১১-১৫. চোখাচোখি হতে হাতছানি

১১.

চোখাচোখি হতে হাতছানি দিল ঝুমা, এখানে এস– সেই কবে, যুদ্ধের আমলে রাজদিয়ায় থাকার সময় বিনয়ের নাকে একটা অদৃশ্য বঁড়শি আটকে দিয়েছিল মেয়েটা। তারপর কত কী-ই তো ঘটে গেল! দুর্ভিক্ষ। দাঙ্গা। দেশভাগ। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর সঙ্গে ধর্ষিত ঝিনুককে নিয়ে পাকিস্তান থেকে সীমান্তের এপারে চলে আসা। কবছরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড উথালপাতাল। কিন্তু সেই বঁড়শিটা যেমন ছিল তেমনই নাকে গেঁথে আছে।

ট্রাম রাস্তা পেরিয়ে পায়ে পায়ে ঝুমার কাছে চলে গেল বিনয়। ঝিনুক নিখোঁজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সারাক্ষণ জড়িয়ে আছে শ্বাসবায়ুতে। রয়েছে সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। কিন্তু কুমার সঙ্গে দেখা হলেই নিশ্বাস তপ্ত হয়ে ওঠে। পা থেকে মাথা অবধি কেমন যেন আনচান আনচান করতে থাকে। একদিন দুপুরে ওদের রাজদিয়ার ছাদের ঘরে তাকে দুহাতে জাপটে ধরে চুমু খেয়েছিল মেয়েটা। তার নতুন, নরম স্তন লেপটে গিয়েছিল বুকের ভেতর। তার ভোলা চুল আর সারা শরীর থেকে আশ্চর্য এক সুগন্ধ উঠে এসে নাকের ভেতর দিয়ে শিরায় শিরায় ছড়িয়ে গিয়ে সব কিছু অবশ করে দিয়েছিল। সেদিন আচ্ছন্নের মতো বাড়ি ফিরে গিয়েছিল বিনয়। সেই একটি তপ্ত চুম্বন, কিশোরীর সুগোল স্তনের প্রথম স্পর্শ, তার দেহের অলৌকিক সুঘ্রাণ–সব একাকার হয়ে যৌবনের অপার, অজানা রহস্যের দরজা খুলে গিয়েছিল বিনয়ের সামনে।

এতকাল বাদেও সেই আচ্ছন্নতা কাটেনি। কলকাতায় আসার পর বার দুই ঝুমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। একবার সুনীতির শ্বশুরবাড়িতে। আর-একবার টালিগঞ্জে সুধাদের বাড়িতে। ওকে দেখলেই নেশার মতো ঝিন ঝিন করে মাথার ভেতর কী যেন বাজতে থাকে। আজও তার হেরফের নেই। নেশার ঘোরটা নতুন করে বিনয়কে আবার পেয়ে বসে।

এই কবছরে কত সুন্দর হয়ে উঠেছে ঝুমা। এখন সে পূর্ণ যুবতী। পুষ্ট স্তন, রাজহাঁসের মতো মসৃণ গলা, লম্বাটে ভরাট মুখ, সরু কোমর, ঘন পালকে-ঘেরা চোখের গভীর দৃষ্টি, সুঠাম চিবুক, কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা মিহি সিল্কের মতো চুল। পেছন দিকটা ভারী। কলকাতার বড় ঘরের মেয়েদের চেহারায় আলাদা একটা পালিশ থাকে। ঝুমারও আছে।

এই মুহূর্তে কুমার পরনে মেরুন রঙের দামি রেশমি শাড়ি, একই রঙের ব্লাউজ, পায়ে ধবধবে সাদা ফিতেওলা স্লিপার। কাঁধ থেকে একটা সুদৃশ্য চামড়ার ব্যাগ নেমে এসেছে। গলায় সোনার সরু চেন, বুকের কাছে মীনে-করা মাছের আকারে লকেট ঝুলছে। বাঁ হাতে সোনালি ব্যাণ্ডে বাঁধা ফেবার লিউবা কোম্পানির ওভাল শেপের ঘড়ি। কানে রক্তবিন্দুর মতো চুনি-বসানো কানফুল, নাকের পাটায় হীরের নাকছাবি। যখনই ঝুমার সঙ্গে দেখা হয়, মনে হয়, এক অপার্থিব পরী সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

পৌষ মাস প্রায় এসে গেল। এগারোটা বাজতে চলেছে। শহরের তাপাঙ্ক সামান্য বেড়েছে, কিন্তু উত্তুরে হাওয়া কদিন আগের তুলনায় অনেক বেশি শীতল, অদৃশ্য হিম ছড়িয়ে ছড়িয়ে উলটোপালটা বয়ে চলেছে।

বাতাসে ঝুমার চুল উড়ছিল। রাজদিয়ায় যেমনটা হতো, অবিকল তেমনি ঝুমার গা থেকে, তার শাড়ি টাড়ি থেকে মিষ্টি গন্ধ উঠে এসে নাকে ঢুকছে। তবে এই গন্ধটা রাজদিয়ার তুলনায় অনেক বেশি উগ্র।

ঝুমা বলল, তোমার সঙ্গে এখানে দেখা হয়ে যাবে, ভাবতে পারিনি। হোয়াট আ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ!

ঝুমা ম্যাট্রিক আর আই এতে ভাল রেজাল্ট করেছিল। নামকরা কলেজে অনার্স নিয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে তার কথাবার্তায় দুচারটে ইংরেজি শব্দ ঢুকে যায়। বিনয় বলল, তোমাকে দেখব, আমিও ভাবিনি।

বা রে, এটা আমাদের পাড়া। হেদুয়ার বাঁধানো সুইমিং পুলের ওধারে আঙুল বাড়িয়ে ঝুমা বলল, ওই যে আমাদের কলেজ

হেদুয়ার সামনের দিকে বেথুন কলেজ। উলটো দিকে স্কটিশ চার্চ। ঝুমা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল সে স্কটিশে পড়ে।

বিনয় জিজ্ঞেস করল, কলেজে যাচ্ছিলে?

না। ঝুমা জানায়, কলেজে গিয়েছিল, কিন্তু একজন প্রাক্তন অধ্যাপকের মৃত্যু-সংবাদ আসায় ছোটখাটো একটা শোকসভার আয়োজন করা হয়। তারপর পরলোকগত শিক্ষকের সম্মানে প্রিন্সিপ্যাল ছুটি দিয়ে দেন। এখন সে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।

বিনয় বলল, ও–।

তুমি তো সেই টালিগঞ্জে সুধা মাসিদের কাছে থাক। এদিকে কোথায় এসেছিলে? আনন্দমামাদের বাড়ি?

অবনীমোহন বাড়িটাড়ি বেচে হরিদ্বার চলে যাবার পর সে যে সুধাদের কাছে গিয়ে উঠেছে, এই খবরটা নিশ্চয়ই সুনীতিদের কাছে জেনেছে ঝুমা। আনন্দদের বাড়ির কথা বলতেই চোখের দৃষ্টি কঠোর হয়ে উঠে বিনয়ের। রূঢ় গলায় বলে, না।

বিনয়ের মনোভাব আঁচ করে নেয় ঝুমা। তার মুখ ম্লান হয়ে যায়, হা, দিদা ঝিনুকের সঙ্গে যা ব্যবহার করেছে, তাতে তুমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছ। বুঝতে পারি ও-বাড়িতে তুমি আর কখনও যাবে না।

বিনয় উত্তর দিল না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর ঝুমা জিজ্ঞেস করে, মামাদের বাড়ি যাওনি। তাহলে?

বিনয় বলল, রামরতন গাঙ্গুলির স্ত্রী আর মেয়েদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম।

এরা কারা?

 বিনয়ের মনে পড়ল, রামরতনদের সম্বন্ধে কখনও ঝুমার সঙ্গে তার কথা হয়নি। জামতলির প্রাক্তন হেড মাস্টারটির সঙ্গে কীভাবে আলাপ, গোয়ালন্দ থেকে কলকাতায় আসার পথে রিফিউজি বোঝাই স্পেশাল ট্রেনে কীভাবে তার শোচনীয় মৃত্যু, তার স্ত্রী এবং মেয়েরা নিজেদের ঘনিষ্ঠ পরিজন বিমল গাঙ্গুলির ভাড়াটে বাসায় কী দুঃসহ, গ্লানিকর জীবনযাপন করছে, ধীরে ধীরে সব শোনালো সে।

বিষণ্ণ সুরে ঝুমা বলল, পাকিস্তান অনেক লোকের অনেক ক্ষতি করে দিয়েছে। শুনতে পাই ওপার থেকে যারা আসছে তারা কেউ সুখে নেই। মহা বিপদে তাদের দিন কাটছে।

বিনয় কিছু বলে না।

ঝুমা বলল, তুমি হেঁটে হেঁটে কোথায় যাচ্ছিলে?

টালিগঞ্জ ফিরতে হবে না?

 ঝুমা বেশ অবাক হল, চিত্রা সিনেমার কাছ থেকেই তো এসপ্ল্যানেডের গাড়ি ধরতে পারতে। এসপ্ল্যানেড থেকে টালিগঞ্জের রুটের প্রচুর ট্রাম বাস পাওয়া যায়

এতটা রাস্তা হেঁটে আসার কারণ জানিয়ে দিল বিনয়।

হঠাৎ ঝুমার চোখমুখ খুশির ছটায় ভরে যায়। রামরতনের স্ত্রী ও মেয়েদের জন্য খানিক আগের সেই বিষাদের লেশমাত্র অবশিষ্ট নেই। ভাবনাহীন, চঞ্চল বালিকার মতো সে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, ভাগ্যিস তার ছিঁড়ে ট্রাম ডিরেলড হয়েছিল, তাই তোমার সঙ্গে দেখা হল।

সেই কবে থেকে মেয়েটাকে দেখে আসছে বিনয়। সারাক্ষণ যেন লঘু মেজাজে হাওয়ায় ভাসছে। এই পৃথিবীর শোক, দুঃখ আর যাতনা, তাকে ছুঁয়ে যায় ঠিকই। বিচলিতও করে। কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী। দীর্ঘকাল সে-সব নিয়ে মগ্ন থাকা তার স্বভাবে নেই।

ঝুমা বলল, রাজদিয়ায় তুমি আমাকে একটা প্রমিস করেছিলে বিনুদা—

 বিনয় মনে করতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, কীসের প্রমিস বল তো? 

কলকাতায় এলে আমাদের বাড়ি আসবে। সুধা মাসিদের ওখানে গিয়ে সেদিনও তোমাকে বলে এসেছি। বুঝি, ঝিনুকের জন্যে আসতে পারনি। এখন তো সে ভয় নেই। এস

বুকের ভেতরটা ছাঁৎ করে ওঠে বিনয়ের। ঝুমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঝিনুকের চিন্তা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। জাদুকরীর মতো অসীম শক্তি এই মেয়েটার। সৌরলোকের সব কিছু

সে লহমায় ভুলিয়ে দিতে পারে।

ঝুমার কাছে এলে কেন যে অন্য কিছু মনে থাকে না? কিন্তু একমাত্র ঝিনুককেই ভোলা যায় না। তার জন্য হঠাৎই অনুশোচনায় বুকের ভেতরটা মুচড়ে যেতে থাকে। চকিতে একবার আকাশের দিকে তাকায় বিনয়। সূর্য প্রায় মাথার ওপর উঠে এসেছে। বিমলদের বাড়িতে যা বলেছিল, ঝুমাকেও তাই বলল, সকালে বেরিয়ে পড়েছিলাম। কোথায় যাচ্ছি, ছোটদিকে বলে আসা হয়নি। অনেক বেলা হয়ে গেল। নিশ্চয়ই ওরা খুব চিন্তা করছে। আজ তোমাদের বাড়ি যাওয়া হবে না। আর-একদিন ঠিক যাব।

আদুরে গলায় ঝুমা বলল, এখন তোমাকে কিছুতেই ছাড়ছি না। আমাদের বাড়ি এখান থেকে মিনিট তিনেকের রাস্তা। বেশিক্ষণ আটকাব না। তোমাকে দেখলে সবাই ভীষণ খুশি হবে।

বেলার দোহাই দিয়ে ফের আপত্তি করতে যাচ্ছিল বিনয় কিন্তু কিছুতেই ঠেকানো গেল না ঝুমাকে, কোনও বাহানা শুনতে চাই না। ফের যদি না না কর, হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাব। সেটা কি ভাল হবে?

সারা শরীরে চমক খেলে গেল বিনয়ের। ঝুমার অসাধ্য কিছু নেই। একটি চোখধাঁধানো, বেপরোয়া তরুণী প্রকাশ্য দিবালোকে শয়ে শয়ে মানুষের চোখের সামনে তাকে টেনে নিয়ে চলেছে, দৃশ্যটা ভাবার মতো দুঃসাহস তার নেই। এই একটি মেয়ে, যার সামনে কোনও সংকল্পই বেশিক্ষণ অটুট। রাখা যায় না। মিনমিনে গলায় বিনয় বলল, ঠিক আছে, চল

ঝুমার ঠোঁটের ফাঁকে নীরব হাসির আভা ফুঠে ওঠে। কী মিশে আছে সেই হাসিতে? সীমাহীন অহমিকা? দম্ভ? সে কি বোঝাতে চায়, একটি পুরুষকে তুড়ি মেরে নিজের ইচ্ছায় চালানোর ক্ষমতা তার আছে?

দুই চোখ সামান্য ছোট করে ঝুমা বলে, দ্যাটস লাইক আ গুড বয়। এস একটু থেমে বলল, আমাদের বাড়ি গেলে রাজদিয়ার দুজনের সঙ্গে দেখা হবে। তোমার খুবই চেনাজানা।

বিনয় উৎসুক হল, কারা তারা?

চলই না। এত অধৈর্য কেন?

হেদুয়ার দক্ষিণ পাশের রাস্তা থেকে ডান দিকে সেকেন্ড যে গলিটা বেরিয়েছে সেটাই রমাকান্ত চ্যাটার্জি লেন। মাঝারি রাস্তাটা দিয়ে কপা এগুলেই ঝুমাদের দোতলা বাড়ি। আনন্দদের মতো বিশাল না হলেও বাড়িটা বেশ বড়ই। সামনের দিকে ফুলের বাগান। তারপর গাড়ি-বারান্দা। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলে চওড়া চাতাল। তারপর কারুকাজ করা বিশাল দরজা।

বিনয় শুনেছে হেমনলিনীরা এই বাড়িটি তার মেয়ে-জামাই অর্থাৎ স্মৃতিরেখা ও শিশিরকে যৌতুক দিয়েছেন। বিয়ের পর থেকে ওঁরা ওখানে আছেন। এ-বাড়িতেই রুমা ঝুমা, দুই বোনের জন্ম।

দরজা খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকে শ্বেত পাথরে বাঁধানো বড় হল-ঘর। ভারী ভারী সোফা, আলমারি, চার ব্লেডওলা বিরাট বিরাট ফ্যান দিয়ে সাজানো সেটার একধারে কটা বেডরুম, কিচেন, খাবার জায়গা। দুজন কাজের লোককে সেখানে দেখা গেল। ব্যস্তভাবে তারা কী সব করছে।

হল-ঘরের আর-এক ধারে দোতলায় যাবার সিঁড়ি। ওপরে উঠতে উঠতে গলার স্বর উঁচুতে তুলে ঝুমা ডাকতে লাগল, মা মা, দেখ কাকে নিয়ে এসেছি।

দোতলার চওড়া বারান্দার একদিকে ঢালাই-করা লোহার নকশাদার রেলিং। অন্যদিকে সারি সারি ঘর। দক্ষিণ প্রান্ত থেকে একটা নরম কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, কে রে ঝুমা, কাকে এনেছিস? পরক্ষণে দেখা যায় ওধারের শেষ ঘরখানা থেকে স্মৃতিরেখা রেরিয়ে এসেছেন। ঝুমার মা।

সেই যুদ্ধের সময় স্মৃতিরেখাকে শেষ দেখেছিল বিনয়। জাপানি বোমার ভয়ে হাজার হাজার মানুষ কলকাতা ফাঁকা করে পূর্ব বাংলায় উধাও হয়েছিল। সেই আতঙ্কগ্রস্ত পলাতকদের মধ্যে রুমা ঝুমা আনন্দ স্মৃতিরেখা শিশিররাও ছিলেন।

প্রতিমার মতো নিখুঁত মুখ, টানা চোখ, ফুরফুরে লম্বাটে নাক। তখনই কত বয়স স্মৃতিরেখার। কিন্তু ত্বকে ছিল মসৃণ সোনালি আভা। কোমর অবধি চুল। হালকা, মেদহীন শরীর। মাঝখানে কটা বছর কেটে গেছে। কত কিছুই না ঘটে গেল! দুর্ভিক্ষ। মহাযুদ্ধের অবসান। দাঙ্গা। দেশভাগ। কিন্তু কিছু চুল পেকে যাওয়া আর শরীর ভারী হওয়া ছাড়া চেহারা তেমন বদলায়নি।

মাথায় তেল মেখেছেন স্মৃতিরেখা। দূর থেকৈও মৃদু সুঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। কাঁধে ধবধবে সাদা তোয়ালে। খুব সম্ভব স্নান করতে যাচ্ছিলেন। বিনয়কে দেখামাত্র চিনতে পারলেন। দুচোখে অনন্ত বিস্ময় নিয়ে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, বিনু না?

বারান্দায় উঠে এসেছিল ঝুমারা। হ্যাঁ দিদি এগিয়ে গিয়ে স্মৃতিরেখাকে প্রণাম করল বিনয়। ভগ্নীপতির দিদি। সেই সম্পর্ক ধরে স্মৃতিরেখা তারও দিদি। একটা কথা মনে পড়তে ভারী মজা লাগল তার। সে স্মৃতিরেখাকে দিদি বলে। কিন্তু তাঁর মেয়ে তাকে বলে দাদা। মামা বলা উচিত।

স্মৃতিরেখা বললেন, এস, এস। কত বড় হয়ে গেছ!

একথার জবাব হয় না। সময় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে না। নিঃশব্দে তার কাজ করে যায়। বিনয় মুখে কিছু বলল না। একটু হাসল শুধু।

যে-ঘর থেকে স্মৃতিরেখা বেরিয়ে এসেছিলেন, বিনয়দের সেখানেই নিয়ে গেলেন। ঘরটা প্রকাণ্ড। বিশাল ছত্রিওলা মেহগনি কাঠের খাট, পুরো পাল্লা জোড়া কাঁচ-বসানো আলমারি, গদিওলা সোফা, ডিভান, ড্রেসিং টেবল, কুশন–এত সব আসবাব থাকা সত্ত্বেও এধারে ওধারে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। বিনয় আঁচ করে নিল এটা শিশির আর স্মৃতিরেখার বেডরুম।

একটা সোফায় বিনয়কে বসিয়ে স্মৃতিরেখা মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, বিনুকে কোথায় পেলি?

খাটের এক কোণে বসতে বসতে ঝুমা বলল, হেদোর সামনে বিনুদার সঙ্গে দেখা। আসতে চায় না। জোর করে ধরে নিয়ে এলাম।

ভাল করেছিস। বলতে বলতে কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ে স্মৃতিরেখার, কিন্তু

কী?

কলেজ ফাঁকি দিয়ে হেদোর সামনে ঘুরছিলি নাকি?

কী যে বল না- ঝুমা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে। তারপর প্রাক্তন অধ্যাপকের মৃত্যু, শোকসভা, প্রয়াত শিক্ষকের সম্মানে ছুটি হয়ে যাওয়া এবং বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎই বিনয়ের সঙ্গে দেখা, ইত্যাদি জানিয়ে দেয় সে।

স্মৃতিরেখা খাটের আর-এক কোনায় বসে পড়েছিলেন। কেন উত্তর কলকাতার এই এলাকায় হেদুয়ার সামনে বিনয় এসেছিল তা নিয়ে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো এখন সুধা আর হিরণের কাছে আছ?

ভেতরে ভেতরে সতর্ক হয়ে গেল বিনয়। এই প্রশ্নের খেই ধরে কোন দিকে, কতদূর স্মৃতিরেখা এগুবেন, বোঝা যাচ্ছে না। সংক্ষেপে বিনয় বলল, হ্যাঁ।

মেসোমশাই, মানে তোমার বাবা বাড়িটাড়ি বেচে হরিদ্বার চলে গেলেন। সবে তুমি পাকিস্তান থেকে এসেছ। আর কিছুদিন থেকে, তোমাকে একটু দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেলে বোধ হয় ভাল হতো।

কেন, আমি তো একটা চাকরি পেয়েছি।

বিনয়ের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন স্মৃতিরেখা। মনে হল, অবনীমোহনের কার্যধারা সম্পর্কে মন্তব্য করা বোধহয় ঠিক হয়নি। বিশেষ করে বিনয়ের কাছে। ব্যাপারটা চাপা দেবার জন্য ব্যস্তভাবে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার খেয়াল ছিল না। শুনেছি, খবরের কাগজে কাজ পেয়েছ।

আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।

স্মৃতিরেখা বললেন, গভর্নমেন্ট কি বড় সাহেব কোম্পানিতে চাকরি পেলে ভাল হতো। ওই সব জায়গায় অনেক সুযোগ সুবিধা। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।

বিনয় বলল, সেটা ঠিক। আপাতত যা পেয়েছি তাই করি। পরে দেখা যাবে।

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল। তেমন কিছু জরুরি নয়। খুব সাধারণ। এমন দিনে বিনয় এল যখন শিশির বাড়িতে নেই। অফিসে গেছে। যে-বছর আনন্দর বিয়ে হয় সে-বছরই ঝুমার দিদি রুমারও বিয়ে হয়েছিল। সে থাকে টাটানগরে। তার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার। ওরা থাকলে বিনয়কে পেয়ে হইচই বাধিয়ে দিত। ইত্যাদি ইত্যাদি।

বেশ খানিকটা সময় স্মৃতিরেখার সঙ্গে কাটালো বিনয়। অনেক কথাও হল। ভেতরে ভেতরে চাপা উদ্বেগ চলছিল তার। এই বুঝি ঝিনুকের প্রসঙ্গ ওঠে। কিন্তু সেদিক দিয়েই গেলেন না স্মৃতিরেখা। মাত্র কদিন আগে মেয়েটা নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। বিশ্বসুদ্ধ কারও সেটা জানতে বাকি নেই। স্মৃতিরেখা শোনেননি, তা তো আর হয় না। কিন্তু মহিলা বুদ্ধিমতী। অত্যন্ত বিচক্ষণ। সহৃদয়ও। ঝিনুকের জন্য কার বুকের ভেতর কতখানি ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে আছে, তার অজানা নেই। অহেতুক ঝিনুকের প্রসঙ্গ তুলে ছেলেটাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ?

কথা বলতে বলতে উৎকণ্ঠা কেটে যাচ্ছিল বিনয়ের। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল সে।

একসময় স্মৃতিরেখা বললেন, অনেক বেলা হয়ে গেছে। এখানেই চান টান করে দুটি শাকভাত খেয়ে নাও

ব্যস্তভাবে বিনয় বলল, না না, আজ আর খেতে বলবেন না দিদি।

এই দুপুরবেলায় কেউ না খাইয়ে ছাড়ে?

কেন তার টালিগঞ্জে এখনই ফিরে যাওয়া দরকার, বুঝিয়ে বলল বিনয়। ঝুমাকেও তা-ই বলেছিল।

একটু চুপ করে থেকে স্মৃতিরেখা বললেন, হ্যাঁ, তোমার ফিরে যাওয়াই দরকার। তবে তুমি প্রথম দিন এলে, একটু কিছু মুখে দিয়ে না গেলে আমাদের খুব খারাপ লাগবে। আমি তাড়াতাড়ি চান করে আসছি। হঠাৎ কী মনে পড়ে যাওয়ায় ঝুমাকে বললেন, ওই দেখ, একদম খেয়াল ছিল না। তুই বিনুকে তোর দাদু আর ঠামুর ঘরে নিয়ে যা। ওকে দেখলে ওঁরা খুশি হবেন।

ঝুমারও মনে পড়ে গেল। বিনয়কে বলল, তোমাকে তখন দুজন দেশের মানুষের কথা বলছিলাম না? দেখবে চলণ

কুমার দাদু আর ঠাকুমা। তার মানে রামকেশব এবং তার স্ত্রী। ওঁরাও তাহলে রাজদিয়া ছেড়ে চলে এসেছেন! রামকেশব মানুষটা ছিলেন ভীষণ একরোখা, প্রচণ্ড সাহসী। অবিকল হেমনাথের মতো। তিনিও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাই ঘটুক, জন্মভূমি ফেলে কখনও সীমান্তের এপারে আসবেন না। এই তো সেদিন বিনয় কলকাতায় এসেছে। রাজদিয়ায় থাকতে প্রায়ই রামকেশবদের বাড়ি গিয়ে ওঁদের খোঁজখবর নিত। নিশ্চয়ই এর ভেতর এমন কিছু ঘটেছে–ভয়াবহ এবং বিপজ্জনক–যাতে পাকিস্তানে থাকা সম্ভব হয়নি। তার সংকল্পের ভিতটা টলে গেছে। রামকেশব যখন দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, হেমনাথ কি আর ভাল আছেন? উৎকণ্ঠায় বুকের গভীর তলদেশ পর্যন্ত কেঁপে যায় বিনয়ের।

নিত্য দাসের হাত দিয়ে হেমনাথকে দ্বিতীয় যে চিঠিখানা বিনয় পাঠিয়েছিল, এখনও তার জবাব আসেনি। হঠাৎ মনে পড়ল, চিঠিটা নিয়ে যাবার পর লোকটাকে আর দেখা যায়নি। হেমনাথের জন্য অসীম শঙ্কায় শ্বাস আটকে আসতে থাকে। তারই ভেতর বিনয়ের মনে হয়, কবে পাকিস্তান থেকে হেমনাথের উত্তর আসবে তার ঠিকঠিকানা নেই। ঝুমাদের বাড়ি এসে একরকম ভালই হয়েছে। রামকেশবের মুখ থেকে হেমনাথদের এখনকার খবরটা জানা যাবে।

বারান্দার আর-এক মাথায় শেষ ঘরখানায় বিনয়কে নিয়ে এল ঝুমা। স্মৃতিরেখা শিশিরের শোবার ঘরের মতো এটাও সেকেলে আসবাবে বোঝাই।

ঘরের মাঝখানে খাটের ওপর শুয়ে ছিলেন রামকেশব। অন্যদিকে দেওয়ালের ধার ঘেঁষে কাঠের সিংহাসনে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মূর্তি। কোনওটা তামার, কোনওটা পাথরের, কোনওটা রুপোর। রামকেশবের স্ত্রী পশমের আসনে বসে পুজোর আয়োজন করছিলেন।

ওই সিংহাসন আর দেবদেবীদের রাজদিয়ায় রামকেশবের বাড়িতে বহুবার দেখেছে বিনয়। দেশ থেকে আর কিছু আনতে পেরেছেন কি না, কে জানে। কিন্তু ঠাকুরদেবতাকে ফেলে আসেননি।

ঝুমা হইহই করতে করতে ঘরে ঢুকেছে, দাদু, ঠামু, দেখ তোমাদের দেশের লোককে ধরে আনলাম।

খাটের ওপর ধড়মড় করে উঠে বসলেন রামকেশব। পরনে ধুতি এবং ফতুয়ার ওপর মোটা উলের ফুলহাতা সোয়েটার।

হেমনাথের কাছাকাছি বয়স। হয়তো দুচার বছরের ছোটই হবেন রামকেশব। কিন্তু এর মধ্যেই ভীষণ বুড়িয়ে গেছেন। মুখ শীর্ণ। ঘোলাটে চোখ। চুল উঠে উঠে মাথা প্রায় কঁকা। যা কয়েক গাছা আছে সেগুলোর রং পাঁশুটে।

মাথার বালিশের পাশে বিঘত খানেক লম্বা চশমার খাপ ছিল। সেটা খুলে নিকেলের গোলাকার বাইফোকাল চশমা বার করে পরে নিলেন রামকেশব। বিনয়কে দেখে বৃদ্ধ খুবই খুশি। বেশ অবাকও। বললেন, আরে বিনু না? কলকাতায় পা দিতে না-দিতেই তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বোসো-বোসো-।

বিনয় এগিয়ে গিয়ে রামকেশবকে প্রণাম করল। এদিকে দেবদেবীর আরাধনা স্থগিত রেখে ঘুরে বসেছেন রামকেশবের স্ত্রী। তারও পা ছুঁতে যাচ্ছিল বিনয়, কিন্তু বাধা পড়ল। রামকেশবের স্ত্রী হাত নেড়ে বললেন, পুজোয় বসেছি। এখন প্রণাম নিতে নেই।

অগত্যা খাটের কোণে বসে পড়ল বিনয়। ঘরের অন্য এক ধারের দেওয়াল ঘেঁষে খানকয়েক গদিওলা মোড়া দাঁড় করানো রয়েছে। তার একটা টেনে এনে কাছাকাছি বসল ঝুমা। হাসি হাসি মুখে বলল, কী দাদু, কালই বিনুদার কথা বলছিলে। আজই তাকে তোমার সামনে হাজির করে দিলাম। ভাবতে পেরেছিলে?

রামকেশব হাসলেন, না রে দিদি, ভাবিনি।

কাল তার সম্বন্ধে আলোচনা হয়েছিল এ-বাড়িতে। কী বলেছিলেন রামকেশব? আন্দাজ করতে চেষ্টা করল বিনয়। কিন্তু আকাশপাতাল হাতড়ে কিছুই আঁচ করা যাচ্ছে না। এই নিয়ে সে কোনও প্রশ্ন করল না। এখানে যখন এসেই পড়েছে, কী কথাবার্তা হয়েছে, অবশ্যই জানা যাবে। সে উৎসুক হয়ে রইল।

বিনয় জিজ্ঞেস করল, দেশ থেকে কবে এলেন?

 রামকেশব বললেন, পরশু

 আপনি না বলেছিলেন, কোনওদিন রাজদিয়া ছেড়ে আসবেন না?

হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু প্রতিজ্ঞা পালন করা গেল না। হঠাৎ কী হল?

তুমি থাকতে থাকতে রাজাকারদের কিছু কিছু উৎপাত হচ্ছিল। গত দশ দিনে তাদের অত্যাচার যে কতগুণ বেড়েছে, ভাবতে পারবে না।

রাজাকারদের দৌরাত্মের কথা হেমনাথও তার চিঠিতে লিখেছিলেন। হয়তো খানিকটা রেখে ঢেকে, বিনয়রা যাতে দুশ্চিন্তায় না থাকে। কিংবা চিঠি লেখার সময় তা অতখানি মারাত্মক হয়ে ওঠেনি। নির্যাতন কতটা লাগামছাড়া হয়ে উঠলে রামকেশবের মতো মানুষও দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তা অনুমান করতে পারছে বিনয়।

রামকেশব সবিস্তার আরও জানালেন। রাজাকারদের ঝাট থাকলেও বাঙালি মুসলমানরা তাদের খুব একটা পাত্তা দিত না। পার্টিশানের পর ইন্ডিয়া থেকে পশ্চিমা মুসলমানরা ঢাকা চট্টগ্রাম খুলনা রাজশাহী, এইসব বড় বড় শহরে চলে আসছিল। বছরখানেক হল, তাদের অনেকেই পূর্ব পাকিস্তানের ছোটখাটো, নগণ্য টাউন, এমনকি গ্রামের দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কিছু কিছু পশ্চিমা রাজদিয়ায় আগেই এসেছিল। ক্রমশ তাদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে। এরা বাঙালি মুসলমানদের সমানে খুঁচিয়ে যাচ্ছে। মুসলমানরা পাকিস্তানের মালিক। ওখানকার জমিজিরাত, বাগ-বাগিচা, দালানকোঠা-সমস্ত কিছু মুসলমানের। অন্য কারও নতুন এই রাষ্ট্রে থাকার অধিকার নেই। তারা তাদের ইন্ডিয়ায় চলে যাক। ক্রমাগত উসকানিতে বেশ কিছু বাঙালি মুসলমান আর আগের মতো শান্ত, নম্র নেই। ভীষণ বদলে যাচ্ছে। লোকগুলো এখন রূঢ়। উদ্ধত। তাদের কর্কশ ব্যবহার। চোখের দৃষ্টিতে উগ্রতা। পুরুষানুক্রমে তারা যে পাশাপাশি বাস করে এসেছে, সুখে-দুঃখে শোকে-আনন্দে উৎসবে-পরবে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছে তা যেন ভাবাই যায় না। নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, অপরিচিত এক হিংস্র বাহিনী চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বিনয়ের মনে পড়ে, এই পশ্চিমা মুসলমানদের কথাও হেমনাথের চিঠিতে ছিল। তারা রাজদিয়ায় বিষ ছড়াচ্ছে।

রামকেশব বলতে লাগলেন, রোজ পাঁচ দশটা করে হুমকি দিয়ে বেনামা চিঠি আসে। এক কাপড়ে ইন্ডিয়ায় চলে যাও। রাত্তিরে বাড়িতে বৃষ্টির মতো ঢিল পড়ে। রাস্তা দিয়ে ওরা শাসিয়ে যায়। সাতদিন সময় দিলাম। তার ভেতর দেশ না ছাড়লে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হবে। এরপর আর রাজদিয়ায় থাকতে সাহস হল না।

বিনয় কিছু বলে না, রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে। রামকেশব জিজ্ঞেস করলেন, রাজদিয়ার নিত্য দাসের কথা মনে আছে?

বিনয় বলল, থাকবে না কেন? কলকাতায় দুতিনবার তার সঙ্গে দেখাও হয়েছে।

খুব ধূর্ত, করিৎকর্মা। পোস্ট অফিসের ওপর ভরসা নেই। ওই ডিপার্টমেন্টটা প্রায় নিষ্কর্মা হয়ে গেছে। কিন্তু নিত্য দাসের লোক পাকিস্তানের চিঠি ইন্ডিয়ায় নিয়ে যায়, ইন্ডিয়ার চিঠি পাকিস্তানে পৌঁছে দেয়।

জানি। নিত্য দাসের হাত খুব লম্বা।

আমার কপাল ভাল। শাসানি যখন চলছে, নিত্যর লোকটা হঠাৎ রাজদিয়ায় গিয়ে হাজির। তার হাতে শিশিরকে চিঠি পাঠালাম। আমাকে যেন ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাবার বন্দোবস্ত করে।

রামকেশব জানালেন, কলকাতায় শিশির যখন হিন্দু হোস্টেলে থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন তখন তাঁর সহপাঠী ছিলেন তোফায়েল আমেদ। অসাধারণ ছাত্র। দুজনের ছিল গভীর বন্ধুত্ব। গ্র্যাজুয়েশনের পর পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা দিয়ে অফিসার হয়ে যান তোফায়েল। আর ইংরেজিতে এম এ করে খাস ব্রিটিশ কোম্পানি ম্যাকিনন অ্যান্ড ম্যাকেঞ্জিতে বড় চাকরি পান শিশির। দুজনের কাজের জায়গা আলাদা। কিন্তু সম্পর্কটা আগের মতোই নিবিড় থেকে গেছে।

তোফায়েলরা খাস পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। বর্ধমান ডিস্ট্রিক্টে ওঁদের আদি বাড়ি। কিন্তু দেশভাগের পর এখানকার জমিজমা বাড়িঘর বেচে অপশন নিয়ে সপরিবারে ঢাকায় চলে যান। ওয়েস্ট বেঙ্গলে কম্পিটিশন অনেক বেশি। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তুলনায় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে সুযোগসুবিধা প্রচুর। সেখানে খোলা মাঠ। পোমোশন পেয়ে খুব তাড়াতাড়ি তরতর করে অনেক ওপরে ওঠা যায়।

ঢাকায় চলে যাবার পরও দুই বন্ধুর মধ্যে যোগাযোগটা রয়েছে। চিঠিপত্রে নয়, টেলিফোনে। দুই দেশের ভেতর ওই যন্ত্রটা এখনও চালু আছে। রামকেশবের চিঠি পেয়ে আতঙ্কগ্রস্ত শিশির তোফায়েলকে ফোন করেন। তোফায়েল এখন ঢাকার পুলিশ কমিশনার। তিনি নিরাপত্তার সবরকম বন্দোবস্ত করে রামকেশব এবং তার স্ত্রীকে ঢাকায় নিয়ে যান। সেখান থেকে পাকিস্তান এয়ারলাইনসের প্লেনে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। রাজদিয়ার বাড়িতে তালা লাগিয়ে পার্থিব যাবতীয় সম্পত্তি ফেলে শুধু দেবদেবীর মূর্তি আর তাদের সিংহাসনটা নিয়ে সীমান্তের এপারে চলে আসতে পেরেছেন রামকেশবরা।

এক নাগাড়ে বলতে বলতে হাঁপিয়ে গিয়েছিলেন রামকেশব। একটু থামলেন। জোরে জোরে বারকয়েক শাস টেনে ফের শুরু করলেন, ইসমাইল দফাদারকে মনে পড়ে?

বিনয় বলল, পড়বে না কেন? রাজদিয়ায় থাকতে বছর বছর আপনাদের চকের জমি ওকে ভাগচাষ করতে দিতেন।

তিন পুরুষ ধরে চাষ করে আসছিল। দেশভাগের আগে মাথা তুলে কথা বলত না। দেখা হলেই কথায় কথায় সেলাম আর আদাব। চোখ সবসময় মাটিতে। অনেকবার বললে তবে বারান্দায় উঠে জড়সড় হয়ে বসত। পাকিস্তান হবার পরও কিছুদিন আগের মতোই ছিল। কিন্তু ইদানীং রাজাকার আর পশ্চিমা মুসলমানরা তার মাথায় হাজারটা কুবুদ্ধি ঢুকিয়ে দিয়েছে। রাতারাতি ভোল পালটে গেছে ইসমাইলের

তীব্র কৌতূহল আর উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে ছিল বিনয়। জিজ্ঞেস করল, কীরকম?

রামকেশব বললেন, কিছুদিন হল, বাড়িতে এসে সে আর উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকত না। সোজা বসার ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে পড়ত। আগের মতো নরম তরম নেই। এখন মেজাজ অনেক চড়া। কথাবার্তা রোখাচোখা। আমি যদি কিছু বলি আর সেটা যদি তার পছন্দ না হয়, মুখের ওপর তার কী চোটপাট!

রামকেশব আরও জানালেন, মাঝে মাঝেই দুই জোয়ান ছেলেকে নিয়ে হাজির হচ্ছিল ইসমাইল। আগে পরত সস্তা লুঙ্গি আর নিমা, খালি পা। পাকিস্তান হবার কিছুদিন পর থেকে পরছে ধবধবে পাজামা আর ফুলশার্ট, পায়ে পাম্প শু। চুল থাকত রুখাশুখা, সাতজন্মে তেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। এখন তার মুখ পরিষ্কার কামানো। মাথা থেকে ভুরভুর করে ফুলেল তেলের সুবাস বেরোয়।

প্রথম প্রথম ছেলেদের সঙ্গে করে একতলায় বসত ইসমাইল। বলত, পাকিস্থান হইয়া গ্যাছে। অহন আমরা সোমান সোমান (সমান সমান)। আপনেগো নিচে আর নাই। আপনেগো রান্ধনীরে (রাঁধুনি) আমাগো লেইগা চা বানাইতে কন। হের (তার) লগে লাড়ু মোয়া উপরাও (মুড়কি) দিতে কইয়েন।

রামকেশব বলতে লাগলেন, এইভাবেই চলছিল। হঠাৎ দিনকয়েক আগে ইসমাইলরা সোজা দোতলায় একেবারে শোবার ঘরে এসে খাটের ওপর বসল। বাধা দেবার সাহস হল না। ইসমাইলরা চা, চিড়েভাজা, তিলা-কদমা খেয়ে বলল, মজার মশয় (মজুমদার মশায়) একখান কথা মন দিয়া হুনেন। মেলা (অনেক) বচ্ছর আপনেগো জমিন চছি। ধানপাট বেইচা আপনেরা লাল হইয়া গ্যাছেন। আমাগো কপালে হুদা (শুধু ঠনঠনঠন। এইবার জমিনের আধাআধি রেজিস্টারি কইরা আমাগো নামে লেইখা দ্যান। যারা শোওয়ার ঘরে উঠে এসেছে তাদের লম্বা ঠ্যাং ভবিষ্যতে আরও কতদুর পর্যন্ত যাবে, কে জানে। সেদিন বুঝলাম, দেশে আর থাকা যাবে না। ভাগ্যই বলব, এর দুদিন পর নিত্য দাসের লোক গিয়ে হাজির। তারপর কীভাবে কলকাতায় এসেছি তা তো আগেই শুনেছ।

বিনয় জানে, পাকিস্তানে এখন তিনটে টার্গেট। যুবতী নারী। জমিজমা। আর সমাজের উঁচুস্তরের মানুষের আত্মসম্মান বোধ। এই তিন জায়গায় আক্রমণ হানতে পারলে পাকিস্তান ফাঁকা হয়ে যাবে। সে জিজ্ঞেস করে, রাজদিয়ার বাড়ি আর জমির কী ব্যবস্থা করে এসেছেন?

রামকেশব বললেন, বাড়িতে তালা লাগিয়ে এসেছি। জমি যেমন ছিল তেমনিই পড়ে আছে। তোফায়েলকে সব জানিয়েছি। সে থাকে ঢাকায়। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। প্রচুর দায়িত্ব। অতদূর থেকে রাজদিয়ায় আমার প্রপার্টির খবর রাখা কি তার পক্ষে সম্ভব? অবশ্য বলেছে চেষ্টা করবে। তবে

তবে কী?

একটাই আশার আলো, নিত্য দাস তার লোক মারফত খবর পাঠিয়েছে, ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে যে মুসলমানেরা পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে তাদের কারও জমি-জায়গার সঙ্গে আমাদের প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ করিয়ে দেবে। দুএকদিনের মধ্যে সে এ-বাড়িতে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। তখন তার সঙ্গে এ নিয়ে কথা হবে। তারপর দেখা যাক

চকিতে বিনয়ের মনে পড়ল, নিত্য দাস হেমনাথের জমি-বাড়ির এক্সচেঞ্জের ব্যাপারে কোনও এক শাজাহান সাহেবের সঙ্গে কথা পাকা করে রেখেছে। প্রথম চিঠিতে হেমনাথ জানিয়েছেন, দেশ। ছেড়ে আসবেন না কিন্তু রামকেশব যা জানালেন, তাতে হাড়ের ভেতর পর্যন্ত হিম হয়ে যাবার জোগাড়। দিনকে দিন রাজদিয়ায় আতঙ্ক মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে। এক দণ্ডও হেমনাথের আর সেখানে থাকা উচিত নয়।

বিনয় ব্যাকুল স্বরে বলল, আসার সময় আমার দাদুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

রামকেশব বললেন, চিরদিনের মতো রাজদিয়া ছেড়ে চলে আসব আর হেমদাদার সঙ্গে দেখা করব না, তাই কখনও হয়? তাকে কত বোঝালাম, পাকিস্তানে থাকতে পারবেন না। তোফায়েল আমাদের ঢাকায় নিয়ে কলকাতার প্লেনে তুলে দেবে। বউ-ঠাকরুন আর শিবানী দিদিকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলুন। এই সুযোগ আর জীবনে আসবে না। কিন্তু কে কার কথা শোনে! ঘাড় একেবারে শক্ত করে রইল হেমদাদা।

বিমর্ষ মুখে বসে থাকে বিনয়। পাকিস্তানে হেমনাথদের যে কী ভবিষ্যৎ, ভাবতেও সাহস হয় না।

রামকেশব থামেননি, কলকাতার খবরের কাগজে কি এই খবরটা বেরিয়েছে?

বিনয় জিজ্ঞেস করল, কোন খবর?

উর্দুকে পাকিস্তানের স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ করা হচ্ছে। এই নিয়ে ইস্ট বেঙ্গলে কিছু কিছু গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। বাঙালিরা ওয়েস্ট পাকিস্তানের সিন্ধি আর পাঞ্জাবি মুসলমানদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি। তাদের একটা সেকশন চায়, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।

বিনয় মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, বেরিয়েছে। রামকেশব বললেন, যারা ভাষা ভাষা করে হই চই বাধিয়েছে তারা আর কজন? ইস্ট পাকিস্তানের টোটাল পপুলেশনের এক পারসেন্টও নয়। কিন্তু এতেই হেমদাদার কী উৎসাহ! একেবারে নেচে উঠেছে। স্বপ্ন দেখছে, ইস্ট পাকিস্তানে খুব শিগগিরই নতুন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম হবে। এখন যে তাণ্ডব চলছে, কিছুদিনের মধ্যে তার লেশমাত্র থাকবে না।

বিনয়কে কিছুদিন আগে হেমনাথ যে চিঠি লিখেছিলেন তাতেও এই কথাগুলো ছিল। সে উন্মুখ হয়ে রামকেশবের দিকে তাকিয়ে থাকে। রামকেশব থামেননি, টু-নেশন থিওরির ওপর যে-দেশের সৃষ্টি, সেখানে জন্মাবে বেঙ্গলি ন্যাশনালিজম! সোনার পাথর বাটি! হেমদাদার কোনও কালেই বাস্তব বোধ নেই।

স্মৃতিরেখা ঘরে ঢুকলেন। এর ভেতর তার স্নান হয়ে গেছে। পরনে নকশা-পাড় ধবধবে টাঙ্গাইল শাড়ি। ভেজা চুল আঁচড়াবার পর পিঠময় ছড়ানো। কপালে সিঁদুরের বড় টিপ। সিঁথির মাঝামাঝি পর্যন্ত ঘোমটা। যেন অলৌকিক এক দেবীপ্রতিমা। তার এক হাতে চিনামাটির বড় প্লেটে নলেন গুড়ের প্রচুর তালশাঁস সন্দেশ আর কাঁচাগোল্লা। অন্য হাতে জলভর্তি কাঁচের গেলাস। ঝুমাকে বললেন, একটা সাইড টেবল এনে বিনুর কাছে রাখ।

ঝুমা ব্যস্ত পায়ে উঠে গিয়ে ঘরের কোণ থেকে টেবল নিয়ে এল। স্মৃতিরেখা প্লেট আর গেলাস তার ওপর রাখলেন। বিনয়কে বললেন, খাও–

পাকিস্তান সম্পর্কে রামকেশবের কাছে যা শোনা গেল তাতে অসীম উৎকণ্ঠায় বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। অন্যমনস্কর মতো বিনয় বলল, এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

স্মৃতিরেখা বললেন, প্রথম দিন এলে। একটু কিছু মুখে না দিলে আমাদের ভীষণ খারাপ লাগবে।

 ঝুমা আর রামকেশবের স্ত্রীও খাওয়ার জন্য প্রায় জোরজারই করতে লাগলেন।

আপত্তি করে রেহাই পাওয়া যাবে না। নীরবে চামচে করে একটা মিষ্টি তুলতে যাচ্ছিল বিনয়, রামকেশব হঠাৎ বললেন, কলকাতায় এসে একটা খবর পেলাম। বউমা আর শিশির বলছিল, ঝিনুক নাকি নিখোঁজ হয়ে গেছে। কত কষ্ট করে তাকে ইন্ডিয়ায় নিয়ে এসেছিলে। তার

ঝুমা এবং স্মৃতিরেখা হতচকিত। বিব্রত মুখে তারা বাধা দিতে লাগলেন, ও-সব কথা থাক–

কিন্তু কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না রামকেশব। নিজের ঝোঁকে বলে যাছিলেন, এ একরকম ভালই হয়েছে বিনু। ওই মেয়েকে নিয়ে কী করতে তুমি! সারা জীবন গলায় কাঁটার মধ্যে বিধে থাকত। না পারতে তাকে ফেলতে, না পারতে তাকে–

সব বুড়োবুড়িই এক ছাঁচে ঢালাই। একই সংস্কারের বেড়াজালে বন্দি। হেমনলিনী। অবনীমোহন। রামকেশব। বিনয়ের মনে হল, একটা তপ্ত লোহার ফলা তার মস্তিষ্কে আমূল বিধে যাচ্ছে। কদিনে ঝিনুকের জন্য যাতনার তীব্রতা খানিকটা কমে এসেছিল। রামকেশব পুরোনো ক্ষতটাকে খোঁচা দিয়ে ফের রক্তাক্ত করে তুলেছেন।

বিনয় লক্ষ করেছে, রাজদিয়ার যার সঙ্গেই দেখা হোক, যত কথাই হোক, সব আলোচনার শেষে অনিবার্যভাবে ঝিনুক আসবেই। ঝিনুক ছাড়া পৃথিবীতে যেন অন্য কোনও বিষয় নেই।

হাতের চামচটা প্লেটে নামিয়ে রেখে তড়িৎস্পৃষ্টের মতো খাট থেকে নেমে পড়ে বিনয়। সোজা দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

ঘরের অন্য সবাই চমকে ওঠে। রামকেশব বললেন, কী হল বিনু, কোথায় যাচ্ছ?

স্মৃতিরেখা বললেন, যেও না, যেও না

 বিনয়ের বুকে কোথায় কোন অদৃশ্য স্তরে রক্তপাত হচ্ছে, তার কারণটা কী, কুমার চেয়ে কে আর তা ভাল জানে। ব্যাকুল স্বরে সে ডাকতে লাগল, বিনুদা–বিনুদা ।

কিছুই শুনতে পাচ্ছে না বিনয়, কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। একেবারে অন্ধ আর বধির। উদ্ভ্রান্তের মতো সামনের বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নিচে নেমে একেবারে রাস্তায়।

পেছন পেছন চলে এসেছিল ঝুমা। কিন্তু বিনয়কে ধরা গেল না। সে ততক্ষণে রমাকান্ত চ্যাটার্জি লেনের শেষ মাথায় চলে গেছে। আর এগোয় না ঝুমা। গেটের কাছে পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।

এই কিছুক্ষণ আগে অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ঝুমার সঙ্গে তাদের বাড়ি চলে এসেছিল বিনয়। সেই কুহক উধাও। কৈশোর থেকে তাকে ঘিরে দুই নারীর কী যে তীব্র টানাপোড়েন! ঝুমাকে দেখলে তার শরীরে শিহরন জাগে, তপ্ত হয়ে ওঠে শ্বাসবায়ু। সবই ঠিক। ঝিনুক নিখোঁজ হয়ে গেছে, সেটাও ঠিক। আর কখনও তার সঙ্গে দেখা হবে কি না, কে জানে। তবু বিনয় এই মুহূর্তে ফের অনুভব করে মেয়েটা সহস্র পাকে এখনও জড়িয়ে আছে। সেই পাকগুলি এত তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে ফেলা অসম্ভব।

কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে এসে এসপ্ল্যানেডের ট্রামে উঠে পড়ল বিনয়। এতক্ষণে এই রুটে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।

.

১২.

ঝুমাদের বাড়ি থেকে ফেরার পর তিনটে দিন কেটে গেল। এর মধ্যে রোজ সকালের দিকে একবারই মোটে হিরণের সঙ্গে বাজারে গেছে বিনয়। বাকি দিনটা বাড়ি থেকে আর বেরোয়নি। সেদিন রামকেশব ঝিনুক সম্পর্কে নিষ্ঠুর একটা মন্তব্য করে যে কষ্ট দিয়েছেন, তার রেশ এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে।

দোতলার কোণের দিকের একটা ঘর বিনয়ের জন্য চমৎকার সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছে সুধা। এই কদিন সারাক্ষণ সেখানে শুয়ে শুয়ে কাটিয়েছে সে। অফিসে জয়েন করতে এখনও কিছু দিন বাকি। অলস মন্থর ভারাক্রান্ত সময় আর কাটতে চায় না। তার ওপর ঝিনুকের জন্য ক্লেশ তো রয়েছেই।

ঘরের জানালা দিয়ে সোজাসুজি ট্রাম রাস্তা চোখে পড়ে। সেখানে রকমারি দৃশ্য। ধাবমান যানবাহন। মানুষজনের যাতায়াত। কতরকম আওয়াজ ভেসে আসে ওখান থেকে। ট্রামের ঘটাং ঘটাং, রিকশার ঠুন ঠুন, বাস কন্ডাক্টরদের একনাগাড়ে চিৎকার, কালীঘাট, ভবানীপুর, ধরমতল্লা। খালি গাড়ি, খালি গাড়ি

সুধাদের এই জাফর শা রোডে দুচারটে ফেরিওয়ালা, ফেরিওয়ালিও ঢুকে পড়ে। কেউ টেনে টেনে হাঁকে, খাগড়াই বাসন– কেউ হাঁকে, চিনা সিঁদুর, তরল আলতা– কেউ হাঁকে পাউরুটি, বিস্কুট চড়া রঙের জমকালো শাড়ি-পরা, কপালে উল্কি-আঁকা, পশ্চিমা মধ্য তিরিশের যুবতী ফেরিওয়ালিরা কোমরে ঢেউ তুলে মরাল-গমনে চলতে চলতে মিষ্টি সুরেলা গলায় হেঁকে যায়, বেলোয়ারি চুড়ি লিবে গ– কেউ হাঁক পাড়ে, ঘুট্টি লিবে। গুল লিবে–

অন্যমনস্কর মতো রাস্তার নানারকম আওয়াজ শুনতে শুনতে আর দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে দিনগুলো কাটিয়ে দিয়েছে বিনয়। সুধা মাঝে মাঝে এসে তাড়া দিয়েছে, সারাদিন ঘরে আটকে আছিস। যা না, একটু ঘুরে টুরে আয়। ভাল লাগবে। .

ঝুমাদের বাড়ি গিয়ে সেদিন যা যা ঘটেছিল, রামকেশব ঝিনুক সম্পর্কে কী মন্তব্য করেছেন, সুধা আর হিরণকে সবই জানিয়েছে বিনয়। রামকেশবের ওপর ক্ষোভে রাগে ফেটে পড়েছিল দুজনে। সুধা জানে, ঝিনুকের জন্য নতুন করে মন খারাপ হয়ে আছে বিনয়ের। হৃদয়হীন বৃদ্ধটি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার বুকের ভেতরকার ক্ষতস্থানটি রক্তাক্ত করে দিয়েছেন।

 ছোটদি যে তাকে হাসিখুশি দেখতে চায়, বিনয় তা জানে। কিন্তু বাড়ির বাইরে কোথায় যাবে সে? এই সুবিশাল শহরে তার চেনাজানা মানুষ আর কটা? খুবই সামান্য। আত্মীয়-পরিজন অবশ্য আছে। সুনীতিদের বাড়িতে যাবার প্রশ্নই নেই। সেখানে হেমনলিনী রয়েছেন। ঝুমাদের বাড়ি যাবার কথা ভাবাই যায় না। সেখানে রামকেশব আছেন। বিমল গাঙ্গুলিদের বাড়ি গিয়ে প্রথম দিনই যা দেখে এসেছে, তাতে দ্বিতীয়বার সেখানে যেতে মন সায় দেয় না। মন-খারাপটা আরও বহু গুণ বেড়ে যাবে। ছায়া-মায়ার কথা খেয়াল আছে তার। হিরণ আর আনন্দকে বলতে হবে, যদি মেয়ে দুটোর জন্য কিছু করে দিতে পারে।

এই তিন দিনে অবশ্য অন্য একটা ব্যাপার ঘটেছে। শওকত আলি খান এ-বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিলেন। তিনি অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। হিরণদের রাজদিয়ার প্রপার্টির সঙ্গে তাঁদের বাড়ি খান মঞ্জিল এক্সচেঞ্জ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইস্ট পাকিস্তানে চলে যেতে চান। দু সপ্তাহ সময় দিয়ে গেছে তাঁর লোক। এর ভেতর হিরণ যদি এক্সচেঞ্জের বন্দোবস্ত করে, শওকত সাহেবের হাতে অনেক খদ্দের আছে, পাকিস্তান থেকে হাজারে হাজারে মানুষ এপারে চলে আসছে, তাদের কারও সম্পত্তির সঙ্গে তিনি বাড়ি পালটাপালটি করে চলে যাবেন।

এক্সচেঞ্জের পর মুসলমানদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে ভীষণ আপত্তি ছিল সুধা আর হিরণের জেঠিমার। সুধাকে অতি কষ্টে রাজি করানো হয়েছে। সে বুঝেছে, এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করলে পরে আপশোশের অন্ত থাকবে না। হিরণের জেঠিমা এলে তাকেও বোঝানো হবে। আশা করা যায়, শেষপর্যন্ত তিনিও গোঁ ধরে থাকবেন না।

শওকত আলির লোকটির সঙ্গে কথা বলার পর হিরণ আর এক মুহূর্ত দেরি করেনি। তক্ষুনি পাটনায় দ্বারিক দত্তকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছে। তিনি যেন অবিলম্বে কলকাতায় চলে আসেন।

.

 আজ বেস্পতিবার। নটা বাজতে না বাজতেই অফিসে চলে গেছে হিরণ। উমা রান্নাঘরে খুটখাট করে কীসব করছে। হিরণ অফিসে বেরিয়ে গেলেই স্নান সেরে নেয় সুধা। সে এখন বাথরুমে।

বিনয় তার ঘরে শুয়ে শুয়ে আজকের খবরের কাগজটা পড়ছিল। ওধারে সুধাদের চানঘর থেকে ছর ছর করে কলের জল পড়ার শব্দ আসছে। এছাড়া বাড়িটা প্রায় নিঝুম।

আচমকা বাইরে থেকে যুগলের হাঁক ভেসে আসে, ছুটোবাবু, ছুটো দিদি, আমি আইয়া গ্যাছি। উমারে সদর দুয়ার খুলতে কন– নিচু গলায় কথা বলতে পারে না সে। যখনই আসে, চারদিক উচ্চকিত করে ডাকাডাকি করে।

উমা বোধহয় শুনতে পেয়েছিল। যাই বলে সে ত্বরিত পায়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল।

সেই যে ঝিনুকের খোঁজে সেদিন যুগলের সঙ্গে শিয়ালদা স্টেশনে গিয়েছিল, তারপর আর তার কথা খেয়াল ছিল না বিনয়ের। রামকেশব তাকে আমূল দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিলেন। কাগজটা এক পাশে রেখে বিছানা থেকে নেমে পড়ল সে। ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের প্যাসেজে আসতেই চোখে পড়ল সিঁড়ি বেয়ে উমার পেছন পেছন ওপরে উঠে আসছে যুগল। বিনয়কে দেখে হাসিমুখে বলল, হাসপাতাল থিকা পায়ের পট্টি (ব্যান্ডেজ) পালটাইয়া আইলাম। ডাক্তরবাবু কইছে, আর দুই বিষ্যদ্বার পর পট্টি বাতে (বাঁধতে) লাগব না। ঘাওখান (ঘাখানা) পুরা সাইরা যাইব।

জবরদখল কলোনি বসাতে গিয়ে মুকুন্দপুরের এক নৈশযুদ্ধে জমিদারের গুণ্ডাদের সড়কির ফলা যুগলের পা এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলেছিল। তখন থেকে লেকের ধারের পুরানো মিলিটারি হাসপাতলে ফি বেস্পতিবার পা ড্রেস করাতে আসে সে। সেখান থেকে সোজা সুধাদের বাড়ি।

বিনয় কিছু বলল না। অল্প হেসে যুগলকে সঙ্গে করে বাইরের ঘরে এসে একটা চেয়ারে বসল। প্রাক্তন মনিবের নাতি নাতনিদের সামনে চেয়ারে বসে না যুগল। আগের মতোই সে মেঝেতে বসে পড়ল। বিনয় লক্ষ করল, পা ভালই মুড়তে পারছে যুগল। কিছুদিন আগের কষ্টটা নেই বললেই হয়।

যুগল বলল, চিল্লাইয়া চাইর দিক ফাইড়া ফালাইলাম। আমার গলা হুনলেই তো ছুটোদিদি লৌড়াইয়া (দৌড়ে) আহে (আসে)। তেনি কি বাড়ি নাই?

যুগলকে দেখলে বিনয় খুব খুশি হয়। এর মধ্যে এমন একটা আপন-করা ভাব আছে যাতে ওকে ভাল না লেগে পারা যায় না।

বিনয় জানায়, সুধা বাথরুমে আছে। যুগলের ডাক নিশ্চয়ই তার কানে গেছে। চান হলেই এ ঘরে চলে আসবে।

হেই কন। এই বাড়িত আইয়া ছুটোদিদিরে না দেখলে মন খারাপ হইয়া যায়। যুগল একটু হাসল। তারপর গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ঝিনুক বইনের কিছু খবর নি পাইলেন?

আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়, না

এইর ভিতরে থানায় গ্যাছিলেন?

ঝিনুকের সন্ধানে প্রায়ই যে বিনয় থানায় যায়, যুগল তা জানে। বিনয় বলল, কদিন যাওয়া হয়নি। খবর থাকলে পুলিশ থেকে জানিয়ে দিত। ছোটদির বাড়ির ঠিকানা থানায় দেওয়া আছে।

 বিষাদ-মাখা মুখে চুপচাপ বসে থাকে যুগল। এই নিরক্ষর যুবকটি চূড়ান্ত আশাবাদী। তার ধারণা ছিল, নিশ্চয়ই ঝিনুককে এই বিশাল মহানগরের জনারণ্যের ভেতর থেকে খুঁজে বার করা যাবে। বিনয়ের সঙ্গে দেখা হলে কত ভাবেই না সে সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু আজ মনে হল, তার বিশ্বাস এবং আশার ভিতটা যেন নড়বড়ে হয়ে গেছে।

যুগল বলল, মুকুন্দপুরে আমাগো রাইজদার ম্যালা (অনেক) মানুষ আছে। হেরা (তারা) নানান কামকাইজে রোজই কইলকাতায় আহে (আসে)। তাগো কইয়া রাখছি, ঝিনুক বইনেরে দ্যাখলে য্যান (যেন) মুকুন্দপুরে লইয়া যায়। কিন্তুক কেও হেরে দ্যাখে নাই। আমিও যে কইলকাতায় আহি, দুই চৌখ মেইলা (মেলে) হেরে (তাকে) বিচারেই (খুঁজি)। কত মানুষ দেখি, খালি ঝিনুক বইনই বাদ। কী যে হইব তার বুক তোলপাড় করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ঝিনুককে যে পাওয়া যাবেই, এমন কথা তার মুখ থেকে আজ আর বেরুল না।

ঝুমাদের বাড়ি থেকে আসার পর তিনটে দিন মন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে বিনয়ের। ঝিনুকের জন্য মানসিক চাপ আর নিতে পারছে না সে। তাই একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল, তোমাদের মুকুন্দপুরের খবর কী?

তাদের কলোনির কথা উঠলেই যুগল একেবারে অন্য মানুষ। তার সারা শরীর যেন চনচন করতে থাকে। তখন তার কী যে উদ্দীপনা! জঙ্গল কেটে, হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ লড়াই চালিয়ে, নতুন এক জনপদ গড়ে তুলছে, সে-জন্য উন্মাদনার শেষ নেই।

ঝিনুকের জন্য ক্লেশ আর বিষণ্ণতা কাটিয়ে উঠতে খানিকটা সময় লাগল যুগলের। তারপর বলল, হেই ব্যাপারে আইজ আপনের লগে ম্যালা (অনেক) কথা আছে।

ঠিক আছে। বল–

বিলের কিনারে আলিসান জঙ্গলের কিছুটা কাইটা আমরা কুলোনি বহাইছি। হে তো আপনে দেইখাই আইছেন।

বিনয় সায় দেয়, হা–

যুগল বলে, হের পরেও তিন ডবল জঙ্গল রইছে। সাপখোেপ, শুয়োর, বাঘডাসার বাসা। চাইর দিন হইল আরও জঙ্গল আমরা সাফা করতে শুরু করছি।

বিনয়ের মনে পড়ল, যুগলের একমাত্র স্বপ্ন এবং সংকল্প, মুকুন্দপুরের অবশিষ্ট বনভূমি নির্মূল করে কলোনির বিস্তার ঘটাবে। ভাটির দেশ এবং রাজদিয়া অঞ্চলের মানুষজন খুঁজে খুঁজে এনে পূর্ব বাংলাকে সীমান্তের এপারে নতুন করে নির্মাণ করবে।

বিনয় জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ বাকি জঙ্গলটা কাটছ কেন? কলোনিতে লোকজন কি বেড়েছে?

ম্যালা, ম্যালা (অনেক, অনেক)। যুগল জানায়, রাজদিয়া, ডাকাইতা পাড়া, গিরিগুঞ্জ, সুজনগুঞ্জ ইত্যাদি এলাকার যে-সব শরণার্থী কলকাতায় চলে এসেছিল, মুকুন্দপুর কলোনির খবর পেয়ে তারা দলে দলে হাজির হচ্ছে। কম করে পঞ্চাশ ষাট ঘর তো হবেই। কলোনিতে আগে এসে যারা থিতু হয়ে বসেছে তাদের বাড়িঘর তো আর রাজপ্রাসাদ নয় যে এত লোকজনকে ভাগাভাগি করে নিয়ে জায়গা দেবে। ফলে ওই উদ্বাস্তুরা খোলা আকাশের তলায় পড়ে আছে। দিনের বেলা একরকম কেটে যায়, কিন্তু হিমঋতুর রাতগুলো অসহ্য। খুব তাড়াতাড়ি ঘর তুলতে না পারলে বউ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে শীতেই ওরা শেষ হয়ে যাবে। তাই জঙ্গলের যে অংশটা এখনও টিকে আছে তা কেটে না ফেলে উপায় নেই।

যুগল বলতে লাগল, ভুরে (ভোরে) সূর্য্য উঠনের লগে লগে কুলোনির পুরুষমানুষগুলান জঙ্গলে গিয়া সান্ধে (ঢোকে)। যতক্ষণ রইদ (রোদ) থাকে, কুড়াল আর দাও (দা) দিয়া বড় বড় গাছ আর ছুটো ছুটো ঝোপ কাটন (কাটা) চলে। এইর ভিতরে অনেকখানি জাগা (জায়গা) সাফা কইরা ফালান হইছে।

চকিতের জন্য বিনয়ের মনে হল, যেভাবে হাজারে হাজারে মানুষ পাকিস্তান থেকে চলে আসছে, পশ্চিম বাংলার কোথাও আর বনজঙ্গল এবং জলাভূমি অবশিষ্ট থাকবে না। জলা বুজিয়ে, বন কেটে গড়ে উঠবে উদ্বাস্তুদের বাসস্থান। ছিন্নমূল মানুষদের জন্য কলোনির পর কলোনি।

যুগল জিজ্ঞেস করে, আইজ আপনের কুনো জবোরি কাম আছে?

 বিনয় অবাক হল, না, কেন?

তয় (তবে) আমার লগে মুকুন্দপুরে লন (চলুন)।

 মুকুন্দপুরে যাব! কেন?

 যুগল জানালো, এর আগে বিনয় যখন মুকুন্দপুরে গিয়েছিল, তখনই ঠিক করা হয়েছে কলোনির পাশের জঙ্গল সাফ হলে তাকে সাত কাঠা জমি দেওয়া হবে। মুকুন্দপুর বাস্তুহারা কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি হরনাথ কুণ্ডু পাকা খাতায় তা লিখেও রেখেছিল। এখন জমি বেরিয়েছে। বিনয় গিয়ে, যে জায়গা পছন্দ করবে, সেটাই তাকে দেওয়া হবে। যুগল তো বটেই, মুকুন্দপুরবাসীদের সনির্বন্ধ আর্জি–হেমকর্তার নাতি কষ্ট করে একবার সেখানে গিয়ে জমি বেছে নিক। তারা বিশেষভাবে যুগলকে, বলে দিয়েছে, আজই যেন বিনয়কে মুকুন্দপুরে নিয়ে যায়।

বিনয়ের একটু মজাই লাগল। তার বাবা কলকাতার বাড়ি বেচে তাকে একরকম রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে গেছেন। যদিও সুধারা আশ্রয় দিয়েছে, কিন্তু চিরকাল তো তার পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব নয়। এই বিশাল মহানগরে নিজের বলতে এক ইঞ্চি জায়গা তার নেই। আর মুকুন্দপুরের মানুষজন, বিশেষ করে যুগল, সম্পূর্ণ অনাত্মীয়, তার সঙ্গে রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই, কতকাল আগে হেমনাথের বাড়িতে কামলা খাটত, সে কি না তার জন্য জমির ব্যবস্থা করে ছুটে এসেছে!

বিনয়ের বুকের ভেতরটা গভীর আবেগে তোলপাড় হয়ে যায়। যাঁর রক্ত আজন্ম তার শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে সেই অবনীমোহন তাঁর জীবনের পরিধি থেকে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যুগল তাকে কত কাছে টেনে নিয়েছে। অবনীমোহনের দিক থেকে অনেক কিছু হারিয়েছে বিনয়, কিন্তু যুগল তার দুহাত ভরে দিয়েছে। তার আগ্রহ, তার প্রগাঢ় ভালবাসা, তার নিবিড় আন্তরিকতা তুচ্ছ করার মতো নয়। কোনওদিনই হয়তো মুকুন্দপুরে থাকা হবে না, তবু বিনয় বলল, তোমাদের ওই জমি আমি নেব। হাতে এখন কাজ নেই। চল, তোমার সঙ্গে মুকুন্দপুরেই ঘুরে আসি।

যুগলের চোখেমুখে আলোর ঝলক খেলে যায়। দুই হাত মুঠো করে শরীরটা বাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে খুশিতে শিশুর মতো কুটিপাটি হতে থাকে যুগল, আপনে আমাগো কাছে থাকবেন কী আনন্দ যে হইতে আছে ছুটোবাবু!

খবরের কাগজে চাকরি হয়েছে। কলকাতা থেকে অত দূরে বাড়িঘর বানিয়ে বসবাস করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সে-কথা বলা গেল না। যুগল দুঃখ পাবে। বিনয় হাসিমুখে চুপ করে থাকে।

যুগল এবার বলে, আমার আর-একখান কথা আছে ছুটোবাবু

বল

আশু মাস্টারমশয়ের লগে আইজই একবার দেখা করতে চাই

মাঝখানে কটা দিন যা যা ঘটে গেছে তাতে আশু দত্তর কথা ঘুণাক্ষরেও মনে পড়েনি বিনয়ের। অথচ শিয়ালদা স্টেশন থেকে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে তাঁকে পৌঁছে দিয়ে বলে এসেছিল, খুব শিগগিরই একদিন গিয়ে দেখা করবে। কথা রাখা যায়নি। ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে।

বিনয় বলল, ঠিক আছে। তোমার সঙ্গে মুকুন্দপুরে তো যাচ্ছিই। যাবার পথে আশু স্যারের ওখানে হয়ে যাব। কিন্তু

কী?

 তুমি আশু স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চাইছ কেন? কোনও দরকার আছে?

জবর দরকার ছুটোবাবু।

প্রথমটা বিনয় ভেবেছিল আশু দত্ত দেশের মানুষ। সেদিন রিফিউজি স্পেশাল থেকে সবে শিয়ালদায় নেমেছেন। ক্লান্ত। বিধ্বস্ত। ভাল করে কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। তাই তাঁর সঙ্গে দেখা করে হয়তো পাকিস্তানের হালচাল জানতে চায় যুগল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার অন্য কোনও উদ্দেশ্য রয়েছে।

বিনয় জানতে চাইল, কীরকম?

বিপুল উৎসাহে যুগল বলতে থাকে, আপনেরে কইছিলাম না, মুকুন্দপুরে একখান ইস্কুল বমু  (বসাব)। মনে আছে?

বিনয় সোজা হয়ে বসে, আছে।

দ্যাশে থাকলে কুননা চিন্তা আছিল না। কত যে খাল বিল আর নদী হের (তার) ল্যাখাজোখা নাই। তার উপুর মাইলের পর মাইল চাষের জমিন। এক মাথায় খাড়ইলে আর-এক মাথা দেখা যায় না। হেইখানে মাছ ধর, ধান রোও (বোনো), পাট বরাও, রবিশস্যের খন্দে কলই সউরষা মুং (মুগ) মুসৈর বরাও। জনম কাইটা যাইব। কিন্তু এইখানে? জল কই? মরা মরা নদী, কয়টা খাল, আর কয়টা বিল আছে হাতে গইন্যা কওন যায়। এইখানকার খাল বিলের উপর ভরসা কইরা কি বাচন যায়? অন্যের জমিনে যে কাম করুম হের উপায় নাই। মালিকগো বান্ধা কিষান আছে। এক নাগাড়ে বলতে বলতে হাঁপিয়ে পড়েছিল যুগল। দম নিয়ে ফের সে শুরু করে, আমাগো জনম তো হাবিজাবি টাণ্টামাষ্ঠা কইরা (উঞ্ছবৃত্তি করে) কুনোরকমে কাইটা যাইব। কিন্তু আমাগো পোলামাইয়াগো?।

যুগল কী ইঙ্গিত দিচ্ছে মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছে বিনয়। সে উন্মুখ হয়ে থাকে।

 যুগল বলে, চাকরি বাকরি ছাড়া ইন্ডিয়ায় আমাগো লাখান রিফুজগো গতি নাই, কিন্তুক চাকরি তো মুখের কথা খসাইলে হয় না। হের লেইগা বিদ্যা চাই। প্যাটে কালির অক্ষর সান্ধাইতে (ঢোকাতে) হইব। হে তো অ্যামনে অ্যামনে হয় না। ইস্কুল বহাইতে (বসাতে) হইব। আশু মাস্টমশয় দ্যাশ ছাইড়া আহনে (আসায়) আন্ধারে আলোর ইটু রেখ (অন্ধকারে আলোর রেখা) দেখতে পাইতে আছি। তেনি যদিন মুকুন্দপুরে ইস্কুল বহান (বসান), কুলোনির পোলাপানগুলান মানুষ হইব।

মুগ্ধ বিস্ময়ে যুগলের দিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়। অক্ষরপরিচয়হীন এই যুবকটি একসময় ছিল খুবই আলাভোলা ধরনের। খাল বিল নদী মাছ পাখি ধানের খেত পাটের খেত-এ-সবের বাইরে অন্য কোনও দিকে নজর ছিল না। সীমান্তের এপারে এসে সে বুঝেছে, লেখাপড়া ছাড়া উদ্বাস্তুদের ছেলে-মেয়েদের গতি নেই। শিক্ষাই হল আসল শক্তি। সেটা ছাড়া তারা টিকে থাকতে পারবে না, একেবারে শেষ হয়ে যাবে।

মুকুন্দপুরে স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা আগেও বিনয়কে জানিয়েছিল যুগল। সেজন্য পছন্দমতো মাস্টার মশায়ের খোঁজ করছিল সে। কিন্তু তেমন কারওকে পাচ্ছিল না। ফলে কিছুটা হতাশই হয়ে পড়েছিল। আশু দত্তকে দেখার পর তার স্বপ্নটা নতুন করে ফিরে এসেছে।

যুগল এবার উৎসুক সুরে জিজ্ঞেস করে, আপনের কী মনে লয় (হয়) ছুটোবাবু, আশু মাস্টরমশয় কি মুকুন্দপুরে ইস্কুল বহাইবেন (বসাবেন)?

বিনয় লক্ষ করল, যুগলের চোখেমুখে বিপুল উদ্দীপনা। একটু চিন্তা করে বলল, ওঁর সঙ্গে কথা বলে দেখ।

রাইজদায় তো দেখছি, লিখাপড়া, ইস্কুল আর ছাত্র, দিনরাইত এই লইয়াই থাকতেন। আপনে তেনির কাছে পড়তেন। কী ভালাটাই না আপনেরে বাসেন। হের উপুর হ্যামকর্তার নাতি আপনে। যদিন তেনিরে ইটু বুঝাইয়া কন–

ঠিক আছে, ওঁকে বলব। তারপর দেখা যাক উনি কী করেন–

মিনতির সুরে যুগল বলতে লাগল, য্যামন কইরা পারেন মাস্টর মশয়রে রাজি করাইতেই হইব ছুটোবাবু। আপনে ত্যামন কইরা ধরলে তেনি না কইতে পারবেন না।

 যুগলের ব্যাগ্রতা বিনয়কে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। বলল, আচ্ছা আচ্ছা। আগে তো ওঁর সঙ্গে দেখা করি।

সুধা ঘরে এসে ঢুকল। সবে চান সেরেছে। পরনে পাটভাঙা শাড়ি, চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। হাতে একটা ট্রেতে তিন কাপ চা আর মিষ্টির প্লেট। এক কাপ চা আর মিষ্টি যুগলের জন্য। বাকি দুকাপ চা তার এবং বিনয়ের। ট্রেটা টেবলে নামিয়ে রেখে একটা বেতের সোফায় বসতে বসতে সুধা হাসিমুখে যুগলকে বলল, চানঘর থেকে তোমার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। নাও, চা খাও

যুগল একমুখ হাসল, ছুটোদিদিরে কিছু কইতে হয় না। আমার পরানটা যে অহন চা চা করতে আছিল, ঠিক ট্যার পাইয়া গ্যাছে। চা বানাইয়া নিজের হাতে লইয়া আইছে। এ-বাড়িতে তার কোনওরকম সংকোচ নেই। ট্রে থেকে চায়ের কাপ তুলে নিল সে।

বিনয় এবং সুধাও তাদের কাপ তুলে নিয়েছে। চায়ে চুমুক দিয়ে যুগলদের খোঁজখবর নিতে লাগল সুধা। পাখি এবং তার ছেলেরা কেমন আছে, মুকুন্দপুরের বাসিন্দারা কে কী করছে, রাজদিয়া অঞ্চলের আরও মানুষজন সেখানে এসেছে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

চা খাওয়া হয়ে গেলে সুধা উঠে পড়ল, এক্ষুনি ধোপা আসবে। ময়লা কাপড়চোপড়ের লিস্টটা করে ফেলি।

বিনয় জানে, কাছাকাছি এক ধোপাবাড়ির সঙ্গে সুধাদের মাসকাবারি ব্যবস্থা আছে। ফি বেস্পতিবার ধোপা এসে সারা সপ্তাহের ময়লা জামাকাপড় নিয়ে যায়। সুধা একটা খাতায় তা লিখে রাখে। মাসের শেষে হিসেব করে টাকা মিটিয়ে দেয়। সে যখন দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে, যুগল ডাকল, ছুটোদিদি

সুধা থেমে গেল, কিছু বলবে?

 আপনের রান্ধন (রায়া) কদ্দূর?

হয়ে গেছে।

 তাইলে আমারে আর ছুটোবাবুরে যত তরাতরি পারেন, খাইতে দ্যান।

সুধা অবাক হল, কেন বল তো? এত তাড়া কীসের?

 যুগল বলল, ছুটোবাবুরে লইয়া মুকুন্দপুরে যামু। আশু দত্তর কথাটা অবশ্য সে জানালো না।

ভাইয়ের দিকে ফিরে সুধা জিজ্ঞেস করল, আজ যে মুকুন্দপুর যাবি, আগে বলিসনি তো?

বিনয় বলল, আগে কী জানতাম যে যাব? তুই যখন চান করছিলি যুগল একটা সুখবর দিল।

 কী সুখবর রে?

সেবার যখন মুকুন্দপুরে যাই, ওরা বলেছিল, বাকি জঙ্গল কাটার পর যে-জমি বেরুবে তার থেকে আমাকে সাত কাঠা দেবে। জঙ্গল সাফ হয়েছে। জমি বুঝিয়ে দেবার জন্যে যুগল আমাকে নিতে এসেছে।

আশু দত্তর সঙ্গে দেখা করার কথাটা বিনয়ও বলল না। সেই প্রসঙ্গ তুললে অনেক প্রশ্নের জবাব। দিতে হবে। এখন আর বকবক করতে ভাল লাগছে না। মুকুন্দপুর থেকে ফিরে এসে সুধা এবং হিরণকে সব জানিয়ে দেবে।

ঝুমাদের বাড়ি থেকে ফেরার পর কটা দিন ঘরের কোণে পড়ে আছে বিনয়। চুপচাপ, বিষণ্ণ। সুধা ভাবল, যুগলের সঙ্গে গেলে মন হালকা হবে ছেলেটার, বিষাদের ভাবটা কেটে যাবে। লঘু সুরে বলল, তুই তো হলে জমিদার হয়ে যাচ্ছিস?

বিনয় হাসল, তাই তো দেখছি।

 কখন ফিরবি?

সুধার প্রশ্নটার উত্তর দিল যুগল, আগে তো ছুটোবাবু মুকুন্দপুর পৌঁছাউক, হের পর তো ফিরনের কথা। রাইত বেশি হইলে ছাড়ুম না কিলাম (কিন্তু)। আমাগো উইখানেই রাইখা দিমু। না ফিরলে চিন্তা কইরেন না।

সুধা আর দাঁড়ালো না। ব্যস্তভাবে ভেতর দিকে চলে গেল।

.

১৩.

আধ ঘণ্টা পর খাওয়াদাওয়া সেরে যুগলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিনয়। ধুতি আর শার্টের ওপর ফুল-হাতা সোয়েটার পরে নিয়েছে সে। সন্ধের পর আজকাল জাঁকিয়ে শীত পড়ছে। তাই একটা গরম চাদরও সঙ্গে নিল।

টালিগঞ্জ থেকে বাস ধরে কালীঘাট ট্রাম ডিপোর স্টপেজে যুগলকে নিয়ে নেমে পড়ল বিনয়। রাস্তা পেরিয়ে কালী টেম্পল রোড আর সদানন্দ রোড হয়ে একটু ঘুরপথে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পৌঁছতে তিন চার মিনিটের বেশি লাগল না।

মাসখানেক পেরিয়ে গেছে পাকিস্তান থেকে কলকাতায় চলে এসেছে বিনয়। এর মধ্যে নিরুদ্দেশ ঝিনুককে পাগলের মতো খোঁজাখুঁজি করতে করতে এই বিশাল মহানগরের প্রচুর রাস্তাঘাট এবং অলিগলি চিনে ফেলেছে। তাছাড়া কোথাও একবার গেলে সহজে সেই জায়গাটা সে ভুলে যায় না।

সেদিন রাত্রিবেলা আশু দত্তকে ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পৌঁছে দিয়েছিল বিনয়। তখন ছিল গাঢ় কুয়াশা আর অন্ধকার। যদিও চারদিকে টিম টিম করে ইলেকট্রিক আলল, গ্যাসবাতি, হেরিকেন কী কেরোসিনের কুপি জ্বলছিল, তবু সব ঝাপসা ঝাপসা। বাড়িঘর ভুতুড়ে।

এখন দিনের আলোয় পাক খেতে খেতে এগিয়ে যাওয়া ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের প্রায় শেষ মাথায় সন্তোষ নাগদের ২৭ বি বাড়িটা খুঁজে বার করতে আদৌ কোনও অসুবিধা হল না। এমনকি হদিস জানার জন্য রাস্তার কোনও লোককে জিজ্ঞেসও করতে হয়নি।

সেকেলে, পলেস্তারা-খসা, নোনা-লাগা বাড়িটার সদর দরজা বন্ধ ছিল। কড়া নাড়তে সেদিনের সেই কিশোরীটি দরজা খুলে দিল। সন্তোষ নাগের মেয়ে। বিনয়কে চিনতে পেরেছে সে। তার মুখটা আলো হয়ে উঠল। বলল, আপনি কদিন আগে জেঠু আর ঠাকুমাকে নিয়ে এসেছিলেন না?

হাসিমুখে বিনয় বলল, হ্যাঁ। স্যার কি বাড়িতে আছেন?

আছেন। আসুন

মেয়েটির সঙ্গে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বিনয় জিজ্ঞেস করল, কী নাম তোমার?

 সবিতা।

কোন ক্লাসে পড়?

এইটে। মহারানী গার্লস হাইস্কুলে।

আজ তো বেস্পতিবার। স্কুল যাওনি?

 না। আজ আমাদের স্কুলের ফাউন্ডনেশন ডে। তাই ছুটি!

সবিতা মেয়েটা বেশ সপ্রতিভ। লেশমাত্র জড়তা নেই। বিনয়ের খুব ভাল লাগল তাকে।

বাড়ির বাইরেটা যেমনই হোক, ভেতরটা কিন্তু বেশ পরিষ্কার। সদর দরজার গা থেকেই বাঁধানো উঠোন। দুএক জায়গায় সিমেন্ট সামান্য উঠে গেলেও তকতক করছে। সেটার এক পাশে কলতলা এবং জোড়া পায়খানা।

একতলায় খানতিনেক ঘর এবং এক ফালি রান্নাঘর চোখে পড়ল বিনয়ের। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। দোতলাটাও নিচের তলারই মতো। সারি সারি শোবার ঘর, রান্নাঘর ইত্যাদি। বাড়তির মধ্যে ওপরের ঘরগুলোর সামনে ঢালাই লোহার রেলিং-দেওয়া চওড়া বারান্দা, নিচে যা নেই।

বাড়িটা প্রায় নিঝুম। পায়ের শব্দে একজন মাঝবয়সী মহিলা আর একজন বৃদ্ধা দোতলার কোনও ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। কৌতূহলী চোখে বিনয়দের দেখতে লাগল।

একতলার রান্নাঘরে সন্তোষের স্ত্রী খুব সম্ভব বাসনকোসন গুছিয়ে রাখছিলেন। মহিলাকে আগের দিনই দেখে গেছে বিনয়। তাই চিনতে পারল।

 উঠোন থেকেই ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে সবিতা, মা, জেঠু, দেখ কারা এসেছেন–

ঘোমটা সিঁথি পর্যন্ত টেনে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সন্তোষ নাগের স্ত্রী। কোণের দিকের একটা ঘর থেকে ততক্ষণে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন আশু দত্ত। প্রাক্তন ছাত্রটিকে দেখে খুব খুশি। বললেন, আয়, আয়-যে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন সেখানেই বিনয়দের নিয়ে গেলেন। সবিতা সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।

ঘরের একধারের দেওয়াল ঘেঁষে বড় তক্তপোশে বিছানা পাতা। আর-এক দিকের দেওয়ালে কাঠের তাক বসিয়ে আয়না চিরুনি ইত্যাদি রাখার ব্যবস্থা। তিন চারটে বেতের চেয়ারও রয়েছে। একটা টেবলও।

আশু দত্ত খাটের ধারে বসতে বসতে বিনয়দের বললেন, বোস্

তাঁকে প্রণাম করে একটা চেয়ারে বসল বিনয়। যথারীতি যুগল মেঝেতে বসেছে।

অনুযোগের সুরে আশু দত্ত এবার বিনয়কে বললেন, সেদিন রাত্তিরে আমাদের এখানে দিয়ে সেই যে চলে গেলি আর কোনও খবর নেই। ভাবলাম বুঝি ভুলেই গেছিস।

রামরতনের স্ত্রী আর মেয়েরা হুবহু এইভাবেই তাদের যাবতীয় অভিমান জানিয়েছিল।

মাঝখানে বিনয়ের জীবনে যা যা ঘটে গেছে সে-সব জোড়া লাগালে একখানা মহাভারত হয়ে যায়। সবিস্তার তা শুনিয়ে বৃদ্ধ মাস্টার মশাইটিকে ভারাক্রান্ত করতে ইচ্ছা হল না। বিনয় শুধু জানালো, আশু দত্তকে সে কি ভুলতে পারে? নানা সমস্যায় এমনই জড়িয়ে পড়েছিল যে এসে খোঁজ নিতে পারেনি। জিজ্ঞেস করল, ঠাকুমা কেমন আছেন?

ঠাকুমা অর্থাৎ আশু দত্তর মা। তিনি বললেন, ওই একইরকম। পাশের ঘরে শুয়ে আছে। কীভাবে যে বেঁচে রয়েছে। যে কোনও সময় প্রাণটা বেরিয়ে যাবে।

বিনয়েরও তেমনই ধারণা। জড়পিণ্ডের মতো যে বৃদ্ধাটিকে সেদিন শিয়ালদায় দেখেছে তার আয়ু যে ফুরিয়ে এসেছে সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। বলল, সন্তোষবাবু আর তার অন্য ছেলেমেয়েদের তোত দেখছি না।

আশু দত্ত বললেন, সন্তোষের অফিস আছে না? কখন বেরিয়ে গেছে। তিনি আরও জানালেন, সন্তোষের আর দুটি ছেলেমেয়ে সবিতাদের স্কুলে পড়ে না। তাদের অন্য স্কুল। খেয়েদেয়ে দশটায় তারা চলে গেছে।

একটু চুপচাপ।

 তারপর বিনয় বলল, এই কদিন কি বাড়িতেই ছিলেন স্যার?

আশু দত্ত বললেন, পায়রার খোপের মতো এই ঘরের ভেতর কতক্ষণ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায়। তাছাড়া

প্রশ্ন না করে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে বিনয়।

আশু দত্ত পুরানো ছাত্রকে লক্ষ করছিলেন। বললেন, তুই তো জানিসই, মাত্র এক হাজার টাকা ছাড়া পাকিস্তান থেকে এপারে কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি। রোজগারপত্তরের কিছু একটা চেষ্টা তো করতে হবে।

সেদিন রাতে শিয়ালদা থেকে আসার সময় তার দুর্ভাবনার কথা বলেছিলেন আশু দত্ত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আয়ের একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। নইলে মহা বিপদ। বিনয় বলল, এই তো সবে দেশ থেকে এলেন। এর মধ্যে কাজকর্মের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলেন?

আশু দত্ত বিশদভাবে জানালেন, মাসতুতো ভাই সন্তোষ মাঝারি ধরনের একটা চাকরি করে। কত আর মাইনে! এদিকে স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও ওর তিন ছেলেমেয়ে। রেশনে চাল গম চিনির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দিনকে দিন বাজার আগুন হয়ে উঠছে। মাছ মাংস আনাজপাতিতে হাত ঠেকানো যায় না। খরচের কী অন্ত আছে? বাড়িভাড়া, খাওয়ার খরচ। ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ। ট্রাম ভাড়া, বাস ভাড়া। তার ওপর সবিতা তেরো পেরিয়ে চোদ্দয় পা দিয়েছে। বড় জোর আর তিন চার বছর। তারপর মেয়েটার বিয়ে দিতে হবে।

ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের এই বাড়িটায় যুদ্ধ লাগার অনেক আগে থেকেই আছে সন্তোষরা। পুরো একতলাটা নিয়ে। দোতলায় থাকে বাড়িওলারা। তারা মানুষ ভালই। যে ভাড়ায় সন্তোষরা ঢুকেছিল এখনও মাসে মাসে তাই দিয়ে যাচ্ছে। বাড়িওলা ভাড়া বাড়ানোর কথা মুখ ফুটে আজ পর্যন্ত বলেনি। এটুকুই যা বাঁচোয়া।

তবে দুবছর আগেও এই রাস্তার বেশির ভাগ বাড়িতে অনেক ঘর ফাঁকা পড়ে থাকত। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্তের এপারে মানুষের ঢল নামার পর কোনও বাড়িই আর খালি নেই। মওকা বুঝে বাড়িওলারা ভাড়ার মাত্রা দ্বিগুণ, তিনগুণ করে দিয়েছে। সন্তোষদের বাড়িওলা কতদিন নির্লোভ মহাপুরুষ হয়ে থাকবে, ঠিক নেই।

আশু দত্ত বলতে লাগলেন, এই অবস্থায় আমরা এসে পড়েছি। সন্তোষরা আমাদের শেলটার দিয়েছে। কিন্তু এটা তো বেশিদিন চলতে পারে না। ওদের কথাও তো ভাবতে হবে।

শুনতে শুনতে রামরতনের স্ত্রী, বাসন্তী, ছায়া আর মায়ার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বিনয়ের। হুবহু একই চিত্র। একই পরিস্থিতি। তফাতের মধ্যে আশু দত্তরা যথেষ্ট আদর যত্নে আছেন। রামরতনের পরিবারের জন্য শুধুই লাঞ্ছনা, অসম্মান।

আশু দত্ত থামেননি, বুঝলি বিনু, একদিন কালীঘাট আর চেতলার অনেকগুলো স্কুল ঘুরলাম। হেড মাস্টার মশাইদের সঙ্গে দেখা করে বললাম, রাজদিয়া হাইস্কুলে চল্লিশ বছর পড়ানোর এক্সপিরিয়েন্স আছে। শয়ে শয়ে ছাত্র আমার হাত দিয়ে বেরিয়েছে। আমি একজন ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া এম এ। কপর্দকশূন্য হয়ে ইন্ডিয়ায় এসেছি। যদি আমাকে একটা কাজ দেওয়া হয়, বেঁচে যাব। সব শুনে হেডমাস্টার মশাইরা অনেক সহানুভূতির কথা বললেন। চা খাওয়ালেন। সেই সঙ্গে জানালেন, আপাতত কোনও ভ্যাকেন্সি নেই। তাছাড়া আমার বয়েসটাও অনেক বেশি হয়ে গেছে। নতুন চাকরি পাওয়ার পক্ষে সেটাও বড় বাধা। তবু স্কুলের গভর্নিং বডিকে বলবেন, স্পেশাল কেস হিসেবে যদি কিছু করা যায়। মাঝে মাঝে গিয়ে খোঁজ নিতে বলেছেন। একটু থেমে বিমর্ষ মুখে ফের শুরু করেন, আশার কোনও লক্ষণ দেখি না। তবে সন্তোষ আমার জন্যে প্রাইভেট টিউশনের খোঁজ করছে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্র পড়িয়ে কোনওদিন তো টাকা পয়সা নিইনি। কী জানি, শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়তো নিতে হবে।

এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি যুগল। মেঝেতে বিনয়ের কাছাকাছি নীরবে বসে ছিল। এবার আঙুল দিয়ে বিনয়ের পায়ে আলতো একটা ঠেলা দিল। বিনয় তার দিকে তাকাতেই মাথা সামান্য ঝাঁকিয়ে চোখের একটা ইঙ্গিত করল।

যুগলের সংকেতটা বুঝে নেয় বিনয়। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ওঠে, স্যার, যুগল আপনাকে কিছু বলতে চায়।

পুরোনো ছাত্রর সঙ্গে নানা কথাবার্তায় আশু দত্ত এতটাই মগ্ন ছিলেন যে যুগলের দিকে নজর ছিল না। এবার তার সম্বন্ধে মনোযোগী হলেন, তুই আগরপাড়ায় থাকিস না?

সেদিন শিয়ালদার প্রচণ্ড ভিড়ে, তুমুল হট্টগোলে আগরপাড়ার কথাটা একবারই বলেছিল বিনয়। সেটা ভুলে যাননি আশু দত্ত। বেশ অবাক হল যুগল। বলল, ঠিক আগরপাড়ায় না। ইস্টিশানে লাইমা পুবে দুই মাইল হাটলে মুকুন্দপুর। আমি হেইখানে থাকি মাস্টর মশয়–

সেদিনও তোকে বিনুর সঙ্গে দেখেছি। আজও তার সঙ্গে এসেছিস। রোজই তুই অতদূর থেকে বিনুর কাছে আসিস না কি?

রোজ নয়, ফি বেস্পতিবার কী কারণে তাকে কলকাতায় আসতে হয় এবং তারপর কোথায় বিনয়ের সঙ্গে দেখা করে, জানিয়ে দিল যুগল। খুব সংক্ষেপে।

আশু দত্ত বললেন, কী বলতে এসেছিস, এবার শোনা যাক–

যুগল বিনয়ের দিকে তাকায়, আপনেই কন ছুটোবাবু। আমি কি মাস্টরমশয়ের লাখান পণ্ডিত মাইনষেরে গুছাইয়া হগল কইতে পারি?

বিনয় একটু হাসল। তারপর দেশভাগের পর যুগল পশ্চিম বাংলায় এসে কীভাবে বন জঙ্গল সাফ করে মুকুন্দপুরে জবরদখল কলোনি বসিয়েছে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিতে থাকে। কাজটা মসৃণভাবে হয়নি। যে জমিতে তারা উপনিবেশ গড়ে তুলেছে তার মালিক ওদের উৎখাত করার জন্য দিন নেই রাত নেই, যখন তখন হানাদার পাঠাচ্ছে। যুগল এবং তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে এই সশস্ত্র বাহিনীর প্রায়ই লড়াই বাধে। যুগলদের অদম্য জেদ, একবার তারা পাকিস্তানে ভিটেমাটি খুইয়ে এসেছে। মুকুন্দপুরের নতুন বাসস্থানের দখল কিছুতেই ছাড়বে না। এর জন্য দরকার হলে আমরণ লড়াই চালিয়ে যাবে।

বিনয় আরও জানায়, মানুষের বাসভূমি শুধু তো কয়েকটা বাড়িঘরের সমষ্টি নয়। তার জন্য আরও অনেক কিছু দরকার। স্কুল, হাসপাতাল, শিক্ষিত মানুষ। যুগলের স্বপ্ন, মুকুন্দপুরে রাজদিয়ার মতো একটা জনপদ গড়ে তোলা। শিয়ালদা স্টেশন, রিফিউজি ক্যাম্প ইত্যাদি নানা জায়গা থেকে খুঁজে খুঁজে রাজদিয়া অঞ্চলের প্রচুর মানুষজন নিয়ে সেখানে জড়ো করেছে সে। এখন দরকার একটা স্কুলের। কিছুদিন ধরেই যুগল এমন একজন নিঃস্বার্থ মাস্টার মশায়ের সন্ধান করে বেড়াচ্ছিল যিনি মুকুন্দপুরে স্কুল বসাবেন। ছিন্নমূল মানুষদের কলোনিতে ছড়িয়ে দেবেন শিক্ষার দিব্য বিভা। আশু দত্তকে দেখার পর থেকে যুগলের মনে হয়েছে, এতদিনে তার ইচ্ছাপূরণ হতেও পারে।

শুনতে শুনতে আশু দত্তর দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল। হেমনাথের বাড়ির এক কামলা, অক্ষরপরিচয়হীন, দেশে থাকতে যে ধান বুনত, সর্ষে কলাই রুইত, পাট জাগ দিত, খাল বিল নদীতে মাছ ধরে বেড়াত, সে যে এমন বড় আকারে ভাবতে পারে, পূর্ব বাংলার এক স্বপ্নবৎ জনপদকে পশ্চিম বাংলার এক প্রান্তে নতুন করে গড়ে তুলতে চায়–সব শোনার পরও যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়। ব্যগ্র সুরে বললেন, তোদের কলোনিতে একদিন আমাকে নিয়ে যাবি যুগল?

এই সুযোগটা হাতছাড়া করল না যুগল, অন্য দিন না, আইজই আপনেরে লইয়া যাইতে চাই। বিনয়কে দেখিয়ে বলল, ছুটোবাবুও আমার লগে যাইব। না কইরেন না মাস্টর মশয়।

সামান্য দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন আশু দত্ত। সন্তোষ তাঁদের আশ্রয়দাতা। তাঁকে না জানিয়ে হুট করে যুগলদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়াটা কী ঠিক হবে?

যুগল বলতে লাগল, মুকুন্দপুরে গ্যালে আপনের বড় ভালা লাগব। দ্যাশের ম্যালা (অনেক) মাইনষের লগে দেখা হইব। আপনের কথা বেবাকরে (সবাইকে) কইছি। হেরা নিজের চৌখে আপনেরে দ্যাখলে কী আনন্দ যে পাইব, মুখে কইয়া কতটুক আর বুঝাইতে পারুম?

যুগলের ব্যাকুলতা আশু দত্তকে ভেতরে ভেতরে ঝাঁকি দিচ্ছিল। তিনি বললেন, কিন্তু মুকুন্দপুর তো অনেক দূরের পথ।

কদ্দুর আর। আধা ঘণ্টার ভিতরে বাইর হইলে সন্ধ্যার পর পর ছুটোবাবুর লগে ফিরা আইতে পারবেন। যদিন সাহস দ্যান, একখান কথা কই।

যুগলের এত আগ্রহ, এমন আন্তরিকতা হেলাফেলার বস্তু নয়। সস্নেহে হেসে আশু দত্ত বললেন, ঠিক আছে, বল

ছুটোবাবুরে কইতে আছিলেন, এইখানে ইস্কুলে ইস্কুলে ঘুরতে আছেন, কিন্তুক কাম পাইবেন কি না, ঠিকনাই। হের থিকা আমাগো মুকুন্দপুরে গিয়া ইস্কুল বহান (বসান)। আমরা তো জানি, আপনে কত বড় বিদ্বান, দ্যাশের মানুষ আপনেরে কত সোম্মান করত। আপনে মুকুন্দপুরে গ্যালে আমাগো পোলাপানগুলান মানুষ হইব। আপনেরে আমরা মাথায় কইরা রাখুম।

দেশভাগের পর সামান্য কটা বছরে কত কিছুই না ঘটে গেল। না, রাজদিয়ায় কেউ তাঁকে হত্যা করতে চায়নি। কিন্তু সমস্ত পরিবেশ রাতারাতি বিষবাষ্পে ভরে গেছে। যে-স্কুল তিনি নিজের হাতে সৃষ্টি করেছেন, চল্লিশটা বছর যা ছিল তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান, তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেখান থেকে তাঁকে তাড়ানো হল। রাজদিয়ায় তার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত। চারপাশের মানুষজনের চোখে অবিশ্বাস, ঘৃণা, সন্দেহ। ওখানে বাস করা আর সম্ভব হচ্ছিল না। জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।

যুগলের কথাগুলো শুনতে শুনতে আশু দত্তর সমস্ত শরীরে খাড়া ঝিলিকের মতো কিছু খেলে যায়। বিচিত্র এক বিদ্যুৎ-তরঙ্গ। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে সব প্রলোভন হেলায় ছুঁড়ে ফেলে হেমনাথ আর মোতাহার হোসেন চৌধুরির সঙ্গে হাত মিলিয়ে একদিন রাজদিয়া হাইস্কুলের পত্তন করেছিলেন। সেই বিপুল উদ্দীপনা যেন নতুন করে ফিরিয়ে দিয়েছে যুগল। তাঁর নিষ্প্রভ ঘোলাটে চোখে আশ্চর্য দ্যুতি ফুটে ওঠে। ব্যগ্র স্বরে বললেন, আমি যাব তোদের সঙ্গে। দরজার কাছে সবিতা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বললেন, তোর মাকে ডেকে নিয়ে আয়–

একটু পর মাকে সঙ্গে করে ফিরে এল সবিতা। আশু দত্ত বললেন, আমি বিনুদের সঙ্গে একটু বেরুব। ফিরতে ফিরতে মনে হয় রাত হয়ে যাবে। সন্তোষ অফিস থেকে এলে বোলো, আমার জন্যে যেন চিন্তা না করে। তোমার হাঁড়িতে কি আমাদের তিনজনের মতো ভাত হবে?

সন্তোষের স্ত্রী ঘোমটাটা কপালের আধাআধি টেনে দিয়েছেন। হাজার হোক আশু দত্ত তার ভাসুর। মৃদু গলায় বললেন, হবে।

মনে হচ্ছে তোমাকে মুশকিলে ফেললাম। আমার ভাত তো বেঁধেছই। বিনু আর যুগল খেলে তোমার আর সবিতার জন্যে আবার ভাত বসাতে হবে।

সন্তোষের স্ত্রী কী উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই হাঁ হাঁ করে ওঠে বিনয়, আমরা এইমাত্র খেয়ে এসেছি। আমাদের জন্যে ব্যস্ত হতে হবে না।

আশু দত্ত বিনয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক বলছিস তো?

স্যার, আপনার কাছে মিথ্যে বলতে পারি?

যুগলও বিনয়ের কথায় সায় দেয়, মাস্টর মশয়, ছুটোবাবু সাচাই (সত্যিই) কইছে। আমাগো প্যাট ঠাসা। এক গরাস ভাত খাওনের লাখান জাগা (জায়গা) নাই–

আগের মতোই নিচু গলায় সন্তোষের স্ত্রী বললেন, লজ্জার কোনও কারণ নেই। পরে দুটি চাল ফুটিয়ে নিতে তিলমাত্র অসুবিধা হবে না। দুপুরবেলা এসে বিনয়রা না খেয়ে চলে যাবে, এটা তার ভাল লাগছিল না। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাঁকে শান্ত করতে হল।

মিনিট কুড়ির মধ্যে চান-খাওয়া চুকিয়ে বিনয়দের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন আশু দত্ত।

.

১৪.

শিয়ালদা স্টেশনে যখনই যুগল আসে, শরণার্থীদের থিকথিকে ভিড়ে রাজদিয়া এলাকা কি ভাটির দেশের লোকজন খুঁজে বেড়ায়। আজ সেদিকে তার লক্ষ্য নেই।

দুনম্বর প্ল্যাটফর্মে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। ওটা আগরপাড়া হয়ে নৈহাটির দিকে যাবে।

প্ল্যাট ফর্মের দিকে পা চালাতে চালাতে যুগল ব্যস্তভাবে বলল, ছুটোবাবু, মাস্টর মশয়, আসেন আসেন। আমাগো টেরেন অহনই ছাইড়া দিব। নিয়মিত যাতায়াতের ফলে এই লাইনের ট্রেনের টাইমটেবল তার মুখস্থ।

আশু দত্ত বললেন, এটা কী হচ্ছে?

 থমকে দাঁড়িয়ে যায় যুগল, কীয়ের (কীসের) কথা কন?

ট্রেনে উঠতে যাচ্ছিস। টিকেট কাটতে হবে না?

সারা মুখ জুড়ে হাসে যুগল। মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে, আমাগো লাখান রিফুজগো টিকট লাগে না মাস্টর মশয়

আশু দত্ত স্তম্ভিত। বিমূঢ়ের মতো বলেন, বলিস কী রে!

কিছুদিন আগে বিনা টিকেটে ভ্রমণের পক্ষে বিনয়কে যা যা বলেছিল যুগল, এবারও নিপুণভাবে সেই যুক্তিজাল বিস্তার করে। ভিটেমাটি, দেশ, সর্বস্ব গেছে। স্বেচ্ছায় কেউ ইন্ডিয়ায় আসেনি। আসতে বাধ্য করা হয়েছে। গরু ছাগল পোকা মাকড়েরওঅধম হয়ে তারা কোনওরকমে টিকে আছে। সরকারের উচিত ছিল তাদের যাবতীয় দায়িত্ব নেওয়া। কিন্তু তারা উদ্বাস্তুদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য দূরে থাক, পেট ভরে সম্মানের সঙ্গে খাওয়ারও বন্দোবস্ত করেছে কি? এই অবস্থায় কীসের রেলের টিকেট? যতদিন বেঁচে আছে বিনা পয়সায় তারা ট্রেনে চড়বে।

যুগলের ক্ষোভের কারণটা বুঝতে পারছিলেন আশু দত্ত। পকেট থেকে টাকা বার করে নরম গলায় বললেন, বে-আইনি কাজ আমি করতে পারব না। যা, তিনটে টিকেট নিয়ে আয়।

যুগল ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বলে, পহা (পয়সা) খরচা কইরা এই হালার গরমেনরে লাই দিয়েন না মাস্টার মশয়–

সস্নেহে ধমক দিলেন আশু দত্ত, গেলি হারামজাদা

 ঘোর অনিচ্ছায় টিকেট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায় যুগল।

.

আগরপাড়া স্টেশনে যখন ওরা এসে নামে, সুর্য পশ্চিম দিকে খানিকটা ঢলে পড়েছে। কলকাতার তুলনায় তাপাঙ্ক এখানে কয়েক ডিগ্রি কম। বিকেল হয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই উত্তুরে হাওয়া কনকনে হতে শুরু করেছে। মিহি মখমলের মতো বহু দূরের গাছপালার মাথায় কুয়াশা নামছে।

ট্রেন লাইনের ওপারে গিয়ে বিনয় বলল, স্যার, মুকুন্দপুর এখান থেকে তিন সাড়ে তিন মাইল। যুগল অবশ্য বলে দুমাইল। রিকশা নেব?

এধারে প্রচুর দোকানপাট। অনেক লোকজনও চোখে পড়ছে। ডালপালাওলা একটা বটগাছের তলায় সাইকেল রিকশার স্ট্যান্ড। রিকশাওলারা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সওয়ারি ডাকছিল।

আশু দত্ত বিনয়কে বললেন, তিন সাড়ে তিন মাইল কতটুকু পথ! দেশে থাকতে লাটসাহেবদের মতো কি গাড়িঘোড়া চড়তাম? পায়ে হেঁটেই চকের পর চক পার হয়ে গেছি। চল, হাঁটতে হাঁটতেই যাই। জায়গাটাও ভাল করে দেখা হবে।

ঠিক আছে–

আগরপাড়া আধা গ্রাম, আধা শহর। ছাড়া ছাড়া সব বাড়িঘর। বেশির ভাগই টালি কি টিনের চালের। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু দালান কোঠাও চোখে পড়ে।

মিনিট দশেকের ভেতর লোকালয়ের চৌহদ্দি ফুরিয়ে গেল। পাকা রাস্তাও শেষ। এরপর দুধারে ধানের খেত, আঁকাবাঁকা খাল, সাঁকো, মাছরাঙা। আকাশ জুড়ে কত যে রংবেরঙের পাখি। উঁচু উঁচু তালগাছ। ক্কচিৎ দু-একটি মানুষ। দূরে দূরে চাষীদের ছন্নছাড়া গ্রাম। প্রায় সব জমি থেকেই ফসল কাটা হয়ে গেছে। বাকি খেতগুলো সোনালি ধানের লাবণ্যে ভরপুর। বাতাসের ঝাঁপটা লেগে ধানের শিষগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ছে। শব্দ উঠছে ঝুন ঝুন ঝুন ঝুন–

তিনজনে কথা বলতে বলতে কখনও জমির আলের ওপর দিয়ে, কখনও সরু মেঠো পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল।

চারদিক দেখতে দেখতে আশু দত্তর খুব ভাল লাগছে। বললেন, অনেকটা আমাদের দেশের মতো

এলাকাটা যে মাস্টার মশায়ের পছন্দ হয়েছে, সেজন্য বেজায় খুশি যুগল। বিপুল উৎসাহে সে বলতে থাকে, নানা খানে ঘুইরা এই জাগাখান (জায়গা) বিচরাইয়া বাইর করছি। নাইলে যাদবপুর বাশধানি গইড়ায় (গড়িয়ায়) জমিন পাইছিলাম। লই নাই। হেই হল জাগাতে খালি মানুষ। মাইনষের মাথা মাইনষে খায়। আর ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি, গায়ে গায়ে বাড়ি। উয়াস (নিশ্বাস) ফালান যায় না।

হঠাৎ দূর থেকে কলরোল ভেসে আসে। অনেক মানুষ একসঙ্গে হইচই করলে যেমন শোনায়, অবিকল সেইরকম আওয়াজ।

দাঁড়িয়ে পড়ল যুগল। কুকুরের মতো কান খাড়া করে শব্দটা শুনল। তারপর উদ্বিগ্ন মুখে বলল, মনে লয় (হয়), আমাগো মুকুন্দপুরে কুনো হাঙ্গম বাধছে। আমি লৌড়াই (দৌড়ই)। আপনেরা আস্তে আস্তে আহেন। জমির আলের ওপর দিয়ে উধ্বশ্বাসে সে ছুটতে লাগল।

বিনয়রা হতচকিত। আশু দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, কী হতে পারে?

বিনয় বলল, কী জানি, বুঝতে পারছি না

 তাড়াতাড়ি চল—

বিনয়রা জোরে জোরে পা চালাতে থাকে।

সামনের দিকে, বেশ খানিকটা দূরে, ধানখেতের ভেতর দশ বারোটা তালগাছের জটলা। অনেক উঁচুতে মাথা তুলে আকাশে পরমাশ্চর্য নকশা এঁকে দাঁড়িয়ে আছে। হিমঋতুর পড়ন্ত বেলার নরম রোদ এসে পড়েছে সেগুলোর ওপর।

চোখের পলকে গাছগুলোর ওধারে উধাও হয়ে গেল যুগল।

আশু দত্ত বেশ চিন্তিত। বিনয়কে বললেন, ও তো আমাদের ফেলে চলে গেল। তুই চিনে যেতে পারবি?

এই কদিন আগে মুকুন্দপুরে ঘুরে গেছে বিনয়। আগরপাড়া স্টেশন থেকে যুগলের সঙ্গে হেঁটে এসেছিল। ফিরেও গিয়েছিল হেঁটেই। এদিকের রাস্তাঘাটে কোনও ঘোরপ্যাঁচ নেই। মাঠের মাঝখান দিয়ে সোজাসুজি হাঁটলেই যুগলদের কলোনি। সব পরিষ্কার মনে আছে তার। বলল, পারব স্যার

মুকুন্দপুরে পৌঁছে দেখা গেল প্রচণ্ড হট্টগোল চলছে। সমস্ত আবহাওয়ায় তুমুল উত্তেজনা।

কেউ আর ঘরে নেই। কলোনির মাঝখানের বিশাল খোলা চত্বরে যুগলকে ঘিরে ধরে নানা বয়সের বউ-ঝিরা চিৎকার করে কী সব বলছে। সবাই একসঙ্গে চেঁচানোয় কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

মেয়েরা সবাই সশস্ত্র। কারও হাতে ধারাল ছ্যান দা, কারও হাতে সড়কি, কারও হাতে বঁটি, কারও হাতে কুড়োল। সেদিন এসে বিনয় যাদের দেখে গিয়েছিল তাদের এখন আর চেনা যাচ্ছে না। সবাই ক্রুদ্ধ। হিংস্র। মনে হয়, কিছুক্ষণ আগে তাদের সঙ্গে কোনও শত্রুপক্ষের খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেছে। তার জের এখনও কাটেনি।

এই ক্ষিপ্ত নারীবাহিনীর মধ্যে সব চেয়ে বেশি করে যাকে চোখে পড়ছে সে পাখি। তার মাথায় ঘোমটা নেই। আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে। সিঁদুর লেপটে কপালে মাখামাখি। শাড়ি এবং ব্লাউজের অনেকখানি ছিঁড়ে গেছে। দুচোখ থেকে আগুন ঠিকরোচ্ছে। একেবারে রণরঙ্গিণী মূর্তি।

চকিতে কবছর আগের, তখনও দেশভাগ হয়নি, একটা ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে। রাজদিয়া থেকে সুজনগঞ্জের হাটে যাবার পথে যুগলের সঙ্গে নৌকোয় করে তার পিসতুতো বোন টুনিদের বাড়ি গিয়েছিল বিনু। সেদিনের বিনু আজকের বিনয়। টুনিদের বাড়িটা অদ্ভুত। দশ পনেরো হাত উঁচু মোটা মোটা খুঁটির মাথায় মহাশূন্যে দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। সেটা আশ্বিন মাস। বর্ষায় ধানখেত, মাঠঘাট, খালবিল, বিশাল বিশাল চক ভেসে গিয়েছিল। সেই জল তখনও নামেনি। চারদিকে অগাধ জলরাশি। বর্ষার সময়কার মাতামাতি অবশ্য ছিল না। যতদূর চোখ যায়, শান্ত নিস্তরঙ্গ এক সমুদ্র।

টুনিদের বাড়ির পাছদুয়ার থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে শাপলা শালুক আর জলপদ্মের বনের ভেতর দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে পাখি এসে উঠেছিল যুগলের নৌকোয়। অলৌকিক জলপরীর মতো

মনে হয়েছিল তাকে। কিশোর বিনয়ের সামনে যুগলের সঙ্গে কথা বলতে তার কী লজ্জা! কী ভাল যে লেগেছিল পাখিকে। নম্র। কোমল। টুনিদের নজর এড়িয়ে যুগলের দেখা করতে সঙ্গে এসেছে। পাছে ধরা পড়ে যায় সেজন্য সদাস্ত।

সেদিনও মুকুন্দপুরে এসে পাখিকে দেখেছে বিনয়। তার হাতের রান্না খেয়েছে। টুনিদের বাড়িতে যেমনটি দেখেছিল, হুবহু একই রকম। তেমনই লাজুক, স্নিগ্ধ, মায়াময়। কে বলবে সে দুছেলের মা।

কিন্তু আশ্চর্য এক ভোজবাজিতে কদিনের মধ্যে আগাগোড়া বদলে গেছে পাখি। এতকালের চেনা লজ্জানত, জড়সড় মেয়েটির ভেতর এমন আগুন লুকিয়ে ছিল, কে ভাবতে পেরেছে! একটু খুঁটিয়ে লক্ষ করতে চোখে পড়ল, পাখির মাথার সামনের দিকের ডান পাশটা অনেকখানি ফুলে আছে। বাঁ হাতের কনুইতে জমাট-বাঁধা রক্ত। অর্থাৎ শত্রুপক্ষ যারাই হোক, তারা সহজে ছেড়ে দেয়নি; লাঠিসোঁটা বর্শা টর্শা চালিয়েছে।

এবার অন্য মেয়েদের ওপরও নজর এসে পড়ল বিনয়ের। তাদের অনেকেরই হাল পাখির মতো। ছেঁড়াফাড়া শাড়ি জামা। কারও কাঁধে, কারও কপালে, কারও বা পায়ে চোটের চিহ্ন।

শুধু মেয়েরাই না, ভিড়ের ভেতর পতিতপাবন, হরিন্দ, হরনাথ কুণ্ডু, হাচাই পাল–নানা বয়সের জনাকয়েক পুরুষকেও দেখা গেল। তারাও কেউ অক্ষত নেই। সবার শরীরেই অল্পবিস্তর চোট আঘাত লেগেছে।

হঠাৎ কে যেন বিনয় আর আশু দত্তকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে, আরে চিল্লানি থামা। ছুটোবাবু আর রাইজদার মাস্টরমশয় আইছে। লোকটা খুব সম্ভব রাজদিয়া বা তার কাছাকাছি কোনও গ্রামের বাসিন্দা ছিল। আশু দত্তকে সে চেনে।

লহমায় শোরগোল থেমে যায়। প্রবল উত্তেজক পরিস্থিতির মধ্যে এসে যুগলের খুব সম্ভব বিনয়দের কথা মনে ছিল না। সে দৌড়ে আসে। সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে, তরাতরি দুইখান চ্যার (চেয়ার) লইয়া আয়।

তৎক্ষণাৎ দুটো হাতলভাঙা, নড়বড়ে চেয়ার চলে আসে। বিনয় আর আশু দত্তকে বসিয়ে যুগল কাঁচুমাচু মুখে বলে, কুলোনিতে হাইন্দাই (ঢুকেই) তাফালে পইড়া গ্যালাম। দুফারে হুমুন্দির পুতেরা এইখানে আইয়া ম্যালা (অনেক) ঝঞট কইরা গ্যাছে। হেই হগল হুনতে হুনতে আপনেগো কং খ্যাল (খেয়াল) আছিল না।

বিনয় এবং আশু দত্ত, দুজনেই উৎকণ্ঠিত। কী হতে পারে, মোটামুটি আঁচ করে নিয়েছিল বিনয়। তবু জিজ্ঞেস করে, কারা এসেছিল? কীসের ঝঞ্ঝাট?

যুগল বলে, হগল হুইনেন। অতখানি পথ হাইটা আইসা হয়রান হইয়া পড়ছেন। হাত-পাও ধুইয়া চা-মিঠাই খাইয়া আগে জিরাইয়া লন (নিন)। হের পর হুনামু।

বিনয় জোরে জোরে মাথা নাড়ে, না, আগে বল।

আশু দত্তও সায় দেন। তিনি রীতিমতো হকচকিয়ে গেছেন। হয়তো একটু ভয়ও পেয়েছেন। সব না শোনা পর্যন্ত তার উদ্বেগ কাটছে না।

হট্টগোল আগেই থেমে গিয়েছিল। কলোনির বউ-ঝিদের সেই অগ্নিমূর্তি আর নেই। কুমারী মেয়েরা ছাড়া সধবা বিধবা সবাই কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টেনে দিয়েছে। বউগুলো ফের আগের মতোই গৃহলক্ষ্মী। ক্ষণিকের রণং দেহি ভাবটা নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

বিনয় তবু আগে এসেছে। কিন্তু রাজদিয়ার শ্রদ্ধেয়, দাপুটে মাস্টার মশাইটি যে এতদূরে তাদের কলোনিতে চলে আসবেন, মুকুন্দপুরবাসীদের কাছে এ ছিল স্বপ্নেরও অতীত। যুগল শুরু করার আগে তার পায়ে মাথা ঠেকাবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। পা দুটো গুটিয়ে হাতজোড় করে আশু দত্ত বলেন, সবার প্রণাম আমি নিলাম। পায়ে হাত দিতে হবে না। যুগলের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার তুই বল

কী ভেবে যুগল বলল, দুফারে আমি তো কুলোনিতে আছিলাম না। আপনেগো জানতে কইলকাতায় গ্যাছিলাম। হরনাথ দাদায় আইজ আপিসে যায় নাই। জ্বর হইছে। কুলোনিতেই আছিল। আমার থিকা তেনিই ভালা কইতে পারব। ভিড়ের একধারে দাঁড়িয়ে ছিল হরনাথ কুণ্ডু। তাকে বলল, আপনে কন।

হরনাথ সবিস্তার বিবরণ দিয়ে গেল। যেখানে কলোনি বসানো হয়েছে সেখানে আগে ছিল। আলিসান জঙ্গল। সাপটাপ মেরে সেই জঙ্গল সাফ করে জনপদ গড়ে তোলা হল।

জায়গাটা জমিদার পালচৌধুরিদের। ব্যাপারটা তারা সুনজরে দেখেননি। সর্বস্ব খুইয়ে সীমান্তের ওপার থেকে চিরতরে এসে যে দুঃখী দিশেহারা মানুষগুলো পরিত্যক্ত, অকেজো জঙ্গল নির্মূল করে মাথা গোঁজার মতো কাঁচা বাঁশের বেড়া আর টিন কি টালি দিয়ে চালাঘর বানিয়ে নিয়েছে, তা মেনে নেবার মতো মহানুভবতা তাদের অন্তত নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন কি কেউ আছে যে বিঘত পরিমাণ ভূখণ্ডের স্বত্ব ছাড়তে চায়? কলোনি যখন পত্তন হচ্ছে তখন থেকেই হানাদার বাহিনী পাঠিয়ে মুকুন্দপুরের বাসিন্দাদের উৎখাত করার চেষ্টা করে চলেছেন পালচৌধুরিরা। উদ্বাস্তুরাও জবর দখল ছাড়বে না। এই নিয়ে কবছর ধরে সমানে লড়াই চলছে। জমিদারের সশস্ত্র বাহিনী মাঝে মাঝেই মধ্যরাতে এসে হানা দেয়। তাদের হয়তো ধারণা, সবাই যখন ঘুমে বেহুঁশ থাকে সেইসময় ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে সমস্ত ছারখার করে দেবে। কিন্তু মুকুন্দপুরবাসীরা ভীষণ সতর্ক। পালা করে রাত জাগে। তাদের চোখ কান নাক–সমস্ত ইন্দ্রিয় খুবই সজাগ। অনেকটা বুনো জন্তুর মতো তারা সর্বক্ষণ বলবান প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকাবার জন্য প্রস্তুত। দূর থেকে শত্রুর গন্ধ পেলে তারা আকাশ বাতাস ফেড়ে ধ্বনি দিতে থাকে, কালী মাঈকি জয়

এখানকার প্রতিটি ঘরই দুর্গ। প্রতিটি ঘরই অস্ত্রভান্ডার। শত্রুর সঙ্গে যুঝবার জন্য মজুদ করা রয়েছে ছ্যান দা, রামদা, বল্লম, সড়কি, বয়রা বাঁশের মজবুত লাঠি, শাবল ইত্যাদি। পরিচিত সেকেলে সব মারণাস্ত্র।

কালী মাঈকি জয় শোনার সঙ্গে সঙ্গেই পলকে জেগে ওঠে কলোনির পুরুষেরা। তারপর লাঠি দা সড়কি নিয়ে রে রে করে বেরিয়ে আসে। এইভাবে বহুবার মুকুন্দপুরে নৈশযুদ্ধ হয়ে গেছে। দুপক্ষে জখমও হয়েছে কম নয়। কিন্তু পালচৌধুরিরা তাদের এক ইঞ্চি জমিও উদ্বাস্তুদের দখল থেকে উদ্ধার করতে পারেননি।

এতদিন আক্রমণটা হচ্ছিল রাতের দিকে। এবার কৌশলটা পালটে ফেলেছেন পালচৌধুরিরা। দিনের বেলা পুরুষেরা কলোনিতে থাকে না। যে যার কাজে বেরিয়ে যায়। রোজগারপাতি না করলে

পেটের ভাত জুটবে কোত্থেকে? তাদের ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়। কারও কারও বা সন্ধে। দিনের বেলায় কলোনিতে থাকে শুধু বাচ্চাকাচ্চা, বুড়োবুড়ি আর মেয়েরা। উদ্বাস্তুদের উপনিবেশ এই সময়টা প্রায় অরক্ষিতই। সুযোগটা কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন পালচৌধুরিরা। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বউ-ঝিরা বেশির ভাগই বিছানায় শরীর ঢেলে জিরিয়ে নিচ্ছিল। কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছিল। অনেকে বাইরের চত্বরে পিঠময় চুল ছড়িয়ে শীতের রোদ পোহাচ্ছিল।

তখনই হানাদার বাহিনী তুমুল শোরগোল তুলে কলোনিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেয়েরা প্রথমটা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। প্রাথমিক ভীতিটা কাটিয়ে পাখি চিৎকার করে ওঠে, লাঠি রাম দাও কুড়াল বল্লম লইয়া আসো

চত্বরে যারা ছিল তারা তো বটেই, হইচইতে যারা ঘরে শুয়ে ছিল তারাও দা কুড়াল টুড়াল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পতিতপাবন, হরিন্দ আর হরনাথ কুণ্ডু আজ বেরোয়নি; কলোনিতেই ছিল। তারাও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দৌড়ে আসে, তবে আজকের লড়াইয়ে কলোনির যোদ্ধাদের আসল সেনাপতি পাখি।

হানাদারেরা ছিল সবসুদ্ধ সাত আটজন। হয়তো ভেবেছিল, কলোনির মেয়েরা কী আর করতে পারবে? তাদের দেখে আতঙ্কে সিটিয়ে যাবে। সেই ফাঁকে তারা লণ্ডভণ্ড কাণ্ড বাধিয়ে দেবে।

কিন্তু হিংস্র নারীবাহিনী সংখ্যায় অনেক। খানিকক্ষণ লাঠিসোটা চালিয়ে, অকথ্য খিস্তি করে শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিয়ে হানাদাররা পালিয়ে যায়। যাবার আগে কয়েকজনকে অল্প বিস্তর জখম করেছে। তারাও পালটা মার খেয়েছে কম নয়। বুঝে গেছে দিনদুপুরে কি রাত দুপুরে, যখনই আসুক, হাতছাড়া জমি ফেরত পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

দুপুরবেলার মহাযুদ্ধের বিবরণ দেবার পর দক্ষিণ দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয় হরনাথ, উই দ্যাহেন, হালার পুতেরা আমাগো একেবারে ছাড়ে নাই। অনেকখানি ক্ষতি কইরা দিয়া গ্যাছে।

মুকুন্দপুর কলোনির ইতিহাস ভূগোল সবই বিনয়ের জানা। কোথায় কে ঘর তুলেছে, আগের দিনই দেখে গিয়েছিল। সমস্ত মনে আছে। চোখে পড়ল, বিলের এধারে যুগলের খুড়শ্বশুর কানাই দাস আর পিসশ্বশুর নবীন দাসের আধপোড়া বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

হরনাথ বলতে লাগল, শুয়োরের ছাওরা উই দুই ঘরে আগুন ধরাইয়া দিছিল। আমরা হগলে মিলা নিভাইছি।

একটু চুপচাপ।

তারপর যুগল হেসে আশু দত্তকে বলল, ছুটোবাবু আমাগো কথা বেবাক জানে। আপনেও। হোনলেন (শুনলেন)। দ্যাশ থিকা আইয়া এইভাবে যুধু কইরা বাইচা আছি মাস্টর মশয়–

আশু দত্ত অপার বিস্ময়ে সব শুনে যাচ্ছিলেন। দেশে থাকতেই তিনি খবর পেয়েছিলেন, সাতপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে এপারে এসে উদ্বাস্তুদের প্রায় সবাই রাস্তায়, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কিংবা ত্রাণশিবিরে ধুকে ধুকে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাদের সংকটের, তাদের কষ্টের অবধি নেই। এটাকেই তারা ললাটলিপি ধরে নিয়েছে। কিন্তু তারই স্বদেশবাসী এই মানুষগুলো–এই যুগল, এই পতিতপাবন, এই পাখিদের দলটা হার মানেনি। পলকের জন্য এটাকে ভাগ্যের মার ভেবে হাত পা গুটিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবার জন্য বসে থাকেনি। পশ্চিম বাংলার সুদূর এই ভূখণ্ডে বিপুল পরিশ্রমে, প্রচণ্ড বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে, পূর্ব বাংলার আদলে একটা জনপদ গড়ে তুলছে।

পাকিস্তান থেকে ইন্ডিয়ায় পা দিয়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন আশু দত্ত। হতাশ। ভবিষ্যতের চিন্তায় বিপর্যস্ত। কিন্তু ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে যুগলের সঙ্গে কথা বলে মুষড়ে পড়া ভাব অনেকটাই কেটে গিয়েছিল। যুগল তার মধ্যে বিলীয়মান উদ্দীপনাকে উসকে দিয়েছে। মুকুন্দপুরে এসে তিনি আপ্লুত। এখানকার মানুষজন তার একান্ত পরিচিত। চোখের সামনে অগুনতি চেনা মুখের সারি। এইসব নিরক্ষর, যুদ্ধরত, জেদি নারীপুরুষেরা তার কাছে যেন হাজারটা উজ্জ্বল আলো জ্বেলে। দিয়েছে।

এদিকে যুগল ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ম্যালা (অনেক) কথা হইছে। তুমরা কেও মাস্টর মশয় আর ছুটোবাবুর লেইগা হাত-পাও ধোওনের জল আইনা দাও। পাখিকে বলল, নয়া যে দুইখান গামছা কিনা আনছিলাম, দিয়া যা। তেনারা মুখটুখ মুছব। হের পর চা বানাইয়া লইয়া আয়। মনে কইরা বিস্কুট আর মিঠাইও আনিস।

যুগল ঠিকই করে রেখেছিল, যেভাবেই হোক আশু দত্ত এবং বিনয়কে আজ এখানে নিয়ে আসবে। প্রবল আত্মবিশ্বাস তার। সে জানে, তার মুখের ওপর ওঁরা না বলতে পারবেন না। আগে থেকে তাই আপ্যায়নের বন্দোবস্ত করে রেখেছে। নিজেদের ব্যবহার করা জিনিস তো আশু দত্তদের মতো মানুষদের দেওয়া যায় না। তাই আগরপাড়ার বাজার থেকে কাল নতুন একজোড়া গামছা, সন্দেশ, দানাদার আর ভাল বিস্কুট কিনে এনে রেখেছিল।

আগে বিনয় যখন মুকুন্দপুরে আসে, কাছের বিল থেকে বালতি করে হাতমুখ ধোবার জল এনে দিতে চেয়েছিল যুগল। বিনয় রাজি হয়নি। ভীষণ অস্বস্তি বোধ করেছিল। আজও প্রবল আপত্তি জানায় সে। আশু দত্তও জোরে জোরে মাথা নেড়ে জল আনতে বারণ করলেন। কেউ জল টেনে এনে দেবে আর তিনি হাত-পা ধোবেন, এটা হয় না। তাছাড়া, তিনি এমন অথর্ব হয়ে পড়েননি যে আড়াই শ হাত দূরের বিল পর্যন্ত যেতে অসুবিধা হবে।

হঠাৎ বিনয়ের খেয়াল হল, হানাদারদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে যাদের চোট লেগেছে তাদের ডাক্তার দেখানো দরকার। সে বলল, চাটা পরে হবে। যাদের জখমটা বেশি তাদের এক্ষুনি আগরপাড়ার ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া দরকার।

ব্যাপারটা প্রায় তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দিল যুগল, এইখানে কারও শরীল ননী-মাখম দিয়া বানাইনা (বানানো) না। ইটু আধটু চোট লাগছে, দুই চাইর ফোঁটা রক্ত পড়ছে, হেইর লেইগা ডাক্তরের বাড়িত লৌড়াইতে (দৌড়তে) হইলে তো গ্যাছি, দুব্বা ঘাস ছেইচা রস লাগাইয়া দিলে রক্ত বন্দ হইয়া যাইব। ঘাও হইব না। লাঠির বাড়ি খাইয়া যাগো ড্যানা (হাত), কপাল কি পাও ফুইল্যা গ্যাছে, চুনা-হলদি গরম কইরা লাগাইয়া দিলে তাগো টাটানি আর ফুলা এক রাইতেই কইমা যাইব।

তড়িৎগতিতে ছুটে গিয়ে গামছা নিয়ে এল পাখি। যুগল বলে, আপনেরা তো জল আনতে দিবেন না। লন বিলে যাই

বিলের নারকেল গুঁড়ির ঘাটলায় এসে, অনেকখানি ঝুঁকে টলটলে ঠাণ্ডা জল সারা মুখে ছিটোতে লাগলেন বিনয় আর আশু দত্ত। কুলকুচো করলেন। পায়ের চেটো থেকে হাঁটু পর্যন্ত ভাল করে ডলে ডলে ধুয়ে নিলেন। যুগল জোড়া গামছা নিয়ে কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে দুটো চেয়ে নিয়ে হাতমুখ মুছে জুতো পায়ে দিয়ে দুজনে ফের চত্বরে এসে বসলেন।

ভিড়টা এখনও জমাট বেঁধে আছে। বিনয় আর আশু দত্তকে পেয়ে কেউ নড়তে চায় না।

যেভাবে পাখি গামছা দিয়ে গিয়েছিল সেই গতিতেই চা এবং মিষ্টি টিষ্টি নিয়ে এল। তার গায়েও লাঠির বাড়ি কি সড়কির খোঁচা-টোচা লেগেছে। কিন্তু সে-সব গ্রাহ্যই করছে না মেয়েটা। তার হাতে পায়ে যেন বিজলি খেলে যাচ্ছে। সম্মানিত অতিথিদের আপ্যায়নে এতটুকু ত্রুটি হতে দেবে না সে।

এত মানুষের সামনে বসে খেতে ঠিক স্বস্তি বোধ করছিলেন না আশু দত্ত আর বিনয়। শুধু চা আর একটা করে বিস্কুট তুলে নিলেন তারা। সন্দেশ আর দানাদার নেবার জন্য কাকুতি মিনতি করতে লাগল যুগল। যদিও সে মান্য অতিথিদের মিষ্টিমুখের আয়োজন করেছে, মুকুন্দপুরবাসীরা সবাই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের একই সনির্বন্ধ অনুরোধ।

আশু দত্ত এবং বিনয় হেসে হেসে জানান, অবেলায় খাওয়ার অভ্যাস তাঁদের নেই। কিছুক্ষণ আগে দুপুরের খাওয়া সেরে এসেছেন। পেটের ভাত হজম হয়নি। এখন খেলে শরীর খারাপ হবে। কেউ যেন কিছু মনে না করে।

এর ওপর কোনও কথা নেই। সকলে চুপ করে থাকে। পাখি আর যুগলের মুখ ম্লান হয়ে যায়। সবচেয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে তারা।

একসময় ভিড়ের ভেতর থেকে আশু দত্তকে লক্ষ করে একের পর এক প্রশ্ন ভেসে আসতে থাকে। দেশের, বিশেষ করে রাজদিয়া এবং তার চারপাশের লোকালয়গুলোর এখনকার খবর তারা জানতে চায়। মুকুন্দপুরবাসীরা অনেকদিন আগেই পাকিস্তান ছেড়ে চলে এসেছে। এখন সেখানে কী চলছে, অবস্থা কতখানি আতঙ্কজনক, এর মধ্যে কারা কারা ভিটেমাটি ফেলে চলে গেছে, কারা কারা এখনও পড়ে আছে, ইত্যাদি নানা ব্যাপারে তাদের অনন্ত কৌতূহল। পৃথিবীর সেই ভূখণ্ডে আর কোনওদিনই যাদের ফেরা হবে না, তবু তাদের ছত্রিশ নাড়িতে এখনও তা জড়িয়ে রয়েছে।

যুগল অসহিষ্ণু সুরে বলে, যে-ই কুলোনিতে আহে দ্যাশের কথা হোননের (শোনার) লেইগা হেরে ছাইকা (হেঁকে) ধরে। পাকিস্থানের গতিক যদিন ভালাই হইব, মাস্টর মশয় কি চইলা আইতেন? দ্যাশ ট্যাশ ভুইলা যাও। অহন কামের কথা হোনো (শোন)। ক্যান আইজ কইলকাতায় গিয়া হাতে পায়ে ধইরা ছুটোবাবুর লগে মাস্টর মশয়রে কুলোনিতে লইয়া আইছি, হেয়া (তা) তো তুমরা জানো।

সবাই মাথা ঝাঁকায়–জানে।

মাস্টর মশয়রে হেই কথাহান কইছি।

তেনি কী কইছেন?

কলোনির বাচ্চাকাচ্চা কিশোরকিশোরীরা ভিড়ের ভেতর ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে ছিল। জনতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে যুগল আশু দত্তকে বলল, এই পোলামাইয়াগুলানের ভার আপনেরে নিতেই হইব মাস্টর মশয়। লিখাপড়ি না শেখলে ইন্ডিয়ায় অগো জনম বেবাক আন্ধার। হঠাৎ মুখটা কাঁচুমাচু করে বলতে থাকে, তয় একখান কথা। পথের ভিখারি হইয়া ইন্ডিয়ায় আইছি। কুনোরকমে বাইচা আছি। আমাগো ক্ষ্যামতা আরা কতটুক? ট্যাহাপহা (টাকা পয়সা) বেশি দিতে পারুম না। আপনের আর আপনের মায়ের খাওন-পরনের কষ্ট না হয়, হেইটা আমরা দেখুম

অদ্ভুত এক ঢল-নামানো আবেগে বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল আশু দত্তর। কোনও অদৃশ্য ডানায় ভর করে তিনি ফিরে যেতে লাগলেন পঁয়তাল্লিশ বছর আগের দিনগুলোতে। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসার পর মোতাহার হোসেন আর হেমনাথের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গড়ে তুলেছিলেন রাজদিয়া হাইস্কুল। স্বপ্ন দেখতেন দেশের মুক্তি বেশি দূরে নয়। ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতের জন্য জাতি গঠনের কাজে বিভোর হয়ে থাকতেন। সে-সব দিনে কী বিপুল উন্মাদনা তার। ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে যুগল তাঁর যুবা বয়সের সেই উদ্দীপনার কিছুটা ফিরিয়ে দিয়েছিল; এই মুহূর্তে পুরোটাই।

যুগল বলছিল, একখান কথা ভাইবা রাখছি মাস্টর মশয়। অহনও কেওরে কই নাই। কইলকাতা থিকা অ্যাদূরে রোজ আহন-যাওনে শরীল নষ্ট, সোময় নষ্ট। আপনেরে আমাগো এইখানেই থাকতে হইব।

আশু দত্ত অবাক। এখানে কোথায় থাকব?

 হেই চিন্তা আমাগো। ছুটোবাবু এইখানে জমিন লইতে রাজি হইছে। আপনেরে হুদা (শুধু) জমিনই না, ঘরও বানাইয়া দিমু।

কিন্তু

আশু দত্তকে শেষ করতে দিল না যুগল। প্রবল বেগে মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে লাগল, আপনের কুনো আপত্ত হুনুম (শুনম) না, হুনুম না, হুনুম না। আমাগো পোলামাইয়াগুলানরে মানুষ কইরা দিতেই হইব

বাকি সবাই তুমুল হইচই বাধিয়ে সায় দেয়, মাস্টার মশাইয়ের কোনও আপত্তিই গ্রাহ্য করা হবে না। মুকুন্দপুরবাসীরা রাজদিয়া এবং তার চারপাশের অঞ্চল থেকে এসেছে। আশু দত্তর চিরপরিচিত। একান্ত আপনজন। মাস্টার মশায়কে তারা অসীম শ্রদ্ধায়, নিবিড় মমতায় ঘিরে রাখবে।

হাত তুলে সবাইকে থামাতে থামাতে আশু দত্ত বললেন, আগে আমার কথাটা বলতে দে।

কী ভেবে যুগলরা বলল, ঠিক আছে। কন—

আমি সন্তোষের কাছে উঠেছি। সে আমার আশ্রয়দাতা। তার মতামত না নিয়ে আসি কী করে?

যুগল বলে, যত ইচ্ছা তেনির লগে কথা কন, তেনির মতামত লন (নিন)। কিন্তুক মুকুন্দপুরে আপনেরে আইতেই হইব। ছাড়ন ছাড়ন নাই।

যুগলের মধ্যে সরল অবুঝ একগুঁয়ে একটি বালক রয়েছে। তার কাঁধে জেদ চাপলে সেটি না করা পর্যন্ত যেন শান্তি নেই। আশু দত্ত হেসে ফেললেন।

যুগল আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বেইল (বেলা) পইড়া গ্যাছে। ইট্ট পরেই সন্ধ্যা নামব। দুটোবাবু, মাস্টর মশয়, লন আপনেগো জমিন দ্যাহাইয়া আনি। হের লগে কুনহানে ইস্কুল বহাইবেন হেই জাগাখানও। দ্যাহেন আপনেগো পছন্দ হয় কি না—

শীতের বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। রোদ এখন আরও নিস্তেজ। বাতাস আরও কনকনে। দেখতে দেখতে আঁধার নেমে যাবে। জমি দেখে তিন সাড়ে-তিন মাইল হেঁটে আগরপাড়া স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে। আর দেরি করা ঠিক নয়। আশু দত্ত এবং বিনয় চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল।

আগে একদিন যুগলের সঙ্গে মুকুন্দপুরে এসে কলোনির সীমানা অবধি বিনয় দেখে গিয়েছিল, তারপর থেকে ছিল চাপ-বাঁধা ঘন জঙ্গল। ঝোপঝাড়, ডালপালা ছড়ানো বিশাল বিশাল সব প্রাচীন বনস্পতি আর কত ধরনের যে বুনো লতা। সেই জঙ্গলের অনেকটাই এর ভেতর সাফ করে ফেলা হয়েছে। একধারে পাহাড়ের মতো উঁই হয়ে পড়ে আছে গাছের মোটা মোটা গুঁড়ি, শাখাপ্রশাখা আর কাঁটাঝোপ এবং লতাপাতা।

অন্য দিকে বিলের পাড় ঘেঁষে যে উদ্দাম কচুবন ছিল সেটার গায়ে হাত পড়েনি। কত ধরনের যে কচু তার লেখাজোখা নেই। পানিকচু, মানকচু, শোলাকচু, লতিকচু, খারকন। সমস্ত অটুট রয়েছে। মুকুন্দপুরবাসীদের কাছে এইসব কচু বিরাট বলভরসা, মস্ত খাদ্যভাণ্ডার। অন্য তরিতরকারি না জুটুক, ভাতের সঙ্গে কচুর একটা পদ পেলে দিনের পর দিন কেটে যাবে।

জঙ্গল নির্মূল করে প্রায় আধ মাইলের মতো জমি বার করা হয়েছে। আশু দত্ত আর বিনয়কে সঙ্গে করে যুগলরা সেখানে চলে এল। বউ-ঝিরা কেউ আসেনি। তবে কলোনির অল্পবয়সী ছেলের পাল ফেউয়ের মতো পেছনে লেগে রয়েছে।

যুগল বলল, বুঝলেন নি মাস্টর মশয়, বুঝলেন নি ছুটোবাবু, সুমখের দিকে আমাগো কুলোনির বাঘির যেইখানে তুলছি হেইখানকার জঙ্গল সাফ করতে তেমুন কষ্ট হয় নাই। কিন্তু এই দিকের বন কাটাতে জবর তাফালে (বিপদে) পড়ছিলাম।

বিনয় জিজ্ঞেস করে, কেন?

যুগল জানায়, সারা বনভূমিতেই সাপ রয়েছে, কিন্তু এই জায়গাটাতেই ছিল সব চাইতে হিংস্র, সব চাইতে বিষধর সাপেদের আসল আস্তানা। কত যে গর্ত, তার হিসেব নেই।

যুগল বলতে লাগল, জঙ্গলে সাইন্দা (ঢুকে) গাছে যেই কোপ মারি, এক এক গাদ (গর্ত) থিকা দশখান কইরা সাপ বাইর হইয়া ল্যাজে ভর দিয়া খাড়য়। কী লোখ হালার পুতেগো! সাপ না তো সাক্ষাইত যম। পতিতপাবন দাদায় একদিন তো ছোবল খাইতে খাইতে বাচছে। কম কইরা দ্যাড় দুই শ জাতি সাপ নিপাত করছি।

আশু দত্ত অবাক। বললেন, বলিস কী রে, এত সাপ!

পাশের বিপুল জলাশয়টা দেখিয়ে যুগল বলল, বিলান (বিল অঞ্চলের) জাগা, বচ্ছরের পর বচ্ছর পইড়া আছিল। সাপের বসত হইব না? আর হুদা কি সাপ, বাঘডাসা আর ভামই তো মারছি বিশ তিরিশটা। আর মারছি শ্যাজা (শজারু)। হেও পনরা ষোলটা। শ্যাজার মাংসের বড় সোয়াদ। আমরা কুলোনির মানুষ হেই মাংস ভাগ কইরা লইয়া খাইছি। শিয়ালও আছিল ম্যালা। নতুন করে যে জঙ্গল কাটা হয়েছে, তারপরেও রয়েছে বিপুল বনভূমি। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে যুগল বলল, শিয়ালগুলানরে মারণ যায় নাই। হালারা জবর চালাক। উই দিকের জঙ্গলে পলাইয়া গ্যাছে।

একটু চুপচাপ।

তারপর যুগল ফের বলে, গাছগাছালি না কাটলে, জন্তু-জাওনার (জানোয়ার) সাপখোপ মাইরা শ্যাষ না করলে মানুষ থাকব কই? বডারের উই পার থিকা যত মানুষ আইব, এই পারের বনজঙ্গল, পশুপক্ষী তত নিব্বংশ হইব।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়েন আশু দত্ত, হ্যাঁ, মানুষ বড় স্বার্থপর জীব।

হরনাথ বলল, উই হগল কথা থাউক। মাস্টর মশয়, বিনয়বাবু, আপনেরা নিজেগো জমিন পছন্দ কইরা লন। যেই জাগা দেহাইবেন, হেই জাগাই আপনেগো দিমু।

যুগল এবং অন্য সবাই যারা সঙ্গে এসেছিল, সমস্বরে হরনাথের কথায় সায় দেয়।

বিনয় বুঝতে পারছিল, যুগলরা কোনও রকম আপত্তি কানে তুলবে না। মুকুন্দপুরের জমি নিতেই হবে। বলল, আমি আর কী পছন্দ করব? যা দেওয়া হবে তাই নেব।

আশু দত্তও একই কথা বললেন।

অগত্যা যুগলরাই অনেক দেখেটেখে দক্ষিণ দিকের সব চাইতে সেরা জমি বেছে দিল। জানালো, সবে জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়েছে। এখন ধুধু ফাঁকা মাঠ। পরে পাশাপাশি সাত কাঠা করে জমি মেপে বাঁশের খুঁটি পুঁতে সীমানা ঠিক করে দেবে। দুজনের ঘরবাড়ির জন্য জমি বাছার পর স্কুলের জন্য অনেকখানি জায়গা দেখে রাখা হল।

জমি বাছাবাছি করতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছে। সূর্য পশ্চিম আকাশের গা বেয়ে এর ভেতর আরও অনেকখানি নেমে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওটা দিগন্তের তলায় অদৃশ্য হয়ে যাবে। বাতাসে হিমকণা মিশতে শুরু করেছে আরও বেশি করে। গাছপালার মাথায় শীতের মরা মরা রোদ আবছাভাবে লেগে আছে।

আকাশের দিকে এক পলক তাকিয়ে বিনয় চঞ্চল হল, কাজ তো মিটে গেল। এবার আমরা কলকাতায় ফিরব।

কিন্তু হরনাথ তাদের এত সহজে ছাড়ল না। বলল, আর সামাইন্য এটু কাম আছে। দশ মিনিটও লাগব না। হের পর যাইয়েন গা–

কী কাজ?

আহেন আমার লগে।

হরনাথ বিনয় আর আশু দত্তকে মুকুন্দপুর বাস্তুহারা কল্যাণ সমিতির অফিসে নিয়ে এল। অফিস আর কি। কাঁচা বাঁশের বেড়া, মাটির মেঝে। মাথায় টালির চাল। একধারে পুরনো আধভাঙা আলমারি। মাঝখানে সস্তা টেবল, কটা নড়বড়ে চেয়ার। বেড়ার গায়ে বাংলা-ইংরেজি মেশানো ক্যালেন্ডার। তাছাড়া বরেণ্য দেশনেতাদের কটা ছবি ঝুলছে। দেশবন্ধু, নেতাজি, গান্ধিজি, রবীন্দ্রনাথ।

ভিড়টা সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। যুগল, হরনাথ, আশু দত্ত আর বিনয় ছাড়া বাকি সবাই অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।

বিনয় আর আশু দত্তকে চেয়ারে বসিয়ে আলমারি থেকে মোটা খাতা বার করে হরনাথ মুখোমুখি বসল। তারপর সেটা খুলে একটা পাতায় খোপকাটা ঘরে আশু দত্তর নাম, বাবার নাম, দেশের বাড়ির ঠিকানা, কোন তারিখে বর্ডার পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় এসেছেন, ইত্যাদি টুকে নিয়ে তলায় লিখল : রাজদিয়া হাই স্কুলের প্রাক্তন অ্যাসিস্টান্ট হেড মাস্টার শ্রীযুক্ত আশুতোষ দত্ত মহাশয়কে মুকুন্দপুর উদ্বাস্তু কলোনিতে বসবাসের উপযোগী সাত কাঠা জমি দেওয়া হইবে। ইহা ছাড়া বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বাবদ স্বতন্ত্রভাবে এক বিঘা জমিও তাঁহাকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত লওয়া হইয়াছে।

এ-সব লেখার পর আশু দত্তকে নিয়ে সই করিয়ে নেওয়া হল।

হরনাথ মানুষটা দূরদশী। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে মুকুন্দপুরের বাসিন্দাদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সুশৃঙ্খলভাবে লিখে রাখছে। তার ধারণা, পরে সরকারের কাছে এগুলো পেশ করে আবেদন জানালে নিশ্চয়ই অনেক সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে। তার কাজে এতটুকু খুঁত নেই।

বিনয় সম্বন্ধে কিছু লেখা হল না। কেননা, কিছুদিন আগে যুগল প্রথম যেদিন তাকে মুকুন্দপুর নিয়ে আসে সেদিনই হরনাথের খাতায় তার নাম উঠে গিয়েছিল।

লেখালেখি শেষ হলে বিনয়রা উঠে পড়ল। আর দেরি করা যাবে না। মুকুন্দপুরবাসীরা কলোনির সীমান্ত পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দিয়ে গেল। তবে যুগল আর পতিতপাবন সঙ্গ ছাড়ল না, আগরপাড়া স্টেশনে গিয়ে ওদের কলকাতার ট্রেনে তুলে দিল।

.

১৫.

 কিছুক্ষণ হল সন্ধে নেমেছে।

শীতের কুয়াশা আর অন্ধকার ভেদ করে ট্রেন কলকাতার দিকে ছুটছে উধ্বশ্বাসে।

বিনয়দের কামরাটার দরজা-জানালা সব বন্ধ। কেননা বাইরে প্রবল প্রতাপে উত্তরে বাতাস বয়ে চলেছে। একটু ফাঁকফোকর পেলেই ভেতরে হানা দিয়ে হাড়মজ্জা কাঁপিয়ে দেবে।

সন্ধের দিকে ডাউন ট্রেনগুলোতে ভিড় থাকে না বললেই হয়। বিনয়দের কামরাটা প্রায় ফাঁকাই। দশ বারোটি প্যাসেঞ্জার এধারে ওধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে।

একটা বন্ধ জানালার পাশে মুখোমুখি বসে ছিল বিনয় আর আশু দত্ত। ট্রেনে ওঠার পর থেকেই বিনয় লক্ষ করেছে, আশু দত্ত কেমন যেন চুপচাপ। গভীর কোনও চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন।

দুতিনটে স্টেশন পেরিয়ে যাবার পর আশু দত্ত বললেন, বুঝলি বিনু, একটা কথা তখন থেকে ভাবছি।

বিনয় উৎসুক চোখে তার প্রাক্তন মাস্টারমশায়টির দিকে তাকায়। কোনও প্রশ্ন করে না।

আশু দত্ত বলতে থাকেন, যুগলরা আমার মাথায় এত বড় গুরু দায়িত্ব চাপিয়ে দিল। নাও বলতে পারলাম না। কিন্তু আমি কি পারব?

এই মানুষটিই একদিন বিপুল উৎসাহে হেমনাথ আর মোতাহার হোসেন চৌধুরির সঙ্গে যৌথভাবে রাজদিয়া হাই স্কুল গড়ে তুলেছিলেন। শুধু তাই না, সেটা পূর্ব বাংলার একটা সেরা শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। কত ভাল ভাল ছেলে যে তার হাত দিয়ে বেরিয়ে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে, দিকে দিকে রাজদিয়া হাই স্কুলের নাম তারা উজ্জ্বল করেছে, তার লেখাজোখা নেই। দিবারাত্রি কী প্রচণ্ড পরিশ্রমই না তিনি করতেন! আজ দুপুরে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে গিয়ে যুগল যখন তাঁকে মুকুন্দপুরে স্কুল বসাবার কথা বলল তখনও তার কী উদ্দীপনা! খানিক আগে কলোনির বাসিন্দারা স্কুলের জন্য যখন কাকুতি মিনতি করছিল তখনও আপত্তি করেননি। কিন্তু স্কুলের জায়গা দেখা হয়ে গেছে, তাঁর ঘরবাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে। নিজের চোখে সব দেখে আসার পরও হঠাৎ এখন তাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে। এবং কিছুটা দ্বিধান্বিত।

বিনয় বেশ জোর দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই পারবেন স্যার। রাজদিয়া হাই স্কুলের মতো অত বড় স্কুল করতে পেরেছেন। কলোনির ছোট একটা প্রাইমারি স্কুল বসানো কি আপনার পক্ষে কঠিন ব্যাপার?

আশু দত্ত বললেন, তখন আমার কত আর বয়েস! তরতাজা ইয়াং ম্যান। এখন আমি বৃদ্ধ।

 কিন্তু আপনি তো স্যার, কদিন ধরে কাজের জন্যে স্কুলে স্কুলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর

 বিনয় কী বলতে চায়, আঁচ করতে পারছিলেন আশু দত্ত। তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, কয়েক ঘণ্টার জন্যে কোথাও গিয়ে পড়িয়ে আসা, আর একটা স্কুল বসানো, সেটা যত ছোটই হোক, কি এক কথা হল? একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, আমার সেই বয়েসের এনার্জি, কর্মশক্তি কি আর আছে? তাছাড়া, রাজদিয়ায় আমার সঙ্গে কারা ছিলেন? হেমনাথদাদা, মোতাহার হোসেন সাহেব। তেমন মানুষ এখানে কোথায় পাব? যা করার নিজেকে একাই করতে হবে।

আশু দত্তর দ্বিধাটা অকারণে নয়। বিনয় কী জবাব দেবে, ভেবে পায় না।

আশু দত্ত বলতে লাগলেন, পার্টিশান হল। ভাইটা ঢাকায় খুন হয়ে গেল। ভিটেমাটি ফেলে, সর্বস্ব হারিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে এলাম। মনের জোরও অনেকখানি নষ্ট হয়ে গেছে বিনু। মানসিক শক্তি না থাকলে ধুকে ধুকে কোনওরকমে বেঁচে থাকা হয়তো যায় কিন্তু বড় কিছু গড়ে তোলা কি সম্ভব?

বিনয় বলল, যুগলরা বড় আশা করে আছে স্যার। একটু সাহস করে শুরু করে দিন। একবার কাজে ডুবে গেলে দেখবেন, পুরানো কষ্ট ভুলে গেছেন। কাজটাই আপনার এনার্জি ফিরিয়ে আনবে।

একটু চুপ।

তারপর বিনয় ফের বলে, কলকাতার স্কুলে চাকরি পাবেন কি না, ঠিক নেই। টিউশন করে টাকা নেওয়াটা আপনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন। আপনি নিজেই বলেছেন, সন্তোষবাবুদের অবস্থা এমন নয় যে চিরকাল ওঁদের কাছে থাকতে পারবেন। তাহলে?

ধীরে ধীরে মাথা নাড়েন আশু দত্ত, হ্যাঁ। এ-সব খুবই চিন্তার ব্যাপার।

সামনের দিকে ঝুঁকে গভীর আগ্রহে বিনয় বলে, মুকুন্দপুরের লোকজন সকলেই আপনার চেনাজানা। সে বোঝাতে থাকে, ওখানে গিয়ে থাকলে দেশের পরিবেশটাই পুরোপুরি পেয়ে যাবেন আশু দত্ত। যুগলরা তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করে। তাঁর সমাদরের অভাব হবে না।

আশু দত্ত বললেন, তা আমি জানি। যুগলও এই কথাই বলেছে।

ব্যাকুলভাবে বিনয় বলে, স্যার, দ্বিধা করবেন না। স্কুলটা গড়ে তুলুন। সে আরও বলে, ইউনিভার্সিটি থেকে বেরুবার পর রাজদিয়া হাই স্কুল বসানো দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন আশু দত্ত। পরমায়ু যখন শেষ হয়ে আসছে, সেই সময় সর্বহারা ছিন্নমূল মানুষগুলির সন্তানদের দায়িত্ব তিনি তুলে নিন। তাঁর জীবনের বৃত্ত এতে সম্পূর্ণ হবে। যৌবনের শুরু থেকে তিনি যা করতে চেয়েছেন, যা নিয়ে মগ্ন থেকেছেন, মুকুন্দপুরের উপনিবেশে তা সার্থক হয়ে উঠবে।

বিনয়ের কথা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন আশু দত্ত। হঠাৎ উৎসাহের সুরে বলে উঠলেন, ঠিকই বলেছিস তুই। এ-সব যে আমি ভাবিনি তা নয়। একটু থেমে ফের বললেন, আমার একটা কথা রাখবি?

উৎসুক দৃষ্টিতে আশু দত্তর দিকে তাকায় বিনয়, কী কথা স্যার?

তুই আমার সঙ্গে থাকবি? তোকে পাশে পেলে অনেকখানি ভরসা পাব। আশু দত্ত বলতে লাগলেন, একদিন হেমদাদার হাত ধরে রাজদিয়া হাই স্কুল বসিয়েছিলাম। এবার তার নাতিকে নিয়ে নতুন করে মুকুন্দপুরে শেষ জীবনটা শুরু করা যাক।

বিনয় চমকে ওঠে, কিন্তু স্যার

কী হল?

আপনাকে তো বলেছি, কলকাতায় আমি একটা চাকরি পেয়েছি। কয়েক দিনের মধ্যে সেখানে জয়েন করতে হবে। আমার পক্ষে মুকুন্দপুরে থেকে স্কুল বসানোর কাজে হেল্প করা তো সম্ভব নয়। তবে

তবে কী?

বিনয় বলল, উইকে একবার নিশ্চয়ই ওখানে যাব। তখন যা বলবেন তাই করে দেব।

আশু দত্ত বললেন, মুকুন্দপুরে শেষ পর্যন্ত হয়তো যেতেই হবে। তুই সপ্তাহে একদিন এলেও অনেকখানি সাহায্য হবে।

একসময় ট্রেন শিয়ালদায় এসে গেল। সেখান থেকে বার দুই বাস ট্রাম বদলে আশু দত্তকে ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পৌঁছে দিয়ে টালিগঞ্জে এল বিনয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *