2 of 2

৫.০১ মার্ক্সের মূল্যায়ন

পঞ্চম অধ্যায় – ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন

৫.১ মার্ক্সের মূল্যায়ন

আধুনিক যুগের গোড়ায় যুক্তি ও বিজ্ঞানে বিশ্বাসী যে আন্দোলনের শুরু সেই আন্দোলনেই মার্ক্সীয় চিন্তাধারারও উৎপত্তি। এই নতুন যুক্তিমুখী আন্দোলনের আদি প্রবক্তাদের অনেকেই ধর্মে অবিশ্বাসী ছিলেন না। বরং বিজ্ঞান ও ধর্মের ভিতর একটি রেখা টেনে দিয়ে তাঁরা দুয়েতেই বিশ্বাস রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আঠারো শতকের জড়বাদী দার্শনিকেরা এই ব্যবস্থা মানতে চাইলেন না। তাঁরা বললেন যে, অজ্ঞতাই ধর্মবিশ্বাসের আশ্রয়।

এই ধর্মবিরোধী যুক্তিবাদী চিন্তাই মার্ক্সও গ্রহণ করেছিলেন। পুরাতন সমাজের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, সব সমালোচনার প্রথমেই প্রয়োজন ধর্মের সমালোচনা। মানুষের চিন্তার ইতিহাসে মার্ক্স এক মহান নাস্তিক।

অথচ ধর্মেরই একটি মূল সমস্যা রূপান্তরিত হয়ে ফিরে এল মার্ক্সের চিন্তায়। ভগবানের নির্দেশ অথবা নিয়ম অমান্য করে মানুষের পতন, পাপের ফলে ঈশ্বর ও মানুষের ভিতর বিচ্ছেদ, ইহুদী ও খ্রীষ্টধর্মের এটি একটি আদি প্রত্যয়। এই বিচ্ছেদবোধ পাশ্চাত্ত্য চিন্তায় যুগে যুগে ফিরে এসেছে নানা প্রসঙ্গে বিবিধ রূপে। উনিশ শতকের গোড়ায় জামান দার্শনিক চিন্তায় একে আমরা পাই এক বিশেষ বেশে। যে সব নিয়ম সমাজকে ধারণ করে থাকে মানুষেরই চেতনায় তাদের উদ্ভব; অথচ মানুষ তাদের আপন বলে চিনতে পারে না। এমনি ভাবে স্রষ্টা মানুষ ও তার সৃষ্টির ভিতর বিরোধ দেখা দেয়। এই বিচ্ছেদকে অতিক্রম না করে মানুষের মুক্তি নেই।

মার্ক্স সমস্যাটা দেখলেন অন্যভাবে। দ্বন্দ্বের মূল খুঁজতে হবে মানুষের খণ্ডিত চেতনায় নয়, বরং সামাজিক উৎপাদন-ব্যবস্থার গঠনে। উৎপাদনের যন্ত্রগুলি মানুষেরই শ্রমে সৃষ্ট; অথচ এদের স্বত্বাধিকার অল্পসংখ্যক মানুষের ভিতর সীমাবদ্ধ। এখানেই সামাজিক দ্বন্দ্বের উৎপত্তি। মূলধনের উপর সমাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলে তবেই এই দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি ঘটবে। ধনতান্ত্রিক সমাজে শ্রমিকের শ্রম ও তাঁর স্বাধীন ইচ্ছার ভিতর যোগ নেই; শ্রমিক তাঁর নিজের সৃষ্টিকেও আপন বলে গ্রহণ করতে পারে না। এই বিচ্ছেদের অবসান হবে সাম্যবাদী সমাজে। বিপ্লবের পথেই শুধু এই বাঞ্ছিত পরিণতি সম্ভব।

ধনতান্ত্রিক সমাজের একটি বিশেষ যুগের অভিজ্ঞতাই মার্ক্সের চিন্তায় তীক্ষ্ণভাবে ব্যক্ত হয়েছিল। শিল্পবিপ্লবের গোড়ার যুগে নতুন শিল্পব্যবস্থার নিয়মকানুনে শ্রমিকশ্রেণী ছিল সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত, তাকে সে আপন বলে গ্রহণ করতে পারেনি। তা ছাড়া সে যুগে মজুরি ছিল স্বল্প। শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি রাষ্ট্রের ব্যবহার ছিল সহানুভূতিহীন। মার্ক্স এই অন্যায়কে ব্যঙ্গ করেছেন, শ্রমিকশ্রেণীকে দিয়েছেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা।

তারপর পৃথিবীতে বহু পরিবর্তন ঘটেছে। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে সাম্যবাদী দলের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ধনতন্ত্রেরও ইতিমধ্যে চরিত্র পালটেছে। এ যুগের নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে তবেই আজ মার্ক্সের মূল্যায়ন সম্ভব।

শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মার্ক্সের জন্মভূমি জার্মানিতে শ্রমিকের জীবনে যে-সচ্ছলতা এসেছে, মার্ক্সের জীবদ্দশায় সেটা ছিল অকল্পনীয়। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়, একথা আর বলা চলে না। সাম্যবাদী সোভিয়েত দেশেও গত পঞ্চাশ বৎসরে শিল্প ও বিজ্ঞানের প্রশংসনীয় উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু মার্ক্সের আদি প্রত্যাশা পূর্ণ হয়নি। বিপ্লবের উদ্দেশ্যে লেনিন যে-দল গঠন করেছিলেন পরবর্তী কালে স্তালিনী নেতৃত্বে সেই দলই বিচারহীন অত্যাচারের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। বিপ্লবের এই অধঃপতন মার্ক্সবাদী তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। স্তালিনী বিভীষিকাকে সাময়িক অঘটন বলে ছেড়ে দিলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সোভিয়েত ও অন্যান্য কম্যুনিস্ট দেশে শ্রমিকের স্বাধীন ইচ্ছার সঙ্গে শিল্প পরিচালনার বাঞ্ছিত যোগসাধন হয়নি। বরং শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কম্যুনিস্ট দেশেও এক নতুন আমলাতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটেছে। মার্ক্সবাদীরা বলে থাকেন যে, পুরনো ধনতান্ত্রিক মনোবৃত্তির পরোক্ষ প্রভাবেই এটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সাম্যবাদী দেশগুলিতে ধনতন্ত্রের বৈষয়িক ভিত্তি ভেঙ্গে দেবার পরও যদি এই মনোবৃত্তি ছিন্নমূল লতার মতো ধীরে ধীরে অবসন্ন না হয়ে বরং পূর্ব ও পশ্চিমে দেশে দেশে প্রাণবন্ত হয়েই উঠে থাকে, তা হলে সন্দেহ করতে হয় দ্বন্দ্বের শিকড় পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেই নয়, আরও গভীরে। বিভিন্ন কম্যুনিস্ট দেশের ভিতর সাম্প্রতিক সংঘাতও মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে অপ্রত্যাশিত। ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ করলেই মানুষে ও শুভে বিচ্ছেদ দূর হয় না।

যে-খণ্ডসত্যকে মার্ক্স তাঁর বিশেষ যুগের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, শিল্পীর মন নিয়ে তাকে তিনি বাস্তবের চেয়েও বৃহৎ করে এঁকেছিলেন। শ্ৰেণীবৈষম্য ও অন্যায়ের প্রতি আমাদের মনকে তিনি সজাগ করেছেন। এজন্য তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব। কিন্তু মার্ক্সেরও মূল্যায়ন প্রয়োজন খণ্ডকালের সীমাতেই। নয় তো তাঁকে সেই ভগবানের আসনেই বসানো হবে যে-ভগবানকে তিনি আসনচ্যুত করতে চেয়েছিলেন।

প্রগতির পথ (১৯৬৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *