৫০
কীচক-বধ
তখন অজ্ঞাতবাসের দশ মাস কাল অতীত হয়েছে। দ্রৌপদী, যিনি রানি সুদেষ্ণার শুশ্রূষা পাবার যোগ্য, তিনিই ভাগ্যের পরিহাসে সুদেষ্ণার সেবা করে দিন অতিবাহিত করছেন। একদিন বিরাটরাজার সেনাপতি কীচক, রানি সুদেষ্ণার গৃহে পরিচারিকা রূপে দ্রৌপদীকে দেখল। দেবকন্যার ন্যায় রূপবতী, দেবকন্যার ন্যায় বিচরণকারিণী দ্রৌপদীকে দেখে কীচক তৎক্ষণাৎ কামার্ত হয়ে পড়ল। কামাগ্নি সন্তপ্ত কীচক আপন ভগ্নি সুদেষ্ণার কাছে গিয়ে বলল, “এই বিরাটরাজার গৃহে এমন সুলক্ষণা রমণী আমি পূর্বে কখনও দেখিনি। সুন্দর সুরা যেমন গন্ধ দ্বারা মাতাল করে, তেমনই এই সুন্দর ভঙ্গিশালিনী রমণী রূপ দ্বারা আমাকে উন্মত্ত করে তুলেছে। দেবতার তুল্য রূপবতী, শুভলক্ষণা ও চিত্তাকর্ষিণী এই সুন্দরীটি কে? কারই বা স্ত্রী? কোথা থেকে এসেছে? এ আমার চিত্ত মথিত করে আমাকে বশীভূত করেছে। এর সঙ্গে সঙ্গম ছাড়া আমার স্বাস্থ্যলাভের অন্য কোনও ঔষধ নেই বলে আমার মনে হচ্ছে।
“সুদেষ্ণা! তোমার এই সুন্দরী পরিচারিকাটি নূতন এসেছে বলে বোধ হচ্ছে। কিন্তু এ যে তোমার পরিচারিকার কাজ করছে, এটা আমার সঙ্গতবোধ হচ্ছে না। সুতরাং আমি বা আমার যা কিছু বস্তু আছে সে সমস্তের উপর এই নারী আধিপত্য করুক। আমার বিশাল ভবন, মনোহর ও সমৃদ্ধিযুক্ত। তাতে আবার বহুতর হস্তী, অশ্ব, রথ, পাত্র, খাদ্য, পেয় ও আশ্চর্য স্বর্ণভূষণ সকল রয়েছে। এই নারী সে ভবনকে শোভিত করুক।”
তারপর কীচক সুদেষ্ণার কাছে গোপনে এই কথা বলে, বনের ভিতর শৃগাল যেমন সিংহের কন্যার কাছে যায় তেমনই রাজনন্দিনী দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “সুন্দরী! তোমার এই সৌন্দর্য, এই প্রথম বয়স কেবল ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। কারণ কোনও পুরুষ ধারণ না করায় উত্তমা ও সুলক্ষণা মালার মতো সুন্দরী হয়েও তুমি শোভা পাচ্ছ না। ভাবিনি! আমার যে সকল পূর্ববর্তী স্ত্রী আছে, তাদের আমি ত্যাগ করব। তারা তোমার দাসী হবে। আমিও তোমার দাসের ন্যায় বশবর্তী হয়ে থাকব।” তখন দ্রৌপদী বললেন—
“অপ্রার্থনীয়াং প্রার্থ্যাং মাং সূতপুত্রাভিমন্যসে।
বিহীনবর্ণাং সৈরিন্ধ্রীং বীভৎসাং কেশকারিণীম্॥ বিরাট :১৩ :১৩॥
সূতপুত্র! আমি হীনবর্ণা কেশসংস্কারকারিণী নিন্দিতা সৈরিন্ধ্রী। সুতরাং আপনার অপ্রাপণীয়া। তথাপি আপনি আমাকে প্রার্থনীয়া বলে মনে করছেন। বিশেষত আমি পরের ভার্যা। আমি আমার স্বামিগণের প্রিয়তমা। সুতরাং আমাকে এমন কথা বলা আপনার উচিত নয়। আপনি ধর্মের বিষয় চিন্তা করুন, আপনার মঙ্গল হবে। আপনি কখনও পরস্ত্রীর প্রতি ইচ্ছা করবেন না। সৎপুরুষেরা কখনও অকার্য করেন না। মুগ্ধ ও পাপাত্মা ব্যক্তিরাই অনর্থক অন্যায় অভিলাষ করে ভয়ংকর নিন্দা ও ভয়ের পাত্র হয়ে থাকেন। সূতপুত্র! আমি বীরগণ দ্বারা সর্বতোভাবে রক্ষিত; সুতরাং আপনার অলভ্যা। আপনি আমাকে লভ্যা বলে মনে করলে আপনার জীবন সংশয় হবে। আমি আপনার বা অন্য কারোরই লভ্যা নই। সুতরাং আপনি সে চেষ্টা করলে আমার গন্ধর্ব স্বামীরা ক্রোধে আপনাকে বধ করবেন। নিজেকে নিজে বিনষ্ট করবেন না। যে পথে মানুষ যেতে পারেন না, আপনি সেই পথে যাবার চেষ্টা করছেন। নির্বোধ বালক যেমন নদীর এক তীরে থেকে কোনও যান ছাড়াই অন্য তীরে যেতে ইচ্ছা করে, অল্পবুদ্ধি আপনিও তেমনই অপ্রাপ্য পেতে ইচ্ছা করছেন। কীচক! তুমি যদি ভূ-গর্ভে প্রবেশ করো, কিংবা আকাশে উড়ে যাও, তবুও আমার ভর্তাদের হাত থেকে মুক্তিলাভ করবে না। কারণ, আমার স্বামীরা দেবতার পুত্র, সর্বপ্রকার শত্রুদমনে সমর্থ। রোগী যেমন মৃত্যু প্রার্থনা করে, তুমি আমাকে তেমনভাবে প্রার্থনা করছ। শিশু যেমন মাতার ক্রোড়ে শুয়ে আকাশের চাঁদকে পেতে চায়, তুমিও আমাকে তেমন করেই পেতে চাইছ।”
ভয়ংকর কামে জর্জরিত কীচক দ্রৌপদী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে সুদেষ্ণার কাছে গিয়ে বলল, “সুদেষ্ণা! সৈরিন্ধ্রীকে আমার কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করো। যদি আমাকে জীবিত দেখতে চাও তবে গজগামিনী সৈরিন্ধ্রী যাতে আমাকে ভজনা করে তার ব্যবস্থা করো।” ভ্রাতা কীচকের বারংবার এই এক বিলাপ শুনে দেবী সুদেষ্ণার মনে দয়া জাগ্রত হল। সুদেষ্ণা বললেন, “কীচক, কোনও উপলক্ষে আমাকে খাওয়ানোর জন্য তুমি বাড়িতে নিমন্ত্রণ করো। গৃহে উত্তম সুরা ও অন্ন প্রস্তুত করাও। তারপর আমি সেই সুরা আনাবার জন্য সৈরিন্ধ্রীকে তোমার গৃহে পাঠাব। তুমি তাকে উপযুক্ত নির্জন স্থানে এমন তোষামোদ করবে, যাতে ও তোমার প্রতি অনুরক্ত হয়।”
সুদেষ্ণা এই কথা বললে, কীচক নিজগৃহে গিয়ে রাজকীয় সুরা ও অন্ন প্রস্তুত করাল। ছাগ, শূকর ও অন্য পশুমাংস, সুশোভন অন্ন ও পানীয় প্রস্তুত করাল। তখন সুদেষ্ণা সৈরিন্ধ্রীকে কীচকের গৃহে পাঠাবার ইচ্ছা করলেন। সুদেষ্ণা বললেন, “সৈরিন্ধ্রী, কীচকের গৃহ থেকে আমার জন্য মদ নিয়ে এসো। কারণ উত্তম সুরার পিপাসা আমাকে কাতর করেছে।” কিন্তু সৈরিন্ধ্রী নির্লজ্জ কীচকের গৃহে যেতে অস্বীকার করলেন। তিনি বললেন, “অনিন্দ্যসুন্দরী! আমি আপনার গৃহে এসে পতিগণের নিকট ব্যভিচারিণী হয়ে কাম ব্যাপারে প্রবৃত্ত হব না। প্রশস্তস্বভাব দেবী! আপনার গৃহে প্রবেশের সময়, আমি যে নিয়ম করেছিলাম তা আপনি জানেন। মূঢ় ও কামমত্ত সেই কীচক আমাকে দেখেই অপমানিত করবে। রাজনন্দিনী! আপনার অনেক দাসী আছে। সুতরাং অন্য কোনও দাসীকে সেখানে পাঠান। আমার কথা শুনুন। আপনার মঙ্গল হবে।”
সুদেষ্ণা বললেন, “আমি এখান থেকে তোমাকে পাঠাচ্ছি। সুতরাং কীচক তোমাকে অপমান করবে না। এই কথা বলে রানি সুদেষ্ণা সৈরিন্ধ্রীর হাতে আবরণ যুক্ত স্বর্ণময় পানপাত্র প্রদান করলেন।” সৈরিন্ধ্রী আশঙ্কার সঙ্গে রোদন করতে লাগলেন। তিনি সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা জানালেন, “আমি পাণ্ডবগণ ব্যতীত অন্য পুরুষকে জানি না। সেই সত্যধর্ম হেতু কীচক যেন আমাকে বশীভূত করতে না পারে।” সূর্যদেব দ্রৌপদীর সেই স্তবের কারণ বুঝে দ্রৌপদীকে রক্ষা করার জন্য এক অদৃশ্য রাক্ষসকে নিযুক্ত করলেন। সেই রাক্ষসও ছায়ার মতো দ্রৌপদীর সঙ্গে থাকতে লাগল।
সৈরিন্ধ্রীরূপী দ্রৌপদী মদ আনবার জন্য কীচকের গৃহে উপস্থিত হলেন। পাড়ে নৌকা পেলে পাড়গামী ব্যক্তি যেমন উঠে দাঁড়ায় তেমনই হরিণীর মতো ত্ৰস্তা দ্রৌপদীকে আসতে দেখে কীচক আনন্দে উঠে দাঁড়াল। কীচক বলল, “তোমার আসতে কোনও অসুবিধা হয়নি তো। তুমি আমার সর্বস্বের অধিশ্বরী। আজ আমার সুপ্রভাত হয়েছে, কারণ তুমি আমার কাছে এসেছ। এখন তুমি আমার প্রিয়কার্য করো। সোনার মালা, শাঁখা, দুটি কুণ্ডল, নানারত্ন খচিত নির্মল দুটি কেয়ূর, সুন্দর মণি ও রত্ন এবং নানাবিধ পট্টবস্ত্র ভৃত্যেরা তোমার জন্য এনে দেবে। আমি তোমার জন্য কল্পিত এক দিব্য শয্যা রচনা করে রেখেছি, সেইখানে চলো, আমার সঙ্গে মিলে পুষ্পমদ্য পান করো।”
দ্রৌপদী বললেন, “সুদেষ্ণা দেবী সুরা নিয়ে যাবার জন্য আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন এবং বলেছেন যে তিনি অত্যন্ত পিপাসার্তা, আমাকে সত্বর সুরা নিয়ে যেতে বলেছেন।”
কীচক বলল, “অন্য দাসীরা সুদেষ্ণার জন্য সুরা নিয়ে যাবে।” এই বলে কীচক দ্রৌপদীর ডান হাত ধরে বিশালনয়না দ্রৌপদীকে আলিঙ্গন করতে চাইল; তখন দ্রৌপদী তাকে তিরস্কার করে উঠলেন। কীচক দ্রুত ছুটে এসে আবার দ্রৌপদীকে ধরল। তখন সুলক্ষণা দ্রৌপদী ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে কীচককে তীব্র ধাক্কা মারলেন। পাপাত্মা কীচক ছিন্নমূল বৃক্ষের মতো ভূমিতে পতিত হল। কীচককে ভূতলে নিক্ষেপ করে দ্রৌপদী কাঁপতে কাঁপতে দ্রুতবেগে রাজসভায় শরণাপন্ন হতে চললেন; সে সভায় রাজা যুধিষ্ঠির ছিলেন। দ্রৌপদী দ্রুতবেগে রাজার কাছে যাচ্ছিলেন, সেই অবস্থায় কীচক তাঁর কেশাকর্ষণ করে বিরাটরাজার সামনেই তাঁকে মাটিতে ফেলে পদাঘাত করল। তখন সূর্যদেব দ্রৌপদীর রক্ষার জন্য যে রাক্ষসটিকে নিযুক্ত করেছিলেন, সেই রাক্ষস বায়ুবেগে কীচককে গিয়ে এক ধাক্কা দিল। রাক্ষসের আঘাতে আহত কীচক নিশ্চেষ্টভাবে মাটিতে পড়ে রইল। এদিকে সেইখানে উপবিষ্ট ভীম ও যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর উপর কীচকের পদাঘাত সহ্য করতে না পেরে, দুঃখ ও রোষের সঙ্গে দ্রৌপদীর দিকে তাকালেন। মহাবল ভীমসেন সেই কীচককে বধ করবার জন্য দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ করতে লাগলেন।
এই সময়ে লোকে বুঝে ফেলবে এই ভয়ে রাজা যুধিষ্ঠির আপন চরণাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা ভীমের চরণাঙ্গুষ্ঠ মর্দন করে ভীমকে নিষেধ করলেন। ধর্মচারিণী, সুদেহিনী দ্রৌপদী তখন যুধিষ্ঠিরের অজ্ঞাতবাসের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য কীচক বধের ইঙ্গিত না করে, সভার মধ্যে গিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে একবার যুধিষ্ঠির ও ভীমের দিকে তাকালেন, তারপর প্রচণ্ড ক্রোধে বিরাটরাজাকে যেন দগ্ধ করতে করতে তাঁকে বললেন, যাঁদের শত্রু তাঁদের দেশ থেকে ষষ্ঠদেশ দূরে থেকেও ভয়ে নিদ্রা যায় না, আমি তাঁদের মানিনী ভার্যা। এই সূতপুত্র আমাকে পদাঘাত করল। ব্রাহ্মণ হিতৈষী ও সত্যবাদী যে বীরেরা কেবল দানই করেন, কখনও প্রার্থনা করেন না, আমি তাঁদেরই মানিনী ভার্যা; আমাকেই সূতপুত্র পদাঘাত করল।
যেষাং দুন্দুভিনির্ঘোষো জ্যাঘোষঃ শ্ৰূয়তে মহান।
তেষাং মাং মানিনীং ভার্যাং সূতপুত্রঃ পদাহবধীৎ॥ বিরাট : ১৫ : ১৯ ॥
“যে বীরগণের ধনুর্গুণাস্ফালনের শব্দ দুন্দুভি শব্দের ন্যায় বৃহৎ শোনা যায়, আমি তাঁদেরই মানিনী ভার্যা, আর আমাকেই সূতপুত্র পদাঘাত করল। যাঁরা তেজস্বী, জিতেন্দ্রিয়, বলবান ও অভিমানী, আমি তাঁদেরই মানিনী ভার্যা; আর আমাকেই সূতপুত্র পদাঘাত করল। অনায়াসে যাঁরা জগৎ ধ্বংস করতে পারেন, কিন্তু বর্তমানে ধর্মপাশে আবদ্ধ হয়ে আছেন, আমি তাঁদেরই মানিনী ভার্যা; সেই আমাকে সূতপুত্র পদাঘাত করল!
“শরণার্থীদের চিরকাল যাঁরা রক্ষা করে থাকেন; যাঁরা গুপ্তভাবে লোকসমাজে বিচরণ করছেন, সেই মহারথগণ এখন কোথায়? সতী ও প্রিয়তমা পত্নীকে সূতপুত্র পদাঘাত করল; এ দেখেও যাঁরা তাঁকে রক্ষা করছেন না, তাঁদের ক্রোধ, বীর্য ও তেজ কোথায় গেল। আমি নিরপরাধ, তবুও কীচক আমাকে পদাঘাত করল; এ দেখেও যে বিরাটরাজা কীচককে ক্ষমা করছেন, সেই বিরাটরাজা যদি ধর্মদুষ্ট হন, তবে আমি অবলা নারী কীচকের আর কী করতে পারি? রাজা, আপনি কীচকের প্রতি রাজোচিত আচরণ করছেন না, সুতরাং আপনার রাজসভা ধর্ম দ্বারা রক্ষিত নয়, দস্যু দ্বারা পীড়িত। সুতরাং আপনার রাজ্যে আমার আর বাস করা সঙ্গত হচ্ছে না। সভাসদগণও এই কীচকের অত্যাচার দেখুন। কীচক তো ধর্মাচারী নয়ই, মৎস্যরাজাও ধর্মাচারী নন, যে সভ্যগণ এই অধর্মাচারী রাজার সেবা করছেন তাঁরাও ধর্মাচারী নন।”
দ্রৌপদীর তীক্ষ্ণ তীব্র ভর্ৎসনা শুনে বিরাটরাজা বললেন, “সৈরিন্ধ্রী, আমার অগোচরে তোমাদের মধ্যে যে বিবাদ হয়েছে, তা আমি জানি না। সুতরাং তোমার এই অপমানের যথার্থ কারণ না জেনে, আমি কী বিচার করতে পারি?” দ্রৌপদী সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং কীচক বিশেষভাবে দোষী, সভাসদগণ এই ঘটনা জেনে দ্রৌপদীর প্রশংসা ও কীচকের নিন্দা করতে লাগলেন।
সভাসদগণ বললেন, “এই সর্বাঙ্গসুন্দরী দীর্ঘনয়না নারী যাঁর ভার্যা, তিনি যথার্থই ভাগ্যবান এবং সেই ব্যক্তি কখনই শোক পাবেন না। এই নারীর মতো সর্বাঙ্গসুন্দরী নারী মনুষ্যসমাজে দুর্লভা, সুতরাং আমাদের ধারণা, ইনি কোনও দেবী হবেন।”
সভাসদগণ দ্রৌপদীকে এইভাবে প্রশংসা করছেন দেখে ক্রোধে যুধিষ্ঠিরের কপালে ঘাম জমতে লাগল। তিনি তাঁর প্রিয়তমা মহিষী দ্রৌপদীকে বললেন, “সৈরিন্ধ্রী তুমি এখানে থেকো না, রানি সুদেষ্ণার কাছে যাও। দেখো, বীরপত্নীরা ভর্তাদের অনুসরণ করতে থেকে কষ্টও পান, কিন্তু ভর্তাদের সেবা করেই পতিলোক জয় করেন। তোমার ভর্তারা এখনও ক্রোধের সময় হয়েছে বলে মনে করছেন না—সেই কারণেই সূর্যতুল্য গন্ধর্বগণ প্রতিকার করার জন্য তোমার কাছে আসছেন না। তুমি প্রতিকারের সময় বোঝ না, তাই নটীর মতো রোদন করছ, রাজসভায় ক্রীড়াকারী মৎস্যদেশীয়গণের ক্রীড়ায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছ। অতএব সৈরিন্ধ্রী তুমি যাও, তোমার গন্ধর্ব স্বামীরা তোমার প্রিয় কার্য করবেন। যে লোক তোমার প্রতি অপ্রিয় আচরণ করেছে, তাকে সুনিশ্চিতভাবে দণ্ড দিয়ে তোমার দুঃখ দূর করবেন।”
দ্রৌপদী বললেন, “যাঁদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্যূতক্রীড়ায় আসক্ত; সেই মহাদয়ালুদের জন্যই আমি ভোগের সময়ও ধর্মচারিণী হয়েছি। তা না হলে সেই দুর্জনদের তাঁরা তখনই বধ করতেন।” ক্রোধে আরক্তা দ্রৌপদী এই কথা বলে কেশকলাপ মুক্ত রেখেই দ্রুত সুদেষ্ণার ভবনে চলে গেলেন।
তখন দ্রৌপদী জল দ্বারা বস্ত্রযুগল প্রক্ষালন করলেন। কারণ কীচকের পদাঘাতে ভূতলে পতিত হওয়ায় এবং রোদনের জন্য বস্ত্রযুগল অপরিচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। তারপর তিনি দুঃখ পরিশোধের উপায় চিন্তা করতে লাগলেন এবং “ভীম ছাড়া অন্য কেউই আমার মনের প্রিয় কাজ করতে পারবে না” এই চিন্তা করে মনে মনে ভীমকেই স্মরণ করতে লাগলেন। গভীর রাতে দ্রৌপদী শয্যা ত্যাগ করে আশ্রয় লাভের জন্য আপন পতি ভীমসেনের নিকট যাওয়ার জন্য গৃহ পরিত্যাগ করলেন। রন্ধনশালায় উপস্থিত হয়ে দ্রৌপদী নিদ্রিত ভীমসেনকে দেখতে পেলেন। ধেনু যেমন মহাবৃষের কাছে গমন করে, তেমনই দ্রৌপদী ভীমসেনের কাছে গিয়ে, দুর্গম বনে সিংহী যেমন নিদ্রিত সিংহকে আলিঙ্গন করে, নিদ্রিত পাণ্ডুনন্দন ভীমসেনকে আলিঙ্গন করে বললেন, “ভীমসেন! ওঠো ওঠো; মৃতব্যক্তির মতো কেমন করে শায়িত আছ? কারণ, পাপিষ্ঠ লোেক জীবিত ব্যক্তির ভার্যাকে স্পর্শ করে কখনও জীবিত থাকে না। পাপিষ্ঠ কীচক আমাকে পদাঘাত করে এখনও জীবিত আছে, এ অবস্থায় তুমি নিদ্রিত থাক কেমন করে?”
দ্রৌপদী এইভাবে জাগিয়ে তুললে ভীমসেন নিদ্রা ত্যাগ করে শয্যায় উঠে বসলেন এবং প্রিয়তমা মহিষী দ্রৌপদীকে বললেন, “তুমি কী প্রয়োজনে, এত ব্যস্ত হয়ে আমার কাছে এসেছ। তোমাকে কৃশ দেখাচ্ছে, তোমার গাত্রবর্ণও স্বাভাবিক নয়। সমস্ত ঘটনা আমাকে বলো, যাতে আমি সব জানতে পারি। সুখ, দুঃখ, প্রিয়, অপ্রিয় সমস্ত ঘটনা আমাকে বলো— তোমার বক্তব্য শুনে আমি আমার কর্তব্য নির্ধারণ করব। কৃষ্ণা তুমি সকল অবস্থায় আমাকে বিশ্বাস কোরো, আমি তোমাকে বারবার বিপদ থেকে উদ্ধার করব। আর তোমার বক্তব্য বলে দ্রুত এই স্থান ত্যাগ করো, অন্যে জানতে পারে তা আমি চাই না।”
দ্রৌপদী বললেন, “যুধিষ্ঠির যার স্বামী, তার কপালে দুঃখ থাকবে না কেন? কিন্তু তুমি সমস্ত জেনেও আমাকে আবার তা বলতে বলছ কেন? দ্যূতক্রীড়ার সময়ে দুর্যোধন আমাকে ‘দাসী দাসী’ বলেছিল এবং বলপূর্বক অভিজাত বিদ্বান পুরুষমণ্ডলীর মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, তা স্মরণ করলে আমি দগ্ধ হতে থাকি। আমি ভিন্ন অন্য কোন রাজকন্যা এত দুঃখ সহ্য করেছেন? তারপর দ্বৈতবনে জয়দ্রথ দ্বিতীয়বার আমার কেশাকর্ষণ করেছিল, অন্য কোনও নারী তা সহ্য করতে পারে? আজও সেই দ্যূতক্রীড়া প্রবৃত্ত মৎস্যরাজের সামনেই কীচক আমাকে পদাঘাত করেছে। ভীমসেন! যে দুঃখ সহ্য করে আমি জীবিত আছি, তা কি তোমার অজানা? আমার বেঁচে থাকার ফল কী? বিরাটরাজার শ্যালক ও সেনাপতি দুরাত্মা কীচক সৈরিন্ধ্রী থাকার সময়ে রাজভবনে সর্বদাই আমাকে বলে— ‘তুমি আমার ভার্যা হও।’ কীচক যখন একথা আমাকে বলে তখন পাকা ফলের মতো আমার হৃদয় যেন বিদীর্ণ হয়। তুমি তোমার দ্যূতক্রীড়াকারী জ্যেষ্ঠভ্রাতার নিন্দা করো, তাঁর জন্যই আমি এই অনন্ত দুঃখ ভোগ করছি। যুধিষ্ঠির ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি নিজের শরীর, রাজ্য ও সর্বস্ব ত্যাগ করে বনবাসের জন্য দ্যূতক্রীড়া করেন? তিনি যদি দশ হাজার মোহর, অন্য মূল্যবান ধন, রুপা, সোনা, বস্ত্র, যান, বাহন, ছাগল, মেষ, অশ্ব ও অশ্বতর— একটার পর একটা পণ ধরে বহু বছর ধরে ক্রীড়া করতেন, তা হলেও তাঁর কোষ কখনও ক্ষয় হত না। সেই যুধিষ্ঠির অনবধানতাবশত ঐশ্বর্যভ্রষ্ট হয়ে, আপন কৃতকার্যের কথা চিন্তা করতে করতে বিকল চিত্তে বসে আছেন। কোথাও যেতে গেলে, দশ সহস্র সাধারণ হস্তী এবং বহু সহস্র স্বর্ণমাল্যধারণকারী মহাহস্তী যাঁর পিছনে পিছনে যেত, তিনি আজ পাশা খেলে লব্ধ ধনদ্বারা জীবিকা নির্বাহ করছেন। শত সহস্র রাজা ইন্দ্রপ্রস্থে এসে যুধিষ্ঠিরের স্তব করতেন। শত সহস্র দাসী পাত্র হাতে করে দিবারাত্র যুধিষ্ঠিরের অতিথিদের ভোজন করাত, প্রত্যহ সহস্র সহস্র স্বর্ণমুদ্রাদাতা, দাতৃশ্রেষ্ঠ সেই যুধিষ্ঠির পাশা খেলার ফলে গুরুতর বিপদপ্রাপ্ত হয়েছেন। মধুর স্বরসম্পন্ন সুপরিষ্কৃত মাল্যধারী বহুতর বন্দি ও চারণ সন্ধ্যাকালে ও প্রভাতে এই যুধিষ্ঠিরের উপাসনা করত। তপস্বী ও শাস্ত্রজ্ঞ ঋষিরা তাঁর কাছে আসতেন। যুধিষ্ঠির অকাতরে অন্ধ, বৃদ্ধ ও বালকদের ভরণ-পোষণ করতেন। সেই যুধিষ্ঠির আজ ‘কঙ্ক’ নাম নিয়ে বিরাটরাজার সঙ্গে আলাপ করেন। যিনি উপহার দিয়ে প্রার্থীদের প্রার্থনা পূর্ণ করতেন, তিনি অন্য লোকের কাছে সম্পদলাভ করতে রত আছেন। পৃথিবীপালক রাজা যুধিষ্ঠির পরের অধীনে বিবশ অবস্থায় বাস করছেন। যিনি সমগ্র পৃথিবীকে সন্তপ্ত করতেন, তিনি আজ পরের সভাসদ হয়ে বাস করছেন। পরের উপাসনার অযোগ্য, মহাপ্রাজ্ঞ ও ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যের আশ্রয় নিয়েছেন দেখে কার না দুঃখ হয়? মধ্যমপাণ্ডব! তুমি কি আমার এই দুঃখ অনুভব করতে পারছ না?
“কুন্তীনন্দন! আমার অসহ্য দুঃখ অনুভব করো। আমি তোমাদের কাউকে দোষারোপ করছি না। আমি গভীর দুঃখেই আমার অন্তরের কথা বলছি। অত্যন্ত নিকৃষ্ট এবং আপনার পক্ষে অযোগ্য কারুকার্য করার সময়ে তুমি যে ‘বল্লব’ নামে নিজের পরিচয় দাও, তাতে আমার মন শুকিয়ে যায়। পাকগৃহে পাককার্য শেষ হয়ে গেলে তুমি যে বিরাটরাজার সভায় গিয়ে তাঁর উপাসনা করো, তাতে দুঃখে বেদনায় আমার মন অবসন্ন হয়ে পড়ে। রানি সুদেষ্ণার সামনে তুমি যখন পশুশালা থেকে আগত ব্যাঘ্র, সিংহ ও বন্য মহিষদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, তখন বিপদাশঙ্কায় আমার মোহ উপস্থিত হয়। আমি উদ্বিগ্ন এবং মূৰ্ছিতপ্রায় দেখে, রানি সুদেষ্ণা যখন বলেন, ‘এই নির্মল মৃদুহাসিনী সৈরিন্ধ্রী একত্র বাস করার ফলে স্নেহবশতই এই বল্লবের বিষয়ে শোক করে। সৈরিন্ধ্রী সুন্দরী, বল্লবও অত্যন্ত সুন্দর। এদের রূপ পরস্পরের যোগ্য আর স্ত্রীলোকের মন বোঝা অতি দুষ্কর। এরা দুজনেই প্রায় এক সময়ে এসেই রাজবাড়িতে বাস করছে। সৈরিন্ধ্রী সকল সময়েই বল্লবের সঙ্গে অতি সদয়ভাবে বাক্যালাপ করে।’ সুদেষ্ণার এই বাক্যে আমার মনে খেদ জন্মায়, আমাকে ক্রুদ্ধ দেখে, সুদেষ্ণা আরও মনে করেন আমি তোমার প্রতি অনুরাগিণী। তাঁর কথা শুনে আমার গভীর দুঃখ হয়। যুধিষ্ঠির কৃত এই শোকসাগরে মগ্ন হয়ে আমি আর জীবন ধারণ করতে পারছি না।
“এক রথেই যিনি দেবতা, মানুষ ও দেবগণকে জয় করেছিলেন, সেই যুবক অর্জুনও এখন বিরাটরাজার কন্যার নৃত্যশিক্ষকের কার্য করছেন। যে অর্জুন খাণ্ডববনে অগ্নিদেবকে পরিতৃপ্ত করেছিলেন, তিনি এখন অন্তঃপুরে কূপে গুপ্ত অগ্নির মতো বাস করছেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুনের নাম শুনলেই শত্রুরা ভীত হন, তিনি আজ নপুংসকবেশে বিরাটরাজার অন্তঃপুরে বাস করছেন। যাঁর জ্যা-নির্ঘোষ শুনলে শত্রুরা কম্পিত হত তিনি এখন গীতবাদ্যাদির দ্বারা স্ত্রীলোকের মনোরঞ্জন করছেন। যাঁর পরিঘতুল্য বাহুযুগল ধনুর গুণঘর্ষণে কঠিন, তিনি হাতে শাঁখা বালা পরে আছেন। যাঁর মাথায় সূর্যের মতো উজ্জ্বল কিরীট শোভা পেত, সেই অর্জুন মাথার কেশকে বেণীদ্বারা বেঁধে রাখেন। বেণীকৃতবেশ ও কন্যা পরিবেষ্টিত অর্জুনকে দেখে আমার মন অবসন্ন হয়ে পড়ে। যে মহাত্মার কাছে সমস্ত স্বর্গীয় অস্ত্র আছে, সেই অর্জুন স্ত্রীধার্য কুণ্ডল কানে বেঁধেছেন। সহস্র সহস্র রাজাও যাঁর সম্মুখবর্তী হতে চান না, সেই অর্জুন নপুংসকের বেশে কন্যাগণের পরিচারক হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। পর্বত, বন ও দ্বীপের সঙ্গে স্থাবর ও জঙ্গম প্রাণীগণ ও সমগ্র পৃথিবী যাঁর রথের শব্দে কম্পিত হত, যাঁর জন্মের পর কুন্তীদেবীর সব দুঃখ নষ্ট হয়েছিল, তোমার কনিষ্ঠভ্রাতা সেই অর্জুন আজ আমার শোক জন্মাচ্ছেন। অলংকারে অলংকৃত, শঙ্খবলয়ে আবৃত হস্ত, কনক ও কেয়ূরে সজ্জিত অর্জুনকে দেখলে আমার মন অবসন্ন হয়ে পড়ে। অতুলনীয় ধনুর্ধর অর্জুন কন্যাগণ পরিবেষ্টিত হয়ে গান গাইছেন। ধর্মপরায়ণ, সত্যাশ্রয়ী অর্জুন আজ স্ত্রীবেশে বিকৃত হয়ে আছেন। হস্তিনাপুরের মদস্রাবী হস্তীর মতো অৰ্জুন ধনপতি মৎস্যরাজার উপাসনা করছেন, আমার চোখ যেন অন্ধ হয়ে যায়। অর্জুনের স্ত্রীবেশে জীবনযাপনের কষ্ট তুমি বুঝতে পারো না?
“কুন্তীনন্দন। তোমাদের সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা, সুবক্তা সহদেব যখন গোপবেশে পথে বিচরণ করেন, তখন লজ্জায়, কুণ্ঠায় আমি বিবর্ণ হয়ে যাই। সকলের প্রিয়, সকলের কনিষ্ঠ পাণ্ডুনন্দন সহদেব বিরাটরাজার গোপগৃহে গো-পরীক্ষা ও গো-পালন দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করছেন, এই দুঃখের আগুনে আমি দগ্ধ হতে থাকি। গো-রক্ষণাদি কার্য সম্পন্ন করে সহদেব অন্য গোপগণের অগ্রে থেকে যখন বিরাটরাজাকে অভিবাদন করতে যান, তখন আমার যেন জ্বর আসে। আমার শ্বশ্রূ আর্যা কুন্তীদেবী সর্বদাই বীর সহদেবের প্রশংসা করেন, ‘যাজ্ঞসেনী, সহদেব কৌলীন্যাভিমানী, সচ্চরিত্র, সদাচারী, লজ্জাশীল মধুরভাষী, ধার্মিক, কোমল, বীর এবং যুধিষ্ঠিরের অনুগত। তুমি বনমধ্যে রাত্রিতেও সহদেবের ভার বহন কোরো, নিজের হাতে তাকে খাইয়ে দিয়ো। বনে আসার সময় আমাকে আলিঙ্গন করে কুন্তীদেবী এই কথা বলেছিলেন।’ সেই সহদেব গো-রক্ষণে ব্যাপৃত এবং রাত্রিতে গো-বৎসগণের সঙ্গে শায়িত দেখেও আমাকে জীবনধারণ করতে হচ্ছে।
“ভীমসেন তুমি কালের অদ্ভুত বিপর্যয় লক্ষ করো। যিনি সর্বদাই রূপ, অস্ত্রবিদ্যা, বুদ্ধি— এই তিনগুণ সম্পন্ন, সেই নকুল বিরাটরাজার অশ্বরক্ষক হয়েছেন। বন্ধনরজ্জু নিয়ে নকুল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অশ্বদের যখন শিক্ষা দিতে দিতে বিরাটরাজাকে উপাসনা করতে থাকেন, তখন আমি গভীর দুঃখ অনুভব করি। স্বামী কুন্তীনন্দন, যুধিষ্ঠিরের জন্য আমাকে এত দুঃখ সহ্য করতে হচ্ছে। তোমরা বর্তমান থাকতেও আমি বিশুষ্ক দেহ ও বিবর্ণ হয়ে দুঃখজর্জরিত আছি। সৈরিন্ধ্রীবেশে বিরাট রাজভবনে থেকে আমি সুদেষ্ণার শৌচসম্পাদন করছি। আমি রাজপুত্রী, আমি কালের প্রতীক্ষা করছি, ভর্তাদের সম্পদলাভের জন্য অপেক্ষা করে আছি। মানুষ সম্পন্ন অবস্থায় দান করে আবার দরিদ্র অবস্থায় প্রার্থনা করে, সবল অবস্থায় নিহত করে, আবার দুর্বল অবস্থায় নিহত হয়, যোগ্যতার দ্বারা অন্যকে নিপাতিত করে, অযোগ্যতার সময়ে অন্য কর্তৃক নিপাতিত হয়। তারপর যে ঘটনা মানুষের জয়ের কারণ হয়, সেই ঘটনাতেই তার পরাজয় ঘটে। কালের জন্য প্রতীক্ষা করা ছাড়া আমার আর কিছু করারও নেই। দৈবকে অতিক্রম করা যায় না, দৈবের দুষ্করও কিছু নেই। আমি পুনরায় সুদৈবের প্রতীক্ষা করছি। দৈব সুসম্পাদিত বিষয়কেও নষ্ট করে, তাই বিজ্ঞ লোক সুদৈবকে আনার চেষ্টা করেন। আমি পাণ্ডবগণের মহিষী এবং দ্রুপদরাজার কন্যা হয়েও এই দুরবস্থা ভোগ করছি; এতে আমি ছাড়া কোন রমণীর জীবিত থাকতে ইচ্ছা করে।
“পাণ্ডুনন্দন! আমার এই কষ্ট প্রত্যক্ষভাবে তোমাদের আশ্রয় করে আছে, ক্রমে কৌরব ও পাঞ্চালদেরও পরিভূত করবে। বহুতর ভ্রাতা, শ্বশুর ও পুত্র কর্তৃক পরিবেষ্টিতা এবং সম্পত্তিশালিনী, অন্য কোনও রমণী এমন দুঃখভোগ করে। আমি বাল্যকালে বিধাতার কোন অপ্রিয় কার্য করেছিলাম যে, এতদূর কষ্টভোগ করছি। বনবাসের বারো বছরেও আমার শরীর এত বিবর্ণ হয়নি, এখন যেমন হয়েছে। আমার ইন্দ্রপ্রস্থের জীবনযাত্রা তুমি জানো— সেই আমি এখন পরের দাসী ও অধীন হয়ে শান্তি পাচ্ছি না। আমি জানি যে আমার এই দুঃখও দৈবকৃত। কারণ, যে দুঃখে ভয়ংকর ধনুর্ধর ও মহাবাহু পৃথানন্দন অৰ্জুনও তেজোবিহীন অগ্নির মতো রয়েছেন। আমি এও জানি যে, তোমাদের এই মহাদুঃখ অতিরিক্তই ছিল এবং অতর্কিত ছিল। ইন্দ্রতুল্য তোমরা সর্বদাই যার মুখাপেক্ষী ছিলে, সেই আমি, শ্রেষ্ঠ হয়েও, নিকৃষ্ট নারীদের মুখাপেক্ষিণী হয়ে আছি। তোমরা পঞ্চভ্রাতা জীবিত থাকতে, আমার যে অবস্থা ভোগ করার কথা নয়, সেই অবস্থা সহ্য করতে হচ্ছে। সসাগরা ধরণী যার বশবর্তিনী ছিল, সেই আমি, রানি সুদেষ্ণার অনুবর্তিনী হয়ে আছি। ভৃত্যেরা যার আগে ও পিছে চলত, সেই আমি রানি সুদেষ্ণার সামনে ও পিছনে চলতে বাধ্য হচ্ছি। যে আমি, দেবী কুন্তী ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির জন্য, এমনকী নিজের জন্যেও গায়ে মাথায় চন্দন পেষণ করিনি, সেই আমাকে, অন্যের জন্য গাত্রানুলেপন, পেষণ করতে হচ্ছে। তুমি আমার হাত দেখো, আমার হাতে কড়া পড়ে গেছে। যে আমি কখনও কুন্তীদেবী বা তোমাদের সামনে ভীত হইনি, সেই আমাকে বিরাটরাজের সম্মুখে ভীত হয়ে চলতে হয়। অন্যের ঘষা চন্দন রাজার ভাল লাগে না। এই কারণে বিরাটরাজার মন্তব্যের জন্য আমি ভীত হয়ে থাকি।”
ভীমের প্রতি অনুরক্তা দ্রৌপদী তাঁর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে রোদন করতে থাকলেন। বারবার নিশ্বাস ত্যাগ করে গদগদকণ্ঠে দ্রৌপদী ভীমকে বললেন, “পাণ্ডুনন্দন ভীমসেন। আমি কোনওদিন দেবগণের অপ্রিয় কার্যে জড়িত থাকিনি। যে কারণে অবধারিত মৃত্যু সত্ত্বেও আমি ভাগ্যহীন হয়ে বেঁচে আছি।” তখন বিপক্ষবীরহন্তা ভীমসেন দ্রৌপদীর কড়া পড়া হাত চোখের সামনে তুলে এনে অনেক চোখের জল ফেললেন। সেই অবস্থায় আবেগে বশীভূত ভীমসেন অশ্রু ত্যাগ করে দ্রৌপদীকে বললেন, “যাজ্ঞসেনী আমার বাহুবল ও অর্জুনের গাণ্ডিবকে ধিক; কারণ তোমার স্বাভাবিক রক্তবর্ণ করতলে কড়া পড়েছে। আমি বিরাটরাজার সভায় কীচককে গুরুতর শাস্তি দিতাম, কিন্তু যুধিষ্ঠির অজ্ঞাতবাস সমাপ্তির প্রতীক্ষা করছেন, তাই আমি কিছু করতে পারিনি। তা নাহলে আমি খেলার যোগ্য সে মহাহস্তী কীচককে বধ করার জন্য একটি মাত্র পদাঘাত করতাম। যখন তোমাকে কীচক পদাঘাত করল, আমার সমস্ত মৎস্যদেশকে গুরুতর পীড়নের ইচ্ছা হয়েছিল।
“কিন্তু ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তখন আমাকে কটাক্ষ দ্বারা নিবারণ করলেন। আমি সেই কটাক্ষ বুঝতে পেরেই নিবৃত্ত হলাম। তারপর, কৌরবদের সামনেই, আমাদের যে রাজ্য ছেড়ে বনবাসে যেতে হয়েছিল এবং পাপাত্মা দুর্যোধন, কর্ণ, সুবলপুত্র শকুনি ও দুঃশাসনের মস্তক যে আমি দেহচ্যুত করতে পারিনি, তা হৃদয়ে প্রবিষ্ট শল্যের মতো প্রতি মুহূর্তে আমাকে দগ্ধ করছে। তথাপি হে সুনিতম্বে! তুমি ধর্ম নষ্ট কোরো না। তুমি বুদ্ধিমতী নারী। ক্রোধ পরিত্যাগ করো। কারণ, রাজা যুধিষ্ঠির যদি তোমার মুখ থেকে এই তিরস্কার শোনেন, তিনি নিশ্চয়ই জীবন ত্যাগ করবেন। তা হলে, অর্জুন, নকুল ও সহদেবও জীবন ত্যাগ করবে এবং এঁরা চলে গেলে আমিও জীবিত থাকতে পারব না। তুমি জানো, পুরাকালে ভূগুপুত্ৰ চ্যবনমুনি তপস্যা করতে করতে উইপোকার স্তূপে ডুবে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি শান্ত থেকেই বনে গমন করেছিলেন এবং তাঁর ভার্যা সুকন্যা দেবীও স্বামীর অনুসরণ করেছিলেন। তুমি শুনে থাকবে যে, পূর্বকালে নারায়ণমুনির কন্যা রূপবতী চন্দ্রসেনা সহস্র বৎসর ধরে বৃদ্ধপতি মুদ্গলমুনির সেবা করেছিলেন। তুমি জানো যে, জনক রাজার কন্যা বৈদেহী সীতাও মহারণ্যবাসী স্বামী রামচন্দ্রের অনুসরণ করেছিলেন। রামচন্দ্রের প্রিয়তমা সেই সীতা দেবী রাবণ কর্তৃক নিগৃহীতা হয়েও কষ্ট পেতে থেকে রামেরই অনুসরণ করেছিলেন। বয়স ও রূপসমন্বিতা লোপামুদ্রা পিতৃগৃহের সমস্ত মনোহর কাম্যবস্তু ত্যাগ করে পতি মুনিশ্রেষ্ঠ অগস্ত্যের অনুগমন করেছিলেন। এই সমস্ত নারী যেমন রূপবতী ও গুণবতী ছিলেন, তুমিও তেমনই সমস্ত গুণসম্পন্না। অতএব পাঞ্চালী, তুমি এই অল্পদিন—অর্থাৎ মাত্র আর পনেরোটি দিন দুঃখ সহ্য করো। তারপর ত্রয়োদশ বৎসর পূর্ণ হলে, তুমি রাজ্ঞীশ্রেষ্ঠা হবে।”
দ্রৌপদী বললেন, “মধ্যমপাণ্ডব! আমি দুঃখে কাতর হয়েই অশ্রুমোচন করেছি; কিন্তু রাজাকে তিরস্কার করছি না। অতীত আলোচনার এখন আর কোনও ফল নেই। বর্তমানে যে কার্যসম্পাদনের প্রয়োজন, তা সম্পন্ন করুন। রাজমহিষী সুদেষ্ণা সর্বদা ভীত হয়ে আছেন যে, তাঁর স্বামী বিরাটরাজা আমার রূপে অভিভূত হয়ে না পড়েন। সেই সুযোগে এবং আমাকে রক্ষকহীন দেখে দুরাত্মা কীচক সর্বদাই আমাকে প্রার্থনা করছে। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হলেও, ক্রোধ সংবরণ করে কামসংমূঢ় কীচককে বলেছিলাম, ‘কীচক! তুমি নিজের জীবন রক্ষা করো।’ আমি পাঁচজন গন্ধর্বের প্রিয়তমা ভার্যা; তুমি যে সাহস করছ, তার পরিণতিতে তোমার মৃত্যু ঘটবে। কীচক স্পর্ধাভরে বলেছিল, ‘সৈরিন্ধ্রী! আমি গন্ধর্বদের ভয় করি না। কারণ শত বা সহস্র গন্ধর্ব যুদ্ধে আসলে, আমি তাদের বধ করতে পারব। তুমি আমার রমণের সময় নির্দিষ্ট করো।’ আমি তখন সেই কামাতুর কীচককে বলেছিলাম, ‘কীচক! তুমি বলে আমার যশস্বী স্বামীদের সমকক্ষ নও। কীচক! আমি সর্বদাই ধর্মে রয়েছি এবং কুলশীলসমন্বিতা। সেইজন্যই কেউ কাউকে বধ করুক, এ আমি চাই না, তাই তুমি জীবিত আছ।’ আমি একথা বললে সেই দুরাত্মা কীচক অট্টহাস্য করে উঠল। কারণ সে সৎপথে থাকে না, ধর্মেও তার মতি নেই।
পাপিষ্ঠঃ পাপভাবশ্চ কামরাগবশানুগঃ।
অবিনীতশ্চ দুষ্টাত্মা প্রত্যাখ্যাতঃ পুনঃ পুনঃ॥ বিরাট : ১৯ : ২৮ ॥
পাপিষ্ঠ, পাপকর্মা, কামবশীভূত, অবিনীত ও দুরাত্মা কীচককে বারবার আমি প্রত্যাখ্যান করব; সেও দেখা হলেই আমাকে প্রহার করবে; যাতে আমি জীবনত্যাগই করব; তা হলে তোমরা ধৰ্মার্জনে যত্নশীল থেকেও তোমাদের সমস্ত ধর্ম নষ্ট হয়ে যাবে। যদি তোমরা অজ্ঞাতবাসের প্রতিজ্ঞায় অবিচল থাকে, তবে তোমাদের ভার্যা থাকবে না। ভার্যাকে রক্ষা করলে, সন্তানও রক্ষিত হয়। সন্তান রক্ষিত হলে, নিজেরও বক্ষা হয়ে থাকে; কারণ, প্রাণী নিজে সন্তানরূপে ভার্যার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে। এইজন্যই পণ্ডিতেরা ভার্যাকে ‘জায়া’ বলে থাকেন। আবার ভর্তা কী প্রকারে আমার উদরে জন্মাবেন, তা ভেবে ভার্যাও ভর্তাকে রক্ষা করবেন। আমি ব্রাহ্মণদের কাছে এই ধর্ম শুনেছি।
“ক্ষত্রিয়দের প্রধান ধর্ম হল সর্বদা শত্ৰু নির্যাতন করা। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ও আপনার উপস্থিতিতেই কীচক আমাকে পদাঘাত করেছে। আপনি ভয়ংকর জটাসুরকে বধ করে আমাকে তার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। অন্য ভ্রাতাদের সঙ্গে নিয়ে আপনি জয়দ্রথকে পরাজিত ও বন্দি করে আমাকে স্পর্শ করার শাস্তি প্রদান করেছিলেন। এখন এই কীচক, যে আমাকে ক্রমাগত অপমানিত করছে, আপনি সেই কীচককেও সংহার করুন। ভীমসেন রাজার শ্যালক ও প্রিয় বলেই কীচক আমার উপর অত্যাচার করতে সাহসী হচ্ছে। মাটির কলসিকে যেমন পাথরের উপর আছড়ে ফেলে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলা হয়, কামসংযত কীচককে চূর্ণ করুন। পাণ্ডুনন্দন! যে কীচক আমার বহুতর দুঃখের কারণ, সেই কীচক জীবিত থাকতে যদি কাল প্রভাতে সূর্যোদয় ঘটে, তবে আলোড়িত বিষ পান করব, কিন্তু কিছুতেই কীচকের কাছে ধরা দেব না।” এই বলে দ্রৌপদী শেষ শপথ বাক্য উচ্চারণ করলেন, “তোমার সম্মুখেই আমার মৃত্যু ভাল।” একথা উচ্চারণ করেই দ্রৌপদী ভীমের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ও রোদন করতে লাগলেন। ভীম তাঁকে আলিঙ্গন করে, বারংবার সান্ত্বনা দিতে দিতে ওষ্ঠপ্রান্ত লেহন করতে থেকে কীচককে স্মরণ করতে লাগলেন। তারপর ভীমসেন দ্রৌপদীকে বললেন—
তথা ভদ্রে! করিষ্যামি যথা ত্বং ভীরু! ভাষসে!
অদ্য তং সূদয়িষ্যামি কীচকং সহবান্ধবম্॥ বিরাট : ২০ : ১ ॥
“ভদ্রে! ভীরু! তুমি যেমন বললে, আমি তেমনই করব অর্থাৎ অদ্যই বান্ধবগণের সঙ্গে সেই কীচককে বধ করব।”
“দ্রুপদরাজনন্দিনী, তুমি দুঃখ ও শোক পরিত্যাগ করে আগামীকাল সূর্যাস্তের পর প্রদোষকালে সংকেতালাপের জন্য কীচকের সঙ্গে দেখা করো। মৎস্যরাজের এই রাজ্যে একটি সুন্দর নৃত্যশালা আছে। দিনের বেলায় কন্যারা সেখানে নাচ শেখে এবং রাত্রিতে চলে যায়। সেই নৃত্যশালার ভিতরে একটি লৌহনির্মিত খাট পাতা আছে, তার উপর সুন্দর শয্যা প্রস্তুত করা আছে। আমি সেখানেই থেকে কীচককে বধ করে, তার মৃত পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাব। কীচকের সঙ্গে তোমার আলাপের সময় কেউ যেন তোমাকে না দেখে, এবং কীচক যাতে অবশ্যই নৃত্যশালায় আসে তার ব্যবস্থা কোরো।”
দুঃখিত দ্রৌপদী ও ভীমসেন এই আলোচনা করে, উভয়েই চোখের জল মুছে রাত্রি প্রভাতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। পরদিন রাত্রি প্রভাত হলেই শয্যা ত্যাগ করে কীচক রাজভবনে গিয়ে দ্রৌপদীকে বলল, “সৈরিন্ধ্রী! সভার মধ্যে রাজার সামনে তোমাকে মাটিতে ফেলে পদাঘাত করেছিলাম। কিন্তু আমি প্রবল বলে, তোমাকে রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। কারণ, এই বিরাট, কেবল কথায় ও নামেমাত্র মৎস্যদেশের রাজা; কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে সেনাপতি বলে আমিই মৎস্যদেশের রাজা। তুমি অনায়াসে আমাকে লাভ করো এবং আমিও তোমার দাসহই। আমি এখনই তোমাকে একশো স্বর্ণমুদ্রা দান করছি। এ ছাড়াও আমি তোমাকে একশো দাসী, একশো দাস, অশ্বতরীযুক্ত একটি রথ দেব। আমাদের সঙ্গম হোক।” দ্রৌপদী বললেন, “কীচক! তুমি আমার কাছে শপথ করো যে, তোমার বন্ধুরা অথবা ভ্রাতারা কেউ আমার সঙ্গে তোমার সঙ্গম জানতে পারবে না। কারণ, যশস্বী গন্ধর্ব স্বামীদের আমি ভীষণ ভয় করি। সুতরাং তুমি আগে গোপনীয়তা বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করো, তারপর আমি তোমার বশবর্তিনী হব।” কীচক বলল, “ভীরু! তুমি যেমন বললে তেমনই আমি করব। তোমার কদলী সদৃশ ঊরু। আমি কামমুগ্ধ! সুতরাং তোমার সঙ্গে সঙ্গমের জন্য আমি একাকীই তোমার শূন্যগৃহে যাব; সূর্যতুল্য তেজস্বী তোমার গন্ধর্ব স্বামীরা জানতেও পারবেন না।” দ্রৌপদী বললেন, “বিরাটরাজার নৃত্যশালায় কন্যারা দিনেরবেলা নৃত্য করে এবং রাত্রিতে আপন গৃহে চলে যায়। তুমি অন্ধকারে এ গৃহে যাবে; গন্ধর্বরা তা জানতে পারবেন না। তা হলেই দোষ কেটে যাবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”
কীচকের সঙ্গে এই আলাপের পর দ্রৌপদীর পক্ষে দিনের অবশিষ্ট অর্ধাংশ যেন এক মাসের তুল্য দীর্ঘ বলে বোধ হতে লাগল। মূঢ় কীচক গৃহে ফিরে অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় আকুল হয়ে পড়ল; মৃত্যুরূপিণী সৈরিন্ধ্রীর আহ্বান সে বুঝতে পারল না। কামমুগ্ধ কীচক সমস্ত দিন গন্ধ, মাল্য ও অলংকারে আপনাকে সুসজ্জিত করতে লাগল। কীচকেরও যেন দিনের অবশিষ্ট অংশ দীর্ঘকালের মতো বোধ হতে লাগল। নেভার আগে প্রদীপের সলতের আগুন অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তেমনই চিরকালের জন্য কান্তি পরিত্যাগের পূর্বে কীচকও অনেক বেশি কান্তিমান হয়ে উঠল। কামমুগ্ধ কীচক দ্রৌপদীর কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে দ্রৌপদীর সঙ্গে সঙ্গমের চিন্তা করতে করতে তার দিন যে শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাও বুঝতে পারল না।
দ্রৌপদী কীচকের সঙ্গে আলাপের পর পাকগৃহে গিয়ে স্বামী ভীমসেনের কাছে উপস্থিত হলেন এবং জানালেন যে, ভীমসেনের নির্দেশমতোই নৃত্যশালায় কীচকের সঙ্গে সঙ্গমের প্রস্তাব দিয়ে এসেছেন। দ্রৌপদী ভীমসেনের কাছে প্রার্থনা করলেন যে, ভীমসেন একাকী শূন্য নৃত্যশালায় আগত কীচককে যেন সেইদিনই বধ করেন। দ্রৌপদী বললেন, “ওই কীচক দর্পবশত আমার গন্ধর্ব স্বামীদের অবজ্ঞা করে। অতএব বীরশ্রেষ্ঠ! হস্তী যেমন শস্যের মূল উৎপাটিত করে, আপনিও কীচকের দেহ থেকে প্রাণ উৎপাটিত করুন। নিজের ও নিজের বংশের নাম রাখুন। আপনার মঙ্গল হোক।” ভীম বললেন, “তুমি সুখে এসেছ তো? তুমি আমাকে যা জানালে, সেই বিষয়ে আমি অন্য কোনও ব্যক্তির সহায়তা চাই না। হিড়িম্ব রাক্ষসকে বধ করে আমার যে আনন্দ হয়েছিল, আজ কীচকের সঙ্গে আমার সম্মেলনে সেই আনন্দই হবে। সত্য, ধর্ম ও ভ্রাতৃগণকে সম্মুখে রেখে তোমাকে বলছি যে, ইন্দ্র যেমন বৃত্রাসুরকে বধ করেছিলেন, আজ কীচককে আমি বধ করব। গুপ্তস্থানে হোক, প্রকাশ্য স্থানে হোক, আজ কীচককে সংহার করবই। তারপর সমস্ত মৎস্যদেশীয় যোদ্ধারা এলেও তাদের বধ করব। তারপর দুর্যোধনকে বধ করে রাজ্যলাভ করব। কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির ইচ্ছানুসারে বিরাটের উপাসনা করুন।”
দ্রৌপদী বললেন, “স্বামী, বীর, আমার জন্য তুমি সত্য পরিত্যাগ কোরো না; গুপ্ত অবস্থায় থেকেই পাপাত্মা কীচককে বধ করো।” ভীম বললেন, “অনিন্দিতে! ভীরু! তুমি যেমন বললে, তেমনই হবে। আজ রাত্রে আমি গুপ্ত অবস্থায় থেকেই কীচককে বধ করব। তুমি কীচকের পক্ষে অলভ্যা; তবুও কীচক তোমাকে দুরাত্মার মতো লাভ করার ইচ্ছা করেছে। অতএব, হস্তী যেমন বেলফল চূর্ণ করে, কীচকের মস্তকও তেমন করেই চূর্ণ করব।”
সেদিন রাত্রিতে, ভীম গুপ্তভাবে নৃত্যশালায় গিয়ে, সিংহ যেমন গুপ্ত থেকে হরিণের অপেক্ষা করে, ভীমও কীচকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। দ্রৌপদীর অসম্মানে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন এবং কীচকের মৃত্যুরূপে নৃত্যশালায় শুয়েছিলেন, এই অবস্থায় কীচক গিয়ে তাঁকে স্পর্শ করলেন এবং কামমুগ্ধ ও আনন্দে অস্থিরচিত্ত হয়ে কাছে গিয়ে অল্প হাস্য করতে করতে কীচক বললেন, “সুন্দরী তোমার জন্য ধন, রত্ন, বহু দাস-দাসী ও মূল্যবান বস্ত্র ও অপরিমিত দ্রব্য আমি তোমার গৃহে প্রেরণ করেছি। আমার পুরস্ত্রীরা সকলেই আমাকে প্রশংসা করেছে যে, তোমার মতো সুবসন ও সুদৃশ্য অন্য কোনও পুরুষ মানুষ নেই।” ভীম বললেন, “কীচক! তুমি আমার ভাগ্যেই সুদৃশ্য হয়েছ এবং আমার ভাগ্যেই আত্মপ্রশংসা করছ।” এই কথা বলে মহাবাহু ও অত্যন্ত পরাক্রমশালী কুন্তীনন্দন তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে কীচককে বললেন, “পাপিষ্ঠ! সিংহ যেমন পর্বতপ্রমাণ মহা হস্তীকে ভূতলে ফেলে টান মারে, তোকে আমি আজ তেমনই ভূতলে ফেলে টান মারতে মারতে বধ করব এবং সেই অবস্থায় তোর ভগ্নি তোকে দেখবে। তারপর আমি তোকে বধ করলে, সৈরিন্ধ্রী নিরুপদ্রবে বিচরণ করবে এবং সৈরিন্ধ্রীর স্বামীরা নিশ্চিন্ত সুখে বিচরণ করবেন।”
তারপর মহাবল ভীমসেন কীচকের মাল্যভূষিত কেশপাশ ধারণ করলেন। তখন বলবান কীচকও বলপূর্বক আপন কেশপাশ ছাড়িয়ে ভীমের বাহুযুগল ধারণ করলেন। বসন্তকালে হস্তিনীর জন্য বলবান হস্তীদ্বয়ের মতো ক্রুদ্ধ নরশ্রেষ্ঠ ভীম ও কীচকের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হল। পূর্বকালে বালী ও সুগ্রীবের মধ্যে যেমন সংগ্রাম হয়েছিল, ভীম ও কীচকের মধ্যে তেমনই ভীষণ যুদ্ধ হতে লাগল। বিষতুল্য ক্রোধে উন্মত্ত ভীম ও কীচক পঞ্চমস্তক সর্পের মতো বাহুদ্বয় উত্তোলন করে, তীক্ষ্ণ দন্তের ন্যায় নখদ্বারা পরস্পরকে আঘাত করতে লাগলেন। বলবান কীচক ভীমকে বেগে আঘাত করলেও ভীম স্থিরদেহে সে আঘাত সহ্য করলেন, এক পদও নড়লেন না। তখন দু’জনেই পরস্পরকে আলিঙ্গন করে পরস্পরকে আকর্ষণ করে দুটি ক্রুদ্ধ বৃষের ন্যায় প্রকাশ পেতে লাগলেন। নখ ও দন্তরূপ দুই অস্ত্রের সহায়তায় দুটি বাঘ্রের মতো গর্বিত ভীম ও কীচকের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হতে লাগল।
তারপর একটা হস্তী যেমন শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে অন্য মদস্রাবী হস্তীকে আকর্ষণ করে, ক্রুদ্ধ কীচক বেগে গিয়ে ভীমসেনকে তেমনই ধারণ করল। বলবান ভীমসেনও কীচককে ধারণ করলেন। তখন কীচক প্রচণ্ড বলে ভীমকে ধাক্কা মারল। তখন বলবান ভীম ও কীচক দুজনেরই বাহুর সংঘর্ষে যুদ্ধস্থানে বাঁশ ফাটার মতো ভয়ংকর শব্দ হতে লাগল। তারপর ভীমসেন সবলে কীচককে একটা ধাক্কা দিয়ে, ঘূর্ণিবায়ু যেমন বৃক্ষকে ধরে, কীচককে ধরে গৃহমধ্যে প্রচণ্ড বেগে ঘূর্ণিত করতে লাগলেন। কীচক যুদ্ধে ক্রমশ দুর্বল হতে থেকে, সমস্ত শক্তি দিয়ে ভীমসেনকে আকর্ষণ করতে লাগল এবং ভীমসেনের হাত থেকে অল্প নির্গত অবস্থায় কীচক জানুদ্বারা ভীমকে আঘাত করে ভূতলে ফেলে দিল। মুহূর্তমধ্যে দণ্ডপাণি যমের মতো ভীম উঠে দাঁড়ালেন এবং সেই নির্জন রাত্রে পরস্পর পরস্পরকে আকর্ষণ করতে লাগলেন। নৃত্যশালা মুহুর্মুহু কম্পিত হতে লাগল; ভীম ও কীচক দুজনেই গর্জন করতে থাকলেন। ভীমসেন দুই হাতে কীচকের বক্ষে আঘাত করলেন কিন্তু কীচক অবিচলিতই রইল। যদিও কীচক মুহূর্তকাল মাত্র ভূতলে থেকে ক্রমশ দুর্বল হতে লাগল। মহাবল ভীমসেন কীচককে বলহীন বলে বুঝতে পেরে, তাকে অচেতনপ্রায় অবস্থায় বক্ষে ধারণ করে প্রচণ্ড পেষণ করতে লাগলেন। যুদ্ধবিজয়ী ভীম ক্রোধাবিষ্ট হয়ে নিশ্বাস ত্যাগ করে আবার দৃঢ়ভাবে কীচকের কেশাকর্ষণ করতে লাগলেন। মাংসভোজনাভিলাষী ব্যাঘ্র মহামৃগ ধারণ করে যে গর্জন করে, ভীম সেই প্রচণ্ড গর্জন করতে লাগলেন। মানুষ যেমন গলায় দড়ি বেঁধে পশুকে টানতে টানতে নিয়ে যায়, ভীমসেন কীচককে পরিশ্রান্ত বুঝে বাহু দ্বারা তাকে বেঁধে ফেললেন। কীচক তখন ছটফট করতে করতে অচেতন হয়ে পড়ল এবং বিদীর্ণ ভেরির মতো গুরুতর শব্দ করতে লাগল। সেই অবস্থায় ভীমসেন তাকে বহুবার ঘোরাতে লাগলেন। পরে ভীমসেন দ্রৌপদীর ক্রোধ নিবৃত্তির জন্য বাহুযুগল দ্বারা ধারণ করে কীচকের গলায় পীড়ন করতে লাগলেন। কীচকের সমস্ত অঙ্গ পূর্বেই ভেঙে গিয়েছিল; তখন তার চোখের আবরণ সংকুচিত হয়ে আসছিল, সেই অবস্থায় ভীম বাহুযুগল দ্বারা পীড়ন করতে লাগলেন এবং পশুর মতো তাকে বধ করলেন। তারপর ভীমসেন গর্জন করে বললেন, “ভার্যার উপরে পদাঘাতকারী এবং সৈরিন্ধ্রীরূপিণী সেই ভার্যার শত্রুকে বধ করে আজ আমি ভ্রাতাদের কাছে ঋণী না থেকে পরম শান্তি লাভ করব।” এই বলে ক্রোধে আরক্তনয়ন ভীম কীচককে পরিত্যাগ করলেন। কীচকের বস্ত্র ও অলংকার খুলে গিয়েছিল। নয়ন ঘুরতে ঘুরতে প্রাণ বার হয়ে গেল। তারপর মানসিক ও কায়িক বলিশ্রেষ্ঠ ক্রুদ্ধ ভীমসেন দুই ঠোঁট চেপে হাতে হাত ঘষে পুনরায় কীচককে আক্রমণ করলেন। পূর্বকালে মহাদেব যেমন করেছিলেন, তেমনই কীচকের পদদ্বয়, হস্তদ্বয়, মস্তক ও গ্রীবা তার শরীরের ভিতর সমস্তটাই প্রবেশ করিয়ে দিলেন।
তারপর মহাবল ভীমসেন দ্রৌপদীকে ডেকে মথিত সর্বাঙ্গ ও মাংসপিণ্ডের ন্যায় কৃত সেই কীচককে দেখালেন। তিনি দ্রৌপদীকে বললেন, “পাঞ্চালী এসো, আমি এই কামুকটাকে কেমন করেছি, তা দেখো।” বলে ভীমসেন পাকগৃহে চলে গেলেন। নারীশ্রেষ্ঠ দ্রৌপদী কীচককে বধ করিয়ে আনন্দিত ও নির্ভয় হয়ে সভারক্ষকদের গিয়ে বললেন, “সভারক্ষকগণ পরস্ত্রীকামুক কীচক আমার পতি-গন্ধর্বগণ কর্তৃক নিহত হয়ে পড়ে আছে। তোমরা যাও, গিয়ে দেখে এসো।” দ্রৌপদীর কথা শুনে নৃত্যশালারক্ষকেরা তৎক্ষণাৎ অনেকগুলি মশাল জ্বালিয়ে নৃত্যশালার ভিতরে গিয়ে ভূতলে পতিত, রক্তাক্ত ও প্রাণহীন অবস্থায় কীচককে দর্শন করল। “এর গলা, পা দুটি কোথায়, হাত দুটি কোথায় এবং মাথাই বা কোথায়?” এই বলে তারা গন্ধর্বনিহত কীচককে পরীক্ষা করতে লাগল।
এই সময়ে কীচকের সমস্ত বন্ধু-বান্ধব সেই স্থানে এসে কীচককে সেই অবস্থায় দেখে রোদন করতে লাগল। কীচকের সমস্ত অঙ্গ শরীরের ভিতরে প্রবিষ্ট ছিল। তাকে একটা কচ্ছপের মতো দেখাচ্ছিল। তখন ইন্দ্র দ্বারা চূর্ণিত মহাদানবের মতো ভীমসেন কর্তৃক চূর্ণিত কীচকের মাংসপিণ্ড দাহ করবার জন্য তার বন্ধুরা বাইরে নিয়ে এসে দেখল যে, অনিন্দ্যসুন্দরী দ্রৌপদী একটি স্তম্ভ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। উপকীচকেরা সেই অবস্থায় দ্রৌপদীকে দেখে বলল, “যার জন্য কীচক নিহত হয়েছেন, সেই অসতীটাকে শীঘ্র হত্যা করো। অথবা এখানে একে হত্যা করা উচিত নয়, কামী কীচকের সঙ্গে একে দগ্ধ করা হবে। কারণ, তাতে মৃত কীচকের অত্যন্ত প্রিয় কার্য করা হবে।”
তখন সেই উপকীচকেরা বিরাটরাজাকে গিয়ে বলল, “মহারাজ! এই নারীর জন্যই কীচক নিহত হয়েছেন। সুতরাং এর সঙ্গে কীচককে দাহ করা হোক। আপনি অনুমতি প্রদান করুন।” বিরাটরাজা উপকীচকদের পরাক্রম স্মরণ করে সৈরিন্ধ্রীকে দাহ করার অনুমোদন করলেন। উপকীচকেরা তখনই গিয়ে ভীতা, অত্যন্ত মোহিতা, কমলনয়না দ্রৌপদীকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করল। তারপর তারা সকলে সুনিতম্বা দ্রৌপদীকে বেঁধে, খাটে তুলে নিয়ে শ্মশানের দিকে চলল। উপকীচকেরা ধরে বেঁধে নিয়ে যেতে থাকলে অনিন্দিতা দ্রৌপদী পতিশালিনী হয়েও রক্ষক লাভের আশায় চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন, “জয়, জয়ন্ত, বিজয়, জয়সেন ও জয়দ্বল—যে যেখানে আছ, তাঁরা আমার বাক্য শোনো—উপকীচকেরা আমাকে দগ্ধ করবার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। মহাযুদ্ধে বলবান ও তেজস্বী যে গন্ধর্বগণের বজ্ৰশব্দতুল্য ধনুষ্টংকার, ভীষণ সিংহনাদ ও গুরুতর রথধ্বনি শোনা যেত, সেই গন্ধর্বেরা আমার কথা শোনো—উপকীচকেরা আমাকে দগ্ধ করতে নিয়ে যাচ্ছে।” দ্রৌপদীর এই কাতর বিলাপধ্বনি শুনতে পেয়েই ভীমসেন কারও সঙ্গে কোনও আলোচনা না-করেই শয্যা ত্যাগ করে উঠলেন। ভীমসেন চিৎকার করে বললেন, “সৈরিন্ধ্রী, তোমার কথা শুনেছি। তোমার উপকীচকদের কাছ থেকে কোনও ভয় নেই।” জিঘাংসায় জ্বলতে জ্বলতে ভীমসেন পাচকের বেশ পরিত্যাগ করে দীর্ঘবস্ত্র পরে, অদ্বার দিয়ে লাফিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেলেন। কারণ, দ্বার খুলে বাইরে গেলে রক্ষীদের চোখে পড়ত। তিনি তৎক্ষণাৎ দ্রুত গিয়ে প্রাচীরের উপর উঠে, যেদিকে উপকীচকেরা গিয়েছিল, সেই শ্মশানের দিকে যাবার ইচ্ছা করলেন এবং প্রাচীর থেকে লাফিয়ে অতি দ্রুত গিয়ে সেই উপকীচকদের সামনে উপস্থিত হলেন। চিতার কাছে গিয়ে ভীমসেন দেখলেন সেখানে তালগাছের মতো একটা বড় গাছ আছে, তার গুঁড়ি বিশাল এবং উপরিভাগ শুষ্ক হয়ে গেছে। হস্তীর ন্যায় বাহুযুগল দ্বারা জড়িয়ে ধরে সেই গাছটাকে ভীমসেন উপড়ে নিজের কাঁধে ফেললেন। যমের মতো সেই বৃহৎ বৃক্ষ নিয়ে উপকীচকদের দিকে ছুটে গেলেন। সিংহের মতো ক্রুদ্ধ সেই গন্ধর্বরূপী ভীমকে দেখে উপকীচকেরা বিষাদে ও ভয়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করল। “বলবান গন্ধর্ব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বৃক্ষ উত্তোলন করে আসছে। অতএব সত্বর সৈরিন্ধ্রীকে ছেড়ে দাও।” ভীমসেন তখন মাথার উপর বৃক্ষ ঘোরাচ্ছেন দেখে উপকীচকেরা রাজধানীর দিকে পালাতে লাগল। ইন্দ্র যেমন দানবদের বধ করেছিলেন, তেমনই ভীমসেন সেই একশো পাঁচজন উপকীচককে যমালয়ে পাঠালেন। দ্রৌপদীকে মুক্ত করে, আশ্বস্ত করে বললেন, “যারা বিনা অপরাধে তোমার হিংসা করে, আমি তাদের এইভাবেই বধ করে থাকি। তুমি রাজধানীতে ফিরে যাও, কোনও ভয় নেই, আমিও অন্য পথে বিরাটরাজার পাকস্থানে যাব।” ভীম কর্তৃক নিহত সেই একশো পাঁচজন উপকীচক ছিন্ন পতিতবৃক্ষ মহাবনের মতো সেইখানে পড়ে রইল। কীচক ও উপকীচক মিলিয়ে মোট একশো ছ’জন ভীম কর্তৃক নিহত হল।
পরদিন নর-নারীগণ নিহত কীচকদের দেখে বিরাটরাজার কাছে গিয়ে বলল, “মহারাজ! গন্ধর্বেরা সকল কীচককেই বধ করেছে। নিহত কীচকদের মস্তক বস্ত্র দ্বারা বিদীর্ণ পর্বতের বিশাল মস্তকের মতো ইতস্তত ছড়ানো আছে। আর সৈরিন্ধ্রীও মুক্ত হয়ে পুনরায় আপনার গৃহে ফিরে এসেছে। অতএব মহারাজ! আপনার সমগ্র রাজধানীই সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। কারণ, সৈরিন্ধ্রী পরমাসুন্দরী, আর গন্ধর্বেরাও পরম শক্তিশালী। আবার ভোগ্যবস্তু মৈথুনের জন্যই পুরুষদের অভীষ্ট। সুতরাং সৈরিন্ধ্রীর কারণে আপনার রাজধানীর সম্পূর্ণ বিনাশের সম্ভাবনা আছে। দ্রুত এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।” বিরাটরাজা সেই সেনাপতি কীচক ও তার ভ্রাতাদের সর্বপ্রকার রত্ন ও গন্ধদ্রব্য সংযুক্ত অবস্থায় এক প্রজ্বলিত অগ্নিতে দাহ করবার আদেশ করলেন। তারপর রাজা বিরাট ভীত হয়ে মহিষী সুদেষ্ণাকে বললেন, “মহিষী আমার ইচ্ছা অনুসারে সৈরিন্ধ্রী রাজবাটীতে ফিরে এলে তুমি তাকে এই কথা বোলো যে, সৈরিন্ধ্রী যেন এই রাজবাটী ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। কারণ, সুনিতম্বে! রাজা গন্ধর্বদের বিষয়ে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছেন। ভীত রাজা তোমাকে একথা বলার সাহস করছেন না। তবে স্ত্রীলোক একথা বলায় দোষ হয় না। অতএব, আমিই তোমাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি।”
ওদিকে ভীমসেন কীচক ও তার ভ্রাতাদের বধ করলে, দ্রৌপদী নির্ভয়ে, জলে সমস্ত অঙ্গ এবং বক্ষযুগল ধুয়ে, আগে ব্যাঘ্রের ভয়ে ভীতা কিন্তু পরে একান্ত নির্ভয় বালিকার ন্যায় দ্রুতপদে রাজধানীর দিকে যেতে লাগলেন। তাঁকে দেখে লোকেরা দশ দিকে ছুটে পালাতে লাগল এবং তাঁর গন্ধর্ব স্বামীদের কথা চিন্তা করে চোখ বন্ধ করে রাস্তায় চলতে লাগল। পাকগৃহের কাছে গিয়ে দ্রৌপদী ভীমসেনকে দেখলেন। তারপর তিনি ঈষৎ হাস্যের সঙ্গে সংকেতে ভীমসেনকে বললেন, “যিনি আমাকে মুক্ত করে দিয়েছেন, সেই গন্ধর্বরাজকে নমস্কার করি।” উত্তরে ভীম তাঁকে বললেন, “তোমার বশবর্তী পুরুষেরা এই নগরে দুঃখের সঙ্গে বাস করলেও আজ তাঁরা ঋণশোধের পর সুখে বিচরণ করবেন।”
তখন দ্রৌপদী দেখলেন, মহাবাহু অর্জুন নৃত্যশালার ভিতরে বিরাটরাজার কন্যাদের নৃত্যশিক্ষা দিচ্ছেন। সেই কন্যারা অর্জুনের সঙ্গে নৃত্যশালার বাইরে এসে বিনা অপরাধে ক্লিষ্টা দ্রৌপদীকে আসতে দেখলেন। তখন সেই কন্যারা বলল, “সৈরিন্ধ্রী ভাগ্যবশত তুমি মুক্ত হয়ে নিরাপদে ফিরে এসেছ এবং বিনা অপরাধে তোমার যারা অনিষ্ট করতে চেয়েছিল, তাদের মৃত্যু ঘটেছে।” বৃহন্নলা বললেন, “সৈরিন্ধ্রী তুমি কীভাবে মুক্ত হলে, কীভাবে সেই পাপী কীচকেরা নিহত হল, আমাকে সমস্ত খুলে বলো।” দ্রৌপদী বললেন, “কল্যাণী বৃহন্নলে! তুমি এখন সৈরিন্ধ্রীর আর কী উপকার করবে। তুমি সর্বদাই কন্যাপুরে সুখে বাস করছ। সৈরিন্ধ্রীর অশেষ দুঃখ তুমি বুঝতেও পারবে না। তুমি তো সুখেই আছো।” বৃহন্নলা বললেন, “কল্যাণী, বৃহন্নলাও গুরুতর দুঃখ ভোগ করছে। সে পশুর মতন জীবনযাপন করছে, তুমি তা বুঝতে পারছ না। আমি সমস্ত সময় তোমার সঙ্গে বাস করছি। নির্দোষ তুমি দুঃখ পেতে থাকলে কে দুঃখ অনুভব না করে? অপরের মনের কথা মানুষ বুঝতে পারে না, তুমিও আমার মনের অবস্থা বোঝ না।”
তখন দ্রৌপদী সেই কন্যাদের সঙ্গেই রানি সুদেষ্ণার কাছে পৌঁছলেন। সুদেষ্ণা বিরাটরাজার আদেশ অনুযায়ী তাঁকে বললেন, “সৈরিন্ধ্রী তুমি যেখানে তোমার ইচ্ছা চলে যাও। কারণ, রাজা তোমার গন্ধর্ব স্বামীদের ভয় পাচ্ছেন। তুমি যুবতী এবং অতুলনীয়া রূপবতী। তোমার মঙ্গল হোক, তুমি চলে যাও।”
সৈরিন্ধ্রী বললেন, “ক্রুদ্ধা রানি, রাজা আর মাত্র তেরোটি দিন আমাকে ক্ষমা করুন। তাতেই আমার স্বামীরা কৃতকার্য হবেন। তারপর তাঁরা আমাকে নিয়ে যাবেন, আপনার প্রিয়কার্য করবেন, রাজাকেও নিশ্চয় মঙ্গলযুক্ত করবেন।”
*
চূড়ান্ত মহড়া হয়ে গেল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভীমসেন ঠিক এইভাবেই দুর্যোধনের একশো ভ্রাতাকে বধ করবেন। ‘কীচক-বধ’ এই দুর্লভ মুহূর্তটির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, দ্রৌপদীর অসাধারণ রূপ। এই সময়ে দ্রৌপদীর বয়স প্রায় ষাট। সেই বয়সেও তাঁকে দেখে কীচক কামাসক্ত হয়ে পড়লেন। দ্বিতীয় কৌরবসভায় দ্যূতক্রীড়ার সময়ের মতোই যুধিষ্ঠির ও অন্য ভ্রাতা ভীমের সামনেই দ্রৌপদীর অসম্মান ঘটল। অজ্ঞাতবাস ভেঙে যাওয়ার ভয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেও যুধিষ্ঠির কীভাবে সেই মুহূর্তে ভীমকে নিবারণ করলেন। ইঙ্গিত দিলেন, “তোমার গন্ধর্ব স্বামীরা অবশ্যই প্রতিবিধান করবেন।” দ্রৌপদী রাজসভায় এসে ক্রন্দনরতা এবং অন্য রাজারা তাঁর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ও তাঁর রূপের প্রশংসা করছেন—এই অবস্থা যুধিষ্ঠিরের অসহ্য লাগছিল। তাঁর স্ত্রীর রূপের প্রশংসা রাজারা সভায় বসে করছেন এবং যুধিষ্ঠিরকে তা শুনতে হচ্ছে। এদিকে, ভীমকেও আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ভীম ক্রুদ্ধ হয়ে কীচককে আক্রমণ করলেই তাঁর পরিচয় প্রকাশিত হয়ে যাবে। কীচক দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করে পদাঘাত করেছেন। স্বামী হিসাবে তাঁর তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করা উচিত। কিন্তু তাতে দ্রৌপদীর মঙ্গলের থেকে অমঙ্গলই হবে বেশি। অজ্ঞাতবাস প্রকাশিত হয়ে পড়লে শর্তানুযায়ী আবার বারো বছর বনবাস করতে হবে। দ্রৌপদীকেও। সুতরাং যুধিষ্ঠির ক্রোধভরে দ্রৌপদীকে নির্দেশ দিলেন, “নটীর মতো কান্নাকাটি করে সভাসদদের ক্রীড়ায় বিঘ্ন ঘটিয়ো না।” সভাসদদের সামনে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনাভোগ যেন নাটকে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। দ্রৌপদীকে সুদেষ্ণার কাছে পাঠিয়ে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর ক্ষোভ সত্ত্বেও ভীমকে ঠেকিয়ে রাখলেন।
এই দুর্লভ মুহূর্তে আমরা দেখলাম, ভীমের অসাধারণ সংযম। দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে তাঁর দুর্দশার জন্য দায়ী করে বিলাপ করতে লাগলেন। সাধারণভাবে ভীম এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করতেন না। এই মুহূর্তে তিনি যুধিষ্ঠিরকে সমর্থন করে দ্রৌপদীকে সম্যক ধৈর্য অবলম্বন করতে বললেন।
কিন্তু নারী পারেন। স্বামী যতই বড় ব্যক্তিত্ব হোন না কেন, যত গুণের, বীর্যবত্তার ও বুদ্ধির অধিকারী হোন না কেন—অশ্রুমুখী স্ত্রীর ইচ্ছা-অনুযায়ী কাজ করতে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলেন। শেষ পর্যন্ত ভীম অজ্ঞাতবাসের শর্ত ভেঙে ফেলে, সেদিন রাত্রেই কীচক বধ করতে চেয়েছিলেন—দ্রৌপদীর তখন চেতনা ফিরেছিল। তিনি যুধিষ্ঠিরের উপর দেওয়া অভিযোগ প্রত্যাহার করে গুপ্ত থেকেই কীচককে বধ করতে বলেছিলেন।
ভীমের অপরিসীম শক্তির পরিচয়ও আমরা এইখানেই দেখলাম। মহাভারতে জয়দ্রথ ছাড়া দ্রৌপদীকে যিনিই স্পর্শ করেছেন, লাঞ্ছনা করেছেন, ভীমের হাতে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। যুধিষ্ঠিরের নিষেধে তিনি জয়দ্রথকে বধ করতে পারেননি। কারণ ভগিনী দুঃশলা বিধবা হবে, মাতা গান্ধারী জামাতৃ হারাবেন। কিন্তু ভীম প্রাণে না মারলেও জয়দ্রথের চূড়ান্ত অসম্মান করেছিলেন। কী অমানুষিক শক্তির অধিকারী হলে একই রাত্রে কীচক ও একশো পাঁচ ভ্রাতাকে বধ করা যায়, ভীমসেন তা দেখিয়েছেন। এই ঘটনা থেকেই অনুমান করা যায় কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে কী ঘটতে চলেছে।
মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডব ও তাঁদের দাম্পত্য সম্পর্ক, শৃঙ্গার বা রতিপরিমলে অনুলিপ্ত অবস্থার বিবরণ খুব অল্প। কিন্তু এই দুর্লভ মুহূর্তে একটি দৃশ্য দেখানো হয়েছে। দুর্গম বনে সিংহী যেমন নিদ্রিত সিংহকে আলিঙ্গন করে, দ্রৌপদীও নিদ্রিত পাণ্ডুনন্দন ভীমসেনকে আলিঙ্গন করলেন এবং বললেন, “ভীমসেন, ওঠো ওঠো; মৃত ব্যক্তির মতো কেমন করে শায়িত আছ?”
এই দুর্লভ মুহূর্তটিতেই অর্জুন প্রকাশ করেছেন দ্রৌপদী-সম্পর্কে তাঁর প্রণয়। “একে অন্যের মনের ভাব বুঝতে পারে না”, “আমি সর্বদাই তোমার সঙ্গে বাস করছি”—এই উক্তিগুলি দ্রৌপদীর প্রতি অর্জুনের তীব্র আসক্তি প্রকাশ করে।
সব মিলিয়ে কীচক-বধ একটি অসাধারণ দুর্লভ মুহূর্ত।
৫১
বৃহন্নলারূপী অর্জুনের আত্মপ্রকাশ
অজ্ঞাতবাসের এক বৎসর অতিক্রান্ত হতে চলল। অথচ গুপ্তচরেরা পাণ্ডবদের কোনও সন্ধানই পেল না। কৌরব সভায় এই নিয়ে বিশদ আলোচনা হল। এদিকে গুপ্তচর এসে বলল, মৎস্যরাজ বিরাটের সেনাপতি কীচক ও তার একশত পাঁচ ভ্রাতা গন্ধর্বদের সঙ্গে যুদ্ধে মারা গিয়েছেন। শুনে দুর্যোধনের বন্ধু ত্রিগর্ত রাজা সুশৰ্মা আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। কারণ মহাবীর কীচকের জন্য তিনি ইতোপূর্বে বহুবার যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন এবং মৎস্যদেশ অধিকার করতে পারেননি। সুশৰ্মা প্রস্তাব দিলেন—মৎস্যরাজের অসংখ্য গো-ধন আছে। সেগুলি হরণ করে নিয়ে আসা হোক। আলোচনার পর স্থির হল যে কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীর দিন সুশৰ্মা মৎস্যরাজ্যের দক্ষিণদিক আক্রমণ করে সেদিকের গো-ধন হরণ করবেন, অষ্টমীর দিন দুর্যোধন অন্যান্য দিকের গো-ধন হরণের জন্য সকলকে নিয়ে যাত্রা করবেন।
নির্দিষ্ট দিনে সুশৰ্মা যাত্রা করলেন এবং বিরাটরাজা সংবাদ পাওয়া মাত্র সমস্ত সৈন্য নিয়ে প্রতিরোধে চললেন। বৃহন্নলা ব্যতীত চার পাণ্ডবভ্রাতাও রাজার সঙ্গে চললেন। তুমুল যুদ্ধের পর বিরাটরাজা সুশর্মার কাছে পরাজিত ও বন্দি হলেন। এই দিনের যুদ্ধে সর্বাপেক্ষা পরাক্রম দেখালেন কঙ্করূপী যুধিষ্ঠির। যুদ্ধ করতে করতে সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি ভীমসেনকে আদেশ করলেন, “বিরাটরাজাকে মুক্ত করো।” ভীম সামান্যক্ষণ যুদ্ধের পর বিরাটকে মুক্ত করে সুশর্মাকে বন্দি করলেন। যুধিষ্ঠিরের করুণায় সুশৰ্মা মুক্ত হলেন। ভীমের আদেশে সুশৰ্মা স্বীকার করলেন, তিনি বিরাটরাজার দাস। বিরাটরাজা পাণ্ডবদের প্রতি অতি প্রীত হলেন এবং গুপ্তচর মারফত রাজধানীতে সংবাদ পাঠালেন যে, তাঁরা যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসছেন।
রাজা বিরাট ত্রিগর্ত সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাওয়ার পরই দুর্যোধন ও তার ‘মন্ত্রিগণ’ বিরাটরাজ্যের অন্য অংশের গো-ধন হরণের জন্য বিরাটরাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হলেন। দুর্যোধনের সঙ্গে গেলেন ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, শকুনি ও দুঃশাসন এবং বলশালী বিবিংশতি, বিকর্ণ, চিত্রসেন, দুর্মুখ ও দুঃসহ। এঁরা মৎস্যদেশে পৌঁছে বলপূর্বক গো-পালককে তাড়িয়ে দিয়ে বিরাটরাজার গো-ধন হরণ করলেন। বিশাল রথসমূহ দিয়ে চারপাশ বেষ্টন করে বিরাটরাজার ষাট হাজার গোরু গ্রহণ করলেন। গো-পালকদের আর্তনাদে বিরাটরাজ্যে গুরুতর কোলাহল সৃষ্টি হল। গো-রক্ষাকারী প্রধান প্রধান কর্মচারী আর্তনাদ করতে করতে রাজধানীতে প্রবেশ করলেন। রাজবাড়িতে তখন একমাত্র রাজপুত্র ‘ভূমিঞ্জয়’ (উত্তর) অবস্থিত ছিলেন। অন্যেরা বিরাটরাজার সঙ্গে ত্রিগর্তরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। কর্মচারীবৃন্দ যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করে তাকে বললেন, “রাজপুত্র! কৌরবেরা আপনাদের ষাট হাজার গোরু হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। অতএব সেই গোরুগুলি ফিরিয়ে আনবার জন্য আপনি নিজেই দ্রুত রাজপুরী থেকে বেরিয়ে চলুন। কারণ মহারাজ আপনাকে শূন্যপুরীর রক্ষক করে রেখে দিয়েছেন। মহারাজ রাজসভায় কতবার গর্ব করে বলেছেন, আমার পুত্র আমারই মতো বীর এবং বংশের ধুরন্ধর। মহারাজ সর্বদাই বলেন যে, আমার পুত্র ধনু ও শরে নিপুণ যোদ্ধা ও বীর। মহারাজের সেই কথা সত্য হোক। আপনি কৌরবসৈন্যদের বধ করেই গো-ধন উদ্ধার করে আনুন। মহাশব্দশালী আপনার ধনুকের গর্জন শোনা যাক। শব্দশালিনী ধনুরূপ বীণা বাজাতে বাজাতে আপনি শত্রু সৈন্যদের মধ্যে প্রবেশ করুন। হে প্রভু! আপনার রথে রৌপ্যের ন্যায় শ্বেতবর্ণ অশ্বসকল সংযুক্ত হোক। ভৃত্যেরা আপনার রথে সিংহাকৃতি স্বর্ণময় ধ্বজা উত্তোলন করুক। বিপক্ষ শত্রুনাশক আপনার তীক্ষ্ণশর সূর্যকে আবৃত করুক। যুদ্ধে সমস্ত কৌরবকে জয় করে মহাযশ প্রাপ্ত হয়ে আপনি আবার রাজধানীতে প্রবেশ করুন। আপনি রাজ্যের পরম আশ্রয়। সুতরাং সমস্ত দেশবাসী আজ আপনার আশ্রয়লাভ করে কৃতার্থ হোক।”
গোপরক্ষকদের অধ্যক্ষ অন্তঃপুরে স্ত্রীলোকদের মধ্যে উৎসাহব্যঞ্জক এই কথাগুলি বললেন। তা শুনে রাজকুমার উত্তর আত্মগর্ব প্রকাশ করে বলতে লাগলেন, “যদি অশ্বচালনায় বিচক্ষণ কোনও লোক আমার সারথি হত, তবে এখনই আমি দৃঢ়ধনু ধারণ করে গোষ্ঠে যেতাম। আমার সারথি হতে পারে এমন লোক আমার চোখে পড়ছে না, তুমি দ্রুত আমার সারথি অন্বেষণ করো। পূর্বের মাসব্যাপী কিংবা তার সামান্য কম আটাশ দিনের মহাযুদ্ধে আমার সারথির মৃত্যু ঘটেছে। অতএব আমি যদি অস্ত্রচালনজ্ঞ অন্য লোক পাই, তবে এখনই রথে মহাধ্বজ উত্তোলন করে দ্রুত রণক্ষেত্রে প্রবেশ করি। তারপর বিপক্ষের হস্তী, অশ্ব, রথ ও সৈন্যপূর্ণ সেই কৌরবপক্ষকে পরাজিত করে দানববিজয়ী ইন্দ্রের মতো আমার পশুগণকে ফিরিয়ে আনব। বীরশূন্য গোষ্ঠ পেয়ে ভীষ্ম, দুর্যোধন, কর্ণ, কৃপ ও অশ্বত্থামাসহ দ্রোণ এই ধনুর্ধরদের পরাজিত করা আমার পক্ষে সম্ভব। সমাগত কৌরবেরা আজ আমাকে দেখে মনে করবে, স্বয়ং পৃথানন্দন অর্জুন আজ আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছেন।” উত্তর এইভাবে বারবার অর্জুনের উল্লেখ করলে দ্রৌপদীর তা সহ্য হল না। যশস্বিনী দ্রৌপদী স্ত্রীলোকদের মধ্য দিয়ে রাজপুত্র উত্তরের কাছে গিয়ে লজ্জিতভাবেই যেন ধীরে ধীরে তাঁকে বললেন, “রাজপুত্র বৃহন্নলা নামে বিখ্যাত, মত্ত হস্তীতুল্য ও নিতান্ত প্রিয়দর্শন এই যে যুবক আছেন, ইনি পূর্বে অর্জুনের সারথি ছিলেন। ধনুর্বেদে ইনি সেই মহাত্মা অর্জুনের শিষ্য ছিলেন এবং তাঁর থেকে নিকৃষ্ট নন। পাণ্ডবভবনে থাকবার সময়ে আমি অনেকবার ওই বীরকে দেখেছি। খাণ্ডবদাহনের সময়ে ইনিই অর্জুনের অশ্বগণকে ধারণ করেছিলেন। এই সারথির গুণেই অর্জুন খাণ্ডবদাহনে সমস্ত প্রাণীকে জয় করেছিলেন। আপনার কনিষ্ঠা ভগিনী উত্তরা অনুরোধ করলে নিশ্চয়ই ইনি আপনার সারথি হবেন। তিনি যদি আপনার সারথি হন, তবে আপনি সমস্ত কৌরবকে জয় করে আজ গো-ধন উদ্ধার করে ফিরতে পারবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।” সৈরিন্ধ্রীর কথা শুনে রাজপুত্র উত্তর ভগিনী উত্তরাকে বললেন, “তুমি বৃহন্নলাকে এখানে নিয়ে এসো।” উত্তরা নৃত্যশালায় প্রবেশ করে ভ্রাতা উত্তরের সারথ্য করার জন্য বৃহন্নলাকে অনুরোধ করল। বৃহন্নলা উত্তরের কাছে এলে উত্তর বললেন, “বৃহন্নলা তোমাকে সারথি করেই অর্জুন খাণ্ডববনে অগ্নিকে সন্তুষ্ট করেছিলেন। সৈরিন্ধ্রী জানিয়েছে যে তোমাকে সারথি করেই অর্জুন পৃথিবী জয় করেছিলেন। আমি গো-ধন উদ্ধার করতে চাই, অতএব, কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধে তুমি আমার সারথি হও। আমি শুনেছি অর্জুনের তুমি প্রিয় সারথি ছিলে। তোমার সারথ্যেই অর্জুন বিশ্বজয়ে সমর্থ হয়েছিলেন।” বৃহন্নলা অত্যন্ত বিনয় দেখিয়ে বললেন, “আমি নাচ, গান করে জীবিকা করে থাকি, যুদ্ধে সারথ্য করবার শক্তি কি আমার আছে?” উত্তর বললেন, “তুমি গায়ক, নর্তক, বাদক যাই হও না কেন, দ্রুত আমার রথে উঠে অশ্বগুলিকে ধারণ করো।” তখন অর্জুন যুদ্ধশাস্ত্রজ্ঞ হয়েও নানাপ্রকার কৌতুকজনক কাজ করলেন। তিনি বর্ম উলটো করে শরীরে লাগাতে গেলেন। দেখে রাজকুমারীরা হেসে ফেলল। তখন রাজকুমার উত্তর তাঁকে ঠিক করে বর্ম পরিয়ে দিলেন। তিনি নিজেও সুর্যের মতো উজ্জ্বল স্বর্ণময় একটি কবচ পরলেন এবং সিংহাকৃতি ধ্বজ রথে লাগিয়ে বৃহন্নলাকে সারথি করে তুলে নিলেন। তারপর উত্তম ধনু ও বহুতর সুন্দর ধনু নিয়ে বৃহন্নলার সঙ্গে যাত্রা করলেন।
তখন রাজকুমারী উত্তরা ও তার সখীগণ বৃহন্নলাকে বললেন, “বৃহন্নলা তুমি যুদ্ধে আগত ভীষ্ম ও দ্রোণ প্রভৃতিকে জয় করে আমাদের পুতুলের জন্য নানাবিধ সূক্ষ্ম, মৃদু ও মনোহর বস্ত্র নিয়ে আসবে।” অর্জুন সে কথা শুনে হাসতে হাসতে মেঘগম্ভীর স্বরে বললেন “যদি রাজকুমার উত্তর যুদ্ধে জয় করে ফিরতে পারেন, তবে মনোহর ও উৎকৃষ্ট বস্ত্ৰসমূহ নিশ্চয় নিয়ে আসব।” এই কথা বলে অর্জুন রথ চালিয়ে দিলেন।
বেগবান অশ্ব দক্ষতাসম্পন্ন সারথির হাতে পড়ে দ্রুত ছুটতে লাগল এবং অনতিবিলম্বে শ্মশানের কাছ দিয়ে দেখা গেল যে, কৌরবসৈন্য ব্যূহ রচনা করে আছেন। সমুদ্রের মতো কোলাহলশালী সেই বিশাল সৈন্য, তাদের পায়ের ধূলিতে অন্ধকার আকাশ এবং ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, কর্ণ ও দুর্যোধন সেই সৈন্যদের রক্ষা করছেন দেখে ভীত ও রোমাঞ্চিত উত্তর বৃহন্নলাকে বললেন, “বৃহন্নলা আমি এই কৌরব সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করি না। দেখো, আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে। দেবগণের পক্ষেও দুর্ধর্ষ মহাবীর অসীম পরাক্রমশালী ব্যক্তিগণ এই সৈন্যদের পক্ষে রয়েছেন। ভয়ংকর কার্মুকধারী এই বীরগণের সৈন্যের মধ্যে আমি প্রবেশও করতে পারব না। সুতরাং রথ ফেরাও।”
দুর্বল, ক্ষুদ্র ও মূঢ় উত্তর মূর্খতাবশত অর্জুনের কাছে এইভাবে ক্লীবের বিলাপ করতে লাগলেন। উত্তর আরও বললেন, “পিতা রাজধানী শূন্য রেখে সব সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধ করতে গেছেন। আমি সৈন্যহীন, একাকী, বালক এবং অস্ত্রে অবিশেষজ্ঞ। শত্রুরা সংখ্যায় বেশি, অস্ত্রে অভিজ্ঞ। আমি এঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করব না। বৃহন্নলা। তুমি ফিরে চলো।” বৃহন্নলা বললেন, “রাজপুত্র, ভয়ে আপনি কাতর হয়ে পড়েছেন এবং আপনার ভীতি দেখে শত্রুরা আনন্দ পাচ্ছে। অথচ শত্রুরা এখনও পর্যন্ত এমন কোনও কাজ করেনি—যাতে আপনি ভীত হয়ে পড়তে পারেন। আপনি আদেশ করেছেন যে, আপনাকে কৌরবসৈন্যদের সম্মুখে নিয়ে যেতে হবে। সুতরাং আমি নিশ্চয় আপনাকে সেখানে নিয়ে যাব। কৌরবেরা মাংসভোজী পাখির মতো হঠাৎ উপস্থিত হয়েছে। এখন ওরা যুদ্ধ আরম্ভ করলেও আমি আপনাকে ওখানে নিয়ে যাব। আপনি স্ত্রী-পুরুষদের মধ্যে আত্মগর্ব করে রাজধানী থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এখন গোরু উদ্ধার না করে ফিরে গেলে সবাই আপনাকে উপহাস করবে। তারপর সৈরিন্ধ্রী আমার সারথ্যের প্রশংসা করেছেন। আপনিও অনুরোধ করেছেন। সুতরাং আমি যুদ্ধ করব।”
উত্তর বললেন, “বৃহন্নলা কৌরবেরা সংখ্যায় অনেক। সুতরাং তারা যথা ইচ্ছা মৎস্যদেশের ধন অপহরণ করুক। স্ত্রী-পুরুষেরা আমাকে যত খুশি উপহাস করুক, আমি যুদ্ধ করব না।” এই বলে উত্তর লাফ দিয়ে রথ থেকে মাটিতে পড়ে দ্রুত পালাতে লাগলেন। বৃহন্নলা উচ্চ স্বরে বললেন, “প্রাচীন আচার্যেরা পলায়ন করাকে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম মনে করেন না। আপনার যুদ্ধে মরা পালানোর থেকে অনেক পুণ্যের কাজ হবে।” এই বলে কুন্তীনন্দন অর্জুনও রথ থেকে লাফিয়ে পড়ে, দীর্ঘ বেণী এবং উজ্জ্বল রক্তবর্ণ বস্ত্রযুগল সঞ্চালিত করতে থেকে রাজপুত্র উত্তরের পিছনে ছুটতে লাগলেন। এই দৃশ্য দেখে কৌরবসৈন্যরা হাসতে আরম্ভ করল। কেউ কেউ বলল, “ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নির মতো, স্ত্রী বেশধারী এই ব্যক্তিটা কে? এর দেহের কোনও অঙ্গ পুরুষের মতো, কোনও অঙ্গ নারীর মতো। এর আকৃতিটা অর্জুনের মতো, অথচ রূপ নপুংসকের। মাথা, গলা, হাত অর্জুনের মতো, সুতরাং শক্তিতেও এ অর্জুনই হবে। বিরাটরাজার গৃহে একটি বালক পুত্র মাত্র ছিল। সেই পুত্ৰই পুরুষকারহীন বাল্যচাপল্যেই রাজধানীর বাইরে এসেছে। নিশ্চয়ই অর্জুন ছদ্মবেশে বিরাটরাজ্যে ছিলেন, উত্তর তাঁকে সারথি করে নগরের বাইরে এসেছে। উত্তর আমাদের দেখে ভয়ে পালাচ্ছে, আর অর্জুন তাকে ধরে আনবার জন্য যাচ্ছেন।” কৌরবেরা কর্তব্যহীন অবস্থায় এইসব আলোচনা করছিল। এদিকে অর্জুন একশো পা দৌড়ে উত্তরের মাথার চুল ধরে ফেললেন। অর্জুনের প্রচণ্ড টানে উত্তর অসুস্থ রোগীর মতো বলতে থাকল, “কল্যাণী সুমধ্যমা বৃহন্নলা! আমার কথা শোনো, রথ ফেরাও, বেঁচে থাকলেই জীবনের মঙ্গল হবে। আমি তোমাকে বিশুদ্ধ সোনার একশো মুদ্রা, সোনার সুতায় গাঁথা আটটি বৈদূর্যমণি, সোনার ধ্বজা সমেত অশ্বচতুষ্টয় যুক্ত একখানি রথ এবং দশটি মত্ত হস্তী দেব, আমাকে ছেড়ে দাও।”
দুর্বলচিত্ত উত্তরের বিলাপ শুনে পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুন হাস্য করে ভয়ার্ত উত্তরকে টেনে রথের কাছে আনলেন এবং বললেন—
যদি নোৎসহসে যোদ্ধুং কুরুভিঃ শত্ৰুকৰ্ষণ!।
এহি মে ত্বং হয়ান্ যচ্ছ যুধ্যমানস্য শত্ৰুভিঃ॥ বিরাট : ৩৫ : ৪৪ ॥
“শত্ৰুকর্ষণ! আপনি যদি কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সমর্থ না হন, তবে আসুন, আমিই শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করব। আপনি আমার রথ সঞ্চালন করুন। আমার বাহুবলে রক্ষিত থেকে, মহারথ বীরগণ কর্তৃক রক্ষিত ভয়ংকর ও দুর্জয় রথিসমূহের মধ্যে গমন করুন, আমার সারথি হোন; আমি কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করব।” অর্জুন এই কথা বলে উত্তরকে রথে টেনে তুললেন। অনিচ্ছুক উত্তর রথ থেকে বারবার নামবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। উত্তরকে রথে তুলে অর্জুন সেই শমীবৃক্ষের দিকে যেতে লাগলেন।
উত্তরকে যেভাবে রথে তোলা হল, দেখে ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতি কৌরবশ্রেষ্ঠগণ অর্জুনের ভয়ে অস্থির হয়ে পড়লেন। ধনুর্ধরশ্রেষ্ঠ ভরদ্বাজগোত্র দ্রোণ চারপাশে দুর্লক্ষণ দেখে বলতে লাগলেন, “প্রচণ্ড রুক্ষ পাথরের গুঁড়া বহন করে বাতাস বইছে, আকাশ ধূসর বর্ণ অন্ধকারে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ছে। মেঘগুলি অদ্ভুত আকার ধারণ করেছে; অস্ত্রগুলি কোষ থেকে খসে পড়ে যাচ্ছে। শৃগালেরা প্রজ্বলিত অগ্নির দিকে মুখ করে চিৎকার করছে, অশ্বগণ অশ্রু মোচন করছে। ধ্বজগুলি সঞ্চালিত না হয়েও কাঁপছে। এইসব দুর্লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। আপনারা ভয়নিবারণের জন্য যত্নবান হোন, ভয় উপস্থিত হয়েছে। বীরগণ আপনারা আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করুন, সৈন্যের ব্যূহ রচনা করুন, মহামারীর প্রতীক্ষা করুন, গোধন রক্ষা করুন। কারণ, মহাধনুর্ধর ও সকল অস্ত্রধারী-শ্রেষ্ঠ মহাবীর অর্জুনই যে এই নপুংসক বেশে এসেছেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গঙ্গানন্দন! কপিধ্বজ, বৃক্ষবিশেষতুল্য নামা, ইন্দ্রপুত্র ও নপুংসকবেশধারী সেই অর্জুন আপনাদের জয় করে গোরু নিয়ে যাবেন—এই আমার ধারণা। বিক্রমশালী, সব্যসাচী ও পরন্তপ এই সেই অর্জুন, সকল দেবাসুরগণের সঙ্গে যুদ্ধ না করে নিবৃত্ত হবেন না। ইনি বনে কষ্ট পেয়েছেন, সুতরাং অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং স্বর্গে ইন্দ্র একে শিক্ষা দিয়েছেন; অতএব, ইনি যুদ্ধে ইন্দ্রতুল্য বীরই হয়েছেন। হে কৌরবগণ, আমি এই সৈন্যমধ্যে এর প্রতিযোদ্ধা দেখতে পাচ্ছি না। শুনতে পাই, হিমালয় পর্বতে অর্জুন কিরাতবেশধারী জগৎপ্রভু মহাদেবকেও যুদ্ধে সন্তুষ্ট করেছেন।”
কর্ণ বললেন, “আপনি সর্বদাই অর্জুনের গুণ বর্ণনা করেন এবং আমাদের নিন্দা করে থাকেন; কিন্তু অর্জুন আমার বা দুর্যোধনের ষোলো ভাগের এক ভাগও ক্ষমতার অধিকারী নয়।” দুর্যোধন বললেন, “কর্ণ এই ব্যক্তি যদি অর্জুন হন, তা হলে আমার কার্যসিদ্ধ হয়েছে। কারণ অজ্ঞাতবাসের মধ্যে পাণ্ডবদের সংবাদ জানতে পারলে, তাদের আবার বারো বছর বনে যেতে হবে; পক্ষান্তরে এই ব্যক্তি যদি নপুংসকবেশধারী অন্য ব্যক্তি হয়, তবে আমিই তীক্ষ্ণ শরের দ্বারা ওকে ভূতলে পতিত করব।” উপস্থিত সকল কৌরব, ভীষ্ম, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা দুর্যোধনের সেই সাহসী বাক্যের প্রশংসা করলেন।
ওদিকে শমীবৃক্ষের কাছে গিয়ে অর্জুন সেই কোমলদেহ এবং যুদ্ধে অপারদর্শী উত্তরকে বললেন, “রাজপুত্র এই গাছে উঠে দ্রুত এই ধনুকগুলি নামান। কারণ আপনার ধনুকগুলি আমার বাহুবল সহ্য করতে পারবে না। এই বৃক্ষেই পাণ্ডবদের ধনুগুলি রক্ষিত আছে এবং যুধিষ্ঠির ভীম অর্জুন নকুল ও সহদেব—এই মহাবীরদের ধ্বজ, বাণ ও দিব্য কবচগুলি রক্ষিত আছে। অর্জুনের গাণ্ডিবধনুও এই বৃক্ষেই আছে; একটি ধনুক হলেও এটি শত সহস্র ধনুর তুল্য রাজ্যবৃদ্ধিকারী, অত্যন্ত আকর্ষণ সহ্য করতে পারে, অতিভীষণ, তালবৃক্ষের মতো বিশাল। সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, শত্রুগণের পীড়াসৃষ্টিকারী, স্বর্ণবিন্দুখচিত, স্বর্গীয়, মসৃণ, দীর্ঘ, অক্ষত, গুরুতর ভার বহন করতে সমর্থ, দৃঢ় ও সুন্দর। রাজপুত্র! ওখানে গাণ্ডিবধনু ছাড়া ভীম, নকুল ও সহদেবের ধনুগুলিও এই বৃক্ষে গোপনে আছে। সেই ধনুগুলি গাণ্ডিব ধনুর মতোই সারবান্ ও দৃঢ়। তুমি সেগুলিও সব নামিয়ে আনো।”
উত্তর বললেন, “শুনতে পাই, এই গাছে একটা মৃতের দেহ বদ্ধ করা আছে। আমি উচ্চকুলশীলজাত রাজপুত্র—আমি কী করে সেই মড়ার শরীর ছোঁব? এতদিন মন্ত্র ও ব্রত পালন ব্যর্থ হবে, সেই মৃতদেহ স্পর্শ করে আমি ব্যাধের মতো অপবিত্র হয়ে যাব। বৃহন্নলা তুমি কি আমাকে অস্পৃশ্য করতে চাও?” বৃহন্নলা বললেন, “ভয় করবেন না। এ বৃক্ষে কোনও মৃতদেহ নেই, এগুলি ধন্য; আপনি এগুলি স্পর্শ করলে স্পৃশ্য ও পবিত্রই হবেন। আপনি মৎস্যদেশের রাজপুত্র, সদ্বংশজাত এবং উদারচেতা। আপনাকে দিয়ে আমি নিন্দনীয় কাজ কেন করাব?” অর্জুনের কথা শুনে উত্তর শমীবৃক্ষে আরোহণ করলে বিশালবক্ষা পাণ্ডবগণের সেই মহামূল্য ধনুগুলি নামিয়ে, গিঁটগুলি খুলে অর্জুনের কাছে নামিয়ে নিয়ে আসলেন। তিনি ধনুগুলির সকল দিকের বন্ধন খুলে, তার মধ্যে গাণ্ডিবধনুর সঙ্গে অন্য চারখানা ধনুও দেখতে পেলেন। সূর্যের মতো তেজস্বী সেই ধনুগুলির অলৌকিক গুণরাশি, উদয়কালীন গ্রহগুলির দীপ্তির ন্যায় উজ্জ্বল দীপ্তিরাশি দেখে উত্তর রোমাঞ্চিত ও অস্থিরচিত্ত হয়ে পড়লেন। ধনুকগুলি নামিয়ে, অন্য অস্ত্রশস্ত্র স্পর্শ করে, খড়্গগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করে, রাজকুমার উত্তর অত্যন্ত রোমাঞ্চিত হয়ে অর্জুনকে কোন অস্ত্রটি কার প্রশ্ন করতে লাগলেন। বৃহন্নলারূপী অর্জুন উত্তর দিলেন, “রাজপুত্র আপনি প্রথমে আমার কাছে যে ধনুখানির বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন, স্বর্ণবিন্দুভূষিত সেই পরমাস্ত্র অর্জুনের প্রসিদ্ধ গাণ্ডিবধনু। এই ধনু চিরকাল দেব ও মনুষ্যের পূজিত, লক্ষ লক্ষ ধনুকের তুল্য রাজ্যবর্ধক, নানাবর্ণে বিচিত্র, মসৃণ, দীর্ঘ এবং অক্ষত গাণ্ডিবধনু। প্রথমে এই ধনু বহু সহস্র বৎসর ব্রহ্মার নিকট ছিল। তারপর প্রজাপতি পাঁচশো তিন বছর, ইন্দ্র পঁচাশি বছর, চন্দ্র পাঁচশো বছর এবং জলের অধিপতি বরুণ একশো বছর ধারণ করেন, তারপরে শ্বেতবাহন অর্জুন পনেরো বছর ধারণ করেছেন। এই গাণ্ডিবধনু অলৌকিক, সর্বশ্রেষ্ঠ ধনু। আর সুন্দর পার্শ্বদ্বয় যুক্ত মধ্যস্থানে স্বর্ণসমন্বিত এই ধনুখানি ভীমসেনের। রাজসূয় যজ্ঞের পূর্বে এই ধনুর সাহায্যে ভীমসেন পূর্বদিক জয় করেছিলেন। ইন্দ্রগোপচিহ্নে (মখমলি পোকার চিহ্নে) বিচিত্র এবং সুন্দর আকৃতিযুক্ত এই ধনুখানি রাজা যুধিষ্ঠিরের। স্বর্ণময়, সুন্দর ও আপন তেজে উজ্জ্বল সূর্যচিহ্ন সকল প্রকাশ পাচ্ছে যে ধনুতে সেই ধনুখানি নকুলের। যে ধনুতে স্বর্ণভূষণে বিচিত্ৰীকৃত ও স্বর্ণময় পতঙ্গ (ফড়িং) সকল আছে। এই ধনু মাদ্রীপুত্র সহদেবের।
“অর্জুন যখন যুদ্ধে শত্ৰু সংহার করেন, তখন আপন তেজে উজ্জ্বল, ক্ষুরধার, লোমবাহী, সর্পবিষতুল্য এই বাণগুলি অক্ষয় হয়ে থাকে। এই যে স্থূল, দীর্ঘ ও অর্ধচন্দ্রাকার বাণগুলি আছে, এগুলি শত্রুনাশক ভীমসেনের। হরিদ্রাবর্ণ, স্বর্ণপুঙ্খ, তীক্ষ্ণধার বাণসমূহ আছে; এতে পরিপূর্ণ ব্যাঘ্রচিহ্ন চিহ্নিত এই তূণীরটা নকুলের। এগুলির সাহায্যে নকুল পশ্চিমদিক জয় করেছিলেন। সর্বাংশে লৌহময়, সূর্যের তুল্য উজ্জ্বল, বিচিত্ৰকার্যকারী এই বাণগুলির অধিকারী সহদেব। তীক্ষ্ণ, পীতবর্ণ, বৃহৎ, দীর্ঘলোমযুক্ত, স্বর্ণপুঙ্খ, তিন স্থানে বেষ্টনযুক্ত এই মহাবাণগুলি রাজা যুধিষ্ঠিরের।
“দীর্ঘ, শিলীর ন্যায় (কেঁচোর মতো) পৃষ্ঠযুক্ত এবং শিলীর তুল্য মুখ সমন্বিত এই খড়্গখানি যুদ্ধে দুষ্করকার্যকারী অর্জুনের। ব্যাঘ্রচর্মের কেশে স্থাপিত, দুষ্কর কার্যসাধক, শত্রুগণের ভয়জনক এই বিশাল খড়্গখানি ভীমসেনের। সুন্দর ফলক, বিচিত্র কোশ, স্বর্ণমুষ্টিযুক্ত সর্বোত্তম এই খড়্গখানি কৌরবনন্দন বুদ্ধিমান ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের। বিচিত্রযুদ্ধে দুষ্করকার্যসাধক দৃঢ় যে খড়্গখানি হস্তীচর্মময় কোশে স্থাপিত আছে, এটি নকুলের। আর এই যে বিশাল খড়্গখানি গো-চর্মনির্মিত কোশে স্থাপিত রয়েছে, দৃঢ় ও দুষ্করকার্যসাধক এই খড়্গখানিকে সহদেবের বলে জানুন।”
উত্তর বললেন, “মহাত্মা পাণ্ডবদের এই মনোহর অস্ত্রসমূহ দেখলাম, কিন্তু কৌরবনন্দন যুধিষ্ঠির, পাণ্ডুনন্দন ভীমসেন, পৃথানন্দন অর্জুন, নকুল ও সহদেব—এঁরা গেলেন কোথায়? দ্যূতক্রীড়ায় হেরে এঁরা বনে গিয়েছিলেন, তারপর কোথায় গেলেন, তা শোনাই যাচ্ছে না। দ্রৌপদীই বা কোথায় গেলেন? আমরা শুনেছি—দ্রৌপদী স্ত্রীরত্ন! তাই তিনি তখন দ্যূত-পরাজিত পাণ্ডবগণের সঙ্গে বনেই গিয়েছিলেন।”
অৰ্জুন বললেন, “আমি পৃথাপুত্র অর্জুন, কঙ্ক নামক সভাসদ যুধিষ্ঠির, আপনার পিতার পাচক বল্লব ভীমসেন। অশ্বশালাধ্যক্ষ—নকুল এবং গোশালা অধ্যক্ষ—সহদেব, আর সৈরিন্ধ্রী, যার জন্য কীচকেরা নিহত হয়েছে, স্বয়ং দ্রৌপদী।” উত্তর বললেন, “আমি পূর্বে অর্জুনের দশটি নাম শুনেছি, তা যদি আপনি আমার কাছে বলতে পারেন, তা হলে আপনার কথা বিশ্বাস করব।” অর্জুন বললেন, “ভাল, আমার দশটি নাম বলছি, আপনি একাগ্রচিত্তে শুনুন। অর্জুন, ফাল্গুন, জিষ্ণু, কিরীটি, শ্বেতবাহন, বীভৎসু, বিজয়, কৃষ্ণ, সব্যসাচী ও ধনঞ্জয়—এই আমার দশটি নাম।” উত্তর প্রশ্ন করলেন, “আপনার এই দশটি নাম কেন হল? সেই বীরের এই নামগুলির কারণ আমি জানি, যদি আপনি বলতে পারেন, তা হলে আমি আপনার সব কথা বিশ্বাস করব।”
অর্জুন বললেন, “আমি সকল দেশ জয় করে সেখানকার ধন নিয়ে আসি, সেই ধনের মধ্যে থাকি, সেই জন্য লোকে আমাকে ‘ধনঞ্জয়’ বলে। যুদ্ধ-দুর্মদ শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধে তাঁদের জয় না করে ফিরি না, তাই আমার নাম ‘বিজয়’। যুদ্ধে আমার রথের চারটি অশ্বের বর্ণ শ্বেত, তাই আমি ‘শ্বেতবাহন’, হিমালয় পর্বতে দিনের ভাগে পূর্ব ফাল্গুনী ও উত্তর ফাল্গুনী নক্ষত্রের সন্ধিক্ষণে আমার জন্ম, লোকে তাই আমাকে ‘ফাল্গুন’ বলে জানে। দানবদের জয় করলে পর দেবরাজ ইন্দ্র আমার মাথায় সূর্যের মতো উজ্জ্বল একটি কিরীট পরিয়ে দিয়েছিলেন, এইজন্যে লোকে আমাকে ‘কিরীটি’ বলে। যুদ্ধের সময়ে আমি কোনওপ্রকার নিন্দার কাজ করি না তাই আমার নাম ‘বীভৎসু’। বাম ও দক্ষিণ হস্তে একই সঙ্গে আমি গাণ্ডিব আকর্ষণ করতে পারি। তাই মনুষ্যলোকে সকলে আমাকে ‘সব্যসাচী’ বলে। চতুঃ সমুদ্র পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে অন্যের পক্ষে দুর্লভ আমার শুভ্র যশ যেহেতু বিস্তৃত, যেহেতু আমি যুদ্ধে শুভ্র (নির্দোষ) কাজই করে থাকি, তাই লোক আমাকে ‘অর্জুন’ বলে। আমি দেবরাজের পুত্র, শত্ৰুবিজয়ী এবং শত্রুদের পক্ষে দুর্লভ ও দুর্ধর্ষ। তাই দেবলোক ও মনুষ্যলোকে আমি ‘জিষ্ণু’ নামেই পরিচিত। আমার গাত্র কৃষ্ণ, এই কারণে পিতৃদেব পাণ্ডু আমার নাম রেখেছিলেন ‘কৃষ্ণ’। এই হল আমার দশম নাম। এ ছাড়াও ভূমি জয় করি বলে আমি ‘ভূমিঞ্জয়’ ও যুদ্ধশাস্ত্রে আমিই শেষ বলে ‘উত্তর’ নামেও পরিচিত।”
অর্জুনের এই আত্মপরিচয় শোনার পর বিরাট রাজপুত্র উত্তর অর্জুনের কাছে গিয়ে নমস্কার করে বললেন, “রক্তনয়ন! মহাবাহু! হস্তিশ্রেষ্ঠশুণ্ডতুল্য বাহুযুগল! পার্থ! ধনঞ্জয়। আমি বহুভাগ্যে আজ আপনাকে দেখতে পেলাম। আপনি আমাদের দেশে সুখে ছিলেন তো? আমি আপনাকে না চিনে যেসব অসঙ্গত কথা বলেছি, আমার সেই অপরাধ মার্জনা করুন। যেহেতু আপনি পূর্বে দুষ্করকার্যকারী, সেইহেতু আমার ভয়ও গিয়েছে এবং আপনার উপর আমার প্রীতিও জন্মেছে। সুতরাং আপনি বলুন আমাকে কী করতে হবে? আপনার নির্দেশ অনুসারে আমি সকল কার্য করব।”
*
“বৃহন্নলা-রূপী অর্জুনের আত্মপ্রকাশ” মহাভারতের এক অত্যন্ত দুর্লভ মুহূর্ত। পাণ্ডবগণ ও দ্রৌপদী গণনা করে জানতেন যে অজ্ঞাতবাসের এক বৎসরকাল পূর্ণ হয়েছে। শর্ত অনুযায়ী এইবার তাঁরা রাজ্যে ফিরবেন। অজ্ঞাতবাস বৎসরে দ্রৌপদীর ভাগ্যে পুনরায় লাঞ্ছনা ঘটেছে, অর্জুন স্ত্রীর লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করতে পারেননি, কারণ তিনি তখন উর্বশীর অভিসম্পাতে নপুংসক। কৌরব সভায়ও দ্রৌপদীর লাঞ্ছনায় অর্জুন প্রতিবাদ করতে পারেননি, কারণ তখন তিনি ধর্মপাশবদ্ধ।
বৃহন্নলাকে সারথি করার পরামর্শ দিয়ে দ্রৌপদী যেন অর্জুনকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, অজ্ঞাতবাস পর্ব শেষ হয়েছে; এইবার অর্জুনকে আত্মপ্রকাশ করতে হবে। এক মুহূর্তে অর্জুন জড়ত্বমুক্ত হয়েছেন। যা তাঁর নিজের স্থান, যেখানে তিনি শ্রেষ্ঠতম; সেই রণক্ষেত্রে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন।
দ্বাপর যুগে সম্ভবত অপর রাজার গো-ধন হরণ মহকীর্তি বলে বিবেচিত হত। এই কার্যে ভীষ্মের উপস্থিতি পাঠককে বিস্মিত এবং ব্যথাতুর করে তোলে। ত্রিগর্তরাজ সুশৰ্মা, যিনি সেনাপতি কীচকের বীরত্বে ভীত সন্ত্রস্ত ও বারংবার পরাজিত ছিলেন, তাঁর পরামর্শে রীতিমতো ষড়যন্ত্র করে বিরাটরাজার গো-হরণের সিদ্ধান্ত হল। সুশৰ্মা সপ্তমীর দিনে মৎস্য রাজ্যের দক্ষিণদিকে গো-হরণ করে বিরাটরাজাকে সেইদিকে নিয়ে যাবেন, পরের দিন, অষ্টমীর দিন দুর্যোধন তাঁর মন্ত্রিমণ্ডলীকে নিয়ে উত্তর দিকের গো-হরণ করবেন। ষড়যন্ত্রটি দুর্যোধন ইত্যাদি ‘দুষ্ট-চতুষ্টয়ের’ চরিত্রের সঙ্গে মানানসই। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপের আসা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। ভীষ্ম, যিনি কুরুকুলের বিবেক, তিনি গোরু চুরি করতে এসেছেন—একথা ভাবতেই খারাপ লাগে। সম্ভবত ভীষ্ম চরিত্রেরও এই একমাত্র কলঙ্ক। সম্ভবত ভীষ্ম গণনা করে দেখেছিলেন যে, অজ্ঞাতবাস বৎসর শেষ হয়েছে। অতএব তিনি পাণ্ডবদের আত্মপ্রকাশের খোঁজেই গেছিলেন। কিন্তু গোরু-চুরির সঙ্গে ভীষ্মের মতো মহান চরিত্রকে মেলানো যায় না।
এই মুহূর্তটির আর একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য সুশর্মার বিরুদ্ধে সবথেকে বেশি বীরত্বের পরিচয় দিলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, যাঁকে সাধারণত মৃদু, বদান্য লজ্জাশীল এবং শান্ত মানুষ বলে মনে করা হত। যুধিষ্ঠির যে ক্লীব, ভীরু মানুষ ছিলেন না, শল্যবধের ক্ষেত্রেও তিনি সে পরিচয় দিয়েছিলেন।
উত্তর বিশাল কৌরবসৈন্য দেখে পালাতে চেয়েছিলেন। বৃহন্নলারূপী অর্জুন তাঁকে ফিরিয়েছিলেন। এরপর অর্জুনের আদেশে শমীবৃক্ষে উঠে উত্তর পাণ্ডবদের গোপন অস্ত্রসম্ভার নামিয়ে দেখে স্তম্ভিত হয়েছিলেন, তারপর অর্জুনের মুখে মৎস্যদেশে আত্মগোপনকারী পাণ্ডবদের পরিচয় পেয়ে, পাণ্ডবদের অস্ত্রশস্ত্র দেখে উত্তর আত্মস্থ হয়ে বলেছিলেন, “আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। যেদিকে যেতে বলবেন, সেইদিকে যাব।” সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে পড়ছিল। ঠিক এই ঘটনাই কয়েক দিনের মধ্যে আরও একবার ঘটেছিল। সেদিন গাণ্ডিবধনু অর্জুন কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে দুই সৈন্যের মাঝখানে গিয়ে সারথি কৃষ্ণকে বলেছিলেন, ‘ন যোৎসে’, ‘আমি যুদ্ধ করব না’,—সেদিন পার্থ-সারথি কৃষ্ণকে ভগ্বদ-গীতা শোনাতে হয়েছিল, নিজের বিশ্বরূপ অর্জুনকে দেখাতে হয়েছিল। তারপর অর্জুন বলেছিলেন, “যথা নিযুক্তোস্মি তথা করোমি”; “আমাকে যেখানে নিযুক্ত করবে, তাই করব।”
উত্তর পাণ্ডবদের অস্ত্র দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, এক এক পাণ্ডবের অস্ত্র নির্বাচন দেখেও। উত্তরের সঙ্গে আমরাও বিস্মিত হই, যখন বিভিন্ন সময়ে তাঁর একক যুদ্ধের বর্ণনা অর্জুন উত্তরকে শোনান। আমরা অনুভব করি—সারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বীরের সঙ্গে সঙ্গে আমরা চলেছি। যিনি একা পৃথিবীর সমস্ত বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে সংগ্রামে অনায়াসে অবতীর্ণ হন।
৫২
অর্জুনের কৌরব বিজয়
“যুদ্ধ করব না” এই বলে ভীত উত্তর পালাতে লাগলেন। কিন্তু দীর্ঘ পদক্ষেপে বৃহন্নলা বেশী অর্জুন তাঁকে ধরে টেনে রথে তুললেন। শমীবৃক্ষের তলায় উপস্থিত হয়ে অর্জুনের আদেশে উত্তর বৃক্ষে উঠতে বাধ্য হলেন। সেখানে পাণ্ডবদের লুক্কায়িত অস্ত্রশস্ত্র দেখে উত্তর রোমাঞ্চিত ও ভীত ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। পরে অর্জুনের মুখে আত্মপরিচয়, পাণ্ডবপরিচয় ও অস্ত্রশস্ত্র পরিচয় পাবার পর উত্তরের মনে ঈশ্বর দর্শনের মতো আনন্দ জাগল। তিনি যুক্ত করে অর্জুনকে বললেন, “যা আদেশ করবেন, তাই করব।”
উত্তর বললেন, “বীর! আপনি রথে চড়ে কোন দিকে যেতে চান? আপনার আদেশ পেলে, সেই দিকে যাব।” অর্জুন বললেন, “পুরুষশ্রেষ্ঠ। আমি তোমার উপরে সন্তুষ্ট হয়েছি, তুমি নির্ভয়ে চলো। দেখো, আমি যুদ্ধবিশারদ তোমার সকল শত্রুকে যুদ্ধে পরাজিত করব। তুমি সত্বর রথে এই সব তূণীর বন্ধন করো। আমি কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করে তোমার গো-ধন ফিরিয়ে আনব। রাজপুত্র! আমি রক্ষা করতে থাকলে এই রথই তোমার পক্ষে রাজধানী হবে। কারণ, ‘শক্রদের জয় করে গোধন ফিরিয়ে আনব’, এই সংকল্পই আমার সহায় হবে এবং সেই সংকল্পগুলি বিপক্ষদের তাড়িয়ে দেবে। আমার প্রসারিত বাহুযুগল হবে প্রাচীরের তোরণ। ধনু, বাণ ও যষ্টি— এই ত্রিবিধ দণ্ডে এবং তৃণসমূহে রথ ও নগর পরিপূর্ণ থাকবে; বহুতর ধ্বজে ব্যাপ্ত হবে। ধনুর গুণই কামান হবে এবং রথচক্রের শব্দই দুন্দুভির শব্দরূপে চলতে থাকবে। ক্রোধই এইসব করে দেবে। আমি গাণ্ডিবধারণ করে রথের উপর থাকলে এ রথ শত্রুসৈন্যের অজেয় হবে। তুমি নির্ভয়ে থাকতে পারো।”
উত্তর বললেন, “বীর! আমি এখন আর এঁদের যুদ্ধে ভয় করি না। কারণ, আমি জানি যে, যুদ্ধে আপনি কৃষ্ণের অথবা দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে সমান। আমি কেবল আপনার এই নপুংসকতার কথা চিন্তা করে মুগ্ধ হচ্ছি। কিন্তু আমার বুদ্ধি অল্প, তাই কারণ নিশ্চয়ই করতে পারছি না। আপনার অঙ্গ ও রূপ পুরুষেরই যোগ্য এবং আপনার সমস্ত লক্ষণ পুরুষের। কোন কর্মের ফলে এই ক্লীবত্ব আপনাকে ধারণ করতে হচ্ছে? আপনার আকৃতি গন্ধর্বরাজের মতো; সুতরাং ক্লীববেশে বিচরণকারী দেবরাজ ইন্দ্র অথবা দেবাদিদেব মহাদেব বলেই আমার মনে হচ্ছে।”
অর্জুন বললেন, “রাজপুত্র, আমি তোমার কাছে সত্য বলছি যে, আমি জ্যেষ্ঠভ্রাতার আদেশে এক বৎসর যাবৎ এই ব্রহ্মচর্যব্রত আচরণ করছি। কিন্তু আমি বাস্তবিকই নপুংসক নই। তবে পরাধীন এবং ধর্মপাশে আবদ্ধ ছিলাম। এখন আমার সে ব্রহ্মচর্যব্রত সমাপ্ত হয়েছে এবং আমি প্রতিজ্ঞা থেকেও উত্তীর্ণ হয়েছি। তুমি নিশ্চিতভাবে একথা বিশ্বাস কোরো।” উত্তর বললেন, “আপনি আমার প্রতি গুরুতর অনুগ্রহ করলেন। যে কারণে আমি চিরকাল জানতাম এ-জাতীয় পুরুষশ্রেষ্ঠরা কখনও নপুংসক হন না। আমার এই অনুমান আপনি মিথ্যা করেননি। আমি যুদ্ধে আপনার সহায়কারী হলাম, আমি এখন দেবগণের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে পারি, আমার ভয় চলে গেছে, এখন কী করব, আপনি বলুন। আমিও শ্রেষ্ঠ গুরুর কাছে সারথ্য বিদ্যা শিখেছি, কৃষ্ণের যেমন দারুক, ইন্দ্রের যেমন মাতলি, আমাকে আপনি সেইরূপ মনে করুন। আমার রথের সামনের দক্ষিণপার্শ্বের ওই অশ্বটি কৃষ্ণের অশ্ব ‘সুগ্রীবের’ তুল্য, আর বামপার্শ্বের এই অশ্বটি কৃষ্ণের ‘মেঘপুষ্প’ নামক অশ্ব বলেই আমি মনে করি। রথের পিছনের বাম দিকের ভারবহনকারী অশ্বকে আপনি কৃষ্ণের অশ্ব ‘শৈব্য’ বলে জানবেন, পিছনের ডান দিকের ভারবহনকারী এই অশটি কৃষ্ণের ‘বলাহক’ নামক অশ্বের থেকেও শ্রেষ্ঠ। এই রথ আপনাকে বহন করার যোগ্য, আপনিও এই রথে আরোহণ করার যোগ্য।”
তখন অর্জুন হাত থেকে শাঁখা খুলে ফেলে সুন্দর দুটি জ্যাঘাতবারণ (চামড়ার ঠুসি) ধারণ করলেন। শ্বেতবর্ণ বস্ত্রদ্বারা মাথার কেশগুলি বন্ধন করে পবিত্র ও সংযতচিত্তে, সেই উত্তম রথে সমস্ত অস্ত্রকে স্মরণ করলেন। তখন সমস্ত অস্ত্রই কৃতাঞ্জলি হয়ে অর্জুনের কাছে এসে বলল, “ইন্দ্রনন্দন, আমরা দাসেরা উপস্থিত হয়েছি।” অর্জুন অস্ত্রগুলিকে প্রণাম করে, হাত দিয়ে স্পর্শ করে বললেন, “আপনারা, আমার স্মৃতিপথে উপস্থিত থাকুন।” অর্জুন গাণ্ডিবে গুণারোপণ করে প্রবল টংকারধ্বনি করলেন, সেই টংকারধ্বনিতে বাতাসের গতি দ্রুততর হল। বৃক্ষসকল কাঁপতে থাকল, কৌরবদের কানে সেই শব্দ বজ্রের মতো বোধ হল।
তখন উত্তর বললেন, “পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! আপনি একাকী কী করে এই বহুতর সর্বশাস্ত্ৰপারদর্শী মহারথদের যুদ্ধে জয় করবেন? হে কুন্তীনন্দন! আপনি নিঃসহায় আর কৌরবেরা সহায়সম্পন্ন।” অর্জুন উচ্চকণ্ঠে হেসে বললেন, “ভয় পেয়ো না। আমি যখন ঘোষযাত্রায় অতি মহাবল গন্ধর্বদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলাম, তখন কে আমার সহায় বা বন্ধু ছিল? খাণ্ডবদাহের সময় দেবদানবব্যাপ্ত সেই ভয়ংকর যুদ্ধে কে আমার সহায় ছিল? দেবরাজের জন্য মহাবল নিবাতকবচ ও পৌলোম অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় কে আমার সহায় ছিল? দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় বহুতর রাজার সঙ্গে যুদ্ধে কে আমার সহায় ছিল? অতএব গুরু দ্রোণ, ইন্দ্র, কুবের, যম, বরুণ, অগ্নি, কৃপ, কৃষ্ণ এবং শিবের আশীর্বাদ নিয়ে কেন আমি এঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারব না? তুমি রথ চালাও, তোমার মনের সন্তাপ দূর হোক।”
তারপর অর্জুন সমস্ত অস্ত্র নিয়ে, উত্তরকে সারথি করে শমীবৃক্ষকে প্রদক্ষিণ করে প্রস্থান করলেন। অর্জুন উত্তরের রথ থেকে সিংহধ্বজ নামিয়ে, শমীবৃক্ষমূলে রেখে, বিশ্বকর্মাকৃত দৈবী মায়া ও স্বর্ণময় ও সিংহলাঙ্গুল বানরধ্বজ সেই রথে যুক্ত করলেন। অর্জুন অগ্নিদেবকে স্মরণ করলে, অগ্নিদেব কতকগুলি ভূত পাঠিয়ে দিলেন, তারা সেই ধ্বজে এসে অধিষ্ঠান করল। তখন বলবান ও শত্রুমর্দন অর্জুন সবলে শত্রুদের লোমহর্ষক বিশাল শব্দকারী মহাশঙ্খ বাজালেন। অর্জুনের সেই শঙ্খের শব্দে অশ্বগুলি জানুতে ভর দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল এবং উত্তরও অত্যন্ত ভীত হয়ে রথে বসে পড়লেন। রশ্মি আকর্ষণ করে অর্জুন অশ্বগুলিকে ওঠালেন, আলিঙ্গন করে উত্তরকে আশ্বস্ত করলেন। অর্জুন বললেন, “ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ! পরন্তপ! তুমি ক্ষত্রিয় সন্তান। সুতরাং ভয় কোরো না। তুমি শত্রুমধ্যে অবসন্ন হচ্ছ কেন? তুমি সর্বপ্রকার শঙ্খশব্দ, ভেরিশব্দ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত হস্তীর গর্জন শুনেছ। তবে সাধারণ লোকের মতো একটি শঙ্খের আওয়াজে ভীত, অবসাদগ্রস্ত ও অস্থির হয়ে পড়ছ কেন?” উত্তর বললেন, “বীর! আমি সর্বপ্রকার শঙ্খশব্দ, ভেরিশব্দ, হস্তীগর্জন শুনেছি। কিন্তু কখনও এরূপ শঙ্খশব্দ শুনিনি, ধ্বজের এ-জাতীয় রূপ দেখিনি, কিংবা ধনুকের এমন টংকারও কখনও শুনিনি। শঙ্খের শব্দে, ধনুর টংকারে, রথের নির্ঘোষে আমার মন অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছে— ধূলি সর্বদিক আবৃত করেছে, আমি কিছু দেখতেও পাচ্ছি না, গাণ্ডিবের টংকারে আমার কর্ণদ্বয় বধির হয়ে গেছে।” অর্জুন বললেন, “উত্তর! রথ থামিয়ে, দুই পায়ে দৃঢ়ভাবে ভর দিয়ে, লাগামগুলি দৃঢ়ভাবে ধারণ করো। কারণ, আমি আবার শঙ্খধ্বনি করব।”
তারপর সেই শঙ্খের রবে, রথচক্রের শব্দে এবং গাণ্ডিবের টংকারধ্বনিতে পৃথিবী কেঁপে উঠল। তখন দ্রোণ বললেন, “রথের যে গম্ভীর শব্দ শোনা যাচ্ছে, এত মেঘ জমছে, পৃথিবী যেভাবে কাঁপছে— তাতে বোঝা যাচ্ছে— ইনি অর্জুন ভিন্ন অন্য কেউ নন। আমাদের অস্ত্রগুলির কোনও তেজ প্রকাশিত হচ্ছে না, অস্ত্রে কোনও আগুনও জ্বলছে না। এগুলি কোনও শুভলক্ষণ নয়। সমস্ত পশু সূর্যের দিকে মুখ করে ভয়ংকর চিৎকার করছে। আমাদের ধ্বজের উপরে কাকেরা এসে বসছে; এও অমঙ্গলসূচক। শৃগালেরা আমাদের দক্ষিণে থেকে গুরুতর ভয়ের সৃষ্টি করছে। এই শৃগালটা চিৎকার করতে করতে আমাদের সৈন্যের মধ্যে দৌড়াচ্ছে এবং কারোর কাছ থেকে প্রহার না পেয়ে মহাভয়ের সূচনা করছে। আপনাদের রোমকূপগুলি উঁচু হয়ে উঠছে; অতএব, যুদ্ধে ক্ষত্রিয়গণের নিশ্চয় বিনাশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। গ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে না, ভয়ংকর পশুপক্ষী সকল চিৎকার করছে, ক্ষত্রিয়দের বিনাশের সব লক্ষণ প্রকাশিত। দুর্যোধন বিশেষভাবেই দুর্লক্ষণগুলি আমাদের বিনাশসূচক, কারণ উজ্জ্বল উল্কাসকল তোমার সৈন্যেরই পীড়া জন্মাচ্ছে। বাহনগুলি বিষণ্ণ মুখে কাঁদছে, শৃগালগণ সব দিকেই তোমার সৈন্যদের আশ্রয় করেছে। অধিকাংশ যোদ্ধার মুখ মলিন এবং চিত্ত যেন বিষণ্ণ। কারও যেন যুদ্ধে কোনও ইচ্ছা নেই। সৈন্যরা যেন উপলব্ধি করছে, তাঁরা অর্জুনের বাণে পীড়িত ও সন্তপ্ত হতে চলেছে। অতএব দুর্যোধন আমরা গোরুগুলি পাঠিয়ে দিয়ে, ব্যূহ রচনা করে প্রহার করার অভিলাষী হয়ে অবস্থান করতে থাকি।”
তখন রাজা দুর্যোধন রথিশ্রেষ্ঠ ও অতিমহাবল ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপকে বললেন, “আমি আর কর্ণ আপনাদের বার বার বলছি, কিন্তু আপনারা শুনছেন না। দ্যূতক্রীড়ার শর্ত ছিল বারো বৎসর বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস। অজ্ঞাতবাস প্রকাশিত হয়ে পড়লে, আবার বারো বৎসর বনবাস। অজ্ঞাতবাসের কাল এখনও শেষ হয়নি, অথচ অর্জুন প্রকাশিত হয়েছে, অতএব পাণ্ডবদের আরও বারো বছর বনবাসে যেতে হবে। লোভবশত পাণ্ডবেরা অজ্ঞাতবাসের সমাপ্তিকাল বুঝতে পারেনি— অথবা আমাদেরই সে-বিষয়ে ভ্রম উপস্থিত হয়েছে। পিতামহই এ-বিষয়ে চূড়ান্ত সত্য নির্ণয় করতে পারেন। আমরা যুদ্ধের জন্য উত্তরকে খুঁজছিলাম এবং মৎস্যদেশীয় সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিলাম। এই অবস্থায় যদি অর্জুন এসে পড়ে, তবে আমরা কার কাছে অপরাধী হব? আমরা ত্রিগর্তদের জন্যই মৎস্যদেশে এসেছিলাম। কারণ ত্রিগর্তেরা আমাদের কাছে মৎস্যদের নানা অপরাধের কথা বলেছিল। আমরাও ভীত ত্রিগর্তদের কাছে এরূপ অঙ্গীকার করেছিলাম। স্থির ছিল, সপ্তমীর দিন বৈকালে ত্রিগর্তেরা মৎস্যদের প্রচুর গো-ধন হরণ করবে, তারা তা করেছে। অষ্টমীর দিন প্রভাতে আমরা বিরাটরাজার গোরুগুলি হরণ করব। সুতরাং হয় ত্রিগর্তেরা গোরুগুলি হরণ করেছে, না হয় বিরাটরাজার কাছে পরাজিত হয়েছে, অথবা আমাদের প্রতারণা করে সন্ধি করেছে। অথবা বিরাটরাজা ত্রিগৰ্তরাজাকে পরাজিত করে, একরাত্রির মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আসছেন। তাঁদের মধ্যের কোনও মহাবীর অগ্রবর্তী হয়ে আমাদের জয় করতে আসছেন। কিংবা ইনি স্বয়ং বিরাটও হতে পারেন।
“এখন ইনি বিরাটই হোন অথবা অৰ্জুনই হোন, আমাদের সকলকে যুদ্ধ করতে হবে। সুতরাং ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ প্রভৃতি মহারথ অস্থিরচিত্তে রথের উপর কেন দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমরা গোধন ছিনিয়ে নিয়েছি। এই অবস্থায় স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র অথবা যমও যদি যুদ্ধ করতে আসেন, আমাদের মধ্যে কে আছেন যে যুদ্ধ না করে হস্তিনাপুরে ফিরে যাবেন? যদি পদাতিকদের কেউ নিবিড় বনে পলায়নের চেষ্টা করে, তা হলে আমিই তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা তাদের মেরে ফেলব। অশ্বারোহীরা জীবন সংশয় করে কেউ পালাতে চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু তিনি সফল হবেন কি না, আমি বলতে পারি না।
“বীরগণ, আপনারা দ্রোণাচার্যকে সৈন্যের পিছনে রেখে প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণ করুন। ইনি পাণ্ডবদের অভিপ্রায় জানেন, অর্জুনের প্রতি এঁর অধিক ভালবাসা লক্ষ করে আসছি। কারণ, অর্জুনকে আসতে দেখেই তিনি এর প্রশংসা আরম্ভ করেছেন। সৈন্যেরা যেন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়, তার ব্যবস্থা করুন। কারণ, দ্রোণ যেই অর্জুনের অশ্বের হ্রেষারব শুনেছেন, আমাদের সৈন্যেরা তখনই বিচলিত হতে আরম্ভ করেছে। একে গ্রীষ্মকাল, তাতে আবার মহাবন নিকটে। এই অবস্থায় বিদেশে আগত সৈন্যরা যাতে শত্রুর বশীভূত না হয়ে যায়, আপনারা তার ব্যবস্থা করুন। অশ্বের হ্রেষাধ্বনি শুনেই বিপক্ষের প্রশংসা করতে হবে? অশ্ব সর্বদাই হ্রেষারব করে, বায়ু সর্বদাই প্রবাহিত হয়, ইন্দ্র বর্ষণ করেন, মেঘও গর্জন করে। এতে অর্জুনের প্রশংসা করার কী আছে? আসলে আচার্য দ্রোণ আমাদের প্রতি বিদ্বেষ ও ক্রোধ পোষণ করেন, অর্জুনের শুভকামনা করেন। আচার্যেরা দয়ালু ও পণ্ডিত এবং সকল কাজেই বিপদের সম্ভাবনাকারী। এঁরা রাজসভায়, লোকসভায়, ভবনে বিচিত্র বিষয়ে বিচিত্র কথা বলেন। এঁরা সেখানেই শোভা পাবার উপযুক্ত। পরের দোষ অন্বেষণে, মনুষ্যচরিত্র নির্ণয়ে, অন্ন-পানাদির দোষ-গুণ বর্ণনায় এঁরা নিপুণ। এঁরা সেখানেই থাকুন।”
কর্ণ বললেন, “বীরগণ! আপনারা সকলেই বীর হওয়া সত্বেও ভীত, উদ্বিগ্ন ও যুদ্ধে অনিচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে। এই ব্যক্তি যদি মৎস্যরাজ বিরাট অথবা অর্জুনই হন, তীর যেমন সমুদ্রকে ধারণ করে, তেমনই আমি এঁকে বারণ করব। আমার বাণগুলি সাপের মতো দ্রুতগতিতে ছুটবে, কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত হবে না। আমি লঘুহস্ত। পতঙ্গসমূহ যেমন আগুনকে আবৃত করে, সেই রকম আমার তীক্ষ্ণাগ্র বাণ অর্জুনকে বিদ্ধ করবে, আবৃত করবে। আমি এত দ্রুত অস্ত্ৰক্ষেপ করব যে আপনারা কেবলমাত্র দুটি ভেরির শব্দের মতো তলদ্বয়ের (দু’হাতের চামড়ার ঠুসি) শব্দ শুনতে পাবেন। আবার, আমরা তেরো বৎসর অর্জুনকে কষ্টে রেখেছি। সুতরাং সে এই যুদ্ধে শোধ নেওয়ার জন্য তীব্র আক্রমণ করবে। আমিও শত সহস্র তীক্ষ্ণবাণ। সেও গুণবাণ ব্রাহ্মণের মতো আমাকে গ্রহণ করবে। অর্জুন পৃথিবীতে মহাধনুর্ধর বলে পরিচিত, আমিও তার অপেক্ষা নিকৃষ্ট নই। সুতরাং নক্ষত্রখচিত আকাশের মতো আপনারা বাণদ্বারা আবৃত আকাশ দেখবেন। পূর্বে আমি মহারাজ দুর্যোধনের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আজ যুদ্ধে অর্জুনকে নিহত করে সেই প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করব। মানুষ যেমন উল্কা দ্বারা হস্তীকে পীড়ন করে, আমিও সেইরূপ ইন্দ্রের বজ্রের মতো তীক্ষ্ণবাণে ইন্দ্রের তুল্য তেজস্বী অর্জুনকে পীড়ন করব।
“সাক্ষাৎ অগ্নির তুল্য তেজস্বী, দুর্ধর্ষ, বহু ক্লেশে পাণ্ডুতাপ্রাপ্ত সেই অর্জুন অসি, শক্তি ও বাণরূপ কাঠ পেয়ে জ্বলতে থাকবে, শত্রুদের দগ্ধ করতে শুরু করবে, আমি মহামেঘরূপে তাকে নির্বাপিত করব। সেই সময় অশ্বের বেগই আমার সম্মুখগামী বাতাস হবে, রথধ্বনিই মেঘগর্জন হবে এবং বাণগুলি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়বে। তীক্ষ্ণ বিষ সাপেরা যেমন উইমাটির মধ্যে প্রবেশ করে, সেইরকম আমার ধনু নিক্ষিপ্ত বাণগুলি অর্জুনের দেহের মধ্যে প্রবেশ করবে। কর্ণিকা ফুল যেমন পর্বতকে ব্যাপ্ত করে, সেই রকম আমার তীক্ষ্ণ, স্বর্ণপুঙ্খ, হলুদবর্ণের ভয়ংকর বাণগুলি অর্জুনকে ব্যাপ্ত করবে। ঋষিশ্রেষ্ঠ পরশুরামের কাছে প্রাপ্ত অস্ত্রসমূহ এবং নিজের বল অবলম্বন করে আমি ইন্দ্রের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে পারি। অর্জুনের ধ্বজাগ্রেস্থিত বানর আমার ভল্লদ্বারা নিহত হয়ে ভয়ংকর চিৎকার করতে করতে ভূতলে পতিত হবে। অর্জুনের ধ্বজাবাহী ভূতেরা আমার অস্ত্রে আহত হয়ে সকল দিকে পালাবে। আজ আমি দুর্যোধনের হৃদয়ে চিরস্থিত উদ্বেগশল্য সমূলে উৎপাটিত করব। অর্জুন পুরুষকার প্রকাশ করবে বটে, কিন্তু আমি তার অশ্বগুলি নিহত করব, রথ বিনষ্ট করব, সে সর্পের মতো নিশ্বাস ত্যাগ করতে থাকবে। কৌরবেরা ইচ্ছানুযায়ী ধন নিয়ে গমন করুন, অথবা রথে থেকে আমার যুদ্ধ দেখুন।”
কৃপাচার্য বললেন, “কর্ণ! তোমার বুদ্ধি নিষ্ঠুর, তাই সর্বদাই যুদ্ধ চাও। তুমি যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারের কারণও জানো না, ফলের অপেক্ষাও কর না। পণ্ডিতেরা চিরকালই যুদ্ধকে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট নীতি বলে ঘোষণা করেন। তা ছাড়া, অনুকূল দেশে ও কালে যুদ্ধ করলে, জয়লাভ হয়। অস্থানে অসময়ে যুদ্ধ করলে, ফল বিপরীত হয়। এই সমস্ত চিন্তা করেই এই স্থানে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করা আমাদের উচিত নয়। একা অর্জুন উত্তর কুরুদেশ জয় করতে গিয়েছিল, একা অর্জুন খাণ্ডববনে দেবগণকে পরাজিত করে অগ্নিদেবকে সন্তুষ্ট করেছিল, একা অর্জুন স্বর্গে পাঁচ বৎসর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য রক্ষা করেছিল। একা অর্জুন সুভদ্রাকে রথে তুলে নিয়ে বলরাম প্রভৃতিকে যুদ্ধে আহ্বান করেছিল। একা অর্জুন সসৈন্যে কিরাতরূপী মহাদেবের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। অর্জুন একাকী স্বর্গে থেকে পাঁচ বৎসর যাবৎ ইন্দ্রের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেছিল। সেই অর্জুন একাই রাজসূয়যজ্ঞের পূর্বে দিগ্বিজয়কালে শত্রুগণকে জয় করে কুরুবংশের যশবৃদ্ধি করেছিল এবং একা অর্জুন যুদ্ধে দেবগণেরও অবধ্য সেই নিবাতকবচ ও কালখঞ্জ নামক দানবগণকে সংহার করেছিল। কর্ণ, অর্জুন যেমন একা রাজগণকে বশীভূত করেছিল, তুমি একাকী পূর্বে সেরূপ কোনও কার্য কি করেছ? স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রও অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারেন না; অতএব যে লোক সেই অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধের ইচ্ছা প্রকাশ করে, তার মস্তিষ্করোগের চিকিৎসার জন্য ঔষধের প্রয়োজন। কর্ণ তুমি না বুঝে ডান হাত তুলে তর্জনী দ্বারা ক্রুদ্ধ তীক্ষ্ণবিষ সাপের দাঁতে হাত দিয়ে বিষ তোলার চেষ্টা করছ। তুমি অঙ্কুশ না নিয়ে বনের মধ্যে মত্তহস্তীর উপর উঠে নগরে যেতে চাইছ। অথবা কর্ণ তুমি কুশের কৌপীন পরে ঘৃতাক্ত দেহে— ঘৃত, মেদ ও বসা নিক্ষেপ করে প্রজ্বলিত অগ্নিকে তারই মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে চাইছ। কোন লোক আপনাকে বেঁধে, গলায় বড় পাথর বেঁধে কেবল দুই হাত সম্বল করে সমুদ্র পার হতে ইচ্ছা করে। অস্ত্রে অশিক্ষিত, অতিদুর্বল যে লোক সর্বাস্ত্রশিক্ষিত বলবান অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধের ইচ্ছা করে, সে মরে। আমরা শঠতা করে অর্জুনকে তেরো বৎসরকাল নির্বাসিত রেখেছি, এখন সিংহ পাশমুক্ত হয়েছে; সুতরাং সে আমাদের শেষ না করে ছাড়বে? শুষ্ক তৃণ আবৃত অর্জুন একপ্রান্তে অবস্থান করছিলেন, আমরা না জেনে আক্রমণ করে গুরুতর ভয় পেয়ে গিয়েছি।
“সে যাই হোক, ভীষ্ম, দ্রোণ, দুর্যোধন, তুমি, অশ্বত্থামা এবং আমি সম্মিলিতভাবেই অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব; একাকী তুমি এ সাহস কোরো না। যদি আমরা সম্মিলিত থাকতে পারি, তা হলে আমরা ছ’জনে মিলে যুদ্ধে আগ্রহী ইন্দ্রের মতন অর্জুনের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে পারি। ব্যূহ সাজিয়ে সৈন্যদের একত্রে সাজিয়ে আমরা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব।”
অশ্বত্থামা বললেন, “কর্ণ! এখনও আমরা গোরুগুলি জয় করিনি। অন্য সীমায় কিংবা হস্তিনাপুরেও পৌঁছতে পারিনি। তুমি এরই মধ্যে গর্ব প্রকাশ করতে আরম্ভ করেছ? অনেক যুদ্ধ জয় করেও, প্রচুর পরকীয় জমি ও ধন পেয়েও সৎপুরুষেরা নিজের প্রশংসা করেন না। দেখো, অগ্নি নীরবেই দাহ করেন, সূর্য নিঃশব্দে আলো দেন, পৃথিবীও নীরবেই চরাচর সকল প্রাণী ধারণ করেন। বর্ণানুযায়ী মানুষের কর্ম, কোনও কর্মে কোনও বর্ণ দোষী হয় না, তা স্বয়ং ব্ৰহ্মাই বিধান দিয়েছেন। ব্রাহ্মণ বেদ অধ্যয়ন করে যাজন ও যজন করবেন এবং ক্ষত্রিয় অস্ত্র অবলম্বন করে যজন করবেন কিন্তু যাজন করবেন না। বৈশ্য ধন লাভ করে বেদোক্ত কাজ করবেন; আর শূদ্র বেতসলতার মতো বৃত্তি অবলম্বন করে অবনত ও অনুগত থেকে সর্বদাই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের সেবা করবে। তা ছাড়াও, মহাত্মা ব্যক্তিরা শাস্ত্র অনুসারে পৃথিবী লাভ করেও বিপক্ষীয় গুরুজনদের সম্মান করেই থাকুন। নিকৃষ্ট লোকের মতো নিষ্ঠুরভাবে কপটদ্যূতদ্বারা রাজ্যলাভ করে অন্য কোন ক্ষত্রিয় সন্তুষ্ট হতে পারেন? বনচারী ব্যাধ যেমন জাল পেতে পশু পাখি ধরে, সেই রকম প্রতারণা করে ধনলাভ করে কোন ব্যক্তি আত্মশ্লাঘা করেন? কর্ণ তোমার প্ররোচনায় দুর্যোধন যাদের ধন হরণ করেছেন, সেই অর্জুন, নকুল ও সহদেবকে কোন দ্বৈরথ যুদ্ধে তুমি জয় করেছ? কর্ণ তুমি কোন যুদ্ধে যুধিষ্ঠির বা ভীমকে জয় করেছ? কোন যুদ্ধে তুমি ইন্দ্রপ্রস্থ জয় করেছিলে? কোন যুদ্ধে তুমি দ্রৌপদীকে জয় করেছিলে? তবে দুষ্কর্মকারী কর্ণ, তোমার প্ররোচনাতেই দুঃশাসন একবস্ত্রা ও রজস্বলা অবস্থায় দ্রৌপদীকে সভায় নিয়ে গিয়েছিল। ধনার্থী লোক চন্দনবৃক্ষের মূল ছেদ করে, তোমরাও তেমনই দ্রৌপদীকে সভায় নিয়ে গিয়ে পাণ্ডবদের সৌহার্দ্যর মূল ছেদন করেছ। মহামতি বিদুর সৎ ব্যবহারের জন্য তোমাদের যা বলেছিলেন স্মরণ করো। মানুষ, অন্য প্রাণী, এমনকী কীট পিপীলিকার পর্যন্ত ক্ষমা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু পাণ্ডবেরা দ্রৌপদীর সেই লাঞ্ছনার কখনও ক্ষমা করবেন না। সুতরাং অর্জুন আজ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের ধ্বংসের জন্যই আবির্ভূত হয়েছেন। তুমি পণ্ডিত সেজে পণ্ডিতের মতো কথা বলতে চাইছ। শত্রুতার শেষকারী অর্জুন আমাদের শেষ করবেন। অর্জুন নির্ভয়ে দেব, গন্ধর্ব, অসুর ও রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারেন। অর্জুন ক্রুদ্ধ হয়ে যাঁর দিকে যাবেন, গরুড় যেমন বেগে বৃক্ষকে ফেলে দেন, অর্জুনও তেমনই তাকে নিপাতিত করে ফিরে যাবেন! অৰ্জুন বলে তোমার থেকে প্রধান, ধনুতে ইন্দ্রের তুল্য, যুদ্ধে কৃষ্ণের সমান, সেই অর্জুনকে কোন ব্যক্তি প্রশংসা না করে? অর্জুন দিব্যাস্ত্র দ্বারা দেবতার এবং মনুষ্যাস্ত্র দ্বারা মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করে থাকেন। নিজের অস্ত্রের দ্বারা বিপক্ষের অস্ত্র নিবারণ করেন। অতএব অন্য কোন পুরুষ অর্জুনের তুল্য? ধর্মজ্ঞেরা বলে থাকেন যে, শিষ্য পুত্র অপেক্ষা ন্যূন নহে। এই কারণে অর্জুন পিতৃদেব দ্রোণাচার্যের প্রিয়। সে যাই হোক, রাজা দুর্যোধন আপনি যেমন দ্যূতক্রীড়া করেছিলেন, যেমন ভাবে ইন্দ্রপ্রস্থ জিতেছিলেন, যেমন ভাবে দ্রৌপদীকে সভায় নিয়েছিলেন, তেমন আজ আপনিই অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করুন। বুদ্ধিমান, ক্ষত্রিয়ধর্ম অভিজ্ঞ, দুষ্টদ্যূতক্রীড়ায় নিপুণ ও গান্ধারদেশের রাজা আপনার মাতুল শকুনি আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করুন। মনে রাখবেন, অর্জুনের গাণ্ডিবধনু পাশার গুটি নিক্ষেপ করে না, গাণ্ডিবধনু তীক্ষ্ণতম ও জাজ্বল্যমান বাণ সকলই নিক্ষেপ করে। যম, বায়ু, বাড়বানল প্রাণীদের মৃত্যুর কারণ হলেও কখনও কখনও কাউকে ছেড়ে দেন, কিন্তু ক্রুদ্ধ অর্জুন কাউকেই অবশিষ্ট রাখবেন না। যদি ইচ্ছা হয়, আচার্য দ্রোণ যুদ্ধ করুন; কিন্তু আমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব না। তবে বিরাটরাজা যুদ্ধ করতে এলে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতাম।”
ভীষ্ম বললেন, “দ্রোণ উচিত কথাই বলেছেন। কৃপের বক্তব্যও যুদ্ধ-শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ও যুক্তিসঙ্গত। কারণ, জ্বলন্ত সূর্যের ন্যায় শক্তিমান পাঁচজন যোদ্ধা যাঁর শত্রু হন, তাঁদের কেউ এলে পণ্ডিতেরাও মুগ্ধ হয়ে পড়েন। কারণ ধর্মজ্ঞ ব্যক্তিও আপন স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না। রাজা যদি আমার বাক্যে তোমার অভিরুচি হয়, তবে আমার কথা শোনো। আচার্যপুত্র, কর্ণ যা বলেছেন, তা আপনার তেজ বাড়াবার জন্য। কাজেই আপনি ক্ষমা করুন। অর্জুন উপস্থিত হয়েছে। সুতরাং এখন বিরোধের সময় নয়। অতএব আপনি, আচার্য দ্রোণ এবং কৃপ সমস্ত ক্ষমা করুন। সূর্যের আলো এবং চন্দ্রের সৌন্দর্য কখনও ক্ষীণ হয় না, তেমন আপনাদের অস্ত্রনৈপুণ্যও কোনও কালে ক্ষীণ হয় না। আপনাদের তিনজনের উপরেই ব্রাহ্মণ্য ও ব্রহ্মাস্ত্র প্রতিষ্ঠিত আছে এবং চারবেদ ও ক্ষাত্ৰতেজও আপনাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। পুত্রের সঙ্গে দ্রোণাচার্যের মধ্যে এই অভূতপূর্ব ক্ষমতা আছে। অতএব আচার্যপুত্র! আপনি ক্ষমা করুন। এই ঘটনা আপনাদের মধ্যে ভেদ জন্মানোর কাল নয়। অর্জুনের সঙ্গে মিলিতভাবেই আমাদের যুদ্ধ করতে হবে। পণ্ডিতেরা বলেন, সৈন্যগণের পক্ষে ভেদই সর্বাপেক্ষা ক্ষতির কারণ এবং পাপসূচক।”
অশ্বত্থামা বললেন, “ভরতশ্রেষ্ঠ, গুরুদেব কারও উপর ক্রুদ্ধ হয়ে অর্জুনের গুণকীর্তন করেছেন, একথা কারও বলা উচিত নয়। কারণ শত্রুরও গুণ বলা উচিত, গুরুরও দোষ বলা সঙ্গত এবং সর্বপ্রকারে ও সর্বপ্রযত্নে পুত্র ও শিষ্যের হিত বলবে।”
দুর্যোধন বললেন, “আচার্য নিজেই ক্ষমা করুন। আমি অসহিষ্ণুতা ও ক্রোধবশত গুরুদেবের প্রতি যে ব্যবহার করে ফেলেছি, আপনারা এ-বিষয়ে শান্তিবিধান করুন।” তখন দুর্যোধন, ভীষ্ম, কর্ণ ও কৃপ মিলিত হয়ে দ্রোণের কাছে ক্ষমা চাইলেন। দ্রোণ বললেন, “শান্তনুনন্দন ভীষ্ম প্রথমেই যা বলেছেন, তাতেই আমি প্রসন্ন হয়েছি। এখন যা কর্তব্য সকলে মিলে তাই করুন। আপনারা দেখুন, যাতে সাহসে বা মোহবশত দুর্যোধন অর্জুনের মুখোমুখি না হন। বনবাস এবং অজ্ঞাতবাস শেষ না হলে অর্জুন আত্মপ্রকাশ করতেন না এবং গোধন না পেয়ে আমাদের ক্ষমা করে চলে যাবেন না। সুতরাং দুর্যোধন যাতে নিন্দার ভাগীও না-হন, পরাজিত না-হন, তা দেখাই কর্তব্য। গঙ্গানন্দন! আপনি সর্বপ্রথমে বলুন, অজ্ঞাতবাস কাল শেষ হয়েছে কি না।”
ভীষ্ম বললেন, “বৎস দুর্যোধন, আচার্য দ্রোণ, কলা, কাষ্ঠা, মুহূর্ত, দিন, অর্ধ-মাস, মাস, নক্ষত্র ও গ্রহ— এই সকল শাস্ত্রীয় ব্যবহার ও লৌকিক ব্যবহারে প্রযুক্ত হয়ে আসছে। আর ঋতু এবং সংবৎসরও শাস্ত্রীয় ব্যবহারে ও লৌকিক ব্যবহারে প্রযুক্ত হয়ে আসছে এবং স্থূল ও সূক্ষ্মকাল বিভাগযুক্ত। বিশেষত চক্রের ন্যায় সর্বদা পরিবর্তনশীল সংবৎসর প্রভৃতি কাল উক্ত দ্বিবিধ ব্যবহারেই প্রচলিত। চন্দ্র ও সূর্যের গতির ব্যতিক্রম তিথি ও চন্দ্রমাসের পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রত্যেক সৌর বা সাধন পঞ্চম বৎসরে দুটি করে চন্দ্রমাস বৃদ্ধি পায়। সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে পাণ্ডবদের বনবাস যাত্রার দিন থেকে বারো বছর, ছয় মাস ও আঠারো দিন গিয়েছে, কিন্তু উক্তক্রমে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত পাঁচ মাস এবং রবিভুক্তির কারণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বারো তিথি তার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় সর্বপ্রকার তেরো বৎসর পূর্ণ হয়ে গেছে। সুতরাং পাণ্ডবেরা যা প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে সমস্তই যথানিয়মে পালন করেছে এবং ত্রয়োদশ বৎসর পূর্ণ হয়ে গেছে, নিশ্চিতভাবে জেনেই অর্জুন এসেছেন। পাণ্ডবেরা যথার্থই ধর্মপরায়ণ ও উদারচেতা। বিশেষত যুধিষ্ঠির যাঁদের রাজা, তাঁরা কখনও ধর্ম লঙ্ঘন করবে না। পাণ্ডবেরা লোভী নয়, তারা দুষ্কর কাজ করেছে। তারা নিকৃষ্ট উপায়ে রাজ্য লাভ করার চেষ্টা করবে না। তারা দ্যূতসভায়ই বিক্রম প্রকাশ করতে চেয়েছিল, কিন্তু ধর্মপাশে আবদ্ধ ছিল বলে, ক্ষত্রিয়ধর্মচ্যুত হয়নি। সুতরাং তাদের আচরণ মিথ্যা যারা ভাববে, তারাই পরাভূত হবে। পাণ্ডবেরা বরং মৃত্যুবরণ করবে কিন্তু কখনই মিথ্যার আশ্রয় নেবে না। আর সময় উপস্থিত হলে, তাদের ন্যায্য ধন স্বয়ং ইন্দ্র কর্তৃক রক্ষিত হলেও তারা পরিত্যাগ করবে না। তারা এতটাই বলবান। অতএব, সাধুলোক বিহিত কর্তব্য করাই উচিত। সময় চলে গেলে আমাদের কর্তব্যও অতীত হয়ে যাবে। আমি যুদ্ধে সাফল্য দেখতে পাচ্ছি না, আর অর্জুন উপস্থিত হল বলে। যুদ্ধ আরম্ভ হলে জীবন ও মরণ, জয় ও পরাজয় যে-কোনও একটি পক্ষকে অবলম্বন করবেই। অতএব, হয় ক্ষত্রিয়োচিত কার্য কিংবা ধর্মসঙ্গত কার্য— এর একটা পালন করা। আর অর্জুন উপস্থিত হল প্রায়।”
দুর্যোধন বললেন, “পিতামহ আমি পাণ্ডবদের রাজ্য দেব না। অতএব যুদ্ধ বিষয়ে যা করণীয়, আপনারা দ্রুত তাই করুন।” ভীষ্ম বললেন, “কুরুনন্দন, যুদ্ধ বিষয়ে আমার মত বলছি, যদি তোমাদের মতের সঙ্গে মেলে, তা হলে সেই কাৰ্যই করো। আমি তোমাদের মঙ্গলের কথাই বলব। তুমি এক চতুর্থাংশ সৈন্য নিয়ে দ্রুত হস্তিনার দিকে যাত্রা করো। অপর এক-চতুর্থাংশ সৈন্য গোরুগুলি নিয়ে দুর্যোধনের পিছনে পিছনে যাত্রা করুক। আমি, দ্রোণ, কর্ণ, অশ্বত্থামা ও কৃপ— অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব। যুদ্ধের জন্য অর্জুনই আসুক, কিংবা মৎস্যরাজ বিরাট অথবা স্বয়ং ইন্দ্রই আসুন তখন আমরাই যুদ্ধ করব।” ভীষ্মের সেই কথা সকলেই অনুমোদন করলেন। দুর্যোধনও তদনুযায়ী কার্য করলেন। ভীষ্ম বললেন, “দ্রোণাচার্য সৈন্যের মধ্যস্থানে, অশ্বত্থামা বামপার্শ্বে, কৃপাচার্য দক্ষিণ পার্শ্ব রক্ষা করুন। যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত সূতপুত্র কর্ণ সৈন্যের সম্মুখভাগে থাকুন; আর আমি সকলকে রক্ষা করার জন্য সকল সৈন্যের পিছনে থাকব।”
এইভাবে সৈন্য সন্নিবিষ্ট করে, কৌরবেরা যখন অপেক্ষারত, তখনই সকল দিক নিনাদিত করে অর্জুনের রথ উপস্থিত হল। কৌরবসৈন্যরা মুগ্ধ হয়ে অর্জুনের রথের ধ্বজাগ্র দেখতে লাগল। গাণ্ডিবের টংকারে তাদের কর্ণ বধির হবার উপক্রম হল। দ্রোণ সেই সমস্ত দেখে অর্জুনকে নিরীক্ষণ করে বলতে লাগলেন, “ওই অর্জুনের ধ্বজাগ্র দূর থেকে দেখা যাচ্ছে এবং এই শঙ্খের সঙ্গে ভয়ংকর বানর বার বার রব করছে। এই দুটি বাণ একসঙ্গে এসে আমার দুই পায়ের সামনে পড়ল, এই দুটি বাণ আমার কানের পাশ দিয়ে চলে গেল। অর্জুন বনবাস সমাপ্ত করে মানুষের অসাধ্য কাজ করে প্রথমে দুই বাণে আমাকে প্রণাম করল, দুই বাণে আমার কর্ণে মঙ্গল প্রশ্ন করল।”
অর্জুন উত্তরকে বললেন, “সারথি বিপক্ষ সৈন্যদের উপর বাণনিক্ষেপ করা যায়, এমন জায়গায় রথ রাখো। আগে আমি দেখি সেই কুরুকুলাধম দুর্যোধন কোথায় আছে। অন্য সকলকে অগ্রাহ্য করে, আমি তার মাথাটাই আগে ধরব, তাতেই সকলে পরাজিত হবেন। দ্রোণ আছেন, অশ্বত্থামা, ভীষ্ম, কৃপ, কর্ণও আছেন। ও! মহাধনুর্ধরেরা সকলেই এসেছেন। কিন্তু দুর্যোধন কোথায়? নিশ্চয় জীবনরক্ষার জন্য গোরুগুলি নিয়ে দক্ষিণের পথ ধরে যাচ্ছেন। উত্তর, এই রথিসৈন্য পরিত্যাগ করে আগে দুর্যোধনের দিকে যাব। লভ্যবস্তুবিহীন যুদ্ধ হতে পারে না। দুর্যোধনকে জয় করে গোরুগুলি নিয়ে আবার এখানে ফিরব।”
অর্জুন এই কথা বললে, উত্তর যত্নপূর্বক রশ্মি সংযত করে ভীষ্ম প্রভৃতির দিক থেকে সরিয়ে দুর্যোধন যেদিকে গিয়েছিলেন, সেইদিকে রথ ছুটিয়ে দিলেন। অর্জুন শত্রুভয়কারী শঙ্খধ্বনি করলেন, ধ্বজস্থিত প্রাণীগণকে গর্জন করতে আদেশ দিয়ে, গাণ্ডিবে ভয়ংকর টংকার ধ্বনি করলেন। শঙ্খের শব্দে, রথচক্রের শব্দে, ধ্বজবাসী অলৌকিক ভূতগণের গর্জনে ও গাণ্ডিবের টংকারে পৃথিবী কেঁপে উঠল। তখন গোরুগুলি উপরের দিকে লেজ তুলে, হাম্বারব করতে করতে দক্ষিণ দিক ধরে সকল দিকে ফিরতে লাগল। গোরুগুলি উদ্ধার করে অর্জুন বিরাটরাজার প্রিয় কাজ করবার জন্য দুর্যোধনের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেই দেখে কৌরবপক্ষীয় মহাবীরেরা তৎক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত হলেন। অর্জুন উত্তরকে বললেন, “কুরুপক্ষীয় যোদ্ধারা ছুটে আসছেন। দুরাত্মা কর্ণ সর্বদাই আমার সঙ্গে যুদ্ধ করার ইচ্ছা করে। দুর্যোধনকে আশ্রয় করেই কর্ণের দর্প। তুমি আমাকে প্রথমে সেই কর্ণের কাছেই নিয়ে চলো।”
উত্তর, বায়ুর ন্যায় বেগবান অশ্বগণ দ্বারা কৌরব রথিসৈন্য বিধ্বস্ত করে অর্জুনকে যুদ্ধ মধ্যে নিয়ে গেলেন। চিত্রসেন, সংগ্রামজিৎ, শত্রুসহ ও জয়— এই চারজন মহারথ কর্ণকে রক্ষা করবার জন্য অর্জুনের সম্মুখীন হলেন। তখন অগ্নি যেমন বন দগ্ধ করে, অর্জুন সেই কুরুশ্রেষ্ঠগণের বস্তুসমূহকে দগ্ধ করতে লাগলেন। যুদ্ধ ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে দেখে, দুর্যোধনের ভ্রাতা বিকর্ণ রথে করে এসে অর্জুনের মুখোমুখি হলেন। অর্জুন বিকর্ণের ধনু ছেদন করলেন, তার ধ্বজটাকেও ছেদন করলেন। বিকর্ণ ছিন্নধ্বজ হয়ে দ্রুত পলায়ন করলেন। তখন অতিরথ শত্রুন্তপ রাজা ‘কূর্মনা’ নামে ভয়ংকর বাণদ্বারা অর্জুনকে আঘাত করলেন। অর্জুন তৎক্ষণাৎ পাঁচটি বাণদ্বারা শত্রুন্তপকে বিদ্ধ করে, দশটি বাণে তার সারথিকে বধ করলেন। অর্জুনের বর্মভেদকারী তীক্ষ্ণ বাণে শত্রুন্তপ রথ থেকে মাটিতে নিপাতিত হলেন।
তখন স্বর্ণময় ও কৃষ্ণলৌহময়-বর্মধারী সুন্দর বেশযুক্ত, ধনদাতা ও ইন্দ্রের তুল্য বলবান যুবক বীরগণ ইন্দ্রপুত্র অর্জুন কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হয়ে বিশালদেহ হস্তীর মতো ভূতলে শয়ন করতে লাগলেন। বাতাস যেমন শুষ্কপত্রকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, অর্জুনও তেমনই শত্রুগণকে তাঁর পথের সামনে থেকে উড়িয়ে দিতে লাগলেন। অর্জুন কর্ণের ভ্রাতা সংগ্রামজিতের শিরশ্ছেদ করলেন। ভ্রাতাকে নিহত দেখে মহাহস্তীর মতো কর্ণ সিংহরূপী অর্জুনের দিকে ছুটে এলেন। তারপর কর্ণ বারোটি বাণদ্বারা অর্জুনকে আঘাত করলেন, অর্জুনের রথের সকল অশ্বকে বিদ্ধ করলেন এবং সারথি উত্তরের হাতেও আঘাত করলেন। কর্ণ কর্তৃক আহত হয়ে অর্জুন ভল্লবাণ দ্বারা কর্ণকে বিদ্ধ করলেন। তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা কর্ণের বাহু, ঊরু, মস্তক, ললাট, গ্রীবা ও অন্যান্য প্রধান অঙ্গ বিদীর্ণ করলেন। বলবান কর্ণ অর্জুন নিক্ষিপ্ত বাণদ্বারা তাড়িত ও তাঁর বাণে পীড়িত হয়ে, হস্তীকর্তৃক বিজিত অপর হস্তীর মতো যুদ্ধের সম্মুখভাগ পরিত্যাগ করে চলে গেলেন। কর্ণ পালিয়ে গেলে দুর্যোধন প্রভৃতি বীরগণ প্রচুর সৈন্য নিয়ে অর্জুনকে আবৃত করে ফেললেন। তারপর অর্জুন হাসতে হাসতে অলৌকিক অস্ত্র নিয়ে সেই শত্রুদের দিকে ধাবিত হলেন ও বাণে দশদিকই আবৃত করে ফেললেন। অর্জুনের বাণে বিপক্ষের রথ, অশ্ব, হস্তী ও বর্মের অঙ্গুলিদ্বয় পরিমিত স্থানও আবদ্ধ ছিল না। তখন উত্তর অর্জুনকে প্রশ্ন করলেন, রথ এবার কার দিকে নিয়ে যাবেন? অর্জুন উত্তর দিলেন, “নীলপতাকাযুক্ত ব্যাঘ্রচর্মাবৃত রথে রক্তনয়ন তাঁর প্রথম গুরু কৃপাচার্য আছেন। সকল যোদ্ধার মাননীয় সেই কৃপাচার্যকে প্রদক্ষিণ করে তাঁর সম্মুখে দাঁড়াও। যাঁর রথে স্বর্ণময় সুন্দর কমণ্ডলু আছে, যিনি সকল অস্ত্রধারীর শ্রেষ্ঠ তিনি আমার গুরুদেব দ্রোণাচার্য। তিনি যদি আমাকে প্রথম প্রহার করেন, তবেই আমি আঘাত করব। তা হলে ইনি ক্রুদ্ধ হবেন না। দ্রোণাচার্যের অনধিক দূরে যার ধ্বজাগ্রে ধনু আছে, তিনি দ্রোণাচার্যের পুত্র, তিনি আমার সখা ও মাননীয়। তুমি তাঁর রথের কাছে বারবার গিয়ে ফিরে আসবে। তৃতীয় শ্রেণির সৈন্যের সম্মুখে ধ্বজাগ্রে স্বর্ণখচিত পতাকায় আবৃত হস্তিমুখ রথে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র রাজা দুর্যোধন আছেন। এই শত্রুহন্তা রাজা যুদ্ধদুর্ধর্ষ ও শীঘ্রাস্ত্রক্ষেপণে পটু। আমি একে শীঘ্রাস্ত্রক্ষেপণ দেখাব। সূর্যনন্দন কর্ণের পরিচয় তুমি পূর্বেই পেয়েছ। নীলবর্ণ পতাকা, পঞ্চতারাযুক্ত ধ্বজ রথে যে বলবান পুরুষ বিশাল ধনু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, যাঁর মাথায় শ্বেত ছত্র— বিশাল রথিসৈন্যের সম্মুখে— মেঘের সম্মুখে সূর্যের মতো দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি আমাদের সকলের পিতামহ, রাজলক্ষ্মীবিহীন চিরকুমার শান্তনুনন্দন ভীষ্ম। যাও উত্তর, এখন কৃপাচার্যের রথের দিকে এগিয়ে চলল।”
তখন দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে তেত্রিশজন দেবতা এবং গন্ধর্বগণ, রাক্ষসগণ, নাগগণ, পিতৃগণ ও মহর্ষিগণ সেই যুদ্ধ দেখতে এলেন। বসুমনা, বলক্ষ, সুপ্রতর্দন, অষ্টক, শিবি, যযাতি, নহুষ, গয়, মনু, ক্ষুপ, রঘু, ভানু, কৃপাশ্ব, সগর ও শল— রাজারাও উপস্থিত হলেন।
তখন অশ্বতত্ত্বজ্ঞ উত্তর দক্ষিণাবর্ত ও বামাবর্তে মণ্ডল করে সৈন্যদের বিস্ময় উৎপাদন করে, কৃপাচার্যকে প্রদক্ষিণ করে, রথ তাঁর সম্মুখে এনে স্থাপিত করলেন। তখন অর্জুন নিজের নাম ঘোষণা করে বলপূর্বক ‘দেবদত্ত’ নামক শঙ্খধ্বনি করলেন। সেই শঙ্খধ্বনির শব্দ আকাশ-বাতাস পরিব্যাপ্ত করে পৃথিবীতে ফিরে এল। কৃপাচার্য সেই শঙ্খধ্বনিতে ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের মহাশঙ্খ বাজালেন ও অতি বিশাল ধনু নিয়ে তখনই তাঁর জ্যা-শব্দ করলেন। তারপর কৃপাচার্য তীক্ষ্ণ, মর্মভেদী দশটি বাণ দ্বারা বিপক্ষবীরহন্তা অর্জুনকে বিদ্ধ করলেন। অর্জুনও জগদ্বিখ্যাত পরমায়ুধ গাণ্ডিবধনু আকর্ষণ করে মর্মভেদী বহুতর বাণনিক্ষেপ করলেন। কিন্তু কৃপাচার্য পথিমধ্যে সেই বাণগুলিকে খণ্ড খণ্ড করতে লাগলেন। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ অর্জুনের সত্বর অস্ত্রনৈপুণ্যে দিক ও বিদিক বাণে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। অর্জুন অসংখ্য বাণে আকাশটাকে একটিমাত্র ছায়াযুক্ত করে কৃপাচার্যকে আবৃত করে ফেললেন। তখন কৃপাচার্য অগ্নিশিখাতুল্য বহু বাণে অর্জুনকে পীড়ন করে গর্বে সিংহনাদ করে উঠলেন। অর্জুন চারটি স্বর্ণপুঙ্খ বাণে কৃপাচার্যের চারটি অশ্বকে বিদ্ধ করলেন। প্রচণ্ড আঘাত প্রাপ্ত অশ্বগুলি তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠল। তাতেই কৃপাচার্য স্থানভ্রষ্ট হলেন। কৃপাচার্যকে স্থানভ্রষ্ট দেখে অর্জুন আর অস্ত্রাঘাত করলেন না। কিন্তু কৃপাচার্য পুনরায় স্থানলাভ করে দশটি কঙ্কপক্ষযুক্ত বাণে অর্জুনকে বিদ্ধ করলেন। অর্জুন একটি ভল্লদ্বারা কৃপাচার্যের ধনুক ছেদন করলেন। আর একটি ভল্লদ্বারা কৃপের অঙ্গুলিতে ছেদন করলেন। মর্মভেদী কতকগুলি তীক্ষ্ণ বাণে অর্জুন কৃপের দেহের কবচ কেটে ফেললেন; কিন্তু দেহে আঘাত করলেন না। কৃপাচার্যের দেহ খোলস ছাড়া সাপের মতো শোভা পেতে লাগল। অর্জুন ধনু ছেদন করলে কৃপাচার্য অন্য ধনু গ্রহণ করলেন। কিন্তু অর্জুন সেই ধনুটিকেও ছেদন করলেন। এইভাবে অর্জুন কৃপের অনেকগুলি ধনুক ছেদন করলেন। তখন কৃপাচার্য ভয়ংকর এক শক্তি নিয়ে অর্জুনের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। অর্জুন আকাশ পথেই সেটিকে দশখণ্ডে ছিন্ন করলেন। কৃপাচার্য অন্য ধনুগ্রহণ করলেন। কিন্তু অর্জুন একটি বাণে কৃপের রথের যুগকাষ্ঠ, চারটি বাণে চারটি অশ্বদেহ বিদ্ধ করলেন এবং ষষ্ঠ বাণে কৃপাচার্যের সারথির মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। আরও তিন বাণে অর্জুন কৃপাচার্যের রথের ত্রিবেণু, দুই বাণে দুই চক্র ও দ্বাদশ বাণে রথের ধ্বজ কেটে ফেললেন। এরপর অর্জুন হাসতে হাসতে বজ্রতুল্য ত্রয়োদশ বাণে কৃপাচার্যের বক্ষ বিদ্ধ করলেন। তখন ছিন্নকার্মুক, রথবিহীন, হতাশ্ব, হতসারথি কৃপাচার্য অর্জুনকে লক্ষ্য করে একটি ভয়ংকর গদা ছুড়ে মারলেন। কিন্তু অর্জুনের বাণে সেই গদা বিপরীতমুখে অর্থাৎ কৃপাচার্যের দিকেই ছুটে গেল। কৃপপক্ষীয় সৈন্যরা কৃপকে রক্ষা করার জন্য সকলে একসঙ্গে অর্জুনের প্রতি বাণক্ষেপ করলেন। অন্য যোদ্ধারা বর্মবিহীন রথবিহীন কৃপাচার্যকে অন্য রথে তুলে মহাবেগে অর্জুনের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন।
গুরুদেব দ্রোণাচার্যকে স্বর্ণরথে তাঁর দিকে আসতে দেখে অর্জুন উত্তরকে বললেন, “সারথি দীর্ঘবাহু, মহাতেজা, শক্তি ও সৌন্দর্যযুক্ত দ্রোণাচার্যের দিকে আমাকে নিয়ে চলো। বুদ্ধিতে শুক্রাচার্যের তুল্য, নীতিতে দ্রোণাচার্য বৃহস্পতির সমান। সমস্ত ধনুর্বেদ তাঁর আয়ত্ত, চারটি বেদ, ব্রহ্মচর্য, উপসংহারের সঙ্গে সকল দিব্য অস্ত্র ও সমগ্র ধনুর্বেদ সর্বদাই প্রতিষ্ঠিত আছে। তার পরে ক্ষমা, ইন্দ্রিয়দমন, সত্য, দয়া ও সরলতা—এই সকল গুণ এই ব্রাহ্মণে সর্বদাই প্রতিষ্ঠিত আছে। আমি সেই মহাত্মার সঙ্গে যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করি।”
উত্তর অর্জুনের কথা অনুসারে রথ দ্রোণাচার্যের রথের দিকে চালিয়ে দিলেন। মত্তহস্তী যেমন অন্য মত্তহস্তীর দিকে ছুটে চলে, দ্রোণও অর্জুনের দিকে তেমনই এগিয়ে আসতে লাগলেন। অর্জুন শতভেরির নিনাদকারী শঙ্খ বাজালেন, দ্রোণের রক্তবর্ণ অশ্বগুলি ও অর্জুনের শ্বেতবর্ণ অশ্বগুলি পরস্পরের মুখোমুখি হল। অর্জুন ও দ্রোণকে পরস্পর সম্মিলিত দেখে সৈন্যরা কাঁপতে লাগল। আপন রথ দ্রোণের রথের কাছে নিয়ে গিয়ে অর্জুন নমস্কার করে বললেন, “আমরা বনবাস সমাপ্ত করেছি; এখন প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছায় এসেছি; অতএব আপনি আমার উপর ক্রোধ করতে পারেন না। গুরুদেব আমার ইচ্ছা, আপনি আমাকে আগে প্রহার করুন, পরে আমি আপনাকে প্রহার করব।”
তখন দ্রোণাচার্য অর্জুনের প্রতি কুড়িটির অধিক বাণ নিক্ষেপ করলেন। অর্জুনও মুহূর্তমধ্যে অত্যন্ত লঘুহস্তের পরিচয় দিয়ে বাণগুলি মধ্যপথেই ছেদন করলেন। তখন দ্রোণাচার্য অস্ত্রক্ষেপশক্তি দেখিয়ে বহুসংখ্যক বাণ দিয়ে অর্জুনের রথ আবৃত করে ফেললেন। দ্রোণ অর্জুনকে ক্রুদ্ধ করবার জন্যই যেন তীক্ষ্ণবাণে অর্জুনের শুভ্র অশ্বগুলিকেও আবৃত করলেন। অর্জুনও সেই বাণগুলিকে প্রতিহত করলেন। দুজনেরই বিক্রম প্রসিদ্ধ ছিল। দুজনেই বায়ুবেগ সম্পন্ন ছিলেন, দুজনেই দিব্য অস্ত্র জানতেন, দুজনেই তেজস্বী ছিলেন— উপস্থিত যোদ্ধৃগণ দ্রোণ-অর্জুনের যুদ্ধকে “সাধু সাধু” বলে প্রশংসা করতে লাগল। “অর্জুন ভিন্ন অন্য কোনও লোক দ্রোণাচার্যকে প্রহার করতে পারে? ক্ষত্রিয় ধর্ম কী ভয়ংকর! গুরু-শিষ্যের যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে?”
লোকেরা এই কথা বলতে লাগল। তারপর অতিক্রুদ্ধ দ্রোণ স্বর্ণখচিত, দুর্ধর্ষ ও অতিবিশাল ধনু বিস্তৃত করে অর্জুনকে বিদ্ধ করলেন। মেঘ যেমন বৃষ্টিদ্বারা পর্বতকে বিদ্ধ করে, তেমনই দ্রোণ তীক্ষ্ণ শরে অর্জুনকে বিদ্ধ করলেন। তখন অর্জুন গাণ্ডিব ধনু নিয়ে দ্রোণের শরবৃষ্টি বন্ধ করার জন্য স্বর্ণখচিত ও বহুতর বাণ একসঙ্গে নিক্ষেপ করলেন। পৃথানন্দন অর্জুন রথে থেকেই আকাশটা একটিমাত্র ছায়াযুক্ত করে ফেললেন। তখন দ্রোণ যেন তুষারে আবৃত হয়ে পড়লেন, তাঁকে আর বাইরে দেখা গেল না। আপন রথ অর্জুনের শরজালে আবৃত দেখে সেই শরজাল বিনষ্ট করতে আরম্ভ করলেন। দ্রোণ তারপর স্বর্ণখচিত বাণক্ষেপ করে আকাশ ও সূর্যালোক আবৃত করলেন। তখন দ্রোণের ধনু থেকে একটি শরের পিছনে সংলগ্ন অন্য শর যেন সমস্ত আকাশে একটি মাত্র দীর্ঘ শরের মতো মনে হতে লাগল। পূর্বকালে বৃত্রাসুর ও ইন্দ্রের যেমন যুদ্ধ হয়েছিল দ্রোণ ও অর্জুনের যুদ্ধ তেমনই ভয়ংকর হয়ে উঠতে লাগল। দ্রোণ ও অর্জুন যেন অস্ত্র বর্ষণ করে পরস্পরের সঙ্গে খেলা করতে লাগলেন। দ্রোণ ঐন্দ্র, বায়ব্য ও আগ্নেয় অস্ত্র প্রয়োগ করলেন, অর্জুনও অনুরূপ অস্ত্র দ্বারা বার বার সেগুলি বিনষ্ট করতে লাগলেন। পর্বতের উপর বজ্র পতনের শব্দের মতো অর্জুনের অস্ত্র কৌরবসেনাদের উপর পতিত হল। তখন সমস্ত রণক্ষেত্র রক্তাক্ত হস্তী, রথ, আরোহীদের পুষ্পশোভিত কিংশুক বৃক্ষের মতো দেখাতে লাগল। চারপাশে হাহাকার ধ্বনি শোনা যেতে লাগল। কেয়ূরযুক্ত ছিন্ন বাহু, চক্রবিহীন বিশাল রথ, স্বর্ণকবচ ও ধ্বজ, অর্জুনের বাণে পীড়িত ও নিহত হতে লাগল। দ্রোণও সমানভাবে অর্জুনকে ক্রমাগত আক্রমণ করতে থাকলেন। আকাশবর্তীরা দ্রোণের প্রশংসা করে বলতে লাগল, “শত্রুবিজয়ী, মহাবীর, দৃঢ়মুষ্টি, দুর্ধর্ষ, দেব-দানব বিজয়ী অর্জুনের সঙ্গে দ্রোণ যে যুদ্ধ করছেন, তা যথার্থই দুষ্কর কার্য।”
যুদ্ধে অর্জুনের ভ্রমহীনতা, শিক্ষানৈপুণ্য, লঘুহস্ততা, দূরে ক্ষেপণ সামর্থ্য দেখে দ্রোণ বিস্মিত হলেন। অর্জুন বাহুযুগল দ্বারা গণ্ডিবধনু উত্তোলন করে ক্রমাগত শরক্ষেপ করতে লাগলেন। তাঁর বাণবৃষ্টি দেখে সকলেই “সাধু সাধু” বলতে লাগল। অর্জুনের বাণবৃষ্টির মধ্যে বায়ুপ্রবেশের ফাঁকও থাকল না। যুদ্ধ যত তীব্র হতে থাকল, অর্জুনের বাণক্ষেপণও তত দ্রুততর হতে থাকল। শত শত ও সহস্র সহস্র বাণ দ্রোণের রথের উপর পড়ে রথখানা আবৃত করে ফেলল, দ্রোণ শরক্ষেপ করার মতো স্থানও বার করতে পারলেন না। তখন অশ্বত্থামা বিশাল রথ সমূহদ্বারা অর্জুনকে থামাবার চেষ্টা করতে লাগলেন, মনে মনে অর্জুনের প্রশংসা করে, কিন্তু গুরুতর ক্রুদ্ধ হয়ে অশ্বত্থামা অর্জুনের দিকে ছুটে গেলেন। এদিকে অর্জুনও ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত দ্রোণাচার্যকে চলে যাবার ফাঁক করে দিয়ে অশ্বত্থামার দিকে ধাবিত হলেন। অর্জুনের তীক্ষ্ণবাণে দ্রোণের বর্ম ও ধ্বজ ছিন্ন হয়েছিল এবং দেহের অনেক স্থান ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল; তাই তিনি ফাঁক পেয়েই বেগবান অশ্বসমূহের গুণে দ্রুত সেস্থান থেকে সরে গেলেন। তখন গরুড় যেমন করে সর্পকে গ্রহণ করে, অর্জুন সেইরকম অশ্বত্থামাকে গ্রহণ করলেন। অশ্বত্থামা ও অর্জুন, দেবাসুর যুদ্ধের ন্যায় পরস্পরের প্রতি অবিরাম বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। পরস্পর সংঘর্ষে সেই বাণগুলি গুরুতর শব্দের সৃষ্টি করল। অর্জুনের প্রচণ্ড প্রহারে অশ্বত্থামার অশ্বগুলি গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হল। তারা সম্পূর্ণ মোহিত হয়ে পড়ল, আর দিক-নির্ণয় করতে পারল না। তখন অশ্বত্থামা অর্জুনের মুহূর্তের অনবধানতায় তাঁর ধনুকের গুণ ছেদন করলেন। অশ্বত্থামার সেই অলৌকিক কাজ দেখে দেবতারাও তাঁর প্রশংসা করলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ ‘সাধু সাধু’ বলে অশ্বত্থামার প্রশংসা করলেন। অনুপ্রাণিত অশ্বত্থামা একটি তীক্ষ্ণ বাণে অর্জুনের হৃদয়ে আঘাত করলেন। তখন অর্জুন সশব্দে হাস্য করে মুহূর্তমধ্যে গাণ্ডিবে নতুন গুণ পরালেন। তারপর অর্জুন অর্ধ-চক্রাকারে ঘুরে মত্তহস্তীষূথপতি যেমন অন্য মত্তহস্তীর সঙ্গে মিলিত হয়, অশ্বত্থামার সঙ্গে মিলিত হলেন। গুরুতর ও লোমহর্ষক যুদ্ধে পরস্পর পরস্পরকে আঘাত করতে লাগলেন। কিন্তু দ্রুতনিক্ষেপ করার জন্য অশ্বত্থামার বাণ নিঃশেষ হয়ে গেল। অর্জুনের তূণীর তখনও অক্ষয় বাণে পরিপূর্ণ ছিল। অশ্বত্থামা পরাজয় স্বীকার করে সেই স্থান ত্যাগ করলেন।
তখন কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বিশাল ধনু পূর্ণ আকর্ষণ করে বাণক্ষেপ করবার উদ্যোগ করলেন। কর্ণ যেখানে থেকে ধনু আকর্ষণ করছিলেন, অর্জুন সেই দিকে দৃষ্টিপাত করে কর্ণকে ধনু আকর্ষণ করতে দেখলেন এবং প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হলেন। অর্জুন দু’চোখে কর্ণকে আপাদমস্তক দেখতে লাগলেন। সেই অবসরে দুর্যোধনের লোকেরা অশ্বত্থামার কাছে সহস্র সহস্র বাণ এনে দিলেন। অর্জুন কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধের ইচ্ছায় অশ্বত্থামাকে পরিত্যাগ করে তৎক্ষণাৎ কর্ণের দিকেই ধাবিত হলেন। দ্বৈরথ যুদ্ধ করবার ইচ্ছায় অর্জুনের রথ কর্ণের রথের সম্মুখে উপস্থিত হলে অর্জুন বললেন, “কর্ণ! তুমি দ্যূতসভায় বলেছিলে, ‘যুদ্ধে আমার সমান কেউ নেই’, তোমার সেই গর্ব প্রকাশের পরীক্ষার কাল উপস্থিত হয়েছে। আজ যুদ্ধে তুমি আমার থেকে কত দুর্বল তা জানতে পারবে এবং ভবিষ্যতে আর গর্ব প্রকাশ করবে না। তুমি ধর্ম লঙ্ঘন করে তখন কেবল নিষ্ঠুর কথাই বলেছিলে, আমাকে না পেয়ে দ্রৌপদীর অসম্মান আনন্দের সঙ্গে দেখছিলে, আজ তার ফল ভোগ করো। আমি ধর্মপাশে আবদ্ধ ছিলাম, এখন আমার ক্রোধ দেখো। বারো বৎসর যাবৎ আমরা বনে যে দুঃখ পেয়েছি, সেই ক্রোধের ফল ভোগ করো। কর্ণ এসো, আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো। আর, কৌরবেরা দর্শক হোন।”
কর্ণ বললেন, “অর্জুন! মুখে যা বলছ, কার্যে তা পরিণত করো। সমস্ত পৃথিবী জানে যে, কার্য অপেক্ষা তোমার বাগাড়ম্বরই বেশি। পূর্বে তুমি যা সহ্য করেছিলে, তা ভিন্ন তোমার কিছু করার ছিল না বলেই সহ্য করেছিলে। আমি তোমার পরাক্রম দেখে একেই সত্য বলে জেনেছি। তুমি পূর্বে যে ধর্মপাশে আবদ্ধ ছিলে, আজও সেই ধর্মপাশেই আবদ্ধ আছ (অর্থাৎ তোমার অজ্ঞাতবাস এখনও শেষ হয়নি)। ঔদ্ধত্যবশত তুমি আপনাকে অবধ্য বলে মনে করছ। স্বয়ং ইন্দ্রও যদি তোমার জন্য যুদ্ধ করেন, তাতেও আমার কোনও উদ্বেগ হবে না। আজ তুমি আমার পরাক্রম দেখতে পাবে।”
অর্জুন বললেন, “রাধানন্দন! তুমি এই মাত্র আমার সঙ্গে যুদ্ধ থেকে পালিয়ে গেলে এবং সেই কারণেই বেঁচে আছ; তোমার সম্মুখে তোমার ভ্রাতা সংগ্রামজিৎ আমার হাতে নিহত হয়েছে। কর্ণ তুমি ছাড়া কোন পুরুষ ভ্রাতাকে বধ করিয়ে, নিজে পালিয়ে গিয়ে সজ্জনের সামনে গর্ব প্রকাশ করতে পারে?” এই কথা বলতে বলতেই অর্জুন বর্মবিদারক বাণসমূহ নিক্ষেপ করতে করতে কর্ণের দিকে ধাবিত হলেন। কর্ণও সন্তুষ্ট চিত্তে বিশাল শরবর্ষণ করে অর্জুনকে গ্রহণ করলেন। সকল দিকেই ভয়ংকর শরজাল উত্থিত হল এবং উভয়েই উভয়ের অশ্ব ও বাহুযুগলের চর্মাবরণ পৃথক পৃথক বিদ্ধ করলেন। তখন অর্জুন কর্ণের বৃহৎ তূণীর ধারণ সহ্য করতে না পেরে তীক্ষ্ণ একটি বাণে তা ছেদন করলেন। কর্ণ ক্ষুদ্র তূণীর থেকে একটি বাণ নিয়ে তার দ্বারা অর্জুনের হস্ত বিদ্ধ করলেন, অর্জুনের মুষ্টি শিথিল হয়ে গেল। তারপর মহাবাহু অর্জুন কর্ণের ধনু ছেদন করলেন। কর্ণও অর্জুনের প্রতি একটি শক্তি নিক্ষেপ করলেন। অর্জুনের বাণে সে শক্তিটা বিনষ্ট হল। তখন অসংখ্য অনুচর কর্ণের সহায়তায় উপস্থিত হল— অর্জুন গাণ্ডিবনিক্ষিপ্ত বাণ দ্বারা সে অনুচরগুলিকে যমালয়ে পাঠালেন। অর্জুনের তীক্ষ্ণবাণে কর্ণের অশ্বগুলি ভূতলে পতিত হল। তখন বলবান অর্জুন—তেজস্বী, উজ্জ্বল, তীক্ষ্ণ একটি বাণদ্বারা কর্ণের বক্ষঃস্থলে বিদ্ধ করলেন। সেই বাণটা কর্ণের বর্মভেদ করে গায়ে প্রবেশ করল। মোহাবিষ্ট হয়ে কর্ণ কিছুই বুঝতে পারলেন না। অত্যন্ত বেদনা হওয়ায় কর্ণ যুদ্ধস্থান পরিত্যাগ করে উত্তরমুখ হয়ে পলায়ন করলেন। তখন অর্জুন আর উত্তর তাঁকে চিৎকার করে ডাকতে থাকলেন। কর্ণ পরাজিত হলেন।
কর্ণ পরাজিত হলে অর্জুন উত্তরকে আদেশ দিলেন, “উত্তর যে সৈন্যের মধ্যে স্বর্ণময় ধ্বজ রয়েছে, সেই সৈন্যের কাছে আমাকে নিয়ে চলো। এবং যে সৈন্যের মধ্যে স্বর্ণময় ধ্বজ রয়েছে, আমাদের পিতামহ, দেবদর্শন ও শান্তনুনন্দন ভীষ্ম আমার সঙ্গে যুদ্ধ করার ইচ্ছা করে রথে অবস্থান করছেন, সেইখানে আমাকে নিয়ে চলো।” বাণবিদ্ধ উত্তর, বিপক্ষের অগণিত সৈন্য দেখে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে বললেন, “বীর। আমি আর আপনার উত্তম অশ্বগুলি সংযত করতে পারছি না। আমার প্রাণ বিষণ্ণ, মন বিহ্বল হয়ে পড়েছে। দুই পক্ষের অলৌকিক অস্ত্রের প্রয়োগে ও প্রভাবে আমার দশ দিক ঘুরছে, বসা, রক্ত ও মেদের গন্ধে আমি মূৰ্ছিতপ্রায় হয়েছি, মহাযুদ্ধে এত বীরের সম্মিলন আমি পূর্বে দেখিনি। যোদ্ধৃগণের আহ্বানে, শঙ্খের বিশাল শব্দে, বীরগণের সিংহনাদে, হস্তীগণের বৃংহিতরবে এবং বজ্রতুল্য গাণ্ডিব ধনুর টংকারে আমার চিত্ত অস্থির, শ্রবণশক্তি ও স্মরণশক্তি লুপ্ত। আপনার গাণ্ডিবধনুকে ঘূর্ণিত জ্বলন্ত কাষ্ঠের ন্যায় মণ্ডলাকারে আকর্ষণ, ক্রুদ্ধ মহাদেবের ন্যায় আপনার ভীষণ দেহ, বাণক্ষেপ দেখে আমি অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছি। অশ্বের কশা ও লাগাম ধরার শক্তি আমার আর নেই।”
অর্জুন বললেন, “নরশ্রেষ্ঠ! তুমি ভীত হোয়ো না। চিত্ত স্থির করো। এই যুদ্ধে তুমি অসাধারণ কাজ করেছ। তুমি জগদ্বিখ্যাত শত্রুদমন রাজবংশে জন্মেছ, ভীত হওয়া তোমার সাজে না। শক্ৰহন্তা রাজপুত্র! বিশেষ ধৈর্য ধরে আমার রথের অশ্বগুলি সঞ্চালন করো। রাজপুত্র এই ভীষ্মের সৈন্যের সম্মুখে চলো। আজ যুদ্ধে ভীষ্মের ধনুর্গুণ ছেদন করে আশ্চর্য দিব্য অস্ত্রের প্রদর্শন করব। কৌরবেরা আজ আমার গাণ্ডিব ধনুকে মেঘ আগত বিদ্যুতের মতো দেখবে। সেই বিদ্যুৎ বাম না দক্ষিণ কোন দিক থেকে আসছে, তা বুঝতে পারবে না। আজ পরলোক প্রবাহিণী একটি নদী প্রবর্তিত করব, রক্ত হবে তার জল, রথ হবে তার আবর্ত (ঘোলা) এবং হস্তী হবে তার কুম্ভীর। কৌরব সৈন্যরূপ মহাবন আজ আমি দগ্ধ করব। হাত, পা, মাথা, পিঠ রূপ শাখাগুলি কেটে বন রচনা করব। চক্রের মতো কৌরব সৈন্যকে ঘোরাব। তুমি আজ আমার বিচিত্র বাণশিক্ষা দেখবে। তুমি রথের উপর সাবধানে থাকবে। পূর্বে আমি ইন্দ্রের আদেশে সহস্র সহস্র পৌলোম ও কালকঞ্জ অসুরদের বধ করেছিলাম, সমুদ্রপারে গিয়ে ষাট হাজার ভয়ংকর রথীকে পরাজিত করে হিরণ্যপুর ধ্বংস করেছিলাম। ইন্দ্র আমাকে দৃঢ়মুষ্টি, ব্ৰহ্মা আমাকে হস্তনৈপুণ্য, প্রজাপতি আমাকে বিচিত্র তুমুল যুদ্ধ শিখিয়েছেন। আজ কৌরবদের আমি তীব্র নদীর স্রোতে ভাঙা পারের দুর্দশা দেখাব। আমি রুদ্রের কাছে রৌদ্র, বরুণের কাছে বারুণ, অগ্নির কাছে আগ্নেয়, বায়ুর কাছে বায়ব্য, ইন্দ্রের কাছ থেকে বজ্র লাভ করেছি। সুতরাং ভীষ্মপ্রমুখ সিংহ, আজ কৌরব সৈন্যরূপ বন রক্ষা করতে পারবেন না।”
অর্জুনের দ্বারা আশ্বস্ত উত্তর ভীষ্মসৈন্যদের দিকে রথ চালালেন। ভীষ্মও ধীরভাবে অর্জুনকে থামাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। অর্জুনের ক্ষিপ্রগতি বাণে ভীষ্মের ধ্বজ মূল সুদ্ধু ভূতলে পতিত হল। তখন দুঃশাসন, বিকর্ণ, দুঃসহ ও বিবিংশতি— এই চার বীর অর্জুনের পথ আটকালেন। দুঃশাসন একটি ভল্লে উত্তরকে বিদ্ধ করলেন, অন্য ভল্লে অর্জুনের বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করলেন। অর্জুন দুঃশাসনের স্বর্ণখচিত ধনু ছেদন করলেন। পাঁচটি বাণে দুঃশাসনের বক্ষ বিদ্ধ করলেন, অত্যন্ত পীড়িত দুঃশাসন তখন যুদ্ধ ত্যাগ করে পালালেন। বিকর্ণ তীক্ষ্ণবাণ সমূহ দ্বারা অর্জুনকে বিদ্ধ করলেন। অর্জুন একটি বাণ বিকর্ণের ললাটে বিদ্ধ করলেন। বিকর্ণ রথ থেকে পড়ে গেলেন। ভ্রাতা বিকর্ণকে রক্ষা করার জন্য দুঃসহ ও বিবিংশতি তীক্ষ্ণ বাণসমূহ দ্বারা অর্জুনকে আবৃত করলেন। অর্জুন অবিচল থেকে একসঙ্গে দুই বাণে সেই দুজনকে বিদ্ধ করে তাদের অশ্বগুলি বিনাশ করলেন। অনুচরেরা দ্রুত এসে তিন ধৃতরাষ্ট্র পুত্রকে অপসারিত করল। তখন কৌরবপক্ষের সকল মহারথ একত্রে অর্জুনকে আক্রমণ করলেন। অর্জুন বাণদ্বারা একটি জাল নির্মাণ করে সেই মহারথগণকে আবৃত করলেন। মধ্যাহ্ন সময়ের তেজস্বী সূর্যের ন্যায় অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিভাত হতে থাকলেন। অর্জুনের তীক্ষ্ণ বাণে ভীত রথীরা রথ থেকে, অশ্বারোহীরা অশ্বপৃষ্ঠ হতে এবং পদাতিকরা ভূতলে পতিত হতে লাগল। বীরগণের সোনা, রুপা, তামা ও লোহার কবচগুলি গুরুতর শব্দ সৃষ্টি করতে লাগল। অর্জুনের বাণে চৈতন্যহীন বীরগণের শরীরে সমস্ত সমরাঙ্গন পূর্ণ হয়ে উঠল। ছিন্ন অঙ্গ, ধনুযুক্ত বাহু এবং হস্তাভরণ যুক্ত অন্যান্য বাহু দ্বারা আবৃত হয়ে রণভূমি শোভা পেতে লাগল। রুদ্রের মতো পরাক্রমশালী ও মহাবীর পাণ্ডুনন্দন অর্জুন তেরো বৎসর যাবৎ অবরুদ্ধ ছিলেন বলে সেই সময়ে দুর্যোধন প্রভৃতির প্রতি ক্রোধানল বর্ষণ করতে লাগলেন। দুর্যোধনের সমক্ষে কৌরবসৈন্যরা পরাজয় স্বীকার করে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হল। ক্রমে অর্জুন একটি ভয়ংকর তরঙ্গযুক্ত নদী প্রবর্তিত করলেন। অস্থি ছিল তার শৈবাল, ধনু ও বাণ ছিল ক্ষুদ্র নৌকা, কেশ ছিল ক্ষুদ্র শৈবাল ও শ্যামতৃণ, হস্তী ছিল কচ্ছপ, রথ ছিল তার ডোঙা— সে নদী ছিল বর্ম ও উষ্ণীষে ব্যাপ্ত, বসা মেদ ও রক্ত বহন করছিল, অত্যন্ত ভয়ংকরী ও রুক্ষদর্শনা। তার পাশে হিংস্র জন্তুরা রব করছিল, আর তাতে তীক্ষ্ণ অস্ত্র ছিল ভীষণ জলজন্তু, মুক্তাহার ছিল প্রবল তরঙ্গ, বিচিত্র অলংকার ছিল বুদবুদ, বাণসমূহ ছিল ভীষণ আবর্ত, মহাহস্তী ছিল কুম্ভীর, মহারথ ছিল বিশাল দ্বীপ, শঙ্খ ও দুন্দুভির শব্দ ছিল কোলাহল, আর সেই দুস্তর নদীর কাছে মাংসভোজী পশু-পক্ষীগণ বিচরণ করছিল।
দুর্যোধন, কর্ণ, দুঃশাসন, বিবিংশতি, অশ্বত্থামা, দ্রোণ ও কৃপ— এই সাতজন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে অর্জুনকে বধ করবার ইচ্ছায় দৃঢ় ধনুসকল বিস্ফারিত করে অর্জুনকে আবৃত করে শরবর্ষণ করতে লাগলেন। সকল দিক থেকে দিব্য অস্ত্রের আঘাতে অর্জুনের শরীরে দুই আঙুল স্থানও শূন্য থাকল না। তখন মহারথ অর্জুন ঈষৎ হাস্য করে গাণ্ডিবধনুতে ঐন্দ্র অস্ত্র যোগ করলেন। সূর্য যেমন কিরণ দ্বারা সকল পদার্থ আবৃত করেন, ঐন্দ্রাস্ত্র গাণ্ডিব থেকেই দশ দিক আলোকিত করল। সেই অস্ত্র দেখেই দশ দিকের সৈন্যরা আপন জীবন সম্পর্কে নিরাশ বোধ করতে লাগল। সপ্তরথী ইন্দ্র প্রদত্ত সেই অস্ত্রকে আকাশ আলোকিত করে আসতে দেখে আপন আপন অস্ত্র ত্যাগ করলেন।
অর্জুনের এই রণতাণ্ডব দেখে অতি দুর্ধর্ষ, প্রতাপশালী, শান্তনুনন্দন পিতামহ ভীষ্ম অর্জুনের দিকে এগিয়ে এলেন। একটি ভৃত্য ভীষ্মের মস্তকের উপর শ্বেতবর্ণ ছত্র ধারণ করেছিল। পর্বত যেমন মেঘকে গ্রহণ করে, অর্জুনও সেইরূপ ভীষ্মকে গ্রহণ করলেন। ভীষ্ম বেগশালী ও শ্বাসত্যাগী সর্পের তুল্য আটটা বাণ বুদ্ধিমান অর্জুনের ধ্বজের উপর নিক্ষেপ করলেন। সেই উজ্জ্বল বাণগুলি গিয়ে অর্জুনের ধ্বজাগ্রে স্থির বানর ও অন্যান্য প্রাণীকে আঘাত করল। তখন অৰ্জুন তীক্ষ্ণধার ও বিশাল একটি ভল্ল দ্বারা ভীষ্মের ছত্র ছেদন করলেন। ছত্র ভূতলে পতিত হল, দ্রুতকার্যকারী অর্জুন বাণ দ্বারা ভীষ্মের ধ্বজ, রথের অশ্ব ও পৃষ্ঠরক্ষক দুইজনকে গুরুতর আঘাত করলেন। তখন ভীষ্ম অর্জুনের ক্ষমতা জেনেও বিশাল ও অলৌকিক অস্ত্র দ্বারা অর্জুনকে আবৃত করলেন। উৎসাহিত অর্জুন সেইরকম অলৌকিক অস্ত্রদ্বারা ভীষ্মকে প্রত্যাঘাত করতে লাগলেন। বলি ও ইন্দ্রের মধ্যে যুদ্ধের মতো এই দুজনের যুদ্ধ কৌরবগণ বিস্মিত দর্শকের মতো দেখতে লাগলেন।
অৰ্জুন একবার বামহাতে আবার দক্ষিণ হাতে গাণ্ডিব ধারণ করে বাণক্ষেপ করতে লাগলেন। গাণ্ডিব ধনুক একটি অগ্নিচক্রের মতো ঘুরতে লাগল। মেঘ যেমন জলধারা দিয়ে পর্বতকে ঢেকে ফেলে, তেমনই অর্জুন বাণ দ্বারা ভীষ্মকে আবৃত করলেন। তখন ভীষ্ম সেই বাণবর্ষণ বিনষ্ট করলেন ও অর্জুনকেও বারণ করলেন। অর্জুনের কাছ থেকে আগত বাণসমূহ ভীষ্মের রথের কাছে এসে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়তে লাগল। তখন সমবেত কৌরবেরা সকলে বললেন, “সাধু সাধু। ভীষ্ম যে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন, এটা যথার্থই দুরূহ কাজ। কারণ, অর্জুন বলবান, যুবক, দক্ষ এবং লঘুহস্ত। ভীষ্ম, দেবকীনন্দন কৃষ্ণ, কিংবা মহাবল ও আচার্যশ্রেষ্ঠ দ্রোণ ছাড়া অন্য কেউই যুদ্ধে অর্জুনের বেগ ধারণ করতে সমর্থ নয়।” তখন ভীষ্ম ও অর্জুন প্রাজাপত্য, ঐন্দ্র, আগ্নেয়, কৌবের, বারুণ, যাম্য ও বায়ব্য অস্ত্র প্রয়োগে সকল প্রাণীকে মুগ্ধ করে তুললেন। সেই স্থানের সমস্ত ব্যক্তি উভয়ের প্রশংসা করতে লাগলেন। “পার্থ! সাধু, মহাবাহু ভীষ্ম! সাধু। যুদ্ধে ভীষ্ম ও অর্জুনের এই যে গুরুতর মহাস্ত্রপ্রয়োগ দেখা যাচ্ছে, এ মনুষ্যমধ্যে সম্ভব নয়।” সেই ভয়ংকর যুদ্ধে কখনও অর্জুন ভীষ্মকে, কখনও বা ভীষ্ম যেন অর্জুনকে অতিক্রম করতে লাগলেন। তখন অর্জুন ভীষ্মের রথরক্ষকদের বধ করলেন। তারা অর্জুনের রথের চারপাশে ভূমিতে শয়ন করতে লাগল।
তারপর অর্জুন রণস্থলকে শত্রুশূন্য করার জন্য গাণ্ডিবে বাণ পরস্পর পুঙ্খে পুঙ্খে সংযুক্ত করে নিক্ষেপ করতে লাগলেন। সেই বাণ আকাশে হংসশ্রেণির মতো আসতে লাগল। গঙ্গানন্দন ভীষ্মও যেন সেই বাণশ্রেণির আগমনে বিমূঢ় বোধ করতে লাগলেন। আকাশে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন দেবরাজ ইন্দ্রকে বললেন, “দেবরাজ! দেখুন দেখুন— অর্জুন নিক্ষিপ্ত এই বাণগুলি পরস্পর সংযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। মানুষ এই কাজ বিশ্বাস করবে না। কেবলমাত্র দিব্যাস্ত্রধারী অর্জুনের পক্ষেই এই আশ্চর্য কার্য করা সম্ভব। অর্জুনের বাণগ্রহণ, সন্ধান ও নিক্ষেপের মধ্যে কোনও ফাঁক দেখা যায় না। মধ্যাহ্নসূর্যের মতো দীপ্যমান অর্জুনের দিকে কেউ তাকাতে পারছে না, তেমনই ভীষ্মের দিকেও তাকাতে পারছে না। এদের দুজনের কার্যই বিখ্যাত, দুজনের পরাক্রমও তীব্র, দুজনেই কার্যে সমান, দুজনেই যুদ্ধে দুর্ধর্ষ।” গন্ধর্ব চিত্রসেন এই কথা বললে দেবরাজ ইন্দ্র ভীষ্ম ও অর্জুনের মাথার উপর পুষ্পবৃষ্টি করলেন।
অর্জুন প্রতিসন্ধানের জন্য বাণ বার করছিলেন, সেই অবকাশে ভীষ্ম একটি ভয়ংকর বাণে অর্জুনের বামপার্শ্বে বিদ্ধ করলেন। অর্জুন হাসতে হাসতে ভীষ্মের ধনুখানা ছেদন করলেন। তারপর আবার দশটা বাণে পরাক্রমশালী ভীষ্মের বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করলেন। সেই বাণের আঘাতে অত্যন্ত পীড়িত হয়ে ভীষ্ম রথের ধ্বজের দণ্ড ধরে দীর্ঘকাল অবস্থান করতে লাগলেন। সারথি ভীষ্মের পূর্বের উপদেশ স্মরণ করে অচেতনপ্রায় ভীষ্মকে নিয়ে রথ রণক্ষেত্র থেকে চলে গেল।
ভীষ্ম রণক্ষেত্র ত্যাগ করে পলায়ন করলে দুর্যোধন সিংহনাদ করে অর্জুনের নিকট উপস্থিত হয়ে একটি ভল্ল অর্জুনের ললাটে বিদ্ধ করল। ভল্ল অর্জুনের ললাটে বিদ্ধ হলে অনর্গল রক্ত ঝরতে লাগল। ললাট নির্গত সেই রক্তের ধারা একটি স্বর্ণপুষ্পশোভিত বিচিত্র মালার মতো অর্জুনের গায়ে অত্যন্ত শোভা পেতে থাকল। অসাধারণ অধ্যবসায়ী ও বলবান অর্জুন দুর্যোধনের সেই বাণের আঘাতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তূণ থেকে বিষ ও অগ্নির তুল্য বাণসমূহ গ্রহণ করে তা দ্বারা দুর্যোধনকে বিদ্ধ করলেন। দুর্যোধনও অর্জুনকে সমানভাবে আঘাত করতে লাগলেন। বিকর্ণ দুর্যোধনকে সাহায্য করার জন্য একটি মহাহস্তী ও চারটি রথ নিয়ে অর্জুনকে আক্রমণ করলেন। অর্জুন তীক্ষ্ণ একটি বাণ দ্বারা হস্তীটির “শুণ্ড, দেহ ও পুঙ্খ এক আঘাতে বিদীর্ণ করলেন। হস্তী পতিত হলে বিকর্ণ দ্রুত বিবিংশতির রথে আরোহণ করলেন। অর্জুনের একটি বাণে দুর্যোধনের বক্ষ বিদীর্ণ হল, বিকর্ণ পরাজিত, তাঁর মহাহস্তী— নিহত দেখে দুর্যোধন যুদ্ধ ত্যাগ করে পালাতে লাগলেন।” অর্জুন পিছন থেকে ডেকে তাঁকে বলতে লাগলেন, “দুর্যোধন প্রচুর কীর্তি, বিপুল যশ ত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাচ্ছ কেন? তুমি যুদ্ধে এসেছ, অথচ তোমার বিজয়বাদ্য বাজল না। আমি যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞাবহ তৃতীয় পাণ্ডব। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে আছি, অথচ তুমি পালিয়ে যাচ্ছ। ফিরে এসো, রাজার কর্তব্য স্মরণ করো। তোমার দুর্যোধন নাম নিরর্থক হয়ে গেল। পলায়নের কারণে তুমি আর দুর্যোধন রইলে না। তোমার সামনে পিছনে রক্ষক নেই। অতএব পাণ্ডবের হাত থেকে প্রিয়তম প্রাণ রক্ষা করো।”
তখন অভিমানী দুর্যোধন, কর্ণকে নিয়ে আবার ফিরলেন। শান্তনুনন্দন ভীষ্মও ফিরে এলেন। দ্রোণ, কৃপ, বিবিংশতি ও দুঃশাসনও দুর্যোধনকে রক্ষা করার জন্য ফিরে আসতে লাগলেন। তখন শত্ৰুবিজয়ী অর্জুন ইন্দ্রদত্ত অনিবার্য ‘সম্মোহন’ বাণ প্রয়োগ করলেন। ‘সম্মোহন’ বাণ নিক্ষেপ করে অর্জুন ভয়ংকর শঙ্খবাদন করলেন। সেই শঙ্খের শব্দে সম্মোহিত হয়ে কৌরবপক্ষীয়রা ধনু ত্যাগ করে চৈতন্যবিহীন হয়ে অবশভাবে পড়ে রইলেন। তখন অর্জুন উত্তরকে বললেন, “উত্তর যতক্ষণ কৌরবেরা চৈতন্যবিহীন হয়ে থাকেন, তুমি তার মধ্যে গিয়ে দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যের শুক্ল বস্ত্রযুগল, কর্ণের পীত বস্ত্রখানি, দুর্যোধন ও অশ্বত্থামার নীলবর্ণ বস্ত্রদ্বয় খুলে নিয়ে এস। কিন্তু ভীষ্মের চৈতন্য লোপ হয়নি বলেই আমার মনে হয়। কারণ তিনি এ অস্ত্রের প্রতিঘাত জানেন। সুতরাং ভীষ্মকে বাদ দিয়ে অন্যদের বস্ত্রগুলি নিয়ে এসো।” উত্তর ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে লাফিয়ে দ্রোণ কর্ণ প্রভৃতির কাপড়গুলি সত্বর নিয়ে এসে আবার রথে উঠলেন। উত্তর রথের অশ্বদের যাবার উপদেশ দিলেন। অশ্বগুলি অর্জুনকে নিয়ে যুদ্ধ মধ্য থেকে বিপক্ষসৈন্য অতিক্রম করে বাইরে চলে এল। অর্জুন সেভাবে যেতে থাকলে ভীষ্ম বাণদ্বারা তাঁকে আঘাত করলেন। অর্জুনও দশটি বাণদ্বারা ভীষ্মের পার্শ্বদেশে আঘাত করলেন। এই সময়ে দুর্যোধন চেতনা ফিরে পেলেন এবং ভীষ্মকে বললেন, “পিতামহ! অর্জুন কোন উপায়ে আপনার কাছ থেকে মুক্তিলাভ করে চলে যাচ্ছে। ওকে প্রহার করুন, যাতে ও না যেতে পারে।” ভীষ্ম হেসে বললেন, “তোমার এ বুদ্ধি এতক্ষণ কোথায় ছিল। দুর্যোধন তুমি অর্জুনের সম্মোহন অস্ত্রের প্রভাবে একেবারে নিস্পন্দ হয়ে ছিলে। অর্জুন তখনও নৃশংস কাজ করেননি। অর্জুন ত্রিভুবনের রাজত্বের জন্যও বীরধর্ম ত্যাগ করবেন না। সেইজন্যই তোমরা বেঁচে আছ। অতএব কুরুপ্রবর! তুমি দ্রুত হস্তিনায় প্রস্থান করো। অর্জুন গোরুগুলি নিয়ে ফিরে যান। মোহবশত আর নিজের সর্বনাশ কোরো না।” রাজা দুর্যোধন ও অন্য কৌরবপক্ষীয় বীরেরা ভীষ্মের কথা যথার্থ বিবেচনা করেই সকলে মিলে দুর্যোধনকে রক্ষা করে হস্তিনার পথে ফিরতে লাগলেন।
অর্জুন মাথা নিচু করে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যকে নমস্কার জানালেন। অন্যদের অভিবাদন করলেন। কিছুপথ তাদের অনুসরণ করে পিছনে পিছনে গেলেন। তারপর গাণ্ডিবের টংকারে পৃথিবী পূর্ণ করে একটি তীক্ষ্ণ বাণদ্বারা দুর্যোধনের উত্তম রত্নখচিত মুকুটখানি ছেদন করলেন। দেবদত্ত শঙ্খ বাজিয়ে, শত্রুগণের মন বিদীর্ণ করে অর্জুন বললেন, “উত্তর! ঘোড়াগুলিকে ফেরাও। তোমার পশুগুলিকে জয় করা হয়েছে; শত্রুরাও চলে গেছে; সুতরাং তুমি এখন আনন্দিত মনে রাজধানীতে চলো।”
*
‘কৌরব বিজয়’ মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত। স্বর্গের বাসনাজাত অভিশাপ সমাপ্ত হল মর্ত্য-মানবের জীবনে। অর্জুন অভিশাপমুক্ত হলেন। এই অভিশাপ অজ্ঞাতবাসের এক বৎসর অর্জুনের কাজে লেগেছিল। বৃহন্নলা রূপে বিরাট রাজার অন্তঃপুরে কন্যাদের নৃত্যশিক্ষক হয়ে কাটান অর্জুন। কিন্তু অর্জুনের মতো শ্রেষ্ঠ বীর, শুধু নৃত্য-গীতে তৃপ্ত হতে পারেন না। গণনা করে পাঁচ ভ্রাতা এবং সৈরিন্ধ্রীরূপিণী দ্রৌপদী জেনেছিলেন, অজ্ঞাতবাসের বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে। এইবার অর্জুনের স্বরূপে আত্মপ্রকাশের কাল এসেছে। তাই দ্রৌপদী রাজকুমার উত্তরের সারথি রূপে যেতে অর্জুনকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
অর্জুন আবির্ভূত হলেন। শমীবৃক্ষ থেকে অস্ত্র নামানোর পর এবং অর্জুনের পরিচয় পাবার পর রাজকুমার উত্তর রথের সারথ্যভার গ্রহণ করলেন। আমরা অর্জুনকে পরিপূর্ণ রূপে দেখলাম। একদিকে কৌরবপক্ষের শ্রেষ্ঠ বীরেরা, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, কর্ণ, দুর্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণ ও অন্য ধার্তরাষ্ট্রগণ, অন্যদিকে অর্জুন একা। ‘কৌরব-বিজয়’ প্রমাণ করল অর্জুন মর্ত্যভূমির শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর। উত্তর বিপক্ষের শ্রেষ্ঠ বীরদের একত্রে দেখে ভয় পেয়ে অর্জুনকে প্রশ্ন করেছিলেন, একা অর্জুন কীভাবে এই শ্রেষ্ঠ রথীদের সম্মুখীন হবেন? ঈষৎ গর্বের সঙ্গে অর্জুন তাঁর একক বিক্রমের সংবাদ দিয়েছেন উত্তরকে। এককভাবে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, দুঃশাসন ইত্যাদিকে পরাজিত করলেন অর্জুন। অবশ ভীষ্মকে নিয়ে সারথি চলে গেলেন। কৃপাচার্যের রথ বিনষ্ট হল, তিনি অন্যের রথে প্রস্থান করলেন, অশ্বত্থামার অস্ত্র শেষ হয়ে গেল। দ্রোণ অর্জুনের শরব্যূহ ভেদ করতে পারলেন না, কর্ণ দু’বার পালালেন, দুর্যোধন ছিন্নমুকুট প্রস্থান করলেন। কর্ণের চোখের সামনে তার ভাই সংগ্রামজিৎকে বধ করলেন অর্জুন। এরপর সমবেত রথীকে একত্রে পেয়ে অর্জুন যেন ছেলেখেলা করলেন। সম্মোহন বাণে সকলকে অচেতন করে উত্তরার পুতুল খেলার জন্য ভীষ্মকে বাদ দিয়ে অন্যদের পোশাক খুলে নিলেন উত্তরকে দিয়ে।
প্রথমেই অর্জুন গুরু দ্রোণাচার্যকে তাঁর বাণ দিয়ে প্রণাম করে, কুশল প্রশ্ন করে চরম শিষ্টতার পরিচয় দিলেন। তারপর দুর্যোধনকে পরাস্ত করে গো-ধন উদ্ধার করলেন। তারপর পাঠক দেখলেন তেরো বৎসর বঞ্চনার অবরুদ্ধ ক্রোধের প্রকাশ। কৃপাচার্য কর্ণকে ভর্ৎসনা করে যা বলেছিলেন— তা যে কতদূর সত্য, তা কর্ণের বারবার পালানোর মধ্যে ধরা পড়েছে। গুরু দ্রোণাচার্য স্তম্ভিত হয়েছেন অর্জুনের লঘুহস্ততা, তীক্ষ্ণ অস্ত্রক্ষেপণ ক্ষমতা, সহিষ্ণুতা ও ঔদার্য দেখে— শিষ্য যে তাঁকেও অতিক্রম করে গেছেন, তা দ্রোণাচার্য উপলব্ধি করেছিলেন।
সম্মোহিত অচেতন কৌরবযোদ্ধাদের চরম ক্ষতি অর্জুন করতে পারতেন, যা অশ্বত্থামা করেছিলেন নিদ্রিত পাণ্ডবপুত্রদের, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডীকে বধ করে। কিন্তু অর্জুন আর অশ্বত্থামা এক নন। যুদ্ধে বীভৎস কাজ অর্জুন করেন না। তাই তিনি ‘বীভৎসু’। পরাজিত প্রতিপক্ষকে তিনি কটূক্তি করেননি। তাঁদের অনুগমন করে শিষ্টতার চরম রূপ দেখিয়েছেন। নিজেকে ‘যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞাবহ’ পরিচয় দিয়ে দুর্যোধনকে পলায়নের জন্য ঈষৎ ব্যঙ্গ মাত্র করেছেন। অর্জুন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। যাঁরা কর্ণকে অর্জুনের থেকে বড় বীর মনে করেন— এই ‘কৌরব-বিজয়’ অংশ পাঠ করলে তাঁরা বুঝবেন, কর্ণ বীর হিসেবে অর্জুনের ধারে-কাছে কোনওদিন পৌঁছতে পারেননি। অর্জুনই একমাত্র বলতে পারেন— পিনাকপাণি মহাদেব ভিন্ন আমার তুল্য ধনুর্ধর পৃথিবীতে নেই। ভীমের মতো অর্জুনেরও নাটকের চূড়ান্ত মহড়া নেবার কাজ শেষ হল। এরপর অষ্টাদশ দিনের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবপক্ষ সম্পূর্ণ বিনষ্ট হবে, তার পূর্বাভাসও পাওয়া গেল।
৫৩
যুধিষ্ঠিরের রক্তপাত ও আত্মপ্রকাশ
উত্তর গো-হরণ কার্যে বৃহন্নলারূপী অর্জুনের কাছে কৌরবপক্ষ পরাজিত হল। পরাজিত ভীষ্ম দ্রোণ প্রমুখ সেনানায়কগণ হস্তিনাপুর যাত্রা করলে, অর্জুন মৎস্যদেশে প্রত্যাগমনের আদেশ দিলেন সারথি উত্তরকে। অর্জুন উত্তরকে বললেন, “পাণ্ডবগণ সকলেই তোমার পিতার আশ্রয়ে অজ্ঞাতবাস করছেন। একথা তুমি আমার নিকট জেনেছ। কিন্তু তুমি নগরে প্রবেশ করে, এ সত্য তোমার পিতাকে জানাবে না। কারণ, তোমার পিতা তা হলে ভয়েই প্রাণত্যাগ করবেন। তুমি পিতাকে বলবে যে, তুমি নিজে যুদ্ধ করেছ অর্থাৎ কৌরবসৈন্যকে পরাজিত করে তুমিই গো-ধন উদ্ধার করেছ।”
উত্তর বললেন, “সব্যসাচী! আপনি যে কাজ করেছেন, তা অন্যের পক্ষে দুষ্কর। আমার পক্ষে এই কাজ করা তো অসম্ভব ব্যাপার। তবুও আপনি যে পর্যন্ত নির্দেশ না দেবেন, আমি আপনাদের বিষয় পিতার কাছে গোপন রাখব।”
অর্জুন উত্তরকে নিয়ে আবার শমীবৃক্ষের কাছে এলেন। অস্ত্র-শস্ত্র, গাণ্ডিব, তূণীর আগের মতোই শমীবৃক্ষে রেখে, অর্জুনের আদেশে রথ নগরের দিকে চালালেন উত্তর। অর্জুন বলামাত্র ধ্বজ ও অন্য প্রাণিগণ রথ ত্যাগ করে আকাশে চলে গেল। অর্জুনও আগের মতো বেশধারণ করে, শাঁখা পরে, বেণীবন্ধন করে আনন্দিত চিত্তে নগরে প্রবেশ করার জন্য যাত্রা করলেন। নগরের পথে যেতে যেতে অর্জুন দেখলেন ভৃত্যদের সঙ্গে গো-পালকেরা গো-ধন নিয়ে ফিরে আসছে। তিনি স্থির করলেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে পরিশ্রান্ত অশ্বগুলিকে স্নান, জলপান ও বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে বৈকালে রাজধানীতে উপস্থিত হবেন। অর্জুন উত্তরকে বললেন, “তুমি কতকগুলি গোপালকে প্রেরণ করো, তারা নগরে গিয়ে রাজার কাছে এই প্রিয় সংবাদ দিক ও তোমার জয় ঘোষণা করুক।” উত্তরও তদনুযায়ী দূত প্রেরণ করলেন।
ওদিকে রাজা বিরাট যুদ্ধে ত্রিগর্তদের সৈন্য পরাজিত করে সকল ধন জয় করে, গোরুগুলি উদ্ধার করে পাণ্ডবদের সঙ্গে নগরে প্রবেশ করলেন। সিংহাসনে আরূঢ় হয়েই রাজা রাজপুত্র উত্তরের মঙ্গল প্রশ্ন করে উত্তর কোথায় গিয়েছে জানতে চাইলেন। তখন অন্তঃপুরিকারা রাজা বিরাটকে জানাল যে, কৌরবেরা তাঁর গোধন হরণ করেছে। সেই সংবাদে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে রাজকুমার উত্তর, বৃহন্নলাকে সারথি করে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ-অশ্বত্থামা, কর্ণ ও দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে একাকী যাত্রা করেছেন। শুনে বিরাটরাজ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলেন।
তিনি মন্ত্রীদের বললেন, “ত্রিগর্তরাজের পরাজয় সংবাদে কৌরবেরা অত্যন্ত কুপিত হবে। তাঁরা ত্রিগর্তরাজের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চাইবেন। রাজপুত্র উত্তর একা। সুতরাং ত্রিগর্তদের সঙ্গে যুদ্ধে যে সৈন্যরা আহত হয়নি, তারা অবিলম্বে উত্তরের সহায়তার জন্য যাত্রা করুক।”
বিরাট তাঁর চতুরঙ্গ সৈন্যকে বললেন, “তোমরা অবিলম্বে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে দেখো কুমার উত্তর জীবিত আছেন কি না; একটা নপুংসক যার সারথি, সে জীবিত থাকতে পারে না বলেই আমার মনে হয়।”
তখন রাজা যুধিষ্ঠির হেসে সেই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন বিরাটরাজাকে বললেন, “মহারাজ বৃহন্নলা যদি সারথি থাকেন, তবে শত্রুরা আজ আপনার গোরু নিতে পারবে না। আর আপনার পুত্র সেই বৃহন্নলা সারথির গুণে সম্মিলিত সমস্ত রাজা, কৌরব, এমনকী দেবতা, অসুর, যক্ষ ও নাগদেরও যুদ্ধে জয় করতে সমর্থ হবেন।”
ঠিক এই আলোচনার সময়ে, উত্তর প্রেরিত গোপাল শ্রেষ্ঠগণ এসে রাজা বিরাটের কাছে উত্তরের জয় ঘোষণা করল। তারা জানাল যে, শত্রুগণ পরাজিত হয়েছে, উত্তর জীবিত আছেন এবং আপনার গোরুগুলি শত্রুরা হরণ করতে পারেননি।
যুধিষ্ঠির বললেন, “রাজশ্রেষ্ঠ! ভাগ্যবশতই আপনার গোরুগুলি বিজিত, কৌরবেরা পরাজিত এবং আপনার পুত্র জীবিত আছেন। কৌরবদের পরাজয় আমি অদ্ভুত বলে মনে করি না। কারণ, বৃহন্নলা যাঁর সারথি হন, তাঁর বিজয় সুনিশ্চিত হয়ে থাকে।”
বিরাটরাজা অমিততেজা উত্তরের বিজয় বৃত্তান্ত শুনে, আনন্দে রোমাঞ্চিত দেহ হয়ে, দূতগণকে পুরস্কার দিলেন। তারপর রাজ্যকে পতাকা শোভিত এবং পুষ্প ও উপহার দ্বারা দেবতার পূজা করতে আদেশ দিলেন। সমস্ত রাজ্যে এই জয় ঘোষণা করতে এবং রাজকুমারী উত্তরাকে অন্য কুমারীদের নিয়ে বৃহন্নলার প্রত্যুদগমন করতে আদেশ দিলেন। নারীরা সেই আদেশ শুনে মাঙ্গলিক দ্রব্য হাতে রাজধানীর প্রবেশ পথের দিকে অগ্রসর হলেন। কন্যাদের এই আদেশ দিয়ে বিরাটরাজা বললেন, “সৈরিন্ধ্রী পাশক আনয়ন করো, কঙ্ক দ্যূতক্রীড়া আরম্ভ হোক।”
যুধিষ্ঠির বললেন:—
ন দেবিতব্যং হৃষ্টেন কিতবেনেতি নঃ শ্রুতম্।
স ত্বমদ্য মুদা যুক্তো নাহং দেবিতুমুৎসহে।
প্রিয়স্তু তে চিকীর্ষামি বর্ত্ততাং যদি মন্যসে॥ বিরাট : ৬৩ : ৩১ ॥
“মহারাজ! আমরা শুনেছি যে, অত্যন্ত আনন্দিত অবস্থায় দ্যূতক্রীড়া উচিত নয়। আপনি আজ অত্যন্ত আনন্দিত, অতএব আজ আপনার সঙ্গে দ্যূতক্রীড়া উচিত কাজ হবে না। কিন্তু আমি আপনার প্রিয় কাজ করতে চাই। আপনার যদি দ্যূতক্রীড়াই ইচ্ছা হয়, তবে তাই হোক।”
বিরাট বললেন, “কঙ্ক যদি তুমি দ্যূতক্রীড়া না করো, তবে আমি তোমাকে যা যা দিয়েছি, সেই গোরু, ধন, স্ত্রী সব কেড়ে নেব।”
কঙ্ক বললেন, “মানদাতা রাজশ্রেষ্ঠ। দ্যূতক্রীড়া বহু দোষের আকর। এতে আপনার কী ফল হবে? দ্যূতক্রীড়ার বহু দোষ। বুদ্ধিমান লোক তা ত্যাগ করেন। রাজা সম্ভবত আপনি পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠিরকে দেখে থাকবেন কিংবা তাঁর কথা শুনে থাকবেন। তিনি দ্যূতক্রীড়া করে বিশাল ও সমৃদ্ধিশালী রাজ্য হারিয়েছিলেন। দেবতার মতো ভ্রাতাদেরও দ্যূতক্রীড়ায় হেরেছিলেন। তাই আমি দ্যূতক্রীড়াতে অভিলাষী নই। কিন্তু আপনি রাজা, যদি দ্যূতক্ৰীড়াতেই আপনার একান্ত ইচ্ছা হয়ে থাকে, তবে আমি তা করতে বাধ্য হব।”
দ্যূতক্রীড়া আরম্ভ হল। বিরাটরাজা যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “কঙ্ক দেখো আমার পুত্র যুদ্ধে সেইসব কৌরবকে জয় করেছে।”
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বিরাটরাজাকে বললেন, “বৃহন্নলা যাঁর সারথি, তিনি কেন জয় করতে পারবেন না?”
এই কথা বলামাত্রই ক্রুদ্ধ বিরাটরাজা যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “ব্রাহ্মণাধম! তুমি আমার পুত্রের সঙ্গে একটা নপুংসকের তুলনা করে প্রশংসা করছ। কী বলতে হয়, কী বলতে হয় না, তা তুমি জানো না। অথবা নিশ্চয়ই তুমি আমাকে অবজ্ঞা করছ। একটা নপুংসক কী করে ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতি বীরদের জয় করবে? ব্রাহ্মণ! তুমি আমার সখা বলে তোমার এই অপরাধ আমি ক্ষমা করলাম। কিন্তু যদি জীবিত থাকতে চাও, তবে একথা আর বোলো না।”
যুধিষ্ঠির বললেন, “রাজশ্রেষ্ঠ! যে যুদ্ধে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা ও দুর্যোধন এবং সেরূপ অন্যান্য মহারথেরা এসেছিলেন, সেই যুদ্ধে বৃহন্নলা ছাড়া অন্য কোন বীর সেই সম্মিলিত রথীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারেন? এমনকী দেবগণ পরিবেষ্টিত দেবরাজও পারেন না। বাহুবলে যার তুল্য বীর হয়নি, হবে না এবং গুরুতর যুদ্ধ দেখে যাঁর আনন্দ হয়, যিনি সম্মিলিত সমস্ত দেবতা, অসুর ও মহানাগদের জয় করেছেন, সেই ব্যক্তি সহায় থাকতে উত্তর কেন কৌরবদের জয় করতে পারবেন না?”
বিরাট বললেন, “কঙ্ক! আমি তোমাকে বহুবার নিষেধ করেছি, তবুও তুমি বাক্য সংযত করছ না। দেখা যাচ্ছে, নিয়ন্ত্রণ না করলে লোকে ধর্মাচরণ করে না।” এই বলে ক্রুদ্ধ বিরাটরাজা পাশা দ্বারা যুধিষ্ঠিরের নাসিকায় গুরুতর আঘাত করলেন। অত্যন্ত আহত হওয়ায় নাক থেকে রক্ত পড়তে লাগল এবং মাটিতে পড়বার আগেই যুধিষ্ঠির দু’হাতে তা গ্রহণ করলেন। তখন যুধিষ্ঠির পার্শ্বস্থিতা দ্রৌপদীর দিকে তাকালেন। স্বামীর মনের অনুবর্তিনী দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের অভিপ্রায় বুঝে একটি জলপূর্ণ সুবর্ণপাত্র নিয়ে, যুধিষ্ঠিরের নাক থেকে পড়া রক্ত সেই পাত্রে গ্রহণ করলেন।
এই সময়ে মাঙ্গলিক বাদ্য সহকারে রাজকুমার উত্তর নগরে প্রবেশ করলেন। পুরবাসী ও দেশবাসী পুরুষ ও নারীরা অভিনন্দন জানাতে লাগল। উত্তর রাজভবন দ্বারে এসে সেই সংবাদ দেবার জন্য দ্বারীকে পিতার কাছে পাঠালেন। দ্বারপাল ভিতরে এসে রাজাকে জানাল, “মহারাজ আপনার পুত্র উত্তর বৃহন্নলার সঙ্গে দ্বারে এসে অবস্থান করছেন।”
অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে মৎস্যরাজ আদেশ দিলেন, “দুজনকেই সত্বর প্রবেশ করাও। আমি তাদের দেখতে চাই।”
যুধিষ্ঠির গিয়ে ধীরে ধীরে দ্বারপালের কানে কানে বললেন, “কেবলমাত্র উত্তরকেই নিয়ে এসো। বৃহন্নলাকে এখন এনো না। কারণ এই মহাবাহু প্রতিজ্ঞা করেছেন যে যুদ্ধ ছাড়া যে ব্যক্তি আমার রক্তপাত ঘটাবে, সে জীবিত থাকবে না। অর্জুন আমার নাক থেকে রক্ত পড়ছে দেখলে এখনই মন্ত্রী, সৈন্য ও বাহন সমেত বিরাটরাজাকে বিনাশ করবেন।”
বিরাটরাজার জ্যেষ্ঠপুত্র উত্তর এসে পিতাকে প্রণাম করে দেখলেন— যুধিষ্ঠির একপ্রান্তে মাটিতে বসে আছেন, তাঁর নাক থেকে রক্ত ঝরছে, সৈরিন্ধ্রী তাঁর পরিচর্যা করছেন, তাঁর মন ব্যস্ত এবং তাকে অপরাধী বলে উত্তরের মনে হল না। উত্তর অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পিতাকে প্রশ্ন করলেন, “মহারাজ কে এঁকে প্রহার করল? কে এই পাপকার্য করল?”
বিরাটরাজা বললেন, “আমি এই কুটিলকে প্রহার করেছি। এত অল্প প্রহার এর পক্ষে যথেষ্ট নয়। কারণ, আমি তোমার মতো বীরের প্রশংসা করতে থাকলে, এই কুটিল একটা নপুংসকের প্রশংসা করেছে।”
উত্তর বললেন, “মহারাজ! আপনি অনুচিত কার্য করেছেন। সত্বর এঁকে প্রসন্ন করুন। ভয়ংকর ব্রহ্মশাপ যেন বংশের সঙ্গেই আপনাকে দগ্ধ না করে।”
বিরাটরাজা পুত্রের কথা শুনে যুধিষ্ঠিরের কাছে ক্ষমা চাইলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, “রাজা আমি বহু পূর্বেই ক্ষমা করেছি। এখন আর আমার কোনও ক্রোধ নেই। মহারাজ আমার এই রক্ত যদি নাসিকা থেকে ভূমিতে পড়ত, তা হলে নিশ্চয় আপনি রাজ্যের সঙ্গে বিনষ্ট হতেন। আর রাজা আমি আপনার কাজের দোষ ধরছি না, কিন্তু যে লোক নির্দোষ লোককে প্রহার করে, সে লোক গুরুতর ভয় প্রাপ্ত হয়।” যুধিষ্ঠিরের রক্তপাত বন্ধ হলে, বৃহন্নলা প্রবেশ করলেন। তিনি প্রথমে বিরাটরাজাকে অভিবাদন করে, পরে গিয়ে যুধিষ্ঠিরের সেবা করতে লাগলেন।
তখন বিরাটরাজা যুধিষ্ঠিরের ক্ষমা পেয়ে অর্জুনকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে উত্তরের প্রশংসা করতে লাগলেন, “বৎস! সুদেষ্ণার আনন্দবর্ধক! তোমার গর্বেই আমি পুত্রবান হয়েছি! কেন না তোমার মতো পুত্র আমার আর নেই, হবেও না। বৎস যে কর্ণ অব্যর্থলক্ষ্য, সেই কর্ণের সঙ্গে তুমি কীভাবে যুদ্ধ করলে? সমগ্র মর্ত্যলোকে যাঁর বীরত্ব অতুলনীয়, সমুদ্রের মতো যিনি অক্ষুব্ধ, প্রলয়াগ্নির মতো দুঃসহ যে ভীষ্ম, তাঁর সঙ্গে তুমি কীভাবে যুদ্ধ করলে? যে ব্রাহ্মণ, বৃষ্ণি, পাণ্ডব, এমনকী সকল ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রশিক্ষক, সেই দ্রোণাচার্যের সঙ্গে তুমি কীভাবে যুদ্ধ করলে? সকল অস্ত্রধারীর শ্রেষ্ঠ আচার্যপুত্র অশ্বত্থামার সঙ্গে তুমি কীভাবে যুদ্ধ করলে? বিপক্ষ যোদ্ধারা যাঁকে দেখলেই অবসন্ন হয়ে পড়েন, সেই কৃপাচার্যের সঙ্গে তুমি কীভাবে যুদ্ধ করলে? যে দুর্যোধন বাণদ্বারা পর্বত বিদীর্ণ করতে পারেন, তাঁর সঙ্গে তুমি কীভাবে যুদ্ধ করলে? কৌরবদের হস্তগত ধন উদ্ধার করে, তুমি যে শত্রুদের পরাভূত করতে পেরেছ, তা আমার কাছে গ্রীষ্মকালে সুখদায়ক বায়ুস্পর্শ বলেই বোধ হচ্ছে। কর্ণ প্রভৃতি নরশ্রেষ্ঠকে পরাজিত করে তুমি বাঘের মুখ থেকে মাংস ছিনিয়ে নেবার মতো দুঃসাধ্য কাজ করেছ।”
উত্তর বললেন, “আমি গোরুগুলি জয় করিনি, কিংবা শত্রুদেরও জয় করিনি। এক দেবপুত্রই সে কাজ করেছেন। আমি ভীত হয়ে পলায়ন করছিলাম, এই অবস্থায় সেই দেবপুত্ৰই আমাকে বারণ করেছিলেন এবং বজ্রের মতো দৃঢ়শরীর সেই যুবাই আমার রথের উপর অবস্থান করছিলেন। তিনিই গোরুগুলি জয় করেছেন, তিনিই কৌরবদের পরাজিত করেছেন। এ সব তাঁর কাজ, আমার নয়। সেই বলবান দেবপুত্ৰই বাণদ্বারা কৃপ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কর্ণ ও ভীষ্মকে পরাজিত করেছেন। দুর্যোধন পরাজিত হয়ে যখন যূথপতি হস্তীর মতো পলায়ন করছিলেন, তখন সেই দেবপুত্র তাঁকে বলেছিলেন, ‘কৌরবনন্দন! হস্তিনাপুরে নিয়েও তুমি রক্ষা পাবে না। যুদ্ধ করে জীবন রক্ষার চেষ্টা করো। পালিয়ে তুমি মুক্তি পাবে না। আমাকে জয় করতে পারলেই পৃথিবী ভোগ করতে পারবে। অতএব যুদ্ধ করো, না হলে নিহত হয়ে স্বর্গে যাও।’
“তাঁর তীব্র ভর্ৎসনায় রাজা দুর্যোধন ক্রুদ্ধ সর্পের ন্যায় শ্বাস ফেলতে লাগলেন। সেই দেবপুত্র বাণদ্ধারা সাগরতুল্য সেই কৌরবসৈন্যকে পীড়ন করতে লাগলেন। দেখে আমার রোমাঞ্চ ও ঊরুস্তম্ভ হল। সিংহের ন্যায় দৃঢ়শরীর ও বলবান সেই যুবা দেবপুত্র সেই রথীসৈন্যকে পরাভূত করে, কৌরবদের উপহাস করে তাঁদের বস্ত্র সকল অপহরণ করলেন। মত্ত ব্যাঘ্র যেমন হরিণদের জয় করে, তেমনই তিনি একাকী ভীষ্ম প্রভৃতি ছয়জন রথীকে জয় করেছেন।”
বিরাটরাজা বললেন, “যিনি কৌরবদের হস্তগত আমার সকল ধন উদ্ধার করে দিলেন, সেই মহাবাহু ও মহারথ দেবপুত্র কোথায় গেলেন? আমি তাঁকে দেখতে ও পূজা করতে চাই।”
উত্তর বললেন, “পিতা তিনি অন্তর্ধান করেছেন। আমার মনে হয় তিনি কাল বা পরশু আবির্ভূত হবেন।”
এই ঘটনার পর তৃতীয় দিনে যথাকালে ব্রতচারী, মহারথ ও অগ্নির তুল্য তেজস্বী পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই স্নান ও শুক্লবর্ণ বস্ত্র পরিধান করে, রাজকীয় অলংকারে ভূষিত হয়ে, যুধিষ্ঠিরকে অগ্রবর্তী করে, বিরাটরাজার সভায় গিয়ে বিভিন্ন বেদির উপর পাঁচটি অগ্নির মতো পাঁচটি রাজাসনে উপবেশন করলেন। তাঁরা সেই সব আসনে বসলে বিরাটরাজা রাজকার্য করার জন্য সেই সভায় আগমন করলেন। প্রজ্বলিত অগ্নির মতো যুধিষ্ঠিরকে রাজা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত দেখে ক্রুদ্ধ বিরাটরাজা বললেন, “কঙ্ক আমি রাজা; আমি তোমাকে সভাসদ করেছি। এই অবস্থায় তুমি রাজার মতো অলংকৃত হয়ে সিংহাসনে বসেছ কেন?”
অর্জুন বিরাটের সেই প্রশ্ন শুনে ঈষৎ হেসে পরিহাস করার ইচ্ছায় বললেন, “রাজা বেদহিতকারী, শাস্ত্রজ্ঞ, দাতা, যজ্ঞপরায়ণ, দৃঢ়ব্রতশালী এই ব্যক্তি ইন্দ্রের আসনেও বসতে পারেন। ইনি মূর্তিমান ধর্ম, বলবানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিতে জগতের মধ্যে প্রধান এবং পরম তপস্বী। চরাচর সমেত ত্রিভুবনমধ্যে ইনিই নানাবিধ অস্ত্র জানেন; অন্য কোনও পুরুষই এঁর তুল্য অস্ত্র জানে না এবং কখনও জানবে না। দেবগণ, অসুরগণ, মনুষ্যগণ, রাক্ষসগণ, গন্ধর্বগণ, যক্ষগণ, কিন্নরগণ এবং মহানাগগণও এঁর তুল্য নানাবিধ অস্ত্র জানেন না। ইনি পণ্ডিত, মহাতেজা, পুরবাসী ও দেশবাসীদের প্রিয়, অতিরথ, ধর্মপরায়ণ এবং পাণ্ডবদের রাজা। ইনি ত্রিভুবনতুল্য বিখ্যাত মহর্ষিতুল্য রাজর্ষি, বলবান, ধৈর্যশীল, কোমলস্বভাব, সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয়। ইনি ধনে ও গুণে ইন্দ্র ও কুবেরের তুল্য। মনু যেমন অনুগ্রহপূর্বক লোকরক্ষা করেন, এই মহাতেজাও তেমনই অনুগ্রহপূর্বক লোকরক্ষা করেন। ইনি কৌরবশ্রেষ্ঠ কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির। এঁর কীর্তি দিবা সূর্যের মতো জগৎ ব্যাপী। এঁর যশের কিরণও দশদিক ব্যাপ্ত। যখন ইনি কুরুদেশে অবস্থান করতেন, বলবান দশ সহস্র হস্তী এঁর পিছনে পিছনে যেত। স্বর্ণমালা শোভিত ত্রিশ হাজার উৎকৃষ্ট অশ্ব এঁর পিছনে যেত। আটশো স্তুতিপাঠক প্রত্যহ এঁর স্তব করত। দেবগণ যেমন কুবেরের উপাসনা করেন, তেমনই কৌরবেরা ও রাজারা এঁর উপাসনা করতেন। অধীন বা অনধীন সমস্ত রাজাই এঁকে কর দিতে বাধ্য থাকতেন। অষ্টাশি হাজার গৃহস্থ এঁর কাছে ব্রতচারী জীবন ধারণ করত। বৃদ্ধ, অনাথ, অঙ্গহীন, পঙ্গু মানুষদের ইনি সন্তানের মতোই পালন করতেন। ইনি সর্বদাই ধর্মনিরত, ইন্দ্রিয়দমন নিরত, ক্রোধে সংযত, ব্রাহ্মণ হিতকারী ও সত্যবাদী। দুর্যোধন এঁরই সম্পদ ও প্রতাপ দেখে আত্মীয়গণ, কর্ণ ও শকুনির সঙ্গে সন্তপ্ত হতেন। এঁর গুণের সংখ্যা করতে পারা যায় না। ইনি সর্বদাই ধর্মপরায়ণ ও দয়ালু। অতএব মহারাজ! এইরূপ গুণসম্পন্ন ও পুরুষশ্রেষ্ঠ রাজা কেন রাজার যোগ্য আসনে বসবেন না।”
বিরাটরাজা বললেন, “ইনি যদি কুরুবংশীয় কুন্তীনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির হন, তবে এঁর ভ্রাতা অর্জুন কোথায়? বলবান ভীমসেন কোথায়? নকুল ও সহদেব কোথায়? যশস্বিনী দ্রৌপদীই বা কোথায়? পাণ্ডবেরা দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হবার পর, আজ পর্যন্ত আমরা তাঁদের আর কোনও খবর পাইনি।”
অর্জুন বললেন, “নরনাথ! আপনার পাচক ‘বল্লব’ই মহাবাহু এবং ভয়ংকর বেগ ও পরাক্রমশালী ভীমসেন। ইনি গন্ধমাদন পর্বতে ‘ক্রোধবশ’ নামক রাক্ষসদের পরাজিত করে দ্রৌপদীর জন্য ‘সৌগন্ধিক’ নামে স্বর্গীয় পুষ্প নিয়ে এসেছিলেন। ইনিই দুরাত্মা কীচক ও তার ভ্রাতাদের নিধনকারী। আপনার অন্তঃপুরে ইনিই ব্যাঘ্র, ভল্লুক ও বরাহদের বধ করেছেন। মহারাজ! যিনি আপনার অশ্ববন্ধক ছিলেন, তিনিই এই পরন্তপ নকুল। যিনি আপনার গো-পরীক্ষক ছিলেন, তিনি এই সহদেব। এঁরা মাদ্রীর পুত্র, মহাবল, শৃঙ্গার, উপযোগী বেশভূষা যুক্ত, রূপবান, যশস্বী ও নানাবিধ বিপক্ষ রথীদের নিবারণে সমর্থ। রাজা এই পদ্মপলাশনয়না, সুমধ্যমা, সুন্দরহাসিনী সৈরিন্ধ্রীই দ্রৌপদী; যাঁর জন্য কীচকেরা নিহত হয়েছে। আর মহারাজ ভীমের কনিষ্ঠ ও নকুল-সহদেবের জ্যেষ্ঠ পৃথাপুত্র অর্জুনই আমি। সম্ভবত আমার বিষয়ে আপনি শুনেছেন। মহারাজ সন্তান যেমন মায়ের উদরে থাকে, আমরা তেমনই সুখে অজ্ঞাতবাস কালটি আপনার গৃহে কাটিয়েছি।”
অর্জুন যখন বীর পঞ্চ-পাণ্ডবের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলেন, তখন উত্তর পাণ্ডবদের দেখিয়ে পিতাকে বলতে লাগলেন, “এই যাঁর দেহটি স্বর্ণের ন্যায় নির্মল ও গৌরবর্ণ, নাসিকাটি সুদীর্ঘ, নয়ন যুগল স্থূল, দীর্ঘ ও তাম্রবর্ণ, মহাসিংহের ন্যায় বিশালাকৃতি এই পুরুষটিই সেই কুরুরাজ যুধিষ্ঠির। আর যাঁর দেহটি তপ্ত কাঞ্চনের মতো নির্মল ও গৌরবর্ণ, মত্তহস্তীর ন্যায় গমন, দুই কাঁধ স্থূল ও দীর্ঘ, বাহুযুগল অত্যন্ত আয়ত, ইনিই সেই ভীমসেন। এঁর পাশে এই যে শ্যামবর্ণ, হস্তীযূথপতিতুল্য, যাঁর কাঁধ সিংহের মতো উন্নত, হস্তীর খেলার ন্যায় যাঁর গতি, পদ্মপত্রের মতো আয়তনয়ন, এই বীর সেই মহাধনুর্ধর অর্জুন। আর কুরুরাজ যুধিষ্ঠিরের দুই পাশে যে দুটি পুরুষ রয়েছেন, সমগ্র মর্ত্যলোকেও রূপে, বলে ও স্বভাবে যাঁদের তুল্য কেউ নেই, এঁরাই বিষ্ণু ও ইন্দ্রের তুল্য সেই নকুল ও সহদেব। আর, যাঁর মাথায় স্বর্ণালংকার আছে, যিনি মানুষী মূর্তিধারিণী প্রিয়ঙ্গু কুসুমকান্তির ন্যায় শোভমানা, নীল উৎপলের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণা, নগরদেবীর মতো বিরাজমানা এবং মূর্তিমতী নীল পদ্মকান্তির মতো এঁদের পাশে অবস্থিতা আছে—ইনি দেবী দ্রৌপদী।
“এই মৃগহন্তা সিংহের মতো শত্রুহন্তা অর্জুন সেই প্রধান কৌরবদের পরাজিত করে আপনার গো-ধন উদ্ধার করেন। এঁরই শঙ্খনাদে আমার কর্ণযুগল বধির হবার উপক্রম হয়েছিল। এঁরই একটি বাণে মহাহস্তীর শুণ্ড ভেদ করে, দেহ ভেদ করে, পুঙ্খ ভেদ করে বার হয়ে যায়। সেই হস্তী নিহত হয়ে দন্তযুগলদ্বারা ভূতল স্পর্শ করে পতিত হয়।”
যুধিষ্ঠিরের কাছে অপরাধী মৎস্যরাজ বিরাট উত্তরকে বললেন, “উত্তর আমি মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সন্তুষ্টি বিধান করতে চাই। তোমার মত হলে আমি কন্যা উত্তরাকে অর্জুনের হাতে সমর্পণ করতে চাই।”
উত্তর বললেন, “পিতা পাণ্ডবেরা পূজনীয়, সজ্জন, আদরণীয়। এঁদের যথোচিত সন্তোষ বিধান করা কর্তব্য। আপনি, পূজনীয় ও মহাত্মা পাণ্ডবদের পূজা করুন।”
বিরাটরাজা বললেন, “আমিও যুদ্ধে শত্রুদের বশীভূত হয়েছিলাম। এই ভীমসেন আমাকে মুক্ত করে এনেছেন এবং গোরুগুলিও জয় করেছেন। এঁদের বাহুবলেই আমাদের জয়ের কারণ হয়েছে। অতএব আমরা সমস্ত মন্ত্রীগণের সঙ্গে মিলিত হয়েই পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির ও তাঁর ভ্রাতৃবর্গের প্রসন্নতাবিধান করব। যুধিষ্ঠির ধর্মাত্মা। তিনি আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন।”
পরমানন্দিত বিরাটরাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে মিলিত হয়ে চিরকালীন সৌহার্দ্যের বিষয় প্রতিজ্ঞা করলেন। বিরাট তাঁরই সৈন্য, কোষ ও রাজধানী যুধিষ্ঠিরকে দান করার প্রার্থনা করলেন। প্রতি প্রফুল্লচিত্ত বিরাট বারবার যুধিষ্ঠির, ভীম, ও অর্জুন, নকুল ও সহদেবের মস্তক আঘ্রাণ করলেন, আলিঙ্গন করলেন, তাঁদের বারবার দেখেও তাঁর যেন তৃপ্তি হচ্ছিল না। তিনি আবার প্রস্তাব করলেন যে, সব্যসাচী অর্জুন উত্তরার পাণিগ্রহণ করুন। যুধিষ্ঠির অর্জুনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে, অর্জুন মৎস্যরাজাকে বললেন, “আমি আপনার কন্যাকে পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করব। আমি অন্তঃপুরে থেকে সর্বদাই আপনার কন্যাকে দেখেছি, সে পিতার মতো আমাকে বিশ্বাস করেছে। বিশেষত এক বৎসর আমি এই যুবতীর সঙ্গে বাস করেছি। লোকেরা এই নিয়ে আলোচনা করবে। কন্যা অথবা পুত্রবধূর সঙ্গে একত্রে থাকলে দোষ হয় না। এতে আমার ও উত্তরার নির্দোষিতা প্রমাণ হবে। আমার পুত্র মহাবাহু অভিমন্যু, চক্রপাণি শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় ভাগিনেয়, তার আকৃতি দেববালকের মতো সুন্দর। বাল্য অবস্থাতেই সে সকল শাস্ত্রে বিশারদ হয়েছে। সে আপনার উপযুক্ত জামাতা হবে এবং আপনার কন্যার উপযুক্ত ভর্তা হবে।”
অর্জুনের এই প্রস্তাব উপস্থিত সকলেই অনুমোদন করলেন। তারপর বিরাটরাজা ও যুধিষ্ঠির সকল আত্মীয় ও কৃষ্ণের কাছে নিমন্ত্রণপত্র পাঠালেন।
ততস্ত্রয়োদশে বর্ষে নিবৃত্তে পঞ্চ পাণ্ডবাঃ।
উপপ্লব্যং বিরাটস্য সমপদ্যন্ত সর্বশঃ॥ বিরাট : ৬৭ : ১৪ ॥
“তারপর ত্রয়োদশ বৎসর অতীত হলে পর পঞ্চ-পাণ্ডবেরা সকলেই বিরাটরাজারই উপপ্লব্য নগরে গমন করলেন।”
*
পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হল। ধর্মপরায়ণ, সত্যবাদী পাণ্ডবগণ কপট দ্যূতে পরাজিত হলেও শর্ত পালন করলেন। এইবার প্রত্যাশিত বিপক্ষ নেতৃবর্গ বীরধর্ম পালন করবেন। বিশেষত যে পক্ষে শ্রেষ্ঠ ধর্মরক্ষক ভীষ্ম আছেন, দুই শ্রেষ্ঠ গুরু দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য আছেন, আছেন আত্ম-অভিমানী রাজা দুর্যোধন ও বীরশ্রেষ্ঠ কর্ণ। এঁদের প্রত্যেকের ভূমিকা আমরা পরবর্তী পর্যায়ে দেখতে পাব।
অজ্ঞাতবাস সমাপ্ত হল। বনবাসের শেষ দিনে যক্ষরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন যে, অজ্ঞাতবাস বৎসরে তাঁদের কেউ চিনতে পারবে না। ধর্মের আশীর্বাদ সত্য হল। আত্মপ্রকাশ অংশটি মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত। প্রথমত, এই প্রথম পাঠক যুধিষ্ঠিরের রক্তপাত দেখলেন। ধর্ম আশীর্বাদ করেছিলেন, পৃথিবীর ত্রিতাপ দুঃখ—জরা-ব্যাধি-মৃত্যু যুধিষ্ঠিরকে স্পর্শ করবে না। করেওনি। কিন্তু পাশক ক্রীড়াও যুধিষ্ঠিরের পক্ষে কল্পনা করতে আমাদের ভাল লাগে না। এমনকী, সমাজের উচ্চবর্গে, দেব-সমাজে, পার্বতী-মহেশ্বর পাশা ক্রীড়া করলেও যুধিষ্ঠিরকে আমরা এই ব্যসন থেকে মুক্তি দিতে চাই। যুধিষ্ঠির মুক্তি পেলেনও, কিন্তু নাক থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত ঝরিয়ে। যুধিষ্ঠির আরও ছত্রিশ বৎসর জীবিত ছিলেন। রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু আর একদিনও পাশা খেলেননি। দ্বিতীয়ত, অর্জুনের মুখে পাঠক শুনলেন যুধিষ্ঠিরের সেই গুণ। সমগ্র জীবন যুধিষ্ঠির যা প্রকাশ করতে চাননি। পাঠক জানলেন, যুধিষ্ঠির সর্ব অস্ত্রবিদ। মানবজাতির কোনও পুরুষের অস্ত্রজ্ঞান যুধিষ্ঠিরের থেকে বেশি নয়। দেব, অসুর, মনুষ্য, রাক্ষস, গন্ধর্ব, যক্ষ, কিন্নর ও মহানাগগণও অস্ত্রবিদ্যায় যুধিষ্ঠিরের সমকক্ষ নন। মহাভারতের শল্য পর্বে এক দিনই সর্বাস্ত্রবিদ যুধিষ্ঠিরকে পাঠক দেখেছিলেন, অতিরথ শল্যকে বধ করার সময়ে। যুধিষ্ঠির নিজেই এ বিদ্যার প্রকাশ চাননি কখনও। অৰ্জুন না বললে তা হয়তো পাঠক জানতেও পারতেন না কখনও। তৃতীয়ত, অভিমন্যু-উত্তরার বিবাহ উপলক্ষে পাণ্ডবদের মিত্র সংখ্যা বাড়ল। মৎস্যদেশের সঙ্গে সম্পূর্ণ সখ্য সম্পর্ক ঘটল। চতুর্থত, আমরা দেখলাম যুধিষ্ঠিরের ‘ভ্রাতাশ্চ-শিষ্যশ্চ’ অর্জুনের ধর্মপরায়ণ লোকাচার পালক, বেদবিৎ সুন্দর মূর্তিটি। উত্তরার সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাবকে তিনি কেন অসমীচীন বোঝালেন, আবার মৎস্যদেশের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করলেন পুত্র অভিমন্যুর সঙ্গে উত্তরার বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে।
৫৪
সঞ্জয়ের দৌত্য
[উপপ্লব্য নগরে অভিমন্যু-উত্তরার বিবাহ উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধব সকলে সমবেত। সমবেত হলেন কৃষ্ণ-বলরাম প্রদ্যুম্ন শাম্ব সাত্যকি। দ্রুপদ রাজার উপস্থিতিতে বিবাহ সম্পন্ন হল। আলোচনান্তে স্থির হল দ্রুপদ রাজার পুরোহিত দূত হিসাবে হস্তিনাপুরে যাবেন ও যুধিষ্ঠিরের পক্ষে রাজ্য দাবি করবেন। এদিকে দ্রুপদ-পুরোহিতকে দৌত্যে পাঠিয়ে অর্জুন দ্বারকায় কৃষ্ণকে বরণ করতে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন দুর্যোধন নিদ্রিত কৃষ্ণের মাথার কাছে বসে আছেন, অর্জুন তখন পায়ের কাছে বসলেন। কৃষ্ণ জেগে উঠে উভয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে কনিষ্ঠ বলে অর্জুনের প্রার্থনা প্রথমে শুনতে চাইলেন। অর্জুন কৃষ্ণকে বরণ করতে চাইলেন। কৃষ্ণ জানালেন একদিকে নিরস্ত্র তিনি, অন্যদিকে তাঁর দশ কোটি নারায়ণী সৈন্য থাকবেন। অর্জুন কৃষ্ণকেই চাইলেন, দুর্যোধন আনন্দিত হয়ে দশ কোটি নারায়ণী সৈন্য গ্রহণ করে চলে গেলেন। অর্জুন কৃষ্ণকে সারথিরূপে চাইলেন, কৃষ্ণ সম্মত হলেন। ওদিকে দ্রুপদ-রাজপুরোহিত কৌরব সভায় গিয়ে যুধিষ্ঠিরের রাজ্য দাবি জানালেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, যুধিষ্ঠিরের উপর বহু অন্যায় হয়েছে, এখন রাজ্য তাঁর প্রাপ্য। ধৃতরাষ্ট্র পুরোহিতকে প্রস্থান করতে বললেন। বললেন, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে পাণ্ডবদের জানাবেন।]
ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ পালন করে সঞ্জয় দূত হিসাবে পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করতে উপপ্লব্য নগরে উপস্থিত হলেন। সঞ্জয় যুধিষ্ঠিরকে নীরোগ, সহায়শালী দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। তিনি বললেন, “মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আপনার, আপনার ভ্রাতাদের, দ্রৌপদী ও তাঁর পুত্রদের কুশল কামনা করেছেন। তিনি আপনার আত্মীয়বর্গের কুশল কামনা করেছেন।” যুধিষ্ঠির গবল্গনন্দনের কুশল প্রার্থনা করে বললেন, “আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতে তোমার কষ্ট হয়নি তো? তোমাকে দেখে আমরা অত্যন্ত আনন্দলাভ করলাম। অনুজগণের সঙ্গে আমি কুশলেই আছি। দীর্ঘকাল পরে ভরতবংশীয়দের মঙ্গল সংবাদ পেয়ে, আর তোমাকে দেখে যেন ধৃতরাষ্ট্রকেই দেখছি বলে মনে হচ্ছে।” যুধিষ্ঠির, ভীষ্ম, দ্রোণ, মহারাজ বাহ্লিক, সোমদত্ত, ভূরিশ্ৰবা, শল, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, যুযুৎসু, বৃদ্ধ স্ত্রীলোকগণ, জননীগণ, পাচিকাগণ, দাসীগণ, পুত্রবধূগণ, পুত্র, ভাগিনেয়, ভগিনীগণ ও দৌহিত্রগণ—প্রত্যেকের কুশল কামনা করলেন। ধৃতরাষ্ট্র যশকারক রাজকার্য চালাচ্ছেন কি না জানলেন, প্রার্থীদের মনোরথ পূর্ণ হচ্ছে কি না, তাও জিজ্ঞাসা করলেন। জানতে চাইলেন ভ্রাতাসহ যুধিষ্ঠিরের প্রতি তাঁর পূর্বস্নেহ আছে কি না।
এরপর যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন, “মেঘের তুল্য গম্ভীর শব্দকারী অর্জুনের বাণগুলি কৌরবেরা স্মরণ করেন তো? অর্জুনের তুল্য কিংবা তাঁর অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী কোনও যোদ্ধা পৃথিবীতে নেই, কারণ অর্জুন একবারে একষট্টিটি বাণ নিক্ষেপ করতে পারেন। গদাধারী বলবান ভীমসেনকে কৌরবেরা স্মরণ করেন তো? যে সহদেব দক্ষিণ ও বামহস্তে অস্ত্ৰক্ষেপ করে কলিঙ্গ-সৈন্যদের পরাজিত করেছিলেন, সেই সহদেবকে কৌরবেরা স্মরণ করেন তো? নকুল সমস্ত পশ্চিম দিক জয় করে আমার বশে এনেছিলেন, কৌরবগণ সেই নকুলকে স্মরণ করেন তো? দুর্যোধন প্রভৃতি ঘোষযাত্রায় গিয়ে মূর্খতাবশত গন্ধর্বগণ দ্বারা বশীভূত হয়েছিলেন। পরে ভীম ও অর্জুন তাদের উদ্ধার করেন। আমি যজ্ঞে ব্রতী থাকায় রক্ষাহোম দ্বারা অর্জুনের পৃষ্ঠ রক্ষা করছিলাম। পরে অর্জুন অক্ষতদেহে শত্রু বিজয় করে ফিরে আসেন। কৌরবেরা সেই বৃত্তান্ত স্মরণ রাখেন তো?”
সঞ্জয় বললেন, “পাণ্ডুনন্দন কৌরবশ্রেষ্ঠ! আপনি যে যে পরিজনের কুশল প্রশ্ন করলেন, তাঁরা কুশলেই আছেন। আপনি অবগত আছেন যে, দুর্যোধনের কাছে সাধুস্বভাব বৃদ্ধেরাও আছেন, আবার পাপাত্মারাও আছেন। সুতরাং আপনি ব্রাহ্মণদের জন্য যে বৃত্তি প্রদান করতেন, তা এখনও তেমনই করা হয়। আপনারা দুর্যোধনের কোনও অপকার করেননি, তবুও তিনি আপনাদের বিষয়ে অপকারীর মতো অধর্মের কাজ করেছেন, তা তাঁর পক্ষে ভাল হয়নি। ধৃতরাষ্ট্র কখনও অনুতাপ করেন, কখনও অমঙ্গল আশঙ্কা করেন কিন্তু সন্ধির প্রস্তাব দেন না। যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠলেই কৌরবেরা আপনাকে, অর্জুনকে এবং ভীমকে স্মরণ করেন। মানুষের ভবিতব্য কেউ বলতে পারে না—কারণ, আপনি নির্দোষ হয়েও ব্রতস্বরূপ এত কষ্ট ভোগ করেছেন। অজাতশত্রু রাজা, কষ্টে পড়লেও আপনার বুদ্ধি দ্বারাই বৈষম্যের মধ্যে সাম্য স্থাপনে সামর্থ্য। পাণ্ডুপুত্রেরা ইন্দ্রতুল্য। ভোগের জন্য তাঁরা ধর্ম ত্যাগ করবেন না। যাতে ধৃতরাষ্ট্রের ও পাণ্ডু-পুত্রের মধ্যে সাম্য স্থাপন হয়, তা বুদ্ধির বলে আপনি একাই করতে পারেন। মহারাজ আমি ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর পুত্রদের বক্তব্য আপনার কাছে নিবেদন করব।” যুধিষ্ঠির জানালেন যে পাণ্ডব, সঞ্জয়, কৃষ্ণ, সাত্যকি ও বিরাট উপস্থিত আছেন। সুতরাং সঞ্জয় নির্ভয়ে আপন বক্তব্য বলতে পারেন।
সঞ্জয় বললেন, “যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, বসুদেবনন্দন কৃষ্ণ, সাত্যকি, চেকিতান, বিরাট, বৃদ্ধ পাঞ্চাল রাজা এবং পৃষ্ণনন্দন ধৃষ্টদ্যুম্ন—আমি সকলকে সম্বোধন করছি। কুরুকুলের মঙ্গলের জন্য আমি যা বলব, আপনারা তা শ্রবণ করুন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র শান্তি চান, শান্তি কামনা করেই তিনি আমার রথের যোজনা করে অতি দ্রুত এখানে পাঠিয়েছেন। পাণ্ডবগণ আপনারা সর্বপ্রকার ধর্ম, বীরযোগ্য আকৃতি, কোমলতা ও সরলতা যুক্ত এবং সদ্বংশে জাত। আপনারা নিষ্ঠুর নন, দাতা ও লজ্জাশীল এবং কর্মফলও জানেন। অতএব জ্ঞাতিবধরূপ নিষ্ঠুর কার্য আপনাদের করা উচিত নয়, আর নিষ্ঠুর কার্য করা আপনাদের স্বভাব নয়। জ্ঞাতিবধের কলঙ্ক আপনাদের শুভ্র বস্ত্রে কালি লাগাবে। যে যুদ্ধে সর্বনাশ, পাপ ও স্বাভাবিক নরকের সম্ভাবনা, সেই যুদ্ধে জয়-পরাজয় দুই সমান। কোনও বুদ্ধিমান লোক সেই যুদ্ধের আয়োজন করেন না।
“জ্ঞাতির উপযুক্ত কাজ যাঁরা করেন, তাঁরাই ধন্য, তাঁরাই পুত্র, সুহৃদ ও বান্ধব। সম্ভবত এই যুদ্ধ হলে দুর্যোধন প্রভৃতি নিন্দিত কৌরব ও তাঁদের সহায়তাকারীরা মৃত্যুবরণ করবে। তাতে তো তাঁদের মঙ্গলই হবে। বিরোধী সকল কৌরবকে বধ করে, আপনাদের সে জ্ঞাতিবধবশত জীবন মৃত্যুরই তুল্য। আবার কোন লোকের পক্ষে কৃষ্ণ, চেকিতান, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকির সঙ্গে আপনাদের জয় করতে পারবে? আবার ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, শল্য প্রভৃতি বীরগণ রক্ষিত কৌরবদেরই বা সহজে কে জয় করতে পারবে? নিজে অক্ষত থেকে দুর্যোধনের বিশাল বাহিনী ধ্বংস করার সম্ভাবনাও অল্প। সুতরাং আমি আপনাদের জয়ে বা পরাজয়ে কোনও মঙ্গল দেখতে পাচ্ছি না। নীচ বংশজাত নীচ লোকেদের মতো পাণ্ডবেরা কী করে ধর্ম ও অর্থশূন্য জ্ঞাতিবধরূপ কাজ করতে পারেন? আমি কৃষ্ণ ও বৃদ্ধ দ্রুপদরাজার কাছে প্রণত হয়ে নিবেদন করছি কুরুবংশ ও সৃঞ্জয়বংশের মঙ্গলের পথ আপনারা দেখুন। আমি কৃতাঞ্জলি হয়ে আপনাদের শরণাপন্ন হলাম। কৃষ্ণ ও অর্জুন যে আমার কথা শুনবেন না, এ হতে পারে না। কারণ প্রার্থনা করলে এঁরা প্রাণ পর্যন্ত দিতে পাবেন, অন্য বস্তু দিতে পারবেন না কেন? আমি সন্ধি স্থাপনের জন্য বলছি। ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্রেও তাই মত।”
যুধিষ্ঠির বললেন, “সঞ্জয় তুমি আমার মুখে যুদ্ধের অভিপ্রায়সূচক কোনও কথা শুনেছ, যে তুমি যুদ্ধ থেকে ভয় পাচ্ছ। সন্ধি সর্বদাই যুদ্ধের থেকে ভাল। একথা জেনেও কোন মূর্খ যুদ্ধ করতে যায়? আমি জানি, মনের ইচ্ছা অনুযায়ী ফল পেলে, সে আর উপযোগী কর্ম করে না। এমনকী যুদ্ধ ছাড়া অল্প পেলেও, তাকেই সে যথেষ্ট মনে করে। অন্য উপায় থাকলে মানুষ যুদ্ধ করবে না। দৈব অভিশপ্ত কোন লোকই বা স্বেচ্ছায় যুদ্ধবরণ করে? সুতরাং সুখাভিলাষী পাণ্ডবেরা ধর্মসঙ্গত ও লোকহিতকর কার্য করে থাকেন। পাণ্ডবেরা ধর্মপথেই সুখ চান। কষ্টসাধ্য ও দুঃখজনক যুদ্ধের কামনা করেন না। ভোগের আনন্দ যে চায়, সে দুঃখ বিনাশ করে সুখই চায়। বিষয়ের অভিলাষ মানুষের দুঃখের কারণ হয়, বিষয়ের অভিলাষ মানুষের শরীর দগ্ধ করে। অগ্নি যেমন বাতাসের দ্বারা বর্ধিত হয়, ভোগেও তেমনই বিষয়ের অভিলাষ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। জ্বলন্ত আগুন ধৃত পেয়ে তৃপ্তি লাভ করে না। মানুষও তেমনই কাম ও অর্থলাভ করে তৃপ্তি পায় না। বিশাল ভোগরাশি পেয়েও পুত্রদের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের তৃপ্তিলাভ হয়নি।
“যে লোক শ্রেষ্ঠ নয়, সে অধিক ভোগ করতে পারে না। অপ্রধান লোক গীত শ্রবণ করে না, মাল্য, গন্ধ ও অনুলেপন সেবন করতে পারে না এবং তাঁরা উত্তম বস্ত্রও পরতে পারে না। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র কৌরবদের সম্পত্তি থেকে আমাদের বঞ্চিত করবেন। কী আশ্চর্য! সেই বঞ্চনার জন্যই দুর্যোধনের ইচ্ছা জন্মেছে, সেই ইচ্ছা প্রতিনিয়ত তাকে দগ্ধ করছে। রাজা ধৃতরাষ্ট্র সংকটে পড়েছেন। তিনি পরের শক্তি যাচাই করতে চাইছেন, নিজের শক্তি বুঝতে পারছেন না। বুদ্ধিমান লোক নিজের চরিত্র যেমন দেখেন, পরের চরিত্রও তেমনই দেখেন। মানুষ যেমন তৃণরাশিতে আগুন দিয়ে, নিজেই পালাবার পথ পায় না, দুর্যোধনেরও সেই একই অবস্থা ঘটেছে। রাজা ধৃতরাষ্ট্র অতুল ঐশ্বর্য লাভ করেও দুর্বুদ্ধি, কুটিলপ্রকৃতি, মূর্খ, বিকৃতচিত্ত এবং কুমন্ত্রীগণে পরিবেষ্টিত পুত্র দুর্যোধনকে আশ্রয় করে এখন কেন বিলাপ করছেন? দুর্যোধন ও তার স্বভাব জানা ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের বাক্য অগ্রাহ্য করে অধর্মকে আশ্রয় করে চলছেন। বিদুর বুদ্ধিমান, কৌরবগণের হিতৈষী, বহু শাস্ত্রজ্ঞ, বাগ্মী ও সচ্চরিত্র। তবুও রাজা ধৃতরাষ্ট্র মন্ত্রণাকালে সেই বিদুরকেই বাদ দিয়েছিলেন।
“সঞ্জয়, দুর্যোধন মানীগণের মান নষ্ট করে, অথচ নিজে মান কামনা করে। ধর্ম ও অর্থ অতিক্রম করে। দুর্যোধন, দুঃসাহসী, কটুভাষী, ক্রোধীগণের অনুগামী, লোভী, দুর্জনসেবী, অবিনীত, অমঙ্গলস্বভাব, চিরক্রোধী, মিত্রদ্রোহী ও পাপবুদ্ধি। সেই কারণে বিদুরের বক্তব্য দুর্যোধনের ভাল লাগে না। আর কৌরবেরা বিদুরের মতের অনুসরণ না করে, আপনাদের ধ্বংসকেই ডেকে এনেছে। বর্তমানে অর্থলোভী দুর্যোধনের সকল পরামর্শদাতা—দুঃশাসন, শকুনি ও কর্ণ। ধৃতরাষ্ট্র, বিদুরকে সরিয়ে দিয়ে ছল করে আমাদের রাজ্য কেড়ে নিয়েছিলেন। সুতরাং এখন কীভাবে পাণ্ডব ও কৌরবদের মঙ্গল হবে, তা আমি বুঝতে পারছি না। আমরা বনে চলে গেলে ধৃতরাষ্ট্র ও দুর্যোধন সমস্ত ধনই নিজেদের বলে মনে করেছিলেন। তাঁরা সমগ্র পৃথিবীতে একটি বিশাল রাজ্যলাভের আশা করেছিলেন। এখন তাঁদের কাছ থেকে শান্তি পাবার কোনও পথই নেই।
“যুদ্ধে সশস্ত্র অর্জুনকে জয় করতে পারবে বলে কর্ণ মনে করে, কিন্তু তা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কারণ, পূর্বেও অনেকগুলি গুরুতর যুদ্ধ হয়ে গেছে। সেগুলি কর্ণ দুর্যোধন প্রভৃতিকে আশ্রয় দিতে পারেনি। কর্ণ, দুর্যোধন, দ্রোণ, ভীষ্ম প্রমুখ কৌরব রক্ষীরা সকলেই জানেন যে অর্জুন তুল্য মহাধনুর্ধর পৃথিবীতে দ্বিতীয় নেই। সেই অর্জুন উপস্থিত থাকতেও যে রাজ্য দুর্যোধনের হাতে গিয়েছিল, তার কারণ সকলেরই জানা। কিন্তু এখন অর্জুন ধর্মপাশমুক্ত। মূর্খ দুর্যোধন এখনও মনে করে বিশাল গাণ্ডিবধারী ও ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে পাণ্ডবদের যে রাজ্য হরণ করেছে সেই পাণ্ডবপ্রাপ্য সে নিজের অধিকারে রাখতে পারবে। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা যতক্ষণ গাণ্ডিবের বিশাল টংকারধ্বনি না শুনছে ততক্ষণই জীবিত থাকছে। আর দুর্যোধনও যতক্ষণ গদাহস্তে ক্রুদ্ধ ভীমসেনকে না দেখছে, ততক্ষণই অভীষ্ট বিষয়কে সিদ্ধ বলে মনে করছে। বীর ও সহিষ্ণু ভীমসেন, অর্জুন, নকুল, সহদেব জীবিত থাকতে, ইন্দ্রও আমাদের ঐশ্বর্য হরণ করতে পারবেন না। বৎস সঞ্জয়, বৃদ্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র যদি দুর্যোধনের সঙ্গে পাণ্ডবদের প্রাপ্য রাজ্য ফিরিয়ে দেন, তা হলে তারা পাণ্ডব কোপানলে বিনষ্ট হয়ে যাবেন না।
অদ্যাপি ত্বমাত্থ তথৈব বৰ্ত্ততাং শান্তিং গমিষ্যামি যথা তত্তত্র।
ইন্দ্রপ্রস্থে ভবতু মমৈব রাজ্যং সুযোধনো যচ্ছতু ভাবতাগ্র্যঃ ॥ উদ্যোগ : ২৬ : ২৯ ॥
এখনও সেখানে পূর্বের শান্তি সম্ভাব বজায় থাকবে, তুমি যেমন বলছ, তেমনই সন্ধি হবে। ভরতশ্রেষ্ঠ দুর্যোধন আমার ইন্দ্রপ্রস্থ ফিরিয়ে দিন, তা আমার রাজ্য হোক।”
সঞ্জয় বললেন, “পাণ্ডুনন্দন পার্থ আপনার সকল কাজেই সর্বদা ধর্ম অক্ষুণ্ণ থাকে; এ আমি লোকমুখে শুনেছি, প্রত্যক্ষও দেখছি। কিন্তু আপনি একটু ভেবে দেখুন, মানুষের জীবন অনিত্য এবং প্রত্যহ গুরুতর বিঘ্নে পরিপূর্ণ। কাজেই, আপনি ধর্ম নষ্ট করবেন না।
ন চেদ্ভাগং কুরবোহন্যত্র যুদ্ধাৎ প্রয়চ্ছেরংস্তুভ্যম-জাতশত্রো।
ভিক্ষচর্যামন্ধকবৃষ্ণিরাজ্যে শ্রয়ো মন্যে ন তু যুদ্ধেন রাজ্যম্ ॥ উদ্যোগ : ২৭ : ২ ॥
অজাতশত্রু! কৌরবেরা যদি যুদ্ধ ছাড়া আপনাকে রাজ্যের ভাগ না দেন, তা হলে অন্ধক ও বৃষ্ণিদের রাজ্যে ভিক্ষা করাও আপনার পক্ষে ভাল মনে করি; কিন্তু যুদ্ধ করে আপনার রাজ্য লাভ করা ভাল মনে করি না।
“মানুষের জীবন অল্পস্থায়ী, বিঘ্নে পরিপূর্ণ, সর্বদা দুঃখময় ও চঞ্চল। যুদ্ধ আপনার যশের সহায়ক নয়। পাণ্ডুনন্দন আপনি পাপজনক যুদ্ধ করবেন না। রাজা, ধর্মাচরণের বিঘ্নসৃষ্টিকারী বস্তুকেই মানুষেরা আঁকড়ে ধরে; বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাই কামনাকেই বিনষ্ট করেন। তাঁরা নির্মল প্রশংসার অধিকারী হন। জগতে অর্থতৃষ্ণাই রজ্জু, তা মানুষকে ধর্মভ্রষ্ট করে। কিন্তু যে লোক অর্থ নয়, ধর্মকেই বরণ করে, সে-ই বুদ্ধিমান। ধর্ম, অর্থ, কামের মধ্যে যে ব্যক্তি ধর্মকে গ্রহণ করে, সেই সূর্যের মতো দীপ্তিমান হয়। ধর্মহীন পাপবুদ্ধি লোক পৃথিবী পেলেও অবসন্ন হয়ে পড়ে। যে লোক স্বর্গলাভে বিশ্বাসী হয়ে বেদ অধ্যয়ন, ব্রহ্মচর্য, যজ্ঞ ও ব্রাহ্মণগণকে দান করে, সে বহুকালের জন্যই সুখভোগে আত্মসমর্পণকারী। যে লোক এগুলি করে না, সে দুঃখশয্যা ভোগ করে। পরলোকে অবিশ্বাসী ব্যক্তিরা ধন উপার্জন করে, কিন্তু ধর্মত্যাগ করে অধর্মই করতে থাকে। সেই বিকৃতচিত্ত মূর্খ লোক দেহত্যাগ করে পরলোকে গিয়ে কেবল দুঃখই ভোগ করে।
“রাজা পরলোকে পাপ-পুণ্য দুই কর্তার আগে গমন করে। কর্তা পরে যান। লোকে বলে সমস্ত জীবন আপনি উত্তম দক্ষিণাযুক্ত বৃদ্ধি শ্রাদ্ধ প্রভৃতি করেছেন। সজ্জনেরা যে সকল কার্য উত্তম ফলদায়ক বলে চিহ্নিত করেন, সব পুণ্যকর্মই আপনি করেছেন। মানুষ পরলোকে জরা, মৃত্যু, ভয় ত্যাগ করে; কিন্তু ক্ষুধা পিপাসা মনের অপ্রিয় চিন্তা ত্যাগ করতে পারে না। আর পরলোকে ভোগ ব্যতীত অন্য কোনও কাজ থাকে না। পাণ্ডুনন্দন আপনি কামনাবশত নরকে যাবেন না, আপনি মুক্তির চেষ্টা করুন। আপনি সৎকার্যের সীমায় পৌঁছেছেন। এখন ইন্দ্রিয়দমন, সত্য, সরলতা, দয়া, অশ্বমেধ, রাজসূয় ও অন্যান্য যাগ পরিত্যাগ করে পাপের শেষ সীমায় যাবেন না। আপনি যদি চিরকাল পাপকার্য করতেন, তবে কেন ধর্ম-পালনের জন্য বারো বছর যাবৎ দুঃখজনক বনবাস করলেন? মহাবীর কৃষ্ণ, সাত্যকি এবং দ্রুপদ প্রভৃতি রাজারা চিরকাল তো আপনার সহায় ও বশীভূত আছেন। এঁদের সৈন্যও আপনার অধীনে ছিল। অতএব সেই দ্যূতক্রীড়ার সময়ে এঁদের পরিত্যাগ না করে, তখনই তো যুদ্ধ করতে পারতেন। বীরগণ, পুত্রগণের সঙ্গে মৎস্যদেশীয় স্বর্ণরথ বিরাটরাজা, এবং আপনি পূর্বে যাঁদের জয় করেছিলেন, সেই রাজারা তো তখনও আপনার পক্ষ অবলম্বন করতেন। কৃষ্ণ ও অর্জুনের সাহায্যে বিপক্ষবীরদের সংহার করে তখনও আপনি দুর্যোধনের দর্পচূর্ণ করতে পারতেন। পরকে শক্তিশালী হতে দিয়ে, নিজে কষ্ট পেয়ে, বারো বছর বনে বাস করে, এখন এই অসময়ে যুদ্ধ করতে চাইছেন কেন?
“পৃথানন্দন, নির্বোধ পাপী লোকেরাও যুদ্ধ করে সম্পদ লাভ করে, আবার বুদ্ধিমান কিংবা ধার্মিক লোকেরাও দৈববশত যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সম্পত্তি-বিচ্যুত হন। আপনি কোনওদিন পাপকার্য করেননি, ক্রোধবশতও পাপ আপনাকে স্পর্শ করতে পারেনি। মহারাজ! আপনি বিষতুল্য ক্রোধকে পান করুন এবং শান্ত হোন। আপনার পক্ষে ক্ষমা করাই ভাল; কিন্তু ভোগ ভাল নয়। যে ভোগে শান্তনুনন্দন ভীষ্ম নিহত হবেন, অশ্বত্থামাসহ দ্রোণ নিহত হবেন। কৃপ, শল্য, সোমদত্ত, বিকর্ণ, বিবিংশতি, কর্ণ, দুর্যোধন—এঁদের বধ করে, আপনি যা লাভ করবেন, সে সুখ আপনার পক্ষে কেমন হবে? রাজা আপনি সমগ্র পৃথিবী জয় করেও জরা, মৃত্যু, প্রিয়, অপ্রিয়, সুখ ও দুঃখ ত্যাগ করতে পারবেন না, এই কথা ভেবে আপনি কখনও যুদ্ধ করবেন না। তারপর, আপনি যদি এই অমাত্যবর্গের ইচ্ছাতেই এই যুদ্ধ করবার ইচ্ছা করে থাকেন, তবে তাঁদের নিজের সর্বস্ব দিয়ে আপনি তপোবনে চলে যান; কিন্তু আজ স্বর্গের পথ থেকে বিচ্যুত হবেন না।”
যুধিষ্ঠির বললেন, “সঞ্জয় তুমি যথার্থই বলেছ। কর্মের মধ্যে ধর্মই প্রধান। তুমি আগে বোঝার চেষ্টা করো, আমি ধর্ম করছি না অধর্ম করছি। তারপর আমার নিন্দা কোরো। ধর্ম অত্যন্ত সূক্ষ্ম বস্তু। তার বিচার করাও কঠিন। কোথাও অধর্মকেই ধর্ম মনে হয়। কোথাও বা ধর্মকে অধর্ম মনে করা হয়। কোথাও বা ধর্ম ধর্মদর্পেই থাকেন। সুতরাং বুদ্ধিমান ব্যক্তি বিচার বিবেচনা করে তা পরীক্ষা করে থাকেন। দেখো, নিজের ব্যবসায় নষ্ট হলে, মানুষ অন্যের ব্যাবসা দ্বারা জীবন নির্বাহ করে থাকেন। এটাই ধর্ম। কিন্তু নিজের ব্যবসায় জীবিকা নির্বাহ হলে যে পরের ব্যবসায় ধরে, সেটা অধর্ম। আবার নিজের ব্যবসায় জীবিকা নির্বাহ না হলে, যে পরের ব্যাবসা না ধরে, সেটা অধর্মের কাজ। এইরূপ ব্যক্তিরা সর্বদাই নিন্দনীয়। আবার পরের ব্যবসায় দ্বারা জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রায়শ্চিত্ত বিধান আছে। অতএব নিজের ব্যবসায় জীবিকা নির্বাহ না হলে পরের ব্যবসায়ও করা যায়। সঞ্জয় আমরা স্ববৃত্তিতে থেকেই পরের বৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছি, এ কথা তোমাকে বুঝতে হবে। তাঁরাই ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করতে পারেন, যাঁরা মুক্তির জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সে পথও কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদের পথ। যাঁরা ব্রাহ্মণভিন্ন অজ্ঞানী, তাঁদের জীবিকা নির্বাহের জন্য সংসারে বাস করে, সকলের সঙ্গে থেকে একই বৃত্তি অবলম্বন করবেন।
“আমার পূর্বপুরুষগণ, যাঁরা যজ্ঞফলকামী ছিলেন, তাঁরা সকলেই একই পথে থেকে ধর্ম করে গিয়েছেন। আমি আস্তিক লোক। সুতরাং আমি তদ্ভিন্ন অন্য পথ অবলম্বন করতে পারি না। সঞ্জয় এই পৃথিবী, পৃথিবীর উপরে দেবলোক, দেবলোকের উপরে প্রাজাপত্য লোক, তারও উপরে ব্রহ্মলোক—আমি অধর্ম অনুসারে এর কোনওটাই পেতে ইচ্ছা করি না। ধর্মনিয়ন্তা, সর্বকার্যনিপুণ, নীতিজ্ঞ, ব্রাহ্মণসেবক ও বুদ্ধিমান কৃষ্ণ এখানে উপস্থিত আছেন। ইনিই বলুন না যে, আমি অধর্ম অনুসারে কিছু চাই কি না। আমি যদি অনুনয়-বিনয় ত্যাগ করতাম, তবে নিন্দনীয় হতাম। আর আমি যদি যুদ্ধ আরম্ভ করে স্বধর্ম ত্যাগ করি, তবেই নিন্দনীয় হব। কৃষ্ণ উভয়পক্ষের হিতৈষী, সেই মহাযশা কৃষ্ণই বলুন, আমার বক্তব্যে কোনও ভুল আছে কি না। কৃষ্ণ বুদ্ধিমান, শত্রুদমন, বন্ধুবর্গের পরিচালক, সকল অভীষ্ট দায়ক। তাঁর আশ্রিত রাজা কিংবা বন্ধু কোনও দুঃখ ভোগ করেন না। কৃষ্ণ সূক্ষ্মতত্ত্বজ্ঞ, তিনি সাধুস্বভাব ও আমাদের প্রিয়, আমি কৃষ্ণের বাক্য লঙ্ঘন করি না। তুমি কৃষ্ণের বক্তব্য শোনো।”
কৃষ্ণ বললেন, “আমি পাণ্ডবদের অবিনাশ, সম্পদ ও প্রিয়কার্য ইচ্ছা করি ও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদেরও উন্নতি কামনা করি। আমি উভয়পক্ষের মধ্যে শান্তি চাই। রাজা যুধিষ্ঠির রাজ্যবিষয়ে অতি দুষ্কর নিস্পৃহতা দেখিয়েছেন। পুত্রগণ সহ ধৃতরাষ্ট্র সেই রাজ্যবিষয়ে অত্যন্ত অভিলাষ দেখিয়েছেন। তুমি আমার অথবা যুধিষ্ঠিরের কোনও ধর্মচ্যুতি দেখেছ, সঞ্জয়? তুমিই স্থির করো এই দুই পক্ষের মধ্যে কেন কলহ বৃদ্ধি হবে না? তুমি যুধিষ্ঠিরের স্বধর্মচিন্তায় ব্যস্ত, তাঁর ধর্মচ্যুতির সম্ভাবনায় কাতর। কিন্তু যুধিষ্ঠির তো পরের রাজ্য চাননি, আপন রাজ্য শর্ত শেষ করে পেতে চেয়েছেন।
“যুধিষ্ঠির শাস্ত্র অনুযায়ী গার্হস্থ্যধর্মে আছেন। সুতরাং তুমি তাঁর ধর্মলোপের কথা কেন বলছ? ব্রাহ্মণেরা ওঁর মত অনুসারী। উনিও ব্রাহ্মণদের মতানুযায়ী চলেন। কর্মদ্বারা পরলোকে সিদ্ধি হয়। কর্ম ছাড়া পরলোকে সিদ্ধির চিন্তা দুর্বলের নিষ্ফল উক্তিমাত্র। দেবতারাও নিরন্তর কর্ম করে চলেছেন, চন্দ্রও কর্মানুযায়ী মাস, অর্ধমাস ও নক্ষত্র সম্বন্ধ পান, সূর্যও কর্মধারা অনুযায়ী দিন ও রাত্রি সম্পাদন করেন। পৃথিবী দেবীও অনলস কর্ম দ্বারা গিরি নদী প্রভৃতির গুরুভার বহন করেন। অলস ব্যক্তির ফললাভ চিন্তা বাতুলতা মাত্র। সমগ্র দেবসমাজ, নক্ষত্রমণ্ডলী, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য কর্মের বলেই আপন আপন লোকে বিচরণ করেন। সঞ্জয় তুমি ধর্ম জানো এবং জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ। তুমি কেন কৌরবদের হিতের জন্য যুধিষ্ঠিরের দোষের কথা বলছ। যুধিষ্ঠির বেদবিৎ, যজ্ঞবিৎ এবং শাস্ত্র এবং অস্ত্রবিদ। কৌরবদের বধ না করে কীভাবে পাণ্ডবেরা আপন রাজ্য লাভ করতে পারেন, বলতে পারো? তেমন কোনও পথ থাকলে ভীমসেনকে সৎ ব্যবহারে আবদ্ধ রেখেই এঁরা ধর্মরক্ষারূপ কার্য করতে পারতেন। পাণ্ডবেরা ক্ষত্রিয়। শক্তি অনুসারে যুদ্ধ করতে গিয়ে ভাগ্যদোষে যদি এঁদের মৃত্যু ঘটে, সে মৃত্যুও প্রশংসনীয় হবে। তুমি যুদ্ধ না করাকেই প্রধান ধর্ম মনে করছ, কিন্তু ক্ষত্রিয়দের প্রধান ধর্ম কী? তুমি ধর্মপরায়ণ। চার বর্ণের প্রধান কর্ম তোমার জানা আছে। তা চিন্তা করে দেখো, তারপর পাণ্ডবদের কাজের নিন্দা বা প্রশংসা কোরো। ব্রাহ্মণের কাজ অধ্যয়ন, যজন, দান এবং তীর্থগমন। আর অধ্যাপন, যজমানদের যাজন এবং বিহিত প্রতিগ্রহ করবেন। ক্ষত্রিয়দের কাজ প্রজাপালন, দান, যজ্ঞ, বেদ অধ্যয়ন করা, বিবাহ করা ও পুণ্য গার্হস্থ্য জীবনযাপন করবেন। বৈশ্য ধার্মিক থেকে, অধ্যয়ন করে, কৃষি, গোপালন ও বাণিজ্য দ্বারা ধন উপার্জন করে, সাবধানে তা রক্ষা করে, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের প্রিয়াচরণ করে পুণ্য গার্হস্থ্য জীবনযাপন করবে। আর শূদ্র অধ্যয়ন করবে না, যজ্ঞ করবে না, সেবাদ্বারা ধন অর্জন করার জন্য সর্বদা উদ্যোগী ও আলস্যবিহীন হবে। সঞ্জয় এইবার তুমি কৌরবদের কার্যগুলি পর্যালোচনা করো।
“ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর পুত্রগণ, প্রাচীন রাজধর্ম উপেক্ষা করে বিনা কারণে পাণ্ডবদের ধর্মসংগত পৈতৃক রাজ্য হরণ করার চেষ্টা করছেন। যে লোক গোপনে অন্যের ধন হরণ করে, অথবা যে লোক প্রকাশ্যে বলপূর্বক অপরের ধন হরণ করে—উভয়েই চোর, উভয়েই নিন্দনীয়। দুর্যোধনের সঙ্গে চোরের কী পার্থক্য আছে? দুর্যোধন ক্রোধের বশে পাণ্ডবদের ধন কেড়ে নিতে চাইছে; সুতরাং আমাদের সেই ভাগ অন্য কেউ কেন নেবে, আমরাই বা তা ছাড়ব কেন? নিজের প্রাপ্য আদায়ের জন্য যুদ্ধে যদি আমাদের মৃত্যুও ঘটে, তবে তাও গর্বের। পরের রাজ্য থেকে পৈতৃক রাজ্য শ্রেষ্ঠ। সঞ্জয় এই প্রাচীন ধর্মগুলি কৌরব সভামধ্যে বোলো। গর্বে মত্ত দুর্যোধন কতকগুলি মূর্খ রাজাকে একত্রে রেখেছে। কৌরব সভায় কতখানি দূষণীয় কার্য তারা করেছিল, তা তুমি মনে রেখো। পাণ্ডবদের প্রিয়তমা ভার্যা, যশস্বিনী, সৎস্বভাবা, সদ্ব্যবহারা দ্রৌপদীকে টেনে হিঁচড়ে রজস্বলা অবস্থায় সভামধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু কৌরবেরা তা উপেক্ষা করেছিলেন। তখন যদি সমবেতভাবে বালক ও বৃদ্ধবর্গের সঙ্গে কৌরবেরা ধৃতরাষ্ট্রের ইঙ্গিতে দ্রৌপদীকে সভায় আসতে বারণ করতেন, তবে আমারও প্রিয় কার্য করা হত এবং ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর পুত্রদেরও মঙ্গল হত।
“সমস্ত জগতের রীতিকে লঙ্ঘন করে দুঃশাসন সভার মধ্যে শ্বশুরদের সামনে দ্রৌপদীকে টেনে নিয়ে গেল। দীন, হতভাগিনী দ্রৌপদী সেখানে গিয়ে বিদুর ছাড়া অন্য কাউকেই রক্ষক পেলেন না। অন্য রাজারা দুর্বলতাবশত কোনও প্রতিবাদ করলেন না। একমাত্র বিদুর সেই নির্বোধ দুর্যোধনের এই অন্যায় কার্যের প্রতিবাদ করেছিলেন। সঞ্জয় তুমি দ্যূতসভায় প্রতিবাদী ছিলে না, কিন্তু দ্রৌপদীর উপর লাঞ্ছনা চোখের সামনে দেখেছিলে। এর পরেও তুমি যুধিষ্ঠিরকে ধর্মোপদেশ দেওয়ার ইচ্ছা করছ? সামান্য নৌকা যেমন দুরন্ত সমুদ্রপ্রবাহ অতিক্রম করে তীরে পৌঁছয়, সেদিন দ্রৌপদী দুষ্কর কার্য সম্পাদন করে দারুণ কষ্ট থেকে পাণ্ডবদের ও নিজেকে উদ্ধার করেছিলেন। দ্রৌপদী তখন সভার মধ্যে শ্বশুরদের মধ্যে ছিলেন—সেই শ্বশুরদের সামনেই পুত্রবধূ দ্রৌপদীকে সূতপুত্র কর্ণ বলেছিল, ‘যাজ্ঞসেনী তোমার আর কোনও উপায় নেই; সুতরাং তুমি দুর্যোধনের ভবনে গমন করো। কারণ পরাজিত পাণ্ডবেরা এখন আর তোমার পতি নন। অতএব ভাবিনি, তুমি এখন অন্য পতি বরণ করো।’ মর্মঘাতী, অতিদারুণ, তীক্ষ্ণতেজা যে বাক্যময় বাণ কর্ণ উচ্চারণ করেছিলেন, অর্জুনের হাড় ছেদন করে তা অন্তরে প্রবেশ করেছিল। সে বাণ এখনও অর্জুনের হৃদয়ে গ্রথিত আছে। তারপর পাণ্ডবেরা বনে যাবার সময়ে যখন কৃষ্ণসারের চর্ম পরিধান করেছিলেন, তখন দুঃশাসন পাণ্ডবদের কটুবাক্য বলেছিল, ‘ক্লীব তিলের মতো এই পাণ্ডবেরা সকলে বিনষ্ট হয়ে গেল এবং দীর্ঘকালের জন্য নরকালয়ে গমন করল।’ আর গান্ধার শকুনিও দ্যূতক্রীড়ার সময়ে শঠতা করে যুধিষ্ঠিরকে বলেছিল, ‘নকুলও পরাজিত হল, সুতরাং এখন আর তোমার কী আছে? এখন তুমি দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণাকে পণ ধরেই খেলা করো।’
“সঞ্জয় সেই দ্যূতক্রীড়ার সময়ে যা কিছু হয়েছিল, যে যে বাক্য বলা হয়েছিল, সবই গর্হিত ছিল। অতএব এই বিপদসংকুল সন্ধিকার্যে আমি নিজেই সেখানে যেতে ইচ্ছা করি। যদি পাণ্ডবদের স্বার্থ হানি না করে কৌরবদের শান্ত করতে পারি, তা হলে গুরুতর একটা পুণ্যের কাজ করব। কৌরবরাও মৃত্যুপাশ থেকে মুক্ত হবে। আমি একবার শেষ চেষ্টা করব, কৌরবেরা শুনলে ভাল, না শুনলে রথারোহী অর্জুন ও যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত ভীমসেনকে দেখতে পাবে। দুর্যোধন যত কুৎসিত আচরণ দ্যূতসভায় করেছিল ভীম গদা ধারণ করে তার প্রত্যেকটির উত্তর দেবেন।
“দুর্যোধন একটা ক্রোধময় মহাবৃক্ষ; কর্ণ তার স্কন্ধ, শকুনি তার শাখা, দুঃশাসন তার প্রকাশিত পুষ্প ও ফল। আর বিবেচনাহীন রাজা ধৃতরাষ্ট্র তার মূল। আর যুধিষ্ঠির একটা ধর্মময় প্রশস্ত বৃক্ষ; অর্জুন তার স্কন্ধদেশ; ভীমসেন তার শাখা; নকুল ও সহদেব তার প্রকাশিত ফুল ও ফল। আর স্বগুণ ব্ৰহ্ম কৃষ্ণ ও ব্রাহ্মণগণ তার মূল। আবার সঞ্জয়! পুত্রগণসমন্বিত ধৃতরাষ্ট্র একটা বন এবং সেই বনে পাণ্ডবেরাই সিংহ। সুতরাং সিংহরক্ষিত বন বিনষ্ট হয় না এবং বনরক্ষিত সিংহও বিনষ্ট হয় না। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা লতার মতো; পাণ্ডবেরা শাল গাছের মতো। মহাবৃক্ষের আশ্রয় ছাড়া তারা বাঁচবে কী করে? শত্রুদমনকারী পাণ্ডবেরা ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতির সেবা করার জন্যও প্রস্তুত আছেন, আবার যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুত আছেন। এখন ধৃতরাষ্ট্রকেই ঠিক করতে হবে, তিনি কী চাইবেন। পাণ্ডবেরা শান্তিতে বিশ্বাসী, প্রয়োজনে অস্ত্রধারণেও পটু। এই অবস্থায় তুমি গিয়ে যথাযথ ধৃতরাষ্ট্রকে বলবে।”
সঞ্জয় বললেন, “নরশ্রেষ্ঠ, আমি আপনার কাছে যাত্রার অনুমতি প্রার্থনা করি; পাণ্ডব আমি এখন যাব, আপনার মঙ্গল হোক। আমি মনের আবেগে আমার কথায় আপনাদের সম্বন্ধে কোনও অন্যায় কথা বলিনি তো? কৃষ্ণ, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, সাত্যকি ও চেকিতানের কাছেও আমি যাত্রার অনুমতি প্রার্থনা করছি। আপনাদের মঙ্গল ও সুখ হোক। আপনারা প্রীতি প্রসন্ন দৃষ্টিতে আমাকে দেখুন।”
যুধিষ্ঠির বললেন, “সঞ্জয় আমরা অনুমতি দিলাম, তোমার মঙ্গল হোক; তুমি যেতে পারো। সঞ্জয় তুমি কখনও আমাদের অপ্রিয় চিন্তা কোরো না। কৌরবেরা এবং আমরা সকলেই তোমাকে নির্মলচিত্ত ও যথার্থ মধ্যস্থসভ্য বলে বিবেচনা করি। তুমি বিশ্বস্ত দূত ও পরম প্রীতির পাত্র এবং তোমার বাক্যও মধুর। আর তুমি সচ্চরিত্র ও সন্তুষ্ট চিত্ত। তুমি কখনও মতিভ্রমে পতিত হও না এবং কটু-বাক্য বললেও ক্রুদ্ধ হও না। তুমি কখনও মর্মপীড়াজনক কর্কশবাক্য এবং কটু ও নীরস বাক্য বলো না। তোমার বাক্য ধর্মমনোহর, অর্থযুক্ত অথচ হিংসাশূন্য। তুমিই আমার আমাদের প্রিয়তম দূত হিসাবে এসেছিলে। এর পরে হয়তো বিদুরও আসতে পারেন। তোমাকে আগেও অনেকবার দেখেছি। আগে তুমি অর্জুনের প্রাণতুল্য প্রিয় সখা ছিলে।”
এর পর যুধিষ্ঠির সর্বপ্রথম বেদপাঠক ব্রাহ্মণদের, ভিক্ষু, তপস্বী ও বৃদ্ধদের কুশল জানাবার কথা বললেন। আচার্য ও পুরোহিতদের প্রণাম জানালেন। ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপকে প্রণাম জানালেন। অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, দুঃশাসনের, বৈশ্যপত্র যুযুৎসু, শকুনি, ভূরিশ্রবা, শল্য, শল, পুরুমিত্র ও জয়, সোমদত্ত, কর্ণ, শকুনির ও অন্য ভ্রাতাদের মঙ্গলকামনা করলেন। বিদুরকে প্রণাম জানালেন। অন্তঃপুরিকা, বৃদ্ধ স্ত্রীলোক, রাজার ভার্যা, পুত্রবধূস্থানীয়া ও রাজকন্যাকে আশীর্বাদ দিলেন। পুরুবংশীয়া বালিকাদের আশীর্বাদ দিলেন, বেশ্যাদের কল্যাণ কামনা করলেন, দুর্বল ব্যক্তিদের, শিল্পীদের, বৈশ্যদের, শূদ্রদের আশীর্বাদ জানালেন। সবশেষে যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে জানাতে বললেন যে, দুর্যোধন শত্রুশূন্য হয়ে কোনওদিন কুরুদেশ শাসন করতে পারবেন না। ইন্দ্রপ্রস্থ যুধিষ্ঠিরকে প্রদান না করলে যুদ্ধ অনিবার্য। তিনি দুর্যোধনকে বলার জন্য সঞ্জয়কে বললেন—
যত্তৎ কুন্তীমতিক্রম্য কৃষ্ণাং কেশেষ্বকর্ষয়ৎ।
দুঃশাসনস্তেহনুমতে তচ্ছাস্মাভিরুপেক্ষিতম ॥ উদ্যোগ : ৩১ : ১৬ ॥
“তারপরে, দুঃশাসন তোমারই অনুমতিক্রমে কুন্তীদেবীর নিষেধ অগ্রাহ্য করে সেই যে দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করেছিল, তাও আমরা উপেক্ষা করব।”
“দুর্যোধন হয় আমাদের ইন্দ্রপ্রস্থ দান করুক—না হয় কুশস্থল, বৃকস্থল, মাকন্দী, বারণাবত এবং পঞ্চম অন্য কোনও একটা গ্রাম দান করুক। নইলে যুদ্ধ অনিবার্য। আমি শান্তি করতেও সমর্থ, যুদ্ধ করতেও সমর্থ। আমি কোমল আচরণ করতে পারি এবং দারুণ ব্যবহারও করতে পারি।”
সঞ্জয় যুধিষ্ঠির ও কৃষ্ণের আশীর্বাদ দিয়ে হস্তিনাপুর যাত্রা করল।
*
ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে হস্তিনাপুর থেকে দূত করে উপপ্লব্য নগরে পাণ্ডবদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র শান্তি চান, সন্ধি চান। তিনি ভ্রাতৃবিরোধ চান না। পাণ্ডবেরা সকলেই ধর্মপরায়ণ। ভ্রাতৃবধ, আত্মীয়বধ করে তাঁরাও শান্তি পাবেন না। কথাগুলি সবই ভাল, সবই প্রাজ্ঞজনের উপদেশ। কিন্তু কোথাও কোনও ভ্রমচ্ছলে একবারও বলেননি যে, তিনি পাণ্ডবদের রাজত্ব ফিরিয়ে দেবেন। অথচ বনবাসের শর্ত তাই ছিল। বারো বছর বনবাস, এক বছর অজ্ঞাতবাস। পাণ্ডবেরা সে শর্ত পালন করেছেন। অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্রের মূল বক্তব্য হল, সবাই শান্তিতে থাক, পরস্পর হানাহানি করে কোনও লাভ নেই, ক্ষতিই আছে। দুর্যোধন যেমন রাজ্যসুখ ভোগ করছে, করুক—পাণ্ডবেরা বনে আছে, থাক। এমনকী তাঁদের নিজস্ব রাজ্য ইন্দ্রপ্রস্থও তাদের পাবার দরকার নেই। যুধিষ্ঠির ধর্মাত্মা মানুষ, তিনি বনবাসেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিন।
ধৃতরাষ্ট্রের বক্তব্য পাঠকেরা বুঝেছেন। বুঝেছেন তিনি পাণ্ডবদের কোনও সম্পদ ফিরিয়ে দেবেন না। কিন্তু সেই সভাতে উপস্থিত ছিলেন ভারত-বিখ্যাত বীরকুল। ছিলেন ভীষ্ম, যিনি সকলের শ্রেষ্ঠ, যিনি গুরুর অন্যায় আদেশ পূর্ণ করতে অস্বীকার করে তাঁর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। সেই ভীষ্মও বললেন না শর্তপূরণ করার পর পাণ্ডবের প্রাপ্য তাঁদের দিতে হবে। অন্যথায় তিনি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পাণ্ডবদের প্রাপ্য তাঁদের উদ্ধার করে দেবেন। গুরু দ্রোণাচার্য! ভারতভূমি ব্যাপী তাঁর বীরত্বের খ্যাতি। তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয় শিষ্য অর্জুন। ন্যায় নিষ্ঠায় সততায় যুধিষ্ঠিরের মতো মানুষ তিনি দেখেননি। সেই দ্রোণাচার্যও প্রতিবাদ করলেন না। অথচ তিনিই একদিন রাজা দ্রুপদ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি বলে, অস্ত্রশিক্ষার গুরুদক্ষিণা চেয়েছিলেন, “দ্রুপদকে জীবিত ধরে আনতে হবে।” অর্জুন সে আদেশও পালন করেছিলেন। সেই বীরত্বের মৌলিক নীতি যেন দ্রোণাচার্য হারিয়ে ফেলেছেন। কেন? ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ নিজেই বলেছেন, “তাঁরা অন্নদাস, তাই নপুংসকের মতো আচরণ করেছেন।” আর কর্ণ! যাঁর গলায় অবিরত পৌরুষ আর বীরত্বের দম্ভ—তাঁর একবার মনেও হল না, বীরত্বের এই অনাচারের জন্য মানুষ তাঁকে ঘৃণা করবে। এ তো চূড়ান্ত খলনায়কদের মতো আচরণ হল। দুই ক্ষত্রিয় পক্ষে যুদ্ধের এক শর্ত যে পরাজিত হবে, সে বারো বছর বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করবে। পরাজিত পক্ষ সেই শর্ত পালন করে ফিরে এল, অথচ বিজয়ী পক্ষ তাঁকে আর সম্পদ ফিরিয়ে দিতে রাজি নয়। কর্ণ এই দলের নেতা। কিছু কিছু পণ্ডিত বলেন, কর্ণ মহৎ। কিন্তু আমাদের বিচারে কর্ণ এক কাপুরুষ (কুৎসিত পুরুষ অর্থে)। যাঁর কাছে বীরের শর্তপালনের কোনও মূল্য নেই।
সঞ্জয়ের এই দৌত্য প্রস্তাবের পর কৃষ্ণ তাঁর অভিমত জানাতে গিয়ে সঞ্জয়কে দ্যূতসভায় কর্ণের চূড়ান্ত অসভ্যতা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কৃষ্ণ বলেছেন, “দ্রৌপদী সেই সভায় শ্বশুরদের মধ্যে ছিলেন। কর্ণ সেই শ্বশুরদের সামনেই দ্রৌপদীকে বলেন, ‘ভাবিনি! তোমার পতিগণ নরকে গিয়েছে, তাঁরা এখন মৃত। তুমি অন্য স্বামী বরণ করো।’ সারা পৃথিবীতেই বীরপুরুষ নারী সম্পর্কে এক বিশেষ শ্রদ্ধারীতি বহন করেন।” ইংরেজরা একে বলেন ‘সিভাল্রি’। কর্ণের দুর্ভাগ্য যে, তিনি ভরতবংশে কোনও শ্রদ্ধাযোগ্য নারী দেখতে পাননি। আসলে স্বয়ংবর সভায় দ্রৌপদী যে, “নাহয়ং বরায়ামি সূতম্” বলেছিলেন, সেই রাগ কর্ণ সারাজীবন বহন করেছেন। কর্ণের ক্ষত্রিয়ের সংস্কার হয়নি, হলে তিনি বুঝতেন যে, এর থেকে সহজ সত্য কথা যজ্ঞবেদি সমুত্থিতা ওই মহীয়সী নারীর পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না।
সঞ্জয়ের দৌত্যের লক্ষণীয় আর একটি বৈশিষ্ট্য আছে। সঞ্জয়ের দৌত্যের মধ্যে ফুটে উঠেছে তাঁর ব্যক্তিগত আবেদন। সে আবেদন যুধিষ্ঠিরের কাছে। তিনি যুদ্ধ করবেন না। বরং তিনি ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করবেন কিন্তু যুধিষ্ঠির যুদ্ধ করবেন না। অস্ত্র হাতে যুধিষ্ঠিরকে কল্পনাও করতে পারেন না সঞ্জয়। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ যদি হয়, তা হলে যুধিষ্ঠির যেন সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেন। ভ্রাতা ও অমাত্যদের হাতে যুদ্ধের ভার সমর্পণ করে যুধিষ্ঠির যেন সরে থাকেন। সঞ্জয়ের সমস্ত দৌত্যের সুর একটাই—আপনি যুদ্ধ করবেন না।
কিন্তু তাই কি হয়? যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয় রাজা। পৈতৃক রাজ্য তাঁকে উদ্ধার করতেই হবে। যুদ্ধ তাঁকে করতেই হবে। ধৃতরাষ্ট্রের সুবুদ্ধি যদি জাগে, যদি অন্তত পাঁচটি গ্রাম ধৃতরাষ্ট্র তাঁদের দেন, তবে যুধিষ্ঠির যুদ্ধ করবেন না, সন্ধি করবেন। সঞ্জয় জানেন যে, ধৃতরাষ্ট্র তা দেবেন না। তাই সঞ্জয় ফিরে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করেন। এই কারণেই ‘দূত সঞ্জয়’ মহাভারতের একটি দুর্লভ মুহূর্ত।
৫৫
অর্জুনের শপথ
[অজ্ঞাতবাস শেষ হলে রাজা দ্রুপদের বৃদ্ধ পুরোহিত হস্তিনাপুর গিয়ে পাণ্ডবদের রাজ্য দাবি করলেন। ধৃতরাষ্ট্র পুরোহিতকে বিদায় করে গবল্গণপুত্র সঞ্জয়কে দূত হিসাবে পাণ্ডবদের কাছে পাঠালেন। সঞ্জয় ফিরে আসার পর উৎসুক এবং শঙ্কাতুর ধৃতরাষ্ট্র বারংবার সঞ্জয়কে প্রশ্ন করতে লাগলেন, “মহাবীর অর্জুন কী বলেছেন?” অর্জুন মহাভারতের সবথেকে মিতবাক পুরুষ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে এবং যুদ্ধের পর যুধিষ্ঠিরের সিংহাসন আরোহণ অনিচ্ছা, এইরকম দুটি একটি ক্ষেত্রে ছাড়া অর্জুন বেশি কথা বলেন না। অর্জুন কর্মে বিশ্বাস করেন, কথায় নয়। সেই অর্জুনও দূত সঞ্জয়ের কাছে অনেকগুলি কথা বলেছিলেন। তাই সে এক দুর্লভ মুহূর্ত]।
সঞ্জয় বললেন, “মহারাজ! কৃষ্ণ শুনছিলেন এই অবস্থায় মহাত্মা অর্জুন যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে ভবিষ্যতে যুদ্ধ করার অভিপ্রায়ে, দুর্যোধনকে শোনানোর জন্য আমাকে বলেছিলেন, ‘সঞ্জয় অল্পবুদ্ধি, কালপক্ব ও অত্যন্ত মূর্খ কর্ণ, যে আমার সঙ্গে সর্বদাই যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করে, তাকে শুনিয়ে কৌরবদের মধ্যে দুর্যোধনকে বোলো। আর পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য দুর্যোধন যে সমস্ত রাজাকে এনেছেন, তাদের সামনে দুর্যোধনকে বোলো’।”
দেবতারা যেমন দেবরাজ ইন্দ্রের কথা শোনেন, তেমনই পাণ্ডব ও সঞ্জয়গণ অর্জুনের বাক্য শুনতে লাগলেন। রক্তপদ্মসদৃশ-রক্তনয়ন ও গাণ্ডিব ধনুর্ধারী অর্জুন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে বললেন, “দুর্যোধন যদি অজমীঢ়বংশসম্ভূত রাজা যুধিষ্ঠিরের রাজ্য ফিরিয়ে না দেন, তা হলে বুঝতে হবে যে, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা পূর্বকৃত পাপের কোনও ফল এখনও পাননি, সেই পাপকর্ম পূর্ণমাত্রায় থেকে গিয়েছে এবং সেই জন্য ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, কৃষ্ণ, সাত্যকি, অস্ত্রধারী ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডী— এবং যিনি ধ্বংস চিন্তা করলেই পৃথিবীকে ও স্বর্গলোককে দগ্ধ করতে পারেন সেই যুধিষ্ঠির— এঁদের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ করতে হবে। দুর্যোধন যদি ভীমসেন ইত্যাদির সঙ্গে যুদ্ধ করার ইচ্ছা করে থাকেন, তা হলে পাণ্ডবদের সব অভীষ্টই সিদ্ধ হবে। সঞ্জয় তুমি সন্ধি ঘটাবার কোনও চেষ্টাই কোরো না; ইচ্ছা হলে তুমিও যুদ্ধে এসো।
“ধার্মিক যুধিষ্ঠির নির্বাসিত হয়ে বনের ভিতর যে দুঃখশয্যা অবলম্বন করেছিলেন, দুর্যোধন প্রাণত্যাগ করে বন্ধুজনের অনিষ্ট ও দুঃখতর সেই শয্যা অবলম্বন করবে। অন্যায় ব্যবহারকারী দুর্যোধন এ-যাবৎ লজ্জা, জ্ঞান, তপস্যা, ইন্দ্রিয়দমন, বীরত্ব, ধর্মরক্ষা ও বল পরিত্যাগ করে কৌরব পাণ্ডবগণের সমস্ত রাজ্যই অধিকার করে আছে। আর দয়ালু ও সত্যবাদী আমাদের রাজা যুধিষ্ঠির দ্যূতে পরাজিত হয়ে অত্যন্ত কষ্ট সহ্য করেও সত্যরক্ষায় আগ্রহ, সরলতা, তপস্যা, ইন্দ্রিয়দমন, ধর্মরক্ষার ইচ্ছা ও সহ্যগুণের বলে কৌরবদের সব অপরাধ সহ্য করেছেন, কিন্তু সংযতচিত্ত যুধিষ্ঠির যখন উত্তেজিত চিত্তে বহু বৎসরের অবরুদ্ধ নিদারুণ ক্রোধ কৌরবদের উপরে ত্যাগ করবেন, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। প্রথমে অল্প জ্বলিত ক্রমে অধিক উত্তপ্ত অগ্নি যেমন গ্রীষ্মকালে আপন পথকে কালো করে দিয়ে শুষ্ক তৃণরাশি দগ্ধ করে, সেই রকমই যুধিষ্ঠির ক্রুদ্ধ চোখে তাকানো মাত্রই দুর্যোধনের সৈন্য দগ্ধ করবেন।
“ক্রোধবিষবমন করতে করতে গদাধারী, ভয়ংকর বেগশালী ও অসহিষ্ণু পাণ্ডুনন্দন ভীমসেনকে যখন দুর্যোধন রথে আরূঢ় দেখবে, তখন সে যুদ্ধের জন্য অনুতপ্ত হবে। বিপক্ষবীরহন্তা ও সুসজ্জিত ভীমসেন যখন সৈন্যদের সামনে থেকে যমের মতো সৈন্য সংহার করবেন, তখন অভিমানী দুর্যোধন আমার কথাগুলি স্মরণ করবে। মহাসিংহ যেমন গো-সমূহ মধ্যে প্রবেশ করে, তেমনই ভীমমূর্তি ভীমসেন যখন গদাহাতে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের মধ্যে প্রবেশ করে তাঁদের বধ করতে থাকবেন, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। ভীমসেন যখন গদার আঘাতে মহাহস্তীর কুম্ভ বিদীর্ণ করে পর্বতশৃঙ্গতুল্য সেই মহাহস্তীগুলি নিপাতিত করবেন, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। গুরুতর ভয়ের সময়েও যিনি নির্ভয় থাকেন, সর্ব অস্ত্র যিনি শিক্ষা করেছেন, একমাত্র রথে যখন অসংখ্য সৈন্য বধ করবেন, কুঠার দ্বারা বন ছেদনের মতো দুর্যোধন যখন সেই ভীমসেনকে একাই শত্রুসৈন্য ছেদন করতে দেখবে, তখন যুদ্ধের জন্য দুর্যোধন অনুতাপ করবে। ভীমসেন অস্ত্রের তেজে সৈন্যদের বধ করবেন এবং তাদেরই রক্তে তাদের স্নান করাবেন; তখন ভীমসেনের মূর্তি দেখেই শ্রেষ্ঠ রথীরা জড় ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। তখন মৃত ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের দিকে তাকিয়ে দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে।
“রথীশ্রেষ্ঠ ও বিচিত্রযোধী নকুল যখন ডান হাতের তরবারি দ্বারা কৌরববাহিনীর মাথা কাটতে আরম্ভ করবেন, তাঁর সম্মুখে যে রথী পড়বে সে যমালয়ে যাবে, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। সুখভোগের যোগ্য এবং অভ্যস্ত নকুল দীর্ঘকাল বনমধ্যে যে দুঃখশয্যায় শয়ন করেছিলেন, সেই দুঃখশয্যা স্মরণ করে যখন বিষোদগারী ক্রুদ্ধ সাপের মতো যুদ্ধে বিচরণ করবেন, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে।
“যুবকের ন্যায় তেজস্বী, সর্ব অস্ত্র বিদ্যায় সুশিক্ষিত দ্রৌপদীর পঞ্চ বালকপুত্র যখন প্রাণের ভয় ত্যাগ করে কৌরবদের দিকে ধাবিত হবে, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। সুবর্ণ তারাখচিত এবং শিক্ষিত উত্তম অশ্বযুক্ত রথে আরোহণ করে যখন সহদেব দানব বিনাশকারী ইন্দ্রের ন্যায় বাণ নিক্ষেপ করে রাজাদের মাথা ছেদন করে মাটিতে ফেলবেন, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। লজ্জাশীল, যুদ্ধনিপুণ, সত্যবাদী, মহাবল, সর্বধর্মসম্পন্ন, ক্ষিপ্রকারী ও বেগবান সহদেব তুমুল যুদ্ধে শকুনির দিকে ধাবিত হয়ে সম্মুখবর্তী বিপক্ষগণকে অপসারিত করবেন। তখন দুর্যোধন স্তম্ভিত বিস্ময়ে শুধু দেখবেন। রথ-যুদ্ধে নিপুণ, মহাধনুর্ধর, সর্বাস্ত্রবিদ দ্রৌপদীর পুত্রেরা যখন ঘোরবিষ সর্পের মতো অগ্রসর হবে, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। কৃষ্ণের তুল্য অস্ত্রে সুশিক্ষিত, বিপক্ষবীরহন্তা অভিমন্যু যখন মেঘের মতো শরবর্ষণ করতে থেকে শত্রুপক্ষকে আলোড়িত করবেন, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। ইন্দ্রের তুল্য অস্ত্রে সুশিক্ষিত এবং বালক হয়েও অবালকবীর্য অভিমন্যু যখন যমের মতো শত্রুসৈন্যের উপরে পতিত হবেন; আর দুর্যোধন তা দেখবে, তখনই সে যুদ্ধের জন্য অনুতপ্ত হবে। ক্ষিপ্রকারী, যুদ্ধবিশারদ ও সিংহের তুল্য বলবান প্রভদ্রকবংশীয় যুবকেরা যখন সৈন্যদের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের অপসারিত করতে থাকবেন, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। বৃদ্ধ ও মহারথ বিরাটরাজা ও দ্রুপদরাজা যখন ক্রুদ্ধ হয়ে দুই দল সৈন্যের সঙ্গে পৃথক পৃথক ভাবে দ্রুত যাত্রা করে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের দেখবেন এবং চাপমুক্ত বাণদ্বারা বিপক্ষ যুবকদের মস্তক ছেদন করতে থাকবেন এবং তাদেরই রথসমূহের মধ্য দিয়ে শত্রুসৈন্যদের মধ্যে প্রবেশ করবেন, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। বিরাটপুত্র উত্তরকে যখন শত্রুরা দেখবে, যখন শিখণ্ডী ভীষ্মকে বধ করবেন, তখন শত্রুরাও জীবন ধারণ করতে পারবে না। বলবান শিখণ্ডী যখন অশ্বগণদ্বারা রথসমূহ মর্দন করতে থেকে ভীষ্মের অভিমুখে যাত্রা করবেন, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। যাঁকে গুরু দ্রোণাচার্য গুপ্ত অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছিলেন, সেই ধৃষ্টদ্যুম্নকে যখন পাণ্ডবসৈন্যের সম্মুখভাগে দেদীপ্যমান অবস্থায় দুর্যোধন দেখতে পাবে, তখন সে এই যুদ্ধের জন্য অনুতপ্ত হবে। অসীম শক্তিশালী ও শত্রুনিবারণকারী সেই সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন যখন বাণদ্বারা ধার্তরাষ্ট্রগণকে মর্দন করতে করতে যুদ্ধে দ্রোণের অভিমুখে যাত্রা করবেন, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতপ্ত হবে। লজ্জাশীল, বুদ্ধিমান, বলবান, প্রশস্তহৃদয়, সুন্দরমূর্তি, সোমক ও বৃষ্ণিবংশশ্রেষ্ঠ সাত্যকি অবশ্যই পাণ্ডবদের পক্ষে যোগ দেবেন এবং সেই অদ্বিতীয় রথারোহী, নির্ভয়, অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত শিনিপুত্র যখন দ্রোণের উদ্দেশে যাত্রা করবেন, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। সেই সাত্যকির ধনুখানি চার হাত প্রমাণ। আমার আদেশে সেই দীর্ঘবাহু, শত্রুমর্দনকারী, বিশালবক্ষ যখন জলভরা মেঘের মতো শরবর্ষণ করবেন, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। সিংহের গন্ধ পেলেই গো-গণ দ্রুত পলায়ন করে, যুদ্ধক্ষেত্রে সাত্যকিকে দেখে কৌরবগণেরও অবস্থা একই প্রকার হবে। সাত্যকি বাণ দ্বারা পর্বত ভেদ করতে পারেন এবং সমস্ত জগৎও সংহার করতে পারেন। সেই লঘুহস্ত সাত্যকিকে যখন দেখবে, তখন দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতপ্ত হবে।
“তারপর অশিক্ষিতচিত্ত, মূঢ়মতি দুর্যোধন যখন কৃষ্ণ অধিষ্ঠিত, স্বর্ণ-মণিমণ্ডিত শ্বেতাশ্বযুক্ত ও বানরধ্বজ সমন্বিত আমার রথ দেখবে, তখনও সে যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। মহাযুদ্ধের সময় আমি গাণ্ডিব আকর্ষণ করতে থাকব, তখন আমার হস্ত সঞ্চালনে বজ্রাঘাতের শব্দের মতো ভয়ংকর ও বিশাল শব্দ হতে থাকবে, মন্দবুদ্ধি দুর্যোধন যখন তা শুনবে; তখন আমার বাণবর্ষণে সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাবে, গো-সমূহের মতো সৈন্যগণ ধ্বংস হতে থাকবে, তখন মূর্খ, দুর্মতি, দুষ্টসহায়শালী দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। গাণ্ডিবনিক্ষিপ্ত, নিশিতাগ্র, সুমুখ, সুপুঙ্খ ও ভয়ংকরমূর্তি বাণসমূহ মেঘ থেকে বাইরে আসা ভয়ংকর বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গের মতো চলতে থেকে যুদ্ধে শত্রুগণের অস্থিছেদন, মর্মবিদারণ ও সহস্র সহস্র শত্রু বিনাশ করবে; সৈন্য, হস্তী, অশ্ব দলে দলে প্রাণত্যাগ করবে, তখন দুর্যোধন এই যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। অন্য বীরেরা বাণ নিক্ষেপ করতে থাকবেন, তখন আমার বাণসমূহ গিয়ে সেই বাণগুলিকে প্রতিকূল দিকে ঘুরিয়ে দেবে; আমার অপর বাণসমূহ গিয়ে বিপক্ষের কতগুলি বাণকে প্রতিকূল দিকে চালিয়ে দেবে এবং আমার অপর বাণগুলি গিয়ে বিপক্ষের বাণকে তির্যকভাবে ছেদন করতে থাকবে। পাখি যেমন গাছ থেকে ফল মাটিতে ফেলে, তেমনই আমার বাণগুলি শত্রুপক্ষের যুবকদের মাথা মাটিতে ফেলবে, তখন যুদ্ধের জন্য দুর্যোধন অনুতপ্ত হবে। যুদ্ধের প্রধান প্রধান যোদ্ধা আমার বাণে নিহত ও নিপাতিত হয়ে হস্তী, অশ্ব ও রথ থেকে পতিত হবে। সেই দৃশ্য দেখে দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতপ্ত হবে। ধৃতরাষ্ট্রের অপর পুত্রেরা আমার অস্ত্রপথে না-গিয়ে সকল দিকে পালাতে থাকবে। বিকৃতবদন যমের ন্যায় আমি যখন সকল দিকে জ্বলন্ত বাণ নিক্ষেপ করব, তখনই মন্দবুদ্ধি দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। আমার রথের উৎক্ষিপ্ত ধূলিতে দুর্যোধনের সৈন্যরা অদৃশ্য হয়ে যাবে, কোন দিকে যাব বুঝবার আগেই তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন হতে থাকবে। দুর্যোধন পক্ষের রাজারাও নিহত হবেন, বহু সৈন্য পিপাসার্ত ও ভয়ার্ত হয়ে পড়বে, তাদের বাহন পরিশ্রান্ত হবে, বহু সৈন্য আর্তস্বরে রোদন করবে। বহু সৈন্য হত ও হন্যমান হবে এবং বহু সৈন্যের কেশ, অস্থি ও কপাল নানাদিকে বিক্ষিপ্ত হবে, তখন মন্দমতি দুর্যোধন যুদ্ধের জন্য অনুতাপ করবে। আমি কৃষ্ণ, কৃষ্ণের দিব্যশঙ্খ পাঞ্চজন্য, আমার শঙ্খ দেবদত্ত, গাণ্ডিব ধনু, অক্ষয় তূণ এবং শ্বেতবর্ণ চারিটি অশ্ব, যখন একসঙ্গে দেখবে, যখন দেখবে প্রলয়ের পর অপর যুগপ্রবর্তন করেই আমি অগ্নির মতো কৌরবদের দগ্ধ করছি, তখন ধৃতরাষ্ট্র পুত্রেরা অনুতপ্ত হবেন। কোপনস্বভাব, অল্পবুদ্ধি ও মূর্খ দুর্যোধন ভ্রাতা, ভৃত্য ও সৈন্যগণের সঙ্গে ঐশ্বর্যভ্রষ্ট, আহত ও কম্পিতদেহ হয়ে দর্পনাশের পরে অনুতাপ করবে। আমি একদিন পূর্বাহ্ণে সন্ধ্যাবন্দনা ও তর্পণ শেষ করে অবস্থান করছিলাম, এমন সময়ে এক ব্রাহ্মণ এসে আমাকে বলেছিলেন, ‘পৃথানন্দন! অর্জুন! কোনও দুষ্কর কার্য তোমাকে করতে হবে— শত্রুদের সঙ্গে তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে। অতএব, ইন্দ্র বজ্ৰধারণ করে শত্রুনাশ করতে করতে তোমার আগে যাবেন? না— বসুদেব কৃষ্ণ সুগ্রীব নামক ঘোটকযুক্ত রথে তোমার পিছনে পিছনে যাবেন?’ তখন আমি বজ্ৰপাণি ইন্দ্রকে পরিত্যাগ করে যুদ্ধে সহায়রূপে কৃষ্ণকে বরণ করেছিলাম এবং কৃষ্ণকে আমি দস্যুবধের জন্য লাভ করেছি। দেবতারা আমার পক্ষে অনুগ্রহই করেছেন। কারণ, কৃষ্ণ যুদ্ধ না করেও মনে মনে যার জয় কামনা করবেন, সে লোক ইন্দ্রসমেত সকল দেবতাকে জয় করতে পারে। মানুষের ক্ষেত্রে তো চিন্তা করার কোনও ব্যাপারই নেই। যে লোক মহাবীর ও তেজস্বী কৃষ্ণকে যুদ্ধে জয় করার ইচ্ছা করে, সে লোক বাহুযুগল দ্বারা অনন্ত জলের আধার সমুদ্রকে পার হতে চেষ্টা করে। হাত দিয়ে পাথরে পূর্ণ অতি বিশাল কৈলাস পাহাড় জয় করবার ইচ্ছা করলে, নখসমেত হাতটাই ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যায়, পর্বতের কোনও ক্ষতি হয় না। কৃষ্ণকে জয় করার ইচ্ছা আর হাত দিয়ে প্রজ্বলিত অগ্নিকে নির্বাপিত করার ইচ্ছা, চন্দ্র ও সূর্যের গতিরোধের ইচ্ছা আর বলপূর্বক দেবগণ রক্ষিত অমৃত হরণের চেষ্টা এক।
“এই কৃষ্ণ এক রথে ভোজবংশীয় রাজগণকে বাহুবলে জয় করে পরমসুন্দরী রুক্মিণীকে ভার্যারূপে গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই রুক্মিণীর গর্ভেই মহাত্মা প্রদ্যুম্ন জন্মগ্রহণ করেছেন। এই কৃষ্ণ বাহুবলে গান্ধারদেশীয় সৈন্যদের মথিত করে নগ্নজিৎ রাজার পুত্রদের পরাজিত করে বদ্ধ, রোরুদ্যমান ও দেবশ্রেষ্ঠ সুদর্শনকে মুক্ত করেছিলেন। ইনিই কবাটগ্রামে পাণ্ড্যরাজাকে বধ করেছিলেন এবং কলিঙ্গদেশীয় সৈন্য সমেত রাজা দণ্ডবক্রকে পরাজিত করেছিলেন, আর বারাণসী নগরীকে এমনভাবে দগ্ধ করেছিলেন যে সেই নগরী বহুকাল রাজাশূন্য ছিল। নিষাদরাজ-একলব্য অন্যের অবধ্য ছিল। সেই নিষাদরাজ কৃষ্ণকর্তৃক নিহত ও প্রাণহীন হয়ে জম্ভাসুরের মতো বেগে পর্বতে আঘাত করে ভূতলে শয়ন করেছিল। তারপর, ইনি বলরামের সঙ্গে মিলিত হয়ে সভার মধ্যে বৃষ্ণি ও অন্ধকদের মধ্যবর্তী অতি দুষ্টস্বভাব উগ্রসেনপুত্র কংসকে নিপাতিত করে উগ্রসেনকে রাজা করে দেন। ইনি—সৌভবিমানস্থ, আকাশবর্তী ও মায়াদ্বারা অতি ভীষণ শাল্বরাজার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন এবং দুই হাতে সেই সৌভ বিমানের দ্বারবর্তী শতঘ্নী (বৃহৎ নালিযুক্ত কামান)-কে গ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং যুদ্ধে এঁকে সহ্য করবে কোন মানুষ? অসুরদের ভয়ংকর, দুর্গম, দুর্ভেদ্য প্ৰাগ্জ্যোতিষ নামে অসুরদের নগরে নরকাসুর বাস করত। সে অদিতি দেবীর দুটি সুন্দর কুণ্ডল হরণ করেছিল। দেবরাজ ইন্দ্রসমেত সমস্ত দেবতা যুদ্ধ করেও নরকাসুরকে জয় করতে পারলেন না। পরে তাঁরা কৃষ্ণকে অনুরোধ করায় তিনি প্রতিশ্রুতি দেন। পরে কৃষ্ণ একা নির্মোচন নগরে প্রবেশ করে ছয় হাজার সৈন্য, মুদ্রাসুর ও রাক্ষসগণকে বধ করে নরকাসুরের সাক্ষাৎ পান। নরকাসুর কৃষ্ণ কর্তৃক নিহত ও প্রাণহীন হয়ে পড়ল, কৃষ্ণ অদিতি দেবীর সেই মণিকুণ্ডল দুটি নিয়ে ফিরে আসেন। সেই অসাধারণ কাজ দেখে দেবতারা তাকে বর দেন, “যুদ্ধে আপনার শ্রম জন্মাবে না এবং আকাশে ও জলে আপনার গমন করবার শক্তি জন্মাবে। আর আপনার শরীরে অস্ত্র-শস্ত্র প্রবেশ করবে না।” সুতরাং, কৃষ্ণে সেই শক্তি ও দেবতার বর আছে। দুরাত্মা দুর্যোধন সেই অসীমবীর্য ও অসহ্য কৃষ্ণকে জয় করবার আশা করছে এবং সর্বদাই তাঁকে ধরবার ইচ্ছা করছে; কিন্তু কৃষ্ণ আমাদের মতের অপেক্ষা করে তাও সহ্য করছেন। নির্বোধ দুর্যোধন মনে করছে যে, আমার এবং কৃষ্ণের মধ্যে কলহ হয়েছে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে সে সত্য বুঝতে পারবে। রাজ্য লাভ করার জন্য আমি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা ও ধৃতরাষ্ট্রকে নমস্কার করে যুদ্ধ করব।
“যে পাপমতি পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে, ধর্মের গুণে তারই মৃত্যু ঘটবে। নৃশংসেরা কপটদ্যূতে জয় করে আমাদের বারো বছর বনে বাস করিয়েছে। যারা দীর্ঘকাল কষ্টকর বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করিয়েছে, পাণ্ডবেরা জীবিত থাকতে সেই ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রেরা আপন পদে থেকে আর কী করে আনন্দ অনুভব করবে। আমরা যুদ্ধ করতে থাকলে, কৌরবেরা যদি ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণকে সহায় করেও আমাদের জয় করতে পারে তা হলে বুঝব ধর্মাচরণ অপেক্ষা অধর্মাচরণ ভাল এবং সৎকর্ম বলে কিছু নেই। পুরুষকার যদি কর্মের ফললব্ধ নাও হয়, তবুও কৃষ্ণের সাহায্যে আমরা দুর্যোধনকে বধ করতে পারব বলেই মনে করি। মানুষের দুষ্কর্ম যদি নিষ্ফল না হয় এবং সৎকর্মও যদি বিফল না হয়, তবে আমি দুর্যোধনের দুষ্কর্ম ও যুধিষ্ঠিরের সৎকর্ম দেখে নিশ্চয়ই বলছি যে, দুর্যোধনের পরাজয় সুনিশ্চিত। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা যদি যুদ্ধ করে, কেউ বেঁচে থাকবেনা। যুদ্ধ না হলে, কৌরবেরা কেউ কেউ বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে; যুদ্ধ হলে একজনও অবশিষ্ট থাকবে না। আমি কর্ণের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের সংহার করে সমগ্র কুরুরাজ্য জয় করব—
হত্বা ত্বয়ং ধার্ত্তরাষ্ট্রান সকর্ণান রাজ্যং কুরূণামবজেতা সমগ্রম্।
যদ্বঃ কার্যং তৎ কুরুধবং যথাস্বমিষ্টান্ দারানাত্মভোগান ভজধ্বম্ ॥ উদ্যোগ: ৩৮: ৯৭ ॥
“—কর্ণ সমেত সমস্ত ধৃতরাষ্ট্রপুত্রকেই আমি বধ করব। সমগ্র কুরুরাজ্য জয় করব। ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ! তোমাদের যার যা কর্তব্য আছে, তা এর মধ্যেই করে নাও এবং প্রিয়তমা বনিতাসম্ভোগ ও অন্যান্য বিষয়ের ভোগ সেরে ফেলো।”
“অলৌকিক জ্যোতিষশাস্ত্রজ্ঞ, গ্রহনক্ষত্র ফলাফল বর্ণনে অভিজ্ঞ, অলৌকিক প্রশ্নবক্তা, বহু দূরদর্শী প্রাজ্ঞ মানুষেরা জানিয়েছেন যে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে গুরুতর যুদ্ধ হবে এবং পাণ্ডবদের জয় হবে। শত্রু দমনের জন্য স্বস্ত্যয়নকারী ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আমাদের জয় হবে নিশ্চিত মনে করছেন, সর্বপ্রত্যক্ষকারী বৃষ্ণিবংশশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণও আমাদের জয় বিষয়ে কোনও সংশয় দেখছেন না। আমি স্পর্শ না করলেও গাণ্ডিবধনু বিস্ফারিত হয়ে আমাকে ডাকছে। আমার বাণগুলি তূণ থেকে বারবার বাইরে আসতে চাইছে। আমার ধ্বজে যেন প্রতিমুহূর্তেই গর্জন উঠছে, ‘অর্জুন! কখন তোমার রথ যুদ্ধের জন্য যোজিত হবে।’ রাত্রে শৃগালেরা চিৎকার করে, রাক্ষসেরা যেন আকাশ থেকে নিপতিত হয় এবং মৃগ, শৃগাল, ময়ূর, কাক, গৃধ্র, বক ও ক্ষুদ্র ব্যাঘ্ৰসকল রথের কাছে ছোটাছুটি করে। স্বর্ণপক্ষ পক্ষীরা আমার শ্বেতাশ্বযুক্ত রথের পিছনে ধাবিত হয়। কারণ, আমি একাকীই বাণবর্ষণ করে সকল রাজা ও যোদ্ধাদের যমলোকে প্রেরণ করতে পারি।”
“গ্রীষ্মকালে দাবানল যেমন বনের কিছুই অবশিষ্ট রাখে না, আমিও তেমনই যুধিষ্ঠির কর্তৃক শত্রুসংহারে বৃত হয়ে মহাস্ত্র স্থূণাকর্ণ, পাশুপত, ব্ৰহ্মাস্ত্র, ইন্দ্র প্রদত্ত দিব্যাস্ত্র ব্যবহার করে, এই যুদ্ধে কোনও শত্রুকেই অবশিষ্ট রাখব না; তারপরে আমি শান্তিলাভ করব— এই আমার ধ্রুব ও স্থির সংকল্প। সঞ্জয় তুমি দুর্যোধনকে আমার এই কথাগুলি বোলো।”
*
মহাভারতের এক অদ্ভুত দুর্লভ মুহূর্ত আমরা পেলাম। ‘অর্জুন’ যিনি বাল্যকাল থেকেই অত্যন্ত মিতবাক। অসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে ধর্মবোধ, যাঁকে যথার্থ যুধিষ্ঠিরের “ভ্রাতাশ্চ শিষ্যশ্চ” করে তুলেছিল, যে অর্জুন— দ্যূতসভায়ও নীরব ছিলেন। তাঁর চোখের সামনেই ঘটেছে তাঁর স্বয়ংবর-লব্ধা নারীর লাঞ্ছনা; তখনও অর্জুন নীরব। যখন হস্তিনাপুরের দ্যূতসভার প্রতিটি অলিন্দ কেঁপে কেঁপে উঠেছে ভীমসেনের মেঘমন্দ্র শপথ উচ্চারণে, যে গর্জন শুনে অকারণে বামদিকে আগুন জ্বলে উঠেছে; দিনের বেলায় চিৎকার করেছে গৃধ্র শৃগাল। কর্কশ কণ্ঠে ডেকে উঠেছে পেচক। যখন ভীষ্ম, বিদুর চারপাশে অমঙ্গল লক্ষণ দেখে ‘স্বস্তি স্বস্তি’ উচ্চারণ করেছেন। তখনও অর্জুন নির্বাক। কিন্তু কতখানি আঘাত যে তাঁর লেগেছিল, তা দুর্যোধনকে শোনানোর জন্য সঞ্জয়কে বলা এই কথাগুলির মধ্যে ফুটে উঠেছে। ভিসুভিয়াসের বুক থেকে লাভাস্রোতের মতো অর্জুনের জ্বালা, অপমান বোধ, পৌরুষের অবরুদ্ধ যন্ত্রণা যেন কৌরবপক্ষের এক এক জন করে সারথিকে দগ্ধ করে, রণক্ষেত্রে হত্যা করার শপথ গ্রহণ করেছে।
অর্জুনের সম্পূর্ণ ভাষণটিতে আছে স্বপক্ষীয় রথীদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা। প্রথমেই তিনি ঘোষণা করেছেন, যুধিষ্ঠিরের দৃষ্টিপাতমাত্র পৃথিবী ও স্বর্গ— উভয়েই দগ্ধ হয়ে যাবে। এর পর আপন পক্ষীয় রথীদের শ্রেষ্ঠত্ব তিনি ঘোষণা করেছেন। ভীমসেন, নকুল, সহদেব, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, চেকিতান, বিরাট, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, আপনপুত্র অভিমন্যু—প্রত্যেকের রণকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। তারপর বলেছেন নিজের কথা। দেবদত্ত শঙ্খ, গাণ্ডিবটংকার ও অক্ষয় তূণ নিয়ে তিনি রণক্ষেত্রে শূলপাণির তাণ্ডব করবেন। কর্ণসহ ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের যুদ্ধ আরম্ভ না হওয়া পর্যন্ত নারী এবং অন্য পদার্থ চূড়ান্ত ভোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ যুদ্ধ আরম্ভ হলে এরা আর কেউ বেঁচে থাকবেন না।
অর্জুন এর পর কৃষ্ণের বীরত্ব বর্ণনা করেছেন। জানিয়েছেন কৃষ্ণ ইচ্ছা করলেই ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের মেরে ফেলতে পারেন। কৃষ্ণের অত্যাশ্চর্য যুদ্ধ কাহিনির বর্ণনা দিয়েছেন। নিষাদরাজ একলব্য, সৌভবিমানগর্বী শাল্ব, নরকাসুর বধ করে অদিতি দেবীর মণিকুণ্ডল উদ্ধার কাহিনি বিবৃত করেছেন। দেবতারা কৃষ্ণকে বর দিয়েছেন “জলে স্থলে যুদ্ধে তিনি অপরাজেয় থাকবেন। অস্ত্র তাঁর দেহ ভেদ করবে না।” অর্জুনের মুখে কৃষ্ণের প্রতি এই দৈবী বরদানের কথা মতে শুনতে আমাদের হঠাৎ খটকা লাগে। মনে পড়ে, জর নামক এক ব্যাধের নিক্ষিপ্ত শর কৃষ্ণের পা ভেদ করে যায় এবং তিনি সেই আঘাতে ইহলোক ত্যাগ করেন। তা হলে সে কি কৃষ্ণের আর এক লীলা? জর ব্যাধ রূপক মাত্র? সাধারণ মানুষের মত জরাগ্রস্ত হয়ে কৃষ্ণ দেহত্যাগ করেছিলেন? এর সুস্পষ্ট উত্তরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। অন্য কোনও বর অথবা অভিশাপের।
প্রচণ্ড ক্রোধে অর্জুন এই ভাষণেই সেই বাক্যই উচ্চারণ করলেন, যা তাঁর পতনের কারণ হয়েছিল। ভীম মহাপ্রস্থানের পথে অর্জুনের পতনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, “অৰ্জুন বলেছিলেন, তিনি একাই কৌরবপক্ষের সব বীরদের বধ করবেন। তা তিনি পালন করতে পারেননি।”
বীর অর্জুনের রূপ আমরা অন্যত্রও দেখেছি। কিন্তু অর্জুনের এতখানি ক্রোধের প্রকাশ অন্য কোথাও দেখা যায়নি।
৫৬
কৌরব-সভায় শ্রীকৃষ্ণ
[পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে শান্তি স্থাপনের শেষ চেষ্টা হিসাবে শ্রীকৃষ্ণ স্থির করলেন তিনিই শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টায় হস্তিনাপুর যাবেন। বাদ-প্রতিবাদের অন্তে পাণ্ডবেরা রাজি হলেন। কৃষ্ণ উপপ্লব্য নগর থেকে হস্তিনার উদ্দেশে রওনা হলেন। যেতে যেতে কৃষ্ণ দেখলেন দলে দলে মুনি, শ্রেষ্ঠ ঋষি, ব্রাহ্মণেরা চলেছেন। প্রশ্ন করে কৃষ্ণ জানতে পারলেন যে, কৃষ্ণ হস্তিনাপুর যাবেন শুনে তাঁরাও সেই সভায় যাবার জন্য যাত্রা করেছেন। কৃষ্ণ হস্তিনায় পৌঁছলে, ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধন তাঁর মর্যাদা অনুসারে ভ্রাতাদের, অন্তঃপুরিকাদের ও বারাঙ্গনাদের দিয়ে পুষ্পবৃষ্টি করালেন। কৃষ্ণ রাজভবনে প্রবেশ করলে দুর্যোধন তাঁর জন্য উত্তম বাসভবন ও খাদ্যসামগ্রীর ব্যবস্থা করেছিলেন। কৃষ্ণ সেগুলি গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, কুন্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিদুরের গৃহে নৈশাহার ও রাত্রিবাস করলেন। পরদিন প্রভাতে প্রাতস্নানাদি সেরে কৃষ্ণ হস্তিনাপুর রাজসভায় প্রবেশ করলেন। সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে সমস্ত সভা কৃষ্ণকে গ্রহণ করলেন। সমস্ত সভাই কৃষ্ণ নিবিষ্ট-চিত্ত হয়ে গেল।]
সমস্ত সভা নীরবে উপবেশন করলে দুন্দুভির মতো মধুরধ্বনি কৃষ্ণ বলতে লাগলেন, “ভরতনন্দন ধৃতরাষ্ট্র, বীরগণের বিনাশ ছাড়াই যাতে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে শান্তি হয়, আমি তাই প্রার্থনা করবার জন্য আপনার কাছে এসেছি। সমস্ত জ্ঞাতব্য আপনার জানা আছে। আমি আপনার মঙ্গলের জন্য শান্তি চাই। সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে কুরুবংশ শ্রেষ্ঠ। দুঃস্থের প্রতি কৃপা, শোকার্তের প্রতি করুণা, শরণাগতকে আশ্রয় দান, সরলতা, সহৃদয়তা, ক্ষমা, সত্য—এই গুণগুলিতেই কুরুবংশ শ্রেষ্ঠ। মহারাজ! সেই প্রশস্ত কুলে আপনার জন্য কোনও অসঙ্গত কাজ হওয়া উচিত নয়। সবাই প্রত্যাশা করে কৌরবেরা ভিতরে বা বাইরে কোনও অন্যায় আচরণ করলে আপনি বারণ করবেন। আপনি জানেন, অশিষ্ট, মর্যাদাশূন্য, লোভী দুর্যোধন প্রভৃতি আপনার পুত্রেরা ধর্ম ও অর্থকে অগ্রাহ্য করে বন্ধু ও স্বজন পাণ্ডবদের প্রতি নৃশংস ব্যবহার করে আসছে। কৌরবদের আচরণের জন্যই এই বর্তমান ভয়ংকর বিপদ এসেছে। আমি বিশ্বাস করি আপনি ও আমি চেষ্টা করলে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারি। আপনি আপনার পুত্রদের সৎপথে নিয়ে আসুন, আমি পাণ্ডবদের সৎপথে স্থাপন করব। আপনি পুত্রদের শাসন করুন, সন্ধির প্রচেষ্টা করুন, তাতে আপনার হিতও হবে, পাণ্ডবদের হিতও হবে। পাণ্ডবদের মতো বীরগণকে যত্ন করেও নিজের পক্ষে পাওয়া যায় না। পাণ্ডবেরা আপনাকে রক্ষা করতে থাকলে, দেবগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে স্বয়ং ইন্দ্রও আপনাকে জয় করতে সমর্থ হবেন না। অন্য রাজারা কী করে পারবেন? যে পক্ষে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, বিবিংশতি, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সোমদত্ত, বাহ্লিক, জয়দ্রথ, কলিঙ্গরাজ, কম্বোজরাজ, সুদক্ষিণ, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল-সহদেব, মহাতেজা সাত্যকি এবং মহারথ যুযুৎসু থাকবেন, কোন বিপরীত বুদ্ধি লোক তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধের ইচ্ছা করবেন? এই মিলিত উভয়পক্ষ নিয়ে আপনি পৃথিবী শাসন করতে পারবেন। জগতের প্রভুত্ব, শত্রুগণের অজেয়ত্ব লাভ করবেন। প্রবল রাজারা আপনার সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হবেন। তখন আপনি পুত্র, পৌত্র, পিতা, ভ্রাতা ও বন্ধুগণকে নিয়ে সর্বপ্রকারে রক্ষিত হয়ে সুখে জীবন কাটাতে পারবেন। শুধু পাণ্ডবগণকে সামনে রেখেই আপনি নির্বিঘ্নে সমস্ত পৃথিবী ভোগ করতে পারবেন। আর পাণ্ডব ও আপনার পুত্রেরা একত্রে মিলিত হলে আপনি অন্য যে কোনও শত্রু জয় করতে পারবেন, শত্রুদের অর্জিত ভূমিও আপনি গ্রহণ করতে পারবেন। পক্ষান্তরে, যুদ্ধ হলে মহামারী সৃষ্টি হবে। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না, এই দুই পক্ষের মারামারিতে কোনও ধর্ম নেই। ক্ষতি সবটাই আপনার—যে পক্ষই নিহত হবে, আপনি ‘সুখ’ পাবেন না। পাণ্ডবগণ ও আপনার পুত্রগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। আপনি তাঁদের মহাভয় থেকে রক্ষা করুন। পৃথিবীর রাজারা যুদ্ধের জন্য সমবেত হয়েছেন। এঁরা লক্ষ লক্ষ নিরীহ সৈন্যকে বধ করবেন। আপনি এই নির্দোষ লোকগুলিকে রক্ষা করুন। এই লোকগুলি বদান্য, লজ্জাশীল, সভ্য, সৎকুলোৎপন্ন এবং পরস্পর পরস্পরের সহায়। আপনি এদের মহাভয় থেকে রক্ষা করুন। মহারাজ এই রাজারা সুন্দর বস্ত্র ও মাল্য ধারণ করে, আপনার কাছে আদর পেয়ে, ক্রোধ ও শত্রুতা পরিত্যাগ করে, পরস্পরের মিলিত সভায় পানভোজন করে পরম সুখে আপন আপন গৃহে ফিরে যান। পূর্বে পিতৃহীন পাণ্ডবদের আপনি স্নেহের সঙ্গে প্রতিপালন করেছিলেন। এখনও, এই আয়ুক্ষয়ের সময়ে, পুত্রের মতো তাঁদের পালন করুন। বিপদের সময়ে পাণ্ডবদের রক্ষা করা আপনার কর্তব্য। আপনি কর্তব্য পালন করুন।
“রাজা পাণ্ডবেরা প্রণাম জানিয়ে আপনাকে বলেছেন, ‘আমরা আপনার আদেশে অনুচরবর্গের সঙ্গে দুঃখ ভোগ করেছি। আমরা বারো বৎসর বনে বাস করেছি এবং এক বৎসর লোকপূর্ণ বিরাট নগরে অজ্ঞাতবাস করেছি। আপনি আমাদের জ্যেষ্ঠতাত! আমাদের শপথ আমরা পালন করেছি, আপনিও আপনার শপথ পালন করুন। আমরা কোনও অবস্থায় শপথভগ্ন করিনি। আপনি শপথ রক্ষা করলে, গুরুতর কষ্টের পর আমরা আপন রাজ্য লাভ করতে পারি। আপনি ধর্ম ও অর্থ জানেন, সুতরাং আপনি আমাদের রক্ষা করুন। আপনি গুরু। আপনার আদেশে আমরা বহুতর কষ্ট সহ্য করেছি। সুতরাং আপনিও আমাদের উপরে পিতা ও মাতার ন্যায় ব্যবহার করুন। গুরুর প্রতি শিষ্যের যে ব্যবহার করা উচিত, তা আমরা করেছি। শিষ্যের প্রতি গুরুর কর্তব্য আপনি পালন করুন। আপনি পিতা, আমরাও বিপথে চলেছি। আপনি আমাদের সৎপথে স্থাপন করুন এবং নিজেও ধর্মে ও সৎপথে থাকুন।’ এই সভাকে লক্ষ্য করে পাণ্ডবেরা বলেছেন, ‘ধর্মজ্ঞ সভাসদগণের অসঙ্গত কাজ করা উচিত নয়। যে সভায় সভাসদদের সামনেই অধর্ম ধর্মকে এবং মিথ্যা সত্যকে বিনষ্ট করে, সে সভার সভাসদগণই বিনষ্ট হন। যেখানে সভায় ধর্ম অধর্ম কর্তৃক আহত হয়, কিন্তু সভ্যেরা সেই আঘাতের প্রতিবিধান করেন না, সেখানে সভ্যেরাও অধর্মাহত হন। নদী যেমন তীরের বৃক্ষকে ভেঙে ফেলে, তেমনই ধর্ম সেই সভ্যদের বিধ্বস্ত করে’।
“ভরতশ্রেষ্ঠ। যাঁরা ধর্মের দিকে লক্ষ্য রেখে, কেবল কর্তব্য বিষয়ের চিন্তা করতে থেকে নীরবে আছেন, সেই পাণ্ডবেরা রাজ্যার্ধ প্রত্যর্পণের কথা সত্য, ধর্মসংগত ও ন্যায়সংগতই বলেছেন। আমিও আপনাকে অনুরোধ করছি পাণ্ডবের প্রাপ্য রাজ্যার্ধ তাঁদের প্রত্যর্পণ করুন। আপনি এই ক্ষত্রিয়গণকে মৃত্যুপাশ থেকে মুক্ত করুন। শান্ত হোন, লোভের বশবর্তী হবেন না। নরনাথ, যুধিষ্ঠির যে সর্বদা সাধুধর্মে অবস্থান করছেন, এবং পুত্রগণের সঙ্গে আপনার উপরে যে ব্যবহার করেছেন, তা আপনি জানেন। আপনি জতুগৃহে যুধিষ্ঠিরকে অগ্নিদগ্ধ করতে চেয়েছিলেন; তবুও তিনি আবার আপনার আশ্রয়েই বাস করতে এসেছিলেন। পুত্রগণের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরকে আপনি ইন্দ্রপ্রস্থে প্রেরণ করেছিলেন এবং শেষে তাঁকে বারো বছর বনে ও এক বছর অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়েছেন। তবু যুধিষ্ঠির আপনার আশ্রয়েই বাস করতে আবার আপনার কাছে প্রার্থনা করেছেন। তিনি ইন্দ্রপ্রস্থে থেকে সকল রাজাকে বশীভূত করে আপনার অনুগত করে দিয়েছিলেন, কিন্তু কখনও আপনাকে অতিক্রম করতে চাননি। তিনি এইভাবে চলেছেন, অথচ শকুনি তাঁর রাজ্য, ধন ও ধান্য হরণ করার ইচ্ছায় দ্যূতক্রীড়ায় অত্যন্ত কপটতা করলেন। অসাধারণ ধৈর্যশীল যুধিষ্ঠির সেই অবস্থায় পড়েও দ্রৌপদীকে সভাগত দেখেও ক্ষত্রিয় ধর্ম থেকে বিচলিত হলেন না।
“সে যাই হোক। ভরতনন্দন আমি আপনার ও তাঁদের মঙ্গল ইচ্ছা করি, আপনি এই লোকগুলিকে ধর্ম, অর্থ ও সুখ থেকে বিচ্যুত করবেন না। আপনি নিজের বিপদকে সম্পদ ও সম্পদকে বিপদ বলে মনে করে লোভের দিকে ধাবিত পুত্রদের দমন করুন। অরিন্দম পাণ্ডবেরা আপনার সেবা করতেও প্রস্তুত, আবার যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত। সুতরাং যা আপনার বিশেষ হিত, তাই করুন।”
তস্মিন্নভিহিতে বাক্যে কেশবেন মহাত্মনা।
স্তিমিত হৃষ্টরোমাণ আসন সর্বে সভাসদঃ ॥ উদ্যোগ : ৮৯ : ১ ॥
“মহাত্মা কৃষ্ণ সেইসব বাক্য বললে, সভ্যেরা সকলেই নীরব ও রোমাঞ্চিতদেহ হয়ে বসে রইলেন।” সকলেই মনে মনে কৃষ্ণের বাক্যের প্রশংসা করলেন, কিন্তু কেউই প্রথমে কথা বলবার চেষ্টা করলেন না। রাজাদের সকলকে নীরব দেখে পরশুরাম উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে সার্বভৌম রাজা দম্ভোদ্ভরের কাহিনি শুনিয়ে বললেন, “প্রাচীনকালে সর্বলোকের অপরাজেয় নর ও নারায়ণ দুই ঋষি ছিলেন। পূর্বের সেই নর ও নারায়ণ ঋষিই, অর্জুন ও কৃষ্ণরূপে জন্মগ্রহণ করেছেন।” তাঁরা অপরাজেয়। সুতরাং তাঁদের সঙ্গে কোনও প্রকারেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ধৃতরাষ্ট্রের উচিত হবে না। পরশুরাম ধৃতরাষ্ট্রকে শান্ত হতে ও সন্ধি করতে বললেন। তখন মহর্ষি কণ্ব উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “লোকপিতামহ ব্রহ্মার নাশ নেই, হ্রাসও নেই। নর ও নারায়ণ ঋষিও ঠিক সেইরকম। দেবগণের মধ্যে একমাত্র বিষ্ণুই অজেয়, হ্রাসবিহীন, প্রভাবশালী এবং সকলের নিয়ন্তা।” বিনতানন্দন গরুড়ের গর্ব চূর্ণ হওয়ার কাহিনি বিধৃত করে কণ্ব দুর্যোধনকে বললেন, “পুত্র গান্ধারীনন্দন, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি মহাবীর পাণ্ডবগণের সঙ্গে যুদ্ধে না মিলিত হচ্ছ, সেই পর্যন্তই জীবিত আছ। বীরশ্রেষ্ঠ ও মহাবল বায়ুপুত্র ভীমসেন এবং ইন্দ্রপুত্র অর্জুন যুদ্ধে কোন ব্যক্তিকে বধ করতে পারে না? কৃষ্ণরূপী বিষ্ণু, ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্র ও অশ্বিনীকুমারদ্বয় এই দেবগণকে তুমি কীভাবে যুদ্ধে মিলিত হবে। অতএব রাজপুত্র তোমার বিরোধের প্রয়োজন নেই, শান্তি লাভ করো এবং কৃষ্ণকে উপায়রূপে অবলম্বন করে বংশ রক্ষা করো।” দুর্যোধন তখন মহর্ষি কণ্বের কথা শুনে কর্ণের দিকে চেয়ে উচ্চ স্বরে হাস্য করে উঠলেন। হাতির শুঁড়ের মতো আপন ঊরুতে চাপড় মেরে বললেন, “মহর্ষি, বিধাতা আমাকে যেমনভাবে গড়েছেন, ভবিষ্যতে যেমন চালাবেন, আমি সেইভাবেই চলছি। অতএব, আপনাদের এই অনর্থক উপদেশে আমার কী হবে?”
তখন দেবর্ষি নারদ দুর্যোধনকে বললেন, পরশুরাম, কণ্বমুনি, ভীষ্ম, দ্রোণ যে উপদেশ দিয়েছেন সেই অনুযায়ী চলাই তাঁর কর্তব্য। দেবর্ষি নারদ তাঁকে বিশ্বামিত্র, গরুড়, গালব ইত্যাদির কাহিনি বর্ণনা করে বললেন, “গান্ধারীনন্দন তুমি অভিমান ও ক্রোধ পরিত্যাগ করো। যুদ্ধের আড়ম্বর ত্যাগ করে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করো। বন্ধুদের হিতকর বাক্য গ্রহণ করো, অহিতকর বাক্য ত্যাগ করো। তুমি শক্তিশালী পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করে বিপদাপন্ন হবে।”
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “ভগবান নারদ! আপনি যা বললেন, তা সত্য। আমিও পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধির ইচ্ছা করি। কিন্তু আমি তা করতে সমর্থ নই।” তারপর ধৃতরাষ্ট্র কৃষ্ণকে বললেন, “কৃষ্ণ তুমি স্বর্গোপযোগী, লৌকিক নিয়মানুসারী, ধর্মসংগত ও ন্যায়ানুমোদিত কথাই বলেছ। কিন্তু আমি স্বাধীন নই। পুত্রেরা যে কার্য করছে, তা আমার প্রিয়ও নয়। তবে জনার্দন, আমি নিষেধ করলেও দুরাত্মা পুত্রেরা শুনবে না। অতএব কৃষ্ণ তুমি অনুনয় দ্বারা দুর্যোধনকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করো। সে কোনও গুরুজনের কথা শোনে না। পিতামাতার কথাও শোনে না, এই পাপবুদ্ধি, ক্রূরস্বভাব, পাপচিত্ত, অচেতনপ্রায় দুরাত্মা দুর্যোধনকে তুমি নিজে একটু উপদেশ দাও। তা হলে আমার বন্ধুর কাজ হবে।”
তখন ধর্মতত্ত্বজ্ঞ কৃষ্ণ দুর্যোধনের দিকে ফিরে অসহিষ্ণু দুর্যোধনকে মধুর বাক্যে বললেন, “ভরতনন্দন! কৌরবশ্রেষ্ঠ! দুর্যোধন! অনুচরদের নিয়ে আপনার মঙ্গলের জন্য যা বলছি তা শুনুন। আপনি মহাপ্রাজ্ঞবংশে জন্মেছেন। শাস্ত্রজ্ঞান ও সৎকার্যশালী হয়ে সর্বগুণসম্পন্ন হয়েছেন। অতএব মহারাজ আপনি সৎকার্য করুন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দুষ্কুলজাত, দুরাত্মা, নৃশংস ও নির্লজ্জ মানুষেরা যে ধরনের কাজ করে, আপনাকে সেই কাজেই উদ্যত হতে দেখছি। বর্তমানে বিনা কারণে উৎপন্ন কার্য অধর্মজনক, ভয়ংকর, অনিষ্টকারী ও প্রাণনাশক। তা ছাড়া আপনি তা সম্পন্নও করতে পারবেন না। সুতরাং এই অনর্থজনক কার্যে আগ্রহ ত্যাগ করলে নিজের, ভ্রাতৃগণের, ভৃত্যদের ও বন্ধুদের মঙ্গল সম্পাদন করবেন এবং আপনি নিজেও পাপ ও নিন্দাজনক কার্য থেকে মুক্তি পাবেন। বিচক্ষণ, বীর, মহোৎসাহী, যত্নশীল ও বহুশাস্ত্রজ্ঞ পাণ্ডবগণের সঙ্গে আপনি সন্ধি করুন। মহামতি ধৃতরাষ্ট্র, ভীম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপাচার্য, সোমদত্ত, বুদ্ধিমান বাহ্লিক, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সঞ্জয়, বিবিংশতি, জ্ঞাতিবর্গ ও মিত্রগণের অত্যন্ত হিত ও প্রিয়কার্য হবে। শান্তিস্থাপন করলে সমগ্র জগতের মঙ্গল হবে। আপনি লজ্জাশীল, সৎকুলে জন্মেছেন, শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করেছেন এবং দয়ালু। আপনি পিতা ও মাতার শাসনে থাকুন। পিতার শাসন অত্যন্ত মঙ্গলজনক। সকল লোকেই বিপদে পড়ে শেষে পিতৃপ্রদত্ত শাসন স্মরণ করে। আপনার পিতা, অমাত্যবর্গ সকলের আন্তরিক ইচ্ছা পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি হোক। আপনারও তাই ইচ্ছা হোক।
“যে লোক বন্ধুদের উপদেশ শুনে তা গ্রহণ করে না, পরিণামে তাই তাকে দগ্ধ করতে থাকে। যে লোক মোহবশত মঙ্গলজনক বাক্য গ্রহণ করে না, সেই দীর্ঘসূত্র ও স্বার্থভ্রষ্ট লোক পরে অনুতপ্ত হয়। যে লোক মঙ্গলজনক বাক্য শুনে নিজের লোক নিজের মত পরিত্যাগ করে প্রথমেই তা গ্রহণ করে, সে লোক অনায়াসে উন্নতিলাভ করে। যে লোক নিজের প্রতিকূল মত থাকায় হিতৈষীদের মঙ্গলজনক বাক্য শ্রবণ করে না, সে শেষ পর্যন্ত শত্রুদের বশীভূত হয়। যে লোক সজ্জনদের মত উপেক্ষা করে অসজ্জনের মতে চলে, অচিরকালের মধ্যেই বন্ধুগণ তাঁর বিপদে শোক করতে থাকেন। যে লোক প্রধান অমাত্যদের উপেক্ষা করে, নিকৃষ্ট অমাত্যদের সেবা করে, সে লোক ভয়ংকর বিপদ থেকে উদ্ধার পায় না। ভরতনন্দন আপনি বীর আত্মীয়বর্গের সঙ্গে বিরোধ করে অশিষ্ট, অসমর্থ ও মূর্খ অন্য লোকদ্বারা আত্মরক্ষার ইচ্ছা করছেন। পৃথিবীতে আপনি ছাড়া অন্য কোন লোক ইন্দ্রতুল্য মহারথ জ্ঞাতিগণকে পরিত্যাগ করে অন্যদ্বারা আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা করে?
“আপনি জন্ম থেকেই পাণ্ডবদের প্রতারণা করে আসছেন। কিন্তু তাঁরা কোনও সময়েই আপনার উপর ক্রুদ্ধ হননি, কারণ পাণ্ডবেরা ধর্মাত্মা। আপনি আজন্ম পাণ্ডবদের সঙ্গে অসৎ ব্যবহার করে আসছেন, তবুও যশস্বী পাণ্ডবেরা আপনার সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত ব্যবহারই করছেন। ক্রোধের বশীভূত না হয়ে, সেই পরম বন্ধুদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করুন। বিচক্ষণ মানুষ ধর্ম, অর্থ, কাম উদ্দেশ্য করেই কার্যারম্ভ করেন। আর ত্রিবর্গ সম্ভব না হলে কেবল ধর্ম ও অর্থের অনুসরণ করে। যারা ধর্ম, অর্থ ও কামের মধ্যে একটি লাভ করতে চায়, উত্তম লোক তাদের মধ্যে ধর্মের অনুসরণ করে, মধ্যম লোক কলহের কারণ অর্থের চেষ্টা করে, অধম লোক কামলাভের বিষয়ে যত্ন করে থাকে। কিন্তু কাম ও অর্থ লাভ করতে হলে, ধর্ম আচরণ করা প্রথমে প্রয়োজন। ধর্ম আচরণ করলে অর্থ ও কাম স্বাভাবিকভাবেই লাভ করা যায়। ভরতশ্রেষ্ঠ আপনি কিন্তু নিকৃষ্ট উপায়ে সকল রাজমধ্যে প্রসিদ্ধ, বিশাল ও উজ্জ্বল সাম্রাজ্য লাভ করার ইচ্ছা করছেন। সদ্ব্যবহারী লোকের সঙ্গে যিনি অসৎ ব্যবহার করেন, তিনি কুঠারদ্বারা বনের মধ্যে আপনাকে ক্ষুদ্র করতে থাকেন। যার পরাভব অভীষ্ট নয়, তার বুদ্ধি দূষিত করতে নেই। মনস্বী লোক ত্রিভুবনের মধ্যে অন্য কোনও সাধারণ লোকের উপরেও অযথা ক্রোধ প্রকাশ করেন না; তাতে বীরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবদের কথা আর কী বলব। মহারাজ আপনার পক্ষে দুর্জনদের সঙ্গে সম্মেলন অপেক্ষা পাণ্ডবদের সঙ্গে সম্মেলন ভাল। কারণ, তাঁরা আপনার প্রীতি বিধান করতে থাকলে, আপনি সমস্ত অভীষ্টই লাভ করতে পারবেন। পাণ্ডবেরা রাজ্য জয় করেছিলেন, বর্তমানে আপনি তা ভোগ করছেন; অথচ সেই পাণ্ডবদের পরিত্যাগ করে আপনি অন্য দ্বারা আত্মরক্ষার আশা করছেন। দুঃশাসন, দুর্বিষহ, কর্ণ ও শকুনি ইত্যাদির উপর প্রভুত্ব স্থাপন করে আপনি সম্পদ লাভ করবার ইচ্ছা করছেন। অথচ এঁরা আপনার জ্ঞান, ধর্ম, অর্থ সম্পাদন করতে সমর্থ হবেন না কিংবা পাণ্ডবদের সামনে বিক্রমও প্রকাশ করতে পারবেন না। এমনকী আপনার সঙ্গে মিলিত হয়েও এই রাজারা সকলে যুদ্ধে ক্রুদ্ধ ভীমসেনের মুখের দিকেও তাকাতে পারবেন না।
“রাজা দুর্যোধন এই সমবেত সমস্ত সৈন্য এবং এই ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, সোমদত্ত নন্দন ভূরিশ্ৰবা, অশ্বত্থামা ও জয়দ্রথ মিলেও যুদ্ধে অর্জুনের সম্মুখীন হতে পারবেন না। কারণ, সমস্ত মানুষ, গন্ধর্ব, এমনকী সকল দেবতা ও অসুরগণও যুদ্ধে অর্জুনকে জয় করতে পারেন না। অতএব আপনি যুদ্ধে মন দেবেন না। ভরতশ্রেষ্ঠ! যুদ্ধে জনক্ষয় করার দরকার কী? আপনি সমগ্র রাজসৈন্যমধ্যে এমন একটি পুরুষকে খুঁজে বার করুন, যিনি জয় করলে আপনার জয় হতে পারে। যিনি খাণ্ডবদাহের সময়ে গন্ধর্ব, যক্ষ, অসুর, নাগদের সঙ্গে দেবগণকে জয় করেছিলেন, সেই অর্জুনের সঙ্গে মানুষ যুদ্ধ করতে পারে? বিরাট রাজ্যে একের সঙ্গে ও বহুর বিশাল যুদ্ধ হয়েছিল শুনতে পাই। সেই ঘটনাই আমার উক্তির পক্ষে যথেষ্ট। যিনি যুদ্ধে সাক্ষাৎ শিবকে সন্তুষ্ট করেছিলেন, সেই অজেয়, দুর্ধর্ষ, বিজয়ী, বীরনিয়ম থেকে অভ্রষ্ট, মহাবীর ও তেজস্বী অর্জুনকে আপনি যুদ্ধে জয় করার আশা করেন? আমি আবার অর্জুনের সহচর থাকব। এ অবস্থায় অর্জুন প্রতিকূলভাবে আসতে থাকলে, কোন ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইবে? স্বয়ং ইন্দ্রও তা চাইবেন না। যিনি অর্জুনকে যুদ্ধে জয় করতে পারবেন, তিনি দু’হাতে পৃথিবী উত্তোলন করতে পারবেন, ক্রুদ্ধ হয়ে সকল লোক দগ্ধ করতে পারবেন, এবং স্বর্গ থেকে দেবগণকে নিপাতিত করতে পারবেন। রাজা আপনি—পুত্র, জ্ঞাতি, ভ্রাতা ও সম্বন্ধিগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। আপনার জন্য এই ভরতশ্রেষ্ঠগণ যেন বিনষ্ট না হয়ে যান। কৌরবেরা বেঁচে থাকুন, এই বংশটা যেন নষ্ট না হয় এবং লোকে আপনাকে ‘নষ্টকীর্তি লোকহন্তা’ না বলে। সন্ধি হলে, মহারথ পাণ্ডবেরা আপনাকেই যুবরাজ পদে এবং আপনার পিতা ধৃতরাষ্ট্রকেই মহারাজ পদে স্থাপন করবেন। রাজলক্ষ্মী আপনাকে আশ্রয় করার জন্য আসছেন, এ অবস্থায় তাঁকে অবজ্ঞা করবেন না। আপনি পাণ্ডবদের অর্ধরাজ্য দান করে বিশাল রাজলক্ষ্মী লাভ করুন। সুহৃদগণের বাক্য পালন করুন, পাণ্ডবদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করুন ও মিত্রদের নিয়ে আনন্দ অনুভব করতে থেকে চিরকালের জন্য নানাবিধ মঙ্গল লাভ করুন।”
তখন ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন যে, কৃষ্ণ অতি সংগত কথাই বলেছেন। দুর্যোধনের কৃষ্ণের প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। কুরুবংশ সারা ভারতবর্ষে বিখ্যাত। সেই বংশের রাজলক্ষ্মীকে ধৃতরাষ্ট্রের জীবিত অবস্থায় হস্তচ্যুত করা দুর্যোধনের উচিত হবে না। হিতৈষী কৃষ্ণ, বুদ্ধিমান বিদুর, বৃদ্ধ পিতা ধৃতরাষ্ট্রের বাক্য লঙ্ঘন করে কুলহন্তা ও কাপুরুষের মতো কুপথে যাওয়া দুর্যোধনের কখনও উচিত হবে না। আচার্য দ্রোণ ভীষ্মের কথা সর্বপ্রকারে সমর্থন করে বললেন যে, কৃষ্ণ এবং ভীষ্ম অত্যন্ত যুক্তিসংগত কথা বলেছেন। বুদ্ধির মোহে কৃষ্ণের অবমাননা করলে দুর্যোধন অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সমস্ত লোক, পুত্র, ভ্রাতৃগণ নিহত হবে এবং তার জন্য কুলক্ষয়ের কারণ হিসাবে দুর্যোধন চিহ্নিত হবে। যে সৈন্যমধ্যে কৃষ্ণ ও অর্জুন থাকবেন—সে সৈন্য চিরকালই অজেয়। পরশুরাম অর্জুন সম্পর্কে যা বলেছেন, অর্জুন তার থেকেও বেশি। দেবকীনন্দন কৃষ্ণ দেবগণের পক্ষেও অতি দুঃসহ। সন্ধি করো, শান্তি লাভ করো। অসহিষ্ণু দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে মহামন্ত্রী বিদুর বললেন যে, তিনি দুর্যোধনের জন্য শোক করবেন না।
কিন্তু দুর্যোধনের মাতা গান্ধারী ও পিতা ধৃতরাষ্ট্রের জন্য শোক করেন। কারণ দুর্যোধন রক্ষক হওয়ায় হতমিত্র ও হতমন্ত্রী দুটি ছিন্নপক্ষ পাখির মতো এদের বেঁচে থাকতে হবে। কুলহন্তা, কুপুরুষ ও পাপিষ্ঠ তোমাকে জন্ম দিয়ে ভিক্ষুকের মতো তোমার পিতা-মাতাকে বেঁচে থাকতে হবে। রাজা ধৃতরাষ্ট্রও ভ্রাতৃগণের সঙ্গে উপবিষ্ট দুর্যোধনকে বললেন যে, কৃষ্ণ অত্যন্ত মঙ্গলজনক কথা বলছেন। কৃষ্ণকে অবলম্বন করেই দুর্যোধন কুরুকুলের মঙ্গল সম্পাদন করতে পারবেন। কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের কাছে যান। কৃষ্ণ শান্তি এনে দিচ্ছেন, তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলে পরাভব অনিবার্য। দ্রোণ ও ভীষ্ম দুজনেই আবার বললেন যে, অর্জুনের গাণ্ডিব টংকার আর ভীমসেনের গদা উত্তোলিত হবার আগেই এবং লজ্জাশীল ও মহাধনুর্ধর ক্রুদ্ধ যুধিষ্ঠিরের দৃষ্টিপাত করার আগেই দুর্যোধন মস্তক অবনত করে যুধিষ্ঠিরকে নমস্কার করুন—রাজশ্রেষ্ঠ ধর্মরাজও দু’হাতে দুর্যোধনকে ধারণ করুন। যুধিষ্ঠির তাঁর দক্ষিণ হস্ত দুর্যোধনের কাঁধে স্থাপন করুন, তাঁর হাত দুর্যোধনের পিঠে বুলিয়ে দিন, তাঁর মস্তকাঘ্রাণ করুন। ভীমসেন দুর্যোধনকে আলিঙ্গন করুন। অর্জুন, নকুল, সহদেব তাঁকে অভিবাদন করবেন—সমস্ত রাজা এই দৃশ্য দেখে আনন্দাশ্রু মোচন করবেন। বৈরসস্তাপশূন্য হয়ে যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন ভ্রাতৃভাবে পৃথিবী ভোগ করুন।
কৌরবসভায় অপ্রিয় বাক্য শুনে দুর্যোধন মহাবাহু ও যশস্বী কৃষ্ণকে বললেন, “কৃষ্ণ, সকল অবস্থা বিশেষভাবে বিবেচনা করে এইসব কথা আপনার বলা উচিত ছিল। কিন্তু আপনি উল্লেখ করে বিশেষভাবে আমারই নিন্দা করছেন। আপনি পাণ্ডবদের প্রতি অনুরাগবশত বিনা কারণে আমার নিন্দা করেন। কিন্তু এই যে এত নিন্দা করেন—সে কি দোষ-গুণ পর্যালোচনা করে করেন? আপনি, বিদুর, রাজা ধৃতরাষ্ট্র, আচার্য দ্রোণ এবং পিতামহ ভীষ্ম—আপনারা কেবল আমারই নিন্দা করেন; কিন্তু কোনও পাণ্ডবের নিন্দা করেন না। অথচ আমি বিশেষ চিন্তা করেও আমার কোনও দোষ দেখতে পাই না। ছোটও নয়, বড়ও নয়। অতএব বোঝা যাচ্ছে আপনারা সকলেই বিদ্বেষবশত আমার নিন্দা করেন। পাশাখেলা যুধিষ্ঠিরের প্রিয় এবং তিনি খেলতে স্বীকার করেছিলেন। শকুনি সেই পাশাখেলায় যুধিষ্ঠিরের রাজ্য জয় করেছিলেন, তাতে আমার অপরাধ কী? শকুনি পাণ্ডবদের যে সব সম্পত্তি জয় করেছিলেন, তা তখনই পিতৃদেব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর অজেয় পাণ্ডবগণ অনুদ্যূতে হেরে বনবাসে গিয়েছিলেন। তাই পণ ছিল, সুতরাং তাতেও আমাদের কোনও অপরাধ ছিল না। পাণ্ডবেরা নিজেরা আমাদের সঙ্গে বিরোধে অসমর্থ, সেই কারণে আমাদের চিরশত্রুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বিনা অপরাধে আমাদের সঙ্গে বিরোধে প্রবৃত্ত হয়েছে। আমরা তাদের কী অপকার করেছি? আমাদের কোন অপরাধে তারা সৃঞ্জয়দের সঙ্গে মিলিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের সংহার করার জন্য ইচ্ছা করছে। তবে কৃষ্ণ, ভয়ংকর কার্য বা বাক্যদ্বারা আমরা ভয়বশত ক্ষত্রিয় ধর্মচ্যুত হব না, অথবা সাক্ষাৎ ইন্দ্রের কাছেও অবনত হব না, তা জানবেন। আমাদের জয় করতে পারেন, এমন ক্ষত্রিয় তো আমার চোখে পড়ে না। দেবতারাও ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ ও কর্ণকে পরাজিত করতে পারেন না। তা পাণ্ডবেরা কী করবে? তার পরেও আমরা আপন ধর্মে অবিচলিত থেকে যদি যুদ্ধে মারা যাই, তা হলে আমরা অবশ্যই স্বর্গলাভ করব।
“কৃষ্ণ ক্ষত্রিয়দের প্রধান ধর্ম এই যে, তাঁরা যুদ্ধে শরশয্যায় শয়ন করেন। আমরা শত্রুদের কাছে অবনত না হয়ে, যদি বীরশয্যা লাভ করি তাতে আমার বন্ধুরা দুঃখিত হবেন না। সদবংশজাত ক্ষত্রধর্মাবলম্বী কোন লোক আপন ধর্মের দিকে লক্ষ্য রেখে শত্রুর কাছে অবনত হয়ে থাকে? ‘উদ্যম করবে, কিন্তু অবনত হবে না। কারণ, উদ্যমই পুরুষকার। বরং অসময়ে বিনষ্ট হবে, তথাপি কখনও অবনত হবে না।’—আত্মহিতৈষী লোকেরা মাতঙ্গ মুনির এই অভিমত গ্রহণ করে থাকেন। আমার মতো লোক সংসারে কেবলমাত্র ধর্ম ও ব্রাহ্মণের নিকট অবনত হতে পারে। অন্য কারও চিন্তা না করে যাবজ্জীবন সেই উদ্যমই করবে, এই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম এবং এই আমার মত।
“কৃষ্ণ পূর্বে আমার পিতৃদেব যে পাণ্ডবদের রাজ্যাংশ দান করবার অনুমতি দিয়েছিলেন, আমি জীবিত থাকতে পাণ্ডবেরা তা আর পাবে না। যে পর্যন্ত রাজা ধৃতরাষ্ট্র জীবিত আছেন, সে পর্যন্ত আমরা ও পাণ্ডবেরা অস্ত্র-শস্ত্র ত্যাগ করে তাঁর উপরে নির্ভর করেই চলব। পূর্বে আমি বালকের মতো পরাধীন ছিলাম, তখন পিতৃদেব পাণ্ডবদের রাজ্যাংশ দিয়েছিলেন, কিন্তু এখন আমি জীবিত থাকতে পাণ্ডবেরা আর সে অংশ পাবে না।
যাবদ্ধি তীক্ষ্ণয়া সূচ্যা বিধ্যেদশ্রেণ মাধব!।
তাবদপ্য পরিত্যাজ্যং ভূমের্নঃ পাণ্ডবান প্রতি ॥ উদ্যোগ : ১২৮ : ২৬ ॥
“মাধব! এমনকী, তীক্ষ্ণসূচির অগ্রভাগদ্বারা ভূমির যতটুকু স্থান বিদ্ধ হয়, তাও আমি পাণ্ডবদের দেব না।”
তখন কৃষ্ণ হাস্য করে ক্রোধে ঘূর্ণিত নয়ন হয়ে কৌরবসভায় দুর্যোধনকে বললেন, “তুমি বীরশয্যা লাভ করবে; স্থির হও, তোমার মন্ত্রীবর্গের সঙ্গে নিশ্চয়ই তুমি বীরশয্যা লাভ করবে। কারণ, গুরুতর যুদ্ধ বাঁধবে। তুমি মনে করো পাণ্ডবদের সম্পর্কে আমার অনুরক্ত হওয়ার কোনও কারণ নেই। রাজগণ আপনারা সবাই শুনুন। রাজসূয় যজ্ঞে মহাত্মা পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য দর্শন করে ঈর্ষান্বিত হয়ে তুমি শকুনির সঙ্গে দ্যূতক্রীড়ার কুমন্ত্রণা করেছিলে। না হলে, সরল স্বভাব সজ্জনপ্রিয় সেই শ্রেষ্ঠ জ্ঞাতিরা একটি কুটিলের সঙ্গে অন্যায় দ্যূতক্রীড়া করতে এখানে আসবেন কেন? যে দ্যূতক্রীড়া সজ্জনের বুদ্ধি নষ্ট করে, পাপিষ্ঠ অনুচরবর্গের সঙ্গে মিলিত হয়ে সদাচারের প্রতি লক্ষ না রেখে, ভয়ংকর বিপদের কারণ সেই দ্যূতক্রীড়া তুমিই করিয়েছিলে। তুমি ছাড়া কোন ব্যক্তি ভ্ৰাতৃভার্যাকে সভায় এনে সেইরকম নির্যাতন করতে পারে? তুমি নিজে স্পষ্টভাবে দ্রৌপদীকে যে কুৎসিত কথা বলেছিলে, তা অন্য কোন ব্যক্তি বলতে পারে? সৎকুলজাতা ও সচ্চরিত্রা এবং পাণ্ডবদের প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়তরা মহিষী দ্রৌপদীকে তুমি সেইপ্রকার নির্যাতন করেছিলে। তারপর, পরন্তপ পাণ্ডবেরা যখন বনে গমন করছিলেন, তখন দুঃশাসন কৌরবসভায় থেকে যে কুৎসিত কথা বলেছিল, তাও কৌরবেরা সকলেই জানে। পাণ্ডবেরা লোভী ছিলেন না, তোমাদের সঙ্গে উপযুক্ত ব্যবহারই করতেন। তাঁরা সর্বদাই ধর্মাচরণ করতেন এবং তাঁরা তোমাদের আপন আত্মীয়। এই অবস্থায় তাঁদের উপর অসংগত আচরণ তুমি ছাড়া আর কে করতে পারে? কর্ণ, দুঃশাসন এবং তুমি—নৃশংস ও অনার্য লোকের মতো বহু নিষ্ঠুর কথা বলেছিলে। বারণাবত নগরে কুন্তী দেবীকে পুত্রদের সঙ্গে পুড়িয়ে মারার চেষ্টায় তোমরা সার্থক হতে পারোনি। তোমাদের দ্বারা গুপ্ত হত্যা সম্ভাবনায় পাণ্ডবেরা মাতা কুন্তীকে নিয়ে এক ব্রাহ্মণের বাড়ি গুপ্তভাবে দীর্ঘকাল বাস করেছিলেন। তুমি পাণ্ডবদের বিষদান করে মারতে চেষ্টা করেছিলে, সর্পবন্ধন করে মারতে চেষ্টা করেছ, কিন্তু তুমি কোনও ক্ষেত্রেই সফল হতে পারোনি। তুমি সমস্ত সময়েই পাণ্ডবদের প্রতি অসৎ ব্যবহার করে নিকৃষ্ট বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছ। সুতরাং তুমি পাণ্ডবদের কাছে অপরাধী নও কেন? তারপর, পাণ্ডবেরা এখন তাঁদের পৈতৃক অংশই চাইছেন, তুমি তাও দিতে চাও না। কিন্তু পাপিষ্ঠ! তুমি ঐশ্বর্যভ্রষ্ট ও নিপাতিত হয়ে, সবই দিতে বাধ্য হবে। তুমি অসদ্ব্যবহারী নিকৃষ্ট ব্যক্তি। পাণ্ডবদের উপর গুরুতর অকার্য করে, এখন তুমি সভাকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছ? তুমি গুরুজনের কথা অগ্রাহ্য করে, দুষ্ট বন্ধুদের পরামর্শে এখনও অসৎ পথে চলছ। তোমার পিতা, মাতা, ভীষ্ম, দ্রোণ ও বিদুর বারবার বলেছেন, কিন্তু তুমি শুনছ না। অথচ তুমি শান্ত হলে, যুধিষ্ঠির ও তোমার গুরুতর লাভ হত। একে তোমার বুদ্ধির দোষ ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে। তুমি হিতার্থীদের কথা অগ্রাহ্য করে কখনও সুখ পাবে না। তোমার সমস্ত কর্মই অধর্ম ও অযশের হচ্ছে।”
কৃষ্ণের কথা শুনে অসহিষ্ণু দুঃশাসন দুর্যোধনকে বললেন, “রাজা যদি আপনি নিজের ইচ্ছায় পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি না করেন, তবে কৌরবেরা আপনাকে বন্দি করে যুধিষ্ঠিরের হাতে সমর্পণ করবেন। ভীষ্ম, দ্রোণ এবং আপনার পিতা—এঁরা আমাকে, আপনাকে এবং কর্ণকে পাণ্ডবদের হাতে প্রদান করবেন।” দুর্মতি, নির্লজ্জ, অশিষ্টের মতো মর্যাদাহীন, অভিমানী ও মান্য ব্যক্তির অবমাননাকারী ধৃতরাষ্ট্রপুত্র দুর্যোধন ভ্রাতা দুঃশাসনের এই কথা শুনে ক্রুদ্ধ সাপের মতো নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে সভার সমস্ত উপস্থিত গুরু-স্থানীয় ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে—সভা থেকে উঠে চলে গেলেন। দুর্যোধনের অনুচরগণও তাঁর অনুসরণ করে সভার বাইরে চলে গেলেন।
তখন ভীষ্ম বললেন, “যে লোক ধর্ম ও অর্থ ত্যাগ করে ক্রোধের বশীভূত হয়, অচিরকালের মধ্যে তার বিপদে শত্রুরা হাসতে থাকে। এই দুরাত্মা রাজপুত্র দুর্যোধন কার্যসাধনের উপায় জানে না, হঠাৎ রাজত্ব পেয়ে মিথ্যা অভিমানী এবং ক্রোধ ও লোভের বশীভূত। কৃষ্ণ আমি মনে করি এই ক্ষত্রিয়গুলিকে ডাক দিয়েছেন কাল—কারণ, মন্ত্রীগণের সঙ্গে রাজারা সকলেই দুর্যোধনের অনুসরণ করেছেন।” তখন বীর্যবান পদ্মনয়ন কৃষ্ণ সে-কথা শুনে ভীষ্ম-দ্রোণ প্রভৃতি সকলকে বললেন, “কুরুবংশীয় বৃদ্ধদের একটা গুরুতর কর্তব্যে ত্রুটি ঘটেছে যে, একটা মূর্খকে রাজা পদে নিযুক্ত করেছে, অথচ তাকে কেউ নিয়ন্ত্রিত করেন না। বর্তমানে আমি যা কালোচিত কর্তব্য মনে করি, তা আপনাদের কাছে বলছি। আপনারা শুনুন—এতে কুরুবংশের মঙ্গল হবে। আপনাদের আনুকূল্য লাভ করার জন্য আমি হিতবাক্যই বলব, এবং তা আপনাদের রুচিকর হবে বলে মনে করি। আপনারা জানেন যে দুরাচার ও নিকৃষ্টচেতা কংস বৃদ্ধ পিতা ভোজরাজ উগ্রসেন জীবিত থাকতেই তাঁর প্রভুত্ব হরণ করে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। জ্ঞাতিবর্গ কংসকে ত্যাগ করেছিল, সেই জ্ঞাতিবর্গের কল্যাণে মহাযুদ্ধে আমি কংসকে বধ করেছিলাম এবং পুনরায় ভোজরাজকে রাজা করেছি। সেই উগ্রসেনের শাসনে যদু, অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়েরা একা কংসকে পরিত্যাগ করে অনায়াসে উন্নতি লাভ করেছে। দেবাসুরের যুদ্ধের সময় প্রজাপতি ব্রহ্মা যখন দেখলেন দেব, অসুর, মনুষ্য, গন্ধর্ব, নাগ ও রাক্ষসগণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে পরস্পরকে সংহার করবে—তখন তিনি ধর্মদেবকে আদেশ করলেন যে তিনি দৈত্য ও দানবগণকে বন্ধন করে বরুণ দেবতার হাতে সমর্পণ করুন। ধর্ম প্রজাপতির আদেশ অনুসারে দৈত্য ও দানবদের বন্দি করে বরুণ দেবতার হাতে সমর্পণ করলেন এবং বরুণদেব আপন পাশে তাঁদের আবদ্ধ করে সমুদ্রমধ্যে সেই অসুরগণকে রক্ষা করতে লাগলেন। সেইরূপ আপনারাও দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ ও শকুনিকে বন্দি করে পাণ্ডবদের কাছে সমর্পণ করুন। কারণ কুলরক্ষার জন্য একটা লোককে ত্যাগ করবে, গ্রাম রক্ষা করার জন্য একটা কুলকে ত্যাগ করবে এবং আত্মরক্ষার্থে গোটা পৃথিবীই ত্যাগ করবে। অথবা রাজা আপনি কেবল দুর্যোধনকে বন্ধন করে পাণ্ডবদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করুন। সমস্ত ক্ষত্রিয় যেন আপনার জন্য বিনষ্ট না হন।”
কৃষ্ণের সমস্ত বক্তব্য শোনার পর ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে আদেশ করলেন যে, তিনি অন্তঃপুরে গিয়ে রাজমাতা গান্ধারীকে সভায় নিয়ে আসুন। দুর্যোধন যদি গান্ধারীর ও তাঁর সমবেত অনুনয় অস্বীকার করে, তবে কৃষ্ণের পরামর্শ গ্রহণ করা ছাড়া অন্য পথ থাকবে না। বিদুর রাজার আদেশ পালন করলেন এবং দুর্যোধন-মাতা গান্ধারী দেবী সভায় প্রবেশ করলেন। ধৃতরাষ্ট্র সংক্ষেপে গান্ধারীকে রাজসভার ঘটনা জানালে গান্ধারী সরাসরি বললেন, “রাজা পুত্রপ্রিয় আপনিই এ বিষয়ে বিশেষ নিন্দনীয়। কারণ দুর্যোধনের পাপপ্রবৃত্তি জেনেও তার বুদ্ধিই অনুসরণ করে চলেছেন। দুর্যোধন লোভী, তার উপর সমগ্র রাজ্যের লোভ ও ক্রোধ তাকে প্রতিদিন উত্তেজিত করেছে। এখন আপনি বলপ্রয়োগ করেও তাকে ঠেকাতে পারবেন না। মূঢ়, মূর্খ, দুরাত্মা ও লোভী এবং দুষ্টসহায়শালী দুর্যোধনকে যে রাজ্য দান করেছিলেন, তার ফল এখন আপনি ভোগ করছেন। আপনি আত্মীয়দের মধ্যে ভেদ স্থাপন করে, এখন আত্মীয়দের উপর দণ্ড প্রয়োগ করতে চাইছেন?”
ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে এবং গান্ধারীর উপদেশে বিদুর পুনরায় দুর্যোধনকে সভায় ডেকে নিয়ে এলেন। গান্ধারী তাঁকে বললেন, “ভবিষ্যতের হিতের জন্য তোমাকে কিছু বলব। তোমার পিতা, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর তোমাকে যা বলেছেন, তা পালন করো। তাতে গুরুজনের আজ্ঞা পালন হবে এবং তোমারও মঙ্গল হবে। মানুষ নিজের ইচ্ছায় রাজ্য লাভ করতে পারে না, রক্ষা করতে পারে না এবং ভোগ করতেও পারে না। আবার অজিতেন্দ্রিয় লোক দীর্ঘকাল রাজ্য রক্ষা করতে পারে না। কারণ, কাম ও ক্রোধ কর্তব্য বিষয় থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করে অন্যত্র নিয়ে যায়। রাজা সেই দুই শত্রুকে পরাজিত করেই পৃথিবী জয় করতে পারেন। রাজত্ব শব্দের অর্থ হল গুরুতর প্রভুত্ব। এই গুরুর প্রভুত্ব বজায় রাখতে হলে ইন্দ্রিয় দমন করতে হবে। কারণ ইন্দ্রিয় বশ না হলে, মানুষের বিনষ্টি ঘটে। আপন ইন্দ্রিয়কে জয় না করে, অমাত্যকে জয় করা যায় না। অমাত্যকে জয় না করে শত্রুকে জয় করা যায় না। বর্ধিত কাম এবং ক্রোধ মানুষের পক্ষে স্বর্গের রুদ্ধ দ্বারের কারণ। যে রাজা কাম, ক্রোধ, লোভ, দম্ভ ও দর্পকে জয় করতে পারেন—তিনিই পৃথিবীর রাজা হবার উপযুক্ত।
“বৎস আরও শোনো। শান্তনুনন্দন ভীষ্ম ও মহারথ দ্রোণ যা বলেছেন, তা সত্য। কৃষ্ণ ও অর্জুন অজেয়। অতএব তুমি কৃষ্ণের শরণাপন্ন হও। কৃষ্ণ উভয় পক্ষেরই মঙ্গল করবেন। যুদ্ধে মঙ্গল নেই, ধর্ম নেই, স্বার্থ নেই, সুখ নেই এবং সর্বদা জয়ও হয় না। অতএব, যুদ্ধে মনোনিবেশ কোরো না। ভীষ্ম, তোমার পিতা এবং বাহ্লিক এঁরা ভেদের ভয়ে ভীত হয়েই পাণ্ডবদের পৈতৃক অংশ দিয়েছিলেন। সেই বীরগণ সমগ্র পৃথিবী নিষ্কণ্টকীকৃতা করেছিলেন, এবং সেই পৃথিবীই তুমি আজ ভোগ করছ। যদি মন্ত্রীদের সঙ্গে পৃথিবী স্থায়ীভাবে ভোগ করতে চাও, পাণ্ডবদের যথোচিত অংশ দান করো। তাদের রাজ্যের অর্ধ-দান করো। বাকি অর্ধ অংশেই তুমি অনায়াসে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। তুমি তেরো বৎসর যাবৎ পাণ্ডবদের অনেক কষ্ট দিয়েছ। এখন তার উপশম করো। তা ছাড়াও তুমি, দৃঢ়ক্রোধী কর্ণ ও তোমার ভ্রাতা দুঃশাসন—তোমরা পাণ্ডবদের রাজ্য আত্মসাৎ করতে পারবে না। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, ভীম, অর্জুন, ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্রুদ্ধ হলে উভয় পক্ষের সমস্ত সৈন্যই বিনষ্ট হবে। তোমার ক্রোধের কারণে পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য কোরো না। তারপর তুমি যে মনে করো ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ তোমার পক্ষে থেকে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে যুদ্ধ করবেন, তা কখনও হবে না। কারণ, এঁরা তোমাদের ও পাণ্ডবদের স্বভাব জানেন এবং তোমাদের উপর ও পাণ্ডবদের উপর এঁদের স্নেহ ও সমান সম্পর্ক আর রাজ্যও সমান। কিন্তু পাণ্ডবদের ধর্ম অধিক। সুতরাং এঁরা তোমার প্রদত্ত অন্নের ভয়ে যদিও জীবন ত্যাগ করতে পারেন, তথাপি যুধিষ্ঠিরকে শত্রুভাবে দেখতে পারবেন না। এ জগতে কেবল লোভে মানুষের অর্থ-সম্পত্তি হতে দেখা যায় না। তোমার আর লোভে প্রয়োজন নেই, তুমি শান্ত হও।”
দুর্যোধন মায়ের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পুনরায় শকুনি প্রভৃতির কাছে ফিরে গেলেন এবং সেখানে শকুনি, কর্ণ, দুঃশাসন প্রভৃতির সঙ্গে মন্ত্রণা করতে লাগলেন। আলোচনা করে তাঁরা সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, কৃষ্ণ, ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্মের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁদের বন্ধন করে পাণ্ডবদেব কাছে নিয়ে যাবেন। “অতএব, পূর্বকালে দেবরাজ ইন্দ্র যেমন বলপূর্বক বলিকে বন্ধন করে রেখেছিলেন, তেমনই আমরাই বলপূর্বক কৃষ্ণকে বন্ধন করে রাখব।” কৃষ্ণ বদ্ধ হয়েছে শুনলে পাণ্ডবেরা ভগ্নদন্ত সর্পের ন্যায় কর্তব্যবিমূঢ় ও নিরুৎসাহ হয়ে পড়বে। এই মহাবাহু কৃষ্ণই পাণ্ডবদের সকলের মশালের মূল ও বর্মের ন্যায় বিপত্তিনিবারক। সুতরাং এই কৃষ্ণকে আবদ্ধ করে রাখতে পারলে, পাণ্ডবেরা সোমকদের সঙ্গে নিরুদ্যম হয়ে পড়বে।
পরের ইঙ্গিত-অভিজ্ঞ ও মহাবিচক্ষণ সাত্যকি সেই দুষ্ট চতুষ্টয়ের দুরভিসন্ধি বুঝতে পারলেন। কৃতবর্মাকে নিয়ে সাত্যকি সভার বাইরে গিয়ে তাঁকে বললেন, “অবিলম্বে সৈন্য প্রস্তুত করো।” কৃতবর্মাকে এই নির্দেশ দিয়ে মহাবীর সাত্যকি পুনরায় সভার মধ্যে প্রবেশ করে মহাত্মা কৃষ্ণের কাছে দুর্যোধন প্রভৃতির দুরভিসন্ধির কথা বললেন। পরে ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুরকেও জানালেন। সাত্যকি বললেন, “মূর্খেরা সজ্জনবিগর্হিত দূতবন্ধনরূপ কাজ করতে চাইছে। কিন্তু তারা তা কোনওমতেই পারবে না। কৃষ্ণকে ধরবার ইচ্ছায়, রাজ্যলোভী মূর্খ পাপাত্মারা এই সভায় এসে গোলমাল করবে। বালকেরা যেমন জ্বলন্ত আগুন ধরতে চায়, তেমনই এই অল্পবুদ্ধিরা কৃষ্ণকে ধরবার ইচ্ছা করছে।” সাত্যকির কথা শুনে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “যম এসে আপনার পুত্রদের ঘিরে ধরেছে। পতঙ্গ যেমন আগুনের কাছে গিয়ে পুড়ে মরে, তেমনই আপনার পুত্রেরা আগুনের কাছে গিয়ে পুড়ে মরবে। ক্রুদ্ধ সিংহ যেমন হস্তীদলকে যমালয়ে প্রেরণ করে, তেমনই এই কৃষ্ণ ইচ্ছা করলে আপনার পুত্রদের যমালয়ে পাঠাতে পারেন। কিন্তু পুরুষোত্তম কৃষ্ণ কোনও প্রকারেই পাপজনক অথবা নিন্দাযোগ্য কার্য করেন না এবং ধর্ম থেকে বিচ্যুত হন না।”
বিদুর এই কথা বললে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “আপনার পুত্রেরা এবং তাঁদের অনুচরবর্গ আমাকে বন্ধন করবার ইচ্ছা করেছেন। তবে আপনি অনুমতি করুন,—এঁরাই আমাকে বন্দি করুন অথবা আমিই এঁদের বন্ধন করি। আমি একাকীই এই ক্রুদ্ধ সকলকে বন্ধন করতে সমর্থ; তবে আমি কোনও প্রকার নিন্দিত বা পাপজনক কার্য করতে পারব না। আপনার পুত্রেরা পাণ্ডবদের অর্থে লোভ করে নিজেদের অর্থ হারাবেন। এই যদি এদের ইচ্ছে হয়ে থাকে, তবে যুধিষ্ঠির কৃতকার্য হয়েছেন। আমি আজই এদের বন্ধন করে পাণ্ডবদের হাতে তুলে দেব। এ কাজ আমার পক্ষে কঠিন হবে না। রাজা এই আমি স্থির করলাম! দুর্যোধনও যদি কৃতসংকল্প হয়ে থাকে, তবে পণব ও আনকধ্বনির সঙ্গে শঙ্খধ্বনি হতে থাকুক। পাণ্ডবদেরও অনায়াসে মহামঙ্গল স্থাপিত হবে। আমি যদি দুর্যোধন প্রভৃতিকে বন্ধন করে নিয়ে পাণ্ডবদের কাছে সমর্পণ করি, তবে তা উপযুক্ত কাজই হবে। কিন্তু ভরতনন্দন মহারাজ, আপনার সামনে ক্রোধ ও পাপবুদ্ধিজাত এই কর্ম আমি করব না। আমি আপনার পুত্রদের অনুমতি দিচ্ছি। ওরা আমায় বন্ধন করুন।”
ধৃতরাষ্ট্র আবার বিদুরকে দুর্যোধনের কাছে পাঠালেন, তাঁকে সভায় নিয়ে আসবার জন্য। দুর্যোধন আসতে চাননি, কিন্তু অনিচ্ছাসত্ত্বেও সভায় এলেন। তখন ধৃতরাষ্ট্র দুষ্ট-চতুষ্টয় (দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ ও শকুনি) ও তাদের অনুগামী রাজদের সামনে দুর্যোধনকে বললেন, “নৃশংস! পাপিষ্ঠ। কতগুলি ক্ষুদ্রকর্মা লোকের সহায়তা নিয়ে তুই পাপকার্য করতে চাইছিস। তোর মতো মূর্খ, কুলদূষক লোক যে কার্য করতে প্রবৃত্ত হয়, তুই তেমনই অসাধ্য, নিন্দনীয় ও সজ্জনবিগর্হিত কাজ করতে প্রবৃত্ত হয়েছিস। তুই পাপিষ্ঠ সহচরদের সঙ্গে মিলিত হয়ে দুর্ধর্ষ ও দুর্ধর কৃষ্ণকে বন্ধন করবার চেষ্টা করছিস।
যো ন শক্যো বলাৎ কর্ত্তুং দৈবেরপি সবাসবৈঃ।
তং ত্বাং প্রার্থয়সে মন্দ! বালশ্চন্দ্রমসং যথা ॥ উদ্যোগ : ১২১ : ৩৯ ॥
“মূর্খ! ইন্দ্রের সঙ্গে দেবতারাও যাকে বলপূর্বক ধরতে পারেন না, বালক যেমন চন্দ্রকে ধরবার ইচ্ছা করে, তুই তেমনই কৃষ্ণকে ধরবার ইচ্ছা করছিস?” “দেবতা, অসুর, গন্ধর্ব, নাগ ও অন্য মানুষেরা যাঁকে যুদ্ধে সহ্য করতে পারেন না, তুই সেই কৃষ্ণকে চিনতে পারিসনি। যেমন হাত দিয়ে বায়ু ধরা যায় না, হাত দিয়ে চাঁদ স্পর্শ করা যায় না এবং মাথায় পৃথিবী ধরে রাখা যায় না, তেমনই বলপূর্বক কৃষ্ণকে ধরে রাখা যায় না।”
ধৃতরাষ্ট্র এই কথা বললে, বিদুর অসহিষ্ণু দুর্যোধনকে বললেন, “দ্বিবিদ নামক অসুর সৌভ বিমানের দ্বারে থেকে অনবরত বিশাল শরবর্বণ করেও কৃষ্ণকে গ্রহণ করতে পারেনি। তুমি সেই কৃষ্ণকে গ্রহণ করার ইচ্ছা করেছ? কৃষ্ণ প্রাগ্জ্যোতিষপুরে গমন করলে, নরকাসুর অন্য অসুরদের সঙ্গে কৃষ্ণকে গ্রহণ করতে পারেনি। অনেক যুগ বর্ষজীবী এই কৃষ্ণ সেই নরকাসুরকে বধ করে, বহু সহস্র কন্যাকে উদ্ধার করে যথাবিধানে তাদের বিবাহ করেছেন। নির্মোচন নগরে ষট্ সহস্র মহাসুর পাশদ্বারা বন্ধন করেও কৃষ্ণকে গ্রহণ করতে সমর্থ হয়নি। তুমি বলপূর্বক তাঁকে গ্রহণ করতে চাইছ? ইনিই বাল্যকালে শিশু হয়েও পুতনা রাক্ষসীকে বধ করে এবং গোরক্ষার্থে গোবর্ধন পর্বত ধারণ করেছিলেন। লোকের অনিষ্টকারী ও মহাবল অরিষ্ট, ধেনুক, চাণূর, অশ্বরাজ ও কংসকে ইনিই বধ করেছেন। ইনি যুদ্ধে জরাসন্ধকে ভীমসেন দ্বারা সংহার করেছেন এবং বীর্যবান দন্তবক্র, শিশুপাল ও বাণরাজাকে নিজে বধ করেছেন আর রুক্মি প্রভৃতি রাজগণকে পরাভূত করেছেন। অমিততেজা এই কৃষ্ণই বরুণদেব ও অগ্নিদেবকে জয় করেছেন এবং পারিজাত হরণ করার সময়ে ইনি দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজিত করেছিলেন। ইনি যখন প্রলয়সাগরে শায়িত ছিলেন, সেই সময়ে মধু ও কৈটভকে বধ করেছিলেন এবং অপর এক জন্মে বেদ অপহারী হয়গ্রীবকে সংহার করেছিলেন। ইনি সকলকে সৃষ্টি করেন, সকলের পুরুষকারের কারণ কিন্তু একে কেউ সৃষ্টি করতে পারেন না। এই কৃষ্ণ যা যা ইচ্ছা করেন, অনায়াসে তা সম্পাদন করেন। দুর্যোধন সেই কৃষ্ণকে তুমি বলপূর্বক বন্ধন করতে চাও?”
তখন বলবান ও শক্ৰহন্তা কৃষ্ণ দুর্যোধনকে বললেন, “অতিদুর্বুদ্ধি দুর্যোধন তুমি মোহবশত আমাকে একা বলে মনে করছ, তাই আমাকে বন্ধন করতে চাও। পাণ্ডবেরা, অন্ধকবংশীয়েরা ও বৃষ্ণিবংশীয়েরা সকলেই এখানে আছেন, আর মহর্ষিদেব সঙ্গে আদিত্যগণ, রুদ্রগণ এবং বসুগণও এখানে আছেন।” এই বলে বিপক্ষবীরহন্তা কৃষ্ণ বিকট হাস্য করলেন। তখন অঙ্গুষ্ঠের মতো ক্ষুদ্র ও অগ্নিশিখার মতো উজ্জ্বল দেবগণ তাঁর দেহ থেকে আবির্ভূত হল এবং তাঁর ললাটে ব্ৰহ্মা ও বক্ষে রুদ্র দৃষ্টিগোচর হলেন। বাহুসমূহ থেকে দিকপালগণ এবং মুখ থেকে অগ্নি জন্ম নিলেন; আর আদিত্যগণ, সাধ্যগণ, বসুগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, ইন্দ্রের সঙ্গে মরুদগণ, বিশ্বদেবগণ এবং যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধর্ব ও নাগসমূহ তাঁর বিভিন্ন অঙ্গ থেকে আবির্ভূত হলেন। কৃষ্ণের বাহুযুগল থেকে অর্জুন ও বলরাম উপস্থিত হলেন। দক্ষিণ বাহু থেকে ধনুর্ধারী অর্জুন, বাম বাহু থেকে হলধারী বলরাম প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন। পৃষ্ঠদেশ থেকে যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব নির্গত হলেন। তারপর মহাস্ত্রধারী অন্ধকগণ এবং প্রদ্যুম্ন প্রভৃতি বৃষিগণ কৃষ্ণের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। ক্রমে শঙ্খ, চক্র, গদা, শঙ্খধনু, লাঙ্গল ও নন্দক নামক খড়্গ প্রাদুর্ভূত হল। কৃষ্ণের বহুতর হস্তে উজ্জ্বল ও উত্তোলিত সর্বপ্রকার অস্ত্র, সকল দিকে দেখা যেতে লাগল। নয়নযুগল, নাসিকারন্ধ্রযুগল ও কর্ণযুগল থেকে সকল দিকে ধূমযুক্ত মহাভয়ংকর অগ্নিশিখা নির্গত হতে থাকল। সূর্যের রশ্মির ন্যায় রশ্মিসকল রোমকূপে প্রকাশ পেতে লাগল এবং তখন কৃষ্ণ সহস্রচরণ, শতবাহু, সহস্রনয়ন ও কান্তিশালী হলেন। তাঁর গুল্ফের নিম্নভাগ পাতালে দেখা যেতে লাগল এবং নয়নযুগলে চন্দ্র ও সূর্য ও অন্য গ্রহগণ প্রকাশিত হল। তাঁর উদরদেশে সমস্ত ঊর্ধ্বলোক দেখা যেতে লাগল এবং সকল নদী ও সমুদ্র তাঁর ঘর্মরূপে প্রকাশ পেতে থাকল। পর্বত সকল তাঁর অস্থিরূপে, বৃক্ষসমূহ রোমরূপে ও দিন ও রাত্রি নয়নের নিমেষরূপে দৃষ্টিগোচর হতে থাকল। আর দেবী সরস্বতী তাঁর জিহ্বায় বিরাজ করতে লাগলেন।
মহাত্মা কৃষ্ণের সেই ভীষণ মূর্তি দেখে রাজারা সকলে ত্রস্তচিত্ত হয়ে চোখ বন্ধ করলেন। কিন্তু ভীষ্ম, দ্রোণ, মহামতি বিদুর, মহাভক্ত সঞ্জয় এবং তপোধন ঋষিরা ভীতচিত্ত হলেন না। কারণ, ভগবান তাঁদের প্রকৃত চক্ষুই দিয়েছিলেন। ভগবান তখন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকেও সুন্দর দৃষ্টি দিয়েছিলেন। তাই এই কয়জন কৃষ্ণের প্রকৃত মূর্তিই দেখতে পেলেন।
তারপর দেবগণ, গন্ধর্বগণ, কিন্নরগণ, মহানাগগণ, ঋষিগণ, লোকপালগণ সেই কৃষ্ণকে প্রণাম করে তাঁর স্তব করতে লাগলেন। “প্রভু! আপনি নিজের যে-রূপ দেখিয়েছেন, সেই রূপ ও ক্রোধ উপসংহার করুন। না হলে, দেবগণের সঙ্গে জগতের এই সমস্ত লোক ভয়েই বিনষ্ট হয়ে যাবে। আপনিই জগতের সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা এবং পালনকর্তা। আপনিই সমগ্র জগৎ ব্যাপ্ত।”
কৃষ্ণের সেই অত্যাশ্চর্য রূপ দেখে দেবদুন্দুভি বেজে উঠল এবং সভার উপর পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকল। তারপর পুরুষশ্রেষ্ঠ অরিন্দম কৃষ্ণ নিজের সেই অলৌকিক, অদ্ভুত ও নানাপ্রকার বিভূতি উপসংহার করলেন এবং ঋষিগণের অনুমতি নিয়ে সাত্যকি ও বিদুরের হাত ধরে সভা থেকে বাইরে চলে গেলেন।
*
‘কৌরবসভায় শ্রীকৃষ্ণ’ মহাভারতের এক আশ্চর্য দুর্লভ মুহূর্ত। বহু কারণেই এ মুহূর্ত অতি দুর্লভ। প্রথমত, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যাচ্ছেন দৌত্য করতে, কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে।
দ্বিতীয়ত, কৃষ্ণ দৌত্য করতে যাচ্ছেন শুনে দলে দলে মুনি ঋষিদের হস্তিনাপুর যাত্রা। এই মুনি ঋষিদের মধ্যে আছেন পরশুরাম, আছেন মহাত্মা মহর্ষি কণ্ব এবং দেবর্ষি নারদ।
তৃতীয়ত, হস্তিনানগরে পৌঁছে কৃষ্ণের রাজকীয় মর্যাদালাভ। দুর্যোধন, দুঃশাসন ব্যতীত অন্য ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রেরা নগর-দ্বারে কৃষ্ণকে অভ্যর্থনা জানালেন। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা পথে। উলুধ্বনি ও অবিরাম পুষ্পবর্ষণ। কৃষ্ণ কিন্তু দুর্যোধনের আতিথ্য গ্রহণ করলেন না। প্রত্যাখ্যান করে বিদুরের গৃহে রাত্রিবাস করলেন।
চতুর্থত, কৃষ্ণের আশ্চর্য বিচক্ষণতা। তিনি দৌত্যকার্যে গেলেন কিন্তু সঙ্গে নিয়ে গেলেন সাত্যকি, কৃতবর্মা ও সহস্র সহস্র যোদ্ধা। মানবচরিত সম্পর্কে তাঁর সুগভীর জ্ঞান প্রকাশিত হল।
পঞ্চমত, কৃষ্ণের অসাধারণ বাগ্মিতা। প্রথম ভাষণেই তিনি শ্রোতৃমণ্ডলীকে মুগ্ধ করেছেন। তিনি শান্তির দূত। কাউকে আঘাত না করে, ভরত বংশের গৌরব উল্লেখ করে, তিনি পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে চেয়েছেন। তাঁর বাণী এতখানি মঙ্গলজনক যে পরশুরাম, মহর্ষি কণ্ব, ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র—সবাই তা অনুমোদন করতে বাধ্য হয়েছেন।
ষষ্ঠত, দুর্যোধন যখন ঘোষণা করলেন, “বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।” তখনই কৃষ্ণের বচন ক্রমশ ধারালো হয়ে উঠেছে। দুর্যোধন প্রমাণ করতে চেয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তিনি বিন্দুমাত্র দায়ী নন, তখন কৃষ্ণ একটি একটি করে দুর্যোধনের অপরাধ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এবং ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, কৌরববংশ দুর্যোধনের জন্যই ধ্বংস হবে। ক্রুদ্ধ দুর্যোধন সভাস্থল ত্যাগ করেছেন।
সপ্তমত, এই মুহূর্তেই আমরা দেখেছি রাজমাতা গান্ধারীর বিচক্ষণতা, মনস্বিতা ও ধর্মাচরণ। বর্তমান সমস্ত দুর্যোগের জন্য তিনি রাজা ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধ পুত্রস্নেহকে দায়ী করে বলেছেন, শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন অজেয়। শান্তি স্থাপন না হলে তাঁর পুত্ররা ধ্বংস হবে, একথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি দুর্যোধনকে জানিয়েছেন। অদ্ভুত তাঁর মনস্তত্ত্বজ্ঞান। দুর্যোধনকে তিনি জানিয়েছেন ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ—তাঁর অন্নের ঋণ পরিশোধ করার জন্য জীবন দেবেন, কিন্তু কোনওদিন যুধিষ্ঠিরকে শত্রু হিসাবে দেখতে পারবেন না।
অষ্টমত, একটি মত সুধীমণ্ডলে প্রচলিত আছে। বৃন্দাবনের কৃষ্ণ ও মহাভারতের কৃষ্ণ একই ব্যক্তি নন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ডাকসাইটে অধ্যাপক এই মত পোষণ করতেন। পরে ঘটনাচক্রে সেই অধ্যাপক ও মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের এই বিষয়ে আলোচনা হয়। ঘটনাক্রমে এই লেখক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্তবাগীশ সেই অধ্যাপককে বলেছিলেন, “সভাপর্ব আর উদ্যোগ পর্ব পড়ে দেখো। দেখবে বৃন্দাবনের কৃষ্ণ আর কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণ একই ব্যক্তি।” অধ্যাপক পরবর্তীকালে তা স্বীকারও করেছিলেন। এই দুর্লভ মুহূর্তটিতে বিদুর কৃষ্ণ-মাহাত্ম্য দুর্যোধনকে বোঝাতে গিয়ে পুতনা রাক্ষসী বধ, গো-রক্ষার্থে গিরি-গোবর্ধন ধারণ, চাণূর, মুষ্টি, কংস বিনাশের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আবার রাজসূয় যজ্ঞের সভায় শিশুপাল কৃষ্ণকে ‘কংসদাস’ বলে বারংবার বিদ্রূপ করেছিলেন। এই দুই অংশ মিলিয়ে পাঠ করলে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, এই কৃষ্ণই যশোদাদুলাল, নন্দ-নন্দন কৃষ্ণ। এঁরা একই ব্যক্তি। অর্জুন তাঁর পিসতুতো ভাই। ইনি অর্জুনের চেয়ে বয়সে ছ’ মাস বড় ছিলেন।
নবমত, এই দুর্লভ মুহূর্তে আমরা কৃষ্ণের সেই রূপের সামান্য দেখতে পেলাম, যে-রূপ অর্জুনের কৈবল্য দূর করার জন্য কৃষ্ণ ধারণ করেছিলেন। এই মুহূর্তেই আমরা পেলাম, আদি-অন্তহীন সেই মহাকাল, যিনি সকল সৃষ্টি-স্থিতি প্রলয়ের কারণ। যিনি অখণ্ড মণ্ডলাকার, সমস্ত জগৎ-ব্যাপ্ত। যিনি স্বয়ং বিষ্ণু বা নারায়ণ। যাঁর ললাটে বাস করেন ব্রহ্মা, বক্ষে বাস করেন দেবাদিদেব মহাদেব এবং যাঁর জিহ্বাগ্রে বাস করেন দেবী সরস্বতী।
৫৭
কৃষ্ণ-কর্ণ সংবাদ
বিদুর ও সাত্যকির হাত ধরে কৌরসভা থেকে কৃষ্ণ বাইরে চলে এলেন। দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ ও ধৃতরাষ্ট্রকে অভিবাদন করলেন। অন্তঃপুরে গিয়ে পিসিমা কুন্তীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর কৃষ্ণ হস্তিনাপুর ত্যাগ করার জন্য আপন রথের দিকে অগ্রসর হলেন। যাত্রাপথে কৃষ্ণ কর্ণকে আপন রথে তুলে নিলেন। রথ অগ্রসর হতে লাগল। হস্তিনার নদীতীরে রথ পৌঁছলে কৃষ্ণের ইঙ্গিতে দারুক রথ থামালেন। কর্ণকে নিয়ে কৃষ্ণ রথে উপবিষ্ট রইলেন এবং দারুককে কিছুক্ষণের জন্য রথ থেকে দূরে থাকতে বললেন। দারুক আদেশ পালন করলে কৃষ্ণ কর্ণকে সেই রথের উপরেই বললেন, “কর্ণ আপনি তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য বেদপারদর্শী ব্রাহ্মণগণের উপাসনা করেছেন, সংযত থেকে, অসূয়া না করে তাঁদের ভরণ-পোষণও করেছেন। আপনি নিশ্চয়ই সনাতন বেদবাক্য সকল অবগত হয়েছেন এবং সূক্ষ্ম ধর্মশাস্ত্রসমূহের মর্মও জেনেছেন। ‘কানীন’ ও ‘সহোঢ়’ নামে কন্যার গর্ভে দুই প্রকার সন্তান জন্মে থাকে। শাস্ত্রজ্ঞ লোকেরা সেই কন্যার পরিণেতাকেই সেই সন্তানদের পিতা বলে থাকেন। কর্ণ আপনি সেই অবস্থায় জন্মেছেন বলে (কুমারী অবস্থায় কন্যাগর্ভে) কানীনপুত্রই বটেন। সুতরাং আপনি ধর্মশাস্ত্রের নিয়ম ও ধর্ম অনুসারে পাণ্ডুরই পুত্র। অতএব চলুন, আপনিই রাজা হবেন। আপনার পিতৃপক্ষে পাণ্ডবেরা এবং মাতৃপক্ষে বৃষ্ণিবংশীয়েরা—এই দুই পক্ষকেই আপনি আপনার সহায় বলে মনে করুন। মাননীয় কর্ণ! আপনি আজ এখান থেকে আমার সঙ্গে উপপ্লব্য নগরে উপস্থিত হলে, পাণ্ডবেরা আপনাকে কুন্তীর পুত্র এবং যুধিষ্ঠিরের অগ্রজ বলে জানতে পারবে। পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, অপরাজিত অভিমন্যু এঁরা আপনার চরণযুগল ধারণ করবেন। পাণ্ডবগণের সাহায্যের জন্য সমাগত রাজগণ, রাজপুত্রগণ এবং সমস্ত বৃষ্ণি ও অন্ধকংশীয় লোক আপনার পদযুগল গ্রহণ করবেন। রাজারা ও রাজকন্যারা আপনার রাজ্যাভিষেকের জন্য স্বর্ণময়, রৌপ্যময় ও মৃন্ময় কুম্ভ এবং ওষধি, সমস্ত বীজ, সকল রত্ন ও লতা আনয়ন করবে। আর দ্রৌপদী দেবী যষ্ঠ সময়ে (প্রথম সময়ে) আপনার নিকট আগমন করবেন। প্রশস্ত চিত্ত ও ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ ধৌম্য অগ্নিতে হোম করবেন এবং চতুর্বেদবিৎ ব্রাহ্মণেরা আজ আপনাকে অভিষিক্ত করবেন। পাণ্ডবগণের অপর পুরোহিত ব্ৰহ্মকার্য শুরু করুন, আর পুরুষশ্রেষ্ঠ পঞ্চভ্রাতা, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, পাঞ্চালগণ, চেদিদেশীয়গণ এবং আমি—আমরা আপনাকে আজ পৃথিবীর রাজ্যে অভিষিক্ত করব। বর্তমান রাজা যুধিষ্ঠির আপনার যুবরাজ হবেন এবং ধর্মাত্মা, দৃঢ়ব্রত সেই কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির চামর ধারণ করে আপনার রথের পিছনে অন্য রথে আরোহণ করুন। কুন্তীনন্দন মহাবল ভীমসেন অভিষেকের পরে আপনার মাথায় শ্বেতবর্ণ ছত্র ধারণ করুন। অর্জুন বহুকিঙ্কিণী নিনাদিত, ব্যাঘ্রচর্মে পরিবেষ্টিত এবং শ্বেতাশ্বযুক্ত আপনার রথ সঞ্চালন করবেন; আর অভিমন্যু সর্বদাই আপনার কাছে থাকবেন। নকুল, সহদেব, দ্রৌপদীর পঞ্চ-পুত্র, পাঞ্চালগণ এবং মহারথ শিখণ্ডী আপনার অনুগমন করবেন। নরনাথ, আমিও আপনার অনুগমন করব; আর অন্ধক, বৃষ্ণি ও দশার্হবংশীয়গণ এবং দশার্নদেশীয়েরা সকলে আপনার পরিবার হবেন। এইভাবে পাণ্ডব ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে জপ, হোম ও অন্য নানাবিধ মাঙ্গলিক কার্যে ব্যাপৃত থেকে আপনি রাজ্যভোগ করতে থাকুন। দ্রাবিড়, কুন্তল, অন্ধ্র, তালচর, চুচুপ ও বেণুপদেশীয় লোকেরা আপনার অগ্রগামী হবেন। আর সূত ও মাগধ প্রভৃতি স্তুতিপাঠকেরা বহুতর স্তুতিবাক্য দ্বারা আপনার স্তব করুক এবং পাণ্ডবেরা আপনার জয় ঘোষণা করবেন। নক্ষত্র পরিবেষ্টিত চন্দ্রের ন্যায় আপনি পাণ্ডবগণ পরিবেষ্টিত হয়ে রাজ্য শাসন করতে থাকুন এবং কুন্তী দেবীকে সর্বদাই আনন্দিত করুন। আজ থেকে পাণ্ডবদের সঙ্গে আপনার সৌহার্দ্য হোক ও শত্রুরা ব্যথিত হোক।
কর্ণ বললেন, “বৃষ্ণিনন্দন কৃষ্ণ, শুভচিন্তক হিসাবে বন্ধুর মতো আপনি যা বললেন, তা সম্পূর্ণ সত্য। আপনি যা জানেন, আমিও সে সমস্ত জানি; ধর্মশাস্ত্রের নিয়ম অনুসারে ধর্মত আমি পাণ্ডুর পুত্রই বটে। জনার্দন কুন্তী দেবী কন্যা অবস্থায় সূর্য হতে আমাকে গর্ভে ধারণ করেন এবং প্রসবের পরে সেই সূর্যের কথা অনুসারেই তিনি আমাকে ত্যাগ করেন। কৃষ্ণ আমি সেই সন্তানই বটে তবু সেই অবস্থায় জন্ম হওয়ায় আমি ধৰ্মত পাণ্ডুর পুত্রই বটে। কিন্তু যাতে আমার মঙ্গল না হয়, সেইভাবেই কুন্তী দেবী আমাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। তারপর সারথি অধিরথ আমাকে গৃহে আনয়ন করেন এবং স্নেহবশত আপন ভার্যা রাধার হস্তে আমাকে সমর্পণ করেন। আমাকে দেখেই রাধার স্তনে দুগ্ধ এসেছিল এবং সেই থেকে রাধা আমার মল-মূত্র ধারণ করেছিলেন। অতএব, ধর্মজ্ঞ ও সর্বদা ধর্মশাস্ত্রশ্রবণে নিরত আমার মতো লোক কী করে সেই রাধার পিণ্ডলোপ করতে পারে? আর সূত অধিরথ স্নেহবশত সর্বদাই আমাকে পুত্র বলে জানেন এবং আমিও ভক্তিবশত তাঁকে পিতা বলেই জানি। সেই অধিরথই পুত্রপ্রীতি নিবন্ধন শাস্ত্রদৃষ্ট বিধান অনুসারে আমার জাতকর্ম প্রভৃতি সংস্কার কার্য করিয়েছেন। তিনিই ব্রাহ্মণগণ দ্বারা আমার ‘বসুষেণ’ নাম করিয়েছিলেন এবং আমিও তাঁর আশ্রয়ে থেকে যৌবনকাল উপস্থিত হলে, অনেক মহিলার পাণিগ্রহণ করেছি। সেই মহিলাদের গর্ভে আমার অনেক পুত্র ও পৌত্র জন্মেছে এবং সেই মহিলাদের উপরে আমার মন কাম সংসৃষ্ট হয়ে আছে। অতএব গোবিন্দ সমগ্র পৃথিবী, স্বর্ণরাশি, আনন্দ কিংবা ভয় দ্বারা সেই সম্পর্ক আমি মিথ্যা করতে পারি না। আবার আমি ধৃতরাষ্ট্রভবনে দুর্যোধনকে অবলম্বন করে আজ তেরো বৎসর যাবৎ নিষ্কণ্টক রাজ্যভোগ করছি। আর সূতগণের সঙ্গে মিলিত হয়েই আমি কৌলিক ধর্মপালন ও বিবাহ করেছি। দুর্যোধন আবার আমার উপর ভরসা করেই অস্ত্রসংগ্রহ এবং যুদ্ধে উদ্যোগ করেছেন। সেই জন্যই তিনি দ্বৈরথ যুদ্ধে অর্জুনের প্রতিমুখগামী ও পরম প্রতিকূলরূপে আমাকে বরণ করেছেন। অতএব জনার্দন, বধ কিংবা বন্ধনের আশঙ্কা, কিংবা ভয় অথবা লোভবশতই আমি দুর্যোধনের সঙ্গে মিথ্যা ব্যবহার করতে পারি না। তা ছাড়া, আমার আর অর্জুনের সঙ্গে যদি দ্বৈরথ যুদ্ধ না হয়, তবে অর্জুনের আর আমার দুজনেরই নিন্দা হবে। মধুসূদন আপনি আমার ও পাণ্ডবদের হিতের জন্যই সবকিছু বলেছেন এবং আপনি যা বলেছেন, পাণ্ডবেরা সে সমস্তই করবেন, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। কৃষ্ণ আপনি এখন এই গুপ্ত আলোচনা গোপন রাখবেন। তা হবে সবদিক থেকে ভাল। না্ হলে, সংযতচিত্ত ও ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির আমাকে কুন্তী দেবীর প্রথম পুত্র বলে জানতে পারলে, আর তিনি রাজ্যগ্রহণ করবেন না। আমাকে দিয়ে দেবেন। আমি সেই বিশাল ও সমৃদ্ধ রাজ্য পেয়েও পূর্ব প্রতিজ্ঞা অনুসারে তা দুর্যোধনকে সমর্পণ করব।
“ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির চিরন্তন রাজা হোন। তা হওয়াও সম্ভব। কারণ, হৃষীকেশ যাঁর নেতা এবং অর্জুন যাঁর যোদ্ধা। আর মহারথ ভীমসেন, নকুল, সহদেব দ্রৌপদীর পুত্রগণ, পাঞ্চাল রাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন, মহারথ সাত্যকি, উত্তমৌজা, যুধামন্যু, সৌমকি, চেদিরাজ, চেকিতান, অপরাজিত শিখণ্ডী, ইন্দ্রগোপবর্গ, কেকয় ভ্রাতারা, মহামনা কুন্তিভোজ, ভীমসেনের মাতুল মহারথ শ্যেনজিৎ, বিরাটপুত্র শঙ্খ আর মাধব। সর্বোপরি, বুদ্ধি ও বীরত্বের আধার স্বয়ং আপনি যাঁর সহায়, সেই যুধিষ্ঠিরের পৃথিবীটাই রাজ্য হয়ে রয়েছে।
“কৃষ্ণ অন্য পক্ষে দুর্যোধন বিশাল ক্ষত্রিয় সমাজ সংগ্রহ করেছেন এবং সমস্ত রাজার মধ্যে প্রসিদ্ধ এই রাজ্য পেয়েছেন। দুর্যোধনের একটি অস্ত্র যজ্ঞ হবে। এই যজ্ঞে আপনি হবেন উপদেষ্টা এবং এই যজ্ঞে যজুর্বেদীয় পুরোহিতের কাজও আপনাকে করতে হবে। সুসজ্জিত কপিধ্বজ অর্জুন হবেন যজ্ঞের কর্মকর্তা, তাঁর গাণ্ডিব ধনু হবে হোম করার পাত্র, আর বিপক্ষ বীরগণের বীর্য হবে ঘৃত। অর্জুন প্রযুক্ত ঐন্দ্র, পাশুপত, ব্রাহ্ম ও স্থূলাকর্ণ প্রভৃতি অস্ত্রের মন্ত্রই সেই যজ্ঞের মন্ত্র হবে। পিতৃতুল্য পরাক্রমশালী অভিমন্যু হবেন সেই যজ্ঞের স্তোত্রপাঠক। অতিমহাবল, হস্তীসৈন্যহন্তা নরশ্রেষ্ঠ ভীমসেন গর্জন করতে করতে যুদ্ধ আরম্ভ করে সামবেদীয় কর্মকর্তার কাজ করবেন। সর্বদা জপ হোম যুক্ত ধর্মাত্মা রাজা যুধিষ্ঠির সেই যজ্ঞে ব্রহ্মার কার্য করবেন। শঙ্খ, মৃদঙ্গ, ভেরি ও উৎকৃষ্ট সিংহনাদ হবে সেই যজ্ঞের বেদধ্বনি। মহাবীর ও যশস্বী মাদ্রীপুত্র নকুল ও সহদেব সেই যজ্ঞে ক্ষত্রিয় রূপ পশুছেদন করবেন। নির্মল রথধ্বজগুলি হবে যজ্ঞে বিচিত্ৰদণ্ড যূপকাষ্ঠ। কর্ণী, বালিক, নারাচ, বৎসদন্ত ও তোমর সকল সোমরসের কুম্ভ এবং ধনুগুলি পবিত্র কুশপত্রদ্বয় হবে। সেই যজ্ঞে তরবারিগুলি চরুপাকপাত্র, মস্তকগুলি বৃহৎ পিষ্টক, এবং রক্ত হবি বা হোমীয় দ্রব্য হবে। নির্মল শক্তি ও গদাসমূহ কুণ্ডের সকলদিকে বিকীর্ণ কাষ্ঠ হবে এবং দ্ৰোণ ও কৃপের সদস্যগণ বা শিষ্যগণ যজ্ঞের সদস্য হবেন।
“অর্জুন, দ্রোণ, অশ্বত্থামা ও অন্যান্য মহারথগণের নিক্ষিপ্ত বাণসমূহ এই যজ্ঞে কুণ্ডের সকল দিকে বিক্ষিপ্ত কুশ হবে। সাত্যকি এক কুণ্ড থেকে অন্য কুণ্ডে যাতায়াত করবেন এবং দুর্যোধন এই যজ্ঞে দীক্ষিত হবেন, আর মহাসেনাই হবে তাঁর পত্নী। ‘অতিরাত্র’ নামে এই যজ্ঞ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলে, ঘটোৎকচ এতে হিংসার কাজ করবে। যিনি যজ্ঞারম্ভে অগ্নি থেকে জন্মেছিলেন, সেই প্রতাপশালী ধৃষ্টদ্যুম্ন এই যজ্ঞের দক্ষিণা হবেন। কৃষ্ণ আমি দ্যূতসভায় দুর্যোধনের প্রীতির নিমিত্ত পাণ্ডবগণকে যে কটু বাক্য বলেছিলাম, সেই গুরুতর অকার্যের জন্য অনুতপ্ত হচ্ছি। কৃষ্ণ আপনি যখন আমাকে অর্জুন কর্তৃক নিহত দেখবেন, তখন আবার এই যজ্ঞের বৃদ্ধি হবে। দুঃশাসন গর্বের সঙ্গে গর্জন করতে থাকলে, ভীমসেন তখন তাঁর রক্ত পান করবেন, তখন এই যজ্ঞ পূর্ণমাত্রায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডী যখন দ্রোণ ও ভীষ্মকে নিপাতিত করবেন, তখন এই যজ্ঞের অবসান হয়ে আসবে। মহাবল ভীমসেন যখন দুর্যোধনকে বধ করবেন, তখন দুর্যোধনের এই যজ্ঞ সমাপ্ত হবে। স্বামী, পুত্র, অন্যান্য অভিভাবক নিহত হলে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধূরা ও পৌত্রবধূরা রোদন করতে করতে গান্ধারীর সঙ্গে মিলিত হলে এই যজ্ঞের শেষ স্নান হবে।
“ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ মধুসূদন! আপনার অনুগ্রহে বিদ্যাবৃদ্ধ ও বয়োবৃদ্ধ ক্ষত্রিয়েরা যেন বৃথা মৃত্যু বরণ না করেন। ত্রিভুবনের মধ্যে পুণ্যতম কুরুক্ষেত্রে গিয়ে বিশাল ক্ষত্রিয়মণ্ডলী অস্ত্র দ্বারাই যেন মৃত্যু লাভ করেন। কৃষ্ণ সমগ্র ক্ষত্রিয়মণ্ডলী যেন যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করে স্বর্গলাভ করতে পারেন, তা আপনি দেখবেন। যত কাল পৃথিবীতে পর্বত ও নদী থাকবে, ততকাল এই কীর্তির কথা অক্ষয় হয়ে থাকবে। আপনি সর্বদাই আমার জন্মবৃত্তান্ত গোপন রেখে যুদ্ধ করার জন্য অর্জুনকে আমার কাছে নিয়ে আসবেন।”
কৃষ্ণ কর্ণের বাক্য শুনে উপহাসছলে মৃদু হাস্য করে বললেন, “কর্ণ, আমি যে রাজ্যলাভের কথা বললাম তা বোধহয় আপনি গ্রাহ্য করলেন না এবং আমার প্রদত্ত রাজ্যও বোধহয় আপনি শাসন করবার ইচ্ছা করেন না। আপনি নিশ্চিত জেনে রাখুন পাণ্ডবদের নিশ্চয়ই জয় হবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ, অর্জুনের রথে বানররাজাধিষ্ঠিত ভীষণ জয়ধ্বজ দেখা যায়। স্বয়ং বিশ্বকর্মা এই ধ্বজে দিব্যকৌশল প্রয়োগ করেছেন আর ওই ধ্বজে জয়সাধক, দিব্য ও ভয়ংকর প্রাণীসকল দেখতে পাওয়া যায়। অর্জুনের রথে খোদিত সেই ধ্বজটি পরম সুন্দর ও অগ্নির ন্যায় উজ্জ্বল; তার ফলে সকল দিকেই এক-যোজন পথ দূর থেকেও তা দেখা যায়, আর সেই ধ্বজ উপরে পর্বতের শৃঙ্গে বা বৃক্ষের শাখায় সংলগ্ন হয় না।
“কর্ণ, অর্জুন কৃষ্ণকে সারথি করে যুদ্ধে উপস্থিত হয়ে ঐন্দ্র, আগ্নেয় ও বায়ব্য অস্ত্র নিক্ষেপ করছেন, যখন আপনি দেখবেন এবং বজ্রনির্ঘোষের মতো গাণ্ডিবের নির্ঘোষ শুনবেন তখন আর সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর যুগ থাকবে না। সর্বদা জপ, হোম-ব্যাপৃত কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির যখন সূর্যের ন্যায় দুর্ধর্ষ হয়ে আপন বিশাল বাহিনী রক্ষা করে বিপক্ষ বাহিনীকে সন্তপ্ত করবেন, তখন আর সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগ থাকবে না। মহাবল ভীমসেন যুদ্ধে উপস্থিত হয়ে দুঃশাসনের রক্ত পান করে, মদস্রাবী ও বিপক্ষ হস্তীঘাতী মহাহস্তীর ন্যায় যুদ্ধস্থানে নৃত্য করতে থাকবেন। এ যখন আপনি দেখবেন, তখন আর সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর যুগ থাকবে না। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, রাজা দুর্যোধন এবং সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ এঁরা যুদ্ধ করার জন্য অগ্রসর হলে, অর্জুন অতিদ্রুত তাঁদের বারণ করছেন, এ যখন আপনি দেখবেন, তখন আর সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর যুগ থাকবে না। নকুল ও সহদেব যুদ্ধে এসে মত্তহস্তীর মতো ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের আলোড়ন করছেন এবং তীব্র অস্ত্রপাতের মধ্যেও বিপক্ষ বীরগণের রথসকল ভগ্ন করছেন, ও যখন আপনি দেখবেন, তখন আর সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর যুগ থাকবে না।
“কর্ণ আপনি এখান থেকে গিয়ে ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপকে বলবেন, এই সুখজনক অগ্রহায়ণ মাস উপস্থিত হয়েছে। এ সময়ে ঘাস ও কাঠ অনায়াসে পাওয়া যায়, বনগুলি লতায় পরিপুষ্ট হয়েছে। ধান্য প্রভৃতি শস্য ও ফল জন্মেছে, মক্ষিকা অল্প হয়ে গেছে, কর্দম নেই, জল সুস্বাদু হয়েছে এবং এ সময়ে গরমও অধিক নয়, শীতও অধিক নয়। আজ থেকে সপ্তম দিন পরে অমাবস্যা হবে; সেইদিনই যুদ্ধ আরম্ভ হোক। কারণ, অমাবস্যার দেবতা যুদ্ধ নিপুণ ইন্দ্র। এবং যুদ্ধের জন্য উপস্থিত সকল রাজাকে বলবেন যে, তাঁদের যা অভীষ্ট, আমি সে সমস্তই সম্পাদন করব। দুর্যোধনের বশবর্তী রাজারা ও রাজপুত্রেরা যুদ্ধে অস্ত্র দ্বারা নিহত হয়ে উত্তম গতি লাভ করবেন।”
কৃষ্ণের সেই হিতকর ও শুভজনক বাক্য শোনার পর কর্ণ তাঁকে বললেন, “মহাবাহু, সমগ্র পৃথিবীরই যে ধ্বংস উপস্থিত হয়েছে, তা আমি জানি। তবুও আপনি আমাকে সম্মোহিত করবার ইচ্ছা করছেন কেন? ধৃতরাষ্ট্রনন্দন রাজা দুর্যোধন এবং দুঃশাসন, শকুনি ও আমি—এই চারজনেই সেই ধ্বংসের নিমিত্ত হয়েছি। পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে এই ভয়ংকর মহাযুদ্ধ উপস্থিত হয়েছে—এতে রক্তের কর্দম হবে। দুর্যোধনের বশবর্তী রাজারা ও রাজপুত্রেরা যুদ্ধে অস্ত্রের অনলে দগ্ধ হয়ে যমালয়ে গমন করবেন। আমি বহুতর ভয়ংকর স্বপ্ন, ভীষণ দুর্লক্ষণ ও অতিদারুণ উৎপাত লক্ষ করছি। সেই নানাবিধ রোমহর্ষণ উৎপাতগুলি যেন দুর্যোধন-পরাজয় এবং যুধিষ্ঠিরের জয় সূচনা করছে। তীক্ষ্ণ ও মহাতেজা শনিগ্রহ দুর্যোধনের পক্ষের বীরগণের পীড়া সূচনা করে রোহিণীনক্ষত্রকে পীড়িত করছেন। জ্যেষ্ঠানক্ষত্রস্থিত মঙ্গলগ্রহ বক্র গমন করে মিত্রদেবতাকে যোগ করার জন্য যেন অনুরাধা নক্ষত্রকে প্রার্থনা করছেন। নিশ্চয়ই কৌরবগণের মহাভয় উপস্থিত হয়েছে। কারণ, রাহুগ্রহ বিশেষভাবে চিত্রা নক্ষত্রকে পীড়া দিচ্ছে। চন্দ্রের কলঙ্কটা উলটে গিয়েছে, রাহু রবির সঙ্গে মিলিত হয়েছে এবং ভূমিকম্পের ও নির্ঘাতের উল্কার আকাশ থেকে পতিত হবার ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে। হস্তীগুলি বিকৃত শব্দ করছে এবং অশ্বগুলি অশ্রুমোচন করছে, আর তারা সন্তুষ্টচিত্তে জল ও ঘাস গ্রহণ করছে না। জ্ঞানীরা বলে থাকেন—এইসব লক্ষণ প্রাদুর্ভূত হলে, প্রাণীনাশক গুরুতর ভয় উপস্থিত হয়। অল্প ভোজন করলেও মানুষ হস্তী ও অশ্বগণের প্রচুর বিষ্ঠা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। জ্ঞানীগণ বলেন—দুর্যোধনের সমস্ত সৈন্যের পরাভবের সেটাই প্রধান লক্ষণ। পাণ্ডবদের দিক থেকে আগত লোকেরা বলে পাণ্ডবগণের বাহনগুলিকে আনন্দিত বলে মনে হয় এবং হরিণগণ তাদের দক্ষিণ দিক দিয়ে চলে, তাই-ই তাদের জয়ের লক্ষণ। আর সমস্ত হরিণ দুর্যোধনের বামদিকে বিচরণ করে এবং আকস্মিক বাণী শুনতে পাওয়া যায়। সেগুলি পরাজয়ের লক্ষণ। শুভসূচক ময়ূর, হংস, সারস, চাতক ও চকোর পাখিগুলি পাণ্ডবদের অনুসরণ করে। আর গৃধ্র, কঙ্ক, শোন, রাক্ষসের ছায়া, চিতাবাঘ, মক্ষিকাসমূহ কৌরবগণের অনুসরণ করে। দুর্যোধনের সৈন্যগণের মধ্যে ভেরি বাজালেও শব্দ হয় না; পাণ্ডবদের ঢাকগুলিতে অল্প আঘাত করলেও গুরুতর শব্দ হয়। দুর্যোধনের সৈন্যদের মধ্যে জলকুম্ভগুলি ধেনু ও বৃষগণের মতো শব্দ করে, তা পরাভবের কারণ। দেবরাজ ইন্দ্র দুর্যোধনের সৈন্যের উপর মাংস ও রক্ত বর্ষণ করেন, আর প্রাচীর, পরিখা, সুন্দর তোরণযুক্ত এবং সূর্যসমন্বিত এক একটা গন্ধর্ব নগর আকাশে উদিত হয়, তাতে আবার এক একটা কৃষ্ণবর্ণ পরিঘ সূর্যকে আবৃত করে অবস্থান করে। সকালে ও সন্ধ্যায় শৃগালেরা একটানা চিৎকার করে, তা পরাভবের লক্ষণ। একপক্ষ, একটি চোখ, একটি চরণযুক্ত কতগুলি পাখি ভয়ংকর চিৎকার করে, তা পরাভবের লক্ষণ। গলার রং কালো, পায়ের রং লাল ভয়ংকর কতকগুলি পক্ষী সন্ধ্যাকালে পশ্চিমদিকে গমন করে, তা পরাভবের লক্ষণ। দুর্যোধন প্রভৃতি প্রধান প্রধান ব্যক্তি প্রথমে ব্রাহ্মণগণের উপরে, তারপরে গুরুজনদের উপরে এবং তারপরে অনুরক্ত ভৃত্যবর্গের উপরে বিদ্বেষ করেন, তা পরাভবের লক্ষণ।
“কৃষ্ণ, পূর্বদিক রক্তবর্ণ, দক্ষিণদিক কৃষ্ণবর্ণ, পশ্চিমদিক কাঁচামাটির পাত্রের মতো উত্তরদিকও কৃষ্ণবর্ণ। দুর্যোধনের পক্ষে চারদিকের বর্ণ এইরকম। আবার কখনও কখনও চারদিক উজ্জ্বল—তা উৎপাতের সময়ের লক্ষণ। আমি স্বপ্নে দেখেছি—যুধিষ্ঠির যেন ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সহস্ৰস্তম্ভ প্রাসাদে আরোহণ করছেন। তাঁরা সকলেই শুক্লবর্ণ বসন পরিধান করেছেন এবং তাঁদের আসনগুলি শুক্লবর্ণ। জনার্দন আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আপনি এই রক্তাক্ত পৃথিবীটাকে হাতে ধরে অন্যত্র ছুড়ে দিচ্ছেন। আরও দেখেছি, অস্থিরাশির উপরে আরোহণ করে আনন্দিত যুধিষ্ঠির স্বর্ণপাত্রে ঘৃত ও পায়স ভোজন করছেন। আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, যুধিষ্ঠির যেন আপনার প্রদত্ত এই পৃথিবীকে গ্রাস করছেন। সুতরাং নিশ্চয়ই তিনি পৃথিবী ভোগ করবেন। আরও দেখেছি, নরশ্রেষ্ঠ ভীমসেন গদাহস্তে উচ্চ পর্বতে আরোহণ করে পৃথিবীকে গ্রাস করছেন। স্বপ্নে আমি দেখেছি যে গাণ্ডিবধারী অর্জুন পরম শোভায় উজ্জ্বল হয়ে আপনার সঙ্গে শ্বেতহস্তীতে আরোহণ করেছেন। অতএব, আপনারা যে দুর্যোধন প্রভৃতি রাজাগণকে বধ করবেন, তাতে সন্দেহ নেই। আমি দেখেছি, নকুল-সহদেব-সাত্যকি—এই তিনজন শুভ্রবর্ণ কেয়ূর, কবচ, মাল্য ও বসন ধারণ করে পাণ্ডুরবর্ণ ছত্র ও উত্তরীয় বস্ত্রে আবৃত হয়ে উত্তম মনুষ্যবাহনে আরোহণ করেছেন। দুর্যোধনের সৈন্যদের মধ্যে আমি মাত্র তিনজনকে শ্বেত উষ্ণীষধারী দেখেছি—অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা। আর সকল রাজাকেই আমি রক্তোষ্ণীষধারী দেখেছি। স্বপ্নে আরও দেখেছি, মহারথ ভীষ্ম ও দ্রোণ যেন আমার ও দুর্যোধনের সঙ্গে উটের উপর রথে চড়েছেন। আমরা চারজনেই দক্ষিণ দিকে চলেছি। অতএব আমরা অচিরকাল সময়ের মধ্যে যমালয়ে যাব। আমি, অন্য রাজারা, উপস্থিত ক্ষত্রিয়েরা সকলেই গাণ্ডিব অনলে প্রবেশ করব।”
কৃষ্ণ বললেন, “কর্ণ পৃথিবীর ধ্বংসকাল উপস্থিত। আমার কথাগুলি আপনার হৃদয়ে প্রবেশ করল না। কারণ, ধ্বংসের সময় উপস্থিত হলে মানুষের মন থেকে দুর্নীতি সরে যায় না।” কর্ণ বললেন, “মহাবাহু! বীর! কৃষ্ণ! জীবিত থেকে কি এই ক্ষত্রিয়নাশক মহাযুদ্ধ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে আবার আপনাকে দেখতে পাব? অথবা সেই স্বর্গে আবার আপনার সঙ্গে দেখা হবে। এখন আসি?” কর্ণ এই কথা বলে কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে চলে গেলেন। কৃষ্ণও আপন সারথি দারুককে আদেশ করলেন, “রথ চালাও।” সাত্যকির রথ পিছনে আসতে লাগল।
*
মহাভারত সহস্র মুক্তার অপূর্ব দুর্লভ মণিহার। তার মধ্যেও একটি উজ্জ্বলতম মুহূর্তে আমরা উপস্থিত হয়েছি। বাইরের কোনও ব্যক্তির মুখ থেকে কর্ণ আপনার জন্মবৃত্তান্ত জানলেন। কর্ণ বললেন, এ সত্য তাঁর জানা আছে যে, তাঁর জন্মদাতা সূর্যদেবও মাতৃদেবী কুন্তী। সূর্যের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে কর্ণের জন্ম। প্রসবের পর সেই সূর্যদেবের আদেশ অনুসারে কুন্তী তাঁকে জলে ভাসিয়ে দেন।
এখন প্রশ্ন হল যে কর্ণ তাঁর জন্মবৃত্তান্ত কীভাবে জানলেন? ব্যাসদেব সে বিবরণ দেননি। অতএব অনুমান ছাড়া কোনও উপায় নেই। মনে হয়, পালক-পিতা অধিরথের কাছ থেকে কর্ণ এই সংবাদ জেনেছিলেন। অধিরথ কীভাবে জেনেছিলেন? কুন্তী কর্ণকে জলে ভাসিয়ে দিলেও কোনও বিশ্বস্ত দাসীকে পাঠিয়েছিলেন মঞ্জুষাটিকে অনুসরণ করতে। অধিরথের গৃহে কর্ণ আশ্রয় লাভ করলে, মনে হয়, কুন্তী নিয়মিত তাঁর সংবাদ রাখতেন। পরিচারিকা মারফত তিনি অধিরথকে জানিয়েছিলেন, শিশুটি অবহেলার নয়, অত্যন্ত উঁচু ঘরে এর জন্ম। হয়তো বা অর্থ সাহায্যও করতেন।
কৃষ্ণ কর্ণকে তাঁর যথার্থ পরিচয় জানিয়ে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানালেন। কর্ণ দুটি কারণে কৃষ্ণের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। প্রথমত, দুর্যোধনের প্রতি তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবেন না। তাঁর উপর নির্ভর করেই দুর্যোধন যুদ্ধের আয়োজন করেছেন। দ্বিতীয়ত অধিরথ-রাধাকে অবহেলা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আবাল্য অধিরথ-রাধা তাঁকে লালন পালন করেছেন। সূতবংশে তিনি বর্ধিত হয়েছেন এবং বহু সূত রমণীকে বিবাহ করেছেন কর্ণ। তাদের গর্ভে বহু পুত্র হয়েছে। পুত্রদের থেকে বহু পৌত্রও লাভ করেছেন তিনি। সুতরাং তাদের ত্যাগ করে পাণ্ডবপক্ষে যোগদান করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। স্মরণ রাখা প্রয়োজন এই সময়ে কর্ণের বয়স প্রায় পঁচাত্তর।
তৃতীয় একটি কারণের উল্লেখ করেননি কর্ণ। ব্যাসও আলোচনা করেননি। মানসিকতার বিরাট এক ব্যবধান ঘটে গেছে কর্ণ আর পাণ্ডবদের। দুর্যোধনের সঙ্গে থেকে কর্ণ এত অন্যায় করেছিলেন যে, কৃষ্ণের ভাষায় যথার্থ দুরাত্মায় পরিণত হয়েছিলেন। অপরপক্ষে পাণ্ডবেরা ছিলেন নিষ্পাপ, ধর্মপরায়ণ। কর্ণ এ পরিবারে নিজেকে কোথাও মেলাতে পারতেন না।
কর্ণ এই দুর্লভ মুহূর্তটিতে অনুতাপ প্রকাশ করেছেন। কর্ণ বলেছেন—
যদব্ৰুবমহং কৃষ্ণ! কটুকাণি স্ম পাণ্ডবাণ্।
প্রিয়ার্থং ধার্তরাষ্ট্রস্য তেন তপ্যেহত্যকর্মনা ॥ উদ্যোগ : ১৩২ : ৪৫ ॥
“কৃষ্ণ আমি দ্যূতসভায় দুর্যোধনের প্রীতির নিমিত্ত পাণ্ডবগণকে যে কটু কথা বলেছি, সেই গুরুতর অকার্যের জন্য অনুতপ্ত হচ্ছি।”
কটুকথা? কটুকার্যগুলি সম্পর্কে কর্ণের অনুতাপ কই? একবস্ত্রা রজস্বলা ভ্রাতৃবধুকে কর্ণ পুরুষের সভায় আনিয়েছেন। কুন্তী দেবী বারংবার নিষেধ করেছেন, তবু দুঃশাসন কর্ণের আদেশে দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করে সভায় নিয়ে গেছেন। পঞ্চ স্বামীর (তাঁরা আপন ভ্রাতা) কারণে শ্বশুর ও গুরুজনদের সম্মুখে দ্রৌপদীকে ‘বেশ্যা’ বলে গাল দিয়েছেন। বলেছেন—“ভাবিনি! তোমার স্বামীরা মরেছে। তুমি এখন দুর্যোধনের গৃহে যাও। অন্য পতি গ্রহণ করো।” দ্রৌপদীকে এই কটু কথা বলার সময় কর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলেন যে, তাঁর জন্মদাত্রী মাতাও পাঁচটি পুরুষের শয্যায় শয়ন করেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী তা হলে তিনিও ‘বেশ্যাপুত্র’ হয়ে যান। শুধু বলা নয়, এরপর কর্ণ আদেশ করেছেন, দ্রৌপদীকে নগ্না করতে হবে। মহাভারতের দুর্যোধন পূর্ণ পাপী। কর্ণও সমান পাপী। অন্তরীক্ষ থেকে ধর্ম দেখছিলেন। কর্ণের মৃত্যুর আদেশে স্বাক্ষর সেই মুহূর্তেই হয়ে গেছে। তা ছাড়াও, এ অনুতাপ হৃদয়োৎসারিত নয়। কারণ এর মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে “সাত মহারথী শিশুরে বধিয়া ফুলায় বেহায়া ছাতি”। পিছন থেকে আঘাত করেছিলেন কর্ণ অভিমন্যুকে। অভিমন্যুর মৃত্যুর পর দুর্যোধনের সঙ্গে পাশবিক আনন্দে নেচেছিলেন কর্ণ।
কর্ণ এরপর এক অপূর্ব যজ্ঞের বর্ণনা দিয়েছেন। যে যজ্ঞে ভারতবর্ষের ক্ষত্রিয় সমাজ শেষ হবে। স্বীকার করেছেন—দুর্যোধন, শকুনি, দুঃশাসন এবং তিনি—এই দুষ্ট চতুষ্টয় এই যজ্ঞের কারণ। সাধারণত মানুষ জলে ডোবার আগে এক লহমায় সমস্ত অতীতকে নাকি দেখতে পায়। কর্ণ সমগ্র ভবিষ্যৎকে দেখেছেন। দেখেছেন অর্জুনের গাণ্ডিবানলে দগ্ধ হওয়া ধার্তরাষ্ট্রদের, দেখেছেন ভীষ্ম দ্রোণ জয়দ্রথের মৃত্যু—ভীমসেনের দুঃশাসনের বক্ষোরক্তপান, গদাঘাতে দুর্যোধনের মৃত্যু। কর্ণ স্বপ্ন দেখেছেন, পাণ্ডবভ্রাতারা সবাই জীবিত থাকবেন, কৌরবপক্ষে থাকবেন মাত্র তিনজন, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা আর কৃতবর্মা। এই অংশের বর্ণনায় ব্যাসদেবের অপূর্ব অলংকার ব্যবহার ক্ষমতা আমাদের মুগ্ধ করে। পাণ্ডবেরা বিজয়ী হবে, যুধিষ্ঠির পৃথিবীর সম্রাট হবেন, অস্থি কঙ্কালের স্তূপের উপর বসে স্বর্ণময় পাত্রে ঘৃত ও পায়স ভক্ষণ করবেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, দুর্যোধন, শকুনি, দুঃশাসন ও তিনি উট বাহিত রথে দক্ষিণে যমালয়ে যাত্রা করবেন।
তবু এই মুহূর্তটিতে এক লহমার জন্য কর্ণকে ভীষণ ভাল লাগে। কর্ণ কৃষ্ণকে অনুরোধ করেছেন তাঁর জন্মবৃত্তান্ত তাঁর জীবিতকালে যেন যুধিষ্ঠির জানতে না পারেন। তা হলে যুধিষ্ঠির কিছুতেই রাজ্যগ্রহণ করবেন না, কর্ণকে তা দিয়ে দেবেন। আবার কর্ণ বন্ধুকৃত্য রক্ষা করতে দুর্যোধনকে তা দেবেন। কর্ণ যুধিষ্ঠিরকে চিনেছিলেন। এই ধর্মাত্মা মানুষটি যে সসাগরা ধরণীর বিনিময়েও ধর্ম ত্যাগ করবেন না, তা কর্ণ বুঝতেন। তাঁর এই উপলব্ধির প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য।
কর্ণ রাজ্যভোগ করতে ভালবাসতেন। তিনি নিজেই বলেছেন—
ধৃতরাষ্ট্রকুলে কৃষ্ণ! দুর্যোধন সমাশ্রয়াৎ।
ময়া ত্রয়োদশ সমা ভুক্তং রাজ্যমকণ্টকম্ ॥ উদ্যোগ : ১৩২: ১৩ ॥
“কৃষ্ণ! আমি ধৃতরাষ্ট্রভবনে দুর্যোধনকে অবলম্বন করে আজ এয়োদশ বৎসর নিষ্কণ্টক রাজ্য ভোগ করছি।”
বড় দুঃখ হয়, এতখানি সম্ভাবনা সত্ত্বেও, এত বড় বংশে জন্মে, দুর্যোধনের চাটুকারিতায়, তোষামোদে, স্তাবকতায় কর্ণ তাঁর জীবন কাটিয়ে গেলেন। পরিবেশ যে মানুষকে কত নীচে নামিয়ে দেয়, তার উজ্জ্বলতম নিদর্শন—মহাভারতের কর্ণ।
৫৮
কুন্তী-কর্ণ সংবাদ
কৃষ্ণ হস্তিনাপুর থেকে চলে যাবার সময়ে বিষণ্ণ, দুঃখিত কুন্তীকে আসন্ন যুদ্ধ সম্পর্কে জানালেন। তখন কুন্তী অতিমাত্রায় চিন্তিত ও ব্যথিত হয়ে পড়লেন। কুন্তী মনে মনে আলোচনা করলেন এবং চিন্তা করলেন, “যার জন্য এই যুদ্ধে জ্ঞাতিবধ করা হবে এবং বন্ধুবর্গের পরাভব ঘটবে, আমি সেই অর্থের প্রতি ধিক্কার করি। পাণ্ডবগণ, চেদিগণ, পাঞ্চালগণ ও যাদবগণ সম্মিলিত হয়ে কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন, এর থেকে আর দুঃখের কী আছে? আমি যুদ্ধ হলেও দোষ দেখতে পাই, আর যুদ্ধ না হলে পাণ্ডবদের ক্ষতি দেখতে পাই। নির্ধনের বরং মরণ ভাল, কিন্তু জ্ঞাতিনাশক জয় ভাল নয়। এই চিন্তায় আমার মনে গভীর দুঃখ জন্মাচ্ছে। মহাযোদ্ধা শান্তনুনন্দন ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ ও কর্ণ এই তিনজনই দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করবেন, সেই জন্য আমার ভয় আরও বাড়ছে। তাঁদের মধ্যে শিষ্যহিতৈষী দ্রোণাচার্য কখনও শিষ্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না। পিতামহ ভীষ্মও পৌত্র পাণ্ডবদের প্রতি স্নেহ বিসর্জন দেবেন না। কিন্তু ভ্রান্তদর্শী ও পাপমতি একমাত্র কর্ণই দুর্মতি দুর্যোধনের মোহানুবর্তী হয়ে সর্বদা পাণ্ডবদের বিদ্বেষ করে। কর্ণ সমস্ত সময়ে পাণ্ডবদের গুরুতর ক্ষতি করার জন্য অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করে, আর সে অত্যন্ত বলবান। তাই কর্ণই এখন আমার উদ্বেগ জন্মায়। অতএব আজ আমি কর্ণের কাছে গিয়ে তার মনটাকে পাণ্ডবদের প্রতি প্রসন্ন করার চেষ্টা করব এবং আমি সমর্থ হব বিশ্বাস করি।
“আমি যখন পিতৃভবনে বাস করতাম, তখন পরিচর্যা করে ভগবান দুর্বাসাকে সন্তুষ্ট করেছিলাম। তাতে তিনি আমাকে একটি বর দিয়েছিলেন যে, ‘তুমি এই মন্ত্রদ্বারা যে দেবতাকে আহ্বান করবে, তিনিই আসবেন।’ কুন্তীভোজ রাজার অন্তঃপুরে আমি ছিলাম। মহর্ষির দেওয়া বর বিষয়ে আমার অত্যন্ত সন্দেহ জন্মেছিল। ক্রমে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে স্ত্রীসুলভ স্বভাবে ও বালচাপল্যে আমি সেই মন্ত্রের ও দুর্বাসার বাক্যের বল পরীক্ষা করবার জন্য বারবার তার উপায় চিন্তা করলাম। তখন একজন ধাত্রী আমাকে সর্বদা রক্ষা করে চলত এবং সখীরা আমাকে পরিবেষ্টন করে থাকত। আমি সর্বপ্রকার দোষ পরিত্যাগ করে চলতাম ও পিতার কাছে অত্যন্ত সচ্চরিত্র থাকতাম। অথচ তখন ভাবলাম, কী করে আমার দেবতাহ্বান সুসম্পন্ন হবে, কী করেই বা আমি অপরাধিনী না হয়ে থাকতে পারব—এই ভেবে দুর্বাসা মুনিকে মনে মনে নমস্কার করে কৌতুক ও মূর্খতাবশত সেই লব্ধমন্ত্র দ্বারা মনে মনে তখনই সূর্যদেবকে আহ্বান করলাম। তারপর আমি কন্যা হয়েও সূর্যদেবকে পেলাম এবং তাঁর সংসর্গ করলাম। তখন আমার কন্যাকালে যে গর্ভ হয়েছিল, যাকে আমি পুত্রের মতো দশ মাস উদরে রক্ষা করেছি, সেই কর্ণ এখন নিজের হিতকর ও ভ্রাতৃগণের হিতজনক বাক্য কেন রক্ষা করবে না?”
কুন্তীদেবী এইরূপে উত্তমভাবে কর্তব্য স্থির করে, আশার উপর নির্ভর করে, কর্তব্য সম্পাদনের জন্য গঙ্গার দিকে গমন করলেন। তারপর কুন্তীদেবী গঙ্গাতীরে সেই দয়ালু ও সত্যপরায়ণ পুত্রের বেদ পাঠধ্বনি শুনতে পেলেন। কর্ণ পূর্বমুখ ও ঊর্ধ্ববাহু হয়ে জপ করছিলেন, সেই সময়ে কুন্তী দেবী আপন কর্তব্য সম্পাদনের জন্য উপস্থিত হয়ে কর্ণের জপসমাপ্তির প্রতীক্ষা করে তাঁর পিছনে দীনভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। বৃষ্ণিবংশে উৎপন্না ও কুরুবংশীয় পাণ্ডুর পত্নী কুন্তী তখন সূর্যের তাপে পীড়িত এবং পদ্মমালার মতো শুষ্ক হতে থেকে কর্ণের চাদরের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকলেন। কিছুকাল পরে কর্ণ, নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে মধ্যাহ্ন পর্যন্ত জপ করে পিছনে ফিরে কুন্তীকে দেখে অভিবাদনপূর্বক কৃতাঞ্জলি হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর মহাতেজা, অভিমানী ও ধার্মিকশ্রেষ্ঠ সূর্যনন্দন কর্ণ বিস্মিত ও অবনত ন্যায় অনুসারে সবিনয়ে কুন্তীকে বললেন,
“রাধার গর্ভজাত অধিরথের পুত্র আমি কর্ণ আপনাকে অভিবাদন করছি। আপনি কী জন্য এসেছেন? বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?” কুন্তী বললেন, “তুমি কুন্তীর গর্ভজাত, রাধার গর্ভজাত নও। অধিরথও তোমার পিতা নন। তুমি সারথির বংশেও জন্মগ্রহণ করনি। তুমি সেই বৃত্তান্ত আমার কাছে শোনো। পুত্র তুমি কুন্তীরাজার ঘরে আমার কন্যা অবস্থায় জন্মেছিলে, আমি তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছিলাম। তুমি নিঃসন্দেহে পার্থ। জগৎ প্রকাশক তাপদানকারী এই সূর্যদেবই তোমাকে আমার গর্ভে উৎপাদন করেছিলেন। এখন তুমি অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ হয়েছ। পুত্র তুমি কুণ্ডল ও কবচ ধারণ করে দেবশিশুর শোভায় শোভিত হয়ে আমার পিতার গৃহে জন্মেছিলে। সেই তুমি ভ্রাতৃগণকে না চিনে মোহবশত ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের পক্ষে যাচ্ছ তা তোমার পক্ষে কোনওমতেই সংগত হচ্ছে না। পুত্র পিতৃলোক ও স্নেহময়ী মাতা যাতে সন্তুষ্ট থাকেন, সেই আচরণ করাই মানুষের পক্ষে ধর্ম; ধর্মশাস্ত্র তাই বলে। পূর্বে অর্জুন অর্জন করেছিলেন, পরে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রেরা লোভবশত হরণ করেছে। এখন তুমি আবার বলপূর্বক পুনরুদ্ধার করে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যসমৃদ্ধি ভোগ করো। আজ কৌরবেরা দেখুক, দুই ভ্রাতা কর্ণ ও অর্জুন মিলিত হয়েছেন, সেই দেখে দুর্জনেরা ভয়ে অবনত হয়ে পড়ুক। রাম ও কৃষ্ণের মতো কর্ণ ও অর্জুন আজ মিলিত হোন। বৎস তোমরা দুজনে মিলিত হলে, জগতে তোমাদের কী অসাধ্য থাকতে পারে? কর্ণ তুমি পঞ্চভ্রাতা পরিবেষ্টিত হয়ে, মহাযজ্ঞবেদিতে দেবগণ বেষ্টিত ব্রহ্মার ন্যায় নিশ্চয়ই শোভা পাবে। সর্বগুণসম্পন্ন তুমি, সর্বজ্যেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠবন্ধুগণের মধ্যে আর যেন কেউ তোমাকে ‘সূতপুত্র’ শব্দ প্রয়োগ না করে। কারণ তুমি পৃথার পুত্র ও বলবান।”
তখন সূর্যমণ্ডল থেকে একটি বাক্য নির্গত হল; সে বাক্যটি স্নেহময় পিতার মতোই সূর্যদেব বলেছিলেন এবং তা দুরতিক্ৰমণীয় ও অতিশয় স্নেহসূচক ছিল। কর্ণ তা শুনতে পেলেন। “নরশ্রেষ্ঠ কর্ণ! কুন্তী দেবী সত্যই বলেছেন। তুমি মাতৃবাক্য পালন করো; তুমি সেই অনুযায়ী আচরণ করলে, তোমার সর্বপ্রকার মঙ্গল হবে।” মাতা কুন্তী এবং পিতা স্বয়ং সূর্যদেব এই কথা বললেও সত্যধারণাশালী কর্ণের বুদ্ধি বিচলিত হল না।
কর্ণ উবাচ
ন চৈতচ্শ্রদ্দধে বাক্যং ক্ষত্রিয়ে! ভাষিতং ত্বয়া।
ধর্মদ্বারং মমৈতৎ স্যান্নিয়োগকরণং তব ॥ উদ্যোগ : ১৩৬ : ৪ ॥
“কর্ণ বললেন, ক্ষত্রিয়ে! আমি আপনার বাক্যের আদর করি না এবং আপনার আদেশ পালন করাও যে আমার ধর্মের কারণ হবে, তাও স্বীকার করি না।” “যেহেতু আপনি আমার উপরে অত্যন্ত কষ্টজনক অন্যায় ব্যবহার করেছেন। জননী আপনি যে আমাকে ত্যাগ করেছিলেন, তাই আমার যশ ও কীর্তি নষ্ট করেছে। আমি যদিও ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মেছিলাম, আপনার জন্যই ক্ষত্রিয়ের যোগ্য সংস্কার লাভ করিনি। কোনও শত্রু এর থেকে বেশি আমার কী ক্ষতি করবে। যখন দয়া করার সময় ছিল, তখন দয়া না করে, এখন সংশোধনের কাল অতীত হয়ে গেলে, এখন আপনি আমাকে ধর্মের পথ দেখাতে এসেছেন। আপনি পূর্বে আমার প্রতি মাতার আচরণ করেননি—এখন নিজের হিতের জন্যই আমাকে হিতোপদেশ দিতে এসেছেন।”
“কোন লোক কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত অর্জুনকে ভয় না করে? অতএব আমি পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলিত হলে কোন লোক আমাকে ভীত মনে না করবে? আমি পূর্বে পাণ্ডবদের ভ্রাতা বলে পরিচিত ছিলাম না, এখন যুদ্ধের সময় পাণ্ডবদের ভ্রাতা পরিচয় দিয়ে পাণ্ডবপক্ষে যোগদান করলে, ক্ষত্রিয় সমাজ আমাকে কী বলবেন? ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা আমার সুখের জন্য সকল অভীষ্ট বস্তু আমাকে প্রদান করেছেন, আমাকে সম্মান দিয়েছেন, আমি কী করে তাঁদের সেই প্রদত্ত সম্মানগুলি নিষ্ফল করে দেব? যাঁরা পরের সঙ্গে শত্রুতা করেও সর্বদা আমার আনুগত্য করেন, বসুগণ যেমন ইন্দ্রের কাছে অবনত থাকেন, তেমন সর্বদাই আমার কাছে অবনত থাকেন, যাঁরা আমার শক্তির উপর নির্ভর করেই শত্রুদের সম্মুখীন হবার আশা করেন, আমি আজ ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের সেই আশা কী করে ছিন্ন করি? যাঁরা অকূল যুদ্ধ-সাগরের কূলে যাবার ইচ্ছা করে আমাকেই ভেলা হিসাবে গ্রহণ করে দুস্তর যুদ্ধ-সাগর উত্তীর্ণ হবার ইচ্ছা করছেন, আমি কী করে তাঁদের ত্যাগ করি? যাই হোক, ধৃতরাষ্ট্র উপজীবিগণের প্রত্যুপকার করার প্রকৃত সময় উপস্থিত হয়েছে। সুতরাং প্রাণের আশা ত্যাগ করেও আমি তার মধ্যে প্রবেশ করব। যে পাপিষ্ঠ ও অস্থিরচিত্ত লোকেরা রাজানুগ্রহে পরিপুষ্ট হয়ে প্রয়োজনকালে অন্যপক্ষে চলে যায়, আমি সেইরূপ বিশ্বাসঘাতক হতে পারব না। অতএব আমি সমস্ত শক্তি ও শিক্ষানৈপুণ্য অবলম্বন করেই ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের জন্য আপনার পুত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। এই আমার কাছে সহজ সত্য। হয়তো আপনি আমার হিতকারী বাক্যই বলেছেন, কিন্তু আমি তা রক্ষা করতে পারব না। তবে আপনার এই উদ্যম একেবারে ব্যর্থ হবে না। কারণ, আপনার পুত্রদের মধ্যে এক অর্জুন ছাড়া যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব যুদ্ধে আমার বধ্য হলেও কিংবা আমি তাঁদের বধ করতে সমর্থ হলেও আমি তা করব না। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের সৈন্যমধ্যে অর্জুনের সঙ্গে আমি প্রাণপণে যুদ্ধ করব। কারণ, আমি অর্জুনকে বধ করে যুদ্ধ-শিক্ষার ফল লাভ করব, কিংবা অৰ্জুন কর্তৃক নিহত হয়ে যশস্বী হব।
“জননী মোটের উপর আপনার পঞ্চপুত্র কখনও নষ্ট হবে না। কারণ, অর্জুন নিহত হলে আমাকে নিয়ে পাঁচ পুত্র থাকবে, আর আমি নিহত হলে অর্জুনকে নিয়ে পাঁচ পুত্র থাকবে।”
কর্ণের এই কথা শুনে কুন্তী দুঃখে কাঁপতে থেকে অত্যন্ত ধৈর্যশালী পুত্র কর্ণকে আলিঙ্গন করে বললেন, “কর্ণ তুমি যা বললে, তাই হবে। এই যুদ্ধে কৌরবেরা ক্ষয় পাবেন! হায়! দৈবই প্রবল। বৎস শত্রুদমন! তুমি অর্জুনভিন্ন অপর চার ভ্রাতাকে অভয় দান করেছ। অতএব প্রতিজ্ঞা করো যে তাদের যুদ্ধে ছেড়ে দেবে। (কর্ণ মাথা নাড়িয়ে তা স্বীকার করলেন)।” তারপর কুন্তী কর্ণকে বললেন, “বৎস! তুমি নীরোগ হয়ে থাকো এবং তোমার মঙ্গল হোক।” কর্ণও সন্তুষ্ট হয়ে কুন্তীকে অভিবাদন করলেন তারপর তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন পথে চলে গেলেন।
*
এই মুহূর্তটির আলোচনায় প্রথমেই দেখা যায়, কুন্তী মন স্থির করে সোজা গঙ্গার দিকে যাত্রা করলেন। অর্থাৎ কুন্তী জানতেন যে, এই সময়ে কর্ণ কোথায় থাকবেন। আবার কর্ণও মধ্যাহ্নকালীন জপ করা শেষ করে পিছনে ফিরে কুন্তীকে দেখে কোনও বিস্ময়ে অভিভূত হলেন না। বোঝা গেল এই নারী তাঁর পূর্ব পরিচিতা। অর্থাৎ মুখোমুখি আলাপ না হলেও মাতা-পুত্র পরস্পরকে জানতেন। অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ নাট্যকাব্যে যে বিস্ময়ের সঙ্গে নাট্যকাব্যটি শুরু করেছিলেন, ব্যাসদেবের কাহিনি তা সমর্থন করে না।
কর্ণ কুন্তীকে প্রশ্ন করলেন যে, কুন্তী কেন তাঁর কাছে এসেছেন। কুন্তী তাঁকে জানালেন যে, কর্ণ অধিরথ-পুত্র নন, তিনি রাধাগর্ভজাত নন। তিনি কুন্তীর সন্তান, রাজভবনে তাঁর জন্ম, দেব-দিবাকর তাঁর জন্মদাতা পিতা। তিনি মোহবশত ভ্রাতৃগণকে অবহেলা করে দুর্যোধনের আনুগত্য গ্রহণ করেছেন। তা কর্ণের উচিত নয়। কুন্তী তাঁকে ভ্রাতৃগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে পৃথিবীর যাবতীয় সুখ অনুভব করার আহ্বান করলেন। কুন্তীর কণ্ঠে কর্ণের প্রতি এই আবেদনের সময় কোনও কুণ্ঠা ছিল না। পুত্রকে ত্যাগ করার জন্য কোনও অনুতাপও ধ্বনিত হয়নি। ঊর্ধ্বাকাশ থেকে কর্ণ শুনতে পেলেন পিতা সূর্যদেবের কণ্ঠস্বর। তিনি কুন্তীর সমস্ত বাক্য অনুমোদন করে, কুন্তীর ইচ্ছানুযায়ী আচরণ করতে কর্ণকে আহ্বান করলেন। কর্ণ পিতা মাতা উভয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন।
কর্ণ বর্তমান অবস্থার জন্য কুন্তীকে সম্পূর্ণ দায়ী করলেন কিন্তু একই কারণে সূর্যের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ জানালেন না। কুন্তীর জন্যই তিনি ক্ষত্রিয়ের সংস্কার লাভ করেননি। তিনি আরও অভিযোগ করলেন যে, তাঁর মঙ্গলের জন্য কুন্তী তাঁর কাছে আসেননি। নিজের মঙ্গলের জন্যই কুন্তী কর্ণের কাছে এসেছেন। কিন্তু কুন্তীর প্রার্থনা পূর্ণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, সমগ্র ক্ষত্রিয় সমাজ তা হলে মনে করবে কৃষ্ণার্জুনের ভয়ে তিনি পক্ষ পরিবর্তন করেছেন। তিনি কুন্তীকে আশ্বাস দিলেন যে, তাঁর আগমন সম্পূর্ণ নিষ্ফল হবে না। কারণ, অর্জুন ছাড়া অপর চারজন পাণ্ডবকে নাগালের মধ্যে পেলেও তিনি বধ করবেন না। কিন্তু এই যুদ্ধে হয় অর্জুন, না হয় তিনি—একজন নিশ্চয়ই মৃত্যুবরণ করবেন। কুন্তী পঞ্চপুত্রের জননীই থাকবেন। হয় অর্জুনকে নিয়ে, না হয় কর্ণকে নিয়ে।
কুন্তী অনুভব করলেন দৈবকে অতিক্রম করা যাবে না। কর্ণার্জুন একপক্ষে কিছুতেই আসবেন না। তিনি প্রস্থানের পূর্বে বলে গেলেন যুদ্ধে কৌরবদের ধ্বংস অনিবার্য। কৌরবদের মধ্যে তিনি কর্ণকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কুন্তী যাত্রাকালে কর্ণকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, অন্য চার ভ্রাতার অনিষ্ট কর্ণ করবেন না। কর্ণ তা স্বীকার করলেন। পিতা সূর্যদেব কোনও অনুরোধ আর কর্ণকে করেননি। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, কর্ণের নিয়তি তাকে টানছে।
মাতা-পুত্রের এই কথোপকথনকালে আর এক পাণ্ডবভ্রাতার কথা বারবার মনে পড়ে, তিনি যুধিষ্ঠির। কর্ণ কুন্তীর কাছে অভিযোগ করেছেন তাঁর সমস্ত ক্ষতির জন্য দায়ী কুন্তী। যুধিষ্ঠির তো একথা অনেক জোরালোভাবে ধৃতরাষ্ট্রকে বলতে পারতেন। বলতে পারতেন, বাল্যাবধি ধৃতরাষ্ট্র তাঁদের ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের ভার্যাকে অপমান করেছেন। রাজা হয়েও রাজার কর্তব্য পালন করেননি। বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাসের শর্ত পালন করে ফিরে আসার পরেও ধৃতরাষ্ট্র তাঁদের রাজ্য ফিরিয়ে দেননি। শঠতা করেছেন—সেই শঠতার প্রেরণাদাতাদের মধ্যে অন্যতম একজন কর্ণ।
বিনয়, নম্রতা, বাধ্যতা যুধিষ্ঠিরের চরিত্রকে মহোত্তম করেছে। কর্ণ অনায়াসে পিতা-মাতার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। যুধিষ্ঠির কখনও ধৃতরাষ্ট্রের আদেশের অবাধ্য হননি।
কর্ণ মাতাকে অভিযুক্ত করেছেন তাঁকে জন্মমুহূর্তে ত্যাগের জন্য। কিন্তু পিতৃ-মাতৃ পরিত্যক্ত তো শকুন্তলাও ছিলেন। কৃপাচার্যও ছিলেন। দ্রোণ জন্মমুহূর্তে পিতা-মাতা কাউকেই পাননি। কিন্তু তাঁরা পরিবেশ পেয়েছিলেন। শকুন্তলা পেয়েছিলেন মহর্ষি কণ্বের আশ্রয়। কৃপাচার্য পেয়েছিলেন রাজা শান্তনুর আশ্রয়। দ্রোণ পেয়েছিলেন মহর্ষি অগ্নিবেশ্য-এর আশ্রয়। কিন্তু কর্ণের পরিবেশ তাঁকে নিয়ে গেল অধিরথ সারথির গৃহে। সেই পরিবেশেই বড় হয়ে উঠলেন তিনি, অভ্যস্ত হলেন পরশ্রীকাতরতায়, অসত্যভাষণে ও দাম্ভিকতায়।
৫৯
রথী-মহারথ-অতিরথ গণনা
সমন্তপঞ্চকে কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে কৌরব ও পাণ্ডব সৈন্যেরা যুদ্ধের জন্য সমবেত হলেন। দুর্যোধন, ভীষ্মকে আপন পক্ষের সেনাপতি বরণ করে নিলেন। দেব-সেনাপতি কার্তিককে স্মরণ করে ভীষ্ম সেনাপতির ভার গ্রহণ করলেন। তখন দুর্যোধন ভীষ্মকে বললেন, “কৌরবনন্দন আমি আপনার কাছে স্বপক্ষ ও বিপক্ষের সমগ্র রথীসংখ্যা ও অতিরথ সংখ্যা জানতে ইচ্ছা করি। আপনি উপস্থিত রাজাদের সামনে আমাকে তা বলুন।”
ভীষ্ম উত্তর দিলেন, “গান্ধারীনন্দন! তোমার সৈন্যের মধ্যে যে সকল রথী ও অতিরথ আছেন, তাঁদের নাম তোমাকে বলছি শোনো। তুমি, দুঃশাসন প্রভৃতি তোমরা একশত ভ্রাতা উত্তম রথী। তোমরা অস্ত্রশিক্ষায় পটু, ছেদে ও ভেদে বিশারদ, রথ ও হস্তীতে আরোহণে পটু এবং গদা, প্রাস, অসি ও চর্মযুদ্ধে দক্ষতা লাভ করেছ। তোমরা সৈন্য পরিচালনায় দক্ষ, অস্ত্রে সুশিক্ষিত, প্রহারকারী, দুষ্কার্যসাধক এবং বাণাস্ত্রে দ্রোণ ও শারদ্বত কৃপের শিষ্য। তোমরা প্রত্যেকেই যুদ্ধ-দুর্ধর্ষ পাঞ্চালদের বধ করবে।
“আমি তোমার সমস্ত সৈন্যের পরিচালক হয়ে পাণ্ডবগণকে আকুল করে তোমার শত্রুদের বিনাশ করব। কিন্তু আমি নিজের গুণ বলব না, কারণ তোমরা তা জ্ঞাত আছ। ভোজবংশীয় অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ কৃতবর্মা একজন অতিরথ। ইনি যুদ্ধে তোমার কার্য সাধন করবেন। অস্ত্রজ্ঞ লোকেরা এঁকে জয় করতে পারেন না। ইনি দূরে সুদৃঢ় অস্ত্রনিক্ষেপ করতে পারেন। ইন্দ্র যেমন দানব সৈন্য বধ করেন, ইনিও পাণ্ডবসৈন্য বধ করবেন। মদ্ররাজ শল্য, যিনি আপন ভাগিনেয়দের ত্যাগ করে তোমার পক্ষে এসেছেন, যিনি সর্বদা কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে স্পর্ধা করেন— তিনি একজন অতিরথ। যিনি সমুদ্রতরঙ্গের মতো অবিরত বাণবর্ষণে পটু, তোমার হিতকারী ও বন্ধু, সেই মহাধনুর্ধর সোমদত্তনন্দন ভূরিশ্রবা একজন শ্রেষ্ঠ অতিরথ। সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ বিক্রমশালী ও রথারোহণে শ্রেষ্ঠ বলে দু’জন রথীর সমান। পাণ্ডবেরা এঁকে গুরুতর কষ্ট দিয়েছে, ইনিও গুরুতর তপস্যায় বরলাভ করেছেন। সেই শত্রুতা স্মরণ করে ইনি প্রাণপণেই পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন।
“কম্বোজরাজ সুদক্ষিণ একজন রথী। মহাবেগে প্রহারকারী ভয়ংকর ইন্দ্রতুল্য এই রাজার পরাক্রম সকলে দেখবেন৷ মাহিষ্মতীপুরীবাসী নীলবর্ণ বর্মধারী নীলরাজা একজন রথী। এঁর রথসমূহ শত্রুদের পীড়ন করবে। পূর্বে সহদেব এঁর সঙ্গে শত্রুতা করেছেন। সুতরাং ইনি তোমার জন্য গুরুতর যুদ্ধ করবেন। অবন্তীদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ এক একজন রথী বলে আমি মনে করি। এঁরা যুদ্ধনিপুণ, দৃঢ়শক্তি, পরাক্রমশালী, হস্তনিক্ষিপ্ত গদা, পাশ এবং অসি দ্বারা যমের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করে তোমার শত্রুবধ করবেন। ত্রিগর্তদেশীয় পঞ্চভ্রাতা প্রধান রথী। বিরাট রাজ্যে দক্ষিণে গো-গ্ৰহযুদ্ধের সময়ে অর্জুন ভিন্ন অন্য পাণ্ডবেরা তাঁদের সঙ্গে শত্রুতা করেছেন। সুতরাং এঁরা পাণ্ডবসেনাকে পীড়ন করবেন। দিগ্বিজয়ের সময়ে অর্জুন তাঁদের সঙ্গে অপ্রিয় আচরণ করেছেন। অতএব তাঁরা প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবেন।
“তোমার পুত্র লক্ষ্মণ এবং দুঃশাসনের পুত্র, এরা দুজনেই পুরুষশ্রেষ্ঠ। যুদ্ধে অপলায়নকারী, যুবক, সুকুমার, বলবান ও বহুবিধ যুদ্ধে বিশেষজ্ঞ। এরা দুজনই শ্রেষ্ঠ রথী এবং ক্ষত্রিয়ধর্মে নিরত এবং বীর। এরা গুরুতর যুদ্ধ করবে। মহাতেজা দণ্ডাধার একজন রথী। তিনি তোমার পক্ষে যুদ্ধ করবেন। মহাবেগ ও মহাপরাক্রমশালী কৌশলদেশীয় রাজা বৃহদ্বল একজন রথী। ভয়ংকর অস্ত্রধারী এই বৃহদ্বল আপন বন্ধুদের আনন্দিত করে ভয়ংকর যুদ্ধ করবেন। মহারাজ দুর্যোধন, শরদ্বানের পুত্র, গৌতমের বংশধর কৃপাচার্য— যিনি শরস্তম্ভ থেকে জন্মেছিলেন এবং অজেয়। সেই অতিরথ অগ্নির মতো তোমার শত্রুসৈন্যদের দগ্ধ করতে থাকবেন। তোমার মাতুল শকুনি একজন রথী। বিশাল সৈন্য নিয়ে ইনি বিপক্ষ সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। এঁর অস্ত্র এদেশে প্রচলিত অস্ত্র অপেক্ষা ভিন্ন। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা একজন মহারথ। এবং মহাধনুর্ধর, বিচিত্ৰযুদ্ধকারী ও দৃঢ়াস্ত্রধারী। অর্জুনের মতো এঁর বাণসকল ধনু থেকে বিশ্লিষ্ট হয়ে পরস্পর সংলগ্ন হয়ে গমন করে। অশ্বত্থামা মহারথ। তিনি ইচ্ছা করলে ত্রিভুবন দগ্ধ করতে পারেন। ইনি ক্রোধী এবং তেজস্বী, মুনিগণের যোগ্য তপস্যাও করেছেন, অত্যন্ত বুদ্ধিমান, এবং দ্রোণাচার্যের অলৌকিক শক্তিতে ও অস্ত্রে দীপ্যমান। কিন্তু এর একটি গুরুতর দোষ আছে যেজন্য আমি তাঁকে অতিরথ বা রথী বলেও মনে করতে পারি না। জীবন অত্যন্ত প্রিয় বলে এই ব্রাহ্মণ সর্বদাই আয়ু কামনা করেন, তা না হলে উভয় পক্ষের সৈন্যের মধ্যে এঁর তুল্য বীর আর নেই। এক রথে ইনি দৈবসৈন্য সংহার করতে পারেন। ধনুষ্টংকারে পর্বত বিদীর্ণ করতে পারেন এবং বিশাল দেহের অধিকারী। এই বীরের গুণ অসংখ্য, প্রহার গুরুতর, এবং তেজও ভয়ংকর। সুতরাং ইনি দণ্ডপাণি যমের মতো যুদ্ধে বিচরণ করবেন।
“অশ্বত্থামার পিতা নরশ্রেষ্ঠ দ্রোণ একজন প্রধান অতিরথ। সুতরাং, ইনি তোমার গুরুতর হিতসাধন করবেন। দ্রোণ মহাতেজা, বৃদ্ধ হলেও যুবক অপেক্ষা কার্যপটু। অস্ত্রবেগরূপ বায়ুকর্তৃক সঞ্চালিত এবং বিপক্ষ সৈন্যরূপ তৃণ ও কাষ্ঠসংলগ্ন দ্রোণ রূপ অগ্নি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়ে পাণ্ডবসৈন্য দগ্ধ করবেন। সকল ক্ষত্রিয়ের শিক্ষক এই দ্রোণ সৃঞ্জয়গণকে ধ্বংস করবেন। কিন্তু অর্জুন এঁর প্রিয়। সুতরাং এই মহাধনুর্ধর নিজের আচার্য-কার্য এবং অর্জুনের উজ্জ্বল ও প্রবল গুণ স্মরণ রেখে অনায়াসে কার্যকরী অর্জুনকে বধ করবেন না। ইনি অর্জুনের সর্বদাই প্রশংসা করেন এবং পুত্র অপেক্ষাও অর্জুনকে প্রিয় মনে করেন। প্রতাপশালী দ্রোণাচার্য একরথে অলৌকিক অস্ত্রদ্বারা সমবেত দেবতা, গন্ধর্ব ও মনুষ্যগণকে যুদ্ধে সংহার করতে পারেন। রাজশ্রেষ্ঠ পৌরব তোমার সৈন্যমধ্যে একজন প্রধান রথী। শত্রুসৈন্য সন্তপ্ত করে ইনি পাঞ্চালগণকে দগ্ধ করবেন। রাজপুত্র সত্যশ্রবা বৃহদ্বল প্রধান রথী হিসাবে শত্রুসৈন্য মধ্যে যমের মতো বিচরণ করতে থাকবেন। কর্ণের পুত্র বৃষসেন রথারোহণ পটু একজন মহারথ। তিনি তোমার শত্রুসৈন্য সংহার করবেন। মহাতেজা, বিপক্ষবীর-হন্তা মধুবংশসদ্ভূত জলসন্ধ একজন শ্রেষ্ঠ রথী। এই জলসন্ধ যুদ্ধে হস্তীস্কন্ধ সজ্জায় বিশারদ। হস্তীতে বা রথে আরোহণ করে ইনি তোমার পক্ষে শত্রুসৈন্য সংহার করতে থেকে যুদ্ধ করবেন। গতিময় বায়ুর মতো ইনিও যুদ্ধে নিবৃত্ত হবেন না। তোমার অন্যতম সেনাপতি সত্যবান যুদ্ধে অদ্ভুতকর্মা। ইনি হাস্য করতে করতে শত্রুগণের উপরে পতিত হবেন।
“ভগদত্ত মায়াবী, নিষ্ঠুরকর্মা ও মহাবল রথীশ্রেষ্ঠ হিসাবে যুদ্ধে শত্রুমধ্যে বিচরণ করবেন। প্রাগজ্যোতিষনগরের রাজা, প্রতাপশালী বীর ভগদত্ত হস্তিযুদ্ধে ও রথযুদ্ধে বিশারদ। পূর্বে অর্জুনের সঙ্গে এর দীর্ঘদিন সংগ্রাম হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সখা ইন্দ্রের গৌরব রক্ষা করবার জন্য অর্জুনের সঙ্গে করদানের অঙ্গীকারে সন্ধি করেছিলেন। ইনি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তোমার পক্ষে যুদ্ধ করবেন। অচল ও বৃষক এঁরা প্রত্যেকেই রথী, দৈহিক বল ও মানসিক বলশালী, গান্ধারদেশীয় বীরদের মধ্যে প্রধান, নরশ্রেষ্ঠ, দৃঢ়ক্রোধ ও প্রহার নিপুণ। এই দুই ভ্রাতা মিলিত হয়ে তোমার পক্ষে শত্রুসৈন্য বধ করবেন।
“নিষ্ঠুরস্বভাব, আত্মশ্লাঘাকারী ও নীচপ্রকৃতির তোমার প্রিয় সখা, মন্ত্রী, পরিচালক ও বন্ধু এবং অভিমানী ও অত্যন্ত গর্বিত বৈকৰ্তন কৰ্ণ, যে তোমাকে সর্বদা যুদ্ধে উৎসাহিত করে, সে একজন পূর্ণ রথীই নয়, অতিরথ তো নয়ই। কারণ এর স্বাভাবিক কবচ আর নেই এবং এ মূঢ়। সহজাত দিব্য কুণ্ডল দুটিও নেই এবং এই লোকটা সর্বদাই পরের কুৎসা করে। পরশুরামের অভিশাপ, ব্রাহ্মণের অভিশাপ এবং স্বাভাবিক কবচটির অভাবে এই কর্ণ একজন অর্ধরথ। সুতরাং যুদ্ধে অর্জুনের মুখে পড়লে জীবিত অবস্থায় মুক্তি লাভ করবে না।” সকল অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ দ্রোণও ভীমের বক্তব্য সমর্থন করলেন। “গঙ্গানন্দন আপনি যা বললেন তা সম্পূর্ণ সত্য; কারণ, কর্ণ অভিমানী এবং প্রত্যেক যুদ্ধে এঁকে পালাতেও দেখা যায়। ইনি দয়ালু ও অসাবধান, সুতরাং আমার মতেও কর্ণ অর্ধরথ।”
কর্ণ এই কথা শুনে ক্রোধে নয়নযুগল ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ কশার মতো বাক্যে ভীষ্মকে বললেন, “পিতামহ আমি কোনও অপরাধ করিনি, তবুও তুমি বিদ্বেষবশত পদে পদে আমাকে কটুবাক্য বল। আমি দুর্যোধনের জন্য সমস্তই সহ্য করি। তুমি আমাকে কাপুরুষের মতো অপটু বলে মনে করো। অতএব আমার মতে তুমিই অর্ধরথ। জগদ্বাসী কী করে বলে যে ভীষ্ম মিথ্যা কথা বলেন না। এই ভীষ্ম যে সর্বদাই কৌরবদের অহিত কামনা করেন, অথচ রাজা দুর্যোধন তা বোঝেন না। ভীষ্ম তুমি বিদ্বেষবশত আমার উপর দুর্যোধনের বিরাগ সৃষ্টির চেষ্টা করছ। অন্য কোনও ব্যক্তি স্বপক্ষীয় বীরদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির এইরূপ চেষ্টা করে না। ব্রাহ্মণদের মধ্যে যিনি অধিক মন্ত্র জানেন, তিনিই জ্যেষ্ঠ। ক্ষত্রিয়দের মধ্যে যিনি প্রধান বলশালী, তিনি জ্যেষ্ঠ, বৈশ্যদের মধ্যে যিনি অধিক ধনবান, তিনিই জ্যেষ্ঠ। আর শূদ্রদের মধ্যে যার বয়স অধিক সেই জ্যেষ্ঠ। ভীষ্ম তুমি নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী রথী ও অতিরথ বলে যাও, তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু তুমি কাম ও ক্রোধবশত আমাদের মধ্যে ভেদসৃষ্টির চেষ্টা করছ, তাতে কৌরবদেরই ক্ষতি হচ্ছে। রাজা তুমি নিজেই ভাল করে রথীপ্রভৃতির পর্যালোচনা করো, কিন্তু এই দুরভিসন্ধি ভীষ্মটাকে ছেড়ে দাও। কারণ, এ তোমার পক্ষে অনিষ্টকারী। তোমার সামনেই ভীষ্ম আমাদের তেজ নষ্ট করতে চেষ্টা করছে। তুমি ওটাকে ছাড়ো, আমিই পাণ্ডবসৈন্যকে শেষ করব। আমার বাণ অব্যর্থ। বৃষগণ যেমন ব্যাঘ্রের কাছে এসে চতুর্দিকে পলায়ন করে, তেমনই পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ আমার কাছে পৌঁছেই দশদিকে পালাতে আরম্ভ করবে।
“যুদ্ধ, সংঘর্ষ, আর মন্ত্রণাকালীন সৎপরামর্শই বা কোথায় আর কোথায় অতিবৃদ্ধ, অল্পবুদ্ধি, কালপ্রেরিত ভীষ্ম। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ভীষ্ম জগতের সমগ্র বীরের প্রতি স্পর্ধা করে আর কাউকেই পুরুষ বলে মনে করে না। অথচ ওটা নিঃসন্তান, আটকুঁড়ে, ওকে দেখে যাত্রা করলে, সব কাজ পণ্ড হয়ে যায়। শাস্ত্রে বলা আছে ‘বৃদ্ধের কথা শুনবে, কিন্তু তা অতিবৃদ্ধের কথা নয়। কারণ অতিবৃদ্ধেরা আবার বালক হয়ে যায়।’ রাজশ্রেষ্ঠ! আমি একক মহাযুদ্ধে পাণ্ডবদের সংহার করব আর যশ লাভ করবে ভীষ্ম। কারণ, তুমি ভীষ্মকে সেনাপতি করেছ, আর যশ সাধারণ যোদ্ধারা পায় না, সব যশ সেনাপতির উপরে গিয়ে পড়ে। অতএব রাজা, ভীষ্ম জীবিত থাকতে আমি কোনও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব না। ভীষ্ম মারা গেলে, আমি পাণ্ডবপক্ষের সকল মহারথের সঙ্গে যুদ্ধ করব।”
ভীষ্ম বললেন, “আমি যুদ্ধে দুর্যোধনের এই সমুদ্রতুল্য সৈন্যের ভার নিয়েছি, বহু বছর ধরে আমি এরই চিন্তা করছিলাম। সেই উষ্ণ ও লোমহর্ষক সময় উপস্থিত হয়েছে। এখন নিজেদের মধ্যে ভেদ করা উচিত নয়; সূতপুত্র শুধু এই কারণেই তুই জীবিত থাকলি। তুই বালক আর আমি অতি বৃদ্ধ হলেও, আজ এই কারণে আমি যুদ্ধের শক্তি দেখিয়ে তোর যুদ্ধের ও জীবনের আশা ছেদ করব না। নিকৃষ্ট কুলাঙ্গার! সজ্জনেরা নিজের শক্তির পরিচয় নিজেরা দেন না। তবু তোকে আজ দু-চারটে কথা বলব। কাশীনগরে স্বয়ংবর সভায় পৃথিবীর সমস্ত ক্ষত্রিয় উপস্থিত ছিলেন। এক রথেই তাঁদের সকলকে পরাজিত করে কন্যা তিনটি হরণ করে আনি, তা সকলের জানা আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে এর থেকেও প্রধান সহস্র সহস্র ক্ষত্রিয়কে আমি পরাজিত করেছি। তুই একটা অতি দুর্মতি! তোর জন্যেই আজকের এই গুরুতর অনর্থ। এখন সেই অনর্থের নিবৃত্তির চেষ্টা কর। পুরুষ মানুষ হবার চেষ্টা কর। যাঁকে চিরকাল স্পর্ধা করে এসেছিস, সেই অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ কর। আমি তোকে যুদ্ধ থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত দেখব।”
তখন রাজা দুর্যোধন ভীষ্মকে বললেন, “গঙ্গানন্দন আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করুন, গুরুতর সময় এসেছে। আপনাদের দু’জনকেই গুরুতর কার্য করতে হবে। এখন আপনি আমাকে শত্রুপক্ষের রথী, অতিরথ ও মহারথদের নাম বলুন।”
ভীষ্ম বললেন, “তোমার পক্ষে রথী, অতিরথ ও মহারথের কথা বলেছি। এবার পাণ্ডবপক্ষের কথা বলব। যুধিষ্ঠির স্বয়ং একজন প্রধান রথী। কোনও সন্দেহ নেই যে, অগ্নির মতো যুধিষ্ঠির যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করবেন। ভীম আটজন রথীর তুল্য একজন রথী। গদাযুদ্ধে কিংবা বাণযুদ্ধে তাঁর মতো বীর নেই। তিনি দশ সহস্র হস্তীর তুল্য বলশালী এবং অত্যন্ত অভিমানী। আর তিনি তেজে তো অতিমানুষ। পুরুষশ্রেষ্ঠ নকুল ও সহদেব প্রত্যেকেই এক একজন রথী এবং তাঁরা রূপে অশ্বিনীকুমারদের মতো তেজে পরিপূর্ণ। এঁরা গুরুতর কষ্টের কথা স্মরণ করে রুদ্রের মতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। এঁরা সকলেই মহাত্মা, শালস্তম্ভের মতো এঁদের উন্নতদেহ এবং উচ্চতায় অন্য পুরুষদের থেকে একহাত বেশি। পাণ্ডবেরা সকলেই দিগ্বিজয়ের সময় রাজাগণকে জয় করেছিলেন। কোনও পুরুষই এঁদের বাণ, গদা বা অন্যান্য অস্ত্র সহ্য করতে পারে না, কিংবা ধনুতেও গুণ পরাতে পারেন না অথবা এঁদের থেকে দ্রুত গদা তুলতে বা বাণ নিক্ষেপ করতে অন্য পুরুষ পারেন না। এই বলমত্ত পাণ্ডবেরা সকলেই যুদ্ধে নেমে তোমার সৈন্য বিনাশ করবেন। তুমি একা কখনও এঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যেয়ো না। বাল্যকালে তাঁরা বেগে, লক্ষ্যহরণে, খাদ্যে ও ধূলিখেলায় তোমাদের সকলকে জয় করতেন। রাজসূয় যজ্ঞের সময়ে তোমরা দেখেছিলে যে, পাণ্ডবেরা এক এক জনই যুদ্ধে সকল রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। এখন দ্রৌপদীর কষ্ট এবং দ্যূতক্রীড়ার সময়ের সমস্ত কটুবাক্য স্মরণ করে রুদ্রের মতো যুদ্ধে বিচরণ করবেন।
লোহিতাক্ষো গুড়াকেশো নারায়ণ সহায়বান্।
উভয়ো সেনয়োর্বীরো রথো নাস্তীহ তাদৃশঃ ॥ উদ্যোগ : ১৫৮ : ১৬ ॥
“—যাঁর নয়নযুগল স্বভাবতই রক্তবর্ণ এবং স্বয়ং নারায়ণ যার সহায়, সেই অর্জুনের তুল্য বীর ও রথী উভয় সৈন্যের মধ্যে কেউই নয়।”
“এমনকী সমস্ত দেবতা, অসুর, নাগ, রাক্ষস ও যক্ষের মধ্যেও তাঁর মতো বীর বা রক্ষী নেই; মানুষের মধ্যে আর থাকবে কী করে?
ভূতোহথবা ভবিষ্যে বা রথঃ কশ্চিন্ময়া শ্রুতঃ।
সমাযুক্তো মহারাজ! রথঃ পার্থস্য ধীমতঃ ॥ উদ্যোগ : ১৫৮ : ১৮ ॥
“— মহারাজ! অর্জুনের তুল্য রথী পূর্বে কেউ ছিলেন বা ভবিষ্যতে হবেন, এমন কথা আমি শুনিনি। সেই ধীমান্ অধিরথ অর্জুনের রথ প্রস্তুত হয়েছে।”
“কৃষ্ণ সারথি, অর্জুন যোদ্ধা, অলৌকিক গাণ্ডিব ধনু এবং বায়ুর মতো বেগবান সেই রথ। আর অভেদ্য দিব্য কবচ, অক্ষয় তূণীরদ্বয় এবং ইন্দ্র, রুদ্র, কুবের, যম ও বরুণের সম্বন্ধযুক্ত সকল অস্ত্র। ভয়ংকর দর্শন গদা ও বজ্র প্রভৃতি নানাবিধ প্রধান প্রধান অস্ত্র অর্জুনের আছে। যিনি একমাত্র রথে হিরণ্যপুরবাসী বহুসহস্র দানবকে যুদ্ধে বধ করেছিলেন, তাঁর তুল্য রথী আর কে আছে? বলবান, যথার্থবিক্রমশালী ও মহাবাহু এই অর্জুন অত্যন্ত ক্রোধের সঙ্গে আপন সৈন্য রক্ষা করতে থেকে তোমার সৈন্য সংহার করবেন। আমি বা দ্রোণাচার্যই এই অর্জুনের অভিমুখে যেতে সমর্থ; কিন্তু উভয় সৈন্যমধ্যে আমাদের তৃতীয় ব্যক্তি অন্য কেউ নেই। গ্রীষ্মকাল অতীত হলে মহাবায়ু সঞ্চালিত মেঘের মতো যে রথী বাণ বর্ষণ করতে থেকে বাণবর্ষণকারী সেই অর্জুনের দিকে যেতে পারে, তেমন কেউ নেই। অর্জুন উদ্যোগী, যুবা, নিপুণ এবং কৃষ্ণকে সহায় পেয়েছেন; আর আমি ও দ্রোণ দুজনেই অতিবৃদ্ধ।” ভীষ্মের এই কথা শুনে এবং পাণ্ডবদের পূর্ব বিক্রম স্মরণ করে কৌরবপক্ষীয় বীরদের অঙ্গ শিথিল হয়ে পড়ল। ভীষ্ম বর্ণনা অব্যাহত রাখলেন, “দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্ৰই মহারথ এবং বিরাট রাজপুত্র উত্তর একজন প্রধান রথী। মহাবাহু ও শত্রুহন্তা অভিমন্যু বল ও পরাক্রমে কৃষ্ণ ও অর্জুনের সমান অতিরথ। অভিমন্যু অতি দ্রুত অস্ত্রক্ষেপণ পটু ও বিচিত্রযোদ্ধা। পিতার ক্লেশ স্মরণ রেখে তিনি যুদ্ধে পরাক্রম প্রকাশ করবেন। মধুবংশীয় বীর সাত্যকি একজন অতিরথ। বৃষ্ণিবংশীয় প্রবীরগণের মধ্যে সাত্যকি শ্রেষ্ঠ পরাক্রমশালী। উত্তমৌজা ও যুধামন্যুও রথীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এঁরা বহু সহস্র রথী, হস্তী-আরোহী ও অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে যুধিষ্ঠিরের সন্তোষ উৎপাদনের ইচ্ছায় অগ্নি ও বায়ুর মতো তোমার সৈন্যমধ্যে বিচরণ করবে। মহাবীর, যুদ্ধে অজেয় বিরাট ও দ্রুপদরাজা বৃদ্ধ হলেও শ্রেষ্ঠ মহারথ। দুই জনেই স্নেহসম্পৰ্কবশত পাণ্ডবদের সঙ্গে আবদ্ধ। দুই রাজাই একই উদ্দেশ্যে তোমার সৈন্য সংহারে অবতীর্ণ হবেন। দুজনেই যুদ্ধে দারুণ এবং এক এক অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে এসেছেন। দ্রুপদ রাজপুত্র শিখণ্ডী যুধিষ্ঠিরের একজন প্রধান রথী। ইনি পূর্বের স্ত্রীভাব পরিত্যাগ করে এখন পুরুষ হয়েছেন। এঁর পাঞ্চাল ও প্রভদ্রকদেশীয় বহু সৈন্য আছে। সেই রথীসমূহ নিয়ে শিখণ্ডী যুদ্ধে গুরুতর কার্য সাধন করবেন।
“মহারাজ পাণ্ডবদের সমস্ত সৈন্যের অধিনায়ক দ্রুপদ-পুত্র ও দ্রোণশিষ্য ধৃষ্টদ্যুম্ন এক অসাধারণ অতিরথ। প্রলয়কালীন রুদ্রের মতো ইনি তোমার সৈন্য সংহার করবেন। সমুদ্রের মতো বিশাল রথীসৈন্য নিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন দেবতাদের মতো আক্রমণ করবেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের পুত্র ক্ষত্ৰধৰ্মা বালক এবং অস্ত্রশিক্ষায় সম্পূর্ণ শিক্ষিত নন, কাজেই ইনি অর্ধ-রথ। শিশুপালপুত্র চেদিরাজ-ধৃষ্টকেতু পাণ্ডবপক্ষের একজন শ্রেষ্ঠ মহারথ। আপন পুত্রের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ইনিও গুরুতর কার্য সাধন করবেন। ক্ষত্রিয় ধর্মে নিরত ও শত্রুনগরবিজয়ী ক্ষত্রদেব একজন উত্তম রথী, জয়ন্ত, অমিতৌজা ও সত্যজিৎ এঁরা তিনজনেই মহারথ এবং মহাত্মা। ক্রুদ্ধ হস্তীর ন্যায় এঁরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। বিক্রমশালী অজ ও ভোজ—দুজনেই মহারথ। কেকয়দেশীয় পঞ্চ ভ্রাতারা সকলেই প্রধান রথী এবং দ্রুত অস্ত্ৰক্ষেপী, বিচিত্রযোদ্ধা, অস্ত্রনিপুণ ও বিক্রমশালী এই পাঁচ ভ্রাতার রথের ধ্বজ রক্তবর্ণ। কাশীরাজকুমার, নীল, সূর্যদত্ত, শঙ্ক ও মদিরা— এই যুদ্ধ-নিপুণ, সর্বাস্ত্রবিদ ব্যক্তিগণ সকলেই প্রধান রথী। বার্দ্ধক্ষেমি মহারথ এবং রাজা চিত্রায়ুধ একজন শ্রেষ্ঠ রথী। চেকিতান ও সত্যধৃতি— এঁরা দুজনেই পাণ্ডবপক্ষের দুই শ্রেষ্ঠ মহারথ। ব্যাঘ্রদত্ত চক্রসেন প্রধান রথী। সেনাবিন্দু ও ক্রোধহন্তাও দুই শ্রেষ্ঠ রথী। যুদ্ধে যিনি কৃষ্ণ ও ভীমসেনের সমান, আমার, দ্রোণের ও কৃপের সমকক্ষ বীর কাশ্য একজন সর্বশ্রেষ্ঠ রথী। যুদ্ধক্ষেত্রে এঁকে আটগুণ অধিক শক্তিধর বলে মনে হয়। দ্রুপদরাজার অপর পুত্র সমরশ্লাঘী ও যুবক সত্যজিৎ ধৃষ্টদ্যুম্নের মতো একজন অতিরথ। মহাবল পাণ্ড্যরাজ একজন মহারথ। শ্রেণিমান ও বসুদান শ্রেষ্ঠ অতিরথ। রোচমান পাণ্ডবপক্ষের মহারথ। মহাধনুর্ধর, মহাবল পুরুজিৎ একজন শ্রেষ্ঠ অতিরথ। ইনি মহাধনুর্ধর, অস্ত্র প্রয়োগে দক্ষ, ইন্দ্রের ন্যায় যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করবেন। ভীমের পুত্র হিড়িম্বার গর্ভজাত রাক্ষসাধিপতি ঘটোৎকচ মায়াবী এবং দুর্ধর্ষ অতিরথ। অন্য সকল বীর রাক্ষসদের নিয়ে সে যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়ংকর কার্য সাধন করবে।
“এঁরা ছাড়াও বহুতর রথী মহারথ যুদ্ধক্ষেত্রে যুধিষ্ঠিরকে সহায়তা করবেন।”
*
রথী-মহারথ-অতিরথ বর্ণনা শেষ হল। আপন বর্ণনা শেষ করে ভীষ্ম জানালেন যে, কোনও অবস্থাতেই তিনি পঞ্চ-পাণ্ডব ভ্রাতার কারও কোনও ক্ষতি করবেন না আর শিখণ্ডী, যে পূর্বে স্ত্রীরূপে জন্মগ্রহণ করেছিল, পরে পুরুষত্ব প্রাপ্ত হয়— তার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না। অর্থাৎ, ভীষ্ম আপন মৃত্যুর ফাঁকটুকু রেখে গেলেন।
যুদ্ধের পূর্বে, দুই পক্ষের বীরদের শক্তি বিচারের এই অসাধারণ মুহূর্তের আলোচনার আগে রথী-মহারথ-অতিরথ বিষয়টা পাঠকের জানা জরুরি। রথী বলতে বোঝানো হয়েছে রথারোহী পরাক্রান্ত খ্যাতনামা যোদ্ধাকে। মহারথ হলেন বহু রথীর সম্মিলিত শক্তির অধিনায়ক। অতিরথ হলেন সেই রথী যিনি একাকী অমিত যোদ্ধার সঙ্গে যুদ্ধ করেন, অর্থাৎ মহারথগণের অধিপতি।
অবাক হয়ে যেতে হয় ভীষ্মের অমিত জ্ঞানের বহর দেখে। ভারতবর্ষের রাজন্যকুলে জাত প্রত্যেক রাজার, রাজপুত্রের, রাজপরিবারের শিশুর শক্তি ভীষ্মের নখদর্পণে। তিনি ক্ষত্রিয়-ধর্ম অবলম্বনকারী ব্রাহ্মণ বীরদের শক্তি ও সামর্থ্য সম্যকভাবে জানতেন। বীরদের প্রতিদিনের ঘটনা, তাঁদের উন্নতি-অবনতি সম্পর্কে খোঁজ রাখতেন। ভীষ্ম জানিয়েছেন যে, দুই পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে অর্জুনের তুল্য ধনুর্ধারী নেই এবং ভবিষ্যতেও হবে না— এ সংবাদে আমরা বিস্মিত হই না। কারণ এ সংবাদ আমরা পিনাকপাণি শিবের মুখেই শুনেছি।
বিস্ময় লাগে যখন ভীষ্ম ঘোষণা করেন যে, বৈকর্তন কর্ণ অতিরথ তো দূরের কথা সামান্য রথীও নন— তিনি অর্ধরথ। তিনি কেন কর্ণকে অর্ধরথ মনে করেন, তার কারণও দুর্যোধনকে জানিয়েছেন। কর্ণ অভিশপ্ত। পিতা সূর্যদেব প্রদত্ত অমৃত কুম্ভে ডোবানো কবচ-কুণ্ডল কর্ণ হারিয়েছেন, লাভ করেছেন গুরু পরশুরামের অভিসম্পাত। এই দুই ক্ষতি পূরণ করার শক্তি কর্ণের নেই। আচার্য দ্রোণ ভীষ্মের বিচারের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। কর্ণ ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু কৌরবপক্ষের দুই শ্রেষ্ঠ রথী তাঁদের মত পরিবর্তন করেননি। কর্ণ ভীষ্মের জীবিতকালে অস্ত্র গ্রহণ করবেন না প্রতিজ্ঞা করে যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। পরবর্তীকালে শরসজ্জায় শায়িত ভীষ্মের মুখেই শুনেছি, কর্ণ অকারণে পাণ্ডবদের সঙ্গে শত্রুতা করতেন, এ আচরণ ভীষ্ম কখনও সহ্য করতে পারেননি।
বিস্ময় প্রবল হয়ে ওঠে যখন ভীষ্ম বলেন, যুধিষ্ঠির একজন শ্রেষ্ঠ রথী। সাধারণভাবে পাঠক এই ধারণার সঙ্গে পরিচিত যে, যুধিষ্ঠির অস্ত্রবিদ্যায় বিশেষ পটু নন। ভ্রাতারা তাঁকে আড়াল করে রাখতে চান। কিন্তু ভীষ্ম বলছেন, অগ্নির মতো যুধিষ্ঠির রণক্ষেত্রে বিচরণ করবেন। তখনই পাঠকের স্মরণে আসে অজ্ঞাতবাস সম্পূর্ণ হবার পর যুধিষ্ঠির বিরাটরাজের সিংহাসনে উপবিষ্ট হলে অর্জুন পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন দেব-দৈত্য-নাগ-কিন্নর-যক্ষ-রক্ষ-মানব সকলের অস্ত্রবিদ্যা যুধিষ্ঠিরের জানা। তিনি একাকী স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল জয় করতে পারেন। তখনই পাঠক বুঝতে পারেন যে, যুধিষ্ঠির সম্পর্কে সাধারণ প্রচলিত মত সত্য নয়। যুধিষ্ঠির শ্রেষ্ঠ রথী ছিলেন, কিন্তু সেই পরিচয়ে পরিচিত হতে চাননি তিনি। তাঁর পথ শুধুমাত্র ক্ষত্রিয়রাজার নয়— গৃহস্থ এক মানুষের পথ। সত্য, ন্যায়, ধর্মকে যুধিষ্ঠির সারা জীবন রক্ষা করতে চেয়েছেন এবং পেরেছেনও বটে।
ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয়দের সামর্থ্য-বিচার তাই মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত।