমার ব্ৰহ্মাস্ত্র মনে পড়বে না। কারণ, ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য জাতীয় লোকের উপর ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ সাধক বেদ কখনও চিরকাল থাকে না। তুমি এখন যাও। আমার এই আশ্রমে মিথ্যাবাদীর স্থান হয় না। কিন্তু এ জগতে কোনও ক্ষত্রিয় তোমার তুল্য যোদ্ধা হবে না।’ রাম একথা বললে, কর্ণ ন্যায় অনুসারে রামকে প্রণাম করে সেখান থেকে চলে এলেন এবং ক্রমে দুর্যোধনের কাছে এসে বললেন, ‘আমি সমস্ত অস্ত্র শিক্ষা করে এসেছি।’

“এইভাবে পরশুরামের কাছে অস্ত্রলাভ করে দুর্যোধনের সঙ্গে মিলিত হয়ে কর্ণ আনন্দে দিন অতিবাহিত করতে লাগলেন। কিছুকাল পরে কলিঙ্গদেশের রাজকন্যার স্বয়ংবর সভায় বিভিন্ন স্থানের রাজারা আগমন করছেন শুনে দুর্যোধন কর্ণের সঙ্গে স্বর্ণময় রথে আরোহণ করে সেখানে গমন করলেন। সেই স্বয়ংবর সভায় শিশুপাল, জরাসন্ধ, ভীষ্মক, বক্র, কপোতরোমা, মহাবিক্রমশালী রুক্ষ্মী স্ত্রীরাজ্যের অধিপতি মহারাজ সুগাল, অশোক, শতধণ্বা, ভোজদেশীয় বীর, দক্ষিণদেশীয় অন্য বহুতর রাজা এবং পূর্বদেশীয় ও উত্তরদেশীয় ম্লেচ্ছ ও আর্যবংশ সম্ভূত রাজারা সভায় উপবেশন করলেন। তাঁরা সকলেই স্বর্ণময় কেয়ূরধারী, নির্মল স্বর্ণের ন্যায় গৌরকান্তি, উজ্জ্বল দেহ এবং ব্যাঘ্রের ন্যায় বলমদে মত্ত ছিলেন। তখন নপুংসকগণের সঙ্গে সেই কন্যাটি ও তার ধাত্রী সভাতে প্রবেশ করলেন। পরে ধাত্রী রাজগণের নাম শোনাতে থাকলে সেই সর্বাঙ্গসুন্দরী কন্যা দুর্যোধনকে অতিক্রম করে চলে গেল। দুর্যোধন সেই অতিক্রমণ সহ্য করলেন না; তিনি সেই কন্যাটিকে চলে যেতে নিষেধ করলেন। ভীষ্মদ্রোণ আশ্রিত দুর্যোধন আপন বলমদে মত্ত হয়ে সেই রাজকন্যাকে রথে তুলে নিয়ে রাজগণকে যুদ্ধের জন্য আহ্বান করলেন। তরবারি, হস্তাবরণ ও অঙ্গুলিত্রধারী, রথারোহী এবং অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ কর্ণ তাঁর অনুগমন করলেন। তখন রাজারা যুদ্ধার্থী হয়ে বর্ম ধারণ ও রথযোজন করতে থাকলে, তাঁরা গুরুতর ঘনিষ্ঠভাবে রাজা দুর্যোধন ও কর্ণের উপর বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। সেই রাজারা এগোতে থাকলে, কর্ণ একটি বাণ দ্বারা তাঁদের ধনু ও বাণগুলি ছেদন করে ভূতলে ফেলতে লাগলেন। তারপর অনেক রাজার ধনু ছিন্ন হয়ে গেলে, অন্যেরা বাণ, রথশক্তি, গদা নিক্ষেপ করতে লাগলেন, অনেক রাজার সারথি নিহত হলেন; এইভাবে বীরশ্রেষ্ঠ কর্ণ নিজের লঘুহস্ততাবশত সেই রাজগণকে বিহ্বল করে পরাজিত করলেন। তখন সেই রাজারা ভগ্নমনোরথ হয়ে ‘যা যা’ এইরকম বলতে বলতে নিজেরাই ঘোড়াগুলিকে চালিয়ে রণস্থল পরিত্যাগ করে পলায়ন করলেন। কর্ণ দুর্যোধনের পৃষ্ঠ রক্ষা করতে থাকলে, দুর্যোধন কন্যাটিকে নিয়ে হস্তিনানগরে প্রস্থান করলেন।

“কর্ণ কলিঙ্গরাজকন্যার স্বয়ংবরে শক্তি প্রকাশ করেছেন শুনে, মগধাধিপতি রাজা জরাসন্ধ দ্বৈরথযুদ্ধে কর্ণকে আহ্বান করলেন। পরে দিব্যাস্ত্রবিৎ কর্ণ ও জরাসন্ধ পরস্পরের উপর নানা অস্ত্র প্রয়োগ করতে করতে তুমুল সংগ্রামে লিপ্ত হলেন। ক্রমে তাঁদের বাণ সকল নিঃশেষ হলে, তরবারি ভেঙে গেল এবং ধনু বিনষ্ট হল। তখন বলশালী তাঁরা দু’জনেই রথ থেকে ভূতলে অবতীর্ণ হয়ে— বাহুযুদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন। জরাসন্ধ বাহুযুদ্ধ করতে থাকলে, কর্ণ বাহুকণ্টকযুদ্ধে জরারাক্ষসী সংযোজিত জরাসন্ধ-দেহের সন্ধিস্থান দ্বিধাবিভক্ত করতে প্রবৃত্ত হলেন। আপন দেহের বিকার উপস্থিত হচ্ছে দেখে জরাসন্ধ দূরে সরে গিয়ে শত্রুতা পরিত্যাগ করে কর্ণকে বললেন, ‘আমি সন্তুষ্ট হয়েছি।’

“তারপর জরাসন্ধ শত্ৰুবিজয় দ্বারা অধিগত মালিনীনগর প্রীতিপূর্বক কর্ণকে দান করলেন। পরে শত্রুবিজয়ী কর্ণ দুর্যোধনের অনুমতিক্রমে চম্পানগরীও পালন করতে লাগলেন। এইভাবে কর্ণ আপন অস্ত্রের প্রভাবে পৃথিবীতে বীর বলে প্রসিদ্ধি লাভ করলেন; সেই জন্যই ইন্দ্র এসে অর্জুনের হিতের জন্য কর্ণের কাছে তাঁর বর্ম ও কুণ্ডল প্রার্থনা করলেন। দেবমায়ায় মোহিত কর্ণ অত্যন্ত আদরের বস্তু ও অলৌকিক স্বাভাবিক কুণ্ডল দুটি এবং বর্মটি ইন্দ্রকে দান করলেন। কর্ণ স্বাভাবিক কুণ্ডল দুটি ও বর্মটি পরিত্যাগ করেছিলেন বলে অর্জুনের হাতে নিহত হয়েছিলেন। অর্জুন রুদ্র, যম, ইন্দ্র, বরুণ, কুবের দ্রোণ ও মহাত্মা কৃপের কাছে থেকে পাশুপত এবং অন্যান্য শ্রেষ্ঠ অস্ত্র লাভ করেছিলেন— সেই ভীষণ যুদ্ধে পূর্বোক্ত ব্রাহ্মণের ও মহাত্মা পরশুরামের অভিশাপে কুন্তীর কাছে প্রতিজ্ঞা করায়, মায়ার প্রভাবে ইন্দ্ৰকর্তৃক কবচ ও কুণ্ডল হরণ করায়, ভীষ্মকে অপমান করার জন্য তিনি রথাতিরথ সংখ্যা করবার সময়ে অর্ধরথ বলে উল্লেখ করায়, শল্যকর্তৃক তেজোহানি করায় এবং কৃষ্ণের নীতির প্রয়োগে সূর্যের ন্যায় তেজস্বী কর্ণকে বধ করতে পেরেছিলেন অর্জুন।

“পুরুষশ্রেষ্ঠ, তোমার ভ্রাতা কর্ণের প্রতি সেই ব্রাহ্মণ ও পরশুরাম অভিসম্পাত দিয়েছিলেন এবং অনেকেই তাঁকে বঞ্চনা করেছিলেন। তারপর তিনি যুদ্ধেই নিহত হয়েছেন। সুতরাং তাঁর জন্য শোক করা উচিত নয়।” দেবর্ষি নারদ এই পর্যন্ত বলে বিরত হলেন এবং রাজর্ষি যুধিষ্ঠির শোকে আকুল হয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। বীর হলেও সেই সময়ে যুধিষ্ঠিরের চিত্ত শোকে কাতর ও পীড়িত হচ্ছিল এবং তাঁর নয়নযুগল থেকে অশ্রুজল পড়ছিল; তিনি মাথা নিচু করে সর্পের ন্যায় নিশ্বাস ত্যাগ করছিলেন। সেই সময়ে শোকাকুলা ও দুঃখিতচিত্তা মধুরভাষিণী কুন্তী যুধিষ্ঠিরের প্রতি উপযুক্ত বাক্যই বললেন, “মহাবাহু, মহাপ্রাজ্ঞ! যুধিষ্ঠির! তুমি কর্ণের জন্য শোক করতে পার না। শোক পরিত্যাগ করো, আমার কথা শোনো। ধর্মজ্ঞশ্রেষ্ঠ! তোমাদের পিতা সূর্যদেবের অনুরোধে পূর্বে আমি কর্ণের কাছে গিয়ে প্রার্থনা করেছিলাম, ‘কর্ণ! তুমি তোমার ভ্রাতাদের সঙ্গে ভ্রাতৃসৌহার্দ্য দেখাও।’ তারপর একদিন কর্ণ স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, সূর্য যেন আমার সম্মুখেই কর্ণের কাছে এসে আত্মীয়ের হিত ও সমৃদ্ধিকামী বন্ধুর মতো কর্ণকে বলেছিলেন, ‘কর্ণ তুমি তোমার ভ্রাতাদের সঙ্গে সৌহার্দ্য করো।’ কিন্তু আমি বা সূর্যদেব স্নেহরূপ হেতু দেখিয়েও কর্ণকে শান্ত করতে পারিনি, কিংবা তোমাদের সঙ্গে তার ঐক্য স্থাপন করতে পারিনি। তারপর কর্ণ কাল প্রযুক্ত হয়ে শত্রুতা উদ্ধারে নিরত হলেন এবং তোমাদের প্রতিকূল কার্য করতে লাগলেন; তখন আমিও তাকে উপেক্ষা করলাম।”

কুন্তী একথা বললে, ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের নয়নযুগল অশ্রুজলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল এবং তিনি শোকে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। তখন তিনি এই কথা বললেন, “মা আপনি এই বিষয় গোপন করেছেন বলে আমার গুরুতর দুঃখপীড়া উৎপাদন করেছেন।” তারপর মহাতেজা ও দুঃখিতচিত্ত যুধিষ্ঠির সমগ্র জগতের স্ত্রীলোকগণের প্রতি এই অভিসম্পাত করলেন, “আজ থেকে স্ত্রীলোকেরা গোপনীয় বিষয় গোপন রাখতে পারবে না, নিজেরাই প্রকাশ করবে।”

*

সুগভীর হৃদয়োৎসারিত যন্ত্রণা নিয়ে কর্ণের পরিচয় পঞ্চপুত্রের কাছে প্রকাশ করলেন কুন্তী। মহাভারত-চর্চাকারেরা অনেকেই কর্ণকে জলে ভাসিয়ে দেবার সব অপরাধ কুন্তীর উপর চাপিয়ে দিয়ে তাঁকে কুমাতা হিসাবে পরিচয় দিয়ে আনন্দ অনুভব করেছেন। কিন্তু কুন্তী যে সূর্যদেবের আদেশেই প্রসবের পরই শিশুসন্তানকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই তথ্য স্মরণ করে কোনও সহানুভূতি কুন্তীর সম্পর্কে তাঁরা প্রদর্শন করেন না। একটি চতুর্দশী মেয়ে, তাঁকে আদেশ দিয়ে যাচ্ছেন দেব দিবাকর। মেয়েটি অনূঢ়া, রাজা কুন্তীভোজের কন্যা। কী করতে পারেন সেই চতুর্দশী কন্যা, সন্তানের পিতার আদেশ পালন করা ছাড়া। ভারতীয়দের ভাগ্য ভাল। মুনি ঋষিরা কুন্তীকে এই কারণে কখনই অপরাধিনী ঘোষণা করেননি, তাঁর অসাধারণ চরিত্র বৈশিষ্ট্যের জন্য প্রাতঃস্মরণীয়া পঞ্চকন্যার মধ্যে তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন। কর্ণ, দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর স্বামীর সংখ্যা পাঁচ হওয়ায় তাঁকে ব্যঙ্গ করেছিলেন ‘বেশ্যা’ বলে। কিন্তু সেই বিচারে কর্ণও যে ‘বেশ্যাপুত্র’ হয়ে যান, তা কর্ণ ভাবেন না। সূর্যদেব, পাণ্ডু, ধর্ম, পবন এবং ইন্দ্র এই পঞ্চপুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছিলেন কুন্তী। তা সত্ত্বেও কুন্তী প্রাতঃস্মরণীয়া। বুদ্ধি, কর্তব্যবোধ, মনস্বিতা, প্রেরণাদাত্রী, নারীর মর্যাদা সম্পর্কে তীব্র সচেতনতা কুন্তীকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক পরিচিতি দান করেছিল।

বর্তমান অসাধারণ মুহূর্তটি সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, কোনও কোনও মহাভারতচর্চাকার বিদুরকে যুধিষ্ঠিরের পিতা বলে গবেষণা করতে চেয়েছেন। আবার কেউ দুর্বাসাকে কর্ণের পিতা বলে ঘোষণা করতে চেয়েছেন। এঁরা একটি প্রাথমিক সত্যকে স্মরণ না রেখেই এইসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। মহর্ষি দুর্বাসা ধ্যানযোগে জেনেছিলেন যে মানবের ঔরসে কুন্তীর সন্তান হবে না। সেই কারণেই তিনি কুন্তীকে ‘অভিকর্ষণ’ মন্ত্র শিক্ষা দিয়েছিলেন। দুর্বাসা অথবা বিদুর—দু’জনেই মানুষ ছিলেন। কাজেই তাঁদের পক্ষে কুন্তীর সন্তানের পিতা হওয়া সম্ভব ছিল না।

কুন্তী সারাজীবন কর্ণের কল্যাণই চেয়েছিলেন। যুদ্ধে কর্ণ কোনওমতেই কৌরবপক্ষ সমর্থন না করুন, এ চেষ্টা কুন্তী করেছিলেন। কিন্তু কর্ণের জীবনের কালস্রোতে তা তখন নিবারণযোগ্য ছিল না। আবাল্য কর্ণ একটি স্বপ্নই হৃদয়ে পোষণ করেছেন, তিনি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন ও অর্জুনকে পরাজিত করবেন। তাই কুন্তীর আবেদন অনুযায়ী পাণ্ডবপক্ষে যোগদান করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না, সম্ভব ছিল না বলরাম অথবা রুক্ষ্মীর মতো নিরপেক্ষ থেকে যাওয়া। কুন্তীকে তিনি কথা দিয়েছিলেন, অর্জুন ভিন্ন অন্যদের সুযোগ পেলেও বধ করবেন না। কর্ণ সে কথা রেখেছিলেন।

তবে যুধিষ্ঠিরের অভিভাবকত্বে বেড়ে ওঠা পাণ্ডবভ্রাতাদের মধ্যে কর্ণ যে মানাতে পারতেন না, তাঁর জীবনের কাহিনি বর্ণনা দিতে গিয়ে ব্যাসদেব বারবার দেখিয়েছেন। বংশগতি বড় হলেও কর্ণের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল। বিশেষত দুর্যোধন ও কৌরবদের সঙ্গে মৈত্রীর কারণে, কর্ণ পরশ্রীকাতর এবং দুষ্ট বৈরীভাবাপন্ন হয়ে উঠছিলেন। শরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম যথার্থই বলেছিলেন, “তুমি অকারণে পাণ্ডবদের সঙ্গে ক্রূরতা ও বৈরীভাব সৃষ্টি করতে বলে আমার বিরাগভাজন হয়েছিলে।”

পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা পাওয়াই কর্ণের জীবনের শেষ প্রাপ্তি। অস্ত্র এবং অভিশাপ দুই পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অর্জুনের তখন পাওনাই শুরু হয়নি। অগ্নিদেব তাঁর বীরত্বকে পুষ্ট করার জন্য দিলেন গাণ্ডিবধনু, দুই অক্ষয় তূণ, দেবদত্ত রথ। পরে সন্তুষ্ট দেবাদিদেব দিলেন তাঁকে পাশুপত অস্ত্র ও আশীর্বাদ— “আমি ভিন্ন ত্রিলোকে কোনও বীর তোমাকে পরাজিত করতে পারবে না।” এর পর ইন্দ্র, চন্দ্র, বায়ু, কুবের, যম, বরুণ, তাঁদের শ্রেষ্ঠ অস্ত্রগুলি উপসংহার সহ প্রয়োগের মন্ত্র সমেত অর্জুনকে দান করলেন। বনবাস শেষ করে যখন অর্জুন ফিরে এলেন, তখন তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অতিরথ। পৃথিবীতে কেবলমাত্র ভীষ্ম ও দ্রোণ তাঁর সম্মুখীন হতে পারেন। অভিশাপ অর্জুনও পেয়েছিলেন। উর্বশীর অভিশাপ। সে অভিশাপ অজ্ঞাতবাসের সময় খুব কাজে লেগেছিল অর্জুনের। পরশুরাম কর্ণকে শাপ দিলেও আশীর্বাদ করেছিলেন— কোনও ক্ষত্রিয় তাঁকে পরাজিত করতে পারবে না। আর, আশীর্বাদ করেছিলেন মহাদেব অর্জুনকে— “ত্রিলোকে অর্জুনের সমকক্ষ কোনও বীর থাকবে না।” অর্জুন সংযত, বেদবিৎ— কর্ণ কোপনস্বভাব, অসত্যভাষী। পরিণাম আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল।

আঘাত পেয়েছিলেন যুধিষ্ঠির। মায়ের মুখে পরিচয় শোনার পর থেকেই তীব্র অনুশোচনায় তাঁর মন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। তিনি ভ্রাতৃঘাতী। ভ্রাতৃহত্যার পাপ লেগেছে তাঁর, হাত তাঁর রক্তাক্ত। এ রাজ্য নিয়ে কী করবেন যুধিষ্ঠির। অগ্রজ ভ্রাতার মৃতদেহের উপর দিয়ে সিংহাসনে গিয়ে বসতে হবে তাঁকে। কিন্তু কেন ঘটল এ ঘটনা। এ কোন পাপের দায় ভোগ করতে হচ্ছে তাঁকে। যুধিষ্ঠির তো মুখেও আনতে পারবেন না। তাই যুধিষ্ঠির অভিসম্পাত দিলেন সমগ্র নারী জাতিকেই— “আজ থেকে স্ত্রীলোকেরা আর কোনও কথাই গোপন রাখতে পারবে না।”

সমস্ত অংশটি পড়তে পড়তে অবাক বিস্ময়ে যুধিষ্ঠিরকে দেখতে হয়। যথার্থ ‘ধর্ম’ হয়ে উঠেছিলেন যুধিষ্ঠির। সমস্ত জীবনের সব অন্যায় দূরে সরিয়ে রেখে তিনি কর্ণ বধের জন্য শোক করেছেন। যুধিষ্ঠিরের মতো ভ্রাতা পাওয়া কর্ণের কপালে ছিল না— এ সত্যও সহজেই বোঝা যায় এই মুহূর্তটিতে।

৯৩
যুধিষ্ঠিরের গৃহ ও কার্যবণ্টন

হস্তিনানগরে মহাসমারোহে অভিষিক্ত হওয়ার পর সিংহাসনে আরোহণ করে যুধিষ্ঠির সর্বপ্রথম কৃতাঞ্জলি হয়ে কৃষ্ণের বন্দনা করলেন। যুধিষ্ঠিরের বন্দনায় কৃষ্ণ সন্তুষ্ট হয়ে, প্রচুর বাক্য দ্বারা ভরত-বংশজাত জ্যেষ্ঠপাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে অভিনন্দিত করলেন। তারপর যুধিষ্ঠির সেই সকল পুরবাসীকে বিদায় দিলেন। তখন তাঁরা যুধিষ্ঠিরের অনুমতিক্রমে আপন আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। তদনন্তর রাজলক্ষ্মী-সম্পন্ন যুধিষ্ঠির ভীষণ পরাক্রমশালী ভীমসেন, অর্জুন, নকুল ও সহদেবকে অনুনয় সহকারে বললেন।

“শত্ৰুভিৰ্বিবিধৈঃ শস্ত্ৰৈঃ ক্ষতদেহা মহারণে।

শ্রান্তা ভবন্তঃ সুভৃশং তাপিতাঃ শোকমন্যুভিঃ॥

অরণ্যে দুঃখে বসতির্মৎকৃতে ভরতর্ষভাঃ।

ভবদ্ভির অনুভূতা হি যথা কুপুরুষস্তথা॥ শান্তি : ৪৪ : ৩-৪ ॥

—“বীরগণ! শত্রুরা মহাযুদ্ধে নানাবিধ অস্ত্ৰদ্বারা তোমাদের দেহগুলিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে এবং তোমরা অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়েছ; বিশেষত শোকে ও দৈন্যে সন্তপ্ত হয়ে পড়েছ। ভরতশ্রেষ্ঠগণ! তোমরা আমারই জন্য কাপুরুষগণের মতো বনমধ্যে কষ্টে বাস করেছ।”

“বীরগণ! এখন তোমরা ইচ্ছা অনুসারে নীরোগ হয়ে, যথাসুখে এই জয় অনুভব করো। তারপর, তোমরা বিশ্রাম করলে এবং বুদ্ধি প্রকৃতিস্থ হলে, আগামীকাল আমি আবার তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব।” তারপর ইন্দ্র যেমন মনোহর মন্দির লাভ করেন, সেইরকম ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতিক্রমে যুধিষ্ঠির দান করলে— মহাবাহু ভীমসেন, দুর্যোধনের বাটী লাভ করলেন। সেই বাটীখানি বহুতর প্রাসাদে পরিপূর্ণ, বহুবিধ রত্নশোভিত এবং দাস-দাসীগণে পরিব্যাপ্ত ছিল।

মহাবাহু অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আদেশক্রমে দুর্যোধনের বাড়িরই তুল্য দুঃশাসনের বাড়িখানি লাভ করলেন। তাতে প্রাসাদশ্রেণি, স্বর্ণময় তোরণ, বহুতর দাস ও দাসী এবং প্রচুর ধন ও ধান্য ছিল। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সন্তুষ্টচিত্তে নকুলকে দুঃশাসনের বাড়ি অপেক্ষাও উত্তম দুর্মর্ষণের বাড়িটি দান করলেন। কেন না নকুল বনবাসকালে গুরুতর দুঃখকষ্ট পেয়েছিলেন; বিশেষত তিনি বিলাসী বলে উত্তমরূপে বস্তু পাবার যোগ্য বিবেচিত হয়েছিলেন। দুর্মর্ষণের ওই বাড়িটি মণি ও সুবর্ণে ভূষিত থাকায় কুবেরের বাড়ির তুল্য ছিল।

ক্রমে যুধিষ্ঠির সর্বদাপ্রিয় কার্যকারী সহদেবকে দুর্মুখের বাড়িটি দান করলেন। সেই বাড়িটি স্বর্ণে ভূষিত ছিল বলে পরমশোভান্বিত ও সমস্ত বাড়ির মধ্যেই উত্তম বলে বিবেচিত হত এবং তাতে পদ্মনয়না রমণীদের বহুতর শয্যা বিন্যস্ত ছিল; সুতরাং কুবের কৈলাস পর্বত লাভ করে যেমন আনন্দিত হয়েছিলেন; তেমন সহদেবও ওই বাড়িটি লাভ করে আনন্দিত হলেন।

যুযুৎসু, সঞ্জয়, বিদুর, সুধর্মা ও ধৌম্য— এঁরা আপন আপন গৃহে গমন করলেন। ক্রমে ব্যাঘ্র যেমন পর্বতগুহায় প্রবেশ করে, সেইরকম পুরুষব্যাঘ্ৰ কৃষ্ণ সাত্যকির সঙ্গে মিলিত হয়ে অর্জুনের গৃহে প্রবেশ করলেন। সেই দিন অবশিষ্ট রাজারা সুস্বাদু অন্ন ও পানীয় গ্রহণ করে, আনন্দিত হয়ে, রাত্রিতে অতিসুখে নিদ্রা গিয়ে, প্রভাতকালে সুখের সঙ্গে জাগরিত হয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে গমন করলেন।

পরদিন প্রভাতে রাজ্য লাভ করে সিংহাসনারূঢ় যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণ প্রভৃতি চারিটি বর্ণকেই যথাযোগ্যভাবে আপন আপন বৃত্তিতে স্থাপন করলেন। যুধিষ্ঠির প্রথমে এক সহস্র গৃহস্থ ব্রাহ্মণকে আহ্বান করে তাঁদের প্রত্যেককে এক সহস্র করে সুবর্ণ মুদ্রা দান করলেন। পরে যুধিষ্ঠির অভীষ্ট বস্তু সকল দান করে উপজীব্য ব্যক্তি, ভৃত্য, আশ্রিত, অতিথি, দরিদ্র ও দৈবজ্ঞদের পরিতৃপ্ত করলেন। যুধিষ্ঠির ধৌম্য পুরোহিতকে বহু সহস্র গো, ধন, স্বর্ণ, রৌপ্য ও নানাবিধ বস্ত্র দান করলেন। সংযতচিত্ত যুধিষ্ঠির কৃপাচার্যকে গুরুর যোগ্য নির্দিষ্ট বৃত্তি দান করতে থাকলেন এবং বিদুরকেও উপযুক্ত সম্মান করতে লাগলেন। দাতৃশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির নানাবিধ সুস্বাদু অন্ন ও পানীয়, নানাবিধ বস্ত্র, শয্যা ও আসন দান করে, সমস্ত আশ্রিতজনকে সন্তুষ্ট করতে লাগলেন। মহাযশা রাজা যুধিষ্ঠির নববিজিত রাজ্যের সর্বত্র শান্তি স্থাপন করে ধৃতরাষ্ট্রপুত্র যুযুৎসুর উপযুক্ত সম্মান করলেন। তৎপরে রাজা যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও বিদুরকে সেই রাজ্যটি নিবেদন করে, সুস্থের মতো কালযাপন করতে লাগলেন।

*

ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্যেও সু-শাসক হিসাবে যুধিষ্ঠির অত্যন্ত খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ভ্রাতারা সকলেই রাজপুত্র, মহিষীও রাজকন্যা— এ সত্য যুধিষ্ঠির কখনও বিস্মৃত হননি। তাঁর পাশাখেলার জন্যই ভ্রাতারা ও ভার্যা বনবাসের দুঃখ পাচ্ছেন। পাশাখেলার জন্য কোনও আত্মগ্লানি যুধিষ্ঠিরের ছিল না। কারণ, তাও ছিল তাঁর ধর্মের অঙ্গ। কিন্তু ভ্রাতা ও ভার্যাদের দুঃখও তাঁর চাক্ষুষ সত্য। তাকেও তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না। তাই রাজ্যলাভ করেই তিনি ভ্রাতাদের প্রাপ্য ভোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। প্রত্যেকের জন্য যথাযোগ্য বাসস্থান প্রদান করে, তাঁদের দুঃখকষ্ট শেষে বিশ্রাম ও ভোগ করতে বলেছিলেন। সাধারণ ক্ষত্রিয় পুরুষ ভোগের জন্য চায় অর্থ ও নারী। অর্থে তাঁর বাসস্থান রচিত হয়, নারী তাঁর কামস্পৃহা তৃপ্ত করে। যুধিষ্ঠির এ দুইয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন।

গুরুজনদের, সাধারণ প্রজাদের, আশ্রিত জনের সম্মান জানানোও তাঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। ধৌম্য পুরোহিত তাঁর সকল দুঃখের সঙ্গী, তাঁকে সুস্থভাবে নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের ব্যবস্থা করতে হল। কৃপাচার্য কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি চিরকাল যুধিষ্ঠিরের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরের প্রথম গুরুও। তাই তাঁকে গুরুর মর্যাদা ও বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করে দিলেন। শতপুত্রহারা গান্ধারী-ধৃতরাষ্ট্র যেন কুণ্ঠিত ও লজ্জিত না হন, তাই তাঁদের ও বিদুরকে সমস্ত প্রজাসুদ্ধ রাজ্য প্রদান করলেন। ধৃতরাষ্ট্রের বৈশ্যাপত্নী-গর্ভজাত পুত্র যুযুৎসু যুদ্ধের পূর্বে তাঁর পক্ষে যোগদান করেছিলেন, তাঁকে যথাযোগ্য স্থান ও সম্মান প্রদান করলেন।

ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব সন্তুষ্ট হলেন। হয়তো এ বাসস্থান প্রদানের সময় যুধিষ্ঠিরের ঠোঁটের কোণে এক আলগা হাসি ছিল। দুর্বিনীত, পাপী নিহতদের প্রাসাদে বাস করে মানুষ কতদূর শান্তি লাভ করতে পারে! কিন্তু ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব দেবপুত্র হলেও সাধারণ ক্ষত্রিয়ের জীবনযাপন করেছেন। মৃত পুত্রদের নিয়ে বিলাপে তাঁরা সময় অতিবাহিত করেননি। তাঁরা যুদ্ধ জয় করেছেন, এখন তার ফল ভোগ করবেন।

যতটা গৃহী, পারিবারিক মানুষ যুধিষ্ঠির ছিলেন— তাঁর কোনও ভাই ততটা ছিলেন না। তাই যুধিষ্ঠিরের দুঃখের গভীরতাও তাঁর নিজস্ব। তিনি অভিমন্যু, ঘটোৎকচকে ভালবাসতেন, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রকে ভালবাসতেন। তাঁরা আজ কেউ নেই। তারপর অগ্রজ সহোদর ভ্রাতা নিহত হয়েছেন তাঁর হাতে। সেই অন্তর্বেদনাই যুধিষ্ঠিরকে চিরকাল রাজত্ব দিয়েও বৈরাগী, সন্ন্যাসী করে রাখল। সকল ভ্রাতাকে গৃহ-কণ্টনের পর যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের প্রাসাদেই তাঁর সঙ্গে বাস করতে থাকলেন।

৯৪
পরীক্ষিতের জন্ম

যুধিষ্ঠির অশ্বমেধযজ্ঞের আয়োজন করেছেন জেনে বীর্যবান কৃষ্ণ বৃষ্ণিবংশীয় শ্রেষ্ঠ পুরুষদের সঙ্গে বলরামকে অগ্রবর্তী করে হস্তিনায় আগমন করলেন। কৃষ্ণ এসেছেন জেনে রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও মহামনা বিদুর যথানিয়মে তাঁদের গ্রহণ করলেন। বিদুর ও যুযুৎসু সম্মানিত করলে কৃষ্ণ হস্তিনানগরীতে বাস করতে থাকলেন। এই সময়ে অভিমন্যুর পুত্র ও জনমেজয়ের পিতা পরীক্ষিৎ জন্মগ্রহণ করলেন।

অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্রে আহত ছিলেন বলে সেই রাজা পরীক্ষিৎ সেই সময়ে নিশ্চেষ্ট একটি শবস্বরূপ হওয়ায় বন্ধুবর্গ একই সময়ে আনন্দিত ও শোকার্ত হয়েছিলেন। আনন্দিত লোকসমূহের সিংহনাদ সকল দিকে গিয়েই থেমে গেল। তখন কৃষ্ণ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সাত্যকিকে নিয়ে অন্তঃপুরে প্রবেশ করে দেখলেন তাঁর পিসিমা কুন্তী “কৃষ্ণ! দ্রুত এসো, দ্রুত এসো” এই কথা বলতে বলতে অন্তঃপুরের বাইরে ছুটে আসছেন এবং যশস্বিনী দ্রৌপদী, সুভদ্রা ও বন্ধুবর্গের স্ত্রীগণ সকরুণ আর্তনাদ করতে করতে কুন্তীর পিছনে পিছনে আসছেন।

ভোজনন্দিনী কুন্তী কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হয়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কৃষ্ণকে বললেন, “মহাবাহু কৃষ্ণ, দেবকী দেবী তোমার জন্যই সুসন্তানা হয়েছেন এবং তুমিই আমাদের গতি ও প্রতিষ্ঠা; আর তোমার অধীনেই এই বংশ। প্রভু যদুশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ, এই যে তোমার ভাগিনেয় অভিমন্যুর পুত্র, অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্রে মৃত অবস্থায় জন্মেছে। একে তুমি সঞ্জীবিত করো। তুমি সেই ঐষিকাস্ত্র নিক্ষেপের সময় এই প্রতিজ্ঞা করেছিলে, ‘এই গর্ভস্থ বালক মৃত অবস্থায় জন্মালে আমি তাকে সঞ্জীবিত করব।’ বৎস পুরুষশ্রেষ্ঠ, এই সেই বালক মৃত অবস্থায় জন্মেছে, তুমি একে দেখো। দুর্ধর্ষ মাধব উত্তরা, সুভদ্রা, আমি, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব আমাদের সকলকে তুমি রক্ষা করো। কৃষ্ণ আমার ও পাণ্ডবগণের প্রাণ এই বালকের অধীন এবং আমার শ্বশুর ও পাণ্ডুরও পিণ্ড এর অধীন। জনার্দন তোমার মঙ্গল হোক। তোমার প্রিয় ও সদৃশাকৃতি মৃত অভিমন্যুর তুমি আজ প্রিয় কার্য করো। শত্রুদমন কৃষ্ণ, অভিমন্যুর কথিত এই উক্তি উত্তরা প্রায় বলেন। কাজেই তোমার প্রীতির বিষয়ে কোনও সন্দেহ তাঁর ছিল না। তখন অভিমন্যু উত্তরাকে বলেছিল, ‘ভদ্রে! তোমার পুত্র আমার মাতুল ভবনে গমন করবে এবং সে বৃষ্ণিগৃহে এবং অন্ধকগৃহে গমন করে ধনুর্বেদ, বিচিত্র অস্ত্র এবং প্রধান নীতিশাস্ত্র শিক্ষা করবে।’ বৎস দুর্ধর্ষ ও বিপক্ষবীরহন্তা অভিমন্যু প্রণয়বশত যে কথা বলেছিল, তা অবশ্যই সত্য হবে, তাতে সন্দেহ নেই। অতএব মধুসূদন আমরা এখন প্রণত হয়ে তোমার কাছে সেই সকল বিষয় প্রার্থনা করছি। তুমি এই বংশের হিতের জন্য, এর জীবনদানরূপ উত্তম কল্যাণ সাধন করো।”

বিশালনয়না কুন্তী কৃষ্ণকে এই কথা বলে বাহুযুগল উত্তোলন করে দুঃখার্ত হয়ে ভূতলে পতিত হলেন এবং কৌরবমহিলারাও ভূতলে পড়ে গেলেন। সেই স্থানের সকল মহিলাই অশ্রুপূর্ণ নয়নে কৃষ্ণকে বললেন, “প্রভু আপনার ভগিনীর পৌত্র মৃত অবস্থায় জন্মেছে।’ তারা এইরকম বললে কৃষ্ণ ভূতলে পতিতা কুন্তীকে তুলে ধরলেন এবং তাঁকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। কুন্তী গাত্রোত্থান করলে, তখন দুঃখিত সুভদ্রা কৃষ্ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করে তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, “পুণ্ডরীকাক্ষ দেখো, যুদ্ধে কুরুবংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে ধীমান অর্জুনের পৌত্র মৃত অবস্থায় প্রসূত হয়েছে। অশ্বত্থামা ভীমের উপর নিক্ষেপ করবার জন্য যে ঈষিকাস্ত্র উত্তোলন করেছিলেন তা উত্তরা, অর্জুন ও আমার উপর নিপতিত হয়েছে। কেশব আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছে বলে সেই ঈষিকাস্ত্র আমার উপরেই পড়েছে, যেহেতু আমি পুত্রের সঙ্গে আমার সেই পৌত্রকে দেখছি না। এই অবস্থায় ধর্মাত্মা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, অর্জুন, নকুল ও সহদেব কী বলবেন? বৃষ্ণিনন্দন, অভিমন্যুর পুত্র জন্মেছে, আবার মরেও গেছে, একথা শুনে পাণ্ডবেরা যেন দ্রোণপুত্র কর্তৃক সর্বস্ব হারানোর অবস্থায় পড়বেন। কৃষ্ণ অভিমন্যু পাণ্ডবভ্রাতৃগণের প্রিয়ই ছিলেন—এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং তাঁরা এ বৃত্তান্ত শুনে কী বলবেন; নিজেরা দ্রোণপুত্র দ্বারা পরাজিত হয়েছেন বলেই মনে করবেন। শত্রুদমন কৃষ্ণ, অভিমন্যুর পুত্র মৃত অবস্থায় জন্মেছে—এর থেকে বেশি দুঃখের আর কী হতে পারে? কৃষ্ণ! আমি মাটিতে মাথা রেখে তোমাকে প্রসন্ন করছি, কুন্তী দেবী ও দ্রৌপদী দেবীও তাই করছেন। পুরুষোত্তম তুমি আমাদের রক্ষা করো।

“মাধব, অশ্বত্থামা যখন পাণ্ডবস্ত্রীগণের গর্ভ নষ্ট করেন, তখন তুমি ক্রুদ্ধ হয়ে অশ্বত্থামাকে বলেছিলে, ‘নিকৃষ্ট ব্রাহ্মণ! নরাধম! আমি তোমার ইচ্ছা ব্যর্থ করব। আমি অর্জুনের পৌত্রকে সঞ্জীবিত করে দেব।’ দুর্ধর্ষ, আমি তোমার শক্তি জানি; সুতরাং তোমার সেই বাক্য শুনে আমি তোমাকে প্রসন্ন করছি। অভিমন্যুর পৌত্র জীবিত হোক। বৃষ্ণিবংশ শ্রেষ্ঠ, তুমিই এইরূপ প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই শুভবাক্য যদি সফল না করো, তা হলে আমাকে মৃত বলে নিশ্চয়ই জেনো। বীর দুর্ধর্ষ, তুমি জীবিত থাকতে অভিমন্যুর এই পুত্রটি যদি জীবিত না হয়, তা হলে আমি তোমাকে দিয়ে কী করব। মেঘ যেমন বর্ষায় মৃতপ্রায় শস্যকে সঞ্জীবিত করে, তুমিও তেমনই তোমার তুল্য নয়ন অভিমন্যুর এই পুত্রটিকে সঞ্জীবিত করো। কেশব তুমি ধর্মাত্মা, সত্যবান ও সত্যবিক্রম; সুতরাং শত্রুদমন, তুমি তোমার সেই বাক্যকে সত্য করো। তুমি ইচ্ছা করলেই মৃত এই ত্রিভুবনকেও সঞ্জীবিত করতে পারো, তাতে ভাগিনেয়র এই মৃত পুত্রটির কথা আর কী বলব। কৃষ্ণ আমি তোমার প্রভাব জানি; সেইজন্যই তোমার কাছে প্রার্থনা করছি যে, তুমি পাণ্ডবগণের উপরে এই পরম অনুগ্রহ করো। মহাবাহু, আমি তোমার ভগিনী কিংবা আমি হতপুত্রা, অথবা এ আমার শরণাপন্ন হয়েছে, এই সকল ভেবে তুমি আমার উপর দয়া করো।”

সুভদ্রা এই কথা বললে কৃষ্ণ সেই স্থানের লোকের আনন্দ সৃষ্টি করে উচ্চ স্বরে বললেন, “তাই হবে।” দাবদাহক্লিষ্ট লোক বারিবর্ষণে যেমন আনন্দ লাভ করে, কৃষ্ণের সেই কথায় সেই স্থানের লোকেরা আনন্দ লাভ করল। কৃষ্ণ তখন সূতিকাগৃহে গেলেন। সেই সূতিকাগৃহ পুষ্পমাল্যে শোভিত ছিল। গৃহের সকল দিকে জলপূর্ণকুম্ভ, ঘৃতপাত্র, গাবগাছের দগ্ধ-শাখা এবং সর্ষে শাখায় স্থাপিত ছিল এবং সকল দিকে নির্মল অস্ত্র ও অগ্নি বিন্যস্ত ছিল। আর বৃদ্ধ মহিলারা, শিশু ও প্রসূতির পরিচর্যা করবার জন্য সেই সূতিকাগৃহ পরিবেষ্টন করে ছিলেন; চিকিৎসাদক্ষ ও রোগনির্ণয় নিপুণ চিকিৎসকেরাও সেই সূতিকাগৃহ পরিবেষ্টন করে অবস্থান করছিলেন। কৃষ্ণ দেখলেন, নিপুণ লোকেরা যথাবিধানে সেই সূতিকাগৃহের সকল দিকে রাক্ষসনিবারক দ্রব্যসকল স্থাপন করে রেখেছে। কৃষ্ণ নবজাতকের সূতিকাগৃহকে সেইরকম দেখে সন্তুষ্ট হয়ে ‘সাধু সাধু’ বললেন।

কৃষ্ণ এই কথা বললে, দ্রৌপদী দ্রুত গিয়ে উত্তরাকে বললেন, “ভদ্রে, তোমার মাতুল-শ্বশুর প্রাচীন নারায়ণ ঋষি, অচিন্তনীয় প্রভাব, অপরাজিত মধুসূদন তোমার কাছে এসেছেন।” উত্তরাও দেবতুল্য কৃষ্ণকে দেখতে পেয়ে বাষ্পরুদ্ধ আর্তনাদ ও অশ্রুজল নিবারণ করে, শরীরটিকে বস্ত্রাবৃত করলেন। কৃষ্ণকে দেখে উত্তরা দেবীও সন্তপ্ত হৃদয়ে করুণ বিলাপ করতে লাগলেন। “পুণ্ডরীকাক্ষ দেখুন, অভিমন্যু ও আমি—আমরা দু’জনেই পুত্রবিহীন হয়েছি। ‘জনার্দন’ বিধাতা আমাদের দু’জনকেই সমানভাবে নিহত করেছেন। অবনত মস্তকে আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, অশ্বত্থামার অস্ত্রে দগ্ধ আমার এই পুত্রটিকে সঞ্জীবিত করুন। পুণ্ডরীকাক্ষ ধর্মরাজ, ভীমসেন বা আপনি যদি বলতেন, ‘এই ঈষিকা অজ্ঞাতভাবে জননীকে দগ্ধ করুক।’ প্রভু! তা হলে আমি বিনষ্ট হতাম কিন্তু এই বালক বিনষ্ট হত না। হায়! দুর্বুদ্ধি অশ্বত্থামা ব্রহ্মাস্ত্ৰদ্বারা গর্ভস্থিত এই বালকের নৃশংস হত্যা করে কী ফল পেয়েছে? শত্রুনাশক গোবিন্দ, আমি মস্তকদ্বারা আপনাকে প্রণাম করে প্রসন্ন করে প্রার্থনা করি যে, এই বালক যদি না বাঁচে, আমি প্রাণত্যাগ করব। কারণ, এই বালকের উপরে আমার যে বহুতর অভিলাষ ছিল, সে সমস্তই অশ্বত্থামা নষ্ট করে দিয়েছে; সুতরাং আমার আর বাঁচার দরকার কী? কৃষ্ণ জনার্দন, আমার অভিলাষ ছিল, পুত্রকে ক্রোড়ে করে আনন্দিত হয়ে আপনাকে প্রণাম করব। কিন্তু দুর্দৈব আমার সে অভিলাষ নিষ্ফল করে দিয়েছে। মধুসূদন চঞ্চলনয়ন অভিমন্যু আপনার অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। আপনি এখন ব্রহ্মাস্ত্রনিহত অভিমন্যুর পুত্রকে দর্শন করুন। যিনি পাণ্ডবদের আশ্রয় নিবন্ধন উত্তম সম্পদ পরিত্যাগ করে আজ যমালয়ে গেছেন, সেই দ্রোণের মতোই অশ্বত্থামাও কৃতঘ্ন এবং নৃশংস। বীর কেশব, আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, অভিমন্যু যুদ্ধে নিহত হলে আমি অচিরকাল মধ্যেই তাঁর কাছে যাব। আমি নৃশংসা ও জীবনপ্রিয়া, তাই তা করিনি; এখন আমি তাঁর কাছে গেলে তিনি কী বলবেন?”

শোচনীয়া, দীনা ও পুত্রাভিলাষিণী উত্তরা এইরূপ করুণ বিলাপ করে উন্মত্তার মতো ভূতলে পতিতা হলেন। হতপুত্রা ও পরিচ্ছদশূন্যা উত্তরাকে ভূতলে পতিতা দেখে কুন্তী ও সমস্ত ভরতন্ত্রীগণ দুঃখার্ত হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন। আর্তনাদ মুখরিত সেই পাণ্ডবভবন মুহূর্তকাল যেন দৃষ্টির অযোগ্য হয়ে পড়ল। পুত্রশোকাতুরা উত্তরা মুহূর্তকাল মূৰ্ছিতা হয়ে রইলেন। পরে উত্তরা চৈতন্যলাভ করে সেই পুত্রটিকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, “বৎস, তুমি ধর্মজ্ঞের পুত্র হয়ে ধর্ম বুঝছ না। তুমি বৃষ্ণিবংশশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণকে অভিবাদন করছ না? পুত্র, তুমি পরলোক গিয়ে তোমার পিতা অভিমন্যুকে আমার এই কথা বলবে—‘বীর! কাল উপস্থিত না হলে প্রাণীগণের মৃত্যু সর্বপ্রকারেই দুষ্কর।’ কেন না আমি, তুমি পুত্র এবং পতি অভিমন্যু—এই উভয়কে ছেড়ে মরাই উচিত হলেও মঙ্গলশূন্যা ও অকিঞ্চনা হয়ে জীবনধারণ করছি। হে মহাবাহু, আমি ধর্মরাজের অনুমতি নিয়ে ভয়ংকর বিষভক্ষণ করব কিংবা অগ্নিতে প্রবেশ করব। কিন্তু হায়! আমার মরণ দুষ্কর। কারণ আমি পতিপুত্রবিহীনা, তা সত্ত্বেও আমি সহস্ৰধা বিদীর্ণ-হৃদয়া হচ্ছি না। পুত্র ওঠো, তোমার প্রপিতামহী কুন্তী দেবী দুঃখিতা, শোকার্তা, আকুলা, দীনা ও শোকসাগরে নিমগ্না হয়েছেন। আর্যা দ্রৌপদী, শোচনীয়া সুভদ্রা এবং ব্যাধবাণবিদ্ধা হরিণীর ন্যায় অতিদুঃখার্তা আমাকেও দর্শন করো। বৎস তুমি ওঠো; পদ্মপলাশলোচন ও পূর্বের ন্যায় চঞ্চলনয়ন এই ধীমান জগদীশ্বর কৃষ্ণের মুখমণ্ডল দর্শন করো।”

বিরাটনন্দিনী উত্তরা গাত্রোত্থান করে ভূতলে থেকেই কৃষ্ণকে প্রণাম জানালেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ উত্তরার করুণ বিলাপ শুনে আচমন করে তারপর সেই ব্রহ্মাস্ত্রের উপসংহার করলেন। কৃষ্ণ তখন সেই মৃত বালকের জীবনদানের প্রতিজ্ঞা করলেন এবং সমস্ত জগৎকে শুনিয়ে এ-কথা বললেন—

যথাহং নাভিজানামি বিজয়েন কদাচন।

বিরোধং তেন সত্যেন মৃতো জীবত্বয়ং শিশুঃ॥

যথা সত্যঞ্চ ধর্মশ্চ ময়ি নিত্যং প্রতিষ্ঠিতৌ।

তথা মৃতঃ শিশুরয়ং জীবিতাদভিমন্যুজঃ॥ আশ্বমেধিক : ৮৭ : ২১-২২॥

“আমি যখন কখনও অর্জুনের সঙ্গে বিরোধের বিষয় জানি না, সেই সত্যের ও যেহেতু ধর্ম সর্বদা আমাতে প্রতিষ্ঠিত আছে, সেইহেতু এই অভিমন্যুর মৃতপুত্র জীবিত হোক।”

“উত্তরা তুমি চিন্তিত হোয়ো না। আমার বাক্য সত্য হবে, সকল প্রাণীর সমক্ষেই এই মৃত বালক সঞ্জীবিত হবে। আমি কখনও যথেষ্ট আলাপের সময়েও মিথ্যা বলিনি। ধর্ম এবং ব্রাহ্মণেরা আমার অত্যন্ত প্রিয়; সেইহেতু অভিমন্যুর মৃতপুত্র জীবিত হোক। আমি যেহেতু ধর্মানুসারে কংস ও কেশীকে বধ করেছি, সেই সত্যধর্মের বলে এই বালক পুনরায় জীবিত হোক।”

কৃষ্ণ এই বাক্যগুলি বললে, সেই বালক চৈতন্যসম্পন্ন হয়ে ধীরে ধীরে অল্প অল্প অঙ্গসঞ্চালন করতে লাগল।

রাক্ষসেরা সূতিকাগৃহ পরিত্যাগ করে পলায়ন করল, আকাশে দৈববাণী হল, ‘কৃষ্ণ! সাধু সাধু।’ প্রজ্বলিত ব্রহ্মাস্ত্র ব্রহ্মার কাছে চলে গেল। বালকটি উৎসাহ ও শক্তি অনুসারে অঙ্গ-সঞ্চালন করতে লাগল। ভরতবংশীয় স্ত্রীলোকেরা অত্যন্ত আনন্দিত হল। তখন মল্ল, নট, গ্রন্থিক, সৌখ্যশায়িক, সূত ইত্যাদি কৃষ্ণের স্তব করতে লাগল। পুত্রকে কোলে তুলে উত্তরা ভূমিষ্ঠ হয়ে কৃষ্ণকে প্রণাম করলেন। কৃষ্ণ শিশুটির নামকরণ করলেন, কুরুবংশ পরিক্ষীণ হয়ে গেলে অভিমন্যুর পুত্র জন্মেছে—তাই এর নাম হবে—“পরীক্ষিৎ”।

*

আপাতদৃষ্টিতে বর্তমান মুহূর্তটি অলৌকিক বলে মনে হবে। পৃথিবীর বিখ্যাত সাধু-সন্ত-পির-পয়গম্বরেরা মৃত মানুষকে জীবিত করেছেন, এরকম কাহিনি বিশ্বের সকল দেশেই বিশেষভাবে প্রচলিত। কৃষ্ণকে ঈশ্বর বলে মহাভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্রগুলি বারবার উল্লেখ করেছেন। তিনি গীতার প্রবক্তা, করালজিহ্বা। তিনি বিশ্বরূপ। অনন্ত, অখণ্ড নারায়ণ ঋষি। স্রষ্টা তিনি, পালক তিনি, অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র ক্ষেপণের সময়েই তিনি জানিয়েছিলেন, উত্তরার গর্ভস্থিত শিশু অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্রে মৃত ও দ্বিখণ্ডিত হলে, তিনি তাকে পুনরুজ্জীবিত করে দেবেন। করেছেনও তাই। সুতরাং সাধারণভাবে তাঁর অন্য দৈবলীলার মতো এ একটি লীলা হিসাবে গ্রহণ করলেই পাঠক নিশ্চিন্ত বোধ করত।

কিন্তু বর্তমান অংশটিতে কৃষ্ণকে অনমনীয় দৃঢ় চরিত্রের এক অতি উন্নত মানুষ বলে বর্তমান লেখকের বিশ্বাস ঘটেছে। পরীক্ষিৎকে সঞ্জীবিত করার পূর্বে যে ঘোষণাগুলি তিনি করেছেন, তা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। ‘ধর্ম আমাতে প্রতিষ্ঠিত আছে’ ‘যথেষ্টালাপের সময়েও আমি কখনও মিথ্যা বলিনি’, ‘ধর্ম ও ব্রাহ্মণেরা আমার অত্যন্ত প্রিয়’, ‘অর্জুনের সঙ্গে আমার কখনও বিরোধ ঘটেনি’, ‘ধর্মানুসারে কেশী ও কংসকে আমি বধ করেছি’—এই সমস্ত বাক্যগুলি পড়তে পড়তে মনে হয়, সকল সত্ত্বগুণের অধিকারী এক মানুষ দৈবী বিচারের কাছে আপন দাবি প্রতিষ্ঠা করছেন। এই দাবি সাবিত্রী করেছিলেন, মৃত্যুদেবতা পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরীক্ষিতের ক্ষেত্রেও স্বয়ং যম দ্বিখণ্ডিত বালকের দেহসন্ধি ঘটান। জরাসন্ধের দ্বিখণ্ডিত দেহ জুড়ে দিয়েছিলেন জরা রাক্ষসী, পরীক্ষিতের দেহ জুড়ে দেন কৃষ্ণের দাবি অনুযায়ী মৃত্যুর দেবতা স্বয়ং।

অশ্বত্থামা আগেই কৃষ্ণ কর্তৃক দ্বিখণ্ডিত হয়েছিলেন। দ্রোণাচার্যের প্রিয় পুত্র, সর্বশ্রেষ্ঠ বীর অশ্বত্থামা মহাভারতে গভীর রাত্রে নিদ্রামগ্ন বীর হত্যাকারী অথবা মাতৃগর্ভস্থ নিষ্ক্রিয় শিশু হত্যাকারী হিসাবেই চিরখ্যাত হয়ে থাকলেন। দুষ্কর্ম করে পাণ্ডবদের ভয়ে আত্মগোপন করলেন। ভীষ্ম ঠিকই বলেছিলেন, ইনি আপন জীবনকে এত ভালবাসেন যে ইনি মহারথ নামের যোগ্য নন।

৯৫
অর্জুনের মৃত্যু ও পুনরুজ্জীবন

যুধিষ্ঠির, হস্তিনাপুরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে, রাজপুরোহিতেরা, ব্যাসদেব, মহর্ষিবর্গ, দেবর্ষি নারদ এবং যদুবংশ শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ তাঁকে পরামর্শ দিলেন অশ্বমেধ যজ্ঞ করার। যুধিষ্ঠির সেই পরামর্শ গ্রহণ করলেন। অশ্বমেধের অশ্ব নিয়ে ভীমসেনের কনিষ্ঠ, সর্বধনুর্ধর শ্রেষ্ঠ, শক্রসহিষ্ণু, সমরদক্ষ অর্জুন অশ্বের রক্ষক হয়ে চললেন। বহুবিধ ম্লেচ্ছ, কিরাতদেশীয় বীরকে পরাজিত করে অর্জুনের অশ্ব ত্রিগর্ত, প্রাগ্জ্যোতিষপুর, সিন্ধুদেশ জয় করে এবং রাজাদের যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা অনুসারে বধ না করে, অশ্বমেধ যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করে যজ্ঞীয় অশ্বের রক্ষক হয়ে মণিপুর উপস্থিত হলেন।

পিতা অর্জুন উপস্থিত হয়েছেন শুনে মণিপুরের রাজা বভ্রুবাহন, ব্রাহ্মণ ও প্রণামীয় ধন অগ্রবর্তী করে বিনীতভাবে রাজধানী থেকে নির্গত হলেন। বুদ্ধিমান অর্জুন ক্ষত্রিয়ের ধর্ম স্মরণ করে মণিপুরের রাজা এইভাবে এসেছেন দেখে তাঁর প্রশংসা করলেন না। বরং ধর্মাত্মা অর্জুন তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, “তোমার এই প্রক্রিয়া সংগত হয়নি। তুমি ক্ষত্রিয়ধর্ম লঙ্ঘন করেছ। পুত্র, যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞীয় অশ্ব সমীচীনভাবে রক্ষিত থেকে, রাজ্যপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছে এবং আমিও রক্ষকরূপে এসেছি, এই অবস্থায় তুমি যুদ্ধ করলে না কেন? অতিদুর্বুদ্ধি তুমি ক্ষত্রিয় ধর্ম থেকে বিচ্যুত; সুতরাং তোমাকে ধিক। আমি যুদ্ধার্থ উপস্থিত হয়েছি; এই অবস্থায় তুমি কোমল বিনীতভাবে আমার কাছে এসেছ কেন? তোমার জীবনে পৌরুষ নেই। আমি যুদ্ধ করতে এসেছি আর তুমি স্ত্রীলোকের মতো আমাকে বরণ করে নিতে এসেছ? অতি দুর্মতি নরাধম। আমি যদি নিরস্ত্র অবস্থায় তোর কাছে আসতাম, তা হলে তোর এই আচরণ সংগত হত।”

ভর্তা অৰ্জুন পুত্র বভ্রুবাহনকে এই রকম ভর্ৎসনা করছেন জেনে তা সহ্য করতে না পেরে নাগদুহিতা উলূপী ভূমি ভেদ করে সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি দেখলেন, যুদ্ধার্থী পিতা বারবার তিরস্কার করছেন, আর সপত্নীর পুত্র বভ্রুবাহন মাথা নিচু করে চিন্তা করছেন। তখন সর্বাঙ্গসুন্দরী নাগদুহিতা উলূপী কাছে গিয়ে ধর্মবিশারদ পুত্র বভ্রুবাহনকে ধর্মসঙ্গত এই কথা বললেন, “পুত্র আমি নাগমাতা উলূপী, তোমার বিমাতা। তোমার পিতার বাক্য পালন করো, তাই তোমার শ্রেষ্ঠধর্ম হবে।”

মাতা উলূপী এইভাবে উৎসাহিত করতে থাকলে, মহাতেজা রাজা বভ্রুবাহন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। বভ্রুবাহন স্বর্ণময় বর্ম ও উজ্জ্বল শিরস্ত্রাণ ধারণ করে শত শত তূণীর পূর্ণ উত্তম রথে আরোহণ করলেন। সেই রথে যুদ্ধের সমস্ত উপকরণ ছিল, অতিদ্রুতগামী অশ্বসকল যোজিত হয়েছিল, চক্রপ্রভৃতি সমস্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছিল এবং সেই রথ স্বর্ণালংকারে অলংকৃত ছিল। রাজা বভ্রুবাহন সেই রথে সিংহচিহ্নিত ও স্বর্ণময় বিশেষ আদৃত ধ্বজ উত্তোলন করে অর্জুনের উদ্দেশে গমন করলেন। তারপর বভ্রুবাহন কাছে এসে অশ্ববিদ্যাবিশারদ পুরুষগণ দ্বারা অৰ্জুনরক্ষিত সেই যজ্ঞীয় অশ্বধারণ করালেন। অর্জুন অশ্বটি ধৃত হয়েছে দেখে সন্তুষ্টচিত্ত হয়ে রথস্থিত পুত্র বভ্রুবাহনকে যুদ্ধে বারণ করতে প্রবৃত্ত হলেন। বভ্রুবাহন তীক্ষ্ণ ও সর্পবিষতুল্য অনেক বাণ দ্বারা অর্জুনকে পীড়ন করতে লাগলেন। ক্রমে সন্তুষ্টচিত্ত পিতা ও পুত্রের মনুষ্যলোকে অদ্বিতীয় দেবাসুরতুল্য যুদ্ধ হতে লাগল। তখন বভ্রুবাহন হাস্য করতে থেকে নতপর্ব একটি বাণ দ্বারা নরশ্রেষ্ঠ অর্জুনের স্কন্ধদেশের এক পার্শ্ব বিদীর্ণ করলেন। সর্প যেমন উইমাটির স্তূপের ভিতর প্রবেশ করে, সেইরকম সেই বাণটি অর্জুনকে বিদীর্ণ করে পুঙ্খদেশের সঙ্গে বার হয়ে গেল এবং ভূতলে প্রবেশ করল। তখন বুদ্ধিমান অর্জুন অত্যন্ত বেদনাপন্ন হয়ে উত্তম ধনু ধারণ করে কেবলমাত্র চৈতন্য অবলম্বন করে মৃতের মতো পড়ে রইলেন। তারপর নরশ্রেষ্ঠ ও মহাতেজা অর্জুন চৈতন্য লাভ করে প্রশংসা করে বভ্রুবাহনকে বললেন, “মহাবাহু বৎস চিত্রাঙ্গদানন্দনপুত্র সাধু সাধু! তোমার উপযুক্ত কাজ দেখে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। পুত্র যুদ্ধে স্থির থাকো। এইবার আমি তোমার উপর বহুতর বাণক্ষেপ করছি।” এই কথা বলে অর্জুন বভ্রুবাহনের উপর অনেক নারাচ নিক্ষেপ করলেন। তখন রাজা বভ্রুবাহন ভল্ল দ্বারা বজ্রের ন্যায় দৃঢ় ও বিদ্যুতের ন্যায় উজ্বল গাণ্ডিবনিক্ষিপ্ত সেই সমস্ত নারাচকেই দুই ভাগে ও তিন ভাগে ছেদন করলেন। পরে অর্জুন অলৌকিক বাণসমূহ ও ক্ষুরপ্র দ্বারা বভ্রুবাহনের রথ থেকে স্বর্ণালংকৃত তালবৃক্ষের তুল্য ধ্বজটিকে ছিন্ন করে ফেললেন। তারপর অর্জুন যেন হাসতে হাসতে বভ্রুবাহনের রথের বিশাল ও মহাবেগশালী অশ্বগুলিকে সংহার করলেন। তখন রাজা বভ্রুবাহন রথ থেকে অবতীর্ণ হয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ অবস্থায় পিতা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ অর্জুন পুত্রের বিক্রম দেখে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অধিক পীড়ন করলেন না।

তখন বলবান বভ্রুবাহন পিতাকে বিমুখ মনে করে সর্পতুল্য বাণসমূহ দ্বারা পুনরায় তাঁকে পীড়ন করতে লাগলেন। বালচাঞ্চল্যবশত অতি তীক্ষ্ণ এবং সুপুঙ্খ একটি বাণ দ্বারা অর্জুনের হৃদয়ে গুরুতর বিদ্ধ করলেন। প্রজ্বলিত অগ্নির মতো তেজে উজ্জ্বল সেই বাণ অর্জুনের হৃদয় ভেদ করে প্রবেশ করল এবং অর্জুন গুরুতর ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। তারপর কৌরবনন্দন অর্জুন পুত্র কর্তৃক সেই বাণে বিদ্ধ ও মূর্ছিত হয়ে ভূতলে পতিত হলেন। কৌরবধুরন্ধর বীর অর্জুন ভূতলে পতিত হলে, বভ্রুবাহনও মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন। কারণ, তিনি পূর্বে অর্জুন কর্তৃক বাণ দ্বারা অত্যন্ত বিদ্ধ হয়েছিলেন, পরে আবার যুদ্ধে পরিশ্রম করে এবং পিতাকে নিহত দেখে, ভূতল আলিঙ্গন করে রণস্থলে পতিত হলেন।

ভর্তাকে নিহত এবং পুত্রকে ভূতলে পতিত দেখে, পরিত্ৰস্তা হয়ে চিত্রাঙ্গদা রণাঙ্গনে প্রবেশ করলেন। চিত্রাঙ্গদা শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে রোদন করতে থেকে অত্যন্ত কম্পিত কলেবরে নিহত পতিকে দর্শন করলেন। “উলূপী দেখো—তুমি দেখো। পতি ভূতলে পতিত হয়ে আছেন। তুমি এই পুত্রকে উৎসাহিত করে এর দ্বারা পতিকে বধ করে শোক করছ। উলূপী আমার মনের কথা তুমি শোনো—এই বালক মৃত অবস্থায় ভূতলে পড়ে থাকুক কিন্তু রক্তনয়ন অর্জুন জীবনলাভ করুন। সুভগে পুরুষগণের বহুভার্যতা দূষণীয় নয়; কিন্তু স্ত্রীগণের বহুপতিব্রতা দোষই বটে। তুমি আমার স্বামীর মৃত্যু ঘটিয়ো না। কারণ, স্বয়ং বিধাতাই চিরকালীনভাবে ও অনশ্বররূপে নিজের অভীষ্ট এই নিয়ম করেছেন। সে যাই হোক, আমার পতির সঙ্গে তোমার সম্মেলন সত্য হোক। উলূপী তুমি পুত্র দ্বারা এই পতিকে বিনাশ করিয়ে আবার যদি আজ আমার পতিকে জীবিত না দেখাও, তা হলে আজ আমি জীবন ত্যাগ করব। আমি পতিপুত্রহীনা হয়ে অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছি। অতএব তোমার সাক্ষাতে এই রণস্থলেই আমি প্রায়োপবেশন করব, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”

চিত্ৰবাহনতনয়া সপত্নী চিত্রাঙ্গদা উলূপীকে এই কথা বলে সেই স্থানেই প্রায়োপবেশন করে নীরব হলেন। চিত্রাঙ্গদা মৃত পতির চরণযুগল ধারণ করে নিশ্বাস ত্যাগ করে অচেতন পুত্রকে দর্শন করে শোকার্ত হলেন। এই সময়ে বভ্রুবাহন চৈতন্যলাভ করলেন। রণাঙ্গনে মাতাকে দেখে বভ্রুবাহন বললেন, “এর থেকে গুরুতর দুঃখ আর কী আছে। সুখে বৃদ্ধিপ্রাপ্তা আমার মাতা ভূতলে পতিত মৃত বীর পতিকে ধারণ করে আছেন। ইনি, যুদ্ধে শত্রুহন্তা সর্বশস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ সমরে আমা কর্তৃক নিহত, অসম্ভাব্য মৃত্যু স্বামীকে দর্শন করছেন। হায়! এই দেবীর হৃদয় অত্যন্ত দৃঢ়; যেহেতু বিশালবক্ষা ও মহাবাহু নিহত স্বামীকে দর্শন করতে থেকেও এঁর হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে না। আমি মনে করি, কাল অবস্থিত না হলে মানুষের মৃত্যুলাভ করা দুষ্কর, কেন না আমি ও আমার মাতা এখনও জীবিত রয়েছি। হায় হায়! আমি পুত্র হয়েও দেখে দেখে অস্ত্র দ্বারা পিতা অর্জুনকে বধ করেছি। তাঁর স্বর্ণময় কিরীট ভূতলে পড়ে আছে। হে ব্রাহ্মণগণ, আমি পুত্র হয়ে পিতাকে বধ করেছি, সেই বীর পিতা ভূতলে বীরশয্যায় শায়িত হয়ে আছেন। অশ্বানুগামী যে সকল ব্রাহ্মণ আমার প্রহার থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তাঁরা এই বীরের শান্তির কী ব্যবস্থা করেছেন। ব্রাহ্মণগণ, আমি যুদ্ধে পিতাকে বধ করেছি বলে অত্যন্ত নৃশংস ও পাপাত্মা। আমার কীভাবে প্রায়শ্চিত্ত হবে, তা আপনারা বিশেষভাবে আদেশ করুন। পিতার চর্মদ্বারা দেহ আবৃত করে আমি দুষ্কর দ্বাদশবার্ষিক মহাব্রত করব। পিতার মস্তকের দুইদিকের দুই অংশ ধারণ করে আমার আজ এই প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। পিতৃহত্যা করায় আমার অন্য প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে না।

“নাগতনয়ে দেখুন, আমি আপনার ভর্তাকে বধ করেছি। আমি আজ যুদ্ধে অর্জুনকে বধ করে আপনার প্রিয়কার্য করেছি। কল্যাণী আজ আমি পিতার অবলম্বিত পথ অনুসরণ করব। কারণ আমি নিজে নিজেকে ধারণ করতে সমর্থ হচ্ছি না। আমি হৃদয় স্পর্শ করে সত্য বলছি যে, আমি ও গাণ্ডিবধন্বা মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ায় আপনি আজ সন্তুষ্ট হবেন।” এই বলে রাজা বভ্রুবাহন দুঃখে ও শোকে আহত হয়ে আচমন করে দুঃখবশতই আবার বললেন, “স্থাবর ও জঙ্গম সমস্ত প্রাণী শ্রবণ করুক, মা নাগশ্রেষ্ঠে আপনিও শ্রবণ করুন যে, আমি সত্যই বলছি। যদি আমার পিতা অর্জুন গাত্রোত্থান না করেন, তা হলে আমি এই রণস্থলে অনাহারে দেহ শুষ্ক করব। কারণ, পিতৃহত্যা করে সেই পাপ থেকে কোথাও গিয়ে আমি নিষ্কৃতি পাব না। পিতৃহত্যা পাপে লিপ্ত হয়ে আমি নিশ্চয়ই নরকে যাব। মানুষ বিনাযুদ্ধে বীর ক্ষত্রিয়কে বধ করে শত গোদান করলে সেই পাপ থেকে মুক্ত হয়। মহাতেজা, পাণ্ডুপুত্ৰ ধনঞ্জয় ধর্মাত্মা এবং আমার পিতা। তাঁকে বধ করে আমি মুক্তি পাব কী করে?” মহামতি বভ্রুবাহন এই কথা বলে পুনরায় আচমন করে প্রায়োপবেশন করলেন।

মণিপুর অধিপতি বভ্রুবাহন মাতার সঙ্গে প্রায়োপবেশন করলে উলূপী সঞ্জীবন মণির স্মরণ করলেন। নাগগণের পরমাশ্রয় সেই মণিও তখনই সেখানে উপস্থিত হল। তখন উলূপী সেই মণি গ্রহণ করে সকল সৈন্যকে আনন্দিত করে বললেন, “পুত্র ওঠো, শোক কোরো না, তুমি জিষ্ণুকে (অর্জুনকে) জয় করনি। কারণ, ইনি মনুষ্যগণের এবং ইন্দ্রের সঙ্গে দেবগণেরও অজেয়। কিন্তু আমি আজ পুরুষশ্রেষ্ঠ ও যশস্বী তোমার পিতার প্রীতির জন্য এই ‘মোহিনী’ নাম্নী মায়া প্রয়োগ করেছি। কারণ, তোমার পিতা তোমার বল পরীক্ষার জন্যই বিপক্ষবীর হিসাবে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেই কারণে, আমি তোমাকে যুদ্ধের জন্য প্রণোদিত করেছি। তোমার অনিষ্ট করার জন্য আমি এখানে আসিনি। পুত্র ইনি প্রাচীন, নিত্য, অচল ও মহাত্মা নরঋষি। সুতরাং স্বয়ং ইন্দ্রও যুদ্ধে একে জয় করতে সমর্থ হন না। নরনাথপুত্র, এই অলৌকিক মণি সর্বদা মৃত নাগগণকে সঞ্জীবিত করে। তুমি এই মণিটিকে পিতার বক্ষে স্থাপন করো। তা হলেই তুমি দেখতে পাবে পৃথানন্দন অর্জুন সঞ্জীবিত হয়েছেন।” উলূপী এই কথা বললে বভ্রুবাহন শ্রদ্ধার সঙ্গে পিতার বক্ষে মণিটি রাখলেন। সেই মণিটি বক্ষে স্থাপন করলে বীর ও প্রভাবশালী অর্জুন পুনরায় জীবিত হলেন এবং দীর্ঘকাল নিদ্রিতের মতো গাত্রোত্থান করে হস্ত দ্বারা রক্তবর্ণ নয়নযুগল মার্জনা করলেন। অর্জুন সুস্থ হয়ে গাত্রোত্থান করলে বভ্রুবাহন তাঁকে প্রণাম করলেন। অর্জুন পূর্বের ন্যায় কান্তিসম্পন্ন হলে ইন্দ্র স্বর্গীয় পবিত্র পুষ্পবর্ষণ করলেন এবং চতুর্দিকে ‘সাধু সাধু’ এই ধ্বনি শুনতে পাওয়া গেল।

মহাবাহু অর্জুন গাত্রোত্থান করে পুত্র বভ্রুবাহনকে আলিঙ্গন করলেন ও তাঁর মস্তক আঘ্রাণ করলেন। কিছু দূরে উলূপীর সঙ্গে শোকাকুলা চিত্রাঙ্গদাকে দেখে অর্জুন বভ্রুবাহনকে জিজ্ঞাসা করলেন, “শত্রুহন্তা, এই রণস্থলকে একই সঙ্গে শোক, বিস্ময় ও আনন্দযুক্ত দেখছি কেন? তুমি যদি জানো, আমাকে কারণ বলো। তোমার জননী রণস্থলে কেন? নাগরাজতনয়া উলূপীই বা এখানে কেন এসেছেন? আমার আদেশেই তুমি আমার সঙ্গে যুদ্ধ করেছ। তাতে তোমার জননীদের এখানে আসার কারণ কী?” বভ্রুবাহন মাথা নিচু করে বললেন, “এই উলূপীকে জিজ্ঞাসা করুন।”

অর্জুন বললেন, “কুরুকুলানন্দকারিণী নাগনন্দিনী, তোমার এবং মণিপুর মাতার এই রণাঙ্গনে আগমন করবার প্রয়োজন কী ছিল? তুমি এই রাজার মঙ্গলাভিলাষ করতে এসেছ তো? তুমি আমার মঙ্গল কামনা করো তো? বিশাল নিতম্বে, প্রিয়দর্শনে, আমি বা এই বভ্রুবাহন তোমার কোনও অপ্রিয় আচরণ করিনি তো? চিত্রবাহনতনয়া, উত্তমাঙ্গনা ও তোমার সপত্নী চিত্রাঙ্গদা কোনও অপরাধ করেননি তো?” উলূপী হাস্যসহকারে বললেন, “আপনি, বভ্রুবাহন বা চিত্রাঙ্গদা আমার কাছে কোনও অন্যায় করেননি। আমি মাথা নিচু করে আপনাকে প্রসন্ন করছি, আমার উপরে ক্রোধ করবেন না। আমি যা করেছি, আপনার প্রীতির জন্যই করেছি। কারণ—

মহাভারতযুদ্ধে যত্ত্বয়া শান্তনবো নৃপঃ।

অধর্মেণ হতঃ পার্থ! তস্যৈষা নিষ্কৃতিঃ কৃতা॥ আশ্বমেধিক : ১০৪ : ৮॥

“পৃথানন্দন আপনি কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে অধর্মপূর্বক ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ ভীষ্মকে যে বধ করেছেন, সেই পাপেরই এই প্রায়শ্চিত্ত করলেন। বীর আপনি যুধ্যমান অবস্থায় ভীষ্মকে নিপাতিত করেননি। কিন্তু আপনি শিখণ্ডীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন, তাঁকে অবলম্বন করেই ভীষ্মকে বধ করেছেন। আপনি সেই পাপের শান্তি না করে যদি জীবন ত্যাগ করতেন, তা হলে সেই পাপের কর্মফলে নিশ্চয়ই নরকে পতিত হতেন। এখন বভ্রুবাহনের হাতে যে অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছিলেন, এ হল সে পাপেরই শাস্তি।

“মহামতি ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ, পূর্বেই গঙ্গা ও বসুগণ আপনার এই পাপ কার্য শুনেছিলেন। বসুগণ এবং আমি এই ব্যাপার গঙ্গার কাছে বলেছিলাম। ভীষ্ম নিহত হলে বসুদেবগণ গঙ্গাতীরে এসে, স্নান করে মিলিত হয়ে গঙ্গার মত অনুসারে এই ভয়ংকর বাক্য সেই মহানদীকে বলেছিলেন, ‘উত্তমাঙ্গনে! শান্তনুনন্দন এই ভীষ্ম রণস্থলে যুদ্ধ করছিলেন না, সেই অবস্থায় অর্জুন শিখণ্ডীকে সামনে রেখে তাঁকে বধ করেছে। অতএব আমরা এই কারণেই আজ অর্জুনকে অভিসম্পাত করব।’ তখন গঙ্গাও বললেন, ‘তাই হোক।’ আমি পিতার গৃহে প্রবেশ করে পিতার কাছে সেই বৃত্তান্ত জানিয়ে দুঃখিত চিত্ত হয়ে রইলাম। আমার পিতাও সেই বৃত্তান্ত শুনে অত্যন্ত বিষণ্ণ হলেন। তারপর আমার পিতা বারবার বসুগণের কাছে আপনার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করলেন। তখন বসুগণ আমার পিতাকে বললেন, ‘মহাভাগ! সেই অর্জুনের পুত্র মণিপুরাধিপতি যুবক বভ্রুবাহন রণস্থল থেকে বাণদ্বারা অর্জুনকে ভূতলে পাতিত করবেন। নাগরাজ, বভ্রুবাহন অর্জুনের এই অবস্থা করলে অর্জুন আমাদের শাপ থেকে মুক্ত হবেন—এখন আপনি যেতে পারেন।’ যখন আমার পিতা আমাকে এই কথা বললেন, তখন আমি তা শুনে আপনাকে সেই শাপ থেকে মুক্ত করেছি। না হলে, স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রও যুদ্ধে আপনাকে পরাজিত করতে পারেন না। স্মৃতিশাস্ত্র পুত্রকে পিতৃস্বরূপ বলেছে, সেইজন্যই আপনি পুত্র কর্তৃক পরাজিত হয়েছেন। আমার মতে পুত্র কর্তৃক পরাজয় দোষের নয়। আপনিই বা কী মনে করেন?”

উলূপীর কথা শুনে প্রসন্ন চিত্তে অর্জুন বললেন, “দেবি তুমি যা করেছ, সেই সমস্তই আমার কাছে অত্যন্ত প্রীতিজনক হয়েছে।” এই বলে অর্জুন চিত্রাঙ্গদা, উলূপীর সম্মুখে মণিপুরাধিপতি পুত্র বভ্রুবাহনকে বললেন, “রাজা পরবর্তী চৈত্র পূর্ণিমাতে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞ হবে। তুমি দুই মাতা ও মন্ত্রীবর্গের সঙ্গে সেই যজ্ঞে যাবে।” অর্জুনের কথা শুনে বুদ্ধিমান রাজা বভ্রুবাহন পিতাকে বললেন, “ধর্মজ্ঞ আমি আপনার আদেশে সেই মহাযজ্ঞ অশ্বমেধে যাব এবং দ্বি-জাতিগণের পরিবেষক হব। ধর্মজ্ঞ আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য দুই ভার্যার সঙ্গে আপনার এই পুরীতে প্রবেশ করুন। আপনি এই পুরীতে নিজগৃহে সুখে একরাত্রি বাস করে পুনরায় অশ্বের অনুগমন করবেন।”

পুত্র এই কথা বললে, কপিধ্বজ অর্জুন অল্প হেসে পুত্র বভ্রুবাহনকে বললেন, “বিশালনয়ন মহাবাহু, এ বিষয়ে তোমার গুরুতর আগ্রহ বুঝলাম; কিন্তু যেহেতু আমি কেবল এই অশ্বের অনুসরণব্রত গ্রহণ করেছি, সেইজন্য তোমার পুরীতে প্রবেশ করব না। নরশ্রেষ্ঠ, এই যজ্ঞীয় অশ্ব ইচ্ছানুসারে বিচরণ করে থাকে। সে যাই হোক, তোমার মঙ্গল হোক—এ যাত্রায় আমি তোমার পুরীতে প্রবেশ করতে পারছি না।”

বভ্রুবাহন প্রণাম করলেন। দুই ভার্যার অনুমতি নিয়ে অর্জুন প্রস্থান করলেন।

*

এক মহাবৈশ্বিক পতনের ইঙ্গিত আমরা পেলাম। অর্জুনের মৃত্যু ঘটতে দেখলাম আমরা। তাও আপন পুত্র বভ্রুবাহনের কাছে। যে অর্জুনের কাছে রথী হিসাবেই বিবেচিত হতে পারে না, সেই মানুষের কাছে পরাজয় অর্জুনের জীবনে এই প্রথম। ইতোমধ্যে অর্জুন দু’বার মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। একবার, ধর্মের নিষেধ অমান্য করতে গিয়ে, অন্যবার দেবাদিদেব মহাদেবের বাহুবদ্ধ অবস্থায়, তাঁর বাহুর চাপে। কিন্তু সে দু’বারই দৈবী ঘটনার ফলে। মানুষের হাতে অর্জুনের পরাজয় এই প্রথম।

ব্যাসদেব এক সাংঘাতিক পরিণাম পাঠকের জন্য রেখে গেলেন৷ পার্থিব জীবনের কৃতকর্মের দায় পার্থিব জীবনেই পরিশোধ করে যেতে হবে। ভীষ্মের নিধন অর্জুন ঘটিয়েছিলেন শিখণ্ডীকে সামনে রেখে। ভীষ্ম শিখণ্ডীকে আঘাত করবেন না জেনে। প্রতিপক্ষের প্রত্যাঘাতের সুযোগ না দিয়ে। অথচ সঞ্জয়কে অর্জুন বলেছিলেন সদর্পে— “আমি রণক্ষেত্রে প্রথমেই ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্মকে বধ করব।” বধ করেছিলেন—কিন্তু ভীষ্ম যখন প্রতিকারহীন অবস্থায়। এই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত অর্জুনকে করতেই হত। বিশেষত ভীষ্ম অর্জুনকে চরাচরের শ্রেষ্ঠ অতিরথ বলে বিশ্বাস করতেন। পুত্রের হাতে মৃত্যুতে অর্জুনের প্রায়শ্চিত্ত হল। পুত্র আত্মস্বরূপ। অর্থাৎ অর্জুনকে আত্মহত্যাই করতে হল। পৃথিবী থেকে যাবার আগে অর্জুনের প্রত্যক্ষ ঋণ শোধ হল। পরোক্ষ ঋণ এখনও বাকি, তাও শোধ করতে হবে যথাসময়ে।

অর্জুনের জীবনের সব ক’টি নারীই অসামান্য। দ্রৌপদী, সুভদ্রা তো বটেই—উলূপী, চিত্রাঙ্গদাও সামান্যা নারী নন। মহাভারতের চিত্রাঙ্গদা আর রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা এক ব্যক্তিত্ব নয়। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা সুন্দরী নন, বীরনারী। ব্যাসদেবের চিত্রাঙ্গদা অপূর্ব রূপসী, মহাভারতে তাঁর বীরত্বের কাহিনি বর্ণিত হয়নি। কিন্তু তিনি অর্জুনকে ভালবেসেছিলেন। অর্জুনের মৃত্যুতে প্রায়োপবেশনে বসেছিলেন। বলেছিলেন, তাঁর পুত্র ভূতলে পতিত থাক, স্বামী জীবিত হয়ে উঠুন। অসামান্য নারী উলূপীও। তিনি অর্জুনের বিবাহিতা নন, কিন্তু অর্জুনের সন্তানের জননী। পুত্র ইরাবান যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। তা নিয়ে কোনও হাহাকার উলূপী করেননি। তিনি অর্জুনের হিত চেয়েছিলেন, অমঙ্গল, অকল্যাণ দূর করতে চেয়েছিলেন। অর্জুনের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। ক্ষমতায় উলূপী চিত্রাঙ্গদা, সুভদ্রার থেকে অধিক শক্তিশালিনী ছিলেন। ভীষ্মবধের পাপ থেকে তিনি অর্জুনকে রক্ষা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্গদা চরিত্রে পরিবর্তন করেছিলেন। তাতে চরিত্রটি অসাধারণ হয়েছে। কিন্তু ব্যাসদেবের চিত্রাঙ্গদা জীবপুত্রিকা। মিলনের পর শ্রবণ অনুরাগই তাঁর সম্বল। অবশ্য স্বামীপ্রদত্ত সন্তান তাঁর কাছে ছিল।

৯৬
ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের রাজ সিংহাসনে বসার পর পনেরো বছর অতিক্রান্ত হল। যুধিষ্ঠিরের সেবায় ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী পুত্রশোক বিস্মৃত হয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরের আদেশে প্রজারা ধৃতরাষ্ট্রকে দেবতার মতো সম্মান করত। শুধু ভীমসেন যুধিষ্ঠিরের অনুপস্থিতিতে ধৃতরাষ্ট্রকে অসম্মানকর কথা বলতেন। পনেরো বৎসর অতিক্রান্ত হলে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী-কুন্তী-বিদুর-সঞ্জয় বানপ্রস্থ গ্রহণ করলেন। এক বছর পরে যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের নিয়ে বনে গিয়ে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী-কুন্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছেন। এরও পরে দু’বছর কেটে গেছে। একদিন দেবর্ষি নারদ ঈশ্বরেচ্ছাক্রমে যুধিষ্ঠিরের কাছে উপস্থিত হলেন।

নারদ উপবেশন ও বিশ্রাম করলে, মহাবাহু ও বাগ্মীশ্রেষ্ঠ কুরুরাজ যুধিষ্ঠির তাঁকে প্রণাম করে বললেন, “ভগবন্! দীর্ঘকাল আপনাকে উপস্থিত দেখিনি। আপনার কি কোনও অমঙ্গল ঘটেছিল? আপনি কোন কোন দেশ দেখে এলেন এবং আপনার কী কার্য করব বলুন। আপনি ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ; আপনি আমাদের অতি প্রিয় অতিথি।” নারদ বললেন, “রাজা আমি তোমাকে দীর্ঘকাল পরে দেখলাম, একথা সত্য। আমি এখন ধৃতরাষ্ট্রের তপোবন থেকে আসছি এবং পথে অনেক তীর্থ এবং গঙ্গা দর্শন করেছি।” যুধিষ্ঠির বললেন, “গঙ্গাতীরবাসী লোকেরা আমার কাছে বলে যে, মহাত্মা ধৃতরাষ্ট্র এখন পরম তপস্যা অবলম্বন করেছেন। আপনি সেই তপোবনে কৌরবশ্রেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী ও সূতপুত্র সঞ্জয়কে কুশলী দেখেছেন তো? ভগবন্ আপনি যদি ধৃতরাষ্ট্রকে দেখে থাকেন, তবে আমি শুনতে চাই যে, আমার জ্যেষ্ঠতাত সেই রাজা এখন কেমন আছেন?”

নারদ বললেন, “মহারাজ আমি সেই তপোবনে যেমন শুনেছি এবং যেমন দেখছি, তুমি স্থির হয়ে সেই বৃত্তান্ত শ্রবণ করো। তোমরা তপোবন থেকে চলে এলে, তোমার জ্যেষ্ঠতাত জ্ঞানী রাজা ধৃতরাষ্ট্র কুরুক্ষেত্র থেকে গঙ্গাদ্বারে গিয়েছিলেন। তখন গান্ধারী, বধূ কুন্তী ও সূতপুত্র সঞ্জয় তাঁর সঙ্গে ছিলেন এবং যাজকেরা অগ্নিহোত্র নিয়ে তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন। তপোধন তোমার জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র ক্রমে তীব্র তপস্যা অবলম্বন করলেন অর্থাৎ তখন তিনি বায়ুমাত্র ভক্ষণ করতে থেকে মুখের ভিতরে একটি গুলিকা রেখে মুনি হলেন৷ এইভাবে তিনি মহাতপা হলে, অন্য মুনিরা সকলেই তাঁর সম্মান করতে লাগলেন। এইভাবে তিনি অস্থিচর্মমাত্র সার হয়ে ছ’মাস যাবৎ থাকলেন। ভরতনন্দন সেই সময়ে জলমাত্র পান করে, কুন্তী একমাস যাবৎ উপবাসিনী থেকে এবং সঞ্জয় দু’দিন উপবাসের পর তৃতীয় দিন রাত্রে ভোজন করে জীবনধারণ করতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র সেই বনে কখনও দৃষ্টিগোচর থাকতেন, কখনও বা স্থানান্তরে অদৃশ্য হতেন। এই অবস্থায় যাজকেরা যথাবিধানে অগ্নিতে হোম করতেন। তখন ধৃতরাষ্ট্র গৃহে বাস করতেন না, তিনি বনে থাকতেন এবং কুন্তী, গান্ধারী ও সঞ্জয়—এঁরাও তাঁর অনুসরণ করতেন। সঞ্জয় সমতল বা অসমতল ভূমিতে ধৃতরাষ্ট্রকে নিয়ে যেতেন, আর অনিন্দিতা কুন্তী গান্ধারীর চোখ ছিলেন। তারপর কোনও সময়ে জ্ঞানী ও রাজশ্রেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র, গঙ্গা স্নান করে আশ্রমের অভিমুখ হয়ে গঙ্গার তীর দিয়ে যাচ্ছিলেন, সে সময় বায়ুও উঠল, বিশাল দাবাগ্নি জন্ম নিল এবং সেই দাবাগ্নি সকল দিক ব্যাপ্ত করে সেই সমগ্র বনটি দগ্ধ করতে লাগল। ক্রমে হরিণগণ ও সর্পগণ সকলদিকে দগ্ধ হতে লাগলে, শূকরগণ জলাশয় আশ্রয় করে থাকলে এবং সেই বন জ্বলে উঠলে, তাঁদের গুরুতর বিপদ উপস্থিত হল। তখন আহার করেন না বলে ধৃতরাষ্ট্রের দৈহিক শক্তি ও দ্রুত চলার শক্তি একেবারে কমে গিয়েছিল বলে তিনি দ্রুত সরে যেতে অসমর্থ হলেন এবং তোমার মাতারা দু’জনে (কুন্তী এবং গান্ধারী) অত্যন্ত কৃশ দেহ বলে দ্রুত অপসরণ করতে পারেননি। তারপর অগ্নি দ্রুত কাছে আসছে বুঝে বিজয়ীশ্রেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র সূতপুত্র সঞ্জয়কে বললেন, ‘সঞ্জয় যে স্থানে অগ্নি তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না, সেই স্থানে দ্রুত সরে যাও। আমরা এই স্থানে থেকে অগ্নিতে দগ্ধ হয়ে পরম গতি লাভ করব।’ তখন বাগ্মীশ্রেষ্ঠ সঞ্জয় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, ‘রাজা এই বৃথাগ্নি দ্বারা আপনার মৃত্যু কারও অভিপ্রেত হতে পারে না। অথচ এই দাবাগ্নি থেকে আমাদের মুক্তির বিষয়ে কোনও উপায়ও দেখছি না। আপনি এখন আমাদের যা কর্তব্য, আদেশ করুন।’ ধৃতরাষ্ট্র আবার সঞ্জয়কে বললেন, ‘আমরা গৃহ থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছি। সুতরাং এই মৃত্যু আমাদের অনভিপ্রেত নয়। কারণ, জল, অগ্নি, বায়ু অথবা নিজেই প্রাণ আকর্ষণ—এগুলি তপস্বীগণেরও মৃত্যুর পক্ষে অতি প্রশস্ত; অতএব সঞ্জয় তুমি চলে যাও, বিলম্ব কোরো না।’

“সঞ্জয়কে এই কথা বলে তখনই ধৃতরাষ্ট্র ইষ্টদেবতার উপরে মন স্থাপন করলেন। গান্ধারী ও কুন্তীও ধৃতরাষ্ট্রের মতো পূর্বমুখ হয়ে উপবেশন করলেন। বুদ্ধিমান সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে সেই অবস্থায় দেখে প্রদক্ষিণ করলেন এবং তাঁকে বললেন, ‘রাজা আপনি ইষ্টদেবতার সঙ্গে আত্মসংযোগ করুন।’ বেদব্যাসের পুত্র জ্ঞানী ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের সেই বাক্য রক্ষা করলেন এবং তখনই ইন্দ্রিয়সমূহকে নিরুদ্ধ করে ধ্যানস্থ হয়ে কাঠের মতো হলেন। এই সময়েই মহাভাগা গান্ধারী ও তোমার জননী কুন্তী দাবাগ্নিকর্তৃক সংশ্লিষ্ট হলেন এবং তোমার জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রও দাবাগ্নিগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধানমন্ত্রী সঞ্জয় সেই দাবাগ্নি থেকে মুক্ত হয়েছেন। গঙ্গাতীরে তপস্বীগণের সঙ্গে আমি তাঁকে দেখেছি। তেজস্বী ও বুদ্ধিমান সঞ্জয় সেই তপস্বীগণের কাছে এই সমস্ত বৃত্তান্ত বলে এবং তাঁদের অনুমতি নিয়ে হিমালয় পর্বতে চলে গিয়েছেন।”

এবং স নিধনং প্রাপ্তঃ কুরুরাজো মহামনাঃ।

গান্ধারী চ পৃথা চৈব জনন্যৌ তে বিশাংপতে॥ আশ্রমবাসিক : ৪০ : ৩৪॥

“নরনাথ, মহামনা কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী এবং তোমার জননী কুন্তী—এঁরা এইভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন।”

“ভরতশ্রেষ্ঠ আমি ঈশ্বরেচ্ছাক্রমে পথে যেতে যেতে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর প্রায় দগ্ধ শরীরগুলি দেখেছি। এইভাবে অগ্নি সংযোগের ফলে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে; সুতরাং তাঁদের মৃত্যুর জন্য তোমাদের শোক করা উচিত নয়।”

ধৃতরাষ্ট্রের এই মহাপ্রস্থানের কথা শুনে পাণ্ডবেরা গুরুতর শোকার্ত হলেন। অন্তঃপুরস্থিত নারীগণের ও পুরবাসীগণের বিশাল ক্রন্দনধ্বনি উত্থিত হল। ‘ধিক ধিক’ বলে রাজা যুধিষ্ঠির অত্যন্ত দুঃখিত ও ঊর্ধ্ববাহু হয়ে মাতাকে স্মরণ করতে লাগলেন। ভীম প্রভৃতি মাতার গুণ বর্ণনা করে কাঁদতে লাগলেন। অন্তঃপুরের হাহাকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। ধৈর্যগুণে যুধিষ্ঠির অশ্রুজল নিরুদ্ধ করে বলতে লাগলেন, “আমাদের মতো বন্ধু থাকতেও ভীষণ তপস্যাকারী ধৃতরাষ্ট্রের মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক। বাহুবলশালী একশত পুত্রের পিতা ধৃতরাষ্ট্র অনাথের মতো মৃত্যুবরণ করলেন! উত্তম নারীগণ তালবৃন্ত দ্বারা যাঁকে ব্যজন করত, দাবানলে দগ্ধ সেই ধৃতরাষ্ট্রকে এখন গৃধ্রগণ পক্ষদ্বারা ব্যজন করছে। পুর্বে সূতমাগধগণ যাঁকে নিদ্রা থেকে জাগাত, এখন রাজা হয়েও তিনি ভূতলে শায়িত, আর গৃধ্র কাকগণ তাঁকে আকর্ষণ করছে। কিন্তু আমি হতপুত্ৰা গান্ধারীর জন্য শোক করি না। কারণ, তিনি পতিব্রতার নিয়মে থেকে পতিলোকই লাভ করবেন। তবে কুন্তীর জন্য শোক করি। তিনি উন্নতিশীল, অতিবিশাল ও উজ্জ্বল পুত্ৰৈশ্বর্য ত্যাগ করে বনবাসের ইচ্ছা করেছিলেন। আর যেহেতু আমরা মাতার এইরূপ মৃত্যুতেও মৃতপ্রায় হয়ে জীবিত আছি, সেইহেতু আমাদের এই রাজ্য, বল, বিক্রম ও ক্ষত্রিয়ধর্মে ধিক। ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ নারদ, কালের গতি অতি দুর্জ্ঞেয়। যেহেতু মাতা কুন্তী রাজ্য পরিত্যাগ করে বনবাস কামনা করেছিলেন, যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনের জননী হয়েও তিনি অনাথার মতো দগ্ধ হলেন, এ চিন্তায় আমি মোহিত হচ্ছি। অর্জুন খাণ্ডবদাহকালে অগ্নিকে অনর্থক সন্তুষ্ট করেছিলেন। সেই অগ্নি, অপকার স্মরণ না রেখে, এই উপকার করে কৃতঘ্ন হয়েছেন, এই আমার ধারণা। ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করে ভিক্ষার্থী হয়ে তিনি অর্জুনের কাছে এসেছিলেন, সেই ভগবান অগ্নি ভিক্ষাদাতা অর্জুনের মাতাকে দগ্ধ করেছেন, তাই তিনি কৃতঘ্ন। সেই অগ্নিকে ধিক এবং অর্জুনের কাছে সেই প্রতিজ্ঞাকেও ধিক। সে যাই হোক, আর একটি বিষয় আমার কাছে অত্যন্ত কষ্টজনক বলে মনে হচ্ছে। পৃথিবীপতি, তপস্বী ও রাজর্ষি ধৃতরাষ্ট্রের অন্তিমকালে অমন্ত্রপূত অগ্নির সঙ্গে সংযোগ হয়েছে। যিনি চিরকাল ক্ষত্রিয়ধর্মে ও সৎকার্যে নিরত ছিলেন এবং পৃথিবীর শাসক ছিলেন, তাঁর এভাবে মৃত্যু হল কেন?

“হায়! তপোবনে তাঁর মন্ত্রপূত অগ্নি থাকতে, আমার সেই জ্যেষ্ঠতাত বৃথাগ্নি কর্তৃক সংশ্লিষ্ট হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন? আমি মনে করি—কশা ও শিরাব্যাপ্তশরীরা কুন্তী দেবী সেই মহাভয়কালে কাঁপতে থেকে ‘হা বৎস! যুধিষ্ঠির’ এই বলে আমাকে ডাকছিলেন। ‘ভীম আমাকে ভয় থেকে পরিত্রাণ করো’ এই কথা উচ্চ স্বরে বলেছিলেন, এমন সময়ে দাবাগ্নি এসে আমার মাতৃদেবীকে সকল দিক থেকে বেষ্টন করেছিল। সব পুত্রের মধ্যে সহদেবকেই তিনি বেশি ভালবাসতেন। সেই বীর সহদেবও তাঁকে অগ্নি থেকে মুক্ত করতে পারেননি।”

যুধিষ্ঠিরের সেই বিলাপ শুনে ও পাণ্ডবদের রোদনের মধ্যেই নারদ বললেন, “নরনাথ আমি যা শুনেছি, তাতে সেই ধৃতরাষ্ট্র বৃথাগ্নি কর্তৃক দগ্ধ হননি। সুতরাং তাঁর জন্য শোক করা উচিত নয়। কারণ, জ্ঞানী ও বায়ুমাত্রভোজী ধৃতরাষ্ট্র বনে প্রবেশ করার সময়ে যাজকগণ দ্বারা যজ্ঞ করিয়ে সেই অগ্নি পরিত্যাগ করেছিলেন, আমি এ সংবাদ শুনেছি। যাজকেরা সেই প্রজ্বলিত অগ্নি নির্জন বনে নিক্ষেপ করে ইচ্ছানুসারে চলে গিয়েছিলেন। তারপর অগ্নি সেই বনে বৃদ্ধি পেয়েছিল; সুতরাং সেই অগ্নিতেই বন প্রজ্বলিত হয়েছিল, তপস্বীরা আমার কাছে এই কথা বলেছেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র সেই স্বকীয় অগ্নি কর্তৃকই সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন। তিনি পরমগতি লাভ করেছেন, তাঁর জন্য শোক কোরো না। আর তোমার জননী কুন্তীও গুরুশ্রুশ্রূষা করতে থেকে উত্তম সিদ্ধি লাভ করেছেন, এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। রাজশ্রেষ্ঠ, তুমি সকল ভ্রাতার সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁদের তর্পণ প্রভৃতি করতে পারো, এখন তাই করো।”

তারপর পাণ্ডব ধুরন্ধর যুধিষ্ঠির, ভ্রাতৃগণ ও ভার্যাগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজধানী থেকে নির্গত হয়ে গঙ্গায় গমন, ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর উদ্দেশে জলদান (তর্পণ) করলেন এবং সেই অশৌচের কাল নগরের বাইরেই কাটালেন।

*

ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু হল। ব্যাসদেবের কুরূপ দেখে অপরূপ রূপসী অম্বিকা চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন। ব্যাস সত্যবতীকে বলেছিলেন যে, মায়ের দোষে এ পুত্র জন্মান্ধ হবে কিন্তু অযুত হস্তীর বলশালী হবে। হয়েছিলও তাই। কিন্তু কুরুবংশে বিকলাঙ্গ সিংহাসনে বসার অধিকারী হন না। তাই জ্যেষ্ঠ হয়েও ধৃতরাষ্ট্র সিংহাসনে বসতে পারেনি। কনিষ্ঠ পাণ্ডু সিংহাসনের অধিকারী হলেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতার এই ব্যাপারে চিত্তক্ষোভ আছে, পাণ্ডু তা জানতেন। তাই দুই স্ত্রী কুন্তী ও মাদ্রীকে নিয়ে তিনি মৃগয়ায় গেলেন, আর হস্তিনাপুরে ফিরলেন না। ধৃতরাষ্ট্রই সম্রাটের মতো সিংহাসনে আরূঢ় হয়ে রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন।

পুত্র জন্মের ব্যাপারেও ভাগ্য ধৃতরাষ্ট্রের প্রতিকূলতা করল। প্রথমেই জন্ম হল পাণ্ডুর জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠিরের। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুর্যোধন এক বৎসর পরে জন্মগ্রহণ করলেন। নিয়তির এই পরিহাস পিতা ধৃতরাষ্ট্র অথবা পুত্র দুর্যোধন মেনে নিতে পারেননি। দুর্যোধন আবাল্য পাণ্ডবদের ধ্বংস করতে চেয়েছেন—ধৃতরাষ্ট্র নির্বিকার থেকেছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রের মৃত্যু ঘটল। যুধিষ্ঠির সিংহাসনে বসলেন। ধৃতরাষ্ট্রকে যুধিষ্ঠিরের আশ্রয়েই বাস করতে হল। নম্র, শ্রদ্ধাশীল, বিনয়ী যুধিষ্ঠির পরম যত্নে ধৃতরাষ্ট্রকে রেখেছিলেন। এত শ্রদ্ধা ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের কাছ থেকেও পাননি। যুধিষ্ঠিরের আশ্রয়ে ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত প্রসন্ন পরিতৃপ্তিতে কাটিয়েছিলেন। পনেরো বছর যুধিষ্ঠিরের কাছে কাটাবার পর ধৃতরাষ্ট্র বনবাসী হলেন। এরপর তপোবন ছেড়ে সন্ন্যাসীর মতো বনে বনে কঠোর তপস্যা করে কাটালেন। তিন বছর পরে আপন যাজকদের পরিত্যক্ত অগ্নিতে দাবানলে তিনি ভস্মীভূত হলেন। জন্মান্ধ কিন্তু অমিতবীর্য, ঈর্ষাবিষেই তিনি স্নেহান্ধ ছিলেন, তাঁর ঈর্ষার আগুনেই কুরুবংশ ধ্বংস হয়েছিল। তিনি এতখানি শক্তির অধিকারী ছিলেন যে বাহুবদ্ধ অবস্থায় লৌহভীম মূর্তি চুর্ণ করেছিলেন। সেই শক্তিধর, দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে দেখেও সরে যেতে পারেননি, সে শক্তিও অবশিষ্ট ছিল না। কালাগ্নি জন্মান্ধ, ঈর্ষান্ধ, স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে অতি অসহায় অবস্থায় গ্রহণ করল।

গান্ধারীর মৃত্যু পতিব্রতা নারীর মৃত্যু। স্বামীর সঙ্গে তিনিও তপস্যা করছিলেন। অগ্নির আক্রমণ বোঝার অবস্থা তাঁর ছিল না। তিনি ছিলেন চক্ষু বস্ত্রাবৃতা। স্বামী যে অগ্নিতে দগ্ধ হয়েছিলেন, সেই অগ্নিতেই দগ্ধ হয়েছিলেন পতিব্রতা গান্ধারী।

কুন্তী। সম্রাজ্ঞী কুন্তী! যাঁর পুত্রেরা ভারতবর্ষের সিংহাসনে আরূঢ়। কুন্তীর জীবনে জল আর আগুনের সম্পর্ক বড় বিচিত্র। অগ্নি (সূর্যদেবই আকাশে অগ্নি) সূর্যরূপে তাঁকে দিয়েছিলেন প্রথম সন্তান। সন্তানের পিতার আদেশেই তাকে জলে বিসর্জন দিতে হয়েছিল কুন্তীকে। আর জল বা বরুণদেব! তাঁর অধিপতি স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। তিনি মেঘবাহন। কুন্তীর গর্ভে তিনি জন্ম দিয়েছিলেন অর্জুনের। কাজেই কুন্তীর জীবনে জল আর আগুনের সম্পর্ক ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর সংসারে নিজস্ব বলতে কেউ ছিল না। কুন্তীর ছিল। বিধবা হলেও পুত্র, পুত্রবধূ নিয়ে তাঁর ভরা সংসার ছিল। তাই তাঁর বনবাস পঞ্চপাণ্ডব মেনে নিতে পারেননি। যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন যে, যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয়ের পুত্র, নিজস্ব রাজ্যের অধিকারী। তাই শত্রুদের পরাজিত করে নিজ রাজ্য তাঁদের উদ্ধার করতেই হবে। বিধবা হলেও কুন্তীর ব্যক্তিত্ব, দৃঢ়তা ও মনস্বিতা ছিল অত্যন্ত প্রখর। পুত্রদের বিজয়ী দেখা তাঁর দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে, তাই তিনি পুত্রদের উত্তেজিত করেছেন। পুত্রেরা বিজয়ী হয়ে নিজের স্থান ফিরে পেলে তাঁর সেই দায়িত্ব শেষ হয়েছিল। তখন বধূ হিসাবে তাঁর দায়িত্ব ছিল ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী—দুই অন্ধের সেবা করা। তিনি সে দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হয়েছিলেন।

অগ্নি যাঁর কাছে সবথেকে বেশি সাহায্য পেয়েছিলেন, অগ্নিদেব সেই অর্জুনের মাতাকে দগ্ধ করলে যুধিষ্ঠির ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু শল্যপর্ব শেষ হবার পর কৃষ্ণ রথ থেকে নেমে যেতেই অগ্নিপ্রদত্ত দেবদত্ত রথ ভস্মীভূত হয়েছিল। অগ্নি পার্থিব কার্যের জন্য অর্জুনকে যা যা ঋণ দিয়েছিলেন, তা একটি একটি করে ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এ দুয়ের সম্পর্ক যুধিষ্ঠির পরে বুঝেছিলেন, অর্জুন বোঝেননি।

কর্ণ দ্রৌপদীকে রাজসভায় ‘বেশ্যা’ বলে গালি দিয়েছিলেন, সে বিচারে কর্ণও ‘বেশ্যাপুত্র’। কারণ তাঁর জননীও পাঁচজন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছিলেন। এ বিচারে মুনি ঋষিরা তাঁদের কর্ণের দৃষ্টিতে দেখেননি, তাই তাঁরা গোটা ভারতবর্ষে প্রাতঃস্মরণীয়া পঞ্চকন্যার অন্তর্গত হয়ে আছেন।

মহাভারত-চর্চাকারেরা কেউ কর্ণকে দুর্বাসার সন্তান চিহ্নিত করতে চেয়েছেন, কেউ বা বিদুরকে যুধিষ্ঠিরের পিতা ঘোষণা করেছেন। এঁরা ভুলে গিয়েছেন, ধ্যানযোগে দুর্বাসা দেখেছিলেন, মানবের ঔরসে কুন্তীর সন্তান হবে না, তাই অভিকর্ষণ মন্ত্র দিয়েছিলেন। দুর্বাসা অথবা বিদুর—উভয়েই মানব ছিলেন, তাই কুন্তীর সন্তানের পিতা হওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

৯৭
যদুবংশ ধ্বংস

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ছত্রিশ বছর পরে একদিন তপস্বী বিশ্বামিত্র, কণ্ব ও নারদ দ্বারকানগর পরিদর্শন করার জন্য এসেছিলেন। তখন সারণ প্রভৃতি বীরগণ তাঁদের দর্শন করলেন। তাঁরা কৃষ্ণের অপূর্ব রূপবান পুত্র শাম্বকে স্ত্রীলোকের মতো সাজিয়ে, তাঁকে অগ্রবর্তী করে, বিশ্বামিত্র প্রভৃতির কাছে দৈবদণ্ড নিপীড়িত হয়ে বললেন, “ঋষিগণ, এটি পুত্রাভিলাষী অমিততেজা বভ্রুর স্ত্রী; অতএব আপনারা ভালভাবে ধ্যানে জেনে বলুন দেখি, এ কী সন্তান প্রসব করবে?”

সারণ প্রভৃতি এই প্রশ্ন করলে প্রতারণার কারণে অত্যন্ত অপমানিত হয়ে ঋষিরা বললেন, “কৃষ্ণের পুত্র এই শাম্ব যদুবংশ ধ্বংসের জন্য ভয়ংকর লৌহময় একটি মুসল প্রসব করবে। যে মুসল দ্বারা অতিদুর্বৃত্ত ও নৃশংস তোমরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে রাম ও কৃষ্ণ ছাড়া সমগ্র যদুবংশকে ধ্বংস করবে। তারপর শ্রীমান বলরাম দেহত্যাগ করে সমুদ্রে প্রবেশ করবেন এবং জর নামক একটি ব্যাধ ভূতলে শায়িত মহাত্মা কৃষ্ণকে বাণ দ্বারা বিদীর্ণ করবে।” ক্রুদ্ধ মুনিরা এই কথা বলে যেমন এসেছিলেন, তেমনই চলে গেলেন। এই বৃত্তান্ত শ্রবণ করে মুনিগণের প্রভাবাভিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান কৃষ্ণ তখন সেই যদুবংশীয়দের বললেন, “এইভাবেই যদুবংশের ধ্বংস হবে।” এই বলে কৃষ্ণ নগরমধ্যে প্রবেশ করলেন।

কৃষ্ণ জগদীশ্বর হয়েও দৈব নিবন্ধন সেই শাপের অন্যথা করতে ইচ্ছা করেননি। সুতরাং সেই রাত্রি প্রভাত হলেই সেই মুনির শাপবশত শাম্ব একটি মুসল প্রসব করলেন। এই মুসল বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশের পুরুষগণকে ভস্ম করেছিল। শাম্ব বৃষ্ণিবংশ ও অন্ধকবংশ বিনাশের জন্য যমদূতের তুল্য মহাভয়ংকর সেই মুসল প্রসব করলেন। তখনই সেখানকার লোকেরা গিয়ে রাজা উগ্রসেনের কাছে সেই বৃত্তান্ত জানাল। তিনিও অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ভৃত্যগণ দ্বারা পাথরে ঘষে ঘষে সেই লৌহমুসলটাকে চূর্ণ করে ফেললেন এবং বহু লোককে দিয়ে সেই চূর্ণগুলি নিয়ে সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করলেন। পরে মহাত্মা আহুক, কৃষ্ণ, রাম, বভ্রুর আদেশক্রমে নগরে ঘোষণা করা হল, “আজ থেকে সমস্ত বৃষ্ণিবংশ ও অন্ধকবংশের নগরবাসী সকল লোক সুরাপান করতে পারবে না। যে লোক আমাদের অজ্ঞাতভাবে কোথাও সুরাপান করবে, সেই লোক নিজে সুরাপান করেও বান্ধবগণের সঙ্গে জীবিত অবস্থাতেই শূলে আরোহণ করবে।” তারপর নগরবাসী সমস্ত লোক সেই মহাত্মা রাজার শাসন জেনে তাঁর ভয়ে সুরাপান না করারই নিয়ম করল।

অন্ধক ও বৃষ্ণিগণ বিপদ নিবৃত্তির জন্য এইভাবে চেষ্টা করতে থাকলেও, কাল সর্বদাই তাদের সকলের গৃহে বিরাজ করতে থাকল। ভীষণ, বিকট, মুণ্ডিতমস্তক ও কৃষ্ণপিঙ্গলবর্ণ একটি পুরুষ বৃষ্ণিগণের গৃহ পরিবেষ্টন করে বেড়াত। কখনও তাঁকে দেখা যেত না, আবার কখনও দেখা গেলেও মহাধনুর্ধর বৃষ্ণিবংশীয়েরা শত শত বাণক্ষেপেও তাঁকে বিদ্ধ করতে পারত না। প্রতিদিন ভীষণ ও লোমহর্ষণ মহাবেগশালী বহুতর বায়ু এসে বৃষ্ণি ও অন্ধকদের গৃহে আবির্ভূত হতে লাগল। রাজপথে বিশাল বিশাল মূষিক বিচরণ করতে লাগল। সেগুলি দংশন করে মণিরত্ন সকল বিকৃত করতে লাগল। রাত্রিতে সেগুলি ঘুমন্ত মানুষের কেশ ও নখ ভক্ষণ করতে লাগল। শারিকাপক্ষিণীরা বৃষ্ণিগণের গৃহে ‘চীচীকুচী’ শব্দ করতে থাকল। দিন বা রাত কোনও সময়েই সেই শব্দ থামত না। সারস পাখিরা পেঁচার ডাক অনুসরণ করতে লাগল। ছাগেরা শৃগালের ডাক অনুকরণ করতে লাগল। শ্বেতবর্ণ ও রক্তচরণ কপোত পক্ষীগণ কালপ্রেরিত হয়ে তখন বৃষ্ণিগণ ও অন্ধকগণের গৃহে বিচরণ করতে লাগল। গোরুর গর্ভে গর্দভ, অশ্বতরীর গর্ভে হস্তীশাবক, কুক্কুরীর গর্ভে বিড়াল এবং বেজির গর্ভে মূষিক জন্ম নিতে লাগল।

সেই সময়ে বৃষ্ণিবংশীয়েরা পাপকার্য করেও লজ্জিত হত না এবং ব্রাহ্মণগণ, পিতৃগণ, দেবগণের উপরেও বিদ্বেষ করতে লাগল। তারা গুরুজনদের অবজ্ঞা করতে লাগল। বলরাম বা কৃষ্ণের আচরণে কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না কিন্তু বৃষ্ণিবংশীয় অন্য পুরুষেরা বিপথগামী হলেন। ভার্যারা ভর্তাদের এবং ভর্তারা ভার্যাদের অতিক্রম করতে ও লঙ্ঘন করতে থাকলেন। অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে নীলবর্ণ, রক্তবর্ণ ও গৈরিকবর্ণ শিখা বিস্তার করে বামাবর্তে পৃথক পৃথক ভাবে ঘুরতে লাগল। পুরুষেরা প্রত্যহ সেই দ্বারকানগরীতে উদয় ও অস্তকালে সূর্যকে কবন্ধ পরিবেষ্টিত অবস্থায় দেখতে লাগল। পরিচ্ছন্ন পাকশালায় অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন অন্নব্যঞ্জন ভোজন করার সময় মানুষ তাতে হাজার হাজার কৃমি দেখতে লাগল। পুণ্যাহ বচনের সময়ে কিংবা মহাত্মাদের জপের কালে বহুলোকের পদশব্দ শুনতে পেত কিন্তু কাউকেই কখনও দেখা যেত না। সকলে দেখত যে, আকাশে গ্রহগণ বারবার নক্ষত্রকে পরস্পর আঘাত করছে; কিন্তু মানুষ নিজের জন্মনক্ষত্রকে কোনও প্রকারেই দেখতে পেত না। বৃষ্ণি ও অন্ধকগণের গৃহে পাঞ্চজন্য শঙ্খধ্বনি হলেই সকলদিকে ভীষণ শব্দকারী গদর্ভগণ ডাকতে থাকত। ত্রয়োদশী তিথি অমাবস্যা তিথি হয়েছে—কালের এরূপ ব্যতিক্রম দেখে এবং পূর্ববর্তী উৎপাতসকল দর্শন করে, কৃষ্ণ এই কথা বললেন—

চতুর্দশী পঞ্চদশী কৃতেয়ং রাহুণা পুনঃ।

প্রাপ্তে বৈ ভারতে যুদ্ধে প্রাপ্তা চাদ্য ক্ষয়ায় নঃ॥ মুসল : ২ : ১৯॥

“কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধ উপস্থিত হলে রাহু এই চতুর্দশী তিথিকে পঞ্চদশী করেছিল অর্থাৎ চতুর্দশী তিথিতে চন্দ্র ও সূর্যের গ্রহণ করেছিল। আজ আবার আমাদের বিনাশের জন্য সেই রীতি উপস্থিত হয়েছে।”

কেশীহন্তা কৃষ্ণ, সেই কালের অবস্থা ভেবে বিশেষ বিচার বিবেচনা করে সেই ছত্রিশ বর্ষ উপস্থিত হয়েছে বলে মনে করলেন। “পুত্রশোকসন্তপ্তা, হতবান্ধবা ও দুরবস্থাপীড়িতা গান্ধারী যা বলেছিলেন, সেই কাল উপস্থিত হয়েছে। এবং পূর্বে কৌরবসৈন্য ও পাণ্ডবসৈন্য ব্যূহরূপে সন্নিবেশিত হলে, অতি দারুণ উৎপাত দর্শন করে যুধিষ্ঠির যা বলেছিলেন, সেই কাল উপস্থিত হয়েছে।” এই কথা বলে শত্রুদমন কৃষ্ণ গান্ধারীর বাক্য সত্য করার ইচ্ছায় তখন সকলের তীর্থযাত্রার আদেশ করলেন। কৃষ্ণের আদেশক্রমে ভৃত্যেরা ঘোষণা করল, “হে পুরুষশ্রেষ্ঠগণ, আপনাদের সমুদ্রতীরে তীর্থযাত্রা করতে হবে।”

শ্বেতদশনা ও কৃষ্ণবর্ণা একটি স্ত্রীলোক রাত্রিতে প্রবেশ করে হাসতে হাসতে স্ত্রীলোকদের হাতের শাঁখা চুরি করতে থেকে দ্বারকানগরীর সর্বত্র বিচরণ করে—এইরূপ স্বপ্ন সকলে দেখতে লাগল। বহু লোক স্বপ্ন দেখত যে, ভয়ংকর গৃধ্রপক্ষীরা অগ্নিহোত্ৰগৃহে, বাসস্থানে ও বাসগৃহে বৃষ্ণিগণ ও অন্ধকগণকে ভক্ষণ করছে। অতিভয়ংকর রাক্ষসেরা অলংকার, ছত্র, ধ্বজ ও কবচ হরণ করছে—স্বপ্নে বহু লোক এই ঘটনা দেখত। বজ্রের মতো দৃঢ়নাভিযুক্ত ও লৌহময় কৃষ্ণের সেই সুদর্শনচক্র বৃষ্ণিগণের সামনেই তখন আকাশে উঠে গেল। দারুকের সামনে দিয়েই অশ্বগুলি সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল কৃষ্ণের সেই রথ হরণ করল এবং মনের মতো বেগগামী সেই চারটি অশ্ব সমুদ্রের উপর দিয়ে চলে গেল। বলরাম ও কৃষ্ণ চিরকাল যে তালধ্বজ ও গরুড়ধ্বজের আদর করতেন, স্বর্গীয় অপ্সরারা সেই ধ্বজ দুটিকে উপরের দিকে হরণ করে নিয়ে গেল এবং দৈববাণী হল, “তোমরা তীর্থযাত্রা করো।”

কৃষ্ণের দর্শন, স্পর্শন ও স্নেহের গুণে যারা বিশেষ ভোগী ছিলেন, সেই যদুবংশীয়েরা স্বর্গে যাবার জন্য বিমানে আরোহণ করে আকাশে উঠে গেলেন। তারপর সেই নরশ্রেষ্ঠ বৃষ্ণিবংশীয়েরা ও অন্ধকবংশীয়েরা ভার্যাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে গমন করলেন। মনোহর বেশধারী সেই যাদবেরা কাল প্রেরিত হয়ে প্রচুর নানাবিধ পানীয় মাংস ও মদ্য সংগ্রহ করলেন এবং মদ্যাসক্ত হয়ে, কান্তিযুক্ত ও তীক্ষ্ণতেজা সেই যাদবগণ হস্তী, অশ্ব ও রথে নগর থেকে বাইরে নির্গত হলেন।

ক্রমে প্রচুর খাদ্য ও পেয় সংগ্রহ করে, ভার্যাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সেই যাদবগণ তখনই প্রভাসতীর্থে গিয়ে পূর্বনির্দিষ্ট স্থানে এবং পূর্বনির্দিষ্ট বাসগৃহে অবস্থান করতে লাগলেন। তখন যোগশাস্ত্রজ্ঞ ও কার্যনিপুণ উদ্ধব যাদবগণকে সমুদ্রতীরে নিবিষ্ট শুনে তাঁদের অনুমতি নিয়ে সে স্থান থেকে প্রস্থান করলেন। উদ্ধব কৃতাঞ্জলি হয়ে অনুমতি চাইলে ‘বৃষ্ণিবংশের ধ্বংস হবে’ একথা জেনে কৃষ্ণ তাঁকে বারণ করলেন না। উদ্ধব চলে গেলেন।

মহাত্মা যাদবেরা ব্রাহ্মণগণের জন্য যে অন্ন পাক করাচ্ছিলেন, তাতে সুরার গন্ধ ছিল বলে বানরগণকে প্রদান করলেন। তারপর প্রভাসতীর্থে মহাতেজা যাদবগণের তুমুল মদ্যপান চলতে লাগল। তখন শত শত তুর্যধ্বনি হতে থাকল এবং নট ও নর্তকেরা নৃত্যগীত করতে লাগল। কৃতবর্মার সঙ্গে বলরাম, সাত্যকি, গদ ও বভ্রু—এঁরা কৃষ্ণের কাছে বসে মদ্যপান করতে লাগলেন। তখন সেই পানসভামধ্যে মদমত্ত সাত্যকি উপহাস ও অবজ্ঞা করে কৃতবর্মাকে বললেন, “কোন ক্ষত্রিয় অন্য কর্তৃক হন্যমান হয়েও মৃতগণের মতো নিদ্রিত ব্যক্তিগণকে বধ করে? অতএব হার্দিক্য। তুই যা করেছিস, যাদবেরা তা সহ্য করবেন না।” সাত্যকি এই কথা বললে, রথীশ্রেষ্ঠ প্রদ্যুম্ন কৃতবর্মাকে অবজ্ঞা করে সেই বাক্যের প্রশংসা করলেন।

তখন কৃতবর্মা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বাম হস্ত দ্বারা অবজ্ঞার সঙ্গে সাত্যকিকে নির্দেশ করেই যেন তাঁকে বললেন, “অৰ্জুন বাহুছেদন করলে, ভূরিশ্রবা সেই রণস্থলে প্রায়োপবেশনে বসেছিলেন। তখন তুই বীর হয়ে কী প্রকারে অতি নৃশংসভাবে তাঁকে বধ করেছিলি? অর্জুন শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখে নিরুৎসাহ ও ন্যস্ত অস্ত্র ভীষ্মকে যে বধ করেছিল, তা গুরুতর কাপুরুষতাই হয়েছে। দ্রোণাচার্য বৃদ্ধ, ব্রাহ্মণ, গুরু, রণক্লান্ত, শোকার্ত ও প্রায়োপবিষ্ট ছিলেন; এই অবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন যে তাঁকে বধ করেছিল, তা অত্যন্ত নৃশংসতা হয়েছে। মহারথ কর্ণ ভূতলে প্রবিষ্ট নিজের রথচক্র উত্তোলন করছিলেন, সেই সময়ে অর্জুন তাঁকে যে বধ করেছিল, সে কার্য বীরজনগর্হিত হয়েছে। বীরাভিমানী ভীম ঊরুদেশে গদাঘাত করে দুর্যোধনকে যে বধ করেছে, বীরেরা সেই কার্যের অত্যন্ত নিন্দা করেন।”

কৃতবর্মার এই প্রকার বাক্য শুনে বিপক্ষবীরহন্তা কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে ক্রোধসূচক বক্রদৃষ্টিতে তাঁকে দর্শন করলেন। সত্রাজিৎ রাজার সেই যে স্যমন্তক মণি ছিল, সাত্যকি কৃষ্ণকে তখন সেই উপাখ্যান শোনালেন। তা শুনে তখন সত্যভামা ক্রুদ্ধ হয়ে রোদন করতে করতে কৃষ্ণকে ক্রুদ্ধ করবার জন্য তাঁর ক্রোড়ের উপর পতিত হলেন। তারপর সাত্যকি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি সত্যদ্বারা এইরূপ শপথ করছি যে, আমি যদি সেই দুষ্কার্যের প্রতিকার না করি, তা হলে আমি দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডীর পথে যাব। সুমধ্যমে, দুরাত্মা ও পাপবুদ্ধি কৃতবর্মা অশ্বত্থামাকে সহায় করে শিবিরে নিদ্রিত অবস্থায় যাদের বধ করেছিল, তাদেরই তুল্য এই দুরাত্মা কৃতবর্মার আয়ু ও যশ আজ সমাপ্ত হয়েছে।” এই কথা বলে সাত্যকি দ্রুত গিয়ে কৃষ্ণের কাছেই তরবারি দ্বারা ক্রোধবশত কৃতবর্মার শিরশ্ছেদ করলেন। সাত্যকি সেইভাবে চার দিকেই অন্যান্যদেরও বধ করতে থাকলে, কৃষ্ণ সাত্যকিকে বারণ করার জন্য ধাবিত হলেন। তারপর ভোজ ও অন্ধকেরা কালপ্রেরিত হয়ে একযোগে সাত্যকিকে পরিবেষ্টন করলেন। তাঁরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সাত্যকির উপরে পতিত হচ্ছেন দেখেও মহাতেজা কৃষ্ণ কালের পরিবর্তন জেনে ক্রুদ্ধ হলেন না। তখন মদ্যপানের কারণে প্রমত্ত সেই ভোজবংশীয়েরা কালপ্রেরিত হয়ে উচ্ছিষ্ট পানপাত্র দ্বারা সাত্যকিকে আঘাত করতে লাগলেন। তাই দেখে, প্রদ্যুম্ন ক্রুদ্ধ হয়ে সাত্যকিকে মুক্ত করার জন্য তাঁর দিকে আসতে লাগলেন। প্রদ্যুম্ন ভোজবংশীয়দের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলে, সাত্যকি অন্ধকবংশীয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। এইভাবে বাহুবলশালী সেই বীর প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকি যুদ্ধ করতে করতে বিপক্ষ বহুতর বলে কৃষ্ণের সম্মুখেই দু’জনেই নিহত হলেন।

সাত্যকি ও পুত্র প্রদ্যুম্নকে নিহত দেখে তখন যদুনন্দন কৃষ্ণ ক্রোধবশত একমুষ্টি শর (তৃণ বিশেষ) গ্রহণ করলেন। মুনি শাপজাত লৌহময় সেই ভয়ংকর মুসলই বজ্রতুল্য সেই শরবন হয়েছিল। যে যে সামনে আসতে লাগল, কৃষ্ণ সেই শরমুষ্টি দ্বারা তাকেই বধ করতে লাগলেন। তারপর অন্ধক, ভোজ, শিনি ও বৃষ্ণিবংশীয়েরা কালপ্রেরিত হয়ে সেই মুসলচূর্ণ থেকে উৎপন্ন শরদ্বারা যুদ্ধে পরস্পরকে বধ করতে লাগল। তাদের মধ্যে যে-কোনও ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হয়ে শরগ্রহণ করতে লাগল, সেই শরই তখন বজ্রের মতো দেখা দিতে লাগল। তখন সেই শররূপ তৃণও মুসল হয়ে গিয়েছে বলে দৃষ্টিগোচর হতে লাগল। ব্রহ্মশাপের ফলেই এই ঘটনা ঘটল। পিতা পুত্রকে বধ করল এবং পুত্র পিতাকে বধ করল। এইভাবে মদমত্ত যাদবেরা পরস্পর যুদ্ধ করতে থেকে একজন অন্য জনের উপরে পড়তে লাগল। পতঙ্গ যেমন আগুনে পতিত হয়, সেইরকম সেই কুকুরবংশীয় ও অন্ধবংশীয়েরা পরস্পরের উপর পড়তে লাগল; কিন্তু বধ্যমান কোনও ব্যক্তিরই পলায়নের বুদ্ধি হল না।

তখন মহাবাহু কৃষ্ণ সেই মুসলচূর্ণসম্ভূত শরমুষ্টি ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং কালের পরিবর্তন দেখতে লাগলেন। তারপর শাম্ব, চারুদেষ্ণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধকে নিহত দেখে কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হলেন। ক্রমে গদকে শায়িত দেখে শঙ্খচক্রগদাধারী কৃষ্ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে অন্য সকলকে নিঃশেষ করলেন। তখন কৃষ্ণসারথি দারুক ও বভ্রু কৃষ্ণকে বললেন, “ভগবন্ আপনি বহু লোককে বধ করেছেন; এখন বলরামের খোঁজ করুন। চলুন, আমরা সেখানে যাই।” তখন কৃষ্ণ, বভ্রু ও দারুক দ্রুতবেগে বলরামের কাছে গমন করলেন। তাঁরা দেখলেন, মহাবীর বলরাম নির্জন স্থানে একটি বৃক্ষমূলে বসে চিন্তা করছেন। কৃষ্ণ বলরামের কাছে গিয়ে দারুককে আদেশ করলেন, “দারুক তুমি কৌরবগণের কাছে গিয়ে অর্জুনের কাছে যাদবদের মহাবিনাশ সমস্ত বলো। অর্জুন সত্বর এখানে আসুন।”

কৃষ্ণকে ছেড়ে যেতে দারুকের ইচ্ছা ছিল না, তবুও তিনি রথে উঠে আদেশ পালন করলেন। দারুক চলে গেলে কৃষ্ণ কাছে বভ্রুকে দেখে বললেন, “বভ্রু তুমি দ্রুত দ্বারকায় গিয়ে স্ত্রীলোকদের রক্ষা করো। ধনলোভে দস্যুরা যেন স্ত্রীলোকদের বিনাশ না করে।” বভ্রু একাকী দ্রুত গমন করতে থাকলে, কৃষ্ণের চোখের সামনেই ব্রহ্মশাপবশত একটি ব্যাধের লৌহমুদ্‌গর সংলগ্ন সেই মুসলজাত তৃণ নিক্ষিপ্ত হয়ে বভ্রুকে বধ করল। বভ্রুকে নিহত দেখে কৃষ্ণ বলরামকে বললেন, “আর্য রাম এইখানেই আপনি আমার জন্য প্রতীক্ষা করুন।” বলে কৃষ্ণ দ্বারকায় প্রবেশ করে পিতা বসুদেবকে প্রণাম করলেন এবং বললেন, “যদুবংশ ধ্বংস হয়েছে। আমি অর্জুনকে সংবাদ পাঠিয়েছি। অর্জুন এসে দ্বারকার স্ত্রীলোকদের হস্তিনাপুর নিয়ে যাবেন। আর্য রাম আমার জন্য প্রতীক্ষা করছেন। আমি তাঁর সঙ্গে বনে গিয়ে তপস্যা করব।” এই বলে বসুদেবের চরণে প্রণাম করে কৃষ্ণ উঠে দ্রুতবেগে চলে গেলেন।

*

গান্ধারীর অভিশাপ ফলল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ছত্রিশ বছর পরে, যেমনভাবে গান্ধারী বলেছিলেন ঠিক তেমনভাবে। কৃষ্ণ-বলরামের উপস্থিতিতেই।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর কৃষ্ণ বলেছিলেন “দুই পক্ষ মিলিয়ে দশজন জীবিত আছেন। কৌরবপক্ষে তিনজন, কৃপাচার্য, অশ্বথামা ও কৃতবর্মা, আর পাণ্ডবপক্ষে সাতজন, পঞ্চপাণ্ডব ভ্রাতা আর সাত্যকি ও আমি।” পরীক্ষিতের উপর ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রয়োগ করলে কৃষ্ণের অভিশাপে অশ্বত্থামা পূতিগন্ধময় নির্জন স্থানে নির্বাসিত হলেন। যদুবংশ ধ্বংসে নিহত হলেন সাত্যকি ও কৃতবর্মা। রইল বাকি সাত। কৌরবপক্ষে কৃপাচার্য, আর পাণ্ডবপক্ষে পঞ্চপাণ্ডব আর কৃষ্ণ। সমস্ত পৃথিবীতে সাতজন মাত্র বীর অবশিষ্ট রইলেন। ব্যাসদেব কী অদ্ভুতভাবে তাঁর কাহিনির উপসংহারে উপস্থিত হচ্ছেন।

যদুবংশ ধ্বংস যেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি। গান্ধারী লৌহপিণ্ড প্রসব করেছিলেন। ব্যাসদেব সেগুলি শত ঘৃতপূর্ণ কলসিতে রেখে পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটালেন ঈর্ষা, ক্রোধ আর ঘৃণার। কোনওটি কম, কোনওটি বেশি। মুনিদের প্রতারণা করতে গিয়ে কৃষ্ণপুত্র শাম্ব জন্ম দিলেন এক লৌহ মুসলপিণ্ড। রাজা বৃত্তান্ত শুনে সেই পিণ্ড পিষে পিষে ভস্মে পরিণত করে সমুদ্রের জলে ফেলে দিলেন, যাতে কিছুতেই তা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে না পারে। তবুও সমুদ্রের তীরে সেই ঈষিকা-বন সৃষ্টি হল। আর, তীর্থযাত্রা করতে গিয়ে ভোজ, অন্ধক আর বৃষ্ণিবংশীয়েরা সেই স্থানে এসেই উপস্থিত হলেন।

কৃষ্ণ বলরাম জীবিত থাকতেই রাজাজ্ঞা, কৃষ্ণের আদেশ অমান্য করে গোটা যদুবংশ মদ্যপানে প্রমত্ত হয়ে উঠল। ব্যভিচারে মত্ত হল তারা। সেই প্রমত্ত অবস্থাতেই সাত্যকি আর কৃতবর্মার কলহ শুরু হল। সুপ্তিমগ্ন দ্রৌপদীর পুত্রদের, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, যুধামন্যু, উত্তমৌজাকে হত্যার জন্য সাত্যকি ধিক্কার দিলেন কৃতবর্মাকে। কৃতবর্মা ভূরিশ্রবার ছিন্নবাহু প্রায়োপবিষ্ট অবস্থায় মুণ্ডচ্ছেদের জন্য সাত্যকিকে চরম নিন্দা করলেন। বললেন ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ সকলকে নির্বিচারে অন্যায় যুদ্ধে বধ করেছেন পাণ্ডবেরা। দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করে সমস্ত পৃথিবীর কাছে নিন্দিত হয়েছেন। কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন সাত্যকিকে সমর্থন করতে এগিয়ে গেলেন। কৃষ্ণ এতক্ষণ নির্বিকারভাবে কালের পরিবর্তন দেখছিলেন। ক্রুদ্ধ সাত্যকি কৃষ্ণকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, কৃষ্ণমহিষী সত্যভামার পিতা সত্রাজিতের মৃত্যুর কাহিনি। কৃতবর্মা ও অক্রূরের প্ররোচনায় শতধন্বা সত্রাজিৎকে বধ করে তাঁর স্যমন্তক মণি ছিনিয়ে নেন। পিতৃ-বধের কাহিনি শুনে সত্যভামা কৃষ্ণের কোলের উপরে পড়ে কাঁদতে থাকেন। কৃষ্ণের সম্মুখেই সাত্যকি খড়্গ দিয়ে কৃতবর্মার মস্তক ছেদন করলেন। তখন ভোজ ও অন্ধকগণ পানপাত্র নিয়ে সাত্যকি ও কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্নকে আঘাত করতে থাকল। মহাবীর সাত্যকি ও প্রদ্যুম্ন—আসমুদ্র হিমাচল যাঁদের বীর্যের খ্যাতি ছিল—তাঁরা সেই পানপাত্রের আঘাতে নিহত হলেন। যাদবেরা নির্বিচারে পরস্পরকে বধ করতে লাগল। কৃষ্ণ এতক্ষণ নির্বাক দর্শক ছিলেন। কনিষ্ঠভ্রাতা গদকে নিহত দেখে কৃষ্ণ একমুষ্টি এরকা নিলেন, তা বজ্রতুল্য লৌহমুসলে পরিণত হল। সেই মুসলের আঘাতে তিনি সম্মুখস্থ সকলকে বধ করতে লাগলেন। কাউকেই অব্যাহতি দিলেন না। সেখানকার সমস্ত এরকাই লৌহমুসলে পরিণত হল। সম্পর্ক ভুলে যাদবেরাও পরস্পরকে হত্যা করতে থাকলেন। দারুক ও বভ্রু ব্যতীত সমস্ত যাদব ধ্বংস হল। অর্জুনকে সংবাদ দেবার জন্য কৃষ্ণ দারুককে হস্তিনাপুর পাঠালেন। কৃষ্ণের আদেশানুসারে বভ্রু অন্তঃপুরে স্ত্রীলোকদের সংবাদ দিতে গিয়ে, এক ব্যাধ-নিক্ষিপ্ত মুসলে নিহত হলেন।

মুসলপর্ব মহাভারতের সংক্ষিপ্ততম পর্বের একটি। কিন্তু সমস্ত পর্বটি জুড়ে আছে ব্যাসদেবের অসাধারণ দিব্য বর্ণনা ক্ষমতা। দ্বারকার দুর্লক্ষণের বর্ণনা যেভাবে ব্যাস দিয়েছেন, তা যে-কোনও পাঠকের চিত্তে ভীতির উদ্ভব ঘটাবে। যাদবদের সামনে দিয়ে যেভাবে কৃষ্ণের রথ, অশ্বসমূহ এবং সুদর্শন চক্র সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে চলে গেল, তখনই বোঝা গেল ভয়ংকর বিপর্যয় আসন্ন। কৃষ্ণপিঙ্গল বর্ণ একটি ব্যক্তি গভীর রাত্রে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তাকে দেখা গেল, কিন্তু ধরা গেল না। একটি স্ত্রীলোক যাদবরমণীদের মঙ্গলসূত্র ও শাঁখা অপহরণ করতে লাগল। প্রাণীরা ভিন্ন প্রাণীর জন্ম দিতে লাগল। সুপরিষ্কৃত অন্নের মধ্যে সহস্র সহস্র কৃমি দেখা যেতে লাগল। এ বর্ণনা পড়া যায় না। পড়তে পড়তে পাঠক চোখ বন্ধ করে ফেলতে বাধ্য হন।

এই একই দুর্লক্ষণ হস্তিনাপুরে বসে যুধিষ্ঠিরও দেখতে পেলেন। অমঙ্গলাশঙ্কায় তাঁর হৃদয় কেঁপে উঠল। তিনি বুঝলেন, কালের পরিবর্তন ঘটছে। পৃথিবীর রূপ পরিবর্তিত হচ্ছে। কৃষ্ণ আর পৃথিবীতে থাকবেন না।

দ্বারকায় কৃষ্ণের শেষ আচরণগুলিও পাঠকের কাছে এ সত্য তুলে ধরে যে, কৃষ্ণ চলে যাচ্ছেন। পিতাকে প্রণাম করে, অন্তঃপুরের রমণীদের জানিয়ে কৃষ্ণ বলরামের উদ্দেশে দ্রুত চলে যান। কৃষ্ণ মহাভারতের সর্বাপেক্ষা রহস্যময় চরিত্র। মহাভারতের অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ চরিত্র কৃষ্ণকে ঈশ্বর বলে মনে করতেন। ব্যাসদেবও তাঁকে ঈশ্বর হিসাবেই গ্রহণ করেছেন। মহাভারতের পরিসরে কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব বাদ দেওয়া যায় না। যুদ্ধে অনিচ্ছুক অর্জুনকে বিশ্বরূপ দর্শন করানো ও গীতাকথন, উদ্‌যোগ পর্বে হস্তিনানগরে দূত হিসাবে উপস্থিত কৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন করানো, জয়দ্রথ-বধের পূর্বে মেঘ দ্বারা সূর্যকে আবৃত করা, উত্তরার মৃত দ্বিখণ্ডিত গর্ভস্থ শিশুকে পুনরুজ্জীবিত করানো—এগুলি কৃষ্ণের অলৌকিক কার্যাবলির সামান্য কয়েকটির উল্লেখমাত্র। মহাভারতে কৃষ্ণের অলৌকিকত্ব প্রতিষ্ঠা ব্যাসদেবের উদ্দেশ্য ছিল না। ভাগবতে আছে কংসের বিনাশ ও যুধিষ্ঠিরের সুকৃতি প্রচারের জন্যই নারায়ণ কৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। মহাভারতের কৃষ্ণ বীতরাগ ভয়ক্রোধ স্থিতপ্রজ্ঞ লোকহিতে রত। কৃষ্ণ সমস্ত শাস্ত্র জানেন, ভারতবর্ষের সমস্ত বীরের জন্ম-মৃত্যু রহস্য তাঁর জানা আছে। অসাধারণ তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। সমস্ত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধটির নিয়ন্তা তিনি। অর্জুনকে তিনি প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় বোধ করেন। কিন্তু শল্যবধের ঘটনার পর অর্জুনকে তিনি রথ থেকে নেমে যেতে বলেন। অর্জুনের পর নিজে নেমে যান। দেবদত্ত রথ অগ্নিতে ভস্মীভূত হয়। কৃষ্ণ জানান তিনি ছিলেন বলেই এত ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষিপ্ত হলেও রথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অন্তত তিনবার তিনি অর্জুনকে রক্ষা করেছেন।

যদুবংশ ধ্বংস মহাভারতে কৃষ্ণের শেষ লীলা। এখানে কৃষ্ণ যেন মহাপ্রলয়ের কাল। যদুবংশ ব্যভিচারী হয়ে গেছে—নির্লিপ্ত দর্শকের মতো কৃষ্ণ সে বংশ ধ্বংস করছেন। গীতায় যে নিষ্কাম-কর্মের শিক্ষা তিনি দিয়েছিলেন, তাই যেন পালন করে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছে। তিনি কর্তব্য সমাপ্ত করেছেন, এখন আপন লোকে ফিরে যাবেন। কিন্তু তিনি পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিলেন। পৃথিবীর শিষ্টাচারের নিয়মগুলি তাঁকে পালন করে যেতে হবে। বসুদেবকে প্রণাম করে, দ্বারকায় স্ত্রীবালবৃদ্ধদের রক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি শেষ কর্তব্য পালন করলেন।

৯৮
কৃষ্ণ ও বলরামের মানবলীলা সংবরণ

যদুবংশ ধ্বংস হয়ে গেলে কৃষ্ণ বলরামকে বললেন, “আর্য রাম আপনি এইখানে ততক্ষণ পর্যন্ত আমার প্রতীক্ষা করতে থাকুন, যতক্ষণে আমি গিয়ে স্ত্রীলোকদের তাঁদের জ্ঞাতিদের অধীন না করি।” তারপর কৃষ্ণ দ্বারকানগরীতে প্রবেশ করে পিতা বসুদেবকে বললেন, “আর্য আপনি অর্জুনের আগমনের প্রতীক্ষা করতে থেকে আমাদের সমস্ত স্ত্রীলোককে রক্ষা করুন। রাম বনপ্রান্তে আমার প্রতীক্ষা করছেন। সুতরাং আমি এখন গিয়ে তাঁর সঙ্গে মিলিত হব। আমি এখন এই যদুবংশ ধ্বংস দেখলাম। পূর্বে রাজাদের ও কৌরবদের বিনাশ দেখেছি; যদুগণশূন্য এই দ্বারকাতে আমি থাকতে পারছি না। আমি রামের সঙ্গে বনে গিয়ে তপস্যা করব, আপনি আমার কাছ থেকে তা জেনে রাখুন।” এই বলে কৃষ্ণ বসুদেবের চরণে মস্তক রেখে তাঁকে প্রণাম করে সত্বর সেখান থেকে চলে গেলেন। রোদনপ্রবৃত্ত স্ত্রীলোকদের আর্তনাদ শুনে কৃষ্ণ তাঁদের বলে গেলেন, “অর্জুন এই দ্বারকানগরীতে আসবেন। সেই নরশ্রেষ্ঠ এসে তোমাদের দুঃখ থেকে মুক্ত করবেন।”

তারপর কৃষ্ণ গিয়ে নির্জন বনস্থিত একাকী রামকে দেখলেন। আরও দেখলেন যে, যোগপ্রবৃত্ত বলরামের মুখ থেকে একটি শ্বেতবর্ণ বিশাল নাগ নির্গত হচ্ছে। মহাপ্রভাবশালী সেই নাগ নির্গত হয়ে মহাসমুদ্রে প্রবেশ করল। সহস্র মস্তক পর্বতের মতো বিশাল দেহ ও রক্তমুখ সেই নাগ নিজ রামদেহ পরিত্যাগ করে সাগরজলে প্রবেশ করলেন। তখন সাগরও আদরের সঙ্গে তাঁকে গ্রহণ করল এবং দিব্য নদীসমূহ ও পুণ্য নদীসকলও তাঁকে গ্রহণ করল। কর্কোটক, বাসুকি, তক্ষক, পৃথুশ্রবা, বরুণ, কুঞ্জর, মিশ্রী, শঙ্খ, কুমুদ, পুণ্ডরীক, মহাত্মা ধৃতরাষ্ট্র, হ্রাদ, ক্ৰাথ, উগ্রতেজা, শিতিকণ্ঠ, চক্ৰমন্দ, অতিষণ্ড, দুর্মুখ ও অম্বরীষ—এই সকল নাগশ্রেষ্ঠ এবং জলের রাজা স্বয়ং বরুণও সেই নাগকে গ্রহণ করলেন।

সেই কর্কোটক প্রভৃতি নাগগণ প্রত্যুদগমন করে স্বাগত প্রশ্নদ্বারা বাসুকির অভিনন্দন এবং অর্ঘ্যপাদ্য প্রভৃতি দ্বারা তাঁর পূজা করল। এইভাবে ভ্রাতা রাম মর্ত্যলোক থেকে প্রস্থান করলে দিব্যজ্ঞানশালী কৃষ্ণ সকলেরই সমস্ত অবস্থা জানতে পেরে চিন্তাকুলচিত্তে শূন্য বনে বিচরণ করতে থেকে, ভূতলে শয়ন করলেন এবং পূর্বে গান্ধারী যে বাক্য বলেছিলেন, মহাতেজা কৃষ্ণ তখন সেই সমস্তই চিন্তা করতে লাগলেন। মহানুভব কৃষ্ণ যদুবংশ ধ্বংস ও কুরুবংশ বিনাশ ভাবতে ভাবতে দুর্বাসা উচ্ছিষ্ট পায়সদ্বারা ভূমি লিপ্ত করে যা বলেছিলেন, দুর্বাসার সেই বাক্য স্মরণ করলেন।

তারপর কৃষ্ণ সেই সময়টিকে নিজের প্রস্থানের উপযুক্ত ক্ষণ মনে করলেন। পরে তিনি ত্রিভুবন পালন করবার জন্য এবং দুর্বাসার বাক্য রক্ষা করবার জন্য ইন্দ্রিয়গণকে নিরুদ্ধ করলেন। সকলার্থ তত্ত্বজ্ঞ কৃষ্ণও সন্দেহ দূর করবার জন্য নিশ্চিত বিষয় কামনা করলেন। তারপর কৃষ্ণ মহাযোগ অবলম্বন করে ইন্দ্রিয়, বাক্য ও মনকে নিরুদ্ধ রেখে ভূতলে শয়ন করলেন।

জরোহথ তং দেশমুপাজগাম্ লুব্ধস্তদানীং মৃগলিপ্সুরুগ্রঃ।

স কেশবং যোগযুক্তং শয়ানং মৃগাশঙ্কী লুব্ধকঃ সায়কেন॥

জরোহবিধ্যৎ পাদতলে ত্বরাবংস্তং ঢাভিতস্তজ্জিযৃক্ষুর্জগাম্।

অথাপশ্যৎ পুরুষং যোগযুক্তং পীতাম্বরং লুব্ধকোহনেকবাহুম্॥

মৌসল : ৪ : ২২-২৩॥

“তারপর উগ্রমূর্তি ও হরিণলিপ্সু জরনামক এক ব্যাধ সেই সময়ে সেইস্থানে এল এবং মৃগ মনে করে বাণদ্বারা যোগযুক্ত অবস্থায় শয়িত কৃষ্ণের পদতলে বিদ্ধ করল, পরে ত্বরান্বিত হয়ে সেই বিদ্ধ মৃগকে গ্রহণ করতে ইচ্ছা করে, তার কাছে গিয়ে পৌঁছল। তখন সে দেখল, অনেক বাহু, পীতাম্বর পরিধায়ী এবং যোগযুক্ত একটি পুরুষ শয়িত আছেন। সেই জরনামক ব্যাধ আপনাকে অপরাধী মনে করে উদ্বিগ্ন চিত্ত হয়ে কৃষ্ণের চরণযুগল ধারণ করল। তখন তার পুণ্য, ভক্তি এবং নিজের দুষ্কর্ম ও জন্মবিষয়ে অনুতাপ করায় কৃষ্ণ তাকে আশ্বস্ত করলেন।”

ক্রমে দেবগণ অনন্তবীর্য নারায়ণকে দেখে তাঁকে স্বর্গে নিয়ে গেলেন এবং কৃষ্ণমূর্তি ত্যাগ করে তিনি আপন কান্তিদ্বারা জগদ্ব্যাপ্ত করে ঊর্ধ্বে গমন করতে লাগলেন এবং মুনিগণ তাঁর পূজা করলেন। কৃষ্ণ স্বর্গে উপস্থিত হলে, ইন্দ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, একাদশ রুদ্র, বিশ্বদেবগণ, সিদ্ধ মুনিগণ এবং অপ্সরাদের সঙ্গে গন্ধর্বশ্রেষ্ঠগণ তাঁর প্রত্যুদগমন করলেন। তারপর ভীষণতেজা, জগতের উৎপাদক, অবিনশ্বর, যোগশিক্ষক ও মহাত্মা ভগবান আপন কান্তিদ্বারা স্বর্গ ও মর্ত ব্যাপ্ত করে, সাধারণের অজ্ঞেয় স্বকীয় বৈকুণ্ঠলোকে প্রবেশ করলেন।

তখন দেবগণ, সাধ্যগণ, ঋষিগণ, চারণগণ, গন্ধর্বশ্রেষ্ঠগণ, প্রধান অপ্সরাগণ এবং সিদ্ধগণ অবনত হয়ে সমাগত নারায়ণের পূজা করতে লাগলেন। দেবগণ, নারায়ণের অভিনন্দন করলেন। মুনি-শ্রেষ্ঠগণ বৈদিক মন্ত্রদ্বারা সেই জগদীশ্বরের পূজা করলেন এবং ইন্দ্র প্রীতিবশত তাঁর অভিনন্দন করলেন। “ভগবন্! নারায়ণ! আপনি ধর্মস্থাপনের উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন; তারপর কংসপ্রভৃতি সকল দেবশত্রুগণকে সংহার করে ভারার্ত পৃথিবীতে সুস্থ অবস্থায় স্থাপন করে এসেছেন; অতএব আপনাকে নমস্কার, আপনাকে নমস্কার। প্রভু, অলৌকিক, অক্ষয়, অতুলনীয়, দুর্জ্ঞেয় ও শাস্ত্রগম্য শ্রেষ্ঠ স্থানে আপনি গমন করুন এবং প্রত্যেক কল্পে উৎপন্ন ও পীড়িত লোকদের রক্ষা করুন।”

এই কথা বলে দেবগণ তাঁর অনুসরণ করে তাঁর উপর পুষ্পবর্ষণ করলেন। এই সময়ে মূর্তিমতী হয়ে লক্ষ্মী ও সরস্বতী—এসে তাঁকে আশ্রয় করলেন। তখন দেবগণ বললেন, “জগদীশ্বর! আপনি সূর্যকল্প বৈকুণ্ঠলোকমধ্যে প্রবেশ করুন।” নারায়ণ বললেন, “দেবগণ! এই আমার রূপ চতুর্ভুজযুক্ত; এতদ্‌ভিন্ন দ্বিভুজযুক্ত কৃষ্ণরূপে মর্ত্যলোকে জীবিত ছিলাম। পরে মৃত্যুবরণ করেছি। তোমরা পৃথিবীগত আমার অপ্রমেয় মূর্তির পূজা কোরো। আমি সর্বদাই নানারূপে পৃথিবীতে বিচরণ করি।”

তখন উপস্থিত দেবগণ নারায়ণের স্থানে যেতে না পেরে, মনে মনে তাঁকে স্মরণ করতে থেকে নিবৃত্তি পেলেন এবং ব্রহ্মাদি শ্রেষ্ঠগণ নারায়ণের গুণকীর্তন করতে থেকে আপন আপন মঙ্গলময় লোকে গমন করলেন।

*

বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন—মৃত্যুর সময় কৃষ্ণের বয়স হয়েছিল ঠিক একশত বছর। বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যসম্রাট। তিনি বাংলা সাহিত্যকে যা দিয়েছেন, তাঁর জন্য বাঙালি তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। বাঙালি হয়ে বঙ্কিমের সমালোচনা করাও সমীচীন হয় না। কিন্তু পাঠক মার্জনা করবেন, কিছুতেই হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। শতশৃঙ্গ পাহাড় থেকে পাণ্ডবেরা যেদিন হস্তিনাপুর আসেন, সেদিন যুধিষ্ঠিরের বয়স ছিল ১৬, ভীমের ১৫, অর্জুনের ১৪, নকুল ও সহদেবের ১৩। একথা ব্যাসদেবই জানিয়েছেন। ব্যাসদেব আরও জানিয়েছেন যে, কৃষ্ণ অর্জুনের থেকে ছ’ মাস বয়সে বড় ছিলেন।

অর্জুন শতশৃঙ্গ পর্বত থেকে এসেছিলেন— ১৪ বছর বয়সে

হস্তিনানগরে তিনি অস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন— ১৩ বছর

বারণাবত ও একচক্রাপুরীতে অর্জুন ছিলেন— ১ বছর

দ্রুপদের রাজ্যে দ্রৌপদীকে বিবাহ ও আনন্দ উৎসব— ১ বছর

দ্রুপদ রাজ্যে বিবাহের ১ বছর ধরে অর্জুন বিয়ে করেছিলেন—২৮+১ = ২৯ বছর বয়সে

হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্রকে বধূ দেখানো ও আনন্দোৎসব— ৫ বছর

খাণ্ডববনে গমন, ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মাণ ও যুধিষ্ঠিরের রাজত্ব— ২৩ বছর

মোট— ৫৭ বছর

অর্জুনের ৫৭ বছর বয়সে দ্যূতক্রীড়া হয়।

বনবাস— ১৩ বছর

মোট— ৭০ বছর

অর্জুনের ৭০ বছর বয়সে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়।

যুধিষ্ঠির বিজয়ী হয়ে হস্তিনাপুরে রাজত্ব করেছিলেন—৩৬ বছর

মহাপ্রস্থানের সময় অর্জুনের বয়স ছিল— মোট— ১০৬ বছর

পার্বত্য পথে যাত্রার ৬ মাস পরে অর্জুনের মৃত্যু হয়

অতএব মৃত্যুর সময় অর্জুনের বয়স ছিল— মোট— ১০৬ বছর ৬ মাস

অতএব অর্জুনের মৃত্যুর সময় কৃষ্ণের বয়স ছিল ১০৭ বছর

অর্জুনের মৃত্যুর ৬ মাস আগে কৃষ্ণের মৃত্যু হয়।

অতএব মৃত্যুর সময় কৃষ্ণের বয়সও ছিল—১০৬ বছর ৬ মাস।

অতএব অর্জুন ও কৃষ্ণ দু’জনেই ১০৬ বছর ৬ মাসে মৃত্যুবরণ করেন।

কৃষ্ণ ও বলরাম মানবলীলা সংবরণ করলেন। বলরামের ইহলোক থেকে চলে যাবার রাজকীয় বর্ণনা দিয়েছেন ব্যাসদেব। বলরামের মুখ থেকে একটি শ্বেতবর্ণ বিশাল নাগ নির্গত হয়ে মহাসমুদ্রে পতিত হল। বিস্ময়ে, ভক্তিতে পাঠক দেখেন সেই মহাপ্রয়াণ। নিজেই নিজের দেহত্যাগ করলেন কৃষ্ণের অগ্রজ হলধারী বলরাম। আর কৃষ্ণের মৃত্যু! সামান্য এক অস্ত্র অনভিজ্ঞ ব্যাধ, যার নাম জর, মৃগভ্রমে কৃষ্ণের শায়িত অবস্থায় পদতলে তির নিক্ষেপ করল। সমস্ত ভূমণ্ডল যিনি ধারণ করে আছেন, যিনি সনাতন, অক্ষয়, অব্যয়, একরাট্, একেশ্বর—যিনি সকল যোগীর আরাধ্য—তিনি সামান্য জর ব্যাধের শর নিক্ষেপে নিহত হলেন! আমরা বুঝলাম, কৃষ্ণ মানুষের মধ্যে ক্রিয়ার সঞ্চারকারী। তিনি জর ব্যাধের মধ্যেও ক্রিয়া সঞ্চার করেছেন। তাই চরম নিষ্ক্রিয়ভাবে বনমধ্যে শায়িত নিঃসঙ্গ কৃষ্ণ চলে গেলেন।

এক চরম শিক্ষা রেখে গেলেন মানুষের সামনে। অবতারই হোন আর অবতারী-ই হোন মর্ত্যলীলা মর্ত্যভূমিতেই শেষ করতে হবে। জননীর জঠরে যাঁর জন্ম, পৃথিবীতেই তাঁর মৃত্যু ঘটবে। এটাই মানবধর্ম। কিন্তু এরও ব্যতিক্রম ঘটবে। সমস্ত জীবন যিনি ধর্মপালক, ধর্ম-আশ্রয়ী, তাঁর ক্ষেত্রে এই লৌকিক নিয়ম প্রযুক্ত হবে না। তেমন মানুষ পৃথিবীতে একটিই এসেছিলেন—তিনি যুধিষ্ঠির। স্বয়ং ধর্ম তাঁকে ‘মূর্তিমান ধর্ম’রূপে ঘোষিত করেছিলেন। পৃথিবীতে ধর্মের মৃত্যু হয় না।

৯৯
পরাজিত পার্থ

কৃষ্ণের আদেশে দারুক কুরুদেশে গিয়ে মহারথ পাণ্ডবদের কাছে মুসল উৎপত্তির কারণে পরস্পর কর্তৃক যদুবংশ বিনাশের বৃত্তান্ত জানাল। ভোজ, অন্ধক ও কুকুরবংশীয়গণের সঙ্গে যদুবংশীয়গণ বিনষ্ট হয়েছেন শুনে পাণ্ডবেরা শোকসন্তপ্ত হলেন এবং তাঁদের মনও ভীত হয়ে পড়ল।

তারপর কৃষ্ণের প্রিয়সখা অর্জুন পাণ্ডবদের অনুমতি নিয়ে মাতুল বসুদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য দারুকের সঙ্গে প্রস্থান করলেন এবং বললেন, “সে যদুকুল আর নেই।” অর্জুন দ্বারকানগরীতে প্রবেশ করে দেখলেন, বিধবা নারীর মতো দ্বারকানগরী পড়ে রয়েছে। কৃষ্ণের ষোড়শ সহস্র ভার্যা, যাঁরা পূর্বে নাথবতী ছিলেন, সেই অনাথা নারীরা অর্জুনকে নাথ দেখে মুক্তকণ্ঠে রোদন করতে লাগলেন। অর্জুনের দুই নয়ন অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি সেই নারীদের পূর্ণভাবে দেখতে সমর্থ হলেন না।

অর্জুনের মনে হতে লাগল দ্বারকানগরী যেন এক নদীর মতো। বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয়েরা তার জল, অশ্ব সকল তার মৎস্য, রথগুলি ভেলা, বাদ্যের ও রথের শব্দই প্রবাহের শব্দ, গৃহ ও প্রাসাদগুলি বিশাল জলজন্তু, রত্নই শৈবাল, হীরকখচিত প্রাচীর ঝিনুকরাশি, চতুষ্পদগুলি আবর্ত, চত্বরগুলি নিশ্চল হ্রদ এবং রাম ও কৃষ্ণরূপ বিশাল জলজন্তু ছিল। অথবা ভীষণা বৈতরণী নদীর মতো দ্বারকানগরী অর্জুনের দৃষ্টিগোচর হল। সেই দুঃসময়ই তাতে কালপাশের মতো ছিল। সেই দ্বারকায় তখন বৃষ্ণিশ্রেষ্ঠরা ছিলেন না, তার সৌন্দর্য তিরোহিত হয়েছিল, কোনও উৎসবও ছিল না; সুতরাং ধীমান অর্জুন শীতকালে পদ্মিনীর মতো সেই দ্বারকানগরী দেখলেন।

অর্জুন সেই দ্বারকানগরী এবং কৃষ্ণের ভার্যাগণকে দেখে মুক্ত কণ্ঠে রোদন করে ভূতলে পতিত হলেন। তখন সত্রাজিৎ-তনয়া সত্যভামা ও রুক্মিণী সত্বর এসে অর্জুনকে পরিবেষ্টন করে রোদন করতে লাগলেন। তখন অন্যান্য স্ত্রীরা এসে মহাত্মা অর্জুনকে তুলে স্বর্ণময় আসনে বসিয়ে দিলেন। অর্জুন কৃষ্ণের প্রশংসা করে, নিজেদের সংবাদ দিলেন এবং বসুদেবের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য গমন করলেন।

বীর, মহাত্মা ও কৌরবশ্রেষ্ঠ অর্জুন প্রবেশ করলে, পুত্রশোকসন্তপ্ত বসুদেব তাঁকে দর্শন করলেন। কঠিনবক্ষা, মহাবাহু এবং অত্যন্ত শোকার্ত অর্জুন অশ্রুপূর্ণ নেত্রে গিয়ে শোকার্ত বসুদেবের চরণযুগল ধারণ করলেন। বসুদেব ভাগিনেয় অর্জুনের মস্তকাঘ্রাণ করবার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। তখন বৃদ্ধ ও মহাবাহু বসুদেব বাহুযুগল দ্বারা অর্জুনকে আলিঙ্গন করলেন এবং কৃষ্ণকে স্মরণ করে অত্যন্ত শোকাকুল অবস্থায় রোদন করতে লাগলেন এবং সুবৃত্ত ও দুর্বৃত্ত ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, দৌহিত্র, সখা, আত্মীয় ও স্বজনদের স্মরণ করতে করতে বিলাপমগ্ন হলেন। বসুদেব বললেন, “অর্জুন যারা শত শত রাজা ও দৈত্যকে বধ করেছিল, আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি না। অথচ অর্জুন আমি এখনও জীবিত আছি।

“অর্জুন সেই যারা তোমার প্রিয়শিষ্য ও অত্যন্ত আদরের ছিল, তাদেরই দুর্ব্যবহারে বৃষ্ণবংশীয়েরা নিধন প্রাপ্ত হয়েছে। যে দু’জন বৃষ্ণিবংশীয় শ্রেষ্ঠ বীর বলে খ্যাত ছিল এবং তুমিও যে প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকির কথা বলে আত্মশ্লাঘা করতে, কৃষ্ণের সর্বদা প্রীতির পাত্র, সেই প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকি যদুবংশ ধ্বংসের প্রথম কারণ হয়েছিল। কিন্তু সাত্যকি, কৃতবর্মা, অক্রূর ও প্রদ্যুম্নকে আমি নিন্দা করি না। যেহেতু এই যদুবংশ ধ্বংসে গান্ধারী ও মুনিগণের শাপই প্রধান কারণ।

“পৃথানন্দন, যিনি বিক্ৰম প্রকাশ করে কেশী, কংস, বলগর্বিত শিশুপাল, নিষাদপুত্র একলব্যকে বধ করেছিলেন এবং কলিঙ্গরাজ, মগধরাজ, গান্ধারদেশীয় বীরগণ, কাশীরাজা, মরুভূমির রাজগণ, পূর্ব ও দক্ষিণদেশীয় রাজগণ এবং পার্বত্যরাজগণকে জয় করেছিলেন; সেই প্রভাবশালী মধুসূদন এই দুর্নীতি উপেক্ষা করেছিলেন। তুমি, নারদ ও অন্যান্য মুনিগণ—তোমরা সেই কৃষ্ণকে নিষ্পাপ, সনাতন, নারায়ণ বলে অবগত ছিলে। আমার পুত্র অথচ প্রভু নারায়ণ নিজে প্রত্যক্ষ জ্ঞাতিক্ষয় দেখেছেন এবং উপেক্ষা করেছেন।

“শত্ৰুসন্তাপক অর্জুন, গান্ধারী ও ঋষিগণের সেই যে অভিসম্পাত হয়েছিল, জগদীশ্বর সেই নারায়ণ তার অন্যথা করতে ইচ্ছা করেননি। যিনি ইচ্ছামাত্রেই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় করে থাকেন, অজ্ঞেয়স্বরূপ সেই নারায়ণ আপন বংশের স্থায়িত্ব ইচ্ছা করেননি। তপস্যায় প্রবৃত্ত ঋষিরা যাঁর অনুগ্রহে সিদ্ধিলাভ করেন, তিনি ঋষিদের বাক্যের অন্যথা করবার চেষ্টা করেননি। যিনি সকলকে ভ্রূভঙ্গি দ্বারাই নিবারণ করতে পারতেন, তিনি নিজের সাক্ষাতে কলহে প্রবৃত্ত যাদবগণকে নিঃসম্পর্কিত ব্যক্তির ন্যায় উপেক্ষা করেছেন। অর্জুন তোমার পৌত্র পরীক্ষিৎ অশ্বত্থামার ঐষিকাস্ত্রে নিহত হয়, আবার কৃষ্ণের প্রভাবে তোমার প্রত্যক্ষে সেই বালক জীবন লাভ করে। নিজের সাক্ষাতে নিজের এই সকল জ্ঞাতি পরস্পর বধ করছিল; কিন্তু তোমার সখা কৃষ্ণ তাদের রক্ষা করতে ইচ্ছা করেননি।

“তারপর পুত্র, পৌত্র, ভ্রাতা এবং বন্ধুগণ নিহত হয়ে ভূতলে শয়ন করেছে, এই দেখে কৃষ্ণ এসে আমাকে বলেছিলেন, ‘আজ যদুবংশের ধ্বংস হয়েছে। ভরতবংশশ্রেষ্ঠ অর্জুন এই দ্বারকানগরীতে আসবেন। আপনি অর্জুনের কাছে বৃষ্ণিবংশের ধ্বংসের বিবরণ দেবেন। তখন অর্জুনই পরের কর্তব্য নির্ধারণ করবেন। পিতা আপনি জানুন যে, যে আমি, সেই অর্জুন। যে অর্জুন, সেই আমি। অতএব অর্জুন যেমন বলবেন, আপনি তাই করবেন। স্ত্রীলোকগণ, বালকগণ এবং আপনি কালপ্রাপ্ত হলে, অর্জুন আপনাদের ঊর্ধ্বদেহিক কার্য করবেন। অর্জুন চলে গেলে সমুদ্র তৎক্ষণাৎ প্রাচীর ও অট্টালিকার সঙ্গে এই দ্বারকানগরীকে প্লাবিত করবে। আমি রামের সঙ্গে বনে কোনও পবিত্র স্থানে নিয়ম অবলম্বন করে সদ্যই কালপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা করি।’

“অর্জুন, অচিন্ত্য পরাক্রমশালী কৃষ্ণ একথা বলে আমাকে পরিত্যাগ করে বালকদের সঙ্গে কোথায় চলে গেছেন। আমি মহাত্মা রাম ও কৃষ্ণের এবং ভয়ংকর জ্ঞাতিবধের কথা চিন্তা করতে থেকে শোকে খেতে পারি না। আমি আহার্য গ্রহণ করব না, জীবিতও থাকব না; ভাগ্যবশত তুমি উপস্থিত হয়েছ; অতএব পৃথানন্দন, কৃষ্ণ যা যা বলেছেন, তা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করো। এ রাজ্য, রত্ন ও স্ত্রীলোক সব এখন তোমার অধীন। প্রিয়প্রাণ আমি ত্যাগ করব।”

দুঃখিত চিত্ত অর্জুন মলিন বদনে বসুদেবকে বললেন, “মাতুল, কৃষ্ণ এবং সাত্যকি প্রভৃতি বন্ধুগণ না থাকায় আমি যদুবংশ দেখতেই পারছি না। আমি যুধিষ্ঠিরের চিরকালের ইচ্ছা অনুযায়ী বৃষ্ণিবংশের বালক, বৃদ্ধ ও ভার্যাদের ইন্দ্রপ্রস্থে নিয়ে যাব। এ বিষয়ে আপনি চিন্তা করবেন না।”

তখন অর্জুন দারুককে রথ প্রস্তুত করতে বলে যাদবসভায় প্রবেশ করলেন এবং সভায় উপস্থিত সমস্ত প্রজা, ব্রাহ্মণগণ ও নগরবাসীদের বললেন, “আমি নিজে বৃষ্ণিবংশীয় এবং অন্ধকবংশীয় সমস্ত লোককে ইন্দ্রপ্রস্থে নিয়ে যাব। আপনারা যান ও নানাবিধ রত্ন সজ্জিত করুন। কারণ, সমুদ্র এই সমস্ত দ্বারকানগরী প্লাবিত করবে। ইন্দ্রপ্রস্থে এই বজ্র আপনাদের রাজা হবেন। আজ থেকে সপ্তম দিনের সকালে আমরা দ্বারকানগরীর বাইরে নিষ্ক্রান্ত হব।”

শোক ও মোহ আক্রান্ত অর্জুন সেই রাত্রি কৃষ্ণের গৃহে বাস করলেন। পরদিন সকালে বসুদেব দেহত্যাগ করলেন। নারীশ্রেষ্ঠা দেবকী, ভদ্রা, রোহিণী ও মদিরা ভর্তার অনুগমনের জন্য প্রস্তুত হলেন। অর্জুন বসুদেবের দেহ নগরীর বাইরে নিয়ে গেলেন, প্রজাগণ বসুদেবের অনুগমন করল। বসুদেবের নির্দিষ্ট প্রিয় স্থানে অর্জুন তাঁর অন্ত্যেষ্টির ব্যবস্থা করলেন। বসুদেবের চার পত্নী পতিলোকে যাবার ইচ্ছা করে চিতায় আরোহণ করলেন। চন্দন কাঠ ও নানাবিধ গন্ধদ্রব্য দ্বারা অর্জুন চিতায় অগ্নি সংযোগ করলেন। অন্তঃপুরিকারা হাহাকার করে ক্রন্দন করতে লাগলেন। যে স্থানে বৃষ্ণিগণ মুসলরেণুজাত এরকা দ্বারা নিহত হয়েছিলেন, প্রধান অনুক্রমে তাঁদের সমস্ত ক্রিয়া অর্জুন করলেন। অন্বেষণ করে রাম ও কৃষ্ণের দেহ দুটি খুঁজে নিয়ে এসে ঊর্ধ্বদেহিক ক্রিয়াধিকারী পুরুষগণ দ্বারা সেই শরীর দুটি দাহ করলেন। ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করে, যথাবিধানে তাঁদের প্রেতকার্য সম্পাদন করে সপ্তম দিবসে রথে আরোহণ করে দ্বারকা থেকে প্রস্থান করলেন। তখন বৃষ্ণিবংশীয় শোকার্ত স্ত্রীগণ রোদন করতে থেকে অশ্বযুক্ত রথে, গো, গর্দভ এবং উষ্ট্রযানে আরোহণ করে অর্জুনের অনুগমন করলেন এবং অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয় ভৃত্যেরা অশ্বে ও রথে আরোহণ করে অর্জুনের পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন।

অর্জুনের আদেশক্রমে রক্ষাকারী বীরবিহীন বৃদ্ধগণ, বালকগণ, পুরবাসীগণ বৃষ্ণিবংশীয় পুরুষগণের ভার্যাদের পরিবেষ্টন করে যেতে লাগল। গজারোহীরা পর্বতপ্রমাণ গজে আরোহণ করে গমন করতে লাগল এবং সম্মুখগামী অস্ত্রধারীগণ পাদরক্ষকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যেতে লাগল। কৃষ্ণের ষোড়শ সহস্র ভার্যা ধীমান কৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্রকে অগ্রবর্তী করে গমন করতে লাগলেন। ভোজ, অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়গণের বহুতর ভার্যা দ্বারকা থেকে নির্গত হলেন। রথীশ্রেষ্ঠ ও বিপক্ষনগরবিজয়ী অর্জুন মহাসমৃদ্ধিযুক্ত ও সমুদ্রতুল্য সেই যদুবংশীয়দের নিয়ে চললেন। তাঁরা দ্বারকা থেকে নির্গত হলেই সমুদ্র আপন জলদ্বারা রত্নপূর্ণা দ্বারকানগরীকে প্লাবিত করে দিলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুন দ্বারকার যে যে স্থান পরিত্যাগ করতে লাগলেন, সমুদ্র জলদ্বারা সেই সেই স্থান প্লাবিত করতে লাগল।

দ্বারকাবাসী লোকেরা সেই অদ্ভুত ব্যাপার দেখে ‘অহো! দৈব’ এই ধরনের কথা বলতে থেকে দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে অগ্রসর হল। অর্জুন ক্রমে মনোহর বন, পর্বত ও নদীতীরে বাস করে বৃষ্ণিবংশীয় নারীদের হস্তিনার পথে নিয়ে আসতে লাগলেন। বুদ্ধি ও প্রভাবশালী অর্জুন অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী পঞ্চনদ দেশে উপস্থিত হয়ে গো, অন্যান্য পশু ও ধান্যসম্পন্ন স্থানে বাস করলেন। তারপর একমাত্র অর্জুন নিয়ে চলেছেন—এহেন বিধবা স্ত্রীদিগকে দেখে দস্যুগণের লোভ হল। তখন পাপকর্মা, লুব্ধচিত্ত, বিকটাকৃতি গোপগণ উপস্থিত হয়ে মন্ত্রণা করল, “এই ধনুর্ধর একমাত্র অর্জুন এবং এই সকল দুর্বল যোদ্ধা আমাদের অতিক্রম করে বালক, বৃদ্ধ ও বিধবা স্ত্রীদের নিয়ে যাচ্ছে।” তখন পরস্বাপহারী ও যষ্টিধারী সেই সহস্র সহস্র দস্যু বৃষ্ণিবংশসংপৃক্ত সেই লোকদের প্রতি ধাবিত হল। তারা কালপ্রেরিত হয়ে বিশাল সিংহনাদে নীচ লোকেদের ভয় সৃষ্টি করে ধনের জন্য এসে পড়ল। তারপর কুন্তীনন্দন মহাবাহু অর্জুন তৎক্ষণাৎ অনুচরবর্গের সঙ্গে চলার গতি থামিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে সেই দস্যুদের বললেন, “অরে পাপিষ্ঠগণ! তোদের যদি বাঁচবার ইচ্ছা থাকে, তা হলে নিবৃত্ত হ। না হলে এখনই আমার বাণে বিদীর্ণ ও নিহত হয়ে শোক করতে থাক।”

মহাবীর অর্জুন একথা বললেও এবং বারবার বারণ করতে থাকলেও মূর্খ দস্যুগণ অর্জুনের বাক্য অগ্রাহ্য করে তাঁর উপরে এসে পতিত হল। তারপর যত্নক্রমে অর্জুন অতিকষ্টেই যেন অলৌকিক, জীর্ণতাবিহীন ও বিশাল গাণ্ডিবধনুতে গুণ আরোপণ করতে প্রবৃত্ত সেই গুরুতর ত্বরার সময়ে কষ্টক্রমে ধনুতে গুণ আরোপ করলেন এবং নিজের অস্ত্রগুলির কথা চিন্তা করলেন; কিন্তু সেগুলি স্মরণ করতে পারলেন না। নিজের সেই গুরুতর বৈষম্য ও যুদ্ধে বাহুবলের ক্ষয় দেখে, বিশেষত অলৌকিক মহাস্ত্রগুলির বিস্মরণ হওয়ায় অর্জুন লজ্জিত হলেন। দস্যুরা তাঁদের ধন হরণ করতে লাগলেও হস্তী, অশ্ব, রথযোধী সেই সকল বৃষ্ণিযোদ্ধা সেই ধন ফিরিয়ে আনতে পারল না। বৃষ্ণিবংশের পুরুষগণের ভার্যারা বহুতর ছিল এবং দস্যুরাও নানা স্থান থেকে এসে পড়ছিল। সুতরাং অর্জুন স্ত্রীলোকদের রক্ষার জন্য গুরুতর চেষ্টা করতে লাগলেন। তখন দস্যুরা যোদ্ধাদের সমক্ষেই সকল দিক থেকে সেই উত্তম নারীদের টেনে নিয়ে যেতে লাগল এবং অনেক স্ত্রীলোক ইচ্ছানুসারে দস্যুদের অধীনতা স্বীকার করে তাদের সঙ্গে যেতে লাগল।

তখন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন অর্জুন সহস্র সহস্র বৃষ্ণিভৃত্যগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে গাণ্ডিব নিক্ষিপ্ত বাণসমূহ দ্বারা দস্যুগণকে বধ করতে লাগলেন। ক্ষণকালমধ্যেই অর্জুনের সেই বাণ সকল ক্ষয় পেল। কী আশ্চর্য! রক্তপায়ী সেই বাণগুলি পূর্বে অর্জুনের তূণে অক্ষয় ছিল। তূণ শূন্য হল। শর সকল ক্ষয় হয়েছে জেনে দুঃখ ও শোক তাড়িত অর্জুন ধনুর অগ্রভাগ দিয়ে দস্যুগণকে বধ করতে লাগলেন। ম্লেচ্ছের মতো ধর্মবিহীন সেই গোপজাতীয় দস্যুরা অর্জুনের সম্মুখেই যাদবদের সেই উত্তম স্ত্রীদের নিয়ে সকল দিকে যেতে লাগল।

তখন প্রভাবশালী অর্জুন এই ব্যাপারটিকে দৈবকৃত বলে মনে মনে ভাবলেন এবং দুঃখে ও শোকে আক্রান্ত হয়ে বিশাল নিশ্বাস ত্যাগ করতে লাগলেন। অস্ত্রগুলির বিস্মরণ, বাহুবলের ক্ষয়, ধনুর অ-বশ্যতা এবং বাণগুলির সম্পূর্ণ ক্ষয়বশত অর্জুন অত্যন্ত বিষণ্ণচিত্তে “এ দৈব” এই কথা ভেবে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্তি পেলেন; তারপর মনে মনে বললেন, “আমার সেই মাহাত্ম্য আর নেই। আমি খাণ্ডবদাহের সময়ে যে ধনুদ্বারা দেবশ্রেষ্ঠগণকে জয় করে অগ্নিকে সন্তুষ্ট করেছিলাম, আজ সেই গাণ্ডিবধনুতেই গুণারোপণ করতে গুরুতর পরিশ্রম হল। পূর্বে অনায়াসে গুণারোপণ করে যে ধনু দ্বারা নিবাতকবচদের মতো অসুরদের বধ করেছিলাম আজ সেই ধনুতে গুণারোপণ করতে আমার গুরুতর কষ্ট হল। উত্তর গোগ্রহে যে ধনুর টংকার শুনে তৎক্ষণাৎ দ্রোণ আমাকে চিনতে পেরেছিলেন, আজ সেই গাণ্ডিবধনু আমার বশে নেই। কুরুক্ষেত্রে কৌরবদের সঙ্গে মহাযুদ্ধে আমার যে তূণ বাণশূন্য হয়নি, আজ ক্ষুদ্র গোপগণের সঙ্গে যুদ্ধে সেই তূণ বাণশূন্য হয়েছে। যে আমার নাম শুনেই রাজারা ভীতসন্ত্রস্ত হতেন, সেই আমার সঙ্গে গোপগণ যুদ্ধ করেছে। চিরকাল যাঁর অনুগ্রহে শত্ৰুজয় করে আমি জিষ্ণু হয়েছিলাম, সেই কৃষ্ণের অভাবে আমি আজ নীচজাতীয় গোপগণ কর্তৃক পরাজিত হলাম। মর্ত্যলোকে দুর্জয় যাদবগণ মুনিগণের শাপের প্রভাবে পরস্পর যুদ্ধ করতে থেকে প্রায় সবাই বিনষ্ট হয়েছেন। তারপর, ভগবান কৃষ্ণও গান্ধারী ও মুনিগণের শাপবাক্য রক্ষা করবার জন্য নিজের কর্তব্য সমাপ্ত করে এখন নিজের লোকে চলে গিয়েছেন। যে প্রভূর প্রভাবে আমি চিরদিন প্রভাবশালী ছিলাম, সেই প্রভুর অভাবে এখন আমার সমস্ত সম্পদের অভাব হয়েছে।”

এইরকম চিন্তা করতে থেকে অর্জুন দেহ ও মনে অত্যন্ত অবসাদ অনুভব করতে লাগলেন। দস্যুগণ বহুতর বিধবা স্ত্রী ও তাদের প্রচুর রত্ন অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল; তারপর যারা অবশিষ্ট ছিল তাদের নিয়ে অর্জুন কুরুক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হলেন। দূত প্রেরণ করে যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে অর্জুন বংশরক্ষক কুমারদের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করলেন। কৃতবর্মার পুত্র অশ্বপতিকে খাণ্ডবারণ্য প্রদেশ মার্তিকাবত নগরে স্থাপন করলেন। ভোজ রাজভার্যাগণও সেই স্থানে গেলেন। তারপর অর্জুন অবশিষ্ট বালক, বৃদ্ধ স্ত্রীলোকদের সকলকে ইন্দ্রপ্রস্থে সন্নিবিষ্ট করলেন। অর্জুন অনিরুদ্ধের পুত্র বজ্রকে ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্য দান করলেন। বজ্রের নিষেধ উপেক্ষা করে অক্রূরের ভার্যারা তপস্যা করতে চলে গেলেন।

রুক্মিণী, গান্ধারী, হৈমবতী, জাম্ববতী—এঁরা অনুগমন বিধানে অগ্নিতে প্রবেশ করলেন। সত্যভামা ও অন্য কৃষ্ণ প্রিয়ভার্যারা তপস্যা করার জন্য গভীর বনে প্রবেশ করলেন। অন্যান্য পুরুষদের যোগ্যতানুসারে অর্জুন বজ্রের নিকটে সমর্পণ করলেন।

তারপর অর্জুন বেদব্যাসের আশ্রমে প্রবেশ করে তাঁকে প্রণাম করলেন। ব্যাসদেব অর্জুনের মলিন বদন ও বাষ্পাকৃত নেত্র দেখে প্রশ্ন করলে অর্জুন বললেন—

যঃ স মেঘবপু শ্রীমান বৃহৎপঙ্কজ লোচনঃ।

স কৃষ্ণঃ সহ রামেন ত্যক্ত্বা দেহং দিবং গতঃ॥ মৌসল : ৮ : ৭॥

“সেই যিনি মেঘের মতো শ্যামবর্ণ, পরমকান্তি সম্পন্ন এবং প্রস্ফুটিত পদ্মতুল্য নয়ন ছিলেন, সেই কৃষ্ণ বলরামের সঙ্গে দেহত্যাগ করে স্বর্গে গিয়েছেন।”

তারপর অর্জুন ব্যাসদেবকে পথের সমস্ত বিবরণ জানালেন। গোপদস্যুদের কাছে তাঁর পরাজয়, অক্ষয় তূণের বাণশূন্যতা, গাণ্ডিবে গুণারোপণে তাঁর অসামর্থ্য, সমস্ত বিবরণ শুনে ব্যাসদেব বললেন, “অর্জুন তোমার অস্ত্র সকল কৃতকৃত্য হয়েছে; সুতরাং তারা যেমন এসেছিল, এখন তেমনই চলে গেছে। আবার যখন কাল আসবে, তখন পুনরায় তোমার হাতে আসবে। ভরতনন্দন, তোমাদেরও উত্তমগতি লাভ করবার এই প্রকৃষ্ট সময়। এই আমি তোমাদের পরম মঙ্গল মনে করি।”

*

অর্জুন পরাজিত হলেন। ইন্দ্রপুত্র অর্জুন। যাঁর জন্মমুহূর্তে স্বর্গের দেবগণ পুষ্পবর্ষণ করেছিলেন। স্বর্গের অপ্সরারা নৃত্যগীত করেছিলেন। স্বয়ং ত্রিলোচন মহেশ্বর যাঁকে বলেছিলেন, “আমি ভিন্ন, ত্রিলোকে তোমার তুল্য বীর হবে না।” ভীষ্ম বারবার দুর্যোধনকে বলেছিলেন, “অর্জুনের তুল্য বীর অতীতে ছিল না, বর্তমানে নেই, ভবিষ্যতে হবে না।” সেই অর্জুন কৃষ্ণের অন্তিম অনুরোধ রক্ষা করতে পারলেন না। দ্বারকাপুরীর নারী, বৃদ্ধ, বালকদের হস্তিনাপুরে যুধিষ্ঠিরের কাছে পৌঁছে দিতে পারলেন না। পথিমধ্যে আভীর পল্লিতে গোপদস্যুগণ তাঁর রক্ষিত নারীদের হরণ করে নিয়ে গেল। অতি কষ্টে অর্জুন যদি বা গাণ্ডিবে জ্যা-আরোপণ করলেন, কোনও যোগ্য অস্ত্র তাঁর স্মরণে এল না। অসার তর্জন-গর্জনের পর দুই অক্ষয় তূণীর নিয়ে গোপদস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলেন, তূণ বাণশূন্য হয়ে গেল— আভীর পল্লির দস্যুরা উপহাস করতে লাগল। কৃষ্ণের সান্নিধ্যলাভধন্য নারীরা স্বেচ্ছায় সেই দস্যুদের সঙ্গে চলে গেল, অর্জুন নীরব দর্শক হয়ে থাকলেন।

অর্জুনের উপলব্ধি শক্তি খুব প্রবল ছিল না। শল্যবধের পর কৃষ্ণ অর্জুনকে রথ থেকে নেমে যেতে বলেন। অশ্বদের রজ্জুমুক্ত করে দিয়ে নিজেও রথ থেকে নেমে যান। তখনই রথ অগ্নিতে ভস্মীভূত হয়। কৃষ্ণ বলেন, “আমি রথে ছিলাম, তাই তোমার রথ এতক্ষণ ভস্মীভূত হয়নি। না হলে এত ব্রহ্মাস্ত্র সহ্য করতে পারত না।” আসলে অর্জুন তখনও বোঝেননি।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হয়েছে, অগ্নিদেব যা যা দিয়েছিলেন, এক এক করে সব ফিরিয়ে নেবেন। এইবার শূন্য হল দুই অক্ষয় তূণ। গাণ্ডিব এখন শুধু অলংকার মাত্র। তাও যথাসময়ে অগ্নিদেব ফিরিয়ে নেবেন। যে বরুণদেবের কাছ থেকে অগ্নি অর্জুনের ধনু, বাণ, তূণ, রথ নিয়ে এসেছিলেন, অর্জুনের চোখের সামনে সেই বরুণদেব গ্রাস করলেন দ্বারকানগরী। অর্জুন শুনলেন, সুদর্শন চক্র উড়ে গেছে সমুদ্রের উপর দিয়ে, চলে গিয়েছে পাঞ্চজন্য শঙ্খ, কৃষ্ণকে ফেলে রেখে চার অশ্ব কৃষ্ণের রথ নিয়ে সমুদ্রের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে। তখনও অর্জুন বুঝতে পারেননি, পার্থিব সব বস্তুই শেষযাত্রার পূর্বে পৃথিবীতে ফেলে যেতে হবে।

অস্ত্র অনভিজ্ঞ সামান্য জর ব্যাধনিক্ষিপ্ত বাণে মৃত্যুবরণ করলেন পরম পুরুষ কৃষ্ণ। ধরণীর ত্রিতাপ-দুঃখ অর্জুনের জন্যও অপেক্ষা করে আছে। মৃত্যুর স্বাদ তিনি পূর্বে তিনবার পেয়েছেন। যক্ষরূপী ধর্মের নির্দেশ লঙ্ঘন করে, মহাদেবের বাহু নিষ্পেষণে, পুত্র বভ্রুবাহনের নিক্ষিপ্ত শরে, হৃদয় দৌর্বল্যবশত স্মরণ রাখেননি। কিন্তু তাঁর দিকে ধেয়ে আসছে কালরূপী জরা। কিছুতেই তাকে ঠেকানো যাবে না। অর্জুন জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। যে সারথি তাঁর রথ পরিচালনা করতেন, সকল কর্ম নির্দিষ্ট করে দিতেন, তাঁর সারথ্য শেষ হবার পর থেকে ক্রমশই অর্জুন দুর্বল হয়ে পড়ছেন। তাঁর অন্তর্ধানের পর অর্জুন নিঃস্ব। একথা অৰ্জুন বোঝেননি, বুঝেছিলেন যুধিষ্ঠির। তাই মহাবৈশ্বিক পতনের মধ্যেও যুধিষ্ঠির একা সুস্থ এবং স্বস্থ।

অর্জুনের এ পরিণতি দেখলে পাঠকেরা স্তম্ভিত হয়ে যান। কিন্তু অর্জুনের এ পরিণতি অত্যন্ত সঙ্গত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যাসদেব অত্যন্ত নিস্পৃহভাবে অর্জুনের পরিণতি রচনা করেছেন। যতখানি উপরে অর্জুন উঠেছিলেন, ততখানি পতনই তাঁর স্বাভাবিক পরিণতি। খাণ্ডবদাহের পর থেকেই অর্জুন কৃষ্ণ-নির্ভর। বনবাসের প্রথম ন’ বছর বাদে তিনি ক্রমশ কৃষ্ণের ইচ্ছাধীন হয়ে পড়েছেন। কৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের পর অর্জুন প্রায় অস্তিত্বহীন। কর্মসাধন তাঁর পক্ষে আর সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর চূড়ান্ত পরিণতি আরও নিঃস্বতা ও রিক্ততায়। যে পরিণতি আঁকা আছে মহাপ্রস্থানিক পর্বে।

১০০
পরীক্ষিতের রাজ্যারোহণ ও যুধিষ্ঠিরের সংসার ত্যাগ

পরাজিত, রিক্ত, হতশ্রী অর্জুন হস্তিনাপুরে প্রবেশ করে যুধিষ্ঠিরের কাছে যদুবংশ ধ্বংসের বিবরণ শোনালেন। জানালেন বসুদেব, কৃষ্ণ ও বলরামের দেহত্যাগ বিবরণ। অবনত মস্তকে জানালেন যে, কৃষ্ণের অন্তিম ইচ্ছা তিনি পালন করতে পারেননি। দ্বারকাপুরীর নারীদের যুধিষ্ঠিরের আশ্রয়ে নিয়ে আসার পথে আভীরপল্লির সামান্য দস্যুরা তাঁকে পরাজিত করে দ্বারকাপুরীর নারীদের ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তাঁর অক্ষয় তূণ শূন্য হয়েছে। কৃষ্ণের অন্তর্ধানে তাঁর সব শক্তি নিঃশেষ হয়েছে।

বৃষ্ণিবংশীয়গণের মহাবিনাশ কাহিনি শুনে যুধিষ্ঠির ইহলোক থেকে প্রস্থান করবার ইচ্ছা করে অর্জুনকে বললেন, “মহামতি, কালই সকল প্রাণীকে কটাহে পাক করছে এবং আমি কালকেই বন্ধনরজ্জু বলে মনে করি। মনে করি যে, তুমিও একথা পর্যালোচনা করতে পারো।” যুধিষ্ঠির এই কথা বললে, অর্জুন “কালই কাল” এই বলে বুদ্ধিমান জ্যেষ্ঠভ্রাতার বাক্য স্বীকার করলেন। অর্জুনের মত জেনে ভীম, নকুল ও সহদেব কালবন্ধন রজ্জু ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

তারপর যুধিষ্ঠির ধর্মকামনায় সংসার ত্যাগ করবেন, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বৈশ্যাপুত্র যুযুৎসুকে আনিয়ে তাঁর উপর সমগ্র রাজ্য পর্যবেক্ষণের ভার সমর্পণ করলেন এবং পরীক্ষিৎকে রাজা ও রাজ্যে অভিষিক্ত করে, দুঃখার্ত হয়ে সুভদ্রাকে বললেন, “সুভদ্রে, তোমার এই পুত্র পরীক্ষিৎ কুরুদেশের রাজা হবেন; আর যদুবংশীয়দের অবশিষ্ট অনিরুদ্ধ-পুত্র বজ্রকেও রাজা করা হয়েছে। পরীক্ষিৎ হস্তিনাপুরে থাকবেন আর যদুবংশীয় বজ্ৰ ইন্দ্রপ্রস্থে থাকবেন। তুমি এই দু’জনকেই রক্ষা করবে; কিন্তু অধর্মের দিকে মন দিয়ো না।”

এই কথা বলে ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সতর্ক থেকে তখন ধীমান কৃষ্ণ, বৃদ্ধ মাতুল বসুদেব এবং বলরাম প্রভৃতি সকলের উদ্দেশে যথাবিধানে তর্পণ ও শ্রাদ্ধ করলেন। তারপর যুধিষ্ঠির যত্নবান হয়ে কৃষ্ণের পারলৌকিক ফল কামনাপূর্বক তাঁর নাম উল্লেখ করে তপোধন বেদব্যাস, নারদ, মার্কণ্ডেয়, ভরদ্বাজ ও যাজ্ঞবল্ক্যকে সম্মানপূর্বক নিজের যোগ্যতানুসারে চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য ও পেয়—এই চতুর্বিধ সুস্বাদু ভোজ্যদ্রব্য ভোজন করালেন।

যুধিষ্ঠির তখন ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠগণকে শত শত ও সহস্র সহস্র রত্ন, বস্ত্র, গ্রাম, অশ্ব ও দাসী দান করলেন। তারপর ভরতশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির পুরবাসী ও দেশবাসী লোকদের সম্মুখে কৃপাচার্যকে সম্মানিত করে পরীক্ষিৎকে তাঁর শিষ্যরূপে সমর্পণ করলেন। তদনন্তর রাজর্ষি যুধিষ্ঠির সকল প্রজাকে আনিয়ে নিজের সমস্ত অভীষ্ট (সংসারত্যাগ) বললেন। তখন সেই পুরবাসী ও দেশবাসী লোকেরা যুধিষ্ঠিরের বাক্য শুনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন চিত্ত হয়ে তাঁর বাক্যের প্রশংসা করল না। বরং তারা তখন যুধিষ্ঠিরকে বলল, “আপনাদের এমন করা উচিত নয়।” কিন্তু কালের অবস্থাভিজ্ঞ যুধিষ্ঠির তাদের মত গ্রহণ করলেন না। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির এবং তাঁর ভ্রাতারা পুরবাসী ও দেশবাসী লোকদের সম্মানিত করে প্রস্থান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। এই সময়ে সহদেব কলিযুগ উপস্থিত হয়েছে জেনে হাসতে হাসতেই যেন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “বিশুদ্ধ ধর্ম চলে গিয়েছে এবং মিশ্ৰধর্ম উপস্থিত হয়েছে।” তাই শুনে যুধিষ্ঠির বললেন—

শ্রুত্বা তু দুর্মনা রাজা পর্যাপ্তং জীবনং মম।

কার্যাণি চ সমাপ্তানি সহদেবমুবাচ হ॥ মহাপ্রস্থানিক : ১ : ২১॥

“আমার জীবনে যথেষ্ট হয়েছে এবং কর্তব্যকর্মসকলও সমাপ্ত হয়েছে।”

গৃহপতি অগ্নিকে নিজের আত্মায় সমর্পণ করলেন যুধিষ্ঠির। যথাবিধানে নিজেদের অন্ত্যেষ্টি করে, শ্রাদ্ধাদি করে, অগ্নিহোত্রের অগ্নি জলে বিসর্জন দিলেন পাণ্ডবেরা। অর্জুনের মুখে কৃষ্ণের অন্তর্ধান সংবাদ শোনার বারোদিন পরে যুধিষ্ঠির সম্রাটের বসন-ভূষণ ত্যাগ করলেন। কৌপীনধারী হলেন যুধিষ্ঠির। আহার বন্ধ করে মৌনব্রত অবলম্বন করলেন। চুল খুলে দিয়ে তিনি জড়, উন্মত্ত তার পিশাচের রূপ ধারণ করলেন। তারপর বধিরের মতো কারও কথা না শুনে গৃহত্যাগ করলেন। হৃদয়ে পরমব্রহ্মের ধ্যান করতে করতে যুধিষ্ঠির অগ্রসর হলেন সেই উত্তর দিকে, যেদিকে ইতিপূর্বে মহাত্মারা সবাই গিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরের সাংসারিক জীবন শেষ হল।

*

বৃত্তটি সম্পূর্ণ হল। পরীক্ষিতের মৃত্যু দিয়ে কাহিনির শুরু হয়েছিল। পরীক্ষিৎকে সিংহাসনে বসিয়ে কাহিনি শেষ হল।

কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে আঠারো অক্ষৌহিণী সৈন্য সমবেত হয়েছিলেন। যুদ্ধের শেষে মাত্র দশজন জীবিত ছিলেন। পঞ্চ পাণ্ডব, কৃষ্ণ, সাত্যকি, অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা ও কৃপাচার্য। অমর অশ্বত্থামা কৃষ্ণের অভিশাপে নিকৃষ্ট স্থানে তিন হাজার বছরের জন্য নির্বাসিত হয়েছিলেন, আর একজন অমর কৃপাচার্য হস্তিনানগরে পরীক্ষিতের গুরুর পদে নিযুক্ত হয়ে থেকে গেলেন। যদুবংশ ধ্বংস পর্বে সাত্যকি আর কৃতবর্মা নিহত হলেন। যদুবংশ ধ্বংস করে কৃষ্ণ তনুত্যাগ করলেন। রইলেন পঞ্চপাণ্ডব। মহাপ্রস্থান যাত্রার পথে সহদেব, নকুল, অর্জুন ও ভীম মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। ধর্মরূপী কুকুরকে নিয়ে একা যুধিষ্ঠির পৌঁছেছিলেন চিরবাঞ্ছিত লোকে। সমস্ত জীবন যুধিষ্ঠির ধর্মকে রক্ষা করেছিলেন, ধর্মও রক্ষা করেছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। তাই শেষ পর্যন্ত ধর্মই একা সঙ্গী রইলেন যুধিষ্ঠিরের।

॥ স্বস্তিবচন ॥

মহাভারতের সূচনায় প্রথম শ্লোকে ব্যাসদেব লিখেছিলেন—

নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্।

দেবীং সরস্বতীঞ্চৈব ততো জয়মুদীরয়েৎ॥

নারায়ণকে নমস্কার করে, ব্রহ্মা এবং নর-ঋষির বন্দনা করে সরস্বতীর নাম উচ্চারণ করে তারপর ‘জয়’ ঘোষণা করবে।

সত্যযুগে সনাতন ব্রহ্ম দুইরূপে সর্বাপেক্ষা শক্তিমান ছিলেন। নারায়ণ এবং নর-ঋষি। দুইরূপ ধারণ করলেও এঁরা অভিন্ন ছিলেন। এঁরাই দুষ্কৃতী বিনাশের জন্য ও সুকৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বাপর যুগে মর্ত্যভূমিতে কৃষ্ণার্জুনরূপে অবতীর্ণ হন।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে নর-ঋষি অর্থাৎ অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু (চন্দ্রদেবের পুত্র বৰ্চার অংশাবতার)-এর পুত্র পরীক্ষিতের হস্তে হস্তিনাপুর রাজ্যের ভার দিয়ে যুধিষ্ঠির সংসার ত্যাগ করেন। কৃষ্ণের দেহলীলা সংবরণের পরে, কৃষ্ণপৌত্র অনিরুদ্ধর পুত্র বজ্রকে অর্জুন ইন্দ্রপ্রস্থে নিয়ে আসেন এবং ব্যাসদেব ও যুধিষ্ঠিরের অনুমোদন অনুসারে বজ্রকে ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্যের রাজপদে অভিষিক্ত করেন।

নারায়ণ এবং নর-ঋষির বংশধরদের হস্তে ভারতবর্ষের শাসনভার অর্পিত হয়। ব্যাসদেব ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে ধর্মের সঙ্গে স্বর্গলোকে উপস্থিত করিয়ে তাঁর ইতিহাস-গ্রন্থ সমাপ্ত করেন। যুধিষ্ঠিরের মহাপ্রস্থানের পরেই পৃথিবী থেকে ধর্মের সাময়িক বিলোপ ঘটল। কলিযুগের প্রতিষ্ঠা হল।

পৃথিবীতে আবার ধর্মের প্রতিষ্ঠা হবে। সত্ত্বগুণাশ্রয়ী মানুষ সত্যে প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষ পরাবিদ্যার অনুসন্ধানী হবে। মহাভারত ভারতবর্ষের এই অন্তর্নিহিত সত্যকেই শাশ্বতবাণীরূপে পাঠকের কাছে উপস্থিত করেছে। রাজন্যবর্গের ক্ষয়িষ্ণু শক্তির পুনরুদ্ধার করবেন নর-নারায়ণের বংশধরেরা। অন্তর্বর্তীকালে পাঠকদের প্রতীক্ষা প্রত্যাশিত থাকতে হবে।

________

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *