৭১-৭৫. হেমনলিনীদের বাড়ি

৭১.

সময় কেটে যাচ্ছে।

সেই যে বিনয় হেমনলিনীদের বাড়ি গিয়েছিল, তারপর থেকে মাঝে মাঝেই সেখানে যেতে লাগল। ছুটির দিনের সকালে ঘুম ভাঙলেই নিজের ভেতর থেকে কেউ যেন তাড়া দিয়ে দিয়ে তাকে বিছানা থেকে তুলে বাথরুমে পাঠায়। তারপর জামাকাপড় পালটে প্রসাদের ঘরে যাওয়া, রুটিতে মাখন লাগানো, চা-জলখাবার খাওয়া, ইত্যাদি সেরে একসময় বড় রাস্তায় গিয়ে ট্রাম বা বাসে উঠে পড়ে।

হেমনলিনীদের বাড়ি পৌঁছলে স্মৃতিরেখা বা শিশিরের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সে যে যাবে সেটা ওঁরা জানেন। কী কারণে শিশিররা হেমনলিনীদের বাড়িতে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন, বিনয়েরও তা। অজানা নেই। প্রথম দিকে একটা মাস রুমাও এখানে চলে আসত। মাসখানেক কলকাতায় কাটিয়ে সে পাটনায় চলে গেছে। তবে যার জন্য যাওয়া, অনিবার্যভাবেই সে থাকে-ঝুমা।

সেই যুদ্ধের আমলে রাজদিয়ায় থাকতে স্কুল পালিয়ে প্রায়ই ঝুমাদের বাড়ি চলে যেত বিনয়। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে। সেই ঘোরটা নিজের ভেতর কোথায় যেন লুকানো ছিল। সেটাই তাকে টানতে টানতে এখন উত্তর কলকাতায় নিয়ে আসছে।

ফি রবিবারই বিনয় যে হেমনলিনীদের বাড়ি আসে তা কিন্তু নয়, কখনও কখনও টালিগঞ্জে সুধাদের কাছেও চলে যায়। কী কারণে উত্তর কলকাতায় তার ছোটাছুটি সে খবরটা ওরাও পেয়ে গেছে। সুধারা খুশি। সুনীতিরা খুশি। সব্বাই খুশি। নিরুদ্দেশ একটি মেয়ের জন্য বাকি জীবনটা বিনয় ছন্নছাড়া, উদ্ভ্রান্তের মতো মেসে কাটিয়ে দেবে তা হয় না। তার মন যে কুমার দিকে ফিরেছে, সেটা সুলক্ষণ। তাড়াহুড়োর দরকার নেই। এতটুকু দ্বিধাও যদি গোপনে বিনয়ের মনে থেকে থাকে সেটা সম্পূর্ণ নির্মূল করার জন্য সময় দিতে হবে। ঝুমা বি এ পাস করুক। তারপর জাগতিক নিয়মে যা ঘটার ঘটবে।

এটা একটা দিক। অন্য দিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুদের আসা বেশ কিছুটা কমে গেছে। সেখানে শান্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে। আসাম থেকেও নতুন করে উৎখাত হয়ে পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষরা পশ্চিম বাংলায় আসছে না। দম-আটকানো, টান টান পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সহজ হয়ে আসছে। পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি মানে পশ্চিমবঙ্গের স্বস্তি।

আগে হেমনাথের চিঠি কবে আসবে, সেজন্য তীব্র উৎকণ্ঠায় থাকতে হতো। কিছুদিন হল, দু-তিন সপ্তাহ পর পর নিত্য দাস তার চিঠিপত্র নিয়মিত পৌঁছে দিচ্ছে। প্রতিটি চিঠির প্রায় একই বয়ান। রাজদিয়া অঞ্চলই নয়, সারা পূর্ব পাকিস্তানে আপাতত তেমন কোনও উত্তেজনা নেই। আগুন, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড, রাজাকারদের হুমকি-প্রায় বন্ধ হয়েছে। যে পশ্চিমা মুসলমানেরা ভারত থেকে ওখানে গিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল, হিন্দুদের সম্পত্তি গায়ের জোরে দখল করে নিচ্ছিল, তারাও এখন চুপচাপ। প্রাণ বাঁচাতে সর্বস্ব ফেলে স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের হাত ধরে সীমান্তের দিকে যারা পা বাড়াতে যাচ্ছিল তারা এই মুহূর্তে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছে। ওরা আর একটু দেখতে চায়।

হেমনাথ আরও জানিয়েছেন, তারা এখন দুশ্চিন্তামুক্ত। কিছুদিন আগেও ত্রাসে, আতঙ্কে, অসীম উদ্বেগে স্থির করেছিলেন, ভারতে চলে আসবেন। চিরকালের মতো। নিরাপত্তার দিক থেকে এই মুহূর্তে কোনওরকম সমস্যা নেই। বিনয়রা তাদের জন্য যেন চিন্তা না করে।

পূর্ব পাকিস্তান স্বাভাবিক হয়ে এলেও, নতুন করে উদ্বাস্তুদের ঢল না নামলেও, আগে থেকেই লক্ষ লক্ষ মানুষ উৎখাত হয়ে চলে এসেছে। তাদের হাজার সমস্যা। কাজেই ছুটির দিনটা বাদ দিলে পুরানো রুটিনটা একই রকম থেকে গেছে বিনয়ের। আজ ত্রাণশিবির তো কাল জবরদখল কলোনি। যেখানে উদ্বাস্তু সেখানেই বিনয়।

.

আজ সন্ধের একটু পরে পরে অফিসে এসে বেশ অবাকই হয়ে গেল বিনয়। রিপোটিং সেকশন রীতিমতো সরগরম। প্রসাদের সামনে বসে আছে একটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের অচেনা যুবক। রির্পোটাররা তো বটেই, সাব-এডিটরদেরও কেউ কেউ এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। বৃত্তাকারে। যুবকটি দুই হাত এবং মাথা ঝাঁকিয়ে উঁচু গলায় কিছু বলে চলেছে। তার চোখে মুখে কণ্ঠস্বরে প্রবল উত্তেজনা। যারা ভিড় করে ছিল তারা মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে তাকে উসকে উসকে দিচ্ছে। ফলে তার গলা আরও চড়ছে।

জটলার কাছাকাছি যেতেই প্রসাদের চোখ এসে পড়ল বিনয়ের ওপর। যুবকটিকে দেখিয়ে গভীর আগ্রহের সুরে তিনি বললেন, ভালই হল, তুমি এসে গেছ। এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ও আন্দামানে থাকে। সরকারি কাজে মেনল্যাণ্ডে এসেছে।

পরিচয়-পর্ব শুরু হল। যুবকটির নাম নিরঞ্জন চক্রবর্তী। বিনয়ের মতো সেও একজন শরণার্থী। দেশভাগের ঠিক পরে পরেই সর্বস্ব হারিয়ে হাজার হাজার উদ্বাস্তুর সঙ্গে সীমান্তের এপারে চলে এসেছিল। পরিবারে সবসুদ্ধ পাঁচজন মানুষ। নিরঞ্জন, তার মা, বাবা এবং দুটো ছোট ঘোট ভাইবোন।

তারা ত্রাণশিবিরে ওঠেনি। শিয়ালদা স্টেশনেও ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকতে হয়নি। ওদের প্রচুর আত্মীয়পরিজন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই কলকাতায় পাকাপাকিভাবে চলে এসেছিল। তারা ভালমানুষ। খুবই সহৃদয়। চরম বিপদের দিনে নিরঞ্জনদের পাশে দাঁড়িয়েছে। পালা করে একমাস দুমাস করে এর বাড়ি ওর বাড়ি থেকেছে নিরঞ্জনরা। এইভাবে বছর খানেক কেটে গিয়েছিল।

কিন্তু অন্যের আশ্রয়ে দিনের পর দিন কাটানো খুব একটা সম্মানজনক ব্যাপার নয়। তাছাড়া আত্মীয়রা হৃদয়বান হলেও তারা কেউ অঢেল পয়সাওলা লোক নয়। সবাই মোটামুটি চাকরি বাকরি করে সংসার চালায়। কারও মাইনে একটু বেশি, কারও কম। এদের পক্ষে অনন্তকাল বাড়তি পাঁচটি মানুষের দায় নেওয়া সম্ভব নয়। সেটা যে নিরঞ্জনরা বুঝতে পারছিল না তা নয়। কিন্তু তখন তারা নেহাতই নিরুপায়।

দেশে থাকতে থাকতেই বি এসসিটা পাশই করেছিল নিরঞ্জন। কলকাতায় এসে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেনি সে। কাজকর্মের আশায় নানা জায়গায় ছোটাছুটি করেছে। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে কত লোককে যে ধরাধরি করেছে তার লেখাজোখা নেই। বিভিন্ন অফিসের বড়বাবু, মেজবাবু, সেজবাবু থেকে রাজনৈতিক নেতা–কেউ বাদ যায়নি।

এমনকি খবরের কাগজগুলোতেও ঘোরাঘুরি করেছে নিরঞ্জন, যদি কিছু জুটে যায়।

নতুন ভারত-এ আসার আগে অন্য একটা কাগজের চিফ রিপোর্টার ছিলেন প্রসাদ। দৈনিক যুগবার্তা। সেখানেও কাজের খোঁজে নিরঞ্জন গিয়েছিল, সেই সূত্রে প্রসাদের সঙ্গে আলাপ। যুগবার্তায় তার চাকরি হয়নি কিন্তু প্রসাদকে তার ভীষণ ভাল লেগেছিল। মাঝে মাঝেই তার কাছে যেত। ছেলেটার কিছু একটা রোজগারের ব্যবস্থা হোক, সেটা তো তিনি চাইতেনই, নানাভাবে তার জন্য চেষ্টাও করেছিলেন।

রিফিউজি কোটায় গভর্নমেন্ট তখন শরণার্থীদের জন্য চাকরি বাকরির ব্যবস্থা করতে শুরু করেছে। হঠাৎ পি ডরু ডির একটা কাজ পেয়ে নিরঞ্জন আন্দামান চলে যায়। বাবা মা ভাই বোনেরা কলকাতায় এক আত্মীয়র বাড়িতে থেকে গিয়েছিল। পোর্ট ব্লেয়ারে সরকারি কোয়ার্টার পেয়ে এবার সে সবাইকে নিয়ে যাবার জন্য এসেছে।

আন্দামানে চলে গেলেও চিঠিপত্রে প্রসাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযযাগটা ছিল নিরঞ্জনের। প্রসাদ দৈনিক যুগবার্তা ছেড়ে নতুন ভারত-এ জয়েন করেছেন, এ খবরটা তার জানা। আন্দামানে ফিরে যাবার আগে আজ তাই এখানে দেখা করতে এসেছে।

অবাক বিস্ময়ে নিরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে ছিল বিনয়। প্রায় পলকহীন। আন্দামান সম্পর্কে ছেলেবেলা থেকে চমকপ্রদ কত কাহিনিই না শুনে আসছ সে। বঙ্গোপসাগরের সুদুর এই দ্বীপমালায় আঠারো শ সাতান্নর পর সিপাহী বিদ্রোহের বীর সেনানীদের পাঠানো হল। তার পরে পরেই জাহাজ বোঝাই করে ফি বছর ভারতের মেনল্যাণ্ড এবং বর্মা থেকে দুর্ধর্ষ সব অপরাধীদের সারা জীবনের সাজা খাটার জন্য চালান দেওয়া হতে লাগল। আরও পরে বিশ শতকের গোড়ায় ঝাঁকে ঝাকে স্বাধীনতা-সংগ্রামীদেরও। একদিকে খুনী দস্যু এবং মুক্তিযোদ্ধার দল। আর এক দিকে এখানকার অগুনতি ছোট বড় দ্বীপ জুড়ে দুর্ভেদ্য অরণ্যে আদিম সব মানুষ–ওঙ্গে, জায়োয়া, গ্রেট আন্দামানিজ, সেন্টিনালিজ ইত্যাদি। কালো কালো, খর্বকায় নিগ্রো গোত্রের মানবগোষ্ঠী।

আন্দামান মানেই রোমাঞ্চ, রহস্য, এক ধরনের ত্রাসও। পূর্ব পাকিস্তানের এক উদ্বাস্তু যুবক বঙ্গোপসাগর–যার আর-এক নাম কালাপানি-পাড়ি দিয়ে শুধু বেঁচে থাকার জন্য সেখানে চলে গেছে, ভাবতে শিহরন বোধ করে বিনয়। নিরঞ্জন একাই নয়, তাদের পুরো পরিবারটাই আন্দামানে চলে যাবে। কোথায় পূর্ব বাংলার অখ্যাত এক গ্রাম, আর কোথায় বঙ্গোপসাগরের দ্বীপপুঞ্জ! দেশভাগ না হলে জন্মভূমি থেকে উৎখাত হয়ে কোনওদিন কি তাদের সেখানে যাওয়া হতো!

প্রসাদ সবার সঙ্গে নিরঞ্জনের আলাপ করিয়ে দিতে লাগলেন। একসময় বিনয়ের পালা এল। তার নামটাম জানিয়ে বললেন, বিনয়ের দেশও তোমাদের ঢাকা ডিস্ট্রিক্টে। মাত্র কমাস হল ইন্ডিয়ায় এসেছে।

নিরঞ্জন ভীষণ হাসিখুশি, ছটফটে, আমুদে। তার চোখমুখ আলো হয়ে ওঠে। হইচই বাধিয়ে বলে, আপনেও ঢাকাইয়া!

বিনয় ঘাড় কাত করে, হ্যাঁ

বিপুল উৎসাহে নিরঞ্জন বলে, আরে আমাগো দ্যাশের মানুষ। বাড়ি আছিল কুনখানে? ঢাকার শহরে, না গেরামের দিকে?

ছোট একটা টাউনে। নাম রাজদিয়া।

 হে তো বিক্রমপুরে।

হা।

আমরাও বিক্রমপুইরা। আমাগো গেরাম আউশসইতে (আউটশাহী)। রাইজদা থিকা বেশি ফারাকে না। বড় জোর দশ বারো মাইল। হেইখানে গ্যাছেন কুনোদিন?

গেছি দু-তিন বার।

আমরা চক্রবর্তীরা আউশসইয়ের নাম-করা বংশ। ম্যালা প্রপাটি আছিল। দ্যাশভাগের লগে লগে রাজাকারেরা বাড়িতে আগুন ধরাইয়া দিল। জমিজমা দখল কইরা নিল। দ্যাশে থাকলে হোল ফ্যামিলি খুন হইয়া যাইতাম।

এরকম হাল ইস্ট পাকিস্তানের বহু মানুষের।

হ। বলেই কী খেয়াল হতে রীতিমতো অবাক হয়ে যায় নিরঞ্জন, আপনে হপায় (সবে) দ্যাশ থিকা ইন্ডিয়ায় আইছেন। কিন্তু কী চমৎকার এইখানকার কথা কন (বলেন)! এক্কেরে কইলকাত্তাইয়া (কলকাতায় পাকা বাসিন্দা) হইয়া গ্যাছেন। কয় বচ্ছর হইয়া গ্যাল আমি ইন্ডিয়ায় আইছি। যে বাঙ্গাল হেই বাঙ্গালই থাইকা গ্যালাম। দ্যাশের ডায়লগ ছাড়া জিভ্যা দিয়া আর কিছু বাইর হয় না।

নিরঞ্জনের মধ্যে আশ্চর্য রকমের আন্তরিকতা আছে। রয়েছে অফুরান গ্রাম্য সারল্য যা দেশভাগের তুমুল ঝড়ঝাঁপটার মধ্যেও নষ্ট হয়ে যায়নি। পুরোপুরি অটুট রয়েছে। তাকে বড় ভাল লেগে গেল বিনয়ের। ওই যবুকটি পূর্ব বাংলার নগণ্য গ্রাম থেকে চলে এসে বঙ্গোপসাগরের এক দ্বীপপুঞ্জে কীভাবে, কোন পরিবেশে দিন কাটাচ্ছে সে সম্পর্কে ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। সে জিজ্ঞেস করে, আন্দামান কেমন লাগছে আপনার?

নিরঞ্জন বলল, পাহাড়, জঙ্গল, বে অফ বেঙ্গল- হগল মিশাইয়া সিনিক বিউটি এক্যালেন্ট। তবে রিলেটিভ টিলেটিভ কেও তো নাই। মনটা মাঝে মইদ্যে খারাপ হইয়া যায়। অবশ্য কয় বচ্ছরে অনেকের লগে আলাপ অইছে। হেরা মানুষ ভালই। একটু থেমে বলে, ওইহানে যখন চাকরি করি, অ্যাডজাস্ট কইরা তত থাকতে লাগব। হেই চ্যাষ্টাই করতে আছি। হে ছাড়া মা বাবা ভাই বইগগা। লইয়া এইবার যাইতে আছি, অহন আর লোনলি ফিল করুম না। আছিলাম বিক্রমপুইরা, হইয়া যামু আন্দামাইনা বলে প্রাণ খুলে হাসতে লাগল।

বিনয়ের আগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই। নিরঞ্জনের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, মিউটিনির সিপাই আর পরের ফ্রিডম ফাইটারদের কী হাল হয়েছে?

এক শ বচ্ছর আগের হেই মিউটিনিয়ারগো পক্ষে কি বাইচা থাকন সম্ভব? কবেই মইরা ঝইরা গ্যাছে। আর টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির শুরুর দিকে যে ফ্রিডম-ফাইটাররা আন্দামানে গেছিল, তেনাগো কথা উপেন্দ্রনাথ বাড়ুইজ্যার (বন্দ্যোপাধ্যায়) নির্বাসতের আত্মকথায় ডিটেল লিখা আছে। পড়ছেন। বইখান?

বিনয় বিব্রত বোধ করে, না।

নিরঞ্জন বলতে লাগল, গ্রেট বুক। অবশ্যই পড়বেন। উপেনবাবু লিখছেন, ম্যালা ফ্রিডম ফাইটারের আন্দামানেই মৃত্যু অইছে। সেলুলার জেলের সলিটারি সেলে থাইকা থাইকা কেও কেও পাগল অইয়া গ্যাছেন। আবার সাজার ম্যায়াদ (মেয়াদ) কমাইয়া ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট অনেকেরে মেনল্যাণ্ডে পাঠাইয়া দিছে।

ট্রাইবালরা ছাড়া ওখানে কী ধরনের লোকজন আছে?

নাইনটি পারসেন্ট লোকাল বর্ন।

 বুঝতে না পেরে বিনয় বলে, লোকাল বর্ন মানে?

নিরঞ্জন সবিস্তার বুঝিয়ে দেয়। যে খুনী বা মারাত্মক অপরাধের আসামীদের ওখানে চালান দেওয়া হতো তাদের ছেলেমেয়েরা লোকাল বর্ন।

বিনয় জানতে চায়, ক্রিমিনালদের ছেলেমেয়ে! আন্দামানে তাদের বিয়ে হতো!

নিরঞ্জন হাসতে থাকে, নিশ্চয়। বিয়াশাদি না হইলে পোলাপান জন্মাইব কী কইরা?

কিন্তু

বিনয়কে শেষ করতে দিল না নিরঞ্জন। তার মুখ থেকে প্রশ্নটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, মার্ডারারগো মাইয়া দিল কারা? আন্দামানে ক্রিমিনালগুলো বউ পাইল কেমনে–এই হগল তো জানতে চান?

হা– মাথা কাত করে বিনয়।

এত কথা কইতে গ্যালে রাইত কাবার হইয়া যাইব। হুধা (শুধু এইটুক শুইনা রাখেন, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ইণ্ডিয়া আর বার্মা থিকা পুরুষ কয়েদিই না, মাইয়া কয়েদিগোও আন্দামানে পাঠাইত। খুনখারাপিতে মাইয়ারাও কম যায় না। পুরুষগো লেইগা যেমুন সেলুলার জেল। মাইয়াগো লেইগা আছিল রেন্ডিবারিক জেল। হেই জেল আর নাই। উৎসুক শ্রোতা পেয়ে নিরঞ্জনের উৎসাহ বেড়েই চলে। একনাগাড়ে সে বলতে থাকে, আন্দামানে কয়েদিরা-পুরুষই হউক আর মাইয়াই হউক-শান্তশিষ্ট অইয়া থাকলে বিয়া শাদি করনের পারমিশান পাইত। তাগো দেওয়া অইত ম্যারেজ সার্টিফিকেট। এয়াগোই পোলামাইয়া নাতি নাতিনরাই অইল লোকাল বর্ন।

 শুনতে শুনতে হাঁ হয়ে গিয়েছিল বিনয়। সে একাই না, নিরঞ্জনকে ঘিরে অন্য যারা দাঁড়িয়ে বা বসে আছে, তাদেরও একই হাল। মেয়ে কয়েদি, রেণ্ডিবারিক জেল, কয়েদিদের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা এবং তাদের বংশধরদের সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। বঙ্গোপসাগরের এক দুয়ে দ্বীপপুঞ্জ জুড়ে কত যে রহস্যময় ইতিহাস!

বিনয় জিজ্ঞেস করে, ক্রিমিনালদের ছেলেমেয়েরা তো-

তার মনোভাবটা আঁচ করে নিয়ে নিরঞ্জন ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকায়, না না, হেরা ক্রিমিনাল হয় নাই। এয়াগো কেও ইঞ্জিনিয়ার, কেও ডাক্তার, কেও স্কুল টিচার।

চমকের পর চমক। নিরঞ্জন থামেনি, লোকাল বর্নরা তো আছিলই। ব্রিটিশ আমলে মেনল্যাণ্ড থিকা সরকারি চাকরি লইয়া অনেকে গ্যাছে। ইণ্ডিপেনডেন্সের পর অহন প্রচুর সুযুগ সুবিধা। কইলকাতা

আর মাদ্রাজ থিকা জাহাজ ভইরা ভইরা মানুষ যাইতে আছে। বেশির ভাগই পোর্ট ব্লেয়ারে, মায়াবন্দরে গিয়া বিজনেস ফাইন্দা (কেঁদে) বইছে। আমার লাগান কেও কেও সারভিস লইয়াও যায়। পাঞ্জাবি বিহারি মারাঠি তেলেঙ্গিতে আইল্যাণ্ড ছাইয়া গ্যাছে। আন্দামান য্যান একখান মিনি-ইণ্ডিয়া।

বিনয় বলে, বাঙালির পার্সেন্টেজ কীরকম?

বাঙালির প্রসঙ্গ ওঠায় আচমকা কিছু মনে পড়ে যায় নিরঞ্জনের। চকিতে মুখ ফিরিয়ে প্রসাদের দিকে তাকায় সে। প্রসাদদা, আপনেরা কি হোনছেন, গভর্নমেন্ট আন্দামানে বাঙ্গালি রিফিউজিগো রিহ্যাবিলিটেশনের লেইগা পাঠানের কুনো প্ল্যান নিছে কি না?

প্রসাদ বললেন, পশ্চিমবঙ্গ ছোট স্টেট। মাত্র তেত্রিশ হাজার স্কোয়ার মাইলের মতো এরিয়া। এমনিতেই এখানে পপুলেশনের বিরাট চাপ। তার ওপর এর মধ্যেই কুড়ি লাখের মতো রিফিউজি ইস্ট পাকিস্তান থেকে চলে এসেছে। একটা ছোট রাজ্যের পক্ষে বাড়তি মানুষের প্রেসার নেওয়া সম্ভব নয়। শুনেছি, বিহারে, ওড়িশায়, সেন্ট্রাল প্রভিন্সে কিংবা ইণ্ডিয়ার অন্য বড় স্টেটগুলোয় যেখানে যেখানে ফাঁকা জায়গা পাওয়া যাবে সেইসব এলাকায় বাঙালি উদ্বাস্তুদের সেটেলমেন্টের কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু আন্দামানের কথা তো জানি না। বিনয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাজ তো রিফিউজিদের নিয়ে। এমন কিছু শুনেছ?

এতক্ষণ প্রসাদ যা বলছিলেন, অর্থাৎ শরণার্থীদের ইণ্ডিয়ায় অন্য প্রভিন্সে নিয়ে যাবার কথাই শুনেছে বিনয়। আন্দামানে সেটেলমেন্টের কোনও পরিকল্পনা হয়েছে কি না, তারও জানা নেই। বলল, না–

প্রসাদ নিরঞ্জনের কাছে জানতে চাইলেন, তুমি কার কাছে শুনেছ?

নিরঞ্জন যা উত্তর দিল, সংক্ষেপে তা এইরকম। পোর্ট ব্লেয়ারে আন্দামান নিকোবর আইল্যান্ডের চিফ কমিশনারের অফিস থেকে এইরকম একটা আভাস সে পেয়েছে। তাছাড়া, দক্ষিণ আন্দামান আর মধ্য আন্দামানে জাঙ্গল ফেলিং শুরু হয়েছে। অরণ্য নির্মূল করে মানুষের বসবাসের জন্য প্রচুর জমি বার করা হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, খুব শিগগির উত্তর আন্দামানেও এই প্রক্রিয়ায় কাজ শুরু হবে।

নিরঞ্জন বলতে লাগল, আমি তো পি.ডব্লু.ডিতে কাম করি। আমারে অফার দেওয়া অইছে, রিফিউজি অ্যাণ্ড রিহ্যালিটেশন ডিপার্টমেন্টে কাম করতে রাজি কি না। এই হগল দেইখা শুইনা মনে অইছে, গভর্নমেন্ট রিফিউজিগো উইখানে পাঠাইতে পারে। প্রসাদদা, সত্যই যদি হেইটা হয়, আমি রিহ্যাবিলিটেশনেই যামু।

প্রসাদ শান্ত, গম্ভীর ধরনের মানুষ। গলা উঁচুতে তুলে কখনও কথা বলেন না। উচ্ছ্বাস কম। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁকে রীতিমতো উত্তেজিত দেখাচ্ছে। বললেন, এ তো একটা বিরাট খবর। তাঁর টেবলের সামনে ভিড়ের ভেতর রিপোর্টিং সেকশনের মণিলাল করও রয়েছে। তাকে বললেন, তোমার তো রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিউটি। বিধানবাবু তোমাকে পছন্দ করেন। আন্দামানের খবরটা তার কাছ থেকে যেভাবেই হোক জেনে নিতে চেষ্টা করবে। বিনয়, তুমিও খবর নিও।

মণিলাল আর বিনয়, দুজনেই বলল, নিশ্চয়ই নেব দাদা

নিরঞ্জন বলে, প্রসাদদা আন্দামানের জমি হাই ক্লাস। ভেরি ফার্টাইল ল্যাণ্ড। ইস্ট পাকিস্তানের। রিফিউজি যারা দ্যাশে চাষবাস লইয়া আছিল, হেগো যদি হেইখানে লইয়া যাওন যায়, সোনা ফলাইয়া দিতে পারব। তার উপুর বে অফ বেঙ্গলে কত যে মাছ তার লিখাজোখা নাই। সাত জন্ম খাইলেও ফুরাইব না। রিহ্যাবিলিটেশন যদি সত্যই হয়, সুযুগটা ছাড়ন ঠিক অইব না। আন্দামান সেকেণ্ড ব্যাঙ্গল অইয়া উঠব। ওয়েস্ট ব্যাঙ্গলের উপুর চাপ অনেক কইমা যাইব। উদ্দীপনায়, তার চোখমুখ ঝকঝক। করতে থাকে।

নিরঞ্জনকে লক্ষ করছিল বিনয়। বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ যুগলের মুখটা মনে পড়ে গেল তার। এর মধ্যে নানা কাজে এমনই জড়িয়ে গিয়েছিল, নানা দুশ্চিন্তায় এতই উতলা থাকতে হয়েছে যে মুকুন্দপুর এবং যুগলের কথা ভাবার ফুরসতই পায়নি।

যুগল অক্ষরপরিচয়হীন, দেশে থাকতে হেমনাথের বাড়িতে কামলা খাটত। কিন্তু তার মধ্যে রয়েছে। এক বিশাল, স্বপ্নদর্শী মানুষ। দেশভাগ না হলে কোনওদিনই তার হদিস পাওয়া যেত না। সে রাজদিয়া এবং তার চারপাশের গ্রামগঞ্জের সর্বস্বখোয়ানো, আশাহীন, ভবিষ্যহীন, অসংখ্য ছিন্নমূল মানুষকে শিয়ালদা স্টেশন, ত্রাণশিবির এবং কলকাতার ফুটপাথ থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে এনে মুকুন্দপুরে নতুন এক পূর্ব বাংলা গড়ে তুলছে। অপার মমতায়, অফুরান উদ্যমে। মহান কোনও শিল্পীর মতো। যুগলের মতোই নিরঞ্জনও চায় আন্দামানে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নেওয়া হোক, এই দ্বীপমালা যেন নতুন এক বঙ্গভূমি হয়ে ওঠে।

নিরঞ্জন বলছিল, রিফিউজরা যদি শ্যাষ তরি (অবধি) আন্দামানে যায়ই, তাগো লেইগা জান দিয়া দিমু। পাকিস্তান থিকা আইয়া শিয়ালদায়, রিলিফ কেম্পগুলানে কীভাবে যে হেরা নরকবাস করতে আছে, নিজের চোখে তো দেখছি। ভিটামাটি ফালাইয়া অন্য দ্যাশে উদ্বাস্তু অইয়া আহনের কী কষ্ট হে আমি জানি। একটু থেমে বলে, এই মানুষগুলার লেইগা কিছু একটা করন লাগবই। আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে বিদায় নেয় নিরঞ্জন। আন্দামানবাসী, স্বপ্নদ্রষ্টা, উদ্বাস্তু যুবকটি। বিনয়ের মনে গভীর ছাপ রেখে যায়।

.

৭২.

বঙ্গোপসাগরের অজানা দ্বীপপুঞ্জ থেকে চকিতের জন্য এসে নিরঞ্জন চক্রবর্তী নামে যুবকটি বিনয়কে। নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। তারপর দেখতে দেখতে আট নটা মাস ঝড়ের গতিতে যেন উড়ে গেল। এই সময়টায় পৃথিবীর এই অংশে বা বিনয়ের জীবনের আহ্নিক গতিতে তেমন কোনও হেরফের ঘটেনি। একই নিয়মে তা কেটে যাচ্ছিল।

এই কটা মাস পাকিস্তান ছিল অনেকটাই শান্ত। এপার বাংলায় ভিটেমাটি খোয়ানো মানুষের ঢল অনেকটাই থেমে গেছে। তবে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ আগেই এসে পড়েছে তাদের পুনর্বাসন নিয়ে মিটিং মিছিল উত্তেজনা চলছিলই। ছিল প্রচণ্ড হইচই, অস্থিরতা। আগের মতোই বিনয়কে এ-সবের পেছনে সারাদিনের অনেকটা সময় ছুটে বেড়াতে হয়। তাছাড়া ঝুমা আছে, হেমনলিনী শিশির স্মৃতিরেখারা আছেন। ঝুমাকে সপ্তাহে দু-তিন দিন না দেখলে এখন ভাল লাগে না। মন উতলা হয়ে ওঠে। তার সঙ্গ যত নিবিড় হচ্ছে, স্মৃতির অ্যালবামে সাজানো ঝিনুকের ছবির ওপর ততই ধূসরতার পোঁচ আরও গাঢ় হয়ে পড়ছে। উদ্বাস্তুদের ঘিরে একদিকে কঠোর নির্মম বাস্তব, অন্যদিকে ঝুমাকে নিয়ে উতরোল স্বপ্নের ঘোর। দুইয়ের মাঝখানে দিনগুলো তার নিজস্ব নিয়মে কেটে যাচ্ছিল।

কিন্তু পাকিস্তান এক বিচিত্র রাষ্ট্র। ঘৃণা বিদ্বেষ হিংসা এবং অজস্র রক্তপাতের মধ্যে যার জন্ম, সেখানে এক কোটির মতো সংখ্যালঘু এখনও থেকে গেছে। রয়েছে তাদের প্রচুর জমিজমা এবং দালানকোঠা। রয়েছে তাদের ঘরে যুবতী মেয়েরা। ফলে ওখানে শান্তি ব্যাপারটা খুবই ঠুনকো। কাঁচের বাসনের মতো। দেশটার কোণে কোণে জমা হয়ে আছে বিদ্বেষ আর অবিশ্বাসের বারুদ। যে-কোনও ছুতোনাতায় যখন তখন সেগুলোতে এসে পড়তে পারে আগুনের একটা ফুলকি। ঠিক তেমনটাই ফের ঘটল। মাঝখানে কয়েক মাসের ক্ষণস্থায়ী ভঙ্গুর শান্তিটি ভেঙেচুরে খান খান হয়ে গেল।

পূর্ব পাকিস্তানে নতুন করে দাঙ্গার সূচনা কীভাবে হল, তার কারণগুলো পশ্চিম বাংলায় বসে সঠিক জানা সম্ভব হচ্ছিল না। তবে সীমান্তের ওপার থেকে টুকরো টুকরো যে খবর পাওয়া যাচ্ছিল তা মোটামুটি এইরকম। তখনও পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি কর্মীদের সিকিভাগ হিন্দু। ডাক্তার, কবিরাজ, স্কুলের শিক্ষক, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, উকিল ইত্যাদি শতকরা ষাট ভাগেরও বেশি। এরা হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকের চক্ষুশূল। এরা যদি দেশ ছেড়ে চলে যায়, অনেকেরই সুবিধা হয়। তাছাড়া বাকি হিন্দুরা এক লহমাও ওখানে পড়ে থাকবে না। কার ভরসায় থাকবে? অথচ এই পাকিস্তান যে তাদেরও জন্মভূমি, তাদেরও স্বদেশ, তাদের পিতৃপুরুষ আবহমান কাল এখানকারই বাসিন্দা-এ-সব আর মানছে কে?

আসলে বিদ্বেষ হল অন্ধ, বধির। তার বিবেক নেই, বোধ নেই। যা আছে তা হল হাঙরের মতো হিংস্র দাঁত আর চিতার মতো নখ। পাকিস্তান মাঝে মাঝে দাঁত এবং নখ লুকিয়ে রাখে, তখন ক্ষণিকের শান্তি। তারপর আবার সেগুলো বেরিয়ে আসে।

দেশভাগের ঠিক আগে আগে সেই ছেচল্লিশ সাল থেকে যা ঘটে আসছে ফের তা শুরু হয়ে গেছে। খুন, আগুন। পুর্ব পাকিস্তানে এক জেলা থেকে আর এক জেলায় সে-সব ছড়িয়ে পড়তে লাগল। হননকারীরা, ধর্ষকেরা দেশটাকে সেই আদিম, বর্বর যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে লাগল।

তাণ্ডব চরম পর্যায়ে পৌঁছল একটা গুজবের সুতো ধরে। একসময় অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ফজলুল হক। তার কর্মক্ষেত্র তখন কলকাতা। রাজনৈতিক নেতারা ছাড়াও, এই শহরের অনেক বিশিষ্ট মানুষ ছিলেন তারা প্রীতিভাজন বন্ধু। ঝাউতলা অঞ্চলে চমৎকার একখানা বাড়িও করেছিলেন। কলকাতায় তিনি সেখানেই থাকতেন।

দেশভাগের পর হক সাহেব পাকাপাকিভাবে ঢাকায় চলে যান। এই বাংলার সঙ্গে তার সম্পর্কে ছেদ পড়ে।

ফজলুল হক পূর্ববাংলার মানুষ। জীবনের শেষ পর্বটা পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে সেখানকার নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তখন জড়িয়ে পড়েছেন, কলকাতায় আর ফেরার সম্ভাবনাই নেই। কাজেই ঝাউতলার বাড়ি রাখার কোনও মানে হয় না।

হঠাৎই একদিন তিনি কলকাতায় চলে আসেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল : ওখানকার বাড়ি বিক্রি করা; তাছাড়া এপার বাংলার পুরনো সহকর্মী এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছাটাও ছিল।

হক সাহেব আবেগপ্রবণ মানুষ। জীবনের সেরা সময়টা যেখানে কাটিয়ে গেছেন সেখানে এক সময়ের চেনাজানা মানুষজনকে পেয়ে কী খুশিই না হয়েছিলেন।

কিন্তু এই আনন্দ খুবই ক্ষণস্থায়ী। আচমকা পূর্ব পাকিস্তানে কারা যেন চাউর করে দিল হক সাহেবকে। কলকাতায় খুন করা হয়েছে। গুজবের হাজারটা পাখনা থাকে। বেড়া আগুনের মতো সেটা ফুলে ফেঁপে সহস্রগুণ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। খুলনায় রাজশাহিতে বরিশালে সিলেটে চট্টগ্রামে, সর্বত্র খুন খারাপি শুরু হয়ে গেল। নিমেষে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠল সুবিশাল এক কসাইখানা। হাজার হাজার মানুষ লাশে পরিণত হল। গ্রামে গঞ্জে শহরে রক্তের স্রোত বয়ে যেতে লাগল। পুড়ে ছাই হয়ে গেল কত যে বাড়িঘর। সাতপুরুষের দালান কোঠা পলকে ধ্বংসস্তূপ। ঘাতকবাহিনীর নজর এড়িয়ে যারা কোনওরকমে বেঁচে ছিল, তারা ছুটল সীমান্তের দিকে। পূর্ব পাকিস্তানের হননপুরী ছেড়ে ওরা ভারতে পালাতে চায়। শয়ে শয়ে নয়, হাজারে হাজারে নয়, লাখে লাখে। কলকাতায় নতুন করে ছিন্নমূল মানুষের স্রোত বইল।

সারা ভারতবর্ষ এই নিদারুণ গণহত্যায় স্তম্ভিত। উৎকণ্ঠিত জওহরলাল নেহরু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি খানকে পর পর চিঠি লিখতে লাগলেন, যেভাবে হোক এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। তিনি ছুটে এলেন পশ্চিম বাংলায়।

ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়কে সঙ্গে নিয়ে গেলেন সীমান্তে! স্বচক্ষে দেখলেন কীভাবে আতঙ্কগ্রস্ত শরণার্থীরা দলে দলে চলে আসছে। তাদের মুখে শুনলেন, কোন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ।

এদিকে ফজলুল হককে অনুরোধ করা হল, তিনি যেন অবিলম্বে পাকিস্তানে ফিরে যান। তাঁকে স্বচক্ষে দেখলে উন্মত্ত জল্লাদেরা বুঝতে পারবে, কলকাতায় তার গায়ে একটি আঁচড়ও লাগেনি। দেশে ফিরে সমস্ত কিছু দেখে শুনে শিউরে উঠছিলেন হক সাহেব। তারপর হিংস্র উন্মত্ততা বন্ধ করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন।

পূর্ব পাকিস্তানের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গেও শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা! দাঙ্গা ঠিক নয়, একতরফা নির্বিচার হনন। হুগলি হাওড়া আর ব্যারাকপুরের চটকলগুলোতে যে বিহারি মুসলমান শ্রমিকরা কাজ করত তাদের ওপর চলল প্রচণ্ড হামলা। খুন হল অজএ নিরীহ নিরপরাধ অসহায় মানুষ।

জওহরলাল আবার কলকাতায় এলেন। ছুটলেন হুগলি, হাওড়ায়। সঙ্গে  রায়। কড়া নির্দেশ দেওয়া হল, প্রতিহিংসা বন্ধ করতে হবে। একবিন্দু রক্তপাতও যেন না

পূর্ব পাকিস্তানের মতো অত বিরাট আকারে না হলেও, পশ্চিমবঙ্গের কোনও কোনও এলাকা তখন বধ্যভূমি। এমন অভিশপ্ত, অন্ধকার দিন এপার বাংলা ওপার বাংলার বাঙালির জীবনে খুব সম্ভব আর কখনও আসেনি।

এরই মধ্যে সীমান্তের ওপার থেকে আরও কয়েক লক্ষ শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছে।

একটা জাতির জীবনে এত সব নিদারুণ ঘটনা ঘটে চলেছে, আর তারই ভেতর পুনর্বাসনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার আন্দামানে উদ্বাস্তু পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল। তার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল আগেই।

কিছুদিন ধরে নানা ত্রাণশিবিরে গিয়ে সরকারি পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মী এবং অফিসাররা কোন কোন উদ্বাস্তু পরিবারকে আন্দামানে পাঠানো হবে তার তালিকা তৈরি করছিল। এখনও করে চলেছে। বেশ কিছু পরিবারকে এর মধ্যে আন্দামানে পাঠানোও হয়েছে। এই নিয়ে ত্রাণশিবিরগুলোতে চলছে তুমুল আলোড়ন।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে নতুন করে যে মানুষের ঢল নেমেছে তাদের নিয়েই বিনয় এখন সারাক্ষণ ব্যস্ত। ঝিনুককে সঙ্গে করে সে যখন দেশ ছাড়ে তখন দিনে একটাই ট্রেন উদ্বাস্তুদের নিয়ে কলকাতায় আসত। সেটার গায়ে একটা তকমা আঁটা থাকত–রিফিউজি স্পেশাল। এখন সারাদিনে কত রিফিউজি স্পেশাল যে আসছে তার লেখাজোখা নেই। সেগুলোর আসার ঠিকঠিকানা নেই। সকালে আসছে, দুপুরে আসছে, বিকেলে আসছে, সন্ধেয় আসছে, এমনকি মধ্যরাতেও।

আন্দামানে উদ্বাস্তু পাঠানোর সরকারি সিদ্ধান্ত জানাজানি হবার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আরও বেশি করে রাস্তায় নেমে পড়েছে। দেশভাগের পর কত যে সংগঠন তৈরি হয়েছে তার হিসেব নেই। উদ্বাস্তু উন্নয়ন সমিতি, উদ্বাস্তু কল্যাণ পরিষদ,পশ্চিমবঙ্গ বিকাশকেন্দ্র ইত্যাদি ইত্যাদি। তারাও হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে না। এখন ট্রামবাস থামিয়ে, যানজট পাকিয়ে কলকাতার নানা প্রান্তে অগুনতি মিছিল থেকে স্লোগানে স্লোগানে মহানগরীর আকাশ চৌচির হয়ে যাচ্ছে।

পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের আন্দামানে নিয়ে যাওয়া
চলবে না, চলবে না–
একজন উদ্বাস্তুও পশিচমবঙ্গের বাইরে
 যাবে না, যাবে না
পশ্চিমবঙ্গেই উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন
দিতে হবে, দিতে হবে।
 উদ্বাস্তুদের নিয়ে সর্বনাশা খেলা–।
বন্ধ কর, বন্ধ কর।

ত্রাণশিবির এবং জবরদখল কলোনিগুলোতে আপাতত যাওয়া বন্ধ রেখেছে বিনয়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই এখন সে ছোটে শিয়ালদা স্টেশনে। সমস্ত দিন সেখানেই পড়ে থাকে। দুপুরে কাছাকাছি কোনও পাইস হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসে। সন্ধের পর নতুন শরণার্থীদের সম্বন্ধে নানা তথ্য জোগাড় করে চলে যায় নতুন ভারত-এর অফিসে। ঝড়ের গতিতে প্রতিবেদন লিখে ফের শিয়ালদা। মেসে ফিরতে ফিরতে মাঝরাত। কখনও কখনও শিয়ালদাতেই পুরো রাত থেকে যেতে হয়।

এরই মধ্যে সীমান্তেও গেছে কয়েকবার। এই তো সেদিন জওহরলাল এবং বিধান রায় যখন বনগাঁ শহরে গেলেন, খবরের সন্ধানে বিনয়কে সেখানেও ছুটতে হয়েছিল। তাছাড়া, সব উদ্বাস্তু কলকাতায় আসে না, বর্ডারের কাছাকাছি রেল স্টেশনগুলোর প্ল্যাটফর্মে, আকাশের নিচে ভোলা মাঠে, গাছতলায় ঝুপড়ি বানিয়ে ঘাড় গুঁজে ছেলেমেয়ে বউ নিয়ে পড়ে আছে। তাদের সঙ্গে দেখা করা, কথা বলা জরুরি।

আন্দামানের ব্যাপারটা পুরোপুরি দেখছেন প্রসাদ নিজে। নিরঞ্জনের সঙ্গে কমাস আগে আলাপ হবার পর বঙ্গোপসাগরের ওই দ্বীপমালা সম্পর্কে বিনয়ের প্রচণ্ড আগ্রহ। উদ্বাস্তুদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিনয়ের ইচ্ছা আন্দামানে যায়। কিন্তু প্রসাদকে তা বলা যায় না। সে আনকোরা রিপোর্টার। তাকে যে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে সেটাই মুখ বুজে করে যেতে হবে।

তবে এত দৌড়ঝাঁপের মধ্যেও বিনয়ের কানে এসেছে, নিরঞ্জন তার পুরানো ডিপার্টমেন্ট ছেড়ে রিফিউজি অ্যাণ্ড রিহ্যাবিলিটেশন মিনিস্ট্রির নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে। এর ভেতর দু দুবার কলকাতায় এসে জাহাজ বোঝাই করে উদ্বাস্তু নিয়ে পোর্ট ব্লেয়ারে গেছে।

কলকাতায় এলে নিরঞ্জন প্রসাদের সঙ্গে দেখা করবেই। মাঝখানে দুবার সে উদ্বাস্তু নিতে এসেছিল। তখনও প্রচণ্ড ছোটাছুটির ভেতর সময় করে নতুন ভারত-এ হাজির হয়েছে। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। নিরঞ্জন যখন এসেছে, তখন সে হয় শিয়ালদায়, নইলে সীমান্তের কোনও রেল স্টেশনে বা ছোটখাটো কোনও শহরে বা মাঠেঘাটে, উদ্বাস্তুদের মধ্যে।

.

আজ সন্ধেবেলায় শিয়ালদা থেকে নতুন ভারত-এর অফিসে আসতেই প্রসাদ বললেন, তাড়াতাড়ি রিপোর্টটা লিখে ফেল। তারপর তোমার সঙ্গে খুব দরকারি কথা আছে।

উৎসুক সুরে বিনয় জিজ্ঞেস করে, কী কথা প্রসাদদা?

পরে শুনো। আগে কাগজ কলম নিয়ে তোমার টেবলে গিয়ে বসো।

ঘণ্টাখানেকের ভেতর প্রতিবেদনটা শেষ করে প্রসাদের সামনে এসে দাঁড়ায় বিনয়। লেখাটা তার হাত থেকে নিয়ে টেবলে পেপারওয়েট চাপা দিয়ে রেখে প্রসাদ উঠে পড়েন। –চল।

বিনয় অবাক। বলে, কোথায়?

 জগদীশবাবু তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।

জগদীশবাবু, অর্থাৎ নতুন ভারত-এর মালিক। সর্বেসর্বা। বুকের ভেতর হাতুড়ির ঘা পড়তে থাকে বিনয়ের। হঠাৎ এই তলব কেন? তার কাজে কি কোনও খুঁত বা ভুল ধরা পড়েছে? সে তো কখনও ফাঁকি দেয় না। লেখা যাতে পাঠকের মনে ধরে, তথ্যে যাতে গোলমাল না থাকে, সেদিকে তার নজর। তা হলে? ঢোক গিলতে গিলতে জিজ্ঞেস করে, উনি যেতে বলেছেন কেন?

বিনয়ের কাঁধে আলতো চাপড় দিয়ে প্রসাদ মৃদু হাসেন।–ভয় নেই। একটা সুখবর পাবে।

জগদীশ গুহঠাকুরতা তার কামরায় একাই ছিলেন। অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। নানা ধরনের ব্যবসা, কলকারখানা এবং খবরের কাগজ–সব মিলিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য চালাতে হয়। ধানাই পানাই করার সময় নেই। বিনয়দের বসতে বলে সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এলেন। বিনয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার লেখাগুলো রেগুলারলি পড়ি। গুড ওয়ার্ক। যাই হোক, তোমাকে একটা নতুন দায়িত্ব দিতে চাই

কাগজের মালিক তার লেখার প্রশংসা করছেন। খুশিতে বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। বিনয় কোনও প্রশ্ন না করে অপেক্ষা করতে থাকে।

জগদীশ থামেননি, তুমি নিশ্চয়ই জানো, আন্দামানে রিফিউজিদের রিহ্যাবিলিটেশন শুরু হয়েছে। ইণ্ডিয়ার কোনও কাগজ থেকে এখনও ওখানে লোক পাঠানো হয়নি। তারাপদবাবু, প্রসাদবাবু এবং আমার ইচ্ছে, তুমি আন্দামানে যাও। রিহ্যাবিলিটেশন কীরকম হচ্ছে, সব নিজের চোখে দেখে ওখান থেকেই রিপোর্ট পাঠাবে। তোমার ওপর আমাদের আস্থা আছে। একটু থেমে জানতে চাইলেন, তোমার কোনও অসুবিধা নেই তো?

আন্দামানে যাবার কথা আগেই ভেবে রেখেছিল বিনয়। ব্যগ্রভাবে বলল, না স্যার

বেশ কিছুদিন ওখানে থাকতে হবে।

যতদিন দরকার, থাকব।

জগদীশ বললেন, গুড। খুব শিগগির কিছু রিফিউজি ফ্যামিলিকে আন্দামানে পাঠানো হচ্ছে। আমরা চাই তুমি ওদের সঙ্গেই যাও। কীভাবে যাবে, কবে যাবে, প্রসাদবাবু সব বুঝিয়ে দেবেন।

কথা হয়ে গিয়েছিল। বিনয়রা উঠে পড়ে।

.

৭৩.

বিনয়কে সঙ্গে করে রিপোর্টিং সেকশনে নিজের টেবলে এসে বসলেন প্রসাদ। বললেন, তোমার ওপর অথরিটির কীরকম আস্থা, বুঝতে পারলে তো? খুব মন দিয়ে আন্দামান রিহ্যাবিলিটেশনের রিপোর্টগুলো করবে। কলকাতা থেকে কীভাবে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কোথায় রাখা হচ্ছে, সেখানকার পরিবেশ কেমন, খুঁটিনাটি কিছু বাদ দেবে না।

নতুন ভারত-এর সর্বেসর্বা জগদীশ গুহঠাকুরতা তার মতো একজন আনভিজ্ঞ, নতুন সাংবাদিককে এত বড় একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন। উদ্দীপনায় ভেতরে ভেতরে টগবগ করে ফুটছিল বিনয়। বলল, আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব প্রসাদদা

শুধু রিফিউজিই নয়, ওখানে প্রায় এক শ বছর আগে পেনাল কলোনি গড়ে উঠেছিল। সে-সব সম্বন্ধেও আলাদাভাবে লিখবে

যে খুনী-ডাকাতদের আন্দামানে পাঠানো হয়েছিল আপনি কি তাদের কথা বলছেন?

হ্যাঁ। তাছাড়া রয়েছে বহুকালের পুরোনো জংলী আদিবাসীরা। ওরাই সন্স অফ দা সায়েল। তাদের সম্বন্ধেও খবরাখবর নিয়ে লেখা পাঠাবে। রিফিউজি রিহ্যাবিলিটেশনটা হাইলাইট করবে ঠিকই, তবে অন্য দিকগুলোর ওপরও জোর দেবে। যাতে আন্দামান সম্পর্কে পাঠক একটা টোটাল পিকচার পেয়ে যায় সেটা মাথায় রাখবে।

অন্য সব দিকের কথা এখনও ভাবেনি বিনয়। তার ভাবনাচিন্তা জুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের সুদূর এক দ্বীপপুঞ্জে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন। সে বলল, যা বললেন, আমি তাই করব প্রসাদদা।

একটু চুপচাপ।

 তারপর প্রসাদ জিজ্ঞেস করেন, আন্দামান জায়গাটা সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণা আছে? হঠাৎ কেন এই প্রশ্ন, বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকে বিনয়। আন্দামান সম্বন্ধে যেটুকু সে জানে তা খুবই ভাসা ভাসা, অস্পষ্ট। ভারতের মেনল্যাণ্ড থেকে একসময় মারাত্মক অপরাধীদের সেখানে চালান করা হতো। অবশ্য এই শতকের গোড়ায় দ্বীপান্তরী সাজা দিয়ে অগুনতি স্বাধীনতা সংগ্রামীকে সেখানে পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া ওখানকার লোকাল বন, সেলুলার জেল, রেন্ডিবারিক জেল, নানা আদিবাসী–এদের সম্পর্কে মাসকয়েক আগে নিরঞ্জনের কাছে যা শুনেছিল তার বেশি জানা নেই বিনয়ের। প্রসাদকে সেই কথাই বলল সে।

প্রসাদ বললেন, কোনও একটা নতুন জায়গায় যাবার আগে তার সম্বন্ধে সমস্ত কিছু জেনে নেওয়া উচিত। তার টোপোগ্রাফি, হিস্ট্রি, পিপল, ক্লাইমেট। তুমি এক কাজ কর–

বলুন

আমাদের অফিস লাইব্রেরিতে আন্দামান সম্পর্কে বিশেষ কিছু পাবে না। ন্যাশনাল লাইব্রেরির মেম্বারশিপ কার্ড করে নাও। জগদীশবাবুকে দিয়ে একটা রেকমেন্ডেশন লেটার লিখিয়ে দেব। কার্ডটা চট করে হয়ে যাবে। ওখানে ডিটেলে সব পাবে। .

আচ্ছা

একটু ভেবে বিনয় বলল, জগদীশবাবু বললেন, খুব শিগগিরই আন্দামান থেকে রিফিউজি নেবার জন্যে রিহ্যাবিলিটেশনের লোকেরা আসবে। কবে আসতে পারে?

প্রসাদ বললেন, মনে হচ্ছে মাসখানেকের ভেতর।

আপনি বলেছিলেন, আগে দুবার নিরঞ্জন চক্রবর্তী এসে আন্দামানে রিফিউজি নিয়ে গেছে। এবারও কি সে আসবে? মানে একজন চেনাজানা লোককে পেলে সুবিধে হয়

রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে কাকে পাঠানো হবে, ঠিক জানি না। তবে নিরঞ্জন খুবই এফিসিয়েন্ট। মনে হচ্ছে ওকেই পাঠাবে।

নিরঞ্জনবাবুর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করব? কলকাতায় এলে কোথায় থাকে, কিছুই জানি না।

সেজন্যে চিন্তা করতে হবে না। ও এলেই হয় মেসে, নইলে অফিসে আমার সঙ্গে দেখা করবে।

.

জগদীশ গুহঠাকুরতা একটি দৈনিক কাগজের সম্পাদক। তাছাড়া এই শহরের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। খুবই প্রভাবশালী। তার সুপারিশের জোরে একদিনেই ন্যাশনাল লাইব্রেরির কার্ড হয়ে গেল।

স্রোতের মতো উদ্বাস্তুরা ওপার থেকে অনবরত আসছিলই। বিনয়কে শিয়ালদায় তো বটেই, সীমান্ত অবধি ওই লাইনের নানা স্টেশনে ছুটতে হচ্ছে। তারই ফাঁকে ফাঁকে সময় করে কোনও কোনও দিন দু-চার ঘণ্টার জন্য ন্যাশনাল লাইব্রেরিতেও যাচ্ছে।

নানা বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে আন্দামান সম্পর্কে সে যা জোগাড় করতে পারল সেটা মোটামুটি এইরকম।

প্রাচীন উপকথায় উল্লেখ আছে, একদল সওদাগর বিশাল ময়ুরপঙ্খী নৌকোর বহর সাজিয়ে আন্ধারমাণিক্যে পৌঁছেছিলেন। এই আন্ধারমাণিক্যই খুব সম্ভব আন্দামান।

কিন্তু উপকথা উপকথাই। তার মধ্যে কতটা সত্যি আর কতখানি কল্পনা তা বোঝার উপায় নেই।

বঙ্গোপসাগর দিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে দুঃসাহসী নাবিকরা যাতায়াত করেছে পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে। শোনা যায়, এক ঝাক সাগরপাখি দিক ভুল করিয়ে দুজন নাবিককে নাকি আন্দামানে নিয়ে এসেছিল। আন্দামানের মাটিতে সেই বোধহয় কোনও ভিনদেশি মানুষের প্রথম পদক্ষেপ। তারপর থেকে এই দীপপুঞ্জে কত মানুষ যে এসেছে! কত জাহাজ যে ভিড়েছে!

আবার এও শোনা যায়, সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় এবং আরব বণিকেরা, বৌদ্ধ শ্রমণ এবং ভিক্ষুণীরা বার বার পালের জাহাজে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়েছেন। সীমাহীন সমুদ্রের মাঝখানে এই দ্বীপমালার খবর তারা জানতেন। খাদ্য এবং স্বাদু জলের সন্ধানে তাদের জাহাজ এখা, এডত। একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রায় কটা দিন ওঁরা বিশ্রামও করে নিতেন।

আরও জানা গেছে, মালয়ি এবং চিনা জলদস্যুরা আন্দামানের উপকুলে উপকূলে শিকারের খোঁজে ঘুরে বেড়াত। মানুষ শিকার। সুযোগ পেলেই এখানকার আদিম অধিবাসীদের ধরে নিয়ে শ্যাম, কম্বোডিয়ায় ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দিত। এ-সবও কতটা সত্যি, কে জানে। আন্দামানের সুদূর সেই অতীত কুয়াশায় ঘেরা।

ঐতিহাসিকদের অনুমান, খ্রিস্টজন্মের হাজারখানেক বছর আগে চিনা এবং জাপানিরা আন্দামানের কথা জানত। ছোট বড় প্রায় আড়াই শ দ্বীপ নিয়ে এই আর্কিপেলাগো। সমুদ্রের মাঝখানে সৃষ্টিছাড়া এই ভূখণ্ডগুলির নাম-মাহাত্ম্য বিচিত্র। কীভাবে আন্দামান নামের উৎপত্তি তার সঠিক হদিস পাওয়া মুশকিল।

চিনারা এই দ্বীপকে বলত ইয়েঙ-তে-মাঙ, জাপানিরা বলত আন্দাবান। এ-দুটো ছাড়াও আন্দামানের আরও অজস্র নাম জানা গেছে। প্রায় অষ্টোত্তর শতনাম। মার্কোপোলো বঙ্গোপসাগরে অ্যাঙ্গামানিয়াম নামে দ্বীপমালা দেখেছিলেন। খুব সম্ভব সেটাই আজকের আন্দামান। চৈনিক ভিক্ষু তি-সিঙ এই দ্বীপে এসেছিলেন। সেই সময় একে বলা হতো আগদামান। ক্লডিয়াস টলেমি একদা এই দ্বীপকে ভুল করে বলেছিলেন-আগাথু ডাইসন নেসস (উত্তর আত্মার দ্বীপ)। পরে তিনি জেনেছিলেন এর নাম আগমাটে। আরও পরে পরিব্রাজক নিকোলো কন্টির মতে এই দ্বীপ হল স্বর্ণদ্বীপ। মাস্টার ফ্রেডরিক ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি নিকোবর থেকে পেও অবধি সারি সারি অসংখ্য দ্বীপ দেখেছিলেন। সে-সময় এখানকার জংলী আদিবাসীরা নাকি এই দ্বীপমালাকে বলত আশুেমেওন। মালয়িরা আন্দামানের আদিম, ভূমিপুত্রদের নাম দিয়েছিল হমানী।

এমনি অজস্র। এ-সবের ভেতর থেকে এই দ্বীপপুঞ্জের আন্দামান নামটি কবে, কীভাবে সৃষ্টি হল, এখন আর তা জানার উপায় নেই।

এ-সব কুহেলিবিলীন অতীতের কথা।

আন্দামানের নতুন ইতিহাস শুরু হল সতেরো শ আটাশি সালের সেপ্টেম্বরে। লর্ড কর্ণওয়ালিস লেফটেনান্ট ব্লেয়ার এবং লেফটেনান্ট নর্থব্রুককে আন্দামানে পাঠালেন। নির্দেশ দেওয়া হল, তারা বেশ কিছুদিন এখানে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব সার্ভে করে কলকাতায় ফিরে একটা বিশাদ রিপোর্ট পেশ করবেন। কর্ণওয়ালিসের উদ্দেশ্য, পরিবেশ অনুকূল হলে এখানে নতুন উপনিবেশ গড়ে তোলা হবে।

ব্লেয়ার এবং নর্থব্রুকের রিপোর্টের ভিত্তিতে পরের বছর দক্ষিণ আন্দামানে সহস্র বছরের নিবিড় জঙ্গল সাফ করে চ্যাথাম এবং এখনকার পোর্ট ব্লেয়ার কলোনি বসানো হল। কিন্তু তিন বছরের মধ্যে উত্তর-পূর্ব দিকে একটা বন্দর বানিয়ে সেটেলমেন্ট সেখানে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পোতাশ্রয়ের পক্ষে জায়গাটা সুরক্ষিত। নামও একটা দেওয়া হল–পোর্ট কর্ণওয়ালিস। কিন্তু এলাকাটা ভীষণ অস্বাস্থ্যকর এবং মুত্যুহার প্রচণ্ড বেশি হওয়ায় চার বছরের মধ্যে কলোনি উঠে যায়।

এরপর ষাট বছর ভারতের মেনল্যাণ্ডের সঙ্গে আন্দামানের যোগাযোগ প্রায় ছিল না।

পুরো ছদশক বাদে ফের আন্দামানের কথা ব্রিটিশ সরকারের বিশেষভাবে মনে পড়ল। সেটা ছিল আঠারো শ সাতান্ন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি বছর। সিপাহী বিদ্রোহ নামে দেশের প্রথম স্বাধীনতা-সংগ্রামের শুরু ওই সাতান্নতেই। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিদ্রোহীদের বহু দূরে নির্বাসনে পাঠানোর পরিকল্পনা নেওয়া হল।

আঠারো শ আটান্নর মার্চে ডক্টর জে. পি. ওয়াকার দুশ জন বন্দি, দুজন ডাক্তার, ওভারসিয়ার, ওল্ড ন্যাভাল ব্রিগেডের পঞ্চাশজন সশস্ত্র রক্ষী নিয়ে কলকাতা থেকে সেমিরামিস নামে একটি জাহাজে আন্দামান রওনা হলেন। তখন থেকেই পোর্ট ব্লেয়ারে নতুন করে স্থায়ী উপনিবেশ তৈরির সূচনা।

এর কাছাকাছি সময়ে বর্মায় রাজা থিবোর সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ব্রিটিশ প্রভুরা প্যাগোডার দেশ বর্মাকে হাতের মুঠোয় পুরতে চায়। হতে চায় সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর। থিবো রাজি নন। তাই এই সংঘাত। ইতিহাসে যার নাম তৃতীয় ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধ। থিবো মরণপণ লড়াই চালিয়েও হেরে যান। ভারতের সিপাহি বিদ্রোহের বীর যোদ্ধাদের মতো বর্মার দুঃসাহসী সৈনিকদেরও বন্দি । হিসেবে আন্দামানে চালান দেওয়া হল। শুধু এদেরই নয়, ভারতের মেনল্যাণ্ডে এবং বর্মা থেকে। মারাত্মক সব অপরাধীদের-খুনী, জলদস্যু, ডাকাত–দীপান্তরী সাজা দিয়ে আঁকে ঝাঁকে পাঠানো হতে লাগল। শুধু পুরুষ অপরাধীদেরই নয়, মেয়ে অপরাধীদেরও। এই শাস্তির আর-এক নাম কালাপানি।

কয়েদিদের দিয়েই শুরু হল শহর তৈরির কাজ। রাস্তাঘাট, কাঠের ব্যারাক, ইটের দালান, এমনকি পুরুষ অপরাধীদের জন্য ভয়াবহ সেলুলার জেল এবং মেয়ে-কয়েদিদের জন্য সাউথ পয়েন্ট বা রেণ্ডিবারিক জেলও।

বিশ শতকের গোড়ার দিকে নির্বাসন দণ্ড দিয়ে পাঠানো হয়েছে নতুন কালের সশস্ত্র বিপ্লবীদের। জাতির ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা কত জ্যোতির্ময় নাম। সাভারকর, উল্লাসকর দত্ত, উপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, অম্বিকা চক্রবর্তী-এমনি অজস্র।

উনিশ শ পঁয়ত্রিশ পর্যন্ত ভারত ও বর্মা থেকে আন্দামানে কয়েদি পাঠানো চলেছে। তারপর নির্বাসন বন্ধ হয়ে যায়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানিরা এই দ্বীপমালায় হানা দেয়। এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্রও।

দেশভাগের পর ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে কিছু কিছু মানুষ জীবিকার সন্ধানে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এখানে আসতে শুরু করে। কেউ এসেছে চাকরি নিয়ে। কেউ বা এসে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। তবে সংখ্যায় তারা হাতে-গোনা। খুবই কম।

এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার আন্দামানের নানা দ্বীপে জঙ্গল নির্মূল করে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নিয়েছে। ছিন্নমূল মানুষেরা সেখানে আসতেও শুরু করেছে। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপমালার নতুন ইতিহাস হয়তো তাদের হাতেই সৃষ্টি হবে।

মাসখানেক পর একদিন সকালবেলায় মেসে প্রসাদের ঘরে বসে প্রসাদ আর বিনয় চা খাচ্ছিল। এ-পাড়ার উদ্বাস্তুদের বাচ্চাগুলো তাদের বরাদ্দ মাখন-পাউরুটি নিয়ে চলে গেছে। হঠাৎ সিঁড়ির দিক থেকে হাঁক শোনা গেল।প্রসাদদা আছেন নি, অ প্রসাদদা

গলাটা চেনা চেনা। ঘুরে বসে প্রসাদ বললেন, কে?

আমি- আমি লগে আর এক জন আছে। বলতে বলতে দরজার সামনে যে এসে দাঁড়াল তার কথা এই মুহূর্তে কারও ভাবনাতে ছিল না। না প্রসাদের, না বিনয়ের।

যে এসেছে সে নিরঞ্জন। তার পাশে অচেনা একটি যুবক। প্র

সাদ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, আরে এস—এস–

ঘরে ঢুকে নিরঞ্জন এবং তার সঙ্গীটি প্রসাদদের কাছাকাছি মোড়ায় বসে পড়ে। প্রসাদ জিজ্ঞেস করেন, কলকাতায় কবে এলে?

নিরঞ্জন বলল, গেল হপ্তার বুধবার। আইজ হইল মঙ্গলবার। হে ছয়দিন হইয়া গ্যাল।

এতদিন এসেছ, আর আজ আমার সঙ্গে দেখা করার সময় হল? অন্তত একটা ফোনও তো করতে পারতে?

কী কইরা করুম? কইলকাতায় আইয়াই জ্বরে পড়লাম। ঠাইসা পিল খাইয়া জ্বর তো নামাইলাম। হের পর রিফিউজি কেম্পে কেম্পে ঘুরতে আছি। হেই সকালে বাইর অই, ফেরতে ফেরতে রাইত। উয়াস (নিঃশ্বাস) ফালানের টাইম নাই। হেইর মইদ্যে সোময় কইরা আইজ আপনের মেসে আইছি। নিরঞ্জন কথা বলছিল ঠিকই, কিন্তু তার চোখ বার বার বিনয়ের দিকে চলে যাচ্ছিল। কয়েক পলক। তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, বিনয়বাবু না?

মাস কয়েক আগে নতুন ভারত-এর অফিসে এক সন্ধ্যায় কিছুক্ষণের জন্য নিরঞ্জনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কিন্তু দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তি যুবকটির। সে তাকে ভোলনি। বিনয় বলল, হ্যাঁ–

কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়ে নিরঞ্জন জানতে চায়, আপনেও এই ম্যাসে থাকেন নিকি?

 বিনয় মাথা হেলিয়ে দেয়, হা- সে আরও কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বলা হল না।

এদিকে প্রসাদ নিরঞ্জনের সঙ্গীটিকে লক্ষ করছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, একে তো চিনতে পারলাম না।

নিরঞ্জন জানায়, ছেলেটির নাম বিভাস সাহা। পোর্ট ব্লেয়ারে থাকে। আদি বাড়ি ছিল ফরিদপুরে। দেশভাগের পর ইণ্ডিয়ায় আসে। তারপর চাকরি নিয়ে সোজা আন্দামানে। বিভাস রিফিউজি অ্যাণ্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টে নিরঞ্জনের সহকর্মী। আন্দামানে উদ্বাস্তু নিয়ে যাবার জন্য এবার সেও এসেছে। প্রসাদদের পরিচয়ও বিভাসকে জানিয়ে দেওয়া হল।

পরিচয়পর্বের পর প্রসাদ সুবলকে দিয়ে চা এবং গৌরাঙ্গ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে চারজনের মতো লুচি, ছোলার ডাল এবং ছানার গজা আনালেন। খেতে খেতে কথা হচ্ছিল।

প্রসাদ নিরঞ্জনকে বললেন, তুমি রিফিউজি নিতে আসবে, সেজন্যে আমরা অপেক্ষা করছিলাম।

উৎসুক সুরে নিরঞ্জন জিজ্ঞেস করে, বিশেষ কোনও দরকার আছে কি?

হ্যাঁ। বিনয়কে দেখিয়ে প্রসাদ বলতে লাগলেন, আমাদের কাগজের তরফ থেকে ওকে তোমাদের সঙ্গে আন্দামানে পাঠানো হবে। সেখানে রিহ্যাবিলিটেশন কীরকম হচ্ছে, সমস্ত নিজের চোখে দেখেও রেগুলার রিপোের্ট পাঠিয়ে যাবে। একটু ভেবে বললেন, তোমরা ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে কীভাবে রিফিউজি নিয়ে যাচ্ছ, সে-সবও দেখাবে। তাহলে পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে বিনয়ের কমপ্লিট একটা ধারণা হয়ে যাবে।

উৎসাহে চনমন করতে থাকে নিরঞ্জন, খুব ভাল অইব। আন্দামানে রিফিউজি সেটেলমেন্ট ক্যামন অইতে আছে, দ্যাশের মাইনষের হেইটা জানন দরকার। বিনয়ের দিকে ঘুরে বসে সে, আইজ কইলকাতার রিহ্যাবিলিটেশন অফিসে কিছু কাম আছে। হেইগুলান সারতে অইব। কাইল সকাল থিকা রিলিফ কেম্পগুলানে ঘুরুম। নেক্সট সোমবার আন্দামানের জাহাজ ছাড়ব। হেইর মইদ্যে রিফিউজি ফ্যামিলি জুটাইয়া ফালাইতে হইব। কাইল আমাগো লগে কেম্পে যাইতে পারবেন?

নিরঞ্জনকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজনা হচ্ছিল বিনয়ের। আন্দামান সম্পর্কে নানা তথ্য জোগাড় করে সে তৈরি হয়েই আছে। মনে মনে বঙ্গোপসাগরের সেই দ্বীপপুঞ্জের দিকে পা বাড়িয়েই রেখেছে। বলল, নিশ্চয়ই পারব।

নিরঞ্জন বলল,রেডি হইয়া থাইকেন। আমাগো লগে গাড়ি থাকব। কাইল সকালে এইহানে আইয়া আপনেরে তুইলা নিয়া যামু।

আচ্ছা—

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর নিরঞ্জন বলে, প্রসাদদা, আগের দুই খ্যাপে (খেপে) যে রিফিউজি লইয়া গ্যাছিলাম, কুননা হুজ্জত হয় নাই। এইবার মনে লয় (হয়) গণ্ডগোল অইব। তাকে রীতিমতো চিন্তিত দেখায়।

প্রসাদ বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করেন, কেন?

 লেফট পার্টিগুলান বাধা দিতে আছে। রোজই মিটিং মিছিল করে। হেরা চায় না, উদ্বাস্তুরা আন্দামানে যাউক। হগল দেইখা শুইনা রিফিউজিরা ডরাইয়া গ্যাছে। এদিকে আমাগো ডিপার্টমেন্ট জানাইছে একশ ডিপি (ডিসপ্লেসড) ফেমিলি লইয়া যাইতে হইব। পুরাটা পারুম কিনা বুঝতে পারতে আছি না।

প্রসাদ বললেন, রিফিউজিদের জন্যে একটা বড় সুযোগ এসেছে। এটা হাতছাড়া করা একেবারেই ঠিক না।

গলার স্বর উঁচুতে তুলে নিরঞ্জন বলে, কী কইতে আছেন–ঠিক না? আন্দামানে না গ্যালে মহা বিপদ অইব। একটু থেমে বলল, ওয়েস্ট ব্যাঙ্গল তো এত্তটুক একটা স্টেট। লাখ লাখ বাড়তি মাইষের জায়গা অইব কুনখানে? থাকব কই? আন্দামান সেকেণ্ড ব্যাঙ্গল অইতে পারে। এই সুযুগটা লওন (নেওয়া উচিত।

হ্যাঁ।

নাইলে কপাল থাপড়াইতে হইব। জঙ্গল রিক্লেম করা হইছে। শুনতে আছি, ইস্ট পাকিস্তানের রিফিউজিরা না গ্যালে জমিন ফাঁকা রাখা হইব না। গভর্নমেন্ট মালাবারী মোপলাগো আইনা বহাইব।

বিনয় পলকহীন নিরঞ্জনকে লক্ষ করছিল। মনে পড়ল, মোপলাদের সম্পর্কে যে শঙ্কার কথা

সে বলছে, সেবার এসেও ঠিক তা-ই বলে গিয়েছিল। গভীর উৎকণ্ঠায় মন ভরে যেতে থাকে বিনয়ের।

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে, বিনয়কে কাল সকালে রিফিউজি ক্যাম্পে যাবার ব্যাপারটা মনে করিয়ে দিয়ে উঠে পড়ল নিরঞ্জন আর বিভাস।

.

৭৪.

পরদিন সকালে চানটান সেরে, চা খেয়ে, বেরুবার জন্য তৈরি হয়েই ছিল বিনয়। হই হই করতে করতে নিরঞ্জন এসে হাজির। বলল, ওঠেন–ওঠেন। অহনই যাইতে অইব।

পাশের ঘরে গিয়ে প্রসাদের সঙ্গে দেখা করে বিনয়রা বেরিয়ে পড়ে। মেসের সামনে একটা স্টেশন-ওয়াগন টাইপের বড় গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। সেটার সামনের দিকে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে বসে আছে ড্রাইভার। পেছনে মুখোমুখি দুটো লম্বা সিটে বসেছেন আরও চারজন। তাঁদের একজনকেই বিনয় চিনতে পারলবিভাস মাছা। অমাদের আগে কখমও দেখেনি। গাড়িতে ওঠার পর নিরঞ্জন ওঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। পরিতোষ পালিত, হিরন্ময় চৌধুরি আর প্রিয়নাথ গুপ্তভায়া। তিন জনই রিফিউজি রিলিফ অ্যাণ্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের অফিসার। হিরন্ময় মাঝবয়সী, বাকি দুজনের বয়স চল্লিশের নিচে। হিরন্ময় এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু পদে আছেন।

তিন অফিসারই জানালেন, বিনয়ের নামটা তাদের খুবই পরিচিত। নতুন ভারত কাগজে নিয়মিত তার লেখা ওঁরা পড়েন।

গাড়ি চলতে শুরু করেছিল। নিরঞ্জন হিরন্ময় চৌধুরিকে জিজ্ঞেস করে, আইজ আমরা ফাস্ট কই যামু হিরন্ময়দা?

কথাবার্তার ধরন থেকে বোঝা যায়, পশ্চিম বাংলার উদ্বাস্তু বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে নিরঞ্জনের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। বিনয় জানে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের যৎকিঞ্চিৎ অনুদান নিয়ে এখানকার ত্রাণশিবিরগুলো চালায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারই। আন্দামানে উদ্বাস্তু নিয়ে যেতে হলে এখানকার রিফিউজি রিলিফ ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটা ভীষণ জরুরি। সেই সুতো ধরেই তাদের সঙ্গে নিরঞ্জনের অন্তরঙ্গতা।

হিরন্ময় বললেন, পরশু লেক আর নিউ আলিপুরের ক্যাম্পগুলোতে যাওয়া হয়েছিল। আজ দমদমের দিকটায় যাব। ওখানে চারটে ক্যাম্প আছে। আমরা যে যাচ্ছি, ক্যাম্পগুলোর ইন-চার্জদের আগেই খবর পাঠানো হয়েছে।

নিরঞ্জন বলল, এই চাইর কেম্পে টোটাল কত রিফিউজি আছে?

পকেট থেকে পিন দিয়ে গাঁথা একতাড়া কাগজ বার করে ওলটাতে ওলটাতে হিরণয় বললেন, বাচ্চাকাচ্চা মিলিয়ে চার হাজার আটাত্তর জন।

বিনয় হিরন্ময়ের সামনের সিটে বসে ছিল। সে লক্ষ করল, কাগজগুলোতে অগুনতি নাম টাইপ করা রয়েছে। ওই চার ক্যাম্পের শরণার্থীদের নাম।

এদিকে নিরঞ্জন বলছিল, ফেমিলি কত অইব?

হিরন্ময় বললেন, সাত শ বাষট্টি।

একটু ভেবে নিরঞ্জন বলল, পরশু লেক আর নিউ আলিপুরে গিয়া জুইত হয় নাই। কেও আন্দামানে যাইতে চায় না। দমদমে গিয়া কি কাম অইব? আমার পুরা এক শ ডি পি ফেমিলি চাইই চাই

ডি পি ফ্যামিলি ব্যাপারটা বিনয় ভালই জানে। ডি পি হল ডিসপ্লেসড পার্সনস অর্থাৎ উদ্বাস্তুদের পরিবার।

হিরন্ময় বললেন, দমদমে কতটা কাজ হবে সেটা নির্ভর করছে তোমরা ওখানকার রিফিউজিদের কতটা কনভিন্স করতে পার, তার ওপর। ওখানে যদি পুরো এক শ ফ্যামিলি নাও পাও, ব্যারাকপুর আছে, নৈহাটি আছে, কাঁচড়াপাড়া আছে, সাউথ বেঙ্গলের নানা জায়গা আছে, নর্থ বেঙ্গল আছে। সারা পশ্চিম বাংলাই রিলিফ ক্যাম্পে ভর্তি। দমদমে সবটা না হলে, কোথাও না কোথাও ঠিক পেয়ে যাবে।

নিরঞ্জন বলল, সোময় তো হাতে বেশি নাই। মোটে চাইর দিন। এইবার আন্দামান থিকা আইয়াই জ্বরে পড়লাম। পিল খাইয়া খাইয়া ট্যাম্পারেচার লামইছি (নামিয়েছি)। কিন্তুক শরীল জবর কাহিল। বেশি ঘুরাঘুরির শক্তি নাই।

আগে তো দমদম চল

 নিরঞ্জন আর কিছু বলল না।

এবার হিরন্ময়দের নজর এসে পড়ল বিনয়ের ওপর। তিন অফিসারই বললেন, আপনার সঙ্গে ভাল করে আলাপ করা যাক।

বিনয়ও সেটাই চাইছিল। উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে প্রচুর তথ্য এর মধ্যে তার জানা হয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষের সে একজন। তবে এটুকুই বাঁচোয়া, অন্যদের মতো তাকে ত্রাণশিবির বা শিয়ালদা স্টেশনের নরককুণ্ডে ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকতে হয়নি। তবু সীমান্তের এপারে এসে এই সব মানুষ কীভাবে দিন কাটাচ্ছে সে ব্যাপারে তার বিপুল অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা নিদারুণ এবং ভয়াবহ। কিন্তু কোন পদ্ধতিতে এই বিশাল মানবগোষ্ঠীর পুনর্বাসন হবে, সরকার এ-বিষয়ে কী কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে সম্বন্ধে তার ধারণা স্পষ্ট নয়।

আসলে ত্রাণশিবির, জবরদখল কলোনি, শিয়ালদা স্টেশন, সীমান্ত এলাকা–এমনি নানা জায়গায় সকাল থেকে সন্ধে অবধি বিনয়কে ছুটে বেড়াতে হয়। অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু হল রাইটার্স বিল্ডিং। সেখানে তাকে আসাইনমেন্ট দেওয়া হয়নি। রাইটার্সে না গেলে বিভাগীয় মন্ত্রী, সেক্রেটারি, কমিশনার, বড় বড় আমলাদের সঙ্গে দেখা হয় না। এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতে পারলে বা সরাসরি কথা না বললে পুনর্বাসন সম্বন্ধে সমস্ত কিছু জানা সম্ভব নয়। অবশ্য তাদের কাগজ থেকে অন্য রিপোর্টারদের রাইটার্সে ডিউটি দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন পড়ে এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে অনেকটাই জানা যায়।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্বাস্তু ত্রাণ এবং পুনর্বাসন বিভাগের তিনজন অফিসারকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে লাভই হল। তাঁদের সঙ্গে কথায় কথায় বিনয় জানতে পারে, শরণার্থীদের স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য নানা সরকারি পরিকল্পনার কথা ভাবা হচ্ছে। এই ছোট রাজ্যে বাড়তি লক্ষ লক্ষ মানুষের বাসস্থান এবং চাষের জমির ব্যবস্থা করে দেওয়া আদৌ সম্ভব নয়। ওড়িশা মধ্যপ্রদেশ বিহার আর উত্তরপ্রদেশে জনসংখ্যার তুলনায় জমিজমা অনেক বেশি। মানবিক কারণে ওই সব প্রদেশের সরকারগুলো কিছু কিছু উদ্বাস্তুকে তাদের রাজ্যে নিয়ে যেতে চায়। কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক সাহায্য করলে তারা চাষের জমি দিয়ে কৃষিজীবী শরণার্থীদের নতুন করে বাঁচার সুযোগ করে দেবে। এঁদের মতে, উদ্বাস্তু সমস্যা সর্বভারতীয় সমস্যা, শুধু পশ্চিমবঙ্গের একার নয়। সর্বস্বখোয়ানোনা, অগুনতি মানুষের চরম দুর্দশার মূল্যে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। এদের দায়িত্ব প্রতিটি ভারতবাসীর ভাগ করে নেওয়া উচিত। এ-জাতীয় সদিচ্ছা আলোচনার স্তরেই রয়েছে। বাস্তব চেহারা নিতে কতদিন লাগবে, কে জানে। তবে হাতের মধ্যে যা রয়েছে তা হল আন্দামান। পশ্চিম বাংলার বাইরে উদ্বাস্তুদের প্রথম পুনবসতি শুরু হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের সুদূর দ্বীপমালায়।

হিরন্ময়দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় নিরঞ্জন জানিয়ে দিয়েছিল, এই খেপে যে উদ্বাস্তুরা আন্দামানে যাচ্ছে, বিনয়ও তাদের সঙ্গে যাবে। তার খেই ধরে হিরন্ময় বললেন, মেনল্যাণ্ডে থেকে কাগজের লোকেদের ওখানে যাওয়াটা ভীষণ দরকার। আন্দামান সম্পর্কে মানুষের সঠিক ধারণা নেই। বিশেষ করে পলিটিক্যাল পার্টিগুলো উলটো পালটা প্রচার চালিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। রিফিউজিরা বেশির ভাগই অশিক্ষিত, সোজা, সরল মানুষ। তারা এই সব প্রচারে ঘাবড়ে যাচ্ছে।

এই ধরনের কথা কাল নিরঞ্জনের মুখেও শুনেছে বিনয়। শুধু শোনাই নয়, নিজের চোখেও কি সে দেখছে না? আজকাল উদ্বাস্তুদের নিয়ে এখানে মিছিল, ওখানে মিটিং। সেইসঙ্গে আকাশ ফাটানো স্লোগান। সব বামপন্থী দলগুলোর একই দাবি-উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পাঠানো চলবে না।

বিনয় বলল, ক্যাম্পে, শিয়ালদা স্টেশনে কি ফুটপাথে কীভাবে রিফিউজিরা দিন কাটাচ্ছে, নিজের চোখে তো রোজ দেখছি। আন্দামানে গিয়ে উদ্বাস্তুরা যদি জমিজমা পায়, ভাল থাকে, তাদের তো যেতে দেওয়াই উচিত।

নিরঞ্জন উত্তেজিত হয়ে ওঠে, এই হগল কথা হু, নে ক্যাঠা? দুই হাত নাড়তে নাড়তে বলতে লাগল, ক্যান যাইতে দ্যায় না জানেন? মিটিং করনের, মিছিল করনের মানুষ চাই। পাট্টির সাপোর্টার চাই।

হিরন্ময় বিনয়কে বললেন, আপনি তো যাচ্ছেন। আন্দামানের সেটেলমেন্ট ঘুরে ঘুরে দেখে, ওখানকার সঠিক ছবিটা মানুষের কাছে তুলে ধরুন। উদ্বাস্তুরা যেন বুঝতে পারে, আন্দামানে গেলে তাদের ভালই হবে।

একসময় গাড়ি দমদমে পৌঁছে গেল।

.

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানের ঝটিকা বাহিনীকে ঠেকাবার জন্য অ্যালায়েড ফোর্স বা মিত্রশক্তি কলকাতায় প্রচুর সেনা নিয়ে এসেছিল। তারা কবেই দেশে ফিরে গেছে। পরিত্যক্ত সেনা ছাউনিগুলো এখন উদ্বাস্তুদের ত্রাণশিবির। এই ধরনের শিবির আগেও অনেক দেখেছে বিনয়।

একটা বড় মাঠ ঘিরে দমদমের চারটে রিলিফ ক্যাম্প। মাঠের ধারে গাড়ি থামলে বিনয়দের নিয়ে নেমে পড়েন হিরন্ময়।

নানা বয়সের প্রচুর লোকজন বাচ্চাকাচ্চা থেকে যুবকযুবতী বুড়োবুড়ি–সেখানে জড়ো হয়েছে। উদ্বাস্তুদের চেহারায় একটা আলাদা ছাপ থাকে। দেখামাত্র টের পাওয়া গেল এরা এই শিবিরগুলোর বাসিন্দা।

লোকগুলোর চোখেমুখে ভয় এবং উদ্বেগ ফুটে আছে। নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে তারা কীসব। বলাবলি করছিল। ফলে চারপাশ থেকে চাপা গুঞ্জনের মতো শব্দ উঠে আসছে।

মাঠময় উৎকণ্ঠিত জনতা। তাদের মাঝখানে সারি সারি বেশ কিছু চেয়ার টেবল। সেখানে কয়েকজন বসে আছেন। বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। আন্দাজ করা যায়, এঁরা ত্রাণশিবিরগুলোর কর্মকর্তা হবেন। হিরন্ময়দের দেখে সবাই শশব্যস্তে উঠে পড়লেন। এগিয়ে গিয়ে বিশেষ করে হিরন্ময়কে সসম্ভ্রমে বললেন, আসুন স্যার, আসুন–

হিরন্ময় জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কতক্ষণ এখানে ওয়েট করছেন?

নটা থেকে। আপনি যেমন ইনস্ট্রাকশন পাঠিয়েছেন, সেইমতো রিফিউজিদের মাঠে চলে আসতে বলেছিলাম। ঠিক সময়েই তারা এসে গেছে।

হাতঘড়ি দেখে হিরন্ময় বললেন, এখন নটা সতেরো। অনেকদূর থেকে আসছি তো। সামান্য লেট হয়ে গেছে।

একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, আন্দামানে যাবার কথা রিফিউজিদের বলেছেন তো?

বলেছি।

রি-অ্যাকশন কীরকম?

ভাল না স্যার। আমরা অনেক করে বুঝিয়েছি, কিন্তু কালাপানি পাড়ি দিতে ভীষণ ভয় পাচ্ছে। দেখুন আপনারা বললে যদি শোনে—

হিরন্ময়কে রীতিমতো চিন্তিত দেখায়। তবে এ নিয়ে আর কিছু বললেন না। হঠাৎ কী খেয়াল হতে ত্রাণশিবিরের অফিসার-ইন-চার্জদের সঙ্গে বিনয়, বিভাস আর নিরঞ্জনদের অর্থাৎ যারা উদ্বাস্তুদের আন্দামানে নিয়ে যাবে, আলাপ করিয়ে দিলেন তিনি। এঁরা হলেন সোমনাথ দত্ত, মহাদেব কুণ্ডু, অজিতেশ সমাজপতি আর নীলমাধব কর। তাছাড়া ওঁদের কজন সহকারীও রয়েছেন।

সোমনাথরা হিরন্ময়দের নিয়ে চেয়ারগুলোতে বসালেন। বিনয়কেও ওঁদের পাশেই বসানো হল।

 বিনয় লক্ষ করল, উদ্বাস্তুরা এখন আরও সন্ত্রস্ত। খনিক আগের চাপা কণ্ঠস্বরগুলি থেমে গেছে। বিশাল মাঠ জুড়ে নেমে এসেছে অপার নৈঃশব্দ্য। দম বন্ধ করে কয়েক শ মানুষ হিরন্ময়দের দিকে তাকিয়ে আছে। পলকহীন। যেন এই আগন্তুকরা তাদের জন্য মৃত্যুর পরওয়ানা বয়ে এনেছেন।

হিরন্ময় মাঠের এ-মাথা থেকে ও-মাথা অবধি বিপুল জনতাকে ধীরে ধীরে একবার দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বলতে লাগলেন, আজ আমরা কী জন্যে এখানে এসেছি, সোমনাথবাবুরা আপনাদের তা জানিয়ে দিয়েছেন।

কেউ উত্তর দিল না।

হিরন্ময় থামেননি, দেশভাগের ফলে আপনাদের সর্বস্ব গেছে। ইন্ডিয়ায় এসে কী কষ্ট করে ক্যাম্পে দিন কাটাচ্ছেন, প্রতি মুহূর্তে সেটা বুঝতে পারছেন। কিন্তু সারাজীবন এভাবে চলতে পারে না। আপনাদের ছেলেমেয়ে আছে, তাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। পশ্চিম বাংলায় জায়গা জমির খুবই অভাব। তাই সরকার ঠিক করেছে, আপনাদের আন্দামান পাঠাবে। সেখানে প্রতিটি পরিবারকে দেওয়া হবে একুশ বিঘে করে চাষের জমি। বাড়িঘর কারার জন্যে আরও কিছু জায়গা। স্কুল, হাসপাতাল, পোস্ট অফিস-সব তৈরি হচ্ছে। পাকিস্তানে যা যা ফেলে এসেছেন, ওখানে গেলে সমস্ত পেয়ে যাবেন। যে টাইপ-করা কাগজের তাড়ায় ক্যাম্পের বাসিন্দাদের নাম রয়েছে সেটা তার হাতেই ছিল। পকেট থেকে পেন বার করে বললেন, কারা কারা যাবেন, বলুন। আমি তাদের নামের পাশে দাগ দিয়ে রাখি। বলুন–বলুন

প্রথমটা সাড়াশব্দ নেই। তারপর স্তব্ধতা ভেঙে জনতার ভেতর থেকে একজন ভয়ে ভয়ে, কাঁপা গলায় বলে ওঠে, আমরা আন্ধারমানে যামু না।

লহমায় সারা জমায়েতে বিদ্যুৎ খেলে যায়। চারদিক থেকে শোরগোল উঠতে থাকে, আন্ধারমানে যামু না, যামু না

হিরন্ময় হতচকিত। তার পাশে যে অফিসাররা রয়েছেন তারাও চমকে উঠেছেন। হিরন্ময় জিজ্ঞেস করলেন, কেন যেতে চাইছেন না? সেখানে এত সুযোগ-সুবিধা

তাঁকে থামিয়ে দিয়ে ভিড়ের সামনের দিক থেকে একটা শীর্ণ, আধবুড়ো লোক চেঁচিয়ে বলে, ছার (স্যার), আপনেগো কুনো কথা হুনুম না। আমরা জানি রিফুজগো জাহাজে ভইরা লইয়া গিয়া মইদ্য সমুন্দরে ফালাইয়া দ্যায়। হাঙ্গরে কুমিরে (কুমিরে) হেগো খাইয়া শ্যাষ করে।

কী উত্তর দেবেন, ভেবে পাচ্ছেন না হিরন্ময়। বিমূঢ়ের মতো তিনি লোকগুলোকে দেখতে থাকেন।

এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল নিরঞ্জন। এবার লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। গলার স্বর চড়িয়ে বলে, ক্যাঠা কইছে এই কথা?

আধবুড়োটা বলে, ছার (স্যার), আমরা হগল খবরই পাই।

মিছা কথা, পুরা মিছা। আমি আপনেগো লগে আন্দামান যামু। আপনেরা এতটি (এতজন) মানুষ। কেও যদিন কালাপানিতে আপনেগো ফালাইয়া দিতে চায়, হের আগে আমারে সমুন্দরে ফেইকা (ছুঁড়ে দিয়েন।

 আধবুড়ো লোকটা ধন্দে পড়ে যায়। বার বার ঢোক গিলে জুতসই একটা জবাব হাতড়াতে থাকে, কিন্তু সেটা খুঁজে পায় না।

উদ্বাস্তুদের জটলা থেকে এবার অন্য একটা লোক উঠে দাঁড়ায়। ক্ষয়াটে চেহারা, ভাঙা গাল, পাশুটে রঙের পাতলা চুল, শিরা বার-করা হাত, চোখ গর্তে ঢোকানো। সে বলে, আন্ধারমান তরি (অবধি) না হয় গ্যালাম, কিন্তুক হেইহানে তো আলিসান জঙ্গল। সাপখোপ বাঘ-ভাল্লুক থিক থিক করতে আছে। আমরা কি সাপের ছুবল খাইয়া মরুম, না বাঘের প্যাটে যামু?

গলার স্বর আরও কয়েক পর্দা চড়িয়ে দেয় নিরঞ্জন, আন্দামানে মাপও নাই, বাঘও নাই। আছে পালে পালে হরিণ। আর ওইহানের সমুন্দরে কত যে মাছ তার ল্যাখ্যাজোখা নাই। জঙ্গলে ঢুকলেই হরিণ পাইবেন। জালের একখান খ্যাও (খেপ) দিলে সমুন্দুর থিকা দশ স্যার পনরো স্যার কইরা মাছ উঠব। প্যাট ভইরা যত ইচ্ছা মাছ, যত ইচ্ছা মাংস খাইতে পাইবেন।

বিভাস সাহা নিরঞ্জনের পাশ থেকে বলে ওঠে, আরও একহান জবর খবর দেই। আন্দামানের জঙ্গলে শয়ে শয়ে গাছে আপেল আঙুর ফইলা রইছে। পইড়া পইড়া পচতে আছে। যাইবেন, পাড়বেন আর খাইবেন।

বিভাসের দিকে হতবাক তাকিয়ে থাকে বিনয়। আন্দামানের বনভূমি আপেলে আঙুরে ছেয়ে আছে। এমন তথ্য তার জানা নেই। ওদিকে হিরন্ময়রাও বিহুলের মতো বিভাসকে লক্ষ করছিলেন। আপেল এবং আঙুরের ব্যাপারটা তাঁদেরও খুব সম্ভব দিশেহারা করে ফেলেছে।

বিভাসের কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। হাত-পা-মাথা ঝাঁকিয়ে বিপুল উদ্দীপনায় সে বলে চলেছে, বুঝতে পারি জাহাজে উঠতে হইব বইলা আপনেরা ডরাইয়া গ্যাছেন। কুনো চিন্তা নাই। মোটে একহান রাইত। ডায়মণ্ডহারবার পার হইলেই দ্যাখবেন চর পড়ছে। হেইহানে আপনেগো নামাইয়া দিমু। হাইটা হাইটা (হেঁটে হেঁটে) আন্দামান চইলা যাইবেন। প্রবল তোড়ে কথাগুলো তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে।

আপেল, আঙুর, ডামণ্ডহারবার পেরুলে চর–চমকের পর চমক। হিরন্ময়রা বিভাসকে বাধা দিতে গিয়েও থমকে গেছেন। কেননা ওকে থামাতে গেলে তার ফল ভাল হবে না। উদ্বাস্তুরা এমনিতেই আন্দামানে যাবার ব্যাপারে ভীষণ অনিচ্ছুক। তার ওপর যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় বিভাস ঝুড়ি ঝুড়ি ফাঁকা আশ্বাস দিচ্ছে, ওরা পুরোপুরি বেঁকে বসবে। দমদমের এই সব ক্যাম্প থেকে অন্য ত্রাণ শিবিরগুলোতেও ব্যাপারটা মুহূর্তে চাউর হয়ে যাবে। আন্দামানে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন পরিকল্পনা তাতে বানচাল হয়ে যাবার সম্ভাবনা।

এদিকে চারপাশে যে তুমুল হট্টাগোল চলছিল সেটা ঝিমিয়ে এসেছে। জনতা ফিস ফিস করে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করতে থাকে। আসলে নিরঞ্জন আর বিভাস চোখের সামনে একটা স্বর্গের ছবি টাঙিয়ে দিয়েছিল। তার নীট ফল আন্দামান সম্পর্কে উদ্বাস্তুদের আতঙ্ক অনেকটাই কেটেছে। তবে দ্বিধাটা রয়ে গেছে। সেই কারণেই খুব সম্ভব এত পরামর্শ।

হঠাৎ ভিড় ঠেলে ঠেলে একটা বুড়োমতো লোক, বয়সের ভারে কুঁজো, বিনয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতজোড় করে বিনীতভাবে বলে, আমারে চিনতে নি পারলেন ছুটোবাবু?

মুখটা চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কোথায় দেখেছে, কিছুতেই মনে করতে পারল না বিনয়। বিব্রতভাবে বলল, ঠিক মানে-।

আমি হলধর সূত্রধর। গিরিগুঞ্জে বাড়ি আছিল। রাইজদায় আপনেগো বাড়ি মাঝে মইদ্যে গ্যাছি। হ্যামকত্তায় কতভাবে যে আমার উপকার করছেন। তেনি আমার বাপের লাখান

এবার আবছাভাবে মনে পড়ল বিনয়ের। সে বলে, আপনি এখানকার ক্যাম্পে কতদিন আছেন?

মাস দুই হইল। হলধর জানায়, দেশভাগের পর তারা আসাম চলে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে টেকা গেল না। ফের উৎখাত হয়ে বউছেলেমেয়ের হাত ধরে শিয়ালদায় এসেছিল। সেখান থেকে দমদমের এই ত্রাণশিবিরে।

একটু চুপচাপ।

 তারপর হলধর আর-একটু কাছে এগিয়ে এসে হিরন্ময়দের দেখিয়ে খুব নিচু গলায় বলে, ওই ছারেরা (স্যারেরা) আন্ধারমানে লইয়া যাইতে চায়। আপনে তো ওনাগো লগে আইছেন। ওনারা যা কইল হের উপুর ভরসা রাখন যায়?

আপেল, আঙুর এবং চরের ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে বিনয় বলল, আন্দামানে গেলে জমিজমা নিশ্চয়ই পাবেন। শুনেছি ওখানকার জমি খুব ভাল। একটু থেমে ফের বলে, যদি গিয়ে দেখেন জায়গাটা পছন্দ হচ্ছে না, ফিরে আসবেন। আপনাদের সঙ্গে আমিও যাব।

হলধরের সংশয় ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। চেহারায় একটা সজীব ভাব ফুটে ওঠে। উৎসাহের সুরে সে বলে, সহত্যই যাইবেন ছুটোবাবু? সহত্যই যাইবেন?

বললাম তো-যাব।

এবার এক কাণ্ডই করে বসে হলধর। সোজা হিরন্ময়ের কাছে এসে বলে, রাইজদার হ্যামকত্তার নাতি আন্ধারমান যাইব। তেনি যহন যাইতে আছেন, আমার ফেমিলিও যাইব। আমাগো নামগুলানে দাগ মারেন ছার। এক লহমা ভেবে বলল, কেম্পে পেরায় মইরাই আছি। এইভাবে কি মাইনষে বাইচা থাকতে পারে! আন্ধারমানে গ্যালে আপনেরা যা দিবেন কইলেন, পাইলে বাচুম। নাইলে মরুম। কেম্পেও মরতাম। আন্ধারমানে গিয়াও না হয় মরুম। মরার আগে আন্ধারমানে গিয়া একবার না হয় দেখি। একহান বড় ভরসা হ্যামকত্তার নাতি লগে যাইব–

কে হেমকর্তা, পৃথিবীর কোন প্রান্তে রাজদিয়া নামের ভূখণ্ডটি রয়েছে, সে সম্পর্কে আগ্রহ থাকলেও কোনও প্রশ্ন করেন না হিরন্ময়। একটা পরিবার আন্দামানে যেতে রাজি হয়েছে, সেটা তার কাছে দিগ্বিজয়ের মতো ব্যাপার। টাইপ-করা কাগজ হাতড়ে হলধরদের নামগুলো বার করে দাগ মেরে দেন।

হলধর সূত্রধরের ফ্যামিলি সাহস করে আন্দামান যেতে চাইছে। এটা বৈদ্যুতিক ক্রিয়ার মতো কিছু ঘটিয়ে দেয়। অন্য উদ্বাস্তুরাও একে একে হিরন্ময়ের কাছে এসে জানায় তারাও যাবে। ক্যাম্পে পোকামাকড়ের মতো জীবন না কাটিয়ে বঙ্গোপসাগরের সুদূর দ্বীপপুঞ্জে বাঁচার জন্য শেষ একটা চেষ্টা তারা করবে।

এক ঘন্টার ভেতর এক শ পরিবারের নামের পাশে দাগ পড়ে যায়।

তারপর হিরন্ময় চার ক্যাম্পের অফিসার-ইন-চার্জদের বলেন, সোমবার আন্দামানের জাহাজ ছাড়বে। তার আগের দিন, মানে রবিবার কয়েকটা লরি পাঠিয়ে দেব। সেগুলো রিফিউজিদের খিদিরপুর ডকের বাইশ নম্বর গেটে পৌঁছে দেবে। আপনারা এখানকার সব ব্যবস্থা করে রাখবেন।

অফিসাররা সমস্বরে বলেন, নিশ্চয়ই স্যার।

.

৭৫.

ত্রাণশিবিরগুলোতে কাজ শেষ হতে হতে দুপুর হয়ে গেল। বিনয়রা এখন ফিরে চলেছে। হিরন্ময় বিনয়কে লক্ষ করছিলেন। বললেন, আপনি একেবারে মিরাকল করে দিলেন। আপনার সাহায্য ছাড়া ক্যাম্পের রিফিউজিদের আন্দামানে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন হত। একটু ভেবে ফের বললেন, হলধর সূত্রধরের কথা শুনে মনে হল সে আপনার দাদু হেমকর্তার ভীষণ ভক্ত। ওই মানুষটি সম্পর্কে খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

হেমনাথের জন্য আশ্চর্য এক আবেগে যেন ভাসছিল বিনয়। সে তার নাতি, একমাত্র সেই কারণে তার কথায় সমস্ত সংশয়, দ্বিধা আর আতঙ্ক কাটিয়ে হলধর আন্দামানে পাড়ি দিতে রাজি হয়েছে। এটা যে কী বিরাট গর্বের, কত আস্থার ব্যাপার, শুধু সে-ই জানে। দেশভাগ হবার পর রাজদিয়া এবং তার চারপাশের পঁচিশ তিরিশটা গ্রাম-গঞ্জের মানুষ কে কোথায় ছিটকে পড়েছে তার ঠিকঠিকানা নেই। কিন্তু তাদের একজনও তাঁকে ভোলেনি। অজস্র ছিন্নমূলের স্মৃতিতে রাজদিয়ার সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষটি অনন্ত মহিমা নিয়ে থেকে গেছেন।

অবশ্য এটাও সত্যি, হলধরের মতো মানুষগুলো রিলিফ ক্যাম্পে ধ্বংস হয়ে যেতে যেতে হতাশার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। তাদের মনের অতল স্তরে হয়তো এমন একটা মরিয়া ভাবনা লুকানো ছিল, এখান থেকে বেরিয়ে কোথাও গিয়ে মানুষের মতো বাঁচার চেষ্টা করবে। কিন্তু তেমন মনোবল ছিল না। হেমনাথের নামটা হলধরকে অসীম সাহস জুগিয়েছে। তার দেখাদেখি কুঁকড়ে-থাকা অন্য অনেকেই ভয় আর সংশয়ের ঘেরাটোপ ভেঙে অজানা ভবিষ্যতের দিকে ঝাঁপ দিতে মনস্থির করে ফেলেছে। যাই হোক, হেমনাথ সম্পর্কে হিরন্ময়কে সবিস্তার জানিয়ে দিল বিনয়। গভীর আগ্রহে সব শোনার পর সসম্ভ্রমে তিনি বললেন, নমস্য মানুষ। একটু চুপ করে থেকে বিভাসের দিকে ফিরলেন, তুমি তো ভাই বিরাট সমস্যা তৈরি করে এলে–

বিভাস অবাক হল। কীসের সমস্যা?

ক্যাম্পের রিফিউজিদের কাছে আপেল, আঙুর আর ডায়মণ্ডহারবারের কাছে চর পড়ার গল্প ফেঁদে এসেছ। যখন ওরা গিয়ে কিছুই দেখতে পাবে না তখন কী হবে?

তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল বিভাস। হেইটা আমাগো উপুর ছাইড়া দ্যান। ঠিক সামলাইয়া লমু। খানিক ভেবে বলে, আন্দামানের মাটিতে যহন সোনার ধান ফলব, আপেল আঙুরের কথা হেগো, মনেও থাকব না।

আর চরের ব্যাপারটা?

যহন ওরা জিগাইব, বানাইয়া বুনাইয়া কিছু এটা কইয়া দিমু। এই নিয়া চিন্তা কইরেন না দাদা–

.

চোখের পলকে তিনটে দিন শেষ।

নিরঞ্জনরা জানিয়ে দিয়েছিল, সোমবার খিদিরপুর ডকের বাইশ নম্বর গেট থেকে উদ্বাস্তুদের নিয়ে আন্দামানের জাহাজ ছাড়বে। জাহাজের নাম এস এস মহারাজা। রবিবার বিকেলের মধ্যেই বিনয়। যেন ডকে পৌঁছে যায়। সন্ধে আটটার ভেতর এম্বারকেশন, অর্থাৎ জাহাজে চড়তে হবে। বাকি রাতটা। কলকাতায় কাটিয়ে সোমবার ভোরে এ এস মহারাজা আন্দামানে রওনা হবে।

এই তিনটে দিন নিঃশ্বাস ফেলার সময় ছিল না বিনয়ের। পায়ে চাকা লাগিয়ে সে যেন উড়ে বেড়াচ্ছিল। শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথায়।

অফিস থেকে তাকে জাহাজের টিকেট কেটে দেওয়া হয়েছে। কেবিনের টিকেট। খরচাপাতির জন্য সেই সঙ্গে নগদ দুহাজার টাকা। যদি আরও দরকার হয়, টেলিগ্রাম করলে টি এম ও করে পাঠানো হবে।

আন্দামানে জগদীশ গুহঠাকুরতার এক বন্ধুর ছেলে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট, তাছাড়া রিফিউজি রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের কিছু দায়িত্বও তাকে পালন করতে হয়। নাম বিশ্বজিৎ রাহা। জগদীশ তাকে একটা চিঠি লিখে দিয়েছেন। অনুরোধ করেছেন আন্দামানে বিশ্বজিৎ যেন রিফিউজিদের মধ্যে বিনয়ের থাকার ব্যবস্থা করে দেন। তার সুবিধা-অসুবিধার দিকে যেন লক্ষ রাখেন।

অচেনা নতুন জায়গায় যাচ্ছে। জামাকাপড় খুব একটা বেশি নেই বিনয়ের। কলকাতায় আসার পর আনন্দরা সেই যা কিনে দিয়েছিল। অফিসের টাকাটা পেয়ে কটা ধুতি, রেডিমেড শার্ট, পাজামা, এক জোড়া ফুল প্যান্ট, একটা বড় সাইজের চামড়ার সুটকেস কিনে ফেলল সে। কিনল হোন্ড-অল, পাতলা তোষক, বালিশ। এখন গরমের রেশ চলছে। লেপ-কম্বলের দরকার নেই। রাতে যদি শীত শীত করে, তাই গায়ে দিয়ে শোবার জন্য একটা মোটা খদ্দরের চাদরও কিনে নিল। তাছাড়া দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম, দুটো ওয়াটারম্যান পেন, দুশিশি কালি, ডায়েরি, এমনি টুকিটাকি নানা জিনিস। রিপোর্ট লেখার জন্য অফিস থেকে অবশ্য ডজন দুয়েক মোটা মোটা নিউজপ্রিন্টের প্যাড দিয়েছে।

কেনাকাটা এবং গোছগাছের ফাঁকে একদিন সে টালিগঞ্জে সুধাদের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। আন্দামানে যাচ্ছে শুনে সুধা তো কেঁদেকেটে সারা। সে কিছুতেই ভাইকে যেতে দেবে না। যদি জাহাজ-ডুবি হয়ে যায়? বিনয় বুঝিয়েছে, তারা স্টিমারে করে তারপাশা থেকে গোয়ালন্দে আসেনি? স্টিমার কি ডুবে গিয়েছিল?

সুধা বলেছে, সেখানে ছিল নদী। তুই যাবি সমুদ্রে। দুটো কি এক হল?

অনেক বোঝাবার পর খানিকটা শান্ত হয়েছে সুধা। ধরা ধরা গলায় বলেছে, আন্দামানে গিয়েই টেলিগ্রাম করবি

করব।

দ্বারিক দত্ত, সরস্বতী, হিরণ, এমনকি কাজের মেয়ে উমারও খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারা বলেছে, নতুন জায়গায় যাচ্ছে বিনয়, যেন খুব সাবধানে থাকে।

একদিন সুনীতিদের বাড়িতেও গিয়েছিল বিনয়। সুনীতি সুধার মতো কান্নাকাটি জুড়ে দেয়নি ঠিকই, তবে তার চোখ ছল ছল করছিল। হেমনলিনী, আনন্দ, মাধুরী, দীপক-কারওই মন ভাল ছিল না। সবাই বলেছে, বিনয়ের জন্য তারা চিন্তায় থাকবে। সময়মতো যেন খাওয়া দাওয়া করে। অনিয়ম যেন না হয়, ইত্যাদি।

সুনীতিদের বাড়ি থেকে সেদিনই বিনয় গিয়েছিল ঝুমাদের বাড়ি। দূরে কেউ কোথাও গেলে, আত্মীয় পরিজনেরা যা যা বলে থাকে, শিশির, স্মৃতিরেখা, রামকেশবরা ঠিক তা-ই বলেছেন। শরীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে একই উপদেশ, চলাফেরা সম্পর্কে একই ভাবে সতর্ক করে দেওয়া। শিশির, স্মৃতিরেখারা যখন কথা বলছিলেন, এক পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল ঝুমা। এক ফাঁকে সে বিনয়কে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেছে। খাটের একধারে তাকে বসিয়ে কাছাকাছি বসেছিল ঝুমা। দুচোখ জলে ভরে যাচ্ছিল তার। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে ভেতরকার চাপা কষ্ট ঠেকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু শেষ অবধি পারেনি। কান্না উথলে বেরিয়ে এসেছে। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে যাচ্ছিল সে।

অপার বিস্ময়ে ঝুমার দিকে কিছুক্ষণ হতবাক তাকিয়ে থেকেছে বিনয়। রাজদিয়ায় যে ঝুমাকে সে দেখেছে সে তেমনটি নেই, আগাগোড়া বদলে গেছে। কলকাতায় আসার পর তার অনেকখানি পরিবর্তন লক্ষ করেছিল বিনয়। কিন্তু যে নারী তার যা প্রিয়, তার যা কাম্য, সমস্ত কিছু সবলে ছিনিয়ে নিতে পারে, তাকে আগে কখনও কাঁদতে দেখা যায়নি।

বিনয় জিজ্ঞেস করেছে, কী হয়েছে ঝুমা, কাঁদছ কেন?

ভাঙা ভাঙা, জড়ানো গলায় ঝুমা বলেছে, তুমি কলকাতায় থাকবে না, আমার কী খারাপ যে লাগছে!

আমি কী একেবারেই চলে যাচ্ছি। কাজ শেষ হলেই চলে আসব।

 কবে শেষ হবে? কতদিন ওখানে থাকবে?

এখানে বসে কী করে বলব? আগে তো যাই। আন্দামানে পৌঁছে সব দেখি। তারপর জানতে পারব ওখানে কতদিন থাকা দরকার।

মুখ থেকে হাত সরিয়ে সজল চোখে তাকিয়েছে ঝুমা। ব্যাকুল স্বরে বলেছে, তোমাকে ছেড়ে আমি কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারব না।

পাগল মেয়ে– বলতে বলতে ঝুমার কাঁধে একটা হাত রেখেছে বিনয়।

সেই স্পর্শে আচমকা ইন্দ্রজালের মতো কী যেন হয়ে যায়।

ঝুমা বিনয়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রগাঢ় আবেগে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, আন্দামানে গিয়ে রোজ আমাকে একটা করে চিঠি লিখবে। বুঝব, তুমি আমার কাছেই আছ। লিখবে ত? আমার কথা মনে থাকবে?

রাজদিয়ায় সদ্য কিশোরী ঝুমা কোনও কোনও বিজন দুপুরে তাকে বুকের ভেতর টেনে নিত। আজ সে পূর্ণ যুবতী। ঝুমার হাত, মুখ, গলা, স্তন, সব মোমের মতো গলে গলে বিনয়ের শরীরে মিশে যাচ্ছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিদ্যুৎ খেলতে থাকে তার। আন্দামানে গিয়ে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কোথায় সে থাকবে, কোন গহন বনভূমিতে বা পাহাড়ে, সেই সব জায়গায় পোস্ট অফিস আছে। কি না, কিছুই জানা নেই। ঝুমার হৃৎপিণ্ডের উত্থান পতন বুকের ভেতর অবিরল অনুভব করতে করতে তা আর খেয়াল থাকেনি। প্রিয় নারীটির আবেগ, আকুলতা তার মধ্যেও চারিয়ে যাচ্ছিল। গাঢ় গলায় বিনয় বলেছে, নিশ্চয়ই লিখব

এবার মুখ তুলে বিনয়ের ঠোঁটের ওপর তার দুই উষ্ণ, রক্তাভ ঠোঁট স্থাপন করেছে ঝুমা। কলকাতায় আসার পর এই তার প্রথম চুম্বন। অফুরান মাধুর্য ছড়িয়ে ছড়িয়ে তা বিনয়ের স্নায়ুমণ্ডলীকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। এই নারীটির চুম্বন যে কী মাদকতাময়!

অনেকক্ষণ পর ঝুমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল বিনয়। তার সঙ্গে সঙ্গে সদর পর্যন্ত এসেছে ঝুমা। খানিকটা চলার পর রাস্তার মোড়ে এসে একবার পেছন ফিরেছে সে। দরজার। ফ্রেমে তার কাম্য নারীটি কোনও রমণীয় ভাস্কর্যের মতো দাঁড়িয়ে ছিল।

.

রবিবার দুপুরে খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়ল বিনয়। মালপত্র ডিকিতে ভরে দেওয়া হয়েছে। প্রসাদ তাকে খিদিরপুর ডকে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। সে রাজি হয়নি। বিনয় এখন আর রাজদিয়ায় সেই গেঁয়ো, জড়সড়, লাজুক যুবকটি নেই। তার ওপর এই কমাসে শহুরে পালিশ পড়ে গেছে। এখন সে অনেক বেশি সপ্রতিভ। অনেক উদ্যমী। অনেক তৎপর। কারও সাহায্য ছাড়াই একা-একা যেখানে সেখানে হুটহাট চলে যেতে পারে।

খিদিরপুর ডকের বাইরে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে এক হাতে সুটকেস, আর-এক হাতে হোল্ড-অল ঝুলিয়ে বাইশ নম্বর গেটের পাশের জেটিতে চলে এল। সেখানে বিশাল জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। সেটার গায়ে লেখা : এস এস মহারাজা। এস এস মানে স্টিমশিপ।

জাহাজটার গায়ে লম্বা উঁচু সিঁড়ি লাগানো। নিচে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে জাহাজ কোম্পানির লোকেরা। বেশ কিছু যাত্রী সেখানে জড়ো হয়েছে। চেহারা দেখে মনে হয় না উদ্বাস্তু। তারা কোম্পানির লোকেদের টিকেট এবং দরকারি কাগজপত্র দেখিয়ে একে একে জাহাজে উঠছে। জেটির একধারে পাহাড়প্রমাণ মালপত্র টাল দিয়ে রাখা আছে। বিরাট বিরাট টিন বোঝাই সরষের তেল, বনস্পতি ঘি, নারকেল, তেল, বস্তা বস্তা আলু, পেঁয়াজ, ডাল, মশলা, নুন, গুড়, চিনি, আটা, ময়দা, গাঁট গাঁট কাপড়, বাক্স বাক্স ওষুধ, সিগারেট, বাসন কোসন, ইলেকট্রিক্যাল গুডস-জীবনধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন সমস্ত কিছু। প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে কুলিরা সেইসব মাল মাথায় চাপিয়ে জাহাজে রেখে এসে ফের নিয়ে যাচ্ছে। এইভাবে খেপের পর খেপ।

বিনয় শুনেছে, দৈনন্দিন প্রয়োজনের সমস্ত জিনিস প্রতি মাসে জাহাজে করে আন্দামানে নিয়ে যাওয়া হয়। এক মাস কোনও কারণে যদি জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকে, দ্বীপের মানুষজনকে উপোস করে থাকতে হবে।

মহারাজা জাহাজে দমদম ক্যাম্পের শরণার্থীদের যাবার কথা। কিন্তু যাচ্ছে অন্য লোকজন। বিনয় বেশ ধন্দে পড়ে যায়। তবে কি উদ্বাস্তুরা এখনও এসে পৌঁছয়নি?

এধারে ওধারে তাকাতে হঠাৎ বিনয়ের চোখে পড়ে বেশ খানিকটা দূরে বিরাট লম্বা শেডের তলায় দড়ির ঘেরের ভেতর অগুনতি মানুষ গা ঘেঁষেঘেষি করে বসে আছে। অতি পরিচিত, ক্ষয়াটে সব চেহারা।

উদ্বাস্তুদের তাহলে আলাদা করে ওখানে রাখা হয়েছে। বড় বড় পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে যায় বিনয়।

একদিকে উদ্বাস্তুদের জটলা। সেখানে সারি সারি মলিন, ভয়ার্ত মুখ। বেশির ভাগই চুপচাপ। জাহাজ, ডক, বন্দরের ব্যস্ত কর্মীদের দেখে তারা কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গেছে। বিহুলের মতো চারদিকে তাকাচ্ছে। বাকি সবাই নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। স্পষ্টই বোঝা যায়, আসন্ন সুমদ্রযাত্রা নিয়ে তারা ভীষণ চিন্তিত। তাদের পাশে রয়েছে রং-চটা দড়িবাঁধা বিছানা, তোবড়ানো সিলভারের হাঁড়িকুড়ি, বালতি, জং-ধরা দা, বঁটি, কুলো থেকে আঁটা, জাঁতি-অর্থাৎ পার্থিব সম্পত্তি বলতে যার যেটুকু ছিল সব নিয়ে এসেছে। এমনকি ক্যাম্পের ফাঁকা জমিতে যে লাউগাছ বা ডাটা ফলিয়েছিল তাও কেটে এনেছে।

বাচ্চাগুলোর কিন্তু তাদের মা-বাপের মতো দুর্ভাবনা নেই। তারা হইচই করে শেডের তলায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

চকিতে তারপাশা স্টিমার ঘাটের সেই দৃশ্যটি চোখের সামনে ফুটে ওঠে। হাজার হাজার আতঙ্কগ্রস্ত, উৎখাত মানুষ সেখানে খোলা আকাশের নিচে দিনের পর দিন রুদ্ধশ্বাসে পড়ে থেকেছে। কখন স্টিমার এসে তাদের গোয়ালন্দে পৌঁছে দেবে সেই আশায়। গোয়ালন্দ থেকে ট্রেন ধরে তারা জন্মের শোধ চলে যাবে ইন্ডিয়ায়। তারপাশার মতো অত না হলেও যে শপাঁচেক মানুষ খিদিরপুর ডকে দলা পাকিয়ে বসে আছে তাদের চোখমুখেও তীব্র উৎকণ্ঠা। জাহাজে করে বঙ্গোপসাগরের যে অজানা দ্বীপপুঞ্জে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেখানে কীভাবে তারা বেঁচে থাকবে, কেমন করে গড়ে তুলবে তাদের নতুন বাসভূমি-হয়তো এইসব চিন্তাই তাদের ব্যাকুল করে রেখেছে।

রিফিউজিরা এক দিকে, অন্যদিকে প্রচুর চেয়ার টেবল। সেখানে বসে আছেন হিরন্ময় চৌধুরি, পরিতোষ পালিত, প্রিয়নাথ গুপ্তভায়া এবং রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের আরও কয়েকজন অফিসার।

রয়েছেন দুজন ডাক্তার। তাদের সামনের মস্ত টেবলে প্রচুর ওষুধপত্র। ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। তবে সবচেয়ে বেশি করে যারা নজর কাড়ছে তারা হল নিরঞ্জন আর বিভাস। তারা এই মুহূর্তে ভীষণ ব্যস্ত।

 বিভাসের মুখে একটা টিনের লম্বাটে চোঙা। সে রিফিউজিদের দিকে ফিরে কিছুক্ষণ পর পর হেঁকে উঠছে, হরিপদ বিশ্বাস, গগন জয়ধর-আপনেরা ফেমিলি লইয়া ডাক্তারবাবুগো কাছে আহেন–

দুটো উদ্বাস্তু পরিবার ভিড়ের ভেতর থেকে উঠে এসে দুই ডাক্তারের সামনে এসে কাতার দিয়ে দাঁড়ায়। ডাক্তাররা তাদের পেট টিপে, বুকে স্টেথোস্কাপের নল ঠেকিয়ে পরীক্ষা টরীক্ষার পর একটা করে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছেন। হাতে ছুঁচ ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাগুলো পরিত্রাহি চিৎকার জুড়ছে।

দুটো পরিবারের পর অন্য দুই পরিবারকে ডাকল বিভাস। কেন উদ্বাস্তুদের ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করানো হচ্ছে, বুঝতে পারছিল না বিনয়। হঠাৎ নিরঞ্জনের নজর এসে পড়ে তার ওপর। সারা মুখে খুশি ছড়িয়ে পড়ে। কাছে এগিয়ে এসে বলে, আইয়া গ্যাছেন! গুড। খাড়ইয়া ক্যান? হিরন্ময়রা যেখানে বসে আছেন সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, ওইহানে গিয়া বহেন–

নিরঞ্জন জানায়, ফি দফায় উদ্বাস্তুদের আন্দামানের জাহাজে তোলর আগে মেডিকেল চেক-আপ করানো হয়। দেওয়া হয় কলেরার ইঞ্জেকশন।

বিনয়ের মাথায় খানিক আগের দৃশ্যটা ঘুরছিল। সে মহারাজা জাহাজটা দেখিয়ে বলে, ওটায় করে তো রিফিউজিদের যাবার কথা। কিন্তু অন্য প্যাসেঞ্জাররা উঠছে যে?

নিরঞ্জন বিশদ বুঝিয়ে দিল, নানা কাজে প্রতি মাসে আন্দামান থেকে সরকারি এবং বেসরকারি অফিসের কর্মীরা কলকাতায় আসে। ব্যবসাদাররা আসে মালপত্র নিয়ে যেতে। এক সপ্তাহ থেকে এখানকার কাজ সেরে সেই জাহাজেই তারা ফিরে যায়। তাছাড়া অন্য প্যাসেঞ্জাররাও রয়েছে। উদ্বাস্তুদের তাদের সঙ্গেই নিয়ে যাওয়া হয়। সাধারণ যাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা আপার ডেকে, কিংবা কেবিনে। সমুদ্রযাত্রায় উদ্বাস্তুদের রাখা হয় জাহাজের খোলের ভেতর। সেখানে রয়েছে সারি সারি বাঙ্ক।

নিরঞ্জন বলল, জাহাজে উঠলে নিজের চোখে হগল দ্যাখতে পাইবেন।

ওদিকে গিরিগঞ্জের হলধর সূত্রধর বিনয়কে দেখতে পেয়েছিল। উদ্বাস্তুদের ভিড় থেকে সে উঠে আসে। বলে, হেই কহন থিকা পথের দিকে তাকাইয়া বইয়া আছি। একবার ভাবলাম আপনে বুঝিন আইলেন না। পরে চিন্তা কইরা দ্যাখলাম, হ্যামকত্তার নাতি যহন কথা দিছে, ঠিকই আইৰ। আপনেরে দেইখা কী ভালা যে লাগতে আছে! তাকে বেশি উদ্দীপ্ত দেখালো।

নিরঞ্জন বিনয়কে বলে, আপনেরা কথাবার্তা কন। আমি ওই দিকটা দেহি। অহনও (এখনও) পঁচিশ-তিরিশখান ফেমিলির মেডিক্যাল চেক-আপ বাকি। সে চলে গেল।

বিনয় হলধরের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে, দমদম ক্যাম্প থেকে আপনারা কখন এসেছেন?

হেই হকাল বেলায় চা-রুটি খাওনের পর দশখান লরিতে কইরা অপিছারেরা (অফিসারেরা) আমাগো এইহানে লইয়া আইছে।

দুপুরে কি এখানেই খেলেন?

হ। ভালাই খাওয়াইছে। ভাত, ডাইল, বাইগন (বেগুন) ভাজা, রুই মাছের ঝো? আর দই।

আরও কিছুক্ষণ কথা বলে হলধর এপাশে ওপাশে তাকিয়ে আচমকা গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে দেয়। ছুটোবাবু, এইদিকে এক কাণ্ড অইয়া গ্যাছে। অপিছাররা অহনও ট্যার পায় নাই।

হলধরের বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু রয়েছে যাতে চমকে ওঠে বিনয়। একটা চাপা উদ্বেগও বোধ করে। বলে, কী হয়েছে?

জাহাজ জুহাজ দেইখা ডরে ছয়টা রিফুজ ফেমিলি পিছন দিক দিয়া চুপে চুপে পলাইয়া গ্যাছে বলে যে বিশাল শেডটার তলায় উদ্বাস্তুরা বসে আছে তার ওধারটা দেখিয়ে দেয়। সেদিকে আরও একটা গেট রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, নিরঞ্জনরা যখন অন্যদিকে ব্যস্ত সেই সময় ওদিক দিয়ে নিঃশব্দে সরে পড়া যায়। ছটা ফ্যামিলি সেই সুযোগটাই নিয়েছে। এটা এক মহা সংকট। রঞ্জনরা চায়, আন্দামান পুরোপুরি বাঙালি উদ্বাস্তুদের উপনিবেশ হয়ে উঠুক। প্রতি খেপে যতগুলো ডি পি ফ্যামিলি যাবার কথা ঠিক ততগুলোই যাক। একটাও যেন কম না হয়। যখন ধরা পড়বে ছটা পরিবার কমে গেছে, তখন নতুন এই সমস্যাটা কীভাবে সামাল দেবে নিরঞ্জনরা, কে জানে।

.

মেডিকেল চেক-আপ শেষ হতে হতে বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এল। ডকের সব বাতি জ্বালিয়ে। দেওয়া হয়েছে। জোরালো আলোর ঢল নেমেছে চারপাশে। ওদিকে অন্য প্যাসেঞ্জার এবং পর্বতপ্রমাণ। মালপত্র জাহাজে উঠে গিয়েছিল। এবার উদ্বাস্তুদের পালা। জেটিতে জাহাজের নিচে সিঁড়ির মুখে নামের তালিকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিভাস, নিরঞ্জন, হিরন্ময় এবং রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের অফিসার আর কর্মীরা। রয়েছে জাহাজ কোম্পানির লোকজন।

লিস্ট দেখে নাম ডেকে ডেকে উদ্বাস্তুদের জাহাজে তুলছে নিরঞ্জনরা। স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে, কাঁধে মাথায় যার যার লটবহর চাপিয়ে, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ছিন্নমূল মানুষগুলো নতুন আশ্রয়ের আশায় ওপরে উঠছে।

নিরঞ্জনদের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ করছিল বিনয়। উদ্বাস্তুদের জাহাজে চড়াবার পর নিরঞ্জন, বিভাস এবং পুনর্বাসন বিভাগের অন্য কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে সেও ওপরে উঠবে। এর মধ্যে তার জানা হয়ে গেছে, আন্দামানে পৌঁছতে চারদিন লেগে যাবে। এতগুলো মানুষ যাচ্ছে। পথে সি-সিকনেস ছাড়াও নানারকম অসুখ বিসুখ হতে পারে, তাই একজন ডাক্তারও যাচ্ছেন।

সার বেঁধে উদ্বাস্তুরা উঠছিল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় চোখে পড়ে একটি তরুণী সিঁড়ির প্রায় শেষ মাথায় পৌঁছে গেছে। তার মুখের ডান পাশটা দেখা যাচ্ছিল। মনে হয় ঝিনুকের আদল। হঠাৎ প্রবল আলোড়নে বুকের ভেতরটা উথালপাতাল হতে থাকে। সৌরজগৎ যেন প্রবল ঘূর্ণিপাকে দুরন্ত গতিতে ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। বিনয়ের শ্বাস আটকে আটকে আসে। সে যে সিঁড়ি টপকে টপকে মেয়েটির কাছে যাবে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে সত্যিই সে ঝিনুক কি না, তার উপায় নেই। সিঁড়িটা সরু, সেখানে কাতার দিয়ে ধাপে ধাপে মানুষ। ওপরে যেতে হলে তাদের ধাক্কা মেরে, ঠেলে উঠতে হয়।

কয়েক লহমা মাত্র। জাহাজের আপার ডেকে উঠে মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে গেল। স্তম্ভিত, হতবুদ্ধি বিনয় আচ্ছন্নের মতো জেটিতে দাঁড়িয়ে রইল। তার মাথার ভেতরটা গুলিয়ে যেতে থাকে।

উদ্বাস্তুরা জাহাজে উঠে পড়েছিল। আচমকা-উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠে নিরঞ্জন, সব্বনাশ হইয়া গ্যাছে। ছয়টা ডি পি ফেমিলি মিসিং। নিঘাত চৌখে ধূলা দিয়া জেটি থিকা ভাইগা পড়ছে। অহন আমি কী করুম? সোময়ও তো নাই যে অন্য কুনোখান থিকা ছয়টা ফেমিলি ধইরা আইনা কোটা পূরণ করি। ছয়টা বাঙ্গালি ফেমিলি না গ্যালে সরকার ছয়টা মোপলা ফেমিলিরে আন্দামানে পাঠাইয়া দিতে পারে। ব্যাঙ্গলের যে কতখানি ক্ষতি হইয়া যাইব? একটানা তার আক্ষেপ চলতেই থাকে।

তার কথার উত্তরে হিরন্ময়রা কিছু বলছিলেন, কিন্তু সে-সব শুনতে পাচ্ছিল না বিনয়। সেই মেয়েটির মুখের আধখানা তার চোখের সামনে স্থির চিত্রের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এখন একটাই চিন্তা, জাহাজে ওঠার পর তাকে খুঁজে বার করতেই হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *