০১-৫. কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল

শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

উৎসর্গঃ সমরেশ মজুমদার অনুজপ্রতিমেষু

প্রসঙ্গত

‘কেয়াপাতার নৌকো’র অখন্ড সংস্করণের ভূমিকায় জানিয়েছিলাম, দেশভাগভিত্তিক এই উপন্যাসের পর আরও কয়েকটি পর্ব ভিন্ন ভিন্ন নামে লিখব। সেই অনুযায়ী ‘কেয়াপাতার নৌকো’-র পরবর্তী পর্ব শতধারায় বয়ে যায় প্রকাশিত হল। আমার বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে। হাতে সময় বড় কম। তাই এর পরের অংশগুলি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে চাই।

‘শতধারায় বয়ে যায়’ ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল বর্তমান পত্রিকার রবিবাসর বিভাগে, দীর্ঘ দু’বছর ধরে। এই বিভাগের সম্পাদক এবং তার সহকারী কাকলি চক্রবর্তী ও সাহানা নাগচৌধুরির অবিরল তাগাদা ছাড়া এটি লেখা আদৌ সম্ভব হতো না। প্রসঙ্গত অনুজপ্রতিম কথাসাহিত্যিক শচীন দাসের কথা না বললেই নয়। সেও এটি লেখার জন্য সমানে আমাকে উসকে গেছে। এদের সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক তাতে সামান্য ধন্যবাদ জানানো যথেষ্ট নয়। তিন স্নেহভাজনকে শুধু আন্তরিক শুভকামনাই জানাতে পারি। ‘শতধারায় বয়ে যায়’-এর জন্য পুরনো পত্রপত্রিকার অসংখ্য প্রতিবেদন তো বটেই, বহু বিশিষ্ট ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক এবং সাংবাদিকের গবেষণাগ্রন্থ থেকেও প্রচুর তথ্য পেয়েছি। এঁদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

দেশভাগের কারণে বাঙালির সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে যে মহাতমসা নেমে এসেছিল, এমনটা আর কখনও দেখা যায়নি। এই বিপর্যয়ের জের কাটিয়ে উঠতে কত যুগ লাগবে, কে জানে।

বঙ্গ-বিভাজন শতসহস্র জনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু মানুষ নিদারুণ প্রতিকূলতার মধ্যেও সহজে পরাভব মানে না। ভগ্ন্যুপের ভেতর থেকে সর্বস্ব-হারানো উদ্বাস্তুদের অনেকে মাথা তুলে আবার নিজেদের নির্মাণ করে চলেছে। বিনাশের পাশাপাশি সৃজন।

অনতিদূর অতীতের সেই চরম বিপর্যয়ের সময় থেকে বর্তমান কাল অবধি বাঙালির ধ্বস্ত জীবনকে আমার এই পর্যায়ের উপন্যাসগুলিতে ফুটিয়ে তোলার ইচ্ছে রয়েছে। কিন্তু কতটা সম্ভব হবে জানি না। তবে অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাব।

আমি গুরুতর অসুস্থ। তাই প্রফ সংশোধনে কিছু ভুলচুক থেকে যেতে পারে। পরবর্তী সংস্করণে তা ঠিক করে দেব।

—গ্রন্থকার

০১.

কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, বিনয়ের খেয়াল নেই। বিহ্বলতা যখন কাটল, মনে হল, শত আলোকবর্ষ পার হয়ে গেছে। রাস্তায় একই রকম ব্যস্ততা, জনস্রোত। কর্পোরেশনের ঘোলাটে-আলোগুলো ঘিরে কুয়াশার ঘোট ঘোট বলয়। ট্রাম বাস ঘোড়ার গাড়ি, এমন অজস্র যানবাহন রকমারি আওয়াজ তুলে আগের মতোই ছুটে চলেছে। চিরদুঃখী এক তরুণী উদ্ভ্রান্তের মতো কোথায় বিলীন হয়ে গেছে, জানা নেই। কিন্তু মহানগরের আহ্নিক গতিতে লহমার জন্যও তাল কাটেনি। সবই আগের মতো চলমান। ধ্বনিময়। কোথাও অস্বাভাবিক কিছু নেই।

বিনু আর সেই বিনু নেই। দেশভাগের পর নানা ঘা খেয়ে খেয়ে অজস্র অভিজ্ঞতায় এখন সে এক পরিপূর্ণ যুবক। [কেয়াপাতার নৌকো’র বিনু জীবনের এই পর্ব থেকে বিনয়।

হিম ঝরে চলেছে বিরতিহীন। শীতল উত্তুরে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে অবিরাম। উত্তর থেকে দক্ষিণে। গায়ে কাঁপুনি ধরার কথা। কিন্তু শরীর কেমন যেন অনুভূতিশূন্য। চোখের সামনে মানুষজন, গাড়িঘোড়া সব ছেঁড়া ছেঁড়া, ঝাপসা ছবির মতো। অসংলগ্ন। একটার সঙ্গে অন্যটার কোনও যোগ নেই।

অসাড় ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যাবার পর বিনয়ের মনে হয়, মাথায় অবিরল ধারালো শেল বিধছে। বুকের ভেতর কী যে অসহ্য যন্ত্রণা! কেউ যেন অতল অন্ধকার খাদে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। শ্বাস আটকে আটকে আসছে তার।

লক্ষ লক্ষ মানুষের এই আধো-চেনা শহর দিগ্বিদিকে ছড়ানো, এখানে ঝিনুককে কোথায় খুঁজবে বিনয়? কোথায় গেলে তাকে ফিরে পাওয়া যাবে, জানা নেই।

ঝিনুক যে কত মায়ায়, কত অজস্র পাকে, তাকে আমূল জড়িয়ে আছে, সেই কিশোর বয়স থেকেই বিনয় অনুভব করে এসেছে। নইলে এত ঝুঁকি নিয়ে সে কি ওকে বুকের ভেতর আগলে আগলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্তের ওপারে নিয়ে আসতে পারত? প্রতি মুহূর্তে সেখানে ছিল ঘাতক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। জলেস্থলে সর্বক্ষণ সেখানে মৃত্যুভয়। আকাশ বাতাস বিষ-বাষ্পে ভরা। কিন্তু ঝিনুকের জন্য কিছুই গ্রাহ্য করেনি বিনয়।

এখন, হেমন্তের এই কুহেলিমাখা রাত্তিরে, কলকাতার সদাব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝিনুক যে তার জীবনের শত দিগন্ত জুড়ে রয়েছে, নতুন করে আবার তা টের পেল সে। একটা হুহু কান্না শরীরের রক্তমাংস ভেদ করে বেরিয়ে আসছে।

কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে ঝিনুকের খোঁজ পাওয়া যাবে না। কিছু একটা করতেই হবে বিনয়কে। কী করা যায়?

এতক্ষণ ঝিনুকের চিন্তাটা এমন ব্যাকুল করে রেখেছিল যে অন্য কিছুই ভাবতে পারছিল না বিনয়। হঠাৎ অবনীমোহনের মুখ, চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাবা নিশ্চয়ই কোনও একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন। পরক্ষণে মাথায় সংশয়ের মেঘ জমে। অবনীমোহন কি ঝিনুককে খুঁজে বার করার জন্য আদৌ কিছু করবেন? একটা ধর্ষিত মেয়ে আচমকা এসে তাকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে, ঘটিয়েছে তার শাস্তির ব্যাঘাত। হঠাৎ সে চলে যাওয়ায় তার তত খুশি হওয়ারই কথা। অনন্ত স্বস্তি। অবাঞ্ছিত আপদ বিদায় হলে যেমনটা হয় আর কি।

তবু বাবার কাছে না গিয়ে উপায় নেই। উধ্বশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি ফিরে এল বিনয়। একসঙ্গে দুতিনটে করে সিঁড়ি টপকে তেতলায় সোজা অবনীমোহনের ঘরে। সমানে হাঁপাচ্ছে। ভেতরে যে উথালপাতাল ভাবটা চলছে, হাড়পাঁজর ভেদ করে তা বেরিয়ে আসতে চাইছে।

অবনীমোহন খাটের ওপর বালিশে ভর দিয়ে একটা বিশাল বইয়ের ভেতর ডুবে ছিলেন। নিশ্চয়ই কোনও ধর্মগ্রন্থ। খুব সম্ভব হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মশাই মূল মহাভারতের বাংলা যে অনুবাদ করেছেন তার কোনও একটি খণ্ড।

পায়ের আওয়াজে মুখ তুললেন অবনীমোহন। ছেলের মুখচোখ লক্ষ করে তার মনে হল, অঘটন কিছু ঘটেছে। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে বিনু?

উদ্বেগে, দুশ্চিন্তায় বিনয়ের কণ্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ঝাপসা গলায় কোনওরকমে বলতে পারল, ঝিনুককে পাওয়া যাচ্ছে না।

হাতের বইটা নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে বসলেন অবনীমোহন, সে কী! কোথায় যাবে সে! এত বড় বাড়ি। দেখ, কোনও ঘরে নিশ্চয়ই আছে।

একতলা থেকে তেতলার প্রতিটি কামরা, অলিন্দ, প্যাসেজ, ছাদ, সব আঁতিপাঁতি করে খুঁজে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত তো বটেই, এমনকি ট্রামরাস্তা অবধি ছুটে গিয়েছিল বিনয়। সবিস্তার সমস্ত জানিয়ে সে বলল, কোথাও নেই ঝিনুক।

 আশ্চর্য! অবনীমোহন যেন থই পাচ্ছেন না, এমন সুরে বললেন, কী এমন ঘটেছে যে কারওকে না জানিয়ে চলে গেল!

বিনয় উত্তর দিল না।

অবনীমোহন এবার বললেন, তুই কি ওকে কিছু বলেছিস?

 ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। বিনয় হয়তো তার সঙ্গে এমন কোনও আচরণ করেছে যাতে মেয়েটা ক্ষোভে, বেদনায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তার বলতে ইচ্ছা হল, যে-মেয়েকে বুকের ভেতর পুরে পাকিস্তানের সীমানা পার করে নিয়ে এসেছে তাকে এতটুকু আঘাত কি সে দিতে পারে? বিমূঢ়ের মতো বাবার মুখের দিকে তাকালো বিনয়। বলল, তখন তোমার ঘর থেকে বেরুবার পর ঝিনুকের সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি। তাকে কিছু বলার প্রশ্নই নেই।

লহমায় বদলে গেলেন অবনীমোহন। তড়িৎস্পৃষ্টের মতো তাঁর শরীর বেঁকে দুমড়ে যেতে লাগল যেন। রক্তের ভেতর আগুনের হলকা ছুটছে। কাঁপা গলায় বললেন, তবে কি, তবে কি, ওকে হোমে পাঠাবার যে কথাগুলো তোকে বলেছিলাম, ঝিনুক তা শুনে ফেলেছে?

বিনয়ের অনুমানও ঠিক তা-ই। সে চুপ করে রইল।

অবনীমোহনের আক্ষেপ থামেনি, মেয়েটার হয়তো আর-এক বার সর্বনাশই করে ফেললাম। এত বড় শহরে কোথায় যাবে সে, কোন বদ লোকের পাল্লায় পড়বে, কিছুই বুঝতে পারছি না।

বাবার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েই আছে বিনয়। নিরাসক্ত মানুষটিকে ভীষণ বিচলিত মনে হচ্ছে। সংসারের যাবতীয় বন্ধন যিনি ছিঁড়ে ফেলেছেন, সুখ দুঃখ মায়া মোহ কিছুই যাঁকে স্পর্শ করে না, সেই অবনীমোহন একেবারে বদলে গেছেন। অনুতপ্ত। তীব্র মনস্তাপ তাকে বিদীর্ণ করে দিচ্ছে।

খাট থেকে দ্রুত নেমে অবনীমোহন বললেন, চল আমার সঙ্গে

বিনয় রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

থানায়।

থানায় কেন?

এখানকার ওসির সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আমাদের পক্ষে কতটুকু কী-ই বা করা সম্ভব? পারলে পুলিশই ঝিনুককে খুঁজে বার করতে পারবে। চল–

যা পরে ছিলেন, সেই পোশাকেই বিনয়কে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়লেন অবনীমোহন।

.

থানা খুব দূরে নয়। বাড়ি থেকে হাঁটাপথে মিনিট পাঁচেক লাগে।

গম্ভীর, ভীতিকর চেহারা নিয়ে থানার মস্ত লাল ইমারত দাঁড়িয়ে আছে। গেটের মুখে বন্দুকধারী, ধড়াচুড়ো-পরা, হিন্দুস্থানী সেন্ট্রি। প্রকাণ্ড চেহারা, জমকালো গালপাট্টা। তাকে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, ওসি তার কামরাতেই আছেন।

ভারী ভারী সেকেলে আলমারি, ভারী ভারী টেবল চেয়ার, টেবলে স্তূপাকার ফাইল, কালো রঙের টেলিফোন ইত্যাদি দিয়ে জবরজং সাজানো একটা বড় কামরায় বাবার পিছু পিছু এসে ঢুকল বিনয়।

টেবলের ওধারে যিনি বসে ছিলেন তাঁর বয়স বাহান্ন তিপ্পান্ন। কোঁকড়া চুল, নিখুঁত কামানো লম্বাটে মুখ, গায়ের রং বেশ ফর্সা। চোখের দৃষ্টি শান্ত এবং গভীর। এই বয়সেও মেদ জমেনি। বেতের মতো ছিপছিপে শরীর। দারোগা বলতে যে রুক্ষ রাগী কর্কশ মুখের ছবিটি ফুটে ওঠে তার সঙ্গে একে মেলানো যায় না। দুর্গের মতো একটা দমবন্ধকরা পরিবেশে তাঁকে যেন ঠিক মানায় না।

ওসি বললেন, আসুন আসুন অবনীবাবু। বসুন অবনীমোহনরা বসলে জিজ্ঞেস করলেন, অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম। শুনেছিলাম, আপনি হরিদ্বার উত্তরকাশী না কনখল, কোথায় যেন গেছেন। আপনার গুরুদেবের কাছে কি?

বিনয় অনুমান করল, অবনীমোহন সম্পর্কে অনেক খবরই রাখেন ওসি। তার গতিবিধিও ওঁর অজানা নয়।

অবনীমোহন মৃদু হাসলেন, গুরু এবং তীর্থদর্শন দুটোই সেরে এলাম। মাসখানেকের ভেতর আবার গুরুর আশ্রমে ফিরে যাব।

মজার সুরে ওসি বললেন, আপনার মতো সাধুসন্ন্যাসী মানুষ হঠাৎ এই পাপীতাপীদের আখড়ায়? কোনও দরকার আছে?

হ্যাঁ।

বিনয় সম্পর্কে ওসির কৌতূহল হচ্ছিল। বার বার তার চোখ সেদিকে চলে যাচ্ছে। বললেন, দরকারের কথা পরে শুনছি। বিনয়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে জানতে চাইলেন, এটি কে? চিনতে পারলাম না তো।

আমার ছেলে। দিনকয়েক হল পাকিস্তান থেকে এপারে চলে এসেছে। ওসির সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন অবনীমোহন। তার নাম দিবাকর পালিত।

দিবাকর বললেন, এর কথা বোধহয় আপনার মুখে শুনেছিলাম। বিনয়কে বললেন, পাকিস্তানে থাকা গেল না বুঝি?

আস্তে মাথা নাড়ল বিনয়।

 অনেকটা আপন মনেই এবার দিবাকর বললেন, ওখানকার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। রোজ হাজার হাজার রিফিউজি চলে আসছে ইন্ডিয়ায়। এই মানুষগুলোর কী যে ভবিষ্যৎ!

একটু চুপচাপ।

 তারপর দিবাকর অবনীমোহনকে বললেন, এবার আপনার প্রয়োজনের কথাটা শোনা যাক।

নানা সংকটের ভেতর দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে ঝিনুকের এপারে চলে আসা থেকে শুরু করে কিছুক্ষণ আগে তার নিরুদ্দেশ হওয়া পর্যন্ত বিশদভাবে সব বলে গেলেন অবনীমোহন। অবশ্য ঝিনুকের ধর্ষিত হবার ঘটনা আর হেমনলিনীর নির্দয় ব্যবহারটুকু বাদ দিয়ে।

শান্ত মানুষটিকে এবার বেশ চঞ্চল দেখাচ্ছে। দিবাকর বললেন, হঠাৎ আপনার বাড়ি থেকে মেয়েটি চলে গেল। কী হয়েছিল?

বিব্রত অবনীমোহন এক পলক ছেলেকে দেখে নিয়ে বললেন, তেমন কিছুই হয়নি। তিনি যে অস্বস্তি বোধ করছেন, চোখেমুখে তা ফুটে উঠেছে।

দিবাকর অবনীমোহনকে লক্ষ করেননি। চিন্তিতভাবে বললেন, কোথায় যেতে পারে বলে আপনাদের ধারণা?

কোনও ধারণাই নেই। কলকাতায় এই প্রথম এসেছে, এখানকার পথঘাট কিছুই চেনে না। তার ওপর এই ঠাণ্ডার রাত। কী যে হবে, ভাবতেই পারছি না।

আপনি বলেছেন, পাকিস্তান থেকে আসার পর ঝিনুক আপনার দুই মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিল। ওই দুজায়গায় খোঁজ নিয়েছেন? যদি ওদের কারও কাছে গিয়ে থাকে–

বিনয় জানে প্রাণ গেলেও সুনীতিদের বাড়ি যাবে না ঝিনুক। সেখানে তাকে যে অসম্মান করা হয়েছে, হেমনলিনী যেভাবে তাকে আবর্জনার মতো একধারে ফেলে রেখেছিলেন, সেখানে যাবার প্রশ্নই নেই। ঝিনুকের অভিমান এবং আত্মসম্মানবোধ খুবই প্রখর। তবে সুধাদের বাড়ি গেলেও যেতে পারে। সুধা আর হিরণ অপার মমতায় তাকে কাছে টেনে নিয়েছিল। লহমার জন্য হলেও ভুলিয়ে দিয়েছিল পুরানো দুঃস্বপ্নের যাবতীয় স্মৃতি। কলকাতায় ওটাই একমাত্র ভূখণ্ড যেখানে নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে পারবে ঝিনুক। কিন্তু এই হিমঋতুতে গাঢ় কুয়াশায় যখন চতুর্দিক আচ্ছন্ন হয়ে আছে, পথ চিনে চিনে তার পক্ষে টালিগঞ্জে পৌঁছনো সম্ভব? বিনয় আন্দাজ করতে পারে, বাড়ি থেকে ঝিনুক যখন বেরোয় তখন তার মাথার ঠিক ছিল না। আচমকা আঘাতে তখন তার পাগল পাগল, উদভ্রান্ত অবস্থা। শিরা-উপশিরার মতো এই শহরে কত যে রাস্তা! পাকে পাকে জড়ানো কত গলিঘুজি! কোন পথ ধরে এই জটিল গোলকধাঁধায়, কোথায় যে ঝিনুক হারিয়ে গেছে, কে জানে।

অবনীমোহন বলছিলেন, না। খোঁজ নেওয়া হয়নি। আমার মেয়েদের কাছে গেলে নিশ্চয়ই ওরা। জানাতে।

দিবাকর বললেন, তবু আজই মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এমনও হতে পারে সে ওই দুটো জায়গার কোথাও এখনও পৌঁছতে পারেনি।

ঠিক আছে, যোগাযোগ করব।

আমিও কলকাতার সব থানায় জানিয়ে দিচ্ছি। মেয়েটি সম্পর্কে ডিটেলে বলুন। নাম তো বললেন ঝিনুক। ওটা নিশ্চয়ই ডাক-নাম। ভাল নাম কিছু আছে?

আছে। তাপসী লাহিড়ি।

শুধু নামই নয়, বয়স, হাইট, রং, চেহারার খুঁটিনাটি বর্ণনা, আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য যেমন শরীরের খোলা অংশে জড়ল, জন্মদাগ, কাটার চিহ্ন আছে কি না–সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়ে দিবাকর বললেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভেতর থেকে একটি মেয়েকে খুঁজে বার করা তো সহজ নয়। তাই এত ডিটেল দরকার। ওর কোনও ফোটো দিতে পারেন?

অবনীমোহন বিনয়ের দিকে তাকালেন। ঝিনুকের ফোটো থাকলে বিনয়েরই জানার কথা। রাজদিয়ার মানুষদের ছবিটবি তোলার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ বা শখ ছিল না। সুযোগ ছিল তার চাইতেও কম। ফোটো তুলতে হলে যেতে হতো নারায়ণগঞ্জ কি ঢাকায়। ঝিনুকের বালিকা বয়সে ভবতোষ দুএকবার ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ফোটো তুলেছিলেন। কিশোরী বয়সের তিন-চারখানা ছবিও আছে তার। সুধা সুনীতির বিয়ের সময় দুজোড়া বর কনেকে ঘিরে কে যেন কটা গ্রুপ ফোটো তুলেছিল। এইসব ছবির কপি বাঁধিয়ে হেমনাথদের বাড়িতে রাখা আছে। বিনয়ের স্পষ্ট মনে আছে, ঝিনুকের তরুণী বয়সের কোনও ফোটো নেই। সে যখন কিশোরী থেকে যুবতী হচ্ছে সেই সময়টা সারা দেশ জুড়েই মহাসংকট। যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। ব্রিটিশ আর আমেরিকান টমিরা ভারতবর্ষের ব্যারাকগুলো ফাঁকা করে প্লেন কি জাহাজ বোঝাই হয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজের নিজের দেশে। ইংরেজরা বুঝতে পারছিল, কয়েক হাজার মাইল দূরের এই উপমহাদেশে কলোনি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মিত্রশক্তি জিতেছে ঠিকই, কিন্তু জার্মান বোমায় অর্ধেক লন্ডন ধ্বংসস্তূপ। অর্থনীতি ফোপরা হয়ে গেছে। তারা চাটিবাটি গুটিয়ে ভারতবর্ষ ছাড়ার জন্য পা বাড়িয়ে রয়েছে।

যুদ্ধের ডামাডোল কাটতে না কাটতেই শুরু হল দাঙ্গা, ধর্ষণ, আগুন, ব্যাপক গণহত্যা, অবশেষে দেশভাগ। এর মধ্যে ছবি তোলার মতো শখ কার প্রাণেই বা থাকতে পারে? ঝিনুকের ছেলেবেলা বা কিশোরী বয়সের কোনও ছবিই পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসেনি বিনয়। আনলেই বা কাজের কাজ কতটুকু হতো? তরুণী হবার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের আদল অনেকখানিই বদলে গেছে।

বিনয় বলল, না, ফোটো নেই।

দিবাকর বললেন, থাকলে সুবিধা হতো। যাক, মেয়েটির যে ডেসক্রিপশন শুনলাম, অন্য থানাগুলোতে তা-ই জানিয়ে দেব।

অবনীমোহন জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটাকে পাওয়া যাবে তো দিবাকরবাবু? তার বলার মধ্যে সংশয় আর উৎকণ্ঠা মেশানো।

দিবাকর মৃদু হাসলেন, আশা তো করছি। আমাদের দিক থেকে চেষ্টার ত্রুটি হবে না। তারপর দেখা যাক।

আমার ছোট মেয়ের বাড়িতে টেলিফোন নেই। সেখানে কারওকে পাঠাতে হবে। আপনাদের এখান থেকে বড় মেয়েকে একটা ফোন করা যাবে?

অবশ্যই। করুন না–

এক্সচেঞ্জে ধরে সুনীতিদের বাড়িতে যোগাযোগ করলেন অবনীমোহন। ওধারে আনন্দ লাইনটা ধরেছিল। ঝিনুকের কথা শুনে সে হকচকিয়ে যায়। উদ্বেগের সুরে জানায়, ঝিনুক তাদের বাড়ি যায়নি। জিজ্ঞেস করলে, আমি কি চলে আসব?

অবনীমোহন বললেন, এই রাত্তিরবেলা এসে আর কী করবে? আসার দরকার নেই।

আনন্দ বলল, এক্ষুনি থানায় জানানো খুব জরুরি।

বিনু আর আমি ভবানীপুর থানায় এসেছি। সেখান থেকেই কথা বলছি।

আপনি আমাকে এখন কী করতে বলেন?

আপাতত কিছু করার নেই। তেমন বুঝলে পরে তোমাকে জানাব।

আমরা ভীষণ চিন্তায় থাকব। ঝিনুকের খবর পেলে তক্ষুনি আমাদের ফোন করবেন।

 হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

টেলিফোন নামিয়ে রেখে আনন্দর সঙ্গে যা কথাবার্তা হয়েছে, ওসিকে জানিয়ে দিলেন অবনীমোহন। জিজ্ঞেস করলেন, এখন আমাদের কী করণীয়?

দিবাকর বললেন, অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। এখন বাড়ি যান। দুচার দিনের ভেতর মেয়েটাকে পাওয়া না গেলে খবরের কাগজের হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ কলমে বিজ্ঞাপন দিতে হবে।

ঠিক আছে। দেব। আচ্ছা চলি

আসুন।

 চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অবনীমোহন বললেন, বিনু রোজ একবার এখানে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করে খবর নিয়ে যাবে।

দিবাকর বললেন, আপনাদের দুশ্চিন্তার কারণটা বুঝি। বেশ, ছেলেকে পাঠাবেন।

থানার বাইরে এসে ধরা গলায় অবনীমোহন বললেন, মেয়েটার কী ক্ষতি যে করে ফেললাম। আক্ষেপ আত্মগ্লানি অপরাধবোধ, সব একাকার হয়ে তার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এল।

বিনয় উত্তর দিল না।

থানার সামনেই ট্রাম রাস্তা। নীরবে ওপারে গিয়ে অবনীমোহন বললেন, এক কাজ কর বিন

কী? জিজ্ঞাসু চোখে বাবার দিকে তাকায় বিনয়।

রাত খুব একটা বেশি হয়নি। তুই একবার সুধাদের বাড়ি চলে যা। দেখে আয় ঝিনুক ওখানে গেছে কি না।

যদি ছোটদির ওখানে গিয়ে থাকে, কী করব?

 বিনয় যে ইঙ্গিতটা দিয়েছে, নিমেষে বুঝে নিয়েছেন অবনীমোহন। ঝিনুকের সঙ্গে দেখা হলে সে তাকে ফিরিয়ে আনবে কি না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, আগে খবরটা নিয়ে আয়। তারপর দেখি কী করা যায়–

দ্বিধাটা এখনও কাটেনি অবনীমোহনের। ধর্ষিত মেয়েটিকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তিনি মনস্থির করতে পারেননি। ঝিনুকের সন্ধানে ছেলেকে যে সুধাদের কাছে পাঠাতে চাইছেন, তার পেছনে রয়েছে খুব সম্ভব ক্ষণিকের অনুশোচনা। বিনয় এক পলক বাবার মুখের দিকে তাকালো। কোনও উত্তর দিল না।

বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না। টালিগঞ্জের ট্রাম এসে গেল। বিনয়কে ট্রামে তুলে দিয়ে অবনীমোহন বাড়ির দিকে চলে গেলেন।

.

এখন রাস্তায় লোজন বেশ কমে গেছে। গাড়িটাড়িও তেমন চোখে পড়ে না। রাত যত বাড়বে, মানুষ এবং যানবাহন তত বিরল হতে থাকবে।

ধাতব শব্দ করে ট্রাম ছুটে চলেছে। দুচারটে বিড়ি সিগারেট কি চায়ের দোকান ছাড়া রাস্তার দুধারে বাকি সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। হিম আরও ঘন হয়ে নামছে। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে হুস হাস ছুটে যাচ্ছে ছাদ-খোলা দোতলা বাস, উলটো দিকের ট্রাম, প্রাইভেট কার কি ঘোড়ার গাড়ি।

একটা জানালার ধারে বসে ছিল বিনয়। হুহু উত্তরে বাতাস মুখেচোখে ঝাঁপটা মেরে যাচ্ছে। ঠাণ্ডায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে তার। জানালাটা যে বন্ধ করে দেবে, সেদিকে লক্ষ নেই। তার অবিরাম একটাই চিন্তা, সুধাদের বাড়িতে ঝিনুককে পাওয়া যাবে কি? বিনয় প্রায় নিশ্চিত, ঝিনুক ওখানে যায়নি। তবু একবিন্দু অলীক দুরাশা বুকের ভেতর যেন ধুকধুক করে। যদি গিয়ে থাকে?

টালিগঞ্জ রেল ব্রিজের তলা দিয়ে ট্রাম একসময় সুধাদের বাড়ির কাছাকাছি স্টপেজটায় এসে থামতেই নেমে পড়ল বিনয়। ব্রিজের ওধারের তুলনায় এদিকটায় আলো অনেক কম। সব কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা। চারদিকের বাড়িটাড়ি এবং টিনের চালের চাপ-বাঁধা বস্তি ভুতুড়ে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কুয়াশা আর আলো-আঁধারি ভেদ করে সুধাদের বাড়ির সামনে এসে কড়া নাড়ল বিনয়। একটু পর সদর দরজা খুলে দিল উমা। বিনয়কে দেখে সে ভীষণ অবাক। সন্ধেবেলায় ঝিনুককে নিয়ে যে চলে গিয়েছিল, দু-আড়াই ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই আচমকা সে ফিরে আসবে, উমা ভাবতে পারেনি।

প্যাসেজে আলো জুলছিল। উমার পাশ দিয়ে নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে উঠতে বিনয় ডাকতে লাগল, ছোটদি, হিরণদা–

ওধারের কোনও একটা ঘর থেকে হিরণ আর সুধা প্রায় ছুটতে ছুটতে সিঁড়ির মুখে চলে এল। বিনয়কে দেখে উমার মতো তারাও হতবাক। বিস্ময় একটু থিতিয়ে এলে সুধা জিজ্ঞেস করল, তুই চলে এলি! ঝিনুক কোথায়? বাবার সঙ্গে বলতে বলতে বিনয়ের মুখের দিকে ভাল করে নজর পড়তেই থমকে গেল। চুল এলোমেলো, উদ্ভ্রান্ত চেহারা। দেখেই টের পাওয়া যায়, তার ওপর দিয়ে এলোপাতাড়ি ঝড় বয়ে গেছে।

রুদ্ধ গলায় সুধা বলল, কী হয়েছে রে বিনু?

হিরণ একদৃষ্টে বিনয়কে লক্ষ করছিল। সুধাকে বলল, আগে ঘরে এসে বিনু বসুক। তারপর যা জিজ্ঞেস করার কোরো।

বাইরের ঘরে এনে বিনয়কে বসানো হল। হিরণরাও বসেছে। মুহূর্তের জন্যও ভাইয়ের মুখ থেকে চোখ সরায়নি সুধা। সে কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই বিনয় বলে, ঝিনুক কি তোদর এখানে এসেছে?

হিরণ সুধা, দুজনেই চমকে ওঠে। সুধা বলে, না। তোর সঙ্গে এই কিছুক্ষণ আগে ও-বাড়িতে গেল। একা একা এখানে ফিরে আসবে কেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

ভাঙা ভাঙা, আবছা গলায় বিনয় বলল, ঝিনুককে পাওয়া যাচ্ছে না।

হতচকিত সুধা প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, কী বলছিস বিনু!

হিরণ ধীর, স্থির, ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। সহজে বিচলিত হয় না। সেও বিহুলের মতো বলে, কোথায় যাবে ঝিনুক? তোমাদের বাড়িটা ভাল করে খুঁজে দেখেছ?

একতলা থেকে তেতলা অবধি সবগুলো ঘর, বারান্দা, প্যাসেজ তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে।

হঠাৎ কী এমন হল যে, ঝিনুক নিরুদ্দেশ হয়ে গেল? ও-বাড়িতে ওকে নিয়ে যাওয়ায় তোমার বাবা কি খুশি হননি? মানে, উনি হয়তো ঝিনুককে — কথা শেষ না করেই থেমে গেল হিরণ।

হিরণের ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। ঝিনুকের নিখোঁজ হওয়ার সঠিক কারণটা ধরে ফেলেছে সে। বিনয় তক্ষুনি উত্তর দেয় না। অদ্ভুত এক কষ্ট তার গলার ভেতর জমাট বাঁধতে থাকে। অনেকক্ষণ পর সে ধীরে ধীরে শুরু করে। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে ঝিনুককে নিয়ে সন্ধেবেলায় অবনীমোহনের সঙ্গে দেখা করার পর থেকে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, সব জানিয়ে বলে, ঝিনুকের খোঁজে বাবা আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিল। বাবাকে গিয়ে খবরটা দিই, ও এ-বাড়িতে আসেনি।

শুনতে শুনতে শ্বাসক্রিয়া যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সুধার, হিরণের। ফুসফুসে জোরে বাতাস টেনে হিরণ বলল, চল, আমি তোমার সঙ্গে যাই

বিনয় উঠে পড়েছিল, না না, এত রাতে আপনাকে যেতে হবে না। ট্রাম বাস চলছে। আমি নিজেই চলে যেতে পারব।

সুধা আর হিরণও উঠে দাঁড়ায়। উৎকণ্ঠিত সুধা জিজ্ঞেস করল, ঝিনুককে কি শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে?

এতক্ষণ নিজেকে অনেকখানি সংযত রেখেছিল বিনয়। এবার উন্মাদের মতো মাথা ঝাঁকাতে থাকে, জানি না, জানি না, জানি না–

.

০২.

সেই যে ঝিনুক নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল তারপর কদিন কেটে গেল। বিনয় প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে অবনীমোহনের কাছেই আছে। সারাক্ষণ উভ্রান্তের মতো অবস্থা। সকালের দিকে বেলা একটু বাড়লে সে সোজা থানায় চলে যায়। ফের যায় সন্ধেবেলায়। যদি ঝিনুকের কোনও খবর পাওয়া যায়। কিন্তু নেহাতই দুরাশা।

ওসি দিবাকর পালিত অত্যন্ত ভদ্র, ভালমানুষ। পুলিশ বলতে যে রুক্ষ, কর্কশ, হাড়হিম করা একটা চেহারা চোখের সামনে ফুটে ওঠে তার সঙ্গে এঁর আদৌ মিল নেই। খুবই সহানুভূতিপ্রবণ। বিনয় থানায় এলে তাকে যত্ন করে বসান। তার কথাবার্তায় সহৃদয়তার ছাপ, গভীর সমবেদনা।

যখনই বিনয় থানায় আসে, বিব্রতভাবে দিবাকর বলেন, না, কোনও খবর নেই। একটি মেয়ে হিমঋতুর এক সন্ধ্যায় কলকাতার মতো বিপুল শহরে বিলীন হয়ে গেছে, অথচ সুশৃঙ্খল, রিশাল পুলিশবাহিনী তাকে খুঁজে বার করতে পারছে না, এ লজ্জা, এ গ্লানি যেন তারই।

বিনয় করুণ মুখে বলে, আপনাদের লোকজনকে একটু ভাল করে খোঁজ নিতে বলুন স্যার। এই একই কথা রোজই বলে সে। একই ধরনের কাকুতি মিনতি।

কোমল স্বরে দিবাকর বলেন, আমাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই বিনয়। শুধু কলকাতা পুলিশ নয়, সারা ওয়েস্টবেঙ্গল পুলিশকেও অ্যালার্ট করে দেওয়া হয়েছে। ঝিনুকের খবর পাওয়ামাত্র তোমাদের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে দেব।

তা তো বলেছেনই। তবু ভীষণ অস্থির অস্থির লাগে। খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না। কীভাবে যে আমার দিন কাটছে বলে বোঝাতে পারব না।

স্বাভাবিক। খুবই স্বাভাবিক। তোমার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারি বিনয়।

বিনয় বলে, সেই জন্যে আপনার কাছে চলে আসি।

দিবাকর বলেন, যখন ইচ্ছে, আসবে। মেয়েটাকে যতক্ষণ না ফিরে পাচ্ছি, আমাদেরও স্বস্তি নেই।

একটু চুপ করে থাকে বিনয়। তারপর বলে, আমি যে রোজ দুবার করে আসি, বিরক্ত হন না তো স্যার?

বিনয়ের একটা হাত নিজের মুঠোয় তুলে নিয়ে দিবাকর বলেন, দুবার কেন, দশবার আসবে। আমাদের কাজ হল মানুষকে সাহায্য করা। কিন্তু ঝিনুকের বেলায় কিছুই করতে পারছি না। মেয়েটার জন্যে ভীষণ কষ্ট হয় বিনয়। পুলিশবাহিনীর অক্ষমতা তাঁকে বিমর্ষ করে তোলে।

শুধু দুবেলা থানাতেই হাজিরা দেয় না বিনয়। সময়ে অসময়ে যখন তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। ঘুরতে থাকে কখনও ট্রামে, কখনও বাসে। কখনও বা অলিগলির সহস্র পাকে জড়ানো মহানগরীর নানা প্রান্তে, পায়ে হেঁটে। চতুর্দিকে অজস্র মানুষ। ভিড়ের ভেতর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রিয় নারীটির মুখ খুঁজে বেড়ায় সে।

.

ঝিনুকের অদৃশ্য হবার খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল আনন্দ, সুনীতি আর ঝুমা। তাছাড়া অবনীমোহন দীর্ঘ তীর্থভ্রমণের পর কলকাতায় ফিরে এসেছেন। তার সঙ্গেও দেখা করা দরকার। সবাই জানে কিছুদিন পর চিরকালের জন্য তিনি তার গুরুর আশ্রমে চলে যাবেন। আর কখনও ফিরবেন কি না, ফিরলেও কবে ফিরবেন, তার ঠিক নেই।

অবনীমোহনের সঙ্গে দেখা করার চেয়েও ঝিনুকের নিখোঁজ হওয়াটা অনেক বিরাট আকারে, অনেক বেশি সংকট নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আনন্দও সমানে ঝিনুকের খোঁজখবর চালিয়ে যাচ্ছে। তার চেহারার বিবরণ দিয়ে কতজনকে যে সন্ধান নেবার কথা বলেছে তার ঠিক নেই।

আনন্দ সুনীতি ঝুমা–সবাই ভীষণ চিন্তিত, বিমর্ষ। আনন্দ বিষণ্ণ সুরে বলেছে, কোথায় যে গেল মেয়েটা, কিছুই বুঝতে পারছি না।

সুনীতি অবনীমোহনকে বলেছে, বাবা, তোমার ওভাবে ঝিনুককে বলা ঠিক হয়নি।

 ঝিনুক হারিয়ে যাবার পর অবনীমোহন প্রতিটি মুহূর্ত অনুশোচনায় বিদ্ধ হচ্ছিলেন। জবাবদিহির সুরে বলেছেন, আমি কিন্তু ঝিনুককে কিছুই বলিনি। বিনুর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলব বলে ওকে ঘর থেকে চলে যেতে বলেছিলাম। চলেও গিয়েছিল। কিন্তু বাইরে গিয়ে মেয়েটা যে শুনে ফেলবে, ভাবতেই পারিনি।

এদিকে পলকহীন আনন্দর দিকে তাকিয়ে থেকেছে বিনয়।

বিনয়ের মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে আসছিল, আমার বাবাই শুধু নয়, তোমার মাও কতখানি হৃদয়হীন ব্যবহার ঝিনুকের সঙ্গে করেছে সেটা ভেবে দেখ– কথাগুলো অবশ্য বলা হয়নি।

ঝুমা কিন্তু বিনয়কে আড়ালে ডেকে নিয়ে হেমনলিনী সম্পর্কে বলেছে, আমার দিদা এখন ভালমানুষ মাজছে। সারাক্ষণ তার মুখে ঝিনুকের জন্য আহ, উন্থ। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে। দিদার ন্যাকামো দেখে গা জ্বলে যায়। ঝিনুক যখন ও-বাড়িতে ছিল, কী অসভ্যতা করেছে, আমি জানি না?

একটা মানুষের নিরুদ্দেশ হবার সঙ্গে সঙ্গে কত মানুষের যে কত রকম প্রতিক্রিয়া! বিনয় উত্তর দেয়নি।

ঝুমা তীব্র, কটু গলায় এবার বলেছে, কীরকম কায়দা করে দিদা ও-বাড়ি থেকে মেয়েটাকে তাড়িয়ে দিল! ইতর! অমানুষ! সে থামেনি, দিদা যদি ঝিনুককে তাদের কাছে থাকতে দিত, এমন একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটত না।

বিনয় বলেছে, তুমি যা ভাবছ তা হয়তো ঠিক নয়, ঝুমা।

 বুঝতে না পেরে ঝুমা জিজ্ঞেস করেছে, কী ঠিক নয়?

ধর তোমার দিদিমা হয়তো ভাল ব্যবহার করতেন। কিন্তু তাঁর কাছে চিরকাল তো থাকা যেত না। একদিন না একদিন বাবার কাছে চলে আসতে হতো। ছোটদিদের কাছে সপ্তাহ দুই থেকে চলেও এসেছিলাম। কিন্তু বাবাও একই কাণ্ড করলেন। একা মাউইমাকে দোষ দিয়ে কী হবে? সবই ওর ভাগ্য।

ঝুমা ঝাঁঝিয়ে উঠেছে, ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে দিও না বিনুদা। দু-দুটো বয়স্ক মানুষ ওর ওপর এমন জঘন্য অন্যায় করল, আর তুমি ভাগ্যের ওপর ওদের অপরাধ চাপিয়ে দিচ্ছ! তোমার কাছে এটা আশা করিনি। একটু থেমে ধরা ধরা গলায় বলেছে, ঝিনুকের জন্যে কী কষ্ট যে হচ্ছে বিনুদা– তার দুচোখ ক্রমশ বাষ্পে ভরে যাচ্ছিল।

হতবাক তাকিয়েই থেকেছে বিনয়। এই কি সেই ঝুমা যে চটুল, প্রগম্ভ, সারাক্ষণ যার কলকলানি। সেই কোন কৈশোর থেকে তার মাথায় অবিরল প্রেম প্রেম খেলা চলে আসছে। অদৃশ্য পোকার মতো যেটা সমানে কুটুর কুটুর কামড়ায়। বিনয়কে রাজদিয়ায় প্রথম দেখার পর থেকেই সেই কামড়টা শতগুণ বেড়ে গিয়েছিল। পাকা মেয়েটা মাত্র বারো বছর বয়সে একটি চুম্বনে তার রক্তমাংসে শুধু শিহরনই জাগায়নি, তাকে এক লহমায় যৌবনের অনন্ত রহস্যের ভেতর টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তাকে। ঘিরে ঝিনুকের সঙ্গে কী তীব্র প্রতিযোগিতা, কী নিদারুণ মহাযুদ্ধ! তাকে দখল করার জন্য কতরকম ফন্দিই না বার করত ঝুমা। কিন্তু ঝিনুকের চোখে ধুলো ছিটানো অত সহজ নয়। ফি বারই কুমার যাবতীয় কৌশল ব্যর্থ করে দিয়েছে সে। কলকাতায় এসেও কি সেই অঘোষিত যুদ্ধ থেমেছে? ঝিনুক লাঞ্ছিত হয়েছে, তার শরীর ও মন ভেঙেচুরে তছনছ, মাথার ওপর সৌরলোক শতখান হয়ে ভেঙে পড়েছে কিন্তু লহমার জন্যও বিনয়ের স্বত্ব ছাড়তে সে রাজি হয়নি। এদিকে ঝুমাও পণ করেছিল, বিনয়কে সহজে ছেড়ে দেবে না।

অথচ সেই ঝুমারই দুচোখ ঝিনুকের জন্য জলে ভরে গেছে। এই ঝুমা বিনয়ের অচেনা। যাকে সে এতকাল দেখে এসেছে, যার স্বভাবের অন্ধিসন্ধি তার জানা, সে যেন অন্য কেউ। ঝুমার ভেতর থেকে এমন বিস্ময়কর এক তরুণী বেরিয়ে এসেছে যার কথা আগে কখনও ভাবেনি বিনয়। একই মানুষের ভেতর কত ধরনের মানুষ যে লুকনো থাকে! ঝিনুকের জন্য ঝুমার কষ্ট যে কতখানি আন্তরিক তা বুঝিয়ে দিতে হয় না।

ঝুমা আকুলভাবে বলেছে, বিশ্বাস কর বিনুদা, এটা আমি চাইনি। যেমন করে পার ওকে খুঁজে বার কর। একটু চুপ করে থেকে ফের শুরু করেছে, রাস্তায় বেরুলে আমাদের বয়সী মেয়ে দেখলেই তার দিকে ভাল করে তাকাই, যদি ঝিনুককে পেয়ে যাই। কিন্তু না, আজও তার দেখা পাইনি তার গলা বিষাদে ভরে গেছে।

সুধা আর হিরণ কাছাকাছি থাকে। তারা রোজই এসেছে।

সুধা জানিয়েছে, তার দাদাশ্বশুর এবং জেঠশাশুড়ি এক্ষুনি পাটনা থেকে ফিরছেন না। আরও মাসখানেক মাসদেড়েক ওখানে থাকবেন। কাচুমাচু মুখে বলেছে, বাবার কাছে তোদের যদি আসতে না দিতাম! আরও কিছুদিন তোরা আমার কাছে থেকে যেতে পারতিস। মেয়েটা কত সুস্থ, কত স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল।

বিনয় জবাব দেয়নি।

সুধা একটানা বলে গেছে, ঝিনুককে বাবার কাছে না নিয়ে এলে এমন বিপদ ঘটত না।

 বিনয় বলেছে, তোদের ওখানে চিরকাল তো থাকা যেত না। এক, দেড় মাস না হয় তোর দাদাশ্বশুরের আসা পিছিয়ে গেছে। তারপর কী হতো?

সুধা চুপ করে থেকেছে।

বিনয় বলেছে, তাছাড়া বাবা ফিরে এসেছে। তারপর তোদের ওখানে কি আর থাকা যায়?

সুধা একটু ভেবে বলেছে, বাবার যে এতটা পরিবর্তন হবে, চিন্তা করতে পারিনি। কত উদার ছিলেন। ভেবেছিলাম ধর্মকর্ম করছেন। কিন্তু সংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারলেন না।

এখন এসব আলোচনা করে কী হবে ছোটদি? সবচেয়ে আগে যা দরকার তা হল ঝিনুককে খুঁজে বার করা।

একটা কথা তোকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছি—

 কী?

সুধা জেদি গলায় বলেছে, ঝিনুককে পাওয়া গেলে আমার কাছে নিয়ে যাব। সে ওখানেই থাকবে।

এসব সুধার আক্ষেপের কথা মনঃকষ্টের কথা আবেগের কথা মানসিক যাতনার কথা। অবনীমোহনের ওপর সে যে ভয়ানক ক্ষুব্ধ, সুধার মতো একটি চিরদুঃখী মেয়ের প্রতি তার নির্দয় আচরণ সে যে আদৌ মেনে নিতে পারেনি, অশেষ ক্লেশে তার বুক যে ভেঙেচুরে গেছে, সেটা বুঝতে পেরেছিল বিনয়। অসহ্য ক্রোধে, অভিমানে সুধার মাথা থেকে যাবতীয় যুক্তিতর্ক লোপ পেয়ে গিয়েছিল। ঝিনুককে যদি সত্যিই পাওয়া যায় আর সুধা তাকে টালিগঞ্জে নিজের কাছে নিয়ে তোলে, পাটনা থেকে ফিরে ওর দাদাশ্বশুররা এসে তাকে দেখলে কত সহস্র সমস্যার সৃষ্টি হবে, সেসব ভাবেনি সুধা। রাগে, অসন্তোষে, মস্তিষ্কের অসহ্য উত্তাপে তখন সে টগবগ ফুটছে। তাকে বোঝাতে যাওয়া মুশকিল। অগত্যা বিনয় চুপ করে থেকেছে।

সুধা কিন্তু অত সহজে ছাড়েনি, কী, ঝিনুক আমার কাছে থাকবে তো?

বললাম তো, ও আগে ফিরে আসুক। তারপর দেখা যাবে।

.

আরও কটা দিন পার হয়ে গেল।

থানায় বা রাস্তায় রাস্তায় উন্মাদের মতো বিনয়ের ছোটাছুটিই সার। মহাবিশ্বের লক্ষ কোটি মানুষের ভিড়ে কোথায় যে ঝিনুক মিলিয়ে গেছে তার কোনও হদিসই পাওয়া গেল না। কখনও পাওয়া যাবে কি না, কে জানে।

একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে বিনয়। ঝিনুক নিখোঁজ হবার পর সবার আক্ষেপ এবং ক্লেশের তীব্রতা ক্রমশ কমে আসছে। শোক, দুঃখ বা মানসিক যাতনা তো চিরদিন উঁচু তারে বাঁধা থাকে না। পার্থিব নিয়মেই শিথিল হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে তা সয়েও আসে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অসহনীয় বলে বুঝি বা কিছু নেই। কিন্তু বিনয়ের কষ্টটা যত দিন যাচ্ছে, অসহ্য হয়ে উঠছে। জীবনের কতখানি অংশ যে ঝিনুক ফাঁকা করে দিয়ে গেছে, প্রতিটি মুহূর্তে সে টের পাচ্ছে। আর দুঃখের সীমা-পরিসীমা নেই সুধার। বিনুর সঙ্গে দেখা হলে তার একটাই কথা কেন মেয়েটাকে ভবানীপুরে আসতে দিয়েছিলাম! কেন তাকে জোর করে নিজের কাছে ধরে রাখিনি!

কদিনে সবচেয়ে আশ্চর্য রকমের বদলে গেছেন অবনীমোহন। গোড়ার দিকের সেই মনস্তাপ প্রায় নেই বললেই চলে। ইদানীং তিনি বলছেন, কারও কিছু করার নেই। ঈশ্বরের খুব সম্ভব এটাই ইচ্ছা ছিল। তার নির্দেশ ছাড়া কিছুই হবার নয়। এমনকি একটা ঘাসের ডগাও নড়ানো যায় না। যা ঘটে গেছে ঈশ্বরের বিধান হিসেবে তা মেনে নিতে হবে।

ধর্মকর্ম করলে মানুষ কি চরম নিরাসক্ত হয়ে যায়? কিংবা নিষ্ঠুর? অবনীমোহনের সান্ত্বনা বাক্যগুলি ফাঁকা ফাঁকা, অসার মনে হয়। ঝিনুকের নিরুদ্দেশ হবার মতো এত বড় একটা ঘটনাকে ঈশ্বরের ইচ্ছায় চাপিয়ে দিয়ে যিনি দায়মুক্ত হতে চান তার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ভয় হয় বিনয়ের। এই নির্মোহ, মমতাহীন অবনীমোহন তার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা, অন্য কোনও অপরিচিত গ্রহের মানুষ।

বাবাকে দেখতে দেখতে চমকে ওঠে বিনয়। মনে পড়ে সেদিন ঝুমাকে সেও বলেছিল, ঝিনুক যে নিরুদ্দেশ হয়েছে সেটা তার ভাগ্যলিপি। অবনীমোহন ঈশ্বরের ঘাড়ে দায়টা চাপিয়েছেন আর সে চাপিয়েছে ভাগ্যের ওপর। দোহাইটা প্রায় একইরকম। কিন্তু ভাগ্যকে টানাটানি করার লেশমাত্র ইচ্ছা তার ছিল না। কেন যে মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে এসেছিল তার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। ঝিনুকের নিখোঁজ হবার আসল হেতুটা কী তা সে জানে না? খুব জানে। এ নিয়ে যত ভাবে, নিজের কাছে ততই ছোট হয়ে যায়।

অবনীমোহন আজকাল প্রায়ই বলেন, ঝিনুকের চিন্তা মাথায় নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। তোমার সামনে অফুরন্ত ভবিষ্যৎ। তুমি তার কথা ভাবো।

বাবার কথায় উত্তর দেয় না বিনয়। তার সব উৎসাহ, বেঁচে থাকার আগ্রহ নষ্ট হয়ে গেছে। সমস্ত উদ্দীপনা ম্রিয়মাণ।

.

আজ বৃহস্পতিবার।

অঘ্রান মাস পড়ে গেছে। বেশ কিছুদিন হল উত্তুরে হাওয়ায় টান ধরেছিল। এমনিতে কলকাতায় ঠাণ্ডাটা একটু দেরিতেই হানা দেয়। কিন্তু এ-বছর অনেক আগেই এসে পড়ল।

অবনীমোহন তেতলায় তার ঘরের পাশের ঘরটায় বিনয়কে থাকতে বলেছিলেন। অর্থাৎ যে কদিন বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা না হচ্ছে, এখানেই সে থাকুক। বিনয় তেতলাটা পছন্দ করেনি। দোতলার কোণের একটা ঘর বেছে নিয়েছে।

অন্যদিনের মতো আজও সকালের দিকে থানায় গিয়েছিল বিনয়। তারপর কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঝিনুকের খোঁজে ঘোরাঘুরি করে যথারীতি ক্লান্ত এবং নিরাশ হয়ে দুপুরের খানিক আগে ফিরে এসেছে। চান করতে হয় তাই চান করেছে, খেতে হয় তাই খেয়েছে। মুখ এতই বিস্বাদ, জিভ আগাগোড়া এমনই কটু এবং তিক্ততায় ভরা যে ভাত ডাল তরকারি কী খেয়েছে, কিছুই ভাল করে বুঝতে পারছিল না।

খাওয়ার পর নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল বিনয়। শিয়রের দিকের জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে হুহু করে। কলকাতার তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে ঝপাঝপ। অতি দ্রুত।

বেলা অনেকটা হেলে গেছে। সূর্য ঢলে পড়েছে দূরের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর আড়ালে। অঘ্রানের ক্ষীণায়ু দিন ঝটিতি ফুরিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ত্বরিত পায়ে নেমে আসবে সন্ধে। তারই তোড়জোড় চলছে।

কনকনে হাওয়া যে গায়ে ঝাঁপটা দিয়ে যাচ্ছে, খেয়াল নেই বিনয়ের। তার শরীর থেকে শীতবোধটাই কেউ বুঝি বা হরণ করে নিয়েছে।

অবনীমোহন বাড়িতে নেই। কী একটা জরুরি কাজে বেরিয়েছেন সন্ধের পর ফিরবেন। খগেন একতলায় কী করছে, কে জানে। লোকটা হাত-পা গুটিয়ে এক লহমা চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। সর্বক্ষণ এটা করছে সেটা করছে।

কখন দুচোখ জলে ভরে গেছে, নিজেই টের পায়নি বিনয়।

আচমকা চেনা একটা গলা কানে ভেসে আসতে শিরায়ুতে চমক খেলে যায়। ছুটোবাবু ছুটোবাবু –সেই সঙ্গে সিঁড়ি ভাঙার ধুপধাপ আওয়াজ।

খানিক পরে দেখা যায় দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে যুগল, সুধা এবং সবার পেছনে খগেন।

 চকিতে হাতের পিঠে চোখের জল মুছে ধড়মড় করে উঠে বসে বিনয়। যুগলকে এ-বাড়িতে এসময় দেখতে পাবে, ভাবতে পারেনি। আসলে ঝিনুক নিখোঁজ হবার পর যুগলের কথা ক্ষণকালের জন্যও তার মাথায় আসেনি। সারা পৃথিবী তার কাছে পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

বিনয় বলল, আয় ছোটদি, এস যুগল, ভেতরে এসে বোসো- খগেন যে ওদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। তাকে বলল, তুমি তোমার কাজ কর গিয়ে

খগেন নীরবে চলে গেল।

যুগল আর সুধা ঘরে এসে ঢোকে। সুধা বিনয়ের খাটের একধারে বসে পড়ে। যুগল মেঝেতে থেবড়ে বসে। বিনয় লক্ষ করল, যুগলের পায়ের ব্যান্ডেজ অনেক ছোট হয়ে গেছে। চলাফেরায় বা উঠতে বসতে আগের সেই কষ্টটা আর নেই। মারাত্মক চোটটা প্রায় সেরে এসেছে।

বিনয় হাঁ হাঁ করে ওঠে, ও কী, ওই ঠাণ্ডা মেঝেতে বসলে কেন? ওই কোণে বেতের মোড়া আছে। একটা টেনে এনে বোসো।

যুগল তার কথায় আমল দেয় না। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলল, এইটা কী অ্যামন টালকি (ঠাণ্ডা)? আমাগো মুকুন্দপুরে গিয়া দ্যাহেন, শীতে শরীল এক্কেরে কালাইয়া যাইব। হেইতেই আমার কিছু হয় না। কইলকাতার এই টালকিতে কী আর হইব? আমার লেইগা ভাইবেন না ছুটোবাবু

যুগল যে তার সামনে উঁচু জায়গায় অর্থাৎ চেয়ার বা মোড়ায় বসতে চায় না তা আগেই জেনে গেছে বিনয়। যাদের বাড়িতে কামলা খেটেছে তাদের সঙ্গে একই উচ্চতায় তাকে বসানো মুশকিল। অন্য সময় হলে জোরজার করত কিন্তু এই মুহূর্তে এ-সব নিয়ে বেশি কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

যুগল পলকহীন বিনয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মুখটা ক্রমশ মলিন হয়ে যেতে থাকে। বিষঃ এবং করুণ। গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে বলল, বিষুদবার বিষুদবার হাসপাতালে ঘাও (ঘ) ধুয়াইয়া, পট্টি পালটাইয়া ছুটোদিদির বাড়িত যাই। আইজ আইয়া যা শুনলাম, বুক এক্কেরে ভাইঙ্গা গ্যাছে ছুটোবাবু। এয়া (এ) আমি চিন্তাও করতে পারি নাই। তার কণ্ঠমণিটা সমানে ওঠানামা করছে। গলা ধীরে ধীরে বুজে এল।

বিনয়ের মনে পড়ে গেল, ফি বেস্পতিবার হাসপাতাল থেকে সুধাদের বাড়ি আসে যুগল। সে কী ইঙ্গিত দিয়েছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। যুগলের কষ্টটা তার নিজের যন্ত্রণাকে শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিনয় কিছু বলতে যাচ্ছিল, পারল না। গলার কাছে শক্ত, নিরেট পাথরের মতো কী যেন ডেলা পাকিয়ে গেল।

সুধা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। এবার বলল, হাসপাতাল থেকে আমাদের কাছে এসেই যুগল তোদের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। ঝিনুক চলে গেছে শুনে পাগলের মতো হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। তক্ষুনি তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য এখানে চলে আসতে চাইছিল। সেই কতদূর মুকুন্দপুর থেকে কোন ভোরবেলায় বেরিয়েছে। খাওয়াদাওয়া হয়নি। অনেক কষ্টে ওকে আটকে রেখে দুটি ভাত খাওয়ালাম। তারপর আর ধরে রাখা গেল না। আমিও ওর সঙ্গে চলে এলাম। একটু থেমে বলল, খগেনের কাছে শুনলাম বাবা নাকি বেরিয়েছে।

আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়, হ্যাঁ।

প্রশ্নটা অর্থহীন, তবু সুধা জিজ্ঞেস করে, ঝিনুকের খোঁজ পাওয়া গেল না?

বিনয় চুপ করে থাকে। তার নৈঃশব্দ্যের মধ্যেই উত্তরটা রয়েছে।

বিমর্ষতা খানিক কাটিয়ে উঠেছিল যুগল। ঝাঝালো গলায় এবার বলে, পুলিশের অত জবর জবর কর্তারা রইছে। গরমেন তাগো মেলা মেলা (অনেক অনেক) ট্যাকা দিয়া পুষতে আছে। এট্টা বষ্যের মাইয়া (যুবতী) সন্ধ্যাবেলা শয়ে শয়ে মাইষের চৌখের সুখে (সামনে) হারাইয়া গ্যাল। হেরে (তাকে) অ্যাত দিনেও বিচরাইয়া (খুঁজে) বাইর করতে পারল না? পুলিশের পিছনে ট্যাকা খরচা করনের কুন কাম? পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, রাগ এবং বিরক্তি উগরে দিতে লাগল সে।

বিনয় কী জবাব দেবে? সে তো রোজই দুবার করে থানায় হাজিরা দেয়। দিবাকর পালিতদের আন্তরিকতা বা চেষ্টার কোনও খামতি নেই। থানায় যাওয়া ছাড়া বিনয় নিজেও রাস্তায় রাস্তায়, গলিতে গলিতে, কতদিন ধরে কম ঘুরছে? কিন্তু ঝিনুককে পাওয়া যাচ্ছে কই?

আক্ষেপের সুরে যুগল এবার বলল, ঝিনুক বইনেরে আমাগো মুকুন্দপুরে যদিন লইয়া যাইতেন, এই সব্বনাশটা হইত না। আমরা বইনেরে বুকে কইরা রাখতাম।

আবেগের ঝেকে কথাগুলো বলল যুগল। কিন্তু সবে ঝিনুককে নিয়ে কলকাতায় এসেছে বিনয়। এখনকার আত্মীয়পরিজন ছেড়ে বহু দূরে এক বিজন এলাকার জবরদখল কলোনিতে তাকে নিয়ে যাওয়া কি সম্ভব ছিল? যুগল যদিও ভরসা দিয়েছিল, লাঞ্ছিত, ধর্ষিত তরুণী অনেকেই আছে মুকুন্দপুরে। সেখানে ঝিনুকের অসম্মান বা গ্লানির কোনও কারণই নেই, তবু সংকটের অবসান এত সহজ নয়।

প্রথমত, যুগলের সঙ্গে গত বেস্পতিবার যখন তার দেখা হয়, তখনও অবনীমোহন কলকাতায় ফিরে আসেননি। তার সঙ্গে কথা না বলে সে ঝিনুককে নিয়ে মুকুন্দপুরে যায়ই বা কী করে? আর যুগল বলল বলেই হুট করে ওখানে গিয়ে থাকতে শুরু করল, তা কি আদৌ সম্ভব? সুধা তাদের ছাড়ত না, হিরণ ছাড়ত না। সুনীতি আর আনন্দ মুখ ফুটে হয়তো কিছু বলত না। কিন্তু কষ্ট কি কম পেত? তাছাড়া মুকুন্দপুরে উঠতই বা কোথায়? কলোনির লাগোয়া বিশাল জঙ্গল নির্মূল করে জমি বার করা হবে, সেখান থেকে তাকে সাত কাঠা জায়গা দেওয়া হবে। মোটামুটি এটাই ওখানকার বাসিন্দাদের একান্ত ইচ্ছা। কিন্তু জমি পেলেই তো হয় না, সেই জমিতে ঘরবাড়ি তুলতে হবে, তবেই মুকুন্দপুরে যাওয়া। অবশ্য তারা গেলে যুগলরা তো বটেই, কলোনির অনেকেই তাদের ঘর ছেড়ে দিত। শুধু তাই না, মাথায় করেও রাখত। কিন্তু ওভাবে তো থাকা যায় না।

পরক্ষণে বিনু নিজেকে জোরে ধমক কষায়। মুকুন্দপুরের মানুষজন সবাই যুগলের মতো সোজাসাপটা সাদাসিধে হবে তার ঠিকঠিকানা নেই। প্যাগোয়া লোকও কি দুচারটে ওখানে নেই? মুখ ফুটে হয়তো তারা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করত না, কিন্তু তাদের অনেকের মাথায় এই প্রশ্নটা অবিরত পাক খেত, বিনুর সঙ্গে ঝিনুকের সম্পর্কটা কী? বিয়ে হয়নি তবু তাকে নিয়ে হাজির হয়েছে, এটা খুবই দৃষ্টিকটু।

তাছাড়া, কলকাতায় বিনয়ের চাকরি ঠিক হয়ে আছে। খবরের কাগজের নিয়মকানুন কিছুই তার জানা নেই। কতক্ষণ তাকে অফিসে থাকতে হবে, কী করতে হবে, কখন ছুটি পাওয়া যাবে, কে জানে। অতদূর থেকে রোজ তিন সাড়ে তিন মাইল হেঁটে আগরপাড়া স্টেশনে এসে শিয়ালদা, সেখান থেকে বাসে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ। কাজ সেরে একই রুটে আবার মুকুন্দপুরে ফেরা। না না, রোজ এত সব তার পক্ষে অসম্ভব।

হঠাৎ বিনয়ের খেয়াল হল, কী হাবিজাবি ভাবছে সে। যাকে নিয়ে মনের ভেতর এমন আলোড়ন, সেই ঝিনুকই তো নিরুদ্দেশ। এ ধরনের অনর্থক চিন্তায় নিজেকে ভারাক্রান্ত করার মানে হয় না।

দুই হাঁটুর ফাঁকে থুতনি রেখে কী ভাবছিল যুগল। হঠাৎ তড়িৎগতিতে মুখ তুলে ডাকল, ছুটোবাবু।

বিনয় চকিত হয়ে ওঠে, কিছু বলবে?

আমার কী মনে লয় জানেন?

কী?

 ঝিনুক বইনে হেই দিন মনের কষ্টে কুনখানে যাইতে পারে, মেলা (অনেক) ভাইবা দেখলাম।

অবাক বিনয় জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবে?

যুগল বলে, আমার মনে লয়, দুইহানে হের (তার) যাওনের জাগা আছে। পেরথমটা হইল পাকিস্থান

বিনয় এবং সুধা হতভম্ব। একসঙ্গে তারা বলে ওঠে, পাকিস্তান! কী বলছ তুমি! যেখান থেকে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বিনয় তাকে বর্ডারের এপারে নিয়ে এসেছে, ঝিনুক সেই হননপুরীতে ফিরে যাবে, এ ভাবাই যায় না। সেখানে তার ভরসা বলতে হেমনাথ, স্নেহলতা আর শিবানী। এই মুহূর্তে হেমনাথরা কোন সংকটের মধ্যে রয়েছেন, কে জানে। তার চেয়েও বড় সমস্যা ঝিনুক একা একা ট্রেনে, স্টিমারে এবং নৌকোয় করে রাজদিয়ায় ফিরে যেতে পারবে তা কল্পনা করতেও সাহস হয় না। এই সম্ভাবনাটা পুরোপুরি নাকচ করে দিল বিনয়। কলকাতায় যতই অসম্মান আর গ্লানিবোধে ঝিনুকের সমস্ত অস্তিত্ব খান খান হয়ে যাক, পাকিস্তানে তার ফিরে যাবার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

যুগল বলল, তাইলে আর-একহানে যাইতে পারে—

 বিনয় জিজ্ঞেস করে, কোথায়?

শিয়ালদার ইস্টিশানে। হেইহানে রিফুজিগো লগে বুঝিন মিশ্যা রইছে।

হাতে একটা পয়সা নেই। তার ওপর এই শহরের কতটুকুই বা দেখেছে ঝিনুক! সেদিন সন্ধ্যায় হিমঋতুর কুয়াশা যখন অবিরল ঝরে চলেছে তখন সে কি হেঁটে হেঁটে যেতে পেরেছে শিয়ালদা পর্যন্ত এতটা পথ? পরক্ষণে ক্ষীণ একটা সম্ভাবনা বিনয়ের মাথায় চকিতে হানা দিয়ে যায়। গেলে একমাত্র সেখানেই যেতে পারে ঝিনুক। রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে। শিয়ালদা স্টেশন, সেখানকার অতগুলো প্ল্যাটফর্ম, বাইরে বিশাল খোলা চত্বর জুড়ে শুধুই উদ্বাস্তু। হাজার হাজার মানুষের থিকথিকে ভিড়ে আশ্রয় পেতেই পারে সে, আদৌ যদি শিয়ালদায় পৌঁছে থাকে।

যুগল বলল, লন (চলুন) যাই ছুটোবাবু, শিয়ালদা ইস্টিশানখান একবার বিচরাইয়া দেহি। ভগমান মুখ তুইলা চাইলে, ঝিনুক বইনেরে হেইখানে পাইয়াও যাইতে পারি– ।

সাঁতার না-জানা মানুষ মহাসমুদ্রে পড়লে হাতের কাছে একটা কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে চায়। সুধা বলল, যা না বিনু, যুগলের সঙ্গে শিয়ালদায় গিয়ে একবার দ্যাখ। কে বলতে পারে, ঝিনুক হয়তো সেখানেই চলে গেছে

 গুছিয়ে ভাবার মতো শক্তি বা সাহস কোনওটাই অবশিষ্ট নেই বিনয়ের। শিয়ালদায় গেলেই ঝিনুককে পাওয়া যাবে, এমন আশা শতভাগের একভাগও আছে কি না সন্দেহ। তবু কেউ যেন ভেতর থেকে তাড়া দিয়ে বিনয়কে টেনে তুলল। নাও যদি পাওয়া যায়, যুগল যখন চিন্তাটা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, একটা চেষ্টা অন্তত করা যাক।

জামাকাপড় পালটে যুগলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে বিনয়। ওদের সঙ্গে সুধাও বেরুল। সে বাড়ি ফিরে যাবে। রাস্তা পেরিয়ে ওধারে গিয়ে বাসে উঠল বিনয়রা। টালিগঞ্জের ট্রামের জন্য এপাশে দাঁড়িয়ে রইল সুধা।

.

০৩.

ধর্মতলায় এসে বাস বদলে বিনয় আর যুগল যখন শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছল, শীতের বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। দূরে হ্যারিসন রোড আর সার্কুলার রোডের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর মাথায় যে মলিন, নিবু নিবু রোদটুকু লেগে আছে তার আয়ু আর কতক্ষণ? চোখের পলক পড়তে না পড়তেই মুছে যাবে।

এর মধ্যেই মিহি কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। বাতাসে মিশে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি হিমকণা।

ট্রামরাস্তা দিয়ে পাঁচমেশালি আওয়াজ করে স্রোতের মতো ঊধ্বশ্বাসে ছুটছে অজস্র যানবাহন। ট্রাম বাস রিকশা ট্যাক্সি ঘোড়ার গাড়ি, এমন কত কী। আর রয়েছে মানুষের ভিড়। কেউ থেমে নেই। সবাই দৌড়চ্ছে। কলকাতা সদাব্যস্ত, সতত ধাবমান। লহমার জন্যও কারও দাঁড়িয়ে থাকার জো নেই। সকাল থেকে বেশ খানিকটা রাত পর্যন্ত কলকাতার যে-কোনও বড় রাস্তায় এমনটাই চোখে পড়ে।

ট্রাম লাইন পেরিয়ে এধারে এসে শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরে ঢুকে পড়ল বিনয়। চতুর্দিকে সেই পরিচিত দৃশ্য। সীমান্তের ওপার থেকে আসা শরণার্থীতে সমস্ত এলাকা থিক থিক করছে। তাদের রিফিউজি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা এখনও করা হয়নি বা করা যায়নি। সর্বত্র হই হই, চিৎকার, খিস্তিখেউড়, কুৎসিত কলহ।

ভিড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে করে তার নিজস্ব কায়দায় একটানা চেঁচিয়ে যাচ্ছিল যুগল, ঝিনুক বইন আছ? থাকলে হুমৈর (সাড়া) দাও। ছুটোবাবুও আমার লগে আছে। যেইখানেই থাক হুমৈর দাও, হুমৈর দাও তার কণ্ঠস্বর শীতঋতুর বায়ুতরঙ্গে ভাসতে ভাসতে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে।

বিনয়ও চারপাশে ব্যগ্র চোখে উদ্বাস্তুদের মধ্যে ঝিনুককে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

ঝিনুক বইন, ঝিনুক বইন করে চিৎকার করার ফাঁকে ফাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের যে উদ্বাস্তুরা পঁচিশ তিরিশ বর্গফুট জায়গা দখল করে খোলা আকাশের নিচে অস্থায়ী সংসার পেতে বসেছে তাদের কাছেও খোঁজখবর নিচ্ছে যুগল, বয্যের (যুবতী) এক মাইয়া, অবিয়াত (অবিবাহিত), সোন্দরী, একইশ বাইশ বচ্ছর বস (বয়স), নাম হইল ঝিনুক। বড় দুখী, পাগল পাগল অবস্থা। দ্যাশ আছিল ঢাকা জিলার রাইজদা। তেনারে আপনেরা কেও দেখছেন?

দেশের ভিটে থেকে উৎখাত এইসব মানুষ, যে-যার নিজের নিজের হাজারো সমস্যায় এবং ভবিষ্যতের চিন্তায় আচ্ছন্ন। তারা জানায়, এমন কারওকে দেখেনি। অন্যদিকে নজর দেবার সময় কোথায় তাদের?

গোটা চত্বর ঘুরতে ঘুরতে সন্ধে নেমে গেল। কুয়াশা দ্রুত গাঢ় হচ্ছে। সেই সঙ্গে গাড়ির ধোঁয়া আর ধুলো মাখামাখি হয়ে সব কেমন যেন আবছা আবছা।

একসময় দুজনে শিয়ালদা সাউথ সেকশনের স্টেশনের ভেতর চলে এল। এখানেও শয়ে শয়ে উদ্বাস্তু। বুড়োবুড়ি, যুবকযুবতী, মাঝবয়সী পুরুষ এবং মেয়েমানুষ, বাচ্চাকাচ্চা। আশাহীন, ভবিষ্যৎহীন নরনারীর দল। যেদিকেই তাকানো যাক, সারি সারি ভাঙাচোরা, সন্ত্রস্ত মুখ। আঁতিপাঁতি করে খুঁজে এখানেও ঝিনুককে পাওয়া গেল না।

এবার বিনয়রা এল শিয়ালদা মেন স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মের এক মাথা থেকে আর এক মাথা অবধি যে ছিন্নমূল মানুষেরা সীমান্তের এপারে এসে ইটের সীমানা-ঘেরা ছোট ছোট খোপের ভেতর পড়ে আছে তাদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে ঝিনুকের চেহারার বর্ণনা দিয়ে খোঁজ করল। না, ঝিনুকের সন্ধান এখানেও কেউ দিতে পারল না।

যেখানে অগুনতি মানুষের ঠাসাঠাসি ভিড়, সারাক্ষণ যেখানে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা আর তাণ্ডব চলছে, সেখানে যুগলের বিবরণের সঙ্গে মেলে এমন একটি তরুণী যদি এসেও থাকে, কেউ তাকে লক্ষ করেনি।

চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা চিরে গিয়েছিল যুগলের। সে বলল, কুনোহানেই তো ঝিনুক বইনেরে পাইলাম না। কই যে গেল! অহন কী করন যায় ছুটোবাবু?

বিনয় উত্তর দিল না। শিয়ালদা এসেই ঝিনুককে পাওয়া যাবে, তাও এতদিন বাদে, এমনটা ভাবতে পারেনি সে। তবু যুগলের কথায় তার মনের কোনও গোপন তলদেশে একটু দুরাশার সৃষ্টি হয়েছিল– যদি নিরুদ্দেশ ঝিনুকের সন্ধান মেলে। তাই এখানে ছুটে এসেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে অনুভব করল, বুকের ভেতর ধস নেমেছে। ভেঙেচুরে ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে সমস্ত কিছু। মনে হল জীবন থেকে চিরকালের মতো যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বৃথাই তার খোঁজে ছোটাছুটি।

শ্রান্ত, হতাশ যুগল এবার বলে, আর এইহানে খাড়ইয়া থাইকা কী হইব? লন (চলুন) যাই গা। আপনেরে ধম্মতলার বাসে উঠাইয়া দিয়া আইসা আগরপাড়ার টেরেন ধরুম। আপনে ধম্মতলা থিকা বাড়িত যাইয়েন গা।

যে যুগল শিয়ালদা এলেই রাজদিয়া ও তার চারপাশের গ্রামগঞ্জ আর ভাটি অঞ্চলের মানুষজনের খোঁজ করে, আজ আর সে-সম্বন্ধে তার কোনও উৎসাহ নেই। দেশের মানুষ সম্পর্কে সব আগ্রহই যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। আসলে ঝিনুকের জন্য দুঃখে, বিষাদে মন ভরে আছে। কিছুই ভাল লাগছিল না তার।

বিনয় বলল, হ্যাঁ, চল– তার কণ্ঠস্বরে নৈরাশ্য মাখানো। এলোমেলো পায়ে যুগলের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল সে।

প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্ত থেকে গেটের দিকে যখন ওরা বেশ খানিকটা চলে এসেছে সেই সময় গোটা স্টেশন জুড়ে তুমুল চাঞ্চল্য দেখা দিল। প্ল্যাটফর্মের একধারে এখানকার পুরানো শরণার্থীদের দেখাশোনা এবং প্রতিদিন নতুন নতুন যারা আসছে তাদের আশ্রয় আর খাদ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করার জন্য সরকারি রিফিউজি অ্যান্ড রিলিফ ডিপার্টমেন্টের যে ক্যাম্প বসানো হয়েছে সেখান থেকে অফিসার এবং কর্মীরা ব্যস্তভাবে বেরিয়ে এসে রেললাইনের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।

দিন নেই, রাত নেই, সারাক্ষণ শিয়ালদা স্টেশনে তীব্র শোরগোল। এখন সেটা হাজারগুণ বেড়ে গেছে। পুরানো উদ্বাস্তুরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে, উত্তেজিত ভঙ্গিতে কী বলতে লাগল, প্রথমটা বোঝা গেল না। পরে অবশ্য সব স্পষ্ট হল।

আইতে আছে, আইতে আছে—

 পাকিস্থানের টেরেন আইতে আছে।

ঝিনুককে না পেয়ে হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল বিনয়। নইলে ট্রেন আসার শব্দটা নিশ্চয়ই শুনতে পেত। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, অনেক দূরে ডিসটান্ট সিগনালের ওধারে একটা ইঞ্জিন প্রকাণ্ড সরীসৃপের মতো ট্রেনের কামরাগুলো টানতে টানতে দুরন্ত গতিতে এদিকে ধেয়ে আসছে। সেটার কপাল থেকে হেডলাইটের তীব্র আলোর ছটা চারপাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে।

যুগল বলল, পাকিস্থানের টেরেন। ইট্টু খাড়ন ছুটোবাবু। দেহি যদিন আমাগো উইদিকের চিনাজানা (পরিচিত) কেও আইয়া থাকে। শরণার্থীদের ট্রেন দেখে রাজদিয়া অঞ্চলের মানুষজন সম্পর্কে পুরানো উদ্দীপনা আবার ফিরে এসেছে তার।

যুগল থেমে গিয়েছিল। তাকে ফেলে চলে যাওয়া যায় না। অগত্যা বিনয়ও দাঁড়িয়ে পড়ল। চকিতে তার মনে হল, এমনও তো হতে পারে, ঝিনুক সত্যিই রাজদিয়ায় ফিরে গেছে। আজকের এই ট্রেনে ওখানকার কেউ যদি এসে থাকে, তার কাছে হয়তো ঝিনুকের খবর পাওয়া যাবে। সেই যে নিত্য দাস হেমনাথের চিঠি নিয়ে এসেছিল এবং পরে সেই চিঠির উত্তর নিয়ে চলে গিয়েছিল, তারপর আর লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। রিফিউজিদের জন্য নির্দিষ্ট আজকের স্পেশাল ট্রেনটায় পরিচিত কারও দেখা মিললে শুধু ঝিনুকই নয়, হেমনাথদের সম্পর্কেও জানা যাবে।

চারদিক ঝাঁপিয়ে, সিটি দিতে দিতে ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে থামল। লম্বা দৌড় শেষ। কয়লার ইঞ্জিন ফোঁস ফোঁস করে এখন হাঁপাচ্ছে।

মাসখানেকও কাটেনি, এমনই একটা ট্রেনে গোয়ালন্দ থেকে ঝিনুককে নিয়ে শিয়ালদায় এসেছিল বিনয়। সেদিনের মতো আজও প্রতিটি কামরায় গাদাগাদি ভিড়। ছাদের ওপরও অজস্র মানুষ, নানারকম লটবহর। বাক্স-পেটরা, পোঁটলা-পুটলি, হাঁড়িকুড়ি, ডালাকুলো, এমনই নানা জিনিস। যে যেটুকু পেরেছে, নিয়ে এসেছে।

 পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে আসার পর ইন্ডিয়ায় এসেও সবাই দিশেহারা। হয়তো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। বিহুলের মতো তারা তাকিয়ে তাকিয়ে আলোকোজ্জ্বল স্টেশনের মানুষজন দেখছে। অনেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী সব বলছে। তাদের চোখেমুখে উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা। প্রতিটি কামরা থেকে বাচ্চাদের কান্না ভেসে আসছে।

প্রতিদিন রিফিউজি স্পেশাল এলে যা হয়, আজও তার হেরফের নেই। মাইকে অবিরাম ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। পাকিস্তান থেকে যারা এসেছেন, হুড়োহুড়ি করবেন না। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে নেমে আসুন। সবার জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করা আছে, ইত্যাদি। সরকারি ত্রাণবিভাগের কর্মীরা প্রতিটি কামরার সামনে গিয়ে উদ্বাস্তুদের ধীরে ধীরে নামিয়ে আনছে।

শিয়ালদায় এলে যা করে থাকে, আজও তাই করতে লাগল যুগল। কামরায় কামরায় হানা দিয়ে গলার স্বর শেষ পর্দায় তুলে একটানা হেঁকে যাচ্ছে, রাইজদা দেলভাগ রসুইনা ডাকাইতা পাড়া মাইনকার চর গিরিগুঞ্জ সুজনগুঞ্জ থিকা কেউ আইয়া থাকলে হুমৈর দ্যান,

বিনয় যুগলের সঙ্গে যায়নি। প্ল্যাটফর্মের কোনায় দাঁড়িয়ে ওর কাণ্ডকারখানা লক্ষ করছিল।

অনেকক্ষণ পর হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল যুগল। দশ কম্পার্টমেন্টের ট্রেনটা বিশাল লম্বা; পুরো প্ল্যাটফর্ম জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাসা ভিড়ের ভেতর দিয়ে ট্রেনের শেষ মাথায় গিয়ে আবার এতটা ফিরে আসা মুখের কথা নয়।

যুগল বলল, আমাগো রাইজদার দিকের কেউ আইজকার গাড়িতে আহে নাই। লন (চলুন) যাই–

দুজনে গেটের দিকে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। কয়েক পা গেছে, পেছন থেকে কেউ গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকল, বিনু–এই বিনু

গলার স্বরটা খুবই পরিচিত। চমকে ঘুরে দাঁড়াল বিনয়। আর তখনই রাজদিয়া হাই স্কুলের অ্যাসিস্টান্ট হেডমাস্টার আশু দত্তকে দেখতে পেল। এক হাতে থুথুড়ে একজন বৃদ্ধাকে ধরে ধরে নিয়ে আসছেন। আরেক হাতে চামড়ার মাঝারি সুটকেস, বগলে শতরঞ্চি-জড়ানো বিছানা দড়ি দিয়ে বাঁধা। তার উষ্কখুষ্ক চুলে তেল জল বা চিরুনি পড়ে নি বহুদিন। গালে খাড়া খাড়া দাড়ি। পরনে। দলামোচড়া ধুতি আর টুইলের ফুল শার্ট। পায়ে লাল ক্যাম্বিসের পুরানো ফিতেওলা জুতোর ওপর ধুলোর প্রলেপ। মাথায়, জামাকাপড়ে কয়লার অজস্র কুচি। বোঝাই যায়, এই ট্রেনেই ওঁরা এসেছেন।

বৃদ্ধাটিকে ভালই চেনে বিনয়। আশু দত্তর মা। কতদিন ওঁদের বাড়ি গিয়ে তার হাতের ক্ষীরের নাড়, চিতই পিঠে, চিড়ের মোয়া কি পাটিসাপটা খেয়ে এসেছে।

কয়েক পলক হতবাক তাকিয়ে থাকে বিনয়। রাজদিয়ার এই শ্রদ্ধেয় মাস্টার মশায়টি দেশ ছেড়ে কোনওদিন ইন্ডিয়ায় চলে আসবেন, ভাবা যায়নি। তার ধারণা ছিল, জন্মভূমিতেই তিনি আমরণ থেকে যাবেন।

পাশ থেকে যুগল ব্যগ্র সুরে বলে ওঠে, ছুটোবাবু, আমাগো রাইজদার মাস্টর মশয়– বলেই আশু দত্তর দিকে দৌড়ে গেল।

বিনয়ও লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়ে আশু দত্ত এবং তার মাকে প্রণাম করে। দেখাদেখি যুগলও দুজনের পা ছুঁয়ে মাথায় ঠেকায়।

প্রশ্নটা অনাবশ্যক। তবু বিনয় জিজ্ঞেস করে, স্যার চলে এলেন? দেশে আর থাকা গেল না বুঝি?

মুখে কিছু বললেন না আশু দত্ত। আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন শুধু।

আশু দত্তর হাত থেকে সুটকেস বিছানা টেনে নিয়ে যুগল বলে, টেরেনের এই মাথা থিকা উই মাথায় সমানে ডাইকা গ্যাছি, রাইজদা থিকা কেউ আইছেন? চিল্লাইয়া চিল্লাইয়া গলার নলি ফাইড়া গ্যাছে। হুমৈর দ্যান নাই ক্যান?

আশু দত্ত বললেন, চারদিকে এত শোরগোল, তোর ডাক শুনতে পাইনি। বিনয়কে বললেন, ট্রেন থেকে নেমে মহা বিপদে পড়ে গেছি।

বিনয় জানতে চায়, কী বিপদ স্যার?

আমার এক মাসতুতো ভাইকে চিঠি লিখেছিলাম। শিয়ালদায় এসে আমাদের যেন নিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম। তাকে কোথাও পেলাম না।

আপনি শোনেননি, আজকাল পাকিস্তানের চিঠি ঠিকমতো এপারে আসে না? হয়তো আপনার ভাই চিঠি পাননি।

আশু দত্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। ভীষণ উদ্বিগ্ন। উদ্ভ্রান্তের মতো বলেন, এখন উপায়?

বিনয় বলে, কীসের?

আশু দত্ত জানালেন, উনিশ শউনচল্লিশের জুলাইয়ে, মহাযুদ্ধ শুরু হবার মুখে কলকাতায় শেষ এসেছিলেন। তারপর এই। মাঝখানে প্রায় একটা যুগ কেটে গেছে। এই শহর তার প্রায় অচেনা। নৌকোয় স্টিমারে এবং ট্রেনের দম বন্ধ করা ভিড়ে তিনটে দিন কেটেছে। প্রচণ্ড ধকলে বৃদ্ধা মা এবং তাঁর শরীরে সারবস্তু কিছু আর অবশিষ্ট নেই। হাত-পা ভেঙে হুড়মুড় করে যে-কোনও মুহূর্তে পড়ে যাবেন। কীভাবে যে নিজেদের খাড়া রেখেছেন, তারাই জানেন। এই অবস্থায় কেমন করে মাসতুতো ভাইয়ের বাসায় পৌঁছবেন, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না।

বিনয় জিজ্ঞেস করে, ঠিকানা জানেন তো?

তা জানি। ভাইয়ের নাম সন্তোষ–সন্তোষ নাগ। ঠিকানা সাতাশের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট। কালীঘাট।

চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।

দুর্ভাবনার আপাতত কিছুটা অবসান। মুখচোখ দেখে মনে হল, আশু দত্ত খানিক স্বস্তি বোধ। করছেন। বললেন, তোর সঙ্গে দেখা না হলে কী যে করতাম! কিন্তু

কী?

এখানে তোর অন্য কোনও কাজ নেই তো? আমাদের নিয়ে গেলে অসুবিধে হবে না?

না স্যার। আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরব।

কীভাবে কালীঘাট যাব?

 বিনয় লক্ষ করল, এই মুহূর্তে একটি মাত্র চিন্তাই আশু দত্তর মাথায় ভর করে আছে। কালীঘাটে মাসতুতো ভাইয়ের বাড়ি নিরাপদে পৌঁছতে হবে। এছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছেন না। বিনয়ের সঙ্গে কত দিন বাদে দেখা। কেন সে শিয়ালদায় এসেছিল, কলকাতার কোথায় থাকে সে, দেশ। থেকে এখানে এসে কেমন আছে, এ-সব সম্বন্ধে তাঁর এতটুকু আগ্রহ নেই।

বিনয় জানালো, কালীঘাট অনেক দূরের পথ। ট্রাম বাস পালটে যাওয়া যায়। কিন্তু আশু দত্তরা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে যেভাবে বিধ্বস্ত হয়ে আছেন, তাতে ভিড়ে-ঠাসা যানবাহনে টানাচড়া করে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। সে বলল, এখান থেকে একটা ঘোড়ার গাড়ি নেব।

আশু দত্তর হঠাৎ কী খেয়াল হল। উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, আমার কাছে হাজারখানেক পাকিস্তানি টাকা আছে। ইন্ডিয়ায় কি সেই টাকা চলবে?

বিনয় জানায়, এই শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরেই চড়া হারে বাট্টা দিলে পাকিস্তানি টাকার বদলে ভারতীয় টাকা পাওয়া যায়।

আশু দত্ত জামার ভেতরের পকেট থেকে টাকা বার করে বিনয়কে দিতে দিতে বললেন, বদলানোর ব্যবস্থা কর।

একসময় মেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে দালালদের কাছ থেকে টাকা বদলাবদলি করে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করল বিনয়। আশু দত্ত এবং তার মাকে গাড়িতে তুলে নিজেও উঠে বসল। যুগল সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। সে আশু দত্তদের মালপত্র গাড়িতে তুলে দিল।– এতক্ষণে যেন যুগলের ওপর ভালভাবে নজর পড়ল আশু দত্তর। খানিক আগে বিনয়ের সঙ্গে সেও যে তাঁকে প্রণাম করেছে, বুঝি বা তা লক্ষ করেননি। উৎকণ্ঠায়, দুর্ভাবনায় তখন তিনি দিশেহারা। বললেন, তুই যুগল না?

যুগল অল্প হাসল, হ মাস্টর মশয়।

গাড়িতে উঠলি না যে?

আশু দত্তর প্রশ্নের জবাবটা দিল বিনয়, ও কলকাতার বাইরে থাকে। আগরপাড়ায়। শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে ওকে যেতে হবে।

অনেক দূরে?

না। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে। আগরপাড়ায় নেমে বেশ খানিকটা হাঁটতে হয়।

আশু দত্ত যুগল সম্বন্ধে আর কোনও কৌতূহল প্রকাশ করলেন না।

যুগল বলল, আমার টেরেনের সময় হইয়া আইছে। অহন যাই মাস্টর মশয়। পরে ছুটোবাবুরে লইয়া আপনের লগে দেখা করুম। সে স্টেশনের দিকে ফিরে গেল।

অশ্বক্ষুরের আওয়াজ তুলে বিনয়দের গাড়ি শিয়ালদার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বাইরের রাস্তায় চলে এল।

এর মধ্যে সন্ধে নেমে গিয়েছিল। রাস্তায় কর্পোরেশনের বাতি জ্বলে উঠেছে। গাঢ় কুয়াশা ক্রমশ সেগুলোর টুটি টিপে ধরতে শুরু করেছে। দুধারের সারি সারি দোকান এবং বাড়িগুলোতেও প্রচুর আলো। কিন্তু শীতের সন্ধ্যায় গাঢ় কুয়াশার কারণে সেগুলোও কেমন যেন নিস্তেজ। মলিন। চারদিকে প্রচুর লোকজন। স্রোতের মতো ছুটে চলেছে ট্রাম বাস মোটর ট্যাক্সি, ইত্যাদি।

.

০৪.

ঘোড়ার গাড়ির ভেতরে মুখোমুখি লম্বাটে সিট। একদিকের সিটে বসেছে বিনয়। তার সামনের সিটটায় আশু দত্ত এবং তার মা। গাড়ির দোলানিতে বৃদ্ধার ঘুম এসে গিয়েছিল। তিনি ঢুলছিলেন। আশু দত্ত জানালার বাইরে ধাবমান গাড়িঘোড়া মানুষজন এবং দোকানপাটের দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বললেন, তুই তখন দেশ ছেড়ে আসার কথা জিজ্ঞেস করছিলি না?

খানিক আগে শিয়ালদা স্টেশনে মাসতুতো ভাইকে দেখতে না পেয়ে আশু দত্ত দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। বিনয় বুঝতে পারে, সেই অস্থির অস্থির ভাবটা এখন অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছেন। আস্তে মাথা নেড়ে সে বলে, হ্যাঁ।

আশু দত্ত বললেন, দিনকে দিন দেশের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে উঠছে। হিন্দুরা কতদিন সেখানে থাকতে পারবে, জানি না। একটু চুপ করে থেকে ফের শুরু করলেন, ইন্ডিয়া থেকে কিছু বিহারী মুসলমান রাজদিয়ায় গিয়ে উঠেছে। তারা স্থানীয় লোকজনদের খুব তাতাচ্ছে। তাছাড়া রাজাকারদের উৎপাতও বেড়ে গেছে।

কিছুদিন আগে হেমনাথের চিঠিতে বিশদভাবে না হলেও এ-সবের ইঙ্গিত ছিল। নতুন করে উৎকণ্ঠায় মন ভরে যেতে থাকে বিনয়ের।

আশু দত্ত থামেননি, আমার ক্ষতিটা হয়েছে দুদিক থেকে। তাই দেশ ছাড়তে বাধ্য হলাম।

উত্তর না দিয়ে পলকহীন রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে বিনয়।

আশু দত্ত জানান, রাজদিয়া হাইস্কুল–যা ছিল যৌবনের শুরু থেকে তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান, কলকাতায় ভাল ভাল চাকরির শত প্রলোভন উপেক্ষা করে তাই নিয়েই জীবনের মহার্ঘ বছরগুলি কাটিয়ে দিয়েছেন। উনিশ শ সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্টের পর যখন পূর্ব পাকিস্তানে ভাঙন ধরল তখনও তিনি তার চিরদিনের সেই স্বপ্নটাকে আঁকড়ে রাজদিয়ায় পড়ে রইলেন। দেশ দুটুকরো হয়েছে, দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক ঘৃণা আর অবিশ্বাসের বিষবাষ্পে সমস্ত পরিবেশ ছেয়ে গেছে, কিন্তু সে-সব দিকে তার লক্ষ ছিল না। রাজদিয়া হাই স্কুল থেকে নতুন নতুন ছাত্র বেরিয়ে, তাদের মেধা দিয়ে সদ্যোজাত পাকিস্তানকে গড়ে তুলবে, এই নিয়েই তিনি বিভোর ছিলেন।

কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হল আচমকা। নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে। রাজদিয়া হাই স্কুলের গভর্নিং বডিতে হেমনাথ ছাড়াও রাজদিয়া তো বটেই, চারপাশের গ্রামগুলোর বেশ কিছু সুশিক্ষিত, বিশিষ্ট মানুষজনও ছিলেন। মুসলিম লিগ একরকম গায়ের জোরে গভর্নিং বডি ভেঙে দিয়েছে। আমূল বদলে দিয়েছে সমস্ত কিছু। মোতাহার হোসেন যে স্কুলে একটানা ছাব্বিশ বছর ধরে হেড মাস্টার, কংগ্রেস করার অপরাধে রাতারাতি তাকে তাড়ানো হয়েছে। আশু দত্ত এবং আরও কয়েকজন মাস্টার মশাইকে, প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে যাঁরা রাজদিয়া হাই স্কুল গড়ে তুলেছেন তাদের রিটায়ারমেন্টের নোটিশ ধরিয়ে একরকম ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে বিদায় করে দেওয়ায় রাজদিয়া এবং চারপাশের বহু মানুষ খুব ক্ষুব্ধ। ছাত্ররা একদিন স্ট্রাইকও করেছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

রাজদিয়ায় হেমনাথ এবং মোতাহার হোসেনের পর সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ আশু দত্ত। এত বড় অসম্মানে তিনি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় আঘাত এসেছিল অন্য দিক থেকে। তার ছোট ভাই সুরেশ দত্ত রেলে চাকরি করতেন। প্যাসেঞ্জার ট্রেনের গার্ড। অবিবাহিত। থাকতেন ঢাকায় রেলের কোয়ার্টার্সে। দেশভাগের সময় সরকারি আধা-সরকারি কর্মচারীদের অপশন দেওয়া হয়েছিল, ইচ্ছা হলে যে কেউ ইন্ডিয়ায় চলে যেতে পারে। সুরেশ দত্ত পাকিস্তানেই থেকে গিয়েছিলেন। ছুটিছাটায় বাড়ি আসতেন। খুব বড় রকমের দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইদানীং হয়নি ঢাকায়। তবে উত্তেজনা রয়েছে। মাঝে মাঝেই স্ট্যাবিংয়ের ঘটনা ঘটছে। একদিন রাতে ডিউটি সেরে ফেরার পথে সুত্রাপুরের কাছে তাকে ছুরি মারা হয়। রক্তাপ্লুত বেহুঁশ অবস্থায় সুরেশকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার জ্ঞান আর ফেরেনি। দুদিন পর তিনি মারা যান।

এই মৃত্যুটা আশু দত্তদের তুমুল ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়। ঢাকা থেকে শোচনীয় খবরটা আসার সঙ্গে সঙ্গে আশু দত্তর মা মূৰ্ছিত হয়ে পড়েন। হুঁশ ফেরার পর শোককাতর বৃদ্ধা আর স্বাভাবিক হতে পারেননি। সারাক্ষণ আচ্ছন্নের মতো বসে থাকতেন। আর মাঝে মাঝেই উন্মাদের মতো বুকে চাপড় মারতে মারতে আকুল হয়ে কাঁদতেন। তার কান্নার আওয়াজ অনেকটা তীরবেধা পশুর আর্তনাদের মতো। এক মুহূর্তও তিনি পাকিস্তানে থাকতে চাইছিলেন না। অবিকল ঝিনুকের মতো।

নিরুপায় আশু দত্ত শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, পাকিস্তানে আর থাকবেন না। গোপনে পূর্বপুরুষের বাড়িঘর জমিজমা বিক্রি করার চেষ্টা যে করেননি তা নয়। কেননা জানাজানি হলে রাজাকাররা প্রচণ্ড হামলা করবে। হিন্দুর সম্পত্তি বেচা প্রায় অসম্ভব। খদ্দের তিনি পেয়েও ছিলেন। কিন্তু তারা ভয়ে আশু দত্তর সঙ্গে রেজিস্ট্রি অফিস পর্যন্ত যেতে পারেনি। অগত্যা বাড়িতে তালা লাগিয়ে সম্পত্তির দলিলপত্র সঙ্গে নিয়ে মায়ের হাত ধরে নৌকোয় উঠেছিলেন। তারপাশা স্টিমারঘাটে আসা, গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে বর্ডারে পৌঁছনো বিনুর যা যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল প্রায় তেমনটাই ঘটেছে আশু দত্তর বেলায়। সেই আতঙ্ক, সেই উৎকণ্ঠা, সেই মৃত্যুভয়। ভেবেছিলেন, পাকিস্তানে উত্তেজনা কমলে, পরিবেশ খানিকটা স্বাভাবিক হলে, দেশে ফিরে বাড়িঘরের ব্যবস্থা করে আসবেন। কিন্তু বর্ডারে পৌঁছবার পর আরেকটা মারাত্মক আঘাতে শেষ আশাটুকুও চুরমার হয়ে গেল। পাকিস্তানি অফিসাররা তাঁর যাবতীয় দলিল-টলিল ছিনিয়ে নেয়। দুঃস্বপ্নের সীমান্ত পেরিয়ে তিনি যখন কলকাতায় এলেন, একেবারে নিঃস্ব। কপর্দকহীন। সেই সঙ্গে ভাইয়ের ভয়াবহ মৃত্যুতে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত।

একনাগাড়ে বলে যাবার পর থামলেন আশু দত্ত। জোরে জোরে শ্বাস টানতে লাগলেন।

 ঘোড়ার গাড়ির ভেতর স্তব্ধতা নেমে আসে। কেমন যেন দমবন্ধ করা পরিবেশ, ভীষণ অস্বস্তিকর। বাইরে থেকে অশ্বক্ষুরের ধ্বনি আর পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া যানবাহন এবং মানুষজনের কলরোল ভেসে আসছে যথারীতি।

ঝিনুকের চিন্তাটা ফের মাথায় ফিরে আসে বিনয়ের। কিন্তু কীভাবে তার কথা জিজ্ঞেস করবে, ঠিক করে উঠতে পারছে না।

অনেকক্ষণ আচ্ছন্নের মতো বসে থাকার পর আশু দত্ত আবার শুরু করেন, এক জামাকাপড়ে মাকে নিয়ে দেশ থেকে চলে এলাম। মাসতুতো ভাইয়ের ক্ষমতা আর কতটুকু? শুনেছি সে প্রাইভেট ফার্মের কেরানি। স্বামী, স্ত্রী, তিন চারটে ছেলেমেয়ে। তার ওপর মা আর আমি এসে ওদের ঘাড়ে চাপলাম। কী করে যে চালাবে? কী হবে আমাদের? তাঁকে খুবই অসহায় দেখাচ্ছে। ভবিষ্যতের চিন্তায় ব্যাকুল।

পলকহীন প্রাক্তন মাস্টার মশাইটির দিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়। মোতাহার হোসেন চৌধুরি রাজদিয়া হাই স্কুলের হেড মাস্টার হলেও প্রবল প্রতাপে স্কুলটা চালাতেন আশু দত্তই। শুধু স্কুল কম্পাউন্ডেই নয়, দাপট ছিল তার সারা রাজদিয়া জুড়ে। সেখানকার প্রতিটি মানুষ তাকে সমীহ করত। এতকাল কী শ্ৰদ্ধাই না তিনি পেয়ে এসেছেন! সেই আশু দত্তকে এখন আর চেনাই যায় না। উদ্বেগে দুর্ভাবনায় তার শক্ত শিরদাঁড়া নুয়ে পড়েছে।

জড়সড় বিপর্যস্ত বৃদ্ধটিকে দেখতে দেখতে মায়াই হয় বিনয়ের। চকিতে আর-একজন মাস্টার মশাই জামতলির রামরতন গাঙ্গুলির মুখটা চোখের সামনে ফুটে ওঠে। শয়ে শয়ে সর্বস্ব হারানো, ভয়ার্ত মানুষের মতো বিনয় আর ঝিনুক ওঁদের সঙ্গে তারপাশা থেকে স্টিমার ধরেছিল। জীবন্ত রামরতন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসতে পারেননি। এসেছিল তার মৃতদেহ। দুই অবিবাহিতা তরুণী মেয়ে, এক বয়স্কা বিধবা মেয়ে এবং বৃদ্ধা স্ত্রীর যাবতীয় দুশ্চিন্তা পৃথিবী নামের এই গ্রহটিতে ফেলে রেখে চিরকালের মতো তিনি চোখ বুজেছেন। বিনয়ের মনে পড়ল, তার স্ত্রী এবং মেয়েরা তার ভাইপো বিমলের কাছে উঠেছে। বিমলের ঠিকানা লিখে নিয়েছিল বিনয়। কথা দিয়েছিল একদিন তাদের বাড়ি যাবে। যাওয়া হয়নি। কলকাতায় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুককে নিয়ে একের পর এক এত সংকট বেড়াজালের মতো তাকে ঘিরে ধরেছে যে ওদের কথা খেয়াল ছিল না। প্রচণ্ড অস্বস্তি বোধ করল বিনয়। ভাবল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, বিমলদের বাসায় গিয়ে ওদের খোঁজখবর নেবে।

আশু দত্ত এবং রামরতন গাঙ্গুলির মধ্যে প্রচুর মিল। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলার গ্রামে গ্রামে ব্যাপকভাবে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়া। একটা জাতিকে বড় হতে হলে সুশিক্ষিত, আদর্শবাদী মানুষ দরকার। যৌবনের শুরু থেকে মানুষ গড়ার কাজটাই নিষ্ঠাভরে করে গেছেন তারা। কিন্তু স্বাধীনতার পর কী মূল্য পেলেন দুজনে? জন্মভূমি থেকে উৎখাত হয়ে, শূন্য হাতে আত্মীয় পরিজনের কাছে একটু আশ্রয়ের আশায় সপরিবারে তাঁদের পাড়ি দিতে হয়েছে। মৃত্যু রামরতনের সব দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়েছে। কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তা আশু দত্তকে যেন গিলে ফেলছে।

বিনয় বলল, অত ভাবছেন কেন স্যার? ইন্ডিয়ায় যখন পৌঁছতে পেরেছেন, রোজগারের একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

আশু দত্ত বললেন, এই বৃদ্ধ বয়েসে কে আমাকে স্কুলে চাকরি দেবে?

রিফিউজি বোঝাই গোয়ালন্দের স্টিমারে দোতলার ডেকে বসে অবিকল এইরকম প্রশ্নই করেছিলেন রামরতন। বিনয় বলল, স্যার, আপনি পণ্ডিত মানুষ। স্কুলে কাজ না পেলেও ছাত্র পড়িয়ে অনেক টাকা পেতে পারেন।

ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিলেন আশু দত্ত। তাঁর শিরদাঁড়া টান টান হয়ে যায়। কঠোর গলায় বলেন, তুই কি প্রাইভেট টিউশনের কথা বলছিস?

তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছুর আভাস রয়েছে যাতে হকচকিয়ে যায় বিনয়। ভয়ে ভয়ে বলে, হ্যাঁ, মানে পরক্ষণে সেই ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শীতগ্রীষ্ম বারোমাস প্রতিদিন সন্ধের পর পুরানো সাইকেলে চেপে সারা রাজদিয়া টহল দিয়ে বেড়াতেন আশু দত্ত। মৃধা বাড়ি, রক্ষিত বড়ি, সৈয়দ বাড়ি, ঘটক বাড়ি-এমনি নানা জায়গায় হানা দিয়ে দেখতেন তার স্কুলের কোন ছাত্রটি পড়ায় ফাঁকি দিচ্ছে, কে অ্যারিথমেটিকের প্রবলেমের অঙ্ক কষতে হিমসিম খাচ্ছে, কার মাথায় বাংলা ব্যাকরণের সমাস ঠিকমতো ঢুকছে না, কে ইতিহাসের মুঘল বাদশাদের রাজত্বকালের সাল তারিখের হিসেব রাখতে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। সবার ভুলটুল শুধরে, পড়াগুলো জলবৎ বুঝিয়ে দিয়ে যখন বাড়ি ফিরতেন তখন প্রায় মধ্যরাত। এর জন্য কারও কাছ থেকে কখনও একটি পয়সাও তিনি নেননি।

আশু দত্ত ধমকে ওঠেন, প্রাইভেট টিউশন করে টাকা নেব! কী বলছিস তুই? এতখানি সাহস তোর হল কী করে? তার ভেতর থেকে রাজদিয়ার সেই প্রবল পরাক্রান্ত মাস্টার মশাইটি লহমার জন্য আগুনের ঝলকের মতো বেরিয়ে আসেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি ফের ঝিমিয়ে পড়েন, নির্জীব সুরে বলেন, কে জানে, পেটের জন্যে শেষপর্যন্ত হাত পেতে তাই হয়তো নিতে হবে। গভীর নৈরাশ্যে তার গলা বুজে আসে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

আশু দত্তর কথা শুনতে শুনতে ঝিনুকের চিন্তাটা কখনও চাপা পড়ে যায়, আবার সেটা বেরিয়ে আসে। কিন্তু সরাসরি ঝিনুক সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না। যা জানার কৌশলে জানতে হবে।

বিনয় বলল, আসার সময় আমার দাদুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

আশু দত্ত বললেন, রওনা হওয়ার আগের দিন হেমদাদার বাড়ি গিয়েছিলাম। তাকে বললাম আমরা চলে যাচ্ছি। আপনিও যত তাড়াতাড়ি পারেন ইন্ডিয়ায় চলে যান। কিন্তু দেশ ছেড়ে তিনি আসবেন না। অনেক বুঝিয়েও কাজের কাজ কিছু হল না। কোন দিন যে কী বিপদ ঘটে যাবে!

হেমনাথের অনড় মনোভাবের কথা বিনয়ের অজানা নয়। সেজন্য তার পাহাড়-প্রমাণ দুশ্চিন্তা। নিজের থেকে যদি তিনি না বোঝেন কী নিদারুণ বিপদের মধ্যে আছেন, অন্যে কী আর করতে পারে? কিন্তু এই মুহূর্তে ঝিনুকের ভাবনাটাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে বিনয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে জিজ্ঞেস করল, আমাদের বাড়িতে দাদু ছাড়া আর কার সঙ্গে দেখা হল?

বউ ঠাকরুন আর শিবানী দিদি।

এঁরা ছাড়া অন্য কেউ ছিল না?

হেমদাদার তো তিনজনের সংসার। ওঁরা ছাড়া আর কে থাকবে? ও হ্যাঁ, তোদের সেই পুরানো কামলা করিম–তাকেও দেখেছি।

মোটামুটি আন্দাজ করা যাচ্ছে, ঝিনুক রাজদিয়ায় যায়নি। পাকিস্তান থেকে চলে আসার জন্য যে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল, আবার সেই হননপুরীতে সে ফিরে যাবে এটা মনে করাই ভুল। তবু ক্ষীণ দুরাশাকে বিনয় প্রশ্রয় দিয়েছে–যদি গিয়ে থাকে? রাজদিয়ায় গেলে হেমনাথ কি আর আশু দত্তকে জানাতেন না? তীব্র হতাশায় ডুবে যেতে থাকে বিনয়।

আশু দত্ত এবার বললেন, হেমদাদা তোদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন। তার বাবার আর দুই দিদির ঠিকানাও দিয়েছেন। শিয়ালদায় নেমে প্রথম দিনই তোর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। এতক্ষণ তো আমার কথাই শোনালাম। তোর খবর বল। কী করছিস? কোথায় আছিস?

ঝিনুক রাজদিয়ায় ফেরেনি, সেটা বুঝে যাবার পর ভেতরে ভেতরে একেবারে ভেঙে পড়েছে বিনয়। কথা বলতে ভাল লাগছিল না। তবু বলতে হল। ঝিনুকের ব্যাপারটা গোপন করে বাকিটা ঠিক ঠিক জানিয়ে দিল।

আশু দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, ভবতোষের মেয়ে ঝিনুক তোর সঙ্গে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিল না?

ঝিনুকের নামটা আশু দত্তর মুখ থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর দমাদ্দম হাতুড়ির ঘা পড়তে লাগল বিনয়ের। দাঁতে দাঁত চেপে ঝাপসা গলায় সে বলল, হ্যাঁ, স্যার।

মেয়েটা নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছে। ওকে যত্ন করিস। দেখিস নতুন করে আর যেন কষ্ট না। পায়।

ঝিনুকের চরম লাঞ্ছনার খবরটা জগৎসংসারে কারও জানতে বাকি নেই। আশু দত্ত রাজদিয়ার মানুষ। তিনি তো জানবেনই।

বিনয় উত্তর দিল না। নীরবে, নতচোখে বসে রইল।

 একসময় ঘোড়ার গাড়ি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পৌঁছে যায়।

.

০৫.

রাস্তাটা বেশ সরু। এঁকে বেঁকে, পাক খেতে খেতে, এগিয়ে গেছে। এখানে বেশির ভাগই পুরানো বাড়ি। একতলা, দোতলা। ক্কচিৎ দু-একটা তিনতলা। সবই সাদামাঠা, ছিরিছাঁদহীন। প্রতিটি দালান কোঠার গায়ে মলিন ছাপ। ফাঁকে ফাঁকে টালি বা টিনের চালের ঘর, মাটকোঠা। মনে হয়, আদ্যিকালের কোনও শহরের পথ।

কর্পোরেশনের যে বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে, ঘন কুয়াশা চারপাশ থেকে সেগুলোর দম বন্ধ করে দিচ্ছে। হিমঋতুর এই রাতের সঙ্গে যুঝে যুঝে কোনওরকমে তারা ঝাপসা আলো বিতরণ করে চলেছে।

এখানে প্রচুর দোকানপাট। কোনওটা তেলেভাজার, কোনওটা মুড়িমুড়কি বাতাসা এবং ছোলাভাজার, কোনওটা চায়ের, কোনওটা মুদিখানা। তাছাড়া দুচার পা ফেললেই ছোটখাটো লন্ড্রি, মনিহারি দোকান, মিষ্টির দোকান, সোনারুপোর গয়নার দোকান। এই দোকানগুলোর কটাতেই বা ইলেকট্রিক আলো! হয় কেরোসিনের লম্ফ, হেরিকেন বা লম্বা উঁটিওলা গ্যাসবাতি জ্বলছে।

রাস্তায় যথেষ্ট লোকজন চোখে পড়ছে। হিমে, কুয়াশায় এবং চতুর্দিকের নিস্তেজ আলোয় মনে হয় ছায়ামূর্তির মিছিল।

নিরুৎসুক চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল বিনয়। চারদিক দেখতে দেখতে আবছাভাবে ভাবল, সে যেন পরিচিত পৃথিবীর বাইরে অচেনা, ভুতুড়ে, অবাস্তব কোনও গ্রহে এসে পড়েছে।

রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে সন্তোষ নাগদের ভাড়া বাড়ির হদিস পেতে অসুবিধা হল না। এই এলাকার অন্য সব বাড়ির মতো সেকেলে ধাঁচের দোতলা। বয়স কম করে ষাট সত্তর বছর তো হবেই। তৈরি হবার পর সেই যে রং করা হয়েছিল, তারপর ওটার গায়ে আর হাত পড়েনি। পলেস্তারা অনেক জায়গায় খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে। দেওয়ালের গায়ে শ্যাওলার কালো কালো ছোপ। রেন-ওয়াটার পাইপ ভাঙাচোরা। বন্ধ সদর দরজার মাথায় অল্প পাওয়ারের একটা বাম্ব জ্বলছিল। সেই আলোয় দেখা গেল, কপাটের পাল্লায় চকখড়ি দিয়ে বড় হরফে লেখা : ২৭বি।

ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে বিনয় জোরে জোরে দরজার কড়া নাড়তে লাগল।

একটু পর তেরো চোদ্দ বছরের একটি সুশ্রী কিশোরী দরজা খুলে বলল, কাকে চান? এখানে সন্তোষ নাগরা থাকেন? ঠিকানাটা খুঁজে বার করার পরও পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য প্রশ্নটা করল বিনয়।

হ্যাঁ। আমার বাবা।

তিনি বাড়ি আছেন?

হ্যাঁ।

তাঁকে খবর দাও, পাকিস্তানের রাজদিয়া থেকে তার এক দাদা আশু দত্ত মশাই এসেছেন-

এক্ষুনি বাবাকে ডেকে আনছি।

মেয়েটি এক ছুটে ভেতর দিকে চলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে যখন ফিরে এল, সঙ্গে একজন প্রৌঢ় এবং আরও তিনটি ছেলেমেয়ে, যাদের বয়স ছয় থেকে দশ এগারোর মধ্যে। অপার কৌতূহল নিয়ে তারা একবার বিনয়, পরক্ষণে ঘোড়ার গাড়ির আরোহীদের লক্ষ করতে লাগল।

প্রৌঢ়টির উচ্চতা মাঝারি। গোলগাল, ভালমানুষ গোছের চেহারা। পরনে আধময়লা ধুতি এবং হাফ শার্টের ওপর চাদর জড়ানো। বিনয় বুঝতে পারছিল, ইনিই আশু দত্তর মাসতুতো ভাই সন্তোষ নাগ।

সন্তোষ ব্যগ্রভাবে বললেন, আশু দাদা কোথায়? আশু দাদা

ঘোড়ার গাড়ি থেকে ততক্ষণে আশু দত্ত নেমে এসেছেন। বললেন, এই যে

পাকিস্তান থেকে আসবেন, আগে জানাননি তো? চিঠি লিখলে শিয়ালদায় চলে যেতাম

বিনয় কলকাতায় পৌঁছে আনন্দ এবং হিরণকে যা বলেছিল, হুবহু তাই বললেন আশু দত্ত। অর্থাৎ চিঠি লিখেছিলেন। হিরণদের মতো একই উত্তর দিলেন সন্তোষ। আশু দত্তর চিঠি তিনি পাননি। সেই সঙ্গে জুড়ে দিলেন, পাকিস্তানের চিঠিপত্র আজকাল নিয়মিত আসছে না। কথা বলতে বলতে নিচু হয়ে আশু দত্তর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে সদরের সামনে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েগুলোকে বললেন, ইনি জেঠু। নমো কর ।

বলমাত্র ঢিপ ঢিপ করে তারা প্রণাম সেরে একধারে সারি সারি দাঁড়িয়ে রইল।

সন্তোষ বললেন, মাসিমা আসেনি?

 এসেছে। এই তো আঙুল বাড়িয়ে ঘোড়ার গাড়িটা দেখালেন আশু দত্ত।

সুরেশদাদাকে দেখছি না তো

গাড়ির ভেতর জড়পিণ্ডের মতো যে বৃদ্ধাটি এক কোণে বসে ছিলেন, আচমকা ক্ষীণ, করুণ সুরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। সেই সঙ্গে অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য গলায় সুরেশের নাম করে একটানা কী বলে যেতে লাগলেন। তার বিলাপের ধ্বনি কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতটাকে বিষাদে ভরিয়ে তুলল।

সন্তোষ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, কী হয়েছে দাদা? মাসিমা কাঁদছে কেন?

ভারী গলায় আশু দত্ত বললেন, পরে শুনিস।

এরপর গাড়ির দরজা খুলে আশু দত্তর মাকে এবং সীমান্তের ওপার থেকে সামান্য যা জিনিসপত্র আনা সম্ভব হয়েছিল, ধরাধরি করে সব নামানো হল।

সন্তোষ কিশোরী মেয়েটার দিকে ফিরে বললেন, শিগগির তোর মাকে ডেকে আন। মাসিমাকে ভেতরে নিয়ে যাবে।

মেয়েটা আরে-একবার দৌড়ে চলে গেল। এবার সঙ্গে করে নিয়ে এল কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টানা একজন মাঝবয়সী মহিলাকে। আশু দত্তর মা সমানে কেঁদে চলেছেন। সন্তোষের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা সযত্নে তাকে ধরে ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল।

এদিকে ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। সওয়ারিদের সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এক লহমাও সে আর এখানে নষ্ট করতে রাজি নয়। তাকে ছেড়ে দেবার জন্য সমানে তাড়া দিতে শুরু করেছে।

বিনয় ভাড়া দিতে যাচ্ছিল, এক ধমকে তাকে থামিয়ে আশু দত্ত নিজেই তা মিটিয়ে দিলেন। গাড়ি ধীর চালে বড় রাস্তার দিকে চলতে শুরু করল। একটু পর সামনের একটা বাঁক ঘুরে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

বিনয় বলল, স্যার, আমি এখন চলি। আপনারা ভীষণ ক্লান্ত। তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ুন।

এতক্ষণ আশু দত্তদের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিলেন সন্তোষ। হঠাৎ বিনয় সম্পর্কে সচেতন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একে তো চিনতে পারলাম না।

আশু দত্ত বললেন, রাজদিয়ার হেমনাথ মিত্রের নাতি বিনয়। স্কুলে আমার ছাত্র ছিল। তুই তো হেমদাদাকে চিনিস।

চিনব না? কলকাতায় চাকরি পাওয়ার আগে যখন রাজদিয়ায় আপনাদের বাড়ি যেতাম, হেমদাদার সঙ্গে দেখা না করলে খুব অভিমান করতেন। এমন মানুষ হয় না।

শিয়ালদায় ট্রেন থেকে নামার পর তোকে না দেখে কী করব যখন ভেবে পাচ্ছি না তখন বিনয়ের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। ও-ই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। বিনয়ের সঙ্গে দেখা না হলে ভীষণ বিপদে পড়তাম।

সন্তোষ ভাল করে বিনয়কে লক্ষ করলেন। বয়সে তার চেয়ে অনেক ছোট। তাকে আপনি করে না বললেও চলে। বললেন, রাস্তা থেকে চলে যাবে, তাই কখনও হয়। এস

বিনয় বলল, অনেক রাত হয়ে গেছে। আজ থাক। পরে একদিন আসব।

আশু দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, কবে আসবি?

দুচার দিনের ভেতর।

 আসবি কিন্তু। তোর সঙ্গে অনেক দরকারি কথা আছে।

 আচ্ছা

বিনয় আর দাঁড়ালো না। সরু গলিটা ধরে বড় রাস্তার দিকে জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। সেখান থেকে ট্রাম বাস, কিছু একটা ধরে সোজা ভবানীপুর যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *