৮. অবনমিত রোহিলা ঝাণ্ডা

অবনমিত রোহিলা ঝাণ্ডা

রোহিলা সদারদের নিবাসভূমি রোহিলাখণ্ড। পশ্চিমে গঙ্গা অববাহিকার ওপরদিকের অযোধ্যা থেকে শুরু করে পূর্বদিকে যমুনা নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডই রোহিলাখণ্ড। ছোটো-বড়ো রোহিলা সদারদের রাজ্যপুঞ্জের শিথিল সমবায়ে গঠিত এর রাজনৈতিক বুনিয়াদ। রোহিলা সদারেরা ছিলেন কাশ্মীরের রুহ নামক স্থানের অধিবাসী। তাঁরা এই অঞ্চলে আগমন করে বসবাসের জন্য এই স্থানকে পছন্দ করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে রোহিলাখণ্ড নামটি সংযুক্ত হয়।

দাউদ খান নামে এক ভাগ্যান্বেষী উদ্যোগী ব্যক্তি সর্বপ্রথম এই অঞ্চলে নিজের বাসভূমির পত্তন করেন। অধ্যবসায় এবং বিচক্ষণতার বলে কালক্রমে তিনি এই অঞ্চলের এক বৃহৎ সামন্ত ভূস্বামী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

দাউদ খানের পালকপুত্র আলী মুহম্মদ খান তার রাজ্যের সীমানা অনেক গুণে সম্প্রসারিত করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে এই দাউদ খানই রোহিলা শক্তির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি রায় বেরিলী জেলার আওনালায় তাঁর সদর দফতর স্থাপন করেন। মোগল সম্রাট তাঁর কার্যে প্রসন্ন হয়ে তাঁকে নওয়াব নিযুক্ত করেন। অন্যান্য প্রতাপশালী রোহিলা সদার যেমন- হাফেজ রহমত খান, দুন্দু খান তার অধীনে চাকুরি গ্রহণ করেণ। তিনি ১৮৪৯ সালে পরলোক গমন করেন।

আলী মুহম্মদ খানের মত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান সাদ আল্লাহ্ খান সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং হাফেজ রহমত খানকে তার অভিভাবক নিয়োগ করা হয়। সাদ আল্লাহ খান ছিলেন অতিশয় পরাক্রান্ত এবং সাহসী শাসক। তার সময়ে এক রোহিলাখণ্ডই ছিলো গোটা মোগল সাম্রাজ্যের একমাত্র সুশাসিত প্রদেশ। কোম্পানী ভারতের প্রাদেশিক রাজ্যসমূহের শাসন-শৃঙ্খলার অবনতি, আন্তঃকলহ ইত্যাদির সুযোগ গ্রহণ করে ধীরে, কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে একের পর এক রাজ্যগুলো গ্রাস করে আসছিলো। রোহিলাখণ্ডে সে রকম গোলমাল এবং অরাজকতা না থাকায় স্বভাবতঃই কোম্পানীর কর্তাব্যক্তিরা এই রাজ্যটির প্রতি ঈর্ষার চোখে তাকাতেন।

১৭৭৪ সালে অযোধ্যার নওয়াব এবং সম্মিলিত সেনাবাহিনী রোহিলাখণ্ডের ওপর আক্রমণ চালায়। সম্মিলিত বাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে প্রবলভাবে যুদ্ধ করে রোহিলারা বাধ্য হয়ে পরাজয় বরণ করেন। যৌথ সেনাবাহিনী গোটা রোহিলাখণ্ডে অত্যাচারের প্লাবন বইয়ে দেয়। ১৭৭৫ সালের ১০ই জানুয়ারি লিখিত বিবৃতিতে স্বয়ং হেস্টিংস স্বীকার করেছেন যে হাজারের ওপরে গ্রাম ধ্বংস করেছি। ঝড়-বৃষ্টির বাধা না পেলে অবশ্যই আমরা আরো অনেক বেশি ধ্বংসকার্য করে যেতাম।’ সে যাহোক ছোট্ট রামপুর রাজ্য বাদে বাকি রোহিলাখণ্ডের সবটাই অযোধ্যার নওয়াবের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলো। তার সাতাশ বছর পরে লর্ড ওয়েলেসলী অযোধ্যার তৎকালীন নওয়াব সাদত আলী খানকে তার রাজ্যের অর্ধাংশ কোম্পানীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য করেন। এভাবে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রোহিলাখণ্ড ব্রিটিশ শাসনাধীনে চলে আসে।

১৮১৪ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন বেরিলী শহরে প্রত্যেক গৃহের ওপর বিশেষ কর ধার্য করেন। শহরের জনগণ ভয়ানক রকম ক্ষিপ্ত হয়ে এই অন্যায় কর রোধ করার প্রতিবাদে মেতে উঠেন। জেলা প্রশাসন জনগণের অনুরোধ প্রতিবাদ সবকিছু অগ্রাহ্য করলো। মৌলবি মুহম্মদ এবাদ এক ব্যক্তি জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সব জায়গায় জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলতে থাকেন। ১৮১৬ সালের ১৬ই এপ্রিল তারিখে কোতোয়ালী বিক্ষোভরত জনতাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গুলি করার হুকুম দিলে কয়েকজন হতাহত হয়। এই ঘটনার পরে মুফতি মুহম্মদ বিক্ষুব্ধ জনতাকে হোসাইনীবাগে নিয়ে যেয়ে জেহাদ ঘোষণা করেন। তারপরে ২১শে এপ্রিল তারিখে এই জেহাদী জনতা সরকারের সৈন্যের ওপর হামলা চালায়। ক্যাপটেন ক্যানিংহামের নেতৃত্বে মুরাদাবাদ থেকে নতুন সৈন্য এলে শীগগির তাঁদের পরাজয় মেনে নিতে হয়।

বেরিলী ছিলো রোহিলাখণ্ডের প্রধান শহর। এখানেই ছিলো হাফেজ রহমত আলী খানের রাজধানী। সেই একই সঙ্গে বেরিলীতে অবস্থিত ছিলো বিভাগীয় কমিশনারের সদর দফতর। ভৌগোলিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে বেরিলীর ছিলো অপরিসীম গুরুত্ব। মুজাহিদ মৌলবি সরফরাজ আলী, সদর আমীন মৌলবি এনায়েত আহমদ এবং জান্দুশাহ নামে একজন ফকির প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ছিলেন বিদ্রোহের ধ্বজাধারী ব্যক্তিত্ব। আর সকলের চালকের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন খান বাহাদূর খান স্বয়ং। তিনি ছিলেন হাফেজ রহমত আলী খানের পৌত্র এবং কোম্পানীর একজন অবসরপ্রাপ্ত বেসামরিক কর্মচারি। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি হিসেবে এবং প্রতাপশালী রোহিলা সর্দারদের উত্তর পুরুষ হিসেবে, দুইভাবে কোম্পানীর সরকারের কাছ থেকে পেনসন পেতেন। বিভাগীয় কমিশনার তাঁকে অতিমাত্রায় বিশ্বাস এবং সম্মান করতেন। বেরিলী এবং বেরিলীর আশেপাশের সকল অঞ্চলে তিনি ছিলেন সকলের তর্কাতীত শ্রদ্ধার পাত্র। বিদ্রোহের শুরুতে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে তিনি ইংরেজ আনুগত্য বর্জন করে সরাসরি বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দান করবেন।

১৮৫৭ সালের মার্চে মীরাটের সেপাইদের মধ্যে যে অসন্তোষ সঞ্চার হয় রোহিলাখণ্ডে তার ঢেউ এসে লাগতে মাস খানেক সময় অতিবাহিত হয়। ইউরোপীয় অফিসারেরা অত্যন্ত সন্তোষজনকভাবে সেপাইদের যাবতীয় ক্ষোভ নিরসন করেন। কিন্তু তারপরেও বিদ্রোহী চিন্তা-চেতনা একইভাবে জনগণ এবং সেপাইদের মধ্যে প্রসার লাভ করতে থাকে। দিল্লীর পতনের সংবাদ সেপাইদের উত্তেজনা ভয়ানকভাবে বাড়িয়ে তোলে। প্রত্যেক দিন দিল্লী থেকে নতুন মানুষ এসে নতুন নতুন চমকপ্রদ গুজব ছড়াতে থাকে। ফরেস্টের বর্ণনা তাই আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। আবার আরেকজন মোগল রাজধানীতে স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ করেছেন, এ সংবাদে রোহিলা পাঠানদের মধ্যে সুপ্ত ধর্মোন্মাদনা এবং সমর তৃষ্ণা জেগে ওঠে। তাঁরা সকলে ছিলেন একই নবীর অনুসারী, সুতরাং তাদের ধর্মশাস্ত্রের মধ্যেই উত্তেজিত করে তোলার এন্তার উপাদান সঞ্চিত ছিলো। প্রাচীন জমিদারেরা তো পূর্বে থেকেই কোম্পানীর সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। সাম্প্রতিককালে অন্যান্য ব্যবসায়ী এবং ব্যাঙ্ক মালিকদের মধ্যে আতঙ্কের সঞ্চার হয়েছে। বিদ্রোহের ধারক বাহকেরা সরকারের নামে বিশ্বাস্য-অবিশ্বাস্য নানা রকমের গুজব রটাতে লাগলো। এক সময়ে সকলে বলাবলি করতে লাগলো যে সরকার বাজারে চামড়ার টাকা চালু করবে এবং সারা দেশে যতো রূপা আছে সব জোর করে কেড়ে নিয়ে যাবে।

১৪ই মে তারিখে মীরাটের সংবাদ এসে পৌঁছলো। ইউরোপীয় মহিলা এবং শিশুদের নৈনিতালে পাঠিয়ে দেয়া হলো। ব্রিগেডিয়ার সে সময় কার্যক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁর স্থলে দায়িত্বে ছিলেন কর্ণেল টুপ। কর্ণেল বিশ্বাস করতেন যে তাঁর সকল সৈন্যের মধ্যে একমাত্র ৮ম রেজিমেন্টই তার প্রতি অনুগত থাকবে। ম্যাকেঞ্জী ছিলেন স্টেশন কমান্ডার। তিনি এই বিশ্বস্ত রেজিমেন্টের শক্তি বৃদ্ধি করলেন। প্যারেড ময়দানে সৈন্যদের নিয়ে যেয়ে জানালেন যে বেরিলীতে কোনো কার্তুজ আসবে না, আর যদি আসে তাহলে তিনি তাদের সকলের সামনে প্যারেড ময়দানে সেগুলো নষ্ট করে ফেলবেন। মৌলবি মোহাম্মদ আহসান নামে স্থানীয় কলেজের এক শিক্ষককে দিয়ে সেপাইদের সামনে ওয়াজের আয়োজন করলেন। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। সেপাইদের মধ্যে তাঁর বক্তৃতার উল্টো প্রতিক্রিয়া হলো। তাঁকে লজ্জায় অপমানে চিরতরে বেরিলী ছেড়ে চলে যেতে হয়। তারপরের দিন ছিলো ঈদুল ফিতরের দিন। মৌলবি রহিমুল্লাহ ঈদের দিন ঐ একই মসজিদে জেহাদের বাণী প্রচার করেন। কিন্তু কোতোয়াল বাধা দেয়। সেই সময় বখ্‌ত খান বেরিলীতে ছিলেন। কুতুবশাহ্ নামে ঐ কলেজের আরেকজন শিক্ষক সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে যে তিনি ছিলেন খান বাহাদুর খানের ঘোষণাপত্রের প্রকৃত লিপিকার। বিচারের সময় মৌলবি রহিমুল্লাহকে ওহাবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শুরু থেকেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি খান বাহাদুর খানের কাছে থেকে মাসিক ১৫০ টাকা নিতেন। যুবরাজ ফিরোজ শাহ্ যখন মুরাদাবাদ দখল করেন, সেই সময়ে মৌলবি সাহেব তার সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছিলেন।

সিভাল্ড ফিরে এলে ২১শে মার্চ তারিখে আরেকবার প্যারেড করার নির্দেশ দেন। তিনি নানারকম নিশ্চয়তা দান করে সেপাইদের ক্ষোভ সাময়িকভাবে প্রশমিত করেন। এ সম্পর্কে দু’দিন পরে সরকারের কাছে রিপোর্ট করেছেন যে “সেপাইদের মধ্যে আবার আনুগত্য এবং আনন্দের ভাব ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। আমি চূড়ান্তভাবে সফল হয়েছি এবং তাদেরকে এতো দূরে বশে এনে ফেলেছি যে যেখানেই প্রয়োজন হবে অনুগত সেপাই হিসেবে যেতে অস্বীকার করবে না।’ সিভালুডের পরিস্থিতি বিচার যে সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত ছিলো অত্যল্পকাল সময়ের মধ্যেই তা সপ্রমাণিত হলো। এক সপ্তাহ না যেতেই একজন হিন্দু রিসালদার কর্ণেল টুপ-এর কাছে জানালেন যে ১৮নং এবং ৮নং দেশী পদাতিক রেজিমেন্ট ঐ দিনেই বেলা দু’টার সময় সেপাইরা অভ্যুত্থান করবে। কিন্তু সেদিন কিছুই ঘটলো না। কিন্তু মাসের শেষ তারিখে একজন ব্রিটিশ অফিসারের গৃহে অগ্নি সংযোগ করা হলো। এতে ইউরোপীয়রা সচকিত হয়ে উঠলো। পরের দিন বেলা এগারোটার সময় একটা কামান বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া গেলো এবং সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের গুলি। সিভাণ্ড দ্রুত অশ্বারোহী বাহিনীর রেজিমেন্টের দিকে ধাওয়া করলেন, কিন্তু পথে তাঁকে গুলি করা হলো। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন। ম্যাকেঞ্জী তাঁর সেপাইদের সরকারের প্রতি অনুগত রাখতে বারবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেপাইরা চীৎকার করে জানিয়ে দিলো যে তারা ধর্ম ছাড়া আর কোনো কিছুর প্রতি অনুগত থাকবে না। একটি সবুজ রঙের পতাকা উত্তোলন করা হলো। কারাগার ভেঙ্গে সমস্ত কয়েদীদের মুক্তি দিয়ে দেয়া হলো এবং বিদ্রোহীরা শাসনভার গ্রহণ করলো।

খান বাহাদুর খানকে সম্রাটের মনোনীত প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করা হলো। তিনি ছিলেন অভিজাত রোহিলা কুল-তিলক। ইউরোপীয় এবং দেশীয় সকলে এই সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকটিকে শ্রদ্ধা করতেন। বিদ্রোহী নেতারা বিশেষ করে বখৃত খান তাঁকে সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। সরকার গঠন করার পর খান বাহাদুর খান সেনাদলের পুনর্গঠনে মনোযোগী হয়ে উঠলেন। নতুন নতুন লোক সেনাদলে ভর্তি হতে লাগলো। তিনি একটা অস্ত্র নির্মাণ কারখানা তৈরি করলেন। থানা এবং তহশীলগুলো খান বাহাদুর খানের নির্দেশ মোতাবেক ভালোভাবে কাজ করে যাচ্ছিলো। গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে তিনি নিজের বিশ্বস্ত এবং কর্মক্ষম লোকদের এনে বসালেন। একটা সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি গড়ে তুললেন। ২১শে জুন তারিখে সম্রাট ফরমানের মাধ্যমে তাকে শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগের স্বীকৃতি জানালেন। খান বাহাদুর খান উভয় সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী জমিদারদের বিদ্রোহীদের পক্ষে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার নবগঠিত সেনাদলের ৯১টি অশ্বারোহী বাহিনীতে সব মিলিয়ে সৈন্যসংখ্যা ছিলো ৪৬১৬ জন এবং ৫৭টি পদাতিক বাহিনীতে সব মিলিয়ে সৈন্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২৪৩০জন। তাদের সঙ্গে ছিলো নবনির্মিত বেরিলী অস্ত্রাগারে প্রস্তত ৪০টি কামান। তাঁর সেনাদলের পেছনে মাসিক অর্থব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার ৬ শত টাকা। বাদবোয়ালীর রঘুনাথ সিং খান বাহাদুর খানের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেছিলেন। তাঁকে শাস্তি দেয়ার জন্য একদল সৈন্য প্রেরণ করা হলো। তারপরে বখৃত খানের নেতৃত্বে সম্রাটের বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সৈন্য দিল্লীতে প্রেরণ করা হলো। পিলিবিত, শাহজাহানপুর, মুরাদাবাদ এবং বিজনৌর অনতিবিলম্বে নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে নিলো।

পিলিবিতের মুসলমানেরা ঈদের দিন ভয়ঙ্কর রকম উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো। ঈদগাহ্ ময়দানে নানা রকম কোম্পানীর সরকার বিরোধী প্ল্যাকার্ড পুঁতে রাখা হয়েছিলো। ১লা জানুয়ারি তারিখে পিলিবিলে বেরিলীর সংবাদ এসে পৌঁছায়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ভয় পেয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থান নৈনিতালে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলো। কতিপয় রাজপুত পরিবার নতুন সরকারের বিরোধিতা করেছিলো। তাদের দমন করার জন্য মরদান আলীর অধীনে একদল সৈন্য প্রেরণ করা হলো এবং অতি সহজে তাদের দমন করা গেলো।

জেলা শহর আওনালায় এক সময়ে রোহিলা সর্দারদের সদর দফতর অবস্থিত ছিলো। এখনো সেখানে রোহিলাদের বংশধরেরা বসবাস করছিলেন। কল্লান খানকে আওনালা শাসন করার দায়িত্ব দেয়া হলো। তিনি ছিলেন অতিশয় সুপুরুষ এবং কর্মক্ষম ব্যক্তি। মৌলবি মুহম্মদ ইসমাইল, গালিব আলী, শেখ খায়েরুল্লাহ এবং হাকিম সৈয়দুল্লাহ প্রমুখকে তাঁর সহকারী হিসেবে নিয়োগ করা হলো।

সমগ্র দিল্লী সাম্রাজ্যের মধ্যে বদাউন ছিলো অতিশয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান। সে কারণে এর রাজনৈতিক গুরুত্ব একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। রোহিলাখণ্ডের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই জেলাটিও ১৮৫১ সালে কোম্পানীর শাসনাধীনে চলে আসে এবং মুরাদাবাদ জেলার সঙ্গে একে যুক্ত করে দেয়া হয়। পরে ১৮৫৭ সালে বদাউনকে আলাদা একটি জেলা করা হয়। ১৫ই মে তারিখে বিদ্রোহের সংবাদ বদাউনে এসে পৌঁছায়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উইলিয়াম এডওয়ার্ডের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, সেপাইরা ভয়ঙ্কর রকম অস্থির এবং অশান্ত হয়ে উঠেছে। স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কারণেই এখনো এখানে শান্ত অবস্থা বিরাজ করছে। এডওয়ার্ড জানতে পারলেন যে ঈদের দিন একটা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এডওয়ার্ড সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে জেলার গণ্যমান্য সম্ভ্রান্ত সকল মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ছল করে ঈদের দিন পর্যন্ত আটকে রাখলেন। তার ফলে হিতের বদলে বিপরীত ঘটলো। সেপাই এবং জনসাধারণের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। ২রা জানুয়ারি তারিখে বেরিলী থেকে ৬৮নং রেজিমেন্টে কিছু সৈন্য এসে পৌঁছোবার সঙ্গে অভ্যুত্থান ঘটে। এডওয়ার্ড কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে পলায়ন করলেন। তিনি অতিকষ্টে ১লা সেপ্টেম্বর তারিখে কানপুর এসে উপস্থিত হলেন।

বিদ্রোহীরা শাসনভার গ্রহণ করলো। আবদুর রহমানকে নিজাম পদে এবং শেখ ফাসাত উল্লাহকে তাঁর সহকারি পদে অধিষ্ঠিত করা হলো। ময়েজউদ্দিনকে প্রধান সেনাপতির কর্তৃত্ব দেয়া হয়। আজম উল্লাহ খানকে বখশীর পদ, ওয়ালীদাদ খান চৌধুরী, তোফাজ্জল এবং কেরামতুল্লাহকে সামরিক বিভাগের সহকারীর দায়িত্ব দেয়া হলো। শুরু থেকেই রাজপুতেরা নতুন সরকারের বিরোধিতা করে আসছিলেন। একজন রাজপুত জমিদার ‘ধাপধুম’ খেতাব গ্রহণ করে সসৈন্যে বদাউনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। নগরীর উপকণ্ঠে তাকে বাধা দিয়ে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা হলো। আরো একটা রাজপুত বিদ্রোহ দমন করা হলো। গুনাউরের ঠাকুরেরা বরাবরই ব্রিটিশের প্রতি অনুগত ছিলেন। জমিদার বিশ্বনাথ নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তাকেও দমন করা হলো।

শাহজাহানপুর ছিলো রোহিলাখণ্ডের আরেকটি জেলা। এখানে মৌলবি সরফরাজ আলী অভ্যুত্থান হওয়ার অনেক পূর্বে থেকেই জিহাদের বাণী প্রচার করে আসছিলেন। শাহজাহানপুরের কালেক্টর এ বিষয়ে রিপোর্ট করে লিখেছিলেন, আজ সন্ধ্যায় সেপাইরা দল বেঁধে বেরিলীর দিকে যাত্রা করেছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে সরফরাজ আলী নামে গোরক্ষপুরের একজন মৌলবী। এ থেকে মনে হয় ঐ লোকটি অন্ততঃ বিশদিন আগে শাজাহানপুরে এসেছে এবং সেপাইদের বিদ্রোহ করার জন্য উত্তেজিত করার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে। সরফরাজ আলীর কয়েকজন শিষ্য শাহজাহানপুরে এসেছে। ফৈজাবাদ সেরেস্তার নায়েব কুদরত আলী এবং তার ভাই নিয়াজ আলী হলো, তাদের মধ্যে দু’জন। আগে থেকেই মৌলবীরা তাদের কাছে যাওয়া-আসা করতো। এই দুই ভাইও বিদ্রোহী সেপাইদের সঙ্গে রয়েছে।

কর্তৃপক্ষ প্রত্যাশা করেছিলেন, সেপাইরা ঈদের দিনে কিছু একটা করবে। কিন্তু সেদিন কিছু ঘটলো না। ৩১শে মে তারিখে গীর্জায় সমবেত ইউরোপীয়দের ওপর আক্রমণ করে বসলো। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রিকেট ঘটনাস্থলেই নিহত হলেন। সেপাইদের বাধা দেয়ার জন্য ছুটে এলো শিখ রেজিমেন্ট। কিন্তু সেপাইরা তার আগেই ক্যান্টনমেন্টে যেয়ে ক্যাপ্টেন জেমসকে পরাজিত করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট জেনকিন পালিয়ে আত্মরক্ষা করলেন। সেপাইরা কারাগার আক্রমণ করে কয়েদীদের মুক্তি দিয়ে দিলো এবং তোষাখানা দখল করে ফেললো। কাদির আলী খানের ওপর জেলা শাসনের দায়িত্ব অর্পণ করা হলো। তিনি শোভাযাত্রা সহকারে শহর প্রদক্ষিণ করে ঘোষণা করলেন যে খান বাহাদুর খান শাসন-কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছেন। গোলাম কাদির খানকে নাজিম, নিজামুদ্দীন খান, হামিদ হাসান খান এবং খান আলী খানকে সহকারি, আবদুর রউফ খানকে সৈন্যাধ্যক্ষ নিয়োগ করা হলো। নওয়াব হাসমত আলী খানের ওপর গোলন্দাজ বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করা হলো। রাজপুতেরা নতুন সরকারের প্রতি সব রকমের অবজ্ঞা প্রদর্শন করে আসছিলো। মরদান আলী খান তাদের দমন করলেন এবং দলপতিকে সমুচিত শাস্তি প্রদান করলেন।

খান বাহাদুর খানের নির্দেশে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে চলছিলো। বিদ্রোহী দলের নেতা ছিলেন গোলাম মুহম্মদ খান। তিনি থানা এবং তহশীল অফিসমূহ দখল করে নিয়েছিলেন। খান বাহাদুর খান তার উপর তিহারীর দায়িত্ব অর্পণ করেন। হেদায়েত আলী এবং ভাইকে গোটা পরগণা ব্যবস্থাপনার অধিকার দিলেন। তাবৎ বিদ্রোহের সময়ে গোলাম মুহম্মদ খান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বলতে গেলে গোটা মীরনপুর জেলার নেতা ছিলেন গোলাম মুহম্মদ খান এবং ফৈয়াজ খান। তাঁদের উভয়ে একটি পদাতিক বাহিনী গঠন করেছিলেন। আহমদ ইয়ার খান নামে একজন প্রবীণ কর্মচারিকে নতুন সরকারের তহশিলদারের পদ প্রদান করা হলো।

পাওয়াইনের রাজা জগন্নাথ খান বাহাদুর খানের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু সরকারি সৈন্য যখন তাঁর রাজ্যে হামলা করলো, এক লাখ টাকা কর এবং তিরিশ হাজার টাকা কর নগদ নজরানা প্রদান করার অঙ্গীকার করে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন।

খান বাহাদুর খান হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। তিনি যোগ্য এবং উপযুক্ত হিন্দুদের উচ্চপদে আসীন করেছিলেন। এক ফরমানে তিনি বলেছেন, সর্বগুণে গুণান্বিত, মর্যাদাবান, সাহসী রাজন্যবর্গ শুধু তাঁদের নিজেদের ধর্মের রক্ষক নন, অন্য ধর্মের প্রতিও সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল। তথাপি তিনি অনেক সময় অনেক জমিদার এবং সামন্তের বিরুদ্ধে কঠোর পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের অনেকেরই ব্রিটিশের প্রতি আনুগত্য অটুট ছিলো।

১৮৫৭ সালের জুলাই মাসে খান বাহাদুর খান কন্নি খানের নের্তৃত্বে পলাতক ইউরোপীয়দের শক্তিশালী আশ্রয়কেন্দ্র নৈনিতালে এক অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু সেখানে তাঁরা বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না। ১৮৫৭ সালের অক্টোবর মাসে গঙ্গার অপর পারে ক্ৰক্রোপ্ট উইলসনের নেতৃত্বে একদল ঘোড়সওয়ার সৈন্য দৃষ্টিগোচর হলো। বেরিলী থেকে পলাতক ক্যাপটেন গাওয়ান এতোকাল যিনি দাতাগঞ্জের একজন হিন্দু ভূস্বামীর আশ্রয়ে অবস্থান করছিলেন এবং বিদ্রোহীদের সম্মুখীন হওয়ার সাহস করতে পারছিলেন না, তিনিই উইলসনকে তাঁর সাহায্যার্থে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

এডওয়ার্ড উইলসন দেশীয় মহিলার ছদ্মবেশে কাদিরগঞ্জে গিয়ে গাওয়ানের সঙ্গে মিলিত হলেন। আবদুর রহমানকে সৈন্যদলসহ উইলসনের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হলো। নিয়াজ মুহম্মদ গুনাউর শহর দখল করে নিলেন। মুবারক হোসেন খানকে বদাউনের জেলা শাসকের পদ প্রদান করা হলো।

নিয়াজ মুহম্মদ খানকে ফতেহগড়ে অভিযান পরিচালনা করার নির্দেশ দেয়া হলো। তিনি সূর্যগড়ের নিকট গঙ্গা অতিক্রম করে শামসাবাদ দখল করে নিলেন। ১৮৫৮ সালের ২৭শে জানুয়ারি তারিখে স্যার হোপ গ্র্যান্ট সুতিয়াতে এসে উপনীত হলেন। তাঁর সঙ্গে একটি খণ্ডযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। তাতে সেপাইদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে।

প্রধান বিদ্রোহী নেতাদের অনেকেই রোহিলাখণ্ডে এসে হাজির হয়েছেন। এখন রোহিলাখণ্ড প্রধান সক্রিয় রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ সেনাপতি একটি বড়ো যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করে যাচ্ছিলেন। পরিকল্পনা অনুসারে তিনটি সৈন্যদল ভিন্ন অবস্থান থেকে একযোগে বেরিলী আক্রমণ করবে, সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। কর্ণেল পেনি দোয়াব থেকে গঙ্গা অতিক্রম করে যাত্রা করবেন প্রধান সেনাপতির সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য। ব্রিগেডিয়ার ওয়ালপোল গঙ্গার পশ্চিম তীরে মার্চ করে প্রধান সেনাপতির সঙ্গে মিলিত হবেন ঠিক হলো। তৃতীয় দলটি রুঢ়কি থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোনসের অধীনে মার্চ করে আক্রমণ করবেন স্থির করা হলো।

২৪শে এপ্রিল পেনি ফতেহগড়ের উদ্দেশ্যে বুন্দেলশর ত্যাগ করলেন প্রধান সেনাপতির সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য। ২৫শে এপ্রিল তারিখে গঙ্গা পার হয়ে তার সেনাবাহিনী উশিয়াত নামক স্থানে প্রবেশ করলো। তারপরে তারা মাত্র চার মাইল দূরে কারাকালা অভিমুখে ঝড়ের বেগে অগ্রসর হতে থাকে। পথে একদল অশ্বারোহী তাঁদের বাধা দিলো। কিন্তু ব্রিটিশ সৈন্যের গতিরোধ করা গেলো না। শহরের উপকণ্ঠে মাত্র চারটি কামান গর্জন করে তাদের বাধা দিলো। ব্রিটিশ সৈন্যও কামানের ধ্বনিতে প্রত্যুত্তর দিলো। গাজীরা বীর বিক্রমে প্রতিবন্ধকতা রচনা করলো। বন্দুকধারী সেপাইদের ক্ষিপ্রতার বলে বিপত্তি এড়ানো গেলো। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই জানা গেলো যে ব্রিটিশ প্রধান সেনাপতিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ঘোড়া ভুলবশতঃ তাকে নিয়ে শত্রুশিবিরে ছুটে গেছে। সেখানে বিদ্রোহীরা তাঁকে হত্যা করে। এই যুদ্ধে মোগল রাজপুত ফিরোজ শাহ্ নেতৃত্বদান করেছিলেন। তিনি তার সৈন্যদলসহ বদাউনে চলে গেলেন। কর্ণেল জোন্স এখন ব্রিটিশ সৈন্যাধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। তিনি প্রধান সেনাপতির সঙ্গে মিলিত হবার জন্য মীরনপুর কাটারার দিকে যাত্রা করলেন।

বদাউনে যে সকল বিদ্রোহী নেতা সমবেত হয়েছিলেন, তারা সময় বুঝে খান বাহাদুর খানের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য বেরিলী অভিমুখে যাত্রা করলেন। রামপুর থেকে হাকিম সায়েদুল্লা খানের নেতৃত্বে নতুন একদল সৈন্য এসে ব্রিটিশ সৈন্যের শক্তি বৃদ্ধি করলো। বদাউন পুনরায় ব্রিটিশ অধিকারে চলে গেলো এবং শরফ উদ্দিন খানকে তহশীলদার হিসাবে নিয়োগ করা হয়। যে সকল হিন্দু জমিদার, যারা শুরু থেকেই বিদ্রোহীদের বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের হাতে তহশীল এবং পরগণাসমূহের দায়িত্ব দেয়া হয়। দেশপ্রেমিকদের প্রতি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত কঠোর পন্থা অবলম্বন করলেন। গৃহদাহ, লুণ্ঠন যে কতো হয়েছে এবং কত জনকে যে ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো হয়েছে তার সীমা সংখ্যা নেই।

তৃতীয় সেনাদলটির অধিনায়ক ওয়ালপোল ৭ই এপ্রিল তারিখে লখনৌ থেকে যাত্রা করলেন। ১৫ তারিখে ২৫০ মাইল মার্চ করে লখনৌর ১৫০ মাইল উত্তর পশ্চিমে কুনিয়াতে এসে উপনীত হলেন। এই এলাকা ছিলো এমন একজন সামন্তের শাসনাধীন যিনি চাপের মুখে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন বটে, ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধ করার সামান্যতম ইচ্ছাও তাঁর ছিলো না। একজন ধৃত সেপাই ওয়ালপেপালকে জানালো যে রাজা নৃপতি সিং ব্রিটিশ সৈন্যদের অভিবাদন জানিয়ে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। তিনি সে গল্প বিশ্বাস না করে কেল্লা আক্রমণ করলেন। কেল্লার লোকেরা ঝড়ের বেগে আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে কামানের গোলা বর্ষণ করতে থাকে। আড্রিয়ান হোপ নামক একজন সাহসী ইংরেজ অফিসার গোলার আঘাতে প্রাণ হারালেন। এই তরুণ অফিসারটির মৃত্যুতে সেনাধিনায়ক ব্যথিত হলেন। নৃপতি সিং দুর্গ ছেড়ে পলায়ন করলেন। ওয়ালপোল অব্যাহত গতিতে মার্চ করে যেতে লাগলেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই শীর্ষায় আরেকটি ছোটোখাটো যুদ্ধ করতে হলো। মে মাসের তিন তারিখে প্রধান সেনাপতির সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য মীরন কাটারায় এসে উপস্থিত হলেন। তার অধীনে এখন প্রয়োজনীয় সৈন্য এবং সে অনুপাতে অস্ত্রশস্ত্রাদি রয়েছে। আরো একদিন মার্চ করে তিনি ফরিদপুরে এসে পৌঁছলেন।

বেরিলীতে বিদ্রোহী নেতৃবৃন্দও বসেছিলেন না। তাঁরা ব্রিটিশ সৈন্যকে ঠেকাবার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন। ডঃ ওয়াজির খান, যুবরাজ ফিরোজ শাহ্, নানা রাও ফারাক্কাবাদের তোফাজ্জল হোসেন এবং ফতেহগড়ের ইসমাইল হোসেন-সকলে বেরিলীতে এসে জড়ো হয়েছেন। তাছাড়া একদল গাজীও এসেছে ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। তারা ছিলেন অন্যান্য সেপাইদের তুলনায় অধিক বয়স্ক মানুষ। বিলম্বিত শশুবিমণ্ডিত এই যোদ্ধাবৃন্দের মাথায় ছিলো সবুজ পাগড়ি, সে সঙ্গে সবুজ কোমরবন্দ পরণে। কোরানের আয়াত লেখা একটি রূপপার আংটি তারা পরিধান করতেন। খান বাহদুর খান ব্রিটিশ সেনার ব্যাপক প্রস্তুতির বিষয়ে ওয়াকেবহাল ছিলেন। তিনি ইচ্ছা করলে এই যুদ্ধ অনায়াসে এড়িয়ে গা ঢাকা দিয়ে চলে যেতে পারতেন। পিলিবেতের রাস্তা তখনো ভোলা ছিলো। কিন্তু উত্তপ্ত রোহিলা-রক্ত তাঁকে শেষবারের যুদ্ধ করতে প্ররোচিত করলো।

যখন শুনলেন যে ব্রিটিশ সেনাপতি কলিন ক্যাম্পবেল তার রাজধানীর দিকে ছুটে আসছেন, তিনি অতি সত্বর শহর থেকে বহির্গত হলেন এবং নাকাতিয়া নদী অতিক্রম করে উন্মুক্ত প্রান্তরে বাধা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শহরের নিকটবর্তী পুরানো ক্যান্টনমেন্টে দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করলেন। মে মাসের ৫ তারিখে সকাল বেলা ব্রিটিশ সৈন্য বিদ্রোহীদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। আনুমানিক বেলা সকাল সাত ঘটিকার সময় অশ্বারোহী এবং গোলন্দাজ সৈন্য দু’দিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমণ করে বিদ্রোহী সৈন্যদের দ্বিতীয় রক্ষণ রেখার দিকে হাঁটে যেতে বাধ্য করলো। এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ব্রিটিশ সৈন্য নদীর অপর পার থেকে ভারী কামান বহন করে নিয়ে এলো। আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে গাজী সেনানীরা এক দুধর্ষ হামলা পরিচালনা করে। গাজী সেনাদের এই আক্রমণ সম্বন্ধে প্রধান সেনাপতি তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘এই রকম সঙ্ঘবদ্ধ এবং দৃঢ় আক্রমণ গোটা যুদ্ধে আমি কোথাও দেখিনি। দীন দীন রব তুলে, আল্লাহ্ আকবর ধ্বনি উচ্চারণ করে তারা পাঞ্জাব রাইফেল বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ৪২নং হাইল্যান্ডার বাহিনীর সন্নিকটে ধাবিত করে নিয়ে গেলো ও তাদের অগ্রগতি রোধ করার জন্য স্যার কলিন ক্যাম্পবেল সৈন্যদের প্রাচীরের মতো সারির পর সারি বিন্যস্ত করলেন। সুদৃশ্য ঢাল বাগিয়ে ধরে মাথার ওপর তলোয়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উদ্যত সঙ্গীনের প্রাচীরের কেন্দ্ৰমুখে অগ্রসর হতে থাকে। জানের পরোয়া না করে গাজী সেনা এবং সাধারণ সেনা সঙ্গীনের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। দু’জন কিংবা তিনজন জেনারেল ওয়ালপেপালকে ঘিরে আক্রমণ করে বাহুমূলে আঘাত করলো। তার দেহরক্ষীর সহায়তা না পেলে হয়তো সে যাত্রা ওয়ালপোলের ভবলীলার ইতি ঘটতো। গাজীদের কেউ পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেনি। তারা এসেছিলো হয় মরতে নয় মারতে। দেখা গেলো ৪২ নং রেজিমেন্টের নিশান স্তম্ভের কাছে তাদের একশ তিরিশ জনের লাশ পড়ে রয়েছে।‘

যুবরাজ ফিরোজ শাহ্ও একটি সাহসী পদক্ষেপ পরিচালনা করেছিলেন। মে মাসের ৬ তারিখে জোনসের সেনাদল সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে বেরিলী আক্রমণ করলো। দুই সেনার মাঝখানে পড়ে বিদ্রোহী সেনাদলের একেবারে শোচনীয় অবস্থা। তারা শহর খালি করে পিলিবিতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। কেউ কেউ ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে ধরা পড়লো এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হলো। ৭ই মে তারিখে সেনাপতি কলিন ক্যাম্পবেল সসৈন্যে বেরিলীতে প্রবেশ করলেন। হত্যা ধ্বংস লুণ্ঠনকার্য চললো অনেক দিন ধরে। বিদ্রোহীদের সমর্থন নয় শুধু, অনেক ব্রিটিশ ভক্তের দুর্দশার অন্ত রইলো না। খানবাহাদুর অযোধ্যাতে পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তাকে ধরে আনার জন্য কোককে পাঠনো হয়েছিলো। বছরের শেষদিকে তিনি অযোধ্যা থেকে আশ্রয়ের আশায় নেপালে পদার্পণ করলেন। নেপালে তিনি আশ্রয় পাবেন, এরকম একটা ভরসা পেয়েছিলেন। কিন্তু নেপাল সরকার বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁকে ব্রিটিশের হাতে সোপর্দ করলেন। কোতোয়ালীর সামনে তাকে ফাঁসি দেয়া হলো। তার মৃত্যু জনগণের মধ্যে কি রকম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিলো, কোলকাতার কট্টর ব্রিটিশ সমর্থক পত্রিকা ‘হিন্দু পেট্রিয়টের’ মন্তব্য থেকে অনুধাবন করা যায়। পেট্রিয়ট মন্তব্য করেছিলো, ‘ভদ্রলোক মৃত্যুবরণ করে তাঁর দুষ্কর্মে গৌরব সঞ্চার করেছিলেন।’

খান বাহাদুর খানের পরাজয় এবং শোচনীয় মৃত্যুতেও রোহিলা শৌর্য হার মানলো না। রোহিলাখণ্ডের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রোহিলা সর্দারেরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে অনেকদিন পর্যন্ত ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। বেরিলীর পরে যে সকল অঞ্চলে বিদ্রোহের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হয় বিজনৌর হচ্ছে তার একটি। আসলে বিজনৌর ছিলো ১৭৬০-৭৬ সাল পর্যন্ত দিল্লীর দ্বিতীয় শাহ আলমের প্রধানমন্ত্রী নজীব উদ্দৌলার জায়গীরের অংশ বিশেষ। বিজনৌরের মাহমুদ খান ছিলেন নজীব উদ্দৌলার দৌহিত্র। মীরাটের অভ্যুত্থানের সংবাদ শুনে ইংরেজ কালেকটর সেক্সপীয়র সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ত্রুটি করেননি। তিনি অফিসারদের কোথাও যাওয়া বন্ধ করে সর্বক্ষণের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিলেন। বরকন্দাজদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার ব্যবস্থাও করলেন। ডেপুটি কালেকটর মুহাম্মদ রহমত খান এবং সৈয়দ আহম্মদ খানের অধীনে দুটি রক্ষীদল গঠন করে, তাদের নেতৃত্বে শহরে নৈশ টহল প্রহরা বসালেন। কিন্তু এ সকল ব্যবস্থা বিজনৌরের অধিবাসী এবং সেপাইদের রুদ্ররোষ দমন করার জন্য বলতে হয় খুবই অপ্রতুল ছিলো। বিজনৌরের কতিপয় ক্ষিপ্ত নাগরিক ছুটে গিয়ে কয়েদখানার দরোজা ভেঙ্গে কয়েদীদের মুক্ত করে দিলেন। রুটকিতে স্যাপারের পরিচালনাধীন তিন’শ সেপাই বিদ্রোহ করে ২০শে মে তারিখে বিজনৌর আগমন করে। তাদের অফিসারেরা মৌলানা আহমদুল্লাহ খান এবং মাহমুদ খানের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে ভবিষ্যতের একটি কর্মসূচী দাঁড় করান।

মাহমুদ খানের পরামর্শে সেপাইরা ২১শে মে তারিখে নাগিনা আক্রমণ করে তহশীল এবং কোষাগারের অর্থ-সম্পদ দখল করে। সৈয়দ আহমদ খান যার ওপর অর্পিত ছিলো কোষাগারের দায়িত্ব, বুদ্ধি করে আপন হাতে এক লাখ ষাট হাজার টাকা কুয়ার মধ্যে ফেলে দিয়ে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। মাহমুদ খান অর্থের আশায় নাজিরাবাদে এসেছিলেন। কিন্তু কিছুই না পেয়ে ভগ্ন মনোরথ হয়ে ফিরে গেলেন। আসার সময়ে তাঁর সঙ্গে ছিলো মাত্র ষাট-সত্তর জন অনুচর। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের সময় পাঠানেরা তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে দল অনেক গুণে বড়ো করে তুললো। তার ওপর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ আদেশ জারী করেছিলো, তিনি যেন একটু দূরে শিবির স্থাপন করে মেওয়াটের দস্যুদের পাহারা দেন। এতোদিন ধরে মাহমুদ খান এই রকম একটা সুযোগেরই প্রতীক্ষা করছিলেন। পূর্ব নির্ধারিত স্থান চাঁদপুরের বদলে তিনি গ্রাম অভিমুখে যাত্রা করলেন।

বেরিলীর সংবাদ বিজনৌরে এসে পৌঁছায় জুন মাসের ৩ তারিখে। জেলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে জেলা শাসনের ভার মাহমুদ খানের ওপর ছেড়ে দেয়ার জন্য আলাপ-আলোচনা চালাতে থাকে। সৈয়দ আহমদ খান ক্ষমতা হস্তান্তরের একখানি দলিল মুসাবিদা করলে, তাতে সেক্সপীয়র ৭ই জুন তারিখে যথাবিধি স্বাক্ষর দান করলেন। ক্ষমতা গ্রহণ করার অত্যল্পকালের মধ্যেই শাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। আজম উল্লাহ খানকে নায়েব, আহমদ উল্লাহ খানকে সহকারি কালেকটর, আহমদ ইয়ার খানকে সৈন্যাধ্যক্ষ এবং হাবিবুল্লাহ খানকে বখশী পদ দেয়া হলো। অধিকাংশ কোম্পানীর কর্মচারীকেই নতুনভাবে নিয়োগ করা হলো। সেই কারণে তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত কোম্পানীর প্রতি আনুগত্য পালন করেছিলেন। এই সময়ে মৌলবী মুনিরখান চারশো গাজী সেনাসহ এসে মাহমুদ খানের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। অবশ্য কিছুকাল পরে তিনি দিল্লী গমন করেন। সেখানে যুদ্ধ করতে করতে ব্রিটিশ সেনার হাতে শহীদ হন। প্রায় একমাস শানকার্য চলার পর দিল্লীর দরবারে অনুমোদনের জন্য আবেদনপত্রসহ দূত পাঠানো হলো। ১৮ই জুলাই তারিখে শাহী ফরমান সঙ্গে করে দূত ফিরে এলো। ফরমানের মর্ম হলো, আপনার আবেদন অনুসারে আপনার উপর সমস্ত জেলার শাসন কর্তৃত্ব অর্পণ করা হলো। পাক্কা সনদ প্রদান না করা পর্যন্ত আপনাকে সৈন্য এবং তহশীলদারদের মাইনে পরিশোধ করার পর রাজস্বের বাকী অর্থ জমা রাখতে হবে এবং তা আমাদের কাছে পাঠাতে হবে।

বেরিলীর খান বাহাদুর খানের মতো তাঁকেও হিন্দু ভূস্বামী সামন্তদের নিয়ে এন্তার সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হয়। তিনি দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্রিটিশ এজেন্টরা দু’সম্প্রদায়ের সম্পর্ক বিষিয়ে দেয়ার জন্য সর্বক্ষণ সর্বত্র বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। বিভিন্ন গ্রামের চৌধুরীরা সঙঘবদ্ধ হয়ে নতুন সরকারকে খাজনা দিতে অস্বীকার করলেন। এই জমিদারদের সমুচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য নায়েব আহমদ উল্লাহ খানকে পাঠানো হলো। যদিও শুরুতে তিনি কিছু সুবিধা করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে নাজিরাবাদে চলে আসতে বাধ্য হলেন। সদ্য বিজয়ী জমিদারেরা এই বিজয়ে উৎসাহী হয়ে বিজনৌর আক্রমণ করে চারদিক থেকে মাহমুদ খানকে বেষ্টন করে ফেললেন। এই সময়ে তাঁর সঙ্গে ছিলো মাত্র চারশো পদাতিক এবং ৩০/৪০ জন অশ্বারোহী সৈন্য। অধিক সংখ্যক শত্রুর দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকার বদলে নাজিয়াবাদে পশ্চাদ্ধাবন করাই অধিকতরা যুক্তিযুক্ত মনে করলেন।

চৌধুরীরা বিজনৌর দখল করে গোটা শহর লুট করলেন, আদালত গৃহ, কাঁচারীর রেকর্ডপত্র সব জ্বালিয়ে ছাই করে ফেলা হলো। মাহমুদ খান যখন চৌধুরীদের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত, এবং সেই সুযোগে স্পেশাল কমিশনার উইলসন ডেপুটি কালেকটর সৈয়দ আহমদ খান, সদর আমিন রহমত খানকে নতুনভাবে তাঁদের দায়িত্বভার গ্রহণ করার নির্দেশ দান করলেন। কিন্তু তারা বেশি দিন সে পদে বহাল থাকতে পারেননি। চৌধুরী জমিদারেরা প্রেরণা এবং সাহস সঞ্চয় করছিলেন ব্রিটিশ পক্ষ থেকে। আরেকদিন জমিদার রামদয়ালের নেতৃত্বে নাগিনা আক্রমণ করে শহর লুটপাট করলেন। এ অনাকাঙ্ক্ষিত উৎপাতে মাহমুদ খান ভীষণ নাজুক হয়ে পড়েছিলেন। দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখার যাবতীয় প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। তাদের সঙ্গে একটা যুদ্ধ অত্যাবশ্যক এবং অত্যাসন্ন হয়ে উঠলো। নাগিনা থেকে জমিদারদের তাড়িয়ে দেয়ার জন্য রহমতুল্লাহ খানকে পাঠানো হলো। তিনি রামদয়ালকে পরাস্ত করে শহর পুনরুদ্ধার করলেন। রামদয়ালের পরাজয়ের সংবাদ শুনে হলদৌড় এবং আশপাশের জমিদারবৃন্দ রামদয়ালের সাহায্যার্থে ছুটে এলো, কিন্তু সংবাদ এলো, যে নওয়াবের সৈন্যরা শহর পুনরুদ্ধার করার জন্য ধেয়ে আসছে। সৈয়দ আহমদ খান এবং তার সমর্থক চৌধুরীরা ভয়ঙ্করভাবে এস্ত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। বালিকোটলায় আহমদ উল্লাহ খান এসে পৌঁছেছেন এ সংবাদ শ্রবণে রণধীর চৌধুরী সৈয়দ আহমদ খানকে জানালেন যে তিনি বিজনৌর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এবং তাঁকেও তাঁর সঙ্গী হতে বললেন। ডেপুটি কালেকটর, সদর আমিন এবং রণধীর চৌধুরী একই সঙ্গে ১৮৫৭ সালের ২৪শে আগস্ট বিজনৌর ত্যাগ করেন।

আহমদ উল্লাহ খান এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ভূস্বামীদের কতিপয়কে সমুচিত শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী মুসলমানদের সবিশেষ অনুরোধে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু অনতিবিলম্বে সংবাদ পাওয়া গেলো, একজন মুসলমানকে বিষ্ণু সরাইয়ের কাছে হিন্দুরা হত্যা করেছে। তিনি বিষ্ণু সরাই আক্রমণ করে লুট করলেন, জ্বালিয়ে দিলেন। তহশীলদার তোঁয়াব আলী যিনি শুরু থেকে নতুন শাসকদের বিরোধিতা করে আসছিলেন, তাঁকে গ্রেফতার করা হলো এবং তাঁকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হলো। স্থানীয় মুসলমান, বিশেষ করে মৌলবি মুহম্মদ আলীর বিশেষ অনুরোধে তাকে প্রাণে হত্যা করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলো না। কিন্তু কড়া পাহারায় রাখার নির্দেশ বলবৎ রইলো। আগস্টের ২৬ তারিখে হলদৌড় যাওয়ার পথে মারে খান এবং শরীফুল্লাহ খানসহ নাহতাওয়ারে এসে হাজির হলেন। নাহতাওয়ার ছিলো চৌধুরীদের শক্তিশালী কেন্দ্র। বান নদীর তীরে উভয় পক্ষে একটা ছোটোখাটো খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেলো। এতে চৌধুরীরা পরাজিত হন। আহমদ উল্লাহ খান হলদৌড়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কিন্তু তিনি সংকল্প পাল্টে বিজনৌরের দিকে যাত্রা করলেন। তখনো চৌধুরীদের কেউ কেউ বিজনৌরে অবস্থান করেছিলেন। আহমদ উল্লাহ খানের সম্ভাব্য আক্রমণের কথা চিন্তা করে তাঁরা আগেভাগেই বিজনৌর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

আহমদউল্লাহ খানের প্রস্থানের পর আবার চৌধুরীরা বিজনৌর আক্রমণ করে লুণ্ঠন, জ্বালানো ইত্যাদি কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। মুসলমানদের প্রতি তাঁরা এতোদূর বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ছিলেন যে তাদের সমর্থক সৈয়দ আহমদ খানকেও বিজনৌরে অবস্থান করা নিরাপদ ভাবতে পারলেন না। তিনি নীরবে চাঁদপুরে চলে গেলেন। দু’জন বিদ্রোহী নেতা রুস্তম আলী এবং সাদিক আলী ছিলেন জেলার দায়িত্বে। রাজনৈতিক মত পার্থক্য সত্ত্বেও সৈয়দ আহমদ খানকে সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগিতা এবং নিরাপত্তা দান করেন। হলদৌড়ের চৌধুরীরা আবার বিদ্রোহী সরকারকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে এক বিশাল সেনাবাহিনী সংগ্রহ করেন। আহমদউল্লাহ অন্যান্য কতিপয় রোহিলা খান সমভিব্যহারে আবার হলদৌড়ের দিকে যাত্রা করলেন এবং ৩০শে আগস্ট তারিখে শহর আক্রমণ করলেন। চৌধুরীদের সেনাবাহিনী সুরক্ষিত কেল্লার মধ্যে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় অবস্থান করলো। আহমদ উল্লাহ খান তাদের সামান্য ক্ষতিও করতে পারলেন না। পক্ষান্তরে তিনি নিজেই বিস্তর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেন। অগত্যা ৩১শে আগস্ট তারিখে তিনি বিজনৌরে ফিরে যেতে বাধ্য হলেন। মাহমুদ খান চৌধুরীদের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে ফেলার প্রয়োজনীয়তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছিলেন। কিন্তু এটাও তিনি পরিষ্কার জানতেন যে চৌধুরীরা আহমদ উল্লাহ খানকে পছন্দ করেন না। তিনি যতোদিন মোক্তার পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন, ততোদিন চৌধুরীদের সঙ্গে আপোস-মীমাংসার কোনো সম্ভাবনা নেই। আবার সে সঙ্গে তিনি আহমদ উল্লাহ খান সম্পর্কে বিদ্রোহী সেপাই এবং নেতৃবৃন্দের মনোভাব বিলকুল ওয়াকেবহাল ছিলেন। গোড়া থেকেই অপরিসীম প্রযত্ন প্রয়াসের মাধ্যমে আহমদ উল্লাহ খান বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গগুলোকে শত শিখায় জ্বালিয়ে তুলেছিলেন। তাই সকলে তাঁকে অতিশয় শ্রদ্ধার চোখে দেখতো। মাহমুদ খান সবদিক রক্ষা পাওয়ার মতো একটা পন্থা খুঁজে বের করলেন। তিনি মোক্তারের পদ একজন ব্যক্তিবিশেষের হাতে দেয়ার বদলে একটি পরিষদের উপর ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

আহমদ উল্লাহ খান, আহমদ ইয়ার খান, মুহম্মদ সফিউল্লাহ খান, আবদুর রহমান এবং সৈয়দ আহমদ শাহ্ প্রমুখ ব্যক্তিবৃন্দ ছিলেন এই পরিষদের সদস্য। তাতেও কিন্তু চৌধুরীদের সঙ্গে বৈরীতার অবসান ঘটলো না। তারা নতুন সরকারকে চূড়ান্ত আঘাত করার জন্য প্রতিবেশী সমস্ত জমিদারদের ঐক্যসূত্রে বেঁধে এক বিশাল সেনাবাহিনী সংগ্রহ করলেন। শফিউল্লাহ খানসহ মাহমুদ খান তাদের নাজিরাবাদে আক্রমণ করলেন। চৌধুরীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন। আবার মাহমুদ খান আপোস-মীমাংসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। সুতরাং যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলো। ২২শে নভেম্বর তারিখে হলদৌড় আক্রান্ত হলো। চৌধুরীরা বীর বিক্রমে বাধা দিলেন বটে, কিন্তু পরাজয় ঠেকাতে পারলেন না। শহর তাদের দখলে চলে এলো এবং শত্রুপক্ষের নেতা রণধীর চৌধুরীকে বন্দী করে নিয়ে গেলেন।

মাহমুদ খানের সৈন্যেরা গঙ্গা অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। ১৮৫৮ সালের ৫ই জানুয়ারি রাজা হাসান মীরপুর অবরোধ করে নিজেকে নওয়াব ঘোষণা করলেন। দু’দিন পরে হলদৌড় এবং কনখল তাদের অধিকারে চলে এলো। সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সেপাইরা রুঢ়কি আক্রমণের কথা চিন্তা করছিলেন। কিন্তু মাহমুদ খানকে তার পরিকল্পনা পাল্টাতে হলো। ৯ই জানুয়ারি তারিখে একদল ব্রিটিশ সৈন্য অতর্কিতে কনখল আক্রমণ করে বসে।

রুঢ়কির সৈন্য বাহিনীর কর্তা ব্রিগেডিয়ার জোন্স ১৮৫৮ সালের ৭ই এপ্রিল তারিখে হরিদ্বারের নিকটে গঙ্গা অতিক্রম করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। চার মাইল অতিক্রম করার পর ভাগিনালায় তিনি বিদ্রোহীদের একটি বাধার সম্মুখীন হলেন। কিন্তু বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ আক্রমণ ঠেকাতে পারলো না। তদুপরি তাদের চারটি ভারী কামান ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে পড়েছে। তারা নাজিয়াবাদে পালিয়ে গেলো। ব্রিটিশ সৈন্য সে অবধি ধাওয়া করলো। বিদ্রোহীরা নাজিয়াবাদ ছেড়ে চলে গেলো। কোম্পানীর সৈন্য শহর লুট করলো এবং বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিলো। কোট কাদির গ্রাম থেকে জালালুদ্দীন খান এবং সাদউল্লাহ খানকে বন্দী করলো। তাঁদের ২৩শে এপ্রিল তারিখে গুলি করে হত্যা করা হলো। এপ্রিলের ২১ তারিখে নাগিনা কোম্পানী সৈন্যের দখলে চলে গেলো। তাদের সৈন্যের অধিকাংশই মুরাদাবাদে পালিয়ে গিয়ে ফিরোজ শাহের সাথে যোগ দিতে সক্ষম হয়েছিলো। ফিরোজ শাহ সেখানে সসৈন্যে ২১শে এপ্রিল তারিখে এসে পৌঁছেছিলেন। মাহমুদ খান পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে ধৃত হলেন এবং তাকে যাবজ্জীবন নির্বাসনদণ্ড প্রদান করা হলো। কিন্তু সে দণ্ড তাঁকে ভোগ করতে হয়নি। আন্দামানে পাঠাবার পূর্বে কারাগারেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সম্পত্তি হয়তো নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল, নয়তো সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিলো।’

মুরাদাবাদ শহরটির পত্তন হয়েছিলো সম্রাট শাহজাহানের আমলে। রোহিলাদের অধীনে আসার পর এই শহরটির দ্রুত উন্নতি ঘটে। অতি শীগগিরই একটা উল্লেখ্য বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালো মুরাদাবাদ। রোহিলাখণ্ড যখন অযোধ্যার নওয়াবের রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হলো ১৮০১ সালে, তখন থেকে একটি জেলা হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছিলো। ওহাবী আন্দোলনের উদ্যোক্তা সৈয়দ আহমদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে মুরাদাবাদে অনেক মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন। মুরাদাবাদের মুসলমান জনসাধারণের মনোভাব প্রসঙ্গে ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে লেখা হয়েছে, মুসলমানেরা সামগ্রিকভাবে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সর্বপ্রকারে বৈরী মনোভাব পোষণ করেছে। সুতরাং কোনো সন্দেহ নেই যে রোহিলাখণ্ডের আন্যন্য জেলার মতো মুরাদাবাদের মুসলমান জনগণের একটি অংশের মধ্যে যা কিছু ইংরেজ তার প্রতি প্রকিতগত ঘৃণার কারণে একটি বিদ্রোহ ঘটেছিলো। এই বিদ্রোহে যে সকল ওলেমা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা হলেন মৌলবি ওয়াজউদ্দিন, মৌলবি নান্নে। নামে যিনি পরিচিত ছিলেন, মৌলবি কিফায়েত আলী কাফী, মাওলানা আলম আলী এই ওলামাদের সঙ্গে স্থানীয় বিদ্রোহী নেতা মাজউদ্দিন খান এবং আব্বাস খান যোগ দিয়েছিলেন।

ক্রক্রোপ্ট উইলসন লিখেছেন, ‘মীরাটের অভ্যুত্থানের অভাবিত সংবাদ শুনে আমরা কিছু পরিমাণ হতচকিত হয়ে গেলাম। আমাদের মতো এই খবর সেপাইরাও পেয়েছিলো। স্বভাবতঃই তারা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো। সুতরাং প্যারেড ময়দানে সকল সেপাইদের উদ্দেশ্য করে উইলসন বললেন যে তাদের ধর্মীয় এবং অন্যান্য ব্যাপারে কোনো প্রকারের হস্তক্ষেপ করা হবে না। উইলসন মনে করেছিলেন যে তাঁর কথায় সেপাইরা পুরোপুরি শান্ত হয়ে গেছে। সুতরাং কোনা গোলমালের আশংকা নেই। দুদিন পরে সকাল দশ ঘটিকার সময় মিথ্যা পাগলাঘণ্টা বাজিয়ে ঘোষণা করা হলো যে শহরের লোকেরা সশস্ত্রে ক্যান্টনমেন্টের ওপর হামলা করতে ছুটে আসছে। উইলসন লিখেছেন, সুতরাং আমরা অস্ত্র হাতে ছাউনির বাইরে এসে শহরের লোকদের সম্ভাব্য হামলার প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। পরে প্রমাণ হলো এটা মিথ্যা বানোয়াট গুজব। তারপর ক্যান্টনমেন্টের জীবন আগের মতো চলতে লাগলো। উইলসনের পরিস্থিতির মূল্যায়ন সঠিক ছিলো না। কারণ তাঁকে আবার পরে লিখতে হয়েছে, ১৮ তারিখের রাত দেড়টার সময় ঘুম থেকে জাগিয়ে নির্দেশ দেয়া হলো যে আমাকে ৪০ জন সেপাইসহ ৪ মাইল দূরে মীরাট সড়কে গিয়ে ছাউনি ফেলে অবস্থান করছে এমন কিছু বিদ্রোহীদের আক্রমণ করতে হবে। মুজফফর নগর থেকে আগত এই সকল বিদ্রোহী সেপাই ঘুম ভেঙ্গে দেখতে পেলো যে তারা আক্রান্ত হয়েছে। আমরা ৫জন বিদ্রোহী, সেই সঙ্গে ১৬টি অস্ত্রের র‍্যাক এবং নগদ ১২ হাজার টাকা পেলাম। এই সময় সেপাইরা ব্যারাক লুটতরাজ করার সুযোগ পেয়েছে। ধৃত সেপাইদের মধ্যে ৫জন পালিয়ে ২৯নম্বর লাইনে ঢুকে পড়লো। আমার একজন শিখ সেপাই তাদের একজনকে গুলি করে হত্যা করলো এবং চারজনকে পুনরায় কয়েদ করে জেলখানায় রাখা হলো। এই অবস্থা দেখে ২৯নং রেজিমেন্টের কতিপয় সেপাই ক্ষিপ্ত হয়ে কারাগারে গিয়ে তাদের মুক্ত করে দিলো। এটা ছিলো একটা স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা। এর পিছনে কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছিলো না। যাহোক আবার সেদিন বিকেলে তাদেরকে কয়েদ করে জেলখানায় আটক করা হলো।’

প্যারেড ময়দানে সেপাইদের জমায়েত করে উইলসন আবার বক্তৃতা দিলেন। বাইরের দিক থেকে পরিস্থিতি সহজ স্বাভাবিক এবং শান্ত হয়ে গেলো। আসলে এই শান্ত অবস্থা ছিলো আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস মাত্র। ২৯শে মে তারিখে মুরাদাবাদের সেপাই এবং জনগণ বিদ্রোহ করে। মৌলবি ওয়াজ উদ্দিন বিদ্রোহীদের নেতা নির্বাচিত হলেন। বাহাদুর খানের নেতৃত্বে রামপুর থেকে বিপুলসংখ্যক গাজী এসে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিলো। রামগঙ্গার তীরে সবুজ পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। সর্বত্র প্রচণ্ড উত্তেজনা। ২৯ তারিখে উইলসন রামগঙ্গা অতিক্রম করে বিদ্রোহীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। বিদ্রোহীরা প্রচণ্ড বাধা দিলো, কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় তাদের নেতা মৌলবি ওয়াহাজ উদ্দিন নিহত হলেন। মৌলবি সাহেবের মৃত্যুতে সেপাইদের যে ক্ষতি হলো, তা পূরণ করার মতো কোনো ব্যক্তিত্ব ছিলো না। যাহোক বিদ্রোহী প্রচারকেরা প্রত্যেকটি ব্রিটিশ পক্ষের সেপাইদের কাছে প্রাণপ্রিয় ধর্মের নামে প্রচার কাজ অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যেতে থাকে। যখনই সংবাদ এলো বেরিলীর সেপাইরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কিছু পরিবর্তন হয়ে গেলো। এখন অধিকাংশ সেপাই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। করতে লাগলো। ব্রিটিশ অফিসারেরা ভয় পেয়ে সপরিবারে নৈনিতালে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করলো।

বিদ্রোহীরা তারপরে নওয়াব মাজুদ্দিন খান ওরফে মাজু খানের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন করলো। আসাদ আলী খানকে গোলন্দাজ বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হলো এবং মাওলানা কাফীকে সদর-আল-শরীয়তের পদ দেয়া হলো। ক্ষুদ্র রাজ্য রামপুরের নওয়াব ইউছুফ আলী খান বাহাদুর মুরাদাবাদ অ্যুত্থানের সুযোগ গ্রহণ করে ব্রিটিশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে তৎপর হয়ে উঠলেন। ব্রিটিশ কমিশনার তাঁকে জেলার শাসন কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। সে অনুসারে তাঁর পিতৃব্য আবদুল আলী খানের নেতৃত্ব একদল সৈন্য পাঠিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন সহকারী সাদত আলী খান। দু’দিন পরে নওয়াব স্বয়ং এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন অবস্থান করতে পারলেন না। কারণ এরই মধ্যে প্রচারিত হয়েছে যে দিল্লী যাওয়ার পূর্বে নওয়াবকে শাস্তি দিয়ে মাজুদ্দীনকে শাসনকর্তা হিসেবে নিষ্কণ্টক করার জন্য বখ্‌ত খান ছুটে আসছেন। বখ্‌ত খানের আগমনের সংবাদে তিনি রামপুরে পালিয়ে গেলেন।

বখ্‌ত খান জুন মাসের ৯ তারিখে রামপুর পৌঁছলেন। ইউছুফ আলী খান তার হুকুম অমান্য করতে পারলেন না। মাজু খানকে ২৫শে জুন তারিখে জেলার নওয়াব ঘোষণা করে বখ্‌ত খান চলে গেলেন। বখ্‌ত খান দূরে চলে যাওয়ার পর ইউসুফ আলী খান পুনরায় সাদত আলী খানের নেতৃত্বে মুরাদাবাদ দখল করার উদ্দেশ্যে একদল সৈন্য পাঠালেন।

সদর দফতর ছাড়াও জেলার অন্যান্য অংশে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিলো। মুরাদাবাদ থেকে আমরোহার দূরত্ব দিল্লী যাওয়ার পথ ধরে বিশ মাইল মাত্র। এখানে কতিপয় সম্ভ্রান্ত প্রভাবশালী মুসলিম পরিবারের নিবাস। এটি অতিশয় প্রাচীন শহর। মে মাসের ১৭ তারিখে শহরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ শাহ্ বিলায়েতের মাজারে গিয়ে আলোচনায় মিলিত হলেন। তার কয়েকদিন পরে গুলজার আলী নামে এক ব্যক্তি কতিপয় বিপ্লবীসহ আমরোহাতে এলেন। ফলে একটি বিদ্রোহ ঘটে গেলো। নতুন শাসন পদ্ধতি চালু করা হলো। অবশ্য তা বেশিদিন টেকেনি। কারণ উইলসন ২৫শে মে তারিখে আমরোহা আক্রমণ করলেন। অবশ্য গুলজার আলী কতিপয় সাথীসহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

অযোধ্যার পতনের পর রোহিলাখণ্ড প্রধান সমস্থল হয়ে দাঁড়ালো। রাজকুমার ফিরোজ শাহসহ কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহী নেতা এখানে এসেছেন। রামপুরের নওয়াব তার আপন প্রজাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, তারা যেনো সর্ব প্রকারে রাজকুমারের বিরোধিতা করে। কিন্তু ফিরোজ শাহ্ একেবারে বিনা বাধায় শহর পুনর্দখল করেন ২১শে এপ্রিল তারিখে। তিনি প্রতিরক্ষার সুবিধার জন্য তাঁর সেনাবাহিনীকে তিনটি দলে বিভক্ত করলেন। একদলকে রামগঙ্গার তীরে স্থাপন করলেন যেনো রামপুরের দিক থেকে যে কোনো সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে নগর রক্ষা করতে পারে। দ্বিতীয় দলটিকে শহরের প্রান্তদেশে শাহ বুলাকীর মাজারের সন্নিকটে স্থাপন করলেন। তৃতীয় দলটিকে দু’দলের মধ্যবর্তী স্থানে প্রস্তুত রাখা হলো। নওয়াবের সৈন্য এবং ফিরোজ শাহের সৈন্যের মধ্যে একটি ঘোরতরো যুদ্ধ হয়ে গেলো। তাতে ৬ শত নওয়াব সৈন্য মারা পড়ে। সংবাদ এলো যে বিজনৌর থেকে ব্রিগেডিয়ার জোনস এসে পড়েছেন। অগত্যা তাঁকে বাধ্য হয়ে শহর ছাড়তে হলো। ২৪শে এপ্রিল তারিখে ব্রিটিশ সৈন্য মুরাদাবাদ দখল করে নিলো। মাঞ্জু খান এবং অন্যান্য বিদ্রোহী নেতাদের হত্যা করা হলো।

রোহিলাখণ্ডের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ঘটে শাহজাহানপুরে। এখানকার বিদ্রোহীরা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ শাহের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বাধীনে ছিলেন। এই সময়ে এলাকা রক্ষার দায়িত্ব ছিলো কর্ণেল হ্যালের উপর। ১৫০০ সৈন্যসহ আহমদ উল্লাহ্ শাহ্ ব্রিটিশ সৈন্যের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে কর্ণেল হ্যালে কারাগারের অভ্যন্তরে আত্মগোপন করে থাকেন। আহমদ উল্লাহ শাহ্ শহর অবরোধ করলেন। কর্ণেল ক্যম্পবেল ব্রিগেডিয়ার জোন্সকে নতুন সমর-সম্ভারসহ পাঠালেন। তিনি ১৮৫৮ সালের ১১ই মে তারিখে শাহজাহানপুরের উপকণ্ঠে হাজির হওয়ার পর জোনস বিদ্রোহীদের সামান্য বাধার সম্মুখীন হলেন। কিন্তু কারাগার থেকে হ্যালেকে বের করে আনতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না। তিনি এবং হ্যালে উভয়ে হৃদয়ঙ্গম করলেন যে যথেষ্ট পরিমাণ সাহায্য না পেলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া উচিত হবে না। সুতরাং সাহায্যের জন্য বেরিলীতে লিখলেন।

অন্যদিকে সিপাহীযুদ্ধের মুখ্যনায়কবৃন্দ বেগম হজরত মহল, ইসমাইল খান, রাজকুমার ফিরোজ শাহ্, খান বাহাদুর খান সকলেই শাহজাহানপুরে এসে উপস্থিত হলেন। নানা রাও আসতে পারেননি। কারণ তিনি তাঁর পত্নীকে অত্যধিক পরিমাণে ভালোবাসতেন। সুতরাং অনিশ্চিত যুদ্ধে যাওয়ার বদলে পত্নীর হেফাজত করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন। ১৫ মে তারিখে বিদ্রোহী সৈন্য ব্রিটিশ সৈন্যের ওপর হামলা চালালো। জোনস অতিশয় দৃঢ়তা সহকারে বাধা দিলেন। তার পরের দিন তিনি সসৈন্যে তিলহার যাত্রা করলেন। পথে যখন শুনতে পেলেন যে মৌলবি আহমদ উল্লাহ মোহাম্মদীতে চলে গেছেন উইলসন সাহস সঞ্চয় করলেন। কলিন ক্যাম্পবেল এ রকমের বিনা বাধাতেই ১৮ তারিখে শাহজাহানপুরে প্রবেশ করলেন।

এখনো তিনি মনে করেন, বিদ্রোহীদের সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধ করার মতো সৈন্য সংখ্যা এবং সমর-সম্ভার তার নেই। কিন্তু সে জন্য তিনি অপেক্ষা করেছিলেন। বিদোহীরা তাঁকে অপেক্ষা করতে দিলো না। ব্রিটিশ সৈন্যের ওপর আবার নতুনভাবে আক্রমণ চালানো হলো। কিন্তু তাতে বিদ্রোহীদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। আহমদ উল্লাহ শাহ্ ফতেগড়ের দিকে যাত্রা করলেন।

ব্রিটিশ সৈন্যাধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার কোকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে তাকে তার সাহায্যার্থে আসতে নির্দেশ দান করলেন। কোক ২২শে মে তারিখে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। দু’দিন পরে কলিন ক্যাম্পবেল ব্রিগেডিয়ার জোনসকে আহমদ উল্লাহ শাহের। নতুন দফতর মোহাম্মদী আক্রমণ করতে পাঠালেন। ব্রিটিশ সৈন্য বার্না গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছোলে বিদ্রোহী সৈন্য তাদের গোলাবর্ষণ করতে আরম্ভ করে। ব্রিটিশ সৈন্য কামান দিয়ে বন্দুকের জবাব দিলো। অধিকাংশ বিদ্রোহী সৈন্য ভারী কামানের আক্রমণ বরদাশত করতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করলো। কিন্তু গাজী সেনাদের ক্ষুদ্র দলটি ভয়ভীতি তুচ্ছ করে অবিচলিতভাবে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করে। দ্বিতীয় দিনে আহমদ উল্লাহ শাহ মোহাম্মদী অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। কোম্পানীর সৈন্য মোহাম্মদী দখল করে গোটা শহরটি তোপের মুখে উড়িয়ে দেয়।

আহমদ উল্লাহ অনুভব করলেন আর কোনো আশা-ভরসা নেই। তিনি সেপাইদেরকে তাঁর নির্দেশ পালন না করার জন্য তীব্র ভাষায় তিরস্কার করলেন। জেলার কালেক্টার জমিদার জগন্নাথের উপর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন, যেন তিনি এমন একটা কোন কাজ করেন যাতে প্রমাণিত হয় যে তিনি কোম্পানী সরকারের অনুগত। সে সঙ্গে জীবিত কিংবা মৃত আহমদ উল্লাহ শাহকে গ্রেফতার করে এনে দিতে পারবে তার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। কারো কারো মতে, রাজা জগন্নাথের ভাই বলদেব ছদ্মবেশে তাঁর সেনাদলে যোগ দিয়ে তাকে পাওয়াইনে আসতে প্ররোচিত করেন, অবশ্য তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে সরকারি মত হলো, যেহেতু রাজা কতিপয় তহশীলদার এবং থানাদারকে আশ্রয় দান করেছিলেন, তাতে তিনি কুপিত হয়ে রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করেছিলেন। সে যাহোক, শাহ রাজপ্রাসাদে এসে দেখতে পেলেন যে ফটক তার মুখের উপর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তখন তিনি হাতীর মাহুতকে বদ্ধ ফটক চুরমার করে অভ্যন্তরে প্রবেশ করার নির্দেশ দিলেন। প্রাসাদে ঢুকবার পূর্বাহ্নেই ছাদের উপর থেকে গুলি এসে তাঁকে বিদ্ধ করলো। তিনি ১৫ই জুন তারিখে সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলে প্রাণ ত্যাগ করলেন। জগন্নাথ তার শরীর থেকে মস্তক বিছিন্ন করে ঘোষিত পুরস্কারের জন্য কালেকটরের কাছে গেলেন। কালেকটর তাকে পুরস্কার দানের সুপারিশ করলেন। জনসমক্ষে তার শরীর দগ্ধ করে ভস্মরাশি নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হলো।

পরবর্তীকালে তাঁর মস্তক শাজাহানপুরের উপকণ্ঠে কবর দেয়া হয়েছিলো। জি.পি. মানি তাঁর সম্পর্কে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, সবচাইতে দৃঢ় এবং প্রভাবশালী সেপাই নেতা। সাহস এবং দেশ প্রেমের তারিফ করে লিখেছিলেন, “যেহেতু শিষ্য দলের উপর তার ছিলো অপ্রতিহত প্রভাব, তাই তিনি ছিলেন আমাদের সবচাইতে বিপজ্জনক শত্রু।’ রোহিলাখণ্ডের সেপাইদের পরাজয়ে ইতিহাসের একটা অধ্যায়ের পুরোপুরি সমাপ্তি ঘটে। তারপরেও এখানে সেখানে কয়েক মাস ধরে যুদ্ধ চলেছে বটে কিন্তু সকলে জানতো যে তারা পরাজিত হওয়ার জন্যই যুদ্ধ করে যাচ্ছে। অপরিসীম আত্মত্যাগ এবং যাতনা সহ্য করেও বিদ্রোহীরা জয়ী হতে পারেননি, কিন্তু আপন ধমনী চিরে লাল রক্ত দিয়ে ইতিহাসের একটা উজ্জ্বল অধ্যায় তাঁরা রচনা করেছিলেন।

উর্দু কবি তায়েবের সঙ্গে একমত হয়ে উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করে ও তাঁরা রক্ত এবং ধূলায় গড়াগড়ি দেয়ার ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিলেন, আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। তাদের উপর।

.

ইংরেজি ও বাংলা গ্রন্থপঞ্জি

1. A Glance of the Past and Future in connection with the Revolt, by Major General H. Tucker, C. B. Rettiwgham Wilson, Royal Exchange. London, 1857.

2. A Narrative of the Campaign of Delhi Army, by Major H. W. Norman, W. H. Dalton Book Seller to the Queen, 28 Cockspur Street, Charing Cross, London, 1858.

3. An Episode of the Rebellion and Mutiny in Oudh of 1857-58, by George Yeoward, American Methodist Mission Press, 1876.

4. Copies of Sandry Despatches on Various Subjects Connected with the Mutiny and Rebellion in India, during the years 1857-58, by Major General Sir Sydeny Cotton K. C. B. Thompson College Press, Roorkeee 1859.

5. Causes of The Indian Revolt, by A Hindu of Bengal. Edited by Malcom Lewis, Esq. Edward Stanford, Charing Cross, London, 1857.

6. Debate of India in the English Parliament, by M. Le Comte de Montalbert. Translated from French Continental Review, 14 Bedford street, London, 1858.

7. Eighteen Fifty-Seven, by Surendranath Sen, Ministry of Information & Bordcasting, Government of India, New Delhi, 1958.

8. Great Indian Mutiny of 1857, its Causes, Features and Results, by Rev. James Kennedy, M. A. War & Co. Paternoster Row, London, 1858.

9. History of the Indian Mutiny. Vol 1 & 2. Edited by Kayes Colonel Malleson C. S. L. W. H. Allen & Co. Waterloo Palace, London, 1889.

10. Letters written during the seize of Delhi by Lt. Colonel J. R. Turnball Torquay, Fleet Street London, 1876.

11. Minutes of the Recognisation of the Indian Army, by Lt. General Sir Out Ram.

12. Military Analysis of the Remote and Proximate Causes of the Indian Rebellion drawn from the official papers of the government of India, by General Sir Robert Gardineer Hawksworth & Co. Charisong Cross, London, 1858.

13. Narrative of the Mutinies in Oudh, by Captain Hatchinson, P. M. Cranenbargh, Military Orphan Press, Calcutta, 1859.

14. Narrative of the Indian Mutiny of 1857. Compiled by Military Male Orphaen Assylum, Assylum Press, Mount Road, Madrass, 1858.

15. Recent writings on the Revolt of 1857. A survey by Kalyan Kumar Sengupta. Council of Historical Research, New Delhi, 1857.

16. Reminiscenes of the Sepoy Rebellion of 1857. by Miss Florence Wagenteiber, Samuel T. Weston. Civil and Military Gazette Press, Lahore, 1911.

17. Sepoy Mutiny and the Revolt of 1857, by Ramesh Chandra Mazumdar FIRMA KLM Private Ltd. 257/B, Bipin Behari Ganguly Street, Calcutta, 1963.

18. Seize of Lucknow, by Rev. Menison Richard Clay & Sons Ltd. London and Benway, 1897.

19. Three Lectures on the Revolt of the Bengal Army. Thomas Evans. The Mafassalite Printing Works Company, Mussoree, 1899.

20. The Great Revolution of 1857. by Syed Moinul Haq, Pakistan Historical Society, Karachi- 5, 1968.

21. The Indian Military Revolt viewed in its Military Aspects, A Lecture by John Wilson, D. D. F. R. S. Smith Taylor & Co. Bombay, 1857.

22. The Indian Mutiny events at Cawnpore, by J. Lee. Medical Hall Press, Cawnpore, 1886.

23. The Late Rebellion in India and our Future Policy, by Henry Harington Thomas, W. Kent & Co. Paternoster Row, London, 1858.

24. The Seize of Delhi in 1857. Compilation by Major General A. G. Handlock, Pioneer Press, Allahabad.

25. The Sepoy Revolt in 1857, by Major General Charles, Doyly, Bart. Henry Shipp, Market Place Bland, 1891.

26. The History of My Escape from Fategarh, by Gavin S. Jones, Cawnpore, 1886.

27. War in Oudh, by John Malcolm Ludlow, Macmillan & Co. Cambridge, 1858.

২৮. ভারতীয় মহাবিদ্রোহ, ১৮৫৭। প্রমোদ সেনগুপ্ত। বিদ্যোদয় লাইব্রেরি প্রাইভেট লিঃ। কলিকাতা-১৯৫৭।

২৯. সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস ও ৪র্থ ও ৫ম খণ্ড। রজনীকান্ত গুপ্ত। সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরী। ৩০, কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট, কলিকাতা।

৩০. মুক্তির সন্ধানে ভারত। যোগেশচন্দ্র বাগল। অশোক পুস্তকালয়। কলিকাতা। ১৩৬৭ বাংলা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *