১. তারাপদ অফিস থেকে মেসে

০১.

তারাপদ অফিস থেকে মেসে ফিরতেই বটুকবাবুর সঙ্গে দেখা। বটুক বললেন, “ওহে, তোমার সেই ম্যাজিশিয়ান কিকিরা এসেছিলেন। আবার আসবেন। বলে গেছেন, তুমি যেন মেসেই থাকো।”

সামান্য অবাক হল তারাপদ। আজ সপ্তাহ দুই হল, কিকিরা কলকাতা-ছাড়া। দু-দুটো রবিবার তারাপদ আর চন্দন অভ্যেসমতন কিকিরার বাড়ি গিয়েছে, গিয়ে ফিরে এসেছে। কিকিরার দেখা পায়নি। কিকিরার বাড়ি গিয়েছে, গিয়ে ফিরে এসেছে। কিকিরার দেখা পায়নি। সর্বজ্ঞ বগলাচন্দ্রও কিছু বলতে পারল না। বরং মনে হল, বগলা খানিকটা চটেই রয়েছে কিকিরার ওপর। সংসারের যা কিছু বগলাই করবে–চণ্ডীপাঠ থেকে জুতো পালিশ, আর বগলাকে বিন্দুমাত্র কিছু না জানিয়ে একটা লোক বেপাত্তা হয়ে বসে থাকবে–এ কেমন কথা! বগলার কি ভাবনাচিন্তা হয় না! যাবার সময় বগলার হাতে কিছু টাকাপত্তর খুঁজে দিয়ে কিকিরা নাকি বলে গেছেন : “বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। সাবধানে থাকবি। তারা আর চাঁদু এলে বলবি, দিন সাত-আট পরে ফিরব।”

সেই সাত-আট দিন পনেরো-ষোলো দিনের মাথায় গিয়ে ঠেকল। যাক্, কিকিরা ফিরে এসেছেন, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

নিজের ঘরে গিয়ে তারাপদ জামা-প্যান্ট ছাড়ল। ছেড়ে সাবেকি লুঙ্গি জড়াল; তারপর সাবান আর গামছা নিয়ে নিচে নেমে গেল স্নান সারতে। আজ তার মন বেশ হালকা। একটা দিন আর, পরশু থেকে পুজোর ছুটি শুরু। আজই মাইনে পেয়ে গিয়েছে। অফিস-টফিসে কাজ করার সময় ছুটিছাটা পাওয়া যে কত আনন্দের, তারাপদর আগে জানা ছিল না। এখন জানছে। অবশ্য এ-সবই কিকিরার দয়ায়। কিকিরা বেছে-বেছে নিজে তদ্বির করে তারাপদকে এই চাকরিটা জুটিয়ে দিয়েছেন। বেসরকারি চাকরি, কিন্তু ভাল। ছোট অফিস। কোনো গোলমাল নেই। যাও, খাতা খুলে কলম ধরে হিসেবপত্র মেলাও, চা-সিগারেট খাও, ছুটি হলে বাড়ি ফিরে এসো ভালই লাগছে তারাপদর। সে স্বপ্নেও ভাবেনি, মাস গেলে শ’ ছয়েক টাকার মতন তার পকেটে আসবে! চাকরি পাবার প্রথম দিকে ভেবেছিল, টাকা যখন আসছে হাতে, তখন বটুকবাবুর মেস ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। কিন্তু যাওয়া হল না। এতকাল থাকতে-থাকতে কেমন মায়া পড়ে গিয়েছে বটুকবাবুর মেসের ওপর, নিজের ওই হতকুৎসিত ঘরের ওপরেও। এক সময় বটুকের টাকার তাগাদায় তারাপদ কেঁচো হয়ে থাকত, এখন বটুককেই কেঁচো করে রেখেছে! না না, বটুকবাবু মানুষ খারাপ নয়, কথাবাতার ধরনটাই যা খরখরে। বটুকবাবু যদি মন্দ হতেন, তারাপদ কি তার দুর্দিনে টিকে থাকতে পারত। এই মেসে! না, তারাপদ নেমকহারামি করতে পারবে না বটুকবাবুর সঙ্গে। বটুকের জয় হোক।

নিচের শ্যাওলা-পড়া কলতলা থেকে স্নান সেরে “বটুকের জয় হোক” গাইতে গাইতে তারাপদ তার ঘরে ফিরে এল। ফিরে এসে মুখ মুছে চুল আঁচড়াচ্ছে, দরজায় পায়ের শব্দ শুনল। মুখ না ফিরিয়েই তারাপদ বলল, “আসুন, কিকিরা মশাই! কোথায় যাওয়া হয়েছিল, স্যার?

কোনো সাড়াশব্দ কানে এল না।

ঘুরে দাঁড়াল তারাপদ। দরজার সামনে বটুকবাবু দাঁড়িয়ে! হাসল তারাপদ। ও, আপনি! টাকা চাইতে এসেছেন?”

“না। বলতে এসেছি, তুমি বড় এঁচোড়ে-পাকা হয়ে গিয়েছ! আমি তোমার ইয়ার? খুব যে গান গাইতে-গাইতে এলে!”

তারাপদ জোরে হেসে উঠল।”আপনার কানে গিয়েছিল? সরি, বটুকদা! ভেরি সরি। তা আপনার টাকাটা এখন নেবেন?”

“আজ বেস্পতিবার। কাল দিও। মাইনে পেয়েছ?”

মাথা হেলাল তারাপদ।

বটুক বললেন, “তোমায় একটা কথা বলব, ভাবছি। দুলালবাবু আজ দু’ তিন মাস ধরে ভুগছেন। কেউ বলছে আলসার, কেউ বলছে লিভার খারাপ হয়েছে। তোমার ওই ডাক্তার-বন্ধুকে বলে হাসপাতালে ঢুকিয়ে দাও না, ভাই; মানুষটার একটা চিকিৎসা হয়!”

তারাপদ দু’মুহূর্ত বটুবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, “আগে কেন বলেননি? আমি চন্দনকে বলব। নিশ্চয় বলব।”

এমন সময় কিকিরাকে দেখা গেল। বটুকবাবু চলে গেলেন।”

“কী গো অফিসের বাবু? কখন ফেরা হল?” কিকিরা ঘরে ঢুকে বললেন।

“খানিকটা আগে। তা আপনার হঠাৎ-আবির্ভাব কেন কিকিরা-স্যার? কোথায় হাওয়া হয়েছিলেন?”

“অজ্ঞাতবাসে গিয়েছিলাম। মাঝে-মাঝে তোমাদের এই কলকাতায় হাঁপিয়ে উঠি। তখন দু-চার দিন কোথাও পালিয়ে যাই।”

“দু-চার দিন তো নয়, স্যার; আপনি সপ্তাহ-দুই ডুব মেরে ছিলেন। বগলা ফায়ার হয়ে গিয়েছে, তা জানেন?”

“ও একটা আস্ত উজবুক। পইপই করে বলে গেলাম, তুই ভাবিস না, আমি দিন কতকের জন্যে এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। অনেক দিন যাইনি। কদিন থেকে আসব। তা হতচ্ছাড়া যাকেই পেয়েছে, তার কাছেই প্যানপ্যান করেছে।”

“গিয়েছিলেন কোথায়?”

“বেশি দূরে নয়। আসানসোলের কাছে কালীপাহাড়ি বলে একটা জায়গা আছে। কোলফিল্ডকে কোলফিল্ড, আবার গ্রামও।”

“সেখানে বন্ধু আছে?”

“পুরনো বন্ধু, বাপু। একসঙ্গে খেলাধুলো করেছি। স্কুল ফ্রেন্ড।…তা নাও, সাজগোজ শেষ করো; চলল, একটু ঘুরে আসি।”

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “এই ভিড়ের মধ্যে কোথায় ঘুরবেন! পুজোর ভিড়। রাস্তাঘাটে হাঁটা যায় না। আজ পঞ্চমী, তা জানেন?”

“সব জানি। নাও, পাজামা চড়িয়ে নাও। চলো।”

তারাপদ কিছু বুঝল না। কিকিরা যখন বলছেন, তখন যেতেই হবে। বলল, “একটু চা হবে না, কিকিরা-স্যার?”

“সে বাইরে হবে। তুমি ঝটপট নাও তো।”

তারাপদ গায়ে গেঞ্জি গলাতে লাগল।

 পার্ক তো নয়, নেড়া মাঠ। বর্ষার দৌলতে কোথাও কোথাও সামান্য ঘাস গজিয়ে কোনো রকমে টিকে ছিল। কিকিরা বেছে-বেছে একটা জায়গায় বসলেন। কাছাকাছি কেউ নেই।

তারাপদও বসল। বসে একটা সিগারেট ধরাল।

কিকিরা হাত বাড়ালেন।”দাও তো, একটা ধোঁয়া দাও।”

 তারাপদ প্যাকেট দিল সিগারেটের।

কিকিরা ন’মাসে ছ’মাসে শখ করে সিগারেট খান। গোটা কয়েক কাঠি নষ্ট করে সিগারেট ধরালেন। বললেন, “তোমার অফিস কবে বন্ধ হচ্ছে?”

“কাল অফিস হয়ে।”

“খুলবে কবে?”

“খুলবে দ্বাদশীর দিন। তবে আমার লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত ছুটি। অবাঙালিরা দেওয়ালির ছুটি পাবে চার দিন, আমরা শুধু কালীপুজোর দিন।”

“ভালই হল। আমরা তা হলে কালকেই কালীপাহাড়ি স্টার্ট করতে পারি।” কিকিরা বেশ সহজভাবেই বললেন।

তারাপদ অবাক হয়ে কিকিরার দিকে তাকাল।”কালীপাহাড়ি! সেখানে যাব কেন?”

কিকিরা হাসিমুখে বললেন, “পুজোর এই ভিড় হই-হট্টগোলের মধ্যে কলকাতায় থেকে কী করবে? চারদিকে শুধু মাইক আর ঢাকের বাজনা। আমার সঙ্গে ঘুরে আসবে চলল। তোফা থাকবে, পোলাও-মাংস খাবে, কত সিনসিনারি দেখবে–ধানখেত, পলাশ ঝোপ, কাশফুল, মাঝে-মাঝে বৃষ্টি। শরৎকাল দেখবে হে, রিয়েল শরৎকাল। পদ্য পড়েছ আজি কি তোমার মধুর মুরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে…? সেই জিনিস দেখবে।”

তারাপদ সিগারেটের টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। কেমন সন্দেহ হচ্ছিল তার। কিকিরা শরৎকাল দেখতে কালী পাহাড়ি যাবেন? বর্ধমান লোকালে গিয়েও তো শক্তিগড় থেকে শরৎকাল দেখে আসা যায়।

“কিকিরা স্যার,” তারাপদ বলল, “খুলে বলুন তো ব্যাপারটা?”

“কেন, কেন! খোলাখুলির কী আছে! একেবারে সিপিল ব্যাপার। পুজোর ছুটিতে দিন কয়েক নিরিবিলিতে থেকে আসা।”

“তা ঠিক,” তারাপদ অবিকল কিকিরার মতন করে বলল, “ভেরি সিমপি। তবে কিনা আপনি এই দিন-পনেরো নিরিবিলিতে কাটিয়ে এলেন, আবার সেই একই জায়গায় নিরিবিলিতে কাটাতে যাচ্ছেন তো, তাই বলছিলাম ব্যাপারটা কী?”

“তোমাদের বড় সন্দেহবাতিক?”

“সঙ্গদোষ স্যার! আপনার রহস্য দেখে-দেখে আমরাও সাসপিশাস হয়ে উঠেছি।…তা সত্যি করে বলুন তো, এবারের মিস্ট্রিটা কী? আবার কোনো ভুজঙ্গ কাপালিক?”

“না।”

“রাজবাড়ির ছোরা-গোছের কিছু পেয়েছেন?”

“না হে, না।”

“তবে?”

 কিকিরা বললেন, “এবার দুশো শক্ত কাজ করতে হবে, একই সঙ্গে। ওঝাগিরি করব একদিকে, আর অন্যদিকে একটা খুন।”

“খুন? মার্ডার?” তারাপদ চমকে উঠল। বড় বড় চোখ করে দেখতে লাগল কিকিরাকে।

কিকিরা বেশ সহজভাবেই বললেন, “তুমি ভেবো না, এমন ছিমছাম, নিট অ্যান্ড ক্লিন খুন হবে যে, কারুর সাধ্য হবে না আমাদের ধরে।”

তারাপদ বলল, “আপনি একলাই যান, খুন সেরে ফেলুন। আমি যাচ্ছি না।”

কিকিরা হেসে ফেললেন। তারাপদর কাঁধের কাছে থাপ্পড় মেরে বললেন, “তুমি একটি আস্ত হাঁদা। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কথা শোনোনি কখনো? বিষ দিয়ে বিষক্রিয়া নষ্ট করা? শোনোনি? এটাও হল সেই রকম। একটাকে

হেভেনে পাঠিয়ে দেব, আর-একটাকে হেল্ থেকে টেনে তুলব।

“হেভেনে কাকে পাঠাবেন? আমাকে?” তারাপদ ঠাট্টা করে বলল।”ঠিক ধরেছ! তোমার মাথার ঘিলু অনেককাল জমাট ছিল। এবার দেখছি গলে যাচ্ছে। শীতকালে নারকেল-তেল যে ভাবে গলে, সেই ভাবে।”

রসিকতা করে তারাপদ বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার তাতে।”

কিকিরা জোরেই হাসলেন। হাসি সামলে বললেন, “এবার কাজের কথা বলি। কাল রাত্রের প্যাসেঞ্জারে আমরা যাচ্ছি। তুমি গোছগাছ করে আমার বাড়িতে সন্ধের মধ্যে চলে আসবে। আর চন্দনের সঙ্গে কাল সকালে দেখা করে বলবে, সে কবে যেতে পারবে?”

“চাঁদু পারবে না।”—

 “কেন?”

“অনেক কষ্টে দিন চারেক ছুটি ম্যানেজ করেছ; বাড়ি যাবে মা-বাবার কাছে।”

“বেশ তো, বাড়ি থেকে ফিরে এসে যাবে।”

“ওর হসপিটাল-ডিউটি নেই?”

“তুমি বড় বাগড়া দাও। বেশ, স্যান্ডেল-উডকে বলল, কাল আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে। দুপুরের পর আমি থাকব। বুঝলে? সকাল আমাকে পাবে না। দুপুরের পর পাবে।”

“বলব।”

“ব্যস, তা হলে ওঠো। কাল দেখা হবে।”

”আপনি কিন্তু ব্যাপারটা বললেন না?”

“অত অধৈর্য হচ্ছ কেন? কাল ট্রেনে যেতে-যেতে বলব।” কিকিরা উঠলেন।

 তারাপদকেও উঠতে হল।

পা বাড়িয়ে কিকিরা বললেন, “একটা ব্যাপার বেশ মন দিয়ে ভেবো তো! তেতালার সমান উঁচু থেকে একটা লোক যদি লাফিয়ে পড়ে, সে মাটিতে-না পড়ে আর-কোথায় যেতে পারে? হাওয়ায় কি মিলিয়ে যাওয়া যায়।” তারাপদ কিছুই বুঝল না।