৮. কুঠি থেকে ঘুরে আসার পর

০৮.

ঘোড়া-সাহেবের কুঠি থেকে ঘুরে আসার পর তিন-চারটে দিন দেখতে-দেখতে কেটে গেল। এই কদিনে কিকিরা যেন সামান্য কাহিল হয়ে পড়েছেন। আপন খেয়ালে যে তিনি কী করছেন, তারাপদ বুঝতে পারত না। অর্ধেক সময় ঘরে বসে কিছু ভাবছেন, না হয় কাগজ পেন্সিল নিয়ে কুঠিবাড়ির নকশা করছেন, কিংবা ফকিরের সঙ্গে কথা বলছেন। কিকিরা ফাঁকে ফাঁকে কুঠিবাড়ির বাইরে বাইরেও ঘুরে আসছিলেন লোচনকে নিয়ে। তারাপদকে একরকম ছুটিই দিয়েছেন, বলেছেন তামাশা করে, “নাও হে তারাপদবাবু, খেয়ে আর ঘুমিয়ে গায়ে গত্তি লাগিয়ে নাও ক’দিন, তারপর তোমার এলেম দেখা যাবে। আসুক চন্দন।”

তারাপদর বাস্তবিক কিছু করার ছিল না। খাওয়া আর ঘুম ছাড়া করার কীই বা আছে। ফকিরদের বাড়িতে পুরনো বইপত্তর ছিল, কিছু সেকেলে বই। সেই বই পড়ে সময় কাটাত। আর বিকেলের দিকে ঘুরে বেড়াত এদিক-ওদিক। একদিন কিকিরার সঙ্গী হয়ে কুঠিবাড়ির বাইরেও ঘুরে এসেছে আবার।

কিকিরা যে একটা মতলব আঁটছেন, তারাপদ সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছিল। কিন্তু মতলবটা কী তা ধরতে পারছিল না।

.

এমন সময় চন্দন চলে এল। এয়োদশীর দিন। স্টেশনে জিপ নিয়ে গিয়েছিল নকুল, সঙ্গে তারাপদ।

জিপ গাড়িতে আসতে-আসতে দু-পাঁচটা কথার পর চন্দন বলল, “কতদূর এগুল ব্যাপারটা?”

তারাপদই বলল, “কিকিরাই জানেন।“

“তুই কিছু জানিস না? তা হলে করছিস কী?”

“আমি কিছুই করছি না। খাচ্ছিাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি। আর মাঝে-মাঝে কিকিরার হেঁয়ালি শুনছি।”

“তোর দ্বারা কিছু হবে না, তারা। এত অলস হয়ে গিয়েছিস। ক’দিনে চেহারাটাও তো নাড়র মতন গোল করে ফেলেছিস। গালে চর্বি জমে গিয়েছে।”

তারাপদ হাসল। বলল, “টাটকা দুধ ঘি মাছের ব্যাপার, বুঝলি না?”

চন্দন বন্ধুর পিঠে থাপ্পড় মারল। হাসল। তারপর বলল, “ঘোড়া-সাহেবের কুঠিটা কী বস্তু রে?” কলকাতাতেই কিকিরার মুখে চন্দন ব্যাপারটা মোটামুটি শুনেছিল। বাড়িতে একটা চিঠিও পেয়েছিল তারাপদর।

তারাপদ বলল, “বস্তুটা একটা পুরনো ভাঙাচোরা কেল্লা বলতে পারিস। সেকেলে সাহেবসুবোর ব্যাপার, দু’হাতে টাকা উড়িয়ে বাড়ি বানিয়েছিল।”

চন্দন বলল, “সেখানে কিছু পাওয়া গেল?”

“না। তবে একটা ব্যাপার জানা গিয়েছে। আমি নিজেও দেখেছি প্রমাণ, কেউ একজন ওখানে আস্তানা গেড়েছিল হালে। হয়ত এখনও গেড়ে আছে।”

“লোকটা কে?”

“বলতে পারব না।”

নকুল জিপটাকে থামিয়ে নিয়ে রাস্তার নামল। বনেট খুলে কী যেন করে আবার বন্ধ করল। ফিরে এসে গাড়িতে উঠল।

“কী হয়েছিল, নকুল?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।

”হরনের তারটা খুলে গিয়েছিল বাবু। লাগাই দিলাম।”

আবার গাড়ি চলতে শুরু করলে চন্দন বলল, “কিকিরার বন্ধুর ছেলে কেমন আছে?”

“এখন একটু ভাল শুনেছি। আমি ছেলেটিকে সামনাসামনি দেখিনি। তফাত থেকে দেখেছি।”

অবাক হয়ে চন্দন বলল, “সে কী! তুই আজ হপ্তাখানেক হল এখানে রয়েছিস–ছেলেটাকেই দেখিসনি?”

“কেমন করে দেখব। ও নিচে আসে না। ওকে আসতে দেওয়া হয় না। দোতলায় নিজের ঘরেই থাকে, বেশির ভাগ সময়। কিকিরাও দু-একদিন মাত্র ওপরে গিয়ে ওকে দেখে এসেছেন।”

চন্দন আর কিছু বলল না। সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল। নকুল গ্রামের পথ ধরল এবার।

.

দুপুর আর বিকেলটা চন্দন আয়েস করে কাটাল। খেল, ঘুম দিল, তারাপদ আর কিকিরার সঙ্গে বকবক করল। এই একটা হপ্তা কেমন করে কেটেছে তার বৃত্তান্ত শোনাল তারাপদ বন্ধুকে। কিকিরা যতটা পারলেন ফকির, অমূল্য, ঘোড়া-সাহেবের কুঠি এ-সবের ইতিহাস শোনালেন চন্দনকে। তারপর বললেন, “আজ রাত্রে আমরা একটা কনফারেন্স করব, স্যান্ডেলউড তুমি, আমি আর তারাপদ। তার আগে তোমায় একটা-দুটো খুচরো কাজ করতে হবে।”

“কী কাজ?”

“ফকিরের ছেলে বিশুকে একবার দেখবে। আমি ফকিরকে বলে রেখেছি। সেই সঙ্গে ফকিরের পায়ের চোটটা।”

“ফকিরবাবুকে তো সকালে দেখলাম। ও দেখার কিছু নেই। গোড়ালি মচকালে সারতে সময় লাগে।”

“তবু একবার দেখো।”

“বেশ, দেখব।” বলেই চন্দনের কিছু মনে হল, বলল, “বিশু নিচে নামবে, না আমাকে ওপরে যেতে হবে?”

“দেখি কী হয়!…তবে সন্ধের পর আমি আর সময় নষ্ট করতে চাই না, আমরা তিনজনে বসব। বুঝলে?”

মাথা নাড়ল চন্দন। যা বলেছেন কিকিরা, তা-ই হবে।

সন্ধের মুখে চা খাওয়ার সময় ফকির নিজেই বিশুকে নিয়ে নিচে এলেন। ভবানীও সঙ্গে ছিল।

ফকির অল্প খোঁড়াচ্ছিলেন। সকালের মতনই।

কিকিরা বললেন, “তুমি যতটা কম সিঁড়ি-ভাঙাভাঙি করলেই পারো, ফকির। আমরাই ওপরে যেতাম।”

ফকির হাসলেন। বললেন, “চেয়ারে পা তুলে বসে থাকা কি আমাদের পোষায়, কিঙ্কর। আগে এসব চোট গায়ে মাখতাম না। এখন ভাই বয়েস হচ্ছে।” বলে চন্দন আর তারাপদর দিকে তাকালেন।”আমার ছেলেকে আনলাম–” বলে বিশুকে দেখালেন। তারপর ভবানীকে দেখিয়ে বললেন, “আমার ভাগ্নে বিশুর খুব বন্ধু।”

কিকিরা বিশুকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে বসালেন। ভবানীকে বসতে বললেন।

তারাপদ বিশুকে মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। ফকির সুপুরুষ ঠিকই, কিন্তু বিশু তার বাবার চেয়েও সুন্দর। বিশুর ভাই অংশুকে আগেই দেখেছে তারাপদ, গল্পটল্পও করেছে। ছেলেমানুষ। স্কুলে পড়ে। অংশুও দেখতে ভাল। তবে বিশুর মতন নয়। ওদের বোন পূর্ণিমাকেও দেখেছে তারাপদ। বাচ্চা মেয়ে। খানিকটা দুরন্ত। সেও চমৎকার দেখতে। মাঝে-মাঝে নিচে এসে কিকিরার ওপর হামলা করে যায়, তারাপদকে বেসমের লাড্ড খাইয়েছিল। বেশ মেয়ে। তবু ভাইবোনদের মধ্যে বিশু সেরা। ছিপছিপে চেহারা, গায়ের রঙ খুবই ফরসা, একমাথা কোঁকড়ানো চুল, কাটাকাটা মুখ-চোখ, ঠোঁট দুটো পাতলা। সবই সুন্দর। কিন্তু বিশুর মুখে কেমন যেন একটা ভয়ের ছাপ, চোখ দুটোয় ঘুম-ঘুম ভাব।

ভবানীকেও দেখল তারাপদ। সাধারণ চেহারা। তবে চালাক-চতুর বলেই মনে হয়। চন্দন বিশুকে দেখছিল। ফকিরকে বলল, “এখানে দেখা হবে না। আপনি ওকে নিয়ে পাশের ঘরে চলুন।” বলেই একটু থেমে হঠাৎ বলল, “আচ্ছা, ওকে কি কোনো ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়?”

“হ্যাঁ। ডাক্তারবাবু যা দিয়েছে, তাই খায়।”

“কবার খায়?”

“দু-তিন বার বোধহয়।”

“এতবার?…আশ্চর্য! চলুন–পাশের ঘরে যাই।”

চন্দন উঠল।

ফকির বিশুকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন।

কিকিরা ভবানীর সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। তারাপদ একটা সিগারেট ধরাল। ধরিয়ে বিশুর কথা ভাবতে লাগল।

হঠাৎ কিকিরার একটা কথা কানে গেল। কিকিরা ভবানীকে বলছেন “তুমি এখন এখানেই থাকবে কিছুদিন, না ফিরবে?”

ভবানী বলল, “কালীপুজো পর্যন্ত থাকব।”

তারাপদ অন্যমনস্কভাবে ভবানীর দিকে তাকাল। কেন তাকাল সে, বুঝতে পারল না। চোখের দিকে তাকাল। কটা চোখ। জোড়া ভুরু। তারাপদর কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল।

ভবানী উঠে দাঁড়াল।”আমি যাই, মামা। বড়মামুর দেরি হবে।”

“যাবে? এসো!”

 ভবানী চলে গেল।

তারাপদ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে নিঃশব্দে দরজার কাছে গেল। মুখ বাড়িয়ে দেখল বাইরেটা।

ফিরে এসে নিচু গলায় বলল, “কিকিরা, ভবানী বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।”

কিকিরা বললেন, “তুমি বোসো।”

ফকির আর বিশু আরও খানিকটা পরে এ-ঘরে এল। চন্দনও পেছনে-পেছনে।. ফকির অবশ্য আর বসলেন না, বললেন, “কিঙ্কর, আমরা যাই। সকালে দেখা হবে। …ভাল কথা, কাল একবার অমূল্যদের বাড়ি যাব। খুড়িমাকে প্রণাম করে আসা হয়নি বিজয়ার পর। যাব তো, কিন্তু…তুমি কী বলো?”

কিকিরা একটু ভেবে বললেন, “নিশ্চয় যাবে। একশো বার যাবে। আমি বলি কি, তুমিও একদিন অমূল্যকে কোনো ছুতোয় এ-বাড়িতে ডেকে আনো।”

“ওকে ডেকে আনব? কেন?”

“সে না হয় পরে বলব। ভেবে দেখো ডাকতে পারবে কি না? এখন। যাও–ছেলেটাকে আর দাঁড় করিয়ে রেখো না।”

“আচ্ছা, চলি।” ফকির তিনজনের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলেন। তারপর ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন।

সামান্য চুপচাপ। চন্দন চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

 কিকিরা বললেন, “বিশুকে কেমন দেখলে, চন্দন?”

চন্দন তারাপদর কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিয়ে ধরাল, বলল, “আপা। যেমন বলেছিলেন, তেমন তো মনে হল না।”।

কিকিরা আর তারাপদ দুজনেই যেন অবাক হয়ে চন্দনের দিকে তাকালেন।

 চন্দন নিজের থেকেই বলল, “আমার মনে হল, এমনিতে ওর কোনো অসুখ নেই। তবে খানিকটা নাভার্স হয়ে রয়েছে। আর-একটা জিনিস দেখলাম, ওকে ঘুমের ওষুধ একটু বেশিই খাওয়ানো হয়েছে। দেখলেন না, কেমন ঝিমোনো ভাব!”

কী ভেবে কিকিরা বললেন, “শরীর-মনের কোনো ক্ষতি হয়েছে?”

“না। তা আমার মনে হল না।”

“সেরে যাবে?”

“না-সারার কী আছে, কিকিরা? একটা আচমকা শক হয়ত পেয়েছে। কিন্তু সেটা মানুষ নিজের থেকেই ধীরে-ধীরে সামলে নেয়। বিশু, পাগলও হয়নি, উন্মাদও নয়। ভাববার মতন কিছু দেখলাম না। বরং বলতে পারেন, ওকে নিজের থেকে ধাক্কাটা সামলাতে না দিয়ে গাদাগুচ্ছের ওষুধ খাইয়ে আর চারপাশ থেকে বেঁধে রেখে “সিক করে দেওয়া হয়েছে।”

কিকিরা যেন খুশি হলেন। বললেন, “তুমি যা বলছ, তা যেন সত্যি হয়।”

চন্দন ঠাট্টা করে বলল, “আমি ঘোড়ার ডাক্তার নই, কিকিরা স্যার।”

 তারাপদ জোরে হেসে উঠল।

কিকিরাও পালটা ঠাট্টা করে বললেন, “অবোলা জীবের ডাক্তারি করা আরও কঠিন হে স্যান্ডেলউড়। পেটে ব্যথা হলেও সে বলতে পারবে না, মাথা ধরলেও নয়। বুঝলে?”

আরও দু চারটে হাসি-তামাশার কথা হল। তারপর কিকিরা বললেন, “এবার কাজের কথা হোক, কী বলো তারাপদ?”

মাথা নাড়ল তারাপদ।

একটু চুপচাপ বসে থেকে কিকিরা বললেন, “চন্দন, তুমি তো মোটামুটি সবই শুনেছ। ঘোড়া-সাহেবের কুঠিটাই যা তোমার দেখা হয়নি। তা সেটাও কাল-পরশু দেখিয়ে আনব। এখন কাজের কথা শুরু করি।”

চন্দন আর তারাপদ তাকিয়ে থাকল। কিকিরার দিকে।

কিকিরা বললেন, “আমি অনেক ভেবেচিন্তে দেখেছি, ঘোড়া-সাহেবের কুঠি নিয়ে যে ঝাট বেধেছে, সেটা নেহাত ওই বাড়িটা নিয়ে নয়। তোমরা বলবে, কেন–বাড়ি নিয়ে নয় কেন? তার জবাবে আমি তারাপদর কথাটাই বলব, বাড়ি নিয়ে ঝঞ্ঝাট হলে সেটা আইন-আদালত করে ফয়সালা হতে পারত। তা কেন হচ্ছে না? কেন অমূল্য আর ফকির দু’জনেই ওই বাড়ির ওপর ঝুঁকে পড়েছে? ঠিক কি না বলো? তা ছাড়া, ঘোড়া-সাহেবের কুঠি এতকাল পড়ে থাকল–কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাল না, হঠাৎ আজ মাস-দুই ধরে দু-তরফের টনক ওঠার কারণ কী?”

চন্দন বলল, “ফকিরবাবু আপনাকে কী বলছেন?”

“কিছুই তো বলছে না। ওর কথাবার্তা থেকে বরং মনে হয়, বিশুকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কুঠিতে নিয়ে গিয়ে অমূল্যরা একটা ভয়ঙ্কর কিছু করবার মতলব এঁটেছিল। পারেনি। এখন ফকিরের রোখ চেপে গিয়েছে।”

তারাপদ বলল, “ভয়ঙ্কর কী করত, কিকিরা?”

“লুকিয়ে রাখতে পারত, গুম করত, মেরে ফেলতেও পারত।”

“কেন? নিজের ভাইপোকে কেউ মেরে ফেলে?”

“টাকা-পয়সা-সম্পত্তির লোভে খুন-খারাপি তো হয়েই থাকে।”

চন্দন বলল, “তা ঠিক। কথায় বলে, অর্থই অনর্থের মূল। রাজবাড়ির সেই কেস না, কিকিরা? কিন্তু আমি ভাবছি, বিশু একজন অচেনা সাধুবাবার কথায় বিশ্বাস করে তার পেছন-পেছন কুঠিবাড়িতে গেল কেন?”

কিকিরা হাতের আঙুল মটকাতে-মটকাতে বললেন, “তুমি ঠিকই ভাবছ। নেহাত কৌতূহলের জন্যে যেতে পারে, কিংবা ভয়ে। আমি ভাবছি এ-ছাড়া অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে কি না?”

তারাপদ বলল, “তা কেন ভাবছেন?”

“ভাবছি এই জন্যে যে, বিশু সাধুবাবার কথায় ভুলে না হয় কুঠিবাড়িতে গেল, কিন্তু সেই সময় অমূল্যর শালা চরণ তার লোক নিয়ে সেখানে হাজির থাকবে কেন? কেন চরণরা গিয়েছিল? কে তাদের নিয়ে গিয়েছিল?”

চন্দন কান চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “আপনি কি বলতে চান, ওই সাধুবাবাই বিশুকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে অমূল্যর শালার হাতে তুলে দিয়েছিল?”

 মাথা নাড়লেন কিকিরা।”না, অতটা বলতে পারছি না। তা যদি হত, তবে বিশুকে চরণদের হাতে তুলে দিয়ে সাধুবাবু পালাত। কিন্তু তা তো হয়নি। উলখে সাধুবাবার সঙ্গে চরণদের কথা-কাটাকাটি হয়েছে। সাধুবাবাকে গুলি করা হয়েছে।”

“গুলি খেয়ে সাধুবাবা পালিয়েছে, তারাপদ বলল, “ম্যাজিক দেখিয়ে উধাও।”

কিকিরা বললেন, “গুলি খেয়েছে কি না, তা বলতে পারব না; তবে বিশুর মুখে আমি যা শুনেছি, তাতে বুঝতে পারলাম, চরণদের সঙ্গে সাধুবাবার কথা কাটাকাটি আর ঝগড়া থেকে বিশু বুঝতে পারছিল, চরণরা সাধুবাবার কাছে কিছু জানতে চাইছিল; সাধুবাবা বলছিল না।”

“সেই রাগেই কি বন্দুক চালায় চরণরা?”

“তাই তো মনে হয়।”

 সামান্য চুপচাপ থেকে তারাপদ চন্দনকে বলল, “আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না, চাঁদু। সাধুবাবাও একটা মিষ্ট্রি। বিশুকে কেনই বা ডেকে নিয়ে যাবে, আর কেনই বা উধাও হয়ে যাবে। লোকটার কোনো ট্রেসই আর পাওয়া গেল না।”

কিকিরা বললেন, “আমার কাছে এখন দুটো প্রশ্নই আসল।”

“প্রশ্ন দুটো কী?” চন্দন বলল।

“ওই সাধুবাবা লোকটি কে? কেন সে হঠাৎ এসে হাজির হয়েছিল এখানে। মজার ব্যাপার কী জানো, সাধুবাবা এখানে আসার সময় থেকেই ওই কুঠিবাড়ি নিয়ে গণ্ডগোল কেন?”

“আর আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন?”

“দ্বিতীয় প্রশ্ন, কী জন্যে সাধুবাবা বিশুকে নিয়ে কুঠিবাড়িতে গিয়েছিল। কেন বলেছিল বিশুকে যে, কুঠিবাড়িতে গেলে তার ভাল হবে। আর কেনই বা চরণ সাধুবাবার সঙ্গে ঝগড়া চেঁচামেচি করছিল? কী জানতে চাইছিল? কেন তারা সাধুবাবার পিছু ধরেছিল?”

তারাপদ বলল, “আপনি বলতে চাইছেন, সাধুবাবাই সব গণ্ডগোলের মূল?”

“নিশ্চয়।”

চন্দন বলল, “সাধুবাবার হাওয়া হয়ে যাবার ব্যাপারটা..?”।

“ওটা স্রেফ চালাকি! এক ধরনের ম্যাজিক। সেই ঘর, জানলা, সিঁড়ি তোমায় দেখাব। দেখলেই বুঝতে পারবে। আমিও ওখান থেকে ভ্যানিশ হতে পারি। ওটা কিছু নয়। তবে হ্যাঁ, কুঠিবাড়ির একটা ঘরে “ডবল উইনডো’ আছে এটা সাধুবাবা কেমন করে জানল? আর কেনই বা সে ওই ঘরটাই বেছে নিয়েছিল, নিয়ে বিশুকে নিয়ে গিয়েছিল?” বলে একটু থেমে আবার বললেন কিকিরা, “প্রথমে আমার মনে হয়েছিল, ম্যাজিকে যেরকম ভ্যানিশিং ট্রিক দেখানো হয়–এখানেও তাই হয়েছে। জানলাটা দেখার পর বুঝতে পারছি–ওটা একটু অন্যরকম। সাধুবাবা সব জেনেই ঘর বেছেছিল। মানে জানলার ব্যাপারটা সে জানত।”

চন্দন আর তারাপদ পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।

চন্দন বলল, “তারা বলছিল, ওই ঘরে কেউ একজন এখন থাকে।”

“থাকার চিহ্ন দেখেছি। লোক দেখিনি। হয়ত কেউ একজন ঘরে থাকত, পাহারা দিত। খুব সম্ভব সাধুবাবারই আস্তানায় ছিল ওটা। কিন্তু কেন? ওই ঘরে কী আছে?”

কেউ কোনো কথা বলল না।

অনেকক্ষণ পরে চন্দন বলল, “সাধুবাবাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না?”

কিকিরা বললেন, “চেষ্টা করছি। লোক লাগিয়েছি।” বলে তারাপদর দিকে তাকালেন। বললেন, “তোমায় একটা কথা বলা হয়নি, তারাপদ। লোচন আজ বিকেলে বলছিল, যে শশিপদকে আবার তার গ্রামে দেখা গিয়েছে।”

“শশিপদ কে?” চন্দন জিজ্ঞেস করল। “সাপের ওঝা, কিকিরা যেন কেমন করে হাসলেন, “ওই ওঝাটিকে ধরতে হবে হে। নকুলকে আমি বলেছি। …নাও, ওঠো রাত হল। আর নয়।”