2 of 2

৮.০৯ “গান্ধীবাদ কি অচল?”

৮.৯ “গান্ধীবাদ কি অচল?”

পরিশিষ্ট

আমাদের সেযুগের সন্ত্রাসবাদীরা শ্রদ্ধেয়। তাঁদের অনেকেরই চরিত্রে এমন কিছু গুণ ছিল যাতে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হতে হয়। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত চরিত্র বিশ্লেষণ আমার প্রবন্ধের বিষয়বস্তু নয়।

রুশদেশেও উনিশ শতকে এক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। লেনিন নিজে মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী বিপ্লবী ছিলেন। কিন্তু দলগঠনের প্রশ্নে জার্মান মার্ক্সীয়দের সঙ্গে তাঁর মতের পার্থক্য ছিল–এ বিষয়ে তাঁর চিন্তায় রুশদেশের সন্ত্রাসবাদীদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। লেনিনী দলসংগঠন গণতান্ত্রিক ছিল না। লেনিনের সমকালীন বিখ্যাত কম্যুনিস্ট নেতা রোজা লুক্সেমবুর্গ থেকে আরম্ভ করে অনেকেই এই সমালোচনা উচ্চারণ করে গেছেন। এদেশের কম্যুনিস্টরাও লেনিনেরই মতো পূর্বতন সন্ত্রাসবাদীদের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত। এ কথা আমি কারও প্রতি ব্যক্তিগত অশ্রদ্ধা থেকে বলছি না। বাম কম্যুনিস্টরা লেনিন ও মাওয়ের কাছ থেকেই দল সংগঠন সম্বন্ধে তাঁদের ধারণা লাভ করেছেন।

কয়েকটি বিশেষ শর্ত পূর্ণ না হলে গণসমর্থন সত্ত্বেও কম্যুনিস্ট আন্দোলন সশস্ত্র অভুত্থানের পথে ক্ষমতা লাভ করতে সক্ষম হবে না, একথা এঙ্গেলস্ নিজেই শেষ জীবনে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে গিয়েছিলেন। আবার বিশেষ কিছু শর্ত পূর্ণ হলে অধিকাংশের সমর্থন ছাড়াও সশস্ত্র বিপ্লবের পথে ক্ষমতালাভ সম্ভব এ কথা লেনিন বুঝতে পেরেছিলেন। এদেশে লেনিনী মতের এক অথবা একাধিক দল আছে, কিন্তু বিপ্লব সফল হবার শর্তগুলি অপূর্ণ।

লেনিনী দলের একাংশ গোপনীয়তা রক্ষাকে সংগঠনের একান্ত প্রয়োজনীয় শর্ত হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে লেনিনের লেখা থেকে আমার প্রবন্ধে একটি উদ্ধৃতি দিয়েছি। উদ্ধৃতিটি পাওয়া যাবে মস্কো থেকে প্রকাশিত ‘Lenin: Selected Works’ গ্রন্থের প্রথম ভমে ১৯৪৭ সালের সংস্করণে ২৩৯-৪০ পৃষ্ঠায়। সম্পূর্ণ বাক্যটি এই :

“Secrecy is such a necessary condition for such an organization that all the other conditions (number and selection of members, functions, etc.) must all be subordinated to it.” বন্ধনীর ভিতরের খুঁটিনাটিতে সাধারণ পাঠকের কৌতূহল থাকার কথা নয় বলে মূল প্রবে সেটা উদ্ধৃত করিনি। এই খুঁটিনাটির ভিতর functions শব্দটি উল্লেখযোগ্য। লেনিনের উদ্ধৃতি ছাড়াও এই ধরনের সংগঠনের বৈশিষ্ট্য অনেকেই হয়তো কিছু কিছু জানেন। দলের কাযাকার্য শুধু যে দল বহির্ভূত লোকের কাছ থেকে গোপন রাখা হয় তাই নয়, দলের কর্মীদের ভিতরও নানা বিষয়ে পারস্পরিক গোপনতারক্ষার বিধান আছে।

গোপনতারক্ষায় সঙ্গে অসত্য ভাষণের সম্পর্ক নিয়ে দুয়েকটি কথা যোগ করা যেতে পারে। ব্যক্তিগত জীবনে বহু বিষয়ে আমরা নীরব থাকি। সেই নীরবতা অনেক সময়ে সঙ্গত। যেকথা শুধু আমারই সেকথা সবাইকে শোনাবার চেষ্টাও অনেক ক্ষেত্রে নিজের ও অপরের প্রতি অত্যাচার। কিন্তু যেখানে দশজনকে নিয়ে আমাদের কাজ সেখানে কেবল নীরবতা দ্বারা গোপনতা রক্ষা হয় না, বরং একটি সত্য গোপন করার জন্য প্রায়ই অপর একটি মিথ্যা সশব্দে ঘোষণা করতে হয়। তারপর এক মিথ্যার পিঠে আর এক মিথ্যা জুড়ে মিথ্যার বন্ধন বিস্তৃত হতে থাকে। মিথ্যাও একেবারে গোপন থাকে না; কাজেই মিথ্যার সঙ্গে সঙ্গে আসে পারস্পরিক অবিশ্বাস।

গোপনতার অতি অভ্যস্ত একটি সংগঠনও তত বিপদের কারণ হয় না যতক্ষণ সমাজের মূল জীবনধারা থেকে তাকে যথাসম্ভব বিচ্ছিন্ন রাখা যায়। উদাহরণত গুপ্ত পুলিশবাহিনীর উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু ঐ রকম একটি দল যখন সমাজের হতাকত হয়ে বসে তখন সমূহ বিপদের সম্ভাবনা।

হিংসা অথবা মিথ্যা দ্বারা কখনও কিছু লাভ করা যায় না এমন নয়। হিংসা সদুদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে এবং সাময়িকভাবে সফলও হতে পারে। কিন্তু হিংসার সাফল্যেও বিপদের সম্ভাবনা আছে। যা-কিছু সফল হয় তারই উপর আমাদের আস্থা ও নির্ভরতা বাড়ে। সত্য ও অহিংসা একবার জয়ী হলে সত্য ও অহিংসাকেই আমরা আবারও গ্রহণ করতে চাই। হিংসা দ্বারা কোনো উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলে হিংসাকেই আমরা আবারও আশ্রয়। করতে চাই। মিথ্যা দ্বারা একের জয় হলে মিথ্যাকেই অপরেও অবলম্বন করতে চায়। কিন্তু হিংসা ও অহিংসা, মিথ্যা ও সত্যের ভিতর একটি মূল প্রভেদ আছে। সত্য ও অহিংসা এমন বস্তু যার প্রসারে সমাজের মঙ্গল। হিংসা ও মিথ্যার সাময়িক সাফল্য সম্ভব, কিন্তু তার প্রসারে সমাজের ক্ষতি। হিংসা, মিথ্যা অথবা অবিশ্বাসের সেই শক্তি নেই যে তাকে ভিত্তি করে কোনো সমাজ দাঁড়াতে পারে। কাজেই হিংসা যেখানে সাময়িকভাবে সফল সেখানে তার সাফল্যজনিত প্রসারের বিপদ সম্বন্ধেই বিশেষভাবে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এই সতর্কবাণী উচ্চারণেই অহিংসাতত্ত্বের প্রধান মূল্য।

দয়া, প্রেম ইত্যাদিকে আমরা অনেকে ভাবালুতা বলি। কিন্তু হিংসার মতো মাদকতা কম বস্তুতেই আছে। দয়ায় আমরা মাত্রা ছাড়িয়ে যাব এ বিপদ তত নয়, হিংসার উন্মাদনায় মাত্রা অতিক্রম করবার সম্ভাবনা যত। তাই মাত্রারক্ষার জন্য অহিংসাতত্ত্বের একটা বিশেষ প্রয়োজন আছে।

বিজ্ঞান ও সহযোগিতা সুস্থ সমাজের ভিত্তি। স্তালিনী বিভীষিকাকে কেউ কেউ সমর্থন করেছেন এই বলে যে, সোভিয়েত দেশের উন্নতির জন্য এর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এ ধারণা ভুল। এর বিস্তৃত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। স্তালিন ক্ষমতায় আসবার পর কম্যুনিস্ট দলের কেন্দ্রীয় সমিতির অধিকাংশ সদস্যকে মিথ্যা অভিযোগে হত্যা করা হয়। সোভিয়েত দেশের উন্নতির জন্য এই মিথ্যার প্রয়োজন ছিল না। প্রতিবেশী দেশ জার্মানির মতোই সোভিয়েত দেশেরও যতটুকু উন্নতি ঘটেছে তার মূলে আছে বিজ্ঞান ও শ্রম।

গান্ধীজী আজ আমাদের নিন্দাস্তুতির উর্ধ্বে। তাঁকে আমাদের স্মরণ করতে হয় তাঁর প্রয়োজনে নয়, আমাদেরই আজকের জীবনের প্রয়োজনে। তাঁর সকল উক্তিই সমান গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু গঠনমূলক দৃষ্টি ও কর্ম ছাড়া বাংলার আজ কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

প্রগতির পথ (প্রথম প্রকাশ, ১৯৬৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *