৪. কানপুর : ধাবমান দাবানল

কানপুর : ধাবমান দাবানল

দিল্লিতে সম্রাট ছিলেন। আর কানপুরের সেপাইরা মহারাষ্ট্রের রাজবংশের কারো নেতৃত্ব গ্রহণ করার অপেক্ষা করছিলো। ১৮১৭ সালে পেশবা দ্বিতীয় বাজীরাও ব্রিটিশ শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, পরে মে মাসে তাঁকে ইংরেজ সৈন্যের হাতে সম্পূর্ণভাবে পরাজয় বরণ করতে হয়। তাঁকে সাম্রাজ্য থেকে দূরে নির্বাসিত করা হলো। এ নির্বাসনের স্থান হিসেবে তিনি কাশীকে পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁর পছন্দে মত দিতে পারলেন না, কারণ সেখানে অনেক রাজপুত্র রয়েছে। তদুপরি কাশী হলো, প্রাচীন হিন্দু সাম্রাজ্যের রাজধানী। সেখান থেকে তিনি অতি সহজেই হারানো সাম্রাজ্যের প্রজাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মুঙ্গের অথবা গোরক্ষপুরকে তার নির্বাসনের স্থান হিসেবে মনোনীত করলেন। কিন্তু পেশবা আপত্তি করলেন, মুঙ্গেরে অত্যধিক গরম এবং গোরক্ষপুরে কোনো উপাসনা মন্দির নেই, সুতরাং যেতে রাজী নন। তিনি গঙ্গা তীরবর্তী কোন স্থান এমনকি বংশানুক্রমিক শত্রুতার কেন্দ্র দিল্লীতেও যেতে রাজী ছিলেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পেশবার রাজধানী কানপুর থেকে কয়েক মাইল দূরে বিঠোরে তাঁকে নির্বাসিত করতে মনস্থির করলেন। সেখানে পেশবাকে একটি জায়গীর দেয়া হলো। তার এবং তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য বার্ষিক ৮০ লক্ষ টাকা বৃত্তি ধার্য করা হলো। বৃত্তির ওপর নির্ভর করে তিনি দৈনন্দিন জীবন ধারণের নিষ্ক্রয়তায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন। এখনো অনেক প্রজা রয়েছে যারা তাঁর প্রতি মহারাজোচিত সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। তার পুরোনো খেতাব পান্থপ্রধান এবং মহারাজ খেতাব ইংরেজ মেনে না নেয়ার ফলে তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হলেন সবচেয়ে বেশি। তাঁর সঞ্চিত অর্থ থেকে তিনি সরকারী ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হলেন, কিন্তু তিনি তাঁর ঘোড়ার ঘেসুড়ের নৌকা ভাড়া দিতে অস্বীকার করলেন, কারণ তা তাঁর মতো সামন্তরাজ্যের মর্যাদার পরিপন্থী। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ রাজ্যহারা সামন্তরাজ্যের এ রকম সামান্য বিষয়ে আহত হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না। বাজীরাও এখন ইংরেজদের রীতিমতো উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। গুজব রটলো এক সময়ে তিনি নেপাল দরবারের সঙ্গে মতলব আঁটছেন। আরেক সময় ব্রহ্মদেশ এবং তিব্বতের সঙ্গে মিলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁর ষড়যন্ত্রের কথা ব্যাপক জনশ্রুতি লাভ করে। পেশবা বংশের কেউ দীর্ঘদিন ধরে বাঁচে না। ব্রিটিশ সরকার আশা করেছিলো যে বৃত্তির টাকাও পেশবা বেশিদিন ভোগ করতে পারবেন না, খুব শীগগিরই মারা যাবেন এবং পেশবা মারা গেলে ইংরেজদের হাড় জুড়াবে। বিঠুড়ের নিরুদ্বেগ সহজ জীবন তাঁর আয়ুসীমাকে সত্তর বছর পর্যন্ত বাড়িয়ে দিলো। তিনি ১৮১৫ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত বেঁচেছিলেন।

পেশবার কোনো পুত্র সন্তান না থাকায়, তিনি তিনজনকে দত্তক সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন। সে তিনজন হলো, ধুন্ধু পান্থ অথবা নানা, সদাশিব পান্থ অথবা দাদা এবং গঙ্গাধর রাও অথবা বালা। পেশবার মৃত্যুকালে নানা সাহেব এবং বালা সাহেব জীবিত ছিলেন। দাদা সাহেব পান্ডুরঙ্গ রাও বা রাও সাহেব নামে একটি শিশুসন্তান ফেলে আগেই প্রাণত্যাগ করেছিলেন। দু’জন নাবালিকা কন্যাসন্তান যোগ বাই এবং রুশমাবাইও বাজীরাওয়ের মত্যুর পরে বেঁচেছিলেন। পেশবার ভাই চিমনজী আপ্পার কন্যা দ্বারকা বাইয়ের সন্তানও মৃত পেশবার ওপর ভরণপোষণের জন্য নির্ভরশীল ছিলেন। ১৮৩৯ সালে দ্বিতীয় বাজীরাও লিখিতভাবে দলিল সম্পাদন করে তার খেতাব এবং জায়গীর জ্যেষ্ঠ দত্তক পুত্র নানা সাহেবকে দিয়ে যান।

নানা সাহেবের বাল্যকাল এবং শিক্ষাদীক্ষা সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না। কিন্তু তিনি ছিলেন অসাধারণ দক্ষতাসম্পন্ন অনেক গুণে গুণান্বিত একজন পুরুষ। কিন্তু সমসাময়িক ইংরেজ অফিসার যারা তার সঙ্গে এসেছেন, মিশেছেন, তার মধ্যে অসাধারণত্বের কোনো সন্ধান খুঁজে পাননি। তারা তাকে একজন সাধারণ মারাঠা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অবশ্য শান্তির সময়ে নামে মাত্র মারাঠা প্রধানের দক্ষতা প্রতিনিধি এবং কর্মচারীদের জানার কথা নয়।

দ্বিতীয় বাজীরাও তাঁর পরিবার-পরিজনের জন্য অনেক টাকা-কড়ি রেখে গিয়েছিলেন কিনা বলা কষ্টকর। সরকারি রেকর্ডপত্র থেকে জানা যায়, তাঁর রক্ষিত টাকার পরিমাণ কিছুতেই তিরিশ লাখের বেশি ছিলো না। নানা সাহেব এ টাকা থেকে তাঁর এবং বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের ব্যয়ভার বহন করবেন, তাই আশা করেছিলেন ইংরেজ সরকার। মুরল্যান্ড নানা সাহেবকে ভালোভাবে চিনতেন, তিনি লিখেছেন, “যদিও নানা খুব দরাজ হাতের যুবক নন এবং তাঁর কোনো খারাপ স্বভাব নেই, তবু তিনি এ আয়ের মধ্যে জীবন ধারণ করতে পারবেন না।” সরকার দ্বিতীয় বাজীরাওয়ের জীবদ্দশায় পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে তাঁর মৃত্যুর পরে, উত্তরাধিকারীরা আর বৃত্তি পাবে না। এ নীতি অনুসারে তাঁরা ১৮৩২ সালে চিমনজী আপ্পার মৃত্যু হলে তাঁর বিধবা পত্নী এবং কন্যার ভাতা বন্ধ করে দিলেন।

সুতরাং বাজীরাওয়ের মৃত্যুর পর তাঁর বংশধরদের ভাতাও যে বন্ধ হয়ে যাবে, তাতে আশ্চর্যের কিছুই ছিলো না। কিন্তু ব্রিটিশ উদারতা এবং ন্যায়পরায়ণতার ওপর নানা সাহেব অবিমিশ্র শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। অনেক ইংরেজ মনে করতে লাগলেন বিধিগত ব্যবস্থা যাই হোক না কেননা, পেশবার বৃত্তির কিছু অংশ অন্ততঃ তাঁর পরিবারবর্গকে প্রদান করা উচিত। নানা এবং তার সমর্থকদের যুক্তি হলো মৃত পেশবা এবং তার আত্মীয়-স্বজনের ভরণপোষণের জন্য বৃত্তি মঞ্জুর করা হয়েছিলো, জীবদ্দশায় পেশবা যতো টাকাই রেখে যান বৃত্তির প্রতি তার পরিবারের আইনতঃ দাবি রয়েছে।

দুর্ভাগ্যবশতঃ পেশবা পরিবার আবার নিজেদের মধ্যে দু’ভাগ হয়ে গেলো। দু’টি শিশুকন্যার পক্ষ থেকে তাদের পিতা বলবন্ত রাও যে দাবি করলেন, তা অধিক জোরালো হয়ে দেখা দিলো। বলবন্ত রাওয়ের পক্ষে যুক্তি হলো, হিন্দু আইন অনুসারে পিতা পুত্র-সন্তানহীন অবস্থায় মারা গেলে কন্যা-সন্তানেরা পুত্র-সন্তানের মতো পিতৃসম্পত্তি দাবি করতে পারে। কন্যা-সন্তানদের দাবিকে অগ্রাহ্য করে পালিত পুত্র-পুত্রসন্তানদের দাবিকে অগ্রাধিকার দান করা কিছুতেই সঙ্গত নয়। সরকার এ আবেদন নাকচ করে দিলেন এবং জানালেন যে পেশবাই আসল এবং একমাত্র দাবিদার। এ ব্যাপারে মৃত দ্বিতীয় বাজীরাওয়ের বিধবা পত্নীরা কি ভূমিকা পালন করেছিলেন সে সম্বন্ধে অমরা জানতে পারিনি। তবে সম্ভবত চিমনজী আপ্পার দৌহিত্র চিমনজী থাষ্ট্রেও একইভাবে নিজের দাবিকে উপস্থিত করেছিলেন। মৃত পেশবার চাকর-বাকর এবং আশ্রিত অনুগৃহীতরাও এ পারিবারিক বিবাদে যে ইন্ধন যোগাননি, সে কথা সত্যি নয়।

১৮৩২ সালের আইন অনুসারে, পেশবা এবং তার সঙ্গে তার জায়গীর বিড়ের মধ্যে যারা অবস্থান করছিলেন, সকলকেই আদালতে উপস্থিত না হওয়ার স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছিলো। কিন্তু পেশবার পরলোক গমনের সঙ্গে সঙ্গেই সে অধিকার কেড়ে নেয়া হলো। এ আঘাতও হয়তো কালের প্রভাবে মৃত বাজীরাওয়ের পরিবার কাটিয়ে উঠতে পরতো, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর পরই দেখা গেলো গোটা পরিবারের আপন বলতে এক ইঞ্চি জমি কোথাও নেই। একজন পেশবা মৃত্যুমুখে পতিত হলে ব্রাহ্মণেরা শ্রাদ্ধ উপলক্ষে পাঁচ রকমের মহাদান (হাতী, ঘোড়া, সোনা, মণি-মাণিক্য এবং জমি) তাঁর বংশধরদের কাছে পায়, এটাই হলো রেওয়াজ। কিন্তু দ্বিতীয় বাজীরাওয়ের শ্রদ্ধে তাঁর বংশধরেরা চার রকমের দান ব্রাহ্মণদের করলেও জমি দিতে পারলেন না। তারা এক কণা জমির মালিক নন। এ সময়ে সর্দার রঘুনাথ রাও ভিনচরকর বিষুড়ে ছিলেন, জমি সম্প্রদান করতে না পারায় তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। তিনি নানা সাহেবের কাছে বিনীতভাবে নিবেদন করেছিলেন, তার জায়গীর এবং যৌতুক সূত্রে প্রাপ্ত গ্রামসমূহের আসল মালিক পেশবা এবং তিনি সেখান থেকে মৃত পেশবার শ্রাদ্ধে যতো ইচ্ছা জমি দান করতে পারেন। এতে নানা সাহেব কেঁদে ফেলেন।

একটু সহানুভূতি সহকারে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যদি এসব ছোটোখাটো ব্যাপারে নজর করতেন, তাহলে অনেক অসন্তুষ্টি রোধ করতে পারা যেতো। কিন্তু তাঁদের সে মন ছিলো না। ন্যায়সঙ্গতভাবে তিনি পেশবার শীলমোহর ব্যবহার করতে পারেন। জনসাধারণের কাছে তিনি তার ন্যায্য উত্তরাধিকারী। এমন কি ইংরেজ অফিসারেরাও তাঁকে মহারাজ’ সম্বোধন না করে পারেন না। ইংরেজ কমিশনার মিেরল্যাণ্ড তাঁকে পেশবার শীলমোহর ব্যবহার করতে দিলেন না। তিনি নিজের নামে ‘পেশবা বাহাদুর’ খেতাব যুক্ত করে নতুন শীলমোহর তৈরি করলেন, কমিশনার তাতেও আপত্তি তুললেন। জানিয়ে দিলেন শীলমোহরে তিনি শুধু শ্ৰীমান নানা ধুন্ধু পান্থ বাহাদুর খেতাব ব্যবহার করতে পারবেন। বৃত্তি হারানোর সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের এ অপ্রীতিকর ব্যবহার তার অসন্তোষকে বাড়িয়েই তুললো।

সে সময়ে ভারতীয় দেশীয় রাজারা ভারত সরকারের পরিষদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্রিটেনে কোর্ট অব ডিরেক্টর্সদের সভায় আপীল করতেন। বৃত্তিহারা সমস্ত দেশীয় রাজপুরুষদের মতো নানা সাহেবও আশা করেছিলেন, তার আবেদন বৃথা যাবে না এবং তাঁর ওপর সুবিচার করা হবে। লেফটেনান্ট গভর্ণর এবং গভর্ণর জেনারেলের কাছে আবেদন করার পরে যখন কোনো ফলোদয় হলো না, তখন তিনি কোর্ট অব ডিরেক্টর্সের সভায় আবেদন করলেন। কোর্ট অব ডিরেক্টর্সের সভা ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে রাজী না হলে তিনি লন্ডনে তাঁর একজন ব্যক্তিগত প্রতিনিধি পাঠাবার কথা স্থির করলেন।

তাঁর প্রতিনিধি আজিমুল্লাহ খান অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন। এক সময় তিনি পরিচারকের কাজ করতেন। নীচকুলে জন্ম হলেও তিনি আপন চেষ্টার বলে নিজেকে সুশিক্ষিত করে তোলেন। ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষা শিক্ষা করে তিনি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার বৃত্তি গ্রহণ করেন। যে লোক এভোগুলো বাধার মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁর জন্য এ কম কৃতিত্ব নয়। তাঁর ছিলো সুদর্শন চেহারা এবং মধুর ব্যক্তিত্ব, তদুপরি আপন ব্যক্তিত্ব তিনি সুচারুভাবে কর্ষণ করতে পেরেছিলেন, সে কারণে ইংল্যান্ডে যাওয়া মাত্রই তাঁকে সম্ভ্রান্ত সমাজ অতি সহজেই গ্রহণ করলো। ব্রিটিশ অভিজাত মহিলাদের প্রীতি এবং কুমারীদের ভালোবাসা যে আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন, তাও তাঁর পক্ষে কম কৃতিত্বের কথা নয়। কিন্তু শীগগিরই আজিমুল্লাহ উপলব্ধি করলেন যে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ঘড়েল রাজনীতিবিদদের কাছে আবেদন নিবেদন করে, তার মনিবের কোনো উপকারই করা সম্ভব হবে না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কোর্ট অব ডিরেক্টরর্সদের সভা যেমন, তেমনি মহারাণীর উপদেষ্টাবৃন্দও তাঁর মনিবের আবেদনের কোনো মূল্য দিলেন না। তিনি দেশে ফিরে আসবেন স্থির করলেন। কিন্তু অন্যান্য ভারতীয় প্রতিনিধির মতো ভারতে আসার জন্য সোজাসুজি জাহাজে চড়ে বসলেন না। তিনি শুনেছেন, মালটাতে ইংরেজ এবং ফরাসী সৈন্য সম্মিলিতভাবে রুশ সৈন্যের হাতে পরাজিত হয়েছে। জাহাজে তিনি কনস্টান্টিনোপলের টিকিট কাটলেন এবং সেখানে বিখ্যাত সাংবাদিক উইলিয়াম হাওয়ার্ড রাসেলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। রাসেল এ অনুসন্ধিৎসু তরুণ মুসলিম সম্বন্ধে লিখেছেন, “কয়েকদিনের জন্য আমি কনস্টান্টিনোপল গেলাম। সেখানে মিশরীয় হোটেলে থাকার সময়ে একজন সুন্দর ছিপছিপে চেহারার ভদ্রলোককে দেখতে পেলাম কয়েকবার। গাঢ় জলপাইয়ের রঙ তাঁর শরীর। পরনে প্রাচ্যের পোশাক। আঙুলে আংটি এবং অঙ্গে নানা সুন্দর বেশভূষা। তিনি হোটেলের টেবিলে বসে খাবার খেলেন, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় কথা বললেন। আমি অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম, তিনি হচ্ছেন একজন ভারতীয় রাজপুত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপীল করার জন্য তিনি ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন, এখন দেশে ফিরছেন।” আজিমুল্লাহ্ ক্রিমিয়াতে যেতে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। কারণ রাশিয়ান সে সকল বীর রুস্তমদের স্বচক্ষে দেখতে চান, যাদের হাতে ইংরেজ এবং ফরাসি বাহিনী এক সঙ্গে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। তিনি নিরাপদ দূরত্ব থেকে রাশিয়ান ব্যাটারী থেকে কিভাবে গোলা নিক্ষেপ করা হয়, নিজের চোখে দেখেছেন। তিনি ধর্মীয় বিধিনিষেধ একদম পালন করতেন না বললেই চলে। জন রাসেলকে তিনি বলেছিলেন, এতো বোকা নই যে আমি ওসব বাজে জিনিসে বিশ্বাস স্থাপন করবো। আমি কোনো ধর্ম মানিনে। তারপরে রাসেল তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ক্রিমিয়াতে যা ঘটছে আপন চোখে দেখার এতো গভীর আগ্রহ দেখে কি অবাক না হয়ে পারা যায়? একজন ইউরোপবাসীর এ রকম কৌতূহল থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু অসামরিক গোত্রের একজন এশিয়াবাসীর এ কৌতূহল অস্বাভাবিক নয় কি? তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের ভীতিবিহ্বল অবস্থায় দেখেছেন। ফরাসীদের সঙ্গে স্বাস্থ্য এবং নৈতিকতার তুলনায় তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে খুবই নিকৃষ্ট ধারণা পোষণ করেছেন।

এদিকে নানা সাহেব ধনী ভারতীয় দেশীয় রাজার স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেছেন। তিনি স্বেচ্ছায় কানপুরের ইংরেজ অফিসারদের খাতির করতে লাগলেন। নিমন্ত্রণ করে তাঁদের বর্ধিতভাবে আপ্যায়ন করতে শুরু করেছেন। মাঝে মাঝে তিনি শহরে যেতেন। কিন্তু তার ইউরোপীয় বন্ধুরা তাঁর আদর-আপ্যায়নের প্রতিদান দিতে পারতেন না। কারণ তিনি তাদের সঙ্গে পান ভোজন করতে রাজী ছিলেন না। নির্বাসিত জীবনের একঘেঁয়েমী দূর করার জন্য নানা সাহেব কাশী, প্রয়াগ, গয়া ইত্যাদি তীর্থকেন্দ্রে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কিন্তু তার গতিবিধির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছিলো। স্থান পরিবর্তনের কারণে তার মধ্যে প্রফুল্লতার সঞ্চার হয়েছে। বাড়িতে নানা সাহেবের ঘোড়া, ভালো জাতের কুকুর, নানা রকম হরিণ এবং ভারতের নানা স্থান থেকে সংগৃহীত জীবজন্তু ছিলো। নিষ্ক্রিয় জীবনের জড়তা ভাঙ্গার জন্য তিনিও সক্রিয় আনন্দের কথা ভাবলেন। ভ্রমণোপলক্ষে তিনি ১৮৫৬ সালে লখনৌ শহরে গেলেন। কাভানাগ তাকে সেখানে দেখেছেন।

রাসেল আরো বলেছেন, তীর্থযাত্রার ছলে তিনি গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের সমস্ত সামরিক ঘাঁটি পরিদর্শন করেছেন, এমন কি সিমলাতে যাওয়ার প্রস্তাবও করেছিলেন। তার তীর্থযাত্রার সহগামী ছিলেন আজিমুল্লাহ খান। একজন হিন্দু তীর্থযাত্রীর প্রকৃত সঙ্গী বটে। যে সকল ইঙ্গ-ভারতীয় কর্মচারীর অনুমতি ব্যতীত নানা তার প্রাসাদ থেকে এক মাইলও ভ্রমণ করতে পারেন না, রাসেল তাঁদের অসাবধানতার নিন্দা করেছেন। এমন কি কল্পি এবং লখনৌতে কোনো হিন্দু তীর্থ নাই জেনেও গ্রীফিথ তাঁকে ভ্রমণ করতে অনুমতি দিয়েছেন। সরকারী রেকর্ডপত্রে তাঁর সফরসূচির কোনো বিবরণী পাওয়ার যায় না। তবে মার্টিনো ১৮৫৭ সালে জানুয়ারি মাসে আজিমুল্লাহ খানকে আমবালাতে দেখেছেন, তখন তাঁর সঙ্গে নানা সাহেব ছিলেন না। বলা হয়ে থাকে লখনৌতে তাঁর গতিবিধি স্যার হেনরী লরেন্সের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছিলো। এ কথা টের পেয়ে তিনি আগে-ভাগে লখনৌ ত্যাগ করে চলে যান। কিন্তু সেখানে অবস্থান কালে তিনি সামরিক অফিসারদের সঙ্গে খোলাখুলি মেলামেশা করেছিলেন। হেনরী মেটকাফের মতে, নানা সাহেব লখনৌতে সামরিক খেলাধুলায় উপস্থিত ছিলেন। এ খেলাধুলা তিনদিন স্থায়ী ছিলো। এ তিনদিন সব সময়ে আমাদের অফিসারদের সঙ্গে দুষ্ট নানা কফি ইত্যাদি পান করেছেন এবং সর্বক্ষণ বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেছেন।

ইতিমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে চিমনজী আপ্পার তরফ থেকে একখানা মামলা দায়ের করা হলো, কিন্তু তা আদালত বাতিল করে দিলো।

তখন কানপুর ছিলো একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি। যে জেলার সদরে সামরিক ঘাঁটি অবস্থিত ছিলো, অযোধ্যার নবাবই ছিলেন তার আসল মালিক। এ জেলার সংগৃহীত রাজস্ব থেকে একদল অতিরিক্ত ব্রিটিশ সৈন্য পোষণ করা হতো। সৈন্যদের আস্তানা ছিলো ক্যান্টনমেন্ট। এ জেলাটি ১৮০১ সালে ব্রিটিশকে ছেড়ে দেয়া হয়। গঙ্গা তীরবর্তী এ শহরটির বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিলো। সারা বছর ক্ষুদ্র নৌকা এবং বর্ষাকালে বড়ো বড়ো নৌকা যাতায়াত করতো এই শহরের পাশ দিয়ে। লখনৌর প্রসারমান চর্ম ব্যবসার কেন্দ্র ছিলো এ শহর। এলাহাবাদ থেকে একশ মাইল এবং লখনৌ থেকে চল্লিশ মাইল দূরবর্তী এ স্থান থেকে একদিকে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড এবং অন্যদিকে অযোধ্যার উঁচু সড়ক পাহারা দেয়া যায়। কানপুরের সামরিক গুরুত্ব অপরিসীম। ১৮৭৫ সালে মে মাসে কানপুরে ৬১ জন ইউরোপীয় গোলন্দাজ, ৬টি কামান এবং ৩টি ভারতীয় পদাতিক বাহিনী ছিলো। সবশুদ্ধ সৈন্য সংখ্যা ছিলো তিন হাজারেরও কম। মেজর জেনারেল হাফ হুইলার ছিলেন দলের অধিনায়ক। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় তিনি কৃতিত্বের সাথে সামরিক বাহিনীতে কাজ করে আসছেন। তিনি লর্ডলেকের অধীনে চাকুরি করেছেন এবং ১৮০৪ সালে দিল্লী অধিকারের সময় তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেছিলেন। বয়স বেড়ে গেলেও পরবর্তীকালে তিনি আফগানিস্তান এবং পাঞ্জাবে যুদ্ধ করে রেকর্ড স্থাপন করেছেন। তার সুনাম সৈন্যবাহিনীতে এতো ছড়িয়ে পড়েছিলো যে দিল্লীর টিলার ওপর অল্পসংখ্যক ব্রিটিশ সৈন্য সব সময়েই প্রত্যাশা করেছিলো যে আর কেউ না এলেও তিনি তাদের সাহায্য করতে ছুটে আসবেন। স্যার হেনরী লরেন্সের মতে, “হুইলার হচ্ছেন সময়োচিত মানুষ, এই বিপদের সময়ে শক্তির একটি দৃঢ় মিনারস্বরূপ।”

১৪ই মে তারিখে মীরাট এবং দিল্লীর খবর কানপুরে এসে পৌঁছালো। তার ফলে সামান্য উদ্বেগেরও সঞ্চার হয়নি। এ সম্বন্ধে হুইলার পুরোপুরি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন। ১৮ তারিখে তিনি গভর্ণর জেনারেলকে টেলিগ্রাম করে জানালেন যে কানপুরে কোনো গোলমাল হয়নি। তার অধীনস্থ সেপাইদের প্রভাবিত করার মতো অশুভ যদি কিছু না ঘটে অন্য কোথাও, তাহলেও ঘাঁটি রক্ষা করতে প্রত্যাশী। ঘাঁটি ছেড়ে যাওয়ার তো কোনো কথাই উঠে না। উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রদেশগুলোর মতো কানপুরের ইউরোপীয় এবং খ্রীস্টান অধিবাসীদের সংখ্যা যথেষ্ট নয়। মহারাণীর ৩২নং রেজিমেন্টের অনেক অফিসার তাঁদের পরিবার-পরিজনকে লখনৌতে রেখে গেছেন। তার অধীনস্থ সেপাইরা বিদ্রোহ করলে তাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সামরিক অফিসারদের পরিবারবর্গকে নিরাপদ স্থানে প্রেরণ করার কোনো প্রচেষ্টাই হুইলার গ্রহণ করেন নি। সেপাইদের মধ্যে বৈরীভাবের সামান্যতম চিহ্নও পরিদৃশ্যমান নয়। যে হুইলার অর্ধশতাব্দী ধরে সেপাইদের সঙ্গে রয়েছেন, তিনি ভালোভাবে জানেন যে তিনি একটু অসতর্ক হলেই বিক্ষোভ ফেটে পড়তে পারে। পক্ষান্তরে তিনি যদি একটুকুও অবিচলিতভাব না দেখাতেন তা হলে একটা গুলি খরচ না করেও সেপাইদের আয়ত্বের মধ্যে রাখতে পারতেন। ১৯ তারিখে তিনি ভারত সরকারের কাছ থেকে এ মর্মে টেলিগ্রাম পেলেন, ক্যান্টনমেন্টে ইউরোপীয় সৈন্য আসছে এবং তাদের স্থান দেয়ার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করার নির্দেশ তাঁকে দেয়া হয়েছে এবং আরো নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সে খবর যেনো তিনি প্রচার করেন। সময়মতো ইউরোপীয় সৈন্য এসে পৌঁছালে খবর প্রকাশ করার পরেও হুইলারের ভয় করার মতো কিছু ছিলো না। কিন্তু এখন খবর প্রকাশ করার অর্থ হলো, সেপাইদের জানিয়ে দেয়া, সরকার তাদের প্রতিও বিশ্বাস হারিয়েছেন এবং তাদের চক্রান্ত সম্বন্ধে সজাগ হয়ে উঠেছেন। ২১শে মে তারিখে ২নং অশ্বারোহী বাহিনী অস্থির হয়ে উঠলো। গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে তাদের কাছ থেকে ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি কেড়ে নিয়ে ইউরোপীয়দের মধ্যে বিতরণ করা হবে। অবশ্য গুজবের কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিলো না। অশ্বারোহী সেপাইরা পদাতিক সেপাই ভাইদের সঙ্গে আলোচনা করতে লাগলো, ঘোড়া এবং অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার আগে তাদের কি করা উচিত।

২২শে মে তারিখে সত্যি সত্যি ৫৫ জন ইউরোপীয় অনিয়মিত অযোধ্যা অশ্বারোহী দলের ২৪০ জন অশ্বারোহীসহ এসে হাজির হলো ক্যান্টনমেন্টে। সব কিছু যদিও শান্তভাবে চলছে, তবু কানপুরের সেপাইদের মধ্যে ভেতরে ভেতরে বিক্ষোভ জমা হতে থাকে, এর জন্য সেপাইদের দোষী করা যাবে না। ইউরোপীয় ও বঙ্গ ভারতীয় সৈন্যরা অস্পষ্টভাবে বিপদের আঁচ করতে চেষ্টা করেছেন। ছাউনির সকলেই প্রত্যাশা করতে লাগলো মারাত্মক কিছু, ভয়ঙ্কর কিছু অনিবার্যভাবেই ঘটবে। কিন্তু তা কি কেউ স্পষ্টভাবে ধরতে পারছে না। দেশীয় সেপাইরা তখনো শান্ত ছিলো রোজকার মতো। তা সত্ত্বেও সকলের মনে মনে প্রবল আতঙ্ক বাসা বেঁধে আছে।

ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের ধনসম্পদ সব কিছু চাকরবাকরের হেফাজতে রেখে এলাহাবাদ চলে যাবার জন্য নৌকা ভাড়া করেছেন। প্রত্যেক লোক তার সাধ্য সঙ্গতি অনুসারে চৌকিদার নিয়োগ করতে লেগে গেলো। সংঘর্ষ যদি হয়, তাহলে অবশ্যই ছড়িয়ে পড়বে। বাইরে শান্ত অবস্থা বজায় থাকলেও ভেতরে ভেতরে সেপাইরাও কম আতঙ্কিত হয়নি। একজন তো তার বন্ধুদের বললো, সাহেব লোকেরা যেভাবে আমাদেরকে ধ্বংস করতে চায়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। ৩নং কোম্পানী এবং ৬নং ব্যাটালিয়নের কামান সম্পূর্ণ তৈরি এবং অশ্বারোহী বাহিনীর ওপর গুলি চালাবার অপেক্ষায় রয়েছে। সে সেপাইকে গ্রেফতার করা হলো, বিচার করে ফাঁসিকাষ্ঠে লটকানো হলো, কিন্তু এ ঘটনা তার সাথীদের উত্তেজনা বাড়িয়ে তুললো। এ সময়ে লখনৌর সৈন্যদের উপস্থিতিতে তাদের আতঙ্ক আরো বেড়ে গেলো। আবার সেপাইদের দমন করার মতো লখনৌর সৈন্যরাও সংখ্যায় যথেষ্ট নয়।

দুর্ভাগ্যবশতঃ সে সময়ে সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দকৃত কিছু পঁচে যাওয়া আটা বাজারে নিয়ে যাওয়া হলো এবং সস্তা দামে বিক্রি করা হলো। সে পুরোনো আটা দিয়ে রুটি তৈরি করলে পরে দুর্গন্ধ ছড়াতে লাগলো, তখনো স্বাভাবিকভাবেই সকলে সন্দেহ করতে লাগলো আটায় গরু-শুয়রের হাড্ডি গুঁড়ো করে মিশিয়ে দেখা হয়েছে। সেপাইরা ভয়ঙ্কর রকম উত্তেজিত হয়ে উঠলো। অনুসন্ধান করে দেখা গেলো, তাদের সন্দেহ অমূলক। তাহলেও কিন্তু সন্দেহপ্রবণ ধর্মান্ধ মানুষের দ্বিধা গেলো না। তারা এজন্য শুধু দোকানদারদের একা দায়ী করলো না।

২১ তারিখে একটি বিক্ষোভ ঘটবে অনুমান করে, হুইলার আগে থেকেই তৈরি ছিলেন। কিন্তু সেদিন কিছুই ঘটলো না। তিনি সুখবরটা গভর্ণর জেনারেলকে জানিয়ে দিলেন। লখনৌ থেকে নতুন সৈন্য আসার সংবাদটা কলকাতায়ও জানিয়ে দেয়া হলো। আরো সুখের খবর বিড়ের মহারাজ ৩০০ সেপাই দু’টি কামানসহ প্রেরণ করেছেন। কলকাতা থেকে ইউরোপীয় সৈন্যেরা এসে পৌঁছালে তিনি প্রধান সেনাপতির কাছে জানালেন, আমি আশা করছি, সবকিছু ভালোয় ভালোয় কেটে যাবে। বর্তমানের অবস্থা শান্ত, পরে কি ঘটবে সে সম্বন্ধে কিছু বলা যায় না। কলকাতা থেকে ইউরোপীয় সৈন্যেরা অত্যন্ত দেরীতে এসে পৌঁছালো। কিন্তু অন্যদিকে মারাঠারা পশ্চিম দেশীয় হিন্দু এবং মুসলমান সেপাইদের প্রভুত্বসুলভ প্রভাবে ইতিমধ্যে বশ করে ফেলেছে।

এখানে অত্যন্ত একটা জরুরী প্রশ্ন উঠে। তাহলে নানা সাহেব কি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন? নাকি ইউরোপীয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন? অবশ্য তিনি ইংরেজ মহিলাদের রক্ষার জন্য এবং বিস্তুড়ে তাঁদের পাঠিয়ে দেবার প্রস্তাব করেছিলেন, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এখন কথা হলো, তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সৈন্যদের সশস্ত্র বিদ্রোহে কোনো ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন কী না?

শেফার্ডের ধারণা হলো, অবশ্যই তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের সহায়তা করেছেন। কারণ তিনি লক্ষ্য করেছেন, নগরীর অনেক দেশীয় সামরিক অফিসারের সঙ্গে তার হৃদ্যতা ছিলো। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টর মিঃ হিলাসডনকে এমনভাবে রাজী করিয়েছিলেন-বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পূর্বে, তাঁরা যেনো তাঁদের পরিবারবর্গকে তাঁর হেফাজতে প্রেরণ করেন। তাঁরা রাজী হয়েছিলেন, কিন্তু মহিলারা যেতে রাজী হননি। তাঁর ওপর এ গভীর বিশ্বাসের কারণেই নবাবগঞ্জের রাজকোষ রক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয় এবং তাঁর অধীনে ৫০০ অশ্বারোহী এবং পদাতিক সেপাই ছেড়ে দেয়া হয়। বিদ্রোহীরা মার্চ করে ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে গেলে তিনি তাদের সাহায্যেই অস্ত্রাগার অধিকার করেন। আমাদেরকে আরো বলা হয়েছে যে, নানা সাহেব নামে একজন বিঠুড়ের অধিবাসী এবং সরকারের ভক্ত প্রজা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেপাইদের সঙ্গে সরকারি রাজকোষ রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে দেখে মনে হয়, তাকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করা হয়েছে। তারপরে তিনি ৫০০ সৈন্য এবং ২টি ক্ষুদ্র কামানসহ রাজকোষের পাশাপাশি একটি বাঙলোতে গিয়ে উঠলেন। এ সময়ে হিলার্সডনের কথাকে বিশ্বাস করা যেত। কিন্তু পরিখা বেষ্টিত অবস্থায় তাঁকে নানা রকম ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ম্যারী থমসন ছিলেন বিদ্রোহের পরে জীবিত চারজনের একজন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, “ম্যাজিস্ট্রেট নানা সাহেবকে রাজকোষের দায়িত্ব গ্রহণ করতে আমন্ত্রণ করেছিলেন। এ সময়ে হিলার্সর্ডনের ওপর প্রায় এক লক্ষ পাউন্ডের মতো অর্থ রক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিলো। তিনি মেজর হুইলারের সঙ্গে আলোচনা করে বিঘুড়ে নানা সাহেবের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে এলেন। রাজকোষ রক্ষা করার জন্য দু’শ অশ্বারোহী সেপাই এবং চার’শ পদাতিক বাহিনী নিয়োগ করা হলো। সে সঙ্গে রইলো মহারাজের নিজের সৈন্যদল। সৈন্য শিবিরের থেকে পাঁচ মাইল দূরে ছিলো রাজকোষ। বিঠুড়ের সৈন্যদল এবং ৫৩নং দেশীয় পদাতিক বাহিনীর উপর রাজকোষ রক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হলো। তা ছাড়া স্বয়ং নানা সাহেবও ক্যান্টনমেন্টের সিভিল লাইনে অবস্থান করতে লাগলেন। এ ভদ্রলোক এতো বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠেছিলেন যে তাঁর সম্বন্ধে কোনো রকমের সন্দেহ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের মনে উদিত হয়নি। তখন হিলার্সড়ন কিংবা হুইলারের দু’জনে নানা সাহেবকে সন্দেহ করেননি, তাঁর কোনো কারণও ছিলো না।

স্বভাবতঃই স্যার হাফ হুইলার শহর এবং সেপাই লাইনের খবর জানার জন্য কিছু সংখ্যক গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ তাঁরা তাঁদের সংবাদ শুধু মাত্র সেনাপতিকেই জ্ঞাত করেননি, নিজেদের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গেও এ নিয়ে গল্প গুজব করেছেন। তার ফলে কিন্তু কম ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়নি। ২৪ তারিখে একটি নিশ্চিত বিদ্রোহের আশঙ্কা করা গিয়েছিলো, কিন্তু সেদিন কিছুই ঘটলো না। ইউরোপীয় এবং ইঙ্গ-ভারতীয়দের কাছে সেপাইরাই একমাত্র ভয়ের কারণ নয়, দুর্ধর্ষ গুর্জরদের ভয়ে তারা ক্ষণে ক্ষণে শঙ্কিত হয়ে উঠতে থাকলো। সর্বক্ষণব্যাপী উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা এবং অব্যবস্থিত চিত্ততার কারণে অনেকেই কাণ্ডজ্ঞান এবং সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন। এ উৎকণ্ঠাজনক পিরিস্থিতির মধ্যে তারা যে কোনো কাজ করতে পারতেন। তাঁদের মধ্যে একজন স্বদেশে লিখেছেন, “আমার একমাত্র ইচ্ছা হলো আমার রেজিমেন্টসহ অথবা একা আমাকে এ সকল লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেয়া হোক। যাতে করে যে সকল লোক আমাদেরকে এতোকাল ধরে উৎকণ্ঠাজনক পরিস্থির মধ্যে রেখেছে। তারা আমাদের সঙ্গে থাকতে চায় নাকি বিরুদ্ধাচরণ করতে চায় সে সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত হতে পারি। ৩০শে মে তারিখে কর্ণেল এওয়ার্ট লিখেছেন, আমি দুঃখিত হয়ে লিখতে চাইনে, আমরা চরম বিপদের মধ্যে পড়েছি সে সম্বন্ধে রাখা ঢাকা করে কোনো লাভ নেই। আমি আগেই বলেছি, সেপাইরা যদি বিদ্রোহ করে, তাহলে নিশ্চিতভাবে আমাকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে। তবে এ সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত যে তারা ইউরোপীয় সৈন্যদের আক্রমণ করতে সাহস করবে না। মিসেস এওয়ার্ট নারীমনের সূক্ষ্মতার সাহায্যে আরো নিখুঁতভাবে পরিস্থিতি যাচাই করেছেন। তিনি লিখেছেন, একটা মাত্র স্ফুলিঙ্গ উড়ে এসে পড়লেই সমস্ত পদাতিক এবং অশ্বারোহী রেজিমেন্টগুলো বিদ্রোহ করবে। যেখানে পরিখা বেষ্টিত অবস্থায় আমরা আছি, সেখানে ছটি কামান আছে। তার ফলে আমরা রক্ষা পেলেও আমাদের অফিসারদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে। গোপন করে লাভ নেই, সমস্ত সেনাবাহিনীতে আমার স্বামীকেই সর্বাধিক বিপদের ঝুঁকি ঘাড়ে নিতে হবে।

সে আকাক্ষিত স্ফুলিঙ্গটি ছড়িয়ে দিলো একজন অফিসার। তিনি মাতাল অবস্থায় ২নং অশ্বারোহী বাহিনীর কয়েকজন সেপাইকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লেন। তাকে কোর্ট মার্শালের সামনে হাজির হতে হলো। কিন্তু এ যুক্তিতে তাকে ছেড়ে দেয়া হলো যে তিনি মাতাল ছিলেন, স্বাভাবিক বোধ তাঁর ছিলো না। এটা একটা মহৎ উদারতা। আইনে মাতাল অবস্থার জন্য রেহাই দেয়ার কোনো শর্ত নেই। তার ফলে সেপাইদের মনের সন্দেহ আরো দৃঢ় হলো যে তাদের অফিসারেরা তাদের গুরুতর শাস্তি দেয়ার জন্য মতলব ফাঁদছেন। শেফার্ড কিছু সংখ্যক ক্রুদ্ধ ঘোড়সওয়ার সেপাইয়ের দেখা পেয়েছিলেন। তারা মনের এ ভাব গোপন করেনি। একজন অভিযোগ করলো যে গরু এবং শূয়রের চর্বি মিশ্রিত কার্তুজ তাদের দিয়ে ব্যবহার করাতে ব্যর্থ হয়ে অফিসারেরা প্রতিহিংসার বশে রুঢ়কি থেকে গরু এবং শূয়রের চর্বি মেশানো আটা আমদানি করেছেন ধর্মনাশ করার জন্য। আরেকজন নালিশ করলো, অফিসারদের মনে দুরভিসন্ধি না থাকলে তারা কেন পরিখা বেষ্টিত অবস্থার মধ্যে রয়েছেন? আরেকজন বললো, অফিসারদের উপর আর কোনো বিশ্বাস নেই, কারণ তারা অস্ত্রাগার এবং রাজকোষে দেশী অফিসারদের বদলে ইউরোপীয় প্রহরী নিয়োগ করার চেষ্টা করছে। মিরাটের অশ্বারোহী সেপাই যারা কার্তুজ দাঁতে কামড়াতে অস্বীকার করছে, তাদের সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করা হয়েছে, সে সম্বন্ধেও আলোচনা করা হলো। ইউরোপীয়ান সৈন্য কানপুরে এসে পড়লে আমাদের সঙ্গেও একই রকম ব্যবহার করা হবে। আমরা ততোক্ষণ অপেক্ষা করবো না। আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করা হয়েছে। কয়েক রাত আগে আমাদের একজনকে টহল দেবার সময় একজন অফিসার গুলি করে হত্যা করেছে। কোর্ট রায় দিয়েছে অফিসারটি পাগল। আমাদের একজন যদি কোনো ইউরোপীয় অফিসারের উপর গুলি ছুঁড়তো তাহলে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হতো। এটাই হলো সেপাইদের চরমতম ক্ষোভের কারণ, কিন্তু তৃতীয় রাতও শান্তভাবে অতিবাহিত হয়ে গেলো।

যে পরিখাবেষ্টিত শিবির সেপাইদের মধ্যে এত বেশি অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে, আদতে তা সুরক্ষিত এবং দুর্ভেদ্য নয়। দু’টো ইষ্টক নির্মিত ইটের ব্যারাক মাত্র। একতলা আবার খড়ের ছাউনি। চারপাশে পরিখাও যথেষ্ট গভীর নয়। দেয়াল উঁচু এবং মজবুত নয়, হাল্কা। আজিমুল্লাহ্ একে উপহাস করে বলেছিলেন, ‘হতাশার দুর্গ’। এটা স্যার হুইলারের অস্থায়ী বাসস্থান হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো। গোয়েন্দাদের কাছ থেকে তিনি জানতে পেরেছেন, সেপাইরা বিদ্রোহ করলে এদিকে আক্রমণ করবে না, সোজাসুজি দিল্লী অভিমুখেই অভিযাত্রা করবে। কারণ কানপুরের ইংরেজ এবং খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের কোনো বিদ্বেষ নেই, কড়া আক্রমণের মুখে দুর্গের প্রতিরোধ গুড়ো হয়ে যাবে, বেসামরিক কর্মচারির দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে অস্ত্রাগার নিরাপদ স্থানেই অবস্থিত রয়েছে। কিন্তু স্যার হাফ হুইলার সেপাই লাইনের চাইতে দূরে যেতে চাইলেন না। সে জন্য সে ইটের একতলা দালানেই ঘুমোত নির্দেশ দিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে সেপাইদের সন্দেহ নিরসন করতে চেষ্টা করেছিলেন এবং ইউরোপীয় অধিবাসীদেরকে হঠাৎ বিক্ষোভে ফেটে পড়লে তাড়াতাড়ি কোনো নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। প্রত্যেক বিপদ সঙ্কেত শুনেই শাসকগোষ্ঠির নারী এবং শিশুরা পরিখার অভ্যন্তরে চলে আসতো। বিপদ সঙ্কেত মিথ্যা প্রমাণিত হলেই আবার তারা গৃহে প্রত্যাবর্তন করতো। সেপাইরা এ সিদ্ধান্তে এলো যে অফিসারদের তাদের প্রতি আর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। কোন দৃঢ় নীতি অবলম্বন করলে, কানপুরকে হয়তো রক্ষা করা সম্ভবপর হতো। যদি হুইলার ইউরোপীয় সামরিক, বেসামরিক অধিবাসীদের নিয়ে অস্ত্রাগার দখল করে ফেলতেন তাহলে সেপাইরা এভাবে চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতি করার জন্য সাহসী হতে পারতো না। তিনি যদি ভারতীয় সৈন্যদের সম্মানের ওপর নিজের বিশ্বাস স্থাপন করতেন, তাদেরকে অত্যাচার না করার নিশ্চয়তা দিতেন, তাহলে অবস্থা আয়ত্বের মধ্যে আসতে পারতো। শান্তির পর্দার অন্তরালে অবিশ্বাস এবং অর্ধবিশ্বাসে এ মিশ্রিত নীতি কোনো কাজে আসেনি। খোলামেলা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সবকিছু নিষ্পত্তি করার সময় অতীত হয়ে গেছে।

৩০ মে তারিখে স্যার হাফ হুইলার মহারাণীর ৩২নং রেজিমেন্টকে লখনৌতে পাঠিয়ে দিতে মনস্থ করলেন। কারণ এখনো কানপুর শান্ত আছে, কিন্তু সেখানে বিদ্রোহের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এখনো তাঁর নিজস্ব বাহিনী তাঁর সঙ্গে রয়েছে। তা ছাড়া আছে মহারাণীর ৮৪নং পদাতিক বাহিনীর কতিপয় সৈন্য এবং অফিসার। তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলে বিভক্ত হয়ে কলকাতা থেকে এসেছিলেন। ৩০ মে তারিখে লখনৌতে প্রকাশ্য বিদ্রোহ দেখা দিলো এবং ৩রা মে তারিখে ২জন অফিসার এবং ৫০জন সৈন্য সেখানে পাঠানো হলো। হুইলার লর্ড ক্যানিংকে লিখেছিলেন, “আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। আরো ইউরোপীয় সৈন্য না আসা পর্যন্ত আমার নিজের সৈন্য নিয়ে আমি প্রতিরক্ষা করে যাবো বলে স্থির করেছি।” সেদিন বিকেলবেলা খবর পৌঁছালো যে একটি অভ্যুত্থান অত্যাসন্ন হয়ে পড়েছে। যারা ওতে যোগ দেবে না, তাদেরকে পরিখা দুর্গের অভ্যন্তরে চলে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরের দিন রাজকোষ থেকে এক লাখ টাকা ওঠানো হলো। পরিখার ভেতরের সকলকে এক মাসের টাকা অগ্রিম দেয়া হলো। এ কাজ বিদ্রোহের পূর্বে সঙ্কেত হিসেবেই কাজ করেছে। উত্তেজিত সেপাইরা শেফার্ডকে বলেছে, ইউরোপীয় সৈন্য আসা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবে না, বাস্তবে করেওনি।

৪ তারিখ রাতের শেষ দিকে সেপাইরা বিদ্রোহ করলো। অনেক দিনের উৎকণ্ঠারও অবসান ঘটলো।

মনে হয়, অশ্বারোহী বাহিনীই বিদ্রোহে নেতৃত্বদান করেছিলো। শীগগির তারা ১ম পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিলো। কিন্তু তারা অফিসারদের ওপর কোনো রকম হামলা করেনি। ৫ তারিখে সকাল পর্যন্ত ৫৩ এবং ৫৬ নং রেজিমেন্ট লাইনে ছিলো। কিন্তু শীগগির ৫৬নং রেজিমেন্ট তাদের সেপাই ভাইদের ডাকে সাড়া দিলো। এ সম্বন্ধে থমসন লিখেছেন,সেনাপতির ভুলবশতঃ তাদের ওপর গুলি চালানো পর্যন্ত ৫৩নং রেজিমেন্ট স্থির ছিলো। এই কাজের ফলাফলের কথা চিন্তা করে আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়লাম। সেপাইরা শান্তভাবে তাদের লাইনে অবস্থান করছিলো, কেউ কেউ পাক চড়িয়েছে, বিদ্রোহ করার কোনো লক্ষণ পর্যন্ত নেই। বিদ্রোহীরা তাদের সঙ্গে যোগ দিতে বার বার অনুরোধ করেছে, কিন্তু তাতে তারা কর্ণপাত করেনি। যখন স্যার হাফ হুইলারের নির্দেশে ব্যাটারী থেকে তাদের গোলাবর্ষণ করা হতে থাকলো, বলতে গেলে তখই তারা বিদ্রোহে যোগ দিয়েছে। তারা আগে পরিখা ও প্রাকারের অভ্যন্তরস্থ দেশী সেপাইদের আহ্বান করেছিলো! কিন্তু তাদের সকলেই শেষ পর্যন্ত আমাদের পক্ষে ছিলেন। ১৫০ জন প্রাইভেট সেপাই ছাড়া তাদের আর বাকী সকলে ছিলো গোলন্দাজ বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত। ৫৩নং রেজিমেন্টের যে দলটিকে রাজকোষ রক্ষার কাজে নিয়োজিত করা হয়েছিলো, তারা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে চার ঘণ্টা কঠোর সংগ্রাম করেছে। দূর থেকে আমরা তাদের বন্দুকের শব্দ শুনতে পেলাম, কিন্তু তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে পারলাম না। এই রাজভক্ত রেজিমেন্টের অবশিষ্ট সেপাইরা শেষ পর্যন্ত তাদের অফিসারদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিলো। পরিখা থেকে ছ’শ গজ পূর্বদিকে তাদেরকে রাখা হয়েছিলো। ব্যারাকে আগুন না ধরা পর্যন্ত তারা নয় দিন তাদের অবস্থান রক্ষা করেছিলো। স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে তাদেরকে পরিখা প্রকারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। কিছু টাকা এবং বিশ্বস্ততার একখানা সার্টিফিকেটসহ বিদায় করে দেয়া হলো। স্যার জর্জ ফরেস্ট অবশ্য শেফার্ডের কথার উপর নির্ভর করে হুইলারের এ কাজের প্রতিবাদ করেছিলেন। কানপুর বিদ্রোহের ঘটনাবলী সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অল্প; তবু আমরা নিশ্চিত যে বিদ্রোহ হয়েছিলো, জুন এবং জুলাই মাসের নিমর্ম হত্যাকাণ্ডের কথাও সত্য। সেপাইরা রাজকোষ অভিমুখে ধাওয়া করলো। তালা ভেঙ্গে তারা রাজকোষ লুট করলো। কারাগারও আক্রমণ করা হলো, তারপরে বন্দীদের মুক্তি দেয়া হলো। তারপরে তারা দিল্লীর পথে মার্চ করে গেলো এবং কল্যাণপুরে গিয়ে থামলো। আকস্মিকভাবে সেপাইরা যখন কানপুরে ফিরে এলো, তখন নানা সাহেব জেনারেল হুইলারকে লিখে জানালেন যে তিনি পরিখা প্রাকার আক্রমণ করতে যাচ্ছেন, এ থেকে জেনারেল হুইলারের ভবিষ্যদ্বানী সত্য মনে হয়। মধ্যবর্তী সময়ে কি ঘটেছিলো? তাঁতিয়া টোপী নানাকে বলপূর্বক সেপাইদের সংগ্রামের নেতৃত্বদান করতে বাধ্য করেছিলেন। প্রথমে তিনি দিল্লী যেতে কিংবা কানপুরে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজী হননি। পরে তাঁর ওপর জোর প্রয়োগ করে তাকে রাজী করানো হয়েছিলো। ব্রিটিশ সরকার কোনো বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে তোপধ্বনি করার জন্য দ্বিতীয় বাজীরাওকে দুটো কামান উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের কাজে সেগুলোকে একেবারেই অকেজো বলা চলে। নানার অধীনে যে সকল সেপাই ছিলো তাদের সর্বমোট সংখ্যা ছিলো তিন’শ, তারা তিনটি পদাতিক এবং একটি অশ্বারোহী রেজিমেন্টকে বাধা দিতে পারতো তা বিশ্বাস করা কষ্টকর। সুতরাং তাতিয়া টোপী বাধ্য করেছে বলে গুজব শোনা যায়, তার মধ্যে কিছু পরিমাণ সত্য থাকলেও থাকতে পারে। একবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে নানার সেপাইরা ইন্দোর এবং গোয়ালিয়রেযেমন হয়েছে, তেমনিভাবে সেপাইদের সঙ্গে হাত মিলাতে পারতো।

অন্য বর্ণনা থেকে জানা যায়, দেশীয় কিছুসংখ্যক অফিসারের একটি প্রতিনিধিদল নানার সঙ্গে দেখা করে জানান যে গোটা একটা রাজত্ব তার জন্য অপেক্ষা করে আছে, তিনি যদি গ্রহণ না করে শত্রুর পক্ষ সমর্থন করেন তাহলে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। সম্ভবতো নানা দু’দিক চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের টোপই গিলেছিলেন। এর সঙ্গে তাঁতিয়া টোপী তাঁকে জোর করেছিলেন বলে যে বণর্না আছে, তার কোনো মিল নেই। নানা চরিত্র সম্বন্ধে অল্প হলেও যেটুকু জানতে পারা যায় তার সঙ্গেও কোনো সঙ্গতি নেই। তবে এ দু’টো গল্পের মধ্যে কোনটা সত্য সে সম্বন্ধে আমাদের মতামত ব্যক্ত করার কোনো অবকাশ নেই। নানা নিজে সেপাইদের কল্যাণপুর গিয়ে তাদেরকে ফিরে আসতে প্রলুব্ধ করেছিলেন, না কি তাঁর প্রতিনিধি কল্যাণপুরে সেপাইদের সঙ্গে দেখা করে, অতিরিক্ত পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে পরিখা প্রকারের অল্প সংখ্যক ইংরেজ সৈন্যকে হত্যা করার জন্য প্ররোচিত করেছিলেন, সে সম্বন্ধে কোনো কিছু নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। নানক চাঁদ নামে নানা সাহেবের এক চরম শত্রুর মতে, মারাঠা রাজপুত্রদের সঙ্গে সেপাই নেতৃবৃন্দের দীর্ঘদিন থেকে যোগাযোগ ছিলো। বিদ্রোহ হওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে তাদের কয়েক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু শেরারের মত হলো, পূর্বাহ্নে সেপাইদের সঙ্গে নানার কোনো স্পস্ট যোগাযোগ ছিলো না। তাই যদি থাকতো, তাহলে রাজপথে গিয়ে প্ররোচিত করে; অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনতে হতো না। থর্ণহিলও ভিন্নভাবে একই সিদ্ধান্তে এসেছেন, তিনি বলেন, “নানার সঙ্গে সেপাইদের কোনো যোগাযোগ থাকলে তারা দিল্লী অভিমুখে ধাওয়া করতো না। কর্ণেল উইলিয়াম কানপুর বিদ্রোহ সম্পর্কে তদন্ত করেছেন, কিন্তু তিনি নানার সঙ্গে সেপাইদের কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা পূর্ব সম্পর্ক খুঁজে পাননি। ঘটনার গতি থেকে এটুকু অনুমান করা যায় যে সেপাইরা সম্ভ্রান্ত বংশের কোনো নেতার প্রয়োজন অনুভব করছিলো। সে কারণে ভয় এবং প্রলোভন দু’টিই নানার চোখের সামনে তুলে ধরেছিলেন, প্রথমে তিনি দ্বিধা করেছিলেন, পরে অবশ্য তিনি তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৫৯ সালে লিখিত এক পত্রে নানা স্বীকার করেছেন যে তখন তিনি এবং তার পরিবার ছিলো সেপাইদের কৃপার উপর নির্ভরশীল। সেজন্য তিনি তাদের সঙ্গে যোগ দিতে রাজী হয়েছেন। জনশ্রুতি আছে, দিল্লী যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আজিমুল্লাহ্ তাকে এই বলে বুঝিয়েছিলেন যে দিল্লীতে তিনি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন না, কিন্তু কানপুরে তিনি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবেন। তারপরে সেপাইরা শহরে ফিরে এসে ধনী ব্যক্তিদের বাড়ি আক্রমণ করতে লাগলো। নানা পরিখা প্রাচীর আক্রমণ করবেন, এ খবর হুইলারকে কেননা জানিয়েছিলেন তা ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রতিদিন পরিখা প্রকারের ওপর কামানের গোলা ছোঁড়া হতে লাগলো। বিদ্রোহীদের সুযোগ-সুবিধা যথেষ্ট থাকলেও তারা একটাও প্রধান আক্রমণ পরিচালনা করেনি।

হতাশার দুর্গে আশ্রিত যারা তার মধ্যে অধিক হচ্ছে নারী এবং শিশু। প্রত্যেক সক্ষম পুরুষ মানুষ ছুটির সময়ে হলেও যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তা ছাড়া, অবরুদ্ধ ব্যক্তিদের রাতদিন অত্যন্ত সতর্কভাবে থাকতে হতো। স্যার হাফ হুইলারও বৃদ্ধ বয়সের জন্য যুদ্ধের পুরোপুরি দায়িত্ব বহন করতে পারছেন না। অনেক ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত তরুণ সুদক্ষ ক্যাপটেন মুরকেই বহন করতে হচ্ছে। অস্ত্রশস্ত্রের কোনো অভাব নেই। একেক জন সৈন্যের জন্য তিনটা থেকে সাতটা এমনকি আটটা পর্যন্ত বন্দুক বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য সরবরাহও হয়ে উঠছিলো না। খুব শীগগির খাদ্য নিঃশেষ হয়ে এলো। তারপরে সকলে দিনে একবেলা আহার করতে লাগলেন। খাদ্যের অভাব মেটানোর জন্য সর্বপ্রকার চেষ্টা করা হলো। একাধিকবার ব্রাহ্মণী ষাড় চরতে এলে গুলি করে মারা হলো। কিন্তু জন্তু শিকার করার চেয়ে প্রাকারের ভেতরে নিয়ে আসাই হচ্ছে সবচেয়ে কষ্টকর। যাহোক ষাঁড়ের মাংস দিয়ে তাড়াতাড়ি সূপ তৈরি করা হলো। সে মাংসের পরিমাণ এতো কম যে বাইরের পোস্টে পাহারা রত মানুষের ভাগে একটুকু মাংসও পড়লো না। একবার একটা ঘোড়ার মাংস দিয়েও অনুরূপ সূপ তৈরি করা হয়েছিলো, কিন্তু মহিলারা ঘোড়ার মাংস খেতে রাজী হলেন না। ক্যাপটেন হ্যালি ডে ঘোড়ার সূপ বানানোর সময়ে বিদ্রোহীদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। এমন কি দেশী পেঁকি কুকুরের মাংস খেয়েও জীবন ধারণ করতে হয়েছে।

ব্যারাকের হাল্কা দেয়াল জুন মাসের প্রচণ্ড গরমে কোনো বাধা দিতে পারলো না। অনেকেই গর্মী রোগে প্রাণ হারালো। বন্দুক ধরা অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো অনেক সময়। দ্বিপ্রহরের প্রচণ্ড গরমে বন্দুকের ক্যাপে বিস্ফোরণ হয়ে যেতো। অথবা অসহ্য গরমের জন্য নল স্পর্শ করা যেতো না। প্রচণ্ড উত্তাপে শীগগিরই মরা জন্তু জানোয়ারের শরীর থেকে গন্ধ ছুটতে লাগলো। বাতাস দূষিত হয়ে উঠলো। অবরুদ্ধ প্রাকার বাসীদের জীবন অতীষ্ঠ হয়ে উঠলো।

শুধু খাদ্য নয়, পানীয় জলেরও অভাব পড়েছে। দুর্গ প্রকারের একমাত্র কুয়োর কোনো ঢাকনা ছিলো না। কেউ পানি আনতে গেলে সেপাইরা তাদের উপর গুলি করে। এমন কি গভীর রাতেও পানি আনা সম্ভব ছিলো না। এক বালতি পানির মূল্য ছিলো দশ থেকে বারো শিলিং। জন ম্যাক কিলপ নামে একজন বেসামরিক কর্মচারি নিজেকে কুয়ো ক্যাপটেন’ বলে ঘোষণা করে কষ্টেসৃষ্টে পানি এনে দুর্বল অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করতে লাগলেন। তিনি অনেকবার পানি আনতে সমর্থ হলেন, কিন্তু একবার গিয়ে গুলির আঘাতে আহত হলেন এবং তার একটু পরেই প্রাণত্যাগ করলেন। মারী থমসনের ভাষায়, মহিলা এবং শিশুরা ভয়ঙ্করভাবে জলকষ্ট ভোগ করতে লাগলো। পুরুষ মানুষেরা জলকষ্ট বিশেষ করে শিশুদের পানি পানি’ বলে চীৎকার কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না। অনেক সময় বিপদের কথা জ্ঞান না করে ছুটে যেত। বহু কষ্ট করে অল্প পরিমাণ পানি সংগ্রহ করা যেতো। আমি নিজে দেখেছি, আমার ভায়ের ছেলেমেয়েকে জলের বদলে পুরোনা জলের ব্যাগের এক টুকরো চামড়া চুষতে দেয়া হয়েছিলো।

অবরোধ করার এক সপ্তাহ পরেই অবরুদ্ধ ব্যক্তিবৃন্দ এক ভয়াবহ বিপত্তির সম্মুখীন হলেন। গুলি বা অন্য কিছু থেকে ব্যারাকের খড়ের চালে আগুন ধরে গেলো। তারই তলায় অসুস্থ লোকেরা ঠাঁই নিয়েছে। আগুন নেভাবার জন্য সাধ্যমতো সকল রকমের চেষ্টা করা সত্ত্বেও গোলন্দাজ বাহিনীর দু’জন সৈন্য আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেলো। সমগ্র ব্যারাক পুড়ে যাওয়ার দরুন আহতদের কোনো ঔষুধপত্র দেয়াও সম্ভবপর হয়নি। তৃষ্ণার্তদের জলের জন্য কাতরানি, জ্বরের উত্তাপ এবং দগ্ধীভূত শরীর এসব দেখলে বুক ভেঙ্গে যায়। আমরা কি করবো জানতাম না। মাথায় উপরের ছাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে কোনো মহিলা পরিখার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখানে মাটির উপর তাঁদেরকে ঘুমোতে হতো।

সবসময় মানুষ মরছে। মেজর লিন্ডসে একটা গুলির আঘাতে অন্ধ হয়ে কদিন পরেই মারা গেলেন। তার একদিন কি দু’দিন পরে তাঁর স্ত্রীও মারা গেলেন। হেভারডেন এক মহিলাকে কিছু পানি দেয়ার সময় আহত হলেন, এক সপ্তাহ অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগে প্রাণ হারালেন। লেফটেনান্ট এফফোর্ড বারান্দায় উপবিষ্ট অবস্থায় গুলির আঘাতে নিহত হলেন। মিসেস হোয়াইট দু’বাহুর আড়ালে দুটি যমজ শিশু নিয়ে স্বামীসহ দেয়ালের পাশে হাঁটছিলেন। মাত্র একটি গুলি তাঁর স্বামীকে নিহত করলো এবং তার দুটি বাহু ভেঙ্গে দিলো। ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ হিলার্সর্ডন বারান্দায় তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময়ে আহত হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন। সেনাপতির সন্তান লেফটেনান্ট হুইলার পরিখাতে আহত হয়েছিলেন। তিনি তার কক্ষে একটি সোফার উপর উপবিষ্ট অবস্থায় গুলি খেয়ে বৃদ্ধ বাবা এবং বোনের সামনে ধড়ফড় করে মারা গেলেন।

ইউরোপীয় অফিসারদের ভারতীয় পরিচারকেরাও তাদের প্রভুদের দুঃখে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। পরিখা প্রাকারে যে সকল ভারতীয় পরিচারক ছিলো, তাদের সংখ্যা অল্প ছিলো না। থমসন বলেন, লেফটেনান্ট ব্রিজকে সাহায্য করবার সময় গুলির আঘাতে তাদের তিনজনেই প্রাণ হারায়। লেফটেনান্ট গোডের এক চাকর কিছু খাবার হাতে এক ব্যারাক থেকে অন্য ব্যারাকে যাবার সময় মাথায় গুলি লেগে প্রাণ হারায়। আরো বহু ভারতীয় চাকর মারা যায়।

মৃতদেহ ভালোভাবে সমাহিত করার অবকাশ কই? কোনো রকমে রাতের বেলা একটু গর্ত খুঁড়ে চাপা দিলেই হলো। প্রথম সকালের প্রথম নিহত লাশকে কফিনে ঢেকে সমাহিত করা হয়েছিলো। তার পরে আর কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাধিস্থ করা হয়নি।

মানুষ যখন মানুষের বুকে মৃত্যুবাণ ছুঁড়ে মারছে, তখনো প্রকৃতি তার সৃষ্টিকার্য বন্ধ করেনি। এই ভয়ংকর দুঃসময়েও শিশু জন্ম নিচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। কিছুসংখ্যক গর্ভবতী মহিলা মাতৃত্বের সংকটকালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ছেলেমেয়েরা মা বাবাদের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরের বিপদ সম্পর্কে অজ্ঞান এবং ভেতরের একটানা একঘেঁয়ে জীবনে বিরক্ত হয়ে মা-বাবার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে তারা দেয়ালের বাইরে চলে আসতো। কিন্তু গুলি নারী-পুরুষ, শিশু এবং বৃদ্ধের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করতো না।

এ ছিলো এক ভয়ংকর যুদ্ধ। এতে অতীত প্রথা এবং মানবিক আইনের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাই প্রদর্শন করা হয়নি। দু’পক্ষের কোনো পক্ষই অপর পক্ষের বন্দীকে রেহাই দেয়নি। অবরুদ্ধদের হাতে প্রথমে যে বিপক্ষের সেপাইটি ধৃত হয়েছিলো, সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলো। ম্যারী থমসন লিখেছেন, “এটা আমাদের কাছে আকাঙ্ক্ষিত ছিলো না। আমরা কিছুতেই চাইনি যে আমাদের এ দুরবস্থার কথা বিদ্রোহীরা জানতে পারুক। এ ভুলের প্রতিকার স্বরূপ সিদ্ধান্ত নিলাম, ভবিষ্যতে কোনো সেপাইকে বন্দী করা হলে সদর দপ্তরের অনুমতি না নিয়েই হত্যা করবো।”

অল্প সংখ্যক রসদপত্র এবং উপাদান নিয়ে ক্রমশঃ ক্ষীয়মাণ প্রতিরক্ষা বাহিনী অনির্দিষ্ট কালের জন্য রুদ্ধ অবস্থায় থাকতে পারে না। যদিও পূর্বদিক থেকে ইউরোপীয় সৈন্যের আগমন সম্ভব, তবু কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন। হয়ে গেছে। লখনৌ হচ্ছে একমাত্র স্থান যেখান থেকে অবরুদ্ধরা অবিলম্বে সাহায্য চাইতে পারে। লখনৌতে জেনারেল হুইলার অবরোধের ২য় সপ্তাহেই সাহায্যের জন্য আবেদন করেছেন। “আমরা গত ৬ তারিখ থেকে নানা সাহেব কর্তৃক অবরুদ্ধ অবস্থায় আছি। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে ৪ঠা মে তারিখের বিদ্রোহী সব দেশীয় সেপাইরা।” শত্রুর কাছে ২টা ২৪ পাউন্ড গুলি ছোঁড়ার মতো কামান এবং আরো কয়েকটি কামান রয়েছে। আমাদের কাছে আছে মাত্র ৯ পাউন্ড গুলি ছোঁড়ার মতো আটটি কামান। সমস্ত খ্রীস্টান অধিবাসীরা অমাদের সঙ্গে রয়েছে পরিখা প্রাচীরের অন্তরালে। আমরা অত্যন্ত মহৎ এবং বিস্ময়করভাবে প্রতিরক্ষা করে আসছি। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি সীমাহীন এবং মর্মন্তুদ। আমরা সাহায্য চাই, সাহায্য, সাহায্য। যদি মাত্র দু’শ মানুষ আমরা পাই তাহলে বদমায়েশদের শায়েস্তা করতে পারি এবং তোমাদের সাহায্য করতে পারবো। কিন্তু লখনৌরও নিজস্ব অসুবিধা রয়েছে। এখন লখনৌ কর্তৃপক্ষ একজন সৈন্যকে বাইরে যেতে দিতে পারেন না। এখনো অবরোধ কাজ শেষ করা হয়নি, শত্রুসৈন্য খুব দূরে নয়। হেনরী লরেন্স এবং তাঁর উপদেষ্টাবৃন্দ কানপুরের তাদের দেশীয় ভাইদের ভগবানের দয়ার উপর সোপর্দ করলেন। স্যার হেনরী লরেন্স লিখলেন, “আমরা এখানে শক্তিশালী, কিন্তু নদী পার হয়ে আপনাদের সাহায্য করতে গেলে আমরা একটা বিরাট প্রতিরোধের সুযোগ হারাবো। আমাকে স্বার্থপর মনে করবে না।” সুতরাং গভর্ণর জেনারেল সাহায্যের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা ছাড়া ইউরোপীয় সৈন্যদের সামনে আর কোন পথ খোলা রইলো না। শত্রুদের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

জেনারেল হুইলার কিন্তু আশা ছাড়লেন না। ছাউনিতে ছিলো অনেক ইউরোপীয় লোক তারা স্থানীয় ভাষা ভালো রকমভাবে বলতে পারতেন। স্বদেশীদের মতো তাদের অনেকেই ছিলো কৃষ্ণাঙ্গ। কেউ তাদেরকে কোনো সন্দেহ করতো না। ব্লেনম্যান নামে একজন ইউরোপীয় ভদ্রলোক একবার কি দু’বার ছদ্মবেশে নানার শিবিরে গিয়ে কোনো প্রকার ক্ষতির সম্মুখীন না হয়েই ইউরোপীয় ছাউনিতে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। তার ওপর আদেশ হলো, তিনি যেনো এলাহাবাদ যেতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পথে তিনি ধরা পড়লেন। যাবতীয় জিনিস-পত্র হারিয়ে কোনো রকমে ফিরে আসতে সক্ষম হলেন। পূর্বদিকের দেশের অধিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টাও করা হয় কয়েকবার। কিন্তু তাতে কোনো ফলোদয় হয়নি। তারপরে শেপার্ড নামে এক ভদ্রলোকের ওপর নির্দেশ দেয়া হলো তিনি যেনো শহরে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করে আনেন। শুধু সংবাদ যোগাড় নয়, ব্রিটিশের প্রতি মৈত্রীভাবাপন্ন প্রভাবশালী স্বদেশীয়দের সাহায্যে বিদ্রোহী সেপাইদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরাতে চেষ্টা করারও নির্দেশ তাঁকে দেয়া হলো। শেপার্ড বলেছেন, সেনাপতি আমাকে শত্রুদের কার্যকলাপ এবং প্রকৃত ইচ্ছা কি, এ সম্বন্ধে সঠিক সংবাদ আনতে নির্দেশ করলেন। তা ছাড়া, লখনৌ কিংবা এলাহাবাদ হতে কোনো সাহায্য পাওয়া যেতে পারে কীনা সে সম্বন্ধেও নিশ্চিত হয়ে আসার কথা বললেন। তারপরে আরো কিছুক্ষণ এটা সেটা বলার পর তিনি আমাকে নান্নে নওয়াবের (মুহম্মদ আলী খান) সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বললেন। প্রধান সেনাপতি আমাকে জানালেন তিনি আমাদের প্রতি বিশ্বস্ত এবং আমরাও তাঁর ওপর আস্থা রাখতে পারি। বিদ্রোহীদের মধ্যে কোনো রকমের ভাঙ্গন ধরাতে পারা যায় কিনা, তাঁকে সে চেষ্টা করে দেখতে বলবে এবং তারা যদি আমাদেরকে নাজেহাল না করে এবং আপোষে এ স্থান থেকে চলে যেতে দেয়, তাহলে তাদেরকে আমি ভালোমতো সন্তুষ্ট করবো।” তিনি আরো জানালেন, যদি আমি নান্নে নওয়াবের সঙ্গে ব্যর্থ হই, তাহলে যেনো মহাজন এবং অন্যান্য প্রভাবশালী দেশীয় ব্যক্তিদের কাছে গিয়ে স্বীয় অভিলাষ ব্যক্ত করি। তারা সাহায্য করতে রাজী হলে তদেরকে পুরস্কার দেয়ার কথা বলতেও আমাকে বলা হলো। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে এক লাখ টাকা পুরস্কার দেয়ার অধিকার দেয়া হলো। তা ছাড়া, আমাদের কাজ করতে দিয়ে কোনো লোক যদি প্রাণ হারায় তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ করার কথা বলার অধিকারও আমাকে দেয়া হলো।

এ সঙ্কটের সময়ে জেনারেল হুইলার যে নান্নে সাহেবের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করেছিলেন, সে সম্বন্ধে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ তিনি ব্যাটারী থেকে ইংরেজ ছাউনিতে রাত দিন সমানে গোলাবর্ষণ করে ইউরোপীয়দের জীবন অতীষ্ঠ করে তুলেছিলেন। সেপাইরা দিল্লীর রাস্তা থেকে কানপুরে ফিরে এসে নগরের প্রাসাদ আক্রমণ করলো। তিনি পরে সেপাইদেরকে বশ করেন এবং গোলন্দাজ বাহিনী তাঁর অধীনে ছেড়ে দেয়া হয়। অথচ কামান সম্বন্ধে তার সামান্য জ্ঞান ছিলো বলে মনে হয় না। এ রকমের দুর্বল মেরুদণ্ডের দোদুল্যমান মানুষ সেপাইদের সংগ্রামে নেতৃত্বদান করার উপযুক্ত মানুষ, কিছুতেই হতে পরে না। সুযোগ পেলেই বিশ্বাসঘাতকতা করবে। এ ধারণা ছিলো জেনারেল হুইলারের মনে। কিন্তু শেপার্ডের ভাগ্য ব্লেনম্যানের মতো প্রসন্ন ছিলো না। ছাউনি ত্যাগ করার অল্পক্ষণ পরেই তিনি ধৃত হলেন। তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো। হ্যাভলকের সৈন্য কানপুরে না আসা পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ অবস্থাতেই কাটিয়েছিলেন।

এ সময়ের মধ্যে নানা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি ক্ষমতা গ্রহণ করলেন। ২নং অশ্বারোহী বাহিনীর সুবাদার টিকা সিংকে প্রধান সেনাপতি এবং দলঞ্জন সিং এবং দীনদয়াল, এ দু’জন সুবাদারকে কর্ণেলের পদে প্রমোশন দেয়া হলো। ফৌজদারী বিচারের ভার নানার ভাই বাবা ভাটের ওপর অর্পণ করা হলো। তস্কর এবং অন্যান্য অপরাধীদেরকে তার সামনে আনা হতো। বিচার করে যথাযথ দণ্ড দেয়া হতো।

২৪শে জুন তারিখে জেনারেল হুইলার লখনৌতে তার সর্বশেষ সংবাদ প্রেরণ করেন। তা হলো হতাশাচ্ছন্ন প্রাণের সর্বশেষ চীৎকার। তিনি লিখেছিলেন, “আমাদের এখন ব্রিটিশ মনোবল ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। কিন্তু বেশিদিন এ মনোবলও অটুট থাকবে না। কিছুতেই আমরা খাঁচাবদ্ধ ইঁদুরের মতো বেশিদিন বাঁচতে পারবো না।” ছাউনিতে খাদ্য ফুরিয়ে এসেছে। এখন সকলে আধপেটা খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। এ অবস্থাও চারদিনের বেশি চলতে পারে না। তাদের গোলাবারুদও ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু কোথাও থেকে গোলা-বারুদ সংগ্রহ করার আশাও নেই। বৃষ্টি যে কোনদিন আসতে পারে। যদি আসে তাহলে ব্রিটিশ সৈন্যদের অসুবিধার অন্ত থাকবে না।

অবশেষে শক্ররা তাদেরকে মুক্তি দিলো। এক মহিলাই তাদের জন্য শান্তির অলিভ বৃক্ষের শাখা বয়ে এনেছিলেন। ম্যারী থমসন লিখেছেন, “অবরোধের ২৬ দিনের দিনে আমার অবস্থানে গোলাবর্ষণ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ ছিলো। প্রহরীরা চীৎকার করে জানালো যে একটি মেয়েমানুষ এগিয়ে আসছে। সকলে তাকে গুপ্তচর মনে করলো এবং একজন প্রহরী তাঁর দিকে তাক করে রাইফেল বাগিয়ে ধরলো। আমি তার হাতে আঘাত করে মহিলাটিকে রক্ষা করলাম। তার বুকে জড়ানো একটি শিশু সন্তান। পায়ে জুতো কিংবা মোজা কিছু নেই। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আমি তাকে উঠিয়ে ছাউনিতে নিয়ে আসলাম। তখনই তাকে চিনতে পারলাম। তিনি হচ্ছেন এক ধনী পরিবারের মহিলা মিসেস গ্রীনওয়ে। তাঁরা কানপুর বাস করতেন এবং ক্যান্টনমেন্ট অঞ্চলে ব্যবসা করছিলেন। মিসেস গ্রীনওয়ের সঙ্গে ইংরেজিতে লেখা কোনো নাম-স্বাক্ষরবিহীন একখানি পত্র ছিলো। তাতে সম্বোধন করা হয়েছে। অশেষ মমতাময়ী সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার প্রজাবৃন্দের মধ্যে যারা লর্ড ডালহৌসির কার্যকলাপের সঙ্গে কোনো প্রকারে সংযুক্ত নয়, তারা অস্ত্র সংবরণ করে নিরাপদে এলাহাবাদ চলে যেতে পারে।” প্রধান সেনাপতির কাছে পত্রখানি নিয়ে যাওয়া হলো। জেনারেল হুইলার তখনো কলকাতা থেকে সাহায্যের প্রত্যাশা করেছিলেন। সেজন্য নানা সাহেবের সঙ্গে কোনো রকমের আপোষ-মীমাংসার আলোচনায় তিনি আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু মুর সেনাপতিকে বোঝালেন যে মহিলা এবং শিশুদের খাতিরে তাদের এলাহাবাদে গমন করাই অধিকতররা সঙ্গত। ব্রিটিশ সৈন্যদের অবস্থা তখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া তাদের কাছে অপর কোনো সম্মানজনক পন্থা খোলা ছিলো না। তার পরের দিন আজিমুল্লাহ এবং জাওলা প্রাসাদ ইংরেজদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে এলেন। কথাবার্তায় ব্রিটিশ সৈন্যদের ছাউনি ত্যাগ করার কথা স্থির হলো। আরো স্থির হলো প্রত্যেক সৈন্যকে তার অস্ত্র এবং ৬০ রাউণ্ড গুলিগোলা নিয়ে যেতে দেয়া হবে। আহতদের জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করা হবে। রসদসহ সৈন্যদের বয়ে নিয়ে যাবার জন্য নৌকা ঘাটে অপেক্ষা করবে, এ রকম কথাবার্তা পাকা হলো। আজিমুল্লাহ নানা সাহেবের কাছে এ সকল প্রস্তাব নিয়ে গেলেন, কিন্তু নানা সাহেব জিদ করলেন, সৈন্যদেরকে রাতের অন্ধকারেই ছাউনি ছাড়তে হবে। কিন্তু ব্রিটিশ সৈন্য পরদিন সকাল হওয়ার আগে ছাউনি ত্যাগ করতে অক্ষমতা জানালো। অবশেষ দূত এসে নানা সাহেবের মৌখিক অনুমতি জানিয়ে গেলো।

পরের দিন ছাউনির সৈন্যদের নৌকায় বয়ে নেওয়ার জন্য এলো ১৬টি হাতী এবং ৭০ থেকে ৮০খানা পাল্কী। তাতে সকলের স্থান হয়নি। ক্যাপটেন মুর, যিনি ছাউনি ত্যাগের সবকিছু রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছিলেন। তাঁকে দ্বিতীয়বারে নৌকাতে আসতে হয়। নারী এবং শিশুদের হাতির পিঠে এবং গরুর গাড়িতে বসানো হলো। তাছাড়া পদমর্যাদা নির্বিশেষে সকল পুরুষ মানুষকে হেঁটে আসতে হলো। প্রথম দল ছাউনি ছাড়ার পরে সেপাইরা ছাউনিতে এসে প্রবেশ করলো। সেপাইরা তাদের পুরোনো অফিসারদের মধ্যে কে কে মৃত্যু বরণ করেছেন জানতে চাইলো। ম্যারী থমসন বলেছেন, অফিসারদের মৃত্যু সংবাদ শুনে সেপাইরা অত্যন্ত দুঃখিত হলো। হতভাগ্য বুড়ো স্যার হাফ হুইলারের পত্নী এবং কন্যাকেও হেঁটে নৌকাতে আসতে হলো। মেজর ভাইব্রাট সকলের শেষেই ছাউনি ত্যাগ করেছিলেন। বিদ্রোহী সেপাইদের অনেকে যারা এই অফিসারের অধীনে চাকুরি করতো তাঁর মালপত্র বয়ে আনার জন্য জেদ করতে লাগলো। গরুর গাড়িতে মালপত্র বোঝাই করে মেজরের পত্নী এবং পরিবারকে নৌকা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন। বেলা ৯টার সময়ে সর্বশেষ নৌকাতে যাত্রী বোঝাই করা হলো। পথে যে তাদের কোনো বিপদ ঘটতে পারে, এ প্রসঙ্গে ম্যারী থমসন এবং ভালফোসে ছিলেন সম্পূর্ণ রকমের অজ্ঞ। নদী অগভীর। নৌকাগুলো ভেসে চলছিলো না। নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সকল যাত্রীকেই নৌকা ঠেলে নিয়ে যেতে হচ্ছিলো।

তারপরে কি ঘটলো তা আমরা ম্যারী থমসনের জবানীতেই ব্যক্ত করেছি, “সে সকালে নদীর তীরে প্রচুর লোক সমাগম হয়েছিলো। হাজার হাজার নরনারী অবাক বিস্ময়ে তাদের ভূতপূর্ব শাসকদের বিদায় দৃশ্য দেখছিলো। তারপরে যে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার বর্ণনা দেবার জন্য ম্যারী থমসন এবং ডালফোসে ছাড়া আর কেউ জীবিত ছিলেন না।

থমসন লিখেছেন, “মেজর ভাইব্রাট তার নৌকায় অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই নৌকা ছাড়তে নির্দেশ দেয়া হলো। তারপরে একটি দেশী নৌকা থেকেই প্রত্যেক নৌকার মাঝিকে নেমে আসার সঙ্কেত দেয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা তীরের দিকে চলে গেলো। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লাম। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলো। নৌকা ছাড়ার পূর্বেই এ সকল মাঝি আমাদের নৌকার খড়ের ছাদে জ্বলন্ত কয়লা রেখে গিয়েছিলো। মাঝিদের ঝাঁপ দিয়ে পড়ে পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে সকল সেপাই মালপত্রসহ মেজর ভাইব্রাটকে এগিয়ে দিতে এসেছিলো, তারা ব্রিটিশ সৈন্যদের দিকে তাক করে গুলি ছুঁড়তে লাগলো। ঠিক সেই সময়েই নৌকগুলোতে আগুন জ্বলে উঠলো। আমরা সংশয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। পনেরো ষোলজন অশ্বারোহী সৈন্যের গুলির জবাবে আমরাও গুলি ছুঁড়েছিলাম। তারপরে শুরু হলো সবচেয়ে ভয়াবহ দুযোগ। অধিকাংশ নৌকা সরানো যায় না। যাত্রীরা নৌকা থেকে লাফ দিয়ে ঠেলে নৌকাকে ভাসিয়ে নিতে চেষ্টা করতে লাগলো। তীর থেকে ছুটে আসছে বন্দুকের গুলি আর নৌকার ছাউনিতে লকলকে আগুনের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। মহিলা ও শিশুরা নৌকা থেকে নেমে নৌকার পেছনে গলা অবধি ডুবিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা গুলির আঘাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিলেন। শুধু ভাইব্রাটের নৌকাখানাই গভীর জলে গিয়ে পড়লো। তার ছাদেও আগুন লাগেনি। থমসন এ নৌকার কাছে সাঁতরে গেলে তাঁকে ওপরে টেনে তোলা হলো। ঘাট থেকে দ্বিতীয় নৌকাখানি ছাড়া হয়েছিলো। কিন্তু জলের নীচে গুলি এসে লাগায় তা ডুবে গেলো। যাত্রীদেরকে ভাইব্রাটের নৌকায় তুলে নিয়ে প্রাণ রক্ষা করা হলো। লগি এবং কাঠের টুকরোর সাহায্যে নৌকাটিকে গুলির রেঞ্জের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলো। চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুটে আসছে। প্রায় দুপুরের সময়ে গাদা বন্দুকের রেঞ্জের বাইরে নৌকাকে নিয়ে আসতে সমর্থ হলো। কিন্তু সমস্ত দিন ধরে তাদের ওপর রাইফেলের গুলি চালানো হলো। রাতের বেলায় জ্বলন্ত তীর নিক্ষেপ করা হতে লাগলো এবং নৌকাখানায় আগুন লাগিয়ে দেবার জন্য একখানা জ্বলন্ত নৌকা স্রোতে ভাসিয়ে দেয়া হলো।

সকালের দিকে অল্পক্ষণের জন্য তাদের ওপর কোনো আক্রমণ করা হয়নি। কিন্তু তারা নদীতে স্নানরত কতিপয় লোকের কাছে জানতে পেলো বাবু রাম বক্স নামে একজন প্রভাবশালী জমিদার তাদের ওপর আক্রমণ করবার জন্য নজফগড়ে আঁটঘাট বেঁধে অপেক্ষা করছে। বেলা ২টার সময় তারা সে আতঙ্কিত স্থানে পৌঁছালো। দুর্ভাগ্য তাদের, সে সময় নৌকাখানি চড়ায় আটকা পড়লো। তারা তীরের রাইফেলের গুলির রেঞ্জের বাইরে নয়। একটা কামান আনা হলো, কিন্তু সেটা অকেজো হয়ে গেলো। সূর্যোদয়ের সময় কানপুর থেকে নৌকায় করে একদল সশস্ত্র সেপাই নিয়ে আসা হলো। তাদের নৌকাখানা বালুচরে আটকা পড়লো। আত্মরক্ষাকারীরা প্রাণপণে আক্রমণ করে অনুসরণকারীদের ধ্বংস করতে চাইলো। আবার তাদের নৌকা বালুচরে আটকা পড়লো। অতি শীগগির প্রবল এক ঘুর্ণিবায়ুর তাড়নায় নৌকা মুক্ত হলো। এখনো তাদের বিপদ কাটেনি। সকালবেলা দেখা গেলো, গাঙের অনাব্য অংশে চলে গেছে, অনুসরণকারী শত্রুরাও বেশি দূরে নয়। দু’টি পুরোদিন আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, নদীর পানি ছাড়া কিছুই খেতে পায়নি, শরীরে এককণা শক্তিও নেই। এ রকম অবস্থাতেও তারা আত্মরক্ষার প্রবল সংগ্রাম করে যাচ্ছে। ভাইব্রাট থমসন, ডালফোসে এবং অপর কয়েকজন আক্রমণকারীদের ওপর আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন। সেপাই এবং জনতা তাদের আক্রমণ বরদাস্ত করতে পারলেন না। তারা ছত্রভঙ্গ করে পলায়ন করলো। কিন্তু ফিরে এসে দেখে, নৌকা চলে গেছে। অনুসরণকারীদের বাধা দিতে সক্ষম না হওয়ায় বেপরোয়া ব্রিটিশ সৈন্যের ক্ষুদ্র দলটি একটি মন্দিরের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেখানে তাদের কোনো খাদ্য ছিলো না। অল্পমাত্র পচা পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করেছিলো। অতি শীগগির সে আশ্রয়ও ত্যাগ করে তাদের আবার নদীতে আসতে হলো। এ সময়ে তাদের সংখ্যা সাতজনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে থেকে দু’জনকে সাঁতার দেয়ার সময় গুলি করে হত্যা করা হলো। তৃতীয় জন বালুচরে এলে তার মাথায় গুলি লাগে। অবশেষে অনুসরণকারীরা অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকলো। তিন ঘণ্টা অবিরাম নদীতে সাঁতার কাটার পরে অবশিষ্ট যারা জীবিত আছেন একটু বিশ্রাম নিতে মনস্থির করলেন। তারা তীরের কাছে জলে গলা অবধি চুবিয়ে বসে রইলেন। এ সময়ে তাঁরা তীরে বন্ধুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। প্রথমে সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারেনি। যখন বুঝতে পারলেন তারা নিরাপদ, তখন কাঁদা থেকে উঠে আসার মতো শক্তিও তাদের শরীরে অবশিষ্ট ছিলো না। থমসনের গায়ে একটি ছেঁড়া সার্ট ডালফোসের কোমরে একখানা নেংটি, মারফি এবং সুলিভানের শরীরে সূতার আঁশ পর্যন্ত ছিলো না। অযোধ্যার মুরার মাওরের জমিদার দিগ্বিজয় সিং ছিলেন তাঁদের আশ্রয়দাতা। তাঁরা ২৯জন সন্ধ্যাবেলা তার বাসভবনে গিয়ে পৌঁছেন।

যদিও কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই, তবু এ কাহিনী একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় । কামান পাতা হয়েছিলো এবং নদীতীরে সৈন্য পাঠানো হয়েছিলো সে কথা একেবারে অস্বীকার করা যায় না। নৌকার গুরু দয়াল এবং লোচন চৌধুরীর মতে, সংকেত অনুসারে একটি নৌকায় গুলি ছোঁড়া হয়েছিলো এবং তারপরে বিনা সঙ্কেতেই অপরাপর নৌকাগুলোর ওপর আক্রমণ চলে। চৌহান জমিদারদের উপস্থিতির আয়োজন হয়তো পূর্বাহ্নে করা হয়নি। কারণ এ খবর ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছিলো। ইংরেজদের চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখবার জন্য দূর-দূরান্তের গ্রামবাসীরা সকালে নদীতীরে জমায়েত হয়েছিলো। এ ষড়যন্ত্রে নানা সাহেব কোন অংশগ্রহণ করেছিলেন কিনা তা বলা সহজ নয়। বিদ্রোহী সেপাইদের নেতা হিসেবে সমস্ত দুস্কৃতির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন বলে বলতে হয় এবং বাস্তবিক দিয়ে দেখতে গেলে তাঁকেই পুরোপুরি দায়ী করতে হয়। কিন্তু জনল্যাভ এ বিষয়ে তাঁকে সন্দেহ করেই ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, কানপুরে ১৮৫৭ সালে জুলাই মাসে যে সকল লোক বিশ্বাসঘাতকতা করে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের অনুষ্ঠান করেছে, সে সম্বন্ধে পত্রাদি পাঠ করার পরে আমি ভয়ঙ্করভাবে মর্মাহত হয়েছি, নানা সাহেব ইংরেজ ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রলোকদের অন্তরঙ্গভাবে না হলেও অনেক বেশি দেখেছেন। অনেক হতভাগ্যের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো। এটা বিশ্বাস করা যায়, তিনি নৌকা যখন তৈরি করতে আদেশ দিলেন, তিনি সরল ভাবে আশা করেছিলেন যে খ্রীস্টানদের কলকাতায় যেতে দেয়া উচিত। কিন্তু যা ঘটেছে তাতে নানা সাহেবের নির্দেশকে খেলাফ করা হয়েছে। কারণ সেপাইরা চেয়েছিলো, নানা সাহেব এবং ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে বিভেদ এতো প্রবল হোক যাতে করে নানা সাহেব এবং সরকারের মধ্যে কোন রকমের সন্ধি হতে না পারে। সুতরাং তারা ইচ্ছা করে এ কাজ করেছে। ব্রিটিশ যদি আবার ভারতের অধিপতি হয়ে বসে তাহলে যারা আত্মসমর্পণ করেছেন, তাদেরকে রক্ষা করার জন্য তাঁর আপন জীবনও রক্ষা পাবে এ কথা নানা সাহেবের চাইতে ভালোভাবে কেউ জানতো না। যে সকল মহিলা এবং শিশু সেপাইদের গুলি এবং তরবারি থেকে রক্ষা পেয়েছিলো তার জন্য নানা সাহেবই দায়ী ছিলেন। কারণ, তারই নির্দেশে হত্যাকান্ড বন্ধ করা হয়েছিলো। কর্ণেল মড এ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে নানা সাহেবকে শিশু এবং নারী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করতে গিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। তিনি লিখেছেন, কর্ণেল উইলিয়াম যে সকল প্রমাণ সগ্রহ করেছেন, সে সকল অতি সাবধানতা সহকারে এবং কোনো রকমের পক্ষপাত ছাড়া পাঠ করলে নানা সাহেব আমাদের শিশু এবং নারীদের হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন কিনা এ সম্বন্ধে মনে সন্দেহের উদয় না হয়ে যায় না। অথচ সাধারণতঃ বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে এতে প্রধান ভূমিকা তিনিই গ্রহণ করেছিলেন। আমার নিজের মত হলো, ব্যক্তিগতভাবে তাঁর হাত থাকলেও, এ ব্যাপারে তিনি তাঁর রক্তপিপাসু অনুচরদের দ্বারা বাধ্য হয়েছিলেন, কারণ তাদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সাহস তাঁর ছিলো না। এমনকি আমাদের দেশেও বর্তমানে একই রকম নৃশংস জঘন্যতাকে মেনে নেয়া হয়। এটা নিশ্চিত যে আত্মসমর্পণ যারা করেছেন, নানা তাঁদের সঙ্গে একবারের বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করেছেন। ঘাটের হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো নৃশংস ব্যক্তিত্বের হাত ছিলো। সুদক্ষ ষড়যন্ত্রকারী না হলে এমনটি হয় না নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এতে নানার কোনো হাত ছিলো না।

এ ষড়যন্ত্রের পেছনে কোনো পরিণত বুদ্ধি কাজ করেছিলো, আজকের দিনে তা খুঁজতে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, ১৮৫৭ সালে উভয় পক্ষই মানবতাকে পদতলে দলিত করেছে। এটা স্বীকৃত সত্য যে কানপুরে বিদ্রোহ ঘোষণার পরেও কোনো সেপাই অফিসারদের গায়ে হাত তোলেনি। ম্যারী থমসন স্বীকার করেছেন যে অবরোধের কয়েকদিন পরে ইংরেজরা কোনো বন্দীকে কোন রকম বিচার না করেই হত্যা করেছে। নীল এবং তার সঙ্গীরা যে অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের আয়োজন করেছেন, সে সম্বন্ধে সেপাইরা পুরোপুরি ওয়াকেবহাল ছিলো। মৌলবি লিয়াকত আলী কানপুরে পৌঁছে নীলের হত্যাকাণ্ডের খবর সেপাইদের অবশ্যই দিয়েছেন। হোম বলেছেন, “বুড়ো মানুষ, দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ স্ত্রীলোকেরাও আমাদের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে।” নীল যে সাধ করে গ্রাম জ্বালাননি কিংবা নিরপরাধ লোককে হত্যা করেননি, এটা নিহত ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনের সান্ত্বনার কারণ নয়। নীলের এলাহাবাদের হত্যাকাণ্ডের পরেই কানপুরের সতীচৌরার ঘাটের হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে নানা সাহেবকে দায়ী করলে নৈতিকদিক দিয়ে নীলকে দায়ী করতে হয়। কঠোর পন্থা অবলম্বন করে তিনি যদি গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে না দিতেন, তা হলে জেনারেল হুইলার যখন সাহায্যের আবেদন করেছিলেন সে সময়ে তিনি কানপুর আসতে পারতেন।

জাওলা প্রসাদ, বলরাও এবং আজিমুল্লাহকে তাঁতিয়া টোপীর সঙ্গে ২৭শে জুন ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো। কোতোয়াল হুলাজ সিং দু’দিন আগে এ ষড়যন্ত্রের কথা শুনেছিলেন, সেজন্য তিনি সেদিন সকালবেলা নদীর ঘাটে যাননি। হুলাজ সিং-এর মতে কাজী ওয়াসিউদ্দীন নামে এক ব্যক্তি এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করছিলেন। তাঁর মতে, দুদিন আগে থেকে ইউরোপীয়দের জন্য নৌকা তৈরি করে রাখা হয়েছিলো। অশ্বারোহী বাহিনীর দু’জন সরদারের সঙ্গে এক সন্ধ্যায় তিনি কাজী সাহেবকে কিভাবে ইউরোপীয়দের হত্যা করা যায় সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে শুনেছেন। তিনি সে সময়ে ঘরে প্রবেশ করে আলোচনা শুনতে পেলেন। তাঁরা স্থির করে ফেলেছেন, ইউরোপীয়দেরকে হত্যা করাটা মোটেও বে-আইনী হবে না। এখানে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে বিচারের সময় যারা সাক্ষ্য দিয়েছিলো তারা অনেকে আপন প্রাণ বাঁচাবার জন্য মিথ্যা কথা বলেছে। আবার অনেকে পুরস্কারের আশায়ও মিথ্যা কথা বলেছে। স্বাভাবিক সময়ে যে সকল সাক্ষীকে আগ্রাহ্য করা হতো কিন্তু বিদ্রোহের পরে সে সকল চাঞ্চল্যকর কাহিনীকেই সত্য বলে ধরে নেয়া হয়েছে।

ফোরজেট বলেন, বোম্বের ইউরোপীয়রা শুধু বিশ্বাসই করেনি বরঞ্চ লর্ড এলফিন স্টোনের কাছে অভিযোগ রয়েছে যে জগন্নাথ শঙ্কর শেঠের মতো একজন প্রগাঢ় পণ্ডিত ব্যক্তি এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিও নানা সাহেবের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, জামকান্দির রাজার স্বপক্ষে যদি বোম্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যারিস্টার মিঃ বারটোনকে নিয়োগ না করেন, তা হলে তাঁর ফাঁসি হয়ে যাবে।

অল্প সময়ের মধ্যে নৌকাগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিলো। সেগুলো মাঝিদের নৌকা ছিলো না। মহেশ্বরীর সাগেরওয়াল সম্প্রদায়ের বানিয়ারাই ছিলো মালিক। মালিকদেরকে যথোপযুক্ত ভাবে ক্ষতিপূরণ করা হয়েছিলো। ২৬ তারিখ সন্ধ্যায় অনেকে নৌকাগুলো পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন, তখনও অনেক নৌকায় বাঁশের ছাদ ইত্যাদি লাগানো হয়নি। তবে নৌকাগুলোকে উপযুক্ত করার জন্য হাজার হাজার শ্রমিক দিনে রাতে কাজ করে যাচ্ছিলো। নানা যদি এ ষড়যন্ত্রে অংশ নিতেন তাহলে এতো টাকা এবং শ্রম ব্যয় করার কি প্রয়োজন ছিলো, তা ভাবলে একটু অবাক হতে হয়। কারণ ছাউনিতে তো ইংরেজেরা নিরাশ্রয়ই ছিলেন, নদীতেও তাদেরকে একই রকম অবস্থার মধ্যে রাখার জন্য অতো সাধ্য সাধনার কি প্রয়োজন। তাদের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র ছিলো, বেপরোয়া সংগ্রামে পরাজিত না করে তাদের স্ত্রী এবং শিশুদের যে নিহত হতে দেবে না তা তো একরকম নিশ্চিতই ছিলো।

সে সময়ে হুইলার এবং তাঁর সঙ্গীরা মরীয়া হয়ে অনশনরত অবস্থায়ও সেপাইদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছিলেন কানপুরে। নীল তখন কঠোর হস্তে এলাহাবাদের বিদ্রোহ দমন করছেন। খুব শীগগিরই দিল্লী এবং মীরাটের সংবাদ লর্ড ক্যানিং-এর কাছে এসে পৌঁছালো। নীল এবং তার সহকর্মীদের মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় তলব করা হলো। নীল ছিলেন দৃঢ়চিত্ত এবং নির্দয় মানুষ। তাঁর মতো সেকেলে গোঁড়া খ্রীস্টান হয়তো ক্রমওয়েলের সময়ের জন্য যথোপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন। আত্মবিশ্বাসের কারণে তিনি নেতা হিসেবে উপযুক্ত হলেও সহকারি হিসেবে নিতান্তই অনুপযুক্ত ছিলেন। তিনি কলকাতায় এসে পৌঁছালেন। হাওড়ার রেলওয়ে কর্মচারিদের সঙ্গে তিনি যে ব্যবহার করেছিলেন তা থেকে মানুষটির ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে জানা যায়। সেনাবাহিনীকে ট্রেনে স্থান দিতে অক্ষম স্টেশন মাস্টার এবং ইঞ্জিনীয়ারকে প্রহরাধীনে রেখে দশ মিনিট পরে ট্রেন এসে পৌঁছালে তাঁর সৈন্যরা নির্বিবাদে স্থান দখল করে নেয়। নীল রেলওয়ের কর্মচারিদের বলতে ভোলেননি যে তাঁদের ব্যবহার বিদ্রোহীদের মতে, তাঁদের সৌভাগ্য যে সামরিক বাহিনীকে এজন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়নি। নীলের পরবর্তী লক্ষ্য হলো কানপুর এবং বেনারসে সৈন্য পাঠানো। তবে উপস্থিত মুহূর্তে তিনি বেনারস যাত্রা করলেন।

বেনারস ভারত সরকারের অপরিসীম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এ স্থান শুধুমাত্র হিন্দুদের তীর্থস্থান নয়, বর্তমানে ইসলাম ধর্মীয় দিল্লীর সম্রাটের কোন কোন বংশধর বেনারসে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেছে। কোন গোলযোগ দেখা দিলে তারা সরকারের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারেন। তা ছাড়াও বেনারস পাটনা এবং এলাহাবাদের রাজপথের মাঝখানে অবস্থিত বলে এর সামরিক গুরুত্বও অপরিসীম। কঠোর শাসনকর্তাদের হাতে না পড়লে বেনারস সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ থাকতে পারতো। গাবিনস যিনি জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, অনেক সাহস, কৌশল এবং দৃঢ়তার পরিচয় দেখিয়েছেন। কালেক্টর লিন্ড সহজে ধৈর্য হারিয়ে বসেননি। কমিশনার টুকার সাহেব ছিলেন একজন গোঁড়া খ্রীস্টান। তিনি আপন ধর্মবিশ্বাসে অটল ছিলেন। নিজের প্রচেষ্টার চাইতে দৈবশক্তিতে অধিক বিশ্বাসী ছিলেন। উদাসীনভাবে তিনি তাঁর ওপর ন্যস্ত কর্তব্য শেষ করেন। শহরে নিরস্ত্র অবস্থায় বের হতেন। কেবল মাত্র চাবুকখানিই তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সামরিক ছাউনির কর্তাদের মধ্যে ধৈর্যের অভাব ছিলো। পনেরো বছর আগে ব্রিগেডিয়ার পসনবি আফগানিস্থানে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছেন। সাহসে তার সমান কেউ ছিলো না। কিন্তু বেনারসে সেপাইদের বিদ্রোহের সংবাদ এসে পৌঁছালে অলফার্টস এবং ওয়াটসন তাকে বোঝালেন যে তাঁদের বেনারস ত্যাগ করে সুরক্ষিত চুনার দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বেসামরিক অফিসারেরা সম্মিলিতভাবে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেন। শুধু তাই নয়, যে সকল সৈন্য পূর্বাঞ্চল হতে কানপুরে এসেছিলো তাদেরকে কানপুরে পাঠিয়ে দিলেন। সামরিক কর্তারা সব সময় তার বিরোধিতা করেছে। কিন্তু টুকার স্যার হেনরী লরেন্সের বারবার সনির্বন্ধ অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারেননি।

৩রা জুন তারিখে নীল বেনারসে এলেন। কানপুরের অবস্থা তখনো শান্ত, তবে লখনৌতে সেপাইরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে ৪ তারিখে, খবর এলো আজমগড়ে গোলমাল আরম্ভ হয়েছে। সেপাইরা রাজকোষ দখল করে নিয়েছে। অনিয়মিত সেপাইরা অফিসারদের নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তারা বিদ্রোহী সেপাইদের বিপক্ষে অস্ত্র ধারণ করতে সাহসী হলো না। সামরিক কর্তারা সাহস হারিয়ে ফেললেন। তাঁরা ভয় করতে লাগলেন যে আজমগড়ের দেখাদেখি বেনারসের সেপাইরাও বিদ্রোহ করে বসবে। গাবিন্‌সের অতিরিক্ত কড়াকড়ি ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে সে ভয় আরো বহুগুণে বেড়ে গেলো। পসনবির সঙ্গে নীল কোথায় এবং কখন সাক্ষাৎ করেছিলেন, সে সম্বন্ধে কিছুই জানা যায়নি, তবে তিনি যে ৩৭নং দেশীয় বাহিনীকে নিরস্ত্র করবার জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বাহিনীর অধিনায়ক মেজর ব্রেট কিন্তু সেপাইদের আনুগত্যের প্রতি কোনোরকমের সন্দেহও পোষণ করেননি। সাধারণতঃ শিখেরা অন্যান্যদের তুলনায় অধিক অনুগত। অশ্বারোহী বাহিনী সম্বন্ধেও একই কথা খাটে। তাদের এবং ইউরোপীয় সৈন্যদের সাহায্যেই সন্দেহপ্রবণ সৈন্যদের নিকট হতে অস্ত্র কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। বিকেল পাঁচটায় প্যারেডের ব্যবস্থা করা হলো। ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে রাইফেল জমা দেয়ার নির্দেশ জারী করা হলো। একের পর এক ছ’টি কোম্পানী অস্ত্র পরিত্যাগ করলো। তারপরে গুলি ভর্তি বন্দুক হাতে ইউরোপীয় সৈন্যরা এসে উপস্থিত হলো। পাঞ্জাবে থাকার সময় থেকে সেপাইদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে ইউরোপীয়দের আসার অর্থ হলো তাদের মৃত্যু। চারদিকে চীৎকার উঠলো ইউরোপীয়রা তাদেরকে হত্যা করতে আসছে। পসনবি তাদেরকে নিশ্চিন্ত করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু সেপাইরা চীৎকার করে জানিয়ে দিলো যে তারা কোনো অপরাধ করেনি। আদেশ পালন করতে বলা ছাড়া পসনবির অন্য কোনো কিছু সেপাইদের কাছে বলার ছিলো না। বিনা দোষে এ কঠিন দণ্ড অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের ওপর নেমে আসতে দেখে সেপাইরা স্থির থাকতে পারলো না। কেউ কেউ অস্ত্রের জন্য হাত বাড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় সৈন্যরা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে লাগলো। সেপাইরা গুলি ছুঁড়ে প্রত্যুত্তর দিলো। শিখ এবং অনিয়মিত সেপাইরা এসবের কিছুই জানতো না। এলোপাথাড়ি গুলিগোলা চলতে দেখে তারাও গুলি ছুঁড়তে লাগলো। এভাবেই অনুগত সৈন্যরা বিদ্রোহ করে বসলো। নীল অধিনায়কত্ব গ্রহণ করলেন। অল্পসংখ্যক সশস্ত্র সৈন্যের পক্ষে অনেকগুণ বেশি সেপাইদের নিরস্ত্র করা কম সাহসের কথা নয়। টুকার নিশ্চিত করে বলেছেন যে অতি কষ্টে সেপাইদেরকে নিরস্ত্র করা সম্ভবপর হয়েছিলো। তার সঙ্গে গভর্ণর জেনারেলের বক্তব্যের মিল রয়েছে।

তাঁর নিজস্ব নীতি অসুসরণ করে বিদ্রোহকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে পেরেছেন ভেবে নীল অত্যন্ত খুশী হলেন। তিনি বিদ্রোহী এবং নিরস্ত্র লোকদের ব্রিটিশ অস্ত্রের তেজ দেখাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। ম্যারি লিখেছেন, “আমাদের সামরিক অফিসারেরা সব রকমের অপরাধীদের খুঁজে এনে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিচ্ছেন।” একমাস পর একজন পুরোহিত ব্রিটিশ নৃশংসতা প্রসঙ্গে লিখেছেন, “তাকালেই চোখে পড়বে সারি সারি ফাঁসি কাঠ, তাতে সাহসী কর্ণেল ধরে আনা বিদ্রোহীদেরকে লটকিয়ে দিচ্ছেন। বালক, রমণী, পথচারী, কেউ রক্ষা পায়নি। সকলকেই ফাঁসিকাষ্ঠে লটকিয়েছেন। ইউরোপীয়দের নৃশংসতা দেখে এদেশবাসীরা মনে করতে লাগলো, ইউরোপীয়রা মানুষের বেশে শয়তান ছাড়া আর কিছু নয়।

বেনারসের বিদ্রোহ ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এলাহাবাদ, ফতেহপুর, ফৈজাবাদ এবং জৈনপুরের সেপাইরা জানতে পারলো নির্দোষ সেপাইদের সঙ্গে সন্দেহপ্রবণ অফিসারেরা কি নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছে। তারা অনুভব করলো, তাদের মধ্যে সবচেয়ে যারা অনুগত তারাও অফিসারদের সন্দেহপ্রবণতা থেকে রক্ষা পাবে না।

পরের দিনেই এলাহাবাদের সংবাদ কানপুরে এসে পৌঁছালো। সে রাতেই দুর্গের ইউরোপীয় নারী এবং সামরিক অধিবাসীদের নিরাপদ স্থানে চলে যেতে আদেশ দেয়া হয়েছিলো। কেউ তাতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেনি। রাতে বিদ্রোহ করবে সেপাইরা, এ রকম অনুমান করা হয়েছিলো, কিন্তু কিছুই ঘটলো না। কতিপয় লোক সকালে তাদের নিজ নিজ বাঙলোতে ফিরে এলেন।

কানপুর থেকে নির্দেশ এসেছে, যে সকল ইউরোপীয় পাওয়া যায়, তাদের নিয়ে দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দৃঢ় করতে। কিন্তু ইউরোপীয়রা সংখ্যায় যথেষ্ট ছিলো না। চুনার থেকে মাত্র ৬০জন পেনশন ভোগী গোলন্দাজ সেনা এসেছে, সে সঙ্গে এসেছেন কয়েকজন সার্জেন্ট। তাদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় যোগ দিলেন ষাটজন বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবক। সামরিক ছাউনির প্রধান অবলম্বন হলো ক্যাপটেন ব্রেসিয়ারের অধীন ৪৫০ জন শিখ সৈন্য এবং ৬নং দেশীয় অশ্বারোহী বাহিনীর ৮০ জন ঘোড়সওয়ার। বাকি সৈন্যদেরকে দু’মাইল দূরে তাদের লাইনে রাখা হলো। তারা স্বেচ্ছায় দিল্লীর বিরুদ্ধে যাত্রা করার প্রস্তাব দিয়েছিলো। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় প্যারেডে তারা সম্পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করেছে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। এটা অনুমান করা হয়ে থাকে যে ৬নং বাহিনী প্রথম থেকেই বিশ্বাসঘাতকতা করছিলো। শিখদেরকেও ভিড়াবার জন্য তারা এতোকাল অপেক্ষা করেছিলো। বেনারস থেকে কতিপয় মানুষ সেপাই লাইনে এসে খবর দিলো যে সেপাইদেরকে পয়লা নিরস্ত্র করে তারপরে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ব্রিটিশ অফিসারেরা বাঙালি পল্টনকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ফিচেট নামে এক জন ড্রামবাদক তাদেরকে জানালো যে ইউরোপীয়রা তাদেরকে নিরস্ত্র করতে ছুটে আসছে। কিন্তু সেপাইদের পূর্বের কোনো ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে তিনি জানতেন না। সেপাইরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলেই, তাদের সাথে এসে যোগ দিলো শহরের একদল উদ্খল জনতা। তারা কারাগারে গিয়ে কয়েদীদের মুক্তি দান করলো। ইউরোপীয়দেরকে খুঁজে এনে হত্যা করা হতে লাগলো। বাঙলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো। সর্বত্র অরাজকতা ছড়িয়ে পড়লো। শুধু খ্রীস্টান অধিবাসীরাই নয়, হিন্দু তীর্থযাত্রীরাও গুণ্ডা বদমায়েশদের অত্যাচার হতে রক্ষা পায়নি।

দুর্গের অভ্যন্তরে শিখেরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলো, ক্যাপটেন ব্রেসিয়ার তাদের শান্ত রাখলেন। তিনি মালী হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন, আপন দক্ষতার গুণে কমিশন লাভ করে ক্যাপ্টেনের পদে উন্নীত হয়েছিলেন। তিনি শুধু তার অধীন সেপাইদেরকে শান্ত রাখেননি, তাদের সাহায্যে দুর্গের ভেতরের ৬নং বাহিনীর সেপাইদের নিরস্ত্র করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। ৬নং রেজিমেন্ট আতঙ্কে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো। বিদ্রোহ ঘোষণা করে লুঠতরাজ করতে মনোযোগ দিলো এবং পরবর্তী যুদ্ধের কথা না ভেবে লুটের মালপত্র নিয়ে সেপাইরা আপন আপন ঘরে চলে গেলো।

এ সঙ্কটকালে সেপাইদের নেতৃত্বদান করতে এগিয়ে এলেন, একজন অতি সাধারণ মানুষ। তার নাম মৌলবি লিয়াকত আলী। তিনি ছিলেন জাতে তাঁতী এবং পেশায় বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সমস্ত অধিবাসীরা তাকে শ্রদ্ধা করতো বলে তাঁর নেতৃত্বে কেউ কোনো আপত্তি তোলেনি। তার কোনো সম্পদ ছিলো না, ছিলো না কোনো আভিজাত্য। চরিত্রবান এবং দয়ালু বলেই তিনি অধিনায়ক হিসেবে ভর্তি হলেন। দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি দিল্লীর সম্রাটের নামে শাসনকার্য চালাতে শুরু করেন। তিনি শান্তি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন এবং আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতেও চেষ্টা করেছিলেন। তিনি যে তাতে ব্যর্থ হয়েছেন সে কথা বলাই বাহুল্য। একটুকু সামরিক অভিজ্ঞতাও তার ছিলো না। কিছুমাত্র সামরিক অভিজ্ঞতা থাকলে তিনি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতেন। তা না হলে জনসাধারণের এক বাক্যে আস্থা স্থাপন করার মতো কোন শক্তিশালী ব্যক্তিত্বও যদি হতেন, হয়তো শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। তাঁর কৃতিত্ব হলো, অনেক ভারতীয় খ্রীস্টান ধর্ম ত্যাগ করে তাদের প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলো।

কিন্তু নীলের এলাহাবাদে পৌঁছাতে বেশি দেরী লাগলো না। বেনারস থেকে যাত্রা করলেন ৯ই জুন এবং ১২ই জুন তারিখে এলাহবাদে এসে উপনীত হলেন। রাস্তা দুর্গম, কোনো ঘোড়া পাওয়া গেলো না। তা সত্ত্বেও তিনি চলে এলেন। তিনি কৃষকদের তার কোচ বয়ে নিতে বাধ্য করলেন বটে, কিন্তু প্রখর রৌদ্র থেকে বাঁচতে পারলেন না। এলাহাবাদে যখন এলেন, তাঁর শরীরে একটুকু শক্তিও অবশিষ্ট নাই। কিন্তু বিলম্ব করার সময় নেই তখন। দুর্গ কোনো রকমে রক্ষা পেলেও বিদ্রোহীরা শহর অধিকার করে নিয়েছে। দুর্গের অভ্যন্তরে শিখ এবং ইউরোপীয়রা অতিরিক্ত মদ্য পান করেছে। উপস্থিত মুহূর্তে কড়াকড়ি আইন-শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা যদি না করা হয়, তা হলে যে কোনো মুহূর্তে দুর্গ বিপন্ন হতে পারে। দারাগঞ্জ এবং কিদগঞ্জে গুলিবর্ষণ করা হলো। শহর ব্রিটিশ সেনাদের দখলে চলে এলো। ১৭ তারিখে মৌলবি লিয়াকত আলী তার সদর দফতর ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।

তার পরেই কিন্তু নীল কানপুর যাত্রা করেননি। অপরাধীদের শাস্তি দান এবং যারা দোদুল্যমান তাদের শঙ্কিত করে তোলাই হলো তাঁর চিরাচরিত নীতি। নদীপথে এবং স্থলপথে শাস্তিদানের জন্য অভিযান চালনা করা হলো। সামরিক অফিসারদের চাইতে বেসামরিক অফিসারেরা এ দেশী নিগারদের বাড়িঘর জ্বালাতে এবং তাদেরকে ফাঁসিকাঠে ঝুলাতে অধিক উৎসাহ দেখিয়েছে। শুধু দোষীদের নয়। সন্দেহভাজন, নির্দোষ, নারী-পুরুষ সকলকেই নির্বিশেষে ফাঁসিকাঠে ঝুলানোর খবর ভারত সরকার জানতে পারলো। তাতে করে অধিকাংশ অধিবাসীর মনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে চরম ঘৃণার সঞ্চার হলো। নীল ভুলে গিয়েছিলেন যে সমস্ত ভারতীয়দের ফাঁসিকাঠে ঝুলানো যাবে না। স্থানীয় অধিবাসীদের সাহায্য এবং সহযোগিতা ছাড়া তিনি মালপত্র বয়ে নেবার জন্য পশু এবং গরুর গাড়ি যোগাড় করতে পারতেন না। তার কঠোর দণ্ডের ভয়ে গ্রামের কৃষক এবং তাদের সঙ্গে সৈন্যদের নিত্য প্রয়োজনীয় শ্রমিকেরাও অদৃশ্য হয়ে গেছে। এমনকি ২০ তারিখে এলাহাবাদ ছেড়ে গেলেও কানপুর রক্ষা পেতো। ২৩ তারিখে যদিও ৪০০ ইউরোপীয় ও ৩০০ শিখ সৈন্য মার্চ করবার জন্য তৈরি হলো, তবু মালপত্র বয়ে নেয়ার মতো পর্যাপ্ত যানবাহনের ব্যবস্থা তিনি করে উঠতে পারলেন না। পাঁচ দিন পরেও এ অচলাবস্থার কোনো পরিবর্তন হলো না। অথচ মেজর রিও সৈন্যদের সঙ্গে ৩০ তারিখে যাত্রা করবেন বলে স্থির করেছিলেন। ৩০শে জুন তারিখে হ্যাভলক কানপুরে এসে আধিনায়কত্ব গ্রহণ করলেন। হুইলারকে যে অবরোধ করে রাখা হয়েছে এ সংবাদ তিনি লখনৌতেই পেয়েছেন।

হেনরী হ্যাভলক ৪২ বছর ধরে সামরিক বিভাগে চাকুরি করেছেন। কানপুর এবং লখনৌতে বিদ্রোহ দমন করার পূর্বে তিনি আফগানিস্তান, পাঞ্জাব এবং পারস্যে যুদ্ধ করেছেন। তিনি ছিলেন সমর বিজ্ঞানের পরিশ্রমী ছাত্র। নেপোলিয়নের সমস্ত অভিযান সম্পর্কে অন্তরঙ্গ পরিচয় তাঁর ছিলো বলে জানতো সকলে। লখনৌতে তিনি লর্ড মেকলের লেখা ইংল্যান্ডের ইতিহাস অধ্যয়ন করছিলেন অবসর সময়ে। নিষ্ঠাবান খ্রীস্টান এবং শ্রীরামপুরের মিশনের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ইস্পাতের তৈরি মানুষ ছাড়া কেউ নীলকে তাঁর নিজের জায়গায় স্থির রাখতে পারতো না। জেনারেল হ্যাভলক রিকে যেখানে আছে সেখানে থেকেই সামনে এবং দুদিকে দৃষ্টি রাখতে নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন, আগামীকাল ৪ তারিখে যে সৈন্য আসবে তাদেরকে দিয়ে সংখ্যা বৃদ্ধি করবো এবং শক্তিশালী করে তুলবো। আর গ্রাম জ্বালিয়ো না, বিদ্রোহীদের দেখা না পেলে যতদূর সম্ভব ইউরোপীয় সৈন্যদের টানা হেঁচড়া করবে না। কিন্তু নীল তখনো বিশ্বাস করতে পারেননি যে কানপুরের পতন ঘটেছে। রিণ্ডের সৌভাগ্য, অতি দ্রুত কথামতো হ্যাভলক এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। পূর্বদিন মধ্যরাতে হ্যাভলক ছাউনি ছেড়েছেন এবং পরদিন অতিপ্রত্যুষে রিণ্ডের সঙ্গে যোগ দিলেন। উভয় পক্ষই অবাক হয়ে গেলো। রিও ফতেহপুরে অল্প সংখ্যক সেপাইয়ের কথা ভেবেছিলেন এবং নানার সৈন্যরা হ্যাভলকের আগমনের কোনো সংবাদই রাখতো না। হ্যাভলক যদি সময় মতো সমরসম্ভার নিয়ে হাজির না হতেন, তাহলে রিণ্ডের অল্প সংখ্যক সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো।

বিচারক টুকার ছাড়া আর সকল ব্রিটিশ অফিসার ৯ তারিখে ফতেহপুর ছেড়ে চলে গেছেন। ৬ তারিখ পর্যন্ত সামরিক ছাউনি প্রশান্ত ছিলো। তারপরে সেপাইরা বাজারে বেনারসের সেপাইদের বিদ্রোহের গুজব শুনতে পেলো। গুজব রটলো শান্তভাবে প্যারেড করার সময়ে ইউরোপীয় সৈন্যরা শিখ এবং পুরবীয়া সম্প্রদায়ের সেপাইদের গুলি করে হত্যা করেছে। তিনদিন পরে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো। ছাউনিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে বত্রিশ দিন সময়ের প্রয়োজন হয়। তারপরে শুরু হয় আওঙ্গের যুদ্ধ। সেদিন জুলাই মাসের ১৫ তারিখ। একই দিনে পাণ্ডু নদী অতিক্রম করা হলো। নদীতে জলস্ফীতি ঘটেছে, কিন্তু সেতুটা তখনো অক্ষত ছিলো। আশঙ্কা হচ্ছিলো, যে কোনো মুহূর্তে সেতু ভেঙ্গে দেয়া হতে পারে। সেজন্য হ্যাভলক কালক্ষেপণ না করে সেতু অতিক্রম করতে ছুটলেন। তাঁর ক্লান্ত-শ্রান্ত সৈন্যদের কোনো বিশ্রামই দিলেন না। সেতুটা যে কেনো ধ্বংস করা হয়নি তা ব্যাখ্যা করা বড়োই মুশকিল। নদী অতিক্রম করা হলেও কানপুরের যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। হ্যাভলক বন্দীদের মুক্ত করার জন্য বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি মনে করেছিলেন নারী এবং শিশুরা নানার হাতে বন্দী অবস্থায় কাল যাপন করেছে। বিনা যুদ্ধে নানা তার সদর দফতর ছেড়ে যেতে রাজী হলেন না। কিন্তু তার শেষ প্রচেষ্টাও প্রাথমিক প্রচেষ্টার মতো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। ১৭ই জুলাই তারিখে এলাহাবাদ থেকে আসার পরের দিন তার বিজয়ী বাহিনী নিয়ে হ্যাভলক কানপুরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু তার স্বজাতি মহিলাদের মুক্তি দেয়ার ভাগ্য তার ছিলো না।

ঘাটের হত্যাকাণ্ডের পরে যারা বেঁচেছিলেন, তাদেরকে বন্দী করে নেয়া হয়েছিলো। পুরুষদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো। নারী এবং শিশুদের আলাদা ভবনে রাখা হয়েছিলো। সেখান থেকে তাদেরকে বিবিঘর নামক স্থানে চালান দেয়া হয়েছিল। যখন বিদ্রোহী নেতারা বুঝতে পারলেন যে তাঁরা আর কানপুর রক্ষা করতে পারবেন না, তখন সমস্ত বন্দীদের হত্যা করে একটি কুয়াতে ফেলে দিলো। হ্যাভলকের সৈন্যরা কানপুরে প্রবেশ করে মৃতদেহ দেখতে পেলো। যে ঘরে তাদের রাখা হয়েছিলো, তার মেঝেয় তখনো তাজা রক্ত।

বিবিঘরের হত্যাকাণ্ডের জন্য নানাকেও দায়ী করা হয়েছে। কর্ণেল উইলিয়ামের সামনে যে সকল প্রমাণ হাজির করা হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে কোনো ফৌজদারী আদালত নানাকে অপরাধী বলে রায় দিতে পারে না। তবে নানার বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ না থাকার অর্থ নানা নিরপরাধ নন। রাজনৈতিক এবং নৈতিকভাবে তাঁর বন্দীদের জানের জন্য নানাই দায়ী এবং তাদের নানার নামেই হত্যা করা হয়েছে। নানা সাহেব নিজে অস্বীকার করেছেন যে তিনি কোনো হত্যা করেননি। মহারাণী ভিক্টোরিয়া, পার্লিয়মেন্ট, কোর্ট অব ডিরেক্টরস, গভর্ণর জেনারেল, সকল প্রদেশের লেফটেনান্ট গভর্ণরবৃন্দ এবং সকল অফিসারের কাছে নিবেদিত এক ইস্তাহারনামাতে তিনি বলেছেন, নারী এবং শিশুদের হত্যার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিলো না। এ ইস্তাহারনামাটি রিচার্ডসনকে ১৮৬৯ সালের এপ্রিল মাসে প্রদান করা হয়। তাতে তিনি বলেছেন, “কানপুরে সেপাইরা আমার আদেশ না মেনে ইংরেজ মহিলা এবং শিশুদের হত্যা করে। যাদেরকে আমি কোনো রকমে রক্ষা করতে পারতাম তাদেরকে রক্ষা করেছি। তারা ছাউনি ত্যাগ করলে আমি তাদের জন্য নৌকার ব্যবস্থা করেছি এবং তাদেরকে ভাটির দিকে এলাহাবাদ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছি। তারপরে আপনাদের সেপাইরা তাদের আক্রমণ করেছে। তবু আমি আমার সৈন্যদের নিবৃত্ত করে ২০০ শিশু এবং নারীর প্রাণ রক্ষা করেছি। আমি শুনতে পেলাম, যে সময়ে আমার সৈন্যরা কানপুর থেকে পালিয়ে এসেছে এবং আমার ভাই আহত হয়েছে, সে সময়ে আপনার সৈন্যরা এবং বদমায়েরা তাদের হত্যা করেছে। আপনারা যে ইস্তাহারনামা প্রকাশ করছেন, সে সম্বন্ধে আমি শুনেছি এবং জানি আপনারা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন এবং এ পর্যন্ত আমিও আপনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছি। যতোদিন বাঁচি যুদ্ধ করেই যাবো।” একই মাসে তাঁতিয়া টোপীও একই রকম বলেছেন। তিনি বলেছেন, “প্রকৃত প্রস্তাবে বিদ্রোহীরা নানাকে বন্দী করেই রেখেছিলো। তাঁতিয়া টোপী সতীচৌরার ঘাটের হত্যাকাণ্ডের জন্য সেপাইদের দায়ী করেন।

এখন কথা হলো বিবিনগরের হত্যাকাণ্ড কখন সংঘটিত হয়? নানা সাহেবের বিঠুর যাত্রার আগে না পরে? তা বলা সত্যিই অসম্ভব। সে যাহোক বাজীরাওয়ের কন্যা কুসুম বাই বিশ্বাস করেন যে তাঁর ভাই নির্দোষ। বুড়ো বয়সে যখন তিনি পুনাতে যান, তখন ভি.কে. রাজওয়াদ এবং পাণ্ডব পাটওয়ার্দন তাঁর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেছেন, নানা বিদ্রোহী সেপাইদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার কোনো রকম সম্বন্ধ ছিলো না।

১৮ই জুলাই তারিখে রাতের অন্ধকারে নানা সাহেব বিটুর ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি গঙ্গায় ডুবে আত্মহত্যা করলেন। কিন্তু গুজব রটলো যে তিনি অযোধ্যা চলে গেছেন।

১৯ তারিখে মেজর স্টিফেনসন বিরে মার্চ করে বসলেন এবং পেশবার প্রাসাদ ধ্বংস করে ফেললেন। ২০ তারিখে নীল এসে পৌঁছালেন এবং হ্যাভলক লখনৌতে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছেন। ২৫ তারিখে হ্যাভলক গঙ্গা অতিক্রম করলেন। তার বিজয়ী সৈন্যরা অযোধ্যার দিকে ধাওয়া করলো।

নীলের হাতেই কানপুরের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেয়া হলো। তার কর্তব্য তো নগরে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং বদমায়েশদের শায়েস্তা করা। কিন্তু হ্যাভলক স্পষ্টভাবে বলেছেন তাকে, যতোদিন তিনি কানপুরে আছেন, ততদিন নীলের একটি নির্দেশ দেয়ার অধিকারও নেই। ২৫ তারিখে তিনি স্বাধীনভাবে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, “প্রথমে কড়াকড়ি মানেই তো শেষে করুণা দেখানো।” অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নীল একটা নতুন পদ্ধতি বার করলেন। সে অনুসারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিধনশালায় নিয়ে গিয়ে জোর করে কিছু রক্ত পরিষ্কার করাতে হবে। হতভাগ্যদেরকে যে সকল লোকের রক্ত পরিষ্কার করতে হতো, তাদের হত্যার পেছনে এদের কোনো হাত নেই।

যে সকল লোককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে তাদের সংখ্যা কম ছিলো না। ইউরোপীয়দের প্রতি মুসলমানের ক্ষোভ এবং তীব্র ঘৃণ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আর হিন্দুরা পরম ঔদাসীন্যের সাথে মৃত্যুকে গ্রহণ করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *