২. ঘটনা পরম্পরা

ঘটনা পরম্পরা

সেনাবাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করতে হবে। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যকাল যাবত ব্রাউন বেস নামক আগ্নেয়াস্ত্রই ছিলো সেপাইদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। ১৮৫২ সালে মাষ্টার জেনারেল অব দ্যা অর্ডন্যান্স ভাইকাউন্ট হার্ডিঞ্জ-এর আদেশানুক্রমে এনফিল্ড অস্ত্র উন্নয়নের পরীক্ষা করা হয় এবং নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এক ধরনের রাইফেলের উদ্ভাবন করা হয়। ১৮৫৩ সালের ক্রিমিয়ার যুদ্ধে নতুন রাইফেল পরীক্ষা করে বেশ সুফল পাওয়া যায় এবং ১৮৫৬ সালে ভারতে এ রাইফেল চালু করা হয়। রাইফেলের সঙ্গে লন্ডন থেকে এলো চর্বি মাখানো টোটা। পরে ভারতীয় সেপাইদের ব্যবহারের জন্য কলকাতা দমদম এবং মীরাটে এ টোটা তৈরি হতে থাকে। এ উন্নত ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার শিক্ষা করার জন্য নির্বাচিত সেপাইদের দমদম, আমবালা এবং শিয়ালকোটের ট্রেনিং কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়। একজন উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ একজন নীচ শ্রেণীর লস্করের কাছে জানতে পারলো যে। টোটার সঙ্গে মাখানো রয়েছে আপত্তিজনক পশুর চর্বি। এ খবর জানার পূর্বে পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়লো। সেপাইদের মধ্যে অসন্তোষ এবং বিক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে। কলকাতা ধর্মসভা এ খবর প্রচার করে ইংরেজ অফিসারকে সতর্ক করে দিলো। তারাও এ সম্বন্ধে ভালোভাবে ওয়াকেবহাল হলেন।

১৮৫৭ সালের ২২শে জানুয়ারি লেফটেনান্ট রাইট বিষয়টি দমদম আগ্নেয়াস্ত্র বিভাগের কম্যাণ্ডিং অফিসার মেজর বন্টেনের দৃষ্টিগোচর করলেন। মেজর বন্টেন তাঁর ঊর্ধ্বতন অফিসারের কাছে লিখলেন, “গতকাল সমস্ত দেশীয় সেপাইদেরকে প্যারেড করবার সময়, কোন অভিযোগ থাকলে জানাতে বলেছিলাম। কমপক্ষে তিনভাগের দু’ভাগ সৈন্য সামনে এসে দাঁড়ালো। তার মধ্যে কমিশন প্রাপ্ত সমস্ত দেশীয় অফিসারেরাও ছিলো। অত্যন্ত ভদ্রোচিতভাবে তারা জানালো যে বর্তমান কার্তুজ তৈয়ারীর পদ্ধতির বিরুদ্ধে তাদের আপত্তি আছে। তারা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে অভিযোগ করেছে যে কার্তুজে যে চর্বি মেশানো হয়, তা তাদের ধর্ম-বিশ্বাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এর বিকল্প স্বরূপ সেপাইরা নোম এবং তেলের ব্যবহার করে কাজ চালাবার পরামর্শ দান করেছে।” এটা পরিষ্কার সেপাইদের মনে প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়, তার মূলে ছিলো ভয়, কোন প্রকারের ক্রোধ নয়। তারা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বন্টেনের কাছে কেননা টোটা ব্যবহার করতে পারবে না তার সঙ্গত কারণ নির্দেশ করেছে। তার বিকল্প ব্যবস্থাও দেখিয়ে দিয়েছে। প্রচারিত খবরে সেপাইদের সন্দেহ করার যথার্থ কারণ ছিলো যে কার্তুজের সঙ্গে অবশ্যই আপত্তিজনক কিছু মাখানো রয়েছে। কীথ ইয়ং-এর কাছে এক পত্রে প্রদান সেনাপতি স্বয়ং লিখেছেন, “কার্তুজের সঙ্গে মেশানো স্নেহ পদার্থের (চবি) পরিমাণ দেখে সেপাইরা যে আপত্তি করেছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।” মার্চ মাসের ২৩ তারিখে এ পত্র লেখা হয়েছিলো। কিন্তু পয়লাদিকে সেপাইদের মনে যে কোনো সন্দেহের উদয় হয়নি, সে সম্বন্ধে একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। ফোর্ট উইলিয়ামের অস্ত্র বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল কোনো প্রমাণ দেখাতে পারলেন না যে চর্বি আপত্তিজনকভাবে সংগৃহীত হয়নি। ২৯শে জানুয়ারি তিনি লিখেছেন যখন আমি শুনতে পেলাম, সামরিক ডিপোর দেশীয় সেপাইরা দমদমে চর্বি ব্যবহারে আপত্তি করেছে, আমি তখনই পরীক্ষা করে দেখলাম যে লন্ডনের ডিরেকটর সভা যেভাবে তৈরি করতে নির্দেশ দান করেছেন, সেভাবেই তা তৈরি করা হয়েছে। তাতে চর্বি এবং মৌমাছির মোম মেশানো হয়েছিলো। আপত্তিজনক চর্বি ব্যবহার না হতে পারে তার জন্য পূর্ব থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এখানে অবশ্য স্বীকার করা হয়নি যে কোনো গরুর চর্বি মেশানো হয়েছে। তেমনি এ মসৃণকারী পদার্থ কিভাবে তৈরি করা হচ্ছে সে সম্বন্ধে ব্রাহ্মণ সন্তানদেরও কোনো ধারণা ছিলো না। চর্বি এবং মোম সরবরাহ করতো একজন বাঙালি ব্রাহ্মণ ঠিকাদার। তার লোকজন হয়তো বাজার থেকে সস্তা চর্বি কিনেও সরবরাহ করতে পারে। তখন ইংরেজরা ধরে নিয়েছিলো ঠিকাদার খারাপ চর্বি সরবরাহ করেছে, কারণ তাকে অন্য চর্বি ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়নি। ২৩শে ফেব্রুয়ারী ‘টাইম পত্রিকার সংবাদদাতা লিখেছেন, “নতুন এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজে চর্বি মাখানো হয়, যাতে করে সহজে নলের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়। সরকার ঠিকাদারকে ছাগলের চর্বির জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন, সামান্য পয়সা বাঁচাবার জন্য ঠিকাদার গরু অথবা শুয়রের চর্বি সরবরাহ করেছে।” কতিপয় সেপাই কলকাতা দুর্গের অধ্যক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন একজন উচ্চ বর্ণের হিন্দু এবং একজন মুসলমানকে চর্বি মাখানোর কারখানায় নিয়োগ করলে সমস্ত সন্দেহের অবসান হয়। অধ্যক্ষের নিয়োগে কোনো আপত্তি ছিলো না, কারণ তার ফলে সেপাইদের মনের সন্দেহের নিরসন হবে। কিন্তু অস্ত্র বিভাগ তা অনুমোদন করলো না। স্বভাবতই সেপাইরা ভাবতে লাগলো যে কর্তৃপক্ষের নিশ্চয়ই কোনো খুঁত আছে, নয়তো দুর্গের অধ্যক্ষের এমন ভালো পরামর্শ তারা গ্রহণ করলো না কেনো?

চর্বি মাখানো টোটার ব্যবহারের পেছনে সত্যিকারের কোনো ভালো মনোভাব ছিলো না। ১৮৫৩ সালে এ কার্তুজ ব্যবহারের জন্য নয়, আবহাওয়ায় উপযুক্ত কিনা পরীক্ষা করে দেখবার জন্য ভারতে আমদানী করা হয়। ভারতীয়দের দিয়ে পরীক্ষা করালে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে এ সম্বন্ধে কর্ণেল টুকার সামরিক বোর্ডকে হুঁশিয়ারী করেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র ইউরোপীয় সৈন্যদের মধ্যেই টোটা বিতরণ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন সে সময়ে। তাঁর সতর্কবাণীর কোনোই আমল দেয়া হয়নি পরবর্তীকালে। ভারতীয় সেপাইদেরকেও থলিতে করে টোটা বইতে দেয়া হয়। সে যাকগে, কিসের চর্বি সে সম্বন্ধে একবারও সেপাইদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়নি, দুর্যোগের পূর্ব পর্যন্ত। ১৮৫৭ সালে সেপাইরা ন্যায্য কারণে আপত্তি তুললো। যদি তারা টোটা কামড়ে বন্দুকে পূরে তাহলে তাদের ভীষণ সামাজিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। সরকার টোটার ব্যবহার বন্ধ অথবা সেপাইদেরকে আপনাপন চর্বি তৈরি করতে দেবে কিনা এবং এ সম্বন্ধে তাদের ভয়ের কোনো কারণ আছে কিনা তা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। কিন্তু দমদমে যে টোটা বিলি করা হয়েছিলো, তাতে সন্দেহ নেই। কোনো নিষিদ্ধ চর্বি ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা সে সম্বন্ধে কোনো সর্তকতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অস্ত্র বিভাগ গুরুতরভাবে অপরাধী।

সরকার ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। ব্যারাকপুরের সৈন্যাধ্যক্ষ জেনারেল হীয়ার্সে সেপাইদেরকে তাদের পছন্দ অনুসারে চর্বি তৈরি করতে অনুমতি দিলেন। ২৮শে জানুয়ারি তারিখে সরকার তাঁর পরামর্শে অনুমোদন দান করলেন। লেফটেনান্ট রাইটের রিপোর্ট এবং কলকাতা থেকে সরকারের উত্তর পৌঁছাবার সময়ের মধ্যে সেপাইদের বিক্ষোভ তীব্র হতে তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগলো। গুজব ছড়িয়ে পড়লো, সরকার ইচ্ছে করেই তাদের জাতি এবং ধর্মনাশ করার জন্য চর্বি মাখানো টোটার প্রবর্তন করেছে। তাদের খ্রীস্টান না বানিয়ে সরকার ছাড়বে না। ইতিমধ্যে এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলের ওপরে পরিদর্শনের দায়িত্ব দেয়া হলো, যাতে করে মীরাট, আমবালা এবং শিয়ালকোটে কোনো চর্বি মাখানো টোটা না বিতরণ করা হয় এবং সেপাইরা আপন আপন ইচ্ছা মতো মসৃণকারী পদার্থ ব্যবহার করতে পারে। তিনি বলেছেন, কিছুদিন আগে থেকে মিনি রাইফেলধারী সেপাইরা নির্দোষ চর্বি মাখানো টোটা ব্যবহার করে আসছে। তার ফলে অবচেতন মনে তারা ভাবতে পারে যে সরকার ইচ্ছে করেই তাদের দিয়ে আপত্তিজনক চর্বি ব্যবহার করিয়ে তাদের ধর্মনাশের ব্যবস্থা করেছে। তখন আর কিছুই করা হয়নি এবং সেপাইদের সন্দেহ ক্রমবর্ধমান হারে ঘনীভূত হতে থাকে। এ ছিলো মারাত্মক প্রমাদ। মীরাটের সেপাইরা জানতেও পেলো না যে তারা নিদোষ কার্তুজ ব্যবহার করছে।

অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে সেপাইদের সন্তুষ্ট করা যেতো কিনা সত্যিই মুশকিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে তারা জানতে পেরেছে এবং নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেছে, যে কার্তুজ তারা ব্যবহার করছে তার সঙ্গে আপত্তিজনক চর্বি মাখানো ছিলো, যার সামান্য ছোঁয়া লাগলেই তাদের ধর্ম নষ্ট হয়ে যায়। হিন্দুরা গরুর চর্বি যেমন জঘন্য মনে করে, তেমনি মুসলমানেরা শুয়রের চর্বি একই রকম মনে করে। চর্বির সঙ্গে যে আপত্তিজনক কোনো পদার্থ নেই কর্তৃপক্ষ সত্তাবে সে কথা অস্বীকার করেনি। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে স্বাভাবিক পন্থা ছিলো অসাবধানতাবশতঃ যে ভুল হয়ে গেছে তা স্বীকার করা। কিন্তু তার ফলে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার বদলে প্রচণ্ডভাবে জ্বলে উঠার সম্ভাবনা ছিলো। অথবা মিনি রাইফেল ব্যবহার কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা যেতো। আবার, তার ফলেও সেপাইদের একগুঁয়েমী থেকে যেতে পারতো এবং সামরিক শৃখলায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে বলে কর্তৃপক্ষ ভয় করলেন। মিঃ হিয়ার্সে জানাচ্ছেন যে মার্চ মাসে দমদম ঘাটিতে ভরতির উপাদানের অভাবে নতুন অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সেপাইদের উত্তেজনা বাড়তে লাগলো। তারা অস্বাভাবিক ঝলোমলো কার্তুজের কাগজের প্রতি ঘৃণাব্যঞ্জক দৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করলো। কাগজে কোনো চর্বি ছিলো না, কিন্তু একটি আদালতে মানুষের পর মানুষ এসে প্রমাণ দিলো যে তার সঙ্গে চর্বি আছে। আরেকটা প্রবল গুজব রটলো যে হাড় চূর্ণ করে আটা কুয়োর পানিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে করে কারো ধর্ম রক্ষা না পায়। ধর্মনাশ করার জন্যই সরকার সুপরিকল্পিতভাবে এ গর্হিত কাজ করেছে।

সেপাইদের ক্রমশ: বিশ্বাস হারানোর সময়ে অফিসারেরা শুধু নির্বাক দর্শক ছিলেন না। প্রেসিডেন্সী ডিভিশনের অধিকর্তা জেনারেল হীয়ার্সে ছিলেন কৌশলী এবং সাহসী পুরুষ। বিদ্রোহের প্রারম্ভিক সময়ে তিনি তার অধীনস্থ সেপাইদের পাঞ্জাব নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। সেপাইদের ভাষাতেই তিনি কথা বলতেন। যে ভুল হয়ে গেছে, সেজন্য তিনি তাদের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করতেন। তিনি বলতেন, ইংরেজরা হলো প্রোটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বী। তাদের নীতিতে বিশ্বাস না করলে এবং স্বেচ্ছায় তাদের ধর্ম গ্রহণ না করলে, কাউকে তারা আপনার মনে করে না। জেনারেল হীয়ার্সের কথায় সত্যতা না থাকলে সে জন্য সেপাইদের দোষ দেয়া যায় না। সে সময় ব্যারাকপুর ঘাটিতে আরেকজন অফিসার ছিলেন, যিনি এ সম্বন্ধে অন্য রকম ধারণা পোষণ করতেন, তাও তিনি গোপনে রাখতেন না। তাঁর নাম ছিলো কর্ণেল হুইলার। তিনি বলেছেন, দু’বছর ধরে তিনি এদেশীয় সেপাইদের মধ্যে সুসমাচার প্রচার করে আসছেন। কর্ণেল হুইলার সেনাবাহিনীতে একমাত্র মানুষ নন, ভগবানের শ্রীমুখের বাণী মূর্তিপূজকদের পরিত্রাণের জন্য প্রচার করেছিলেন, এমন আরো অনেকে ছিলেন।

চর্বি এবং কাগজ সম্বন্ধে গুজব যখন একবার রটে গেলো, একস্থানে যে তা আর আবদ্ধ রইলো না, সে কথা বুঝিয়ে বলবার প্রয়োজন নেই। আকাশ-বাতাস সন্দেহে ভারী হয়ে উঠলো। সেপাইদের উত্তেজনা এতো প্রচন্ড আকার ধারণ করলো যে ব্যারাকপুর এবং আশেপাশের কয়েকটি স্থানে অগ্নি সংযোগ করা হলো। প্রায় একশো মাইল দূরে রাণীগঞ্জে একই ঘটনা ঘটলো। দুষ্কৃতিকারীদের সন্ধান না পাওয়া গেলেও সেগুলোকে সাধারণ ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটলো নামমাত্র নওয়াবের বাসভূমি মর্শিদাবাদের নিকটস্থ বহরমপুরে। বিশেষ ডিউটিতে ৩৪নং রেজিমেন্টের দু’টো দলকে ব্যারাকপুরে থেকে বহরমপুরে পাঠানো হয়েছিলো। সেখানে আগে থেকে কর্ণেল মিচেলের পরিচালনাধীন ১৯নং বাহিনী ছাউনী ফেলেছিলো। হীয়ার্সের মতো কর্ণেল মিচেল উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন কিন্তু চর্বি মাখানো কার্তুজের খবর তার অধীনস্থ সেপাইদের কানে এসে পৌঁছেছে। একজন ব্রাহ্মণ হাবিলদার তা সত্য কিনা জানতে চাইলো। সে যাক, ৩৪নং রেজিমেন্ট এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত কিছুই ঘটলো না। কিন্তু রেজিমেন্টে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ১৯নং রেজিমেন্টের সৈন্যদের মনে গভীর সন্দেহের শিকড় বিস্তার করলো। চর্বিতে সন্দেহ হওয়ায়, তারা বন্দুকের ক্যাপ স্পর্শ করলো না। তাদের মনে কোন নৃশংস ইচ্ছা ছিলো না। কারণ সংঘর্ষ ক্যাপের অভাবে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু মিচেল তাদেরকে গালাগালি করলেন এবং দণ্ডদানের ভয় দেখালেন। তিনি নিজে পল্টনে গিয়ে দেশীয় অফিসারদের ডেকে বললেন, এক বছরেরও আগের তৈরি কার্তুজ ব্যবহার করতে আগামীকাল অস্বীকার করলে কঠোর দণ্ডদান করা হবে। চতুর্থ কোম্পানীর সুবেদার শেখ করিম বক্স বলেছেন, তিনি কর্ণেলকে বলতে শুনেছেন, তাদেরকে অবশ্যই কার্তুজ ব্যবহার করতে হবে নইলে ব্রহ্মদেশ, চীন ইত্যাদি দূরদেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। দুর্ভাগ্যবশত সেপাইদের সন্দেহের নিরসন হলো না। তদুপরি কর্ণেলের কড়া নির্দেশের কারণে, সন্দেহ আরো গাঢ়রূপ ধারণ করলো। সকালের প্যারেড শুরু হওয়ার আগেই গোলযোগ শুরু হলো। জোর করে সেপাইরা অস্ত্রশালা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে নিলো এবং বন্দুকে গুলি ভর্তি করলো। মিচেল কাপুরুষ ছিলেন না, তিনি অস্ত্রের সাহায্যে অস্ত্রের সম্মুখীন হতে ইচ্ছা পোষণ করলেন। কিন্তু ধারে কাছে কোথাও ইউরোপীয় সৈন্য ছিলো না। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে দমাতে পারলো না। দেশীয় অশ্বারোহী এবং পদাতিক বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়ে গেলেন। দেশীয় সেপাইরা কর্ণেলকে বুঝালেন যে তাদের লোকেরা বিদ্রোহের বশবর্তী হয়ে নয়, ভয়েই উচ্ছল হয়ে পড়েছে। কর্ণেলকে অশ্বারোহী এবং পদাতিক বাহিনী ফেরত পাঠাতে পরামর্শ দিলেন। কারণ তাদের উপস্থিতি সৈন্যদের অসংযত করে তুলতে পারে। কর্ণেল মিচেল তাদের কথা শোনার ফলে এ ঘটনা আর বেশিদূর গড়ালো না। তিনি প্যারেডের নির্দেশ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেপাইরা শান্ত হয়ে এলো।

১৯নং রেজিমেন্ট যেমনি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন, তেমনিভাবে শান্ত হয়ে পড়লো। তারা সেনাবাহিনীর সমস্ত নিয়মকানুন মেনে চলতে লাগলো। মহারাণীর ৮৪নং রেজিমেন্ট তখন রেঙ্গুনে ছিলো। তাদের বাঙলায় ফিরিয়ে আনার জন্য একখানা ষ্টীমার পাঠানো হলো। সেপাইদের কাছে এটা কোনো গোপন খবর ছিলো না। স্যার এডওয়ার্ড প্যাজেটের নিষ্ঠুর বিচারের কথা সেপাইরা ভুলতে পারেনি। সমস্ত রেজিমেন্ট ভীত হয়ে পড়লো। ৮৪নং রেজিমেন্ট এসে পড়লে সমস্ত রেজিমেন্টের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে কঠিন দণ্ডদান করা হবে। জেনারেল হীয়ার্সে তাঁর অধীনস্থ সেপাইদের কাছে বললেন, সেপাইদের ধর্ম এবং জাতের উপর সরকারের কোন বিদ্বেষ নেই। তিনি নিশ্চিত করে বললেন, অপরাধী ছাড়া আর কারো ডর ভয় করার কারণ নেই। অল্পদিনের মধ্যেই ৮৪ং রেজিমেন্ট এসে পড়লো ব্রহ্মদেশের চিনশুরা থেকে। ১৯নং রেজিমেন্টকে ব্যারাকপুর থেকে মার্চ করে নিয়ে যাওয়ার জন্য কর্ণেল মিচেলকে নির্দেশ দেয়া হলো। দেশে ফেরার সময় ৮৪নং রেজিমেন্ট বহু কষ্টে পরিকল্পিত বিদ্রোহ করা থেকে বিরত থেকেছে। তাদের দৃষ্টিতে সমপেশায় নিযুক্ত সেপাইরা চর্বি মাখানো কার্তুজ ব্যবহার না করে উত্তম কাজ করেছে।

২৬শে ফেব্রুয়ারি বহরমপুরের সেপাইরা বিক্ষোভ শুরু করলো। ২৯শে মার্চ ব্যারাকপুরের ভীত-সন্ত্রস্ত সেপাইরা আরো প্রচণ্ডভাবে বেপরোয়া বিক্ষোভ শুরু করলো। ৩৪নং পদাতিক বাহিনীর একজন তরুণ সেপাই মঙ্গল পান্ডে। চাকুরীতে তার রেকর্ড খুবই ভালো। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তাকে উৎক্ষিপ্ত করে তুলেছে। কিছুদিন আগে দু’জন সেপাইকে ষড়যন্ত্র করার অপবাদে ১৪ বছরের সশ্রমদন্ড দেয়া হয়েছে। জমাদার শালিগ্রাম সিংকে তাঁর সাথীদের চর্বি মাখানো টোটা ব্যবহার করতে নিষেধ করার কারণে কোর্ট মার্শালের সামনে হাজির হতে হয়েছে। চাকুরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ধর্মীয় কারণে ১৯নং রেজিমেন্টের একজন সেপাইয়ের কাছে যা মূল্যবান সবকিছু বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এ সকল ঘটনা সেপাইদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলো তা থেকে অনুমান করতে কষ্ট হয় না-এ সকল ঘটনা মঙ্গল পান্ডের মনেও গভীর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিলো। ২৯শে মার্চ রোববার দ্বি-প্রহরে ৩৪নং রেজিমেন্টের এ্যাডজুট্যান্ট লেফটেনান্ট বাগ জানতে পারলেন, তাঁর রেজিমেন্টের একজন সেপাই ক্ষিপ্ত হয়ে সার্জেন্ট মেজরকে গুলী করেছে। তিনি তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে গমন করলেন। তাঁকেও গুলি করা হলো। গুলি এসে ঘোড়ার গায়ে লাগলো। বাগ এবং সার্জেন্ট মেজর দু’জনে সেপাইটির দিকে ধাওয়া করলে, শেখ পন্টু নামে একজন মুসলমান সেপাই তাদেরকে বাধা দিলেন। নয়তো দুজনেই মারা পড়তেন। তখন ডিউটিরত কোয়ার্টার গার্ডরা দূরে ছিলেন না। তারা কিন্তু নীরব দর্শক হয়েই রইলেন। আহত লেফটেনান্ট বাগ ঘটনাস্থল পরিত্যাগ করে চলে গেলেন। ইতিমধ্যে গোলমালের খবর জেনারেল হীয়ার্সের কানে গিয়ে পৌঁছলো। সকলে ধারণা করলো যে সমস্ত সেপাই বিদ্রোহ করেছে। জেনারেল হীয়ার্সে তাঁর পুত্রগণ এবং দেহরক্ষীদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে প্যারেড ময়দানে এলেন। জেনারেলকে এ রকম সুসজ্জিত অবস্থায় দেখে মঙ্গল পান্ডে বুঝে নিলো, তার অন্তিম সময় উপস্থিত। মঙ্গল পান্ডে জ্বালাময়ী ভাষায় আপন ধর্মাবলম্বীদের আহবান করলো অস্ত্র তুলে নিতে, কিন্তু কেউ সাড়া দিলো না। তারপরে বুকের কাছে বন্দুক তুলে নিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলো। কিন্তু জখম মারাত্মক হয়নি। তাকে হাসপাতালে পাঠানো হলো এবং পরে ফাঁসি দেয়া হয়। ঈশ্বরী পান্ডে নামে অপর একজন প্রহরী, যে মঙ্গল পান্ডেকে গ্রেফতার করতে অস্বীকার করে তার ওপরও ফাঁসির নির্দেশ দেয়া হয়, কিন্তু কতিপয় কারণে কিছু দিনের জন্য তা স্থগিত রাখতে হয়। ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলবার সময় সে তার বক্তব্য পেশ করেছে এবং সাথীদেরকে বলেছে এ মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে।

৩৪নং রেজিমেন্টের সাম্প্রতিক রেকর্ডকে কিছুতেই খারাপ বলা যায় না। অধিনায়ক হুইলার এ রেজিমেন্টকে অত্যন্ত ভালোভাবে গড়ে তুলেছেন। এ রেজিমেন্টের সুবাদারের কাছে পদাতিক বাহিনীর দু’জন সৈন্য এসে ষড়যন্ত্রের প্রস্তাব করলে, তিনি তাদের দু’জনকেই গ্রেফতার করেন। ৩৪নং রেজিমেন্টের সঙ্গে বহরমপুরের ঘটনার কোনো সম্পর্ক ছিলো না। কিন্তু তাদের এসে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই ঘটলো এক দুঃখজনক ঘটনা। যখন মঙ্গল পান্ডের হত্যা প্রচেষ্টা এবং ঈশ্বরী পান্ডের নিষ্ক্রিয়তার ফলেই কর্তৃপক্ষ ধরে নিয়েছিলেন, সমস্ত সেপাইর মনেই বিদ্রোহের চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে। মঙ্গল পান্ডে সে সময় ভাং খেয়ে নেশাগ্রস্ত ছিলো কিনা তা আলোচনা করার প্রয়াজন আছে। স্পষ্টতই দেখা যায়, সে কোনো ষড়যন্ত্র করেনি এবং অন্যান্যদের নিয়ে কোনো দল গড়েনি। তার সাথীরা তার ডাকে সাড়া দিলেও ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে তাদের মনে প্রবল বিদ্বেষ ছিলো। সে জন্য তারা নিরপেক্ষ দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। তাদের মধ্যে যে একজন সক্রিয় হয়েছিলো সেও মঙ্গল পান্ডের পক্ষ নিয়েছিলো। চর্বি মাখানো টোটা সেপাইদের মন বিষিয়ে দিয়েছিলো। তার ফলে তারা সামরিক কর্তব্যের প্রতিও নিষ্ঠা রাখতে পারেনি।

কোনো রকমের দুর্ঘটনা ছাড়াই ১৯নং রেজিমেন্টের সেপাইদের নিরস্ত্র এবং বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলো। সরকার নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন, কিন্তু কম্যান্ডিং অফিসারদের ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কেও সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন না। প্রধান সেনাপতি গভর্ণর জেনারেলের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করলেন না। আমবালা হচ্ছে তিনটি সামরিক ট্রেনিং কেন্দ্রের একটি। বিভিন্ন রেজিমেন্টের কিছু কিছু নির্বাচিত সেপাইকে নতুন রাইফেল চালনা শিক্ষা দেয়ার জন্য আনা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ছিলো কাশীরাম তেওয়ারী নামে একজন হাবিলদার। আর ছিলো জিউলাল দুবে নামে ৩৫নং রেজিমেন্টের একজন নায়েক। এই ৩৬নং রেজিমেন্টেই ছিলো প্রধান সেনাপতির অগ্রবর্তী বাহিনী।

সুবাদার কমিশনপ্রাপ্ত নয়, এমন দু’জন অফিসারকে ডাকলেন। তিনি জানালেন, তাঁরা কার্তুজ স্পর্শ করেছেন এবং সে জন্য ধর্ম থেকে পতিত হয়ে খ্রীস্টান হয়ে গেছেন। চোখের জল মুছতে মুছতে তারা ইন্ট্রাক্টর মার্টিনোর কাছে এলেন। তাঁর কাছে সবিস্তারে সবকিছু জানালেন। আপন রেজিমেন্টের একজন সুবাদার যখন তাদের ধর্ম থেকে পতিত বলে ঘোষণা করেছেন, গ্রামে যে কি রকম ভয়ঙ্কর দুর্ভোগ পোহাতে হবে সে সম্বন্ধে তাঁকে জানালেন। লেফটেনান্ট মার্টিনো বিষয়টিকে প্রধান সেনাপতির গোচরীভূত করলেন। জেনারেল এ্যানসন পরিদর্শন করে সমবেত সেপাইদের জানালেন, যে গুজব রটেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

লেফটেনান্ট মার্টিনোর মতে, তাদের ভয় অকারণে হয়নি। এতে তারা বাড়াবাড়ি করেনি। ট্রেনিং কেন্দ্রের শিক্ষার্থীরা ভদ্রভাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাদের অসুবিধার কথা নিবেদন করেছে। সুবাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করার জন্য তাড়াতাড়ি একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছে। কিন্তু কোনো অনুসন্ধান করা হয়নি। ১৬ই এপ্রিল সেপাইরা জানতে পারলো যে সুবাদার ছকু পাল সিংয়ের আচরণ অন্যায় এবং সৈনিকোচিত নয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ফরিয়াদী দু’জনকে এতো সহজে ছেড়ে দেয়া হলো না। তারা ডিপোতে সুবাদারের অসৈনিকোচিত আচরণের কথা জোর করে প্রচার করেছে, সেপাইরা মনে করতে লাগলো, আপনাপন সৈন্যদলে ফিরে যাওয়ার পর তাদের একই রকম হেনস্থা ভোগ করতে হবে। এ ধরনের আপত্তিকর কাজের জন্য সেপাইদের প্রকাশ্যে সাজা দেয়া হলো।

কম্যান্ডিং অফিসারেরা ব্যগ্রভাবে প্রমাণ করতে চাইতেন যে সেপাইরা তাদের সদাশয় প্রভুর ইচ্ছা ভুল বুঝেছে। তারা মনগড়া কতিপয় ধারণার সৃষ্টি করেছিলো। সেপাইকে অস্ত্র রাখার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলেও ইউনিফর্ম পরার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। তাদের বেতন এবং পেনশন থেকে বঞ্চিত করা হলো, কিন্তু সরকার ঘরে ফিরবার পথ খরচ দিলেন। ঘরে ফেরার পথে ইচ্ছা করলে যে কোনো মাজার, যে কোনো তীর্থস্থানে যেতে পারতো। সরকারের তাদের ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো দুরভিসন্ধি নেই। ধর্মীয় সকল আচার আচরণের স্বাধীনতা মেনে নিতে সদা প্রস্তুত। ১৯নং রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেয়ার পরে উত্তরে ভারতের শত শত গ্রামে চাকুরীহারা সেপাইরা চর্বি মাখানো কার্তুজের খবর রটিয়ে দিয়েছিলো এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় না। তেমনি করে তারা অগুণতি গ্রামীণ জনতার মধ্যেও বিদ্রোহের বীজ ছড়িয়ে দিলো। প্রকৃত ঘটনা ঘটে যাবার পরে সহজেই জ্ঞানী হওয়া যায়। সেপাইদেরকে পারস্য কিংবা চীনে পাঠিয়ে দেয়া যেতো। কিন্তু তার বিপক্ষেও যুক্তি ছিলো। সাগর পরপারে পাঠানোর জন্য দু’বার বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সাধারণ বিনিয়োগ তালিকাভূক্তিকরণ আইনের (General Service Enlistment Act) ফলে সেপাইদের মধ্যে কম আতঙ্কের সঞ্চয় হয়নি। কারণ খ্রীস্টান সরকারের শয়তানী মনোভাবের পরিচয় তারা ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছে। স্যার অবফিয়ার কেভেনাগ আবিষ্কার করেছেন, অধিকাংশ সেপাই বিশ্বাস করে সাগরের পরপারে চাকুরী করা আর অস্ত্রহীন থাকা একই কথা। সুতরাং তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেপাইদের চীনদেশে পাঠিয়ে দেয়া হোক, সেখানে তাদের প্রয়োজন ছিলো। এই পরামর্শ গ্রহণ এবং সে অনুসারে কাজ করা হলো। সরকারের সততা সম্বন্ধে যখন সেপাইদের মনে সন্দেহ জেগেছে এবং প্রত্যেক ভুলের মধ্যে ধর্মচ্যুত হওয়ার সতেজ সম্ভাবনা যখন দেখা যাচ্ছে, ততোই তারা মনে করতে থাকলো তাদের বিদ্রোহের পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

অস্ত্র হারালে যে অপমান ভোগ করতে হয়, জনমত তার চাইতেও অপমানজনক পদ্ধতির উদ্ভাবন করতে পারে। সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করার পরেও সরকার সে অপমান থেকে নিষ্কৃতি পেলো না। ১৮৫৭ সালের মার্চ মাসে প্রধান সেনাপতি সিমলা যাওয়ার পথে আমবালাতে এলেন। স্পষ্টতঃই সরকার কলকাতার নিকটে সেপাইদের বিক্ষুদ্ধ চীকারে যথেষ্ট গুরুত্বদান করেননি এবং এ সম্বন্ধে আপন রেজিমেন্টে গুজব ছড়াবার কারণে তাদের পেনশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে শেষ নয়, সেপাইদের ভয় এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কার্তুজ ব্যবহার করতে বাধ্য করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন সরকার। পরের দিন সকালেই তাদের কার্তুজ ব্যবহার করতে হলো। তারা যদি প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রধান সেনাপতির কাছে কার্তুজ ব্যবহারে তাদের ভয়ের কারণ নিবেদন করতো তাহলে প্রধান সেনাপতি তাদের রাজভক্তিতে সন্তুষ্ট হতেন, কিন্তু ভয়কে আমলই দিতেন না। সেপাইদের দোষ দেয়া যায় না, কারণ ধর্ম এবং মনিবের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে বাধ্য করা হয়েছিলো।

সরকার যখন ড্রিলের পদ্ধতি এভাবে বদলালেন যে দাঁতে কার্তুজ কেটে বন্দুক ভর্তি করা অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়লো, তখন প্রধান সেনাপতির এরকম নির্দেশ সত্য সত্যই আপত্তিকর। মীরাটের লেফটেনান্ট কর্নেল হুগ উল্লেখ করেছেন ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে, কার্তুজের পেছনটা ছিঁড়ে ফেলা হলে দাঁতে কামড়ানো বন্ধ করা যেতো। অন্যান্য অফিসারেরাও তা সমর্থন করেছেন। এ ব্যাপারে গভর্ণর জেনারেল প্রধান সেনাপতির কাছে লিখেছিলেন এবং তার জবাব দেবার পূর্বেই দমদমে বন্দুকে টোটা ভর্তি করা বন্ধ করতে নির্দেশ দান করলেন। ৫ই মার্চ সরকার দাঁতে কামড়িয়ে টোটা ভর্তি করা বন্ধ করতে নির্দেশ দিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, সেপাইদের কাছ থেকে এই নির্দেশটি গোপন রাখা হয়। মে মাসের পয়লা দিকে লখনৌতে বিপদের লক্ষণ দেখা গেলো। আমবালার ঘটনার খবর সে সময়ে অয্যোধ্যায় এসে পৌঁছেছিলো কিনা সে বিষয়ে কিছু জানার উপায় নেই। অফিসারদের আপত্তি সত্ত্বেও সেপাইরা কার্তুজ সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করলো এবং দাঁতে কামড়াতে অস্বীকৃতি জানালো। দু’মাস আগে কার্তুজের প্রচলন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, অথচ তাদের দাঁতে কেটে কেনো বন্দুকে পুরতে হবে তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। কোম্পানীর সেপাইদের সঙ্গে অযোধ্যার সেপাইদের পরিচয় খুবই সাম্প্রতিক। স্যার হেনরী লরেন্সের মতো সুবিবেচক চীফ কমিশনার, যিনি ভারতবর্ষ এবং ভারতবাসীকে ভালো করে চেনেন, তাঁর শাসনের সময়েও এমন বিক্ষোভের প্রবল হাওয়া ছড়িয়ে পড়তে পারলো। তা-ই সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়। এখানে উল্লেখ্য যে অযোধ্যার ৭নং অনিয়মিত পদাতিক বাহিনী কার্তুজ নিতে গররাজি হলো না, কিন্তু দাঁত দিয়ে কাটতে অস্বীকার করলো। মার্চের ৩ তারিখে স্যার হেনরী লরেন্সের কাছে খবর দেয়া হলো অযোধ্যার ৭নং অনিয়মিত বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে খুন-খারাবীর নেশায় মেতে উঠেছে। তিনি তাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। গুলিভর্তি বন্দুকের সামনে থেকে বিদ্রোহীরা পলায়ন করলো। এক’শ বিশজন সেপাই মাটিতে অস্ত্র রেখে দিলো। সরকার বিদ্রোহীদের রুটিন মাফিক শাস্তি দিতে মনস্থ করলেন।

মে মাসের ৪ তারিখে ব্যারাকপুরের মঙ্গল পান্ডের রেজিমেন্টকে ভেঙ্গে দেয়া হয়। সেপাইদের কাছ থেকে ইউনিফর্ম কেড়ে নেয়া হলো। এ খবর সমস্ত ঘাঁটিগুলোতে পড়ে শোনানো হলো। তাদের সমপেশার অন্যান্য সেপাইরা শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের নিন্দা করার বদলে বীরের সম্মান দেবে এ কথা কর্তৃপক্ষ ভাবতেও পারেনি। এ সেপাইরাও ধর্মের কারণে পার্থিব সমস্ত কিছুর মায়া মোহ পরিত্যাগ করেছিলো। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, ধর্মপ্রচারক কর্ণেল এস. জি. হুইলার ছিলেন ৩৪নং রেজিমেন্টের কম্যান্ডার।

১৮৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম সরকারকে অস্ত্রের সাহায্যে উৎখাত করার জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। সরকার যদি শান্তিপূর্ণ উপায়ে সেপাইদের বিক্ষোভ প্রশমিত করার চেষ্টা করতো তাহলে জল্পনা কল্পনার প্রয়োজন হতো না। সম্মানবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে কোনো বিদেশী সরকার কর্তৃত্ব বিস্তার করতে পারে না। তা হলে তার শক্তির মূল উৎসেই আঘাত আসবে। অনেক অফিসার সত্তাবে বিশ্বাস করেছিলেন যে সেপাইদের দাবির সামনে শৈথিল্য প্রদর্শন করা উচিত হবে না। কারণ এ ধরণের শৈথিল্য দুর্বলতারই পরিচয় দিয়ে থাকে। অবিশ্বাসী সেপাইদের জেনারেল হীয়ার্সে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে সেপাই এবং দেশীয় অফিসারদের চর্বি সম্বন্ধে কথা বলার জন্য শাস্তিও দান করা হলো। ১৯নং রেজিমেন্টে যেমনটি ঘটেছে, তেমনি সম্পূর্ণভাবে রেজিমেন্টের বিলুপ্তিকরণ সৈন্যদের আতংক কমানোর চাইতে বরঞ্চ বহুল পরিমাণে বাড়িয়েই দিয়েছিলো। আমবালার ব্যাপারে প্রধান সেনাপতি খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুবিবেচনাকে তো তিনি জলাঞ্জলি দিয়েছেন বরঞ্চ ন্যায় নীতির খেলাফ করেছেন। সেপাইরা বুঝে নিলো তাদের অসুবিধার সময়ে তারা উধ্বতন অফিসারদের কোনো সহানুভূতি পাবে না। যদিও ব্যক্তিগতভাবে হুগ মার্টিনো এবং বন্টেনের মতো অফিসারেরা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। যদি মনে করে থাকে সরকার তাদেরকে দিয়ে জোর করে কার্তুজ ব্যবহার করাতে চায় তা হলে মোটেও অন্যায় করেনি। আরো দুঃখজনক হলো, অবিবেচক অফিসারেরা আপন ইচ্ছামতো কাজ করেছে এবং স্যার হেনরী লরেন্স মে মাসের প্রথম দিকে সম্ভবতঃ তাঁর অতি উৎসাহী সহকর্মীদের দ্বারা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আগের মাসে শৃঙ্খলার একনিষ্ঠ রক্ষাকর্তারা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তার ফলশ্রুতিস্বরূপ ১০ই মে তারিখে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়।

মীরাটের ৩নং দেশীয় অশ্বারোহী বাহিনী পরিচালনা করতেন কারমাইকেল স্মিথ। তিনি ছিলেন আত্মমতসর্বস্ব এবং গোঁয়ার মানুষ। অধীনস্থ সেপাইরা তাকে পছন্দ করতো না। যে সকল ঘটনা ঘটে গেছে তার প্রেক্ষিতে বিচার করলে তাকে কিছুতেই সাহসী বলা যায় না। ৩১মে তারিখে স্থিরীকৃত উপমহাদেশ জুড়ে বিদ্রোহের পরিকল্পনা বানচাল করে তিনি উপমহাদেশকে রক্ষা করেছেন বলে দাবি করা হয়েছে। তিনি যদি সে রকম ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেন, তাহলেও তিনি সমপেশার কম্যান্ডিং অফিসারকে তা জানাননি। ২৩শে এপ্রিল তারিখে তিনি নির্দেশ দিলেন, পরের দিন সকালে এক প্যারেড অনুষ্ঠিত হবে। তাতে সমস্ত রেজিমেন্ট নয়, বিভিন্ন বাহিনীর মাত্র নব্বই জন সেপাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে। উদ্দেশ্য প্রশংসনীয় ছিলো। কর্ণেল তার অধীনস্থ সেপাইদের দেখাতে চাচ্ছিলেন কিভাবে দাঁতে না কামড়ে হাত দিয়ে বন্দুক কার্তুজ প্রবিষ্ট করাতে হয়। এর আগে সেপাইদের নতুন অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। সুতরাং কোনো রকমের কোনো ভয়ের কারণ ছিলো না। অধিকন্তু তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুরাই চর্বি মাখানো কার্তুজকে ভয় করে মুসলমানদের মধ্যে সে রকম কোনো সংস্কার নেই। বিলুপ্তকৃত ১৯নং রেজিমেন্টের মধ্যে হিন্দুরা ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং স্মিথের অশ্বারোহীদের মধ্যে মুসলমানরাই সংখ্যায় অধিক। যে কার্তুজ নিয়ে ঘাঁটিতে এতো ঝড় বৃষ্টি হয়ে গেছে, নির্দোষ এবং ক্ষতিকর না হলে এর পরীক্ষা করার কি প্রয়োজন আছে, কোনো কোনো সেপাইয়ের মনে এ প্রশ্ন উদিত হলো। ব্রজমোহন নামে একজন সেপাইকে কার্তুজ ব্যবহারের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিলো। তার নৈতিকতা বলতে কিছুই ছিলো না। নীচ জাতীয় এ লোকটা পয়লা পদাতিক বাহিনীতে ভর্তি হয়। চুরি করার অপরাধে সেখান থেকে বহিষ্কৃত হয় এবং নাম ভাড়িয়ে পরে অশ্বারোহী বাহিনীতে ভর্তি হয়। সে দিনের বেশিরভাগ সময় কর্ণেল স্মিথের বাসাতেই কাটাতো এভং কার্তুজ পরীক্ষা করাবার জন্য নিজে কর্ণেলকে প্ররোচিত করে। সে আবার সেপাইদের কাছে এসে নিজের দোষ খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে এবং জানায় যে, সে যা করছে, সকলকে তা-ই করতে হবে বাধ্যগতভাবে। তখন অশ্বারোহীরা কঠিন শপথ নিলো, সেনাবাহিনীর সমস্ত সেপাইরা যতো দিন বিরত থাকবে, ততোদিন তারা ঐ অপবিত্র কার্তুজ স্পর্শও করবে না।

এ খবর কর্ণেল জানতেন না। প্যারেড বন্ধ করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। কারণ তিনি শুনেছেন যে সেপাইরা বিদ্রোহ করতে যাচ্ছে। মীরাটে কোনো বিদ্রোহের সম্ভাবনা ছিলো না। কারণ অল্প যে ক’টি সামরিক ঘাঁটিতে সশস্ত্র ইউরোপীয়রা অধিক সংখ্যায় ছিলো, তার মধ্যে মীরাট অন্যতম। সুতরাং কর্ণেল মনে করলেন, ভীত হয়ে প্যারেড বন্ধ করলে কাপুরুষতার পরিচয় দেয়া হবে। আবার, তিনি প্রধান নির্দেশনা পরিষদকে একটি অ্যুত্থানের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে কোন পূর্বাভাষ দান করেননি। শুধুমাত্র নব্বইজন সেপাই প্যারেড করতে এলো সকালে। নতুন নির্দেশকে তারা কিভাবে বুঝেছে, কর্ণেল সে কথা বুঝিয়ে দিলেন। তাঁর ব্যাখ্যাতে কোন কাজ হলো না। একটি অনুসন্ধান কমিটি নিয়োগ করা হলো, তারা দেখতে পেলেন, অশ্বারোহীদের ভীতিই তাদের বিরূপ মনোভাবের কারণ। প্রধান সেনাপতি আদেশ দিলেন, স্বদেশীয়দের দ্বারা পরিচালিত কোর্ট মার্শালে অপরাধীদের বিচার করা হবে। অপরাধীদের মধ্যে অভিজাত যারা তাদেরকে দিয়ে বিচার করানো ছাড়া ব্রিটিশ আইনে আর কোন ভালো ব্যবস্থা ছিলো না। কিন্তু দেশীয়দের দৃষ্টিতে সেপাইদের দ্বারা পরিচালিত কোর্ট মার্শালের মধ্যে দুর্নীতির অন্ত ছিলো না। তারা ধরে নিলো যে স্বদেশীয় কোর্ট মার্শালের কর্মকর্তারা আপন আপন রেজিমেন্টের কর্মকর্তাদের সন্তুষ্ট করবে কিন্তু তারা এ সম্বন্ধে মন খুলে কিছু বললো না। জেনারেল হাফগাফ তখন মীরাটে ছিলেন, তিনি বলেছেন, “পরিদর্শনকারী অফিসার বলে একজন ইউরোপীয় অফিসার সাহায্য করার জন্য স্বদেশীয়দের দ্বারা পরিচালিত মার্শাল কোর্টে ছিলেন। তাঁর উপদেশ এবং আইন সম্পর্কে পরামর্শ সম্ভবত তাদের মতামতকে প্রভাবিত করেছিলো।” কয়েদীরা আত্মপক্ষ সমর্থন করলো না, সাক্ষীদের কোনো জেরা করা হলো না, যদিও একইভাবে উচ্চস্বরে মেলভিল ক্লার্কের কাছে তারা নির্জলা মিথ্যা কথা বললেন। কোর্টের সকলে একমত হতে পারেননি। বিচারকদের পনেরো জনের মধ্যে একজনকে সেপাইদের দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দান করার বিপক্ষে রায় দিতে দেখা যায়। অবশ্য রায়ে এ সুপারিশ করা হয়েছিলো যেহেতু সেপাইদের পূর্ববর্তী রেকর্ড ভালো এবং ভিত্তিহীন গুজব তাদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে, সে জন্য তাদের বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। বিভাগীয় কম্যান্ডার জেনারেল হিওইট ছিলেন সাদাসিধা মানুষ, বয়সের কথা বিবেচনা করে ১১ জন ছাড়া অন্যান্যদের কারাবাসের মেয়াদ কমানোর কোনো কারণ তিনি খুঁজে পাননি।

হোমস্ বলেছেন, ৮ই মে তারিখের সকালবেলা মেঘাচ্ছন্ন এবং এলোমেলো প্রবল ঝড়ো হাওয়া আক্রান্ত অবস্থায় ব্রিগেডের সমস্ত মানুষ সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীদের দেখতে এলো। তাদের ইউনিফর্ম ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, কামার এনে তাদের হাতে পায়ে লোহার বেড়ি পরানো হয়েছে। কামারেরা আস্তে আস্তে এক ঘন্টারও অধিককাল সময় বেড়ি পরাতে ব্যয় করলো এবং সেপাইরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাথীদের এ শোচনীয় দুর্দশা দেখলো। বিচারে তারা অপরাধী হতে পারে কিন্তু তারা এ পর্যন্ত কোনো ক্ষতিকর কাজ অথবা ওজাতীয় কিছু করেনি। জেনারেল গাফ বলেন, “তাদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক বিশিষ্ট লোক ছিলো।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের রেজিমেন্টের সৈন্যদের মধ্যে ব্রিটিশ অফিসারদের উপস্থিতিতেই বেশ শোরগোল উঠে। ব্রিটিশ অফিসাররা না থাকলে কি ঘটতে তা বলা যায় না। কিন্তু কোনো কিছুই ঘটলো না। শান্তভাবে প্যারেড শেষ হলো। কোনো কোনো সেপাইকে বিষণ্ণ দেখালেও কোনো রকমের বিক্ষোভ কিংবা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়নি। শেষ পর্যন্ত কয়েদীরা যখন দেখলো তাদের সবকিছুই হারাতে হচ্ছে… তখন তারা একেবারে অধৈর্য হয়ে উঠলো। বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগলো।” জেনারেল গাফ বলেন, “এ বুড়ো সেপাইরা বহু সংগ্রামে ইংরেজ প্রভুদের জন্য বেপরোয়া সংগ্রাম করেছে, ইংরেজদের জন্য বিজয় ছিনিয়ে এনেছে, তাদের ভবিষ্যত করেছে উজ্জ্বল। তরুণেরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সমস্ত জীবনে আমি এরকম মর্মান্তিক দৃশ্য কোনদিন দেখিনি। আমি হচ্ছি চার বছরের চাকুরীর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক তরুণ সৈনিক। আমার মনে হয়, তাদের দুঃখে সমবেদনা জানাবার ক্ষমতা আমার নেই। এ সকল ঘটনা ঘটতে পারে, আমরা কিংবা তারা কেউ কখনো ধারণা করতে পারেনি।

গ্রীষ্মের সুদীর্ঘ দিনের অবসান হয়ে এলো। কোন বিশৃঙ্খলার চিহ্নমাত্রও নেই। সে রাতে নতুন করে কোনো অগ্নি সংযোগ করা হয়নি। সকালেও সেপাইরা শান্ত ছিলো। এর বিরুদ্ধে কোনো আপীল সম্ভবপর কিনা জানার জন্য কেউ কেউ আইনজীবীর কাছে ছোটাছুটি করলো। গাফের বাহিনীর একজন দেশীয় অফিসার তাঁকে সন্ধ্যাবেলা জানালো যে পরদিন সেপাইরা বিদ্রোহ করবে। কিন্তু কর্ণেল মাইকেল স্মীথ খবরটাকে অবজ্ঞা করে উড়িয়ে তো দিলেনই, তদুপরি অলস গুজবে কান দেয়ার জন্য তিরস্কার করলেন। একইভাবে ব্রিগেডিয়ার উইলসনও বিশ্বাস স্থাপন করলেন না। অন্যান্য দিনের মতো সেপাইরা বাজারে তাদের আড্ডার জায়গায় গিয়ে জমায়েত হলো। লোহার বেড়ি পরানো কয়েদীদেরকে সিভিল জেলে ঢুকানো হলো। কোথাও আসন্ন ঝড়ের কোনো রকম পূর্বাভাস নেই। কিন্তু গুজবের শেষ নেই।

একজন দাসী একটি কাশ্মিরী মেয়ে অথবা তার মায়ের কাছে শুনেছে যে সেপাইরা একটি সশস্ত্র বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করেছে। সেপাইরা শুনলো, দু’হাজার বেড়ি নাকি তৈরি হয়ে গিয়েছে। তা সমস্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ভেঙ্গে দেবার জন্যই করা হয়েছে। নাগরিকেরা এসব কথায় কান দিলো না। প্রতিদিনের মতো দোকানগুলো ভোলা হলো, ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকমতো চলতে লাগলো এবং শহরে রাস্তা এবং গলিতে লোকজন চলাফেরা করেছিলো ঠিক আগের মতোই।

হঠাৎ বেলা পাঁচটার পরে ভেঙ্গে পড়লো ঝড়। একটি পাঁচক বালক সেপাই লাইনে দৌড়ে গিয়ে খবর জানালো যে গোলন্দাজ এবং রাইফেল বাহিনী রেজিমেন্টের অস্ত্রাগার দখল করার জন্যে ধাওয়া করছে। এ সংবাদ শুনে সেপাইরা হতচকিত হয়ে গেলো। কাপড়চোপড় না পরে নিরস্ত্র অবস্থায় কি করতে হবে স্থির করতে না পেরে আপন আপন লাইনের দিকে ছুটতে শুরু করলো। ৩নং অশ্বারোহী বাহিনীর লোকেরা পুরানো জেলখানায় দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পুরোনো সাথীদের মুক্ত করে আনলো। ২০নং রেজিমেন্টে প্যারেড ময়দানে এসে সাবধানী ঘন্টা বাজিয়ে দিলো। ১১নং রেজিমেন্টও সমানভবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়েছে, তবে তারা অতোটা বিশৃখল নয়। দোকানদারেরা তাড়াতাড়ি তাদের দোকানের দরোজা জানালা বন্ধ করে ফেললো। বাজারের চোর-গুণ্ডারা একটা সুযোগ পেয়ে গেলো।

চার ঘণ্টা অতীত হবার পর পাশের গ্রামের দুর্ধর্ষ গুর্জরেরা গোলমালের খবর আঁচ করতে পেরে দলে দলে শহরে এসে পড়লো। সাহসী কর্ণেল মাইকেল স্মীথ প্রায়শঃ অনুপস্থিত থাকতেন। তার অধীনস্থদের হাতে দায়িত্ব অর্পন করে তিনি তাড়াতাড়ি কমিশনার, পরে ব্রিগেডিয়ার এবং তার পরে প্রধান কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করে গোলন্দাজ বাহিনীর পাহারায় ক্যান্টনমেন্ট রাত্রি যাপন করলেন। গোলন্দাজ বাহিনীতে সাহসী অফিসারের অভাব ছিলো না। মেজর টমর এ বাহিনী পরিচালনা করছিলেন। পরে তিনি দিল্লীর প্রাচীরের সামনে যথার্থ বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তাছাড়া ছিলেন তরুণ গাফ, যিনি হডসনের অভিযানে অংশগ্রহণ করে ভিক্টোরিয়া ক্রস পেয়েছিলেন। আরো ছিলেন জন, যিনি দিল্লীতে একটি অগ্রবর্তী বাহিনীর পরিচালনায় ছিলেন। বিগ্রেডিয়ার আর্কডেল উইলসন দৃঢ় সিদ্ধান্তের মানুষ না হলেও দিল্লী দখলে তিনি সাফল্য অর্জন করেছিলেন।

প্রধান কম্যাণ্ডার জেনারেল হিওইট এ সময়ে যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেননি। সত্তর বছর বয়স্ক এ বৃদ্ধ নিজের বয়সের ভারেই কাবু হয়ে পড়েছিলেন। এ ছাড়া তাঁর নিজস্ব অসুবিধা ছিলো। তার অধীনস্থ সেপাইরা অনেকেই ঘোড়ার পিঠে চাপতে জানত না, যারা জানতো তাদের ঘোড়া ছিলো না। আক্রমণকারীরা অনেকে আগেই অস্ত্রশস্ত্র দখল করে ফেলেছে। কিন্তু কোথায় শত্রুর সন্ধান করতে হবে তাদের কেউ জানতো না। কারণ সেপাইদের কোনো পূর্বনিধারিত পরিকল্পনা ছিলো না। প্রত্যেক দল আপন অভিরুচি অনুসারেই ধাওয়া করলো। পরিস্থিতি এখনো আয়ত্বের বাইরে চলে যায়নি। অল্প চেষ্টা এবং উদ্যম ব্যয় করলে অবস্থাকে বশে আনা যায়। জেনারেল হিওইটকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কিন্থালে নাসিরী রেজিমেন্টের বিদ্রোহ করার সময়ে জেনারেল পেনী এবং তার সহ-অফিসারেরা এবং সে অশুভ রোববারে কলকাতার ইংরেজরাও সাহসের পরিচয় দিতে পারেননি।

পাঁচক বালকেরা চীঙ্কারে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু তার আরো একটি দিক আছে। তখন রাইফেল বাহিনী গীর্জার প্যারেডের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তাদের আচরণে প্রাথমিক গুজবের কিছুটা সত্যতা পরিলক্ষিত হয়। নরমপন্থীরা উকিলের পরামর্শ নিতে গিয়েছিলো যখন, তখন চরমপন্থীরা কারাগার ভেঙ্গে ফেলে সাথীদের সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে মুক্ত করার জন্য তোড়জোড় করেছিলো। এ সংশয় বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎ তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কারাগারের ফটক ভেঙ্গে ফেলতে লেগে গেলো। তার নিজেদের লোকদেরকে শুধু মুক্ত করতে চেয়েছিলো; নাকি সমস্ত কয়েদীদের মুক্তি দিতে ইচ্ছে করেছিলো তা জানা যায় না। কারাগারের ডিউটিরত প্রহরী তাদেরকে কোন বাধা দেয়নি। তারা কারাধ্যক্ষ এবং তার পরিবারের ওপর অত্যাচার করেনি। কিন্তু পরবর্তীকালে নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ সবকিছু যে তারা করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রচুর। ভয়ের কারণে সেপাইরা উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলো, কিন্তু তাদের দিয়ে খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি সংসাধিত হয়নি। প্রকৃতপ্রস্তাবে, যারা ডিউটি করেছিলো, তারা ঘাঁটিতেই ছিলো। তৃতীয় অশ্বারোহী বাহিনীর একজন বাজারে এসে ম্যাক কার্টনি, ম্যাক অলরয় এবং ম্যাক কেওকে পালিয়ে যেতে অনুরোধ করলো। একজন ইউরোপীয় মেডিকল অফিসারকে একজন ১১নং রেজিমেন্টের হাবিলদার মেজর সতর্ক করে কর্ণেল ফিনিশের মৃত্যু এবং বিদ্রোহের খবর জানিয়েছিলো। একজন রাজভক্ত ননকমিশণ্ড অশ্বারোহী ঘোড়ায় চেপে কর্ণেল গাফের বাঙলোয় এসে ব্যক্তিগতভাবে পুরুষ এবং ভদ্রমহিলাদের বিদ্রোহের খবর জানিয়েছিলো। ভদ্রমহিলারা অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে সে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ দিনের ঘটনা লিখে রেখে গেছেন। কিন্তু তা সম্পূর্ণ নয়। পরদিন জেনারেল হিওইট যে সরকারি রিপোর্ট লিখেছেন, তাও সম্পূর্ণ নয়। একেকটা হিংস্র আক্রমণের পরে আরেকটা আক্রমণ এবং নৃশংসতা ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত হয়েছিলো কিনা তা আমরা জানতে পারি না। কোনো রেজিমেন্টকে সম্পূর্ণভাবে দোষযুক্ত বলা যায় না-আবার রেজিমেন্টের অনুগত সেপাইও ছিলো। ৩নং অশ্বারোহী বাহিনীর ভূমিকাই সবচেয়ে দুঃখজনক। এক’শ অশ্বারোহী বাহিনীর ভূমিকাই সবচেয়ে দুঃখজনক। এক’শ অশ্বারোহী সৈনিক স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো। ১১নং রেজিমেন্টের ক্ষতি সবচেয়ে কম, বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পরেই তারা শান্তভাবে প্রস্থান করেছে এবং তাদের মধ্যে থেকে একশো বিশজন পরে মীরাটে ফিরে এসেছিলো। এমনকি দুর্ধর্ষ ২০নং রেজিমেন্টেও কিছু অনুগত সেপাই ছিলো। যারা বেশিরভাগ সেপাইদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলো, তার অনুগত সেপাইদের মতামত গ্রাহ্য করেনি। একজন নকমিশণ্ড দেশীয় অফিসার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটিশ মনিবদের পক্ষই সমর্থন করেছিলো। ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উর্ধ্বে রেজিমেন্টের প্রতি আনুগত্যকে স্থান দিয়েছিলো। সে এবং তার রেজিমেন্টের অন্য দু’জন সেপাই নিরাপদে লেফটেন্যান্ট গাফকে গোলন্দাজ বাহিনীতে পৌঁছে দিয়ে মৃত্যুকে পরোয়া না করে রেজিমেন্টে ফিরে এসেছিলো।

৩নং অশ্বারোহী দল পুরোনো কারাগার ভাঙতে যাওয়ার পরে ২০নং রেজিমেন্ট এবং ১১নং রেজিমেন্ট প্যারেড ময়দানে গিয়ে জমায়েত হলো। তাদের কম্যান্ডার কর্ণেল ফিনিস তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে চেষ্টা করলেন। প্রথম দিকে তিনি কিছু সাফল্যও লাভ করেছিলেন। এমনকি ২০নং রেজিমেন্টও তার নির্দেশ মানার কথা চিন্তা করেছিলো। এ সময়ে ৩নং অশ্বারোহী বাহিনীর একন অশ্বারোহী ঘোড়ায় চেপে এসে সংবাদ দিয়ে গেলো ইউরোপীয়রা আসছে। একজন তরুণ সেপাই গুলি করে কর্ণেল ফিনিসকে হত্যা করলো। কম্যান্ডারকে হত্যা করার পর ১১নং রেজিমেন্টের দোদুল্যমানতা ঘুচে গেলো ২০নং রেজিমেন্ট সত্যি সত্যি বিদ্রোহীরা আক্রমণ শুরু করে দিয়েছিলো। কিন্তু তারা ভয় করছিলো কর্ণেল ফিনিসের মৃত্যুর পর সেপাইদের সঙ্গে যোগ দেয়াটাই যুক্তিযুক্ত মনে করলো। ১১নং কিংবা ২০নং রেজিমেন্ট তাদের নিজেদের অফিসারদের কোনো ক্ষতি করেনি। কর্ণেল গাফ বলেন, আমাদের নিজেদের অধীনস্থ সেপাইরা একজন অফসারকেও হত্যা করেনি। ওয়াজির আলী খান নামে একজন ডেপুটি কালেক্টর বলেছেন যদিও রাতভর লুঠতরাজ চলছিলো, সেপাইরা কিন্তু একটা জিনিসও স্পর্শ করেনি। তারা শুধু বাঙলোতে আগুন লাগিয়েছিলো এবং ইউরোপীয়দের হত্যা করেছিলো-সদরে এবং শহরে এ খবরই প্রচারিত হয়েছিলো। এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয়, সেপাইরা নিরস্ত্র মানুষের ওপর আক্রমণকারী লুঠেরাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেছে।

বস্তী অঞ্চল এবং ফটক মুক্ত কারাগার থেকে দুর্ধর্ষ অপরাধীরা বেরিয়ে এসেছিলো। শহরের পুলিশেরাও তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলো। ক্ষমতাসীন কোতোয়াল ধনা সিং ছিলো জাতে গুর্জর এবং গুর্জরেরা নিকটবর্তী বস্তী অঞ্চলের অধিবাসী ছিলো। সঙ্কটকালে ধনা সিংয়ের কোন কর্তৃত্ব ছিলো না, তাদের উপর। নিরীহ নাগরিকদের অর্থ তারা লুণ্ঠন করলো, নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করলো। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হলো। এবং কৈলাশ চন্দ্র ঘোষ নামে বাঙালির শুড়িখানা আক্রান্ত হলো। মিঃ ক্রেইগীর বাঙলোতে একা ছিলেন মিসেস চেম্বার্স। সামরিক ঘটিতে তিনি এসেছেন নতুন। তাঁর স্বামী ডিউটি করতে বাইরে গেছেন। তিনি ছিলেন পরিণত অন্তঃসত্ত্বা। অনুগত অশ্বারোহীরা মিঃ ক্রেইগীর বাঙলো পাহারা দিচ্ছিলো। মিসেস চেম্বার্স প্রতিবেশীর কথা ভুলে যাননি। তিনি চাকরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু দুষ্কৃতিকারীদের একজন চাকরকে জবাই করে ফেললো। সে ছিলো একজন সেপাই, পরে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। তারপর মিসেস চেম্বার্সকে হত্যা করা হলো। মিসেস চেম্বার্সের নৃশংস হত্যাই ইউরোপীয়দের প্রচণ্ড প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলেছিলো এবং তারা সর্বত্র সেপাইদেরকে এর জন্য দায়ী করছিলো।

বিদ্রোহের ফলে প্রহরীরা ঘাটি ছেড়ে দিয়েছিলো। লেফটেন্যান্ট গাফ ডিউটিতে যাওয়ার জন্য পোশাক পরছিলেন, দু’জন সামরিক যাজক গীর্জাতে গেছে। মিঃ ম্যাকেঞ্জী তাঁর বাঙলোতে নীরবে একটা বই পড়ছিলেন। মিসেস ম্যাকেঞ্জী এবং মিসেস ক্রেইগী সান্ধ্যভ্রমণে বের হচ্ছিলেন। এ সময়েই সেপাই লাইনে হল্লা শুরু হয়। তাড়াতাড়ি গাফ ঘোড়ায় চেপে সেপাই লাইনে না গিয়ে ২০নং রেজিমেন্টের পাশ দিয়ে প্যারেড ময়দানে এলেন। দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক লোমহর্ষক দৃশ্য আমার মনে গেঁথে গেলো-বলেছেন গাফ। কুটিরগুলোতে আগুন দাউ দাউ জ্বলছে। সশস্ত্র সেপাইরা পরস্পরকে ডাকাডাকি করে দানবীয় অট্টহাস্যে নর্তন-কুর্দন করছিলো। বন্য উন্মত্ত ক্ষিপ্ত কাঁপালিকের মতো অফিসারদের এবং সাধারণত: ইউরোপীয়দের রক্তের তৃষ্ণায় তারা পাগল হয়ে উঠেছে। তিনি কোনোরকমে তাঁর আপন অধীনস্থ সেপাইদের মধ্যে চলে এলেন। তাঁর জীবনের উপর কোনো হামলা করা হয়নি এবং তাঁর উপস্থিতির কোনো গুরুত্বই তারা দিলেন না। সবকিছু এলোমেলো বিশৃঙ্খল। আসবার পথে তিনি গ্রেটহেডদেরকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন তারা পালিয়ে গেছেন এবং তাঁদের বিশ্বস্ত চাকরটি তাঁকে পালাবার পথ প্রদর্শন করলো। ম্যাকেঞ্জীও নিজেকে অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত করে সাহসের সঙ্গে ঘোড়ায় চেপে সেপাই লাইনের দিকে ছুটলেন। তিনি পথে অগণিত অশ্বারোহী সেপাই দেখতে পেলেন এবং পরে ঘটনাক্রমে ক্যাপ্টেন ক্রেইগীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সেপাইরা তাকে কয়েকটি কোপ দিতে চেষ্টা করে অন্যদিকে ধাওয়া করলো। তারা বুঝতে পারলো তাদের স্থান হচ্ছে প্যারেড ময়দান। দু’জন ব্রিটিশ অফিসার প্যারেড ময়দানে গেলেন। রেজিমেন্টের প্রায় প্রতিটি অফিসারই প্যারেড ময়দানে এসেছিলেন, শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বপ্রকার চেষ্টা করলেন। এমনকি ভয়ও দেখালেন। তাতে কোনোও ফলোদয় হলো না। সেপাইদের ধন্যবাদ তারা অফিসারদেরকে আক্রমণ করেনি এবং ফিরে যেতে বলেছে এবং বলেছে চীৎকার করে কোম্পানীর রাজত্বের শেষ হয়েছে। ক্রেইগী দেখলেন, কিছু সংখ্যক সেপাই বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিতে সংশয় এবং দ্বিধাবোধ করেছে। তিনি সাহস করে তাঁদের আপন ভাষায় তাঁদের নির্দেশ দিলেন। এতে কাজ হলো, চল্লিশজন সেপাই তার চারপাশে এসে জড়ো হলো। তাদের নিয়ে তিনি পুরোনো জেলখানার দিকে ছুটলেন। কিন্তু তারা অনেক দেরী করে ফেলেছেন। কয়েদীরা বেরিয়ে এসেছে এবং প্রহরীরাও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এ সময়ে সমস্ত ক্যান্টনমেন্টে আগুন লাগানো হয়ে গেছে। ক্রেইগী এবং ক্লেয়ার্ক অনুগত সেপাইদের নিয়ে প্যারেড ময়দানে এলেন। ক্ষুদ্র একটি দেহরক্ষী দল কর্তৃক পরিবেষ্টিত হয়ে তার বোন এবং ম্যাকেঞ্জীর স্ত্রীর খবর নেয়ার জন্য দ্রুতবেগে ছুটলেন। কোচম্যানের সাহস এবং উপস্থিত বুদ্ধিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তারা বাঙলোয় এসে পৌঁছলেন। চারদিকে মৃত্যু এবং আগুনের তাণ্ডবলীলা চলেছে। তখন ম্যাকেঞ্জী তাঁর সেপাইদের কাছে সম্মান রক্ষার আবেদন করলেন। আমি অসমসাহসিক কাজ করার জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছিলাম। আমি মহিলাদের ঘরের দরোজার কাছে নিয়ে এলাম। সঙ্গে সঙ্গে সেপাইরা অশ্ব থেকে অবতরণ করে মহিলাদের পায়ে হাত দিয়ে অশ্রুসিক্ত স্বরে প্রাণপণে তাঁদের রক্ষা করবেন বলে শপথ করলেন।

সেপাইরা মীরাটে বেশিকাল ছিলো না। থাকলে তারা বোকামীর পরিচয় দিতো। তাদের বিরুদ্ধে পনেরো’শ সশস্ত্র ইউরোপীয়ান সৈন্য মোতায়েন ছিলো এবং সেপাইদের সংগ্রাম ক্ষমতা সম্পর্কে কোন নিশ্চিত ধারণা ছিলো না। কারণ তাদের মধ্যে সংশয়াচ্ছন্ন এবং দোদুল্যমান মানুষের অভাব নেই, এটা তারা বেশ ভালোভাবেই জানতো। তা সত্ত্বেও তারা কি করবে, কোথায় যাবে সে সম্বন্ধেও তাদের কোন ধারণা ছিলো না। কেউ কেউ সদলবলে তাদের রোহিলাখণ্ডে যেতে এবং অন্য কেউ কেউ মাত্র চল্লিশ মাইল দূরের নগরীতে যেতে পরামর্শ দিলেন। নিরাপত্তার আশায় তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লো। তাদের লাইন জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করা হয়েছে। খাদ্য এবং আশ্রয়ের কোন রকম ব্যবস্থা ছাড়াই নারী এবং শিশুদের ফেলে যেতে হলো। কেউ হাপুরের পথ ধরলো, কেউ ভাগপতের দিকে এগুতে থাকলো। আবার অন্যান্যরা গুরগাঁওয়ের আশে পাশে কয়েকদিন অবস্থান করলো। সেপাইদের বেশিরভাগই দিল্লী অভিমুখে পথ দিলো।

সকাল হবার সঙ্গে সঙ্গেই উচ্ছখল জনতা চলে গেলো। মিসেস প্রীথিড় লিখেছেন, দিনের আলোতে দেখলাম, একরাতের মধ্যে সবকিছু কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। আমাদের প্রফুল্লিত সুখের নীড় কৃষ্ণবর্ণ অঙ্গারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সরকারের শোক প্রকাশ করার জন্য অনেক ক্ষয়ক্ষতি অপেক্ষা করছিলো। রেভারেন্ড টি. মি. স্মীথ বলেছেন, এ পর্যন্ত আমি এবং মি: রটন ৩১ জন নিহতকে কবরস্থ করেছি। এখনো ১১নং রেজিমেন্টের নিহতদের আনা হয়নি। তিনি বলেছেন ১১নং কে সম্পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, নিহতদের পরিমাণও অনেক। তবে মহিলা এবং শিশুদের রক্ষা করা হয়েছিলো, এ কথাও তিনি বলেছেন।

১০ তারিখের রাতে অনেক ভয়াবহ এবং নিষ্ঠুর কার্য সংসাধিত হয়েছিলো, এ কথা সত্য। কিন্তু সাহস এবং করুণার মহৎ দৃষ্টান্তও আছে। কমিশনারের জমাদার গোলাব খানের কাহিনী তার একটি। তাঁর সাহায্য না হলে গ্রীথিরা জ্বলন্ত ছাদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতো। বওয়ার নামে একজন চৌকিদার তার মনিব গিন্নী মিসেস ম্যাকডোনাল্ডকে বাঁচাবার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জনের ঝুঁকি গ্রহণ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ তার চেষ্টা সফল হয়নি। মিসেস ম্যাকডোনাল্ডের হত্যার পর তার শিশুদেরকে আয়া নসিবনের সহায়তায় রক্ষা করা সম্ভবপর হয়েছিলো। অশ্বারোহী বাহিনীর একদল অশ্বারোহী মিসেস কোর্টনীর জীবন রক্ষা করেছিলো। আসগর আলীর বাঙলো আক্রান্ত হয়েছিলো, নিজের প্রাণ বিসর্জন দেয়ার ভয় দেখানো হলেও তিনি খ্রীস্টান ভাড়াটেদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে অস্বীকার করলেন। স্থানীয় ভারতীয়রা যদি মহানুভবতা না দেখাতেন, তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হতো।

গ্রীষ্মের দিনের ঘূর্ণি হাওয়ার মতো মীরাটের অভ্যুত্থান ক্ষণস্থায়ী এবং আকস্মিক ছিলো। কোনো রকমের পূর্বসঙ্কেত ছাড়াই অভ্যুত্থান ঘটেছিলো, যতোক্ষণ তা চলছিলো ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি করেছে। তারপরে যেমন আকস্মিকভাবে এসেছিলো তেমনি দ্রুততার বেগও প্রশমিত হয়ে এলো। কর্ণেল স্মীথের প্যারেডই ছিলো অ্যুত্থানের সাক্ষাৎ কারণ। জেনারেল হিওইট দুঃখের সাথে কর্ণেলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কেন আপনি প্যারেড করাতে গিয়েছিলেন? আমার ডিভিশন একমাস কিংবা তার কিছুকাল পরে শান্ত হয়ে যেতো। অথবা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দিতাম। গভীর সন্দেহ, অবিশ্বাস এবং বিতৃষ্ণ সেপাইদের মধ্যে ছিলো এ কথা সত্য। কিন্তু প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি সতর্ক থাকতেন, যদি তারা সুবিবেচনার সঙ্গে কাজ করতেন তাহলে অপ্রিয় কিছুই ঘটতো না।”

অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার অল্পকাল পরেই সামরিক কর্তৃপক্ষ সেপাই লাইনের সামনে তাদের দুর্বলতার লক্ষণ দেখান। রাইফেলধারী গোটা একটি কোম্পানীকে কালেক্টরের কাঁচারীর তহবিল সংরক্ষণের জন্য নিয়োগ করা হয়। বাকী রাইফেলধারী সেপাই এবং গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে উইল্সন প্যারেড ময়দানে গেলেন। সেখানে একজন বিদ্রোহী সেপাইয়েরও দেখা পেলেন না। শুধুমাত্র অল্পসংখ্যক সেপাই অশ্বারোহী লাইনের কাছে ঘোরাঘুরি করছিলো। রাইফেলের আওয়াজ শুনেই তারা পালিয়ে গেলো। উইলসন ভয় করছিলেন, হয়তো সেপাইরা ইউরোপীয়দের বাসাবাড়িতে হানা দেয়ার পরিকল্পনা করেছে এবং সেদিকেই তিনি ধাবিত হলেন। পথে তাঁর সঙ্গে বন্দুকধারী সেপাইরা এসে যোগ দিলো। সে রাতে আর কিছুই করা হলো না। সেপাইদের পশ্চাদ্ধাবনের কোনো চেষ্টাই করা হলো না। পরবর্তী কয়দিন মীরাট ব্রিগেড ব্যারাকে অলসভাবে কাটিয়ে দিলো। তারা এখনো আকস্মিকতার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এটা নিশ্চিত যে বিদ্রোহীদের পশ্চাদ্ধাবন করে আক্রমণ করলে দিল্লীকে রক্ষা করা যেতো। দু’চারটা অভ্যুত্থান এখানে সেখানে ঘটলেও বিভিন্ন স্থানের বিদ্রোহ পূর্বাহ্নে দমন করা যেতো। তাতে করে সরকারের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক বিদ্রোহ মাথা তুললো শীগগির তা অংকুরেই বিনষ্ট করা সম্ভব ছিলো।

বীর হৃদয়ও যে মাঝে মাঝে ভীত হয়ে পড়ে, তার স্বীকৃতি না পেলে মীরাটে ইউরোপীয়দের অলসতা এবং নিষ্ক্রিয়তাকে সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভবপর হতো না। সে সময় মিঃ রটন সেখানে ছিলেন। তিনি বলেছেন, সত্য করে বলতে গেলে আমাদের সামরিক কর্তৃপক্ষ পর্যদস্ত হয়ে পড়েছিলো; কী করলে বেশি ভালো হয়, সে সম্বন্ধে কেউ কিছু জানতেন না এবং কিছু করাও হয়নি। আগে ব্রিটিশেরা কোনোদিন ভারতে নিজেদেরকে এতো অসহায় এবং বিপর্যস্ত মনে করেননি। অনাত্মীয় অসংখ্যের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক ইউরোপীয় প্রত্যেক মুখে অবিশ্বাস এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বিশ্বাসঘাতকতা প্রত্যক্ষ করছিলো। সকলে আশা-আকাঙ্খা করতে লাগলো, তাদের এদেশীয় চাকরেরা কোনো মুসলমানী ভোজানুষ্ঠানোপলক্ষে তাদের সকলকে হত্যা করে আরাম করে ভক্ষণ করবে। নানা রকমের অশুভ সন্দেহের দোলায় তারা দুলতে লাগলো। নারী এবং শিশুদের দমদমের দেয়ালঘেরা আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তার মধ্যে নিরস্ত্র সিভিলিয়ানেরাও ছিলেন। সামরিক প্রধান এবং অন্যান্য অফিসারেরা ব্যারাকের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। ব্যারাকের ওপরে এবং ভেতরে পাহারা বসানো হলো। বড় বাজারের গুণ্ডা বদমায়েস এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামের গুর্জরদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবরকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *