৫. অযোধ্যা : গজল কাননের অগ্নি-গোধূলি

অযোধ্যা : গজল কাননের অগ্নি-গোধূলি

অযোধ্যা ছিলো একটি পুরোনো প্রদেশ। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তাতে এক রাজবংশ জেগে উঠেছে। মাত্র ৮৩ বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে পাঁচজন রাজা সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। ক্ষমতাসীন শাসকেরা পারস্য থেকে এদেশে আসেন এবং তারা শিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছিলেন। এ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মোগল দরবারের একজন সামন্ত।

মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সময়ে উজির অথবা সম্রাটের শাসক প্রতিনিধির পদ বংশানুক্রমিক হয়ে যায় এবং অযোধ্যা প্রদেশে স্থাপিত হয় শাসনকর্তার সদর দফতর।

দীর্ঘকাল যাবত অযোধ্যার শাসনকর্তারা সর্বপ্রকারে মোগল দরবারের বশ্যতা মেনে চলতেন। নওয়াব সুজাউদ্দৌলা শাহজাদা শাহ আলমের সঙ্গে বিহার প্রদেশে অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। নওয়াব এবং শাহজাদার মিলিত সৈন্য ১৭৬৪ সালে বক্সারে স্যার হেকটো মুনরোর হাতে ভয়ঙ্করভাবে পর্যুদস্ত হন। লর্ড ক্লাইভ সম্রাট এবং তার উজিরের সঙ্গে এলাহাবাদের সন্ধি করে যে কূটনৈতিক সুযোগ-সুবিধা লাভ করেন, তার ফলে তারা সামরিক বিজয়ের পথ খোলাসা করেন। সম্রাট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দেওয়ানী আদায়ের ভার দিলেন এবং বিদেশী শক্তির কাছে তাঁর সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিলেন।

অযোধ্যার পরবর্তী নওয়াবেরা এ সন্ধির সব শর্ত পরিপূর্ণভাবে মেনে চলতেন। কিন্তু বলবান পক্ষ ধীরে ধীরে থাবা বিস্তার করে অযোধ্যার অর্ধেক রাজ্য গ্রাস করে নিলো এবং নওয়াবের অবস্থা এসে দাঁড়ালো একজন সামন্তের পর্যায়ে। সুজাউদ্দৌলা যিনি কোম্পানীর সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্ৰতা করেছিলেন, তাঁর উত্তরাধিকারী আসফউদ্দৌল্লার মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র মির্জা আলী এবং আপন ভাই সাদত আলীর মধ্যে সিংহাসনে আরোহণ করার ব্যাপারে গণ্ডগোল বাধে। সে সময় বেনারসে থাকতত একদল ব্রিটিশ সৈন্য। সাদত আলীর দাবি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছে অধিকতরো সুবিধাজনক মনে হওয়ায় কোম্পানী তাঁকে সমর্থন করতে লাগলো। কিন্তু ব্রিটিশ প্রতিনিধির সঙ্গে নওয়াবের কল্যাণের জন্য যে ব্রিটিশ সৈন্য থাকবে তাদের জন্য অধিকতরো বার্ষিক বৃত্তি মঞ্জুর করিয়ে নিলেন। চার বছরের মধ্যে সন্ধিপত্র সংশোধন করতে হলো, নওয়াব আলীকে ১,৩৫,২৫,৪৭৪ টাকার বার্ষিক রাজস্বসম্পন্ন দোয়াব অঞ্চল পুরোনো পাওনার বাবদে ইংরেজকে ছেড়ে দিতে হলো। ১৮০১ সালে কৃত সন্ধিপত্রের ৬নং দফা অনুসারে নওয়াব সাদত আলী তার নিজ রাজ্য নিজের কর্মচারিদের মাধ্যমে প্রজাদের যেভাবে মঙ্গল হয়, সেভাবে শাসন করে যাচ্ছিলেন। তা ছাড়া তিনি এ ব্যাপারে সম্মানীত কোম্পানীর প্রতিনিধিদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। এভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নৈতিকভাবে নিজেকে অযোধ্যার জনসাধারণের মঙ্গলামঙ্গলের জন্য দায়ী মনে করতেন। কেননা রাজ্যের আভ্যন্তরীণ শাসন-ব্যবস্থাতেও তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিলো। নওয়াব সামন্তদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময়ে নিঃসন্দেহে ব্রিটিশ সৈন্যের সহায়তা কামনা করতেন এবং ব্রিটিশ সৈন্যেরা সুরক্ষিত কেল্লার মধ্যে বাস করতো এবং মনে করতো রাজ্যের আইন তাদের ওপর প্রযোজ্য নয়। কিন্তু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নওয়াব এবং তার অধীনস্থ ভূস্বামীদের মধ্যবর্তী বিবাদে যখন মনে করতো নওয়াবের কার্যই ন্যায়সঙ্গত তখন কোনো রকমের হস্তক্ষেপ করতো না। নওয়াব সাদত আলী সব সময় মনে করতেন, আপন নিরাপত্তার জন্য ব্রিটিশ সৈন্য পুষে তিনি অতিরিক্ত মূল্য প্রদান করছেন এবং নিজেকে অপমানিত জ্ঞান করতেন। ১৮১৪ সালে নওয়াব সাদত আলী মৃত্যুমুখে পতিত হলে তাঁর সন্তান গাজীউদ্দিন হায়দার সিংহাসনে আরোহণ করেন। নতুন নওয়াব নেপাল যুদ্ধে প্রবল মিত্রকে ব্যাপক আর্থিক সাহায্য করে তাঁদের সুনজরে পতিত হন। কোম্পানীর সরকার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলসমূহ তাঁর দখলে ছেড়ে দিলেন না শুধু, তাকে একজন প্রকৃত শাসকের মর্যাদাও দান করলেন। নতুন সৃষ্ট উপাধি ধারণ করে মুহম্মদ আলী শাহ্ এবং আমজাদ আলী শাহ্ পর পর সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৮৪৭ সালে শেষ নওয়াব ওয়াজিদ আলী শাহ্ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছাড়া অন্য নওয়াবেরা কোম্পানী সরকারকে প্রচুর পরিমাণে ঋণদান করে কোম্পানীর কর্মচারিদের সন্তুষ্ট করতেন, যাতে করে নওয়াবের মৃত্যুর পরে তার মনোনীত উত্তরাধিকারীদের ঠিকমতো বর্ধিত হারে সরকার থেকে বৃত্তি দান করা হয়।

১৮০১ সালের সন্ধি চুক্তি অনুসারে, সবকিছু সুনির্দিষ্ট করা হলেও শাসন কার্যে ধীরে ধীরে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। বিদেশী সঙ্গিনের তলায় নওয়াবের প্রকৃত ক্ষমতা চাপা পড়ে গেলো এবং তারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার জন্য স্বভাবতঃই উদগ্রীব ছিলেন। অধিকতর শক্তিশালী সামন্ত শাসকেরা দুর্নীতিপরায়ণ অফিসারদের অত্যাচারের বিরোধিতা করতেন। দুর্নীতি এবং খারাপ শাসনের ফলে অযোধ্যার অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে। কোম্পানীর কর্তারা তাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সজাগ হয়ে উঠলেন। জোর করে ১৮৩৭ সালে ইংরেজরা মুহম্মদ আলী শাহকে একটি নতুন সন্ধি করতে বাধ্য করলেন। নতুন সন্ধিপত্রে ৭নং ধারার কড়াকড়ি অত্যন্ত ভয়াবহ ছিলো। পূর্বোল্লেখিত ৬নং ধারার সংশোধন করা হলো। এভাবে কোম্পানী পদে পদে নওয়াবের শাসনকার্যে হস্তক্ষেপ করার ফলে নওয়াব মুহম্মদ আলী মনে করলেন সন্ধির কারণে গুরুতরভাবে তাঁর সম্মানহানি হয়েছে। কিন্তু তিনি এও ভালো মতো জানতেন যে ব্রিটিশ সরকারের দয়ার ওপরই তার সবকিছু নির্ভর করছে। সুতরাং সন্ধিপত্রের শর্ত মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর রইলো না তার পক্ষে।

তাছাড়াও অধীনতামূলক মিত্রতার আরো কিছু দুর্বলতা ছিলো। ব্রিটিশ সরকারের অধীনতামূলক মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ দেশীয় রাজারা আভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক দিক থেকে নিরাপদ থাকে বিধায়, তাঁদের মধ্যে শৈথিল্য আসে, আলস্যের স্রোতে তাঁরা গা ভাসিয়ে দেন এবং ধীরে ধীরে রক্তের প্রখর তেজ কমে আসে। কোনো রকমের নীতির বন্ধনহীন এ সকল দেশীয় রাজপুরুষেরা নানারকম অপকর্ম এবং নিকৃষ্টতরো আনন্দে লিপ্ত হয়ে পড়েন। একমাত্র ব্রিটিশ রেসিডেন্ট ছাড়া আর কেউ তাঁদের অপমান থেকে নিষ্কৃতি পেতো না। তাদের ব্যবহার চূড়ান্তভাবে অসহ্য হয়ে না পড়লে ব্রিটিশ রেসিডেন্টও তাঁদের কোনো কার্যকলাপে সহজে হস্তক্ষেপ করতেন না। অযোগ্য অযোধ্যা শাসকেরা শাসনকার্যের সমস্ত দায়-দায়িত্ব তাদের খয়ের খা কর্মচারিদের হাতে দিয়ে নিজেদের হাল্কা করে নেন এবং কোম্পানীর কর্মচারির পরামর্শেও কোনো মনোযোগ দিতেন না।

নব নির্বাচিত ওয়াজিদ আলী শাহ্ও তাঁর পূর্বপুরুষদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে লাগলেন। কবিতা এবং সঙ্গীতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন। কাব্যে তাঁর নিজ বংশের একটি ইতিহাস রচনার কাজে মনোনিবেশ করলেন। তার মেলামেশার ক্ষেত্র শুধুমাত্র কবি এবং শিল্পীদের মধ্যে ছিলো না। তার পিতা তাঁকে নীচ বংশীয় নাচিয়ে গাইয়েদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশার অনুমতিও দিয়েছিলেন। আর ওয়াজেদ আলী শাহ্ নিজে কবি ও শিল্পীদের চাইতে নর্তকীদের সঙ্গে অধিককাল সময় ব্যয় করতে পছন্দ করতেন। মন্ত্রীরা সপ্তাহ কিংবা পনেরো দিনের মধ্যে পাঁচ অথবা দশ মিনিট তার দেখা পেতেন, সে-ও প্রাসাদে নয়, কোনো নর্তকী কিংবা বাইজির বাড়িতে। এসকল অকর্মণ্য মন্ত্রী ইচ্ছা করলে যে কোনো তালুক কিংবা জমিদারী বিক্রি করে দিতে পারতেন। ১৮৪৯ সালে স্লীম্যান লিখেছেন, “বর্তমানে এ কথা সত্য যে অযোধ্যায় কোনো সরকার নেই। নাচিয়ে বাজিয়েরা ছাড়া আর কারো সঙ্গে নওয়াবের দেখা হওয়ার জো নেই। জনসাধারণের কোনো বিষয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহও নেই। মন্ত্রী পরিবর্তন করেও কোনো লাভ নেই, কারণ নীচ বংশোদ্ভূত নওয়াবের প্রিয়পাত্রেরা সিংহাসনের পেছনে সব সময়েই থাকবে।” স্লীম্যানের পরামর্শ হলো, শাসন-ব্যবস্থা একটি বোর্ডের ওপর অর্পণ করা উচিত। তিনি বলেছেন, সাময়িকভাবে তাঁর কর্তৃত্ব হয়তো কোনো একটি বোর্ড, নয়তো কোনো উত্তরাধিকারীদের মনোনীত করে তার সপক্ষে মসনদ ত্যাগ করা উচিত। কিন্তু ভারত সরকার তেমন ঝুঁকি নিতে সাহস করতে পারলো না। সেজন্য নওয়াবকে এখনো পরামর্শ দেয়া এবং সতর্ক করা হতে লাগলো ভারত সরকারের তরফ থেকে। আগের দিনে নওয়াব সতর্কবাণী এবং পরামর্শের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করতেন। ১৮৩৭ সালের সন্ধি যে বাতিল করা হয়েছে সে সম্বন্ধে তিনি জানতেন না। সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন, যতো ব্যয় পরিবর্তনই হোক না কেনো, তিনিই নওয়াব থাকবেন এবং নিজের ইচ্ছে মতো রাজস্ব ব্যয় এবং ভোগ করত পারবেন।

১৮৫৪ সালে স্লীম্যানের স্থলে আউটরাম রেসিডেন্ট হয়ে এলেন। তিনি এসে অযোধ্যার অবস্থা যা দেখতে পেলেন, তা কর্ণেল শ্লীম্যানের বর্ণিত অবস্থা থেকে একটুকুও ভালো নয়। নওয়াব সর্বক্ষণ মহিলা মহলে কাটান। ১৮৫১ সালের সন্ধিপত্রে রাজ্য নিয়ে যাওয়ার কোনো কথা ছিলো না। সন্ধির মর্ম ছিলো, দেশীয় কর্মচারিদের সাহায্যে শাসন ব্যবস্থার উন্নতি বিধান করা। কিন্তু ১৮৩৭ সালের সন্ধি অনুসারে রাজ্য নওয়াবের কাছ থেকে একেবারে কেড়ে নেয়া হলো। লর্ড ডালহৌসী নওয়াবকে একেবারে বঞ্চিত করা এবং নওয়াবী খেতাব কেড়ে নেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। কিন্তু ডালহৌসীর সহকর্মীরা তার সঙ্গে একমত হননি। ব্রিটিশেরা আশা করেছিলেন যে নওয়াব এ-ব্যাপারে নিজের কর্তৃত্ব এবং খেতাবের দাবি ছাড়তে রাজী হবেন না। তিনি যদি পুরুষের মতো আপন সৈন্যদলের সাহায্যে ব্রিটিশ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন, তাহলে ব্রিটিশ রেসিডেন্টের পক্ষে তাঁকে পরাজিত করে রাজ্য দখল করে নেয়া একটুকুও অসুবিধা হবে না। কিন্তু নওয়াব ব্রিটিশ রেসিডেন্টের কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করলেন, তিনি তাঁর হাতে আনুগত্যের প্রমাণস্বরূপ পাগড়ি খুলে রেখে গভর্ণর জেনারেলের কাছে তার হয়ে ওকালতি করার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন। তিনি রেসিডেন্টকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে তাঁর পূর্বপুরুষেরা সকলেই ইংরেজকে সহযোগিতা করেছেন এবং তিনি সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃত হলেন। তিনি এবং তার পরামর্শদাতারা আশা করেছিলেন, এতোকাল যাবত যে অনুকম্পা তারা ভারত সরকারের কাছ থেকে পেয়ে আসছেন, এবারেও পাবেন, কিন্তু ফল ফললো বিপরীত। ব্রিটিশ চরমপত্রে সই দিতে ওয়াজিদ আলী শাহ্ অস্বীকার করলেন বটে, কিন্তু অযোধ্যা একটি ব্রিটিশ প্রদেশে পরিণত হলো।

নতুন প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনার ভার জেনারেল আউটরামকে চীফ কমিশনার করে তার ওপর ছেড়ে দেয়া হলো এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক সৈন্যসহ তিনজন সিনিয়র সিভিল সার্ভিস সার্জেন্টকে তাড়াতাড়ি প্রেরণ করা হলো। ইংরেজরা আশা করেছিলো, এতোদিনের কুশাসনে জর্জরিত অযোধ্যাবাসীরা ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানাবে এবং ব্রিটিশ সৈন্যকে তাদের মুক্তিদাতা এবং বন্ধু মনে করবে। কিন্তু কার্যতঃ ঘটলো তার বিপরীত। রেসিডেন্ট কুশাসন এবং দুর্নীতির হাজারো অভিযোগ করেছেন নওয়াবের নামে। নওয়াবের অত্যাচারের কারণে কয়েকজন কৃষকও অযোধ্যা ত্যাগ করে অন্য ভারতীয় প্রদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। কিন্তু একটি দেশের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন বহু বছরের ধৈর্যশীল শ্রম।

একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন সাধন করাই হলো বিদেশী শাসনের বৈশিষ্ট্য। কোম্পানী অযোধ্যা দখল করে নেয়ার ফলে যে সকল উচ্চতম কর্মচারিরা দরবারে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁরা বেকার হয়ে পড়লেন। একই সঙ্গে নওয়াবের ষাট সহস্র সৈন্য বেকার হয়ে গেলো, তাদের মধ্যে মাত্র অল্প সংখ্যক পুলিশ বাহিনীতে পুনরায় নিযুক্ত হতে পারলো। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলো। দরবারের অধীনে কর্মরত ছিলো অনেক শিল্পী এবং কারিগর, তারাও সম্পূর্ণরূপে বেকার হয়ে পড়লো। তাদের জীবিকার আর কোনো সংস্থান ছিলো না, কারণ নতুন শাসকের রুচি ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন, তাই তাদের আর নতুন শাসন-ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না। স্যার জেমস আউটরাম যদি শাসক হিসেবে থাকতেন অথবা স্যার হেনরী লরেন্সের মতো কোনো রাজনীতিবিদের হাতে শাসন ক্ষমতা দীর্ঘকাল থাকতো, তাহলে জনগণের ক্ষোভ দূর করার জন্য অনেক কিছু করা হয়তো অসম্ভব হতো না এবং জনগণ ধীরে ধীরে নতুন শাসন-ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতো, বিশেষ গণ্ডগোল ঘটতো না। কিন্তু আউটরাম অত্যল্পকালের মধ্যেই ছুটি কাটাতে চলে গেলেন, তাঁর স্থলে এলেন কর্ভালে জ্যাকসন। তিনি হচ্ছেন অনেক বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন বেসামরিক সিভিল সার্জেন্ট। কোম্পানীর একটি প্রাথমিক প্রদেশে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু এ প্রদেশে তাঁর নতুন কর্তব্যের জন্য যেমন প্রয়োজন তেমন সহানুভূতি এবং কল্পনাশক্তি দু’টোর কোনোটিই তাঁর ছিলো না। রেসিডেন্ট হিসেবে এসেই ছত্তর মঞ্জিলকে আপন বাসভবন হিসাবে নির্দিষ্ট করলেন। কিন্তু সে প্রাসাদটিতে কেবল নওয়াব খান্দানের লোকেরাই বসবাস করতেন। সঙ্গে সঙ্গে তার ধৃষ্টতার প্রতিবাদ করা হলো, তিনি সরতে বাধ্য হলেন, কিন্তু জনতার ক্ষোভ একটুও কমলো না। মুসলিম জনসাধারণের কাছে কদম রসুল ভবনের প্রতিটি ইট-কাঠও পবিত্র। কেননা তাঁর একটি পাথরে রসুলের চরণচিহ্ন অঙ্কিত রয়েছে। কিন্তু কোম্পানীর সরকার সে অট্টালিকাকে গোলাবারুদের আগারে পরিণত করলেন। নওয়াবের অনেক আশ্রিত এবং বৃত্তিভোগী এক বছরেরও অধিক সময় ধরে কোনো বৃত্তি পাননি। এক বছর পরে স্যার হেনরী লরেন্স লখনৌতে এসে পৌঁছেই তিনি অত্যন্ত তাড়াতাড়ি তাঁদের বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করেন। মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে গেছে। জনসাধারণের আতঙ্ক দূর করার জন্য কোম্পানীর তরফ থেকে কিছুই করা হয়নি। অধিকন্তু কোম্পানীর অফিসারদের নতুন নতুন সংস্কারের ফলে জনসাধারণের অসন্তুষ্টি বেড়েই যেতে লাগলো।

পূর্বেই স্থির করা হয়েছিলো, কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য একটি নতুন রাজস্ব জরীপ করা হবে। আগের শাসন ব্যবস্থায় কৃষকদের দুরবস্থার সীমা-পরিসীমা ছিলো না। তারা ছিলো জমিদার এবং অন্যান্য রাজস্ব আদায়কারী সরকারি অফিসারদের কৃপার পাত্র। তাদেরকে অনেক রকমের বিরক্তিকর কর এবং সেস দিতে হতো। পুরোনো অনেক রকম কর মওকুফ করে দেয়া হলেও রাস্তার লোকের তাতে বিশেষ কোনো উপকার হলো না। আবার তাদের ঘাড়ে নানা রকম অপমানজনক করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হলো। একমাত্র আফিমের ওপর কর ধার্য করার ফলে জনসাধারণ বিশেষ করে শহরের অধিবাসীরা ভয়ঙ্কর রকম ক্ষেপে উঠলো। চীনের মতো লখনৌতেও আফিম ব্যাপক ব্যবহারে লাগতো। হঠাৎ করে এ নেশাদায়ক বস্তুটি না পেয়ে দরিদ্র আফিমখোরদের দুর্দশার অন্ত রইলো না।

পুলিশ এবং বিচার ব্যবস্থার উন্নতি সাধনও অল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব নয়। নতুন সরকার এক সঙ্গে সমস্ত পুরোনো অফিসারকে বরখাস্ত করতে পারে না যেমন, তেমনি পুরোনো অফিসারেরাও হঠাৎ করে পুরোনো রীতিপদ্ধতি বাদ দিতে পারে না। আগের মতোই ঘুষ এবং দুর্নীতি চলতে লাগলো, কিন্তু এজন্য নতুন সরকারকেই করা হলো দোষী। কেননা নতুন সরকার উচ্চকণ্ঠে নিজেকে সুবিচারের রক্ষক বলে ঘোষণা করেছে। এমনকি নতুন রাজস্ব সংগ্রহকারীরা কৃষকদের মধ্যে প্রচার করতে লাগলো যে কৃষকই জমির প্রকৃত মালিক, তালুকদার, জমিদার ইত্যাদি পরগাছা মাত্র। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে জমিদার তালুকদারেরা কেবল জমির মালিক নয়, মহল্লা কিংবা কওমের সর্দারও বটে। অনেক ভূস্বামী তলোয়ারের সাহায্যে যতোটা না, তারও চাইতে বেশি গোত্রীয় আনুগত্যের সূত্রে জমির মালিকানা দাবি করতেন। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা জমির মালিকানা স্বত্বের কোনো দলিল রক্ষা করেননি। সুতরাং তাদের অনেকেই পূর্বপুরুষের গ্রাম হারাতে বাধ্য হলো। প্রজাদের শস্য আত্মসাৎ করার দুর্নাম থাকার অপরাধে তাদের মাটির কেল্লা ভেঙ্গে দেয়া হলো এবং সশস্ত্র প্রহরী রাখার ব্যবস্থাও বন্ধ করে দেয়া হলো। কৃষকেরা জমিদারদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে উঠলো, নতুন শাসনব্যবস্থার প্রতি কোনো আগ্রহই জাগলো না। গাবিন্‌সের মতে, কোনো কোনো ব্যাপারে তালুকদারদের সঙ্গে বড়ো অপ্রিয় ব্যবহার করা হয়েছিলো, কিন্তু তা ফৈজাবাদ বিভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। তাছাড়া সীতাপুরে খ্রীস্টান কমিশনার অভিজাত ভূস্বামী সম্প্রদায়কে একেবারে সহ্য করতেন না।

অযোধ্যাকে ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কিন্তু ১৮৫৭ সালের মার্চ মাসে স্যার হেনরী লরেন্সকে অসন্তুষ্ট জনসাধারণের অসন্তোষের কারণসমূহ দূর করার জন্য চীফ কমিশনার করে পাঠানো হলো। স্যার হেনরীর সঙ্গে লর্ড ডালহৌসীর সদ্ভাব ছিলো না। লর্ড ডালহৌসী ভারতীয় রাজপুরুষদের রাজ্য কেড়ে নিলেন, তারা পথে বসলেন। তারপরে স্যার হেনরী কাটা ঘায়ে মলম লাগাতে এলেন। বৃত্তিভোগীরা বৃত্তি পেলেন, তালুকদারেরা আভিজাত্যের কারণে চীফ কমিশনারের কাছ থেকে দ্র ব্যবহার পেলেন। কোনো কোনো লোককে পেনশনের অর্থ প্রদান করা হলো। কিন্তু স্যার হেনরী এসেছেন অত্যন্ত দেরীতে। চর্বি মাখানো টোটার ব্যবহার নিয়ে সেপাইদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছে। যে বিক্ষোভের ফুলকি জ্বলে উঠছে, তা যে কোনো মুহূর্তে দাবানলে পরিণত হতে পারে। কিন্তু সে সময়ে কিছু লোক ছিলো, যারা চলতো আপন খেয়ালে, কালের লেখনের প্রতি যারা সব সময়ই অন্ধ ছিলেন। ডঃ ওয়েল নামে ৪৮নং দেশীয় পল্টনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন সার্জন অজান্তে এমন এক ব্যাপার করে বসলেন, ভারতীয়দের কাছে তার কোনো ক্ষমা নেই। ঘটনাটি ঘটেছিলো মার্চের প্রথম দিকে। মেডিকেল স্টোর পরিদর্শনকালে তাঁর শরীর খারাপ লাগা বশতঃ একটি বোতল মুখে দিয়ে ঔষধ পান করে নিলেন। কিন্তু কোনো হিন্দু মেডিকেল স্টোরের দূষিত মিকচার গ্রহণ করতে পারেন না। হাসপাতালের রোগীরা কোনো ঔষধ স্পর্শ করতেও অস্বীকৃতি জানালো। এজন্য সার্জনকে তিরস্কার করা হলো। দেশীয় অফিসারদের সামনে দূষিত ঔষধের বোতলটি নষ্ট করে ফেলা হলো। কিন্তু ভুলে যাওয়া কিংবা ক্ষমা করার মতো মনের অবস্থা সেপাইরা হারিয়ে ফেলেছে। তারা ধরে নিয়েছিলো, এ হচ্ছে তাদের জাতি নষ্ট করার প্রচেষ্টা। কোনো রকমে তিনি প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হলেন। ১৮ই এপ্রিল তারিখে চীফ কমিশনারের গায়ে একটি ঢিল ছোঁড়া হলো। হতে পারে এ কর্ম সেপাইদের দ্বারা সম্পাদিত হয়নি। কিন্তু যেই করুক, গভীরভাবে অপমানিত হয়েছে বলেই তো প্রধান শাসককে ঢিল ছুঁড়তেও পরোয়া করেনি। ৪৮নং স্বদেশী পল্টনকে সরিয়ে নেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। কিন্তু চীফ কমিশনার নিশ্চিত যে চর্বি মাখানো টোটা কিংবা অন্য কোনো বিশেষ কারণের সঙ্গে বর্তমান গোলমালের কোনো সম্পর্ক নেই। ২রা মে তারিখে ৭নং অযোধ্যা বাহিনীকে দাঁতে টোটা কেটে বন্দুকে পুরতে আদেশ করলে তারা টোটা কামড়াতে অস্বীকার করলো। পুনরায় ব্রিগেডিয়ার এসে আদেশ দিলেন। আবারও তারা অস্বীকার করলো। সে প্রথা পুরোপুরি বাতিল করে দেয়ার পরেও সেপাইদেরকে কেনো টোটা কামড়ে বন্দুকে ভর্তি করতে নির্দেশ দেয়া হলো, তা ব্যাখ্যা করা যায় না। সম্ভবতো কতিপয় অতি উৎসাহী অফিসারই এই স্বেচ্ছাকৃত ভ্রান্তির অপরাধে অপরাধী। শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য ব্রিগেডিয়ার তাদের সাহায্য করেছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা হলো। অবাধ্য অযোধ্যার সেপাইদের শাস্তিদানের ব্যাপারে ভারতীয় সেপাইরা ইউরোপীয় সেপাইদের সহযোগিতা করেছিলো। কিন্তু তথাকথিত বিদ্রোহীরা কোনো বাধা দেয়নি। তারা ছিলো একেবারে প্রশান্ত, এমন কি যখন দেখতে পেলো, তাদেরকে গুলি করার জন্য বন্দুক আনা হচ্ছে, তখন ভয় পেয়ে অনেকে পালিয়ে গেলো। তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে কাউকে কাউকে ফিরিয়ে আনা হলো। নিরস্ত্র সেপাইদেরকে তাদের লাইনে চলে যেতে আদেশ দেয়া হলো এবং পরে রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং কিছুকালের জন্য গোলমাল মিটে গেলো।

কিন্তু স্যার হেনরীকে সচেতন থাকতে হয়েছিলো। ভবিষ্যতে যে গোলমাল হতে পারে, সে সম্বন্ধে তিনি ধারণা করেছিলেন এবং ক্যান্টনমেন্টও শহরের সাদা চামড়াঅলাদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেছিলেন। তবে এতে তিনি অপ্রয়োজনীয় সন্দেহ করে এবং অকারণে ভয় পেয়ে বিষয়টিকে জটিল করে তোলার কোনো যুক্তিই খুঁজে পেলেন না। তিনি অপেক্ষাকৃত শান্ত সেপাইদের সমবেত করতে পারতেন, কিন্তু সেপাইদের ক্ষোভ এতো প্রবল যে করবার মতো বিশেষ কিছু ছিলো না। ৭নং অযোধ্যা বাহিনী ৪৮নং দেশীয় বাহিনীর কাছে একখানা চিঠি লিখলো। ৪৮নং সেপাইরাও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহ করা হয়েছিলো। কিন্তু একজন সেপাই এবং দু’জন অফিসার যাদের হাতে চিঠিখানি পড়েছিলো, বিশ্বস্তভাবে উপরে অফিসারদের কাছে দিয়ে দিলো। ১৩নং দেশীয় বাহিনীর একজন সেপাই ক্যাপটেন গ্যামনের কাছে শহরের তিনজন মানুষকে সোপর্দ করলো। কারণ তারা সেপাইটির কাছে ষড়যন্ত্রের প্রস্তাব করেছিলো। লরেন্স এ সকল বিশ্বস্ত সেপাইকে প্রকাশ্যে দরবার করে পুরস্কার প্রদানের কথা ঘোষণা করলেন। ১২ই মে তারিখে দরবার বসলো। এই দরবারে ঘাঁটির সকল সামরিক বেসামরিক অফিসার, ক্যান্টনমেন্টের কমিশনপ্রাপ্ত দেশীয় অফিসার এবং প্রত্যেক রেজিমেন্ট থেকে পাঁচজন করে সেপাই অংশগ্রহণ করেছিলো। স্যার হেনরী সম্মেলনে বক্তৃতা দিলেন। যে সকল অফিসার এবং সেপাই এ রকম অপূর্ব আনুগত্যের দৃষ্টান্ত প্রদান করেছে, তাদেরকে পুরস্কার স্বরূপ সম্মানী পোষাক এবং টাকার তোড়া প্রদান করলেন। তিনি সমবেত জনতাকে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে সব সময় যে ভালো ব্যবহার তারা পায়, তা স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি হিন্দুকে আওরঙ্গজেবের এবং মুসলমানদের রণজিৎ সিংয়ের কঠোর শাসনের কথা সব সময় স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি তাদের বাংলার সেনাবাহিনীর গৌরবময় ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং তাদের পূর্ববর্তীরা যে সুনাম অর্জন করেছে তা হারিয়ে না ফেলার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন।

এ বক্তৃতার ফলে সেপাইরা যে গলেনি সে কথা সত্যি নয়, তবে স্যার হেনরীর বক্তৃতা সকলের ওপর সমান প্রতিক্রিয়া করেনি। কেউ কেউ তার বক্তৃতার প্রশংসা করলেও অন্যদের মনে ভয় ধরে গেলো। এটাই আশ্চর্য লাগে, স্যার হেনরী লরেন্স নিজে তার যুক্তির অসারতা ধরতে পারেননি। সৈন্যেরা যে হতাশায় ভুগছে, এ কথা তার চাইতে অপর কেউ ভালোভাবে জানেন না। তিনি নিজেই এ সম্বন্ধে গভর্ণর জেনারেলের কাছে লিখেছেন কয়েক বছর পূর্বে। সে যাহোক স্যার হেনরীর বক্তৃতা সকলকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ১২ তারিখে পুরস্কৃত এবং অনুগত মানুষদের মধ্য থেকে বেশ কিছুসংখ্যক লোক পরবর্তীকালে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু রাজভক্তদের সমবেত করার জন্য তাঁর যে প্রচেষ্টা তা কিন্তু সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়নি। ইউরোপীয় সাথীদের সাথে সাথে ভারতীয় সেপাইদেরও বেশ কিছুসংখ্যক লখনৌর প্রতিরক্ষার কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সামরিক পেনশনভোগীদের লখনৌতে আহ্বান করে তিনি যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন তার কোনো তুলনা হয় না।

মে মাসের ১৪ তারিখে মীরাট বিদ্রোহের সংবাদ লখনৌতে এসে পৌঁছালো। পরদিন এলো দিল্লীর বিদ্রোহের সংবাদ। স্যার হেনরী অযোধ্যাতে সর্বাত্মক ক্ষমতা পরিচালনার জন্য আবেদন করলেন এবং আবেদন মঞ্জুর হলো। তাঁকে ব্রিগেডিয়ারের পদে উন্নীত করা হলো এবং সামরিক ও বেসামরিক প্রধান হিসাবে তিনি শাসনকার্য চালিয়ে যেতে লাগলেন। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে সেনাবাহিনী। লখনৌ থেকে কয়েক মাইল দূরে মারিওন নামক স্থানের ক্যান্টনমেন্টে ৩টি পদাতিক বাহিনী এবং গোলন্দাজ বাহিনী তখন সাদিকপুরে অবস্থান করছিলো। স্যার হেনরী জানতেন ভালোভাবে অল্প সংখ্যক ইউরোপীয় এবং ভারতীয় সৈন্যদের সাহায্যে সবগুলো সামরিক ঘাঁটি তিনি রক্ষা করতে পারবেন না। তখনো তিনি ক্যান্টনমেন্টে বাস করেন। নগরের দুটি কেন্দ্রে তিনি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে মনস্থ করলেন। একটি হলো মচ্ছি-ভবন এবং অপরটি তাঁর নিজের বাসভবন। এ দু’টি স্থানকে শক্তিশালী করা হলো। ক্যান্টনমেন্টের নারী এবং শিশুদের এ দুটি স্থানে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করবার নির্দেশ দেয়া হলো। স্যার হেনরী ভারতীয়দের সাহায্য যে পাবেন, সে আশা ছাড়তে পারেননি এবং তখনো নতুন সৈন্য সংগ্রহ করার কথা চিন্তা করছেন। স্যার হেনরী শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেই ক্ষান্ত ছিলেন না। তিনি জানতেন ভয় ভয়ের জন্ম দেয় এবং বিশ্বাস বিশ্বাসকে জীবন্ত করে। পর মুহূর্তে যদি তিনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তা যেমন তাঁর পক্ষে বোকামোর কারণ হবে, তেমনি দোদুল্যমানদেরও অনুভব করতে দেয়া উচিত হবে না যে তিনি বড়ো বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তার শক্তির প্রকাশ দেখালে একটা সংকট এড়ানো না গেলেও কিছুকালের জন্য হয়তো তা স্থগিত রাখা সম্ভব হবে। কানপুরে কিছু সংখ্যক সৈন্য সাহায্য স্বরূপ পাঠানো হয়েছে। ক্যাপটেন ফেচার হায়েসকে কিছু সংখ্যক অযোধ্যার সেপাইর সঙ্গে প্রেরণ করা হলো। হায়েস নিরাপদে কানপুরে এসে গেলেন। তিনি চিন্তা করলেন, পশ্চিম দেশসমূহের দিকে একবার অভিযানে বেরিয়ে পড়লে রাজপথে কোনো বাধা থাকবে না। কিন্তু পরে মনিপুরের নিকটে তাঁর সেপাইরা বিদ্রোহ ঘোেষণা করে এবং তাঁকে হত্যা করে।

সে যাকগে, মারিওনের ইউরোপীয় সৈন্যরা নিদারুণ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলো। কারণ প্রতি মুহূর্তে অভ্যুত্থানের নতুন নতুন গুজব তাঁদের কাছে আসছে। সব সময়েই তারা সেপাইদের অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করছিলো। অবশেষে ৩০ তারিখে রাত্রি ন’টার সময় সেপাইরা সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে। যদিও কয়েকটি প্রাণহানি হয়েছে, এখন পর্যন্ত ভয়াবহ কোনো যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৩ এবং ৭১নং দেশীয় বাহিনীর দেশীয় সেপাইরা সে মুহূর্তেই ৩২নং ইউরোপীয় বাহিনীতে যোগদান করলো। ১৩নং বাহিনীর সেপাইদের একটি দল ক্যান্টনমেন্টে স্যার হেনরীর বাসভবন পাহারা দিতে বেষ্টনী রচনা করলো। শহরের রাস্তা একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো, সে জন্য সেপাইরা সে দিকে একদম অগ্রসর হতে পারেনি। পরের দিন সামনের দিক থেকে সেপাইদের উপর আক্রমণ করা হলো, কিন্তু তারা কোনো রকমের বাধা না দিয়ে সরে পড়লো। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিনের উৎকণ্ঠার অবসান ঘটলো। কারা বন্ধু এবং কারা শত্রু তা নির্দিষ্ট করে জানার উপায় নেই। শহরের একটি অভ্যুত্থান পুলিশের সাহায্যে অতি সহজে দমন করা সম্ভব হলো।

কোর্ট মার্শালে বন্দীদের বিচার করা হলো এবং তাদের অনেককেই ফাঁসিকাঠে ঝুলানো হলো। মচ্ছি-ভবনের সামনে এক সারি ফাঁসিকাঠ পোঁতা হলো এবং ৮০ পাউন্ড গুলি ছুঁড়তে সক্ষম একটি কামান বসানো হলো, যাতে করে সাহসী দুষ্কৃতিকারীরা কোনো সুবিধা করতে না পারে। কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে লাগলো, যে সকল সেপাইকে বিদ্রোহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেখা যাচ্ছিলো, তারা অনেকেই চরম দণ্ড লাভ করেছিলো। বিদ্রোহীরা এবার দিল্লী অভিমুখে ধাওয়া করলো, কিন্তু রাজভক্ত সেপাইদের নিয়ে কি করা হবে-সে ব্যাপারে একটা সমস্যা দেখা দিলো। তাদের অনেকেই স্বেচ্ছায় ৩০শে মে-র অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছে এবং পুরোনো সাথীদের সাথে হাত মিলিয়ে ফেলেছে। অর্থনৈতিক কমিশনার মর্টিন গাবিন্‌স দাবি করতে লাগলেন যে তাদেরকে নিরস্ত্র করে ফেলা হোক। কতেক ছাউনিতে অশুভ সংবাদ শুনে ইউরোপীয় অধিবাসীদের আতঙ্ক বেড়ে গেলো। কারণ অধিক পরিমাণে ভারতীয় সেপাই জড়ো করার ফলে ইউরোপীয় অধিবাসীরা ভারতীয়দের কৃপার পাত্র হয়ে পড়েছে। সুতরাং গাবিস তাদেরকে শক্তির বদলে দুর্বলতার উৎস বলে মনে করতে লাগলেন। তিনি বলেছেন, স্যার হেনরী লরেন্সও তার প্রস্তাবে প্রায় রাজী হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি এমনভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেলো যে হঠাৎ করে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করাও অসম্ভব হয়ে পড়লো। স্যার হেনরী দুর্বল মানুষ ছিলেন না। তিনি বুড়ো পেনশনভোগী সেপাইদের আহ্বান করলেন, আগুনের গোলার মুখে তারা আপন সতোর পরিচয় দিয়েছিলেন। গাবিন্‌সের যুক্তি হলো, নিশ্চিত অবস্থায় তাদেরকে সকল রকমে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, একটু নড়চড় হলে ১২০০ লোকের তলোয়ার এবং সঙ্গিন তাদের বিপক্ষ দলে যাবে। সে জন্য এ সকল সেপাইদের নিরস্ত্র করে ফেলা হলে তাদের আর বিপদের কোনো আশঙ্কা থাকে না। গাবিন্‌সের সন্দেহ যে অমূলক, সে কথাও কিছুতে বলা যায় না। চিনহাটে গোলমাল দেখা দিয়েছে। কিন্তু এখনো পাঁচশো ভারতীয় সৈন্য কোম্পানীর পক্ষে লড়াই করছে। গাবিন্‌সের পরামর্শ মতো কার্যকর করা হলে ভারতীয় সেপাইরা এতো বড়ো অপমান মুখ বুজে সহ্য করতো কি না তা বলা যায় না। এমন কি স্থান পরিবর্তন ব্যতিরেকে সেপাইদের পিছু হটানো হলে সর্বনাশ হয়ে যেতো। কারণ যে সকল ইউরোপীয় সৈন্য সামরিক পোষ্টগুলো পাহারা দিচ্ছিলো, তাদের সংখ্যা ছিলো নিতান্তই অল্প। গাবিনস যদি যাত্রা করতেন তা হলে লখনৌর দশাও কানপুরের মতো হতো। অবরোধকৃত অঞ্চলসমূহে ভারতীয় সেপাইদের প্রতি সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের দৃষ্টিপাতে তাকানো হচ্ছিলো।

লখনৌতে বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ রইলো না, খুব শীগগির অযোধ্যার প্রান্তস্থিত সামরিক ঘাঁটিসমূহেও এ খবর ছড়িয়ে পড়লো। সেপাইদের কোনো পরিকল্পিত কর্মসূচি কিংবা সুচিন্তিত পন্থা ছিলো না। প্রত্যেক রেজিমেন্ট নিজ নিজ ইচ্ছা অনুসারে চলতে লাগলো। কোনো কোনো ব্যাপারে সরকারি ব্যবস্থার প্রতি যে সন্দেহ ছিলো তা ভয়ে পরিণত হলো এবং শীগগিরই দোদুল্যমান সেপাইরা সক্রিয় বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে।

শাসনকার্যের সুবিধার জন্য অযোধ্যা প্রদেশকে ৪টি বিভাগ এবং ১২টি জেলায় বিভক্ত করা হয়। ৩রা জুন তারিখে খয়েরপুর বিভাগের সামরিক দফতর সীতাপুরে গোলমাল আরম্ভ হয়। কমিশনার জে. জি. খ্ৰীষ্টিয়ান সাহেব ছিলেন কড়া মেজাজের লোক, অধীনস্থ কর্মচারি হিসাবে একদম বেমানান ছিলেন তিনি। তিনি অর্থনৈতিক কমিশনার মার্টিন গাবিন্সকে দু’চোখে দেখতে পারতেন না। সে জন্য কিছুতেই পুরোনো জমিদারদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার নীতি মেনে নিতে পারলেন না। তাঁর বিভাগের অবস্থা অন্যান্য অঞ্চলের চাইতে ভালো, কিন্তু শীগগির সংবাদ পাওয়া গেলো, জমিদারেরা তালুকহারা তালুকদারদের সঙ্গে মিলিত হতে শুরু করেছেন। সীতাপুরে ৪৮নং দেশীয় বাহিনী এবং অযোধ্যায় আরো দু’টি অনিয়মিত রেজিমেন্ট ছাউনি ফেললো। ৩০শে মে পর্যন্ত খ্রস্টিয়ান নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি অনিয়মিত বাহিনীর উপর আস্থা রাখতে পারেন এবং এ বিভাগের জন্য চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে ৪১নং দেশীয় বাহিনীর সেপাইরা লখনৌর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মার্চ করে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করে এবং বিদ্রোহী সেপাইদের বিরুদ্ধে গুলি বর্ষণ করে। তাদের সঙ্গে মেশার কোনো ইচ্ছে যে নেই তা গোপন করলো না তারা। সতর্কতার ব্যবস্থা স্বরূপ খ্রীস্টিয়ান সকল মহিলা এবং শিশুদের তাঁর বাঙলোতে এসে অবস্থান করতে আমন্ত্রণ জানালেন। প্রতিরক্ষার জন্য সেটা ছিলো খুবই উপযুক্ত স্থান, কিন্তু হঠাৎ করে সেখান থেকে পলায়ন করার কোনো উপায় ছিলো না। সাদা চামড়ার লোকেরা বাঙলোতে আশ্রয় নিয়েছে দেখে অনিয়মিত বাহিনীর লোকদের মনে সন্দেহের উদয় হলো। তারা মনে করলো অফিসারেরা তাদের অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে। পরদিন সেপাইদের ছাউনিতে একটা গুজব রটলো, কোতোয়াল যে

আটা পাঠিয়েছে তাতে ভেজাল রয়েছে। সেপাইরা জেদ করতে লাগলো, এ ভেজাল আটা নদীতে ফেলে দেয়া হোক। যদিও পরে আটা নদীর জলে ফেলে দেয়া হলো, তথাপিও সেপাইদের ক্ষোভ গেলো না। পরদিন বিদ্রোহ শুরু হলো। কর্ণেল বার্চ যিনি ৪১নং স্বদেশী বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন, তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হলো। ৪১নং স্বদেশী বাহিনী এবং অনিয়মিত অযোধ্যা বাহিনী একই সঙ্গে বিদ্রোহ শুরু করলো। খ্রীস্টিয়ান পরিবার এবং বাঙলোতে আশ্রয় প্রাপ্ত সকল ইউরোপীয়কে নিয়ে পলায়ন করতে পরিকল্পনা করেছিলেন। কয়েকজন ছাড়া কেউই রেহাই পায়নি, সকলকেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

ফৈজাবাদের কাহিনী সম্পূর্ণ আলাদা। ফেব্রুয়ারি মাসে শহরে এলেন এক রহস্যময় মানুষ, পরে অবশ্য জানা গিয়েছিলো তিনি হলেন ফৈজাবাদের মৌলবি। তিনি কে এবং কোন্ স্থান থেকে এসেছেন, সে সম্বন্ধে কিছু জানতো না কেউ। তিনি আহমদ আলী শাহ্ এবং সেকান্দার শাহ্ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি কিছু সংখ্যক সশস্ত্র শিষ্য পরিবেষ্টিত অবস্থায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতেন। সমগ্র ভারতবর্ষে তাঁর শিষ্য ছড়িয়ে ছিলো। তিনি প্রকাশ্যে ফিরিঙ্গীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন এবং গরম গরম বক্তৃতা দিতেন। পুলিশ জোর করে তাকে এবং তার শিষ্যবর্গকে নিরস্ত্র করলো এবং জনসাধারণের মধ্যে তাকে ছেড়ে দেয়া নিরাপদ মনে না করায় সামরিক তত্ত্বাবধানে তাঁকে রাখা হলো। বিদ্রোহের সূচনাকালে তিনি ছিলেন বন্দী।

ফৈজাবাদেও এলাহাবাদের মতো বিদ্রোহ শুরু হলো। তার ফলে বেনারসের সেপাইদের নিরস্ত্র করা হলো। বলা হয়ে থাকে, বেনারসের সেপাইদের নিরস্ত্র করে গোলন্দাজ বাহিনী এবং ইউরোপীয় পদাতিক বাহিনী তা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। ফৈজাবাদে সেপাইরা রাজকোষ দখল করে নিলো এবং ইংরেজদের শান্তিতে চলে যেতে নির্দেশ দিলো। তারা ইংরেজদের জন্য নৌকা সংগ্রহ করলো, অর্থ প্রদান করলো; এমনকি অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও করে দিলো। অশ্বারোহী বাহিনী শান্তিপূর্ণভাবে ছেড়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলো না, কিন্তু পদাতিক বাহিনী তাদের সিদ্ধান্তে অটল রইলো। সে যাহোক বৈরামঘাটে আজমগড় থেকে আগত সেপাইরা দু’খানি নৌকার ওপর হামলা করলো। কর্ণেল গোল্ডনি এবং কমিশনারসহ অনেকেই নিহত হলেন।

স্থানীয় ভদ্রলোকদের মনোভাব এখনো বন্ধুত্বপূর্ণ। ফৈজাবাদ থেকে আগত অনেক মহিলা এবং শিশু শাহগঞ্জ দুর্গে আশ্রয় লাভ করেছিলেন। শাহগঞ্জ ছিলো রাজা মানসিং-এর সদর দফতর। রাজা মানসিং পুরোনো অভিজাত খান্দানের ছিলেন না। তাছাড়া জাতিতে তিনি রাজপুত ছিলেন না। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ। তিনি দুর্গে মহিলা এবং শিশুদেরকে আশ্রয় দিলেন, কিন্তু পুরুষদের ঢুকতে দিলেন না। তাহলে বিদ্রোহীদের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে বলে তিনি আশঙ্কা করতে লাগলেন। তাছাড়াও শাহগঞ্জে তিনি আশ্রয় প্রার্থীদের বেশিদিন রাখলেন না। তাঁদেরকে দানাপুরে পাঠিয়ে দিলেন নৌকাযোগে।

বাহরাইকের কমিশনার চার্লস উইংফিল্ড কিছু গোলমালের আভাস পেয়েই ঘাঁটি ছেড়ে চলে গেলেন। ১৮৫৭ সালের ১লা মে তারিখে তিনি তাঁর সদর দফতরে ছিলেন না। সিকরোরা সামরিক ঘাঁটিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেখানে কোনো ইউরোপীয় সৈন্য ছিলো না। এক রেজিমেন্টে অশ্বারোহী, এক রেজিমেন্ট পদাতিক এবং কিছু সংখ্যক গোলন্দাজ সৈন্য মিলে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করেছিলো। মহিলা এবং শিশুদের নিরাপদে লখনৌতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সেজন্য অফিসারদের কোনো উদ্বেগ বা শঙ্কা ছিলো না। ইউরোপীয় সার্জেন্টদের সেপাইদের গতিবিধির ওপর দৃষ্টি রাখতে নির্দেশ দেয়া হলো। যদি কোনো সন্দেহজনক কিছু দেখে তাহলে তাদের অফিসারদের জানাতে বলা হয়েছিলো। ৮ই জুনের মাঝরাতে এক সার্জেন্ট ভাবলেন, তিনি পদাতিক সেপাইদের মধ্যে অস্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ প্রত্যক্ষ করেছেন। তৎক্ষণাই একটা ব্যাটারি আনা হলো এবং ব্যারাকের সামনে স্থাপন করতে নিয়ে যাওয়া হলো। আর কিছুই ঘটলো না। পরদিন সকালে সৈন্যেরা অভিযোগ করলো যে অফিসারেরা তাদের ঘুমের মধ্যে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তারা শুধু বন্ধু গোলন্দাজদের কৃপাতেই রক্ষা পেয়েছে। পদাতিক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর মধ্যে পুরোনো ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটলো এবং তারা মিলে দাবি করতে লাগলো যে এক্ষুণি তাদেরকে ক্যাপটেন বয়লিউ প্যারেডে আহ্বান করুন এবং তাদেরকে অস্ত্র ফিরিয়ে দেয়া হোক। বয়লিউ আত্মসমর্পণ করলেন, কিন্তু উইংফিল্ড ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে কোনো কিছু জানতে না দিয়ে গোন্ডাতে অশ্বারোহণ করে স্থানান্তরে চলে গেলেন। গোলন্দাজ বিভাগের অধ্যক্ষ, লেফটেন্যান্ট বনহ্যাম ছাড়া আর সকলেই ছাউনি পরিত্যাগ করলেন। গোলন্দাজ বাহিনী তাকে অধিনায়কত্ব গ্রহণ করতে বললেন, তিনি রাজী হলেন। এ শর্তে যে তারা মার্চ করে লখনৌ যাত্রা করবে। প্রথমতঃ সেপাইরা তাঁর কথা মেনে চলতে রাজী হলেন, কিন্তু পরে অবস্থা বিভিন্ন রকম দাঁড়ালো। তারা বনহ্যামকে পালিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। তাঁকে প্রধান রাজপথ দিয়ে না যেতে অনুরোধ করা হলো। তিনি নিরাপদে লখনৌতে এসে পৌঁছালেন।

উইংফিল্ড বেশিক্ষণ গোলাতে অবস্থান করেননি। তিনি এবং তাঁর বন্ধুরা বলরামপুরের রাজার বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করলেন। দলের মধ্যে একজন ছিলেন ডঃ বাড্রাম, তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছে চিঠিতে লিখেছেন, শেষ পর্যন্ত সেপাইদের মনোভাব খুব ভালো ছিলো। আসবার পথে অনেকেই আমাদের সাথী হতে চেয়েছে, তাদের চোখের জল ঝরেছে। দেশীয় অফিসারেরা সালাম করেছে, কিন্তু কারো ইচ্ছা নয় যে আমরা অবস্থান করি। সকালবেলা হাবিলদার মেজর আমাদের কাছে এসে সিকরোরা থেকে প্রাপ্ত একখানা চিঠি দেখালেন। চিঠিখানার মর্ম হলো-‘অফিসারদেরকে বন্দী করো এবং রাজকোষ অধিকার করে। সুতরাং এ হলো আমাদের সর্বশেষ সুযোগ।’

জুনের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে সমস্ত অযোধ্যা প্রদেশে ব্রিটিশ শাসনের সম্পূর্ণ অবসান ঘটে। কিন্তু লখনৌ শহর এখনো তাদের জন্য ভোলা রয়েছে এবং দূরবর্তী ঘাঁটিসমূহ থেকে আশ্রয়প্রার্থীরা এসে সে শহরে আশ্রয় গ্রহণ করে।

বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পরেই স্যার হেনরী ক্যান্টনমেন্ট থেকে রেসিডেন্সিতে তাঁর সদর দফতর স্থানান্তরিত করলেন। তখন তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো ছিলো না। তখন তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন ছিলো সবচেয়ে বেশি। কিন্তু অপরিসীম দায়িত্ববোধ তাকে অযোধ্যাতে নিয়ে এলো। উৎকণ্ঠিত অবস্থায় তিনি গভর্ণর জেনারেলের কাছে টেলিগ্রাফ করলেন, বর্তমানের গোলমালে যদি আমার খারাপ কিছু ঘটে, আমি আন্তরিকভাবে সুপারিশ করছি, মেজর ব্যাঙ্কসকে চীফ কমিশনার হিসেবে যেনো আমার স্থলে মনোনীত করা হয়। সুদিন না আসা পর্যন্ত কর্ণেল ইনগলিসকে যেনো সেনাদলের কর্তৃত্বদান করা হয়। উপরঅলার আদেশ যথাযথভাবে মেনে চলার সময় এখন নয়। তারা হলেন একমাত্র উপযুক্ত মানুষ। এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে সেক্রেটারী পুরোপুরি একমত। এ পর্যন্ত যে অবসর তিনি গ্রহণ করেননি তা গ্রহণ করার জন্য তাঁর চিকিৎসকেরা চাপ দিতে লাগলেন। পাঁচজন সদস্য বিশিষ্ট একটি অস্থায়ী কাউন্সিল গঠন করা হলো। সে সদস্য পাঁচজন হলেন-অর্থনৈতিক কমিশনার মার্টিন গাবিন্স, বিচার বিভাগীয় কমিশনার মিঃ ওম্যানি, মেজর ব্যাঙ্কস, কর্ণেল ইনগলিস এবং চীফ ইঞ্জিনিয়ার মেজর এন্ডারসন। স্বভাবতঃই মার্টিন গাবিন্‌স কাউন্সিলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সেপাইদের নিরস্ত্র করার তাঁর প্রিয় প্রস্তাবটি তুলে ধরলেন। তাদের অস্ত্র কেড়ে নেয়া হলো। তবে অল্প দিনের ছুটিতে সকলকেই বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তাঁর নীতির পরিবর্তন করার সঙ্গে সঙ্গেই হেনরী লরেন্স আবার তার কর্তব্যকর্মে যোগ দিলেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করে কাউন্সিল বাতিল ঘোষণা করলেন এবং যে সকল সেপাইকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো, তাদেরকে ডেকে আনলেন। সেপাইদের অনেকেই ফিরে এলো এবং অবরোধকালীন সময়ে তারা যথেষ্ট বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছে।

৩০ এবং ৩১শে মে তারিখের বিক্ষোভ সম্বন্ধে অনুমান করা হয়েছিলো। ৩১শে মে তারিখের একটা ধর্মীয় বিক্ষোভ পুলিশ দমন করেছিলো। দশ দিন পরেই সেপাইরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। স্যার হেনরী একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে প্রতিরক্ষার কাজ করে যেতে লাগলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্যান্টনমেন্ট এবং মচ্ছি-ভবন খালি করে সকলে রেসিডেন্সীতে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। উত্তরে এবং দক্ষিণে ব্যাটারী স্থাপন করা হলো। সুন্দর সুন্দর সুশোভিত বৃক্ষরাজি কেটে ফেলা হলো, পরিখা খনন করা হলো। সামরিক স্টোরের সরঞ্জামপত্র শান্তভাবে মচ্ছি-ভবন থেকে রেসিডেন্সীতে সরিয়ে দেয়া হলো। স্যার হেনরী সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখাশোনা করতে লাগলেন।

ব্রিটিশ জনসাধারণের সৌভাগ্য যে স্যার হেনরী প্রস্তুতি গ্রহণের যথেষ্ট সুযোগ এবং সময় পেয়েছিলেন। এভাবে জুন মাস কেটে গেলো। অযোধ্যার সামরিক এবং বেসামরিক ঘাঁটিগুলোর পতন ঘটতে থাকে একের পর এক। এমনকি যেখানে কোনো সামরিক ঘাঁটি ছিলো না, সেখানকার বেসামরিক কর্মচারিদেরও সময় মতো ঘাঁটি ত্যাগ করার নির্দেশ দান করা হয়েছিলো। কিন্তু লখনৌর অবস্থা করুণ হয়ে এসেছে। কিন্তু স্যার হেনরী নিশ্চিত যে বিপদ নিশ্চিতভাবেই আসবে। যতোই দেরী হবে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার অধিক সুযোগ তিনি পাবেন। জেনারেল হুইলার যে অবরুদ্ধ হয়েছেন, তিনি সে খবর পেয়েছেন এবং তিনি যথার্থই অনুমান করেছেন যে লখনৌ হবে সেপাইদের পরবর্তী আক্রমণের লক্ষ্য। আটাশ তারিখে শহর থেকে বিশ মাইল দূরে নবাবগঞ্জ নামক স্থানে সেপাইরা জড়ো হলো। তড়িৎগতিতে ব্রিটিশ সেনাদলকে মচ্ছি-ভবন এবং ক্যান্টনমেন্ট থেকে রেসিডেন্সীতে নিয়ে আসা হলো।

তারপরের কর্তব্য কি-এ ব্যাপারে চিন্তা করতে লাগলেন। ছাউনির মধ্যে আবদ্ধ থেকে শত্রুর মোকাবিলা করা উচিত, নাকি শহরের বাইরে গিয়ে শত্রুদেরকে বাধা দিলে ভালো হয়, সে সম্বন্ধে কিছুই স্থির করা হয়নি। একটি বিজয় যদি অর্জন করা যায় তাহলে তার লোকজনের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে এবং তাদের মধ্যে নতুন মনোবলের সঞ্চার হবে। দোদুল্যমান চিত্তের স্থানীয় মানুষেরাও তার ফলে নিশ্চিতভাবে তাদের পক্ষে চলে আসবে। স্যার হেনরী স্থির করলেন, তাঁরা যতো দুঃসাহসী হবেন, তাঁদের নীতি ততোটুকু নির্ভুল হবে। অযোধ্যার গোলন্দাজ সেনাদলের দুর্বলতা এবং দেশীয় গোলন্দাজ সেনাদের ভীরুতার প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষিত হতে পারেনি। শত্রুদের শক্তি সম্বন্ধে সঠিক খবর স্যার হেনরীকে জানানো হয়নি। সেজন্য যুদ্ধে ব্রিটিশপক্ষ চরমতম ক্ষতির সম্মুখীন হলো।

ব্রিটিশ সেনার পরাজয়ের সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। শিশু এবং মহিলারা ধন-সম্পদ অরক্ষিত রেখে সমস্ত ঘাঁটি থেকে রেসিডেন্টের বাড়িতে পালিয়ে যেতে লাগলেন। সকলেই আপনাপন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। সক্ষম পুরুষেরা অস্ত্র হাতে পরিখার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করতে লাগলেন। সে যাহোক, বিজয়ী বাহিনী কিন্তু শত্রুদের এ শঙ্কার কোনো সুযোগ গ্রহণ করতে পারেনি। তারা যদি শত্রুর পিছু পিছু ধাওয়া করতো তাহলে সম্ভবততা শত্রুর ছাউনি অধিকার করে নিতে পারতো। বিরতিটুকু ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য দৈবী সুযোগ। এ সময়ের মধ্যে অন্য কোনো পথ খোলা না থাকায় দীর্ঘমেয়াদী অবরোধের মোকাবেলা করার জন্য উঠে পড়ে লাগলো।

কতেক ব্যাটারী এখনো স্থাপন করা হয়নি। শ্রমিকেরা রাত-দিন পরিশ্রম করছে। মজুরী অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। একজনের মজুরী যেখানে প্রতিরাতে দু’আনা, সেখানে স্যার হেনরীকে প্রতিরাতে দু’টাকা পর্যন্ত মজুরী দিতে হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণ মজুরদের বিশেষ লাভ হয়নি। ঘেসুড়ে, গৃহভৃত্য, ঝাড়ুদার সকলেই অধিক মজুরীতে কাজ করতে লেগে গেলো। অবরোধের সময়ে কিছু চাকর প্রভুদের সঙ্গে ছিলো।

গবাদি পশু তাদের বর্ধিত উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। দেখাশোনা করার কোন চাকর-বাকর ছিলো না এবং আশেপাশে কোথাও ঘাস ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছিলো না। কতেক পশু কুয়ার জলে ঝাঁপ দিয়ে জল বিষাক্ত করে তুললো। অন্যান্য প্রাণী গুলির আঘাতে প্রাণ দিয়ে বাতাস দুষিত করলো।

প্রত্যেক পরিবারের জন্য আলাদা আলাদা রান্না-বান্না করা অসম্ভব হয়ে পড়লো। পুরুষ মানুষেরা প্রাণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। সময়ে সময়ে মাত্র তারা স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে পারে। শিশু এবং নারীদের তয়খানা অথবা ভূগর্ভস্থ কক্ষে আশ্রয় দেয়া হলো। কারণ গুলি-গোলার আক্রমণ থেকে নিরাপত্তার জন্য সেটাই ছিলো সবচেয়ে প্রকৃষ্ট ব্যবস্থা। অনেকগুলো পরিবার এক সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকার ফলে অল্পদিনের মধ্যেই কলেরা বসন্ত ইত্যাদি মহামারী দেখা দিলো। রেসিডেন্সীতে অনেকগুলো পরিবার আশ্রয় পেয়েছিলো। তাছাড়া আরো কতিপয় পরিবার ডঃ ফেরিয়ার এবং মার্টিন গাবিনসের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলো। মার্টিন গাবিস আসন্ন অবরোধের আশঙ্কা করে ভাণ্ডারে প্রচুর খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। তাই অবরোধের সময় তাদেরকে অন্যান্যদের মতো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি।

অবরুদ্ধ মানুষদের মধ্যে ছিল সকল শ্রেণীর মানুষ। সরকারি চাকুরে, কেরাণী, ব্যবসায়ী-সব রকমের মানুষ ছাউনিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। এখন সকলকেই অস্ত্র ধরতে হচ্ছে। সমস্ত ইউরোপীয় অধিবাসী আবার ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দা নন। এমন একজনও ইউরোপীয় ছিলো না, বিদ্রোহের সময়ে যিনি গ্রেফতার হননি। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিদ্রোহীদের গুলিতে হতাহত হলেন।

অবরোধের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভ্রান্ত ভারতীয়দের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আটক করে রাখা হলো। তাঁদের প্রধান ছিলেন মোস্তাফা আলীখান। তিনি ছিলেন নওয়াব ওয়াজেদ আলী শাহের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। দুর্বল চিত্তের লোক ছিলেন বলে তাঁর পিতা তাঁকে সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করেন। দিল্লীর সম্রাটের বংশোদ্ভুত দু’জন রাজপুরুষ মীর্জা মুহম্মদ হুমায়ুন এবং মীর্জা মুহম্মদ শিকোহ্ যারা লখনৌ দরবারের প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁদেরও বন্দী করে রাখা হলো। মুসলিম সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের সাথে হিন্দু তালুকদার, জমিদার এবং রাজাদেরও বন্দী করা হলো। তাদের মধ্যে তুলসীপুরের অল্পবয়স্ক রাজাও ছিলেন। এ সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মচ্ছি-ভবনে স্থান দেয়া হয়েছিলো।

অবরোধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ পক্ষ গোয়েন্দার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করতে থাকে, কেননা ছাউনির সঙ্গে তাবৎ জগৎ সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে। ছদ্মবেশে মেজর গল এলাহাবাদ যাওয়ার চেষ্টা করে বিফল হলেন। সেপাইদের হাতে ধৃত হয়ে তিনি নিহত হলেন। গোয়েন্দা বিভাগের কর্তা ছিলেন গাবিন্স। তার অধীনে বিশ্বস্ত এবং সুদক্ষ কতিপয় গোয়েন্দা কাজ করছিলো। কিন্তু সেপাই বেষ্টনী ভেদ করা খুব সহজ ছিলো না।

রেসিডেন্সীর উত্তর দিকে গোমতী নদী অবস্থিত। সেদিক দিয়ে অবরোধকারীদের একক হামলা করার জন্য প্রচুর সৈন্য সমাবেশ করার স্থান ছিলো। নিরাপদ দূরত্ব থেকে গোলাবর্ষণ করে-দুর্গ প্রাকারও তারা ভেঙ্গে ফেলতে পারতো। দক্ষিণে কানপুর সীমান্ত, পশ্চিমদিকে শহর এবং প্রহরীরা রেসিডেন্সীর পূর্বদিক রক্ষা করে আসছিলো। রণাঙ্গনের মধ্যবর্তী অট্টালিকাগুলো গোলার আক্রমণ ব্যর্থ করে দিচ্ছিলো এবং অধিকসংখ্যক সৈন্যের সাহায্যে আক্রমণও অসম্ভব করে তুলেছিলো। উত্তরের রণাঙ্গনের কেন্দ্রবিন্দুতে কামান পাতা হয়েছে, দক্ষিণ প্রান্তে ইনসের ঘাঁটি এবং একবারে পূর্বদিকে হাসপাতাল ঘাঁটি। তার পাশে হলো বেইলী গার্ডদের অবস্থান। একটু দূরে দক্ষিণে পূর্ব কোণে কানপুর গোলন্দাজ বাহিনী এবং মার্টিন গাবিন্‌সের বাড়িতে এন্ডারসনের ঘাঁটি। চীনহাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে উত্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোটেই জোরদার করা সম্ভব হয়নি। দক্ষিণ দিকটা অপেক্ষাকৃতভাবে নিরাপদ ছিলো। বিদ্রোহীরা সীমানার কাছাকাছি এসে যায়। অবরোধকারী সেপাইরা অবরুদ্ধ শিখ সেপাইদের সঙ্গে হামেশা কথাবার্তা বলতো। কিন্তু সমগ্র দক্ষিণ দিকে ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিলো, তার ফলে সেপাইরা অগ্রসর হতে পারছিলো না এবং কামানের গোলাবর্ষণ থেকে অট্টালিকার নীচের দিক রক্ষা পেয়েছিলো। পূর্বদিকে হাসপাতাল এবং এন্ডারসনের ঘাটির মাঝখানে পেছনের সারিতে ডঃ ফেয়ারের বাড়ি। সামনের সারিতে বেইলী গার্ড, স্যান্ডার্স এবং ফ্যাগোর ঘাটি। এই লাইনের উত্তর-পূর্ব দিক অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিলো। পশ্চিম প্রান্তে অথবা নগরের দিকে গাবিন্স এবং ইনসের ঘাঁটির মধ্যবর্তীস্থানে কসাইখানা, বকরীঘর এবং রেসিডেন্সীদের চাকর বাকরদের নিবাসকেন্দ্র। তা ছাড়া রয়েছে গীর্জা, খ্রীস্টান গোরস্থান এবং ইভানের কামান। বলতে হয়, সবদিক দিয়ে রেসিডেন্সী সুরক্ষিত ছিলো। অনুগত সেপাইরা চারটা ঘাঁটি পুরোপুরিভাবে রক্ষা করে আসছিলো। অবরুদ্ধ অধিবাসীদের সংখ্যা ছিলো ৩ হাজার। তার মধ্যে ১৭২০ জন ছিলেন যোদ্ধা। বাকী ১২৮০ জন ছিলেন শরণার্থী। সমস্ত সৈন্যের অর্ধেক ছিলো ভারতীয়। সেপাই ছাড়া আরো ৬৮০ জন ভারতীয় ছাউনির মধ্যে ছিলো। নিকটবর্তী উচ্চ অট্টালিকা হতে সুরক্ষিত দুর্গে রাইফেলের গুলি ছোঁড়া হতো।

অবরোধকারী সেপাইদের পুরোপুরি সংখ্যা সঠিকভাবে জানা যায়নি। ইনস মনে করেন, দু’টি নিয়মিত রেজিমেন্ট, অষ্টম অযোধ্যা স্থানীয় রেজিমেন্ট, ১৫ নং নিয়মিত রেজিমেন্ট, গোলন্দাজ বাহিনীর পুরো দুটি দল, অন্যান্য অশ্বারোহী বাহিনী এবং অযোধ্যার তালুকদারদের তিনটি দল বিদ্রোহী অবরোধকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। স্যার হেনরী লরেন্স প্রথমে অযোধ্যার তালুকদারদের সমর্থন লাভ করতে চেষ্টা করলেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন শাহূগঞ্জের রাজা মানসিং। তিনি ইংরেজদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দান করলেন। কিন্তু রামগড়ের হিন্দুরাজা গুরুবক্স এবং মাহমুদাবাদের মুসলিম ভূস্বামী নওয়াব আলী কঠোর জবাব দান করলেন। জুলাই মাসে তাঁদের সৈন্যদল লখনৌর বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিলো। প্রথমদিকে রেসিডেন্সীর দেয়াল ভাঙ্গার কোনো প্রচেষ্টাই সেপাইরা করেনি। রেসিডেন্সীর অভ্যন্তরস্থ নিবাসসমূহই ছিলো সেপাইদের গোলাগুলির নিশানা। কথিত আছে, বরকত আহমদ নামে ১৫নং অশ্বারোহী বাহিনীর একজন অফিসার সেপাইদের নেতৃত্বদান করেছিলেন, মাহমুদাবাদের রাজার লেফটেন্যান্ট খান আলী খান, তালুকদারদের বাহিনীতে নেতৃত্ব দান করেছিলেন।

স্যার হেনরী লরেন্স অনুভব করলেন, এখন মচ্ছি-ভবন ত্যাগ করে সেনাবাহিনীকে রেসিডেন্সীতে নিয়ে আসাই উত্তম হবে। পরিত্যক্ত ঘাঁটি ছিলো কর্ণেল পামারের অধীনে। রেসিডেন্সীর ছাদের যন্ত্র অকেজো হয়ে পড়েছিলো। অবিরাম গোলাবর্ষণের মুখে দু’জন অফিসারকে ক্যাপটেন কালটন খবর দিতে সক্ষম হলেন, বন্দুকগুলো ভালোভাবে রক্ষা করো, দুর্গ উড়িয়ে দাও, তারপরে মধ্যরাতের দিকে পালিয়ে এসো। অধিকতর ক্ষয়ক্ষতির পূর্বে নির্দেশ পালন করা হয়েছিলো। তবে ভাণ্ডারের অনেক অস্ত্রশস্ত্র ছেড়ে আসতে হলো। সকাল বেলা ১টার মধ্যে সেপাইরা ঘেরাও করার কাজ শেষ করে ফেলেছে।

সকাল হওয়ার একটু পরেই স্যার হেনরী লরেন্স সবগুলো ঘাঁটি পরিদর্শন করতে গেলেন। সবকিছু নিজের চোখে দেখার পর তিনি রেসিডেন্সীতে নিজের কক্ষে এসে রেশন বণ্টন সম্বন্ধে একখানা নির্দেশ লিখিয়ে নিচ্ছিলেন। তার আগের দিন তাঁর কক্ষে গুলি এসে পড়েছিলো কিন্তু কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। সকলে তাঁকে সে কক্ষ ছেড়ে অধিকতররা নিরাপদ কক্ষে চলে যাবার জন্য অনুরোধ করেছিলো। তিনি পরের দিন চলে যাবেন বলে স্থিরও করেছিলেন। শত্রুদের মধ্যে এমন অব্যর্থ লক্ষ্য মানুষ আছে সেকথা তিনি চিন্তাও করতে পারেননি। যা আশাও করতে পারেনি কেউ তাই ঘটে গেলো। ক্যাপটেন উইলসন আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। ধূলো এবং ধূয়ার জন্য উইলসন কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন “স্যার হেনরী, আপনি কি আহত হয়েছেন?” একটু পরেই এলো অস্ফুট চীৎকার “আমি মারা গেলাম।” ডঃ ফেরারের গৃহে স্যার হেনরী লরেন্সকে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে তিনি ৪ তারিখে মারা গেলেন। তিনি মেজর ব্যাঙ্কসকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করলেন এবং তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নির্দেশ দান করলেন।

৩রা জুলাই তারিখে বিচার বিভাগীয় এম. এম. ওম্যানির মস্তকে গোলার আঘাত লাগলো এবং দুদিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে নতুন চীফ কমিশনার মেজর ব্যাঙ্কসও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারলেন না। গাবিন্‌সের ঘাঁটিতে তিনিও ২১শে জুলাই তারিখে মস্তকে গুলিবিদ্ধ হলেন। এভাবে এক সপ্তাহকাল সময়ের মধ্যে চীফ কমিশনারের আসন দু’দুবার খালি হলো। ব্রিগেডিয়ার ইঙ্গলিস স্থির করলেন, সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে প্রতিরক্ষার সমস্ত দায়িত্ব তাঁর গ্রহণ করা উচিত। তারপর থেকে শিবিরে বেসামরিক কর্তৃত্বের অবসান ঘটলো। অহরহ মৃত্যু ঘটছে। মিসেস ডোরিন নামে সীতাপুরের এক আশ্রয় প্রাথিনী গাবিন্‌সের ঘরের জানালা দিয়ে আসা একটি গুলির আঘাতে নিহত হলেন।

জুলাইয়ের পয়লা দিকে প্রকৃতি ব্রিটিশ পক্ষের সহায়ক হলো। ৫, ৭ এবং ১০ তারিখে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টির পানি অনেক ময়লা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, আবহাওয়া পরিষ্কার করে তুলেছে। ৭ তারিখে বৃষ্টি স্বাস্থ্যকর অবস্থা সৃষ্টি ছাড়াও যে সুযোগ দিয়েছে তা বলে শেষ করা যায় না। হাসপাতালের কামানের সামনে প্রচুর পরিমাণ ভুষি রাখা হয়েছিলো জমা করে। কতিপয় সাহসী সৈনিক এ ভূষির স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিলো। ভীষণ দাহ্য ভূষিতে আগুন লাগানোর পরেও সময়মতো বৃষ্টির জন্য অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়নি।

পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গে অবরোধকালে মহিলাদেরকেও অনেক দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। তয়খানা অথবা ভূগর্ভস্থ কক্ষে ইঁদুর বেড়ালের সঙ্গে তাঁদের কাটাতে হয়েছে। রসদের ঘাটতি পড়েছে। চারদিকে গুমোট অবস্থা। সকলের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে।

মিঃ রীস ধারণা করতে পারেন না যে এতো সকালে লখনৌ শহরের পতন ঘটবে। কিন্তু অতিসত্বর কোনো সাহায্যের প্রত্যাশাও তিনি করতে পারছেন না। সকলেই বলছে, সাহায্য আসছে, কিন্তু কোথায় সেই সাহায্য? কোত্থেকে আসছে? কখন আসছে? কানপুর শত্রুর অধিকারে চলে গেছে। সমগ্র ভারত জুড়ে দেখা দিয়েছে বিশৃঙখলা।

সুদীর্ঘকাল ধরে রেসিডেন্সী অবরোধকালে সেপাই নেতৃবৃন্দ মাত্র চারবার ব্যাপকভাবে আক্রমণ পরিচালনা করেছেন। ২০শে জুলাই তারিখে তারা প্রথমবারের মতো আক্রমণ করেন। কামানের নিকটের একটি গোলা বিস্ফোরিত হলো, কিন্তু তার ফলে কামানের কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ দূরত্ব সম্বন্ধে সঠিক ধারণা তারা পোষণ করতে পারেনি। তারপরে সেপাইরা চতুর্দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগলো। ধীরস্থির সুসংহত গতিতে তারা এগিয়ে আসছিলো। কোনো সুদক্ষ ইউরোপীয় অফিসার তাদেরকে নেতৃত্ব দান করেছিলো বলে সন্দেহ করা হয়। ব্রিটিশ পক্ষও সমান দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিরক্ষা করে চলেছে। দলে দলে সেপাই সৈন্য এগিয়ে আসে কিন্তু তাদের নেতৃবৃন্দ ভেতরে প্রবেশ করতে অপারগ। যুদ্ধ শুরু হয় সকাল নটায় এবং চার ঘণ্টা পর্যন্ত চলে। তারপরে অবরোধকারীরা চলে যেতে বাধ্য হয়। শত্রুদের তুলনায় সেপাইদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। ব্রিটিশ পক্ষে ২৩জন হতাহত হয়েছে, তার মধ্যে ১৪ জন হলেন ইউরোপীয় ।

একে তো যুদ্ধের গতি ভালোর দিকে। ২২ তারিখে আরো ভালো খবর এলো। ২৯ তারিখে এ্যানগাড কানপুর ত্যাগ করেছেন। তিনি ফিরেছেন ২২শে জুলাই। তাঁর সঙ্গে কোনো লিখিত নির্দেশ নেই। যে নির্দেশ তাকে দেয়া হয়েছিলো তিনি তা পথে হারিয়ে ফেলেছেন। তবে তিনি নানার সেনাবাহিনীর উপর হ্যাভলকের বিজয়ের অবিশ্বাস্য সংবাদ বয়ে এনেছেন।

উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে কয়েকদিন আকাশের দিকে তাকাতে থাকলেন। কিন্তু সাহায্যকারী বাহিনীর কোনো হাউই সঙ্কেত দেখতে না পেয়ে তারা নিরাশ হয়ে গেলেন। দিনের পর দিন অতীত হয়ে যাচ্ছে। শিবিরের লোকজনের মনোবল বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই।

জুলাইয়ের শেষের দিকে আহত মানুষে হাসপাতাল ভর্তি হয়ে গেলো। রক্তাক্ত আহত মানুষ বিছানায়, কৌচে সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। হাসপাতালের সেবক এবং পরিচারকের সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। সকলকে সেবা করার সময় এবং সুযোগও নেই।

উল্কণ্ঠিত চিত্তে অবরুদ্ধ ব্রিটিশ সেনা যখন দিন যাপন করেছিলেন, হ্যাভলকও বসে সময় কাটাননি তখন। ১৭ জুলাই তারিখে তিনি কানপুর এসে পৌঁছেছেন। ২০ তারিখে তাঁর কিছু সৈন্য অযোধ্যার অংশে নদী অতিক্রম করলেন। ২৫ তারিখের মধ্যে নদী পার হওয়ার কাজ শেষ হলো এবং জেনারেল নিজেও সেনাদলের সঙ্গে যোগ দিলেন। ২৬ তারিখে তিনি লখনৌ থেকে ৫ মাইল দূরে মঙ্গলওয়ার নামক স্থানে শিবির স্থাপন করলেন। তিনদিন পরে উনাও নামক স্থানে তাঁর অগ্রগতি বাধার সম্মুখীন হলো। ঘোরতর যুদ্ধের পর তিনি সেপাইদের তাদের সুরক্ষিত স্থান থেকে তাড়িয়ে দিলেন। প্রাচীর ঘেরা শহর বশিরাতগঞ্জে তারা বিজয়ী শত্রুকে প্রচণ্ডভাবে বাধা দিলো। দ্বিতীয়বারেও হ্যাভলক জয়লাভ করলেন। কিন্তু এজন্য তাঁকে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি অবরোধ করলেন। দানাপুরে বিদ্রোহের সংবাদ শুনে তার দলের লোকেরা বিচলিত হয়ে উঠলেন। কলকাতা থেকে সাহায্য পাবার পূর্বেই বিদ্রোহীরা প্রত্যেক ঘাঁটিতে দৃঢ়চিত্তে তাঁকে বাধা দিতে লাগলো। টাইটলার শত্রুদের শক্তি এবং দৃঢ়তা সম্বন্ধে খুব নাজুক ধারণা পোষণ করেছিলেন। যারা তাকে বাধা দিচ্ছিলো, তাদেরকে পরাস্ত করার জন্য উপযুক্ত শক্তি তার ছিলো না। তিনি এমন একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, তার ফলে তার সৈন্যদলকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। তিনি মঙ্গলওয়ারে ফিরে গিয়ে কলকাতা থেকে সৈন্য না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাই যুক্তিযুক্ত মনে করলেন।

আগস্ট মাসের ১৩ তারিখে হ্যাভলক অল্পসংখ্যক সৈন্য সাহায্য পেয়ে লখনৌর দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। তাঁর ফিরে আসার সুযোগে সেপাইরা বশিরাতগঞ্জ পুনরায় দখল করে নিয়েছে। তিনি বশিরাতগঞ্জের সেপাইদেরও পুনরায় পরাজিত করলেন। কিন্তু শীগগিরই স্পষ্ট হয়ে উঠেলো যে লখনৌকে মুক্ত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী তিনি নন। এখন প্রশ্ন হলো অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে তিনি ঝুঁকি গ্রহণ করবেন, নাকি কর্ণেল ইঙ্গলিসকে ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করবেন? তার সৈন্যের পতন লখনৌর পতনকে ত্বরান্বিত করবে। পক্ষান্তরে তিনি যদি অপেক্ষা করেন এবং সেনাদলকে অক্ষত রাখেন, সেপাইদের কোনো ভুলের সুযোগ গ্রহণ করে হয়তো ইতিমধ্যে অবরুদ্ধদের মুক্ত করার কোনো পন্থা বের করতে পারবেন। বশিরাতগঞ্জে পরাজয় বরণ করার পরেও সেপাইরা কিন্তু নিরুত্সাহী হয়ে পড়েনি। পরাজয় বরণ কররার পূর্ব পর্যন্ত বুরিয়াকা চক নামক স্থানে তাঁকে আবার আরেকটি যুদ্ধ করতে হলো। ইতিমধ্যে তিনি সংবাদ পেলেন প্রবল বিদ্রোহী সৈন্যের মোকাবেলায় কানপুর এবং বিরের পতন আসন্ন হয়ে এসেছে।

আগস্ট মাসটি হলো লখনৌর অধিবাসীদের জন্য চরমতম দুঃসময়ের কাল। তারা প্রাথমিক সাহায্যের সমস্ত আশা হারিয়ে ফেলেছেন। ব্যর্থতা তাদেরকে এতোদূর সন্দেহপ্রবণ করে তুলেছে যে তারা হ্যাভলকের বিজয়ের সংবাদও বিশ্বাস করতে পারলেন না। রসদের পরিমাণ ভয়াবহভাবে কমে এসেছে। মোটা আটা, মাষকলাইয়ের ডাল ছাড়া তাদের খাবার মতো অন্য কোনো জিনিস নেই। খাদ্যের অভাবের চাইতে আফিমের অভাব আরো গুরুতরভাবে অনুভূত হতে লাগলো।

আগস্ট মাসের ১১ তারিখে রেসিডেন্সীর ছাদ ধ্বসে পড়লো। ৩২নং রেজিমেন্টের অর্ধডজন মানুষ ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়লো। তাদের মধ্যে থেকে দু’জনকে বের করে আনা হলো। কেবলমাত্র এক জনকেই বাঁচানো সম্ভব হয়েছিলো। ২৩ তারিখে রেসিডেন্সীর পেছনের বারান্দা ধ্বসে পড়লো। কিন্তু তাতে কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ওই আগস্ট তারিখে অবরোধকারীরা ঘোষণা করলো যে তাদের রাজার রাজ্যাভিষেক হয়ে গেছে। ফিরিঙ্গি রাজত্বের অবসান হয়েছে। বিদ্রোহী সেপাইদের জন্য এমন একজন আনুষ্ঠানিক শাসকের প্রয়োজন, যার আহ্বানে তারা সকলে সমবেত হতে পারে। প্রকৃত নওয়াব কলকাতাতে বন্দী জীবন যাপন করছেন। কাজেই সেপাইরা তাঁর নাবালক পুত্রকে তাদের শাসক নির্বাচিত করলেন। তার নির্বাসিত পিতা দিল্লীর অধীন ছিলেন না। তাঁর রাজত্বের একটা নতুন দিক হলো তিনি, অথবা অধিকতরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে তার উপদেষ্টারা দিল্লীর সম্রাটের যাবতীয় আদেশ মেনে চলবেন। অধিকতরা দায়িত্বশীল সেপাই নেতৃবৃন্দ আনুগত্যের মাধ্যমে সংহতি আনয়ন করার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। রাষ্ট্রের যাবতীয় দায়িত্বশীল পদ হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করা হলো। শরফুদ্দৌলাকে প্রধান মন্ত্রী এবং মহারাজ বালকিষাণকে অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করা হলো। মাম্মু খানকে প্রধান বিচারক এবং জয়লাল সিংকে সমর মন্ত্রীর পদ দান করা হলো। নাবালক ওয়ালী বিরজিস কাদিরের জননী বেগম হজরত মহল সমস্ত ক্ষমতা পরিচালনা করবেন।

বিরজিস কাদিরের রাজ্যাভিষেকের পরে শহরবাসীদের উৎসাহ উদ্দীপনা বহুগুণে বেড়ে গেলো। ওদিকে ব্রিটিশ সৈন্য তাদের আরেকজন নায়ককে হারালো। তিনি হলেন চীফ ইঞ্জিনিয়ার মেজর এন্ডারসন। তিনি গুলির আঘাতে নয়, পেটের অসুখে ভুগেই মারা গেলেন। অতিরিক্ত পরিশ্রম করা এবং অবসর গ্রহণ না করার জন্যই জেনারেল এন্ডারসন মারা গেলেন। হ্যাভলকের দ্বিতীয় দফা পশ্চাদপসরণ তালুকদারদের মধ্যে ভয়ানক প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করে। দীর্ঘদিন যাবত তারা ওয়ালীকে সমর্থন না করে পারেন না। আগস্ট মাসে অবরোধকারী শত্রুর সংখ্যা বিশ থেকে চল্লিশ হাজার বলে জানা গেলো। কিন্তু জেনারেল এন্ডারসন পরে শুনেছেন, তাদের সংখ্যা পুরোপুরি এক লক্ষ।

আগস্ট মাসটা হচ্ছে পরিখা কাটার উপযুক্ত সময়। এ ব্যাপারে পাচিরা হলো ওস্তাদ। বৃষ্টিতে মাটি নরম হওয়ায় তাদের কাজও সহজ হয়ে এসেছিলো। ব্রিটিশ সৈন্য অভ্যন্তরের অত্যন্ত শঙ্কিতভাবে সময় কাটাচ্ছিলো। ১০ই আগস্ট তারিখে রেসিডেন্সী দ্বিতীয়বার ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত হলো। বেলা এগারোটার পর থেকে গোলার পর গোলা ফুটতে আরম্ভ করলো। কর্ণেল ইঙ্গলিস অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন। তার পাশে যে লোকটি ছিলো তাকে গুলি করে হত্যা করা হলো। গোলার পর গোলার আঘাতে প্রাচীর স্থানে স্থানে ধ্বসে পড়লো। এ সময় বিদ্রোহীরা যদি ভালোভাবে চেষ্টা করতো তাহলে ভেতরে প্রবেশ করতে পারতো।

আগস্ট মাসেও অবরুদ্ধ ব্রিটিশ সৈন্যদের মাথার ওপর থেকে দুর্যোগের কালো মেঘ অপসারিত হলো না, যদিও তারা একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। তবুও বন্ধুদের আগমনবার্তা তারা শুনতে পাচ্ছে। ফিরতে এ্যানগাডের অনেকদিন লেগে গেলো। কিন্তু ১৫ই আগস্ট তারিখে তিনি কর্ণেল টাইটলারের কাছে থেকে দ্বিতীয় সংবাদ বয়ে এনেছেন। ৪ তারিখের চিঠিখানিতে হ্যাভলকের দ্বিতীয়বার লখনৌ উদ্ধারের প্রচেষ্টার কথা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু পথিমধ্যে এ্যানগার্ড শহস্তে পতিত হলেন। তিনি যখন শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পেলেন, ততোদিনে পুনর্বার নদী অতিক্রম করে হ্যাভলক কানপুরে ফিরে গেছেন।

সেপ্টেম্বর মাসটি ছিলো ইংরেজদের জন্য অত্যন্ত ভাগ্যবন্ত মাস। এ মাসেই ঘটে দিল্লীর পতন এবং এ মাসেই লখনৌতে সাহায্য আসে। সাহায্য আসার পরেও কিন্তু অবরুদ্ধ অধিবাসীদের মুক্তি আসেনি। খাদ্য-বস্তু এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অসম্ভব রকম চড়ে গেছে। আটা, মদ, সিগারেট ভীষণ দুর্মূল্য হয়ে উঠেছে। মিসেস কেসি বলেছেন ৫ই সেপ্টম্বর তারিখে মহিলারা যখন নৈশ ভোজনে রত, তাদের কক্ষের একটা দেয়াল ধ্বসে পড়লো। সুতরাং মহিলাদেরকে অভূক্ত অবস্থাতেই কক্ষান্তরে যেতে হলো।

সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে শাহগঞ্জের প্রভাবশালী তালুকদার রাজা মানসিং বিপুল সৈন্য নিয়ে লখনৌর নিকটবর্তী স্থানে শিবির রচনা করেছেন। তার উপস্থিতিতে অবরুদ্ধদের মনে একদিকে যেমন আশার সঞ্চার হলো, তেমনি অন্যদিকে তারা শঙ্কিত হয়ে উঠলেন ভয়ানক ভাবে। যদি রাজা মানসিং ব্রিটিশ পক্ষে যোগ দেন, তাহলে অবরুদ্ধরা হয়তো বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারে আর বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিলে সকলকে যে ভবলীলা সাঙ্গ করতে হবে, সে ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ রইলো না। ১৪ তারিখে ক্যাপটেন কালটন মাথায় গুলি লেগে মারা গেলেন। কালটনের মৃত্যুতে ইংরেজদের মনে গভীর বিষাদের সঞ্চার হলো, কিন্তু অনতিবিলম্বে সুখপ্রদ সংবাদ এলো। ১৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে এ্যানগাড একখানা চিঠিসহ আবার হ্যাভলকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

প্রকৃত প্রস্তাবে ভারতীয় সৈন্যরা তাদের প্রভুদের কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও লিখিত কোনো প্রমাণ নেই, এ্যানগার্ড একাধিকবার নালিশ করেছেন যে, বেষ্টনীর ভেতরের দেশীয় সেপাইদের সঙ্গে বাইরে সেপাইদের সংযোগ রয়েছে। সেজন্য শিবিরের সমস্ত খবর আগেভাগে সেপাইরা জেনে যায়। লেফটেন্যান্ট জেমস গ্রাহাম আত্মহত্যা করলেন। কিন্তু তা বিশেষ হতাশার সঞ্চার করতে পারেনি। অবরুদ্ধতার কারণে সাফল্যের সমস্ত আশা হারিয়ে ফেললো। এ্যানগাডের সংবাদও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলো না হতাশাগ্রস্থ সৈন্যদের। কেউ তাঁর কথাকে আর বিশ্বাস করতে পারলেন না। কিন্তু ২২ তারিখে তিনি খবর নিয়ে এলেন, উদ্ধারকারী সৈন্যদল আর বেশি দূরে নয়। এবার তিনি হ্যাভলকের কাছ থেকে নয়, জেনারেল আউটরামের কাছ থেকে একখানা চিঠি নিয়ে এসেছেন। ২৩ তারিখে কানপুরের দিকে দূরবর্তী বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেলো। ২৫ তারিখে হ্যাভলক এবং আউটরাম রেসিডেন্সীর মধ্যে প্রবেশ করলেন।

বিদ্রোহের সময় তিনি পারস্যে ছিলেন। তাঁকে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে ডেকে আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে গভর্ণর জেনারেল প্রদেশগুলোর প্রতিরক্ষার ব্যাপারে ভয়ানক উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। সে জন্য তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

আউটরাম এবং হ্যাভলক ছিলেন পুরোনো বন্ধু। হ্যাভলক পারস্যে আউটরামের অধীনে কাজ করেছেন। আউটরামের নিয়োগের ফলে হ্যাভলক ব্যথিত হলেন। কানপুর অভিযানে তিনি অবিমিশ্র সাফল্যের দাবিদার। তাঁর বিরুদ্ধে যতোই নালিশ থাকুক না কেননা, আউটরাম হ্যাভলকের সামরিক কর্তৃত্বকে অস্বীকার করলেন না। আউটরাম ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে কানপুর পৌঁছলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন চীফ অব ষ্টাফ। মগডালার লর্ড ন্যাপিয়ের ছিলেন একজন প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বশীল পুরুষ। ৮ তারিখে ভাসমান ব্রিজ অতিক্রম করা হলো। পরের দিন সেনাবহিনী আবার লখনৌ অভিমুখে মার্চ করতে লাগলো। এবারে তাঁরা লখনৌতে এসে পৌঁছালেন। এ বাহিনীতে ২৭৯৯ জন সশস্ত্র ইউরোপীয় সৈন্য ছিলো। তাদের মধ্যে দেশীয় সৈন্যদের সংখ্যা ছিলো ৪০০ জনের মতো। তার মধ্যে ৩৪১ জন ছিলো শিখ। তারা মঙ্গলওয়ারে প্রথম বাধার সম্মুখীন হলেন। কিন্তু এ সময়ে উনাও কিংবা বশিরাতগঞ্জে তাদের যুদ্ধ করতে হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্য হলো, সাইয়ের কাছে বান্নী ব্রিজে তাদেরকে কোনো বাধাই দেয়া হয়নি। ব্রিটিশ সেনাপতিরা এরকম সৌভাগ্য আশা করেননি। তাঁরা ২৩ তারিখে লখনৌর কাছাকাছি আলমবাগে এসে পৌঁছালেন। সেখানে তারা প্রবল বাধার সম্মুখীন হলেন। বিদ্রোহীরা পরাজিত হলো এবং লখনৌর পথ পরিষ্কার হয়ে গেলো।

হ্রস্বতম পথ সব সময়ে নিরাপদ নয়। ছারবাগ ব্রিজ এবং খাল অতিক্রম করে যাওয়াই হলো তাদের পক্ষে সবচেয়ে সোজা পথ। কিন্তু পথে যুদ্ধ হলে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। সবচেয়ে নিরাপদ রাস্তা হলো দিলখুসার ওপর দিয়ে মার্চ করে গোমতী নদী অতিক্রম করা। তারপরে বামে ঘুরে শহরের অদূরস্থ লোহার সেতু দখল করে পুনরায় শহরের পাশে নদী অতিক্রম করে বাদশাহবাগ অতিক্রম করে অবরুদ্ধদের মুক্তি দান করা। কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টিপাতের দরুন ভারী কামানপাতি বহন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো এবং সেজন্য এ পথও বাদ দিতে হলো।

অনেক ক্ষতি সহ্য করার পরে প্রথম মুক্তিবাহিনী এসে পৌঁছালো। কিন্তু তাদেরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছিলো। হ্যাভলক তাঁর ইউরোপীয় সৈন্যদের প্রত্যেক দেশীয় সেপাইদের শত্রু ভাবতে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাদের প্রথম জিঘাংসার শিকার হলো সে সকল অনুগত দেশীয় সেপাই, যারা এতোকাল ধরে অবরুদ্ধদের সঙ্গে যথেষ্ট দুঃখ-কষ্ট এবং লাঞ্ছনা ভোগ করেছে। কিন্তু মিসেস বাটুসের সঙ্গে তার সৈন্যরা যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে তার কোনো তুলনাই চায় না।

ভদ্রমহিলার স্বামী ছিলেন গোণ্ডা অঞ্চলের সামরিক চিকিৎসক। স্যার হেনরী লরেন্স যখন বাইরের ঘাঁটির মহিলা এবং শিশুদেরকে লখনৌতে প্রেরণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি প্রথমে সিকরোরাতে এসেছিলেন, সেখান থেকে একদল সেপাই তাঁকে রামনগর পৌঁছে দিয়ে আসে। সেখান থেকে অন্যান্য আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে তিনি লখনৌ অভিমুখে যাত্রা করেন। ডঃ বাট্রস যিনি পেছনে ছিলেন, বলরামপুরের রাজপ্রাসাদে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করেছিলেন। তিনি বন্ধুভাবে সেপাইদের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন অশুপূর্ণ নয়নে। ডঃ বাট্রস হ্যাভলকের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। পূর্বের দিন উদ্ধারকারী সেনাদল এসে পৌঁছেছে। মিসেস বাট্রুস জানেন যে তাঁর স্বামী সেনাবাহিনীর সঙ্গে আছেন। কতিপয় অফিসার জানালেন যে, ডঃ বাট্রস জানেন যে, তাঁর স্বামী পরের দিন আসবেন। কিন্তু তিনি পরের দিন এলেন না। অবশেষে তিনি জানতে পেলেন, রেসিডেন্সির ফটকের বাইরে তার স্বামী নিহত হয়েছেন।

রেসিডেন্সীর রসদ ফুরিয়ে এলো। কমিসারিয়েট আর আটা সরবরাহ করতে পারছেন না, তার বদলে গম দেয়া হলো। সকলকেই সাধ্যমতো গম পিষতে হতো। ডাল খাওয়া এখন পরিপূর্ণরূপে বন্ধ করা হয়েছে। নুনের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে। দৈনিক ৬ আউন্সের বেশি মদ কারো জন্য বরাদ্দ করা হয় না। ৩রা অক্টোবর তারিখে কোথাও চিনি পাওয়া গেলো না। এক সের চিনির জন্য পঁচিশ টাকা দিতেও তাঁরা রাজী ছিলেন। ২৪ তারিখে রেশনের পরিমাণ আরো কমিয়ে দেয়া হলো, যাতে করে জমা রসদে ১লা ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। স্যার জেমস আউটরাম একটা লোককে এক হাজার টাকাসহ চিনি যোগাড় করতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু একদানা চিনিও যোগাড় করা সম্ভবপর হয়নি।

এই সময়ের মধ্যে মানসিং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বেশিদূর এগুতে পারেননি। তিনি নির্দিষ্টভাবে কোনো পক্ষ অবলম্বন করেননি, তবে কথা দিয়েছেন তিনি ইংরেজদের সমর্থন করবেন। তিনি দু’পক্ষের যুদ্ধের গতি দেখছিলেন। বিশেষ দিকে মোড় নেয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করছিলেন। জুলাই মাসে তিনি তাঁর অন্যান্য তালুকদার ভাইদেরকে ইংরেজ পক্ষ সমর্থন করার জন্য প্রচারপত্র পাঠালেন। কিন্তু তা তাদের সিদ্ধান্তকে বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত করতে পারেনি। লখনৌ ত্যাগ করার পূর্বে সেপাইদের আটককৃত সীতাপুরের মিস ম্যাডেলিন জ্যাকসন এবং মিসেস ওরকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলেন। স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সমবায়ে একটা সরকার গঠন করে লখনৌ থেকে সামরিক দফতর স্থানান্তরিত করার নির্দিষ্ট পরিকল্পনাসহ এসেছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো সুবিধা করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝলেন যে নারী, শিশু এবং রুগ্নদের স্থানান্তরিত করা এবং আলমগড়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা অসম্ভব। সাহায্য না আসা পর্যন্ত তাঁকে আক্রমণ করার বদলে আত্মরক্ষাই করতে হবে-এ কথা তিনি হৃদয়ঙ্গম করলেন। খাদ্য সমস্যা নিয়ে তিনি সত্য সত্যই বিব্রত হয়ে পড়লেন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে সাহায্য এসে পৌঁছলো। উদ্ধারকারী সৈন্যদল সঙ্গে করে প্রচুর রসদ নিয়ে এসেছে।

৭ই নভেম্বর তারিখে মেজর ব্রসের কাছ থেকে একখানা চিঠিসহ এলেন একজন দূত। চিঠিতে প্রকাশ স্যার কলিন ক্যাম্পবেলের অধীনে বিরাট সেনাদল যাত্রা করেছে, তারা তিনদিন সময়ের মধ্যে আলমবাগে এসে উপনীত হতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ১৮৫৭ সালের ১১ই জুলাই তারিখে স্যার কলিন ক্যাম্পবেলকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করা হয়। সে সময়ে তাঁর বয়স পঁয়ষট্টি বছর। হঠাৎ করে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যাত্রা করেননি। তার আগে তিনি শাসনতান্ত্রিক এবং সাংগঠনিক পর্যায়ের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। ২৭শে অক্টোবর তারিখে তিনি কলকাতা থেকে যাত্রা করলেন। এলাহাবাদ থেকে বেনারস যাত্রা করার সময় সেপাইদের হাতে বন্দী হওয়া থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যান। এলাহাবাদে এসে তিনি জানতে পেলেন, আউটরাম হ্রাসকৃত রসদে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। প্রধান সেনাপতি ৩রা নভেম্বরে কানপুর পৌঁছালেন। তিনি লখনৌ যাবেন নাকি কানপুরে যে গোয়ালিয়রের সেনাদল ভীতি প্রদর্শন করছে তাদের দমনে যাবেন, সে বিষয়ে প্রথমে তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো। তিনি কানপুরে বেশি সৈন্য না রেখে লখনৌ যাওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে করলেন, সময়মতো পৌঁছাতে না পারলে লখনৌর অনশনক্লিষ্টদের রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তিনি উইণ্ডহ্যামকে অল্প সংখ্যক সৈন্যসহ কানপুরে পাঠিয়ে দিলেন।

ক্যাম্পবেল ৩রা নভেম্বর তারিখে কানপুর ত্যাগ করলেন। দিল্লীর পতন হওয়ায় দু’টি সেনাদলকে ব্রিগেডিয়ার উইলসন পাঠাতে পারলেন। একটি দল বুন্দেলশর এবং আলীগড় হয়ে আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করলেন গ্রীথিডের নেতৃত্বে। আগ্রাতে গ্রীথিড ইন্দোরের যে সকল বিদ্রোহী হঠাৎ আক্রমণ করে শহর দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা করেছিলো তাদের দমন করলেন এবং সেনাবাহিনী কানপুর অভিমুখে যেতে লাগলো। অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে তারা কানপুরে এসে পৌঁছলো তখন কর্ণেল হোপ গ্রান্ট সেনাবাহিনীর অধিনায়ক পদে বৃত হয়েছেন। তিনি আলমবাগ অভিমুখে ধাওয়া করলেন এবং বানতেরাতে বিদ্রোহী সেপাইদের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হলেন। তিনি শিশু নারী এবং রোগীদের আলমবাগ থেকে কানপুরে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন এবং নিজে বানতেরাতে অবস্থান করতে লাগলেন। প্রধান সেনাপতির নির্দেশমতো ৩ মাইল ঝটিকা সফর শেষে প্রধান সেনাপতিও তাঁর সঙ্গে এসে যোগ দিলেন।

ক্যাম্পবেল চিন্তা করলেন, একজন ইউরোপীয় পথ প্রদর্শক পেলে তার অনেক সুবিধা হবে। টমাস হেনরী ক্যাভানগ যিনি অবরুদ্ধ ছিলেন, স্বেচ্ছায় একজন ভারতীয় গুপ্তচরসহ প্রধান সেনাপতির শিবিরে এসে হাজির। তিনি লোকটাকে আউটরামের সমস্ত চিঠিপত্র এবং পরিকল্পনা বয়ে নেয়ার কথা বললেন। কিন্তু লোকটি কোনো ইউরোপীয়কে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে সঙ্কোচবোধ করছিলো। তার ধারণা তিনি একাই শহরে এবং সামরিক ঘাঁটিসমূহে সকল রকমের আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু ক্যাভানগকে সঙ্গে নিলে তার নীল চোখ দেখেই সবকিছু প্রকাশ হয়ে পড়বে। সে যাহোক ছদ্মবেশে ভারতীয় গুপ্তচরের সঙ্গে ক্যাভানগ বেরিয়ে পড়লেন।

স্যার কলিন রেসিডেন্সীর দিকে অগ্রসর হবার সময় বিপদসঙ্কুল লখনৌর রাজপথ বর্জন করতে চেয়েছিলেন। যদিও তাঁর সঙ্গে আউটরাম এবং হ্যাভলকের সেনাদলের চাইতে অধিক শক্তিশালী একদল সৈনিক রয়েছে, তবু তিনি কোনো রকমের সামরিক ঝুঁকি গ্রহণ করতে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। তার গতিবিধি ছিলো ধীর এবং সতর্ক। তিনি ১৩ই নভেম্বর আলমবাগ থেকে যাত্রা করলেন এবং দিলখুশা দখল করলেন। তাঁর আসল লক্ষ্য ছিলো মতিমহল আক্রমণ করা। পূর্বকৃত পরিকল্পনা অনুসারে আউটরামের তার সঙ্গে যোগ দেয়ার কথা। শত্রুদের মধ্যে ভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য তিনি বেগম কুঠিতে গোলা বর্ষণ করার নির্দেশ দান করলেন। ১৬ তারিখে যেখানে গোমতীর সঙ্গে খালটি যুক্ত হয়েছে, সে স্থান অতিক্রম করে সিকান্দরবাগ আক্রমণ করে বসলেন। এদিক দিয়ে যে কোনো আক্রমণ হতে পারে, বিদ্রোহী নেতারা তা কখনো আশা করতেও পারেননি। যে সকল সেপাই সিকান্দরবাগ পাহারা দিচ্ছিলো, তাদের সঙ্গে কোনো কামান ছিলো না। দুর্গ প্রাচীর ছিলো শক্ত এবং সেপাইরা প্রাণপণে শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করে গেলো। কামানের সামনে বন্দুক টিকতে পারলো না। ফাঁদে আটকা পড়ে একজন সেপাইও প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলো না। বাগানে। দু’হাজার সেপাইয়ের লাশ পড়ে রইলো।

তারপরে কদম রসুল এবং শাহ্ নজফ আক্রমণ করা হলো। শাহ্ নজফ হলো অযোধ্যার ভূতপূর্ব শাসকের সমাধি। পুরো দেয়াল সহজে ভাঙ্গতে পারলো না। হঠাৎ ৩৩নং বাহিনীর কিছু সৈনিক আবিষ্কার করলো যে একটি প্রবেশ পথে ঘোট ফুটো দেখা যাচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে মোতিমহলের দিকে গিয়েছে যে অট্টালিকা তা উড়িয়ে দিলেন। ১৭ তারিখে অবরুদ্ধ নরনারী মুক্তিবাহিনীর দেখা পেলেন। চারদিনের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ৪৯৬ জন অফিসার হতাহত হয়েছেন। প্রধান সেনাপতি স্বয়ং আহত হয়েছেন। অবশেষে লখনৌকে মুক্ত করা হলো, অবরুদ্ধ নর-নারীরা মুক্তিলাভ করলো। বহুদিন অভুক্ত থেকে তারা পেট পুরে খেতে পেলো। অনেকদিন পর পত্রিকা পড়তে পারলো। কিন্তু আনন্দ কোথায়? কতো স্ত্রী বিধবা হয়েছে। কতো স্বামী পরিবার-পরিজন হারিয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্ত নরনারীর মনে প্রিয়জনের বিয়োগব্যথা উথলে। উঠলো। বিজয়ের মুহূর্ত তাদের জন্য দুঃখের মুহূর্তে রূপান্তরিত হলো। তখন হ্যাভলক মৃত্যুশয্যায় শায়িত। ২৪শে নভেম্বর তিনি মারা গেলেন। নগরের অদূরের আলমবাগে তাঁকে সমাহিত করা হলো। ক্যাম্পবেল রেসিডেন্সীতে বেশিদিন থাকা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলেন না। তিনি তাড়াতাড়ি নারী, শিশু এবং রোগীদেরকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেবার কাজে হাত দিলেন। তাঁর গতিবিধি সম্বন্ধে শত্রুদের অজ্ঞ রাখার জন্য তিনি কায়সারবাগে একটি কামান স্থাপন করলেন। বাতি জ্বালিয়ে যখন রেসিডেন্সীর অধিবাসীরা চলে গেলো সেপাইদের কোনো সন্দেহ রইলো না যে তারা চলে গেছে। ইউরোপীয়রা চলে যাওয়ার অনেক পরে তারা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আউটরাম নিজেই সবশেষে দুর্গ ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইঙ্গলিস জেদ করতে লাগলেন যে তিনি নিজেই তাঁর দুর্গের দ্বার বন্ধ করবেন। কিন্তু ক্যাপটেন ওয়াটারম্যানই সবশেষে দুর্গত্যাগ করেছেন। সেনাবাহিনী চলে যাবার সময় তিনি নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ জেগে উঠে তিনি অপরিসীম নিস্তব্ধতার ভারে ডুবে গেলেন। তারপরে তাড়াতাড়ি দৌড়ে একটা ঘাঁটিতে গেলেন। সেখানে কোন জনপ্রাণী নেই। সকলে চলে গেছে, পরক্ষণে তিনি দৌড়াতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পর সেনাবাহিনীর শামিল হলেন।

অনেকদিন থেকে গোয়ালিয়রের বিদ্রোহীরা অকেজো হয়ে পড়েছে। জুনের প্রথম দিকে তারা সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছিলো। এতোকাল কেননা তারা কিছু করেনি তা এখন আর রহস্য নয়। ইন্দোরের বিদ্রোহীরা মাদ্রাজের বিরুদ্ধে মার্চ করলে তাদের গোয়ালিয়রের বন্ধুরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়নি। হ্যাভলকের অধীনে যখন মাত্র অল্প সংখ্যক সৈন্য তখনও তারা কানপুর আক্রমণ করেনি। তারা যদি তখন তাঁকে আক্রমণ করার জন্য মনস্থির করে উঠতে পারতো, তাহলে ব্রিটিশ সৈন্য কানপুর ত্যাগ করতে বাধ্য হতো এবং সেপাইদের সংগ্রাম জনসাধারণের শ্রদ্ধার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হতো। তারা এমন অলস রয়ে গেলো যে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি তাদের হাত থেকে খসে পড়লো এবং হ্যাভলক ও আউটরাম লখনৌতে যাত্রা করলেন। যদি কোনো দূরদর্শী নেতা থাকতো তাহলে এ সঙ্কটকালে ব্রিটিশ সৈন্যকে আক্রমণ করে ছারখার করে ফেলতে পারতো। গোয়ালিয়রের সেপাইদের মধ্যে দেখবার চোখ এবং পরিকল্পনা করার মগজ বিশিষ্ট একজন লোকও ছিলো না। তারা সিন্ধিয়ার রূপার প্রলোভনের উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। মহারাজের ইংরেজ বন্ধুরা তাঁকে এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে পুরোনো ঘাঁটিসমূহে বিভিন্ন উপায়ে বিদ্রোহীদের নিষ্ক্রিয় করে রাখার জন্য প্রচুর অর্থ দান করেছেন। ব্রিটিশের জন্য এটা কম সুযোগের বিষয় নয়। এতগুলো সৈন্যের সহযোগিতা থেকে সেপাইরা বঞ্চিত হলো। তারা আগ্রার দুর্গ অবরোধ করতে পারতো, তারা দিল্লীর সেপাইদের সঙ্গে যোগ দিতে পারতো, এমন কি দেশের অভ্যন্তরে তারা গ্যারিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারতো, কিন্তু তারা কিছুই করলো না। অক্টোবর মাসে তারা শৈথিল্য ঝেড়ে ফেলে কল্পি অধিমুখে যাত্রা করলো। তাতিয়া তাদের দোদুল্যমানতার সুযোগ গ্রহণ করে অধিনায়ক পদে বরিত হলেন। একই সময়ে কুমার সিং বান্দা থেকে কম্লিতে আসছিলেন। এমনও হয়ে থাকবে তাতিয়া টোপীর এজেন্টরা গোয়ালিয়রের মানুষদের শেষ পর্যন্ত রাজী করাতে পেরেছিলো। কিন্তু তখনও তাদের গতিবিধি ধীর এবং সন্দেহজনক। তারা ছিলো সংখ্যায় ৫ হাজার শক্তিশালী সেপাই এবং গোলন্দাজ বিভাগে তাদের খুব ভালো ট্রেনিং ছিলো।

সিপাহী বিদ্রোহ যে সকল পারঙ্গম নেতার সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে রামচন্দ্র পান্ডুরঙ্গ ওরফে তাঁতিয়া টোপী তাদের অন্যতম। তার বাবা বাজীরাওয়ের একজন সামান্য প্রজা ছিলেন। তাঁতিয়া টোপী ছিলেন নানার ব্যক্তিগত অনুগৃহীতদের মধ্যে একজন। আনুগত্য এবং কৃতজ্ঞতার বন্ধনে তিনি সব সময় নানা সাহেবের সঙ্গে আবদ্ধ ছিলেন। তাঁর কোনো সামরিক অভিজ্ঞতা ছিলো না। কিন্তু বেড়া দেয়ার জ্ঞান এবং অব্যর্থ লক্ষ্য তাঁকে অপ্রত্যাশিত ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়েছিলো। তাঁর কওমের গ্যারিলা যুদ্ধ সম্বন্ধে তার স্পষ্ট ধারণা ছিলো। ব্রিটিশ সৈন্য যখন মনে করেছে তাকে ঘেরাও করেছে, তখনও তিনি তাদের হতবুদ্ধি করে ছেড়েছিলেন। ১৩ তারিখের পূর্বে যদি তিনি কানপুরে উপস্থিত হতেন, তাহলে কানপুরের ব্রিটিশ সৈন্যাধ্যক্ষ উইন্ডহামকে পরাজিত করার সমস্ত সুযোগ লাভ করতেন। কিন্তু ১৭ তারিখে যে দিন স্যার ক্যাম্পবেল রেসিডেন্সীতে প্রবেশ করলেন তখনও তাঁতিয়া টোপীর অগ্রবর্তী শিবির গন্তব্যস্থল থেকে পনেরো মাইল দূরে রয়েছে।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধে উইন্ডহ্যাম অপূর্ব কৃতিত্ব প্রদর্শন করছিলেন। সাহসে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর অধিনায়ক অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে তাঁকে ছাউনির ভিতরে যুদ্ধ করতে বারণ করছেন। ১৭ তারিখে উইন্ডহ্যাম শহরের বাইরে চলে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহের একটি সাহসী এবং বলিষ্ঠ আন্দোলনের মাধ্যমেই তিনি শহর এবং শহরতলীকে হত্যা এবং লুঠতরাজ থেকে রক্ষা করতে পারবেন। ইতিমধ্যে লখনৌর সঙ্গে তাঁর সকল রকম যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো। ২৪ তারিখে তিনি কল্পির রাজপথ এবং খালের সংযোগস্থলে ছাউনি ফেললেন এবং শত্রুদেরকে প্রথমবারের মতো আঘাত করতে তিনি প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। ২৬ তারিখে তিনি তাঁতিয়া টোপীর এক ডিভিশন সৈন্যকে পশ্চাদ্ধাবনে বাধ্য করলেন । তারা পেছনে দুটো কামান ফেলে যেতে বাধ্য হলো। পরের দিন তাঁর শিবির ঘেরাও করা হলো। তার পরের দিন তার অবস্থা আরো সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠলো, তিনি শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন এবং ছাউনিতে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।

২৮ তারিখে কামানের গর্জনে সচকিত হয়ে স্যার কলিন তাড়াতাড়ি কানপুরে ধাওয়া করলেন। তাড়াতাড়ি সাহায্য চেয়ে তাঁর কাছে একখানা পত্র প্রেরণ করা হলো। পর পর আরো দু’বার সংবাদ পাঠানো হলো যে উইন্ডহ্যাম ছাউনিতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রধান সেনাপতি তার সেনাবাহিনী এবং কনভয়কে পেছনে পেছেনে ঠেলে দিয়ে অল্প সংখ্যক সৈন্যসহ যাত্রা করলেন। তার সৌভাগ্য সেতুর নৌকাগুলো তখনো অক্ষত আছে। যখন তিনি কানপুরে গিয়ে পৌঁছেছেন, তখন ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর বড়ো দুরবস্থা।

ক্যাম্পবেল গিয়েই আক্রমণ করতে পারলেন না। তাঁর সামরিক কনভয় নিরাপদে এলাহাবাদ রাজপথে না আসা পর্যন্ত কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করতে পারলেন না। নারী শিশু এবং রোগীদের সরানোই তার প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু তাঁতিয়া টোপী তাঁকে বিব্রত না করে ছাড়লেন না। ৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে ব্রিটিশ শিবির লক্ষ্য করে প্রবল গোলাবৃষ্টি করা হলো। তিনি সেতুর নৌকাগুলো জ্বালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। সেতুটা এখন সুরক্ষিত। ডিসেম্বর মাসের ৬ তরিখে স্যার ক্যাম্পবেল তাঁতিয়া টোপীর সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করলেন। তাঁতিয়া টোপীর সেনাবাহিনীর কেন্দ্রস্থলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী ছিলো, সে কারণে ডান দিকে আক্রমণ করে নানার সৈন্যদের থেকে গোয়ালিয়রের সেপাইদের আলাদা করে ফেলতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। নানার সেনাবাহিনী শত্রুদের চাইতে অনেক বড় ছিলো, কিন্তু তারা বিভিন্ন দিকে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। কেউ রান্না করছিলো, কেউ পান খাচ্ছিলো, কেউ কেউ চা-পাতি তৈরি করেছিলো। এমন সময় আকস্মিক আগমনে আতঙ্কিত হয়ে যে যেদিকে পারলো পলায়ন করলো। কিন্তু ম্যাক্রফিল্ড তাঁর সেনাবাহিনীকে পুরোনো ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়াটা পছন্দ করলেন না। বিঠোরের রাজপথ বেয়ে আবার বিদ্রোহীরা ফিরে এলো। তাতিয়ার অবস্থানের মধ্যভাগ এখনো শহর রক্ষা করে চলছে, কিন্তু তাঁর ডানভাগ সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ৮ তারিখে হোপ গ্র্যান্ট বিঠোর যাত্রা করলেন, কিন্তু জানতে পারলেন, সেপাইরা সেরাই ঘাটে চলে গেছে। সেখানে গিয়ে সেপাইদের ওপর আক্রমণ চালালে তারা পুনরায় পলায়ন করতে বাধ্য হয়। এভাবে তাতিয়া টোপীর কানপুর আক্রমণ এবং মূল আক্রমণস্থল থেকে স্যার ক্যাম্পবেলের যোগাযোগ বিছিন্ন করে দেয়ার পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়া হলো। যদিও তাঁর সৈন্য বাহিনী ভেঙ্গে গেছে, কামানগুলো হারিয়ে ফেলেছেন, তথাপি তিনি বৃটিশ সেনাবাহিনীর আতঙ্কের কারণ হয়ে রইলেন।

তারপরে বিঠোরের দিকে বিজেতাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হলো। ব্রিগেডিয়ার হোপ গ্র্যান্টকে সেখানে পাঠানো হলো। বলা হয়ে থাকে যুদ্ধের আগের দিন নানা প্রাসাদে নিদ্রা গিয়েছিলেন। তাঁর প্রাসাদ নয় শুধু, দেবদেবীর মন্দির কিছুই ব্রিটিশ প্রতিহিংসার হাত থেকে রেহাই পায়নি। নানা সাহেব বিঠোর থেকে অযোধ্যা চলে যাবার সময় তাঁর রত্ন আভরণ নিয়ে যেতে পারেননি। ব্রিটিশ সৈন্য তার প্রাসাদ লুঠপাট করলো। ধন-সম্পদ যা নিয়ে যেতে পারেননি, কুয়োর পানিতে ফেলে দিয়েছিলেন। পাম্পের সাহায্যে জল অপসারণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বালতি দিয়ে জল সরিয়ে ধন-সম্পদ উদ্ধার করে ব্রিটিশ সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে যায়।

দিল্লী দখল করার কাজ শেষ, কানপুর মুক্ত এবং লখনৌকে মুক্ত করা হয়েছে, এখন শুধু বাকী ফতেহগড়ের পুনরুদ্ধার সাধন। ফারাক্কাবাদ থেকে কয়েক মাইল দূরে ফতেহগড় এককালের পাঠান নওয়াবদের রাজধানী, কানপুর থেকে আগ্রা পর্যন্ত যে রাস্তা তার মধ্যস্থলে অবস্থিত বলে ফতেহগড়ে সামরিক গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। কর্ণেল স্মিথ এখানে একটি বন্দুক নির্মাণ কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন সেপাইদের বিদ্রোহ করার প্রাক্কালে। বিদ্রোহের সময়ে কর্ণেল স্মিথই ছিলেন দুর্গের অধিনায়ক। তার আগে কর্ণেল ভাবলেন, নারী, পুরুষ এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের কানপুরে পাঠিয়ে দেয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে কতিপয় দেশীয় অফিসার তাকে জানালেন যে তাঁরা আর তাঁর আদেশ মেনে চলবেন না। ইউরোপীয়রা দুর্গের অভ্যন্তরে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে দুর্গ রক্ষা করতে অপারগ হওয়ায় তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা তিনখানি নৌকাযোগে পালিয়ে আত্মরক্ষা করলেন। এ সকল নৌকায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হলো, আশ্রয়প্রার্থীদের অনেকেই বিঠোরে গিয়ে ধরা পড়লেন। ১৮ই জুন তারিখে সেপাইরা ফারাক্কাবাধের নামমাত্র নওয়াবের অধীনে দুর্গের শাসনভার গ্রহণ করলেন।

স্যার কলিন ক্যাম্পবেল ফতেহগড়ের বিদ্রোহীদের সকল দিক থেকে বেষ্টন করতে ইচ্ছা পোষণ করছিলেন। স্যার ক্যাম্পবেলের সুসংহত আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে বিদ্রোহীরা দোয়াব অঞ্চল ছেড়ে যেতে বাধ্য হলো। তারা অযোধ্যা এবং রোহিলাখণ্ডের দিকে ধাবিত হলো। অতি অল্পদিনের মধ্যে ফতেহগড় দুর্গ বিজিত হলো।

বহুদিন পর গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড বিদ্রোহীদের হাত থেকে মুক্ত হলো। বাঙলা থেকে পাঞ্জাব, কলকাতা থেকে লাহোর পর্যন্ত যোগাযোগ আবার প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু অযোধ্যা এবং রোহিলাখণ্ড এখনো বিদ্রোহীদের হাতে। ফতেহগড়ের পতনের ফলে রোহিলাখণ্ডের পথ পরিষ্কার হয়েছে। স্যার কলিন ক্যাম্পবেল বিদ্রোহীদের পশ্চাদ্ধাবন করাই যুক্তিযুক্ত মনে করলেন। তিনি অযোধ্যায় ১৮৫৮ সালের শরঙ্কাল পর্যন্ত কোনো হস্তক্ষেপ না করে শাহরানপুর এবং বেরিলীতে তার সৈন্য সমাবেশ করলেন, কারণ তিনি খবর পেয়েছেন, ঐ দু’অঞ্চলে বিদ্রোহীরা জমায়েত হয়েছে। অন্যান্য স্থানের বিদ্রোহীদেরকে দমন করা সম্ভব হলে অযোধ্যার সেপাইদেরকে পরাজিত করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে বলে মনে করলেন। কিন্তু গভর্ণর জেনারেল একাই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। তার যুক্তি হলো ভারতে সকলের দৃষ্টি অযোধ্যর দিকে নিবদ্ধ। সুতরাং অয্যোধ্যার সেপাইরা পরাজিত হলে সমগ্র ভারতের সেপাইদের মনোবল ভেঙ্গে যাবে। রাজনৈতিক কারণে রোহিলাখণ্ডের বদলে অযোধ্যা আক্রমণই প্রাধান্য দেয়া হলো।

উত্তর দিক থেকে অযোধ্যা আক্রমণ করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। নেপালের রাজা জং বাহাদুর প্রয়োজনের সময় ইংরেজদেরকে সাহায্য করে বন্ধুত্বের ভিত্তি পাকা করে গড়ে নিতে তৎপর হয়ে উঠলেন। বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর সকল স্থানে ব্রিটিশের মর্যাদা হ্রাস পেতে থাকে। এ দুঃসময়ে জং বাহাদুর ব্রিটিশ সরকারকে তাঁর সাহায্য দানের প্রস্তাব করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রস্তাব গৃহিত হলো, কারণ লর্ড ক্যানিং তার বন্ধুত্বপূর্ণ আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বলে মনে করলেন। জুলাই মাসে ৩ হাজার লোকের একটি গুখা সেনাবাহিনী গোরক্ষপুর জেলায় প্রবেশ করলো। নাজিম অথবা গভর্ণরের অধীনে এখানে একটা বিদ্রোহী সরকার গঠিত হয়েছিলো। আগেকার ব্যবস্থা অনুসারে মুহম্মদ ছিলেন নাজিম, কিন্তু রাজ্য কেড়ে নেয়ার পর তিনি সে পদ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কর্ণেল লেনোস্ক এবং অন্যান্য আশ্রয় প্রার্থীদেরকে তিনি নিজে ঝুঁকি গ্রহণ করেই আশ্রয় দান করেছেন। যতদূর সম্ভব তিনি যে ব্রিটিশ মিত্র এটা প্রমাণ করার জন্য তিনি এক ফোঁটা রক্তপাত করেননি। প্রথমে গুখা সৈন্যদের তার বিরুদ্ধেই নিয়োগ করা হলো। তারপরে গোরক্ষপুর থেকে জানুপুর এবং আজমগড়ে শুখা সৈন্য চলে গেলো। অল্প সংখ্যক সৈন্য পাঠিয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে নেপালরাজ নিজে এসে অংশগ্রহণ করার প্রস্তাব করলেন। ২১শে ডিসেম্বর তারিখে রাজা জং বাহাদুর দশ হাজার গুখা সৈন্যসহ এসে হাজির হলেন সীমান্ত প্রদেশে। সেখানে তিনি গভর্ণর জেনারেলের নেপালী সৈন্যদের এজেন্ট ম্যাক গ্রেগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন।

পরবর্তী অভিযানের লক্ষ্য অযোধ্যা যখন স্থির হলো প্রধান সেনাপতি ফতেহগড় থেকে কানপুরে চলে এলেন। শীতকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান শুরু হলো না। পূর্বদিক থেকে জেনারেল ফ্রাঙ্কের অযোধ্যায় প্রবেশ করার কথা এবং রাজনৈতিক কারণে স্যার কলিন ক্যাম্পবেলের জং বাহাদুরের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তিনি ১৮ই ফেব্রুয়ারিতে আক্রমণ করার কথা স্থির করেছিলেন, কিন্তু ২৭ তারিখের পূর্বে জং বাহাদুর এবং জেনারেল ফ্রাঙ্ক আসতে পারছেন না। লর্ড ক্যানিং জং বাহাদুরের জন্য অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচনা করলেন।

জেনারেল ফ্র্যাঙ্ক পথ দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন পালোয়ান সিং নামে এক শুখা অফিসার। তাঁরা বান্দা হাসান এবং মেহেদী হাসানের অধীন একদল অযোধ্যার সেপাইদের মোকাবেলা করলেন চান্দায়। সেদিন ছিলো ফেব্রুয়ারি মাসের ১৯ তারিখ। তারপরে মেহেদী হাসান বায়ুনের কাছে তাদের আবার বাধা দিতে চেষ্টা করে পরাজিত হলেন। পরবর্তী পর্যায়ে জেনারেল ফ্রান্স সুলতানপুরে যাত্রা করলেন। লখনৌর জেনারেল গফুর বেগের অধীন একদল শক্তিশালী সৈন্য তার মোকাবেলা করার জন্য অপেক্ষা করছিলো। ঘোরতরো যুদ্ধের পর জয়লাভ করে সেনাদলের বিশ্রামের জন্য কয়েকদিন সেখানে অপেক্ষা করলেন। পরের দিন জলন্ধর থেকে আগত ৩নং শিখ বাহিনী তাঁর সঙ্গে যোগ দিলো। মার্চ মাসের ৪ তারিখে জেনারেল ফ্রাঙ্ক লখনৌ থেকে আট মাইল দূরে এসে উপনীত হলেন। ১১ই মার্চের আগে জং বাহাদুর লখনৌতে আসতে পারেননি।

এ সময়ে আউটরাম আলমবাগে প্রচণ্ড বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন, তাঁর সৈন্য সংখ্যা নিতান্তই অল্প। লখনৌর অতি নিকটে অবস্থিত ছিলো বলে সবসময়ে আলমবাগ বিদ্রোহীদের চোখের ওপর ছিলো। কানপুরের সঙ্গে অতিকষ্টে যোগাযোগ রক্ষা করা যায় তাতেও বহুদিন সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। শীগগির যদি অযোধ্যা আক্রমণ না করা হয়, তাহলে কানপুরের নিকটবর্তী কোনো ঘাঁটিতে গিয়ে উঠতে তিনি বাধ্য হবেন। আলমবাগের কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিলো না। কিন্তু যদি অযোধ্যা আক্রমণ করা হয়, তা হলে তিনি সর্বশক্তি ব্যয় করে আলমবাগ দুর্গ রক্ষা করবেন। ৬ বার আক্রমণ করে স্থানটিকে তিনি বিদ্রোহীদের হাত থেকে মুক্ত করে নিলেন। রাণী নিজে কয়েকবার এসে তার সেনাবাহিনীকে উৎসাহিত করেছেন। সেপাইরা প্রথম দিকে ভালোভাবে যুদ্ধ করলেও কোনো উপযুক্ত নেতার অভাবে শেষ পর্যন্ত তাদের উৎসাহ অটুট রইলো না। স্যার কলিন ক্যাম্পবেল অযোধ্যা আক্রমণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত আউটরাম বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনমাস ধরে বিদ্রোহীদের হাত থেকে দুর্গ রক্ষা করেছেন। প্রধান সেনাপতি ব্রিগেডিয়ার হোপ গ্র্যান্টকে ফতেহপুর চৌরাশিতে পাঠালেন। কারণ গুজব রটেছে যে নানা সেখানে আত্মগোপন করে আছেন। হোপ গ্র্যান্ট ১৭ই ফেব্রুয়ারি সেখানে পৌঁছে বিদ্রোহী সর্দার ঝামা সিংয়ের ভাঙ্গা কেল্লা জ্বালিয়ে দিলেন, কিন্তু নানা সেখানে ছিলেন না। হোপ গ্র্যান্টকে নির্দেশ দেয়া হলো, তিনি যেনো ১লা মার্চ তারিখে বানতেরাতে তাঁর প্রধান সেনাপতির সঙ্গে মিলিত হন। তার আগের দিন স্যার কলিন ক্যাম্পবেল কানপুর ত্যাগ করেছেন, অশ্বারোহণে চল্লিশ মাইল পথ অতিক্রম করে আলমবাগ এবং আলমবাগ থেকে নতুন সদর দফতর বানতেরাতে এসে পৌঁছালেন। ২রা মার্চ তারিখে লখনৌ আক্রমণ শুরু হলো।

এ সময়ের মধ্যে লখনৌর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। শহরের প্রত্যেক লাইনে মৃত্তিকা প্রাচীর তোলা হয়েছে, কিন্তু গোমতীর উত্তর তীরের প্রতি তারা কোনো দৃষ্টি দেয়নি। স্যার কলিন ক্যাম্পবেলের সঙ্গে ছিলো নব্বই হাজার সৈন্য। জং বাহাদুর এবং জেনারেল ফ্র্যাঙ্কের যোগ দেয়ার ফলে সৈন্যসংখ্যা বেড়ে গেলো আরো তিরিশ হাজার। আউটরাম নদীর উত্তর পাড়ের দিকে ধাওয়া করলেন। সে দিকে শত্রুসৈন্যের সঙ্গে মোকাবেলা করার দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পণ করা হয়েছিলো। তাঁর কর্মসূচি শেষ করে লৌহের সেতুর পাশে এসে গেলেন, কিন্তু তাঁকে সেতু অতিক্রম করতে দেয়া হলো না। গোমতীর দক্ষিণ পাড়ে প্রধান বাহিনী দিলখুশা দখল করে নিলেন। একের পর এক সুরক্ষিত অট্টালিকাসমূহের পতন ঘটতে থাকে। বিদ্রোহীরা তাদের অবস্থা খারাপ দেখে নগর থেকে পলায়ন করতে লাগলো। দুর্জয় সাহসের সঙ্গে তারা সগ্রাম করেছে, বেগম কুঠি যখন আক্রমণ করা হয়েছিলো তখন ৮৬০জন প্রতিরক্ষী মৃত্যুবরণ করেছিলো। চরমতম বিপদের সময়ও তারা পলায়ন করেনি। রাজমাতা নিজেও সাহস হারাননি, সব সময় সেপাইদের মধ্যে সাহস এবং উদ্দীপনার সঞ্চার করেছেন। কিন্তু কিছুতে কিছু হলো না। ১৮ তারিখে শহরের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য ব্রিটিশের হাতে চলে গেলো। বেগম কর্তৃক অনুপ্রাণিত একদল দুঃসাহসী বিদ্রোহী সেপাই ১৯শে মার্চ পর্যন্ত মুসাবাগ রক্ষা করেছিলেন। মৌলবি সাহেব সকলের চেয়ে অধিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন, ২২ তারিখের পূর্বে তাঁকে পরাজয় করা সম্ভব হয়নি। এভাবে লখনৌ বিজিত হলো, কিন্তু লখনৌ এখনো অজেয় রয়ে গেছে। বন্দী মহিলারা তখনো আশা করতেন, সেপাইরা জয়লাভ করবে।

অধিকার করার পরে অন্যান্য শহরের ভাগ্যে যা ঘটেছে লখনৌও তা এড়াতে পারেনি। বেগম কুঠি যেভাবে লুটপাট করা হয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সেপাইরা মালখানা ভেঙ্গে জিনিসপত্র এনে প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে দিলো। জড়োয় জড়ানো পোশাক, অলংকার, রৌপ্য নির্মিত বাদ্যযন্ত্র, বই, ছবি, অস্ত্রশস্ত্র আরো নানাবিধ জিনিসপত্র উচ্ছল সৈন্যেরা একাকার করে ফেললো। আগুন জ্বালিয়ে সোনা-রূপার জড়োয়া জড়ানো শাল, কাপড়-চোপড় ইত্যদি নিক্ষেপ করে রই আভরণ আলাদা করে রাখলো। রাসেল বলেছেন, লখনৌর প্রাসাদে ইংরেজ সৈন্য যেভাবে লুঠপাট করেছে, পৃথিবীতে কোথাও তেমন ঘটেছে কিনা তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না। এমনকি তাদের হাত থেকে গরু বাছুর, কবুতর পর্যন্ত রেহাই পায়নি।

বিদ্রোহীদের নেতা মৌলবি এবং বেগম নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফিরোজশাহ্ আবার যুদ্ধ করতে ছুটে গেলেন। কুমার সিং পুনরায় আজমগড়ে নিয়ে তার দুর্দমনীয় সাহস এবং অক্লান্ত শ্রমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। কিন্তু নওয়াব পরিবারের সকলে তেমন সৌভাগ্যবান বা সৌভাগ্যবতী ছিলেন না, একরাতের মধ্যে ধনী বেগমেরা ভিখারিণীতে পরিণত হলেন। লখনৌর রাজপুরী সমস্ত রহস্য হারিয়ে ইটের স্তূপে পরিণত হলো।

মার্চ মাসের ২১ তারিখে রেভারেন্ড ম্যাককি একটি সরগরম সুললিত বক্তৃতা প্রচার করলেন। অন্যান মহান সাম্রাজ্যের মতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধ্বংস হবে না, কারণ ইংল্যান্ড হলো একটি খ্রীস্টান দেশ। সে নিশ্চয়তায় সামরিক এবং বেসামরিক অফিসারদের মাথাব্যথা কমলো না। লখনৌ অধিকারের পূর্বেই স্যার জেমস আউটরাম গভর্ণর জেনারেলের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছেন। কিন্তু নগরী ব্রিটিশের হাতে না আসা পর্যন্ত সে নির্দেশ প্রচার করা হয়নি। সে আদেশ বলে অযোধ্যার ভূস্বামীদের সমস্ত কিছু ভেঙ্গে যাবে বলে তিনি এতোদিন প্রকাশ করতে সাহসী হননি। ছ’টি পরিবার ছাড়া অযোধ্যার সকল জমিদার এবং তালুকদারদের পূর্বপুরুষের জমিদারী এবং তালুকদারী কেড়ে নেয়া হয়েছে। গভর্ণর জেনারেল

অযোধ্যার জনসাধারণকে জানিয়ে দিলেন যে তাদের জীবন-মরণ সবকিছু এখন ব্রিটিশ সরকারের উপরই নির্ভর করছে। তিনি আরো জানিয়ে দিলেন, ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তারা মস্ত অপরাধ করেছে। ঘোষণায় আরো বলা হয়েছে, এ ঘোষণার অব্যবহিত পরে যে সকল সর্দার, তালুকদার, ভূস্বামী চীফ কমিশনারের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন, তারা যদি ইংরেজ রক্তপাত না করে থাকেন, তাহলে তাদের ধন-প্রাণ অটুট থাকবে। লখনৌর পতন ঘটলেও অযোধ্যা অজেয় রয়ে গেলো। জেনারেল আউটরাম ভয় দেখিয়ে তালুকদারী বাজেয়াপ্ত করে জনসাধারণের আনুগত্য আদায় করতে প্রাণপণে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জনসাধারণ কিছুতেই আস্থা স্থাপন করতে পারলো না। ব্রিটিশ বিচারবোধ সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণাই নেই। জমিদারী এবং তালুকদারী রক্ষা করার জন্য পূর্বপুরুষেরা যেমন নওয়াবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তেমনি তারাও ইংরেজের বিরুদ্ধে জমির জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলেন। একবার বিদ্বেষের শিখা জেগে উঠতেই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *