৫. ফকির রায়দের বাড়ি থেকে

০৫.

ফকির রায়দের বাড়ি থেকে ঘোড়া-সাহেবের কুঠি মাইল দুয়েকের পথ। মাঠঘাট ভেঙে গেলে সামান্য কম। ফকির চেয়েছিলেন, কিকিরাদের সঙ্গে নকুল যাক জিপ নিয়ে; কিকিরা রাজি হননি। জিপের দরকার নেই, মাঠ ভেঙে হাঁটাপথে তাঁরা চলে যাবেন। জিপ সঙ্গে থাকলে পাঁচজনের চোখ পড়বে, হাঁটাপথে বেড়াতে বেরুলে কে আর নজর করবে।

বিকেলে ছোট হয়ে আসছে, আলো থাকতে-থাকতেই কুঠিতে পৌঁছতে চান কিকিরা পড়ন্ত বেলার রোদ নিস্তেজ হয়ে আসার আগেই তিনি বেরিয়ে পড়লেন তারাপদকে নিয়ে।

রোদ সরাসরি মুখে লাগায় সামান্য অস্বস্তি হচ্ছিল তারাপদর। নয়ত এই হাঁটাপথ তার ভালই লাগছিল এখানকার মাঠের চেহারা খানিকটা আলাদা, অনবরত উঠছে আর নামছে, যেন ঢেউ-খেলানো মাঠ, মাটির রঙ কোথাও কোথাও গেরুয়া রঙের হলেও বেশির ভাগটাই কালচে গোছের। পায়ে-পায়ে পলাশ-ঝোপ, আর আকন্দ। কিকিরা চিনিয়ে দিচ্ছিলেন ওটা শিশুগাছ, ওকে বলে অর্জুন।

কিকিরা যে এই অঞ্চলের অনেক কিছুই জানেন, বেশ বোঝা যাচ্ছিল। এমনকী, তিনি ঘোড়া-সাহেবের কুঠি যাবার মেঠো রাস্তাও বেশ চেনেন।

তারাপদ একবার ঠাট্টা করেই বলেছিল, “কিকিরা স্যার, ঠিক রাস্তায় নিয়ে যাবেন তো?”

কিকিরা জবাব দিয়েছিলেন, “চলো দেখবে, সব জায়গায় মাকা করে এসেছি।”

কথাটা ঠিকই। কদিন আগেই কিকিরা ফকিরের বাড়িতে এসে দশ-পনেরো দিন থেকে গিয়েছেন, তখন লোচনকে নিয়ে বার তিনেক এই হাঁটাপথেই ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে গিয়েছেন এসেছেন। অবশ্য কোথায় কী মাকা করে এসেছেন তিনিই জানেন।

মাঠ দিয়ে যেতে-যেতেই সামান্য তফাতে কয়লাখনিও চোখে পড়ছিল। লোহার উঁচু-উঁচু থাম, তার মাথায় বিশাল চাকা ঘুরছে, ডুলি উঠছে নামছে, কয়লার টব গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে কুলি মজুর, এক-এক জায়গায় কয়লার পাহাড় জমে আছে, বাতাসে কেমন কয়লা-কয়লা গন্ধ।

বেশ খানিকটা রাস্তা এগিয়ে এসে গাছপালা ঝোপঝাড় পাওয়া গেল। ছায়াও ঘন। তারাপদ বলল, “স্যার, একটু জল খেয়ে নিই। আপনার বন্ধুর বাড়িতে যেভাবে খেয়েছি, তাতে গলা পর্যন্ত বুজে আছে এখনো।”

তারাপদর কাঁধেই জলের বোতল ঝুলছিল। কিকিরাই নিতে বলেছিলেন। তারাপদ জল খেল।

কিকিরাও জল খেয়ে নিলেন। ঢিলেঢালা পোশাক তাঁর, হাতে একটা সরু ছড়ি, হাতলটা ছাতার হাতলের মতন বাঁকানো। ঘন খয়েরি রঙ ছড়িটার; বোঝাই যায় না ওটা লোহার।

জল খেয়ে তারাপদ একটা সিগারেট ধরাল। আবার হাঁটতে লাগল দুজনেই।

হাঁটতে হাঁটতে কিকিরা বললেন, “তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করি, তারাপদ। ফকিরদের যে বংশতালিকা দেখলে, তা থেকে কিছু আন্দাজ করতে পারো?”

তারাপদ বলল, “সত্যি কথা বলতে কী কিকিরা, ওই টেবল–কিংবা বলুন চার্ট-এর ছেলে অমুক, তার ছেলে তমুক–এসব আমার মাথায় ঢোকে না। একরাশ নাম দেখলাম এই মাত্র।”

“তা ঠিক। নাম থেকে কী আর বোঝা যায়?” বলে সামান্য চুপ করে থেকে কিকিরা আবার বললেন, “আচ্ছা, ফকিরের ছোটাকাকা সম্পর্কে তোমার কী মনে হয়?”

“ছোটকাকা! মানে সেই সন্ন্যাসী! তিনি তো মারা গিয়েছেন।”

“হ্যাঁ। কিন্তু কেউ চোখে দেখেনি। লোকের মুখের খবর থেকে জেনেছে ফকিররা।”

তারাপদ বেশ অবাক হয়ে কিকিরার মুখের দিকে তাকাল।”আপনার কথা বুঝলাম না। আপনার কি মনে হয়, ছোটকাকা মারা যায়নি?”

“তা আমি বলছি না। হয়ত গিয়েছেন। ..আবার ধরো, না-ও যেতে পারেন?”

“মানে?”

“মানেটা তো এখন বোঝা যাচ্ছে না। …তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপারে আমার খটকা লাগছে। ফকিরের ঠাকুরদারা দুই ভাই। বড় হলেন ফকিরের ঠাকুরদা। ছোটজনের একটি ছেলের নাম দেখতে পেলাম ওই লিস্টিতে, কিন্তু তারপর আর কোনো নাম নেই। অর্থাৎ ফকিরের ছোট ঠাকুরদার বংশের একজনকে পাচ্ছি। অন্যরা কোথায়? কেউ কি ছিল না?”

তারাপদ এত জটিল ব্যাপার বুঝল না। বলল, “আপনার সন্দেহ আমি বুঝতে পারছি না।”

কিকিরা হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “বিষয়-সম্পত্তি, ধন-দৌলত নিয়ে বড়বড় রাজরাজড়াদের মধ্যে যত না গণ্ডগোল বাধে, এই সব ছোটখাট রাজা-টাইপের লোকের মধ্যে তার চেয়ে ঢের বেশি গোলমাল। উটকো বড়লোকদের মধ্যে আকছাড়। তা ছাড়া এই সব এলাকায় পারিবারিক ঝগড়াঝাটি, খুনোখুনি, মামলা-মকদ্দমা খুব বেশি। আমার মনে হচ্ছে, ফকিরদের ফ্যামিলিতে আরও কিছু রহস্য আছে।”

“সে তো আপনারই জানার কথা। ফকিরবাবু আপনার বন্ধু।”

“বন্ধুরাও সব সময় সব কথা বলে না। যেমন আজ ফকির বলল, তার ছেলে বিশু ছুঁড়েছিল। আমার কিন্তু কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না।”

তারাপদ কোনো কথা বলল না। বরং কিকিরার মাথায় কেমন করে এত। চিন্তা আসে ভেবে অবাক হচ্ছিল।

আর কিছুক্ষণ হেঁটে আসার পর কিকিরা তাঁর ছড়ি তুলে দূরে কিছু দেখালেন। বললেন, “ওই যে দেখো, দেখতে পাচ্ছ? ওটাই ঘোড়া-সাহেবের কুঠি।”

তারাপদ দূরে তাকাল। গাছপালার জঙ্গলের মতন খানিকটা জায়গা, ঘর বাড়ি কিছুই চোখে পড়ে না। তারাপদ বলল, “ওই জঙ্গলটা?”

“আর-একটু এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবে।”

বেশি এগিয়ে যেতে হল না, গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা বাড়ির সামান্য অংশ চোখে পড়ল। তারাপদ বলল, “নদী কোথায়? আপনি বলেছিলেন বাড়ির পাশে নদী আছে?”

“নদী নয়; নালা। এখানকার লোক নদীই বলে। নুনিয়া নদী। এখান থেকে দেখতে পাবে না। বাড়ির কাছে গেলে পাবে। নুনিয়া ও-পাশ দিয়েই চলে গিয়েছে।”

“জল নেই?”

“বর্ষাকালে থাকে। ভরেই থাকে। এখন হাঁটুতক থাকতে পারে। চলো, দেখা যাবে।”

“আপনি কদিন আগেই এসেছিলেন, তখন ছিল?”

“অল্প।”

কথা বলতে বলতে কুঠির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তারাপদরা। সামান্য পরে একেবারে কাছাকাছি এসে গেল।

ঘোড়া-সাহেবের কুঠির কাছাকাছি এসে তারাপদ থমকে দাঁড়াল।

কিকিরার কথা থেকে এতটা বোঝেনি সে। এখন বুঝতে পারছে। বিশাল-বিশাল গাছপালায় ঘেরা একটা পরিত্যক্ত, ভাঙা দুর্গর মতনই দেখতে। মনে হয়, এককালে এখানে বোধ হয় কোনো রাজাটাজা দুর্গ বানিয়ে থাকত। কিকিরা বললেন, “এদিক দিয়ে এসো। পেছন দিক দিয়ে যাব।”

“কেন? সামনে কেউ থাকে?”

“সাবধানের মার নেই। তা ছাড়া সামনে দিয়ে ঢুকতে পারব না। সদর-ফটকটা কাঁটা-তার দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে। আসা-যাওয়ার পথ বন্ধ। আগাছার পাঁচিল হয়ে গেছে ওখানটায়।”

তারাপদ কিকিরার কথামতন তাঁর পেছনে-পেছনে এগুতে লাগল। নালার মতন নদীটাও চোখে পড়ল এবার। বাড়ি আর পাথর, মাঝ-মধ্যিখানে গোড়ালি-ডোবা জল। চারদিক ফাঁকা মাঠ আর মাঠ, একেবারে নেড়া মাঠই বলা যায়, গাছপালা নামমাত্র।

এবড়ো-খেবড়ো জমি, কাঁটা-ঝোপ, বনতুলসীর ভেতর দিয়ে এগুতে-এগুতে তারাপদ বুঝল, কিকিরা একটা ঢোকার রাস্তা আগেই বেছে রেখে গিয়েছেন। অবশ্য না বেছে রাখলেও চলত, কেননা কুঠিবাড়ির চারদিকে যে মানুষ-সমান উঁচু পাঁচিল, তার অনেক জায়গাই ভেঙে গিয়েছে, ভেতরের গাছপালার শেকড় পাঁচিল ফাটিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া ওই আম-জাম-জারুলের ডালপালা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, সামান্য চেষ্টা করলেই পাঁচিলের বাইরে হাত পাওয়া যায়।

রোদের তাত আর নেই, আলোও মরে এসেছে। চারদিক থেকে গাছপালার জংলা গন্ধ ছড়াচ্ছিল, বনতুলসীর গন্ধ বেশ ভারী, অজস্র নয়নতারা ফুটে আছে, কাঁটাঝোপে নানা রঙের ছোট-ছোট ফুল।

অনেকটা হেঁটে এসে কিকিরা বললেন, “এসো। ওই ফাটলটার মধ্যে দিয়ে ঢুকে যাব।”

“পেছনে কোনো ফটক নেই?”

“আছে। গোটা দুয়েক আছে। ছোট ছোট। সেদিকটা এত অপরিষ্কার নয়। তবু ওখান দিয়ে ঢুকব না।”

“কেন বলুন তো? বাড়ির চেহারা দেখে মনে হচ্ছে এখানে কেউ ভুলেও পা দেয় না। এক যদি ভূতটুত থাকে তো আলাদা কথা।” তারাপদ ঠাট্টা করেই বলল শেষের কথাগুলো।

কিকিরা বললেন, “ভূতের কাছে সাহস দেখানো ভাল। কিন্তু অদ্ভুতের কাছে নয়। এখানে যদি অদ্ভুত কিছু দেখো। এসো। সাবধানে আসবে।”

ভাঙা পাঁচিলের গায়ে আতা ঝোপ, কোনোরকমে শরীরটাকে গলানো যায়। কিকিরা রোগা মানুষ, দিব্যি গলে গেলেন। তারাপদ কিকিরার মতন করে সাবধানে ভেতরে মাথা গলিয়ে দিল।

পাঁচিলের এ-পারে গাছ। লতাপাতার জঙ্গল। দু-চার পা এগুতেই বড় বড় গাছের সারি। কতকালের পুরনো। ডালপালায় ছায়া করে রেখেছে নিচেটা। খানিক পরে সূর্য ডুবে গেলে হয়ত অন্ধকার হয়ে যাবে।

কিকিরার পাশে-পাশে আসছিল তারাপদ। গাছপালা পেরিয়ে আসতেই ঘোড়া-সাহেবের কুঠির মুখোমুখি হল। না, তারাপদই কল্পনাই করতে পারেনি এই কুঠি এত বড়, শুরু আর শেষ চোখে যেন ধরাই যায় না। বিশাল বাড়ি। গড়নটা কলকাতার পুরনো সাহেববাড়ির মতন, অন্তত পাশ থেকে সেই রকমই দেখাচ্ছে। পাথরের বাড়ি। রোদে বৃষ্টিতে পড়ে থাকতে থাকতে পাথরের গায়ে। শ্যাওলা ধরে-ধরে কালচে রঙ হয়ে গিয়েছে। বিশাল বিশাল জানলা। জানলার মাথাগুলো বাঁকানো। খড়খড়ি-করা পাল্লা। কোনোটা বন্ধ, কোনোটা ভেঙে জানলার গায়ে ঝুলছে। ভেতরের শার্সিও ভাঙাচোরা। বাড়ির গা-বেয়ে বাঁধানো নালা ছিল চারপাশে জল যাবার জন্যে, আর্বজনায় ভরতি হয়ে সেখানে আগাছা জন্মেছে নানারকমের।

বাড়িটা দোতলা হলেও অনেক অনেক উঁচু দেখাচ্ছিল। সেকালের বাড়ি, তার ওপর সাহেববাড়ি–উঁচু, উঁচু-ছাদ দোতলাই বোধ হয়, সাধারণ বাড়ির চারতলার কাছাকাছি। তারাপদ বলল, “কত উঁচু হবে? ওই ছাদ পর্যন্ত?”

“তা বলতে পারব না। আগেকার দিনে বাংলোবাড়ির ঘরও যত বড় হত, মাথার ছাদও তত উঁচু হত। এতে ঘর ঠাণ্ডা থাকে, বাতাস-চলাচল ভাল হয়। আসলে, এইটেই ছিল তখনকার ধরন। কলকাতার বনেদি পুরনো বাড়িতেও এই রকম ব্যবস্থা।”

“আপনি তেতলা থেকে লাফ মারার কথা বলছিলেন না? তেতলা কোথায়?”

 “এ-বাড়ির দোতলার ছাদ কম করেও সাধারণ বাড়ির তেতলা হবে। তাই নয়? আমি কতটা উঁচু থেকে লাফ মারা হয়েছিল সেটা বোঝাতে চেয়েছিলাম। ধরো, পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ ফুটের কাছাকাছি হবে ছাদটা।”

তারাপদ অত বুঝল না।

কিকিরা ধীরে-ধীরে বাড়ির সামনের দিকে এগুতে লাগলেন। এক সময় বাংলো ঘিরে রাস্তা ছিল। সেই রাস্তা এখন ঘাস আর বুনো লতায় ভরতি, ফাটল ধরেছে, এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে।

“একটু সাবধানে,” কিকিরা বললেন, “সাপখোপ আছে কিন্তু।“

তারাপদ সঙ্গে-সঙ্গে লাফিয়ে উঠল। সাপের নামে গা শিরশির করে উঠেছিল। বলল, “আপনি কি আমাকে সাপের মুখে ফেলবেন?”

কিকিরা হাসলেন। “কলকাতার ছেলে তোমরা, সাপের নামেই চমকে ওঠো। না, তোমায় সাপের মুখে ফেলব না। আমি নজর রাখছি।”

তারাপদ ভয়ে-ভয়ে বলল, “বিষাক্ত সাপ রয়েছে?”

“থাকলে বিষাক্ত থাকবে,” কিকিরা মজার গলায় বললেন।”কেউটে, গোখরো?”

তারাপদ দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, “তা হলে আর এগিয়ে দরকার নেই ফিরে চলুন। বিকেল শেষ হয়ে আসছে। এখুনি ঝপ করে অন্ধকার হয়ে যাবে। সাপের মুখে পড়ার চেয়ে ফিরে যাওয়াই ভাল।”

কিকিরা বললেন, “তা ঠিক। অন্ধকারে এ বাড়ির চারপাশে ঘোরাঘুরি করা ভাল না। বিপদ হতে পারে। বাড়িটা তোমাকে চোখের দেখা দেখাবার জন্যে এনেছিলাম। কেমন দেখছ?”

“পুরনো সাহেবি কেল্লার মতন?”

কিকিরা তাঁর ঢিলেঢালা পোশাকের ভেতর থেকে বায়নাকুলার বের করে তারাপদকে দিলেন। বললেন, “এটা চোখে দিয়ে দেখো।”

তারাপদ দূরবীন চোখে লাগিয়ে দেখতে লাগল বাড়িটা। সেকেলে কোনো বিশাল ইমারতের মতনই দেখাচ্ছিল। দেওয়ালের গায়ে গাছ পর্যন্ত গজিয়ে গিয়েছে।

“কত ঘর আছে জানো এই বাড়িটায়?” কিকিরা বললেন, “মোটামুটি কুড়ি পঁচিশটা। বাড়িটা সামনের দিকে ছিল ঘোড়া-সাহেবের অফিস। পেছনে থাকত খানসামা, বাবুর্চি, আয়া। আস্তাবল ছিল আলাদা। ঘোড়া থাকত। সাহেব থাকত ওপরে। বুড়োবুড়ি। মেয়ে থাকত দার্জিলিংয়ে। ছেলে বিলেতে।”

তারাপদ লক্ষ করছিল, বিকেল পড়ে যাবার পর খুব তাড়াতাড়ি ছায়া ঘন হয়ে আসছে। হয়ত আর আধ ঘণ্টার মধ্যে অন্ধকার নেমে যাবে। তার অশান্তি হচ্ছিল। ভয় করছিল। এত গাছপালা জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে তার সাহস হচ্ছিল না। বাড়িটাও ভীষণ ভুতুড়ে দেখাচ্ছিল। দূরবীন নামিয়ে নিল তারাপদ।

কিকিরা আবার এগুচ্ছেন দেখে তারাপদ বলল, “আবার কোথায় যাচ্ছেন?”

“চলো, সামনেটা একবার দেখে আসবে?”

“না। অন্ধকার হয়ে যাবে।”

“হবে না। এসো। আমার সঙ্গে টর্চ আছে।”

“আপনি স্যার বেশি-বেশি সাহস দেখাচ্ছেন। অন্ধকার হয়ে গেলে ঝোপঝাড় গাছপালা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাব কেমন করে?”

“চলে যেতে পারব। এসো। দাঁড়িয়ে থেকো না।”

অনিচ্ছাসত্ত্বেও তারাপদ পা বাড়াল। তার ভাল লাগছিল না।

খানিকটা এগিয়ে তারাপদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিকিরাও দাঁড়ালেন।

”কিসের শব্দ?” তারাপদ বলল।

”বাড়ির ভেতর থেকে আসছে?” কান পেতে থাকলেন কিকিরা।

 শব্দটা দূরে মেঘ ডাকার মতন লাগছিল অনেকটা। বাড়ল। তারপর থেমে গল হঠাৎ।

তারাপদর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল বড়বড় চোখ করে।

কিকিরা যেন কিছু ভাবছিলেন। বললেন, “না, ফিরেই চলল।”

“শব্দটা কিসের?”

“বুঝতে পারছি না। মনে হল, কোনো ভারী জিনিস কেউ সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে দিয়েছে। কাঠের সিঁড়ি। শব্দ হচ্ছিল।”

“বাড়িতে কেউ আছে তা হলে?” “থাকাই সম্ভব। যে আছে, সে হয়ত আমাদের দেখতে পেয়েছে। বোধ হয় ভয় দেখাল।” কিকিরা তারাপদকে টেনে নিয়ে ফিরতে লাগলেন।