2 of 2

৭.৫ উত্তরণের শর্ত

৭.৫ উত্তরণের শর্ত

বাক্‌ এবং অর্থ যেমন পরস্পর সম্পৃক্ত, প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধও তেমনি। এই সম্পর্কটাকে উপেক্ষা করলে বাক্য তার অর্থ হারায়, প্রতিষ্ঠান তার মূল্য। আদর্শ সমাজ নিয়ে আলোচনায় অনেক সময় বাইরের প্রতিষ্ঠানের দিকটাই লক্ষ করা হয়; ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’, ‘সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা’, এইসব নিয়ে তর্ক চলে। মূল্যবোধের কথাটা উপেক্ষিত থেকে যায়। এর অবশ্য কিছু কারণ আছে।

প্রতিষ্ঠান জিনিসটা বাইরের বলেই তার চেহারা বর্ণনা করা অপেক্ষাকৃত সহজ। মূল্যবোধ যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তা নিয়ে আলোচনা করতে অসুবিধা বোধ হতে পারে। আরো একটা ব্যাপার আছে। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিছু ঐতিহাসিক স্তরভেদের সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানীরা আমাদের পরিচিত করিয়েছেন। সবাই অবশ্য একমত নন; ভুলেরও সম্ভাবনা খুবই। তবুও এ বিষয়ে আলোচনার কিছু পরিচিত উল্লেখবিন্দু আছে। মূল্যবোধের ক্ষেত্রে সেই পরিচয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।

এইরকমের কিছু কথা মনে হতে পারে। কিন্তু আসল বাধা অন্যত্র। আমরা বাইরের সঙ্গে ভিতরের যোগ ঘটাবার অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছি। ফলে কিছুরই আর অর্থ থাকছে না। ভিতরের সঙ্গে বাইরেকে মিলিয়ে দেখা দরকার।

মূল্যবোধের ক্ষেত্রে অন্বেষণটা বাইরে শুরু হলেও শেষ অবধি প্রত্যয়ের ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় চেতনার ভিতরে।

আকাঙ্ক্ষার নানা স্তর আছে। এ আমরা সবাই জানি। তবু বিষয়টা ভেবে দেখবার যোগ্য। এ ব্যাপারে চিন্তার পরিচ্ছন্নতা এলে আরো নানা বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

সামান্য একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। যেমন, খাদ্য ও পানীয়। নিতান্ত জৈব স্তরে এর প্রয়োজন। ক্ষুধা তৃষ্ণা মেটাবার জন্য খাদ্য ও পানীয় চাই। দেহধারণের জন্য এটা দরকার। কিন্তু খাদ্যে শুধু খিদে মেটে, পেটের জ্বালা দূর হয়, তা তো নয়। তার। অতিরিক্ত একটা সুখ, রসনার সুখ, সেইসঙ্গে পাওয়া যায়। রসনার সুখের সন্ধানে রান্না। নিয়ে হরেক রকম পরীক্ষা চলে। উদ্ভাবিত হয় নানা রকমের রসুই। এটাই হয়ে ওঠে সংস্কৃতির একটা শাখা। ফরাসী রসুই, চীনে রান্না, মোগলাই, আরো কত রকম। পানীয়েরও আছে কত বিচিত্র রূপ। জৈব স্তর ছাড়িয়ে খাদ্য ও পানীয় পৌঁছে যায় আভিজাত্যের অন্য এক স্তরে।

এর বিরুদ্ধেও আবার প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। অতি ভোজনে অসুখ বাড়ে। পৃথিবীর ধনী দেশে, ধনবানদের ভিতর, ভোজনের অতিশয্যই দৈহিক পীড়া এবং মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিকিৎসকদের কাছে স্বীকৃত। পানীয়ঘটিত দুর্ঘটনার কথা সবাই জানেন। এসবের দুষ্ট ক্রিয়া শুধু দেহের ওপরই নয়, আক্রান্ত হয় মনও। খাদ্যে ও পানীয়ে যখন মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ে তখন মনের পক্ষে সেটা একটা বন্ধনদশা। সুখের সন্ধানে যার শুরু তার পরিণতি এক বিশেষ ধরনের অসুখে।

অর্থব্যয় করে মানুষ নিজের মনকে শৃঙ্খলিত করে। সেই শৃঙ্খলকেই আবার কেউ অলংকার জ্ঞান করে। দামী গয়না নিয়ে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে দামী খাদ্য, ধূম্র ও পানীয় নিয়েও সেইরকম। এইসব হয়ে ওঠে আভিজাত্যের মাপকাঠি। দরিদ্র মানুষ শাকা থেকে যে তৃপ্তিলাভ করে ধনী সেটা পায় না বিলাসী আহার্য অথবা পানীয় থেকে, কিন্তু এই সবের অভাবটা ধনীর কাছে বড়ই দুঃখজনক মনে হয়।

মনের এই শৃঙ্খলিত অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। সরল আহারেই খুঁজে পাওয়া যায় দেহের স্বাস্থ্য, রসনার স্বাদ, মনের মুক্তি। খাদ্য ও পানীয়ের বিবর্তনে এটা তৃতীয় স্তর। দারিদ্র্যের অতি দীন আহার্য বাধ্যতামূলক, কুখাদ্যেও কেউ অভ্যস্ত হয়। আতিশয্য ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় সারল্যে প্রত্যাগমন রুচি ও মননের অন্য এক অবস্থা। খাদ্য ও পানীয় উদারহণ মাত্র। উদ্দেশ্য ছিল, পরিচিত জীবনের মাঝখানে এনে চেতনা-ও-আকঙ্ক্ষার স্তরভেদ দেখানো। যে-তিনটি স্তরের কথা বলা হল, এদেশের ঐতিহ্যাশ্রয়ী ভাষায় অদের অমসিক, রাজসিক ও সাত্ত্বিক বলে চিহ্নিত করা সহজ। কেবল বাইরের লক্ষণ দিয়ে চেনার শুরনিধারণ করতে গেলে অবশ্য ভুলের সম্ভাবনা থেকেই যায়।

এই সঙ্গে বুঝে নিতে হবে আরো একটা কথা। প্রতিটি স্তরের ভিতরই প্রচ্ছন্ন আছে। সেই শক্তি যার সাহায্যে আরোহণ করা যায় পরবর্তী স্তরে। তামসিক অবস্থাতেও থাকে সেই প্রাণশক্তির বীজ ও সুখের আকাঙ্ক্ষা যাতে মানুষকে ঠেলে দেয় রাজসিকতার। দিকে। রাজসিকতাও একটি স্থির অবিকল ভাব নয়। তাতে আছে নানা রঙের খেলা। কখনো জয়ের আকাঙ্ক্ষা প্রবল, কখনো ভোগের। আবার রাজসিকতার ভিতর থেকেই দেখা দেয় বন্ধন বিষয়ে সেই সচেতনতা যাতে ক্রমে উদ্‌ঘাটিত হয় মুক্তির নতুন দিগন্ত।

যে গুণত্রয়ের বিষয়ে বলা হল তাদের কোনো একটিকে শুদ্ধরূপে স্বতন্ত্রভাবে পাওয়া কঠিন। বরং মিশ্ররূপেই এদের আমরা পেয়ে থাকি। তবে কোথাও একটির অথবা অন্যটির প্রাধান্য। প্রাধান্যভেদেই গুণভেদ যেমন শৃগালের তুলনায় সিংহের ভিতর রাজসিকতার প্রাধান্য। আরো একটি কথা যোগ করা দরকার। প্রতিটি গুণের ভিতরই এমন কিছু আছে যেটিকে প্রাণীর প্রয়োজন, অতএব যার মূল্য স্বীকার্য। তামসিকতার ভিতরও বোধ করি এমন একটি অন্ধ প্রাকৃত প্রেম আছে যার মূলোচ্ছেদ হলে প্রাণীর চলে না। এক স্তর থেকে অন্য স্তরে আরোহণ যে অনিবার্য এমন কোনো কথা নেই। অনেকেই আটকে থাকে এক স্তরে। তবে মানুষকে এবং তার ইতিহাসকে যখন আমরা সমগ্রভাবে দেখি তখন একটা চলমানতাই চোখে পড়ে। বাবুই পাখি যুগের পর যুগ একই ভাবে বাসা বেঁধে চলেছে। এই অভ্যস্ত পুনরাবৃত্তি ইতিহাস নয়। ইতিহাসে একটা। গতিশীলতা আছে। এক স্তর থেকে অন্য স্তরে যাত্রার সব চেষ্টা সফল হয় না। তবু সেই চেষ্টার একটা বিশেষ মূল্য স্বীকার করি, এমন কি ব্যর্থ চেষ্টাও মূল্যহীন নয়।

রবীন্দ্রনাথের একাধিক উপন্যাসে পাওয়া যাবে তামসিক অথবা রাজসিক চরিত্রের পাশে একটি সাত্ত্বিক মানুষ। তলস্তয়ের উপন্যাসেও এইরকম দেখা যায়। এইসব চরিত্রের বৈপরীত্যে ও ঘাতপ্রতিঘাতে কাহিনীর ভিতরকার গতি স্মরণীয় হয়ে ওঠে। যেমন ব্যক্তির জীবনে তেমনি পরিবারের ইতিহাসেও গতি ও বৈপরীত্য চোখে পড়ে। দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন রাজসিক প্রকৃতির মানুষ। দেবেন্দ্রনাথ ঝুঁকেছিলেন সাত্ত্বিকতার দিকে। দুজনেই শ্রদ্ধার যোগ্য, তবে দুইভাবে। পিতা ও পিতামহের এই বৈপরীত্য কি ঐতিহাসিক সমন্বয় খুঁজেছিল রবীন্দ্রনাথে?

ভোগবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার কিছু বিপদ আছে। প্রতিক্রিয়ার শক্তিটা কখনো কখনো আত্মপীড়ন ও পরপীড়নের রূপ নিয়ে ফিরে আসে। শাহজাহান ছিলেন রাজসিক ও ভোগবাদী। ঔরঙ্গজেবের ভিতর দেখা দিল প্রতিক্রিয়া। তাঁর জীবনযাত্রা ছিল সরল, তাঁর বিশ্বাস ছিল ধর্মে। কিন্তু তাঁর ভিতর ঔদার্যের অভাব ছিল, অন্তত অনেক। ঐতিহাসিকেরই এই রায়। নানা গুণ সত্ত্বেও তাঁকে সাত্ত্বিক বলা যাবে না। ঔরঙ্গজেবের পর অবশিষ্ট রইল এক ক্ষয়িষ্ণু আভিজাত্য। অনেক রাজবংশেরই ইতিহাস এইরকম। আরম্ভে শৌর্যবীর্য। স্বর্ণযুগে দেখা যায় শিল্পসঙ্গীতের বণাঢ্য বিকাশ। তারপর নেমে আসে অমিতব্যয়িতা, উজ্জ্বলতা ও অবক্ষয়ের ভিতর দিয়ে বংশের অবসান। রাজসিকতার ভিতর যে দ্বন্দ্ব তাকে একটা সার্থক সমন্বয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া কোনো কালেই সহজ হয়নি। ইতিহাসের পথের ধারে একের পর এক পড়ে আছে কত বিগতমহিমা রাজবংশের ধ্বংসস্তূপ।

ব্যক্তি পরিবার রাজবংশ এইসব ছাড়িয়ে মানুষের সমাজের বৃহত্তর ইতিহাসের দিকে যখন তাকাই তখন কি সেখানে স্তর থেকে শুরান্তরে উন্নতির কোনো ছবি চোখে পড়ে? সমাজের সংগঠন যে বদলে চলেছে তাতে তো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা বলছি না শুধু বাইরের পরিবর্তনের কথা। এইসবের ভিতর দিয়ে মানুষের চেতনার পরিবর্তনের কোনো দিগনির্দেশ কি পাওয়া যায়?

কোনো এক যুগে মানুষ ছিল প্রকৃতির বন্য সন্তান, ভীত মূঢ় অসহায়। ক্রমে বৃদ্ধি পেল প্রকৃতির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণের শক্তি। এই শক্তি সমাজের সর্বস্তরে সমানভাবে কাজে লাগেনি। তবু শুরু হয়ে গেল ইতিহাসের অন্য এক পর্ব। সমাজের ভিতর যে বিচিত্র ও বহুমুখী দ্বন্দ্ব তাকে বাদ দিয়ে এই পর্বের ইতিহাস বোঝা যায় না। আবার মানুষের ভিতর যুক্তি ও আত্মপ্রত্যয়ের যে বহুবিঘ্নিত প্রকাশ, শিল্প ও বিশ্বজনীনতার যে অস্ফুট উচ্চারণ, তাকে অগ্রাহ্য করলেও ইতিহাস মানবিক হয়ে ওঠে না। যেমন ব্যক্তির এই মুহূর্তের কোনো চিন্তা কিংবা কর্মেই তার সমগ্র চেতনা অথবা সম্ভাবনা রূপলাভ করে না, তেমনি কোনো বিশেষ সমাজবিন্যাস অথবা কর্মকাণ্ডেও মনুষ্যজাতির চেতনার সম্পূর্ণ পরিচয় ও সম্ভাবনা জানা যায় না।

দ্বন্দ্বের প্রকারভেদ আছে। একদিকে দেখি বিভিন্ন বর্গ ও সম্প্রদায়ের ভিতর বিরোধ ও সমবায়। ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা ছেড়ে দিয়ে যদি সমষ্টিগত বিরোধের বিচার করা যায় তবু তার কত নাম, কত রূপবর্ণবিদ্বেষ, ধর্মযুদ্ধ, শ্রেণীসংগ্রাম, জাতিতে জাতিতে সংঘাত। অন্য দিকে পাই ভিন্ন এক দ্বন্দ্ব, পরিস্থিতির দাবির সঙ্গে মানুষের তৎকালীন চেতনার স্তরের বিরোধ এইসব নিয়ে আরো কিছু আলোচনা পরে করা যাবে। তার আগে সংক্ষেপে যোগ করব একটি কথা। সমস্ত দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করে যে আদর্শ উঁকিঝুঁকি মারে তাকে শুধু ঘটনা থেকে পাওয়া যায় না। পরিস্থিতি সংকট সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু সংকট থেকে উত্তীর্ণ হবার বুদ্ধি বাইরের পরিস্থিতি থেকে এককভাবে আসে না। অন্য এক তেজ বিশ্ব থেকেই মানুষ এসে পৌঁছেছে, আবার মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে বিশ্বের সঙ্গে মিলিত হবার দিকে।

প্রগতির সংজ্ঞা নিয়ে সাধারণ স্তরে একটা তর্ক আছে। সেখানেও জটিলতা সহজেই চোখে পড়ে, সেজন্য বেশি গভীরেও যাবার প্রয়োজন হয় না। প্রগতি কাকে বলে, এই প্রশ্নের উত্তর শুধু ঘটনার বিশ্লেষণ থেকে উদ্ধার করা সহজ নয়। আজকের জগতের উন্নত দেশগুলি বিজ্ঞান তথা প্রযুক্তির শক্তিতে অন্যান্য দেশ থেকে এগিয়ে আছে। তবু প্রযুক্তির অগ্রগতিকেই মানুষের প্রগতির সঙ্গে সমার্থক বলে অনেকেই মেনে নিতে চাইবেন না। সাম্যের একটা বিশেষ মূল্য অনেকের কাছেই স্বীকার্য। অথচ যদি দেখি যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রসর সমাজের তুলনায় সরল আদিবাসী সমাজে অসাম্য কম, তবু তো আদিবাসী সমাজকে আমরা তুলনায় বেশি প্রগতিশীল বলি না। আবার এরকম একটি এমশিবিরের কথা সহজেই ভাবা যায়, যেখানে উৎপাদনের বণ্টনে অনেকটা সাম্য আছে, প্রযুক্তির মানও কিছুটা উঁচু, কিন্তু যেখানে শৃঙ্খলারই জয়জয়কার, ব্যক্তিস্বাধীনতার পরাজয়। প্রগতির বিচারে ঐ ব্যবস্থাকে আমরা কোথায় স্থান দেব? ঘটনার পর্যবেক্ষণ থেকে প্রগতির সংজ্ঞা সম্বন্ধে যদি কেউ বিভ্রান্ত বোধ করে তবে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।

আমরা যখন রাজসিকতা অথবা সাত্ত্বিকতাকে তা ___ ঊর্ধ্বে স্থান দিই তখনও সেই প্রত্যয় কেবলমাত্র ঘটনা অথবা বহির্মুখী দৃষ্টি থেকে আসে না। বহিঁদৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হয় জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার রসাস্বাদন থেকে উদ্ভূত অন্য এক রসবোধ ও অন্তদৃষ্টি। আর তখনই শ্রেয় সম্বন্ধে আমাদের ধারণা যেন অন্য এক নিশ্চিতি লাভ করে। মানুষের যে বাইরের ইতিহাস সর্বজনের দৃষ্টিগ্রাহ্য, অতীতের কিছু কৃতি ও বহু ব্যর্থ সাধনার সেই চিত্রশালার সঙ্গে পরিচয় রক্ষা করা নিশ্চয়ই মূল্যবান। আরো আছে কিন্তু অন্য এক ইতিহাস, মানুষের চেতনার অন্তস্তলে যা প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এদের যদি আমরা যুক্ত করে না দেখি তবে সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে মিলিতভাবে দেখা হয় না। মানুষের এই সভ্যতা তার নিজের অথচ নিজের নয়। মানুষ যখন জানবে যে একে সে নিজে সৃষ্টি করেছে, তখন সর্বশক্তি দিয়ে একে রক্ষা করতে চাইবে। মানুষের গভীরতম উৎকাঙ্ক্ষা এই যে, ইতিহাসের পথ ধরে এমন এক পৃথিবীর দিকে সে অগ্রসর হবে যাকে তার নিজেরই সৃষ্টি বলে সে মেনে নিতে পারবে।

আশাবাদীরা বলেন, তারায় তারায় ঘোষিত হচ্ছে মানুষের জয়ের বাতা। এমন ভবিষ্যদ্বাণীর সপক্ষে যুক্তি নেই। নৈরাশ্যবাদীরা বলেন, মানুষের সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য। এমন সার্বিক নৈরাশ্যেরও সদর্থ হয় না। ঐতিহাসিক জানাতে পারেন অতীতের কিছু তথ্য ও বিশ্লেষণ। সমাজবিজ্ঞানী তাঁর বক্তব্যের পরিধির ভিতর তুলে ধরতে পারেন অন্য এক প্রশ্ন, কী সেই সমাজের বিন্যাস যাকে লক্ষ্য করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে? পূর্বনির্ধারিত বলে কিছুই স্বীকার করে নেওয়া যায় না। শুধু বিবেচনা করা যায় কিছু বিকল্প, কিছু সম্ভাবনা। আমরা বুঝতে চেষ্টা করতে পারি, দ্বন্দ্বের জটিল বুনট, যার প্রতিটি সরল ভাষ্যেই আছে একদেশদর্শিত। আমরা দাঁড়াতে পারি সেই কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি, সংকটের স্বরূপ কী? একটি ভবিষ্যদ্বাণীই সম্ভব কারণ সেটা আসলে বিকল্পেরই পুনরুচ্চারণ। মানুষের ইতিহাসে বহু সভ্যতা লুপ্ত হয়ে গেছে, তারই পাশে গড়ে উঠেছে নতুন সভ্যতা। সেই অতীতে পৃথিবী ছিল প্রশস্ত। আজ এক ছোটো পৃথিবীতে আমরা বাস করি যেখানে সকলের সঙ্গে ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা। যদি ধ্বংস আসে তবেসেটাহবে মানুষের সভ্যতার সামগ্রিক ধ্বংস। যদি উত্তরণ ঘটে তবে মানবজাতির সেটা সার্বিক উত্তরণ।

মানুষজাতিকে আজ সমগ্রভাবে দেখা ছাড়া উপায় নেই। মানুষের এই সভ্যতা উচ্চতর স্তরে উন্নত হবে কি না আমরা জানি না। আমরা শুধু বুঝবার চেষ্টা করতে পারি, আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে? কী আমাদের চাই? আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে তাতে সভ্যতার এক নতুন স্তরে উত্তরণ ছাড়া মানুষের বাঁচবার কোনো উপায় আছে কি না?

ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজে প্রাধান্য লাভ করেছে বিভিন্ন শ্রেণী। এই শ্রেণীসংগঠনের সঙ্গে মানুষের চেতনার বিবর্তনের কিছুটা সম্পর্ক প্রথম থেকেই লক্ষণীয়। মার্ক্সবাদীরা ‘শ্রেণী’ শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। আমরা ঠিক সেইভাবে ব্যবহার করছি না। বিবাহাদি সামাজিক বন্ধনের দ্বারা এক মনুষ্যগোষ্ঠী অন্যান্য গোষ্ঠী থেকে আলাদা বলে চিহ্নিত হয়ে যায়। এইরকম কোনো গোষ্ঠী যদি সমাজের উচ্চনীচ বিন্যাসেরও অন্তর্ভুক্ত হয় তবে তাকে উচ্চ অথবা নীচ শ্রেণী বলে ধরা যেতে পারে। শিখ সম্প্রদায়কে শ্রেণী বলা যাবে না কারণ শুধু শিখ বলেই কেউ সমাজে উচ্চ অথবা নীচ গণ্য হয় না। কিন্তু ব্রাহ্মণ অথবা শূদ্ৰ ঐভাবে গণ্য হয়।

কোনো এক যুগে পুরোহিত শ্রেণীর প্রাধান্য ছিল। বণিকের প্রাধান্যকে আর্থিক কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু ব্রাহ্মণ অথবা পুরোহিত শ্রেণীর সমাজে যে বিশেষ স্থান তার ব্যাখ্যা ঐভাবে হয় না। প্রাচীন যুগের মানুষের মনে ছিল প্রকৃতির প্রতি একই সঙ্গে একটা। অন্ধ ভয় আর প্রবল আকর্ষণ। এটাই স্বাভাবিক। এর সঙ্গে যোগ আছে সে-যুগের ধর্মের। ধর্মেরও আছে স্তর ও প্রকারভেদ। নীচের তলায় অনেকখানি তামসিকতা না থাকলে উপর তলায় পুরোহিততন্ত্র জাঁকিয়ে বসতে পারে না।

মানুষের একটা দিক যেমন বাধানিষেধ মেনে চলে, সীমার ভিতর সুরক্ষা খোঁজে, অচেনাকে ভয় করে, অন্য এক দিক তেমনি দুঃসাহসী, সীমা ডিঙ্গানো তার স্বভাব। প্রাচীন পুরোহিততন্ত্রের পাশে পাই ক্ষাত্রশক্তিকে।

অসি আর মসির ভিতর কে বেশি শক্তিশালী, এই রকম একটা তর্কের কথা অনেকেই শুনে থাকবেন। ক্ষত্রিয়ের প্রতিষ্ঠার মূলে আছে অসিশক্তি। কোনো এক যুগে অশ্বারোহী যোদ্ধারা ছিল প্রবল। এরা দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, দলে দলে এসে দেশ জয় করেছে। কখনো এরা এসেছে দেশের বাইরে থেকে, যেমন ভারতের উত্তরপশ্চিম সীমান্তের গিরিপথ ধরে। কখনো দেশের ভিতরই নানা দলে বিভক্ত হয়ে এদের যুদ্ধ করতে দেখা গেছে। অসিশক্তি হয়ে উঠেছে রাজশক্তি। বাহুবলের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভূসম্পত্তির উপর অধিকার।

ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের ভিতর কখনো ঐক্য আবার কখনো বিরোধ, প্রাচীন ইতিহাসের অনেকখানি স্থান জুড়ে আছে এই কাহিনী। বণিকের স্থান ছিল প্রথমে সমাজের তলার দিকে। ক্রমে তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হল। ইতিহাসের এক পর্যায়ে রাজশক্তির সঙ্গে বণিক শ্রেণীর সম্পর্কটাই প্রধান কথা। তবে এখানেও পাই দ্বন্দ্ব আর সহযোগ এই দুয়ের মিশ্রণ।

বণিকের শক্তির মূলে আছে অর্থ শক্তি। কিন্তু ঐ কথাটুকুতে ধরা পড়ে না সভ্যতার ইতিহাসে বাণিজ্যের অবদান। বিশ্বব্যাপী ঐক্যের ধারণা গড়ে উঠেছে নানা পথে। ধর্মে সেই ঐক্যের ধারণা পাওয়া গেছে একভাবে। ধর্মপ্রচারকেরা দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। ভ্রাতৃত্বের বাণী নিয়ে। ক্ষত্রিয় অসির শক্তিতে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছে; অগণিত উপজাতি মিলিত হয়েছে একই সাম্রাজ্যের মধ্যে। বাণিজ্য নানা দেশের ভিতর সৃষ্টি করেছে অন্য এক বন্ধন। এই তিনের যখন মিল হয়েছে তখন ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে দেখা দিয়েছে এক প্রচণ্ড শক্তি, এসেছে যুগবদলের পালা। তাতে ভালোমন্দ দুইই ঘটেছে। আধুনিক যুগে যুক্তিবাদী দৃষ্টি বলতে আমরা যা বুঝি তার গঠনে বাণিজ্যের বিস্তারের দান অনেকখানি। কোনো এককালে স্থানীয় আচারের প্রাবল্য সমাজ-জীবনে ছিল অপ্রতিহত। বণিক ছড়িয়ে। পড়ল দেশ-দেশান্তরে। জানা গেল যে, বিভিন্ন দেশাচারের ভিতর ঐক্য নেই। বাণিজ্যিক কারণে প্রয়োজন হল এমন কিছু নিয়মকানুন যেটা দেশাচারের দ্বারা খণ্ডিত নয়, বরং বিভিন্ন দেশের কাছেই গ্রাহ্য। বাণিজ্যিক বিচারে এমন কিছু উপাদান আছে যা মানুষকে উপজাতীয় বদ্ধতার বাইরে নিয়ে যায়। মানুষের শ্রেষ্ঠ আদর্শ বণিকের নয়, কিন্তু বাণিজ্যের অবদান উপেক্ষা করাটাও ভুল।

সংশয়বাদের সঙ্গে যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর যে যোগ দেখা যায় সেটা আকস্মিক বা আপতিক নয়। তামসিকতা যখন সাত্ত্বিকতার মুখোশ পরে উপস্থিত হয় তখন সেই মুখোশ খুলে দেওয়া যুক্তিবাদের একটা প্রধান কাজ। এই কাজে কোনো শ্রেণীর একক ভূমিকা নেই। বরং এক মিশ্র মধ্যশ্রেণীর অন্তর্বিরোধ ও বিতর্কের ভিতর একে বিশেষভাবে পাওয়া যায়। চিন্তার ইতিহাস ও সমাজের ইতিহাস এখানে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এরই ভিতর প্রচ্ছন্ন আছে ভবিষ্যতের ছবি। সাম্প্রতিককালে যে মধ্যশ্রেণী প্রধান হয়ে উঠেছে তার। গঠন পুরনো যুগের সঙ্গে মেলে না। ব্রাহ্মণ আর তেমন পৃজিত নয়। উদ্ভব হয়েছে নতুন ‘বুদ্ধিজীবী’ শ্রেণীর। কোনো কোনো দেশে যদিও ক্ষত্রিয় অর্থাৎ সামরিকগোষ্ঠীর প্রাধান্য সুস্পষ্ট তবু আমলাতন্ত্রের শক্তিবৃদ্ধিই এ যুগের বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে আছে। রাজনীতিবিদেরা। পুরনো বণিকশ্রেণীর স্থানে চোখে পড়ে শিল্প ও ব্যবসায়িক সংস্থার ডিরেক্টর ও পরিচালকগোষ্ঠী। যন্ত্রবিদ এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরাও নতুন মধ্য শ্রেণীতে উল্লেখযোগ্য স্থান নিয়ে আছে। সাবেকি উচ্চশ্রেণীর পরিবর্তিত রূপ এই নতুন মিশ্র শ্রেণী। মধ্যবিত্ত নামটারও বৈশিষ্ট্য আছে। আজকাল কেউ নিজেকে উচ্চ শ্রেণী বলে না। সবাই মধ্যম কেউ উচ্চমধ্য, কেউ-বা নিম্নমধ্য। মার্ক্স বলেছিলেন যে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা বড় অংশ ভেঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে এক হয়ে যাবে। কথাটা ক্রমে ক্রমে গ্রাহ্য হতে চলেছে উলটোভাবে। শ্রমিকশ্রেণীর একটা অতুচ্ছ অংশ মধ্যবিত্তশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছে।

সমাজের ভিতর যে বিরোধ বার বার দেখা দেয় সেটা সর্বক্ষেত্রে উচ্চ শ্রেণী ও নিম্ন শ্রেণীর সংঘাত নয়। বরং বহুক্ষেত্রেই সেটা এক উচ্চবর্গের সঙ্গে অন্য উচ্চবর্গের দ্বন্দ্ব। অথবা, আজকের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মধ্যবিত্তেরই একাংশের সঙ্গে অন্য অংশের বিরোধ। উচ্চনীচের দ্বন্দ্বও এরই সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এর বহু উদাহরণ দেওয়া যায়, কিন্তু সেটা নিষ্প্রয়োজন। যে বর্গ অথবা বংশ যখন আধিপত্য স্থাপন করে তারই একটা স্বাভাবিক চেষ্টা দেখা যায় সেই আধিপত্যের সমর্থনে কিছু বক্তব্য তুলে ধরবার। এটাকে বলা যেতে পারে প্রতিষ্ঠিত প্রাধান্যের পক্ষে যৌক্তিকতার ও নায্যতার সন্ধান। বিভিন্ন যুগে এই চেষ্টা হয়েছে বিভিন্ন রূপে। যুগের চেতনার স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই যৌক্তিকতার আকারপ্রকার নির্ধারিত হয়। কোনো এক যুগে জোর পড়েছিল বংশগৌরবের ওপর। রাজা যদি চন্দ্রবংশ অথবা সূর্যবংশের হন তবেই তাঁর সিংহাসনে অধিকার দৈবসিদ্ধ। পুরাণে তাই বংশতালিকার গুরুত্ব বিরাট। পরবর্তী যুগে বংশতালিকার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেল ধর্ম। কোনো রাজা হয়তো গ্রহণ করলেন বৌদ্ধধর্ম বা হিন্দুধর্ম। ইয়োরোপে সম্রাট হলেন খ্রীষ্টধর্মের রক্ষক ও পৃষ্ঠপোষক। প্রতিষ্ঠিত হল রাজকীয় অধিকারের ধর্মীয় ভিত্তি।

ক্রমে যৌক্তিকতার ভাষার আরো বদল হল। ইতিহাসে যাকে ‘যুক্তির যুগ বলা হয়েছে তার গোড়াতেই এই পরিবর্তন চোখে পড়ে। বলা হল, প্রকৃতি যেমন নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজও সেইরকম নিয়মের উপর স্থাপিত হওয়া চাই। এই নিয়মগুলি কী, এই নিয়ে চললো তর্ক ও অনুসন্ধান। বিশেষ সমাজব্যবস্থার সমর্থনে বলা হল, প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য আছে অথবা মানুষের স্বাভাবিক অধিকার রক্ষার জন্যই এটা। প্রয়োজন।

প্রাকৃতিক আর সামাজিক নিয়মকে একই ভিত্তিতে দাঁড় করাবার চেষ্টাও স্থায়ী হল না। আবারও কিছু আপত্তির কারণ দেখা দিল। এবার সমাজনীতির যৌক্তিকতা খোঁজা হল। উপযোগবাদে। আকাঙ্ক্ষিত সমাজব্যবস্থার সপক্ষে যুক্তির ভিত্তি ও বিন্যাস এইভাবে বদলে চলেছে। উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গীও শেষ কথা নয়।

দ্বন্দ্বের সঙ্গে যুক্ত করে পরিবর্তনকে বুঝবার চেষ্টা হয়েছে ___ আর সহযোগ কিন্তু একই সঙ্গে চলে।

শুধু দ্বন্দ্ব অথবা সহযোগিতা দিয়ে এককভাবে পরিবর্তনের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ হয় না। দ্বন্দ্বের প্রকৃতি বোঝা দরকার সহযোগিতাকে পূর্ণ করে তুলবার জন্য।

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম চলছে। আবার প্রকৃতির কাছ থেকে শক্তি আহরণ করেই মানুষ ধাপে ধাপে এগিয়েছে। কৃষির ক্ষেত্রে এর উদাহরণ সহজ। মাটিকে ভালোবেসে কৃষক কৃষিকাজে সফলতা অর্জন করে না। অরণ্যকে ধ্বংস করবার মধ্যে দ্বন্দ্বের দিকটা বড় হয়ে ওঠে। পৃথিবীকে শস্যশ্যামলা করবার ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায় স্নিগ্ধ সান্নিধ্যের দিকটা।

শিল্পবিল্পবের যুগ থেকে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে প্রকৃতির ওপর মানুষের কর্তৃত্ব স্থাপনের ওপর। প্রকৃতি যেন বিরুদ্ধ পক্ষ, মানুষকে তার ওপর জয়ী হতে হবে। অথচ বিজ্ঞানী নিজের মতো করে প্রকৃতিকে ভালোবেসেছে, প্রকৃতি তার কাছে প্রতিপক্ষ নয়। কর্তৃত্ব বিস্তারের চিন্তাকে বড় করে তুলেছে কিছু বিশেষ পরিস্থিতি; যেমন, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বড় আকারে ব্যবহার করা হয়েছে যুদ্ধের স্বার্থে। একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, প্রযুক্তির বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর অগ্রগতি ঘটেছে যুদ্ধসংক্রান্ত গবেষণার মধ্য দিয়ে।

প্রযুক্তির অগ্রগতির ভিতর দিয়ে সমাজের গঠনবিন্যাস বদলে চলেছে। উৎপাদনের জন্য মানুষকে একরকমভাবে সংঘবদ্ধ হতে হয়। উৎপাদনের পদ্ধতি ও কৌশল বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে এই সংঘবদ্ধতার রূপেরও পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। তবে এটাও লক্ষ করা দরকার যে, প্রযুক্তির মোটামুটি একই স্তরে সমাজের বিভিন্ন বিন্যাসও সম্ভব। উৎপাদনের স্তর দিয়ে এককভাবে নির্ধারিত হয় না রাজনীতির কাঠামো, মানুষের মূল্যবোধ অথবা স্বাধীনতা সম্বন্ধে ধারণা।

অনেকখানি জোরজবরদস্তি ছাড়া শিল্পবিপ্লব হয়নি কোনো দেশেই। অর্থশক্তি আর রাষ্ট্র শক্তি মিলিতভাবে এই জবরদস্তি চালিয়েছে। ইতিহাসের এই পর্যায়টাকে রাজসিক বলা যাবে না, সাত্ত্বিক তো নয়ই। যদিও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে শক্তিমত্তার ভাবটা লক্ষ না করে উপায় নেই, তবু সেই রাজসিকতার সঙ্গে এসে মিশেছে ধনতন্ত্রের হিসেবি ব্যবহারিক বুদ্ধি। শ্রমিক শ্রেণীর চেতনাতেও ক্রমে ক্রমে মিশেছে একদিকে সাহস অন্যদিকে সংঘবদ্ধ। স্বার্থবুদ্ধি। বলা যেতে পারে, এর প্রয়োজন ছিল। তবু এখানে স্থিতি সম্ভব নয়। একটা কথা আজ স্পষ্ট। শিল্পোন্নত দেশগুলির ভিতর থেকেই এমন কিছু শক্তি বেড়ে উঠছে। যাতে সমাজের আরো মৌল পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।

শিল্পবিল্পব প্রাচীন আত্মীয় সমাজকে ভেঙে ফেলেছে। তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। নতুন সমাজেও সমস্যার অন্ত নেই। অনুন্নত দেশগুলিতে দারিদ্র্যের সমস্যা প্রধান। উন্নত দেশগুলিতেও কিন্তু মানুষ সুখে নেই। যুদ্ধের আশঙ্কা তো মনের ওপর বিভীষিকার মতো ঝুলছেই। তার বাইরেও কিছু গভীর চিন্তার বিষয় আছে। শিল্পোন্নত দেশে মানুষের এক বড় সমস্যা তার একাকিত্ব। উন্নয়নশীল দেশগুলির নাগরিক জীবনে আজ সেই সমস্যা উপস্থিত। যে-সমাজবিন্যাস ও জীবনদর্শন নিয়ে মানুষ আজ বড় হচ্ছে তাতে একাকিত্ব থেকে সাময়িক মুক্তি পাবার প্রধান উপায় কিছু ব্যয়সাপেক্ষ উত্তেজনা, পরিকল্পিত চাঞ্চল্য। এতে যে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে চারদিকে। নেশাগ্রস্ততা, অপরাধ-উল্লাস ও পৃথিবীজোড়া বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাসবাদ এরই প্রত্যক্ষ লক্ষণ। দারিদ্র্য যেখানে দূর হয়েছে সেখানেও দুঃখ দূর হয়নি। এ সেই দুঃখ নয় যাতে হৃদয় কোমল হয়। এক আত্মঘাতী কষ্ট শিল্পোন্নত সমাজকে ভিতর থেকে কুরে খাচ্ছে।

এইখানে অন্য এক দ্বন্দ্ব। সমাজসংগঠনের সঙ্গে উৎপাদনের সম্ভাবনার বিরোধ নিয়ে এর মূল কথা নয়। এতদিন প্রধান প্রশ্ন ছিল, সমাজব্যবস্থা কীভাবে বদলালে উৎপাদিকা শক্তি বাস্তবে বৃদ্ধি পাবে। সে-প্রশ্ন অন্তত দরিদ্র দেশগুলিতে এখনও গুরুত্ব হারায়নি। তবু নতুন সমাজ নিয়ে চিন্তার ভিত্তি ক্রমে বদলে যাচ্ছে। শান্তি কোন পথে? এটাই প্রধান প্রশ্ন হয়ে উঠছে।

মানুষ আবারও সমাজব্যবস্থার যৌক্তিকতার সন্ধানটাই করতে চলেছে নতুন ভাবে। যুগসন্ধিতে বারবার এইরকমই ঘটেছে।

ইতিহাসের যাত্রাপথে এই-যে নবপর্যায়, এর বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত কিছু দ্বন্দ্বের প্রতি সংক্ষেপে দৃষ্টিপাত করা যাক।

শিল্পবিপ্লবের দাপটে পৃথিবীটা হয়ে উঠছে নগরময়। আধুনিকতার প্রতীক নগর।

মানুষের সভ্যতার গঠনে নগরের কিছু দান আছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ বলতে আমরা যা বুঝি সেসব গঠিত হয়েছে প্রধানত নাগরিক সংস্কৃতির মধ্যেই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের মূল্য সম্বন্ধে নগর আমাদের সচেতন করেছে। বাস্তব অর্থে বিশ্বজনীনতা বলতে যা বোঝায় তার অনেকটাই নগরের দান। স্বাধীনতার অর্থ অসম্পূর্ণ থেকে যায় নগরকে বাদ দিলে।

তবু পল্লীর মাটির স্পর্শ চাই। সেই স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হলে মানুষের সংস্কৃতি হয়ে ওঠে যেন ফুলদানিতে সাজানো কাগজের ফুল। পল্লীতে মানুষ দরিদ্র নিরক্ষর কুসংস্কারগ্রস্ত হতে পারে, তবু সে পাশের মানুষকে প্রতিবেশী বলে জানে। সেখানে মানুষ শুধুই মানুষ স্বার্থসাধনের যন্ত্র নয়। পুরনো পল্লী বিদায় নিচ্ছে। তবু মানুষের মনের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হলে সমাজের ভিত্তিতে চাই এমন এক পল্লীর আদর্শ যার আশ্রয়ে প্রতিবেশীবোধ, অন্তরের টান, সুখদুঃখে সংবেদনশীলতা রক্ষা পাবে, রসের অভাবে শুকিয়ে যাবে না। প্রশ্নটা শুধু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিয়েই নয়, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কের কথাও একই সঙ্গে এসে যায়। নগরে আছে প্রমোদ, পল্লীতে আছে আত্মার বিশ্রাম।

এই সবই আদর্শের কথা। নগর তার আদর্শরূপে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের ধারক, আর পল্লী আত্মীয়তার আধার। এ দুয়ের ভিতর কীভাবে সমন্বয় আনা যায়, এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। কিন্তু প্রশ্নটা আমদের মনে পরিষ্কার হয়ে ওঠা চাই। নয় তত ভ্রান্ত উত্তরকেও সদুত্তর বলে মনে হতে পারে।

এইসঙ্গে এসে যায় জাতীয়তাবাদের কথা। জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেম এক বস্তু নয়। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি–এটা দেশপ্রেমের কথা। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যোগ, আছে আধুনিক রাষ্ট্রের, ক্ষমতা নিয়ে জাতিতে জাতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার। প্রকৃতিপ্রেম অথবা আত্মীয়তাবোধের পুনরুদ্ধারের জন্য জাতীয়তাবাদের দ্বারস্থ হবার অর্থ হয় না। আমাদের এ যুগে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সমস্ত প্রধান প্রধান দেশেই জাতীয়তাবাদ প্রবল। তবু এ যুগের সমস্যার সমাধানের জন্য তার বেশি কিছু চাই। কেউ কেউ আশা স্থাপন করে এক ধরনের শ্ৰেণীতত্ত্বে। কিন্তু সেটাও দুর্বল আশ্রয়। জাতীয়তাবাদের মতোই শ্ৰেণীবাদও ক্ষমতালাভের জন্য সংঘবদ্ধ সংগ্রামের মন্ত্র কণ্ঠে নিয়ে জন্মলাভ করেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের যে-আদর্শ নাগরিক সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য দান তার যতটুকু মূল্যবান তাকেও রক্ষা করা কঠিন হয় শ্রেণীতত্ত্বের বৃহবদ্ধ অসহিষ্ণুতার ভিতর।

শ্ৰেণীতত্ত্বকে কেউ কেউ মানবতাবাদের সঙ্গে কার্যত সমার্থক বলে দেখাতে চেয়েছেন। পার্থক্য তবু আছে। সেই পার্থক্য একই সঙ্গে দার্শনিক ও প্রায়োগিক। শ্ৰেণীতত্ত্বের পরিচিত ভাষ্য বলে যে, শ্রমিকশ্রেণীর জয়লাভই মানবমুক্তর অপরিহার্য শর্ত। জাতীয়তাবাদীর কাছে যেমন স্বজাতির জয়ের চেয়ে বড় উদ্দেশ্য আর নেই, শ্রেণীসংগ্রামে বিশ্বাসী যোদ্ধার কাছে শ্রমিকশ্রেণীর জয়লাভও সেইরকম। আজ হিংসার ক্ষমতা এতই মারাত্মক হয়ে উঠেছে যে, জাতিবিশেষের জয়লাভের আকাঙ্ক্ষা উগ্ররূপ ধারণ করলে মনুষ্যজাতিরই সামগ্রিক বিনাশের সম্ভাবনা। শ্রেণীসংগ্রামের ক্ষেত্রেও এই সাবধান বাণী। উপেক্ষা করা যায় না। সব হিংসাত্মক সংগ্রামের মতোই শ্রেণীসংগ্রামেরও একটা মাদকতা আছে। মানবতাবাদের সঙ্গে এখানেই শ্রেণীবাদের অসামঞ্জস্য।

জাতিতে জাতিতে সংগ্রামে কোনো পক্ষই স্বীকার করে না যে, আঘাতটা সে প্রথম করেছে। প্রত্যেকেরই বক্তব্য, আত্মরক্ষার জন্যই কিংবা অন্যায়ের প্রত্যুত্তরে তাকে বাধ্য হয়ে আঘাত করতে হয়েছে। একই রকমের যুক্তি ব্যবহার করা হয়ে থাকে শ্রেণী সংগ্রামের ক্ষেত্রে, হিংসাকে সমর্থন করা হয় আত্মরক্ষার যুক্তিতে। এই পুরনো তর্ককে পিছনে ফেলে আসা সহজ নয়। অথচ অহিংসায় বিশ্বাস স্থাপন করতে হলে ঐ তর্ককে অতিক্রম করে যেতে হয়। কুঁকি নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। অহিংস যোদ্ধা ঝুঁকি নেন শান্তির সপক্ষে।

এটা অবশ্য আনন্দের কথা যে, সোভিয়েত নেতা গর্বাচভ অহিংসার সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন। এতেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে, তার কিছুদিন পরেই তিনি পারমাণবিক বোমা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা নতুন করে শুরু করবার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। যে-কোনো রাষ্ট্রনেতার পক্ষেই এটা এক কঠিন পরিস্থিতি।

নতুন পৃথিবী গড়বার আন্দোলনে তবে নেতৃত্ব দেবে কারা? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। অথচ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। তার উচ্চারণ সব সময় স্পষ্ট নয়, পদক্ষেপ নির্ভুল নয়। তবু তাকে নবযুগের আন্দোলন বলে চেনা যায়।

নব আন্দোলনের পুরোভাগে দেখা যায় যুবশক্তিকে, সেই যুবশক্তি উৎপাদনের যন্ত্রে যে। স্থায়ীভাবে বাঁধা পড়েনি। এর সংগঠন দুর্বল, স্থায়িত্ব কম, তবু ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মতো আন্দোলনের ধারা আছড়ে পড়ছে। আরো আছে নারীমুক্তির সংগ্রাম। কিছু আতিশয্য অতিক্রম করে সেই সংগ্রামও নতুন পৃথিবীর প্রতিশ্রুতি বহন করে চলেছে।

গ্রামে গ্রামে কিছু আদর্শবাদী মানুষের সাক্ষাৎ মেলে, যারা নিযুক্ত গঠনমূলক কাজে। এদের অনেকেরই মনের দিগন্ত প্রশস্ত নয়। কিন্তু এরই ভিতর কারো কারো দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন, কল্পনা সুদূরপ্রসারী। আরো আছে শান্তি আন্দোলনের কর্মীরা। আছে শিল্পী ও সাহিত্যিক। নতুন সমাজের ছোটো ছোটে প্রতিকৃতি, বিক্ষিপ্ত দ্বীপের মতো, সৃষ্টি করবার কাজে নিযুক্ত কিছু মানুষ। কত দুর্বল মনে হয় এদের প্রচেষ্টা। তবু এদের ভিতর দিয়েই মানুষের প্রাণশক্তি নতুন জগৎ গড়বার পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।

শিল্পবিপ্লব মানুষের ছোটো ছোটো জনপদের সীমানা ভেঙে, তাদের বৈচিত্র্য মুছে দিয়ে, পৃথিবীটাকে যেন একাকার করে দেবার দিকে ঠেলছিল। আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতিকে জাতিচত করে, ধর্মকে বিদায় দিয়ে, পৃথিবীজোড়া এক বহুত্বহীন নাগরিকত্বের স্থাপনা হয়ে উঠছিল আধুনিক প্রগতিবাদের আদর্শ।

একদিকে সাম্রাজ্যবাদীরা দুর্বল দেশগুলিকে এক প্রবল শক্তির পদানত করবার চেষ্টায় মত্ত হয়েছিল। অন্যদিকে রব উঠেছিল, মেহনতী জনতার কোনো পিতৃভূমি নেই, দুনিয়ার মজদুর এক। লেনিন অবশ্য জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তবে লেনিনবাদীর কাছে বিপ্লবের প্রতি আনুগত্যই প্রথম ও প্রধান নীতি, অতএব সেই নীতির বিরুদ্ধাচারণ করে আত্মনিয়ন্ত্রণও চলবে না। সোভিয়েত শিবিরের অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশ যদি আজ সেই শিবির থেকে বেরিয়ে আসতে চায় তবে মহান বিল্পবের বিরুদ্ধে শত্রুতা বলেই, তাকে সহজে মেনে নেওয়া যাবে না। বিপ্লব আর সোভিয়েত নেতৃত্ব সমার্থক হয়ে গেছে।

এইসবের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া অনিবার্য, প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। শিবিরবদ্ধ বিপ্লববাদও আর মানুষের মুক্তির আদর্শ নয়।

মানুষ এক, কিন্তু বহুত্বে চিহ্নিত। তার ঐক্য ও বৈচিত্র্য দুইই শ্রদ্ধেয়। স্বশাসিত বহু জনপদ নিয়ে এক যুক্তরাজ্য, প্রগতির পথ এই দিকে। একদিন সারা পৃথিবীই হবে। এইরকম এক যুক্তরাজ্য, আজকের এই দুরাশা আগামী কালের লক্ষ্য। যে-যুগ অবসিত হতে চলেছে তার ঝোঁক ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের দিকে আর্থিক, রাজনীতিক, সব ক্ষমতার ক্ষেত্রেই এইরকম। এবার অগ্রসর হতে হবে সাম্য ও বিকেন্দ্রীকরণের পথে।

সত্য এক, একথা আমরা শুনেছি। কিন্তু ব্যক্তির চেতনায় সত্য প্রতিফলিত হয়। বহুরূপে। ব্যক্তির আনুগত্য সেই সত্যের প্রতি যাকে সে নিজের চেতনায় লাভ করে। একই কথা এসে যায় সংস্কৃতি সম্বন্ধেও। সত্যের যে খণ্ডিত ও বহুমুখী প্রকাশ তারই দ্বন্দ্ব ও সহাবস্থানের ভিতর দিয়ে মানুষের যাত্রা পূর্ণতার দিকে। দ্বন্দ্ব চাই, এ ছাড়া গতি নেই। দেখতে হবে সেটা অধোগতি না হয়। আমরা যখন যুক্তির কথা বলি, অহিংসার কথা বলি, তখন যুক্তি ও অহিংসাকেও মানতে হবে সংগ্রামের শক্তি বলে, এগিয়ে যাবার শক্তি বলে। অজ্ঞতা কুসংস্কার নিষ্প্রাণ আচার, এইসবের বিরুদ্ধে যুক্তি এসেছে সমালোচকের ভূমিকায়। দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে যুক্তিরও যাত্রা অনিবার্যভাবে স্তর থেকে স্তরাস্তরে। শুধু সমালোচনা দিয়ে অন্ধকার দূর করা যায় না। যুক্তিকে যুক্ত হতে হয় অন্য এক আনন্দ ও জ্যোতির্ময়তার সঙ্গে, তবে সে জয়ী। রবীন্দ্রনাথের জীবনের ভিতর দিয়ে এই সত্যটি বাণীরূপ পেয়েছে। হিংসার ভিতরও একটা প্রাণের শক্তি আছে, সেটা নিষ্প্রাণতার চেয়ে ভালো। তবু সত্যকে অন্য এক তামসিকতায় আবৃত করে হিংসার শক্তি। সেই দ্বন্দ্ব তত সার্থক যত তাকে পাই অহিংসার সীমার মধ্যে। এইখানে ইঙ্গিত সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্য এক স্তরের দিকে। যদিও সত্যের প্রকাশে আছে বহুত্ব তবু শান্তি অবিভাজ্য।

অহিংসা দিয়েই কথা শেষ করা যাক।

যে বন্য প্রকৃতিতে আদিম মানুষকে জীবনধারণ করতে হয়েছে সেখানে অন্যান্য অনেক জীবের তুলনায় সে ছিল দুর্বল। দন্ত ও নখরের শক্তিতে প্রবলতর বহু হিংস্র প্রতিবেশীর মধ্যে সেদিন ভীত ও দুর্বল মানুষ নিজেকে কষ্টে রক্ষা করেছে অস্ত্রের সাহায্যে। এইখানে ছিল তার শ্রেষ্ঠত্ব। অন্য প্রাণী যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাই তার সম্বল। নিজেরই সৃষ্ট হাতিয়ারের সাহায্য নিতে জানে মানুষ। আদিতে এটা ছিল দুর্বল মানুষের আত্মরক্ষার উপায়। কিন্তু অস্ত্রের ব্যবহার সেইখানে সীমাবদ্ধ রইল না। বাঘের যেটা ঘাতকশক্তি প্রকৃতিই তার সীমা টেনে দিয়েছে, তার আর বিশেষ বৃদ্ধি সম্ভব নয়। মারণাস্ত্রের স্রষ্টা। যেহেতু মানুষ নিজে অতএব প্রকৃতির উদ্দেশ্য নিয়ে তার সীমা টানা নেই, সেটা ক্রমাগত বেড়ে চলে। এর একটা উত্তেজনা আছে, নেশা আছে। একদিন অস্ত্র আর দুর্বল মানুষের আত্মরক্ষার সহায় রইল না, বরং দুর্বলের উপর প্রবলের আধিপত্যের উপায় হয়ে উঠল। শুরু হল এইভাবে মানুষের সভ্যতার রাজসিক পর্যায়।

এতেও বহুদিন পর্যন্ত তেমন বড় বিপদ দেখা দেয়নি। অবস্থার একটা গুণগত পরিবর্তন হয়েছে একেবারে আধুনিক কালে পৌঁছে। মানুষের হাতে আজ যে ধ্বংসের শক্তি এসে পড়েছে তাতে যে শুধু দুর্বলের উপর প্রবলের অত্যাচারই সম্ভব তাই নয়; সংকট আজ আরো গভীর। মানুষ আজ নিজের গড়া শক্তিতে মনুষ্য জাতিটাকেই ধ্বংস করতে পারে। এই সম্ভাবনা আগে ছিল না। অতএব আজ প্রয়োজন হয়েছে হিংসার প্রশ্নে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী।

শান্তির জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল আরো আগেই, প্রবলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষায় কিন্তু প্রবল তাতে বড় বেশি কর্ণপাত করেনি। ক্রমে সমস্যা কঠিন। হয়ে উঠেছে। আজ যখন ধ্বংসের শক্তিটা এমনই যে তাকে নিয়ন্ত্রণের ভিতর আনতে না পারলে দুর্বল ও প্রবল সহ গোটা মানুষের সমাজটাই বিনষ্ট হবে, তখন এই মহতী বিনষ্টির সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করা কারো পক্ষেই আর নিতান্ত পাগলামি ছাড়া কিছু নয়। ইতিহাস। যেন গভীর থেকে গভীরতর সংকট সৃষ্টি করে পরীক্ষা করতে চাইছে কবে মানুষ নতুন পথ। বেছে নেবে। একদিন মানুষের আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে প্রয়োজন হয়েছিল হিংসার। অস্ত্র। আজ মানুষের সামগ্রিক আত্মরক্ষার জন্যই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে অহিংসার পথ।

চেতনার এক নতুন পদক্ষেপ ছাড়া সভ্যতার এই উত্তরণ সম্ভব নয়। যেমন মৃত্যুর। চিন্তা দূরে ঠেলে রেখে প্রতিদিনের জীবনে মানুষ বাঁচে তেমনি বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্করতাকেই হয়তো মাঝে মাঝে ভুলে থাকা যায়। তবু ভোলা যায় না অন্য এক চিত্র। একদিন মানুষের আদর্শবাদী মনকে আকৃষ্ট করেছিল সর্বহারা শ্রমিক! শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সেদিন প্রয়োজন হয়েছিল দয়া নয়, সংগঠন ও সাহস। সংঘবদ্ধ শ্রমিক আজ সবদেশেই একটা প্রতিষ্ঠা অর্জন করে নিয়েছে, নিচ্ছে তারা আর সমাজের হতভাগ্যতমদের ভিতর গণ্য নয়। কিন্তু চোখের সামনে ছড়িয়ে পড়ছে অন্য এক নরক। এদের পাওয়া যায়। সর্বত্র, সর্বস্তরে। সাম্যবাদী সমাজও আর নেশা ও মদ্যপতা থেকে মুক্ত নয়। সেই সঙ্গে সংক্রামিত হচ্ছে বিক্ষিপ্ত হিংসার আকর্ষণ।

এইসব বীভৎসতার ভিতর থেকেই মানুষের মনে এক নতুন আদর্শবাদের ডাক স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে।

কৌশল আর বীরত্বই যথেষ্ট নয়। আরো চাই সেই চেতনা যেখানে মিলিত হয়েছে অভয় ও করুণা। আমরা কি জয়ী হব উত্তরণের এই পরীক্ষায়? আমরা কি জয়ী হতে পারি এই উত্তরণ ছাড়া? এ-যুদ্ধে ও-যুদ্ধে কে জিতল কে হারল সেটা বড় কথা নয় কোন পরিণতির দিকে মানুষ অগ্রসর হচ্ছে সেটাই প্রধান কথা। দীর্ঘ সেই যাত্রা; তবু সেটাই পথ।

মানুষের মৌল দুরবস্থা–বন্ধন। শোষনের চেয়েও বন্ধন মৌল। মানুষ বাঁধা পড়ে অন্ধ কুসংস্কারের কাছে, অত্যাচারী শাসকের কাছে, অবশেষে নিজেরই ভয় লোভ অহংকারের কাছে। বন্ধনের নানা রূপ, বিচিত্র পথে বন্ধনমুক্তির সন্ধান, এই নিয়ে ইতিহাস।

এ-আশা কি দুরাশা, যে, বহু ব্যর্থতা বহু মৃত্যুকে অতিক্রম করে শেষ অবধি মুক্তির পথেই মানুষের সভ্যতা এগিয়ে যাবে?

দ্বন্দ্ব ও উত্তরণ (১৯৮৯)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *