২৬-৩০. জাফর শা রোডে

২৬.

জাফর শা রোডে এসে বিনয় যখন পৌঁছল, প্রায় সোয়া নটা বাজে। একটা পানবিড়ি সিগারেটের দোকান আর একটা চায়ের দোকান ছাড়া চারপাশের মুদিখানা, লন্ড্রি, ডাক্তারখানা সব বন্ধ হয়ে গেছে। যেদিকে যত দালনাকোঠা কি টিনের চালওলা বাড়িঘর বা খাপরার চাপ-বাঁধা বস্তি রয়েছে, সেগুলোর জানালাকপাট বন্ধ। এই শীতে রাস্তার কুকুরগুলো অবধি উধাও।

সুধাদের বাড়ির কড়া নাড়তে উমা নেমে এসে দরজা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে উঠতে যুগলের গলা শুনতে পেল বিনয়। রীতিমতো অবাক হয়ে যায় সে। সেই যে শেষবার আশু দত্তর সঙ্গে মুকুন্দপুর গিয়েছিল, তারপর এত কাণ্ড ঘটে গেছে যে, যুগলের কথা তার মাথাতেই ছিল না।

যুগল এমনিতে এ-বাড়িতে আসে দুপুরবেলায়। আগে আগে ফি সপ্তাহে লেকের ধারের হাসপাতালে পা ড্রেস করিয়ে দশটা সাড়ে-দশটার ভেতর চলে আসত। পায়ের ক্ষত যত শুকিয়ে আসছিল, হাসপাতালে আসাটা তার ততই অনিয়মিত হয়ে পড়ছিল। এখন মাঝে মাঝে এসে ডাক্তারকে দেখিয়ে গেলেই চলে।

যে মানুষ দশটা সাড়ে-দশটায় এসে দিনের আলো থাকতে থাকতেই ফিরে যায়, হঠাৎ সে কেন আজ রাত্তিরে এসে হাজির হয়েছে, বোঝা যাচ্ছে না। তাহলে কি ওদের কলোনি নিয়ে কোনও ঝাট দেখা দিয়েছে? কিংবা যুগলের নিজস্ব কোনও সমস্যা?

দোতলায় এসে আরও একবার অবাক হতে হল। বিনয়ের চোখে পড়ল, বাইরের ঘরে শুধু যুগলই নেই, আশু দত্তও রয়েছেন। আর আছে সুধা, হিরণ, দ্বারিক দত্ত। যুগল ছাড়া সবাই বসেছে চেয়ারে। যুগল যথারীতি মেঝেতে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, তাই একটা পুরু কম্বল কাটা আসনের ওপর।

বিনয়কে দেখে হইচই বাধিয়ে দিল যুগল, আসেন ছুটোবাবু, আসেন

আশু দত্তও ডাকলেন, আয় বিনু হাতকাটা সোয়েটারে শীত ঠেকানো যাচ্ছিল না। নতুন ভারত-এর অফিস থেকে এতটা পথ বিনয় কীভাবে এসেছে, তা শুধু সেই জানে। সারা শরীর হি হি কাঁপছে। আঙুলগুলো সিঁটিয়ে গেছে। বাইরের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বিনয় সুধাকে বলল, ছোটদি, চট করে আগে আমাকে একটা কম্বল টম্বল এনে দে

এক্ষুনি আনছি। দুপুরে তাড়াহুড়োয় আমার একদম খেয়াল ছিল না। কাল থেকে গরম শাল দিয়ে দেব। ফেরার সময় গা-মাথা ভাল করে ঢেকে নিবি। এই শীতে ইত্যাদি বলতে বলতে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুধা।

যুগল বলল, ইস, ছুটোবাবু এক্কেরে কালাইয়া (ঠান্ডায় কাবু হয়ে) গ্যাছে। এই টালকির (শীতের) সোময় কেও চদর চুদর ছাড়া পথে বাইর অয় (হয়)?

আশু দত্ত, হিরণ এবং দ্বারিক দত্তও একই কথা বললেন। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না নিয়ে এই হিমঋতুতে বাইরে থাকলে, বিশেষ করে রাত্তিরে, ঠাণ্ডা লেগে বড় রকমের অসুখ বিসুখ বেধে যাবে।

কারও কথাই মন দিয়ে শুনছিল না বিনয়। তার মাথায় একটাই চিন্তা। একটাই প্রশ্ন। যুগলরা কেন এল? একটা খালি চেয়ারে বসতে বসতে বিনয় আশু দত্তকে বলল, স্যার, আপনি আজ এ বাড়িতে আসবেন, ভাবতেই পারিনি। ছোটদি, হিরণদা, দ্বারিকদাদুর সঙ্গে এই সেদিন কথা হচ্ছিল, এক রবিবার আপনাকে নিয়ে আসব। সারাদিন আমাদের কাছে থাকবেন। তা হঠাৎ আজই–তা এই রাত্তিরবেলায়– কথা শেষ না করে সে থেমে গেল।

আশু দত্ত উত্তর দেবার আগেই যুগল তড়বড় করে বলে, রাইতে আইছেন নিকি? আইছেন হেই বিকালে। আমিই কালীঘাটে গিয়া তেনার মাউসাতো ভাইয়ের বাসা থিকা লইয়া আইছি।

সুধা মোটা পশমি চাদর নিয়ে ফিরে এল। বিনয়কে সেটা দিতেই সারা গায়ে জড়িয়ে নিল সে। চাদরের উত্তাপ ধীরে ধীরে রক্তমাংসে ছড়িয়ে পড়ছে তার। আরাম বোধ করতে লাগল বিনয়।

দ্বারিক দত্ত এতক্ষণ প্রায় চুপ করেই ছিলেন। এবার বলে উঠলেন, আমি তো পার্টিশানের পরেই কলকাতায় চলে এসেছিলাম। বহুকাল পর আশুর সঙ্গে দেখা। কী ভাল যে লাগল! সেই বিকেল থেকে সারাক্ষণ খালি দেশের গল্প করছি। ওখানকার মাটির সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক ছিঁড়ে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছি। কী সোনার দেশ ছিল! কী আনন্দেই না দিন কেটেছে একসময়। সব ছবির মতো চোখের সামনে ভাসে। পার্টিশান সমস্ত কিছু ছারখার করে দিল।

হিরণ লঘু সুরে বিনয়কে বলল, সন্ধেবেলায় অফিস থেকে ফিরে দেখি রাজদিয়ার দুই গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান দেশের জন্যে চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছেন। আমিও সেই শোক-সংকীর্তনে গলা মেলাতে মেলাতে তোমার জন্যে ওয়েট করতে লাগলাম। একটু চুপ করে থাকার পর বলল, যা হবার হয়েই গেছে। যে দেশ হারিয়ে এসেছি তা আর কোনওদিনই ফিরে পাওয়া যাবে না। পুরানো দিনের কথা ভাবলে শুধুই কষ্ট। তার স্বর শেষ দিকে ভারী হয়ে আসে।

বিনয় উত্তর দিল না। যা সে জানতে চায়, জানা হয়নি। ভেতরে ভেতরে সে বিরক্ত হচ্ছিল।

এদিকে আশু দত্ত সময় সম্পর্কে হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠলেন। অনেক রাত হয়ে গেছে। এবার আমাকে ফিরতে হবে। সন্তোযরা নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে। বিনু, একটা বিষয়ে আমি মনস্থির করে ফেলেছি। তোকে সেটা জানিয়েই উঠে পড়ব।

গভীর বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে বিনয়। জিজ্ঞেস করে, বিষয়টা কী?

আশু দত্ত বলতে লাগলেন, কাল সকালে যুগলের সঙ্গে আমি মুকুন্দপুরে চলে যাচ্ছি। ভেবেছিলাম তোকেও দুচার দিনের জন্যে নিয়ে যাব। কিন্তু এখানে এসে সুধাদের কাছে শুনলাম, আজই তুই খবরের কাগজে জয়েন করেছিস। নতুন চাকরি। এখনই কি আর তোর পক্ষে ছুটি নেওয়া সম্ভব?

বিনয় বিব্রতভাবে বলল, না স্যার। অফিস থেকে আমাকে প্রচুর কাজ দেওয়া হয়েছে। একটা দিনও কামাই করা যাবে না।

আশু দত্ত বললেন, তুই সঙ্গে থাকলে অনেকখানি ভরসা পেতাম। স্কুল বসানো কি সোজা কাজ?

এমন কথা আগেও বলেছিলেন আশু দত্ত। মুখ নিচু করে চুপচাপ বসে থাকে বিনয়।

মুকুন্দপুর কলোনিতে আশু দত্ত যাবেন, সেখানে উদ্বাস্তু ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন স্কুল গড়ে তুলবেন, মোটামুটি এরকম কথা হয়েই আছে। কিছুদিন আগে বিনয় আর যুগলের সঙ্গে সেখানে গিয়ে স্কুলের জন্য জায়গাও পছন্দ করে এসেছেন। মুকুন্দপুর বাস্তুহারা কল্যাণ সমিতির খাতাতেও তার নাম উঠে গেছে। বাড়ি তৈরির জন্যও তাকে জমি দেওয়া হবে।

সবই ঠিক। তবু এই বয়সে শরীর যখন দ্রুত অচল হয়ে পড়ছে তখন নতুন স্কুল বসানোর মতো প্রচণ্ড ধকল নিতে পারবেন কি না, এই নিয়ে আশু দত্তর নিজেরই সংশয় ছিল। তাই রাতারাতি তিনি যে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেবেন, ভাবা যায়নি।

বিনয় কয়েক পলক আশু দত্তকে লক্ষ করে। তারপর ভয়ে ভয়ে বলে, একটা কথা জিজ্ঞেস করব স্যার?

কর না—

সন্তোষবাবুদের ওখানে আপনাদের কি কোনওরকম অসুবিধে হচ্ছে?

 বিনয়ের প্রশ্নটার মধ্যে একটা ইঙ্গিত রয়েছে। লহমায় সেটা ধরে ফেলেন আশু দত্ত। তার এই প্রাক্তন ছাত্রটি হয়তো জানতে চায়, এই বাজারে যখন চাল ডাল তেল মশলা আনাজপাতি মাছটাছের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে চড়ছে, দুটো মানুষ হুট করে পাকিস্তান থেকে চলে আসায় নিশ্চয়ই বিপাকে পড়েছেন সন্তোষরা। প্রথম দিকে আবেগের বশে তাদের কিছু বলেননি ওঁরা। এখন হয়তো বাড়তি খরচের চাপ সামলাতে না পেরে দুর্ব্যবহার শুরু করেছেন।

আশু দত্ত চমকে উঠে হাত-পা নাড়তে নাড়তে বলেন, না না, সন্তোষরা আমাদের মাথায় করেই রেখেছে। মাকে আর আমাকে কী যত্নই না করে! কিন্তু আমার তো বিবেক বলে একটা বস্তু আছে। সন্তোষ মুখ ফুটে কিছু বলে না। তবে বুঝতে পারি ওকে ধার কর্জ করে চালাতে হচ্ছে। আমরা থাকলে দেনা বেড়েই চলবে।

আশু দত্ত আরও জানালেন, সন্তোষের ভার লাঘব করার জন্য কম চেষ্টা করেননি। সেদিন মুকুন্দপুরে যাবার আগে কালীঘাট চেতলা টালিগঞ্জের স্কুলগুলোতে একটা চাকরির জন্য বার বার হানা দিয়ে বেড়িয়েছেন। মুকুন্দপুর থেকে ফেরার পরও সেসব জায়গায় ফের গেছেন। কিন্তু কোনও আশার সংকেত নেই।

হতাশ, ক্লান্ত আশু দত্ত মানসিক দিক থেকে ভেঙে পড়তে পড়তে কখনও যা ভাবেননি, ঠিক করলেন, তাই করবেন। পয়সার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলেমেয়ে পড়াবেন। কিন্তু প্রাইভেট টিউশনের পথও আপাতত বন্ধ। বছর শেষ হয়ে আসছে। টিউটর যা রাখার আগেই রাখা হয়ে গেছে। স্কুলে স্কুলে অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর রেজাল্ট বেরুলে নতুন বছরে প্রাইভেট টিউটরের কথা ভাবা যাবে। অভিভাবকরা তখন আশু দত্তকে দেখা করতে বলেছেন।

কিন্তু নতুন বছর পড়তে এখনও কিছুদিন দেরি। ততদিন কী করে চালাবে সন্তোষ? সে তো ধারদেনায় আরও ডুবে যাবে। হাতের কাছে বাঁচার একটা রাস্তাই খোলা রয়েছে। সেটা হল মুকুন্দপুরে চলে যাওয়া।

আশু দত্ত বলতে লাগলেন, মাঝখানে কিছুদিন তুই ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে যাসনি। সুধাদের বাড়ির ঠিকানাও জানতাম না যে নিজে এসে তোর সঙ্গে স্কুলের বিষয়ে পরামর্শ করব। খুব অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। আজ দুপুরে হঠাৎ ঘোড়ায় জিন দিয়ে শ্রীমান যুগলচন্দ্র সন্তোষের বাসায় এসে হাজির। কী ব্যাপার? না, আজই তার সঙ্গে মুকুন্দপুরে যেতে হবে। ওদের কলোনির লোকজন চাইছে, নতুন ইংরেজি সাল থেকেই স্কুল চালু করতে। তাই আগে আগেই আমার সেখানে যাওয়া চাই। মুখের কথা খসালেই তো স্কুল হয় না। তার আগে অনেক কাজ থাকে। যথেষ্ট প্রিপারেশন দরকার। তা আমি যুগলকে বললাম, বিনুর সঙ্গে দেখা না করে যাব না। যুগলও তাই চাইছিল। সন্তোষের বাসায় দুপুরের খাওয়া সেরে দুজনে এখানে চলে এলাম।

আশু দত্ত মুকুন্দপুরে গিয়ে স্কুল বসাতে রাজি হয়েছেন। যুগলকে আর কে পায়? সে যেন তার জীবনের সেরা স্বপ্নটিকে হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছে। তার উদ্দীপনা বেড়ে গেছে শতগুণ। জ্বলজ্বলে চোখে বিনয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝলেন নি ছুটোবাবু, ইট কাঠ বাশ নয়া টিন-ইস্কুল-বাড়ি বানানের লেইগা হগল জুগাড় কইরা রাখছি। মাস্টরমশয় গিয়া য্যামন য্যামন কইবেন ত্যামন ত্যামন ঘর তুইলা দিমু। অ্যাতদিনে মনে লয় (হয়), কুলোনির পুলাপানগুলান লিখাপড়া শিখ্যা মানুষ হইব।

যুগলের কথার জবাব না দিয়ে বিনয় আশু দত্তকে বলে, আপনি যে মুকুন্দপুর চলে যাবেন, সন্তোষবাবু কি জানেন?

আশু দত্ত বললেন, কলকাতায় কিছু না পেলে আমাকে যে মুকুন্দপুর চলে যেতে হবে সেটা ও বুঝতে পেরেছে। তবে কালই যে যাব, তা জানে না। যুগল দুপুরে যখন এল তখন সন্তোষ অফিসে। এখন ফিরে গিয়ে ওকে বলব।

ঠাকুমাকেও কি নিয়ে যাবেন?

ঠাকুমা, অর্থাৎ আশু দত্তর মা।

আশু দত্ত বললেন, না। এখন মা সন্তোষের কাছেই থাকবে। তারপর কিছু একটা ব্যবস্থা হলে নেবার কথা ভাবব। 

মুকুন্দপুরে তো আপনার বাড়িঘর কিছুই নেই। ওখানে গিয়ে কোথায় থাকবেন?

প্রশ্নটার জবাব দিল যুগল, আমার একখান বাড়তি ঘর আছে হেইখানে থাকতে পারেন। হরনাথদাদাও তেনার বাড়িতে থাকনের কথা কইছেন। হে এট্টা বন্দবস্ত হইয়া যাইব।

আরও দুচার কথার পর উঠে পড়লেন আশু দত্ত। তাঁর সঙ্গে যুগলও। হঠাৎ কিছু খেয়াল হতে বিনয় উঠল, এত রাতে যুগল তো মুকুন্দপুরে ফিরতে পারবে না। শিয়ালদা থেকে ওই লাইনের লাস্ট ট্রেন এতক্ষণে চলে গেছে।

হিরণ পাশ থেকে বলল, ও আমাদের এখানেই থাকতে পারে।

আশু দত্ত বললেন, আমাকে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পৌঁছে দিয়ে আবার এখানে আসবে। কাল সকালে ফের ওকে আমার কাছে যেতে হবে। এত দৌড়ঝাপের কী দরকার? একটু কষ্ট টষ্ট করে একটা রাত সন্তোষের ওখানেই না হয় থেকে যাবে। সকালে উঠেই তো মুকুন্দপুর রওনা হব।

বিনয় কঁচুমাচু মুখে বলল, স্যার, কাল সকালে আপনি যখন বেরুবেন তখন গিয়ে যে দেখা করব তার উপায় নেই। আগেই কথা হয়ে আছে, ঠিক ওই সময় অফিসের কাজে একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

না না, তোর যাবার দরকার নেই। অফিস আগে, তারপর অন্য সব। পরে সময় সুযোগ করে মুকুন্দপুরে যাস।

নিশ্চয়ই যাব স্যার। চলুন, আপনাদের ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পৌঁছে দিয়ে আসি।

কাল যেতে পারবে না। তাই আজ যতটা পারা যায়, প্রাক্তন মাস্টার মশাইটিকে সঙ্গ দেবার ইচ্ছা বিনয়ের। কিন্তু হিরণ বাধা দেয়, না না, সারাদিন অফিস করে এত ঠাণ্ডায় বাড়ি এসেছ। এই হিমে আর তোমাকে বেরুতে হবে না। আমি একটা ট্যাক্সি করে স্যারেদের দিয়ে আসি। এই রাত্তিরে রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। যে ট্যাক্সিতে যাব সেই ট্যাক্সিতেই ফিরব। মিনিট কুড়ি পঁচিশের বেশি লাগবে না।

আশু দত্তও জানালেন, বিনয়ের যাবার দরকার নেই। তবে হিরণ গেলে আপত্তি নেই। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে হিরণ, সুধা এবং বিনয়। সুধা আর বিনয় সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেবে। দ্বারিক দত্ত অবশ্য নামবেন না। বুড়ো মানুষ। সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামা করতে তার হাঁফ ধরে যায়।

নিচে নামতে নামতে বিনয় যুগলকে বলল, তুমি যে আজ মুকুন্দপুরে ফিরবে না, পাখিকে বলে এসেছ?

যুগল কী ভাবছিল। মুখ ফিরিয়ে বলল, না। কইছিলাম সন্ধ্যা তরি (নাগাদ) ফিরা যামু। আপনের লেইগাই তো দেরি হইয়া গ্যাল

পাখি খুব চিন্তা করবে।

হে তো করবই। কিন্তুক অহন আর কী করন? এত রাইতে পাখিরে খবর পাঠামু ক্যামনে? এই নিয়া ভাইবা লাভ নাই—

একতলায় এসে হিরণ আশু দত্ত আর যুগলকে নিয়ে বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে। মুহূর্তে গাঢ় কুয়াশায় তিনটি মানুষ ঝাপসা হতে হতে দূরে মিলিয়ে যায়।

সুধা ধীরে ধীরে সদর দরজা বন্ধ করে ভাইকে বলল, চল—

 দোতলায় উঠে উমাকে দিয়ে গরম জল করিয়ে বাথরুমে পাঠিয়ে দিল সুধা। বিনয়কে বলল, যা, হাত মুখ ধুয়ে, বাইরের জামাকাপড় পালটে নে। আমি খাবার গরম করতে থাকি।

মিনিট পঁচিশের ভেতর হিরণ ফিরে এল। দ্বারিক ও দুপুরে মাছ মাংস ডাল তরকারি সব খান কিন্তু রাত্তিরে স্রেফ দুখানা সুজির রুটি, নিরামিষ রকারি আর একটা সন্দেশ। হিরণের জেঠিমা সরস্বতী খান দুধ-খই। খাবারগুলো তাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে সুধারা তিনজন খেতে বসে। তাদের খাওয়া হলে উমা খায়। এটাই হল তাদের রোজ রাতের রুটিন। আজও তার হেরফের ঘটল না।

অফিসে প্রথম দিনটা বিনয়ের কেমন কেটেছে, জানার জন্য উৎসুক হয়ে ছিল হিরণ আর সুধা। কিন্তু যুগল এবং আশু দত্ত এসে পড়ায় এ নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়নি।

খেতে খেতে হিরণ জিজ্ঞেস করল, অফিস কেমন লাগল?

বিনয় বলল, খুব ভাল।

তোমার কলিগদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে?

অনেক জার্নালিস্ট। সবার সঙ্গে কি একদিনে আলাপ হওয়া সম্ভব? আমাদের রিপোর্টিং সেকশানের কয়েকজনের সঙ্গে হয়েছে।

কেমন মনে হল?

চকিতে রমেন বিশ্বাসের মুখটা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। ঈর্ষাকাতর, স্বার্থপর একটি মানুষের মুখ। রমেনের কথা বললে হিরণদের মন খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু বাকি সবাই যথেষ্ট আন্তরিক। কথায় বার্তায় চমৎকার। একটু অন্যমনস্ক হয়ে রইল সে। ভাবল সবাই তো আর দেবশিশু হয় না। যে কজনকে তার পছন্দ হয়েছে শুধু তাদের সম্বন্ধে বলল, বেশ ভদ্র, হেল্পফুল

অফিসে যাবার পর তাকে কী কী করতে হয়েছে, তার ডিউটি কটা থেকে কটা অবধি, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিল সুধা। রমেন আর লাহোরের সেই ধর্ষিতা মেয়েটা যার নাম নীলম, এই দুজনকে ছাড়া বাকি সব বলে গেল বিনয়। নীলমকে বাদ দিল, কারণ তার প্রসঙ্গ উঠলেই ঝিনুকের কথা মনে পড়ে যাবে সুধাদের। আজ সেটা চায় না সে।

.

২৭.

পরদিন সকালে সাতটার ভেতর মুখ টুখ ধুয়ে, শেভ করে, বাসি কাপড় চোপড় পালটে, চা। খেয়ে, গায়ে একটা শাল জড়িয়ে নিল বিনয়।

সুধা জিজ্জেস করল, এখনও ভাল করে রোদ ওঠেনি, কুয়াশা পুরোপুরি কাটেনি। কোথায় চললি তুই?

বিনয় বলল, কাল তোদের সবার সামনেই তো আশু স্যারকে বললাম, আজ সকালে একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাব। মনে নেই?

সুধার মনে পড়ল, হ্যাঁ, বলেছিলি।

যার কাছে যাচ্ছি তিনি আমাদের চিফ রিপোর্টার। অফিসেরই একটা দরকারে আমাকে যেতে বলেছেন।

কখন ফিরবি?

একটু ভেবে বিনয় বলল, মনে হয় দশটা সাড়ে-দশটার ভেতর চলে আসতে পারব। তারপর তো রেডি হয়ে অফিসে যাওয়া আছে।

সুধা আর কোনও প্রশ্ন করল না।

জাফর শা রোড থেকে বড় রাস্তায় আসতে হাসতে বিনয়ের চোখে পড়ল, শীতের শহর সবে আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছে। কুয়াশা পাতলা হয়ে এলেও রোদ খুব ম্যাড়মেড়ে, নিস্তেজ। হিম-  বাতাস বয়ে যাচ্ছে ধীর চালে।

খাবারের দোকান, চায়ের দোকান আর বিড়ি-সিগারেটের দোকান ছাড়া অন্য সব দোকানপাট বন্ধ। রাস্তায় লোজন কম। গাড়িটাড়ি আরও কম।

একটা ফাঁকা ট্রামে উঠে পূর্ণ সিনেমার সামনের স্টপেজে এসে নামল বিনয়। তারপর বাঁদিকের একটা গলি দিয়ে চলে এল হরিশ মুখার্জি রোডে।

কীভাবে তার মেসে যেতে হবে, প্রসাদ লাহিড়ি কাল তা নিখুঁতভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বিনয় ডানদিকের ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলল। হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে ডেকে উঠল, বিনয় বিনয়–

বিনয় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। রীতিমতো অবাক সে। এখানে কে তাকে ডাকতে পারে? এধারে ওধারে তাকাতে চোখে পড়ল, রাস্তার উলটো দিকের ফুটপাথে, কোনাকুনি একটা গলির মুখে, একজন দাঁড়িয়ে আছে। বয়স তিরিশের আশেপাশে। যুবকই বলা যায়। পরনে পাজামা এবং শার্টের ওপর র‍্যাপার জড়ানো। হাতে বাজারের থলে। মুখটা চেনা চেনা মনে হল।

চোখাচোখি হতেই যুবকটি হাত নেড়ে ডাকতে লাগল, এস–এস,

কয়েক পলক তাকিয়ে থাকার পর চিনতে পারল বিনয়। হিরণের বন্ধু আদিত্য। মাসদেড়েক আগে তরুণ সঙঘ এখানকার হরিশ পার্কে যে জলসার আয়োজন করেছিল সে ছিল তার একজন মস্ত পাণ্ডা।

রাস্তা পেরিয়ে ওপারে চলে এল বিনয়। আদিত্যর হাতের চটের থলেটা বোঝাই। টাটকা পালং মুলো পেঁয়াজকলির সতেজ সবুজ পাতা মাথা তুলে আছে। এছাড়া রয়েছে ছোট একটা মাছের ব্যাগ। বোঝাই যাচ্ছে সে বাজার করে এসেছে।

আদিত্যও বিনয়কে দেখে বেশ অবাক হল। এত সকালে তুমি আমাদের পাড়ায়!

বিনয় বলল, একটা দরকারে এসেছি। একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

কার সঙ্গে?

 বিনয় প্রসাদ লাহিড়ির নাম বলল।

আদিত্য বলে, মহেশ হালদার লেনের শান্তিনিবাস মেসে থাকেন। জার্নালিস্ট?

বিনয় জিজ্ঞেস করে, আপনি চেনেন?

আদিত্য হাসে, আমরা চার জেনারেশন এপাড়ায় আছি। ঠাকুরদা বাবা আমি–সবাই এখানে জন্মেছি। ভবানীপুরের এদিকটার নাইনটি পারসেন্ট লোককে আমি চিনি। তা প্রসাদ লাহিড়ির সঙ্গে তোমার আলাপ হল কী করে?

বিনয় নতুন ভারত-এর কথা জানালো।

তুমি তাহলে নিউজ পেপারে জয়েন করেছ? গুড।

একটু হেসে বিনয় বলল, হ্যাঁ। মহেশ হালদার লেন এখান থেকে কতদূর?

কাছেই। বাঁদিকের দুটো সরু গলি ছেড়ে যে রাস্তাটা পাবে সেটাই মহেশ হালদার লেন।

আদিত্যদা, আজ চলি। পরে আবার দেখা হবে

আদিত্য প্রায় লাফিয়ে উঠল, চলি মানে? বাড়ির দোর অবধি এসেছ। এক কাপ চা না খেয়ে। গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে। এস–এস

হাতজোড় করে বিনয় বলল, দেখতেই পাচ্ছি, বাজার করে নিয়ে এসেছেন। রান্নাবান্না হবে। খেয়ে অফিসে দৌড়বেন। এই তাড়াহুড়োর সময় আপনাদের আর ব্যস্ত করব না। পরে একদিন আসব।

পরের কথা পরে। এক কাপ চা খেতে কতক্ষণ আর লাগবে–অ্যাঁ? আদিত্য প্রায় নাছোড়বান্দা, ম্যাক্সিমাম পনেরো কুড়ি মিনিট। আজ না হয় অফিসে একটু লেটই হবে। তুমি হিরণের শালা। যখন শুনবে, বাড়িতে না নিয়ে, চা না খাইয়ে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি, আমার গর্দান চলে যাবে।

প্রচুর কাকুতি মিনতির পর রেহাই পাওয়া গেল। আসলে বিনয়ের মনটা একমুখী। যে-চিন্তা একবার মাথায় চেপে বসে তার বাইরে আর কিছু ভাবতে চায় না। আজ সকালে প্রসাদ লাহিড়ি দেখা করতে বলেছেন। প্রথমে সেটাই করবে সে। তারপর অন্য কিছু।

আদিত্য বলল, ফাংসানের দিন আমার বউ সবিতা তোমাদের আসার জন্যে বার বার বলেছিল। আমিও বলেছি। আসোনি কিন্তু।

বিনয় জানালো, মাঝখানে বেশ কিছুদিন চাকরির জন্য ছোটাছুটি ছাড়াও নানা সংকটে এতই জড়িয়ে পড়েছিল যে আদিত্যদের বাড়িতে আসার মতো সময় করে উঠতে পারেনি। তবে এবার আসবে, নিশ্চয়ই আসবে।

যে-গলির মুখে দাঁড়িয়ে দুজনে কথা বলছিল সেটার ভেতর দিকে ডান ধারের তিনটে বাড়ির পর একখানা সেকেলে ধাঁচের হলুদ রঙের তেতলা বিল্ডিং দেখিয়ে আদিত্য বলল, ওটা আমাদের বাড়ি। সুধা আর হিরণকে সঙ্গে নিয়ে এস। জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে

আচ্ছা।

 বিনয় যাবার জন্য সবে পা বাড়িয়েছে, আদিত্য ব্যস্তভাবে বলে উঠল, ভাল কথা, সেই মেয়েটির খবর কী? ওই যাকে তুমি পাকিস্তান থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলে?

বিনয়ের বুকের ভেতরটা আমূল কেঁপে যায়। আদিত্য কোন মেয়েটির কথা বলল তা কী আর বুঝতে বাকি আছে? ঝাপসা গলায় সে কী জবাব দেয়, নিজের কাছেই তা স্পষ্ট নয়।

আদিত্য কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ঠিকই, কিন্তু বিনয়কে সেভাবে লক্ষ করেনি। করলে দেখতে পেত, পাকিস্তানের মেয়েটির কথা উঠতেই কত দ্রুত তার মুখ কষ্টে ভেঙেচুরে কতটা বদলে গেছে। আদিত্য নির্ঘাত হতভম্ব হয়ে যেত।

আদিত্য বলল, ঠিক আছে ভাই, তুমি প্রসাদবাবুর সঙ্গে গিয়ে দেখা করো। আমাদের বাড়ি চিনিয়ে দিলাম। যেদিন আসবে সেই মেয়েটিকেওকী যেন নাম, হ্যাঁ ঝিনুক–নিয়ে এস- বলে সে তাদের গলির দিকে এগিয়ে গেল।

বিনয় আচ্ছন্নের মতো সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। ঝিনুক কবেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কিন্তু তাকে ভুলে যাবে, সাধ্য কী বিনয়ের? তার গোটা সৌরলোক জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েটা।

.

২৮.

 মহেশ হালদার লেনটা খুব চওড়া নয়। বড়জোর কুড়ি বাইশ ফিট। পাক খেতে খেতে আদি গঙ্গার দিকে চলে গেছে।

এক নজরেই টের পাওয়া যায়, এলাকাটা খুবই পুরানো। দুধারে মলিন চেহারার দালান কোঠা। সাদামাঠা। ছিরিছাঁদহীন। বেশির ভাগেরই ছালচামড়া খসে হাড়গোড় বেরিয়ে পড়েছে। তাছাড়া গা জড়াজড়ি করে রয়েছে প্রচুর টিন বা টালির ঘর। আছে খোলার চালের চাপবাঁধা বস্তি। আছে সস্তা চায়ের দোকান, মুদিখানা, ডাক্তারখানা, লন্ড্রি, হরেকরকমবা মনিহারি দোকান, তেলেভাজার দোকান, মুড়ি মুড়কি চিড়ে বাতাসার দোকান, ইত্যাদি। ফুটপাথ নেই, রাস্তার ধার ঘেঁষে ল্যাম্পপোস্টগুলো ঘাড় ঝুঁকিয়ে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলোর মাথা থেকে ঝুলছে একটা করে বাস্তু।

মহেশ হালদার লেনে ঢুকে কয়েক পা এগুতেই বিনয়ের মনে হল, আদ্যিকালের কলকাতায় চলে এসেছে। এখানকার সব কিছুতেই প্রাচীনত্বের ছাপ মারা। চার দিক থেকে উঠে আসছে পুরানো সোঁদা গন্ধ।

পাকিস্তান থেকে চলে আসার পর ঝিনুক যখন নিখোঁজ হয়ে গেল, তার খোঁজে উভ্রান্তের মতো প্রায় সারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছে বিনয়। এ-রাস্তা, সে-রাস্তা, এ-গলি, সে-গলি, এ-পাড়া, সে-পাড়া এমন কোনও এলাকা নেই যেখানে সে হানা দেয়নি। কদিনই বা সে কলকাতায় এসেছে। এর মধ্যেই এই বিশাল মেট্রোপলিসের নাড়িনক্ষত্র অনেকটাই জানা হয়ে গেছে।

তবু কলকাতার কত রহস্যই যে জানতে বাকি। কোনও এলাকা ঝকঝকে নতুন। চোখ একেবারে ধাঁধিয়ে যায়। আবার কোথাও এক শদেড় শ বছর আগের সময়, অনড় দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারা, তার গন্ধ, তার ঠাট, তার জীবনযাপনের চাল–সমস্ত কিছু হুবহু সেকালের মতো। এতটুকু হেরফের না ঘটিয়ে কলকাতার আদিকালটাকে অবিকল বজায় রেখেছে। লেশমাত্র পরিবর্তন নেই। যেমন এই মহেশ হালদার লেন।

এখানে বেশির ভাগ বাড়িরই সদর দরজার মাথায় কি পাশের দেওয়ালে বাড়ির নম্বর লেখা আছে। সেগুলো দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছিল বিনয়। খানিক আগে ঝিনুকের জন্য বুকের ভেতরটা উতরোল হয়ে উঠেছিল; সেটা অনেকখানি শান্ত হয়ে এসেছে।

মিনিট তিন-চার হাঁটার পর তেইশ নম্বর বাড়িটা পাওয়া গেল। বেঢপ চেহারার মস্ত তেতলা। ছাদেও দুখানা ঘর চোখে পড়ে। সে-দুটোর মাথায় অ্যাসবেস্টসের চাল।

বাড়িটার দেওয়াল থেকে জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে। ছাদের কার্নিসও পুরোটা অটুট নেই। জং-ধরা রেনওয়াটার পাইপে বেশ কটা বড় গর্ত।

খোলা দরজার মাথায় সাইন বোর্ডে লেখা : শান্তিনিবাস। প্রতিষ্ঠা : বাং সন ১৩০২। বহু বছর রোদে পুড়ে জলে ধুয়ে রং ফিকে হয়ে গেলেও লেখাগুলো পড়া যায়।

বাড়িটা ভাল করে এবার লক্ষ করল বিনয়। একতলা বাদ দিয়ে দোতলা এবং তেতলায় রাস্তার দিকে রেলিং-বসানো টানা বারান্দা। বারান্দার গা ঘেঁষে সারি সারি ঘর। সেগুলোর দরজা জানালা খোলা। কয়েকজনকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করতে দেখা যাচ্ছে। খুব সম্ভব ওরা এই মেসের বোর্ডার।

কখন কুয়াশা পুরোপুরি কেটে গেছে, খেয়াল নেই বিনয়ের। পুবদিকে উঁচুনিচু বাড়িগুলোর ছাদ টপকে সূর্য মাথা তুলতে শুরু করেছে। শীতের সোনালি রোদ ছড়িয়ে যাচ্ছে মহেশ হালদার লেনে।

বিনয় আর দাঁড়াল না। শান্তিনিবাস-এর ভেতর চলে এল। ঢুকেই একটা প্যাসেজের ডানপাশে। একখানা মাঝারি ঘর। কাঠের ভারী ভারী টেবল চেয়ার আলমারি দিয়ে সাজানো। সেখানে রোঁয়াওলা, পুরু আলোয়ান জড়িয়ে মাঝবয়সী একটি লোক টেবলের ওপর হুমড়ি খেয়ে মস্ত খাতায় কী সব লেখালেখি করছিল। মাথাজোড়া বিশাল টাক। চোখে নিকেলের গোল চশমা।

কলকাতার মেস সম্পর্কে বিশেষ কোনও ধারণা নেই বিনয়ের। যেটুকু জানে সবই বাংলা উপন্যাস আর গল্পটল্প পড়ে। অবশ্য রাজদিয়া এবং তার আশেপাশের গ্রামগুলোর কিছু লোকজন কলকাতার মেসে থেকে চাকরি বাকরি করত। পুজোর লম্বা ছুটি পড়লে দেশে এসে পনেরো বিশ দিন কাটিয়ে যেত। তাদের মুখে মেসের কিছু কিছু গল্প শুনেছে সে।

বিনয়ের মনে হল, ওই লোকটা শান্তিনিবাস-এর ম্যানেজার কিংবা মালিক। তবে তা না-ও হতে পারে। খানিক ইতস্তত করে সে বলল, একটু শুনবেন?

লোকটি টেবল থেকে মুখ তুলে তাকাল। বলুন

আমি প্রসাদ লাহিড়ির সঙ্গে দেখা করব। কোন ঘরে উনি থাকেন?

লোকটি বুঝিয়ে দিল। যে প্যাসেজে বিনয় দাঁড়িয়ে আছে সেটা ধরে কপা এগুলেই লম্বা বারান্দা। বাঁধারে, বারান্দাটার শেষ মাথায় ওপরে ওঠার সিঁড়ি। তেতলায় গিয়ে বাঁ দিকের কোণের ঘরখানা প্রসাদ লাহিড়ির।

কথা শেষ করে ফের খাতার ওপর ঝুঁকে পড়ল লোকটি। তার কথামতো ভেতরে যেতেই একটা চৌকো, বড় চাতাল চোখে পড়ল বিনয়ের। সেটার একধারে দুটো বড় বড় চৌবাচ্চা। জলে বোঝাই। চৌবাচ্চার পাশে কর্পোরেশনের দুটো জলের কল। তার একটা গঙ্গাজলের, আরেকটা টালার জলের। চাতালটা ভীষণ সঁতসেঁতে। এখানে ওখানে শ্যাওলা জমে আছে। বহুকাল ওটা সাফ টাফ করা হয়নি।

চাতালটার তিন দিক ঘিরে চওড়া, উঁচু বারান্দা। আর-একদিকে রান্নাঘর। উনুন ধরানো হয়েছিল। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে গল গল করে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে।

বারান্দার একধারে চাতাল। অন্য ধারে ঘরের পর ঘর। সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বিনয় লক্ষ করল, প্রতিটি ঘরেই আলাদা আলাদা তক্তপোশে দুটো বা তিনটে করে বিছানা। তার মানে এক-এক ঘরে দুই বা তিনজন বোর্ডার।

সারা মেস-বাড়ির ঘুম ভেঙে গেছে। বোর্ডারদের কেউ বিছানায় বসেই দাঁতন করছে, কেউ খবরের কাগজ পড়ছে। কারও হাতে চায়ের কাপ। কোনও ঘরে রেডিওতে গান বাজছে।

সিঁড়ি ভেঙে দোতলা পেরিয়ে তেতলায় উঠে এল বিনয়। প্রতিটি ফ্লোরেরই নকশা একরকম। বারান্দা ঘিরে সারিবদ্ধ ঘর। প্রতিটি ঘরে একই দৃশ্য। বোর্ডারদের চা খাওয়া, খবরের কাগজ পড়া, ইত্যাদি। এই মুহূর্তে কারও কোনও তাড়া নেই। শীতের সকালটা সবাই আয়েশ করে কাটিয়ে দিচ্ছে।

তেতলার বাঁ পাশের শেষ ঘরখানার সামনে চলে আসে বিনয়। দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে একটা ক্যাম্বিসের ইজিচেয়ারে বসে কী যেন করছেন প্রসাদ। তার কাছাকাছি কোত্থেকে যেন চাপা সাঁ সাঁ আওয়াজ হচ্ছে। শব্দটা কীসের ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

প্রসাদের মুখ উলটো দিকে ফেরানো। বিনয় রয়েছে তার পেছনের বারান্দায়। তাই তাকে তিনি দেখতে পাননি।

বিনয় খুব আস্তে ডাকল, প্রসাদদা–।

প্রসাদ শুনতে পেয়েছিলেন। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। ও, তুমি। ভেতরে এস–

চটি খুলে বারান্দায় রেখে বিনয় ঘরে ঢুকে পড়ল। মেসের অন্য সব ঘর যেটুকু চোখে পড়েছে। তার থেকে এটা আলাদা কিছু নয়। নেহাতই সাদামাঠা। সাজসজ্জার বালাই নেই। একটা দেওয়ালের গায়ে কাঠের অনেকগুলো র‍্যাক। সেগুলো বইয়ে ঠাসা। এছাড়া সিঙ্গল-বেড খাটে বিছানা, কাঠের একটি আলমারি, পড়াশোনার জন্য টেবল চেয়ার, টেবলে ফেবার-লিউবা কোম্পানির টেবল ক্লক, টেলিফোন, আরাম করার জন্য ইজিচেয়ার ইত্যাদি ছাড়াও গদি-বসানো কটা বেতের মোড়া। একটা মাত্র বিছানা দেখে বিনয়ের মনে হল, পুরো ঘরখানা নিয়ে একাই থাকেন প্রসাদ। অন্য কোনও ভাগীদার নেই।

পেছন দিকের মতো ঘরটার সামনেও রাস্তার দিকে বারান্দা। ওধারের দরজা জানালাও খোলা রয়েছে। তার ফাঁক দিয়ে ঝলমলে রোদ এসে পড়েছে ঘরের ভেতর।

বিনয় লক্ষ করল, প্রসাদের হাতে একটা লম্বা ছুরি। তার ইজিচেয়ারের সামনে একটা বড়সড় নিচু টেবল। টেবলটার ওপর একধারে পাউরুটির টুকরোর স্থপ। তা ছাড়া দুটো এক পাউন্ড ওজনের রুটি এখনও আস্ত রয়েছে। পেছন থেকে দেখা যায়নি, এখন বোঝা গেল, তিনি রুটি কাটছিলেন। সাঁ সাঁ আওয়াজের কারণটাও জানা গেল। নিচু টেবলটার কাছেই একটা কেরোসিনের স্টোভ জ্বলছে। তবে সেটার তেজ কমিয়ে রাখা হয়েছে। স্টোভটার মাথায় একটা পলসন বাটারের মুখ কাটা কৌটো বসানো। শীতে মাখন জমে শক্ত হয়ে গিয়েছিল। আগুনের তাপে অল্প অল্প গলতে শুরু করেছে।

ঘরের একধারে কটা মোড়া পর পর দাঁড় করিয়ে রাখা আছে। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে প্রসাদ বললেন, একটা মোড়া এনে আমার কাছে বোসা।

এই পাহাড়প্রমাণ পাউরুটি দিয়ে প্রসাদ কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিল না বিনয়। অবাক চোখে তাকে দেখতে দেখতে একটা মোড়া নিয়ে এসে বসে পড়ল সে।

রুটি কাটা চলছেই প্রসাদের। প্রতিটি স্লাইস ইঞ্চি খানেকের মতো পুরু। কাটতে কাটতে এক পলক পড়ার টেবলের ঘড়িটা দেখে নিয়ে বললেন, তোমার সাড়ে-আটটা পৌনে নটায় আসার কথা ছিল। এখন সবে আটটা বেজে সাত। এত আগে না এলেই হতো।

বিনয় থতমত খেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি চলে আসায় প্রসাদ বিরক্ত হয়েছেন কি না, বোঝা যাচ্ছে না। ভয়ে ভয়ে সে বলল, আমি আর্লি-রাইজার। সাড়ে-পাঁচটা ছটার ভেতর ঘুম ভেঙে যায়। ভাবলাম, বাড়িতে বসে থেকে কী করব? তাই চলে এলাম। একটু থেমে ফের বলে, আপনার হয়তো অসুবিধে হল–

মাথা নাড়তে নাড়তে প্রসাদ বললেন, একেবারেই না। শীতের দিনে সকাল সকাল উঠে এতটা আসতে কষ্ট হবে, তাই একটু দেরি করে আসতে বলেছিলাম। সে যাক, আগে আগে এসেছ। ভালই হয়েছে। খানিকক্ষণ বেশি গল্প করা যাবে।

প্রসাদ অসন্তুষ্ট হননি। অস্বস্তি কেটে গেল বিনয়ের। প্রসাদ বলতে লাগলেন, কাল রাতে অফিস থেকে ফিরে কলকাতার চারপাশের রিফিউজি কলোনি আর রিলিফ ক্যাম্পের অ্যাড্রেস–যতগুলো আমার কাছে রয়েছে–সব একটা কাগজে তোমার জন্যে লিখে রেখেছি। হাতের কাজটা সেরে তোমাকে সেটা দিচ্ছি। তা আমাকে একটু হেল্প কর না। তাহলে কাজটা কুইকলি হয়ে যাবে।

বিনয় বলল, কী করতে হবে বলুন

টেবলের ওপর শুধু পাউরুটিই না, একটা বড় টিনের কৌটো এবং আরও একটা ছুরি রয়েছে। ছুরিটা বিনয়কে দিয়ে, কৌটোটা দেখিয়ে প্রসাদ বললেন, এটার ভেতর চিনি আছে। স্টোভের আঁচে মাখন গলে গেছে। তুমি রুটির স্লাইসগুলোতে ছুরি দিয়ে মাখন লাগিয়ে তার ওপর চিনি ছড়িয়ে দাও

প্রসাদ লাহিড়ি মানুষটাকে অদ্ভুত লাগছিল। এইসব মাখন রুটির সদ্গতি কীভাবে হবে, কে জানে। রুটিতে মাখন মাখাতে মাখাতে এবং সেগুলোর ওপর চিনি ছড়াতে ছড়াতে নিজের অজান্তেই ফস করে বিনয় জিজ্ঞেস করল, এত রুটি কে খাবে?

প্রসাদ বললেন, আমার পাওনাদারেরা।

পাওনাদার!

 হ্যাঁ। একটু ওয়েট কর। দশ পনেরো মিনিটের ভেতর তারা চলে আসবে।

বিনয় তাকিয়ে থাকে।

প্রসাদ থামেননি, নিউট্রিশনের জন্যে মাখনটা খুব দরকার, তাই না?

 নতুন ভারত-এর এই চিফ রিপোর্টারটির কথাবার্তার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কার তার পাওনাদার, কাদের নিউট্রিশন দরকার, কে বলবে। সবই ধাঁধার মতো। বিনয় আস্তে আস্তে ঘাড়টা কাত করে শুধু।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। দুজনের হাত ত্বরিত গতিতে চলছে।

একসময় প্রসাদ বললেন, তুমি কিছুদিন হল পাকিস্তান থেকে চলে এসেছ। টালিগঞ্জে এক দিদির কাছে থাক। আর কে কে আছেন তোমার?

বিনয় আন্দাজ করে নিল, তার সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে চান প্রসাদ। ঝিনুককে বাদ দিয়ে বাকি সবার কথা বলে গেল সে।

প্রসাদ বিষণ্ণ সুরে বললেন পাকিস্তান থেকে চলে এসে ভাল করেছ। তোমার দাদুকেও খবর পাঠাও, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন ইন্ডিয়ায় চলে আসেন।

অনেক বুঝিয়েছি। লোক দিয়ে চিঠিও পাঠিয়েছি। তিনি আসবেন না।

আবার নীরবতা।

শান্তিনিবাস-এর বাসিন্দা সাংবাদিকটি সম্পর্কে ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল বিনয়ের। সে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব প্রসাদদা?

নির্ভয়ে।

আপনি এই মেসে কতদিন আছেন?

অ্যাবাউট টোয়েন্টি ইয়ার্স।

 চোখ গোল হয়ে যায় বিনয়ের। কুড়ি বছর!

 প্রসাদ হাসলেন।

বিনয় বলল, আপনার বাড়ির আর সবাই?

কেউ নেই আমার। রাজশাহী ডিস্ট্রিক্টে আমাদের দেশ ছিল। এখন পাকিস্তান। আমি নাইনটিন টোয়েন্টিতে কলকাতায় চলে আসি। লেখাপড়া, চাকরি, সব এখানে। শুরু থেকে মেসেই আছি। এক মেস থেকে আর-এক মেস। এইভাবে সাত আটবার আস্তানা পালটে শেষ পর্যন্ত শান্তিনিবাস-এর পার্মানেন্ট বোর্ডার। মা-বাবা দেশে থাকতেন। পার্টিশানের আগে মারা গেছেন। আমাকে মুক্ত-পুরুষ বলতে পার। রাজশাহী পাকিস্তানে পড়লেও আমি তোমাদের মতো রিফিউজি নই। বয়স পঞ্চাশ হতে চলল। বাকি দিনগুলো এই মেসেই কেটে যাবে।

প্রসাদের কথা শেষ হতে না-হতেই ভেতর দিকের বারান্দায় দুদ্দাড় পায়ের আওয়াজ। পরক্ষণে দরজার কাছে এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের মুখ দেখা দিল। বয়স সাত-আট থেকে এগারো-বারো। ঘুরে বসে প্রসাদ হাসতে হাসতে বললেন, এরাই হল আমার পাওনাদার–

বিনয় গুনে গুনে দেখল সবসুদ্ধ তেরোটি ছেলেমেয়ে। বোগা নোগা চেহারা। গর্তে-বসা চোখ। শুকনো, ফাটা ফাটা চামড়া থেকে খড়ি উড়ছে। সারা গায়ে অপুষ্টির ছাপ। আচ্ছাদন বলতে ময়লা, তালিমারা ইজের আর ছিটের জামার ওপর ছেঁড়াখোঁড়া সোয়েটার বা চাদর। কারও চাদর টাদর কিছুই জোটেনি। দুহাতে বুক চেপে ধরে শীতে কাঁপছে।

ছেলেমেয়েগুলো সমানে কলবল করে চলেছে, আমরা আইয়া গ্যাছি, আমরা আইয়া গ্যাছি।

 প্রসাদ হেসে হেসে বললেন, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। একজন একজন করে এসে নিয়ে যা।

এতটুকু হুড়োহুড়ি নেই। প্রসাদ যেমনটি বললেন ঠিক তেমনি সুশৃঙ্খলভাবে এক এক করে ছেলেমেয়েগুলো ঘরে ঢুকে তার হাত থেকে দুপিস করে চিনি আর মাখন লাগানো রুটি নিয়ে ফের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে লাগল। রুটি বিলি শেষ হলে তিনি ওদের জিজ্ঞেস করলেন, আসার সময় দুলাল আর হারুকে তোরা দেখেছিস?

দরজার মুখ থেকে ছেলেমেয়েগুলো সমস্বরে জানালো, দেখেনি।

প্রসাদ বললেন, এখন যা। ওদের খুঁজে বার করে বলবি, আমি ডেকেছি। এক্ষুনি যেন চলে আসে।

আইচ্ছা—

 নিমেষে দরজার কাছ থেকে বাচ্চাগুলো উধাও। তাদের পায়ের আওয়াজ সামনের বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচে মিলিয়ে যেতে লাগল।

প্রসাদের কার্যধারার তল খুঁজে পাচ্ছিল না বিনয়। এতক্ষণ অপার বিস্ময়ে সে তাকে দেখে যাচ্ছিল। এবার জিজ্ঞেস করল, ওই ছেলেমেয়েগুলো কারা? মনে হল ইষ্ট বেঙ্গলে ওদের বাড়ি ছিল—

হ্যাঁ– প্রসাদ মাথা নাড়লেন, ওরা রিফিউজি। রিসেন্টলি পাকিস্তান থেকে এসেছে। এই পাড়ারই। বস্তি টাইপের বাড়িতে থাকে।

বিনয়ের মনে পড়ল, খানিকক্ষণ আগে পাউরুটি কাটতে কাটতে নিউট্রিশনের কথা বলছিলেন প্রসাদ। খুব সম্ভব তাঁর মাথায় এই বাচ্চাগুলোর চিন্তাই ঘুরছিল। সে বলল, রোজই ওরা এসে রুটি নিয়ে যায়?

বেশির ভাগ দিনই। তবে রোজ এক খাবার কি ভাল লাগে? মাঝে মাঝে বদলে দিই। কোনও দিন হয়তো দিলাম মুড়ি মুড়কি কি চিড়ে গুড়।

– একটু চুপচাপ।

তারপর প্রসাদ ফের শুরু করেন, ওরা কেউ এসেছে খুলনা থেকে, কেউ বরিশাল থেকে, কেউ ঢাকা কিংবা ফরিদপুর থেকে। ওদের বাবা-মায়েরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে শিয়ালদা স্টেশনে পড়ে থাকেনি, রিলিফ ক্যাম্পে গিয়ে ভিড় বাড়ায়নি। দেশ থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু পয়সাকড়ি আনতে পেরেছিল। তার কিছুটা দিয়ে এখানকার বস্তিতে ঘরভাড়া নিয়েছে। বাকিটা দিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা বা অন্য কিছু করে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। গভর্নমেন্টের খয়রাতির আশায় ভিখিরির মতো বসে থাকার এতটুকু ইচ্ছে নেই। ওদের আত্মসম্মান বোধ আর ফাইটিং স্পিরিটকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু প্রসাদ বিশদভাবে আরও জানালেন, এখন যা রোজগার করে তাতে দুবেলা পেট ভরে বউ-বাচ্চাদের খাওয়াতে পারে না। তাই ওই ছেলেমেয়ে কটার সকালের খাবার আমি দিই।

কাল এই মানুষটিকে নতুন ভারত-এর অফিসে গম্ভীর আর স্বল্পভাষী মনে হয়েছিল। খবরের কাগজের কাজকর্মের বাইরে একটি কথাও বলেননি। নতুন ভারত বেরুবার পর কীভাবে তার সার্কুলেশন বাড়ানো যাবে, পাঠক টানতে কোন কোন বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হবে, এই নিয়েই মগ্ন ছিলেন। কিন্তু আজ অন্য এক প্রসাদ লাহিড়িকে দেখতে পেল বিনয়। কোমল। সহৃদয়। মমতাময়। একই মানুষের ভেতর গোপনে কতরকম মানুষ যে থাকে! খুব কাছাকাছি না এলে টেরই পাওয়া। যায় না।  

প্রসাদ লাহিড়ি মলিন মুখে বলতে লাগলেন, এই পাড়াতেই আরও অনেক রিফিউজি ছেলেমেয়ে রয়েছে। সবার জন্যে তো খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি না। আমার আর কতটুকু ক্ষমতা! হঠাৎ কী খেয়াল হতে ধড়মড় করে ইজিচেয়ার থেকে উঠে পড়লেন, ওই দেখ, এতক্ষণ এসেছ। এখনও চাটা কিছু দেওয়া হয়নি।

বিনয় বিব্রতভাবে কী বলতে যাচ্ছিল, বলা হল না। ততক্ষণে ভেতর দিকের বারান্দায় চলে গেছেন প্রসাদ। গলা চড়িয়ে ডাকতে লাগলেন, সুবল-সুবল–একতলা থেকে সাড়া দিতেই তাকে চেঁচিয়ে বললেন, গৌরাঙ্গ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে আটখানা লুচি, ছোলার ডাল আর চারটে নলেন গুড়ের সন্দেশ নিয়ে আয়। ঠাণ্ডা লুচি থাকলে নিবি না। গরম গরম ভাজিয়ে আনবি। আসার সময় শোভা কাফেতে বলবি দুগেলাস স্পেশাল চা যেন দিয়ে যায়। দুজায়গায় আমার নামে খাতায় লিখে রাখতে বলিস। চটপট চলে আসবি। বাইরে গিয়ে আবার আড্ডায় জমে যেও না।

খাতায় লিখে রাখার ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল না বিনয়ের।

আপ্যায়নের বন্দোবস্ত করে ঘরে ফিরে এলেন প্রসাদ। লেখার টেবলের ওপর ভাজকরা এক তা ফুলস্ক্যাপ কাগজ পেপার ওয়েট চাপা দেওয়া ছিল। সেটা এনে বিনয়ের হাতে দিয়ে ইজিচেয়ারে বসে পড়তে পড়তে বললেন, এটায় কলকাতার কাছাকাছি নটা রিফিউজি কলোনি আর পাঁচটা সরকারি রিলিফ ক্যাম্পের ঠিকানা রয়েছে। আপাতত এগুলো দিয়েই কাজ শুরু কর। পরে আরও লিস্ট দেব। তাতে দূরের ক্যাম্প ট্যাম্পের অ্যাড্রেস থাকবে। তাছাড়া

উৎসুক চোখে প্রসাদের দিকে তাকায় বিনয়। তাছাড়া কী?

এখন ফাঁকা পোড়ো জমি, জলা জায়গা টায়গা পেলেই রিফিউজিরা বসে পড়ছে। নতুন নতুন এত জবরদখল কলোনি মাথা তুলছে যে সবগুলোর হদিস পাওয়া মুশকিল। তোমাকে তত চারদিকে ঘোরাঘুরি করতে হবে। নতুনগুলোর খোঁজ নিও

আচ্ছা ।

কথা বলতে বলতে প্রসাদের দেওয়া কাগজটার ভাজ খুলে চোখ বুলোতে থাকে বিনয়। দেশ নেতাদের নামে কলোনিগুলোর নাম। নেতাজি সুভাষ কলোনি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কলোনি। মহাত্মা গান্ধি কলোনি ইত্যাদি। সরকারি ত্রাণশিবিরগুলোর কোনও নাম নেই। তবে সেগুলোর ঠিকানা কলকাতার আশেপাশে।

প্রসাদ বললেন, তুমি কি জানো, সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারের সময় কলকাতা আমেরিকান আর ব্রিটিশ টমিতে ছেয়ে গিয়েছিল?

শুনেছি।

সিটিতে তো বটেই, আউটস্কার্টে মিলিটারি থাকার জন্যে অনেক ব্যারাক তৈরি করা হয়েছিল। যুদ্ধ থামলে টমিরা যে-যার দেশে ফিরে যায়। তারপর বেশির ভাগ ব্যারাক ভেঙে ফেলা হয়। যে কটা আস্ত রয়েছে এখন রিফিউজিদের রিলিফ ক্যাম্প।

বিনয় বলল, আপনি ক্যাম্পগুলোর যে অ্যাড্রেস দিয়েছেন তার মধ্যে ঢাকুরিয়া লেকের একটা ব্যারাকও রয়েছে। কিন্তু

কী?

আমি ওই লেকে একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম। একটা ভাঙাচোরা ব্যারাকও দেখেছি। সেটা রিলিফ ক্যাম্প নয়। কোনও রিফিউজিও চোখে পড়েনি। একদম ফাঁকা।

তুমি যে ব্যারাকটার কথা বললে সেটা বাচ্চাদের সুইমিং পুলের কাছাকাছি তো?

আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়, হ্যাঁ

প্রসাদ বললেন, ওটা ছাড়াও আরও একটা ব্যারাক আছে। সেটা ভাঙা হয়নি। ওখানে ক্যাম্প বসানো হয়েছে। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সাদার্ন অ্যাভেনিউতে একটা হাসপাতাল দেখেছ?

বিনয় জানে, যুদ্ধের সময় শুধুমাত্র মিলিটারির জন্য ওই হাসপাতালটা করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর অবশ্য সবার জন্য ওটা খুলে দেওয়া হয়। মুকুন্দপুর থেকে এসে যুগল ওখানে পা ড্রেস করিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন আগে হিরণদের সঙ্গে সে লেকে বেড়াতে গিয়েছিল, হাসপাতালটা তখন তার চোখে পড়েছে।

বিনয় বলল, দেখেছি।

প্রসাদ বললেন, আমি যে ব্যারাকটার কথা বলছি সেটা হাসপাতালটার উলটো দিকে, একটু কোনাকুনি, লেকের ভেতরে। চারপাশে এত গাছপালা যে হঠাৎ চোখে পড়ে না।

বিনয় ভাবল, প্রসাদের কথাই হয়তো ঠিক। সেদিন লেকে প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছিল কিন্তু রিলিফ ক্যাম্পটা তার নজর এড়িয়ে গেছে।

প্রসাদ বললেন, আমার লিস্টটায় দেখ, লেকের কাছাকাছি আরও কটা রিলিফ ক্যাম্পের অ্যাড্রেস আছে। লেকের ক্যাম্পটায় গিয়ে জিজ্ঞেস করলে তারা নিশ্চয়ই অন্যগুলো দেখিয়ে দেবে।

একটা ঢ্যাঙা মতো ছেলে ঘরে এসে ঢুকল। বয়স ষোল সতেরো। সবে কৈশোর পেরিয়েছে। ঠোঁটে খুব মিহি গোঁফের রেখা। মুখেচোখে সারল্য মাখানো। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল। পরনে আধময়লা পাজামা, ছিটের হাফ শার্ট। শার্টের ওপর সস্তা আলোয়ান। পায়ে পুরানো, খেলো চটি। ছেলেটার একটা হাতে শালপাতার বড় ঠোঙা, মাটির ভাঁড়। আর-এক হাতে কাগজের চৌকো একটা বাক্স।

বিনয় আন্দাজ করে নিল–সুবল।

প্ৰসাদ এক পলক সুবলকে দেখে বললেন, এসে গেছিস? ভেরি গুড। এক কাজ কর, ওখান থেকে কাপ আর গেলাস এনে ভাল করে ধুয়ে লুচি টুচি আর খাবার জল আমাদের দুজনকে দে বলে ঘরের কোণের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন। সেখানে একটা নিচু জলচৌকির ওপর কয়েকটা কাপ প্লেট আর কাঁচের গেলাস রয়েছে।

হাতের ঠোঙা, ভাড়টাড় লেখার টেবলে রেখে প্লেট গেলাস নিয়ে বেরিয়ে গেল সুবল। সেগুলো পরিষ্কার করে ধুয়ে এনে চটপট খাদ্যবস্তুগুলো দুভাগ করে বিনয় এবং প্রসাদকে দিয়ে, জিজ্ঞেস করল, আর কিছু করন লাগব?

না। নিজের প্লেট থেকে দুটো লুচি, খানিকটা ডাল এবং একটা সন্দেশ সুবলের হাতে দিয়ে প্রসাদ বললেন, যা–

মাথা নিচু করে সুবল বলল, যহনই কিছু আনি আমারে হেইর থিকা দ্যান

প্রসাদ ধমকে ওঠেন, পাকামি করতে হবে না। যাও

সুবল নিঃশব্দে চলে গেল।

বিনয় বলল, কথা শুনে মনে হল সুবল ইস্ট বেঙ্গলের ছেলে

হ্যাঁ। রিফিউজি। কয়েক মাস হল পাকিস্তান থেকে চলে এসেছে। প্রসাদ বলতে লাগলেন, ভাল ফ্যামিলির ছেলে। ব্রাহ্মণ। ফরিদপুরে বাড়ি। বেশ কিছু জমিজমা ছিল। ফর্টি সিক্সের রায়টে ওর বাবা খুন হয়ে যায়। তারপরও দেশেই মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছে। একসময় আর পারল না। সর্বস্ব ফেলে মা আর বোনকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে আসতে হল। লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু টাকা আনতে পেরেছিল। শিয়ালদা স্টেশনে দিন পনেরো কাটিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে চারদিকে খোঁজাখুঁজি করে শেষ পর্যন্ত আমাদের পাড়ার এক বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে উঠে এসেছে। বাঁচতে তো হবে। তাই ছেলেটা এই মেসের চাকরগিরি করছে। কী হতে পারত আর কী হয়ে গেল! এরকম হাজার হাজার ইয়ং বয় তুমি দেখতে পাবে, পার্টিশান তাদের ফিউচার ধ্বংস করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ নিঝুম বসে রইলেন তিনি। তারপর হঠাৎ ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, এ কি, হাত গুটিয়ে বসে আছ যে? খাও–খাও-লুচি ঠাণ্ডা হলে জুতোর চামড়া হয়ে যায়।

খেতে খেতে কয়েক দিন আগের একটা পুরানো ভাবনা আচমকা বিনয়ের মাথায় ফিরে এল। সে ঠিক করে রেখেছিল, চাকরি বাকরি কিছু একটা হলে আর সুধাদের কাছে থাকবে না। অন্য কোথাও নিজের ব্যবস্থা করে নেবে। বিনয় জানে, এই কথাটা তার মুখ থেকে খসার সঙ্গে সঙ্গে হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে যাবে। হিরণ, দ্বারিক দত্ত বা সরস্বতী, কেউ রাজি হবেন না। বরং শতভাবে তাকে নিজেদের কাছে ধরে রাখতে চেষ্টা করবেন। আর সুধা তো কেঁদে কেটে জগৎ সংসার ভাসিয়ে দেবে। হিরণদের কাছে তার আদরযত্নের ত্রুটি নেই। ওরা তাকে মাথায় করে রেখেছে। সবই ঠিক। তবু ওটা তার ছোটদির শ্বশুরবাড়ি। আসলে দ্বিধাটা রয়েছে তার নিজের মধ্যে। বাধাটা আসছে ভেতর থেকে। সারা জীবন বোনের শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকার কথা ভাবা যায় না। তার পৌরুষ, তার আত্মসম্মানবোধ কোনও ভাবেই তা মেনে নেবে না।

সবে চাকরিতে জয়েন করেছে বিনয়। কবে সুধাদের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে উঠবে, স্পষ্ট করে ভাবেনি সে। যাবে যে, সেটাই শুধু ঠিক হয়ে আছে। এই শহরের রাস্তাঘাট অনেকটাই তার জানা। কিন্তু কোথায় গেলে নিরাপদ এবং নিঝাট একটা আস্তানা মিলবে, সে-সম্বন্ধে তার ধারণা নেই।

আজ শান্তিনিবাস-এ এসে মেসটাকে বেশ ভাল লেগে গেল বিনয়ের। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে প্রসাদ লাহিড়ি থাকেন। হৃদয়বান একটি মানুষ।

বিনয় জিজ্ঞেস করল, এই মেসে আপনি ছাড়া আর কারা থাকে?

লুচি চিবোতে চিবোতে বিনয়ের দিকে তাকালেন প্রসাদ, কেন বল তো?

এমনি। জানতে ইচ্ছে করল, তাই

প্রসাদ জানিয়ে দিলেন। নানা ধরনের বোর্ডার রয়েছে শান্তিনিবাস-এ। সরকারি অফিসের কেরানি, মার্চেন্ট অফিসের লেজার কিপার, কারখানার কর্মী স্কুল-মাস্টার, দুজন এম এ ক্লাসের ছাত্র, ইত্যাদি। সবাই খুব ভদ্র। এদের অনেকেরই বাড়ি হুগলি, চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর কি বর্ধমান ডিস্ট্রিক্টের দূর দূর গ্রামে। শনিবার হাফ-ডে অফিস করে চাকুরেরা ট্রেন ধরতে শিয়ালদা কি হাওড়ায় ছোটে। অন্য কাজটাজ যারা করে তারাও তা-ই। ফেরে সেই সোমবার। তবে দুচারজন মেসে থেকে যায়। তারা বাড়ি যায় একমাস কি দুমাস বাদে।

প্রসাদ বললেন, শনিবার নটার পর থেকে সোমবার সন্ধে অব্দি শান্তিনিবাস প্রায় ফাঁকা। এই সময়টা আমরা কজন ঘাঁটি আগলে পড়ে থাকি। আমার তো আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। এই শান্তিনিবাস-ই আমার দেশ। বলে একটু হাসলেন।

এখানে বোর্ডারদের কীরকম খরচ পড়ে?

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিনয় কেন এত সব জানতে চাইছে, সে সম্বন্ধে প্রসাদের হয়তো কৌতূহল হচ্ছিল, কিন্তু তিনি কোনও প্রশ্ন করলেন না। বললেন, পুরো একটা ঘর নিয়ে থাকলে মাসে ভাড়া পঁচিশ টাকা। অন্যের সঙ্গে শেয়ার করলে সিট রেন্ট পনেরো টাকা। আর দুবেলা মিলের জন্যে কুড়ি টাকা। তবে চা আর সকাল বিকেলের জলখাবার দেওয়া হয় না। সেটা নিজেদের আলাদা কিনে খেতে হয়।

একটা আধবয়সী লোক–মাথায় কাঁচাপাকা চুল, ক্ষয়াটে চেহারা, ভাঙা গাল, পরনে খাটো ধুতি ফতুয়া আর চাদর–দুগেলাস চা দিয়ে গেল। নিশ্চয়ই শোভা কাফে থেকে পাঠানো হয়েছে তাকে।

লুচি-সন্দেশ খাওয়া হয়ে গেছে। জল খেয়ে চায়ের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে বিনয় ভাবছিল এজমালি ঘরে থাকলে খাওয়া দাওয়া মিলে মাসে সবসুদ্ধ পঁয়ত্রিশ টাকা। খুব একটা বেশি নয়। তার মনে হয়েছিল, মেসের খরচ কম করে এর দু-আড়াই গুণ পড়বে।

প্ৰসাদ কী একটু ভেবে বললেন, স্বাধীনতার আগে আমার এই ঘরটার জন্যে মান্থলি দিতে হতো সাত টাকা, আর দুবেলা মিলের জন্যে বারো টাকা। কবছরে খরচ অনেক গুণ বেড়ে গেছে।

বিনয় উত্তর দিল না। চুপচাপ শুনে যেতে লাগল।

প্রসাদ থামেননি, মেস মালিকের আর কী দোষ? জিনিসপত্রের দাম যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে চড়ছে, চার্জ না বাড়িয়ে সে-ই বা কী করবে? না পোষালে মেস চালিয়ে কী লাভ?

বিনয় মাথা হেলিয়ে সায় দিল, হ্যাঁ

প্রসাদ বললেন, আগে চল্লিশ টাকায় চার পাঁচজনেব একটা ফ্যামিলির দিব্যি হেসে খেলে চলে যেত। এখন দিনকাল যা পড়েছে, সাধারণ মানুষ কী করে যে টিকে থাকবে, কে জানে। চাল ডাল মাছ মাংস জামা কাপড়–সব আগুন। ছেলেমেয়ে থাকলে পড়ার খরচ, অসুখ বিসুখ হলে চিকিৎসার খরচ, বাড়ি ভাড়া–সমস্ত কিছু ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে।

প্রসাদের দুশ্চিন্তা এবং আক্ষেপের মধ্যেই ভেতর দিকের বারান্দা থেকে একটা গলা শোনা গেল, আমাগো ডাকছিলেন প্রসাদকাকা?

বিনয় লক্ষ করল, দুটি যুবক, বয়স উনিশ কি কুড়ি, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। একজন শ্যামবর্ণ, আর-একজনের রং ফর্সা। একজনের পরনে পাজামা আর শার্টের ওপর হাফ-হাতা সোয়েটার। অন্য যুবকটি পরেছে সস্তা ঢোলা ফুলপ্যান্ট আর একটা মোটা খদ্দরের জামা। এই ঠাণ্ডাতেও তার সোয়েটার বা চাদর টাদর কিছু নেই। দুজনের পোশাকআশাক খুবই খেলো। চেহারায় চরম দুর্দশা আর অভাবের ছাপ।

প্রসাদ ঘুরে বসে ছেলে দুটিকে এক পলক দেখেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। গলার শির ছিঁড়ে চিৎকার করে উঠলেন, হারামজাদা রাসকেল, জুতোর বাড়ি মেরে তোমাদের ছাল তুলে ফেলব। রাগে গনগন করছে মুখ। উত্তেজনায় কাঁপছে গলার স্বর।

প্রসাদের দিকে তাকিয়ে হকচকিয়ে গেল বিনয়। চোখের পলকে একটা মানুষ যে এতখানি বদলে যেতে পারে, সে কল্পনাও করতে পারেনি।

মাথা নিচু করে ছেলে দুটো নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। পাংশু মুখ। ভয়ে কাঁচুমাচু।

আরও কিছুক্ষণ তোড়ে বকাবকি করলেন প্রসাদ। দুই যুবকের মুখ থেকে টু শব্দটিও বেরুলো না। নতচোখে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। যেন দুটো কাঠের পুতুল।

ওদের অপরাধ যে কী, প্রসাদ তাদের দেখামাত্র কেন যে এমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন, কিছুই আঁচ করা যাচ্ছে না। ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে থাকে বিনয়।

একটানা অগ্ন্যুৎপাতের পর একসময় শান্ত হলেন প্রসাদ। সেই আগেকার মানুষ। নরম, মৃদুভাষী, স্নেহপ্রবণ। ছেলেদুটোকে কোমল গলায় বললেন, দয়া করে ভেতরে এস

ঘরে ঢুকে ওরা দাঁড়িয়ে থাকে। প্রসাদ বললেন, কী রে, বসতে বলতে হবে নাকি?

ছেলেদুটো ঘরের কোণ থেকে মোড়া এনে জড়সড় হয়ে বসে পড়ে। প্রসাদ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কী শুনছি তোদের সম্বন্ধে? পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে দিনরাত্রি নাকি চায়ের দোকানে আর রকে বসে আড্ডা দিচ্ছিস? সত্যি?

যুবকেরা উত্তর দিল না। তাদের মাথা আর-একটু নুয়ে পড়ল শুধু।

খবরটা তা হলে ঠিক প্রসাদ বলতে লাগলেন, বাকি লাইফটা রকে গুলতানি করেই কাটিয়ে। দিতে চাস? নিজেদের এভাবে ওয়েস্ট করছিস কেন?

শ্যামবর্ণ ছেলেটি ঢোক গিলে বলল, কী করুম? কলেজে ছয় মাসের মাইনা বাকি। আমাগো নাম কাইটা দিছে।

গলার স্বর সামান্য উঁচুতে তুলে প্রসাদ বললেন, মাইনে বাকি পড়েছে তো আমায় বলিসনি কেন?

ফর্সা ছেলেটি বলল, কতবার আর আপনের কাছে হাত পাতুম?

প্রসাদ হালকা ধমকের সুরে বললেন, টাকা নিতে সম্মানে বাধে– না?

আপনের কাছে সম্মান-অসম্মানের কিছু আছে নিকি?

তাহলে?

একটু ভেবে দ্বিধাভরে ছেলেটি বলল, আমাগো ফেমিলির হাল তো সগলই জানেন। রোজগার পত্তর না করলে আর চলতে আছে না। কলেজ থিকা নাম কাটাইয়া দিছে। পড়াশুনা বন্ধ। দুইজনে চাকরি বাকরির লেইগা এইখানে ওইখানে ঘুরি। এরে-ওরে ধরি। বাকি সময়টা কী করুম? বাসায় জাগা নাই। তাই চায়ের দোকানে কি কারও বাড়ির বোয়াকে বইয়া কাটাইয়া দেই।

প্রসাদ গুম হয়ে বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, চাকরির জন্যে ঘোরাঘুরি করছিস! কই আমাকে জানাসনি তো?

জানাইলে আপনে রাইগা যাইতেন।

আরে আহাম্মকেরা, চেষ্টাচরিত্র করলে রিফিউজি কোটায় ছোটখাটো কিছু একটা পেয়ে যাবি। কিন্তু ম্যাট্রিকে, ইন্টারমিডিয়েটে ভাল রেজাল্ট করেছিস। থার্ড ইয়ারেও কিছুদিন ক্লাস করলি। গ্র্যাজুয়েটটা হতে পারলে কত ভাল চাকরি পাবি বল তো?

ছেলে দুটো চুপ করে থাকে।

প্রসাদ সদয় সুরে এবার বললেন, তোদের অবস্থা সবই জানি। পাকিস্তান থেকে আসার পর অনেক কষ্ট করেছিস। আর বছর দেড়েক দাঁতে দাঁত চেপে কাটিয়ে দে। বি এটা তোদর পাস করতেই হবে।

ফর্সা ছেলেটি বলল, কিন্তুক,

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রসাদ বললেন, কাল সকালে দুজনে তিন মাসের মতো মাইনের টাকা আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবি। কালই কলেজে গিয়ে নাম তোলার ব্যবস্থা কর। বাকি মাইনে পরের মাসে দিয়ে দেব। এখন যাও। সময় নষ্ট না করে পড়াশোনায় মন দাও—

ছেলেদুটোর চোখ বাষ্পে ভরে গেছে। ধীরে ধীরে তারা উঠে পড়ে। কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে একবার প্রসাদকে দেখে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

প্রসাদের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল বিনয়। এই মানুষটিকে যত দেখছে ততই আপ্লুত হচ্ছে সে।

প্রসাদ তাকে লক্ষ করছিলেন না। গেলাসে এখনও খানিকটা চা রয়েছে। ছোট একটা চুমুক দিয়ে বললেন, ওই ফর্সা ছেলেটা হল হারু, কালো ছেলেটার নাম দুলাল। মুন্সিগঞ্জের কাছে কমলাপুর বলে একটা ছোট শহর আছে, জানো?

বিনয়ের মনে পড়ল, যে অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের দঙ্গলটা পাউরুটি নিতে এসেছিল, প্রসাদ তাদের হারু আর দুলালকে খুঁজে বার করে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন। খানিক আগে ভয়ে ভয়ে দুজনে যখন দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল তখনই আন্দাজ করা গেছে ওরা কারা।

বিনয় জানায়, কমলাপুরের নাম সে শুনেছে, তবে দেশে থাকতে কখনও সেখানে তার যাওয়া, হয়নি।

প্রসাদ বলতে লাগলেন, হারু আর দুলাল ওই শহরেরই ছেলে। একই সঙ্গে বড় হয়ে উঠেছে। লেখাপড়াও করেছে একসঙ্গে। দেশে থাকতেই ম্যাট্রিক আর ইন্টারমিডিয়েটটা পাশ করেছিল। দুটো পরীক্ষাতেই তাদের রেজাল্ট বেশ ভাল, ফাস্ট ডিভিসন, সঙ্গে দু-একটা লেটার।

প্ৰসাদ আরও জানালেন, দেশে হারুদের বিরাট অবস্থা ছিল। কমলাপুরের বাজারে ওর বাবা হরিপদ সরকারের ছিল মস্ত ধানচালের আড়ত। প্রচুর পয়সা। হারুদের মতো অতটা না হলেও দুলালদের ফ্যামিলিও যথেষ্ট সচ্ছল। ওদের ষাট কানির মতো জমি ছিল। বছরে তিনবার ফসল হতো। তাছাড়া অনেকটা জায়গা জুড়ে বসত-বাড়ি, পুকুর, নানারকম ফলের বাগান।

প্রসাদ বলতে লাগলেন, সব ফেলে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর মতো একদিন ওদেরও চলে আসতে– হল ইন্ডিয়ায়। দুলালের দূর সম্পর্কের এক মামা কলকাতায় পার্টিশানের অনেক আগে থেকেই ছিল। ওই যে দেখছ– আঙুল বাড়িয়ে রাস্তার ওধারের একটা বাড়ি দেখিয়ে দিলেন তিনি।

পাতলা ইটের গাঁথনি, মাথায় টিনের চাল, লোহার শিক বসানো ছোট ছোট জানালা-এইসব নিয়ে সারি সারি ঘর। বাইরে থেকে এটুকুই চোখে পড়ছে। বিনয়ের মনে হল, একটু ভাল ধরনের বস্তি। প্রচুর লোকজন ওই বাড়িটায় থাকে।

প্রসাদ বললেন, দুলালের মামা ওখানে হারু আর দুলালদের জন্য ঘরভাড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ধানচালের আড়তদার হারুর বাবা কালীঘাটে একটা ছোট কাপড়ের দোকান দিয়েছে। আর দুলালের বাবা জমিজমার মালিক পরিতোষ বণিক এখন ট্রেনে ট্রেনে হকারি করে বেড়াচ্ছে। চরম অভাব। তবু ছেলেদের নিয়ে দুই বাপের কিছু অ্যাম্বিশান ছিল। হারুকে আর দুলালকে চারুচন্দ্র কলেজে বি এতে ভর্তি করে দিয়েছিল তারা। ছেলেরা মানুষ হয়ে তাদের পেছনে দাঁড়াবে। সংসারের হাল ধরবে। এমনটাই ছিল তাদের আশা। তারপর কী হয়েছে, নিজের কানেই তো সব শুনলে

আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।

প্রসাদ চুপচাপ খানিকক্ষণ বসে থাকেন। কেমন যেন আত্মগত। কী ভাবছিলেন, কে জানে। তারপর হঠাৎ যেন সচেতন হয়ে উঠলেন, অনেক বেলা হয়ে গেছে। আর তোমাকে আটকে রাখব না। অফিসে দেখা হবে। দুটো নাগাদ চলে এস

আচ্ছা।

বিনয় ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে লক্ষ করল, শান্তিনিবাস জুড়ে এখন প্রচণ্ড ব্যস্ততা। সকালের সেই গড়িমসি ভাবটা নেই। নেই আলস্যের লেশমাত্র। সে যখন প্রসাদের সঙ্গে কথা বলছে তার মধ্যে কখন যে বোর্ডাররা কাজে বেরুবার জন্য তৈরি হতে শুরু করেছিল, টের পাওয়া যায়নি। সারিবদ্ধ ঘরগুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে বিনয়ের নজরে পড়ল, কেউ চুল আঁচড়াচ্ছে, কেউ ইস্তিরি-করা জামাকাপড় ভেঙে পরছে, কেউ হাত-ব্যাগে দরকারী কাগজপত্র গোছগাছ করে ভরে নিচ্ছে।

নিচে এসে দেখা গেল, সেই বড় চৌকো চাতালটায় চার পাঁচজন চৌবাচ্চা থেকে মগে জল তুলে ঝপাঝপ মাথায় ঢালছে। ওধারের কিচেনের গা ঘেঁষে যে একটা খাওয়ার ঘর রয়েছে, তখন লক্ষ করেনি বিনয়। জায়গাটা ঘুপচিমতো। তাই দিনের বেলাতেই আলো জ্বালতে হয়েছে। দেখা গেল, ওই ঘরের মেঝেতে আসনে বসে চার পাঁচজন খাচ্ছে। কাজের লোকেদের ত্বরিত পায়ে ছোটাছুটি, বোর্ডারদের হাঁকডাকে মেস-বাড়ি সরগরম।

.

২৯.

শান্তিনিবাস থেকে বেরিয়ে, মহেশ হালদার লেন পেছনে ফেলে বড় রাস্তায় চলে এল বিনয়। হরিশ পার্কের পাশের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রসাদ লাহিড়ির মুখ বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে। রোগা, খেতে না পাওয়া রিফিউজি ছেলেমেয়েদের হাতে সযত্নে পাউরুটি তুলে দেওয়া, তাদের প্রতি তার অসীম মমতা, হারু আর দুলালকে দেখে রাগে ফেটে পড়া–সমস্ত কিছু চোখের সামনে ভাসছে। ছবির মতো। তার কথাগুলো কানে বেজে চলেছে একটানা।

কাল অফিসে প্রসাদ বলেছিলেন, নানা জায়গার খবরের কাগজ ঘেঁটে চমকদার ঘটনা বা বিস্ময়কর কোনও মানুষের সন্ধান পাওয়া গেলে তা নিয়ে নতুন ভারত-এর জন্য যেন স্টোরি তৈরি করে বিনয়। অন্য বিষয় নয়, তাকে শুধু ইস্ট আর ওয়েস্ট পাকিস্তানের শরণার্থীদের, বা তাদের সঙ্গে জড়িত অন্য সব মানুষ সম্পর্কে লিখতে বলা হয়েছে। বানানো গল্প নয়, রিয়েল লাইফ স্টোরি। এই মুহূর্তে হঠাৎ বিনয়ের মনে হল, প্রসাদ লাহিড়ির মতো একজন মানুষকে নিয়ে লেখা একান্ত উচিত। ভাবল, শেষ পর্যন্ত যদি লিখেও ফেলে সেটা তার হাতেই তুলে দিতে হবে। ব্যাপারটা কীভাবে। নেবেন প্রসাদ?

হরিশ পার্ক, মিত্র ইনস্টিটিউশন পেরিয়ে বাঁ পাশের গলি দিয়ে আশুতোষ মুখার্জি রোডে চলে এল বিনয়। অফিস টাইম শুরু হয়ে গেছে। এসপ্ল্যানেড আর ডালহৌসির দিকের ট্রাম-বাসগুলো ভিড়ে ঠাসা। সেগুলোর ভেতর মাছি গলার উপায় নেই। তবু এক-একটা স্টপেজে গাড়ি থামলেই অদ্ভুত কসরতে অফিসের বাবুরা ঠেলেঠুলে ওই বাদুড়ঝোলা ভিড়ের মধ্যেই উঠে পড়ছে।

রাস্তা পেরিয়ে বিনয় ওধারের ফুটপাথে চলে গেল। বালিগঞ্জ টালিগঞ্জের গাড়িগুলো এ-সময় ফাঁকা থাকে। জনস্রোত এখন শুধু ডালহৌসির অফিসপাড়ার দিকে।

টালিগঞ্জের বাস দু-একটা আসছে ঠিকই, তবে ট্রামের পাত্তা নেই। টিনের লম্বা লম্বা বাক্সের মতো কলকাতার বাসগুলো মোটেই পছন্দ করে না বিনয়। ঝকর ঝকর করে থামতে থামতে যায়। ঝাঁকুনিতে হাড়-মাংস আলগা হবার উপক্রম। সেই তুলনায় ট্রামে চড়াটা অনেক আরামের। বোগির ভেতর যথেষ্ট জায়গা। দাঁড়িয়ে গেলেও অসুবিধে হয় না। কোনওরকম ঝকিটাকি নেই। গতিও খুব মসৃণ।

ট্রামের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বিনয়ের চোখে পড়ল, ফুটপাথের একধারে মোটা চট বিছিয়ে একটি এগারো বারো বছরের মেয়ে দোকান সাজিয়ে বসেছে। রকমারি জিনিস। খাতা, পেন্সিল, কালি, রাবার, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়, লক্ষ্মীর পাঁচালি, সরল হোমিওপ্যাথি শিক্ষা, ধারাপাত, কাঠের স্কেল, ধূপকাঠির প্যাকেট, পঞ্জিকা, ম্যাজিক শেখার বই, রান্নার বই ইত্যাদি।

বিনয় লক্ষ করল, মেয়েটির গা ঘেঁষে একটা মলিন কাপড়ের ব্যাগ। সেটার ওপর ব্রাউন পেপারের মলাট দেওয়া কটি বই। লোকজন এসে পঞ্জিকা কি খাতাটাতা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তবে সবসময় তো খদ্দের থাকে না। বিকিকিনির ফাঁকে একটা মুহূর্তও মেয়েটা নষ্ট করছে না। খদ্দের চলে গেলেই পাশ থেকে মলাট লাগানো বই তুলে নিয়ে একমনে পড়ে যায়। কী পড়ছে সে? ভীষণ কৌতূহল হল বিনয়ের। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে। মুখ বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করল কিন্তু কী বই বোঝ যায় না। রাস্তায় বসে কে কী পড়ছে না-পড়ছে সেটা জানা এমন কিছু জরুরি ব্যাপার নয়। তবু ছেলেমানুষী কৌতূহলটা কিছুতেই কাটানো যাচ্ছে না। আবার সরাসরি জিজ্ঞেস করতেও বাধছে।

বিনয়ের মাথায় আচমকা একটা ফন্দি এসে গেল। দরকার নেই, তবু একটা মোটা খাতা, পেন্সিল আর রাবার তুলে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, এগুলোর দাম কত?

বিনয় যখন খাতাটাতা বাছাবাছি করছে, হাতের বই বন্ধ করে পাশে রেখে দিয়েছিল মেয়েটি। মনে মনে হিসেব করে বলল, চৌদ্দ পয়সা–

পকেট থেকে মানি ব্যাগ বার করতে করতে মেয়েটিকে ভাল করে লক্ষ করল বিনয়। গায়ের রং মাজা মাজা। পাতলা গড়ন। কৃশই বলা যায়। তবে মুখখানা বেশ ঢলঢলে। পরমাশ্চর্য তার দুই চোখ। টানা টানা, উজ্জ্বল। সমস্ত চেহারায় ঝকঝকে বুদ্ধির ছাপ।

মেয়েটির হাতে দাম দিতে দিতে বিনয় জিজ্ঞেস করে, রোজই তুমি এখানে দোকান খুলে বসো?

কোনও জড়সড় ভাব নেই। সোজাসুজি বিনয়ের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল, হ।

তোমার কী নাম?

আরতি পাল।

বন্ধ বইটা দেখিয়ে বিনয় বলে, ওটা পড়ছিলে না?

 আস্তে মাথাটা হেলিয়ে দেয় আরতি, হ।

কী বই ওটা?

ভূগোল।

 বেশ অবাক হল বিনয়, তুমি কি পড়াশোনা কর?

 আরতি বলল, হ। দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস সিক্সে পড়ি।

হঠাৎ কী খেয়াল হতে বিনয় বলল, তোমার স্কুল কটায় বসে?

আরতি বলল, দশটায়।

খানিক দূরে একটা মস্ত ঘড়ির দোকানের মাথায় গোলাকার প্রকাণ্ড ঘড়ি আটকানো রয়েছে। এক ঝলক সেটা দেখে বিনয় বলল, এখন নটা বেজে সাতচল্লিশ। স্কুলে কখন যাবে? তাকে চিন্তিত দেখাল।

আইজ ইস্কুলে যামু না।

কেন?

 বাবার আসতে দেরি হইব। কেও না থাকলে দোকান দেখব কে? 

ব্যাপারটা পুরোপুরি পরিষ্কার হল না। বিনয় জিজ্ঞেস করল, মানে?

আরতি বুঝিয়ে দিল, আমি নয়টা তরি (পর্যন্ত) দোকান চালাই। হের পর বাবায় আইয়া বসে। তখন আমি বাসাত্ (বাসায়) গিয়া ছান (স্নান) কইরা, ভাত খাইয়া ইস্কুলে যাই–

আরতিদের দেশ যে ওপার বাংলায় সেটা ওর কথা শুনেই টের পাওয়া গেছে। ক্রমশ আগ্রহ বাড়ছিল বিনয়ের। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নেয় সে।

আরতিদের দেশ ঢাকা ডিস্ট্রিক্টের মানিকগঞ্জ সাব ডিভিসনের একটা গ্রামে। নাম মীরপুর। অন্য শরণার্থীদের সঙ্গে তাদের তফাত নেই। মাস আষ্টেক আগে ভয়ে আতঙ্কে দেশ ছেড়ে সীমান্তের এপারে চলে আসে। দিনকয়েক এখানে, দিনকয়েক ওখানে, তারা উদভ্রান্তের মতো এইভাবে ছোটাছুটি করতে করতে শেষ পর্যন্ত কালীঘাটের কাছে নকুলেশ্বর ভট্টাচার্য লেনে একটা বস্তিতে এসে উঠেছে। তিন ভাইবোন, মা-বাবা, এই নিয়ে ওদের সংসার। বাবা রাধানাথ পাল অনেক ধরাধরি করে চেতলার একটা মাদুরের আড়তে কাজ জুটিয়েছে। সকালে সাতটা থেকে সাড়ে-আটটা আর সন্ধে পাঁচটা থেকে সাড়ে-সাতটা অবধি তার ডিউটি। তাতে এই বাজারে ঘরভাড়া দিয়ে পাঁচটি মানুষের পেট চালানো দুষ্কর। তাই খাতা পেন্সিল পঞ্জিকা পাঁচালি ইত্যাদি নিয়ে ফুটপাথে দোকান খুলে বসতে হয়েছে।

রাধানাথের একটা উচ্চাশা আছে। ছেলেমেয়েরা গোমুখ হয়ে থাকবে এটা সে একেবারেই চায় না। এত কষ্ট, এত অভাব, তবু তিন ছেলেমেয়েকেই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে।

সেই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ভূতের মতো খেটে যায় রাধানাথ। তাদের বস্তিতে জলের খুব সমস্যা। অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠে রাস্তার কল থেকে কয়েক বালতি জল নিয়ে আসে। ছটার ভেতর চান সেরে এক কাপ চা, আর দু-এক টুকরো বাসি পাউরুটি খেয়ে প্রকাণ্ড দুটো কাপড়ের ব্যাগে বইখাতা পেন্সিল রাবার ইত্যাদি ভরে আরতিকে সঙ্গে করে ভবানীপুরের ফুটপাথে চলে আসে। চোখের পলকে চট বিছিয়ে দোকান সাজিয়ে দিয়ে আরতিকে বসিয়ে চেতলায় হাজিরা দিতে দৌড়ায়।

সকালের দিকে বাসায় বসে পড়ার উপায় নেই। তাই একটা ছোট কাপড়ের ঝোলায় স্কুলের পড়ার বই খাতাটাতা নিয়ে আসে। দোকান সামলাবার ফাঁকে ফাঁকে সেগুলো পড়ে। স্কুলের দিদিমণিরা ভীষণ কড়া। পড়া তৈরি করে না গেলে ভীষণ বকাবকি করেন। এমনকি দাঁড় করিয়েও রাখেন। তাছাড়া, না পড়লে, পরীক্ষায় পাশ করে উঁচু ক্লাসে উঠবে কী করে?

নটা নাগাদ রাধানাথ চেতলা থেকে চলে আসে। তখন আরতির ছুটি। সে ঊধ্বশ্বাসে বাড়ি ফিরে যায়। ঝপাঝপ দুচার মগ জল মাথায় ঢেলে, নাকে মুখে গুঁজে স্কুলে ছোটে।

আরতি বলল, বাবায় কইছে যত কষ্টই হউক, আমাগো তিন ভাই-বইনেরে পড়াইব। আমি সবাইর বড়। আমার পরে দুই ভাই। ঠিক করছি কিছুতেই পড়াশুনা ছাড়ুম না। তার চোখেমুখে দৃঢ়তা। আত্মবিশ্বাস। জেদ।

কিছুক্ষণ আগে হারু আর দুলালকে দেখে এসেছে বিনয়। প্রবল হতাশায় তারা পড়া ছেড়ে দিয়েছে। প্রসাদ লাহিড়ির ধমক ধমক খেয়ে হয়তো আবার কলেজে যেতে শুরু করবে। তাদের সঙ্গে এই মেয়েটির কত পার্থক্য।

মুগ্ধ চোখে সদ্য কিশোরী আরতির দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে বিনয়। তারপর বলে, তোমার সময় আর নষ্ট করব না। পড়। আমি যাচ্ছি

আরতি বলল, খাতা পেন্সিল, ধূপকাঠিটাঠি দরকার হইলে আমাগো দোকান থিকা নিয়েন।

 বিনয় ভাবল, সে থাকে টালিগঞ্জে। যে ধরনের জিনিস আরতিরা বেচে সে-সব তার আদৌ প্রয়োজন নেই। তাছাড়া অত দূর থেকে কেনাকাটার জন্যে ভবানীপুরে আসাও সম্ভব নয়। কিন্তু কিশোরী মেয়েটিকে নিরাশ করতে ইচ্ছা হল না। বলল, নিশ্চয়ই নেব। বলতে বলতে ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নেমে এল বিনয়। ট্যাং ট্যাং আওয়াজ করতে করতে টালিগঞ্জের একটা ট্রাম এসে স্টপেজে থামল। সে উঠে জানালার ধারের সিটে বসে পড়ে।

বিনয়ের সঙ্গে আরও দু-তিনটি প্যাসেঞ্জার উঠেছিল। কন্ডাক্টর ঘন্টি বাজাতেই ট্রাম টিমে তালে দৌড় লাগায়। ঘাড় ফিরিয়ে সে লক্ষ করল, আরতি আবার তার বই তুলে নিয়েছে। নিশ্চয়ই সেই ভূগোলের বইটা।

সাড়ে দশটা নাগাদ জাফর শা রোডে পৌঁছে গেল বিনয়। সুধাদের বাড়ির সদর দরজার কড়া নাড়তেই উমা এসে খুলে দিল। বলল, একজন আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে অনেকক্ষণ বসে আচে।

বিনয় জিজ্ঞেস করল, কে?

নাম জানি না।

 যুগল কি? বলেই বিনয়ের খেয়াল হল, কাল রাতেই যুগল আশু দত্তকে নিয়ে এসেছিল। আজ সকালে তার মুকুন্দপুর চলে যাবার কথা। তবে কি সন্তোষ নাগ চায় না আশু দত্ত তাদের বাড়ি থেকে চলে যাক? এই ব্যাপারেই কি কোনও সমস্যা দেখা দিয়েছে?

উমা বলল, না না, যুগলদাদা না। এ অন্য লোক। আপনি পাকিস্তান থেকে এ-বাড়িতে আসার পর দু-তিনবার আপনার সঙ্গে দেখা করে গেছে। এই তো কদিন আগেও এসে অনেকক্ষণ ছিল।

বাইরের লোকজন এলে উমা চা বিস্কুট মিষ্টি টিষ্টি দিয়ে যায়। কতক্ষণই বা তাদের কাছে থাকে? সবার নাম ধাম সে জানেও না, জানার দরকারও নেই। তবে যুগলের কথা আলাদা। সে ফি সপ্তাহে একবার না একবার আসেই। এ-বাড়িরই একজন হয়ে গেছে।

উমার হঠাৎ কী মনে পড়ে গেল। ওই যে, যখনই আসে আপনাদের দেশের জমিবাড়ি নিয়ে কীসব বলে। চা দিতে গিয়ে একটু আধটু কানে এসেছে।

নিশ্চয়ই নিত্য দাস। এক মুহূর্ত আর দাঁড়ায় না বিনয়।

.

৩০.

একসঙ্গে দু-তিনটে করে সিঁড়ি টপকে ওপরে উঠতে উঠতে চকিতে বিনয়ের মনে পড়ল, গত সপ্তাহে হেমনাথের চিঠি নিয়ে আসার কথা ছিল নিত্য দাসের। হয়তো সীমান্তের ওপারের চিঠিপত্র যে তাকে পৌঁছে দেয়, কোনও কারণে তার দেরি হয়েছে।

পাকিস্তানের যা হাল তাতে কথা দিলেই যে রাখা যাবে, জোর দিয়ে তা বলা যায় না। যদিও নিত্য দাস বর্ডারের ওধারে যাদের দিয়ে কাজ করায় তারা সবাই ওখানকারই বাসিন্দা। পুরোদস্তুর পাকিস্তানি, তবু হাজারটা বিঘ্ন। হেমনাথের কাছ থেকে চিঠি হয়তো জোগাড় করা হল কিন্তু তারপাশায় পৌঁছে দেখা গেল স্টিমার দুদিন বন্ধ। শেষ পর্যন্ত স্টিমার মিলল তো গোয়ালন্দে এসে খবর পাওয়া গেল, কলকাতার ট্রেন চলছে না। সেখানে হয়তো বসে থাকতে হল তিন-চার দিন।

দোতলায় আসতেই বিনয়ের চোখে পড়ল, বাইরের ঘরে বসে আছে নিত্য দাস, সুধা আর দ্বারিক। দত্ত। হিরণের এ-সময় বাড়িতে থাকার কথা নয়। নেইও। সে এখন তার অফিসে।

সুধারা কথা বলছিল। হঠাৎ বিনয়কে দরজার সামনে দেখে ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়াল নিত্য দাস। আসেন ছুটোবাবু, আসেন। হেই পৌনে নয়টার সোময় আইছি। আপনের পথ চাইয়া বইয়াই আছি, বইয়াই আছি। শোনলাম জলরারি কামে বাইর হইছেন।

লোকটা বেশি মাত্রায় কথা বলে। ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসতে বসতে বিনয় জিজ্ঞেস করল, দাদুর চিঠি এনেছেন?

ফের বসে পড়েছিল নিত্য দাস। আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল, না ছুটোবাবু।

কেন? বিনয় বলে, গেল সপ্তাহে আনার কথা। তার পরও কদিন কেটে গেছে। কী ব্যাপার?

হেই কথাই ছুটোদিদি আর ঠাউরদাদের কইতে আছিলাম। ঠাউরদা অর্থাৎ ঠাকুরদা। দ্বারিক দত্তকে তাই বলেই ডাকে নিত্য দাস। হেমনাথের চিঠি না আসার কথা সুধাদের আগেই অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে সে। বিনয়কেও বিশদভাবে জানালো।

পাকিস্তানে তার লোক জয়নালকে রাজদিয়ায় গিয়ে হেমনাথের চিঠি নিয়ে আসার ভার দিয়েছিল সে। শুধু হেমনাথেরই না, আরও কয়েকজনের চিঠি এবং পাকিস্তানের হিন্দুদের বিষয় সম্পত্তি সম্পর্কে কিছু খবরও তার নিয়ে আসার কথা।

ফি সপ্তাহে শনিবার জয়নাল পাকিস্তানের বর্ডারে আসে। এপারেও নিত্য দাসের লোকজন আছে। তাদের একজন হল নরেশ। সেও ওইদিনই ইন্ডিয়ার বর্ডারে যায়। দুধারেই পুলিশকে পয়সা খাওয়ানো আছে। জয়নাল নির্বিঘ্নে এপারে এসে চিঠিচাপাটি নরেশের হাতে দিয়ে যায়। তখন পুলিশ অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে থাকে। যাই হোক, হেমনাথের চিঠি নিয়ে শনিবার জয়নালের বর্ডারে আসার কথা, ছিল। সেদিন তো সে আসেইনি, এমনকি তার পরের শনিবারও না। অসুখবিসুখে পড়ল কি না কে জানে। পর পর দুই শনিবার নরেশ খালি হাতে ফিরে এসেছে।

হেমনাথের চিঠি না আসায়, মুষড়ে পড়ে বিনয়। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলে, রাজদিয়ায় কোনও গণ্ডগোল হয়েছে কি না, শুনেছেন?

নিত্য দাস বলল, না। উই দিকের খবর জয়নালই রাখে। হ্যায় না আইলে কিছুই কওন যাইব না।

পাকিস্তান থেকে আসার পর হেমনাথের একটাই মাত্র চিঠি পেয়েছিল বিনয়। তাও অনেকদিন হয়ে গেল। সেই চিঠিতে হেমনাথ জানিয়েছিলেন, রাজাকারেরা এবং বিহারী মুসলমানেরা রাজদিয়ায় ভীষণ উৎপাত করছে। তিনি কেমন আছেন, এর মধ্যে তার কোনও রকম বিপদ ঘটেছে কি না, কলকাতায় বসে জানার উপায় নেই। উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে আসে বিনয়ের। সে জিজ্ঞেস করে, আপনার ওই নরেশ আসছে শনিবারও বর্ডারে যাবে তো?

নিয্যস (নিশ্চয়) যাইব। হ্যামকত্তার লেইগা আমারও খুব চিন্তা হইতে আছে।

পাকিস্তানে তো আপনার অনেক লোক রয়েছে। পরের সপ্তাহেও যদি জয়নাল না আসে, আপনি অন্য কারওকে দিয়ে দাদুর খবর আনিয়ে দিতে পারবেন?

 নিত্য দাস বলল, আমিও হেইটাই ভাইবা রাখছি।

 দ্বারিক দত্ত বললেন, ভাবাভাবি না, যেমন করে পারিস হেমনাথের খবরটা নিয়ে আয়।

খুব চ্যাষ্টা করুম ঠাউরদা।

 একটু চুপচাপ।

তারপর নিত্য দাস বিনয়কে বলে, ছুটোবাবু, হ্যামকত্তার চিঠি আনতে পারি নাই। তয় আপনের লেইগা পাকিস্থানের অন্য একজনের চিঠি আনছি। এই ন্যান (নিন)। জামার পকেট থেকে একটা মুখবন্ধ লম্বা খাম বার করে সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয় সে।

বিনয় হতবাক। হেমনাথ ছাড়া পাকিস্তানে এমন আর কেউ নেই যে তাকে চিঠি লিখতে পারে। নিত্য দাসের হাত থেকে খামটা নিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, কে লিখেছে?

শাহেদ আলি–

ওই নামের কারও সঙ্গে ওপার বাংলায় থাকার সময় তার কি পরিচয় হয়েছিল? বিনয় মনে করতে পারল না। বলল, কে সে?

নিত্য দাস বলল, জামতলির নাসের আলির কথা কইছিলেন, ইনি তেনার ছুটো ভাই–

নাসের আলির নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায় বিনয়ের। পরক্ষণে সমস্ত কেমন যেন গুলিয়ে গেল।

চিঠি লিখলে নাসের আলিরই লেখার কথা। কিন্তু লিখেছে তার ছোট ভাই শাহেদ আলি, যাকে চোখে দেখা দূরের কথা, তার নাম অবধি আগে শোনেনি বিনয়। রহস্যটা ভেদ করতে না পেরে অবাক তাকিয়ে থাকে সে।

তার মনোভাব আঁচ করে নিয়ে নিত্য দাস বলে, আপনে হেই দিন জামতালির পুরানা মাস্টর রামরতন গাঙ্গুলি মশয়ের দ্যাশের জমিজেরাত ব্যাচন (বিক্রি) কি এক্ষেঞ্জের কথা কইছিলেন। কইছিলেন তেনাগো দলিলপত্তর আছে নাসের আলির কাছে। তয়–

নিত্য দাসকে শেষ করতে না দিয়ে বিনয় বলে ওঠে, রামরতন স্যারের স্ত্রী এবং মেয়েরা দেশ থেকে আসার পর নাসের আলির কোনও চিঠি টিঠি পায় নি। তাই বলেছিলাম। তার সঙ্গে শাহেদ আলির কী সম্পর্ক, তা আমি ভেবে পাচ্ছি না।

আমার কথাহান আগে হুইনা লন। বলে নিত্য দাস জানায়, জয়নাল ছাড়াও পাকিস্তানে তার যে-সব লোকজন আছে তাদের একজনের নাম আবদুল। আবদুলকে নাসের আলির সঙ্গে দেখা করে রামরতনের জমিজমা সম্পর্কে তিনি কতদূর কী করতে পেরেছেন, আদৌ তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হবে কি না, সব খবরাখবর জেনে আসতে বলেছিল সে। কিন্তু নাসেরের সঙ্গে দেখা হয়নি আবদুলের। তাঁর ছোট ভাই শাহেদ আলি বিনয়কে একখানা চিঠি লিখে তাকে দেয়। গত শনিবার আবদুল বর্ডারে এসে সেটা নরেশের হাতে দিয়েছে।

বিনয় জিজ্ঞেস করে, নাসের আলির সঙ্গে আপনার লোকের দেখা হয়নি কেন? তিনি কি জামতলিতে ছিলেন না?

বিষণ্ণ সুরে নিত্য দাস বলে, একহান খারাপ খবর আছে ছুটোবাবু।

বিনয় সামনের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, কী খবর? তার চোখেমুখে উৎকণ্ঠা ফুটে ওঠে। পত্রখান পইড়া দ্যাখেন। হগল বুঝতে পারবেন।

খামের মুখ ছিঁড়ে কাঁপা হাতে চিঠি বার করে বিনয়। ফুলস্ক্যাপ কাগজের পুরো দুটো পাতা পরিচ্ছন্ন হাতের লেখায় ভর্তি। সে পড়তে শুরু করে।

শ্রী বিনয়কুমার বসু মহাশয় সমীপেষু,

প্রথমে আমার সালাম লইবেন। আপনার সহিত আমার সাক্ষাৎ পরিচয় নাই। তবে আপনার কথা আমার বড় ভাই নাসের আলির মুখে বহুবার শুনিয়াছি। আপনার প্রতি ছিল তাহার গভীর শ্রদ্ধা।

দেশ ছাড়িয়া জামতলির প্রাক্তন হেড মাস্টার রামরতন গাঙ্গুলি মহাশয় যখন সপরিবারে ইন্ডিয়ায় চলিয়া যান, তারপাশা স্টিমারঘাট পর্যন্ত আমার ভাইসাহেব তাহাদের পাহারা দিয়া লইয়া গিয়াছিলেন। তাহার পক্ষে গাঙ্গুলি মহাশয়দের সহিত কলিকাতা অবধি যাওয়া সম্ভব ছিল না। কীভাবে তাহারা সীমান্তের ওই পারে যাইবেন, এই লইয়া ভাইসাহেবের ভীষণ দুর্ভাবনা ছিল। কিন্তু তারপাশায় আপনার মতো একজন ভদ্র, সহৃদয় মানুষকে পাইয়া তিনি নিশ্চিন্ত হন এবং কলিকাতায় গাঙ্গুলি পরিবারকে পৌঁছাইয়া দিবার দায়িত্ব আপনাকে দেন। এই কথা আমি ভাইসাহেবের মুখে শুনিয়াছি।

কলিকাতায় যাইবার পর গাঙ্গুলি মহাশয়দের পৌঁছ-সংবাদ পাওয়া যায় নাই। ভাইসাহেব ধরিয়া লইয়াছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই চিঠিপত্র লিখিয়াছেন, কিন্তু ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ডাক চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় সে চিঠি তিনি পান নাই। পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের কাজকর্ম স্বাভাবিক হইলে যোগাযোগ করা সম্ভব হইবে।

কিন্তু সম্প্রতি আবদুল নামে একটি লোক জামতলিতে আমাদের বাড়িতে আসিয়া জানায়, সে আপনার নিকট হইতে গাঙ্গুলি মহাশয়দের সম্পর্কে কিছু খবর আনিয়াছে। শুনিলাম, রামরতনবাবু কলিকাতায় পৌঁছাইতে পারেন নাই। গোয়ালন্দ হইতে ইন্ডিয়ায় যাইবার পথে ট্রেনে তাহার মৃত্যু হইয়াছে। তাহার স্ত্রী এবং কন্যারা এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে অত্যন্ত দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাইতেছেন। খুবই খারাপ সংবাদ। কী বলিয়া ওই অসহায় মহিলাদের সমবেদনা জানাইব, বুঝিতে পারিতেছি না।

এদিকে আমাদের পরিবারেও চরম সর্বনাশ ঘটিয়া গিয়াছে। আমার বড় ভাই নাসের আলি আবদুল আসিবার কয়েকদিন আগে খুন হইয়া গিয়াছেন। এই হত্যাকাণ্ডের ফলে আমরা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি।

মর্মান্তিক এই খুনের কারণটা এবার জানাইতেছি। আপনি নিশ্চয়ই শুনিয়াছেন, রামরতন গাঙ্গুলি মহাশয় আমার বড় ভাইয়ের উপর তাহাদের বিষয়সম্পত্তির যাবতীয় দায়িত্ব দিয়া গিয়াছিলেন। তিনি যেন যত শীঘ্ৰ পারেন সেই সব বিক্রয় করিবার ব্যবস্থা করেন। শূন্য হাতে তাহারা ইন্ডিয়ায় যাইতেছেন। জমিবাড়ি বিক্রির টাকা না পাইলে তাঁহাদের দুর্গতির অন্ত থাকিবে না।

আমার ভাইসাহেব গাঙ্গুলি মহাশয়েরা চলিয়া যাইবার দুই তিন দিন পর হইতেই খরিদ্দারের খোঁজ করিতে থাকেন। বিনয়বাবু, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, এখন পাকিস্তানের যা হাল তাহাতে হিন্দুদের প্রপার্টি বিক্রি করা কত কঠিন। লিগ এবং রাজাকাররা সাধারণ মানুষকে এই বলিয়া তাতাইতেছে যে একটি ঘষা পয়সাও খরচ করিবার প্রয়োজন নাই। যাহারা ইন্ডিয়ায় চলিয়া গিয়াছে তাহাদের জমিজমা বিনা বাধায় দখল করা যাইবে। অনেকেই এই বিষয়ে উৎসাহিত হইলেও বেশির ভাগ মানুষ ঝাট পছন্দ করে না। তাহারা নগদ টাকা দিয়া বৈধ উপায়ে কোর্টে রেজিস্ট্রি করিয়া জমি কিনিতে চায়। কিন্তু লিগ এবং রাজাকারদের ভয়ে মুখ ফুটিয়া তাহা বলিতে পারে না।

আমার ভাইসাহেব নাসের আলি ছিলেন জামতলি হাই স্কুলের অ্যাসিস্টান্ট হেড মাস্টার, এই অঞ্চলের একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। এখানকার অধিকাংশ মানুষই তাহাকে মান্য করে। তিনি কোনও কিছু বলিলে সসম্ভ্রমে মানিয়া লয়। অন্তত এতকাল মানিয়া আসিয়াছে।

কিন্তু দেশভাগের পর হইতে দিনকাল রাতারাতি বদলাইয়া গিয়াছে। পরিবেশ এমনই বিষাক্ত যে রামরতন গাঙ্গুলিদের বিষয়আশয় লইয়া প্রকাশ্যে কিছু করিতে তাহারও সাহস হয় নাই। গোপনে বিক্রির চেষ্টা করিতে থাকেন। জামতলিতে খরিদ্দারের সন্ধান করিলে পাছে জানাজানি হইয়া যায় তাই পাশের গ্রামগুলিতে ইচ্ছুক ক্রেতাদের কাছে গিয়া কথাবার্তা চালাইতে থাকেন।

এদিকে গাঙ্গুলি মহাশয় যে তাঁহাদের জমিবাড়ির দায়িত্ব আমার ভাইসাহেবকে দিয়া গিয়াছেন, জামতলির কাহারও তাহা জানিতে বাকি নাই। লিগের লোজন এবং রাজাকাররা আসিয়া তাহাকে বলিয়া গিয়াছিল, গাঙ্গুলিদের সম্পত্তি তিনি এবং তাঁহার পরিবারের মানুষেরা ভোগদখল করুন, তাহাতে উহাদের আপত্তি নাই। তবে জমিজমা বেচিয়া কোনওভাবেই টাকা কলিকাতায় পাঠানো চলিবে না। পাকিস্তানের সমস্ত জমি, সমস্ত বিষয়আশয় পাকিস্তানিদের। যাহারা চলিয়া গিয়াছে তাহারা একটি কানাকড়িও পাইবে না। এ-দেশের কেউ যদি তাহাদের সাহায্য করিতে চেষ্টা করে তাহারা দুশমন। গাঙ্গুলিদের সম্পত্তি ভাইসাহেব যে বেচিতে পারেন কীভাবে এই লোকগুলি তাহা আন্দাজ করিয়াছিল, বলিতে পারিব না।

যাহা হউক, ভালভাবে বলিলেও উহাদের কথায় শাসানি ছিল। ভাইসাহেব তাহা গ্রাহ্য করেন নাই। রামরতন গাঙ্গুলি তাহার শিক্ষক। এই মানুষটির জন্য তাহার উচ্চ শিক্ষালাভ সম্ভব হইয়াছে। পিতৃতুল্য মানুষটি সর্বস্ব খুয়াইয়া ইন্ডিয়ায় গিয়া নিদারুণ অর্থকষ্টে স্ত্রী-কন্যাসহ শেষ জীবনটা কাটাইবেন, এই চিন্তা ভাইসাহেবকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছিল। তিনি নিজের এবং পারিবারিক সব কাজ ফেলিয়া গাঙ্গুলিদের জমি বেচার জন্য আরও বেশি করিয়া ছুটাছুটি করিতে লাগিলেন। কিন্তু রাজাকারদের চোখে পুরাপুরি ধূলা দেওয়া যায় নাই। তাহাদের সন্দেহ, ভাইসাহেব নিষেধ অমান্য করিয়া কিছু একটা করিতেছেন।

একদিন লিগের মাতব্বর সালাউদ্দিন আর রাজাকারদের মাতব্বর মনসুর আলি আমাদের বাড়ি আসিয়া হাজির। তাহাদের মেজাজ এইবার অনেক চড়া। সালাউদ্দিন বলিল, মাস্টারসাহেব, আপনেরে আমরা সোম্মান করি। হেইটা নষ্ট কইরেন না।

ভাইসাহেব সালাউদ্দিনের চোখের দিকে সিধা তাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কী অসম্মানের কামটা করছি আমি?

আপনে রামরতন গাঙ্গুলিগো সোম্পত্তি ব্যাচেনর (বেচার) লেইগা চাইর দিকে ঘুরাঘুরি করতে আছেন।

ভাইসাহেব বলিলেন, তুমরা দেখছ?

মনসুর আলি বলিল, দেহি নাই। তয় শুনাশুন কানে আইতে আছে। হিন্দুর লেইগা আপনের অত মাথাব্যথা ক্যান? শ্যাষবার কইয়া যাইতে আছি, এই হগল বন্ধ করেন।

ভাইসাহেব মনসুরের হুঁশিয়ারিতে কর্ণপাত করেন নাই। নানাজনের সঙ্গে কথা বলিয়া শেষ পর্যন্ত জামতলি হইতে বারো তেরো, মাইল দূরের গ্রাম আদিলপুরে মুস্তাফা খানের কাছে বিক্রয়ের ব্যবস্থা পাকা করিয়া ফেলেন। জমিবাড়ির যে দাম হওয়া উচিত, মুস্তাফা তাহার অর্ধেক দিতে চায়। ভাইসাহেব বুঝিলেন লোকটা পুরাপুরি সুযোগ লইতেছে। কিন্তু কিছুই করিবার নাই। অন্য কেহ ভয়ে গালিদের সম্পত্তির ধারেকাছে ঘেঁষিবে না।

ভাইসাহেব মুস্তাফাকে লিগ এবং রাজাকারদের শাসানির কথা জানাইয়া দিয়াছিলেন। সে বিরাট ধনী গৃহস্থ। জমিদারই বলা যায়। অর্থবল লোকবল দুইই তাহার যথেষ্ট। সে বলিয়াছে, রাজাকারদের সে সামলাইয়া লইবে।

কথাবার্তা হইয়া গেলে গাঙ্গুলি মহাশয়দের দলিলপত্র দেখিতে চায় মুস্তাফা খান। ঠিক হয় দুই দিন পর দলিলগুলি লইয়া ভাইসাহেব আবার মুস্তাফার বাড়ি যাইবেন। অনুরোধ করিলে জামতলিতেই সে চলিয়া আসিত। কিন্তু তাহাকে দেখিলে সালাউদ্দিনদের সন্দেহ বহুগুণ বাড়িয়া যাইত।

স্থির হইয়াছিল মুস্তাফা দলিল দেখিয়া সেইদিনই দশ হাজার টাকা অগ্রিম দিবে। পরে রামরতনকে কলিকাতা হইতে আনাইয়া মুন্সিগঞ্জে গিয়া সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করানো হইবে। তিনি আসিতে না পারিলে যাহাতে ভাইসাহেবের নামে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি পাঠান সেই ব্যবস্থা করিতে হইবে। তখন ভাইসাহেবই বৈধভাবে বিক্রয় করিতে পারিবেন।

কথামতো ভাইসাহেব আদিলপুরে গিয়াছেন। দলিল দেখাইয়া টাকাও নিয়াছেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয় নাই। ফিরিবার পথে তিনি সালাউদ্দিনদের হাতে ধরা পড়িয়া যান। তাহারা অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করিতে থাকে। হিন্দুর দালাল বলিয়া চিৎকার করিতে করিতে তাহার উপর ঝাপাইয়া পড়ে। ভাইসাহেব প্রতিবাদ করিলে তাহারা আরও ক্ষিপ্ত, আরও উত্তেজিত হইয়া ওঠে। তাহার নিকট যে দশ হাজার টাকা এবং দলিল ছিল সেগুলি ছিনাইয়া লইতে গেলে তিনি প্রাণপণে বাধা দেন। কিন্তু সালাউদ্দিনরা ছিল সশস্ত্র। চাকু মারিয়া তাহারা ভাইসাহেবকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দেয়। তাহার পর টাকা এবং দলিল লইয়া চলিয়া যায়। আমার ধারণা কিছুদিনের মধ্যে রাজাকাররা গাঙ্গুলি মহাশয়ের জমি দখল করিয়া লইবে এবং সেখানে নিজেদের লোক বসাইয়া দিবে।

ঘটনাটি ঘটিয়াছিল সন্ধ্যা নাগাদ। সারা রাত্রি ভাইসাহেবের লাশ পথের ধারে পড়িয়া ছিল। খবর পাইয়া পরদিন আমরা উঠাইয়া লইয়া আসি।

বুঝিতেই পারিতেছেন, ভাইসাহেবের মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমাদের পরিবারের সকলে ভাঙিয়া পড়িয়াছে। এই দুঃসময়ে আবদুল আসিয়া রামরতন গাঙ্গুলির মৃত্যু সংবাদ দিল। মাস্টার মহাশয়ের আশা ছিল দেশের সম্পত্তি বাবদ টাকা পাইবেন। তাহাই হইবে তাহার শেষ জীবনের সম্বল। কিন্তু কিছুই করা গেল না। মাস্টার মহাশয়ের স্ত্রী এবং কন্যাদের ভবিষ্যৎ কী হইবে, কীভাবে তাহাদের চলিবে, ভাবিয়া পাইতেছি না। বিস্তারিতভাবে সব আপনাকে জানাইলাম। সালাম।
ইতি শাহেদ আলি

চিঠি পড়া শেষ হলে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে বিনয়।

.

রামরতনদের সম্পর্কে আগেই সব শুনেছেন দ্বারিক দত্তরা। পাকিস্তান থেকে আসার সময় ট্রেনের গাদাগাদি ভিড়ে কীভাবে প্রাক্তন মাস্টারমশাইটির শোচনীয় মৃত্যু ঘটেছে, তার স্ত্রী এবং মেয়েরা কী নিদারুণ গ্লানির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে তার খুঁটিনাটি বিবরণও তাদের জানিয়েছে বিনয়। কদিন আগে এই ঘরে বসেই রামরতনদের জামতলির বিষয়সম্পত্তির ব্যাপারে খোঁজখবর নেবার বা সম্ভব হলে, বিক্রি কিংবা এক্সচেঞ্জ করার দায়িত্বও নিত্য দাসকে দিয়েছিল বিনয়ই। জামতলি থেকে শাহেদ আলির যে চিঠিটা এসেছে তাতে যে আদৌ কোনও সুসংবাদ নেই তার মুখচোখ দেখে টের পাওয়া যাচ্ছিল।

উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে বিনয়কে লক্ষ করছিলেন দ্বারিক দত্ত এবং সুধা। দ্বারিক দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, কী লিখেছে শাহেদ আলি?

আচ্ছন্নের মত বসে ছিল বিনয়। নীরবে চিঠিটা দ্বারিক দত্তকে দিল সে। তার পড়া হলে সেটা গেল সুধার হাতে।

চিঠির বয়ানটা এখন সবারই জানা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের জন্য বাইরের এই ঘরখানা একেবারে নিঝুম হয়ে যায়।

একসময় অপার নৈঃশব্দ্য কাটিয়ে দ্বারিক দত্ত বিষণ্ণ সুরে বললেন, পাকিস্তানে নাসের আলির মতো মানুষ যে ছিল, ভাবতেই পারিনি। রামরতন গাঙ্গুলি তার কে? স্কুলে তার কাছে কয়েক বছর পড়েছিল–এই তো। পুরোনো শিক্ষকের জন্যে প্রাণটা দিয়ে দিল।

সারা পাকিস্তান জুড়ে এখন শুধুই অবিশ্বাস। চারদিক বিষবাষ্পে ভরা। দখল হয়ে যাচ্ছে হিন্দুদের বিষয়আশয়। লুট হয়ে যাচ্ছে অস্থাবর সম্পত্তি। ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে যুবতী মেয়েদের। এমন এক দমবন্ধ-করা আবহাওয়ায় নাসের আলি যেন অপার্থিব কোনও দেবদূত।

নিত্য দাস আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, হ। মাইয়ের লাখান একখান মানুষ। যোয়ম্ ভগমানও এতখানি করত না।

সুধার বড় বেশি আবেগ। চিঠিতে নাসের আলির ভয়াবহ মৃত্যুর খবরটা পড়ে অভিভূত হয়ে পড়েছে সে। নিত্য দাসের কথায় সায় দিয়ে সে আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ। তারপর বলে, ওঁর তো তবু ভাই ছেলে মেয়ে আছে। ফ্যামিলিটা ভেসে যাবে না। কিন্তু রামরতন গাঙ্গুলির স্ত্রী আর মেয়েদের কী হবে?

কিছুদিন আগে বিমল গাঙ্গুলিদের ভাড়া বাড়িতে গিয়ে রামরতনের স্ত্রী এবং তিন মেয়েকে দেখে এই চিন্তাটাই বিনয়কে ভীষণ বিচলিত করে তুলেছিল। কিন্তু তারপর একের পর এক কত কিছু ঘটে গেল। মৃত রামরতনের পরিবারের ভাবনাটা ক্রমশ ফিকে হয়ে গিয়েছিল। আজ শাহেদ আলির চিঠিটা পড়ার পর দুশ্চিন্তাটা সহস্রগুণ ভারী হয়ে তার মাথায় চেপে বসেছে।

রামরতনের স্ত্রী তার হাত ধরে তাদের দুই মেয়ে ছায়া আর মায়ার জন্য একটা ভদ্র রকমের কাজ জুটিয়ে দিতে ব্যাকুলভাবে কত যে কাকুতি মিনতি করেছিলেন। কিন্তু সে আত্মকেন্দ্রিক, নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। নিজের চাকরি বাকরি, নিজের ভবিষ্যৎ, এ-সবের বাইরে আর কোনও দিকে তাকাবার সময় পায়নি। অথচ মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল ছায়া-মায়ার কাজের ব্যাপারে হিরণ এবং আনন্দকে বলবে।

একই বাড়িতে হিরণদের কাছে থাকে বিনয়। আনন্দ সুদূর উত্তর কি দক্ষিণ মেরুতে থাকে না যে তার সঙ্গে যোগাযোগ অসম্ভব। ওদের বাড়িতে সে যায় না ঠিকই, তবে তার অফিসে যেতে পারে কিংবা একটা ফোন করা এমন কী মারাত্মক কঠিন কাজ? তবু হিরণকে বলা হয়নি। আনন্দকে ফোন করার কথাও তার মাথায় আসেনি। তীব্র অপরাধবোধে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যেতে থাকে বিনয়। মনে মনে ঠিক করে নেয় আজকালের মধ্যে ছায়া-মায়ার সম্বন্ধে হিরণদের সঙ্গে কথা বলে নেবে।

কিন্তু চাকরির আর্জি জানানো মাত্রই তো চাকরি হয়ে যায় না। তার জন্য দুচার মাস অপেক্ষা করতে হয়। এই দীর্ঘ সময় বিমলদের বাড়িতে কেমন করে ছায়া-মায়াদের কাটবে? আরও কতটা অসম্মান আর কতখানি গ্লানি তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে, কে বলবে।

বিনয় জানে, রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েরা দেশের সম্পত্তি বিক্রির টাকার আশায় উগ্রীব হয়ে আছে। ওটুকুই তাদের শেষ সম্বল। টাকাটা তাড়াতাড়ি পাওয়া গেলে প্রতি মুহূর্তের অপমানের হাত থেকে ওরা রেহাই পেত। সসম্মানে বাঁচার একটা পথ তাদের সামনে খুলে যেত। কিন্তু শাহেদ আলি যা জানিয়েছে তাতে সমস্ত আশা ধূলিসাৎ।

বিনয় ভাবে, এই খবরটা রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েদের দিয়ে আসা দরকার। পরক্ষণে খেয়াল হয়, শাহেদ আলির চিঠির কথা জানালে নিমেষে ওদের চারজনের চোখের সামনে সমস্ত ভবিষ্যৎ খান খান হয়ে যাবে। রামরতন মারা গেছেন, বৃদ্ধ বয়সে যদিও সে-মৃত্যু খুবই শোচনীয় তবু চার রমণী তা অনেকখানিই সামলে নিয়েছেন। কিন্তু বিষয়আশয় হারানোর শোক কতটা কাটিয়ে উঠতে পারবেন, আন্দাজ করা যাচ্ছে না।

বিনয়ের মস্তিষ্কের ভেতর বিদ্যুৎ গতিতে চিন্তার কাজটা চলছিল। একটার পর একটা ভাবনা। এবার চকিতে সে ঠিক করে ফেলে, না, আপাতত শাহেদ আলির চিঠির কথা জানাতে সে বিমল গালিদের বাড়ি যাবে না। ছায়া বা মায়ার জন্য একটা কাজের বন্দোবস্ত করে তবেই ওদের সঙ্গে। গিয়ে দেখা করবে। ততদিন অবশ্য ওদের দুর্গতির সীমা পরিসীমা থাকবে না। কিন্তু কী আর করা যাবে?

দ্বারিক দত্ত নিত্য দাসকে বললেন, তোর তো কত লোক পাকিস্তানে রয়েছে। তাদের দিয়ে শেষ চেষ্টা একটা করে দ্যাখ না যদি রামরতন মাস্টারের জমিজমার কিছু গতি করা যায়–

মুখটা ম্লান হয়ে যায় নিত্য দাসের। আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে থাকে সে। শাহেদ আলির পত্রখানা তো পড়লেন ঠাউরদা। পাকিস্থানে মুসলিম লিগ রাজাকারগো উপুর কথা কইব ক্যাঠা (কে)? মাস্টর মশয়গো জমিনজুমিন ব্যাচতে গিয়া জানডাই চইলা গ্যাল নাসের সাহেবের। এইর পর কার অ্যামুন বুকের পাটা আছে যে কিছু করে। একটু চুপ করে থাকার পর বলল, না, কুনো ভরসা নাই। যেহানে যেহানে রাজাকার আর মুসলিম লিগের দাপট বেশি হেই হগল জাগায় হিন্দুর জমিন ফাঁকা পইড়া থাকনের কি জো আছে? শাহের আলি ঠিকই ল্যাখছে অ্যাদ্দিনে মাস্টরমশয়ের সোম্পত্তি বেদখল হইয়া যাওনের কথা। তভু আপনে যহন কইতে আছেন, তহন খোঁজ-খবর লওনের চ্যাষ্টা করুন।

দ্বারিক দত্ত আর কিছু বললেন না।

সুধা এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। এবার বলে উঠল, বিনু, আমার একটা কথা ভেবে দেখবি?

 বিনয় উৎসুক চোখে সুধার দিকে তাকায়, কী ভাবব?

যুগলকে বলে রামরতন গাঙ্গুলির স্ত্রী আর মেয়েদের মুকুন্দপুর কলোনিতে থাকার ব্যবস্থা করে দে। সেখানে গেলে ওরা অন্তত মর্যাদার সঙ্গে থাকতে পারবে। পদে পদে এত অসম্মান সহ্য করতে হবে না।

এ-দিকটা আগে ভেবে দেখেনি বিনয়। হাতের কাছেই মুকুন্দপুর বাস্তুহারা কলোনি ছিল। মুখের কথা খসালেই যুগলরা এসে রামরতনের পরিবারকে মাথায় করে নিয়ে যাবে। মুষড়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ উদ্দীপনায় ভেতরে ভেতরে টগবগানি অনুভব করে সে। উৎসাহের সুরে বলে, ওঁদের মুকুন্দপুর যাওয়ার ব্যাপারে কোনও সমস্যা নেই। জমি তো পাবেনই, মাথা গোঁজার মতো একটা ঘরও তুলে দেবে যুগলরা। বলতে বলতে আচমকা কী খেয়াল হতে ভীষণ দমে যায়, কিন্তু,

কিন্তু কী?

থাকার বন্দোবস্ত হয় করে দেওয়া যাবে। তবে অন্য একটা বড় সমস্যাও তো রয়েছে।

কীসের সমস্যা?

ওঁদের চলবে কী করে?

এই প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। ঘরের বাকি সবাই নিঃশব্দে বসে থাকে।

বিনয় এবার জানায়, মুকুন্দপুরবাসীদের যা হাল তাতে উদয়াস্ত খেটে কোনওরকমে তারা পেটের। ভাত জোটায়। দুটো পয়সার জন্য কতরকমের যে তাদের উঞ্ছবৃত্তি! এদের অবস্থা দিন আনি দিন খাই। বাড়তি চারজন মানুষের দায় নেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

রামরতনের স্ত্রী এবং তাঁর মেয়েদের সমস্যাগুলো যেমন ছিল তেমনই থেকে গেল।

হঠাৎ বিনয়ের চোখ সামনের দেওয়াল ঘড়িটার ওপর গিয়ে পড়ে। বারোটা বেজে সতেরো। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ওঠে সে।–ইস, অনেক বেলা হয়ে গেছে। আর দেরি করলে অফিসে লেট হয়ে যাবে। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায়।

নিত্য দাসও আর বসল না। তারও কী একটা জরুরি কাজের কথা মনে পড়ে গেছে। বলল, আমারেও একহানে লৌড়াইতে (এক জায়গায় দৌড়তে) অইব। এক মিঞাসাব তেনার ইন্ডিয়ার সোম্পত্তি এচ্চেঞ্জ করতে চায়। বারোটায় তেনার লগে দ্যাখা করনের কথা। এইহানেই সোয়া বারোটা বাইজা গ্যাছে।

নিত্য দাস চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *