২০
স্বয়মাগতা উলূপী
দাম্পত্য-জীবনের নিয়ম লঙ্ঘন করে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের কাছে বনবাসের আজ্ঞা চাইলেন। যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বনবাসে যেতে দিতে চাইছিলেন না। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, জ্যেষ্ঠের ঘরে কনিষ্ঠের প্রবেশে কোনও নিয়ম-লঙ্ঘন হয় না, উলটোটি ঘটলেই ঘটে। অর্জুন উত্তর দিলেন, “মহারাজ, আপনার কাছেই শিখেছি, ছলপূর্বক ধর্মাচরণ করা উচিত নয়। সুতরাং আমি সত্য অতিক্রম করব না। আপনি অনুমতি দিন, আমি বনবাস গমন করব।” অর্জুন যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে, ব্রহ্মচর্য পালনের জন্য, বারো বৎসরের জন্য বনবাসের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলেন।
কুরুবংশীয় মহাবীর বংশের যশোবৃদ্ধিকারী অর্জুন ইন্দ্রপ্রস্থ ত্যাগ করলে, বেদপারদর্শী, মহাত্মা ব্রাহ্মণেরা তাঁর পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন। বেদবিৎ, বেদাঙ্গবিৎ, ব্রহ্মজ্ঞ, ভিক্ষুক, বৈষ্ণব, স্তুতিপাঠক, পৌরাণিক, কথক, জিতেন্দ্রিয়, বনবাসী এবং অলৌকিক উপাখ্যান পাঠক প্রভৃতি সাধুলোক ও মধুরবাসী অন্যান্য বহুতর সহচর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে অর্জুন দেবগণে পরিবৃত দেবরাজের মতো গমন করতে লাগলেন।
যাত্রাপথে অর্জুন মনোহর ও বিচিত্র বন, সরোবর, নদী, সাগর, দেশ ও পবিত্র তীর্থগুলি দর্শন করলেন; পরে গঙ্গাদ্বারে গিয়ে আশ্রম নির্মাণ করলেন। সেই আশ্রমে থেকে অর্জুন অনেকগুলি অদ্ভুত কার্য করেছিলেন। মন্ত্র পড়ে আগুন জ্বালা হতে লাগল। আগুন জ্বলতে লাগল, হোম হতে থাকল। অগ্নিকুণ্ডে পুষ্পনিক্ষেপ চলতে থাকল। তখন সেই সকল অগ্নি আলোক অপর তীর পর্যন্ত যেতে লাগল। সুতরাং স্নাত, তপোনিষ্ঠ ও সৎপথস্থিত সেই জ্ঞানী মহাত্মাদের সেই গঙ্গাদ্বারটি অত্যন্ত শোভা পেতে লাগল। সেই আশ্রমটি সাধুলোকে পরিপূর্ণ হলে, একদিন অর্জুন স্নান করবার জন্য গঙ্গায় নামলেন। তিনি স্নান সমাপন ও পিতৃলোকের তর্পণ করার পর অর্জুন হোম করার জন্য উপরে উঠতে আরম্ভ করলেন। এমন সময়ে কামার্ত উলূপীনান্মী নাগকন্যা অর্জুনকে টেনে জলের ভিতরে নিয়ে গেল। অর্জুন জলের ভিতরে গিয়ে কৌরব্য-নামক নাগের ভবনে পরিষ্কৃত ও পরিচ্ছন্ন ভবন দেখতে পেলেন। শান্ত ও সমাহিত চিত্তে অর্জুন দেখলেন সেখানে অগ্নিহোত্রের অগ্নি রয়েছে। তিনি সেই অগ্নিতেই হোম করলেন। নাগভবনে এসেও নিঃশঙ্কচিত্তে হোম করায় অগ্নিদেব সন্তুষ্ট হলেন। হোম সমাপ্ত করে অর্জুন হাসতে হাসতেই যেন উলূপীকে প্রশ্ন করলেন, “সুন্দরী তুমি এই অসাধারণ সাহসের কাজ কেন করলে? এই সুন্দর দেশটির নাম কী? তুমি কে? তোমার বংশ পরিচয় কী?”
উলূপী বললেন, “ঐরাবত বংশসম্ভূত ‘কৌরব্য’ নামে এক নাগ আছেন, আমি তাঁর কন্যা, আমার নাম উলূপী! হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি স্নান করার জন্য গঙ্গায় নেমেছিলেন, তখন আমি আপনাকে দেখেই কামে পীড়িত হয়েছি। আপনার জন্যই কামদেব আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছেন, অন্য কেউ আমার পিতাও নেই। সুতরাং আপনি এই নির্জনস্থানে আত্মসমর্পণ করে আমাকে আনন্দিত করুন।”
অর্জুন বললেন, “ভদ্রে! ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বারো বৎসরের জন্য আমার ব্রহ্মচর্য স্থির করে দিয়েছেন। সুতরাং আমি স্বাধীন নই। অথচ আমি তোমার প্রীতিজনক কাজ করতে ইচ্ছা করি। কিন্তু পূর্বে আমি কোনওদিন মিথ্যা কথা বলিনি। নাগকন্যা! কী প্রকারে আমাদের ব্রহ্মচর্যের নিয়ম মিথ্যা না হয় এবং ধর্ম নষ্ট না হয়। অথচ তোমার প্রিয় কার্য করা হয়, তেমন একটা উপদেশ দাও দেখি।”
উলূপী বললেন, “পান্ডুনন্দন, আপনি যে কারণে পৃথিবী বিচরণ করছেন এবং যে কারণে আপনার জ্যেষ্ঠভ্রাতা আপনার উপর ব্রহ্মচর্যের আদেশ দিয়েছেন, সে সমস্তই আমি জানি। আপনার মধ্যে যে কোনও ভ্রাতা দ্রৌপদীর সঙ্গে এক ঘরে বাস করার সময় আপনাদের অপর কোনও ভ্রাতা মোহবশত যদি সেই ঘরে প্রবেশ করেন, তিনি বারো বৎসর পর্যন্ত বনে থেকে ব্রহ্মচর্য করবেন—এই আপনাদের নিয়ম। সুতরাং ব্রহ্মচারী থেকে পরস্পরের বনবাস করার এই নিয়ম আপনারা ধর্মের জন্য, দ্রৌপদীর বিষয়েই করেছেন। অতএব আমার সঙ্গে রমণ করলে আপনার ধর্ম কলুষিত হবে না। তা ছাড়াও, পীড়িতের পরিত্রাণ করাও কর্তব্য। তা ছাড়া, আমার সঙ্গে রমণ করায় যদি ধর্মের অনুমাত্র ব্যতিক্রমও হয়, তবুও আমাকে রক্ষা করায় আপনার ধর্ম নষ্ট হবে না। বরং আমার প্রাণরক্ষা করলে আপনার ধর্মই হবে। কারণ, আমি আপনার ভক্ত। সুতরাং, আপনিও আমাকে ভজন করুন, সাধুরাও এই কথাই বলেন। অন্যদিকে আপনি আমাকে রমণ না করলে আমি মৃত্যুমুখে পতিত হব। আপনি সুনিশ্চিতভাবে আমার একথা বিশ্বাস করবেন। অপরের প্রাণরক্ষার শ্রেষ্ঠ ধর্ম আপনি পালন করুন। আমি আপনার শরণাগত। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমি বারবার বলছি যে, আমি কামাতুরা হয়ে আপনাকে প্রার্থনা করছি। অতএব আপনিও আমার প্রিয় কার্য করুন, আপনি আত্মসমর্পণ করে আমার অভিলাষ পূর্ণ করুন।”
উলূপী এই কথা বললে, অর্জুন ধর্ম রক্ষার জন্যই উলূপীর প্রার্থনা অনুসারে তাঁর সঙ্গে সর্বপ্রকার রমণ করলেন। অর্জুন নাগরাজের বাড়িতে থেকেই সেই রাত্রি অতিবাহিত করলেন। সূর্য উদয়ের পর অর্জুন উলূপীর সঙ্গেই নাগরাজের বাড়ি থেকে পুনরায় গঙ্গাতীরে আগমন করলেন। তখন উলূপী অর্জুনকে এই বর দিলেন যে, অর্জুন সমস্ত জলেই অজেয় হবেন এবং সমস্ত জলজন্তুই অর্জুনের বশীভূত হবে।
অর্জুনকে এই কথা বলে মুনিগণের মধ্যে রেখে উলূপী আপন ভবনে চলে গেলেন।
*
ব্রহ্মচর্য বিষয়ে উলূপীর ব্যাখ্যা তাঁর নিজস্ব। অর্জুন নিজেও এ বিষয়ে অনিচ্ছুক ছিলেন বলে মনে হয় না। পরবর্তীকালেও অর্জুন চিত্রাঙ্গদা, সুভদ্রা ইত্যাদি নারীকে গ্রহণ করেছিলেন।
ইরাবান অর্জুন ও উলূপীর মিলনজাত পুত্র। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মের সেনাপতি থাকাকালীন সময়ে ইরাবাণ অসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে শকুনির ছয় ভ্রাতাকে হত্যা করেন এবং রাক্ষস অলম্বুষের হাতে প্রাণ দেন। উলূপী অর্জুনের বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন না। ‘সেই হিসাবে অর্জুন ইরাবাণের স্বাভাবিক পিতা ছিলেন না। ছিলেন ধর্মপিতা।’
২১
অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার বিবাহ
অর্জুন আশ্রমস্থ সকল মুনিকে উলূপী সংক্রান্ত সকল ঘটনা জানিয়ে হিমালয় পর্বতে গমন করলেন। যাত্রাপথে অর্জুন ব্রাহ্মণদের যথোচিত ধন দান করতে থাকলেন। চিত্তশুদ্ধির জন্য তীর্থ, দেবালয় ও সিদ্ধাশ্রম দেখলেন। সমুদ্র-সন্নিহিত প্রত্যেকটি দেশ, মনোহর বন দেখতে দেখতে চলতে লাগলেন। অর্জুন মহেশ পর্বতে উপস্থিত হয়ে অসংখ্য তপস্বী দেখলেন। তাঁদের আশীর্বাদ গ্রহণ করে অর্জুন সন্নিহিত মণিপুর দেশে প্রবেশ করলেন।
মণিপুরের সমস্ত তীর্থক্ষেত্র ও পবিত্র স্থানগুলি পরিদর্শনের পর অর্জুন রাজদর্শনের জন্য মণিপুরের ধার্মিক রাজা চিত্ৰবাহনের নিকট উপস্থিত হন। রাজা চিত্ৰবাহনের এক পরম সুন্দরী কন্যা ছিল। তার নাম চিত্রাঙ্গদা।
তাং দদর্শ পুরে তস্মিন্ বিচরন্তীং যদৃচ্ছয়া।
দৃষ্ট্বা চ তাং বরারোহাং চকমে চৈত্রবাহনীম্॥ আদি: ২০৮ : ১৬॥
সেই চিত্রাঙ্গদা তখন রাজবাড়িতে যদৃচ্ছ বিচরণ করছিলেন। সেই অবস্থায় ঈশ্বরের ইচ্ছায় অর্জুন সেই অপরূপা নারী চিত্ৰবাহন কন্যা চৈত্ৰবাহনী বা চিত্রাঙ্গদাকে দেখতে পেলেন।
চিত্রাঙ্গদাকে দেখে সেই মুহূর্তেই অর্জুন তার প্রতি অভিলাষী হলেন। অর্জুন অত্যন্ত স্থির ধর্মাচারীর ন্যায় রাজা চিত্ৰবাহনের নিকট উপস্থিত হয়ে আপন অভিলাষ তাঁর কাছে নিবেদন করলেন। অর্জুন চিত্রাঙ্গদাকে প্রার্থনা করে বললেন, “মহারাজ আমি ক্ষত্রিয় এবং সৎকুলোৎপন্ন; অতএব আমাকে আপনার কন্যাটি দান করুন।” অর্জুনের প্রার্থনা শুনে রাজা বললেন, “তুমি কার পুত্র? তোমার নাম কী?” তখন অর্জুন বললেন, “আমি পাণ্ডব, কুন্তীর পুত্র, আমার নাম ধনঞ্জয়।”
রাজা চিত্ৰবাহন শান্তকণ্ঠে অর্জুনকে বললেন, “এই বংশে প্রভঞ্জন নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি অপুত্রক বলে সন্তান কামনায় গুরুতর তপস্যা করেন। তাঁর সেই ভয়ংকর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে বর দেন, ‘তোমাদের বংশে এক এক পুরুষের এক একটি করে সন্তান হবে।’
“এইজন্য বহুদিন যাবৎ এই বংশে একটি করে সন্তান জন্মগ্রহণ করছে। তবে আমার সকল পূর্বপুরুষদের পুত্রই জন্মেছিল। কিন্তু আমার এই একটি কন্যা জন্মেছে। এই আমার বংশরক্ষা করবে। সুতরাং আমার ধারণা আছে যে, এইটিই আমার পুত্র। কারণ, আমি পুত্রিকা-পুত্র করবার বিধান অনুসারে যজ্ঞানুষ্ঠান করেছি। তাতেই এর ‘পুত্র’ এই সংজ্ঞা হয়েছে। সুতরাং অর্জুন তোমার দ্বারা এর গর্ভে যে পুত্র জন্মগ্রহণ করবে সে আমারই বংশধর হবে। যদি তুমি এই শপথগ্রহণ করে এর পাণিগ্রহণ করো এবং এই শপথগ্রহণকে শুল্ক বিবেচনা করে যদি আমার কন্যাকে গ্রহণ করো, তবে তোমার শুভ হবে।”
“তাই হবে”—এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্জুন চিত্রাঙ্গদার পাণিগ্রহণ করলেন। চিত্রাঙ্গদার পাণিগ্রহণের পর অর্জুন তপস্বীদের অনুরোধে পাঁচটি তীর্থক্ষেত্রকে জলজন্তুদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন। পাঁচটি তীর্থক্ষেত্র নিরুপদ্রব হলে অর্জুন মণিপুরে এসে চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে গিয়ে অর্জুন চিত্রাঙ্গদার গর্ভে বভ্রুবাহন নামে একটি পুত্র জন্ম দিলেন এবং সেই উৎপাদিত পুত্রকে নিয়ে চিত্রবাহনের কাছে গিয়ে বললেন—“মহারাজ! চিত্রাঙ্গদাকে গ্রহণ করার শুল্কস্বরূপ এই বভ্রুবাহনকে গ্রহণ করুন। বভ্রুবাহন দ্বারাই আমি আপনার ঋণ মুক্ত হব।”
অর্জুন চিত্রাঙ্গদাকে বললেন, “ভদ্রে, তুমি এইখানেই থাকো, তোমার মঙ্গল হোক। বভ্রুবাহনকে বড় করে তোলো। পরে আমাদের ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে তুমি আনন্দিত হবে। সেখানে কুন্তী, যুধিষ্ঠির, ভীম আর কনিষ্ঠ ভ্রাতা নকুল-সহদেব ও অন্যান্য বান্ধবগণকে দেখতে পাবে এবং সকলের সঙ্গে মিলিত হয়ে অত্যন্ত আনন্দলাভ করবে।
“মহারাজ যুধিষ্ঠির ধর্মপথেই আছেন এবং তার অক্ষুন্ন ধৈর্য আছে। সুতরাং তিনি পৃথিবী জয় করে রাজসূয় যজ্ঞ করবেন। সেই যজ্ঞে পৃথিবীর ক্ষত্রিয় নৃপতিরা বহুতর রত্ন উপঢৌকন নিয়ে আসবেন এবং তোমার পিতাও যাবেন। তখন তুমি তোমার পিতার আনুকূল্যে একসঙ্গে যেতে পারবে। সেই যজ্ঞেই তোমাকে আমি আবার দেখব। তুমি পুত্রকে পালন করতে থাকো, শোক কোরো না।
“বভ্রুবাহন আমার বাইরের প্রাণ এবং এই পুরুষটি বংশবর্ধক। সুতরাং তুমি পুত্রটিকে পালন করতে থাকো। এই পুত্রটি পুরুবংশের আনন্দজনক, পাণ্ডবগণের প্রিয়তম এবং ন্যায় অনুসারে মহারাজ চিত্ৰবাহনের উত্তরাধিকারী হবে। সুতরাং অত্যন্ত দায়িত্ব সহকারে তুমি একে পালন করবে। সুন্দরী, তুমি আমার বিরহে শোক কোরো না।” এইভাবে তিন বৎসরকাল মণিপুরে অতিবাহিত করে অর্জুন গোকর্ণতীর্থের দিকে গমন করলেন।
*
বভ্রুবাহন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। তিনিই মর্ত্যমানবীর গর্ভের একমাত্র সন্তান, যার সঙ্গে যুদ্ধে অর্জুনকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। বিমাতা উলূপীর প্ররোচনায় বভ্রুবাহন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করেন ও অর্জুনের মৃত্যু হয়। পরে উলূপী সঞ্জীবনী মণি বভ্রুবাহনের হাতে দিলে তিনি তা মৃত পিতার বক্ষের উপর রাখেন। তাতেই অর্জুন প্রাণ ফিরে পান। অশ্বমেধ যজ্ঞে পিতার আদেশ অনুযায়ী দুই মাতাকে নিয়ে বভ্রুবাহন অংশগ্রহণ করেন এবং যজ্ঞশেষে মণিপুরে ফিরে আসেন।
রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাট্যকাব্যের সঙ্গে ব্যাসদেবের মূল কাহিনির অনেক পার্থক্য। নাট্যকাব্যে রবীন্দ্রনাথ চিত্রাঙ্গদাকে কুৎসিত, কুরূপা করেছিলেন, ব্যাসদেবের চিত্রাঙ্গদা অপূর্ব রূপসী। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা পৌরুষদৃপ্তা। ব্যাসদেবের চিত্রাঙ্গদা অনেক রমণীয়া ও কমনীয়া।
অর্জুন যুদ্ধে বভ্রুবাহনের হস্তে নিহত হলে তাঁকে পুনরায় জীবিত করে উলূপী বলেছিলেন, “তুমি শিখণ্ডীকে সামনে রেখে ভীষ্মকে বধ করেছিলে।” বভ্রুবাহনের হাতে মৃত্যু সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত ঘটাল।
২২
পঞ্চতীর্থ উদ্ধারে অর্জুন
মণিপুরে চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করার পর অর্জুন কিছুদিন দক্ষিণ সমুদ্রবর্তী অতিপবিত্র এবং তপস্বী পরিশোভিত তীর্থদর্শনের জন্য যাত্রা করলেন। তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে শুনলেন যে, সেখানে পাঁচটি বিশিষ্ট তীর্থক্ষেত্র ছিল, যেগুলিতে পূর্বে তপস্বীগণে শোভিত থাকত, কিন্তু বর্তমানে তপস্বীরা সেগুলি সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেছেন। এই তীর্থগুলির নাম অগস্ত্যতীর্থ, সৌভদ্রতীর্থ, পৌলমতীর্থ, আর কারন্ধমতীর্থ ও ভারদ্বাজতীর্থ। কারন্ধমতীর্থে স্নান করলে মানুষ অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ করত। ভারদ্বাজতীর্থ ছিল সর্বপাপনাশক তীর্থ।
অর্জুন দেখলেন সেই পাঁচটি তীর্থক্ষেত্ৰই জনশূন্য। সেখানে কোনও স্নানার্থী নেই, কোনও তপস্বী সেই তীর্থক্ষেত্রে তপস্যায় মগ্ন নেই, ব্রাহ্মণেরা অগ্নিহোত্র করছেন না। স্তুতিপাঠক বেদ পাঠ করছেন না। সর্বত্রই রয়েছে অভিশপ্ত নির্জনতা। অর্জুন কৃতাঞ্জলি হয়ে দূরের তপস্বীদের প্রশ্ন করলেন, “ব্রাহ্মণবাদীরা এই তীর্থগুলিকে বর্জন করেছেন কেন?” তখন তপস্বীরা বললেন, “অর্জুন এই পাঁচটি তীর্থেই পাঁচটি জলজন্তু বাস করে এবং তারা তপস্বিগণকে হরণ করে নিয়ে যায়। এইজন্যই তপস্বীরা এই তীর্থগুলিকে বর্জন করে থাকেন।” তপস্বীরা অর্জুনকে সেই পাঁচটি তীর্থ বর্জন করতে উপদেশ দিলেন।
তপস্বীদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে অর্জুন সৌভদ্র নামক মহর্ষিতীর্থে উপস্থিত হয়ে অবগাহনপূর্বক স্নান করতে লাগলেন। তখন জলচারী বিশাল একটি জন্তু এসে অর্জুনের চরণ আক্রমণ করল। আক্রমণ করামাত্র মহাবল অর্জুন বলপূর্বক সেই জন্তুটাকে নিয়ে উপরে উঠলেন। ওঠার সময়ে সেই জন্তুটা লাফাচ্ছিল।
উপরে তোলামাত্র সেই জন্তুটা পরমসুন্দরী একটি রমণী হয়ে গেল। তার সর্বাঙ্গ অলংকারপূর্ণ ছিল এবং স্বর্গীয় আকৃতি ছিল, আর সে আপন কান্তিতে আলোকিত ছিল। অর্জুন সেই গুরুতর আশ্চর্য ঘটনা দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে সেই রমণীটিকে বললেন, “কল্যাণী তুমি কে? কোথা থেকেই বা এই জলের মধ্যে এসেছিলে? কোন গুরুতর পাপের ফলে তোমার এই অবস্থা?”
বর্গা বলল, “হে মহাবীর, আমি দেবোদ্যানবিহারিণী অপ্সরা। আমার নাম বর্গা। আমি চিরদিনই কুবেরের প্রিয়তমা। আমার আরও চারটি সখী আছে। তারা সকলেই শুভলক্ষণা এবং স্বেচ্ছাগামিনী। আমি একদিন আমার সখীদের সঙ্গে ইন্দ্রপুরীতে গিয়েছিলাম, সেই স্থান থেকে ফেরার সময়ে আমরা সকলে দেখলাম—নিষ্ঠাবান ও রূপবান এক ব্রাহ্মণ তপোবনের একদিকে থেকে একাকী বেদপাঠ করছেন, তাঁর তপস্যার তেজে সেই বন ব্যাপ্ত হয়ে আছে। ব্রাহ্মণ সূর্যের ন্যায় তেজে সেই সম্পূর্ণ স্থানটিকে আলোকিত করে আছেন। তখন আমি, সৌরভেয়ী, সমীচী, বুদ্বুদা ও লতা—এই পাঁচজনেই তাঁর তপস্যা এবং সেই জাতীয় উত্তম ও অদ্ভুত রূপ দেখে আকাশ থেকে সেই স্থানে নেমে এলাম।
“আনন্দ উচ্ছ্বাস করতে করতে, হাসতে হাসতে, গান গাইতে গাইতে সেই ব্রাহ্মণকে লুব্ধ করার জন্য আমরা তার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম। কিন্তু তেজস্বী ও নির্দোষ তপস্যায় নিরত ব্রাহ্মণকে কোনও মতেই লুব্ধ করতে বা বিচলিত করতে পারলাম না। তিনি ধ্যানমগ্ন চোখ দুটি খুলে একবার আমাদের দেখে ক্রুদ্ধ অভিসম্পাত করলেন যে, তোমরা জলজন্তু হয়ে শত বৎসর পর্যন্ত জলে বিচরণ করবে।
“তখন আমরা সকলেই অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে সেই ধার্মিক ও তপস্বী ব্রাহ্মণের শরণাপন্ন হলাম। বললাম, “ব্রাহ্মণ আমরা রূপে, বয়সে, কামে দর্পিত হয়ে এই অসঙ্গত কার্য করেছি। আপনি আমাদের ক্ষমা করুন। হে তপস্বী, আমরা যথেষ্টভাবে বধ হয়েছি যে আমরা আপনাকে প্রলুব্ধ করবার জন্য এখানে এসেছি। ধার্মিকেরা মনে করেন যে, বিধাতা স্ত্রীলোকদের অবধ্য করেই সৃষ্টি করেছেন। অতএব আপনি আমাদের বধ করতে পারেন না। ধর্মানুসারে আপনি শ্রীবৃদ্ধি লাভ করুন। জ্ঞানীরা বলে থাকেন যে, ব্রাহ্মণ সকল প্রাণীরই বন্ধু। জ্ঞানীগণের এই প্রবাদ সত্য হোক। আপনি আমাদের রক্ষা করুন।”
“অপ্সরারা এই কথা বললে, ধর্মাত্মা, পুণ্যকার্যকারী ও চন্দ্র সূর্যের তুল্য তেজস্বী সেই ব্রাহ্মণ প্রসন্ন হলেন। ব্রাহ্মণ বললেন, “শত ও শতসহস্র প্রভৃতি শব্দ অন্যত্র আনন্ত্যবোধক হয় বটে, কিন্তু আমার এই শাপবাক্যের এই শতশব্দ সংখ্যাবোধক, সে আনন্ত্যবোধক নয়। অতএব তোমরা জলজন্তু হয়ে জলে থেকে লোকদের টেনে নিয়ে যেতে থাকলে, যখন কোনও শ্রেষ্ঠ মানুষ তোমাদের সেই জল থেকে তুলে নিয়ে যাবেন, তখনই তোমরা আবার আপন আপন রূপ ফিরে পাবে। আমি পূর্বে কোনওদিন মিথ্যা কথা বলিনি, অতএব আমার শাপ ব্যর্থ হবে না। তোমরা জলে প্রবেশ করলেই সেইসব কটি তীর্থ ‘নারীতীর্থ’ নামে সর্বত্র প্রসিদ্ধ হবে এবং জ্ঞানিগণের পুণ্য ও পবিত্রতা জন্মাবে।”
“তখন অপ্সরারা সেই ব্রাহ্মণকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করে, সেই স্থান থেকে একটু দূরে এসে অত্যন্ত দুঃখিত মনে চিন্তা করতে লাগল, “আমরা অল্পকালের মধ্যে সেই মানুষকে কোথায় পাব, যিনি আবার আমাদের নিজরূপ ধারণ করিয়ে দেবেন। আমরা যখন এই চিন্তা করছিলাম তখন পথিমধ্যে মহাত্মা দেবর্ষি নারদ আবির্ভূত হলেন। আমরা সেই অসাধারণ তেজস্বী দেবর্ষি নারদকে দেখে, অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাঁকে প্রণাম করলাম এবং লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলাম। তখন তিনি আমাদের দুঃখের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। আমরা তাঁকে সবিস্তারে তা বললাম।
“নারদ যথাবৎ বৃত্তান্ত শুনে বললেন, “দক্ষিণ সমুদ্রের উপকূলে মনোহর ও পাঁচটি পবিত্র তীর্থ আছে। তোমরা পাঁচজনে সেই পাঁচ তীর্থে গমন করো, বিলম্ব কোরো না। সেখানে নির্মল চিত্ত ও পুরুষশ্রেষ্ঠ পাণ্ডুনন্দন অর্জুন অতিদ্রুত তোমাদের এই দুঃখ থেকে মুক্ত করবেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”
অঙ্গরা বর্গা বলল, “হে নিস্পাপ অর্জুন, আমরা দেবর্ষি নারদের কথা শুনেই সকলে এখানে এসেছি। নারদের সেই কথা সম্পূর্ণ সত্য হয়েছে। আপনি আমাকে মুক্ত করেছেন। কিন্তু আমার অপর চারটি সখীও এই জলে রয়েছেন। আপনি তাঁদেরও মুক্ত করে দিন।” তারপর পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ বলবান অর্জুন হৃষ্টচিত্তে অপ্সরাদের সেই শাপ থেকে মুক্ত করলেন। তখন সেই অপ্সরারা জল থেকে উঠে আপন আপন শরীর লাভ করে পূর্বের মতোই সকলের দৃষ্টিগোচর হতে থাকল।
*
অর্জুন এইভাবে সেই তীর্থগুলিকে নিরুপদ্রব করলেন এবং অভিশপ্ত অপ্সরাদের উদ্ধার করলেন। পঞ্চতীর্থ উদ্ধার অর্জুনের জীবনের একটি বড় ঘটনা। পরবর্তীকালে এই ঘটনায় অত্যন্ত প্রীত কুবের অর্জুনের বহু উপকার করেছেন।
২৩
সুভদ্রা ও অর্জুন পরিণয়
বনবাসকালে অসাধারণ বিক্রমশালী অর্জুন ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তের সমস্ত তীর্থ ও সমস্ত পবিত্র স্থানগুলি বিচরণ করেছিলেন।
পশ্চিম সমুদ্রে যে সকল তীর্থ ও দেবালয় আছে, সেগুলি পরিদর্শন করে অর্জুন প্রভাসতীর্থে উপস্থিত হলেন। অর্জুন প্রভাসতীর্থে পৌঁছেছেন, লোকপরম্পরায় একথা কৃষ্ণের কানে পৌঁছল। সখা অর্জুনকে সমাদরে গ্রহণ করার জন্য কৃষ্ণ প্রভাসতীর্থে উপস্থিত হলেন। প্রভাসতীর্থে দুই সখার পরস্পর সাক্ষাৎ ঘটল। পূর্বজন্মে অর্জুন ও কৃষ্ণ নর-নারায়ণ ঋষি ছিলেন। ইহলোকে দুইজন অচ্ছেদ্য-বন্ধনে আবদ্ধ সখা হিসাবে পরস্পরকে পেয়েছিলেন।
কৃষ্ণ কৌতূহলবশত একদিন অর্জুনকে প্রশ্ন করলেন, “অর্জুন কী জন্য তুমি এই তীর্থভ্রমণ করছ?” অর্জুন আনুপূর্বিক সমস্ত বিবরণ তাঁকে জানালে, কৃষ্ণ তাঁর তীর্থভ্রমণ অনুমোদন করলেন। প্রভাসতীর্থে কিছুদিন বিচরণ করে কৃষ্ণার্জুন বাস করার জন্য রৈবতক পর্বতে চলে গেলেন। কৃষ্ণের আদেশে ভৃত্যেরা ইতোপূর্বেই রৈবতক পর্বতকে সুসজ্জিত করে রেখেছিল এবং সেখানে প্রচুর খাদ্য-পানীয় সংগ্রহ করে রেখেছিল। অর্জুন সেই খাদ্য-পানীয় গ্রহণ করলেন, নট-নর্তকদের নৃত্য-গীতাদি দর্শন ও শ্রবণ করলেন। অর্জুন তাঁদের প্রশংসা করলেন ও যাবার অনুমতি দান করলেন। কৃষ্ণের সঙ্গে একই দিব্য-শয্যায় শয়ন করে পূর্বে যে সমস্ত জলাশয়, তীর্থ পর্বত, নদী ও বন দেখেছিলেন, সে সমস্ত বৃত্তান্ত কৃষ্ণকে বলতে লাগলেন। বলতে বলতেই অর্জুন গভীর নিদ্রায় মগ্ন হলেন। মধুর গীত, বীণাশব্দ ও বৈতালিকগণের স্তুতি শুনে অর্জুনের ঘুম ভাঙল। সন্ধ্যাবন্দনা প্রভৃতি নিত্যকর্ম সমাপ্ত করে অর্জুন কৃষ্ণের আগ্রহে স্বর্ণময় রথে আরোহণ করে দ্বারকায় গমন করলেন।
অর্জুনের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য রাজপথ থেকে আরম্ভ করে গৃহ সন্নিকটবর্তী কৃত্রিম বনটি পর্যন্ত সমস্ত দ্বারকানগরী সুসজ্জিত করা হয়েছিল। সহস্র সহস্র দ্বারকাবাসী অর্জুনকে দেখার জন্য দ্বারকার রাজপথে উপস্থিত হল। অর্জুনকে দেখবার জন্য ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় পুরুষদের বিশাল সম্মিলন ঘটল। সকলেই অর্জুনের সম্মান করল, অর্জুনও নমস্যদের নমস্কার করলেন; তখন সেই নমস্যগণও তাঁকে আশীর্বাদ করলেন। কুমারগণ বিশেষ আদরের সঙ্গে অর্জুনকে আপন আপন ভবনে নিয়ে যাবার জন্য আগ্রহ করতে লাগল; তখন অর্জুন সমবয়স্ক সেই কুমারগণকে বারবার আলিঙ্গন করে, বহু খাদ্য ও রত্নসম্পন্ন মনোহর কৃষ্ণভবনে গিয়ে, কৃষ্ণের সঙ্গে সেখানে অনেকদিন বাস করলেন।
এইভাবে কিছুদিন কাটলে সেই রৈবতক পর্বতে কৃষ্ণ ও অন্ধকবংশীয়গণের বার্ষিক উৎসব আরম্ভ হল। ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় বীরগণ রৈবতক পর্বতের সেই উৎসবে সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণকে নানাবিধ বস্তু দান করতে লাগলেন। রৈবতক পর্বতের সকল দিকেই রত্নবিচিত্রীকৃত বহুতর অট্টালিকা এবং কল্পবৃক্ষ দ্বারা শোভিত হয়েছিল। বাদ্যকারেরা বাজনা বাজাচ্ছিল। নর্তকেরা নৃত্য করছিল এবং গায়কেরা গান করছিল। মহাবীর বৃষ্ণিকুমারেরা অলংকৃত হয়ে স্বর্ণময় যানে আরোহণ করে সকল দিকে বারবার বিচরণ করে বেড়াচ্ছিল। সহস্র সহস্র পুরবাসী ভার্যা ও অনুচরবর্গের সঙ্গে মিলিত হয়ে পায়ে হেঁটে ও নানাবিধ যানে আরোহণ করে ভ্রমণ করছিল।
তখন বলরাম মদ্যপানে মত্ত হয়ে, রেবতীকে সঙ্গে নিয়ে বিচরণ করতে লাগলেন; গন্ধর্বরাও তাঁর সঙ্গে বেড়াতে লাগল। প্রতাপশালী বৃষ্ণিরাজ উগ্রসেন বহুতর স্ত্রী সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ করতে লাগলেন; তাঁর পিছনেও গন্ধর্বেরা বিচরণ করতে লাগল। যুদ্ধদুর্ধর্ষ প্রদ্যুম্ন ও শাম্ব মদ্যপানে মত্ত হয়ে, দিব্য মাল্য ও বস্ত্র পরিধান করে, দুটি দেবতার মতোই বিচরণ করতে লাগলেন। অক্রূর, সারণ, গদ, বভ্রু, বিদূরথ, নিশঠ, চারুদেষ্ণ, পৃথু, বিপৃথু, সত্যক, সাত্যকি, ভঙ্গকার, মহারব, হার্দিক্য ও উদ্ধব—এঁরা এবং অন্যান্য অনেক লোক স্ত্রীগণ ও গন্ধর্বগণে পরিবেষ্টিত হয়ে পৃথক পৃথক ভাবে সেই উৎসবকে শোভিত করে তুললেন। কৃষ্ণ ও অর্জুন, উৎসবে মগ্ন হয়ে চারিদিকে বিচরণ করতে থাকলেন। তাঁরা সেখানে বিচরণ করতে থেকে সুলক্ষণা ও অলংকৃতা বসুদেবকন্যা সুভদ্রাকে দেখতে পেলেন।
দৃষ্ট্বৈব তামৰ্জুনস্য কন্দর্পঃ সমজায়ত।
তং তদৈকাগ্রমনসং কৃষ্ণঃ পার্থমলক্ষয়ৎ॥ আদি: ২১২: ১৫:॥
সুভদ্রাকে দেখেই অর্জুনের কাম আবির্ভূত হল, তাই তিনি একাগ্রচিত্তে তাঁকেই চিন্তা করতে লাগলেন, কৃষ্ণ এই ঘটনা লক্ষ করলেন।
লক্ষ করেই যেন তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “বনবাসীর মন কামে আলোড়িত হচ্ছে কেন? ইনি আমার ভগিনী, সারণের সহোদরা এবং আমার পিতার প্রিয়তমা কন্যা; এর নাম—সুভদ্রা। ইনি তোমার পক্ষে মঙ্গলময়ীই হবেন; সুতরাং তোমার যদি ইচ্ছা হয়, তবে আমি নিজেই পিতৃদেবকে বলব।”
অর্জুন বললেন, “বসুদেবের কন্যা, বাসুদেবের ভগিনী, অথচ রূপবতী। সুতরাং কোন পুরুষ এঁকে দেখে মুগ্ধ হবেন না? অতএব কৃষ্ণ তোমার এই ভগিনীটি যদি আমার ভার্যা হন, তবে নিশ্চয়ই আমার সর্বপ্রকার মঙ্গল হবে। কিন্তু এঁকে পাবার উপায় কী, তা বলো, যদি মানুষের শক্তিসাধ্য হয়, তবে তা আমি অবলম্বন করব।”
কৃষ্ণ বললেন, “অর্জুন, ক্ষত্রিয়ের স্বয়ংবর বিবাহ আছে বটে; তবে তা তোমার পক্ষে সন্দিগ্ধ। কেন না, স্ত্রীলোকের স্বভাব অনিয়ত, হয়তো সুভদ্রা স্বয়ংবরে অন্য পুরুষকে বরণ করেও ফেলতে পারেন। তারপর বিবাহের জন্য বীর ক্ষত্রিয়গণের বলপূর্বক কন্যাহরণও প্রশস্ত—ধর্মজ্ঞেরা এই কথা বলে থাকেন। অতএব অর্জুন তুমি বলপূর্বকই আমার ভগিনী সুভদ্রাকে হরণ করো। কারণ, সে স্বয়ংবরে কাকে বরণ করবে, কে জানে।”
তারপর অর্জুন ও কৃষ্ণ সুভদ্রাকে হরণ করার বিষয়ে ইতিকর্তব্য স্থির করেই, সে বিষয়ে অনুমতি নেবার জন্য ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের কাছে দ্রুতগামী বিশ্বস্ত কয়েকটি লোক পাঠিয়ে দিলেন। যুধিষ্ঠির তাঁদের কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনেই সে বিষয়ে অনুমতি দিলেন। সুভদ্রাকে হরণ করার ব্যাপারে কৃষ্ণের সম্মতি ও যুধিষ্ঠিরের অনুমতি পেয়ে অর্জুনও প্রস্তুত হলেন। সুভদ্রা রৈবতক পর্বতে গিয়েছেন জেনে, তাঁকে হরণ করার সম্পূর্ণ কর্তব্য স্থির করে অর্জুন আবার কৃষ্ণের অনুমতি চাইতে গেলেন।
সারথি কৃষ্ণেরই অনুমতিক্রমে একখানি স্বর্ণময় রথ প্রস্তুত করে এনেছিল। তাতে শৈব্য ও সুগ্রীব নামে দুটি ঘোড়া সংযোজিত ছিল এবং কিঙ্কিণীর মালা দুলছিল। আর তার ভিতরে সকল প্রকার অস্ত্র ছিল এবং রথখানি প্রজ্বলিত অগ্নির ন্যায় প্রকাশ পাচ্ছিল। মেঘের ন্যায় গম্ভীর শব্দ করছিল এবং শত্রুপক্ষের আনন্দ নষ্ট করছিল। অর্জুন এহেন রথে আরোহণ করে কবচ, খড়্গ, তল, অঙ্গুলিত্র ধারণপূর্বক যুদ্ধের জন্য সজ্জিত হয়ে সুভদ্রাকে হরণ করবার জন্য যাত্রা করলেন।
এদিকে সুভদ্রা সমস্ত দেবতার ও রৈবতক পর্বতের পূজা সমাপ্ত করে, ব্রাহ্মণগণ দ্বারা স্বস্তিবচন করিয়ে এবং রৈবতক পর্বতকে প্রদক্ষিণ করে দ্বারকার দিকে গমন করতে লাগলেন; এমন সময়ে অর্জুন কামবাণে প্রপীড়িত হয়ে, হঠাৎ গিয়ে সেই সর্বাঙ্গসুন্দরী সুভদ্রাকে বলপূর্বক রথে তুলে নিলেন। তারপর তিনি স্বর্ণখচিত রথে সেই মধুরহাসিনী সুভদ্রাকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে রওনা দিলেন।
অর্জুন সুভদ্রাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন দেখে সেখানকার সৈন্যরা কোলাহল করতে করতে দ্বারকানগরীতে সংবাদ দেবার জন্য ছুটে চলল। তারা মিলিত হয়ে, সুধর্মাসভায় গিয়ে, সভাপালের চারদিকে দাঁড়িয়ে, তাঁর কাছে অর্জুনের সুভদ্রাহরণ বৃত্তান্ত জানাল। সভাপাল সেই বৃত্তান্ত শুনে, স্বর্ণখচিত বিশালাকৃতি যুদ্ধসজ্জাসূচক মহাভেরি বাজাতে লাগলেন। তখন সেই শব্দে উদ্বেলিত হয়ে ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয়েরা ভোজন ও পান পরিত্যাগ করে, সকল দিক থেকে ছুটে এলেন।
তাঁরা সেখানে এসে মন্ত্রণা করার জন্য স্বর্ণখচিত গদি ও আস্তরণযুক্ত, মণি ও প্রবালশোভিত এবং অগ্নির ন্যায় উজ্জ্বলবর্ণ শত শত সিংহাসনে উপবেশন করলেন। তখন তাঁদের নিজের কিরণে সমাচ্ছন্ন অগ্নির মতো মনে হতে লাগল। দেবগণের মতো তাঁরা সভায় উপবিষ্ট হলে, সভাপাল অনুচরবর্গের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁদের কাছে অর্জুনের ব্যবহারের কথা বললেন। তাই শুনে বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ ক্রোধে আরক্ত নয়ন হয়ে, গর্ব প্রকাশ করতে থেকে অর্জুনের ব্যবহার সহ্য না করতে পেরে উঠে দাঁড়ালেন এবং অনেকে আদেশ করলেন, “সত্বর রথ প্রস্তুত করো এবং কুন্ত, ধনু ও মহামূল্য বৃহৎ কবচ আনয়ন করো।”
কেউ কেউ উচ্চ স্বরে সারথিগণকে ডাকতে লাগলেন, কেউ কেউ রথ প্রস্তুত করতে বললেন আবার কেউ কেউ নিজেরাই স্বর্ণভূষিত অশ্ব নিয়ে এসে রথে যোগ করতে লাগলেন। রথ, কবচ, ধ্বজ প্রভৃতি আনীত হল, মহাকোলাহল চলতে থাকল, বীরগণ ছুটোছুটি করতে লাগলেন।
তখন বনমালাধারী, মদ্যপানমত্ত, কৈলাস পর্বতের শৃঙ্গের ন্যায় উন্নতদেহ এবং মদগর্বিত বলরাম বললেন, “হে মূঢ়গণ, কৃষ্ণ এখনও নীরব আছেন। এই অবস্থায় তাঁর অভিপ্রায় না জেনে, ক্রুদ্ধ হয়ে, বৃথা গর্জন করে তোমরা এটা কী করছ? প্রথমে মহামতি কৃষ্ণ নিজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করুন। তাঁর অভিপ্রায় শুনে, সেই অনুযায়ী তোমরা কাজ কোরো।” বলরামের কথা সমস্ত সভা অনুমোদন করল। সকলে উপবিষ্ট হলে বলরাম কৃষ্ণকে বললেন, “কৃষ্ণ তুমি বীরগণের অবস্থা দেখেও নীরবে বসে আছ কেন? তোমার সন্তোষের জন্যই আমরা সকলে অর্জুনের সম্মান করেছি। কিন্তু কুলদূষক অর্জুন দুর্বুদ্ধি, সে সম্মান পাওয়ার যোগ্য নয়। কোন সৎকুলজাত ব্যক্তি যে পাত্রে অন্নভোজন করে, সেই পাত্রখানাকেই ভেঙে ফেলতে পারে? কোন ব্যক্তি পূর্বসম্বন্ধের গৌরব রেখে, নূতন সম্বন্ধ করার ইচ্ছা করে। অথচ কোন বস্তুর প্রার্থী হয়ে এইরকম সাহসের কাজ করে? অর্জুন আমাদের অবজ্ঞা করে এবং তোমাকেও অগ্রাহ্য করে আজ নিজের মৃত্যুস্বরূপ সুভদ্রাকে বলপূর্বক হরণ করেছে। অর্জুন আমার মাথার মধ্যখানে পদস্থাপন করেছে। অতএব কৃষ্ণ, আমি কী করে সেই সর্পের ন্যায় পদার্পণ সহ্য করব? আমি একাকীই পৃথিবীকে কৌরবশূন্য করব। কারণ, অর্জুনের অত্যাচার কোনওমতেই সহ্য করার যোগ্য নয়।” ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকেরা বলরামের সেই মেঘগর্জন অনুমোদন করলেন।
তখন কৃষ্ণ বললেন, “অর্জুন এই বংশের অপমান করেননি। বরং তিনি অধিক সম্মান প্রদান করেছেন। অর্জুন আমাদের বংশকে ধনলুব্ধ মনে করেননি এবং স্বয়ংবর ব্যাপারটিকে বাঞ্ছনীয় মনে করেননি। আর ক্ষত্রিয়বীর কন্যাদান বিষয়টিও অনুমোদন করেন না। জগতে কোন পুরুষই বা সন্তান বিক্রয় করে? আমার ধারণা অর্জুন মনে মনে এই সমস্ত দোষের পর্যালোচনা করেই ক্ষত্রিয়ের নিয়ম অনুসারেই বলপূর্বক সুভদ্রাকে হরণ করেছেন। আর অর্জুন, যশস্বী ভরত ও শান্তনুর বংশে কুন্তীর গর্ভজাত সন্তান। কোন ব্যক্তি অর্জুনকে পাত্ররূপে লাভ করতে চায় না? আর সুভদ্রাও সৌন্দর্যের কারণে যশস্বিনী এবং তাঁর এই রূপই অর্জুন বলপূর্বক হরণ করেছেন। আর্য বলরাম, আমি ইন্দ্রলোক ও রুদ্রলোক প্রভৃতি সমস্ত লোকের মধ্যেও সেরূপ ব্যক্তিকে দেখি না, যিনি যুদ্ধে অর্জুনকে জয় করতে পারেন। কারণ, সেই প্রকার রথ, আমার সেই অশ্বগুলি এবং যোদ্ধা ও লঘুহস্ত অর্জুন। অতএব অপর কোনও ব্যক্তি অর্জুনের তুলনীয় হতে পারে? অতএব আপনারা আনন্দিত হয়ে দ্রুত গিয়ে অতিমধুর বাক্যে অর্জুনকে ফিরিয়ে আনুন। এই আমার সম্পূর্ণ মত। কেন না, অর্জুন বলপূর্বক আপনাদের জয় করে যদি ইন্দ্রপ্রস্থে যেতে পারেন, তবে আপনাদের সমস্ত যশ নষ্ট হবে। কিন্তু মধুরবাক্যে ফিরিয়ে আনলে আপনাদের পরাজয় হবে না। তারপর তিনি আমাদের পিসতুতো ভাই হয়ে শত্রুর মতো ব্যবহার করতে পারবেন না।”
কৃষ্ণের কথা শুনে যাদবেরা সেই কাৰ্যই করলেন। অর্জুন দ্বারকায় ফিরে সুভদ্রাকে বিবাহ করলেন এবং এক বৎসরেরও অধিককাল দ্বারকায় থেকে, ইচ্ছানুসারে বিহার করে, যাদবদের দ্বারা সম্মানিত হয়ে, বারো বৎসরের অবশিষ্টকাল পুষ্করতীর্থে গিয়ে অতিবাহিত করলেন। তারপর বারো বৎসর পূর্ণ হলে, অর্জুন বনবাস নিয়মে সংযত থেকেই ইন্দ্রপ্রন্থে গিয়ে যুধিষ্ঠির ও ব্রাহ্মণগণের পূজা করে দ্রৌপদীর কাছে গেলেন। গভীর প্রণয়ের সঙ্গে দ্রৌপদী বললেন—
তত্রৈব গচ্ছ কৌন্তেয়! যত্র সা সাত্বতাত্মজা।
সুবদ্ধস্যাপি ভারস্য পূর্ববন্ধঃ শ্লথায়তে॥ আদি: ২১৪: ১৭॥
“পার্থ যেখানে সুভদ্রা আছেন, তুমি সেইখানে যাও। কারণ, কোনও বস্তু দ্বিতীয়বার বন্ধন করলে, পূর্বের বন্ধন শিথিল হয়ে যায়।”
*
দ্রৌপদী নানাপ্রকার বিলাপ করতে লাগলেন, অর্জুন বহু সান্ত্বনা দিয়ে, বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করেও দ্রৌপদীকে প্রসন্ন করতে পারলেন না। অর্জন তখন সুভদ্রাকে গোপবধুর বেশ পরিয়ে দ্রৌপদীর কাছে পাঠালেন। সুভদ্রা সেই বেশে কুন্তী দেবীর কাছে গিয়ে প্রণাম করলেন। কুন্তী সুভদ্রার মস্তকাঘ্রাণ করে আশীর্বাদ করলেন। পূর্ণচন্দ্রমুখী সুভদ্রা তখন দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে বললেন, “আমি আপনার দাসী।” তখন দ্রৌপদী উঠে সুভদ্রাকে আলিঙ্গন করে বললেন, “তোমার পতি শত্রুশূন্য হোন।” আনন্দিত সুভদ্রাও উত্তর দিলেন, “তাই হোক।”
২৪
অভিমন্যুর জন্ম
ব্যাসদেব কর্মফল ও পুনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিলেন। মহাভারতের প্রায় প্রত্যেক পুরুষ ও নারী চরিত্রের আবির্ভাবের অংশ তিনি ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ কোন কোন চরিত্র কোন দেবতার অংশে আবির্ভূত, কোন কোন চরিত্র রাক্ষস ও অসুরের অংশে আবির্ভূত, মানুষ ও অপ্সরার মিলনে কোন কোন নারী অথবা পুরুষের জন্ম, তার স্পষ্ট উল্লেখ মহাভারতে আছে।
মহাভারতে একটি অর্ধস্ফুট, অশেষ রূপবান, অপার শৌর্যবীর্য গুণের অধিকারী সকলের প্রিয়পাত্র, মহা সম্ভাবনাময় পুরুষ চরিত্রের আলোচনা আছে। যার শৌর্যবীর্য পিতা অর্জুনের মতো অথবা মাতুল শ্রীকৃষ্ণের তুল্য ছিল। পিতামাতা ও গুরুজনদের নয়ণের মণি অভিমন্যু সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই কবির উক্তি মনে পড়ে যায়, “যে ফুল না ফুটিতে, ঝরেছে ধরণীতে।” মহাভারতের এক অবিস্মরণীয় চরিত্র অভিমন্যু।
দেবশ্রেষ্ঠ চন্দ্রের এক অসাধারণ যশস্বী ও প্রতাপশালী পুত্র ছিল। সেই পুত্রের নাম ছিল বৰ্চা। মর্ত্যলোকে গিয়ে অসুরদের বধ করার আদেশ দেবতারাও লঙ্ঘন করতে পারেননি। বৰ্চার উপরেও একই দৈবাদেশ এসেছিল। চন্দ্রদেব প্রিয়তম পুত্রকে ছেড়ে থাকতে রাজি ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি দেবতাদের সঙ্গে শর্ত করলেন। “তবে আপনারা আদৌ বর্চচাকে নিয়ে যেতে পারবেন কি না, তা আপনাদের শপথের উপরেই নির্ভর করছে। আপনারা শপথ করুন এবং সেই শপথ আপনাদের পালন করতে হবে। মর্ত্যলোকে গিয়ে অসুরদের বধ করা দেবতাদের কর্তব্য। সুতরাং তা বৰ্চারও কর্তব্য। অতএব বৰ্চা অবশ্যই যাবে। কিন্তু দীর্ঘকাল থাকতে পারবে না।
“মহর্ষি নর ইন্দ্রের পুত্র অর্জুন হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন। স্বয়ং নারায়ণ গিয়ে তাঁর সখা হবেন। এই বৰ্চা, অর্জুনের পুত্র হয়ে বাল্যকালেই পৃথিবীতে মহাপ্রতাপশালী মহারথ হবে। তারপর পৃথিবীতে ষোলো বছর থাকবে; এর ষোলো বৎসর বয়সের সময় সেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে কৃষ্ণ ও অর্জুন যখন থাকবেন না (তাঁরা সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকবেন) তখন শত্রুরা চক্রব্যুহ রচনা করে পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠিরকে ধরতে আসবে। তখন আমার পুত্র সমস্ত শত্রুকে পরাভ্মুখ করে, বালক হয়েও অভেদ্য ব্যূহমধ্যে প্রবেশ করে মত্ত হস্তীর মতো বিচরণ করবে এবং বিপক্ষ বীরগণকে সংহার করতে থাকবে। দুই প্রহরের মধ্যে সমস্ত শত্রুপক্ষের এক-চতুর্থাংশকে যমালয়ে প্রেরণ করে, বারংবার শত্রুপক্ষের মহাসৈন্যদের সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতে, দিবাবসানে আবার আমার সঙ্গে এসে মিলিত হবে।
“এই পুত্র একটিমাত্র বংশধর বীর পুত্র উৎপাদন করবে; সেই পুত্রটিই লুপ্তপ্রায় ভরতবংশ রক্ষা করবে।”
*
এই হল বর্চার অভিমন্যুরূপী জাতকের দৈব অভিলাষ। দেবতারা এই অভিলাষ পূরণ করতে স্বীকৃত হলেন।
ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের রাজত্বের প্রথম বছরেই নিয়মভঙ্গের কারণে অর্জুন বারো বছরের বনবাসী হন। সেই বনবাসের শেষ তিন বছর অর্জুন দ্বারকায় ছিলেন। দ্বারকাবাসের প্রথম বছরেই অর্জুন বীর্যশুল্কে শ্রীকৃষ্ণ-বলরামের ভগ্নি সুভদ্রাকে আপন রথে তুলে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে রওনা হন। বিষয়টিতে কৃষ্ণের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। কিন্তু অন্য যাদববীরগণ এই ঘটনায় অত্যন্ত কুপিত হন। তাঁরা মনে করেন, অর্জুন আতিথ্যের অসম্মান করেছেন। তাঁরা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু কৃষ্ণের হস্তক্ষেপে বিবাদ মিটে গেল এবং সুভদ্রার সঙ্গে মহা ধুমধামে অর্জুনের বিবাহ হল। অর্জুন কৃষ্ণের সঙ্গে সুভদ্রাকে নিয়ে দ্বারকায় আসার তিন বছর পরে ইন্দ্রপ্রস্থের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। মাতা কুন্তী, যুধিষ্ঠির এবং অন্য ভ্রাতারা অভিমন্যু জন্মগ্রহণ করলে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। কৃষ্ণ কিছুকাল ইন্দ্রপ্রস্থে থাকার পর অভিমন্যুকে দ্বারকায় নিয়ে যান। সেখানে তাঁর এবং সাত্যকির কাছে অভিমন্যু অস্ত্রশিক্ষা করেন। কিছুকালের মধ্যেই তিনি অশেষ প্রতাপশালী বীররূপে গণ্য হন।
দুর্যোধনের প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম জানিয়েছিলেন যে অভিমন্যু প্রতাপে পিতা অর্জুন অথবা মাতুল কৃষ্ণের সমান, অথবা অধিক। তিনি একজন শ্রেষ্ঠ অতিরথ। কৌরবপক্ষে ভীষ্ম অথবা দ্রোণ ভিন্ন অন্য কোনও বীর নেই, যিনি অভিমন্যুর মুখোমুখি হতে পারেন।
২৫
দ্রৌপদীর পঞ্চ সন্তানজন্ম
দ্বারকায় মহাসমারোহে অর্জুন ও সুভদ্রার বিবাহ হল। এদিকে বনবাসের বারো বৎসরও অতিক্রান্ত হল। অর্জুন সুভদ্রাকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরলেন। দ্রৌপদী প্রথমে অত্যন্ত অভিমানিনী ছিলেন। অভিমান অর্জুনের উপরে যতটা না ছিল, কৃষ্ণের উপর ছিল অনেক বেশি। কৃষ্ণ তাঁর প্রিয় সখা, তাঁর সবথেকে কাছের বন্ধু। কৃষ্ণ জানতেন দ্রৌপদী অর্জুনকে কত ভালবাসেন। সেই কৃষ্ণই আপন ভগিনীকে অর্জুনের সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন। কিন্তু এ দুঃখ দ্রৌপদী বলবেন কাকে? তাই অর্জুন সাক্ষাৎ করতে এলে কুপিতা দ্রৌপদী কপট প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, “যাও পার্থ, তুমি সুভদ্রার কাছে যাও। নূতন বন্ধন যুক্ত হলে, পূর্বের বন্ধন স্বভাবতই শিথিল হয়ে যায়।” অর্জুন বুঝলেন তাঁর পক্ষে দ্রৌপদীর মানভঞ্জন অসম্ভব। তিনি অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে, সমস্ত অলংকার ত্যাগ করে সাধারণ গোপবধূর বেশে সুভদ্রাকে দ্রৌপদীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সুভদ্রা দ্রৌপদীর পদপ্রান্তে বসে সজল নয়নে বললেন, “আমি আপনার দাসী।” মুহুর্তমধ্যে দ্রৌপদীর হৃদয় গলল, তিনি সুভদ্রাকে তুলে নিয়ে আলিঙ্গন করে বললেন, “তোমার পতি শত্রুশূন্য হবেন।” সুভদ্রা বললেন, “তাই হোক।”
কিছুদিন পরেই কৃষ্ণের নেতৃত্বে বৃষ্ণি এবং অন্ধকেরা প্রচুর পরিমাণে যৌতুক ও উপঢৌকন নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ পঞ্চপাণ্ডব, কুন্তী এবং দ্ৰৌপদীকে মহার্ঘ রত্ন, মূল্যবান বস্ত্র, অসংখ্য দাস-দাসী ও গোধন উপহার দিলেন। যুধিষ্ঠিরও নূতন বৈবাহিকদের মর্যাদা অনুসারে বহু উপহার দিলেন। উভয়পক্ষই ব্রাহ্মণদের অকাতরে দান করলেন। দীর্ঘ সময় ধরে ইন্দ্রপ্রস্থে অবিশ্রাম আনন্দোৎসব ও পান-ভোজন চলল। অনেক সময় আনন্দে অতিবাহিত করার পর বলরাম, তাঁর অনুচরদের নিয়ে কুন্তী এবং যুধিষ্ঠিরের অনুমোদন ক্রমে দ্বারকায় ফিরে গেলেন। যুধিষ্ঠির যাত্রাকালীন উপহার দিলেন। কৃষ্ণ আরও কিছুকাল ইন্দ্রপ্রস্থে থেকে গেলেন। তিনি অর্জুনের সঙ্গে যমুনাতীরে বিচরণ করে ও হরিণ, শুকর বিদ্ধ করে আনন্দে দিন অতিবাহিত করতে লাগলেন।
তারপর, শচীদেবী যেমন যশস্বী জয়ন্তকে প্রসব করেছিলেন, তেমনি কৃষ্ণের প্রিয়তমা ভগিনী সুভদ্রা অভিমন্যুকে প্রসব করলেন। ক্রমে সেই অভিমন্যু দীর্ঘবাহু, বিশালবক্ষ, বৃষতুল্য নয়ন, শত্ৰুহন্তা, মহাবীর ও নরশ্রেষ্ঠ হয়েছিলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ সেই অর্জুনপুত্রের ভয় ছিল না, ক্রোধ ছিল বলে সকলেই তাকে ‘অভিমন্যু’বলে ডাকত। যজ্ঞ মন্থন করায় শমীবৃক্ষের ভিতর থেকে অগ্নির তুল্য, সেই অতিরথ অভিমন্যু অর্জুন থেকে সুভদ্রার গর্ভে জন্মেছিল। অভিমন্যু জন্মালে যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণদের দশ হাজার গোরু এবং স্বর্ণালংকার দান করেছিলেন। চন্দ্র যেমন লোকের প্রিয়, তেমনই অভিমন্যু বাল্যকাল থেকেই যুধিষ্ঠির প্রভৃতির অত্যন্ত প্রিয় হয়েছিলেন।
জন্মপ্রভৃতি কৃষ্ণশ্চ চক্রে তস্য ক্রিয়া শুভাঃ।
স চাপি ববৃধে বালঃ শুক্লপক্ষে যথা শশী॥ আদি: ২১৪: ৭১॥
“কৃষ্ণ অভিমন্যুর জন্ম থেকেই তার জাতকর্ম প্রভৃতি সমস্ত শুভকার্য করেছিলেন এবং অভিমন্যুও শুক্লপক্ষের চন্দ্রের ন্যায় বৃদ্ধি পেয়েছিলেন।” শত্রুবিজয়ী অভিমন্যু বেদ এবং সমস্ত ধনুর্বেদ অর্জুনের কাছে শিক্ষা করেছিলেন; স্বর্গে ও মর্ত্যে প্রচলিত ধনুর্বেদের চার পাদ ও দশ অবস্থা সমস্তই অভিমন্যুর আয়ত্ত হয়েছিল। অর্জুন অভিমন্যুকে অস্ত্রজ্ঞানে ও অস্ত্রপ্রয়োগে নিজের তুল্য করে গড়ে তুলেছিলেন এবং অভিমন্যুকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। কেন না, অভিমন্যু শত্ৰুবিজয়ের সমস্ত কৌশল জানতেন, সর্বপ্রকার সুলক্ষণে লক্ষিত ছিলেন এবং বিবৃতমুখ সর্পের ন্যায় দুর্ধর্ষ, মহাধনুর্ধর ছিলেন। অভিমন্যুর বৃষের ন্যায় স্কন্ধ, সিংহের ন্যায় দর্প, মত্ত হস্তীর ন্যায় বিক্রম, মেঘ ও দুন্দুভির ন্যায় গভীর কণ্ঠস্বর এবং পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় সুন্দর মুখ ছিল। পূর্বে ইন্দ্র যেমন অর্জুনকে কৃষ্ণের তুল্য দেখেছিলেন, তেমনই অর্জুন ও অভিমন্যুকে শৌর্যে, বীর্যে, সৌন্দর্য ও আকৃতিতে কৃষ্ণেরই তুল্য দেখতেন।
এদিকে শুভলক্ষণা দ্রৌপদীও তাঁর পঞ্চ পতির থেকে পঞ্চ-পর্বতের মতো পাঁচটি শ্রেষ্ঠ বীর পুত্র লাভ করেছিলেন। অদিতি যেমন দেবগণকে প্রসব করেছিলেন, সেইরকম দ্রৌপদী যুধিষ্ঠির থেকে প্রতিবিন্ধ্যকে, ভীম থেকে সুতসোমকে, অর্জুন থেকে শ্রুতকর্মাকে, নকুল থেকে শতানীককে ও সহদেব থেকে শ্রুতসেনকে প্রসব করেছিলেন।
“এই যুধিষ্ঠির-পুত্র অন্যের প্রহার বোঝার বিষয়ে বিন্ধ্য পর্বতের মতো হোক”, অর্থাৎ অন্যের প্রহার যেমন বিন্ধ্য পর্বত তুচ্ছ বোধ করতেন, এ-পুত্র তেমনই শত্রুর প্রহারকে তুচ্ছ বোধ করবে”—ব্রাহ্মণেরা এই আশীর্বাদ করলে, যুধিষ্ঠির পুত্রের নাম রাখলেন— ‘প্রতিবিন্ধ্য’।
শিশু গর্ভে আগত হলে বহু সোমবার ব্রত পালন করলেন দ্রৌপদী। তার ফলে ভীমের পুত্রের জন্ম হলে তার নাম রাখা হল— ‘সুতসোম’। এই পুত্র চন্দ্র ও সূর্যের ন্যায় তেজস্বী হয়েছিলেন।
অর্জুন বহু তীর্থ পর্যটন করে মহৎ কর্ম সম্পাদন করে এসেছিলেন, পঞ্চ-তীর্থ উদ্ধার করেছিলেন। তাঁর সেই লোকবিশ্রুত কর্ম স্মরণ রেখে দ্রৌপদীর গর্ভজাত অর্জুনের পুত্রের নাম রাখা হল—‘শ্রুতকর্মা’।
কুরুবংশে শতানীক নামে এক মহাত্মা রাজর্ষি ছিলেন— নকুল সেই মহাত্মা শতানীকের নাম অনুসারে দ্রৌপদীর গর্ভজাত আপন পুত্রের নাম রাখলেন— শতানীক।
দেবী কৃত্তিকা যেমন ‘স্কন্ধ’-কে জন্ম দিয়েছিলেন, তেমনই কৃত্তিকা নক্ষত্রে দ্রৌপদী সহদেবের পুত্র জন্ম দিলেন। তাই তার নাম রাখা হয়েছিল— ‘শ্রুতসেন’।
দ্রৌপদীর পুত্রেরা এক এক বৎসরের কনিষ্ঠ হয়েছিল এবং তারা যথাসময়ে যশস্বী ও পরস্পরহিতৈষী হয়েছিল। ধৌম্য পুরোহিত জ্যেষ্ঠানুক্রমে এবং যথাবিধানে তাদের জাতকর্ম প্রভৃতি সংস্কার এবং চুড়া ও উপনয়ন সংস্কার করেছিলেন। তারপর তারা যথানিয়মে ব্রহ্মচর্য পালন করতে থেকে এবং বেদ অধ্যয়ন করে অর্জুনের কাছে সর্বপ্রকার দেবাস্ত্র ও মনুষ্যাস্ত্র শিক্ষা করেছিল।
*
অভিমন্যু ও পঞ্চ-পাণ্ডব পুত্র অর্জুনের কাছে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণের পর দ্বারকায় কৃষ্ণ ও সাত্যকির কাছেও অস্ত্রশিক্ষা করেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে এঁরা প্রত্যেকেই অংশগ্রহণ করেন। কুরু সেনাপতি পিতামহ ভীষ্মের গণনা অনুসারে অভিমন্যু অতিরথ এবং অন্য পঞ্চ-পাণ্ডব ভ্রাতা উত্তম রথী ছিলেন। দ্রোণ চক্রব্যুহ নির্মাণ করে যুদ্ধে অগ্রসর হলে যুধিষ্ঠিরের আদেশে অভিমন্যু ব্যূহে প্রবেশ করে একক যুদ্ধে সমস্ত শ্রেষ্ঠ কৌরব বীরকে পরাজিত করে সপ্তরথী বেষ্টিত যুদ্ধে দিবসান্তে প্রাণ দেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধশেষে যখন পাণ্ডব-পুত্রগণ সুপ্তিমগ্ন— তখন অশ্বত্থামা কৃতান্তের ন্যায় সকলকেই নিদ্রিত অবস্থায় হত্যা করেন। পাণ্ডব সন্তানদের মধ্যে একমাত্র অভিমন্যুর বিবাহ হয়েছিল। বিরাট রাজকন্যা উত্তরার গর্ভস্থিত সেই শিশু অভিমন্যুর সন্তান কৃষ্ণের করুণায় দ্বি-খণ্ডিত ও মৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেও জীবন লাভ করে ক্ষীণ কুরুবংশকে পরিত্রাণ করেন। তাঁর নাম হয়েছিল—পরীক্ষিৎ।
২৬
খাণ্ডব-দাহন
পঞ্চ-পাণ্ডব সন্তানেরা জাত-কর্ম ইত্যাদির পর অর্জুনের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করছিলেন। যুধিষ্ঠিরের রাজত্বে প্রজারা অত্যন্ত সুখে ছিলেন। প্রিয় বন্ধু অর্জুনের সাহচর্যে কৃষ্ণও অত্যন্ত সুখে আছেন। ইন্দ্রপ্রস্থ তাঁর দ্বিতীয় বাসস্থান হয়ে উঠেছে। ক্রমে গ্রীষ্মকাল উপস্থিত হল। একদিন অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, “কৃষ্ণ বড়ই গ্রীষ্ম পড়েছে। চলো আমরা যমুনায় যাই। আমরা বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে দিনের বেলা সেখানে যাব। সন্ধ্যা হবার পর ফিরে আসব।” কৃষ্ণ বললেন, “অর্জুন আমরা সুহৃদ্বর্গের সঙ্গে সঙ্গে পরিবৃত হয়ে যথাসুখে জলবিহার করি।”
তারপর কৃষ্ণ ও অর্জুন, যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে যমুনায় গেলেন। তাঁরা যমুনানদী দর্শন করলেন। যমুনার তীরবর্তী উদ্যানগুলিতে অসংখ্য পুষ্প দেখলেন। খড়্গ ও চর্মধারী কৃষ্ণ অর্জুনের সঙ্গে মিলিত হয়ে যমুনার তীরবর্তী খাণ্ডববন ও সংলগ্ন সমস্ত অঞ্চল পরিভ্রমণ করলেন। খাণ্ডববন সকল ঋতুতেই মনোহর ছিল। সেখানে সর্বপ্রকার প্রাণী— ভল্লুক, শৃগাল, ব্যাঘ্র, ক্ষুদ্র ব্যাঘ্র ও কৃষ্ণসার মৃগ বিচরণ করত।
কৃষ্ণ ও অর্জুন গিয়ে বিহারস্থানে উপস্থিত হলেন। সেই স্থানটিতে বহু বৃক্ষ ও নানাবিধ গৃহ থাকায় ইন্দ্রপুরীর ন্যায় শোভিত ছিল। সেখানে সুস্বাদু খাদ্য-পেয়, মহামূল্য মাল্য, নানাবিধ গন্ধদ্রব্য ও নানাপ্রকার মাঙ্গলিক দ্রব্য ছিল। তখন কৃষ্ণ ও অর্জুনের সহচর সমস্ত লোকই দ্রুত গিয়ে সে গৃহের অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন ও আনন্দে মেতে উঠলেন। বিশাল-নিতম্বা, সুন্দর-পীন-স্তনী, মদবিহ্বলগামিনী ও মনোহরনয়না রমণীরাও সেই আনন্দে যোগ দিলেন। তখন দ্রৌপদী ও সুভদ্রা মদবিহ্বল হয় সেই রমণীদের মহামূল্য বস্ত্র ও অলংকার দান করতে লাগলেন। সেই সময়ে রমণীদের কেউ কেউ আনন্দিত হয়ে নাচতে লাগল, কেউ কেউ ডাকতে লাগল, কেউ কেউ অকারণে হাসতে লাগল, কেউ কেউ উত্তম মদ্য পান করতে থাকল। কোনও কোনও রমণী অন্য রমণীকে বক্ষোবদ্ধ করল, লীলার সঙ্গে একে অপরকে প্রহার করতে লাগল। কেউ কেউ নিভৃতে বসে পরস্পরের সঙ্গে নিভৃতে রহস্যালাপ করতে থাকল। বেণু, বীণা, মৃদঙ্গের সঙ্গে নৃত্য-গীতের মধুরধ্বনি সমস্ত উপবনটিকে পরিপূর্ণ করে তুলল।
কৃষ্ণ ও অর্জুন নিকটবর্তী স্থানে দু’খানি মহামূল্য আসনে উপবেশন করে পূর্ববর্তী বিক্রম ও অন্যান্য বহু বিষয়ে সুখে আলোচনা করতে লাগলেন। তাঁদের তখন স্বর্গের অশ্বিনীকুমারদের মতো বোধ হচ্ছিল। এমন সময় একটি ব্রাহ্মণ সেই পথে তাঁদের লক্ষ্য করে এগিয়ে এলেন। তাঁর শরীর বিশাল শালগাছের ন্যায়, গায়ের বর্ণ উত্তপ্ত স্বর্ণের তুল্য, শ্মশ্রু পিঙ্গলবর্ণ ও উজ্জ্বল। আকারটি যেমন দীর্ঘ তেমন স্থূল। তিনি নবোদিত সূর্যের ন্যায় তেজস্বী, কৌপীন ও জটাধারী এবং পিঙ্গলবর্ণ তেজ দ্বারা যেন জ্বলছিলেন। তাঁর চোখ দুটি পদ্মপত্রের মতো সুন্দর ছিল।
তিনি নিকটে এসেছেন দেখে কৃষ্ণ ও অর্জুন সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। তখন সেই ব্রাহ্মণ খাণ্ডববন সংলগ্ন ভূমিতে কৃষ্ণার্জুনকে বললেন—আমি বহুভোজী ব্রাহ্মণ, আমি সর্বদাই অপরিমিত ভোজন করে থাকি। অতএব হে কৃষ্ণার্জুন, আপনাদের কাছে প্রার্থনা করছি যে, আপনারা একটিবার মাত্র আমার তৃপ্তি সম্পাদন করুন। ব্রাহ্মণের প্রার্থনা শুনে কৃষ্ণ ও অর্জুন দুজনেই বললেন, “আপনি কোন খাদ্যে তৃপ্তি লাভ করবেন, আমরা সেই খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করব।” তখন ব্রাহ্মণ আপন পরিচয় দিয়ে বললেন, “আমি অগ্নিদেব। আমি অন্ন ভোজন করতে ইচ্ছা করি না। অতএব যে অন্ন আমার যোগ্য বিবেচনা করেন, তাই আপনারা আমাকে দান করুন। ইন্দ্র এই খাণ্ডববনটিকে সর্বদা রক্ষা করেন। তিনি রক্ষা করেন বলে আমি এই বন দগ্ধ করতে পারি না।
“ইন্দ্রের সখা তক্ষকনাগ সপরিবারে এই বনে বাস করেন। তার জন্যই ইন্দ্র এই বন রক্ষা করেন। ইন্দ্র তক্ষকনাগকে রক্ষা করেন বলেই বনের অন্য প্রাণীরাও রক্ষা পেয়ে যান। ফলে আমি এই বনটিকে ভক্ষণ করতে পারি না কিংবা দগ্ধ করতেও পারি না। আমি জ্বলে উঠেছি— এই দেখলেই ইন্দ্র মেঘ থেকে জল বর্ষণ করতে থাকেন। এতেই আমি অভীষ্ট বনটিকে দগ্ধ করতে পারি না। আপনারা দুজনেই অস্ত্রজ্ঞ, আপনারা সহায়তা করলে আমি খাণ্ডববন দগ্ধ করতে সমর্থ হব। এই অন্নই আমি প্রার্থনা করছি।”
কিন্তু অগ্নিদেব খাণ্ডব-দাহন করতে চেয়েছিলেন কেন? সে কারণ জানিয়েছেন ঋষি বৈশম্পায়ন।
পুরাকালে শ্বেতকি নামে এক বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তিনি ইন্দ্রের তুল্য বল-বিক্রমশালী ছিলেন। তিনি যথাবিধানে যজ্ঞ করতেন এবং দানে মত্ত ছিলেন। সে বিষয়ে অন্য কোনও রাজাই তাঁর তুলনীয় ছিলেন না। তিনি প্রচুর দক্ষিণাযুক্ত বৃহৎ বৃহৎ যজ্ঞ করে দেবগণের তৃপ্তি সাধন করতেন। অন্য কোনও দিকে দৃষ্টি না দিয়ে তিনি কেবল যজ্ঞ, নানাবিধ সৎকার্য এবং নানাবিধ দান করতেন। পুরোহিতেরা রাজার এই যজ্ঞকার্য করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। তাঁদের চোখ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ত, দীর্ঘকাল পরে তাঁরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে রাজাকে ত্যাগ করলেন। তবুও রাজা তাদের আরও যজ্ঞ করতে প্রণোদিত করলেন। কিন্তু পুরোহিতেরা নেত্র-রোগগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁরা যজ্ঞ সমাপন না-করেই চলে গেলেন। রাজা তাঁদের অনুমতি নিয়ে অন্য পুরোহিত নিয়োগ করে যজ্ঞ সমাপ্ত করলেন।
কিছুকাল অতিক্রান্ত হলে রাজা শ্বেতকি আবার শতবর্ষব্যাপী এক যজ্ঞ করার ইচ্ছা করলেন। কিন্তু পুরোহিতেরা আর রাজি হলেন না। রাজা পুরোহিতদের প্রণিপাত করে, সান্ত্বনা দিয়ে, অপর্যাপ্ত ধনের প্রলোভন দেখিয়েও রাজি করাতে পারলেন না। তখন ক্ষিপ্ত রাজা, ক্রুদ্ধ হয়ে আশ্রমে গিয়ে পুরোহিতগণকে বললেন, “ব্রাহ্মণগণ, আমি যদি পতিত হয়ে থাকি, তবে আপনাদের পরিচর্যা করার উপযুক্তও নই। তবে আমাকে এখনি পরিত্যাগ করা আপনাদের উচিত। আমি আপনাদের কাছে পতিত হলে সমস্ত ব্রাহ্মণের কাছেই নিন্দনীয় হব। কিন্তু আমি পতিত নই এবং আপনারা যজ্ঞের প্রতি আমার বিশ্বাস নষ্ট করতে পারেন না অথবা অকারণে আমাকে ত্যাগ করতে পারেন না। আমি আপনাদের আশ্রয়ে আছি। সুতরাং আপনারা অনুগ্রহ করুন। ব্রাহ্মণগণ! যথার্থই আমার প্রয়োজন আছে; তাই আমি সাম ও দানাদিসূচক বাক্য দ্বারা আপনাদের প্রসন্ন করে, পরে আপনারা যে কার্য করবেন, তা বলব। অথবা, যদি বিদ্বেষবশত আপনারা আমাকে পরিত্যাগ করেন, তবে আমি যাজনের জন্য অন্য ব্রাহ্মণের কাছে যেতে বাধ্য হব।”
শ্বেতকি রাজা তাঁর বক্তব্য বলে থামলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণেরা যাজনের জন্য রাজাকে গ্রহণ করতে পারলেন না। তাঁরা অসন্তুষ্ট হয়ে রাজাকে বললেন, “মহারাজ আপনার যজ্ঞকার্য অনবরত চলেছে। আর সেই ভারবহন করতে করতে আমরা শ্রান্ত হয়ে পড়েছি। অতএব আপনি আমাদের পরিত্যাগ করতে পারেন। আপনি বুদ্ধিবৈকল্যবশত আমাদের কাছে এসেছেন, কিন্তু আমরা পারব না। আপনি রুদ্রের কাছে যান, তিনিই আপনার যাজন করবেন।”
শ্বেতকি ব্রাহ্মণদের সেই তিরস্কার শুনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে কৈলাস পর্বতে গিয়ে ভয়ংকর তপস্যা আরম্ভ করলেন। তিনি ধ্যানী, ব্রহ্মচারী ও উপবাসী থেকে, মহাদেবের আরাধনা করতে থেকে দীর্ঘকাল তপস্যা করতে লাগলেন। শ্বেতকি রাজা কোনও দিন দ্বাদশ মুহূর্তের সময়, কোনও দিন সোড়শ মুহুর্তের সময়ে সামান্য ফল-মূল আহার করতেন। রাজা শ্বেতকি দীর্ঘকাল এইভাবে তপস্যা করতে থাকলে মহাদেব অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে দেখা দিলেন। মহাদেব স্নিগ্ধ বাক্যে শ্বেতকি রাজাকে বললেন, “মহারাজ আপনার তপস্যায় আমি সন্তুষ্ট। আপনি যা ইচ্ছা করেন, সেই মঙ্গলজনক বর গ্রহণ করুন।” রাজা মহাদেবের কথা শুনে তাঁকে প্রণাম করে বললেন, “সর্বলোক পূজিত, আপনি যদি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন, তবে হে দেবদেব! আপনি নিজেই আমার যাজন করুন।” রাজার এই কথা শুনে মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে, ঈষৎ হাস্য করে বললেন, “মহারাজ! আমাদের যাজন করার অধিকার নেই। কিন্তু রাজা আপনি বরপ্রার্থী হয়ে গুরুতর তপস্যা করেছেন; সুতরাং আপনি একটি নিয়ম স্বীকার করলে, আমি আপনার যাজন করব। আপনি বারো বছর পর্যন্ত ব্রহ্মচারী ও একাগ্রচিত্ত হয়ে যদি ঘৃতদ্বারা অগ্নিদেবের তৃপ্তি সাধন করেন, তবে আপনি যা প্রার্থনা করবেন, তাই আমার কাছে পাবেন।”
মহাদেব এই কথা বললে, শ্বেতকি রাজা তাঁর কথা অনুসারে সে সমস্তই করলেন এবং বারো বৎসর পূর্ণ হলে পুনরায় মহাদেবের কাছে গেলেন। জগৎ-সৃষ্টিকর্তা মহাদেব শ্বেতকি রাজাকে দেখে পরম সন্তুষ্ট হলেন এবং বললেন, “মহারাজ আপনি তপস্যা করে আমাকে সন্তুষ্ট করেছেন বটে, কিন্তু বেদ অনুযায়ী যাজন ব্রাহ্মণদেরই কাজ। অতএব, আমি নিজে আপনার যাজন করব না; কিন্তু ভূ-মণ্ডলে আমারই অংশোদ্ভূত অত্যন্ত ভাগ্যবান ‘দুর্বাসা’ নামে এক বিখ্যাত ব্রাহ্মণ আছেন। সেই তেজস্বী ব্রাহ্মণ আমার আদেশে আপনার যাজন করবেন; সুতরাং আপনি গিয়ে যজ্ঞের উপকরণ সংগ্রহ করুন।” শ্বেতকি রাজা মহাদেবের আদেশ অনুসারে রাজধানীতে এসে যজ্ঞের সমস্ত উপকরণ সংগ্রহ করলেন। তারপর আবার মহাদেবের কাছে গিয়ে বললেন, “আমি সমস্ত দ্রব্য এবং উপকরণ সংগ্রহ করেছি।” শ্বেতকি রাজার কথা শুনে মহাদেব দুর্বাসা মুনিকে ডেকে বললেন, “ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ, ইনি মহাত্মা শ্বেতকি রাজা; আমার আদেশ অনুসারে তুমি এর যাজন করো।” তখন দুর্বাসা বললেন, “অবশ্য করব।”
তারপর, যথাবিধানে, যথাসময়ে, ব্রতীদের উপদেশক্রমে এবং প্রচুর দক্ষিণাযুক্ত অবস্থায় সেই মহাত্মা শ্বেতকি রাজার যজ্ঞ সমাপ্ত হয়ে গেল। যজ্ঞ সমাপ্ত হয়ে গেলে দুর্বাসার অনুমতিক্রমে যাজকেরা নিজ নিজ গৃহে চলে গেলেন। মহাত্মা শ্বেতকি রাজাও আপন রাজধানীতে প্রবেশ করলেন। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা তাঁর গৌরব করতে লাগলেন, বৈতালিকেরা স্তব করতে লাগল, পুরবাসীরা প্রশংসা করতে লাগল। দীর্ঘকাল পুরবাসীদের প্রশংসাভাজন হয়ে যথাকালে শ্বেতকি রাজা সমস্ত পুরোহিত এবং সমস্ত সদস্যের সঙ্গে স্বর্গে চলে গেলেন।
ওদিকে সেই শ্বেতকি রাজার যজ্ঞে অগ্নিদেব একটানা বারো বৎসর ঘৃত পান করেছিলেন। ক্রমাগত ঘৃত পান করে তাঁর ঘৃত বিষয়ে অত্যন্ত অরুচি দেখা দিল। কোনও ব্যক্তি প্রদত্ত ঘৃত পান করতে তিনি চাইতেন না। তিনি যজ্ঞস্থানে উপস্থিত থাকতেন না। পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেলেন, তেজোহীন হয়ে পড়লেন, ক্রমশ রোগের যন্ত্রণাও তাঁর দেহে আবির্ভূত হল। অত্যন্ত যন্ত্রণার্ত হয়ে অগ্নিদেব জগৎপূজিত ও পবিত্র ব্রহ্মভবনে গমন করলেন। সেখানে গিয়ে উপবিষ্ট ব্রহ্মাকে দেখে অগ্নিদেব বললেন, “ভগবন্! শ্বেতকি রাজা আমার অতিরিক্ত তৃপ্তি জন্মিয়ে দিয়েছেন। তাতে আমার গুরুতর অরুচিরোগ হয়েছে, আমি সে রোগ দূর করতে পারছি না। আমি তেজ ও বলশুন্য হয়ে পড়েছি। অতএব, আপনার কাছে আমার প্রার্থনা এই যে, আপনার অনুগ্রহে আমার রোগ দূর হোক, আমি পুনরায় স্থায়ী স্বাস্থ্য লাভ করি।”
অগ্নির এই কথা শুনে ব্রহ্মা হাসতে হাসতেই যেন তাঁকে এই কথা বললেন, “অগ্নি তুমি বারো বৎসর পর্যন্ত পাত্র থেকে ধারাক্রমে আহুত ঘৃত পান করেছ; তাতেই তোমার এই গ্লানি উপস্থিত হয়েছে। সে যাই হোক, অগ্নি! তুমি তেজোহীন হয়েছ বলে বিচলিত হোয়ো না, অচিরকালের মধ্যেই তুমি স্বাভাবিক দেহ ফিরে পাবে। যথাসময়ে আমি তোমার অরুচিরোগ সারিয়ে দেব। অগ্নি! তুমি দেবগণের আদেশে দেবশত্রুদের বাসস্থান অতি ভয়ংকর যে খাণ্ডববন পূর্বে দগ্ধ করেছিলে, সেখানে আবার পূর্বের সকল জন্তু বাস করতে আরম্ভ করেছে। তুমি তাদের মেদ পান করে পরিতৃপ্ত হয়ে প্রকৃতিস্থ হবে। শীঘ্র সেই বন দগ্ধ করতে গমন করো, সেই বন দগ্ধ করতে পারলেই সমস্ত রোগ থেকে মুক্তি লাভ করবে।”
অগ্নিদেব ব্রহ্মার সেই আদেশ শুনে মহাবেগ অবলম্বন করে ধাবিত হলেন এবং খাণ্ডববনে উপস্থিত হয়ে তৎক্ষণাৎ প্রবল বেগে জ্বলে উঠলেন। বায়ুও তাঁকে সাহায্য করতে লাগলেন। সেই খাণ্ডববনে বাসকারী সকল প্রাণী অগ্নি নির্বাপণের জন্য বিশেষ চেষ্টা করতে লাগল। শত শত হস্তী ক্রুদ্ধ হয়ে শুঁড়ে করে জল এনে আগুনের উপর ঢালতে লাগল। বহুমস্তক নাগসমূহ ক্রুদ্ধ ও ব্যস্ত হয়ে মুখে করে জল এনে আগুনের উপর ঢালতে লাগল। এইভাবে অগ্নি সাতবার জ্বলে উঠে, সাতবারই নিভে যেতে বাধ্য হলেন।
রোগযন্ত্রণায় কাতর, অত্যন্ত নিরাশ হয়ে অগ্নিদেব পুনরায় ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হলেন। ব্রহ্মার কাছে গিয়ে তিনি সমস্ত বৃত্তান্ত তাঁকে জানালেন। তখন ব্রহ্মা কিছুক্ষণ চিন্তা করে অগ্নিকে বললেন, “অগ্নি যেভাবে তুমি খাণ্ডববন দাহ করতে পারবে, আমি তার উপায় দেখেছি। তুমি কিছুকাল অপেক্ষা করো, তারপর তোমার অভীষ্ট পূর্ণ হবে। নর-নারায়ণ ঋষি তোমার সহায় হবেন। তাঁরা তোমার সঙ্গে মিলিত হলেই তুমি খাণ্ডববন দগ্ধ করতে পারবে।” অগ্নিদেবও ধ্যানে জানতে পারলেন যে নর-নারায়ণ ঋষি অর্জুন ও কৃষ্ণরূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি ব্রহ্মাকে বললেন, “তাই হোক।”
রোগযন্ত্রণায় কাতর, অত্যন্ত নিরাশ হয়ে অগ্নিদেব পুনরায় ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হলেন। ব্রহ্মার কাছে গিয়ে তিনি সমস্ত বৃত্তান্ত তাঁকে জানালেন। তখন ব্রহ্মা কিছুক্ষণ চিন্তা করে অগ্নিকে বললেন, “অগ্নি যেভাবে তুমি খাণ্ডববন দাহ করতে পারবে, আমি তার উপায় দেখেছি। তুমি কিছুকাল অপেক্ষা করো, তারপর তোমার অভীষ্ট পূর্ণ হবে। নর-নারায়ণ ঋষি তোমার সহায় হবেন। তাঁরা তোমার সঙ্গে মিলিত হলেই তুমি খাণ্ডববন দগ্ধ করতে পারবে।” অগ্নিদেবও ধ্যানে জানতে পারলেন যে নর-নারায়ণ ঋষি অর্জুন ও কৃষ্ণরূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি ব্রহ্মাকে বললেন, “তাই হোক।”
আরও কিছুকাল অপেক্ষা করে অগ্নি পুনরায় ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ব্রহ্মা বললেন, “অগ্নি আজই তুমি ইন্দ্রকে অগ্রাহ্য করে খাণ্ডববন দগ্ধ করতে পারবে। কারণ, দেবগণের প্রধান নর-নারায়ণ ঋষি অর্জুন ও কৃষ্ণরূপে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁরা এখন সেই খাণ্ডববনের নিকটেই অবস্থান করছেন। তুমি গিয়ে খাণ্ডববন দাহের জন্য তাঁদের কাছে প্রার্থনা করো। তাঁরা সাহায্য করলে, দেবতারাও তোমার বিপক্ষে যাওয়া সত্ত্বেও, তুমি খাণ্ডববন দাহ করতে পারবে। কৃষ্ণার্জুনের মিলিত শক্তির কাছে দেবরাজও পরাজয় বরণ করবেন, এতে আমার কোনও সন্দেহ নেই।”
অর্জুন, ব্রহ্মার আদেশে-আগত অগ্নিদেবের প্রার্থনা শুনে বললেন, “অগ্নিদেব আমার বহুতর অলৌকিক উৎকৃষ্ট অস্ত্র আছে, যেগুলির সাহায্যে আমি বহু ইন্দ্রকে পরাজিত করতে পারি। কিন্তু আমি যত্নের সঙ্গে যুদ্ধ করবার সময়ে যে ধনু আমার বেগ সহ্য করতে পারে, এমন বাহুবলোপযোগী ধনু আমার নেই এবং সত্বর বাণক্ষেপ করার সময়ে বহুতর অক্ষয় বাণ আমার থাকা দরকার। আর, বহুতর অভীষ্ট বাণ বহন করতে পারে, এমন রথও আমার নেই। এ ছাড়া, শ্বেতবর্ণ, বায়ুর তুল্য বেগবান এবং অলৌকিক শক্তিশালী অশ্বও আমি চাই এবং সূর্যের তুল্য তেজস্বী ও মেঘের তুল্য গম্ভীরনাদী একখানি রথও আমার চাই। কৃষ্ণের বলের উপযোগী কোনও অস্ত্র নেই, যার দ্বারা উনি যুদ্ধে নাগ ও পিশাচদের বধ করবেন। অতএব অগ্নিদেব, আপনি এই কার্যসিদ্ধির কোনও উপায় বলতে পারেন? খাণ্ডবদাহনের সময়ে ইন্দ্র বর্ষণ শুরু করলে আমি কোন উপায়ে তাকে বারণ করব? পুরুষকার দ্বারা যা করা যায়, তা আমরা অবশ্যই করব। কিন্তু তার উপযুক্ত উপকরণ আপনি দিতে পারবেন কি?
অর্জুন এই কথা বললে, মাহাত্মশালী ধূম্ৰধ্বজ অগ্নিদেব, অদিতির পুত্র জলনিবাসী ও জলের অধিপতি লোকপাল বরুণদেবকে স্মরণ করলেন। অগ্নিদেব স্মরণ করেছেন জেনে বরুণদেব তৎক্ষণাৎ অগ্নিদেবের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। তখন অগ্নিদেব চতুর্থ লোকপাল, দেবদেব ও সনাতনমূর্তি বরুণদেবকে সমাদরপূর্বক গ্রহণ করে বললেন, “চন্দ্রদেবকে, আপনাকে যে ধনু, দুটি তূণীর এবং বানরধ্বজ রথ দিয়েছিলেন, তা শীঘ্র আমাকে দান করুন। অর্জুন সেই গাণ্ডিবধনু দিয়ে এবং কৃষ্ণ সুদর্শন চক্র দিয়ে গুরুতর কার্য সাধন করবেন। অতএব, সেগুলি আমাকে এখনই দিন।”
তখন বরুণদেব অগ্নিদেবকে বললেন, “অবশ্যই দেব।” এই বলে বরুণদেব সেই ধনুশ্রেষ্ঠ গাণ্ডিব এবং অক্ষয় তূণ দুটি সমর্পণ করলেন। সেই গাণ্ডিব অত্যন্ত ভারী ছিল ও অদ্ভুত ছিল; যশ ও কীর্তি বর্ধন করত। সমস্ত অস্ত্রের অজেয় অথচ সমস্ত অস্ত্রবিজয়ী ছিল, সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে তার দৈর্ঘ্যই সর্বাধিক ছিল। সে ধনু শত্রুসৈন্যকে জয় করত এবং একটিমাত্র হয়েও অন্য লক্ষ ধনুর তুল্য ছিল। সে রাজ্যবৃদ্ধি করত এবং তা নানাবর্ণে বিচিত্র ও শোভিত ছিল; ধনুর পালিশ ছিল অত্যন্ত সুন্দর ও ব্রণশূন্য। দেব, দানব ও গন্ধর্বেরা দীর্ঘকাল তার পূজা করেছিলেন।
বরুণদেব একখানি রথও দিলেন; তাতে চারটি দিব্য অশ্ব যোজিত ছিল এবং ধ্বজার উপরে বিশাল একটি বানর ছিল। সেই চারটি অশ্বই রৌপ্যের ন্যায় উজ্জ্বল, গন্ধর্বদেশে উৎপন্ন, স্বর্ণালংকৃত, নির্মল মেঘের ন্যায় শুভ্রবর্ণ এবং বেগে মন ও বায়ুর তুল্য ছিল। সে রথখানিতে যুদ্ধের সমস্ত উপকরণ ছিল— সে রথ দেবতা ও দানবদের অজেয় ছিল।
মহাত্মা বিশ্বকর্মা অতিকষ্টে উজ্জ্বল, গম্ভীর শব্দশালী এবং সমস্ত লোকের মনোহর করে সে রথখানি নির্মাণ করেছিলেন; রথখানি রূপে সূর্যের রূপের ন্যায় অনির্বচনীয় ছিল এবং প্রজাপতি চন্দ্র এই রথে আরোহণ করে দানবগণকে জয় করেছিলেন; ইন্দ্রধনুর তুল্য কৃষ্ণ ও অর্জুন অভিনব মেঘতুল্য সেই উজ্জ্বল রথে আরোহণ করলেন। রথখানিতে স্বর্ণনির্মিত একটি সুন্দর ধ্বজ ছিল; তার উপরে সিংহ ও ব্যাঘ্রের ন্যায় ভীষণাকৃতি একটা বানর ছিল এবং সে বানরটা যেন শত্রুগণকে দগ্ধ করতে চাইছিল; আর সেই ধ্বজে নানাবিধ বৃহৎ বৃহৎ জন্তু বাস করছিল। সেই জন্তুগণের গর্জনে শত্রুসৈন্যের চৈতন্য লোপ পেত। অর্জুন সেই পতাকাযুক্ত রথখানিকে প্রদক্ষিণ করে এবং অভীষ্ট দেবগণকে নমস্কার করে কবচ, খড়্গ, তরবারি ও অঙ্গুলিত্রাণ ধারণপূর্বক সজ্জিত হয়ে, পুণ্যবান লোক যেমন বিমানে আরোহণ করেন, সেইরকম সেই রথে আরোহণ করলেন। তারপর ব্রহ্মার নির্মিত সেই অলৌকিক গাণ্ডিবধনু ধারণ করে আনন্দিত হলেন এবং অগ্নিদেবের সম্মুখেই বলপূর্বক সেই ধনুতে গুণ আরোপণ করলেন। তিনি গুণারোপণ করবার সময়ে যে শব্দ হল, তা শুনে সকলের হৃদয় কম্পিত হল। অর্জুন সেই রথ, ধনু ও অক্ষয় তূণীর দুটি লাভ করে, আনন্দিত হয়ে, যুদ্ধের জন্য সজ্জিত হলেন।
তখন অগ্নিদেব কৃষ্ণকে একটি চক্র দান করলেন; সেই চক্রটির মধ্যভাগ বজ্রের মতো ছিল। কৃষ্ণও আগ্নেয় অস্ত্রের তুল্য প্রিয় সেই চক্র লাভ করে তখনই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। অগ্নিদেব তাঁকে বললেন, “কৃষ্ণ! আপনি এই চক্র দ্বারা যুদ্ধে দেবতাদেরও পরাজিত করতে পারবেন; আপনি এই চক্রের প্রভাবে দেবতা, মানুষ, রাক্ষস, পিশাচ, দৈত্য ও নাগেদের সঙ্গে প্রবল হয়ে তাদের বধ করতে সমর্থ হবেন, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। আর কৃষ্ণ! আপনি যুদ্ধের সময়ে শত্রুগণের প্রতি এই চক্র বার বার প্রয়োগ করলেও শত্রুনাশ করে চক্রটি আবার আপনার হাতে আসবে।” তখন বরুণদেবও কৃষ্ণকে একখানি ‘কৌমোদকী’ নামে ভয়ংকর গদা দান করলেন। সে গদা বজ্রের ন্যায় গর্জন করে দৈত্যগণকে বিনাশ করত।
তারপর অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত এবং সেই সময়ে উপযুক্ত অস্ত্রসম্পন্ন, রথারোহী ও ধ্বজশালী কৃষ্ণ ও অর্জুন আনন্দিত হয়ে অগ্নিদেবকে বললেন, “ভগবন্! আমরা এখন সমস্ত দেব-দানবগণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সমর্থ। অতএব তক্ষক নাগকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধার্থী একাকী ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করা তো অতি সামান্য ব্যাপার।”
অর্জুন বললেন, “দৈহিক ও মানসিক শক্তিশালী কৃষ্ণ, চক্ৰধারণ করে যুদ্ধে-বিচরণ করতে থাকলে, ত্রিভুবনে এমন কোনও বস্তু নেই, যা তিনি চক্র নিক্ষেপ করে বিধ্বস্ত না করতে পারেন। এবং আমিও গাণ্ডিবধনু এবং অক্ষয় তূণীর দুটি নিয়ে যুদ্ধে ত্রিভুবনকেই জয় করতে পারি। অতএব ভগবন্ অগ্নিদেব! আপনি এখনই এই খাণ্ডববনটাকে পরিবেষ্টন করে সকল দিকেই পর্যাপ্তরূপে জ্বলে উঠুন; আমরা আপনার সাহায্যের জন্য প্রস্তুত হয়েছি। যদি দেবরাজ-অসতর্কতাবশত সৈন্যগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে এই খাণ্ডববন রক্ষা করার জন্য আসেন, তখন আমার বাণে অঙ্গ ও কুণ্ডল তাড়িত হতে থাকলে, সেই দেবসৈন্যগণের কী দুরবস্থা হয়, তা আপনি দেখতে পাবেন।
তখন অগ্নিদেব, ব্রাহ্মণের রূপ পরিত্যাগ করে তেজোময় রূপ ধারণ করে খাণ্ডববন দগ্ধ করতে আরম্ভ করলেন। তিনি সকল দিক পরিবেষ্টন করে, প্রলয়কালীন অবস্থা সৃষ্টি করে খাণ্ডববন দগ্ধ করতে লাগলেন। মেঘ গর্জন করতে করতে অগ্নিদেব সেই খাণ্ডববনের সকল প্রাণীকেই কম্পিত করে তুললেন। আগুন জ্বলে উঠলে সেই খাণ্ডববন সূর্যকিরণ পরিব্যাপ্ত সুমেরু পর্বতের মতো বোধ হতে লাগল। অর্জুন ও কৃষ্ণ খাণ্ডববনের দুই দিক আটকে রাখলে, সেখানকার প্রাণীদের গুরুতর দুরবস্থা দেখা দিল। কৃষ্ণ ও অর্জুন পলায়নপ্রবৃত্ত খাণ্ডববাসী প্রাণীগণকে যেখানে যেখানে দেখতে পেলেন সেখানেই তাদের তাড়া করলেন। তাঁদের রথ দু’খানি এত দ্রুত চলতে লাগল যে, প্রাণীরা তাদের মধ্যে কোনও ফাঁক দেখতে পেল না। এইভাবে খাণ্ডববন দগ্ধ হতে থাকলে সেখানকার বহুতর প্রাণী ভয়ংকর শব্দ করতে করতে সেই আগুনের মধ্যে পড়তে লাগল। অনেকের শরীরের একদিক দগ্ধ হয়ে গেল, অনেকগুলি অর্ধ-দগ্ধ হয়ে গেল, কয়েকটির চোখ ফেটে গেল, অনেকগুলি গলিতাঙ্গ হয়ে গেল। কয়েকটি প্রাণী সন্তানদের, কয়েকটি প্রাণী পিতৃগণকে, কয়েকটি ভ্রাতৃগণকে আলিঙ্গন করে রইল। স্নেহবশত তাদের ত্যাগ করতে পারল না, তারা সে অবস্থায় একসঙ্গে দগ্ধ হল। কতকগুলি প্রাণী দাঁত কিড়মিড় করে উঠতে গেল কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে আগুনে পুড়ে মরতে হল। নানা স্থানেই দেখা গেল, পাখিগুলির পাখা পুড়ে গেছে, চোখ ও চরণ দগ্ধ হয়েছে, তারা মাটিতে পড়ে ছটফট করতে করতে মারা যাচ্ছে। জলাশয়গুলির জল প্রথমে ফুটতে লাগল, তখন কচ্ছপ ও মাছগুলি প্রাণত্যাগ করতে লাগল। প্রাণীরা এমনভাবে জ্বলতে লাগল যে, তাদের অগ্নিরই অংশ বলে মনে হতে লাগল। অর্জুনের বাণে বিদ্ধপাখিরা খণ্ড খণ্ড হয়ে আগুনের মধ্যেই পড়তে লাগল। যেসব পাখির গায়ে অর্জুনের বাণ লাগেনি, তারাও সমুদ্র-মন্থনের সময়ে জলচর প্রাণীদের মতো আর্তনাদ করতে লাগল। সেই প্রজ্বলিত অগ্নির শিখা গিয়ে আকাশে উঠল এবং দেবগণের উদ্বেগ জন্মাতে লাগল।
তখন দেবগণ ও ঋষিগণ সেই অগ্নির তেজে অত্যন্ত সন্তপ্ত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের শরণাপন্ন হলেন। দেবতারা বললেন, “দেবরাজ! অগ্নিদেব কি সমস্ত মানুষকেই দগ্ধ করছেন? জগতের প্রলয়কাল উপস্থিত হয়নি তো?” দেবরাজ তাঁদের কথা শুনে এবং পরিব্যাপ্ত অগ্নিশিখা দেখে নিজেই খাণ্ডববন রক্ষা করার জন্য যাত্রা করলেন। তিনি গিয়ে নানাজাতীয় অসংখ্য রথ দ্বারা আকাশ ব্যাপ্ত করে জল বর্ষণ করতে লাগলেন। মেঘসমুহ দেবরাজের আদেশে খাণ্ডববনের উপর জপমালার মতো বড় বড় বিন্দুর শত সহস্র জলধারা বর্ষণ করতে লাগলেন। কিন্তু অগ্নির প্রচণ্ড তেজে সেগুলি আকাশেই শুকিয়ে গেল, খাণ্ডববনের ভিতরে পড়ল না। অগ্নিকে নিবারণ করার জন্য স্বয়ং ইন্দ্র মহামেঘসমূহ দ্বারা প্রচুর পরিমাণে জলবর্ষণ করতে লাগলেন। তখন অগ্নির শিখায় অথচ জলধারায় এক ধূমে ও বিদ্যুতে ব্যাপ্ত হয়ে মেঘাচ্ছাদিত সেই খাণ্ডববন ভয়ংকর আকার ধারণ করল।
ইন্দ্র জলবর্ষণ করতে থাকলে, অর্জুন অস্ত্রপ্রয়োগের উত্তম কৌশল দেখাতে থেকে বাণবর্ষণ দ্বারা সে জলবর্ষণ বারণ করতে থাকলেন। চন্দ্র যেমন নীহার দ্বারা জগৎ আচ্ছাদিত করেন, অর্জুনও তেমন বহুতর বাণদ্বারা খাণ্ডববন আচ্ছাদিত করলেন। কোনও প্রাণীই সেই বাণের আচ্ছাদনের বাইরে যেতে পারল না। খাণ্ডববন দগ্ধ হতে লাগল, কিন্তু মহাবল তক্ষক নাগ সেখানে ছিল না, সে পূর্বেই কুরুক্ষেত্র গিয়েছিল। কিন্তু তার বলবান পুত্র অশ্বসেন সেখানে ছিল। সে অগ্নি থেকে মুক্ত হবার প্রাণান্ত চেষ্টা করল। কিন্তু অর্জুনের বাণের বাইরে সে যেতে পারেনি। তখন তার মাতা প্রাণরক্ষার জন্য তাকে গিলে ফেলল। প্রথমে সে অশ্বসেনের মাথা গিলে ফেলল। তারপর তার লেজ পর্যন্ত সবটা গিলে ফেলল এবং তাকে উদরের মধ্যে নিয়ে অগ্নি থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করল। অর্জুন তীক্ষ্ণ বাণে তার মাথা কেটে ফেললেন। ইন্দ্র অশ্বসেনকে মুক্ত করার ইচ্ছায় ভয়ংকর বায়ুবর্ষণ করলেন। বায়ুবর্ষণে অর্জুন মুহূর্তকাল মোহিত হয়ে গেলেন। সেই অবসরে অশ্বসেন মুক্ত হয়ে পালিয়ে গেল।
ইন্দ্রের ভয়ংকর মায়া দেখে এবং অশ্বসেন তাকে প্রতারণা করে গেছে বুঝে অর্জুন আকাশের প্রাণীগণকে দুই তিন খণ্ডে ছেদন করতে লাগলেন। তখন অর্জুন ও কৃষ্ণ অশ্বসেনকে অভিসম্পাত করলেন, “তুই নিরাশ্রয় হবি।”
তখন অর্জুন ইন্দ্রের সেই প্রতারণা স্মরণ করে, ক্রুদ্ধ হয়ে, আকাশ বাণে ব্যাপ্ত করে ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন। ইন্দ্রও অর্জুনকে ক্রুদ্ধ দেখে নিজের তীব্র অস্ত্ৰক্ষেপ করতে লাগলেন। মহাগর্জনশালী বায়ু সমস্ত সমুদ্রকে উদ্বেলিত করে, আকাশে থেকে, জলধারাবর্ষী মেঘ সৃষ্টি করতে লাগলেন। অর্জুন মেঘের গম্ভীর গর্জন, বজ্রপাত, বিদ্যুৎ-প্রকাশ দেখে উত্তম বায়ব্যাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। ইন্দ্রের বজ্র ও মেঘসমূহের প্রভাব ও তেজ নষ্ট হল। ক্ষণকালের মধ্যে জলধারা তিরোহিত হল। বিদ্যুৎ লুকিয়ে পড়ল এবং আকাশের ধুলি ও অন্ধকার দূর হল। সুখস্পর্শ শীতল বায়ু বইতে লাগল, সূর্যমণ্ডল প্রকৃতিস্থ হল এবং নানাবিধ মূর্তিধারী অগ্নিও প্রতিবন্ধক না থাকায় আনন্দিত হলেন। প্রাণীগণের দেহ নিঃসৃত সেই বসাপ্রবাহে সিক্ত হতে থেকে অগ্নিও আপন গর্জনে জগৎ পূর্ণ করে জ্বলতে লাগলেন।
কৃষ্ণ ও অর্জুন খাণ্ডববন রক্ষা করছেন দেখে গরুড়বংশীয় পক্ষিগণ গর্বিত হয়ে আকাশে উড়তে লাগল। অন্যান্য গরুড়বংশীয় পক্ষীরা বজ্রতুল্য পক্ষ, চঞ্চু ও নখ দ্বারা বিপক্ষগণকে প্রহার করার জন্য আকাশ থেকে কৃষ্ণ ও অর্জুনের কাছে আসল। জ্বলিতমুখ সর্পসমূহ ভয়ংকর বিষ উদগিরণ করতে করতে অর্জুনের কাছে গিয়ে পড়তে লাগল। অর্জুনও তাদের ক্রোধাগ্নি সমন্বিত বাণ দ্বারা কেটে ফেলতে লাগলেন। তখন তারা মরণের জন্য অগ্নির ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলেন। তখন বলবান অসুর, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস ও নাগসমূহ ক্রুদ্ধ হয়ে, কৃষ্ণ ও অর্জুনকে বধ করার জন্য লোহা ও সোনার চক্র, পাথর এবং চর্মরজ্জুময় ভুশণ্ডি উত্তোলন করে যুদ্ধের জন্য গুরুতর সিংহনাদ করতে করতে উপস্থিত হল। তারা অস্ত্রবর্ষণ করতে থাকলে অর্জুন তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা মস্তকছেদন করতে লাগলেন। অত্যন্ত বলবান এবং শত্রুহন্তা কৃষ্ণও চক্র দ্বারা দৈত্য ও দানবগণের গুরুতর দুরবস্থা করলেন। জলের বেগে ঘুরতে ঘুরতে তৃণ প্রভৃতি গিয়ে যেমন তীরে সংলগ্ন হয়, তেমনই অর্জুনের শরে ও কৃষ্ণের চক্রের বেগে তাড়িত হয়ে শত্রুরা দূরে বহুদূরে গিয়ে পড়তে লাগল।
তখন দেবরাজ ইন্দ্র অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ঐরাবতে চড়ে কৃষ্ণ ও অর্জুনের দিকে ধাবিত হলেন। তিনি বেগে বজ্র এবং হীরক-খচিত অন্য অস্ত্র ধারণ করে এবং নিক্ষেপ করতে উদ্যত হয়ে বললেন, “এরা হত হল।” দেবরাজকে বজ্র উত্তোলন করতে দেখে অন্য দেবতারা আপন আপন সমস্ত অস্ত্র ধারণ করলেন। যম কালদণ্ড, কুবের গদা, বরুণ পাশ ও বিচিত্র বজ্র ধারণ করলেন। কার্ত্তিক শক্তি ধারণ করে সুমেরু পর্বতের মতো অচল হয়ে দাঁড়ালেন এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয় উজ্জ্বল ঔষধি নিলেন। ধাতা ধনু নিলেন, জয় মুষল ধরলেন, এবং মহাবল ত্বষ্টা ক্রুদ্ধ হয়ে একটি পর্বত গ্রহণ করলেন। অংশ শক্তি নিলেন, মৃত্যুদেব পরশু নিলেন এবং সূর্যও ভয়ংকর পরিঘ ধারণ করে বিচরণ করতে লাগলেন। মিত্র, পুষা, ভগ, সবিতা—এরা প্রত্যেকেই ক্রুদ্ধ হয়ে তীক্ষ্ণ চক্রধারণ করে অবস্থান করতে লাগলেন। মহাবল একাদশ রুদ্র, অষ্ট বসু, ঊনপঞ্চাশ বায়ু—এরা প্রত্যেকেই ধনু ও তরবারি নিয়ে কৃষ্ণ ও অর্জুনের দিকে ধাবিত হলেন।
এইভাবে বিশ্বদেবগণ ও সাধ্যগণ নানাবিধ অস্ত্র ধারণ করে কৃষ্ণ ও অর্জুনকে বধ করার জন্য ছুটে চললেন। তখন সেই মহাযুদ্ধে প্রলয়কালের মতো প্রাণীগণের মোহজনক আশ্চর্য দুর্লক্ষণ সকল দেখা দিতে লাগল। এদিকে যুদ্ধদুর্ধর্ষ কৃষ্ণ ও অর্জুন দেবগণের সঙ্গে ইন্দ্রকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আসতে দেখেও নির্ভয়চিত্তে ধনু ও তীক্ষ্ণ বাণ ধারণপূর্বক দেবতারা আসামাত্র তাঁদের তাড়া করতে লাগলেন। দেবতারা বারবার ব্যর্থ সংকল্প হয়ে, ভয়ে যুদ্ধ পরিত্যাগ করে ইন্দ্রের আশ্রয় গ্রহণ করলেন। কৃষ্ণ ও অর্জুন দেবতাদের বিতাড়িত করেছেন দেখে আকাশের মুনিরা বিস্মিত হলেন। ইন্দ্রও বারবার কৃষ্ণ ও অর্জুনের ক্ষমতা দেখে বিশেষ সন্তুষ্ট হলেন এবং আবার যুদ্ধ আরম্ভ করলেন এবং প্রচণ্ড পাষাণবর্ষণ করতে লাগলেন। কারণ, ইন্দ্র অর্জুনের বল জানার জন্য ইচ্ছা করেছিলেন। অর্জুন তীক্ষ্ণ বাণদ্বারা ইন্দ্রের পাষাণগুলিকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেললেন। নিজের পাষাণবৃষ্টি ব্যর্থ হতে দেখে ইন্দ্র আরও বড় বড় পাথর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। অর্জুন পিতা ইন্দ্রদেবকে অত্যন্ত আনন্দিত করে তাঁর সকল পাষাণবৃষ্টি নিস্ফল করে দিলেন।
তখন ইন্দ্র অর্জুনকে বধ করার জন্য দু’হাত দিয়ে মন্দার পর্বতের একটি শৃঙ্গ উৎপাটিত করে নিক্ষেপ করলেন। অর্জুন বেগবান, উজ্জ্বলমুখ ও সরলগামী বাণসমূহদ্বারা সেই শৃঙ্গটাকে সহস্র খণ্ড করে ফেললেন। খণ্ডিত সেই পর্বতশৃঙ্গ খাণ্ডববনের উপরে পড়ে সেখানকার প্রাণীদের বিধ্বস্ত করতে লাগল। খাণ্ডববাসী দানব, রাক্ষস, নাগ, ব্যাঘ্র, ভল্লুক, শত শত হস্তী, হরিণ, মহিষ ও পক্ষী চূর্ণ হয়ে গেল। অন্যান্য প্রাণীরা ভয়ে দূরে সরে গিয়ে অস্ত্রধারী কৃষ্ণ ও অর্জুনের দিকে সভয়ে তাকাতে থাকল। একদিকে আকাশস্পর্শী অগ্নি, আর অন্যদিকে চক্রধারী কৃষ্ণ—এই দুই দিকে তাকিয়ে তারা সভয়ে আর্তনাদ করতে লাগল। কৃষ্ণ ক্রমান্বয়ে চক্র নিক্ষেপ করতে লাগলেন—তাতে দানব, রাক্ষস এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপর প্রাণীরা পীড়িত ও শত খণ্ডে ছিন্ন হয়ে তৎক্ষণাৎ আগুনের মধ্যে গিয়ে পড়তে লাগল। সেই সকল দৈত্য কৃষ্ণের চক্রে বিদীর্ণ হওয়ায় তাদের শরীরগুলি বসা ও রুধিরে লিপ্ত হল। তাই তাদের সন্ধ্যাকালীন মেঘের মতো দেখাতে লাগল। কৃষ্ণ তখন সাক্ষাৎ যমের মতো সহস্র সহস্র পিশাচ, পক্ষী, নাগ ও পশুকে বধ করতে থেকে রথের উপর বিচরণ করতে লাগলেন। কৃষ্ণ বারবার চক্র নিক্ষেপ করলেন অথচ সে চক্র বারবারই অনেক জন্তু বধ করে আবার তাঁর হাতে ফিরে আসল। সর্বভূতাত্মা কৃষ্ণ সেইভাবে পিশাচ, নাগ ও রাক্ষসদের বিনাশ করতে থাকলে, তাঁর আকৃতি অতি ভয়ংকর হল।
কিন্তু উপস্থিত দেবগণ ও দানবগণের মধ্যে কোনও ব্যক্তিই যুদ্ধে কৃষ্ণ ও অর্জুনকে জয় করতে পারলেন না। দেবগণ কৃষ্ণ ও অর্জুনকে পরাজিতও করতে পারলেন না, খাণ্ডববনও রক্ষা করতে পারলেন না। তাঁরা তখন পালাতে লাগলেন। দেবগণকে পরাজিত দেখে দেবরাজ ইন্দ্র কৃষ্ণ ও অর্জুনের প্রশংসা করতে লাগলেন। তখন সমস্ত আকাশ জুড়ে এক মহাগম্ভীর দৈববাণী শোনা গেল, “দেবরাজ, আপনার সখা নাগরাজ তক্ষক খাণ্ডববন দাহের সময়ে এখানে ছিলেন না, তিনি পূর্বেই কুরুক্ষেত্র গিয়েছেন। আপনারা যুদ্ধ করে কোনওমতেই এই কৃষ্ণার্জুনকে জয় করতে পারবেন না। তার কারণ, এই কৃষ্ণার্জুন পূর্বে স্বর্গে নর-নারায়ণ নামে বিখ্যাত দেবতা ছিলেন। সুতরাং এদের শক্তির পরিমাণ আপনারও জানা আছে। এঁরা প্রাচীন ঋষিশ্রেষ্ঠ, দুর্ধর্ষ এবং সর্বত্র অপরাজিত; সুতরাং ত্রিভুবনের কোনও লোকই এঁদের যুদ্ধে পরাজিত করতে পারবে না। ঋষিশ্রেষ্ঠ বলে এঁরা সমস্ত দেব, দানব, যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধর্ব, নর, কিন্নর ও নাগদের পূজনীয়। অতএব দেবরাজ, আপনি অন্য দেবতাদের নিয়ে চলে যান। খাণ্ডববন দাহ হওয়া নিয়তি নির্দিষ্ট।”
দেবরাজ ইন্দ্র সেই দৈববাণী শুনে “এ সত্যই বটে”—এই চিন্তা করে ক্রোধ ও অসহিষ্ণুতা ত্যাগ করে সেই স্থান ত্যাগ করলেন। কৃষ্ণ ও অর্জুন দেবতাদের সেই স্থান ত্যাগ করতে দেখে বারংবার সিংহনাদ করতে লাগলেন। বায়ু যেমন মেঘকে সরিয়ে দেয় অর্জুন ও কৃষ্ণ তেমনি দেবতাদের সরিয়ে দিলে অগ্নিদেব সানন্দে এবং স্বচ্ছন্দে আহার করতে লাগলেন। অর্জুন অনবরত বাণক্ষেপ করতে থাকায় কোনও প্রাণীই খাণ্ডববনের বাইরে যেতে পারল না। আঘাত করা তো দূরের কথা তারা অর্জুনের দিকে দৃষ্টিপাতও করতে পারছিল না। নদীতীর, উঁচু-নিচু স্থান, শ্মশান ও দেবালয়—কোনও স্থানেই প্রাণীরা রক্ষা পেল না, তারা ক্রমাগত অগ্নিদগ্ধ হতে থাকল। ওদিকে যে কোনও দানব, রাক্ষসও শ্রেণিবদ্ধ হয়ে সে স্থানে উপস্থিত হলে কৃষ্ণ চক্র দ্বারা তাদের সংহার করতে লাগলেন। তারা এবং বিশাল দেহ অন্য প্রাণীরা কৃষ্ণের চক্রের বেগে মস্তক ও দেহ বিদীর্ণ হয়ে প্রজ্বলিত অগ্নির ভিতর পড়তে লাগল। অগ্নি প্রাণীগণের বসা এবং রক্ত মাংস পান করে, তৃপ্ত হয়ে আকাশে উঠে ধূমশূন্য, দীপ্তনয়ন, দীপ্তজিহ্বা, দীপ্তমুখ, দীপ্তকেশ এবং পিঙ্গলনয়ন হলেন। কৃষ্ণার্জুন সম্পাদিত সেই বসারূপ অমৃত লাভ করে অগ্নি আনন্দিত, তৃপ্ত এবং অত্যন্ত সুস্থ হলেন।
এই সময়ে ময় নামে এক অসুর যখন তক্ষকের ভবন থেকে দ্রুত পলায়ন করছিল, কৃষ্ণ তাকে দেখতে পেলেন। অগ্নি তাকে দেখতে পেয়ে দগ্ধ করতে চেয়ে কৃষ্ণের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। কৃষ্ণ বধ করার জন্য চক্র উত্তোলন করলেন। ভয় পেয়ে ময়দানব বলল, “অর্জুন শীঘ্র আসুন, আমাকে রক্ষা করুন।” তার সেই আর্তনাদ শুনে অর্জুন বললেন, “ভয় নেই।” এতে ময়দানব যেন জীবন লাভ করল। তখন অর্জুন দয়াপরবশ হয়ে আবার বললেন, “তুমি ভয় কোরো না।” অর্জুন অভয় দান করলে নমুচির ভ্রাতা সেই ময়দানবকে কৃষ্ণও বধ করলেন না এবং অগ্নিও দগ্ধ করলেন না। এইভাবে কৃষ্ণ ও অর্জুন ইন্দ্রের হাত থেকে রক্ষা করতে থাকলে, অগ্নি পনেরোদিন যাবৎ সেই খাণ্ডববন দগ্ধ করলেন।
তস্মিন্ বনে দহ্যমানে ষড়গ্নির্ণ দদাহ চ।
অশ্বসেনং ময়ঞ্চৈব চতুরঃ শার্ঙ্গকাংস্তথা॥ আদি: ২২১: ৪৬॥
সেই খাণ্ডববন দাহের সময় অগ্নি, তক্ষকের পুত্র অশ্বসেন, ময়দানব ও চারটি খঞ্জনপাখি এই ছয়জনকে দগ্ধ করেননি।
*
খাণ্ডবদাহে সহায়তা করার জন্য কৃষ্ণ পেলেন সুদর্শন চক্র আর কৌমোদকী গদা, অর্জুন গাণ্ডিব ধনু, ইন্দ্রদত্ত রথ ও দুই অক্ষয় তূণীর। মহাভারত যুদ্ধের সবথেকে আলোচিত আয়ুধ কৃষ্ণার্জুন লাভ করলেন। কৃষ্ণ আরও লাভ করলেন পাঞ্চজন্য শঙ্খ। গাণ্ডিব লাভ করার পর অর্জুনের নাম হয় গাণ্ডিবধম্বা। এই গাণ্ডিব ধনুকে সর্বাপেক্ষা প্রিয়া নারীর মতো অৰ্জুন সর্বদা সঙ্গে রাখতেন।
পশুপতি মহাদেবের সঙ্গে যুদ্ধকালে মহাদেব গাণ্ডিব ধনু গিলে ফেলেন এবং পরে আবার তা অর্জুনকে ফিরিয়ে দেন। এই ধনু নিয়ে অর্জুন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয় করেন। যদুবংশ ধ্বংসের পর কৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের পূর্বে সুদর্শন চক্র ও পাঞ্চজন্য শঙ্খ সমুদ্রের উপর মিলিয়ে যায়। হাতে গাণ্ডিবধনু ও দুই অক্ষয় তূণীর থাকা সত্ত্বেও অর্জুন কৃষ্ণের রমণীদের দ্বারকায় নিয়ে যেতে পারেননি। আভীর পল্লির গোপদস্যুদের কাছে তিনি পরাজিত হন। মহাপ্রস্থানের সময়ে অগ্নিদেব অর্জুনের গতিপথ রুদ্ধ করে দাঁড়ান এবং গাণ্ডিব ও অক্ষয় তূণীর সহ বাণসমূহ সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করতে নির্দেশ দেন। অর্জুন তা করতে বাধ্য হন।
২৭
জরা রাক্ষসীর সন্ধিকরণ
ময়দানব ইন্দ্রপ্রস্থে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের উপযুক্ত অপরূপ প্রাসাদ ও মনুষ্যলোকে দুর্লভ অপরূপ সভাগৃহ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরের শাসনে প্রজারা অত্যন্ত সুখে বাস করতেন। অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টি হত না, শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটত না। ব্রাহ্মণেরা অত্যন্ত সুখে যাগ-যজ্ঞাদি আচার-অনুষ্ঠান করতেন।
একদিন দেবর্ষি নারদ যুধিষ্ঠিরের সভায় প্রবেশ করলেন। যুধিষ্ঠির যথাবিহিত নারদকে পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়ে বন্দনা করলেন। নারদ যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যশাসন ইত্যাদি বিষয়ে নানা উপদেশ দেওয়ার পর জানালেন যে, তিনি মনুষ্যলোকে আসছেন জেনে পিতা পাণ্ডু যুধিষ্ঠিরকে আদেশ করেছেন, “তুমি যজ্ঞশ্রেষ্ঠ রাজসূয়ের অনুষ্ঠান করো। পুত্র, তুমি রাজসূয় যজ্ঞ করলে, আমি হরিশ্চন্দ্রের ন্যায় অতি দ্রুত দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় গিয়ে বহু বৎসর পর্যন্ত আনন্দ অনুভব করতে পারব।” নারদও যুধিষ্ঠিরকে রাজসূয় যজ্ঞ করার আদেশ দান করে দ্বারকানগরে চলে গেলেন।
যুধিষ্ঠির রাজসূয়-যজ্ঞ সম্পর্কে পিতার ও নারদের আদেশ ভ্রাতৃগণ এবং সভাসদদের জানালেন। সকলেই একবাক্যে যুধিষ্ঠিরকে জানালেন, “মহারাজ আপনি মহাযজ্ঞ রাজসূয় করার পক্ষে সম্পূর্ণ যোগ্য।” তখন যুধিষ্ঠির নিজে অনেক বিবেচনা করে ধারণা করলেন যে, রাজসূয়-যজ্ঞ তাঁর করা উচিত। কিন্তু একক বুদ্ধিতে রাজসূয় যজ্ঞ আরম্ভ করা অনুচিত বিবেচনা করে সর্বলোকশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ, যাঁকে তিনি সাক্ষাৎ নারায়ণ হিসাবে গ্রহণ করতেন, তাঁকেই স্মরণ করলেন। দূত যুধিষ্ঠিরের সংবাদ নিয়ে দ্বারকায় পৌঁছলেই কৃষ্ণ আপন সারথি ইন্দ্রসেনকে ইন্দ্রপ্রস্থে যাবার জন্য তখনই আদেশ করলেন।
কৃষ্ণ শীঘ্রগামী রথে আরোহণ করে দ্রুত নানাদেশ অতিক্রম করে ইন্দ্রপ্রস্থে উপস্থিত হলেন। পিসতুতো ভাই যুধিষ্ঠির ও ভীম, মামাতো ভাই কৃষ্ণের সম্মান করলেন। কৃষ্ণ পিসিমা কুন্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তারপর কৃষ্ণ প্রিয়সখা অর্জুনের সঙ্গে মিলিত হয়ে অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করলেন। তখন নকুল ও সহদেব এসে তাঁকে প্রণাম করলেন। কৃষ্ণ মনোহর স্থানে বিশ্রাম লাভ করেছেন, তাঁর পথের ক্লান্তি দূর হয়েছে, তিনি কল্পতরুর মতো অবস্থান করছেন, বুঝে যুধিষ্ঠির নিজে গিয়ে কর্তব্য বিষয়ে আলোচনা শুরু করলেন, “কৃষ্ণ! আমি রাজসূয় যজ্ঞ করার ইচ্ছা করেছি। কিন্তু তোমার জানা আছে যে, কেবলমাত্র ইচ্ছা দ্বারা রাজসূয় যজ্ঞ করা যায় না। যাঁর কাছে সবই সম্ভবপর, যিনি সর্বত্র পূজিত হন, যিনি সমগ্র পৃথিবীর অধীশ্বর, রাজসূয় যজ্ঞ করার অধিকার কেবলমাত্র তেমন রাজারই। আমার বন্ধুবর্গ আমাকে রাজসূয় যজ্ঞ করতে অনুরোধ করছেন, কিন্তু তোমার অভিমত পাবার পরই আমি চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারব। কেউ প্রীতিবশত অসুবিধার কথা বলেন না, কেউ কেবল স্বার্থ সাধনের জন্য কেবলমাত্র প্রিয় বাক্যই বলতে থাকেন, আবার কেউ নিজের হিতকর, সেই অভীষ্ট সাধনের কথাই বলে থাকেন। কিন্তু তুমি এই সমস্ত কারণ অতিক্রম করে, স্বার্থলিপ্সা ও ক্রোধ পরিত্যাগ করে, আমার পক্ষে যা কল্যাণকর, যা জগতের মঙ্গলজনক, তাই যথার্থভাবে বলতে পারো।”
কৃষ্ণ বললেন, “মহারাজ আপনি সমস্ত গুণেই রাজসূয় যজ্ঞ করার অধিকারী। সমস্ত বিষয়ই আপনার জানা আছে, তবু আপনাকে আমি কিছু বলব। মহারাজ! পরশুরাম ক্ষত্রিয়কুল নির্মূল করে যাদের অবশিষ্ট রেখেছিলেন, তাঁদের বংশে ক্ষত্রিয় নামধারী যাদের দেখা যায়—তাঁরা নিজেদের আপন অভিরুচি অনুযায়ী সম্রাট বলে ঘোষণা করেছেন, তাও আপনার জানা আছে। পৃথিবীতে যত ক্ষত্রিয় রাজা আছেন, তাঁরা সকলেই পুরূরবা বা ইক্ষাকুর সন্তান। পুরূরবা বা ইক্ষ্বাকুর বংশধর যেসব রাজা বর্তমান আছেন, তাঁরা বর্তমানে একশত বংশে বিভক্ত হয়েছেন।
এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী জরাসন্ধ রাজা। অন্য সকল রাজার রাজলক্ষ্মীকে অভিভূত করে জরাসন্ধ সম্রাট অভিধায় অভিহিত হয়েছেন। তিনি আপন তেজে সমস্ত রাজাকে পরাভূত করে মগধদেশ ভোগ করে অন্য রাজাদের মধ্যে ভেদ জন্মাচ্ছেন। মহারাজ! যে রাজা অন্যদের প্রভু এবং সমস্ত জগৎ যাঁর আধিপত্যে থাকে, তিনিই সম্রাট। চেদিরাজ শিশুপাল রাজা জরাসন্ধকে আশ্রয় করেই সেনাপতি হয়েছেন। করূষদেশাধিপতি রাজা বক্র জরাসন্ধের কাছে শিষ্যের মতো উপস্থিত থাকেন। মহাবীর্য ও মহাত্মা হংস ও ডিম্বক নামে অপর দুই রাজাও জরাসন্ধকে আশ্রয় করেছেন। লোকে যে মণিটিকে অদ্ভুত মণি বলে জানে, সেই দিব্য মণিটিকে যিনি মস্তকে ধারণ করেন সেই মেঘবাহন রাজাও জরাসন্ধের অনুগত। বরুণ যেমন পশ্চিমদিক শাসন করছেন, সেইরকম যিনি মুর ও নরকদেশ শাসন করছেন, যাঁর সৈন্যের পরিসীমা নেই এবং যিনি আপনার পিতার সখা, সেই বৃদ্ধ যবনাধিপতি ভগদত্ত রাজা বাক্য ও কর্মদ্বারা জরাসন্ধের কাছে অবনত হয়ে আছেন।
তবে, যিনি স্বভাবতই স্নেহশীল, পুত্রের উপরে পিতার যেমন স্নেহ থাকে, সেইরকম আপনার উপরে যার স্নেহ আছে, যিনি ভারতের পশ্চিম দিক ও দক্ষিণ প্রান্তের রাজা, আপনার মাতুল, মহাবীর, শক্ৰহন্তা ও কুন্তীবংশবর্ধন একমাত্র সেই পুরুজিৎই স্নেহবশত আপনার পক্ষে আছেন।
যিনি নিজেকে পুরুষোত্তম বলে মনে করেন, যিনি মোহবশত সর্বদাই আমার চিহ্নধারণ করেন এবং জগতে বাসুদেব নামে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন, সেই বঙ্গ, পুণ্ড্রক ও কিরাতদেশের রাজা পৌণ্ড্রকও জরাসন্ধের অনুগামী। ভারতবর্ষের এক চতুর্থাংশের অধিপতি, ইন্দ্রের সখা ও বলবান ভীষ্মক রাজা, যিনি ভোজবংশীয় ও আপন ক্ষমতায় পাণ্ড্যদেশ ও ক্ৰথকৈশিকদেশ জয় করেছিলেন, যাঁর ভ্রাতা অকৃতি পরশুরাম তুল্য মহাবীর ছিলেন, সেই শত্ৰুহন্তা ভীষ্মক রাজাও জরাসন্ধের অনুগত। আমরা সকল সময়ে সেই ভীষ্মক রাজার প্রীতিপূর্ণ আচরণ করি, কিন্তু তিনি আমাদের প্রতি অনুরক্ত নন এবং প্রিয় ব্যবহারও করেন না। নিজের বল, বংশমর্যাদা, অভিমান, উজ্জ্বল যশ ত্যাগ করে তিনি জরাসন্ধের অনুগামী।
উত্তরদিকের আঠারোটি ভোজবংশ জরাসন্ধের ভয়েই পশ্চিমদিকে আশ্রয় নিয়েছেন। শুরসেন, ভদ্রকায়, বৌধ, শাল্ব, পটচচর, সুস্থল, সুকুট্ট, কলিন্দ, কুন্তী এবং শাল্বায়নদেশীয় রাজারা এবং বদ্ধমূল মৎস্যদেশীয় রাজারা জরাসন্ধের ভয়ে উত্তরদিক পরিত্যাগ করে দক্ষিণদিক আশ্রয় করেছেন। পাঞ্চালদেশীয়গণ জরাসন্ধের ভয়ে আপন আপন রাজ্য পরিত্যাগ করে সকল দিকে পলায়ন করেছেন। কিছুকাল পরে দুর্মতি কংস যাদবগণকে উৎপীড়িত করে জয়দ্রথের পুত্র সহদেবের ভগিনী অস্তি ও প্রাপ্তি নামের দুটি সুন্দরী কন্যাকে বিবাহ করেন। জরাসন্ধের সাহায্য লাভ করে দুর্মতি কংস আপন জ্ঞাতিবর্গের উপর অত্যাচার শুরু করেন ও আপন শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন। কংসের অত্যাচারে ভোজবংশীয় বৃদ্ধলোকেরা আমাদের শরণাপন্ন হন। “তখন আমি ও বলরাম আহুক কন্যা সুতনুকে অক্রূরের হাতে সম্প্রদান করি ও কংস ও সুনামাকে বধ করি।” কংসের মৃত্যু হলে তাঁর দুই স্ত্রী অস্তি ও প্রাপ্তি পিতার কাছে গিয়ে স্বামীর নিধনকারীদের শাস্তির প্রার্থনা করে।
জরাসন্ধ তখন সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের জন্য উদ্যত হলেন। “তখন আমরা আঠারোটি বংশ একত্র হয়ে মন্ত্রণা করি যে, আমরা শত্রুনাশক ভীষণ অস্ত্র দ্বারা অনবরত বধ করতে থেকেও তিনশো বছরেও জরাসন্ধের সমস্ত সৈন্য সংহার করতে পারব না।” তারপর বলবানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং অস্ত্র দ্বারা অবধ্য হংস ও ডিম্বক নামে দুই মহাবীর জরাসন্ধের সহায় আছে। তারা দুইজন এবং জরাসন্ধ মিলে ত্রিভুবন ধ্বংস করতে পারেন—এ ধারণা সকলেরই ছিল। তারপর হংস নামের দ্বিতীয় এক প্রবল পরাক্রান্ত রাজাকে আঠারোবার যুদ্ধ করে বলরাম বধ করেন। তখন এক ব্যক্তি ডিম্বকের কাছে গিয়ে তাঁকে জানান যে, হংস নিহত হয়েছেন, হংস ডিম্বকের প্রাণাপেক্ষা অধিক প্রিয় ছিল। “আমি এই জগতে হংস ছাড়া জীবন ধারণ করতে পারব না।” এই গভীর শোকে মগ্ন হয়ে ডিম্বক যমুনার জলে আত্মবিসর্জন করেন। ডিম্বক প্রাণবিসর্জন করেছেন এই সংবাদ পেয়ে প্রবল পরাক্রান্ত শত্রুনগরবিজয়ী, ডিম্বকের বন্ধু সেই হংস এসে যমুনাতীরে উপস্থিত হন। ডিম্বক তাঁরই মৃত্যুসংবাদে আত্মবিসর্জন করেছেন এই শুনে, পরম দুঃখিত হংসও যমুনার জলে নিমগ্ন হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। হংস ও ডিম্বকের প্রাণ বিসর্জনের সংবাদ পেয়ে জরাসন্ধ সমস্ত সৈন্য নিয়ে আপন রাজধানীতে প্রস্থান করেন।
জরাসন্ধের আপন রাজ্যে প্রত্যাবর্তনের সংবাদে দ্বারকাবাসী আনন্দিত হয়ে মথুরাতেই বাস করতে লাগলেন। কিন্তু কংসের দুই স্ত্রী অস্তি ও প্রাপ্তি পিতা জরাসন্ধকে বারবার উত্তেজিত করে বলতে লাগল, “আমাদের পতিহন্তাকে বধ করুন”; ক্রোধে জরাসন্ধ পুনরায় যুদ্ধ-সজ্জা করতে লাগলেন। এই সংবাদে দ্বারকাবাসী মথুরা ত্যাগ করে পশ্চিমদিকে রৈবতক পর্বত শোভিত ‘কুশস্থলী’ নামক নগরীতে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। সেখানে গিয়ে তাঁরা দেবগণের অজেয় করে একটি দুর্গসংস্কার করলেন। সেই দুর্গ এমনভাবে সংস্কার করা হল, যাতে সেই স্থানে থেকে স্ত্রীলোকেরাও যুদ্ধ করতে পারে। কংসের মৃত্যু জরাসন্ধ কখনও ভুলতে পারেননি। সেই অপরাধে তিনি যাদবদের ধ্বংসের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। রৈবতক পর্বতে এসে যাদবেরা নিশ্চিন্ত হলেন।
সেই রৈবতক পর্বতের একুশটি শৃঙ্গ আছে, রৈবতক পর্বত তিন যোজন দীর্ঘ ও এক যোজন বিস্তৃত। এক এক যোজনের পরে একশোটি করে দ্বার আছে, প্রত্যেক দ্বারেই বীরগণ বিক্রম প্রকাশ করতে পারেন, এমন তোরণ আছে এবং আঠারোজন করে অতি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা প্রত্যেকটি তোরণ রক্ষা করতে পারেন। যাদববংশে আঠারো হাজার ভ্রাতা আছেন এবং আহুকের একশত পুত্র আছে, যাদের এক একটিই বহুদেবতা অপেক্ষা বলবান। কৃষ্ণ, বলরাম, চারুদেষ্ণ, চক্রদেব, সাত্যকি, চারুদেষ্ণের ভ্রাতা এবং কৃষ্ণ-নন্দন শাম্ব—এই সাতজনই যুদ্ধে বিষ্ণুর তুল্য। এঁরা অতিরথ। এ ছাড়াও কৃতবর্মা, অনাধৃষ্টি, সমীক, সমিতিঞ্জয়, কঙ্ক, শঙ্কু এবং কুন্তি—এই সাতজন মহারথ; আর অন্ধকভোজের দুই পুত্র এবং বৃদ্ধ অন্ধকভোজ রাজা; এই দশজনের শরীরই বজ্রের ন্যায় দৃঢ় এবং এরা সকলেই বীর, তেজস্বী ও মহারথ। মনোরম মথুরা প্রদেশকে স্মরণ করতে করতে এঁরা সকলেই রৈবতক পর্বত সন্নিহিত অঞ্চলে আছেন।
কৃষ্ণ এই আনুপূর্বিক বিবরণ দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “হে ভরতশ্রেষ্ঠ, আপনি সর্বদাই সম্রাটের সমস্ত গুণে গুণবান; সুতরাং ক্ষত্রিয় সমাজে আপনি সম্রাট হবার যোগ্য। কিন্তু মহারাজ! মহাবল জরাসন্ধ জীবিত থাকতে আপনি রাজসূয় যজ্ঞ করতে পারবেন না। কারণ, সিংহ যেমন জয় করে হস্তীগণকে পর্বতের গুহায় আবদ্ধ রাখে, তেমনই জরাসন্ধ সমস্ত রাজাকে জয় করে পর্বতের গুহার মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রেখেছেন। তিনি সেই রাজাদের দিয়ে পুরুষমেধ যজ্ঞ করার ইচ্ছা করেছেন। জরাসন্ধ ভয়ংকর তপস্যা করে উমাপতি মহাত্মা মহাদেবকে তুষ্ট করে, তাঁরই বরে, সেই রাজাদের বন্দি করে রেখেছেন। আমরাও সেই জরাসন্ধের ভয়ে মথুরা পরিত্যাগ করে রৈবতকে বাস করছি। অতএব মহারাজ! আপনি রাজসূয় যজ্ঞ করতে চাইলে প্রথমেই সেই রাজাদের মুক্ত করে জরাসন্ধ বধ করতে হবে, নইলে আপনি রাজসূয় যজ্ঞ সম্পাদন করতে পারবেন না। এখন আপনি আমাকে বলুন যে, এ বিষয়ে আপনি কী করতে চান?”
যুধিষ্ঠির বললেন, “কৃষ্ণ তুমি যা বললে তা তুমি ছাড়া কেউ বলতে পারে না। তুমি ছাড়া অন্য কেউ আমার সংশয়ও দূর করতে পারে না। পৃথিবীতে বহু রাজা আছে, কিন্তু তাঁরা সম্রাট নন। পরের বল জেনে নিজের প্রশংসায় মানুষ শ্রেষ্ঠ হয় না—পরকে যুদ্ধে জয় করে মানুষ শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়। পৃথিবী বিশালা, বহু খণ্ডে বিভক্ত এবং বহুরত্নে পরিপূর্ণা; সম্পূর্ণ পৃথিবী জয় করতে পারলে শ্রেষ্ঠ বলে নিজেকে বিবেচনা করতে পারতাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি রাজসূয় যজ্ঞ আরম্ভ করতে পারলেও নির্বিঘ্নে সমাপ্ত করতে পারব না। এই অবস্থায় আমার মনে হয় শান্তিই ভাল, শান্তি থেকেই আমার মঙ্গল হবে। মনস্বীরাও জানেন যে সৎকুলে জাত রাজাদের মধ্যে গুণে কেউ অপর হতে শ্রেষ্ঠ হতে পারে।”
ভীম বললেন, “উদ্যোগহীন এবং সামাদি উপায় অবলম্বন না করে যে রাজা সকল রাজাকে আক্রমণ করতে যান, তিনি বল্মীক মৃত্তিকা স্তুপের ন্যায় অবসন্ন হয়ে পড়েন। দুর্বল রাজা যথানিয়মেনীতি প্রয়োগ করে প্রবল শত্রুকেও জয় করতে পারেন এবং প্রায়ই নিজের হিতসাধন করতে পারেন। কৃষ্ণে নীতি, আমাতে বল এবং অর্জুনে যুদ্ধশিক্ষাকৌশল আছে। সুতরাং দক্ষিণাগ্নি, গার্হপত্য ও আহ্বনীয়—এই তিন অগ্নি যেমন যজ্ঞ সম্পাদন করে, আমরা তিনজনও জরাসন্ধের জয় সম্পাদন করব।”
কৃষ্ণ বললেন, “মূর্খ লোক কাজ আরম্ভ করে, কিন্তু পরিণাম দেখে না। সেইজন্যই বুদ্ধিমান লোক স্বার্থপরায়ণ মুর্খ শত্রুকে গ্রাহ্য করেন না। মহারাজ আমরা শুনেছি—মান্ধাতা শত্রু জয় করে, ভগীরথ প্রজাপালন করে, কার্তবীর্যার্জুন তপস্যা করে, ভরতরাজা বল প্রয়োগ করে এবং মরুত্তরাজা সম্পদের বলে সম্রাট হয়েছিলেন। আর আপনার সাম্রাজ্যলাভের উপরোক্ত পাঁচটি কারণই আছে। হে ভরতশ্রেষ্ঠ আপনি স্থির জানুন যে, বৃহদ্রথের পুত্র জরাসন্ধ ধর্ম, অর্থ, নীতি ও আচারের অযথা অপপ্রয়োগ করে দমনীয় হয়ে পড়েছে। পূর্বে আমি যে একশত কুলোৎপন্ন রাজার কথা আপনাকে বলেছি, তাঁরাও এখন আর জরাসন্ধের অনুসারী নন। জরাসন্ধ এখন বলপূর্বক সাম্রাজ্য করছেন। তবে, ধনী রাজারা এখনও ধন দ্বারা জরাসন্ধের উপাসনা করছেন। তবে মূর্খতাবশত জরাসন্ধ তাতে সন্তুষ্ট নন। তিনি রাজাদের কাছ থেকে করও গ্রহণ করছেন এবং বলি দেবার জন্য তাদের ধরেও রাখছেন। এইভাবে জরাসন্ধ সমস্ত রাজাকেই বশ করেছেন। কিন্তু মহারাজ দুর্বল রাজারা তাঁকে আক্রমণ করবেন কী করে? পশুদের মতো রাজগণকে মহাদেবের ঘরে নিয়ে প্রোক্ষণ ও স্নান করিয়ে রেখেছেন। সুতরাং তাঁদের জীবনের প্রতি আর কোনও মমতা নেই। অস্ত্র দ্বারা ক্ষত্রিয়কে আঘাত করা হলে, তাকে সমাদর করা হয়। কিন্তু আমরা মিলিত হয়েও জরাসন্ধকে বধ করতে পারছি না। জরাসন্ধ ছিয়াশিজন রাজাকে ধরে এনেছেন, বাকি আছে চোদ্দো জন। এর পরেই তিনি নরমেধ যজ্ঞ শুরু করবেন। যে রাজা তাঁর সেই কাজে বিঘ্ন ঘটাতে পারবেন, তিনি উজ্জ্বল যশ লাভ করবেন। আর যে রাজা জরাসন্ধকে জয় করতে পারবেন, তিনি নিশ্চয়ই সম্রাট হবেন।”
যুধিষ্ঠির বললেন, “কৃষ্ণ আমি স্বার্থপরায়ণ লোকের ন্যায় সাম্রাজ্যলাভের জন্য কেবল সাহসের বলে কী করে তোমাদের পাঠাব। জনার্দন, ভীম আর অর্জুন আমার দুটি নয়ন, আর তুমি আমার মন। মন আর দুটি নয়ন হারালে আমার জীবনের কী বাকি থাকবে? ভয়ংকর বিক্রমশালী এবং অসংখ্য জরাসন্ধ সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধে স্বয়ং যমও জয়লাভ করতে পারেন না; সুতরাং তোমরা চেষ্টা করে কী করবে? কৃষ্ণ আমি আমার মত সুস্পষ্টভাবে তোমাকে জানাচ্ছি, এই কার্য সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করাই আমার অভিপ্রেত। আমার অনুরোধ তুমিও আমার অভিমত গ্রহণ করো। রাজসূয় যজ্ঞের দুষ্করতাই আমার মনকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।”
অর্জুন, যিনি অগ্নিদেবের কাছ থেকে গাণ্ডিব ধনু, অক্ষয় তূণ, রথ, ধ্বজা ও ময়দানবের নির্মিত সভা লাভ করেছিলেন, তিনি নিজেকে যথেষ্ট আত্মনির্ভরশীল বলে মনে করে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “মহারাজ, মানুষের যা অভীষ্ট অথচ দুর্লভ, আমি সেই ধনু, বাণ, উৎসাহ, সহায়, সবল দেহ, যশ ও বল পেয়েছি। সাধু সমাজস্থ বিদ্বান লোকেরা সৎ বংশে জন্মগ্রহণের প্রশংসা করে থাকেন। কিন্তু সৎ বংশে জন্মগ্রহণও বলের তুলনীয় নয়। অতএব বল প্রকাশ করাই আমার অভিপ্রেত। বলবানের বংশে জন্মেও দুর্বল লোক কী করতে পারে? আবার দুর্বলের বংশে মানুষ জন্মগ্রহণ করেও বলবান হয়ে প্রধানও হতে পারে। মহারাজ শত্রুজয়ে যার প্রবৃত্তি থাকে, তিনিই সর্বপ্রকারে ক্ষত্রিয়। অন্য গুণ না থাকলেও শত্ৰুজয় করতে যিনি সমর্থ, তিনিই যথার্থ ক্ষত্রিয়। দুর্বল লোকের অন্য সব গুণ থাকলেও পরাক্রম না থাকায় তিনি চিরদিন অপ্রধান থেকে যান। মহারাজ, অত্যন্ত মনোযোগ, যুদ্ধ করা এবং দৈব—এই তিনটি মিলিত হয়েই জয়ের হেতু হয়ে থাকে। আবার বলবান হয়েও কোনও লোক মনোযোগ না থাকায় জয় করার উপযোগী হতে পারে না। সুতরাং মনোযোগী দুর্বল শত্রুও অমনোযোগী প্রবল শত্রুকে ধ্বংস করতে পারে। অবসাদ এবং অমনোযোগ— দুইই বলবানের অনিষ্টের কারণ। সুতরাং জয়ার্থী রাজা অনিষ্টকারক এই দুটিকেই পরিত্যাগ করেন। আমরা যদি রাজসূয় যজ্ঞ করবার জন্য জরাসন্ধবধ এবং তিনি যে রাজাদের অবরুদ্ধ করে রেখেছেন, তাঁদের মুক্ত করতে পারি তবে তার থেকে উৎকৃষ্ট কাজ আর কী হবে? আপনি যদি রাজসূয় যজ্ঞের উদ্যোগ না করেন, তবে জগতে আপনার নির্গুণতা প্রকাশ পাবে। অসন্দিগ্ধ উৎসাহলাভ অপেক্ষা অপকর্ষকে কেন ভাল মনে করছেন? শান্তিকামী মুনিদের গৈরিক বস্ত্র ধারণ করার কাজ আপনি পরেও করতে পারবেন। আপনি সাম্রাজ্যলাভ করবেন; আমরা শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করব।”
কৃষ্ণ বললেন, “ভরতের বংশে উৎপন্ন এবং কুন্তীর পুত্রের যে ধরনের বুদ্ধি হওয়া দরকার, তা অৰ্জুন দেখিয়েছেন। আমাদের মৃত্যু দিনে অথবা রাত্রে হবে, তা আমরা জানি না। কিংবা যুদ্ধ না করে কোনও প্রাণী অমর হয়েছেন, তাও আমরা শুনিনি। মানুষের মনস্তুষ্টির জন্য শাস্ত্রসম্মত কৌশল অবলম্বন করে শত্রুকে আক্রমণ করতে হবে। যাতে বিপদ হবে না, এমন সুকৌশলে শত্রুকে আক্রমণ করতে হবে। তারপর যুদ্ধ আরম্ভ হলে জয় বা পরাজয় একটা হয়েই থাকে। কারণ, যুদ্ধে উভয়পক্ষই এক ফল লাভ করতে পারে না। যে কৌশলী নয়, কিংবা সামাদি উপায় অবলম্বন করে না, যুদ্ধে তার অত্যন্ত ক্ষতি হয়। আর উভয়পক্ষ সমান হলে, জয়-পরাজয়ের সংশয় জন্মে। কারণ, দুই পক্ষেরই জয় বা পরাজয় হয় না। আমরা শত্রুর কাছে গিয়ে তার ফাঁক খুঁজব, নিজেদের ফাঁক ঢেকে রাখব; তারপর কৌশল অবলম্বন করে পরাক্রমের সঙ্গে তাকে আক্রমণ করব। নদীর বেগ যেমন বড় গাছকে নিপাত করে, তেমনি আমরা কেন তাকে নিপাত করতে পারব না? ‘সজ্জিতসৈন্য প্রবল শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে না’—বুদ্ধিমানেরা এই নীতি মানেন, জরাসন্ধ সম্পর্কে আমারও সেই মত। আমরা প্রথমে সজ্জিত হয়ে ছদ্মবেশে শত্ৰুভবনে প্রবেশ করব, তারপরে তাকে একাকী পেয়ে আক্রমণ করে অভীষ্ট লাভ করব। কারণ, অন্তরাত্মা যেমন ভৌতিক দেহের সম্পদ ভোগ করেন, তেমন একমাত্র জরাসন্ধই সর্বদা ভূমণ্ডলের সাম্রাজ্যলক্ষ্মী ভোগ করছে। সুতরাং তাঁকে নিপাত করাই আমার লক্ষ্য। জরাসন্ধ কর্তৃক অবরুদ্ধ আত্মীয় নৃপতিগণকে রক্ষা করার জন্য আমরা যুদ্ধে সেই জরাসন্ধকে নিহত করে, তারপরে তাঁর লোকেদের হাতে নিহত হয়ে স্বর্গলাভ করব।”
যুধিষ্ঠির বললেন, “কৃষ্ণ এ জরাসন্ধ কে? এর বল বা পরাক্রমই কেমন? যে অগ্নিতুল্য তোমাকেও স্পর্শ করে দগ্ধ হয়ে যায় না।”
কৃষ্ণ বললেন, “মহারাজ, জরাসন্ধ কেমন, তার বল কেমন, কেন সে আমাদের অপ্রিয় ভাজন আচরণ করে থাকলেও আমরা তা উপেক্ষা করে আছি, সে সকলই আপনি আমার কাছে শ্রবণ করুন।”
মহারাজ তিন অক্ষৌহিণী সৈন্যের নেতা এবং সমরগর্বিত ‘বৃহদ্রথ’ নামে মগধ দেশে এক রাজা ছিলেন। তিনি রূপবান, বলবান, সম্পত্তিশালী, অসাধারণ বিক্রমী, সর্বদাই যজ্ঞদীক্ষায় চিহ্নে এবং দ্বিতীয় ইন্দ্রের ন্যায় বিদ্যমান ছিলেন। হে ভরতশ্রেষ্ঠ। সূর্যের কিরণে এই পৃথিবী যেমন ব্যাপ্ত আছে, তেমনি তাঁর সৎকুলোচিত গুণে এই সমগ্র পৃথিবী ব্যাপ্ত ছিল। সেই মহাবীর বৃহদ্রথ কাশীরাজের পরমা সুন্দরী যমজ দুই কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। একদিন নির্জনে বৃহদ্রথ সুন্দরী দুই ভার্যার নিকট শপথ করলেন, “আমি তোমাদের দু’জনের সঙ্গে অপক্ষপাত সমান ব্যবহার করব।” রাজা বৃহদ্রথ হস্তী যেমন হস্তিনীদ্বয় দ্বারা শোভা পায়, তেমনই প্রিয়তমা দুই ভার্যা দ্বারা শোভা পেতে লাগলেন। রাজা বিষয়কার্যে নিবিষ্ট থাকা অবস্থায় তাঁর যৌবন চলে গেল; কিন্তু বংশরক্ষক কোনও পুত্র জন্মগ্রহণ করল না। নানাবিধ মাঙ্গলিক কাজ, বহুতর হোম এবং অনেক পুত্রযজ্ঞ দ্বারাও রাজা বংশবর্ধক পুত্র লাভ করলেন না।
একদিন রাজা শুনতে পেলেন যে, গৌতমবংশীয় কাক্ষীবানের পুত্র উদারচেতা চণ্ডকৌশিকমুনি তপস্যায় পরিশ্রান্ত হয়ে এক বৃক্ষমূলে অবস্থান করছেন। রাজা দুই ভার্যার সঙ্গে গিয়ে অনেক সেবায় তাঁকে সন্তুষ্ট করলেন। তখন দৃঢ়সন্তোষী সত্যবাদী ও ঋষিশ্রেষ্ঠ চণ্ডকৌশিক রাজাকে বললেন, “মহারাজ আমি সন্তুষ্ট হয়েছি, আপনি বর গ্রহণ করুন।”
তখন বৃহদ্রথ রাজা দুই ভার্যার সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রণাম করে, পুত্ৰমুখ না দেখার সুগভীর নৈরাশ্যে বাষ্পগদগদ কণ্ঠে মুনিকে বললেন, “ভগবান, আমি রাজ্য পরিত্যাগ করে তপোবনে চলেছি। আমি মন্দভাগ্য, আমার বরে প্রয়োজন কী? আমি নিঃসন্তান, আমার রাজ্যেই বা প্রয়োজন কী?” এই কথা শুনে বিচলিত চণ্ডকৌশিক মুনি সেই আমগাছের ছায়াতে উপবেশন করলেন এবং ধ্যানস্থ হলেন।
মুনি উপবেশন করলে, একটি আম্রফল বায়ুসঞ্চারিত বা শুকদষ্ট না হয়েই তাঁর কোলের উপর পড়ল। মুনি সেই অতুলনীয় ফলটিকে গ্রহণ করে, মনে মনে মন্ত্রপাঠ করে পুত্রলাভের জন্য তা রাজাকে দিলেন। মুনি রাজাকে জানালেন যে, এই আম্রফল ভক্ষণ করলেই রানি পুত্রবতী হবেন। অতএব রাজার তপোবনে যাবার কোনও প্রয়োজন নেই। মুনির এই কথা শুনে রাজা তাঁর চরণে প্রণাম করে আপন গৃহে প্রত্যাগমন করলেন এবং পত্নীদের ঋতুকাল উপস্থিত হয়েছে জেনে একটি আম্রফল দুই পত্নীকে প্রদান করলেন এবং রাজরানিরা মুনিবাক্য অবশ্য সত্য হবে, এই ভেবে, একটি ফলকেই দুইভাগে ভাগ করে দুজনেই ভক্ষণ করলেন। ফল ভক্ষণ করার ফলে রাজরানিদের দু’জনেরই গর্ভ হল। রাজা তাঁদের গর্ভবতী দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তারপর দশম মাস উপস্থিত হলে তাঁরা দু’জনেই যথানিয়মে দুটি শরীরখণ্ড প্রসব করলেন।
তখন সেই ভগিনীরা দু’জনেই অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন, তাঁদের প্রতি প্রসূত খণ্ডে এক-একটি চোখ, এক একটি হাত ও এক একখানি চরণ ছিল এবং উদরের অধ, মুখের অর্ধ এবং শরীরের অধোভাগের অর্ধ ছিল। সেই অবস্থা দেখে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও দুঃখিত রানিরা কাঁপতে কাঁপতে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সেই সজীব শরীরখণ্ড দু’খানিকে পরিত্যাগ করলেন।
এদিকে রক্তমাংসভোজী ‘জরা’ নামে এক রাক্ষসী এসে চতুষ্পথনিক্ষিপ্ত সেই গর্ভখণ্ড দু’খানি গ্রহণ করল। তারপর সেই রাক্ষসী বিধাতার প্রভাবে প্রণোদিত হয়ে সেই খণ্ড দু’খানিকে সুদৃশ্য করার ইচ্ছায় সংযোজিত করল। সেই খণ্ড দু’খানিকে সংযোজিত করা মাত্র তা শরীর ধারণ করে একটি বীরশিশুর রূপে পরিণত হল। রাক্ষসী বিস্ময়ে বিস্ফারিত নেত্রে দেখল যে, সে নিজে এই শিশুকে বহন করতে পারছে না। এদিকে সেই শিশুটি রক্তবর্ণ ডান হাতখানি মুঠো করে, তা মুখে পুরে অতি দর্পিত জলপূর্ণ মেঘের গর্জনে রোদন করে উঠল। সেই প্রচণ্ড গর্জন শুনে অন্তঃপুরের লোকেরা এবং দুই রানি রাজার সঙ্গে পথে নেমে এল। জরারাক্ষসী সেই দুগ্ধপূর্ণস্তনী রাজমহিষী দুজন ও পুত্রার্থী বিষন্ন রাজাকে দেখে ভাবল, “ধার্মিক, মহাত্মা, পুত্রার্থী রাজার রাজ্যে বাস করে আমি তাঁর এই শিশু পুত্রকে বধ করতে পারি না।”
তখন সেই রাক্ষসী মানুষীর রূপ ধারণ করে, মেঘশ্রেণি যেমন সূর্যকে ধারণ করে, তেমনই অতি কষ্টে শিশুটিকে ধারণ করে রাজাকে বলল, “মহারাজ আমি এই পুত্রটি আপনাকে দিলাম, আপনি গ্রহণ করুন। একটি ব্রাহ্মণের বরে আপনার দুই পত্নীর গর্ভে শিশুটি জন্মেছিল; পরে ধাত্রীরা তাঁকে পরিত্যাগ করেছিল। কিন্তু আমি রক্ষা করেছি।” কাশীরাজকন্যারা তৎক্ষণাৎ সেই শিশুপুত্রকে ক্রোড়ে নিয়ে স্তন্যদুগ্ধ দ্বারা স্নান করাতে লাগলেন। রাজা সেই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে স্বর্ণবর্ণা মনুষ্যরূপিণী সেই রাক্ষসীকে বললেন, “হে পদ্মকোষবর্ণা কল্যাণী, আমার পুত্রদায়িনী তুমি কে? নিঃসংকোচে আমাকে বলো। আমার মনে হয়, তুমি দেবতা।” রাক্ষসী বলল, “মহারাজ! আমি জরানাম্নী কামরূপিণী রাক্ষসী! আমি আপনার ঘরে পূজিত হতে থেকে সুখে বাস করেছি; আপনার মঙ্গল হোক। গৃহদেবী নামে রাক্ষসী প্রত্যেকের গৃহে সর্বদা বাস করে; পূর্বকালে ব্রহ্মা তাদের দিব্যরূপবতী করে সৃষ্টি করে দানবদের বিনাশ করার জন্য মনুষ্যগৃহে স্থাপন করেছেন। যে লোকভক্তির সঙ্গে যুবতী ও পুত্রদের নিয়ে গৃহদেবীকে ঘরের দেওয়ালে এঁকে রাখে, তাদের উন্নতি হয়, না হলে অবনতি ঘটে। মহারাজ আমি বহু-পুত্ৰবেষ্টিত অবস্থায় আপনার ঘরের দেওয়ালে চিত্রিত অবস্থায় বহুদিন সম্মানিত হয়েছি। গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, খাদ্য এবং পেয় দ্বারা বিশেষভাবে পূজিত হয়েছি। তাই সর্বদাই আমি আপনার উপকার করার কথা চিন্তা করে থাকি। আমি আপনার এই পুত্ৰশরীরের খণ্ড দুটি দৈববশত দেখেছিলাম। তারপরে তা সংযোজিত করা মাত্রই আপনার ভাগ্যবশত এই শিশু জন্মেছে। আমি নিমিত্তমাত্র। আমি সুমেরু পর্বত পর্যন্ত খেয়ে ফেলতে পারি; আপনার পূজায় সন্তুষ্ট তাই আপনার পুত্রকে খাইনি।”
জরা রাক্ষসী এই বলেই অন্তর্হিত হল। রাজা বালকটিকে নিয়ে গৃহে প্রবেশ করলেন। রাজা শিশুটির জাতকর্ম প্রভৃতি সম্পন্ন করলেন এবং জরা রাক্ষসীর উদ্দেশে মহোৎসব করবার আদেশ দিলেন। ব্রহ্মার তুল্য প্রভাবশালী পিতা বৃহদ্রথ সেই বালকটির নামকরণ করলেন—যেহেতু জরারাক্ষসী শিশুটিকে সংযোজিত করেছিল, সেই হেতু এর নাম হোক—জরাসন্ধ। মাতা-পিতার আনন্দজনক ও অত্যন্ত তেজস্বী মগধরাজের সেই পুত্রটি ক্রমে শরীরের পরিমাণ ও বলসম্পন্ন হতে থেকে আহুতিপ্রাপ্ত অগ্নির মতো, শুক্লপক্ষীয় চন্দ্রের মতো বেড়ে উঠতে থাকল।
তারপর কিছুকাল কেটে গেলে অসাধারণ তপস্যাকারী ভগবান চণ্ডকৌশিক পুনরায় মগধদেশে আগমন করলেন। তাঁর আগমনে রাজা বৃহদ্রথ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে অমাত্যগণ, বন্ধুগণ, ভার্যা ও পুত্রের সঙ্গে তাঁর কাছে আসলেন। তারপর রাজা পাদ্য, অর্ঘ্য ও আচমনীয় দ্বারা মুনিকে পূজা করলেন ও রাজ্যের সঙ্গে পুত্রটিকেও তাঁকে নিবেদন করলেন।
মহর্ষি চণ্ডকৌশিক সন্তুষ্ট চিত্তে রাজার পূজা গ্রহণ করে বললেন, “মহারাজ আমি দিব্যচক্ষু দ্বারা এই সমস্ত ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। আপনার পুত্র কেমন হবে, শুনুন। মহারাজ নদীর বেগ যেমন পর্বতকে পীড়া দিতে পারে না, তেমনই দেবগণের নিক্ষিপ্ত অস্ত্রেও এর কোনও পীড়া জন্মাতে পারবে না। এই বালক সকল রাজার শিরোমণি হবে এবং সূর্য যেমন জ্যোতিষ্কগণের প্রভাকে তিরোহিত করে, এও তেমনই সকল রাজার প্রভাবকে তিরোহিত করবে। পতঙ্গ যেমন আগুনে পুড়ে বিনষ্ট হয়, তেমনই প্রচুর বলশালী রাজারাও এর কবলে পড়ে বিনষ্ট হবেন। সমুদ্র যেমন বর্ষাকালে প্রভূত জলসম্পন্ন নদীগুলিকে গ্রহণ করে, এও তেমনই সকল রাজার সমস্ত সম্পত্তি গ্রহণ করবে। সমস্ত শস্যশালিনী বিশালা পৃথিবী যেমন মঙ্গল ও অমঙ্গল ধারণ করে, এই মহাবল জরাসন্ধও তেমনই চারবর্ণকে ধারণ (পালন) করবে। প্রাণীরা যেমন প্রাণবায়ুর আদেশবর্তী হয়, রাজারাও তেমনি এর আদেশবর্তী হবেন। এই জরাসন্ধ ভূমণ্ডলের মধ্যে প্রধান বলবান হবে এবং ত্রিপুরাসুর-হন্তা সংহারকর্তা মহাদেবকে প্রত্যক্ষ দেখতে পাবে।”
এই বলে মুনিশ্রেষ্ঠ চণ্ডকৌশিক নিজের কর্তব্য বিষয়ের চিন্তা করে রাজা বৃহদ্রথকে যথোচিত সম্মানের সঙ্গে বিদায় দিলেন। মগধরাজ বৃহদ্রথও তখন রাজধানীতে প্রবেশ করে, জ্ঞাতি ও বন্ধুগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে জরাসন্ধকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে অত্যন্ত আনন্দ লাভ করলেন। জরাসন্ধ রাজ্যে অভিষিক্ত হলে, রাজা বৃহদ্রথ পত্নীদ্বয়কে সঙ্গে নিয়ে তপোবনে গমন করলেন। পিতা ও মাতারা দুইজন তপোবনে অবস্থান করতে থাকলে, জরাসন্ধ নিজের বাহুবলে অন্যান্য রাজাকে বশীভূত করলেন। তারপর, দীর্ঘকাল অতীত হলে, রাজা বৃহদ্রথ তপোবনে থেকে তপস্যা করে ভার্যাদের সঙ্গে স্বর্গে গমন করলেন। জরাসন্ধও চণ্ডকৌশিক যেমন বলেছিলেন, সেই অনুসারে তাঁর বরদত্ত সমস্ত লাভ করে রাজ্য পালন করতে লাগলেন—
জরাসন্ধোহপি নৃপতির্যথোক্তং কৌশিকেন তৎ।
বর প্রদানমখিলং প্রাপ্য রাজ্যম্পালয়ৎ॥ সভা: ১৮: ১৯॥
*
দ্বাপরযুগে ভারতবর্ষের ক্ষত্রিয় সমাজ দুই অক্ষশক্তিতে বিভক্ত ছিলেন। একদিকে ছিলেন জরাসন্ধ, তাঁর জামাতা কংস, শিশুপাল, শাল্ব, নিষাদরাজ একলব্য ও ধৃতরাষ্ট্র পুত্র দুর্যোধন, অন্যদিকে ছিলেন যদুবংশীয়েরা—বৃষ্ণি, অন্ধক, ভোজ। এঁরা আশ্রয় করেছিলেন পাণ্ডুপুত্র ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে। দ্বিতীয় পক্ষের যোদ্ধারা ধর্মপরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ। কৃষ্ণ এঁদের নেতা ছিলেন। জরাসন্ধ অত্যন্ত বলশালী, ক্ষমতাবান ব্যক্তি ছিলেন। মহাভারত পাঠ করলে জানা যায় একমাত্র কর্ণ বাহুবলে জরাসন্ধকে পরাজিত করেন এবং জরাসন্ধ সন্ধি করতে বাধ্য হন। কৃষ্ণ জরাসন্ধের জন্মরহস্য জানতেন। তাই অযুত হস্তীর শক্তিসম্পন্ন ভীমসেন ও অর্জুনকে নিয়ে তিনি জরাসন্ধ বধ অভিযানে যাত্রা করলেন।
২৮
জরাসন্ধ-বধ
(মহারাজ যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করার বিষয়ে চূড়ান্ত কর্তব্য স্থির করার জন্য কৃষ্ণকে দ্বারকা থেকে আমন্ত্রণ জানালেন। কৃষ্ণ ইন্দ্রপ্রস্থে উপস্থিত হলে যুধিষ্ঠির তাঁর কাছে রাজসূয় যজ্ঞ করার বিষয়ে সুবিধা-অসুবিধা জানতে চাইলেন। কৃষ্ণ জানালেন, জরাসন্ধ জীবিত থাকতে যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করতে পারবেন না। যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে কৃষ্ণ জানালেন যে, জরাসন্ধ এবং তাঁর দুই অনুগত রাজা হংস ও ডিম্বক, ত্রিভুবনজয়ী বীর। সম্মুখযুদ্ধে তাঁদের পরাস্ত করা অসম্ভব। যুধিষ্ঠির জরাসন্ধ সম্পর্কে বৃত্তান্ত জানতে চাইলে, কৃষ্ণ জরারাক্ষসী কর্তৃক দ্বিখণ্ডিতদেহী শিশুর দেহ সংযোজনের কাহিনি জানালেন। চণ্ডকৌশিক মুনির বরদানের ফলে জরাসন্ধের জন্ম এবং তাঁর বরদানের ফলেই জরাসন্ধের প্রবল বিক্রম। ভীম ও অর্জুন জরাসন্ধকে বধ করে রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত করতে চাইলেন। কৃষ্ণ ও তাঁদের মতের অনুকুলেই মত প্রদান করলেন। কৃষ্ণ জরাসন্ধের বধের উপায় আলোচনা করলেন)। জরাসন্ধ সম্পর্কে যাদবদের শত্রুতা প্রসঙ্গে কৃষ্ণ বললেন—
হতা চৈব ময়া কংসে সহংসডিম্বকে তদা।
জাতো বৈ বৈরনিৰ্বন্ধো ময়াসীত্তত্র ভারত॥ সভা : ১৮: ২০।।
“এদিকে আমি হংস ও ডিম্বকের সঙ্গে কংসকে বধ করলে, আমার সঙ্গে জরাসন্ধের গুরুতর শত্রুতা জন্ম নিল।”
“সেই শত্রুতাবশত বলবান জরাসন্ধ নিরানব্বইবার ঘূর্ণিত করে তাঁর গিরিব্ৰজনগর থেকে একটি গদা নিক্ষেপ করেন। মথুরাবাসী অদ্ভুতকর্মা সমস্ত লোকের বিনাশের জন্য নিক্ষিপ্ত সেই অমঙ্গলকারিণী গদাটা গিয়ে নিরানব্বই যোজন দূরে পতিত হয়। তখন মথুরাবাসী সেই গদাটিকে ভাল করে দেখে আমার কাছে গিয়ে বলে। মথুরার নিকটবর্তী সেই স্থানটি ‘গদাবসান’ নমে বিখ্যাত হয়। অস্ত্ৰদ্বারা অবধ্য হংস ও ডিম্বক জরাসন্ধের শ্রেষ্ঠ সহায় ছিল। মন্ত্রণাবিষয়ে তারা দুজন বুদ্ধিমানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং নীতিশাস্ত্রে বিশারদ ছিল। জরাসন্ধ, হংস ও ডিম্বক—এই তিনজন একত্রে ত্রিভুবন বিধ্বস্ত করতে পারত। মহারাজ ! ‘প্রবলের সঙ্গে যুদ্ধ করবে না’ এই নীতি অনুসরণ করেই কুকুর, অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়েরা জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধকে এড়িয়ে চলেছেন।
‘মহারাজ হংস ও ডিম্বক মরেছে, সহায় সম্পদের সঙ্গে কংসকেও বধ করেছি। সুতরাং জরাসন্ধকেও বধ করার সময় উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু সম্মুখযুদ্ধে দেবাসুর সকলে মিলেও জরাসন্ধকে বধ করতে পারবে না। আমার ধারণা, একমাত্র দৈহিকবলেই জরাসন্ধকে বধ করতে হবে। আমাতে কৌশল আর ভীমে বল আছে, আর অর্জুন আমাদের রক্ষা করবেন; এই বলে, দক্ষিণাগ্নি, গার্হপত্য ও আঙ্গুনীয়—এই তিন অগ্নি যেমন যজ্ঞ সম্পন্ন করে, সেই রকম আমরা তিনজন জরাসন্ধকে বধ করতে পারব। আমার বা অর্জুনের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করায় জরাসন্ধের অপমান; কারণ তিনি বাহুবলে দর্পিত; অতএব নিশ্চয়ই তিনি মল্লযুদ্ধের জন্য ভীমের সঙ্গেই মিলিত হবেন। তখন, যম যেমন পূর্ণতাপ্রাপ্ত লোককে সংহার করতে সমর্থ হন, তেমনই মহাবাহু ও মহাবল ভীমসেনও তাঁকে সংহার করতে সমর্থ হবেন। অতএব, আপনি যদি আমার মনের ভাব জেনে থাকেন, আর আমার প্রতি বিশ্বাস থাকে, তবে অবিলম্বে আমার কাছে ভীম ও অর্জুনকে গচ্ছিত রাখুন।”
যুধিষ্ঠির বললেন, “কৃষ্ণ ! কৃষ্ণ ! শত্রুনাশক! তুমি একথা বোলো না, একথা বোলো না তুমি। কারণ, তুমি পাণ্ডবদের প্রভু; আর আমরা তোমার আশ্রিত। কৃষ্ণ তুমি যা বললে, সে সবই সঙ্গত। লক্ষ্মী যাদের প্রতি বিমুখ, তুমি তাদের কাছে থাকো না। আমার বিশ্বাস, আমরা তোমার আদেশের অধীনে আছি বলে জরাসন্ধও নিহত হয়েছেন, রাজারাও মুক্তিলাভ করেছেন, আমার রাজসূয় যজ্ঞও সম্পন্ন হয়েছে। হে জগন্নাথ ! হে নরোত্তম ! যাতে শীঘ্র এই কাজ সম্পন্ন হয়, তুমি সাবধান হয়ে তার ব্যবস্থা করো।
“কারণ, ধর্ম, অর্থ ও কামরহিত দরিদ্র রোগাৰ্ত লোকের মতো আমি তোমাদের তিনজনকে ছাড়া জীবন ধারণ করতে পারব না। অর্জুন কৃষ্ণ ছাড়া নন, কৃষ্ণও অর্জুন ছাড়া নন এবং জগতে কৃষ্ণার্জুনের অজেয় কেউ নেই। বলিশ্রেষ্ঠ, সুন্দর মূর্তি, যশস্বী এবং বীর ভীমসেনও তোমাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কোন কার্য সাধন করতে না পারেন। কারণ, বিচক্ষণ নায়ক পরিচালিত সৈন্যগণ উত্তম কার্য করতে পারে, না হলে সে সৈন্য অন্ধ বা জড়ের মতো হয়ে পড়ে। বিচক্ষণ লোকেরাই সৈন্য পরিচালনা করবেন। নিচু স্থান থেকেই ধীবরেরা জল নিয়ে থাকে অথবা যেখানে ছিদ্র থাকে, সেখান থেকেও তারা জল গ্রহণ করে। সেইজন্যই আমরা জগদ্বিখ্যাত কৌশলপ্রয়োগে অভিজ্ঞ পুরুষ কৃষ্ণকে অবলম্বন করে কার্যসিদ্ধির জন্য চেষ্টা করছি। এবং কৃষ্ণের বল, বুদ্ধি, কৌশল, অধ্যবসায় ও উপায়সমন্বিত গুণের উপর নির্ভর করেই আমরা কার্যে প্রবৃত্ত হয়েছি। কার্যসিদ্ধির জন্য অর্জুন কৃষ্ণের পিছনে এবং ভীম অর্জুনের পিছনে যান, এইভাবে গিয়ে বিক্রম প্রকাশ করতে পারলে, নিশ্চয়ই নীতি, জয় ও বল—এরা কার্যসিদ্ধি করতে পারবে।”
যুধিষ্ঠির এই কথা বললে, অসাধারণ তেজস্বী কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন—এই তিন ভ্রাতা তেজস্বী গৃহস্থ ব্রাহ্মণের পরিচ্ছদ ধারণ করে এবং বন্ধুদের উৎসাহজনক শুভেচ্ছা নিয়ে মগধ রাজ্যের দিকে যাত্রা করলেন। অসাধারণ তেজস্বী সেই তিনজনের শরীরই ক্রোধে উত্তপ্ত এবং জরাসন্ধ কর্তৃক অবরুদ্ধ রাজাদের উদ্ধারের জন্য চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নির ন্যায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল। সেই সময়ে একটি মাত্র কার্যসিদ্ধিই তাঁদের লক্ষ্য ছিল এবং চিরদিনই যুদ্ধে অপরাজিত কৃষ্ণ ও অর্জুনকে ভীমের অগ্রবর্তী দেখে সেই স্থানের লোকেরা জরাসন্ধকে নিহত বলেই মনে করতে লাগল। কারণ, সেই দুই মহাত্মা জগতের সমস্ত কার্যের প্রযোজক এবং ধর্ম, অর্থ, কামপরায়ণ সকল লোকের প্রবর্তক ঈশ্বর ছিলেন।
তাঁরা তিনজন কুরুদেশ থেকে যাত্রা করে, কুরুজাঙ্গলের মধ্য দিয়ে, মনোহর পদ্ম সরোবরে গমন করে, কালকূট দেশ অতিক্রম করে, ক্রমশ গণ্ডকী নদী, মহাশোন নদ, সদানীরা নদী এবং এক পর্বতক দেশের সব নদী পার হয়ে চলতে লাগলেন। তারপর তাঁরা মনোহর সরযু নদী পার হয়ে, পূর্ব কোশলদেশ দেখে, চর্মম্বতী নদী অতিক্রম করে মিথিলা নগরে গমন করলেন।
ব্রাহ্মণের পোশাকধারী মহাশৌর্যশালী কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন সেখান থেকে পূর্বমুখে গিয়ে, গঙ্গানদী ও শোণনদ অতিক্রম করে মগধদেশে উপস্থিত হলেন। তখন তাঁরা সর্বদা গোধনে পরিপূর্ণ, বহুতর জলাশয়-সম্পন্ন এবং মঙ্গলকর বৃক্ষসমাকীর্ণ গোরথ পর্বতে উপস্থিত হয়ে মগধ রাজধানী দেখতে পেলেন।
কৃষ্ণ বললেন, “অৰ্জুন এই সর্বমঙ্গলময় বিশাল মগধ রাজধানী শোভা পাচ্ছে। এখানে প্রচুর পশু আছে, সর্বদা জল থাকে এবং সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা রয়েছে; কিন্তু কোনও রোগ পীড়া নেই। বৈহার, বিপুল, বরাহ, বৃষভ এবং চৈত্যক নামে পাঁচটি মঙ্গলজনক পর্বত ওই দেখা যাচ্ছে। ওই পর্বতগুলিতে বিশাল বিশাল শৃঙ্গ ও অজস্র শীতল বৃক্ষ আছে এবং ওই পর্বতগুলি পরস্পর গায়ে গায়ে সংলগ্নভাবে গিরিব্রজ নামে ওই রাজধানীটিকে যেন রক্ষা করছে। পুষ্পপরিপূর্ণ, সৌরভসম্পন্ন ও কামীজনপ্রিয় মনোহর লৌধ্রবৃক্ষের বন যেন এই পর্বতগুলিকে লুকিয়ে রেখেছে। এইখানে নিয়তব্রতচারী দীর্ঘতমা মুনি ঔশীনরীনাম্নী শূদ্রার গর্ভে কাক্ষীবান প্রভৃতি পুত্রগণকে উৎপাদন করেছিলেন। দীর্ঘতমা মুনি সেই আশ্রমে থেকে সস্নেহ দৃষ্টিতে মগধবংশকে পর্যবেক্ষণ করতেন। মহাবল অঙ্গ বঙ্গ প্রভৃতি রাজপুত্রগণ দীর্ঘতমার আশ্রমে এসে খেলা করতেন। অর্জুন দীর্ঘতমা আশ্রমের নিকটবর্তী অশ্বত্থ ও লোধ্রবৃক্ষের এই মনোহর ও কল্যাণকারী বড়শ্রেণিগুলি দর্শন করো। এর কাছে শত্রুতাপক অর্বুদ নাগ, শত্ৰুকাপী নাগ, স্বস্তিক নাগ, মণি নাগের উত্তম ভবন আছে। বিধাতা মগধ রাজ্যটিকে মেঘের অপরিহার্য করে সৃষ্টি করেছেন এবং চণ্ডকৌশিক মুনি এবং মণিমান মুনিও এই দেশের উপর অনুগ্রহ করতেন। জরাসন্ধ এমন মনোহর ও সর্বপ্রকার দুর্ধর্ষ রাজধানী পেয়ে তাঁর সকল স্বার্থসিদ্ধি হবে মনে করে থাকেন; কিন্তু আজ আমরা আক্রমণ করে তাঁর দর্প চূর্ণ করব।”
তখন মহাতেজা কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন—এঁরা সকলে মিলে সেই মগধ রাজধানীর দিকে অগ্রসর হলেন। তাঁরা চারপাশে স্বাস্থ্যবান মানুষ, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি চারবর্ণ পরিপূর্ণ, সর্বদা মহোৎসবসম্পন্ন এবং দুর্ধর্ষ গিরিব্রজনগরে উপস্থিত হলেন। তারপর তাঁরা একটি উঁচু পর্বতে উঠলেন; সেটি নগরের দ্বার নয়; কিন্তু বৃহদ্রথরাজার জ্ঞাতিরা এবং নগরবাসীরা সে পর্বতটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখত; মগধবাসীদের সেই মনোহর চৈত্যক পাহাড়ের মধ্যে তাঁরা প্রবেশ করলেন। এই পর্বতে মাংসভোজী এবং বৃষরূপধারী এক রাক্ষসকে রাজা বৃহদ্রথ বধ করেছিলেন এবং তার চর্ম ও নাড়ি দ্বারা তিনটি ভেরি নির্মাণ করেছিলেন। দিব্য পুষ্পভূষিত সেই ভেরি তিনটি শব্দ করত; জরাসন্ধকে বধ করার জন্য কৃষ্ণ, ভীম, অর্জুন মগধবাসীদের মাথায় আঘাত করেই যেন সেই চৈত্যক পর্বতে আরোহণ করলেন। সেই চৈত্যক পর্বতের একটি পুরাতন শৃঙ্গ ছিল—তা ছিল নিশ্চল, স্থূল, দীর্ঘ এবং সুরক্ষিত। আর, নগরবাসীরা গন্ধমাল্য দ্বারা সর্বদাই সেটিকে সাজিয়ে রাখত। কিন্তু তিন বীর বিশাল বাহু দ্বারা আকর্ষণ করে তা নিপাতিত করলেন। তারপর তাঁরা অতিশয় আনন্দিত চিত্তে নগরে প্রবেশ করলেন।
এই সময়ে প্রতাপশালী জরাসন্ধ রাজা কোনও যজ্ঞে প্রবৃত্ত হয়ে ব্রহ্মচর্য এবং উপবাসে কৃশ ছিলেন। স্নাতক ব্রাহ্মণবেশধারী কৃষ্ণ, ভীম, অর্জুন অন্য অস্ত্র ত্যাগ করে বাহুবল দ্বারা জরাসন্ধকে বধ করার ইচ্ছায় প্রবেশ করলেন। পথে তাঁরা সুসজ্জিত, সুঅলংকৃত, খাদ্য ও মাল্যে পরিপূর্ণ দোকানগুলির অপূর্ব সৌন্দর্য দেখতে লাগলেন। মনুষ্যশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন পথে একজন মালির কাছ থেকে মালা ও অঙ্গরাগ গ্রহণ করে, আপন আপন বস্ত্র রঞ্জিত করে মালা পরিধান করলেন এবং কুণ্ডলগুলি পরিষ্কার করলেন। হিমালয়জাত সিংহেরা যেমন গোষ্ঠের দিকে দৃষ্টিপাত করে, তেমনই জরাসন্ধভবনের দিকে দৃষ্টিপাত করে সেদিকে যাত্রা করলেন। বাহুবলশালী কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুনের শালস্তম্ভতুল্য বাহুগুলি চন্দন ও অগরু দ্বারা রঞ্জিত হয়ে শোভা পেতে লাগল। হস্তীর তুল্য বলবান, শালবৃক্ষের তুল্য উন্নত এবং বিশালবক্ষা কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুনকে দেখে নগরবাসী বিস্মিত হল। তাঁরা জনাকীর্ণ তিনটি মহল অতিক্রম করে, নিরুদ্বেগে সগর্বে গিয়ে রাজার কাছে উপস্থিত হলেন।
জরাসন্ধ রাজা গাত্রোত্থান করে যথাবিধানে তাঁদের সম্মান করলেন, পাদ্য, মধুপর্ক ও গোদান করে বললেন, “আপনাদের শুভাগমন হোক।” জরাসন্ধের নিয়ম ছিল, তিনি মহাবল-পরাক্রমশালী ও যুদ্ধবিজয়ী হলেও স্নাতক ব্রাহ্মণ এসেছেন শুনলে মধ্যরাত্রেও তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। সেদিনও জরাসন্ধ আগত কৃষ্ণ, ভীমার্জুনকে তাঁদের বেশভূষার অপূর্বত্ব দেখেও সম্মান জানিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
নরশ্রেষ্ঠ ও শত্ৰুহন্তা কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন রাজা জরাসন্ধকে অভিবাদন করে বললেন, আপনার মঙ্গল হোক। এই কথা বলে তাঁরা পরস্পর দৃষ্টিবিনিময় করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন জরাসন্ধ কপটব্রাহ্মণবেশধারী কৃষ্ণপ্রভৃতিকে উপবেশন করতে অনুরোধ করলেন। উজ্জ্বলকান্তি তিনটি অগ্নির মতো তাঁরা উপবেশন করলে ব্রাহ্মণবেশধারী কিন্তু বিকৃতদেহী কৃষ্ণপ্রভৃতিকে যেন নিন্দা করতেই জরাসন্ধ বললেন, “মহাশয়গণ, আমি সুস্পষ্টভাবে জানি, স্নাতক ব্রাহ্মণেরা বাইরে মালা বা অনুলেপন ধারণ করেন না। আপনারা মালা পরেছেন, অথচ জ্যাঘাতকঠিন বাহুতে ক্ষত্রিয়ের তেজও বহন করছেন, আবার বেশ দ্বারা ব্রাহ্মণের আকার গ্রহণ করেছেন, অতএব সত্য করেই বলুন আপনারা কে ? রাজার কাছে সত্য কথাই বলা ভাল। আপনারা চৈত্যক পর্বতের শৃঙ্গ-ভগ্ন করায় রাজার কাছে অপরাধ করেছেন অথচ নির্ভয়ে পার্শ্বদ্বার দিয়ে কেন এখানে প্রবেশ করেছেন ? ব্রাহ্মণের বল বাক্যে, অথচ আপনাদের কাজ ক্ষত্রিয়ের, এ বিষয়ে আপনাদের বক্তব্য আমাকে বলুন। আমি যথাবিধানে আপনাদের পূজা করেছি, অথচ সে পূজা আপনারা গ্রহণ করেননি। আপনারা কী কারণে এখানে এসেছেন ?”
তখন মহামনা ও বাক্যবিশারদ কৃষ্ণ স্নিগ্ধগম্ভীর স্বরে জরাসন্ধকে বললেন, “মহারাজ আপনি আমাদের স্নাতক ব্রাহ্মণ বলে মনে করেছেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য—এই তিন জাতিই স্নাতকব্রতাবলম্বী হতে পারেন। এই তিন জাতিরই আবার বিশেষ এবং অবিশেষ— এই দুই নিয়মই প্রচলিত আছে। বিশেষ নিয়মশালী ক্ষত্রিয় সর্বদাই সম্পদ লাভ করে থাকেন। আবার যাঁরা মাল্যধারণ করেন, তাঁরা অবশ্যই সম্পদশালী হয়ে থাকেন। সেই কারণেই আমরা মাল্য ধারণ করেছি। আবার ক্ষত্রিয়েরা বাহুবলে বলীয়ান হন, বাক্যবলে নয়। হে বৃহদ্রথনন্দন ! এই কারণে, আমরা ক্ষত্রিয়সুলভ অপ্রগল্ভ বাক্য বলেছি। বিধাতা ক্ষত্রিয়ের বাহুতে বল দিয়েছেন। আপনি যদি দেখতে চান, তা অবশ্যই আজ দেখতে পাবেন। বুদ্ধিমান লোকেরা অদ্বার, গুপ্তদ্বার, পার্শ্বদ্বার দিয়ে শত্রুর কক্ষে প্রবেশ করেন। সম্মুখ দ্বার দিয়ে মিত্রের ঘরে প্রবেশ করেন। এই কারণেই আমরা সম্মুখ দ্বার দিয়ে আপনার গৃহে প্রবেশ করিনি। আমরা বিশেষ প্রয়োজনেই আপনার গৃহে প্রবেশ করেছি, কিন্তু আপনি শত্রু বলে আপনার পূজা গ্রহণ করিনি।”
জরাসন্ধ বললেন, “মহাশয়, আমি আপনাদের সঙ্গে কখনও শত্রুতা করেছি, একথা মনে করতে পারছি না, কিংবা আপনাদের কোনও অপকার করেছি, তাও স্মরণ করতে পারছি না। আপনাদের যদি কোনও অপকার না করে থাকি, তবে আমি নিরপরাধ। আপনারা আমাকে শত্রু বলে মনে করছেন কেন ? হে ব্রাহ্মণগণ এই বিষয়গুলি সত্য করে আমাকে বলুন; কারণ, সত্য বলা সজ্জনের নিয়ম। বিনা কারণে স্বার্থ বা ধর্মের ব্যাঘাত করলে মন অত্যন্ত সন্তপ্ত হয়। আমি নিরপরাধ অথচ আপনারা আমার উপর অপরাধের আরোপ করছেন। সুতরাং আপনি ক্ষত্রিয়, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যে ক্ষত্রিয় ধর্মজ্ঞ হয়ে জগতে মিথ্যা ব্যবহার করে, সে পরলোকে নরকগামী হয় এবং ইহলোকেও তার অত্যন্ত অমঙ্গল হয়। সাধুলোকের মতে ক্ষত্রিয়ধর্মই ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং যাঁরা ধর্মজ্ঞ, তাঁরাও অন্য ধর্মের তত প্রশংসা করেন না। আমি সংযতচিত্তে স্বধর্মে আছি; সুতরাং আমি নিরপরাধ। তবুও আপনারা আমার উপরে অপরাধ করে আমাকেই দোষী করতে চাইছেন।”
কৃষ্ণ বললেন, “মহারাজ, ক্ষত্রিয় সমাজের মধ্যে কোনও এক ধুরন্ধর ব্যক্তি ক্ষত্রিয়সমাজের কর্তব্যভার বহন করছেন। আমরা তাঁরই আদেশে আপনাকে শাসন করতে এসেছি। রাজা তুমি মর্তবাসী ক্ষত্রিয়গণকে এনে আবদ্ধ করে রেখেছ। নিষ্ঠুরভাবে সেই কাজ করেও তুমি নিজেকে নিরপরাধ বলছ কীভাবে ? রাজা কীভাবে সৎস্বভাবসম্পন্ন রাজগণকে হত্যা করতে পারেন ? কিন্তু তুমি সেই রাজগণকে নিগৃহীত করে রুদ্রকে উপহার দিতে চাইছ। জরাসন্ধ তোমার কৃত সেই পাপ আমাদেরও স্পর্শ করেছে। আমরা মনুষ্যচ্ছেদন কখনও দেখিনি; তুমি সেই মনুষ্যচ্ছেদন করে কীভাবে মহাদেবের পূজা করবার ইচ্ছা করছ ? কী আশ্চর্য ! তুমি ক্ষত্রিয় হয়ে ক্ষত্রিয়দের পশুসংজ্ঞা দেবে ! জরাসন্ধ তুমি দুর্বুদ্ধি, তোমার মতো দুর্বুদ্ধি আর কেউ নেই। যে লোক যেমন কাজ করে, সে তেমন ফলভোগ করে। রাজা হয়েও তুমি ক্ষত্রিয়দের ক্ষয় করছ; আর আমরা তাদের রক্ষা করে থাকি; তাদের রক্ষা করার জন্যই আমরা এখানে এসেছি। আপনি মনে করেন, জগতে আপনি ভিন্ন ক্ষত্রিয় নেই, কিন্তু আপনার সে ধারণাও ভুল। নিজেকে ক্ষত্রিয় জেনে কোন ক্ষত্রিয় পুরুষ যুদ্ধের অন্তে অবিনশ্বর ও অতুলনীয় স্বর্গের ইচ্ছা না করে ? আপনার জানা দরকার, ক্ষত্রিয়েরা স্বর্গ উদ্দেশ্য করেই যুদ্ধযজ্ঞে দীক্ষিত হন এবং অনন্ত স্বর্গলাভের অধিকারী হন। পরব্রহ্ম উপাসনা স্বর্গের কারণ; সৎ কার্য স্বর্গের কারণ; তপস্যাও স্বর্গের কারণ; কিন্তু ক্ষত্রিয়ের মৃত্যু নিশ্চিত স্বর্গের কারণ। ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধে মৃত্যু—সর্বদা সর্বগুণসম্পন্ন ইন্দ্ৰপালিত বৈজয়ন্তধাম লাভের কারণ। দেবরাজ ইন্দ্র স্বয়ং যুদ্ধ করে অসুরগণকে পরাভূত করে জগৎ শাসন করছেন। অতএব রাজা, আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা আপনার পক্ষে স্বর্গলাভের কারণ হচ্ছে, এমন ভাগ্য ক’জনের হয় ? বিপুল মগধসৈন্যের বলে গর্বিত হয়ে আপনি অন্য ক্ষত্রিয়দের অবজ্ঞা করেন। প্রত্যেক মানুষেরই বল আছে; তবে কারও বল আপনার সমান, কারও বা আপনার থেকে অধিক। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের বল আপনি না বুঝছেন, ততক্ষণই আপনার গর্ব আছে। আপনি সজাতীয়দের উপরেই অহংকার ও গর্ব ত্যাগ করুন; পুত্র, অমাত্য ও সৈন্যদের সঙ্গে যমালয়ে যাবেন না। দম্ভোদ্ভব, কার্তবীর্যাজুন, মরুত্ত ও বৃহদ্রথ—এই চারজন রাজাই শ্রেষ্ঠ লোকেদের অবজ্ঞা করে সৈন্য-সামন্তগণের সঙ্গে বিনষ্ট হয়েছিলেন। আমরা নিশ্চয়ই ব্রাহ্মণ নই; আমি বসুদেবনন্দন কৃষ্ণ, আর ওঁরা মনুষ্যশ্রেষ্ঠ পাণ্ডুর পুত্র। আমরা আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতেই এসেছি। মগধরাজ ! আমরা আপনাকে আহ্বান করছি; আপনি স্থির হয়ে যুদ্ধ করুন। হয়, আপনি সমস্ত রাজাকে ছেড়ে দিন, না হয় যমালয়ে গমন করুন।”
জরাসন্ধ বললেন, ‘কৃষ্ণ আমি জয় না করে কোনও রাজাকে ধরে আনিনি। আর, আমি জয় করিনি এমন অজেয় রাজা পৃথিবীতে কে আছেন ? মুনিরা বলেন যে, ক্ষত্রিয়ের আদর্শ ধর্ম হল বিক্রমপ্রকাশ করে বশে নিয়ে এসে ইচ্ছানুসারে আচরণ করবে। কৃষ্ণ আমি দেবপূজার জন্য ক্ষত্রিয় রাজাদের নিয়ে এসে, এখন ভয়ে তাঁদের ত্যাগ করতে পারি না। আমি সৈন্যব্যুহ নিয়ে তোমাদের সৈনাব্যুহের সঙ্গে যুদ্ধ করব। অথবা একাকী তোমাদের একজন বা দুজন বা তিনজনের সঙ্গে একসঙ্গে যুদ্ধ করব।”
জরাসন্ধ এই কথা বলে, পাছে কোনও অঘটন ঘটে, তাই তখনই পুত্র সহদেবকে রাজপদে অভিষিক্ত করলেন এবং কৃষ্ণ প্রভৃতির সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। যুদ্ধের প্রারম্ভে জরাসন্ধ তাঁর দুই সেনাপতি হংস ও ডিম্বক, যাঁদের অন্য নাম ছিল কৌশিক ও চিত্রসেন এবং কৃষ্ণের হাতে নিহত হয়েছিলেন—সেই দুই প্রিয় সেনাপতিকে স্মরণ করলেন। তখন বলরামের কনিষ্ঠ ভ্রাতা, সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান, সত্যপ্রতিজ্ঞ, জগদীশ্বর, মধু নাম দৈত্যহন্তা কৃষ্ণ, বলবান-শ্রেষ্ঠ, সিংহের তুল্য বলশালী, ভয়ংকর পরাক্রমশালী জরাসন্ধকে যাদবদের অবধ্য বলে মনে করে, অন্যের ভাগ স্মরণ করে, ব্রহ্মার আদেশের গৌরব রক্ষা করে নিজে জরাসন্ধকে বধ করতে পারলেন না।
তখন কৃষ্ণ যুদ্ধের জন্য কৃতনিশ্চয় জরাসন্ধকে বললেন, “জরাসন্ধ তুমি কার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাও ? কে যুদ্ধের জন্য সজ্জিত হবে?” কৃষ্ণের প্রশ্নের উত্তরে জরাসন্ধ বলবান শ্রেষ্ঠ ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইলেন। তখন পুরোহিত, গোরোচনা, পুষ্পমাল্য ও অন্যান্য মাঙ্গলিক দ্রব্য নিয়ে; বলকর ঔষধ, স্বাস্থ্যজনক ঔষধ ও চৈতন্যরক্ষক ঔষধ নিয়ে, যুদ্ধার্থী জরাসন্ধের কাছে উপস্থিত হলেন। একজন যশস্বী ব্রাহ্মণ জরাসন্ধের জন্য স্বস্ত্যয়ন করলে, তিনি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম স্মরণ করে যুদ্ধসজ্জা করতে লাগলেন। মাথার কিরীট পরিত্যাগ করে দৃঢ়ভাবে বেশবন্ধন করলেন এবং তীর অতিক্রমে সমর্থ সমুদ্রের মতো উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ভয়ংকর পরাক্রমশালী ও বুদ্ধিমান জরাসন্ধ ভীমসেনকে বললেন, “ভীম আমি তোমার সঙ্গেই যুদ্ধ করব। কারণ, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ও ভাল।”
তারপর বাহুমাত্র শস্ত্রধারী, মহাবীর ও মনুষ্যশ্রেষ্ঠ ভীম ও জরাসন্ধ জয়াকাঙক্ষী হয়ে পরমানন্দিত হয়ে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হলেন। পূর্বকালে বল নামে অসুর যেমন ইন্দ্রের দিকে ধাবিত হয়েছিলেন, তেমনই মহাতেজা জরাসন্ধ শত্রুদমনকারী ভীমের প্রতি ধাবিত হলেন। জরাসন্ধকে আক্রমণে উদ্যত দেখে, ভীমও কৃষ্ণের সঙ্গে পরামর্শ করে, কৃষ্ণ কর্তৃক স্বস্ত্যয়ন ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে জরাসন্ধের দিকে ধাবিত হলেন। তারপর তাঁরা পরস্পরের হাত ধরে, পা দিয়ে একে অপরকে বেষ্টন করে, পরস্পরের পিঠে ভয়ংকর আঘাত করতে লাগলেন। সেই আঘাতের শব্দে প্রকোষ্ঠটি কাঁপতে লাগল। তাঁরা বাহুদ্বারা পরস্পরের স্কন্ধে আঘাত করে বারবার সমস্ত অঙ্গ কম্পিত করলেন, আবার অঙ্গ দ্বারা সেই অঙ্গ আলিঙ্গন করে পরস্পরকে নাড়াতে লাগলেন। তারপর তাঁরা বাহুমূল বেষ্টন করে কণ্ঠ এবং গণ্ডদেশে প্রচণ্ড আঘাত করতে লাগলেন, আঘাতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ঠিকরে পড়তে লাগল এবং বজ্রপাতের মতো শব্দ হতে লাগল। পরে, তাঁরা দুজনেই পরস্পরের বাহুবেষ্টন করে দুজনের মস্তকেই প্রচণ্ড পদাঘাত করলেন; তারপর হাত দু’খানিকে চক্রের মতো ও পূর্ণকুম্ভের মতো করে পরস্পরের বক্ষে আঘাত করলেন। তাঁরা দুটি হস্তীর মতো পরস্পরকে আঘাত করলেন; মেঘের মতো গর্জন করে পরস্পরকে চপেটাঘাত করলেন। দুটি সিংহের মতো চোখ স্থির করে, পরস্পরকে আকর্ষণ করতে লাগলেন। ক্রমে তাঁরা অঙ্গ ও বাহু দ্বারা পরস্পরের অঙ্গে আঘাত করে, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উভয়ের উদরে উভয়েই ভয়ংকর আঘাত করতে লাগলেন। তারপর মল্লযুদ্ধে অত্যন্ত শিক্ষিত ভীম ও জরাসন্ধ বিহ্বলের মতো হস্ত দ্বারা পরস্পর পরস্পরের কটি, স্কন্ধ, পার্শ্ব ও অণ্ডকোষে আঘাত করলেন এবং আপন আপন কণ্ঠে আঘাত নিবারণের জন্য বাহু দ্বারা তা আবৃত করলেন। তখন তাঁরা দুটি সুচের মতো দু’খানি বাহুকে সম্মিলিত করে তা দিয়ে পূর্ণচক্র, তূর্ণপীড়, কাল, মুষ্টি ও পূর্ণযোগবন্ধ করলেন। জরাসন্ধ ও ভীমের ভয়ংকর যুদ্ধ দেখতে সমস্ত পুরবাসী সেই স্থানে উপস্থিত হলেন।
সমস্ত স্থান থেকে সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, স্ত্রীলোক ও বৃদ্ধসকল এসে উপস্থিত হতে লাগল। জনসমূহে পরিপূর্ণ হয়ে সে স্থানটা একেবারে রন্ধ্রশূন্য হয়ে গেল।
তারপর তাঁদের হস্তাঘাতে, হাঁটুর উপর একে অপরকে ফেলে আঘাত করায় এবং চিত করে ফেলবার চেষ্টা করায় বজ্র ও পর্বতের সংঘর্ষের মতো দারুণ সংঘর্ষ হতে লাগল। বলিশ্রেষ্ঠ ভীম ও জরাসন্ধ পরস্পরকে জয় করার অভিলাষে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে পরস্পরের ফাঁক খুঁজতে লাগলেন। পূর্বকালে ইন্দ্র এবং বৃত্রাসুরে যেমন ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল, সেইরকম জনসমূহকে সরিয়ে দেবার পর ভীম ও জরাসন্ধের ভয়ংকর যুদ্ধ হতে থাকল। দূরে ছুড়ে ফেলা, সামনে টেনে আনা, বাঁদিকে ফেলা, ডানদিকে ফেলা—এইভাবে তাঁরা পরস্পরকে টানতে লাগলেন, জানু দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন। বিশালবক্ষা, লম্বিতবাহু এবং বাহুযুদ্ধ নিপুণ দুই যোদ্ধা ভয়ংকর কণ্ঠস্বরে পরস্পরকে ভর্ৎসনা করতে করতে পাষাণতুল্য প্রহার করতে লাগলেন। চারখানা লোহানির্মিত পরিঘের মতো চারখানি হাত পরস্পরকে আঘাত করতে লাগল।
সৌর কার্তিক মাসের প্রথমদিনে সেই যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে অনাহারে এবং অবিশ্রান্তভাবে দিবারাত্র চলেছিল। ত্রয়োদশী তিথিতে যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল; কিন্তু চতুর্দশীর দিন রাত্রে জরাসন্ধের মধ্যে ক্লান্তি দেখা দিল। তাঁর যেন আর প্রত্যাঘাত করার ক্ষমতাও ছিল না। তখন কৃষ্ণ জরাসন্ধকে ক্লান্ত দেখে ভীমকর্মা ভীমসেনকে কর্তব্য বোঝাতেই যেন বললেন, “হে কুন্তীনন্দন, যুদ্ধে ক্লান্ত শত্রুকে পীড়ন করার জন্য ধরা উচিত নয়। কেন না, সর্বপ্রকারে পীড়ন করলে ক্লান্ত ব্যক্তি জীবন পরিত্যাগ করে। অতএব যত্নপূর্বক আপনি রাজাকে পীড়ন করবেন; আপনি বাহুযুগলদ্বারা কোমলভাবে এঁর সঙ্গে যুদ্ধ করুন।” ভীম কৃষ্ণের ইঙ্গিত বুঝে, অধিক উদ্যমে জরাসন্ধকে ধরলেন। তারপর ভীমসেন জরাসন্ধকে বধ করবার জন্য কৃষ্ণকে বললেন, “যদুশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ, এই জরাসন্ধ তোমার বন্ধুদের অনেককেই হত্যা করেছে। অতএব এ অনুগ্রহ অযোগ্য।” তখন কৃষ্ণ জরাসন্ধকে বধ করবার জন্য ভীমকে ত্বরান্বিত করার জন্য বললেন, “মধ্যম পাণ্ডব, দৈববশত আপনি যে অসাধারণ বলের অধিকারী, পিতা বায়ুর কাছ থেকে যে বল পেয়েছেন, এখনই জরাসন্ধের উপর তা প্রয়োগ করুন।”
কৃষ্ণ একথা বললে, শত্রুহন্তা ভীম, বলবান জরাসন্ধকে দু’হাতে তুলে মাথার উপর ঘোরাতে লাগলেন। শতবার এইভাবে জরাসন্ধকে ঘুরিয়ে, তাঁকে মাটিতে আছড়ে ফেললেন, দুই পা উপরের দিকে চাপ দিতে দিতে তাঁর পৃষ্ঠের সন্ধিস্থান ভেঙে ফেললেন। জরারাক্ষসী যে সন্ধি সংযোজন করেছিলেন, ভীম তা ভেঙে ফেললেন। জরাসন্ধ প্রচণ্ড গর্জন করতে লাগলেন, মগধবাসী অত্যন্ত ভীত হলেন, স্ত্রীলোকেরা গর্ভপাত করে ফেলল। মগধবাসী বুঝতে পারল না, হিমালয় ভেঙে দু’ টুকরো হল কি না ? অথবা পৃথিবী কি ফেটে গেল ?
মৃত জরাসন্ধের প্রাণহীন দেহ রাজভবন দ্বারে ফেলে রেখেই কৃষ্ণ, ভীমার্জুন অক্ষতদেহে জরাসন্ধের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন। এরপর কৃষ্ণ, জরাসন্ধের পতাকাশোভিত রথে ভীমার্জুনকে বসিয়ে কারাগার-বদ্ধ বন্ধু নৃপতিগণকে মুক্ত করে দিলেন। মুক্ত রাজারা কৃতজ্ঞতাবশত কৃষ্ণকে বহু উপহার দিলেন। কারাগার-মুক্ত রাজারা কৃষ্ণের পূজা করলেন এবং বললেন, “হে পুরুষশ্রেষ্ঠ ! আমরা আপনার কাছে অবনত; সুতরাং আমরা কী করব, তা আপনি আদেশ করুন। মানুষের পক্ষে দুষ্কার্য হলেও আমরা তা সম্পন্ন করব।” কৃষ্ণ তাঁদের বললেন, “যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করতে ইচ্ছা করেছেন। সেই ধার্মিক রাজা সাম্রাজ্য করবার ইচ্ছাও করেছেন। আপনারা সর্বপ্রকারে তাঁকে সাহায্য করুন।” কৃতজ্ঞ ও আনন্দিত রাজারা সকলেই বললেন, “তাই হবে।” কৃষ্ণ স্মরণ করামাত্র গরুড় এসে রথের মাথায় বসলেন। জরাসন্ধের অতিদুর্লভ রথে চড়ে কৃষ্ণ, ভীমার্জন ইন্দ্রপ্রস্থে উপস্থিত হয়ে জরাসন্ধ বধের সংবাদ যুধিষ্ঠিরকে প্রদান করলেন।
*
জরাসন্ধ বধ মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত। জরাসন্ধ বধের সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সর্বপ্রধান বাধা দুর হল। দ্বাপরযুগে ভারতবর্ষের রাজন্যবর্গ দুটি অক্ষশক্তিতে বিভক্ত হয়েছিলেন। একটি ছিল অত্যাচারী, অন্যায়কারী পক্ষ। এঁদের নেতা ছিলেন জরাসন্ধ। তাঁর দুই সেনাপতি হংস ও ডিম্বক দৈববিপাকে নিহত হন। জরাসন্ধের জামাতা কংসকে কৃষ্ণ পূর্বেই বধ করেন। ভীমের হাতে জরাসন্ধের মৃত্যু ঘটে। এই অক্ষশক্তির আর এক নেতা শিশুপালকে রাজসূয় যজ্ঞের সভায় কৃষ্ণ বধ করেন। বাকি থাকেন মহারাজ শাল্ব, ভগদত্ত ও কৌরব বংশ। তাঁরা নিহত হন কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে। নিষাদরাজ একলব্য, যাঁর দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দ্রোণ গুরুদক্ষিণা ছলে গ্রহণ করেছিলেন, তিনি কালক্রমে অঙ্গুষ্ঠ বাদ দিয়েই ভয়ংকর বীর হয়ে দাঁড়ান। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ইনি দুর্যোধনের পক্ষই অবলম্বন করতেন। পাহাড় থেকে ছুড়ে কৃষ্ণ একে হত্যা করেন। সন্ধিস্থান ভগ্ন করে ভীমসেন জরাসন্ধকে বধ করেন। যুধিষ্ঠিরের প্রতিপক্ষ ভগবান কৃষ্ণের ইচ্ছায় ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। রাজসূয় যজ্ঞের সভায় কৃষ্ণ সুদর্শন চক্র দিয়ে শিশুপালের মস্তক খণ্ডন করেন। অন্য অন্যায়কারীরা ধ্বংস হন কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে।
২৯
ময়দানবের সভাগৃহ নির্মাণ
খাণ্ডবদাহের পর অর্জুনের কৃপায় জীবিত ময়দানব একদিন কৃষ্ণের সম্মুখেই বারবার অর্জুনের সম্মান করে কোমল বাক্যে অর্জুনকে বললেন, “হে কুন্তীনন্দন ! অত্যন্ত ক্রুদ্ধ এই কৃষ্ণ এবং দহনেচ্ছু অগ্নির হাত থেকে আপনি আমাকে রক্ষা করেছেন। অতএব বলুন—আমি আপনার কী প্রত্যুপকার করব।”
অর্জুন বললেন, “দানব আপনি সমস্তই করেছেন। অতএব আপনার মঙ্গল থোক। আপনি যেতে পারেন। তবে আপনি আমার প্রতি সর্বদা সন্তুষ্ট থাকবেন, আমি সর্বদা আপনার প্রতি সন্তুষ্ট থাকব।” ময়দানব উত্তরে বললেন, “হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি যা বললেন, তা আপনার পক্ষেই সম্ভব। তবুও আমি প্রীতিপ্রদর্শনের জন্য আপনার কোনও উপকার করতে চাই। কারণ, আমি দানবদের বিশ্বকর্মা এবং মহাকবি। সুতরাং আমি আপনার জন্য কিছু করতে চাই।”
অর্জুন বললেন, “দানব আপনি যদি মনে করেন যে, আমি আপনার প্রাণ সংকট থেকে মুক্ত করেছি, তবে আপনাকে দিয়ে আমি কিছু করাতে পারি না। কিন্তু আমি আপনার ইচ্ছাকেও বিনষ্ট করতে চাই না। অতএব আপনি কৃষ্ণের জন্য কিছু করুন, তাতেই আমার প্রত্যুপকার করা হবে।” তখন ময়দানব কৃষ্ণের কাছে গিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলে, “আমি কী করব ?” কৃষ্ণ কিছুকাল চিন্তা করে ময়দানবকে বললেন, “আপনি একটি সভা নির্মাণ করে দিন। হে দানবশ্রেষ্ঠ ময়, আপনি যদি আমাদের প্রীতিকর কার্য করতে চান, তবে আপনি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের যে সভা যোগ্য বলে বিবেচনা করেন এবং যে সভা দেখে সমস্ত মনুষ্যলোকে শিল্পনিপুণ মানুষেরা তাঁর অনুকরণ করতে সমর্থ হবে না, সেই রকম একটি সভা নির্মাণ করুন। যে সভাগৃহে আপনার নির্মিত দেব, দানব ও মানুষদের সমস্ত শিল্পনৈপুণ্য আমরা দেখতে পারি, তেমনই একটি সভা নির্মাণ করুন।”
ময়দানব তখন অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে কৃষ্ণের বাক্য অঙ্গীকার করে যুধিষ্ঠিরের জন্য সাততলা ভবনের তুল্য সুন্দর একটি সভা নির্মাণ করবার ইচ্ছা করল। তখন কৃষ্ণ ও অর্জুন গিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে এই সমস্ত বিষয় জানিয়ে ময়দানবকে দেখালেন। যুধিষ্ঠির সেই ময়দানবকে যথাযোগ্য সম্মান দেখালেন এবং ময়দানবও যুধিষ্ঠিরকে উপযুক্ত সম্মান দেখিয়ে যুধিষ্ঠির প্রদত্ত সম্মান গ্রহণ করলেন।
পাণ্ডবগণের এবং মহাত্মা কৃষ্ণের অভিপ্রায় অনুসারে ময়দানব পুণ্যদিবসে কৌতুক ও মাঙ্গলিক সম্পাদন করে ঘৃতযুক্ত পায়সদ্বারা ব্রাহ্মণগণকে পরিতৃপ্ত করে এবং তাঁদের নানাবিধ ধন দান করে, সমস্ত ঋতুর গুণযুক্ত ও স্বর্গীয় সভার মতো মনোহর সেই সভাটিকে সকল দিকেই দশ হাজার হাত করে মেপে নিল। তারপর ময়দানব বিজয়ী শ্রেষ্ঠবীর অর্জুনকে বললেন, “আমি আপনার কাছে অনুমতি চাইছি, আমি যাব, আবার আসব। কৈলাসপর্বতের অদূরবর্তী উত্তরদিকে মৈনাক পর্বতের কাছে পূর্বকালে দানবেরা যজ্ঞ করার ইচ্ছা করেছিলেন। তখন আমি বিন্দু সরোবরের তীরে কতগুলি আশ্চর্য ও মনোহর দ্রব্য সংগ্রহ করেছিলাম, যার কিছু অংশ দানবরাজ বৃষপর্বার সভায় দেওয়া হয়েছিল। তা যদি এখনও থাকে, তবে আমি তা নিয়ে আসব। তারপর, আমি আপনাদের জন্য যশস্কর, চিত্তমোহন, সর্বরত্নসজ্জিত বিচিত্র সভা নির্মাণ করে দেব। আর, সেই বিন্দু সরোবরের তীরে ভয়ংকর একটি গদা আছে। রাজা বৃষপর্ব শত্রুদের বধ করে তা সেখানে রেখেছিলেন। সে গদাটি বিন্দু বিন্দু স্বর্ণখচিতা, বিচিত্রা, ভারবতী, দৃঢ়া, ভারসহা এবং অন্য লক্ষ গদার ন্যায় শত্ৰুনাশিনী। আপনার যেমন গাণ্ডিব, সেই রকম সে গদা ভীমের যোগ্য। আর, সেখানে বরুণের ব্যবহৃত মনোহর শব্দকারী দেবদত্ত নামে একটি শঙ্খ আছে। এই সমস্ত এনে আপনাদের সমর্পণ করব।” অর্জুনকে এই কথা বলে ময়দানব ঈশানকোণে চলে গেল। কৈলাসপর্বতের উত্তর দিকে মৈনাক পর্বতের কাছে স্বর্ণশৃঙ্গ অথচ মহামণিময় একটি বিশাল পর্বত আছে।
সেই পর্বতে ‘বিন্দুসর’ নামে একটি সুন্দর সরোবর আছে এবং ভগীরথ রাজা গঙ্গার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার জন্য বহু বৎসর বাস করেছিলেন। সেই পর্বতে মহাত্মা ভূতনাথ মহাদেব শত শত এবং সহস্র সহস্র প্রধান যজ্ঞ করেছিলেন ও যজ্ঞস্থানে শোভার জন্য মণিময় যুপ এবং হিরন্ময় ও মণিমণ্ডিত চত্বর নির্মাণ করা হয়েছিল; সেখানে ইন্দ্র যজ্ঞ করে দেবরাজত্ব লাভ করেছিলেন; সে পর্বতে মহাপ্রভাবশালী সনাতন ব্রহ্মা সমস্ত লোক সৃষ্টি করে অবস্থান করতে থাকলে, ভূতেরা তাঁর সেবা করেছিল; আর নর-নারায়ণ, ব্রহ্মা, যম এবং ইন্দ্র ও রুদ্র—এঁরা সহস্র যুগ পর্যন্ত যজ্ঞ করেছিলেন এবং নারায়ণ বিশ্বস্তচিত্তে ধর্মলাভের জন্য বহু বৎসর পর্যন্ত যজ্ঞ করেছিলেন; আর তিনি স্বর্ণমালাভূষিত বহুতর যূপ ও দীপ্তিশালী অনেক আয়তন দান করেছিলেন; সেই পর্বতে গিয়ে ময়দানব গদা, শঙ্খ এবং অসুররাজ বৃষপর্বার স্ফটিকময় সভাদ্রব্য সকল সংগ্রহ করল। অসুরগণ কিঙ্করনামের রাক্ষসগণ কর্তৃক যে প্রচুর ধনরাশি রক্ষা করছিল, ময়দানব সেখানে গিয়ে সে সমস্ত গ্রহণ করল। সেগুলি এনে ময়দানব ত্রিভুবনবিখ্যাত, স্বর্গীয় মূর্তি, কল্যাণকারী এবং মণিময় সেই নিরুপম সভা নির্মাণ করল। সেই উৎকৃষ্ট গদাটি ভীমসেনকে এবং দেবদত্ত নামক উৎকৃষ্ট শঙ্খটি অর্জুনকে সমর্পণ করল— এই শঙ্খের শব্দে সমস্ত প্রাণীই ভয়ে কম্পিত হত। ময়দানব নির্মিত সে সভাটি চারদিকে দশ হাজার হাত বিস্তৃত ছিল এবং তাতে বহু স্বর্ণময় বৃক্ষ ছিল।
অগ্নি, সূর্য এবং চন্দ্রের সভা যেমন শোভা পেয়ে থাকে, ময়দানব নির্মিত সভাটি তেমনই শোভা পেতে থেকে সুন্দর আকার ধারণ করেছিল। সেই দিব্য সভাটি আপন দীপ্তির দ্বারা সূর্যের উজ্জ্বল দীপ্তিকেও যেন প্রতিহত করে নিজের অলৌকিক তেজে শোভিত হচ্ছিল। অসুরদের বিশ্বকর্মা ময়দানব নানা প্রকারে ও সুন্দরভাবে নির্মাণ করেছিল বলে সেই সভাটি যেন নতুন মেঘের ন্যায় আকাশ ব্যাপ্ত করেছিল, দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে বিশাল ছিল; সেটি মনোহারী অথচ পাপনাশকারী ছিল, সেই সভাটি শ্রম দূর করত, তার ভিতরে উত্তম বস্তু ও নানাবিধ চিত্র ছিল, আর রত্নের প্রাচীর ছিল। দেবসভা তার তুল্য ছিল না; এমনকী ব্রহ্মার সভাও তেমন সুন্দর ছিল না।
আকাশচারী, ভয়ংকরাকৃতি, বিশাল শরীর, অত্যন্ত বলবান, রক্তনয়ন ও পিঙ্গলনয়ন, শুক্তিতুল্য বর্ণ এবং মহাযোদ্ধা কিঙ্কর নামক আট হাজার রাক্ষস ময়দানবের আদেশে সেই সভাটিকে রক্ষা করত এবং প্রয়োজন হলে অন্যস্থানে তুলে নিয়েও যেতে পারত। ময়দানব সেই সভায় পদ্মময় অতুলনীয় একটি সরোবর নির্মাণ করেছিল; তাতে বহুতর স্বর্ণপদ্ম ছিল, তার নালগুলি মণিময় এবং পাতাগুলি ছিল বৈদূর্যময়; আর স্বর্ণময় বহুতর সুগন্ধ উৎপল ছিল; সেগুলির কাছে নানাবিধ পক্ষী ঘুরে বেড়াত এবং স্বর্ণময় প্রস্ফুটিত পদ্ম, মৎস্য ও কূর্ম দ্বারা সে সরোবরটি বিচিত্র হয়েছিল; আর তাতে আশ্চর্য স্ফটিকময় সোপান এবং নির্মল জল ছিল; অল্প অল্প বাতাস এসে তাতে ঢেউ তুলত; তাতে পদ্মপত্রের উপরে জলবিন্দু ছড়িয়ে পড়ে মুক্তার মতো শোভা পেত এবং সেই সরোবরটির চার তীরেই মহামণিশিলা দ্বারা বেদি নির্মাণ করা ছিল। মণি ও রত্নের দ্বারা জলের তলদেশ সজ্জিত ছিল, তার কিরণ এসে জলের উপর ছড়িয়ে পড়ত; তাতে অনেক রাজা এসে দেখেও সরোবর বলে বুঝতে পারতেন না; তাই তাঁরা জলে পড়ে যেতেন।
সেই সভাটির সকল দিকেই সর্বদা পুষ্প ও শীতল ছায়াযুক্ত এবং নীলবর্ণ নানাবিধ উৎকৃষ্ট বৃক্ষ ছিল। সকল দিকেই সৌরভশালী উদ্যান ও পুষ্করিণী ছিল; সেই পুষ্করিণীগুলিতে সমস্ত সময়ে হাঁস, কারণ্ডব ও চক্রবাকপক্ষী অবস্থান করত। জলপদ্ম, স্থলপদ্মের সুগন্ধযুক্ত বায়ু পাণ্ডবগণের সেবা করত। ময় সভানির্মাণ সমাপ্তির কথা যুধিষ্ঠিরকে জানাল। দেবর্ষি নারদ যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, “রাজা আপনার এই সভাটি যেমন, এরূপ মণিময়ী সভা আমি পূর্বে মনুষ্যলোকে দেখিনি, শুনিওনি।”
*
এই সেই ময়দানব নির্মিত সভা। স্বর্গে যেমন বিশ্বকর্মা, দানবদের মধ্যে তেমনই সর্বশ্রেষ্ঠ বাস্তুশিল্পী ছিলেন ময়দানব। তাঁর নির্মিত এই সভায় যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সভাতেই কৃষ্ণ সুদর্শন চক্র দ্বারা শিশুপালের মস্তক ছেদন করেছিলেন। এই সভাতে এসেই দুর্যোধন চূড়ান্ত অপদস্থ হয়েছিলেন। শুষ্ক ভূমি ভেবে জলে পতিত হয়েছিলেন। গৃহ প্রাকারে তাঁর মস্তকে আঘাত লেগেছিল।
এই সভা দুর্যোধনের হৃদয়ে ভয়ংকর ঈর্ষার সৃষ্টি করেছিল। সেই মুহূর্ত থেকেই দুর্যোধন সংকল্প করেছিলেন যে, এই সভা তিনি কেড়ে নেবেনই। অনিবার্য ফল হিসাবে দ্যূতক্রীড়া হল। শঠতা করে শকুনি দুর্যোধনের হয়ে পাশার চালে যুধিষ্ঠির ও পাণ্ডবদের অশেষ লাঞ্ছনা করলেন, দ্রৌপদীকে নিয়ে কুৎসিত আচরণ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত পাণ্ডবদের বনে গমন করতে বাধ্য করলেন।
বনবাস শেষ করে তেরো বৎসর পর ভয়ংকর যুদ্ধে পাণ্ডবেরা বিজয়ী হন এবং ইন্দ্রপ্রস্থ ও তার যজ্ঞস্থান ফিরে পান। কৃষ্ণের প্রপৌত্র (অনিরুদ্ধের পুত্র) বজ্রকে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজত্ব দিয়ে যুধিষ্ঠির মহাপ্রস্থানে যাত্রা করেন।