2 of 2

৮.০৬ ভারতে ও চীনে খাদ্যোৎপাদন

৮.৬ ভারতে ও চীনে খাদ্যোৎপাদন

পরিশিষ্ট

“আটষট্টির সন্ধিক্ষণে” প্রবন্ধে আমি লিখেছি : “গত পনেরো বছরে চীনে খাদ্যোৎপাদন শতকরা যত ভাগ বেড়েছে, ভারতে তার চেয়ে কিছু কম বাড়েনি।”

পাঠকগোষ্ঠীর কৌতূহল তৃপ্তির জন্য এবিষয়ে কিছু তথ্য জানাচ্ছি।

চীন যদিও আয়তনে ও জনসংখ্যায় ভারতের চেয়ে অনেক বড় তবু উভয় দেশে মোট কর্ষিত জমির পরিমাণে পার্থক্য বড় বেশী নয়। চীনে একর প্রতি উৎপাদন কিন্তু বহুকাল যাবৎই ভারতের চেয়ে অনেকটা বেশী। যে বৎসরে সারা চীনে কম্যুনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই ১৯৪৯ সালে চীনে শস্যোৎপাদন ছিল দশ কোটি টনেরও বেশী। (মাও 697-98-47 “On the Correct Handling of Contradictions Among the People.” নামক বিখ্যাত পুস্তিকা থেকে এই সংখ্যাটি চীনা পরিমাপে পাঠক সহজেই পেতে পারেন)। তুলনার জন্য মনে রাখা আবশ্যক যে, ১৯৫০ সালে ভারতে শস্যোৎপাদনের পরিমাণ পাঁচ কোটি টনের কিছুটা বেশী।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, চিয়াং কাইশেকের যুগে সাধারণ বৎসরে চীনে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ভারতের (বর্তমান সীমানার ভিত্তিতে) প্রায় তিনগুণ। সেযুগের সাধারণ বৎসর বলতে ১৯৩৭ সালের আগের বৎসরগুলিকেই ধরতে হয়, কারণ ১৯৩৭ সাল থেকে জাপান চীনে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। ন্যাশনাল এগরিকালচারাল রিসার্চ ব্যুরোর হিসাব অনুসারে ১৯৩১-৩৭ সালে চীনে বাৎসরিক গড়পড়তা খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি টনের মতো। কিন্তু এই হিসাবে কর্ষিত সমস্ত জমি ধরা হয়নি, যে জমি কর দিত না সেগুলি বাদ পড়েছে। তদানীন্তন নানকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জে এল বাক-এর হিসাব অনুসারে সমস্ত জমি ধরা হলে শস্যোৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ কোটি টনের মতো। ১৯২৯-৩৩ সালের বাৎসরিক উৎপাদন ১৮ কোটি টনের সামান্য বেশী। এই সংখ্যাগুলিকে অবশ্য সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য বলা যায় না। তবে ১৯৩১-৩৭ সালে চীনের বাৎসরিক খাদ্যশস্যের উৎপাদন যে ১৩ কোটি টনের বেশ অনেকটা ওপরেই ছিল, এ বিষয়ে বিশেষ সন্দেহের অবকাশ নেই।

১৯৫২ সালে চীনের শস্যোৎপাদন সরকারী হিসাব অনুসারে প্রায় সাড়ে পনেরো কোটি টন। অর্থাৎ যুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি অতিক্রম করে ১৯৫২ সালে উৎপাদন আবার যুদ্ধপূর্ব সাধারণ বৎসরের প্রায় সমপর্যায়ে গিয়ে পৌঁচেছে। ১৯৬০ সাল থেকে চীনা সরকার বাৎসরিক শস্যোৎপাদনের সংখ্যা প্রকাশ বন্ধ করে দেন। তবু খবর যে একেবারেই পাওয়া যায় না এমন নয়। চীনা সরকারী মহল থেকেই বলা হয়েছে যে, ১৯৬৫ সালে শস্যোৎপাদনের পরিমাণ বিশ কোটি টন।

চীনে শস্যোৎপাদন কতটা বেড়েছে তার হিসাব করতে গিয়ে ১৯৪৯ সালের সঙ্গে তুলনা করাটা ঠিক নয়, কারণ ১৯৪৯ সালের বিধ্বস্ত চীনে উৎপাদন ছিল অস্বাভাবিক রকম কম। কাজেই ১৯৫২ সালের সঙ্গে তুলনাটাই অপেক্ষাকৃত যুক্তিসঙ্গত। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬৫ সালে চীনে শস্যোৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে মোটামুটি শতকরা ত্রিশ ভাগ। ১৯৫২ সালে ভারতে শস্যোৎপাদনের পরিমাণ ছিল ছয় কোটি টনের কিছুটা বেশী, আর ১৯৬৪-৬৫ সালে প্রায় নয় কোটি টন। শতকরা হিসাবে চীনের তুলনায় ভারতেই শস্যোৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বেশী। ১৯৬৪-৬৫ সালের পরবর্তী দুই বৎসর এদেশে খারাপ। কেটেছে সন্দেহ নেই; কিন্তু ১৯৬৭-৬৮ সালে আমাদের শস্যোৎপাদন বেড়ে সাড়ে নয় কোটি টনে পৌচেছে। ১৯৬৪-৬৫ ও ১৯৬৫-৬৬ ভারতের পক্ষে ভালো ও মন্দ এই দুটি বছরের গড় ধরলেও ১৯৫২-র পর চীনের তুলনায় এদেশে শস্যোৎপাদন দ্রুত তালে বেড়েছে বলতে হয়।

চীনের শস্যোৎপাদনের সংখ্যাগুলি ব্যবহার করতে গিয়ে দু-একটি বিষয়ে একটু সাবধান হওয়া আবশ্যক। প্রথমত, চীনে শস্যে’র সরকারী হিসাবে আলু, লাল আলুও ধরা হয়; আমরা তা ধরি না। দ্বিতীয়ত, হিসাবে নানা স্তর আছে। যেমন মাঠে যে পরিমাণ ফসল ফলে তার হিসাব এক, মাঠ থেকে যা ঘরে তোলা সম্ভব হয় তার পরিমাণ অন্য, আবার ঝাড়াই-মাড়াই করে যা অবশিষ্ট থাকে সেটার হিসাব স্বতন্ত্র। ভারত ও চীনের সরকারী হিসাবগুলো সমস্তরের নয়; অতএব সরাসরি তুলনায় খানিকটা ভুল থেকে যায়। যথাযথ তুলনার জন্য চীনের সংখ্যাগুলো খানিকটা কমানো আবশ্যক হয়। কোনো কোনো গবেষকের মতে এক্ষেত্রে ০৮৫ গুণকে হিসাবে ব্যবহার্য; অর্থাৎ চীনা হিসাবের ১০০ উন=ভারতের ৮৫ টন। এই সব জটিলতা দূর থেকে সাধারণভাবে বলা যায়, চীনের শস্যোৎপাদন বর্তমানে ভারতের প্রায় দ্বিগুণ।

অর্থাৎ, চীনের শস্যোৎপাদন বহুকাল যাবৎই আমাদের চেয়ে অধিক; কিন্তু গত পনেরো বছরের শস্যোৎপাদন বৃদ্ধির হার প্রদেশের তুলনায় এদেশে কম তো নয়ই, সম্ভবত বেশী। এমন একটা কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়, এদেশে শস্যোৎপাদন বেড়ে থাকতে পারে, কিন্তু ওপরের দিকের অল্প সংখ্যক ধনী মানুষই শুধু তার ফল ভোগ করেছেন। কথাটা বিশ্লেষণ পুরোপুরি টেকে না। ওপরের দিকের সঙ্গতিপন্ন মানুষেরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী ভাত অথবা রুটি উদরস্থ করছেন এটা হতে পারে না; তাঁদের বর্ধিত আয় তাঁরা ব্যয় করছেন প্রধানত অন্য দিকে। গত কয়েক বত্সরে ভারতের গ্রামে গ্রামে অতি সাধারণ পরিবারে আহারের যে-উন্নতি ড্যানিয়ল থনার প্রমুখ পর্যবেক্ষকেরা লক্ষ্য। করেছেন, তাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। এই সঙ্গে স্বীকার করা চলে যে, ভারতের কোনো কোনো অংশের তুলনায় বাংলা দেশে উন্নতি কম হয়েছে।

পরিশেষে চীনের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষণীয় দুই-একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব। আগেই লক্ষ করেছি যে, চীনে শস্যোৎপাদন বহুকাল থেকেই ভারতের চেয়ে অনেক বেশী। জাতীয় অহমিকা ত্যাগ করে বলব যে, চীনের এই উন্নততর কৃষির পিছনে একটা অপেক্ষাকৃত বৈজ্ঞানিক মন বহুকাল যাবৎ কাজ করে আসছে। আমরা যখন গো-জাতীয় জীবের ত্যক্ত বস্তু পবিত্র এবং মানবজাতির মল অপবিত্র ও অস্পৃশ্য এই ধারণাকে জীবনের অঙ্গ করে তুলেছি, চীন তখন দেশময় বিষ্ঠার বিশেষ ব্যবহারে কী করে জমির উৎপাদিকা শক্তি বাড়ানো যায় সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এগিয়ে গেছে। মাংস ভক্ষণ বিষয়ে নানা নিষেধ আমরা যখন ধর্মের ধারা করে তুলেছি, যুক্তিবাদী চীনা মন তখন আবিষ্কার করেছে যে, শুকরই সেই পোষ্য জীব যাকে খাওয়াতে খরচ সামান্যতম কিন্তু যাকে খেয়ে পেট ভরে। চীনা কম্যুনিজম সম্বন্ধে আমাদের মতামত যাই হোক না কেন, চীনা মনের বহুদিনের এই ব্যবহারিক বৈজ্ঞানিক ঝোঁকটাকে প্রশংসা করতে হয়।

চীনের কাছ থেকে যদি আমাদের কিছু শিক্ষণীয় থাকে তো সে কম্যুনিজম নয়, বরং চীনাদের পরিশ্রমের অভ্যাস, পরিচ্ছন্ন ব্যবহারিক বুদ্ধি ও বহু দুর্দশার মধ্যেও একটি আশাবাদী নন।

.

অন্যত্র তথ্যাদি সহ দেখাতে চেষ্টা করেছি যে, (ক) ১৯৫২ সালের পর ভারতে শস্যোৎপাদন বৃদ্ধির হার চীনের তুলনায় কম তো নয়ই বরং বিপরীত সিদ্ধান্তই অপেক্ষাকৃত সত্য; এবং (খ) মোট শস্যোৎপাদন কিন্তু ভারতের তুলনায় চীনে বহুকাল যাবৎই অনেকটা বেশী–চিয়াং কাইশেকের যুগে সাধারণ বৎসরে (১৯২৯-৩৩ সালে) ছিল সম্ভবত প্রায় তিনগুণ, আর এখন মোটামুটি দ্বিগুণ। প্রাচীন চীনে দুর্ভিক্ষের কারণ ভিন্ন। ভারতের চেয়ে আয়তনে চীন তিনগুণ এরকম বৃহৎ দেশের অংশবিশেষে অজন্মা অবশ্যম্ভাবী। ভারতের রেলগাড়ির কল্যাণে বিশ শতকে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ গত শতকের তুলনায় হ্রাস পায়। অপরপক্ষে চিয়াং কাইশেকের চীনে ভারতের তুলনায় যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত আর সামাজিক বিশৃঙ্খলাও ছিল বেশী। কিন্তু এসব দিক থেকে চীনের সঙ্গে ভারতের তুলনা বর্তমান আলোচনার উদ্দেশ্য নয়!

শস্যোৎপাদন বৃদ্ধির হারই আমাদের আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল। এ ব্যাপারে সূক্ষ্ম হিসাবের ভ্রান্ত আড়ম্বর ত্যাগ করলে মোদ্দা কথাটা অতি স্পষ্ট এবং সরল। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় এ দেশে মোট শস্যোৎপাদন ছিল ছ’কোটি টনের মতো; আর খরার বছরগুলি পেরিয়ে ষাটের দশকের শেষ দিকে আমাদের স্বাভাবিক উৎপাদন দাঁড়াচ্ছে প্রায়। দশ কোটি টন। একই সময়ে চীনে শস্যোৎপাদন বেড়েছে মোটামুটি পনরো কোটি থেকে বিশ (১৯৬৫) অথবা বাইশ কোটি টনে। ভারতের সঙ্গে তুলনার জন্য এই চীনা সরকারী হিসাবগুলি কেন কিছুটা কমিয়ে ধরা প্রয়োজন অন্যত্র সেটা ব্যাখ্যা করেছি। কিন্তু অসংশোধিত চীনা সংখ্যা থেকেও এটা স্পষ্ট যে, শতকরা হিসাবে উৎপাদন বৃদ্ধির হার ভারতের চেয়ে চীনে বেশী নয়

এই প্রসঙ্গে অবশ্য একটি যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা সম্ভব। সেটি এই : চীনে একর প্রতি উৎপাদন বহুদিন থেকেই ভারতের চেয়ে বেশী। এ অবস্থায় ভারতের সঙ্গে চীনের শস্যোৎপাদন বৃদ্ধির হার তুলনা করা সঙ্গত কিনা সেটাও বিবেচ্য, কারণ যে-কোনো শস্যের ক্ষেত্রে একটা উচ্চস্তরের পর উৎপাদন আরও বাড়ানো অপেক্ষাকৃত কঠিন হয়ে ওঠে। ভারতের চেয়ে চীনে শস্যোৎপাদন বৃদ্ধির হার বেশী নয় এই কথাটা কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত অস্বীকার করাতেই চীন ও ভারতের বিষয়ে কয়েকটি তথ্য তুলে ধরা প্রয়োজন হয়েছে। চীনের সমতুল অপর কোনো দেশের সঙ্গে শস্যোৎপাদন বৃদ্ধির তুলনা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে একথা স্বীকার্য।

এদিক থেকে চীন ও তাইওয়ানের কৃষিবিষয়ক তথ্য পাশাপাশি রাখার সার্থকতা আছে। ইকনমিক কমিশন ফর এশিয়া এণ্ড দ্য ফার ইস্টের ১৯৬৪ সালের “সার্ভে রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৫২-৫৩ সালে গড়পড়তা হিসাবে চীন ও তাইওয়ানে একর প্রতি ধানের উৎপাদন ছিল প্রায় সমান। পরবর্তী দশ বৎসরে চীনে একর প্রতি ধানের উৎপাদন বাড়ে শতকরা ২৪ ভাগ, আর তাইওয়ানে শতকরা ৪১ ভাগ। একই সময়ে ভারতে একর প্রতি উৎপাদন ঐ রিপোর্টের হিসাব মতো বেড়েছে শতকরা ২৮ ভাগ। এখানে লক্ষ করা যেতে পারে যে, যেহেতু বিশেষ বৎসরে চাষ অপ্রত্যাশিতভাবে ভালো অথবা মন্দ বলে আপত্তি ওঠা সম্ভব অতএব ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৫২-৫৩ এই পাঁচ বৎসরে গড় উৎপাদনের সঙ্গে ১৯৫৮-৫৯ থেকে ১৯৬২-৬৩-র গড়ের তুলনা অপেক্ষাকৃত বিজ্ঞানসম্মত ও নির্ভরযোগ্য।

মনে রাখা প্রয়োজন যে, ঐ দশ বৎসরে চীন ও তাইওয়ানে ভূমিসংস্কার হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। তাইওয়ানে কৃষককে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরাসরি জমির স্বত্ত্বাধিকার দেওয়া হয়েছ! চীনে কৃষক গোড়ায় ভূমির মালিকানা লাভ করেছেন; কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই পরিবারভিত্তিক চাষপ্রথার বিলোপ করে স্থাপিত হয়েছে বৃহদাকার কমিউন। এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পক্ষে নানা যুক্তি থাকা সম্ভব। কিন্তু এতে শস্যোৎপাদন তেমন বাড়েনি।

তাইওয়ান থেকে আমরা তাইচুং বীজের সন্ধান পেয়েছি। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। কৃষকদের ভিতর নিরক্ষরতা দূর করবার পথে তাইওয়ান বহুদূর এগিয়ে গেছে। আমরা পিছিয়ে আছি। জমিতে সারের ব্যবহারও তাইওয়ানে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী। তাছাড়া কৃষির সঙ্গে ওঁরা শিল্পের যোগ স্থাপন করেছেন সুচারুভাবে। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে এশিয়ার এই ছোট দেশটির কাছ থেকে কিছু শিখবার আছে।

প্রগতির পথ (প্রথম প্রকাশ, ১৯৬৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *