৬. বিহার: ওহাবী-সিপাহী যুগল সম্মিলন

বিহার: ওহাবী-সিপাহী যুগল সম্মিলন

লখনৌর দুঃখের কথা এসে পৌঁছোতেই পাটনার নিকটবর্তী স্থানে গোলমাল শুরু হলো। ১৮৫৭ সালে টেইলার নামে এক ভদ্রলোক পাটনা শাসন করতেন। তিনি কোনো কর্তব্যে ফাঁকি দিতেন না এবং কোন রকমের বাজে জিনিস সহ্য করতে পারতেন না। তিনি হচ্ছেন সে সব লোকদের একজন, যিনি জনমতকে উপেক্ষা করে নিজের খেয়াল-খুশীর উপরই অধিক গুরুত্ব প্রদান করেন। তিনি শাহবাদের বিচারক। ইউরোপীয় নীলচাষীরা তাঁর মতো একজন লৌহমানবের শাসনামলে অত্যন্ত নিশ্চিন্ত ছিলেন। অশান্তি এবং বিশৃঙ্খলা শুরু হলে তাদের ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস না হলেও কম লাভ হবে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। টেইলার ছিলেন বিহারের উপযুক্ত শাসক। তিনি সব সময় সন্দেহ করতেন, পাটনার লোকেরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। কারণ পাটনা ছিলো ওহাবী আন্দোলনের শক্তিশালী কেন্দ্র। তার দৃষ্টিতে প্রত্যেক ওহাবীই ছিলেন একজন বিদ্রোহী। তাঁর অনুগত পাঁচ ছয় জন মানুষ যারা ব্রিটিশকে অপরিমেয় সাহায্য প্রয়োজনের সময় দান করেছে, তাদেরকে তিনি সম্প্রদায়ের ব্যতিক্রম মনে করতেন।

কলকাতা হতে বেনারস যাওয়ার যে রাজপথ এবং জলপথ, পাটনা অবস্থিত তার মধ্যস্থলে। তাকে সীমান্ত প্রদেশের চাবিকাঠি বললেও অত্যুক্তি হয় না। পার্শ্ববর্তী ক্যান্টনমেন্ট দানাপুরে তিনটি সেপাই রেজিমেন্ট (৭, ৮ এবং ৪০নং রেজিমেন্ট) এবং কোম্পানীর ভারতীয় গোলন্দাজ সৈন্য অপেক্ষা করছিলো। তাদের সঙ্গে ছিলো মহারাণীর ১০নং পদাতিক বাহিনী এবং এক কোম্পানীর ভারতীয় গোলন্দাজ সেনা। মীরাটের বিদ্রোহের পরে ভারতীয় সেপাইরা সামরিক বেসামরিক সেপাইদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে সময় মেজর জেনারেল লয়েড ছিলেন দানাপুর ডিভিশনের অধিনায়ক। ৫৩ বছর ধরে তিনি সামরিক বিভাগে চাকুরি করেছেন। সাঁওতাল বিদ্রোহ দমন করে তিনি লর্ড ডালহৌসীর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পেরেছেন। দানাপুরের অধিকাংশ সেপাইয়ের বাড়ি হলো পার্শ্ববর্তী জেলা শাহবাদে। ৭ই জুন তারিখে তারা বেনারসের খবর শুনেছেন। খুব শীগ্‌গির একটা গোলমাল শুরু হবে সে বিষয়ে অনুমান করা হতে লাগলো। জেনারেল লয়েড সেপাইদের নিরস্ত্র করার কথা চিন্তা করতে লাগলেন, সে উদ্দেশ্যে মাদ্রাজ ১৫০জন থেকে সৈন্যও অবতরণ করানো হয়েছে, কিন্তু তারা অনুগত রয়ে গেলো।

মীরাটের বিদ্রোহের খবর শুনতে পেয়ে বিহারের জনজীবনে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। বেনারসের কাহিনী শুনে ইউরোপীয় মহলে আতঙ্ক জাগলো এবং অনেক ইউরোপীয় তাঁদের ঘাঁটি ত্যাগ করে গ্রামের দিকে নিরাপদে বাস করবার জন্য চলে গেলেন। দানাপুরে ৭ তারিখে বিদ্রোহ ঘটবে বলে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়লো। জেনারেল টেইলার ইউরোপীয় অধিবাসীদের নিশ্চয়তার জন্য নিজের বাসভবনকে দুর্গে পরিণত করলেন। সমস্ত নর-নারীকে সেখানে আশ্রয় দেয়া হলো, পাহারা বসানো হলো।

জুন মাসে দানাপুরে কোনো রকমের গোলমাল ঘটলো না। টেইলার মনে মনে অস্থির হয়ে উঠছেন। তিনি সরকারকে বার বার অনুরোধ করেও সেপাইদের তখন নিরস্ত্র করার প্রস্তাবে রাজী করাতে পারেনি। তার গুপ্তচরেরা নানা সংবাদ পরিবেশন করতে লাগলো। কখনো খবর এলো সেরা জমিদারেরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, কখনো খবর এলো ওহাবীরা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। জুন মাসের ১২ তারিখে নজীব নামে এক ব্যক্তিকে শিখদের কাছে রাজদ্রোহ প্রচার করার সময় ধরা হলো। বিচার করে তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে লটকানো হলো। এখন টেইলার অনুভব করতে লাগলেন যে তাঁর আর অপেক্ষা করার সময় নেই। তিনি মনে করলেন ওহাবী নেতৃবৃন্দকে এভাবে শক্তি বৃদ্ধি করতে দেয়া কিছুতেই উচিত হবে না। সে সময়ে ছিলেন তিনজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ওহাবী নেতা। তাঁরা হলেন মৌলবি শাহ্ মুহম্মদ হোসেন, আহমদ উল্লাহ্ এবং ওয়ায়েজুল হক। তাঁদের এমনিতে গ্রেফতার করলে জনগণের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি হবে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সে জন্য এক কৌশল অবলম্বন করলেন। শাসন-ব্যবস্থা সম্বন্ধে এক অধিবেশনের আয়োজন করে উল্লেখিত তিনজন ওহাবী নেতাকেও ডেকে পাঠালেন। কিন্তু আলোচনার শেষে ওহাবী নেতৃবৃন্দ তিনজনকে তিনি আটকে রাখলেন। জানালেন যে রাজনৈতিক কারণে তাদেরকে অন্তরীণাবদ্ধ অবস্থায় থাকতে হবে। দামরাওনের মহারাজা এবং টিকারীর রাণীর প্রতিও অনুরূপভাবে সন্দেহ পোষণ করা হলো। বড়ো বড়ো জমিদারেরা এ সময়ে ব্রিটিশ শাসনকে সর্বান্তঃকরণে কামনা করেছিলেন। কিন্তু হালে মরচে ধরা বন্দুক পরিষ্কার করলেও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বলে সন্দেহ করা হতে লাগলো।

ওহাবী সম্প্রদায় বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয়নি। তাদের অন্যান্য দেশবাসীর ন্যায় ব্যক্তিগতভাবে হয়তো তাঁরা ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছেন।

শান্তিতে বসে থাকার মানুষ টেইলার নন। ওহাবী নেতৃবৃন্দকে আটক করার পরে তিনি এক ঘোষণা জারী করলেন যে যার কাছে যে অস্ত্রশস্ত্র আছে তা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই জমা দিতে হবে এবং রাত নটার পরে কাউকে ঘরের বাইরে আসার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারী করা হলো।

৩রা জুলাই বিকেলবেলা প্রচুর মুসলমান জনসাধারণের একটি শোভাযাত্রা নগর প্রদক্ষিণ করে। তারা নিশান বয়ে এবং ড্রাম বাজিয়ে রাস্তা পরিক্রমণ করতে থাকে। সরকারি আফিম এজেন্ট পঞ্চাশ জন নাজিব এবং আট জন শিখকে তাকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দান করলেন। কিন্তু লোকজন আসার আগেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হলো। তাঁর মাথা কেটে ফেলা হলো। তারপরে দাঙ্গাকারীরা হটে যেতে বাধ্য হলো, তাদের মধ্যে একজন নিহত এবং কয়েকজন ভয়ানকভাবে আহত হয়েছে; পীর আলী নামে একজন স্থানীয় পুস্তক বিক্রেতা এবং একজন ওহাবীকে দাঙ্গাকারীদের নেতা হিসেবে গ্রেফতার করা হলো। তেতাল্লিশ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলো। সাধারণ আদালতে তাদের বিচার করে তাদের অপরাধ যাচাই করার জন্য একটি কমিশন গঠন করা হলো। টেইলার এবং পাটনার ম্যাজিস্ট্রেট লুইস সাহেবও ছিলেন সে কমিশনের সদস্য। তাদের মামলায় কোনো সওয়াল-জবাব করা হয়নি। তেতাল্লিশ জনের মধ্যে উনিশ জনকেই ফাঁসি দেয়া হলো। পাঁচজনকে যাবজ্জীবন নির্বাসিত করা হলো, তিনজনকে বেত্রাঘাত এবং তিনজনকে মুক্তি দেয়া হলো।

টেইলার ব্যক্তিগতভাবে আসামীদের সঙ্গে আলাপ করে তাদের মুক্তিপণ আদায়ের জন্য প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করতেন। একবার দেশীয় পুলিশ রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেফতার হলে টেইলার নিজে তাঁকে বলেন, “তুমি আমাকে তিনজনের জীবন দাও, আমি তোমার জীবন ফিরিয়ে দেবো। পীর আলী ধনী ছিলেন না। সন্দেহ করা হয়েছিলো নিশ্চয়ই কোনো ধনী তাঁকে রাজদ্রোহের জন্য অর্থ সরবরাহ করছে। শেখ ঘাসিত নামে একজন লোককেও পীর আলীর সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হলো যে তিনি ছিলেন পাটনার প্রধান ব্যাংক মালিকের কর্মচারী। তাঁকে এ অভিযোগে আটক করা হলো যে তিনি হচ্ছেন একজন অচেনা ব্যক্তি এবং তিনি পীর আলীর ব্যবসায়ে অর্থ সাহায্য করেছেন। পাটনার কোনো ভারতীয় লয়েডের আচরণে সন্তুষ্ট না হলেও কোলকাতার ইউরোপীয় বণিকরা তাকে সমর্থন করতো। তাঁর কাজের যে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সে সময় তিনি তা চিন্তা করে দেখেননি।

দানাপুর বিভাগের সামরিক অধ্যক্ষ প্রথমে বিদ্রোহ যে ঘটতে পারে, সে সম্বন্ধে চিন্তাও করেননি। কিন্তু সেপাইদের মধ্যে পূর্বে দৃষ্ট হয়নি এমনি এক ধরনের চাঞ্চল্য দর্শন করে বিদ্রোহের ব্যাপারে তিনি আঁচ করে নিলেন। কিন্তু ভারত সরকার তাঁর থেকে সেপাইদের নিরস্ত্র করার অধিকারও কেড়ে নিয়েছেন।

নীল-চাষীরা অনেকে খবর সংগ্রহ করে ফেলেছে। তার উপর সরকার কি নির্দেশ দিয়েছেন, তাও তাদের কাছে গোপন নয়। লয়েডের কাছে গভর্ণর জেনারেল ১৫ তারিখে চিঠি লিখেছেন। ২০ তারিখে নীল-চাষীরা দানাপুরের সেপাইদের নিরস্ত্র করবার জন্য গভর্ণর জেনারেলকে অনুরোধ করলেন। তারা আরো ভালোভাবে জানতো তাদের টাকার থলি নিরাপদ রাখার জন্য এরকম একটি ভয়ঙ্কর উদ্যোগ গ্রহণ করতে তিনি অবশ্যই দ্বিধান্বিত হবেন। এভাবেই গোপন সামরিক নির্দেশ ফাঁস হয়ে গেলো। সেপাইদের বুদ্ধি যোগাবার নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। তা অনেক সময় অফিসারদের পন্থার চাইতে দ্রুত এবং নিশ্চিত।

স্বভাবতঃই লয়েড এরকম একটি ভয়ঙ্কর উদ্যোগ গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু ২৪শে জুলাই তারিখে তাঁকে মনস্থির করতে হলো। দৃঢ়তার অভাবের জন্য তাঁকে নানা রকম উপায় অবলম্বন করতে হলো। যদি তিনটি রেজিমেন্টকে প্যারেডে আহ্বান করে ব্রিটিশ বন্দুকের মুখে অস্ত্র ত্যাগ করতে নির্দেশ দেয়া হতো, তাহলে কয়েকজন ছাড়া আর সকলেই সে আদেশ মেনে নিতো। যে কোনো রকমের বাধাকে বল প্রয়োগে দমন করা যেতো। লয়েড বন্দুকের ক্যাপ নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত করলেন এবং তার ফলে আগ্নেয়াস্ত্র অকেজো হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করলেন। পরদিন সকালে ব্যারাকের চত্বরে ইউরোপীয় সৈন্যদের আনা হলো এবং বন্দুকের ক্যাপ সংগ্রহ করার জন্য দুখানি গরুর গাড়ি আনা হলো। গাড়িগুলো ফেরত যাওয়ার সময় আতঙ্কিত ৭ এবং ৮নং রেজিমেন্টের সেপাইরা থামাতে চেষ্টা করে এবং তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সে যাহোক অফিসারেরা সেপাইদের মধ্যে শান্তি এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।

লয়েডের কাজ এখনো অর্ধসমাপ্ত মাত্র। কারণ এখনো পনেরোটি করে বন্দুকের ক্যাপ রয়েছে। তিনি আশা করেছিলেন ফেরত চাওয়া মাত্রই সেপাইরা ক্যাপ দিয়ে দেবে। তিনি কাজটি দেশীয় অফিসারদের দ্বারা করাবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু সেপাইরা যখন ক্যাপ প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করলো, ইউরোপীয় অফিসারদের আর করার কিছুই রইলো না। অফিসারদের চলে যেতে নির্দেশ দেয়া হলো। বলা হয়ে থাকে তাদের উপর গুলি বর্ষণ করা হয়েছিলো। তার ফলে মহারাণীর ১০নং বাহিনীর ইউরোপীয় সৈন্যরা ঘটনাস্থলে আসে এবং সেপাইদের উপর গুলি চালিয়ে কয়েক ডজনকে হত্যা করে। প্রথমে ৪০নং স্বদেশী রেজিমেন্ট বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয়নি, কিন্তু হাসপাতালের ছাদ হতে ১০নং ইউরোপীয় রেজিমেন্ট কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে তারাও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিলো। গোলযোগের সময়ে স্টীমারে নদীবক্ষে ছিলেন টেইলার। অত্যন্ত প্রয়োজনের সময় সামরিক অফিসারেরা তাঁর প্রয়াজনীয় সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন। বিদ্রোহীদের দমন করার কোনো সুযোগ না দেয়ায় তারা দ্রুত শাহবাদ জেলার সদর দফতর আরাতে চলে গেলেন। তাঁদের স্ত্রী পুত্র-পরিজন সকলেই পেছনে রয়ে গেলেন।

লয়েড নৌকা করে তাঁদের স্ত্রী-পুত্রদের স্টীমারে তুলে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের কয়েকখানা নৌকা ডুবিয়ে দিলো বিদ্রোহীরা। অগত্যা তাদের আর কোনো পন্থা ভোলা রইলো না। তা ছাড়াও তাদের গন্তব্য যে কোথায় সে সম্বন্ধেও কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিলো না। তারা আরাতে যেতে পারতেন এবং পাটনা থেকে বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারতেন অথবা তারা গয়ার দিকে অগ্রসর হতে পারতেন। পাটনা রক্ষা করাই এখন তাঁর অব্যবহিত কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুটি কামানসহ কিছু সংখ্যক সৈন্য সেখানে পাঠানো হয়েছে। ২৬ তারিখে অল্প সংখ্যক রাইফেলধারী সৈন্যসহ একখানি স্টীমার নদীতে ভাসানো হলো। নদীবক্ষ অগভীর ছিলো বলে স্টীমারখানা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারলো না। আরেকখানি ষ্টীমার আরাতে বেসামরিক কর্মচারিদের বয়ে আনতে পাঠানো হয়েছিলো, কিন্তু সেখানে বালুচরে আটকা পড়লো। তৃতীয় স্টীমারখানা এলাহাবাদ থেকে কলকাতাগামী যাত্রী বহন করে বিকেল বেলা পৌঁছেছিলো। এ স্টীমারখানা রিকুইজিশন করা হয়েছিলো, তাঁদের বয়ে নেবার জন্য। কিন্তু ক্যাপটেন ঘুমন্ত যাত্রীদের বিরক্ত করতে রাজী না হওয়ায় তাতে অনেক সময় লেগে গেলো। তাই ২৯ তারিখে বিকেল বেলাতেই মাত্র অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে ক্যাপটেন ডানবারকে পাঠানো সম্ভব হয়েছিলো।

অভিযান ব্যর্থ হয়ে গেলো। জগদীশপুরে বাবু কুমার সিং সেপাইদের পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি রাত্রিবেলা আক্রমণ করে ব্রিটিশ সৈন্যদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করলেন। অর্ধেক মানুষ নিহত হলো। তার ফলে পাটনা এবং অন্যান্য জেলায় অফিসারেরা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। এ শোচনীয় ঘটনার পরে টেইলারকে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলাতে বদলি করা হলো।

লখনৌতে হঠাৎ করে বিদ্রোহ দেখা দেয়নি। টেইলার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়েককে সাবধান করে বলেছিলেন, “আরার সেপাইরাও যে বিদ্রোহ করতে পারে তা বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ রয়েছে।” একটি অধিবেশনে স্থির করা হলো মহিলা এবং শিশুদেরকে দানাপুরে রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার মিঃ বয়লারের বাসগৃহে স্থান দেয়া হবে, যেখানে চরমতম বিপদের মুহূর্তে পুরুষ মানুষেরাও আশ্রয় গ্রহণ করবে। অল্প সংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র এবং রসদপত্র সংগ্রহ করা হলো। কিন্তু বেসামরিক অফিসারেরা সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করা নিরাপদ জ্ঞান করলেন না। দু’জন ছাড়া আর সকলেই অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করলেন। ২৬শে জুলাই একজন অশ্বারোহী সেপাই সংবাদ নিয়ে এলো যে সেপাইরা শোন নদী অতিক্রম করেছে। পনেরো জন ইউরোপীয় এবং পঞ্চাশ জন শিখ সৈন্য আরাতে মিঃ বয়লারের বাসগৃহ পাহারা দিতে গেলেন। ২৭ তারিখে বিদ্রোহীরা কুমার সিংয়ের ঝান্ডার তলায় সমবেত হলেন।

কুমার সিংয়ের শরীরে এখন যৌবন অবশিষ্ট নেই। তাঁর বয়স সত্তর বছর অতীত হয়ে গেছে। তাছাড়া শরীরটাও তাঁর ভালো নয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বড়ো একজন জমিদার। বছরে ব্রিটিশ সরকারকে কম করেও এক লক্ষ আটচল্লিশ হাজার টাকা খাজনা পরিশোধ করতেন। আর তিনি প্রজাদের কাছে যে টাকা খাজনা স্বরূপ আদায় করতেন, তার পরিমাণ ছিলো তিন লাখ টাকা। তিনি ছিলেন অশিক্ষিত। কর্মচারিরা তাকে নানাভাবে শোষণ করতো। কিন্তু তিনি ছিলেন সাহসী, উদারচেতা ও দয়ালু জমিদার। কিন্তু অকর্মণ্য পরজীবী কর্মচারিদের স্বার্থপরতা বশতঃ তিনি এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা দেনাদার হয়ে পড়লেন। তিনি এবং তাঁর পাওনাদার কয়েকজন মিলে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করলেন জমিদারী বন্ধক দিয়ে যেনো তাঁকে দেনা থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। টেইলার এবং ড্যামপীয়ার এজন্য চেষ্টা করেও তাঁর জন্য কিছু করতে পারলেন না। কুমার সিং দেউলিয়া হয়ে পড়লেন। পিতৃপুরুষের জমিদারী হারিয়ে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। তাছাড়াও অন্যান্য রাজপুতদের মতো ইংরেজদের বাধা দেবার কথা তাঁর মনে কম সময়েই খেলে যেতো। যেদিন সেপাইরা আরাতে এলো সেদিনই জগদীশপুর থেকে কুমার সিং আরাতে এলেন। এখন কথা হতে পারে এ অল্প সময়ের মধ্যে কুমার সিং কিভাবে সেপাইদের সঙ্গে চুক্তি করে ফেললেন। কিন্তু তখনকার দিনে প্রত্যেক জমিদার কম বেশি আসন্ন পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য তৈরি থাকতেন।

কুমার সিংকে কখন পাটনাতে আহ্বান করা হয়েছিলো আমাদের পক্ষে তা সঠিকভাবে জানার উপায় নেই। সম্ভবত জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হবে। ওহাবী নেতৃবৃন্দ মিঃ টেইলারের সঙ্গে জুনের ২ তারিখে তার আমন্ত্রণক্রমে দেখা করেছিলেন এবং তাদেরকে অন্তরীণ করা হয়েছিলো। সন্দেহভাজন দাঙ্গাকারীদেরকে জুলাই মাসে ইতর-বিশেষ প্রভেদ না করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছিলো। ম্যাজিস্ট্রেট ওয়েক কুমার সিং-এর গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলেন, কিন্তু তার প্রতীতি জন্মালো যে বিদ্রোহ বিক্ষোভ কিছু ঘটলে প্রজারা বৃদ্ধ সামন্তকেই সবান্তঃকরণে সমর্থন করবে।

কুমারের প্রধান সহকারীদের মধ্যে ছিলেন তাঁর ভ্রাতা অমর সিং, ভাইপো রীতভঞ্জন সিং, তহশীলদার হরকিষাণ সিং এবং ষাট বছরের বুড়ো তাঁর বন্ধু নিশান সিং। দিলওয়ার খান এবং সারনাক সিংয়ের নামও উল্লেখ করা যেতে পারে।

সেপাইরা রাজকোষ লুঠ করে ফেললো। কয়েদখানা ভেঙ্গে কয়েদীদেরকে মুক্তিদান করলো। কুমার সিংয়ের কাছে ছিলো দু’টো কামান, কিন্তু সেগুলো কোনো কাজে এলো না। শিখেরা ছিলো ব্রিটিশদের প্রধান রক্ষাকর্তা। জনৈক ব্রিটিশ অফিসার মন্তব্য করেছেন, আমাদের সঙ্গে যদি শিখেরা না থাকতো, তাহলে সেপাইরা প্রথম ধাক্কাতেই আমাদের শেষ করে দিতো। শিখদের পক্ষে হুকমত সিংহ অবরোধকারী সেপাইদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যে শৌর্য-বীর্য এবং বীরত্বের পরিচয় দান করেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। ৩১ তারিখ জুলাইয়ে মেজর ভিনসেন্ট আয়ার না আসা পর্যন্ত শিখেরা অপরিসীম বীরত্ব সহকারে ইউরোপীয়দের রক্ষা করে। তিনি এলে অবরোধকারীরা চলে যেতে বাধ্য হয়।

মেজর আয়ার আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারপরে তিনি ব্রহ্মদেশে ছিলেন। বিদ্রোহের প্রাদুর্ভাবের পরে তিনি ভারতে আসেন। সে যাহোক তিনি বক্সার থেকে আরা অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথে তিনি ডানবারের পরাজয়ের খবর পেলেন। সেপাইরা পথে তাকেও বাধা দিলেন। কিন্তু ভারী কামানের অবিরাম গোলাবর্ষণের মুখে রাইফেলধারী সেপাইরা হটে যেতে বাধ্য হয়। আবার কুমার সিং বিবিগঞ্জে তাঁর অগ্রগতি রোধ করে দাঁড়ালেন। কিন্তু দৃঢ় আক্রমণের মুখে তার সৈন্যেরা কোনোরকম সুবিধা করে উঠতে পারছিলো না। সঙ্গিনের সাহায্যে ২রা আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে গেলেও কুমার সিংয়ের পক্ষে আরা রক্ষা করা সম্ভব হলো না। সুতরাং মেজর আয়ার আরামে মুক্ত করে ফেললেন।

আরা থেকে কুমার সিং তাঁর পৈতৃক দুর্গ জগদীশপুর চলে গেলেন। সেখানেও মেজর আয়ার তার পিছু পিছু ধাওয়া করলেন। প্রাণপণে বাধা দেয়া হলো, কিন্তু ভারী কামানের গোলা বর্ষণের মুখে রাইফেলধারী সেপাইরা দাঁড়াতে পারলো না। কেউ রেহাই পেলো না। আহত সেপাইদের সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হলো। প্রচুর অর্থ ব্যয়ে কুমার সিং যে নতুন মন্দির নির্মাণ করেছেন, ভেঙ্গে তা চুরমার করা হলো। কারণ ব্রাহ্মণেরা বিদ্রোহের প্ররোচনা দিয়েছিলো বলে গুজব রটেছিলো। জগদীশপুর প্রাসাদ এবং অন্যান্য অট্টালিকা ধ্বংস করে দেয়া হলো।

কুমার সিংয়ের সেপাইরা পরাজিত হয়েছে, প্রাসাদ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে তা সত্য, তবু বুড়ো সিংহকে ধরা এতো সহজ নয়। জগদীশপুরের জঙ্গল থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি রোহতাস পাহাড়ের দিকে গমন করলেন। সেখানে গেলে গ্র্যান্ড রোডে ব্রিটিশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। কিন্তু কুমার সিংয়ের পরিকল্পনা ছিলো আরো ব্যাপক। তিনি সঠিক ধারণা পোষণ করেছিলেন যে নিম্নাঞ্চলের প্রদেশসমূহের জয়-পরাজয়ের উপরই যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ভর করছে। রেওয়া, মীর্জাপুর ইত্যাদি অঞ্চলে গমন করে তিনি দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করলেন যে সময়ে তাঁর সঙ্গে মাত্র পাঁচশ অনুগামী ছিলো। আর সকলে তার সঙ্গ পরিত্যাগ করেছে। ইতিমধ্যে দিল্লীর পতন ঘটলো এবং কুমার সিংকে তাঁর পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হলো।

অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরির পর ১৮৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কুমার সিং লখনৌ এবং দরিয়াবাদের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করেছিলেন। মার্চ মাসে তিনি অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠলেন। এতোদিন ধরে গুর্খারা আজমগড় থেকে বিদ্রোহীদের বিতাড়িত করছিলো, কিন্তু তারা লখনৌতে স্যার কলিন ক্যাম্পবেলের সঙ্গে যোগ দিতে গমন করলে নগরী অরক্ষিত হয়ে পড়লো, তা কিন্তু কুমার সিংয়ের শ্যেনদৃষ্টি এড়ালো না। তিনি আজমগড় থেকে বিশ মাইল দূরে আডাউলী গ্রাম আক্রমণ করলেন। কর্ণেল মিলম্যান, যিনি ঘাঁটি রক্ষা করছিলেন, তাঁকে পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে হলো। তারপর তিনি আজমগড় আক্রমণ করলেন। কর্ণেল ডেমস এলেন গাজীপুর থেকে মিলম্যানের সাহায্যার্থে। তিনিও পরাজিত হলেন এবং পলায়ন করলেন। পর পর দু’বার ব্রিটিশ পরাজয়ের সংবাদ প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে লোকচক্ষে ব্রিটিশ মর্যাদা অনেকটা নেমে গেলো। লর্ড ম্যাককারকে সঙ্গে সঙ্গে আজমগড় উদ্ধার করার জন্য পাঠানো হলো। তিনি নগরী পুনরায় দখল করে নিলেন এবং অল্পদিন পরেই তাঁর সঙ্গে এসে যোগ দিলেন স্যার এডওয়ার্ড ন্যুগার্ড। উভয়ের মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে কুমার সিংয়ের করার মতো কিছু ছিলো না। তিনি আপন প্রদেশ বিহারে চলে যেতে মনস্থ করলেন। এ সময়ে তিনি বীরত্বপূর্ণ কতকগুলো সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এভাবে তিনি শিবপুর ঘাটে এসে কতেক নৌকা যোগাড় করলেন। এ সময়ে একটা খবর রটলো যে নৌকা কম হওয়ায় তিনি হাতীর পিঠে চড়ে নদী অতিক্রম করতে মনস্থ করেছেন। কিন্তু জেনারেল ডগলাস সে স্থানে পৌঁছোবার পূর্বে দু’শ সৈন্যের বেশি নদী পার হতে পারলো না।

এবারে কুমার সিং তাঁর জগদীশপুরের ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদের দিকে পথ দিলেন। বুড়ো সিং এবার সত্যি তাঁর মরণ ফাঁদে পা বাড়ালেন। গঙ্গা পার হওয়ার সময় কামানের গোলার আঘাতে তার একখানা হাত একেবারে ভেঙ্গে গেলো। কথিত আছে, বুড়ো রাজপুত ধারালো তরবারির সাহায্যে তাঁর বিক্ষত বাহু কেটে গঙ্গার পবিত্র জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বিনা বাধায় অগ্রসর হতে পারছিলেন না। তাঁর সঙ্গে ছিলো খুব বেশি হলে মাত্র দু’হাজার মানুষ। তারা অভুক্ত, ক্লান্ত, আহত-সঙ্গে একটি বন্দুকও নেই। আবার ক্যাপটেন লি গ্র্যান্ড মেজর আয়ারের মতো জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু আহত সিং আক্রমণের পর আক্রমণ করে অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। লি গ্র্যান্ড সৈন্যদের মধ্যে কেবলমাত্র শিখেরাই কিঞ্চিৎ শৃঙ্খলা বজায় রেখেছিলো। ইউরোপীয় সৈন্যরা সম্পূর্ণরূপে ছন্নছাড়া হয়ে পড়লো। তাদের বিস্তর ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। লি গ্র্যান্ড এবং অন্য দু’জন অফিসার মারা গেলেন। ৩০নং রেজিমেন্টে ১৫০জন সৈন্যের মধ্যে ১০০জন সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ২৩শে এপ্রিল লি গ্র্যান্ডের সৈন্যরা পরাজিত হলো এবং ২৪ তারিখে কুমার সিং মারা গেলেন। একটি মহান জীবনের অবসান ঘটলো।

কুমার সিংয়ের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর ভ্রাতা অমর সিং সৈন্যদের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। কোনো সামরিক প্রতিভা না থাকলেও রাজপুত পূর্ব পুরুষের দৃঢ়তা এবং সাহস তার মধ্যে ছিলো। তাঁর প্রজাদের আস্থাভাজন হয়ে তিনি শাহবাদে একটা সরকার গঠন করেন, বিচারক এবং উসুলকারক নিয়োগ করলেন। ব্রিটিশ সরকার যেমন তাঁর মস্তকের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন, তিনিও তেমনি ব্রিটিশ সরকারের প্রধানের মস্তকের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন।

এখন অমর সিং ভয়ানক বিপদের সম্মুখীন হলেন। তিনটি ব্রিটিশ সৈন্যদল এখন আরাতে এসে মিলিত হয়েছে। ডগলাস এসেছেন শোন নদী পার হয়ে দানাপুর থেকে। স্যার এডওয়ার্ড ন্যুগার্ড এসেছেন আমগড় থেকে এবং কর্ণেল করফিল্ড সাসারাম থেকে। এখন অমর সিংয়ের সৈন্য সংখ্যা দু’হাজার থেকে আড়াই হাজার। তার মধ্যে অশ্বারোহীর সংখ্যা ৩০০ থেকে ৪০০ জন। সম্মুখ যুদ্ধে রাজপুত জমিদারদের জয়লাভ করার কোনো সম্ভাবনা নেই। সুতরাং অমর সিং জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করে গ্যারিলা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া স্থির করলেন। জগদীশপুর ব্রিটিশ দখলে চলে গেলে অমর সিং লাতাওয়ারপুরে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। গার্ড জঙ্গলের মধ্য দিয়ে অভিযান করে শত্রুদের শায়েস্তা করতে চাইলেন। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে সুবিধা করতে পারলেন না। স্বাস্থ্য খারাপের অজুহাতে তিনি অধিনায়কের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করলেন। ইতিমধ্যে বিদ্রোহীরা ইংরেজদের অনুগত জমিদারদের আক্রমণ করে শাস্তি দিলেন। জুন মাসে অমর সিং গঙ্গার অপর তীরের ঘুরমার নামক স্থানে উপনীত হলেন। খবর রটলো তিনি অযোধ্যা যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। গাজীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ভয় করতে লাগলেন যে তাঁর ঘাঁটি আক্রান্ত হবে এবং গাবিনস্ ভয় করতে লাগলেন রাজপুত প্রধান বেনারস আক্রমণ করবেন। ১৮৫৮ সালের জুলাই মাসে তাঁরা আরা আক্রমণ করে শহরের উপকণ্ঠে মিঃ ভিক্টরের বাঙলো জ্বালিয়ে দিলো। বিদ্রোহীদের পশ্চাদ্ধাবন করা হলো, তারা অমর সিংয়ের গ্রামে আশ্রয় নিলেন। আবার ব্রিটিশ সৈন্যাধ্যক্ষ কর্ণেল ওয়াল্টারম্যান খবর পেলেন বিদ্রোহীরা শহরের বারো মাইল পশ্চিমে এসে পড়েছে। তারপরে তিনি পলায়ন করলেন, কিন্তু তাদের ঘাঁটি রক্ষা পেয়ে গেলো। পরের দিন ওয়াল্টার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে চিঠি পেলেন যে বিদ্রোহীরা শহরের কাছে এসে পড়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ সৈন্য আসবার আগেই তারা পঁচিশটা ঘর এবং দোকানপাট লুটপাট করে ফেলেছে। প্রত্যাবর্তনের সময় তারা ইংরেজের অনুগত জমিদার চৌধুরী প্রতাপ নারায়ণ সিংয়ের বাড়ি জ্বালিয়ে দিলেন। পরের দিন পঞ্চাশ জন সেপাইয়ের একটি ক্ষুদ্র দল পুনরায় আরার উপর হামলা করলো। একটি দল গয়া আক্রমণ করে কারাগারের দরোজা খুলে দিলো। ডগলাস জঙ্গল বেষ্টন করে বিদ্রোহীদেরকে ধরতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিদ্রোহীদের মতো তাড়াতাড়ি তারা চলাফেরা করতে পারতেন না। তরুণ হ্যাভলকের পরামর্শে ডগলাস পার্বত্য পদাতিক বাহিনী নিয়োগ করলেন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। তারা অধিকতর যোগ্যতার পরিচয় দিলো। বিদ্রোহী বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো, কিন্তু তাঁদের নেতা কাইমুর উপত্যকায় নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করলেন। ১৮৫৮ সালে ডগলাস তাকে সেখানে অক্রমণ করলেন। এভাবে পশ্চিম বিহার অভিযান শেষ হয়ে এলো। অমর সিং এবারেও গা ঢাকা দিলেন।

নিশান সিং ধৃত হয়ে ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণ দিলেন। হরকিষাণ সিংকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। অমর সিংয়ের সেনাদল নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো। কিন্তু কিছুতেই অমর সিংকে পরাজিত করা সম্ভব হলো না। ১৮৫৮ সালে কর্ণেল রামজে শুনতে পেলেন জগদীশপুরে অমর সিং তেরাইয়ের সেপাইদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। বিহারের ভূস্বামীগণ সব সময় ব্রিটিশকে সাহায্য করেছে। শাহবাদের সিংয়েরা যে শৌর্য-বীর্যের পরিচয় দিয়েছেন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *