২১-২৫. হিরণদের রাজদিয়ার জমিবাড়ি

২১.

হিরণদের রাজদিয়ার জমিবাড়ি এক্সচেঞ্জের পাকাপাকি ব্যবস্থা হয়ে যাবার দুদিন বাদে হঠাৎ লাফাতে লাফাতে নিত্য দাস এসে হাজির। সে এল সন্ধের পর। বেশ কিছুদিন বাদে তাকে সুধাদের বাড়িতে দেখা গেল।

এর মধ্যে হিরণ অফিস থেকে ফিরে এসেছিল। এখন বাড়িতে রয়েছে সে, বিনয়, দ্বারিক দত্ত এবং উমা। সুধা আর সরস্বতী নেই। কাছেই এক বাড়িতে সত্যনারায়ণের পুজো। ওঁরা বিশেষ করে যাবার জন্য বলে গিয়েছিলেন। সরস্বতী আগের তুলনায় ইদানীং অনেকটাই ভাল। জবুথবু ভাব আর ততটা নেই। মোটামুটি হাঁটাচলা করতে পারেন। সুধা তাঁকে নিয়ে পুজোবাড়িতে গেছে। পুজো শেষ হলে গীতাপাঠ হবে। তারপর প্রসাদ নিয়ে ওদের ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে।

অনাত্মীয় লোকজন এলে যেমনটা করা হয়, নিত্য দাসকেও তেমনি বাইরের ঘরে বসানো হয়েছে। ওখানেই রয়েছে বিনয়, হিরণ এবং দ্বারিক দত্ত।

আজ সেই বিকেল থেকেই জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। যত সময় যাচ্ছে, ঠাণ্ডার দাপট ততই বেড়ে চলেছে। কনকনে হাওয়া ছেড়েছে উত্তর দিক থেকে। চামড়ায় লাগলে মনে হয়, ছুরির ফলা কেটে কেটে বসে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে গাঢ় হয়ে নামছে কুয়াশা।

দ্বারিক দত্তর পরনে মোটা খদ্দরের ধুতি, পাঞ্জাবি এবং সোয়েটারের ওপর শাল। মাথায় কানঢাকা উলের টুপি। বিনয় আর হিরণের গায়ে ঘরে পরার পোশাক। পাজামা এবং পাঞ্জাবির ওপর ভারী পুল-ওভার। নিত্য দাসও তুষের রোঁয়াওলা চাদর দিয়ে মাথা ঢেকে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে।

উত্তুরে বাতাস রুখবার জন্য ঘরের সব দরজা-জানালা সেই বিকেল থেকে বন্ধ। তবু অদৃশ্য ছিদ্র দিয়ে ঘরের ভেতর হিম এসে ছুঁচের মতো হাড়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।

টালিগঞ্জের এই এলাকাটায় মশাদের প্রচণ্ড উৎপাত। বেলা পড়ে এলে তারা ঝাঁকে ঝাকে চারপাশের বাড়িগুলোতে হানা দিতে থাকে। দরজা-জানালা বন্ধ করেও রেহাই নেই। মশাদের একটা পল্টন ঠিক ফাঁক খুঁজে খুঁজে হিরণদের এই বাইরের ঘরটায় চলে এসেছে। পিন পিন আওয়াজ তুলে সমানে চক্কর দিচ্ছে। আর তাক বুঝে চারটি মানুষের শরীরে যেখানে যেখানে খোলা জায়গা নজরে পড়ছে, ঝাঁপিয়ে পড়ে হুল বেঁধাচ্ছে।

উমা চা-বিস্কুট দিয়ে গিয়েছিল। একটা কাপ তুলে সশব্দে লম্বা চুমুক দিয়ে নিত্য দাস বলল, ভাবছিলাম কাইল দিনের বেইলে আহুম। কিন্তুক শুনাশুন একখান কথা কানে আইতে আইজই লৌড়াইয়া আইলাম।

অন্য সবাইও চায়ের কাপ তুলে নিয়েছিল। হিরণ জিজ্ঞেস করল, কী শুনে দৌড়ে এলেন?

প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে নিত্য দাস বলে, এইটা কি ভালা হইল হিরণ ভাই?

 আপনার কথা কিছুই তো বুঝতে পারছি না। কোনটা ভাল হল না?

 এই যে দ্যাশের বাড়ি-জমিন এচ্চেঞ্জ করলেন, হেই খবরটা একবার আমারে জানাইলেন না?

 হিরণ অবাক। পলকহীন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সে বলে, আপনাকে জানাবার কথা কি ছিল?

অনুযোগের সুরে নিত্য দাস বলল, হেয়া আছিল না। কিন্তুক আমি আপনেগো দ্যাশের লোক। আপনে তো জানেন, আমি হিন্দুস্থান-পাকিস্থানের সোম্পত্তি এক্ষেঞ্জের কারবার করি। আগে যেইদিন আইছিলাম, ঠিকানা দিয়া গ্যাছি। একখান পোস্টোকার্ড ছাইড়া দিলে কবে চইলা আইতাম।

লোকটা কী চাইছে, বুঝতে না পেরে তাকিয়েই তাকে হিরণ।

নিত্য দাস এবার বলে, রাইজদায় আপনেগো দুই-ফসলী ষাইট কানি সরস চাষের জমিন, বাগ বাগিচা, পুকৈর, বসত বাড়ি–হেই হগলের বদলে পাইলেন কিনা খান মঞ্জিল। যাইট সত্তর বছরের পুরানা একখান দালান।

অপার বিস্ময়ে হিরণ জিজ্ঞেস করে, খান মঞ্জিল-এর সঙ্গে আমাদের বাড়িটাড়ি এক্সচেঞ্জ করেছি, আপনি জানলেন কী করে?

এক বচ্ছরের উপুর এই কাম করতে আছি হিরণভাই। ম্যালা (অনেক) খবর আমারে রাখতে হয়। কারা ইন্ডিয়ার সোম্পত্তি বদলাবদলি কইরা পাকিস্থানে যাইতে চায়, কারা পাকিস্থান থিকা একই উদ্দিশ্য লইয়া ইন্ডিয়ায় আইতে চায়–এই হগল না জানলে কারবার চালামু ক্যামনে?

হিরণ উত্তর দিল না।

এদিকে বিনয় একদৃষ্টে নিত্য দাসকে লক্ষ করছিল। রাজদিয়া থেকে হেমনাথের চিঠি এসেছে কি না, জানার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাচ্ছে না।

নিত্য দাস বলে ওঠে, আমার হাতে আরও বড় গাহেক (খদ্দের) আছিল। আপনেগো জমিন বাড়ির বদলে এই টালিগুঞ্জেই খান মঞ্জিল-এর দ্যাড়া (দেড় গুণ) বাড়ি আর পেরায় নয় কাঠা জমিন পাইয়া যাইতেন। আর হেই বাড়িও খান মঞ্জিল-এর লাখান অত কালের পুরানা না। একটু থেমে ফের শুরু করে, আপনেগো জবর লুকসান হইয়া গ্যাল। আমিও মধ্যিখান থিকা ফাঁকে পইড়া গ্যালাম। আপনেগো কাছ থিকা বেশি কিছু নিতাম না; কিন্তু অন্য পক্ষ কম কইরা পাঁচ সাত হাজার নিয্যস (নিশ্চয়) দিত। ইস, দানপত্র করনের আগের দিনও যদিন ট্যার পাইতাম, খান মঞ্জিল এর এচ্চেঞ্জটা আটকাইয়া দিতাম।

নিত্য দাসের এত মনস্তাপ, এমন আফসানির কারণ এতক্ষণে বোধগম্য হল। বিরাট অঙ্কের দালালিটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় শোক উথলে উঠেছে তার।

হিরণ আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, তা পারতেন না।

ক্যান?

অনেক আগেই শওকত আলি খানের সঙ্গে এক্সচেঞ্জের কথাবার্তা বলে রেখেছিলাম। তখনও আপনি আমাদের এ-বাড়িতে আসেননি। দাদু আর জেঠিমা সেই সময় পাটনায়। দেশের জমিজমার বদলে মুসলিম প্রপার্টি নিতে ওঁদের ভীষণ আপত্তি ছিল। সুধারও মত ছিল না। পরে অবশ্য সবাই রাজি হল। শওকত সাহেব আমাদের আশায় এতদিন অপেক্ষা করে ছিলেন। তাকে কি ফট করে না বলে দেওয়া যায়?

দ্বারিক দত্ত নিঃশব্দে দুজনের কথা শুনে যাচ্ছিলেন। এবার মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, কথা যখন দেওয়া হয়েছে তার নড়চড় করা ঠিক হতো না।

নিত্য দাস থতমত খেয়ে গেল। নিমেষে সামলে নিয়ে গলার স্বর একটু উঁচুতে তুলে বলল, একখান কথা কমু, কিছু মনে কইরেন না। আপনেরা অহনও সইত্য যুগে পইড়া আছেন। দিনকাল আর আগের লাখান নাই। যা করলে লাভ বেশি হেয়াই করন উচিত। যদিন সুযুগ পাওন যায় হেইটা পুরা উশুল কইরা নেওন হইল বুদ্ধিমানের কাম। কারে শুকনা মুখের কথা দিছিলেন হেয়া ধইরা বইয়া থাকলে চলে?

নিত্য দাস নামে এই ধুরন্ধর লোকটা জগতে মাত্র কয়েকটা জিনিসই বোঝে। অনেক টাকা। অনেক লাভ। আর সুযোগ এলে পুরোপুরি সেটা কাজে লাগাবার জন্য সারাক্ষণ চোখকান খোলা রাখা।

একনাগাড়ে উপদেশ বর্ষণ করে হাঁফিয়ে পড়েছিল নিত্য দাস। একটু দম নিয়ে আবার আরম্ভ করে, দ্যাশের অত সোম্পত্তির বদলে আপনেরা পাইলেন মোটে ছয় কাঠা জমিন আর পুরানা একখান দালান। আর আমার কপালে ঠনঠনঠন। একটা ঘষা আধলাও জুটল না। হগলই অদ্দিষ্ট। আক্ষেপে তার গলা বুজে আসে।

খানিক চুপচাপ।

যার জন্য এতক্ষণ অস্থির হয়ে ছিল, এই ফাঁকে সেটা বলে ফেলে বিনয়, অনেক দিন পর আপনি এলেন। আর দু-একদিন দেখে আপনার বাড়িতে যেতাম। কেন জানেন? দাদুকে যে সেই চিঠি লিখেছিলাম তার উত্তর এখনও পাইনি। রাজদিয়া থেকে তার চিঠি কি এসেছে?

আস্তে মাথা নাড়ে নিত্য দাস, না। তয় (তবে) আমার হেই লোকটা, জয়নাল যার নাম, ঢাকা আর ফরিদপুর থিকা চিঠিপত্তর আইনা বর্ডারে পৌঁছাইয়া দ্যায়, হেয় খবর পাঠাইছে পরের হপ্তায় হ্যামকত্তার চিঠি লইয়া আইব।

দাদুর জন্যে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি।

চিন্তা তো হওনের কথাই। হ্যামকত্তার চিঠি যে আর কয়দিনের মইধ্যেই পাইবেন হেই কথাখান কওনের লেইগা কাইল আইতাম। কিন্তু হিরণ ভাইগো সোম্পত্তি এচ্চেঞ্জের খবর পাইয়া আইজই চইলা আইছি।

দাদু আর দিদারা কেমন আছেন কিছু জানেন?

 না।

দিন কুড়ি আগে দাদু যে চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন তাতে লিখেছেন, রাজদিয়ার অবস্থা দিনকে দিন খুব খারাপ হচ্ছে। এখন ওখানে কী চলছে, কে জানে।

নিত্য দাস বলে, বডারে জয়নালের লগে দেখা না হওন তরি (পর্যন্ত) কিছুই কইতে পারুম না। আর তো কয়টা দিন। হের পর হ্যামকত্তার চিঠি আইনা দিমু। হগল জানতে পারবেন। তদ্দিন এটু ধৈয্য ধইরা থাকেন।

সরকারি ডাক বিভাগে এখনও ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না। প্রায় অচল। হেমনাথের সঙ্গে যেটুকু যোগাযোগ সবই নিত্য দাসের মারফত। তার নোকজন পূর্ব পাকিস্তানের, বিশেষ করে ঢাকা আর ফরিদপুরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। তারা ওই দুই ডিস্ট্রিক্টের হিন্দুদের চিঠিপত্র বা অন্যান্য খবরাখবর বর্ডার অবধি পৌঁছে দেয়। সীমান্তের এপারেও বেশ কিছু লোককে কাজে লাগিয়েছে নিত্য দাস। তারা এখানকার মুসলমানদের চিঠি টিঠি সীমান্তে নিয়ে গিয়ে নিত্যর ওপারের লোকেদের হাতে তুলে দেয়। তেমন জরুরি কিছু হলে স্বয়ং নিত্যকেই বর্ডারে গিয়ে তার পাকিস্তানি এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলতে হয়।

যতদিন না নিত্য দাস হেমনাথের চিঠি নিয়ে আসছে, অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া উপায় কী?

রাত বাড়ছিল। তাপাঙ্ক হু হু করে নেমে যাচ্ছে। বড় রাস্তা থেকে ক্কচিৎ ট্রাম বাস কিংবা অন্য যানবাহনের ছুটে যাওয়ার ক্ষীণ শব্দ বা লোকজনের অস্পষ্ট কথা ভেসে এসেই মিলিয়ে যায়। ঘরে বসেই টের পাওয়া যায়, রাস্তাঘাট দ্রুত ফাঁকা হয়ে আসছে। এই শীতের রাতে মহানগর যখন হিমে কুয়াশায় কুঁকড়ে রয়েছে, কে আর বাইরে থাকতে চায়?

নিত্য দাস অন্যমনস্কর মতো কী ভাবছিল। হঠাৎ তার দুই চোখ চকচক করে ওঠে। বেশ উত্তেজিত ভাবেই ডাকে, ছুটোবাবু

নিত্যর গলার স্বরের পরিবর্তনটা খট করে কানে ধাক্কা দেয় বিনয়ের। সে রীতিমতো অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবেন?

হ। নিত্য বলতে থাকে, আপনের বাবায় কেতুগঞ্জের মজিদ মিঞার কাছ থিকা তিরিশ কানি জমিন কিনছিলেন না? তিন ফসলী চেমৎকার খেতি। বচ্ছরে তিনবার ফসল হইত। আউশ আমন আর রবিখন্দের সোময় তিল কলই সউর (সর্ষে) রান্ধনি–

বিনয় সায় দেয়, হ্যাঁ, খুবই ভাল জমি।

শুনছি, আপনের বাবার তীর্থধম্মে মতি হইছে। তেনি সোংসার, পোলমাইয়ার মায়া ছাইড়া কুন এক গুরুর কাছে চইলা গ্যাছেন?

হ্যাঁ।

তা রাইজদার হেই জমিগুলানের কী ব্যবস্তা কইরা গ্যাছেন?

অবনীমোহন গুরুর কাছে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে রাজদিয়ায় তার বিষয়আশয়ের ব্যাপারটা পুরোপুরি মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বিনয়ের। নিত্য দাস কিন্তু ভোলেনি। পাকিস্তানে তার পরিচিত মানুষজনের কার কতটুকু জমি এবং অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে, সমস্ত কিছু তার নখদর্পণে।

বিনয় বলল, বাবা কোনও ব্যবস্থাই করে যাননি। জমিগুলো যেমন ছিল তেমনিই রয়েছে। দাদু লোক দিয়ে কবছর ধরে চাষবাস করাচ্ছেন।

বিপুল উদ্যমে বিনয়ের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিত্য দাস, আমার একখান পরামশ্য লন (নিন) ছুটোবাবু।

কী পরামর্শ?

হ্যামকত্তা তেনার বিষয় সোম্পত্তি এচ্চেঞ্জ করবেন কি না, তেনিই জানেন। ওনার মতিগতির তল পাই না। পাকিস্থান হইয়া গ্যাছে। উইখানের লগে আমাগো সম্পর্ক শ্যাষ। এত বড় বিদ্বান মানুষ, ক্যান যে বুঝেন না, হিন্দুরা বডারের উইধারে থাকতে পারব না। দ্যাশের উপুর ক্যান যে অ্যাত টান! ক্যান যে অ্যাত মায়া! হে যাউক, উনি যা ভালা মনে করবেন হেয়াই করবেন। কিন্তুক আপনেগো জমিনগুলান এচ্চেঞ্জ কইরা ফালান। আমার হাতে গাহেক আছে।

ইঙ্গিতটা আগেই পেয়ে গিয়েছিল বিনয়। কিন্তু জমিজমা, বিষয়আশয় সম্পর্কে তার কোনও রকম মোহ নেই। তাছাড়া রাজদিয়ার ওই জমি তার একার নয়, সুধা এবং সুনীতিরও। ওই ব্যাপারে তাদেরও খুব একটা আগ্রহ নেই।

বিনয় বলল, দেখুন, বাবা আমাদের তিন ভাই বোনকে বলে গেছেন, ওই জমিটা নিয়ে আমরা যা ভাল বুঝি তাই যেন করি। কিন্তু এ নিয়ে আমরা এখনও কিছু ভাবিনি। একটু থেমে ফের বলল, রাজদিয়ার জমি এক্সচেঞ্জ করলে ওয়েস্ট বেঙ্গলে খানিকটা জমি হয়তো পাব কিন্তু সে-সব কে দেখাশোনা করবে? কে চাষবাস করাবে? আমাদের অত সময় নেই। ওগুলো যেমন আছে তেমনই থাক।

নিত্য দাস সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। জোঁকের মতো সে লেগে থাকে। জমিনের বদলে যদিন এই পারের জমিন না ন্যান, অন্য এট্টা উপায়ও হইতে পারে।

লোকটা ফন্দিবাজ। নিশ্চয়ই তার মাথায় হঠাৎ কোনও একটা মতলব খেলে গেছে। বিনয় সামান্য। উৎসুক হল, কী উপায়?

জমিন না নিয়া ট্যাকা নিতে পারেন।

টাকা নেব কী করে? দলিল টলিল সব পড়ে আছে রাজদিয়ায়, দাদুর কাছে। এখন আমাদের কারও পক্ষে পাকিস্তানে গিয়ে সে-সব নিয়ে আসা সম্ভব নয়।

নিত্য দাস দুহাত তুলে হাঁ হাঁ করে ওঠে, আপনেগো পাকিস্থানে যাওন লাগব না। টালিণ্ডঞ্জের এই বাড়িত বইয়াই ট্যাকা পাইয়া যাইবেন। পদ্ধতিটাও সে বিশদভাবে জানিয়ে দেয়। বিনয় সুধা আর সুনীতি, তিন ভাইবোন স্ট্যাম্প পেপারে লিখে জমি বিক্রি বা হস্তান্তরের ক্ষমতা হেমনাথকে দেবে। নিত্যর লোক সেটা নিয়ে রাজদিয়ায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করবে। কলকাতা থেকে পাকিস্তানে চলে যেতে চায়, নিত্যর হাতে এমন বহু ক্রেতা আছে। সবচেয়ে বেশি দাম যে দেবে তার নামেই বিনয়দের জমিটা রেজিস্ট্রি করে দেবেন হেমনাথ। টাকাটা ঢাকার মারোয়াড়িদের কাছ থেকে হুন্ডি করিয়ে ওদের কলকাতার বাজারের গদি থেকে তুলে নিতে তিলমাত্র অসুবিধা হবে না। এইভাবে মারোয়াড়িদের মারফত ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের মধ্যে আকছার টাকা পয়সার লেনদেন চলছে। বিনয়দের কষ্ট করে বড়বাজার অবধি যেতেও হবে না। নিত্য দাস নিজে গিয়ে টাকাটা এনে দেবে।

একটু ভেবে সে আরও বলে, আপনেরা সন্দ (সন্দেহ) করলেও করতে পারেন যে আমি ট্যাকাটা মাইরা দিমু। কিন্তুক এক দ্যাশে আমাগো বাড়ি। আপনেরা আমার আপন মানুষ। হ্যামকত্তারে কত সোম্মান করি। তেনার নাতি-নাতিনগো আমি ঠকামু না। মাথার উপুর ভগমান আছে, ধম্ম আছে। আমারে বিশ্বাস করতে পারেন। যদিন আপনেগো ট্যাকা মারনের মতলব করি, নিঃবংশ হমু। আমাগো মাথায় ঠাটা (বাজ) পড়ব।

এত বুঝিয়ে সুঝিয়েও সুফল কিছুই হল না। বিনয় নিস্পৃহ সুরে বলল, রাজদিয়ার জমি নিয়ে আমরা কিছুই করব না। যা করার দাদুই করবেন।

হিরণদের জমি বাড়ি তো হাতছাড়া হয়েছেই। সে-সবের জন্য দালালির আশা নেই। এদিকে বিনয়রাও তাদের অতটা জমি বেচবেও না, এক্সচেঞ্জও করবে না। কী যে এদের ভাবগতিক! নিত্য দাস মুষড়ে পড়ে। হতাশার সুরে বলে, নিজেগো কতখানি ক্ষেতি করলেন, অখন বুঝতে পারবেন না ছুটোবাবু। একখান কথা কইয়া থুইলাম, পরে কপাল থাপাড়াইতে হইব। তখন আর কিছু করনের থাকব না।

একটু চুপচাপ।

তারপর নিত্য দাস বলল, ম্যালা রাইত হইয়া গ্যাছে। আইজ উইঠা পড়ি। শীতের রাইতে গাড়িঘুড়া কইমা যায়। এইর পর কসবার বাস পামু না। ছুটোবাবু আপনে খাড়া না কইয়া দিছেন। তর্ভু আমি লাইগা থাকুম কিলাম (কিন্তু)। পরের হপ্তায় হ্যামকত্তার চিঠি লইয়া আহুম। এইর মইধ্যে রাইজদার জমিনটা বেচবেন কিনা, ভাইবা দেইখেন। দুই বইনের লগে, দুই ভগ্নীপতির লগে পরামশ্য কইরেন। দ্বারিক কত্তা বুড়া মানুষ। পিরেথিমীতে কত কিছু দ্যাখছেন, কত কিছু হোনছেন। তেনার মতও লইয়েন।

নিত্য উঠে পড়েছিল, হঠাৎই জামতলি হাই স্কুলের মৃত হেডমাস্টার রামরতন গাঙ্গুলির বৃদ্ধা স্ত্রী এবং তাঁদের তিন মেয়ে ছায়া মায়া আর বাসন্তীর মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিনয়ের। তারপাশা স্টিমারঘাটে পাহারা দিয়ে দিয়ে ওঁদের পৌঁছে দিয়েছিলেন রামরতনের প্রাক্তন ছাত্র নাসের আলি এবং তার অনুগত কয়েকটি সশস্ত্র যুবক। 

তারপশায় নাসের আলি আর রামরতনের কথাবার্তা শুনে বিনয় জানতে পেরেছিল, জামতলিতে রামরতনদের চল্লিশ কানি উৎকৃষ্ট চাষের জমি ছাড়াও আছে বসত-বাড়ি, বাগান, পুকুর ইত্যাদি। তাদের সম্পত্তির দলিল রেখে এসেছেন নাসেরের কাছে। রামরতন বিশেষ করে অনুরোধ করেছিলেন নাসের যেন সুযোগ পাওয়ামাত্র তাদের জমিবাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করেন। খালি হাতে কলকাতায় যাচ্ছেন। সেখানে টাকার বড় দরকার।

 কদিন আগে বিমলদের বাড়ি গিয়েছিল বিনয়। রামরতনের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, নাসের আলি এর মধ্যে তাদের বাড়িটাড়ি বেচার বন্দোবস্ত করতে পেরেছেন কি না। অবশ্য তেমন কিছু হলে বৃদ্ধা নিশ্চয়ই তাকে খবরটা দিতেন। খুব সম্ভব কলকাতায় আসার পর নাসেরের সঙ্গে তিনি যোগাযোগই করতে পারেননি।

নিত্য দাস যে ধরনের ফন্দিবাজ লোক, রামরতনের সম্পত্তির ব্যাপারে মাথা খাঁটিয়ে কিছু একটা ফিকির কি আর বার করতে পারবে না? বিনয় হাত নেড়ে বলল, আর একটু বসে যান। কাজের কথা আছে।

নিত্য দাস অবাক। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করল, কী কাম?

আগে বসুন তো। সব শুনুন। কাজটা করে দিতে পারলে আপনার বেশ ভাল লাভ থাকবে।

টাকা পয়সার গন্ধ পেয়ে মুষড়ে-পড়া ভাবটা কেটে যায় নিত্য দাসের। লহমায় চাঙ্গা হয়ে ওঠে সে। কাপ করে ফের চেয়ারে বসে পড়ে।

বিনয় জিজ্ঞেস করল, জামতলির নাম শুনেছেন?

নিত্য দাস বলল, হুনুম না ক্যান? তারপাশা ইস্টিমারঘাটা থিকা চার মাইল পুবে। আলিসান গেরাম। বামন কায়েত যুগী তেলী কুমার কামার মুসলমান-নানা জাইতের মাইনষের বাস। আছে বড় বড় দিঘি, পদ্মবিল। ম্যালা দালানকোঠা। এককালে দশ বিশটা টোল আছিল। পাকিস্থান–

নিত্য দাস যেভাবে শুরু করেছে তাতে জামতলির ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক বিবরণ আরও অনেকক্ষণ চলত। হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল বিনয়, বুঝেছি, ওই জায়গাটা আপনি ভাল করেই চেনেন।

হেইখানে গ্যাছিও কয়েক বার। তা আতখা (হঠাৎ) জামতলির কথা উঠাইলেন যে ছুটোবাবু?

দরকার আছে। পাকিস্তানে আপনার যে কাজের লোকেরা আছে তারা কি জামতলি যেতে পারবে?

জামতলি ক্যান, ট্যাকা পাইলে পাকিস্থানের যেইহানে কইবেন হেইহানে চইলা যাইব। কন (বলুন) জামতলিতে কী করতে হইব?

রামরতন গাঙ্গুলি এবং তার পরিবার সম্পর্কে সবিস্তার জানিয়ে বিনয় বলল, ওঁদের জমি বাড়ির দলিল আছে নাসের আলি নামে এক ভদ্রলোকের কাছে। তিনি জামতলি হাই স্কুলের অ্যাসিস্টান্ট হেড মাস্টার। একসময় রামরতনবাবুর প্রিয় ছাত্র ছিলেন। খুবই ভাল মানুষ। রামরতনবাবু তাকে সম্পত্তি বিক্রির দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলেন। খুব সম্ভব তিনি এখনও তা করে উঠতে পারেননি।

নিত্য দাস জোরে মাথা ঝাঁকায়, হ। ফন্দিফিকির না জানলে পাকিস্থানে বইয়া হিন্দুর সোম্পত্তি ব্যাচন (বেচা) অত সোজা না।

আপনি কি আপনার লোকদের দিয়ে রামরতনবাবুর বাড়িটাড়ি বিক্রি করতে পারবেন? ওঁর ফ্যামিলি ভীষণ কষ্টে আছে। টাকাটা পেলে ওঁরা বেঁচে যাবেন। অবশ্য আপনার যা প্রাপ্য, ঠিকই পাবেন।

উদ্দীপনায় দুচোখ জ্বল জ্বল করে ওঠে নিত্য দাসের। নিয্যস পারুম। আপনে তো জানেন আমার হাতে কত গাহেক আছে। তেনারা এহানেই ট্যাকাপয়সা দিয়া দানপত্র ল্যাখাইয়া বডারের উই পারে চইলা যাই।

বিনয় বলে, তাহলে তো খুবই ভাল হয়। যত তাড়াতাড়ি পারেন, ব্যবস্থা করে দিন।

আগে নাসের আলির কাছে লোক পাঠাই। গাঙ্গুলি মশয়ের সোম্পত্তিগুলান নিয়া তেনি কদ্দূর কী করতে পারছেন, খবর লই। হের পর যা করনের করুম।

কবে আপনার লোক নাসের আলির কাছে যেতে পারবে?

খানিক চিন্তা করে নিত্য দাস বলল, কাইলই বারের উই পারে খবর পাঠামু। লগে লগে তক্ষনই আমার লোক জামতলিতে চইলা যাইব। পরের হপ্তায় তো হ্যামকার চিঠি লইয়া আপনের কাছে আইতেই আছি। নাসের আলির লগে দ্যাখা কইরা আমার নোক কী জানতে পারছে, আপনেরে কইয়া যামু। যদিন নাসের সাহেব অহনও কিছু না কইরা উঠতে পারেন, গাঙ্গুলি মশয়ের ফেমিলির লগে আমার দ্যাখা করন লাগব।

বিনয় বলল, কোনও অসুবিধে নেই। যেদিন বলবেন সেদিনই আপনাকে রামরতনবাবুর স্ত্রী আর মেয়েদের কাছে নিয়ে যাব।

নিত্য দাস আর বসল না। চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। উৎসাহে সে টগবগ করছে। মনে লয় (হয়), মা কালীর দয়ায় এই কামটা আমি কইরা দিতে পারুম ছুটোবাবু। চলি– সবার। কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে দরজার দিকে পা বাড়ায়।

.

২২.

আজ বিনয়ের অফিসে জয়েন করার দিন। জীবনের একটা পর্ব শেষ। এবার নতুন পর্বের সূচনা। কাল রাতে ভাল করে ঘুমোতে পারেনি সে। বার বার ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছিল। আর মাথার ভেতর নানা চিন্তা বিজ বিজ করছিল। ছিল অদ্ভুত এক মানসিক চাপ। চাপের কারণটা এইরকম। আনন্দ। তার বাবার এক সময়ের মক্কেল এবং তাদের পারিবারিক হিতাকাঙ্ক্ষী জগদীশ গুহঠাকুরতাকে ধরে চাকরিটার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বিনয়ের সঙ্গে কথা বলে তাকে পছন্দও হয়েছে জগদীশের। ছোটখাটো একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। জগদীশের কাগজের নিউজ এডিটর তারাপদ ভৌমিক তাকে একটা প্রতিবেদন লিখতে দিয়েছিলেন। পরীক্ষায় সে ভালই উতরে গিয়েছিল। তারাপদ লেখাটার যথেষ্ট তারিফ করেছেন। তার লেখার হাত যে চমৎকার সেটা জগদীশকে জানিয়েও দিয়েছেন।

একটা লেখা না হয় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারাপদ বলেছেন, রোজই বিনয়কে কিছু না কিছু লিখতে হবে। এমন সব রিপোর্ট যা পাঠকরা গোগ্রাসে গিলবে। তাতে কাগজ সম্বন্ধে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। প্রচারও বেড়ে যাবে হু হু করে। আর প্রচার বাড়লে, কাগজের লাভ হলে, কর্মীদেরও ষোল আনা লাভ। তাদের মাইনে এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও বাড়বে। সবই ঠিক। কিন্তু বিনয়ের দুশ্চিন্তা, নিত্য নতুন, চমকপ্রদ লেখার জোগান কি সে দিতে পারবে? জগদীশ গুহঠাকুরতা আর তারাপদ ভৌমিককে তার ভাল লেগেছে। জগদীশ রাশভারী। উচ্ছ্বাসহীন। তবু টের পাওয়া গেছে তিনি স্নেহপ্রবণ। তবে তারাপদ ভৌমিক একেবারে মাটির মানুষ। কিন্তু অন্য সহকর্মীরা কেমন হবে, কে জানে। এইসব মিলিয়ে বিনয় নার্ভাস হয়ে পড়েছিল।

সকালে উঠেও অস্থিরতা, দুর্ভাবনা কাটেনি। কর্মজীবনে প্রথম পা ফেলতে চলেছে, সেজন্য এব ধরনের উত্তেজনাও হচ্ছে। সেই সঙ্গে আনন্দও যে হচ্ছে না তা নয়। এ-সবের মধ্যেই মুখটুখ ধুয়ে বাইরের ঘরে হিরণ সুধা এবং দ্বারিক দত্তর সঙ্গে চা খেতে বসল সে।

বিনয় চাকরিতে জয়েন করবে। কিন্তু সুধার উত্তেজনা তার চাইতেও বেশি। চা খেতে খেতে ভাইকে জিজ্ঞেস করল, তোকে কখন বেরুতে হবে?

বিনয় বলল, আনন্দদা এসে আমাকে নিয়ে যাবে বলেছে। দেখি কখন আসে—

 সুধা বলল, সেই কবে বলে গিয়েছিল। ভুলে টুলে যায়নি তো?

 হালকা ধমকের সুরে হিরণ বলে, ভুলে যাবে! কী যে বল তার মাথামুণ্ডু নেই।

দ্বারিক দত্তও বললেন, আনন্দকে তো জানি। খুবই দায়িত্বশীল ছেলে। কথা যখন দিয়েছে ঠিক চলে আসবে। চিন্তা কোরো না।

হিরণ নটা নাগাদ অফিসে বেরিয়ে যায়। চান টান সেরে পৌনে নটায় খেতে বসে। তাই রোদ উঠতে না উঠতেই এ-বাড়িতে কয়লার উনুন ধরিয়ে রান্নার তোড়জোড় শুরু হয়। তবে সকাল বিকেল সন্ধে বা রাতে চাটা করা হয় ইলেকট্রিক হিটারে কিংবা স্টোভে।

রান্না হয় দুভাগে। প্রথমেই মাছের ঝোল। সরস্বতী বিধবা মানুষ। নিরামিষ খান। আমিষের ছোঁয়া পর্যন্ত বারণ। তাই মাছ হয়ে গেলে উনুন ভাল করে নিকিয়ে ভাত ডাল ভাজা দুতিন রকমের নিরামিষ তরকারি করা হয়। আজ হবে বেগুন ভাজা, মুগের ডাল, আলু কপির ডালনা এবং পালংয়ের ঘন্ট।

মাছ নামিয়ে উনুন সাফ করে, ডাল বসিয়ে, চা করে নিয়ে এসেছিল সুধা। উমাকে আনাজ কাটার দায়িত্ব দিয়ে এসেছে। তবে চা খেতে খেতে মাঝে মাঝে রান্নাঘরে গিয়ে সব দেখে আসছে। ডাল ফুটে উঠলেই সম্বরা দিয়ে নিজের হাতে অন্য রান্নাগুলো সেরে ফেলবে।

সুধা বিনয়কে জিজ্ঞেস করল, আনন্দদা কখন আসবে, তোকে বলে গেছে?

 বিনয় মাথা নাড়ল, না।

ভাল করে জেনে নিসনি কেন?

বিনয় জানে, তার এই ছোটদিদিটি ছোটখাটো, তুচ্ছ ব্যাপারেও ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে। সে উত্তর দিল না।

একটু চিন্তা করে সুধা এবার বলল, তুই এক কাজ কর—

কী?

চান করে তোর হিরণদার সঙ্গে খেয়ে রেডি হয়ে থাক। আনন্দদা এলে তক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে পারবি।

সুধার এই কথাগুলো মনঃপূত হল বিনয়ের। আনন্দ আসার পর তাকে বসিয়ে রেখে চান-খাওয়া সারতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। প্রথম দিনই লেট করলে তার সম্বন্ধে অফিসের লোকজনের, বিশেষ করে কর্তৃপক্ষের ধারণা খারাপ হবে। সেটা একেবারেই চায় না বিনয়। বলল, ঠিক আছে।

সুধা কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, উমা এসে খবর দিল, ডাল ফুটে গেছে।

এখন আর এক মুহূর্তও বসার সময় নেই। এক ঢোকে বাকি চা শেষ করে সুধা রান্নাঘরে ছুটল।

বিনয়ের এই ছোটদিদি একসময় ছিল কুঁড়ের বাদশা। পাশ ফিরে শুতেও তার যেন কষ্ট হতো। কিন্তু বিয়ের পর কবছরে আগাগোড়া পালটে গেছে। এখন সে ঘরের লক্ষীমার্কা সুগৃহিণী। সারাক্ষণ সংসারের যাবতীয় ঝক্কি দশভুজা হয়ে সামলায়।

ক্ষিপ্র হাতে সাড়ে আটটার ভেতর সব রান্না সেরে ফেলল সুধা। এর মধ্যে হিরণ আর বিনয়ের চান হয়ে গিয়েছিল। কাঁটায় কাঁটায় পৌনে নটায় তাদের খেতে বসিয়ে দিল।

খাওয়াদাওয়া সেরে হিরণ অফিসে চলে গেল। আর সাদামাঠা ঘরোয়া পোশাকে অপেক্ষা করতে লাগল বিনয়। আনন্দ এলে জামাকাপড় পালটাতে আর কতক্ষণ? তারপর দুজন বেরিয়ে পড়বে।

নটার পর দশটা বাজল। তারপর এগারোটা। বেলা যত বাড়ছে ততই চঞ্চল হয়ে উঠতে থাকে সুধা। বিনয়কে বলে, কি রে, আনন্দদা এখনও এল না যে? অফিস তো দশটায় বসে যায়।

বিনয়েরও যে চিন্তা হচ্ছিল না তা নয় কিন্তু সেটা জানালে সুধা আরও অস্থির হয়ে পড়বে। তার দুর্ভাবনা কাটিয়ে দেবার জন্য স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করল বিনয়। বলল, অফিস থেকে হয়তো দেরি করে নিয়ে যেতে বলেছে। আনন্দদা আগে এসে কী করবে?

সুধা উত্তর দিল না। তার চাঞ্চল্য কতটা কমল, আদৌ কমল কি না, কে জানে।

শেষ পর্যন্ত উৎকণ্ঠার অবসান। সোয়া বারোটায় আনন্দ এল। সদর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে উমা নিচে গিয়ে তাকে বাইরের ঘরে নিয়ে এল। সুধা আর বিনয় সেখানে বসে ছিল।

অন্য দিনের মধ্যে দ্বারিক দত্ত এগারোটা নাগাদ খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছেন। বুড়ো মানুষ। শরীর নড়বড়ে হয়ে গেছে। খাওয়ার পর ঘন্টা তিনেক দিবানিদ্রা না হলে তার খুব কষ্ট হয়। বাড়ির অন্য কারও এখনও খাওয়া হয়নি। সরস্বতী বাথরুমে। স্নানের পর তার পুজো আছে। তারপর খেতে বসবেন। তার খাওয়া হলে সুধা আর উমা খাবে।

সুধা জিজ্ঞেস করল, এত দেরি করলেন যে আনন্দদা?

কোথায় দেরি? একটা বেতের চেয়ারে শরীর ঢেলে দিয়ে আয়েশ করে বসে পড়ল আনন্দ।

সোয়া বারোটা বাজে। দেরি নয়?

আনন্দ বুঝিয়ে দিল, খবরের কাগজের অফিস, বিশেষ করে নিউজ ডিপার্টমেন্ট, অর্থাৎ বার্তা বিভাগ চব্বিশ ঘন্টাই খোলা থাকে। তবে কাজের ব্যস্ততা বাড়ে দুপুরের পর থেকে। তখন প্রধান সম্পাদক থেকে শুরু করে নিউজ এডিটর, চিফ রিপোর্টার সবাই চলে আসেন। পৃথিবী নামে গ্রহটি তো আগের মতো অপার শান্তির স্বর্গ হয়ে নেই। প্রায়ই কোথাও না কোথাও ঘটছে ভয়াবহ সব ঘটনা। গণহত্যা। স্বাধীনতার জন্য লড়াই। বৈধ গণতান্ত্রিক সরকারকে ফেলে দিয়ে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে সেই যে শুরু হয়েছে তার শেষ নেই। শুধুই অশান্তি। এছাড়া মারাত্মক মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো রয়েছেই। ভূমিকম্প। বন্যা। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস। কোনও আগ্নেয়গিরি বহু কাল ঘুমিয়ে থাকার পর আচমকা জেগে উঠে লাভা উগরে দিয়ে ধ্বংস করে দেয় অগুনতি জনপদ। চারদিকে শুধু লোকক্ষয়। এই ধরনের কিছু ঘটলে, সকাল হোক আর মধ্যরাতই হোক, সম্পাদক বার্তা-সম্পাদক সবাই অফিসে দৌড়ে আসেন।

বিনয় যাঁদের কাছে কাজ করবে, এমনিতে তাদের কেউ দুটোর আগে আসেন না। তাই তাড়াতাড়ি যাবার মানে হয় না। আনন্দ বিনয়কে বলল, হাতে অনেক সময় আছে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ধীরেসুস্থে খেয়ে নাও।

বিনয় বলল, আমার খাওয়া হয়ে গেছে। হিরণদা অফিস থাকলে পৌনে নটায় খেতে বসে। ছোটদি তার সঙ্গে আমাকেও জোর করে বসিয়ে দিয়েছিল। যদি দেরি করে গেলে চাকরিটা ফসকে যায়, তাই।

আনন্দ তার শ্যালিকাটিকে ভালই জানে। কারণে অকারণে তার দুশ্চিন্তা। হেসে হেসে বলল, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।

সুধা অপ্রস্তুত। ঠোঁট কামড়ে সামান্য হেসে বিনয়কে বলল, সেই কখন খেয়েছিস। আর দুটি খেয়ে নে। আনন্দদা, আগের দিন যখন এসেছিলেন নেমন্তন্ন করা হয় নি। হাতজোড় করে মজার সুরে বলতে লাগল, নিজগুণে ত্রুটি মার্জনা করে আপনিও দুমুঠো খান।

বিনয় এবং আনন্দ কেউ রাজি হল না। বিনয় বলল, অসম্ভব। এখনও ভাত হজম হয়নি। আনন্দ জানায়, বিনয়কে নিয়ে যাবে বলে সে আজ অফিসে যায়নি। বাড়ি থেকে এইমাত্র খেয়েদেয়ে আসছে। আদরের শ্যালিকাটি যেন জোরজার না করে।

শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল সুধা।

আনন্দ বিনয়কে বলল, বাড়িতে বসে থেকে কী হবে? চল, বেরিয়ে পড়া যাক।

বিনয় ওধারের একটা ঘর থেকে পাঁচ মিনিটের ভেতর ধবধবে ধুতি এবং ফুল শার্টের ওপর সোয়েটার পরে চলে এল। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ে নিয়েছে। জুতোও পরা হয়ে গেছে।

যাচ্ছি রে ছোটদি

বিনয়রা বেরুতে যাবে, হঠাৎ কী মনে পড়ে গেল সুধার। শশব্যস্তে সে বলল, দাঁড়া দাঁড়া। জুতো খুলে আমার সঙ্গে আয়

বিনয় অবাক। কোথায়?

আয় না ।

সুধার কার্যধারার তল পাওয়া মুশকিল। অগত্যা জুতো খুলতে হল বিনয়কে। তার একটা হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে আনন্দকে বলল, এক মিনিট আনন্দদা। আমরা যাব আর আসব—-

আনন্দ হাসিমুখে বলল, ঠিক আছে।

সুধা ভাইকে টানতে টানতে তার আর হিরণের শোবার ঘরে নিয়ে এল। খাট আলমারি ড্রেসিং টেবল ইত্যাদি দিয়ে ঘরটা সাজানো। একধারে কাঠের সিংহাসনে রয়েছে লক্ষ্মী দুর্গা সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং কাঁচ দিয়ে বাঁধানো কালীর ফোটো।

আগে পুজোটুজোর তেমন ঝোঁক ছিল না সুধার। কিন্তু ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় যেভাবে পার্ক সার্কাসে অনিবার্য মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে তারা নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে পেরেছিল, সেটাকে দৈব করুণা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না সে। তখন থেকেই তার ঈশ্বর-ভক্তি বেড়ে গেছে। রোজ সকালে বাসি কাপড় ছেড়ে, গা ধুয়ে, পরিষ্কার শাড়ি পরে, দুর্গা লক্ষ্মী ইত্যাদি চার দেবদেবীকে প্রণাম করে তার দিন শুরু হয়। হিরণ অফিসে বেরিয়ে যাবার পর স্নান সেরে ফের শাড়ি বদল। এবার দেবদেবীর ফোটোগুলো গঙ্গাজলে ধুয়েমুছে ফুলচন্দন দিয়ে সাজিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে পুজো চলে। সন্ধেবেলায় পেতলের পঞ্চপ্রদীপ এবং সুগন্ধি ধূপ জ্বেলে হাতজোড় করে অনেকক্ষণ ধ্যান করে সে। দৈনিক তিন পর্বে তার আরাধনা। শীত-গ্রীষ্ম বারোমাস, এই রুটিনের হেরফের নেই।

সরস্বতী আসার পর পুজোর মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। দেশ থেকে তিনি কুলদেবতা দেবাদিদেব মহেশ্বরকে নিয়ে এসেছিলেন। পাথরে খোদাই মূর্তিটা রয়েছে তার শোবার ঘরে। তিনিও তিনবার পুজোয় বসেন। হিরণ মাঝে মাঝে রগড় করে সুধাকে বলে, তুমি আর জেঠিমা দুজনে মিলে বাড়িটাকে একেবারে পোবন বানিয়ে ছাড়বে দেখছি।

সুধার দ্বিতীয় দফার পুজো হয়ে গিয়েছিল। দেবদেবীর সিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে ভাইকে বলল, শুভ কাজে যাচ্ছিস। ঠাকুর প্রণাম করে যা।

ঈশ্বর-টিশ্বর নিয়ে সুধার মতো বাড়াবাড়ি নেই বিনয়ের। এই ব্যাপারে কোনওদিন সে মাথা ঘামায়নি। খানিকটা নিস্পৃহ ভাব। ভগবান ভগবানের মতো থাকুন, আমি আমার মতো থাকি, এইরকম আর কি। কিন্তু আজ কী যে হয়ে গেল, হাঁটু মুড়ে বসে মেঝেতে মাথা ঠেকিয়ে আলাদা আলাদা করে চার দেবতাকে প্রণাম করল। নতুন জীবনে প্রবেশ করতে চলেছে। মনে মনে হয়তো ঈশ্বরের করুণা চেয়ে নিল।

বিনয় উঠে দাঁড়াতেই সিংহাসন থেকে দুচারটে পুজোর ফুল তুলে নিয়ে তার কপালে ঠেকিয়ে পকেটে পুরে দিতে দিতে সুধা বলল, ফেলে দিস না কিন্তু তার বিশ্বাস, পুজোর এই ফুল ভাইয়ের কর্মজীবনকে রক্ষাকবচের মতো নির্বিঘ্ন করবে।

বিনয় মাথা নেড়ে জানায়, ফেলবে না।

সুধা বলল, চল এবার। আনন্দদা অপেক্ষা করছেন।

দুজনে বাইরের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

.

২৩.

সুধাদের বাড়ি থেকে বড় রাস্তায় এসে ঘড়ি দেখল আনন্দ। একটা বাজতে এখনও সাত মিনিট বাকি। চারদিকে বেশ লোকজন আছে। ট্যাং ট্যাং আওয়াজ করে ট্রাম চলছে। চলছে প্রাইভেট বাস। কন্ডাক্টরদের হাঁক কানে আসছে, রাসবিহারী….কালীঘাট……হাজরা…..ভবানীপুর…ধর্মতলা……খালি, গাড়ি, খালি গাড়ি….উঠে আসুন…।

মাসখানেক আগে পাকিস্তান থেকে এই শহরে আসার পর যে-কোনও বড় রাস্তায় পা ফেললে, তা টালিগঞ্জেই তোক কি শিয়ালদা বা শ্যামবাজারেই, কন্ডাক্টরদের একই লজ শুনে আসছে বিনয়। একই ধরনের খ্যানখেনে টানা সুর, একই বলার ভঙ্গি। মনে হয়, কোনও এক স্পেশাল গানের স্কুল থেকে স্বরলিপি রপ্ত করে এই কন্ডাক্টররা সুরটা গলায় তুলে নিয়েছে। অবশ্য বাসের রুট অনুযায়ী লিরিকটা পালটে পালটে যায়। টালিগঞ্জের বাস হলে রাসবিহারী…কালীঘাট….ইত্যাদি। শ্যামবাজারের বাস হলে হাতিবাগান…হেদো….বিবেকানন্দ রোড……কলেজ ইস্টিট…..

শীতের এই দুপুরবেলায় মানুষজন আছে ঠিকই, কিন্তু তাদের কোনওরকম তাড়া নেই। ট্রাম বাস কি অন্য সব গাড়িটাড়ি চলছে ঢিকিয়ে টিকিয়ে। সবই কেমন যেন অলস। ত্বরাহীন। তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা আগে অফিস টাইমের যে ব্যস্ততা ছিল, এখন তার লেশমাত্র চোখে পড়ে না।

রাস্তার একধারে লাইন দিয়ে কটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। আনন্দ সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, চল, একটা ট্যাক্সি নেওয়া যাক—

উঁহু আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।

– উঁহু কেন?

রোজ রোজ তো আপনি ট্যাক্সি করে অফিসে পৌঁছে দেবেন না। ট্রামে-বাসে আমাকে যাতায়াত করতে হবে। তাই ধরা যাক। তাছাড়া হাতে যথেষ্ট সময় আছে। আম জনতার গাড়িতে গেলেও দুটোর ভেতর ঠিক পৌঁছে যাব।

আনন্দ হাসল, ঠিক আছে।

ওদের কথাবার্তার মধ্যেই একটা ট্রাম এসে গেল। দুজনে সামনের দিকের ফার্স্ট ক্লাসে উঠে পড়ে। গাড়ি প্রায় ফাঁকাই। জানালার ধারের জোড়া সিটে আনন্দ আর বিনয় পাশাপাশি বসল।

ট্রাম ধীর চালে চলতে থাকে। হিমঋতুর এই দুপুরে বোদ বেশ ঝলমলে, যদিও তেজ কম। শহরের গায়ে সোনালি মলিদার মতো সেটা জড়িয়ে রয়েছে। ট্রাম যত এগুচ্ছে, দুধারের বাড়ি, রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্ট, ডালপালাওলা উঁচু উঁচু গাছ পেছন দিকে সরে সরে যাচ্ছে। অনেক সময় সিনেমার ব্যাক প্রোজেকশনে যেমন দেখা যায়।

খানিকটা চলার পর আনন্দ ডাকল, বিনু

 জানালার বাইরে অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে ছিল বিনয়। মুখ ফিরিয়ে উৎসুক চোখে তাকালো।

 কদিন ধরেই তোমার সম্বন্ধে সুনীতির সঙ্গে আলোচনা করছিলাম।

কী আলোচনা?

বাবার বন্ধু জগদীশবাবুর কাগজের অফিসে তোমার চাকরি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু বাজারে আরও অনেক কাগজ রয়েছে। জগদীশবাবু খুবই আশাবাদী। তার ধারণা তার পেপার বছরখানেকের ভেতর দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু

কী?

এটা ফ্যাক্ট, পশ্চিমবাংলায় মানুষ অনেক বেড়ে গেছে। রিডারশিপও বাড়ছে। কিন্তু খবরের কাগজ পড়াটা হল হ্যাবিট। প্রত্যেকটা কাগজের কম হোক বেশি হোক, কিছু লয়াল পাঠক থাকে। তারা চট করে নতুন কাগজের দিকে ঝুঁকবে না। পিকিউলিয়ার সাইকোলজি। আর নিউ জেনারেশনের যে রিডার বাড়ছে তাদেরও ঝোঁক পুরোনো নামকরা কাগজগুলোর দিকে। পরিচিত কোনও কিছুর বাইরে মানুষ সহজে যেতে চায় না।

বিনয় ধন্দে পড়ে গেল। আপনি কী বলতে চাইছেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।

আনন্দ বুঝিয়ে দিল, নতুন একটা কাগজের পক্ষে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা, শুধু থাকাই নয়, সেটা লাভজনক করে তোলা অত্যন্ত কঠিন। জগদীশ গুহঠাকুরতা যদিও যথেষ্ট উদ্যোগী এবং অত্যন্ত বিচক্ষণ শিল্পপতি, শেষ না দেখে ছাড়বেন না, তবু এক বছরের মধ্যে কাগজ কতটা কী করতে পারবে সে সম্বন্ধে সংশয় থেকেই যায়। যত টাকাই থাক, যদি ক্রমাগত লোকসান দিতে হয়, উৎসাহ ঝিমিয়ে পড়তে বাধ্য।

আনন্দ বলতে থাকে, আপাতত যা পাওয়া গেছে সেটাই করো। দুমাস পর আমাদের অফিসে কিছু লোক নেবে। নানা ডিপার্টমেন্টে কম করে বারো চোদ্দ জন জুনিয়র অফিসার দরকার। ছমাস প্রবেশান পিরিয়ড। তারপর পার্মানেন্ট করা হবে। প্রবেশানের সময় মাসে দেবে চার শ করে। পার্মানেন্ট হয়ে গেলে সাড়ে আট শ দিয়ে শুরু। তাছাড়া, অন্য সব বেনিফিট আছে। তোমার বড়দি বলছিল তোমার জন্যে ওখানেই ব্যবস্থা করে দিতে। একটা অ্যাপ্লিকেশন লিখে নেক্সট উইকে আমাকে দিও।

খবরের কাগজে বিনয়ের চাকরি হয়েছে, কিন্তু এ নিয়ে হিরণ আর সুধাও খুব একটা খুশি নয়। বরং বলা যায় বিনয়ের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তারা যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় আছে। নতুন কাগজ। কবে আছে, কবে নেই। সুধাদের ইচ্ছা, সরকারি বা নামকরা বড় কোনও কোম্পানিতে ভাইয়ের চাকরি হোক যাতে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকে। হিরণ তাদের অফিসে তো বটেই, আরও দু-একটা অফিসে বিনয়ের দরখাস্ত জমা দিয়ে রেখেছে। সুধাদের মনোভাব অবিকল আনন্দদের মতোই। যত দিন না মনের মতো কিছু একটা জুটছে, খবরের কাগজের কাজটাই চালিয়ে যাক বিনয়। বেকার বসে থেকে লাভ নেই।

বিনয় বলল, ঠিক আছে। অ্যাপ্লিকেশনটা কার নামে দিতে হবে?

আনন্দ বলল, টু দা জেনারেল ম্যানেজার, তার তলায় আমাদের কোম্পানির নাম আর ঠিকানা লিখবে হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে, ভাল কথা, পাকিস্তান থেকে হেমদাদু তোমার ম্যাট্রিকুলেশন, ইন্টারমিডিয়েট আর গ্র্যাজুয়েশনের সার্টিফিকেট ডিগ্রিটিগ্রিগুলোর ডুপ্লিকেট পাঠাতে পেরেছেন?

না। সেই যে একখানা চিঠি লিখেছিলেন তারপর আর কোনও যোগাযোগ নেই। তবে কদিন আগে নিত্য দাস ছোটদির বাসায় এসেছিল। বলে গেছে, এক সপ্তাহের ভেতর দাদুর সেকেন্ড চিঠিটা নিয়ে আসবে। সেই চিঠির সঙ্গে পাঠাতে পারেন।

রাজদিয়া থেকে ঝিনুককে নিয়ে রাজেক মাঝির নৌকোয় নদী পাড়ি দিয়ে আসার সময় মামুদপুরে বিনয়দের মালপত্র লুট হয়ে যায়। বাক্স-পেটরার ভেতর ছিল তার সার্টিফিকেট, ডিগ্রির কাগজপত্র। হানাদাররা বাক্সটাক্সর সঙ্গে সে-সবও নিয়ে গেছে। আত্মীয়-পরিজনেরা এ খবর জানে। আনন্দ খানিক চিন্তা করে বলল, জগদীশবাবু ভাল মানুষ। তার ওপর নিজেই কাগজের মালিক। তিনি ডিগ্রিটিগ্রি না দেখে তোমাকে চাকরি দিলে কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু গভর্নমেন্ট অফিসই হোক আর বড় মার্চেন্ট অফিসই হোক, তোমার সার্টিফিকেটগুলো খোয়ানোর কথা হয়তো বিশ্বাস করবে কিন্তু ওগুলো না দেখে চাকরি দেবে না। একটু থেমে বলল, পাকিস্তানে এখন যা অবস্থা, তাড়াতাড়ি ডিগ্রিটিগ্রির নকল পাওয়া অসম্ভব। অন্তত মার্কশিটের ডুপ্লিকেট কিংবা যে স্কুল আর কলেজে পড়েছ সেখানকার হেডমাস্টার আর প্রিন্সিপ্যাল যদি লিখে দেন তুমি ওই সব ইনস্টিটিউশন থেকে পাশ করেছ, তা হলেও আশা করি, কাজ চলে যাবে। আমার ধারণা, রিফিউজি হিসেবে এটুকু কনসিডারেশন তোমার প্রাপ্য।

এ-জাতীয় কথাবার্তা হিরণের সঙ্গে আগেই হয়েছে বিনয়ের। আনন্দের সঙ্গে হয়েছিল কি না, মনে পড়ল না। ডিগ্রিটিগ্রির ডুপ্লিকেট না পাওয়া যাক, হেডমাস্টার এবং প্রিন্সিপ্যালের চিঠি পাওয়া যাবে ধরে নিয়ে হিরণ তার চাকরির জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে।

বিনয় বলল, আপনি যা বললেন, দাদুকে সব জানিয়েছি। এখন দেখা যাক, কী উত্তর আসে।

পাকিস্তান থেকে আসার সময় যে বর্ডার স্লিপ দিয়েছিল সেটা যত্ন করে রেখেছ তো?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

ইন্টারভিউর সময় ওটা লাগবে। তুমি যে জেনুইন রিফিউজি, ওটা তার ডকুমেন্ট।

ট্রাম কালীঘাট, ভবানীপুর, সাকুলার রোড পার হয়ে অনেক দূর চলে এসেছে। এখন বাঁ দিকে আদিগন্ত ময়দান। ঘন সবুজ ঘাসে ছাওয়া বিশাল এক জাদু কার্পেট। দূরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাথায় পরি নেচে চলেছে অবিরাম। আরও দূরে রেস কোর্সের সাদা গ্যালারি। তার গা ঘেঁষে রাস্তা। ওই রাস্তা ধরেও ট্রাম বাস মোটর চলছে। এধার থেকে সেগুলো খেলনা-গাড়ির মতো মনে হয়। ময়দানের নানা জায়গায় থোকায় থোকায় মানুষ বসে আছে। অনেকে ঘাসে পা ডুবিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চার দঙ্গল ফাঁকা মাঠ পেয়ে উদ্দাম হয়ে উঠেছে। মনের খুশিতে তারা যেন উড়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও স্থির চিত্র। কোথাও চলমান ছবি।

পাশ থেকে হঠাৎ আনন্দ বলল, জানো বিনু, আমার দিদি আর জামাইবাবু সেদিন আমাদের বাড়ি এসেছিল। ওদেরও খুব ইচ্ছে, আমার অফিসে তোমার চাকরিটা যেন হয়। আমাকে চাপ দিয়ে গেছে, যেমন করে পারি ওটা করে দিতেই হবে।

বিনয় প্রথমটা হতবাক হয়ে যায়। আনন্দর দিদি জামাইবাবু মানে শিশির এবং স্মৃতিরেখা। ঝুমার মা আর বাবা। তার চাকরির জন্য ওঁরা এত উৎসাহী কেন? নিজের অজান্তে প্রশ্নটা করেই ফেলল সে।

হাসির চিকন একটা রেখা খেলে গেল আনন্দর ঠোঁটে। আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল, কারণ কিছু একটা আছে।

বিনয় ধন্দে পড়ে যায়। তার চাকরি সম্বন্ধে শিশির এবং স্মৃতিরেখার আগ্রহের পেছনে কীসের একটা সংকেত যেন রয়েছে। ঠিক ধরা যাচ্ছে না। বলল, কী কারণ?

উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেল আনন্দ। সামলে নিয়ে বলল, ছেলেবেলা থেকে ওরা তোমাকে দেখছে। তোমার ভীষণ ওয়েল-উইশার। ভাল চাকরি পেলে জীবনে এস্টাব্লিশড হবে, সেটাই ওরা চায়। এই আর কি–।

 বিনয় পরিষ্কার টের পায়, আসল উত্তরটা এড়িয়ে গেল আনন্দ। কয়েক পলক আনন্দকে লক্ষ করে সে। স্মৃতিরেখাদের সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন না করে ধীরে ধীরে জানালার বাইরে চোখ ফেরায়।

এসপ্ল্যানেডে এসে ট্রাম থেকে নেমে যে বাসগুলো সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ ধরে শ্যামবাজারের দিকে যায় তার একটা ধরে যখন বিবেকানন্দ রোডের কাছাকাছি বিনয়রা এসে নামল, দুটো বাজতে তখনও মিনিট সাতেক বাকি।

রাস্তার যে-দিকটায় ওরা নেমেছে তার উলটো দিকে জগদীশবাবুদের কাগজের অফিস। ওপারে যেতে যেতে বিনয়ের চোখে পড়ল মস্ত অফিসের গেটের মাথায় সাইন বোর্ড লাগানো হয়েছে। হলুদের ওপর বড় বড় লাল হরফে লেখা : নতুন ভারত।

বিনয় বলল, সেদিন যখন এসেছিলাম, সাইন বোর্ডটা তো দেখিনি–।

আনন্দ বলল, কেমন করে দেখবে? কী নাম পাওয়া যাবে তখনও তো ঠিক হয়নি। কদিন হল পাওয়া গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সাইন বোর্ড করিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বুঝতে না পেরে বিনয় জিজ্ঞেস করল, নাম পাওয়া যায়নি মানে?

আনন্দ বুঝিয়ে দিল, ইচ্ছামতো পত্রপত্রিকা বার করা যায় না। সেজন্য দিল্লি থেকে সরকারি অনুমতি দরকার। কেননা, নিয়ন্ত্রণ না থাকলে একই নামে হয়তো পাঁচটা কাগজ বেরিয়ে যাবে। তাতে বিরাট সমস্যা। জগদীশবাবু মাস দুতিনেক আগে তার কাগজের জন্য অনেকগুলো নাম পাঠিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত নতুন ভারত নামটার অনুমোদন পাওয়া গেছে।

আনন্দ জিজ্ঞেস করল, কী, নামটা ভাল লেগেছে?

বিনয়ের পছন্দ হয়েছিল। বলল, খুব ভাল।

দেশ স্বাধীন হয়েছে। নতুন করে সেটা গড়ে তুলতে হবে। এব্যাপারে নিউজ পেপারের একটা বড় বোল রয়েছে। সেদিক থেকে নামটা বেশ সিগনিফিকান্ট।

হঠাৎ বিনয়ের নজরে পড়ল, অফিস বিল্ডিংটার গোটা ছাদ জুড়ে মস্ত প্যান্ডেল খাটানোর তোড়জোড় চলছে। বাঁশের ফ্রেম তৈরি করে আধাআধি তেরপল দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছে। মজুররা হাঁকডাক করে বাকি অর্ধেক এখন ঢাকছে।

ছাদের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বিনয় জিজ্ঞেস করল, ওখানে কী হবে আনন্দদা?

আনন্দ মুখ তুলে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে। বেশ অবাক হয়ে বলে, বুঝতে পারছি না। ভেতরে চল। জগদীশবাবুকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেব।

কদিন আগে আনন্দর সঙ্গে প্রথম যখন বিনয় এখানে আসে, বাড়িটা ছিল প্রায় নিঝুম। বাইরে থেকে শুধু রোটারি মেশিন চলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আজ সেটা তো আছেই, সেই সঙ্গে ভেসে। আসছে অন্য আওয়াজও। বহু মানুষ একসঙ্গে কথা বললে যেমন শোনায় ঠিক তেমনই।

গেটের কাছে এসে দেখা গেল, একজন মাঝবয়সী হিন্দুস্থানী দারোয়ান টান টান দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে খাকি উর্দি, মাথায় পাগড়ি। সেদিন একে দেখা যায়নি। আনন্দ তাকে জিজ্ঞেস করে, জগদীশবাবু। এসেছেন?

লোকটা হেসে বলল, হাঁ সাব। এক বাজে মালিক আ গিয়া—

ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল, চারদিক সরগরম। সারা অফিসে তুমুল ব্যস্ততা। ছোটাছুটি। একতলার বিশাল হল-ঘরের আধখানা জুড়ে সেদিনই রোটারি মেশিন দেখে গিয়েছিল বিনয়, অন্য দিকটায় বেশ কটা লাইনো মেশিন। মেশিনগুলোর পাশে উঁচু দেওয়াল তুলে নিউজপ্রিন্ট রাখার ব্যবস্থা। বিশাল বিশাল গোলাকার চাকার মতো বিদেশি নিউজপ্রিন্টের রিল উঁই হয়ে পড়ে আছে। তার পাশে আবার একটা দেওয়াল। ওই দেওয়ালের পর কাতার দিয়ে নতুন সাইকেল। কম করে ষোল সতেরোটা। প্রতিটি সাইকেলের সামনের হ্যাঁন্ডেলের সঙ্গে আটকানো হলুদ রং করা টিনের প্লেটে লাল হরফে লেখা আছে : নতুন ভারত। এতগুলো সাইকেল দিয়ে কী হবে, কে জানে। বিনয় অবাক হলেও এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করল না।

সেদিন ছাপাখানায় বেশি লোক ছিল না। বড় জোর পাঁচ সাত জন। লাইনো মেশিন চালাচ্ছিল দু-তিনটি কম্পোজিটার। আজ দুজায়গাতেই প্রচুর লোক। সারা এলাকায় ঝড় তুলে রোটারি মেশিন চলছে। ওধারে কম্পোজিটাররা সামনে হাতে-লেখা কপি রেখে দ্রুত বোতাম টিপে টিপে কম্পোজ করে চলেছে।

হল-ঘরটার একধারে সিঁড়ি। আনন্দ আর বিনয় দোতলায় উঠে এল। এখানেও একতলার মত লম্বা হল-ঘর। কাঠ আর কাঁচ দিয়ে গোটা হল জুড়ে অগুনতি খুপরি বানানো হয়েছে। একটা খুপরিও ফাঁকা নেই।

দোতলা থেকে তেতলা। সব ফ্লোরের নকশাই একরকম। এখানে হল-ঘরের অর্ধেক জুড়ে বিশাল নিউজ ডিপার্টমেন্ট। সেটার একধারে নিউজ এডিটর এবং অ্যাসিস্টান্ট এডিটরদের আলাদা আলাদা কামরা। বাকি আধখানা ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ডিরেক্টর, এডিটর, জেনারেল ম্যানেজারদের চেম্বার।

আজ নিউজ ডিপার্টমেন্ট গম গম করছে। দুটো টেলিপ্রিন্টার খট খট আওয়াজ তুলে হিল্লি দিল্লির খবর উগরে দিচ্ছে। ক্লান্তিহীন। অবিরাম।

বিনয়কে সঙ্গে করে আনন্দ নিউজ ডিপার্টমেন্টের উলটো দিকে জগদীশ গুহঠাকুরতার চেম্বারের সামনে চলে এল। পালিশ-করা কাঠের চওড়া দরজার পাল্লায় চকচকে পেতলের প্লেট লাগানো হয়েছে। সেটায় লেখা ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড এডিটর। আগের দিন এই প্লেটটা দেখেনি বিনয়।

সেদিনের সেই বেয়ারাটাই দরজার বাইরে টুলের ওপর বসে ছিল। আনন্দকে সে চেনে। ত্বরিত পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নমস্কার স্যার

প্রতি-নমস্কার হিসেবে মাথাটা সামান্য হেলিয়ে আনন্দ বলল, তোমাদের সাহেবকে খবর দাও। আমরা ওঁর সঙ্গে দেখা করব।

সাহেবের ঘরে এখন কেউ নেই। একাই আছেন। আপনার ব্যাপারে খবর দিতে হবে না। যান জগদীশ গুহঠাকুরতার সঙ্গে আনন্দর সম্পর্ক কতটা নিবিড়, বেয়ারাটা তা জানে। সে পান্না ঠেলে দরজাটা আধাআধি খুলে দিল।

জগদীশ বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবলের ওপর ঝুঁকে খুব মগ্ন হয়ে কী সব টাইপ-করা কাগজপত্র দেখছিলেন। পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকালেন, ও-আনন্দ। এস এস। বোসো

বিনু মানে বিনয়কে নিয়ে এলাম। বলতে বলতে বসে পড়ল আনন্দ।

সেভাবে বিনয়কে লক্ষ করেননি জগদীশ। এবার তার দৃষ্টি ওর মুখের ওপর স্থির হল। চিনতে একটু সময় লাগল যেন। আনন্দকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সেই শ্যালক না?

হ্যাঁ, জগদীশকাকা–।

বিনয় দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দর কাছে সে শুনেছে, জগদীশ গুহঠাকুরতা একজন বিরাট বিজনেসম্যান। নানা ধরনের কলকারখানার মালিকও। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। এত সব ব্যবসা এবং ইন্ডাস্ট্রি সামলানো কি মুখের কথা! আজ এই সমস্যা। কাল সেই সমস্যা। লেবার ট্রাবল। ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলা। ফ্যাক্টরিগুলোতে পোডাকশন বাড়ানোর ছক তৈরি করা। যে-সব বিজনেস লোকসানে চলছে সেগুলো চাঙ্গা করে লাভজনক করার জন্য পরিকল্পনা। তার বিভিন্ন কোম্পানিতে ডিরেক্টররা রয়েছেন। আছেন দক্ষ ম্যানেজাররা। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাকেই। ফলে সর্বক্ষণ প্রচণ্ড চাপে থাকেন। বিনয়ের মতো একজন তুচ্ছ, আনকোরা রিপোর্টার কবে তার কাগজে কাজ শুরু করবে, হয়তো খেয়ালই নেই জগদীশের। না-থাকারই কথা।

আনন্দ ফের বলে ওঠে, আজ বিনয়ের এখানে জয়েন করার তারিখ। তাই চলে এলাম।

জগদীশ গুহঠাকুরতার কপালে ভাঁজ পড়ল। আনন্দর দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, নো আনন্দ, নো 

আনন্দ হকচকিয়ে গেল। জগদীশ কী বলতে চান, সে বুঝতে পারছে না।

জগদীশ থামেননি, ওকে সঙ্গে করে আনা ঠিক হয়নি।

আনন্দ আমতা আমতা করতে থাকে, না, মানে–

ছেলেটিকে স্বাবলম্বী হতে দাও। বলে জগদীশ আবার বিনয়ের দিকে তাকালেন, যে-ডিপার্টমেন্টে তোমার জয়েন করার কথা, সেখানে গিয়ে ডিপার্টমেন্টাল এডিটরের সঙ্গে দেখা কর। তিনি তোমার কাজ বুঝিয়ে দেবেন। যাও ।

কদিন আগে যে-জগদীশের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল তিনি ছিলেন নরম, স্নেহশীল একজন মানুষ। কিন্তু সেক্রেটারিয়েট টেবলের ওধারে আজ যিনি বসে আছেন তিনি একেবারে আলাদা। আবেগহীন। যান্ত্রিক। আনন্দ বিনয়কে নিয়ে এসে জগদীশকে ধরে তার কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ঠিক আছে। তারপর কেউ তাকে আগলে আগলে রাখুক সেটা তিনি চান না।

এদিকে আনন্দ উঠে দাঁড়িয়েছিল। বিনয়কে বলল, চল, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

তর্জনী বাড়িয়ে আনন্দ যে-চেয়ারে বসে ছিল সেটা দেখিয়ে দিলেন জগদীশ। ধমকের সুরে বললেন, সিট ডাউন। আমি ওকে একা গিয়ে দেখা করতে বলছি। একটা কথা মনে রেখ আনন্দ, যখন ইচ্ছে তুমি আমার কাছে আসতে পার, কিন্তু তোমার শ্যালকের ব্যাপারে এখন থেকে কোনও অনুরোধ করবে না। প্রোটেকশন দিয়ে চললে ও নিজের পায়ে দাঁড়াতেই পারবে না। লেট হিম ফেস দা ওয়র্ল্ড।

জগদীশের চেম্বারের বাইরে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল বিনয়। তার মনে পড়ল, আজ তাকে নিউজ এডিটর তারাপদ ভৌমিকের সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়েছে।

হল-ঘরের ওদিকটায় অর্থাৎ যেখানে সাব-এডিটর, রিপোর্টার, প্রুফ-রিডারদের বসার জায়গা সেখানে একটানা ভনভনে আওয়াজ হচ্ছে। তার সঙ্গে তবলার সঙ্গতের মতো টেলিপ্রিন্টারের অনবরত খটখটানি।

তারাপদ ভৌমিকের কামরাটা বিনয় চেনে। প্রথম যেদিন এখানে আসে, ওই কামরায় তাকে যেতে হয়েছিল। নিউজ ডিপার্টমেন্টের সাংবাদিকদের বসার জন্য টেবলগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে হল-ঘরের এধার থেকে ওধারে যাবার জন্য ফাঁকে ফাঁকে প্যাসেজ রয়েছে।

বিনয় আর দাঁড়াল না। প্যাসেজের ভেতর দিয়ে ভেতর দিয়ে তারাপদ ভৌমিকের কামরার সামনে। চলে এল।

.

২৪.

নিউজ এডিটরের কামরার দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ নয়। খানিকটা খোলা রয়েছে। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, তারাপদ ভৌমিক এদিকে মুখ করে বসে আছেন। তাঁর টেবলের এধারে রয়েছে আরও কয়েকজন। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না। পিঠের দিকটা চোখে পড়ছে। বোঝা যায়, ওরা জরুরি কোনও মিটিং করছে। আজ এখানে পা দিয়ে সারা অফিস বিল্ডিং জুড়ে যে তুমুল ব্যস্ততা বিনয় লক্ষ করছে তাতে মনে হয়, নতুন ভারত খুব শিগগিরই বাজারে বেরিয়ে যাবে। সেই ব্যাপারেই হয়তো নিউজ এডিটরের ঘরে আলোচনা চলছে। দ্বিধান্বিতের মতো বাইরে দাঁড়িয়ে রইল বিনয়। এই অবস্থায় ভেতরে ঢোকা ঠিক হবে কি না, সে বুঝতে পারছে না।

মরিয়া হয়ে শেষ পর্যন্ত দরজার খুব কাছে চলে এল বিনয়। কিন্তু এবারও ঢুকতে গিয়ে সেই দ্বিধা। খানিকটা ভয়ও। মিটিংয়ের সময় বিরক্ত করলে নিউজ এডিটর নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হবেন।

তারাপদ ভৌমিক তাঁর কামরায় অন্যদের কী বোঝাচ্ছিলেন, হঠাৎ তার চোখ এসে পড়ল বিনয়ের ওপর। হাত নেড়ে বললেন, ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এস ।

তারাপদর কামরাটা মাঝারি মাপের। নতুন টেবল, চেয়ার, টেলিফোন ইত্যাদি দিয়ে সাজানো। একধারের দেওয়াল জুড়ে বুক-সমান উঁচু বইয়ের সারি সারি র‍্যাক। সেখানে নানা ধরনের রেফারেন্সের বই, ইয়ার বুক, ডিকশনারি। সিলিং থেকে ঝুলছে চার ব্লেডওলা ফ্যান। এখন নিশ্চল। এই হিম ঋতুতে সেটা চালানোর প্রশ্নই নেই।

ভেতরে আসতে তারাপদ বললেন, বোসো

বাইরে থেকে বোঝা যায়নি, ঠিক কজন টেবলের এধারে বসে ছিল। এখন দেখা গেল মোট চারজন। ওদের পাশে আরও তিনটে চেয়ার ফাঁকা রয়েছে। তার একটায় বসে পড়ল বিনয়। জড়সড় ভঙ্গি।

তারাপদ বললেন, তোমার জন্যে আমরা ওয়েট করছিলাম। সে যাক। আগে তোমাদের আলাপ করিয়ে দিই।

যারা বসে ছিল তাদের তিনজনের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। একজন পঞ্চাশের কাছাকাছি। বয়স্ক লোকটির একহারা, রোগাটে চেহারা। খুব ফর্সা। মাথায় কাঁচাপাকা ঘন চুল। মোটা ফ্রেমের চশমার ভেতর তার শান্ত চোখে গভীর দৃষ্টি। চোয়াল এবং থুতনির গড়নে বেশ একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে বেরিয়েছে। তবু মনে হয়, তার মধ্যে কোথায় যেন গাঢ় বিষাদ জমা হয়ে আছে। পরনে ধুতি পাঞ্জাবির ওপর গরম কাপড়ের জহর কোট। তার দিকে আঙুল বাড়িয়ে তারাপদ বললেন, ইনি প্রসাদ লাহিড়ি। আমাদের চিফ রিপোর্টার। কলকাতায় অন্য একটা নামী পত্রিকার নাম করে বলেন, জগদীশবাবু ওঁকে ওই কাগজ থেকে এখানে নিয়ে এসেছেন।

অন্য তিনজন হল সুধেন্দু চক্রবর্তী, মণিলাল কর এবং রমেন বিশ্বাস। এরাও রিপোর্টার। প্রসাদ লাহিড়ি আগে যেখানে ছিলেন সুধেন্দু আর মণিলাল সেই কাগজে কাজ করত। প্রসাদের সঙ্গে ওরাও। নতুন ভারত-এ চলে এসেছে।

সুধেন্দু খুব লম্বা। ছফিটের ওপরে হাইট। পেটানো স্বাস্থ্য। লম্বাটে মুখ। রীতিমতো কালো। তার চেহারা যতই জবরদস্ত হোক, চোখ দুটিতে আশ্চর্য এক সারল্য রয়েছে। মনে হয় খুব ভালমানুষ। কোনওরকম ঘোরপ্যাঁচ নেই। পরনে ঢোলা ফুলপ্যান্ট এবং শার্টের ওপর পুল-ওভার।

মণিলাল কর তেমন লম্বা নয়। মাঝারি উচ্চতা। তামাটে রং। গোলগাল চেহারা, গোলাকার মুখ। চওড়া কপাল। চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। পরনে ধুতি, ফুল শার্ট আর গরম চাদর।

রমেন বিশ্বাসের খুব সাদামাঠা চেহারা। গড়পড়তা বাঙালির যেমন হয়। বিশেষ করে নজরে পড়ার মতো কিছুই নেই। চোখে গোল চশমা। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি এবং হাতাকাটা সোয়েটার। ঢাকার একটা কাগজে সে কাজ করত। মাস ছয়েক আগে পাকিস্তান থেকে চলে এসেছে। চাকরির জন্য কলকাতার নামকরা কাগজগুলোতে হন্যে হয়ে ঘুরছিল কিন্তু কোথাও ভ্যাকান্সি নেই। যখন পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়েছে সেই সময় হঠাৎ খবর পায়, জগদীশবাবু নতুন কাগজ বার করতে চলেছেন। সোজা তার সঙ্গে দেখা করে সে চাকরির আর্জি জানায়। রমেনের সঙ্গে কথা বলে জগদীশবাবু খুশি। তারাপদর সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি তাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেন।

 বিনয় সম্পর্কে অন্যদের সবিস্তার জানিয়ে দিলেন তারাপদ। তারপর বিনয়কে বললেন, আপাতত তোমাদের পাঁচজনকে নিয়ে আমাদের রিপোর্টিং সেকশনের টিম। তুমি মেনলি প্রসাদবাবুর কাছে কাজ করবে। তেমন দরকার হলে আমি তোমাকে ডেকে নেব। তুমিও ইচ্ছে হলে আমার কাছে চলে আসতে পার।

বিনয় ভাবছিল তার অন্য চার কলিগের কাগজে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। সে-ই শুধু আনকোরা। তার মানে নতুন ভারত-এর কর্তৃপক্ষ এবং পাঠকের নজরে পড়তে হলে এইসব ঝানু সাংবাদিকদের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হবে। ভয় নয়, মানসিক চাপ নয়, টের পেল, এক ধরনের জেদ তার মধ্যে চারিয়ে যাচ্ছে। তারাপদর কথার উত্তরে সে মাথা হেলিয়ে দিল,, আচ্ছা

তারাপদ সুধেন্দু, মণিলাল এবং রমেনকে বললেন, তোমাদের সঙ্গে আগেই কথা হয়ে গেছে। নিজেদের জায়গায় গিয়ে বোসো। প্রসাদবাবু আর বিনয়ের সঙ্গে আমার কিছু ডিসকাশন আছে।

সুধেন্দুরা চলে যাবার পর তারাপদ বললেন, প্রসাদবাবু, আপনাকে সেদিন বলেছিলাম, জগদীশবাবুর খুব ইচ্ছে বিনয়কে বিশেষভাবে কাজে লাগাতে হবে। রিফিউজি প্রবলেম আমাদের ওয়েস্ট বেঙ্গলে এখন সব চাইতে মারাত্মক সমস্যা। ও মাসখানেক কি মাসদেড়েক হল ইস্ট পাকিস্তান থেকে চলে এসেছে। পাকিস্তানে হিন্দুরা কী আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, কেন তারা ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে, ও ভাল করেই জানে। কেন না নিজেও ও ভুক্তোভোগী। বিনয়ের এক্সপিরিয়েন্সটা। আমাদের কাজে লাগাতে হবে। একটু থেমে বললেন, রিফিউজিদের সমস্যা, পাকিস্তানে যে লক্ষ লক্ষ মাইনোরিটি কমিউনিটির মানুষ এখনও পড়ে আছে তাদের সমস্যা যদি আমরা ঠিকমতো তুলে ধরতে পারি, রিডারদের নজর আমাদের কাগজের ওপর এসে পড়বেই। স্পেশালি ইস্ট বেঙ্গলের, উদ্বাস্তুদের।

প্রসাদ সায় দিলেন, জগদীশবাবু ঠিকই বলেছেন। উদ্বাস্তুদের ব্যাপারটা সঠিক ধরতে পারলে আমরা ভাস্ট রিডারশিপ পেয়ে যাব। শুরু থেকে সার্কুলেশন হু হু করে বেড়ে যাবে।

কী?

সব কাগজই রিফিউজিদের নিয়ে কিছু কিছু লিখছে। শিয়ালদায় রোজ ঢাকা, মেল কি খুলনা মেলে যে উদ্বাস্তুরা আসছে তাদের সম্বন্ধে খবর টবর জোগাড় করে আর রাইটার্সে রিফিউজি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের মিনিস্টার আর সেক্রেটারির ইন্টারভিউ নিয়ে ছাপছে। এ-সব তো আছেই। আমার মনে হয়, আলাদাভাবে স্পেশাল কিছু করা দরকার। এ নিয়ে আপনি কিছু ভেবেছেন?

হ্যাঁ। তারাপদ ভৌমিক বিশদভাবে জানালেন, কলকাতার আশেপাশে এবং পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় অগুনতি মিলিটারি ব্যারাক বানানো হয়েছিল। যুদ্ধের পর ব্রিটিশ আর আমেরিকান টমিরা জাহাজ আর প্লেন বোঝাই হয়ে দেশে ফিরে যায়। তাদের ছেড়ে যাওয়া খালি ব্যারাকগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের সাময়িক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, রোজই তো সীমান্তের এপারে মানুষের ঢল নামছে। নতুন নতুন ত্রাণশিবির বসিয়ে তাদের রাখা হচ্ছে। শুধু তাই না, ফাঁকা মাঠ, জলা নিচু জায়গা, বনজঙ্গল যা পাচ্ছে সেখানে বসে পড়ছে উদ্বাস্তুরা। গড়ে তুলছে জবরদখল কলোনি। এইসব কলোনি সংখ্যায়, যে কত, তার লেখাজোখা নেই।

তারাপদ বলতে লাগলেন, অন্য কাগজগুলো সরকারি ক্যাম্পের, মিলিটারি ব্যারাকের আর জবরদখল কলোনির রিফিউজিদের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই লিখছে না। উদ্বাস্তুদের ওপর আমরা জোর দেব। বিনয় প্রত্যেক সপ্তাহে একটা করে কলোনি বা ক্যাম্পে গিয়ে সেখানকার মানুষজন কীভাবে আছে, কী তাদের সমস্যা, সব ডিটেলে জেনে বড় একটা লেখা লিখবে। ওর সঙ্গে ফোটোগ্রাফার যাবে। লেখার সঙ্গে কলোনি টলোনির বাসিন্দাদের ছবিও ছাপা হবে।

প্রসাদ প্রায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, ভেরি গুড আইডিয়া

আরও একটা কথা ভেবেছি।

কী?

 যে-সব গ্রাম ছেড়ে মানুষ চলে আসছে ফি উইকে সেইরকম দুটো গ্রামের ওপর রিপোর্টাজও লিখতে হবে বিনয়কে। লেখাটার নামও আমি ঠিক করে রেখেছি। আমার দেশ, আমার গ্রাম। অবশ্য এর চেয়ে বেটার কিছু পাওয়া গেলে সেটাই দেওয়া হবে। আপনারাও ভাবুন।

প্রসাদের মনে সামান্য সংশয় দেখা দেয়। তিনি জিজ্ঞেস করেন, লেখার মেটিরিয়াল পাবে কী করে?

তারাপদ বললেন, যে-সব গ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে মানুষ আসছে তাদের জিজ্ঞেস করে। ওদের গ্রামের ফোটো অবশ্য পাওয়া যাবে না। আর্টিস্টকে দিয়ে স্কেচ আঁকিয়ে নিতে হবে।

খুব মগ্ন হয়ে তারাপদ আর প্রসাদের কথা শুনছিল বিনয়। ভয়ে ভয়ে বলল, আমি একটা কথা বলব?

তারাপদ বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

বিনয় জানালো, রোজ যারা ওপার থেকে আসছে, পথে তাদের কী ধরনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হচ্ছে, আতঙ্কজনক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে কীভাবে প্রাণ হাতে নিয়ে তারা ইন্ডিয়ায় আসতে পেরেছে, আবার অনেকে পারেনি, রাস্তায় তাদের শোচনীয় মৃত্যু ঘটেছে–সপ্তাহে তেমন দু-চারজনকে নিয়ে যদি লেখা যায়, উদ্বাস্তুদের নিদারুণ অসহায়তা সম্বন্ধে পাঠকের পরিষ্কার একটা ধারণা হতে পারে।

একসেলেন্ট তারাপদ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, গোয়ালন্দ থেকে আসার সময় ট্রেনে একজন বৃদ্ধ মাস্টার মশাইয়ের মৃত্যুর কথা লিখে আমাকে দেখিয়েছিলে। পড়ে চোখে জল এসে গিয়েছিল। হৃদয়কে টাচ করে এমন লেখা খুবই জরুরি।

তারাপদ ভৌমিক মানুষটি যে যথেষ্ট আবেগপ্রবণ, আগেই জেনেছে বিনয়। খুবই উদার। আর সেই লেখাটা পড়ে ঢালাও প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন। আনন্দর সুপারিশে নতুন ভারত-এ তার চাকরি হতোই। সে আনন্দর শ্যালক এবং উদ্বাস্তু। করুণাবশত কোনও একটা ডিপার্টমেন্টে হেলাফেলা করে তাকে হয়তো বসিয়ে দিতেন জগদীশ। কিন্তু তারাপদর অঢেল বাহবায় বার্তা বিভাগে সসম্মানে সে কাজটা পেয়েছে। তারাপদর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তার।

উৎসুক সুরে প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, কোন মাস্টার মশাইয়ের মৃত্যুর কথা লিখেছে বিনয়?

রামরতন গাঙ্গুলির কথা বললেন তারাপদ।

প্রসাদ ভীষণ উৎসাহিত। বললেন, এই ধরনের হিউম্যান স্টোরি পেলে কাগজের উপকার হবে। কিন্তু

কী?

শিয়ালদা স্টেশন, রিফিউজি ক্যাম্প, কলোনি, এত কিছু সামলে বিনয় কি এ-সব লিখতে পারবে? ওর ওপর ট্রিমেন্ডাস প্রেসার পড়ে যাবে।

তারাপদ বললেন, ইয়াং ম্যান। এই তো খাটার বয়েস। আমার মনে হয়, পারবে। চ্যালেঞ্জটা নিক না– একটু থেমে ফের মনে করিয়ে দিলেন, জগদীশবাবুর ইচ্ছে, রিফিউজিদের ব্যাপারে বিনয়কে ভালভাবে কাজে লাগানো হোক। কথা হয়ে গেল। বিনয়কে নিয়ে আপনার সেকশানে যান। খুব তাড়াতাড়ি রিপোর্টারদের কার্ডগুলো কিন্তু করিয়ে দিতে হবে।

আজই ওদের ফোটো তোলার ব্যবস্থা করছি। দুতিন দিনের ভেতর কার্ডগুলো হয়ে যাবে?

কীসের কার্ড, কেন রিপোর্টারদের ফোটো তোলা হবে, কিছুই বুঝতে পারল না বিনয়। তবে এ নিয়ে তার কৌতূহল হলেও কোনও প্রশ্ন করল না। 

প্রসাদ উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বিনয়কেও তার সঙ্গে যেতে হবে। সেও উঠে পড়ল।

.

নিউজ ডিপার্টমেন্টের বাঁদিকে খানিকটা জায়গা নিয়ে রিপোর্টারদের বসার ব্যবস্থা। চিফ রিপোর্টারের জন্য বেশ বড় টেবল। সামনে অনেকগুলো চেয়ার। অন্যদের টেবলগুলো তুলনায় ছোট। সেখানে এসে দেখা গেল রমেন বিশ্বাস, সুধেন্দু চক্রবর্তী আর মণিলাল কর চিফ রিপোর্টারের টেবলের এধারে বসে কথা বলছে। প্রসাদকে দেখে তারা সবাই উঠে দাঁড়াল।

প্রসাদ সবাইকে বসতে বলে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। বিনয় সুধেন্দুদের পাশে বসে পড়ল।

প্রসাদ বললেন, তোমরা কি লক্ষ করেছ, কলকাতার রাস্তায় আমাদের কাগজের পোস্টার পড়েছে।

বিনয় খেয়াল করেনি। তবে সুধেন্দুরা দেখেছে। তারা জানালো, হ্যাঁ। নতুন ভারত শীঘ্রই প্রকাশিত হতে চলেছে।

কাল থেকে কলকাতার সব পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বেরুবে।

বিনয় জিজ্ঞেস করল, কাগজ বেরবার ডেট ঠিক হয়েছে?

প্রসাদ বললেন, আজ থেকে ঠিক পনেরো দিন পর বেরুবে। ছাদে ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে দেখেছ কি?

অফিসে ঢোকার সময় ছাদে মজুরদের কাজ করতে দেখেছিল বিনয়। তারপর জগদীশ গুহঠাকুরতার চেম্বার হয়ে তারাপদ ভৌমিকের কামরায় এসে নানা কথায় প্যান্ডেলের ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে উৎসুক হয়ে উঠল, হা হা, দেখেছি। কী হবে ওখানে?

প্রসাদ জানালেন, নতুন ভারত পত্রিকার প্রকাশ উপলক্ষে বড় একটা অনুষ্ঠান করা হবে। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন। নামকরা বিজনেসম্যান, শিল্পপতি, শিল্পী, সাহিত্যিক, গায়ক, চলচ্চিত্র পরিচালক, রাজনৈতিক নেতা, বিখ্যাত খেলোয়াড়, অভিনেতা বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট মানুষজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। জগদীশ গুহঠাকুরতা খুবই প্রভাবশালী। তার বিপুল প্রতিপত্তি। তিনি ডাকলে কেউ না বলতে পারবেন না। সবাই চলে আসবেন।

রাজদিয়ায় থাকতে বিধানচন্দ্রের নাম বহুবার শুনেছে বিনয়। ডাক্তার হিসেবে তিনি লিজেন্ডের নায়ক। ভারতবর্ষের সেরা ধন্বন্তরি। মৃত্যু অবধারিত, এমন কত রোগীকে যে তিনি বাঁচিয়ে দিয়েছেন তার হিসেব নেই। বিধানচন্দ্র যে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সেটা অনেক আগেই জেনেছে বিনয়। তাকে তো বটেই, প্রসাদ অন্য যে-সব খ্যাতিমান মানুষদের নাম করলেন তাঁদেরও দেখা যাবে। ভাবতেই অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে।

প্রসাদ এবার বললেন, সুধেন্দুরা নিউজ পেপারে চাকরি করেছে। ওরা জানে কাগজে তিন শিফটে কাজ চলে। মর্নিং, ডে আর নাইট। সকাল আটটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত একটা শিফট। দুটো থেকে রাত দশটা অবধি একটা শিফট। রাত দশটা থেকে ভোর পর্যন্ত আর-একটা শিফট। বিনয়, তুমি বোধহয় এই ব্যাপারটা জানো না?

বিনয় বলল, না। আমার তো এই প্রথম চাকরি

মাসে এক উইক করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোমাদের নাইট ডিউটি দেওয়া হবে। তখন কিন্তু বাড়ি যেতে পারবে না।

বিনয় এতকাল জেনে এসেছে, চাকরি মানেই দশটা থেকে পাঁচটা। খবরের কাগজের নিয়ম যে আলাদা, এই প্রথম শুনল। বলল, আচ্ছা–

রাতে খুব একটা এমার্জেন্সি না হলে বারোটা সাড়ে বারোটার ভেতর কাজ শেষ হয়ে যায়। অফিসে বিছানা আছে। বাকি রাতটা ঘুমোত পারবে।

একটু চুপচাপ।

তারপর বিনয় বাদে বাকি তিনজনকে বললেন, নেক্সট উইক থেকে কে কোন শিফটে কাজ করবে, কাকে কী দায়িত্ব দেওয়া হবে, সব ঠিক করে দেব। এই উইকে তেমন প্রেসার নেই। তোমরা বেলা দেড়টা দুটোয় এস। রাতে আটটা নটায় চলে যেও। এখন সাব-এডিটর নিউজ ট্রানস্লেশন করে দিচ্ছে। তাছাড়া এটা সেটা দিয়ে পাতা মেক-আপ করে মেশিনের ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছে। পরের সপ্তাহ থেকে পুরোদস্তুর কাজ শুরু হবে। রাইটার্স, পলিটিক্যাল পার্টির অফিস, হাসপাতাল, ইউনিভার্সিটি, লালবাজার–সব জায়গার রিপোর্ট চাই। খবরের কাগজে যা যা থাকে, সমস্ত দিয়ে পাতা সাজানো হবে। বিনয়কে বললেন, তোমাকে কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়ে গেছে। নেক্সট উইকের জন্যে তোমাকে ওয়েট করলে চলবে না। দু-চার দিনের ভেতর রিফিউজি কলোনি, আর রিলিফ ক্যাম্পগুলোতে যেতে শুরু কর। কাগজ বাজারে বেরুবার আগে যতগুলো লেখা সম্ভব, তৈরি করে ফেল। ওগুলো জমা করে রাখা হবে। যেদিন কাগজ বেরুবে সেদিন থেকে ছাপতে শুরু করব।

বিনয় মাথা হেলিয়ে বলল, আচ্ছা

প্রসাদ বললেন, তুমি তো সবে ইস্ট পাকিস্তান থেকে এসেছ। কোথায় কোথায় রিলিফ ক্যাম্প আর জবরদখল কলোনি বসেছে, জানো কি?

বিনয় জানালো, আগরপাড়া থেকে তিন মাইল দূরে যুগলদের মুকুন্দপুর কলোনি ছাড়া অন্য কোনও কলোনি সে দেখেনি। তবে শুনেছে, যাদবপুর বাঁশদ্রোণী গড়িয়া অঞ্চলে অনেক জবরদখল উপনিবেশ তৈরি হয়েছে। রিলিফ ক্যাম্পগুলো সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানে না। ভাসা ভাসা ধারণা আছে মাত্র।

একটু চিন্তা করে প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি থাকো কোথায়?

 বিনয় বলল, টালিগঞ্জে, জাফর শা রোডে

একটা কাজ করতে পারবে?

 বলুন

হরিশ মুখার্জি রোড চেনো? ভবানীপুরে পূর্ণ সিনেমার পেছন দিকটায়– ।

চকিতে মনে পড়ে গেল বিনয়ের। এই তো সেদিন হিরণদের সঙ্গে ঝিনুক আর সে ওখানকার হরিশ পার্কে জলসা শুনতে গিয়েছিল। জগন্ময় হেমন্ত শচীনদেব–কুড়ি পঁচিশ ফিট দূরে বসে স্বপ্নের এইসব শিল্পীদের নিজের চোখে দেখে, তাদের গান শুনে ঝিনুক অভিভূত। জলসা শেষ হলে বাড়ি ফিরে বালিকার মতো তার কী উচ্ছ্বাস! কত হইচই! অফুরান খুশির প্লাবনে ভেসে গিয়েছিল মেয়েটা। ঝিনুকের মুখ মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা চাপা কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকে বিনয়ের। নিচু গলায় বলল, চিনি–

প্রসাদ বললেন, ভালই হল। ওখানে হরিশ পার্কের উলটোদিকে একটা রাস্তা আছে। মহেশ হালদার লেন। ওই রাস্তার তেইশ নম্বর বাড়িটা হল মেসবাড়ি। নাম শান্তিনিবাস। আমি সেখানে থাকি। কাল সকাল সাড়ে-আটটা নটা নাগাদ একবার আমার মেসে আসতে পারবে?

মেস ব্যাপারটা বিনয়ের জানা। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সরকারি এবং বেসরকারি অফিসের কর্মচারী, ছোটখাটো ব্যবসায়ী, ইন্সিওরেন্স কোম্পানির দালাল–এমনি নানা ধরনের মানুষ, কলকাতায় যাদের ফ্যামিলি থাকে না, মেস হল তাদের অস্থায়ী আস্তানা। কলকাতার কাছাকাছি যাদের পৈতৃক বাড়ি তারা শনিবার হাফ-ডের পর চলে যায়, ফেরে সোমবার। আর যাদের বাড়ি দূরে, বড় ছুটি না পড়লে তাদের যাওয়া হয় না। কেন না দেড় দিনের মধ্যে কাজের জায়গায় ফিরে আসা সম্ভব নয়। বিনয় জানে, দেশভাগের আগে পূর্ব বাংলার বহু মানুষ কলকাতার মেসে সারা বছর পড়ে থাকত। পুজোর লম্বা ছুটিতে তারা দেশে স্বজন-পরিজনের কাছে চলে যেত। রাজদিয়ার এমন অনেককেই সে দেখেছে।

বিনয় একটু ধন্দে পড়ে গেল। প্রসাদ কেন তাকে তার মেসে যেতে বললেন, বোঝা যাচ্ছে না। এ নিয়ে সে কোনও প্রশ্ন করল না। শুধু বলল, পারব।

প্রসাদ ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিলেন, আমার কাছে অনেকগুলো জবরদখল কলোনি আর ক্যাম্পের ঠিকানা লেখা আছে। লিস্টটা রয়েছে আমার মেসে। তুমি এলে সেগুলো দিয়ে দেব। তোমার কাজের সুবিধে হবে। বলেই কী ভেবে ব্যস্তভাবে জানালেন, না না, সকালে কষ্ট করে আসার দরকার নেই। কাল দুপুরে অফিসে তো আসছই। আমি লিস্টটা নিয়ে আসব। তখন দিয়ে দেব।

যদিও মাথার উপরে তারাপদ ভৌমিক আছেন কিন্তু সরাসরি কাজটা তাকে করতে হবে প্রসাদের অধীনে। তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটা খুবই জরুরি। পরে না বললেও তিনি নিশ্চয়ই চান বিনয় তার মেসে যাক।

অফিসের পরিবেশ একরকম। সেখানে নানা ব্যস্ততার মধ্যে কারওকেই পুরোপুরি বোঝা যায় না। কিন্তু মেসে গেলে খোলামেলা আবহাওয়ায়, চাপমুক্ত অবস্থায় জানা যাবে প্রসাদ লাহিড়ি মানুষটা কী ধরনের, তার মেজাজ কেমন, ইত্যাদি। বিনয় বলল, আমার একটুও কষ্ট হবে না। সকালে তো কোথাও কাজ নেই। চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকা। ট্রাম-বাস কিছু একটা ধরে চলে যাব।

প্রসাদের হয়তো মনে হল, কাজ শুরু করার জন্য উৎসাহে টগবগ করছে ছেলেটা। কম বয়স। উদ্যম বেশি। একটু হাসলেন তিনি, ঠিক আছে, এস। এবার তোমাদের ফোটো তোলার ব্যবস্থা করি। বলেই একটা মাঝবয়সী বেয়ারাকে ডেকে বললেন, অধীরকে ক্যামেরা নিয়ে এক্ষুনি আমার এখানে আসতে বল। দেরি যেন না করে।

বেয়ারা চলে গেল।

.

কিছুক্ষণ পর একটি যুবক প্রসাদ লাহিড়ির টেবলের পাশে এসে দাঁড়াল। বয়স কুড়ি একুশ। ছিপছিপে চেহারা। শ্যামবর্ণ। লম্বা ধাঁচের মুখে পাতলা, নরম দাড়ি। মাথাভর্তি এলোমেলো জংলা চুল প্রায় কাঁধ অবধি নেমে এসেছে। বহুকাল ওগুলোতে তেল পড়েনি। বোধহয় নিয়মিত আঁচড়ায়ও না। সব চেয়ে আশ্চর্য ওর চোখ। সারাক্ষণ যেন সে-দুটো স্বপ্ন দেখছে। পোশাক-আশাকের দিকে নজর নেই। পরনে দলামোচড়া আধময়লা ফুল প্যান্ট আর শার্টের ওপর মোটা উলের পুল-ওভার। কাঁধ থেকে একটা ঢাউস ক্যামেরা ঝুলছে।

বোঝাই যায় ছেলেটি অধীর। নতুন ভারত-এর ফোটোগ্রাফার সে। বিনয়দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে প্রসাদ তাকে বললেন, এদের পাসপোর্ট সাইজের ফোটো চাই। এখনই তুলে নাও। কাল ডেভলাপ করে দেবে। প্রত্যেকটা ফোটো দুকপি করে।

অধীর ঘাড় কাত করে বলল, আচ্ছা—

একটু দূরে, রিপোর্টিং সেকশানের এক কোণে বিনয়দের নিয়ে গিয়ে লেন্স ঠিকঠাক করে চারজনের ছবি তুলে ফেলল অধীর।

পনেরো মিনিটের ভেতর কাজ শেষ। তারপর বিনয়রা প্রসাদ লাহিড়ির কাছে ফিরে আসে। অধীর হল-ঘর পেরিয়ে নিউজ ডিপার্টমেন্টের অন্য প্রান্তে চলে গেল।

সুধেন্দু বলল, প্রসাদদা, আজ এখানে জয়েন করলাম কিন্তু প্রথম দিন অ্যাসাইনমেন্ট দিচ্ছেন না। চুপচাপ বসে থাকার মানে হয়? সে আর মণিলাল নতুন ভারত-এ আসার আগে অন্য একটা কাগজে প্রসাদের সহকর্মী ছিল। অনেক দিনের সম্পর্ক। তাই ওভাবে বলতে পারল।

সুধেন্দু যা বলল, হুবহু তাই ভাবছিল বিনয়। অফিসে এসে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে তারও ভাল লাগবে না। কিন্তু প্রসাদ তার ডিপার্টমেন্টের ইন-চার্জ। আজই পরিচয় হয়েছে। তার পক্ষে সুধেন্দুর মতো করে বলা সম্ভব নয়।

খানিক চিন্তা করে প্রসাদ বললেন, ঠিক আছে, তোমরা দোতলায় লাইব্রেরিতে চলে যাও। ওখানে ইন্ডিয়ার অন্য সব শহরের নামকরা ইংলিশ ডেইলি আর নিউজ ম্যাগাজিন রয়েছে। সেগুলো উলটে পালটে দেখ ইন্টারেস্টিং কিছু পাও কি না। তার বেসিসে প্রত্যেকে একটা করে রাইট-আপ তৈরি কর। রোজই তো ট্রায়াল দেবার জন্যে কাগজ ছাপা হচ্ছে। তোমাদের লেখাগুলো কম্পোজ করে পাতায় বসিয়ে দেওয়া হবে। যখন রেগুলারলি কাগজ বেরুতে শুরু করবে তখন যদি দেখা যায়, ওই লেখাগুলোর টপিক পুরোনো হয়ে যায়নি, ফের ছাপা যেতে পারে।

খবরের কাগজের কাজের পদ্ধতি সম্বন্ধে বিনয়ের ধারণা পরিষ্কার নয়। তবে নতুন ভারত এ চাকরি পাবার পর থেকে সারাক্ষণ নিজের মধ্যে একটা চনমনে ভাব টের পাচ্ছে। তার লেখা ছাপার হরফে বেরুবে। হাজার হাজার মানুষ সে-সব পড়বে। কম উত্তেজনা? প্রসাদ একটা লেখার কাজ দেওয়াতে সে খুশি হল। আজকের লেখাটা কাগজে ছাপা হবে ঠিকই, কিন্তু বাইরের লোক জানতে পারবে না। না জানুক, তবু তো ছাপা হবে। বিনয় ভাবল, খুব যত্ন করে লেখাটা লিখবে। রামরতন গাঙ্গুলির মৃত্যুর বিবরণ পড়ে অভিভূত হয়েছিলেন তারাপদ। আজ এমন কিছু লিখবে যাতে প্রসাদ সন্তুষ্ট হন। প্রথম দিন থেকেই সে চিফ রিপোর্টারের নজরে পড়তে চায়।

সুধেন্দুদের সঙ্গে দোতলায় নেমে এল বিনয়। চারদিক সরগরম। কাঠ আর কাঁচ দিয়ে বানানো কুঠুরিগুলোতে যারা কাজ করছিল তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করে লাইব্রেরির হদিস পাওয়া গেল।

ডানদিকের শেষ প্রান্তে একটা চওড়া দরজার মাথায় পেতলের প্লেটে বড় বড় কালো অক্ষরে লেখা : লাইব্রেরি।

ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল, কামরাটা বিশাল। কম করে তিন শ স্কোয়ার ফিট। দেওয়াল ঘেঁষে উঁচু উঁচু কাঁচের আলমারি বোঝাই নানা ধরনের বই। অর্থনীতি, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, সিনেমা, স্পোর্টস–এমনি কত যে বিষয়। আছে এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে শুরু করে ইয়ার বুক, ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঘরের মাঝখানে মস্ত লম্বা টেবলের দুপাশে পাঁচটা করে চেয়ার। একসঙ্গে দশজন বসে পড়তে পারে। কিন্তু কামরাটা একেবারে ফাঁকা।

কোথায় চালু খবরের কাগজগুলোর কপি রয়েছে, কে জানে। বিনয়রা যখন এধারে ওধারে তাকাচ্ছে, আচমকা কেউ বলে উঠল, এই যে এদিকে শ্লেষ্ম জড়ানো নাকি সুর। সর্দি হলে কিংবা অতিরিক্ত নস্যি টানলে যেমনটা শোনায়।

এবার দেখা গেল, ডানদিকের শেষ মাথায় একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক বসে আছেন। তার সামনে বড় টেবল। টেবলের এপাশে দুটো চেয়ার।

বিনয়রা এগিয়ে গেল। ভদ্রলোকের রং ধবধবে ফর্সা। চেহারা গোলগাল, নাড়ুগোপাল মার্কা। ভীষণ শীতকাতুরে। পরনে ধুতি এবং পাঞ্জাবির ওপর সোয়েটার। তার ওপর চাদর। গলায় মাফলার জড়ানো। ঠাণ্ডা যাতে না লাগে সেজন্য নিজেকে দুর্ভেদ্য করে রেখেছেন। হাতে ঢাউস একটা বই। খুব সম্ভব সেটা পড়ছিলেন।

বইটা টেবলে নামিয়ে রেখে ভদ্রলোক বললেন, আগে তো চাঁদবদনদের দেখিনি। নতুন ভারত এ নতুন আমদানি বুঝি! তার বলার ভঙ্গিতে একটা মজাদার ব্যাপার আছে।

সুধেন্দু বলল, হ্যাঁ। আজই আমরা জয়েন করেছি। দিল্লি বম্বের ইংরেজি ল্যাংগুয়েজের কাগজগুলোর লাস্ট মাস্থের সব কপি দেখতে চাই। দয়া করে

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, হবে হবে, সব হবে। আগে একটু গা-শোঁকাকি হোক। বিনয়দের পা থেকে মাথা অবধি নিরীক্ষণ করলেন, হাঁটুর বয়িসি সব ছেলে। তোমাদের কিন্তু তুমি করে বলছি—

 লোকটাকে বেশ ভাল লেগে গেল বিনয়ের। গা-শোঁকাকি শুনে আন্দাজ করে নিল আলাপ পরিচয় করতে চাইছেন।

এদিকে সুধেন্দু বলে উঠেছে, তুমি করেই তো বলবেন।

আমার সামনে মোটে দুখানা চেয়ার। তোমরা চারজন। ওখেন থেকে আর দুখানা টেনে এনে বোসো দিকিন। বলে ভদ্রলোক ঘরের মাঝখানের মস্ত পড়ার টেবলটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন।

বিনয়রা চেয়ার এনে ভদ্রলোকের মুখোমুখি বসে পড়ল। তিনি এবার বললেন, প্রথমে নিজের কথা বলি। আমার নাম রামগোপাল দত্ত। আমরা দত্তরা কোলকেতার খাস বাসিন্দে। কত জেনারেশন ধরে এখেনে আচি, হিসেব নেই। দেড়শ বছর আগে আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা, নাকি তারও ঠাকুরদা এই শহরে এসে শেকড় গেড়েছিল। আমার গায়ে নাক ঠেকালে সেকেলে কোলকেতার গন্ধ পাবে। সে যাক গে, আমি দত্ত বংশের কুলাঙ্গার। আমার বাপ-ঠাকুরদারা টাকা ছাড়া কিচ্ছুটি বুঝত না। ব্যবসা করে প্রচুর পয়সা কামিয়ে গেছে। আমি আবার বই ছাড়া কিছু বুঝি না। পৃথিবীতে কত জানবার আচে। বই ছাড়া জানব কী করে? বি এ পাস করার পর বনের মোষ তাড়ানো শুরু করলাম। মানে একটা বড় পাবলিক লাইব্রেরি চালাতাম। নতুন ভারত-এর মালিক জগদীশবাবুর সঙ্গে একটু আধটু জানাশোনা ছিল। তিনি হিড়হিড় করে টেনে এনে এখানে জুড়ে দিলেন। বললেন, ভাল একটা লাইব্রেরি করতে হবে। লাইব্রেরি ছাড়া কাগজ চলে না। জার্নালিস্টরা যে লিখবে, তার জন্যে নানা রেফারেন্সের বই দরকার। ভুল বেরুলে কাগজের বদনাম হয়ে যাবে। রিডার নতুন ভারত চিমটে দিয়েও ছুঁয়ে দেখবে না। মনের মতন কাজ পেয়ে চান-খাওয়া শিকেয় তুলে দুমাসে এই লাইব্রেরি খাড়া করেছি। এখনও অনেক কাজ বাকি। আরও বইটই কিনতে হবে। বলে পকেট থেকে একটা নস্যির কৌটো বার করে বড় এক টিপ নস্যি নিয়ে নাকে পুরলেন। তারপর ঝিম মেরে চোখ বুজে বসে রইলেন। নস্যির ঝঝটা মস্তিষ্কে চারিয়ে যাচ্ছে। সেটা তিনি বেশ উপভোগ করছেন।

বিনয় যা আঁচ করেছিল সেটা মিলে গেল। তাদের লাইব্রেরিয়ানের নস্যির নেশা আছে।

কিছুক্ষণ বাদে চোখ মেলে পটকা ফাটার মতো আওয়াজ করে নাক ঝেড়ে রুমালে মুছে নিলেন। রামগোপাল। তারপর বললেন, আমার সম্বন্ধে পরে আরও জানতে পারবে। এবার তোমাদের ঠিকুজি শোনা যাক। নামগুলো বল

সুধেন্দুরা তাদের নাম জানিয়ে দিল।

কে কোন ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হলে?

 রিপোর্টিংয়ে–

সব্বাই? 

হ্যাঁ।

আগে কোনও কাগজে কাজ করতে?

সুধেন্দু জানালো, সে মণিলাল আর রমেন অন্য দৈনিকে সাত-আট বছর কাজ করেছে। তবে বিনয়ের এটাই প্রথম চাকরি।

রামগোপাল সস্নেহে বিনয়ের দিকে তাকালেন, তুমি তাহলে এই গোয়ালের একমাত্তর কচি বাছুর। আর সব্বাই ঝানু মাল

রামগোপালের কথাবার্তা, স্বরক্ষেপণ, মুখচোখের ভাব–সবই নাটকের কমেডিয়ানের মতো। বিনয় হেসে ফেলল, তা বলতে পারেন।

এবার রামগোপাল মণিলালের দিকে তর্জনী তুলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার মতন কোলকেতার পুরনো তেলাপোকা, না বাইরে থেকে এসে জুটেচ?

মণিলাল বলল, আমাদের বাড়ি হাওড়ায়—

কাছেই। ঘটি। রামগোপালের তর্জনী সুধেন্দুর দিকে ঘুরে গেল, তোমার দেশ ছিল কোতায়?

যশোর ডিস্ট্রিক্টে। এখন ইস্ট পাকিস্তান

 তুমি তাহলে হাফ বাঙাল?

 বুঝতে না পেরে সুধেন্দু বলল, হাফ বাঙাল মানে?

 পদ্মার ওপারের মালগুলো হল রিয়েল বাঙাল। তোমরা না ইস্ট বেঙ্গলের, না ওয়েস্ট বেঙ্গলের। মাজখানে ঝুলে আছো।

দিনির্ণয় যন্ত্রের কাটার মতো রামগোপালের আঙুল রমেনের দিকে ঘুরল, তোমার দেশ?

রমেন বলল, ঢাকায়। ঢাকা সিটিতেই আমরা কয়েক পুরুষ আছিলাম। পার্টিশানের পর কইলকাতায় চইলে আসি। তার গলায় পূর্ব বাংলার টান। কলকাতার ভাষাটা এখনও রপ্ত করে উঠতে পারেনি ঠিকমতো। ঢাকাই ডায়লেক্টের ভেজাল মিশে অদ্ভুত শোনায়।

রামগোপাল কণ্ঠস্বর উঁচুতে তুলে বলে উঠলেন, অ্যাই–অ্যাই হল আসল বাঙাল। এখনও জিভের আড় ভাঙেনি। হাঁ করেচে, অমনি পদ্মার ওপারের গন্ধ বেরুচ্চে ভুর ভুর করে।

এরপর বিনয়ের পালা। তোমার কোথায় হে?

খুব ছেলেবেলার কয়েকটা বছর বাদ দিলে বিনয়ের জীবনের সেরা সময়টাই কেটেছে রাজদিয়ায়। রাজদিয়ার খাল-বিল-নদী, অবারিত ধানের খেত, অফুরান আকাশ, পাখিতে পাখিতে ছয়লাপ মহাশূন্য–এ-সবের মধ্যেই তার বড় হয়ে ওঠা। পূর্ব বাংলার সেই ছোট্ট ভূখণ্ডটিই তার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। রাজদিয়াকেই সে নিজের দেশ মনে করে। বলল, আমার বাড়িও ঢাকায়। তবে ঢাকা সিটিতে নয়। সেখান থেকে অনেকটা দুরে, ছোট একটা মফস্বল টাউনে।

তুমিও বাঙাল! কপালে একটা চাপড় মেরে রামগোপাল বলে উঠলেন, বাঙালে বাঙালে কোলকেতাটা একেবারে ছেয়ে গেল! ছ্যা ছ্যা। যেখনেই যাবে সেখেনেই বাঙাল!

রামগোপালের কথাগুলোর মধ্যে বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ বা ঘৃণা রয়েছে, তা মনে হয় না। বরং এমন একটা লঘু মজার ব্যাপার রয়েছে যে বিনয়রা হেসে ফেলল।

রামগোপাল ফের বললেন, যেভাবে তোমরা ওপার থেকে এসে পঙ্গপালের মতো কোলকেতাটাকে হেঁকে ধরেচ, আমাদের ঘটিদের ন্যাজ গুটিয়ে পালাতে হবে দেকছি।

স্রেফ রগড়। বিনয়রা হাসতেই থাকে।

রামগোপাল থামেননি, তবে হ্যাঁ, একটা কথা মানতেই হবে। তোমাদের হেঁকোড় আচে। ওয়েস্ট বেঙ্গল যদি পাকিস্তানে পড়ত, আমরা যে কী করতুম, ভাবলে ভয়ে গায়ে কাঁটা দেয়।

একটু চুপচাপ।

তারপর রামগোপাল নতুন উদ্যমে শুরু করলেন, রিফুজিরা বনজঙ্গল সাবাড় করে কলোনি হাসাচ্চে, হকারি কোরচে, দোকানপাট খুলচে, যারা লেখাপড়া জানে তারা চাকরি বাকরি জোটাচ্চে। বাঙাল মেয়েগুনোও তাক লাগিয়ে দিলে। মদ্দদের সঙ্গে তারাও কাজকম্মো জোগাড় করে পয়সা রোজগারে নেমে পড়েছে। সিধে কথা, বাঁচতে হবে। আমরা হলে পরতুম না গো। স্রেফ কেতরে পড়তুম। আবার বলচি, তোমাদের হেঁকোড় আচে।

হেঁকোড় কথাটার মানে কী? ক্ষমতা? সাহস? উদ্যম? পরিষ্কার বোঝা না গেলেও আন্দাজ করা যাচ্ছে ওইরকম একটা কিছু। রামগোপালের সঙ্গে যেটুকু আলাপ হয়েছে তাতে অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু শব্দ শেখা গেল যা আগে কখনও শোনেনি বিনয়। কলকাতার অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে তার। কিন্তু তাদের উচ্চারণ বেশ খানিকটা আলাদা। এমন সব শব্দ তাদের মুখ থেকে বেরোয়নি। অথচ রামগোপাল নাকি এই শহরের আদি বাসিন্দা, তার নিজের কথায় তারা কলকাতার প্রাচীন তেলাপোকা। তবে কি সেকেলে কলকাতার বংশধরদের ভাষা টা একটু অন্য ধরনের? প্রথম দিনই তা জিজ্ঞেস করা যায় না। এখন থেকে প্রায়ই তো লাইব্রেরিতে আসতে হবে। পরে ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই তা জানা যাবে।

রামগোপালের হঠাৎ যেন কী মনে পড়ে গেল। চিড়িক মেরে উঠে বললেন, আমার সঙ্গে বসে বসে গুলতুনি মারলেই হবে? আপিসের ডিউটি আছে। ওঠ, উঠে পড়। দিল্লি বম্বের কাগজগুনো ওইখানে আচে। যাও হাত উঁচুতে তুলে আঙুল বাড়িয়ে ডানদিকের কোণটা দেখিয়ে দিলেন।

বিনয়রা হতচকিত। যে লোকটা লঘু মেজাজে গল্প করছিলেন, লহমায় তিনি আদ্যোপান্ত বদলে যাবেন, ভাবা যায়নি। ধড়মড় করে সবাই উঠে পড়ে। রামগোপালের আঙুল বরাবর দেওয়ালের কাছে এসে দেখতে পায় সারি সারি চওড়া স্টিলের র‍্যাক। প্রতিটি র‍্যাকের মাথায় টিনের পাতে একটা করে কাগজের নাম লেখা আছে। আনন্দবাজার, যুগান্তর, বসুমতী, স্বাধীনতা, স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, হিন্দু, ফ্রি প্রেস জার্নাল, হিন্দুস্থান টাইমস, দা নেশন ইত্যাদি। পুরু শালু দিয়ে প্রতিটি কাগজের এক মাসের সব কপি একসঙ্গে যত্ন করে বাঁধিয়ে এক-একটা তাকে রাখা আছে। দুমাস আগে নতুন ভারত-এর লাইব্রেরি করা হয়েছে। বোঝা যায় তখন থেকেই এইসব কাগজ রাখছেন জগদীশবাবুরা। প্রতি তাকে দুমাসের জন্য দুটো করে ফাইল।

কলকাতার কাগজগুলোর নাম বিনয় জানে। সুধাদের বাড়িতে দুখানা কাগজ রাখা হয়। একটা বাংলা, একটা ইংরেজি। অন্য পত্রিকাও মাঝে মাঝে কিনে আনে হিরণ। কিন্তু এখানে কলকাতার বাইরের যে-সব কাগজ রয়েছে সেগুলোর নাম আগে তো শোনেইনি, কোনটা দেশের কোন শহর থেকে বেরোয় সে সম্পর্কেও তার কোনও ধারণা নেই। সে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই কাগজগুলোর কোনটা থেকে লেখার মালমশলা জোগাড় করা যাবে, কে জানে।

নিরুপায় বিনয় সুধেন্দুদের দিকে তাকায়। এরা সবাই তার চেয়ে চোদ্দ পনেরো বছরের বড়। সাত আট কি দশ বছর ধরে সাংবাদিকতা করে হাড় পাকিয়ে ফেলেছে। খবরের কাগজের কাজের ঘোঁতঘাত নাড়ি-নক্ষত্র সব ওদের জানা।

ঢোক গিলে বিনয় বলল, সুধেন্দুদা, আমাকে একটু হেল্প করবেন?

সুধেন্দু তাক থেকে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর ফাইল নামাতে নামাতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো, কীসের হেল্প?

বিনয় তার সমস্যার কথা বলল।

হু, বুঝেছি। পয়লা দিন থেকেই জ্বালানো শুরু হল। এরপর এটা করে দাও, সেটা করে দাও এরকম চলতে থাকবে। আমার লাইফ মিজারেবল করে ছাড়বে দেখছি। বলে ভুরু কুঁচকে কী একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, এক কাজ কর, দিল্লির পেপারগুলো দেখ। শুনেছি, তোমাকে রিফিউজিদের ব্যাপারে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। ইস্ট পাকিস্তান থেকে যেমন লাখ লাখ মানুষ চলে আসছে তেমনি ওয়েস্ট পাকিস্তান থেকে আসছে হিন্দু আর শিখেরা। হিন্দুস্থান টাইমস কি দিল্লি এডিশনের কাগজগুলোতে ওদের খবর বেশি থাকে। মনে হয়, তোমার লেখার মতো ভাল মেটিরিয়াল পেয়ে যাবে।

দিল্লির নানা পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করে আপাতত গেল মাসের একটা ডেইলির ফাইল নিয়ে মাঝখানের প্রকাণ্ড টেবলটায় এসে বসল বিনয়। সুধেন্দুরাও এক-একটা ঢাউস ফাইল নিয়ে বসে পড়েছে।

বিনয় ধীরে ধীরে কাগজের পাতা উলটে যাচ্ছিল। কলকাতার পত্রিকাগুলোর মতো এখানেও প্রায় প্রতিদিনের প্রথম পাতার বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে কাশ্মিরের খবর। পশ্চিম সীমান্তের ওপার থেকে হানাদার বাহিনী সেখানে এসে অবিরাম উৎপাত চালাচ্ছে। পাকিস্তানি ফৌজ সমানে তাদের মদত দিয়ে যাচ্ছে। মনোরম ভূস্বর্গে রোজ আগুন। রোজ হত্যা। রোজ রক্তপাত। দেশভাগের। সময় থেকে সেই যে অশান্তি শুরু হয়েছিল, যত দিন যাচ্ছে সেটা ক্রমশ ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। এই সমস্যার কোনওদিনই বুঝি বা অবসান ঘটবে না।

বিনয়ের মনে পড়ল, বেশ কিছুদিন আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাফরুল্লা খান বলেছিলেন, কাশ্মিরে ইউ এন ওর হস্তক্ষেপ চাই। তখন থেকে ছোট-বড় সব পাকিস্তানি নেতাই তারস্বরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মেদিনী কাঁপয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধিদের কাশ্মিরে আসতে হবে। আসতেই হবে।

কাশ্মির ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী নেহরুর ভাষণ প্রায় প্রতিদিনই থাকে। সম্প্রতি এশিয়ায় নতুন স্বাধীন এক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। বার্মা। সে দেশের রাষ্ট্রপতি সাও সোয়ে যাইক এবং প্রধানমন্ত্রী থাকিন নু সারা পৃথিবীর, বিশেষ করে ভারতের বন্ধুত্ব প্রার্থনা করেছেন। মাঝে মাঝে তাদের খবরও চোখে পড়ছে। একদিনের কাগজে দেখা গেল, বেশ কিছু মুসলিম এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সরকারি অফিসার দেশভাগের সময় অপশন দিয়ে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগই নানা অসুবিধার কারণে ইন্ডিয়ায়, তাদের ফেলে-যাওয়া স্বদেশে ফিরে আসতে চাইছেন।

 দেশ-বিদেশের নানা সংবাদের মাঝখানে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুরা নেই বললেই চলে। তবে পশ্চিম পাঞ্জাব কি সিন্ধু থেকে উৎখাত হয়ে আসা মানুষের অনন্ত দুর্দশার সবিস্তার বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। সেই সঙ্গে দিল্লির চারপাশের ত্রাণ-শিবিরগুলোর ছবিও।

পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল বিনয়ের। তিন কলম জুড়ে বিরাট একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। বড় বড় হরফে যে শিরোনাম রয়েছে, বাংলায় তর্জমা করলে তা এইরকম দাঁড়ায়। করাচি থেকে এক অপহৃত তরুণীকে উদ্ধার করে ভারতে প্রেরণ : যুবকের মহত্ত্ব।

পড়তে পড়তে বুকের ভেতরটা অসাড় হয়ে আসতে থাকে বিনয়ের। অবিকল ঝিনুকেরই কাহিনি। শুধু শেষটা অন্যরকম।

বিনয় জানে, দেশভাগের আগে আগে বাংলাদেশের মতো সিন্ধু এবং পাঞ্জাবেও ভয়াবহ দাঙ্গা হয়ে গেছে। এই দুই প্রভিন্সে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে তখন প্রতিদিন গণহত্যা। রক্তের সমুদ্র বয়ে গিয়েছিল সেখানে। বড় বড় শহরেই শুধু নয়, সুদূর দুর্গম গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছিল তাণ্ডব। সারা পাঞ্জাব আর সিন্ধু তখন কসাইখানা।

হত্যার পাশাপাশি একটানা চলেছে আগুন, ধর্ষণ। বিনয় একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে, সব জায়গায়–তা বাংলা হোক, বিহার হোক বা পাঞ্জাব-হননকারীদের মূল টার্গেট তিনটে। প্রপার্টি, মানুষের প্রাণ আর নারী। দাঙ্গার সময় শয়ে শয়ে যুবতী লুট হয়ে গেছে।

বাংলার মতো সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্ট পাঞ্জাবও দুটুকরো হয়ে গিয়েছিল। দেশভাগের আগে এবং পরে লাহোর থেকে ট্রেন বোঝাই হয়ে শরণার্থীরা চলে এসেছিল অমৃতসর, দিল্লি কি লুধিয়ানায়। অনেকে কানপুর, বম্বে এবং কলকাতাতেও। তেমনি এপার থেকেও ট্রেন বোঝাই হয়ে উদ্বাস্তু গেছে সীমান্তের ওধারে। এমনও শোনা গেছে, দাঙ্গার সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে কোনও কোনও ট্রেনে এসেছে শুধুই লাশ। তেমনি পাকার মৃতদেহ নিয়ে সেই সব ট্রেন ওপারে ফিরে গেছে। লাশের বদলে লাশ। হত্যার বদলা হত্যা।

দেশভাগের পরও ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওয়া মানুষের সীমান্তের এপার থেকে ওপারে যাওয়া, কিংবা ওপার থেকে এপারে আসা বন্ধ হয়নি। কবে যে এর অবসান ঘটবে, আদৌ ঘটবে কি না, কে জানে।

লাখে লাখে মানুষ এসেছে, ক্রমাগত আরও আসছে, কিন্তু যে তরুণীদের ছিনিয়ে নিয়ে গেছে হানাদারেরা তাদের শতকরা দুজনও ফিরে আসেনি।

নতুন ভারত-এর লাইব্রেরিতে বসে বিনয় এই মুহূর্তে দিল্লির কাগজের যে প্রতিবেদনটা পড়ছিল তাতে ছেচল্লিশের আগস্ট থেকে ধারাবাহিক দাঙ্গার প্রসঙ্গ টেনে এনে লেখা হয়েছে, দুই দেশের সরকার উদ্ধার কমিটি তৈরি করেছিল বেশ কিছুদিন আগে। তাতে পদস্থ অফিসাররা ছাড়াও রয়েছেন সমাজসেবী এবং নানা ক্ষেত্রের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিশিষ্ট জনেরা। এঁদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দাঙ্গায় লুট হয়ে যাওয়া তরুণীদের খুঁজে বার করে যেন সরকারের হাতে তুলে দেন। ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তান সরকার এই লাঞ্ছিত মেয়েদের মা-বাবা, স্বামী কি আত্মীয় পরিজনের হাতে পৌঁছে তুলে দেবে। যদি কারও আপনজনের সন্ধান না পাওয়া যায়, সংশ্লিষ্ট সরকার তার সুরক্ষার ব্যবস্থা তো করবেই, ভবিষ্যতে সে যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তার সুযোগও করে দেবে।

এই পটভূমিতে প্রতিবেদক নীলম নামে মেয়েটির কথা সবিস্তার জানিয়েছেন।

সাতচল্লিশে, স্বাধীনতার কিছু আগে, দেশজোড়া সেই দাঙ্গার সময়, সশস্ত্র হিংস্র ঘাতকের দল একদিন রাতে মশাল জ্বালিয়ে তুমুল হল্লা করতে করতে লাহোরের বড় একটা মহল্লায় ঢুকে পড়েছিল। এলাকাটা পাঁচমেশালি। নানা ধরনের মানুষ সেখানে থাকত। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, হাতে-গোনা কটি খ্রিস্টান পরিবারও। হানাদারদের টার্গেট হিন্দু এবং শিখেদের বাড়িগুলো। তেমন বাড়ি পাওয়ামাত্র পেট্রোল বা কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। দাউ দাউ জ্বলতে জ্বলতে বাড়িগুলো চোখের সামনে ছাই হয়ে যাচ্ছিল। প্রাণ বাঁচাতে ভয়ে, আতঙ্কে উদ্ভ্রান্তের মতো যারা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল, শুধু তরুণীরা বাদে বাকি সবাই মুহূর্তে লাশে পরিণত হচ্ছিল।

মহল্লার যে মানুষগুলো কয়েক পুরুষ পাশাপাশি বাস করে এসেছে তাদের সকলে সেই নিদারুণ দুঃসময়ে পশু হয়ে য়নি। চিরকাল এমন অনেকেই আছে, হাজার উসকানিতেও তারা অটল থাকতে পারে। মনুষ্যত্ব জলাঞ্জলি দেবার কথা ভাবতেই পারে না। এই ধরনের কিছু মানুষ বিপন্ন শিখ এবং হিন্দু পড়োশিদের বাঁচাতে ছুটে এসেছিল। কিন্তু হানাদার ঘাতক বাহিনীকে পুরোপুরি ঠেকাবার শক্তি তাদের ছিল না।

মহল্লার বেশ কিছু বাড়ি ধ্বংসস্তূপ আর বেশ কিছু জীবন্ত মানুষকে লাশ বানিয়ে পঁচিশ তিরিশটি তরুণীকে জোর করে টানতে টানতে নিয়ে চলে গিয়েছিল দাঙ্গাবাজরা। এই মেয়েদের একজন নীলম। তারা হিন্দু, জাঠ।

নীলমদের ছিল মাঝারি ধরনের পরিবার। বাবা, মা, ঠাকুমা, ছোট একটা ভাই এবং সে নিজে। বাড়িতে আগুন লাগানোর পর বাইরে বেরিয়ে দিশেহারার মতো যে যেদিকে পারে পালিয়ে গিয়েছিল। হানাদারেরা তাদের নাগাল পায়নি। বাড়ির সবাই পারলেও নীলমের পক্ষে পালানো সম্ভব হয়নি।

নীলমের বাবার নাম রাজিন্দর সিং। মা জানকী। ছোট ভাই হল অজিত। ঠাকুমার নাম মহালছমী।

রাজিন্দর আর জানকী মহল্লা থেকে অনেকটা দূরে একটা জংলা মতো জায়গায় ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল। অজিত আরও দূরে প্রকাণ্ড এক তালাও অর্থাৎ দিঘিতে চাপ-বাঁধা টোপা পানার ভেতর গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে ছিল। আর তাদের মহল্লারই এক প্রতিবেশী জামাল খান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহালছমীকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল।

দাঙ্গা থামাবার জন্য তখন সবে মিলিটারি নামানো হয়েছে। একটা টহলদার ভ্যান আচমকা ভোরের দিকে এসে নানা জায়গা থেকে রাজিন্দরদের উদ্ধার করে শেখপুরার রেসকিউ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। শুধু রাজিরদেরই নয়, ব্যাপক খুনখারাপির পর মহল্লার যে কজন বেঁচে ছিল, তাদেরও। দেশভাগের পর তারা চলে আসে দিল্লি। শুধু নীলম পড়ে থাকে লাহোরে। পুলিশ এবং মিলিটারিকে জানানোও হয়েছিল তার কথা। তখন চারদিকে লুটপাট, হত্যা। পুলিশ বা মিলিটারি সে-সব ঠেকাবে, না সারা লাহোরের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে নীলমকে উদ্ধার করে আনবে? এমন ঘটনা তো একটা দুটো নয়–অগুনতি।

মেয়ের জন্য একেবারে ভেঙে পড়েছিল রাজিররা। দিল্লিতে যখন এল, পুরোপুরি বিধ্বস্ত। লাহোরের সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি সারাক্ষণ তাদের বুকে শেল বিধিয়ে দিত। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে নীলমের মুখটা যেন ভাসতে থাকত। লহমার জন্যও তাকে ভোলা যেত না। তখন চোখ মেললেও নীলম, চোখ বুজলেও নীলম। সে যে কী তীব্র যন্ত্রণা! কী নিদারুণ ক্লেশ! শোকাচ্ছন্ন রাজিন্দর, জানকী, মহালছমী আর অজিত খেত না, ঘুমতো না। জানকী আর মহালছমী অবিরল কেঁদেই যেত। কেঁদেই যেত। এই কান্না কোনওদিনই বুঝি বা শেষ হবে না।

শুধু রাজিন্দররাই না, আরও একটি যুবক নীলমের জন্য ভেঙেচুরে শতখান হয়ে গিয়েছিল। সে সুরেশ। লাহোরে একই মহল্লায় তারা থাকত। নীলমের সঙ্গে একই কলেজে পড়ত সে। নীলম সেকেন্ড ইয়ারে, সে ফোর্থ ইয়ারে। একই এলাকায় তাদের জন্ম, তাদের বড় হয়ে ওঠা, একই কো-এড স্কুল এবং কলেজে তাদের পড়াশোনা। হঠাৎ একদিন কোনও অদৃশ্য মায়াবী নকিব জানান দিয়ে গেল, একজনকে ছাড়া আর-একজনের চলবে না। এক মহল্লায় আলাদা আলাদা বাড়িতে নয়, একই বাড়িতে, একসঙ্গে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। তারা ঠিকই করে ফেলেছিল, পড়াশোনা শেষ হলে আর সুরেশের চাকরি বাকরি জুটলে দুই বাড়িতে তাদের সবচেয়ে জরুরি সিদ্ধান্তের কথাটা জানিয়ে দেবে। কিন্তু তার আগেই লাহোরের দাঙ্গায় সমস্ত তছনছ। সব স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন। নানা রঙে ভবিষ্যতের যে ঝলমলে নকশাটা তারা এঁকেছিল, চকিতে বিলীন হয়ে গেল।

জোর করে নারীহরণের ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানে বিশেষ কোনও তফাত নেই।

 লেখাটা পড়তে পড়তে গাঢ় বিষাদে মন ভরে যাচ্ছিল বিনয়ের। খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকে সে। তারপর বাকি অংশটুকু পড়তে শুরু করে। ..

দিল্লিতে আসার পর কয়েক মাস ত্রাণশিবিরে কেটে যায় রাজিন্দরদের। শহরতলিতে নতুন নতুন কলোনি তৈরি হচ্ছিল। তার একটায় আরও অনেকের সঙ্গে তাদেরও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। এদের বেশির ভাগই লাহোর থেকে আসা উদ্বাস্তু। তাদের কারও কারও সঙ্গে সীমান্তের ওপারে থাকতেই পরিচয় ছিল রাজিরদের। কেউ কেউ লাহোরে একই মহল্লায় থাকত। যেমন সুরেশরা। ওদের খুবই ছোট্ট পরিবার। সে আর তার বাবা ধনরাজ কাপুর। সুরেশের মা তার ছেলেবেলায় মারা গেছেন। তার কোনও ভাইবোন নেই।

সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের ত্রাণ এবং পুনর্বাসন দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উৎখাত হয়ে আসা মানুষদের জন্য ঢালাও সাহায্যের ব্যবস্থা করেছে। সামান্য লেখাপড়া জানলেই হাজারটা কাজের সুযোগ। যারা ব্যবসা করতে চায় তাদের বিনা সুদে কিংবা নামমাত্র সুদে ঋণ। তবে অনুদানই বেশি। হাতের কাজ শেখার জন্য কত যে পলিটেকনিক খোলা হয়েছে তার হিসেব নেই। স্থায়ী বাসস্থানের জন্য দেওয়া হচ্ছে জমি। যত তাড়াতাড়ি এদের স্বয়ম্ভর করে তোলা যায় সেজন্য চেষ্টার ত্রুটি নেই।

রাজিন্দররা অন্য সবার মতো জমি পেল। বাড়ি তৈরির জন্য টাকা পেল। সে টাকার বেশিটা ফেরত দিতে হবে না। বাকিটা সুদহীন লোন। তাও পনেরো বছর ধরে কিস্তিতে কিস্তিতে শোধ করলে চলবে।

লাহোরের একটা বড় মার্কেটে রাজিলরদের বিরাট কাপড়ের দোকান ছিল। তিন-চার পুরুষের ব্যবসা। বিজনেসটা তাদের রক্তে। দিল্লিতে এসে বাড়ি তৈরির জন্য সরকারি টাকা তো পেয়েছিলই, ব্যবসার জন্য লোন নিয়ে কাছাকাছি একটা মার্কেটে কাপড়েরই দোকান খুলে বসল রাজির। একমাত্র ছেলে অজিত লাহোরে ক্লাস টেনে পড়ত। তাকে দিল্লির স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল।

লাহোরের দাঙ্গার পর রাজিলরদের মনে হতো, পৃথিবী নামে এই গ্রহটায় আলো নেই। বাতাস নেই। সব থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। চারদিকে চাপ চাপ অন্ধকার। আকাশ খান খান হয়ে ভেঙে পড়েছে কিন্তু সময় এক আশ্চর্য জাদুকর। ধীরে ধীরে অন্তহীন শোক, অশেষ যন্ত্রণাও ভুলিয়ে দেয়। মুছে দেয় যাবতীয় সন্তাপ।

জীবনকে পাকিস্তান থেকে উপড়ে এনে সীমান্তের এপারে নতুন করে গড়ে তুলতে তুলতে লাহোরের আগুন, হত্যা, রক্তপাত, ধর্ষণের স্মৃতি ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে রাজিরদের কাছে। অনেকটা জলে ধোওয়া ঝাপসা ছবির মতো।

নতুন দেশে, সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে ব্যবসা জমিয়ে তুলতে হবে। সারাদিনই রাজিন্দরের ব্যস্ততা। অজিত বরাবরই লাহোরে ভাল রেজাল্ট করত। দিল্লিতে এসে ভর্তি হবার পর তার একমাত্র ধ্যান জ্ঞান আরও ভাল করতে হবে। সকালে উঠে পড়াশোনা, তারপর স্কুল, স্কুলের পর প্রাইভেট টিউটরের কাছে ছোটা। এক মুহূর্তও তার ফুরসত নেই। রিলিফ ক্যাম্পে থাকার সময় জানকীর কোনও কাজ ছিল না। ক্যাম্প থেকেই চার বেলা খাবার দেওয়া হতো। তখন সমস্ত দিনই অবসর। কিন্তু ত্রাণ শিবির থেকে নতুন বাড়িতে উঠে গিয়ে ফের সংসার শুরু করার পর তারও বসে থাকার জো নেই। কাজের লোক রাখার মতো রোজগার তখনও হয়নি রাজিলরের। ব্যবসা সেভাবে দাঁড়ায় নি। ফলে সংসারের যাবতীয় :জ একাই সামলাতে হতো জানকীকে। দুবেলা রান্না, কাপড় কাঁচা, ঘর বোয়ামোছা, ইত্যাদি। তারই কে ফাঁকে যখন নীলমকে মনে পড়ত, চোখ বুজে চুপচাপ বসে থাকত সে। বুকের ভেতরটা আমূল উথালপাতাল হয়ে যেত। কিন্তু কতক্ষণ আর! সংসারের শত কাজ পড়ে আছে। অনিচ্ছুক শরীরটাকে টেনে তুলতে হতো তাকে। রাজিন্দরের মা মহালছমীর যথেষ্ট বয়স হয়েছিল। লাহোর থেকে আসার পর জানকীর মতো সেও নাতনির জন্য বুক চাপড়ে কাঁদত। কিন্তু রিলিফ। ক্যাম্পে থাকতে থাকতেই কেমন যেন অথর্ব হয়ে পড়েছিল সে। নতুন বাড়িতে আসার পর একেবারে। জবুথবু। বোধবুদ্ধি অসাড় হয়ে যাচ্ছিল তার। কেউ কিছু বললে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত।

সুরেশরাও একই কলোনিতে বাড়ি তুলেছিল। লাহোরের মতো তারা এখানেও রাজিন্দরদের পড়োশি। ইন্ডিয়ায় আসার পর রিলিফ ক্যাম্পে সারাক্ষণ আচ্ছন্নের মতো কেটে যেত তার। কিন্তু সময় তো এক জায়গায় থেমে থাকে না। লাহোরে ফোর্থ ইয়ারে পড়ত সুরেশ। একদিন দিল্লির • কলেজে ভর্তি হল। বি এ পাস করে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গেল। তার বাবা ধনরাজ কাপুর লাহোরের একটা কলেজে পড়াতেন। পণ্ডিত মানুষ। তিনি দিল্লির কলেজেও কাজ পেয়ে গেলেন।

কলোনিতে বাড়ি তৈরি করার পর গোড়ার দিকে সুরেশ রোজই রাজিন্দরদের বাড়ি দিনে বা রাতে একবার করে আসতই। এলে একই আলোচনা-নীলম, দাঙ্গা, দুঃস্বপ্নের মতো সেই দিনগুলোর কথা ভেবে অবিরল শিউরে ওঠা। পরে সুরেশের আসাটা কমে যেতে লাগল। সপ্তাহে একবার, আরও পরে ক্কচিৎ কখনও। আসলে নানাভাবে জড়িয়ে পড়ছিল সে। পড়াশোনার চাপ। ইউনিভার্সিটি। নতুন নতুন বন্ধুবান্ধব। পুরানো দুঃখের স্মৃতিতে কতদিন আর ডুবে থাকা যায়?

যত দিন যাচ্ছিল, লাহোরের দাঙ্গায় লুট হয়ে যাওয়া একটি যুবতী তার মা-বাবা-ভাই এবং অন্য সব আপনজনের কাছ থেকে দূরে, আরও দূরে সরে যাচ্ছিল। হয়তো চিরদিনের মতো নীলম লুপ্ত হয়ে যেত, কিন্তু গেল না।

 দেশভাগের পর পরই ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানে রেসকিউ কমিটি গড় হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের কমিটি হঠাৎ একদিন লাহোরের এক বাড়ি থেকে নীলমকে উদ্ধার করে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেয়। তাকে তোলা হয় একটা হোমে। পাকিস্তানে যে মেয়েদের ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের খুঁজে বার করে এই উদ্ধার আশ্রমে রাখা হয়।

নীলমের কাছ থেকে তার মা-বাবা-ভাই এবং ঠাকুমা সম্পর্কে সবিস্তার জেনে নিয়ে দিল্লি পুলিশের একজন অফিসার আর দুই কনস্টেবল খুঁজে খুঁজে এক রবিবারের বিকেলে কলোনিতে রাজিলরদের বাড়িতে এসে হাজির। ছুটির দিন। লোকজন বিশেষ কেউ বেরোয়নি। যে যার বাড়িতেই ছিল। পুলিশ দেখে সবাই ছুটে এসে ভিড় জমায়। তাদের সঙ্গে সুরেশও। সবার চোখেমুখে তীব্র কৌতূহল। প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা।

নীলমকে উদ্ধার করে পাকিস্তান ফেরত পাঠিয়েছে, সে তার মা-বাবার কাছে আসতে চায়, পুলিশ অফিসার এই খবরটা দেবার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমটা সমস্ত কলোনি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরক্ষণে তড়িৎপ্রবাহ খেলে যায়। তখন কৌতূহলের বদলে চারদিকে শুরু হল গুঞ্জন, উত্তেজনা, তুমুল চাঞ্চল্য।

যে মেয়ে খোয়া গেছে, যার স্মৃতি প্রায় ঝাপসা হয়ে এসেছে সে যে কোনওদিন ফিরে আসবে, কে ভাবতে পেরেছিল? রাজিন্দর একেবারে বিহ্বল হয়ে পড়ে। তারপর অবোধ বালকের মতো দুহাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে ওঠে। অজিত দিশেহারা। পুলিশ অফিসারের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল সে। জানকী একটি কথাও বলছিল না। কেউ বুঝি তার বাকশক্তি হরণ করে নিয়েছে। এমনভাবে সে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন এক পাথর-প্রতিমা। শুধু দুচোখ বেয়ে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছিল। অথর্ব মহালছমীর মস্তিষ্কে ক্ষণিকের জন্য হয়তো সাড় ফিরে এসেছিল। হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে দুর্বোধ্য, জড়ানো গলায় সমানে চিৎকার করে যাচ্ছিল সে। অদৃশ্য কোনও অস্ত্রের আঘাতে ছিন্নভিন্ন জন্তুর মতো। রাজিন্দাদের বুকের ভেতরকার যে দগদগে ক্ষতটা শুকিয়ে এসেছিল সেটা ফের রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে।

পুলিশ অফিসার সহৃদয় গলায় বলেছিলেন, কাঁদবেন না সিংজি। আজ তো আপনাদের আনন্দের। দিন। আমার সঙ্গে হোমে চলুন। মেয়েকে নিয়ে আসবেন। আমি নিজে পৌঁছে দিয়ে যাব।

হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে সম্বিত ফিরে পেয়েছিল যেন রাজিন্দর। কী ভেবে হাতজোড় করে বলেছে, কৃপা করকে আপ থোড়া ঠহরিয়ে মা আর স্ত্রীকে নিয়ে ভেতর দিকের একটা ঘরে চলে গিয়েছে সে। খানিকক্ষণ পর ফিরে এসে, ভাঙা গলায় বলেছিল, আমি যাব না। নীলম যেখানে আছে সেখানেই থাক।

অফিসার চমকে ওঠেছেন, মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। কত আশা নিয়ে আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছে, ভাবতে পারবেন না। ও যাতে অতীত ভুলে যেতে পারে–  

এদিকে উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে উঠেছে সুরেশ, এ আপনি কী বলছেন রাজিন্দর চাচা! প্রিয় নারীটিকে প্রায় ভুলতেই বসেছিল সে। হঠাৎ নীলম ফিরে আসায় তার সৌরজগৎ ওলটপালট হয়ে গেছে।

রাজিন্দর পুলিশ অফিসার বা সুরেশের কথার উত্তর দেয়নি। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল, তার মনোভাবটা বোঝা যাচ্ছিল। যে মেয়ে দাঙ্গার সময় লুট হয়ে গেছে, যে ধর্ষিত, নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও যাকে দিনের পর দিন ঘৃণ্য জীবন কাটাতে হয়েছে তাকে বাড়িতে ঠাই দিলে লোকে কী বলবে? বাকি জীবন কারও দিকে মুখ তুলে তাকানো যাবে? মাত্র কটা বছরে ভারত নামে এই ভূখণ্ডটি জুড়ে কত কীই তো ঘটে গেল। দাঙ্গা, গণহত্যা, দেশভাগ, লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ওপার থেকে এপারে আসা, এপার থেকে ওপারে চলে যাওয়া। আদ্যোপান্ত বদলে গেছে কত কিছুই। কিন্তু বিনাশ নেই সংস্কারের। ধর্ষিত মেয়েকে ফিরিয়ে নেওয়াটা মহাপাতক। পূর্ব-পুরুষের যে-সব আত্মা পঞ্চভূতে মিশে আছে তারা কোনওদিনই ক্ষমা করবে না। এই বদ্ধমূল বিশ্বাস, এই ধারণা থেকে মুক্তি নেই রাজিন্দরদের।

পুলিশ অফিসার অনেক বুঝিয়েছেন কিন্তু মুখ তোলে নি রাজিন্দর। কিছুই যেন শুনতে পাচ্ছিল না। একেবারে বধির।

অনেক বুঝিয়েও যখন কাজ হল না, হতাশ সুরে অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, কী হবে মেয়েটার? সে আপনার নিজের সন্তান

এবার মুখ খুলেছে রাজিন্দর। ক্ষীণ, কাঁপা গলায় বলেছে, এটাই ওর নসিব স্যার। সরকার আছেন, ভগোয়ান আছেন, তাঁরাই ওকে দেখবেন।

এতক্ষণ নীরবে সব শুনে যাচ্ছিল সুরেশ। হঠাৎ সে ফেটে পড়েছে, আপনারা কি মানুষ রাজিন্দর চাচা? অফিসারের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করছিল, আমি কি নীলমের সঙ্গে দেখা করতে পারি স্যার?

অফিসার একটু অবাক হয়েছেন, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।

সুরেশ নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছে, লাহোরে নীলমরা আর আমরা একই মহল্লায় থাকতাম। পার্টিশানের পর রাজিন্দর চাচাঁদের সঙ্গে দিল্লি চলে আসি। এই কলোনিতেই ওঁদের কাছাকাছি বাড়ি করেছি–

অফিসার কী ভেবে বলেছেন, আচ্ছা, চলুন আমার সঙ্গে

সুরেশ সেদিনই শুধু যায়নি। তারপর আরও কয়েকদিন গেছে। শেষবার উদ্ধার আশ্রমে গিয়েছিল দুসপ্তাহ পর। সঙ্গে তার বাবা। কলোনিবাসীদের চমকে দিয়ে সেদিনই ফিরে এসেছিল নীলমকে নিয়ে। পুলিশ এবং হোমের কর্মকর্তাদের সামনে, বাবার মত নিয়ে সে নীলমকে বিয়ে করেছে।

পৃথিবীর কারওকে তোয়াক্কা করেনি সুরেশ। কে কী বলল, না-বলল, গ্রাহ্য করেনি। যাবতীয় সংস্কার তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে যৌবনের বিপুল অহঙ্কারে নিজের কাম্য নারীটিকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে। ….

কাগজের প্রতিবেদনটা এখানেই শেষ। পড়ার পর অনেকক্ষণ নিঝুম বসে থাকে বিনয়। তার এবং সুরেশের জীবনের ঘটনা তো প্রায় একই। সুরেশ পেরেছে। কিন্তু আকাশ পাতাল চিরে ফেড়ে চিৎকার করে সে বলতে পারেনি, হবার হবে, ঝিনুককে আমি বিয়ে করব।

আত্মগ্লানিতে মন ভরে যায় বিনয়ের। নিজেকে শতবার ধিক্কার দেয়। সে ভীরু। সে অপদার্থ। সে কাপুরুষ। কেঁচোর মতো মেরুদণ্ডহীন।

একসময় টের পেল, পায়ের তলায় মেঝেটা ঢেউয়ের মতো দুলছে। আবছা হয়ে যাচ্ছে চারদিক। মাথাটা সোজা রেখে বসে থাকা যাচ্ছে না। হুড়মুড় করে টেবলের ওপর ভেঙে পড়ল বিনয়।

লম্বা টেবলটার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে খুব মগ্ন হয়ে দিল্লি বম্বের কাগজগুলোর পাতা উলটে যাচ্ছিল সুধেন্দুরা। আচমকা ভারী কিছু পড়ার আওয়াজ কানে আসতে সবাই চমকে ওঠে।

কী হল তোমার? কী হল?

 উদ্বিগ্ন সুধেন্দুরা দৌড়ে আসে।

লাইব্রেরির শেষ মাথা থেকে মার্কামারা গলায় রামগোপাল দত্ত চেঁচিয়ে উঠলেন, ছোকরা অমন ছেতরে পড়ল কেন হে? দেখ, ওকে দেখ–

বিনয় ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছিল। লজ্জার একশেষ। কোনওরকমে সামলে নিয়ে টেবল থেকে নিজেকে টেনে তুলে সোজা হয়ে বসল।

সুধেন্দুরা ঝুঁকে পড়েছিল। কি, শরীর খুব খারাপ লাগছে?

বিব্রতভাবে বিনয় বলল, না না, আমি ঠিক আছি। মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গিয়েছিল। তাই

সুধেন্দুরা বার বার জানতে চাইল, ডাক্তারখানায় নিয়ে যাবে কি না। বিনয় তাদের বোঝালো তার জন্য উৎকণ্ঠার কারণ নেই। ডাক্তার দেখাবার মতো কিছুই হয়নি।

সুধেন্দুরা যে-যার জায়গায় ফিরে গেল।

টেবলের ওপর নিউজপ্রিন্টের চৌকো চৌকো কটা বাঁধানো প্যাড পড়ে ছিল। সেগুলো সাংবাদিকদের লেখালিখির জন্য। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর একটা প্যাড টেনে নিয়ে কাগজের সেই প্রতিবেদনটা থেকে নীলমের জীবনের ঘটনাধারার চুম্বক টুকে নিতে লাগল বিনয়। পরে এগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে বিশদ করে লিখতে হবে।

ওদিকে সুধেন্দুরাও তাদের পছন্দমতো বিষয় পেয়ে সংক্ষেপে মূল পয়েন্টগুলো লিখে নিচ্ছে।

.

লাইব্রেরির কাজ শেষ হলে রামগোপালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিনয়রা ফের নিউজ ডিপার্টমেন্টে প্রসাদ লাহিড়ির কাছে চলে এল।

প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, কী, ইন্টারেস্টিং কিছু মেটিরিয়াল পাওয়া গেল?

সুধেন্দু, মণিলাল এবং রমেন জানালো, লেখার মতো ভাল মালমশলা তারা পেয়েছে।

প্রসাদ বিনয়ের দিকে তাকালেন, তুমি?

বিনয় ভারী গলায় বলল, আমিও পেয়েছি। লাহোরের একটি মেয়ের লাইফ হিস্ট্রি।

সবাই কপি তৈরি করে নিয়ে এস।

 রিপোর্টিং সেকশানে বেশ কটা নতুন টেবল চেয়ার খুব যত্ন করে পর পর পেতে রাখা আছে। বিনয়রা এক-একটা টেবল নিয়ে বসে পড়ে।

সাব-এডিটর, প্রফ-রিডার এবং ফটোগ্রাফারদের টেবলগুলো থেকে কলরোল ভেসে আসছে। এদের আধাআধি অল্প বয়সের টাটকা যুবক। কলেজ বা ইউনিভার্সিটি থেকে সবে বেরিয়েছে। নতুন কাগজে নতুন চাকরি। বিপুল উৎসাহ তাদের। প্রবল উদ্দীপনা। অবশ্য বয়স্ক, অভিজ্ঞ সাংবাদিকও রয়েছে। অন্য সব কাগজ থেকে তাদের বেশি টাকার টোপ দিয়ে নিয়ে এসেছেন জগদীশ গুহঠাকুরতা। নতুন পুরানো মিলিয়ে তার নতুন ভারত-এর টিম।

আনকোরা ছোকরা সাংবাদিকদের ক্যাচর ম্যাচর তো রয়েছেই। তার সঙ্গে দুই টেলিপ্রিন্টারের অবিরাম খটখটানি। কিন্তু এই শব্দপুঞ্জ বিনয়ের কানে ঢুকছে না। হালকা গুঞ্জনের মতো পাশ দিয়ে পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। লাহোরের এক লুণ্ঠিত তরুণী, দুবছর ধরে তার মৃত্যুযন্ত্রণা, তাকে নরক থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা, নিদারুণ লাঞ্ছনার পর তার পুনর্জন্ম–সব একাকার হয়ে বিনয়কে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

কেমন ছিল নীলম? দিল্লির কাগজের সেই লেখাটার সঙ্গে তার কোনও ছবি ছাপা হয়নি। বিনয় কল্পনা করে নেয়, সে সুন্দরী। সদ্যফোঁটা ফুলের মতো। সে চুলবুলে। চঞ্চল, লঘু কোনও পাখির মতো। আর দশটা ওই বয়সের মেয়ের মতো দুই মুঠিতে স্বপ্ন পুরে মনে মনে, উড়ে উড়ে, আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে, দূরে কোথাও ভেসে যেতে সে ভালবাসত। কিন্তু লাহোরের দাঙ্গায় তার সব স্বপ্ন পুড়ে ছাই।

বিনয় নীলমের মুখ যতবার ভাবতে চেষ্টা করছে ততবারই সেটা ঝিনুকের মুখ হয়ে যাচ্ছে।

একসময় তার মনে হল, দেরি করা ঠিক নয়। সব টেবলেই সাংবাদিকদের লেখালেখির জন্য নিউজ প্রিন্টের চৌকো চৌকো প্যাড পড়ে আছে। ভাবনাটা গোছগাছ করে নিয়ে একটা প্যাড টেনে সে লিখতে শুরু করে।

লেখাটা শেষ করতে বেশ সময় লাগল। বাইরে শীতের রোদ কখন মুছে গেছে, কখন নেমেছে সন্ধ্যা, কখন রাস্তায় আলোগুলো জ্বলে উঠেছে, খেয়াল করেনি বিনয়। নিউজ ডিপার্টমেন্টের বিশাল হল-ঘরটাকে আলোয় ভাসিয়ে দিয়ে চতুর্দিকে অগুনতি তেজী বাল্ব জ্বলছে।

বিনয় লক্ষ করল, তার পাশের টেবলগুলোতে সুধেন্দুরা নেই। দূরে সাব-এডিটরদের জটলায় গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। একই কাগজে কাজ করবে। সবাই সহকর্মী। প্রথম দিনই আলাপ-পরিচয় করে নিচ্ছে। আন্দাজ করা যাচ্ছে, সুধেন্দুরা এর মধ্যেই কপি তৈরি করে প্রসাদের কাছে জমা দিয়েছে।

ওধার থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে লেখাটা পড়ে ফেলল বিনয়। একবার। দুবার। তিন বার। নিউজ এডিটর তারাপদ ভৌমিক সেদিন বার বার বলে দিয়েছিলেন, খবরের কাগজের বেশির ভাগ পাঠকই সাধারণ মানুষ। বিদ্যেবুদ্ধি যৎসামান্য। তারা যাতে সহজেই বুঝতে পারে তেমন ভাষায় লিখতে হবে। যতটা সম্ভব খটমট, শক্ত শক্ত শব্দ বাদ দেওয়া দরকার।

তিন বার পড়ার পর কয়েকটা আলগা, অনাবশ্যক শব্দ বাদ দিয়ে অন্য শব্দ বসাল বিনয়। ছসাতটা সেনটেন্স কেটেকুটে ছোট করল। তারপর লেখাটা নিয়ে পায়ে পায়ে প্রসাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

প্রসাদ ঘাড় ঝুঁকিয়ে লিখছিলেন, পায়ের আওয়াজে মুখ তুলে তাকালেন। বিনয়কে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, হয়ে গেছে?

নিঃশব্দে টেবলের এধারে একটা চেয়ারে বসতে বসতে হাতের লেখাটা বাড়িয়ে দিয়ে বিনয় ঘাড় কাত করে। আধফোঁটা গলায় বলে, হ্যাঁ। এই যে

 লেখাটা নিয়ে তক্ষুনি পড়তে শুরু করেন প্রসাদ। বিনয়ের বুক দুরু দুরু। তার লেখা তারাপদ ভৌমিকের ভাল লেগেছিল বলে প্রসাদ লাহিড়ির ভাল লাগবে, এমন কোনও নিয়ম নেই। পড়তে পড়তে প্রসাদের চোখেমুখে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করছে সে।

এক নিশ্বাসে পড়া শেষ করলেন প্রসাদ। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর বললেন, ভেরি গুড কপি। ভীষণ টাচিং। প্রসাদ তারাপদর মতো ততটা আবেগপ্রবণ নন। উঁচু গলায় কথা বলেন না। তবু যে কটি শব্দ উচ্চারণ করলেন সেগুলোতে অঢেল প্রশংসা। বুকের কাঁপুনিটা উধাও বিনয়ের। তারাপদর কাছে প্রথম পরীক্ষাটা খুব ভালভাবেই উতরে গিয়েছিল। দুনম্বর পরীক্ষার বেড়াও নির্বিঘ্নে পেরিয়ে গেল।

প্রসাদ বলতে লাগলেন, নীলমের জন্যে ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু সুরেশের গ্রেটনেসের জন্যে কী শ্রদ্ধা যে হল, বলে বোঝাতে পারব না। তিনি আরও বললেন, পার্টিশানের পর দেশ তোলপাড় হয়ে গেছে। সুরেশের মতো সাহসী, সংস্কারমুক্ত যুবকদের এখন খুবই প্রয়োজন। ইত্যাদি।

লেখাটার প্রশংসায় বিনয় যতটা খুশি হয়েছিল, সুরেশের নামটা শোনামাত্র–যদিও তার কথা সে এখনই লিখে এনেছে–ততটাই কুঁকড়ে যায়। নিজেকে আরও একবার ধিক্কার দেয় সে। একটি কথাও না বলে মুহ্যমানের মতো বসে থাকে।

প্রসাদ জিজ্ঞেস করেন, কোন কাগজে রিপোর্টটা বেরিয়েছে?

বিনয় দিল্লির কাগজের নাম বলল। তার লেখাটার শেষ পাতায় নিচের দিকে নামটা লিখতে লিখতে জিজ্ঞেস করলেন, লেখাটা কি পুরোপুরি বাংলায় ট্রানস্লেশন করে দিয়েছ?

না। বিনয় জানায় নীলমের জীবনের ঘটনাগুলো সাজিয়ে নিজের মতো করে লিখেছে।

গুড। এই লেখাটা এখন রেখে দিচ্ছি। আমাদের কাগজ যখন বাজারে বেরুবে, এটা ছাপা হবে। বাইরের কাগজ ঘেঁটে এরকম হিউম্যান স্টোরি পেলে লিখে আমাকে দিও।

আচ্ছা

একটু চুপচাপ।

তারপর প্রসাদ বললেন, এখন তো কাজের কোনও প্রেসার নেই। পুর শিফট না থাকলেও চলবে। ইচ্ছে করলে বাড়ি চলে যেতে পার। নইলে- নিউজ ডিপার্টমেন্টের অন্য প্রান্তে সুধেন্দুরা যেখানে সাব-এডিটরদের সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছে সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন, নতুন নতুন অনেক ছেলে নিউজে জয়েন করেছে। যাও না, ওদের সঙ্গে আলাপ টালাপ করো। ওই তো সুধেন্ধুরাও রয়েছে–

বিনয়ের স্বভাবটাই এমন, যেচে কারও সঙ্গে মিশতে পারে না। কিন্তু একবার পরিচয় হয়ে গেলে বাধো বো ভাব আর থাকে না।

বিনয় বলল, রোজই তো অফিসে আসব। আস্তে আস্তে সবার সঙ্গে আলাপ হবে। আজ বাড়িই চলে যাই। আসলে এখন কিছুই ভাল লাগছে না। ঘুরে ফিরে নীলম আর ঝিনুক তার ভাবনায় হানা দিয়ে চলেছে।

ঠিক আছে। বলেই হঠাৎ প্রসাদের নজরে পড়ল, বিনয়ের পরনে ধুতি আর ফুলশার্টের ওপর উলের হাতকাটা সোয়েটার। শীতবস্ত্র বলতে মাত্র এটুকুই। বললেন, এবার বেশ শীত পড়েছে। ওইটুকু সোয়েটারে ঠেকানো যাবে না। কাল থেকে গরম চাদর নিয়ে এস।

বিনয় উঠে পড়েছিল। এই সময় রমেন ওদিক থেকে চলে এল। সে একাই এসেছে। বাকি দুজন চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সহজে সুধেন্দুরা ওখান থেকে নড়বে বলে মনে হয় না।

রমেন প্রসাদকে বলল, আমার একটা দরকারী কাজ আছে। আপনে পারমিশান দিলে চইলা যেতে পারি।

তক্ষুনি অনুমতি পাওয়া গেল।

এদিকে বিনয় নিউজ ডিপার্টমেন্ট পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নিচে নামছিল।

.

২৫.

অফিস থেকে বেরিয়ে টের পাওয়া গেল বাইরে তাপাঙ্ক দু-তিন ডিগ্রি কম। কনকনে উত্তরে হাওয়া শহরটাকে উলটো পালটা চাবুক মারতে মারতে ছুটে যাচ্ছে। হিম নামছে আকাশ থেকে। হিম উঠছে পাতাল থেকে। এখন কত আর রাত হবে? সাতটার বেশি নয়। এর মধ্যেই মানুষজন কমে গেছে, গাড়িঘোড়াও তেমন চোখে পড়ে না। কুয়াশা এমনভাবে চারপাশের আলোর টুটি চেপে ধরেছে যে সব কেমন যেন ঘোলাটে দেখায়।

বাস-স্ট্যান্ড অবধি যাবার আগেই পেছন থেকে ডাকটা শোনা গেল, বিনয়—

চমকে ঘুরে দাঁড়াতেই বিনয়ের চোখে পড়ল–রমেন। কাছে এসে সে বলল, বাড়ি যাচ্ছ তো?

হ্যাঁ।

কোথায় বাড়ি?

বিনয় জানিয়ে দিল, টালিগঞ্জে।

 এখান থেকে ধর্মতলায় গিয়ে বাস কি ট্রাম ধরলে তোমার সুবিধা হয়। তা এট্টু কষ্ট করবা?

বিনয় অবাক।–মানে?

রমেন বুঝিয়ে দিল। সে থাকে মির্জাপুরে। তাকে বিবেকানন্দ রোড ধরে একা একা হেঁটে কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে গিয়ে ট্রাম কি বাস ধরতে হবে। বিনয় তার দেশের ছেলে। সে যদি সঙ্গে থাকে, গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে গিয়ে দুনম্বর দোতলা বাস ধরলে তাদের দুজনেরই সুবিধা। রমেন মির্জাপুরের মুখে নেমে যাবে। আর বিনয় সোজা রাসবিহারী পর্যন্ত চলে যেতে পারবে। সেখান থেকে টালিগঞ্জের গণ্ডা গণ্ডা বাস কি ট্রাম পাওয়া যায়।

হিম-বাতাস জামাকাপড়-সোয়েটার ভেদ করে হাডেমজ্জায় হাজারটা ছুরির ফলা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বিনয় টের পাচ্ছে, শরীরের রক্ত-মাংস-ত্বক জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে গরম জলে হাত-পা-মুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়া চুকিয়ে কম্বল কি লেপের ভেতর ঢুকে পড়াটাই এখন একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু রমেন বয়সে বড়, সহকর্মী। তাছাড়া তার সঙ্গ পেতে সে এমন উৎসুক যে মুখের ওপর না বলা গেল না।

সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ থেকে ডাইনে ঘুরে ফাঁকা হয়ে আসা বিবেকানন্দ রোড ধরে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে নিমেষে বিনয় টের পেয়ে গেল, রমেন অন্যের কথা শোনার চেয়ে নিজের কথা বলতেই বেশি ভালবাসে। মিনিট চারেকের ভেতর তার জীবনের সত্তর শতাংশ জানা হয়ে যায় বিনয়ের।

রমেন বলে, আমি যে ঢাকার কাগজে রিপোর্টারি করতাম, হে তো শোনছই। মীরকাদিমের নাম জানো? ঢাকার পোলা যখন নিশ্চয়ই জানো। মুন্সিগঞ্জ স্টিমারঘাটা থিকা বড় জোর মাইল তিনেক। সেইখানে আমাগো বাড়ি। বাড়িতে থাকত বাবা, মা, এক ভাই, আঠার উনিশ বচ্ছরের এক ভগ্নী। আমি বি. এ পাস কইরা ঢাকার কাগজে চাকরি নিলাম। কামকাজ যেখানে করি সেইখানেই তো থাকা লাগব। নাকি? আমি ঢাকাতেই থাকতাম। অনর্গল বকে যায় সে।

মোটামুটি মসৃণভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল রমেনদের। শেষপর্যন্ত কাটল না। ছেচল্লিশে বড় দাঙ্গা। সাতচল্লিশে পার্টিশান। দেশভাগের পর রাতারাতি সব বদলাতে লাগল। সারাক্ষণ আতঙ্ক। সারাক্ষণ অবিশ্বাস।

একদিন পূর্ব পাকিস্তানের অন্য সব এলাকার মতো মীরকাদিমেও ভাঙন শুরু হল। দেশে আর থাকতে সাহস হয় নি। ভিটেমাটি ফেলে প্রথমে তারা চলে এসেছিল আগরতলায়। মা-বাবা-ভাই-বোনকে ওখানকারই এক ত্রাণশিবিরে রেখে রমেন সোজা চলে এল কলকাতায়। অনার্স গ্র্যাজুয়েট। উদ্বাস্তু। যে কোনও সরকারি দপ্তরে তার চাকরি হয়ে যেত। কিন্তু একবার যার শ্বাসপ্রশ্বাসে খবরের কাগজ ঢুকে গেছে তার কি অন্য কাজ মনে লাগে? মির্জাপুরের মেসে কয়েক মাস থেকেও একাগজ সেকাগজ ঘোরাঘুরি করে, একে তাকে ধরাধরি করেও কিছু না পেয়ে যখন হতাশ হয়ে পড়েছে, তখন মরিয়া হয়ে জগদীশ গুহঠাকুরতার সঙ্গে দেখা করে এবং নতুন ভারত-এর কাজটা হয়ে যায়।

রমেন বলে, থাউক এই সব প্যাচাল। প্রায় প্রতিটি রিফিউজির একই হিস্টোরি।

কীভাবে রমেনের চাকরি হয়েছে, দুপুরে তারাপদ ভৌমিকের কামরায় বসে একবার শুনেছে বিনয়। ফের শুনতে হল। সে কোনও উত্তর দেয় না। সে পাকিস্তান থেকে কবে এসেছে, কী কারণে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে, এ-সব সম্বন্ধে লেশমাত্র আগ্রহ নেই রমেনের। এ নিয়ে কিছু জানতেও চায় না সে।

কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটার পর আচমকা রমেন জিজ্ঞেস করে, নতুন ভারত-এ তোমার কাজটা হইল কী করে?

বিনয় সরল মনে সব জানিয়ে দেয়।

রমেন একটু থতিয়ে যায়। তারপর বলে, জগদীশবাবু তোমার ভগ্নীপতিরে খাতির করেন। তোমার খুটির জোর জবর। বলেই খেয়াল হয় এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। দ্রুত সামলে নিল সে, অবশ্য নিউজ এডিটর আর চিফ রিপোর্টার তোমার লেখার খুব প্রেইজ করতে আছিলেন। তবু

তবু কী?

আমার উপুর কিন্তু অবিচার হইল বিনয়।

রমেনের কথাগুলোর আগামাথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কে অবিচার করল, কীভাবে করল, কেন করল, ভেবে তলকূল পায় না বিনয়। তবে এটুকু আঁচ করতে পারে, লোকটার মধ্যে কোনও কারণে ক্ষোভ জমে আছে।

রমেন এবার বলে, আমি একজন পাক্কা রিপোর্টার। সাত-আট বচ্ছর কাজের এক্সপিরিয়েন্স রইছে আমার। এই মুহূর্তে ইন্ডিয়ার সব থিকা জ্বলন্ত প্রবলেম হইল রিফিউজি প্রবলেম। এই অ্যাসাইনমেন্ট গুলা আমার মতো অভিজ্ঞ সাংবাদিকরে না দিয়া কি না তোমারে দিলেন তারাপদদা, প্রসাদদা! তোমার লেখার হাত ভাল হইতে পারে কিন্তু এক্সপিরিন্সে? সেইটা তো আর নাই। এই লাইনে তুমি একেবারে নূতন।

ঝুলির ভেতর থেকে এতক্ষণে বেড়ালটি বেরিয়ে পড়েছে। সাব-এডিটরদের টেবলের আড্ডা ছেড়ে কেন রমেন চলে এসেছিল, কেন তাকে কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তা এখন বিনয়ের কাছে মোটামুটি স্পষ্ট। উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে লেখালেখির দায়িত্ব তাকে দেওয়াতে রমেন খুশি হতে পারেনি।

 ওরা কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের ক্রসিংয়ে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা দুনম্বর রুটের ডবল ডেকার এসে পড়ল। বিনয়রা উঠে সোজা একতলায় ঢুকে যায়।

বাসটা একরকম ফাঁকাই। এধারে ওধারে অল্প কটি প্যাসেঞ্জার চাদর, কম্ফোর্টার বা ফুলহাতা সোয়েটার আর মাঙ্কি ক্যাপের ভেতর জড়সড় হয়ে বসে আছে।

রমেন আর বিনয় মুখোমুখি সিটে বসেছে। জানালা টানালা সব বন্ধ। বাস হিমবাতাস আর শীতের কুয়াশা কুঁড়ে কুঁড়ে দৌড়চ্ছে। উধ্বশ্বাসে।

রমেন বলল, এখন সারা দ্যাশের নজর রিফিউজিগো উপুর। যে তাগো নিয়ে লেখবে তারই নামডাক হয়ে যাবে। একটা উপকার করবা ভাই?

লোকটার যে কিছু একটা মতলব আছে, সে যে খুব সাদাসাপটা মানুষ নয়, ধীরে ধীরে টের পাচ্ছিল বিনয়। তার স্নায়ুগুলো সতর্ক হয়ে উঠল। কী উপকার?

তুমি রিফিউজিগো ব্যাপারটা আমারে ছেড়ে দাও—

 রমেনের চোখেমুখে, গলার স্বরে কাকুতি মিনতি।

কিছুক্ষণ হতবাক তাকিয়ে থাকে বিনয়। রমেনের উদ্দেশ্যটা এখন জলের মতো পরিষ্কার। উদ্বাস্তুদের নিয়ে লিখলে তার সুনাম হবে, সাংবাদিক হিসেবে কলকাতায় সে প্রতিষ্ঠা পাবে। সেজন্য বিনয়ের হাতের মুঠোয় অযাচিতভাবে যে সুবর্ণ সুযোগটা এসেছে সেটা তাকে ছেড়ে দিতে হবে।

বিনয়ের ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ তাকে রূঢ় হতে দেয় না। সে জিজ্ঞেস করে, আমাকে একটা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেটা কীভাবে ছাড়ব?

তার পথ আছে।

কী পথ?

তুমি তারাপদদা আর প্রসাদদারে বলবা, রিফিউজির ব্যাপারটা খুব ডিফিকাল্ট। তোমারে যেন ওনারা অন্য অ্যাসাইনম্যান্ট দ্যান

খুব ঠাণ্ডা গলায় বিনয় বলল, আমার পক্ষে ওঁদের বলা সম্ভব নয়। আমাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছে আমি সেটাই করব–

ও-ও- মুখটা কালো হয়ে যায় রমেনের।

এরপর অদ্ভুত নীরবতা। মির্জাপুরের মুখের স্টপেজটায় বাস এসে থামতেই নেমে যায় রমেন। কোনও কথা তো বলেই না, বিনয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না।

আজ অফিসের প্রথম দিনটা চমৎকার কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ষোল আনা ভাল বলে বোধহয় কিছু হয় না। এই মুহূর্তে রমেন তার মন তিক্ততায় ভরে দিয়ে গেছে। স্বার্থপর, ঈর্ষাকাতর এই লোকটা সম্পর্কে তাকে ভবিষ্যতে সাবধান থাকতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *