৮০. শল্য-বধ

৮০
শল্য-বধ

সপ্তদশ দিনের যুদ্ধে, বেলাশেষে, অর্জুনের তীক্ষ্ণ ‘অঞ্জলিক’ বাণ সেনাপতি কর্ণের মস্তক হরণ করল। অশ্রুভারাক্রান্ত দুর্যোধন শিবিরে ফিরলেন। দুর্যোধনের বড় বিশ্বাস ছিল, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ স্নেহবশত পাণ্ডবদের না-মারলেও কর্ণ তাঁদের বধ করতে সমর্থ হবেন। কর্ণের পতনে দুর্যোধন নিশ্চিত পরাজয় চোখের উপর দেখতে পেলেন। কিন্তু দুর্যোধন অত্যন্ত স্বাভিমানী রাজা ছিলেন। ভীষ্মের সন্ধির প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেননি, অশ্বত্থামার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছেন। কর্ণের মৃত্যুর পর কৃপাচার্য দুর্যোধনকে সন্ধি করতে পরামর্শ দিলেও, দুর্যোধন সে-প্রস্তাবও গ্রহণ করলেন না। অশ্বত্থামার পরামর্শ অনুযায়ী মদ্ররাজ শল্যকে কৌরব সেনাপতি পদে বরণ করলেন। দুর্যোধন বললেন, “যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ মাতুল, আপনি অতুলনীয় বীর। সুতরাং, আমি আপনাকে সেনাপতিরূপে বরণ করছি। কার্তিক যেমন যুদ্ধে দেবগণকে রক্ষা করতেন, সেইরকম আপনি যুদ্ধে আমাদের রক্ষা করুন।”

তখন শল্য বললেন, “দুর্যোধন! মহাবাহু! বাগ্মিশ্রেষ্ঠ! তুমি এই যে রথারোহী কৃষ্ণ ও অর্জুনকে রথীশ্রেষ্ঠ বলে মনে করো, কিন্তু এঁরা বাহুবলে আমার তুল্য নয়। আমি ক্রুদ্ধ হয়ে সৈন্যসম্মুখে থেকে যুদ্ধোদ্যত দেবতা, অসুর ও মানুষগণের সঙ্গে, সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি, পাণ্ডবেরা তো কোন ছার। সে যাই হোক, আমি তোমার সেনাপতি হব এবং যুদ্ধে সমাগত পাণ্ডব, ও সোমকদের জয় করব; এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমি এমন ব্যূহ নির্মাণ করব, যা পাণ্ডবেরা অতিক্রম করতে পারবে না।” আনন্দিত দুর্যোধন শল্যকে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করলেন। ওদিকে যুধিষ্ঠির কৌরবদের সিংহনাদ শুনে সমস্ত ক্ষত্রিয়ের সামনে কৃষ্ণকে বললেন, “মাধব! দুর্যোধন মহাধনুর্ধর সর্বসৈন্য সম্মানিত মদ্ররাজ শল্যকে সেনাপতি করেছেন। এই জেনে, যা সম্ভব ও সঙ্গত তা করো; কারণ তুমিই আমাদের পরিচালক ও রক্ষক।

তখন কৃষ্ণ রাজা যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “ভরতনন্দন, আমি শল্যকে যথাযথভাবে জানি। তিনি বলবান, মহাতেজা, মহাত্মা, বিশেষত যুদ্ধনিপুণ, বিচিত্রযোধী এবং লঘুহস্ত যুক্ত। যুদ্ধে ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণ যেমন ছিলেন, শল্য তেমনই। অথবা শল্য তাঁদের অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। ভরতনন্দন রাজা, আমি চিন্তা করেও যুধ্যমান শল্যের সমান যোদ্ধা দেখতে পাচ্ছি না। শল্য বলে ভীম, অর্জুন, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং শিখণ্ডী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। প্রলয়কালে সংহারমূর্তি রুদ্র যেমন ক্রুদ্ধ হয়ে লোকমধ্যে বিচরণ করেন। সিংহ ও হস্তীর ন্যায় বিক্রমশালী শল্যও তেমনই নির্ভয়চিত্তে যুদ্ধকালে বিচরণ করবেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ! আপনি ব্যাঘ্রের ন্যায় বিক্রমশালী। সুতরাং আপনি ছাড়া শল্যের প্রতিযোদ্ধা আমি কাউকেই দেখছি না। যুদ্ধে শল্যকে বধ করার উপযুক্ত পুরুষ, কেবলমাত্র আপনিই। শল্য প্রত্যহ যুদ্ধ করতে থেকে আপনার সৈন্য বিক্ষুব্ধ করে আসছেন। সুতরাং ইন্দ্র যেমন শম্বরাসুরকে বধ করেছিলেন, তেমন আপনিও যুদ্ধে শল্যকে বধ করুন। দুর্যোধন কর্ণের পরে ওই বীরকে সেনাপতি করে সম্মানিত করেছেন। সুতরাং আপনি যুদ্ধে শল্যকে বধ করলে নিশ্চয়ই আপনার জয় হবে। কারণ মহারাজ শল্য নিহত হলে, দুর্যোধনের বিশাল সৈন্যই নিহত হবে। সুতরাং মহাবাহু যুদ্ধে মনোযোগ দিন এবং ইন্দ্র যেমন নমুচি দানবকে বধ করেছিলেন তেমনই শল্যকে বধ করুন। ‘মাতুল’ এই ভেবে দয়া করবেন না। ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ রূপ সমুদ্র থেকে উত্তীর্ণ হয়ে শল্যরূপ গোষ্পদে নিমগ্ন হবেন না। শল্যকে বধ করুন।” কর্ণ বধে আনন্দিত পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ সে রাত্রে সুখে নিদ্রা গেলেন।

পরদিন প্রভাতে কৃপ কৃতবর্মা অশ্বত্থামা শল্য শকুনি প্রভৃতি দুর্যোধনের সঙ্গে মিলিত হয়ে এই নিয়ম করলেন যে, তাঁরা কেউ একাকী পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না, পরস্পরকে রক্ষা করেই মিলিত হয়ে যুদ্ধ করবেন। শল্য সর্বতোভদ্র নামক ব্যূহ রচনা করলেন এবং মদ্রদেশীয় বীরগণ ও কর্ণপুত্রদের সঙ্গে ব্যূহের সম্মুখে রইলেন। ত্রিগর্ত সৈন্য সহ কৃতবর্মা ব্যূহের বামে, শক ও যবন সৈন্য সহ কৃপাচার্য দক্ষিণে, কাম্বোজ সৈন্য সহ অশ্বত্থামা পৃষ্ঠদেশে এবং কুরুবীরগণ সহ দুর্যোধন ব্যূহের মধ্যদেশে অবস্থান করলেন। পাণ্ডবগণও নিজেদের সৈন্য ব্যূহবদ্ধ ও দ্বিধা বিভক্ত করে অগ্রসর হলেন। কৌরবপক্ষে এগারো হাজার রথী, দশ হাজার সাতশো গজারোহী, দু’লক্ষ অশ্বারোহী ও তিন কোটি পদাতি এবং পাণ্ডবপক্ষে ছ’ হাজার রথী, ছ’হাজার গজারোহী, দশ হাজার অশ্বারোহী ও দু’কোটি পদাতি অবশিষ্ট ছিল।

দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হল। কর্ণপুত্র চিত্রসেন, সত্যসেন ও সুশৰ্মা নকুলের হাতে নিহত হলেন। পাণ্ডবপক্ষের গজ অশ্ব রথী ও পদাতি সৈন্য শল্যের বাণে নিপীড়িত ও বিচলিত হল। সহদেব শল্যের পুত্রকে বধ করলেন। ভীমের গদাঘাতে শল্যের চার অশ্ব নিহত হল, শল্যও তোমর নিক্ষেপ করে ভীমের বক্ষ বিদ্ধ করলেন। বৃকোদর অবিচলিতভাবে, সেই তোমর টেনে নিলেন এবং তারই আঘাতে শল্যের সারথির হৃদয় বিদীর্ণ করলেন। পরস্পরের প্রহারে দু’জনেই আহত হলেন, তখন কৃপাচার্য শল্যকে নিজের রথে তুলে নিয়ে চলে গেলেন। ক্ষণকাল পরে ভীমসেন উঠে দাঁড়ালেন এবং মত্তের মতো বিহ্বল হয়ে মদ্ররাজকে আবার যুদ্ধে আহ্বান করলেন।

দুর্যোধনের প্রাসের আঘাতে যাদববীর চেকিতান নিহত হলেন। শল্যকে মধ্যবর্তী করে কৃপাচার্য, কৃতবর্মা ও শকুনি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে এবং তিন হাজার রথী সহ অশ্বত্থামা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের ও কৃষ্ণকে ডেকে বললেন—

যথাভাগং যথোৎসাহং ভবন্তঃ কৃতপৌরুষাঃ।

ভাগোহবশিষ্ট একোহয়ং মম শল্যো মহারথঃ॥

সোহহমদ্য যুধা জেতুমাশংসে মদ্রকেশ্বরম্‌।

তত্র যন্মানসং মহং তৎ সর্বং নিগদামি বঃ॥ শল্য : ১৪:১৭-১৮॥

—“আপনারাও ভাগ অনুসারে এবং উৎসাহ অনুসারে পুরুষকার দেখিয়েছেন। এখন আমার ভাগের একমাত্র এই মহারথ শল্য অবশিষ্ট আছেন। সুতরাং আজ আমি যুদ্ধে সেই শল্যকে জয় করতে ইচ্ছা করি। অতএব সে বিষয়ে যে যে সংকল্প আছে, সেসকল আপনাদের বলছি।”

“বীর, ইন্দ্রেরও অজেয় এবং বীরপ্রিয় এই নকুল ও সহদেব আমার চক্ররক্ষক আছেন। সম্মানযোগ্য ও সত্যপ্রতিজ্ঞ এই বীরেরা যুদ্ধে ক্ষত্রিয় ধর্মকে প্রধান করে আমার জন্য মাতুলের সঙ্গে সমীচীনভাবে যুদ্ধ করবেন। হে লোকবীরগণ! আপনাদের মঙ্গল হোক; আপনারা আমার এই সত্য বাক্য শ্রবণ করুন— আজ যুদ্ধে শল্য আমাকে বধ করবেন, কিংবা আমি তাঁকে বধ করব। আজ আমি জয়লাভ কিংবা মৃত্যুর জন্য ক্ষত্রিয়ধর্ম অনুসারে মাতুল শল্যের সঙ্গে যুদ্ধ করব। অতএব রথযোজক ভৃত্যেরা যুদ্ধশাস্ত্র অনুসারে সত্বর আমার রথে প্রচুর অস্ত্র ও সমস্ত উপকরণ সংস্থাপন করুক। সাত্যকি আমার দক্ষিণ চক্র এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন বামচক্র রক্ষা করুন, আর পৃথানন্দন অর্জুন আজ আমার পৃষ্ঠরক্ষক হোন। অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ ভীম আজ আমার অগ্রবর্তী হোন— এই ব্যবস্থায় আমি শল্য থেকে প্রধান হব।” যুধিষ্ঠির একথা বললে তাঁর প্রিয়াভিলাষী ভৃত্যেরা সকল সেই ইচ্ছানুযায়ী কার্য করল।

তারপরে পাঞ্চালেরা শঙ্খ, ভেরি ও শত শত পুস্কল বাজাতে লাগল এবং সিংহনাদ করতে লাগল। ক্রমে সেই বলবান পাঞ্চালেরা উৎসাহী হয়ে গজঘণ্টার শব্দে, শঙ্খের নিনাদে ও বিশাল তূর্যধ্বনিতে সমরভূমি নিনাদিত করে হর্ষজাত বৃহৎ কোলাহলের সঙ্গে শল্যের দিকে ধাবিত হলেন। তখন উদয়পর্বত ও অস্ত্রপর্বত যেমন বহুতর বিশাল মেঘকে গ্রহণ করে, সেইরকম কুরুরাজ দুর্যোধন ও বলবান শল্য তাঁদের গ্রহণ করলেন। ইন্দ্র যেমন পর্বতের উপর জলবর্ষণ করেন, তেমন সমরশ্লাঘী শল্য শত্রুদমন যুধিষ্ঠিরের উপর বাণবর্ষণ করতে থাকলেন। মহামনা দুর্যোধনও সুন্দর ধনু ধারণ করে দ্রোণের নানাবিধ উপদেশ দেখিয়ে রণস্থলে বিচরণ করতে থেকে দ্রুত, বিচিত্র ও সুন্দরভাবে বাণবর্ষণ করতে থাকলেন। তখন কোনও লোকই দুর্যোধনের কোনও ছিদ্র দেখতে পেল না। ক্রমে মাংসলোভী দুটি ব্যাঘ্রের মতো পরাক্রমশালী শল্য ও যুধিষ্ঠির নানাবিধ বাণ দ্বারা পরস্পরকে প্রহার করতে লাগলেন।

ভীমসেন যুদ্ধমত্ত অভিমানী দুর্যোধনের সঙ্গে মিলিত হলেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, নকুল, সহদেব সকল দিকে, শকুনি প্রভৃতি বীরগণকে গ্রহণ করলেন। ক্রমে দুর্যোধন উল্লেখ করে একটি নতপর্ব বাণ দ্বারা ভীমসেনের স্বর্ণভূষিত ধ্বজটাকে ছেদন করলেন। সেই প্রিয়দর্শন সুন্দর ধ্বজটা বিশাল কিঙ্কিণীজালের সঙ্গে ভীমসেনের সম্মুখে ভূতলে পতিত হল। দুর্যোধন পুনরায় একটি তীক্ষ্ণ বাণে ভীমসেনের হস্তীশুণ্ড সদৃশ বিচিত্র ধনু ছেদন করলেন। ধনু ছিন্ন হলে, তেজস্বী ভীমসেন বিক্রম প্রকাশ করে একটি রথশক্তির দ্বারা দুর্যোধনের বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করলেন। দুর্যোধন বেদনায় রথমধ্যে উপবিষ্ট হলেন। দুর্যোধন মোহপ্রাপ্ত হলে, ভীমসেন পুনরায় একটা ক্ষুরপ্র দ্বারা দুর্যোধনের সারথির মস্তক ছেদন করলেন। সারথি নিহত হলে, দুর্যোধনের অশ্বগণ তাঁর থ নিয়ে নানাদিকে ছুটতে লাগল। তখন কৌরবসৈন্যমধ্যে হাহাকার হতে লাগল। এই সময়ে মহারথ অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা দুর্যোধনকে রক্ষা করার জন্য ধাবিত হলেন। কৌরব সৈন্য ভগ্ন হলে, দুর্যোধন ভগ্ন হলে, দুর্যোধনের অনুচরেরা ভীত হয়ে পড়ল। তখন অর্জুন ধনু বিস্ফারিত করে বাণ দ্বারা তাঁদের বধ করতে লাগলেন।

এই সময়ে যুধিষ্ঠির ক্রুদ্ধ হয়ে দন্তের ন্যায় শুভ্রবর্ণ ও মনের তুল্য বেগবান অশ্বগুলিকে নিজেই চালাতে থেকে শল্যের দিকে ধাবিত হলেন। উপস্থিত সমস্ত সৈন্য যুধিষ্ঠিরের একটি অদ্ভুত বিষয় দেখতে পেলেন, যেহেতু তিনি পূর্বের কোমলতা ও ক্রোধশূন্যতা ত্যাগ করে দারুণ হলেন। ক্রমে তিনি নয়ন বিস্ফারিত করে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে তীক্ষ্ণ ভল্লসমূহ দ্বারা সহস্র সহস্র যোদ্ধাকে বিনাশ করতে লাগলেন। ইন্দ্র যেমন উত্তম বজ্র দ্বারা পর্বত সকল নিপাতিত করেন, তেমনি যুধিষ্ঠির যে যে সৈন্যের দিকে যেতে লাগলেন, সেই সেই সৈন্যই নিপাতিত করতে লাগলেন। বায়ু যেমন মেঘ নিপাত করে খেলা করে, তেমনই বলবান এক যুধিষ্ঠির অশ্ব, সারথি, ধ্বজ ও রথের সঙ্গে বহু রথীকে নিপাত করতে থেকে যেন খেলা করতে লাগলেন। রুদ্র যেমন ক্রুদ্ধ হয়ে পশু সংহার করেন, যুধিষ্ঠিরও তেমনই যুদ্ধে আরোহীদের সঙ্গে সহস্র সহস্র অশ্ব ও পদাতিকে সংহার করতে লাগলেন। এইভাবে যুধিষ্ঠির বাণবর্ষণপূর্বক সকল দিকের রণস্থল শূন্য করে শল্যের দিকে ধাবিত হলেন এবং “শল্য! দাঁড়াও” এই কথা বললেন। যুদ্ধে ভীষণ কার্যকারী যুধিষ্ঠিরের সেই কাজ দেখে কৌরবপক্ষীয়েরা সকলেই ভীত হয়ে পড়লেন; কিন্তু শল্য তাঁর দিকে ধাবিত হলেন। তারপর শল্য ও যুধিষ্ঠির অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শঙ্খধ্বনি করে পরস্পর আহ্বানপূর্বক ভর্ৎসনা করতে থেকে অগ্রসর হলেন। তখন শল্য বাণবর্ষণ করে যুধিষ্ঠিরকে প্রহার করতে লাগলেন, আবার যুধিষ্ঠিরও বাণবর্ষণ দ্বারা শল্যকে আঘাত করতে থাকলেন। তখন দেখা গেল—যুদ্ধে বাণের আঘাতে বীর শল্য ও যুধিষ্ঠির দুজনের গাত্র থেকেই রক্ত নির্গত হচ্ছে। বীরশোভায় শোভিত, মহাত্মা ও যুদ্ধদুর্ধর্ষ শল্য ও যুধিষ্ঠির সেই সময়ে বনে পুষ্পসমন্বিত শাল্মলিবৃক্ষ ও কিংশুক বৃক্ষের মতো প্রকাশিত হতে লাগলেন। সৈন্যরা যুদ্ধের অবস্থা দেখে তাঁদের মধ্যে কার জয় হবে তা নিরূপণ করতে পারল না। তারা ভাবল, “যুধিষ্ঠির আজ শল্যকে বধ করে পৃথিবী ভোগ করবেন কিংবা শল্য যুধিষ্ঠিরকে বিনাশ করে দুর্যোধনকে রাজ্য দান করবেন।” কোনও দু’জন যোদ্ধাই এ বিষয়ে একমত হতে পারল না। কিন্তু যুদ্ধের সমস্তই যুধিষ্ঠিরের অনুকূল হতে লাগল।

তারপর শল্য যুধিষ্ঠিরের উপর উত্তম উত্তম বহুতর বাণক্ষেপ করতে লাগলেন এবং একটি তীক্ষ্ণ বাণে তাঁর ধনু ছেদন করে ফেললেন। তখন যুধিষ্ঠির অন্য ধনু নিয়ে তিন শত বাণ দ্বারা শল্যকে আঘাত করলেন এবং একটি ক্ষুরপ্র দ্বারা তাঁর ধনুখানি কেটে ফেললেন। তারপর যুধিষ্ঠির চার বাণে শল্যের চারটি অশ্বকে এবং অতি তীক্ষ্ণ দুই বাণে তাঁর দু’জন পৃষ্ঠসারথিকে বধ করলেন। একটি উজ্জ্বল, পীতবর্ণ ও তীক্ষ্ণ ভল্লদ্বারা সম্মুখে বিদ্যমান শল্যের ধ্বজটাকে ছেদন করলেন। দুর্যোধনের সমস্ত সৈন্য ভেঙে ছত্রখান হয়ে পড়ল। তখন অশ্বত্থামা সেই অবস্থা দেখে শল্যের দিকে দ্রুত এগিয়ে এলেন এবং শল্যকে আপন রথে তুলে নিয়ে অপসরণ করলেন। ওদিকে যুধিষ্ঠির গর্জন করতে লাগলেন। কিছু দূরে গিয়ে শল্য অন্য একখানি সুসজ্জিত রথে আরোহণ করে যুধিষ্ঠিরের দিকে ফিরে আসতে লাগলেন।

শক্তিশালী শল্য যুধিষ্ঠিরের দিকে অগ্রসর হলে ভীমসেন, সাত্যকি, নকুল ও সহদেব শল্যকে আহ্বান করলেন। তাঁরা রাজা যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করছিলেন। সেই অবস্থায় যুধিষ্ঠির ভীষণ বেগশালী বাণসমূহ দ্বারা শল্যের বক্ষঃস্থলে আঘাত করলেন। তখন কৌরব বীরেরা সকল দিক থেকে গিয়ে শল্যকে পরিবেষ্টন করল। শল্য সাতটি বাণে যুধিষ্ঠিরকে বিদ্ধ করলেন এবং যুধিষ্ঠির ন’টি তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা শল্যকে আঘাত করলেন। পরে মহারথ শল্য ও যুধিষ্ঠির আপন আপন ধনু কর্ণ পর্যন্ত আকর্ষণ করে নিক্ষিপ্ত তৈলমার্জিত বাণসমূহ দ্বারা যুদ্ধে পরস্পরকে আচ্ছাদন করলেন। তারপর মহারথ, মহাবল ও শত্রুগণের অজেয় রাজশ্রেষ্ঠ শল্য ও যুধিষ্ঠির পরস্পরের ছিদ্র অন্বেষণ করতে থেকে বাণ দ্বারা অতি দ্রুত পরস্পরকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। শল্য ও যুধিষ্ঠিরের ধনুর্গুণের হস্তাবরণের শব্দ ইন্দ্রের বজ্র ও বিদ্যুতের শব্দের মতো মনে হচ্ছিল। মাংসলোভী দু’টি তরুণ ব্যাঘের মতো শল্য ও যুধিষ্ঠির পরস্পরের ছিদ্র খুঁজে আঘাত করতে থাকলেন। তখন মহাবেগশালী মদ্ররাজ, সূর্য ও অগ্নির ন্যায় উজ্জ্বল একটি বাণ দ্বারা বীর যুধিষ্ঠিরের হৃদয়ে বিদ্ধ করলেন। যুধিষ্ঠির অতিশয় বিদ্ধ হয়ে একটি বাণে শল্যকে প্রচণ্ড আঘাত করলেন ও অতিশয় হৃষ্ট হলেন। চৈতন্য হারিয়ে শল্য রথেই পতিত হলেন এবং পরমুহুর্তেই চেতনা ফিরে পেয়ে একশত বাণ দ্বারা যুধিষ্ঠিরকে আঘাত করলেন। যুধিষ্ঠির নয়টি বাণ দ্বারা শল্যের বক্ষঃস্থলে আঘাত করে আরও ছ’টি বাণ তাঁর স্বর্ণময় বর্মের উপর আঘাত করলেন। তখন শল্য দুটি ক্ষুরপ্র বাণদ্বারা যুধিষ্ঠিরের ধনু ছেদন করলেন। ইন্দ্র যেমন নমুচি দানবকে বিদ্ধ করেছিলেন, যুধিষ্ঠিরও তেমনই শল্যের সকল দিক বিদ্ধ করতে থাকলেন। তখন মহাবল শল্য ন’টি বাণদ্বারা ভীম ও যুধিষ্ঠিরের স্বর্ণময় বর্ম দুটি ছেদন করে তাদের বাহুযুগলে গুরুতর আঘাত করলেন। তারপর শল্য অগ্নি ও সূর্যের মতো উজ্জ্বল একটি ক্ষুরপ্রদ্বারা যুধিষ্ঠিরের ধনু ছেদন করলেন। তখন কৃপাচার্য ছ’টি তীক্ষ্ণ বাণে যুধিষ্ঠিরের সারথিকে বধ করলেন। সেই সারথির দেহ যুধিষ্ঠিরের রথের অভিমুখেই পতিত হল। শল্য আরও চারটি বাণে যুধিষ্ঠিরের চারটি অশ্বকে বধ করে, তাঁর চারপাশের সৈন্য সংহার করতে লাগলেন। শল্য ও কৃপাচার্য গুরুতর অনিষ্ট করতে থাকলে মহাবল ভীমসেন একটি বাণে শল্যের ধনু ছেদন করলেন এবং আরও দুটি বাণে শল্যকে গুরুতরভাবে বিদ্ধ করলেন। ক্রুদ্ধ ভীমসেন তারপর অন্য একটি বাণ দ্বারা শল্যের সারথির বর্মাবৃত দেহ থেকে মস্তক হরণ করলেন এবং দ্রুত শল্যের চারটি অশ্বকে বধ করলেন। শল্য তখন একাকী রণস্থলে বিচরণ করতে থাকলে ভীমসেন ও মাদ্রীপুত্র সহদেব শত শত বাণ দ্বারা তাঁকে প্রহার করতে লাগলেন এবং শল্যকে মোহিত দেখে ভীম তাঁর বর্ম ছেদন করলেন।

তখন মহাবল শল্য সহস্র নক্ষত্র চিহ্নযুক্ত চর্ম ও তরবারি ধারণ করে রথ থেকে নেমে নকুলের দিকে ধাবিত হলেন এবং নকুলের রথদণ্ড ছেদন করে যুধিষ্ঠিরের দিকে ধাবিত হলেন। যমের মতো শল্য যুধিষ্ঠিরের দিকে আসতে থাকলে ধৃষ্টদ্যুম্ন, দ্রৌপদীর পুত্রগণ, শিখণ্ডী ও সাত্যকি সকল দিক থেকে তাঁর দিকে ধাবিত হলেন। ভীমসেন দশটি বাণদ্বারা শল্যের চর্ম এবং একটি ভল্লদ্বারা তাঁর তরবারির মুষ্টিদেশ ছেদন করলেন। ভীমসেনের সেই কার্য দেখে পাণ্ডবেরা সিংহনাদ করতে লাগলেন। তখন অত্যন্ত আহত ও আক্রান্ত শল্য, সিংহ যেমন মৃগের দিকে ছুটে চলে, তেমন যুধিষ্ঠিরের দিকে ধাবিত হলেন। অশ্ব ও সারথিশূন্য যুধিষ্ঠিরও ক্রোধে অগ্নির মতো জ্বলতে থেকে শল্যের দিকে ছুটে চললেন।

তখন যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের কথা স্মরণ করে, তাঁর ভাগ্যে কেবলমাত্র শল্যই আছেন বুঝে শল্যবধের উপায় স্থির করলেন। যুধিষ্ঠির ক্রুদ্ধ চিত্ত হয়ে মণি ও স্বর্ণখচিত দণ্ডযুক্ত এবং স্বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল শক্তি গ্রহণ করলেন এবং তারপর উজ্জ্বল নয়নযুগল বিস্ফারিত করে শল্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। তারপর কৌরবশ্রেষ্ঠ ও মহাত্মা যুধিষ্ঠির সুন্দর ও ভীষণ দণ্ডযুক্ত, মণি ও প্রবালখচিত এবং নির্মল সেই শক্তিটিকে শল্যের প্রতি অতি দ্রুতবেগে নিক্ষেপ করলেন। তখন সম্মিলিত কৌরবেরা দেখলেন— মহাবেগে নিক্ষিপ্ত সেই উজ্জ্বল শক্তিটি প্রলয়কালে আকাশ থেকে পতিত বিশাল উল্কার মতো যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে বেগে আসছে। পূর্বকালে মহাদেব যেমন অন্ধকাসুরের প্রতি বিনাশকারী বাণ নিক্ষেপ করেছিলেন, যুধিষ্ঠিরও তেমনই শল্যকে বধ করার জন্য “পাপাত্মা তুমি নিহত হলে” এই বলে সুদৃঢ় ও সুহস্ত বাহু প্রসারণ করে ক্রোধে যেন নৃত্য করতে থেকে যত্নপূর্বক ভীষণ মন্ত্রে অভিমন্ত্রিত করে শক্তি ও যত্নসহকারে বেগবতী সেই শক্তিটিকে, সরল পথে নিক্ষেপ করেছিলেন। পাণ্ডবেরা বহুকাল ধরে যত্নসহকারে গন্ধদ্রব্য, মালা, উত্তম আধার, পান ও ভোজন দ্বারা সেই শক্তিটির সেবা করে আসছিলেন। সেটি প্রলয়কালের অগ্নির মতো জ্বলছিল অথবা অঙ্গিরার উৎপাদিত অভিচারদেবতার মতো ভীষণ ছিল, আপন বলে সে শক্তিটি পৃথিবী, আকাশ, জলাশয়, এমনকী সমস্ত ভূতই বিনাশ করতে সমর্থ ছিল। স্বয়ং বিশ্বকর্মা যত্ন সহকারে ও নিয়মাধীনভাবে সেটিকে নির্মাণ করেছিলেন এবং সে শক্তিটি বেদবিদ্বেষীগণের বিনাশকারী ও অব্যর্থ ছিল। যুধিষ্ঠির সমস্ত শক্তি দ্বারা সেই অনিবার্য শক্তিটিকে নিক্ষেপ করলে, অগ্নি যেমন সম্যক ক্ষিপ্ত ধৃত দ্বারা গ্রহণ করার জন্য শব্দ করে ওঠে, শল্যও সেই শক্তিটিকে গ্রহণ করার জন্য গর্জন করে উঠলেন।

তখন সেই শক্তিটি গিয়ে শল্যের শুভ্রবর্ণ বর্ম বিদারণ করে যুধিষ্ঠিরের বিশাল যশ যেন বহন করতে থেকে শল্যের বুক ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে এসে ভূতলে প্রবেশ করল। ক্রমে কার্তিকের আঘাতে মহাপর্বতের শ্রেষ্ঠ ক্রৌঞ্চের যেমন গৈরিক ধাতুসিক্ত শরীর হয়েছিল, সেই শক্তির আঘাতে শল্যের নাসিকা, কর্ণ, চক্ষু ও মুখ থেকে তেমনই রক্ত ঝরে পড়তে লাগল। যুধিষ্ঠির শল্যের বর্ম ও বক্ষ বিদারণ করলে, মহাবল শল্য বাহুযুগল প্রসারণ করে ইন্দ্রের অশ্বের তুল্য এবং বজ্রাহত পর্বতশৃঙ্গের ন্যায় রথ থেকে ভূতলে পতিত হলেন। প্রিয়তমা কামিনী যেমন প্রেমবশত আপন বক্ষোদেশে পতনার্থী প্রত্যুদগমন করে, সেইরকম ভূমিও যেন প্রেমবশত বিদীর্ণগাত্র ও রক্তসিক্ত নরশ্রেষ্ঠ শল্যের প্রত্যুদগমন করেছিলেন।

শল্য নিপাতিত হলে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা রথারোহণে যুধিষ্ঠিরের দিকে ধাবিত হলেন এবং বহু নারাচ নিক্ষেপ করে তাঁকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির শল্য-ভ্রাতার ধনু ও ধ্বজ ছেদন করে ভল্লের আঘাতে তাঁর মস্তক দেহচ্যুত করলেন। কৌরবসৈন্য ভগ্ন হয়ে হাহাকার করে পালাতে লাগল। শল্য নিহত হলে তাঁর সাতশো অনুচর রথী কৌরবসৈন্য থেকে বেরিয়ে এলেন। এই সময়ে একটি পর্বতাকার হস্তীতে চড়ে দুর্যোধন সেখানে এলেন। একজন তাঁর মস্তকের উপর ছত্র ধরেছিল, আর একজন তাঁকে চামর বীজন করছিল। দুর্যোধন বারবার মদ্ৰযোদ্ধাদের বলছিলেন, “যাবেন না, যাবেন না। অবশেষে তাঁরা দুর্যোধনের অনুরোধে পুনরায় পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। শল্য হত হয়েছেন এবং মদ্রদেশীয় মহারথগণ ধর্মরাজকে পীড়িত করছেন শুনে অর্জুন সত্বর সেখানে এলেন, ভীম নকুল সহদেব সাত্যকিও যুধিষ্ঠিরকে বেষ্টন করলেন। পাণ্ডবগণের আক্রমণে মদ্রবীরগণ বিনষ্ট হলেন, তখন দুর্যোধনের সমস্ত সৈন্য ভীত ও চঞ্চল হয়ে পালাতে লাগল। বিজয়ী পাণ্ডবগণ শঙ্খধ্বনি ও সিংহনাদ করতে লাগলেন।

*

মহাভারতের এই দুর্লভ মুহূর্তটি আলোচনার প্রথমেই আমাদের মনে পড়ে বিরাট রাজ্যে অজ্ঞাতবাসের পর আত্মপ্রকাশের দিন অর্জুন যুধিষ্ঠিরের পরিচয় করিয়ে দেবার সময়ে বিরাটরাজাকে বলেছিলেন, “রাজা বেদহিতকারী, শাস্ত্রজ্ঞ, দাতা, যজ্ঞপরায়ণ, দৃঢ়ব্রতশালী এই ব্যক্তি ইন্দ্রের আসনেও বসতে পারেন। ইনি মূর্তিমান ধর্ম, বলবানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিতে জগতের মধ্যে প্রধান এবং পরম তপস্বী। চরাচর সমেত ত্রিভুবন মধ্যে ইনিই নানাবিধ অস্ত্র জানেন; অন্য কোনও পুরুষই এঁর তুল্য অস্ত্র জানে না এবং কখনও জানবে না। দেবগণ, অসুরগণ, মনুষ্যগণ, রাক্ষসগণ, গন্ধর্বগণ, যক্ষগণ, কিন্নরগণ এবং মহানাগগণও এঁর তুল্য নানাবিধ অস্ত্র জানেন না। …ইনি কৌরবশ্রেষ্ঠ কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির।” আমাদের আরও মনে পড়ে, রথী-মহারথ-অতিরথ গণনাকালে ভীষ্ম বলেছিলেন, “যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব অতি উত্তম রথী।”

রাজশেখর বসু তাঁর সারানুবাদে অর্জুন প্রদত্ত যুধিষ্ঠিরের অস্ত্রজ্ঞান অংশটি বাদ দিয়েছেন। বহু বিশিষ্ট মহাভারতচর্চাকার যুধিষ্ঠিরকে ভীরু, দুর্বল, ভ্রাতাদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা নিরীহ ভালমানুষ হিসাবে চিত্রিত করেছেন। একথা আদপেই সত্য নয়। যুধিষ্ঠির প্রভূত অস্ত্রশস্ত্রে জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রায় প্রতিদিন তিনি সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্নকে ব্যূহ রচনার কৌশল বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। একথা অবশ্যই সত্য যে, যুধিষ্ঠির ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, ভীম বা অর্জুনের মতো বীর ছিলেন না। অস্ত্রশস্ত্র অনুশীলন বা চর্চা যুধিষ্ঠিরের আগ্রহের মধ্যে পড়ত না। যদিও যুদ্ধে তিনি দু’বার দুর্যোধনকে ও একবার দুঃশাসনকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করেছিলেন। সমস্ত জীবন যুধিষ্ঠির সত্যবীক্ষণের সন্ধানে রত ছিলেন, তিনি ধর্মকে রক্ষা করে ধর্মের পথ ধরেই এগোতে চেয়েছিলেন। তাঁর চর্চার ক্ষেত্র ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, নিজস্ব।

কিন্তু যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয় রাজা। শ্রেষ্ঠ রাজবংশের সন্তান। কৃষ্ণের কথার— “মহাবাহু, মহারথ শল্যকে বধ করার একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি আপনি”, গূঢ়ার্থ বুঝতে যুধিষ্ঠিরের বিলম্ব হয়নি। কয়েকদিনের মধ্যে তিনি সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর হবেন। এই ভয়ংকর যুদ্ধে কোনও শ্রেষ্ঠ রথীকে তিনি বধ করেননি—ভ্রাতারাই বিজয় এনে তাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছেন, ভবিষ্যতের মানবকুল এ ঘটনা সশ্রদ্ধভাবে মেনে নেবে না। সঞ্জয় অস্ত্রধারী যুধিষ্ঠিরকে কল্পনাও করতে পারেননি। কিন্তু যুধিষ্ঠির সত্য সত্যই সঞ্জয়ের অভিলাষ অনুযায়ী অস্ত্রহীন দ্রষ্ট্রার ভূমিকায় থাকতে পারেন না। তাঁর ‘ভাগ’ তাঁকে পালন করতেই হবে।

শল্য অতিরথ ছিলেন। কৌরবপক্ষের শেষ মরণশীল অতিরথ। কারণ কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা অমর। এই শেষ মরণশীল অতিরথকে বধ করতে হবে যুধিষ্ঠিরকে। সম্পর্কে শল্য তাঁর মাতুল ছিলেন। মাতা মাদ্রীর আপন ভ্রাতা মদ্ররাজ শল্য। নকুল ও সহদেবের আপন মাতুল।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে শল্য যুধিষ্ঠিরের পক্ষে যোগ দেবার জন্য আসছিলেন বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে। পথিমধ্যে দুর্যোধন তাঁকে লুণ্ঠন করেন। বিশাল তোরণ নির্মাণ করে, সুসজ্জিত দাস দাসী পান ভোজনে দুর্যোধন তাঁকে গভীরভাবে আপ্যায়িত করেন। শল্য দুর্যোধনের যত্নে আপ্যায়নে সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলেন। দুর্যোধন তাঁকে তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করতে অনুরোধ করেন। শল্য সে প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। শল্য যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে দুর্যোধন ঘটিত কাহিনি জানালে, যুধিষ্ঠির অনায়াসে তাঁকে ধর্মসংকটে ফেলতে পারতেন। তিনি দুর্যোধনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে বললে শল্যের যুদ্ধ থেকে সরে যাওয়া ছাড়া কোনও পথ থাকত না। কিন্তু তিনি তা না করে, অত্যন্ত বাস্তববাদী রাজার মতো শল্যকে বললেন, তিনি দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করুন, কিন্তু কর্ণ তাঁকে সারথি হতে বললে তিনি যেন কর্ণের তেজোহানি করেন। যুধিষ্ঠির জানতেন সারা পৃথিবীতে সারথ্য বিদ্যায় তিনজন শ্রেষ্ঠ। কৃষ্ণ, শল্য এবং তিনি স্বয়ং। কর্ণ যে শল্যকে সারথি হিসাবে চাইবেন, যুধিষ্ঠিরের সে অনুমান নির্ভুল ছিল।

শল্যের সঙ্গে যুদ্ধে যুধিষ্ঠির অত্যন্ত পরাক্রম ও মহাবলের পরিচয় দিয়েছিলেন। যুদ্ধে রত সৈন্যেরা যুধিষ্ঠিরের রুদ্রমূর্তি দেখে ভীত হয়ে পড়েছিলেন। শান্ত, বদান্য, ক্ষমাশীল এই মানুষটির হাতে অস্ত্র দেখে সঞ্জয়ের মতো পাঠকেরা স্তম্ভিত হয়ে ওঠেন। তাই এই মুহূর্ত মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত।

৮১
উলূক-শকুনি বধ

বৃক্ষটিতে ফুল-ফল সব ঝরে গিয়েছিল, কাঁধ (স্কন্ধ) নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শুকনো কতগুলি শাখা-প্রশাখা গাছটিতে তখনও ঝুলছিল, গাছটির মূলও সাংঘাতিক বিপর্যয়ে ভিত আলগা হয়েছিল—ব্যাসদেবের অনুক্রমণিকা স্মরণ করলে আলোচ্য মুহূর্তটির প্রস্তাবনা এইভাবে করাই সবথেকে সমীচীন। গাছটি দুর্যোধন। কর্ণের মৃত্যুতে তাঁর কাধ ভেঙে গিয়েছিল। অশ্বত্থামার সন্ধির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, ক্ষত্রিয়োচিত ধর্ম অবলম্বন করে, শল্যকে সেনাপতি করে যুদ্ধ করছিলেন। যুধিষ্ঠির শল্যকে বধ করলে বাকি সৈন্যদের নিয়ে উন্মত্তের মতো প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দুর্যোধন। তখনও শল্যের মৃত্যুর শোকে চোখের জল শুষ্ক হবার সময় পায়নি, সেই সময়ে সুবলপুত্র শকুনি সহদেবকে হত্যা করার জন্য দ্রুতগতিতে ধাবিত হলেন।

শকুনি আসতে থাকলে প্রভাবশালী সহদেব তাঁর প্রতি পতঙ্গের ন্যায় দ্রুতগতিসম্পন্ন দ্রুতগামী বাণসমূহ নিক্ষেপ করতে থাকলেন এবং শকুনির পুত্র উলূককে দশটি বাণদ্বারা বিদ্ধ করলেন। শকুনি তিন বাণে ভীমকে বিদ্ধ করে, নব্বইটি বাণ সহদেবের উপর নিক্ষেপ করলেন। সমস্ত দিক বাণে আচ্ছন্ন করে শকুনি ও সহদেব পরস্পরের মুখোমুখি হলেন। বীর ও অতিমহাবল ভীমসেন ও সহদেব বিপক্ষ সৈন্যদের মধ্যে মহামারী ঘটাতে থেকে আকাশকে অন্ধকারে ঢেকে দিলেন। যাত্রাপথ সরল ছিল না। দ্রুতসঞ্চারী অশ্বেরা ভূতলে পতিত সৈন্যদের মৃতদেহ টানতে টানতে অগ্রসর হতে থাকল। কেয়ুর, বর্ম, তরবারি, পরশুযুক্ত বিশাল হস্তীশুণ্ডতুল্য ছিন্ন বাহুসকল এবং ছিন্ন ও নৃত্যকারী মস্তকহীন কবন্ধসমূহ কাঁপতে কাঁপতে যেন ওঠবার চেষ্টা করতে লাগল। মাংসভোজী জন্তুগণ প্রকাশ্যে সমরভূমিতে এসে মৃতদেহগুলি আবৃত করে মাংস ভোজন করতে লাগল।

ক্রমে কৌরবসৈন্য অল্পমাত্র অবশিষ্ট থাকলে, পাণ্ডবেরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে সেই কৌরবসৈন্যদের যমালয়ে পাঠাতে লাগলেন। এই সময়ে প্রতাপশালী শকুনি একটি প্রাস দ্বারা সহদেবের মস্তকে গুরুতর আঘাত করলেন। তখন সহদেব বেদনায় বিহ্বল হয়ে রথমধ্যে উপবেশন করলেন। সহদেবকে অত্যন্ত বিহ্বল দেখে মহাবলশালী ভীমসেন একাকী নারাচ দ্বারা শত শত ও সহস্র সহস্র কৌরবসৈন্য বিদীর্ণ করতে লাগলেন এবং ভয়ংকর সিংহনাদে পৃথিবী কম্পিত করলেন। তখন হস্তী ও অশ্বগণের সঙ্গে সমস্ত কৌরবসৈন্য ও শকুনির অনুচরেরা পালাতে লাগল। শৃঙ্খলাহীন, ভগ্ন সৈন্যগণকে চতুর্দিকে পালাতে দেখে রাজা দুর্যোধন উচ্চ স্বরে বলতে লাগলেন, “হে অধর্মজ্ঞ সৈন্যগণ! তোমরা নিবৃত্ত হও, যুদ্ধ করো, পলায়ন করে তোমাদের কী ফল হবে। যে বীর যুদ্ধে পৃষ্ঠ প্রদর্শন না করে প্রাণ পরিত্যাগ করেন, তিনি ইহলোকে কীর্তি রেখে, পরলোকে স্বর্গলাভ করেন।” দুর্যোধনের কথা শুনে শকুনির অনুচরেরা মৃত্যুপণ করে পাণ্ডবদের অভিমুখে সমুদ্রের গর্জন তুলে ধাবিত হলেন। শকুনির অনুচরদের আসতে দেখে বিজয়ী পাণ্ডবেরাও তাঁদের দিকে ধাবিত হলেন। এই সময়ে দুর্ধর্ষ সহদেব সুস্থ হয়ে দৃঢ় বাণে শকুনিকে বিদ্ধ করে, তিন বাণে তাঁর অশ্বগুলিকে বিদ্ধ করলেন এবং হাসতে হাসতেই এক বাণে শকুনির ধনু ছেদন করলেন। তখন শকুনি পথ পরিষ্কার করার জন্য অন্য ধনু নিয়ে ষাট বাণে নকুলকে এবং সাত বাণে ভীমসেনকে বিদ্ধ করলেন। তখন উলূকও পিতা শকুনিকে রক্ষা করবার ইচ্ছা করে সাত বাণে ভীমসেনকে এবং সত্তর বাণে সহদেবকে বিদ্ধ করলেন। ভীমসেন তখন চৌষট্টিটি তীক্ষ্ণ বাণদ্বারা উলূক ও শকুনিকে এবং তিন তিনটি বাণে তাঁদের পার্শ্ববর্তী যোদ্ধাদের বিদ্ধ করলেন। উলূক তৈলাক্ত নারাচ দ্বারা, বিদ্যুৎ সমন্বিত মেঘ যেমন জল বর্ষণ করে পর্বতকে আচ্ছাদন করেন, সেই রকম বাণ বর্ষণ করে সহদেবকে আচ্ছাদন করলেন। তখন উলূককে আসতে দেখে প্রতাপশালী সহদেব একটি ভল্লদ্বারা তাঁর মস্তক অপহরণ করলেন।

পুত্ৰন্তু নিহতং দৃষ্ট্বা শকুনিস্তত্র ভারত!

সাশ্রুকণ্ঠো বিনিশ্বস্য ক্ষত্তুর্বাক্যমনুস্মরণ॥ শল্য : ২৬ : ৩২ :॥

“পুত্র উলূককে নিহত দেখে, শকুনি তখন বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠ হয়ে বিদুরের বাক্য স্মরণ করতে থেকে অশ্রুপূর্ণ নয়নে নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।”

উলূক সহদেবকর্তৃক নিহত হয়ে পাণ্ডবদের আনন্দ বিধান করে ভূতলে পতিত হলে, শকুনি মুহূর্তকাল চিন্তা করে সম্মুখে এগিয়ে গেলেন এবং তিন বাণে সহদেবকে বিদ্ধ করলেন। তখন প্রতাপশালী সহদেব বাণসমূহদ্বারা শকুনির সেই বাণগুলিকে প্রতিহত করে শকুনির ধনু ছেদন করলেন। ধনু ছিন্ন হলে, শকুনি একটি বিশাল তরবারি গ্রহণ করে সহদেবের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। শকুনির সেই তরবারি ভীষণ বেগে আসতে থাকলে সহদেব হাসতে হাসতে সে তরবারিটিকে দুই খণ্ডে ছেদন করলেন। তরবারিখানা দু’খণ্ডে ছিন্ন হল দেখে শকুনি একটি বিশাল গদা নিয়ে তা সহদেবের উপরে নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু সহদেবের প্রতিঘাতে সে গদাটি ব্যর্থ হয়ে ভূতলে পতিত হল। তখন শকুনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে, হননোদ্যত কালরাত্রির ন্যায় অতিভীষণা একটি শক্তি সহদেবের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। সেই শক্তিটি বেগে আসতে থাকলে, সহদেব সহাস্য মুখে স্বর্ণখচিত বাণ দিয়ে সেই শক্তিটিকে তিন খণ্ডে ছেদন করলে, মেঘবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ যেমন আকাশ থেকে পতিত হয়, সেইরূপ তা ভূতলে পতিত হল।

শকুনির শক্তি বিনিহত হলে, শকুনি ভয়ে আকুল হয়ে পড়লেন। তিনি পালাতে লাগলেন। শকুনিকে পালাতে দেখে তাঁর অনুচরেরাও শকুনির সঙ্গে বেগে পালাতে লাগলেন। তখন বিজয়শোভী পাণ্ডবেরা উচ্চ স্বরে বিশাল কোলাহল করতে লাগলেন। সেই সমবেত গর্জনে প্রায় সমস্ত কৌরবসৈন্যই পরাঙ্মুখ হল। পরাজয়ে বিষণ্ণচিত্ত সেই কৌরবসৈন্যদের উপর সহদেব বহুসহস্র বাণক্ষেপ করলেন। ওদিকে শকুনি গান্ধারসৈন্যে সুরক্ষিত থেকে প্রবল অশ্বসৈন্যের গুণে মনে মনে আশা করছিলেন যে কিছুটা বিশ্রাম পাবার পর তিনি যুদ্ধ জয় করতে পারবেন; এমন সময়ে সহদেব তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হলেন। তাঁর ভাগে শকুনিই কেবল এখন অবশিষ্ট আছেন। এই কথা চিন্তা করে স্বর্ণভূষিত রথে সহদেব শকুনির প্রতি গমন করলেন। ক্রুদ্ধ সহদেব সুদৃঢ় ও বিশাল ধনুতে গুণারোপণ করে আকর্ষণ করতে থাকলেন এবং সম্মুখে গিয়ে, অঙ্কুশের আঘাতে মহাহস্তীকে যেমন আঘাত করে, সেইরকম শিলাশাণিত বাণ দ্বারা শকুনিকে আঘাত করতে লাগলেন। স্মরণশক্তিশালী সহদেব শকুনিকে পূর্বের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি ক্ষত্রিয়ের ধর্মে স্থির থেকে যুদ্ধ করো, পুরুষ হও। মূঢ়! দুর্মতি! তুমি তখন দ্যূতসভায় দ্যূতক্রীড়া করতে থেকে যে আনন্দ প্রকাশ করেছিলে, আজ সেই কার্যের ফল দর্শন করো। দুরাত্মা! যারা পূর্বে আমাদের উপহাস করেছিলেন, সেই দুরাত্মারা সকলেই নিহত হয়েছেন; এখন কেবল কুলাঙ্গার দুর্যোধন আর তাঁর মাতুল তুমি—মাত্র এই দু’জন অবশিষ্ট আছো। গাছের থেকে ফল পাড়ার জন্য লোকে যেমন আঁকশি ব্যবহার করে, সেইরকম আজ আমি ক্ষুরপ্র দিয়ে তোমার মাথা মাটিতে ফেলব এবং তোমাকে বধ করব।” এই বলে মহাবল ও নরশ্রেষ্ঠ সহদেব ক্রুদ্ধ হয়ে শকুনির দিকে গমন করলেন।

দুর্ধর্ষ ও যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ সহদেব শকুনির সম্মুখে গিয়ে দৃঢ় ধনু আকর্ষণ করে, ক্রোধে যেন দগ্ধ করতে থেকে, দশ বাণে শকুনিকে এবং চার বাণে তাঁর চারটি অশ্বকে তাড়ন করে ছত্র, ধনু, ধ্বজ ছেদন করে সিংহের মতো গর্জন করে উঠলেন। এইভাবে সহদেব শকুনির সমস্ত মর্মস্থানে আঘাত করলেন। সহদেব ক্রমাগত অব্যাহতভাবে শকুনির উপর দুঃসহ বাণ বর্ষণ করত লাগলেন। তখন শকুনি ক্রুদ্ধ হয়ে স্বর্ণভূষিত প্রাসদ্বারা বধ করার ইচ্ছা করে, মাদ্রীনন্দন সহদেবের অভিমুখে বেগে ধাবিত হলেন। সহদেব তিনটি ভল্ল দ্বারা উত্তোলিত সেই প্রাস ও শকুনির সুগোল বাহুযুগল একসঙ্গেই ছেদন করলেন এবং উচ্চ স্বরে সিংহনাদ করে উঠলেন। ক্ষিপ্রকারী সহদেব স্বর্ণপুঙ্খ, দৃঢ় লৌহনির্মিত, সর্বাবরণভেদী ভল্লটিকে সম্যক সন্ধান করে শকুনির দেহ থেকে মস্তকটি ছেদন করলেন। সহদেব স্বর্ণভূষিত, সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল ও তীক্ষ্ণ ভল্লদ্বারা মস্তক ছেদন করলে, শকুনি রথ থেকে ভূতলে পতিত হলেন। যে মস্তকটি কৌরবপক্ষের দুর্নীতির মূল হয়েছিল, ক্রুদ্ধ সহদেব বেগবান, স্বর্ণপুঙ্খ ও শিলাশাণিত বাণদ্বারা সেই মস্তকটি ভূতলে নিপাতিত করেছিলেন।

তখন শকুনিকে ছিন্নমস্তক, রক্তাক্তদেহ ও ভূতলে শায়িত দেখে, তাঁর অস্ত্রধারী যোদ্ধারা ভয়ে উৎসাহবিহীন হয়ে, নানাদিকে পলায়ন করতে লাগল। গাণ্ডিবের শব্দে উদ্বিগ্ন, শুষ্কবদন ও অচেতনপ্রায় পদাতিরা এবং রথভগ্ন হস্তী ও অশ্বসকল পরাজিত হলে, রথী ও আরোহীরা ভয়ার্ত হয়ে কৌরবসৈন্যগণের সঙ্গেই পালাতে লাগল। শকুনিকে রথ থেকে নিপাতিত করে, পাণ্ডবেরা আনন্দিত ও কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়ে, সৈন্যদের আনন্দিত করতে থেকে শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন। পাণ্ডবপক্ষের সমস্ত লোক আনন্দিত হয়ে সহদেবের প্রশংসা করতে থেকে বলতে লাগল, “বীর! আপনি উলূকের সঙ্গে শঠ ও দুরাত্মা শকুনিকে আজ ভাগ্যবশত বধ করেছেন।” সহদেবের দ্যূতসভার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হল

*

উলূকের সঙ্গে মহাভারত-পাঠকের পরিচয় অতি সামান্য। শকুনির পুত্র উলূক। অর্থাৎ দুর্যোধনের মামাতো ভাই। কৃষ্ণের দৌত্য ব্যর্থ হলে, কৃষ্ণ কর্ণের সঙ্গে আলাপের পর তাঁকে বললেন যে অগ্রহায়ণ মাসের অমাবস্যার দিন যুদ্ধ আরম্ভ হবে। পাণ্ডবপক্ষ কুরুক্ষেত্রে হিরণ্বতী নদীর কাছে তাঁদের সেনা স্থাপন করলেন। কৌরবপক্ষও প্রস্তুত হলেন। তখন কর্ণ, শকুনি ও দুঃশাসনের সঙ্গে পরামর্শ করে দুর্যোধন উলূককে দূত করে পাণ্ডবদের আরও তাতাতে চেষ্টা করলেন। কৌরবপক্ষের বিজয় সম্পর্কে দুর্যোধন এতদূর নিশ্চিত ছিলেন যে, পাণ্ডবদের পক্ষে ব্যক্তিগত ও সমবেতভাবে তিনি যত অন্যায় করেছেন, তার পুনরায় উল্লেখ করে পাণ্ডবদের চূড়ান্তভাবে ব্যঙ্গ করতে চাইলেন। যুধিষ্ঠিরকে বৈড়াল ব্ৰত ত্যাগ করে ক্ষত্রিয়ধর্ম পালন করতে আহ্বান করলেন। কৃষ্ণকে পুংশ্চিহ্নধারী নপুংসক বললেন, ভীমকে পাচক হতে তিনিই বাধ্য করেছিলেন তাও স্মরণ করিয়ে দিলেন, নকুল-সহদেবকে দ্রৌপদীর উপর যত অত্যাচার করা হয়েছে, তা স্মরণ করতে বললেন। ভীমসেন উলূকের কথা শুনে অত্যন্ত উত্তেজিত হলেন এবং তাঁকে মূর্খ বলে সম্বোধন করলেন। কৃষ্ণ সহাস্যে ভীমকে নিবৃত্ত করে উলূককে বললেন, দুর্যোধনের সব কথার অর্থ পাণ্ডবেরা বুঝেছেন, দুর্যোধন যা চাইছেন, তিনি সবকিছু পাবেন। এই বলে কৃষ্ণ দূত উলূককে বিদায় দিলেন। উলূককে এই দৌত্যকালে ভীম যুদ্ধে নিধন করবেন জানিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সহদেবের হাতে নিহত হন। সহদেব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি শকুনিকে বধ করবেন। পুত্র পিতার আত্মস্বরূপ। সুতরাং সহদেব উলূককে বধ করায় ভীমসেন ক্রুদ্ধ হননি।

শকুনি মহাভারতের এক অবিস্মরণীয় চরিত্র। পৃথিবীর তিন বিখ্যাত মাতুলের মধ্যে শকুনি অন্যতম। বাকি দুই মামা কংস ও কালনেমি। মাতুল কংসের সঙ্গে তাঁর ভাগিনেয় সম্পর্ক অত্যন্ত শত্রুতার আর মাতুল শকুনির সঙ্গে তাঁর ভাগিনেয় দুর্যোধনের শুধুমাত্র মিত্রতার সম্পর্ক নয়, দুর্যোধনের সকল অপকর্মের মূল প্রেরণাও শকুনি। আবার দুই মাতুল কংস ও শকুনি—তাঁদের প্রধান বিরোধীরূপে পেয়েছিলেন কৃষ্ণকে। কংস বলে শকুনির থেকে অনেক শক্তিশালী ছিলেন, শকুনি বুদ্ধিতে এবং ছলনায়। দ্যূতক্রীড়ায় শকুনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন, বিশেষত কপট পাশাখেলায় তাঁর কোনও দ্বিতীয় ছিল না। আরও দুই প্রথমে অনভিজ্ঞ, পরে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দ্যূতক্রীড়কের নাম মহাভারতে পাওয়া যায়। দুজনেই অনভিজ্ঞ অবস্থায় দ্যূতক্রীড়ার জন্য রাজত্ব, ধন, সম্পদ হারিয়েছিলেন। রাজা নল পরবর্তীকালে রাজা ঋতুপর্ণকে অশ্বহৃদয়জ্ঞান দান করে, অক্ষহৃদয়জ্ঞান তাঁর কাছ থেকে প্রতিদান পেয়েছিলেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বনবাসকালে মহর্ষি বৃহদশ্বের কাছ থেকে বিশ্বের অক্ষহৃদয়জ্ঞান লাভ করেছিলেন। নল অক্ষের সাহায্যেই রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। আর যুধিষ্ঠির রাজ্য উদ্ধার করেছিলেন কুরুক্ষেত্রে ভয়ংকর যুদ্ধে।

আধুনিক কালের বহু নাট্যকার শকুনিকে মহাভারতের প্রধান চরিত্র হিসাবে গ্রহণ করে নাটক লিখেছেন—তাঁকে নিয়ে অনেক যাত্রাও হয়েছে। পালাকারেরা সম্পূর্ণ নূতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শকুনিকে দেখেছেন। তাঁদের বক্তব্য, গান্ধারী শকুনির অত্যন্ত প্রিয় ভগিনী ছিলেন। ভীষ্ম তাঁকে অন্ধ স্বামীকে বিবাহ করতে বাধ্য করেন। স্বামী অন্ধ বলে গান্ধারীও চোখে বস্ত্র বেঁধে স্বেচ্ছা অন্ধত্ব বরণ করেন। শকুনি সেই ঘটনায় এতদূর মর্মাহত হন যে, তিনি প্রতিজ্ঞা করেন কুরুবংশ ধ্বংস করবেন। ভাগিনেয় দুর্যোধনকে কু-পরামর্শ দিয়ে তিনি একটির পর একটি ঘটনা ঘটান। সঙ্গী হিসাবে তিনি কর্ণকে পেয়েছিলেন। দুঃশাসন জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তিনি ছায়ার মতো দুর্যোধনকে অনুসরণ করতেন। কর্ণের মতো বীরকে সঙ্গে পাওয়ায় ও দুঃশাসনের মতো অনুগত ভাগিনেয় পাওয়ায় শকুনির কাজ সহজ হয়ে যায়। পাণ্ডবদের সঙ্গে কৌরবদের ক্রমাগত বিরোধ তিনি বাড়িয়ে তোলেন। দ্যূতসভায় কপট পাশা খেলে তিনি পাণ্ডবদের বনবাসী করেন, বনবাস সম্পূর্ণ করে পাণ্ডবেরা ফিরে এসে রাজ্য দাবি করলে, তা ফিরিয়ে না দিতে তিনি দুর্যোধনকে পরামর্শ দেন, কৃষ্ণকে বন্দি করার উপদেশ দেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবেরা ধ্বংস হবে, একথা শকুনি জানতেন। বস্তুত দুর্যোধন ছাড়া সমগ্র কৌরবপক্ষের ধ্বংস দেখার পর তিনি ভাগিনেয় দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করে প্রাণ দেন।

এই ব্যাখ্যা নূতন এবং ব্যাসদেবের মহাভারতে এর সমর্থনও পাওয়া যায় না। পরিণতি অপরিবর্তিত রেখে প্রতি যুগেই রামায়ণ মহাভারতের নূতন ব্যাখ্যা হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যাখ্যার সবথেকে অসুবিধা এই যে, ব্যাসদেবের মহাভারতে শকুনি এবং গান্ধারী সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতার মানুষ। গান্ধারী ধর্মপরায়ণা, শকুনি ক্রমাগত অধর্মে দুর্যোধনকে উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু তাঁর কাজের ফলে সবথেকে ক্ষতি যে গান্ধারীর হচ্ছে, শকুনি তাও চিন্তা করেননি। শকুনি গান্ধারীর বিবাহের পর তাঁর সঙ্গে হস্তিনাপুরে চলে এসেছিলেন। আর নিজের রাজ্যে ফিরে যাননি, পুত্র উলূক পরে এসে পিতার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।

গান্ধাবী জ্যেষ্ঠভ্রাতার উপরে রুষ্ট ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর অধর্মপরায়ণ ভ্রাতার জন্যই দুর্যোধন প্রতিদিন ধ্বংসাত্মক হয়ে যাচ্ছেন। গান্ধারী চাননি যে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে নিহত হয়ে শকুনি স্বর্গবাসের অধিকার লাভ করুন। স্ত্রীপর্বে গান্ধারী কৃষ্ণকে বলেছিলেন, “কৃষ্ণ! ওই দেখো, শকুনিকে শকুনগণ বেষ্টন করে আছে, এই দুর্বুদ্ধিও অস্ত্রাঘাতে নিধনের ফলে স্বর্গে যাবেন।”

দুর্যোধনরূপ বৃক্ষটির সব শাখা-প্রশাখা নষ্ট হল, স্কন্ধ আগেই বিনষ্ট হয়ে গেছে। মূল মাটি থেকে আলগা হয়ে গেছে। এই চরমতম দুর্লভ মুহূর্তে দুর্যোধন দেখলেন, তিনি সম্পূর্ণ একা। গদা হাতে নিয়ে দুর্যোধন পূর্বদিকে যাত্রা করলেন। অংশাবতরণ পর্বে বলা হয়েছে শকুনি দ্বাপরের অংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

৮২
দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ

[শকুনির মৃত্যুর পর দুর্যোধন দেখলেন তিনি কুরুক্ষেত্রে একা। তিনি জানতেন না কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা অন্যত্র আত্মগোপন করেছিলেন। গদা হাতে পদব্রজে দুর্যোধন পূর্বদিকে হাঁটতে শুরু করলেন। স্বপক্ষীয় সমস্ত যোদ্ধার মৃত্যু মানসিকভাবে দুর্যোধনকে গভীর আঘাত করেছিল। তা ছাড়াও আঠারো দিনের একটানা যুদ্ধে তিনি শারীরিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। তাই দ্বৈপায়ন হ্রদের জলে প্রবেশ করে তিনি জলস্তম্ভন করেছিলেন। জল একদম স্থির হয়ে গেল, বাইরে থেকে কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না, সেই জলের ভিতরে কোনও মানুষ আছেন।

একজন মাংস বিক্রেতা ব্যাধ দুর্যোধনকে চিনত। বটগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দুর্যোধনের দ্বৈপায়নের জলে প্রবেশ এবং জলস্তম্ভন সমস্ত ঘটনাটি সে দেখছিল। প্রচুর পুরস্কারের লোভে সে যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে সকল বৃত্তান্ত জানাল। যুধিষ্ঠির ব্যাধকে পুরস্কৃত করে ভ্রাতাদের ও কৃষ্ণকে নিয়ে দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে ভৎর্সনা করে আত্মপ্রকাশ করতে বললেন, “সসাগরা পৃথিবীর বীরদের মৃত্যু ঘটিয়ে দুর্যোধন চোরের মতো আত্মগোপন করে আছেন কেন?” দুর্যোধন জলের ভিতর থেকেই বললেন, “আত্মীয়স্বজন ও সুহৃদদের মৃত্যুর পর তাঁর আর রাজ্য প্রয়োজন নেই। যুধিষ্ঠির রাজ্যগ্রহণ করুন। তিনি প্রব্রজ্যা নেবেন।” যুধিষ্ঠির তিরস্কার করে বললেন, “তুমি রাজ্য দান করবে কী করে, তুমি তো ভিখারি। গর্ব করে বলেছিলে বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী। তোমার কথা সত্য করতেই আমরা তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছি। তোমাকে বধ করে, আমরা মেদিনী ভোগ কব্ব।”

দুর্যোধন চিরকালই অত্যন্ত অভিমানী লোক। তিনি কখনও কারও ভর্ৎসনা শোনেননি। তিনি জল থেকে উঠে এসে জানালেন যে, তাঁর অশ্ব, রথ, বর্ম কিছুই নেই, তিনি কীভাবে যুদ্ধ করবেন। যুধিষ্ঠির তাঁকে অশ্ব, রথ, বর্মাদি দিলেন এবং যে কোনও একজন পাণ্ডবকে যুদ্ধে পরাজিত করতে আহ্বান করলেন। অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে দুর্যোধন ভীমসেনের সঙ্গে গদাযুদ্ধের প্রস্তাব করলেন। যুদ্ধ আরম্ভের ঠিক পূর্বমুহূর্তে কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরাম সেখানে উপস্থিত হলেন। ভীমসেন ও দুর্যোধন—দু’জনেই তাঁর গদাযুদ্ধের শিষ্য। বলরাম দ্বৈপায়নে যুদ্ধ না করে কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে গিয়ে যুদ্ধ করার প্রস্তাব দিলেন। কারণ কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে গিয়ে যুদ্ধ করলে, মৃত্যু ঘটলে স্বর্গবাস সুনিশ্চিত। বলরামের কথা শুনে দুর্যোধন ও পাণ্ডবপক্ষ কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে সরস্বতী নদীর তীরে উপস্থিত হলেন।]

সরস্বতী নদীর দক্ষিণ দিকে অন্য একটি উত্তম তীর্থ আছে; সেই অনাবৃত স্থানে তাঁরা যুদ্ধ করবার ইচ্ছা করলেন। তারপর বর্মধারী ভীমসেন বিশাল গদা ধারণ করে, গরুড়ের মতো আকৃতি ধারণ করলেন। এদিকে স্বর্ণময় বর্ম ও শিরস্ত্রাণধারী দুর্যোধন সুমেরু পর্বতের মতো শোভা পেতে লাগলেন এবং ক্রোধে আরক্তনয়ন হয়ে নিশ্বাস ত্যাগ করতে করতে ওষ্ঠপ্রান্তদ্বয় লেহন করতে লাগলেন। তখন বলবান রাজা দুর্যোধন গদাধারণপূর্বক ভীমের দিকে দৃষ্টিপাত করে এক হস্তী যেমন অপর হস্তীকে আহ্বান করে, সেইরকম ভীমকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। একইভাবে বলবান ভীমও লৌহময়ী গদা ধারণ করে, বনে এক সিংহ যেমন অপর সিংহকে আহ্বান করে, সেইরকম দুর্যোধনকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। তখন ভীম ও দুর্যোধন গদা তুলে ধরে শৃঙ্গযুক্ত দুটি পর্বতের মতো রণস্থলে প্রকাশ পেতে লাগলেন। তাঁরা দু’জনেই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং ভয়ংকর পরাক্রমশালী ও গদাযুদ্ধে বুদ্ধিমান বলরামের শিষ্য ছিলেন। দু’জনেই ময়দানব ও ইন্দ্রের তুল্য কার্য করতে পারতেন এবং বরুণের তুল্য কার্যকারী ও মহাবল ছিলেন। তাঁরা যুদ্ধে কৃষ্ণ, বলরাম, কুবের ও মধু ও কৈটভের সমান ছিলেন। দু’জনেই সুন্দ ও উপসুন্দ, রাম ও রাবণ এবং বালি ও সুগ্রীবের সদৃশ কার্য করতে সমর্থ ছিলেন। তাঁরা দু’জনেই রুদ্রের তুল্য ও যমের সমান সন্তাপকারী ছিলেন এবং দুটি মত্ত মহাহস্তীর মতো পরস্পরের প্রতি ধাবিত হয়েছিলেন, আর শরৎকালে ঋতুমতী হস্তিনীর সঙ্গমার্থে দপশালী দুটি হস্তীর মতো মত্ত হয়ে গিয়েছিলেন। শত্রুদমনকারী ভীম ও দুর্যোধন—সর্প যেমন বিষ উদ্‌গার করে, সেইরকম ক্রোধ প্রকাশ করছিলেন এবং পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে থেকে সর্বপ্রকারে উৎসাহী হয়েছিলেন।

দু’জনেই ভরতবংশ শ্রেষ্ঠ, বিক্রমসমন্বিত ও গদাযুদ্ধে সিংহের মতো দুর্ধর্ষ ও শত্ৰুসন্তাপক ছিলেন। তাঁরা দু’জনেই দুটি মত্তহস্তীর মতো পরম্পর জয় করবার ইচ্ছা করছিলেন এবং নখ ও দন্ত শস্ত্রধারী দুটি ব্যাঘ্রের মতো অন্যের দুঃসহ ছিলেন। তাঁরা দু’জনেই মহারথ ও প্রলয়কালে উদ্বেলিত দুটি সমুদ্রের মতো দুস্তর ছিলেন, আর ক্রুদ্ধ দুটি মঙ্গলগ্রহের মতো পরস্পরের সন্তাপ জন্মাচ্ছিলেন। বর্ষাকালে বায়ু সঞ্চালিত পূর্ব ও পশ্চিম দিগবর্তী ভীষণ গর্জনকারী ও বর্ষণকারী দুটি মেঘের মতো তাঁরা দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলেন। মহাবাহু ভীম ও দুর্যোদন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ দুটি ব্যাঘ্রের ন্যায়, গর্জনকারী দুটি মেঘের তুল্য এবং কেশরযুক্ত দুটি সিংহের সদৃশ, পরস্পর হর্ষ প্রকাশ করতে লাগলেন। মহাত্মা ভীম ও দুর্যোধন, অতিশয় ক্রুদ্ধ দুটি হস্তীর সমান, প্রজ্বলিত দুটি অগ্নির সদৃশ এবং শৃঙ্গযুক্ত দুটি পর্বতের মতো দৃষ্টিগোচর হতে থাকলেন। ক্রোধকম্পিত ওষ্ঠ, পরস্পর নিরীক্ষণকারী, মহাত্মা ও নরশ্রেষ্ঠ ভীম এবং দুর্যোধন ক্রমে গদাহস্তে পরস্পর নিকটবর্তী হলেন। অথবা হ্রেষারবকারী উত্তম দুটি অশ্বের মতো, বৃংহিতধ্বনিকারী দুটি হস্তীর মতো, বলবীর্যে লোকসম্মত, ভীম ও দুর্যোধন দুজনেই যুদ্ধের জন্য অত্যন্ত আনন্দিতচিত্ত হলেন।

ক্রমে নরশ্রেষ্ঠ ভীম ও দুর্যোধন দুটি বৃষের মতো গর্জন করতে লাগলেন এবং দুটি দৈত্যের মতো বলে উন্মত্তের মতো হয়ে উঠলেন। তখন দুর্যোধন, মহাত্মা কৃষ্ণ ও ভ্রাতৃগণের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বললেন, “অমিত শক্তিশালী রাম—মহাত্মা পাঞ্চালগণ, কেকয়গণ ও সৃঞ্জয়গণরক্ষিত যুধিষ্ঠিরের প্রতি উদার মনোভাবাপন্ন বাক্যই বলেছেন। সুতরাং আপনারা সকলে নিকটে বসে, আমার ও ভীমের এই যুদ্ধ দর্শন করুন।” দুর্যোধনের কথা শুনে, সকলেই সেইরূপ করলেন। তখন দেখা গেল উপবিষ্ট বাজসমূহ আকাশে সূর্যমণ্ডলের মতো শোভা পাচ্ছেন। সুন্দর মূর্তি, নীলবস্ত্রধারী মহাবাহু বলরাম সেই বীরগণ ও রাজগণের মধ্যে উপবেশন করে, রাত্রিকালে নক্ষত্র পরিবেষ্টিত পূর্ণচন্দ্রের মতো শোভা পেতে লাগলেন; তখন সকল দিকে সকলেই তাঁর সম্মান করতে থাকলেন। অন্যের পক্ষে অতি দুঃসহ ও গদাধারী ভীম এবং দুর্যোধন ভীষণ বাক্যদ্বারা পরস্পর ভর্ৎসনা করতে থেকে, যুদ্ধের নিয়মে দাঁড়ালেন। ক্রমে কৌরবশ্রেষ্ঠ ভীম ও দুর্যোধন পরস্পর অপ্রিয় বাক্য সকল বলে, রণস্থলে ইন্দ্র ও বৃত্রাসুরের মতো একে অপরকে দেখতে লাগলেন।

তখন মেঘের ন্যায় বলবান ও গম্ভীরস্বর দুর্যোধন আনন্দ সহকারে মহাবৃষের মতো গর্জন করে, যুদ্ধ করবার জন্য ভীমসেনকে আহ্বান করলে অতিভীষণ নানাবিধ দুর্লক্ষণ সকল আবির্ভূত হতে লাগল। নির্ঘাতের (বায়ুকর্তৃক আহত বায়ুপতনের নাম—নির্ঘাত) সঙ্গে বায়ু বইতে লাগল, ধূলিবৃষ্টি হতে থাকল এবং সমস্ত দিকই অন্ধকারে আবৃত হয়ে গেল। বিশাল শব্দকারী, তুমুল, লোমহর্ষণ শত শত উল্কা ভূতল যেন বিদীর্ণ করতে থেকে, আকাশ থেকে পড়তে লাগল। রাহু অমাবস্যার অনির্দিষ্টকালে সূর্যকে গ্রাস করল এবং বনবৃক্ষের সঙ্গে ভূমি কাঁপতে লাগল; ভূমিস্থিত সকল পদার্থেরই মহাকম্পন হতে লাগল। শর্করবর্ষী রুক্ষ বায়ু নীচ দিয়ে বইতে লাগল এবং পর্বতশৃঙ্গসকল ভূতলে পতিত হতে থাকল। নানা বিচিত্রবর্ণ হরিণসকল দশ দিকে বিচরণ করতে লাগল এবং উজ্জ্বলমূর্তি ও ভীষণমুখ শৃগালসমূহ ভয়ংকর রব করতে লাগল। অতিভয়ংকর ও লোমহর্ষণ নির্ঘাত হতে লাগল এবং অমঙ্গলসূচক পশুগণ দিকে দিকে বিচরণ করতে লাগল। সকল দিকের জলাশয়ের জল স্ফীত হয়ে উঠল এবং আকস্মিক বিশাল শব্দসকল শোনা যেতে লাগল। এই সমস্ত দুর্লক্ষণ দেখে ভীমসেন জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “এই অল্পবুদ্ধি দুর্যোধন যুদ্ধে আমাকে জয় করতে সমর্থ হবে না। কিন্তু চিরকাল আমি যে ক্রোধ মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম, তা আজ প্রকাশ করব। পাণ্ডুনন্দন! খাণ্ডববনে যেমন অগ্নি ছিল, সেইরকম এ যাবৎ কুরুরাজ দুর্যোধনের বিষয়ে আপনার হৃদয়ে যে ক্রোধশেল ছিল, তা আজ আমি উদ্ধার করব। গদাদ্বারা আজ এই কুরুকুলাধমকে, এই পাপাত্মাকে বধ করে, আপনাকে কীর্তিময়ী মালা পরিয়ে দেব। আজ এই গদাদ্বারা পাপকর্মা দুর্যোধনকে বধ করে, তার দেহটাকে শতভাগে বিচ্ছিন্ন করব। এই দুরাত্মা আর হস্তিনানগরে প্রবেশ করতে পারবে না।

সর্পোৎসর্গস্য শয়নে বিষদানস্য ভোজনে।

প্রমাণকোট্যাং পাতস্য দাহস্য জতুবেশ্মনি॥

সভায়ামবহাসস্য সর্বস্বহরণস্য চ।

বৰ্ষমজ্ঞাতবাসস্য বনবাসস্য চানঘ!॥ শল্য : ৫২: ২০-২১:॥

“আমার শয্যায় সর্পনিক্ষেপ, আমার খাদ্যে বিষমিশ্রণ, প্রমাণকোটি গ্রামে আমাকে নিদ্রিত অবস্থায় জলে নিক্ষেপ, জতুগৃহে আমাদের দগ্ধ করবার উপক্রম। দ্যূতসভায় আমাদিগকে উপহাস, আমাদের সর্বস্ব হরণ, দ্বাদশ বৎসর বনবাস—এই সকল ব্যাপার চেষ্টা করায়, আমি একদিনেই সেই সকল দুঃখের অবসান করব এবং নিজের কাছে জমে থাকা ঋণ আজ পরিশোধ করব। আজ দুর্মতি ও অশিক্ষিতবুদ্ধি দুর্যোধনের আয়ু ও মাতাপিতার দর্শন সমাপ্ত হবে। আজ দুর্মতি দুর্যোধনের রাজ্যসুখভোগ ও রমণীগণের দর্শন শেষ হবে। আজ কুরুরাজ শান্তনুর বংশদূষক এই পাপাত্মা প্রাণ, সম্পদ ও রাজ্য পরিত্যাগ করে ভূতলে শয়ন করবে। আজ রাজা ধৃতরাষ্ট্র পুত্রকে নিহত শ্রবণ করে—শকুনির বুদ্ধি অনুযায়ী যে সমস্ত কাজ করেছিলেন, সেই সমস্ত অমঙ্গলজনক কাজ স্মরণ করবেন।”

এই বলে, বলবান ভীমসেন গদা নিয়ে পূর্বকালে ইন্দ্র যেমন বৃত্রাসুরকে আহ্বান করেছিলেন, সেইরকম দুর্যোধনকে আহ্বান করে, যুদ্ধের জন্য অবস্থান করলেন। দুর্যোধন গদা তুলে, কৈলাস পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন দেখে ভীমসেন ক্রুদ্ধ হয়ে আবার বললেন, “দুরাত্মা দুর্যোধন! বারণাবত নগরে যা ঘটেছিল, রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও তোমার সেই দুষ্কার্য এখন স্মরণ করো। তুমি ও শকুনি দ্যূতসভামধ্যে রজস্বলা দ্রৌপদীর যে কষ্ট দিয়েছিলে এবং রাজা যুধিষ্ঠিরকে যে প্রতারণা করেছিলে, তা এখন স্মরণ করো। দুর্মতি! আমরা তোমার প্রদত্ত যে বনবাসের মহাদুঃখ পেয়েছি এবং জন্মান্তর প্রাপ্ত হয়েই যেন বিরাটনগরে যে অজ্ঞাতবাসের কষ্টভোগ করেছি, আজ সে সমস্ত দুঃখকষ্টের প্রতিশোধ দেব। কারণ, আজ তুমি ভাগ্যবশত আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছ। প্রতাপশালী ও রথীশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম তোমার জন্যই শিখণ্ডীকর্তৃক আহত হয়ে ওই শরশয্যায় শয়ন করে আছেন। দ্রোণ, কর্ণ, প্রতাপশালী শল্য এবং বৈরানলের প্রথম প্রবর্তক সুবলপুত্র শকুনিও নিহত হয়েছেন। দ্রৌপদীর ক্লেশদাতা পাপাত্মা প্রতিকামী নিহত হয়েছে এবং বীর ও বিক্রম সহকারে যুদ্ধ করে তোমার ভ্রাতারাও নিহত হয়েছে। তোর জন্যই এই সকল রাজা ও অন্যান্য বহুতর রাজা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন; আজ তোকেও বধ করব, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”

ভীমসেন উচ্চ স্বরে এরূপ বলতে লাগলে, নির্ভয়চিত্ত ও যথার্থ বিক্রমশালী ধৃতরাষ্ট্র-পুত্র দুর্যোধন বললেন, “কুরুকুলাধম বৃকোদর! বহু আত্মশ্লাঘা করবার প্রয়োজন কী? তুই যুদ্ধ কর, আজ তোর যুদ্ধের লালসা দূর করব। আরে ক্ষুদ্র! তুই বা তোর মতো লোক যেভাবে কেবল বাক্যদ্বারা সামান্য ব্যক্তির ভয় উৎপাদন করে, সে ভাবে দুর্যোধনের ভয় উৎপাদন করতে পারবি না। আমি চিরকাল তোর সঙ্গে গদাযুদ্ধ করবার ইচ্ছা করে আসছি; আজ ভাগ্যবশত দেবতারা তা ঘটিয়ে দিয়েছেন। দুর্মতি ভীম! কেবল বাক্যদ্বারা বহু বিষয় বলবার বা গর্ব প্রকাশ করবার প্রয়োজন কী? এখন কর্মদ্বারা এই বাক্য সফল কর, বিলম্ব করিস না।” দুর্যোধনের সেই বাক্য শুনে, রাজারা, সোমকেরা এবং অন্যান্য যাঁরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা সকলেই তাঁর প্রশংসা করতে লাগলেন। তারপর সকলের প্রশংসা শুনে, রোমাঞ্চিত দেহে, দুর্যোধন পুনরায় যুদ্ধে বুদ্ধি স্থির করলেন। পরে রাজারা করতল ধ্বনিদ্বারা মস্তহস্তীর ন্যায় অসহিষ্ণু দুর্যোধনকে আরও আনন্দিত করলেন।

তখন মহাবল পাণ্ডুনন্দন ভীমসেন গদা উত্তোলন করে, দুর্যোধনের অভিমুখে ধাবিত হলেন। সেই সময় হস্তী সকল বৃংহিতধ্বনি করতে লাগল, অশ্বগণ হ্রেষারব করতে থাকল এবং জয়াভিলাষী পাণ্ডবগণের উত্তোলিত অস্ত্রগুলি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভীমসেনকে সেইভাবে আসতে দেখে দুর্যোধন অকাতর চিত্তে গর্জন করতে করতে তাঁর দিকে ধাবিত হলেন। ক্রমে তাঁরা দু’জনে শৃঙ্গযুক্ত দুটি মহাবৃষের ন্যায় পরস্পরের উপর পতিত হলেন এবং মহানির্ঘাত শব্দের মতো তাঁদের গদাপ্রহারের শব্দ হতে লাগল। ইন্দ্র ও প্রহ্লাদের যুদ্ধের ন্যায় তাঁরা পরস্পরকে আঘাত করতে লাগলেন। তখন রক্তাক্তগাত্র, মহাবল, গদাধারী এবং অকাতরচিত্তে ভীম ও দুর্যোধন পুষ্পসমন্বিত দুটি কিংশুকবৃক্ষের মতো দেখাতে লাগলেন। অতিদারুণ সেই মহাযুদ্ধ সেইভাবে চলতে লাগলে, গগনমণ্ডল খদ্যোতসমূহের মতো অগ্নি স্ফুলিঙ্গে প্রকাশ পেতে থাকল। তুমুল যুদ্ধে উভয়েই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লে—কিছুকাল বিশ্রাম করে পরস্পর আবার আঘাতে প্রবৃত্ত হলেন। মহাবল, বিশ্রান্ত, নরশ্রেষ্ঠ ও ঋতুমতী হস্তিনীর সঙ্গমের জন্য মদমত্ত দুটি বলবান হস্তীর ন্যায় সমান বলশালী ভীম ও দুর্যোধনকে দেখে এবং তাঁদের দুটি উত্তোলিত গদা দেখে, আকাশে দেবতা ও গন্ধর্বেরা এবং ভূতলস্থিত মনুষ্যেরা অত্যন্ত বিস্ময়াপন্ন হলেন। উভয় যোদ্ধার মধ্যে কে জয়ী হবেন, তা নিয়ে সেস্থানের উপস্থিত ব্যক্তিদের সন্দেহ জন্মাল।

সেই সময়ে বলিশ্রেষ্ঠ ভীম ও দুর্যোধন দুই ভ্রাতা পরস্পরের ছিদ্র লাভ করবার জন্য সেই ছিদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন। তারপর ভীমসেন যখন গদা ঘোরাতে লাগলেন, তখন কিছুকাল ভীষণ ও তুমুল শব্দ হতে লাগল। ভীমসেন অতুলনীয় বেগসম্পন্ন সেই গদা অতি দ্রুত ঘোরাচ্ছেন দেখে দুর্যোধনের বিস্ময় জন্মাল। বীর ভীমসেন তখন নানাবিধ পথে বিচরণ এবং মণ্ডলাকারে ভ্রমণ করতে থেকে অত্যন্ত শোভা পেতে লাগলেন। তাঁরা পরস্পরের নিকটবর্তী হয়ে এবং আত্মরক্ষায় যত্নবান থেকে খাদ্যলাভের জন্য দুটি বিড়ালের মতো মুহুর্মুহু প্রহার করতে থাকলেন। ভীমসেন নানাবিধ পথে গমন, মণ্ডলাকারে বিচিত্র ভ্রমণ, অগ্রগমন এবং পশ্চাৎ অপসরণ করতে লাগলেন। অস্ত্রনির্মিত যন্ত্রের ন্যায় বিচিত্র গমন, নানাপ্রকারে অবস্থান, পিছনে সরে প্রহার এড়ানো, পাশে সরে প্রহার এড়ানো, প্রতিপ্রহার করে প্রহার নিষ্ফল করা, অভিমুখে ধাবিত হওয়া, হস্ত ও চরণ ধরে আকর্ষণ করা, আকর্ষণ করলেও যুদ্ধ করতে থেকে পূর্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা, একজন পিছনে সরলে অন্যজনের সম্মুখে আগমন, অবনত হয়ে লাফাতে লাফাতে যাওয়া, উঁচু হয়ে লাফাতে লাফাতে যাওয়া উল্লম্ফন ও প্রলম্ফন ইত্যাদি করতে থেকে, গদাযুদ্ধ বিশারদ ভীম ও দুর্যোধন পরস্পরকে আঘাত করতে লাগলেন। কৌরবশ্রেষ্ঠ ভীম ও দুর্যোধন পরস্পরকে আঘাত করতে লাগলেন। তাঁরা পরস্পরকে বঞ্চনা করতে থেকে এবং পরস্পর যেন খেলা করতে করতে পুনরায় বিচরণ করতে থাকলেন। শত্রুদমনকারী ভীম ও দুর্যোধন সকলদিকে রণস্থলে যুদ্ধক্রীড়া দেখাতে দেখাতে গদাদ্বারা বেগে পরস্পরকে আঘাত করতে লাগলেন।

দুটি হাতি যেমন দন্তদ্বারা পরস্পরে আঘাত করে, সেইরূপ তাঁরা গদাদ্বারা পরস্পর আঘাত করে, রক্তাক্তদেহ হয়ে, শোভা পেতে থাকলেন। দিবাবসান সময়ে ইন্দ্র ও বৃত্রাসুরের মতো ভীম ও দুর্যোধনের ভীষণ ও নিষ্ঠুর যুদ্ধ অবাধে চলতে লাগল। তারপর তাঁরা গদাধারণ করে মণ্ডলীভূত অবস্থায় অবস্থান করতে লাগলেন। তাঁদের মধ্যে বলবান দুর্যোধন দক্ষিণভাগে এবং ভীমসেন বামভাগে রইলেন। ভীমসেন সেইভাবে রণস্থলে বিচরণ করতে থাকলে, দুর্যোধন গদাদ্বারা তাঁর পার্শ্বদেশে আঘাত করলেন। দুর্যোধন সেইভাবে আঘাত করলে, ভীমসেন সে আঘাত অগ্রাহ্য করে, নিজের বিশাল গদাটি ঘোরাতে লাগলেন। তখন ইন্দ্রের বজ্রের তুল্য এবং যমের দণ্ডের সদৃশ ভীষণ ভীমের সেই উত্তোলিত গদাটি সকলে দেখতে থাকল। তেজস্বী দুর্যোধন রণস্থলের বিভিন্ন স্থানে নানাবিধ পথে বিচরণ ও মণ্ডলাকারে ভ্রমণ করতে থেকে, ভীমের থেকে অধিক শোভা পেতে লাগলেন। ভীমকর্তৃক মহাবেগে ঘূর্ণিত বিশাল, উত্তম ও মহাশব্দযুক্ত সেই গদাটি ধূম ও শিখার সঙ্গে অগ্নি আবিষ্কার করতে থাকল।

ভীমসেন গদা ঘোরাচ্ছেন দেখে, দুর্যোধন লৌহময়ী বিশাল গদা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, অত্যন্ত শোভা পেতে লাগলেন। মহাবল দুর্যোধনের গদার বায়ুর বেগ দেখে, সোমক ও পাণ্ডবগণের হৃদয়ে ভয় প্রবেশ করল। দুর্যোধন ভীমসেনকে তখনও অবস্থিত দেখে নানা প্রকার ভঙ্গিতে গমন করতে করতে তাঁর প্রতি ধাবিত হলেন। তখন ক্রুদ্ধ ভীমসেন গদাদ্বারা সর্বতোভাবে ক্রুদ্ধ দুর্যোধনের মহাবেগা ও স্বর্ণপট্টবেষ্টিতা সেই গদার উপরে আঘাত করলেন। দুটি বজ্রের পরস্পর আঘাতজনিত শব্দের ন্যায় সেই গদা দুটির পরস্পর আঘাতজনিত শব্দ ও অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আবির্ভূত হল। ভীমসেন নিক্ষিপ্ত বেগবতী সেই গদাটা ভূতলে পতিত হলে, সেই ভূমি কেঁপে উঠল। দুর্যোধন নিজের গদা প্রতিহত হল দেখে তা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি ভীমসেনকে বধ করার জন্য কৃতনিশ্চয় হয়ে, বাঁদিকে নিজের গদাটি মণ্ডলাকারে ঘুরিয়ে, সেই ভীষণবেগযুক্ত গদাদ্বারা ভীমসেনের মস্তকে আঘাত করলেন। কিন্তু সেই আঘাতেও ভীমসেন বিচলিত হলেন না। ভীমসেন সেরূপ আহত হয়েও এক পা থেকে অন্য পায়ে যে সরলেন না, সমস্ত সৈন্যই সেই আশ্চর্য ব্যাপারের প্রশংসা করল। তখন ভয়ংকর পরাক্রমশালী ভীমসেন স্বর্ণপট্টবেষ্টিত ও উজ্জ্বল বিশাল গদাটিকে দুর্যোধনের উপর নিক্ষেপ করলেন। মহাবল দুর্যোধন অবিচলিত থেকে, সত্বর অপসৃত হয়ে, ভীমের সেই প্রহারটিকে ব্যর্থ করলেন; তা দেখে সেখানকার লোকেরা অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। ভীমসেন-নিক্ষিপ্ত, সেই ভয়ংকর গদাটি ভূতলে পড়ে রণস্থল কাঁপিয়ে দিল।

ক্রমে মহাবল ও কৌরবশ্রেষ্ঠ দুর্যোধন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ভীমকে বঞ্চিত জেনে, তিনি আবারও প্রহার করবেন বুঝে, পেচকের গতিভঙ্গি অবলম্বন করে, বারবার লাফিয়ে উঠতে থেকে, আপন গদাদ্বারা ভীমসেনের বক্ষঃস্থলে আঘাত করলেন। দুর্যোধন আঘাত করলে ভীমসেন মূৰ্ছিতপ্রায় হয়ে পড়লেন এবং নিজের কর্তব্য স্থির করতে পারলেন না। ভীমসেনের সেই অবস্থা দেখে পাণ্ডব ও সোমকেরা জয়ে নিরাশ ও বিষন্ন হয়ে পড়লেন। কিন্তু দুর্যোধনের সেই প্রহার হস্তীর মতো ভীমসেনের ক্রোধ উৎপাদন করল। তিনি হস্তীর মতো হস্তীতুল্য দুর্যোধনের দিকে ধাবিত হলেন। সিংহ যেমন বন্যহস্তীর দিকে ধাবিত হয়, সেইরকম ভীমসেন গদা নিয়ে দুর্যোধনের দিকে বলপূর্বক ধাবিত হলেন। গদানিক্ষেপ-নিপুণ ভীমসেন নিকটবর্তী হয়ে, আপন শত্রু দুর্যোধনের দিকে লক্ষ্য রেখে গদা ঘূর্ণিত করতে করতে দুর্যোধনের পার্শ্বদেশে প্রচণ্ড আঘাত করলেন। তখন দুর্যোধন জানুযুগল পেতে ভূমি অবলম্বন করলেন। সৃঞ্জয়গণ আনন্দে মহাকোলাহল করতে লাগলেন। সেই আনন্দ কোলাহলে অসহিষ্ণুতাবশত দুর্যোধন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তখন মহাবাহু দুর্যোধন গাত্রোত্থান করে, মহাসর্পের মতো শ্বাসত্যাগ করতে থেকে, নয়নযুগল দ্বারা ভীমসেনকে যেন দগ্ধ করবার ইচ্ছা করে, তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। তারপর ভীমসেনের মস্তক চূর্ণ করবার জন্য তাঁর দিকে ধাবিত হলেন। তখন মহাবল ও ভীষণ পরাক্রমশালী দুর্যোধন গিয়ে গদাদ্বারা ভীমসেনের ললাটের উপরিভাগে আঘাত করলেন; কিন্তু ভীমসেন তাতে পর্বতের মতো অবিচলিত রইলেন। তাঁর ললাট থেকে রক্ত ঝরে পড়তে লাগল। তিনি মদস্রাবী হস্তীর ন্যায় অধিক শোভা পেতে লাগলেন। তারপর শক্ৰহন্তা ভীমসেন লৌহময়ী, বীরনাশিনী এবং বজ্র ও বিদ্যুতের ন্যায় গদাধারণ করে, বিক্রমের সঙ্গে সবলে দুর্যোধনের দেহে আঘাত করলেন। ভীমসেনের সেই আঘাতে বর্মধারী দুর্যোধন বনমধ্যে বায়ুবেগে তাড়িত ও পুষ্পসমন্বিত বিশাল শালবৃক্ষের ন্যায় ঘুরতে লাগলেন। দুর্যোধনকে ভূতলে পতিত দেখে, পাণ্ডবেরা আনন্দিত হয়ে কোলাহল করতে লাগলেন। তখনই দুর্যোধন চৈতন্যলাভ করে, হস্তী যেমন হ্রদ থেকে গাত্রোত্থান করে, সেইরকম ভূতল থেকে গাত্রোত্থান করলেন। সর্বদা কোপান্বিত মহারথ রাজা দুর্যোধন শিক্ষিতের মতো ভ্রমণ করতে থেকে, সম্মুখবর্তী ভীমসেনকে আঘাত করলেন। ভীমসেন বিহ্বল হয়ে ভূতলে পতিত হলেন। দুর্যোধন সেইভাবে বলপূর্বক ভীমসেনকে ভূতলে নিপাতিত করে, সিংহনাদ করলেন এবং বজ্রতুল্য গদার আঘাতে ভীমের বর্মটিকে বিদীর্ণ করলেন। তখন আকাশে দেবগণ ও অপ্সরাগণ আনন্দধ্বনি করতে থাকল, সেখানে মহাকোলাহল হতে লাগল এবং ঊর্ধ্ব থেকে দেবনিক্ষিপ্ত উত্তম পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল।

সেই সময়ে ভীমসেন পতিত হয়েছেন। দুর্যোধন সবলই আছেন এবং ভীমসেনের বর্ম বিদীর্ণ হয়েছে, এইসব দেখে পাণ্ডবগণের গুরুতর ভয় জন্মাল। কিছুকাল পরে ভীমসেন চৈতন্য লাভ করে, নিজের রক্তাক্ত মুখমণ্ডল মুছে, ধৈর্য অবলম্বনপূর্বক চিত্ত স্থির করে দুর্যোধনের দিকে্ চোখ ফিরিয়ে তাকালেন। এদিকে যমতুল্য নকুল ও সহদেব এবং বলবান ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকি—দুর্যোধনকে আহ্বান করে “এই আমি তোমাকে বধ করছি, এই আমি তোমাকে বধ করছি” এই কথা বলে দুর্যোধনের দিকে ধাবিত হওয়ার উপক্রম করলেন। তখন বলবান ভীমসেন তাঁদের নিবৃত্ত করে, শ্রম ও কম্প তিরোহিত হলে, যমের মতো পুনরায় দুর্যোধনের দিকে ধাবিত হলেন। কৌরব প্রধান ভীম ও দুর্যোধনের গদাযুদ্ধ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে অর্জুন যশস্বী কৃষ্ণকে বললেন, “জনার্দন, এই যুধ্যমান বীর দু’জনের মধ্যে কে প্রধান? এবং এদের মধ্যে কার কোন গুণই বা অধিক তা বলো।” কৃষ্ণ বললেন, “গুরুর উপদেশ এঁদের দু’জনেরই সমান। কিন্তু ভীমসেন অধিক বলবান, আর ভীমসেন অপেক্ষা দুর্যোধন গদাযুদ্ধে অধিক যত্নবান ও নিপুণ। অতএব ভীমসেন ন্যায় অনুসারে যুদ্ধ করলে দুর্যোধনকে জয় করতে পারবেন না; কিন্তু অন্যায়ভাবে যুদ্ধ করে অবশ্যই দুর্যোধনকে বধ করতে পারবেন। দেবতারা কুটকৌশলে অসুরগণকে বধ করেছিলেন আর ইন্দ্রও কূটকৌশলেই বিরোচনকে পরাজিত করেছিলেন। আবার ইন্দ্র কূটকৌশলেই বৃত্রাসুরের তেজ নষ্ট করেছিলেন। সুতরাং ভীমসেন কূটকৌশলবহুল পরাক্রমই অবলম্বন করুন। অর্জুন, ভীমসেন দ্যূতক্রীড়ার সময়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ‘দুর্যোধন, আমি গদাদ্বারা তোর ঊরুযুগল ভগ্ন করব।’ ভীমসেন তাঁর প্রতিজ্ঞা পালন করুন; কূটকৌশলী দুর্যোধনকে কুটকৌশলেই বধ করুন। ভীমসেন যদি ন্যায় অনুসারে যুদ্ধ করেন, তা হলে রাজা যুধিষ্ঠির বিষম বিপদে পড়বেন। আমি আবার বলছি, ধর্মরাজের অপরাধে পুনরায় আমাদের ভয় উপস্থিত হয়েছে। অতি গুরুতর ব্যাপারের অনুষ্ঠান করে ভীষ্ম প্রভৃতি কৌরবগণকে বধ করে উত্তম যশও লাভ করা গিয়েছিল এবং শত্রুতারও প্রতিশোধ দেওয়া হয়েছিল। জয় প্রায় হস্তগত হয়েছিল, এমন অবস্থায় ধর্মরাজ পুনরায় তাঁকে সংশয়াপন্ন করেছেন। এটা ধর্মরাজের অত্যন্ত নির্বুদ্ধিতাই হয়েছে। ‘দুর্যোধন, তুমি আমাদের একজনকে জয় করতে পারলেই তোমার জয় হবে’ এইরূপে ধর্মরাজ যুদ্ধে ভয়ংকর পণ রেখেছেন। কারণ, দুর্যোধন গদাযুদ্ধে নিপুণ, বীর এবং মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করছেন। পূর্বকালে শুক্রাচার্য বলেছিলেন, ‘জীবনার্থী, হতাবশিষ্ট, যোদ্ধারা পরাজিত হয়ে, আবারও ফিরে আসলে, অবশ্যই তাঁদের ভয় করতে হবে। কারণ, তাঁরা তখন মরণে কৃতনিশ্চয় হয়েই ফিরে এসে থাকেন।’ অর্জুন, শত্রুরা আপনার জীবনে নিরাশ হয়ে, বেগে এসে পড়লে তাঁরা ইন্দ্রেরও অসহ্য হন।

“দুর্যোধনের সমস্ত সৈন্য নিহত হয়েছে, তিনি নিজেও পরাজিত হয়েছেন, এ অবস্থায় তিনি দ্বৈপায়ন হ্রদে প্রবেশ করেছিলেন এবং সেখান থেকে রাজ্যলাভে নিরাশ হয়ে বনে যাবার ইচ্ছাই করছিলেন। তারপর, দুর্যোধন আমাদের বিজিত রাজ্য আবার হরণ না-করে, এই ধারণা করে কোনও বুদ্ধিমান লোক খুঁজে বার করে পুনরায় তাঁকে যুদ্ধে আহ্বান করেন? যে দুর্যোধন, ‘ভীমের সঙ্গে অবশ্যই আমার গদাযুদ্ধ হবে’ এই কৃতনিশ্চয় করে, ভীমকে বধ করবার ইচ্ছা করে, আজ ত্রয়োদশ বৎসর যাবৎ উপরের দিকে ও পার্শ্বদেশে গদাঘাতের অভ্যাস করে আসছেন। মহাবাহু ভীমসেন অন্যায়ভাবে সেই দুর্যোধনকে যদি বধ না করেন, তা হলে এই দুর্যোধনই পুনরায় তোমাদের রাজা হবেন।”

অর্জুন মহাত্মা কৃষ্ণের সকল কথা শুনে ভীমসেন দেখতে পান এমনভাবে হস্তদ্বারা নিজের বাম ঊরুর উপর আঘাত করলেন।

তারপর ভীমসেন চৈতন্য লাভ করে, গদাধারণপূর্বক রণস্থলে কখনও ঘুরে ফিরে, কখনও অন্যান্যভাবে বিচিত্র মণ্ডলাকারে বিচরণ করতে লাগলেন। ভীমসেন দুর্যোধনকে মুগ্ধ করেই যেন কখনও ডানদিকে, কখনও বাঁদিকে, কখনও গোমূত্রের প্রকারে ভ্রমণ করতে থাকলেন। দুর্যোধনও ভীমসেনকে বধ করবার ইচ্ছা করে, সেইরূপই বিচিত্রভাবে দ্রুত বিচরণ করতে লাগলেন। দুটি মহাপক্ষী যেমন মহাসর্পের মাংসের লোভে পরস্পরকে বধ করবার ইচ্ছা করে যুদ্ধ করে, সেইরকম মহাবীর ও পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীম ও দুর্যোধন শত্রুতার সমাপ্তি করার অভিপ্রায়ে পরস্পরকে বধ করার ইচ্ছা করে। চন্দন ও অগুরুরঞ্জিত ভীষণ দুটি গদা সঞ্চালন করতে থেকে, ক্রুদ্ধ দুই যমের মতো পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন।

বীর ও বলবান ভীম ও দুর্যোধন বায়ুসঞ্চালিত দুটি সমুদ্রের মতো রণস্থলে বিচিত্র মণ্ডলাকারে বিচরণ করতে থেকে, যখন পরস্পর সমানভাবে গদা প্রহার করতে লাগলেন, সেই গদা দুটি থেকে অগ্নিশিখা নির্গত হতে লাগল। দুটি মত্তহস্তীর ন্যায় ভীম ও দুর্যোধন সমানভাবে পরস্পর প্রহার করতে থাকলে, গদা দুটির পরস্পর আঘাতের গুরুতর শব্দ হতে লাগল। তখন সেই ভীষণ ও তুমুল প্রহার চলতে লাগল। শত্রুদমনকারী ভীম ও দুর্যোধন দু’জনেই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লেন। দু’জনেই সামান্য কিছু সময় বিশ্রাম করার পর আবার পরস্পরকে আঘাত করতে লাগলেন। প্রহারে প্রহারে তাঁদের শরীর জর্জরীভূত ও রক্তাক্ত হয়ে পড়ল; তখন তাঁদের হিমালয় পর্বতে পুষ্পসমন্বিত দুটি কিংশুক বৃক্ষের মতো দেখাতে লাগল। ভীম এমন ভাব দেখালেন যে তিনি প্রহারের জন্য কিছু সময় চাইছেন। তখন দুর্যোধন মৃদু হাস্য করে ভীমের দিকে বেগে ছুটে গেলেন। দুর্যোধন কাছাকাছি হলে ভীম মহাবেগে তাঁর দিকে গদা নিক্ষেপ করলেন। দুর্যোধন সেই গদানিক্ষেপ দেখে, অতিদ্রুত সেই স্থান থেকে সরে গেলেন। বেগে সেই স্থান থেকে সরে, ভীমের প্রহার ব্যর্থ করে আপন গদাদ্বারা ভীমকে ভীষণ প্রহার করলেন। ভীমসেনের তেজ অসাধারণ হলেও দুর্যোধনের সেই গুরুতর প্রহারে রক্ত নির্গত হতে থাকায় তাঁর যেন মূৰ্ছা জন্মাল।

কিন্তু ভীমসেন যে পীড়িত হয়েছিলেন, তা দুর্যোধন বুঝতে পারেননি। কারণ ভীমসেনও অত্যন্ত পীড়িত নিজের শরীর যথাযথভাবেই ধারণ করছিলেন। সুতরাং দুর্যোধন মনে করেছিলেন, ভীম প্রহার করবেন বলেই তিনি সেই প্রহারের অপেক্ষা করছিলেন, নিজে প্রহার করেননি। তারপর প্রতাপশালী ভীমসেন কিছুক্ষণ পরে সুস্থ হয়ে, নিকটবর্তী দুর্যোধনের উপরে বেগে গিয়ে পতিত হলেন। মহামনা দুর্যোধন অমিততেজা ও ক্রুদ্ধ ভীমসেনকে ছুটে আসতে দেখে, তার প্রহার ব্যর্থ করবার ইচ্ছা করে, দাঁড়িয়ে থাকবার ইচ্ছাই যেন দেখিয়ে ভীমসেনকে বঞ্চনা করবেন বলে, উপরের দিকে লাফিয়ে উঠবার ইচ্ছা করলেন। ওদিকে ভীমসেন দুর্যোধনের সেই অভিপ্রায় বুঝতে পারলেন; দুর্যোধনও মৃত্যুকে বঞ্চনা করে লম্ফ প্রদান করে উপরের দিকে উঠলেন, ভীমসেনও বেগে গিয়ে, সিংহের মতো গর্জন করে, মহাবেগে দুর্যোধনের ঊরুযুগলের উপর গদাঘাত করলেন। ভীমকর্মা ভীমসেন আঘাত করামাত্র বজ্রাঘাতের ন্যায় আঘাতকারিণী সেই গদাটি দুর্যোধনের মনোহর ঊরুযুগল ভগ্ন করল।

ভীমসেন ঊরুযুগল ভগ্ন করলে, নরশ্রেষ্ঠ দুর্যোধন রণভূমি নিনাদিত করতে থেকে পতিত হলেন। রাজাধিরাজ বীর দুর্যোধন নিপতিত হলে, নির্ঘাতের সঙ্গে বায়ু বইতে লাগল, ধূলিবৃষ্টি হতে থাকল এবং বৃক্ষ ও পর্বতের সঙ্গে পৃথিবী কেঁপে উঠল। উজ্জ্বল উল্কাসকল বিশাল শব্দ করে নির্ঘাতের সঙ্গে পতিত হতে থাকল। ইন্দ্র রক্তধূলি বর্ষণ করতে লাগলেন। আকাশে যক্ষ, রাক্ষস ও পিশাচগণের বিশাল কোলাহল শোনা যেতে লাগল। পশু ও পক্ষীরা ঘোরতর শব্দ করতে থাকল। দুর্যোধনের পতনের পর অবশিষ্ট হস্তী, অশ্ব, মনুষ্য বিশাল আর্তনাদ করতে লাগল। ধ্বজধারী, অস্ত্রশালী ও শূলপাণি লোকেরা কাঁপতে লাগল। হ্রদ ও কূপসকল রক্ত উদ্‌গার করতে লাগল ও মহাবেগযুক্ত নদীগুলির স্রোত প্রতিকূলভাবে চলতে লাগল।

দুর্যোধন নিপতিত হলে স্ত্রীলোকেরা যেন পুরুষের মতো হয়ে উঠল এবং পুরুষেরা যেন স্ত্রীলোকের আচরণ শুরু করল। দেবগণ, গন্ধর্বগণ, অপ্সরাগণ ভীম ও দুর্যোধনের অদ্ভুত যুদ্ধের বিষয় আলোচনা করতে থেকে অভীষ্টস্থানে গমন করলেন। সিদ্ধগণ ও বায়ুভরগামী চারণগণ, নরশ্রেষ্ঠ ভীম ও দুর্যোধনের প্রশংসা করতে করতে, যথাস্থানে চলে গেল। তখন পাণ্ডবেরা সকলে দুর্যোধনকে উন্নত বিশাল শালবৃক্ষের মতো নিপাতিত দেখে, অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। সোমকেরা সকলেই রোমাঞ্চিত দেহে সিংহ নিপাতিত মত্তহস্তীর ন্যায় দুর্যোধনকে দেখতে লাগলেন। তারপর প্রতাপশালী ভীমসেন ঊরুভঙ্গ করে নিপতিত সেই কৌরবশ্রেষ্ঠের কাছে গিয়ে বললেন, “মূর্খ! দুর্মতি! তুই পূর্বে দ্যূতসভায় একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে উপহাস করতে থেকে, আমাদের যে ‘গোরু’ ‘গোরু’ বলেছিলি; আজ সেই উপহাসের সমস্ত ফলভোগ কর।” এই কথা বলে ভীমসেন বামচরণদ্বারা রাজশ্রেষ্ঠ দুর্যোধনের ললাটের উপরিভাগ স্পর্শ করলেন এবং সেই চরণদ্বারাই তাঁর মস্তকটি অনেকবার সঞ্চালিত করলেন। ভীমসেন আবার বললেন, “যে মূর্খরা পূর্বে আমাদের লক্ষ্য করে, ‘গোরু’ ‘গোরু’ বলে নৃত্য করেছিল, এখন আবার আমরা তাদের লক্ষ্য করে, ‘গোরু’ ‘গোরু’ বলে প্রতিনৃত্য করছি। আমাদের শঠতা নেই, অগ্নিদান নেই, দ্যূতক্রীড়া নেই এবং বঞ্চনাও নেই; কিন্তু আমরা আপন বাহুবল অবলম্বন করেই শত্রুগণকে বধ করে আসছি।” ভীষণ শত্রুতার শেষ করে ভীমসেন মৃদুহাস্যে যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণ, অর্জুন, নকুল, সহদেব ও সৃঞ্জয়গণকে বললেন, “যারা সেই দ্যূতসভায় রজস্বলা দ্রৌপদীকে নিয়ে গিয়েছিল এবং যারা তাঁকে বিবস্ত্রা করবার চেষ্টা করেছিল; সেই ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা দ্রৌপদীরই তপস্যার প্রভাবে পাণ্ডবদের হাতে নিহত হয়েছে, আপনারা দর্শন করুন। রাজা ধৃতরাষ্ট্রের যে ক্রূর পুত্রেরা পূর্বে আমাদের যে ‘ষণ্ডতিল’ বলেছিল, তারা সকলেই পরিজনগণ ও অনুচরদের সঙ্গে আমাদের হস্তে নিহত হয়েছে। এখন আমরা স্বর্গেই যাই, কিংবা নরকেই পড়ি, বিধাতার যা ইচ্ছা আমাদের তাই হোক।” পুনরায় ভীমসেন স্কন্ধস্থিত গদাটি হাতে ধরে, বামচরণদ্বারা ভূপতিত দুর্যোধনের মস্তকটিকে মর্দন করে তাকে ‘শঠ’ বলে তিরস্কার করলেন। কৌরবশ্রেষ্ঠ দুর্যোধনের মস্তকে ভীমসেন পদাঘাত করলে, ধর্মাত্মা সোমকশ্রেষ্ঠরা ভীমের এই কার্যের প্রশংসা করলেন না।

তখন যুধিষ্ঠির সেই অত্যন্ত আনন্দিত ভীমসেনকে বললেন, “ভীম তুমি সঙ্গত বা অসঙ্গত কার্যদ্বারা শত্রুতার প্রতিশোধ নিয়েছ এবং প্রতিজ্ঞাও পূর্ণ করেছ। এখন অত্যাচার থেকে বিরত হও। নিষ্পাপ ভীমসেন, তুমি চরণ দ্বারা দুর্যোধনের মস্তকটিকে নিষ্পেষণ কোরো না। ধর্ম যেন তোমাকে অতিক্রম না করে। ইনি রাজা, তোমার জ্ঞাতি এবং প্রায় নিহত হয়ে আছেন; অতএব ওঁকে তোমার পদাঘাত করা সঙ্গত হয়নি। ইনি একাদশ অক্ষৌহিণী সৈন্যের অধিপতি, কুরুবংশের নেতা, কুরুদেশের রাজা এবং তোমার জ্ঞাতি ছিলেন; অতএব তুমি ওকে চরণদ্বারা স্পর্শ কোরো না। এর বন্ধুগণ, অমাত্যগণ নিহত হয়েছে এবং ইনি সৈন্যশূন্য হয়ে নিহত হয়েছেন। এর জন্য শোক করা উচিত, উপহাস করা উচিত নয়। এর অমাত্যগণ, ভ্রাতৃগণ, সন্তানগণ নিহত হয়েছেন; সুতরাং এর পিণ্ড লোপ পেয়েছে, নিজেও বিধ্বস্ত হয়েছেন এবং ইনি তোমার ভ্রাতা। অতএব এর পরে তোমার এই পদাঘাত করা উচিত হয়নি। ভীমসেন, পূর্বে লোকেরা বলত, ‘ভীমসেন ধার্মিক’ সুতরাং সেই তুমি কী করে চরণদ্বারা রাজাকে আক্রমণ করছ?”

যুধিষ্ঠির ভীমসেনকে এই কথা বলে, অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠ ও শোককাতর হয়ে নিকটে গিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী শত্রুদমনকারী দুর্যোধনকে বললেন, “বৎস তুমি অনুতাপ কোরো না এবং নিজের জন্য শোক কোরো না। কারণ, তুমি নিশ্চয়ই পূর্বকৃত অতিদারুণ কর্মের এই ফল অনুভব করছ। তুমি যে আমাদের বিনাশ করার ইচ্ছা করে আসছিলে এবং আমরাও যে তোমাকে ধ্বংস করবার ইচ্ছা করছিলাম, তা বিধাতার উপদিষ্ট, অশোভন, বিষম কর্মের ফল। ভরতনন্দন, লোভ, মত্ততা ও মূঢ়তাবশত নিজকৃত অপরাধের ফলে এই বিপদে পড়েছ। বয়স্যগণ, ভ্রাতৃগণ, পিতৃগণ, পুত্রগণ, পৌত্রগণ, বিনাশ করিয়ে তুমি নিজেও বিনষ্ট হয়েছ। নিজের জন্য শোক কোরো না। তুমি শ্লাঘ্য মৃত্যুই পেয়েছ। আমরাই এখন শোকাহত অবস্থায় পড়লাম। কেন না আমরা এখন সেই প্রিয় বন্ধুগণবিহীন হয়ে সমস্ত অবস্থাতেই দীনভাবে দিন অতিবাহিত করব। ভ্রাতৃগণ, পুত্রগণ, পৌত্রগণের বিধবা বধূরা শোকে আকুল হয়ে থাকবেন, সে অবস্থায়, আমি শোকে বিহ্বল হয়ে, কী প্রকারে তাদের দেখব। তুমি একাকী স্বর্গে চললে, কিন্তু আমরা ‘নারকী’ নাম ধারণ করে দারুণ দুঃখ ভোগ করব। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের বিধবা পুত্রবধূ ও পৌত্রবধূ প্রভৃতিরা শোকে আকুল হয়ে নিশ্চয় আমাদের নিন্দা করতে থাকবেন।”

*

যে মহামন্যুময় বৃক্ষের উল্লেখ অনুক্রমণিকায় করে ব্যাসদেব মহাভারত রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, তার শাখা-প্রশাখা স্কন্ধ ক্রমাবধি বিনষ্ট হতে পাঠক দেখেছেন। প্রায় বৃক্ষটির মধ্যভাগ থেকেই। ভীমসেন গদাঘাতে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করলে বলরাম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন; কারণ, গদাযুদ্ধে নাভির নিম্নে প্রহার নিষিদ্ধ। কিন্তু দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ ঘটেছে সেইদিন, সেদিন দ্যূতক্রীড়া সভায় সমস্ত সভ্যতা-ভব্যতার রীতি লঙ্ঘন করে, শ্বশুর এবং গুরুজনদের সামনে দুর্যোধন দ্রৌপদীকে বাম ঊরুর বস্ত্র অনাবৃত করে দেখিয়েছিলেন। নারীকে বাম ঊরু অনাবৃত করে দেখালে সম্ভোগ বাসনা প্রকাশ করা হয়। স্বামীদের উপস্থিতিতেই শ্বশুর এবং গুরুজনদের সামনে দুর্যোধন এই কদর্যকাণ্ড করেছিলেন। দুর্যোধন পাপী এবং অনাচারী, সভ্যতার সমস্ত নিয়ম তিনি লঙ্ঘন করেছিলেন। এই অবস্থায় যে কোনও স্বামীই প্রতিশোধ নিত। ভীমও নিয়েছেন। তিনি দ্যূতসভায় শপথ করেছিলেন যে, দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করে শাস্তি দেবেন। প্রচণ্ড ক্রোধে তিনি যখন শপথ করছেন, তখন তাঁর গদাযুদ্ধের নিয়ম মনে থাকার কথা নয়। “যে অঙ্গ প্রদর্শন করে তুমি আমার স্ত্রীকে অপমান করলে, আমি সেই অঙ্গ বিনষ্ট করব।” এটি অতি সাধারণ প্রতিক্রিয়া। বলরাম একে নিয়মবিরুদ্ধ মনে করেছেন, কারণ পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা তাঁর স্মরণে ছিল না। ভীমসেনের খাদ্যে বিষদান করে অচেতন অবস্থায় জলে ফেলে দেওয়া, ভীমসেনকে সর্পদংশন করিয়ে মারবার চেষ্টা, বারণাবতে জতুগৃহে মাতা সমেত পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারবার চেষ্টা, দ্যূতসভায় রজস্বলা দ্রৌপদীর চরম লাঞ্ছনা, কূট দ্যূতে বিজয়ী হয়ে পাণ্ডবদের বনে পাঠানো, বনবাস ও অজ্ঞাতবাস কাল শেষ হলেও শর্তানুযায়ী পাণ্ডবদের রাজত্ব ফিরিয়ে না দেওয়া—কোনও ঘটনায় দুর্যোধন যথার্থ উচ্চবংশের বংশধরের পরিচয় দেননি। অথচ দুর্যোধন ব্যাসদেবের পৌত্র। তাঁর দেহে ব্যাসের রক্ত। জন্মমুহূর্তে পিতামহী সেই যে চোখ বন্ধ করেছিলেন, তাতে কেবলমাত্র ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হননি। দুর্যোধনও চিরকালের মতো জ্ঞাতিবর্গ সম্পর্কে ঘৃণায় অন্ধ হয়ে রইলেন। পিতার অন্ধত্ব তাঁর বিচারে নিয়তির অন্যায় বিচার, পিতা রাজ্য পেলেন না। মাতৃগর্ভে তিনি এলেন আগে কিন্তু জন্ম হল আগে যুধিষ্ঠিরের—এও নিয়তির অবিচার। এই অবিচার মেনে নিতে পারেননি দুর্যোধন।

ঊরুভঙ্গ দুর্যোধনের অনিবার্য ছিল। তাঁর দেহগঠন করেছিলেন শিব ও পার্বতী। দেহের ঊর্ধ্বাংশ শিবনির্মিত এবং বজ্রের ন্যায় কঠোর। নিম্নাংশ পার্বতী নির্মিত স্ত্রীজনের পক্ষে অতিশয় কমনীয় ও বাঞ্ছনীয়। দেহের নিম্নাংশের সৌন্দর্য সম্পর্কে দুর্যোধন সচেতন ছিলেন। সেই কারণেই দ্রৌপদীর সম্ভোগেচ্ছা জন্মানোর জন্য বাম ঊরু দেখিয়েছিলেন। তাই ভীম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করবেন। মৈত্রেয় মুনি দুর্যোধনের অশিষ্ট ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে অভিসম্পাত করেছিলেন, “সেই যুদ্ধে বলবান ভীম গদার আঘাতে তোমার ঊরুভঙ্গ করবে।” ঊরু চাপড়ে দুর্যোধন মহর্ষি কণ্বের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন। তিনি অভিশাপ দেননি কিন্তু ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। অর্থাৎ দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ দৈবনির্দিষ্ট এবং অনিবার্য ছিল।

দুর্যোধন পূর্ণ পাপী। উদ্‌যোগ পর্বে কণ্বমুনি তাঁকে সদুপদেশ দিলে দুর্যোধন ঊরুতে চাপড় মেরে বললেন, “মহর্ষি, ঈশ্বর আমাকে যেমন করে সৃষ্টি করেছেন এবং ভবিষ্যতে আমার যা হবে আমি সেই ভেবেই চলেছি, কেন প্রলাপ বকছেন।” দুর্যোধনের হিসাবে খুব ভুল ছিল না। ইচ্ছামৃত্যু পিতামহ ভীষ্ম, অমর পুত্রের মৃত্যুসংবাদ না-শুনলে অস্ত্রত্যাগ করবেন না এমন গুরু দ্রোণাচার্য, অমর কৃপাচার্য, অমর অশ্বত্থামা এবং সহজাত কবচকুণ্ডলের অধিকারী কর্ণকে নিয়ে দুর্যোধন যুদ্ধে এগিয়েছিলেন—কিন্তু একটি জিনিস দুর্যোধনের পক্ষে ছিল না, সে বস্তুর নাম ধর্ম। ওইখানেই দুর্যোধন পদে পদে হারলেন।

দুর্যোধন দিব্যপুরুষ, তিনি মানুষ নন। প্রায়োপবেশনের পূর্বে দানবেরা তাঁকে জানিয়েছিলেন মহাদেবকে তপস্যা করে দানবেরা দুর্যোধনকে পেয়েছিল, তিনি (মহাদেব) তাঁর নাভির ঊর্ধ্ব দেহ বজ্রের ন্যায় দৃঢ় ও অস্ত্রের অভেদ্য করেছেন আর পার্বতী তাঁর অধঃকায় পুষ্পের ন্যায় কোমল ও নারীদের মনোহর করেছেন। মহেশ্বর-মহেশ্বরী নির্মিত দেহ দুর্যোধনের এবং মহেশ্বরের ইচ্ছায় ঊর্ধ্বদেহে তিনি অবধ্য। অতএব অধঃকায়েই তাঁকে মরতে হবে। তা ছাড়া দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ না হলে ক্ষত্রিয় হিসাবে ভীমের প্রতিজ্ঞা অপূর্ণ থেকে যেত। সেটিও কোনও পাঠক মনে নিতে পারতেন না। দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের জন্য কোনও পাঠক ভীমসেনকে অপছন্দ করেন না।

কৃষ্ণ এই মুহূর্তটির জন্য যুধিষ্ঠিরের উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। এমনকী তিনি অর্জুনের কাছে যুধিষ্ঠিরকে ‘নির্বোধ’ পর্যন্ত বলেছিলেন। অথচ এতখানি বিচলিত যুধিষ্ঠির হননি। তিনি যতই বলুন না, “তুমি আমাদের যে-কোনও জনের সঙ্গে যুদ্ধ করো, যদি জিততে পারো রাজ্য তোমার।” দুর্যোধন যে ভীম ভিন্ন অন্য কারওর সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইবেন না, একথা সবাই বোঝেন। যে ভীমকে আঘাত করার জন্য তিনি লৌহভীম নির্মিত করে তেরো বছর গদা প্রহারের অভ্যাস করেছেন, আজ সামনা-সামনি পেয়েও তাঁর সঙ্গে লড়বেন না! এটুকু মনস্তত্ত্বজ্ঞান যুধিষ্ঠিরের ছিল। কর্ণের যেমন সারাজীবন অভিলাষ ছিল অর্জুনের সঙ্গে ধনুর্বাণ নিয়ে যুদ্ধ করবার, এবং অর্জুনকে পরাজিত করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধারী আখ্যা পাওয়া, তেমনই দুর্যোধনের ইচ্ছা ছিল গদাযুদ্ধে ভীমকে পরাজিত করার।

এই মহাদুর্লভ মুহূর্তে অর্জুনকে আর একবার নিন্দিত কর্ম করতে দেখলাম। কৃষ্ণ যখন জানালেন ভীমসেন ন্যায়যুদ্ধে দুর্যোধনকে মারতে পারবেন না, অন্যায় পথেই দুর্যোধনকে মারতে হবে, অর্জুন বাম ঊরুতে চাপড় মেরে ভীমসেনের প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়ে দিলেন। যদিও অর্জুন জানতেন যে গদাযুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী নাভির নীচে আঘাত করা নিষেধ। ইতোপূর্বে ভূরিশ্ৰবা-সাত্যকির যুদ্ধের সময়েও আমরা দেখেছি ভূরিশ্রবা যখন যুদ্ধে সাত্যকিকে পরাজিত করে বধ করতে উদ্যত হচ্ছেন, তখন অর্জুন দূর থেকে ভয়ংকর বাণক্ষেপ করে তরবারি সুদ্ধ ভূরিশ্রবার হাত কেটে নিয়েছিলেন।

দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের পর আঠারো দিনের কুরুক্ষেত্র প্রান্তরের যুদ্ধ শেষ হল। কিন্তু বৈরিতার অবসান এখনও হল না। পিতার মৃত্যুশোকে উন্মত্ত অশ্বত্থামা অমর। সুতরাং তাঁর প্রতিজ্ঞা পূরণও বাকি আছে।

দুর্যোধনের পরিণতি আমরা অনুমান করতে পারি। মহারাজ কুরুর ক্রমাগত ভূমি কর্ষণে শেষ পর্যন্ত দেবরাজ ইন্দ্র বর দিয়েছিলেন, কুরুর নাম অনুযায়ী এই ক্ষেত্রের নাম হবে কুরুক্ষেত্র এবং এই ক্ষেত্রে কেউ উপবাসে মৃত্যু বরণ করলে অথবা যুদ্ধে নিহত হলে সরাসরি স্বর্গে যাবে। অতএব কলির অংশে জাত দুর্যোধন সরাসরি স্বর্গেই যাবেন। কুরুক্ষেত্রে মৃত অন্য সব বীরও স্বর্গলাভ করেছিলেন।

শুধু একজন বীর কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে মৃত্যুবরণ করেও স্বর্গে যেতে পারেননি। জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে নিন্দনীয় কার্য করে মহাবীর কর্ণ যথার্থ দুরাত্মা হয়েছিলেন। তাই দেবরাজ ইন্দ্রের আশীর্বাদ ও ধর্মের বিচারে ব্যর্থ কর্ণ নরকে পতিত হন। সেই নরক থেকে তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। যাঁকে দেব ধর্ম স্বয়ং ‘ধর্ম’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

৮৩
দুর্যোধনের ভর্ৎসনা

সিংহ যেমন বন্যহস্তীকে বধ করে, সেইরকম ভীমসেন যুদ্ধে দুর্যোধনকে বধ করেছেন দেখে, কৃষ্ণের সঙ্গে পাণ্ডবগণ, পাঞ্চালগণ ও সৃঞ্জয়গণ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে, উত্তরীয় বস্ত্র আন্দোলন ও সিংহনাদ করতে লাগলেন। সৈন্যদের মধ্যে বহু ব্যক্তি নাচতে লাগলেন। অনেকে উল্লাস করতে লাগলেন এবং অন্য বীরেরা বারবার ভীমসেনকে বললেন, “বীর! দুর্যোধন গদাযুদ্ধ শিক্ষায় অত্যন্ত পরিশ্রম করেছিলেন; তবুও আজ আপনি গদাযুদ্ধে তাঁকে বধ করে দুষ্কর কাজ করেছেন। ইন্দ্র যেমন মহাযুদ্ধে বৃত্রাসুরকে বধ করেছিলেন, আপনিও সেইরকম এই শত্রুকে বধ করেছেন, লোকেরা এইরকম ধারণা করেছেন। মহাবীর দুর্যোধন নানাবিধ পথে ও সর্বপ্রকার মণ্ডলভাবে বিচরণ করছিলেন; সেই অবস্থায় এক ভীমসেন ব্যতীত অন্য কোনও লোক একে বধ করতে পারে? ভীমসেন আপনি অন্যের পক্ষে অতি দুর্গম শত্রুতা সাগরের পরপারে গিয়েছেন। অন্য লোক এইরকম কার্য করতে পারতেন না। মহাবীর, আপনি ভাগ্যবশত মত্তহস্তীর ন্যায় চরণদ্বারা রণস্থলে দুর্যোধনের মস্তকটি মর্দন করেছিলেন। সিংহ যেমন অদ্ভুত যুদ্ধ করে মহিষের রক্ত পান করে, ভাগ্যবশত আপনি দুঃশাসনের রক্ত পান করেছেন। যাঁরা মহাত্মা যুধিষ্ঠিরকে প্রতারণা করেছিল, নিজের কার্যের প্রভাবে ভাগ্যবশতই আপনার মহাযশ পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়েছে। ভরতনন্দন! আপনি শত্রুকে নিহত করলে, আমরা যেমন আপনার অভিনন্দন করছি, বৃত্রাসুর নিহত হলে, তখনকার স্তুতিপাঠকেরা নিশ্চয়ই ইন্দ্রের এইরূপ অভিনন্দন করেছিল। দুর্যোধন নিহত হলে আমাদের যে সকল রোম উদ্‌গত হয়েছিল, তা এখনও সমান হয়নি, আপনি তা দেখুন।” সেইখানে সম্মিলিত বীরেরা এইসব কথা বললেন।

পাণ্ডব ও পাঞ্চালেরা আনন্দিত হয়ে এই ধরনের অসদৃশ বাক্য বলতে থাকলে কৃষ্ণ বললেন, “রাজগণ! এই মন্দ বুদ্ধি নিহত হয়েছে, ভীষণ বাক্য দ্বারা নিহত শত্রুকে পুনরায় আঘাত করা উচিত নয়। যখনই এই নির্লজ্জ, রাজ্যলুব্ধ ও পাপসহচর দুর্যোধন সুহৃদদের উপদেশ লঙ্ঘন করেছিল, তখনই এই পাপাত্মা নিহত হয়েছিল। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর ও সঞ্জয় বহুবার প্রার্থনা করলেও এই দুরাত্মা পাণ্ডবগণের পৈতৃক অংশ দান করেনি। এই নরাধম শক্রই হোক বা মিত্রই হোক, এখন আর কোনও প্রতিবিধান করতে সমর্থ নয়। কারণ, এখন এ একখানা কাঠের মতো পড়ে আছে। সুতরাং বাক্য দ্বারা একে অত্যন্ত ব্যথিত করে লাভ কী? হে রাজগণ, অমাত্য, জ্ঞাতি ও বন্ধুগণের সঙ্গে এই পাপাত্মা নিহত হয়েছে। সুতরাং আপনারা সত্বর রথে আরোহণ করুন, চলুন, আমরা যাই।”

রাজা দুর্যোধন কৃষ্ণের মুখ থেকে এই সকল নিন্দাবাক্য শুনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে গাত্রোত্থান করলেন। তিনি পশ্চাৎভাগ দ্বারা ভূতলে উপবিষ্ট হয়ে, হস্তযুগলদ্বারা ভূমি অবলম্বন করে কৃষ্ণের উপরে ভ্রূকুটিভীষণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। রাজা দুর্যোধন শরীরের অর্ধভাগ উত্থিত করলে তাঁর রূপটি ছিন্ন পুচ্ছ ও ক্রুদ্ধ তীক্ষ্ণবিষ সর্পের রূপের মতো দেখাতে লাগল। পরে দুর্যোধন ঊরুভঙ্গজনিত প্রাণান্তকারী দারুণ বেদনাকেও অগ্রাহ্য করে ভীষণ বাক্য দ্বারা কৃষ্ণকে পীড়ন করতে থাকলেন, “কংসদাসের পুত্র! ভীম গদাযুদ্ধে অন্যায়ভাবে আমাকে যে নিপাতিত করেছে, তাতে তোর লজ্জা হয়নি। দুরাত্মা! তুই ‘ঊরুভঙ্গ করো’ এইরূপ ভীমের মিথ্যাস্মৃতি জন্মিয়েছিস। কারণ, তুই অর্জুনকে যা বলেছিলি, তা কি আমি জানি না? পাপাত্মা! তুই বহুতর কূটনীতি প্রয়োগ করে, সরলভাবে যুদ্ধকারী সহস্র সহস্র রাজাকে বধ করিয়েছিস, তবু তোর লজ্জা জন্মাল না। কিংবা নিজের উপর ঘৃণা হল না। পিতামহ ভীষ্ম প্রত্যহ তোদের পক্ষের বীরগণের মহামারী ঘটাচ্ছিলেন। সেই অবস্থায় তুই শিখণ্ডীকে অর্জুনের সামনে রেখে, অর্জুন দ্বারা তাঁকে বধ করিয়েছিস। অতিদুর্মতি! তুই দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামার সমাননাম যুক্ত একটি হস্তীকে ভীমদ্বারা বধ করিয়ে, যুধিষ্ঠির দ্বারা ‘অশ্বত্থামা হতঃ’ এই কথা বলিয়ে দ্রোণাচার্যের অস্ত্র ত্যাগ করিয়েছিলি; তা কি আমার জানা নেই? তারপরে এই নৃশংস ধৃষ্টদ্যুম্ন বলবান সেই দ্রোণাচার্যকে বধ করছিল, তুই তা দেখছিলি। কিন্তু তুই একে বারণ করিসনি। দুরাত্মা! কর্ণ অর্জুনকে বধ করার জন্য প্রার্থনা করে ইন্দ্রের কাছ থেকে একটা শক্তি নিয়েছিলেন। তুই কর্ণের সেই শক্তিটিকে ঘটোৎকচের উপর ব্যয় করিয়েছিস; অতএব কোন ব্যক্তি তোর অপেক্ষা গুরুতর পাপী আছে? বলবান ভূরিশ্রবা সাত্যকিকে বধ করবার চেষ্টা করছিলেন, সেই অবস্থায় তুই অর্জুন দ্বারা ভূরিশ্রবার দক্ষিণবাহু ছেদ করিয়েছিলি। তখন ভূরিশ্রবা প্রায়োপবেশন করলে, মহাত্মা কিনা, তাই সাত্যকি এসে, তখনই তাঁকে বধ করেছিল।

“মহাবীর কর্ণ অর্জুনকে জয় করার জন্য ন্যায়যুদ্ধই করছিলেন এবং তক্ষকনাগের পুত্র অশ্বসেনকে প্রত্যাখ্যান করে ভালই করেছিলেন। তারপরে রথের চাকা ভূমিতে প্রবিষ্ট হলে, কর্ণ বিপন্ন ও পরাজিতের মতো হয়ে পড়েছিলেন পরে নরশ্রেষ্ঠ সেই কর্ণ চক্র উত্তোলন করতে প্রবৃত্ত হলে সেই অবকাশে তুই অর্জুন দ্বারা তাঁকে বধ করিয়েছিস। কৃষ্ণ! তোরা যদি রণস্থলে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ ও আমার সঙ্গে প্রতিযুদ্ধ করতিস তা হলে নিশ্চয়ই তোদের জয় হত না। তুই দুর্জন; সুতরাং তুই স্বধর্মানুসারী হয়ে রাজগণকে এবং আমাদের কূটনীতি প্রয়োগে বিনাশ করেছিস।”

কৃষ্ণ বললেন, “গান্ধারীপুত্র! তুই পাপপথগামী কিনা, তাই তুই ভ্রাতৃগণ পুত্রগণ, অমাত্যগণ ও বন্ধুগণের সঙ্গে নিহত হয়েছিস। তোরই পাপে ভীষ্ম, দ্রোণ এবং তোর স্বভাব অনুসারী কর্ণ যুদ্ধে নিপাতিত হয়েছেন। মূঢ়! আমি প্রার্থনা করলেও তুই লোভবশত এবং শকুনির যুদ্ধজয় করার ক্ষমতার বিষয়ে অসন্দিগ্ধ হয়ে পাণ্ডবগণকে তাঁদের পৈতৃক অংশ নিজ রাজ্য দান করতে ইচ্ছা করিসনি। অতিদুর্মতি! তুই ভীমসেনকে বিষ দান করেছিলি এবং মাতা কুন্তী দেবীর সঙ্গে পাণ্ডবগণকে জতুগৃহে দগ্ধ করবার ইচ্ছা করেছিলি। দুর্মতি! নির্লজ্জ তুই দ্যূতসভায় যখন রজস্বলা দ্রৌপদীকে কষ্ট দিচ্ছিলি, তখনই তুই বধ্য হয়েছিস। দুরাত্মা! যুধিষ্ঠির অক্ষক্রীড়ায় নিপুণ নন, তথাপি তুই অক্ষক্রীড়ানিপুণ শকুনিদ্বারা শঠতাপূর্বক তাঁকে যে পরাজিত করেছিলি, সেই জন্যই তুই নিহত হয়েছিস। পাণ্ডবেরা মৃগয়া করতে করতে মহর্ষি তৃণবিন্দুর আশ্রমে চলে গেলে, পাপাত্মা জয়দ্রথ বনমধ্যে হরণ করবার ইচ্ছায় দ্রৌপদীকে যে কষ্ট দিয়েছিল, সেই কারণেই সে নিহত হয়েছে। পাপাত্মা! তোর দোষেই যুদ্ধে একাকী ও বালক অভিমন্যু যে বহুকর্তৃক নিহত হয়েছে সেই জন্যেও তুই নিহত হয়েছিস। সম্পর্কে সমান হলেও ভীষ্ম যে পাণ্ডবদের অনর্থ কামনা করে যুদ্ধ করছিলেন, সেই জন্যেই শিখণ্ডী তাঁকে বধ করেছেন। এতে ধর্ম বিন্দুমাত্র লঙ্ঘিত হয়নি। দ্রোণাচার্য তোরই সন্তোষ জন্মাবার ইচ্ছায় আপন ধর্ম পরিত্যাগ করে অসজ্জনের পথে চলেছিলেন; তাই ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে বধ করেছেন। বুদ্ধিমান সাত্যকি নিজের প্রতিজ্ঞা সত্য করবার ইচ্ছা করেই যুদ্ধে মহারথ ভূরিশ্রবাকে বধ করেছেন। রাজা! পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুন যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়ে কোনও সময়েই কোনও প্রকারে নিন্দিত কাজ করেননি। সেই জন্যই তিনি যুদ্ধের সময়ে বহুপ্রকার ছিদ্র পেয়েও তখন প্রহার না করে বীরের ধর্ম স্মরণ করেই কর্ণকে বধ করেছেন। অতএব অতিদুর্মতি! তুই এরূপ কথা বলিস না। তুই ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ ও অশ্বত্থামা তোরা সকলেই বিরাটনগরে অর্জুনের দয়াতেই জীবিত ছিলি। আমরা যে সকল অকার্য করেছি বলে তুই বলছিস, সে সমস্তই তোর অপরাধেই আমরা করেছি। তুই বৃহস্পতি ও শুক্রের উপদেশ শুনিসনি, বৃদ্ধদের সেবা করিসনি, কিংবা তাদের উপদেশও শুনিসনি৷ রাজ্যলোভে এবং অধিক শক্তি ও প্রভুত্ব লাভের আশায় বশীভূত হয়ে তুই বহুতর অকার্য করেছিস; এখন তার পরিণামফল ভোগ কর।”

দুর্যোধন বললেন, “আমি যথাবিধানে অধ্যয়ন, দান ও সসাগরা পৃথিবী শাসন করেছি এবং শত্রুগণের মস্তকের উপরে আরোহণ করে রয়েছি। অতএব আমার তুল্য আর কে আছে? স্বধর্মদর্শী ক্ষত্রিয়গণ ও বন্ধুগণের যা অভীষ্ট আমি সেইরূপ নিধনই প্রাপ্ত হলাম এবং অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছি, দেবগণের যোগ্য ও অন্যান্য রাজগণের দুর্লভ ভোগ আমি এই মনুষ্যলোকেই পেয়েছি, সুতরাং আমার তুল্য আর কে আছে? কৃষ্ণ, আমি সুহৃদগণের ও অনুজদের সঙ্গে স্বর্গে যাব; আর তোমরা নষ্টসংকল্প হয়ে শোক করতে থেকে জীবন ধারণ করবে।”

বুদ্ধিমান দুর্যোধন এই কথা বলে থামলে, তাঁর উপর আকাশ হতে পবিত্র সৌরভসম্পন্ন পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল। গন্ধর্বেরা অতিমনোহর বাদ্য বাজাতে লাগল ও অপ্সরারা দুর্যোধনের যশোযুক্ত গান গাইতে লাগলেন। আকাশস্থিত সিদ্ধ পুরুষেরা ‘সাধু সাধু’ বলতে থাকলেন, পবিত্র গন্ধসম্পন্ন, ঘ্রাণের তৃপ্তিকারী, সুখজনক ও কোমল বায়ু বইতে লাগল। সমস্ত দিক শোভা পেতে লাগল এবং গগনমণ্ডল বৈদূর্যমণির মতো নির্মল হল। কৃষ্ণ প্রভৃতি পাণ্ডবপক্ষীয় বীরেরা পুষ্পবৃষ্টি প্রভৃতি অত্যদ্ভুত ব্যাপার ও দুর্যোধনের সম্মান দেখে লজ্জিত হলেন।

হতাংশ্চাধর্মতঃ শ্রুত্বা শোকার্ত্তাঃ শুশুচুর্হি তে।

ভীষ্মং দ্রোণং তথা কর্ণং ভূরিশ্রবসমেব চ॥ শল্য: ৫৭: ৬৪॥

তাঁরা নিজেদের বন্ধুবান্ধব বিনষ্ট হওয়ায় পূর্ব হতেই শোকার্ত ছিলেন; “আবার তৎকালে ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ ও ভূরিশ্রবাকে অন্যায়যুদ্ধে নিহত করা হয়েছে এই কথা স্মরণ করে তাঁদের জন্য শোক করতে লাগলেন।”

পাণ্ডবেরা চিন্তাযুক্ত ও বিষণ্ণচিত্ত হয়েছেন দেখে কৃষ্ণ মেঘ ও দুন্দুভির শব্দের ন্যায় গম্ভীর স্বরে বললেন, “অতি দ্রুতাস্ত্ৰক্ষেপী এই দুর্যোধনকে এবং মহারথ ও বিক্রমশালী সেই ভীষ্ম প্রভৃতি বীরগণকে আপনারা কখনও ন্যায়যুদ্ধে বধ করতে পারতেন না। আমি আপনাদের হিতকামনা করে বারবার কূটনীতি প্রয়োগ এবং অনেক উপায় অবলম্বন করে সেই বীরগণকে নিহত করিয়েছি। আমি যদি কখনও এই কূটনীতি প্রয়োগ না করতাম, তবে কী করে আপনাদের জয়, রাজ্য ও ধনসম্পদ হত? সেই চারজনই মহাত্মা ও অতিরথ বলে পৃথিবীতে বিখ্যাত ছিলেন। অতএব স্বয়ং দিকপালেরাও ন্যায়যুদ্ধে তাঁদের বধ করতে সমর্থ হতেন না। দণ্ডধারী স্বয়ং যমও গদাযুদ্ধে এই দুর্যোধনকে বধ করতে সমর্থ হতেন না। এই শত্রুকে যে কূটনীতি প্রয়োগে বধ করানো হয়েছে, একথা আপনারা মনে করবেন না। শত্রুপক্ষ বহুতর অথবা প্রবলতর হলে তাদের নানাবিধ উপায়ে বধ করতে হয়। অসুরহন্তা দেবতারাও এই পথ গ্রহণ করেছেন। পরবর্তী সজ্জনেরাও করেছেন, এখনও বহুলোক এই পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। আমরা কৃতকার্য হয়েছি। সায়াহ্নকাল উপস্থিত। অতএব এখন সকলেই বিশ্রাম গ্রহণ করুন।

*

দুর্যোধন ভাঙবেন, কিন্তু মচকাবেন না। তিনি কোনওদিনই ভীরু, কাপুরুষ ছিলেন না। ক্ষত্রিয়ের শেষ যে বীরশয্যায়, তা তিনি জানতেন। ক্ষত্রিয়ের মতোই তিনি অপার কষ্টসহিষ্ণু ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধারম্ভের দিন তিনি কল্পনাও করতে পারেননি এই যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটতে পারে। একে সৈন্যসংখ্যা পাণ্ডবদের থেকে অনেক বেশি, তাও তাঁর যোদ্ধারাও বিভিন্ন বরে বলীয়ান। পিতামহ ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যু, গুরু দ্রোণাচার্য সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত ব্যক্তির মুখে তাঁর অমর পুত্র অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ না শুনলে অস্ত্রত্যাগ করবেন না। গুরু কৃপাচার্য অমর, গুরুপুত্র অশ্বত্থামা অমর, সখা ও সুহৃদ কর্ণ পরশুরামের শিষ্য, সহজাত কবচ ও কুণ্ডলের অধিকারী হয়ে জন্মেছিলেন, যদিও তা ইন্দ্রের ছলনায় বর্তমানে আর নেই, কিন্তু কর্ণ এখনও দিব্যাস্ত্র ও ব্রহ্মাস্ত্রের অধিকারী, আর তিনি নিজে সমস্ত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গদাযোদ্ধা। কিন্তু এতগুলি সম্মিলিত শক্তিও কাজে লাগল না, সৈন্যদল ধ্বংস হল, সেনাপতিরা নিহত হলেন, তাঁর নিজের ঊরুভঙ্গ হল।

এ সমস্ত কিছুর কারণ অর্জুনের বীরত্ব নয়—ভীমের ভয়ংকর বল নয়—কৃষ্ণের অদ্ভুত কৌশল। বস্তুত কৃষ্ণকে অভিযুক্ত করতে গিয়ে ঊরুভঙ্গের যন্ত্রণা ছাপিয়ে কৃষ্ণের প্রতি যে তীক্ষ্ণবাণতুল্য বাক্যসমূহ ব্যবহার করেছেন তাতে দুর্যোধন প্রকারান্তরে কৃষ্ণকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বলেই যেন স্বীকার করে নিয়েছেন। ভীষ্মবধের জন্য শিখণ্ডীর আড়াল নিতে হবে অর্থাৎ ভীষ্মের মৃত্যুর ইচ্ছা সৃষ্টি করতে হবে। দ্রোণাচার্যকে অস্ত্রত্যাগ করাবার জন্য যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে অর্ধ-সত্য বলাতে হবে, ইন্দ্রের প্রদত্ত একাঘ্নী ব্যয় করাতে কর্ণের সম্মুখে ঘটোৎকচকে পাঠাতে হবে। একাঘ্নী ব্যবহার না করে কর্ণ ঘটোৎকচের সঙ্গে পারবেন না এবং ভীমসেন কেবলমাত্র ঊরুভঙ্গ করেই দুর্যোধনকে পরাজিত করতে পারবেন, সেই কারণে যথাসময়ে তাঁর ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়ে দেওয়া— এ সবের মূলেই কৃষ্ণ। তা হলে যুদ্ধের পূর্বে দুর্যোধন ভুল পক্ষকে বরণ করেছিলেন। অস্ত্রহীন কৃষ্ণকে বরণ করে অর্জুন যে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন, দুর্যোধন সে পরিচয় দিতে পারেননি। অস্ত্রধারী সংশপ্তকদের পেয়েই তিনি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।

মহাভারতের দৈবী বিচার দেখে মাঝে মাঝে পাঠক বিস্মিত হন। ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যুধিষ্ঠির তাঁর নিকটজনকে নরকে দেখে, দৈবী বিচারের নিন্দা করেছিলেন। পূর্ণ পাপী দুর্যোধনের মস্তকে পুষ্পবৃষ্টি পাণ্ডবদের বিস্মিত, লজ্জিত করেছিল, পাঠকদেরও। কৃতকর্মের বিষয়ে কোনও অনুতাপ দুর্যোধন করেননি। দ্রৌপদীর প্রতি অন্যায় তাঁর কাছে কোনও দূষণীয় ঘটনাই নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা দেখেছিলাম কৃষ্ণের ঐশ্বরিক উচ্চারণ। সে উচ্চারণ কেবলমাত্র দুর্যোধনের অথবা সম্মুখস্থ পাণ্ডব-পাঞ্চালদের জন্য নয়—পুষ্পবৃষ্টিকারী দৈব-শক্তির উদ্দেশ্যেও। দুন্দুভিধ্বনির গম্ভীর কণ্ঠে তিনি অদৃশ্য সেই সমস্ত শক্তিকে জানিয়েছিলেন—তিনি যা উপযুক্ত মনে করেছেন, তা করেছেন। কেউ তা ঠেকাতে পারেননি আর কখনও পারবেন না। কৃতকর্ম অনুযায়ী তিনি দণ্ডদান করেছেন। ভীষ্ম-দ্রোণের সঙ্গে পাণ্ডব-কৌরবের সমান সম্পর্ক। অথচ অজ্ঞাতবাসের পরেই ভীষ্ম দ্রোণ পাণ্ডবদের পিতৃ-রাজ্যের অংশ, নিজেদের রাজ্য ইন্দ্রপ্রস্থ ফিরিয়ে দিলেন না। পাণ্ডব বধ করতে এলেন। তাঁরা দুর্যোধনকে অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু বাধ্য করতে পারেননি। যোগদান করেননি লাঞ্ছিত অপমানিত অত্যাচারিত পাণ্ডবদের পক্ষে। অতএব মৃত্যু তাঁদের প্রাপ্য। কর্ণ অকারণ সমস্ত জীবন পাণ্ডবদের দ্বেষ করেছেন, কৃষ্ণ নিজে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, ভ্রাতৃবিদ্বেষ শেষ করে নিজের জায়গায় ফিরে আসতে, কর্ণ কৃষ্ণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন, সুতরাং তাঁর শ্রেষ্ঠ অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছে রাক্ষসবীর ঠেকাতে।

মহাভারতের সমস্ত ঘটনা দৈব-নির্দেশেই ঘটেছে। দুর্যোধন শ্বশুর-গুরুজন সকলের সম্মুখে দ্রৌপদীকে অনাবৃত ঊরু দেখিয়েছিলেন সম্ভোগ করার জন্য। দৈব-নির্দেশ তখনই ভীমের গলায় উচ্চারিত হয়েছিল। রাজাধিরাজ দুর্যোধনের পরিণতি অবশ্যই মহাভারতের এক অতি দুর্লভ মুহূর্ত।

৮৪
ভস্মীভূত দেবদত্ত

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাঞ্চালেরা দুর্যোধনকে নিহত দেখে, আনন্দিত হয়ে, শঙ্খধ্বনি করতে থাকল এবং কৃষ্ণও পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজাতে লাগলেন। পরিঘ-অস্ত্রের ন্যায় দৃঢ়বাহু রাজারা সকলে আনন্দিত হয়ে, শঙ্খধ্বনি করতে থেকে, বিশ্রাম করার জন্য সেখানে থেকে চলে গেলেন। পাণ্ডবেরা শিবিরের দিকে অগ্রসর হলে, মহাধনুর্ধর সাত্যকি ও যুযুৎসু তাঁদের পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন। ধুষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও দ্রৌপদীর পুত্রেরা সকলে এবং অন্যান্য মহাধনুর্ধরেরা সকলেও শিবিরের দিকে যেতে লাগলেন।

তারপর পাণ্ডবেরা গিয়ে দুর্যোধনের শিবিরে প্রবেশ করলেন। তখন সে শিবিরটির আর শোভা ছিল না, প্রভু নিহত হয়েছিলেন এবং বৃদ্ধ অমাত্যেরা তাতে অবস্থান করছিলেন; সুতরাং সে শিবিরটি সেই সময় দর্শকেরা চলে গেলে রঙ্গালয় যেমন শূন্য হয়ে যায়, সেরকম উৎসববিহীন নগরের তুল্য অথবা সর্পরহিত হ্রদের মতো মনে হচ্ছিল, তাতে স্ত্রীলোক ও নপুংসক ব্যক্তিরাই অধিক সংখ্যায় ছিল। দুর্যোধনের শিবিরের মলিন কাষায়বস্ত্রধারী শিবির-রক্ষাকারী লোকেরা কৃতাঞ্জলি হয়ে এসে, পাণ্ডবদের সামনে উপস্থিত হল। ক্রমে রথীশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবেরা দুর্যোধনের শিবিরে গিয়ে, রথ থেকে অবতরণ করলেন।

তখন সর্বদাই পাণ্ডবদের হিত ও প্রিয়কার্য সাধনে রত কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, “ভরতশ্রেষ্ঠ! তুমি এই রথ থেকে তোমার গাণ্ডিবধনু ও অক্ষয়তূণ এই দুটি নীচে নামিয়ে আনো; তারপরে আমি অবতরণ করব। নিস্পাপ অর্জুন, তুমি নিজেও রথ থেকে নীচে নেমে এসো; আমি যা বলছি তদনুসারে কাজ করো। তোমার মঙ্গল হবে।” তখন অর্জুন তাই করলেন। তারপর বুদ্ধিমান কৃষ্ণ অশ্বগুলির মুখরজ্জু পরিত্যাগ করে সেই রথ থেকে অবতরণ করলেন। জগদীশ্বর ও অতিমহাত্মা কৃষ্ণ রথ থেকে অবতরণ করলে, অর্জুনের ধ্বজস্থিত সেই বানর অন্তর্হিত হল। দ্রোণ ও কর্ণ ক্রমাগত দিব্য অস্ত্রের অপ্রজ্বলিত অগ্নিদ্বারা সেই বিশাল রথখানাকে পূর্বেই অগ্নিবদ্ধ করে রেখেছিলেন; কৃষ্ণ অবতরণ করা মাত্র তৎক্ষণাৎ রথখানা জ্বলে উঠল। দেখতে দেখতে অর্জুনের সেই রথখানা তূণ, রজ্জু, অশ্ব, যুগকাষ্ঠ ও বন্ধুরকাষ্ঠের সঙ্গে ভস্মীভূত হয়ে ভূতলে পতিত হল।

পাণ্ডবেরা সেই রথখানাকে ভস্মীভূত দেখে, বিস্ময়াপন্ন হলেন এবং অর্জুন অবনত ও কৃতাঞ্জলি হয়ে, কৃষ্ণকে অভিবাদন করে, বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “ভগবন্! গোবিন্দ! এই রথখানা কেন অগ্নিতে দগ্ধ হল। মহাবাহু যদুনন্দন! এই গুরুতর আশ্চর্য ঘটনা ঘটল কেন? আমার শোনা উচিত বলে যদি মনে কর, তা হলে আমাকে বলো।” কৃষ্ণ বললেন, “শত্ৰুসন্তাপক অর্জুন, পূর্বেই এই রথখানা বহুবিধ অস্ত্রের তেজে দাহোপযোগী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আমি রথের উপরে ছিলাম বলে, তা ভস্ম হয়ে যায়নি। কুন্তীনন্দন, তুমি এখন কৃতকার্য হয়েছ, আমিও পরিত্যাগ করেছি। সেই কারণেই রথখানি পূর্ব নিক্ষিপ্ত ব্রহ্মাস্ত্রের তেজে ভস্ম হয়ে গেল।”

তারপর শক্ৰহন্তা ভগবান কৃষ্ণ ঈষৎ হেসে রাজা যুধিষ্ঠিরকে আলিঙ্গন করে বললেন, “কুন্তীনন্দন! ভাগ্যবশত আপনি বিজয়ী হয়েছেন। শত্রুগণকে জয় করেছেন এবং ভাগ্যবশত আপনি, ভীমসেন, অর্জুন, নকুল ও সহদেব কুশলে আছেন।

মুক্তা বীরক্ষয়াদস্মাৎ সংগ্ৰামন্নিহতদ্বিষঃ।

ক্ষিপ্রমুত্তরকালানি কুরু কার্যানি ভারত!॥ শল্য: ৫৮: ২২॥

—বীরগণের ক্ষয় হয়েছে, আপনার শত্রুরা নিহত হয়েছে। অতএব আপনি পরকর্তব্যগুলি সম্পাদন করুন।”

“আমি অর্জুনের সঙ্গে উপপ্লব্যনগরে উপস্থিত হলে, আপনি মধুপর্ক এনে আমাকে বলেছিলেন, ‘কৃষ্ণ, এই অর্জুন তোমার ভ্রাতা ও সখা; অতএব মহাবাহু! প্রভু! তুমি একে সমস্ত আপদে রক্ষা করবে।’ আপনি এই কথা বললে আমি বলেছিলাম, ‘তাই হবে।’ রাজা আপনার সেই অর্জুনকে আমি রক্ষা করেছি এবং ইনি বিজয়ীও হয়েছেন। বীর ও যথার্থ বিক্রমশালী অর্জুন ভ্রাতৃগণের সঙ্গে অক্ষতদেহে বীরনাশক ও লোমহর্ষক যুদ্ধ থেকে মুক্তিলাভ করেছেন।”

কৃষ্ণ এই কথা বললে রোমাঞ্চিত দেহ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বললেন, “হে শত্রুমর্দন! দ্রোণ ও কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত ব্রহ্মাস্ত্র তুমি ভিন্ন অন্য কোনও ব্যক্তি সহ্য করতে পারেন না, এমনকী বজ্রধারী ইন্দ্রও পারেন না। তোমারই অনুগ্রহে অর্জুন সংশপ্তকগণকে জয় করেছেন এবং মহাযুদ্ধে গিয়েও যে অর্জুন পরাঙ্মুখ হননি, তাও তোমার অনুগ্রহেই সম্ভব হয়েছে। মহাবাহু! আমি দেখেছি যে, তোমার অনুগ্রহে আমাদের পক্ষ ক্রমশই বিজয় লাভ করেছে এবং উত্তমভাবে শক্তি প্রয়োগ করতে পেরেছে। উপপ্লব্যনগরে মহর্ষি বেদব্যাস আমাকে বলেছিলেন, যেখানে ধর্ম থাকে, সেইখানে কৃষ্ণ থাকেন এবং যেখানে কৃষ্ণ থাকেন, সেইখানে জয় থাকে।”

যুধিষ্ঠির এই কথা বললে, তাঁরা সকলেই দুর্যোধনের শিবিরে প্রবেশ করে, সেখানকার ধন, রত্ন, বস্ত্র প্রভৃতি সম্পদ হস্তগত করলেন। শত্ৰুবিজয়ী সেই মহাত্মা পাণ্ডবেরা ধৃতরাষ্ট্রদের সোনা, রুপা, মণি, মুক্তা, উত্তম অলংকার, কম্বল, চর্ম, অসংখ্য দাস ও দাসী, ছত্র, চামর প্রভৃতি রাজত্বের উপকরণ ও অক্ষয় ধনসমূহ হস্তগত করে আনন্দ কোলাহল করতে লাগলেন। সেই বীর পাণ্ডবেরা ও সাত্যকি হস্তী ও অশ্ব প্রভৃতি বাহনগুলিকে ছেড়ে দিয়ে, নিজেরাও কিছুক্ষণ সেই শিবিরেই বিশ্রাম করলেন।

তারপর মহাযশা কৃষ্ণ বললেন, “মঙ্গল লাভের জন্য শিবিরের বাইরে গিয়ে কোথাও আজ আমাদের বাস করতে হবে।” “তাই হোক” বলে, পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই এবং সাত্যকি ও কৃষ্ণ মঙ্গললাভের জন্য শিবিরের বাইরে গমন করলেন। শত্ৰুবিজয়ী সেই পাণ্ডবেরা কুরুক্ষেত্রস্থিত পূর্বোক্ত ওঘবতী নদীর তীরে গিয়ে, সেই রাত্রি পটমণ্ডপের ভিতরে অতিবাহিত করলেন। তারপর পাণ্ডবেরা কৃষ্ণকে হস্তিনানগরে পাঠালেন। প্রতাপশালী কৃষ্ণও সারথি দারুককে রথে তুলে নিয়ে, যেখানে রাজা ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন, সেই স্থানে বেগে গমন করবার উপক্রম করলেন। কৃষ্ণ শৈব্য ও সুগ্রীব নামক ঘোটকযুক্ত রথে আরোহণ করে প্রস্থান করবেন, এমন সময়ে পাণ্ডবেরা তাঁকে বললেন, “কৃষ্ণ তুমি গিয়ে হতপুত্রা ও শোচনীয়া গান্ধারী দেবীকে আশ্বস্ত করো।” পাণ্ডবেরা একথা বললে, সাত্বতশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ হস্তিনানগরে গিয়ে, হতপুত্রা গান্ধারীর কাছে উপস্থিত হলেন।

ভীমসেন গদাযুদ্ধের নিয়ম অতিক্রম করে, অন্যায়ভাবে যুদ্ধে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র মহাবল দুর্যোধনকে নিহত করেছেন দেখে এবং মহাভাগা ভয়ংকর তপস্যাসম্পন্না গান্ধারী দেবী; শাপের প্রভাবে ত্রিভুবনও দগ্ধ করতে পারেন, এই ভেবে যুধিষ্ঠির অত্যন্ত ভীত হলেন। এই চিন্তা করতে করতেই যুধিষ্ঠিরের এই বুদ্ধি জন্মাল যে, সবথেকে আগে প্রজ্বলিতা গান্ধারীর ক্রোধের শান্তি করা উচিত। কারণ আমরা এইরূপ অন্যায়ভাবে পুত্রকে নিহত করেছি শুনে, গান্ধারী দেবী ক্রোধে জ্বলে উঠে, আমাদের ভস্ম করে ফেলবেন। পুত্র দুর্যোধন ন্যায়ভাবে যুদ্ধ করছিলেন, কিন্তু আমরা তাকে ছলপূর্বক বধ করেছি এই শুনে, গান্ধারী কী প্রকারে তীব্র দুঃখ সহ্য করতে পারবেন। যুধিষ্ঠির এইরকম নানা প্রকার চিন্তা করে ভয়ে ও শোকে আকুল হয়ে কৃষ্ণকে বললেন, “গোবিন্দ! অচ্যুত! মনেরও অগোচর এই নিষ্কণ্টক রাজ্য, তোমার অনুগ্রহেই আমরা পেয়েছি। মহাবাহু যাদবনন্দন, তুমি আমাদের সামনেই লোমহর্ষক যুদ্ধে গুরুতর সংঘর্ষ ভোগ করেছ। মহাবাহু বৃষ্ণিনন্দন, তুমি পূর্বকালে অসুরগণের বধের জন্য দেবাসুর যুদ্ধে যেমন দেবগণকে সাহায্য ও অসুরগণকে বধ করেছিলে, সেইরকম এই যুদ্ধেও আমাদের সাহায্য করেছ। তুমি অর্জুনের সারথ্য অবলম্বন করে যুদ্ধের সময় পাণ্ডবপক্ষকে যেন আবৃত করে রেখেছিলে। কৃষ্ণ তুমি যদি মহাযুদ্ধে অর্জুনের রক্ষক না হতে; তা হলে, অর্জুন কী করে, এই সৈন্যসাগর জয় করতে সমর্থ হতেন। কৃষ্ণ তুমি আমাদের জন্য অনেক গদাঘাত এবং পরিঘ, শক্তি, ভিন্দিপাল, তোমর, পরশু ও বজ্ৰস্পর্শ তুল্য অন্যান্য অস্ত্রপ্রহার সহ্য করেছ এবং অনেক নিষ্ঠুর বাক্য শুনেছ। কৃষ্ণ অচ্যুত! আজ দুর্যোধন নিহত হওয়ায় তোমার সে সমস্ত সহ্য করাই সফল হয়েছে। আবার গান্ধারীর কোপে যাতে সে সকল নষ্ট না হয়, তাই করো। মহাবাহু কৃষ্ণ মাধব! জয় হয়ে গেলেও আমাদের মন সন্দেহ-দোলায় দুলছে; কারণ, গান্ধারীর কোপের বিষয়টা একবার ভেবে দেখো। মহাভাগা গান্ধারী দেবী ভয়ংকর তপস্যা করতে থেকে, শরীরটিকে কৃশ করেছেন। তিনি পুত্র ও পৌত্র প্রভৃতির বধ বৃত্তান্ত শুনে নিশ্চয় আমাদের শাপানলে দগ্ধ করে ফেলবেন। অতএব বীর, বর্তমান সময়ে তাঁকে প্রসন্ন করা উচিত, এই আমার মত। পুরুষোত্তম, তুমি ছাড়া কোন ব্যক্তি পুত্ৰমৃত্যুশ্রবণদুঃখিতা ও ক্রোধে আরক্তনয়না সেই গান্ধারী দেবীকে দর্শন করতে সমর্থ হবে? শত্রুদমনকারী কৃষ্ণ, ক্রোধে প্রজ্বলিত সেই গান্ধারী দেবীকে শান্ত করার জন্যই তোমার সেখানে যাওয়া প্রয়োজন। মহাপ্রাজ্ঞ! তুমি লোকের প্রকৃত অবস্থা ও বিকৃত অবস্থা দুই করতে পার এবং তুমি জগতের সৃষ্টিকর্তা এবং সংহারকর্তা। সুতরাং তুমি যুক্তিযুক্ত ও তৎকালোচিত বাক্যদ্বারা গান্ধারী দেবীকে প্রসন্ন করতে পারবে। বিশেষত তখন সেখানে আমাদের পিতামহ ভগবান বেদব্যাস উপস্থিত থাকবেন। মহাবাহু সাত্বতশ্রেষ্ঠ। তুমি পাণ্ডবদের হিতৈষী বলে সর্বপ্রকারে গান্ধারী দেবীর ক্রোধে নিবৃত্তি তোমার করা উচিত।”

যদুকুল ধুরন্ধর কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে, নিজ সারথি দারুককে ডেকে বললেন, “আমার রথ সজ্জিত করো।” দারুক কৃষ্ণের আদেশ শুনে, দ্রুত বেরিয়ে গেল এবং ক্ষণকাল পরে কৃষ্ণকে এসে জানাল যে, রথ সজ্জিত হয়েছে। পরে সর্বশক্তিমান, যদুবংশ শ্রেষ্ঠ ও সন্তাপকারী কৃষ্ণ, এই রথে আরোহণ করে, সত্বর হস্তিনানগরের দিকে প্রস্থান করলেন। বীর কৃষ্ণ রথের শব্দে সমস্ত দিক নিনাদিত করতে থেকে, হস্তিনানগরে প্রবেশ করে, উত্তম রথ থেকে অবতীর্ণ হয়ে, অকাতর চিত্তে ধৃতরাষ্ট্রের গৃহে প্রবেশ করলেন এবং সেস্থানে পূর্বেই সমাগত ব্যাসদেবকে দেখতে পেলেন; ওদিকেও ধৃতরাষ্ট্রও রথের শব্দে কৃষ্ণ এসেছেন বলে জানতে পারলেন। ক্রমে কৃষ্ণ অনাকুলভাবে বেদব্যাস, ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর চরণ স্পর্শ করে তাঁদের অভিবাদন করলেন।

তারপর যদুবংশপ্রধান কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের হস্ত ধারণ করে মুক্তকণ্ঠে রোদন করতে থাকলেন। শত্রুদমনকারী কৃষ্ণ শোকসঞ্জাত অশ্রুজল সংবরণ করে, জল দিয়ে চোখ ধুয়ে ও আচমন করে, বিস্তৃতভাবে ধৃতরাষ্ট্রকে এই কথা বললেন, “ভরতনন্দন! অতীত ও বর্তমান কালের কোনও ঘটনাই আপনার না জানা নেই এবং যে সকল ঘটনা ঘটে গিয়েছে, সে সমস্তই আপনি বিশেষভাবে জানেন। যাতে বংশের ও ক্ষত্রিয়গণের ক্ষয় না হয়, সে জন্য আপনার চিত্তানুবর্তী পাণ্ডবেরা সকলেই যত্ন করেছিলেন। ধর্মবৎসল যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে, সময়ের প্রতীক্ষা করে, সমস্ত কষ্টই সহ্য করেছেন এবং নির্দোষ পাণ্ডবেরা দ্যূতক্রীড়ায় শকুনির শঠতায় পরাজিত হয়ে, বনবাস স্বীকার করেছেন। তাঁরা নানাবিধ বেশ ধারণ করে, বিরাটনগরে অজ্ঞাতবাস করেছেন এবং সর্বদা অসমর্থের ন্যায় থেকে, অন্য বহুবিধ ক্লেশও সহ্য করেছেন। তারপর যুদ্ধের কাল উপস্থিত হলে, আমি নিজে এসে, সমস্ত লোকের সামনে পাণ্ডবের জন্য পাঁচখানি গ্রাম চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি কালপ্রেরিত ও লোভাকৃষ্ট হয়ে, তখন তা দেননি। অতএব রাজা, আপনারই অপরাধে সমস্ত ক্ষত্রিয় ক্ষয় পেয়েছে। বুদ্ধিমান ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, বিদুর, সোমদত্ত ও বাহ্লিক সর্বদাই আপনার কাছে সন্ধি প্রস্তাব করেছেন, কিন্তু আপনি তাঁদের কথায় কর্ণপাত করেননি। ভরতনন্দন, সমস্ত মানুষই কালের প্রভাবে মুগ্ধ হয়ে থাকে; যেমন আপনি এই বিষয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কাল ছাড়া এই ক্ষয়ের অন্য কী কারণ হতে পারে? অতএব এই ক্ষয়ের প্রতি সেই কাল ও দৈবই প্রধান কারণ। সুতরাং মহাপ্রাজ্ঞ, আপনি পাণ্ডবদের উপর দোষারোপ করবেন না। হে পরন্তপ! এই বিষয়ে মহাত্মা পাণ্ডবগণ ধর্ম, ন্যায় ও স্নেহের অল্পমাত্র অতিক্রম করেননি। এ সমস্তই আপনার আত্মকৃত দোষের ফল, এ কথা বুঝে আপনি পাণ্ডবদের উপরে দোষারোপ করতে পারেন না।

“আপনার ও গান্ধারী দেবীর বংশগৌরব, বংশরক্ষা, পিণ্ড প্রত্যাশা এবং পুত্রের যে সকল প্রয়োজন আছে, সে সমস্তই এখন পাণ্ডবগণের উপর প্রতিষ্ঠিত হল। কৌরবশ্রেষ্ঠ নরনাথ! আপনি এবং যশস্বিনী গান্ধারী দেবী পাণ্ডবগণের এই অপরাধ বিষয়ে শোক করবেন না। এই সমস্ত বিষয় ও নিজের দোষ স্মরণ করে, মঙ্গলময় চিত্তে পাণ্ডবগণের বিষয়ে চিন্তা করতে থাকুন। আপনাকে নমস্কার করি। আপনার উপরে স্বভাবতই যুধিষ্ঠিরের যে ভক্তি ও স্নেহ আছে, তা আপনি জানেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অপকারী শত্রুগণের এইরূপ মহামারী ঘটিয়ে দিবারাত্রই অনুতাপ অনলে দগ্ধ হচ্ছেন; কখনই শান্তি পাচ্ছেন না। রাজা যুধিষ্ঠির আপনার ও গান্ধারী দেবীর বিষয়ে শোক করতে থেকে, কোনও সময়েই শান্তি পাচ্ছেন না। আপনি পুত্রশোকে সর্বতোভাবে সন্তপ্ত হয়েছেন এবং আপনার বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়গুলি শোকে বিশেষ আকুল হয়ে গেছে। তবুও রাজা যুধিষ্ঠির অত্যন্ত লজ্জিত হওয়ায় আপনার কাছে আসছেন না।”

যদুবংশশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে এই কথা বলে, শোকাকুল গান্ধারী দেবীকে উত্তম বাক্য সকল বলতে লাগলেন, “সুবলনন্দিনি সুব্রতে! আমি আপনাকে যা বলব, আপনি তা শ্রবণ করুন। কল্যাণী, বর্তমান সময়ে এই জগতে আপনার তুল্য নারী নেই। রাজ্ঞী, আপনি জানেন যে সেই সময়ে আপনি সভায়, আমার সামনে উভয় পক্ষের হিতজনক ও ধর্মার্থযুক্ত অনেক কথা বলেছিলেন। কিন্তু আপনার পুত্রেরা আপনার সে বাক্য রক্ষা করেননি। কল্যাণী তারপর আপনি দুর্যোধনকে অনেক নিষ্ঠুর কথা বলেছিলেন, ‘মূঢ় দুর্যোধন! তুই আমার কথা শোন— যেখানে ধর্ম থাকে, সেইখানে জয়ও থাকে।’ রাজপুত্রী এখন আপনার সেই বাক্য সত্য হয়ে উপস্থিত হয়েছে। এই কথা বুঝে আপনি আর শোক করবেন না এবং কখনও পাণ্ডবগণের বিনাশের দিকে বুদ্ধি করবেন না। মহাভাগে! আপনি তপস্যার প্রভাবে ক্রোধজ্বলিত নয়নদ্বারা স্থাবর ও জঙ্গমের সঙ্গে সমগ্র পৃথিবীই দগ্ধ করতে পারেন।”

তখন গান্ধারী কৃষ্ণের কথা শুনে বললেন, “মহাবাহু কৃষ্ণ, তুমি যা বললে, তা সত্য বটে। জনার্দন মনের বেদনায় আমার বুদ্ধি বিচলিত হয়েছিল; কিন্তু তোমার বাক্য শুনে, আমার বুদ্ধি এখন স্থির হয়েছে। মনুষ্যশ্রেষ্ঠ কেশব, সম্মিলিত পাণ্ডবগণের সঙ্গে তুমিই এখন অন্ধ, বৃদ্ধ, হতপুত্র রাজার একমাত্র অবলম্বন।” পুত্রশোকাতুরা গান্ধারী এই পর্যন্ত বলে, বস্ত্র দ্বারা মুখ ঢেকে রোদন করতে লাগলেন। তখন সর্বশক্তিমান ও মহাবাহু কৃষ্ণ যুক্তি ও কারণযুক্ত বহুবিধ বাক্যদ্বারা শোকাকুলা গান্ধারীকে আশ্বস্ত করলেন। কৃষ্ণ সেইভাবে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীকে আশ্বস্ত করে, অশ্বত্থামার সংকল্পিত বিষয় বুঝতে পারলেন। কৃষ্ণ তখনই গাত্রোত্থান করে, মস্তকদ্বারা বেদব্যাসের চরণযুগলে নমস্কার করে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “কৌরবশ্রেষ্ঠ! আমি আপনার নিকট প্রস্থানের অনুমতি প্রার্থনা করছি। আপনি আর শোকের দিকে মন দেবেন না। অশ্বত্থামার পাপ অভিপ্রায় জন্মেছে, আমি সেই জন্য হঠাৎ গাত্রোত্থান করেছি। অশ্বত্থামা রাত্রিতে পাণ্ডবগণের গুপ্তহত্যা বিষয়ে সংকল্প করেছেন।” এই কথা শুনে মহাবাহু ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর সঙ্গে মিলিত হয়ে বললেন, “কেশিহন্তা মহাবাহু কৃষ্ণ, তুমি সত্বর যাও পাণ্ডবগণকে রক্ষা করো। জনার্দন আমরা আবার তোমার সঙ্গে মিলিত হব।” কৃষ্ণ ত্বরান্বিত হয়ে দারুকের সঙ্গে প্রস্থান করলেন। ধর্মাত্মা কৃষ্ণ কৃতকার্য হয়ে নদীতীরস্থ পাণ্ডবশিবিরে উপস্থিত হয়ে তাঁদের কাছে গান্ধারীর কোপ নিবৃত্তির কথা বলে, পরকর্তব্য বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলেন।

*

বস্তুত বর্তমান আখ্যানাংশে দুটি মহাদুর্লভ মুহূর্ত উদ্ভাসিত হল। দুটি ঘটনার কারণ একই, নায়কও একজন। দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের পর কৃষ্ণ অর্জুনকে গাণ্ডিবধনু ও দুই অক্ষয় তূণ নামিয়ে নিতে বললেন। অর্জুনকেও নেমে যেতে বললেন। অর্জুন রথ থেকে নেমে গেলে অশ্বরজ্জু ছেড়ে দিয়ে নিজেও রথ থেকে নেমে গেলেন। রথ জ্বলে উঠল। কারণ, কৃষ্ণ জানিয়েছেন। কিন্তু ঘটনা গভীর তাৎপর্যবাহী। কৃষ্ণের অর্জুনের সারথ্য শেষ হল। অর্জুনের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট কৃষ্ণ অর্জুনের সারথ্য করতে সম্মত হয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হয়েছে। অর্জুন বিজয়ী হয়েছেন। দেবদত্ত রথের প্রয়োজন আর তাঁর হবে না। কিন্তু গাণ্ডিব ধনু এবং দুই অক্ষয় তূণের প্রয়োজন হবে। ধ্বজস্থিত অলৌকিক বানরটি অন্তর্হিত হল। কৃষ্ণ জগদীশ্বর। তিনি স্বয়ং নারায়ণ। তিনি মধুসূদন, কংসারি, কেশিহন্তা, গোবিন্দ, মাধব। তিনি রথে থাকতে সে রথ জ্বলতে পারে না। দেবদত্ত রথ প্রজ্বলনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকও অনুভব করতে পারে কৃষ্ণ অর্জুনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা শুরু হল।

দ্বিতীয় অংশটিতেও কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব প্রকটিত হয়ে উঠেছে। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বলেছিলেন, “তুমি অর্জুনের সারথ্য গ্রহণ করে, সমস্ত পাণ্ডবপক্ষকে আবৃত করে রেখেছ।”এ কথা চরম সত্য। যুধিষ্ঠিরের মুখে তাঁর অমঙ্গলাশঙ্কা শুনলেন কৃষ্ণ। বুঝলেন— এ দুশ্চিন্তার সঙ্গত কারণ আছে। পতিব্রতা, দীর্ঘ তপস্যাকারিণী গান্ধারী দুর্যোধনকে অন্যায়ভাবে নিহত করা হয়েছে শুনলেই পাণ্ডবদের অভিসম্পাত দিতে পারেন। এ কথা শোনার পর কৃষ্ণ একমুহূর্তও অপেক্ষা করলেন না। আপন সারথিকে নিয়ে সেই মুহূর্তেই হস্তিনানগরে গিয়ে পৌঁছলেন। গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রের ক্রোধের উপশম ঘটালেন। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী শান্ত হলেন। কিন্তু পাঠক বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখল যে কৃষ্ণ অন্তর্যামী। তিনি সকলের অন্তরের সংবাদ জানেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে অশ্বত্থামার মনে পাপচিন্তার উদয় ঘটেছে। তিনি সেই রাত্রেই পাণ্ডবদের গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র করছেন। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীকে সে সংবাদ দিয়ে তাঁদের অনুমতি নিয়েই সেই মুহূর্তেই তিনি রথ নিয়ে এসে পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলিত হলেন। কৃষ্ণের চেতনায় ছাপ ঠিকই পড়েছিল। কিন্তু ঘটনাটি ঘটল পুত্রদের উপর দিয়ে। যা সম্ভবত কৃষ্ণেরও কল্পনাতে আসেনি।

যথারীতি দেখা গেল, যুধিষ্ঠির পাণ্ডবপক্ষের সব থেকে বুদ্ধিমান ব্যক্তি। দুর্যোধনের মৃত্যুর আঘাত সবথেকে বেশি পড়বে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর উপরে। গান্ধারী মূর্তিমতী তপস্যা। তিনি ক্রুদ্ধা হয়ে অভিসম্পাত করলে সব জয় পরাজয়ে পরিণত হতে সামান্যও বিলম্ব হবে না। এ মুহূর্তে একমাত্র কৃষ্ণের মতো সর্বদর্শী, বিচক্ষণ, ভূত-ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাই পারবেন ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীকে শান্ত করতে। যুধিষ্ঠিরের অনুমান ভুল হয়নি।

৮৫
দুর্যোধনের আক্ষেপ

কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে সন্ধ্যা নেমে এল। মানব-কোলাহল স্তব্ধ হল। মাংসভোজী ও নৈশ প্রাণীদের ডাক শোনা যেতে লাগল। ভগ্নোরু ও ধূলিধূসরিতদেহ রাজা দুর্যোধন দশ দিকে দৃষ্টিপাত করে, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কেশগুলিকে সমীকরণপূর্বক যথাস্থানে রেখে, সর্পের ন্যায় নিশ্বাস ত্যাগ করতে থেকে, মত্তহস্তীর মতো ভূতলে হস্ত সঞ্চালন, কেশ কম্পন ও দন্তে দন্তঘর্ষণ করে সঞ্জয়কে সামনে উপস্থিত দেখে যুধিষ্ঠিরের নিন্দা করতে করতে বললেন, “শান্তনুনন্দন ভীষ্ম, অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ দ্রোণ, কৃপ, বীরশ্রেষ্ঠ কর্ণ, শকুনি, অশ্বত্থামা, শল্য ও কৃতবর্মা— এই সকল বীর আমার রক্ষক ছিলেন; তবুও আমি এই অবস্থা প্রাপ্ত হলাম। হায়, কালকে অতিক্রম করা দুষ্কর। মহাবাহু সঞ্জয়, একাদশ অক্ষৌহিণী সৈন্যের অধিপতি সেই আমি এই অবস্থা প্রাপ্ত হলাম। অতএব আমি মনে করি, কোনও লোকই কালকে অতিক্রম করতে পারে না।

“সঞ্জয় এই যুদ্ধে যাঁরা জীবিত আছেন, তুমি তাঁদের বলবে যে, ভীম গদাযুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করে, আমাকে নিহত করেছে। পাণ্ডবেরা মহাবীর ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ ও ভূরিশ্রবার বিষয়ে অতি নিষ্ঠুর বহুতর কার্য করেছে। আমি বিশ্বাস করি, নৃশংস পাণ্ডবেরা এমন নিন্দাজনক কার্য করে মানবসমাজে ধিক্কারের পাত্র হবে। ছলক্রমে জয় করে বলবানের কি প্রীতি হতে পারে? কোনও বুদ্ধিমান লোক কি নিয়মলঙ্ঘনকারী লোককে আচারপালক বলে মনে করতে পারেন? পাপাত্মা পাণ্ডুপুত্র ভীমটা যেমন আনন্দ প্রকাশ করছে, শিক্ষিত কোনও লোক অধর্ম অনুসারে জয়লাভ করে, এইরকম আনন্দ প্রকাশ করেন? অতএব আজ ভগ্নোরু অবস্থায় আমার মস্তকে ক্রুদ্ধ ভীম যে পদাঘাত করেছে, তাতে আর বৈচিত্র্য কী আছে? সঞ্জয় প্রতাপশালী, সম্পদযুক্ত ও বন্ধুগণের মধ্যে বিদ্যমান লোকের উপরে এইরূপ ব্যবহার যে লোক করতে পারে, সেই লোক কি বীরসমাজে সম্মানিত হয়?

“সঞ্জয় আমার পিতা ও মাতা যুদ্ধধর্ম, ক্ষত্রিয়ের পরিণতি জানেন। তথাপি তাঁরা এখন দুঃখার্ত; সুতরাং তুমি আমার আদেশ অনুসারে তাঁদের জানাবে যে, আমি যজ্ঞ করেছি, পোষ্যবর্গকে সম্যক ভরণপোষণ করেছি, সসাগরা পৃথিবী শাসন করেছি এবং জীবিত শত্রুগণের মাথার উপরে থেকেছি। শক্তি অনুসারে দান করেছি, বন্ধুগণের প্রীতিবিধান করেছি এবং সমস্ত শত্রুকে দমন করেছি। অতএব সর্বপ্রকারে আমার তুল্য লোক আর কে আছে? সমস্ত বন্ধুজনের সম্মান করেছি, রাজগণকে ভৃত্যের মতো শাসন করেছি। বশীভূত লোককে সম্মানের সঙ্গে পালন করেছি এবং যথানিয়মে ধর্ম, অর্থ, কামের সেবা করেছি। অতএব সর্বপ্রকারে আমার তুল্য লোক আর কে আছে?

“আমি প্রধান প্রধান রাজার উপরে আদেশ চালিয়েছি। অতিদুর্লভ সম্মান পেয়েছি এবং উত্তম উত্তম অশ্বে আরোহণ করে গমনাগমন করেছি। সুতরাং সর্বপ্রকারে আমার তুল্য লোক আর কে আছে? আমি ভাগ্যবশত ভৃত্যের ন্যায় অন্যের আশ্রয়ে থেকে কিংবা যুদ্ধ থেকে ফিরে রাজধর্ম বিস্মৃত হইনি এবং ভাগ্যবশত আমার মৃত্যুর পরই রাজলক্ষ্মী অন্যের কাছে গেল। স্বধর্ম অনুযায়ী ক্ষত্রিয় বন্ধুগণের যা অভীষ্ট, আমি সেইরূপ নিধনই প্রাপ্ত হলাম। আমি ভাগ্যবশত সাধারণ লোকের মতো পরাঙ্খুখ হয়ে বিজিত হইনি কিংবা কোনও ধর্মবিরুদ্ধ বুদ্ধি করে পরাজিত হইনি। মানুষ যেমন নিদ্রিত ও অসাধারণ লোককে হত্যা করে কিংবা বিষদ্বারা গোপনে বিনাশ করে, তেমন ভীম ধর্ম অতিক্রম করে গদাযুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করে আমাকে নিহত করেছে। সঞ্জয় তুমি আমার আদেশ অনুসারে মহাত্মা অশ্বত্থামা, সাত্বতবংশীয় কৃতবর্মা এবং শরদ্বানের পুত্র কৃপাচার্যকে বলবে— পাণ্ডবেরা অধর্মক্রমে কার্য করে আসছেন এবং অনেকবার সদাচার লঙ্ঘন করেছেন। অতএব আপনারা তাদের আর বিশ্বাস করতে পারেন না।” তারপর যথার্থবিক্রমশালী দুর্যোধন স্তুতি পাঠকদের বললেন, “ভীম অধর্ম অনুসারে যুদ্ধে আমাকে নিহত করেছে। দ্রোণ, কর্ণ, শল্য, মহাবীর বৃষসেন, সুবলনন্দন শকুনি, মহাবল জলসন্ধ, মহাবীর ভগদত্ত, মহাধনুর্ধর ভূরিশ্ৰবা, সিন্ধুরাজ জয়দ্ৰথ, প্রাণের তুল্য দুঃশাসন প্রভৃতি ভ্রাতৃগণ, বিক্রমশালী দুঃশাসনের পুত্র ও লক্ষ্মণ এই পুত্রদ্বয়, এঁরা এবং অন্যান্য বহুতর আমার পক্ষীয় যোদ্ধা ও সহস্র সহস্র বীর স্বর্গে গমন করেছেন; এখন আমি একাকী সঙ্গীবিহীন পথিকের মতো তাঁদের পিছনে গমন করব।

“হায়! আমার ভগিনী দুঃশলা ভ্রাতৃগণ ও ভর্তাকে নিহত শুনে, দুঃখার্ত হয়ে, গুরুতর রোদন করতে থেকে, কীরূপ হয়ে পড়বেন? বিশেষত, আমার বৃদ্ধ পিতা, গান্ধারী দেবী, পুত্রবধুগণ ও পৌত্রবধুগণের সঙ্গে কী অবস্থা প্রাপ্ত হবেন? শুভলক্ষণা, ও বিশালনয়না আমার ভার্যা— পুত্র ও ভর্তা নিহত হওয়ায় নিশ্চয়ই সত্বর মৃত্যুমুখে পতিত হবেন। আমার সুহৃদ, পরিব্রাজক ও বাক্যবিশারদ, মহাত্মা চার্বাক যদি আমার এই অন্যায়বধ বৃত্তান্ত জানতে পারেন, তা হলে নিশ্চয়ই তিনি এর প্রতিশোধ নেবেন। ত্রিভুবনবিখ্যাত এই পবিত্র সমন্তপঞ্চকে মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে, নিশ্চয়ই আমি চিরস্থায়ী স্বর্গ লাভ করব।”

তখন সহস্র সহস্র লোক দুর্যোধনের বিলাপ শুনে জলভরা চোখে, দশ দিকে চলে যেতে লাগল। তারপর সমুদ্র, বন, স্থাবর ও জঙ্গমের সঙ্গে সমগ্র পৃথিবী ভীষণ মূর্তি ধারণ করে কেঁপে উঠল। দারুণ শব্দ হল এবং দিক সকল মলিন হয়ে পড়ল। এদিকে সেই লোকেরা অশ্বত্থামার কাছে গিয়ে, ভীমের গদাযুদ্ধে অন্যায় ব্যবহার এবং দুর্যোধনকে নিপাতিত করা প্রভৃতি সমস্ত ঘটনা যথাযথভাবে জানাল। তখন তীক্ষ্ণ বাণ, তোমর ও শক্তির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষতদেহ, কৌরবপক্ষের মহারথ, হতাবশিষ্ট কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা সেই লোকগুলির কাছে দুর্যোধনের নিধনবার্তা শুনে, বেগবান অশ্বগণের গুণে সত্বর রণস্থলে আগমন করলেন।

তাঁরা এসে দেখলেন বনমধ্যে বায়ুবেগে ভঙ্গ বিশাল শালবৃক্ষের মতো, ব্যাধকর্তৃক নিপাতিত মহাহস্তীর মতো, ঈশ্বরের ইচ্ছায় ভূতলে নিপাতিত সূর্যমণ্ডলের মতো, মহাবায়ুবেগে সংশোধিত সমুদ্রের সমান, আকাশে নীহারাবৃত চন্দ্রমণ্ডলের তুল্য এবং নিপতিত ব্যাঘ্রের ন্যায়, মহাবাহু, মহাবল, হস্তীর তুল্য বিক্রমশালী ও নরশ্রেষ্ঠ দুর্যোধন ভূতলে নিপাতিত রয়েছেন। তিনি তখন রক্তাক্ত দেহে দারুণ বেদনায় ছটফট করছেন এবং বার বার এ-পাশ ও-পাশ করছেন; ধূলিতে তাঁর দেহ আবৃত হয়ে গেছে; ধনলোভী লোকেরা যেমন রাজাকে সকল দিকে বেষ্টন করে থাকে, সেইরকম মাংসভোজী প্রাণীরা তাঁকে সকল দিকে বেষ্টন করে আছে। ক্রোধে তাঁর মুখমণ্ডলে ভীষণ ভ্রূকুটি প্রকাশ পাচ্ছে, নয়নযুগল উপরে উঠেছে এবং তিনি আর বেদনা, দুঃখ ও আক্ষেপ সহ্য করতে পারছেন না।

মহাধনুর্ধর কৃপাচার্য প্রভৃতি সেই রথীরা— রাজা দুর্যোধনকে ভূতলে নিপতিত দেখে প্রথমে যেন মোহ প্রাপ্ত হলেন। তারপর তাঁরা সকলে রথ থেকে নেমে দ্রুত তাঁর কাছে গেলেন এবং ভূতলেই উপবেশন করলেন। তখন অশ্বত্থামা অশ্রুপূর্ণ নয়নে, নিশ্বাস ত্যাগ করতে করতে, ভরতবংশশ্রেষ্ঠ ও সমস্ত রাজার অধীশ্বর দুর্যোধনকে বললেন, “নরশ্রেষ্ঠ! নিশ্চয়ই মনুষ্যলোকে কোনও বস্তুই চিরস্থায়ী নয়। কারণ, আপনি ধূলিধূসর দেহে ধূলির উপরেই শয়ন করে আছেন। রাজশ্রেষ্ঠ! সমস্ত পৃথিবীর উপরে আদেশে অভ্যস্ত আজ কেন একাকী এই নির্জন রণস্থলে পড়ে আছেন?

“পুরুষশ্রেষ্ঠ! দুঃশাসন, মহারথ কর্ণ এবং সেই সকল বন্ধুকে দেখছি না কেন? এ কী ব্যাপার? দৈবের কোনও গতি এবং মানুষের অবস্থা জানা নিশ্চয়ই দুষ্কর, যেহেতু আপনি ধূলিধূসর দেহে ভূতলে ধূলির উপরেই শয়ন করে আছেন। আপনার সেই নির্মল ছত্র আর চামর কোথায় গেল? আপনার সেই বিশাল সৈন্যই বা কোথায় গিয়েছে? বিভিন্ন কারণ উপস্থিত হলে কার্যও যে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, সেগুলির অবস্থা জানা দুষ্কর। যেহেতু আপনি লোকশ্রেষ্ঠ হয়ে বর্তমান সময়ে এইরূপ অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছেন। আপনি ইন্দ্রকেও স্পর্ধা করতেন; অথচ বর্তমান সময়ে আপনার এই অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মানুষের সম্পদ চিরস্থায়ী নয়।”

তখন রাজা দুর্যোধন অত্যন্ত দুঃখিত অশ্বত্থামার সেই কথা শুনে হস্তযুগল দ্বারা নয়ন মার্জনা করে, অশ্রু বিসর্জন করতে থেকে, কৃপাচার্য প্রভৃতি বীরগণকে বললেন, “কালের পরিবর্তনবশত সমস্ত পদার্থই যে ধ্বংস হয়, এ বিধাতারই নির্দিষ্ট প্রাণীজগতের ধর্ম। সেই অবস্থাই আমার উপস্থিত হয়েছে, যা আপনারা দেখছেন। আমি পৃথিবী পালন করে শেষে এই অবস্থা প্রাপ্ত হলাম। ভাগ্যবশত আমি যুদ্ধে কোনও সংকটের সময়েই পরাঙ্মুখ হইনি। ভাগ্যবশত পাপাত্মারা বিশেষ ছলপূর্বকই আমাকে নিহত করেছে। আমি ভাগ্যবশত যুদ্ধ করবার অভিপ্রায়ে সর্বদা উৎসাহ প্রকাশ করেছি এবং ভাগ্যবশতই আমি জ্ঞাতিগণ ও বন্ধুগণ নিহত হওয়ার পরেই নিহত হয়েছি। ভাগ্যবশতই আমি আপনাদের কুশলে ও অক্ষতদেহে এই লোকক্ষয় থেকে মুক্ত দেখছি। তা আমার অত্যন্ত প্রীতিকর হয়েছে।

মা ভবন্তোহনুতপ্যন্তাং সৌহৃদান্নিধনেন মে।

যদি বেদাঃ প্রমাণং বো জিতা লোকা ময়াক্ষয়াঃ॥ সৌপ্তিক : ২ : ২৮॥

—আপনারা আমার মৃত্যুতে সৌহার্দ্যবশত অনুতপ্ত হবেন না। কারণ, বেদবাক্য যদি প্রমাণ বলে আপনাদের অভিমত হয়, তা হলে আমি অক্ষয় স্বর্গ জয় করেছি।

“অমিততেজা কৃষ্ণের প্রভাব আমি জানি; কিন্তু তিনিও আমাকে সম্যক অনুষ্ঠিত ক্ষত্রিয়ধর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারেননি। আমি সেই ক্ষত্রিয়ধর্ম যথাযথভাবে রক্ষা করেছি। অতএব আপনারা কোনও প্রকারেই আমার জন্য শোক করতে পারেন না। আবার আপনারাও নিজেদের অনুরূপ উপযুক্ত কাজ করেছেন। আপনারা সর্বদাই জয়লাভের জন্য চেষ্টা করেছেন; কিন্তু দৈবকে অতিক্রম করা দুষ্কর বলে সে জয় হল না।”

অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে সেই অবস্থায় পতিত দেখে অগ্নির মতো ক্রোধে জ্বলে উঠে বললেন যে, অতি নৃশংসভাবে তাঁর পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। তাতেও তিনি ততটা দুঃখিত হননি, যতটা ছলপূর্বক নিহত দুর্যোধনকে দেখে হয়েছেন। অশ্বত্থামা মৃত্যুপথযাত্রী দুর্যোধনের সম্মুখে প্রতিজ্ঞা করলেন যে, তিনি সেই দিনই কৃষ্ণের সম্মুখে পাণ্ডবদের নিহত করবেন। অশ্বথামার প্রতিজ্ঞায় সন্তুষ্ট দুর্যোধন কৃপাচার্য দ্বারা জল আনিয়ে অশ্বত্থামাকে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত ও বৃত করলেন। অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা প্রস্থান করলেন। যন্ত্রণার্ত, বেদনার্ত, দুর্যোধন শেষ নিশ্বাসের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।

*

মৃত্যুপথযাত্রী দুর্যোধনের এই বিদায়-ভাষণের দুর্লভ মুহূর্তটি সম্পর্কে আলোচনার প্রথমেই একটি সংস্কৃত শ্লোক স্মরণে আসে—

অতি দর্পে হত লঙ্কাঃ অতি মানে চ কৌরবা।

অতি দানে বলিঃ বন্ধো সর্বম অত্যন্ত গর্হিতম্॥

অতি মানী দুর্যোধন! কলির অংশাবতার। সারা জীবন কারও অধীনতা সহ্য করেননি দুর্যোধন। তাঁর জন্মমুহূর্তে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অমঙ্গলচিহ্ন দেখে বিদুর তৎক্ষণাৎ তাঁকে পরিত্যাগ করতে বলেছিলেন। বস্তুত তাঁর জন্যই কৌরববংশ ধ্বংস হয়ে গেল। পিতা ধৃতরাষ্ট্র কেবলমাত্র জন্মান্ধ ছিলেন না, পুত্রস্নেহে অন্ধও ছিলেন। পিতার প্রশ্রয়ে অবাধ্য ও দুর্বিনীত হয়ে উঠলেন দুর্যোধন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর, সঞ্জয়, গুরুজন স্থানীয় কোনও ব্যক্তিকে গ্রাহ্য করতেন না দুর্যোধন। হস্তিনানগরে পাণ্ডুপুত্রদের প্রবেশ কোনওদিন স্বাভাবিকভাবে নেননি তিনি।

যে অভিযোগ বর্তমান মুহূর্তটিতে দুর্যোধন করেছিলেন সে সব অন্যায় তিনি নিজেও করেছিলেন। ছলনা করে, বিষ প্রয়োগ করে, অগ্নিদগ্ধ করে তিনি পাণ্ডবদের ও তাঁদের মাতাকে হত্যা করতে চেয়েছেন। খাণ্ডবপ্রস্থকে যখন পাণ্ডবেরা ইন্দ্রপ্রস্থে রূপান্তরিত করলেন এবং রাজসূয় যজ্ঞ করলেন, তখন থেকেই ঈর্ষা ও বিদ্বেষ অনলে দুর্যোধন দগ্ধ হতে লাগলেন। শকুনিকে অবলম্বন করে কপট পাশা খেলে পাণ্ডবদের রাজত্ব হস্তগত করলেন, পাণ্ডবভার্যা দ্রৌপদীকে অন্তঃপুর থেকে কুন্তীর নিষেধসত্ত্বেও পুরুষের রাজসভায় কেশাকর্ষণ করে এনে শ্বশুর ও গুরুজনদের সামনে তাঁকে নগ্না করতে চাইলেন। দ্রৌপদীকে অনাবৃত বাম ঊরুতে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজের মৃত্যুকে আহ্বান করলেন দুর্যোধন। দ্রৌপদী কেবলমাত্র কুরুকুলবধূ ছিলেন না, তাঁর ভ্রাতৃজায়াও ছিলেন। শকুনি, কর্ণ, দুঃশাসনকে সঙ্গী করে দ্রৌপদীর যে লাঞ্ছনা সেদিন দ্যূতসভায় তাঁরা করলেন, তখনই যম ভীমের কণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে, দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ হবে।

দুর্যোধন পরিপূর্ণ পাপী। পরিপূর্ণ পাপীর মতোই তিনি বিশ্বাস করতেন— রাজা কোনও অন্যায় করতে পারেন না। মহর্ষি কণ্বকে দুর্যোধন দৌত্যসভায় বলেছিলেন, “বিধাতা আমাকে যেমন করে সৃষ্টি করেছেন, আমি তেমনই করে চলেছি।” নিরস্ত্র বালক অভিমন্যুকে সপ্তরথী মিলে হত্যা করতেও তিনি কুণ্ঠিত হননি। তিনি শত্রুর মাথায় পা দিয়ে চলতে অভ্যস্ত। শত্রুপক্ষের সকলেই তাঁর কাছে বধ্য। পাণ্ডবদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ দুর্যোধনের সত্তার এত গভীরে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল যে, নিজে মৃত্যুপথযাত্রী হয়েও তিনি পাণ্ডবদের নিধনের জন্য অশ্বত্থামাকে সেনাপতি অভিষিক্ত করেন।

কিন্তু স্বপক্ষীয় রথী ও প্রজাদের সম্পর্কে দুর্যোধন অত্যন্ত সহৃদয় এবং স্নেহশীল। আশ্রমবাসিক পর্বে ধৃতরাষ্ট্রের বনবাসের পূর্বে প্রজাদের প্রতিনিধি ব্রাহ্মণ স্বীকার করেছিলেন যে, দুর্যোধন কোনওদিন তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেননি।

ভগ্নোরু দুর্যোধন রাজকীয় মর্যাদাবোধের গভীর পরিচয় অবশিষ্ট তিন কৌরব মহারথের সামনে রাখলেন। যন্ত্রণার কোনও একটি বাক্যও তিনি উচ্চারণ করেননি— বরং যোগ্য নেতার মতো অশ্বত্থামাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। দুর্যোধন নিয়তিবাদী। তিনি জানেন যে, দৈবকে অতিক্রম করা যায় না। কৃষ্ণের অলৌকিক শক্তি সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। কিন্তু সেই অলৌকিক শক্তির সামনে তিনি মাথা নত করেননি। অপার কষ্টসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে নির্জন কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে নিঃসঙ্গ দুর্যোধন সমস্ত পাঠকের সামনে প্রমাণ রেখে গিয়েছেন, তিনিই মহাভারতের যথার্থ প্রতিনায়ক।

৮৬
অশ্বত্থামার মহাদেবের অনুগ্রহ লাভ

মৃত্যুপথযাত্রী দুর্যোধন অশ্বত্থামাকে কৌরবপক্ষের শেষ সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করলেন। অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা পাঞ্চালশিবিরের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। একটি বিশাল বটবৃক্ষের নিকটে এসে রথ থেকে নেমে তাঁরা সন্ধ্যাবন্দনা করলেন। ক্রমে রাত্রি গভীর হল, কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা ভূতলে শুয়ে নিদ্রিত হলেন। অশ্বত্থামার নিদ্রা এল না, তিনি ক্রোধে অধীর হয়ে সর্পের ন্যায় নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন। তিনি দেখলেন, সেই বটবৃক্ষে বহু সহস্র কাক নিঃশঙ্ক হয়ে নিদ্রা যাচ্ছে, এমন সময়ে এক ঘোরদর্শন কৃষ্ণপিঙ্গলবর্ণ বৃহৎ নাসিক্য পেচক এসে নির্বিচারে নিদ্রিত কাকদের বিনষ্ট করল, তাদের ছিন্ন দেহে ও অবয়বে বৃক্ষের তলদেশ আচ্ছন্ন হয়ে গেল।

অশ্বত্থামা ভাবলেন, “এই পেচক যথাকালে আমাকে শত্ৰুসংহারের উপযুক্ত উপদেশ দিয়েছে। আমি বলবান বিজয়ী পাণ্ডবদের সম্মুখযুদ্ধে বধ করতে পারব না। যে কার্য গর্হিত বলে গণ্য হয়, ক্ষত্রিয় ধর্মাবলম্বী মানুষের পক্ষে তাও করণীয়। এই প্রকার শ্লোক শোনা যায়— পরিশ্রান্ত, ভগ্ন, ভোজনে রত, পলায়মান, আশ্রয়ে প্রবিষ্ট, অর্ধরাত্রে নিদ্রিত, নায়কহীন, বিচ্ছিন্ন বা দ্বিধাহীন নয় এমন অবস্থায় শত্রুকে প্রহার করা বিধেয়।”

অশ্বত্থামা তাঁর নিদ্রিত দুই সঙ্গীকে জাগরিত করে আপন সংকল্প জানালেন। এমন অক্ষত্রিয়োচিত প্রস্তাবে কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা লজ্জিত হয়ে উত্তর দিতে পারলেন না। শেষে কৃপাচার্য অশ্বত্থামাকে এই সংকল্প থেকে নিবৃত্ত হতে বললেন। কৃপ বললেন— লোভী অদূরদর্শী দুর্যোধন হিতৈষী মিত্রদের উপদেশ শোনেননি, তিনি লোভী অসাধু লোকদের মন্ত্রণায় পাণ্ডবদের সঙ্গে শত্রুতা করেছেন। আমরা সেই দুঃশীল পাপীর অনুসরণ করে এই দারুণ দুর্দশায় পড়েছি। চলো, হস্তিনানগরে গিয়ে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও বিদুরের উপদেশ গ্রহণ করি।

অশ্বত্থামা বললেন, “মাতুল, আমি শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণকুলে জন্মে মন্দভাগ্যবশত ক্ষত্রধর্ম আশ্রয় করেছি। সেই ধর্ম অনুসারে আমি মহাত্মা পিতৃদেব ও রাজা দুর্যোধনের পথে যাব। বিজয়লাভে আনন্দিত, শান্ত পাঞ্চালগণ আজ যখন বর্ম খুলে ফেলে নিশ্চিন্ত হয়ে নিদ্রামগ্ন থাকবে তখন আমি তাদের বিনষ্ট করব।” কৃপাচার্য বললেন, “সুপ্ত নিরস্ত্র অশ্বরথহীন লোককে হত্যা করলে কেউ প্রশংসা করে না। পাঞ্চালেরা আজ রাত্রে মৃতের ন্যায় অচেতন হয়ে নিদ্রা যাবে। সেই অবকাশে যে কুটিল লোক তাদের বধ করবে সে অগাধ নরকে নিমগ্ন হবে। এ কাজ করা কখনও তোমার উচিত হবে না।” অশ্বত্থামা বললেন, “ধর্মের সেতু পাণ্ডবেরা শত খণ্ডে ভগ্ন করেছে। আমি আজ রাত্রিতেই পিতৃহন্তা পাঞ্চালগণকে সুপ্ত অবস্থায় বধ করব, তার ফলে যদি আমাকে কীট পতঙ্গ হয়ে জন্মাতে হয় তাও শ্রেয়। আমার পিতা যখন অস্ত্রত্যাগ করেছিলেন, তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে বধ করেছিল; আমিও সেইরূপ পাপকর্ম করব, বর্মহীন ধৃষ্টদ্যুম্নকে পশুর মতো বধ করব, যাতে সেই পাপী অস্ত্রাঘাতে নিহত বীরের স্বর্গ না পায়।” এই বলে অশ্বত্থামা বিপক্ষ শিবিরের দিকে যাত্রা করলেন, কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা তাঁর অনুসরণ করলেন।

শিবিরের দ্বারে এসে অশ্বত্থামা দেখলেন— একটি ভীষণ পুরুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে; তার শরীর বিশাল, শরীরের তেজ চন্দ্র ও সূর্যের তুল্য, পরিধানে ব্যাঘ্রের চর্ম, উত্তরীয় বসনের স্থানে কৃষ্ণসারের চর্ম ও গলদেশে সর্পের যজ্ঞোপবীত রয়েছে। মুখ থেকে রক্তের ধারা পড়ছে, অতি দীর্ঘ ও স্থূল বহুতর বাহু প্রকাশ পাচ্ছে। সেগুলিতে আবার নানাবিধ অস্ত্র উত্তোলিত আছে। প্রত্যেক বাহুতেই মহাসর্পের কেয়ূর রয়েছে। মুখ থেকে অগ্নিশিখা নির্গত হচ্ছে, দন্তপঙ্‌ক্তি দুটি মুখখানিকে অতিভীষণ করেছে। মুখমণ্ডল বিকৃত রয়েছে এবং বিচিত্র সহস্র নয়ন প্রকাশ পাচ্ছে। সেই পুরুষের আকৃতি বা বেশের বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব, তবে সেই পুরুষকে দেখে পর্বত সকলও ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে যায়। সেই পুরুষের মুখ, নাসিকা, কর্ণযুগল এবং সেই বহু সহস্র নেত্র থেকে বিশাল অগ্নিশিখা নির্গত হচ্ছিল এবং সেই অগ্নিশিখার কিরণ থেকে শত শত ও সহস্র সহস্র শঙ্খচক্রগদাধারী বিষ্ণু আবির্ভূত হচ্ছিলেন।

অশ্বত্থামা অতিশয় অদ্ভুত ও জগতের ভয়ংকর সেই পুরুষকে দেখেও নির্ভয়চিত্ত হয়েই তাঁর দিকে অলৌকিক অস্ত্রসকল নিক্ষেপ করতে লাগলেন এবং সেই বিশাল পুরুষও অশ্বত্থামা নিক্ষিপ্ত অস্ত্রসকল গ্রাস করতে লাগল। বাড়বানল যেমন সমুদ্রের জলপ্রবাহ গ্রাস করে, তেমন সেই পুরুষও অশ্বত্থামা নিক্ষিপ্ত বাণসকল গ্রাস করতে লাগল। অশ্বত্থামা সেই বাণগুলিকে ব্যর্থ দেখে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার মতো একটি রথশক্তি সেই পুরুষের দিকে নিক্ষেপ করলেন। তখন প্রলয়কালীন আকাশচ্যুত বিশাল উল্কা যেমন সূর্যমণ্ডলকে আঘাত করে বিদীর্ণ হয়ে যায়; তেমনই অশ্বত্থামার সেই উজ্জ্বল রথশক্তিটিও সেই পুরুষকে আঘাত করে বিদীর্ণ হয়ে গেল।

তারপর সাপুড়ে যেমন গর্তের ভিতর থেকে উজ্জ্বল সর্প বার করে আনে, অশ্বত্থামাও তেমনই কোষের ভিতর থেকে স্বর্ণমুষ্টি ও আকাশের মতো নির্মল তরবারি নিষ্কাশিত করলেন। অশ্বত্থামা তরবারিটি সেই পুরুষের দিকে নিক্ষেপ করলেন; তখন বেজি যেমন গর্তের ভিতরে প্রবেশ করে, সেই তরবারিখানি গিয়ে সেই পুরুষের মুখবিবরের মধ্যে প্রবেশ করল। তখন অশ্বত্থামা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে, ইন্দ্ৰধ্বজের ন্যায় উজ্জ্বল একটি গদা সেই পুরুষের প্রতি নিক্ষেপ করলেন; সেই পুরুষ সেই গদাটিকেও গ্রাস করল। অশ্বত্থামার সমস্ত অস্ত্র নিঃশেষ হয়ে গেলে, তিনি ইতস্তত দৃষ্টিপাত করতে থেকে দেখলেন— পূর্বে কথিত শঙ্খচক্রগদাধারী বিষ্ণুগণ আকাশটাকে ছেয়ে ফেলেছেন।

সেই অত্যাশ্চর্য ব্যাপার দেখে নিরস্ত্র অশ্বত্থামা অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়ে কৃপাচার্যের বাক্য স্মরণ করে মনে মনে বললেন, “নির্বোধ লোক সুহৃদগণের উপদেশ স্মরণ না করে কার্য আরম্ভ করলে বিপদে পতিত হয়। নীতিশাস্ত্র দৃষ্ট পথ অতিক্রম করে শত্রুবধ করতে চাইলে, ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়, বিফলকাম হয়। গো, ব্রাহ্মণ, যজ্ঞপ্রবৃত্ত রাজা, স্ত্রীলোক, সখা, মাতা, গুরু, দুর্বল, জড়, অন্ধ, নিদ্রিত, ভীত, নিদ্রা থেকে সদ্য জাগরিত, মত্ত, উন্মত্ত এবং অসাবধান ব্যক্তির উপরে কখনও অস্ত্রাঘাত করবে না— মহর্ষিরা এইরূপ উপদেশ দিয়েছেন। আমি সেই সনাতন শাস্ত্রবাক্য অতিক্রম করে অসৎপথে চলে, ভীষণ বিপদে পতিত হয়েছি। কেবল শক্তির প্রভাবে কোনও গুরুতর কার্য করতে পারা যায় না, কারণ নীতিজ্ঞেরা বলেন, দৈব অপেক্ষা পুরুষকার প্রবল নয়। অজ্ঞানতাবশত যে কার্য আরম্ভ করা হয়, তা ভয়বশত নিবৃত্তিমূলক হয়, সার্থকভাবে শেষ হয় না। কিন্তু আজ অশ্বত্থামা যুদ্ধ থেকে নিবৃত্তি পাবে না। কিন্তু দৈবদণ্ডের মতো দণ্ডায়মান এই বিশাল পুরুষকে আমি কিছুতেই চিনতে পারছি না— অথচ ইনি আমার বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন। আমি অন্যায়ভাবে পাপমতি হয়ে কার্যারম্ভ করছিলাম, তার বিষময় ফল দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং দৈবই আমার বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। দৈবের প্রসন্নতাতেই সে বিঘ্ন সমাপ্ত করতে হবে। অতএব আমি এখন প্রভাবশালী, জটাজূটধারী, দেবদেব, উমাপতি, দুঃখনাশক, নরমুণ্ডমালাসমন্বিত, রুদ্র, ভগদেবের নেত্রনাশক, কামহন্তা মহাদেবের শরণাপন্ন হব। নিশ্চয়ই তিনি আমার এই ভীষণ দৈবদণ্ড দূর করবেন। কারণ সেই মহাদেবের তপস্যা ও বিক্রমের প্রভাবে অন্যান্য দেবতাকে অতিক্রম করেছেন। অতএব এই শূলপাণি মহাদেবেরই শরণাপন্ন হই।”

অশ্বত্থামা এই চিন্তা করে, রথ থেকে ভূতলে নেমে, নতজানু হয়ে মহাদেবের সম্মুখে অবস্থান করলেন। পরে অশ্বত্থামা বললেন, “দেবদেব! আমি নির্মলচিত্তে এবং অকিঞ্চিৎকর হলেও দুষ্কর আত্মোপহার দিয়ে আপনার পূজা করব। কেন না, আপনি— উগ্র, স্থাণু, শিব, রুদ্র, ঈশান, ঈশ্বর, গিরিশ, বরদাতা, দেব, জগৎসৃষ্টিকর্তা, অবিনশ্বর, শিতিকণ্ঠ, জন্মরহিত, শুভ্রবর্ণ, দক্ষযজ্ঞনাশক, কামহন্তা, বিশ্বরূপ, বিরূপাক্ষ, বহুরূপধারী, উমাপতি, শ্মশানবাসী, দর্পান্বিত, বিশাল, প্রমথগণের অধিপতি, সর্বব্যাপী, খটাঙ্গধারী, রুদ্রমূর্তি, জটাজূটযুক্ত ব্রহ্মচারী এবং ত্রিপুরহন্তা। মহাদেব! দেবতারা পূর্বকালে আপনার স্তব করেছেন, ভবিষ্যৎকালে স্তব করবেন এবং বর্তমানকালেও স্তব করছেন। কারণ, আপনি অব্যর্থকাম, কৃত্তিবাস, রক্তনেত্র, নীলকণ্ঠ, বিরোধীদের অসহ্য ও অনিবার্য, নির্মলচিত্ত, সৃষ্টিকর্তারও সৃষ্টিকর্তা, পরব্রহ্ম, ব্রহ্মচারী, তপোনিয়মযুক্ত, তপোনিষ্ঠ, অসীম, তপস্বীদের আশ্রয়, বহুরূপ, ত্রিলোচন, নিজ পারিষদগণের প্রিয়, কুবেরদৃষ্টমুখ, পার্বতীর হৃদয়বল্লভ, কার্তিকের পিতা, পিঙ্গলবর্ণ, জটাধারী, বৃষবাহন, ক্ষুদ্র ব্যাঘ্রচর্মপরিধারী, অতিভীষণ মূর্তি, পার্বতীর ভূষণকার্যে ব্যাপৃত, ব্রহ্মাদি শ্রেষ্ঠগণ থেকেও শ্রেষ্ঠ, এমনকী জগতে যার থেকে কোনও বস্তু শ্রেষ্ঠ নয়, বাণ ও উত্তম অস্ত্রমধ্যে পাশুপত অস্ত্রধারী, দিগন্তব্যাপী, জগৎপালক, স্বর্ণময়কবচযুক্ত, দীপ্তিমান ও চন্দ্রশেখর। অতএব মহাদেব। আমি অত্যন্ত একাগ্রচিত্তে আপনার আশ্রয় নিলাম।

“আমি যদি আজ অতি দুস্তর ও ভীষণ এই আপদ থেকে উত্তীর্ণ হতে পারি, তবে এই পবিত্র দেহ উপহার দিয়ে অগ্নিময়মূর্তি আপনার পুজা করব।” অশ্বত্থামার এইরূপ নিজ দেহ উপহার দানের উদ্‌যোগ ও অধ্যবসায় দর্শনের পরে, মহাত্মা মহাদেবের সম্মুখে একটি সুবর্ণময় বেদি আবির্ভূত হল। সেই সময় সেই বেদির উপরে অগ্নি জ্বলে উঠল এবং তার শিখায় দিকবিদিক ও আকাশ পূর্ণ হতে থাকল।

ক্রমে মহাদেবের সম্মুখে হস্তীতে উত্থিত পর্বতের মতো দীর্ঘাকৃতি মহাপ্রমথগণ আবির্ভূত হল। তাদের মুখ ও নয়ন উজ্জ্বল এবং বহুতর চরণ, অনেক মস্তক ও প্রচুর বাহু ছিল, তারা প্রত্যেকেই রত্নময় বিচিত্র কেয়ূর ধারণ করেছিল, সকলেই হাত উপরে তুলে রেখেছিল। তাদের মধ্যে কারও কুকুরের মতো, কারও শূকরের তুল্য, কারও গোরুর সমান, কারও ভল্লুকের মতো, কারও বিড়ালের মতো, কারও বা ব্যাঘ্রের তুল্য, কারও চিত্ৰব্যাঘ্রের মতো, কারও মৃগ বিশেষের মতো, কারও বানরের ন্যায়, কারও শুকপক্ষীর তুল্য, কারও বিশাল সর্পের মতো, কারও হংসের সদৃশ, কারও দাঁড়কাকের মতো, কতগুলির কচ্ছপের তুল্য, অনেকের কুম্ভীরের ন্যায়, কতকগুলি বিশাল মকরমৎস্যের সদৃশ, কতকগুলি তিমি মৎস্যের সমান, অনেকগুলি ভেকের মতো, কতকগুলি গৃহকপোতের ন্যায়, অনেকের হাতির মতো, বহুর মাগুর মৎস্যের মতো, অনেকের কাকের মতো এবং অনেকের শ্যেনপক্ষীর মতো মুখ ছিল। কতকগুলি শ্বেতবর্ণ ছিল, কতকগুলির কান ছিল হাতে, কতকগুলির হাজার হাজার চোখ ছিল, আবার অনেকের বিশাল উদর ছিল। কারও কারও দেহে মাংস ছিল, আবার অনেকের বিশাল মস্তক ছিল, কারও কেশ ছিল অগ্নিশিখার মতো উজ্জ্বল, অনেকের লোমগুলি জ্বলছিল, কতগুলি চতুর্ভুজ ছিল, অনেকের মুখ ছিল মেষমুখের মতো, অনেকগুলির মুখ ছিল ছাগমুখের তুল্য, অনেকের বর্ণ ছিল শঙ্খের ন্যায় শুভ্র, মুখ ও কর্ণ ছিল শঙ্খের তুল্য। কতগুলি জটাধারী, কতগুলি পঞ্চশিখাশালী, কতকগুলি মুণ্ডিত মস্তক, কতগুলি কৃশোদর ছিল। কতগুলির চারটে দাঁত, অনেকগুলির চারটি জিহ্বা, কতগুলির কান পেরেকের মতো ছিল, কতগুলির মাথায় মুকুট, কতগুলির কেশ কুঞ্চিত, কতগুলির মস্তকে মুকুট এবং কতগুলির মুখ সুন্দর ছিল, কতগুলির গাত্রে নানা অলংকার, কতগুলির মস্তকে পদ্ম, কতগুলির মস্তকে উৎপল এবং কতগুলির মস্তকে কুমুদ ছিল। শত শত ও সহস্র সহস্র ভূত মাহাত্ম্যশালী ছিল। কতকগুলির হাতে শতঘ্নী, অনেকের হাতে বজ্র, কারও কারও হাতে মুসল, বহুর হাতে ভুশণ্ডি, অনেকের হাতে পাশ ও কতগুলির হাতে পরশু, অনেকের উত্তোলিত হস্তে বিশাল পাশ, অনেকের হাতে লগুড়, বহুর হস্তে প্রস্তরস্তম্ভ, অনেকের হাতে তরবারি, কতগুলির মস্তকে সর্পের উন্নত কিরীট, অনেকের বাহুতে বিশাল সর্পের কেয়ূর, অনেকের অঙ্গে বিচিত্র অলংকার, বহুর অঙ্গ ধূলিধূসর, অনেকের অঙ্গ কর্দমলিপ্ত, সকলের অঙ্গেই শুভ্র বস্ত্র ও শুভ্রবর্ণ মালা, কতকগুলির অঙ্গ নীলবর্ণ, অনেকের অঙ্গ পিঙ্গলবর্ণ ও অনেকের মস্তক মুণ্ডিত ছিল।

সেই স্বর্ণবর্ণ পারিষদগণের মধ্যে অনেকে ভেরি, কেউ কেউ শঙ্খ, কেউ কেউ মৃদঙ্গ, বহু ব্যক্তি ঝর্ঝর, অনেকে আনক ও কতগুলি গোমুখ বাজাচ্ছিল। কেউ গান, কেউ নৃত্য, কেউ লঙ্ঘন, কেউ উল্লঙ্ঘন, কেউ প্রলঙ্ঘন করছিল; কেউ কেউ মহারবে ও মহাবেগে ধাবিত হচ্ছিল, কতগুলির স্বভাব অত্যন্ত কোপন ছিল, কতগুলির কেশ বায়ুতে উড়ছিল, অনেকের ভীষণ মূর্তি, অনেকের ভয়ংকর বর্ণ এবং বহু ব্যক্তির হস্তে শূল ও পট্টিশ ছিল; অনেকের বস্ত্রসকল নানারাগে রঞ্জিত ছিল, কতগুলি বিচিত্রমাল্য ও অনুলেপন ধারণ করেছিল। অনেকে রত্নখচিত বিচিত্র কেয়ূর ধারণ করেছিল; অনেকে হস্ত উত্তোলন করেছিল, অনেকে অসহ্যবিক্রমশালী, বীর ও বলপূর্বক শক্ৰসংহার করতে সমর্থ ছিল, অনেকে রক্ত, বসা প্রভৃতি পান করছিল, বহু ব্যক্তি মাংস নাড়ি ভক্ষণ করছিল, অনেকের চুড়া ছিল, বহু ব্যক্তির দেহ স্থলপদ্ম বৃক্ষের ন্যায় দীর্ঘ ছিল, অনেকে সর্বদা হৃষ্টচিত্ত ছিল, অনেকের উদর স্থালীর ন্যায় স্থুল ছিল, কতগুলি অত্যন্ত খর্ব, কতগুলি অত্যন্ত দীর্ঘ, কতগুলি অতিভীষণ মূর্তি ছিল, কতগুলির ওষ্ঠ কৃষ্ণবর্ণ ও ঝোলানো ছিল, কতগুলির বৃহৎ শিশ্ন ও কতগুলির বিশাল অণ্ডকোষ ছিল; অনেকের মহামূল্য নানাবিধ মুকুট, অনেকের মুণ্ডিত মস্তক, অনেকের মাথায় জটা ছিল। সেই পারিষদেরা চন্দ্র, সূর্য, অন্যান্য গ্রহ ও নক্ষত্রযুক্ত আকাশমণ্ডলকেও ভূতলে পাতিত করতে পারত।

যারা জরায়ুজ, অণ্ডজ, স্বেদজ, উদ্ভিজ্জ— এই চতুর্বিদ প্রাণীসমূহ সংহার করতে সমর্থ ছিল এবং যারা নির্ভয়চিত্তে মহাদেবের ভ্রূকুটি সহ্য করতে পারত; আর যারা ইচ্ছানুযায়ী কার্য করতে পারত, ত্রিভুবনের প্রভুগণের উপরেও প্রভুত্ব করতে পারত এবং সর্বদা আনন্দে প্রফুল্লচিত্ত বক্তা ও বিদ্বেষবিহীন ছিল, যারা অষ্টবিধ ঐশ্বর্য লাভ করেও আপন মহিমার ঐশ্বর্য বিস্মৃত হয়নি, বস্তুত যাদের কাজে ভগবানই বিস্মিত হয়ে থাকেন। যারা সর্বদা ভক্তিযুক্ত হয়ে কায়, মন ও বাক্য ও কর্মদ্বারা আরাধনা করে বলে, ভগবান মহাদেবও ঔরসপুত্রগণের ন্যায় যে ভক্তগণকে কায়, মন, বাক্য ও কর্মদ্বারা রক্ষা করে থাকেন; যারা রক্ত ও বসা পান করেও বেদবিরোধী অসুর ও রাক্ষসগণের প্রতি সর্বদা ক্রুদ্ধ থাকে এবং যারা সর্বদা চতুর্বিধ সোমরস পান করে; যারা শাস্ত্রজ্ঞান, ব্রহ্মচর্য আচরণ, তপস্যা ও ইন্দ্রিয়দমনদ্বারা মহাদেবের আরাধনা করে তাঁর সহচর হয়েছে; ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানের নিয়ন্তা ভগবান মহাদেব নিজের তুল্য যে ভূতগণ ও পার্বতী দেবীর সঙ্গে যজ্ঞভাগ গ্রহণ করে থাকেন; সেই ভূতেরা নানাবিধ বাদ্যধ্বনি, হাস্যরব, সিংহনাদ, উচ্চ স্বরে আহ্বান ও গর্জন করে সমস্ত শিবির প্রদেশ নিনাদিত করতে থেকে অশ্বত্থামার দিকে অগ্রসর হতে লাগল।

ক্রমে ভীষণ পরিঘ, মশাল, শূল ও পট্টিশধারী এবং অত্যন্ত তেজস্বী ও ভীষণমুর্তি সেই ভূতেরা মহাদেবের স্তব ও আলোক উৎপাদন করে মহাত্মা অশ্বত্থামার বৃদ্ধি ও তাঁর তেজের পরীক্ষা ও সুপ্ত পাণ্ডবপক্ষের হত্যাকাণ্ড দেখবার ইচ্ছা করে, সকল দিকে বিচরণ করতে লাগল, যাদের দেখেই ত্রিভুবনের ভয় জন্মাতে পারে, সেই ভূতগণকে দেখেও মহাবল অশ্বথামা কোনও ভয় করলেন না। তারপর অশ্বথামা ধনু, হস্তাবরণ, অঙ্গুলিত্র ধারণ করে, নিজেই নিজের শরীরটিকে মহাদেবের উদ্দেশে উপহার দেবার উপক্রম করলেন। সেই হোমকার্যে ধনুগুলি সমিধ, তীক্ষ্ণ বাণ সকল পবিত্র এবং বলবান অশ্বত্থামার দেহটি হবি হল।

ততঃ সৌমেন মন্ত্রেণ দ্রোণপুত্রঃ প্রতাপবান।

উপহারং মহামন্যুরথাত্মনমুপাহরৎ॥ সৌপ্তিক : ৮: ৫৩॥

—“তদনন্তর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও প্রতাপশালী অশ্বত্থামা সৌম্যমন্ত্রে মহাদেবকে নিজ শরীরটি উপহার দিতে উদ্যত হলেন।”

পরে বীর নিয়মশালী অশ্বত্থামা ভীষণ কার্যদ্বারা ভীষণকর্মা মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, “ভগবন্! আজ আমি অঙ্গিরার বংশে উৎপন্ন এই দেহটিকে অগ্নিতে হোম করছি। আপনি এই উপহার গ্রহণ করুন। হে বিশ্বাত্মন! মহাদেব! আপনার প্রতি ভক্তি ও একাগ্রতা সহকারে এই বিপদের সময় আপনার সম্মুখে এই দেহ উপহার দিলাম। ভগবান সমস্ত ভূত আপনাতে আছে এবং প্রধান গুণগুলির প্রকৃতি আপনাতে আছে। হে সর্বভূতের আশ্রয়! হে প্রভো! হে মহাদেব! আমি যদি অন্য উপহার নাও দিতে পারি; তথাপি আমার এই দেহটিকে আপনার সম্মুখে উপস্থাপিত করছি; আপনি এই দেহ গ্রহণ করুন।” এই কথা বলে অশ্বত্থামা সেই বেদির উপরে উঠে নিজের প্রতি মমতা ত্যাগ করে, জ্বলিত বহ্নিযুক্ত অগ্নিতে আরোহণ করে বসলেন।

অশ্বত্থামা ঊর্ধ্ববাহু হয়ে নিশ্চেষ্টভাবে হব্যরূপে অবস্থান করলেন দেখে, মহাদেব দেখা দিলেন এবং হাসতে হাসতে বললেন, “অনায়াস-কার্যকারী কৃষ্ণ সত্য, শৌচ, সরলতা, দান, তপস্যা, ব্ৰত, ক্ষমা, ভক্তি, ধৈর্য, জ্ঞান ও বাক্যদ্বারা যথাযথভাবে আমার আরাধনা করেছেন, সেই কারণে কৃষ্ণের থেকে আমার অধিক প্রিয় ব্যক্তি আর নেই। সেই কৃষ্ণের সম্মান রাখার জন্য এবং তোমাকে পরীক্ষা করার নিমিত্ত পাঞ্চালগণকে আমি রক্ষা করেছি এবং হঠাৎ তোমার সামনে নানাবিধ মায়া প্রকাশ করেছি। আমি পাঞ্চালগণকে রক্ষা করতে থেকে কৃষ্ণের গৌরব বৃদ্ধি করছিলাম; কিন্তু পাঞ্চালেরা কালকর্তৃক আক্রান্ত হয়েছে। সুতরাং আজ আর তাদের জীবন থাকবে না।”

এইরূপ বলে ভগবান মহাদেব নিজেরই অংশস্বরূপ মহাত্মা অশ্বত্থামার শরীরে আবিষ্ট হলেন এবং অশ্বত্থামাকে একখানি নির্মল তরবারি সমর্পণ করলেন। ভগবান মহাদেব শরীরে আবিষ্ট হলে, অশ্বত্থামা তেজে সাতিশয় জ্বলে উঠলেন এবং দেবকৃত তেজে যুদ্ধবিষয়ে গুরুতর বলশালী হলেন। ক্রমে অশ্বত্থামা শত্রুশিবিরের অভিমুখে গমন করতে থাকলে, সাক্ষাৎ মহাদেবেরই তুল্য সেই ভূতেরা ও রাক্ষসেরা অশ্বত্থামার সকল দিকে গমন করতে লাগলেন।

*

এই মুহূর্তটির আলোচনা করতে গেলেই আর একটি দুর্লভ মুহূর্ত পাঠকের মনে পড়ে। সেদিন একটি কিরাতের বেশ ধরে মহাদেব এসে দাঁড়িয়েছিলেন অর্জুনের সামনে। একটি বরাহের দাবি নিয়ে অর্জুনের সঙ্গে মহাদেবের দ্বন্দ্ব বেঁধেছিল। সেদিনও অর্জুনের সব বাণ গ্রাস করে নিয়েছিলেন দেবাদিদেব। তবে মহাদেবকে লাভ করতে অশ্বত্থামাকে আপন দেহ অগ্নিতে আহুতি দেবার সংকল্প করতে হয়েছিল। সেখানে অর্জুন আগুন জ্বালাবার স্থানের উপর মহাদেবের মূর্তি গড়ে তাঁর পূজা করেছিলেন। মহাদেব-পার্বতীকে নিয়ে দেখা দিয়েছিলেন। অর্জুন সংযত, ভক্ত ছিলেন— অন্যায়কারী ছিলেন না। অস্ত্র নিঃশেষ হয়ে গেলে অর্জুন মহাদেবের সঙ্গে বাহুযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মহাদেবের বাহুর চাপে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে পেলে অর্জুন মহাদেবের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন, সব অস্ত্র পেয়েছিলেন, বর পেয়েছিলেন যে, মহাদেব ভিন্ন পৃথিবীতে অর্জুনের তুল্য বীর হবেন না। মহাদেব চলে গেলে, অর্জুন বিস্মিত হয়ে কেবলমাত্র ভাবতে পেরেছিলেন, “আমি মহাদেবকে স্পর্শ করেছি।”

সে রকম ভাগ্য অশ্বত্থামার ছিল না। যদিও তিনি রুদ্রাংশেই জন্মেছিলেন। দ্রোণাচার্য সকল শিক্ষা অত্যন্ত যত্নসহকারে দিয়েছিলেন। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র ‘ব্রহ্মশির’ অশ্বত্থামাকে দেবার পূর্বে দ্রোণাচার্য বার বার তাঁকে বলেছিলেন, “তুমি কখনও মনুষ্যের উপর এ অস্ত্র ব্যবহার করবে না।” আরও বলেছিলেন, “তুমি কখনও সৎপথে থাকবে না।” অশ্বত্থামা সত্যই সৎপথে থাকতে পারলেন না। নিদ্রিত, অস্ত্রবিহীন পাঞ্চাল ও পাণ্ডবদের হত্যা করার সংকল্প নিয়েই তিনি শিবিরদ্বারে উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু সংকল্প পূরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ কৃষ্ণকে যিনি সবথেকে ভালবাসতেন, সেই দেবদেব মহাদেব শিবিরদ্বারে পাহারা দিচ্ছিলেন।

মহাদেবের সঙ্গে যুদ্ধে অশ্বত্থামার সব অস্ত্র মহাদেব গ্রাস করে ফেললে অশ্বত্থামা পিনাকপাণি শিবের উপাসনা শুরু করলেন। এক স্বর্ণময় বেদি উত্থিত হল— সেই বেদিতে আগুন জ্বলে উঠল। অশ্বত্থামা আপনদেহে শিবের হবি রচনা করতে চাইলেন। তিনি জ্বলন্ত অগ্নিতে উপবেশন করলেন। ভূত-প্রেত-রাক্ষস অনুচরসহ মহাদেব দর্শন দিলেন। জানালেন, কৃষ্ণ পাণ্ডবদের অনুরাগী, তাই তিনি পাঞ্চাল ও পাণ্ডবসন্তানদের রক্ষা করছিলেন। কিন্তু পাঞ্চাল ও পাণ্ডবসন্তানেরা কালপক্ক হয়েছে, তাই তাঁদের ধ্বংস অনিবার্য। তিনি অশ্বত্থামার হাতে তুলে দিলেন এক ভয়ংকর শক্তিশালী খড়্গ। দিলেন আপন শক্তির অংশ। অশ্বত্থামা শিবশক্তিতে বলীয়ান হয়ে শিবিরের দিকে এগিয়ে চললেন।

পার্থক্যটা সহজেই চোখে পড়ে। অর্জুনকে পাশুপত অস্ত্র দিয়েছিলেন শিব দেব-মানবের কল্যাণের জন্য। কালকেয় দানবদের বিনাশের কাজে তা ব্যবহার করলেও মানুষের উপর অর্জুন জীবনেও তা ব্যবহার করেননি। অর্জুন পেয়েছিলেন শিবের কল্যাণময় আশীর্বাদ, আর অশ্বত্থামা পেলেন শিবের ধ্বংসাত্মক রূপের অগ্নিশিখা। সেদিন রাত্রেই অশ্বত্থামা সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন, উত্তমৌজা, শিখণ্ডী, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, কেউ রক্ষা পেলেন না অশ্বত্থামার হাত থেকে।

৮৭
নিদ্রিত পাণ্ডব-পাঞ্চাল বধ

মহাদেবের কাছ থেকে বরলাভের পর অশ্বত্থামা দেখলেন কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা তাঁর অনুসরণ করে কুটিরদ্বারে উপস্থিত হয়েছেন। তাঁদের দেখে অশ্বত্থামা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। দু’জনকেই শিবিরদ্বার রক্ষার কার্যে নিযুক্ত করে অশ্বত্থামা নির্দেশ দিয়ে গেলেন, ভিতর থেকে কেউ এসে যেন কুটিরদ্বার লঙ্ঘন করে যেতে না পারে, দুই মহারথী তা অবশ্যই দেখবেন। “আমি শিবিরের ভিতর প্রবেশ করব এবং যমের মতো বিচরণ করব কিন্তু কোনও মানুষই যাতে জীবিত অবস্থায় আপনাদের কাছ থেকে মুক্তি না পায়, আপনারা তা দেখবেন।” এই কথা বলে ‘অশ্বত্থামা’ লাফ দিয়ে সেই বিশাল পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশ করলেন।

শিবির বিশেষজ্ঞ মহাবাহু অশ্বত্থামা ধীরে ধীরে ধৃষ্টদ্যুম্নের গৃহের দিকে গমন করলেন। সেই শিবিরের লোকেরা সমস্ত দিন যুদ্ধে গুরুতর কার্য করে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে, বিশ্বস্তচিত্তে এবং আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিতভাবে গভীর নিদ্রামগ্ন ছিল। অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নের গৃহে প্রবেশ করলেন। ভূতলে পাতা একটি গদিবিন্যস্ত শয্যায় ধৃষ্টদ্যুম্ন নিদ্রিত ছিলেন। গদির উপর পট্টবস্ত্রের আবরণ ও উত্তম পুষ্পমালা বিস্তৃত ছিল। সমস্ত গৃহ ধূপচূর্ণে সুবাসিত ছিল। মহাবল ধৃষ্টদ্যুম্ন বিশ্বস্তচিত্তে এবং অকুতোভয়ে নিদ্রিত ছিলেন। এই অবস্থায় অশ্বত্থামা পদাঘাত করে তাঁকে জাগ্রত করলেন। যুদ্ধদুর্ধর্ষ ধৃষ্টদ্যুম্ন পদাঘাতে অশ্বত্থামার প্রবেশ জানতে পারলেন। পরে ধৃষ্টদ্যুম্ন শয্যা থেকে উঠেছিলেন, এমন সময় মহাবল অশ্বত্থামা দু’হাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের কেশ ধারণ করে তাঁকে ভূতলে নিষ্পেষণ করতে লাগলেন। অশ্বত্থামা বলপূর্বক নিষ্পেষণ করতে থাকলে, ভয় ও নিদ্রার আবেশে ধৃষ্টদ্যুম্ন কোনও অঙ্গই সঞ্চালন করতে সমর্থ হলেন না।

সেই অবস্থায় অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নের বক্ষে ও কণ্ঠে আক্রমণ করলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন আর্তনাদ করতে লাগলেন এবং ছটফট করতে লাগলেন। এই অবস্থায় অশ্বত্থামা তাঁকে পশুর মতো প্রহার করতে লাগলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন অশ্বত্থামার অঙ্গে নখাঘাত করতে থেকে অস্পষ্ট স্বরে বললেন, “মনুষ্যশ্রেষ্ঠ আচার্যপুত্র! আপনি বিলম্ব করবেন না। আমাকে অস্ত্রদ্বারা বধ করুন; তা হলে আমি আপনার জন্য পুণ্যলোকে গমন করতে পারব।” বলবান অশ্বত্থামা তীব্র আক্রমণ করায় শত্রু সন্তাপক ধৃষ্টদ্যুম্ন এইটুকু মাত্র বলেই বিরত হলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের সেই অস্পষ্ট বাক্য শুনে অশ্বত্থামা বললেন, “কুক্ষত্রিয় কুলকলঙ্ক! গুরুহত্যাকারীগণের পুণ্যলোক প্রাপ্য হয় না। অতএব দুর্মতি! অস্ত্রাঘাত দ্বারা তোর মৃত্যু হওয়া উচিত নয়।” ক্রুদ্ধ অশ্বত্থামা এই কথা বলতে বলতে সিংহ যেমন মত্তহস্তীকে আঘাত করে, সেইরকম অতি দারুণ চরণের গোড়ালিদ্বারা ধৃষ্টদ্যুম্নের সমস্ত মর্মস্থানে তীব্র আঘাত করতে লাগলেন। অশ্বত্থামার প্রচণ্ড প্রহারে এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের আর্তনাদে সেই গৃহের স্ত্রীলোকেরা এবং যারা রক্ষক ছিল, সেই পুরুষেরা জাগ্রত হলেন। অশ্বত্থামা বলপূর্বক ভীষণ আক্রমণ করেছেন দেখে সেই লোকেরা সকলেই তাঁকে অলৌকিক বিক্রমশালী কোনও ভূত স্থির করে ভয়ে কোনও কথাই বলতে পারল না। অশ্বত্থামা সেইভাবে ধৃষ্টদ্যুম্নকে যমালয়ে প্রেরণ করে, নিজের সুন্দর রথে আরোহণ করলেন।

বলবান অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নের গৃহ থেকে নির্গত হয়ে সিংহনাদে দিক সকল পূর্ণ করতে থেকে, রথারোহণ করেই পাণ্ডবপক্ষের অন্য শিবিরে গমন করলেন। মহারথ অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নের শিবির থেকে নির্গত হয়ে গেলে, রক্ষীগণ ও স্ত্রীলোকেরা আর্তনাদ করতে লাগল। ধৃষ্টদ্যুম্নের ভোগ্যরমণীরা সকলে ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিহত দেখে, অত্যন্ত শোকার্ত হয়ে রোদন করতে লাগল। তাঁদের সেই আর্তনাদে ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠরা যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হলেন— ‘এ কী এ কী’ এইরূপ বলতে লাগলেন। স্ত্রীলোকেরা অশ্বত্থামাকে দেখে, ভয়ে আকুল হয়ে, আর্তস্বরে বলতে লাগল, “তোমরা সত্বর এসো। এটা কি রাক্ষস না মানুষ— তা আমরা বুঝতে পারছি না; কিন্তু এই ব্যক্তি ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করে রথে উঠেছে।”

তারপর যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠেরা তৎক্ষণাৎ গিয়ে অশ্বত্থামাকে পরিবেষ্টন করবার উপক্রম করলেন; কিন্তু অশ্বত্থামা মহাদেবপ্রদত্ত অস্ত্রদ্বারা সকলকেই বধ করলেন। এইভাবে অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্ন ও তার অনুচরণগণকে বধ করে, একটু দূরে অগ্রসর হয়েই দেখলেন— উত্তমৌজাও শয্যার উপরে শয়ন করে নিদ্রা যাচ্ছেন। পরে অশ্বত্থামা চরণদ্বারা বলপূর্বক উত্তমৌজারও বক্ষঃস্থল এবং কণ্ঠদেশ আক্রমণ করলে, শত্রুদমনকারী উত্তমৌজা আর্তনাদ করতে লাগলেন। তখন অশ্বত্থামা তাঁকেও বধ করলেন। কোনও রাক্ষস উত্তমৌজাকে নিহত করেছে মনে করে, বিক্রমশালী যুধামন্য গদা তুলে এগিয়ে এলেন এবং অশ্বত্থামার বক্ষে ভয়ংকর আঘাত করলেন। সেই আঘাতে অশ্বত্থামা ভূতলে পতিত হলেন। তিনি যুধামন্যুকে ভূতলে নিপাতিত করে প্রহার করতে লাগলেন। যুধামন্যু হস্ত পদ সঞ্চালন করে ছটফট করতে লাগলেন এবং অশ্বত্থামা তাঁকে পশুর মতো হত্যা করলেন।

যুধামন্যুকে হত্যা করে অশ্বত্থামা ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নিদ্রিত অন্যান্য মহারথগণের দিকে বেগে যেতে লাগলেন। যজ্ঞীয় পশুগণ কম্পিত ও স্ফুরিত হতে থাকলে, ছেদনকারী লোক যেমন সেগুলিকে ছেদন করে, তেমন অশ্বত্থামাও খড়্গ ধারণ করে, স্ফুরিত ও কম্পিত লোকদের একটির পর একটি হত্যা করতে লাগলেন। অসিযুদ্ধ বিশারদ অশ্বত্থামা শিবিরের ভাগে ভাগে ভিন্ন ভিন্ন পথে বিচরণ করতে থেকে, তেমনই শিবিরের মধ্যস্থানে নিদ্রিত, পরিশ্রান্ত ও নিরস্ত্র সমস্ত যোদ্ধাকেই ক্ষণকালের মধ্যে বিনাশ করলেন। ক্রমে অশ্বত্থামার সমস্ত অঙ্গ রক্তে আপ্লুত হয়ে গেল; সেই অবস্থায় তিনি উত্তম খড়্গদ্বারা দৈবপ্রেরিত যমের মতো হস্তী, অশ্ব ও যোদ্ধাদের ছেদন করতে লাগলেন। ছিন্ন, ছিদ্যমান লোকদের অঙ্গ সঞ্চালন, খড়্গ উত্তোলন এবং খড়্গ আকর্ষণ— এই তিনটি ব্যাপারেই অশ্বত্থামার সমস্ত অঙ্গ রক্তে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল। রক্তাপ্লুতদেহ ও উজ্জ্বল খড়্গধারী যুদ্ধমান অশ্বত্থামার আকৃতিটি অতি ভীষণ ও অমানুষিক হয়ে প্রকাশ পেতে লাগল। তৎকালে যারা জাগরিত হল, তারাও অশ্বত্থামাকে দেখে মোহিত হয় পড়ল এবং পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে থেকে, অশ্বত্থামার দিকে চেয়ে ভয়ে আকুল হতে লাগল।

শত্রুহন্তা ক্ষত্রিয়েরা অশ্বত্থামার সেই আকৃতি দেখে তাঁকে রাক্ষস মনে করে, ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তখন ভীষণমূর্তি অশ্বত্থামা যমের মতো শিবিরে বিচরণ করতে লাগলেন। ক্রমে তিনি দ্রৌপদীর পুত্রগণকে ও অবশিষ্ট সোমকদের দেখতে পেলেন। দ্রৌপদীর মহারথ পুত্রগণ সেই কোলাহলে চকিত হয়ে ধনুর্ধারণ করে, ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিহত শুনেও নির্ভয়ে বাণসমূহে অশ্বত্থামার উপর প্রহার করতে লাগলেন। সেই কোলাহলে, শিখণ্ডী ও প্রভদ্রকেরা জাগ্রত হয়ে বাণদ্বারা অশ্বত্থামাকে পীড়ন করতে লাগলেন। অশ্বত্থামা দ্রৌপদীর পুত্রগণকে বাণ বর্ষণ করতে দেখে, সেই মহারথদের বধ করবার ইচ্ছায় সিংহনাদ করলেন।

ততঃ পরমসংক্রুদ্ধঃ পিতৃবধমনুস্মরণ।

অবরুহ্য রথোপস্থাত্ত্বরমাণোহভিদ্রুবে॥ সৌপ্তিক : ৯ : ৪৮॥

—“ তারপরে অশ্বত্থামা পিতার বধ স্মরণ করে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে, রথ থেকে অবতরণ করে সত্বর দ্রৌপদী-পুত্রগণের দিকে ধাবিত হলেন।” ক্রমে বলবান অশ্বত্থামা সহস্র চন্দ্রচিহ্ন সমন্বিত ঢাল ও স্বর্ণখচিত বিশাল তরবারি উত্তোলন করে তাঁদের দিকে ধাবিত হলেন। তিনি তরবারিদ্বারা প্রতিবিন্ধ্যের উদরদেশে আঘাত করলে, তিনি নিহত হয়ে পতিত হলেন। প্রতাপশালী সুতসোম প্রাস দ্বারা অশ্বত্থামাকে বিদ্ধ করে তরবারি উত্তোলন করে অশ্বত্থামার দিকে অগ্রসর হলেন। অশ্বত্থামা তরবারি দ্বারা সুতসোমের তরবারিযুক্ত দক্ষিণবাহু ছেদন করলেন এবং তাঁর হৃদয়ের পাশে আঘাত করলেন। সুতসোম বিদীর্ণহৃদয় হয়ে পতিত হলেন। পরে নকুলপুত্র বলবান শতানীক দু’হাতে একটি বিরাট রথের চাকা তুলে অশ্বত্থামার বুকে আঘাত করলেন। অশ্বত্থামা তাঁকে প্রহার করলেন। শতানীক বিহ্বল হয়ে ভূতলে পতিত হলে অশ্বত্থামা তাঁর মস্তক ছেদন করলেন। শ্রুতকর্মা একটি পরিঘ ধারণ করে বেগে গিয়ে অশ্বত্থামার চর্মফলকযুক্ত বাম হাতে আঘাত করলেন। অশ্বত্থামা উত্তম তরবারি দ্বারা শ্রুতকর্মার মুখদেশে আঘাত করলেন। শ্রুতকর্মা বিকৃত মুখ, অচেতন ও নিহত হয়ে ভূতলে পতিত হলেন। শ্রুতকর্মার আর্তনাদ শুনে বীর ও মহারথ শ্রুতকীর্তি এসে বাণবর্ষণ করে অশ্বত্থামাকে পীড়ন করতে লাগলেন। অশ্বত্থামা ঢাল দিয়ে শ্রুতকীর্তির সমস্ত বাণ নিবারণ করে তরবারির আঘাতে তাঁর কুণ্ডলযুক্ত সুন্দর মস্তকটি ছেদন করলেন। তারপর বলবান অশ্বত্থামা নানাবিধ অস্ত্র দ্বারা সমস্ত প্রভদ্রকের সঙ্গে শিখণ্ডীকে প্রহার করতে লাগলেন। একটি বাণ দ্বারা তাঁর ভ্রূযুগলের মধ্যে আঘাত করে ক্রুদ্ধ অশ্বত্থামা শিখণ্ডীকে দুইভাগে ছেদন করলেন।

এরপর অশ্বত্থামা দেখে দেখে দ্রুপদপুত্র, পৌত্র ও সুহৃদগণকে নির্বিচারে বধ করতে লাগলেন। অসি দ্বারা অশ্বত্থামা নিকটে আগত পুরুষদের ছেদন করতে লাগলেন। মৃত্যু সময়ে সেই পুরুষেরা দেখল, রক্তবদনা, রক্তনয়না, রক্তমাল্যা, রক্তানুলেপনা, রক্তবসনা, পাশহস্তা, অনেক সহচরী যুক্তা ও কালরাত্রিস্বরূপা এক কালীমূর্তি অশ্ব ও মনুষ্যগণকে বন্ধন করে নিয়ে যাচ্ছে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আরম্ভের পর লোকেরা এই নারীকে স্বপ্নে দেখত। কালপ্রেরিত অশ্বথামা তরবারি দ্বারা কারও চরণযুগল, কারও জঘনদেশ, কারও পার্শ্বদেশ ছিন্ন করতে লাগলেন। অতিভীষণভাবে বহু পুরুষকে ভূতলে নিষ্পেষণ করতে লাগলেন। কতকগুলি লোক হস্তী ও অশ্বের পদাঘাতে মথিত হতে লাগল। কিছু যোদ্ধা যুদ্ধসজ্জায় প্রস্তুত হচ্ছিলেন। অশ্বত্থামা নির্বিচারে তাঁদের হত্যা করলেন। অশ্বত্থামা শিবিরের সমস্ত জীবিত ব্যক্তিকে হত্যা করতে লাগলেন। তখন মাংসভোজী প্রাণীরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে শিবিরে প্রবেশ করতে আরম্ভ করল। নিরস্ত্র, বাহনশূন্য, বর্মবিহীন অসংখ্য মানুষ শিবিরের দ্বারের দিকে ছুটে গেল। সেখানে কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা খড়্গাঘাতে তাঁদের বধ করতে লাগলেন। কৃপাচার্য ও কৃতবর্মা অশ্বত্থামার প্রিয় কার্য করবার জন্য শিবিরের তিনটি স্থানে আগুন লাগিয়ে দিলেন। শিবির আলোকময় হয়ে উঠলে আনন্দকারী অশ্বত্থামা শিক্ষিতহস্ত ঐন্দ্রজালিকের মতো প্রত্যেকটি মানুষকে প্রাণহীন করতে লাগলেন।

তখন দেখা গেল— নানাবিধ পিশাচ ও রাক্ষসেরা শিবিরে প্রবেশ করে নরমাংস ও রক্তপান করছে। সেই রাক্ষসেরা রক্তপান করে আনন্দিত হয়ে দলে দলে বিকট নৃত্য করতে লাগল এবং বলতে থাকল—‘এটা উৎকৃষ্ট, এটা পবিত্র, এটা সুস্বাদু,’ সমস্ত শিবির রাক্ষসে পূর্ণ হয়ে গেল। অশ্বত্থামা নিজের প্রতিজ্ঞা অনুসারে সেই কার্য শেষ করে, দুর্গম পথ দিয়ে বাইরে যেতে যেতে পিতার সম্বন্ধে শোকসন্তাপশূন্য হলেন। শিবির থেকে বাইরে এসে অশ্বত্থামা কৃপাচার্য ও কৃতবর্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে, আনন্দের সঙ্গে সেই সমস্ত কার্য পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করতে লাগলেন। অশ্বত্থামা বললেন, “আর বিলম্ব করব না। চলুন যাই, আমাদের রাজা দুর্যোধন যদি জীবিত থাকেন, তবে তাঁর নিকট এই প্রিয় সংবাদ দিই।” দুর্যোধন তখনও জীবিত ছিলেন। তিনি এই বিবরণ শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে, অশ্বত্থামার ভূয়সী প্রশংসা করে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

*

মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারতে সব কটি রসের পুষ্টি ঘটিয়েছেন। সৌপ্তিক পর্ব জুড়ে বীভৎস রসের সাংঘাতিক পরিবেশন। সুপ্তিমগ্ন পাঞ্চাল, পাণ্ডব, সোমকদের যেভাবে অশ্বত্থামা হত্যা করেছেন, মহাভারতের অন্য কোনও চরিত্রের পক্ষে এতখানি অমানুষিক নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, বীভৎস আচরণ করা কল্পনা করাও অসম্ভব।

অশ্বত্থামার সঙ্গে পাঠকের প্রথম পরিচয় দুধের বদলে পিটুলি গোলা খেয়ে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশের মধ্যে। দারিদ্রের মধ্যে মানুষ হয়েছিলেন অশ্বত্থামা। পিতা পরে ভীম-অর্জুনের গুরুদক্ষিণার মধ্যে দিয়ে দ্রুপদরাজার রাজ্যের অর্ধাংশ লাভ করলেও— সেই অর্ধাংশ রাজ্যে দ্রোণাচার্য যাননি। পিতামহ ভীষ্ম তাঁর জন্য অপর্যাপ্ত বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। কাজেই অর্থাভাব অশ্বত্থামার ঘুচে গিয়েছিল। অশ্বত্থামা নিজেই বলেছেন— দুর্যোধনের অপর্যাপ্ত দানে তাঁর, কৃপাচার্যের গৃহ ধনরত্নে পরিপূর্ণ।

পিতা দ্রোণাচার্য পুত্রকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তিনি চেয়েছিলেন, পুত্র পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর রূপে স্বীকৃত হোন। কিন্তু অর্জুনের সংযম, নির্লোভ গুরুভক্তি, অনুশীলন ও অধ্যবসায় অশ্বত্থামার চরিত্রে ছিল না। দ্রোণ তাঁর শ্রেষ্ঠ অস্ত্র ‘ব্রহ্মশির’ অশ্বত্থামাকে দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলেছিলেন— “তুমি কখনও সৎপথে থাকবে না।”

ভীষ্ম রথী-মহারথ-অতিরথ গণনাকালে বলেছিলেন— “দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা মহারথ, কিন্তু একটি মহাদোষের জন্য আমি তাঁকে রথী বা অতিরথ মনে করতে পারি না। ইনি নিজের জীবন অত্যন্ত প্রিয় জ্ঞান করেন, নতুবা ইনি অদ্বিতীয় বীর হতেন।” অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে অশ্বত্থামা পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রুদ্ধ যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, “পুরুষব্যাঘ্র, তোমার প্রীতি নেই, কৃতজ্ঞতাও নেই, তুমি আমাকেই বধ করতে চাইছ। ব্রাহ্মণের কার্য তপ দান ও অধ্যয়ন, তুমি নিকৃষ্ট ব্রাহ্মণ, তাই ক্ষত্রিয়ের কার্য করছ।” অশ্বত্থামা একটু হাসলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের অনুযোগ ন্যায্য ও সত্য জেনে কোনও উত্তর দিলেন না।

অশ্বত্থামা সত্যই নিকৃষ্ট ব্রাহ্মণ ছিলেন। পিতা দ্রোণাচার্য ও মাতুল কৃপাচার্যও ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি অবলম্বন করেছিলেন। পিতার ভয়ংকর মৃত্যুর পর তাঁর নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগ, (যা কৃষ্ণের পরামর্শে যোদ্ধাদের অস্ত্রত্যাগে ব্যর্থ হল) যদিবা মেনে নেওয়া যায়, দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের পর সুপ্ত পাণ্ডব, পাঞ্চাল, সোমকদের নির্মম হত্যা কখনও মেনে নেওয়া যায় না। ঊরুভঙ্গের জন্য ভীমসেনকে দোষারোপ করা বৃথা, কারণ ঊরুভঙ্গ দুর্যোধনই আমন্ত্রণ করেছিলেন। ভ্রাতৃজায়া দ্রৌপদীকে পিতা ও গুরুজনদের সম্মুখে অনাবৃত বাম উরু দেখিয়ে দুর্যোধন ভীমসেনকে প্ররোচিত করেছিলেন। ঊরুভঙ্গ না হলে ভীমসেনের ক্ষত্রিয়ের শপথ পূর্ণ হত না।

অশ্বত্থামা এ ঘটনা জানতেন। ভূলুণ্ঠিত দুর্যোধনকে দেখে তাঁর দুঃসহ দুঃখও স্বাভাবিক। কিন্তু তার যে প্রতিশোধ অশ্বত্থামা নিয়েছিলেন, তা কোনও সুস্থ ব্যক্তির পক্ষে উচিত নয়। কৃপাচার্য তাঁকে বারবার বলেছেন— এ ভাবে নিদ্রিত ব্যক্তিদের হত্যা করলে, ভবিষ্যতের মানুষের কাছে সে চিরনিন্দার পাত্র হবে, কোনও স্বর্গলাভ সে করতে পারবে না। অশ্বত্থামা গ্রাহ্য করেননি।

শিবিরের মধ্যে প্রবেশ করে অশ্বত্থামা যে পৈশাচিক, তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিলেন তা কল্পনা করাও যায় না। তা আনন্দবর্ধন করেছিল পিশাচ ও রাক্ষসদের। তাঁর কর্মের মাধ্যমে তিনি আমন্ত্রণ করেছিলেন রাক্ষস ও পিশাচদের। ব্যাসদেব বর্ণনা দিয়েছিলেন, “রাক্ষসগণের মধ্যে অনেকের বিকটমূর্তি, অনেকের পিঙ্গলবর্ণ, অনেকের ভীষণ আকার, অনেকের দন্ত সকল পর্বতের মতো বৃহৎ বৃহৎ, অনেকের অঙ্গ ধূলিধূসর, অনেকের মস্তকে জটা, অনেকের ঊরুযুগল দীর্ঘ, কতগুলির পাঁচখানা করে পা, কতগুলির উদর বৃহৎ, কতগুলির অঙ্গুলি সকল পশ্চান্মুখ, কতগুলির আকৃতি রুক্ষ, কতগুলির আকার বিকৃত, কতগুলির কণ্ঠস্বর ভীষণ, কতগুলির কটিদেশে কিঙ্কিণীর মালা, কতগুলির কণ্ঠদেশ নীলবর্ণ এবং কতগুলির পুত্র ও কলত্রদের সঙ্গে মিলিত, সকলেই অতিভীষণ, অতিনৃশংস, অতিদুর্দৃশ্য ও অতিনির্দয় ছিল। সেই রাক্ষসেরা রক্তপান করে আনন্দিত হয়ে দলে দলে বিকট নৃত্য করতে লাগল এবং অন্য রাক্ষসেরা বলতে থাকল—“এটি উৎকৃষ্ট, এটি পবিত্র, এবং এটি সুস্বাদু।”

রুদ্রাংশে জাত অশ্বত্থামা। মহাভারতের বিশাল পরিসরেও সৃষ্টিধর্মী কোনও কাজ তিনি করেননি। সত্য, তিনি দুর্যোধনকে একবার সন্ধি করার কথা বলেছিলেন, কিন্তু তা কর্ণের আসন্ন মৃত্যুদর্শন করেই, কৌরব-পক্ষের সুনিশ্চিত পরাজয় প্রত্যক্ষ করেই। তিনি দুষ্ট-চতুষ্টয়ের অন্তর্গত ছিলেন না, কিন্তু তার সহায়ক শক্তি ছিলেন। পিতা ও মাতুলের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁদের অসম্মান দেখলে প্রতিবাদও করেছেন। কিন্তু অশ্বত্থামার মধ্যে কোনও কল্যাণধর্মিতা ছিল না।

সৌপ্তিক পর্বের শেষে দেখা যায় যে, গান্ধারীর যে অবস্থা, দ্রৌপদীরও সেই অবস্থা। গান্ধারীর পুত্রেরা দোষী ছিল, পাপী ছিল। কিন্তু দ্রৌপদীর পুত্রেরা নির্দোষ ছিল। ব্যাসদেব দেখালেন যে, এই ধরনের বিশ্বক্ষয়ী যুদ্ধের পরিণাম এরকমই হয়। ভালমন্দ সব একাকার হয়ে যায়। আঠারো অক্ষৌহিণী সৈন্যের মধ্যে দশজন মাত্র অবশিষ্ট রইলেন। কৌরবপক্ষে তিনজন—কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা, আর পাণ্ডবপক্ষে সাতজন, পঞ্চ-পাণ্ডব, কৃষ্ণ আর সাত্যকি। এ ছাড়া জীবিত রইলেন ধৃতরাষ্ট্রের বৈশ্যা স্ত্রীর গর্ভজাত যুযুৎসু, সম্ভবত পিণ্ডদানের প্রয়োজনেই। যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠিরের উক্তি কী ভীষণ সত্য হয়ে দাঁড়াল— “তারাও জয়লাভ করল না, আমাদেরও জয়লাভ করতে দিল না। তারা পরাজিত হয়েও জয়ী হল, আমরা জয়ী হয়েও পরাজিত হলাম।”

৮৮
দ্রৌপদীর প্রায়োপবেশন

সুপ্তিমগ্ন শিবিরে নিদ্রিত পাণ্ডব-পাঞ্চাল-সোমকদের নির্বিচারে হত্যা করলেন অশ্বত্থামা। শিবিরে ধৃষ্টদ্যুম্নের সারথি ভিন্ন অন্য কোনও ব্যক্তিই জীবিত রইলেন না। রাত্রি প্রভাত হলে, ধৃষ্টদ্যুম্নের সারথি গিয়ে—অশ্বত্থামা নিদ্রিত অবস্থায় সৈন্যগণের যে মহামারী ঘটিয়েছিলেন, তা যুধিষ্ঠিরের কাছে বলল। সেই সারথি বলল, “রাজা! দ্রৌপদীর পুত্রেরা দ্রুপদের পুত্রগণের সঙ্গে রাত্রিতে নিজ নিজ শিবিরে অসাবধান অবস্থায় ও নিরুদ্বেগে নিদ্রা যাচ্ছিলেন, তখন অশ্বত্থামা গিয়ে তাঁদের সকলকেই বধ করেছেন। নৃশংস ও পাপাত্মা কৃপ, কৃতবর্মা এবং অশ্বত্থামা রাত্রিতে আপনার শিবিরটাই বিধ্বস্ত করেছেন। প্রাস, শক্তি ও পরশুদ্বারা সেই তিন মহারথী সহস্র সহস্র রথী, অশ্ব ও মনুষ্যকে ছেদন করে আপনার সমস্ত সৈন্য নিঃশেষ করেছেন। সারা রাত্রি শিবিরে বিশাল আর্তনাদ ভিন্ন অন্য কোনও শব্দ ছিল না। ধর্মাত্মা রাজা! কৃতবর্মা যখন অন্যান্য সৈন্য সংহারে ব্যাপৃত ছিলেন, সেই সময়ে আমি তাঁর কাছে গিয়ে কোনও প্রকারে মুক্ত হয়ে এসেছি।”

তচ্ছ্রুত্বা বাক্যমশিবং কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ।

পপাত মহ্যাং দুর্দ্ধর্ষঃ পুত্রশোক সমন্বিতঃ ॥ সৌপ্তিক : ১১ : ৭ ॥

— “কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির দুর্ধর্ষ হলেও সেই অমঙ্গলময় বাক্য শুনে, পুত্রশোকে আকুল হয়ে, ভূতলে পতিত হতে থাকলেন।”

তিনি পতিত হতে থাকলে সাত্যকি, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব লাফিয়ে গিয়ে তাঁকে ধরলেন। পরে যুধিষ্ঠির কিঞ্চিৎ চিত্তস্থির হয়ে পূর্বে জয় করেও পরে পরাজিত হওয়ায় আকুলের মতো শোকবিহ্বল বাক্যে বিলাপ করতে লাগলেন, “যাঁরা দিব্য চক্ষু, তাঁদের পক্ষেও পদার্থের গতি বোঝা দুষ্কর। হায়! অন্য লোকেরা পরাজিত হয়েও জয়লাভ করে, আর আমরা জয় করেও পরাজিত হলাম। আমরা ভ্রাতৃগণ, বয়স্যগণ, পিতৃগণ, পুত্রগণ, সুহৃদগণ, অমাত্যগণ ও পৌত্রগণকে বধ করে এবং সকলকে জয় করে, পরিশেষে পরাজিত হলাম। দৈববশত প্রাণীগণের পক্ষে কোনও সময়ে অনিষ্টও বাস্তবিক ইচ্ছাস্বরূপ হয়ে থাকে; আবার কোনও সময়ে অনিষ্টকে ইষ্টের মতো দেখা যায়। আমাদের এই জয়টা অজয়ের মতোই হয়েছে; সুতরাং আমাদের এই জয় পরাজয়ই। দুর্বুদ্ধি মানুষ যে জয়লাভ করে পরে বিপদাপন্ন-এর মতো অনুতপ্ত হয়, সে জয়কে কী করে জয় বলে সে মনে করে। কারণ তার পরে শত্রুরা তাকে গুরুতরভাবে জয় করে। জয়লাভের জন্য সুহৃদ বধ করায় যাদের পাপ হয়, তারা জয়লক্ষ্মী লাভ করেও পরাজিত ও অবহিত শত্রুগণ দ্বারা পুনরায় পরাজিত হয়।

“কর্ণি ও নালীক প্রভৃতি বাণসমূহ যার দন্তশ্রেণিতুল্য, খড়্গ যার জিহ্বার মতো, আকৃষ্ট ধনু যার প্রকটিত মুখের তুল্য এবং ধনুর গুণ ও হস্তাবরণের শব্দ যার গর্জনের মতো ছিল, সেই সিংহতুল্য ক্রুদ্ধ ও ভীষণ, যুদ্ধে অপলায়ী কর্ণের হাত থেকে যারা মুক্তি পেয়েছিল, আজ তারা অনবধানবশত নিহত হয়েছে। রথ— যার গর্ত, বাণবর্ষণ— যার তরঙ্গ, বাহনগুলি— যার জলাশ্ব, শক্তি ও ঋষ্টি যার মৎস্য, ধ্বজ যার সর্প ও জলজন্তু, ধনু যার আবর্ত, বিশাল বাণ—যার ফেনা, যুদ্ধরূপ চন্দ্রের বেগ— যার জোয়ার এবং ধনুর গুণ। হস্তাবরণ ও রথচক্রের শব্দই যার গর্জন স্বরূপ ছিল, সেই রত্ন পরিপূর্ণ দ্রোণরূপ সমুদ্রকে যারা নানাবিধ অস্ত্ররূপ নৌকা দ্বারা অতিক্রম করেছিলেন, সেই রাজপুত্রেরা অনবধানতাবশত আজ নিহত হয়েছেন। এই জীবলোকে অনবধানতাবশত মৃত্যু ভিন্ন মানুষের বিনাশের অন্য কোনও প্রধান কারণ নেই। কারণ, সমস্ত অভীষ্ট বিষয়ই অসাবধান লোককে পরিত্যাগ করে এবং সমস্ত অনর্থ এসে তাকে আশ্রয় করে।

“উত্তমধ্বজের উপরে পতাকারূপ যার ধূম, বাণ যার শিখা, ক্রোধ যার প্রবল বায়ু, বিশাল ধনুর গুণ, হস্তাবরণ ও চক্রপ্রান্তের শব্দ যার রব, বর্ম ও নানাবিধ অস্ত্র যার আহুতি এবং যা বিশাল সৈন্যরূপ শুষ্কতৃণবর্ণে লগ্ন হত, সেই ভীষ্মস্বরূপ মহাদাবানলকে যাঁরা মহাযুদ্ধে নানাবিধ অস্ত্রদ্বারা অতিক্রম করেছিলেন, সেই রাজপুত্রেরাই অনবধানতাবশত নিহত হয়েছেন। অসাবধান মানুষ ধন, শোভা কিংবা বিপুল যশ লাভ করতে পারেন না। দেখো— ইন্দ্র সাবধানতাবশতই সমস্ত শত্রুকে সংহার করে অনায়াসে সমৃদ্ধি লাভ করেছেন। আরও দেখো, ইন্দ্রের তুল্য রাজপুত্র ও রাজপৌত্রেরা অনবধানতাবশতই অ-বিশেষভাবে আমাদের শিবিরে নিহত হয়েছেন। অতএব সমৃদ্ধি-সম্পন্ন বণিকেরা সমুদ্র অতিক্রম করে এসে অসাবধানতাবশত যেমন ক্ষুদ্র নদীতে মগ্ন হয়, আমাদের সেই যোদ্ধারা ভীষ্ম প্রভৃতির হাত থেকে মুক্ত হয়ে আজ ক্ষুদ্র অশ্বত্থামার হাতে নিহত হয়েছেন।

“ক্রুদ্ধ শত্রুরা যে সকল নিদ্রিত ব্যক্তিকে নিহত করেছে তারা স্বর্গেই গিয়েছে, সুতরাং তাদের জন্য শোক করা উচিত নয়। কিন্তু আমি দ্রৌপদীর জন্যই শোক করছি। কেন না সেই সাধ্বী আজ কী করে এই শোকসাগর সহ্য করবেন। ভ্রাতৃগণ, পুত্রগণ এবং বৃদ্ধ-দ্রুপদরাজাকে নিহত শুনে শোকে ক্ষীণ ও অচেতন হয়ে দ্রৌপদী নিশ্চয়ই আজ ভূতলে পতিত হয়ে শয়ন করবেন। সুখভোগ অভ্যস্তা দ্রৌপদী অগ্নির মতো পুত্র ও ভ্রাতৃগণের বিনাশ শোকে আকুল হয়ে, সেই শোক দুঃখ সহ্য করতে না পেরে তাঁর আজ কী অবস্থা হবে ? কুরুরাজ যুধিষ্ঠির শোকার্ত হয়ে এরূপ বিলাপ করতে থেকে নকুলকে বললেন, “নকুল তুমি যাও, মাতৃগণের সঙ্গে মন্দভাগা দ্রৌপদীকে এইখানে নিয়ে এসো।”

ধর্মের গুণে ধর্মদেবের তুল্য যুধিষ্ঠিরের এই আদেশ গ্রহণ করে নকুল—যে স্থানে দ্রুপদরাজার ভার্যারা অবস্থান করছিলেন, সেই দ্রৌপদীর ভবনে গমন করলেন। যুধিষ্ঠির নকুলকে পাঠিয়ে, বন্ধুগণের সঙ্গে মিলিত ও শোকার্ত হয়ে, গুরুতর আর্তনাদ করতে থেকে, জন্তুগণে পরিপূর্ণ পুত্রদের সংহারস্থানে প্রবেশ করলেন। যুধিষ্ঠির সেই অমঙ্গলময় ও ভীষণ শিবিরে প্রবেশ করে দেখলেন—পুত্রগণ, সুহৃদগণ ও সখাগণ ভূতলে শয়ন করে আছে, তাদের সকলের দেহই অস্ত্রাঘাতে ছিন্নভিন্ন ও রক্তাক্ত এবং জন্তুগণ অনেকের মস্তক অপহরণ করেছে। ধার্মিকশ্রেষ্ঠ ও কৌরব প্রধান যুধিষ্ঠির তাদের দেখে অত্যন্ত শোকার্ত হয়ে তাদের উচ্চ স্বরে ডাকতে থেকে অচেতন হয়ে, পরিজনগণের সঙ্গে ভূতলে পতিত হলেন। মহাত্মা যুধিষ্ঠির সেই সময়ে পুত্র, পৌত্র, ভ্রাতা ও স্বজনদের স্মরণ করতে থাকায় তাঁর গুরুতর শোক উপস্থিত হল। তিনি অশ্রুজলে পরিপূর্ণ ও কম্পিত কলেবর হয়ে অচেতনপ্রায় হলে সুহৃদগণ অত্যন্ত অস্থির হয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। সেই সময়ে নকুল বেগবান ও স্বর্ণমালাংকৃত অশ্বগণের গুণে অত্যন্ত দুঃখিত দ্রৌপদীর সঙ্গে সত্বর সেই স্থানে উপস্থিত হলেন। দ্রৌপদী সেই যুদ্ধের সময় বিরাটরাজার উপপ্লব্য নগরে ছিলেন। সেখানে তিনি নকুলের মুখে গুরুতর অপ্রিয় সংবাদ, সমস্ত পুত্রেরই নিধনবৃত্তান্ত শুনে শোকাকুল হয়েছিলেন। ক্রমে শোকার্তা দ্রৌপদী বায়ুসঞ্চালিত কদলী-স্তম্ভের মতো কাঁপতে কাঁপতে যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে ভূতলে পতিত হলেন। প্রস্ফুটিত পদ্মপলাশনয়না দ্রৌপদীর মুখখানি শোকে রাহুগ্রস্ত চন্দ্রের মতো মলিন হয়ে গেল। তারপর দ্রৌপদীকে পতিত দেখে, কোপন স্বভাব ও যথার্থ বিক্রমশালী ভীমসেন লাফ দিয়ে বাহুযুগল দ্বারা তাঁকে ধারণ করলেন।

ক্রমে ভীমসেন আশ্বস্ত করলে, দ্রৌপদী রোদন করতে থেকে বিশেষ অভিপ্রায়ে যুধিষ্ঠিরকে বলতে থাকলেন, “রাজা! আপনি ক্ষত্রিয় ধর্ম অনুসারে পুত্রদের যমকে দিয়ে, ভাগ্যবশত সমগ্র পৃথিবী লাভ করে ভোগ করতে থাকবেন। পৃথানন্দন, আপনি ভাগ্যবশত অক্ষতদেহে থেকে সমগ্র পৃথিবী লাভ করে অভিমন্যুকে আর স্মরণ করবেন না। আপনি ক্ষত্রিয়ধর্মানুসারে পুত্রগণকে নিপাতিত শুনেও ভাগ্যবশত উপপ্লব্য নগরে আমার সঙ্গে তাঁদের আর স্মরণ করবেন না। পৃথানন্দন, পাপকারী অশ্বত্থামা নিদ্রিত ব্যক্তিদের বধ করেছে শুনে অগ্নি যেমন আপন আশ্রয়কে দগ্ধ করে, সেইরূপ শোক আমাকে দগ্ধ করেছে। অতএব অদ্য আপনি যদি বিক্রম প্রকাশ করে যুদ্ধে সেই পাপকারী অশ্বত্থামার জীবন হরণ না করেন এবং অশ্বত্থামা যদি সেই পাপকার্যের ফলভোগ না করে, তা হলে আমি এই স্থানেই প্রায়োপবেশনে জীবন শেষ করব। পাণ্ডবগণ আপনারা আমার এই প্রতিজ্ঞা অবগত হবেন।”

পাণ্ডুনন্দন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বলে শোচনীয়া দ্রৌপদী সেই স্থানেই প্রায়োপবেশনে বসলেন। তখন চারুদর্শনা প্রিয়মহিষী দ্রৌপদীকে প্রায়োপবিষ্ট দেখে, ধর্মাত্মা রাজর্ষি যুধিষ্ঠির তাঁকে বললেন, “শুভে ধৰ্মজ্ঞে! তোমার পুত্রেরা ও ভ্রাতারা ক্ষত্রিয় নিয়মানুসারে ধর্মসঙ্গতে নিধন প্রাপ্ত হয়েছেন। সুতরাং তুমি তাঁদের জন্য আর শোক করতে পার না। কল্যাণী অশ্বত্থামা এ স্থান ছেড়ে দূরবর্তী ও দুর্গম বনমধ্যে গিয়ে প্রবেশ করেছে; অতএব এ স্থানে থেকে তুমি তার নিপাত কেমন করে দেখবে?” দ্রৌপদী বললেন, “রাজা আমি শুনেছি যে—জন্মাবধি অশ্বত্থামার মাথায় একটি মণি রয়েছে; আপনি সেই পাপাত্মাকে বধ করে সেই মণিটি মস্তকে ধারণপূর্বক নিয়ে আসবেন। আমি মণিটি দেখব, তা হলে জীবন ধারণ করতে পারব।”

চারুদর্শনা দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে এ কথা বলে ভীমসেনের কাছে গিয়ে উত্তম বাক্যে বললেন, “মধ্যমপাণ্ডব, আপনি ক্ষত্রিয়ধর্ম স্মরণ করে আমাকে রক্ষা করুন। ইন্দ্র যেমন শম্বরাসুরকে বধ করেছিলেন, আপনি সেই পাপকর্মা অশ্বত্থামাকে বধ করুন। সাধারণ অবস্থায় অথবা মহাবিপদের সময়ে বিক্রম প্রকাশের পক্ষে আপনার তুল্য কোনও পুরুষ নেই, সারা পৃথিবীতে একথা প্রসিদ্ধ। বারণাবতে জতুগৃহ দাহের সময় আপনি পাণ্ডবদের আশ্রয় হয়েছিলেন; হিড়িম্ব রাক্ষসের আক্রমণ থেকে আপনি পাণ্ডবদের রক্ষা করেছিলেন। ইন্দ্র যেমন শচী দেবীকে অসুর-সংকট থেকে মুক্ত করেছিলেন, তেমনই আপনি বিরাটনগরে কীচকের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেন। পূর্বের ন্যায় আমাকে রক্ষা করুন, অশ্বত্থামাকে বধ করুন।”

কুন্তীনন্দন ভীমসেন দ্রৌপদীর সেই বাক্য অসহ্য বিবেচনা করে তখনই নকুলকে সারথি করে বিশাল বাণযুক্ত এবং সুন্দর ধনুযুক্ত রথে আরোহণ করে নকুলকে রথ চালাতে আদেশ করলেন। ভীমসেনের রথ চলে গেলে যদুবংশশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “পাণ্ডুনন্দন! ভীমসেন আপনার সকল ভ্রাতার মধ্যে প্রিয়। তিনি বিপন্ন হতে চলেছেন; আপনি তাঁকে সাহায্য করছেন না কেন। দ্রোণাচার্য প্রদত্ত বিশ্বজয়ী ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র এখনও অশ্বথামার কাছে আছে।” কৃষ্ণের কথা শুনে যুধিষ্ঠির তৎক্ষণাৎ কৃষ্ণ ও অর্জুনকে নিয়ে আর এক রথে ভীমকে অনুসরণ করলেন। দ্রৌপদীর রক্ষকের ভূমিকা পালন করার জন্য তাঁরা সহদেবকে রেখে গেলেন।

*

ধৃতরাষ্ট্র দ্রৌপদী সম্পর্কে বলেছিলেন, “নাথবৎ অনাথবতীম্”, স্বামী থাকতেও অনাথার মতো। এর থেকে সত্য কথা দ্রৌপদী সম্পর্কে আর হয় না। তাঁর স্বামী ছিল, সুস্থ সবল, একটি নয়, ব্যাঘ্রের মতো পাঁচটি স্বামী। স্বামীরা ত্রিভুবন জয়ী ছিলেন। তবুও দ্রৌপদীকে সারাজীবন অনাথার মতো কাটিয়ে যেতে হল। সুখ শব্দটাই দ্রৌপদীর ললাটে লিখে দিতে ভুলে গিয়েছিলেন বিধাতা। আদিকবির কাহিনির নায়িকার সঙ্গে ব্যাসদেবের নায়িকার মিল যতটা অমিলও প্রায় ততটাই। দু’জনের জন্মই অলৌকিক, দু’জনেই অযোনিজা। একজনের জন্ম জমি কর্ষণকালে লাঙ্গলের ফলায়, অন্যজন যজ্ঞবেদি সমুত্থিতা। একজন দেবী লক্ষ্মীর অংশজাতা—অন্যজন ইন্দ্রাণী শচীর অংশজাতা। দু’জনেরই বিবাহ ধনু সম্পর্কিত বিবাহ। দু’জনই রাজ্যসুখ ত্যাগ করে বনবাসিনী হয়েছিলেন। দু’জনেই স্বামী ভিন্ন অপর পুরুষের লালসার সম্মুখীন হয়েছিলেন। দু’জনেরই মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যুশয্যায় ঘটেনি।

কিন্তু অমিলও অনেক। পুরুষের সভায় যে লাঞ্ছনা দ্রৌপদীকে ভোগ করতে হয়েছে, সীতাকে তেমন কিছু ভোগ করতে হয়নি। শাশুড়ির সামনে দিয়ে, তাঁর নিষেধকে উপেক্ষা করে, কেশাকর্ষণ করে, রজস্বলা একবস্ত্রা অবস্থায় দুঃশাসন দ্রৌপদীকে পুরুষের সভায় টেনে নিয়ে যান। সেখানে শ্বশুর ও গুরুজনদের সামনে তাঁকে নগ্না করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাঁকে কুৎসিত কথা বলা হয়েছে, কুৎসিত ইঙ্গিত করা হয়েছে। দ্রৌপদীকে একাধিক সপত্নী নিয়ে ঘর করতে হয়েছে। দ্রৌপদী মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত স্বামীদের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু সীতার ভাগ্যে তা সয়নি, তাঁকে ধরণীগর্ভে স্থান নিতে হয়েছিল।

তা সত্ত্বেও দ্রৌপদীর জীবনের যন্ত্রণা অনেক বেশি মনে হয়। দ্রৌপদী অনেক সবলা ছিলেন। অন্য পুরুষ স্পর্শ করলে সীতা মাতাধরণীর আশ্রয় প্রার্থনা করতেন, দ্রৌপদী তাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিতেন। পঞ্চপুত্রের জননী দ্রৌপদী, পিতামহ ভীষ্ম গণনাকালে যাঁদের মহারথ বলেছিলেন। সেই পাঁচটি পুত্রকেই অশ্বত্থামা নিদ্রিত অবস্থায় হত্যা করলেন। পুত্রহারা দ্রৌপদী গান্ধারীর অবস্থা প্রাপ্ত হলেন। এ যন্ত্রণার্ত অবস্থা সীতাকে সহ্য করতে হয়নি।

স্বামী দ্বিতীয়বার পরীক্ষা নিতে চাইলে, সীতা আত্মবিলুপ্তির আকাঙ্খা করেছিলেন। দ্রৌপদী ক্ষত্রিয়া রমণী। তিনি আত্মবিলুপ্তি চাননি। পুত্ৰ-হত্যাকারীর মৃত্যু চেয়েছিলেন। বীরজায়া, বীরজননী দ্রৌপদী। কারও কাছে তিনি ভিক্ষা করেননি। দাবি করেছেন। সেই দাবির মধ্যে তাঁর মর্যাদাবোধ, রাজকীয় বিচার ও সম্ভ্রান্ত প্রত্যাশা ফুটে ওঠে। তাই পঞ্চ-স্বামীর ঘরনি হওয়া সত্ত্বেও ঋষিরা তাঁকে প্রাতঃস্মরণীয়া পঞ্চকন্যার মধ্যে স্থান দিয়েছেন, যেমন দিয়েছেন তাঁর শাশুড়ি কুন্তীকে, তিনি পঞ্চ-পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হওয়া সত্ত্বেও।

৮৯
ব্রহ্মশির ও অশ্বত্থামার মণি

দ্রৌপদীর কথায় ক্রুদ্ধ ভীমসেন, নকুলকে সারথি করে অশ্বত্থামাকে বধ করতে রথারোহী হয়ে যাত্রা করলেন। কৃষ্ণ একাকী ভীমসেন যাত্রা করায় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরকে জানালেন বিপক্ষনগরজয়ী ব্রহ্মশির অস্ত্র অশ্বত্থামার কাছে আছে! সেই অস্ত্র সমগ্র পৃথিবীকে দগ্ধ করতে পারে। দ্রোণাচার্য এই অস্ত্র অশ্বত্থামা ভিন্ন তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয়শিষ্য অর্জুনকে দিয়েছিলেন। এই দু’জন ছাড়া এই অস্ত্র পৃথিবীতে কোনও তৃতীয় ব্যক্তির কাছে নেই।* অশ্বত্থামাকে ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র দ্রোণাচার্য আনন্দিত চিত্তে দেননি। অশ্বত্থামাকে স্বভাবের চাঞ্চল্য পিতা এবং গুরু দ্রোণাচার্য জানতেন। ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র শিক্ষাদানের পর সর্বধর্মজ্ঞ দ্রোণ, পুত্রকে এই উপদেশ দিয়েছিলেন, “বৎস! তুমি যুদ্ধে অত্যন্ত আক্রান্ত হলেও এই অস্ত্র প্রয়োগ কোরো না। বিশেষত মানুষের উপর কখনও না।” দ্রোণাচার্য অশ্বত্থামাকে প্রথমে এই কথা বলে পরে বললেন, “তুমি কখনও সৎপথে থাকবে না।”

খলস্বভাব অশ্বত্থামা পিতার এই অপ্রিয় বাক্য শ্রবণ করে, নিজের সর্ববিধ অভীষ্ট সম্পাদনে নিরাশ হয়ে শোকে পৃথিবী বিচরণ করতে থাকলেন। পঞ্চপাণ্ডব বনবাসী হলে, অশ্বত্থামা দ্বারকানগরে গিয়ে বৃষ্ণিবংশীয়দের বিশেষ আদর যত্ন পেয়ে সেখানে বাস করতে থাকলেন। তারপর কোনও এক সময়ে সমুদ্রের কাছে দ্বারকানগরীর ভিতরে একা কৃষ্ণের কাছে গিয়ে হাসতে হাসতেই বললেন, “কৃষ্ণ ভরতবংশীয়গণের গুরু আমার পিতৃদেব মহর্ষি অগস্ত্যের কাছ থেকে যে অস্ত্র লাভ করেছিলেন, দেবগন্ধর্বপূজিত সেই ব্ৰহ্মশির অস্ত্র এখন আমার কাছে এসেছে। অতএব কৃষ্ণ, আমার পিতা যেমন ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র জানতেন আমারও তেমনই বিদিত হয়েছে। যদুবংশশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ, আপনি আমার কাছ থেকে সেই ব্ৰহ্মশির অস্ত্র নিয়ে, আমাকে আপনার শত্রুনাশক সুদর্শনচক্রটি দান করুন।”

অশ্বত্থামা কৃতাঞ্জলি হয়ে বিশেষ যত্নপূর্বক কৃষ্ণের কাছে এই প্রার্থনা করলে কৃষ্ণ সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বললেন, “দেব, দানব, গন্ধর্ব, মনুষ্য, পক্ষী ও সর্পগণ একত্র হয়েও আমার বলের শতাংশের একাংশের তুল্য হয় না। আচার্যপুত্র, আপনি যদি আমার কাছে অস্ত্রগ্রহণ করতে ইচ্ছা করেন তা হলে আমার এই ধনু, শক্তি, চক্র এবং গদা রয়েছে, এর মধ্যে যা যা আপনি গ্রহণ করতে ইচ্ছা করেন, আপনাকে আমি তাই ফিরে দেব। আপনি যে যে অস্ত্র উত্তোলন করতে কিংবা যুদ্ধে প্রয়োগ করতে সমর্থ হন, তাই নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু আপনি যে ‘ব্রহ্মশির’ আমাকে দিতে চেয়েছেন, তা দেবার কোনও দরকার নেই।”

কৃষ্ণের সঙ্গে স্পর্ধাকারী সেই মহাবল অশ্বত্থামা তখন সুন্দর নাভিযুক্ত, বহুসংখ্যক তির্যগদণ্ড সমন্বিত, বজ্রের ন্যায় দৃঢ়, মধ্যদেশশালী এবং লৌহময় কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রটি গ্রহণ করতে চাইলেন। কৃষ্ণ তাঁকে বললেন, “আপনি চক্রটি গ্রহণ করুন।” তখন অশ্বত্থামা বেগে গিয়ে বাম হাতে সেই চক্রটি ধরলেন। সেই অবস্থায় চক্রটিকে তিনি নাড়াতেও পারলেন না, তারপর দক্ষিণ হাত দিয়ে টেনে নেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে, দু’হাতে তাকে ধরে সমস্ত বলপ্রয়োগ করেও তা তুলতে পারলেন না। অশ্বত্থামা কৃষ্ণের চক্রটিকে যখন নাড়াতেও পারলেন না, তখন অত্যন্ত দুঃখিত চিত্তে পরিশ্রান্ত অশ্বত্থামা নিবৃত্তি পেলেন।

তখন সেই অভিপ্রায় থেকে নিবৃত্ত, বিষণ্ণ ও অস্থিরচিত্ত অশ্বত্থামাকে সম্বোধন করে কৃষ্ণ বললেন, “সেই যিনি দেবলোক ও মনুষ্যলোকে মহাবীর বলে সকলেরই বিশ্বাসের পাত্র হয়েছেন। যাঁর ধনুর নাম গাণ্ডিব, অশ্বগুলি শ্বেতবর্ণ ও ধ্বজের উপর বিশাল একটা বানর রয়েছে; যিনি সাক্ষাৎ দেবদেব, ঈশ্বর, শিতিকণ্ঠ, শঙ্করকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাজয় করে সন্তুষ্ট করেছিলেন; জগতে তাঁর অপেক্ষা প্রিয় অন্য কোনও পুরুষ আমার নেই, যাঁকে অদেয় আমার স্ত্রীপুত্র পর্যন্ত নয়; ব্রাহ্মণ! অনায়াস কার্যকারী পরমসুহৃদ সেই অর্জুনও পূর্বে এরূপ বাক্য বলেননি, যা আপনি আমাকে বলেছেন।

“আমি হিমালয়ের পাশে গিয়ে দ্বাদশ বর্ষ পর্যন্ত ভয়ংকর ব্রহ্মচর্যব্রত আচরণ করে এবং গুরুতর তপস্যার অনুষ্ঠান করে যাকে লাভ করেছি এবং যিনি আমারই তুল্য ব্রতচারিণী রুক্মিণীদেবীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেছেন, সনৎকুমারের ন্যায় তেজস্বী আমার সেই পুত্রের নাম প্রদ্যুম্ন। মূঢ় ব্রাহ্মণ! আমার সেই পুত্র বিশাল, অলৌকিক ও অতুলনীয় এই চক্র প্রার্থনা করেননি; যা তুমি প্রার্থনা করলে। তুমি যা প্রার্থনা করলে মহাবল রাম, শাম্ব এবং গদও এ চক্র কোনওদিন প্রার্থনা করেননি এবং তুমি যা প্রার্থনা করলে, দ্বারকাবাসী, বৃষ্ণিবংশীয় ও অন্ধকবংশীয় মহারথেরাও পূর্বে তা প্রার্থনা করেননি। রথীশ্রেষ্ঠ বৎস, তুমি ভারতাচার্য দ্রোণের পুত্র; যদুবংশীয়েরা সকলেই তোমাকে সম্মান করে থাকেন কিন্তু তোমাকে জিজ্ঞাসা করি— তুমি এই চক্র দিয়ে কার সঙ্গে যুদ্ধ করার ইচ্ছা করো।”

কৃষ্ণ এই কথা বললে, প্রত্যুত্তরে অশ্বত্থামা বলেছিলেন, “কৃষ্ণ আমি আপনার প্রতি সম্মান দেখিয়ে, এই চক্র দিয়ে আপনারই সঙ্গে যুদ্ধ করব! প্রভু কৃষ্ণ, আমি আপনার কাছে সত্য বলছি যে— দেবদানবপূজিত আপনার এই চক্রটি আমি প্রার্থনা করেছি এই জন্য যে— এ চক্র ধারণ করে আমি সকলের অজেয় হব। কেশব এখন আপনার কাছ থেকে আমি সেই দুর্লভ অভীষ্ট বিষয় লাভ না করেই ফিরে যাব, অতএব আপনি প্রসন্নচিত্তে আমাকে অনুমতি দিন। কৃষ্ণ, মহাভয়ংকর বীর ও প্রতিচক্ৰশূন্য বলেই আপনি এই চক্ৰধারণ করতে সমর্থ হয়েছেন। কিন্তু এই পৃথিবীতে আপনি ভিন্ন অন্য কোনও পুরুষই এ চক্র ধারণ করতে সমর্থ হয় না।”

অশ্বত্থামা কৃষ্ণকে এই পর্যন্ত বলে যথাসময়ে গ্রহণ উপযোগী অশ্ব, ধন এবং নানাবিধ রত্ন নিয়ে গন্তব্যস্থানে গমন করেছিলেন। সেই অশ্বত্থামা ক্রোধী, দুষ্টচিত্ত, চঞ্চল স্বভাব ও নিষ্ঠুরহৃদয়, তাঁর কাছে ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্রও আছে। সুতরাং তাঁর হাত থেকে ভীমসেনকে রক্ষা করতে হবে।

এই বলে যদুশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ— সমস্ত উত্তম অশ্বযুক্ত উত্তম রথে আরোহণ করলেন। সেই উত্তম রথে স্বর্ণমালাধারী কম্বোজদেশীয় উত্তম চারটি অশ্ব সংযোজিত ছিল এবং অরুণবর্ণ উত্তম রথের দক্ষিণপার্শ্বের ভার শৈব্যনাম অশ্ব বহন করতে লাগল, সুগ্রীব বামদিকে থাকল। আর মেঘপুষ্প ও বলাহক তার সম্মুখভাগ বহন করতে লাগল। এই রথে বিশ্বকর্মা নির্মিত রত্ন ও ধাতুবিভূষিত একটি ধ্বজদণ্ড উত্তোলন করা হল, তা যেন কৃষ্ণেরই মায়ার মতো দৃষ্টিগোচর হতে লাগল। প্রভামণ্ডল ও কিরণসঞ্চয়শালী গরুড় এসে সেই ধ্বজের উপরে অবস্থান করলেন। ক্রমে কৃষ্ণ, সর্বধনুর্ধরশ্রেষ্ঠ অর্জুন, সত্যকর্মা যুধিষ্ঠির সেই রথে আরোহণ করলেন। তখন কৃষ্ণের উভয়পার্শ্বস্থিত মহাত্মা যুধিষ্ঠির ও অর্জুন ইন্দ্রের উভয় পার্শ্বস্থিত অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের মতো শোভা পেতে লাগলেন। কৃষ্ণ তাঁদের রথে তুলে কশাঘাত করে, বেগবান অশ্বগুলিকে সত্বর চালিয়ে দিলেন। সেই অশ্বগণ যেন উড়তে থেকেই উত্তম রথখানাকে বহন করতে লাগল। সেই নরশ্রেষ্ঠরা বেগে অনুসরণ করে ক্ষণকাল মধ্যেই মহাধনুর্ধর ভীমসেনকে ধরে ফেললেন। মহারথ কৃষ্ণ যুধিষ্ঠির ও অর্জুন উপস্থিত হয়েও ক্রোধে উত্তেজিত এবং শত্রু বিনাশের জন্য উদ্যত ভীমসেনকে নিবারণ করতে সমর্থ হলেন না। ধনুর্ধারী ও বীরশোভাশালী কৃষ্ণ প্রভৃতি দর্শন করছিলেন, এমন সময়ে ভীমসেন বেগবান অশ্বের গুণে গঙ্গাতীরে গিয়ে উপস্থিত বলেন— কেন না তিনি শুনেছিলেন যে পুত্রহন্তা অশ্বত্থামা গঙ্গাতীরে ব্যাসদেব ও অন্যান্য ঋষিগণের মধ্যে আত্মগোপন করে আছেন। ভীমসেন সেখানে অশ্বত্থামাকে দেখতে পেলেন। সে সময়ে নিষ্ঠুর কার্যকারী অশ্বত্থামা কৌপীন ধারণ করে গায়ে ঘৃত লেপন করে ধূলিধূসরদেহে তাঁদের মধ্যে উপবিষ্ট ছিলেন।

তখন মহাবাহু ভীমসেন ধনু ও বাণ গ্রহণ করে অশ্বত্থামার দিকে ধাবিত হলেন এবং ‘থাক থাক’ এই কথা বললেন। ভীষণ ধনুর্ধর ভীমসেন ধনু ধারণ করেছেন এবং তার পৃষ্ঠভাগে যুধিষ্ঠির ও অর্জুন কৃষ্ণের রথে রয়েছেন, এই দেখে অশ্বত্থামার মনে গুরুতর ভয় জন্মাল। সুতরাং তিনি মনে করলেন, “এই সময়ে এইরূপ করাই উচিত।” অকাতরচিত্ত অশ্বত্থামা তখন সেই অলৌকিক মহাস্ত্র স্মরণ করলেন এবং বামহস্ত দ্বারা একটি ইষিকা (নলখাগড়া) গ্রহণ করলেন। অলৌকিক অস্ত্রধারী সেই বীরগণকে উপস্থিত দেখে, তাঁদের সহ্য করতে পারবেন না ভেবে, বিপদাপন্ন অশ্বত্থামা অলৌকিক ব্রহ্মশির অস্ত্র নিক্ষেপ করবার ইচ্ছা করলেন। তখন তিনি ক্রোধবশত “পাণ্ডবগণের ধ্বংস হোক” এই বাক্য উচ্চারণ করে সেই ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। তখন ত্রিভুবন দগ্ধ করবে বলে যেন সেই ইষিকাতে প্রলয়কালের যমের মতো ভীষণ অগ্নিরাশি উৎপন্ন হল।

মহাবাহু কৃষ্ণ প্রথমেই অশ্বত্থামার মুখভঙ্গি প্রভৃতি দেখে তাঁর অভিপ্রায় বুঝতে পেরে অর্জুনকে বললেন, “পাণ্ডুনন্দন অর্জুন, দ্রোণ কর্তৃক উপদেশ সহকারে প্রদত্ত যে অলৌকিক অস্ত্র তোমার মনে রয়েছে, এখন সেই অস্ত্র নিক্ষেপ করার সময় হয়েছে। নিজেকে এবং ভ্রাতৃগণকে রক্ষা করার জন্য অশ্বত্থামার অস্ত্র নিবারক তোমার সেই অস্ত্র এখন নিক্ষেপ করো।” কৃষ্ণ এ কথা বললে, বিপক্ষবীরহন্তা অৰ্জুন ধনু ও বাণ ধারণ করে দ্রুত রথ থেকে নেমে এলেন। “প্রথমে অশ্বত্থামার পরে নিজের, ভ্রাতৃগণের ও অন্যান্য সমস্ত লোকের মঙ্গল হোক” এই কথা বলে এবং সমস্ত দেবতা ও গুরুজনকে নমস্কার করে, জগতের মঙ্গল চিন্তা করে “আমার অস্ত্রদ্বারা অশ্বত্থামার অস্ত্র নিবৃত্ত হোক” উচ্চারণ করে বিপক্ষসন্তাপকারী অর্জুনও ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন।

তখন অর্জুন নিক্ষিপ্ত মহাশিখাশালী সেই ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রলয়কালের অগ্নির মতো জ্বলে উঠল। আবার তীক্ষ্ণতেজা অশ্বত্থামার ব্রহ্মশির অস্ত্রও বিশাল শিখা ও তেজোমণ্ডলে ব্যাপ্ত হয়ে প্রকাশ পেতে লাগল। তখন বহুতর নির্ঘাত হয়ে থাকল, সহস্র সহস্র উল্কাপাত হতে থাকল, এবং সমস্ত প্রাণীরই মহাভয় উপস্থিত হল। আকাশে বিশাল শব্দ হতে থাকল, অগ্নিশিখা ব্যাপ্ত হয়ে পড়ল এবং পর্বত ও বনবৃক্ষের সঙ্গে সমস্ত পৃথিবী কাঁপতে লাগল। সেই সময়ে, অর্জুন ও অশ্বত্থামা আপন আপন অস্ত্রের তেজে সকলেরই ত্রাস জন্মাতে লাগলেন এবং মহর্ষি নারদ ও বেদব্যাস সম্মিলিতভাবে তা দেখতে লাগলেন। পরে সর্বভূত হিতৈষী নারদ ও বেদব্যাস অর্জুন ও অশ্বত্থামাকে শান্ত করবার ইচ্ছা করলেন। ক্রমে সর্বধর্মজ্ঞ, সর্বভূতহিতৈষী ও মহাতেজস্বী নারদ ও বেদব্যাস উভয় অস্ত্রের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালেন। তপস্যার প্রভাবে অতিদুর্ধর্ষ ও যশস্বী নারদ ও বেদব্যাস সেই অগ্নিরাশি দুটির মধ্যস্থানে গিয়ে অপর দুটি প্রজ্বলিত অগ্নিরাশির মতো দাঁড়ালেন। তাঁরা সকল প্রাণীরই অজেয় এবং দেব ও দানবগণের প্রিয় ছিলেন; আর জগতের হিতের জন্য সেই অস্ত্ৰতেজ নিবারণ করা তাঁদের ইচ্ছা ছিল। পরে নারদ ও বেদব্যাস বললেন, “নানা শাস্ত্রজ্ঞ প্রাচীন বহু মহারথ অতীত হয়ে গেছেন। তাঁরা কোনও কারণেই মানুষের উপর এই অস্ত্র প্রয়োগ করেননি। অতএব হে বীরদ্বয়! তোমরা জগতের মহাবিপত্তি জনক এই সাহস করলে কেন?”

আপন অস্ত্রের সম্মুখভাগে অগ্নির ন্যায় তেজস্বী সেই ঋষি দু’জনকে দেখেই অর্জুন ত্বরান্বিত হয়ে আপন অস্ত্রের কিঞ্চিৎ উপসংহার করলেন। তিনি কৃতাঞ্জলি হয়ে সেই দুই ঋষিকে বললেন, “আমার অস্ত্রে অশ্বত্থামার অস্ত্র নিবারিত হোক, এই ইচ্ছাতেই আমি এই অস্ত্র প্রয়োগ করেছি। আমি এই উত্তম অস্ত্র উপসংহার করলে পাপকর্ম অশ্বত্থামা নিশ্চয়ই নিজের অস্ত্রের প্রভাবে আমাদের সকলেই দগ্ধ করবে। এখন আমাদের এবং সমস্ত লোকের যাতে মঙ্গল হয়, দেবতার তুল্য প্রভাবশালী আপনারা দু’জন তার উপায় উদ্ভাবন করুন।” এই কথা বলে অর্জুন নিজের অস্ত্রের সম্পূর্ণ উপসংহার করলেন। কিন্তু যুদ্ধে দেবতারাও সেই ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র প্রয়োগ করে উপসংহার করতে পারেন না। ব্রহ্মশির অস্ত্র একবার নিক্ষেপ করলে, পুনরায় তার উপসংহার অর্জুন ছাড়া অন্য সকলের পক্ষেই অসম্ভব হয়ে থাকে, এমনকী দেবরাজ ইন্দ্রও তা পারেন না। কারণ ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র ব্রহ্মতেজ থেকে উৎপন্ন। সুতরাং ব্রহ্মচর্য ছাড়া অসংশোধিত চিত্ত লোক এর প্রয়োগ করলে, এ অস্ত্রের উপসংহার করা তার পক্ষে অসাধ্য হয়। যে লোক ব্রহ্মচর্য ব্রত না করে এই অস্ত্র নিক্ষেপ করে আবার ফেরাবার চেষ্টা করে, এই অস্ত্র অনুচরবর্গ সহ সেই লোকের মস্তক ছেদন করে।

ওদিকে অর্জুন পূর্বে ব্রহ্মচর্য ও অন্যান্য ব্রত করেছিলেন; পরে দুর্যোধন প্রভৃতির এই সকল দুর্ব্যবহারে অত্যন্ত বিপন্ন হয়েও এই অস্ত্র নিক্ষেপ করেননি। অর্জুন সত্যবাদী, বীর ও পূর্বে ব্রহ্মচর্যব্রতকারী এবং সর্বদাই গুরুজনের প্রতি অনুকূল ছিলেন। সেই জন্যই অর্জুন ব্রহ্মশির অস্ত্র নিক্ষেপ করেও আবার তার উপসংহার করতে পেরেছিলেন। কিন্তু অশ্বত্থামা নিজের অস্ত্রের সম্মুখে সেই ঋষি দু’জনকে দেখেও আপন শক্তিতে সেই অস্ত্রের উপসংহার করতে সমর্থ হননি। অশ্বত্থামা নিজের দারুণ ব্রহ্মশির অস্ত্র উপসংহার করতে সমর্থ না হওয়ায় বিষণ্ণচিত্তে বেদব্যাসকে বললেন, “মুনি আমি অত্যন্ত বিপদাপন্ন হয়ে প্রাণরক্ষা করার জন্যই ভীমসেনের ভয়বশত এই অস্ত্র নিক্ষেপ করেছি। ভগবন্! এই ভীমসেন গদাযুদ্ধের সময় দুর্যোধনকে বধ করবার ইচ্ছা করে, শাস্ত্রনিষিদ্ধ আচরণ করায় অধর্ম করেছে। মহর্ষি! আমার চিত্ত রাগদ্বেষাদি শূন্য নয়। সেই জন্যই আমি আজ এই ব্রহ্মশির অস্ত্র নিক্ষেপ করেছি; কিন্তু আমি পুনরায় তা উপসংহারে সমর্থ নই। ‘পাণ্ডবগণের ধ্বংস হোক’ এই অগ্নির তেজ আহ্বান করে,অলৌকিক ও দুর্ধর্ষ এই ব্রহ্মশির অস্ত্র আমি নিক্ষেপ করেছি। অতএব পাণ্ডবগণের বিনাশের জন্য সংকল্পিত এই অস্ত্র আজ সমস্ত পাণ্ডবকেই জীবন শূন্য করবে। ব্রহ্মর্ষি আমি রোষাবিষ্টচিত্তে পাণ্ডবগণের বধের উদ্দেশ্যে এই অস্ত্র নিক্ষেপ করে পাপের কার্য করেছি।”

বেদব্যাস বললেন, “বৎস! পৃথানন্দন অর্জুনও ব্রহ্মশির অস্ত্র জানেন; কিন্তু তবুও তিনি ক্রোধবশত কিংবা তোমার বিনাশের জন্য এ অস্ত্র নিক্ষেপ করেননি, তবে অর্জুন নিজের ব্রহ্মশির অস্ত্রদ্বারা তোমার ব্রহ্মশির অস্ত্র নিবারণ করবেন বলেই তা নিক্ষেপ করেছেন এবং পুনরায় তার উপসংহারও করেছেন। তারপর মহাবাহু অর্জুন তোমার পিতার উপদেশে ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করেও ক্ষত্রিয় ধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি। অর্জুন এমন ধৈর্যশালী, সাধুপ্রকৃতি, সর্বাস্ত্রবিদ ও সত্যবাদী; অতএব ভ্রাতৃগণ ও বন্ধুগণের সঙ্গে তুমি তাঁকে বধ করতে চাইছ কেন? যে রাজ্যে ব্রহ্মশির অস্ত্রদ্বারা অপর ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রতিহত করা হয়, সে রাজ্যে বারো বছর পর্যন্ত মেঘ জলবর্ষণ করে না। এই জন্যেই মহাবাহু অর্জুন সমর্থ হয়েও লোকের হিতসাধন করবার ইচ্ছায় নিজের ব্ৰহ্মশির অস্ত্রদ্বারা তোমার ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রতিহত করেননি। মহাবাহু অশ্বত্থামা, পাণ্ডবগণ, তুমি ও রাজ্য এ সমস্তই তোমার রক্ষণীয়। অতএব তুমি এই অলৌকিক অস্ত্রের প্রতিসংহার করো। তোমার চিত্ত ক্রোধশূন্য হোক এবং পাণ্ডবেরা নিরুপদ্রব হোন। রাজর্ষি যুধিষ্ঠির অধর্ম অনুসারে জয় করতে ইচ্ছা করেন না। অতএব আমার মত হল তোমার মাথার মণিটি তুমি পাণ্ডবদের দান করো। পাণ্ডবেরা এই মণিটি নিয়ে তোমার প্রাণ প্রতিদান দেবেন।”

অশ্বত্থামা বললেন, “মহর্ষি! এ যাবৎ পাণ্ডব-কৌরবেরা যত ধন ও রত্ন লাভ করেছেন, সে সমস্ত থেকে আমার মণিটির মূল্য অধিক। এই মণিকে অঙ্গে ধারণ করলে মানুষের অস্ত্র, রোগ ও ক্ষুধার ভয় থাকে না এবং দেব, দানব অথবা নাগ থেকে কোনও ভয় হয় না। রাক্ষসের ভয় কিংবা চোরের ভয় হয় না। এই মণিটির এতটাই শক্তি। কাজেই আমি এ মণি কোনও মতেই ত্যাগ করতে পারি না। কিন্তু আপনি পূর্বে যা বলেছেন, তা পালন করা আমার অবশ্য কর্তব্য। সুতরাং এই মণি এবং এই আমি রয়েছি। আর ইষিকা পাণ্ডবগণের শিশুসন্তান ও উত্তরার গর্ভে গিয়ে পতিত হবে। মহর্ষি আমি আপনার বাক্য রক্ষা করব না, এমন হতে পারে না; অথচ ভগবন্, নিক্ষিপ্ত অস্ত্র উপসংহার করতেও আমি সমর্থ নই। অতএব এই অস্ত্র আমি পাণ্ডব শিশুদের উপর নিক্ষেপ করব।”

ব্যাসদেব বললেন, “তুমি তাই করো, অন্য প্রকার বুদ্ধি কোরো না। পাণ্ডবগণের শিশু সন্তানদের উপরে ব্রহ্মশির নিক্ষেপ করে বিরত হও।” অশ্বত্থামা তাই করলেন।

পাপকর্মা অশ্বত্থামা উত্তরার গর্ভে ঐষীকাস্ত্র নিক্ষেপ করেছেন, তা বুঝেও কৃষ্ণ তখন আনন্দিত হয়ে অশ্বত্থামাকে বললেন, “বিরাটরাজার কন্যা এবং অর্জুনের পুত্রবধূ উত্তরাকে উপপ্লব্য নগরে দেখে ব্রতনিষ্ঠ কোনও ব্রাহ্মণ বলেছিলেন— উত্তরা! কুরুবংশ ক্ষয় হয়ে গেলে, তোমার একটি পুত্র জন্মাবে, এই কারণেই তার নাম হবে— ‘পরীক্ষিৎ’! সেই সাধু ব্রাহ্মণের কথা সত্য হবে। এঁদের বংশরক্ষক ‘পরীক্ষিৎ’ নামে একটি পুত্র জন্ম নেবে।” সাত্বতবংশশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ এই কথা বললে, অশ্বত্থামা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন—

নৈতদেবং যথাত্থ ত্বং পক্ষপাতেন কেশব!।

বচনং পুণ্ডরীকাক্ষ! ন চ মদ্বাক্যমন্যথা ॥ সৌপ্তিক : ১৬ : ৬ ॥

—“কৃষ্ণ! তুমি পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাত করে যা বলছ, তা সত্য হবে না। কেন না, পুণ্ডরীকাক্ষ আমার বাক্যের অন্যথা হবে না।”

“কৃষ্ণ তুমি যাকে রক্ষা করবার ইচ্ছা করছ, উত্তরার সেই গর্ভে আমার অস্ত্র নিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে।”

কৃষ্ণ বললেন, “অশ্বত্থামা, তোমার ভীষণ অস্ত্ৰক্ষেপও অব্যর্থ হবে, এবং তাতে গর্ভস্থ বালকটিও মরে যাবে। তবে আবার সে বালকটি জীবিত হবে ও দীর্ঘায়ু লাভ করবে। বুদ্ধিমান লোকেরা সকলেই জানেন যে, তুমি কাপুরুষ, পাপাত্মা ও বারবার পাপকার্যকারী এবং এখনও তুমি বালকের জীবননাশ করতে উদ্যত হয়েছে। অতএব তুমি এই পাপ কার্যের ফল লাভ করো। তুমি তিন সহস্র বৎসর পর্যন্ত কোনও স্থানে কোনও সময়ে কোনও ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ-সুখ না পেয়ে এই পৃথিবীতে বিচরণ করবে। ক্ষুদ্ৰহৃদয়! তুমি অসহায়ভাবে নির্জনদেশে বিচরণ করবে। কিন্তু লোকমধ্যে কখনও তোমার অবস্থিতি ঘটবে না। পাপাত্মা, তুমি পুঁজ ও রক্তের গন্ধে আকুল হয়ে এবং দুর্গম মহারণ্যে থেকে থেকে সর্বপ্রকার ব্যাধিযুক্ত হয়ে বিচরণ করবে।

“আর এদিকে উত্তরার পুত্র পরীক্ষিৎ, উপযুক্ত বয়সে ব্রহ্মচর্যব্রত আচরণ করতে থেকে বীর হবে, শরদ্বানের পুত্র কৃপাচার্যের কাছ থেকে সমস্ত অস্ত্র লাভ করবেন। এবং ধর্মাত্মা পরীক্ষিৎ সমস্ত অস্ত্রে অভিজ্ঞ হয়ে ক্ষত্রিয়ধর্মে নিরত থেকে দীর্ঘায়ু লাভ করে ষাট বৎসর পর্যন্ত পৃথিবী পালন করবে। অতিদুর্মতি! মহাবাহু সেই উত্তরার পুত্র এঁদের পরেই তোমার সামনেই ‘পরীক্ষিৎ’ নামক কুরুদেশের রাজা হবে। নরাধম তোমার অস্ত্রাগ্নির তেজে সেই বালকটি দগ্ধ হলে, আমি তাকে জীবিত করব। তুমি আমার তপস্যার ও সত্যের প্রভাব দেখবে।”

বেদব্যাস বললেন, “অশ্বত্থামা তুমি যখন আমাদের অবজ্ঞা করে দারুণ কার্য করেছ এবং তুমি ব্রাহ্মণ হলেও যখন তোমার এই আচরণ দেখা গেল, তখন তোমার সম্পর্কে, কৃষ্ণ যে উত্তম বাক্য বলেছেন, অবশ্যই তা ঘটবে। বিশেষত তুমি ক্ষত্রিয়ধর্ম অবলম্বন করেছ।”

অশ্বত্থামা বললেন, “মহর্ষি জগতে মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আপনার কাছেই আমি থাকব, এতে কৃষ্ণের বাক্যও সত্য হবে।”

তারপর অশ্বত্থামা মহাত্মা পাণ্ডবদের নিজের মণিটি দান করে, সকলের সামনেই গভীর বনে প্রবেশ করলেন। শত্ৰুবিজয়ী পাণ্ডবেরা অশ্বত্থামার সহজাত মণিটি নিয়ে কৃষ্ণ, মহর্ষি বেদব্যাস ও নারদকে অগ্রবর্তী করে প্রায়োপবিষ্টা মনস্বিনী দ্রৌপদীর দিকে সত্বর ছুটে গেলেন। তারপর মহাবল ভীমসেন যুধিষ্ঠিরের অনুমতিক্রমে সেই মণিটি দ্রৌপদীকে দিলেন এবং বললেন, “ভদ্রে! এই তোমার সেই মণিটি, তোমার সেই পুত্রহন্তাও পরাজিত হয়েছে। অতএব তুমি শোক পরিত্যাগ করে গাত্রোত্থান করো এবং ক্ষত্রিয়ধর্ম স্মরণ করো। ভীরু নীলনয়নে! কৃষ্ণ সন্ধির জন্য হস্তিনানগরে গেলে তুমি তীব্র বাক্যে বলেছিলে, ‘কৃষ্ণ আমার পতিরা নেই, পুত্রেরা নেই, ভ্রাতারাও নেই, তুমিও নেই।’ এখন তুমি সেই বাক্য স্মরণ করো। পাপাত্মা দুর্যোধনকে আমি নিহত করেছি, দুঃশাসনকে ভূতলে নিপাতিত করে তাঁর রক্তপান করেছি। শত্রুতার শেষ হয়েছি, পরনিন্দাকারী লোকেরা আর আমাদের নিন্দা করতে পারবে না, তারপর অশ্বত্থামাকে জয় করে মণি কেড়ে নিয়েছি।”

দ্রৌপদী বললেন, “ভরতনন্দন! আপনার এই কার্যে আমি পুত্র প্রভৃতির কাছে ঋণশূন্য হলাম। গুরুপুত্র বলে অশ্বত্থামার নিধনেও আমার আগ্রহ নেই। তবে রাজাই এই মণিটি মস্তকে বন্ধন করুন।”

“এই মণি আমার গুরুর উচ্ছিষ্ট” বলে যুধিষ্ঠির তখনই মণিটি নিয়ে মস্তকে ধারণ করলেন। দ্রৌপদীর প্রায়োপবেশনও শেষ হল।

*

মহাভারতে অসংখ্য বীভৎস কাণ্ড আছে। ধ্যানরত মুনির গলায় মৃতসাপ ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন মহারাজ পরীক্ষিৎ! সভাপর্বে দ্রৌপদীর সঙ্গে কৌরবেরা যে পাশবিক আচরণ করেছেন, শ্বশুর ও গুরুজনদের সামনে ভ্রাতৃজায়াকে নগ্ন করার প্রচেষ্টায় বীভৎস আনন্দ অনুভব করেছিলেন কৌরবপক্ষের দুষ্ট চতুষ্টয় ও তাঁদের অনুগামী রাজারা। দুঃশাসনকে বীভৎসভাবে হত্যা করেছিলেন ভীমসেন। মৃত দুঃশাসনের বক্ষোরক্ত পান করেছিলেন। দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের পর চরণদ্বারা দুর্যোধনের মস্তক মর্দন করেছিলেন। এগুলি সবই বীভৎস ঘটনা।

কিন্তু অশ্বত্থামা যা করেছিলেন, তা বীভৎসতম ঘটনা। নিদ্রা সমস্ত দিনের সকল কর্মের থেকে বিশ্রাম। পাপ পুণ্য ভাল মন্দ— সব কিছুরই বিরাম এনে দেন নিদ্রাদেবী। নিদ্রিত পাণ্ডবপুত্ররা, ধৃষ্টদ্যুম্ন, উত্তমৌজা, যুধামন্যু, শিখণ্ডী এঁরা সকলেই মহারথ অতিরথ ছিলেন। দিনের আলোয় অথবা সশস্ত্র অবস্থায় অশ্বত্থামার পক্ষে সম্ভব ছিল না এঁদের হত্যা করা। সম্ভব ছিল না পঞ্চপাণ্ডব ও কৃষ্ণের সম্মুখে এঁদের নিধন ঘটানোর। তাই অশ্বত্থামা পৈশাচিক বৃত্তি অবলম্বন করলেন। প্রশান্ত সুগভীর নিদ্রার মধ্যে, চূড়ান্ত অসতর্ক, অসাবধান অবস্থায় হত্যা করলেন দ্রৌপদীর পুত্রদের। সমান আসনে করে দিলেন পুত্রহীনা গান্ধারী ও দ্রৌপদীকে।

অশ্বত্থামা ঘটনার পরিণতি জানতেন। জানতেন প্রভাতে পঞ্চ-পাণ্ডব যখন এ সংবাদ জানবেন— তখন পৃথিবীর কোনও শক্তিই তাঁকে রক্ষা করতে পারবে না। তাই তিনি পলায়ন করে ব্যাসদেবের আশ্রমে প্রবেশ করে ঘৃত-ধূলিধূসর দেহে আত্মগোপন করেছিলেন। কিন্তু প্রভাতে ধনুর্বাণ হাতে ভীমকে রথে সারথি নকুলের সঙ্গে আসতে দেখে এবং পিছনের রথে কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির ও অর্জুনকে দেখে অশ্বত্থামা আত্মসংবিৎ হারালেন। যে অস্ত্র প্রদানকালে পিতা দ্রোণাচার্য বারবার নিষেধ করেছিলেন, “কখনও মানুষের উপর এ অস্ত্র প্রয়োগ কোরো না” সেই নিষেধ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রচণ্ড শক্তিধর সেই ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। কৃষ্ণ ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্রের ক্ষমতা জানতেন। তাই তিনি অর্জুনকে নির্দেশ দিলেন ব্রহ্মশির অস্ত্র দ্বারা অশ্বত্থামার ব্রহ্মশির অস্ত্র নিবারণ করতে।

কী অসাধারণ বৈপরীত্য দুই রথীর। অশ্বত্থামা ব্রহ্মশির নিক্ষেপ করবার সময়ে বললেন, “পাণ্ডবেরা ধ্বংস হোক।” আর অর্জুন ব্রহ্মশির নিক্ষেপ করবার পূর্বে বলেছিলেন, “অশ্বত্থামার মঙ্গল হোক, পৃথিবীর মানুষের মঙ্গল হোক— আমার অস্ত্রে অশ্বত্থামার অস্ত্র নিবারিত হোক।” ধ্বংসকামিতা অর্জুনের মধ্যে ছিল না, তাই নারদ-ব্যাসদেবের অনুরোধ শুনে অর্জুন আপন ‘ব্রহ্মশির’ উপসংহার করলেন কিন্তু অসংযত, পাপাত্মা, পাপকর্মা, অশ্বত্থামা আপন অস্ত্র সংবরণ করতে পারলেন না। অশ্বত্থামার অস্ত্র উত্তরার গর্ভস্থ শিশুকে আঘাত করল৷ কৃষ্ণ সেই অলৌকিক সংকল্প ঘোষণা করলেন। অশ্বত্থামার অস্ত্র উত্তরার গর্ভে আঘাত করলে, তিনি যথাসময়ে সেই শিশুকে জীবিত করে দেবেন। কৃষ্ণ তা করেছিলেন। এই ঘটনায় তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতা আর একবার প্রমাণ হয়েছিল।

কৃষ্ণ অশ্বত্থামাকে অভিসম্পাত করেছিলেন— জনমানবহীন, পুঁজ ও রক্তের গন্ধযুক্ত স্থানে তিন হাজার বছর তাঁকে কাটাতে হবে। তিনি কথা বলার মতো সঙ্গী পাবেন না। মহাভারত-কথায় অশ্বত্থামা কাহিনি শেষ হল।

জন্মকালীন সহজাত মণি অশ্বত্থামাকে পাণ্ডবদের হাতে দিয়ে যেতে হল। এ মণি দেওয়া আর মাথা দেওয়া অশ্বত্থামার পক্ষে একই ঘটনা। অশ্বত্থামা পরাজয় স্বীকার করলেন। অশ্বত্থামার ধারণা ছিল তিনি দ্রোণের পর কৌরবপক্ষের সব থেকে বড় বীর। কৃপাচার্যও সে কথা মনে করতেন। দ্রোণের ব্রহ্মলোক প্রয়াণের পর অশ্বত্থামা চেয়েছিলেন কৌরব সেনাপতি হতে। কৃপাচার্য প্রস্তাব করেছিলেন দুর্যোধনের কাছে, কিন্তু ততক্ষণে দুর্যোধন কর্ণকে সেনাপতি হিসাবে বরণ করেছিলেন। অশ্বত্থামা ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন কিন্তু প্রতিবাদ করেননি।

পাণ্ডবদের ধ্বংস করার জন্য দু’বার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেছিলেন অশ্বত্থামা। এবার দ্রোণের মৃত্যুর পর নারায়ণাস্ত্র ব্যবহার করে। কিন্তু সেক্ষেত্রে কৃষ্ণ সকলকে অস্ত্রত্যাগ করিয়ে নারায়ণাস্ত্র ব্যর্থ করে দেন। দ্বিতীয়বার ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র ব্যবহার করে। যা ব্যাসদেব ও নারদের মধ্যস্থতায় ব্যর্থ হয়ে যায়। ভারত-কাহিনিতে অশ্বত্থামার পরিচয় শেষ পর্যন্ত ঘুমন্ত শিশুযোদ্ধাদের ঘাতকরূপে চিহ্নিত হয়। সৌপ্তিক পর্বে তিনি দ্রৌপদীর ঘুমন্ত পাঁচ পুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, উত্তমৌজা, যুধামন্যুকে নিধন করেন। আর, আশ্বমেধিক পর্বে উত্তরার গর্ভস্থিত পরীক্ষিৎকে হত্যা করেন। পরীক্ষিৎ তখনও অপ্রকাশিত, কাজেই ঘুমন্ত।

অশ্বত্থামা তাঁর নিষ্ঠুরতার শাস্তি পান কৃষ্ণের অভিশাপে। সহায়ক কৃতবর্মা হয়ে ওঠেন, যদুবংশ ধ্বংসের অন্যতম কারণ। সাত্যকির খাড়্গাঘাতে দ্বিখণ্ডিত হয় তাঁর দেহ। খড়্গাঘাতে সাত্যকি তাঁর মস্তক ছেদন করেন। শিখণ্ডীর মৃত্যুর পর কুবেরের অনুচর স্থূণাকর্ণ, শিখণ্ডীকে আপন পৌরুষ দিয়ে শিখণ্ডিনীর স্ত্রীত্ব গ্রহণ করেছিলেন যিনি, তিনি কুবেরের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় পুরুষ রূপ লাভ করেছিলেন।

* বনপর্ব ১০ পরিচ্ছেদে আছে, ব্রহ্মশির অস্ত্র মহাদেব অর্জুনকে দিয়েছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *