৭. ফকিরের যাওয়া হল না

০৭.

পরের দিন ফকিরের যাওয়া হল না। আগের দিন রাত্রে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পা হড়কে পড়ে গোড়ালি মচকে ফেলেছেন। বাঁ পায়ের গোড়ালি গোদের মতন ফুলে গিয়েছে; ব্যথা প্রচণ্ড। বসার ঘরে বসে গুলাব লোশান লাগাচ্ছেন।

ফকির যেতে পারলেন না, কিন্তু তিনি নকুলকে সঙ্গে দিলেন। বললেন, “গাড়ি নিয়ে যাও, নকুলও সঙ্গে থাক।”

জিপের রাস্তা সরাসরি নয়, খানিকটা ঘোরা পথে যেতে হয়। রাস্তাও পাকা নয়, কোথাও মাটি আর নুড়ি-ছড়ানো রাস্তা, কোথাও ঘেঁষ ছড়ানো, কোথাও বা একেবারে মেঠো পথ।

সঙ্গে লোচনও ছিল।

যেতে-যেতে সাধারণ কিছু কথার পর কিকিরা লোচনকে বললেন, “সেই শশিপদর খবর পেলে, লোচন?”

“আজ্ঞা না। দামড়া গাঁয়েও লাই।” লোচন বলল।

“নেই তো গেল কোথায়? ওর বাড়ি দামড়া গাঁয়ে।”

 লোচন বলল, “উ মস্ত খেপা, বাবু! আজ হেথায়, কাল হোথায়, কুথায় যে থাকে খেপা, কেউ বলতে লারে। তবে গাঁয়ের লোকে বলল বটে, খেপা গাঁয়ে ঘোরাফেরা করছিল।”

নকুল গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, “শশিপদ বড় একটা ওঝা বটে, বাবু। চিতি সাপেরও বিষ নামায়।”

কিকিরা আগ্রহ দেখিয়ে বললেন, “তাই নাকি! শশী তো গুণী লোক হে। শুনি, কিছু বলো বটে উর কথা।”

তারাপদ মুচকি হাসল। কিকিরার কথা শুনেই।

লোচন শশিপদর বৃত্তান্ত বলতে লাগল, মাঝে-মাঝে নকুলও বলছিল দু চার কথা।

শশিপদ দামড়া গ্রামের লোক। বরাবরই খেপাটে ধরনের। একটা কুঁড়ে ঘর আর একফালি সবজি বাগানের বেশি ওর কিছু ছিল বলে কেউ জানে না। গানটান গাইতে পারত শশী। গ্রামের যাত্রাদলে গানটান গাইত। শশীর মাসি মারা যাবার পর অনেকদিন ও আর নিজের গ্রামে ছিল না। কোথায় চলে গিয়েছিল কে জানে। আবার ফিরে এল। একেবারে বোষ্টম বৈরাগীর বেশ। ফিরে আসার পর জানা গেল, শশী ওঝাগিরি শিখেছে। গাছ-গাছড়ার ওষুধ দিতে পারত, কাউকে সাপে কামড়ালে বিষ নামাত। শশিপদর হাতে সাপে কামড়ানো লোক অনেক বেঁচে গিয়েছে। যারা মারা গিয়েছে, তাদের জন্যে শশী অনেক করেছিল, বাঁচাতে পারেনি। সদর হাসপাতালে পাঠিয়েও তো সাপেকামড়ানো রোগী মরে। মোট কথা, শশিপদ খেপা হলেও তার কতক গুণ রয়েছে।

কিকিরা আর-কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, শুধু তারাপদকে বললেন, “এদিকে সাপের উৎপাত বেশ, বুঝলে তারাপদ। মাঝে-মাঝেই সাপের কামড়ে লোক মারা যায়।”

তারাপদ প্রথমটা ধরতে পারেনি, পরে কিকিরার চোখের দিকে তাকিয়ে ধরতে পারল। কিকিরা বোধ হয় ফকিরের ছোটকাকার ব্যাপারটা ইঙ্গিত করলেন। অবশ্য, এই দুইয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক তারাপদ খুঁজে পেল না। ফকিরের ছোটকাকা সাপের কামড়ে মারা গিয়েছেন, আর শশিপদ সাপের ওঝা। এই দুয়ের সম্পর্ক কী?

তারাপদ কিছু জিজ্ঞেসও করল না।

ঘোড়া-সাহেবের কুঠির পেছন দিকে একটা গাছতলায় জিপ রেখে চারজন কুঠির ভাঙা পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকল।

তারাপদ চারদিকে তাকিয়ে দেখল একবার। মাথার ওপর সূর্য দেখা যাচ্ছে না, গাছে আড়াল পড়েছে, রোদও তেমন গায়ে লাগে না বড় বড় গাছপালার জন্যে। পাখির ডাক ছাড়াও কোথাও কোনো শব্দ নেই। নির্জন, নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে কুঠিটা। আলোয় স্পষ্ট।

আগের বার বিকেলের দিকে এসেছিল বলে, কিংবা প্রথম এসেছিল বলেই তারাপদর ভয়-ভয় লেগেছিল। আজ আর লাগছে না। তা ছাড়া তারা চারজন রয়েছে। নকুল আর লোচন কি কিছু কম!

বাইরে ঘোরাঘুরি না করে কিকিরা প্রথমেই বললেন, “লোচন, সোজা ভেতরে ঢুকব। নকুল, তুমি সবার পেছনে থাকবে। তোমার হাতের ওই লোহার রড়ে শব্দ করো না।”

নকুল গাড়িতে একটা হাত তিনেক লম্বা লোহার রড় সব-সময় রেখে দেয়। সেটা হাতে নিয়ে এসেছে। লোচনের হাতে কিছু নেই। তারাপদরও খালি হাত। কিকিরার হাতে সেই সরু ছড়ি। আলখাল্লা ধরনের ঢিলেঢালা জামার পকেটে কী আছে কে জানে।

কুঠিবাড়ির সামনের দিকে ঢাকা বারান্দা। বারান্দাটা চাঁদের কলার মতন বাঁকানো। বিশাল বারান্দা চওড়াও কম নয়। সাত-আট ধাপ সিঁড়ি উঠে বারান্দা। মাঝের দরজাটা যেন পাহাড়। খোলার উপায় নেই। পাশাপাশি ঘর অনেক। দরজাও রয়েছে পর-পর। একটা দরজার জানলা ভাঙা। লোচন কিকিরাকে ডাকল।

সেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল চারজনেই।

ভেতরে পা দিতেই তারাপদ বিশ্রী গন্ধ পেল। কতকালের ধুলোবালি, আবর্জনা জমে-জমে গন্ধ হয়েছে। বদ্ধ বাতাস। দরজার পাল্লা ভাঙা থাকার দরুন আলো আসছিল মোটামুটি। উলটো মুখের জানলাও আধ-খোলা। তারাপদ পকেট থেকে রুমাল বার করে নাক চাপা দিল।

কিকিরা ঘরটা একবার দেখলেন। একেবারে ফাঁকা ঘর ভেতরের পলেস্তরা ভেঙে পড়েছে, একদিকে কিছু কাঠকুটো জড়ো করা, সাপের খোলস, মরা টিকটিকি, ঝুলে আর মাকড়শার জালের কোনো অভাব নেই। সাপ, ছুঁচো সবই থাকা সম্ভব এই ঘরে।

কিকিরা বললেন, “লোচন, প্রথমে নিচের ঘরগুলো দেখে নিই, পরে দোতলায় উঠব।”

বাড়িটার সুবিধে এই, পাশাপাশি ঘরের মধ্যে আসা-যাওয়া করার জন্যে দরজা রয়েছে, দরজার পাল্লাগুলো ভাঙাচোরা, একটা হয়ত আছে, অন্যটা নেই; কোথাও কোথাও একেবারেই নেই। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে অসুবিধে হয় না। ঘরগুলো বড়বড়, বেশ বড়, মাথার ছাদ ধরতে হলে লম্বা সিঁড়ি চাই, লোহার কড়ি বরগা, জানলাগুলো বেশির ভাগই বন্ধ, রোদে-জলে কাঠের এমন অবস্থা হয়েছে যে, সেই বন্ধ জানলা আর খোলার উপায় নেই। সমস্ত ঘরেই দুর্গন্ধ। আসবাবপত্রের মধ্যে কদাচিৎ কোনো ভাঙাচোরা চেয়ার কিংবা টেবিল চোখে পড়ে।

কিকিরা তারাপদকে বললেন, “নিচের তলাটা ছিল ঘোড়া-সাহেবের অফিসঘর। এজেন্টেস অফিস।“

তারাপদর মনে হল, অফিসঘর বলেই হয়ত পাশাপাশি ঘরে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা। অফিসের অংশটা মোটামুটি দেখে নিয়ে কিকিরা ভেতর-দরজা দিয়ে সরু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। এটা ভেতর দিকের বারান্দা। প্যাসেজ বলা যায়। প্যসেজের ওদিকে আরও কতকগুলো ঘর। প্যাসেজের গা দিয়ে চওড়া সিঁড়ি উঠে গিয়েছে দোতলায়। কাঠের সিঁড়ি।

তারাপদ বুঝতে পারল, নিচের তলায় দুটো অংশ। সামনের দিকে অফিস ছিল। পেছনের দিকে কী ছিল? কিকিরা বললেন, “চাপরাশি, পিয়ন, বয়বাবুর্চিরা থাকত।”

প্যাসেজে দাঁড়িয়ে কিকিরা বললেন, “লোচন, ও-পাশে বারান্দায় গিয়ে একবার দেখো তো কোনো দরজা খোলা পাও কি না?”

লোচন বারান্দার দিকে চলে গেল।

তারাপদ বলল, “কিকিস্যার, এটা দেখছি একেবারে ভুতের বাড়ি হয়ে গিয়েছে। এখানে ঢুকলে মানুষ এমনিতেই মরে যাবে।” বলতে বলতে তারাপদ হাঁচল। বদ্ধঘর, ধুলো ময়লা আর দুর্গন্ধে তার মাথা ধরে উঠছিল।

কিকিরা বললেন, “তা ঠিক। তবে ভূতের একটু-আধটু চিহ্ন দেখতে পেলে ভাল হত, তাই না? চলো, দোতলায় চলো, সেখানে যদি দেখতে পাই।”

লোচন ফিরে এল। বলল, দরজা দিয়ে ঢাকার কোনো উপায় নেই। সবই বন্ধ। শুধু বন্ধ নয়, এমনভাবে আটকে আছে যে, একটু নড়ানোও যায় না। তবে ভাঙা জানলা দিয়ে ভেতরে ঢোকা যায়।

কিকিরা একটু ভেবে বললেন, “আগে দোতলাটা ঘুরে আসি। পরে ওদিকটা দেখব, লোচন।”

নকুল হাতের রডটা কাঁধে তুলে এদিক-ওদিক ঘুরছিল। কথাবার্তা বলছিল না। কিন্তু তার চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে খুব সতর্ক, বাইরে গাছপালার শব্দ হলেও কান খাড়া করে শুনেছে।

কিকিরা সিঁড়ি উঠতে লাগলেন। পেছনে তারাপদরা। কাঠের সিঁড়ি। শব্দ হচ্ছিল। পুরু হয়ে ধুলো জমে আছে সিঁড়িতে। ধুলো, পাখির পালক, ঘেঁড়া-খোঁড়া কাগজ, আরও নানান আবর্জনা। সিঁড়ির ধাপ কোনো-কোনোটা নড়বড়ে, কোনোটা আধভাঙা। পায়ের দাগ স্পষ্ট করে বোঝার উপায় নেই, কাঠের রঙ কালচে হয়ে গিয়েছে, ধুলো আর কাঠের রঙ প্রায় এক।

বাইরের আলো থাকায় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কোনো অসুবিধে হল না।

দোতলায় আসতেই বাইরের আলোয় চোখ যেন জুড়িয়ে গেল। অজস্র গাছপালার মাথায় গায়ে শরতের রোদ মাখানো। কাল বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় ঘোওয়া-মোছা গাছপালা যেন সকালের উজ্জ্বল রোদে আরও সবুজ হয়ে গিয়েছে। বাতাসও রয়েছে এলোমেলো।

তারাপদ বেশ কয়েকবার হাঁটার পর রুমালে নাক-মুখ মুছে নিয়ে আলোর দিকে তাকাল।

নিচের তলার মতন দোতলাতেও টানা বারান্দা। বারান্দার ধার ঘেঁষে মোটা মোটা থাম। কোনো কোনো থাম খসে যাচ্ছে। মেঝে ধুলোয় ভরতি, গাছের শুকনো পাতা জমে রয়েছে, আরও নানান রকম আবর্জনা।

কিকিরা প্রথমে বাঁদিকেই পা বাড়ালেন। নিচের তুলনায় ঘরের সংখ্যা কম লাগছিল চোখে। নিচের তলায় পর-পর দরজা ছিল। ওপরে পাশাপাশি দরজা কম। বিশাল-বিশাল দরজা-জানলা। দরজা বন্ধ, জানলা কোথাও-কোথাও খোলা, কাচের শার্সি ভাঙা। সামনের ঘরটারই জানলা খোলা ছিল।

জানলা টপকেই ঘরে ঢুকলেন কিকিরা। তারাপদরাও সাবধানে জানলা টপকাল।

রোদ বা আলো কোনোটাই ঘরে ঢোকার উপায় নেই। জানলা দিয়ে যেটুকু আলো আসছিল।

কিকিরা হাতের টর্চ জ্বাললেন।

তারাপদ টর্চের আলোয় ঘরটা অনুমান করার চেষ্টা করল। এত বড় ঘরে টর্চের আলো কিছুই নয়। ঘরের চারটে দেওয়াল যেন চারপ্রান্তে। বিরাট একটা ভাঙা টেবিল পড়ে আছে একদিকে। কোনো বড়সড় ছবির ভাঙা ফ্রেম। একটা পা মচকানো আর্ম চেয়ার।

কিকিরা টর্চের আলোয় মেঝে দেখালেন। তারাপদর মনে হল, দাবার ছকের মতন দেখতে মেঝেটা। পা দিয়ে ধুলো সরাল।”কিসের মেঝে? কাঠের?”

“সিমেন্টের,” কিকিরা বললেন, “লাল আর কালো রঙ দিয়ে চৌকো ডিজাইন করা।”

লোচন বলল, “মাথার উপর শিকলি ঝুলছে বটে, বাবু।”

কিকিরা টর্চের আলো ফেললেন ছাদের দিকে। একসময় বোধহয় ঝাড়বাতি গোছের কিছু ঝোলাতেন ঘোড়াসাহেব। ঝাড় নেই, কিন্তু গোটা দুয়েক শেকল ঝোলানো রয়েছে। কিকিরা বললেন, “সাহেবের বাতি ঝুলত গো! লাও, চলো।”

জানলা টপকেই বাইরে আসতে হল।

পর-পর তিনটে ঘর দেখলেন কিকিরা। কোনটা কিসের ঘর ছিল বোঝা দায়। কোনোটা হয়ত খাবার, কোনোটা বসার কোনোটা বা শোবার।

বাঁদিকের ঘরগুলো দেখা হয়ে যাবার পর ডান দিকে এগুলেন কিকিরা।

ডানদিকের প্রথম ঘরটার জানলার সবই রয়েছে। কাঁচই যা ভাঙা। দরজা খোলা ছিল।

দরজা দিয়েই ভেতরে এলেন কিকিরা। ফাঁকা ঘর। দুপাটি পুরনো দোমড়ানো জুতো মাত্র পড়ে আছে। বুট জুতো।

কিছুই পাওয়া গেল না। কিকিরা যেন হতাশই হলেন।

আবার বারান্দায় এসে পা বাড়াতেই তারাপদ হঠাৎ বলল, “কিকিরা?”

 “কী?”

 “পায়ের দিকে তাকান”, তারাপদ বলল।

মেঝের দিকে তাকালেন কিকিরা। তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। হাত দিয়ে ইশারায় নোচন আর নকুলকে দাঁড়াতে বললেন।

“কিসের দাগ কিকিরা?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।

মাটিতে বসে কিকিরা ভাল করে নজর করলেন। বললেন, “কোনো ভারী জিনিস টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেন। ধুলোটুলোর ঘষটানো দাগ।“ বলে সামনের ঘরের দিকে তাকালেন, দাগটা ঘর পর্যন্ত গিয়েছে। ঘরের দরজা বন্ধ। জানলাও। এতক্ষণে একটিমাত্র জানলা চোখে পড়ল, যা অটুট।

কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন।”দরজাটা খোলা যায় কি না দেখ তো, নকুল?”

নকুল প্রথমে ধাক্কা মারল, শেষে লোহার রড গলাবার চেষ্টা করল দরজার ফাঁকে, পারল না।

জানলাটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত খোলা গেল।

 কিকিরা জানলা টপকে ভেতরে ঢুকলেন।

 টর্চের আলোয় এই ঘর একেবারে অন্যরকম দেখাল। ঘরটার অনেকটা পরিষ্কার। একপাশে লোহার স্প্রিং দেওয়া খাট, ছোবড়ার গদি রয়েছে খাটের ওপর, যদিও পুরনো গদি। কোণের দিকে মাটির কলসি আর কলাইয়ের অগ রাখা। দু চারটে শুকনোশালপাতা পড়ে আছে ঘরের পাশে। লণ্ঠনও চোখে পড়ল। শিসওঠা কাঁচ। মাদুর গুটিয়ে রেখেছে কেউ।

বাইরের দিকের জানলা বন্ধ ছিল। বড় বড় দুই জানলা। হাত আট-দশ অন্তর। কিকিরা নকুলকে জানলা দুটো খুলে দিতে বললেন, “সাবধানে খুলো হে।”

লোচন আর নকুল জানলা দুটো খুলে দিল। খুলে দিয়েই লোচন যেন কী লল। আলো এল জানলা দিয়ে, ঘর স্পষ্ট হল।

তারাপদ ঘরটা দেখতে লাগল। বিশাল ঘর, সেই একই রকমের লাল কালোর চৌকো-ঘর কাটা সিমেন্টের মেঝে। মাথার ওপর এক জোড়া শেকল ঝুলছে। ঘরের এক কোণে একটা বা দাঁড় করানো।

কিকিরা ডানদিকের জানলার কাছে গিয়ে একমনে কখনো জানলা, কখনো বাইরেটা দেখছিলেন। একবার ডানদিকের জানলাটা দেখেন, আবার গিয়ে বাঁদিকেরটা। জানলার কাঠের ওপর হাত বোলান। বেশ কিছুক্ষণ জানলা দেখার পর তারাপদকে ডাকলেন।

কাছে গেল তারাপদ।

ডানদিকের জানলাটা দেখালেন কিকিরা। তারাপদ অবাক হয়ে দেখল, পর-পর প্রায় গায়ে-গায়ে দুটো জানলা। একই মাপ।

কিকি বাইরের দিকটাও দেখালেন। ”দেখো, নিচেও দেখো।”

তারাপদ অবাক হয়ে দেখল, লোহার একটা ঘোরানো সিঁড়ি নিচে নেমে গিয়েছে। সিঁড়িটা বাড়ির বাইরে থেকে দেখার উপায় নেই, কেননা সিঁড়ির বাইরের তিনটে দিকই ইটের গাঁথনি দিয়ে গোল করে ঘেরা। সেই গাঁথনির জায়গায়-জায়গায় ইট খসে যাওয়ায় আলো ঢুকছে সিঁড়িতে। সুড়ঙ্গর মতন দেখায় সিঁড়িটা।

তাারাপদ সরে গিয়ে বাঁদিকের জানলা দেখল। কিছু বুঝতে পারল না।

 কিকিরা বললেন, “বাঁদিকের ওই জানলা আর এই ডান দিকের জানলাটায় তফাত বুঝতে পারছ? আসলে, ডানদিকেরটা ডবল জানলা। দু আড়াই ফুট তফাত দুটো জানলার মধ্যে। মাঝখানে ফাঁক। সেই ফাঁক দিয়ে গলে গেলেই ওই সিঁড়ি। তুমি লক্ষ করে দেখো, সিঁড়িটা ওপরের দিকে একেবারে জানলা পর্যন্ত উঠে আসেনি। খানিকটা নিচুতে শেষ হয়েছে। তার মানে, এই সামনের দিকের জানলাটা টপকে ফাঁকের মধ্যে দিয়ে গলে গেলেই সিঁড়িটা ধরতে পারা যাবে। আমি যতটা জানি, এই রকম ডবল জানলা একসময় য়ুরোপে দেখা। যেত যুদ্ধবাজ রাজ-রাজড়াদের প্রাসাদে। কেন জানো? তখন কথায় কথায় কাটাকাটি রক্তারক্তি চলত। কে যেন শত্রু হবে কখন, কেউ জানত না। কাজেই, ঘরের মধ্যে আচমকা শত্রুর মুখোমুখি হলে বাঁচবার এই একটা পথ খোলা থাকত। ঘোড়া-সাহেব কেন এমন জানলা বানিয়েছিলেন জানি না। শখ করে কিংবা আভিজাত্যের জন্যে হতে পারে। অন্য কারণও থাকতে পারে।”

তারাপদ বলল, “সাধুবাবা তা হলে এই পথ দিয়েই হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন?

কিকিরা মাথা নাড়লেন, “অবশ্যই।”

“তা হলে এই ঘরেই সেই কাণ্ড ঘটেছিল?”

“এই ঘরে।” বলে কিকিরা নিশ্চিন্তভাবে নিজেই জানলার চারদিক পরীক্ষা করতে লাগলেন।