০১. ধৃতরাষ্ট্রের হাহাকার


ধৃতরাষ্ট্রের (তদা নাশংসে বিজয়ায় সঞ্জয়) হাহাকার

(মহাভারতের গঠনরীতির অনন্যতা স্বাভাবিকভাবেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। উপন্যাসে ছোটগল্পে কাহিনি বর্ণনায় ‘flash back’ বা ‘medias res’ অর্থাৎ অতীত চারণার বা মধ্য ও শেষ থেকে কাহিনি শুরু করার যে রীতি বর্তমানে অনুসৃত হয়ে থাকে, তা ব্যাসদেবই প্রথম আবিষ্কার করেন। মহাভারতের সূচনা হয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে, দুর্যোধনের পতনের পর অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের আক্ষেপের মধ্য দিয়ে। এই আক্ষেপের মধ্যে বস্তুত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রধান ঘটনাগুলির উল্লেখ করা হয়েছে। কোন ঘটনাগুলিকে ধৃতরাষ্ট্র কুরুবংশের পতনের অন্যতম কারণ হিসাবে চিত্রিত করেছেন, তার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী কালে এই ঘটনাগুলিই বিস্তৃতভাবে বলা হয়েছে। ধৃতরাষ্ট্রের আক্ষেপে উল্লিখিত ঘটনাগুলি ধৃতরাষ্ট্রের মতে মহাভারতের দুর্লভ মুহূর্ত। মহাভারতের মূল রস বজায় রাখার জন্য সমস্ত বিবরণটি উত্তম পুরুষে দেওয়া হল।)

পাণ্ডবদের জয় হলে, ধৃতরাষ্ট্র সেই গুরুতর অপ্রিয় সংবাদ শুনে এবং দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনিকে মৃত জেনে, বহুকাল চিন্তা করে সঞ্জয়কে বললেন, “সঞ্জয় সমস্ত বিষয় শোনো, আমার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ কোরো না। তুমি শাস্ত্র পড়েছ, মেধাবী ও বুদ্ধিমান। অতএব পণ্ডিতগণের প্রিয়। যুদ্ধে আমার মত ছিল না, কিংবা বংশনাশেও আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না। আপন পুত্র ও পাণ্ডুর পুত্রের মধ্যে আমার তারতম্য জ্ঞান ছিল না। কিন্তু ক্রোধপরায়ণ আমার পুত্রগণ, আমি বৃদ্ধ বলে সব ব্যাপারে আমার দোষ দেখত। কিন্তু আমি অন্ধ; সেইজন্য অক্ষমতানিবন্ধন এবং পুত্রস্নেহবশত সে দোষ দেখানো সহ্য করতাম এবং অবিবেচক দুর্যোধন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ত। দুর্যোধনের মোহ দেখে আমি আরও মোহগ্রস্ত হতাম। রাজসূয় যজ্ঞে মহাপ্রভাবশালী যুধিষ্ঠিরের সমৃদ্ধি দেখে এবং সভাগৃহে ওঠার সময়ে ও তা দেখার সময়ে ভীমের সেই উপহাস শুনে দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হল বটে, কিন্তু নিজে যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয় করতে পারবে না— এই ভেবে একেবারে নিরুৎসাহ হয়ে পড়ল; তারপর যুধিষ্ঠিরকে বশীভূত করবার জন্য শকুনির সঙ্গে মন্ত্রণা করে কপট পাশা খেলার আয়োজন করল। সঞ্জয়, আমি ক্রমাগতভাবে যা জেনেছি, তোমাকে বলছি, শোনো। আমার এই কথাগুলি শুনলে তুমি আর আমাকে ঘৃণা করতে পারবে না, বরং প্রজ্ঞাদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ বলেই বোধ করবে।

যখন আমি শুনলাম যে অর্জন ধনুতে গুণারোপণ করে আশ্চর্য লক্ষ্যভেদ করেছে এবং সমবেত রাজাদের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করেই দ্রৌপদীকে হরণ করেছে; সঞ্জয়! তখন আর আমি জয়ের আশা করিনি।

যখন আমি শুনলাম, অর্জুন দ্বারকানগরীতে মধুবংশীয়া সুভদ্রাকে বলপূর্বক বিবাহ করেছে; তাতে আবার যদুবংশীয় মহাবীর বলরাম এবং কৃষ্ণ

যখন আমি শুনলাম, অর্জুন দ্বারকানগরীতে মধুবংশীয়া সুভদ্রাকে বলপূর্বক বিবাহ করেছে; তাতে আবার যদুবংশীয় ইন্দ্রপ্রস্থেই এসেছেন; সঞ্জয় ! তখন আর আমি জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, অগ্নি নির্বাপিত করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্র অবিশ্রান্ত জল বর্ষণ করছিলেন; কিন্তু অর্জন উৎকৃষ্ট বাণ বর্ষণ করে তাঁকে নিবারিত করেছে ও অগ্নিদেবকে সন্তুষ্ট করেছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, কুন্তীর সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডব জতুগৃহ থেকে মুক্তি লাভ করেছে এবং বিদুর তাঁদের সহায়তা করছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, অর্জুন রাজসভামধ্যে লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে জয় করেছে এবং মহাবীর পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণ পরস্পর সম্মিলিত হয়েছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, ভীমসেন গিয়ে বাহুদ্বারাই মগধদেশের বীরশ্রেষ্ঠ এবং ক্ষত্রিয়দের মধ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজা জরাসন্ধকে বিনষ্ট করেছে; সঞ্জয়!! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, রজস্বলা, একবস্ত্রা, দুঃখিতা এবং বাষ্পাবরুদ্ধকণ্ঠা দ্রৌপদীকে সনাথা হলেও অনাথার মতো সভায় নিয়ে এসেছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, খলস্বভাব এবং অল্পবুদ্ধি দুঃশাসন সভামধ্যে দ্রৌপদীর বস্ত্ররাশি আকর্ষণ করেছে; কিন্তু একেবার উৎসন্ন হয়ে যায়নি; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, শকুনি অচিন্তনীয় শক্তি ভ্রাতৃগণের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরকে দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত করেছে এবং তাঁর রাজ্য অপহরণ করেছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, ধর্মাত্মা পাণ্ডবগণ বনে প্রস্থান করেছে, যুধিষ্ঠিরের প্রতি ভক্তিবশত তারা বনে কষ্ট অনুভব করবে বলে স্বীকার করেছে, যাবার সময়ে তারা নানা ভঙ্গি করতে করতে গিয়েছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, ভিক্ষাভোজী মহাত্মা স্নাতক ব্রাহ্মণেরা বনেও যুধিষ্ঠিরের অনুসরণ করছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম; যুদ্ধে অর্জুন ব্যাধরূপী দেবদেব মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে তাঁর নিকট থেকে পাশুপত অস্ত্র লাভ করেছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, সত্যপ্রতিজ্ঞ অর্জুন স্বর্গে গিয়ে সাক্ষাৎ দেবরাজেরই নিকটে যথানিয়মে স্বর্গীয় অস্ত্র শিক্ষা করছে আর দেবরাজ তার প্রশংসা করছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

তারপর যখন শুনলাম, ব্রহ্মার বরদানে দর্পিত দেবগণের অজেয় পুলোম বংশজাত সেই কালকেয় নামক অসুরদের অর্জুন জয় করেছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, শত্রুহস্তা অৰ্জুন অসুরবধের জন্য স্বর্গলোক গিয়েছে এবং কৃতকার্য হয়ে আবার সেখান থেকে ফিরে এসেছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, মানুষের অগম্য স্থানে ভীম ও অন্যান্য পাণ্ডবেরা কুবেরের সঙ্গে সম্মিলিত হয়েছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, আমার পুত্রেরা কর্ণের পরামর্শে ঘোষযাত্রায় গিয়েছিল, গন্ধর্বেরা তাদের বন্ধন করেছিল, আবার অর্জুন তাদের মুক্ত করে দিয়েছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, স্বয়ং দেব ধর্ম যক্ষের রূপ ধারণ করে এসে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সম্মিলিত হয়েছিলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে তিনি কতকগুলি প্রশ্ন করেছিলেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, পাণ্ডবেরা দ্রৌপদীর সঙ্গে বিরাটরাজ্যে গুপ্তভাবে বাস করেছে, কিন্তু আমার পুত্রেরা তাদের অবস্থান জানতেও পারেনি; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, ভীমসেন দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করবার জন্য যুদ্ধে শত ভ্রাতার সঙ্গে প্রধান কীচকটাকে বধ করেছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, মহাত্মা অর্জুন বিরাটরাজ্যে বাস করার সময়ে একমাত্র রথে আরোহণ করে, ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতি মৎপক্ষীয় প্রধান বীরগণকে পরাজিত করেছে সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, মহাত্মা অর্জুন বিরাট রাজের অলংকৃত কন্যা উত্তরাকে আপন পুত্র অভিমন্যুর জন্য গ্রহণ করেছেন, যদিও বিরাট রাজা আপন কন্যা উত্তরাকে অর্জনের হাতে সমর্পণ করতে চেয়েছিলেন; তখন সঞ্জয়! আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় পরাজিত হয়ে একেবারে সম্পত্তিশূন্য অবস্থায় বনে গিয়েছিল এবং সেখানেও আত্মীয়শূন্য হয়েই থেকেছিল, তবু তার সাত অক্ষৌহিণী সৈন্য জুটেছিল; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

পূর্বকালে বামন অবতারে এই সমস্ত পৃথিবীটাই যাঁর একটিমাত্র পদক্ষেপের স্থান হয়েছিল— মুনিরা এমনই বলেন, স্বয়ং লক্ষ্মীপতি সেই শ্রীকৃষ্ণ সর্বপ্রযত্নে পাণ্ডবদের উদ্দেশ্যসাধনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, এ যখন শুনলাম; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

কৃষ্ণ ও অর্জুন সাক্ষাৎ সেই নর-নারায়ণ ঋষি, এ আমি ব্ৰহ্মলোকে প্রত্যক্ষ দেখেছি; এ কথা নারদের মুখে শুনলাম; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, জগতের মঙ্গলের জন্য শ্রীকৃষ্ণ কুরু-পাণ্ডবদের বিবাদের শান্তি করতে এসেছেন এবং সে বিষয়ে প্রবৃত্তও হয়েছেন; আবার অকৃতকার্য হয়ে ফিরে গিয়েছেন; তখন সঞ্জয়! আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, কর্ণ ও দুর্যোধন শ্রীকৃষ্ণকে আবদ্ধ করে রাখবার পরামর্শ করেছিল, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ নিজের দেহকে নানাভাবে দেখিয়ে মুক্ত হয়ে গিয়েছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, শ্রীকৃষ্ণ প্রস্থান করলে, দুঃখিতা একাকিনী কুন্তীদেবী তাঁর রথের সম্মুখে গিয়ে আপনাদের বিপদের বিষয় জানাচ্ছিলেন; আর শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে আশ্বস্ত করে গিয়েছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের মন্ত্রী হয়েছেন এবং শান্তনু নন্দন ভীষ্ম ও দ্রোণ তাঁদের জয়লাভের আশীর্বাদ করেছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

ভীষ্ম। আপনি যে পর্যন্ত যুদ্ধ করবেন, আমি তার মধ্যে যুদ্ধ করব না; সঞ্জয়! যখন শুনলাম, এই কথা বলে কর্ণ আপনার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে চলে গেছে; তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, সেই কৃষ্ণ, অর্জুন আর দুর্ধর্ষ গাণ্ডিবধনু— এই তিন উগ্রবীর্য বস্তুই আমার বিপক্ষে সম্মিলিত হয়েছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, অর্জুন আত্মীয় স্নেহে মুগ্ধ হয়ে রথের উপরে অবসন্ন হয়ে পড়লে; কৃষ্ণ তাঁকে আপন শরীরে বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, শত্ৰুহন্তা ভীষ্ম যুদ্ধে প্রতিদিন বিপক্ষের দশ হাজার রথী বধ করছেন; কিন্তু বিপক্ষের কোনও বিখ্যাত বীরকে বধ করছেন না; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, ধার্মিক ভীষ্ম যুদ্ধে আপনার মৃত্যুর উপায় স্বয়ং বলে দিয়েছেন, পাণ্ডবেরা আনন্দিত হয়ে তাই করেছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, অর্জুন শিখণ্ডীকে সামনে রেখে মহাবীর অজেয় ভীষ্মকে যুদ্ধে বধ করেছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, ভীষ্ম সোমকদের প্রায় নিঃশেষ করেছেন, পরে অর্জুন বিচিত্র বাণদ্বারা তাঁকে কাতর করে ফেলেছেন; তাতে ভীষ্ম সেই শরশয্যায় শয়ন করেছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করে অর্জুনের কাছে জল চেয়েছেন, আর অর্জুন ভূতল ভেদ করে, ভোগবতীর জল দ্বারা ভীষ্মকে পরিতৃপ্ত করেছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম; শুক্র ও সূর্য আগ্রহান্বিত হয়ে পাণ্ডবগণের জয়ের জন্য অনুকূল হয়েছেন এবং শৃগাল প্রভৃতি হিংস্রজন্তুগণ সর্বদাই আমাদের পক্ষকে ভয় দেখাচ্ছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, বিচিত্র যোদ্ধা দ্রোণাচার্য নানা প্রকার অস্ত্রপ্রয়োগের কৌশল দেখাতে থেকেও পাণ্ডবপক্ষের শ্রেষ্ঠ বীরগণকে বধ করছেন না; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, আমাদের পক্ষবর্তী মহারথ সংশপ্তকগণ অর্জুন বধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল; কিন্তু অর্জুনই তাদের বধ করেছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, দ্রোণাচার্য অস্ত্রধারণ করে রক্ষা করছিলেন— এই অবস্থায় অন্যের অভেদ্য সেই ব্যূহ ভেদ করে অদ্বিতীয় বীর অভিমন্যু তার ভিতরে প্রবেশ করেছে, সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

আমার পক্ষের সমস্ত মহারথীরা অর্জুনকে বধ করতে না পেরে, বালক অভিমন্যুকে পরিবেষ্টন পূর্বক বধ করে যখন আনন্দিত হয়েছিলেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, মূর্খ দুর্যোধন প্রভৃতি অভিমন্যুকে বধ করে আনন্দে কোলাহল করেছে এবং অর্জুনও ক্রোধে জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞা করেছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, অর্জুন জয়দ্রথ বধের জন্য প্রতিজ্ঞা করেছে এবং শত্রুমধ্যে সে প্রতিজ্ঞায় উত্তীর্ণও হয়েছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, অর্জুনের ঘোড়াগুলি পরিশ্রান্ত হলে, শ্রীকৃষ্ণ সেগুলিকে খুলে নিয়ে জলপান করিয়ে এনে আবার রথে যুক্ত করে উপস্থিত হয়েছেন সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, ঘোড়াগুলি রথ বহন করতে অসমর্থ হলে, অর্জুন রথের উপরে থেকেই গাণ্ডিবধনুদ্বারা আমাদের সমস্ত যোদ্ধাদের বারণ করতে সমর্থ হয়েছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, সাত্যকি হস্তিসৈন্যে দুর্ধর্ষ দ্রোণাচার্যের সেনাকে পরাজিত করে, যেখানে কৃষ্ণ ও অর্জুন ছিলেন, সেইখানে উপস্থিত হয়েছেন; সঞ্জয়। তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, মহাবীর ভীম কর্ণের হাতে পড়েছিল; কিন্তু কর্ণ তাকে কটুবাক্যে ভৎসনা করে এবং ধনুর অগ্ৰদেশদ্বারা ব্যথিত করে ছেড়ে দিয়েছে; সঞ্জয়। তখন আর জয়ের আশা করিনি।

অর্জুন যখন জয়দ্রথকে বধ করল, তখন মহাবীর দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, কৃতবর্মা, কর্ণ, অশ্বত্থামা ও শল্য— এঁরা সকলেই তা সহ্য করেছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, ইন্দ্রদত্ত দিব্য শক্তিটিকে কৃষ্ণ ভয়ংকর রাক্ষস ঘটোৎকচের উপরেই ব্যয় করিয়ে দিয়েছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, কর্ণ ও ঘটোৎকচ যুদ্ধ করছিল; সেই অবস্থায় কর্ণ যে শক্তিদ্বারা অৰ্জুনকে বধ করবে বলে ভেবেছিল, সেই শক্তিটিকে সে ঘটোৎকচের উপরেই নিক্ষেপ করে ফেলেছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

দ্রোণাচার্য একাকী রথের উপরে প্রায়োপবেশনে অবস্থান করছিলেন, এই অবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন ধর্ম লঙঘন করে তাঁকে বধ করেছে: সঞ্জয়! এ সংবাদ যখন শুনলাম তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, মাদ্রীপুত্র নকুল অশ্বত্থামার সঙ্গে দ্বৈরথযুদ্ধে মণ্ডলাকারে সমানভাবে বিচরণ করছে; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

দ্রোণাচার্য নিহত হলে অশ্বত্থামা উৎকৃষ্ট নারায়ণাস্ত্র নিক্ষেপ করেও যখন পাণ্ডবদের বিনাশ করতে পারলেন না; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, যুদ্ধে ভীমসেন, ভ্রাতা দুঃশাসনের রক্ত পান করল; কিন্তু দুর্যোধন প্রভৃতি কেউই তাকে বাধা দিতে পারল না; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, দৈবসম্পাদিত সেই ভ্রাতৃকলহে মহাবীর যুদ্ধে অজেয় কর্ণকে অর্জুন বধ করেছেন; সঞ্জয়। তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির মহাবীর অশ্বত্থামাকে, দুঃশাসন এবং ভয়ংকর যোদ্ধা কৃতবর্মাকে জয় করেছেন, সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

হে সূতবংশীয় সঞ্জয়। যিনি সর্বদাই যুদ্ধে কৃষ্ণকে জয় করতে ইচ্ছা করতেন। সেই মহাবীর শল্যকে যুধিষ্ঠির যুদ্ধে বধ করেছেন; এ যখন শুনলাম, তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, বিবাদঘটক পাশক্রীড়ার মূল এবং কপটতার বলে বলীয়ান পাপাত্মা শকুনিকে পাণ্ডুনন্দন সহদেব যুদ্ধে বধ করেছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, রথহীন শক্তিহীন পরিশ্রান্ত একাকী দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদে গিয়ে, তার জল স্তম্ভিত করে আত্মগোপন করে আছে সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, পাণ্ডবেরা কৃষ্ণের সঙ্গে দ্বৈপায়ন হ্রদে গিয়ে, স্ব স্ব অভিপ্রায় জানিয়ে কটুবাক্যে আমার পুত্র অসহিষ্ণু দুর্যোধনকে ব্যথিত করছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, গদাযুদ্ধে দুর্যোধন মণ্ডলাকারে নানাবিধ আশ্চর্য পথে বিচরণ করছিল; এই অবস্থায় কৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীম তাকে অন্যায়ভাবে বধ করেছে; সঞ্জয়!তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা, নিদ্রিত অবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি পাঞ্চালগণকে এবং দ্রৌপদীর পঞ্চ-পুত্রকে বধ করে ধর্মবিগর্হিত নিন্দিত কার্য করেছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, ভীম অশ্বত্থামার পিছনে ধাবিত হচ্ছিল, এই অবস্থায় অশ্বত্থামা ক্রুদ্ধ হয়ে উত্তরার গর্ভ নষ্ট করার জন্য ঐষীক নামে ভীষণ অস্ত্র নিক্ষেপ করেছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

যখন শুনলাম, অর্জুন ‘স্বস্তি’ বলে আপন অস্ত্রদ্বারা ব্ৰহ্মশির নামে অশ্বত্থামার অস্ত্র নিবারণ করেছে এবং অশ্বত্থামা আপনার উৎকৃষ্ট মণিটি দান করেছেন; সঞ্জয়! তখন আর জয়ের আশা করিনি।

দ্রোণাচার্য একাকী রথের উপরে প্রায়োপবেশনে অবস্থান করছিলেন, এই অবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন ধর্ম লঙ্ঘন করে তাঁকে বধ করেছে; সঞ্জয়!এ সংবাদ যখন শুনলাম, তখন আর জয়ের আশা করিনি।

গান্ধারী পুত্র, পৌত্র, বন্ধু, পিতা, ভ্রাতা শূন্য হয়েছেন। তাঁকে দেখলে সকলের শোক উপস্থিত হয়। এদিকে পাণ্ডবেরা দুষ্কর কার্য করেছেন এবং তাঁরা শত্রুহীন রাজ্যলাভ করেছে। এ সকল বড়ই কষ্টের বিষয়। এই যুদ্ধে মাত্র দশজন অবশিষ্ট আছেন। আমাদের পক্ষে তিনজন, আর পাণ্ডবদের পক্ষে সাতজন। অতএব বাইরে থেকে অতিবিশাল অন্ধকার ও ভিতর থেকে অতিপ্রবল মোহ আমাকে যেন আক্রমণ করছে। আমি যেন চেতনা রাখতে পারছি না এবং আমার মন যেন আকুল হয়ে পড়ছে।

দুঃখিত ধৃতরাষ্ট্র এই কথা বলে অনেক বিলাপ করে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন।

*

ধৃতরাষ্ট্র কেবল জন্মান্ধ ছিলেন না, স্নেহান্ধও ছিলেন। মায়ের দোষে তিনি জন্মান্ধ হন। ভাগ্য তাঁর সহায় ছিল না। যদিও গান্ধারী-প্রসূত লৌহপিণ্ড থেকে ব্যাসদেব অনেক যত্নে গান্ধারীর পুত্র-জন্মের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে পাণ্ডুর প্রথম সন্তান যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়ে যাওয়ার ফলে সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী স্থির হয়েই গিয়েছিল। দৈবের উপর অভিমান ধৃতরাষ্ট্রের আরও বেড়েছিল।

দুর্যোধনের জন্মের পর তার শৃগালের মতো চিৎকারে তত্ত্বদর্শী বিদুর তাঁকে ত্যাগ করতে বলেছিলেন। ছেলে যে পাণ্ডবদের সহ্য করতে পারে না, সে নিষ্ঠুর প্রকৃতির, ছলকৌশলে যে কোনও প্রকারের অপরাধ সে সংঘটন করতে পারে, তা ধৃতরাষ্ট্রের অজানা ছিল না। তবুও দুর্যোধনের সব বাসনা তিনি পূর্ণ করেছিলেন। প্রথম দ্যূতক্রীড়ায় তিনি প্রতিটি বিজয়ের সঙ্গে বালকের মতো হেসেছিলেন। পাণ্ডবদের ক্ষেত্রে পিতার কর্তব্য তিনি করেননি। রাজার ধর্ম মানেননি। তাই দুর্যোধনের মতো তিনিও পাণ্ডবদের বনবাসে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্ম, অমর কৃপাচার্য, অমর অশ্বত্থামা, পুত্রের মৃত্যু সংবাদ না শুনলে অস্ত্রত্যাগ করবেন না, অথচ পুত্র অমর— এমন গুরু দ্রোণাচার্য, দুর্ধর্ষ কর্ণ— এদের উপর আস্থা ছিল ধৃতরাষ্ট্রের খুব বেশি।

কিন্তু অন্তরীক্ষে দৈব আর এক পাশা খেলছিলেন। তাতে প্রতিটি দানে ধৃতরাষ্ট্র হারছিলেন। কিন্তু নেশা তাঁর সংবিৎ ফেরাতে পারেনি। দুর্যোধনের মৃত্যুর পর তিনি দেখলেন তিনি সর্বহারা। কালের দ্যূতক্রীড়ায় তিনি সর্বস্বান্ত, নিঃস্ব এবং চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত।


দেব-দানবের অংশাবতরণ

মহাভারতের দুর্লভ মুহূর্তে অংশগ্রহণকারী প্রধান প্রধান চরিত্রের অংশ অবতরণের অংশটি নানা কারণে পাঠকের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। স্মরণীয় যে, সৃষ্টির পরে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে ভয়ংকর যুদ্ধ হয়। অসুরেরা পরাজিত হয়ে পলাতক হন। এঁদের অধিকাংশই মর্ত্যভূমিতে আবির্ভূত হন এবং আপন পূর্বজন্মের আচরণ অনুযায়ী আচরণ পৃথিবীতে এসেও করতে থাকেন। যুদ্ধ কিন্তু তখনও শেষ হয়নি। অসুরদের দমনের জন্য দেবতারাও মর্ত্যভূমিতে আবির্ভূত হন। দ্বাপর যুগে পৃথিবীতেও তাঁদের ভয়ংকর সংগ্রাম হয়। সে সংগ্রামে দেবতারা যে পক্ষে অংশাবতরণ করেছিলেন সেই পক্ষীয় বীরেরাই বিজয়ী হন। অনুমান করা চলে, সেই অংশাবতরণ কলিতেও ঘটে চলেছে, তারও নিষ্পত্তি ঘটবে একদিন। অর্থাৎ সৃষ্টি-সংঘর্ষ-সংগ্রাম এবং ধ্বংস ঘটে চলেছে অব্যাহত গতিতে। এ সংগ্রাম ঈশ্বর ও শয়তানের চিরন্তন সংগ্রাম।

স্বর্গবাসী যে সব দানব এসে মানুষের মধ্যে জন্মেছিলেন, প্রথমে তাঁদেরই উল্লেখ করতে হয়। দানবরাজ বিপ্রচিত্তি মানুষের মধ্যে জন্মে রাজশ্রেষ্ঠ জরাসন্ধ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপু মনুষ্যলোকে শিশুপাল নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। প্রহ্লাদের কনিষ্ঠভ্রাতা সংহ্লাদ, বাহ্লীকশ্রেষ্ঠ শল্য নাম নিয়ে পৃথিবীতে জন্মেছিলেন। প্রহ্লাদের ভ্রাতাদের মধ্যে কনিষ্ঠ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বলবান অনুহ্লাদ পৃথিবীতে এসে ধৃষ্টকেতু নামধারী রাজা হয়েছিলেন। শিবি নামের যে দৈত্য ছিলেন, তিনি রাজা দ্রুম নামে আবির্ভূত হয়েছিলেন, অসুরশ্রেষ্ঠ বাস্কল পৃথিবীতে ভগদত্ত নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। অয়! শিরা, অশ্বশিরা, অয় শঙ্কু, গগনমূর্ধা ও বেগবান— এই পাঁচজন মহাসুর কেকয়দেশের প্রধান পাঁচ রাজা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। প্রতাপশালী মহাসুর কেতুমান পৃথিবীতে এসে ভয়ংকর স্বভাব উত্তমৌজা নামের রাজা হয়েছিলেন। সুন্দরাকৃতি মহাসুর স্বর্ভানু ভয়ংকর স্বভাব উগ্রসেন নামে পরিচিত হয়েছিলেন।

সমৃদ্ধিশালী অশ্ব নামক মহাসুর, তিনিই মহাবলবান অশোক নামের রাজা হয়েছিলেন। অশ্বের কনিষ্ঠ সহোদর দৈত্যশ্রেষ্ঠ অশ্বপতি হার্দিক্য নামের রাজা হয়ে জন্মেছিলেন। মহাসুর বৃষপর্বা পৃথিবীতে এসে দীর্ঘপ্রজ্ঞ নামে রাজা হয়েছিলেন। মহাবলবান মহাসুর অশ্বগ্রীব ভূমণ্ডলে রোমান নামে বিখ্যাত রাজা হয়েছিলেন। বৃষপর্বার কনিষ্ঠ অজক নামক অসুর শাল্ব নাম রাজা হয়েছিলেন। সূক্ষ্ম নামের যশস্বী ও বুদ্ধিমান অসুর বৃহদ্রথ রাজা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। অসুরশ্রেষ্ঠ তুহুন্ডু সেনাবিন্দু রাজা নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। বলবান দৈত্যশ্রেষ্ঠ একপাৎ ভূমণ্ডলে বিখ্যাত বিক্রম নগ্নজিৎ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। মহাসুর একচক্র প্রতিবিন্ধ্য নামে প্রসিদ্ধ রাজা হয়েছিলেন। বিচিত্রযোদ্ধা মহাসুর বিরূপাক্ষ ভূতলে রাজা চিত্রবর্মা নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। মহাবীর শত্রুহস্তা হরদানব, সুবাহু নামের রাজা হয়েছিলেন। শক্ৰহন্তা মহাবলবান অহর নামক অসুর এসে বাহ্লীক বংশের অন্য এক রাজা হয়েছিলেন। চন্দ্রবদন নিচন্দ্ৰনামের মহাসুর, ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হয়ে মুক্তকেশ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন, মহাবুদ্ধিমান যুদ্ধবিজয়ী নিকুম্ভ দানব শ্রেষ্ঠ রাজা দেবাধিপ নামে সমৃদ্ধিশালী রাজা হয়েছিলেন। দৈত্যশ্রেষ্ঠ, পৌরব নামের রাজর্ষি হয়েছিলেন। বলবান ও সমৃদ্ধিমান কুপটনামক মহাসুর পৃথিবীতে এসে সুপার্শ্ব নামে রাজা হয়েছিলেন। ধার্মিক কপট নামক দৈত্য, ভূমণ্ডলে এসে সুমেরু তুল্য গৌরকান্তি পার্বতেয় নামে রাজা হয়েছিলেন। অসুরদের মধ্যে দ্বিতীয় শলভ, বাহ্লীক দেশে প্রহ্লাদ নামে রাজা হয়েছিলেন।

চন্দ্রতুল্য সুন্দর চন্দ্ৰনামক দৈত্য এসে কম্বোজদেশে চন্দ্রবর্মা নামে রাজা হয়েছিলেন। দানবশ্রেষ্ঠ অর্ক এসে অধিক নামে রাজা হয়েছিলেন। মৃতপা নামে প্রধান অসুর, পশ্চিমদেশে অনুপক নামে রাজা হয়েছিলেন। বিক্রমশালী মহাসুর গরিষ্ঠ ভূমণ্ডলে এসে দ্রুমসেন নামে রাজা হয়েছিলেন। বিখ্যাত সমৃদ্ধিশালী ময়ূর, মর্ত্যভূমিতে এসে বিশ্বনামের রাজা হন। ময়ূরের কনিষ্ঠভ্রাতা সুবর্ণ, কালকীর্তি নামে প্রসিদ্ধ রাজা হয়েছিলেন। অসুরশ্রেষ্ঠ চন্দ্ৰহন্তা, শুনক নামের রাজর্ষি হয়েছিলেন। চন্দ্রবিজয়ী বিনাশন নামক মহাসুর এসে জানকি নামের রাজা হয়েছিলেন। দানব দীর্ঘজিহ্ব পৃথিবীতে এসে কাশিরাজ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। সিংহিকাদেবী চন্দ্র ও সূর্যের উৎপীড়ক যে গ্রহকে প্রসব করেছিলেন, সেই রাহু ক্ৰাথনাস্ব রাজা হয়েছিলেন। দনায়ুর চার পুত্রের প্রধান বিক্ষর নামক অসুর এসে বসুমিত্র নামে রাজা হয়ে জন্মেছিলেন। বিক্ষরের কনিষ্ঠ সহোদর পাণ্ড্যরাজ্যের রাজা হয়েছিলেন। বলীন নামের মহাসুর, পৌণ্ড্রম্যাস্যক নামে রাজা হয়েছিলেন। মহাসুর বৃত্র, মনিমান নামের রাজা হয়েছিলেন। বৃত্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ক্রোধহন্তা নামের অসুর, ভূমণ্ডলে এসে দণ্ড নামের রাজা হয়েছিলেন। ক্রোধবর্ধন নামের অসুর, দণ্ডধার নামে রাজা হয়েছিলেন। অসুর রাজ কাষ্ণেয়ের আট পুত্র আটজন সিংহতুল্য রাজা হয়েছিলেন। প্রথম কালেয় মগধরাজ জয়ৎসেন, দ্বিতীয় কালেয় রাজা অপরাজিত, মহামায়াবী, মহাতেজস্বী তৃতীয় কালেয় নিষাদ রাজ্যের রাজা, চতুর্থ কালেয় রাজা শ্রেণীমান্‌, পঞ্চম কালেয় রাজা মহৌজা নামে, ষষ্ঠ কালেয় পৃথিবীতে এসে অভীরু নামে, সপ্তম কালেয় ধার্মিক সমুদ্রসেন নামক রাজা, অষ্টম কালেয় ভূতলে সমস্ত প্রাণীর হিতৈষী ও ধার্মিক বৃহৎ নামে বিখ্যাত রাজা হয়েছিলেন। কুক্ষিনামক বলবান দানব পৃথিবীতে এসে সুমেরু-পর্বত তুল্য গৌরবর্ণ পার্বতীয় রাজা নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। সুন্দর ও বলবান ক্ৰথনাসুর পৃথিবীতে এসে সূর্যাক্ষ নামে জন্মেছিলেন। মহাসুর সূর্য দরদদেশে বাহ্লীক নামে প্রধান রাজা হয়ে জন্মেছিলেন। ক্রোধবশ নামের অসুরসমূহ পৃথিবীতে এসে মহাবীর বহুতর রাজা হয়েছিলেন। ক্রোধবশ নামক অসুরের নিম্নলিখিত সন্তানেরা পৃথিবীতে অত্যন্ত ভাগ্যবান, বিশেষ যশস্বী ও মহাবলবান হয়েছিলেন। এঁরা হলেন— সত্রক, কর্ণবেষ্ট, সিদ্ধার্থ, কীকট, সুবীর, সুবাহু, বাত্নীক, ক্ৰথ, বিচিত্র, সুরথ, নীল, চীরবাস, দন্তবক্ত্র, দুর্জয়, রুক্মী, জন্মেঞ্জয়, আষাঢ়, বায়ুবেগ, ভূরিতেজ, একলব্য, সুমিত্র, বাটধান, গোমুখ, কারুষক, ক্ষেমধূর্তি, ক্রুতায়ু, উদ্বহ, বৃহৎসেন, ক্ষেম, উগ্ৰতীর্থ, কুহর এবং ঈশ্বর।

বলবান কালনেমি নামক বিখ্যাত দানব, তিনিই মর্ত্যভূমিতে উগ্রসেনের পুত্র কংস নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ইন্দ্রের তুল্য তেজস্বী দেবক নামের অসুর পৃথিবীতে গন্ধর্ব পতি নামে শ্রেষ্ঠ রাজা হয়েছিলেন। মহাযশস্বী দেবর্ষি বৃহস্পতির অংশে ভরদ্বাজগোত্রে দ্রোণাচার্য অযোনিসম্ভূত হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দ্রোণাচার্য ধনুর্ধরদের প্রধান ছিলেন। সর্বাত্মবিৎ হওয়ায় তিনি মহাতেজস্বী ও বিশেষ কীর্তিশালী হয়েছিলেন। তিনি ধনুর্বিদ্যায় এবং অন্যান্য বেদবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। আশ্চর্য কার্যক্রমের অধিকারী হয়ে তিনি আপন বংশের বিস্তৃত গৌরব বাড়িয়েছিলেন। শিব, যম, কাল, ক্রোধ— এই চার দেবতার সম্মিলিত অংশ থেকে অশ্বত্থামার সৃষ্টি। বশিষ্ঠের অভিশাপে এবং ইন্দ্রের আদেশে অষ্ট বসু এসে গঙ্গার গর্ভে এবং শান্তনুর ঔরসে জন্মেছিলেন। ভীষ্ম এই বসুগণের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি বেদজ্ঞ, বুদ্ধিমান, বাকপটু, কুরুবংশের অভয়দাতা ও শত্রুহন্তা ছিলেন। অস্ত্রপ্রধান ও মহাতেজস্বী এই ভীষ্ম, মহাত্মা পরশুরামের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন।

কৃপ নামের ব্রহ্মর্ষি রুদ্রগণের অংশে মহাবীর হিসাবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। জগতে মহারথ নামে বিখ্যাত শকুনি দ্বাপরের অংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সত্যপ্রতিজ্ঞ, শত্রুহন্তা, বৃষ্ণিবংশ প্রধান সাত্যকি উনপঞ্চাশ বায়ুর অংশে জন্মেছিলেন। সকল অস্ত্রজ্ঞের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রাজর্ষি দ্রুপদ এবং অতুলনীয় কার্যক্ষম কৃতবর্মা, শত্ৰুহন্তা ও শত্রুরাজ্যের ভীতিকর বিরাট রাজা— এই তিনজন মরুদগণের অংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অরিষ্টার পুত্র বিখ্যাত হংসের জন্ম হয়, কুরুবংশে এবং তিনি গন্ধর্বদের রাজা হয়েছিলেন। সমস্ত অস্ত্রধারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ, মহাতেজস্বী ও আজানুলম্বিত বাহু ধৃতরাষ্ট্র মাতার দোষে ও ব্যাসদেবের কোপে অন্ধ হয়ে, মরুদগণের অংশে জন্মেছিলেন। অত্যন্ত অধ্যবসায়ী, মহাবলবান সত্যধর্মে নিরত ও পবিত্রস্বভাব পাণ্ডু সেই ধৃতরাষ্ট্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হয়ে বেদব্যাসের ঔরসেই জন্মগ্রহণ করেন। ভাগ্যবান ও মহাবুদ্ধিমান ব্যাসপুত্র বিদুর ধর্মের অংশে ভূমণ্ডলে জন্মেছিলেন। কূটবুদ্ধি ও দুরাশয় ও কুরুকুলের কলঙ্কজনক রাজা দুর্যোধন কলির অংশে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কলি জগতের সমস্ত লোকের বিরাগভাজন, সেই কলির অংশে জাত দুর্যোধন পৃথিবীর সমস্ত বীরের বিনাশের কারণ হয়েছিলেন। দুঃশাসন, দুর্মুখ ও দুঃসহ প্রভৃতি দুর্যোধনের নিরানব্বই জন ভ্রাতা রাক্ষসের অংশে জন্মেছিলেন। রাক্ষসের অংশে জন্মালেও বৈশ্যা স্ত্রীর গর্ভজাত যুযুৎসু স্বভাব ও চরিত্রে ভিন্ন ধরনের ছিল। তিনি ওই একশত ভ্রাতার অধিক ছিলেন। এই একশত পুত্র ব্যতীত রাক্ষসের অংশে ধৃতরাষ্ট্রের দুঃশলা নামে এক কন্যার জন্ম হয়। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা সকলেই শ্রেষ্ঠ রথী ও বীর, যুদ্ধকার্যে নিপুণ, সকলেই বেদবিৎ এবং দণ্ডনীতি প্রভৃতি শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। তারা সকলেই যুদ্ধশাস্ত্র জানতেন, বিদ্যা ও সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং সকলেই অনুরূপ ভার্যা গ্রহণ করেছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র শকুনির মত অনুসারে যথাকালে দুঃশলা নাম্নী কন্যাটিকে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের হাতে দান করেছিলেন।

এদিকে রাজা যুধিষ্ঠির ধর্মের অংশে, ভীমসেন বায়ুর অংশে এবং অর্জুন দেবরাজ ইন্দ্রের অংশে জন্মেছিলেন। অশ্বিনীকুমার দ্বয়ের অংশে নকুল ও সহদেব মর্ত্যলোকে অতুলনীয় সুন্দর হয়ে, সকল লোকের চিত্ত আকর্ষণ করতেন। চন্দ্রের পুত্র বৰ্চা অর্জুনের ঔরসে সুভদ্রার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। পুত্র চন্দ্রের অসাধারণ প্রিয় ছিল এবং সেই কারণে তিনি পুত্রকে কেবলমাত্র ষোলো বৎসরের জন্য মর্ত্যলোকে থাকার অনুমতি প্রদান করেছিলেন। চন্দ্র আরও জানিয়েছিলেন যে, এই অভিমন্যু একটি মাত্র সন্তানের জন্ম দেবে এবং সেই পুত্ৰই লুপ্তপ্রায় ভরতবংশকে রক্ষা করবে। মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন অগ্নির অংশে জন্মেছিলেন। শিখণ্ডী রাক্ষসের অংশে প্রথমে স্ত্রী হয়ে জন্মে, পরে পুরুষ হয়েছিলেন। দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র বিশ্বদেবগণের অংশে জন্মেছিলেন। সূর্যের অংশে কুন্তীর গর্ভে সুর্যনন্দন সহজাত কবচ কুণ্ডলধারী মহাবীর কর্ণের জন্ম হয়েছিল। নারায়ণ নামে যিনি সনাতন দেবতা, যিনি দেবগণের দেবতা, তিনি মর্ত্যলোকে প্রতাপশালী কৃষ্ণরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অনন্তনাগের অংশে বলরাম ও সনৎকুমারের অংশে মহাতেজা প্রদ্যুম্ন অবতীর্ণ হলেন। এইরকম বহু দেবতার অংশ এসে বসুদেবের বংশে গদ-মারন প্রভৃতি মনুষ্যশ্রেষ্ঠরূপে আবির্ভূত হলেন।

স্বর্গের অপ্সরারা ইন্দ্রের আদেশে মর্ত্যভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। স্বর্গের অপ্সরারা ইন্দ্রের আদেশে শ্রীকৃষ্ণের ষোলো হাজার মহিষী হয়েছিলেন। আর, লক্ষ্মীদেবীর অংশ, কৃষ্ণের প্রীতির জন্য পৃথিবীতে এসে ভীষ্মক রাজার কন্যারূপে রুক্মিণী নামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

দ্রৌপদী ত্বথ সংজজ্ঞে শচীভাগাদনিন্দিতা।

দ্রুপদস্য কুলে কন্যা বেদীমধ্যাদনিন্দিতা ॥ আদি: ৬২: ১৫৮ ॥

নাতিহ্রস্বা ন মহতী নীলোৎপলসুগন্ধিনী।

পদ্মায়তাক্ষী সুশ্রোণী স্বসিতাঞ্চিত মূৰ্দ্ধজা ॥ আদি: ৬২: ১৫৯ ॥

সর্বলক্ষণসম্পন্না বৈদুর্যমণিসন্নিভা।

পঞ্চাণাং পুরুষেন্দ্রাণাং চিত্ত প্রমথনী রহঃ ॥ আদি : ৬২: ১৬০ ॥

দ্রৌপদী, শচীদেবীর অংশে, দ্রুপদ রাজার কন্যা হয়ে যজ্ঞবেদী থেকে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অতি খর্ব ছিলেন না, অতি দীর্ঘও ছিলেন না; নীলোৎপলের মতো গাত্রের সৌরভ ছিল, নয়নযুগল পদ্মপত্রের ন্যায় দীর্ঘ এবং নিতম্বযুগল মনোহর ছিল। নিশ্বাস বায়ুতেও তাঁর কেশকলাপ সঞ্চালিত হত, শরীরে লক্ষণগুলি শুভসূচক ছিল। শরীরে বর্ণ বৈদূর্যমণির মতো শ্যামল ও স্নিগ্ধ ছিল; সুতরাং তিনি নির্জনে ইন্দ্রতুল্য পাঁচটি পুরুষের চিত্তকেই উদ্বেলিত করতেন।

সিদ্ধি ও ধৃতি নামে যে দু’জন দেবী ছিলেন, তারাই কুন্তী ও মাদ্রী নামে জন্মগ্রহণ করে পঞ্চপাণ্ডবের মাতা হয়েছিলেন। আর মতি-দেবী গান্ধারী হয়ে জন্মেছিলেন।

*

এইভাবে দেবতা, অসুর, গন্ধর্ব, অপ্সরা ও রাক্ষসের অংশে মর্ত্যলোকে বিভিন্ন পুরুষ ও নারী জন্মেছিলেন। অর্থাৎ মঞ্চ প্রস্তুত হল। সমুদ্র মন্থনের পর দেবতা ও দৈত্য, অসুরদের মধ্যে প্রচণ্ড সংগ্রাম ঘটেছিল। সেই সংগ্রাম ত্রেতাযুগে রাম ও রাবণের যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু সেদিনের সংগ্রাম প্রধানত ছিল নারীর অধিকার নিয়ে। দ্বাপরে সেই সংগ্রাম জমির অধিকার নিয়ে ঘটেছিল, নারীও এখানেও ছিল, কিন্তু তা উদ্দীপক হিসাবে। গোটা ভারতবর্ষের রাজন্যবর্গ এই সংগ্রামে জড়িয়ে পড়লেন। পাওয়া গেল একটির পর একটি দুর্লভ মুহূর্ত। আঠারো অক্ষৌহিণী সৈন্য কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে সমবেত হলেন। যুদ্ধ শেষ হবার পর মাত্র দশজন জীবিত ছিলেন। পাণ্ডব পক্ষে সাতজন আর কৌরবপক্ষে তিনজন। এই দশজনের মধ্যে অশ্বত্থামা পূতিগন্ধময় দেশে নির্বাসিত হন, সাত্যকি ও কৃতবর্মা মুষলপর্বে নিহত হন, কৃষ্ণ দেহত্যাগ করেন। ভীম-অর্জুন নকুল, সহদেব মহাপ্রস্থানিক পর্বে পার্বত্যপথে মৃত্যুবরণ করেন। কৃপাচার্য পরীক্ষিতের গুরু হিসাবে পৃথিবীতে থেকে যান আর একমাত্র যুধিষ্ঠির পৃথিবীর ধূলি মলিন দেহে উপস্থিত হন স্বর্গলোকে, একাকী, কেবলমাত্র ধর্মকে সঙ্গী করে।


অভিশপ্ত অগ্নিদেব-ভৃগুর শাপমোচন

পুরাণে অলৌকিক উপাখ্যান ও মনীষীদের আদিবংশ কথিত আছে। সেই সমস্ত আদি বংশের মধ্যে প্রথম ভৃগুর বংশ।

ভৃগুর্মহর্ষির্ভগবান ব্ৰহ্মণা বৈ স্বয়ম্ভূবা।

বরুণস্য ক্ৰতৌ জাতঃ পাবকা দিতি নঃ শ্রুতম্‌॥ আদি: ৫: ৭ ॥

ব্রহ্মা বরুণের যজ্ঞ করছিলেন; সেই যজ্ঞের অগ্নি থেকে মহর্ষি ভৃগু জন্মগ্রহণ করেন, এমনটি আমরা শুনেছি।

ভৃগুর পুত্রের নাম ছিল চ্যবন, চ্যবন ভৃগুর অত্যন্ত প্রিয় ছিল। চ্যবনের প্রমিতি নামের ধার্মিক পুত্র ছিল। দেব অপ্সরা ঘৃতাচীর গর্ভে প্রমিতির পুত্র জন্মে। সেই পুত্রের নাম হয় রুরু। রুরুর পত্নীর নাম ছিল প্রমদ্বরা। প্রমদ্বরা রুরুকে শুনক নামে বেদশাস্ত্রে পারদর্শী, তপস্বী, যশস্বী, প্রধান ব্রহ্মজ্ঞানী, সত্যবাদী, আচারনিষ্ঠ, হিতভোজী ও মিতভোজী এক পুত্র প্রদান করেন। শৌনক ছিলেন সম্রাট অশেষ পরাক্রমশালী শুনকের প্রপিতামহ।

ভৃগুর পত্নী ছিলেন পুলোমা। তিনি ভৃগুর প্রিয়তমা ছিলেন। ভৃগুর সংস্পর্শে পুলোমা গর্ভবতী হলেন। পুলোমা স্বামী ভৃগুকে ভালবাসতেন, ভক্তি করতেন। তিনি শান্ত, সচ্চরিত্র স্বভাবের নারী ছিলেন। ভৃগুর সন্তানকে তিনি অসীম মমতায় আপন গর্ভে বহন করছিলেন।

একদিন ধার্মিকশ্রেষ্ঠ ভৃগু স্নান করবার জন্য আশ্রম থেকে গঙ্গার দিকে যাত্রা করলেন। সেই সময়ে আশ্রমে এক রাক্ষস প্রবেশ করল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই রাক্ষসেরও নাম ছিল পুলোমা। পুলোমা রাক্ষস সেই আশ্রমে প্রবেশ করে ভৃগুর সুন্দরী স্ত্রীকে দেখে, কামবশে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়ল।

এদিকে পরমাসুন্দরী পুলোমাদেবী তখন সেই অতিথি রাক্ষসকে বন্য ফলমূলাদি ভোজন করবার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু কামপীড়িত সেই রাক্ষস পুলোমাদেবীকে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত চিত্তে তাঁকে অপহরণ করবার ইচ্ছা করল। পুলোমা রাক্ষস শুভলক্ষণা পুলোমাদেবীকে হরণ করার ইচ্ছা করে আনন্দিত হয়ে মনে মনে বলল, “আমার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।” কারণ, পুলোমা রাক্ষস পুলোমাদেবীর বিবাহের পূর্বে এঁকে দেখেছিল এবং মুগ্ধ হয়েছিল। সে স্থির করেছিল, যথাসময়ে সে পুলোমাদেবীকে বিবাহ করবে। পুলোমা রাক্ষস তার ভাবী স্ত্রী মনোনীত করে চলে গিয়েছিল। ইতোমধ্যে ভৃগুর সঙ্গে পুলোমাদেবীর বিয়ে হয়ে যায়। পুলোমাদেবীর পিতা রাক্ষস পুলোমাকে প্রত্যাখ্যান করেন, এই প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা পুলোমা রাক্ষসকে সমস্ত সময়ে দুঃখিত করে রাখত।

“ভৃগু আশ্রমে নেই, পুলোমাকে অপহরণ করবার পক্ষে এই উপযুক্ত সময়” এ কথা ভেবে পুলোমা রাক্ষস তখন পুলোমাদেবীকে অপহরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, তখন সে হোমগৃহে প্রজ্বলিত অগ্নি দেখতে পেল।

তারপর, পুলোমা রাক্ষস তখন সেই প্রজ্বলিত অগ্নিকে জিজ্ঞাসা করল, “অগ্নি, আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি। তুমি আমাকে সত্য করে বলো, এই পুলোমা দেবী— কার ভার্যা।

“অগ্নি, তুমি দেবগণের মুখ; অতএব আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। এই বরবর্ণিনীকে আমি পূর্বেই আপন ভার্যা হিসাবে বরণ করেছিলাম। তারপরে এঁর পিতা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে এঁকে ভৃগুর হাতে সমর্পণ করেন। তাতে ইনি যদি গোপনে ভৃগুর ভার্যা হয়ে থাকেন, তবুও তুমি সত্য বলো যে ন্যায়ত ইনি আমার ভার্যা হন কি না। যদি ন্যায়ত ইনি আমার ভার্যা হয়ে থাকেন, তবে আমি, এই আশ্রম থেকে এঁকে হরণ করতে ইচ্ছা করি। কেন না, সে দুঃখ আমার হৃদয়কে চিরকাল যেন দগ্ধ করে চলেছে। এই সুন্দরী পূর্বেই আমার ভার্যা হবেন বলে স্থির ছিল। ভৃগু এঁকে গ্রহণ করে আমার অসম্মত কাজ করেছেন; সুতরাং আজ আমি এঁকে আশ্রম থেকে হরণ করব।”

পুলোমা দেবী ন্যায়ত ভৃগুর ভার্যা হতে পারেন কি না এই সন্দেহ করে পুলোমা রাক্ষস প্রজ্বলিত অগ্নিকে বারবার এই প্রশ্ন করতে লাগল। “অগ্নি! তুমি সমস্ত প্রাণীর অন্তরে সর্বদাই বিচরণ করে থাক এবং তাদের পাপ-পুণ্যের সাক্ষীর মতোই থাক; অতএব হে সর্বজ্ঞ! তুমি আমাকে সত্য কথা বলো। ভৃগু মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আমার পূর্ববৃত ভার্যাকে গ্রহণ করেছে। ইনি যদি আমার পূর্ববৃত ভার্যাই হন, তবে তুমি আমাকে সে কথা সত্য বলো। আমি তোমার সত্য কথা শুনে তোমার সাক্ষাতেই এই ভৃগুর ভার্যাকে আশ্রম থেকে হরণ করব। অতএব অগ্নি! আমার নিকট সত্য কথা বলো।”

অগ্নি পুলোমা রাক্ষসের কথা শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন এবং মিথ্যা কথার ভয়ে ও ভৃগুর শাপের ভয়ে ভীত হয়ে আস্তে আস্তে বললেন, “হে দানবনন্দন। তুমিই পূর্বে এই পুলোমাকে বরণ করেছিলে; কিন্তু তুমি যথাবিধানে মন্ত্রপাঠপূর্বক বরণ করনি। কিন্তু পুলোমার পিতা এই পুলোমাকে ভৃগুর হাতেই সমর্পণ করেছিলেন; তিনি ভৃগুর কাছ থেকে বর পাবার আশায় কন্যাকে তোমার হাতে সমর্পণ করেননি। হে দানব। তারপর মহর্ষি ভৃগু বেদদৃষ্ট বিধানে যথানিয়মে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে এঁকে ভার্যারূপে গ্রহণ করেছেন। ইনি সেই পুলোমা, তা আমি জানি। মিথ্যা কথা বলতে পারব না। কেন না, জগতে মিথ্যা কথার সম্মান কেউ করে না।”

পুলোমা রাক্ষস অগ্নির কথা শুনে, মন ও বায়ুর তুল্য বরাহরূপ ধরে পুলোমাদেবীকে অপহরণ করে নিয়ে চলল। তারপর মাতার গর্ভস্থিত সেই সন্তানটি গৰ্ভচ্যুত হয়ে মাটিতে পতিত হল। গর্ভচ্যুত হল বলে সন্তানটির নাম হল চ্যবন। মাতার উদর থেকে নির্গত, সূর্যতুল্য তেজীয়ান সেই বালকটিকে দেখে পুলোমা রাক্ষস ভস্মীভূত হল এবং পুলোমা দেবীকে পরিত্যাগ করে মাটিতে পড়ে গেল। তখন সুন্দরনিতম্বা, দুঃখবিলা পুলোমাদেবী ভৃগুর পুত্র সেই চ্যবনকে নিয়ে আশ্রমের দিকে চললেন। তখন সমস্ত জগতের পিতামহতুল্য মাননীয় ব্রহ্মা দেখলেন, অনিন্দ্যসুন্দর পুলোমাদেবী রোদন করছেন। তাতে তাঁর অশ্রুজলে নয়নযুগল প্লাবিত হয়ে আছে। তখন ব্রহ্মা আপন পুত্রবধূ সেই পুলোমাকে নানাবিধ প্রবোধবাক্যে সান্ত্বনা দান করলেন। এদিকে পুলোমার অশ্রুবিন্দু থেকে একটি বৃহৎ নদী উৎপন্ন হল। তা দেখে ভগবান ব্রহ্মা নদীটির নাম রাখলেন ‘বধুসরা’ কারণ নদীটি ভৃগুর পত্নীর পিছনে পিছনে তাঁর আশ্রমের দিকে চলছিল।

প্রতাপশালী ভৃগুর পুত্র এইভাবে ‘চ্যবন’ নামে প্রসিদ্ধ হলেন। ভৃগু আশ্রমে গিয়ে আপন পুত্র সেই চ্যবনকে এবং পত্নীকে দেখতে পেলেন। তারপর তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে পত্নী পুলোমাকে প্রশ্ন করলেন, “পুলোমা রাক্ষস তোমাকে হরণ করবারই ইচ্ছা করেছিল, এই অবস্থায় তার কাছে তোমার পরিচয় কে দিল? সে রাক্ষস তো নিজের ভার্যা বলে তোমাকে জানত না। পুলোমা, তুমি আমাকে বলো। আমি ক্রোধে সেই ব্যক্তিকে এখনই শাপ দিতে ইচ্ছা করি। কোন ব্যক্তি আমার শাপের ভয় করে না? কোন ব্যক্তিই বা সেই ভয় লঙ্ঘন করল?”

পুলোমাদেবী বললেন, “ভগবান! অগ্নিদেবই সেই রাক্ষসের কাছে আমার পরিচয় জানিয়ে দিয়েছেন। তার পর আমি কুররী (বাজকুরল) পাখির মতো চিৎকার করতে থাকলাম। সেই অবস্থায় রাক্ষস আমাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর আপনার পুত্রের তেজেই আমি মুক্তিলাভ করলাম। সে রাক্ষস আমাকে ছেড়ে দিয়ে ভস্ম হয়ে পড়ে গেল।” ভৃগু পুলোমার কাছে এ বৃত্তান্ত শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন, আবার অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে অগ্নিকে অভিসম্পাত করলেন, “অগ্নি! তুমি সর্বভুক হবে।”

ভৃগু অভিসম্পাত করলে, অগ্নিও ক্রুদ্ধ হয়ে একথা বললেন, “ব্রাহ্মণ তুমি আমাকে অভিসম্পাত দিলে কেন? আমি সর্বদাই ধর্মরক্ষার জন্য যত্ন করে থাকি এবং বিনা পক্ষপাতেই সত্য বলে থাকি; সুতরাং, পুলোমা রাক্ষস জিজ্ঞাসা করায় আমি সত্য কথা বলেছি, তাতে আমার কী অপরাধ হয়েছিল? যে সাক্ষী পাপ ও পুণ্যের কারণ জানে এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, সে নিজের বংশের পূর্ববর্তী সাত পুরুষ এবং পরবর্তী সাত পুরুষকে নরকে নিপাতিত করে। হে ব্রাহ্মণ! আমিও তোমাকে অভিসম্পাত করতে পারতাম, কিন্তু ব্রাহ্মণেরা আমার মাননীয় বলেই আমি তোমাকে অভিসম্পাত করিনি। তোমার জানা থাকলেও আমি তোমাকে বলছি শোনো।

“আমি যোগবলে নিজেকে বহু অংশে বিভক্ত করেও অগ্নিহোত্র, সত্রযাগ, উপনয়নাদিক্রিয়া এবং সোমযাগ প্রভৃতি কার্যে, বহু মূর্তিতে অবস্থান করে থাকি। ব্রাহ্মণ প্রভৃতি যাজ্ঞিকেরা বেদবিধানে আমাতে যে ঘৃতাদির আহুতি দেন, তার দ্বারা দেবগণ ও পিতৃগণ তৃপ্তি লাভ করেন। সমস্ত দেবগণই জল, আবার সমস্ত পিতৃগণও জল এর সঙ্গে মিলিত হলেই তাঁদের জন্য দর্শযাগ ও পৌর্ণমাসযাগ হয়ে থাকে। অতএব দেবগণই পিতৃগণ এবং পিতৃগণই দেবগণ। পর্বকালে সেই উভয়ের সম্মিলিত অবস্থায় পুজা হয়ে থাকে। আবার পৃথকভাবেও পূজা হয়ে থাকে। দেবগণ ও পিতৃগণ যখন আমাতে প্রদত্ত বস্তু ভোজন করেন, তখন আমিই দেবগণ ও পিতৃগণের মুখ। আমি তাঁদের মুখ বলেই অমাবস্যার দিন পিতৃগণকে ও পূর্ণিমার দিন দেবগণকে উদ্দেশ্য করে আমাকে হোম করা হয়ে থাকে। সুতরাং আমি তাঁদের মুখ হয়ে কীভাবে সর্বভুক হব?”

অগ্নিদেব শাপ প্রতিরোধের উপায় চিন্তা করে দ্বি-জাতিগণের অগ্নিহোত্র, যজ্ঞে, সত্রে, উপনয়ন প্রভৃতি ক্রিয়ায় এবং রন্ধনাদি কার্যে নিজের অন্তর্ধান করলেন। অগ্নি না থাকায় যজ্ঞাদিকার্যে ওঙ্কার, বষট্‌কার, স্বধা ও স্বাহা প্রভৃতি কিছুই থাকল না এবং রন্ধনাদি না করতে পারায় সমস্ত লোক অত্যন্ত বিপাকে পড়ল।

তারপর, ঋষিরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে গিয়ে দেবগণকে বললেন “দেবগণ! অগ্নি লোপ পাচ্ছেন। তাতে সর্বপ্রকার ক্রিয়াও লোপ পাচ্ছে। ত্রিজগতের সমস্ত লোকই অস্থির হয়ে পড়েছে। সুতরাং কালবিলম্ব না করে এর প্রতিকার করুন।” তখন ঋষিগণ ও দেবগণ গিয়ে ব্রহ্মার কাছে ভৃগু কর্তৃক অগ্নির অভিশাপের বিষয় এবং জগতে ক্রিয়াকলাপের কথা জানিয়ে বললেন, “হে সর্বলোকধারক। মহর্ষি ভৃগু কোন কারণবশত অগ্নিকে অভিসম্পাত করেছেন। অগ্নি দেবগণের মুখ হয়ে এবং যজ্ঞের অগ্রভাগভোজী হয়ে কীভাবে জগতে সর্বভুক হবেন?”

ব্রহ্ম তাঁদের কথা শুনে, অগ্নিকে ডেকে প্রাণিগণের হিতকারী ও অবিনশ্বর সেই অগ্নিকে কোমল বাক্যে বলতে লাগলেন, “অগ্নি, এ জগতে তুমিই সকল লোকের সৃষ্টিকর্তা ও সংহারকর্তা এবং তুমিই ত্রিভুবন রক্ষা করছ। আর তুমিই অগ্নিহোত্র প্রভৃতি বৈদিক ক্রিয়ার প্রবর্তক।

“অতএব হে লোকেশ্বর! তুমিই সেইরূপই কর, যাতে ক্রিয়াকলাপ লোপ না পায়। হুতাশন! তুমি ঈশ্বর হয়েও এইরূপ কর্তব্যজ্ঞানহীন হলে কেন? জগতে তুমি সর্বদাই পবিত্র এবং সকল প্রাণীর জীবনের গতি; অতএব তুমি সমস্ত শরীরদ্বারা সর্বভুক হবে না। অগ্নি, তোমার অবধাদেশে যে সকল শিখা আছে, সেগুলিই সমস্ত ভক্ষণ করবে। সূর্যকিরণে সৃষ্ট হয়ে সকল বস্তু যেমন পবিত্র হয়, তেমনি তোমার শিখায় দগ্ধ হয়েও সমস্ত বস্তু পবিত্র হবে। অগ্নি! তুমি মহাশক্তিশালী; তাই তুমি আপন শক্তিবলে উদ্ভূত মহাতেজ স্বরূপ; অতএব নিজের তেজেই মহর্ষির অভিশাপকে সত্য করো এবং তোমার মুখে আহুতিভাবে যা পড়বে, তুমি দেবতাদের ও নিজের সেই ভাগ গ্রহণ করো।

“তাই হবে” — এই কথা বলে অগ্নি ব্রহ্মার কথার প্রত্যুত্তর দিলেন এবং তাঁর আদেশ অনুযায়ী কার্য করার জন্য চলে গেলেন। দেবগণ ও মুনিগণ আনন্দিত হয়ে যথাস্থানে চলে গেলেন এবং ঋষিরাও পূর্বের মতোই যাগযজ্ঞাদি কার্য করতে লাগলেন। স্বর্গে দেবগণ আনন্দিত হলেন; মর্ত্যে মনুষ্য প্রভৃতি প্রাণিগণ সন্তুষ্ট হল এবং ব্রহ্মার ব্যবস্থা অনুযায়ী ঘৃণিতভাব দূর হওয়ায় অগ্নিও পরম প্রীতিলাভ করলেন।

ভগবান অগ্নিদেব পূর্বকালে ভৃগুর দ্বারা এইভাবে অভিশপ্ত হয়েছিলেন। অগ্নিদেবের সত্য বলার কারণেই পুলোমা রাক্ষস দেবী পুলোমাকে অপহরণ করেছিল। আবার অগ্নিদেব ভৃগুপুত্র চ্যবনের দৃষ্টিতে আবির্ভূত হয়ে সেই অন্যায়কারী পুলোমা রাক্ষসকে ভস্মীভূত করেছিলেন।

অগ্নিদেব মহাভারত কাহিনিতে অত্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। জনমেজয়ের সর্পসত্র যজ্ঞে তাঁর আবির্ভাব। অসুস্থ অগ্নিদেব অর্জুন ও কৃষ্ণের সহায়তা লাভের প্রার্থনায় তাঁদের কাছে উপস্থিত হন। অর্জুন দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে সংগ্রামের উপযুক্ত অস্ত্রের অভাবের কথা বললে অগ্নিদেব বরুণের কাছ থেকে গাণ্ডিবধনু, দুই অক্ষয়তূণ, দেবদত্ত শঙ্খ ও রথ এবং কৃষ্ণকে সুদর্শন চক্র, পাঞ্চজন্য শঙ্খ এনে দেন।

খাণ্ডবদাহ করে কৃষ্ণার্জুন অগ্নিদেবকে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু যে মুহূর্তে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়, সেই মুহূর্তেই কৃষ্ণ রথ থেকে নেমে গেলে অগ্নিদেব অর্জুনের রথ ভস্মীভূত করে দেন। আশ্রমবাসিকপর্বে অর্জুনের মাতা কুন্তীদেবীকেও ভস্মীভূত করতে দ্বিধা করেননি অগ্নিদেব। অর্জুন মহাপ্রস্থান যাত্রার সময় পথ আটকে যা যা অর্জুনকে দিয়েছিলেন, তা সব ফিরিয়ে নেন অগ্নিদেব। তাঁর এই সব আচরণ থেকে দেবচরিত্রের বৈশিষ্ট্যও ফুটে ওঠে। কোনও পার্থিব বস্তুই চিরতরে তাঁরা দান করেন না। মানুষের কাছে তাঁরা ঋণী নন, মানুষই তাঁদের কাছে ঋণী। সেখানে তাঁরা দৈবধর্মই পালন করে থাকেন।


ভৃগুবংশের বিস্তার ও রুরুর সর্পহত্যা

মহর্ষি ভৃগুর পুত্র চ্যবন সুকন্যানাম্নী এক নারীকে বিবাহ করেন। সুকন্যার গর্ভে প্রমতি নামের পুত্র জন্মগ্রহণ করে। প্রমিতি উদার হৃদয় ও মহাতেজস্বী হয়েছিলেন। স্বর্গের অপ্সরা ঘৃতাচীর গর্ভে প্রমিতি রুরু নামে এক প্রসিদ্ধ সন্তান উৎপাদন করেছিলেন। রুরু এবং তাঁর ভার্যা প্রমদ্বরার কাহিনি মহাভারতের এক অসাধারণ কাহিনি। এঁরা সকলেই প্রথমে ভূগুবংশীয় ও পরে পাণ্ডব-কৌরবদের পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারী ছিলেন।

পূর্বকালে সমস্ত প্রাণীর হিতকার্যে নিরত এবং তপস্যা ও বিদ্যাশালী ‘স্থুলকেশ’ নামে বিখ্যাত একজন মহর্ষি ছিলেন। সেই মহর্ষির সময়েই গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসু অপ্সরা মেনকার সঙ্গে মৈথুনপ্রবৃত্ত হন। অপ্সরা মেনকা বিশ্বাবসুর উৎপাদিত সেই গর্ভটিকে মহর্ষি স্থূলকেশের আশ্রমের কাছে যথাসময়ে প্রসব করল এবং প্রসব করেই সেই নির্দয় ও নির্লজ্জ অপ্সরা নদীতীরে সন্তানটিকে পরিত্যাগ করে চলে গেল।

প্রভাবশালী মহর্ষি স্থূলকেশ তখন দেখতে পেলেন— কে যেন একটি কন্যাকে নির্জন নদীতীরে পরিত্যাগ করে গিয়েছে। আপন কান্তিতে সে কন্যা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে এবং দেবকন্যার মতো শোভা পাচ্ছে। কিন্তু চারপাশে তার কোনও রক্ষক নেই। মহর্ষি অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে কন্যাটিকে আপন কোলে তুলে নিলেন এবং আশ্রমে তাকে নিয়ে গিয়ে প্রতিপালন করতে লাগলেন। কন্যাটিও মহর্ষির কল্যাণকর আশ্রমে থেকে বড় হতে লাগল। মহামতি মহর্ষি স্থূলকেশ যথাবিধানে এবং যথাক্রমে সেই কন্যাটির জাতকর্ম প্রভৃতি সংস্কারগুলি করালেন। সেই কন্যাটি রূপে, গুণে ও স্বভাবে অন্যান্য সকল স্ত্রীলোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলে, মহর্ষি স্থূলকেশ তাঁর নাম রাখলেন— প্রমদ্বরা।

কোনও এক সময়ে রুরু, স্থূলকেশমুনির আশ্রমে প্রমদ্বরাকে দেখে, ধার্মিক হয়েও তৎক্ষণাৎ কামে অভিভূত হলেন। কাম তাঁকে আর্ত ও পীড়িত করে তুললেও রুরু ধর্ম বিস্মৃত হলেন না। তিনি স্বয়ং কন্যাটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন না। বয়স্যগণ দ্বারা নিজের অভিলাষ আপন পিতাকে জানালেন। পিতা প্ৰমতিও পুত্রের জন্য স্থূলকেশ মুনির কাছে সেই কন্যাটিকে প্রার্থনা করলেন। মহর্ষি পুলকেশ শুভক্ষণ দেখে পরবর্তী উত্তরফাল্গুনী নক্ষত্রে বিবাহ স্থির করলেন এবং রুরুর হাতে প্রমদ্বরাকে দান করবেন বলে অঙ্গীকার করলেন।

কয়েকদিন কেটে গেল, বিয়ের দিনও এসে গেল; এমন সময়ে একদিন প্রমদ্বরা সখীদের সঙ্গে খেলা করতে করতে খেলার জায়গায় একটি শায়িত সাপকে না দেখে সাপের গায়ের উপর পা দিয়ে পাড়িয়ে দিল। অসাবধানে প্রমদ্বরা পা দিয়ে সাপকে আঘাত করলে মৃত্যুপ্রেরিত সেই সর্প তার চরণে তীব্র দংশন করল। সেই সর্প দংশন করলে প্রমদ্বরা তৎক্ষণাৎ ভূতলে পড়ে গেল; তার শরীরের বর্ণ মলিন হয়ে গেল, উজ্জ্বল কান্তি তিরোহিত হল। অলংকারগুলি পড়ে গেল এবং চৈতন্যলোপ পেল। তার চুলগুলি খুলে পড়ল এবং প্রাণ চলে গেল। এই দারুণ দুর্ঘটনায় সখীরা আর্তনাদ করতে লাগল। প্রমদ্বারা অসাধারণ সুন্দরী নারী ছিল। সর্প বিষের আঘাতে গতপ্রাণ সে নারীকে আরও অপরূপ দেখতে লাগল।

পিতা স্থূলকেশ ও অন্যান্য তপস্বীরা দেখলেন— পদ্মকোষের মতো গৌরকান্তি প্রমদ্বারা ভূতলে পড়ে আছে। তার স্পন্দন নেই। তারপর স্বস্ত্যাত্রেয়, মহাজানু, কৌশিক, শঙ্খমেখল, উদ্দালক, কঠ, শ্বেত, ভরদ্বাজ, কৌণকুৎস্য, আর্ষ্টিসেন এবং গৌতম— এই সকল প্রধান প্রধান ব্রাহ্মণগণ দয়া স্নেহ করুণাবশত সেই স্থানে উপস্থিত হলেন। পুত্র রুরুর সঙ্গে প্রমতি এবং অন্যান্য সেই সকল বনবাসী, সর্পবিষের জ্বালায় সেই গতপ্রাণা কন্যাটিকে দেখে অশ্রুপাত করতে থাকলেন; গতায়ু প্রিয়তমাকে দেখে অত্যন্ত দুঃখিত রুরু আশ্রমের বাইরে চলে গেলেন! মৃত প্রমদ্বরার মুখ তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। শোকার্ত রুরু বলতে লাগলেন, “আমার প্রিয়তমার দেহখানি কৃশ ছিল, পূর্ণচন্দ্রের মতো ছিল তার মুখ। আমাকে অশেষ দুঃখসাগরে পতিত করে তিনি প্রাণহীন অবস্থায় ভূতলে পড়ে আছেন। সেই সুন্দর নিতম্বা ও পদ্মনয়না অপরূপা নারী মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে আমার প্রাণ আকর্ষণ করছেন। জীবিত অবস্থায় প্রমদ্বরা ভিন্ন অন্য নারীর সঙ্গে মিলন আমার পক্ষে অসম্ভব। কাজেই আমার আর বংশধর থাকার সম্ভাবনা রইল না, আমার আর পিণ্ডের সম্ভাবনা থাকল না। সুতরাং আমার পিতামাতা বয়স্য ও বন্ধুদের এর থেকে অধিক দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে? আমি যদি দান করে থাকি, তপস্যা করে থাকি এবং গুরুজনদের সেবা করে থাকি, তবে আমার সেই পুণ্যে আমার প্রিয়তমা জীবন লাভ করুন। আমি যদি জন্মাবধি সংযতচিত্ত জিতেন্দ্রিয় থাকি এবং ব্রহ্মচর্য প্রভৃতি নিয়ম যথাবিধি পালন করে থাকি; তা হলে আমার সেই সকল পুণ্যে আমার প্রিয়তমা প্রমদ্বরা জীবন লাভ করুন। কৃষ্ণ, বিষ্ণু, হৃষীকেশ, জগদীশ্বর এবং অসুরহন্তা নারায়ণের প্রতি যদি আমার অচলা ভক্তি থাকে, তা হলে আমার প্রিয়তমা প্রমদ্বরা জীবন লাভ করুন।

রুরু এইরকম বিলাপ করতে থাকলে সমস্ত দেবতা কৃপান্বিত হয়ে, রুরুর হিতজনক বাক্য বলে, একটি দূত তার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। দেবগণের প্রিয়কারী ও পবিত্র হৃদয় সেই দূত সত্বর উপস্থিত হয়ে, শোকার্ত রুরুকে সম্বোধন করে বলল, “হে দ্বিজোত্তম, সমস্ত দেবতা মিলে আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন, তাঁরা আপনার হিতৈষী; এই তাঁরা আপনার হিতের কথা বলেছেন, আপনি তা শুনুন। রুরু শশাকে অধীর হয়ে আপনি যা বলেছেন, তা মিথ্যা। কারণ যার আয়ু চলে যায়, তার পুনরায় আয়ুলাভ ঘটে না। গন্ধর্ব ও অপ্সরার এই কন্যাটির আয়ু চলে গিয়েছে; অতএব বৎস! তুমি কোনও প্রকারেই শোকে কাতর হয়ো না। তবে এ বিষয়ে, মহাত্মা দেবতারা পূর্বে এক উপায় করে রেখেছেন, তুমি যদি তা করতে ইচ্ছা কর, তবেই এখনই প্রমদ্বরাকে জীবিত পাবে।”

রুরু বললেন, “হে আকাশচর, দেবতারা আমার প্রমদ্বরার জীবনের জন্য কী উপায় স্থির করেছেন, তা আপনি আমাকে বলুন; আমি তৎক্ষণাৎ তা পালন করব; আপনি আমাকে রক্ষা করুন।”

দেবদূত বললেন, “হে ভৃগুনন্দন, এই কন্যাটিকে তুমি তোমার আয়ুর অর্ধ দান করো। তুমি তা করলে, তোমার ভার্যা প্রমদ্বারা জীবিত হয়ে গাত্রোত্থান করবেন।”

রুরু বললেন, “হে খেচরশ্রেষ্ঠ, এই কন্যাটিকে আমি আমার অর্ধ-আয়ু দান করলাম; আমার প্রিয়তমা শৃঙ্গারের উপযোগী রূপ ও বেশভূষা নিয়ে জেগে উঠুন।”

আয়ুষোহর্দ্ধং প্রয়চ্ছামি কন্যায়ৈ খেচরোত্তম!

শৃঙ্গাররূপাভরণা সমুত্তিষ্ঠতু মে প্রিয়া ॥ আদি: ৮:১৭ ॥

তারপর, গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসু (প্রমদ্বরার পিতা) এবং সচ্চরিত্র সেই দেবদূত— যমরাজের কাছে গিয়ে বললেন, “ধর্মরাজ রুরুর ভার্যা কল্যাণী প্রমদ্বরা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন; এখন যদি আপনি অনুমতি করেন, তবে সে রুরুরই আয়ুর অর্ধ লাভ করে জীবিত হয়ে উঠুক।” যমরাজ বললেন, “দেবদূত! তুমি যদি রুরুর ভার্যা প্রমদ্বরার জীবন ইচ্ছা কর, তবে সে রুরুর আয়ুরই অর্ধ পেয়ে জীবিত হয়ে উঠুক।”

যমরাজ একথা বললে, সেই বরবর্ণির্নী কন্যা প্রমদ্বারা রুরুর আয়ুর অর্ধ পেয়ে যেন ঘুম ভেঙে উঠে দাঁড়ালেন। মহাপ্রতাপশালী রুরুর অতি দীর্ঘ আয়ু ছিল। প্রমদ্বরার জন্য রুরুর আয়ু অর্ধ হয়ে গেল।

তারপর পাত্রের পিতা প্রমতি এবং পাত্রীর পিতা স্থূলকেশ— অভীষ্ট দিবসে সেই বর-কন্যার বিবাহ সম্পাদন করলেন। বরকন্যাও পরস্পর হিতসাধনে প্রবৃত্ত থেকে আনন্দ লাভ করতে লাগলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য রুরু ভয়ংকর সর্পদ্বেষী হলেন।

*

রুরু ও প্রমদ্বরার কাহিনি পুরুবংশ কথনের পূর্বের কাহিনি। নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ, সর্পের প্রতি মানুষের ঘৃণা— এই কাহিনিতে বর্ণিত হয়েছে। এদের বহু বংশ পরে পুরু বংশের শুরু। রুরুর সর্পযজ্ঞের আদর্শ অনুসরণ করেই জনমেজয় সর্পসত্র যজ্ঞ আরম্ভ করেছিলেন।


অভিশপ্ত দেবযানী—যদু বংশের প্রতিষ্ঠা

প্রাচীনকালে স্থাবর-জঙ্গমপূর্ণ ত্রিভুবনের সম্পত্তি নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে গুরুতর বিবাদ হয়েছিল। তখন দেবগণ অসুরদের জয় করবার জন্য বৈজয়িক যজ্ঞ করেন এবং সেই যজ্ঞে পৌরোহিত্য করার জন্য ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ বৃহস্পতিকে বরণ করেন। একই কারণে, দৈত্যরা ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ শুক্রাচার্যকে বরণ করেন।

এই দুই ব্রাহ্মণ সর্বদাই স্পর্ধার সঙ্গে অপরের উল্লেখ করতেন। কিন্তু দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের একটি বিশেষ জ্ঞান ছিল, যা দেবগুরু বৃহস্পতির ছিল না। শুক্রাচার্য সঞ্জীবনী মন্ত্র জানতেন। দেবতারা যুদ্ধে দৈত্যদের বধ করলে, শুক্রাচার্য সঞ্জীবনী মন্ত্রে তাঁদের আবার বাঁচিয়ে দিতেন। জীবিত দানবেরা পুনরায় দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধে রত হতেন। কিন্তু এই জ্ঞান দেবগুরু বৃহস্পতির ছিল না। দৈত্যদের হাতে নিহত দেবগণকে বৃহস্পতি পুনরায় জীবিত করতে পারতেন না। তখন দেবগণ অত্যন্ত বিষন্ন হয়ে বৃহস্পতির পুত্র কচের কাছে গিয়ে বললেন, “কচ, আমরা উপকার করে সর্বদাই আপনাদের সেবা করে থাকি। অতএব আমাদের প্রত্যুপকার করুন। আপনার সাহায্য আমাদের বিশেষ প্রয়োজন। মহাতেজস্বী দৈত্যগুরু শুক্রের সঞ্জীবনী নামে যে বিদ্যা আছে, তা আপনি শিক্ষা করে আসুন। আপনি দৈত্যরাজ বৃষপর্বার গৃহে শুক্রাচার্যের সাক্ষাৎ পাবেন। শুক্রাচার্য যুদ্ধের সময় দানবগণকে বাঁচিয়ে দেন। কিন্তু দানবছাড়া অন্য কাউকেই বাঁচিয়ে দেন না। আপনি অল্পবয়স্ক, তাই যথোচিত সেবা করে শুক্রাচার্যকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন। কারণ, দেবযানী নামে শুক্রাচার্যের এক কন্যা আছেন। আপনিই তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন, অন্য কেউ পারবে না। আপনার স্বভাব, উদারতা, কোমলতা, আচার ও ইন্দ্রিয় সংযমের গুণে দেবযানী সন্তুষ্ট হলে, আপনি নিশ্চয়ই সেই সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করতে পারবেন।” “তাই হবে” এই কথা বলে বৃহস্পতির পুত্ৰ কচ অসুররাজ বৃষপর্বার রাজধানীর দিকে যাত্রা করলেন এবং অনতিবিলম্বে অসুররাজের পুরীতে শুক্রাচার্যকে দেখতে পেয়ে বললেন, “মহাশয় আমি মহর্ষি অঙ্গিরার পৌত্র, দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র, আমার নাম ‘কচ’, আমাকে আপনার শিষ্যরূপে গ্রহণ করুন। আমি সহস্র বৎসর পর্যন্ত আপনার কাছে থেকে ‘ব্রহ্মচর্য’ ব্রত করব। আপনি আমাকে অনুমতি প্রদান করুন।”

শুক্রাচার্য বললেন, “কচ তোমার আগমন শুভ হোক। আমি তোমার প্রার্থনা স্বীকার করলাম। তুমি মাননীয়; সুতরাং আমি তোমাকে শিক্ষা দিয়ে সন্তুষ্ট করব। তাতে তোমার পিতা বৃহস্পতিও সন্তুষ্ট হবেন।” “তাই হোক” বলে কচ শুক্রাচার্যের আদেশ অনুসারে শাস্ত্রোক্তভাবে ব্রহ্মচর্য ব্রতের নিয়ম পালন করতে থাকলেন। যুবক কচ প্রতিদিন নাচ, গান ও বাজনা বাজিয়ে গুরুদেব শুক্রাচার্যের সন্তোষের জন্য যুবতী দেবযানীকে সন্তুষ্ট করতে লাগলেন। কচ ফল ও পুষ্প আহরণ ও আজ্ঞাপালন করে যুবতী দেবযানীকে বিশেষ সন্তুষ্ট করে তুললেন। দেবযানীও কচকে পাবার আশায় নির্জনে গান করে, ব্রতচারী কচের পরিচর্যা করতে লাগলেন। কারণ সঙ্গীতনিপুণ, পরিষ্কৃতবেশ, অভীষ্ট বস্তু দাতা, প্রিয়ভাষী, রূপবান ও অলংকৃত পুরুষকে রমণীরা স্বভাবতই কামনা করে থাকেন।

কচ গুরুগৃহে থেকে এইভাবে ব্ৰত আচরণ করতে থাকলেন; এবং পাঁচশত বৎসর অতীত হল। তারপর দানবগণ তার অভিসন্ধি বুঝতে পেরে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হল; একদিন কচ একা নির্জন বনে যখন গোরু চরাচ্ছিলেন, তখন দানবেরা বৃহস্পতির প্রতি বিদ্বেষবশত কচকে মেরে ফেলল এবং টুকরো টুকরো করে কুকুরদের খেতে দিল। গোরুগুলি রক্ষকশূন্য হয়ে ঘরে ফিরে আসল। কচকে ছাড়াই গোরুগুলি ফিরে এসেছে দেখে দেবযানী পিতা শুক্রাচার্যকে বললেন, “পিতা! আপনিও হোম করেছেন, সূর্য অস্ত গিয়েছেন, গোরুগুলি ফিরে এসেছে; কিন্তু কচকে তো দেখছি না। সুতরাং, নিশ্চয়ই কেউ কচকে মেরে ফেলেছে। অথবা অন্য কোনও কারণে সে মরেছে। পিতা! আমি আপনাকে সত্য বলছি যে, আমি কচকে ছাড়া বাঁচব না।” শুক্রাচার্য বললেন, “কচ মারা গেলেও ‘এখনই এসো’ বলে আমি আহ্বান করলেই সে আবার বেঁচে উঠবে।” এই বলে তিনি সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে কচকে আহ্বান করলেন। শুক্রাচার্য আহ্বান করা মাত্রই সঞ্জীবনী বিদ্যার প্রভাবে কচ কুকুরের দেহ বিদীর্ণ করে, প্রফুল্ল মূর্তিতে সেখানে উপস্থিত হলেন।

দেবযানী প্রশ্ন করলেন, “কচ তোমার এত দেরি হল কেন?” তখন কচ তাঁকে বললেন, “কল্যাণী, আমি সমিধ, কুশ, ফুল ও কাঠ নিয়ে আসবার সময়ে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে একটি বটগাছের ছায়ায় বসেছিলাম। গোরুগুলিও আমার সঙ্গে সেই বৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। অসুরেরা আমাকে সেই বটগাছের ছায়ায় বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে?’ আমি বললাম, ‘আমি বৃহস্পতির পুত্র, কচ।’ অসুরেরা এই কথা শোনামাত্র, আমাকে মেরে, খণ্ড খণ্ড করে কুকুরদের আমার মাংস খাইয়ে, আনন্দিত মনে আপন আপন ভবনে চলে গেল। তারপর মহাত্মা ভার্গব শুক্রাচার্য আবার সঞ্জীবনী মন্ত্র প্রয়োগ করে আমাকে আহ্বান করলেন—। আমি কোনওরকমে জীবন লাভ করে আপনার কাছে এসেছি।” দেবযানীর প্রশ্নের উত্তরে কচ জানিয়েছিলেন যে, তিনি নিহত হয়েছিলেন।

আবার অন্য এক সময়ে দেবযানী কচকে বলেছিলেন, “আমার জন্য ফুল নিয়ে এসো।” কচ দেবযানীর ইচ্ছা অনুযায়ী ফুল আনতে বনের মধ্যে প্রবেশ করলেন। দানবেরা তাকে দেখতে পেল। আবার খণ্ড খণ্ড করে কেটে সমুদ্রের জলে ফেলে দিল। দেবযানী শুক্রাচার্যকে আবার জানালেন যে, কচ বহু সময় গিয়েছেন কিন্তু এখনও ফিরে আসছেন না। শুক্রাচার্য আবার সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে কচকে আহ্বান করলেন। কচ আবার দেহধারণে শুক্রাচার্যের কাছে উপস্থিত হয়ে, সমস্ত ঘটনা তাঁকে জানালেন। তারপর অসুরেরা তৃতীয়বার কচকে মেরে, দগ্ধ করে, সেই ভস্মচূর্ণ সুরার সঙ্গে মিশিয়ে, তা শুক্রাচার্যকে পান করতে দিল। শুক্রাচার্যও সুরার সঙ্গে কচের ভস্মচূৰ্ণ পান করে ফেললেন। এদিকে সন্ধ্যাকালে গোরুগুলি রক্ষকশূন্য অবস্থায় ফিরে এসেছে দেখে দেবযানী কচের মৃত্যু আশঙ্কা করে পিতাকে বললেন, “পিতা আজ্ঞা বহন করে কচ ফুল আনতে গেছিল, তাঁকে তো দেখতে পাচ্ছি না। অতএব নিশ্চয়ই তাঁকে কেউ মেরে ফেলেছে, অথবা সে কোনও কারণে মরে গিয়েছে। কচকে ছেড়ে আমি বাঁচব না। আপনি কচকে আমার কাছে এনে দিন।”

শুক্রাচার্য দেবযানীর কথা শুনে, কচ তাঁর দেহের ভিতরেই আছেন না জেনে, সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে তাঁকে আসতে আহ্বান করলেন। শুক্রাচার্য বললেন, “দেবযানী বৃহস্পতির পুত্র কচু অন্যান্য ব্যক্তির মতোই মরে গিয়েছে। আমি সঞ্জীবনী বিদ্যার দ্বারা তাঁকে বারবার বাঁচিয়ে তুলছি, তবুও অসুররা আবার মেরে ফেলছে। সুতরাং আমরা কী করব? দেবযানী তুমি এইরূপ শোক কোরো না, কান্নাকাটি কোরো না। তুমি বুদ্ধিমতী নারী, মৃত্যুশীল লোকের জন্য শোক করা তোমার শোভা পায় না। বিশেষত, যে তোমার প্রভাবে জ্ঞানী লোক, ব্রাহ্মণগণ, ইন্দ্রাদি দেবগণ, বসুগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, অসুরগণ, এমনকী সমস্ত জগৎ উপাসনার সময় অবনত হয়ে থাকে। দেখো, ওই ব্রাহ্মণকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কেন না, বাঁচিয়ে দিলে অসুররা আবার মেরে ফেলছে।”

দেবযানী বললেন, “অতিবৃদ্ধ অঙ্গিরার পৌত্র, মহাতপস্বী বৃহস্পতির পুত্র সেই কচের জন্য কীভাবে আমি শোক না করে থাকতে পারি? কচ ব্রহ্মচারী, তপস্বী, উদ্‌যোগী এবং কার্যদক্ষ ছিলেন। সুতরাং আমি কচের পথেই যাব, তাঁর পথ আমি ছাড়ব না। কারণ, বিদ্বান ও সুন্দর কচ আমার প্রীতির পাত্র ছিলেন।” শুক্রাচার্য বললেন, “নিশ্চয়ই অসুরেরা আমায় বিদ্বেষ করে; যে হেতু তারা আমার নিরপরাধ শিষ্যটিকে বারবার হত্যা করছে। বিশেষত অসুরেরা আমাকে অব্রাহ্মণ করবার ইচ্ছা করছে। আর সর্বদাই আমার প্রতিকূলাচরণ করছে। যাই হোক এই পাপের ফলে শীঘ্র তাদের ধ্বংস হবে। ব্রহ্মহত্যার পাপ কাকে না দগ্ধ করে? ইন্দ্রকেও দগ্ধ করে থাকে।”

মহর্ষি শুক্রাচার্য দেবযানীর বারবার অনুরোধে উচ্চ স্বরে পুনরায় কচকে আহ্বান করলেন। সঞ্জীবনী বিদ্যার প্রভাব মহাত্মা ও মহাপ্রতাপশালী কচ সংজ্ঞা লাভ করলেন। কিন্তু গুরুর উদরের ভিতরে আছেন বলে ভীত হলেন। তবুও বিদ্যাপ্রভাব আহূত হয়েছেন বলে, গুরুর উদরের ভিতর থেকেই আস্তে আস্তে বললেন, “ভগবান! আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হোন, আমি আপনাকে প্রণাম করি। লোকে পুত্রকে যেমন আদর করে, আপনিও আমাকে পুত্রের মতো বিবেচনা করুন।” তখন শুক্রাচার্য জিজ্ঞাসা করলেন, “কচ তুমি কোন পথে গিয়ে আমার উদরে বাস করছ, বলল। আমি এই মুহূর্তেই অসুরদের বিনষ্ট করে, আজই দেবগণের পক্ষে চলে যাব।” কচ বললেন, “গুরুদেব আপনার অনুগ্রহে আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়নি! যেভাবে এই ঘটনা ঘটেছিল, তার সবই আমার মনে আছে। আর, এই অপমৃত্যুতেও আমার তপস্যার ক্ষয় হয়নি। তারই ফলে, আমি এই দুঃসহ যন্ত্রণাও সহ্য করতে পারছি। গুরুদেব! অসুররা আমাকে মেরে, দগ্ধ করে, সেই ভস্ম চূর্ণ করে তা সুরার মধ্যে মিশিয়ে আপনাকে দিয়েছিল। আপনি অসুরদের মায়া শিখিয়েছেন। সুতরাং আপনি থাকতে, আমি আপনার মায়ারই তুল্য। অসুরদের মায়া কীভাবে অতিক্রম করব?”

তখন শুক্রাচার্য দেবযানীকে বললেন, “বৎসে দেবযানী, তোমার কোন প্রিয় কার্য করব বলো। আমাকে মেরে কচকে রক্ষা করা যেতে পারে; কেন না, আমার উদর বিদীর্ণ করা ব্যতীত, আমার উদরের মধ্যে থাকা কচকে দেখতে পাওয়া যাবে না।” দেবযানী বললেন, “পিতা আপনার মৃত্যু ও কচের মৃত্যু—এই দুই মৃত্যুই অগ্নিতুল্য শোকের মতো আমাকে দগ্ধ করবে। কচের মৃত্যুতে আমার জীবনের সুখ থাকবে না। আর আপনার মৃত্যু হলে আমি তো বাঁচতেই পারব না।”

শুক্রাচার্য বললেন, “কচ তুমি তপস্যায় সম্পূর্ণ সিদ্ধিলাভ করেছ। ভক্ত বলে দেবযানী তোমাকে গুরুতর স্নেহ করছে। অতএব তুমি যদি কচরূপী ইন্দ্র না হও, তবে তুমি এই সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করো। আর তা ছাড়া, ব্রাহ্মণ ভিন্ন কেউই আমার উদর থেকে জীবিত অবস্থায় ফিরতে পারবে না; সুতরাং তুমি সঞ্জীবনী বিদ্যা গ্রহণ করো। বৎস কচ, আমি তোমাকে জীবিত করে দিচ্ছি। তুমিও পুত্ররূপে আমার উদর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ো। দেখো, গুরুর কাছ থেকে বিদ্যা লাভ করে, বিদ্বান হয়ে, ধর্মের দিকে দৃষ্টি রেখো।” বিদ্বান কচ গুরুর কাছ থেকে বিদ্যা লাভ করে, গুরুর উদর বিদীর্ণ করে, পূর্ণিমার চন্দ্রের মতো প্রকাশিত হলেন। কচ বাইরে এসে দেখলেন, মূর্তিমান অধ্যাত্মজ্ঞানের পুঞ্জের মতো শুক্রাচার্য মৃত অবস্থায় ভূতলে পতিত আছেন। তখন কচ সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে শুক্রাচার্যকে বাঁচিয়ে তুললেন। তারপর, কচ সিদ্ধবিদ্যা লাভ করেছেন বলে গুরুকে প্রণাম করে বললেন, “দেব, আপনার ন্যায় ব্যক্তি, যিনি বিদ্যাশূন্য শিষ্যের কর্ণে অমৃতের তুল্য বিদ্যা দান করেন, আমি তাঁকে একই দেহে পিতা ও মাতা বলে মনে করি। সুতরাং, আপনার সেই উপকার স্মরণ রেখে, কখনও আপনার অনিষ্টের চিন্তাও মনে আনতে পারি না। যে সমস্ত শিষ্য বিদ্যা লাভ করে, উৎকৃষ্ট তত্ত্বজ্ঞানদাতা এবং বেদের নিধি পরম পূজনীয় গুরুদেবের আদর করে না, তারা ইহলোকে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না, পরলোকেও নরকগামী হয়!”

জ্ঞানী ও মহাত্মা শুক্রাচার্য সুরা পান করার দোষ এবং দারুণ সংজ্ঞালোপ অনুভব করে এবং মোহিত অবস্থায় নিজেই সুরার সঙ্গে যাঁকে পান করে ফেলেছিলেন, সেই জ্ঞানী কচকে সম্মুখে দেখে দুঃখিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সুরা পানের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে এবং ব্রাহ্মণদের হিত সাধনের ইচ্ছা করে এই কথা বললেন, “আজ থেকে ভ্রমক্রমে যে অল্পবুদ্ধি ব্রাহ্মণ সুরা পান করবে; সে ধর্মহীন এবং ব্রহ্মঘাতীর মতো পাপী হয়ে ইহলোকেও নিন্দিত হবে, পরলোকেও নিন্দিত হবে। গুরুশুশ্রূষাপরায়ণ সাধু ব্রাহ্মণগণ, দেবগণ এবং ক্ষত্রিয় প্রভৃতি অন্যান্য সমস্ত লোক শ্রবণ করুন। আমি সমস্ত জগতে আজ থেকে এই নিয়ম স্থাপন করলাম।”

তপস্বীশ্রেষ্ঠ ও অসাধারণ প্রভাবশালী মহাত্মা শুক্রাচার্য এইকথা বলে দৈববশত মুগ্ধমতি দানবগণকে আহ্বান করে তাদের এই কথা বললেন, “দানবগণ তোমরা বড়ই মূর্খ! তাই তোমাদের বলছি; মহাত্মা কচ সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করে সিদ্ধ হয়েছেন; সুতরাং কচ এখন আমারই মতো প্রভাবশালী, এমনকী ব্ৰহ্মারই তুল্য ক্ষমতাপন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং আমার কাছে দীর্ঘকাল বাস করবেন।”

এই বলে শুক্রাচার্য বিরত হলেন। বিস্ময়াপন্ন হয়ে দানবেরাও আপন আপন গৃহে চলে গেল। এদিকে কচও সহস্র বৎসর পর্যন্ত শুক্রাচার্যের কাছে থেকে, তাঁর অনুমতি নিয়ে স্বর্গলোকে যাবার ইচ্ছা করলেন। কচ ব্রত সমাপ্ত করলেন, শুক্রাচার্যও তাঁকে বিদায় দিলেন; কচ স্বর্গলোকে যাবার উপক্রম করলে, দেবযানী তাঁকে বললেন, “হে মহর্ষি অঙ্গিরার পৌত্র, তুমি কুল, ব্যবহার, বিদ্যা, তপস্যা ও ইন্দ্রিয় সংযমদ্বারা অলংকৃত হয়েছ। আমার পিতার কাছে যেমন মহর্ষি অঙ্গিরা মাননীয়, আমার কাছেও তেমনই তোমার পিতা বৃহস্পতি মাননীয় এবং পূজনীয়। হে তপোধন। আমার কথা শোনো। তুমি যখন ব্রত নিয়ম পালনে ব্যাপৃত ছিলে, তখন আমি ভক্তি সহকারে তোমার পরিচর্যা করেছি। তুমি এখন বিদ্যাশিক্ষা সমাপ্ত করেছ, আমি তোমার প্রতি সেই অনুরক্তাই আছি। সুতরাং তোমারও আমার প্রতি প্রীতিযুক্ত হওয়া উচিত। সুতরাং তুমি মন্ত্রপাঠপূর্বক যথাবিধানে আমার পাণিগ্রহণ করো।

কচ বললেন, “শোভনে। আপনার পিতা যেমন আমার পূজনীয় ও মাননীয়। আপনিও আমার কাছে তেমনই মাননীয়া। ভদ্রে! আপনি মহাত্মা শুক্রাচার্যের প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়তরা এবং আমার গুরুপুত্রী। অতএব ন্যায় অনুসারে আপনি সর্বদাই আমার পূজনীয়া। আপনার পিতা শুক্রাচার্য গুরু বলে সর্বদাই আমার পূজনীয়। দেবযানী গুরুপুত্রী বলে আপনিও আমার তেমনই পূজনীয়া; অতএব আমাকে এইরূপ বলতে পারেন না।”

দেবযানী বললেন, “কচ তুমি আমার পিতার গুরুপুত্রের পুত্র; কিন্তু আমার পিতার পুত্র নয়। অতএব তুমিও আমার পূজনীয় এবং মাননীয়। অসুরেরা তোমাকে বারবার হত্যা করতে থাকলে, তখন তোমার প্রতি আমার যে অনুরাগ জন্মেছে; তা আজ স্মরণ করো। স্নেহ ও অনুরাগ এই দুই বিষয়েই তোমার প্রতি আমার যে অচলা ভক্তি আছে, তা তুমি জানো; অতএব হে ধর্মজ্ঞ। আমি তোমার ভক্ত, অথচ আমার কোনও অপরাধ নেই; এ অবস্থায় তুমি আমাকে ত্যাগ করতে পারো না।”

কচ বললেন, “দেবযানী যে বিষয়ে আদেশ করা অনুচিত, সে বিষয়ে আপনি আমাকে আদেশ করতে পারেন না। আমার প্রতি প্রসন্না হোন, আপনি আমার কাছে গুরুর থেকেও গুরুতরা। আপনি যেখানে বাস করেছিলেন, আমিও সেই শুক্রাচার্যের উদরেই বাস করেছিলাম। ধর্মানুসারে আপনি আমার ভগিনী হন; অতএব আপনি আর একথা বলবেন না। আমি আপনাদের গৃহে সুখে বাস করেছি। কোনওদিন কোনও অভাব অনুভব করিনি।

আপৃচ্ছে ত্বাং গমিষ্যামি শিবমাশংস মে পথি!
অবিরোধেন ধৰ্ম্মস্য স্মৰ্ত্তব্যোহস্মি কথান্তরে!
অপ্রমত্তোত্থিতা নিত্যমারাধয় গুরুম্ মম ॥ আদি: ৬৫: ১৫ ॥

“আমি এখন চলে যাব, আপনার নিকট তার অনুমতি চাইছি। আপনি আশীর্বাদ করুন, পথে যেন আমার মঙ্গল হয়। কথার প্রসঙ্গে ধর্মকে লঙ্ঘন না করে আমাকে স্মরণ করবেন; আর সর্বদা উদ্‌যোগী ও সাবধান হয়ে আমার গুরুদেবের পরিচর্যা করবেন।”

দেবযানী বললেন, “কচ আমি তোমার কাছে পাণিগ্রহণের প্রার্থনা করেছিলাম। তুমি যদি আমাকে সে বিষয়ে প্রত্যাখ্যান করো, তবে তোমার এইসঞ্জীবনী বিদ্যা কখনও সফলতা লাভ করবে না।” কচ বললেন, “দেবযানী তুমি আমার গুরুর কন্যা; তাই আমি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি; কিন্তু অন্য কোনও প্রত্যক্ষ দোষে নয়। বিশেষত গুরুদেব আমাকে এই বিষয়ে কোনও আদেশ দেননি; তবু তুমি আমাকে ইচ্ছা করেই এই অভিসম্পাত করলে দেবযানী! আমি মুনি ঋষিগণের অভিমত অনুযায়ী ধর্মের কথাই বলেছিলাম। সুতরাং আমি তোমার অভিসম্পাতের যোগ্য নই। তবু তুমি আমাকে ধর্ম প্রণোদিত হয়ে নয়, কাম প্রণোদিত হয়ে যেহেতু অভিসম্পাত করলে, সেইহেতু তোমার অভিশাপও কখনওই পূর্ণ হবে না; কোনও ঋষিপুত্র কখনও তোমার পাণিগ্রহণ করবেন না। তোমার সঞ্জীবনী বিদ্যা ফলবে না। তুমি যে আমাকে এই অভিশাপ দিয়েছ, তা সেইরূপই হবে, তবে তাতে আমার খুব একটা ক্ষতি হবে না। কারণ, আমি যাকে সে বিদ্যা দান করব, তার তা অবশ্য ফলবে।”

ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ কচ দেবযানীকে এই কথা বলে সত্বর ইন্দ্রভবনে চলে গেলেন। ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ কচকে আগত দেখে, বৃহস্পতির অভিনন্দন করে, কচকে স্বাগত জানালেন। দেবগণ বললেন,—“কচ আপনি যখন আমাদের হিতকর এই অদ্ভুত কাজ করেছেন, তখন আপনার যশ কখনও নষ্ট হবে না; বিশেষত আপনি যজ্ঞাদিকার্যে আমাদের অংশভাগী হবেন।”

*

কচ ও দেবযানী উপাখ্যান মহাভারতের এক অনবদ্য দুর্লভ মুহূর্ত। এই কাহিনিতে দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র ও দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের পুত্রীর চরিত্রবৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। কচের অসাধারণ গুরুভক্তি, বিনয়নম্র আচরণ, ধর্মপরায়ণতা আমাদের মুগ্ধ করে। শুক্রাচার্যের মধ্যেও আমরা পাই শ্রেষ্ঠ গুরুর আচরণ। কচের পরিচয় পাবার পরও তিনি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেননি। সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাই দিয়েছিলেন। সঞ্জীবনী বিদ্যা দেবার সময় তিনি জানতেন, দেবতারা দৈত্যদের থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠবে, এমনকী তাঁর দেহ থেকে বাইরে এসে কচ যদি এ বিদ্যা প্রয়োগ না করেন, তবে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু শুক্রাচার্য শিষ্যকে চিনেছিলেন। তিনি জানতেন, ধর্মবিরুদ্ধ কাজ কচ কখনও করবেন না। অবশ্যই দেবযানীর প্রতি শুক্রাচার্যের অপরিসীম স্নেহ ছিল। তিনি দেবযানীর জন্যেও কচকে বারংবার জীবিত করে তুলেছিলেন। কিন্তু তিনি কখনও কচের কাছে প্রতিদান চাননি। দেবযানীর প্রেম যে ব্যর্থ হবে—একথা শুক্রাচার্য জানতেন। তিনি জানতেন যে দেবগুরু ও দৈত্যগুরুর বৈবাহিক সম্বন্ধ অসম্ভব। কিন্তু কন্যার প্রেমের মূল্য পিতা হিসাবে যতটুকু দেওয়া সম্ভব, কচকে বারবার জীবিত করে, তা তিনি দিয়েছেন। দেবযানী প্রেম-কাতরা নারী। তাঁর প্রেম স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। কুণ্ঠাহীন কণ্ঠে তিনি সেই প্রেম পিতাকে জানিয়েছেন। কচকে পাণিগ্রহণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হবার পর তিনি কালভুজঙ্গিনীর মতোই কচকে দংশন করেছেন। তাঁর এতদিনের শিক্ষাকেই মিথ্যা করে দিয়েছেন। কিন্তু কচের অভিশাপ তার ক্ষেত্রে ফলেছিল। ঋষিপুত্র নয়, ব্রাহ্মণ-তনয় নয়, পুরু বংশের আদিপুরুষ যযাতিকে বিবাহ করে তাকে ক্ষত্রিয়াণী হতে হয়েছিল এবং তাদের বংশই যদুবংশ নামে খ্যাত ছিল।

আধুনিক ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিদায়-অভিশাপ নাট্যকাব্যে কচ ও দেবযানীর আদ্যন্ত কাহিনি গ্রহণ করেননি। শুধু বিদায়কালীন কাহিনিটুকু গ্রহণ করেছিলেন। রোমান্টিক কবি-কল্পনার সাহায্যে শুক্রাচার্যের আশ্রয়ে থাকা কচকে দেবযানী আশ্রমিক জীবনের যে বর্ণনা দিয়েছে, প্রতিটি ঘটনার মধ্যে আপন উপস্থিতিকে যেভাবে তুলে ধরেছে, তার অনবদ্য কাল্পনিক রূপদান করেছেন। বিদায়-অভিশাপ নাট্যকাব্যে অভিশাপ দিয়েছেন দেবযানী, কচ দিয়েছেন আশীর্বাদ। কচ সেখানে দেবযানীকে বলেছেন—

আমি বর দিনু দেবী, তুমি সুখী হবে।

ভুলে যাবে সর্ব গ্লানি বিপুল গৌরবে।

কিন্তু মহাভারতে কচ দেবযানীকে অভিসম্পাত করেছিলেন। তার কারণও ছিল। যাদব বংশের প্রবহমানতা, তার রক্ত সংমিশ্রণ—ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়-অপ্সরা মিলনের মধ্য দিয়েই যে এই বংশধারা এগিয়ে চলেছিল—তা পাঠকের সামনে তুলে ধরার দায়ও ব্যাসদেবের ছিল। এই বংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষরূপে আবির্ভাব ঘটল, ভগবান কৃষ্ণের। ভূমিকায় বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত কচ দেবযানীকে যে অভিশাপ দিয়েছিলেন, তারই ফলে রাজা যযাতির সঙ্গে দেবযানীর বিবাহ হয় এবং যদুবংশের সৃষ্টি হয়। আশীর্বাদ না দিয়েও কচ গুরুপ্রণামী দিয়েছিলেন।


দুষ্মন্তের ভরতকে গ্রহণ—ভরত বংশের প্রতিষ্ঠা

মহাত্মা পুরুর বংশে জন্মগ্রহণকারী ঈলিন বিশ্ববিজয়ী সম্রাট ছিলেন। ঈলিন রথন্তরী নাম্নী এক রমণীকে ভার্যারূপে গ্রহণ করেছিলেন। সেই রথন্তরীর গর্ভে ঈলিনের জ্যেষ্ঠপুত্র দুষ্মন্তের জন্ম হয়। দুষ্মন্ত যুদ্ধে দুর্জয় রাজশ্রেষ্ঠ হিসাবে পরিচিত হয়েছেন। দুষ্মন্তের ঔরসে লক্ষণার গর্ভে জনমেজয় নামে এক পুত্র জন্মগ্রহণ করে। আর দুষ্মন্ত থেকেই শকুন্তলার গর্ভে ভরত নামে অন্য একটি পুত্রের জন্ম হয়। সেই ভরত থেকেই ভরতবংশের বিশাল যশোরাশি বিস্তীর্ণ হয়েছে এবং ভরতের রাজধানী ভারতবর্ষ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

পুরুর বংশরক্ষক বলবান দুষ্মন্ত রাজা চতুঃসমুদ্র বেষ্টিত পৃথিবীর রাজা ছিলেন। যুদ্ধ-বিজয়ী রাজা দুষ্মন্ত পৃথিবীর পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ—এই চারটি অংশ সমস্তই ভোগ করতেন এবং সমুদ্র সন্নিহিত দেশগুলিও শাসন করতেন। দুষ্মন্ত রাজার রাজত্বকালে কোনও লোকই বর্ণসংকর জন্মাত না। কৃষিক্ষেত্ৰকৰ্ম বা খনি আবিষ্কার করত না কিংবা কোনও পাপকার্য করত না। তারা ধর্মানুষ্ঠান করত এবং তার দ্বারা ধর্ম ও অর্থ লাভ করত। দুষ্মন্ত রাজা হলে, চোরের ভয় থাকত না, রোগ হত না। কোনও বিপদ না দেখা দেওয়ায় মানুষের শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করার প্রয়োজন হত না। মানুষ আপন আপন বর্ণ অনুযায়ী কাজ করত। ধর্মপালন করত। দুষ্মন্তের শাসনে প্রজারা পরম সুখে বাস করত। যথাসময়ে বর্ষণ হত। শস্য সকল সুস্বাদু ছিল। পৃথিবী রত্নে পরিপূর্ণ ছিল, গোরু প্রভৃতি পশু যথেষ্ট পরিমাণে ছিল; ব্রাহ্মণগণ আপন আপন কার্যে নিরত ছিলেন; মিথ্যা ব্যবহার করতেন না। প্রজারা দুষ্মন্তের রাজ্যে নির্ভয়ে বাস করত।

অদ্ভুত বলবান ও বজ্রতুল্য দৃঢ়শরীর যুবক দুষ্মন্ত দুই হাতে জল ও বন প্রভৃতির সঙ্গে মন্দর পর্বত তুলে নিয়ে বহন করতে পারতেন। তিনি গদাযুদ্ধ, সর্বপ্রকার অস্ত্র সঞ্চালন, হাতির পিঠে ও ঘোড়ার পিঠে চড়ার ব্যাপারে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন, বলে তিনি ছিলেন বিষ্ণুর সমান, তেজে সূর্যের সমান, ধৈর্যে সমুদ্রের সমান এবং সহিষ্ণুতায় পৃথিবীর সমান। তিনি সকলের প্রিয় ছিলেন। নগরবাসী ও দেশবাসী লোক তাঁর প্রতি প্রসন্ন ছিল। ধর্মসঙ্গত ব্যবহারে সকল লোককে সন্তুষ্ট রেখে তিনি দেশ শাসন করতেন।

মহাবীর দুষ্মন্ত কোনও এক সময়ে প্রচুর সৈন্য ও বাহন নিয়ে, হস্তী ও অশ্বসমূহে পরিবেষ্টিত হয়ে, মৃগয়া করার জন্য গভীর বনে প্রবেশ করেছিলেন। সেই সময়ে অতি সুন্দর হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিক—চতুরঙ্গ সৈন্য সঙ্গে নিয়ে এবং তরবারি, শক্তি, গদা, মুষল, কুন্ত ও তোমরধারী যোদ্ধাগণে পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি চলতে লাগলেন। তখন যোদ্ধাদের সিংহনাদ, শঙ্খ ও দুন্দুভিধ্বনি, হস্তীর বৃংহিত শব্দ, রথচক্রের শব্দ, নানা বেশধারী ও নানাবিধ অস্ত্রধারী বীরগণের কণ্ঠধ্বনি, অশ্বের হ্রেষারব ও বীরগণের সিংহনাদ ও বাহু চাপড়ানোর শব্দে ভয়ংকর কোলাহল হতে লাগল।

পুরস্ত্রীরা অট্টালিকার উপরে উঠে, অপূর্ব শোভাধারী দুষ্মন্তকে দেখতে লাগল। শক্ৰহন্তা ও ইন্দ্রতুল্য সেই রাজাকে দেখে তাদের সাক্ষাৎ ইন্দ্র বলেই মনে হতে লাগল। রাজার বহু প্রশংসা করে স্ত্রীলোকেরা তাঁর মাথায় পুষ্প বর্ষণ করতে লাগল। ব্রাহ্মণেরা এসে তাঁর স্তব করতে লাগলেন। আনন্দিত রাজা মৃগয়া করার জন্য বনের দিকে যেতে লাগলেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রগণ তাঁর পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন। বহুদূর পর্যন্ত তাঁরা রাজার পিছনে পিছনে গেলেন। তারপর রাজার অনুমতি নিয়ে তাঁরা ফিরে গেলেন। তারপরে রাজা গরুড়তুল্য উজ্জ্বল রথে আরোহণ করে, তার শব্দে ভূমণ্ডল ও গগনমণ্ডল পরিপূর্ণ করলেন এবং যেতে যেতে নন্দনকাননের মতো একটি বন দেখতে পেলেন। সে বনে বেল, আকন্দ, খদির, কদ্বেল ও ধব প্রভৃতি বৃক্ষ ছিল; পর্বত থেকে পাথর পড়ে প্রায় সকল জায়গাই উঁচু ও নিচু হয়েছিল। তাতে মানুষ ছিল না; আর সে বন সিংহ, হরিণ ও অন্যান্য ভয়ংকর জন্তুগণে ব্যাপ্ত ছিল এবং বহুযোজন বিস্তৃত ছিল। নরশ্রেষ্ঠ রাজা দুষ্মন্ত ভৃত্য, সৈন্য ও বাহনদের সঙ্গে থেকে নানাবিধ পশু বধ করে, সেই বনটাকে তোলপাড় করে তুলেছিলেন। তীক্ষ্ণ বাণে তিনি বহুতর ব্যাঘ্রকে নিপাতিত করতে লাগলেন। তিনি দূরের পশুদের তীক্ষ্ণ শরে বধ করতে লাগলেন, আর কাছের পশুদের তরবারি দ্বারা ছেদন করতে লাগলেন। মহাশক্তিশালী অসাধারণ বিক্রমী, গদা ক্ষেপণে অভিজ্ঞ রাজা দুষ্মন্ত বন্য পশুদের বধ করতে করতে সমস্ত বনটিতেই তোলপাড় সৃষ্টি করতে লাগলেন। সেই বনে যুথপতিকে বধ করায় হরিণযূথ পালাতে লাগল। হরিণযূথ ভয়বশত ইতস্তত আর্তনাদ করতে লাগল। কতগুলি হরিণ পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে, জলপিপাসায় শুষ্ক নদীতে গিয়ে, জল না পেয়ে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল। কতগুলি পরিশ্রান্ত হরিণ ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হয়ে যে মুহূর্তে ভূতলে পড়ল, অমনি ক্ষুধার্ত নররূপী ব্যাঘ্রগণ সেগুলি ভক্ষণ করতে লাগল। কতগুলি সৈন্য হাড় থেকে হরিণের মাংস বার করে নিয়ে আগুনে ঝলসে নিয়ে তা ভক্ষণ করতে লাগল। অস্ত্রের আঘাতে বিশাল বন্য হস্তীরা ক্ষতবিক্ষত হয়ে শুঁড় গুটিয়ে বেগে পলায়ন করতে লাগল। তাদের দেহ থেকে প্রচুর পরিমাণে রক্ত ঝরতে লাগল। এই অবস্থায় তারা বিষ্ঠা ও মূত্রত্যাগ করতে করতে বহুতর মানুষকে নিষ্পেষিত করে ছুটে চলল। রাজা সিংহগুলিকে মেরে ফেললেন; এই অবস্থায় সে বনটা নিহত পশুতে পরিপূর্ণ হয়ে গেল।

অত্যন্ত শক্তিশালী রাজা পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত হয়ে, তৃষ্ণার্ত অবস্থায় একাকী সেই বনের প্রান্তে গিয়ে এক বিশাল প্রান্তরে উপস্থিত হলেন। সে প্রান্তরও দ্রুত অতিক্রম করে রাজা অন্য এক বনে উপস্থিত হলেন। সে বনটির ভিতরে মুনিদের আশ্রম ছিল। শীতল বাতাস বইছিল, ঝিঁঝি ডাকছিল, নানাবিধ পাখি মধুর রব করছিল, কোকিলের কুহুধ্বনি শোনা যাচ্ছিল, গাছগুলি ফুলে ফুলে পরিপূর্ণ ছিল। ভ্রমরগণ ফুলে ফুলে মধুপান করছিল—বহুতর বিশাল গাছের ছায়ায় বনভূমি মনোরম ছিল, সবুজ ঘাসে বনভূমি পরিপূর্ণ ছিল। সে বনে এমন কোনও গাছ ছিল না, যাতে ফুল ধরেনি। এমন কোনও গাছ ছিল না যাতে ফল ধরেনি এবং কোনও গাছেই কাঁটা ছিল না। সকল ঋতুতেই গাছগুলিতে ফুল ধরত, সেই ফুল যেন বনভুমিকে গয়না পরিয়ে দিয়েছিল। রাজা ধনুধারণ করেই সে মনোরম বনে প্রবেশ করলেন। ফুলেভরা গাছগুলি তার মাথায় পুষ্পবর্ষণ করতে লাগল। বাতাসে গাছের শাখাগুলি বারবার আন্দোলিত হয়ে রাজার মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগল। পাখিরা আনন্দে মুখর হয়ে রব করতে লাগল। গাছগুলি ফুলের ভারে অবনত হয়ে পড়েছিল কিন্তু ফুলগুলি আবার আকাশের দিকে উঁচু উঁচু হয়ে আপন যৌবনের স্পর্ধা ঘোষণা করছিল, আর মধুলোভী ভ্রমরগণ সে ফুলের চারপাশে গুনগুন রব করে ঘুরছিল। সে বনে বহু স্থানে লতামণ্ডপ ছিল। সে লতামণ্ডপগুলিতেও রাশি রাশি ফুল ফুটেছিল। আনন্দময় সেই স্থান দেখে রাজা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। কতকগুলি বৃক্ষ ছিল ইন্দ্ৰধ্বজের মতো দীর্ঘ। তার শাখাগুলি পরস্পর সংযুক্ত ছিল এবং সেই শাখাগুলিও পুষ্পে পরিপূর্ণ ছিল। সিদ্ধ, চারণ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, বানর, কিন্নর ইত্যাদি সকল সময়ে সেই বনে বিচরণ করত। সুখস্পর্শ, শীতল ও সুগন্ধী পুষ্পরেণুবাহী বাতাস ইতস্তত বিচরণ করে যেন রমণেচ্ছায় সেই বৃক্ষের তলায় উপস্থিত হত।

রাজা দুষ্মন্ত এমন সুন্দর, নদীতীরজাত, স্বভাবসুকোমল অথচ ইন্দ্ৰধ্বজের ন্যায় উচ্চ বনটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি সেই বনটি দেখতে দেখতে তার মধ্যে একটি অতি মনোহর আশ্রম দেখতে পেলেন। সে আশ্ৰম পাখির কূজনে মুখরিত ছিল। অজস্র বৃক্ষের মাঝখানে ছিল আশ্রমটি। হোমাগ্নি জ্বলছিল। ইন্দ্রিয়জয়ী বালখিল্যগণ ও অন্যান্য মুনিরা বিচরণ করছিলেন। অনেকগুলি হোমগৃহ ছিল, সেগুলিতে ফুলের আস্তরণ ছিল। সেই আশ্রমটি পবিত্র ও নির্মল মালিনী নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। তার পাশ দিয়ে দীর্ঘ ও বিস্তৃত নদী প্রবাহিত হচ্ছিল। তপস্বীরা স্নান করতে সেখানে যাতায়াত করছিলেন এবং ব্যাঘ্র প্রভৃতি হিংস্র জন্তুরাও শান্ত স্বভাবের ছিল। দেখে রাজা দুষ্মন্ত অশেষ আনন্দ লাভ করলেন। রাজা দুষ্মন্ত দেখলেন পুণ্যসলিলা মালিনী নদী জননীর মতো সেই আশ্রমকে রক্ষা করছে। চক্রবাক পক্ষীযূথ নদীতীরে বিচরণ করছে। স্রোতের উপর ফুলের মতো ফেনা ভাসছে, তীরে কোথাও কিন্নরগণ বাস করছে, কোথাও বানর ও ভল্লুকেরা বাস করছে। কোথাও মত্ত হস্তী ভয়ংকর ব্যাঘ্র এবং ভীষণ সর্প একত্রে বাস করছে। চারপাশে পবিত্র বেদপাঠের শব্দ ভেসে আসছে।

সেই মালিনী নদীর তীরে মহর্ষি কন্বমুনির মনোহর আশ্রম। সেখানে অন্য মহর্ষিরা অবস্থান করছেন। মালিনী নদী পাদদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, আশ্রমের প্রান্তদেশগুলিও সুন্দর। এই সমস্ত দেখে রাজা সেই আশ্রমে প্রবেশ করতে ইচ্ছা করলেন। রাজা কুবেরের উদ্যানের মতো সেই মনোহর উদ্যানে প্রবেশ করলেন। সেখানে ময়ুরেরা পাখনা তুলে নাচছিল। মহর্ষি কণ্বকে দেখার জন্য রাজা সমস্ত সৈন্যবাহিনী চতুরঙ্গ-অনুচর সকলকে তপোবনের দ্বারদেশে রেখে রাজা বললেন, “কামক্রোধাদিশূন্য মহর্ষি কণ্বকে দেখার জন্য আমি সেখানে যাব, তোমরা এইখানেই আমার ফিরে আসার প্রতীক্ষা করো। তপোবনে প্রবেশ করলেই রাজার ক্ষুধা ও পিপাসা দূর হল। রাজা রাজচিহ্ন, ছত্র, মুকুট পরিত্যাগ করে, পুরোহিত ও মন্ত্রীদের সঙ্গে সেই সুন্দর আশ্রমে প্রবেশ করলেন। রাজা দীর্ঘজীবী ও মূর্তিমান তপঃপুঞ্জের ন্যায় বিরাজমান মহর্ষি কণ্বকে দেখতে চাইলেন। আনন্দিত রাজা উৎফুল্ল নয়নে ব্ৰহ্মলোকের মতো সেই আশ্রমটিকে দেখতে লাগলেন। ঋগ্বেদী ব্রাহ্মণেরা পদ ও ক্রম অনুসারে ঋগ্বেদ পাঠ করছিলেন। যজ্ঞবিদ্যায় পারদর্শী ও অন্যশাস্ত্রাভিজ্ঞ যজুর্বেদী ব্রাহ্মণগণ ও মধুর সামগানকারী ব্রাহ্মণগণ সেই সভা আলোকিত করে রেখেছিলেন। ভারুণ্ড নামক সামবেদের অংশ এবং অথর্ব বেদের শেষাংশ পাঠ করবার সময়ে ব্রতনিষ্ঠ মুনিগণের সেই স্বরে আশ্রমটি তখনও মুখরিত ছিল। ব্রাহ্মণদের উদাত্ত মন্ত্রোচ্চারণে আশ্রমটি দ্বিতীয় ব্রহ্মলোকের মতো বোধ হচ্ছিল।

যজ্ঞবিধান, যজ্ঞাঙ্গের পরিপাটি, শিক্ষাশাস্ত্র, ন্যায়দর্শন, উপনিষদ এবং বেদশাস্ত্রে পারদর্শী, আত্মা সম্পর্কিত বিধানে পারদর্শী ধ্যানাদিকার্যাভিজ্ঞ, মুক্তি সাধক কর্মনিরত ব্রাহ্মণগণ পঞ্চাঙ্গ অধিকরণে বিশেষাভিজ্ঞ, ব্যাকরণ, ছন্দ ও নিরুক্ত ও জ্যোতিষ শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ, রসায়নাভিজ্ঞ, আয়ুবেদবিৎ, পশু-পক্ষীর রবে অর্থজ্ঞ এবং বিশাল বিশাল পুস্তকধারী ব্রাহ্মণগণ এবং অন্যান্য শাস্ত্রে সুনিপুণ ব্রাহ্মণগণ যে সকল আলোচনা করছিলেন এবং তাদের সঙ্গে মিলে প্রধান প্রধান নাস্তিকগণ যে আলাপ করছিলেন, রাজা সে সমস্ত শুনলেন। শত্রুহন্তা দুষ্মন্ত ভিন্ন ভিন্ন স্থানে দেখতে পেলেন যে কেউ কেউ ধ্যান, কেউ কেউ জপ ও কেউ কেউ হোম করছেন।

নানাপ্রকার সুন্দর সুন্দর আসন যত্নপূর্বক পেতে রাখা হয়েছে। দেখে রাজা অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। ব্রাহ্মণেরা দেবতার ঘরগুলিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখেছেন। রাজার মনে হল তিনি ব্রহ্মলোকে উপস্থিত হয়েছেন। মহর্ষি কণ্বের তপস্যায় সুরক্ষিত, মঙ্গলজনক সেই আশ্রমটি দেখে রাজার যেন আশ মিটছিল না। রাজা, মন্ত্রী ও পুরোহিতের সঙ্গে মিলে মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে প্রবেশ করলেন। সেখানে মহাব্রতী ও মহাতপস্বী ঋষিরা অবস্থান করছিলেন। ফলে স্থানটি পবিত্র, মনোহর ও অত্যন্ত মঙ্গলজনক মনে হচ্ছিল। তখন রাজা সেই পুরোহিত ও মন্ত্রীদের পরিত্যাগ করে একাকী আশ্রম মধ্যে প্রবেশ করলেন কিন্তু কোথাও মহর্ষি কণ্বের দেখতে পেলেন না। মহর্ষিকে দেখতে না পেয়ে এবং আশ্রম শূন্য দেখে রাজা উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “এখানে কেউ আছ কি?” রাজার সেই কণ্ঠস্বর শুনে, মূর্তিমতী লক্ষ্মীর মতো একটি কন্যা আশ্রম থেকে বেরিয়ে এল। নীলোৎপলের মতো কৃষ্ণবর্ণা সেই কন্যাটি রাজা দুষ্মন্তকে দেখেই সম্মান করে সত্বর বলল, “আপনার আসার পথ সুগম হয়েছে তো?” সেই কন্যাটি রাজা দুষ্মন্তকে আসন, পাদ্য ও অর্ঘ্য দান করে প্রশ্ন করল, “আপনি সুস্থ আছেন তো? রাজ্যের মঙ্গল তো?” যথাবিধানে সম্মান করে এবং আরোগ্যের বিষয় জিজ্ঞাসা করে কন্যাটি মৃদু হাস্য করতে করতেই যেন প্রশ্ন করল, “আমি কী করতে পারি, বলুন।”

যথাবিধানে সম্মানিত হয়ে রাজা মধুরভাষিণী ও সর্বাঙ্গসুন্দরী সেই কন্যাটিকে দেখে বললেন, “ভদ্রে! আমি মহাত্মা কণ্বের সেবা করবার জন্য এসেছি। সুন্দরী, মহর্ষি কোথায় গিয়েছেন আমাকে বলুন।” শকুন্তলা বললেন, “আমার পিতা ফল আহরণ করার জন্য গিয়েছেন; আপনি একটুকাল অপেক্ষা করুন; তিনি আসলেই তাঁকে দেখতে পাবেন।” রাজা তখন কণ্বমুনির দেখা পেলেন না, এদিকে শকুন্তলাও তাঁকে প্রতীক্ষা করতে বলছেন। সুতরাং রাজা অপলকে শকুন্তলাকে দেখতে লাগলেন—

অপশ্যমানস্তমৃষিং তথা চোক্তস্তয়া চ সঃ।
তাং দৃষ্ট্বা চ বরারোহাং শ্রীমতীং চারুহাসিনীম্‌ ॥
বিভ্রাজমানাং বপুষা তপসা চ দমেন চ।
রূপযৌবনসম্পন্নামিত্যুবাচ মহীপতিঃ ॥ আদি: ৮৫: ১০-১১ ॥

“শকুন্তলার নিতম্ব দুটি পরম সুন্দর, শরীরের কান্তিও মনোহর; হাস্য সুমধুর, রূপ আছে, যৌবনও এসেছে এবং শরীরের গুণে বিশেষ শোভা পাচ্ছেন!” অথচ তপস্যা থাকায় ইন্দ্রিয় সংযম এসেছে ইত্যাদি দেখে রাজা বললেন, “সুনিতম্বে! আপনি কে? কার কন্যা? কেনই বা বনে এসেছেন? সুন্দরী। আপনি এত রূপবতী ও গুণবতী হয়ে কোথা থেকে এখানে এলেন? আপনি দেখা দিয়েই আমার মন অপহরণ করেছেন। সুতরাং আমি আপনার সম্পূর্ণ পরিচয় জানতে চাই; আপনি তা বলুন।”

রাজার কথা শুনে কন্যাটি ঈষৎ হেসে মধুর স্বরে তাঁকে বলল, “মহারাজ, তপস্বী, ধৈর্যশীল, ধার্মিক, উদারচেতা এবং মাহাত্ম্যশালী কণ্বের কন্যা আমি, লোকেরা তাই বলে থাকে।” দুষ্মন্ত বললেন, “ভদ্রে! জগতের সম্মানিত ভগবান কণ্বমুনি ঊর্ধ্বরেতা। স্বয়ং ধর্মও আপন কর্তব্য থেকে ভ্রষ্ট হতে পারেন; কিন্তু চিরব্রহ্মচারী কখনও কর্তব্য থেকে ভ্রষ্ট হতে পারেন না। সুতরাং আপনি কী করে তাঁর কন্যা হলেন? এই বিষয়ে আমার গুরুতর সন্দেহ জন্মেছে; আপনি আমার সেই সন্দেহ দূর করুন।”

শকুন্তলা বললেন, “মহারাজ এই বৃত্তান্ত যেভাবে আমার কর্ণগোচর হয়েছিল, যেভাবে আমার জন্ম হয়েছিল এবং যেভাবে আমি কন্বমুনির কন্যা হয়েছি, তা আপনি বিশদভাবে শুনুন। কোনও সময়ে এক ঋষি আশ্রমে এসে আমার জন্মের বিষয় প্রশ্ন করলে মহর্ষি কণ্ব তাঁকে যা বলেছিলেন, তা আপনাকে আমি জানাচ্ছি।” কণ্ব বলেছিলেন—

পূর্বকালে মহর্ষি বিশ্বামিত্র গুরুতর তপস্যা করছিলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্র তাতে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হন। তপস্যার প্রভাবে বলবান বিশ্বামিত্র তাকে ইন্দ্ৰত্বপদ থেকে বিচ্যুত করতে পারেন, এই ভেবে ভীত হয়ে দেবরাজ স্বর্গের অপ্সরাশ্রেষ্ঠ মেনকাকে ডেকে বলেন, “মেনকা তুমি নিজের অলৌকিক গুণে স্বর্গের অপ্সরাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং কল্যাণী, তোমাকে যা বলব, আমার কল্যাণের জন্য তা করো। সূর্যের তুল্য তপস্বী বিশ্বামিত্রকে ভয়ংকর তপস্যা করতে দেখে আমার মন উদ্বিগ্ন হয়েছে। তাঁর তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য তোমাকে অনুরোধ করছি। তিনি যাতে আমাকে ইন্দ্ৰত্বপদ থেকে বিচ্যুত করতে না পারেন, তুমি গিয়ে তাঁকে প্রলুব্ধ করো। তাঁর তপস্যার বিঘ্ন ঘটিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করো। তুমি অনুপম সুন্দরী। রূপ ও যৌবনের অনুরূপ কোমল অঙ্গভঙ্গি, মন্দ হাস্য এবং মধুর বাক্য দ্বারা তাঁকে লুব্ধ করে তাঁর তপস্যা ভঙ্গ করো।”

মেনকা বলল, “মহাত্মা বিশ্বামিত্র যে মহাতেজস্বী এবং অত্যন্ত কোপনস্বভাবা, তা আপনার অজানা নয়। যে মহাত্মার তেজ, তপস্যা ও কোপের প্রভাবে আপনি দেবরাজ উদ্বিগ্ন, তাঁর প্রভাবে আমি অধিকতর উদ্বিগ্ন হব না কেন? যিনি মহাত্মা বশিষ্ঠের প্রিয়তম পুত্রদের বিনষ্ট করেছেন এবং যিনি প্রথমে ক্ষত্রিয় বংশে জন্মের পরে বলপূর্বক ব্রাহ্মণ হয়েছেন, যিনি স্নানাদি করবার জন্য আশ্রমের কাছে অগাধজলসম্পন্ন দুর্গম এক নদী নির্মাণ করেছেন, যে পবিত্র নদীকে লোকে ‘কৌশিকী’ নামে জানে। পূর্বকালে দুর্ভিক্ষের সময়ে ধার্মিক রাজা ব্যাধ হয়েও যে মহাত্মার ভার্যাবর্গকে ভরণ-পোষণ করেছিলেন। দুর্ভিক্ষ অতীত হলে পুনরায় আশ্রমে এসে যিনি সেই কৌশিকী নদীর নাম করেছিলেন—‘পারা।’ যিনি সন্তুষ্ট হয়ে নিজেই ত্রিশঙ্কুর যাজন করেছিলেন এবং দেবরাজ! আপনি স্বয়ং যাঁর ভয়ে আত্মস্থ হবার জন্য সোমরস পান করেছিলেন। যিনি ক্রুদ্ধ হয়ে শ্রবণা প্রভৃতি নূতন নক্ষত্র সৃষ্টি করে, তার দ্বারা আর একটি নক্ষত্রলোক সৃষ্টি করেছিলেন। শাপগ্রস্ত রাজা ত্রিশঙ্কু যখন চিন্তা করছিলেন, রাজর্ষি বিশ্বামিত্র আমাকে কীভাবে ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের শাপ থেকে রক্ষা করবেন, তখন বিশ্বামিত্র কিন্তু তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। দেবতারা অবজ্ঞা করে যজ্ঞাঙ্গ বিনষ্ট করলেন, কিন্তু সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের বিধানে সমর্থ তেজস্বী বিশ্বামিত্র অন্য যজ্ঞাঙ্গ সৃষ্টি করেছিলেন। বশিষ্ঠকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বিশ্বামিত্র ত্রিশঙ্কু রাজাকে স্বর্গে প্রেরণ করেছিলেন।

“দেবরাজ, এতগুলি অদ্ভুত কার্য যিনি করেছিলেন, সেই বিশ্বামিত্র ক্রুদ্ধ হয়ে যাতে আমাকে দগ্ধ না করেন, আপনি তার ব্যবস্থা করুন। যিনি আপন তেজে ত্রিজগৎ দগ্ধ করতে পারেন, পদাঘাতে পৃথিবীকে বিচলিত করতে পারেন। মহামেরু পর্বতকে ক্ষুদ্র পর্বত করে দিতে পারেন এবং দিক সকলকেও হঠাৎ পরিবর্তিত করে দিতে পারেন। মহাতপস্বী, প্রজ্বলিত অগ্নির মতো অবস্থিত এবং জিতেন্দ্রিয় সেই তপস্বীকে আমার মতো অতি তুচ্ছ রমণী কী করে স্পর্শ করবে? দেবরাজ! যার মুখে অগ্নি রয়েছেন, নয়নের তারা দুটি সূর্য ও চন্দ্রের মতো এবং যাঁর জিহ্বা যমের মতো অবস্থিত, তপস্যায় প্রজ্বলিত সেই বিশ্বামিত্রকে আমার মতো রমণীই বা কীভাবে স্পর্শ করবে? যম, চন্দ্র, মহর্ষিগণ, সাধ্যগণ, বিশ্বদেবগণ এবং বালখিল্য ঋষিগণ—এঁরাও যার প্রভাবের ভয়ে ভীত—আমার মতো তুচ্ছ নারী তাঁকে ভয় পাবে না কেন? দেবরাজ আপনি আদেশ করলে আমাকে বিশ্বামিত্রের কাছে যেতেই হবে। অতএব আপনি আমার রক্ষার বিষয় স্থির করুন। যাতে আমি রক্ষিত অবস্থায় আপনার কার্য সম্পাদন করতে সমর্থ হই। আমি যখন বিশ্বামিত্রের কাছে গিয়ে নৃত্যরত অবস্থায় খেলা করব, তখন যেন বায়ু আমার অঙ্গ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে বস্ত্র সরিয়ে দেন এবং আপনার আদেশে কামদেব আমাকে যথেষ্ট সহায়তা করেন। আর, আমি যখন মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে প্রলুব্ধ করতে থাকব, তখন বন থেকে যেন যথেষ্ট পরিমাণে সুগন্ধ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকে।” মেনকার কথা শুনে দেবরাজ ইন্দ্র বায়ু ও কামদেবকে মেনকার সহচর হবার আদেশ দিলেন। তখন মেনকা বায়ুর সঙ্গে বিশ্বামিত্রের আশ্রম উদ্দেশে যাত্রা করল! সুন্দর নিতম্বা মেনকা বিশ্বামিত্রের আশ্রমে উপস্থিত হয়ে ভয়চকিত চিত্তে দেখল—তপস্যার পুর্বেই সব পাপ নষ্ট হয়ে গেলেও বিশ্বামিত্র সেই তপস্যাই করছেন।

তারপর মেনকা বিশ্বামিত্রকে নমস্কার করে তাঁর চারপাশে নৃত্য করতে আরম্ভ করল। তার বস্ত্রখানি চন্দ্রকিরণের মতো সূক্ষ্ম ও শুভ্রবর্ণ ছিল। বায়ু তো অপহরণ করলেন। তখন সে লজ্জাবশত বায়ুকে যেন নিন্দা করতে থাকল; এদিকে বিশ্বামিত্র তাকে ভাল করে দেখতে লাগলেন; তবুও সে বস্ত্রখানি গ্রহণের জন্য বিশ্বামিত্রের আরও কাছে এগিয়ে গেল। তখন বিশ্বামিত্র দেখলেন, মেনকা একেবারে উলঙ্গ, তার সমস্ত অঙ্গ দেখা যাচ্ছে তার রূপযৌবনের কোনও নিরূপণ করা যাচ্ছে না। সে অপরূপা সুন্দরী, তার দেহের কোনও অঙ্গের নিন্দা করা যায় না এবং যে যেন সেই বস্ত্রখানি নেবার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত ও সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। বিশ্বামিত্র সেই অসাধারণ রূপ দেখে, কামাতুর হয়ে, তখন তার সঙ্গে রমণ করার ইচ্ছা করলেন। তিনি সেই সম্পূর্ণা উলঙ্গা মেনকাকে আহ্বান করলেন, মেনকাও সোৎসাহে তাঁর নিকটে এসে বাহুবন্ধনে ধরা দিলেন। তাঁরা দু’জনে দীর্ঘকাল সেখানে রমণ করতে থাকলেন এবং সেই দীর্ঘ বৎসরটি একটি দিনের ন্যায় অতি দ্রুত অতিবাহিত হল। বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গ হল। কিন্তু বিশ্বামিত্র মেনকা ভিন্ন অন্য কোনও চিন্তাও করতে পারলেন না। তারপর একদিন বিশ্বামিত্র মালিনী নদীর কাছে হিমালয়ের মনোহর সমতলভূমিতে মেনকার গর্ভে শকুন্তলাকে উৎপাদন করলেন। মেনকা বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গে কৃতকাম হয়ে মালিনী নদীর কাছে জন্মমাত্র সেই কন্যাটিকে পরিত্যাগ করে তৎক্ষণাৎ ইন্দ্রের সভায় চলে গেল। বিশ্বামিত্রও সেই স্থান ত্যাগ করে চলে গেলেন।

সিংহ-ব্যাঘ্র পরিপূর্ণ নির্জন বনমধ্যে সেই সদ্য জাতিকাকে শায়িত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে, পক্ষীগণ এসে তাকে সকলদিকে পরিবেষ্টন করে রইল। মাংসলভী জন্তুরা বনের ভিতরে সেই বালিকাটিকে পাছে ভক্ষণ করে ফেলে, এই কারণেই সেই পক্ষীগণ এসে, কন্যাটিকে রক্ষা করছিল। সেই সময়ে মহর্ষি কণ্ব স্নান করতে নদীতে যাচ্ছিলেন—তিনি দেখলেন মনোহর নির্জন বনের ভিতরে সেই কন্যাটি শুয়ে আছে। আর পক্ষীগণ তাকে বেষ্টন করে অবস্থান করছে। মহর্ষি কন্যাটিকে তুলে আশ্রমে এনে আপন কন্যার মতো লালন-পালন করতে লাগলেন। যেহেতু নির্জন বনের মধ্যে পক্ষীগণ একে রক্ষা করেছিল, তাই মহর্ষি কন্যাটির নাম দিলেন ‘শকুন্তলা’। শরীরোৎপাদক, প্রাণরক্ষক ও যাঁর অন্ন ভোজন করে—ধর্মশাস্ত্রে এই তিনজনকে ক্রমিক পিতা বলা হয়।

আশ্রমে আগত ঋষির কাছে মহর্ষি কণ্ব এইভাবে শকুন্তলার কাহিনি বর্ণনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, “ব্রাহ্মণ, এইজন্যই আপনি শকুন্তলাকে আমার কন্যা বলে মনে করুন। অনিন্দ্যসুন্দরী শকুন্তলাও আমাকে এই জন্যই পিতা বলে মনে করে।” শকুন্তলা বললেন, “সেই ঋষির প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি কণ্ব আমার এই জন্মবৃত্তান্ত বলেছিলেন। মহারাজ আপনিও এইভাবেই আমাকে মহর্ষি কণ্বের কন্যা বলে জানবেন। আমি নিজের পিতাকে জানি না বলেই কণ্বকে পিতা বলে মনে করি। আমি আমার জন্মবৃত্তান্ত যেমন শুনেছিলাম, আপনার কাছে তেমনই বললাম।”

দুষ্মন্ত বললেন, “কল্যাণী তুমি যে কাহিনি বললে, তাতে সুস্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, তুমি ক্ষত্রিয়ের কন্যা। অতএব তুমি আমার ভার্যা হও; বলো আমি তোমার জন্য কী করব। সুন্দরী, সোনার হার, নানাবিধ বস্ত্র, সুবর্ণনির্মিত দুটি কুণ্ডল, নানাদেশীয় নির্দোষ ও সুন্দর মণি ও রত্ন বক্ষের ভূষণ এবং নানাবিধ মৃগচর্ম—এগুলি এখনই তোমার জন্য এনে দিচ্ছি। আর আজ হতে আমার সমস্ত রাজ্য তোমার হোক; তুমি আমার ভার্যা হও। সুন্দরী! তুমি গান্ধর্ব বিবাহ অনুসারে আমার ভার্যা হও। কেন না, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে গান্ধর্ব বিবাহই আট প্রকার বিবাহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।”

শকুন্তলা বললেন, “মহারাজ আমার পিতা ফল নিয়ে আসার জন্য একটু আশ্রমের বাইরে গেছেন; সুতরাং আপনি একটুকাল অপেক্ষা করুন। তিনি এসেই আমাকে আপনার হাতে দান করবেন। আমার পিতা সর্বদাই আমার নিয়ন্তা এবং পরম দেবতা; সুতরাং তিনি আমাকে যাঁর হাতে দেবেন, তিনিই আমার ভর্তা হবেন। বিবাহের পূর্বে পিতা রক্ষা করেন, যৌবনকালে ভর্তা রক্ষা করেন এবং বৃদ্ধকালে পুত্র রক্ষা করে; সুতরাং স্ত্রীলোক কোনও সময়েই স্বাতন্ত্র অবলম্বন করতে পারে না। ধার্মিক মহারাজ, আমার তপস্বী পিতাকে আমি অগ্রাহ্য করে অধর্মের অনুসরণপূর্বক কী করে পতি নির্বাচন করি?”

দুষ্মন্ত বললেন, “না না কল্যাণী তুমি একথা বোলো না। তোমার পিতা মহাতপস্বী এবং ইন্দ্রিয়দমনশীল।” শকুন্তলা বললেন, “ব্রাহ্মণের ক্রোধই অস্ত্র; কিন্তু তাঁরা অন্য অস্ত্র ধারণ করেন না। ইন্দ্র যেমন বজ্রদ্বারা অসুর বধ করে থাকেন, ব্রাহ্মণেরা তেমন ক্রোধ দ্বারা শত্রু বধ করে থাকেন। অগ্নি তেজ দ্বারা দগ্ধ করেন, সূর্য রশ্মিদ্বারা দগ্ধ করেন। রাজা দণ্ডদ্বারা দন্ধ করেন আর ব্রাহ্মণ ক্রোধ দ্বারা দগ্ধ করে থাকেন। ইন্দ্র বজ্র দ্বারা অসুর বধ করেন, ব্রাহ্মণ ক্রোধ দ্বারা শত্রু বধ করেন।” দুষ্মন্ত বললেন, “সুন্দরী আমার ইচ্ছা এই যে, তুমি আমাকে ভজন করো। কেন না, আমি তোমার জন্য এখানে রয়েছি এবং আমার মন তোমার জন্য অত্যন্ত আকুল হয়েছে। দেখো—মানুষ নিজেই নিজের বন্ধু এবং নিজেই নিজের গতি। সুতরাং তুমি ধর্ম অনুসারেই নিজেকে দান করতে পারো। ধর্মশাস্ত্র অনুসারে বিবাহ আট প্রকার হতে পারে। ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ। স্বায়ম্ভূব মনু যথাক্রমে এই বিবাহগুলির লক্ষণ বলে গেছেন। সুন্দরী, ব্রাহ্মণের পক্ষে প্রথম চারটি এবং ক্ষত্রিয়ের পক্ষে প্রথম ছ’টি বিবাহ প্রশস্ত। আর বৈশ্য ও শূদ্রের পক্ষে আসুরবিবাহও অধর্মজনক নয়। কিন্তু প্রথম পাঁচটি বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম, দৈব ও প্রাজাপত্য—এই তিনটি বিবাহ সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট; আর অপর দুটি, আর্য ও আসুর উক্ত তিনটি থেকে নিকৃষ্ট। ব্রাহ্মণ কখনও আসুর বিবাহ করবেন না। আর ব্রাহ্মণাদি সকল বর্ণই কখনও পৈশাচ বিবাহ করবেন না। এই বিধান অনুসারে সকলে বিবাহ করবেন, কেন না, এই ধর্মের পদ্ধতি। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে খাঁটি গান্ধর্ব বিবাহ বা খাঁটি রাক্ষস বিবাহ অথবা গান্ধর্ব-রাক্ষস উভয় লক্ষণ মিশ্রিত বিবাহ ধর্ম সঙ্গত বলে কর্তব্য। সুতরাং এ বিষয়ে তুমি কোনও আশঙ্কা কোরো না; কেননা, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তোমার প্রতি আমার অনুরাগ জন্মেছে; তুমিও আমার প্রতি অনুরক্ত হয়েছ। সুতরাং তুমি গান্ধর্ব বিবাহ অনুসারে আমার ভার্যা হতে পারো।’

শকুন্তলা বললেন, “পৌরবশ্রেষ্ঠ, যদি আপনার বক্তব্য ধর্মসঙ্গত হয় এবং যদি আমি নিজেকে দান করতে সমর্থ হই, তবে আমার প্রার্থনা শুনুন। আমি এই নির্জন স্থানে যা বলব, আপনি সে বিষয়ে আমার কাছে সত্য প্রতিজ্ঞা করুন; আমার গর্ভে আপনার যে পুত্র হবে, সে আপনি জীবিত থাকতেই যুবরাজ হবে এবং আপনার পরে মহারাজ হবে। মহারাজ! আপনি যদি আমার এ বক্তব্য স্বীকার করেন, তবে আমিও আপনাকে সত্য বলছি যে, আপনার সঙ্গে আমার সঙ্গম হোক।”

রাজা তখন কোনও বিবেচনা না করেই প্রত্যুত্তর করলেন যে “তাই হবে এবং আমি তোমাকে আপন রাজধানীতেই নিয়ে যাব। কারণ তুমি রাজধানীতেই বাস করার যোগ্যা; নিতম্বিনী। আমি তোমাকে একথা সত্য বলছি।” এই কথা বলে রাজা গান্ধর্ব বিধানে শকুন্তলার পাণিগ্রহণ করলেন, এবং তাঁর সঙ্গে সহবাস করলেন। তারপর বিদায় নেওয়ার কালে শকুন্তলার বিশ্বাস উৎপাদন করার জন্য বারবার বললেন—“সুন্দরী তোমার জন্য চতুরঙ্গিণী সেনা প্রেরণ করব এবং তারা তোমাকে রাজভবনে নিয়ে যাবে।”

রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলার কাছে এই প্রতিজ্ঞা করে মনে মনে কণ্বমুনির প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে প্রস্থান করলেন। মহাতপস্বী কণ্বমুনি ফিরে এসে তাঁর এই গান্ধর্ববিবাহ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। ভাবতে ভাবতে আপন রাজধানীতে প্রবেশ করলেন। কিছুকাল পরে মহর্ষি কণ্ব আশ্রমে ফিরলেন। শকুন্তলা লজ্জায় তাঁর কাছে গেলেন না। মহাতপস্বী ও দিব্যজ্ঞানী কণ্ব দিব্য চোখে সব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। শকুন্তলার বিষয় বুঝতে পেরে, সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “কল্যাণী তুমি আমার অনুমতি না নিয়ে আজ নির্জনে যে পুরুষসংসর্গ করেছ, তা তোমার ধর্মনাশক হয়নি। কেন না, কামী পুরুষ নির্জনে বিনা মন্ত্রে কামার্ত রমণীর যে পাণিগ্রহণ করে, তাকেই গান্ধর্ব বিবাহ বলে; ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সেই বিবাহই শ্রেষ্ঠ। শকুন্তলা তুমি যে অনুরক্ত পুরুষকে পতি বলে স্বীকার করেছ তিনি ধার্মিক, উদারচেতা ও পুরুষশ্রেষ্ঠ দুষ্মন্ত। জগতে সর্বাপেক্ষা বলবান এবং উদারচেতা তোমার একটি পুত্র জন্মাবে, সে এই সসাগরা ধরিত্রীর অধীশ্বর হবে। তোমার সেই সম্রাট পুত্র শত্রুকে আক্রমণ করতে গেলে, তার সৈন্যদের কেউ প্রতিহত করতে পারবে না।”

তারপর শকুন্তলা মহর্ষি কণ্বের কাঁধ থেকে সমিধ, কুশ ও ফল নামিয়ে রেখে তাঁর চরণ ধুইয়ে দিলেন। মহর্ষি বিশ্রাম গ্রহণ করলে, শকুন্তলা তাঁকে বললেন, “আমি স্বেচ্ছায় পুরুষশ্রেষ্ঠ দুষ্মন্ত রাজাকে পতিত্বে বরণ করেছি। অতএব পিতা আপনি মন্ত্রীবর্গ সমেত রাজা দুষ্মন্তের প্রতি অনুগ্রহ করুন।” কণ্ব বললেন, “শকুন্তলা আমি তোমার জন্য দুষ্মন্তের প্রতি প্রসন্নই আছি। অতএব কল্যাণী তুমি আমার কাছ থেকে অভীষ্ট বরগ্রহণ করো।” শকুন্তলা দুষ্মন্তের হিত কামনা করে, পুরুবংশের ধার্মিকতা ও চিরস্থায়ী রাজত্ব বর হিসাবে চাইলেন।

দুষ্মন্ত শকুন্তলার কাছে প্রতিজ্ঞা করে রাজধানীতে ফিরে গেলেন। সেইদিন থেকে পুরো তিন বৎসর কেটে গেলে, শকুন্তলা পরম সুন্দর একটি পুত্র প্রসব করলেন। সেই দুষ্মন্তনন্দনের কান্তি অগ্নির মতো উজ্জ্বল ছিল এবং তার শরীরের তেজও অসাধারণ ছিল। ধার্মিক শ্রেষ্ঠ কণ্ব যথাবিধানে সেই ক্রমাগত বড় হয়ে ওঠা বালকটির জাতকর্মাদি সংস্কার করলেন। ক্রমে সেই বালকটির সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম শুভ্রবর্ণ দন্ত জন্মাল। শরীর সিংহের মতো দৃঢ় হয়ে উঠল, আকৃতি দীর্ঘ হতে লাগল, হাতের মধ্যে চক্রচিহ্ন দেখা দিল, কান্তি মনোহর হয়ে উঠল, মাথাটি অপেক্ষাকৃত বড় হল এবং শরীর বলবান হতে লাগল; এইভাবে বালকটি কণ্বের আশ্রমই বড় হতে লাগল। বালকটির বয়স যখন ছয়, তখনই সে অসাধারণ বলবান হয়ে উঠল। সে তখন সিংহ, ব্যাঘ্র, বরাহ, মহিষ এবং হস্তী ধরে এনে আশ্রমের নিকটবর্তী বৃক্ষে বেঁধে রাখতে আরম্ভ করল। আবার কখনও সে বৃক্ষে বা পর্বতে আরোহণ করত, কখনও সিংহ প্রভৃতি জন্তুকে ধরে এনে নির্যাতন করত, কখনও বা ব্যাঘ্র প্রভৃতি জন্তুর সঙ্গে খেলা করতে করতে দৌড়াত। সকল জন্তুকে ইচ্ছামতো দমন করত বলে আশ্রমবাসীরা তার নাম রাখল ‘সর্বদমন’।

সে বালক ক্রমে উৎসাহ, তেজ ও শক্তিশালী হয়ে উঠল। তার অবস্থা, শক্তি ও অলৌকিক কার্যকলাপ দেখে মহর্ষি কণ্ব শকুন্তলাকে বললেন, “এর যুবরাজ হবার সময় এসেছে।” তারপর শিষ্যগণকে বললেন, “শিষ্যগণ, তোমরা সর্বপ্রকারে প্রশংসনীয়া এই শকুন্তলাকে পুত্রের সঙ্গে তপোবন থেকে দুষ্মন্তের গৃহে রেখে এসো। কেন না, স্ত্রীলোক দীর্ঘকাল পিতৃগৃহে বাস করলে তার চরিত্র, ধর্ম ও যশ নষ্ট হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। বন্ধুজনের তা কখনই অভিপ্রেত হতে পারে না। অতএব, তোমরা বিলম্ব কোরো না। অবিলম্বে একে নিয়ে যাও।”

“তাই হোক”, এই কথা বলে তেজস্বী শিষ্যগণ, পুত্রের সঙ্গে শকুন্তলাকে নিয়ে হস্তিনানগরের দিকে যাত্রা করল। দুষ্মন্তগতস্বভাবা শকুন্তলা পদ্মনয়ন ও দেববালকের তুল্য পুত্রটিকে নিয়ে হস্তিনানগরে উপস্থিত হলেন। দ্বাররক্ষকেরা রাজার কাছে গিয়ে শকুন্তলার আগমন সংবাদ জানাল এবং রাজার অনুমতি পেয়ে নবোদিত সূর্যের মতো সেই বালকটি ও শকুন্তলাকে রাজার কাছে নিয়ে গেল। কণ্ব-শিষ্যরা শকুন্তলাকে জানিয়ে আশ্রমের দিকে ফিরে চললেন। শকুন্তলা রাজার কাছে উপস্থিত হয়ে, যথানিয়মে তাঁকে অভিবাদন করে বললেন, “মহারাজ আপনি আপনার পুত্রটিকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করুন। আপনি দেবতুল্য এই পুত্রটিকে আমার গর্ভে উৎপাদন করেছিলেন। সুতরাং পূর্বকৃত শপথ অনুযায়ী এই পুত্রের সঙ্গে ব্যবহার করুন। পূর্বে মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে আমার সঙ্গে সঙ্গমের সময়ে আপনি যে শপথ করেছিলেন, তা এখন স্মরণ করুন।”

রাজা শকুন্তলার বক্তব্য শুনে, সমস্ত বৃত্তান্ত স্মরণ করেও বললেন, “আমার তো এ জাতীয় কোনও ঘটনা স্মরণ হচ্ছে না! দুষ্টতপস্বিনী! তুমি কার লোক? পত্নী বলে তোমার সঙ্গে কখনও ধর্ম, অর্থ বা কামের কোনও ঘটনা ঘটেছিল, তা আমার মনে পড়ছে না।

রাজা এই কথা বললে দীনা শকুন্তলা অত্যন্ত লজ্জায় মাটিতে যেন মিশে গেলেন এবং দুঃখে তাঁর চৈতন্য যেন লোপ পেল। তিনি একটি স্তম্ভের মতো স্তব্ধ হয়ে রইলেন। ক্রোধ ও অধীরতাবশত তার দুটি চোখ তাম্রবর্ণ হল, ওষ্ঠযুগল কাঁপতে লাগল এবং কটাক্ষদ্বারা তিনি যেন রাজাকে দগ্ধ করতে লাগলেন। এই অবস্থায় তিনি রাজার প্রতি বক্র দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন। ক্রোধ বর্জন করে তপোবন যে তেজ অর্জন করেছিলেন, যে তেজের ফলে তার ক্রোধ উপস্থিত হয়েছিল, সেই তেজ তিনি সংবরণ করলেন। তারপর তিনি একটু কাল চিন্তা করে দুঃখিত আর ক্রুদ্ধ হয়ে রাজার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মহারাজ মনে থাকা সত্ত্বেও প্রাকৃত লোকের মতো আপনি বলছেন যে, আমার স্মরণ হচ্ছে না। আমি সত্য না মিথ্যা বলছি, আপনার হৃদয়ই তা জানে। সুতরাং সাধু সাক্ষীর মতো সত্য কথা বলুন, মিথ্যা বলে আত্মাকে অবজ্ঞার পাত্র করবেন না। যে লোক নিজে অন্যরূপ আর আত্মাকে অন্যরূপ বলে মনে করে সে তো আত্মাপহারী চোর। সুতরাং সে লোক কোন পাপ না করেছে? মহারাজ, আপনি নিজেকে প্রচণ্ড জ্ঞানী মনে করেন; অথচ আপনারই হৃদয়ে যে অনাদি জীবাত্মা রয়েছেন, তা আপনি জানেন না। কারণ যে জীবাত্মা পাপকার্যের সংবাদ জানতে পারেন, তাঁর কাছেই আপনি পাপ করছেন। মানুষ নির্জনে পাপ করে ভাবে যে, আমার পাপ কেউ জানতে পারছেনা; কিন্তু তার জীবাত্মা ও দেবগণ তা জানতে পারেন। আর সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, পৃথিবী, জল, মন, যম, দিন, রাত্রি, প্রাতঃসন্ধ্যা, সায়ংসন্ধ্যা এবং ধর্ম—এরা মানুষের সব বৃত্তান্ত জানতে পারছেন। কর্মের সাক্ষী ও হৃদয়বর্তী জীবাত্মা যে ব্যক্তির সৎকর্ম দ্বারা সন্তুষ্ট থাকেন, স্বয়ং যমই তার পাপ দূর করে দিয়ে থাকেন। আর, সেই জীবাত্মাই দুষ্কর্ম দ্বারা যে দুরাত্মার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন, যমই সেই পাপাত্মাকে দারুণ যাতনা দিয়ে থাকেন।

“যে লোক আপনিই আপনাকে অবজ্ঞা করে মুখে অন্যরূপ বুঝিয়ে দেয়, দেবতারা তার মঙ্গল করেন না। কেন না, তার আত্মাই তো তার কাছে প্রমাণ নয়। আমি পতিব্রতা, সুতরাং, আমি নিজে উপস্থিত হয়েছি বলে আমার প্রতি অবজ্ঞা করবেন না। কারণ, ভার্যা পতির কাছে নিজে উপস্থিত হলেও আদরের যোগ্য। তবুও আপনি যে আদরের সঙ্গে আমাকে গ্রহণ করছেন না, তা অত্যন্ত অনুচিত হচ্ছে। আপনি সভার মধ্যে নীচ নারীর মতো আমাকে উপেক্ষা করছেন কেন? মনে হচ্ছে, আমি শূন্যে রোদন করছি, কারণ, আপনি আমার কথা শুনছেন না। আমি আপনার কাছে থাকব বলেই প্রার্থনা করছি। এ অবস্থায় আপনি যদি আমার প্রার্থনা পূরণ না করেন, আপনার মস্তক শতধাবিদীর্ণ হয়ে যাবে। পতি ভার্যার ভিতরে প্রবেশ করে, পুনরায় পুত্রাদিরূপে জন্মগ্রহণ করেন, সেই জন্যই ভার্যার নাম হয়েছে ‘জায়া’, এ কথাই প্রাচীন পণ্ডিতরা বলে থাকেন। বৈদিক সংস্কারসম্পন্ন পুরুষের যে তেজ আছে, তাই সন্তানরূপে জন্মগ্রহণ করে এবং সেই সন্তানই আবার সন্তানের জন্ম দিয়ে মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্ধার করে। ‘পুৎ’ নামক নরক থেকে পিতাকে রক্ষা করে বলে স্বয়ং ব্রহ্মাই তনয়ের নাম রেখেছেন ‘পুত্র’। তিনিই ভার্যা, যিনি গৃহকার্যে নিপুণ; তিনি ভার্যা, যাঁর পুত্র জন্মেছে; তিনি ভাৰ্যা, যিনি পতিকে প্রাণের মতো ভালবাসেন এবং তিনি ভার্যা, যিনি পতিব্রতা হন। ভার্যা পুরুষের শরীরের অর্ধাংশ, ভার্যা সর্বপ্রধান সখা! ভার্যা ধর্ম, অর্থ ও কামের প্রধান কারণ এবং ভার্যাই পুরুষের উদ্ধারের প্রধান হেতু। যাদের ভার্যা আছে, তারা যজ্ঞাদিক্রিয়ার অধিকারী, তারাই গৃহস্থ, তারাই আমোদ করতে পারে এবং তারাই সর্বত্র শোভা পেয়ে থাকে। প্রিয়ভাষিণী ভার্যা নির্জন বন্ধুস্বরূপ, ধর্মকার্যে পিতৃস্বরূপ এবং রোগপীড়ায় মাতৃস্বরূপ। যে লোক সংসাররূপ দুর্গমপথের পথিক, তার পক্ষে ভার্যা পরম বিশ্রাম স্থান এবং যার ভার্যা আছে সেই বিশ্বাসের পাত্র; সুতরাং সংসারক্ষেত্রে ভার্যাই প্রধান অবলম্বন। পতি মৃত্যুর পর যখন একাকী ভয়ংকর দুর্গম পথ দিয়ে পরলোকগমন করতে থাকেন, তখন পতিব্রতা ভার্যাই তাঁর অনুসরণ করেন। ভার্যা পূর্বে মৃত্যুমুখে পতিত হলে তিনি পরলোকে গিয়ে পতির জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকেন; আর, পতি পূর্বে মৃত হলে সাধ্বী ভার্যা তাঁর অনুগমন করেন।

“মহারাজ ভর্তা ইহলোকেও ভার্যাকে পান, পরলোকেও ভার্যাকে পেয়ে থাকেন; এই কারণেই মানুষ বিয়ে করে। জ্ঞানীগণ বলে থাকেন— ভর্তা, ভার্যার গর্ভে আপনাকে আপনিই পুত্ররূপে উৎপাদন করে থাকেন; সুতরাং তিনি পুত্রবতী ভার্যাকে মাতার মতো দেখবেন। দর্পণে যেমন নিজ মুখের প্রতিবিম্ব পড়ে, ভার্যাতেও তেমন পতি নিজেই নিজেকে পুত্ররূপে উৎপাদন করেন। সুতরাং, ধার্মিক লোক যেমন স্বর্গলাভ করে আনন্দ লাভ করেন, তেমনই পিতাও পুত্ৰমুখ দেখে আনন্দ লাভ করেন। ঘর্মাক্ত লোক যেমন জলে স্নান করে আনন্দ অনুভব করে, তেমনই দুঃখিত ও পীড়িত লোক পত্নীর সহিত মিলিত হয়ে আনন্দলাভ করেন। রতি, প্রীতি ও ধর্ম— এ সমস্তই পত্নীর অধীন বুঝে মানুষ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেও স্ত্রীলোকের অপ্রিয় কার্য করবে না। স্ত্রীলোকই নিজের পবিত্র ও চিরন্তন উৎপত্তি স্থান। স্ত্রীলোক ব্যতীত ঋষিদের সন্তান সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই। যখন ধূলি ধূসরিত পুত্রটি গিয়ে পিতার অঙ্গ আলিঙ্গন করে, তখন তার থেকে অধিক সুখ জগতে আর কী থাকে? এই পুত্রটি নিজে উপস্থিত হয়েছে, আপনার কোলে যাবার জন্য ইচ্ছা করছে, করুণ নয়নে আপনার দিকে চাইছে, এই অবস্থায় আপনি কেন একে অবজ্ঞা করছেন? অতি ক্ষুদ্র প্রাণী পিপীলিকারাও আপন ডিমগুলিকে প্রতিপালন করে, পরিত্যাগ করে না— আপনি ধর্মজ্ঞ অথচ পুত্রকে প্রতিপালন করবেন না?

“সূক্ষা বস্ত্র, সুন্দরী স্ত্রী এবং শীতল জলের স্পর্শও শিশুপুত্রের আলিঙ্গনের সুখ দিতে পারে না। দ্বিপদ প্রাণীর মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, চতুষ্পদ প্রাণীর মধ্যে গোরু শ্রেষ্ঠ, গুরুজনের মধ্যে পিতা শ্রেষ্ঠ আর, সুখস্পর্শ বস্তুর মধ্যে পুত্রই শ্রেষ্ঠ। এই প্রিয়দর্শন পুত্রটি গিয়ে আলিঙ্গন করে আপনাকে স্পর্শ করুক। পুত্ৰস্পৰ্শ অপেক্ষা অধিক সুখস্পর্শ জগতে নেই। মহারাজ, গর্ভধারণের পর থেকে তিন বৎসর পূর্ণ হলে, আমি এই পুত্রটিকে প্রসব করেছিলাম এবং এই পুত্রের প্রসবের পর আমি আপনার বিরহের কষ্ট কিছু পরিমাণে বিস্মৃত হয়েছিলাম। নরনাথ! এই পুত্র প্রসবের পরে আমার প্রতি এই দৈববাণী হয়েছিল, ‘এই পুরুবংশীয় বালকটি ভবিষ্যতে একশত অশ্বমেধ যজ্ঞ করবে।’ মহারাজ আমি মনে করি—মানুষ স্থানান্তরে যাবার সময়ে স্নেহবশত পুত্রকে কোলে তুলে নিয়ে তার মস্তকাঘ্রাণ করে অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করে। মহারাজ আপনার জানা আছে জাতকর্ম করার সময়ে ব্রাহ্মণেরা এই বেদমন্ত্র পাঠ করে থাকেন, ‘পুত্র! তুমি আমার প্রত্যেক অঙ্গ থেকে, বিশেষত হৃদয় থেকে জন্মেছ; সুতরাং তুমি এখন আমার আত্মা পুত্র নাম ধারণ করেছ, একশত বছর বেঁচে থাক। বৃদ্ধকালে আমার ভরণপোষণ করা তোমার অধীন হবে এবং তোমার বংশ অক্ষয় হবে। অতএব পুত্র, তুমি অত্যন্ত সুখী হয়ে এক শত বৎসর জীবিত থাকো।’ মহারাজ এই বালকটি আপনার অঙ্গ থেকেই জন্মেছে; সুতরাং, একটি পুরুষ থেকে আর একটি পুরুষ উৎপন্ন হয়েছে; অতএব সরোবরের নির্মল জলে যেমন আপন প্রতিবিম্ব দেখে, তেমন এক আত্মাই পুত্ররূপে দুই হয়েছে দেখুন।

“মহারাজ আপনি পূর্বে মৃগয়া করবার জন্য বনে গিয়েছিলেন, তখন একটি মৃগ আপনাকে আকর্ষণ করে নিয়ে গিয়েছিল, সেই অবস্থায় আপনি মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে গিয়ে কুমারী অবস্থায় আমাকে লাভ করেন। উর্বশী, পূর্বচিত্তি, সহজন্যা, মেনকা, বিশ্বাচী ও ঘৃতাচী—এই ছ’জন অপ্সরাশ্রেষ্ঠা। তাদের মধ্যে আবার প্রধান অপ্সরা ব্রহ্মার কন্যা মেনকা স্বর্গ থেকে ভূমণ্ডলে এসে বিশ্বামিত্র থেকে আমাকে উৎপাদন করেন। সেই নিষ্ঠুর স্বভাবা মেনকা হিমালয়ের কোনও সমতল ভূমিতে আমাকে প্রসব করেন এবং তখনই পরের সন্তানের ন্যায় আমাকে পরিত্যাগ করে চলে যান। আমি জানি না পূর্বজন্মে আমি কী গুরুতর পাপ করেছিলাম, যার ফলে পিতামাতা আমাকে জন্মের পরেই পরিত্যাগ করেছিলেন আর এখন আপনিও আমাকে পরিত্যাগ করছেন। তবে, ইচ্ছা করলে এবং আপনি আমাকে পরিত্যাগ করলে, আমি নিজের আশ্রমে চলে যাব। কিন্তু এই বালকটি আপনারই পুত্র, সুতরাং আপনি একে পরিত্যাগ করতে পারেন না।”

দুষ্মন্ত বললেন, “শকুন্তলা তোমার গর্ভে যে আমার পুত্র জন্মেছিল, তা আমার স্মরণ হচ্ছে না। স্ত্রীলোকেরা সাধারণত মিথ্যা কথাই বলে, সুতরাং তোমার কথা কে বিশ্বাস করবে? তোমার জননী বেশ্যা মেনকা অত্যন্ত নির্দয়া; কেন না সে তোমাকে হিমালয়ের উপরে বাসী ফুলের মতো ফেলে দিয়েছে। আর মূলত ক্ষত্রিয় অথচ ব্রাহ্মণ হবার জন্য লোভী এবং কামাতুর সেই বিশ্বামিত্রও নির্দয়। মেনকা অপ্সরাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা এবং তোমার পিতা বিশ্বামিত্রও মহর্ষিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ; তুমি তাদের সন্তান হলে কী করে। তুমি বেশ্যার মতো কথা বলছ। এই অবিশ্বাস্য কথা বলতে তোমার লজ্জা হচ্ছে না? বিশেষত আমার কাছে। অতএব দুষ্টতাপসী, তুমি চলে যাও। সেই কোপনস্বভাব বিশ্বামিত্রই বা কোথায় এবং সেই অপ্সরা মেনকাই বা কোথায়, আর এই দীনা ও তাপসীবেশা তুমিই বা কোথায়? তোমার এই বালকটি এত অল্প কালের মধ্যে বিশাল শরীর, অত্যন্ত বলবান এবং শালবৃক্ষের মতো এত দীর্ঘ হল কী করে?

“তোমার মাতা বেশ্যা বলে অত্যন্ত নিকৃষ্টা, তুমিও বেশ্যার মতোই কথা বলছ। তারপর, সেই স্বৈরিণী মেনকাও কামান্ধ হয়েই তোমার জন্ম দিয়েছিল। সুতরাং তোমার জন্মও অত্যন্ত নিকৃষ্ট। তাপসী, তুমি বিশ্বাসের অযোগ্য কথা বলছ। আমি তোমাকে চিনি না; সুতরাং তুমি চলে যাও।”

শকুন্তলা বললেন, “রাজা আপনি পরের সর্ষের পরিমাণে ছিদ্র দেখে নিন্দা করছেন, কিন্তু নিজের বেল-ফলের মতো ছিদ্রগুলি দেখেও দেখছেন না। মেনকা বেশ্যা হলেও দেবতার মধ্যে গণ্যা। এমনকী দেবতারা মেনকা অপেক্ষা নিকৃষ্ট। অতএব দুষ্মন্ত, আপনার জন্ম থেকে আমার জন্ম উৎকৃষ্ট। আপনি কেবল ভূতলেই বিচরণ করতে পারেন, আর আমি ভূতল ও আকাশ—দুই স্থানেই বিচরণ করতে পারি। সুতরাং সুমেরু পর্বত ও সরিষার দানার মধ্যে যে প্রভেদ, আপনার ও আমার মধ্যে সেই প্রভেদ। আমি ইচ্ছানুসারে ইন্দ্র, কুবের, যম ও বরুণের গৃহে যাতায়াত করতে পারি। অতএব আপনি আমার ক্ষমতা অনুভব করুন। মহারাজ এবার আমি যা বলব, সেই সত্যগুলি আপনাকে শুনতে হবে। কথাগুলি আপনাকে জানাবার জন্য, কোন বিদ্বেষের বশে নয়, অতএব আমাকে ক্ষমা করবেন।

“কুৎসিত লোকেরা দর্পণে যতক্ষণ আপনার মুখ দর্শন না করে, ততক্ষণই আপনাকে সুন্দর বলে মনে করে। কিন্তু যখন দর্পণে সে আপনার মুখ দেখে, তখন অন্যের ও নিজের পার্থক্য অনুভব করে। অত্যন্ত সুন্দর লোক কাউকে অবজ্ঞা করেন না, আর অধিকভাষী ও কটূভাষী লোক নিন্দা করে পরপীড়ক হয়ে থাকে। শূকর যেমন ফুল ফেলে বিষ্ঠা গ্রহণ করে, তেমনই মূর্খেরা অন্যের ভাল ও মন্দ কথার মধ্যে মন্দ কথাটিই গ্রহণ করে। আর বিজ্ঞ লোক, অন্যের ভাল-মন্দ দুই কথার মধ্যে কেবলমাত্র ভাল কথাটিই গ্রহণ করে। হংস যেমন জলমেশানো দুগ্ধ থেকে কেবলমাত্র দুগ্ধই গ্রহণ করে, ভাল লোকেরাও তাই করে। সজ্জন অন্যের নিন্দা করে দুঃখিত হন, দুর্জন অন্যের নিন্দা করে সুখী হন। পণ্ডিতেরা বৃদ্ধদের অভিবাদন করে সুখী হন, মূর্খেরা সজ্জনের প্রতি আক্রোশ করে সুখী হয়। প্রাজ্ঞ লোকেরা পরের দোষ জেনেও তার আলোচনা না করায় সেই ব্যাপারে অনভিজ্ঞের মতো থেকে সুখে জীবনযাপন করেন। আর মুর্খেরা পরের দোষ অনুসন্ধান করতে থেকে আকুল হয়ে জীবনযাপন করে এবং সজ্জনেরা যেখানে দুর্জনদের নিন্দা করেন, সেইখানে আবার দুর্জনেরাও সজ্জনের নিন্দা করেন। জগতের সর্বাপেক্ষা হাস্যকর এই যে দুর্জন মানুষ সজ্জনের নিন্দা করে। আস্তিকেরা তো বটেই, নাস্তিক লোকেরাও ক্রুদ্ধ সর্পতুল্য সত্যভ্রষ্ট লোককে ভয় করে থাকে। যে ব্যক্তি নিজেই পুত্র উৎপাদন করে, তা অস্বীকার করে, দেবতারা তার সম্পদ নষ্ট করেন এবং সে স্বর্গলাভ করতে পারে না। পিতৃপুরুষেরা বলেন— পুত্ৰই বৃদ্ধকালে পিতার দেহরক্ষার, চিরদিন বংশরক্ষার এবং সমস্ত ধর্মরক্ষার প্রধান উপায়; সুতরাং পুত্রকে ত্যাগ করবে না। মনু পাঁচ প্রকার পুত্রের কথা বলেছেন—নিজের স্ত্রীর গর্ভে বা অন্যের স্ত্রীর গর্ভে নিজের উৎপাদিত, লব্ধ, ক্রীত, পালিত এবং পুত্রিকাপুত্র। পুত্র ধর্ম ও কীৰ্তিজনক, মনের আনন্দবর্ধক এবং ধর্মের ভেলা হয়ে নরক থেকে পিতৃলোকের পরিত্রাণকারক। মহারাজ আপনি আত্মা, সত্য এবং অপরাপর ধর্মের রক্ষায় প্রবৃত্ত রয়েছেন। সুতরাং আপনি পুত্রকে ত্যাগ করতে পারেন না এবং কপটতাও করতে পারেন না। শত কূপ খনন করার থেকে একটি দীঘি খনন শ্রেষ্ঠ, শত দীঘি খনন করা থেকে একটি যজ্ঞ করা শ্রেষ্ঠ, শত যজ্ঞ করার থেকে একটি পুত্র উৎপাদন করা শ্রেষ্ঠ এবং শত পুত্র উৎপাদন করা থেকে একটি সত্য পালন করা শ্রেষ্ঠ। দাঁড়িপাল্লার একদিকে সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ এবং অন্য দিকে একটি সত্য তুলে একবার পরীক্ষকেরা মেপেছিলেন; তাতে তাঁরা দেখেছিলেন সহস্র অশ্বমেধ থেকে একটি সত্যই অধিক হয়ে গিয়েছে। সমস্ত বেদ অধ্যয়ন, সমস্ত তীর্থে স্নান ও সত্য বাক্য—অন্যগুলি সব মিলিয়েও সত্য বাক্যের সমান হতে পারে না। সত্যের তুল্য ধর্ম নেই এবং সত্য অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বস্তু নেই। আবার, এই পৃথিবীর সব থেকে ভয়ংকর বস্তু মিথ্যা। সত্যই পরম ব্রহ্ম এবং সত্যই পরম সদাচার। মহারাজ সত্য ত্যাগ করবেন না, আপনার হৃদয়ে চিরকাল সত্য সংলগ্ন থাক। পক্ষান্তরে, আপনি যদি মিথ্যাতেই আসক্ত হয়ে পড়েন এবং আমার কথায় বিশ্বাস না করেন, তবে আমি নিজেই চলে যাচ্ছি। আপনার মতো লোকের সঙ্গে আমার সম্মেলন সম্ভব হবে না। দুষ্মন্ত! তোমার সাহায্য ব্যতীতও আমার পুত্র, হিমালয়ালঙ্কৃত চতুঃ সমুদ্রবেষ্টিত এই পৃথিবী শাসন করবে।” এই বলে শকুন্তলা পুত্রের সঙ্গে সেই রাজসভা ত্যাগ করলেন।

মন্ত্রী, অমাত্য, পুরোহিত পরিবেষ্টিত সেই রাজার প্রতি তখন দৈববাণী হল, “দুষ্মন্ত! মাতা তো কেবল ভস্ত্রা (জাঁতা) স্বরূপ, পুত্র পিতারই বটে, কারণ পিতাই পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। দুষ্মন্ত এই পুত্রটিকে রেখে ভরণপোষণ করো, শকুন্তলার প্রতিও অবজ্ঞা কোরো না। কারণ, নরনাথ সন্তানোৎপাদক পুত্র পিতাকেই যমালয় থেকে উদ্ধার করে। শকুন্তলা সত্যই বলেছে, তুমিই এই পুত্রটির জনক। বিধাতা পিতার শরীর দুই ভাগ করে পুত্র সৃষ্টি করেন, আর মাতা তাকে প্রসব করেন। অতএব দুষ্মন্ত! শকুন্তলার গর্ভজাত পুত্রটিকে রেখে ভরণ-পোষণ করো। কারণ পিতা জীবিত পুত্রকে পরিত্যাগ করে যে-জীবনধারণ করেন, তা তাঁর পক্ষে অমঙ্গল। মহারাজ এই পুত্র তোমার ঔরসে শকুন্তলার গর্ভে জন্মেছে; সুতরাং এই মহাত্মাকে রেখে ভরণপোষণ করো। যখন আমাদের অনুরোধেও একে রেখে তোমার ভরণপোষণ করতে হবে, তখন এই পুত্রটির নাম ‘ভরত’ হিসাবে প্রসিদ্ধ হোক।”

রাজা দুষ্মন্ত দেবগণের সেই বাক্য শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে পুরোহিত ও মন্ত্রীবর্গকে এই কথা বললেন—“আপনারা এই দেবদূতের বাক্য শ্রবণ করুন, আমি নিজেও এই বালকটিকে নিজের পুত্র বলেই জানি। কিন্তু আমি যদি কেবল শকুন্তলার কথাতেই এই বালকটিকে পুত্র বলে গ্রহণ করি, তবে লোকের আশঙ্কা হবে যে, এ রাজার ঔরস পুত্র না হতেও পারে।”

তখন দুষ্মন্ত সেই আকাশবাণী দ্বারা সেই বালকটিকে নিজের ঔরস পুত্র বলে প্রমাণ করিয়ে নিয়ে, সহাস্যমুখে এবং আনন্দিত চিত্তে তাকে পুত্র বলে গ্রহণ করলেন। তারপর রাজা আনন্দিত ও স্নেহপরায়ণ হয়ে তখনই সেই পুত্রটির উপনয়ন প্রভৃতি পিতার সমস্ত কর্তব্য কার্য সম্পন্ন করলেন। তখন ব্রাহ্মণগণ প্রশংসা করতে লাগলেন এবং বন্দিগণ স্তব করতে থাকল, এই অবস্থায় রাজা সস্নেহে পুত্রটির মস্তকাঘ্রাণ করে আলিঙ্গন করলেন। রাজা সেই পুত্রসংস্পর্শের কারণে পরম আনন্দ লাভ করলেন এবং ধর্মানুসারে শকুন্তলাকে ভার্যা বলে গ্রহণ করে বিশেষ সম্মানিত করলেন এবং রাজা অনুনয় সহকারে এই কথাগুলি শকুন্তলাকে বললেন—“দেবী আমি লোকের অনুপস্থিতিতে ও অসাক্ষাতে তোমার সঙ্গে এই সম্বন্ধ স্থাপন করেছিলাম। সেই জন্য আমি বিশেষ বিবেচনা করেই তোমার নির্দোষিতা প্রমাণ করার জন্য এইরূপ ব্যবহার করেছি। না হলে, লোকে মনে করত যে, স্ত্রীলোকের স্বাভাবিক চপলতাবশতই তোমার সঙ্গে আমার সঙ্গম হয়েছিল। আর আমি বিশেষ বিবেচনা করে পূর্বেই স্থির করেছিলাম যে, এই পুত্রটিকে রাজ্যে অভিষিক্ত করতে হবে এবং প্রিয়তমে! বিশাল নয়নে! কল্যাণী! তুমি ক্রুদ্ধ হয়ে আমার প্রতি যে সকল অপ্রিয় বাক্য বলেছ, আমি সে সমস্তই ক্ষমা করেছি।”

রাজর্ষি দুষ্মন্ত প্রিয়তমা মহিষী শকুন্তলাকে এই বলে, উপযুক্ত বস্ত্র, অন্ন ও পানীয় দ্বারা তাঁকে সম্মানিত করলেন।

দুষ্মন্তস্তু ততোরাজা পুত্রং শাকুন্তলং তদা।
ভরতং নামতঃ কৃত্বা যৌবরাজ্যেহভ্যষেচয়ৎ ॥ আদি: ৮৮:১২৬ ॥

“তারপর, দুষ্মন্ত শকুন্তলার পুত্রটির ‘ভরত’ নাম করে, তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন।” মহারাজ দুষ্মন্ত পূর্ণ এক শত বৎসর রাজত্ব করার পর বনে গমন করেন, বনেই দেহত্যাগের পর স্বর্গ লাভ করেন। ভরত দুষ্মন্তের সিংহাসনে আরূঢ় হন। তিনি অত্যন্ত পরাক্রমশালী দিকবিজয়ী সম্রাট ছিলেন। তিনি যমুনার তীরে থেকে শত অশ্বমেধ, সরস্বতীর তীরে থেকে তিন শত অশ্বমেধ এবং গঙ্গার তীরে থেকে চার শত অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। শকুন্তলার গর্ভজাত দুষ্মন্তনন্দন ভরত থেকেই ভরতবংশের যশোরাশি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।

*

কাহিনিটি অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে লিখতে হল। কারণ, এই কাহিনির সঙ্গে ভারতবর্ষের পাঠক সমাজ পরিচিত নন। মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্” নাটক এর প্রত্যক্ষ কারণ। মহাকবি, কালিদাস মহর্ষি ব্যাস রচিত কাহিনির চরিত্র ও পরিণতি অবিকৃত রেখে কাহিনিকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে রচনা করেন। তাতে অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। সমস্ত নাটকটি নিয়ন্ত্রণ করেন কল্পিত মহর্ষি দুর্বাসার চরিত্র, সম্ভবত রাজা দুষ্মন্তের চরিত্র কলঙ্ক দূর করতেই কালিদাস দুর্বাসার অভিশাপ কল্পনা করেছিলেন। কালক্রমে কালিদাসের নাট্যকাহিনিটি ভারতবর্ষে অধিক পরিচিত হয় এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও প্রাচীন সাহিত্যের আলোচনায় কালিদাসকেই আকর গ্রন্থ হিসাবে গ্রহণ করেন। তাঁর ‘শকুন্তলা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যে শকুন্তলার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়েছেন, তা কালিদাসের শকুন্তলা অবলম্বনেই। সে আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ কেবলমাত্র ভারতীয় গণ্ডির মধ্যেই থেমে থাকেননি। শেকসপিয়রের ‘টেম্পেস্ট’ নাটকের নায়িকা মিরান্দার সঙ্গে শকুন্তলার অসাধারণ তুলনাও করেছেন। ইউরোপের কবিকুলগুরু, জার্মন কবিসম্রাট গ্যেটে একটি শ্লোক লিখে শকুন্তলাকে বিশ্বব্যাপ্ত করে গিয়েছেন। গ্যেটে লিখেছিলেন, “কেউ যদি তরুণ বৎসরের ফুল ও পরিণত বৎসরের ফল, কেউ যদি মর্ত্য ও স্বর্গ একত্র দেখতে চায়, তবে শকুন্তলায় তা পাবে।” এ শকুন্তলা কিন্তু কালিদাসের, ব্যাসদেবের নয়।

আবার গ্যেটের সেই শ্লোকটির বিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরও অপরূপা করে তুলেছেন শকুন্তলাকে। ফলে মূল শকুন্তলা পাঠকের দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেল। ব্যাসদেবের শকুন্তলা আশ্রম পালিতা কিন্তু অনভিজ্ঞা নন। তপোবনের দীর্ঘ তপশ্চর্যা তাঁর মধ্যে সংযমও এনে দিয়েছে। রাজা দুষ্মন্তের বিবাহপ্রস্তাব তিনি অনুমোদন করেছেন, কারণ বিবাহরীতি তাঁর অজানা নয়। আশ্রম-পালিতা হলেও তিনি মূলত রাজকন্যা। কিন্তু গান্ধর্ব রীতিতে দুষ্মন্তের কাছে আত্মসমর্পণের পূর্বে তাঁর শর্তটি স্মরণীয়। এই শর্ত কালিদাসের শকুন্তলা কোনওদিনও দিতে পারতেন না। তাঁর গর্ভস্থ শিশুকে যৌবরাজ্য দিতে হবে এবং রাজার অবর্তমানে তিনিই রাজত্ব পাবেন—এই শর্তে শকুন্তলা আত্মসমর্পণ করেছেন। আবার রাজসভায় উপস্থিত হয়ে তিনি রাজাকে যে বক্তব্য বলেছেন, তা কেবলমাত্র শাস্ত্র অনুমোদিতই নয়, জীবনের অবশ্য পালনীয় ধর্ম। ভাৰ্যা, জায়া এবং পুত্রের স্থান মানুষের জীবনে কত দূর প্রসারিত শকুন্তলা বিশদভাবে তা বুঝিয়েছেন। জীবনে সত্য পালনের প্রয়োজনীয়তা, মিথ্যায় কত দূর ক্ষতি হতে পারে তা শকুন্তলা দুষ্মন্তকে শিক্ষা দিয়েছেন।

ব্যাসদেবের শকুন্তলা অবলা নারী নন—সন্তানের সামর্থ্যের উপর তাঁর বিশ্বাস অটুট। তিনি মহারাজা দুষ্মন্তকে অনায়াসে বলতে পেরেছেন যে, দুষ্মন্তের সহায়তা ব্যতীত ভরত চতুঃ সমুদ্রবেষ্টিত ধরণীর সম্রাট হবে। ব্যাসদেবের শকুন্তলা দুষ্মন্তের কাছে দাবি জানিয়েছেন, আপন সততায়, অপাপবিদ্ধতায়।

ব্যাস-রচিত দুষ্মন্ত-শকুন্তলা কাহিনি পড়তে পড়তে মনে হয়, তিনি কেবলমাত্র ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন। কোনও চরিত্রকে উজ্জ্বল ও মলিন করে আঁকার কোনও অভিপ্রায় তাঁর নেই। তিনি ইতিহাসের বর্ণনা দিচ্ছেন। ইতিহাস নিজেই তাঁর চরিত্রের ভালত্ব মন্দত্ব স্থির করে দেবে। ভরত-বংশের প্রতিষ্ঠার নিরপেক্ষ ইতিহাস বর্ণনা করছেন তিনি। ভরত-বংশের প্রতিষ্ঠা মহাভারতের দুর্লভতম মুহূর্ত। এই বংশের সন্তানদের কাহিনিই মহাভারত। শকুন্তলা-পুত্র ভরতের নামকরণে এই দেশের নাম ভারতবর্ষ। মহত্বে ও ভারবত্তায় অদ্বিতীয়। তাই কাহিনির নাম মহাভারত।


পরীক্ষিতের মৃত্যু

(কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অষ্টাদশ দিনে গদাযুদ্ধে ভীমসেন দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করেন। মৃত্যুপথযাত্রী দুর্যোধন অশ্বত্থামাকে শেষ সেনাপতি হিসাবে অভিষিক্ত করেন। কৃপাচার্য ও কৃতবর্মাকে নিয়ে দেবাদিদেব মহেশ্বরের প্রসন্নতায় অশ্বত্থামা গভীর রাত্রে নিদ্রিত দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন ইত্যাদিকে নির্বিচারে হত্যা করেন।

পরদিন প্রভাতকালে দ্রৌপদী এই সংবাদ পান ও অশ্বত্থামার মৃত্যু অথবা তাঁর মাথার মন্ত্রপূত মণিলাভের প্রতিজ্ঞা করে প্রায়োপবেশনে বসেন। কৃষ্ণার্জুন, যুধিষ্ঠির, ভীম অশ্বত্থামাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ব্যাসদেবের আশ্রমের উদ্দেশে রওনা হন। অশ্বত্থামা সেখানে লুকিয়ে বাস করছিলেন। কৃষ্ণ সহ পাণ্ডবদের আসতে দেখেই ভীত অশ্বত্থামা পিতৃদত্ত ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রয়োগ করেন। কৃষ্ণের পরামর্শ অনুযায়ী অর্জুনও ব্রহ্মশির অস্ত্র নিক্ষেপ করেন। দুই দিক থেকে আগত ‘ব্ৰহ্মশির’ সমস্ত পৃথিবীকে জ্বালিয়ে ছারখার করতে করতে অগ্রসর হয়। ব্যাসদেব ও নারদ দুই অস্ত্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে উভয়কেই অস্ত্র সংবরণ করতে নির্দেশ দেন। অর্জুন সংযত ও বেদবিৎ ছিলেন। তিনি অস্ত্র সংবরণ করেন। কিন্তু অত্যন্ত ক্রোধী, অসংযত অশ্বত্থামা অস্ত্র সংবরণ করতে পারেন না। অশ্বত্থামার অস্ত্র উত্তরার গর্ভস্থিত শেষ পাণ্ডবপুত্রকে দ্বি-খণ্ডিত করে। কৃষ্ণ প্রতিশ্রুতি দেন, যথাসময়ে এই দ্বিখণ্ডিত পাণ্ডব সস্তানকে তিনি পুনর্জীবিত করবেন। অশ্বত্থামা তাঁর মাথার মণি অর্জুনকে দিতে বাধ্য হন ও কৃষ্ণের অভিশাপে পূতিগন্ধময় নরক সদৃশ এক দেশে নির্বাসিত হন। যথাসময়ে উত্তরার গর্ভস্থিত দ্বি-খণ্ডিত সন্তানের জন্ম হয়। প্রতিশ্রুতিমতো কৃষ্ণ তাঁকে সংযুক্ত করেন ও জীবন দান করেন। কুরুবংশ পরিকীর্ণ হয়ে গেলে এই সন্তানের জন্ম হয় বলে কৃষ্ণ তাঁর নাম রাখেন পরীক্ষিৎ। যুধিষ্ঠির মহাপ্রস্থানের পূর্বে হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে পরীক্ষিৎকে অভিষিক্ত করেন ও কৃপাচার্যকে তার অস্ত্রশিক্ষার ভার দিয়ে যান)।

কালক্রমে পরীক্ষিৎ যৌবনলাভ করে ধনুর্বিদ্যায় অসাধারণ পারদর্শিতা লাভ করেন। প্রপিতামহ পাণ্ডুর মতো তাঁর ধনুর্বিদ্যার খ্যাতি জগতে ছড়িয়ে পড়ে। পাণ্ডুর মতোই পরীক্ষিৎ মৃগয়া করতে ভালবাসতেন। হরিণ, শূকর, ব্যাঘ্র, মহিষ—তাঁর দৃষ্টিপথে পড়লে আর কোনওমতেই রক্ষা পেত না।

একদিন পরীক্ষিৎ অনেকগুলি হরিণ বধ করে বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। একটি হরিণকে দেখে তিনি শর নিক্ষেপ করলে, হরিণটি আহত হল, কিন্তু পতিত হল না। হরিণটি সেই অবস্থায় অদৃশ্য হয়ে গেল। পরীক্ষিৎ তার পিছনে পিছনে ছুটলেন। পরিশ্রান্ত এবং পিপাসার্ত পরীক্ষিৎ বনের মধ্যে এক মুনিকে দেখতে পেলেন। মুনি গোরুগুলির মধ্যে বসেছিলেন। বাছুরেরা গোরুর বাঁটে মুখ দিয়ে দুগ্ধ-পান করছিল। সেই সময়ে বাছুরদের মুখে প্রচুর ফেনা নির্গত হত। সেই ফেনাগুলিই ছিল মুনির খাদ্য।

ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত পরীক্ষিৎ মুনির কাছে পৌঁছে, হাতের ধনুক উপরে তুলে, তাঁকে আত্মপরিচয় দিলেন, “মহর্ষি! আমি অভিমন্যুর পুত্র রাজা পরীক্ষিৎ; আমি একটি হরিণকে শরাঘাত করেছিলাম, সে পালিয়ে গিয়েছে, আপনি তাকে দেখেছেন কি?”

মুনি সেই সময়ে মৌনব্রতী ছিলেন। ব্রতভঙ্গের ভয়ে তিনি রাজাকে কোনও উত্তর দিলেন না। ক্রুদ্ধ রাজা মুনির গলায় একটি মরা সাপ ঝুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।

মহর্ষির শৃঙ্গী নামে একটি অল্পবয়স্ক পুত্র ছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি মহাতপস্বী, মহাব্রতচারী ও অত্যন্ত তেজীয়ান ছিলেন। তাঁর ক্রোধ অত্যন্ত প্রবল ছিল। তিনি ক্রুদ্ধ হলে, তাঁকে প্রসন্ন করাও দুষ্কর হত। শৃঙ্গী, অত্যন্ত সংযত থেকে, পদ্মাসনে উপবিষ্ট হয়ে প্রাণীর হিতকামনায় ব্রহ্মার উপাসনায় মগ্ন ছিলেন। ব্রহ্মা তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে, বাকসিদ্ধ হবার বরদান করলেন এবং শৃঙ্গী প্রসন্ন মনে গৃহে ফিরলেন।

গৃহে কৃশ নামে এক ঋষিকুমার তাঁর সখা ছিলেন। কৃশ খেলার সময়ে, হাসতে হাসতে কৌতুকছলে শৃঙ্গীকে বললেন, “শৃঙ্গী! তুমি তেজস্বী ও তপস্বী। আবার তোমার পিতাও তেজস্বী ও তপস্বী। অথচ তোমার পিতা স্কন্ধে করে একটি শব বহন করে আছেন। এই অবস্থায় তুমি আর গর্ব কোরো না। অথবা আমাদের মতো ঋষিকুমারেরা কথা বললে তাতে তুমি আর অংশ গ্রহণ কোরো না। তোমার পুরুষ-অভিমান অথবা দর্পোদ্ধত বাক্য বৃথা। তুমি এখনই তোমার শবধারী-পিতাকে দেখতে পাবে।”

কৃশ এই কথা বললে শৃঙ্গী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। কৃশের দিকে তাকিয়ে শৃঙ্গী প্রশ্ন করলেন, “আমার পিতা আজ শব ধারণ করছেন কেন?” কৃশ উত্তরে বললেন, “রাজা পরীক্ষিৎ মৃগয়ায় এসেছিলেন, তিনিই তোমার পিতার গলায় মৃত সর্প ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।” শৃঙ্গী তাঁর পিতার অপরাধ জানতে চাওয়ায় কৃশ বললেন, “অভিমন্যুর পুত্র রাজা পরীক্ষিৎ মৃগয়ায় এসেছিলেন। তিনি শীঘ্রগামী একটি বাণ দ্বারা হরিণকে বিদ্ধ করেন। রাজা তার অনুসরণ করেন। রাজা হরিণটিকে ধরতে পারেননি। তিনি তোমার মৌনী পিতাকে হরিণের বিষয়ে প্রশ্ন করেন। কিন্তু ব্রতভঙ্গের ভয়ে তোমার পিতা উত্তর দেননি। তখন রাজা ধনুর একদিক দিয়ে একটি মৃত সর্প তোমার পিতার গলায় ঝুলিয়ে দেন। রাজা হস্তিনাপুরে চলে গেছেন, তোমার পিতা এখনও সেই অবস্থায় আছেন।”

রাজা পরীক্ষিৎ পিতার গলায় মরা সাপ ঝুলিয়ে দিয়েছেন এই শুনে ক্রুদ্ধ ও তেজস্বী শৃঙ্গী তখনই আচমন করে রাজাকে অভিসম্পাত করলেন। শৃঙ্গী বললেন, “আমার পিতা বৃদ্ধ, তারপর তিনি অত্যন্ত কষ্টকর ব্রত অবলম্বন করে আছেন। এই অবস্থায় যে পাপিষ্ঠ রাজা তাঁর গলায় মৃত সাপ ঝুলিয়ে দিয়েছেন, আজ থেকে সাতদিনের পর তীক্ষ্ণবিষ, মহা তেজীয়ান ও অত্যন্ত ক্রোধী নাগরাজ তক্ষক আমার আদেশ অনুসারে ব্রাহ্মণের অপমানকারী কুরুকুলের গ্লানি সেই পাপিষ্ঠ রাজাকে যমালয়ে প্রেরণ করবে।”

শৃঙ্গী পিতার নিকট গিয়ে ঝুলন্ত সাপসমেত পিতাকে দেখতে পেয়ে আপন অভিসম্পাত বৃত্তান্ত পিতাকে জানাল। তখন মহর্ষি শমীক মৌনী ভঙ্গ করে পুত্রকে বললেন, “তুমি আমার প্রীতিকর কাজ করনি। তপস্বীদের এত ক্রোধও ভাল না। আমরা সেই রাজার রাজ্যে বাস করি। তিনিও ন্যায় অনুসারে আমাদের রক্ষা করেন। তিনি সর্বদাই তপস্বীদের পাশে থাকেন। সুতরাং তাঁর বিপদ কোনওমতেই আমাদের বাঞ্ছিত নয়। বৎস, সর্বদা ক্ষমা করা উচিত। ধর্মকে নষ্ট করলে সে নিজেই নষ্ট হয়।

“রাজা যদি আমাদের রক্ষা না করতেন, তবে আমরা যথাসুখে ধর্মকার্য করতে পারতাম না। ধর্মানুযায়ী রাজা রক্ষা করেন বলেই আমরা প্রচুর ধনৈশ্বর্য লাভ করি। আমাদের সেই ধনৈশ্বর্যে রাজারও ভাগ আছে। মহারাজ পাণ্ডু যেমন ব্রাহ্মণদের রক্ষা করতেন, রাজা পরীক্ষিৎও তেমনি আমাদের রক্ষা করেন। তিনি আমার ব্রতের কথা না জেনে অন্যায় কাজ করে ফেলেছেন। রাজা না থাকলে দস্যু তস্কর প্রভৃতির উৎপাত আরম্ভ হয়। লোকে ধর্মকার্য করতে পারে না। রাজা ধর্মকাজ করেন, তাই মানুষের স্বর্গ লাভ হয়। দেবতারা সন্তুষ্ট হন। বৃষ্টি দান করেন। সেই বৃষ্টির ফলে শস্য হয়। ভগবান মনু বলেছেন, যে রাজা দশজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সমান। সুতরাং তিনি অভিসম্পাতের যোগ্য নন, তুমি চপলতাবশত অন্যায় অভিসম্পাত করেছ।”

শৃঙ্গী বললেন, “পিতা হয়তো আমি অবিবেচকের মতো কাজ করেছি, হয়তো আপনার অপ্রিয় কাজ করেছি, হয়তো আমার কাজ ন্যায়সঙ্গত হয়নি, পাপের কাজ হয়েছে, তবুও আমার অভিসম্পাত মিথ্যা হবে না।”

শমীক বললেন, “পুত্র, আমিও জানি তোমার অভিসম্পাত মিথ্যে হবে না। তুমি বালক, আবার তপস্যার বলে বলীয়ান। কিন্তু শাস্ত্রানুযায়ী তুমি বয়স্থ হলেও শাস্তিযোগ্য। তপোবলে অধিক প্রভাবশালী হওয়ায় তোমার ক্রোধও অত্যন্ত বেশি। তুমি অল্পবয়স্ক, চপল এবং হঠকারী—অতএব তুমি আমার আদেশ অনুসারে বন্য ফল-মূল আহার করো। তাতে তোমার ক্রোধ বিনষ্ট হবে, ধর্মহানি ঘটবে না। ধার্মিক লোক বহু দুঃখে যে ধৰ্মলাভ করেন, ক্রোধ তা সমূলে বিনষ্ট করে—ফলে সে অভীষ্ট স্বর্গ লাভ করতে পারে না। তুমি ক্ষমা করতে শেখো, ক্ষমা দ্বারাই তুমি জিতেন্দ্রিয় হতে পারবে। যাই হোক, তুমি যে অভিসম্পাত দিয়েছ, তা আমি রাজা পরীক্ষিৎকে জানিয়ে দেব, তোমার কোপনস্বভাব অশিক্ষিত বুদ্ধিজাত অভিসম্পাত থেকে রাজাকে সদা সর্বদা সতর্ক থাকতে অনুরোধ করব।”

তখন মহাব্রত ও মহাতপস্বী শমীক সচ্চরিত্র ও তপস্বী গৌরমুখ-নামক এক শিষ্যকে রাজা পরীক্ষিৎ-এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। গৌরমুখ রাজধানীতে প্রবেশ করে, রাজা কর্তৃক বিশেষ সম্মানিত হলেন এবং শমীক মুনির নির্দেশ অনুযায়ী সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক রাজার কাছে নিবেদন করলেন। গৌরমুখ বললেন, “মহারাজ, আপনি পরমধার্মিক, জিতেন্দ্রিয়, মহাতপস্বী শমীক মুনির মৌনব্রতকালে তাঁর গলায় মৃত সাপ ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। মুনি আপনাকে ক্ষমা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর পুত্র করেননি। তিনি আপনাকে অভিসম্পাত দিয়েছেন, আজ থেকে সপ্তম দিনে তক্ষক নাগ আপনার মৃত্যুর কারণ হবে। মহর্ষি শমীক আপনাকে বিশেষভাবে আত্মরক্ষা করতে বলেছেন।”

রাজা পরীক্ষিৎ মুনির গলায় সাপ ঝুলিয়ে প্রথমেই অনুতপ্ত ছিলেন, এখন অভিসম্পাত শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। বিশেষত মহামুনি শমীক মৌনব্রতধারী ছিলেন এই চিন্তা রাজাকে আরও অনুতপ্ত করে তুলল। অভিসম্পাত শুনে তিনি যতদুর দুঃখিত হলেন, তার থেকে বেশি দুঃখিত হলেন তিনি শমীকের অপমান করেছেন এই ভেবে। তিনি গৌরমুখের কাছে প্রার্থনা করলেন, “মহর্ষি শমীক আমার প্রতি পুনরায় অনুগ্রহ করুন।” গৌরমুখ চলে গেলে রাজা মন্ত্রিগণের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি মাত্র স্তম্ভের উপরে সুরক্ষিত একটি প্রাসাদ নির্মাণ করলেন। প্রাসাদ রক্ষার জন্য বহু সংখ্যক প্রহরী নিযুক্ত করলেন এবং স্তম্ভ ও প্রাসাদের চতুর্দিকে সচিকিৎসক, সর্পবিষের ঔষধ এবং সর্পমন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণদের নিযুক্ত করলেন। সেই প্রাসাদে কারওরই প্রবেশ অধিকার ছিল না।

সপ্তম দিনে সর্পদংশনের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক কাশ্যপ রাজার চিকিৎসার জন্য স্তম্ভ-প্রাসাদের দিকে যাত্রা করলেন। তিনি শুনেছিলেন নাগরাজ তক্ষক রাজশ্রেষ্ঠ পরীক্ষিৎকে দংশন করে যমালয়ে পাঠাবে। “তক্ষক দংশন করলে আমি রাজাকে বাঁচিয়ে দেব। এতে আমার ধর্মও হবে, প্রচুর ধনলাভও হবে।” —এই ভাবতে ভাবতে কাশ্যপ আসছিলেন। নাগরাজ-তক্ষক তখন এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে সেই পথেই চলেছিলেন। পথে তক্ষক কাশ্যপকে দেখতে পেলেন এবং প্রশ্ন করলেন, “আপনি এত তাড়াতাড়ি কোন কাজের জন্য যাচ্ছেন?” কাশ্যপ উত্তর দিলেন, “আজ নাগরাজ তক্ষক রাজশ্রেষ্ঠ পরীক্ষিৎকে দংশন করবে, তখন আমি পরীক্ষিৎকে সুস্থ করে দেবার জন্য যাচ্ছি। আমি বিষবিদ্যা জানি। বিষের চিকিৎসা করতে আমি অত্যন্ত পটু।”

তক্ষক বলল, “ব্রাহ্মণ, আমিই সেই তক্ষক; আমার বিষের তেজে আজ পরীক্ষিৎ দগ্ধ হবেন। আপনি ফিরে যান; আমি দংশন করলে আপনি তার চিকিৎসা করতে পারবেন না।”

ব্রাহ্মণ কাশ্যপ বললেন, “তুমি দংশন করলে আমি রাজাকে সুস্থ করতে পারব, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।”

তখন তক্ষক কাশ্যপকে বললে যে সে কিছু দংশন করবে, কাশ্যপকে তা বাঁচিয়ে দিতে হবে। এই বলে তক্ষক সম্মুখস্থ একটি বিরাট বটবৃক্ষকে দংশন করল। তক্ষকের প্রচণ্ড বিষে সমস্ত বটবৃক্ষটি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। তখন কাশ্যপ সেই ছাইগুলি একত্র করে মন্ত্র পড়তে আরম্ভ করলেন। মন্ত্রের মাহাত্মে গাছটিতে প্রথমে অঙ্কুর দেখা দিল, তারপর দুটি পাতা, তারপর বহু-পাতা, ছোট ছোট শাখা, শেষে বড় বড় শাখাযুক্ত গাছটি আপন স্থানে শোভা পেতে লাগল।

তক্ষক অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে ব্রহ্মাতুল্য শক্তিশালী বলে কাশ্যপকে প্রণাম করলেন এবং প্রশ্ন করলেন, কোন বস্তু লাভ করার জন্য কাশ্যপ সেখানে যাচ্ছেন? কাশ্যপ উত্তরে জানালেন যে ধনলাভের জন্যই রাজা পরীক্ষিৎ-এর কাছে যাচ্ছেন। তক্ষক বলল, পরীক্ষিৎ কাশ্যপকে যত অর্থ দিতেন, তিনি তার থেকে বেশি অর্থ কাশ্যপকে দেবেন। পরীক্ষিৎ-এর আয়ু শেষ হয়েছে। সুতরাং কাশ্যপও তাঁকে বাঁচাতে পারবেন না। এই কথা শুনে কাশ্যপ ধ্যানযোগে জানলেন যে পরীক্ষিৎ-এর আয়ু শেষ হয়েছে। তক্ষক কাশ্যপকে ইচ্ছানুযায়ী ধনদান করলেন। কাশ্যপ সেই স্থান থেকে চলে গেলেন।

তক্ষক বিদ্যুদ্বেগে পরীক্ষিতের প্রাসাদের দিকে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে শুনতে পেলেন যে বহুলোক পরীক্ষিৎকে রক্ষা করার জন্য সমবেত হয়েছেন। তখন তক্ষক বহু সংখ্যক নাগকে আহ্বান করে তাদের তপস্বীর বেশে প্রচুর ফল-মূল নিয়ে পরীক্ষিৎ-এর প্রাসাদে সেগুলি পৌঁছে দিতে আদেশ করলেন। তক্ষক সুক্ষ্ম একটি কৃষ্ণবর্ণ কৃমির বেশে একটি ফলের মধ্যে লুকিয়ে রইলেন। তপস্বীরূপী নাগেরা পরীক্ষিৎ-এর কাছে ফল-মূল পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিল।

রাজা তখন মন্ত্রী ও বন্ধুদের মধ্যে সেই ফলমূল বণ্টন করে দিয়ে দৈবপ্রেরিত হয়েই যে ফলটির মধ্যে তক্ষক নাগ কৃমি রূপে আত্মগোপন করে ছিলেন, সেই ফলটি আহারের জন্য স্বয়ং গ্রহণ করলেন। রাজা ফলটি ভক্ষণ করতে উদ্যত হলে ফলের ছিদ্র থেকে একটি কৃশ, ক্ষুদ্র, কৃষ্ণবর্ণনয়ন ও তাম্রবর্ণশরীর কৃমি আবির্ভূত হল। রাজা ফলের সঙ্গে সেই কৃমিটিকে হাতে করে বললেন, “সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। মৃত্যুতে আমার দুঃখও নেই, ভয়ও নেই। শৃঙ্গী মুনির বাক্য সত্য হোক, এই কৃমিটাই তক্ষক নাগ হয়ে আমাকে দংশন করুক। তা হলে শমীক মুনির প্রতি আমার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হবে।” —এই কথা বলে সেই ফলের সঙ্গে কৃমিটিকে পরীক্ষিৎ আপন গলায় রাখলেন। তখন তক্ষক আপন মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে রাজার কণ্ঠবেষ্টন করে ভয়ংকর গর্জন করে বিদ্যুদ্বেগে রাজাকে দংশন করল। পরীক্ষিৎ-এর মৃত্যু ঘটল।

পরীক্ষিতের মৃত্যুর পর তার পুত্র জনমেজয় হস্তিনাপুরের রাজা হন। জনমেজয় যৌবন প্রাপ্ত হয়ে কাশীরাজকন্যা বপুষ্টমাকে বিবাহ করেন। একদিন পুরোহিতদের প্রশ্ন করে জনমেজয় তাঁর পিতার মৃত্যুর কাহিনি জানতে পারেন। তক্ষক নাগের বিষদংশনে পিতার মৃত্যু হয়েছিল, এই কারণে জনমেজয় স্থির করেন তিনি তক্ষককে অগ্নিতে পুড়িয়ে মারবেন। পুরোহিতদের পরামর্শে জনমেজয় ‘সর্পসত্র’ যজ্ঞের আয়োজন করেন। অসংখ্য সর্প যজ্ঞে দেহ আহূতি দেন। কিন্তু মনসাপুত্র আস্তিকের পুণ্যপ্রভাবে তক্ষক জীবিত থাকতে পারেন। ব্রহ্মহত্যা জনিত পাপক্ষালনে জনমেজয় ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়নের কাছে কৃষ্ণকথা শুনতে চান।

*

এইখান থেকেই মহাভারত কাহিনির আরম্ভ। সমস্ত কাহিনিটি বৈশম্পায়ন ফ্ল্যাশব্যাকে বলতে আরম্ভ করেন। অর্থাৎ সাতপুরুষের কাহিনি বলতে আরম্ভ করেন বৈশম্পায়ন। পাণ্ডব-কাহিনি শুরু হয় রাজা শান্তনু থেকে। আধুনিক কালে বিভিন্ন দেশের উপন্যাসে ছোটগল্পে কাহিনি বর্ণনায় flash back বা medius res অর্থাৎ অতীতচারণা বা মধ্য ও শেষ থেকে কাহিনি শুরু করার যে রীতি অনুসৃত হয়ে থাকে, তা মহাভারতেই প্রথম অনুসৃত হয়। মহাপ্রস্থান পর্বে অভিমন্যুর পুত্রকে (পরীক্ষিৎ) রাজ্যভিষিক্ত করে যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুর ত্যাগ করেন। এরপর যুধিষ্ঠিরের স্বর্গারোহণ পর্যন্ত মহাভারতের কাহিনি শেষ। আবার পরীক্ষিৎ-এর মৃত্যু থেকে মহাভারত শুরু। পরীক্ষিৎ-পুত্র জনমেজয়ের সর্পসত্র শেষে বৈশম্পায়ন ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে জনমেজয়কে রক্ষা করার জন্য মহাভারত-কাহিনি বর্ণনা করে শোনান। অর্জুন পূর্বজন্মে মহাতপা নর ঋষি ছিলেন। অর্জুনের বংশধর পরীক্ষিতের হাতে হস্তিনাপুরের দায়িত্ব প্রদান করে যুধিষ্ঠির সংসার ত্যাগ করেন।


অলৌকিক-মাতা

মৎস্যগন্ধা সত্যবতী

প্রাচীনকালে চেদিরাজ্যে উপরিচর নামে এক পৃথিবীপালক সর্বদা ধর্মপরায়ণ, বেদপাঠে নিরত অথচ মৃগয়াশীল রাজা ছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র স্বয়ং তাঁর সখা ছিলেন। ইন্দ্রের পরামর্শে তিনি বসু অর্থাৎ পৃথিবীর অধিপতি বলে ইন্দ্র স্বয়ং তাঁকে উপরিচর বসু নাম দিয়েছিলেন। ইন্দ্রের উপদেশে উপরিচর বসু সমৃদ্ধ, সুন্দর ও শস্যাদিপূর্ণ চেদিরাজ্যে বাস করতেন। তিনি ছিলেন পুরুবংশীয় রাজা—স চেদিবিষয়ং রম্যাং বসুঃ পৌরবনন্দনঃ।

উপরিচর বসু অস্ত্র পরিত্যাগ করে তপোবনে গিয়ে তপস্যায় প্রবৃত্ত হন। সেই তপস্যার নিষ্ঠাতে দেবতারা বিচলিত হলেন। “ইন্দ্ৰত্ব করার যোগ্য এই রাজা ইন্দ্রত্বপদের কামনা করে, এই গুরুতর তপস্যায় মগ্ন হয়েছেন—” এই আশঙ্কা করে দেবরাজ ইন্দ্র অন্য দেবতাদের নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, “মহারাজ পৃথিবীতে ধর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না, কারণ আপনি সেই ধর্মকে ধারণ করে রেখেছেন। আপনার রক্ষিত ধর্ম জগৎকে রক্ষা করছে। আপনি সর্বদা উদ্‌যোগী, সতর্ক ও ধার্মিক থেকে ভূলোকে ধর্মকে রক্ষা করুন। পরিণামে আপনি পুণ্যলোক চিরস্থায়ী ব্ৰহ্মলোক দেখতে পাবেন।”

দেবরাজ আরও বললেন, “নরনাথ, আপনি ভূতলে আছেন আর আমি স্বর্গে আছি। তবুও আপনি আমার অত্যন্ত প্রিয় সখা। সেই জন্যই আপনাকে বলছি, যে দেশে ধর্মের নিয়ত অনুষ্ঠান হয়, যে দেশ পশুর পক্ষে হিতকর এবং যে দেশে প্রচুর ধনধান্য রয়েছে, যে দেশ স্বর্গের ন্যায় রক্ষণীয়, সুন্দর ও উর্বরা আপনি সেই দেশেই বাস করুন। হে চেদিরাজ! এই দেশে প্রয়োজনীয় সমস্ত বস্তুই পাওয়া যায়, ধন ও রত্নও রয়েছে; ভূমিতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ আছে। অতএব, আপনি এই চেদিরাজ্যেই বাস করুন। এই দেশের লোকেরা ধার্মিক, সাধু ও সদা আনন্দময়। এ দেশের মানুষ মিথ্যা কথা বলে না। পিতা পুত্রকে বিভক্ত করে দেন না, পুত্ৰও পিতার হিতে রত থাকে। কৃষকেরা গোরুকে ভারবহনের কার্যে নিযুক্ত করে না, দুর্বল গোরুকে সবল করে তোলে। সকল বর্ণের মানুষ আপন আপন ধর্ম পালন করে।

“মহারাজ আমি আপনার উদ্দেশে দিব্য একটি বিমান দান করে রেখেছি। বিমানটি স্ফটিক নির্মিত, দেবভোগ্য, আকাশগামী ও বিশাল। তা আপনার কাছে উপস্থিত হবে। আপনি মর্ত্যলোকের মধ্যে প্রধান; সুতরাং আপনি সেই মহাবিমানে আরোহণ করে মূর্তিমান দেবতার ন্যায় আকাশে বিচরণ করবেন। আর ‘বৈজয়ন্তী’ নামে একছড়া পদ্মের মালা আপনাকে দান করছি। এর একটি পাপড়িও কখনও বিবর্ণ হবে না, এই মালা আপনাকে যুদ্ধে অক্ষত অবস্থাতে রক্ষা করবে। এই মালা জগতে ‘ইন্দ্ৰমালা’ নামে বিখ্যাত এবং এই মালাই আপনার চিহ্ন হবে।” এ ছাড়াও ইন্দ্ৰ শিষ্ট ব্যক্তির পালনকর্তা হিসাবে ও দুষ্ট ব্যক্তির শাসনকর্তা হিসাবে উপরিচর বসুকে একটি ‘বংশযষ্টি’ দান করলেন। কার্যসিদ্ধি করে ইন্দ্র প্রস্থান করলেন।

রাজা উপরিচর বসুও ইন্দ্রদত্ত অলংকারে অলংকৃত হয়ে, ইন্দ্রদত্ত সেই বিমানে আরোহণ করে আপন রাজধানীতে ফিরে এলেন। রাজধানীতে প্রবেশ করে অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষে মহা উৎসবের সঙ্গে ইন্দ্রপূজা করে ইন্দ্রপ্রদত্ত সেই বেণুযষ্টিটি পুরীতে প্রবেশ করালেন। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত অন্য রাজারাও সেইভাবে পুরীর ভিতরে ইন্দ্রযষ্টি প্রবেশ করিয়ে থাকেন এবং তার পরের দিন বেতের ঝাঁপি, গন্ধ, মাল্য ও অলংকারদ্বারা অলংকৃত করে সেই ইন্দ্ৰযষ্টি উত্তোলন করেন এবং মালা দিয়ে তাকে পরিবেষ্টনও করেন।

উপরিচর রাজা, ফুলে ফুলে রাঙানো বস্ত্রদ্বারা সেই ধ্বজটিকে বেষ্টন করে দ্বাদশ মুষ্টি উঁচু বেদির উপর সেই ধ্বজটিকে তুলে রাখলেন। পরে খাদ্য, পেয় ও বস্ত্রদ্বারা ব্রাহ্মণদের সন্তুষ্ট করে তাঁদের দ্বারা পুণ্যাহ বাচন করে, সেই ধ্বজটিকে দাঁড় করালেন। তখন শঙ্খ, ভেরী ও মৃদঙ্গ বাজতে লাগল; এদিকে রাজা ধ্বজমূলে মাহাত্ম্যশালী—যষ্টিরূপী ইন্দ্রের পূজা করলেন—ভগবান পূজ্যতে চাত্র যষ্টিরূপেন বাসবঃ ॥ আদি: ৫৮: ২৬ ॥ আর, রাজা নিজেই বসুর প্রীতির জন্য পাদ্য-অর্ঘ্য প্রভৃতি উপাচারে দেবতাদের সঙ্গে মণিভদ্র প্রমুখ যক্ষের পূজা করলেন।

তখন নাগরিকেরা পুষ্প, মাল্য ধারণ করে, প্রার্থীদের নানাবিধ বস্তু দান করে, রাজার আদেশ অনুসারে বন্ধুবর্গের সঙ্গে জলে নেমে, বিভিন্ন মৎস্যকে নিয়ে খেলা করল, পরস্পর কৌতুকালাপ করে রাজাকে সন্তুষ্ট করল—আর সূত, বৈতালিক, নট ও নর্তকগণ দেশবাসীর সঙ্গে মিলে উৎসব করতে থাকল। রাজা উপরিচরও কুসুমদামে পরিপূর্ণ হয়ে, সমস্ত অঙ্গে হিঙ্গুল লেপন করে ভার্যাগণ, অন্তঃপুরের পরিজনগণ ও মন্ত্রিগণের সঙ্গে আমোদ করতে লাগলেন। এইভাবে চেদিরাজ্যে ইন্দোৎসব প্রচলিত হল।

দেবরাজ ইন্দ্র চেদিরাজকৃত এই মনোহর পূজা দেখে, শচীদেবীর সঙ্গে অপ্সরাগণ পরিবেষ্টিত হয়ে, পিঙ্গলবর্ণ-অশ্বযুক্ত বিমানে আরোহণ করে এসে, রাজশ্রেষ্ঠ উপরিচর বসুকে বলেন, “চেদিরাজ যে ভাবে আমার পূজা করলেন, যে রাজা মনুষ্যলোকে এই ভাবে পূজা করবেন বা করাবেন, তাঁদের সম্পদ ও জয়লাভ হবে, দেশ ধন-ধান্যপূর্ণ হবে, শস্য উপদ্রবশূন্য হবে, রাক্ষস বা পিশাচ তাদের কোনও প্রকারেই উৎপাত করতে পারবে না।”

আশীর্বাদ করে ইন্দ্র চলে গেলেন। যথাসময়ে নির্বিঘ্নে চেদিরাজের পূজাও সমাপ্ত হল। উপরিচর বসুর পাঁচ পুত্র ছিল। তিনি তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে অভিষিক্ত করেছিলেন। তিনি ইন্দ্রদত্ত বিমানে চড়ে নগরীর উপরে বিচরণ করতেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল—“উপরিচর রাজা।” তাঁর রাজ্যের পাশ দিয়ে ‘শুক্তিমতী” নামে একটি নদী প্রবাহিত হত। কোলাহল নামে এক চৈতন্যশালী পর্বত কামের আবেগে শুক্তিমতীকে ধর্ষণ করে ও আবদ্ধ করে। রাজা উপরিচর সেই কথা শুনে কোলাহলকে প্রচণ্ড পদাঘাত করেন। সেই পদাঘাতে কোলাহলের দেহ বিদীর্ণ হয়। সেই বিদীর্ণ দেহের রন্ধ্রপথে শুক্তিমতী বেরিয়ে আসে। শুক্তিমতীর গর্ভে কোলাহলের একটি পুত্র ও একটি কন্যার জন্ম হল। পর্বত থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন বলে শুক্তিমতী আপন পুত্র ও কন্যা রাজাকে দান করল। সদ্য ভূমিষ্ঠ সেই শিশু দুটি সদ্যই যৌবনলাভ করে। রাজা পুত্রটিকে আপন সেনাপতি করেন ও অপূর্ব রূপলাবণ্যবতী কন্যাটিকে আপন ভার্যা হিসাবে গ্রহণ করেন। পর্বতের কন্যা বলে তার নাম হয়েছিল গিরিকা।

তারপর একদিন উপরিচর বসুর পত্নী গিরিকা ঋতুস্নান করে পবিত্র হয়ে পুত্র উৎপাদনের জন্য রাজাকে রমণের সময় জানালেন। সেই দিনই রাজার পিতৃপুরুষগণ এসে সন্তুষ্ট চিত্তে রাজাকে বললেন, “তুমি আজ মৃগ বধ করো।” পিতৃপুরুষগণের আদেশে রাজা গিরিকাকে ছেড়েই মৃগয়া করতে চলে গেলেন। কিন্তু মনে কামের আবেগ থাকল। সাক্ষাৎ দ্বিতীয় লক্ষ্মীর মতো অত্যন্ত সুন্দরী গিরিকাকে চিন্তা করতে করতেই মৃগয়ায় গেলেন। মৃগয়ার পথে তিনি কুবেরের উদ্যানের মতো অত্যন্ত সুন্দর একটি বন দেখতে পেলেন। সেই বনে অশোক, চম্পক, আম্র, তিনিস, পুন্নাগ, কর্ণিকার, বকুল, পারুল, কাঁঠাল, নারকেল, চন্দন ও অর্জুন প্রভৃতি বহুতর মনোহর, পবিত্র ও সুস্বাদুফলযুক্ত বৃক্ষ ছিল। একে বসন্তকাল, কোকিলগণ আকুল হয়ে রব করছিল, মত্ত ভ্রমরগণ গুনগুন করে বেড়াচ্ছিল। রাজার সমস্ত দেহ-মন কামতপ্ত হয়ে উঠল—কিন্তু তিনি গিরিকাকে দেখতে পেলেন না।

কামসন্তপ্ত রাজা মনোহর একটি অশোবৃক্ষ দেখতে পেলেন। তার শাখার অগ্রভাগ পুষ্পবৃত ছিল, পল্লবে শোভা পাচ্ছিল এবং বহুতর পুষ্পগুচ্ছে আবৃত ছিল। সেই অশোকবৃক্ষের তলায় বসে, মধু ও পুষ্পের সৌরভবাহী বায়ু সেবন করতে করতে রাজার উত্তেজনা জন্মাল। তিনি মনে মনে স্ত্রীসম্ভোগ সুখ অনুভব করতে লাগলেন। তাতে সেই গভীর বনমধ্যে তার শুক্রপাত হল। “আমার শুক্র নিস্ফল না হয়”—এই ভেবে রাজা, পড়বার সময়েই সেই শুক্র কোনও বৃক্ষপত্রে ধারণ করলেন—“স্কন্নমাত্রঞ্চ তদ্রেতো বৃক্ষপত্রেন ভূমিপঃ/প্রতিজগ্রাহ মিথ্যা মে ন পতেদ্রেত ইব্যুত ॥ আদি: ৫৮: ৬৪ ॥

রাজা অঙ্গুলি দ্বারা সেই শুক্র সংযত করলেন এবং অশোকের রক্তপল্লবদ্বারা সেই পত্রটিকে বন্ধন করলেন। রাজা ধর্মের সূক্ষ্মতত্ত্ব জানতেন এবং নিজের বীর্য যে অব্যর্থ তাও জানতেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, “আমার এই শুক্র নিস্ফল যেন না হয় এবং মহিষীর ঋতুও যেন ব্যর্থ না হয়।” এই ভেবে রাজশ্রেষ্ঠ বসু বারবার কর্তব্য বিষয় পর্যালোচনা করে এবং মহিষীর গর্ভধারণের সময় এই, এই ভেবেই সেই শুক্রকে অভিমন্ত্রিত করে, তা পাঠাবার জন্য নিকটবর্তী শীঘ্রগামী এক শ্যেনপক্ষীর কাছে গিয়ে তাকে বললেন, “হে সৌম্যমূর্তি শ্যেন, তুমি আমার সন্তোষের জন্য এই শুক্র আমার গৃহে পত্নী গিরিকার কাছে নিয়ে যাও।”

তখন সেই বেগবান শ্যেনপক্ষী সেই শুক্র নিয়ে দ্রুত আকাশে উঠে মহাবেগে যেতে লাগল। অন্য এক শ্যেনপক্ষী, পূর্বের শ্যেনপক্ষীটিকে বেগে আসতে দেখল; শ্যেনপক্ষীর চরণে সেই বন্ধন করা পত্রটিকে দেখে মাংস বলে মনে করে তাকে আক্রমণ করল। তখন দুই শ্যেনপক্ষীই চঞ্চদ্বারা আকাশে যুদ্ধ আরম্ভ করল। ফলে উপরিচর বসু প্রেরিত শ্যেনপক্ষীর চরণ থেকে সেই শুক্র যমুনার জলে পড়ে গেল।

তখন অদ্রিকা নাম কোনও প্রধান অপ্সারা, কোনও ব্রাহ্মণের শাপে মৎসী হয়ে যমুনার জলে বাস করছিল। মৎস্যরূপিণী সেই অদ্রিকা বেগে এসে, পূর্ব শ্যেনপক্ষীর চরণ থেকে পতিত বসুরাজার সেই শুক্র মুখদ্বারা গ্রহণ করল। এই ঘটনার দশ মাস পরে মৎস্যরূপিণী সেই অপ্সারা জেলেদের জালে ধরা পড়ল। তখন তার উদরের ভিতর থেকে একটি পুরুষ ও একটি নারী বের হল। ছেলেরা রাজা উপরিচর বসুর কাছে গিয়ে সেই অদ্ভুত বৃত্তান্ত জানাল, “মহারাজ মৎসীর পেটের ভিতর এই মানুষ দুটি জন্মেছে।” উপরিচর বসু তখন সেই মানুষ দুটিকে গ্রহণ করলেন। সেই পুরুষটিই পরে মৎস্য নামে ধার্মিক ও সত্যপ্রতিজ্ঞ রাজা হয়েছিলেন। আর, সেই অপ্সরাও তৎক্ষণাৎ শাপমুক্ত হয়েছিল। কেন না, অভিসম্পাতকারী ব্রাহ্মণ শাপ দেবার সময় সেই অপ্সরাকে বলেছিলেন, “তুমি মৎস্য হয়ে, দুটি মানুষের জন্ম দেবে। তারপর শাপ থেকে মুক্তি লাভ করবে।”

সুতরাং সেই প্রধানা অপ্সরা মৎস্যরূপ পরিত্যাগপূর্বক স্বর্গীয় নিজ রূপ ধারণ করে আকাশপথে চলে গেল। “এই কন্যাটি তোমার হোক” এই কথা বলে, মৎসীগর্ভজাতা সেই কন্যাটিকে ধীবরের কাছে সমর্পণ করলেন উপরিচর বসু।

*

সেই কন্যাটির রূপ, উৎসাহ ও সমস্ত গুণ ছিল এবং তার নাম হল সত্যবতী। আর মৎসীর পেটে জন্ম হওয়ায় এবং মৎস্যঘাতীদের আশ্রয়ে থাকার জন্য কিছু লোক তাকে মৎস্যগন্ধা বলেও ডাকত। পরে ঋষি পরাশরের সঙ্গে মিলনের পূর্বে পরাশরের বরদানের ফলে তিনি পদ্মগন্ধা বা যোজনগন্ধা নামে খ্যাতি লাভ করেন।

সত্যবতী রাজরক্তে জাতা এবং ক্ষত্রিয় কন্যা। সত্যবতী রাজকন্যা। তার পিতার নাম চেদিরাজ—উপরিচর বসু, মাতা স্বর্গভ্রষ্টা অপ্সরা অদ্রিকা। সত্যবতীর জন্ম মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত। সত্যবতীর কানীন পুত্র ব্যাসদেব। আপন পুত্র বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর সত্যবতীর আদেশে ব্যাসদেব বিধবা দুই রাজমহিষীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর জন্মদান করেন। মহাভারতের যুদ্ধ সত্যবতীর দুই বংশধরের মধ্যে যুদ্ধ।


ব্যাসদেবের জন্ম

তপসা ব্রহ্মচর্য্যেন ব্যস্য বেদং সনাতনম্‌।
ইতিহাসম্‌ইমং চক্রে পুণ্যং সত্যবতীসুতঃ ॥ আদি:১: ৫৪ ॥

সত্যবতী-নন্দন ব্যাসদেব আপন তপস্যা এবং ব্রহ্মচর্যের প্রভাবে সনাতন বেদশাস্ত্রকে বিভক্ত করে এই পুণ্যজনক ইতিহাস মহাভারত রচনা করেন।

ব্যাসের বৃত্তান্ত বর্ণনার পূর্বে বেদের উল্লেখের প্রয়োজন আছে। বেদের সঙ্গে মহাভারতের একটা সনাতন সম্পর্ক আছে। মহাভারতের ইতিবৃত্তের মাঝে মধ্যেই বেদের অনেক ঘটনা, অনেক রূপক, অনেক ঋক বারংবার উচ্চারিত হয়েছে। সনাতন মতে বিশ্বাসী হলে বলতে হয়, মহাভারত রচনার সময়ে ব্যাসদেবের সামনে ছিল বেদ, রামায়ণ আর কিছু পুরাণকথা। অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে ব্যাস সেগুলি ব্যবহার করেছেন।

বেদের সময়ে আর্য-অনার্য দুটি যুধ্যমান জাতি—আক্রমণকারী ও আক্রান্ত, বিজেতা ও বিজিত। রামায়ণেই সর্বপ্রথম দেখা গেল, আর্য-অনার্যের মধ্যে বন্ধুত্ব হল আর্যরাজপুত্রের বিপদকালে—আর্য প্রভু, অনার্য ভক্ত। মহাভারতের যুগে এসে দেখা গেল ততদিনে সব রং মিলেমিশে শ্যামল হয়ে গেছে, যা ভারতের জাতীয় রং। আর্যপরাশর এবং অনাৰ্যপালিতা সত্যবতীর মিলনে জন্ম নিলেন এক কৃষ্ণোজ্জ্বল পুরুষ—কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। তাঁর রক্তে বইছে গঙ্গা গোদাবরীর দু’ধারা। তিনি বুঝলেন, বেদামৃতকে ব্রাহ্মণদের মধ্যে আটকে রাখা অন্যায়। আর্য অনার্য—সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে বেদের বিজ্ঞানকে। তাই, রচনা করলেন মহাভারত—ইতিহাসম্‌ ইমং—ইতিহাসের আখ্যান যজ্ঞে বেদের নির্যাস নিয়ে— সে আর এক অমৃত নিঃসারী প্রপা।

মহাভারতকার ব্যাসদেব সত্যবতীর কানীন পুত্র। সত্যবতী ছিলেন ধীবররাজের পালিতা কন্যা। মৎস্যঘাতীদের সঙ্গে থেকে তাঁর গায়ে সব সময়েই মাছের আঁশটে গন্ধ ম ম করত। তাই তাঁর নাম হল মৎস্যগন্ধা। কিন্তু কন্যার রূপ, গুণ আর উৎসাহের সীমা ছিল না— “রূপসত্বসমাযুক্তা সব্বৈঃ সমুদিতা গুণৈঃ।” রূপ তার ছিল অসাধারণ, মুনিঋষিদেরও মন টলে যেত—

অতীবরূপসম্পন্নাং সিদ্ধানামপি কাঙিক্ষতাম। আদি: ৫৮: ৮৪॥

পরিশ্রান্ত পিতা ধীবরবাজকে অবসর দেওয়ার জন্য সত্যবতী মাঝে মধ্যেই যমুনানদীতে খেয়া পারাপার করতেন। একদিন মুনিশ্রেষ্ঠ পরাশর তীর্থযাত্রাপথে তাঁর নৌকায় উঠলেন। একা যাত্রী। উত্তাল যমুনা। সম্মুখে, দাঁড় চালানোর অপূর্ব ভঙ্গিমায় সঞ্চারিণী চারুহাসিনী কন্যা—কদলীকাণ্ডসদৃশ রম্ভোরু, সর্বাঙ্গে যৌবনের চড়াই-উৎরাই, সুশ্রোণী— শ্রমে চাঁদপানা মুখখানি বিন্দু বিন্দু মুক্তোঘামে পরিপূর্ণ। পরাশর কামমোহিত হলেন।

দৃষ্ট্বৈব স চ তাং ধীমাংশ্চকমে চারুহাসিনীম্‌।

দিব্যাং তাং বাসবীং কন্যাং রম্ভোরূং, মুনিপুঙ্গবঃ ॥ আদি: ৫৮; ৮৫ ॥

পরাশর মুনি মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থেকে মধুর হেসে বললেন, কল্যাণী, বসুনন্দিনী, তুমি নৌকা বাইছো কেন? পাটনি কোথায়?

সত্যবতী চোখ বড় বড় করে বললেন—হে মহামুনি, আপনি আমাকে বসুনন্দিনী বলছেন কেন? আমি তো ধীবররাজের কন্যা। কামার্ত পরাশর সত্যবতীর পাশে গিয়ে বসলেন। বললেন, ‘সুন্দরী তুমি ধীবরের কন্যা নও। তুমি রাজ-রক্ত জাতা। সম্ভ্রান্ত বংশে তোমার জন্ম। তোমার পিতা ভুবন-বিখ্যাত সম্রাট ইন্দ্রসখা উপরিচর বসু, তোমার মাতা অপ্সরাবরিষ্ঠা অদ্রিকা।” মুগ্ধা সত্যবতী আরও বেশি করে আপন জন্মবৃত্তান্ত জানতে চাইলেন। পরাশর বললেন, “শোনো বাসবীকন্যা, একবার রূপসীশ্রেষ্ঠা অপ্সরা অদ্রিকা কোনও এক ব্রাহ্মণের শাপে মৎসী হয়ে যমুনার জলে বাস করছিলেন। সে সময়ে দৈবাৎ চেদিসম্রাট উপরিচর বসুর রেতঃ যমুনার জলে পড়ে। মৎসী অদ্রিকা এসে তা খেয়ে ফেলেন। তারপর, দশ মাস পূর্ণ হলে ধীবররাজের জালে মৎসীরূপী অদ্রিকা ধরা পড়েন এবং তার পেট থেকে তোমাকে পাওয়া যায়। সেই জন্যই তুমি মৎস্যগন্ধা। তোমার মা অভিশাপমুক্ত হয়ে মীনভাব ত্যাগ করে স্বর্গে চলে গিয়েছেন।

সত্যবতীর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে বিভিন্ন মহাভারত চর্চাকার অন্যমনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন। সত্যবতীকে দাস-রাজকন্যা ও শূদ্রা বলে চিহ্নিত করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু মহাভারত কাহিনি অনুযায়ী সত্যবতী ক্ষত্রিয় রাজকন্যা। তাঁর পিতা চেদিরাজ উপরিচর বসু। উপরিচর বসু ইন্দ্রসখা ছিলেন। মাতা স্বর্গের অপ্সরাশ্রেষ্ঠা অদ্রিকা। অদ্রিকা তাঁকে দাস রাজার কাছে দিয়ে গিয়েছিলেন। সত্যবতী দাস রাজার পালিতা কন্যা।

পরাশর-সত্যবতীর পুত্র ব্যাসদেবকে স্বয়ং নারায়ণের অবতার বলে সর্বত্রই স্বীকার করা হয়েছে। দেবী ভাগবতের মতে—

“অষ্টাদশ-পুরাণানি কৃত্বা সত্যবতীসুতঃ।

ভারতাখ্যানমতুলং চক্রে তদুপবৃংহিতম্‌॥

অর্থাৎ সত্যবতীর পুত্র ব্যাসদেব আঠারোটি পুরাণ রচনা করার পর সেই পুরাণতত্ত্বকে আরও ব্যাখ্যা করার জন্য মহাভারত রচনা করেছিলেন। অলোক-সামান্য প্রতিভা না থাকলে এতগুলি পুরাণ ও মহাভারত রচনা করা সম্ভব নয়, তাই বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে:

“কৃষ্ণদ্বৈপায়নং ব্যাসং বিদ্ধি নারায়ণং প্রভুম্‌।”

অর্থাৎ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবকে স্বয়ং নারায়ণের অবতার মনে করবে।

মহাভারতম্‌ পড়তে পড়তে বিভিন্ন বিচার ও ভবিষ্যদ্বাণী শুনে বার বার মনে হয়, এত নির্ভুল বিচার ভগবান ছাড়া কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। মনে হয়, ব্যাসদেব যেন ভগবান স্বয়ং।

তোমার মা শাপমুক্ত হয়ে, তোমাকে দাসরাজার কাছে দিয়ে ভুবনমোহিনী রূপ নিয়ে আবার স্বর্গে চলে যান। সেই কারণেই তুমি মাকে দেখনি।

সত্যবতীর পদ্মকোষতুল্য আয়ত চোখ দুটি আহত বিস্ময়ে ছলছল করে উঠল। রক্তাভ ঠোঁটে চুর্ণ অভিমান। তিনি আরও জানতে চাইলেন। পরাশর বললেন—“বসুনন্দিনী, তারও আগে তুমি ছিলে পিতৃলোকের মানসীকন্যা—অচ্ছোদা। তোমা থেকেই অচ্ছোদ সরোবর সৃষ্টি হয়েছিল। তুমি যুগভ্রষ্টা দেবী। দৈব নির্দিষ্ট আছে যে—তুমি পরাশর মুনির ঔরসে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেবে। সেই পুত্র ব্রহ্মর্ষি হয়ে বেদকে চার ভাগে ব্যাস করে প্রভূত কল্যাণসাধন করবে।

তস্মাৎ বাসবি! ভদ্রং তে যাচে বংশকরং সুতম।

সঙ্গমং মম, কল্যাণি! কুরুস্ব—ইতি অভিভাষত। আদি: ॥ ৫৮; ১১১ ॥

অতএব বসুকন্যা তোমার মঙ্গল হোক—আমি তোমার কাছে একটি বংশরক্ষক পুত্র প্রার্থনা করি। কল্যাণি! তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গম করো।

শুনে সত্যবতীর সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হল। দেবতার নির্দেশ। ততক্ষণে নৌকা মাঝনদীতে চলে এসেছে। সত্যবতীর দাঁড়টানা দু’হাত স্তব্ধ, শিথিল। সমস্ত অনুভূতিতে তার অকথিত বিস্ময়। সূর্যালোকে নদীর দুই পার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দু’পারেই মুনি ঋষিরা উপস্থিত আছেন। মৃদুকণ্ঠে সত্যবতী বললেন—

গশ্য ভগবন্‌! পরপারে স্থিতান ঋষীণ

আবয়োৰ্দৃষ্টয়োরেভিঃ কথং নু স্যাৎ সমাগমঃ? ॥ আদি: ৫৮:১১২ ॥

ভগবন্‌! চেয়ে দেখুন, দু’পারেই ঋষিরা রয়েছেন। ওঁরা দেখতে থাকলে কী করে আমাদের সঙ্গম হবে?

মহর্ষি পরাশর বুঝলেন মিলনে সত্যবতীর অসম্মতি নেই। তিনি তখনই তপস্যার প্রভাবে সমস্ত স্থানটি কুয়াশায় ঢেকে দিলেন—এপার ওপার দিকচরাচর কোনও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পরাশরের ক্ষমতায় সত্যবতী স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি বুঝলেন, মিলন অবশ্যম্ভাবী। আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা করে বললেন—

বিদ্ধি মাং ভগবন্‌! কন্যাং সদা পিতৃবশানুগম্‌।

ত্বৎসংযোগাৎ চ দূধ্যেত কন্যাভাবো মম, অনঘ! ॥ আদি: ৫৮; ১১৫ ॥

ভগবন্‌। আমি কুমারী, বিশেষত সর্বদাই পিতার অধীন হয়ে চলি। আপনার সঙ্গে সংসর্গ করলে আমার কন্যাত্ব যে দূষিত হয়ে যাবে, তার কী হবে?

পরাশর আশীর্বাদ করে বললেন, “হে ভয়শীলে! তুমি আমার প্রিয় কার্য করে কন্যাই থেকে যাবে। হে অনুরাগিণী, তুমি যে বর ইচ্ছা কর, তাই গ্রহণ করো।”

সত্যবতী সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনা করলেন যে তার গায়ের মৎস্যগন্ধ দূর হয়ে পদ্মগন্ধ আসুক। পরাশরের আশীর্বাদে পদ্মের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। সেই থেকে সত্যবতীর নাম হল যোজন গন্ধা।

সুগন্ধ লাভ করে সত্যবতী মনপ্রাণ উজাড় করে সমাগত ঋষিকে উপগমে গ্রহণ করলেন—রমণকালীন প্রগল্‌ভতা, ধৃষ্টতা প্রভৃতি মনোহর নারীসুলভ ললিত রতিকলা প্রয়োগ করে, সুরতে প্রতিস্পর্ধিনী হয়ে, সত্যবতী পরাশরকে তৃপ্ত করলেন। কুয়াশা ঢাকা যমুনার ঢেউদোলা প্রেমে জন্ম হল বিশ্ববিখ্যাত বাদরায়ণ বেদব্যাসের। মহর্ষির সঙ্গমে তৎক্ষণাৎ গর্ভবতী সত্যবতী পুত্র প্রসব করলেন। দ্বীপে জন্ম বলে তার নাম হল দ্বৈপায়ন। গাত্রবর্ণ কৃষ্ণ বলে নাম হল কৃষ্ণ। পরবর্তীকালে অখণ্ড বেদকে চার ভাগে ভাগ করে তাঁর নাম হয় বেদব্যাস।

*

জন্মমাত্র ব্যাস পিতার সঙ্গে চলে গেলেন। যাত্রাকালে মাতাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন— মাতা স্মরণ করা মাত্র তিনি উপস্থিত হবেন। এইভাবে, অতুলনীয় জ্ঞান, ক্রান্তদর্শী, পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ, সর্বজ্ঞ, মহাভারত ও ভাগবত রচনাকার ব্যাসদেবের জন্ম হল।

ব্যাসদেবের জন্ম তাই মহাভারতের সর্বাপেক্ষা দুর্লভ মুহূর্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *