৩. এই সে দিল্লী-এই সে নগরী

এই সে দিল্লী-এই সে নগরী

দিল্লীতে এক সম্রাট ছিলেন। তাঁর কোনো সাম্রাজ্য ছিলো না। কিন্তু তাঁর পিতা পিতামহের সাম্রাজ্যের স্মৃতি এখনো লোকের অনুভূতিতে সজীব-জীবন্ত। রাজপ্রাসাদের বাইরে কোনো ক্ষমতা ছিলো না সম্রাটের। অভ্যন্তরের ক্ষমতাও নিয়ন্ত্রিত করতে ইংরেজ। অতীতের সকল প্রথা এবং রীতি তাকে মেনে চলতে হতো। তাঁর সরকারের প্রতি সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা ছিলো, কিন্তু সরকারের কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিলো না। তিনি পেনশনের অর্থে জীবনধারণ করতেন এবং সভাসদেরা তাকে ভালোবেসে শ্রদ্ধা জানাতেন। প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশের করুণার ওপরেই তাঁর রাজকীয় প্রতিষ্ঠা। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের কাছে এখনো তিনি একচ্ছত্র ভারত সম্রাট, প্রতাপান্বিত সম্রাট বাবর এবং আকবরের মহিমান্বিত উত্তর পুরুষ। সকলে এখনো তাকে আসল শাসনকর্তাদের ন্যায্য প্রভু বলে মনে করে। কোম্পানীর সরকার বংশানুক্রমে এই অনিঃশেষিত সার্বভৌমত্বকে লালন করে আসছিলেন, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। সাম্রাজ্যের সোনালী দিনে পূর্বপুরুষেরা যে ধরনের সম্মান ভোগ করতেন, অল্প কদিন আগেও ইংরেজ সরকার তাঁকে সেই সম্মান নিবেদন করেছেন। গভর্ণর জেনারেল শহর দিল্লীতে এলে তার প্রতিনিধিকে সম্রাটের সামনে নগ্ন পায়ে দাঁড়াতে হতো, বিনম্রভাবে সম্রাটের স্বাস্থ্যের খবর নিতে হতো এবং একান্ত কর্তব্যপরায়ণতার সাথে দিল্লীশ্বরো জগদীশ্বরের সামনে উপঢৌকন তুলে ধরতে হতো। সম্রাট নিজে এসব তার প্রাপ্য রীতিগত সম্মান বলে গণ্য করতেন। অতীত দিনের মতো দরবারের ফরমান জারী করা হতো। মহামান্য সম্রাট এই বলেছেন, এই করেছেন, তা বাইরের লোকে জানতে পারতো। কোনো কোনো ভারতীয় দেশীয় রাজ্যে তখনো বাদশাহর নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলিত ছিলো। গৌরবময়ী অতীতের জীবন্ত প্রতাঁকের দিকে এখনো অনেকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বিদেশী শাসকদের কাছে সম্রাট বিপদের একটি সক্রিয় উৎস বিশেষ। কারণ একমাত্র তিনিই কোম্পানীর সরকারের সশস্ত্র অভ্যুত্থান অনুমোদন করার একমাত্র আইনসঙ্গত দাবিদার।

সরকার এ বিপদের কথা বেশ ভালোভাবেই জানতেন। তাঁরা অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে ভারতের অন্যান্য রাজবংশের উচ্ছেদ সাধন করেছেন। আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারীদেরকে রাজ্যের বাইরে নির্বাসিত করেছেন। যে পেশবা বংশের উপর অর্পিত ছিলো সমগ্র মারাঠা জাতির আনুগত্য, তাঁকে উত্তর ভারতের একটি গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। টিপু সুলতানের উত্তরাধিকারীদের বেলুড় থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছে। রণজিৎ সিংয়ের ছেলেদের গ্রেটব্রিটেনে স্থানান্তরিত করেছে। কিন্তু নামমাত্র সম্রাট এখনো পূর্বপুরুষ শাজাহানের প্রাসাদে অবস্থান করছেন। এক সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী দিল্লীর সম্রাটের অপ্রতিহত ক্ষমতার থিয়োর প্রচার করে নিজের সুবিধা আদায় করেছিলেন। বাঙলা ও কর্ণাটকে তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে এবং মারাঠা ও শিখ শক্তি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেলে দিল্লীর সম্রাটের পদবী রাজনৈতিক গুরুত্ব হারিয়ে ফেললো। পক্ষান্তরে, কিন্তু দিল্লীর সম্রাট প্রকৃত শাসক ও আসল সরকারের বিপদের জীবন্ত কারণ হিসেবে রয়ে গেলো। সুতরাং সম্রাটের পদবীর বিলুপ্তি এবং দিল্লীর সুসজ্জিত প্রাসাদ থেকে তাঁকে বের করে আনা কোম্পানীর সরকারের কাছে আশু প্রয়োজন হয়ে দেখা দিলো।

১৮৩৭ সালে বাহাদুর শাহ সম্রাট হলেন। তাঁর পিতার মতো তিনিও বাদশাহ এবং গাজী উপাধি ধারণ করলেন। রাজ্যহীন সম্রাটের এবং বিনাযুদ্ধে গাজীকে জনসাধারণ সহ্য করে নিয়েছিলো। এ রকম একটি সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা তার ছিলো না। স্বাভাবিক সময়ে অল্পস্বল্প আড়ম্বরের সাথে নিজের মুখোশটা রক্ষা করা ছাড়া তাঁর কাছে আর কিছু আশা করা যেতো না। যুদ্ধপ্রিয় পূর্বপুরুষদের অজেয় সাহস তার ছিলো না। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো কোনো পূর্বপুরুষের সাহিত্য রুচি লাভ করেছিলেন। অবসর সময়ে তিনি নিজেই কবিতা রচনা করেন। তিনি জন্মেছেন এবং বড়ো হয়েছেন প্রাসাদের শঠতা, ছলনা এবং ষড়যন্ত্রপূর্ণ পরিবেশে। যুগের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন না, তাই দায়িত্বহীন অভিযানের দ্বারা তিনি চালিত হতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর মন্ত্রণাদাতা হাসান আসকারী তোষামুদে বাকসর্বস্ব মানুষ। প্রত্যেক মোঘল শাহজাদা পরিবারের সম্মান ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু বাহাদুর শাহের মনে ইংরেজ প্রভুদের সঙ্গে সামান্যতম বিবাদে লিপ্ত হওয়ার আকাভ ক্ষাও ছিলো না। তার পিতার মতো তিনিও কোম্পানীর কাছে পেনশন বৃদ্ধি করার জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু কোম্পানীর সরকার সম্রাট পদবী এবং রাজপ্রাসাদ ত্যাগ না করলে পেনশন বৃদ্ধি করতে রাজী ছিলো না। বর্তমানে তিনি অন্য বিষয়ের প্রতি সম্পূর্ণভাবে মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। তিনি বেগম জিনাতমহলের গর্ভজাত শেষ বয়সের নাবালক সন্তান জওয়ান বখৃতকে সিংহাসনের নিরাপদ উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করতে চান। কিন্তু পদবী এবং নাবালক ছেলের মাঝামাঝি ছিলেন কয়েকজন শাহ্জাদা। কোম্পানীকে এজন্য চাপ প্রয়োগ করার সকল সুযোগের সদ্ব্যবহারই করেছেন সম্রাট। অন্যদিকে সরকার নামমাত্র সম্রাটকে প্রাসাদের বাইরে এনে, পদবী ছাড়তে প্রলুব্ধ করে নিকটবর্তী কুত্‌ব-এ পাঠিয়ে দিতে একটা সুযোগের অপেক্ষা করেছিলেন।

বাহাদুর শাহ তাঁর খান্দানের প্রতি অসম্মানজনক এ প্রস্তাবে রাজী হতে পারেননি। ব্রিটিশ সরকার সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর প্রহসন সহ্য করতে রাজী ছিলো না। কিন্তু তারা শক্তি প্রয়োগ করতেও আগ্রহী ছিলো না। বহুযুগ আগের মতো এখনও মোঘল দরবার লক্ষ লক্ষ মানুষের নিষ্ক্রিয় শ্রদ্ধা পেয়ে আসছে। তাতে কিন্তু ইংরেজদের কোনো ক্ষতি হয়নি। আনুগত্যের বাহ্যিক চিহ্নগুলো তারা একের পর এক দূর করতে লাগলো। লর্ড এলেনবোরো তার পক্ষ থেকে অথবা ব্যক্তিগতভাবে কোনো নজর দিতে রেসিডেন্টকে বারণ করেছিলেন, যদিও সমপরিমাণ অর্থ অন্যভাবে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ তাঁর খান্দানের মর্যাদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। বাহাদুর শাহ এবং পরিবারের সকলে চরম অপমানবোধ করলেও প্রকাশ্যে তিনি কোনো নালিশ করলেন না। লর্ড ডালহৌসী সম্রাটের পদবী কেড়ে নেয়া এবং প্রাসাদ থেকে অন্য কোনো উপযুক্ত পরিবেশে স্থানান্তরের জন্য বিলাতের কর্তাদের ওপর চাপ দিতে থাকেন, তা করা সঙ্গত হবে কি না এ নিয়ে কোর্ট অব ডিরেকটরস, বোর্ড অব কন্ট্রোলের সঙ্গে একমত হতে পারছিলো না। গভর্ণর জেনারেল এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ক্ষমতা লাভ করার পরেও এ ব্যাপারে তাকে শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হলো। অবশেষে বৃদ্ধ, অশক্ত সম্রাট বাহাদুর শাহের মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করাই স্থির করলেন। ১৯৪৯ সালে আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারী মারা গেলো, দিল্লীর রেসিডেন্ট পরবর্তী উত্তরাধিকারী শাহজাদা ফকরুদ্দীনের সঙ্গে একটা বোঝা-পড়ায় এলেন। তাঁর পিতার অন্তর্ধানের পর তাকেই সম্রাটের বংশের প্রধান বলে স্বীকার করে নেয়া হবে। তার পদবী থাকবে শাহজাদা। কিন্তু তার বিনিময়ে প্রাসাদ, রাজধানী, দুর্গ সবকিছু ত্যাগ করতে হবে। এ ব্যবস্থা গোপন রইলো না। অধিকাংশ রাজপুত্র তাতে অস্বীকৃতি জানালেন। ১৮৫৬ সালে শাহজাদা ফখরুদ্দীনও মারা গেলেন। তাঁকে বিষপান করিয়ে হত্যা করানো হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। এ সময়ে সম্রাটের ওপর বেগম জিনাত মহলের অপ্রতিহত প্রভাব ছিলো। জওয়ান বখতের ভাগ্যকে নিষ্কন্টক করার জন্য আবার চেষ্টা করা হলো, কিন্তু তাতে বিশেষ ফলোদয় হলো না। দিল্লী সাম্রাজ্যের অন্তিমক্ষণ ঘনিয়ে আসছিলো। বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পরে শাহজাহান এবং আলমগীরের অযোগ্য বংশধরেরা অস্বাভাবিক কিছু একটা না ঘটলে পূর্ব পুরুষের প্রাসাদ থেকে বিতাড়িত হবে এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ রইলো না।

১৮৫৭ সালের ১১ই জুন সকালবেলা মীরাটের বিদ্রোহীরা নৌকা দিয়ে সেতু বানিয়ে যমুনা পার হয়ে দিল্লীতে এলো। গরমের দিনে সকালবেলা কলেজ বসেছে। গোটা দিনে কি ঘটবে না জেনে অধ্যাপক রামচন্দ্র সেখানে গেলেন। বিখ্যাত ভ্রমণকারী মুনশী মোনেলাল তাঁর এক ইংরেজ বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলেন। কলকাতা থেকে গতদিনের সংবাদপত্র এসে পৌঁছেছে। ঝিজ্জার নওয়াবের এজেন্ট কালীপ্রসাদ প্রতিদিনের মতো সকালবেলা অশ্বারোহণে বেড়াতে বেরিয়েছেন। তিনি আসন্ন বিপদের কোনো সূচনাই দেখতে পেলেন না। মুনশী জীবনলাল ক্যাপ্টেন ডগলাসের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং বাড়িতে ফিরে গিয়ে কোর্টে যাবার পাল্কী তৈরি করতে আদেশ দিলেন। থানার অফিসার ইনচার্জ মুইনুদ্দীন হাসান একটি ফৌজদারী মামলার ব্যাপারে কালেক্টরের কোর্টে এসে হাজির হয়েছেন। কমিশনার সাইমন ফ্রেসার এখনো ঘুমিয়ে আছেন। হঠাৎ খবর রটলো-মীরাটের অশ্বারোহীরা নগরীর ফটকের সামনে এসে হাজির হয়েছে। তারা উসুলী কালেক্টরকে হত্যা করেছে এবং তাঁর অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছে। কালেক্টর হাচিনসন তাড়াতাড়ি কমিশনারের বাঙলোতে পালিয়ে এলেন। শান্তভাবে শুরু হওয়া গ্রীষ্মের মনোরম সকাল পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লীর রাজপথে নৃশংস বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড চলতে লাগলো।

কমিশনারের মতো সম্রাট নিজেও আশ্চর্য হয়ে গেছেন। প্রাসাদের গবাক্ষর কাছে একটা আওয়াজ শুনে বুড়ো সম্রাট বুঝতে পারলেন যে বিদ্রোহীরা এসেছে। আগেকার দিনে, সাম্রাজ্য যখন প্রাণপূর্ণ ছিলো, সম্রাটেরা অলিন্দে দাঁড়িয়ে নীচের প্রজাদের দেখতেন। অবাধ্য জনতার সামনে এসে দাঁড়াবার মতো সাহসও বাহাদুর শাহের ছিলো না। তিনি ক্যাপ্টেন ডগলাসকে ডেকে পাঠালেন। ডগলাস তাদেরকে চলে যেতে বললেন, কারণ তাদের শোরগোল সম্রাটের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। তারপরে বিদ্রোহীরা কলকাতা ফটকের দিকে গেলো। কিন্তু আগে থাকতেই ফটক বন্ধ ছিলো। ইতিমধ্যে কমিশনার সাইমন ফ্রেসার এবং হাচিনসন অকুস্থলে এসে হাজির হলেন। তারা এসে ক্যাপ্টেন ডগলাসের সঙ্গে যোগ দিলেন। সবগুলো ফটক আগে থাকতে বন্ধ রাখা হলে নগরে প্রবেশ করা অসাধ্য না হলেও বেশ কষ্টসাধ্য হতো বিদ্রোহীদের পক্ষে। কিন্তু নগরের অভ্যন্তরে সেপাইদের সমমর্মীর অভাব ছিলো না। গুজব রটে গেলো যে সেপাইরা মীরাটের ইউরোপীয়দের হত্যা করে দিল্লীতে ধর্মের জন্য সগ্রাম করতে এসেছে। কৌতূহলী জনতার ভিড়ে রাজপথ মুখরিত হয়ে উঠলো। তারপরেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। তাদের অনেকেই ইংরেজদের জবরদখলকারী এবং বহিরাগত বলে ঘৃণা করতো। দিল্লীর নাগরিকদের ইংরেজদের বিতাড়িত করতে আবেদন জানিয়ে ইরানের শাহ মাত্র কিছুদিন আগে একটি ফরমান পাঠিয়েছেন। কে রাজঘাট ফটক খুলে দিয়েছিলো, জানা সম্ভবপর হয়নি। সেপাইরা পরে সেখানে গিয়ে হাজির হলো। তাদের মনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিলো না। লুট করার লোভ ছিলো প্রবল, তাও বলবার উপায় নেই। দুর্ধর্ষ অশ্বারোহীরা নগরে প্রবেশ করার পরে তাদের সঙ্গে স্থানীয় দুষ্কৃতিকারীরাও যোগ দিলো।

ডঃ চমনলাল নামে ডিসপেনসারীর সামনে দণ্ডায়মান একজন ভারতীয় খ্রীস্টান হলেন নগরীর প্রথম নিহত ব্যক্তি। তারপরে সেপাইরা দলে দলে প্রাসাদ অভিমুখে ধাওয়া করলো। প্রাসাদের প্রহরীরা কোনো বাধা দিলো না, আবার সেপাইদের সঙ্গে যোগও দিলো না। হাচিনসন, ফ্রেসার এবং ডগলাস প্রাসাদে ফিরে এলেন এবং সেখানেই নিহত হলেন। যাজক মিঃ জেনিংস, তাঁর পত্নী এবং কন্যাকেও বিদ্রোহীরা নিহত করলো। বিদ্রোহীরা বাদশাহকে আহ্বান করে নেতৃত্বদান করতে বললো। সম্রাট দারিদ্র্যের কথা বললেন, বুড়ো বয়সের কথা বলে নিরস্ত করতে চেষ্টা করলেন। সেপাইরা সে কথা শুনবে কেনো? তারা তাদের আসল প্রভুর সেবা করতে এসেছে, ধর্ম রক্ষা করতে এসেছে, বেতন এবং প্রমোশনের কথা উঠবে কেনো? কিন্তু তিনি বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ীদের অনুরোধে এখনো বিষয়টি চিন্তা করে দেখবেন। তাঁর বন্ধু এবং ব্যক্তিগত চিকিৎসক হেকিম আহসানউল্লার পরামর্শ অনুসারে আগ্রায় লেফটেন্যান্ট গভর্ণরের কাছে মীরাটের বিদ্রোহ এবং সেপাইদের দিল্লী আগমনের সংবাদ উটযোগে পাঠাবেন কিনা গভীরভাবে চিন্তা করছেন। তিনি দৃঢ়বিশ্বাস পোষণ করছিলেন মীরাট থেকে ইউরোপীয় সৈন্যরা সাহায্যের জন্য ছুটে আসবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেলো, কিন্তু কোনো দিক থেকে কোনো সাহায্য এলো না। অবস্থা প্রতি মুহূর্তে ভয়াবহ আকার ধারণ করছিলো। প্রথমতঃ সম্রাট ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন, কারণ সেপাইরা অশ্বারোহণে ভেতরে ঢুকে তাঁর প্রাসাদের সম্মান নষ্ট করেছে, যে প্রাসাদে ঢুকতে সকল সম্ভ্রান্ত বংশের লোক, এমন কি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর এজেন্টদের পর্যন্ত ঘোড়া থেকে অবতরণ করতে হয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসের মুখে বুড়ো সম্রাট কাবু হয়ে পড়লেন। সূর্য ডোবার পরে তাঁকে স্বেচ্ছায় অনিবার্যকে মেনে নিতে হলো। এ বিয়োগান্তক নাটকে শাহজাদারা কোন্ ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, সে সম্বন্ধে আমরা জানতে পারিনি। স্বভাবতঃই তাঁরা আরো আন্তরিকভাবে সেপাইদের অভিনন্দন জানিয়ে থাকবেন। তাদের বংশের লুপ্তপ্রায় গৌরব পুনরুজ্জীবিত করার একটা সুযোগ পেয়ে সম্ভবতো তাঁরা আনন্দিত হয়ে উঠেছিলেন। তা না হলে তো তাদেরকে সম্রাটের প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে হবে এবং চিরদিনের জন্য সম্রাট পদবী ত্যাগ করতে হবে। সহজেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। মীর্জা মোগল, মীর্জা খিজির সুলতান এবং আবুবকর অবস্থার সবচেয়ে বেশি সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন, ঘটনা পরম্পরা বিচার করলে আমরা তাই দেখতে পাই। মধ্যরাতে একুশটা তোপধ্বনি করে ঘোষণা করা হলো বাবুরের বংশধর আবার স্বহস্তে সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

মীরাটের মতো দিল্লীতে কোনো ইউরোপীয় সৈন্য ছিলো না। দিল্লীর কতেক সেপাই অফিসার কোর্ট মার্শালে সেপাইদের বিচার করেছিলেন। চর্বি মাখানো কার্তুজ হতভাগ্য সেপাই যাদেরকে তারা দণ্ডদান করেছিলো তাদের কাছে যেমন, তেমনি অফিসারদের কাছেও অনুরূপ ভয়ের কারণ ছিলো। আমরা সে দণ্ডিত জমাদারের কর্ম কিভাবে বিচার করবো? সত্যি কি সে রাজদ্রোহের অপরাধী ছিলো? তার প্রাণদণ্ডাজ্ঞা কি আইনসঙ্গত হয়েছে? ধর্মের কারণে শহীদ? নাকি ব্রিটিশ প্রতিহিংসার সময়ের শিকার? সে বিশেষ দলিলটি ইংরেজদের মে মাসের ১১ তারিখে প্রচার করা উচিত ছিলো। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ইংরেজরা করেনি। ঐ একই দিনে ৩৮নং রেজিমেন্ট ব্রহ্মদেশে যেতে অস্বীকার করলো। এ সকল ঘটনা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অনেক সময় দুর্ঘটনাই ইতিহাসের গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে বর্তমানে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানেই রাজাপুর গ্রামে অবস্থিত ছিলো ক্যান্টনমেন্ট। অল্পক্ষণ পূর্বে ব্রিগেডিয়ার গ্রেভস বিপদের আঁচ করতে পেরেছেন। সেপাইরা মারমুখো হয়ে রয়েছে। কর্ণেল রিপ্লের নেতৃত্বে ৫৪নং দেশীয় বাহিনী কাশ্মিরী ফটকের দিকে যাত্রা করলো। তাদের অধিনায়ককে কেটে ফেলা হলো, অফিসারদের গুলী করে মারা হলো, কিন্তু তারা যুদ্ধ করতে স্বীকৃত হলো না। মেজর এ্যাবোট পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারলেন না। দ্বিপ্রহর পর্যন্ত শহরের প্রধান প্রতিরক্ষীরা বাধা দিয়ে আসছিলো। বিকেলবেলা ৩৮নং-এর সেপাইরা তাদের অফিসারদের গুলি করতে থাকে। মহিলাদের কোনো রকমে সঙ্গে নিয়ে অফিসারদের পলায়ন করতে হয়। এ সময়ে শহরে একজনও ইউরোপীয় কিংবা ভারতীয় খ্রীস্টান ছিলো না। দারিয়াগঞ্জ অঞ্চলে ভারতীয় এবং ইউরোপীয় খ্রীস্টানেরা থাকতো। সে এলাকা ছারখার করে দেয়া হলো, প্রত্যেক খ্রীস্টানকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো। ব্যাঙ্ক লুট করা হলো। ম্যানেজার এবং তার পরিবারকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো। স্থানীয় সংবাদপত্র অফিস আক্রমণ করে একজন ছাড়া কম্পোজিটরদের মেরে ফেলা হলো। কিষেণগড়ের রাজার বাড়িতে দুদিন ধরে বহু নরনারী লুকিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো। রাজা তাদের রক্ষা করার জন্য তার বড়ো ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি হয়তো দেরীতে পৌঁছেছিলেন, অথবা সময় মতো এসেও তাদেরকে নিবৃত্ত করতে পারেননি। আত্মগোপনকারীদের সকলকেই নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো। পঞ্চাশজনকে বন্দী করে প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হলো, সেখানে তাদেরকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। অধিকাংশ আশ্রয়প্রার্থী ফ্যাগ স্টাপ টাওয়ারে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো, কিন্তু সেখানে নিরাপদ মনে না করায় তারা রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে পড়লো। কেউ কেউ নিরাপদে মীরাটে এসে পৌঁছালো, কেউ কেউ আমবালা এবং কর্ণাটকের দিকে এগুতে লাগলো। তারা দিনের বেলায় রাস্তার পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতো এবং রাতের বেলায় পথ চলতো। ক্লান্ত পায়ে নানারকম ঘুরতি পথে বহু কষ্ট করে এগিয়ে যেতে লাগলো। গ্রামাঞ্চলের বহু কৃপালু মানুষ তাদেরকে দয়া করে খাদ্য এবং আশ্রয় দান করেছে।

পরবর্তীকালের গৌরবময় বীরত্বই তাদের এ বিপত্তি অতিক্রমণে সাহায্য করেছে। শহর খালি হয়ে গিয়েছিলো, ক্যান্টনমেন্ট পরিত্যাগ করতে হলো, কিন্তু অস্ত্রাগার এখনো পুরোপুরি তাদের দখল থেকে যায়নি। দুর্গরক্ষী ছিলেন নয়জন পরাক্রান্ত ইংরেজ। সকালবেলা স্যার থিওফিলাস মেটকাফ অস্ত্রাগারে এসে দু’টো কামান নিয়ে গোলার সাহায্যে সেতু উড়িয়ে দেবার জন্য এসেছিলেন। কামান স্থানান্তর করার জন্য গরুর গাড়ি পাওয়া গেলো না। ইতিমধ্যে বিদ্রোহীরা সেতু পার হয়ে এসেছে। লেফটেনান্ট উইলোবি অস্ত্রাগার রক্ষা করার জন্য তাঁর সাধ্যমতো চেষ্টা করলেন এবং শেষ পর্যন্ত না পারলে অস্ত্রাগার উড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। ক্যান্টনমেন্ট থেকে তিনি কোনো সাহায্যের প্রত্যাশা করতে পারছিলেন না এবং বাইরের উচ্ছখল জনতা বারে বারে ভীতিপ্রদ হয়ে উঠছে।

তাঁদের আত্মসমর্পণের দাবি জানানো হয় সম্রাটের নামে। অবশেষে জোর করে প্রাচীর অতিক্রম করার জন্য মই আনা হলো। শেষ পর্যন্ত পূর্বসংকেত অনুসারে গোলা নিক্ষেপ করা হলো। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ সেপাইরা সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয়ই রয়ে গেলো। মীরাট থেকে তাদের দমন করার জন্য কোনো সৈন্যসামন্ত এলো না। কোথায় কি ঘটলো, তা সেপাইদের জানা নেই। সম্রাটের কিন্তু দুর্দশার অন্ত নেই। আগে তাঁর জন্য সকল ব্যবস্থা করতে অন্যেরা। এখন তার ঘাড়ে সেপাইদের প্রতিপালন করবার দায়িত্ব এসে পড়েছে। তার বিশ্বস্ত বন্ধু হেকিম আহসান উল্লাহও ছিলেন, সম্রাটের মতো একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ। শাসনকার্যে অভিজ্ঞতা বলতে যা বোঝায় তার একটুকুও ছিলো না। তাছাড়া সেপাইদের ওপর তার আস্থা ছিলো না, সেপাইরাও তাকে বিশ্বাস করতো না। তার দৃঢ় বিশ্বাস শীগগির হোক অথবা দেরীতে হোক ইংরেজ ফিরে আসবেই আসবে। সুতরাং বিদ্রোহে নেতৃত্বদান করতে হলে যে অটুট মনোবলের প্রয়োজন তা তার ছিলো না। সম্রাট ১২ তারিখে সম্ভ্রান্ত মুসলমান রাজপুরুষদের দরবারে আহ্বান করলেন। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ঝিজ্জরের নওয়াবের পিতৃব্যও ছিলেন একজন। একটা শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করার জন্য সকলকে আহ্বান করা হয়েছে। নগরে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে, সেপাইদের রসদ এবং বাসস্থানের সংস্থান করতে হবে। নতুন সেপাইদের ভর্তি করতে হবে। রাজধানীর সর্বত্রই হট্টগোল আর বিশৃঙ্খলা। দুষ্কৃতিকারীরা খ্রীস্টান এবং ইউরোপীয়দের সন্ধান করবার অজুহাতে সম্পদশালী মানুষদের ভয়ানক দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। রাজকোষে টাকা নেই অথচ সেপাইদের ব্যয়ভার মেটাতে অর্থের প্রয়োজন। এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ের মোকাবেলা করার জন্য যে রকমের সাহসী এবং উদ্যমশীল পুরুষের প্রয়োজন ছিলো, দুর্ভাগ্যবশতঃ নব আহূত দরবারে সে রকম মানুষ একজনও ছিলো না। সম্রাটের ‘ আবেদনে যে কাপুরুষেরা কান দেননি, তাতে আশ্চর্য হওয়ার বেশি কিছুই নেই। একজন তো সরাসরি সম্রাটকে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানালেন। সে যাকগে, তারপরে একজন শাসনকর্তা নিয়োগ করা হলো। মীর্জা মোগলকে দেয়া হলো প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব এবং অন্যান্য সম্রাটপুত্রদের উচ্চ সামরিক পদসমূহে বসানো হলো। সম্রাটের মতো, সম্রাটপুত্ররাও উজ্জ্বলতার স্বাদ পাওয়া সেপাইদের মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার উপযুক্ত ছিলেন না। সম্রাট হাতীর পিঠে চড়ে নগর প্রদক্ষিণ করলেন, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্যদের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে আবেদন জানালেন। কিন্তু এতো সহজে আতঙ্ক কাটলো না। প্রাসাদের বাগানে সেপাইরা ডেরা পেতেছে। তারা সকল উপায়ে নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতি করে যাচ্ছে। এ সম্বন্ধে মুন্সী জীবনলাল লিখেছেন। প্রতিটি বাড়ি থেকে আবেদন, নালিশ অনিচ্ছুক সম্রাটের কানে আসতে লাগলো। নিহত ইউরোপীয়দের চাকর-বাকরেরা আবেদন করছে। আবেদন করছে দোকানদার-যাদের দোকান লুট হয়ে গিয়েছে। তৎক্ষণাৎ প্রতিকারের জন্য সকল সম্রাটের দিকে তাকাতে লাগলো। লুণ্ঠন এবং অত্যাচার বন্ধ করার জন্য সম্রাটের কাছে আবেদনের পর আবেদনপত্র আসতে থাকে। সম্রাট যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন কিন্তু একজন দুর্বল অশক্ত অশীতিপর বৃদ্ধের যথাসাধ্য চেষ্টার কীই-বা ফল ফলবে। তিনি সেপাইদের আবেদন করলেন, অনুরোধ করলেন, শেষ পর্যন্ত বিতাড়িত করে দেবার নির্দেশ দিলেন। সম্রাট তো নির্দেশ দিলেন কিন্তু সে অনুসারে কাজ করা হলো না। দুর্বল মানুষের সম্রাট হওয়া সাজে না। শেষ মোগলদের কেউই বিপ্লবী সংগ্রামে নেতৃত্বদানের জন্য উপযুক্ত ছিলেন না।

শেষ পর্যন্ত বেসামরিক এবং সামরিক বিভাগের মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং সকল রকম অব্যবস্থার নিরসন করার জন্য একটি সামরিক এবং বেসামরিক কমিটি বা আদালত গঠন করা হলো। কমিটির সভ্য সংখ্যা ছিলো দশ। তার মধ্যে সেপাইরা দু’জনকে নির্বাচিত করেছিলো, পদাতিক অশ্বারোহী এবং গোলন্দাজ প্রতিটি বিভাগের দু’জন করে প্রতিনিধির সমবায়ে। বাকী চারজনের উপর অর্পণ করা হয়েছিলো বেসামরিক দায়িত্ব। সামরিক প্রতিনিধিদের দায়িত্ব ছিলো সেনাবাহিনীর সবকিছু দেখাশোনা করা। কারা বেসামরিক প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেছিলো এবং সে নির্বাচনের ভিত্তি কি ছিলো তাও জানা যায়নি। কিন্তু সামরিক প্রতিনিধিদের নির্বাচনের বেলায় অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতা বিচার করা হতো সে সঙ্গে সংখ্যাধিক্যের মতামতকেই প্রাধান্য দেয়া হতো। কমিটিকে একজন সভাপতি নির্বাচন করার অধিকার এবং নির্বাচিত সভাপতিকে আরেকটা অতিরিক্ত ভোটের অধিকার দেয়া হয়েছিলো। এই আদালত অথবা কমিটি প্রধান সেনাপতির অধীনে ছিলো। তাঁর অনুমোদন না পেলে কমিটির কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকরী হতো না। প্রধান সেনাপতি দরবারের কোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে না পারলে সে সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার জন্য দরবারে ফেরত পাঠাতে পারতেন। তারপরেও যদি দরবারীরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকতেন, তা হলে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সম্রাটের কাছে পাঠাতে হতো। সম্রাট এবং প্রধান সেনাপতি ইচ্ছা করলেই এ কমিটির সভায় উপস্থিত থাকতে পারতেন। কাগজে কলমে এ কমিটি ছিলো গণতান্ত্রিক, কিন্তু কার্যতঃ তার কোনো প্রভাব ছিলো না বললেই চলে। কখন যে এ আদালত গঠন করা হয়েছিলো, সে সম্বন্ধে সঠিকভাবে কিছু জানার উপায় নেই। কারণ শাসনতন্ত্রে কোনো সন তারিখের উল্লেখ নেই। দিল্লীর পতনের পূর্বেও এ কমিটি সক্রিয় ছিলো। সক্রিয় থাকলে কি হবে, এ কমিটি ক্ষণস্থায়ী সরকারের সেনাবাহিনী অথবা বেসরকারি কর্মচারিবৃন্দের উপর বিশেষ প্রতিপত্তি বিস্তার করতে পারেনি। মে মাসে সম্রাট নতুন বিপদের সম্মুখীন হলেন। ২৮শে মে তারিখের একটি রিপোের্ট মতে সেপাইরা তিনদিন ধরে দিল্লীতে লুঠতরাজ করেছে। তারা বেগম জিনাতমহলকে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে সন্দেহ করতে লাগলো। সম্রাট আশেপাশের জমিদারদেরকে সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহ করতে নির্দেশ দান করলেন। টাকার অভাবে শাসনকার্য প্রায় অচল হয়ে পড়লো। শহরের কোষাগারিকদের পরোয়ানাজারী করে দুর্গে নিয়ে যাওয়া হলো এবং রাজকোষে টাকা দেয়ার জন্য নির্দেশ দান করা হলো। নবনিযুক্ত কোষাগারিক এবং কর্মচারীরা সম্রাটের চাপ সহ্য করতে না পেরে সেপাইদের বেতন মিটিয়ে দেবার জন্য কোনো মতে এক লাখ টাকা আদায় করে রাজকোষে জমা দিলো। এক লাখ টাকাতে সাক্ষাৎ প্রয়োজনের অল্পও মিটলো না। কিছুদিনের মধ্যেই সেপাইরা হায়দারাবাদের একজন সম্পদশালী ব্যক্তির বাড়ি লুঠ করলো। যে সকল কোষাগারিক এবং সম্পদশালী লোকদের সঙ্গে ইংরেজদের বন্ধুত্ব আছে, তাদের আটক করে টাকা আদায় করার কথা ঘোষণা করা হলো। মে মাসের শেষ সপ্তাহে রোহতক থেকে এক লাখ সত্তর হাজার টাকা আসার ফলে অবস্থার অল্প একটু উন্নতি হলো। কিন্তু পরিবেশ এখনো সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের বাষ্পে আচ্ছন্ন।

ইসলামগড় দুর্গের কামানগুলোকে কে বা কারা অকেজো করে দিলো। এ সম্বন্ধে গুজব ছড়িয়ে পড়লো, সম্রাটের বিশ্বস্ত মন্ত্রী এবং বন্ধু আহসান উল্লাহ্ খানের সঙ্গে এর গোপন যোগাযোগ রয়েছে। দিল্লী এবং মীরাটের বিদ্রোহীদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিলো না। তার ফলে অবস্থা আরো ঘোরালো হয়ে উঠলো। মীরাটের সেপাইরা নালিশ করতে লাগলো যে দিল্লীর সেপাইরা স্থানীয় রাজকোষ লুট করে প্রচুর বিত্তের অধিকারী হয়েছে, অথচ তাদের দুঃখ-দুর্দশার সীমা নেই।

ইংরেজ সরকারের প্রস্তুতির অভাবই বিদ্রোহীরা এবং তাদের নেতৃবৃন্দকে দীর্ঘদিন নিশ্চিন্ত থাকার সুযোগ দান করেছিলো। ১২ই মে থেকে ৮ই জুন অর্থাৎ বাদল কি সরাইর খণ্ডযুদ্ধ এবং ঢিলা দখলের পর থেকে দিল্লী দখল পর্যন্ত বিদ্রোহীদের নেতৃবৃন্দ আপন ঘর সামলে নিয়ে চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হওয়ার প্রচুর সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তারা সব সুযোগ নষ্ট করলেন। জুন মাসে দেখা গেলো সেপাইদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরেছে এবং ব্যবসায়ী শ্রেণীর সৈন্যদের প্রতি বিদ্বেষের অন্ত নেই। শাহজাদাদের অত্যাচার থেকে প্রজাদের রক্ষা করার জন্য বৃথাই চেষ্টা করলেন সম্রাট।

ইংরেজ সেনাপতি জেনারেল আনসনের স্বাস্থ্য বিদ্রোহের প্রথম সূত্রপাতের সময় ভালো ছিলো না। অন্যান্য অক্ষম ইংরেজরা যেমন যায়, তেমনি তিনিও হিমালয়ে গিয়ে আরোগ্য লাভ করলেন। দাগসাই, কাসৌলি এবং সুবাতু ইত্যাদি গ্রীষ্মকালীন ঘাঁটিগুলোতে ব্রিটিশ সৈন্য মোতায়েন করা হলো। পাঞ্জাবের কমিশনার জন লরেন্স তখন রাওয়ালপিন্ডি থেকে মারী আসছিলেন। কিন্তু বৈদ্যুতিক তার সেপাইদের বিদ্রোহের খবর জানিয়ে দিলে, তিনি তাঁর কর্মসূচি বদল করলেন এবং তাড়াতাড়ি লাহোর এবং পেশোয়ারে সহকর্মীদের কাছে ফিরে গেলেন। আনসন দাগসাইয়ের ব্রিটিশ সৈন্যদের যাত্রা করতে নির্দেশ করলেন। দেরাদুন থেকে মীরাটে একটি গুর্খা রেজিমেন্ট তলব করা হলো। আমবালার সেপাইরা তখনও সম্পূর্ণ অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ১৬ তারিখে জেনারেল আনসন সেখানে গিয়ে পৌঁছালেন। এখনো সময় আছে, দিল্লী যদি রক্ষা করা যায়, তাহলে হয়তো সমগ্র ভারতবর্ষও রক্ষা করা যেতে পারে। লরেন্স তাড়াতাড়ি অগ্রসর হওয়ার জন্য আনসনকে চিঠির পর চিঠি লিখছেন। কিন্তু আনসনের নিজস্ব অসুবিধা আছে। তাঁকে যানবাহন পেতে হবে, প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র তাঁর হাতে থাকা চাই, তাঁবুর সরঞ্জামপত্রের ব্যবস্থা করতে হবে, তা নইলে সাত মাইল পরিধির একটি সুরক্ষিত নগরী কীভাবে তিনি আক্রমণ করবেন। তদুপরি সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ অফিসারদের কাছে ট্রেনিংপ্রাপ্ত স্বদেশীয় সশস্ত্র সেপাইরা সে নগর রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। এক আঘাতে দিল্লীর দুর্গ প্রাচীর চূর্ণ করা যায় এমন আশা করা কিছুতেই উচিত হবে না। সবচেয়ে সাহসী সৈন্যরাও হাওয়াতে লাফ দিতে পারে না। অসাবধানে যদি কিছু করে বসে, তাহলে সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ত্যাগ করাই হবে সে অসাবধানতার মূল্য। সেজন্য আনসনকে ধীরে ধীরে যেতে হচ্ছিলো। সৈনিক হিসেবে তাঁর নিজের এবং সহকর্মীদের দায়িত্ব তিনি বোঝেন, সেজন্য একজন বেসামরিক কর্মচারির তাড়াহুড়ায় কান দিয়ে সমগ্র পরিকল্পনা বানচাল করতে তিনি রাজী ছিলেন না।

সে সময়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের মনোবলও ভেঙ্গে গিয়েছিলো। শুখাদের নাসিরি রেজিমেন্টকে সিমলার নিকটস্থ জুতোঘে স্থাপন করা হয়েছিলো। অন্যান্য পার্বত্য বাহিনীর মতো তাদেরকেও আমবালা যেতে নির্দেশ দেয়া হলে তারা অবিলম্বে পথ দিতো। কিন্তু তাদের বাকী মাইনে পরিশোধ করা হয়নি। তাদের অবর্তমানে স্ত্রী পুত্রদের খাওয়া-পরার জন্য কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। স্ত্রী-পুত্রদের ভরণ পোষণের কোনো সন্তোষজনক ব্যবস্থা না করে অতোদূরে যাওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলো না। তারা অসন্তুষ্ট হলো, দু’পক্ষে কড়া বাক্য বিনিময় হলো। এমনকি তাদের আচরণে অনানুগত্যও প্রকট হয়ে উঠলো। গ্রীষ্মবাসের ইউরোপীয়েরা শুনতে পেলো গুর্খারা বিদ্রোহ করেছে এবং সিমলার দিকে এগিয়ে আসছে। খবর শুনেই হৈ চৈ পড়ে গেলো। এ গোলমালের মধ্যেও লর্ড উইলিয়াম মে নামক একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মাথা ঠিক রেখেছিলেন। তিনি অরক্ষিত শিশু এবং নারীদের ব্যাংক প্রাঙ্গণে এনে জমায়েত হতে বললেন, যাতে করে বিপদের সময়ে তাদের রক্ষা করা যায়। কিন্তু ভীত-সন্ত্রস্ত আতঙ্কিত ইউরোপীয়দের কেউই তাঁর পরামর্শে কান দিলো না। অল্প সময়ের মধ্যে বিক্ষুব্ধ নগরীর বাইরে চলে যেতে শুরু করলো, যাতে বিদ্রোহীরা তাদের নাগাল না পায়। দুর্ভাগ্যবশতঃ কিছু সামরিক অফিসারও সাহসের পরিচয় দিতে পারেননি। তাঁরা কিয়োন্থালের রাজার সিমলার প্রাসাদ নিরাপদ মনে করতে পারেননি। অধিকতররা নিরাপত্তার আশায় তারা রাজধানীর প্রাসাদের উদ্দেশ্যে ধাওয়া করলেন। মেজর জেনারেল পেনি, লেফটেনান্ট কর্ণেল কিথ, ইয়ং গ্রীথিড, কুইন কোলিয়ার চারজন ক্যাপটেন এবং তিনজন লেফটেনান্ট রাজা সংসার সেনের রাজধানীতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু গুর্খারা সিমলাতে হামলা করলো না এবং পলাতকেরা নিরাপদে ঘরে ফিরে এলেন।

পূর্বদিকে যাত্রা শুরু করার আগে হিওইটের সঙ্গে যোগাযোগ করে মীরাটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা প্রয়োজন মনে করলেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিলো, মীরাটের সৈন্যরা ভগপতে এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দেবে এবং সম্মিলিত বাহিনী দিল্লী অভিযানে যাত্রা করবে। প্রধান সেনাপতির নির্দেশ পেয়ে কিছু সংখ্যক শিখ অশ্বারোহী সমেত লেফটেনান্ট হডসন মীরাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তৃতীয় অশ্বারোহী বাহিনীর বিশজন সেপাইসহ ক্যাপটেন স্যানফোর্ডও পথ দিলেন। অফিসার দু’জনে কেউ পথে কোনো বাধার সম্মুখীন হননি। পাতিয়ালার রাজা, ঝিন্দের রাজা, কর্ণেলের নওয়াব ইংরেজের প্রতি অনুগত থাকতে মনস্থ করলেন এবং তাদের সাধ্যমতো সর্বপ্রকারে ইংরেজদের সহায়তা করতে লাগলেন। ওদের উপর আমবালা থেকে দিল্লী যাওয়ার পথের পাহারা ভার দেয়া হলো। এভাবে নিশ্চিন্ত হয়েই ব্রিটিশ বাহিনী গৌরবময় মুসলিম রাজধানী দিল্লী অভিমুখে অগ্রসর হতে লাগলো। কিন্তু আনসন এতো সহজে দিল্লীতে পৌঁছাতে পারলেন না। গ্রীষ্মকালে উত্তর ভারতের উত্তপ্ত সমভূমির উপর দিয়ে মার্চ করতে ব্রিটিশ সৈন্যরা অভ্যস্ত ছিলো না। সুতরাং দিবাভাগের অধিকাংশ সময় বিশ্রাম করতে হতো এবং রাতে তারা পথ চলতো। শিবিরের স্বাস্থ্যরক্ষা বিধি একেবারেই সন্তোষজনক ছিলো না। কলেরা এবং সর্দিগর্মি রোগে মৃত্যু ছিলো একটি অতি সাধারণ ব্যাপার। ২৭শে মে তারিখে রুগ্ন এবং উৎকণ্ঠিত প্রধান সেনাপতি জেনারেল আনসন মারা গেলেন। তাঁর স্থলে জেনারেল স্যার হেনরী বার্নাড সেনাবাহিনীকে পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।

বার্নাড ছিলেন ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সৈনিক। দিল্লীতে তিনি নতুন এসেছেন। ব্রিগেডিয়ার উইলসনের নেতৃত্বাধীন মীরাট বাহিনী পরিকল্পনা অনুসারে ভগপতে এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলো। গন্তব্যে উপনীত হবার পূর্বে গাজী উদ্দীন নগর এবং হিন্দান নদীর তীরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাদের দু’টি সংঘর্ষ হয়। এতে ইংরেজরাই জয়লাভ করে । ৮ই জুন তারিখে দিল্লী থেকে পাঁচ মাইল দূরে বাদল-কি সরাইতে তারা বিদ্রোহী সৈন্যেদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। সামনাসামনি যুদ্ধে বিদ্রোহীরা পরাজিত হলো এবং ২৪টি কামান তাদের হারাতে হলো। সেপাইরা অধিক সংখ্যক এবং বেশি অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সুযোগ্য সেনাপতির পরিচালনার গুণে ইংরেজেরাই জয়লাভ করলো। তাদের পক্ষে নিহতের সংখ্যা ছিলো চার এবং কয়েকজন আহত হয়েছিলো। সেনাবাহিনীর এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল কর্ণেল চেষ্টারও ছিলেন নিহতদের মধ্যে একজন। সেদিনই বিজয়ী বাহিনী সামনে অগ্রসর হতে থাকে এবং দিল্লীর বহিঃপ্রকারের ধারের নীচু টিলা-শ্রেণী দখল করে। সেপাইদের মধ্যে সাহসের অভাব ছিলো না, কিন্তু তাদের পরিচালনা করার মতো কোনো সামরিক প্রতিভা ছিলো না। তা না হলে প্রচণ্ড সংগ্রাম ছাড়া ইংরেজেরা এসে সহজে টিলা শ্রেণী দখল করতে পারতো না। ব্রিটিশ সৈন্য ১১ই মে তারিখে দিল্লী অভিযান শুরু করে এবং ৮ই জুন এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তারা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।

টিলা-শ্রেণী নগরের উত্তর দিকে অবস্থিত ছিলো। তিনটি প্রধান ফটক নিয়ন্ত্রিত করা যেতো এ টিলা-শ্রেণী থেকে। জেনারেল বার্নাডের সেনাবাহিনী আর কোনো আক্রমণ করেনি বললেই চলে। ১৮৫৭ সালে দিল্লী প্রাচীরের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী কিংবা টিলার ওপরে মোতায়েন বিরোধী সেনাবাহিনী কেউ কাউকে আক্রমণ করেনি। মথুরার রাস্তা খোলা ছিলো। অযোধ্যা, রোহিলাখণ্ড, ঝাঁসী, কানপুর এবং নাসিরাবাদ থেকে দলে দলে বিদ্রোহীরা নগরের ভেতরে প্রবেশ করে সেপাইদের শক্তি বৃদ্ধি করছিলো। এতে তারা সামান্যতম বাধার সম্মুখীনও হয়নি। অন্যদিকে আমবালার সঙ্গে ব্রিটিশ সৈন্যের যোগাযোগও অব্যাহত ছিলো। সে ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার জন্যও বিদ্রোহীরা কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। সুতরাং রসদ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র পেতে ব্রিটিশ সৈন্যদের কোনো অসুবিধা হচ্ছিলো না। টিলা-শ্রেণীর সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করাই হলো বার্নাডের প্রথম কাজ। সোজাসুজি দক্ষিণে যেখানে নগরীর উপকণ্ঠের সবজীমণ্ডির কাছে টিলা ঢালু হয়ে নেমে এসেছে, সেখানে দণ্ডায়মান একখানা পাথরের প্রাসাদ। সে প্রাসাদ হিন্দু রাওয়ের প্রাসাদ নামেই খ্যাত। দৌলতরাও সিন্ধিয়ার নিকট-আত্মীয় মৃত হিন্দু রাওয়ের বাড়িটাতে সে সময়ে কোনো ভাড়াটে ছিলো না। গুর্খা সেনাবাহিনীসহ মেজর রীড এখানেই তাঁর ঘাঁটি স্থাপন করলেন। টিলার বামে ছিলো ফ্ল্যাগস্টাফ টাওয়ার-একটি ইস্টক নির্মিত দ্বিতল গোলাকার অট্টালিকা। সামরিক পর্যবেক্ষণের উপযুক্ত জায়গা। সেখানে কিছু সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন রাখা হলো। টাওয়ার থেকে অল্প দূরেই একটা পুরানো পাঠান মজিদ এবং হিন্দু রাওয়ের প্রাসাদের কাছেই ছিলো একটি মানমন্দির। এ দু’টো অট্টালিকাকেই প্রহরাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হলো। ফ্ল্যাগস্টাফ টাওয়ারের পেছনে নদীর তীরে স্যার থিয়োফিলাস মেটকাফের গ্রামনিবাস। সুরক্ষিত প্রাসাদের মধ্যে থেকে সেপাইরা ব্রিটিশ বাহিনীর বামদিকে আক্রমণ করতে পারতো। লাডলো ক্যাসেল নামে একটি গম্বুজবিশিষ্ট ইস্টক প্রাসাদ থেকে সেপাইরা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মর্মকেন্দ্রে হানা দিতে পারতো। কিন্তু সেপাইরা এ সকল অবস্থানের সুযোগ খুব অল্পই গ্রহণ করেছে। হিন্দু রাওয়ের প্রাসাদে যে প্রচণ্ড আক্রমণ করা হবে সে কথা ব্রিটিশ অফিসারেরা তখনই মাত্র বুঝতে পারলো। নগর আক্রমণ করে শত্রুদের অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরবে কিনা পরক্ষণেই বার্নাডকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলো।

তিন তিনটি পরাজয়ের পর সেপাইরা যে দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করতে পারবে না, এ আশা পোষণ করেছিলো ইংরেজরা। তড়িৎগতিতে মোগল রাজধানী দখল করা এবং মোগল সম্রাটকে পরাজিত করতে পারলে যে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে, তার তুলনা হয় না কোননা। স্যার জন লরেন্স এ ব্যাপারে সেনাপতিকে দুঃসাহস দেখাতে সর্বপ্রকারে প্ররোচিত করতে লাগলেন। রবার্ট ক্লাইভ এবং প্রাথমিক ব্রিটিশ বীরদের নাম প্রবল আশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারিত হতে লাগলো। কলকাতায়ও সকলে বিশ্বাস করতে লাগলো যে দিল্লীর ফটক ভাঙতে পারলেই নগরী অধিকার করা সম্ভব। একবার দিল্লী অধিকৃত হয়ে গেলে অন্যান্য স্থানের বিদ্রোহ সমূলে ধ্বংস করা সম্ভবপর। টিলা-শ্রেণীর ওপরের সেনা শিবিরে জুনিয়র অফিসারেরা এ সকল বিশ্বাসে আস্থাবান হয়ে উঠেন। কিন্তু তাদের সাহস এবং বীরত্বের কোনো পরীক্ষা এখনো হয়নি। ইঞ্জিনীয়ারদের মধ্যে উইলবার ফোর্স গ্রীথিড একটি আক্রমণের পরিকল্পনা খাড়া করলেন, অনেক ভাবনা-চিন্তার পর জেনারেল বার্নাড সে পরিকল্পনা অনুমোদন করলেন। বার্নাডের ভারত সম্বন্ধে কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না। সে জন্য তাঁকে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেই কাল কাটাতে হচ্ছে। এ রকম অবস্থায় যে সামরিক দিকের চাইতে রাজনৈতিক দিকে অধিকতররা গুরুত্বদান করতে হয়, সে সম্বন্ধে তিনি সজাগ ছিলেন। গ্রীথিডের পরিকল্পনা ছিলো রাতের অন্ধকারে নগরের দু’টি প্রধান ফটক উড়িয়ে দেয়া এবং দিবাভাগে শহরের অভ্যন্তরে সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান আক্রমণ পরিচালনা করা। সম্পূর্ণ গোপনীয়তার ওপরেই এ পরিকল্পনার সাফল্য নির্ভর করছিলো। রাতে দু’টি বাহিনীর প্রস্তুতিপর্ব যখন সমাপ্তপ্রায়, সেদিনের ফিল্ড অফিসার ব্রিগেডিয়ার গ্রেভস্ শুধুমাত্র মৌখিক আদেশে অভিযান চালাতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। অশ্বারোহণে তিনি জেনারেল বার্নাডের তাবুতে গেলেন। জেনারেল বার্নাড এ আক্রমণের সাফল্য সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দাবি করলেন। নগর না হয় নেয়া হলো, পরিশেষে কিভাবে তা রক্ষা করা হবে, সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। শিবিরের সকলের চেয়ে গ্রেভস্ দিল্লী সম্বন্ধে অনেক বেশি ওয়াকেবহাল। সুতরাং তার মতামত হাল্কাভাবে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু কোনো রকমে পরিকল্পনার কথা একবার প্রকাশ হয়ে গেলে তার সাফল্যের আশা তিরোহিত হবে। কিন্তু সকলে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন যে ইতিমধ্যে আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে। সুতরাং পরিকল্পনা বাদ দিতে হলো। তার ফলে ভয়ঙ্কর অসন্তোষের সঞ্চার হলো। কেউ পরিকল্পনার সামান্য সমালোচনাও করলো না। পরে অবশ্য সকলেই বুঝেছিলেন, বিজ্ঞোচিত কাজই করেছেন বার্নাড। সে সঙ্কটকালের ব্যর্থতা বড়ো মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারতো। রটন মনে করেন অল্পসংখ্যক সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দিল্লী আক্রমণ করা বোকামীরই পরিচয় হতো। তিনি বলেন, নগরের অভ্যন্তরের শত্রুরা যদি এশীয় না হয়ে ইউরোপীয় হতো তাহলে কোনো জেনারেলই সে সময়ে তাদেরকে আক্রমণ করতে সাহস করতো না।

টিলাতে শিবির স্থাপন করে তিন দিনের ভেতর ব্রিটিশ সৈন্যরা যেমন একটি প্রধান আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিলো, অন্যদিকে সেপাইরাও বসে ছিলো না। চালনা করার মতো সামরিক প্রতিভা না থাকলেও তাদের সাহস এবং উদ্দীপনার অভাব ছিলো না। ৯ই জুন, বাদল-কি সরাইয়ের যুদ্ধের পরের দিন তারা হিন্দু রাওয়ের প্রাসাদে আক্রমণ চালায়, ব্রিটিশের সৌভাগ্যই বলতে হবে, যেদিনই ৫৮০ মাইল অবিরাম মার্চ করে বিখ্যাত ডেলীজ গাইড বাহিনী পেশোয়ারের নিকটস্থ মর্দান থেকে এসে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে। পরের দিন সেপাইরা ব্রিটিশ সৈন্যের সম্মুখভাগে আক্রমণ চালালো। কিন্তু ব্রিটিশ সৈন্য মেটকাফ হাউজ দখল করে তাদের বামদিকের রক্ষণভাগকে নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত করলো। তারপরে উভয় দলের গোলন্দাজদের মধ্যে একদিন গুলি বিনিময় চলে। ১৫ তারিখে সেপাইরা মেটকাফ হাউজ অধিকার করার জন্য আবার আক্রমণ চালায়। কিন্তু তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়া হলো। দুদিন পর তার আরো বেপরোয়াভাবে আক্রমণ চালাতে শুরু করে। তারা হিন্দু রাওয়ের প্রাসাদের নিকটবর্তী ঈদগাঁর প্রাকার ঘেরা ময়দানে একটা ব্যাটারী স্থাপন করতে চেষ্টা করে। বিচক্ষণ বার্নাড বুঝতে পারলেন, ব্যাটারী স্থাপনে সেপাইরা সক্ষম হলে পরে তাদের ডানদিকের রক্ষণভাগের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে দাঁড়াবে। যে কোনো উপায়ে বাধা দিতে সংকল্প গ্রহণ করলেন। ইংরেজদের সৌভাগ্য সেপাইদের কোনো উপযুক্ত সেনাপতি ছিলো না। ঈদগাঁতে ব্যাটারী স্থাপন করতে পারলেও কিভাবে কামান দাগাতে হয়, সে সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান ছিলো না।

১৯ তারিখে ব্রিটিশ সৈন্যদের রক্ষণভাগ ভয়ঙ্করভাবে ভীত হয়ে পড়লো। টমের গোলন্দাজ বাহিনীর পরাজয় এক সময় প্রায় অনিবার্য হয়ে পড়েছিলো। ব্রিগেডিয়ার হোপ গ্র্যান্ট আহত হয়ে পড়লেন। একজন নিঃস্বার্থ মুসলিম ঘোড়সওয়ার তার প্রাণরক্ষা করতে অত্যন্ত সাহসের পরিচয় দিয়েছে। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে অমীমাংসিতভাবেই সেদিনকার সংগ্রাম শেষ হলো। তারপরে শত্রুরা কোনদিকে আক্রমণ করবে সে সম্বন্ধে সেপাইরা কোনো স্থির ধারণা পোষণ করতে পারছিলো না। ব্রিটিশ সৈন্য যদি অনড়ভাবে টিলা-শ্রেণীতে অবস্থান করতো, তাহলে তাদের পাঞ্জাবের যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। সকালবেলা ব্রিটিশ সৈন্য যুদ্ধ করতে এসে দেখে, রাতের অন্ধকারে সেপাইরা সকলেই চলে গেছে। টিলার ওপরের অনেক ইংরেজ অকপটভাবে বিশ্বাস করলেন যে সৃষ্টিকর্তা তাদের পক্ষে। তিনিই রাতের বেলা সেপাইদের নিয়ে গিয়েছেন। ক্লাইভের পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের একশ বছর অতীত হয়ে গেছে। সকলে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতো-এক’শ বছর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানীর রাজত্বের অবসান হবে। সব সময় তারা বেপরোয়া সগ্রাম করলো এবং বিশ্বাস করতে থাকলো ভাগ্য তাদের স্বপক্ষে। মেজর রীড, যার অবস্থান ছিলো হিন্দু রাওয়ের প্রাসাদের নিকটে, ভীষণ বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন কোনো সেনাবাহিনী এর চাইতে কঠোরভাবে সংগ্রাম করতে পারে না। তারা রাইফেল বাহিনী, গাইড বাহিনী, এমনকি আমার পরিচালনাধীন সৈন্যদের উপর আক্রমণের পর আক্রমণ চালাচ্ছিলো। আমার মনে হচ্ছিলো, এই বুঝি হেরে গেলাম। নগরের কামানের অগ্নিবৃষ্টি, এবং যে সকল ভারী কামান বের করে নিয়ে এসেছিলো সেগুলোর ভয়ঙ্কর গোলা বর্ষণের সামনে আমি বারবার অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বিজ্ঞান শেষ পর্যন্ত সংখ্যার ওপর জয়লাভ করলো। মগজের শক্তি পেশীর শক্তির চাইতে অধিক প্রমাণিত হলো। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে প্রতিকূল আবহাওয়া এবং সেপাই-এই দুই প্রবল বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে লড়তে হচ্ছিলো।

২৪ তারিখে নেভিলি চেম্বারলেন ব্রিটিশ শিবিরে এলেন। প্রথমে তাকে পাঞ্জাবের ভ্রাম্যমাণ বাহিনীর অধিনায়কের পদে নিয়োগ করা হয়েছিলো। কর্ণেল চেষ্টারের মৃত্যুর পর এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলের পদ এতোদিন খালি পড়েছিলো। তাঁকে সে পদে বৃত করে পাঠানো হয়েছে। তার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে টিলা-শ্রেণীর উপরের সেনাবাহিনীর মধ্যে নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার হলো। একটি প্রধান আক্রমণ পরিচালনা করে দিল্লী ছিনিয়ে নেয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে উঠলো। উইলবার ফোর্স গ্রীথিড় এখনো তার পরিকল্পনার কাজে রূপদানের জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সেই দিনই তাঁর আপন ভাই হার্ভে তার স্ত্রীর কাছে লিখেছিলেন, নেভিলী চেম্বারলেন এসে পড়েছেন, তার ফলে আমরা সকলে আনন্দিত। এবারে জেনারেল উইলবির দুঃসাহসী পরিকল্পনা কাজে রূপায়িত হতে পারে। জেনারেল বানার্ড সব সময়ে এ সম্বন্ধে আশাবাদী, কিন্তু তিনি আরো সমর্থন চাইতেন। জেনারেল চেম্বারলেনের সঙ্গে লেফটেনান্ট আলেকজান্ডার টেইলার নামে একজন তরুণ ইঞ্জিনীয়ার এসেছেন। কর্ণেল বেয়ার্ড স্মীথের সঙ্গে তাঁকেই সেপ্টেম্বরের চূড়ান্ত আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা সংশোধনের ভার দেয়া হয়েছে। কর্ণেল বেয়ার্ড স্মীথকেও রুঢ়কি থেকে ডেকে আনা হয়েছে। মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করে ২৯শে জুন তিনি দিল্লীর উদ্দেশ্যে পথ দিলেন। পাঞ্জাব থেকে সৈন্য এসে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে। বর্তমানে ইংরেজ দলের সৈন্য সংখ্যা ছ’শ থেকে ছ’হাজারে উন্নীত হয়েছে। পরিস্থিতি সুবিধাজনক, পরিকল্পনা প্রস্তুত, শিবিরে এখন সাহসী সেনাপতির অভাব নেই। হডসন এখন গোয়েন্দা বিভাগের কর্তা। এক চোখ কাণা সৈয়দ রজব আলী শুধু গুপ্তচর বৃত্তিই করছে না শত্রুদের মধ্যে বিভেদের বীজও রোপণ করে চলেছে। বানার্ড জানতে পেলেন বিদ্রোহীরা তাঁদেরও নির্দিষ্ট তারিখ ৩রা জুলাইয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের আক্রমণ করা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ইংরেজদের পরিকল্পনার প্রধান সাফল্য নির্ভর করছে, নিরস্ত্র এবং অপ্রস্তুত অবস্থায় শক্রদের আক্রমণ করার ওপর। সেভাবে যদি আক্রমণ না করা যায় তাহলে এক থাবায় নগর ছিনিয়ে নেয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা নেই। তিনি কোনো ব্যর্থতার ঝুঁকি বহন করতে রাজী ছিলেন না।

দিল্লীর বিদ্রোহী সেপাইরাও আঁটঘাট বেঁধে তৈরি হয়েছে। জুলাইয়ের ১ এবং ২ তারিখে বেরিলীর সেপাইরা এসে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। ২ তারিখে অধিনায়ক বখৃত খান স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সম্রাটকে সহায়তা করার প্রস্তাব দান করলেন। তিনি হচ্ছেন চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন গোলন্দাজ বাহিনীর একজন সুবাদার। তিনি প্রথম আফগান যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ১৮৫৭ সালে আর তার শরীরে যৌবনের সে অমিততেজ ছিলো না। এখন ঘোড়ার পিঠে চড়তে রীতিমতো কষ্ট হয়। জীবনলালের মতো তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশের মানুষ। দিল্লীর সম্রাট এবং তাঁর বংশ একই। কিন্তু জীবনলাল তাকে অন্যত্র অযোধ্যার নওয়াব পরিবারের আত্মীয় বলে বর্ণনা করেছেন। সম্রাটের সঙ্গে বখত খানের গোপন আলোচনার পর মীর্জা মোগলকে সরিয়ে তাকে প্রধান সেনাপতির পদ দেয়া হলো এবং একই দিনে মীর্জা মোগলকে সেনাবাহিনীর এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলের পদে রত করা হলো। সবদিক দিয়ে বিচার করলে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে, প্রধান সেনাপতি হওয়ার যোগ্য কোনো গুণ বখ্‌ত খানের ছিলো না। তিনি তার অধীনস্থ সেনাবাহিনীকে ছ’মাসের মাইনে আগাম পরিশোধ করেছেন। টাকার জন্য সম্রাটকে চাপ দেবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বখ্‌ত খান বেরিলী থেকে প্রচুর টাকা-পয়সা নিয়ে এসেছিলেন এবং তাকে প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ করার কারণে সম্রাট কিছুকাল টাকা-পয়সার ভাবনা থেকে নিশ্চিন্ত হতে পারলেন।

অন্যদিকে আবার সম্রাটের উৎকণ্ঠার অন্ত নেই। শান্তিপ্রিয় মানুষ তিনি, সামরিক প্রবৃত্তিকে শাসনে রাখবার মতো ক্ষমতা তার নেই। সেজন্যই তিনি নগরে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বখৃত খানকে নির্দেশ দান করেছেন। ২৩শে জুনের পরাজয় স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়ীশ্রেণীর মধ্যে আতঙ্কের সঞ্চার করে। সতর্কতা স্বরূপ তারা দোকানপাট বন্ধ করলো এবং ব্যবসাপত্র গুটিয়ে ফেললো। এ অবস্থা কিছুতেই চলতে দেয়া যায় না। তাই ম্রাট জোর করে দোকান-পাট খুলবার নির্দেশ দিলেন। এ নির্দেশ দিয়ে তিনি ভেবেছিলেন, সেপাইরা নগরীর মানুষদের শান্তিতে থাকতে দেবে এবং তাদের যা প্রয়োজন আইনসঙ্গত উপায়ে খরিদ করবে। কিন্তু সেপাইদের তখন শৃঙ্খলা মেনে চলার মতো অবস্থা নয়। ১৪ তারিখে তারা যমুনা দাসের দোকান লুট করলো, কারণ সে নির্ধারিত দামের চাইতে আটার বেশি দাম চেয়েছিলো। ২০ তারিখে সেপাইরা বিল্লী মহল্লাতে লুটতরাজ এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। তাদের হাতে পাহারাগঞ্জ এলাকার অধিবাসীরাও নিষ্ঠুরভাবে লাঞ্ছিত হলো। দু’জন নাগরিক সম্রাটের কাছে এ-মর্মে নালিশ করেছে যে সেপাইরা দাম না দিয়ে জোর করে দোকানের জিনিসপত্র নিয়ে গেছে এবং দরিদ্র মহল্লাবাসীদের ঘরে ঢুকে তাদের বালিশ, বিছানা, ঘটিবাটি সবকিছু জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। বাহাদুর শাহের আর যাই দোষ থাকুক, তিনি সভাবে অমাত্যদের দ্বারা কাজ করাতে চেয়েছিলেন। অশক্ত, বৃদ্ধ এবং দুর্বল হলেও তিনি কখনো কর্তব্য কর্মে ফাঁকি দেননি। পৌনপুনিক নালিশে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ২৭শে জুন তারিখে মীর্জা মোগল এবং মীর্জা খায়ের সুলতানের কাছে লিখলেন। সেপাইরা আসার এবং শহরে ডেরা পাতার একটি দিনও অতীত হয়নি, ইতিমধ্যে পদাতিক সেপাইদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দরখাস্তের স্তূপ জমে গেছে। সম্রাটকে আইন শৃঙখলার রক্ষা করার জন্য যে রাজকুমারদের ওপর সব সময় নির্ভর করতে হতো, তারাও অনেক সময় অন্যের সম্পদ হরণ করার ব্যাপারে সক্রিয় সহযোগিতা করার লোভ সামলাতে পারতেন না। যুগল কিশোর এবং শিও প্রসাদের তারিখবিহীন একটি অভিযোগপত্র থেকে আমরা জানতে পারি, রাষ্ট্রের কর্মচারি এবং শাহজাদারাই তাদের নানাভাবে হয়রানি করে। এতেই লাঞ্ছনার শেষ নয়। সরকারি সেপাই এসে তাদের ঘরবাড়ি লুট করে এবং বেঁধে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখায়। ৪ঠা জুলাই বখত খানের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণের দুদিন পরে আহসান-উল হক নামে এক ব্যক্তি, সম্রাটের নাতি আবু বাকারের বেআইনী কার্যকলাপের কথা উল্লেখ করে সম্রাটের দরবারে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তারপরের দিন সম্রাট প্রথম বাহাদুর শাহের দৌহিত্রী ঈমানী বেগমের মতো একজন মহিলা সম্রাটের কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, আগের রাত মীর্জা আবু বাকার সুরামত্ত অবস্থায় কয়েকজন সওয়ারসহ তাঁকে ধরে নিয়ে যাবার জন্য আসেন এবং রাইফেল আর পিস্তলের আওয়াজ করেন ও মহল্লার কিছু লোককে প্রহার করেন। আবু বাকারকে ধরতে গেলে তিনি তরবারির সাহায়্যে কোতোয়ালকে আহত করেন। তাকে আটক করেন। আরো নানাভাবে অসম্মান করার পর শেষমেষ তাঁর বাড়ি লুঠ করে। খবর শোনার পর সম্রাট ভীষণভাবে কুপিত হয়ে উঠলেন। তার সামরিক পদ কেড়ে নিলেন এবং গ্রেপ্তার করতে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু শাহজাদার পক্ষে শাস্তি এড়িয়ে যাওয়া বেশি কিছু অসম্ভব ছিলো না। সম্রাট শাহজাদাদের সম্মান কেড়ে নিলেন এবং প্রতি মহল্লার প্রধান পাহারাদারদের নির্দেশ দিলেন, শাহজাদারাও যদি আইন ভঙ্গ করে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে, তাহলে তাঁদের সঙ্গেও অন্যান্য দুষ্কৃতিকারীর মতো আচরণ করতে হবে। সম্রাটের অসন্তুষ্টি যে এ সকল অকর্মণ্য যুবকদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পেরেছিলো তার কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।

নগরবাসীরা বিদ্রোহীদের হাতে যেমন, তেমনি যে সকল শাহজাদা সেপাইদের নেতৃত্ব দিতেন, তাদের হাতেও তেমনি একইভাবে লাঞ্চিত হতেন। প্রামাঞ্চলের অবস্থাও ভালো নয়। সে কথা আমরা ১৮৫৬ সালের ২৯শে জুন তারিখে লিখিত সৈয়দ আবদুল্লাহর একখানি অভিযোগপত্র থেকে জানতে পারি, তিনি লিখেছেন, গোটা শস্য বছরের হৈমন্তিক ফসল ধ্বংস হয়ে গেছে। তদুপরি কৃষির প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যেমন লাঙ্গল এবং কুয়ো থেকে জল উঠাবার কাঠের সরঞ্জাম সব সৈন্যরা লুঠ করে নিয়েছে। লুঠতরাজ করে গুর্জরেরা দেশের লোকের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।

শান্তির সময়ে যুদ্ধের সময়ের মতো রাস্তায় বের হতে মানুষ নিরাপত্তাবোধ করতো না। দেশের জনগণ সরকার এবং সরকারি আমলা উভয়ের দ্বারাই লাঞ্ছিত হতে লাগলো। সেপাই নেতৃবৃন্দের এ সকল কাজের সমর্থনে বলা যায় তাদের ইংরেজদের দালালদের বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছিলো। কিন্তু নগর প্রাচীরের অভ্যন্তরে ইংরেজ সমর্থকদের সংখ্যা কম ছিলো। কেউ সন্দেহের উর্ধ্বে ছিলো না। সম্রাটের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং মন্ত্রী হেকিম আহসান উল্লাহ্ খানকে সন্দেহ করা হলো, তাঁকে প্রাসাদের অভ্যন্তরের একটি কক্ষে আটক রাখা হলো। সম্মানী এবং বিত্তবান অনেক ভদ্রলোককে অকারণে সন্দেহ করে হয়রানি করতে লাগলো। পাতিয়ালার মহারাজা হচ্ছেন ইংরেজদের মিত্র, তাঁর সেনাবাহিনী ইংরেজদের যোগাযোগ পথে পাহারা দিচ্ছে। সে সময়ে অজিত সিং নামে পাতিয়ালার মহারাজের এক বৈমাত্রেয় ভাই দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। ১০ই জুন তারিখে কতিপয় সেপাই তাঁকে সম্রাটের কাছে বন্দী করে নিয়ে আসে। আহসান উল্লাহ খান যখন সম্রাটকে বোঝালেন অজিত সিং আর তার ভাইয়ের মধ্যে সদ্ভাব নেই, তখন তাঁকে মুক্তি দিলেন। কুলী খান নামে একজন গোলন্দাজ সৈন্য সম্রাটের পক্ষের বিশিষ্ট লোক বলে পরিচিতি লাভ করেছিলেন, কিন্তু ২৩শে জুন তারিখে সারাদিন যুদ্ধ করে ফেরার সময় তার গোলার আঘাতে তিনজন সেপাই আহত হলো। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ইংরেজের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছে বলে ঘোষণা করে গ্রেফতার করা হলো। ইংরেজদের যদি একবারও পরাজিত করতে পারতো তাহলে পরিস্থিতি একটু সন্তোষজনক রূপ পরিগ্রহ করতো। ভীতি এবং সন্দেহের কারণেই সবদিকে বিশ্বাসঘাতকতা আবিষ্কার করছিলো। সেপাইরা নিরাপত্তাবোধ ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলতে লাগলো।

যদিও ব্রিটিশ সৈন্যদের নৈতিকতা অপেক্ষাকৃত উন্নত, তবুও সেখানকার পরিস্থিতিও ভুল বোঝাবুঝি থেকে মুক্ত নয়। ভারী কামান চালাবার মাল-মশলা সুপ্রচুর নয়। শক্রর অবিস্ফোরিত কামানের গোলাগুলি সংগ্রহ করে আবার শত্রুর প্রতি ছোঁড়া হতো। রটনের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি অল্পসংখ্যক ব্রিটিশ সৈন্য এবং সেপাইদের সংখ্যার স্ফীতির ফলে প্রথম তিন সপ্তাহে যুদ্ধের ভাবী ফলাফল সম্পর্কে কোনো অনুমান করা সম্ভবপর হয়নি। যখন তারা শুনলো স্যার হাফ হুইলার একদল শক্তিশালী সৈন্যসহ পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছেন, তখন তাদের মনে সাহস সঞ্চার হলো। আবার নানা গুজবও কানে আসতে লাগলো। ভারতীয় সেপাইদের আনুগত্যের ওপর কিছুতেই আস্থা রাখতে পারছিলো না। অথচ তারাই জীবন এবং শরীরকে তাদের বিজয়ের খাতিরে নিয়োগ করেছে। শত্রুদের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন সংবাদ থেকে নিশ্চিত ধরে নিলো যে তাদের শিবিরের মধ্যেও বিশ্বাসঘাতক রয়েছে। তিনজন পুরবীয়াকে ফাঁসিকাষ্ঠে লটকাতে হলো এবং গোটা কোম্পানী ভেঙে দিতে হলো। গোটা মাস ধরে বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে সেপাইদের বিদ্রোহের সংবাদ আসতে থাকলো। তদুপরি, প্রধান সেনাপতির নেতৃত্বের ওপর তাদের কোনো ভরসা ছিলো না। কীথ ইয়ং প্রধান সেনাপতি সম্বন্ধে লিখেছেন, “যদিও জেনারেল বার্নাড চমৎকার মানুষ, দয়ালু এবং অত্যন্ত সাহসী তবু এ বুড়ো বয়সে তিনি সেনাপতির চাইতে রোমের পোপ হওয়ারই অধিক যোগ্য। আমার মতে, জেনারেল রীডও এমন কিছু ভালো না, তবে তিনি বিজ্ঞোচিত পদ্ধতিতে কোনো সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করেন । জেনারেল বার্নাড কড়াকড়িভাবে দায়িত্ব পালন করতেন এবং একটুকুও চ্যুতি প্রদর্শন করেনি। ভারতের জল-হাওয়ার সঙ্গে অপরিচিত বুড়ো মানুষটি সর্বক্ষণই শিবিরে কাটাতেন, রাতে একবারও ঘুমোতেন না। অবশেষে অতিরিক্ত শারীরিক চাপ এবং মানসিক দুর্ভাবনায় ৫ই জুলাই তারিখে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। দিল্লীর দরবারে খবর গেলো ইংরেজ সেনাপতি আত্মহত্যা করেছেন।”

জেনারেল রীড স্যার হেনরী বানাডের স্থলে দিল্লী সৈন্যদের অধিনায়ককের পদ অধিকার করলেন। তিনি ছিলেন বলতে গেলে এক রকম অকর্মণ্য। যুদ্ধ করার চাইতে বিছানায় শুয়ে থাকারই অধিক উপযুক্ত। আরো কিছুদিন না গেলে আক্রমণ করে নগর অধিকার করার কোনো কথাই উঠতে পারে না। তাছাড়াও সৈন্যরা রসদের অভাবে কষ্ট পেতে লাগলো। ৮ই জুলাই তারিখে লবণাক্ত প্রতি পাউণ্ড শূয়রের মাংসের দাম আট টাকা এবং অতি প্রয়োজনীয় মোমবাতি প্রতি পাউণ্ডের দাম ছিলো তিন টাকা। অবশ্য অন্যান্য জিনিষপত্রের দাম তুলনামূলকভাবে সস্তাই ছিলো। ৯ তারিখে একদল বিদ্রোহী অশ্বারোহী সৈন্য সাহস করে একটি কামান পাহারা অতিক্রম করে আক্রমণকারীদের পর্যদস্ত করে সেপাইদের কামান ঘাঁটিতে চলে গেলো। সবজীমণ্ডিতে দু’দলের মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ বাঁধে। উভয় দলের ক্ষয়ক্ষতি বিস্তর হয়েছিলো। ব্রিটিশ পক্ষে নিহত এবং আহতদের সংখ্যা ছিল ২২৩ আর সেপাইদের ১৫০০। এই যুদ্ধেই লেফটেনান্ট হিলস্ এবং মেজর টমস্ ভিক্টোরিয়া ক্রস লাভ করেছিলেন।

শিবিরের মালপত্রবাহক নিরীহ লোকেরা ইংরেজ সৈন্যদের রোষানল থেকে রক্ষা পায়নি। তারা ভালোভাবে তাদের প্রভুদের সেবা করতো। অনেক সময় মনিবদের খাবার খাওয়াতে গিয়ে তাদের জীবন-মরণের ঝুঁকি গ্রহণ করতে হতো। তারা অবিস্ফোরিত গোলাগুলি সংগ্রহ করে শুণ্য ভাণ্ডার পূরণ করতো। ব্রিটিশ সৈন্য তাদের ছাড়া এক কদমও চলতে পারতো না।

১৪ তারিখে আরেকটা খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেলো। সেপাইরা হিন্দু রাওয়ের প্রাসাদ এবং সবজীমণ্ডির ঘাঁটি আক্রমণ করলো। নগরের প্রাচীর থেকে সারাদিন প্রবলভাবে গোলাবৃষ্টি করলো। সন্ধ্যার সময় ব্রিগেডিয়ার চেম্বারলেন কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিতে গেলে তিনি ঘাড়ে চোট পেয়ে আহত হয়ে পড়েন। দিল্লীর পতন পর্যন্ত তিনি কোনো আক্রমণ কিংবা প্রতি-আক্রমণে অংশ নিতে পারেননি।

অতি অল্প সময়ের মধ্যে পরপর তিনজন সেনাপতি হারানো-যে কোনো ভারতীয় সেনাবাহিনী সহজে তার ক্ষতিপূরণ করতে পারতো না। কিন্তু ব্রিটিশ সৈন্যরা আঘাত সামলে উঠলো না শুধু, বিপদের সময়ে বলতে গেলে প্রায় বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনীতে শৃখলাও ফিরিয়ে আনলো। বর্তমান প্রধান সেনাপতি আর্কডেল উইলসন শিবিরের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ অফিসার ছিলেন না। ১০ তারিখে রাতে মীরাটের বিদ্রোহের সময়েও তিনি কোনো সাহস কিংবা বীরত্বের পরিচয় দিতে পারেননি। কিন্তু তিনি ছিলেন ধীরস্থির প্রকৃতির মানুষ। গাজীউদ্দিন নগর এবং হিন্দালে সেপাইদের পরাজিত করে তিনি ধীরে ধীরে সেনাবাহিনীতে সুনাম অর্জন করেন। ক্ষমতা বুঝে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেনাশিবিরের দৈনন্দিন কর্মপদ্ধতির প্রতি তিনি মনোযোগী হয়ে উঠলেন। কীথ ইয়ং ২২শে জুলাই তারিখে লিখেছেন, “ব্রিগেডিয়ার উইলসন প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, এখন শিবিরের দৈনন্দিন কাজ আগের তুলনায় দ্রুতগতিতে এবং মসৃণভাবে চলছে। তিনি খুবই দ্র, ধীরস্থির। সব কিছু নিজেই দেখাশোনা করেন এবং তাঁর নির্দেশ পরিষ্কার সুস্পস্ট। আমরা সকলে নিশ্চিন্ত অনুভব করছি যা আমার পূর্ববর্তী সেনাপতির কাছ থেকে পাইনি। তিনি অতি সাবধানী, কিন্তু তাও আবার দক্ষিণপন্থী প্রমাদ। তাঁর সাহসের অভাব সে সময়ে কোনো ক্ষতির কারণ হয়নি, কারণ বিদ্রোহীদের রাজধানী আক্রমণ করার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। হার্ভে গ্রীথিড বিলম্বের জন্য তো খুশি হয়েছেনই, বরঞ্চ প্রাথমিক আক্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করলে আরো বুদ্ধিমানের কাজ করা হতো বলে মনে করেন। ২৯ শে জুলাই তারিখে তিনি লিখেছেন, স্রোতের গতি এখন ফিরতে শুরু করেছে। জোয়ারের ঢেউ আমাদের প্রতিরক্ষার শিলাদৃঢ় প্রাচীরে দুর্বলভাবে আঘাত করেছে। সমস্ত অসুবিধা অপসারিত করার জন্য এ সেনাবহিনী যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা আমি মনে করিনে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেবে। সেনাবাহিনী হয়তো আরো সাহসিকতা এবং বীরত্বের পরিচয় দিতে পারতো, কিন্তু সামান্য রকম ভুলচুকের জন্য মারাত্মক ফলও করতে পারতো। এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, দেরী করলে সাম্রাজ্যের কোনো ক্ষতি হবে না। যে সময়ে প্রচণ্ড হত্যাকাণ্ড চলেছিলো, লুটপাট হয়েছিলো এবং দিল্লী দখল করে নিয়েছিলো, আমি মনে করি সে সকল দিনের উল্লেখ করে লাভ নেই, কারণ আমরা আসার আগেও সেপাইরা দিল্লী অধিকার করে নিয়েছিলো। পূর্বদিক থেকে দুঃসংবাদ আসছে। কানপুরে হুইলারের পরিণতির কথাও তাদের অজানা নয়। তবে আমার কথা, নগরের অভ্যন্তরের অবস্থাও ভালো নয়। খবর আসছে, সেপাইরা মাইনে তলব করছে, না পেয়ে চলে যাচ্ছে দলে দলে, অপমানিত লাঞ্ছিত ব্যাংক মালিক, দোকানদারেরা অধীর আগ্রহে ইংরেজদের প্রত্যাগমনের প্রতীক্ষা করছে। সেপাইদের নেতৃবৃন্দ এবং সম্রাটের পরামর্শদাতাদের মধ্যে মতান্তর চলছে। অস্ত্রশস্ত্রে ঘাটতি এবং সর্বোপরি ঈদের কোরবানী নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিবাদের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

কিন্তু সংবাদ সবগুলো সত্য নয়। বেনিয়ারা যদিও ব্রিটিশ শিবিরে বন্দুকের ঝাঁকুনি দেয়ার ক্যাপ বিক্রয় করছে তথাপি নগরের অভ্যন্তরে গোলাগুলির কোনো অভাব দেখা দেয়নি। বারুদের অভাব পড়েছে এ কথা সত্যি। ১৮ই জুলাই তারিখে অস্ত্রাগারের দারোগা রজব আলী জানাচ্ছেন যে বারুদের অভাব পড়েছে। ২৪শে মে জুলাই তারিখে মুহম্মদ বখত খানও সম্রাটের কাছে একই ধরনের তথ্য পেশ করেছেন। নগরের অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত পরিমাণে সালফার পাওয়া যায় না এবং সেপাইরা যে বারুদ তৈরি করে, তা মানের দিক দিয়ে ব্রিটিশদের তৈরি বারুদের মতো উৎকৃষ্ট নয়। জুলাই মাসের প্রথম দিকে সম্রাট প্রধান সেনাপতিকে কোষাগারিক এবং বণিকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। রাজকোষে আর কোনো টাকা ছিলো না। ঋণ এবং চাদা তুলে আশু প্রয়োজন মেটাবার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিলো। সত্যি সত্যি সম্রাট বৃন্দাবন নামক এক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলেন। রেওয়ারীর রাও তুলারামকে তার এলাকার রাজস্ব আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং অন্যান্য এলাকার রাজস্ব আদায়কারীদের প্রতিও একই নির্দেশ জারী করা হয়েছিলো। জুলাই মাসে সম্রাটের খুব বেশি টাকা প্রয়োজন পড়েছিলো বলে মনে হয় না, কারণ তিনি চাঁদার উপর জোর না দিয়ে ঋণ চেয়েছিলেন। রামজী মল নামে একজন ব্যাংক মালিকের কাছে তিনি লিখেছিলেন, আমি আপনার কাছে কর হিসেবে টাকা চাইনি, ঋণ দিতে বলেছিলাম। দেখুন আমার বন্ধু জ্যোতিপ্রসাদ ইংরেজদেরকে ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম ধার দিয়েছেন, কি অজুহাতে আপনি টাকা দিতে আমাকে অস্বীকার করেন?

এখনো চাঁদা দাবি করা হয়নি। কিন্তু সেপাইরা আইন হাতে তুলে নিয়েছে। তাদের হাতে নাগরিকদের ভোগান্তির অন্ত নেই। আবার যারা ইংরেজের সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহ হতো, তাদেরকে কড়া নজরে রাখাও তাদের কর্তব্য ছিলো। ৭ই জুলাই তারিখে কর্ণেল বেচার কীথ ইয়ং-এর কাছে বল্লভগড়ের রাজা নাহার সিংহের একখানি চিঠি দিলেন। এ পর্যন্ত রাজা রসদপত্র এবং লোকজন দিয়ে দিল্লীর সম্রাটের সহায়তা করে আসছেন। এখন তিনি ইংরেজদেরকেই সাহায্য করবেন বলে নিশ্চয়তা দান করেছেন এবং শিবিরে আসতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। একই অফিসার মাসের শেষ তারিখে ঝুঝঝুরের নওয়াবেরও একখানা পত্র এনে হাজির করলেন। একইভাবে নওয়াবও ইংরেজ শিবিরে এসে সালাম জানাবার বাসনা প্রকাশ করেছেন। প্রধান সেনাপতি বখৃত খান সম্রাটের কাছে অভিযোগ করলেন যে কতেক দুষ্ট লোক রটাচ্ছে। তিনি ইংরেজদের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেছেন। রাও তুলারাম দু’দিকেই হাত রেখেছেন। সম্রাটকে নজর এবং মৌখিক সমর্থন জানাচ্ছেন, আবার অন্যদিকে ইংরেজদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করছেন। যে সকল সামন্ত সম্রাটকে সমর্থন জানিয়েছিলেন প্রকাশ্যে, তারাই আবার সেপাইদের কোনো উল্লেখ্য পরাজয় বরণ করার আগে, গোপনে ইংরেজদের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। এ সামন্তদের বিশ্বাসঘাতকতা বেশির ভাগই অনুদঘাটিত ছিলো।

কোরবানীর ঈদ এগিয়ে আসছে। হডসন একরকম নিশ্চিত আশা করতে লাগলেন যে জামে মসজিদে গরু কোরবানী নিয়ে ধর্মান্ধ মুসলমান এবং হিন্দুদের মধ্যে একটা বিরোধ বাধবে। তাঁর চরেরা খবর দিয়েছে বিরোধ আরম্ভ হয়ে গেছে। গোড়া মুসলমানেরা তাদের ধর্মীয় অনুশাসন পালন করা থেকে বিরত থাকবে না। তাতে করে হিন্দু মুসলমানে যে একটা প্রচণ্ড বিবাদ বাধবে সে সম্বন্ধে ইংরেজরা এক রকম নিশ্চিত ছিলো। দিল্লীর অধিক সংখ্যক মোগল নিজেদেরকে জেহাদী বা ধর্মযোদ্ধা বলে ঘোষণা করলো। টঙ্ক থেকে আগত সেপাইদের সমবায়ে সৈনিক সংখ্যা অনেকগুণে বেড়ে গেলো। জেহাদীরা সামরিক শিক্ষাপ্রাপ্ত সৈনিক ছিলো না। তারা মৃত্যুকে ভয় করতে না বটে, কিন্তু উন্নত ধরনের কোনো যুদ্ধের কৌশলও তাদের জানা ছিলো না। মাথার উপর দিয়ে তলোয়ার ঘোরানো ছাড়া আর কোনো কৌশল তারা জানতো না। তাদের মধ্যে একজন মহিলাও ছিলেন, যিনি কামান দেগে দু’জন ইংরেজ সৈন্যকে ধরাশায়ী করেছেন। বিরোধী সৈন্যের গুলির আঘাতে আহত হওয়ার পর তিনি বন্দিনী হন। এই জেহাদী সেপাইয়েরা সম্রাট এবং তাঁর মন্ত্রীদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের যুদ্ধ না করতেও বলা যায় না, আবার তারা ধর্মযুদ্ধ বা জেহাদ ঘোষণা করেছে তাও উৎসাহিত করা যায় না। লখনৌতে ওয়ালী নিজে জেহাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, কিন্তু দিল্লীতে তা হতে পারে না, কারণ সেপাইদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা প্রচুর এবং প্রভাবশালী মুসলমানেরা হিন্দুদের আলাদা করে রাখতে রাজী ছিলেন না। একই কারণে বেরিলীতে খান বাহাদুর খান গরু জবাই নিষিদ্ধ করেছেন যাতে করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে হিন্দুরাও সহযোগিতা করতে পারে। একথা রক্ষা করার জন্য সম্রাট কি উপায় অবলম্বন করেন সে বিষয়ে সকলে অবাক হয়ে ভাবছিলেন। এটা জানা কথা যে এ সকল বিষয়ে কোনো বিকল্প সিদ্ধান্ত জনসাধারণের সমর্থন লাভ করতে পারে না। হেকিম আহসান উল্লাহ দীর্ঘদিনের প্রথা বন্ধ করতে ভয় পাচ্ছিলেন এবং মৌলভীদের তিনি সবচেয়ে বেশি ভয় করেছিলেন। কিন্তু সম্রাট অপূর্ব সাহসের পরিচয় দিলেন। প্রধান সেনাপতি এবং অপরাপর সামরিক কর্মচারিদের তিনি জানিয়ে দিলেন, ঈদপর্বে নগরের মধ্যে কোনো গরু জবাই হতে পারবে না। যদি কেউ গরু কোরবানী করে তাহলে তাকে তোপের মুখে উড়িয়ে দেয়া হবে এবং কোনো মুসলমান তিনি যেই হোন না কেন গরু জবাই করতে সাহায্য করলে, তাকেও হত্যা করা হবে। ঈদগার ময়দানে একটা ভেড়া কোরবানী করে সম্রাট নিজেই প্রজাদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। সুতরাং আগস্ট মাসের পহেলা তারিখে কোরবানীর ঈদের দিনে কোনো সাম্প্রদায়িক বিবাদ বাধলো না।

সকালে নামাজ পড়া হলো। দ্বিপ্রহর থেকে যুদ্ধ শুরু হলো। সারারাত যুদ্ধ চললো এবং পরের দিন দুপুরেই বন্ধ হলো। কামান থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণ অগ্রাহ্য করে সেপাইরা ব্রিটিশ সৈন্যের রক্ষণভাগে বারবার প্রচণ্ডভাবে হামলা চালাতে থাকে। কিন্তু গুলীর আঘাতের জন্য বারবার তাদের ফিরে আসতে হচ্ছিলো। সেপাইদের সাহসের প্রশংসা করতে হয়, কিন্তু তার পেছনে বিজ্ঞানের শক্তি না থাকায় কিছুই করতে পারলো না। টিলার ওপর ছাউনি পাতা সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর কাছেও তারা ঘেঁষতে পারলো না। তারা দু’মাস ধরে শত্রুদের অসুবিধাজনক স্থান থেকে বিতাড়িত করার জন্য চেষ্টা করে আসছে। সবসময় ডান দিকেই আক্রমণ করেছে। সম্মুখ ভাগে এবং মাঝে মাঝে দু’য়েকবার হামলা মাত্র করা করেছে। সামনে, পিছে, ডান, বাম চারদিক থেকে ঘিরে কখনো শত্রুর ওপর আক্রমণ করেনি। নতুন কোনো সেপাইদল দিল্লীতে এসে পৌঁছালেই তাদের ব্যর্থতা এবং বুদ্ধিহীনতার পরিচয় দেয়ার জন্য টিলার ওপর আক্রমণ চালাতো। আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য কোনো সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিলো না এবং অভিযান সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য কোনো সামরিক প্রতিভার সত্যিই অভাব ছিলো। সংখ্যার দিক দিয়ে বেশি হওয়া অনেক সময় শক্তিবৃদ্ধির কারণ না হয়ে অসুবিধার কারণ হয়েই দাঁড়ায়। শিক্ষিত সৈন্যদের সঙ্গে উচ্ছল সৈন্যদের মেশামেশি ঘটলে সাফল্যের বদলে ব্যর্থতাকে বরণ করতে হয়। বারবার পরাজয়ের ফলে তাদের সাহস কমে গেছে এবং সেপাইরা উচ্চতর মহলের বিশ্বাসঘাতকতা আবিষ্কার করার কাজে নিজেদের নিয়োগ করেছে। আগস্ট মাসের ৭ তারিখে অস্ত্রাগার বিস্ফোরণ হওয়ার পর তারা হেকিম আহসান উল্লাহ্কে বিশ্বাসঘাতক বলে সন্দেহ করতে লাগলো।

প্রথম থেকেই হেকিম আহসান উল্লাহর কোনো সহানুভূতি ছিলো না সেপাইদের প্রতি এবং সেপাইরাও এ কথা জানতো। কিভাবে বিস্ফোরণ ঘটেছে কেউ জানে না। হতে পারে একটা দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা, অথবা ইংরেজদের কোনো লোক ইচ্ছাকৃতভাবে এ নাশকতামূলক কাজ করেছে। কিন্তু হেকিমের অস্ত্রাগার পরিদর্শন করার পরেই বিস্ফোরণ ঘটে। ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে তাকে সন্দেহ করা হলো। হেকিমের বাড়ি আক্রমণ করে যখন তালাস করা হলো, সন্ধিসূচক একখানি চিঠিও পাওয়া গেলো। কুপার বলেন, “হেকিমকে সন্ধিপ্রার্থী হিসেবে প্রমাণ করাবার জন্যই রজব আলী চক্রান্ত করে পত্রখানা তার বাড়িতে রেখেছিলো।” হেকিমকে যে তারপরে কয়েদ করা হবে সে তো একদম জানা কথাই। অবশ্য জীবনলাল বলেছেন সম্রাট বিশ্বস্ত বন্ধুকে প্রাসাদের কোনো গোপন কক্ষে লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু সম্রাটকে আবার হেকিমকে সেপাইদের হাতে সমর্পণ করতে হলো। হেকিমের পরিবার-পরিজনেরা আগে থাকতেই পলায়ন করেছিলো।

সম্রাটের এ রকম বিশ্বস্ত পরামর্শদাতার বিশ্বাসহানির ফলে সেপাইদের নৈতিক বল হ্রাস পেয়েছিলো এবং দরবারের প্রতি শ্রদ্ধাও তারা হারিয়ে ফেললো। সেপাইরা জানতো যে এ ব্যাপারে সম্রাট ও হেকিমের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। তিনি জুন মাসের পয়লা থেকেই ইংরেজদের সঙ্গে পত্রালাপ শুরু করেছেন। কিন্তু সম্রাট একাকীই তার সৈন্যদলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা এবং ধর্মহানির অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন। সেপাইদের বিদ্রোহ তার বহুদিনের লালিত পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিয়েছে। তিনি তাঁর পুত্র জওয়ান বখৃতকে সিংহাসনে বসাবার চেষ্টা করে আসছেন। দু’জন প্রতিদ্বন্দির স্বাভাবিক অথবা অস্বাভাবিক মৃত্যু তার সংকল্পের পথ অনেকটা পরিষ্কার করে দিয়েছে। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে রাজী করাতে পারলেই জওয়ান বখৃতকে সিংহাসনে বসিয়ে সম্রাট উপাধিতে ভূষিত করা অসম্ভব হবে না। বিদ্রোহের কারণে মীর্জা মোগল এবং অন্যান্য জ্যেষ্ঠ শাহজাদারাই পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছেন। ইংরেজরা পরাজিত হলে সেনাবাহিনী সম্রাট হিসাবে মীর্জা মোগলকেই পছন্দ করবে, জওয়ান বখৃতকে নয়। মীর্জা ইলাহী বক্স ইংরেজের স্বপক্ষে প্রাণপণে কাজ করছিলেন। হতে পারে হেকিম আহসান উল্লাহ্ এ সময় তাঁকে সহায়তা করে থাকবেন। এ যোগাযোগের ব্যাপারে মৌলবি রজব আলীর সক্রিয় ভূমিকাই সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য। পরিকল্পনা ছিলো অতি সরল। ইংরেজরা সম্রাটকে আগের মতো বৃত্তি দিতে এবং প্রাসাদে অবস্থান করতে দিতে রাজী হয়েছেন। বিনিময়ে সম্রাটের লোকেরা নৌকার সেতু উড়িয়ে দেবে, যাতে করে অশ্বারোহী বাহিনীকে পরাজিত করা যায়, তারপর পদাতিক বাহিনীকে পরাজিত করে ইংরেজরা নগরীতে প্রবেশ করবে। বর্তমানে ব্রিটিশের সামরিক অবস্থা অনেক সুবিধাজনক এবং তারা দুর্বল মুহূর্তে এ সকল যোগাযোগ করছিলো। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বিজয়লাভ সম্বন্ধে নিশ্চিত হলে সে সকল প্রস্তাব কানেও নিলো না।

ঠিক কখন সম্রাট এবং ইংরেজদের মধ্যে আবার নতুন করে যোগাযোগ শুরু হলো সে সম্বন্ধে নিশ্চিত করে বলা যায় না। ৬ই আগস্ট তারিখের একখানা পত্রে গ্রীথিড স্যার উইলিয়াম মুইরকে জানাচ্ছে, মেটকাফ ডাকযোগে সম্রাটের একখানা চিঠি পেয়েছেন এবং তাতে সম্রাট তাঁর শারীরিক কুশল জানতে চেয়েছেন। এতে কোনো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ২০শে আগস্ট গভর্ণর জেনারেলের কাছে সম্রাটের প্রস্তাব এসেছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়লো। এডমনস্টোন কলভিনকে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে এ তথ্য ওয়াকেবহাল করেছিলেন। সম্রাট দিল্লীর সেনাবাহিনীর প্রধানের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন যে দিল্লী এবং মীরাটে বিদ্রোহের আগে সম্রাট যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন, তা মেনে নিলে হয়তো নতুন করে আপোষ করার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু গভর্ণর জেনারেল মনে করেন সম্রাটকে আগের সুযোগ-সুবিধা দান করার ব্যাপারে বর্তমানে এ সরকার কিছুতেই সমর্থন প্রদান করতে পারে না। ২৭শে আগস্ট মুইর হ্যাভলকের কাছে লিখেছেন, মিঃ গ্রীথিডের কাছ থেকে দু’খানা কি তিনখানা চিঠি পেয়েছেন। তাঁরা সাহায্য করার প্রস্তাব করেছেন, কিন্তু তাঁদের কোনো জবাব দেয়া হয়নি। গ্রীথিডের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে শাহজাদারা ব্রিগেডিয়ার উইলজনের সাথে পত্রালাপ শুরু করলেন। সে সম্বন্ধে পরে মুইর হ্যাভলককে বলেছেন, “কয়েকজন সম্রাট পুত্র সহায়তা করার যে প্রস্তাব করেছেন মিঃ গ্রীথিড তা সরাসরি বাতিল করে দিয়েছেন। অন্যভাবে সম্রাট পুত্রেরা আবার জেনারেল উইলসনের কাছেও একই প্রস্তাব করেছেন। সেতু ধ্বংস করে অশ্বারোহী বাহিনীর সাহায্যে পদাতিক বাহিনীকে পরাজিত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, কিন্তু তার বিনিময়ে সম্রাট পরিবারের পূর্ব সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। জেনারেল উইলসন প্রাসাদের সঙ্গে কোনো রকম পত্রালাপ করতে সরাসরিই অস্বীকার করলেন। সুতরাং অনুমান করতে কষ্ট হয় না, বিশ্বাসী অনুচরগণের মাধ্যমেই কথাবার্তা হতো। চিঠি লেখার পথ তাঁরা এড়িয়ে চলতেন। ২১শে আগস্ট সম্রাটের প্রধানা মহিষী বেগম জিনাতমহলের পক্ষ থেকে একজন দূতকে পাঠানো হলো। তিনি প্রস্তাব করেছেন সম্রাটের সঙ্গে ইংরেজদের আপোষ মীমাংসার জন্য তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব কাজে খাটাতে পারেন। গ্রীথিড বলেছেন, “আমরা ব্যক্তিগতভাবে তার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করলাম, কারণ মহিলা এবং শিশুদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিবাদ নেই। কিন্তু জানিয়ে দিলাম সম্রাট প্রাসাদের কারো সঙ্গে আমরা কোন যোগাযোগ রাখতে ইচ্ছুক নই। মহিষীকে সন্দেহ করা হলো, তার ষড়যন্ত্রের সবটা জানতে পারলে তাকে ছেড়ে দেবে না। সেপাইদের প্রতি সম্রাটের কোনো ভালো মনোভাব যে ছিলো না, সে তো এক রকম জানা কথাই। ব্রিটিশ সৈন্যদের বারবার চেষ্টা করেও টিলাশ্রেণী থেকে তাড়িয়ে দিতে না পারায় তাদের পারঙ্গমতার প্রতি সম্রাটের কোনো বিশ্বাসই রইলো

এবং প্রকাশ্যেই অভিযোগ করলেন, পাঁচ’শ বছর ধরে যে সাম্রাজ্য চলে আসছে, তারা সে সাম্রাজ্যের পতন ডেকে এনেছে। হেকিম আহসান উল্লাহকে কয়েদ করা হলে তিনি আত্মহত্যার ভয় দেখালেন। সামরিক অত্যাচার থেকে নগরের লোকদের রক্ষা করতে না পারার জন্য তিনি প্রকাশ্যে দুঃখ করতেন। অনেক সময় তিনি কাবের কথা উল্লেখ করতেন এবং প্রাসাদ ও পদবী চিরতরে ছেড়ে দিয়ে মক্কা শরীফ গিয়ে অবস্থান করার কথাও উল্লেখ করতেন। শাহজাদারা তাকে মানতেন না। সেপাইরা তাকে অপমান করতো। মাঝে মাঝে তিনি কবিতা রচনা করে শান্তি খুঁজে পেতে চেষ্টা করতেন।

একবার তিনি লিখলেন–

‘কাফন বস্ত্রে শরীর ঢেকে
শেষ দিনগুলো আমি কোনো বাগানে একাকীই কাটিয়ে দেবো।’

কিন্তু ভাগ্য তার জন্য কি রেখেছে তা জানতেন না। মহিষী এবং শাহজাদারা আশা করছেন যে তাদের আগের অবস্থায় ফিরে গিয়ে নিরাপদে জীবনযাপন করার এখনো সুযোগ আছে।

পত্রালাপ এবং প্রস্তাব বিনিময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। সমস্ত ব্রিটিশ সৈন্যের বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার আরো কারণ ছিলো। ব্যবসায়ীরা এখন আবিষ্কার করলো যে টিলা হচ্ছে ব্যবসায়ের জন্য একটি খাসা জায়গা। সেপাইরা যে সকল জিনিসপত্রের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন থেকে অনুভব করে আসছিলো, ব্যবসায়ীরা সে সকল জিনিসপত্র নিয়ে দোকান খুলে বসলো। ১৮ তারিখে কীথ ইয়ং তাঁর স্ত্রীর কাছে লিখেছেন, “তোমাকে আমি বলেছি কি পিক এণ্ড এ্যালেন এখানে অনেক প্রতিনিধি পাঠিয়ে অনেকগুলো দোকান খুলে দিয়েছেন। শিবিরে দু’জন পার্সি ব্যবসায়ীও আছেন। জাহাঙ্গীর এবং কাওয়াসজী নামে এ দু’জন ব্যবসায়ীর বিক্রয়ের প্রচুর জিনিসপত্র মজুত রয়েছে। বিশেষ করে, বীয়ার, ব্রাণ্ডি এবং সোডা ওয়াটার। প্রথমে প্রতি ডজন বীয়ারের বোতলের জন্য ২৩ টাকা দাবি করছিলো, কিন্তু পরে তাঁরা সেরা ইংলিশ পানীয় ৫ টাকা ডজনে বিক্রয় করতে রাজী হয়েছে। সদর দফতরের মেস একশো ডজন ঐ দামে খরিদ করেছে।” লাভের আশায় পার্সিরা দোকান পেতেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের আগমনের ফলে ইংরেজরা নিশ্চিত হলো যে রাস্তাঘাটে এখন সেপাইদের উপদ্রব নেই।

বিদ্রোহী সেপাইরা আকাঙ্খিত বিশ্বাসঘাতকতার কথা কিছুই জানে না, তাই এখনো সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আশা পোষণ করে। আগস্ট মাসেও টিলার ওপরে শিবিরের ইংরেজদের কোনো অসুবিধা পোহাতে হলো না। বরং তার নতুন আশা এবং উদ্দীপনায় অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেছে। ৭ তারিখে জন নিকলসন তাঁর বাহিনীর আগে অশ্বারোহণে শিবিরে এসে পৌঁছেছেন। মানসিক দিক দিয়ে নিকলসন ছিলেন বীরত্বের গৌরব-গাঁথার যুগের মানুষ। দুর্দান্তভাবে সাহসী এবং যমের মতো নির্মম। একখানা মাত্র তলোয়ার হাতে তিনি সবচেয়ে হিংস্র বাঘের মুখোমুখী দাঁড়াতে পারতেন। তিনি ক্লান্তি কাকে বলে জানতেন না। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে সুদীর্ঘ পথ অশ্বারোহণেও তিনি এতোটুকু শ্রান্ত হয়ে পড়েননি। নানা অসুবিধার মধ্যেও যুদ্ধ করবার জন্য তিনি প্রস্তুত। বিদ্রোহীদের প্রতি তার মনে কোনো দয়া কিংবা অনুকম্পার স্থান ছিলো না। আনন্দিত মনে সেপাইদের হত্যা, তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালাননা এবং স্ত্রী ও শিশুকে নির্মূল করার অনুমতি দিতে পারতেন তিনি। তাঁর সমসাময়িক অন্যান্যদের মতো তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান খ্রীস্টান। সীমান্তে তাঁকে সবাই যেভাবে ভয় করে এবং তিনি যে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন, তাতে করে দেবতা হয়ে উঠেছেন। ভারত এবং ভারতের অধিবাসীদেরকে তিনি পছন্দ করতেন না। চেম্বারলেনের স্থলাভিষিক্ত হতে যখন তাঁকে আহ্বান করা হলো তাঁর বয়স মাত্র পঁয়ত্রিশ। যদিও তখন তিনি সেনাবাহিনীর মাত্র একজন ক্যাপ্টেন, তাঁকে ব্রিগেডিয়ারের পদ প্রদান করা হলো। তিনি পিলাউয়ের সেপাইদের নিরস্ত্র করে এবং শিয়ালকোট থেকে বিদ্রোহী সেপাইদের তাড়িয়ে দিয়ে নিজেকে সে পদের যোগ্য বলে প্রমাণিত করেছিলেন। তিনি তাঁর সেনাবাহিনীর পূর্বেই আমবালা থেকে যাত্রা করেছিলেন দিল্লীতে জেনারেল উইলসনের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। ১৪ তারিখে ২ হাজার ৪’শ জন পদাতিক সৈন্য, ৬টা কামান এবং কিছু সংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্য দিল্লীতে এসে পৌঁছালো।

নিকলসনের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই একটি প্রধান আক্রমণ করার কথা আবার জীবন্ত হয়ে উঠে। নিকলসন ছিলেন গরম মানুষ, তখন আক্রমণ করতেই তিনি প্রস্তুত ছিলেন। অস্ত্রশস্ত্রের সম্পূর্ণ উপস্থিতি, কামানের ব্যাটারী পোঁতা এবং শত্রুদের অবস্থান সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান অর্জন, ইত্যাদি ছাড়া অন্য কোনো অজুহাতে অপেক্ষা করার মানুষ তিনি ছিলেন না। কিন্তু উইলসন তখনও মনস্থির করে উঠতে পারেননি। তখন একমাত্র তিনিই ভালোভাবে জানতেন যে একবার ব্যর্থ হলে তার সেনাবাহিনীর নয়, সমগ্র ভারত সাম্রাজ্যে তাঁদের প্রভুত্বের অবসান ঘটবে। এতোদিন পর্যন্ত পাঞ্জাব শান্ত ছিলো, কিন্তু সেখানেও এখন বিদ্রোহের দোলা লাগতে শুরু করেছে। প্রত্যেক গ্রামে ব্রিটিশ-বিরোধী প্ল্যাকার্ড পোঁতা হয়েছে। বোম্বাইয়ে প্রচণ্ড তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। এই বুঝি ভারতবর্ষ ইংরেজদের হাত থেকে সরে পড়লো। উইলসনের প্রকৃতিতে বীরত্ব ছিলো না। তাই স্বভাবতঃই ভাগ্যকে নিয়ে জুয়া খেলতে তিনি রাজী ছিলেন না। বিজয় লাভ সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হলেই তিনি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নগরের ভেতর থেকে সংবাদ পেয়েছেন, বিদ্রোহী সেপাইদের সংখ্যা ব্রিটিশ সৈন্যদের চাইতে চল্লিশগুণ বেশি। চরম সঙ্কটের দিনে শত্রুরা যদি সম্মুখভাগে আক্রমণ করতো তাহলে প্রকৃত প্রস্তাবে উইলসনকে শত্রুদের হাতে শিবির ছেড়ে দিয়ে পলায়ন করতে হতো। কেননা ব্রিটিশ সৈন্য সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সে সময়ে সেপাইরা একটু বুদ্ধি করে আক্রমণ করলে সহজেই ব্রিটিশ বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দিতে পারতো।

নিকলসনের সৈন্য যেদিন পৌঁছলো, সেদিন কিছুসংখ্যক সেপাইকে মার্চ করে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো। অবশেষে সেপাইরা অনুভব করেছে যে তাদের আক্রমণ করার প্রাথমিক পর্যায়ে বার্নাডের সময়ে হাজার চেষ্টা করেও দূর এলাকার সেনাবাহিনীর যোগাযোগ-ব্যবস্থা রক্ষা করতে পারেনি। সেপাইরা পুরোপুরি সাফল্যের সঙ্গেই ইংরেজ সৈন্যের পাঞ্জাব থেকে রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে পেরেছিলো। ঝিন্দের সৈন্যরা নৌকার সেতু রক্ষা করতে পারেনি। দিল্লীর সেপাইরা তা মিসমার করে দিয়েছিলো। এ ব্যাপারে পাতিয়ালার সৈন্যরাও কোনো সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেনি। কিন্তু বর্তমানে অবস্থান সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। নতুন সংগৃহীত দু’শ সৈন্যসহ হডসনকে সৈন্যদের ওপর দৃষ্টি রাখতে নির্দেশ দেয়া হলো। কিন্তু হডসনও এ যুগের মানুষ ছিলেন না। মধ্যযুগে হয়তো তিনি সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব বলে পরিচিত হতে পারতেন। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে যারা তাঁর যোদ্ধা মনোবলের প্রশংসা করতেন, তারাও তার দম্ভকে পছন্দ করতেন না। তাঁর নিজ মাতৃভূমির সেবা করতে গিয়ে আপন স্বার্থোদ্ধারের কথাও ভুলে যাননি তিনি। তাঁর সাহসিকতা এবং অপরাজেয় শৌর্য যেমন একদিকে অনেক ভালো লোকের বন্ধুত্বলাভে সাহায্যে এসেছে তেমনি তার খেয়ালী নির্মমতার কারণেই অনেকে আবার তার ওপর বিরূপ ছিলেন।

হডসনের অনিয়মিত অশ্বারোহী বাহিনীর এখনো বিশৃঙ্খল অবস্থা। শিখ, পাঞ্জাবী, পাঠান, মুসলমান, আফ্রিদি, সীমান্তের অন্যান্য গোত্রের লোক, এমনকি হিন্দুস্থানী সেপাইরা এখনো ইংরেজের প্রতি অনুগত রয়েছে, তাদের সকলকে নিয়েই এ পাঁচমিশেলী অশ্বারোহী বাহিনী গঠন করা হয়েছে। তাদের নিয়ে হডসন প্রথমে একটি সুরক্ষিত গ্রামে আশ্রয়গ্রহণকারী কতিপয় অশ্বারোহী সেপাইকে আক্রমণ করেন। কিন্তু তারা ইংরেজদের প্রতি অনুগত ছিলেন না। বিদ্রোহের পরে ভয়ে ডিউটিতে যেতে পারেনি। প্রথম অনিয়মিত অশ্বারোহী বাহিনীর একজন স্বদেশী অফিসার হডসনকে অভ্যর্থনা জানাতে এলেন, কিন্তু তাঁকে তখনই গ্রেফতার করা হলো। এ খবর শুনে অন্যান্য অশ্বারোহী সেপাইরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। তারা ছোটো ছোটো অট্টালিকাসমূহের মধ্যে আত্মগোপন করে রইলো। সমগ্র গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হলো এবং একজন বাদে অপর সকলকে হত্যা করা হলো।

তারপরে হডসন রোহতকের দিকে যাত্রা করলেন। কাছেই একটা পুরোনো দুর্গ, যেখানে বেশকিছু সশস্ত্র অশ্বারোহী সেপাই অবস্থান করছিলেন। হডসন শহরে গেলেন। শহরের লোকেরা আপন পৌরসীমার মধ্যে শত্রুকে আক্রমণ করা অধর্মের কাজ মনে করে, তার সৈন্যদলের রসদপত্র যোগাড় করে দিলেন। হডসন তাদের নগর সীমার বাইরের যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাবার জন্য এক ফন্দী আঁটলেন। তিনি প্রত্যাবর্তনের ভান করলেন। রোহতকের অশ্বারোহীরা যখন পেছন পেছন বেরিয়ে এলো, তার সেনাদল তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের পরাজিত করে। চারদিনের মধ্যে দু দু’বার বিজয় অর্জন করে তিনি দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করলেন। তিনি যেভাবে বিদ্রোহীদের দমন করেছেন, সেজন্য শতমুখে তার প্রশংসা করতে লাগলো সকলে।

ব্রিটিশরা দেখলো যে নগরের অভ্যন্তরে তাদের গোপন বন্ধু থাকলেও আপন সেনাবাহিনীর মধ্যেও বহু গুপ্ত শত্রু রয়েছে। হিন্দু রাওয়ের প্রাসাদের কাছে একটি ষড়যন্ত্র ধরা পড়লো। দু’টি কামানের বারুদের মধ্যে নুড়িপাথর দিয়ে অকেজো করে দেয়ার চেষ্টা করা হলো। এ খবর কাউকে জানানো হয়নি। খালাসীদের মধ্যে কয়েকজন কামান দাগতে না পারার জন্য অথবা দাগলেও গোলা যাতে আশানুরূপ দূরে গিয়ে না পৌঁছে সেজন্য বারুদের সঙ্গে নুড়ি পাথর মিশিয়ে দিয়েছে। তাদের দু’জনকে ফাঁসিতে লটকানো হলো। জেনারেল উইলসন সবসময় ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর লোকদের সন্দেহ করতেন এবং তাদের অনেকেই ছিলো পুরবীয়া। ভাগ্যের এমন পরিহাস, তিনি সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় সৈন্যদের বাদও দিতে পারেন না, আবার তাদের বিশ্বাসও করতে পারেন না। কীথ ইয়ং-এর মতে, এ পর্যন্ত গুর্খা এবং পাঞ্জাবীদের সন্দেহ করার মতো কিছু ঘটেনি। কিন্তু শিখদের কথা বলা যায় না। তারা যেমন নগরের ভেতরে আছে, তেমনি বাইরেও আছে।

সেপাইরা এখন মর্মে মর্মে আসন্ন ভয়ঙ্কর বিপদের কথা উপলব্ধি করছে। তারা জানতে পারলো যে অবরোধ করবার জন্য সেনাবাহিনী পথ দিয়েছে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবরোধ ব্যর্থ করে দেবার জন্য তারা অনেক দিন থেকে চেষ্টা করে আসছে। মাঝপথে যদি আগত বাহিনীকে বাধা দিয়ে বিচ্ছিন্ন করা যায়, তাহলে আরো কিছুদিনের জন্য রাজধানী রক্ষা করা সম্ভবপর হবে। সুতরাং তারা ২৪শে আগস্ট তারিখে ১৮টি কামান নিয়ে যাত্রা করলো কিন্তু তাদের অভিযানের কথা গোপন রইলো না। প্রকৃত প্রস্তাবে, ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ এত তৎপর ছিলো যে নগরীর অভ্যন্তরের যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ইংরেজ সদর দফতরে এসে অবশ্যই পৌঁছাতো। পরের দিন নিকলসন ২ হাজার পদাতিক এবং ১৬টি অশ্ববাহী কামানসহ তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলেন। দুর্গম পথ, আবহাওয়া আর্দ্র। বালু এবং কাদার মধ্য দিয়ে ১৬টা কামান টেনে টেনে নিয়ে যাওয়া খুব সহজ কাজ ছিলো না। কিন্তু নিকলসন ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সেপাইদের তিনি কামান টেনে নেয়ার কাজে নিয়োজিত রাখলেন। নজফগড় খালের ওপারে তিনি শত্রুদের দেখা পেলেন এবং শত্রুর শিবির আক্রমণ করতে মনস্থ করলেন। কামানের গোলা বর্ষণ উপেক্ষা করে ব্রিটিশ সৈন্য সামনে এগুতে লাগলো। কামান থেকে মাত্র ত্রিশ গজ দূরে ব্রিটিশ সৈন্য এসে পড়েছে। এখনো যুদ্ধ শেষ হয়নি। কিন্তু সঙ্গীন আক্রমণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেপাইরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করতে আরম্ভ করলো। আর কিছুসংখ্যক একটি গ্রামের কাছে ছাউনি পেতে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছিলো। সেদিনের জন্য যুদ্ধ বন্ধ হলো। কিন্তু রাত্রির অন্ধকারে সেপাইরা সে গ্রাম ছেড়ে পলায়ন করলো। নিকলসনের কাজ শেষ হয়েছে, তিনি আবার টিলার ওপর চলে এলেন। আশ্চর্যের বিষয়, আগত সৈন্যদলকে বাধা দেবার জন্য দিল্লী থেকে আর কোনোও প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি। ৩রা সেপ্টেম্বরে ৩০টি ভারী কামান এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রসহ নতুন সৈন্যদল দিল্লীতে এসে ব্রিটিশ সৈন্যের সাথে যোগ দিলো। বখত খান এবং নিমক রেজিমেন্টের বিদ্রোহীদের সেনাপতি গওস খানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কতোখানি দায়ী, তা আমরা জানি না। প্রকাশ্যে বখ্‌ত খান অভিযোগ করেছেন যে তার নির্দেশ প্রতিপালিত হয়নি এবং পরে তিনি প্রধান সেনাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলেন।

আগস্ট মাসে সম্রাটের অর্থসঙ্কট ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো। এখন আর ঋণ করার ভড়ং নেই, ঋণদাতাদের দলিল দেয়ার সময় বয়ে গেছে। সুদের প্রশ্নই তো উঠে না। দিল্লীতে একটা টাকশাল বসানো হলো। তার ফলেও কিন্তু কোনো সুবিধা হলো না। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে একইভাবে দাবি করা হতে লাগলো। বড়ো ব্যাংক মালিক এবং ক্ষুদ্র দোকানদার সকলকেই সমর তহবিলে চাঁদা দিতে নির্দেশ জারী করা হলো। শুধু মাত্র দরিদ্র জনসাধারণকেই এ সময় কর থেকে রেহাই দেয়া হলো। কিন্তু ব্যাংক মালিকেরা সরকারের আসন্ন পতন লক্ষ্য করে চুপ করে রইলো। পরোয়ানা এলেও দরবারে হাজির হলো না। অন্যেরা নিজেদের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখলো। আবার অতি অল্পসংখ্যক লোক সাহস সঞ্চয় করে চাঁদা দিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলো। সম্রাটের বৃহত্তর স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে সরকারি কর্মচারিরা নিজেদের ব্যক্তিগত লাভ-লোভের জন্য উৎকোচ গ্রহণ করতে লাগলো। এতে করে অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে উঠলো। পাতৌদির মুহম্মদ আকবর আলী খান নামে এক ব্যক্তি সম্রাটের কাছে অভিযোগ পেশ করেছেন যে, লখনৌর সেপাইদের রিসালদার আকবর আলী খান নামে এক ব্যক্তি তার কাছে থেকে অনেক চাঁদা নেওয়ার পরেও তাঁর সম্পত্তি লুঠ করেছে। দুর্ভাগ্যবশতঃ চাঁদা এবং ঋণ গ্রহণের ভার নির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষের উপর ন্যস্ত ছিলো না। সেনাবাহিনী, শাহজাদাবৃন্দ, প্রধান সেনাপতি বখৃত খান, বিদ্রোহী দরবার সকলেই অর্থ সংগ্রহ করছিলেন আলাদা আলাদাভাবে। একজনের কাছ থেকে দুতিনবার চাঁদা দাবি করা হলো। যে সমস্ত লোক ইংরেজদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলে সন্দেহ করা হলো। তাদের আলাদা করে মোটা টাকা দাবি করা হলো। এ ব্যাপারে জীবনলাল একা ছিলেন না। আগস্ট মাসে তাঁকে পঁচিশ হাজার টাকা দিতে বলা হলো। মীর্জা ইলাহী বখশ তার পক্ষ সমর্থন করে অনুরোধ করলে জীবনলালকে কিছু দিনের জন্য রেহাই দেয়া হয়। কিন্তু পরে জীবনলালকে আটক এবং তার বাড়ি লুঠ করা হয়। মুফতি সদর উদ্দীন নামে আরেক ব্যক্তিকে সন্দেহ করা হলো। সেপাইরা তাঁর কাছ থেকে দু’লাখ টাকা দাবি করলো। টাকার দাম ভয়ংকরভাবে কমে গিয়েছিলো। নতুন এক টাকার পরিবর্তে পুরোনো এক আনার চেয়ে বেশি দাবি করা হলে শাস্তি দেবার জন্যে কোতোয়ালকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। গুজব উঠলো যে সলিমগড় দুর্গের মধ্যে গুপ্তধন রক্ষিত আছে। সেপাইদের অনেক গুপ্তধনের সন্ধানে ছুটলো। সে যাকগে, ৩১শে আগস্ট ঘোষণা করা হলো চাঁদা এবং ঋণ আদায় করার একমাত্র ভারপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ হলো দরবার।

ইতিমধ্যে বারুদ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ফুরিয়ে এসেছে। খোলাবাজারে সালফার পাওয়া গেলো না। দেবী দাস নামে এক ব্যক্তির দোকান অবরোধ করে প্রচুর সালফার পাওয়া গেলো। ইংরেজদের জিনিসপত্র সরবরাহ করছে, এ সন্দেহে অনেককে গ্রেপ্তার করা হলো। চাঁদনী চক থানার দারোগা সৈয়দ নাজির আলীর কয়েকখানা চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি যে ঐ অঞ্চলে কোনো কসাই পাওয়া যাচ্ছে না, পাটের বস্তা অদৃশ্য হয়েছে, আগের বাকি শোধ না করায় রুটিওয়ালারা রুটি সরবরাহ করতে রাজী হচ্ছিলো না। তিনি একবারের বেশি কুলি এবং দুলিবাহক পাঠিয়েছেন, কিন্তু কোনো মুচি কিংবা কোনো ঘোড়া বা উট যোগাড় করতে পারেননি। চাঁদনী চকে ময়লা জমে স্থূপাকার হয়ে রয়েছে। কোনো মেথর কিংবা ঝাড়ুদার তা পরিষ্কার করছে না। অফিসারদের কাঠ সরবরাহ করা হয়েছে, কিন্তু প্রত্যেক সেপাইয়ের অতীব প্রয়োজনীয় তাম্রপাত্র কিংবা হুঁকা দেয়া হয়নি। নাজির আলী আরো অভিযোগ করেছেন, তিনি যে মহিষের গাড়ি যোগাড় করেছিলেন, সেপাইরা তা ছেড়ে দিয়েছে। সেনাপতির পক্ষে যা না হলে চলে না, সে কুলি এবং কারিগরদের অত্যন্ত অভাব ছিলো। সেপাইদের ওপর নাগরিকদের কোনো শ্রদ্ধা ছিলো না, দোকানদারদের তারা নাজেহাল করতো এবং ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের টাকাকড়ি লুট করে নিতো। প্রধান সেনাপতি নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে বিশেষ ফলোদয় হয়নি। একজন অশ্বারোহী কর্তৃক এক মেয়েকে ধর্ষণই হলো সবচেয়ে মারাত্মক। এমনকি সেনাবাহিনীর ঘোড়ার ঘাস কাটিয়েরাও নিজেদের পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছিলো। ইংরেজদের মতে, দলে দলে সেপাইরা চলে যাচ্ছিলো, তা সত্য হতে পারে, নাও হতে পারে।

নতুন সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র এসে পৌঁছাবার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারেরা মনে-প্রাণে আক্রমণের পরিকল্পনা করতে লাগলেন। একটা পরিখা খনন করা হলো এবং ব্রিটিশ সৈন্যদের একেবারে দক্ষিণ দিক ঘেঁষে কামানের ব্যাটারী পাতা হলো। সেপাইদের আকস্মিক আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো। জুনের প্রথম থেকে যখন অল্পসংখ্যক ব্রিটিশ সৈন্য টিলা অধিকার করেছিলো, তখন থেকে চূড়ান্তভাবে নগর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা পর্যন্ত হিন্দু রাওয়ের প্রাসাদে ব্রিটিশ সৈন্যের দক্ষিণ বাহুর সৈনিকদের কঠোর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা হয়েছে। যদি বিদ্রোহীরা এখান থেকে ব্রিটিশ সৈন্য সরাতে পারতো, তাহলে অন্যান্য স্থান থেকে তাদের তাড়িয়ে দিতে বিশেষ বেগ পেতে হতো না। সুতরাং সেপাইরা মনে করলো, ডান দিক থেকেই নগর আক্রমণ করা হবে। পরিখা খননের জন্যে পুরষ্কার ঘোষণা করা হলো। এ যুদ্ধে যারা মারা যাবে বিদ্রোহী দরবার তাদের পরিবার পরিজনদের ভরণপোষণের প্রতিশ্রুতি দান করলো। কিন্তু ইংরেজরা বাম দিকের অরক্ষিত কাশ্মীরি ফটক, লাভলো ক্যাসল এবং জলের ট্যাঙ্ক থেকেই আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। টেইলর একাই লাভলো ক্যাসলে প্রবেশ করে আক্রমণের সব বিধি-ব্যবস্থা সেরে নিরাপদে ফিরে এলেন। লাভলো ক্যাসেল দখল করার পর ইংরেজরা সেখানে প্রহরার স্থান বাছাই করে দিলেন। নগর প্রাকারের বাইরের এ পুরানো আট্টালিকাগুলো শক্রর জন্যে এতো সুবিধাজনক হবে, আগেভাগে চিন্তা করে তা ভেঙ্গে ফেলার ইচ্ছা সেপাইদের মনে একবারও উদিত হয়নি। লাভলো ক্যাসলের সামনে তিনটা ব্যাটারী, জলের ট্যাঙ্কের কাছে একটা এবং কাঁদেসিয়া বাগে একটা ব্যাটারী তাড়াতাড়ি স্থাপন করলো।

কিছু প্রাণহানি ছাড়া এটা করা সম্ভব হতো না। কিন্তু সশস্ত্র সৈনিকেরা কেউ মারা গেলো না। যারা মরলো তারা সকলেই নিরস্ত্র এদেশীয় মানুষ। ১৮৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের যুদ্ধে টিলার ওপর যে সকল সংগ্রামরত সৈনিক ছিলো, তার অর্ধেকেরও বেশি ছিলো ভারতীয় এবং সমস্ত শিবির পরিচারক যাদের সংখ্যা সগ্রামী সৈন্যদেরও ছাড়িয়ে যায়, তাদেরও সকলে ভারতীয়। এই নীরব সাহসী মানুষদের কোনো তুলনা হয় না। গোলার আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে যাচ্ছে, তাদের কোনো ভাবান্তর নেই। ১০ই সেপ্টেম্বরে তৃতীয় ব্যাটারী স্থাপন করার সময় দেখা গেলো তাদের মধ্যে ৩৯জন হতাহত হয়েছে।

চার রাতের মধ্যে পরিখা খনন এবং তিনটা ব্যাটারী স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। চার নম্বর ব্যাটারীর কাজ সমাপ্ত প্রায়। ইঞ্জিনীয়ারেরা আরো তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে পারবেন বলে আশা দিয়েছিলেন। এ বিলম্বের জন্য সহযোদ্ধারা বারংবার ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। ৩নং ব্যাটরী প্রতিষ্ঠার কাজ শেষ হওয়ার আগে ১৬ তারিখে কীথ ইয়ং লিখেছিলেন, “ইঞ্জিনীয়ারেরা প্রধান সেনাপতিকে ব্যাটারী স্থাপন করার জন্য যে সময়ের কথা বলেছিলেন, সে সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারেনি। সে জন্য তাঁরা ভয়ংকরভাবে দায়ী। এক রাতের মধ্যে সবকিছু শেষ করতে পারবেন বলে বলেছিলেন। আমরা মনে করেছিলাম, হয়তো দু’তিনদিন লাগতে পারে। কিন্তু আজকে চারদিন অতিবাহিত হতে চলেছে, এখনো শেষ হয়নি। ইঞ্জিনীয়ারেরা চমৎকার মানুষ, কিন্তু তাঁরা অসম্ভবকে সম্ভব করার বাসনা পোষণ করেন। তাঁরা সকলেই ছিলেন তরুণ, তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা সম্ভাব্য বিপদ সম্বন্ধে কিছুই ভাবেননি। কিন্তু বয়স্কেরা সে সম্বন্ধে আগেই ভাবনা-চিন্তা করতেন। কিন্তু তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। ইতিহাস দিল্লী অধিকারের মাধ্যমে তাঁদের পুরস্কৃত করেছেন।

১১ই সেপ্টেম্বর সকাল থেকে ব্যাটারী হতে নগর প্রাচীরে গোলা নিক্ষেপ করা হতে লাগলো। ১৩ তারিখে নগর প্রাচীরের দুটি স্থান বিদীর্ণ হয়ে গেলো। লেফটেন্যান্ট মেডলী রাতের অন্ধকারে প্রাচীরের ভগ্নস্থান পরীক্ষা করে জানালেন যে ওতে তাদের উদ্দেশ্য সাধিত হবে। পরদিন সকালে নগরীর মধ্যে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। প্রতীক্ষার দিনের অবসান হয়েছে, আক্রমণের প্রত্যাশিত মুহূর্তটি এসেছে হাতের কাছে। জন নিকলসন হচ্ছেন সময়ের উপযুক্ত মানুষ। কোনো দ্বিধা, কোনো সন্দেহ তাঁকে দমাতে পারে না। কোনো ভয় কোনো ভীতি তাঁর বিশ্বাসকে টলাতে পারে না। সুতরাং তাঁকেই নগর আক্রমণের নেতা নির্বাচন করা হলো। আক্রমণকারী সেনাবাহিনীকে চারটি দলে বিভক্ত করা হলো। প্রথম দল স্বয়ং নিকলসনের পরিচালনাধীনে কাশ্মীর দুর্গের পাশ দিয়ে ঝটিকা বেগে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলো। দ্বিতীয় বাহিনী ব্রিগেডিয়ার জোনসের অধীনে জলের ট্যাঙ্কের কাছের ভগ্ন অংশ দিয়ে এবং তৃতীয় বাহিনী কর্ণেল ক্যাম্পবেলের নেতৃত্বে কাশ্মীর ফটক উড়িয়ে দিয়ে নগরে প্রবেশ করবে বলে স্থির হলো। চতুর্থ দল পাহারপুর এবং কিষাণগঞ্জের সেপাইদের হটিয়ে দিয়ে উপকণ্ঠ ঘুরে লাহোর ফটক দিয়ে নগরে প্রবেশ করার কথা ঠিক হলো। মেজর রীড, যিনি হিন্দু রাওয়ের প্রাসাদের অসংখ্য সেপাই আক্রমণ বহুবার প্রতিহত করেছেন, তিনিই চতুর্থ বাহিনীর অধিনায়ক। বাদবাকী সেপাইদের ব্রিগেডিয়ার লংফিল্ডের অধীনে রাখা হলো। সেনাবাহিনী প্রস্তুত কিন্তু আক্রমণ স্থগিত রাখতে হলো। রাতের মধ্যে প্রাচীরের ভগ্ন অংশ মেরামত করে ফেলা হয়েছে। ইংরেজদের সৌভাগ্য, এ ভগ্ন অংশে ইট এবং কামান না বসিয়ে সেপাইরা বালির বস্তা স্থাপন করেছে। আবার কামান থেকে গোলা বর্ষণ করা হলে মেরামতকৃত ভগ্নস্থানসমূহ পুনরায় ফাঁক হয়ে গেলো।

বেয়ার্ড স্মিথ দিল্লীকে ভালোভাবে চিনতেন। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা মিলে যে পরিকল্পনা করেছেন, তাতে খুঁটিনাটি কিছুই বাদ পড়েনি। প্রত্যেক অধিনায়ককে এ পরিকল্পনার এক একটি কপি দেয়া হলো। কিন্তু যুদ্ধেরও তো দুর্ঘটনা আছে। রীডের বাহিনী লক্ষ্যে তো পৌঁছাতে পারলোই না, বরঞ্চ ফিরে আসতে হলো। আর, সি, লরেন্সের অধীন গুর্খা বাহিনীও তাঁর সঙ্গে যোগদান করেছিলো। দক্ষিণ দিক থেকেই সেপাইরা প্রচণ্ড আক্রমণের প্রতীক্ষা করছিলো, সে জন্য সেখানে তারা বেপরোয়াভাবে বাধা দিতে থাকে। জম্মু বাহিনীকে ফিরে আসতে বাধ্য হতে হলো। অন্যান্য বাহিনীও সাফল্যের পরিচয় দিতে পারলো না। সমগ্র বাহিনীকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়া হলো। হোপ এ্যান্টের সেনাদলকে লাহোর ফটকের কাছ থেকে গোলন্দাজদের নির্মম আক্রমণের মুখে ফিরে আসতে হলো। সেপাইদের যদি একজন প্রতিভা এবং পারঙ্গমতাসম্পন্ন নেতা থাকতো তাহলে এ সাফল্যের ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু করতে পারতো। যদি সম্মুখভাগে ব্রিটিশ সৈন্যদের আক্রমণ করা হতো, তাহলে শুধুমাত্র নগর রক্ষাই হতো না, শত্রুরা দু’দিকের গোলা বর্ষণের পাল্লায় পড়ে হতাশ হয়ে যেতো। দুর্ভাগ্য, দিল্লীর সেপাইদের মধ্যে এমন একজন নেতাও ছিলো না, কখন এবং কোথায় আঘাত করতে হবে এ জ্ঞান যার ছিলো। চতুর্থ সেনাবাহিনীর ওপর জয়লাভ করার পরেও সেপাইরা দিল্লীর পতন রোধ করতে পারলো না।

নিকলসন পরিচালিত বাহিনী প্রাচীরের ভগ্ন অংশ অতিক্রম করে শীগগিরই মোরি দুর্গ অধিকার করলো। কাবুল ফটক দখল না করা পর্যন্ত নিকলসনের অধীন সেনাবাহিনী সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলো। কাবুল ফটকের পেছনে বার্ন দুর্গ পর্যন্ত তারা এগিয়ে গেলো। কিন্তু তার পরে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। প্রতি ইঞ্চি মাটি ছেড়ে দেয়ার আগে সেপাইরা মরণপণ সংগ্রাম করছে। আক্রমণকারী সেনাদল সেপাইদের গোলাগুলির আঘাতে ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অফিসারেরা নিজেরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, সেপাইদের অনুপ্রাণিত করছেন। কিন্তু মানুষের সাহসেরও তো সীমা আছে। আক্রমণকারীরা বারবার সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু প্রতিরক্ষীদের অবিরাম কামানের গোলাগুলি তাদেরকে বারবার পেছনে হটিয়ে দিচ্ছে। মেজর জেকব গোলার আঘাতে আহত হয়ে পড়লেন। সামনে এলেন নিকলসন। তাঁর মানুষদের অনুসরণ করতে আদেশ দিয়ে তুমুল গোলাবর্ষণ অগ্রাহ্য করে তিনি সামনে এগিয়ে গেলেন এবং গোলার আঘাতে মারা গেলেন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এতো ব্যাপক যে সেনাবাহিনী কাবুল ফটকে ফিরে যাওয়াই উপযুক্ত মনে করলো।

জোনস পরিচালিত দ্বিতীয় দল ভগ্নপ্রাচীর অতিক্রম করলো। কিন্তু নিকলসনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। তৃতীয় বাহিনী পরিকল্পনা অনুসারে আক্রমণে সাফল্যলাভ করে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। তারা কাশ্মীর ফটকে এসে দেখে যে সেতু আংশিকভাবে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু অবশিষ্ট দণ্ডগুলো বেয়ে তারা সেতু অতিক্রম করতে লেগে গেলো। গোলার পর গোলা এসে আঘাত করছে। আহত নিহত হয়ে নীচে পড়ছে। আবার তারা সামনে এগিয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত তারা আক্রমণ করতে সক্ষম হলো। ফটক প্রবল শব্দে ভেঙ্গে পড়লো। বিউগলের উচ্চনিনাদ তাদের সাফল্যের প্রতিধ্বনি করলো। এই আক্রমণের বীর হলেন, লেফটেন্যান্ট শ্যালকেল্ড, হোম, কর্পোরাল বার্গেস, সার্জেন্ট স্মীথ, কাৰ্মাইকেল, হাবিলদার মধু, হাবিলদার তিলক সিং এবং সেপাই রামনাথ। তৃতীয় বাহিনী তাদের অবস্থান দৃঢ় করে জামে মসজিদ পর্যন্ত অগ্রসর হলো। মসজিদ থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণ অবশ্য তাদেরকে পেছনে হটতে বাধ্য করলো। দিনের শেষভাগে ব্রিটিশ সৈন্য নগর প্রাচীরের একাংশ দখল করে নগরের মধ্যে নিজেদের আধিপত্য প্রসারিত করলো। সে রাতে ব্রিটিশ সৈন্য স্কীনারের বাড়িতে ঘুমোলেন। গীর্জা এবং কলেজের অট্টালিকাও তাদের হাতে চলে এলো। ক্ষয়ক্ষতি যা হয়েছে মারাত্মক। ১১০৪ জন সৈন্য, ৬৬ জন অফিসার এবং প্রতি ৯ জনের ২ জন হয়তো মারা গেছে অথবা আহত হয়ে পড়ে আছে। ইঞ্জিনীয়ারদের সঙ্গে কর্মরত সতেরো জন অফিসারের মধ্যে আটজন ভয়ঙ্করভাবে আহত হয়েছেন এবং একজন নিহত হয়েছেন। স্বভাবতই উইলসন দুঃখিত হয়েছেন। সেলিমগড়ের সুরক্ষিত দুর্গপ্রাসাদ এবং অস্ত্রশস্ত্র এখনো সেপাইদের হাতে রয়েছে। সে দুর্গের ছিদ্র দিয়ে গোলাগুলি বর্ষণ করে দু’দিকে এখনো প্রত্যেকটা রাজপথ ওরা আগলে রাখতে পারবে। তিনি চিন্তা করলেন, তার সেনাবাহিনীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে, এখনো অপেক্ষা করা যুক্তিযুক্ত হবে কি? না কি তাঁর উচিত নগর পরিত্যাগ করে আবার টিলা-শ্রেণীর ওপর চলে গিয়ে নতুন সৈন্য আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা? এ হতাশাজনক পরামর্শের নিন্দা করলেন বেয়ার্ড স্মীথ। যাহোক শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সৈন্যরা সাহস করে নগরের মধ্যেই রয়ে গেলো।

চালর্স জন গ্রিফিথ, যিনি উইলসনের অধীনে চাকুরি করতেন, এভাবে ১৫ই সেপ্টেম্বরের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। “সব বয়সের সব সৈন্যরা এখন কড়া মদের নেশায় বিভোর। এটা ব্রিটিশ সৈন্যদের পক্ষে ভয়ঙ্কর লজ্জার কথা। কে এবং কার দ্বারা প্রথম এ কাজ হয়েছে আমি বলতে পারবো না। ১৫ তারিখ সকাল বেলা দেখা গেলো মদের ভাঁড়ারের দরজা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে এবং সৈন্যরা মদের নেশায় বিভোর হয়ে হৈ হল্লা শুরু করেছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক, সে সময়ে যদি শত্রু আমাদের ওপর আক্রমণ করতো, তাহলে আমাদেরকে বেকায়দায় পড়তে হতো। তাদের মদ খাওয়া থেকে বিরত করার জন্য চেষ্টা করা হলো। কিন্তু তাতে কোন ফল হলো না। শেষ পর্যন্ত প্রধান সেনাপতি মদের সমস্ত ভাড়ার নষ্ট করে ফেলার আদেশ দিলেন। এ কাজ পাঞ্জাবী এবং শিখদের দ্বারাই করা হয়েছিলো। দিল্লীর রাজপথে মদের স্রোত বয়ে গিয়েছিলো।” সেপাইরা এসব দিকে কিন্তু নজর রাখেনি। শুধুমাত্র সন্ধ্যে বেলাতেই তারা কলেজ চত্বরে বন্দুক এবং সেলিমগড়ের আশপাশের বাড়িগুলোতে কামানের গোলা ছুঁড়তে লাগলো।

১৬ তারিখে ইংরেজরা অস্ত্রাগার অধিকার করে নিলো। ১৭ থেকে ১৯ তারিখের মধ্যে সেলিমগড় দুর্গে ভারী কামানের গোলা বর্ষণ করতে লাগলো। ইংরেজদের অধিকারের সীমা এখন বিস্তার লাভ করেছে। ২০ তারিখে তারা প্রাসাদ এবং সেলিমগড় দুর্গের চারদিকে স্থান দখল করে নিলো। এ সুরক্ষিত দুর্গ প্রাসাদ রক্ষা করার জন্য কেউ ছিলো না। কেবল কয়েকজন প্রহরী প্রাণপণে বাধা দিয়ে সম্মান রক্ষার চেষ্টা করেছে। এই নামহারা বীরেরা সেদিন ইংরেজদের বাধা দিয়েছিলো, মৃত্যুবরণ করেছিলো। ইংরেজরাও এ বীরদের বীরত্বের প্রশংসা না করে পারেনি। জেনারেল উইলসন প্রাসাদের মধ্যেই ইংরেজদের সদর দফতর স্থানান্তরিত করলেন। দেওয়ান-ই খাসে নৈশ ভোজের আয়োজন করে ইংরেজরা বিজয় উৎসব করলো।

এভাবে দিল্লী দখল করা হলো, কিন্তু কতো মানুষকেই না এজন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। ৩০শে মে হতে ২০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধুমাত্র ব্রিটিশ পক্ষেই ৩,৮৩৭ জন লোক নিহত, আহত অথবা নিখোঁজ হয়েছে। রেজিমেন্টগুলোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও সামান্য নয়। গুর্খা সৈন্য, যারা হিন্দু রাওয়ের প্রাসাদে ব্রিটিশ সৈন্যের ডান দিকে ছিলো তাদের ৫৫০ জনের মধ্যে শতকরা ৬০ জন নিহত বা আহত হয়েছে। বিদ্রোহীদের মধ্যে কতজন নিহত কিংবা আহত হয়েছিলো সে খবর আমরা জানি না।

একদিক দিয়ে ধরতে গেলে এ বিজয় এখনো সম্পূর্ণ নয়। কারণ সম্রাট এবং শাহজাদারা এখনো মুক্ত অবস্থায় আছেন। প্রধান সেনাপতি বখৃত খান সম্রাটকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে অযোধ্যায় চলে গিয়ে সেখানে যুদ্ধ শুরু করতে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু ইলাহী বক্স শৰ্তমূলকভাবে আত্মসমর্পণ করতে উপদেশ দিলেন। মহিষীর প্ররোচনাতেই তিনি এ পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারণ মহিষী তাঁর ছেলে, স্বামী এবং তাঁর কিছু রত্ন-অলঙ্কার ফিরে পাবার প্রত্যাশা করেছিলেন। একজন ছাড়া সম্রাটপুত্রদের কারো বাবুরের সে অদম্য সাহসের একবিন্দুও ছিলো না। শাহজাদা ফিরোজ শাহ তখন দিল্লীতে ছিলেন না। মীর্জা মোগল, মীর্জা খিজির সুলতান এবং আবু বাকার এতাদিন পর্যন্ত সাম্রাজ্যের পুনর্জীবনের অসম্ভব আশায় মেতে উঠেছিলেন, কিন্তু বর্তমানে তারা আপন আপন প্রাণ বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। সম্রাট পয়লা কাতবে গিয়েছিলেন। মীর্জা ইলাহী বক্স তাঁকে হুমায়ুনের মাজারে আশ্রয় গ্রহণ করতে বললেন। ব্রিটিশ গুপ্তচর মৌলবি রজব আলী ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগকে পলাতকদের অবস্থান জানিয়ে দিলেন। হডসন উইলসনের কাছে গেলেন, শুধুমাত্র প্রাণের দাবিতে সম্রাটের আত্মসমর্পণের বিষয়ে মীর্জা ইলাহী বক্সের মাধ্যমে আলোচনা চালাবার জন্য অনুমতি পেলেন। এটা ছিলো বেসামরিক অফিসারের দায়িত্ব। কিন্তু বেসামরিক অফিসার হার্ভে গ্রীথিড ২০ তারিখে কলেরায় মারা গেলেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন মিঃ স্যাণ্ডার্স। হডসন মৌখিকভাবে তাঁকে জানালেন যে শুধুমাত্র প্রাণ রক্ষার তাগিদে, সম্রাটের আত্মসমর্পণের ব্যাপারে আলোচনা চালাবার অনুমতি তিনি প্রধান সেনাপতির কাছ থেকে লাভ করেছেন। হডসন শাহজাদা জওয়ান বস্তৃত এবং তার শ্বশুর আহমদ কুলী খানকেও প্রাণের দায় থেকে রেহাই দিয়ে তার ওপর প্রদত্ত ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করলেন। সে সময়ে সম্রাটের মুক্তির জন্য তার আলোচনার কড়া সমালোচনা করেছেন অনেক দায়িত্বশীল ইংরেজ, কারণ প্রাসাদের অনেক ইংরেজকে হত্যার জন্য তাঁরা সম্রাটকেই দায়ী মনে করেন।

২১শে সেপ্টেম্বর তারিখে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ হডসনের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন, তাঁকে দিল্লীতে আনা হলো। তারা পরের দিন হডসন হুমায়ূনের মাজারে অভিযান চালিয়ে শাহজাদাদের শর্তহীন আত্মসমর্পণ দাবি করলেন। শাহজাদারা প্রাণ রক্ষার নিশ্চয়তা পেতে চেয়েছিলেন। মীর্জা মোগল, মীর্জা খিজির সুলতান এবং মীর্জা আবু বাকারকে একটি গরুর গাড়িতে ভোলা হলো। হডসন বলেছিলেন শাহজাদাদের এ অবস্থা দেখে একদল সশস্ত্র জনতা জমা হয়েছিলো। কিন্তু তাদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিতে তাঁকে বেগ পেতে হয়নি। তারপর তিনি বন্দীদের নিয়ে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করলেন, জনতাও তাঁকে অনুসরণ করতে লাগলো। তারা দিল্লীর ফটকের কাছে এসে পৌঁছালে হডসন বন্দীদের কাপড় খুলতে আদেশ করলেন। তারপর আপন হাতেই তিনজনকে গুলি করে মারলেন। তার একটু পরেই সম্রাটের বংশের ২১ জন শাহজাদাকেই ফাঁসিকাষ্ঠে লটকানো হলো। বল্লভগড়ের রাজা এবং ঝজঝরের নবাবকেও ফাঁসি দেয়া হলো।

সম্রাট আপন প্রাণ রক্ষার জন্য দরাদরি না করলেই হয়তো ভালো করতেন। জঘন্য অপরাধীর সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়, তার সঙ্গেও তেমন ব্যবহার করা হলো। তাঁকে শেকল পরানো হয়নি এ কথা সত্য। কিন্তু এমন খারাপ জায়গায় তাঁকে রাখা হয়েছে যে প্রত্যেক ইংরেজ নরনারী সম্রাটের গোপনীয়তা ভঙ্গ করতো এবং তার দিকে রোষকষায়িত লোচনে তাকাতো। গ্রীফিথ ২২শে সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণ করার পরের দিন একটি সাধারণ চারপায়ার কুশনের উপর সম্রাটকে উপবিষ্ট দেখেছিলেন এবং লিখেছেন, “মোগল সাম্রাজ্যের শেষ বংশধর দরবারের বারান্দা অথবা বিছানায় একখানা সাধারণ দেশী চারপায়ার কুশনের উপর বসে আছেন হাঁটু বাঁকা করে। বুকের ধার অবধি নেমে আসা লম্বা দাড়ি ছাড়া তাঁর চেহারার মধ্যে আর কোন আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য নেই। মাঝামাঝি দীর্ঘ, সত্তর বছরের উপরে বয়স, পরনে সাদা কাপড়, মাথায় চূড়াকৃতি একটি সাদা পাগড়ি। পেছনে দু’জন পরিচারক দাঁড়িয়ে বৃহৎ ময়ূরের পালকের পাখা দিয়ে হাওয়া করছে। এ হলো তার সার্বভৌমত্বের প্রতীক। কিন্তু যে সম্রাট শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, তারপরেও তাঁর সার্বভৌমত্বের প্রহসন দেখে মনে করুণারই উদয় হয়। তাঁর মুখ থেকে একটা কথাও বেরুচ্ছে না। রাতদিন তিনি স্থির হয়ে মাটির দিকে চেয়ে চুপচাপ বসে আছেন। দেখে মনে হয় যে অবস্থার মধ্যে পড়েছেন, তার বিপত্তি সম্বন্ধে তিনি পুরোপুরি সজাগ। তার থেকে মাত্র তিন ফুট দূরে আরেকটি বিছানায় বসে আছেন প্রহরারত অফিসার। দুপাশে দু’জন ইউরোপীয় প্রহরী যমদূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের রাইফেলের সঙ্গিনগুলো চকচক করছে। প্রহরারত অফিসারের কাছে নির্দেশ দেয়া আছে, সম্রাট যদি পালাবার কোনো চেষ্টা করেন, তিনি যেন নিজের হাতে সম্রাটকে গুলি করেন। রেইকস তাঁকে ১৮ই ডিসেম্বর তারিখে দেখে ১৯ তারিখে লিখেছিলেন, আমার অনেক ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলাকে নিয়ে গতকাল সম্রাটকে দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে মিঃ ও মিসেস স্যাণ্ডার্সও ছিলেন। সম্রাট নব্বই বছরের একজন আশাহত বৃদ্ধ। আমি দেখলাম, তিনি একটি ছোটো ঘরে, আগে যেখানে সামান্য চাকর থাকতো সেখানে কুশনের ওপর বসে আছেন। আমি তার পাশে গিয়ে চেয়ারে বসলাম এবং তাঁকে স্বপ্নের কথা বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম। তারপরে তিনি স্বরচিত কবিতা আবৃতি করতে লাগলেন অনুচ্চস্বরে। সম্রাটকে কিছু না বলে আমি স্থান পরিত্যাগ করলাম।”

মহিষীকেও রেহাই দেয়া হয়নি। ইউরোপীয় মহিলারা তার দিকে ঘৃণাব্যঞ্জক দৃষ্টিতে তাকাতেন এবং অনেক সময় কঠোর মন্তব্যও করতেন। মিসেস কুপল্যাণ্ড যার স্বামী গোয়ালিয়রে নিহত হয়েছেন, তিনিও সম্রাটকে দেখতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে রাজ্যহারা সম্রাটের কোনো মহিমা, কোনো মহানুভবতা তিনি প্রত্যক্ষ করেননি। তিনি লিখেন, আমরা সিঁড়ি বেয়ে কয়েক কদম অগ্রসর হয়ে একটা নোংরা ঘরে প্রবেশ করলাম। ঘরের সামনে প্রহরীরা ঘোরাফেরা করছে। তারপরে রাজার রাজা মোগল সম্রাটের ঘরে প্রবেশ করলাম। তারপরে পর্দা ঠেলে আমরা নিচু নোংরা একটি কক্ষে এসে ঢুকলাম। সেখানে একটি নিচু চারপায়ার ওপরে সাদা সুতী কাপড়ের পোশাক পরা ক্ষীণাঙ্গী এক বুড়ো মহিলাকে দেখতে পেলাম। শীতের জন্য তিনি ময়লা চাদর এবং লেপে সারা শরীর ঢেকে আছেন। আমাদের প্রবেশ পথে তিনি হুঁকাটা রেখেছেন। যে সম্রাট অতীতে তাঁর সামনে কেউ বসলে সে অপমান সহ্য করতে পারতেন না, অত্যন্ত দীনভাবে আমাদের সালাম করে বলতে লাগলেন, আমাদের দেখে তিনি খুবই খুশি হয়েছেন।”

শাহজাদা জওয়ান বখতের অবস্থাও ভালো নয়। তিনি অসুখে ভুগছেন। তথাপিও তাঁকে প্রত্যেক দর্শককে সম্মান জানাবার জন্য উঠে দাঁড়াতে হয়। কমিশনার বসবার অনুমতি না দিলে বসতে সাহস করতেন না। বিচারের সময় বিচারক এবং প্রসিকিউটাররা সম্রাটকে সাধারণ ভদ্রতাটুকুও দেখাতে পারেননি। এখনো তিনি কবিতা লিখতে চান। কিন্তু তাঁকে কাগজ-কলম দেয়া হয়নি। তার অভাবে কয়লা দিয়ে তিনি বদ্ধঘরের দেয়ালে কবিতা লিখতেন। এক সময় বলা হলো তাঁকে আন্দামানের বন্দী উপনিবেশে আফ্রিকায় অথবা অন্য কোনো দেশে পাঠিয়ে দেয়া হোক। সিসেন বিডন তাকে চীনা উপকূলের হংকং শহরে পাঠিয়ে দিতে পরামর্শ দিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে ব্রহ্মদেশের রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হলো। কয়েক বছর পর সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাহাদুর শাহ নিজের মন্দভাগ্যের জন্য কাউকে দোষ দিতে পারেন না। তিনি যদি সাহসিকতায় ভর করে সেপাইদের সঙ্গে যেতেন এবং বীরের মতো মৃত্যুকে যুদ্ধক্ষেত্রে আলিঙ্গন করতেন তাহলে দেশবাসী এমন কি শত্রুদের শ্রদ্ধাও তিনি আকর্ষণ করতে পারতেন। প্রথমে সেপাইদের দ্বারা প্রলুব্ধ হলেন ক্ষমতার জন্য, তারপরে রজব আলী এবং ইলাহী বক্সের দ্বারা প্রলুব্ধ হলেন আপন প্রাণের জন্য। নিষ্ঠুর ভাগ্যের হাতের ক্রীড়নক বাহাদুর শাহ আপন সাম্রাজ্য থেকে দূরে বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেন।

দিল্লী এবং তার অধিবাসীদের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত নেই। জেনারেল উইলসন নারী এবং শিশুদের প্রতি কোনো রকমের নৃশংসতা না করার জন্য কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এমন সৈন্য কোথায় আছে যে বিজয়ের মহেন্দ্রলগ্নে করুণা দেখবার আদেশ মেনে নেবে? এখন শিখরা মনে করতে লাগলো, গুরু যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তাঁর শিষ্যেরা দিল্লীকে ছারখার করে দেবে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছে। লুণ্ঠনের আশা এবং পূরবীয়া সম্প্রদায়ের ওপর প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করার প্রবল বাসনায় তারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে লাগলো। ব্রিটিশ সৈন্যরা শুনেছে শিশু হত্যা এবং মহিলাদের অসম্মানের কথা এবং শুনেছে তাদের বন্ধুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এতোদিন তাদের মনে প্রতিহিংসার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিলো। এমনকি খ্রীস্টান ধর্মযাজকেরা একে ধর্মসঙ্গত কাজ বলে মেনে নিতেও কোনো আপত্তি করেনি।

২১শে সেপ্টেম্বর গ্রফিথ দিল্লীর রাজপথ এবং জনাকীর্ণ দিল্লী নগরী সম্বন্ধে লিখেছেন, “রাজপথে একজন মানুষও নেই। বিপত্তির কারণে সমগ্র নগরীকে মৃত মানুষের শহর বলে ভ্রম হয়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আমরা যে রাজপথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, মাত্র কয়েকদিন আগেও তার দু’দিকে হাজার হাজার লোক বাস করতো, সেপাই এবং নগরবাসীদের শব চারদিকে ছড়ানো রয়েছে। অনেক দিন ধরে বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। শ্বাস নেয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু পরিকল্পিত লুণ্ঠনের কাজ অব্যাহত গতিতে চলছে। পরিত্যক্ত গৃহের মেজ খনন করে গুপ্ত ধনের সন্ধান করতে লাগলো। গুপ্তধন পাওয়া গেলে অফিসারেরা তার অংশগ্রহণ করতে লাগলেন কোনো রকমের কুণ্ঠা না করে। সোমনাথের কাহিনী এখনো জীবন্ত। হিন্দু প্রতিমাগুলোকে অপসারণ করা হলে রহমাণিক্যের সন্ধানে কতোগুলোকে ভেঙ্গে ফেলা হলো। ৩১শে অক্টোবর তারিখে গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী সার্জনের রিপোর্টের উপর নির্ভর করে মুঈর শেরারকে লিখলেন, “এখনো দিল্লী তার সবরকম ঐশ্বর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কামান কিংবা গুলির সামান্যতম চিহ্ন কোথাও দৃষ্টিগোচর হয় না, কিন্তু বাড়িগুলো সব পরিত্যক্ত এবং লুণ্ঠিত। হতভাগ্য অধিবাসীরা পালিয়ে উপোস করছে এবং আমি কিছুতেই মনে করতে পারি না যে তাদের ওপর নির্মম ব্যবহার করা হয়েছে। সেপাইদেরকে নির্দয়ভাবে হত্যা করার জন্য আপনি আমাকে দোষারোপ করতেন, কিন্তু আমারও মনে হয় সরকার হতভাগা বেনিয়া এবং কায়েতদের প্রতি খুবই রূঢ় ব্যবহার করছেন। নগরে প্রতিদিন বর্ধিত হারে লুণ্ঠনকার্য চলছে। আমার ধারণা প্রত্যেক অফিসার যারা অবরোধ কাজে লিপ্ত আছেন, এ মুহূর্তে অবসর গ্রহণ করলেও কোনো ক্ষতি হবে না। এটা কোনো অহেতুক অনুমান ছিলো না। গ্রীফিথ এমন একজন অফিসারের কথা বলেছেন যার অন্যায়ভাবে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ ছিলো দু’লাখ টাকা। তিনি আরো বলেছেন, “ আমার রেজিমেন্টের অনেক সৈন্য লুণ্ঠনের অনেক দুর্মূল্য বস্তু সামগ্রীর অধিকারী হতে পেরেছিলেন। আমাদের ইংল্যান্ডে ফিরে আসার পরই পুরোপুরি দেখতে পেয়েছিলাম। অধিকসংখ্যক নকমিশন্ড অফিসার এবং সৈন্য স্বেচ্ছায় চাকুরি ছেড়ে দিয়েছিলেন, কারণ মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী যা দিল্লীতে হস্তগত করেছেন এবং তিন বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন, এখন বিক্রয় করার উপযুক্ত সুযোগের সন্ধান করছেন। অনেক দোকানে রত্ন-অলঙ্কার বিক্রয়ের জন্য ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দেখলেই প্রাচ্যের অণুকরণীয় সূক্ষ্ম শিল্পের কথা মনে পড়ে যায়। আমরা জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছি সৈন্যদের কাছ থেকেই তারা সে সব খরিদ করেছে।”

সমগ্র নগরী এখন বিজয়ীদের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। এমনকি নভেম্বর মাসেও তাদের লুণ্ঠনকার্য থামেনি। শুধু সম্পত্তির নিরাপত্তা নয়, মানুষের প্রাণেও কোনো নিরাপত্তা ছিলো না। সে সময়ে উর্দু কবি গালিব দিল্লীতে ছিলেন। তিনি শোক-সন্তপ্ত মনে লিখেছেন, আমার সামনে রক্তের বিশাল দরিয়া। আমার সহস্ৰ সখা প্রাণ হারিয়েছে। কার কথা আমি স্মরণ করবো? কাকে আমি নালিশই বা জানাবো? সম্ভবতো আমার মৃত্যুর পরে আমার জন্য অশ্রুপাত করবার মতোও কেউ নেই। আমরা কবিসুলভ অত্যুক্তির প্রতি পুরোপুরি আস্থা নাও রাখতে পারি। তাহলেও সেপাইদের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ নাগরিকদেরকেও যে একই ভাগ্যের শিকার হতে হয়েছে, তার অন্য প্রমাণ মিলে। জহির দেহলভী দস্তানী গফর’ গ্রন্থে লিখেছেন, অনেক সময় দোষীদের সঙ্গে নির্দোষ মানুষদেরও হত্যা করা হয়েছে। বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ের এ হলো এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ইংরেজ সৈন্যরা রাস্তায় যাকে দেখা পায় তাকেই গুলিকরে মারতে লাগলো। নগরের মধ্যে এমন কতিপয় মানুষ ছিলেন যাদের সমান প্রতিভাধর মানুষ অতীতে জন্মগ্রহণ করেনি এবং ভবিষ্যতেও জন্ম গ্রহণ করবে না। মিয়া মুহম্মদ আমিন পাঞ্জাকুশী নামে একজন বিখ্যাত লেখক মৌলভি ইমান বক্স এবং তাঁর দু’পুত্রও কাঁচা চেহলানের অন্যান্য সকলকে বন্দী করে রাজঘাট ফটকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সেখানে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের মৃতদেহ যমুনা গর্ভে নিক্ষেপ করেছে। মহিলারা তাদের সন্তানের হাত ধরে বেরিয়ে এসে কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কাঁচা চেহলানের সমস্ত কুয়া মৃতদেহে ভরে উঠেছিলো। আমার লেখনীর সাধ্য নেই আর বেশি কিছু লেখে । কত জনকে যে ফাঁসি দেয়া হয়েছে একমাত্র আল্লাহই তার সংখ্যা বলতে পারে। এ কথা লিখেছেন গালিব তাঁর দাসতাম্বু’ কাব্যগ্রন্থে। প্রধান রাজপথ দিয়ে বিজয়ী বাহিনী নগরে প্রবেশ করেছিলো। পথে যার সঙ্গেই দেখা হয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। গোরা সৈন্যরা নগরে প্রবেশ করে নির্দোষ এবং নিরপেক্ষ মানুষদের হত্যা করতে লাগলো। দু’টো তিনটে মহল্লাতে ইংরেজরা সম্পদও লুট করেছে এবং মহল্লাবাসীদেরও নির্মমভাবে হত্যা করেছে।”

রাজনীতি এবং ধর্মের মধ্যে কোনোরকম ভেদাভেদ ব্যতিরেকেই ব্রিটিশ সামরিক অফিসারেরা সমস্ত ভারতীয়দের প্রতি একই রকমের ব্যবহার করতে লাগলো। অধ্যাপক রামচন্দ্র ছিলেন একজন খ্রীস্টান। প্রাণের ভয়ে তাঁকেও ১১মে তারিখে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো। উচ্চ মহলে তাঁর বন্ধু-বান্ধব ছিলেন। মি. মুঈর (পরে স্যার উইলিয়াম মুঈর) তাঁকে মুক্তি দিলেন এবং পরে দিল্লীর পুরোনো কাগজপত্র রক্ষা করার জন্য তাকে দিল্লীর প্রাইজ এজেন্টের অফিসে নিয়োগ করলেন। অঙ্কিত চিত্র, দলিলপত্র, আসবাবপত্র, গৃহসজ্জার উপকরণ কিছুই সেপাইদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। অধ্যাপক রামচন্দ্র নিজেকে খ্রীস্টান এবং সরকারি কর্মচারী বলে পরিচয় দিলেও শিক্ষিত খ্রীস্টান সামরিক অফিসারেরা তাকে অপমান এবং অসম্মান হতে রেহাই দেয়নি।

শুধু তিনি একা নন, তাঁর মতো অন্যান্যেরাও রাজভক্তির কারণে লাঞ্ছিত এবং নিগৃহীত হয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সম্পত্তি লুণ্ঠিত হয়েছে। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মতো তাদেরও গৃহত্যাগী হতে হয়েছে। তারা যে নির্দোষ, তা তাদের এ দুঃখ-যন্ত্রণার উপশম করতে পারেনি।

সৌভাগ্যবশতঃ বেসামরিক অফিসারেরা সামরিক অফিসার বন্ধুদের চোখে চোখে তাকাতে পারতো না। সকলের প্রতি যেভাবে সমান অত্যাচার করা হচ্ছে, যার ফলে সকলকেই শাস্তিভোগ করতে হচ্ছে সে বিষয়ে মিঃ স্যান্ডার্স পুরোপুরি সজাগ ছিলেন। তিনি নাগরিকদের দুঃখ-যন্ত্রণা এবং অসুবিধার কথা কঠোরভাবে ব্যক্ত করলেন। তার মত অনেক উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মচারী সমর্থন করলেন, তার মধ্যে স্যার জন লরেন্স একজন। মুঈর বিডনের কাছে ১৮ নভেম্বর লিখেছিলেন, সামরিক কর্তৃপক্ষ যে নীতি অনুসরণ করছে, তাতে অপরাধী এবং নিরপরাধের মধ্যে যে কোনো প্রভেদ করা হয়নি, তা এক রকম স্পষ্ট এবং তার ফলে নাগরিকেরা যে পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তার অন্ত নেই। এমনকি যারা বিদ্রোহীদের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হয়েছে তাদের রেহাই দেয়া হয়নি। আমার মনে হচ্ছে বর্তমানে এর কোনো বিকল্প নেই। আমি আশা করছি, দিন গত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অধিকতরো ন্যায়ানুগ নীতি অনুসরণ করা হবে। যে সকল লোক আগ্রার সঙ্কটের সময় অটলভাবে আমাদের সমর্থন করেছে যার জন্য তাদের পরিবারকে চরম দুর্ভোগ ভোগ করতে হয়েছে। কাপড়চোপড়, খাদ্য, আশ্রয় এমন কি জীবনের ভয়েও কম্পিত শিহরিত ছিলো, তাদের প্রতি সুবিচারের জন্য অন্ততঃ সুশাসনের প্রয়োজন। সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের মানুষের অভাবের দরুন নগরীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলো।

প্রহরার সুবন্দোবস্ত করতে না পারায় দু’টো ছাড়া দিল্লীর আর সব ফটকগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হলো। নগরে প্রবেশের জন্য কাশ্মীর ফটক এবং নগর থেকে বেরোবার জন্য লাহোর ফটক ভোলা রাখা হলো। প্রাক্তন শাসন ব্যবস্থার সমর্থকদের ওপর জরিমানা করা হলো। ইংরেজদের ধারণা, হিন্দুরা মুসলমানদের চাইতে ইংরেজদের প্রতি অধিকতররা প্রসন্ন। আর মুসলমানেরা পুরোপুরি ইংরেজ বিদ্বেষী । সেজন্য হিন্দুদের জরিমানার অর্থ পরিশোধ করার দায় থেকে রেহাই দেয়া গেলো। জরিমানা পরিশোধ করতে গিয়ে অধিবাসীরা, তাদের সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি হারালো। তাদের শূন্য ঘরের চারটি দেয়াল ছাড়া আর কিছুই রইলো না। তারপর দিল্লীকে পাঞ্জাবের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *