১০. ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা

১০
ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা (আজ হতে এ বিশ্বের সমস্ত রমণী আমার জননী)

হস্তিনাপুর রাজচক্রবর্তী প্রতীপ বৃদ্ধ বয়সে পুত্র লাভ করার জন্য ভার্যার সঙ্গে গঙ্গাতীরে দুর্লভ তপস্যায় রত হয়েছিলেন। একদিন অতি মনোহর রূপধারিণী এক রমণী গঙ্গার মধ্য থেকে উঠে তপস্বী প্রতীপের শালবৃক্ষের মতো দক্ষিণ ঊরুর উপর এসে উপবেশন করলেন। রমণী প্রতীপকে বললেন, “মহারাজ, আমি আপনাকে প্রার্থনা করি, সুতরাং আমাকে সন্তুষ্ট করুন। কামুকী রমণীকে পরিত্যাগ করা সাধুজনগৰ্হিত।

তপস্যারত প্রতীপ জানালেন যে তিনি পরস্ত্রী গ্রহণ করেন না এবং অসবর্ণ স্ত্রীও গ্রহণ করেন না। উত্তরে রমণী বললেন যে, তিনি দুর্লক্ষণা নন, অগম্যাও নন, কোনও বিষয়ে নিন্দনীয়াও নন। তিনি স্বর্গীয়া, উৎকৃষ্ট স্ত্রী এবং কুমারী। তিনি প্রতীপের প্রতি অনুরক্তা। অতএব তাঁকে সন্তুষ্ট করা প্রতীপের কর্তব্য। কিন্তু প্রতীপ রমণীর আহ্বানে সাড়া দিলেন না। তিনি জানালেন যে, প্রথমত তাঁর নারীসঙ্গ করার বয়স চলে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত আগতা রমণী তার দক্ষিণ ঊরুর উপর বসেছেন। পুরুষের দক্ষিণ ঊরু কন্যা বা পুত্রবধূর আসন। পুরুষের বাম ঊরু স্ত্রীর ভোগ্য। আগতা রমণী নিজেই তা পরিত্যাগ করেছেন। যেহেতু নারী তাঁর পুত্রবধূর আসন গ্রহণ করেছেন, সেই হেতু প্রতীপ তাঁকে পুত্রবধূই করবেন। তাঁর যে পুত্র হবে, তার সঙ্গেই রমণীর বিবাহ দেবেন। রমণী জানালেন যে, রাজশ্রেষ্ঠ প্রতীপের প্রতি তাঁর ভক্তির শেষ নেই। তাঁর আদেশ তিনি মান্য করবেন। প্রতীপের যে পুত্র হবে, তাঁকেই তিনি বিবাহ করবেন। তবে তিনি একটি শর্ত প্রতীপের কাছে জানালেন। তাঁর স্বামী তাঁর কোনও কার্যে কখনও বাধা দিতে পারবেন না। প্রতীপ এই শর্তে সম্মতি দিলেন।

স্ত্রীরূপধারিণী গঙ্গা তখনই অন্তর্হিত হলেন। রাজা প্রতীপ আপন ভার্যার সঙ্গে পুত্রকামনায় গুরুতর তপস্যা আরম্ভ করলেন। ব্রহ্মশাপগ্রস্ত রাজা মহাভিষ প্রতীপের পুত্র হিসাবে জন্মগ্রহণ করলেন।

সমগুণান্বিত রাজার পুত্র হিসাবে জন্মগ্রহণ করায় সেই পুত্রের নাম হল শান্তনু। শান্তনু যৌবনে পদার্পণ করলে, প্রতীপ রাজা তাঁকে পূর্বাগত রমণীর বৃত্তান্ত জানালেন এবং নির্দেশ দিয়ে গেলেন যে, সেই পরমাসুন্দরী রমণী পুত্রকামনায় শান্তনুর কাছে আসলে শান্তনু কোনও প্রশ্ন না করেই তাঁকে যেন গ্রহণ করেন এবং তাঁর কোনও কাজেই যেন কখনও বাধা না দেন।

শান্তনু মৃগয়ায় আসক্ত ছিলেন। হরিণ, মহিষ, পশু ইত্যাদি বধ করে একাকী গঙ্গার তীরে ঘুরে বেড়াতেন। একদিন এইরকম সময়ে গঙ্গাতীরে শান্তনু এক অপূর্ব কান্তিময়ী নারী, দ্বিতীয় লক্ষ্মীর ন্যায় রূপবতী—সর্বাঙ্গ সুন্দর, অনিন্দনীয়, অতি সুন্দর দন্তময়ীকে দেখতে পেলেন। সেই রমণীর সৌন্দর্যে শান্তনু মুগ্ধ হলেন—দুই নেত্র দিয়ে সেই রমণীর সৌন্দর্য পান করে যেন তাঁর তৃপ্তি হচ্ছিল না। আবার, পরমসুন্দর রাজাকে দেখে সেই নারীর প্রথম দর্শনেই অনুরাগ জন্মাল। স্বেদ শিহরনে তিনি কম্পিত হলেন।

রাজা শান্তনু সেই রমণীকে বললেন, “সুন্দরী আপনি দেবী? না দানবী? গন্ধর্বী কি? অথবা অপ্সরা? আপনি যক্ষী? না সর্পী? না মানবী? দেববালিকাতুল্যা হে নারী, আপনি যেই হোন না কেন, আমার ভার্যা হন।”

সেই রমণী রাজার প্রার্থনা শুনে ধীর পায়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, ‘মহারাজ আমি আপনার বশবর্তিনী মহিষী হব। কিন্তু আমি শুভ বা অশুভ যে কাজই করি না কেন, আপনি বারণ করতে পারবেন না, অথবা আমাকে কোনও কটু কথা বলতে পারবেন না। আপনি এই নিয়ম স্বীকার করলে আমি আপনার সঙ্গে বাস করব। আপনি বারণ করলে, কিংবা কটু কথা বললে আমি তৎক্ষণাৎ আপনাকে ত্যাগ করে চলে যাব। শান্তনু সম্মত হলেন। জিতেন্দ্রিয় শান্তনু গঙ্গাকে লাভ করে ইচ্ছানুসারে ভোগ করতে লাগলেন। গঙ্গার স্বভাব, ব্যবহার, রূপ, উদারতা ও নির্জনে পরিচর্যায় শান্তনু অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন এবং শর্ত অনুযায়ী তিনি গঙ্গাকে কখনও কোনও প্রশ্ন করতেন না। বাস্তবিক গঙ্গাও তাকে কোনও প্রশ্ন করার সুযোগ দিতেন না। তিনি স্বর্গীয়া দেবী ও নদী হয়েও, মনোহর মানবীর মূর্তি ধারণ করে যথার্থ ভার্যার মতো রাজা শান্তনুকে সেবা করতেন। শান্তনু যাতে অন্য কোনও রমণীতে আসক্ত না হন, তার জন্য গঙ্গা শৃঙ্গার ব্যবহার, কোমল নৃত্য, সম্ভোগ, অনুরাগ ও রমণ ব্যাপারে নৈপুণ্য দেখিয়ে রাজাকে সন্তুষ্ট করতে লাগলেন।

শান্তনু উত্তম রমণী গঙ্গার গুণে আকৃষ্ট থেকে তাঁর সঙ্গে রমণে আসক্ত ছিলেন বলেই, বহু বৎসর, ঋতু ও মাস যে গত হয়েছিল, তা বুঝতেও পারেননি। শান্তনু ইচ্ছানুসারে গঙ্গার সঙ্গে রমণ করতে থাকায়, গঙ্গার গর্ভে তাঁর আটটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেছিল।

কিন্তু যখনই পুত্র জন্মাত, তখনই গঙ্গা ‘আমি তোমাকে সন্তুষ্ট করছি’—এই কথা বলে সেই পুত্রকে প্রথমে জলে নিক্ষেপ করতেন, পরে স্রোতের ভিতরে ডুবিয়ে দিতেন। গঙ্গার এই কাজ শান্তনুর অত্যন্ত অপ্রিয় হত। অথচ প্রশ্ন করলে গঙ্গা তাঁকে ত্যাগ করবেন, এই ভয়ে তিনি গঙ্গাকে কিছু বলতেন না। এইভাবে গঙ্গা সাতটি পুত্র জলে ভাসিয়ে দিলেন।

তারপরে অষ্টম পুত্র জন্মালে, গঙ্গা যেন আনন্দে হাস্য করে উঠলেন। শান্তনুর আর সহ্য হল না। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তিনি গঙ্গাকে বললেন, “পুত্রবধ কোরো না। তুমি কে? কার স্ত্রী? কোন কারণে সদ্যোজাত পুত্রদের বধ করছ? পুত্রহত্যাকারিণী? তোমার যে অত্যন্ত গুরুতর গহিত পাপ হচ্ছে।”

স্ত্রীরূপধারিণী গঙ্গা বললেন, “হে পুত্রকাম, তুমি পুত্র কামনা করছ; সুতরাং আর তোমার পুত্র বধ করব না; তবে তোমার সঙ্গে আমার থাকা এখানেই শেষ হল। কেন না আমাদের বিবাহের শর্ত তাই ছিল। আমি জহ্নুমুনির কন্যা গঙ্গা। মহর্ষিগণ আমার সেবা করেন। দেবকার্য সিদ্ধির জন্য আমি আপনার সঙ্গে বাস করেছি। মহর্ষি বশিষ্ঠের অভিশাপে স্বর্গের মহাভাগ্যবান ও মহাতেজস্বী আটজন বসুদেবতা আপনার পুত্র হয়ে জন্মেছিলেন। মর্ত্যলোকে আপনি ছাড়া অন্য কেউ সেই বসুগণের জনক হতে পারেন না; আবার এই মর্ত্যলোকে আমার মতো গর্ভধারিণী কোনও মনুষ্যরমণী হতে পারেন না। বসুগণের জননী হবার জন্যই আমি মানুষী হয়েছি এবং আপনি আমার গর্ভে সেই অষ্ট বসুকে উৎপাদন করে অক্ষয় স্বর্গের অধিকারী হয়েছেন। বসুগণ প্রার্থনা করেছিলেন যে তাঁরা জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি তাঁদের মনুষ্যজন্ম থেকে মুক্তি দেব। সাত বসুদেবতা বশিষ্ঠের অভিশাপ মুক্ত হয়েছেন। আপনার এই অষ্টম পুত্র স্বর্গের দ্যু-বসু। স্ত্রীর প্ররোচনায় ইনি মহর্ষি বশিষ্ঠের সুরভি নাম্নী গাভীকে অপহরণ করেছিলেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ অন্য বসুদের কেবলমাত্র এক বৎসর মনুষ্যজন্মের অভিশাপ দিয়েছিলেন কিন্তু দ্যু-বসুকে দীর্ঘকাল মনুষ্যলোকে থাকার অভিশাপ দেন। তবে বশিষ্ঠ একথাও বলেছিলেন, এর মতো মহাত্মা মনুষ্যলোকে আর কেউ জন্মাবে না। এই দ্যু-বসু ধার্মিক, সর্বশাস্ত্রে নিপুণ, পিতার প্রিয় ও হিতসাধনে নিরত থাকবে এবং স্ত্রীসম্ভোগ পরিত্যাগ করবে। ইনি দেবতার ব্রত পালনে জন্মেছেন, তাই এঁর নাম হবে দেবব্রত এবং গঙ্গার পুত্র বলে ইনি গাঙ্গেয় নামেও পরিচিত হবেন। আমি এখন এই পুত্রটিকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। আপনার আহ্বান মাত্র আমি আপনার কাছে এসে দেখা দেব।”

এই বলে গঙ্গা অন্তর্হিত হলেন। শান্তনুও পুত্রশোক ও গঙ্গার শোকে কাতর হয়ে আপন রাজধানীতে ফিরে গেলেন।

রাজা শান্তনু দেবগণ, রাজগণ, ঋষিগণ আদৃত, বুদ্ধিমান, ধার্মিক, সত্যবাদী বলে জগতে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইন্দ্রিয়দমন, দানশক্তি, ক্ষমা, বুদ্ধি, লজ্জা, ধৈর্য এবং অসাধারণ তেজ—এই সমস্ত গুণই পুরুষশ্রেষ্ঠ ও অত্যন্ত অধ্যবসায়ী শান্তনু রাজাতে বিদ্যমান ছিল। শান্তনু ধর্মনীতি ও অর্থনীতিতে নিপুণ ছিলেন। তিনি ভরতবংশের এবং সমস্ত প্রজার রক্ষক ছিলেন। তাঁর গলা ছিল শাঁখের মতো, দুই স্কন্ধ বিশাল, তিনি মত্ত হস্তীর মতো বিক্রমশালী ছিলেন। শান্তনুর শাসনে প্রজারা সুখে শান্তিতে বাস করছিল। অন্য রাজারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। শান্তনু অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন, দানকর্ম তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ব্রত ছিল।

গঙ্গা অন্তর্হিত হবার পর শান্তনু ছত্রিশ বৎসর স্ত্রীসংসর্গ পরিত্যাগ করে বনবাসী হয়েছিলেন। একদিন শান্তনু রাজা একটি হরিণকে শরবিদ্ধ করে তার অনুসরণ করে গঙ্গার তীরে উপস্থিত হয়ে দেখলেন—গঙ্গার জল অল্প। তিনি দেখলেন দেবপুত্রের মতো মনোহর ও দীর্ঘ শরীর একটি বালক দেবরাজের মতো দিব্য অস্ত্র নিক্ষেপ করছে এবং তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা সমস্ত গঙ্গাকে আবৃত করে তার তীরে অবস্থান করছে। শান্তনু জন্মমুহূর্তে পুত্রকে একবার দেখেছিলেন, চিনতে পারলেন না। এদিকে বালকটি পিতাকে দেখে মায়া দ্বারা তাঁকে মুগ্ধ করল, মুগ্ধ করে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে অন্তর্হিত হল।

বালকটি অন্তর্হিত হতেই শান্তনু উপলব্ধি করলেন—এ পুত্র তাঁরই। তিনি দেবী গঙ্গাকে স্মরণ করে বললেন, “গঙ্গা পুত্রটিকে দেখাও।” তখনই সালংকরা সুসজ্জিতা গঙ্গা দক্ষিণ হস্ত ধারণ করে সেই সুন্দর বালকটিকে রাজার সামনে নিয়ে আসলেন। গঙ্গা বললেন, “মহারাজ আমার গর্ভে আপনি যে অষ্টম পুত্রটি লাভ করেছিলেন, এই সেই পুত্র। এই পুত্র এখন অস্ত্রাভিজ্ঞদের মধ্যে সর্বপ্রধান। এ বশিষ্ঠের কাছে সাঙ্গবেদ অধ্যয়ন করেছে, মহাধনুর্ধর ও পরাক্রমশালী হয়েছে, যুদ্ধে ইন্দ্রের মতো ক্ষমতাবান। দেবগণ ও অসুরগণ এই ছেলেটিকে অত্যন্ত ভালবাসেন। শুক্রাচার্য যত শাস্ত্র জানেন, সবই একে শিখিয়েছেন। বৃহস্পতির বিদ্যা এ লাভ করেছে। পরশুরাম একে সর্বশ্রেষ্ঠ রথীতে পরিণত করেছেন। মহাধনুর্ধর এবং রাজধর্মাভিজ্ঞ এই সন্তান আপনি নিজের গৃহে নিয়ে যান।” এই কথা বলে গঙ্গা অন্তর্হিত হলেন। দীপ্তিমান সূর্যের মতো শান্তনুনন্দনকে দেখে পুরবাসী এবং প্রজারা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। রাজ্যের মঙ্গলের জন্য শান্তনু সেই পুত্র, দেবব্রতকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। যশস্বী দেবব্রত আপন ব্যবহারে পিতাকে, পুরবাসীকে, রাজ্যের সমস্ত লোককে অনুরক্ত করে ফেললেন। এইভাবে চার বৎসর কাল কেটে গেল।

একদিন শান্তনু যমুনানদীর তীরবর্তী বনে গিয়ে অনির্বচনীয় একপ্রকার উৎকৃষ্ট গন্ধ অনুভব করলেন। সেই গন্ধের উৎপত্তিস্থান অন্বেষণ করতে থেকে তিনি দেবতার মতো সুন্দরী একটি কন্যা দেখতে পেলেন। দীর্ঘনয়না সেই সুন্দরীকে দেখে তাঁকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কার কন্যা? তোমার নাম কী? তুমি এখানে কী করছ?”

সেই কন্যাটি উত্তর দিলেন, “আমি কৈবর্তের কন্যা; আমার পিতা মহাত্মা দাসরাজের আদেশে আমি ধর্মের জন্য নৌকা বহন করে পারাপার করছি।

দেবীর মতো অপরূপ রূপ লাবণ্যবতী ও সৌরভযুক্তা সেই নারীকে দেখেই শান্তনু তাঁকে সম্ভোগ করার ইচ্ছা করলেন। তিনি সেই মুহূর্তেই সেই কন্যাটির পিতার কাছে গিয়ে তাঁকে পত্নীরূপে পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করলেন। দাসরাজ শান্তনুর প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “মহারাজ কন্যা যখন জন্মেছে, অবশ্যই উপযুক্ত পাত্রে তাকে দান করতে হবে। কিন্তু আপনি আমার মনের ইচ্ছা শুনুন। আপনি ধর্মপত্নীরূপে আমার কন্যাকে প্রার্থনা করেছেন, সমগ্র ভারতবর্ষে আমি আপনার তুল্য জামাতা পাব না। কিন্তু আপনাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, আমার কন্যার গর্ভে আপনার যে পুত্র জন্মাবে, সেই পুত্র আপনার পরে ভরতবংশের রাজা হবে। জন্মের পর তাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে হবে—অন্য কাউকেই ভাবী রাজা বলে অভিষিক্ত করতে পারবেন না।”

কিন্তু পুত্র দেবব্রতকে স্মরণ করে শান্তনু ধীবররাজাকে তাঁর প্রার্থিত বর দান করতে পারলেন না। তীব্র কামানলে দগ্ধ হতে থেকেও, কামবেদনায় মূর্ছিতপ্রায় হয়ে, সেই দাসকন্যাকে চিন্তা করতে করতে শান্তনু হস্তিনাপুরে প্রবেশ করলেন। শান্তনু রাজকার্য করতে পারলেন না, মৃগয়ায় যাওয়া বন্ধ করলেন—তাঁর দেহ কান্তিহীন, পাণ্ডুরবর্ণ ও কৃশ হয়ে গেল।

পুত্র দেবব্রত কিছুকাল ধরেই পিতার বিকার লক্ষ করছিলেন। শেষে একদিন সরাসরি পিতা শান্তনুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি প্রশ্ন করলেন, “পিতৃদেব সকল দিকেই মঙ্গল দেখা দিচ্ছে, সকল রাজা আপনার বশবর্তী আছেন। কিন্তু আপনি মৌনী থাকেন, আমার সঙ্গেও কথা বলেন না। আপনার দেহ বিবর্ণ কৃশ হয়ে যাচ্ছে। আপনি যদি আমাকে এর কারণ বলেন, তা হলে আমি প্রতিকার করতে পারব।”

শান্তনু পুত্র দেবব্রতকে বললেন, “বৎস, তুমি যে আমাকে চিন্তামগ্ন দেখেছ, তা ঠিকই। তুমি আমাদের বংশের একমাত্র সন্তান। তুমি বীর যোদ্ধা এবং সর্বত্র আপন পুরুষকার অবলম্বন করে থাক। মনুষ্যজীবন স্থায়ী নয়, তোমার কোনও বিপদ ঘটলে আমাদের বংশ আর থাকবে না। তুমি আমার কাছে শত পুত্রের অধিক—এই কারণেই আমি অনর্থক পুনরায় দার পরিগ্রহ করতে ইচ্ছা করি না। বেদবাদীরা বলে থাকেন, এক পুত্র থাকা, আর নিঃসন্তান হওয়া—এই উভয়ই প্রায় সমান। সন্তান সর্বকল্যাণকর। একথা দেবতা ও প্রাচীনেরা বলে থাকেন। তুমি বীর, সর্বদা অস্ত্র ব্যবহার করে থাক। সুতরাং যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনও কারণে তোমার মৃত্যু ঘটবে না। কিন্তু তুমি না থাকলে এই বংশের কী হবে, এই ভাবনায় আমি অস্থির হয়ে পড়েছি।”

দেবব্রত তখন পিতার হিতৈষী বৃদ্ধ মন্ত্রীর কাছে গিয়ে পিতার শোকের যথার্থ কারণ জানতে চাইলেন। মন্ত্রী বললেন, “দাসকন্যা সত্যবতীকে মহারাজ কামনা করছেন।” দেবব্রত তখনই অন্য ক্ষত্রিয়গণের সঙ্গে পরামর্শ করে দাসরাজের কাছে গিয়ে পিতার জন্য সত্যবতীকে প্রার্থনা করলেন।

দাসরাজ দেবব্রতকে যথাবিহিত আপ্যায়ন করে বললেন, “আপনি মহারাজ শান্তনুর পুত্র। আপনি অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ। আপনি মহারাজের উপযুক্ত অবলম্বন। কোনও ব্যক্তিই এইরূপ শ্লাঘ্য ও অভীষ্ট বৈবাহিক সম্বন্ধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। আমার কন্যা আমার ঔরসজাত কন্যা নয়। এ কন্যার পিতা রাজা উপরিচর। রাজা উপরিচর আমাকে বলেছেন যে ধার্মিক রাজা শান্তনুই সত্যবতীকে বিবাহ করার যোগ্য। দেবর্ষি অসিত সত্যবতীর বিশেষ প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু আমি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছি। কিন্তু রাজকুমার, কন্যার পিতা হিসাবে আমি আপনাকে কিছু বলব। এই বিবাহের একমাত্র দোষ, প্রবল শত্রু জন্মাবে। কারণ আপনি শত্রু হয়ে যার প্রতি ক্রুদ্ধ হবেন, সে দেব দৈত্য গন্ধর্ব হলেও সুখভোগ করতে পারবে না। এই বিবাহের এই একমাত্র দোষ।”

তখন দেবব্রত সমাগত সঙ্গী ক্ষত্রিয়গণকে শুনিয়ে বলতে লাগলেন, “হে সত্যবাদী দাসরাজ, আমার এই সত্য প্রতিজ্ঞা শ্রবণ করুন। অতীতে কেউ এ প্রতিজ্ঞা করেনি। বর্তমান অথবা ভাবী কোনও লোক এ প্রতিজ্ঞা করতে পারবে না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে, সত্যবতীর গর্ভজাত পুত্রই আমাদের রাজা হবে।”

কিন্তু দাসরাজ তখনও সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি আবার বললেন, “আপনি প্রতিজ্ঞা অনুসারে সত্যবতীরও প্রভু হলেন। আমি জানি আপনার প্রতিজ্ঞা কখনও মিথ্যা হবে না। কিন্তু আপনার যে পুত্র হবে, সে আপনার প্রতিজ্ঞায় বাঁধা পড়বে না। তার বিষয়ে আমার গুরুতর সন্দেহ আছে।”

দেবব্রত দাসরাজার অভিপ্রায় বুঝলেন। পিতার প্রিয় কাজ করার জন্য তিনি আবার এক, প্রতিজ্ঞা করলেন। “দাসরাজ, সমবেত এই ক্ষত্রিয় সমাজের সম্মুখে আমি আমার পিতার ইচ্ছা পূরণের জন্য যে প্রতিজ্ঞা করছি, তা আপনি শ্রবণ করুন। ক্ষত্রিয়গণ, আমি পূর্বে সমস্ত রাজ্য পরিত্যাগ করেছি। এখন আমি সেই প্রতিজ্ঞা করছি, যে প্রতিজ্ঞার ফলে আমার জীবনেও কোনও পুত্র জন্মগ্রহণ করবে না। দাসরাজ, আজ থেকে আমি ব্রহ্মচর্য ব্রত গ্রহণ করলাম। এর ফলে আমার আর পুত্র জন্মগ্রহণ করবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার অক্ষয় স্বর্গ লাভ হবে।” গাঙ্গেয় প্রতিজ্ঞা করলেন যে, সেদিন থেকে পৃথিবীর সমস্ত রমণী তাঁর জননী তুল্যা হবেন।

গাঙ্গেয়র এই প্রতিজ্ঞা শুনে দাসরাজ ও উপস্থিত ক্ষত্রিয়গণ সকলেই রোমাঞ্চিত হলেন। দাসরাজ গাঙ্গেয়কে বললেন, “অবশ্যই আমি সত্যবতীকে দান করব।”

তারপর অপ্সরাগণ, দৈবগণ ও পিতৃগণ আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করলেন। আকাশ থেকে দৈববাণী হল—“এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্য আজ থেকে এঁর নাম হল ভীষ্ম।”

তখন ভীষ্ম, পিতার কাছে নিয়ে যাবার জন্য যশস্বিনী সত্যবতীকে বললেন, “মা আপনি রথে উঠুন, চলুন আমরা নিজের গৃহে যাই।” এই কথা বলে, সত্যবতীকে রথে তুলে, হস্তিনাপুরে গিয়ে, পিতা শান্তনুর কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। রাজারা সমবেতভাবে এবং পৃথক পৃথক ভাবে ভীষ্মের সেই দুষ্কর কাজের প্রশংসা করলেন এবং বললেন, “ইনি ভীষ্মই বটেন।”

ভীষ্মের সেই দুষ্কর কাজের কথা শুনে পিতা শান্তনু সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ইচ্ছামৃত্যু বর দিলেন এবং বললেন, “বৎস তুমি যতকাল জীবিত থাকতে ইচ্ছা করবে, ততকাল তোমার মৃত্যু হবে না। তুমি অনুমতি দিলে তবেই মৃত্যু তোমার কাছে আসতে পারবে।”

*

ভীষ্মের এই প্রতিজ্ঞা মহাভারতের এক অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বস্তুত ভরত বংশের ইতিহাস সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেল। ভীষ্মের এক পূর্বপুরুষ পুরু পিতা যযাতির ভোগতৃষ্ণা নিবারণের জন্য আপন যৌবন পিতাকে দান করেছিলেন। হাজার বছর সে যৌবন উপভোগ করে যযাতি পুত্রকে যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন ভোগের দ্বারা ভোগের তৃষ্ণা মেটে না। কিন্তু পুরু পিতার প্রার্থনা অনুযায়ী তাঁকে যৌবন দান করেছিলেন। শান্তনু ভীষ্মের কাছে কোনও অনুরোধ করেননি। পিতার সন্তুষ্টির জন্য ভীষ্ম স্বেচ্ছায় ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করে ঊর্ধ্বরেতা হয়েছিলেন। পিতার জন্য পৃথিবীর সব সৌন্দর্য, সব তৃষ্ণা তিনি বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাই ভীষ্মের ব্রত আরও মহান, অলোক-সামান্য।

কিন্তু ভরত বংশের ইতিহাস আর স্বাভাবিক গতিতে প্রবাহিত হল না। শান্তনু-সত্যবতীর দুই পুত্র চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেন। কৌরব বংশের ধারা বজায় রাখার জন্য মাতা সত্যবতী ভীষ্মের অনুমতিক্রমে আপন কানীন পুত্র ব্যাসদেবকে অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য নিয়োগ করলেন। ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ড এবং বিদুর—ব্যাসদেবের পুত্র। পরিণেতার পুত্র হিসাবে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু পুরু বংশের সন্তান হিসাবে পরিচিত হলেও—কৌরব বংশের প্রত্যক্ষ রক্তধারা শেষ হল। এর পরের কাহিনি ব্যাসদেবের সন্তানদের কাহিনি। ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা তাই মহাভারতের প্রধানতম বিরল মুহূর্ত।

কামুক পিতার জন্য এতখানি আত্মত্যাগের ঔচিত্যবোধ সম্পর্কে আমাদের প্রশ্ন জাগে। ভীষ্ম ব্রহ্মচর্য গ্রহণের জন্য পরবর্তীকালে সত্যবতীর মনস্তাপের কাহিনি আমরা জানি। কিন্তু শান্তনু খুব একটা অনুতপ্ত হয়েছিলেন, তার প্রমাণ মহাভারতে নেই। ভীষ্মের অসাধারণ আত্মত্যাগের কাহিনি শুনে শান্তনু বলেছিলেন:

তচ্‌শ্রুত্বা দুষ্করং কর্ম কৃতং ভীষ্মেণ শান্তনুঃ।

স্বচ্ছন্দমরণং তুষ্টো দদৌ তস্মৈ মহাত্মনে ॥ আদি: ৯৪: ১০২ ॥

ন তে মৃত্যুঃ প্রভাবিতা যাবজ্জীবিতুমিচ্ছসি।

ত্বত্তো হ্যনুজ্ঞাং সম্প্রাপ্য মৃত্যু প্রভাবিতাহনঘ! ॥ আদি: ৯৪: ১০৩ ॥

কিন্তু এই ইচ্ছামৃত্যু বরদান ভীষ্মকে মহান করেনি, মর্যাদাপূর্ণ করেনি। তিনি অশেষ গুণসম্পন্ন সসাগরা পৃথিবীর অধিপতি হওয়ার যোগ্য ছিলেন। কিন্তু কৌরবদের অন্নদাস হয়ে নপুংসকের মতো দুর্যোধনের সকল অন্যায় সহ্য করেছিলেন। অন্যায়পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। এমনকী গোরু-চুরির মতো নিকৃষ্ট কাজে যোগদান করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

১১
চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের অকালমৃত্যু

সত্যবতীর গর্ভে মহারাজ শান্তনুর দুই পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। জ্যেষ্ঠ চিত্রাঙ্গদ, কনিষ্ঠ বিচিত্রবীর্য। শান্তনুর মৃত্যুর পর চিত্রাঙ্গদ হস্তিনাপুরের রাজা হন। চিত্রাঙ্গদ বাহুবলে পৃথিবীর সমস্ত রাজাকে পরাস্ত করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত আত্মগর্বী ছিলেন। তিনি দেবতা, অসুর ও মানুষদের নিন্দা করতেন। গন্ধর্বদের রাজার নামও ছিল চিত্রাঙ্গদ। তিনি শান্তনু পুত্রের নিন্দাবাদ শুনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। বললেন, হয় শান্তনুপুত্র নাম পরিত্যাগ করুন, না হয় তাঁর নাম পরিবর্তন করান। শান্তনুপুত্র চিত্রাঙ্গদ অসীম অবজ্ঞায় গন্ধর্বরাজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলেন এবং পরাজিত হয়ে মৃত্যুলাভ করলেন। ইতোমধ্যে শান্তনুর মৃত্যু ঘটেছিল। ভীষ্ম শান্তনুনন্দন বিচিত্রবীর্যকে হস্তিনাপুরের রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। বিচিত্রবীর্য কান্তিমান, কীর্তিমান রাজা ছিলেন।

ভীষ্ম শুনতে পেলেন অপ্সরার মতো সুন্দরী কাশীরাজের তিন কন্যাই একসঙ্গে স্বয়ম্বরা হবেন। মাতা সত্যবতীর অনুমতি নিয়ে ভীষ্ম ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের জন্য কন্যা সংগ্রহ করতে রথে করে কাশীরাজ্যে উপস্থিত হলেন। তখন পরিচয়ের জন্য রাজাদের নাম কীর্তন করা হতে থাকলে সেই পরমাসুন্দরী কন্যারা ভীষ্মকে বৃদ্ধ এবং একাকী দেখে ‘ইনি বৃদ্ধ’ এই কথা ভেবে তাঁর কাছ থেকে সরে গেলেন। সভায় উপস্থিত রাজারা ভীষ্মের উপস্থিতি নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলেন। “ভীষ্ম নিজেকে ধার্মিক বলেন, তিনি বৃদ্ধ এবং শরীরের মাংস শিথিল হয়ে পড়েছে, চুল পেকে গেছে, ইনি আজীবন ব্রহ্মচারী থাকবেন বলে মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। ভীষ্ম নির্লজ্জ এবং লোভী।” রাজাদের এই আলোচনা শুনে ভীষ্ম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন।

তখন ভীষ্ম রাজাদের সম্বোধন করে বললেন, “গুণবান বরকে আহ্বান করে সালংকারা কন্যা ও ক্ষমতা অনুযায়ী যৌতুক দিয়ে কন্যা দান করার প্রথা প্রচলিত আছে। অন্য লোকেরা বরদত্ত দুটি গোরুর সঙ্গে কন্যা দান করেন। কেউ কেউ নির্দিষ্ট অর্থ নিয়ে কন্যা দান করেন। অন্যেরা কন্যা সম্মত হলে বিবাহ করেন। কেউ কেউ অসতর্ক কন্যাকে রমণ করার পর বিবাহ করেন। কেউ কেউ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে দাম্পত্য ধর্ম পালনের জন্য বিবাহ করেন। পণ্ডিতেরা অষ্টম প্রকার বিবাহের বিধি প্রদান করেছেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে পিতামাতার আশীর্বাদ নিয়ে বিবাহ করার রীতি উত্তম রীতি। কিন্তু ক্ষত্রিয়ের পক্ষে স্বয়ংবৃতা কন্যাকে, বিপক্ষীয় বীরদের পরাভূত করে হরণ করাই সর্বশ্রেষ্ঠ রীতি। আমি বলপূর্বক এই তিনটি কন্যাকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা শক্তি অবলম্বন করে আমাকে থামাবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করুন।”—এই বলে ভীষ্ম কাশীরাজের তিন কন্যাকে রথে তুলে নিয়ে চললেন। সমবেত রাজারা ভীষ্মের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড যুদ্ধ আরম্ভের পরই কিছুকালের মধ্যেই সম্পূর্ণ পরাভূত হলেন। একমাত্র মহারথ শাল্ব স্ত্রীলাভের জন্য ভীষ্মের সঙ্গে অল্পকাল যুদ্ধ করতে সমর্থ হলেন। কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বা ও শাল্বরাজা পরস্পরের প্রতি অনুরাগ পোষণ করতেন। শাল্বরাজাকে পরাজিত করে তিন কন্যা নিয়ে ভীষ্ম হস্তিনাপুরে ফিরে এলে কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বা লজ্জার সঙ্গে ভীষ্মকে জানালেন যে মনে মনে তিনি পূর্বেই রাজা শাল্বকে পতি হিসাবে বরণ করেছিলেন এবং রাজা শাল্বও সে সম্পর্ক স্বীকার করেছিলেন। ভীষ্ম বেদপারদর্শী ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আলোচনা করে অম্বাকে শাল্বরাজার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। অন্য দুই ভগ্নী, অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে, মহাধুমধামের সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ হল।

অম্বিকা ও অম্বালিকাকে দেখতে খুব সুন্দর ছিল। গায়ের রং শ্যামবর্ণ, কেশকলাপ কুঞ্চিত ও নীলবর্ণ, নখসমূহ কিঞ্চিৎ উন্নত ও রক্তবর্ণ এবং নিতম্বযুগল ও স্তনযুগল স্হূল ছিল। বিচিত্রবীর্য সাত বৎসর ধরে দুই স্ত্রীর সঙ্গে অতিরিক্ত বিহার করে যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত হলেন। সকল চিকিৎসকের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোকগমন করলেন।

*

শান্তনুর বংশধারা শেষ হল। এর পর আরম্ভ হল ব্যাসদেবের বংশধারা। কিন্তু ব্যাসের রক্তজাত সন্তানেরা পূণ্যাত্মা হল না। মাতা অম্বিকা সঙ্গমকালে বিতৃষ্ণায় চক্ষু বন্ধ করে রাখলে জ্যেষ্ঠপুত্র ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হলেন। মাতা অম্বালিকা সঙ্গম-পুরুষের কুৎসিত চেহারা দেখে বিবর্ণ হয়ে গেলেন। ফলে তাঁর পুত্র হল পাণ্ডুর। পাণ্ডুর জীবনও স্বাভাবিক হল না। সঙ্গমরত মুনি ও মুনিপত্নীকে বধ করে তিনি প্রজনন শক্তি হারালেন। দাসীর গর্ভে জাত ব্যাস-পুত্র বিদুর হলেন অসাধারণ ধার্মিক, সর্বোত্তম এক মানব।

কিন্তু এই মুহূর্তে ভীষ্মের জীবনের পরিণতিও স্থির হয়ে গেল। অম্বাকে গ্রহণ করলেন না শাল্বরাজা। অম্বার জীবন নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে সে শূলপাণির আশীর্বাদ লাভ করল। পরজন্মে সেই হবে ভীষ্মের মৃত্যুর-কারণ।

১২
ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু ও বিদুরের জন্ম

বিচিত্রবীর্যের বিয়োগব্যথা ভীষ্মকে ব্যথাতুর করে তুলল যতখানি, তার থেকে ঢের বেশি উদবিগ্ন করে তুলল কারণ কুরু বংশের সিংহাসনে বসার মতো কেউ আর রইল না। মাতা সত্যবতীও উপলব্ধি করলেন কী গুরুতর ক্ষতি ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার ফলে ঘটেছে। প্রথমত, তিনি সিংহাসনে বসবেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি স্ত্রী গ্রহণ করবেন না। সুতরাং ভীষ্মের কোনও সন্তানের জন্মের সম্ভাবনাও নেই। তবুও সত্যবতী শেষ চেষ্টা করলেন। নিয়োগ-প্রথার উল্লেখ করে ভীষ্মকে বললেন, “ আমার পুত্র তোমার ভ্রাতা ছিল, সে বলবান এবং তোমার বিশেষ প্রিয়ও ছিল। সে বাল্যাবস্থায় অপুত্রক স্বর্গে গিয়েছে। সেই ভ্রাতার মহিষীদ্বয় কাশীরাজকন্যা, শুভলক্ষণযুক্তা, রূপযৌবনসম্পন্ন এবং পুত্রকামার্থী। অতএব তুমি আমাদের বংশরক্ষার জন্যে আমার আদেশে এদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করো এবং তা করে ধর্ম অর্জন করো।”

কিন্তু ভীষ্ম সরাসরি সত্যবতীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। ভীষ্ম বললেন, “সন্তান উৎপাদন বিষয়ে আমার প্রতিজ্ঞা আপনি অবগত আছেন। পৃথিবী গন্ধ ত্যাগ করতে পারে, জল আপন রস ত্যাগ করতে পারে, তেজ নিজের রূপ ত্যাগ করতে পারে, বায়ু স্পর্শগুণ ত্যাগ করতে পারে, সূর্য আলো ত্যাগ করতে পারেন, অগ্নি উষ্ণতা ত্যাগ করতে পারেন, আকাশ শব্দ ত্যাগ করতে পারে, চন্দ্র শীতরশ্মিতা ত্যাগ করতে পারেন, ইন্দ্র পরাক্রম ত্যাগ করতে পারেন, ধর্মরাজও ধর্ম ত্যাগ করতে পারেন— কিন্তু আমি সত্য ত্যাগ করতে পারি না।”

ভীষ্ম কিছুতেই সত্য ত্যাগ করবেন না বুঝে সত্যবতী অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে ভীষ্মের কাছে আপন কানীন পুত্র ব্যাসের জন্মবৃত্তান্ত জানালেন। সত্যবতী ভীষ্মকে বললেন, “তুমি অনুমতি করলে নিশ্চয়ই আমার পুত্র সেই মহাতপস্বী বেদব্যাস বিচিত্রবীর্যের ভার্যাদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবেন।” ভীষ্ম এই বৃত্তান্ত শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে সত্যবতীকে বললেন যে সত্যবতীর কথা কুরুবংশের হিতকর, মঙ্গলজনক ও ন্যায়সঙ্গত ও ভীষ্মের অত্যন্ত অভিপ্রেত।

সত্যবতী স্মরণ করা মাত্র বেদব্যাস বেদ পাঠ করতে করতে সকলের অজ্ঞাতে ক্ষণমধ্যে মাতা সত্যবতীর সম্মুখে উপস্থিত হলেন। সত্যবতী বহুকালের পর পুত্রকে দেখে যথাবিধানে স্বাগত প্রশ্নে তাঁকে সম্মান জানালেন, আলিঙ্গন করলেন, স্তনদুগ্ধে তাঁকে অভিষিক্ত করলেন এবং বললেন, বিদায়কালে বেদব্যাস তাঁকে বলেছিলেন যে প্রয়োজনে তাঁকে স্মরণ করলেই তিনি মায়ের কাছে চলে আসবেন।

বেদব্যাস বললেন, “আমি উপস্থিত হয়েছি, আপনি আদেশ করুন, আমি আপনার প্রিয় কার্য সম্পাদন করব।” সত্যবতী বললেন, তিনি যেমন বেদব্যাসের জননী তেমনি বিচিত্রবীর্যের জননী ছিলেন। ব্যাস এবং বিচিত্রবীর্য উভয়েই তাঁর গর্ভস্থ সন্তান। সুতরাং বিচিত্রবীর্য ব্যাসের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন। তিনি রোগগ্রস্ত হয়ে পরলোকগমন করেছেন। কিন্তু তাঁর দুই ভার্যা দেবকন্যার মতো রূপ ও যৌবনসম্পন্না। তাঁরা ধর্ম অনুসারে পুত্রকামনা করছেন। অতএব ব্যাসদেব, সেই ভ্ৰাতৃভার্যাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে এই বংশ রক্ষা করুন।

সত্যবতীর আবেদন শুনে ব্যাসদেব বললেন যে, তিনি সত্যবতীর আদেশ পালন করবেন। “আমি ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের জন্য মিত্র ও বরুণ দেবতার তুল্য পুত্র উৎপাদন করব। অতএব আমার নির্দেশ অনুসারে রানিরা দুজনে এক বৎসর ব্রত পালন করুন। তারপর তাঁরা দুজনে শুদ্ধ হলে আমি তাঁদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করব। কেন না অশুদ্ধ রমণী আমার কাছে আসতে পারে না। সত্যবতী পুত্রকে বললেন, “রাজ্য অরাজক। রানিরা যাতে সদ্য গর্ভধারণ করেন, তুমি তাই করো। অরাজক রাজ্যে বৃষ্টি হয় না, দেবতা প্রসন্ন হন না, আর আমরাই বা কী করে রাজ্য রক্ষা করব। দ্বৈপায়ন, তুমি শীঘ্র রানিদের গর্ভ উৎপাদন করো; ভীষ্ম সেই সন্তানদের লালন পালন করবেন।”

বেদব্যাস বললেন, “মা যদি আমাকে অকালে পুত্র উৎপাদন করতে হয়, তবে রানিদের আমার এই বিকৃত রূপ সহ্য করতে হবে। অম্বিকাদেবী যদি আমার শরীরের গন্ধ, বেশ, রূপ এবং এই বিকৃত দেহ সহ্য করতে পারেন তবে আজই তিনি উৎকৃষ্ট গর্ভধারণ করবেন।” এই বলে ব্যাসদেব তখন অন্তর্হিত হলেন।

তখন সত্যবতী নির্জনে অম্বিকাকে ডেকে বললেন, “ভীষ্মের পরামর্শ অনুযায়ী বিনষ্ট ভরতবংশ তোমাকে পুনরায় উদ্ধার করতে হবে। তোমাকে পুত্ৰ প্রসব করতে হবে। এই বংশের ভারবহনের জন্য উপযুক্ত পুত্র প্রয়োজন। অদ্য রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে তোমার এক দেবর তোমার শয়নকক্ষে প্রবেশ করবেন। তুমি সতর্ক হয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে।” অম্বিকা মাতা সত্যবতীর কথায় সম্মত হয়ে মনোহর শয্যায় শয়ন করে দেবর ভীষ্মকে এবং অন্যান্য দেবর স্থানীয় কুরুবংশীয় প্রধান পুরুষকে চিন্তা করতে লাগলেন।

রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে অম্বিকার জন্য নিযুক্ত ব্যাসদেব সেই কক্ষে প্রবেশ করলেন। তখন সেই গৃহে বহু দীপ জ্বলছিল। বেদব্যাসের জটা ও তামাটে দাড়ি গোঁফের স্তূপ এবং তীব্র তীক্ষ্ণ দুই চোখ দেখেই ভয়ে অম্বিকা চোখ বন্ধ করে ফেললেন। সত্যবতীর প্রিয় কার্যকারী ব্যাসদেব সেই অবস্থাতেই অম্বিকার সঙ্গে রমণকার্য শেষ করলেন। বিতৃষ্ণায় সমস্ত সময়ে অম্বিকা একবারও চোখ খুললেন না। বেদব্যাস শয়নকক্ষের বাইরে এলে মাতা সত্যবতী তাঁকে প্রশ্ন করলেন, “ব্যাস এর গর্ভে গুণবান রাজপুত্র হবে তো?” উত্তরে বেদব্যাস বললেন, মা এর গর্ভে যে পুত্র সন্তান হবে, সে দশ হাজার হস্তীর তুল্য বলবান, বিদ্বান, রাজর্ষিশ্রেষ্ঠ, অত্যন্ত ভাগ্যবান, উৎসাহী ও বিশেষ বুদ্ধিমান হবে। তাঁর একশত পুত্রও হবে। কিন্তু মায়ের দোষে অম্বিকার পুত্র অন্ধই হবে।” সত্যবতী ব্যাসকে বললেন যে, অন্ধ ব্যক্তি কুরুবংশের রাজা হতে পারেন না। অতএব ব্যাসদেবকে আর একটি পুত্রের জন্ম দিতে হবে যে ভরতবংশ রক্ষা এবং পিতৃবংশের বৃদ্ধি করতে পারবে। ‘তাই হবে’বলে ব্যাসদেব পুনরায় অন্তর্হিত হলেন। যথাক্রমে অম্বিকা একটি অন্ধ পুত্র প্রসব করলেন। সেই পুত্রের নাম হল ধৃতরাষ্ট্র।

সত্যবতী পুত্রবধু অম্বালিকাকে পূর্বের মতো কথা বলে শয়নকক্ষে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিলেন। সত্যবতী আহ্বান করলে ব্যাসদেব আবার বিকৃত আকারে এসে অম্বালিকাকে ধরলেন। অম্বালিকাও তাঁর পিঙ্গলবর্ণ দাড়ি, জটা ও নয়নযুগল দেখে ভয়ে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেলেন। ব্যাস তাঁকে ভীত ও পাণ্ডুবর্ণ দেখে বললেন, “সুন্দরী আমার বিকৃতমূর্তি দেখে তুমি যখন পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গিয়েছ, তখন তোমার পুত্রও পাণ্ডুবর্ণ হবে, এবং তার নাম হবে ‘পাণ্ডু’।” ব্যাসদেব ঘর থেকে বাইরে এলে সত্যবতীর প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “এই বালক যথাকালে অত্যন্ত বিক্রমশালী ও জগদ্বিখ্যাত হবে। কিন্তু মায়ের দোষে পাণ্ডুবর্ণ হবে। এই বালকের আবার মহাধনুর্ধর পাঁচটি পুত্র হবে।” এই বলে ব্যাসদেব চলে গেলেন। সত্যবতী ব্যাসের কাছে আরও একটি পুত্র চাইলে ব্যাস “তাই হবে” বলে চলে গেলেন।

সত্যবতী আবার পুত্রবধূ অম্বিকাকে ব্যাসের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। কিন্তু অম্বিকা ব্যাসের বিকট রূপ, শরীরের বিকৃত গন্ধ স্মরণ করে নিজের পরিবর্তে পরমসুন্দরী আপন দাসীকে অলংকারে সাজিয়ে দিয়ে বেদব্যাসের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ব্যাস উপস্থিত হলে সেই দাসী প্রত্যুদগমন করে অভিবাদন করলেন। ব্যাসের অনুমতিক্রমে তাঁকে পরিচর্যা ও আদর করলেন। ব্যাসও সেই দাসীকে মৌখিক অনুরাগ জানিয়ে অঙ্গস্পর্শ করে কামসম্ভোগ করে সন্তুষ্ট হলেন। বেদব্যাস সেই আনন্দমগ্না দাসীর সঙ্গে সহবাস করে ওঠার সময়ে তাঁকে বললেন, “তুমি আমার অনুগ্রহে আজ থেকে আর কারও দাসী থাকবে না।”

কোন শ্রেষ্ঠ পুরুষের গর্ভরূপে তোমার উদরে আবির্ভাব ঘটেছে। ইনি ধার্মিক এবং জগতে সমস্ত বুদ্ধিমানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হবেন।”

বেদব্যাসের সেই পুত্ৰই ‘বিদুর’ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন এবং মহাত্মা ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর ভ্রাতা বলে পরিচিত ছিলেন।

স জজ্ঞে বিদুরো নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়নাত্মেজঃ।

ধৃতরাষ্ট্রস্য বৈ ভ্রাতা পাণ্ডোশ্চৈব মহাত্মনঃ|| আদি: ১০০; ৩২||

বেদব্যাসও অম্বিকার প্রতারণা এবং শূদ্রার গর্ভে নিজের পুত্রোৎপত্তি ইত্যাদি সমস্ত বৃত্তান্ত সত্যবতীকে জানালেন।

*

ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ড ও বিদুরের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে কুরুবংশের প্রত্যক্ষ রক্তধারাও শেষ হল। অবশ্য তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী এই পুত্রেরা পরিণেতার পুত্র হিসাবে কৌরব ও বিদুর পারশব নামে পরিচিত ছিলেন।

ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পিতা ব্যাস সত্যবতীর কানীন পুত্র। আর ভীষ্ম হলেন সত্যবতীর সতীনের পুত্র। ভীষ্ম কৌরব বংশের কুলরক্ষক প্রহরী হিসাবে ব্যাসের একপুত্রের বংশধরদের রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাসের আর এক পুত্রের সন্তানেরা দেবতা দ্বারা নিযুক্ত হয়ে শতশৃঙ্গ পর্বতে জন্মগ্রহণ করলেন।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ব্যাসের এক পক্ষের পৌত্রেরা অর্থাৎ কৌরবেরা ভীষ্ম দ্বারা রক্ষিত হয়ে ব্যাসের অন্য পৌত্রদের অর্থাৎ পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধের পর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। পাণ্ডবপক্ষে ছিলেন কৃষ্ণরূপী চক্রপাণি। তাই মহাভারত এক অর্থে সত্যবতীর দুই পুত্রের মধ্যে সংগ্রাম ও সংঘর্যের কাহিনি, তার থেকেও বেশি ব্যাসদেবের বংশধরদের সংগ্রাম কাহিনি।

১৩
অভিশপ্ত পাণ্ডু

একদিন পাণ্ডু, হরিণ ও হিংস্ৰজন্তুপরিপূর্ণ মহাবনে বিচরণ করার সময় মৈথুনপ্রবৃত্ত একটি প্রধান হরিণকে দেখতে পেলেন। তিনি স্বর্ণখচিত, সুন্দর, কঙ্কপত্রযুক্ত ও শীঘ্রগামী পাঁচটি তীক্ষ্ণ শরনিক্ষেপ করে সেই হরিণ ও হরিণীকে বিদ্ধ করলেন। হরিণটি কিন্তু আসলে হরিণ ছিল না, মহাতেজস্বী ঋষিকুমার কিমিন্দম হরিণ রূপ ধারণ করে হরিণী রূপধারিণী আপন ভার্যার সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। হরিণরূপী সেই ঋষিকুমার ভার্যার সঙ্গে মিলিত অবস্থায় তিরবিদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ বিকল ইন্দ্রিয় অবস্থায় ভূতলে পতিত হলেন। মনুষ্যজনোচিত বাক্যে তিনি বিলাপ করতে লাগলেন। তিনি মহারাজ পাণ্ডুকে বললেন, “কামার্ত, ক্রুদ্ধ, মূঢ় এবং পাপাসক্ত লোকেরাও এমন নৃশংস কাজ করে না। বুদ্ধি দৈবকে লুপ্ত করতে পারে না, কিন্তু দৈবই জীবনের বুদ্ধিলোপ করে দেয়। মহারাজ, আপনি চিরধার্মিকদের প্রধান বংশে জন্মেছেন। এই অবস্থায় আপনি কামে ও লোভে অভিভূত হলেন কেন? আপনার বুদ্ধি সৎপথভ্রষ্ট হল কেন?”

পাণ্ডু বললেন, “যে কারণে রাজাদের শত্রুবধে প্রবৃত্তি হয়ে থাকে, সেই একই কারণে মৃগবধেও প্রবৃত্তি হয়ে থাকে। সুতরাং তুমি মোহবশত মৃগয়ার নিন্দা করতে পারো না। শাস্ত্রকারগণও অকপট বেশে এবং অকপট ব্যবহারে মৃগবধ অনুমোদন করে থাকেন। সুতরাং তা রাজাদের ধর্ম। অতএব তোমার ক্রোধ হওয়া উচিত নয়। দেখো, মহর্ষি অগস্ত্য মহাবনমধ্যে যজ্ঞে প্রবৃত্ত থেকে, বন্য সমস্ত পশুকে প্রেক্ষণের মধ্য দিয়ে মৃগয়া করেছিলেন। বেদে যে ধর্ম দেখা যায়, আমি তদনুসারেই তোমাকে বধ করেছি। বিশেষত ঋষি অগস্ত্যের উদাহরণ অনুযায়ী অন্য ঋষিরাও তোমাদের বধ করে তোমাদের বসা দিয়ে হোম করে থাকেন।”

মৃগরূপী ঋষিকুমার বললেন, “ধার্মিক লোকেরা ফাঁক পেলেই শক্রর প্রতি বাণক্ষেপ করেন না। উপযুক্ত সময়েই শত্রুবধ প্রশস্ত বলে মনে করেন।” পাণ্ডু বললেন, “মৃগ সাবধান হোক আর অসাবধান হোক, দেখা পেলেই রাজারা মৃগবধ করেন। তবে তুমি আমার নিন্দা করছ কেন?”

মৃগরূপী ঋষিকুমার আবার বললেন, “মহারাজ, আপনি আমাকে মৃগ বলে বধ করেছেন। আমি নিজের জীবনের জন্য আপনার নিন্দা করছি না। কিন্তু দয়া করে আমার মৈথুন সমাপ্তি পর্যন্ত আপনার অপেক্ষা করা উচিত ছিল। সকল প্রাণীর হিতকর ও সকল প্রাণীর হিতকর অভীষ্ট মৈথুনের সময় কোন জ্ঞানী লোক মৃগকে বধ করে? মহারাজ! আমি পুত্র উৎপাদনের জন্য আনন্দে এই মৃগীর সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম। আপনি তা নিষ্ফল করে দিলেন। পৌরববংশে আপনার জন্ম, এ কাজ আপনার পক্ষে উপযুক্ত হয়নি। সকল লোকই, গুরুতর নৃশংস কাজের নিন্দা করে থাকে। কারণ তা স্বর্গের প্রতিবন্ধক এবং লোকনিন্দার কারণ। হে দেবতুল্য মহারাজ! আপনি তো স্ত্রীসুখ সম্ভোগের মর্ম জানেন এবং শাস্ত্র ও ধর্মের তত্ত্ব অবগত আছেন। এই অবস্থায় এই নরকজনক কাজ আপনার উপযুক্ত নয়। আপনি রাজা, নৃশংসকার্যকারী, পাপাচারী এবং ধর্ম, অর্থ ও কামবিহীন ব্যক্তিদের দণ্ড দেওয়াই আপনার উচিত।

‘আমি বনবাসী মুনি, ফলমূলাহারী, মৃগরূপধারী, সর্বদা শান্তিপরায়ণ এবং নিরপরাধ। আপনি আমাকে বধ করেছেন, তখন আমিও আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছি। আপনি আমাকে ও আমার ভার্যাকে বধ করেছেন, আমার বংশ লোপ করে দিয়েছেন। আপনি অসংযতচিত্ত ও কামমুগ্ধ। আপনারও এইভাবেই জীবন নাশ ঘটবে। আমি তপস্যায় অতুলনীয় ‘কিমিন্দম’ নামে মুনি। মানুষের মধ্যে সম্ভোগের ইচ্ছার লজ্জা অতিক্রম করতেই আমি হরিণের রূপ ধারণ করে হরিণীরূপিণী ভার্যায় সঙ্গে রমণে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম।

“আমি হরিণ রূপে হরিণদের মধ্যে নিবিড় বনে বিচরণ করছিলাম। সুতরাং আপনি আমাকে ব্রাহ্মণ বলে জানতে পারেননি। তাই ব্রাহ্মণহত্যার পাপ আপনার হবে না।

প্রিয়য়া সহ সংবাসং প্রাপ্য কাম বিমোহিতঃ।

ত্বমপ্যস্যামবস্থারাং প্রেতলোকং গমিষ্যসি ॥ আদি: ১১২: ৩১ ॥

“তুমিও কামমুগ্ধভাবে প্রিয়তমার সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়ে সেই অবস্থাতেই প্রেতলোক গমন করবে।”—এই বলে মৃগরূপধারী সেই কিমিন্দম মুনি অত্যন্ত দুঃখিত অবস্থায় ভার্যার সঙ্গে পরলোকগমন করলেন।

কিমিন্দম মুনির পরিচয় জানার পর নিজের ভবিতব্য সম্পর্কে পাণ্ডু গভীর হতাশায় ডুবে গেলেন। দুঃখার্ত, পীড়িত চিত্তে তিনি ভার্যাদের কাছে বিলাপ করে বলেন যে, অসংযতচিত্ত, কামমুগ্ধ ব্যক্তিরা “সৎকুলে জন্মগ্রহণ করেও দুষ্কার্যের ফলস্বরূপ দুর্গতি ভোগ করে।” পাণ্ডু স্মরণ করেন তাঁর পিতাও কামুকতার জন্য বাল্য অবস্থাতেই প্রাণত্যাগ করেন। তাঁর পরলোকগত পিতার ভার্যার গর্ভে সাক্ষাৎ নারায়ণ বেদব্যাস তাঁকে উৎপাদন করেছেন। সেই তিনিও বুদ্ধি বিপত্তি হেতু মৃগয়ায় গিয়ে ন্যায়বিগর্হিত কার্য করায় দেবতারা তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন। সুতরাং বন্ধনের জীবন পরিত্যাগ করে বনবাস অবলম্বনের জন্য তিনি মনস্থির করলেন।

“আমি ভার্যা ও পরিজনদের পরিত্যাগ করে বৃক্ষমূলে থেকে গুরুতর তপস্যা করব। প্রিয় বা অপ্রিয় সমস্ত ত্যাগ করব। শোক করব না, আনন্দও করব না। নিন্দা-প্রশংসাকে সমান জ্ঞান করব। কারও আশীর্বাদের প্রার্থী হব না, কাউকে নমস্কার করব না। শীত এবং উষ্ণ প্রভৃতি দ্বন্দ্ব দুঃখ সহ্য করব। সর্বদা প্রসন্নমুখে সকল প্রাণীর হিতসাধন করব। সকল প্রাণীর প্রতি নিজের সন্তানের মতো ব্যবহার করব। একবারে পাঁচ ঘর কিংবা দশ ঘরের বেশি ভিক্ষা করব না, ভিক্ষা না পেলে উপবাস করব। ভিক্ষা পাই বা না পাই, গৃহস্থদের কাজ করব না। জীবন-মরণকে সমান দৃষ্টিতে দেখব। জীবিত মানুষ উন্নতির জন্য যে যে কাজ করে, সে সকল কাজ পরিত্যাগ করব। ধর্ম ও অর্থ ছেড়ে দিয়ে আত্মার মলরাগদ্বেষাদি নির্মুল করব। সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়ে, সকল বন্ধন ছিঁড়ে, বায়ুর মতো স্বাধীন থাকব। সর্বদা এইরূপ ব্যবহার করে মুক্তির পথ আশ্রয় করে দেহত্যাগ করব। মৃগমুনির অভিসম্পাতে আমার সন্তান উৎপাদনের শক্তি নষ্ট হয়েছে, সুতরাং গৃহস্থধর্ম আমার পক্ষে শোকের আকর, স্বধর্মভ্রষ্ট এবং নিতান্ত নিকৃষ্ট। পুত্র অভিলাষী যে লোক আদৃত বা অবজ্ঞাত হয়ে কাতর চোখে অন্য পুরুষের কাছে পুত্র উৎপাদন প্রার্থনা করে সে লোক কুকুরের মতো ব্যবহার করে।”

বনবাসে কৃতসংকল্প পাণ্ডুর কথা শুনে কুন্তী ও মাদ্রী বললেন, “মহারাজ, আমরা আপনার ধর্মপত্নী। সুতরাং আমাদের সঙ্গে করেই আপনি গুরুতর তপস্যার জন্য অন্য আশ্রম গ্রহণ করতে পারেন। তা হলে শরীর মুক্তির জন্য মহাফলজনক ধর্ম অবলম্বন করে স্বর্গলাভের পরও আপনি আমাদের ভর্তাই হবেন। আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়দমন করে আপনার সঙ্গে যাব এবং কামসুখ ও অন্যান্য সুখ ত্যাগ করে গুরুতর তপস্যা করব। আপনি যদি আমাদের ত্যাগ করেন, আমরা তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগ করব।”

পাণ্ডু বললেন, “এই ধর্মসঙ্গত বিষয় যদি তোমাদের অভিপ্রেত হয়, তবে আমি পিতা বেদব্যাসের চিরস্থায়ী সদবৃত্তির অনুসরণ করব। সুখজনক আহার পরিত্যাগ করে, বল্কল ধারণ করে ফলমূল আহার করে দিন কাটাব। প্রাতঃকালে ও সন্ধ্যাকালে অগ্নিতে হোম করব, ওই দুই সময়ে স্নান করব। পরিমিত আহার করে কৃষ্ণসারের চর্ম, জটা ধারণ করব। শীত, বায়ু ও রৌদ্রের কষ্ট সহ্য করব এবং ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হব না। দুষ্কর তপস্যা দ্বারা শরীর শুষ্ক করব, বন্য ফলমূল ও মন্ত্র ও জল দ্বারা পিতৃগণ ও দেবগণকে তুষ্ট করব। বনবাসী গৃহস্থের সঙ্গে দেখা করব না, তাঁদের অপ্রিয় আচরণ করব না। আমি বানপ্রস্থ আশ্রমের সমস্ত রীতি ক্রমে ক্রমে পালন করব।”।

মহারাজ পাণ্ড সমস্ত অলংকার উৎকৃষ্ট বস্ত্র ইত্যাদি ব্রাহ্মণদের দান করলেন। অনুচর ও ভৃত্যদের দিয়ে হস্তিনাপুরে সংবাদ পাঠালেন যে পাণ্ডু বনে থেকে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছেন। অর্থ, বিষয়ভোগ, সুখ, স্ত্রীসম্ভোগ ইত্যাদি ত্যাগ করে স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি বনগমন করেছেন।

অনুচরগণ অশ্রু ভারাক্রান্ত কণ্ঠে হস্তিনাপুরে গিয়ে এই সংবাদ প্রদান করল। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর বৃত্তান্ত শুনে শোকে কাতর হয়ে পাণ্ডুর কথাই চিন্তা করতে লাগলেন। বিষয়ভোগে তাঁরও বিতৃষ্ণা দেখে দিল।

পাণ্ডু সেই স্থান ছেড়ে নাগশত-পর্বতে গেলেন; সেখান থেকে চৈত্ররথ, চৈত্ররথ থেকে কালকূটে এবং কালকূট থেকে গন্ধমাদন পর্বতে গেলেন। এখান থেকে তিনি হংসকূট-পর্বতে এবং সেখান থেকে শতশৃঙ্গপর্বতে চলে যান।

শতশৃঙ্গ-পর্বতে পাণ্ডু অনুভব করলেন, তিনি যজ্ঞ করে দেব-ঋণ, বেদ-পাঠ ও তপস্যা করে ঋষি ঋণ, দয়াপ্রকাশ করে মনুষ্যঋণ পরিশোধ করেছেন। কিন্তু তাঁর পিতৃঋণ পরিশোধ করা হয়নি। কারণ সন্তান উৎপাদন না করলে পিতৃঋণ পরিশোধ করা যায় না। পিতৃঋণ পরিশোধের চিন্তায় পাণ্ডু ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। এই সময়ে পাণ্ডু কুন্তীর মুখে শুনলেন ঋষি দুর্বাসার কুন্তীকে অভিকর্ষণ মন্ত্রদানের বৃত্তান্ত। আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন পাণ্ডু।

*

পাণ্ডুর ইচ্ছায় কুন্তী আহ্বান করলেন দেবধর্মকে। ধর্ম ও কুন্তীর মিলনে জন্ম হয় ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের, যাঁর জীবন কাহিনি মহাভারত।

কোনও কোনও মহাভারতের চর্চাকার ঘোষণা করেছেন যে, মহর্ষি দুর্বাসা হলেন কর্ণের পিতা।

এঁরা ভুলে যান যে, মহর্ষি দুর্বাসা ধ্যানযোগে জানতে পারেন যে মানবের ঔরসে কুন্তীর সন্তান হবে না। তাই তিনি তাকে অভিকর্ষণ মন্ত্র দান করেন। দুর্বাসা কিংবা বিদুর কেউ-ই মানুষ ভিন্ন কিছু ছিলেন না। অর্থাৎ দুজনেই মানুষ ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে মিলনে কুন্তীর সন্তান হওয়া কখনও সম্ভব ছিল না। সুতরাং কর্ণকে দুর্বাসার সন্তান, অথবা বিদুরকে, যুধিষ্ঠিরের জন্মদাতা ইত্যাদি গবেষণা অর্থহীন। পিতা সূর্যদেব ও ধর্মদেব আপন আপন পুত্রের কাছে পিতৃত্ব স্বীকার করেছেন। পাণ্ডু অভিশপ্ত হওয়ার জন্যই কুন্তী ও মাদ্রীকে দেব অভিকর্ষণ করতে হয়েছিল। তাই ‘অভিশপ্ত পাণ্ডু’ মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত।

১৪
ভীমসেনের জন্ম

পাণ্ডুর অনুমতিক্রমে কুন্তীদেবী মহর্ষি দুর্বাসা প্রদত্ত মন্ত্রপাঠ করে রাজা পাণ্ডুর ইচ্ছা অনুসারে দেবগণের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পুণ্যবান ধর্মরাজকে আহ্বান করলেন। ধর্ম ও কুন্তীর মিলনে যুধিষ্ঠিরের জন্ম হল। পাণ্ডু সেই ধার্মিক পুত্র লাভ করে পুনরায় কুন্তীকে বললেন, “কুন্তী লোকে বলে যে ক্ষত্রিয় জাতি বলে সর্বপ্রধান। অতএব তুমি বলে সর্বপ্রধান একটি পুত্র বরণ করে নাও।” পাণ্ডু এই আদেশ করলে কুন্তী বায়ুকে আহ্বান করলেন। তখন অত্যন্ত বলবান বায়ুদেব মৃগে আরোহণ করে এসে কুন্তীকে বললেন, “কুন্তি আমি তোমাকে কী দেব, তুমি কী চাও আমাকে বলো।”

কুন্তী সলজ্জ হাসির সঙ্গে বললেন, “দেবশ্রেষ্ঠ, বিশালদেহ এবং সকল বীরের দর্প হরণ করতে পারে, এমন একটি বলবান পুত্র দান করুন।” সেই বায়ুদেব ও কুন্তীর মিলনের ফলে ভয়ংকর পরাক্রমশালী মহাবীর ভীমসেন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তখন তাঁকে লক্ষ্য করে এই দৈববাণী হয়েছিল, “এই বালকটি সমস্ত বলবানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হবে।” ভীমসেন জন্মগ্রহণ কালে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। জন্মের পর মাতা কুন্তী যখন ভীমসেনকে কোলে তুলে নিলেন, ভীমসেন তখন ঘুমন্ত ছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে বনের মধ্যে একটি ব্যাঘ্র প্রচণ্ড গর্জন করে উঠল। ব্যাঘ্রের গর্জনে অত্যন্ত ভীতা হয়ে কুন্তী তাঁর বুকের কাছে রাখা ভীমসেনকে ছেড়ে দিলেন। কুন্তীর মুহূর্ত অন্যমনস্কতায় তাঁর ঘুমন্ত শিশু মাতৃক্রোড় থেকে একটি পাথরের উপর পড়ে গেল। বজ্রতুল্য দৃঢ় শরীর সেই বালকটি পাথরের উপর পড়ে গেলে তার অঙ্গের আঘাত নীচের পাথরখানি শতখণ্ডে চূর্ণ করেছিল। পাথরখানি শতচূর্ণ দেখে পাণ্ডু বিস্ময়াপন্ন হলেন। চৈত্রমাসে, শুক্লপক্ষে, এয়োদশী তিথিতে, বৃহস্পতির উদয়কালে, মঘা নক্ষত্রে, সিংহস্থ চন্দ্রে, দিনে, সূর্য আকাশের মধ্যবর্তী হলে এবং অষ্টম মুহূর্ত সময়ে কুন্তীদেবী অত্যন্ত সাহসী ভীমকে প্রসব করেছিলেন।

যে দিন ভীম জন্মেছিলেন, দুর্যোধনও সেই দিন জন্মেছিলেন।

*

মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, সুপ্রসিদ্ধ জ্যোতিষী শ্রীদেবেন্দ্রমোহন জ্যোতিঃশাস্ত্রী, প্রবীণ জ্যোতির্বিৎ শ্ৰীযুক্ত রোহিণীকান্ত বিদ্যাভূষণ, পাশ্চাত্য জ্যোতির্বিৎ শ্ৰীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়গণের সহায়তায় যুধিষ্ঠির, ভীমসেন ও অর্জুনের কোষ্ঠী রচনা করেছিলেন, তাঁদের প্রণীত রাশিচক্র অনুযায়ী দেখা যায় যে (১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৫ই ডিসেম্বর প্রণীত), বন্ধনীতে প্রদত্ত তারিখ থেকে ৫১০২ (পাঁচ হাজার একশ দুই) বৎসর পূর্বে চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে দিনে যোলো দণ্ড সময়ে মঘানক্ষত্রে ভীমসেনের জন্ম হয়েছিল (যাঁরা উৎসাহী, তাঁদের হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের মহাভারতের আদিপর্বের ১১৭ পর্বের, বিশ্ববাণী প্রকাশনী সংস্করণ ১৩০৪-১৩০৫ পৃষ্ঠা দেখে নিতে অনুরোধ করা হচ্ছে)। রাশিচক্র বিচার করে তাঁরা ভীমসেনের কোষ্ঠীর ফল নিম্নানুরূপ লিখেছেন—

(১) ক্ষমাহীন, অসহিষ্ণু, ক্ষিপ্রকারী, উগ্ৰস্বভাব, বিশালবদন, পিঙ্গলনয়ন, স্ত্রীবিদ্বেষী, আমিষ ভোজনপ্রিয়, বন ও পর্বতবিহারী, অত্যন্ত ক্রোধী, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর, অভিমানী, মাতৃভক্ত, অল্পবুদ্ধি ও দ্বিমাতৃক হয়।

(২) মহাবিক্রমশালী।

(৩) সহোদর হতে সুখী, গর্বিত, কৃপণ, দয়াহীন ও বলবান।

(৪) উৎকৃষ্ট বন্ধুযুক্ত, বিশেষ বিদ্বান নয়।

(৫) পুত্র হয়; কিন্তু স্থায়ী হয় না।

(৬) অত্যন্ত বলবান, নিঃশেষে শত্রুনাশক এবং মাতুল ও পিতৃব্য দ্বারা বিপন্ন।

(৭) “কান্তাসুতপ্রীতি বিবর্জিতশ্চ” স্ত্রী পুত্রের প্রতি আসক্তিশূন্য।

(৮) দীর্ঘায়ু পাওয়ার পর বন বা পার্বত্যদেশে মৃত্যু।

(৯) ধার্মিক, সরল স্বভাব, গুরুজনভক্ত, শতায়ু, লব্ধপ্রতিষ্ঠ, শোকদুঃখহন্তা, স্বয়ং ক্লেশ সহিষ্ণু, গর্বিত এবং কলহপ্রিয়।

(১০) পিতা ও অগ্রজ থেকে শ্রেষ্ঠ, বংশমধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী, আশ্রিত প্রতিপালক এবং প্রার্থীর প্রার্থনাপূরক।

(১১) প্রিয়বিচ্ছেদ দুঃখী, রাজমান্য, কীর্তিমান ও বীর্যবান।

(১২) মাতুল দ্বারা বিপন্ন, সদ্ব্যয়ী এবং যুদ্ধে শক্রহন্তা হয়।

এই হল ভীমসেনের কোষ্ঠী ফল।

ভীমসেন মহাভারতের সর্বাপেক্ষা বলবান পুরুষ। তিনি যুধিষ্ঠিরের পিঠোপিঠি ভাই। শতশৃঙ্গ পর্বতে যুধিষ্ঠির খেলার সঙ্গী হিসাবে প্রথম যে মানবশিশুকে পেয়েছিলেন, তিনি ভীমসেন। বস্তুত ভীম তাঁর জীবনে দাদা ও গদা ছাড়া আর কিছুই জানতেন না।

অতি বাল্যকাল থেকেই ভীমসেনের অসাধারণ বাহুবলের পরিচয় সর্বত্র পাওয়া যায়। হস্তিনাপুরে পৌঁছেই তিনি ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের মাথা ঠোকাঠুকি করে, তুলে আছাড় মেরে অতীব আনন্দ উপভোগ করতেন। দুর্যোধন ও তাঁর সঙ্গীরা একাধিক বার ভীমকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছেন। তাঁকে বিষ খাইয়ে, হাত পা বেঁধে জলের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন—আবার সাপের বিষ দিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেকবার ফল ভিন্ন হয়েছে। ভীমসেন আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরেছেন। কৌরবেরা পঞ্চ-পাণ্ডব ও তাঁদের মাতাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করলে, ভীমসেন তাঁর চারভ্রাতা ও মাতাকে একাকী বহন করে নিয়ে যান।

রাক্ষস বধ ভীমসেনের একটি অত্যন্ত প্রিয় ব্যসন ছিল। বিকট দর্শন, ভয়ংকর শক্তিশালী সমস্ত রাক্ষস ভীমসেনের হাতে পড়ে নিহত হয়েছেন। বক রাক্ষস, হিড়িম্ব রাক্ষস, কির্মীর রাক্ষস, জটাসুর সকলেই ভীমের হাতে পড়ে মৃত্যু লাভ করেছেন। মাটি থেকে বড় বড় শালগাছ উপড়ে নিয়ে হাতের লাঠি করা ভীমসেনের কাছে ছেলে-খেলার ব্যাপার ছিল। এ বিষয়ে দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় অর্জুনের পাশে দণ্ডায়মান ভীমসেনের মূর্তিটি আমাদের চোখে পড়ে। সেদিন রাজসভায় হাতের কাছে অন্য অস্ত্র না থাকায় ভীমসেন একটি থাম উপড়ে নিয়েছিলেন।

স্বামী ছাড়া অন্য যে পুরুষ দ্রৌপদীকে স্পর্শ করেছে, অপমান করেছে, লাঞ্ছনা করেছে— প্রত্যেকেই ভীমসেনের হাতে মৃত্যু বরণ করেছে। একমাত্র জয়দ্রথ ছাড়া। ভগিনী দুঃশলা বিধবা হবে, এই আশঙ্কায় ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ধৃত জয়দ্রথকে মুক্তি দিতে বলেছিলেন। অত্যন্ত অনিচ্ছায় ভীমসেন জয়দ্রথকে মুক্তি দেন। কিন্তু তার পূর্বে অর্ধচন্দ্র বাণে জয়দ্রথের মাথা ইতস্তত কামিয়ে পাঁচচূড়া সাতচূড়া করে ছেড়ে দেন।

বিরাট রাজসভায় কীচক দ্রৌপদীর অসম্মান করলে ভীমসেন কীচক ও তাঁর একশো পাঁচভ্রাতাকে বধ করেন। দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করার অপরাধে তিনি দুঃশাসনকে বধ করেন ও তার বক্ষোরক্ত পান করেন। দ্রৌপদীকে বাম ঊরু দেখানোর অপরাধে তিনি দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করেন। ধৃতরাষ্ট্রের একশো পুত্র ভীমের হাতে নিহত হন।

যে কোনও দুরূহ কার্যে দ্রৌপদীর সর্বাপেক্ষা বড় সহায় ছিলেন ভীমসেন। সহস্রদল পদ্ম সংগ্রহ করতেও দ্রৌপদী ভীমসেনকেই অনুরোধ করেছিলেন। স্ত্রী-জাতি সম্পর্কে ভীমসেনের স্বাভাবিক আগ্রহ ছিল না। যদিও তিনি চারটি স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন। পুত্র ঘটোৎকচের বীরত্ব সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন গর্ব হয়তো ছিল, কিন্তু ভীম প্রকাশ করেননি। হিড়িম্বার প্রেম লাভ ভীমসেনের জীবনের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এই রাক্ষসী নারী জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁর শপথ পালন করেছেন।

ভীমসেন ভ্রাতাদের ও মাতাকে ভালবাসতেন। তাঁর মতো কঠিন মানুষের হৃদয়ে এত কোমল অনুভূতি প্রত্যাশিত ছিল না। তবুও তা নহুষের কাছে, হনুমানের কাছে প্রকাশিত হয়েছে।

ভীমসেন অপ্রতিরোধ্য। শত্রুপক্ষে সকলেই তাঁকে ভয় করতেন। সেই ভীমসেনও কর্ণের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। অবশ্য রাজসূয় যজ্ঞের সময়ে ভীম অঙ্গদেশ জয় করেছিলেন। অঙ্গরাজ কর্ণ ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসে পরাজিত হন, পালিয়ে যান ও করদান করতে বাধ্য হন। সুতরাং কর্ণের সঙ্গে তাঁর ঋণ শোধ হয়েছিল। কিন্তু তিনটি ক্ষেত্রে ভীমসেন সম্পূর্ণ পরাজিত হয়েছিলেন। যদিও তা তাঁর পক্ষে লজ্জার কারণ হয়নি। হনুমান তাঁকে দিয়েছিলেন বিচিত্র জ্ঞান, দেখিয়েছিলেন আপনার দিব্য রূপ, দিয়েছিলেন অপরিসীম শক্তি।

পূর্বপুরুষ সর্পরূপী, নহুষের কাছে তিনি অসহায়ের মতো বন্দি হয়েছিলেন। তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। যক্ষরূপী বকের আদেশ অগ্রাহ্য করতে গিয়ে তিনি মৃত্যুলাভ করেন। সেক্ষেত্রেও তাঁকে উদ্ধার করেন ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির।

যুধিষ্ঠির ভীমকে ভালবাসতেন (অন্তত ভীমসেনের দাবি তাই এবং সে দাবি যুধিষ্ঠির অস্বীকার করেননি)। যদিও দাদার সর্বদা ধর্মপ্রাণতা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। কৃষ্ণও যুধিষ্ঠিরকে ভীমসেনের প্রতি তাঁর প্রীতি স্মরণ করিয়ে বলেছেন যে, অশ্বত্থামার কাছে ব্রহ্মশির’ অস্ত্র আছে। তাই প্রিয় ভ্রাতা ভীমসেনকে পাঠানো যুধিষ্ঠিরের উচিত হয়নি। বনবাসের তেরো মাসকেই তেরো বছর ধরে নিয়ে তিনি কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যুধিষ্ঠিরকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছিলেন।

ভীমসেন শুধু খেতে ভালবাসতেন না, তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভোজনপটু, তাঁর ভোজনের জন্য দ্বৈতবন প্রায় মৃগশূন্য হয়ে গিয়েছিল। এই অত্যন্ত ভোজনপ্রিয়তার কারণেই ভীমসেনের মৃত্যু হয়। ভীমসেনের জন্ম মহাভারতের এক অতি দুর্লভ মুহূর্ত।

১৫
অর্জুনের জন্ম

ভীমসেনের জন্মগ্রহণের পর, পাণ্ডু পুনরায় চিন্তা করলেন— “লোকশ্রেষ্ঠ এবং বীরশ্রেষ্ঠ আমার আর একটি পুত্র কী প্রকারে হতে পারে?

দৈবে পুরুষকারে চ লোকোহয়ং সম্প্রতিষ্ঠিতঃ।

তত্র দৈবন্তু বিধিনা কালযুক্তেন লভ্যতে ॥ আদি: ১১৭; ২৪ ॥

“এই জগৎ দৈব ও পুরুষকার— এই দুয়ের উপর নির্ভর করে রয়েছে; তার মধ্যে পুরুষকার দ্বারাই যথাসময়ে দৈব পাওয়া যায়।

“আমরা শুনেছি যে, ইন্দ্রদেব দেবরাজ এবং তাঁদের মধ্যে প্রধান; আর, তার বল ও উৎসাহের শেষ নেই এবং তেজ ও সাহস অসাধারণ। তপস্যা দ্বারা তাঁকে সন্তুষ্ট করে একটি মহাবীর পুত্র লাভ করব। কেন না, তিনি আমাকে যে পুত্র দান করবেন, সে পুত্ৰ বীরশ্রেষ্ঠই হবে। সে পুত্র যুদ্ধে মানুষ ও অসুরদের বধ করবে; অতএব কার্য, মন ও বাক্য দ্বারা গুরুতর তপস্যা করব।”

তারপর পাণ্ডু মহর্ষিগণের সঙ্গে পরামর্শ করে কুন্তীকে এক বৎসর যাবৎ একটি মাঙ্গলিক ব্রত করবার জন্য আদেশ দিলেন। পাণ্ডু নিজে অত্যন্ত একাগ্রতার সঙ্গে ঘোরতর তপস্যা করতে থাকলেন। তিনি এক চরণে অবস্থান করে দেবরাজ ইন্দ্রের প্রসন্নতা কামনায় কুন্তীর সঙ্গে কঠিন তপস্যায় রত হলেন। বহুকাল পরে, ইন্দ্র এসে তাঁকে বললেন, “আমি তোমাকে এমন একটি পুত্র দান করব যে, সে ত্রিভুবন বিখ্যাত হবে, ব্রাহ্মণ গোরু ও বন্ধুবর্গের কার্য সাধন করবে, শত্রুগণের শোক জন্মাবে এবং সমস্ত আত্মীয়ের আনন্দ উৎপাদন করবে।” দেবরাজ কুরুরাজ পাণ্ডুকে এই কথা বলে অন্তর্হিত হলেন।

ধর্মরাজ পাণ্ডু দেবরাজের ওই কথা স্মরণ করে কুন্তীকে বললেন, “কল্যাণী দেবরাজ সন্তুষ্ট হয়েছেন; সুতরাং ভাবী ফল ভালই হবে। তিনি আমাকে ইছানুরূপ পুত্র দান করতে ইচ্ছা করেছেন; অতএব সুন্দরী, তুমি এমন একটা পুত্ৰ উৎপাদন কর যে, সে অলৌকিক কার্য করতে পারে, যশস্বী, শত্রুদমনকারী, নীতিজ্ঞ, উদারচেতা, সূর্যের তুল্য তেজীয়ান, অন্যের অজেয়, সৎক্রিয়ান্বিত, অদ্ভুতাকৃতি এবং ক্ষত্রিয়তেজের একমাত্র আশ্রয় হয়। আমরা যখন দেবরাজের অনুগ্রহ লাভ করেছি তখন তাঁকেই তুমি আহ্বান করো।”

এবমুক্তা ততঃ শক্ৰমাজুহাব যশস্বিনী।

অথাজগাম দেবেন্দ্রো জনয়ামাস চার্জুনম্‌ ॥ আদি: ১১৭: ৩৮ ॥

পাণ্ডু এই কথা বললে, কুন্তী ইন্দ্রকে আহ্বান করলেন। তারপর ইন্দ্র আসলেন এবং কুন্তীর গর্ভ উৎপাদন করলেন।

ফাল্গুন মাসে, দিনের বেলায় পূর্বফাল্গুনী ও উত্তরফাল্গুনী নক্ষত্রের সন্ধিক্ষণে একটি বালক জন্মগ্রহণ করল। ফাল্গুনমাসে ও ফাল্গুনী নক্ষত্রে জম্মেছিল বলে ওই বালকটির নাম রাখা হয়েছিল—ফাল্গুন।

এই বালকটির জন্মমাত্র আকাশ মণ্ডল শব্দিত করে মহাগম্ভীর স্বরে এক দৈববাণী হল। সেই দৈববাণী কুন্তীকে সম্বোধন করে সেই আশ্রমবাসী সমস্ত প্রাণীর সমক্ষে সুস্পষ্টভাবে এই কথা বলল, “কুন্তী তোমার এই পুত্র কার্তবীর্যার্জুনের তুল্য তেজস্বী, শিবের তুল্য পরাক্রমী এবং ইন্দ্রের তুল্য অজেয় হয়ে তোমার যশ বিস্তৃত করবে। বামনরূপী নারায়ণ যেমন অদিতির আনন্দ বর্ধন করেছিলেন, নারায়ণের তুল্য এই বালকটিও তোমার আনন্দ বর্ধন করবে। এই বালক যথাক্রমে মদ্র, কুরু, সোমক, চেদি, কাশী ও করুষদেশীয় রাজগণকে বশে এনে কুরুবংশীয় রাজলক্ষ্মীকে বর্ধিত করবে। অগ্নিদেব এঁরই বাহুবলে খাণ্ডববনে সমস্ত প্রাণীর মেদভক্ষণ করে অত্যন্ত তৃপ্তি লাভ করবেন। এই বালক ভ্রাতৃগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে, প্রধান প্রধান রাজাকে জয় করে তিনটি অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পাদন করবে। কুন্তী! বলবানের মধ্যে তোমার এই পুত্র পরশুরামের তুল্য উৎসাহী এবং বিষ্ণুর তুল্য পরাক্রমী হয়ে অত্যন্ত যশস্বী হবে। এই বালক যুদ্ধে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করবে এবং তাঁর কাছ থেকে পাশুপত অস্ত্র লাভ করবে। তোমার এই পুত্র ইন্দ্রের আদেশে দেবদ্বেষী নিবাতকবচ নামক দৈত্যগণকে বধ করবে। আর তোমার এই পুত্র সকল দিব্য অস্ত্র লাভ করবে এবং তাতেই সর্বপ্রকারে পুরুষ প্রধান হয়ে শক্রকর্তৃক অপহৃত রাজলক্ষ্মীকে পুনরায় উদ্ধার করবে।”

এই পুত্রের জন্ম হলে কুন্তী এই অদ্ভুত দৈববাণী শুনতে পেলেন। সেই দৈববাণী শুনে শতশৃঙ্গবাসী তপস্বীগণ অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। আকাশে বিমানারোহী ইন্দ্রাদি দেবগণের তুমুল দুন্দুভি ধ্বনি হতে থাকল, সেই বিশাল শব্দ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে পুষ্পবৃষ্টি হল। আর দেবগণ, সর্পগণ, গরুড়াদি পক্ষিগণ, গন্ধর্বগণ, অপ্সরাগণ, সকল প্রজাপতি, সপ্তর্ষিগণ অর্জুনের স্তব করতে লাগলেন। ভরদ্বাজ, কাশ্যপ, গৌতম, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, বশিষ্ঠ এবং সূর্য অস্ত গেলে যিনি উদিত হন, মাহাত্মশালী সেই অত্রিও সেখানে এলেন। মরীচি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, দক্ষপ্রজাপতি, অন্যান্য গন্ধর্বগণ ও অপ্সরাগণ সেখানে এলেন। স্বর্গীয় মাল্য ও বস্ত্রধারী এবং সমস্ত অলংকারে অলংকৃত অপ্সরাগণ অর্জুনকে লক্ষ্য করে গান ও নাচ করতে লাগল। মহর্ষিরা সেখানে সকল দিকে থেকে বালকের মঙ্গলের জন্য ইষ্টমন্ত্র জপ করতে লাগলেন এবং মনোহর মূর্তি তুম্বুক অন্যান্য গন্ধর্বের সঙ্গে পূর্বেই সেখানে এলেন।

ভীমসেন, উগ্রসেন, ঊর্নায়ু, অনঘ, গোপতি, ধৃতরাষ্ট্র, পুর্ণবৰ্চা, যুগপ, তৃণপ, কাঞ্চি, নন্দি, চিত্ররথ, শালিশিবা, পর্জন্য, কলি, নারদ, ঋত্বা, বৃহত্ত্বা, বৃহক, করাল, ব্রহ্মচারী, অত্যন্ত বিখ্যাত সুবর্ণ, বিশ্ববসু, ভূমনু, সচন্দ্র, শরু, মধুর গান কারী হা-হা ও হু-হু—এই সকল গন্ধর্ব সেখানে গান গাইতে লাগল।

সমস্ত অলংকারে অলংকৃতা আয়তনয়না ভাগ্যবতী অপ্সরারা সেখানে নৃত্য ও গীতে প্রবৃত্ত হল। অনুচানা, অনবদ্যা, গুণমুখ্যা, গুণাবরা, অদ্রিকা, সোমা, মিশ্রকেশী, অলম্বুষা, মরীচি, শুচিকা, বিদ্যাপর্ণা, তিলোত্তমা, অম্বিকা, লক্ষণা, ক্ষেমা, দেবী, রম্ভা, মনোবর্মা, অসিতা, সুবাহু, সুপ্রিয়া, সুবপু, পুণ্ডরীকা, সুগন্ধা, সুরসা, প্রমাথিনী, কাম্য, সারস্বতী—এই আটাশ জন অপ্সরা সেখানে সম্মিলিতভাবে নৃত্য করতে লাগল। আর মেনকা, সহজন্যা, কর্ণিকা, পুঞ্জিকস্থলা, ঋতুস্থলা, ঘৃতাচী, বিশ্বাচী, পূর্বচিত্তী, উম্লোচা, প্রম্লোচা এবং উর্বশী—এই আয়তনয়না অপ্সরারা গান গাইতে লাগল। তারা সংখ্যায় ছিলেন এগারোজন।

ধাতা, অর্যমা, মিত্র, বরুণ, অংশ, ভগ, ইন্দ্র, বিবস্বান, পূষা, মঙ্গলজনক ত্বষ্টা, পর্জন্য ও বিষ্ণু— এই বারোজন আদিত্য তৃতীয় পাণ্ডবের অভিনন্দনার্থ উপস্থিত হয়ে, তাঁর মহিমা বর্ধন করতে থেকে আকাশে অবস্থান করতে লাগলেন। মৃগব্যাধ, সর্প, নিঋতি, অজৈক পাদ, অহিব্রধ্ন, পিনাকী, দহন, ঈশ্বর, কপালী, স্থাণু ও ভগ—এই এগারোজন রুদ্র সেখানে এসে অবস্থান করতে লাগলেন। অশ্বিনীকুমারদ্বয়, অষ্ট বসু, ঊনপঞ্চাশ বায়ু, বিশ্বদেবগণ ও সাধ্যগণ সেখানে উপস্থিত হলেন।

কর্কোটক, অনন্ত, বাসুকি, কচ্ছপ, কুণ্ড, তক্ষক প্রভৃতি তপস্বী, অত্যন্ত ক্রোধী ও অত্যন্ত বলবান নাগ ও অন্যান্য বহুতর নাগ সেখানে অবস্থান করতে লাগলেন। তার্ক্ষ, অরিষ্টনেমি, গরুড়, অসিতধ্বজ, অরুণ ও আরুণি—বিনতার এই সন্তানগণও সেখানে উপস্থিত হলেন। স্বর্গবাসী লোকেদের মধ্যে অনেকে বিমানে ও পর্বতের উপর অবস্থান করছিলেন কেবল তপসিদ্ধ মহর্ষিরাই তা দেখতে পেলেন। তপসিদ্ধ মহর্ষিরা এই আশ্চর্য ঘটনা দেখে বিস্মিত হয়ে অর্জুনের জন্মগ্রহণে অত্যন্ত আনন্দ লাভ করলেন।

ভীমসেনের মতো অৰ্জুনেরও জন্মপত্রিকা রচিত হয়েছে। (ভীমসেনের জন্ম দ্রষ্টব্য)। কোষ্ঠী ও রাশিচক্রের বিচার অনুযায়ী অর্জুনের কোষ্ঠীর ফল নিম্নানুরূপ:-

১। সাধুজন সংসর্গপ্রিয়, বিনয়ী, বলবান, দয়ালু, দেবদ্বিজভক্ত, দাতা, লোকমান্য অতিধীর, বিদেশগামী, সাহসী, রণপ্রিয়, শত্ৰুহন্তা হয়।

২। রাজ্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, ধনবান, দীর্ঘজীবী, সৎকার্যপরায়ণ এবং সুদৃঢ় দেহের অধিকারী।

৩। (বশিষ্ঠজাতকমতে কল্পবৃক্ষ যোগ ও তার ফল) অসাধারণ প্রতাপশালী, যুদ্ধবিশারদ এবং যোদ্ধা বলে বিখ্যাত হন। আর, এঁর স্ত্রী সর্বগুণ সম্পন্না হন।

৪। সর্বপ্রকার বিদ্যায় অধিকারী, সর্বপ্রকার যানচর্যায় সুনিপুণ ও মাতৃকুলের সুখজনক হয়। আর, স্ত্রী বান্ধবপক্ষ দ্বারা বিশেষ সাহায্য লাভ করে।

৫। অসাধারণ গুণসম্পন্ন বীরপুত্র লাভ করে। আবার সেই পুত্রের মৃত্যুতে দারুণ শোক পায়; কিন্তু বংশহীন হয় না।

৬। ব্রাহ্মণ প্রবল শত্রু হয়, আরও বহু শত্রু হয়, পরে সেই শত্রু সমূলে বিনষ্ট হয়।

৭। (সর্বার্থচিন্তামণি এই মতে) উৎকৃষ্ট বহু স্ত্রী লাভ করে।

৮। বন ও পর্বতচারী হয়, পরিশেষে পার্বত্যপ্রদেশে এর মৃত্যু ঘটে।

৯। (কুণ্ডলীকল্পতরু মতে) তীর্থচারী, পবিত্র স্বভাব, স্বধর্মপরায়ণ এবং জগদ্বিখ্যাতকীর্তি হয়ে থাকে। (জাতকাভরণ মতে) অতিথি, গুরু এবং দেবতা অর্চনাপরায়ণ ও মুনিব্রতাবলম্বী আর (বৃহস্পাতক মতে) বহু গুণশালী, নিরহংকার ও উৎকৃষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন হয়।

১০। (জ্যোতিষ কল্পবৃক্ষ মতে) শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও মনুষ্যপ্রধান (বৃহৎপরাশরীর মতে), সমস্ত রাজন্যকর্তৃক সম্মানিত এবং অল্প বয়সে অকস্মাৎ পিতৃবিয়োগে অত্যন্ত সন্তপ্ত হয়।

১১। (বৃহজ্জাতক মতে কেমদ্রুমযোগ ও তাহার ফল) বিদেশবাসী, অর্থাভাবে অত্যন্ত কষ্টভোগী, অন্যের আনুগত্যকারী এবং জ্যেষ্ঠভ্রাতার বিশেষ অনুগত হয়।

১২। কোনও ভার্যা এঁর প্রতি শত্রুতা আচরণ করে এবং তাতে এঁর পরাভব ঘটবে।)

জন্ম হল ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অতিরথের। মানবীর গর্ভে দেবতার সন্তান আবির্ভাব আমরা আগেও দেখেছি। কিন্তু এত মাতামাতি পূর্বে কখনও দেখিনি। আকাশ বাতাস, জলধি-পর্বত ভূমি অন্তরীক্ষ—সর্বত্রই আনন্দের উচ্ছ্বাস। মুনিগণ ঋষিগণ বসু-সাধ্য গন্ধর্ব কিন্নর রুদ্র আদিত্য—সকলেই ছুটে এসেছেন নবজাতককে বরণ করতে। গরুড়-নাগ পরস্পর বৈরিতা ত্যাগ করে উপস্থিত হয়েছে দেবরাজ ইন্দ্রের মানব সন্তানের জন্ম মুহূর্তের সাক্ষী হতে।

কী তৃপ্ত, আনন্দিত দেবরাজ ইন্দ্র। তিনি সকল দেবতাকে আহ্বান করেছেন তাঁর সন্তানকে দেখতে। প্রকৃতির আদরের দুলাল অর্জুন। সকল দেবতার (সূর্যদেব বাদে) অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। গুরু দ্রোণাচার্যের তিনি পুত্র অপেক্ষা প্রিয় শিষ্য। ভীষ্মের মতে তাঁর মতো বীর পৃথিবীতে পূর্বে ছিল না, বর্তমানে নেই, ভবিষ্যতেও হবে না। আমরা জানব তিনি পূর্বে ছিলেন নর-ঋষি। তাঁর সখা স্বয়ং নারায়ণ। পিতার স্নেহধন্য অর্জুন। অথচ জীবনের সর্বপ্রথম বিরাট যুদ্ধ তাঁর পিতৃদেবের বিরুদ্ধেই। অসুস্থ অগ্নিদেবকে সহায়তা করলেন কৃষ্ণ ও অর্জুন। পিতা ইন্দ্র দেবকুলের সঙ্গে অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে পরাজিত হলেন। কিন্তু তাতে পিতা অধিক সন্তুষ্টই হলেন৷ গোটা মহাভারত জুড়ে অর্জুনের প্রতি পিতা ইন্দ্রের স্নেহময় পিতৃ-ভূমিকা আমাদের মুগ্ধ করে। সন্তানকে জগতের শ্রেষ্ঠ বীর করতে তিনি তাঁকে পথি-প্রদর্শন করেছেন। দেব মহেশ্বরের সাক্ষাৎ পাওয়ার উপায় বলেছেন। অর্জুন সেই উপদেশ পালন করে মহাদেবের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। পেয়েছেন আশীর্বাদ সহ তাঁর পাশুপত অস্ত্র। পাশুপত-অস্ত্র লাভের পর ইন্দ্র তাঁকে দিয়েছেন প্রয়োগসহ সকল দিব্যাস্ত্র। পুত্র দেবতাদের অপ্রিয় কালকেয় বধ ও নিবাত কবচ অসুর বধ করে ফিরলে রক্তমাংসের পিতার মতো তাঁকে আদর করেছেন। নিজের আসনের অর্ধে বসতে দিয়েছেন। পুত্রের ভোগের বয়স হয়েছে ভেবে উর্বশীকে তাঁর ঘরে যেতে বলেছেন। পুত্রের বিরুদ্ধ একমাত্র শক্তি নিজে হরণ করেছেন। একেবারে স্নেহময় পার্থিব পিতার ভূমিকা ইন্দ্রের। এই মানব-পুত্রটিকে নিয়ে দেবরাজের অসাধারণ গর্ব ছিল। তখনই দেবরাজের প্রতি পাঠকের ভক্তি ও শ্রদ্ধা আরও অনেক বেড়ে যায়, যখন দেখা যায় অর্জুনের নিঃসঙ্গ মৃত্যুর সময়ে— যাঁর জন্মের সময়ে গোটা প্রাণীজগৎ আনন্দে মুখর হয়েছিল— সেই অর্জুন মৃত্যুমুখে পতিত হলেন পার্বত্যদেশে অসহায় নিঃসঙ্গ অবস্থায়। এই অবস্থায় ইন্দ্র কিন্তু এলেন না। দৈব-বিচারেই তিনি বুঝেছিলেন অর্জনের পতন তাঁর অন্তঃস্থিত অহমিকায়। সে শাস্তি তাঁকে পেতেই হবে। ইন্দ্র সব দেবতাকে অর্জুনকে অস্ত্রদানে সম্মত করাতে পেরেছিলেন, একমাত্র সূর্য ছাড়া। সূর্যের এই মানবিক বৈরিতাও আমরা সমর্থন করতে পারি।

অর্জুনের প্রথম দৈবী সহায়তা লাভ অগ্নিদেবের কাছ থেকে। গাণ্ডিব ধনু দেবদত্ত শঙ্খ, দুই অক্ষয় তূণীর অগ্নিদেব দিয়েছিলেন অর্জুনকে। কৃষ্ণকে দিয়েছিলেন পাঞ্চজন্য শঙ্খ এবং সুদর্শন চক্র। এগুলি সব অগ্নিদেব দিয়েছিলেন বরুণদেবের কাছ থেকে। অর্জুনের সহায়তায় অগ্নিদেব নীরোগ হলেন। সেই অগ্নিদেব এতখানি উপকারী মানুষটির মাতাকে যখন গ্রাস করলেন, তখন সেই অব্যর্থ দৈবী বিচারের প্রতি শ্রদ্ধা জাগে। যে বরুণদেব দিলেন সুদর্শন চক্র। তিনিই গ্রাস করলেন দ্বারকা নগরী। মহাপ্রস্থানের পথে অগ্নিদেব অত্যন্ত ঋজু ও স্পষ্ট গলায় অর্জুনের কাছে দাবি করলেন গাণ্ডিব ধনু ও অক্ষয় তূণীর। বললেন— পৃথিবীর প্রয়োজন তাঁর শেষ হয়েছে।

গুরু দ্রোণাচার্যকে অত্যন্ত ভক্তি করতেন অর্জুন। বস্তুত যুধিষ্ঠিরের অর্ধ-সত্য উচ্চারণের কিছু দায়িত্ব অর্জুনের। অর্জুন, যিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর— তিনি দ্রোণাচার্যকে থামাবার কোনও চেষ্টাই করেননি। নিষ্ক্রিয় হয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন। যে কৃষ্ণ যুদ্ধের চতুর্থ দিনেই ভীষ্মের দিকে সুদর্শন চক্র নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। তিনিও দ্রোণাচার্যের ব্রহ্মাস্ত্রে সাধারণ সৈন্যরা নির্বিচারে নিহত হচ্ছেন দেখে, তাঁর দিকে ধেয়ে গেলেন না, যুধিষ্ঠিরকে অনুরোধ করলেন অশ্বত্থামা নিহত এই সংবাদ দিতে। একথা স্পষ্ট দ্রোণাচার্য, অর্জুন অথবা কৃষ্ণকে, সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত ব্যক্তি মনে করতেন না। যুধিষ্ঠির পাণ্ডবপক্ষের রাজা। তিনি নির্বিচারে আপন সৈন্যদের মৃত্যু দেখতে পারেন না। তাই তিনি আপন রথকে নামিয়ে আনলেন ধরণীতে। কিন্তু এই ঘটনায় তিনি কোনও মতেই ছোট হয়ে যাননি।

অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে ঈশ্বরের মতো ভক্তি করতেন। তিনি ছিলেন যুধিষ্ঠিরের ভ্রাতাশ্চ শিষ্যশ্চ। যুধিষ্ঠিরের প্রতিটি সিদ্ধান্ত তিনি সমর্থন করেছেন এবং সমর্থন করেছেন শাস্ত্র বচন অনুযায়ী। শুধুমাত্র যুদ্ধজয়ের পর যুধিষ্ঠির রাজ্যগ্রহণে অস্বীকার করলে, অর্জুন তা সহ্য করতে পারেননি। তিনি ক্ষত্রিয়, শত্রুবিজয়ের পর সিংহাসন আরোহণ তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের শোক অনুভবের সামর্থ্য তাঁর ছিল না। ওই জাতীয় যুদ্ধ যে জয়-পরাজয়কে সমার্থক করে দেয়— বিশ্বব্যাপী পড়ে থাকে এক শূন্যতা, তা বোধ করার শক্তি অর্জুনের ছিল না। যেমন অর্জুন সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলেন যুদ্ধের পূর্বে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখে। অর্জুন উপলব্ধিই করতে পারেননি বনবাসের শেষ দিনে যক্ষরূপী বকের নিষেধ অগ্রাহ্য করার ফলে তাঁর মৃত্যুর তাৎপর্যকে। জীবনে বাধ্যতারও যে প্রয়োজন আছে, সর্বত্র গাণ্ডিব তুলে— “আমি অর্জুন” এই ঘোষণায় যে সবসময় শুভ হয় না, অর্জুন কোনও দিনই তা বোঝেননি।

অভিমন্যুকে পিতা অর্জুন ভালবাসতেন। কিন্তু জয়দ্রথের মৃত্যুর পর অভিমন্যুর কথা অর্জুন আর স্মরণ করেননি। তিনি মেনে নিয়েছিলেন, ক্ষত্রিয়ের পুত্র রণক্ষেত্রে নিহত হয়েছে। এই তো স্বাভাবিক। কিন্তু অভিমন্যর মৃত্যু যুধিষ্ঠিরকে অনেক বেশি আঘাত করেছিল। আর, অর্জুনের জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞাও যুধিষ্ঠির মানতে পারেননি। “অর্জুন অল্প-কারণে জয়দ্রথের বধের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আমি সন্তুষ্ট হইনি। কারণ, তাঁর প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত ছিল, দ্রোণ কিংবা কর্ণবধের।” দ্রোণের সঙ্গে অর্জুন কখনও সমস্ত কৌশল, দক্ষতা নিয়ে যুদ্ধ করেননি— সম্ভবত একলব্যের গুরুদক্ষিণার কথা স্মরণ রেখেই।

অর্জুন অসাধারণ যোদ্ধা ছিলেন। একক যুদ্ধে তিনি খাণ্ডবদাহনের সময় দেবরাজ সমেত দেবগণকে, গো-বধ হরণের সময় বৃহন্নলারূপে সমস্ত কৌরব পক্ষকে, কালকেয় ও নিবাত-কবচ অসুরগণকে, এমনকী তিনি পিনাকপাণি শিবের সঙ্গে (অবশ্য না জেনে) যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনকে কোনও অসাধ্য সাধন করতে হয়নি। শিখণ্ডীর পিছনে থেকে ভীষ্মকে, সুর্ষমা সমেত সংশপ্তককে, জয়দ্রথকে আর কর্ণকে নিধন করেছিলেন অর্জুন এবং অবশ্যই ভগদত্তকে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কৃষ্ণ দিয়েছিলেন অকৃত্রিম সহায়তা। অন্তত যুদ্ধক্ষেত্রে চারবার অর্জুনকে রক্ষা করেছিলেন তিনি। বিপক্ষের অন্যান্য প্রধান বীরদের হত্যা করেছিলেন ভীমসেন, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন। শল্যকে নিধন করেছিলেন যুধিষ্ঠির। দূত সঞ্জয়ের কাছে যে দৃপ্ত আত্মঘোষণা করেছিলেন অর্জুন ‘‘আমি এক রথে এক দিনে সম্পূর্ণ কৌরবপক্ষকে ধ্বংস করব।” তা তিনি পারেননি এবং তাই তার পতনের কারণ হয়েছিল। আত্ম-অহমিকার দোষ কাউকেই ছাড়ে না। অর্জুনকেও ছাড়েনি।

অর্জুন চির ভ্রাম্যমাণ। ব্যাসদেব বলেছিলেন, অর্জুনের পায়ের গুলি খুব মোটা। তাই ওকে চিরকাল এত ঘুরতে হয়। ভ্রাতারা শুনে হেসেছিলেন।

অর্জুন চিরদিন রমণীরঞ্জন। মেয়েরা তাকে ভালবেসেছেন। অর্জুনও তার ভ্রাম্যমাণ জীবনের ক্ষণের অবসরে অস্থায়ী বাসরঘরে প্রবেশ করেছেন।

কেউ কেউ মনে করেন সূর্যপুত্র কর্ণ অর্জুনের থেকে বড় বীর ছিলেন। একথা কখনই সত্য নয়। পরশুরামের কাছে পাওয়া কর্ণের শেষ পাওয়া—তাও অভিশাপের সঙ্গেই, অর্জুনের তখনও যথার্থ পাওয়া শুরুই হয়নি। খাণ্ডব দাহন মুহূর্ত থেকে অর্জুনের পাওয়া শুরু। পেলেন গাণ্ডিব ধনু, দেবদত্ত শঙ্খ, দুই অক্ষয় তূণীর। ব্যাসদেব ‘প্রতিস্মৃতি’ মন্ত্র দিলেন যুধিষ্ঠিরকে। যুধিষ্ঠির শেখালেন অর্জুনকে। সেই মন্ত্র জপ করতে করতে অর্জুন সাক্ষাৎ পেলেন পিনাকপাণি শিবের, পেলেন পাশুপত, দেবতারা দিলেন সব দিব্য অস্ত্র। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দিন স্বয়ং পিনাকপাণি শিব এবং চিরসখা কৃষ্ণ, যিনি স্বয়ং নারায়ণ, ব্যতীত অর্জুনের তুল্য ধনুর্ধর স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালে দ্বিতীয় ছিলেন না।

১৬
গান্ধারীর শতপুত্র প্রসব

নিয়তি-তাড়িত পাণ্ডু সঙ্গমরত হরিণরূপী কিমিন্দম মুনির জীবননাশ করলেন, মৃত্যুপথযাত্রী কিমিন্দম মুনি পাণ্ডুকে অভিসম্পাত দিলেন, “মহারাজ, তুমি না জেনে আমাকে হত্যা করেছ। কাজেই ব্রহ্মহত্যার পাপ তোমাকে স্পর্শ করবে না। আমি সঙ্গমরত অবস্থায় ছিলাম। চুড়ান্ত সম্ভোগ সুখ মুহূর্তে তুমি আমাকে হত্যা করেছ। পরম পাপিষ্ঠ ব্যক্তিও এ কাজ করে না। সে চূড়ান্ত সম্ভোগ সুখ অনুভব করতে দেয়। মনুষ্য সমাজে জনাকীর্ণ স্থানে আপন রূপে স্ত্রীকে সম্ভোগ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই হরিণের রূপ ধারণ করে আমি আমার হরিণীরূপিণী স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলাম। তুমি আমাকে চূড়ান্ত সম্ভোগ সুখও অনুভব করতে দাওনি, আমার বংশধরের জন্ম সম্ভাবনাও বিনষ্ট করে দিয়েছ। আমি অভিসম্পাত দিচ্ছি যে, তুমিও তোমার স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম মুহূর্তে প্রাণত্যাগ করবে।”

কিমিন্দম মুনির অভিসম্পাতে পাণ্ডুর সংসার-আসক্তি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হল। তিনি সমস্ত বৃত্তান্ত কুন্তী ও মাদ্রীকে জানিয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। কুন্তী ও মাদ্রী তাঁর অনুগামিনী হলেন। দীর্ঘকাল বনে বনে ঘুরে পাণ্ডু শতশৃঙ্গ পর্বতে উপস্থিত হলেন। তিনি অনুভব করলেন তাঁর দেবঋণ, ঋষিঋণ ও মনুষ্যঋণ পরিশোধ হয়েছে, কিন্তু পিতৃঋণ শোধ হয়নি। পুত্র উৎপাদন না করলে পিতৃঋণ পরিশোধ হবে না। তাই পাণ্ডু পুত্র লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তিনি ক্ষেত্রজ পুত্রলাভের জন্য কুন্তীকে অনুরোধ জানালেন। কুন্তী লজ্জার সঙ্গে পাণ্ডকে জানালেন তাঁর কুমারী জীবনের সেই আশ্চর্য মন্ত্র লাভের কাহিনি। যে মন্ত্র কুন্তীকে দান করেছিলেন মহর্ষি দুর্বাসা তাঁর অপরিসীম সশ্রদ্ধ-সেবার আশীর্বাদরূপে। কুন্তী তাঁর কানীন পুত্র লাভের কথা পাণ্ডকে জানাননি। শুধু জানিয়েছিলেন যে তিনি মন্ত্র উচ্চারণ করলে যে কোনও দেবতা তাঁর সন্তান উৎপাদনের জন্য আবির্ভূত হবেন। শুনে পাণ্ডু অত্যন্ত প্রীতিলাভ করলেন। তিনি কুন্তীকে বললেন যে, ধর্ম সর্বাপেক্ষা নিরপেক্ষ দেবতা। তিনি সত্য, তিনি নিত্য। তিনি সর্ব-আরাধ্য, কুন্তী তাঁকেই আহ্বান করুন। শুচিবস্ত্রে শুচিস্নিগ্ধ হৃদয়ে কুন্তী ধর্মকে আহ্বান করলেন। এক সৌভ-বিমানে দেব-ধর্ম কুন্তীর কাছে উপস্থিত হলেন।

বিদুরের সঙ্গে পরামর্শ করে ভীষ্ম গান্ধাররাজ সুবলের কন্যা গান্ধারীর সঙ্গে জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ দিয়েছিলেন। অন্ধ-পতিকে অতিক্রম করবেন না—এই প্রতিজ্ঞা করে পতিব্রতা গান্ধারী বস্ত্রখণ্ড ভাঁজ করে চোখের উপর চিরকাল বেঁধে রেখেছিলেন। পিতা বেদব্যাস ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহের পর পুত্রবধূ গান্ধারীকে আশীর্বাদ করে বর দিয়েছিলেন যে গান্ধারীর শত পুত্র জন্মাবে।

যথাকালে গান্ধারী গর্ভবতী হলেন। কিন্তু দুই বৎসরেও তাঁর কোনও সন্তান ভূমিষ্ঠ হল না। একদিন গান্ধারী, শতশৃঙ্গ পর্বত আগত এক ব্রাহ্মণের মুখে শুনলেন দেবতা ধর্মের ঔরসে কুন্তী দেবী সদ্য গর্ভলাভ করেছেন এবং তাঁর একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। গান্ধারী অধীর ও ঈর্ষান্বিত হলেন। স্বামী ধৃতরাষ্ট্রকে না জানিয়ে গান্ধারী নিজের গর্ভপাত করলেন তাতে লৌহের ন্যায় কঠিন এক মাংসপিণ্ড প্রসূত হল। তিনি সেই মাংসপিণ্ড ফেলে দিতে যাচ্ছিলেন এমন সময় পিতা ব্যাসদেব সেই স্থানে উপস্থিত হলেন।

ব্যাসদেব বললেন, “আমার আশীর্বাদ কখনও ব্যর্থ হবেনা।” তখন ব্যাসদেবের উপদেশে গান্ধারী একটি শীতল জলের পাত্রে সেই মাংসপিণ্ড ভিজিয়ে রাখলেন। কিছুকাল পরে সেই মাংসপিণ্ড থেকে অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ একশো একটি ভ্রূণ পৃথক হল। তখন ব্যাসদেব একশত একটি ঘৃতপূর্ণ কলস আনতে বললেন। তারপর ব্যাসদের এক একটি ঘৃতপূর্ণ কলসিতে এক একটি ভ্রূণ রাখলেন। এক বৎসর পরে একটি কলসে দুর্যোধন জন্মগ্রহণ করলেন। সেই একই দিন কুন্তীর দ্বিতীয় পুত্র ভীমসেনেরও জন্ম হল। যুধিষ্ঠির ভীম-দুর্যোধনের থেকে এক বছরের বড় ছিলেন।

দুর্যোধন জন্মেই গর্দভের মতো কর্কশ কন্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, সঙ্গে সঙ্গে গৃধ্র, শৃগাল, কাক প্রভৃতিও ডাকতে লাগল এবং অন্যান্য দুর্লক্ষণ দেখা দিল। ধৃতরাষ্ট্র ভয় পেয়ে ভীষ্ম, বিদুর প্রভৃতিকে বললেন, আমাদের বংশের জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠির তো রাজ্য পাবেই, কিন্তু তারপরে আমার পুত্র (দুর্যোধন) রাজা হবে তো? শৃগালাদি শ্বাপদ জন্তুরা আবার ডেকে উঠল। তখন ব্রাহ্মণগণ ও বিদুর বললেন, আপনার এই পুত্র বংশ নাশ করবে। সুতরাং ওকে পরিত্যাগ করাই মঙ্গল। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র তা করতে সম্মত হলেন না। বিদুর বললেন, একটি কুলনাশক পুত্র বিসর্জন দিলেও আপনার শতপুত্ৰই থাকবে। কিন্তু দুর্যোধন জন্মমুহূর্ত মাত্রেই ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে অপরিসীম পুত্রস্নেহ দেখা দিল। তিনি কোনও মতেই দুর্যোধনকে ত্যাগ করতে রাজি হলেন না। পুত্রের আবির্ভাব মাত্রই গান্ধারীর একটি কন্যা সন্তানের জন্য বাসনা জাগল। ব্যাসদেব আশীর্বাদ করলেন, তাই হবে, শতপুত্র ছাড়াও তাঁর একটি কন্যা জন্ম গ্রহণ করবে। এক মাসের মধ্যেই দুর্যোধন-এর আরও নিরানব্বইটি ভ্রাতা ও একটি ভগ্নির জন্ম হল।

কূটবুদ্ধি, দুরাশয়, কুরুকুলের কলঙ্কজনক রাজা দুর্যোধন কলির অংশে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাক্ষসগণের অংশে দুঃশাসন প্রভৃতি ভ্রাতাদের জন্ম হয়েছিল। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণের আনুপূর্বিক জ্যৈষ্ঠ-কনিষ্ঠ অনুসারে নাম নিম্নানুরূপ:

১) দুর্যোধন

২) যুযুৎসু

৩) দুঃশাসন

৪) দুঃসহ

৫) দুঃশল

৬) দুর্মুখ

৭) বিবিংশতি

৮) বিকর্ণ

৯) জলসন্ধ

১০) সুলোচন

১১) বিন্দ

১২) অনুবিদ

১৩) দুর্দ্ধর্ষ

১৪) সুবাহু

১৫) দুষ্প্রধর্ষণ

১৬) দুর্ম্মর্ষণ

১৭) দুর্মুখ

১৮) দুষ্কর্ণ

১৯) কর্ণ

২০) চিত্র

২১) উপচিত্র

২২) চিত্রাক্ষ

২৩) চারুচিত্র

২৪) অঙ্গদ

২৫) দুর্মদ

২৬) দুষ্প্রহর্ষ

২৭) বিবিৎসু

২৮) বিকট

২৯) মম

৩০) ঊর্ণনাভ

৩১) পদ্মনাভ

৩২) নন্দ

৩৩) উপনন্দ

৩৪) সেনাপতি

৩৫) সুষেণ

৩৬) কুণ্ডোদর

৩৭) মহোদর

৩৮) চিত্ৰবাহু

৩৯) চিত্ৰবৰ্মা

৪০) সুবর্মা

৪১) দুর্ব্বিরোচন

৪২) অয়োবাহু

৪৩) মহাবাহু

৪৪) চিত্ৰচাপ

৪৫) সুকুণ্ডল

৪৬) ভীমবেগ

৪৭) ভীমবল

৪৮) বলাকী

৪৯) ভীমবিক্রম

৫০) উগায়ুধ

৫১) ভীমশর

৫২) কনকায়ু

৫৩) দৃঢ়ায়ুধ

৫৪) দৃঢ়বর্মা

৫৫) দৃঢ়ক্ষত্র

৫৬) সোমকীর্তি

৫৭) অনূদর

৫৮) জরাসন্ধ

৫৯) ধৃঢ়সন্ধ

৬০) সত্যসন্ধ

৬১) সহস্রবাক্‌

৬২) উগ্ৰসবা

৬৩) উগ্রসেন

৬৪) ক্ষেমমুর্তি

৬৪) অপরাজিত

৬৬) পণ্ডিতষ্ক

৬৭) বিশালাক্ষ

৬৮) দুরাধন

৬৯) দৃঢ়হস্ত

৭০) সুহস্ত

৭১) বাতবেগ

৭২) সুবৰ্চা

৭৩) আদিত্যকেতু

৭৪) বহবাশী

৭৫) নাগদত্ত

৭৬) অনুযায়ী

৭৭) নিষঙ্গী

৭৮) কবচী

৭৯) দণ্ডী

৮০) দণ্ডধার

৮১) ধনুর্গ্রহ

৮২) উগ্র

৮৩) ভীমরথ

৮৪) বীর

৮৫) বীরবাহু

৮৬) অলোলুপ

৮৭) অভয়

৮৮) রৌদ্রকর্মা

৮৯) দৃঢ়রথ

৯০) চয়

৯১) অনাধৃষ্য

৯২) কুণ্ডভেদী

৯৩) বিবারী

৯৪) দীর্ঘলোচন

৯৫) দীর্ঘবাহু (দ্বিতীয়)

৯৬) মহাবাহু

৯৭) ব্যুঢ়োরু

৯৮) কনকাঙ্গদ

৯৯) কুণ্ডজ

১০০) চিত্রক

গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রের একমাত্র কন্যা দুঃশলা। রাজা জয়দ্রথ দুঃশলার স্বামী ছিলেন। কৌরব ভ্রাতারা সকলেই অতিরথ ও বীর, সকলেই যুদ্ধকার্যে নিপুণ, বেদবিদ এবং দণ্ডনীতি প্রভৃতি শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন।

গান্ধারী যখন গর্ভভারে ক্লিষ্ট ছিলেন, তখন এক বৈশ্যা ধৃতরাষ্ট্রের সেবা করত। তার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের ‘যুযুৎসু’ নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। এই যুযুৎসু যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষে যোগদান করেন। যুধিষ্ঠিরের মহাপ্রস্থানের সময়ও তিনি জীবিত ছিলেন।

গান্ধারীর শতপুত্ৰই ভীমসেনের হাতে মৃত্যুলাভ করেন। দুর্যোধন দুঃশাসন ব্যতীত বিকর্ণ আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বলতা লাভ করেছিলেন। কৌরব সভায় দ্যূতক্রীড়ার সময়ে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার সময়ে কৌরব শত ভ্রাতার মধ্যে একমাত্র বিকর্ণই প্রতিবাদ করেছিলেন। স্বয়ংবর সভায় অর্জুন লক্ষ্যভেদ করলে পাণ্ডবদের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ হয়। ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশক্রমে বিদুর পাঞ্চাল রাজ্যে গিয়ে পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে ফিরে আসতে আমন্ত্রণ জানান। পাণ্ডবেরা হস্তিনাপুরে প্রবেশ করলে কৃপাচার্যের সঙ্গে বিকর্ণও তাঁদের অভ্যর্থনার জন্য প্রত্যাগমন করেছিলেন। বিকর্ণ ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। তিনি কৌরবপক্ষেই যুদ্ধ করেছিলেন এবং ভীমসেনের হাতে নিহত হয়েছিলেন।

১৭
ভীম ও হিড়িম্বার বিবাহ

জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়ে মরার খবর দাবানলের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। প্রজারা দুর্যোধন-ধৃতরাষ্ট্রের নিন্দা করতে লাগল। মৃত পাণ্ডবদের নানা আলোচনা ঘরে ঘরে চলতে লাগল। ধৃতরাষ্ট্র মহা ধুমধামের সঙ্গে কুন্তী ও পাণ্ডবদের উদ্দেশে তর্পণ করলেন। বিদুর সমস্ত ঘটনা জানতেন বলে অল্প শোক প্রকাশ করলেন।

এদিকে পাণ্ডবেরা তখন বিদুর প্রেরিত নৌকাচালকের নৌকায় বায়ুর মতো গতিতে বারাণাবত নগরের নদীতীরে অন্যপারে গিয়ে উপস্থিত হলেন। পাণ্ডবেরা দীর্ঘ পথ হেঁটে, নৌকাতে চড়ে পরিশ্রান্ত, পিপাসার্ত এবং নিদ্রায় কাতর হয়ে ভীমসেনকে বললেন, “এর থেকে আর দুঃখের কথা কী হতে পারে যে, আমরা অন্ধকারে নিবিড় বনমধ্যে দিকনির্ণয় করতে পারছি না। চলতেও পারছি না। পাপিষ্ঠ পুরোচন পুড়ে মরেছে কি না তাও আমরা জানি না। অন্যের অজ্ঞাতসারে কীভাবে এই বিপদ থেকে রক্ষা পাব, তাও বুঝতে পারছি না।”

যুধিষ্ঠির পুনরায় ভীমসেনকে তাঁদের বহন করে নিয়ে যেতে আদেশ করলেন। মাতা কুন্তীকে পিঠে নিয়ে, নকুল সহদেবকে দুই কাঁধে নিয়ে, যুধিষ্ঠির ও অর্জুনকে দুই হাতে ধরে মহাবল ও মহাসাহস ভীমসেন মত্ত হস্তীর মতো গমন করতে লাগলেন। ভীম এত দ্রুত পথ চলছিলেন যে, তাঁর চলার গতিতে অন্য পাণ্ডবদের যেন মূৰ্ছার উপক্রম হল। এইভাবে ভীমসেন নদীর অন্যপারে উপস্থিত হলেন। সমস্ত দিন হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যার ঠিক পূর্বে ভীমসেন একটি ভয়ংকর বনের মধ্যে প্রবেশ করলেন। ভীম ছাড়া তাঁর অন্য চার ভাই আর চলতে পারছিলেন না। তাঁরা বনের মধ্যেই মাটিতে ঘুমিয়ে পড়লেন। কুন্তী দেবী আক্ষেপ করে বললেন, “আমি প্রবল পরাক্রম পঞ্চ-পাণ্ডবের জননী। আমি পঞ্চ-পাণ্ডবের মধ্যেই আছি। অথচ পিপাসায় আমার জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে, আমি অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছি।”

মায়ের কাতরোক্তি শুনে ভীমসেনের হৃদয় মাতৃস্নেহে ও দয়ায় আকুল হয়ে পড়ল। তিনি জল আনার জন্য ভয়ংকর বনের মধ্যে প্রবেশ করলেন। যাত্রার পূর্বে একটি বড় বটগাছের নীচে তিনি মা ও ভাইদের শোবার ব্যবস্থা করলেন। এবং যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে জল আনতে গেলেন। অদূরেই ভীম একটি জলাশয় দেখতে পেলেন। জলপান ও স্নান করে অনেক অনেক পদ্মপত্র দ্বারা এক-একটি জলপাত্র নির্মাণ করে ভীম অনেকগুলি জলপাত্র পূর্ণ করে আপন উত্তরীয় দিয়ে সেই পাত্রগুলি বেঁধে নিলেন। অতি দ্রুত দুই ক্রোশ পথের দূরত্ব অতিক্রম করে তিনি মা ও ভাইদের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখলেন যে, তাঁরা সকলেই গভীর নিদ্রাভিভূত। ওইভাবে সকলকে নিত্রাভিভূত দেখে ভীমসেনের গভীর দুঃখ হল। ভাগ্যকে দোষারোপ করে ভীমসেন আপন মনে বললেন, “শত্ৰুজয়ী বসুদেবের ভগিনী, কুন্তীরাজের কন্যা, সর্বসুলক্ষণ-সম্পন্না, বিচিত্রবীর্য রাজার পুত্রবধূ, মহাত্মা পাণ্ডু রাজার ভার্যা, আমাদের মাতৃদেবী, পদ্মকোষের মতো গেীরবর্ণা অত্যন্ত কোমলাঙ্গী এবং মহামূল্য শয্যায় শয়ন করার যোগ্যা দেবী কুন্তী ভূতলে শয়ন করে আছেন। যিনি ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্র দেবতার তিন সন্তানের মাতা, তিনি আজ মৃত্তিকায় শয়ন করে আছেন।

‘সর্বদা ধর্মপরায়ণ যে যুধিষ্ঠির ত্রিভুবনের রাজত্ব করার যোগ্য, তিনি সাধারণ মানুষের মতো ভূতলে শয়ন করে আছেন।

“অতুলনীয় শৌর্যবীর্যগুণান্বিত, নীলমেঘতুল্য শ্যামবর্ণ, অর্জুন সাধারণ ব্যক্তির মতো ভূতলে শয়ন করে আছেন। এর থেকে দুঃখের আর কী হতে পারে?

“চিরকাল আদরে লালিত-পালিত এই অশেষ রূপবান ও জ্ঞানী সহদেব ও নকুল ভূতলে শায়িত আছেন, এর থেকে দুঃখের আর কী হতে পারে?”

নিদ্রিত মাতৃদেবী ও ভ্রাতাদের দেখতে দেখতে ভীমসেন এইসব ভাবছিলেন। অসহ্য ক্রোধে তাঁর চোয়াল কঠিন হয়ে উঠছিল। ইচ্ছা হচ্ছিল, একটি ভয়ংকর গদা নিয়ে হস্তিনাপুরে প্রবেশ করে ধৃতরাষ্ট্র, তাঁর একশো পুত্র ও কর্ণ শকুনি প্রতি শুভার্থীদের নির্বিচারে হত্যা করে আসেন। কিন্তু দয়ালু যুধিষ্ঠির কোনওমতেই তার অনুমোদন দেবেন না। ভীমসেন বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

অনতিদূরে এক শালগাছের ডালে বসেছিল ভীষণদর্শন রাক্ষস হিড়িম্ব আর তার বোন রাক্ষসী হিড়িম্বা। বনের সোঁদা হাওয়ায় মানুষের উগ্রগন্ধ। বারবার সেই সুঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে ক্ষুধার্ত হিড়িম্ব আনন্দে তার রুক্ষ রক্তবর্ণ চুল-দাড়ি চুলকে, মাথা কাঁপিয়ে ছোট বোন হিড়িম্বাকে বলল, আহা-হা, বহু বহুদিন পরে মনের মতো খাদ্য পাওয়া গেছে রে। জিঘ্রতঃ প্রশ্রুতা স্নেহঃজ্জির্হ্বা পর্য্যেতি মে সুখাৎ—নোলায় আমার মুখ ভরে গেছে। বহুদিন পরে আজ আবার মানুষের স্বাদু মাংসে কষে দাঁত বসাব। কণ্ঠশিরা ছিঁড়ে গরম গরম রক্ত পান করব। তারপরে পেটভরে মানুষের মাংস খেয়ে দু’জনে মিলে হাততালি দিয়ে নাচতে নাচতে সারারাত গান গাইব। বোন রে, তুই এখনই যা। ওদের সবগুলোকে মেরে এখানে নিয়ে আয়। আমরা দু’জনে মিলে মিশে খাব।

বোনের তেমনি সঙ্গীন অবস্থা। আনন্দে দাঁত শিরশির করছে। সে তখনই আনন্দে গাছের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে, পাণ্ডবেরা যেখানে ছিলেন, সেখানে গেল। গিয়ে দেখে কী। সবাই ঘুমোচ্ছে—শুধু অনিন্দ্যসুন্দর এক পুরুষ জেগে বসে আছে। কী সুন্দর মহাবাহু সিংহস্কন্ধ পুরুষটি। দেহখানি একেবারে চকচক করছে। ভীমের রূপসাগরে হিড়িম্বার হৃদয় হারিয়ে গেল। হৃদয়ের দু’কুল ছাপিয়ে প্রেমের ভয়ংকর বন্যা বয়ে গেল। ভীমের অনুপম রূপ দেখে, রাক্ষসী কামাতুরা হয়ে পড়ল।

রাক্ষসী কামায়মাস রূপেণাপ্রতিমং ভুবি ॥ আদি; ১৪৬: ১৮ ॥

সেই মুহূর্তে, যে চিন্তাটি রাক্ষসী হিড়িম্বার নারীমনকে প্রলুব্ধ করেছিল তা হল, এমন সর্বাঙ্গসুন্দর পুরুষ মানুষটির হাড়-মাংস চিবিয়ে খেলে আমি আর কতক্ষণ সুখ পাব? তার থেকে আমি ওকে পতিরূপে বরণ করলে, সারাজীবন ধরে ভোগ করব আর আনন্দ পাব। ভ্রাতৃপ্রেমের চেয়ে স্বামীপ্রেম অনেক প্রীতিকর, ওকে আমাকে স্বামীরূপে পেতে হবে, সারাজীবন আমি ওকে ইচ্ছামতো ভোগ করব।

হিড়িম্বা রাক্ষসী ছিল। মনুষ্য মাংসভোজী ছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার মধ্যে জেগে উঠল শাশ্বত নারীচিত্ত। সে অনঙ্গ পীড়িত হয়ে পড়ল। রাক্ষসকুল থেকে, রাক্ষসধর্ম থেকে বেরিয়ে এল। আত্মসমর্পণের পথে, কল্যাণের পথে, বংশবিস্তারের আকাঙক্ষায় সে সম্পূর্ণ এক স্বাভাবিক নারীতে রূপান্তরিত হল। অকুণ্ঠিত প্রণয়ভাষণে সে বিন্দুমাত্র সংকোচবোধ করল না। সমুদ্রমন্থনের ফলে অমৃত উঠেছিল। হিড়িম্বার হৃদয় সমুদ্র মন্থন করে উঠে এল প্রেম।

অভিলাষিণী হিড়িম্বা তখন রূপবতী মানুষীর রূপ ধরে, দিব্য অলংকারে অলংকৃত হয়ে, ভীমের কাছে এসে সলজ্জে বলল, “হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, তোমরা কে? কোথা থেকেই বা আসছ? জান না এই বন রাক্ষসসেবিত? আমি রাক্ষসী হিড়িম্বা। তোমাদের মেরে স্বাদু মাংস খাব বলে আমার ভাই রাক্ষস হিড়িম্ব আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। কিন্তু তোমার দেবপুত্রের মতো রূপ দেখে অন্য পুরুষ আর পতি করতে ইচ্ছা করি না—

নান্যং ভর্ত্তারম্‌ ইচ্ছামি, সত্যম্ এতৎ ব্রবীমি তে। আদি: ১৪৬: ২৮

তুমি ধর্মজ্ঞ, এখন যা ধর্ম মনে কর, তাই করো—

কামোপহত চিত্তাঙ্গীং ভজমানাং ভজস্ব মাম্‌। আদি; ১৪৬: ২৯।

কামে আমার দেহ নিপীড়িত হচ্ছে। মন কেমন কেমন করছে। আমি সর্বতোভাবে তোমাতেই আত্মসমর্পণ করেছি। এবার আমায় গ্রহণ করো—

অন্তরীক্ষচরী হি অস্মি, কামতো বিচরামি চ।

অতুলাং আপ্নুহি প্রীতিং, তত্র তত্র ময়া সহ ॥ আদি; ১৪৬: ৩১ ॥

আমি আকাশচারিণী। পৃথিবীর যেখানে ইচ্ছা নিমেষে যেতে পারি। এসো আমার সঙ্গে। মনোহর সব স্থানে গিয়ে আমার সঙ্গে সহবাস করে তুমি বহু সুখ লাভ করবে।

ভীমসেন অবজ্ঞার সঙ্গে হেসে বললেন, “হে ভীরু-সুনয়না, সুপ্ত মাতা ও ভ্রাতাদের রেখে আমি কি কোথাও যেতে পারি। পৃথিবীতে কোনও রাক্ষস আছে, যে আমার পরাক্রম সহ্য করতে পারে? আমার বিক্রম যক্ষ-গন্ধর্বরা সহ্য করতে পারে না। তোমার ভ্রাতা তো এক অতি তুচ্ছ রাক্ষস। অতএব তন্বী মেয়ে, তোমার ইচ্ছা হয় থাক, না হলে চলে যাও, অথবা তোমার নরখাদক ভাইটিকে পাঠিয়ে দাও।”

এদিকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তিতিবিরক্ত ক্রোধান্ধ হিড়িম্ব নিজেই সেখানে চলে এল। এসে সে স্তম্ভিত। তার রাক্ষসী বোন সুন্দরী মানুষীর রূপ ধরে এক অচেনা পুরুষ মানুষের সঙ্গে ঢলাঢলি করছে। ক্রোধে হিড়িম্ব বোনের বেলেল্লাপনা দেখে চোখ বড় বড় করে, দাঁতে দাঁত ঘষে বলল —

ধিক, ত্বাম্‌, অসতি! পুংস্কামে। মম বিপ্রিয়কারিনি!

পূর্বেষাং রাক্ষসেন্দ্রাণাং সর্বেষাম্‌ অযশস্করি ॥ আদি: ১৪৭; ১৮ ॥

ধিক তোকে। তুই পরপুরুষ কামনা করে অসতী হয়েছিস। আমার অপ্রিয় আচরণ করেছিস। প্রাচীন রাক্ষসশ্রেষ্ঠগণের মুখে চুনকালি মাখিয়েছিস। এই মানুষগুলোর সঙ্গে তোকেও খুন করব।

ভীমসেন হিড়িম্বাকে আশ্বস্ত করে বললেন—মাভৈঃ ত্বং বিপুলশ্রোণি হে বিশাল-নিতম্বে ভয় কোরো না। এই শ্যালককে আমি এখনই শেষ করব। তারপর অনেকক্ষণ হুলস্থুল যুদ্ধ হল। অবশেষে ভীমসেন হিড়িম্ব রাক্ষসকে খণ্ড খণ্ড করে বধ করলেন।

যুদ্ধের তর্জন গর্জনে কুন্তী ও চার পাণ্ডব ভ্রাতার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সম্মুখে রূপসি হিড়িম্বাকে দেখে বিস্মিত কুন্ত্রী প্রশ্ন করলেন, কে গো তুমি বরবর্ণিনী। দেববালার মতো রূপ! তুমি কি অপ্সরা? এখানে দাঁড়িয়ে আছই বা কেন?

হিড়িম্বা তখন কৃতাঞ্জলি হয়ে নিজের যথার্থ পরিচয় দিয়ে সমস্ত কিছু আনুপূর্বিক বিবৃত করে, অবশেষে লজ্জা-নম্র কণ্ঠে বলল—

আর্য্যে! জানাসি যদ্‌ দুঃখমিহ স্ত্রীণাম্‌ অনঙ্গজম্‌।

তদিদং মাম্‌ অনুপ্রাপ্তং ভীমসেন কৃতং শুভে ॥ আদি: ১৪৯; ৫ ॥

আর্যে! পঞ্চশরে অনুবিদ্ধ হলে মেয়েদের কী যে জ্বালা হয়, সে তো আপনি জানেন। ভাগ্যবতী। আপনার পুত্র ভীমসেন হতে আমি সেই দুঃখ ভোগ করছি।

যশস্বিনি। কাল প্রতীক্ষা করে সেই নিদারুণ দুঃখ সহ্য করেছি—একসময়ে সুখ আসবে এই আশায়। আমার বন্ধুবর্গ, স্বজন ও স্বধর্ম—সবই ত্যাগ করে এসেছি। আপনার পুত্রকে পতিরূপে বরণ করেছি।

প্রত্যাখ্যাত ন জীবামি—সত্যমেতদ্য ব্রবীমি তে॥ আদি: ১৪৯; ৮ ॥ প্রত্যাখ্যাত হলে আমি আর বেঁচে থাকব না।

কুন্তী দেখলেন হিড়িম্বার বেদনাময় স্নিগ্ধ রূপটি। কুন্তী বুঝলেন, তার অসহায়তা। অনার্য এই মেয়েটি পাটরানি হতে চায়নি, ক্ষণলগ্না পত্নী হতে চেয়েছিল। সহজ মেয়েলি বুদ্ধিতে সে বুঝেছিল, প্রত্যাখ্যাতা হলে মরণ ছাড়া তার গতি থাকবে না। সে বুঝেছিল, কোনও অবস্থাতেই সে ভীমসেনকে এই বনের মধ্যে আটকে রাখতে পারবে না। রাজপুত্রের এই আসা যাওয়া তার জীবনে সামান্য কয়েকদিনের ঘটনাই হয়ে থাকবে। বাকি জীবন কাটাতে হবে স্বামী সঙ্গহীনা বিধুরা বধূর মতো, একান্ত একাকিনী, নিঃসঙ্গা। ধুলায় ধূসর হবে জীবন—বৈরীকৃত রাক্ষসকুলের মধ্যে কুল-ত্যাগিনী অরক্ষণীয়ার মতো। তা সত্ত্বেও সে বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিল। সুতরাং হিড়িম্বা সাধারণ মেয়ে ছিল না। চিত্রাঙ্গদা যে ঝুঁকি নিয়েছিল, উলূপী যে ঝুঁকি নিয়েছিল—সেই একই ঝুঁকি তাকেও নিতে হয়েছিল। প্রিয়তম দারিতকে এই ক্ষণজীবনের পর হয়তো সে আর কখনও দেখতে পাবে না। সন্তানের পিতার সঙ্গে জীবনে দ্বিতীয়বার দেখা হয়নি দেবী সত্যবতীর, দেবী কুন্তীর, দেবী মাদ্রীর, অম্বিকা-অম্বালিকা দেবীর। কিন্তু সত্যবতী জীবনে স্বামী-সন্তান আবার ফিরে পেয়েছিলেন, অম্বিকা-অম্বালিকা বিধবা ছিলেন, কুন্তী-মাদ্রীও সন্তান জন্মের পর অন্তত ষোলো বছর স্বামীর সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। মাত্ৰী সহমৃতা হয়েছিলেন, কুন্তীকেও পরবর্তীকালে বিধবার জীবন কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু এ যে কুমারী মেয়ে। স্বামীকে ছেড়ে থাকার পর রাক্ষসমাজে আবার বিবাহও করতে পারবে না, কাঙিক্ষত পুরুষকেও চিরকাল ধরে রাখতে পারবে না। হিড়িম্বার চাহিদার গভীরতা বুঝতে পেরেছিলেন কুন্তী। তিনি বুঝেছিলেন রাক্ষসী হলেও মেয়েটি হেলাফেলার মতো নয়। তাই সানন্দে নির্দ্বিধায় তিনি এই সজল নয়না অনার্যা কন্যাটিকে তার প্রথম পুত্রবধূ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।

হিড়িম্বার প্রার্থনার অসাধারণত্ব উপলব্ধি করেছিলেন যুধিষ্ঠিরও। নিজে তিনি তখনও অবিবাহিত। অথচ হিড়িম্বা কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে বিবাহ করতে চাইছে। তিনি দেখলেন, হিড়িম্বা নতজানু হয়ে মায়ের পদতলে বসে প্রার্থনা করছে:

তদর্হসি কৃপাং কর্ত্তৃং ময়ি ত্বং বরবৰ্ণিনি!

তস্মাৎ মূঢ়েতি মা ত্বং ভক্তা চানুগতেতি চ ॥ আদি: ১৪৯; ৯ ॥

অতএব আমাকে মুগ্ধা, ভক্তা, অনুগতা মনে করে আমার উপর দয়া করুন। ভাগ্যবতী। আপনার এই পুত্রই আমার পতি। সুতরাং আপনি ওঁকে আমার সঙ্গে সংযুক্ত করে দিন। এই দেবমূর্তি পতিকে নিয়ে আমি অভীষ্ট স্থানে যাব, আবার আপনার কাছে এনে দেব। আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন। আপনারা আমাকে মনে মনে চিন্তা করা মাত্রই আমি আপনাদের সকলকেই দুর্গম বিষম স্থানে নিয়ে যাব এবং সব বিপদ থেকে রক্ষা করব। বিপদ উপস্থিত হলে, যে কোনও উপায়ে তা থেকে উদ্ধার পেয়ে প্রাণধারণ করবে এবং ধর্মের অনুসরণ করে আদরের সঙ্গে সব কাজ করবে। বিপদের সময় যিনি পরের ধর্ম রক্ষা করেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ ধর্মজ্ঞ। আর ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হওয়াকেই ধার্মিকের বিপদ বলা হয়। ধর্ম প্রাণরক্ষা করে, তাই ধর্মকে প্রাণদাতা বলে; অতএব যে যে উপায়ে ধর্ম করা যায়, তাতে কোনও নিন্দা হয় না।

যুধিষ্ঠির বললেন, “হিড়িম্বা, তুমি যা বললে তা সত্য, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি তোমাকে যা বলব, তোমাকে সেই অনুযায়ী সত্য পালন করতে হবে। ভীমসেন স্নান, আহ্নিক ও মাঙ্গলিক বেশ-ভূষাদি করার পর সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত তুমি তার সঙ্গে বিহার করবে। তুমি মনের মতো বেগশালিনী হয়ে দিনেরবেলায় ইচ্ছানুসারে তার সঙ্গে বিহার করবে। কিন্তু প্রত্যেকদিন রাত্রিবেলায় ভীমসেনকে আমাদের কাছে এনে দেবে।”

হিড়িম্বা ‘তাই হবে’ বলায় ভীমসেন বললেন, “রাক্ষসী। শোনো আমি তোমার কাছে সত্যভাবে আমাদের বিহারের সময় বলছি। সুন্দরী! যে পর্যন্ত তোমার পুত্র জন্মগ্রহণ করবে, আমি সেই সময় পর্যন্ত তোমার সঙ্গে বিহার করার জন্য যাব। তারপরে আর পারব না।” ‘তাই হবে’ বলে হিড়িম্বা তথনই ভীমসেনকে নিয়ে উপরের দিকে চলে গেল। মনোহর পর্বতশৃঙ্গে, সুপুষ্পিত বনে, নদীচরের নিভৃতে, স্বর্ণাভ সমুদ্র সৈকতে—যখন যেখানে ভাল লাগে হিড়িম্বা ভীমসেনকে নিয়ে প্রমোদবিহার করতে লাগল।

বিভ্ৰতী পরমং রূপং রময়ামাস পাণ্ডবং।

রময়ন্তী তথা ভীমং তত্র তত্র মনোজবা ॥ আদি; ১৪৯; ৩০ ॥

এইভাবে ভ্রমণ করতে করতে, কামবিহারিণী হিড়িম্বা নর্মলীলা শৃঙ্গারে ভীমকে সর্বদা আনন্দে রেখে বহুদিন ধরে সুখে সঙ্গত হতে থাকল।

তারপর হিড়িম্বা ভীমসেন থেকে একটি বলবান পুত্র প্রসব করল। তার দুই চোখ বিকৃত, মুখমণ্ডল বিশাল, কর্ণযুগল শঙ্কুর (পেরেকের) মতো সুক্ষ্মাগ্র, শব্দ ভয়ংকর, ওষ্ঠ তাম্রবর্ণ, দন্ত সুতীক্ষ্ণ, কণ্ঠস্বর বিকট, ধনুর্বিদ্যা অধিক, তেজ গুরুতর, অধ্যবসায় অত্যন্ত, বাহুযুগল সুদীর্ঘ, বেগ গুরুতর, শরীর বিশাল, মায়া ভয়ংকর, নাসিকা দীর্ঘ, বক্ষ বৃহৎ, জানু ও গুল্‌ফের পিছনের দিক বিশাল এবং গোল এবং আকৃতি অতি ভীষণ ছিল। আর সে মানুষ থেকে জন্মগ্রহণ করেও অমানুষ হয়েছিল অর্থাৎ রাক্ষস হয়েছিল এবং অন্যান্য রাক্ষস ও পিশাচগণকে অতিক্রম করে তখনই অতি ভীষণ হয়েছিল। সেই হিড়িম্বার পুত্র জন্মগ্রহণ করেই যৌবন লাভ করেছিল এবং বলবান বীর হয়ে রাক্ষসদের মধ্যে সমগ্র অস্ত্রে অত্যন্ত উৎকর্ষ লাভ করেছিল। কারণ রাক্ষসীরা গর্ভধারণ করেই সদ্য প্রসব করে এবং সেই সন্তানও সদ্যই কামরূপী ও বহুরূপী হয়ে থাকে। বিলক্ষণ কেশযুক্ত সেই হিড়িম্বার পুত্র তখনই পিতা ও মাতাকে প্রণাম করে তাঁদের চরণ ধারণ করল। তখন তাঁরা তার নামকরণ করলেন।

সেই হিড়িম্বাপুত্রের মাথাটা ঘটের মতো এবং তাতে খাড়া খাড়া চুল ছিল বলে হিড়িম্বা তার নাম দিল ঘটোৎকচ। বিশালশরীর ঘটোৎকচ কুন্তীর সঙ্গে পাণ্ডবদের যথানিয়মে অভিবাদন করে, তাঁদের সম্বোধন করে বলল, “হে নিষ্পাপগণ! আমি আপনাদের কী করব, তা নিঃশঙ্কভাবে বলুন।” মহাদেবী কুন্তী আদরের সঙ্গে গ্রহণ করলেন প্রথম পৌত্রকে। “জ্যেষ্ঠ পুত্রোহসি পাঞ্চনাম্‌।” বৎস, তুমি পঞ্চ-পাণ্ডবের জ্যেষ্ঠপুত্র হিসাবে কুরুবংশে জন্মেছ। এই স্বীকৃতি দান মহীয়সী কুন্তী দেবীর পক্ষেই সম্ভব। কুন্তীর এই স্বীকৃতি যেন আর্য-অনার্য দুই ধারার শ্যামল-সঙ্গমের স্বীকৃতি। ঘন মেঘমালার মতো নিবিড় এই জঙ্গল হল অন্যতম প্রয়াগতীর্থ।

*

তারপর একদিন এল, রোদনভরা বিদায়ের পালা—নিষ্ঠুর প্রাক-শর্ত। চোখের জলে ভেসে বিদায় জানাল হিড়িম্বা। বলল, “আর্যপুত্র, আমার এই পুত্র যদি কোনওদিন পিতৃকুলের কোনও কাজে আসে তো ডেকে পাঠিয়ো।”

যুধিষ্ঠির ভীষণ ভালবাসতেন ঘটোৎকচকে। কতবার বিপদে স্মরণ করেছেন ঘটোৎকচকে। বনপর্বে পাণ্ডবেরা অর্জুনের ফিরে আসার প্রতীক্ষায়—তখন সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী পাহাড়ে পৌঁছে দিয়েছেন সবাইকে ঘটোৎকচ। আর, বহুদিন পরে, প্রায় বিয়াল্লিশ বছর পরে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে এই পুত্র ঘটোৎকচই পিতা ইন্দ্র প্রদত্ত অর্জুনের জন্য সংরক্ষিত অব্যর্থ মৃত্যুবাণ নিজের বুকে নিয়ে দুর্নিরোধ্য বীর কর্ণের হাতে অবধারিত মৃত্যু থেকে পিতৃব্য অর্জুনকে রক্ষা করে পিতৃঋণ শোধ করে চলে গেছেন মৃত্যুর ওপারে।

ঘটোৎকচের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ উল্লাসভরে নৃত্য করেছিলেন। প্রাণসখা অর্জুনের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী আয়ুধ ধ্বংস হওয়ার জন্য। তিনি ঘটোৎকচ সম্পর্কে সুবিচার করেননি। ঘটোৎকচ সম্পর্কে তিনি যা বলেছিলেন তার কোনও প্রমাণ মহাভারতে নেই। ঘটোৎকচ ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষী। সে অশুভ শক্তির প্রতীক। একথা ব্যাসদেব কোথাও বলেননি। পাণ্ডবেরা ব্যথাতুর হয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির বারবার সকৃতজ্ঞ চিত্তে পুত্ৰ অভিমন্যু ও পুত্ৰ ঘটোৎকচের উদার আত্মত্যাগ স্মরণ করেছেন। রথী-মহারথ-অতিরথ গণনার কালে ভীষ্ম বলেছিলেন—পাণ্ডবপক্ষে ঘটোৎকচ অতিরথ। তিনি পিতার থেকে বড় বীর। কর্ণ যুদ্ধে তার সঙ্গে পরাজিত হয়েছিলেন—আত্মরক্ষার জন্য ইন্দ্রপ্রদত্ত একাঘ্নী বাণের ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

আর হিড়িম্বা? অমন একটি শ্রদ্ধেয়া নারী মহাভারতেও বেশি নেই। সে রাক্ষসী। শর্তভঙ্গ করে কোনওদিনও স্বামীর কাছে ফিরে আসেনি। অশ্বমেধ যজ্ঞকালে চিত্রাঙ্গদা, উলূপী হস্তিনাপুরে এসেছিলেন। হিড়িম্বা আসেনি। স্মৃতি সম্বল করে পুত্রকে স্বামীর উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে চেয়েছে। পুত্রকে বড় করেছে। বিবাহ দিয়েছে। পৌত্র অঞ্জনপর্বাকে বুকে করে মানুষ করেছে। পুত্র-পৌত্র দুজনেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেছে। অভাগিনী হিড়িম্বা থেকে গিয়েছে চিরকাল কুটিরের অঙ্গনে প্রতীক্ষায়। স্মৃতি তার একমাত্র সম্বল। মহাবীর স্বামী, চার পাণ্ডব ভ্রাতা, দেবী কুন্তী—এঁদের মঙ্গল কামনা করতে করতে। এতখানি ত্যাগব্রতধারিণী নারী মহাভারতে বেশি নেই। ভীমসেনের স্মৃতিতে হিড়িম্বা কতখানি উজ্জ্বল ছিল, তা পাঠকেরা অনুমান করবেন।

কিন্তু আমি দেখতে পাই এক চিরবধূ হিড়িম্বাকে। চির নববধূ। নির্জন কুটিরের দাওয়ায় বসে যার মনে পড়ে একচক্রাপুরীর সেই ঘন জঙ্গল। অশথ গাছের গোড়ায় নিদ্রিত ক্লান্ত চার পাণ্ডবপুত্র আর তাঁদের অপূর্ব রূপবতী তিলোত্তমা মাতা। একটি বিশাল দেহ বৃষস্কন্ধ মানুষ জানুতে মাথা রেখে পাহারা দিচ্ছেন। তিনি ঘুমোত পারছেন না। মাতা ও ভ্রাতারা তাঁর অভিভাবকত্বেই নিশ্চিন্ত নিদ্রাগত। হিড়িম্বা অনিমেষ লোচনে তাঁকে দেখছেন, আর দেখছেন। সেই অন্তহীন দেখাই তার চিরসঙ্গী।

১৮
দ্রৌপদীর স্বয়ংবর

একচক্রাপুরীতে আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের পরিবারকে রক্ষা করতে ভীমসেন বক রাক্ষসের মৃত্যু ঘটালেন। এখানেই গন্ধর্বরাজ চিত্ররথের সঙ্গে অর্জুনের বন্ধুত্ব হল এবং চিত্ররথের পরামর্শ অনুযায়ী—সর্ববেদজ্ঞশ্রেষ্ঠ ধৌম্যকে যথোচিত সম্মান জানিয়ে পাণ্ডবেরা তাঁদের পৌরোহিত্য গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। ধৌম্য সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। বেদজ্ঞ এবং উদারবুদ্ধি ধৌম্য পাণ্ডবদের পুরোহিত হয়ে তাঁদের ক্রমশ ধর্মজ্ঞ করে তোলবার চেষ্টা করতে লাগলেন। আর, দেবতার মতো দৈহিক বল, মানসিক বল ও উৎসাহশালী মহাবীর পাণ্ডবগণ ধর্ম অনুসারেই রাজ্য লাভ করেছেন বলে তখন থেকে ধৌম্য মনে করতে লাগলেন।

পাণ্ডবগণ স্বস্ত্যয়ন করে ধৌম্য পুরোহিতের সঙ্গে দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। কুন্তী, ধৌম্য এবং পঞ্চ-পাণ্ডব পথে যেতে যেতে সম্মিলিত বহু ব্রাহ্মণকে দেখতে পেলেন। ব্রাহ্মণেরা পাণ্ডবদের প্রশ্ন করলেন, “আপনারা কোথায় যাবেন? কোথা থেকেই বা আপনারা আসছেন।” যুধিষ্ঠির জানালেন, “আমরা পাঁচভাই মায়ের সঙ্গে একচক্রাপুরী থেকে আসছি।” ব্রাহ্মণেরা বললেন, “আপনারা আজই পাঞ্চাল দেশে যাত্রা করুন; সেখানে দ্রুপদ রাজার বাড়িতে বহু ব্যয়ে বিশাল একটি স্বয়ংবর সভা হবে। আমরাও সমবেতভাবে সেখানেই যাব এবং মহোৎসব দেখব।”

যজ্ঞসেনস্য দুহিতা দ্রুপদস্য মহাত্মনঃ।

বেদীমধ্যাৎ সমুৎপন্না পদ্মপত্রনিভেক্ষণা॥

দর্শনীয়াহনবদ্যাপী সুকুমারী মনস্বিনী।

ধৃষ্টদ্যুম্নস্য ভগিনী দ্রোণশত্রোঃ প্রত্যাপিনঃ ॥ আদি: ১৭৭:৭-৮ ॥

“মহাত্মা দ্রুপদ রাজার কন্যা পদ্মনয়না দ্রৌপদী যজ্ঞবেদি থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন। তাঁর কোনও অঙ্গই নিন্দনীয় নয়, অতি সুদৃশ্য এবং সুকোমল; আর তিনি প্রশস্ত হৃদয় এবং দ্রোণশত্রু প্রতাপশালী ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী।

“যে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন কবচ, তরবারি, ধনু বাণ ধারণ করে প্রজ্বলিত যজ্ঞাগ্নি থেকে অগ্নির তুল্য উৎপন্ন হয়েছিলেন। অনিন্দ্যসুন্দরী ক্ষীণমধ্যা দ্রৌপদী সেই ধৃষ্টদ্যুম্নেরই ভগিনী, যার নীলোৎপল তুল্য দেহের গন্ধ একক্রোশ দূর থেকেও বইতে থাকে। সেই দ্রুপদকন্যা নিজেই বর নির্বাচনের জন্য উৎসুক হয়েছেন, তাঁকে দেখবার জন্য এবং সেই মহোৎসব প্রত্যক্ষ করবার জন্য আমরা যাচ্ছি। যাঁরা প্রচুর দক্ষিণা দিয়ে যথাবিধানে যজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন, বেদপাঠ করেছেন, যথানিয়মে ব্রত করেছেন এবং সমস্ত অস্ত্র শিক্ষা করেছেন, সেই পবিত্র মহাত্মা ও মহারথ রাজারা এবং সুদর্শন যুবক রাজপুত্রেরা নানাদেশ থেকে সেখানে আসছেন। তাঁরা জয়লাভ করার জন্য নানাবিধ ধন, দ্রব্য, গোরু ও সর্বপ্রকার খাদ্য ও পেয় দান করবেন। আমরা সেইসব গ্রহণ করে, স্বয়ংবর দেখে আপন আপন ইচ্ছানুসারে চলে যাব। স্তুতিপাঠক, পুরাণপাঠক, বংশপরিচায়ক, নট, নর্তক এবং মহাবলশালী বাহুযোদ্ধারা নানাদেশ থেকে সেখানে আসবে। আপনারাও সেইসব দেখে, আনন্দে পূর্ণ হয়ে, নানাবিধ বস্তু গ্রহণ করে আমাদের সঙ্গেই ফিরে আসবেন। তারপর, দেবতাদের মতো সুন্দর মূর্তি আপনাদের দেখে দ্রৌপদী হয়তো কোনও একজনকে বররূপে গ্রহণ করতেও পারেন। সুন্দর মূর্তি ও মহাবাহু এই ভাইটি আপনার আদেশে হয়তো বহুতর ধন জয় করেও আনতে পারেন।”

যুধিষ্ঠির বললেন, “ভদ্রমণ্ডল, আমরা সকলেই আপনাদের সঙ্গে মহোৎসব সম্পন্ন সেই দ্রৌপদীর স্বয়ংবর দেখতে যাব।”

এই কথা বলে পাণ্ডবেরা দ্রুপদরক্ষিত দক্ষিণ পাঞ্চাল দেশের দিকে যাত্রা করলেন। পথে, তাঁরা পবিত্র চিত্ত ও নিস্পাপ মহাত্মা বেদব্যাসকে দেখতে পেলেন। পাণ্ডবেরা ব্যাসদেবকে নমস্কার করলে, তিনি তাদের আদর করলেন। বেদব্যাসের অনুমতিক্রমে পাণ্ডবেরা দ্রুপদ নগরের দিকে প্রস্থান করলেন। তাঁরা পথে মনোহর বন ও সরোবর দেখে সেই স্থানে কিছুকাল অবস্থান করে ধীরে ধীরে পথ চলতে থাকলেন। বেদপাঠী, পবিত্র চিত্ত, মনোহরাকৃতি এবং প্রিয়বাদী পাণ্ডবগণ পাঞ্চাল দেশে উপস্থিত হলেন। ক্রমে তাঁরা রাজধানী এবং সেনানিবেশগুলি দেখে এক কুম্ভকারের বাড়িতে গিয়ে বাস করতে থাকলেন। সেখানে তাঁরা ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করে ব্রাহ্মণের বৃত্তি অবলম্বন করে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন। ফলে কেউ তাঁদের চিনতে পারল না।

দ্রুপদরাজের সর্বদাই ইচ্ছা ছিল পাণ্ডুনন্দন অর্জুনের হাতে দ্রৌপদীকে দান করব; কিন্তু তিনি এ ইচ্ছা বাইরে প্রকাশ করেননি। অর্জুনকে খুঁজে বার করবার জন্য তিনি এমন একটি ধনুক নির্মাণ করলেন, যা অর্জুন ভিন্ন অন্য কেউ নোয়াতে পারবে না। আর তিনি আকাশে একটি কৃত্রিম যন্ত্র নির্মাণ করলেন, তার উপরে সংলগ্নভাবে একটি লক্ষ্যও রচনা করলেন। তারপরে দ্রুপদ ঘোষণা করলেন, “যিনি এই ধনুতে গুণারোপণ করে এই পাঁচটি বাণের সাহায্যে যন্ত্র পার করে লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন, তিনিই আমার কন্যা লাভ করবেন।”

দ্রুপদরাজা এইভাবে স্বয়ংবরে কন্যাপ্রার্থীদের কর্তব্য ঘোষণা করলেন। তা শুনে অন্যান্য রাজারা, কর্ণের সঙ্গে দুর্যোধন প্রভৃতি কুরুবংশীয়েরা এবং স্বয়ংবর দর্শনার্থী ঋষিগণ সেখানে আসলেন। নানা দেশের ব্রাহ্মণেরা দেখতে এলেন। দ্রুপদ রাজা অম্রপানাদি দ্বারা আগন্তুক রাজাদের সংবর্ধনা করলেন। পুরবাসী লোকেরা স্বয়ংবর দেখবার ইচ্ছায় সমুদ্রের মতো কোলাহল করতে করতে মঞ্চের উপর ঘনিষ্ঠভাবে বসে পড়ল৷ মধ্যে বিশাল সভামণ্ডপ। তার চারপাশে অট্টালিকা; তার বাইরে প্রাচীর ও পরিখা এবং দ্বারে দ্বারে তোরণ ছিল; উপরে বিচিত্র চাঁদোয়া; কোনও স্থানে অনেকগুলি ভেরি ছিল; চারপাশে অগুরুর সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল। সকল স্থানই চন্দন গন্ধে স্নিন্ধ ছিল এবং পুষ্পমাল্য দ্বারা সাজানো ছিল। কৈলাস পর্বতের শৃঙ্গের মতো উঁচু ও শুভ্রবর্ণ অনেক প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল; সেগুলির ভিতরে মণি দ্বারা বহুতর বেদি নির্মাণ করে সেগুলিকে আবার সোনার ঝালরযুক্ত বস্ত্রে ঢেকে রেখে অগুরু দিয়ে সুবাসিত করা হয়েছিল। প্রাসাদগুলির ভিত্তি ছিল হাঁসের মতো সাদা, তা অতিশয় দৃষ্টিনন্দন ছিল; নানারকমের ধাতু দ্বারা চিত্রিত হওয়া সেই প্রাসাদগুলি হিমালয়ের শৃঙ্গের মতো সুন্দর দেখাচ্ছিল; আর তার ভিতরে মহামূল্য আসন, শয্যা ও পরিচ্ছদ ছিল। সাততলা সেই অট্টালিকাগুলিতে রাজারা পরস্পর স্পর্ধা করে অবস্থান করছিলেন। উপস্থিত লোকেরা দেখতে পেল অসাধারণ অধ্যবসায়ী, পরাক্রমশালী, প্রজাবর্গের প্রতি বিশেষ প্রসন্ন, ব্রাহ্মণ হিতৈষী, স্ব স্ব রাজ্যরক্ষক এবং আপন আপন লোকহিতকর কার্য দ্বারা সমস্ত লোকের প্রিয় রাজারা অগুরু প্রকৃতি গন্ধদ্রব্যে অলংকৃত হয়ে সেইসব স্থানে বসে আছেন।

নগরবাসী ও দেশবাসী লোকেরা দ্রৌপদীকে দেখার জন্য সকল দিকে উৎকৃষ্ট মঞ্চের উপর বসে পড়ল। আর পাণ্ডবেরা দ্রুপদরাজার অসাধারণ সম্পদ দেখতে দেখতে ব্রাহ্মণদের মধ্যেই বসলেন। এইভাবে সমস্ত সভা দিনে দিনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। যোলা দিনের দিন দ্রৌপদী স্নান করে, সুন্দর বস্ত্র পরিধান করে, সমস্ত অলংকারে অলংকৃত হয়ে এবং মণিখচিত সূবর্ণমালা ধারণ করে সেই রঙ্গস্থানে উপস্থিত হলেন।

তখন মন্ত্রজ্ঞ ও পবিত্র সোমকবংশীয়দের পুরোহিত অগ্নি স্থাপন করে তাতে ঘৃত দ্বারা যথাবিধানে হোম করলেন। তিনি হোম করলে, ব্রাহ্মণেরা স্বস্তিবাচন করলেন, সকল দিকের বাদ্য নীরব হল। রঙ্গস্থান নীরব হয়ে গেলে, মেঘ ও দুন্দুভির মতো কণ্ঠধ্বনি সম্পন্ন ধৃষ্টদ্যুম্ন যথা অনুষ্ঠানে দ্রৌপদীকে নিয়ে রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করে, মেঘের মতো গম্ভীর উচ্চ স্বরে কোমল, সঙ্গত এবং মনোেহর এই কথাগুলি বললেন, “সমবেত রাজগণ আমার কথা শ্রবণ করুন—এই ধনু, এই বাণ এবং ওই লক্ষ্য। আপনারা এই তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা ওই যন্ত্রের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে ওই লক্ষ্যটাকে বিদ্ধ করুন। উচ্চ বংশ, মনোহর রূপ এবং অসাধারণ বলশালী যে রাজপুত্র এই গুরুতর কার্য সম্পন্ন করতে পারবেন, আমার ভগ্নি দ্রৌপদী আজ তাঁর ভার্যা হবেন, আমি একথা মিথ্যা বলছি না।”

ধৃষ্টদ্যুম্ন রাজগণকে এই কথাগুলি বলে নাম, গোত্র ও কার্যদ্বারা উপস্থিত রাজগণের পরিচয় দেবার জন্য ভগ্নি দ্রৌপদীকে বললেন, “দ্রৌপদী, দুর্যোধন, দুর্বিষহ, দুর্ম্মুখ, দুষ্প্রধর্ষণ, বিবিংশতি, বিকর্ণ, মহ, দুঃশাসন, যুযুৎসু, বায়কো, ভীমবেগ, উগ্ৰায়ুধ, বলাকী, কনকায়ু, বিরোচন, কুম্ভজ, চিত্রসেন, সুবৰ্চা, কনকধ্বজ, নন্দক, বাহুশালী, তুহুণ্ড এবং বিকট—এই সকল ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র এবং বলবান অন্যান্য ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরাও কর্ণের সঙ্গে তোমার জন্য এসেছেন। উদারচেতা এবং ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ অন্যান্য অসংখ্য রাজাও এসেছেন। শকুনি, সৌবল, বৃষক এবং বৃহদ্বল—এই চারজন গান্ধার রাজপুত্র এসেছেন। অস্ত্রজ্ঞশ্রেষ্ঠ অশ্বত্থামা ও ভোজরাজ—এঁরা দুজনেই অলংকৃত হয়ে তোমার জন্য উপস্থিত হয়েছেন। বৃহন্ত, মণিমান এবং দণ্ডধার রাজাও এসেছেন। সহদেব, জয়সেন, মগধরাজ মেঘসন্ধি এবং শঙ্খ ও উত্তর নামক দুই পুত্রের সঙ্গে বিরাটরাজাও এসেছেন। বার্দ্ধক্ষেমি, সুবৰ্চা, সেনবিন্দু এবং সুনামা নামক পুত্রের সঙ্গে সুকেতুরাজাও এসেছেন। অংশুমান, চেকিতান, মহাবল, শ্রেণিমান এবং সমুদ্রসেনের পুত্র প্রতাপশালী চন্দ্রসেন উপস্থিত হয়েছেন। সুচিত্র, সুকুমার, বৃক, সত্যধৃতি, সূর্যধ্বজ, রোচমান, নীল এবং চিত্রায়ুধরাজা উপস্থিত আছেন। বিদণ্ড ও দণ্ড নামক পুত্রের সঙ্গে জলসন্ধ, পৌণ্ড্রক বাসুদেব ও বলবান ভগদত্ত এসেছেন। কলিঙ্গের রাজা, তাম্রলিপ্তের রাজা, পত্তনের রাজা এবং পুত্রের সঙ্গে মদ্ররাজ শল্য এসে সমবেত হয়েছেন। রুক্মাঙ্গদ ও রুক্মরথের সঙ্গে কুরুবংশীয় সোমদত্ত ও তাঁর পুত্রেরা এসেছেন। মহাবীর ভূরি, ভূরিশ্রবা এবং শল—এঁরা তিনজন আর কম্বোজদেশীয় সুদক্ষিণ এবং পুরুবংশীয় দৃঢ়ধণ্বা আসন গ্রহণ করেছেন। বৃহদ্বল, সুষেণ, উশীনরপুত্র শিবি এবং কৌরহন্তা করাষের রাজা এসেছেন। বলরাম, কৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, চারুদেষ্ণ, প্রদ্যুম্নের পুত্র গদ, অক্রূর, সাত্যকি, উদ্ধব, কৃতবর্মা; হার্দিক্য, পৃথু, বিপৃথু, বিদূরথ, কঙ্ক, শঙ্খ, গবেষণ, আশাবহ, অনিরুদ্ধ, সমীক, সারিমেজয়, বাতপতি, ঝিল্লি, পিণ্ডারক এবং উশীনর—এইসব বৃষ্ণি বংশীয়েরা এসেছেন। ভগীরথ, বৃহৎক্ষত্র, সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ, বৃহদ্রথ, বাহ্লিকি, এবং মহারথ শ্রুতায়ু এসেছেন। উলূক, কৈতর, চিত্রাঙ্গদ, শুভাঙ্গদ, বৎসরাজ, কোশলরাজ, বিক্রমশালী শিশুপাল ও জরাসন্ধ এসেছেন। এঁরা এবং নানাদেশের অধীশ্বর অন্যান্য অনেক রাজা আর জগৎ-প্রসিদ্ধ বহুতর ক্ষত্রিয় তোমার জন্য আগমন করেছেন।

“কল্যাণি! এই বিক্রমশালী রাজারা তোমার জন্য লক্ষ্যভেদ করতে প্রবৃত্ত হবেন। এঁদের মধ্যে যিনি লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন, তুমি আজ তাঁকেই বরণ করবে।”

কুণ্ডল প্রভৃতি সমস্ত অলংকারে অলংকৃত যুবক রাজপুত্রগণ অস্ত্রশিক্ষা ও দৈহিক বল নিজেদের আছে মনে করে পরস্পরের সঙ্গে স্পর্ধা করে লক্ষ্যভেদ করার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। কুল, শীল, রূপ, যৌবন, বল ও বিত্ত থাকায় হিমালয়বাসী মদমত্ত শ্রেষ্ঠ হস্তিগণের মতো তাঁদের দর্প প্রকাশ পেতে লাগল। তাঁরা সকলেই দ্রৌপদীর দিকে দৃষ্টিপাত করে, কামার্ত হয়ে, “দ্রৌপদী আমারই হবেন”—এই বলতে বলতে নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। পূর্বকালে হিমালয়কন্যা উমাকে লাভ করবার জন্য সমবেত দেবগণ যেমন শোভা পেয়েছিলেন, তেমনই দ্রুপদনন্দিনীকে লাভ করার জন্য রাজগণ রঙ্গস্থানে শোভা পেতে লাগলেন। তাঁদের সমস্ত মন দ্রৌপদীর উপর নিবিষ্ট হয়েছিল। কামবাণ জর্জরিত হৃদয়ে তাঁরা পরস্পর বন্ধু হয়েও দ্রৌপদীর জন্য পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করতে লাগলেন।

তখন একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, সাধ্যগণ, মরুদ্‌গণ এবং যমকে অগ্রবর্তী করে কুবেরের বিমানে চড়ে রঙ্গস্থানে এলেন। দৈত্যগণ, গরুড়বংশীয়গণ, নাগগণ, দেবর্ষিগণ, গুহ্যকগণ, চারণগণ, বিশ্বাবসু, নারদমুনি, পর্বতমুনি ও অপ্সরাদের সঙ্গে প্রধান গন্ধর্বগণও সেখানে এলেন। তখন বলরাম, কৃষ্ণ, বৃষ্ণিবংশীয়গণ, অন্ধকবংশীয়গণ এবং প্রধান প্রধান যদুবংশীয়গণ কৃষ্ণের মতানুসারে দৈবগণ ও ঋষিগণের মতো কেবল দেখতেই লাগলেন।

এই সময়ে মত্ত হস্তীর মতো সবল দেহ, ভস্মাবৃত অগ্নির মতো নিগূঢ় মূর্তি এবং একটি পদ্মকে লক্ষ করে অবস্থিত পাঁচটি হস্তীর ন্যায় পঞ্চপাণ্ডবকে দেখেই কৃষ্ণ চিনতে পারলেন। তারপর তিনি বলরামের কাছে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেবের বিষয় বললেন। বলরাম ভালভাবে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন।

কিন্তু দ্রৌপদীর রূপের ছটায় মুগ্ধ অন্যান্য রাজা বা রাজপুত্ররা আরক্ত কামার্ত চোখে দ্রৌপদীকেই দেখছিলেন। তাঁরা পাণ্ডবদের চিনতে পারলেন না। শুধু অন্যেরা নয়, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব—এঁরাও দ্রৌপদীকে দেখে কামবাণে পীড়িত হতে থাকলেন।

এই সময়ে দেবগণ, ঋষিগণ, গন্ধর্বগণ, গরুড় বংশীয়গণ, নাগগণ, অসুরগণ, সিদ্ধগণ আকাশপথে এসে উপস্থিত হলেন। স্বর্গীয় সুগন্ধে সমস্ত স্থান পরিপূর্ণ হল। আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকল, বিশাল দুন্দুভিধ্বনি শোনা যেতে লাগল। বেণু, বীণা ও পণবের বাদ্য হতে লাগল এবং বিমানে আকাশ ব্যাপ্ত হয়ে গেল।

তখন কর্ণ, দুর্যোধন, শাল্ব, শল্য, দ্রৌণায়নি, ক্রাথ, সুনীথ এবং বক্র—এঁরা দ্রৌপদীকে লাভ করার জন্য ক্রমশ বিক্ৰম প্রকাশ করতে লাগলেন; আর কলিঙ্গ, বঙ্গ, পাণ্ড্য ও পৌন্ড্রদেশের রাজা, বিদেহের রাজা, যবনদেশের রাজা এবং কিরীট, হার, কেয়ূর ও বলয় প্রভৃতি নানাবিধ অলংকারে অলংকৃত, পদ্মনয়ন, দীর্ঘবাহু, বিক্রম ও অধ্যবসায়শালী অন্যান্য রাজারা, রাজপুত্রেরা, রাজপৌত্রেরা বল ও দর্পবশত গর্জন করতে লাগলেন, কিন্তু সেই বিশাল আকৃতির ধনুতে গুণারোপণ করা মনে করতেও পারলেন না; তবু তাঁরা কম্পিত ওষ্ঠে বিক্রম প্রকাশ করতে করতে ধনুতে গুণরোপণ চেষ্টা করতে গিয়ে সেই ধনুর আঘাতেই ছিটকে পড়তে লাগলেন। সেই রাজারা শক্তি অনুসারে বিশেষ চেষ্টা করলেন কিন্তু তাঁরা মাটিতে পড়ে গেলেন। তাঁদের মাথার মুকুট, গলার হার প্রভৃতি ছড়িয়ে পড়ল। তাঁরা নিশ্বাস ত্যাগ করতে করতে দ্রৌপদী লাভের আশা ত্যাগ করে, আপন আসনে গিয়ে বসে পড়লেন।

তখন ধনুর্ধর প্রধান কর্ণ প্রায় সকল রাজার সেই অবস্থা দেখে ধনুর কাছে গেলেন এবং অতি দ্রুত সেই ধনু তুলে তাতে গুণ পরিয়ে বাণ সংযোগ করলেন। পাণ্ডবেরা কর্ণকে দেখে মনে করলেন যে, পৃথিবীর মধ্যে এই কর্ণই লক্ষ্যভেদ করে, দ্রৌপদীকে অবশ্য গ্রহণ করবেন। আর, অন্যান্য ধনুর্ধরেরা মনে করলেন যে কর্ণ দ্রৌপদীর প্রতি অনুরাগবশত লক্ষ্যভেদ করার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছেন। সুতরাং তিনি আপন তেজে অগ্নি, সুর্য ও চন্দ্রকেও অতিক্রম করেছেন। কর্ণকে লক্ষ্যভেদ করতে উদ্যত দেখে দ্রৌপদী উচ্চ স্বরে বললেন—

দৃষ্ট্বা তু তং দ্রৌপদী বাক্যমুচৈচর্জগাদ নাহং বরয়ামি সূতম্।

সামর্ষহাসং প্রসমীক্ষ্য সূৰ্য্যম্‌ তত্যাজ কর্ণঃ স্ফুরিতং ধনুস্ত্যৎ ॥ আদি: ১৮০: ২৩ ॥

তাঁকে লক্ষ্যভেদে উদ্যত দেখে দ্রৌপদী উচ্চ স্বরে বললেন, “আমি সূতকে বরণ করব না।” তখন কর্ণ ক্রোধ ও হাস্যের সঙ্গে সূর্যের দিকে তাকিয়ে, সেই স্পন্দিত ধনুখানি পরিত্যাগ করলেন।

এইভাবে সকল দিকের ক্ষত্রিয়েরা ব্যর্থ হলে চেদিদেশের রাজা, যমের মতো বীর ও সাহসী, ধীর প্রকৃতির ও অত্যন্ত বুদ্ধিমান, দমঘোষ পুত্র শিশুপাল সেই ধনুতে গুণ আরোপণ করতে প্রবৃত্ত হয়ে তারই আঘাতে হাঁটু পেতে ভূতলে বসে পড়লেন।

তারপর, মহাবীর ও মহাসাহসী জরাসন্ধ রাজা ধনুর কাছে গিয়ে পর্বতের মতো অচল হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর তিনি সেই ধনুতে গুণ আরোপণ করতে গেলেন, অমনি তার আঘাতে হাঁটু পেতে ভূতলে পড়ে গেলেন। মদ্ররাজ শল্যও সেই ধনুতে গুণ আরোপ করতে গিয়ে একই অবস্থা প্রাপ্ত হলেন। মদ্ররাজ শল্যর অবস্থা দেখে সভার সমস্ত লোকই বিস্মিত হয়ে গেল। রাজারাও সেই লক্ষ্যভেদ করা যে সম্ভব সে আশা পরিত্যাগ করলেন।

তখন কুন্তীপুত্র মহাবীর অর্জুন সেই ধনুতে গুণারোপণ করে শরসংযোগ করতে ইচ্ছা করলেন। রাজারা ধনুতে গুণারোপণ থেকে নিবৃত্তি পেলে বুদ্ধিমান অৰ্জন ব্রাহ্মণের মধ্য থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ইন্দ্ৰধ্বজের মতো দীর্ঘাকৃতি অর্জুন যাচ্ছেন দেখে প্রধান প্রধান ব্রাহ্মণেরা মৃগচর্ম আন্দোলিত করে বলতে লাগলেন, “থামো থামো।” কিছু ব্রাহ্মণ উদ্বিগ্ন হলেন, কিছু ব্রাহ্মণ আনন্দিত হলেন, বুদ্ধিমান কয়েকজন ব্রাহ্মণ বলতে লাগলেন, “লোকবিখ্যাত বলবান, বেদবিদ্যা ও ধনুর্বিদ্যায় শ্রেষ্ঠ শল্য প্রভৃতি ক্ষত্রিয়েরা যে কাজ সম্পন্ন করতে পারলেন না, অস্ত্রে অশিক্ষিত এবং অত্যন্ত দুর্বল শরীর ক্ষুদ্র এক ব্রাহ্মণ ধনুতে সেই গুণ আরোপ কীভাবে করবেন? এই ব্যক্তি পূর্বে লক্ষ্যভেদ পরীক্ষা করে দেখেনি। অথচ এখন চাঞ্চল্যবশত এই কাজ যদি সম্পন্ন করতে না পারে, তবে সমস্ত রাজার মধ্যে ব্রাহ্মণেরা হাস্যাস্পদ হবেন। এই ব্যক্তি গর্ব, হর্ষ বা ব্রাহ্মণ্যচাপল্যবশত যদি ধনু নোয়াবার জন্য এগিয়ে গিয়ে থাকে, তবে ওকে ভাল করে বারণ করুন, ও যেন না যায়। আমরা জগতে উপহাস্য বা হালকা হব না, রাজাদের বিদ্বেষের পাত্রও হব না।” কয়েকজন ব্রাহ্মণ সম্পূর্ণ ভিন্নমত প্রকাশ করে বললেন যে, এই ব্যক্তি যুবক, সুশ্রী, ঐরাবতের শুঁড়ের মতো দীর্ঘ এবং ধৈর্যে হিমালয়ের তুল্য। এর দুই কাঁধ, দুই ঊরু, দুই বাহু স্থূল, সিংহের মতো সাবলীল গতি, বলিষ্ঠ দেহ, মত্ত হস্তীর মতো বিক্রম আছে। এর উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে, এ লক্ষ্যভেদ করতে পারবে।

এর দেহে শক্তি আছে, মনে উৎসাহও আছে। সমর্থ হবে না এ-কথা ভাবলে এ নিজেই যেত না। ব্রাহ্মণদের কোনও অসাধ্য কাজ নেই। শুধু জল, বায়ু বা ফল আহার করে ব্রাহ্মণেরা যোগ অভ্যাস করেন। দেহে দুর্বল হলেও যোগপ্রভাবে ব্রাহ্মণ অত্যন্ত বলবান। তার প্রমাণ পরশুরাম একা যুদ্ধে সমস্ত ক্ষত্রিয়কে জয় করেছিলেন। অগস্ত্য আপন ব্ৰহ্মতেজে অগাধ সমুদ্র পান করেছিলেন। সুতরাং সুখজনক বা দুঃখজনক, বিশাল বা ক্ষুদ্র এবং সৎ বা অসৎ যে কোনও কার্যই ব্রাহ্মণ করুন না কেন, তাকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। এই ব্রাহ্মণ ব্ৰহ্মতেজে মহান; সুতরাং ইনি সত্বর ধনুতে গুণ আরোপণ করুন।

তারপর অর্জুন ধনুকের কাছে গিয়ে কিছুকাল পর্বতের মতো স্থির হয়ে থাকলেন। অর্জুন ধনুককে প্রদক্ষিণ করে, মাথা নিচু করে ঈশ্বর, বরদাতা ও জগতের নিয়ন্তা কৃষ্ণকে মনে মনে ধ্যান করে ধনু ধারণ করলেন। রুক্মী, সুনীথ, বক্র, রাধেয়, দুর্যোধন, শল্য এবং শাল্ব প্রভৃতি রাজারা বিশেষ চেষ্টা করেও যে ধনুতে গুণারোপণ করতে পারেননি। দর্পশালী এবং বিষ্ণুর মতো প্রভাবশালী ইন্দ্রপুত্র অর্জুন নিমেষমধ্যে বীরগণের উপস্থিতিতে সেই ধনুতে গুণ পরিয়ে বাণ পাঁচটি হাতে নিলেন। পরে, সেই লক্ষ্য বিদ্ধ করলেন। তৎক্ষণাৎ সে লক্ষ্য যন্ত্রের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত বিদ্ধ হয়ে ভূতলে পড়ল। তখন আকাশে দেবগণের এবং সমাজমধ্যে সভ্যগণের বিশাল কোলাহল শোনা গেল। দেবতারা শত্ৰুহন্তা অর্জুনের মাথায় স্বর্গীয় পুষ্পবর্ষণ করলেন। ব্রাহ্মণেরা উত্তরীয় বস্ত্রের অঞ্চল আন্দোলিত করতে লাগলেন এবং রাজারা লজ্জিত হয়ে সকল দিক থেকে হাহাকার করতে লাগলেন।

আকাশের সকল দিক থেকেই পুষ্পবৃষ্টি হতে আরম্ভ করল। বাদ্যকারেরা শতাঙ্গ এবং তূর্য বাজাতে থাকল। সূত ও মাগধগণ সুন্দর স্বরে স্তুতিপাঠ করতে লাগল। দ্রুপদরাজ অর্জুনকে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং সৈন্যদল নিয়ে তাঁকে সাহায্য করার কথা চিন্তা করলেন। সেই বিশাল শব্দ ক্রমশ বাড়তে লাগল। ধার্মিকশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেবের সঙ্গে দ্রুত বাসস্থানের দিকে চলে গেলেন।

আর, লক্ষ্য বিদ্ধ হয়েছে দেখে এবং লক্ষ্যবিদ্ধকারী অর্জুনকে শৌর্য ও সৌন্দর্যে ইন্দ্রের তুল্য নিরীক্ষণ করে দ্রৌপদী বহুদৃষ্ট হয়েও লোকের চোখে নতুন বলেই যেন মনে হতে লাগলেন এবং মুখে না হেসেও যেন হাসতে লাগলেন। মত্ত না হয়েও দ্রৌপদী যেন হাবেভাবেই পড়ে যেতে লাগলেন। মুখে কোনও কথা না বলেও তিনি যেন চোখের দৃষ্টিতে কথা বলতে লাগলেন। এইভাবে দ্রৌপদী শুভ্রবর্ণ বরমাল্য নিয়ে মনোহর মৃদু হাস্য করতে করতে অর্জুনের দিকে এগিয়ে গেলেন। অর্জুনের সামনে উপস্থিত হয়ে, শুভদৃষ্টি করে মনোহর মৃদু হাস্য করতে করতে নিঃশঙ্কচিত্তে রাজগণ ও ব্রাহ্মণগণের মধ্যে অর্জুনের বুকে সেই বরমাল্য সমর্পণ করেন দ্রৌপদী। দ্রৌপদীর অর্জুনকে বরণ করা দেখতে দেখতে মনে হল শচী যেমন দেবরাজকে, স্বাহা যেমন অগ্নিকে, লক্ষ্মী যেমন নারায়ণকে, উষা যেমন সূর্যকে, রতি যেমন কামদেবকে এবং পার্বতী যেমন মহাদেবকে বরণ করেছিলেন, দ্রৌপদী সেইভাবে অর্জুনকে বরণ করে নিলেন। ব্রাহ্মণেরা অচিন্ত্যকর্মা অর্জুনের প্রশংসা করতে লাগলেন, অর্জুন দ্রৌপদীকে নিয়ে রঙ্গস্থান থেকে নির্গত হলেন। দ্রৌপদী তাঁর পিছনে পিছনে চললেন।

মহারাজ দ্রুপদ অর্জুনের হাতে দ্রৌপদীকে সমর্পণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। সমবেত রাজারা পরস্পরকে বলতে লাগলেন, “আমরা রাজারা সম্মিলিত আছি, এই অবস্থায় রাজা দ্রুপদ আমাদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে স্ত্রীরত্ন দ্রৌপদীকে একটি ব্রাহ্মণের হাতে সমর্পণ করতে উদ্যত হয়েছেন। গাছ রোপণ করে ফল জন্মাবার সময়ে গাছটাকে নষ্ট করছে। সুতরাং এই দুরাত্মা দ্রুপদকে আমরা বধ করব। এই ব্যক্তি গুণিগণের সম্মান করতে জানে না, সুতরাং বয়োবৃদ্ধ হলেও এ নির্বোধ। সমস্ত ভারতবর্ষের রাজাদের ডেকে এনে, ভাল খাইয়ে-দাইয়ে, তাঁদের অপমান করছে। উপস্থিত এতগুলি রাজার মধ্যে এই দুরাত্মা একজনকেও কন্যা দানের উপযুক্ত মনে করল না। কন্যা বরণ বিষয়ে ব্রাহ্মণের কোনও অধিকার হয় না। কারণ, সারা পৃথিবী জানে ‘স্বয়ংবর ক্ষত্রিয়দের জন্যই’। আর, এই কন্যা যদি কোনও রাজাকে বরণ না-করে, একে অগ্নিতে নিক্ষেপ করে আমরা চলে যাব। কিন্তু এই ব্রাহ্মণ চাঞ্চল্য বা লোভবশত যে অপ্রিয় কাজ করেছে, তার জন্য একে কোনও দণ্ড দেওয়া যায় না। কারণ রাজাদের রাজ্য, জীবন, ধন, পুত্র-পৌত্রাদি এবং অন্য সকল বস্তুই ব্রাহ্মণের জন্য। তবে আমরা অপমানের ভয়ে এবং স্বধর্মরক্ষার জন্য অবশ্যই দ্রুপদকে বধ করব—যাতে অন্য স্বয়ংবরে এমন ঘটনা আর না ঘটে।”

রাজারা ক্রুদ্ধ হয়ে দ্রুপদরাজার প্রতি ধাবিত হলে দ্রুপদ ব্রাহ্মণদের শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু তিনি ভয়ে অথবা দুর্বলতায় কিংবা প্রাণরক্ষায় ব্রাহ্মণদের আশ্রয় নেননি, বিবাদ-নিবৃত্তির জন্যই গিয়েছিলেন। মত্ত হস্তীর মতো সেই রাজারা অগ্রসর হলে, শত্ৰুহন্তা ভীম ও অর্জুন তাঁদের সম্মুখীন হলেন। রাজারা অর্জুনকে বধ করার জন্য অস্ত্র ধারণ করলেন। তখন অদ্বিতীয় বীর, বজ্রের মতো দৃঢ় শরীর, অত্যন্ত বলবান, অদ্ভুত ও ভয়ংকর কার্যকারী ভীম দুহাতে একটি বিরাট গাছ মাটি থেকে উপড়ে নিয়ে, সেটি ডাল-পালা এবং পত্রশূন্য করে নিলেন। এমনকী অর্জুনও ভীমের সেই ভয়ংকর কাণ্ড দেখে বিস্মিত হলেন এবং ধনু ধারণ করে প্রস্তুত হলেন।

ভীম এবং অর্জুনের অচিন্তনীয় কাজ দেখে অসাধারণ বুদ্ধিমান কৃষ্ণ অগ্রজ বলরামকে বললেন, “আর্য! সঙ্কৰ্ষণ! সিংহ ও বৃষের ন্যায় সাবলীল গতি এই যে ব্যক্তি তাল প্রমাণ বিশাল ধনু আকর্ষণ করছে এ ব্যক্তি অর্জুন; আমি যদি বাসুদেব হই, তবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যিনি বলপূর্বক বৃক্ষ ভগ্ন করে, তৎক্ষণাৎ রাজাদের বধ করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তিনি ভীমসেন। কেন না ভীমসেন ছাড়া পৃথিবীর কোনও ব্যক্তিই যুদ্ধে এই ধরনের কাজ করতে পারে না। আর পূর্বে যিনি এই স্থান থেকে চলে গিয়েছেন, যার দুই চোখ পদ্মের পাতার মতো দীর্ঘ, বিশাল শরীর, সিংহের মতো গতিভঙ্গি, স্বভাব বিনীত, শরীরের কান্তি গৌরবর্ণ, নাক লম্বা, উন্নত ও মনোহর, তিনি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। কার্তিকের মতো যে দুটি কুমার চলে গিয়েছেন তাঁরাই নকুল ও সহদেব। কারণ আমি শুনেছিলাম যে কুন্তী দেবী ও পাণ্ডবগণ জতুগৃহদাহ থেকে মুক্তিলাভ করেছেন। সমস্ত শুনে বলরাম অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে কনিষ্ঠ ভ্রাতা কৃষ্ণকে বললেন, “কৃষ্ণ, বড়ই আনন্দিত হলাম যে, আমাদের পিসি কুন্তী দেবী কৌরবপ্রধান যুধিষ্ঠিরদের সঙ্গে ভাগ্যবশত মুক্তিলাভ করেছেন।”

ব্রাহ্মণেরা মৃগচর্ম ও কমণ্ডলু আন্দোলিত করে অর্জুনকে বললেন, “তুমি ভীত হোয়ো না। আমরা শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করব।”

ব্রাহ্মণদের কথা শুনে অর্জুন হেসে তাদের বললেন, “আপনারা দর্শক হয়ে এক পার্শ্বে থাকুন, মন্ত্র দ্বারা যেমন সাপকে বশ করা যায়, তেমনই সরলমুখ শত শত বাণ দ্বারা আমি এই ক্রুদ্ধ রাজাদের প্রতিহত করব।” এই বলে অর্জুন পণলব্ধ ধনুখানাকে আয়ত্ত করে ভীমের সঙ্গে পর্বতের মতো অচল হয়ে দাঁড়ালেন। দুটি হাতি যেমন বিপক্ষের হাতিদলের দিকে ধাবিত হয়, তেমনি ভীম ও অর্জুন, যুদ্ধবিশারদ কর্ণ প্রভৃতির দিকে নির্ভয়ে অগ্রসর হলেন। তখন রাজাগণ বললেন, “ওহে, যুদ্ধার্থী ব্রাহ্মণকেও কিন্তু বধ করার ঘটনা ঘটে।” এই বলে রাজারা ব্রাহ্মণদের দিকে ছুটে চললেন। তখন কর্ণ অর্জুনের দিকে, এবং মদ্ররাজ শল্য ভীমের প্রতি ধাবিত হলেন। আর দুর্যোধন প্রভৃতি অন্য রাজারা অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উপেক্ষাভরে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন।

অর্জুন তীক্ষ্ণ বাণে কর্ণকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। সেই তীক্ষ্ণবাণগুলিতে গুরুতর আঘাত পেয়ে কর্ণ অত্যন্ত বিস্মিত ও মুগ্ধ হলেন। তখন কর্ণ ও অর্জুন উভয়েই ক্রুদ্ধ হয়ে পরস্পরের প্রতি কঠিন শরক্ষেপণ করতে লাগলেন। বস্তুত উভয়ের মধ্যে তারতম্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হল। “তোমার বাণ দেখলাম, এইবার আমার বাণের ক্ষমতা দেখো।” দুজনেই এই স্পর্ধিত বাক্য প্রয়োগ করে পরস্পরকে আঘাত করতে লাগলেন।

তখন সুর্যপুত্র কর্ণ অর্জুনের বাহুবল জগতে অতুলনীয় বুঝে অত্যন্ত যত্ন সহকারে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন। কর্ণ অর্জুনের নিক্ষিপ্ত বাণসকল প্রতিহত করে সিংহনাদ করে উঠলেন। তারপর মুগ্ধ কর্ণ বললেন, “ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ, তুমি কি সাক্ষাৎ ধনুর্বেদ না পরশুরাম, না ইন্দ্র, না সাক্ষাৎ বিষ্ণু, আত্মগোপনের জন্য এই ব্রাহ্মণরূপ ধারণ করে বাহুবল অবলম্বন করে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করছ? কারণ, আমি ক্রুদ্ধ হলে, সাক্ষাৎ ইন্দ্র কিংবা অর্জুন ছাড়া অন্য কোনও পুরুষই আমার সঙ্গে যুদ্ধে সমর্থ হয় না।” অর্জুন উত্তরে বললেন, “কর্ণ আমি ধনুর্বেদ নই, প্রতাপশালী পরশুরাম নই। আমি সমস্ত অস্ত্ৰজ্ঞের মধ্যে শ্রেষ্ঠ একজন ব্রাহ্মণ; গুরুর উপদেশে ব্রাহ্ম ও ইন্দ্র অস্ত্রে শিক্ষিত হয়েছি। আজ আমি তোমাকে জয় করার জন্য যুদ্ধ করছি, হয় যুদ্ধ কর, না হয় পরাজয় স্বীকার করে প্রস্থান কর।” এই বলে অর্জুন নিক্ষিপ্ত বাণে কর্ণের ধনু ছেদন করলেন। ক্রুদ্ধ কর্ণ অন্য ধনু নিয়ে বাণ সন্ধান করলেন। অর্জুন বাণ দ্বারা কর্ণের সেই নূতন ধনুও ছেদন করলেন। ধনু ছিন্ন ও অঙ্গ-অত্যন্ত বিদ্ধ হলে, মহাবল কর্ণ পলায়ন করলেন। মুহূর্তমধ্যে তিনি অন্য ধনু ও বাণ নিয়ে পুনরায় যুদ্ধ করতে এলেন। অর্জুন বাণ দ্বারা কর্ণের নিক্ষিপ্ত সকল বাণ প্রতিহত করলেন। কর্ণ নিজের ভয়ংকর বাণগুলি ব্যর্থ হয়েছে দেখে, ব্রাহ্মতেজকে অজেয় মনে করে তৎক্ষণাৎ বাইরে চলে গেলেন।

অন্যদিকে, মহাবীর শল্য ও ভীম দুটি মত্ত হস্তীর মতো মুষ্টি ও জানু দ্বারা পরস্পরকে আঘাত করছিলেন। তাঁরা বাহু দ্বারা পরস্পরকে টেনে কাছে আনলেন, বাহু দ্বারা দূরে ফেলে দিলেন। দক্ষিণ পার্শ্বে ও বাম পার্শ্বে প্রেরণ করলেন। তখন ভীম দুই হাতে শল্যকে মাথার উপর তুলে ভূমিতে ফেলে দিলেন। তখন ব্রাহ্মণেরা হেসে উঠলেন। ভীম শল্যকে ভূতলে পতিত করেও বধ করলেন না। কর্ণ অত্যন্ত ভীত হলেন, অন্য রাজারাও ভীমের চারপাশে দাঁড়িয়ে পরবর্তী ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ভীম কেন শল্যকে বধ করছেন না, এই প্রশ্ন রাজাদের মধ্যে দেখা দিল। (ভীম বলতে পারলেন না শল্য তাঁর মাতুল, নকুল-সহদেবের মাতা মাদ্রীর ভ্রাতা)।

তখন সকলে মিলে প্রশ্ন করতে লাগল, “এই ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ দু’জন অসাধারণ প্রশংসার কাজ করেছেন। আমরা জানতে চাই, কোথায় এঁদের জন্ম, কোথায় বা এঁদের নিবাস? পরশুরাম, দ্রোণাচার্য, কৃষ্ণ, কৃপাচার্য এবং অর্জুন ছাড়া কোনও ব্যক্তিই বা কর্ণ এবং দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সমর্থ হয়? মহাবীর বলরাম, পাণ্ডব ভীমসেন এবং দুর্যোধন ছাড়া কেই বা যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ মদ্ররাজ শল্যকে ভূপাতিত করতে পারে? অতএব এই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে যুদ্ধ বিরতি ঘটুক, কারণ ব্রাহ্মণদের সর্বদা রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।”

কৃষ্ণ নির্বাক হয়ে ঘটনা দেখছিলেন। ভীমকে কুন্তীপুত্র বলে বুঝতে পেরে কৃষ্ণ সকল রাজাকে নিবৃত্ত করে বললেন, “ইনি ধর্ম অনুসারেই দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন।” যুদ্ধ-বিশারদ রাজারা নিবৃত্ত হলেন। যত লোক সেখানে এসেছিল, সবাই এই কথা বলতে বলতে চলে গেলেন, “ব্রাহ্মণ প্রধান স্বয়ংবর সম্পন্ন হল, দ্রৌপদীকেও ব্রাহ্মণেরাই লাভ করলেন।”

ব্রাহ্মণ পরিবেষ্টিত ভীম ও অর্জুন দ্রৌপদীকে নিয়ে সভাস্থল থেকে বহির্গত হলেন।

*

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন মনে আসে যে কন্যার জন্য এত কাণ্ড কারখানা ঘটল, সে কন্যা দেখতে কেমন ছিল? অংশাবতরণ পর্বে ব্যাসদেব বর্ণনা দিয়েছেন—যজ্ঞবেদি থেকে উঠে এলেন সর্বযোষিতবরা ঋতাবরী দ্রৌপদী।

নাতিহ্রস্বা ন মহতী নীলোৎপল সুগন্ধিনী।

পদ্মায়তাক্ষী, সুশ্রোণী, স্বসিতাঞ্ছিতমূৰ্দ্ধজা॥

সর্বলক্ষণা সম্পন্না, বৈদূর্যমণিসন্নিভা—

পঞ্চানাং পুরুষেন্দ্রাণাং চিত্ত প্রমথনী রহঃ॥ আদি:৬২: ১৫৯-১৬০॥

তিনি অতি খর্বাও ছিলেন না, অতি দীর্ঘাও ছিলেন না। নীলোৎপলের মতো সৌরভ উৎসারিত হত তার অনবদ্য অঙ্গ থেকে; তার চোখ দুটি ছিল পদ্মপত্রের মতো দীর্ঘায়ত। নিতম্বযুগল ছিল সুশোভন। নিশ্বাস বায়ুতেও তার মিহি কেশকলাপ সঞ্চালিত হত। তার দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সকল শুভলক্ষণ সূচিত করত। তার গায়ের রং ছিল বৈদুর্যমণির ন্যায় শ্যামল স্নিগ্ধ। তিনি নির্জনে ইন্দ্রতুল্য পাঁচটি পুরুষের চিত্তকে প্ৰমথিত করতেন।

অসাধারণ এই নারী। ইন্দ্রপত্নী শচীরানিই দ্রৌপদীরূপে অংশাবতরণ করেছিলেন। তাঁর আবির্ভাব মুহুর্তে দৈববাণী হয়েছিল—“সর্ব ঘোষিৎবরা কৃষ্ণা নিনীষুঃ ক্ষত্রিয়ান্ ক্ষয়ম্‌।”— এই কন্যাটির নাম হোক কৃষ্ণা, এ কন্যা সকল নারীর শ্রেষ্ঠা হবে—আর ক্ষত্রিয়দের ক্ষয়ের কারণ হবে।

চন্দ্রভাগা দ্রৌপদী। মনস্বিনী, ওজস্বিনী, সম্ভ্রান্ত দৌপদী। মহাভারতের পাতায় পাতায় ছড়ানো আছে দ্রৌপদীর ব্যক্তিত্বের অসামান্যতা।

১৯
নারদ কর্তৃক পাণ্ডবদের দাম্পত্য জীবনের নিয়ম-বন্ধন
(তিলোত্তমা সম্ভব)

স্বয়ংবর সভায় অর্জুন লক্ষ্যভেদ করলে পঞ্চ-পাণ্ডবের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ হল। এক বৎসর কাল পাঞ্চাল রাজ্যে আনন্দে অতিবাহিত করার পর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের আমন্ত্রণে, কৃষ্ণের সঙ্গে আলোচনা করে পাণ্ডবেরা হস্তিনাপুরে ফিরলেন। পাঁচ বৎসর হস্তিনাপুরে পরম আনন্দে কাটল। তারপর ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে রাজত্ব করার আজ্ঞা দিলেন। পাণ্ডবেরা আজ্ঞা পালন করলেন। তখন ইন্দ্রপ্রস্থ ভয়ংকর বন ও জলাশয়ে পরিপূর্ণ ছিল। অসাধ্যসাধন করে, কৃষ্ণের সাহায্য নিয়ে সেই জলা-জঙ্গল পরিপূর্ণ স্থানে পাণ্ডবেরা একটি নগর নির্মাণ করলেন। সমুদ্রের ন্যায় বিশাল পরিখা এবং জলশূন্য মেঘ ও চন্দ্রের তুল্য শুভ্রবর্ণ অত্যুচ্চ প্রাচীর দ্বারা সেই নগরটি অলংকৃত হল। নগরটিতে বহুসংখ্যক অট্টালিকা শোভিত হল এবং মন্দার পর্বতের ন্যায় বিশাল দ্বার আর গরুড়ের দুই পক্ষের ন্যায় বিশাল কপাট দ্বারা অট্টালিকাগুলি রক্ষিত হল। সেখানে বহু রাজমিস্ত্রি বাস করতে লাগল, যোদ্ধারা নগর রক্ষা করতে লাগল। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা সেখানে আসতে আরম্ভ করলেন। সর্বপ্রকার ভাষাভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নগরে বাস করতে এলেন এবং বণিকেরা ও শিল্পীরা দলে দলে প্রবেশ করতে লাগলেন। ধার্মিক ব্যক্তিদের আগমনে ইন্দ্রপ্রস্থপুরী আনন্দে পরিপূর্ণ নগরীতে রূপান্তরিত হল। বুদ্ধিমান ও ধর্মপরায়ণ পাণ্ডবগণ কাম-ক্রোধাদি জয় করে অত্যন্ত আনন্দ সহকারে ইন্দ্রপ্রস্থে বাস করতে লাগলেন।

তারপর একদিন মহাত্মা পাণ্ডবেরা উপবিষ্ট আছেন, এমন সময়ে দেবর্ষি নারদ সেখানে উপস্থিত হলেন। তখন যুধিষ্ঠির নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং নারদকে বসতে অনুরোধ করলেন। নারদ যুধিষ্ঠিরের আসনের উপর আপন কৃষ্ণাজিন ছড়িয়ে তার উপরে বসলেন। নারদ উপবিষ্ট হলে যুধিষ্ঠির নিজেই তাঁকে অর্ঘ্য দান করলেন এবং আপন রাজ্য দিতে চাইলেন। নারদ সেই পূজা গ্রহণ করে, সন্তুষ্ট হয়ে আশীর্বাদ করে যুধিষ্ঠিরকে উপবেশন করতে বললেন। নারদের অনুমতি লাভ করে যুধিষ্ঠির উপবেশন করলেন এবং অন্তঃপুরে দ্রৌপদীর কাছে সংবাদ পাঠালেন যে, দেবর্ষি নারদ এসেছেন। দ্রৌপদী পবিত্র ও ভক্তিযুক্ত হয়ে নারদের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাঁর চরণযুগলে প্রণাম করে কৃতাঞ্জলি হয়ে অবনতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইলেন। দ্রৌপদীকে নানাবিধ আশীর্বাদ করে নারদ দ্রৌপদীকে বললেন, “তুমি যেতে পারো।” দ্রৌপদী চলে গেলে নারদ পঞ্চ-পাণ্ডবকে বললেন, “যুধিষ্ঠির একমাত্র দ্রৌপদীই তোমাদের ধর্মপত্নী। সুতরাং যাতে তাঁকে নিয়ে তোমাদের পরস্পর বিবাদ উপস্থিত না হয়, তেমন নিয়ম করো। কারণ, পূর্বকালে ত্রিভুবন বিখ্যাত সুন্দ ও উপসুন্দ নামে দুই ভ্রাতা ছিল। তারা দুজনেই একত্রে থাকত, এক গৃহ, এক শয্যা ও একত্র ভোজন ও অবস্থান করত। কিন্তু তারাও এক তিলোত্তমার জন্য পরম্পরকে বধ করেছিল। অতএব তোমরা পরস্পরের প্রণয়জনক সৌভ্রাত্র রক্ষা করো এবং যাতে তোমাদের মধ্যে ভেদ না জন্মায় তা করো।”

যুধিষ্ঠির বললেন, “মহর্ষি, সুন্দ ও উপসুন্দ কার পুত্র ছিল? কী ভাবে তাদের মধ্যে ভেদ জন্মেছিল এবং কেনই বা তারা পরস্পরকে বধ করেছিল? এই তিলোত্তমা অপ্সরা ছিল না দেবকন্যা ছিল এবং সে কার অধীনে ছিল? হে তপোধন, আমাকে বিশদভাবে সেই বৃত্তান্ত বলুন যার প্রতি কামে উন্মত্ত হয়ে সুন্দ ও উপসুন্দ পরস্পরকে বধ করেছিল।”

নারদ তখন বিশদভাবে পাণ্ডব ভ্রাতাদের কাছে সুন্দ-উপসুন্দ বৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন। পূর্বকালে মহাসুর হিরণ্যকশিপুর বংশে তেজস্বী ও বলবান ‘নিকুম্ভ’ নামে এক মহাদৈত্য জন্মগ্রহণ করেছিল। নিকুম্ভের সুন্দ ও উপসুন্দ নামে দুই পুত্র জন্মেছিল।

তারা অত্যন্ত বলবান, ভয়ংকর পরাক্রমশালী, ভীষণ প্রকৃতি ও নিষ্ঠুর চিত্ত ছিল। তারা সর্বদাই একরূপ কার্য স্থির করত, এক কার্যে উভয়ে সম্মত হত, উভয়েই সমান সুখ এবং সমান দুঃখ পেত। পরস্পর মিলিত না হলে তারা ভোজন করত না এবং পরস্পর পরস্পরের প্রিয় কার্য করত ও প্রিয় কথা বলত। তাদের স্বভাব ও আচরণ এক রকম ছিল। বিধাতা যেন একটিকেই দুটি করে সৃষ্টি করেছিলেন। অভিন্ন হৃদয় ও মহাবীর সুন্দ ও উপসুন্দ ক্রমে বড় হয়ে উঠল।

তারপর তারা ত্রিভুবন জয় করার জন্য একমত ও একনিশ্চয় হয়ে, দীক্ষা গ্রহণ করে, বিন্ধ্য-পর্বতে গিয়ে, ভয়ংকর তপস্যা করতে লাগল। জটা ও বল্কল ধারণ করে, ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হয়ে, দীর্ঘকাল তপস্যা করার উপযুক্ত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠল। তারা বায়ুমাত্র ভক্ষণ করে, আপন আপন মাংস দ্বারা হোম করতে থেকে, কেবল পাদাঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগ দ্বারা ভূতলে অবস্থানপূর্বক ঊর্ধ্ববাহু ও নির্নিমেষ নয়ন হয়ে দীর্ঘকাল তপস্যা করল। তখন তাদের অঙ্গে মল জমা হয়েছিল।

তাদের তপস্যার প্রভাবে দীর্ঘকাল সন্তপ্ত হতে থেকে বিন্ধ্যপর্বত ধুম উদ্‌গার করতে লাগল; সে ঘটনা যেন অদ্ভুত বলে বোধ হল। তাদের ভয়ংকর তপস্যা দেখে দেবতারা ভীত হয়ে পড়লেন। তাঁরা তপোভঙ্গের জন্য বিঘ্ন সৃষ্টি করতে লাগলেন। দেবতারা নানাবিধ মণি, রত্ন ও যুবতী স্ত্রী দ্বারা তাদের প্রলুব্ধ করতে চাইলেন। কিন্তু তারা তপস্যায় দৃঢ়ব্রত থাকায় তপোভঙ্গ করল না।

তখন দেবতারা, তাদের উপর মায়াপ্রকাশ করলেন। শূলধারী কোনও রাক্ষস তাদের মাতা, ভগিনী ও ভার্যা ও দাসী প্রভৃতি পরিজনদের এনে একেবারে বিবস্ত্র করে আঘাত করতে লাগল; তাদের চুলের অলংকার খুলে পড়তে লাগল এবং তারা ভূতলে পড়ে চিৎকার করতে লাগল। তারা সুন্দ, উপসুন্দকে সম্বোধন করে ‘রক্ষা করো, রক্ষা করো’ বলে আর্তনাদ করতে লাগল। তথাপি সুন্দ ও উপসুন্দ তপস্যা ভঙ্গ করল না; ক্ষুব্ধ বা দুঃখিত হল না, তখন সেই সকল স্ত্রীলোক এবং রাক্ষস অন্তর্হিত হল।

তখন সমস্ত লোকের হিতৈষী ও প্রভাবশালী ব্রহ্মা তাদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন এবং বরপ্রার্থনা করতে বললেন। সুন্দ ও উপসুন্দ, দুই ভাই, ব্রহ্মাকে দেখে কৃতাঞ্জলি হয়ে অবস্থান করতে লাগলেন। তখন, দুই ভাই সম্মিলিতভাবে ব্রহ্মাকে বলল, “এই তপস্যা দ্বারা আমাদের উপর আপনি যদি সন্তুষ্ট ও প্রসন্ন হয়ে থাকেন, তবে আমরা দুইজনেই যেন মায়াবিৎ, অস্ত্রবিৎ, বলবান, কামরূপী ও অমর হতে পারি।” ব্রহ্মা বললেন, “অমরত্ব ব্যতীত অন্য যা যা চেয়েছ, তা তোমরা পাবে। মৃত্যু ছাড়া অন্য সমস্ত বিষয়েই তোমরা দেবতার তুল্য প্রভাবশালী হবে। ‘আমরা ত্রিভুবনের প্রভু হব’ এই উদ্দেশ্য করেই যেহেতু তোমরা গুরুতর তপস্যা করেছ, সেই হেতুই তোমাদের অমরত্ব প্রদান করব না।”

তখন সুন্দ ও উপসুন্দ বলল, “পিতামহ ত্রিভুবনের মধ্যে স্থাবর ও জঙ্গম যে কিছু প্রাণী আছে, সেইসব প্রাণী থেকে আমাদের মৃত্যু হবে না। আমাদের পরস্পর ছাড়া কোনও প্রাণীই আমাদের মৃত্যু দিতে পারবে না, এই বর দিন।”

ব্রহ্মা বললেন, “যা তোমরা চেয়েছ, সেই বরই তোমাদের দিলাম। তোমাদের মৃত্যু এইভাবেই হবে।” ব্রহ্মা তাঁদের তপোভঙ্গের নির্দেশ দিয়ে ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন। দৈত্যশ্রেষ্ঠ দুই ভাইও, বর লাভ করে সমস্ত জগতের অবধ্য হয়ে আপন ভবনে চলে গেল। তারা বরলাভ করে পূর্ণ মনোরথ হয়ে এসেছে দেখে তাদের বন্ধুবর্গ অত্যন্ত আনন্দ লাভ করল। তখন তারা জটা খুলে বাবরি করল এবং মহামূল্য অলংকার ও নির্মল বস্ত্র পরিধান করল৷ তারা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাকে সমস্ত সময়ে ধরে রাখল। তাতে বন্ধুরা আরও আনন্দিত হল। “ভক্ষণ করো, ভোজন করো, পান করো, দান করো, গান করো এবং আরাম করো”—ঘরে ঘরে এই শব্দ শোনা যেতে লাগল। যেখানে সেখানে বিশাল কোলাহল, আমোদের আহ্বান এবং আনন্দ করতালি ধ্বনিতে দৈত্যনগরী পরিপূর্ণ হতে থাকল, বোঝা গেল সকলেই আনন্দিত ও আমোদিত হয়েছে। কামরূপী দৈত্যরা এইভাবে আমোদ করতে থাকলে, তাদের সেই নানাবিধ উৎসব অনেক বৎসরও যেন একটি দিনের মতো চলে গেল।

উৎসব সমাপ্তি মাত্র সুন্দ ও উপসুন্দ মন্ত্রণা করে ত্রিভুবন জয় করার ইচ্ছায় সৈন্যগণকে সজ্জিত হবার জন্য আদেশ দিল। তারপর বন্ধুগণ ও মন্ত্রিগণের অনুমতিক্রমে তারা যাত্রাকালীন মাঙ্গলিক আচরণ করে রাত্রিতে মঘা নক্ষত্রে যাত্রা করল। তারা গদা, পট্টিশ, শূল, মুদগর ও বর্মধারী বিশাল দৈত্যসৈন্যের সঙ্গে প্রস্থান করল। স্তুতিপাঠকেরা জয় ইচ্ছা করে মাঙ্গলিক স্তুতি করল। সুন্দ ও উপসুন্দ পরমানন্দে আকাশে উঠে দেবলোকে চলে গেল। দেবতারা তাদের আগমন সংবাদ শুনে ব্রহ্মার বরদান স্মরণ করলেন এবং স্বর্গলোক ত্যাগ করে ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন। মহাবিক্রমশালী সুন্দ ও উপসুন্দ স্বর্গলোক, যক্ষগণ, রাক্ষসগণ এবং আকাশচর প্রাণীগণকে জয় করে চলে গেল। তারা পাতালবাসী নাগদিগকে জয় করে সমুদ্রতীরবাসী সমস্ত ম্লেচ্ছ জাতিকে জয় করল। তারপর তারা ভয়ংকর শাসন প্রচার করে সমস্ত পৃথিবী জয় করতে আরম্ভ করে সৈন্যদের ডেকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর বাক্য বলল।

“রাজর্ষিরা মহাযজ্ঞ দ্বারা এবং ব্রাহ্মণেরা হব্য-কব্য-দ্বারা দেবগণের তেজ, বল ও সম্পদ বৃদ্ধি করে থাকে। অতএব আমাদের সকলেরই সম্মিলিত হয়ে সেই অসুরদ্বেষী রাজর্ষি প্রভৃতিকে সর্বপ্রযত্নে বধ করা উচিত।”

সকলকে এই আদেশ করে সুন্দ ও উপসুন্দ মহাসমুদ্রের পূর্বতীরে গিয়ে নিষ্ঠুর বুদ্ধি অবলম্বন করে সকল দিকে বিচরণ করতে লাগল। যে কেউ যজ্ঞ করছিলেন এবং যে সকল ব্রাহ্মণ যজ্ঞ করাচ্ছিলেন, তাদের বলপূর্বক হত্যা করে সেই স্থান থেকে চলে যেতে লাগল। আর, তাদের সৈন্যরা জিতেন্দ্রিয় মুনিগণের আশ্রমে প্রবেশ করে তাঁদের অগ্নিহোত্রের সমস্ত বস্তু নিয়ে নির্ভয়ে জলে ফেলে দিতে লাগল। তপস্বীরা ক্রুদ্ধ হয়ে যে সকল অভিসম্পাত করতেন, ব্রহ্মার বরে সেগুলি তাদের স্পর্শও করতে পারত না। প্রস্তরের উপর নিক্ষিপ্ত বাণের তুল্য সেই অভিসম্পাতগুলি ব্যর্থ হতে থাকলে ব্রাহ্মণেরা নিয়ত কার্য পরিত্যাগ করে পালাতে লাগলেন। পৃথিবীতে জিতেন্দ্রিয় ও শমগুণান্বিত তপস্বীরা, সর্প যেমন গরুড়ের ভয়ে পালায়, তেমনই সুন্দ ও উপসুন্দের ভয়ে পালাতে লাগলেন।

তারা মুনিদের আশ্রমগুলি মথিত ও ভগ্ন করে সেখান থেকে কলস, স্রুক, স্রব ইত্যাদি হোমের উপকরণগুলি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত করত। সমস্ত কাল যেন নিহত হয়ে শূন্য হয়ে গেল। রাজর্যি ও মহর্ষিরা অদৃশ্য হয়ে যেতেন বলে সুন্দ ও উপসুন্দ সর্বত্র তাঁদের অনুসন্ধান করতে লাগল। তারা মদমত্ত হস্তীর রূপ ধারণ করে গুপ্তস্থান থেকে খুঁজে খুঁজে তাদের হত্যা করতে লাগল। একবার সিংহের রূপ ধারণ করে, পরমু্হূর্তে ব্যাঘ্রের রূপ ধারণ করে তারা মুনিগণকে হত্যা করতে লাগল।

তখন পৃথিবীতে যজ্ঞ ও বেদপাঠ নিবৃত্তি পেল, রাজা ও ব্রাহ্মণ লুপ্ত হল এবং উপনয়ন প্রভৃতি উৎসবকার্য বন্ধ হয়ে গেল। সর্বত্র হাহাকার পড়ে গেল, অবশিষ্ট লোকেরা ভয়ার্ত হয়ে পড়ল, হাটে আর ক্রয়-বিক্রয় থাকল না, দেবকার্য উঠে গেল, পুণ্যকার্য ও বিবাহকার্য বন্ধ হয়ে গেল, কৃষি ও গোরক্ষা নিবৃত্তি পেল, নগর ও আশ্রমগুলি ধ্বংস হতে লাগল এবং অস্থি-কঙ্কালে পরিপূর্ণ পৃথিবী ভয়ংকরদর্শনা হয়ে পড়ল। পিতৃকার্য উঠে গেল এবং যাজ্ঞিকমণ্ডলে স্বাহা-বষটকারাদি থাকল না। সমস্ত জগৎ ভয়ংকর মূর্তি এবং দুষ্প্রেক্ষ্য হয়ে পড়ল। ওদিকে চন্দ্র, সূর্য, অন্যান্য গ্রহ, সপ্তর্ষিমণ্ডল, অশ্বিনী প্রভৃতি নক্ষত্র সুন্দ ও উপসুন্দের সেই কার্য দেখে বিষাদমগ্ন হলেন। এইভাবে, সুন্দ ও উপসুন্দ নিষ্ঠুর ব্যবহারে সমস্ত দিক জয় করে, শত্রুশূন্য হয়ে কুরুক্ষেত্রে রাজধানী স্থাপন করল।

দেবর্ষিগণ ও সিদ্ধ মহর্ষিগণ জগতের সেই গুরুতর দুরবস্থা দেখে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। তখন, ক্রোধবিজয়ী, সংযতচিত্ত ও জিতেন্দ্রিয় সেই মহর্ষিরা জগতের উপর দয়াবশত ব্ৰহ্মলোকে গমন করলেন। তাঁরা সেখানে গিয়ে দেখলেন—ব্রহ্মা দেবতাদের সঙ্গে উপবিষ্ট হয়ে আছেন। ব্রহ্মর্ষিরা তাঁকে পরিবেষ্টন করে আছেন। সেইখানে বিষ্ণু, শিব, অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, সূর্য, শুক্র এবং ব্রহ্মার মানসপুত্র মরীচি প্রভৃতি ঋষিরাও অবস্থান করছিলেন। তখন বৈখানস, বালখিল্য, বাণপ্রস্থ, মরীচিপায়ী, বিষ্ণু উপাসক এবং মোহশূন্য ব্ৰহ্মচিন্তকগণ, এঁরা সকলেই ব্রহ্মার কাছে গিয়ে, সুন্দ ও উপসুন্দের সমস্ত কার্যই বললেন। তারা যেভাবে ত্রিভুবনের রাজ্য হরণ করেছিল এবং অন্য যে সমস্ত অন্যায় কার্য করেছিল, তাও বিশদভাবে তাঁরা ব্রহ্মার কাছে নিবেদন করলেন এবং সুন্দ ও উপসুন্দের অত্যাচারের প্রতিকার প্রার্থনা করলেন।

ব্রহ্মা মহর্ষি ও দেবর্ষিগণের সমস্ত কথা শুনে মুহূর্তকাল কর্তব্য নির্ধারণের উপায় চিন্তা করলেন এবং তারপর বিশ্বকর্মাকে আহ্বান করলেন। বিশ্বকর্মা উপস্থিত হলে ব্রহ্মা তাঁকে আদেশ করলেন, “বিশ্বকর্মা সকলেরই প্রার্থনীয়া হয়, এমন একটি রমণী তুমি সৃষ্টি করো।” তখন বিশ্বকর্মা ব্রহ্মাকে নমস্কার করে এবং তাঁর বাক্যের প্রশংসা করে, চিন্তাপূর্বক বিশেষ যত্নসহকারে একটি অলৌকিক রমণী সৃষ্টি করলেন। সর্বজ্ঞ বিশ্বকর্মা ত্রিভুবনের মধ্যে স্থাবর ও জঙ্গমাত্মক প্রাণীগণের যা কিছু মনোহর উপাদান ছিল, সে সমস্তই সেই রমণীর জন্য নিয়ে এলেন। তার অঙ্গে কোটি কোটি রত্ন সন্নিবেশিত করলেন। এইভাবে তিনি সেই রমণীটিকে সর্বরত্নময়ী ও দেবরূপিণী করে সৃষ্টি করলেন। বিশ্বকর্মার গুরুতর চেষ্টায় নির্মিত সেই রমণীটি ত্রিভুবনের সমস্ত রমণীর মধ্যেই রূপে অতুলনীয়া হল। কেন না, তার শরীরে এমন সুক্ষ্ম স্থানও ছিল না, যাতে দ্রষ্টৃবর্গের দৃষ্টি রূপরাশির গুণে সংলগ্ন না হত।” (১৫)

ন তস্যাঃ সূক্ষ্মামপ্যস্তি যদ্‌ গাত্রে রূপ সম্পদা।

নিযুক্তা যত্র বা দৃষ্টির্ণ সজ্জতি নিরীক্ষতাম্‌॥

সা বিগ্রহবতীব শ্রীঃ কামরূপা বপুষ্মতী।

পিতামহমুপাতিষ্ঠৎ কি করোমীতি চাব্রবীৎ॥ আদি: ২০৪: ১৫-১৬॥

—কামরূপিণী ও মনোহরাঙ্গী সেই রমণী, মূর্তিমতী লক্ষ্মীর ন্যায় ব্রহ্মার নিকট গেল এবং বলল, “আমি কী করব।”

ব্রহ্মা তাকে দেখেই আনন্দিত হয়ে স্নেহবশত তাকে এই বর দিলেন, “তুমি সমস্ত প্রাণীর মধ্যে অধিক কমনীয়তা লাভ করো এবং তোমার দেহখানি সৌন্দর্যের গুণে সর্বোৎকৃষ্ট হোক।” ব্রহ্মার সেই বরদানে এবং বিশ্বকর্মার নির্মাণের গুণে সেই রমণী তখন সকল প্রাণীর নয়ন ও মন হরণ করল।

বিশ্বকর্মা ত্রিভুবনের মধ্যে উৎকৃষ্ট বস্তুর তিল তিল এনে যেহেতু তাঁকে নির্মাণ করেছিলেন, সেই হেতু ব্রহ্মা তাঁর নাম দিলেন—“তিলোত্তমা”।

সেই তিলোত্তমা ব্রহ্মাকে নমস্কার করে কৃতাঞ্জলি হয়ে বলল, “প্রজানাথ, আমার দ্বারা আপনাদের কোন কার্য সম্পন্ন হবে? যেহেতু আমাকে সৃষ্টি করলেন।” তখন ব্রহ্মা বললেন, “তিলোত্তমা তুমি গিয়ে সুন্দ ও উপসুন্দের মধ্যে তোমার প্রার্থনীয় রূপ নিয়ে প্রলুব্ধ করো।” “তাই হবে” এই বলে ব্রহ্মাকে নমস্কার করে তিলোত্তমা মণ্ডলাকারে দেবতাদের প্রদক্ষিণ করতে আরম্ভ করলেন।

তখন ব্রহ্মা পূর্বমুখ হয়ে, শিব দক্ষিণমুখ হয়ে, অন্যান্য দেবতারা উত্তরমুখ হয়ে বসেছিলেন। আর, ঋষিরা তাঁদের চারপাশে ছিলেন। তিলোত্তমা মণ্ডলাকারে প্রদক্ষিণ করতে থাকলে শিব এবং ইন্দ্র কিছুকাল ধৈর্য অবলম্বন করে রইলেন। কিন্তু ব্রহ্মা তাকে দেখার জন্য অত্যন্ত অভিলাষী হলেন। সুতরাং সে যখন দক্ষিণ দিকে গেল, তখন তাঁর দক্ষিণমুখ প্রকাশিত হল, সেই মুখের পদ্মতুল্য নয়ন দুটি তিলোত্তমার উপর গিয়ে পড়ল। তিলোত্তমা পিছনের দিকে গেলে ব্রহ্মার পিছনের মুখ প্রকাশিত হল, আবার সে উত্তর দিকে গেলে তাঁর উত্তর দিকের মুখ প্রকাশিত হল। তারপর ইন্দ্রেরও পিছন থেকে, পার্শ্বদ্বয় থেকে এবং সম্মুখ থেকে এক সহস্র রক্তবর্ণ বিশাল নয়ন প্রকাশিত হল। এই কারণে, পূর্বকালে ব্রহ্মা চতুর্মুখ, শিব স্থাণু এবং ইন্দ্র সহস্রাক্ষ হয়েছিলেন।

আর, প্রদক্ষিণ করার সময় তিলোত্তমা যে-যে দিকে যেতে লাগল, সেই-সেই দিকে দেবগণ ও মহর্ষিগণের মুখ সর্বপ্রকারে পরিবর্তিত হতে থাকল এবং সেই মহাত্মাদের সকলের দৃষ্টি সেই তিলোত্তমার অঙ্গে গাঢ় সংলগ্ন হতে লাগল। কিন্তু ব্রহ্মার তা হল না। তখন দেবর্ষি, মহর্ষিরা মনে করতে লাগলেন যে অপূর্ব রূপ-লাবণ্যবতী তিলোত্তমা অনায়াসে সুন্দ ও উপসুন্দের মধ্যে বিরোধ ঘটিয়ে দেবেন। তিলোত্তমা চলে গেলে, ব্রহ্মা সকল দেবতা ও ঋষিগণকে বিদায় দিলেন।

সুন্দ ও উপসুন্দ সমগ্র পৃথিবী জয় করে, শত্রুশূন্য ও আনন্দিত হয়ে এবং ত্রিভূবনকে ত্রস্ত করে, কৃতকার্য হয়েছিল। তারা দেব, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, নাগ ও ভূপালগণের সর্বপ্রকার রত্ন আত্মসাৎ করে অত্যন্ত আনন্দ লাভ করেছিল। তখন ত্রিভুবনের মধ্যে কোনও লোকই তাদের প্রতিপক্ষ ছিল না, কাজেই তারা যুদ্ধের উদ্‌যোগ পরিত্যাগ করে দেবতার মতো বিহার করতে লাগল। তারপরে, তারা কোনও সময়ে বিন্ধ্য পর্বতের সমতল ভূমিতে পুষ্প শোভিত শালবনে বিহারসুখ অনুভব করতে লাগল। অনুচরগণ সর্বপ্রকার উৎকৃষ্ট বস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়ে আসছিল। সুন্দ ও উপসুন্দ স্ত্রীদের সঙ্গে মনোহর আসনে উপবেশন করল।

রমণীরা তাদের স্তুতিসূচক গান গাইতে লাগল, বাদ্য ও নৃত্য পরিবেশন করে তাদের সন্তুষ্ট করল এবং প্রেমবশত তাদের সঙ্গে সঙ্গম করল। তখন, তিলোত্তমা একখানি রক্তবস্ত্র পরিধান করে পুরুষের চিত্তাকর্ষক বেশ ধারণ করে, নদীতীরবর্তী স্থলপদ্ম চয়ন করতে করতে ধীরে ধীরে সেইখানে গেল, যেখানে সুন্দ ও উপসুন্দ বসে ছিল। সুন্দ ও উপসুন্দ উত্তম সুরা পান করে, মদে আরক্তলোচন হয়েছিল, তারা তিলোত্তমাকে দেখেই কামপীড়িত হয়ে পড়ল। আসন পরিত্যাগ করে উঠে— দুজনেই তিলোত্তমার কাছে গেল এবং কামমত্ত অবস্থায় দুজনেই তিলোত্তমাকে প্রার্থনা করল৷ সুন্দ আপন হস্তে তিলোত্তমার দক্ষিণ হস্ত ধারণ করল; আর উপসুন্দ তার বাম হস্ত ধারণ করল। তারপর ব্রহ্মার বরদানের মত্ততা, কায়িক বলের মত্ততা, ধন ও রত্নের মত্ততা, সুরাপানের মত্ততা— এতগুলি মত্ততার দ্বারা অত্যন্ত মত্ত, পরস্পরের দিকে ভ্রূকুটি করতে থেকে পরস্পর পরস্পরকে বলল—

সুন্দ বলল, “আমার ভার্যা তো তোমার নিকট মাতার তুল্য।” উপসুন্দ বলল, “আমার ভার্যা তো তোমার নিকট পুত্রবধুর তুল্য।” তারপর তারা দুজনেই উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগল —“এ তোমার নয়, এ আমারই।” তিলোত্তমার রূপে তারা অত্যধিক মত্ত হয়েছিল বলে তাদের স্নেহ ভালবাসা অন্তর্হিত হয়েছিল এবং তার পরিবর্তে অত্যন্ত ক্রোধ দেখা দিল। তখন তারা দুজনেই তিলোত্তমাকে নেবার জন্য ভয়ংকর গদা ধারণ করল। “আমি আগে নেব, আমি আগে নেব।” বলতে বলতে পরস্পরকে গদার আঘাত করতে লাগল। সেই আঘাতে দুজনের শরীর রক্তাক্ত হয়ে গেল। তখন ভয়ংকরাকৃতি সেই সুন্দ ও উপসুন্দ গগনচ্যুত দুটি সুর্যের ন্যায় ভূতলে পতিত হল এবং মৃত্যুবরণ করল। তখন সেই রমণীরা পলায়ন করল এবং সেই অনুচর দৈত্যগণও বিষাদে ও ভয়ে কম্পিত হয়ে সকলেই পাতালে চলে গেল।

তারপর, নির্মলচিত্ত ব্রহ্মা তিলোত্তমাকে সম্মানিত করার জন্য দেবগণ ও মহর্ষিগণের সঙ্গে সেখানে আগমন করলেন। ভগবান ব্রহ্মা প্রীত হয়ে তিলোত্তমাকে বর দিয়ে সন্তুষ্ট করেছিলেন। তিনি বর দিতে ইচ্ছা করে তিলোত্তমাকে বললেন, “তিলোত্তমা তুমি সূর্যলোকে বিরাজ করবে; কিন্তু সেখানেও কোনও ব্যক্তি তোমার তেজের প্রভাবে তোমাকে ভাল করে দেখতে সমর্থ হবে না।” ব্রহ্মা তিলোত্তমাকে এই বর দিয়ে এবং ইন্দ্রকেই আবার ত্রিভুবনের রাজত্বে প্রতিষ্ঠিত করে ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন।

নারদ এই কাহিনি বিবৃত করে পাণ্ডবদের বললেন, “এইভাবে সুন্দ ও উপসুন্দ সম্মিলিত থেকেও সমস্ত বিষয়ে একমত হয়েও তিলোত্তমার জন্য পরস্পর ক্রুদ্ধ হয়ে পরস্পরকে বধ করেছিল। অতএব হে ভরত শ্রেষ্ঠগণ! আমি স্নেহবশত তোমাদের সকলকেই বলছি যে, যাতে দ্রৌপদীর জন্য তোমাদের সকলের মধ্যে ভেদ না জন্মে, তাই করো এবং যদি আমার প্রিয় কার্য করিতে ইচ্ছা করো, তবে তেমন উপায় করো, তোমাদের মঙ্গল হবে।”

দেবর্ষি নারদ এই কথা বললে, পাণ্ডবেরা নারদের উপস্থিতিতেই নিয়ম করলেন, “পাপশূন্যা দ্রৌপদী আমাদের এক একজনের ঘরে এক একটি বৎসর করে বাস করবেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে যে কেউ দ্রৌপদীর সঙ্গে বাস করার সময়ে, অন্য যে কেউ এসে দেখা করবেন, তিনি ব্রহ্মচারী থেকে বারো বৎসর পর্যন্ত বনে বাস করবেন।”

ধার্মিক পাণ্ডবেরা এই রকম নিয়ম করলে মহামুনি নারদও সন্তুষ্ট হয়ে অভীষ্ট স্থানে চলে গেলেন। নারদের ‘প্রেরণায়’ পাণ্ডবগণ এই নিয়ম করেছিলেন বলে পাণ্ডবদের মধ্যে বিবাদ ঘটেনি।

*

কিন্তু নিয়মবন্ধনের প্রথমে বছরের গোড়ার দিকেই নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছিল। দস্যুদের বিতাড়িত করার জন্য অর্জুন অস্ত্রাগারে প্রবেশ করেন। সেখানে তখন দ্রৌপদী-যুধিষ্ঠির বাস করছিলেন। অর্জুন নিয়ম অনুসারী হয়ে দ্বাদশ বর্ষের জন্য বনে গমন করলেন। ঘটনাচক্রে বোঝা যায় যে, অন্য পাণ্ডবেরাও এই বারো বছর দ্রৌপদী বিষয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করেছিলেন। অর্জুন বারো বৎসর পর ফিরে এলে দাম্পত্য নিয়ম আবার চালু হয়। এই কারণেই অভিমন্যু জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব সন্তান হিসাবে স্বীকৃত হন। যুধিষ্ঠির পুত্র প্রতিবিন্ধ্য সে স্থান লাভ করতে পারেননি। ইন্দ্রপ্রস্থে রাজত্বের ত্রয়োদশ বৎসর থেকে আবার পাণ্ডবদের দাম্পত্যজীবন আরম্ভ হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *