2 of 2

৭.১ মানুষ! মানুষ!!

সপ্তম অধ্যায় – হে মহাজীবন, হে মহামরণ

৭.১ মানুষ! মানুষ!!

ছোটবেলায় নানা দৃশ্য যেমন গভীরভাবে মনে অঙ্কিত হত এখন আর তেমন হয় না। তবু সেদিনের কথা স্পষ্টই মনে পড়ে। ১৩ই মার্চ, ১৯৬৯। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ সত্যেন্দ্রনাথ সেন মহাশয়কে তাঁর অফিসঘরে একদল যুবক বন্দী করে রেখেছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে এমন সব কথা সমস্বরে উচ্চারণ করছিলেন যা লিপিবদ্ধ করতে প্রবৃত্তি হয় না। ডঃ সেনের সঙ্গে অন্যান্য যে অধ্যাপকেরা ছিলেন আমিও তাঁদের একজন। বিক্ষুব্ধ যুবকদের কলহ যদিও উপাচার্যের সঙ্গেই তবু আমার বিরুদ্ধেও ওঁদের আক্রোশ তীক্ষ্ণস্বরে ধ্বনিত হচ্ছিল। মার্ক্স লেনিন ও গান্ধী সম্বন্ধে আমার মতামতের উল্লেখ মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল। আমার একাধিক প্রবন্ধে ওঁরা স্পষ্টতই ক্রুদ্ধ। আমাকে পুড়িয়ে মারবার ভয় দেখানো হচ্ছিল।

আমি খুব সাহসী লোক নই। চেষ্টা করলেও সম্ভবত শল্যচিকিৎসক হতে পারতাম না, কারণ রোগীর আর্তনাদ আমাকে কেমন বিমূঢ় করে ফেলে। তবে ব্যক্তিগত মৃত্যুর চিন্তা বহুকাল যাবৎই আমাকে তেমন ভীত করে না। কাজেই সেই সন্ধ্যার দৃশ্য দেখছিলাম অনেকটা নিরাসক্ত দর্শকের মন নিয়ে। আমার মনে পড়ছিল কয়েক শতাব্দী পূর্বের ইয়োরোপের ইতিহাসের এক হিংস্র অধ্যায়ের কথা। এক ধর্মমতের মানুষ সেদিন পুরম। উৎসাহে অপর মতের মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে। তারপর যুগের পরিবর্তন হয়েছে। ভলতেয়র থেকে জন স্টুয়ার্ট মিল পর্যন্ত অনেকেই অবিস্মরণীয় ভাষায় পরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু মানব প্রকৃতির আমূল পরিবর্তন সহজে হয় না। বিপ্লবের নামে সেদিন আবারও মানুষকে জীবন্ত পোড়াবার ধ্বনি শুনছিলাম। আমি বুঝতে চেষ্টা করছিলাম সেই মনকে যে-মনের গভীরে এই জিঘাংসার জন্ম।

যে-যুবকেরা সেই সন্ধ্যায় আমাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুবাক্য উচ্চারণ করছিলেন তাঁরা যে আদর্শবাদী এতে আমার সন্দেহ নেই। প্রেমই এঁদের হিংসাকে এমন কুণ্ঠাহীন করেছে। ইয়োরোপে যে ধর্মান্ধ মানুষেরা একদিন বিধর্মীকে পুড়িয়ে মেরেছিলেন তাঁরাও নিঃসন্দেহে আদর্শনিষ্ঠ ছিলেন। প্রবল হিংসা ও আদর্শপ্রেমের এই সংমিশ্রণেই মানুষ অন্যান্য জীবের চেয়ে রহস্যময় ও ভয়ংকর। মানুষের মনে হিংসা ও প্রেমের এই মিশ্রণকে যদি না বুঝি তো মানুষকে বোঝা হা।

.

এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, জীবনধারণের জন্য যতখানি হিংসার প্রয়োজন তার চেয়ে অনেকটা বেশী পরিমাণ হিংসাই মানুষের প্রকৃতিতে আছে। এর কারণ সহজ। মানুষের। মনের গভীর স্তরে জমা হয়েছে এক দীর্ঘ প্রাগৈতিহাসিক যুগের অন্ধকার, যখন মানুষ ছিল অজ্ঞ, ভীত, মারণাস্ত্রে দুর্বল। সেই বিপদসংকুল গণনাতীত দীর্ঘযুগের উত্তরাধিকারী আজকের পৃথিবীর মানুষ। যে বর্বর অতীতকে আমরা বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় পিছনে ফেলে এসেছি আমাদের অন্তঃপ্রকৃতিতে তার আধিপত্য আজও অব্যাহত। মানুষের মনে সহজাত হিংসার পরিমাণ এ যুগের প্রয়োজন দিয়ে নির্ধারিত হয়নি। এ যুগ আমাদের শিখিয়েছে নতুন ভাষা। পুরাতনী হিংসাকে আমরা প্রকাশ করি এই নতুন ভাষায়।

অন্তঘাতী হিংসায় মানুষ অন্যান্য বহু জীবকেই ছাড়িয়ে যায়। কলকাতার উপকণ্ঠে যেখানে আমার বাস, সেখানে মানুষে মানুষে খুনোখুনি লেগেই আছে। আমাদের বাড়ির পিছনে ধানক্ষেত। রাতে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। পাড়ার কুকুরের সঙ্গে শেয়ালের মাঝে মাঝে লড়াই লাগে। এক আধটা শেয়াল কখনও কখনও মারা যায়। কিন্তু কোনো। কুকুর অন্য কুকুরকে খুন করেছে এমন চোখে পড়েনি। মানুষ যদি পারস্পরিক হিংসায় কুকুরের স্তরে উন্নীত হতে পারতো তাহলে আমাদের অঞ্চলে শান্তি বৃদ্ধি পেত।

প্রাণিতত্ত্ববিদেরা মনুষ্য জাতির ভিতর অন্তঘাতী হিংসার এই আধিক্যের কারণ অনুসন্ধান করেছেন। মানুষের তুলনায় অন্য বহু জীবের দন্ত ও নখরের শক্তি বেশী, অর্থাৎ আঘাত করবার প্রকৃতিদত্ত সামর্থ্য তাদের অধিক। এসব জীবের হিংস্রতা যদি প্রধানত স্বজাতির বিরুদ্ধে চালিত হত তা হলে এতদিনে সম্ভবত এরা জাতি হিসাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। সৃষ্টির আদিপর্বের মানুষ অপেক্ষাকৃত দুর্বল জীব বলেই অধিক পরিমাণ পারস্পরিক হিংসা সত্ত্বেও জাতি রক্ষা করতে পেরেছে। আদিযুগে তাই মানুষের অন্তঘাতী হিংসাকে সংযত করবার তাগিদ ছিল কম।

বিপদ দেখা দিল যখন মানুষের দুর্বল দত্ত ও নখরের সঙ্গে যোগ হল তার নিজেরই হাতে গড়া সেই মারণাস্ত্র, যুগের পর যুগ যার ধ্বংসাত্মক শক্তি বেড়েই চলেছে। প্রাক্সভ্যতা যুগে মানুষের প্রাণী হিসাবে দুর্বলতা ও হিংসার ভিতর যে স্বাভাবিক ভারসাম্য ছিল সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেটা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হ’ল। এ অবস্থায় মানুষের আদিম জিঘাংসাকে সামাজিক বাধা নিষেধ দিয়ে ক্রমশ সংযত করে তবেই কোনো প্রকারে আত্মঘাতে মৃত্যুর হাত থেকে মানুষ নিজেকে বাঁচিয়ে চলেছে। যে-পরিমাণে বিজ্ঞান মানুষের হাতে মারবার শক্তি বেশী করে তুলে দিয়েছে সে-পরিমাণে হিংসার বিরুদ্ধে সামাজিক বাধা নিষেধের প্রয়োজনও বেড়েছে।

আমার বক্তব্য তবু এই নয় যে, অহিংসার মূলে আছে শুধু নেতিবাচক নীতি। মানুষের বৃহত্তম নৈতিক বিধানগুলির একটি নিম্নমাত্রা আছে যেখানে শুধু শুনি ‘না’, আবার একটি ঊর্ধ্বমাত্রা আছে যেখানে শুনি হাঁ।

.

মানুষ সেই আশ্চর্য জীব যার হিংসার যেমন সীমা নেই তার প্রেমও তেমনই বাধা মানে না। কাকপক্ষীও শোকসভা করে; কিন্তু শুধু মানুষই পারে সকল মানুষের হয়ে সজ্ঞানে ক্রুশবিদ্ধ হতে। মানুষই পারে এই আত্মত্যাগের কাছে যুগে যুগে মাথা নীচু করে দাঁড়াতে।

সাংসারিক কর্মকাণ্ডে আমরা পরস্পরের সঙ্গে নানা সম্পর্কে আবদ্ধ। পদমর্যাদা নিয়ে ব্যক্তি যেখানে ব্যক্তির সম্মুখীন সেখানে তার দাবিদাওয়া, দায়িত্ব ও অধিকারের প্রশ্নটাই বড়। কিন্তু পদমর্যাদার বাইরেও মানুষের একটা অস্তিত্ব আছে। একথা জীবনের সাধারণ সময়ে হয়তো আমরা ভুলে থাকি; তবু বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে, প্রেম অথবা মৃত্যুর লগ্নে কিংবা কোনো শিশুতীর্থে, সেই সত্য আমরা স্মরণ করি। মানুষের মনের একটি বৃহৎ ক্ষেত্র আছে যেখানে সকল মানুষই সকলের স্বজাতি। এই স্বজাতির সঙ্গে যুক্ত হবার একটা বাসনা মানুষের মনের গভীরে আছে। এটা যদি মানুষের চিরন্তন বাসনা না হত তবে পৃথিবীর সকল মহৎ ধর্মে একটি বৃহৎ ভ্রাতৃত্বের সুর এমন শতাব্দীর পর শতাব্দী অবিরত ধ্বনিত হত না। মানুষের এই প্রীতি সম্ভবত হিংসার চেয়েও মৌলিক। মানুষ প্রীত হয় কারণে ও অকারণে; কারণে, অর্থাৎ, স্বার্থের যোগাযোগে; আবার অকারণে, অথবা অপরের ভিতর নিজেকে আবিষ্কার করবার ফলাকাঙ্ক্ষাহীন আনন্দে। হিংসার। কারণ ভয়, যদিও যুগান্তরের পুঞ্জীভূত ভয়কে এই মুহূর্তের স্বার্থ নিয়ে সব সময়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।

মানুষকে স্বার্থান্বেষী, সামান্য জীব হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু এটা মানুষ সম্বন্ধে নিতান্তই অসম্পূর্ণ ধারণা। মানুষের আদিম হিংসা স্বার্থবুদ্ধিকে অতিক্রম করে যায়। আবার তার ভ্রাতৃত্ববোধ সম্বন্ধেও সেই একই কথা সত্য। হিংসা যদি স্বার্থবুদ্ধিকৈ ছাড়িয়ে না যেত তো এ যুগের বিশ্বজোড়া রক্তাক্ত অধ্যায়ের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন হত। মানুষই সেই জীব যে হিংসা পুষে রাখে এবং অতীতের হিংসা নিয়ে অন্ধের মতো ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে। অন্যান্য জীবের ভিতর এটা কদাচিৎ দেখা যায়; মানুষের ইতিবৃত্তে এটা নিত্যকার ঘটনা। আবার মানুষের প্রতি মানুষের সহজাত আকর্ষণের প্রকাশও অপূর্ব। মানুষের মন চায় মানুষের মন; আর এই স্বাভাবিক আকর্ষণ যে মানুষের আদর্শ কল্পনায় স্থান পেয়েছে শুধু তাই নয়, ইতিহাসও এর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। স্বাদেশিকতার কবি ও দার্শনিক স্থাপন করতে চেয়েছেন এক জাতি, এক প্রাণ, একতা { জাতীয়তাবাদ মানুষের স্বাভাবিক ভ্রাতৃত্ববোধেরই আংশিক প্রকাশ, বহু ক্ষেত্রে বিকৃত প্রকাশও বটে। ইসলাম ও অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ের ভিতর পৃথিবীজোড়া যে। ঐক্যবন্ধন তাও অনুরূপ উপাদানে গড়া। যে-আদর্শ মানুষকে সাময়িক স্বার্থের ওপারে নিয়ে যায় তাকে ছাড়া মানুষ অসম্পূর্ণ। কিন্তু সেই আদর্শকে যখন স্থানে কালে সীমাবদ্ধ কোনো বস্তুর সঙ্গে অভিন্ন করে দেখা হয় তখনই বিপদ। ইতিহাসে বিকৃত আদর্শের প্রভাব অপরিসীম।

.

মানুষের একটা দিক আছে যেটা কালে আবদ্ধ, বিশেষ সামাজিক সম্পর্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তার আর একটি দিক আছে যেখানে সে নিত্যকালের মানুষের সঙ্গে যুক্ত হতে উন্মুখ। যে-মানুষ কালকে অতিক্রম করতে চায় তাকে বাদ দিয়ে যে-মানুষ কালে আবদ্ধ তাকেও বোঝা যায় না; কারণ এ দুয়ের ঘাতপ্রতিঘাতে মানুষের ইতিহাস বিবর্তিত।

এ যুগে সাম্যবাদ মানুষের মনকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে। আদর্শ সাম্যবাদী সমাজে মানুষ বাইরের বন্ধন থেকে মুক্ত হবে, পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হবে সৃষ্টিশীল কর্মের সূত্রে, শুদ্ধ মনুষ্যত্বের পরিচয়ে। মধ্যযুগের মানুষ স্বর্গের কল্পনায় বিভোর ছিল। সাম্যবাদ তথা নৈরাজ্যবাদ এ যুগের “উটোপিয়া” অথবা লৌকিক স্বৰ্গকল্পনা। মানুষের যেমন আদর্শে সাড়া দেয় তাকে বাদ দিয়ে শুধু সাময়িক স্বার্থবুদ্ধি দিয়ে সাম্যবাদের আবেদন ব্যাখ্যা করতে যাওয়া ভুল। মার্ক্সবাদী অবশ্য বিশ্বাস করেন যে তাঁর আদর্শের বনিয়াদ ইতিহাসের বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায়। কিন্তু ধর্মের জয় অবশ্যম্ভাবী এই বিশ্বাসের যেমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই, পৃথিবীতে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে এই ধারণারও তেমনই যুক্তিতে ভিত্তি নেই। আমরা যা প্রাণপণে চাই তাকে অবশ্যম্ভাবী বলে ভাবতে ভালোবাসি। আদর্শকে প্রাণপণে চাইতে পারায় মানুষের মহত্ত্ব। আদর্শের জন্য কর্মে এবং সেই কর্মে সামান্য সাফল্যেও মানুষের গৌরব। কিন্তু আমাদের দৃষ্টির সীমার ভিতর কোনোদিন সেই আদর্শ তার সম্পূর্ণতায় রূপায়িত হবে এই কল্পনাকে বিজ্ঞানসম্মত মনে করাটাই অবৈজ্ঞানিক। কাল ও কালাতীতের পারস্পরিক আকর্ষণেই আদর্শের সৃষ্টি।

তরুণ মার্ক্স একদিন উপলব্ধি করেছিলেন যে, কর্মবিভাগই কর্মবন্ধন। তিনি দেখেছিলেন যে, শ্রমবিভাগ একদিকে উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতির জন্য অপরিহার্য; আবার অন্যদিকে কর্মকে খণ্ড খণ্ড করে বাঁধাধরা নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ করে মানুষের ব্যক্তিত্বের উপর এই ব্যবস্থাই হয়ে ওঠে এক কঠোর বন্ধন। জীবিকার জন্য এই ব্যবস্থায় আমাদের ঢুকতে হয়। তারপর চলে কাজের দিনে আমাদের বন্দীদশা। মার্ক্স তাঁর তরুণ বয়সের কোনো কোনো পুস্তকে এই ভাবটি সবিস্তারে আলোচনা করেছিলেন। পরবর্তী কালে যদিও কর্ম বিভাগের চেয়েও উৎপাদনে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রশ্নটিই তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠেছিল তবু তাঁর তরুণ বয়সের সেই চিন্তা তিনি কখনও বিস্মৃত হননি। তাঁর আদর্শ সাম্যবাদী সমাজে কর্মবিভাগ থেকে তিনি ব্যক্তিকে মুক্তি দিয়েছেন। সেখানে একই মানুষ “সকালে শিকার করবে, দুপুরে মাছ ধরবে, বিকালে মাঠে গরু চরাবে এবং সন্ধ্যায় আহারের পর (সাহিত্যদর্শনাদি) আলোচনা করবে।” কথাগুলি মার্ক্স নিজেই লিখেছিলেন। বাস্তব। বুদ্ধিকে এখানে অতিক্রম করে গেছে কামনা শক্তি। মার্ক্সের নাম কণ্ঠে নিয়ে প্রথমে রুশ দেশে এবং পরে আরও একাধিক দেশে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। রুশ দেশে শিল্পে ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ হয়েছে অর্ধশতাব্দী আগে। কিন্তু মালিকানা লোপ পেলেই কর্মবিভাগ। লোপ পায় না। কর্মবিভাগের ভিত্তি উৎপাদন ব্যবস্থার আরও গভীরে। তাই রুশ দেশেও কর্মবিভাগ ও কর্মবন্ধন তেমনই অব্যাহত যেমন অন্যান্য শিল্পপ্রধান দেশে। সেই সঙ্গে আছে নিয়মশৃঙ্খলা, রাষ্ট্র ও আমলাতন্ত্র। এখান থেকে সেই কল্পিত সাম্যবাদে যাবার পথ মার্ক্সই কি জানতেন? কিন্তু সেই স্বর্গ যে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে এই বিশ্বাসে মার্ক্সবাদী অটল। ইতিহাসের বিশ্লেষণ অনুষঙ্গ মাত্র বিশ্বাসের এই অটলতা আসে কালাতীত আদর্শের আকর্ষণ থেকে।

ধনতন্ত্র আদর্শ ব্যবস্থা নয় একথা আজ সাধারণভাবে স্বীকৃত। বিশ শতকের “উটোপিয়া” সাম্যবাদী সমাজ। আমার কম্যুনিষ্ট বন্ধুদের দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একদল সোভিয়েত পরিকল্পিত অর্থনীতির প্রতি অনুরক্ত। অন্যদল মূলত নৈরাজ্যবাদী। এঁরা জানেন যে, সোভিয়েত দেশের শ্রমিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভিতর বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে এক অতি স্ফীত আমলাতন্ত্র। ওদেশের চাষীর সঙ্গে যৌথ খামারের আজও মনের মিল হয়নি। শিল্পী সাহিত্যিকের স্বাধীনতা ওখানে শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরাচারে অতিশয় খণ্ডিত। এ সব তথ্য প্রথম দলের বন্ধুরাও হয় তো সম্পূর্ণ অস্বীকার করবেন না। তবে ওঁরা যুক্তি ফাঁদবেন যে, এ সবই ধনতান্ত্রিক সমাজচেতনার প্রলম্বন মাত্র। এ যুক্তিতে প্রকৃত অবস্থার কিছু তারতম্য হয় না। মোট কথা হিংসাত্মক বিপ্লবের আগুনে সমাজের বহিরঙ্গের যে অংশটা বিনাশ করা যায় তাতে অসাম্যের গভীরতর কারণ নির্মূল হয় না। বরং সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্রে অসাম্য নতুন সমর্থন খুঁজে পায়। তা ছাড়া দলীয় ক্ষমতার কাড়াকাড়ির প্রশ্ন বাদ দিলেও আর্থিক পরিকল্পনার রূপায়ণে কয়েকটি কঠিন সমস্যা এড়ানো যায় না। অধস্তন সমস্ত সংগঠনের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব না থাকলে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে যথাযথ রূপদান করা কঠিন। এই কারণে পরিকল্পিত অর্থনীতিতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের দিকে একটা ঝোঁক দেখা দেয়। অথচ কেন্দ্রে ক্ষমতা যতই বৃদ্ধি পায় ততই অধস্তন সংগঠনগুলি অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পরিকল্পনার গুণাগুণ যাই হোক-না-কেন সেটা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া পরিকল্পনা মনে হয়। পরিকল্পনার সফল রূপায়ণ। এতেও আবার অসম্ভব হয়ে ওঠে। এ সমস্যার বিভিন্ন সমাধান সম্ভব এবং কোনো সমাধানই কার্যত সর্বাঙ্গসুন্দর নয়। সাম্যবাদের এই বাস্তব চিত্রের সঙ্গে আদর্শ চিত্রের পার্থক্য বিস্তর। কিন্তু ভক্ত সাম্যবাদী এই বিকৃত বাস্তবের পিছনে এক অবিকৃত আদর্শের আসন্ন অভ্যুদয় নিয়ত অনুভব করেন।

.

“উটোপিয়ার একটি বিপদ আছে। মিথ্যা ধর্মের মতোই এ যুগের “উটোপিয়া” প্রেমের প্রচণ্ড শক্তিকে হিংসার দাসে পরিণত করেছে।

মানুষের মনের আদিম হিংসাকে সভ্যতা বহু যত্নে নানা বাধা নিষেধ দিয়ে সংযত করে। রাখে। যে-স্বার্থ শুধুই ব্যক্তিগত সেই ক্ষুদ্র স্বার্থের এত জোর নেই যে সভ্যতার স্বীকৃত বাধা নিষেধকে সে সদর্পে ও প্রবলভাবে অস্বীকার করে। আদর্শের নামে যখন হিংসাকে আহ্বান করা যায় তখনই সেই বিশোরক শক্তির সৃষ্টি হয় যাতে সমস্ত নীতি ধূলিসাৎ হয়ে। যায়। আমরা যখন একটি বড় ধারণাতে সমগ্রভাবে বিশ্বাস স্থাপন করি এবং সেই আদর্শকে কার্যে পরিণত করার পথে একটি স্কুল বাধাকে চরম বাধা বলে কল্পনা করি তখন সেই বাধা অতিক্রমের জন্য কোনো উপায়কেই আর নীতির দিক থেকে অগ্রাহ্য বলে মেনে। নিতে পারি না। অতি বড় অন্যায় কর্মকেও তখন এত বড় একটা উদ্দেশ্য লাভের জন্য গ্রহণযোগ্য মনে হয়। ঈশ্বরকে যতক্ষণ জগতের উর্ধ্বে অথবা ভক্তের অন্তরের জিনিস ভাবা যায় ততক্ষণ জাগতিক কলহে তাঁকে টেনে নামানো হয় না। কিন্তু ঈশ্বরকে যখন বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক করে দেখা হয় এবং শমিত্র সেই সূত্রে নির্ধারিত হয়, তখনই বিপদের শুরু। সাম্যবাদী প্রচেষ্টাকে শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব এমনই একটা ধর্মযুদ্ধের ব্যাপার করে তুলেছে। শ্রেণী বিশেষই যদি পরম উদ্দেশ্য সাধনের পথে চরম বাধা হয় তবে তাকে সর্বপ্রকারে উচ্ছেদ করাই প্রয়োজন।

উদ্দেশ্য ও উপায়ের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় তাই এ কথাটা প্রথমেই মনে রাখা আবশ্যক যে, কোনো স্থূল বাধাই আদর্শ সিদ্ধির পথে শেষ বাধা নয়। বিধর্মীকে আগুনে পুড়িয়ে ধর্মকে বিপন্মুক্ত করা যায়নি। হিংসাদ্বারা কখনও কোনো ফললাভ হয়নি এমন নয়। অহিংসা উচ্চতর নীতি হলেও আক্রমণের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য বলপ্রয়োগকে এক কথায় অন্যায় বলা যায় না। কিন্তু হিংসাদ্বারা কদাচিৎ দেশের কোনো স্থায়ী কল্যাণ সাধিত হয়। বরং হিংসাকে উপায় হিসাবে গ্রহণ করলে তারই ফলে শেষ উদ্দেশ্য সাধনের পথে নতুন বাধা সৃষ্টি হয়। প্রতিক্রিয়াশীলদের নিধনের জন্য যে-অস্ত্র শানিত হয়েছে তাতেই আবার বিপ্লবীরা পরস্পরকে বিনাশ করেছেন। হিংসাকে পরিবর্তনের প্রধান অস্ত্র হিসাবে গ্রহণ করলে পুরনো ব্যবস্থা যদিবা ভাঙ্গে নতুন ব্যবস্থার মূলে হিংসা ও সন্দেহই থেকে যায়। এরই ভিত্তিতে স্বৈরাচারের নতুন সৌধ সৃষ্টি হয়।

প্রগতি নিশ্চয়ই কাম্য। বিজ্ঞানের অনুশীলন চাই, কারণ পশ্চাৎপদ দেশগুলিতে বিজ্ঞানের প্রয়োগের সাহায্যে ধনোৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়া দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব নয়। ব্যবহারিক প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা বাঞ্ছনীয়। শ্রমের সঙ্গে পারিশ্রমিকের ঘনিষ্ঠতাআবশ্যক, কারণ তা নইলে শ্রমে উৎসাহ আশা করা যায় না। উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অসাম্য যত কমানো যায় ততই ভালো। এ সবই স্বীকার্য এবং এজন্য দেশজোড়া পরীক্ষানিরীক্ষা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সতর্ক সংগ্রাম ও গঠনধর্মী কর্ম প্রয়োজন। কিন্তু সেই সঙ্গে এই কঠিন সত্যটাও মনের এক কোণে জেনে রাখাই ভালো যে, সমাজ কখনও সর্বাঙ্গসুন্দর হবে না; মানুষের জীবনে দুঃখেরও কখনও অবসান ঘটবে না।

প্ল্যাটোর মতোই প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসীরা দেহ ও আত্মার ভিতর বিভেদ করতেন। তাতে অপর সত্যাসত্য যাই ব্যক্ত হোক না কেন একটা মূল বিশ্বাস স্পষ্ট হত। মানুষের মনের মহত্তম অংশ একটি আদর্শের ধ্যানে অভ্যস্ত, যে-আদর্শ দেহ ও কালের সীমাবদ্ধতায় কখনও পূর্ণতা লাভ করে না। আত্মার অমরত্বের কথা বাদ দিলেও এই বিশ্বাসটিই অবশিষ্ট থাকে। আমাদের এই বিজ্ঞানের যুগে প্রকৃতির উপর মানুষের কর্তৃত্ব বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আত্মাকেও দেহেরই একটি গুণ মাত্র ভাবতে শিখেছি। অর্থাৎ, মানুষ যখন মহাকাশের যাত্রী হতে পেরেছে, একদিন যা কল্পনা ছিল আজ যখন তা বাস্তবে পরিণত হচ্ছে, তখন মানুষের ক্ষমতার কোনো সীমাই আমরা আর মানতে রাজী নই। বাইরের সমস্ত বাধা সম্বন্ধে মানুষ, বিশেষত তরুণেরা, আজ অধৈর্য। অথচ বহিঃপ্রকৃতির উপর আমাদের কর্তৃত্ব যতই বৃদ্ধি পাক না কেন, মানুষের অন্তরের আদর্শকে বাস্তবে পরিণত করার পক্ষে সেটা যথেষ্ট নয়। প্রকৃতির শক্তিকে আমরা চালনা করতে শিখেছি, কিন্তু হিংসার শক্তি এখনও অজিত। টেস্ট টিউবে ভূণ সৃষ্টি সম্ভব কি না বিজ্ঞানের এই সাময়িক প্রশ্ন বাহ্য। এই মাটির আধারে দুঃখকে জয় করা যাবে কিনা বুদ্ধের সেই চিরকালের প্রশ্নই তুলছি। বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষের আয়ু বেড়ে চলেছে, কিন্তু সুখ কণামাত্র বেড়েছে কি না সন্দেহ। বরং এ যুগের বিজ্ঞান মিথ্যা আশার ছলনায় মানুষের মানসিক স্থৈর্যকে বিপর্যস্ত করেছে। বিজ্ঞান ছাড়া আমাদের গতি নেই; কিন্তু অবাস্তব আশাও বিপদের কারণ হয়। কাজেই ধৈর্য ছাড়া উপায় কি?

আমাদের মনের যে-ছদ্মবেশী হিংসা সব ভাঙ্গতে চায় সে বলে যে, বিরাট ভাঙ্গনের ভিতর দিয়ে সম্ভব সমাজের মহং মুক্তি। কিন্তু এটা পাগলামি। ইয়োরোপে গত দুশ বছরে যে-দেশগুলিতে বিপ্লবের ধ্বনি সবচেয়ে বেশী শোনা গেছে তারা অন্যদেশের তুলনায় কিছু বেশী এগিয়ে যায়নি। ব্যক্তির নিঃসঙ্গ অন্তরে হয় তো কখনও মুক্তি আসে প্রেমের প্রলয়ের ভিতর দিয়ে। কিন্তু সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনে পতনই সম্ভব সহসা, স্থায়ী উন্নতি ঘটে ধীরে ধীরে অপূর্ণতার সীমারেখা ধরে।

সমাজ ও ইতিহাস (১৯৭০)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *