2 of 2

৫.০৭ রবীন্দ্রনাথ ও যুক্তিবাদ

রবীন্দ্রনাথ ও যুক্তিবাদ

যুক্তিবাদের একটা মূল কথা এই রকম। বিশ্বের ঘটনা সকল যদি আকস্মিকতার ওপর নির্ভর করত, এসবের ভিতর যদি কোনো নিয়মের রাজত্ব না থাকত, তবে কিসের থেকে কী হচ্ছে সে বিষয়ে বিচারবিবেচনার কোনো ভিত্তিই থাকতো না। সে ক্ষেত্রে যুক্তিবাদ হত নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্ব নিয়মের দ্বারা চালিত। আর মানুষের ভিতর আছে সেই বুদ্ধি বা মননের শক্তি যা দিয়ে নিয়মকে বোঝা যায়, বিশ্বের নিয়ম ক্রমে ক্রমে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়। বহির্বিশ্বের নিয়ম আর মানুষের অন্তর্নিহিত যুক্তি এ দুয়ের ভিতর আছে। এক আশ্চর্য সামঞ্জস্য।

বিশ্বপ্রকৃতির নিয়ম জানবার জন্য বুদ্ধির অনুশীলিত প্রয়োগকেই বলি বিজ্ঞান। এযুগে বিজ্ঞান বলতে এই বোঝায়। যুক্তির দ্বারা আহৃত জ্ঞানকে নানা উদ্দেশ্যে আমরা প্রয়োগ করি, সঠিক প্রয়োগের ভিতর দিয়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। অন্যান্য প্রাণীদের ভিতর দেখি অন্ধ প্রবৃত্তির প্রাধান্য। উদ্দেশ্যের উপযোগী উপায় ও পরিকল্পনা সচেতনভাবে উদ্ভাবন করে মানুষ। পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজন হয় কার্যকারণজ্ঞান। প্রকৃতির নিয়মে আছে সেই জ্ঞানের বাস্তব ভিত্তি, আর যুক্তিতে আছে নিয়ম-অনুসন্ধানের শক্তি। আত্মশক্তিতে বিশ্বাস হারালে মানুষ হয়ে পড়ে অন্তরে অন্তরে অসহায়। তাই থেকে তার বিপত্তি বেড়েই চলে। যুক্তিনির্ভরতা থেকে আসে বিজ্ঞান ও আত্মশক্তিতে বিশ্বাস। এই সবই হল যুক্তিবাদীর মূল প্রত্যয়।

রবীন্দ্রনাথকে যদিও বিশ্বের লোক ভাবুক কবি বলেই জানে তবু যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে তাঁর চিন্তাভাবনার আশ্চর্য মিল চোখে পড়ে। একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করা যাক। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “বুদ্ধির নিয়মের সঙ্গে এই বিশ্বের নিয়মের সামঞ্জস্য আছে, এই জন্যে এই নিয়মের ‘পরে অধিকার আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে নিহিত এই কথা জেনে তবেই আমরা আত্মশক্তির উপর নিঃশেষে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পেরেছি। বিশ্বব্যাপারে যে। মানুষ আকস্মিকতাকে মানে সে নিজেকে মানতে সাহস করে না, সে যখন-তখন। যাকে-তাকে মেনে বসে; শরণাগত হবার জন্য সে একেবারে ব্যাকুল।” আবার বলেছেন, “বুদ্ধিকে মোহমুক্ত ও সতর্ক করবার জন্য প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞানচর্চা।”

যুক্তিবাদী বলে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের খ্যাতি আছে। কয়েকটি মূল সূত্রের ভিতর তাঁর পরিণত বয়সের ধ্যানধারণাকে সংক্ষিপ্ত রূপ দেওয়া হয়েছে। এই রকম একটি সূত্রে বলা CUYO”Rising out of the background of the law-governed physical nature, the human being is essentially rational.’’ রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন যে, “বুদ্ধির নিয়মের সঙ্গে এই বিশ্বের নিয়মের সামঞ্জস্য আছে”, এবং “এই নিয়মের ‘পরে অধিকার প্রত্যেকের। মধ্যে নিহিত”, তখন এইসব কথার সঙ্গে যুক্তিবাদের মিল স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বুদ্ধি ও বিজ্ঞানের উপর রবীন্দ্রনাথ যে এতটা জোর দিয়েছিলেন তার কিছু বিশেষ কারণ ছিল। তাঁর চারিদিকে তিনি দেখেছিলেন এক কুসংস্কারগ্রস্ত জগৎ কুসংস্কার থেকে জন্ম। নিয়েছে ভয় ও নির্দয়তা। আরাধ্য হয়ে উঠেছে নানা সাম্প্রদায়িক ও ভৌগোলিক “অপদেবতা”। পরাস্ত হয়েছে মানুষের মহত্ত্ব। রবীন্দ্রনাথ কুসংস্কারের বন্ধন থেকে মনুষ্যত্বকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন, আর এই কাজে বিজ্ঞান-বুদ্ধিকে সহায় বলে জেনেছিলেন। এই কারণেই তিনি বুদ্ধিকে “মোহমুক্ত” ও “সতর্ক” রাখতে বলেছিলেন। রবীন্দ্রভাবনার এই দিকটি উপেক্ষণীয় নয়।

তা ছাড়া ছিল দারিদ্র্যমোচনের প্রশ্ন। বিশেষত গ্রামবাসীর দারিদ্র্যদূরীকরণের কাজ যৌবন থেকেই রবীন্দ্রনাথকে ভাবিত করেছে। এবিষয়ে তিনি কেবল দূরদর্শী দার্শনিক চিন্তায় আবদ্ধ থাকেননি। কৃষিকর্মের প্রায়োগিক দিক পর্যন্ত তাঁর কর্মধারা প্রসারিত হয়েছে। এইখানে আবারও বিজ্ঞান হয়েছে তাঁর সহায়। বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরতা ছাড়া দারিদ্র্যমোচনের উপায় নেই। তাঁর এই বিশ্বাস এতোটাই গভীর ছিল যে, নিজের পুত্রকে তিনি বিদেশে পাঠান কৃষিবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য। বিজ্ঞানের শক্তির অপব্যবহার হয় একথা অবশ্য তিনি জানতেন। বিজ্ঞানকে প্রয়োগ করতে হবে শুভকর্মে, দরিদ্র মানুষের মঙ্গলসাধনের জন্য। “বিজ্ঞান মানুষকে মহাশক্তি দিয়েছে। সেই শক্তি যখন সমস্ত সমাজের হয়ে কাজ করবে তখনই সত্যযুগ আসবে।” এইরকম তিনি বলেছিলেন।

কাজেই যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গীর একটা বড় দিক। এসব বাদ দিয়ে রবীন্দ্রদর্শনকে দাঁড় করাতে গেলে ভুল হয়। অথচ রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন এখানেই আবদ্ধ নয়। তাঁর কাছ থেকে আমরা আরো কিছু পাই যা যুক্তিবিরোধী অবশ্য নয়, তবু যুক্তিবাদের পরিচিত সীমানার মধ্যে পড়ে না।

.

(খ)

যুক্তি ও বিজ্ঞান সম্বন্ধে এতক্ষণ যা বলা হল তাতে জোর পড়েছে প্রয়োগের ওপর। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির একটা সংগ্রাম চলছে। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে সেই শক্তি যা। দিয়ে পরিপার্শ্বের ওপর সে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করছে। আধুনিক যুগের প্রথম থেকেই এই কথাটার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে : বিজ্ঞান হল শক্তি। যুক্তি ও বিজ্ঞান মানুষের হাতে এনে দেয় সেই শক্তি যার সাহায্যে প্রকৃতি ও সমাজকে সে ক্রমশ বদলে নিতে পারে তার সচেতন ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী।

সেই সব দেশকেই এযুগে আমরা উন্নত বলে মানি যারা প্রযুক্তিতে প্রাগ্রসর। প্রযুক্তির অগ্রগতির জন্য আধুনিক রাষ্ট্র যে এতোটা উঠে-পড়ে লেগেছে, তার কারণ এই নয় যে, এযুগের নেতারা বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রতি সবিশেষ আকৃষ্ট। বরং কারণটা এই যে, যুদ্ধাস্ত্র আর ভোগ্যবস্তু দুয়েরই উৎপাদনে প্রযুক্তির ভূমিকা খুবই শক্তিশালী। শুধু রাষ্ট্রনীতিতে নয়, জনমানসেও বিজ্ঞানের প্রয়োগের দিকটাই আজ বিশেষ মূল্যবান ও আকর্ষক।

যে-প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি এযুগে প্রাধান্য লাভ করেছে, ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাকে আমরা অনেকেই অভিন্ন বলে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছি। যুক্তিবাদও যুগধর্মের এই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। দুনিয়াটাকে বদলানোই হল মানুষের প্রধান কাজ, এটা শুধু মার্কসীয়। দর্শনের কথা নয়। একালের যুক্তিবাদী দর্শনের সাধারণ ঝোঁক এইদিকে। শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব নিয়ে তর্কাতর্কি যাই থাকুক না কেন, যুক্তি ও বিজ্ঞান এযুগে কাঙিক্ষত পরিবর্তনের উপায় হিসেবেই সমাদৃত।

এই দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যবান, তবু অসম্পূর্ণ।

প্রকৃতির ওপরই তোক আর অপর মানুষের ওপরই হোক, কর্তৃত্বটাই যেখানে প্রধান। কথা অথবা প্রয়োজনসিদ্ধিই উদ্দেশ্য, সেখানে ভেদবুদ্ধি প্রখর। আমাদের ভাষায় আত্মপর ভেদ বলে একটা কথা আছে, অর্থাৎ আপন থেকে অপরকে আমরা ভিন্ন করে দেখি। কিন্তু এই ভেদবোধ নিয়ে মানুষ তৃপ্ত নয়। মানুষের মনের গভীরে মিলনের একটা আকাঙ্ক্ষা আছে। সেই আকাঙ্ক্ষা কখনো পূর্ণ হয়, কখনো হয় না। অপূর্ণতার দুঃখকে অনিবার্য জেনেও মিলনের আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত হয় না, জীবনতৃষ্ণার মতোই সে শাশ্বত।

মিলিত হতে পারলে আমরা খুশী হই। এই মিলনের আনন্দের সঙ্গে জৈব সুখের একটা প্রভেদ আছে। জৈব সুখের পিছনে কোনো বাস্তব প্রয়োজন থাকে, সেই প্রয়োজন মিটলে আমরা সুখ অনুভব করি। মিলনের আনন্দ প্রয়োজনের অতিরিক্ত। আত্মার প্রসার বলেই তাতে আমরা প্রসন্ন হয়ে উঠি। সাধারণ অভিজ্ঞতায় এই দুই বস্তু মিলেমিশে যায়, এদের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। যেমন শিশুর কাছে মা জীবনধারণের সহায়, আবার মায়ের সঙ্গে তার একটা আত্মিক যোগের মাধুর্যও আছে।

মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের ভিতর এই রকমের একটা দ্বৈত লক্ষ করা যায়। প্রকৃতির কাছ থেকে আমরা নানা প্রয়োজন মেটাবার উপাদান লাভ করি। তাই প্রকৃতির শক্তিকে আমরা ভৃত্য হিসেবে পেতে চাই। আবার প্রকৃতির অসীমতার ভিতর মানুষের চেতনা নিজেকে প্রসারিত করার একটা ক্ষেত্র খুঁজে পায়, সেখানে ব্যক্তিমানুষের চেতনা বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েই আনন্দিত। সেই আনন্দকে যখন ‘আধ্যাত্মিক’ বলা হয় তখন তার মানে এই নয় যে, প্রকৃতির নিয়মকে সে খণ্ডন করছে। তার মানে এই যে, নিতান্ত জৈব প্রয়োজননির্ভর সুখের সঙ্গে সেই আনন্দের একটা গুণগত পার্থক্য আছে।

কথাটা আশ্চর্য সুন্দর ভাষায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রার্থনাভাষণে বহুবার বহুভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। একবার শুনে নেওয়া যাক। “রোজ সকালবেলায় বহুযোজন দূর থেকে আলো এসে বলছে, দেখো”। সেই যে একই মন্ত্র রোজই আমাদের কানে উচ্চারণ করে যাচ্ছে তার মধ্যে একটি অত্যান্ত আশ্বাস প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে…

“আলোক যে দেখাটা দেখায় সে তো ছোটোখাটো কিছুই নয়।…দিগন্তবিস্তৃত আকাশমণ্ডলের নীলোজ্জ্বল থালাটির মধ্যে যে সামগ্রী সাজিয়ে সে আমাদের সম্মুখে ধরে সে কী অদ্ভুত জিনিস! তার মধ্যে বিস্ময়ের যে অস্ত পাওয়া যায় না। আমাদের প্রতিদিনের যেটুকু দরকার তার চেয়ে সে যে কতই বেশি!…

“এই পৃথিবীতে যে আমরা প্রতিদিন চোখ মেলে চেয়েছিলুম এবং আলোক এই চোখকে প্রতিদিনই অভিষিক্ত করেছিল, তার কি পুরো হিসাব ওই টাকা এবং খ্যাতি এবং ভোগের মধ্যে পাওয়া যায়?…

“তাই আমি বলছি, এই আলোক অন্ধ কুঁড়িটির কাছে প্রত্যহই যেমন একটি অভাবনীয় বিকাশের কথা বলে যাচ্ছে, আমাদের দেখাকেও সে তেমনি করেই আশা দিয়ে যাচ্ছে যে, ‘একটি চরম দেখা, একটি পরম দেখা আছে, সেটি তোমার মধ্যেই আছে।

“তুমি কি ভাবছ, চোখ বুজে ধ্যানযোগে দেখবার কথা আমি বলছি? আমি এই চর্মচক্ষে দেখার কথাই বলছি।…আমি বলছি, এই চোখ দিয়েই, এই চর্মচক্ষু দিয়েই এমন দেখা দেখবার আছে যা চরম দেখা…

“আলোক তাই প্রত্যহই আমাদের চক্ষুকে নিদ্রালস থেকে ধৌত করে দিয়ে বলছে, ‘তুমি স্পষ্ট করে দেখো, তুমি নির্মল হয়ে দেখো, পদ্ম যেরকম সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে সূর্যকে দেখে তেমনি করে দেখো’।”

প্রকৃতিকে অতিক্রম না করেও কবি এইখানে প্রকৃতির অন্তরে অন্য এক জ্যোতি খুঁজে পেয়েছেন। দুটি কথার ওপর তিনি একই সঙ্গে জোর দিচ্ছেন যে-আনন্দের অথবা মুক্তির কথা বলা হচ্ছে তাকে পাবার জন্য ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে বসতে হয় না, কিন্তু। তাকে ভোগের মধ্যে কিংবা প্রতিদিনের প্রয়োজনের মধ্যেও ধরা যায় না। আমাদের সত্তায় নিহিত এক শক্তি পঞ্চেন্দ্রিয়ের পথ ধরে বিশ্বচরাচরে পরিব্যাপ্ত অসীম শক্তিকে যখন চেতনার মধ্যে গ্রহণ করে তখন সেই মিলন হয় অন্য সকল ফল নিরপেক্ষভাবে আনন্দময়, তাতে আছে এক পরম মুক্তির বিস্ময়।

এইখানে রবীন্দ্রনাথের মঙ্গলবোধের ভিত্তি। আমরা যখন বিশ্বের দিকে শুদ্ধ ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে তাকাই তখন সেই দেখাতেই মঙ্গল, তাকেই কবি বলেছেন নির্মল হয়ে দেখো, তাতেই আনন্দ। এই দেখাতে বিশ্বের কোনো নিয়মকে অস্বীকার করা হচ্ছে না। অথচ এটা বিশ্বকে শুধু নিয়মস্বরূপ দেখাও নয়। মানুষের ভিতর যেমন আছে যুক্তি, যাতে বিশ্বের নিয়মকে চিনে নেওয়া যায়, তেমনি আবার আছে সেই প্রথম চোখ মেলে চাইবার প্রত্যাশাহীন বিস্ময়বোধ, সেই অহৈতুকী প্রীতির শক্তি, যাতে ধরা পড়ে বিশ্বের আনন্দরূপ।

যুক্তি প্রতিদিনের জীবনে বার বার পরাস্ত হয়, তবু সে সত্য। মানুষের বিশ্বপ্রীতি ভয়ে ও বিদ্বেষে বারবার খণ্ডিত হয়, তবু সে মনুষ্যত্বের এমনই এক অঙ্গ যাকে অস্বীকার করে মানুষের মুক্তি নেই। কবি বলছেন “আমার মধ্যে যদি প্রেম না জাগে, আনন্দ না থাকে, তবে বিশ্ব আমার পক্ষে কারাগার। সেই কারাগার থেকে পালাবার চেষ্টা মিথ্যা, প্রেমকে জাগিয়ে তোলাই মুক্তি।…বিজ্ঞানের সাধনা যেমন আমাদের প্রাকৃতিক জ্ঞানের বন্ধন মোচন করছে তেমনি মঙ্গলের সাধনাই আমাদের প্রেমের, আমাদের আনন্দের বন্ধন মোন করে দেয়।”

রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মবাদ কখনো বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে চলেনি। আবার তাঁর বিজ্ঞাননিষ্ঠাও অধ্যাত্মভাবনার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ায়নি। যুক্তির যেমন একটা বিশ্বজাগতিক ভিত্তি আছে, শুদ্ধ প্রেমের ক্ষেত্রেও সেই কথাই সত্য। কোনো সীমাবদ্ধ উদ্দেশ্য দিয়ে ছোটো করে দেখলে তাকে সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। বিজ্ঞান বিশ্বকে জানতে চায়। তার মানে এই নয় যে, বিজ্ঞানী বিশ্বকে জেনেছে সম্পূর্ণভাবে বা কখনো জানবে। কিন্তু জ্ঞানের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে কোনো সীমাকেই চরম বলে মানতে সে রাজী নয়। আত্মার প্রসারের ক্ষেত্রেও একই কথা। বিশ্বকে আমরা কখনো স্থায়ী আত্মীয়ভাবে পাই কি না পাই, কোনো সীমাকেই শেষ বলে মেনে নিয়ে মানুষের আত্মার মুক্তি নেই।

গান্ধী ‘soul force’ কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন আত্মশক্তি। রবীন্দ্রনাথের কথাই আমরা এখন বলছি। যুক্তি ও প্রেম উভয়কেই তিনি আত্মশক্তির অন্তর্গত করে নিয়েছিলেন। মানুষের অন্তরে এর নিবাস। মহাবিশ্বের সঙ্গে কোথাও এর মিল আছে। তা নইলে আত্মশক্তির উপর নির্ভর করে দাঁড়াবার সব চেষ্টাই অর্থহীন হত। রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্বাস।

.

(গ)

যদি বলা হয়, এই আত্মশক্তি অতি অল্প কিছু মানুষের মধ্যেই আছে, তবে তাকে প্রকারান্তরে অস্বীকার করাই হয়, অর্থাৎ মনুষ্যত্বের অচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে তাকে স্বীকার করা হয় না। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, সব মানুষের ভিতরেই তাকে পাওয়া যায় সম্ভাবনারূপে, মানুষের ধর্ম সেটা। মহাপুরুষদের ভিতর তার উজ্জ্বল প্রকাশ কিন্তু বিশ্বজন যে তাঁদের মহাপুরুষ বলে চিনে নিতে পেরেছে তাতে কি এটাই প্রমাণ হয় না যে সেই মহত্ত্বের একটা সায় সাধারণ মানুষও নিজেদের অন্তরে খুঁজে পেয়েছে?

মানুষের এই সুপ্ত সম্ভাবনার প্রমাণের জন্য মহামানবদের দ্বারস্থ না হলেও চলে। প্রমাণ ছড়িয়ে আছে আমাদেরই চোখের সামনে পৃথিবীর শিশুদের ভিতর। মহাপুরুষদের বাণীর ব্যাখ্যা অনেকেই করেছেন। শিশুদের কথা রবীন্দ্রনাথের মতো করে ক’জন বলতে পেরেছেন।

নিঃসন্দেহে ভালোমন্দ সব সম্ভাবনাই শিশুর ভিতর আছে। শিশুরা সরলভাবে হিংসুটে হয়, নির্মম হয়। কিন্তু মানুষের হিংসা অথবা নির্মমতার এমনিতেই তো প্রমাণের অভাব। নেই, সেজন্য শিশুদের সাক্ষ্য জরুরী নয়। তাদের কাছ থেকে অন্য কিছু বিশেষভাবে শিক্ষণীয়। মানুষের কিছু মূল্যবান সম্ভাবনা, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যে সব ঢাকা পড়ে যায়, শিশুদের ভিতর সেইসব আমরা অনায়াসে দেখি। তাই তো শিশুরা আমাদের জ্ঞানী করে তোলে।

বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে আমরা যতই সংসারে লিপ্ত হয়ে পড়ি, সংসারে নানা স্বার্থে ও প্রয়োজনে যতই জড়িয়ে যাই, ততই জগতটাকে আমরা সেই সব প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত করে দেখতে অভ্যস্ত হই। এক রকমের উদ্দেশ্যনির্ভর ব্যবহারিক জানা আমাদের কাছে একমাত্র জানা হয়ে ওঠে। শিশুরা এই সাংসারিক প্রয়োজনের জালে তেমন আবদ্ধ হয়নি বলেই পৃথিবীটাকে অন্য এক দৃষ্টিতে সহজে দেখতে পারে, অন্য এক সরল বিস্ময় ও আনন্দে মুহূর্তে মুহূর্তে উদ্বেল হয়ে ওঠে, প্রকৃতির নানা স্পর্শে গন্ধে ধ্বনিতে অন্য একভাবে অনায়াসে সাড়া দেয়। অতি তুচ্ছ কারণে শিশু যখন খুশী হয়ে ওঠে, দুহাত তুলে নাচে, তখন বয়স্কদের চোখে সেটা অর্থহীন মজার ব্যাপার মনে হয়, কারণ সংসারের কোনো পরিচিত প্রয়োজনের সঙ্গে মেলানো যায় না। তবু এই অহেতুক আনন্দে আছে মানুষের জন্মগত অধিকার, যে-অধিকার ক্রমশ হারাতে হারাতে সে বয়স্ক হয়ে ওঠে। শিল্পী ও সন্তদের বৈশিষ্ট্য এইখানে যে, শিশুর দৃষ্টি তাঁরা বয়স্ক জীবনেও রক্ষা করতে পারেন। সংসারের দাহক অভিজ্ঞতা অতিক্রম করে সেই দৃষ্টিতে যোগ হয় সারল্যের সঙ্গে অন্য এক সহ্যশক্তি ও গভীরতা।

সংশয়বিদ্ধ একটি প্রশ্ন বহুদিন ধরে আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। মানুষকে আমরা ভালোবাসব কেন? যে-মানুষকে সংসারে আমরা অহরহ দেখি সে কি ভালোবাসার যোগ্য? বিশেষ বিশেষ মানষকে ভালোবাসা যায়, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মনুষ্যপ্রজাতিকে নিয়ে। মানুষের মতো নীচ, অকৃতজ্ঞ, স্বার্থপর, নির্দয় জীব কি আর দ্বিতীয় আছে? পোষা কুকুরের প্রতি প্রেম রক্ষা করা বরং অপেক্ষাকৃত সহজ। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রীতি রক্ষা করবার কি কোনো যুক্তি আছে?

যুক্তিবাদীরা মানুষে মানুষে, সহযোগিতার কথা বলে। স্বার্থসিদ্ধির জন্যই একরকমের সহযোগিতা নিশ্চয়ই আবশ্যক হয়ে পড়ে। সেই সহযোগিতার জন্য প্রেমের প্রয়োজন হয় নামানবপ্রেমের তো নয়ই। স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে ব্যবসায়িক সংগঠন গড়ে ওঠে। ব্যবসায়ীরা খদ্দেরের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলে। তারা মানবপ্রেমিক একথা বলা যাবে না। আবারও মূল প্রশ্নটায় ফিরে আসতে হয়। মানুষের রক্তাক্ত ইতিহাসের এই মধ্যবিন্দুতে দাঁড়িয়ে অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতার ভূপীকৃত উদাহরণকে উপেক্ষা করে। কীভাবে এই বিশ্বাস রক্ষা করা যায়, সবার উপরে মানুষ সত্য?

যুক্তিবাদী এবার প্রমাণ খুঁজবে মানুষের কিছু অক্ষয় কীর্তির মাঝে। যতই নীচ ও নির্দয় হোক মানুষ, এই জীবটি তবু কয়েক হাজার বছরে এমন কিছু রচনা করে গেছে যাতে তার। শ্রেষ্ঠত্বের দাবি উপেক্ষা করা কঠিন। কিছু অস্ফুট ধ্বনি থেকে যাত্রা শুরু করে সে ক্রমে সৃষ্টি করেছে শুধু ভাষা নয়, কাব্য ও সাহিত্য, ধ্বনির সঙ্গে ধ্বনি মিলিয়ে অমর সঙ্গীত। তার অন্য সব কৃতি যদি আমরা ভুলে যাই তবু ঐ সঙ্গীতই মানুষকে এক অতুলনীয় জীব বলে চিহ্নিত করে দেয়। গণিতে বিজ্ঞানে দর্শনে শিল্পের আরো অজস্র প্রকাশে মানুষের আশ্চর্য পরিচয় ছড়িয়ে আছে। বিশ্বমানবের এই সব কীর্তি অস্বীকার করা যুক্তিহীন। মানুষের এই সৃজনশীলতা থেকেই তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিছু আশা হয়তো রক্ষা করা সম্ভব।

এই পর্যন্ত অগ্রসর হওয়া যায় যুক্তির হাত ধরে। তারপর আরো কিছু কথা থাকে যেখানে যুক্তি ও অধ্যাত্মভাবনার সীমারেখা মুছে যায়।

মানুষকে যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা তো শুধু মানুষের কীর্তির জন্যই তাকে ভালোবাসেন। দোষেগুণে মিশ্রিত পরিচয় ব্যক্তিমানুষের, মানবজাতির। অথচ আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি তখন তো তার কিছুটা বাসি না এমন হয় না। ঐ রকমের বাছবিচার সমালোচকের শোভা পায়, স্নেহ কিংবা প্রেমের ধর্ম নয় নয় সেটা। পরীক্ষক ছেলেকে বেশি নম্বর দিয়েছে বলে মা ছেলেকে বেশি ভালোবাসবে এতে মাতৃস্নেহের পরিচয় নেই। যেমন পীড়িত সন্তানের প্রতিই মায়ের ভালোবাসা বেশী হয় তেমনই দুঃখতপ্ত মানুষের আর্তিনাশের জন্য মানবপ্রেমিক উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। গুণের পরিমাপ নয় বরং অভেদানুভূতিই প্রেমের প্রধান কথা।

বিশ্বকে আমরা প্রেমের দৃষ্টিতে দেখব কেন, এ প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে এর পর। আমাদের প্রবেশ করতে হয় নিজেরই অন্তরে। সেখানে খুঁজে পাই সেই শিশুটিকে যে এই বিশ্বকে একদিন দু’হাত মেলে ভালোবাসতে চেয়েছিল। সংসারের তাপে দগ্ধ, ছলনায় বিভ্রান্ত হয়ে দিনে দিনে সে বদলে গেছে। তবু নিজেরই অন্তর থেকে আমরা জানি, মানুষের মনের গভীরে আজও আছে অন্য এক আকাঙ্ক্ষা, যাকে সে আজ হয়তো শুধু বিদ্রুপের ভাষাতেই স্বীকার করতে সাহস পায়। সেই আকাঙ্ক্ষাকে নিজের অন্তরে অনুভব। করি বলেই জানি সেটা মানুষেরই অন্তরের কথা। ভিতর থেকে এই কথাটা যতক্ষণ না স্পষ্ট হয়ে ওঠে ততক্ষণ সেটা যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কিন্তু একবার যখন অনুভূতির ভিতর সে প্রত্যক্ষ হয় তখন আর তাকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা যায় না। বিশ্বকে আমরা ভালোবাসব বিশ্বের মুক্তির জন্য নয়, নিজেরই মুক্তির জন্য। আমাদের বিদ্বেষে বিশ্ব কতটা পোড়ে কে জানে, কিন্তু আমরা পুড়ি, ভিতরে ভিতরে খাক হয়ে যাই।

বাইরের প্রমাণে সব সংশয় কাটে না। সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপকে’ পৃষ্ঠভূমিতে রেখে বিশ্বকবি যখন বলেন, মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি, তখন বাইরের কোনো ঘটনার সাক্ষ্যের ওপর সে বিশ্বাস দাঁড়িয়ে নেই। তার প্রতিষ্ঠা কবির অন্তরে। যুক্তি সেই বিশ্বাসের সামনে। যদি বা সংশয়গ্রস্ত তবু শ্রদ্ধাবনত।

রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন তাঁর অধ্যাত্ম অনুভূতিকে সেই ভাষায় প্রকাশ করতে, সেই আত্মপ্রত্যয়ে উজ্জ্বল করে তুলতে, অবিশ্বাসীর যুক্তিও যাকে পরিহাস করতে কুণ্ঠিত হয়। মানুষের চেতনা আজ বিবর্তনের যে-স্তরে এসে পৌঁছেছে তাতে যুক্তি ও বিজ্ঞানকে ত্যাগ করা যাবে না, অধ্যাত্মবোধকেও নয়। এ দুয়ের ভিতর যথার্থ সমন্বয় সাধনের শক্তি আমাদের সকলের নেই, রবীন্দ্রনাথের ছিল স্মরণীয়ভাবে। শুধু তাঁর জন্মদিনে নয়, তিনি স্মরণীয় সভ্যতার সংকটের দিনে।

দ্বন্দ ও উত্তরণ (১৯৮৯)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *