১৬-২০. হিমঋতুর কুয়াশা

১৬.

এখন আটটার মতো বাজে। গাঢ় হয়ে নামছে হিমঋতুর কুয়াশা। উত্তুরে হাওয়া সাঁই সাঁই চাবুক হাঁকাতে হাঁকাতে শহরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। কর্পোরেশনের টিমটিমে বাতিগুলো বড় বেশি নিস্তেজ। কুয়াশা সেগুলোকে চারপাশ থেকে ঠেসে ধরেছে।

এর মধ্যেই এলাকার দোকানপাটে ঝাঁপ পড়ে গেছে। দুএকটা পানবিড়ি আর চায়ের দোকান এবং একটা খালসা হোটেল এখনও খোলা রয়েছে। শীত-গ্রীষ্ম বারোমাস ওগুলো মাঝরাত পর্যন্ত চালু থাকে। তবে তীব্র শীতল বাতাসকে রুখে দেবার জন্য দুধারের বাড়িগুলোর দরজা-জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় লোকজন খুব কম। মাঝে মাঝে কঁকা ড্রাম কি পাবলিক বাস ঘন্টি বাজাতে বাজাতে চলে যাচ্ছে।

বিনয় বড় রাস্তা থেকে জাফর শা রোডে চলে আসে। সুধাদের বাড়ির সদর দরজায় কিছুক্ষণ কড়া নাড়তে ওপর থেকে উমা নেমে এসে সেটা খুলে দিল। সে ভেতরে ঢুকতেই দরজায় খিল লাগাতে লাগাতে উমা বলল, দাদাবাবু, ওপরে গিয়ে দেখ, কারা এসেছে

বিনয় জিজ্ঞেস করল, কারা রে?

 উমা নামটাম জানালো না। বলল, তর সইছে না বুঝি? ওপরে যাও। দেখতে পাবে।

দোতলায় আসতেই বাইরের ঘরে হিরণ এবং সুধা ছাড়া আরও দুজন চেনা মানুষের দেখা পাওয়া গেল। হিরণের ঠাকুরদা দ্বারিক দত্ত আর তার জেঠিমা সরস্বতী।

কদিন আগে হিরণ পাটনায় টেলিগ্রাম করেছিল। শওকত আলি তাঁদের টালিগঞ্জের বিষয় সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ করে পাকিস্তানে হিরণদের বাড়িতে চলে যাবার জন্য ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছেন। হিরণরা যদি গড়িমসি করে কিংবা কোনও কারণে দেরি করে ফেলে, তিনি অন্য ব্যবস্থা করবেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে রোজ ঝুঁকে ঝাঁকে মানুষ এপারে চলে আসছে। প্রপার্টি বিনিময় করার জন্য তারা হন্যে হয়ে ঘুরছে। দালালরা রোজই এই ধরনের দুচারটে করে খদ্দেরের খবর শওকত আলির কাছে নিয়ে আসছে। তিনি দুসপ্তাহের বেশি অপেক্ষা করবেন না।

টেলিগ্রাম পেয়ে আজই যে দ্বারিক দত্তরা চলে আসবেন, ভাবতে পারেনি বিনয়। লক্ষ করল, বয়সের তুলনায় বৃদ্ধ মানুষটি অনেক বেশি শক্তপোক্ত আছেন। সরস্বতী কম করে তার চেয়ে বিশ বছরের ছোট। সবে পঞ্চাশ পেরিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যেই অথর্ব, লুজবুজে হয়ে পড়েছেন।

সবাই মোটা পশমি চাদর জড়িয়ে বসে গল্প করছিলেন। দ্বারিক দত্তকে রাজদিয়ায় থাকতে কতবার দেখেছে বিনয়। মানুষটার এক সময় ছিল ভীষণ মজলিশি মেজাজ, হইহই করে দিন কাটাতে ভালবাসতেন। বয়স তার পুরানো স্বভাব পুরোপুরি হরণ করতে পারেনি। বিনয়কে দেখে খুব খুশি হলেন। গলার স্বর উঁচুতে তুলে বললেন, আয় আয়, আমার পাশে বো–

বিনয় দ্বারিক দত্ত আর সরস্বতীকে প্রণাম করে ওঁদের কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসল। জিজ্ঞেস করল, কখন এসেছেন আপনারা?

দুপুরবেলায়। এসেই শুনলাম যুগলরা যেখানে কলোনি বসিয়েছে সেই মুকুন্দপুরে গেছিস। কতকাল পর যে তোকে দেখলাম–

সরস্বতীও দুর্বল স্বরে তার কথায় সায় দিয়ে বললেন, তোর আশায় পথের দিকে তাকিয়ে বসে আছি।

এই বৃদ্ধ মানুষ দুটির আন্তরিকতা বুকের ভেতরটা ছুঁয়ে গেল বিনয়ের। সে জিজ্ঞেস করল, কে আপনাদের নিয়ে এল?

দ্বারিক দত্ত জানালেন, পাটনায় যে ভাইপোর বাড়িতে গিয়েছিলেন সেই অজিত তাঁদের পৌঁছে দিয়ে সন্ধের ট্রেনে ফিরে গেছে। তার অফিসের প্রচণ্ড জরুরি কাজ। দুচারদিন যে কলকাতায় কাটিয়ে যাবে, তার উপায় নেই। বিনয়ের সঙ্গে এবার দেখা হল না বলে খুব আক্ষেপ করে গেছে অজিত। তার ইচ্ছা, বড়দিনে কলকাতায় আসবে। তখন অন্তত সপ্তাহখানেক থেকে যাবে।

এরপর মুকুন্দপুর নিয়ে কিছু কথাবার্তা হল। অনেকদিন আগে দ্বারিক দত্ত পাকিস্তান থেকে চলে এসেছেন কলকাতায়। যুগলের সব খবরই তার জানা। পূর্ব বাংলার নিরক্ষর, সামান্য এক কামলা ময়দানবের উদ্যম নিয়ে নির্জন বনভূমি সাফ করে জনপদ বানিয়েছে–এতে তিনি চমৎকৃত। আশু দত্ত কলোনিতে গিয়ে স্কুল বসাবেন, শুনে খুশি হলেন।

কিছুক্ষণ নীরবতা।

তারপর জোরে শ্বাস ফেলে দ্বারিক দত্ত বললেন, ত্রৈলোক্য সেনরা, রামকেশবরা, আশু দত্তরা রাজদিয়া ফাঁকা করে সবাই চলে এল। শুধু হেমদাদা বাদ। জেনে শুনে মরণের ওষুধ কেউ কানে বাঁধে! পাকিস্তানে কেউ থাকতে পারবে না, এই বোধবুদ্ধিটুকু পর্যন্ত নেই!

বিনয় উত্তর দিল না। কী বলবে সে? নিত্য দাসকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে কত বোঝানো হয়েছে হেমনাথকে। কিন্তু কোনও কথা শুনবেন না তিনি। সৎ পরামর্শ দিলে উড়িয়ে দেবেন। পুরোপুরি অবুঝ। একগুঁয়ে। অপরিণামদর্শী।

একসময় খুব ভারী গলায় দ্বারিক দত্ত বললেন, পাটনা থেকে এসে একটা খুব খারাপ খবর শুনলাম বিনু

সচকিত বিনয় জিজ্ঞেস করে, কী খবর দাদু? দ্বারিক দত্ত হিরণের ঠাকুরদা। সেই সুবাদে তারও দাদু।

দ্বারিক দত্ত বললেন, ঝিনুক নাকি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। তোর বাবা, সুনীতির শাশুড়ি, সবাই ওর সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার করেছে। কিন্তু কী অপরাধ মেয়েটার?

সরস্বতী ধরা ধরা, ভাঙা গলায় বললেন, সারা জীবন দুঃখই পেল ঝিনুক। আমরা কলকাতায় থাকলে ওকে কোথাও যেতে দিতাম না। নিজেদের কাছে রেখে দিতাম।

 স্তব্ধ হয়ে দুটি বৃদ্ধ মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়। বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। গলার কাছটা থির থির কাঁপছে। বাষ্পে ভরে যাচ্ছে দুচোখ।

এই মানুষ দুটি সম্পর্কে কত সংশয় ছিল বিনয়ের। কী নিদারুণ উৎকণ্ঠা! ভেবেছিল, ঝিনুককে দেখামাত্র দূর করে দেবেন ওঁরা। তীব্র ঘৃণায়। অপরিসীম বিতৃষ্ণায়।

বিনয় ভাবল, মাত্র কটা দিন আগে যদি দ্বারিক দত্তদের সঙ্গে দেখা হতো!

 দ্বারিক দত্ত বললেন, যেমন করে পারিস মেয়েটাকে খুঁজে বার করে আমাদের কাছে নিয়ে আয়।

দুহাতে মুখ ঢেকে জোরে জোরে মাথা নাড়তে থাকে বিনয়, অনেক খুঁজেছি। ওকে পাওয়া। যাবে না।

আমার মন বলছে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। ভাল করে চেষ্টা কর–

সুধা আর হিরণ তো প্রথম থেকেই তার পাশে রয়েছে। আজ আরও দুজনকে পাওয়া গেল। সমস্ত নৈরাশ্য দুহাতে ঠেলে সরিয়ে নতুন উদ্যমে ঝিনুকের খোঁজে আবার তাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। যদি সে বেঁচে থাকে, পৃথিবীর যে প্রান্তেই গিয়ে থাক, তাকে নিয়ে আসবে। আসবেই।

.

১৭.

খান মঞ্জিল-এর সঙ্গে রাজদিয়ার বিষয়সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ করার যে ব্যবস্থা হিরণ করে ফেলেছে তাতে প্রথমেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন দ্বারিক দত্ত। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অযাচিতভাবে যে সুযোগটা পাওয়া গেছে সেটা হাতছাড়া করলে বাকি জীবন আপশোশ করে কাটাতে হবে। পাকিস্তানে ফিরে যাবার আর সম্ভাবনা নেই। সেখানকার ফেলে-আসা বাড়িঘর জমিজমা পুরোপুরি বেহাত হয়ে যেত। রাজাকার বা ইন্ডিয়া থেকে চলে-যাওয়া বিহারী মুসলমানরা একবার সে-সব দখল করে বসলে কে তাদের কবল থেকে তা উদ্ধার করবে? কলকাতায় থেকে ওদের চুলের ডগাও ছোঁওয়া যাবে না। কেউ যদি দখল করে নাও নেয়, অন্যদিক থেকে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা রয়েছে। হাওয়ায় হাওয়ায় এখন একটাই গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তান গভর্নমেন্ট খুব তাড়াতাড়িই হিন্দুদের ফাঁকা বাড়ি-টাড়ি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করবে। তাহলে সব আশায় জলাঞ্জলি। এই অবস্থায় পাকিস্তানের বাড়িঘরের বদলে যদি কলকাতায় একখানা বাড়ি পাওয়া যায়, এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে?

দ্বারিক দত্তর যুক্তি হল, তার তত তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। কদিন আর বাঁচবেন? কিন্তু হিরণ আর সুধার সামনে অনন্ত ভবিষ্যৎ। হিরণ ভাল চাকরি করে ঠিকই কিন্তু তার পক্ষে সংসার চালিয়ে কলকাতায় একটা বাড়ি করা কি মুখের কথা। তাঁর মতে খান মঞ্জিল নেওয়াটা খুবই বুদ্ধিমানের কাজ।

কিন্তু মুসলমানের সম্পত্তি বলে ভীষণ আপত্তি ছিল সুধা এবং হিরণের জেঠিমা সরস্বতীর। সুধাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করানো গেলেও, সরস্বতী ঘাড় বাঁকিয়ে ছিলেন। পাটনা থেকে ফিরে আসার পর দ্বারিক দত্ত, হিরণ আর বিনয় পুরো দেড় দিনের অবিরল চেষ্টায় তার মস্তিষ্কে শেষ পর্যন্ত এটা প্রবেশ করিয়ে দিতে পেরেছে যে এমন সুযোগ হেলায় হারানো ঠিক হবে না। মুসলমানের সম্পত্তি বলে দোষটা কোথায়? সম্পত্তি সম্পত্তিই। তাছাড়া শওকত আলিরা তো তাঁদের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকছেন না। অবশেষে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি মত দিয়েছেন।

কিন্তু হিরণ ছাড়া বাড়ির অন্য কেউ খান মঞ্জিল দেখেনি। অবশ্য বিনয় রাজদিয়া থেকে চলে আসার পর একদিন হিরণ তাকে বাইরে থেকে বাড়িটা দেখিয়ে এনেছিল। দ্বারিক দত্তরা দেখেননি, তার কারণ শওকত আলির সঙ্গে যখন এক্সচেঞ্জের কথা হচ্ছে সেইসময় দ্বারিক দত্ত আর সরস্বতী পাটনা চলে গেলেন। ওঁদের বাদ দিয়ে সুধা বাড়িটা দেখতে যেতে চায়নি। যা দেখার হিরণই দেখে এসেছে।

সরস্বতীকে রাজি করানোর পর দ্বারিক দত্ত বলেছিলেন, এক্সচেঞ্জ করে কেমন বাড়ি পাওয়া যাবে, সেটা একবার দেখাবি না হিরণ?

হিরণ বলেছে, নিশ্চয়ই। সে শওকত আলিকে খবর পাঠিয়েছিল, দ্বারিক দত্তরা পাটনা থেকে ফিরে এসেছেন। যেদিন তিনি এক্সচেঞ্জ করতে চাইবেন সেদিনই তা করা হবে। তবে দাদুরা একবার খান মঞ্জিল দেখতে চান। শওকত আলি যদি দেখাবার ব্যবস্থা করেন সে কৃতজ্ঞ থাকবে।

শওকত আলি তাঁর একটি লোককে দিয়ে খান মঞ্জিল-এর চাবি এবং একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল, চারদিন পর বিনিময়ের যাবতীয় ব্যবস্থা করে ফেলা হবে। তিনি একজন অ্যাডভোকেটকে নিয়ে হিরণদের বাড়ি আসবেন। হিরণও যেন তার উকিলকে সেই সময় থাকতে বলে। এক্সচেঞ্জের প্রক্রিয়া নিখুঁত হল কিনা দুই আইনজ্ঞ সেটা খুঁটিয়ে দেখবেন।

আজ রবিবার। ঠিক হল, বেলা খানিকটা চড়লে, দিনের তাপাঙ্ক বাড়লে খান মঞ্জিল দেখতে যাওয়া হবে। সবাই যেতে রাজি হলেও, সরস্বতী পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, যাবেন না। বাড়িটা সারিয়ে সুরিয়ে, ভোল পালটে যেদিন পুজোটুজো দিয়ে শুদ্ধিকরণ করা হবে, সেদিন যাবেন। তার আগে নয়। রক্তের মধ্যে বদ্ধমূল সংস্কার কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তিনি। এ-জীবনে বুঝিবা তা আর সম্ভব হবে না।

অগত্যা দুটো রিকশা ডেকে দ্বারিক দত্ত, হিরণ, সুধা আর বিনয় বেরিয়ে পড়ল। বিনয় এবং হিরণ বসেছে একটা রিকশায়। অন্যটায় দ্বারিক দত্ত আর সুধা।

হিমঋতুর বাতাস বয়ে যাচ্ছে ধীর লয়ে। কুয়াশা কেটে গেছে। রোদের তেজ কিছুটা বাড়ায় ঠাণ্ডাটা সেভাবে গায়ে বিধছে না। শীতের দিন হলেও ঝলমলে আলোয় ভরে আছে চারদিক।

জাফর শা রোড থেকে বেরিয়ে নানা অলিগলির ভেতর দিয়ে ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে দুই রিকশা। একটার পেছনে আর-একটা।

সপ্তাহ কয়েক আগে এই এলাকায় হিরণের সঙ্গে বাজার ফেরত একবার এসেছিল বিনয়। দুধারের গরিব মুসলমানদের বস্তিগুলোতে সেই পরিচিত দৃশ্য। অগুনতি বাচ্চা কাচ্চা ছুটোছুটি করছে। তুমুল হইচই। তাদের সঙ্গে রয়েছে একপাল মুরগি আর রাস্তার নেড়ি কুকুর। খাঁটিয়া পেতে বয়স্ক কিছু পুরুষ ময়লা কাথা বা ধুসো কম্বল গায়ে জড়িয়ে রোদ থেকে উত্তাপ শুষে নিচ্ছে। এখানে পর্দার কড়াকড়ি নেই। সেদিনের মতো আজও দেখা গেল, দূর থেকে নানা বয়সের অনেকগুলো মেয়েমানুষ তাদের লক্ষ করছে। এখানকার বাসিন্দাদের চোখেমুখে যতটা কৌতূহল, তার চেয়ে উদ্বেগ এবং অস্বস্তি অনেক বেশি। হিরণের কাছে বিনয় শুনেছিল, ছেচল্লিশের ডাইরেক্ট অ্যাকশনের দিন এই-সব বস্তি থেকে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান স্লোগান দিতে দিতে লম্বা মিছিল গড়ের মাঠের দিকে গিয়েছিল। যে নেতারা একদিন এদের উসকে দিয়েছিল, ইন্ডিয়াকে দুটুকরো করে মুসলমানদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা একটি রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য গরম গরম বুলিতে রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে লটবহর গুছিয়ে সীমান্তের ওপারে তারা উধাও হয়েছে। পড়ে আছে এইসব হা-ভাতে গরিব মানুষের দঙ্গল। এই সেদিন গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ঘটে গেছে। কলকাতা শহর হয়ে উঠেছিল নিদারুণ এক বধ্যভূমি। চারদিকে শুধু হত্যা। আগুন। অবিরল রক্তপাত। রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহের পাহাড়। সেদিনের ভয়াবহ দাঙ্গা কারও স্মৃতি থেকে এখনও বিলীন হয়ে যায়নি। বরং দগদগে ক্ষতের মতো টাটকা। এইসব বস্তির বাসিন্দারা হয়তো ভাবে, চারপাশের মানুষ সারাক্ষণ অস্ত্রে শান দিচ্ছে। তাই ভয়। তাই শঙ্কা। তাই উৎকণ্ঠা।

হিরণ বলেছিল, পার্টিশানের পর এই এলাকা থেকে অনেকেই চলে গেছে। এখনও যাচ্ছে। কেউ পূর্ব পাকিস্তানে। কেউ পশ্চিম পাকিস্তানে। কিন্তু বস্তির এই মানুষগুলো ঘাড় গুঁজে এখানেই পড়ে আছে।

নতুন দেশে গিয়ে কোথায় আশ্রয় পাবে, কী করবে, কী খাবে, কিছুই জানা নেই। হয়তো সেখানে গেলে আরও বড় কোনও সংকটের মধ্যে পড়তে হবে। কিন্তু এই টালিগঞ্জ তাদের পরিচিত জায়গা। কয়েক পুরুষ ধরে তারা এখানে বাস করে আসছে। দেশভাগের পর ভয়ে ভয়ে তাদের দিন কাটছে। রয়েছে প্রবল দুর্ভাবনা। তবু এই এলাকা ছেড়ে তারা চলে যেতে পারেনি।

চাপ-বাঁধা বস্তিগুলোর পর আরও কটা অলিগলি পেরিয়ে একটা বেশ চওড়া রাস্তায় এসে পড়ল বিনয়রা। ডান পাশে মিনিট খানেক যেতেই খান মঞ্জিল। হিরণ রিকশাওলাকে বলল, এখানে থামো–

রিকশা দাঁড়িয়ে পড়ল। সুধারা পেছন পেছন আসছিল। তাদের রিকশাও থেমে গেল।

 হিরণ বলল, আমরা এসে গেছি। সবাই নেমে পড়।

বিনয় লক্ষ করল, সেদিনের মতো আশেপাশের কটা বাড়ির জানালায় আজও বেশ কিছু কৌতূহলী মুখ। পুরুষ কম। মেয়েরাই বেশি। কিশোরী থেকে মধ্যবয়সিনী। উৎসুক দৃষ্টিতে তারা বিনয়দের দেখছে।

দ্বারিক দত্তকে ধরে ধরে নামিয়ে এনেছিল সুধা। ভাড়া মিটিয়ে বিনয় সবাইকে নিয়ে খান মঞ্জিল এর গেটের সামনে চলে এল।

মস্ত লোহার ফটকের পাশে বাউন্ডারি ওয়ালের গায়ে শ্বেত পাথরের ফলকে বাড়িটার নাম এবং প্রতিষ্ঠার বছর বড় বড় কালো হরফে লেখা রয়েছে। দ্বারিক দত্তর চোখ ফলকটায় আটকে গেল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেটা পড়ে হিরণকে জিজ্ঞেস করলেন, এক্সচেঞ্জ করার পর বাড়ির নাম খান মঞ্জিলই থাকবে না কি?

হিরণ শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে, না না, বাড়িটা তখন আমাদের হয়ে যাবে। পছন্দমতো একটা নাম দেব। কদিন আগে বিনুকে বাড়িটা দেখাতে এনে সেই কথাই বলেছি।

কী নাম দিতে চাস?

সেটা তোমাদের সবার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করব।

 দ্বারিক দত্ত খুশি হলেন, হ্যাঁ, ভেবে চিন্তে একটা সুন্দর নাম দিতে হবে।

গেটের দুটো পাল্লা শেকল দিয়ে আটকে তালা লাগানো ছিল। তালা খুলে সকলকে সঙ্গে করে ভেতরে ঢুকে পড়ল হিরণ।

সেকেলে ধাঁচের তেতলা বাড়িটা মাঝখানে। সেটাকে ঘিরে চারপাশে অনেকটা করে ফাঁকা জায়গা। এককালে সামনের দিকে বাগান ছিল। এখন মানুষজন থাকে না। যত্ন নেই। পরিচর্যা নেই। ফুলের গাছগুলো শুকিয়ে কাঠিসার। নানা ধরনের বাহারি লতা ছিল। সব দড়ি পাকিয়ে গেছে। পাতাবাহার গাছ, ঝাউ গাছ, কোনওটাই সতেজ নেই। সেগুলোরও মরণদশা।

হিরণ সুধা আর দ্বারিক দত্তকে জিজ্ঞেস করল, আগে বাড়ির ভেতরে যাবে, নাকি চারপাশ দেখে নেবে?

সুধারা জানায়, চারদিক দেখার পর মূল বাড়িতে ঢুকবে।

চল–

বাড়িটার দুধারে এবং সামনে পেছনে এক চক্কর ঘোরা হল। দুপাশে লাইন দিয়ে দেবদারু গাছ। সেগুলোও মলিন। ম্রিয়মাণ। বাড়ির সামনের অংশের মতো পেছনেও বেশ বড় বাগান। সেখানকার গাছগুলোর একই হাল। একধারে একটা গ্যারাজ আর ঘোড়ার আস্তাবল রয়েছে। এসব এ-বাড়ির সুখের দিনের স্মৃতিচিহ্ন। শওকত আলির বাবা রহমত আলি ছিলেন বাঘা উকিল। বিপুল পশার ছিল তার। সেই সময় একটা অস্টিন গাড়ি, ফিটন আর ঘোড়া কিনেছিলেন। এখন গাড়ি ঘোড়া কিছুই নেই। গ্যারাজ, আস্তাবল ফাঁকা পড়ে আছে।

চারপাশ দেখানোর পর তালা খুলে মূল বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল হিরণরা। বিনয় সেদিন বাইরে থেকে দেখে গিয়েছিল। বাইরেটা সাদামাঠা, সাবেক ধাঁচের হলেও ভেতরটা চমৎকার। একতলা থেকে তিনতলা, সমস্ত ঘরের মেঝে, বারান্দা, সিঁড়ি, সবেতেই শ্বেত পাথর বসানো। সিলিংয়ে পঙ্খের সুন্দর সুন্দর নকশা। চওড়া চওড়া দেওয়াল। প্রতিটি জানালায় দুটো করে পাল্লা। একটা রঙিন কাঁচের। অন্যটা কাঠের খড়খড়ি। সেগুন কাঠের পুরু দরজাগুলোতে কত রকমের কারুকাজ। ওঠানামার সিঁড়ির ধারে কাঠের রেলিংয়ের ওপর পেতলের পাত বসান। প্রতিটি ঘর বার্মা টিকের ভারী ভারী আসবাবে বোঝাই। খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবল, চেয়ার, কুশন ইত্যাদি রকমারি জিনিস।

ছাদটাও ঘুরে ঘুরে দেখা হল। কার্নিস কোথাও কোথাও ভেঙে গেছে। রেন-ওয়াটার পাইপের মুখে ফাটল। সমস্ত দেখা হয়ে গেলে প্রতিটি ঘরে তালা লাগিয়ে নিচে নামতে নামতে হিরণ সবাইকে জিজ্ঞেস করল, কেমন দেখলে বাড়িটা?

দ্বারিক দত্ত তারিফের সুরে বললেন, খাসা। আমাদের রাজদিয়ার বাড়িঘর আর জমিজমার সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করে কলকাতায় এমন একটা বিল্ডিং পাওয়া যাবে, ভাবতেই পারিনি। এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থা করে খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছিস হিরণ। খান মঞ্জিল হাতছাড়া হলে পস্তাতে হতো। দক্ষিণ আর পুব দিকটা পুরো খোলা। আলো হাওয়ার কোনওদিন অভাব হবে না। তা ছাড়া

কী?

দেখে টেখে মনে হল, বাড়িটা ভীষণ মজবুত। যেটুকু মেরামতি দরকার, তাতে খুব একটা খরচ হবে না। তবে রান্নাঘর টর ভেঙে নতুন করে বানাতে হবে।

ইঙ্গিতটা ধরে ফেলেছিল হিরণ। বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

সুধা বলল, পুরো বাড়িটার ভেতরে বাইরে রং করাতে হবে। নইলে জেঠিমাকে এখানে আনা যাবে না।

হিরণ বলল, রংও করাব। বিল্ডিংটার ভোল এমন পালটে দেব যে চিনতেই পারবে না। মনে হবে একেবারে নতুন।

হঠাৎ কী মনে পড়ে যাওয়ায় চিন্তাগ্রস্তের মতো সুধা বলে উঠল, কিন্তু

আবার কী?

 এ-বাড়িতে যে খাট আলমারি টালমারি রয়েছে সেগুলোর কী হবে?

এদিকটা আগে ভেবে দেখেনি হিরণ। কী উত্তর দেবে, ঠিক করে উঠতে পারল না।

সুধা থামেনি, এ-সব ফার্নিচার আমরা কিছুতেই ব্যবহার করব না।

হিরণের মাথাতেও আসবাবগুলোর চিন্তা পাক খাচ্ছিল। চকিতে সমস্যার একটা সমাধানও সে পেয়ে গেল। বলল, শওকত সাহেবকে তার খাট টাট নিয়ে যেতে বলব।

সেই ভাল। নিজেদের জিনিস ওরা নিয়ে যাক।

.

বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেটে তালা লাগিয়ে রাস্তায় চলে এল বিনয়রা।

যে রিকশা দুটোয় চড়ে তারা এখানে এসেছিল, কোথাও তাদের দেখা পেল না। ভাড়া বুঝে নিয়ে ওরা চলে গেছে।

এখানকার কাজ শেষ। খান মঞ্জিল দেখে সুধা এবং দ্বারিক দত্ত দুজনেই খুশি। দ্বারিক দত্ত তো উচ্ছ্বসিতুই হয়ে উঠেছেন। বেশ ভালই লাগছে হিরণের।

এবার ফেরার পালা। সেই দুটো রিকশা না থাকলেও ডান পাশে খানিক দূরে একটা ডালপালাওলা ঝকড়া রেন-ট্রির তলায় রিকশা স্ট্যান্ড চোখে পড়ল হিরণের। পাঁচ ছটা গাড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত নেড়ে তাদের ডাকতে যাচ্ছিল, বাধা পড়ল।

দ্বারিক দত্ত বললেন, এখন বাড়ি যাব না। রিকশা ডাকিস না।

হিরণ অবাক হল, কী করবে এখানে থেকে?

বাড়ি তো ভালই জোগাড় করেছিস। তবে আশেপাশের লোকজন, পরিবেশ কেমন, সেটা একটু বুঝবার চেষ্টা করি। প্রতিবেশী ভাল না হলে বড় অশান্তি।

দ্বারিক দত্তর মনোভাবটা পরিষ্কার। হিরণ বলল, তুমি কি বাড়ি বাড়ি গিয়ে এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জিজ্ঞেস করবে, মশায় আপনারা মানুষ কেমন? কথায় কথায় কি ঝামেলা বাধান, না শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক?

দ্বারিক দত্ত হেসে ফেললেন, আরে বাবা, কারও বাড়িতেই আমি ঢুকব না। দুনিয়ায় কতকাল বেঁচে আছি! বয়েস আর এক্সপিরিয়েন্স তো কম হল না। মানুষের মুখ দেখলে তার চরিত্র কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারি। কোথাও গেলে, সেই জায়গাটা কেমন, ভাল না মন্দ, তার গন্ধ পাই।

হিরণ এ নিয়ে কথা বাড়াল না। বলল, কোন দিকে যাবে, বল–।

এধারে ওধারে তাকিয়ে দ্বারিক দত্ত বললেন, বাঁ দিকটায় চল ওই দিকটায় অনেকগুলো দোতলা তেতলা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার ওপারেও বেশ কিছু দালানকোঠা। দূরে একটা মাজার চোখে পড়ছে।

হাঁটতে হাঁটতে সব লক্ষ করছিলেন দ্বারিক দত্ত। বললেন, এখানে হিন্দুদের বাড়ি খুব কম– তাই না?

হিরণ বলল, আগে এই এরিয়ায় টেন পারসেন্টের মতো হিন্দু ছিল। এখন প্রায় সেভেন্টি পারসেন্ট। যত বাড়ি দেখছ তার বেশির ভাগই এখানকার মুসলিমরা, এক্সচেঞ্জ করে বা বেচে পাকিস্তানে চলে গেছে। বাকি যারা রয়েছে তারাও অনেকে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে আছে।

ও।

আগেই রাস্তার ধারের বাড়িগুলোর জানালায় জানালায় সারি সারি উৎসুক মুখ দেখা গিয়েছিল। এখনও তারা অপার কৌতূহলে তাকিয়ে আছে। কী উদ্দেশ্যে বিনয়রা এ-পাড়ায় এসেছে, সেটা আঁচ করে নিতে চাইছে।

বাঁ পাশের তিন চারটে উঁচু বাড়ি পেরিয়ে যাবার পর একটা দোতলার সামনে আসতে দেখা গেল, গেটের কাছে একজন প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে ধুতি আর পাঞ্জাবির ওপর গরম পশমি চাদর জড়ানো। পায়ে চটি।

টকটকে রং ভদ্রলোকের। ধারালো নাক। বড় বড় চোখ। চওড়া কপাল। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হলেও বেশির ভাগ চুলই কুচকুচে কালো। অল্পই পেকেছে। সব মিলিয়ে বেশ সুপুরুষ। কিন্তু চোখের তলায় গাঢ় কালির ছোপ। সমস্ত চেহারায় অনন্ত বিষাদ মাখানো। তার দিকে তাকানোমাত্র টের পাওয়া যায়, সারাক্ষণ বুঝি বা কী এক যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন।

ভদ্রলোক যেচে আলাপ করলেন। হাতজোড় করে বললেন, নমস্কার। আমার নাম মধুসূদন ভট্টাচার্য। আমাদের দেশ ইস্ট পাকিস্তানে। কুমিল্লায়। সম্প্রতি ইন্ডিয়ায় এসেছি। তাঁর কথায় পূর্ব বাংলার টান।

 বিনয়রা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সবাই প্রতি-নমস্কার জানালো। দ্বারিক দত্ত নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমাদের দেশ ছিল ঢাকা ডিস্ট্রিক্টের রাজদিয়ায়। আরও জানালেন সুধা, হিরণ আর তিনি বেশ কবছর হল কলকাতায় এসেছেন। বিনয় এসেছে দেশভাগের অনেক পর, এই সেদিন।

মধুসূদন বললেন, আপনাদের খান মঞ্জিল থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। আজকাল ইস্ট পাকিস্তানের অনেকে এখানকার মুসলিমদের বাঘিরের সঙ্গে তাদের দেশের প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ করে চলে আসছে। আপনাদেরও কি সেইরকম ইচ্ছা?

ঠিকই ধরেছেন। দ্বারিক দত্ত জানান, খান মঞ্জিল-এর সঙ্গে তারা রাজদিয়ার বিষয়আশয় এক্সচেঞ্জ করবেন। কথা পাকা হয়ে গেছে।

গভীর আগ্রহে মধুসূদন বললেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন চলে আসুন। বাইরে থেকে যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয় খান মঞ্জিল বিল্ডিংটা বেশ মজবুত। চারপাশে জায়গাও অনেকখানি। একটু থেমে নিজের বাড়িটা দেখিয়ে বললেন, এক দালাল মারফত এক্সচেঞ্জ করে আমিও এটা পেয়েছি। ঈশ্বরের করুণাই বলতে পারেন। পাকিস্তানের যা হল, আর দেরি হলে সেখানকার প্রপাটি বেহাত হয়ে যেত। আমাদের শিয়ালদা স্টেশনে কিংবা রিফিউজি ক্যাম্পে পচে মরতে হতো।

বিনয়রা এবার খুঁটিয়ে মধুসূদন ভট্টাচার্যের বাড়িটা লক্ষ করল। সদ্য কলি ফেরানো হয়েছে। দরজা জানালা থেকে টাটকা পেন্টের গন্ধ ভেসে আসছে।

হিরণ বলল, আপনিও বেশ ভাল বাড়ি পেয়েছেন।

মধুসূদন সামান্য হাসলেন।

খান মঞ্জিল-এর একতলা থেকে তেতলার ছাদ পর্যন্ত ওঠানামা করে, ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখে, তারপর রাস্তায় বেরিয়ে খানিকটা হাঁটাহাঁটি করে, ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন দ্বারিক দত্ত। হাজার হোক, বয়স তো কম হয়নি। তার ওপর তেষ্টাও পেয়েছে। বললেন, ভট্টাচাজ্জি মশায়, আমাকে এক গেলাস জল খাওয়াতে পারেন?

বিনয়দের নজরে পড়ল, কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়েছেন মধুসূদন। চোখেমুখে অস্বাচ্ছন্দ্য ফুটে বেরিয়েছে। ভদ্রতার খাতিরে দ্বারিক দত্তদের অনেক আগেই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মধুসূদনের মধ্যে এ-ব্যাপারে কোথায় যেন একটা বাধা আছে। এদিকে তৃষ্ণার্ত মানুষটিকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে জল এনে দেওয়া যায় না। দ্বিধাভরে তিনি বললেন, ভেতরে আসুন

 গেটের পর সুরকির পথ পেরিয়ে মূল বাড়ির সদর দরজা। সেটা ভোলাই ছিল। মধুসূদন সবাইকে একতলার বসার ঘরে নিয়ে এলেন। গদি-বসানো খানকয়েক বেতের সোফা, কাঁচ-লাগানো গোলাকার নিচু সেন্টার টেবল দিয়ে ঘরটা সাজানো। অবশ্য এক ধারে ধবধবে চাদর পাতা একটা তক্তপোশ আর গোটা দুই বইয়ের আলমারিও রয়েছে।

মধুসূদন বললেন, বসুন। আমি জল নিয়ে আসছি—

বিনয়রা সবে বসেছে, আচমকা বাড়ির ভেতর থেকে তীব্র কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। কোনও মহিলার বুকফাটা বিলাপ। করুণ, একটানা।

ত্রস্ত, সচকিত মধুসূদন দৌড়ে ডানদিকের একটা দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। অতিথিদের দিকে একবার ফিরেও তাকালেন না।

আর বিমূঢ়ের মতো বিনয়রা পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল।

.

১৮.

যে কাঁদছে তার কত বয়স, কে জানে। তবে কিশোরী বা যুবতী নয়। হয়তো বয়স্ক কোনও মহিলা। কান্নাটা তার শিরায়ু ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে। কী যে তীব্র আকুলতা আর ক্লেশ এর সঙ্গে জড়ানো, ঠিক বোঝানো যায় না। এটুকু আন্দাজ করা যাচ্ছে, দেশের ভিটেমাটি সোনাদানার চেয়েও অনেক বেশি মূল্যবান কিছু না খোয়ালে কেউ এভাবে কাঁদতে পারে না।

মধুসূদন ভট্টাচার্যের পরিবারে এমন কিছু ঘটেছে যা শোকাবহ, নিদারুণ। তার তলকূল অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বিনয়রা ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।

হিরণ চাপা গলায় বলল, আমাদের এখানে আর থাকা ঠিক হবে না। চল—

বিনয় বলল, মধুসূদনবাবুর মুখচোখ দেখে তখন মনে হচ্ছিল, বাড়ির ভেতর আমাদের নিয়ে আসার ইচ্ছা ওঁর ছিল না। দাদু জল খেতে চাইলেন, তাই ভদ্রতার খাতিরে ডেকে এনেছেন। একটু থেমে বলল, এদের বাড়িতে মারাত্মক কিছু ঘটেছে। হিরণদা ঠিকই বলেছে, আমাদের চলে যাওয়াই উচিত; উঠে পড়–

বিনয়, সুধা আর হিরণ উঠতে যাচ্ছিল, হাত নেড়ে তাদের থামিয়ে দিলেন দ্বারিক দত্ত, লোকটা আমাদের বাড়িতে এনে বসিয়েছে। তাকে না বলে চলে যাব? এটা কোন দেশি শিষ্টাচার? তাছাড়া

বিনয় জিজ্ঞেস করল, তাছাড়া কী?

ওরা আমাদের ইস্ট বেঙ্গলের লোক। উদ্বাস্তু। নিশ্চয়ই কোনও বড় রকমের দুঃখের কারণ ঘটেছে। সমস্ত জেনে নিয়ে, পারলে ওদের সাহায্য করা উচিত। দেশের মানুষের পাশে না দাঁড়ালে চলে?

অগত্যা কারওই আর ওঠা হয় না। যে যার চেয়ারে বসে থাকে।

বাড়ির ভেতরে কী হচ্ছে, বাইরের ঘর থেকে তার কিছুই আঁচ করা যাচ্ছে না। শুধু কান্না আর করুণ, কাতর বিলাপ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই।

অনেকক্ষণ পর কান্নার তীব্রতা কমতে কমতে থেমে যায়। বাড়িটা একেবারে নিঝুম হয়ে গেছে।

একসময় মধুসূদন বাইরের ঘরে ফিরে এলেন। তার হাতে ঝকঝকে কাঁসার থালায় চার গেলাস জল। সঙ্গে এসেছে একটি চোদ্দ-পনেরো বছরের কিশোর। রোগা, ফর্সা, মুখখানা ভারী মলিন। চুল উষ্কখুষ্ক। পরনে হাফ প্যান্ট আর হাফ শার্টের ওপর সোয়েটার। তার হাতেও একটা কাঁসার থালা। সেটায় সাজানো রয়েছে অনেকগুলো নারকেলের নাড় আর কাঁচাগোল্লা। অতিথিদের শুধু জল তো দেওয়া যায় না।

বিনয় লক্ষ করল, মধুসূদনকে আগের থেকে অনেক বেশি বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। সারা মুখে অসহ্য কষ্টের ছাপ। কেমন যেন উভ্রান্ত লাগছে।

টেবলে কাঁসার থালাসুদ্ধ জলের গেলাসগুলো নামিয়ে রাখলেন মধুসূদন। কিশোরটিও তার হাতের থালাটা সেটার পাশে রাখল।

দ্বারিক দত্ত বললেন, খালি জল চেয়েছিলাম। আবার মিষ্টি কেন?

মধুসূদন বললেন, এই সামান্য একটু

দাঁড়িয়ে কেন? বসুন–

মধুসূদন একটা চেয়ারে নিঃশব্দে বসে পড়লেন। দ্বারিক দত্ত কিশোরটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ কে? ছেলে?

আস্তে মাথা নাড়লেন মধুসূদন, হ্যাঁ।

দ্বারিক দত্ত ছেলেটিকে ডেকে তার পাশে বসিয়ে বললেন, কী নাম তোমার দাদাভাই?

ছেলেটি সবে কলকাতায় এসেছে। এখনও জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আড়ষ্টভাবে বলল, মন্টু। ভাল নাম কৃষ্ণকিশোর ভট্টাচার্য।

কোন ক্লাসে পড়?

 দেশে থাকতে নাইনে পড়তাম। এখানে এসে এখনও স্কুলে ভর্তি হতে পারিনি।

মধুসূদন জানালেন, কাছাকাছি দুতিনটে স্কুলে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। আশা করা যায়, এই সপ্তাহেই কোথাও ভর্তি করে দিতে পারবেন।

জলের গেলাস তুলে নিলেন দ্বারিক দত্ত। বিনয়রাও একটা করে তুলল। ঘোরাঘুরি করে তাদেরও তেষ্টা পেয়েছে।

মধুসূদন বললেন, প্রথম দিন এলেন। একটু মিষ্টিমুখ না করলে কি হয়? একটা নাড় কি কাঁচাগোল্লা অন্তত নিন।

দ্বারিক দত্ত বয়সের দোহাই দিয়ে জানালেন, বৃদ্ধ হয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছেন। তার ওপর খেলে কষ্ট হবে। বিনয়রা অবশ্য রেহাই পেল না। তাদের নাড়-টাড় নিতেই হল।

জল খাওয়া হলে দ্বারিক দত্ত বললেন, যদি অন্যায় না হয়, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

মধুসূদন কয়েক মুহূর্ত দ্বারিক দত্তর দিকে তাকিয়ে রইলেন। পলকহীন। তারপর জোরে শ্বাস টেনে বললেন, আপনি কী জানতে চাইছেন তা আন্দাজ করতে পারছি।

দ্বারিক দত্ত উত্তর দিলেন না।

মধুসূদন মন্টুকে বললেন, তুই ভেতরে যা। ছেলে চলে যাবার পর এভাবে শুরু করলেন, মন্টুর সামনে কথাটা বলতে চাই না, তাই পাঠিয়ে দিলাম। অবশ্য ও বড় হয়েছে। সবই বোঝে। তবু– শেষ না করে থেমে গেলেন তিনি।

দ্বারিক দত্ত এবারও চুপ।

মধুসূদন বলতে লাগলেন, যার কান্না শুনে আপনাদের বসিয়ে রেখে বাড়ির ভেতর দৌড়ে গিয়েছিলাম সে আমার স্ত্রী কমলা। দিন নেই, রাত নেই, যে-কোনও সময় ও এইভাবে কেঁদে ওঠে। যতদিন বেঁচে আছে, কেঁদেই যাবে। ওর কান্নার শেষ নেই।

ঘরের ভেতর স্তব্ধতা নেমে আসে।

কিছুক্ষণ পর নৈঃশব্দ্য ভেঙে মধুসূদন এলোমেলোভাবে যা বললেন, গুছিয়ে নিলে এইরকম দাঁড়ায়।

তিনি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান। কয়েক পুরুষ ধরে তারা গুরুগিরি করে এসেছেন। গোটা ইস্ট বেঙ্গল জুড়ে তাদের কত যে শিষ্য-সেবক ছিল তার লেখাজোখা নেই।

মধুসূদনদের শহরে এবং গ্রামে দুজায়গাতেই বিশাল বাড়ি। তারা অবশ্য বেশির ভাগ সময় শহরে থাকতেন। মাঝে মাঝে গ্রামে। বাড়ি ছাড়াও গ্রামে ছিল চকের পর চক জুড়ে জমিজমা। ফলের বাগান। তিন চারটে দীঘি। ফলে প্রচুর ধান, প্রচুর পাট, অজস্র ফল, অঢেল মাছ। সে-সব তদারকি করতে তাঁদের গ্রামে যাওয়া।

ব্রাহ্মণত্বের যাবতীয় গোঁড়ামি এবং সংস্কার ছিল মধুসূদনদের হাড়ে-মজ্জায়। এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্ম উত্তরাধিকার হিসেবে সেগুলো পেয়ে আসছিল। ঠাকুরদা পর্যন্ত তাঁদের বংশের সবাই টোলে গিয়ে সংস্কৃত টংস্কৃত পড়ে এসেছেন। গুরুগিরিটা চলছিল মসৃণ নিয়মে। কিন্তু সময় বদলে যাচ্ছিল ত্বরিত গতিতে। মধুসূদনের বাবা শশিশেখর টোলে আদ্য মধ্য ইত্যাদি পড়তে যাননি। বংশধারা বিরোধী কাজই করেছিলেন তিনি। ইংরেজি শেখার জন্য কেঁদেকেটে শহরের অন্য সব বাড়ির ছেলেদের মতো প্রথমে এম ই স্কুলে পড়ে হাইস্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। গুরুগিরি-টিরি তার ধাতে ছিল না। ম্যাট্রিকটা পাশ করার পর ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিলেন। তখন ব্রিটিশ আমল। ডি. এম খাঁটি ইংরেজ। ম্লেচ্ছর দপ্তরে গোলামি করার জন্য বাড়িতে অশান্তি কম হয়নি।

সেই যে পরম্পরা ভেঙে গিয়েছিল, সেটা আর ঠেকানো যায়নি। শশিশেখরের ছেলে মধুসূদনও গুরুগিরি বা সংস্কৃত টংস্কৃত নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাননি। বি এ পাস করার পর জুট কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিলেন। তাদের শহরে কোম্পানিটার ব্রাঞ্চ অফিস ছিল। চারপাশের চাষীদের কাছ থেকে পাট জোগাড় করে তাঁরা নারায়ণগঞ্জের জুট মিলে পাঠাতেন।

জুট কোম্পানিতে কয়েক বছর কাজ করার পর যুদ্ধ লেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙের ছাতার মতো ব্যাঙ্ক গজাতে লাগল সারা দেশে। পূর্ব বাংলায় তাদের সেই শহরটিও বাদ পড়ল না। তেমনই একটা ব্যাঙ্কে অনেক বেশি মাইনেতে কাজ পেয়ে গেলেন মধুসূদন। প্রথমে ডেপুটি ম্যানেজার, পরে ম্যানেজার।

যুদ্ধ থামার পর শতকরা নব্বই ভাগ ব্যাঙ্কই মানুষের টাকাপয়সা মেরে দপ্তরে তালা ঝুলিয়ে দিল। কিন্তু মধুসূদনদের ব্যাঙ্কের মালিকরা লোকজনকে সর্বস্বান্ত করে, পথের ভিখিরি বানিয়ে, নিজেরা রাতারাতি লক্ষপতি, কোটিপতি হতে চাননি। তেমন কু-মতলব তাদের ছিল না। তাঁরা সৎভাবে ব্যবসা করতে এসেছিলেন। অন্যগুলো লাল বাতি জ্বাললেও মধুসূদনদের ব্যাঙ্ক রমরম করে চলতে লাগল।

মহাযুদ্ধের অবসান হল ঠিকই, কিন্তু ভারতবর্ষের ওপর চরম দুর্যোগ ঘনিয়ে এল। নিমেষে কত কী-ই যে ঘটে গেল। ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশনের এ দেশে আসা, আই এন এর সেনাপতিদের বিচার। রশিদ আলি ডে। স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল শহর বন্দর গ্রামগঞ্জ। নৌ-বিদ্রোহ। পাকিস্তানের দাবিতে অনড় জিন্নার ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ডাক। রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। কলকাতা বিহার নোয়াখালি বোম্বাই পাঞ্জাব-সারা দেশ জুড়ে শুধুই হত্যা। লুটপাট। ধর্ষণ। আগুন।

মধুসূদনদের শহরে উত্তেজনার আঁচ যে ছড়িয়ে পড়েনি তা নয়। কিন্তু খুন বা আগুনের মতো কোনও ঘটনাই তখনও সেখানে ঘটেনি। শহরটা মোটামুটি শান্তই ছিল।

ডাইরেক্ট অ্যাকশনের এক বছরের মধ্যে দেশভাগ হয়ে গেল। অখণ্ড ভারতবর্ষকে দুটুকরো করে তৈরি হল আলাদা একটি দেশ-পাকিস্তান। বাকি অংশটা সাবেক নামই ধরে রাখল–ভারত।

পার্টিশানের পর কিছুদিন নির্বিঘ্নেই কেটেছে। কিন্তু তারপর শুরু হল মুসলিম লিগ আর রাজাকারদের উৎপাত। তাছাড়া, ইন্ডিয়া থেকে যে পশ্চিমা মুসলমানরা ইস্ট বেঙ্গলে চলে গেছে তাদের অনেকেই মধুসূদনদের শহরে গিয়ে আস্তানা গেড়েছিল। এরা হাত মিলিয়েছিল রাজাকারদের সঙ্গে। স্থানীয় বহু মুসলমানও এদের সঙ্গে জুটে গিয়েছিল। ওদের সবার লক্ষ্য হিন্দুদের প্রপার্টি। শহরের আবহাওয়া দ্রুত পালটে যেতে লাগল। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক।

প্রথম প্রথম ওরা বেনামা চিঠি দিত। যত তাড়াতাড়ি পার, হিন্দুস্থানে চলে যাও।

 খানিকটা ঘাবড়ে গেলেও দেশ ছাড়ার কথা ভাবেননি মধুসূদন। কয়েক পুরুষ ধরে পাশাপাশি বাস করে আসছেন, এমন মাতব্বর জাতীয় কয়েকজনকে গিয়ে চিঠিগুলো দেখিয়েছেন তিনি। তারা ভরসা দিয়েছেন, ইন্ডিয়ায় যাবার কোনও প্রায়োজন নেই। যেমন আছেন তেমনি থাকুন। তিনি পাকিস্তানের নাগরিক। অন্য সবার মতো জন্মভূমিতে থাকার হক তার আছে।

আশ্বাস পাওয়া সত্ত্বেও কিন্তু দুর্ভাবনা কাটল না। আগে যারা বেনামা চিঠি পাঠাত এবার তাদের চেহারাগুলো দেখা যেতে লাগল। রাস্তায় বেরুলেই সামনে এসে তারা দাঁড়াত।

পাকিস্থান অহন আমাগো দ্যাশ। এইখানে পইড়া আছেন ক্যান? ইন্ডিয়ায় ম্যালা সুযুগ সুবিধা পাইবেন। যান গিয়া।

শহরের মান্যগণ্য মানুষগুলোর কাছে আবার ছুটলেন মধুসূদন। ফের আশ্বাস জুটল।

এইভাবে চলল মাস দেড় দুই। তারপর সরাসরি হুমকি শুরু হল।

ভাল কথায় কতবার কইছি, কিন্তুক আপনে কানে তুললেন না। ভসচাষ (ভট্টাচার্য) মশয়, এইবার কিম জবর তাফালে (বিপদে পড়বেন।

তাদের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী বলে যাঁকে জানতেন, সেই শাহাবুদ্দিন সাহেব, শহরের মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান, তার কাছে দৌড়লেন মধুসূদন। খাতির যত্ন করে তাঁকে বসালেন শাহাবুদ্দিন। মন দিয়ে তার দুর্ভাবনার কথা শুনলেন।

আগে বহুবার শাহাবুদ্দিনের কাছে এসেছেন। কিন্তু এবার কোনওরকম ভরসা দিলেন না। চিন্তাগ্রস্তের মতো গম্ভীর মুখে বললেন, টাউন জবর গরম হইয়া উঠছে। আপনার লাখান অনেকেরই দ্যাশ ছাড়নের লেইগ্যা পশ্চিমারা আর রাজাকাররা শাসাইতে আছে। অবোস্থা দিন দিন আমার কনট্রোলের বাইরে চইলা যাইতে আছে। একটু থেমে সদয় সুরে বলেছিলেন, আমার একখান কথা হোনবেন?

কিসের একটা সংকেত পেয়ে গিয়েছিলেন মধুসূদন। বলেছিলেন, কী?

 চির কাল তো দেইখা আইছেন, আমি আপনেগো হিত চাই। ইন্ডিয়ায় চইলাই যান।

আপনিও চলে যেতে বলছেন?

আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে শাহাবুদ্দিন সাহেব বলেছিলেন, হ। নাইলে শয়তানের ছাওরা কহন যে কী কুকম্ম কইরা ফালাইব ক্যাঠা জানে।

শেষ ভরসাটুকুও মুহূর্তে ধূলিসাৎ। মধুসূদন দিশেহারার মতো বলেছিলেন, কিন্তু আমাদের বাড়িঘর,  জমিজমা-এ-সবের কী হবে? ইন্ডিয়ায় গিয়ে কী করব? কী খাব? তার গলার স্বর বুজে এসেছিল।

হেই হগলের কথাও আমি ভাইবা রাখছি। দ্যাশ ছাইড়া চইলা গ্যালে আপনেগো বিষয়আশয় বেদখল হইয়া যাইতে পারে। উই রাজাকাররা কি পশ্চিমারা যদিন একবার গাইড়া বসে, সব্বনাশ। এই জম্মে আর হেইগুলা ফিরত পাওনের আশা নাই। আমি আপনেগো শহরের বাড়িখান দেখুম, কেও.যাতে বইয়া পড়তে না পারে। ইন্ডিয়া থিকা চিঠিপত্তরে যুগাযুগ রাইখেন। যদিন সুদিন ফিরে, দ্যাশে চইলা আইয়েন। কিন্তুক

কিন্তু কী?

টাউনে বইসা আপনেগো গেরামের জমিজেরাত সামলান তো সম্ভব না। তাই কই কি, হেই হগলের লেইগা আমি দ্যাড় লাখ টাকা দিমু। গেরামের উই সোম্পত্তি আমারে লেইখা দিবেন।

মধূসূদন বুঝতে পারছিলেন, শাহাবুদ্দিন সাহেব শুভাকাঙ্ক্ষী ঠিকই, কিন্তু তার অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছেন। কিন্তু এছাড়া উপায়ই বা কী? তবু টাকার অঙ্কটা বাড়ানোর শেষ একটা চেষ্টা করেছিলেন, আমাদের সত্তর কানি ধান-পাটের জমি, গ্রামের বাড়ি, বাগান, তিন-তিনটে দীঘি, এত কিছুর বদলে মাত্র দেড় লাখ টাকা!

ভাইবা দ্যাখেন, চাইর দিকের যা হাল হেতে আপনে একখান ঘষা পয়সাও পাইতেন না। খালি হাতে ভিটামাটি ছাইড়া যাইতে হইত। হেই জাগায় আমি দ্যাড় লাখ দিতে আছি। কম হইল?

বুঝতেই পারেন, সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে হবে। কী যে কষ্ট! আমাকে কটা দিন ভাবতে দিন।

দ্যাশের গতিক দিনকে দিন খারাপ হইয়া যাইতে আছে। যা ভাবনের তরাতরি ভাইবেন।

কয়েক দিনের মধ্যে শহরের অবস্থা আরও ঘোরালো হয়ে উঠল। বেশ কটা বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হল। খুন হয়ে গেল পাঁচ ছজন।

শহরে ভাঙন শুরু হল। সর্বস্ব ফেলে স্রোতের মতো শয়ে শয়ে মানুষ পালাতে লাগল সীমান্তের ওপারে–ত্রিপুরায়, আসামে, পশ্চিম বাংলায়। তাদের ছেড়ে-যাওয়া জমিজমা বাড়িঘর দখল করে নিতে লাগল রাজাকাররা, ইন্ডিয়া থেকে যাওয়া পশ্চিমারা। এমনকি স্থানীয় মুসলমানরাও।

এদিকে আরও একটা মারাত্মক ব্যাপার ঘটছিল। এতদিন সংখ্যালঘুদের বিষয় সম্পত্তির দিকে চোখ ছিল ইবলিশদের। এবার তাদের নজর এসে পড়ল যুবতী মেয়েদের ওপর। শহরের পুরানো বাসিন্দা আচার্যদের, গুহদের, বসাকদের এবং এমন আরও কয়েকটা বাড়ির সাত-আটটা মেয়েকে রাতের অন্ধকারে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হল। তাদের টার্গেট তখন থেকে শুধু প্রপাটিই নয়, যুবতী নারীও।

মন্টু ছাড়াও মধুসূদনের একটি মেয়ে ছিল। দীপালি। তার বয়স তখন আঠারো। কলেজে পড়ছে। একদিন উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে এল সে। মুখ ছাইবর্ণ। আতঙ্কে চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে।

বাড়িতে ঢুকেই ঘরের মেঝেতে আছড়ে পড়েছিল দীপালি। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে অঝোরে কাঁদতে শুরু করেছিল সে।

মধুসূদন সেদিন বাড়িতেই ছিলেন। শরীরটা ভাল ছিল না। জ্বর জ্বর ভাব। তাই ব্যাঙ্কে যাননি। তিনি এবং তার স্ত্রী দুজনেই মেয়েকে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। গভীর উদ্বেগে অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর জানা গেছে, স্থানীয় লিগের এক পাণ্ড নিয়ামত আলির ছেলে শোভান সেদিন কলেজ কমপাউণ্ডে তার হাত ধরে টানাটানি করেছে। সে মার্কামারা বদমাশ। বলেছে, তাকে শাদি করতে চায়। দীপালি কোনওরকমে হাত ছাড়িয়ে বাড়িতে পালিয়ে এসেছে। উন্মাদের মতো সে বলে যাচ্ছিল, আর কলেজে যাবে না। পাকিস্তানে এক মুহূর্ত থাকবে না। তক্ষুনি নিরাপদ কোনও জায়গায় তাকে নিয়ে যেতে হবে।

মধুসূদন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। প্রাণ গেলেও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বংশের মেয়ের এ-জাতীয় বিয়ে হতে দেবেন না। কিন্তু শোভান বেপরোয়া, মারাত্মক। পাকিস্তান কায়েম হবার পর তার মতো শয়তানের পালের দাপট শতগুণ বেড়ে গিয়েছিল।

জন্মভূমি ছেড়ে চলে যাবার ব্যাপারে মধুসূদনের সামান্য দ্বিধা ছিল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ইন্ডিয়ায় চলে যাবেন। তবে সব গোছগাছ করে নিতে দুচারদিন লাগবে। সেই সময়টুকুর জন্য নিরাপত্তা দরকার। তিনি থানায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু শোভানের বিরুদ্ধে কোনওরকম অভিযোগ শুনতে তারা রাজি নয়। নিরুপায় হয়ে এবার গিয়েছিলেন এস ডি ওর কাছে। তরুণ অফিসার। ভদ্র এবং সহৃদয়। নাম রফিকুল ইসলাম। আশ্বাস দিয়েছিলেন, সুরক্ষার ব্যাপারটা তিনি দেখবেন। লিগের পাণ্ডার ছেলেকে রফিকুল কতটা দমিয়ে রাখতে পারবেন, সে-সম্বন্ধে সংশয় ছিল। তবু খানিকটা স্বস্তি বোধ করেছিলেন মধুসূদন।

এস ডি ওর সঙ্গে কথা বলে তিনি গিয়েছিলেন শাহাবুদ্দিন সাহেবের কাছে। দেড় লাখ টাকায় গ্রামের যাবতীয় সম্পত্তি তার হাতে তুলে দিতে তিনি প্রস্তুত। এই হননপুরীতে আর এক লহমাও থাকা ঠিক নয়। বিশেষ করে দীপালিকে বাঁচাতে হলে দেশ ছাড়তেই হবে।

মধুসূদন জিজ্ঞেস করেছিলেন, টাকা নিয়ে কীভাবে ওপারে যাব? টের পেলে পথে ডাকাতরা কেড়ে নেবে। না দিলে খুন করে ফেলবে। যদিও বা তাদের নজর এড়াতে পারি, বর্ডারের অফিসাররা ছাড়বে না। পাকিস্তানের টাকা পাকিস্তানেই রেখে যেতে হবে।

শাহাবুদ্দিন সাহেব কিছুটা স্বার্থপর হলেও বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ লোক। বহু খবর রাখেন। বলেছেন, ঢাকায় মারোয়াড়িরা আছে। হেগো কাছে টাকা জমা দিয়া হুণ্ডি করন লাগব। কইলকাতায় হেগো আসল গদি। হেইখানে গিয়া হুণ্ডির কাগজ দ্যাখাইলে ট্যাকাটা পাইয়া যাইবেন।

ঠিক হল পরদিন স্ট্যাম্প কাগজে বিষয়সম্পত্তি লিখে সই করে দেবার পরই মধুসূদনকে নিয়ে ঢাকায় যাবেন শাহবুদ্দিন। সেইমতো যাওয়াও হল।

হুণ্ডি করে একটা রাত ঢাকায় কাটিয়ে যখন নিজেদের শহরে ফিরে এলেন, মধুসূদনের চোখের সামনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শতখান হয়ে ভেঙে পড়েছে। যে রাতটা তারা ছিলেন না, সেই সময়টুকুর মধ্যে বেশ কয়েকটা বাড়িতে আগুন ধরানো হয়েছিল। তাদের বাড়িটাও বাদ যায়নি। তবে সেটা খুব বেশি পোড়েনি। কিন্তু যেটা সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার তা হল, বাড়িতে কেউ নেই। না স্ত্রী, না মন্টু, না দীপালি। চারদিক খাঁ খাঁ করছে।

উন্মাদের মতো মধুসূদন ছুটেছিলেন এস ডি ওর কাছে। এই বিপদের দিনে শাহাবুদ্দিন সাহেব তার সঙ্গেই ছিলেন।

অনেক খোঁজাখুঁজির পর নিকারি পাড়ায় স্ত্রী এবং মন্টুকে পাওয়া গিয়েছিল। গরিব নিকারিরা তাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু দীপালির হদিস নেই। সারা শহরে তল্লাশি চালিয়েও তার সন্ধান মেলেনি।

শেষ পর্যন্ত মন্টু আর স্ত্রীর হাত ধরে সীমান্তের এপারে চলে এসেছেন মধুসূদন। কিছুদিন শিয়ালদা স্টেশন, কিছুদিন রিফিউজি ক্যাম্প ঘুরে, ইস্ট পাকিস্তানে তাদের সেই পোড়া বাড়িটার সঙ্গে টালিগঞ্জের এই বাড়িটা এক্সচেঞ্জ করেছেন। শাহাবুদ্দিন সাহেব কথা রেখেছিলেন, দেশের সেই বাড়িটা তিনি গ্রাস করেননি। বাড়ি বিনিময়ের কথা তাকে জানানো হয়েছিল। তিনি খুশি হয়েছেন।

মধুসূদন উদ্বাস্তু। বি এ পাস। বয়সটা বেশি হলেও একটা চাকরি জুটেছে। তাছাড়া সেই দেড় লাখ টাকা ব্যাঙ্কে রেখেছেন। পয়সাকড়ির দিক থেকে তিনি নিশ্চিন্ত।

কিন্তু তার জীবনের সব চেয়ে বড় সংকটের কারণ হলেন তার স্ত্রী। রাতের অন্ধকারে দীপালিকে চোখের সামনে জোর করে হননকারীর দল তুলে নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে তিনি প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছেন। বছরখানেক হল, ইন্ডিয়ায় চলে এসেছেন তারা। দিন নেই, রাত নেই, যখন তখন, হঠাৎ হঠাৎ স্ত্রী বুক ফাটিয়ে কেঁদে ওঠেন। সহজে সেই কান্না থামতে চায় না।…

.

কথা শেষ করে অনেকক্ষণ বসে রইলেন মধুসূদন, নীরবে। বিধ্বস্ত, ভাঙাচোরা। তারপর রুদ্ধস্বরে বলতে লাগলেন, আপনারা আমাদের প্রতিবেশী হবেন। একদিন তো সবই জানতে পারবেন। আগেই তাই জানিয়ে দিলাম। একটু থেমে ফের শুরু করেন, মেয়েটাকে পাওয়া যায়নি। এ একরকম ভালই হয়েছে। পেলে কী করতাম? বিয়ে দেওয়া যেত না। কেউ আমাদের হাতের ছোঁয়া জল খেত না। ধর্ম গেছে। বংশের মান-সম্মান নাশ হয়েছে। সন্তানের মৃত্যুকামনা করতে নেই। কিন্তু দিবারাত্রি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, মেয়েটা যেন মরে যায়, মরে যায়, মরে যায়—

তার শেষ কথাগুলোর প্রতিধ্বনি হতে থাকে সমস্ত বাড়ি জুড়ে। বিনয় মধুসূদনের দিকে তাকিয়ে ছিল, একদৃষ্টে। বুকের ভেতর শ্বাস আটকে যাচ্ছে। দীপালি যেন আরেক ঝিনুক। যার সঙ্গেই দেখা হয়, কোনও না কোনওভাবে, অনিবার্য এক নিয়মে, লাঞ্ছিত অপমানিত ঝিনুক বার বার তার স্মৃতিকে তোলপাড় করে দিয়ে যায়।

কারও মুখে কথা নেই। সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। যে ভয়াবহ সর্বনাশ মধুসূদনের হয়ে গেছে, সামান্য দুচারটে সহানুভূতির কথায় তার কতটুকু ক্ষতিপূরণই বা করা যায়!

একসময় বিদায় নিয়ে দ্বারিক দত্তরা উঠে পড়লেন। তাঁদের বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আছে। চোখমুখ বেদনাকাতর।

মধুসূদন সঙ্গ ছাড়েননি গেট অবধি বিনয়দের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এলেন। ধরা ধরা, ভাঙা গলায় বললেন, খান মঞ্জিল-এ এসে তো থাকবেনই। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসবেন।

দ্বারিক দত্ত মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

মধুসূদন এবার সুধার দিকে তাকান, মা, তুমি এসে তোমার মাসিমাকে একটু বুঝিও, যা ভাগ্যে ছিল তাই ঘটেছে। এর ওপর তো মানুষের হাত নেই।

সুধার আবেগটা বড় বেশি প্রবল। কারও দুঃখের কথা শুনলে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ে। তীব্র ক্লেশে তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। ঝাপসা গলায় বলল, আমার যতদূর সাধ্য, বোঝাতে চেষ্টা করব।

সুধাকে মধুসূদন যে আলাদা করে বেছে নিয়েছেন, তার কারণ সে মেয়ে। দ্বারিক দত্তদের অর্থাৎ পুরুষদের তুলনায় একটি মেয়ের কাছে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন তার স্ত্রী। সুধার সাহায্য চাইলেও মধুসূদনের অবশ্য সংশয় রয়েছে। খানিকটা আপন মনেই বললেন, ওর যা মনের অবস্থা তাতে কতটা কাজ হবে, কে জানে।

সুধা উত্তর দিল না।

সামনের রাস্তায় তিনটে সাইকেল রিকশা দেখা গেল। কোথাও সওয়ারি নামিয়ে সেগুলো ওধারের গাছতলার স্ট্যান্ডে ফিরে যাচ্ছে। হিরণ হাত তুলে দুটো রিকশাকে থামালো। তখনকার মতোই একটায় বিনয়কে নিয়ে সে উঠে পড়ল। অন্যটায় সুধা আর দ্বারিক দত্ত।

আগে আগে অলিগলির ভেতর দিয়ে, গরিব মুসলিমদের বস্তিগুলোর গা ঘেঁষে ঘেঁষে পথ দেখিয়ে, নিয়ে চলেছে হিরণ। পেছনে সুধারা।

মধুসূদন ভট্টাচার্যের মেয়ে দীপালির কথা শোনার পর থেকে সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলী ছিঁড়ে পড়ছে বিনয়ের। যতটা দীপালির জন্য, তার বহুগুণ ঝিনুকের কারণে। সময় শোক এবং দুঃখের তীব্রতা ধীরে ধীরে জুড়িয়ে দেয়। প্রলেপ লাগিয়ে দেয় অদৃশ্য ক্ষতমুখে। ঝিনুক নিরুদ্দেশ হবার পর প্রথম দিকে যতটা উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল, অসহনীয় কষ্টে যতটা ছটফট করত, পরে সেটা মোটামুটি সামলে উঠেছিল সে। মানুষের সহ্যশক্তির বুঝি সীমাপরিসীমা নেই। কিন্তু দীপালির ঘটনাটা যখন মধুসূদ বলছিলেন, তার হৃৎপিণ্ডে একটা অদৃশ্য শেল আমূল বিধে যাচ্ছিল।

রিকশায় ওঠার পর থেকে একটি কথাও বলেনি বিনয়। আচ্ছন্নের মতো বসে আছে। দুধারে নানা দৃশ্যাবলী–পুরোনো আমলের বাড়িঘর, খাপরা কি টিনের চালের চাপ-বাঁধা মুসলমানদের বস্তি ফাঁকা মাঠ, ঝোপঝাড়, পানাপুকুর–কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। এলাকাটা যত নিরিবিলিই হোব কিছু শব্দ তো হচ্ছেই। মানুষের কথাবার্তার, পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সাইকেল রিকশা কি কচি দুএকটা মোটরের। কিছুই শুনতে পাচ্ছে না বিনয়। শুধু টের পাওয়া যাচ্ছে, বুকের ভেতরে কোথা যেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অবিরল।

হঠাৎ তারপাশার স্টিমারঘাটে সেই ভাঙাচোরা, করুণ চেহারার আধবুড়ো লোকটার মুখ চোখে সামনে ভেসে ওঠে। নয়া চিকন্দি গ্রামের হরিদাস সাহা। তার যুবতী মেয়েকে জোর করে তুলে নিন যাওয়া হয়েছে। হরিদাসের স্ত্রী ঘোমটায় মুখ ঢেকে একটানা কেঁদে যাচ্ছিল। শুধু কি সে-ই, যুগলদে মুকুন্দপুর কলোনিতে গিয়েও বেশ কটি মেয়েমানুষের এমন কান্না শুনে এসেছে বিনয়। সেই সব নিরবচ্ছিন্ন বিলাপ। সে যে কী বুক-নিঙড়ানো কাতরতা! ওদের মেয়েদেরও কেড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে

মধুসূদন, হরিদাস সাহা আর মুকুন্দপুরের সেই শোকাকুল মায়েদের মতো দেশভাগের পর আর কত যে মা-বাপের যুবতী মেয়ে খোয়া গেছে তার লেখাজোখা নেই। এদের সবার অফুরান কান্না সঙ্গে ঝিনুকের জন্য বিনয়ের অন্তহীন কষ্টটা একাকার হয়ে যেতে লাগল।

হিরণ বিনয়কে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিল। আস্তে ডাকল, বিনু

 বিনয় চমকে ওঠে, কিছু বলবেন?

কী ভাবছিলে? ঝিনুকের কথা? হিরণ আর সুধা এই কয়েক দিনের মধ্যেই বিনয়কে অনেকখা বুঝে ফেলেছে। ওরা জানে, পূর্ব পাকিস্তানের কোনও ধর্ষিত, লাঞ্ছিত কিংবা জোর করে ছিনি নিয়ে যাওয়া মেয়ের কথা শুনলেই সে ভীষণ ভেঙে পড়ে। ঝিনুকের চিন্তাটাই তখন পাষাণভারে মতো তার ওপর নতুন করে চেপে বসে।

বিনয় মুখে কিছু বলল না। আস্তে মাথা নাড়ল শুধু।

হিরণ বলতে লাগল, ঝিনুককে তবু ঢাকা থেকে উদ্ধার করে আনা গিয়েছিল। কিন্তু মধুসূদ ভট্টাচার্যের মেয়েকে আর কোনওদিনই পাওয়া যাবে না। বলেই হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে, ঝিনুককে অবশ্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি। সেও ফিরে আসবে কি না, কে জানে।

বিনয় উত্তর দিল না। তার দুচোখ বাষ্পে ভরে যেতে থাকে।

.

১৯.

বাড়ির সামনে সাইকেল রিকশা থেকে সবাই নেমে পড়ল। ভাড়া মিটিয়ে হিরণ সদরে কড়া নাড়তে উমা এসে দরজা খুলে দিল। বলল, একজন অনেকক্ষণ বসে আছে। আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাবে না।

হিরণ জিজ্ঞেস করল, কে লোকটা?

 চিনি না। আগে কখনও দেখিনি।

হিরণ বিরক্ত হল, আমরা যখন থাকব না, অচেনা কারওকে বাড়িতে ঢোকাতে বারণ করেনি না?

উমা ভয় পেয়ে গেল। বলল, আপনাদের দেশের মানুষ। সেই সঙ্গে আরও খানিকটা জুড়ে দিল। লোকটি বেশ বয়স্ক। সাধু সাধু চেহারা। কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে, খুবই সরল। সাদাসিধে। কোনওরকম দুরভিসন্ধি তার মধ্যে নেই। তবু বার বার আপত্তি করেছে উমা, তাকে পরে আসতে বলেছে। কিন্তু লোকটা নাছোড়বান্দা। এমন ধরেছিল যে শেষ পর্যন্ত বাড়িতে না নিয়ে গিয়ে পারা যায়নি।

কী নাম তার?

উমা অনেকখানি গুটিয়ে গেল, জিজ্ঞেস করিনি।

 গাধা মেয়ে। দেশের লোক বলে একেবারে শোবার ঘরে নিয়ে বসাসনি তো?

না-না– সবেগে মাথা ঝাঁকায় উমা, সেটুকু বুদ্ধি আমার আছে। বাইরের ঘরে বসিয়েছি।

জেঠিমাকে লোকটার কথা জানিয়েছিস?

আপনারা যাবার পর জেঠিমার শরীর খারাপ লাগছিল। শুয়ে পড়েছেন। তাই জানাইনি।

সবাই ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। হিরণ ত্বরিত গতিতে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে দোতলায় উঠে গেল। তার পেছন পেছন বিনয়ও। সকলের শেষে দ্বারিক দত্তকে ধরে ধরে ওপরে তুলতে লাগল সুধা।

হিরণ আর বিনয় বাইরের ঘরে চলে এসেছিল। চেয়ারে যে বসে আছে তার বয়স ষাটের কাছাকাছি। বুক পর্যন্ত কাঁচাপাকা দাড়ি। কাঁধ অবধি চুল। পরনে গেরুয়া রঙে ছোপানোমোটা সুতোর ধুতি আর পাঞ্জাবির ওপর ভারী খদ্দরের চাদর। সেটার রংও গেরুয়া। পায়ে কয়েক গণ্ডা তালি মারা পুরোনো লাল কেডস। চোখে নিকেলের গোল বাই-ফোকাল চশমা, যেটার উঁটিদুটো টেড়াবাঁকা, ঢেউ-খেলানো। তার পাশে পেট-মোটা, ধুসো ক্যাম্বিসের পুরানো, ঢাউস একটা বাক্স। সেটার গায়ে পেল্লায় তালা ঝুলছে।

উমা মিথ্যে বলেনি। সত্যিই মুনি-ঋষি মার্কা চেহারা। মুখটা চেনা চেনা লাগল বিনয়ের। রাজদিয়ার লোক নয়, তবে ওখানে এর যাওয়া-আসা ছিল। মনে পড়ল, হেমনাথের কাছেও দু-একবার এসেছে।

বিনয় এবং হিরণকে দেখে উঠে দাঁড়াল লোকটা। একমুখ হেসে বলল, আমারে চিনতে নি পারেন? আমি কিলাম আপনাগো দেইখাই চিনা ফালাইছি। আপনে হ্যামকার নাতি, আর আপনে হইলেন দ্বারিক দত্ত মশয়ের নাতি। কী, ঠিক কইছি তো?

এইসময় দ্বারিক দত্ত বাইরের ঘরে ঢুকলেন। সুধা একবার উঁকি দিয়ে ভেতর দিকে চলে গেল। দল বেঁধে সকালবেলায় খান মঞ্জিল দেখতে বেরিয়েছিল। রান্নাবান্না কিছুই হয়নি। উমাকে নিয়ে কোমর বেঁধে এখনই কাজে লাগতে হবে।

বিনয় আর হিরণ লোকটার কথার কী জবাব দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই দ্বারিক দত্ত থমকে দাঁড়িয়ে কয়েক পলক লোকটির দিকে তাকিয়ে থেকে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, তালতলির গুপীবল্লভ আচায্যি না?

তালতলি রাজদিয়ার থেকে মাইল দশেক দূরের মাঝারি একটা গঞ্জ। গুপীবল্লভ ছিল সেখানকার নামকরা কবিরাজ তারিণী সেন ভিষকরত্নের শাগরেদ। তারিণী কবিরাজের যথেষ্ট বয়স হয়েছিল। আশির কাছাকাছি। রোগভোগ নিয়ে যারা তার কবিরাজখানায় আসত, তাদেরই শুধু চিকিৎসা করতেন। বাইরের রোগী দেখতে যেতে পারতেন না। সেই কাজটা করত গুপীবল্লভ। বহু বছর তারিণীর সঙ্গে লেগে থেকে কবিরাজিটা মোটামুটি শিখে নিয়েছিল সে। বাইরের রোগী দেখা ছাড়াও সুজনগঞ্জ, ইনামগঞ্জ, দেলভোগ–এমনি সব হাটে হাটে ঘুরে তারিণী সেনের বিখ্যাত মকরধ্বজ, স্বর্ণসিন্দুর, মৃতসঞ্জীবনী ইত্যাদি নানা ওষুধ এবং সালসা টালসা বিক্রি করত। মাঝে মাঝে রাজদিয়ায় এলে হেমনাথের সঙ্গে দেখা করে যেত। তবে বিনয়ের সঙ্গে তখন সেভাবে আলাপ হয়নি।

গুপীবল্লভের মুখের হাসিটা আরও ছড়িয়ে পড়ল। বলল, হ দত্তমশয়, আমি গুইপা আচায্যিই। গুপীবল্লভের ডাক নাম গুপী। পূর্ব বাংলায় বলে গুইপা।

দ্বারিক দত্ত বললেন, বোস বোস্। দেশের মানুষ দেখলে কী ভাল যে লাগে!

 সবাই বসে পড়ে।

দ্বারিক আপেক্ষের সুরে এবার বলেন, দেশভাগের পর রাজদিয়া রসুনিয়া ডাকাইতা পাড়া গিরিগঞ্জ তালতলি মালখানগর, এমনি নানা গ্রামগঞ্জের মানুষ যে কত দিকে ছিটকে পড়েছে। তাদের অনেকের সঙ্গে এ-জীবনে আর দেখা হবে না। একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, পাকিস্তান থেকে কবে এলি?

গুপীবল্লভ বলল, তা হইব মাস ছয়েক

কোথায় উঠেছিস?

আমার এক ভাইগনা গইরার (গড়িয়া) উই দিকে জবরদখল কুলোনিতে ঘর তুলছে। আমি হের কাছেই থাকি।

তারিণী কবিরাজের খবর কী? তিনি কি তালতলিতেই পড়ে আছেন?

তেনি মারা গ্যাছেন। কবিরাজখানাও উইঠা গ্যাল। আমি দ্যাশে থাইকা কী করুম? চইলা আইলাম–

তারিণী সেনের স্ত্রী? ছেলেমেয়ে?

স্যান কত্তার স্ত্রী তো আগের বচ্ছরই স্বগৃগে গ্যাছেন। আর ওনাগো (ওঁদের) পোলামাইয়া নাই।

 একটু চুপচাপ।

 তারপর দ্বারিক দত্ত বললেন, তা আমাদের এ-বাড়ির খোঁজ পেলি কী করে?

গুপীবল্লভ বলল, কয়দিন আগে আতখা (হঠাৎ) আপনেগো রাইজদার তৈলোক্য-ত্রৈলোক্য) স্যানের বড় পোলা পরিতোষ স্যানের লগে দেখা। তৈলোক্য স্যান, যেনি যৈবনকালে মগের মুল্লুকে (বর্মায়) চইলা গ্যাছিলেন, যুদ্ধ বাধলে দ্যাশে ফিরা আইলেন–

লোকটা একটু বেশি মাত্রাতেই বকবক করে। এক কথা বলতে গিয়ে ডালপালা ছড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। বাধা দিয়ে দ্বারিক দত্ত বলে উঠলেন, পরিতোষ কী করল তাই বল–

গুপীবল্লভ একটু অপ্রস্তুত হল। হ-হ, এক কথা কইতে গিয়া আর-এক কথা আইয়া পড়ছে। তা পরিতোষ স্যান আমারে তেনাগো ঢাকুইরার (ঢাকুরিয়া) বাড়ি লইয়া গ্যালেন। পুরা দিনটা আছিলাম হেইখানে। ওনাগো কাছেই আপনেগো ঠিকানা পাইছি। গইরা থিকা টালিগঞ্জ আর কদ্দূর? আপনেগো দ্যাখনের লেইগা কয়দিন ধইরা পরানটা উথালপাতাল হইতে আচ্ছিল। আইজ সকালে উইঠা চইলা আইলাম।

বিনয় লক্ষ করছিল, গুপীবল্লভ দ্বারিক দত্তর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বার বার উৎসুক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। একটু অস্বস্তি বোধ করল সে। ত্রৈলোক্য সেনদের বাড়িতে যখন গেছে, ঝিনুকের খবর কি আর সে পায়নি? সে-সম্বন্ধে ফস করে কি কিছু বলে বসবে নোকটা?

উমা সবার জন্য চা আর গুপীবল্লভের জন্য আলাদা করে মিষ্টি-টিষ্টি দিয়ে গেল। সুধা পাঠিয়ে দিয়েছে। দেশের মানুষ বাড়িতে এসেছে। তাকে আপ্যায়ন করা যে দরকার, শত ব্যস্ততার মধ্যেও সেদিকে খেয়াল আছে তার।

যেতে যেতে দেশের কথা হতে লাগল। কোন স্বর্গসুখে দিন কাটিয়েছে, আর পার্টিশানের পর সীমান্তের এপারে এসে পচে মরতে হচ্ছে, এজন্য আক্ষেপের অবধি নেই গুপীবল্লভের। দ্বারিক দত্তও মাথা নেড়ে সায় দিতে লাগলেন।

গুপীবল্লভ অনেক খবর রাখে। সে জানায়, দেশভাগের পর রাজদিয়া এবং তার আশেপাশের নানা অঞ্চলের কারা কারা আসামে ত্রিপুরায় বিহারে বা উত্তর বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের অনেকের ঠিকানা পর্যন্ত জোগাড় করে ফেলেছে। বাকিদেরও খুঁজে বেড়াচ্ছে।

বিনয় অবাক হয়ে শুনছিল। অনেকটা যুগলের মতোই দেশ থেকে উৎখাত হয়ে আসা মানুষ সম্পর্কে লোটার বিপুল আগ্রহ। কী চায় গুপীবল্লভ? যুগলের মতোই কি দেশের পরিচিত মানুষজন জড়ো করে সীমান্তের এপারে পূর্ববঙ্গের সেই ভুখণ্ডটিকে নতুন করে নির্মাণ করতে?

দ্বারিক দত্তও কম অবাক হননি। এত লোকের ঠিকানা কী করে পেলি?

গুপীবল্লভ বলল, একজনের কাছে গ্যালে আরেক জনের খবর পাই। এইভাবে ঘুইরা ঘুইরা অ্যাতগুলান ঠিকানা জুটাইছি।

দ্বারিক দত্তর শুধু নয়, হিরণ এবং বিনয়ের বিস্ময়ও ক্রমাগত বাড়ছিল। হিরণ জিজ্ঞেস করল, আপনি কি দেশের মানুষের ঠিকানার জন্যে এর ওর বাড়ি ঘুরে বেড়ান?

গুপীবল্লভ হেসে হেসে বলল, ঠিকই ধরছেন ছুটো নাতিন জামাইবাবু সুধা-সুনীতির বিয়েতে তালতলি থেকে নেমন্তন্ন খেতে রাজদিয়ায় এসেছিল সে। হেমনাথের সঙ্গে হিরণদের সম্পর্কটা সে জানে।

এইসব ঠিকানা দিয়ে কী হবে?

কামে লাগক। হুদাহুদি (শুধু শুধু) কেউ এ বস্যে (বয়সে) ছুটাছুটি করে?

হিরণ আর কোনও প্রশ্ন করে না।

দ্বারিক দত্ত বললেন, দেশের মানুষের বাড়ি তো ঘোরাঘুরি করে বেড়াস। কাজকর্ম কী করিস? তারিণী সেনের চেলাগিরি করে তো জীবন কাটিয়ে দিলি। তার কাছে কিছু কিছু শিখেছিসও। এপারে এসে কি কবিরাজি করছিস?

হতাশার সুরে গুপীবল্লভ বলল, স্যানকত্তার কাছে যা শিখছিলাম হেয়া গেরামে-গুঞ্জে চলত। কইলকাতার লাখান জবর শহরে কেও স্বন্ন সিন্দুর, সালসা মালসা পোছে না। কত বড় বড় ডাক্তর : আর হাসপাতাল এইখানে! রোগ ব্যারাম হইলে মাইষে হেগো কাছে লৌড়ায়।

তাহলে?

গুপীবল্লভ জানায়, দূর সম্পর্কের যে ভাগনের কাছে সে উঠেছে তারই সংসার চলতে চায় না। দিন আনি দিন খাই অবস্থা। কাজেই নিজের পেটের চিন্তা নিজেকেই করতে হয় তাকে। কলকাতায় তার কবিরাজি অচল। তাই রোজগারের জন্য ভেবেচিন্তে অন্য ফিকির বার করেছে। তারিণী সেন ভাল জ্যোতিষ জানতেন। কবিরাজির সঙ্গে এই বিদ্যেটাও তার কাছ থেকে মোটামুটি শিখে নিয়েছিল গুপীবল্লভ। জ্যোতিষের মার নেই। জীবনে সমস্যা নেই, এমন কোনও মানুষের দেখা আজকাল মেলে না। বিশেষ করে দেশভাগের পর। বেশির ভাগেরই ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। যারা রিফিউজি ক্যাম্পে কি শিয়ালদা স্টেশনে পড়ে আছে তারা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কিন্তু ওপার থেকে যারা কিছু টাকা পয়সা আনতে পেরেছে, এখানে মাথা গোঁজার মতো জায়গাও হয়তো জুটিয়ে নিয়েছে, তাদেরও দুর্ভাবনার শেষ নেই। ছেলের পড়াশোনা বা চাকরি, মেয়ের বিয়ে ইত্যাদি নানা সমস্যায় তারা জর্জরিত। হাতের টাকা ফুরিয়ে গেলে কী খাবে, কী করবে, রোজগারের কোনও উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে কি না– এ-সব জানার জন্য সবাই ব্যাকুল। সুতরাং গুপীবল্লভের দুপয়সা আয় হচ্ছে। জ্যোতিষের সঙ্গে সে আরও একটা কাজ করে। ঘটকালি। অবশ্য খাটতে হয় প্রচুর। লোকের বাড়ি বাড়ি যাওয়া তো আছেই। দূরে যারা থাকে, নিয়মিত চিঠিপত্রে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়।

বিনয়রা এতক্ষণে বুঝতে পারল, এই বয়সে গুপীবল্লভের এত ঘোরাঘুরির কারণটা কী। পেটের জন্য মানুষ কত কী-ই না করছে!

শুপীবল্লভ বলে যাচ্ছিল, আপনেরা দ্যাশের মানুষ। আপনজন। আপনেগো কাছে লুকাছাপা নাই। টাণ্ঠা মাণ্ঠা কইরা বাইচা তো থাকতে হইব। হুদা (শুধু কবিরাজি লইয়া থাকলে না খাইয়া মরতাম। অ্যাতিষ আর ঘটকালি কইরা ভালাই আছি।

দ্বারিক দত্ত গুপীবল্লভকে দেখার পর থেকেই তার পোশাক আশাক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করছিলেন। নানা ব্যাপারে কথা বলতে বলতে প্রসঙ্গটা তোলার সুযোগ হয়নি। এবার জিজ্ঞেস করলেন, যতদূর মনে পড়ে, দেশে থাকতে সাদা ধুতি সাদা জামা পরতিস। এখানে এসে গেরুয়া ধরেছিস কেন?

গুপীবল্লভ বলল, ভ্যাক না ধরলে কি ভিখ মিলে দত্তমশয়? গেরুয়া দ্যাখলে মাইনুষে ভাবে সাধু-সন্ন্যাসী। তাগো মনে ভক্তিভাব জাগে। আমার উপর বিশ্বাস বাইড়া যায়। দ্যাশভাগের পর আগের দিন কি আর আছে? ফন্দিবাজি কইরা না চললে টিকা থাকন মুশকিল।

দ্বারিক দত্ত একটু হাসলেন।

গুপীবল্লভ জানালার বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। মেলা বেইল (অনেক বেলা) হইছে। আপনেরা ছান (স্নান) খাওয়া করেন। আইজ চলি–

দ্বারিক দত্ত ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন, না-না, এই দুপুর বেলা না খেয়ে যাবি কী! এটা একটা কথা হল?

হাতজোড় করে গুপীবল্লভ বলল, আইজ হাতে সোময় নাই। বাগবাজারে একজনের লগে সাড়ে বারোটার ভিতরে দেখা করতে হইব। হের কাছে কিছু টাকা পামু। দেরি করলে দেখা পামু না।

তাহলে আর আটকাব না। মাঝে মাঝে আসিস কিন্তু।

আইতে তো হইবই। বিনয়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে গুপীবল্লভ বলল, উই ছুটোবাবুর লেইগা কতবার আইতে লাগব, ক্যাঠা জানে–

বিনয় প্রথমটা হতবাক। তারপর বলে, আমার জন্যে?

 হ মাথা দোলাতে দোলাতে উঠে দাঁড়ায় গুপীবল্লভ।

কী ব্যাপার বলুন তো?

পরথম দিন আইলাম। আতথা কওনটা (আচমকা বলাটা) ঠিক হইব না। পরে ধীরেসুস্থে কমু। গুপীবল্লভের চোখেমুখে রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে।

দ্বারিক দত্ত এবং হিরণেরও কৌতূহল হচ্ছিল। কথাটা শোনার জন্য তারা প্রায় জোরই করতে থাকে। গুপীবল্লভ কিন্তু কিছুতেই মুখ খুলল না। তার পেল্লায় বাক্সটা তুলে নিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল।

ভীষণ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল বিনয়। কী বলবে নোকটা? ঝিনুকের কথা কি? দেশের মানুষজন যার সঙ্গেই দেখা হোক, শুরুতেই ঝিনুক সম্পর্কে জানতে চায়। কেউ সহানুভূতি জানায়, আহা উঁহু করে, কেউ আভাসে বুঝিয়ে দেয় অমন একটা মেয়ে নিজের থেকে চলে গিয়ে বিনয়কে বাঁচিয়ে দিয়েছে। নইলে সারাটা জীবন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেত।

ঝিনুকের কথা নিশ্চয়ই গুপীবল্লভের জানতে বাকি নেই, কিন্তু তার সম্বন্ধে টু শব্দটিও করেনি সে।

হঠাৎ বিনয়ের মনে হল, ঝিনুক বা হিরণদের সম্পর্কে গুপীবল্লভের খুব একটা আগ্রহ নেই। জাফর শা রোডের এই বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে শুধু তারই জন্য এখানে হানা দিয়েছে, লোকটা। জানিয়ে গেছে, আবারও আসবে। আসবে বার বার।

যে-লোক সীমান্তের এপারে এসে রাতারাতি সাধুর ভেক ধরেছে সে যে খুবই চতুর এবং ধুরন্ধর তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। গুপীবল্লভ তাকে নিয়ে কী মতলব এঁটেছে তার তলকূল পাচ্ছে না বিনয়। তীব্র অস্বস্তি তার মাথায় কাঁটার মতো বিধতে থাকে।

.

২০.

খান মঞ্জিল দেখে আসার পর দুটো দিন কেটে গেছে। অলস। মন্থর। ঢিলেঢালা। বিনয়ের অফিসে জয়েন করতে এখনও কদিন বাকি। কাজকর্মের মধ্যে থাকলে একঘেয়ে লাগে না। কিন্তু আপাতত উপায় কী?

এর ভেতর বাড়ি থেকে বেরোয়নি বিনয়। এই বিশাল শহরে তার চেনাজানা মানুষ খুব কম। একরকম হাতে গোনা। আনন্দদের বাড়ি সে কখনও যাবে না। বিমল গাঙ্গুলিদের বাড়ি যাওয়া যেত। কিন্তু ছায়া মায়ার জন্য এখনও কোনও চাকরি বাকরির ব্যবস্থা করা যায় নি। মদন বড়াল লেনে গেলে ওরা যখন বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে তার মুখের দিকে তাকাবে কী বলবে বিনয়? না, আপাতত সেখানে যাওয়া যাবে না।

ঝুমাদের বাড়ির দরজা তার জন্য সারাক্ষণ খোলা। কিন্তু পাকিস্তান থেকে রামকেশব চলে এসেছেন। কিন্তু সেদিন তিনি ঝিনুক সম্বন্ধে যা সব বলেছেন, জঘন্য এবং কুৎসিত, তারপর আর সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। বিনয় যায়নি।

ঝুমা তাদের কলেজে গিয়ে বার বার দেখা করতে বলেছে। সেখানে অবশ্য যাওয়া যায়। কিন্তু মেয়েটার মধ্যে রয়েছে কী যে প্রচণ্ড আকর্ষণ! কাছে গেলে বিনয়ের মনে হয়, বিচিত্র সম্মোহনে ঝুমা শিরাস্নায়ু অবশ করে দিচ্ছে। মনে হয়, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে! হাতের মুঠি থেকে আলগা হয়ে যাচ্ছে বন্ধু। নিশির ডাকের মতো ঝুমা মাঝে মাঝেই তাকে টানতে থাকে। কিন্তু নিজের অজান্তে যদি তার দিকে পা বাড়াবার কথা বিনয় ভাবেও, ঝিনুকের হাজার স্মৃতি পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাই ঝুমার কলেজে যাওয়া হয়নি।

আশু দত্তর কাছে বা মুকুন্দপুরে গিয়েও খানিকটা সময় কাটিয়ে আসা যেত। কিন্তু এই তত ক দিন আগে আশু দত্তকে নিয়ে যুগলদের কলোনিতে ঘুরে এল। এত তাড়াতাড়ি তাদের কাছে ফের যাওয়ার মানে হয় না।

অনেকদিন থানায় গিয়ে ঝিনুকের খোঁজ নেওয়া হয়নি। বিনয় যে ভবানীপুর থেকে জাফর শা রোডে সুধাদের বাড়ি চলে এসেছে, এই ঠিকানা বদলের খবরটা ওসি দিবাকর পালিতকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মানুষটি সহানুভূতিশীল। বলেছিলেন, রোজ রোজ কষ্ট করে থানায় যাওয়ার দরকার নেই। ঝিনুকের সন্ধান পাওয়া মাত্র তিনি বিনয়ের কাছে লোক পাঠিয়ে দেবেন। কাজেই থানায় যাওয়ার কথা ভাবলেও শেষপর্যন্ত যায়নি।

পরিচিত মানুষজনের কাছে না যাক, সারাক্ষণ বাড়িতে বসে না থেকে একা একা রাস্তায় কি লেকে খানিকটা ঘুরে আসা যেত না? যেত। কিন্তু বিনয়ের মন সায় দেয়নি। তার কারণ ঝিনুক।

সেদিন খান মঞ্জিল দেখে মধুসূদন ভট্টাচার্যের বাড়ি গিয়েছিল বিনয়রা। মধুসূদনের মেয়ে দীপালির কথা শুনতে শুনতে আতঙ্কে সিটিয়ে গেছে সে। আর বার বার ঝিনুকের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। প্রায় একই কাহিনি। করুণ। নিদারুণ কষ্টদায়ক।

ঝিনুককে আর কোনওদিনই পাওয়া যাবে না। তার কথা নতুন করে ভেবে ভেবে এই দুটো দিন আচ্ছন্নের মতো কাটিয়ে দিয়েছে বিনয়।

.

আজ সকাল থেকে জাফর শা রোডের ছোট দোতলা বাড়িটা জুড়ে তুমুল ব্যস্ততা শুরু হয়েছে।

নটা নাগাদ শওকত আলি তার দুই বন্ধু এবং লইয়ারকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন। হিরণ কাল আনন্দদের বাড়ি গিয়ে তাকে আর সুনীতিকে বিশেষ করে বলে এসেছে। ওরা দুজনে তো আসবেই। হিরণ আগেই একজন উকিল ঠিক করে রেখেছিল। তিনিও ওই সময়েই চলে আসবেন। আজই হিরণদের রাজদিয়ার জমিজমা এবং বাড়ির সঙ্গে শওকত আলিদের খান মঞ্জিল এক্সচেঞ্জের পাকা ব্যবস্থা করা হবে। প্রায় মাস দুয়েক ধরে ব্যাপারটা কথাবার্তার স্তরে ছিল। সুধা আর সরস্বতী যেভাবে বেঁকে বসেছিলেন তাতে কী হতো, বলা মুশকিল। এবার সব অনিশ্চয়তার অবসান। হিরণরা খান মঞ্জিল-এর পুরোপুরি মালিকানা পেয়ে যাবে।

শওকত আলির সঙ্গে তার যে দুই বন্ধুর আসার কথা তারা এক্সচেঞ্জের সাক্ষী হবেন। উকিলরা বিনিময়ের যে বয়ান ঠিক করে স্ট্যাম্প কাগজে টাহপ করিয়ে নিয়েছেন তাতে ওই দুজনের সই থাকবে। আর হিরণদের তরফে সাক্ষী হবে বিনয় আর আনন্দ। আনন্দ আসবে আর সুনীতি আসবে না, তাই কখনও হয়? কলকাতায় আত্মীয় পরিজন বলতে তো একমাত্র ওরাই। এমন একটা শুভ কাজে আনন্দ সুনীতিরা না থাকলে চলে?

এতগুলো মানুষ আসবে। তাদের আপ্যায়নে যাতে বিন্দুমাত্র খুঁত না থাকে সেজন্য ভোরে ঘুম ভাঙার পর থেকেই তোড়জোড় চালাচ্ছে সুধা। হিরণের রুণ জেঠিমা তার দুর্বল, অথর্ব শরীর টেনে টেনে সুধাদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন। না বললে শুনছেন না। কারও নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই এখন।

কালই বেশ খানিকটা কাজ এগিয়ে রেখেছে সুধারা। বাড়িটা ধুয়েমুছে তকতকে করে তোলা হয়েছে। বাইরের ঘরের সোফার গদির ওয়াড় আর পদাগুলো পালটে ফেলেছে তারা। মেঝেতে পেতে দিয়েছে রঙিন জুটের কার্পেট।

হিরণ অফিস থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েছিল। আজ আর সময় পাওয়া যাবে না। তাই কালই বাজার করে রেখেছে। বাড়ির লোকজন তো বটেই, তবে বিশেষ করে অতিথিদের, অর্থাৎ শওকত আলি, তার দুই বন্ধু এবং দুপক্ষের উকিলদের জন্য হবে লুচি, বেগুনভাজা, আলুভাজা, আলুকপির তরকারি, ছোলার ডাল। তাছাড়া দ্বারিক ঘোষের দোকান থেকে প্রচুর মিষ্টি আর চিনিপাতা দইও এনে রাখা হয়েছে।

সম্পত্তি বিনিময়ের কাজ সারতে বড় জোর ঘণ্টাখানেক কি ঘণ্টাদেড়েক। তারপর শওকতরা লুচি মিষ্টি খেয়ে চলে যাবেন। কিন্তু আনন্দ আর সুনীতিদের ছাড়া হবে না। সারাদিন এখানে কাটিয়ে সন্ধের পর তারা বাড়ি ফিরবে। তাদের জন্য রান্নার আয়োজনও কম হয়নি। তিন রকমের মাছ হবে। পাঁঠার মাংসের কোর্মা হবে। তাছাড়া নিরামিষ পদ আর দুইমিষ্টি তো আছেই।

নটা বাজতে না বাজতেই সবাই আসতে শুরু করল। প্রথমে সবান্ধবে উকিলসমেত এলেন শওকত আলি। ওঁরা এসেছেন ঘোড়ার গাড়িতে। হিরণরা প্রস্তুত হয়েই ছিল। বিনয়কে সঙ্গে করে সে খুব খাতির করে দোতলার বসবার ঘরে শওকতদের নিয়ে এল। দ্বারিক দত্ত সেখানেই ছিলেন। বুড়ো মানুষ। তার পক্ষে সিঁড়ি ভেঙে ওঠা-নামা করা কষ্টকর। 

শওকতদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন দ্বারিক দত্ত। হাতজোড় করে বললেন, বসুন, বসুন। আমার বয়েস সত্তর। শরীরও কাহিল হয়ে পড়েছে। তাই আপনাদের নিচে গিয়ে নিয়ে আসতে পারিনি।

আদাব জানিয়ে শওকত আলি বিব্রতভাবে বললেন, নানা, আপনি গেলে আমাদের খুব খারাপ লাগত। আদি বাড়ি বিহারে হলেও তিন পুরুষ কলকাতায় আছেন। পরিষ্কার বাংলা বলেন। বিন্দুমাত্র জড়তা নেই।

দ্বারিক দত্ত আগে শওকত আলিকে দেখেননি। তবে আন্দাজ করে নিয়েছিলেন। সকলে বসার পর হিরণ তাঁর সঙ্গে শওকতের পরিচয় করিয়ে দিলেন।

শওকত আলির বয়স চুয়ান্ন পঞ্চান্ন। দাড়িগোঁফ কামানো, লম্বাটে মুখ। মাথায় কাঁচাপাকা চুল ছোট করে ছাঁটা। চোখের তলায় কালির ছোপ। পরনে ঢোলা ফুল প্যান্ট আর লম্বা ঝুলের শার্টের ওপর মোটা উলের পুল-ওভার। পায়ে ফিতে-বাঁধা কাবলি চপ্পল। সমস্ত চেহারায় কেমন যেন বিষাদ মাখানো।

শওকত তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে দ্বারিক দত্তদের আলাপ করিয়ে দিলেন। তার বন্ধুদের একজন বেশ সুপুরুষ। টকটকে রং। মেদহীন শরীর। গালে অল্প অল্প দাড়ি। পরনে পাজামা এবং চিকনের কাজ করা ধবধবে পাঞ্জাবির ওপর শাল। শওকতেরই সমবয়সী হবেন। কলুটোলায় ওঁর আতর-সুর্মার কারবার। নাম সালমান সিদ্দিকি। ওঁরা উত্তরপ্রদেশের মুসলমান। তবে শওকতদের মত এই শহরের কয়েক পুরুষের বাসিন্দা।

শওকত আলির দ্বিতীয় বন্ধুটিও অবাঙালি। ওরা হায়দরাবাদের লোক। নাম শেখ মুনাব্বর। বেজায় ঢ্যাঙা এবং বোগা। চোখ কোটরে ঢোকানো। ভাঙা গালে ঘন দাড়ি। পরনে ঢোলা শেরওয়ানি কুর্তার ওপর লম্বা কোট। টেরিটি বাজারে তার বিরাট ফলের ব্যবসা।

ওঁদের উকিলটি হলেন নৃসিংহ রাহা। গোলাকার মাংসল চেহারা। গোল মুখ। গোল গোল চোখে গোল বাই-ফোকাল চশমা। পরনে ঢলঢলে সাদা প্যান্ট আর সাদা শার্টের ওপর কালো কোট।

শওকতরা আসার মিনিট পনেরো পর আনন্দ আর সুনীতি এল। ওরা এসেছে ট্যাক্সি করে। আনন্দ ওপরে উঠে বাইরের ঘরে বসল। সুনীতি সোজা চলে গেল ভেতর দিকে। সুধাদের কাছে।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হলেন হিরণের লইয়ার সুরঞ্জন লাহিড়ি। বয়স ষাটের ধারে কাছে। অটুট স্বাস্থ্য তাঁর। এই বয়সেও দুচারটের বেশি চুল পাকেনি। দাঁতগুলো সবই আসল এবং সাদা ধবধবে। চওড়া কপাল। মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে শান্ত চোখ দুটিতে গভীর দৃষ্টি। যার দিকে তাকান, মনে হয় তার বুকের তল পর্যন্ত দেখতে পান। সমস্ত চেহারায় অদ্ভুত এক বুদ্ধির ঝলক। পরনে উকিলদের পোশাক। সাদা শার্ট এবং কালো কোট।

আনন্দ এবং সুরঞ্জনের সঙ্গে শওকতদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। অবশ্য সুরঞ্জন এবং নৃসিংহ রাহা পরস্পরকে চেনেন। পেশা এক। কাজের সূত্রে কোর্টে রোজই তাদের দেখা হয়। চেনাই তো স্বাভাবিক।

দ্বারিক দত্ত বয়সে সবার বড়। নিজেই আজকের অনুষ্ঠানের পরিচালকের দায়িত্ব তুলে নিলেন। কাজ শুরু করার আগে একটু চা খাওয়া যাক।

নৃসিংহ রাহা বললেন, শুধু চা কিন্তু

দ্বারিক দত্ত বললেন, আপাতত। কাজ হয়ে যাবার পর মিষ্টিমুখ না করিয়ে কিন্তু ছাড়ছি না।

সবাই হাসিমুখে চুপচাপ বসে থাকেন। যে কারণে আজ এখানে তারা জড়ো হয়েছেন সেটা সুচারুভাবে সমাধা হয়ে গেলে মিষ্টিমুখে কারও আপত্তি নেই।

হিরণকে বলতে হল না, ব্যস্তভাবে ভেতরে চলে গেল। দশ মিনিটের ভেতর সে আর উমা দুটো বড় ট্রেতে কয়েক কাপ চা আর প্লেট বোঝাই করে বিস্কুট এনে সেন্টার টেবলে রাখল।

চা খেতে খেতে দ্বারিক দত্ত শওকতকে বলেন, আপনাদের বাড়ি সেদিন দেখে এলাম। হিরণ সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল।

 শওকত জিজ্ঞেস করেন, কেমন লাগল আমাদের বাড়ি?

ভাল। বেশ মজবুত মনে হল।

আমার আব্বাজান প্রায় সত্তর বছর আগে খুব যত্ন করে সেরা মেটিরিয়াল দিয়ে বাড়িটা তৈরি করিয়েছিলেন। চারতলার ভিত। একটু সারিয়ে টারিয়ে নিলে আরও পঞ্চাশ ষাট বছর নিশ্চিন্তে থাকা যাবে।

হিরণ এইসময় বলে ওঠে, আপনাদের বাড়ি তো আমরা দেখেছি। কিন্তু আমাদের রাজদিয়ার বাড়ি, জমিজমা সম্বন্ধে খোঁজ নেবেন বলেছিলেন। নিতে পেরেছিলেন কি?

হিরণের সঙ্গে শওকতের আগেই কথা হয়েছিল, টালিগঞ্জে তাঁদের তেতলা বাড়ির বিনিময়ে পাকিস্তানে তারা হিরণদের বিষয় সম্পত্তি কী পাবেন, সে ব্যাপারে যেন ভাল করে খবর নেন। দেশের যা অবস্থা, হিরণদের পক্ষে রাজদিয়ায় গিয়ে সে-সব দেখানো সম্ভব নয়। পরে যেন শওকতের মনে না হয়, তারা তাকে ঠকিয়েছে। শওকত জানিয়েছিলেন, এক আত্মীয় বেশ কিছুদিন আগে বাড়ি এক্সচেঞ্জ করে কলকাতা থেকে নারায়ণগঞ্জে চলে গেছে। নাম জাহাঙ্গির চৌধুরি। শওকত তাকে খবর পাঠিয়েছিলেন, সে যেন রাজদিয়ায় গিয়ে হিরণদের বাড়িটাড়ি নিজের চোখে দেখে আসে।

শওকত বললেন, হ্যাঁ। জাহাঙ্গির লোক মারফত আমাকে জানিয়েছে, আপনাদের বাড়িও খুব ভাল। চাষের জমিগুলোতে তিনবার ফসল হয়। এই ধরনের প্রপার্টিই আমি চাইছিলাম।

দ্বারিক দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, আপনি খুশি তো?

হ্যাঁ, খুশি।

 চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল।

উকিল সুরঞ্জন লাহিড়ি বললেন, বারোটা নাগাদ আমাকে অন্য এক জায়গায় পৌঁছতে হবে। এবার কাজটা সেরে ফেলা যাক।

সবাই তার কথায় সায় দিলেন।

ভারত এবং পাকিস্তান, এই দুই দেশে সম্পত্তি বিনিময়ের প্রক্রিয়াটা খুব একটা জটিল নয়। দ্বারিক দত্তর নামে রয়েছে রাজদিয়ার জমি-বাড়ি-বাগান-পুকুর ইত্যাদি। তিনি স্ট্যাম্প কাগজে সেগুলো দানপত্র করে দেবেন শওকত আলি খানকে। সাক্ষী থাকবে তার এবং শওকতের তরফে দুজন করে চারজন। একই পদ্ধতিতে শওকতও তার বাড়ি দ্বারিক দত্তকে লিখে দেবেন।

শওকতের দানপত্রের বয়ানটা আগেই তৈরি করেছিলেন তার উকিল নৃসিংহ রাহা। সেটা দ্বারিক দত্তদের উকিল সুরঞ্জন লহিড়ি খুঁটিয়ে দেখার পর সামান্য অদল বদল করে দুকপি টাইপ করা হয়েছে। একটা কপি আগেই সুরঞ্জনের কাছে পাঠানো হয়েছিল। অ্যাটাচি কেস থেকে সেট বার করে তিনি পড়তে লাগলেন।

আমি শওকত আলি খান, পিতা মরহুম রহমত আলি খান, পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত কলিকাতাস্থ টালিগঞ্জের ১৮/২ আমিনুল হক স্ট্রিটে অবস্থিত ত্রিতল বসত গৃহ খান মঞ্জিল, মোট জমির পরিমাণ ছয় কাঠা সাড়ে তিন ছটাক, নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে, সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্ণে, বর্তমানে কলিকাতাস্থ টালিগঞ্জের ১৩-এ জাফর শা রোডের বাসিন্দা, শ্রীদ্বারিক দত্তকে, পিতা রাজারাম দত্ত, আদি নিবাস পূর্ববঙ্গের (বর্তমানে পাকিস্তান) ঢাকা জিলার রাজদিয়া শহর, বিনামূল্যে দানপত্র করিয়া দিলাম। উক্ত খান মঞ্জিল-এর উপর এই দানপত্রে স্বাক্ষর করার মুহূর্ত হইতে আমার বা আমার পুত্রকন্যা বা আমার পরিবারের কাহারও কোনও অধিকার রহিল না। শ্রীদ্বারিক দত্ত মহাশয় এবং তাহার উত্তরাধিকারীরা অদ্য হইতে পুরুষানুক্রমে উহা ভোগদখল করিবেন।

পড়া হয়ে গেলে টাইপ-করা কাগজটা এবং একটা কলম শওকত আলির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সুরঞ্জন লাহিড়ি বললেন, নিচে সই করে দিন। তারপর সাক্ষীরা সই করবেন।

নীরবে কাগজটা টেবলে রেখে, কলম ধরে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন শওকত। তার হাত ভীষণ কাঁপছিল, বার বার ঢোক গিলছিলেন। কণ্ঠমণিটা ক্রমাগত ওঠা-নামা করছে। দুচোখ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরতে লাগল তার।

সমস্ত ঘরটা লহমায় নিঝুম হয়ে গেল। তীব্র একটা কষ্ট ভেতরে ভেতরে শওকত আলি খানকে যে ভেঙেচুরে ফেলছে তা বুঝতে পারছিল বিনয়রা। এই যাতনার কারণটাও খুব স্পষ্ট।

অনেকটা সময় কেটে গেল।

উকিল বা ডাক্তারদের পেশাটাই এমন যে সহজে তারা অস্থির হয়ে পড়েন না। তবে নৃসিংহ রাহা সামান্য বিচলিত হয়েছিলেন। ঘরের নৈঃশব্দ্য ভেঙে একসময় নরম গলায় বললেন, সইটা করে ফেলুন শওকত সাহেব ।

শওকত আলি খান যেন শুনতেই পাচ্ছেন না। এই জগতেই বুঝি বা তিনি নেই। বহু দূরে, অন্য কোনও গ্রহে চলে গেছেন।

শওকতের পিঠে একখানা হাত রেখে নৃসিংহ বলতে লাগলেন, পাকিস্তানে চলে যাওয়াই যখন মনস্থ করে ফেলেছেন তখন শেষ মুহূর্তে এপারের বিষয় সম্পত্তির জন্যে মায়া করে কী লাভ? তাতে শুধু দুঃখ বাড়বে।

শওকত যেন ফের এই ঘরে ফিরে এলেন। হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে ধরা ধরা গলায় বললেন, ঠিকই বলেছেন রাহা সাহেব। পিছুটান রেখে লাভ নেই। বলে দানপত্রের নিচে সই করে দিলেন। তারপর বললেন, কত সাল আমরা ইন্ডিয়ায় আছি। আমার বাপজান, দাদা, পরদাদা, তাঁদের বাপ দাদা, পরদাদারা। জেনারেশনের পর জেনারেশন। এখন থেকে আমরা আর এ-দেশের কেউ না। পুরোপুরি বিদেশি হয়ে গেলাম– তাঁর স্নায়ুমণ্ডলী ভেদ করে অফুরান আক্ষেপ বেরিয়ে এল। সর্বস্ব হারানোর বেদনা।

নৃসিংহ রাহা পেশাদার কাজের লোক। মক্কেলের দুঃখে বেশিক্ষণ কাতর হয়ে থাকলে তার চলে না। এবার তিনি যান্ত্রিক নিয়মে সাক্ষীদের দিয়ে সইগুলো করিয়ে নিলেন। সইয়ের সঙ্গে তাদের ঠিকানা এবং তারিখ লিখিয়ে নেওয়া হল। মোট চারজন সাক্ষী।

শওকতের দুই বন্ধু তো বটেই, সেই সঙ্গে হিরণ আর বিনয়।

নৃসিংহ বললেন, আজকাল যেভাবে এক্সচেঞ্জ চলছে তাতে স্ট্যাম্প কাগজে সই-ই যথেষ্ট। তবে যদি মনে করেন, কোর্টে গিয়ে রেজিস্ট্রি করিয়ে নিতে পারেন।

শওকত বললেন, আপনি যেটা ভাল মনে করেন তাই করবেন।

হিরণ আগাগোড়া শওকত আলি খানকে লক্ষ করছিল। কথা বলছেন ঠিকই, কিন্তু কেমন যেন স্রিয়মাণ। সারা মুখে বিষাদ মাখানো। জন্মভূমির সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক ছিঁড়ে চিরকালের জন্য চলে যাওয়া কি সোজা কথা! কতকাল ধরে লোকটার বুকের ভেতর গোপনে রক্তক্ষরণ হতে থাকবে, কে জানে।

হিরণ ডাকল, শওকত সাহেব ।

শওকত মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।

হিরণ বলতে লাগল, আপনার কষ্টটা বুঝতে পারি। কেন না আমরাও ভুক্তভোগী। দেশ ছেড়ে আমাদেরও চলে আসতে হয়েছে। সারা জীবনে এ দুঃখ ঘুচবে না।

এ-সব আবেগের কথা একবার শুরু হলে থামতে চায় না। সুরঞ্জন লাহিড়ির চলে যাবার তাড়া ছিল। তিনি কাজের কথায় চলে এলেন। নৃসিংহ রাহার কাছে দ্বারিক দত্ত এবং শওকত আলি খান, দুজনেরই টাইপ-করা দানপত্র ছিল। তিনি নৃসিংহকে বললেন, এবার দ্বারিক দত্ত মশায়ের দানপত্রটা পড়ে শোনান।

হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ব্যাগ থেকে টাইপ-করা পাকিস্তানের স্ট্যাম্প পেপার বার করলেন নৃসিংহ।

 হিরণ হতবাক। কিছুক্ষণ পলকহীন তাকিয়ে থাকার পর বলল, পাকিস্তানি স্ট্যাম্প পেপার কোথায় পেলেন?

নৃসিংহর চোখ দুটো আধাআধি বুজে গেল। গোলাকার মুখে মিটি মিটি, চতুর হাসি ফুটে উঠেছে। লোকটা যে অতীব ধুরন্ধর সেটা ওই হাসিই বুঝিয়ে দেয়। বললেন, কোথায় পেলাম, কীভাবে পেলাম, সে-সব অবান্তর। রিফিউজি ছাড়াও রেগুলারলি কিছু লোক এপার থেকে বর্ডারের ওপারে যাচ্ছে। ওপার থেকে এপারে আসছে। তাদের কারও সঙ্গে দুচারটে পাকিস্তানি স্ট্যাম্প পেপার চলে আসা কি অসম্ভব ব্যাপার? না কী বলেন লাহিড়ি সাহেব? সুরঞ্জন লাহিড়ির দিকে একবার চকিত দৃষ্টিক্ষেপ করে, মুখ ফিরিয়ে টাইপ-কৰা লেখা পড়তে শুরু করলেন।

দ্বারিক দত্তর দানপত্রের বয়ান অবিকল শওকত আলি খানের বয়ানের মতোই। শুধু নামধামগুলো আলাদা। এখানে দ্বারিক দত্তর বাবা ও ঠাকুরদার নাম এবং রাজদিয়ায় তাদের বসত-বাড়ি এবং চাষের জমির অনুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। পড়া শেষ হলে সেটা দ্বারিক দত্তর দিকে এগিয়ে দিয়ে সই করতে বললেন নৃসিংহ রাহা।

শওকতের মতো ততটা ভেঙে পড়েননি দ্বারিক দত্ত। দানপত্রে সই করে বিমর্ষ সুরে বললেন, দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও চিরকালের মতো চুকেবুকে গেল। শওকতের দিকে ফিরে বললেন, আমাদের রাজদিয়ার বাড়ির তালাগুলোর দুগোছা করে চাবি আছে। এক গোছা হিরণ আপনাকে আগেই দিয়েছিল। অন্যটা আজই দিয়ে দেব। স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে আপনারা গিয়ে সেখানে সুখে শান্তিতে থাকুন। বলতে বলতে তার বুকের অতল স্তর ঠেলে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

ঘরের আবহাওয়া আগেই ভারী হয়ে উঠেছিল। চারপাশে বিষাদ আরও ঘন হতে লাগল।

হাতজোড় করে শওকত আলি খান বললেন, আপনি, আপনার বাপদাদা, পরদাদা, ছেলে নাতি– কতকাল ধরে সবাই রাজদিয়ায় বাস করে এসেছেন। আমরা গিয়ে থাকব ঠিকই। কিন্তু ও-বাড়ি আপনাদেরই। পাকিস্তানে গেলে ওখানেই উঠবেন। আপনাদের জন্যে সবসময় একখানা ঘর তালাবন্ধ থাকবে। যখন যা, ওটা খুলে দেওয়া হবে।

ধন্যবাদ জানিয়ে দ্বারিক দত্ত বললেন, আমার যা বয়েস তাতে কি আর কোনওদিন পাকিস্তানে যেতে পারব! তাছাড়া ওখানকার যা হাল! সেই বাকিটা আর শেষ করলেন না।

শওকত আলি খান বললেন, চিরকাল কি এমন হাল থাকবে? সব বদলে যাবে চাচাজি দ্বারিক তার বাবার না হলেও কাকার বয়সী তো হবেনই। তাই চাচাজি বলা।

দ্বারিক দত্ত উত্তর দিলেন না।

শওকত এবার বললেন, আপনি যেতে না পারেন, হিরণবাবু আছেন। তার বয়েস কম, অনেক দিন বেঁচে থাকবেন। দেশের বাড়ি দেখতে যাবার ইচ্ছে কি কখনও তার হবে না?

দ্বারিক দত্ত বললেন, হয়তো হবে। হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, উকিলবাবুরা যদি মনে করেন, আপনার দানপত্রটা এখানে রেজিষ্ট্রি হতে পারে, কিন্তু আমি পাকিস্তানে গিয়ে আমার দানপত্র রেজিস্ট্রি করে দিয়ে আসতে পারব না।

শওকত বললেন, আপনাকে এজন্যে কষ্ট করে এখন বর্ডারের ওপারে যেতে হবে না। তিনি সবিস্তার জানালেন, তার এত্মীয় জাহাঙ্গির যে হিন্দু ভদ্রলোকটির সঙ্গে প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ করে নারায়ণগঞ্জে চলে গেছেন তিনি অনেক আগেই বাড়িঘর এক বিশ্বাসী মুসলমান বন্ধুর হেফাজতে রেখে কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলেন। জাহাঙ্গিরের সঙ্গে এক্সচেঞ্জের কথাবার্তা তার কলকাতাতেই হয়েছিল। তিনি দ্বারিক দত্তর মতোই পাকিস্তানি স্ট্যাম্প পেপারে দানপত্র করে দিয়েছিলেন কিন্তু নিজে নারায়ণগঞ্জে আর যাননি। জাহাঙ্গির কীভাবে যেন আইনের দিক থেকে সেটা বৈধ করিয়ে নিয়েছে। শওকত আলি খানকে সে জানিয়ে দিয়েছে, সেরকম দরকার হলে সব ব্যবস্থা সে-ই করে দেবে। শওকত যত তাড়াতাড়ি পারেন দ্বারিক দত্তকে দিয়ে দানপত্র লিখিয়ে যেন পাকিস্তানে চলে যান।

তাহলে তো ভালই হয়।

একটু চুপচাপ।

তারপর দ্বারিক দত্ত ফের বলতে লাগলেন, পাকিস্তানে গেলে রাজদিয়ার বাড়িতে গিয়ে যে আমাদের থাকতে বলেছেন তাতে মন ভরে গেছে। একটা অনুরোধ করছি।

উৎসুক চোখে দ্বারিক দত্তর মুখের দিকে তাকান শওকত, কী অনুরোধ?

ইন্ডিয়ায় এলে আপনিও আপনাদের খান মঞ্জিল-এ এসে থাকবেন। যে ক দিন ইচ্ছে, থেকে যাবেন। কোনওরকম সংকোচ করবেন না।

বিনয় অবাক হয়ে শুনছিল। এই দ্বারিক দত্তই কিছুদিন আগে মুসলমানের প্রপার্টির সঙ্গে রাজদিয়ার বাড়িঘর এক্সচেঞ্জ করতে চাননি। অন্ধ সংস্কার তার রক্তে ডালপালা ছড়িয়ে রেখেছে কতকাল ধরে। তিনিই কিনা শওকতকে তাদের কাছে এসে থাকার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।

 শওকত বললেন, অনেক ধন্যবাদ চাচাজি। নতুন দেশে যাচ্ছি। সব গোছগাছ করে বসতে কতদিন লাগবে, কে জানে। ইন্ডিয়ায় কবে আসতে পারব তার ঠিক নেই। একটু চুপ করে থাকার পর হেসে ফের বললেন, তবে মরার আগে একবার আসবই। মানুষ যেখানে জন্মায়, যেখানে তার জীবনের বেশির ভাগটাই কেটে গেছে, সেই জায়গার ওপর নাড়ির টান থাকে, তাই না?

দ্বারিক দত্ত তো বটেই, ঘরের সবাই আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।

শওকত আলি খান কী ভেবে একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যান, নতুন দেশে যাচ্ছি। সমস্ত কিছুই অজানা। আমার চেনা যারা কলকাতা থেকে পাকিস্তানে চলে গেছে তাদের বেশির ভাগই উঠেছে ঢাকায়, কেউ কেউ নারায়ণগঞ্জে। শুনেছি রাজদিয়া থেকে সে-সব টাউনে যেতে লঞ্চে পাঁচ সাত ঘণ্টা সময় লাগে। ওদের সঙ্গে চট করে দেখা করার উপায় নেই। এদিকে রাজদিয়ার কারওকে চিনি না। সেখানকার মানুষজন কীরকম হবে, আমাদের তারা পছন্দ করবে কি না, কে জানে। হয়তো নানা ঝাটে পড়তে হবে।

শওকত আলি খানকে বেশ ভাল লাগছিল বিনয়ের। মানুষটি ভদ্র। আবেগপ্রবণ। তিনি বুঝতে পারছিলেন, পিতৃভূমির সঙ্গে চিরকালের মতো সম্পর্ক চুকিয়ে অন্য দেশে চলে যেতে তার যে কষ্ট হচ্ছে ঠিক তেমনটাই হচ্ছে দ্বারিক দত্তদেরও। এখনকার উত্তেজনা, অশান্তি কেটে সুদিন এলে পাকিস্তানে গিয়ে তাদের কাছে হিরণদের থেকে আসার জন্য বলেছেন শওকত আলি। সেটা শুধু মুখের কথা নয়। যথেষ্ট আন্তরিকও। কিন্তু তার শেষ কথাগুলো শুনে চমকে উঠেছে বিনয়।

আবহমান কালের ভারতবর্ষকে ছিন্ন করে মুসলমানেরা আলাদা একটা ভূখণ্ড চেয়েছিল। সম্পূর্ণ নিজস্ব এক দেশ। নতুন মুসলিম জাহান। সেজন্য কত যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। কত দাঙ্গা। কত হত্যা। কলকাতা-নোয়াখালি-বিহার-পাঞ্জাব, সমস্ত ভারত জুড়ে কত যে রক্তের স্রোত বয়ে গেছে! শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান কায়েম হল। আর সেখানেই ছেলেমেয়ে স্ত্রী, সবাইকে নিয়ে সপরিবারে চলে যাচ্ছেন শওকত। সদ্যোজাত মুসলিম দেশটিতে যাবেন, সেজন্য তার উল্লসিত হবার কথা। খুশিতে আত্মহারা। কিন্তু অপরিচিত পরিবেশে স্থানীয় লোকজন দুহাত বাড়িয়ে তাঁদের বুকে টেনে নেবে কি না, সে সম্বন্ধে শওকতের যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

বিনয় কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই শওকত জিজ্ঞেস করেন, আপনারা রাজদিয়ায় জেনারেশনের পর জেনারেশন কাটিয়ে এসেছেন। ওখানকার মানুষগুলো কেমন? এখন থেকে তাদের সঙ্গেই তো আমাদের থাকতে হবে। বুঝতেই তো পারছেন, পড়োশি মনের মতো না হলে সুখশান্তি সব খতম। সারাক্ষণ ঝামেলা, অশান্তি নিয়ে থাকতে কি ভাল লাগে?

বিনয় ইতস্তত করতে থাকে। রাজদিয়া একসময় ছিল শান্ত। নির্ঞ্ঝাট। খাল-বিল-নদী আর অবারিত ধানের খেত দিয়ে ঘেরা প্রকৃতির সেই চোখজুড়ানো ভূমণ্ডলে কোথাও কোনও উত্তেজনা ছিল না। জীবন ধীর চালে বয়ে যেত। তিরতিরে, স্রোতের মতো। বাসিন্দারা ছিল সাদাসিধে। অকপট। তাদের চোখেমুখে সারল্য মাখানো থাকত। কিন্তু গেল কবছরে সব আমূল বদলে গেছে। এখন সর্বক্ষণ ভয়। আতঙ্ক। পারস্পরিক অবিশ্বাস। এসব বলতে গিয়ে থেমে গেল বিনয়।

কিন্তু উত্তরটা দিলেন দ্বারিক দত্ত, রাজদিয়ার মানুষ খুবই ভাল ছিল। এতকাল আমরা কী আনন্দে যে পাশাপাশি থেকে এসেছি। কিন্তু এখন আর আগের মতো সবকিছু নেই। তবে —

সামনের দিকে ঝুঁকে শওকত জিজ্ঞেস করলেন, তবে কী?

 আপনাদের কোনও ভয় নেই। আপনারা বিপদে পড়েন, এমন কিছুই ওরা করবে না।

ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। স্বজাতের মানুষজনকে রাজাকাররা নিশ্চয়ই রেহাই দেবে।

তবু কোথায় যেন খানিক ধন্দ থেকেই যায় শওকতের। একটু চিন্তা করে তিনি বলেন, আপনার একটা পরামর্শ চাইছি চাচাজি

বলুন

রাজদিয়ায় গিয়ে যদি অসুবিধায় পড়ি, কার কাছে যাব? মানে যিনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন দ্বারিক দত্ত। তারপর বলেন, একজনের কথা বলতে পারি। নির্দ্বিধায় আপনি তার কাছে যেতে পারেন।

কে তিনি?

আমার বন্ধু হেমনাথ মিত্র। বিনয়ের দাদা (দাদু)। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, পার্টিশান হয়ে যাবার পর লাখ লাখ হিন্দু ইন্ডিয়ায় চলে এসেছে। রোজই দলে দলে আসছে। আবার লক্ষ লক্ষ হিন্দু পাকিস্তানে থেকেও গেছে। তারা ভিটেমাটি ছেড়ে ইন্ডিয়ায় আসবে না। হেমনাথ তাদেরই একজন। রাজদিয়ার সে সব চাইতে রেসপেক্টেড পার্সন। আমাদের সেই ছোট্ট টাউনটা ঘিরে তিরিশ চল্লিশটা গ্রামের সব মানুষ, হিন্দুই হোক কি মুসলমান হোক, তাকে সম্মান করত। যতদূর জানি, এখনও করে। হেমনাথ যে আজীবন কত মানুষকে কত ভাবে সাহায্য করেছেন, বিপদের দিনে সবার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে দ্বারিক দত্ত বললেন, সে কারওকে ফেরায় না। তার দরজা সব সময় সকলের জন্যে খোলা।

শওকতের দুর্ভাবনা কিছুটা কেটে যায়। উৎসুক সুরে বলেন, মেহেরবানি করে আমার সম্বন্ধে, ওঁকে একটা চিঠি লিখে দেবেন?

নিশ্চয়ই দেব। আপনি তো এখনও কদিন ইন্ডিয়ায় আছেন। চিঠিটা এর মধ্যে লিখে রাখব। আপনি নিজে এসে নিয়ে গেলে খুশি হব। কারণ আপনার সঙ্গে আর একবার দেখা হবে। নইলে কারওকে পাঠাবেন। তার হাতে দিয়ে দেব।

আমি নিজেই আসব।

 খুব ভাল।

হঠাৎ বিনয়ের মনে হয়, দ্বারিক দত্ত বেশ কিছুদিন আগে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছেন। দেশের হাল তখন যা দেখে এসেছিলেন, এর ভেতর তার চাইতে ঢের খারাপ হয়ে গেছে। এখন আতঙ্ক অনেক বেশি তীব্র। দিনকে দিন সমস্ত বদলে যাচ্ছে। আজ যতটা খারাপ, কাল তার চেয়ে আরও খারাপ। হেমনাথ এই মুহূর্তে কী অবস্থায় আছেন, বিপুল সম্মান নিয়ে তার পক্ষে পাকিস্তানে থাকা সম্ভব হচ্ছে কি না, কিছুই জানা নেই।

নিত্য দাস তার যে চিঠিখানা দিয়ে গিয়েছিল, তারপর দুসপ্তাহের মতো কেটে গেছে। এর মধ্যে রাজদিয়ায় কী ঘটে চলেছে, কলকাতায় বসে সেই সব ঘটনাপ্রবাহের হদিস পাওয়া অসম্ভব। নিত্য দাসও আর আসেনি যে তার কাছ থেকে সেখানকার কোনও খবর পাওয়া যাবে। প্রয়োজন হলে শওকতের জন্য হেমনাথের পক্ষে এই মুহূর্তে কতটা কী করা সম্ভব, সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

চকিতে অন্য একজনের মুখ বিনয়ের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মোতাহার হোসেন চৌধুরি। হেমনাথের পর ওই অঞ্চলের সবচেয়ে সম্মানিত মানুষ। হিন্দু মুসলমানের বিভাজন কোনওদিনই মেনে নেননি। দুই সম্প্রদায়ের ভেদ-বিভেদ যখন মাথা চাড়া দিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছল, কী কষ্টই না পেয়েছেন! দেশভাগের পর একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। বিনয় তো সেইসময় দেখেছে, সারাক্ষণ মুহ্যমান হয়ে থাকতেন মোতাহার হোসেন। মনে হতো, মানুষ নয়, একটা ভগ্নস্তূপ।

সেই ছেচশ্লিশ সাল থেকে রাজদিয়ার বেশির ভাগ লোকজন রাতারাতি পালটে গেল। দুদিন আগেও যারা হেসে হেসে কথা বলত, তাদের মুখ থেকে হাসি উধাও হল। তখন তাদের দুচোখে ঘৃণা। সন্দেহ। কিন্তু মোতাহার হোসেন চৌধুরি একই রকম থেকে গেলেন। হেমনাথের মতো তিনিও অন্যের জন্য দুহাত বাড়িয়ে রেখেছেন।

মোতাহার হোসেনের কী জাত, কোন সম্প্রদায়, এ নিয়ে রাজদিয়ার কেউ কখনও মাথা ঘামায়নি। তিনি মাস্টার মশায়, শ্রদ্ধেয় গুরুজন। ব্যস, এ-ই ছিল তার একমাত্র পরিচয়। বাকি সব কিছুই অনাবশ্যক। অর্থহীন।

কিন্তু এই মুহূর্তে আচমকা বিদ্যুৎচমকের মতো বিনয়ের মাথায় যা খেলে গেল তা হল, মোতাহার হোসেন হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক বিদ্বেষ যতই অপছন্দ করুন, দেশভাগ যতই তার বুকে শেল বিধিয়ে দিক, তিনি একজন মুসলমান। পাকিস্তানের এখন যা পরিস্থিতি তাতে হেমনাথ মিত্রের চেয়ে মোতাহারই হয়তো অনেক বেশি উপকার করতে পারবেন।

বিনয় শওকতকে বলল, আমিও একজনকে চিঠি লিখে দেব। তার সঙ্গেও দেখা করবেন।

শওকত জিজ্ঞেস করলেন, কার কথা বলছেন?

 বিনয় মোতাহার হোসেন সম্পর্কে বিশদভাবে জানায়।

এইসব কথাবার্তার মধ্যেই দুই আইনজ্ঞ দুনম্বর দানপত্রে সাক্ষীদের দিয়ে সই-সাবুদ করিয়ে নিয়েছেন।

প্রতিটি দানপত্রের দুটো কপি করা হয়েছে। আপাতত একটা করে কপি দুই উকিলের কাছে থাকবে। পরে সেগুলো তাদের মক্কেলদের দেওয়া হবে।

যে-উদ্দেশ্যে আজ জাফর শা রোডের এই বাড়িটিতে এতগুলো মানুষ জড়ো হয়েছে তা সুচারুভাবে শেষ হল। কোথাও এতটুকু ত্রুটি নেই।

এবার আপ্যায়নের পালা।

 হিরণ ভেতরে গিয়ে খবর দিতেই সুধা, সুনীতি এবং উমা লুচি তরকারি মিষ্টি-টিষ্টি নিয়ে এল।

.

অতিথিরা চলে যাবার ঘণ্টাদেড়েক পর খাবার ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে দ্বারিক দত্তদের খেতে বসিয়ে দিল সুধা। সুনীতিদের মতো এ-বাড়িতেও টেবল-চেয়ারে নয়, মেঝেতে সুতোর ফুল-তোলা আসন পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা।

প্রথমে পুরুষেরা খাবে। তারপর সুধা সুনীতি উমা এবং সরস্বতী।

মুখোমুখি খেতে বসেছিল হিরণরা। একদিকে সে আর বিনয়। অন্যদিকে দ্বারিক দত্ত এবং আনন্দ। পরিবেশন করছিল সুধা আর সুনীতি। উমা তাদের হাতে এটা সেটা এগিয়ে দিতে লাগল দরকার মতো। রান্না হয়েছে প্রচুর। উমাকে সঙ্গে নিয়ে দশভুজা হয়ে সব প্রায় একাই করে ফেলেছে সুধা। সুনীতি এ-বাড়িতে এসেছে বেলা করে। এসেই রান্নায় হাত লাগিয়েছে। সেও দু-একটা পদ বেঁধেছে।

খেতে খেতে নানা কথা হচ্ছিল। তার সবটাই আজকের এই দানপত্রের বিষয়ে। আনন্দ বলছিল, ক, কলকাতায় তোমাদের একটা ভাল প্রপার্টি হল।

হিরণ খুব খুশি। দুটো মাস প্রচণ্ড মানসিক চাপে ছিল সে। দ্বারিক দত্ত আর সরস্বতী যেভাবে বেঁকে বসেছিলেন তাতে মনে হয়েছিল খান মঞ্জিল হাতছাড়া হয়ে যাবে। আজ সব দুর্ভাবনার অবসান। এতদিনের দৌড়ঝাঁপ সার্থক।

হিরণ হেসে হেসে বলল, তা হল। কোনওদিন ভাবিনি, কলকাতায় আমরা বাড়ি করতে পারব।

আনন্দ বলল, যত তাড়াতাড়ি পার, বাড়িটা সারিয়ে টারিয়ে নাও ।

তা তো নিতেই হবে। দুচারদিনের ভেতর প্রভিডেন্ট ফান্ডের লোনের জন্যে অ্যাপ্লাই করব।

তার পরও যদি কিছু টাকা দরকার হয়, আমাকে বোলো। লজ্জা কোরো না।

আগে দেখি কতটা পাওয়া যায়। তাতে না কুলোলে আপনার কাছে হাত পাততেই হবে।

একটু ভেবে আনন্দ জিজ্ঞেস করল, বাড়িটার নাম খান মঞ্জিলই থাকবে না কি?

 হিরণ মাথা নেড়ে বলে, না না, দাদুর সঙ্গে আগেই কথা হয়েছে অন্য একটা নাম দিতে হবে। সবে তো আজ দানপত্র হল। পরে সবাই মিলে বসে নামটা ঠিক করে নেব। সেদিন সুনীতি দিদি আর আপনাকেও ডাকব। এর মধ্যে আপনারাও নাম ভাবতে থাকুন। আমরাও ভাবি। যেটা বেশি ভোট পাবে সেই নামই রাখা হবে।

খেতে খেতে বিনয় লক্ষ করছিল, দ্বারিক দত্ত কোনও মন্তব্য করছেন না। চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছেন। কিছু একটা চিন্তার ভেতর মগ্ন হয়ে আছেন। কেমন যেন ঝিম-ধরা ভাব। অথচ খানিক আগে শওকতরা যখন ছিলেন, অনবরত কথা বলছিলেন।

কী ভাবছেন তিনি? দেশের বাড়িঘর জমিজমা ফেলে চলে আসতে হয়েছে। হয়তো বেদখল হয়ে যেত, তবু বলা যেত, সে-সব তাঁদেরই। তারাই রাজদিয়ার ওই সম্পত্তির বৈধ স্বত্বাধিকারী। কিন্তু দানপত্রে সই করার পর রাজদিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের যে পলকা গিটটা ছিল, পট করে সেটা ছিঁড়ে গেল। সেই জন্যই কি দ্বারিক দত্ত এমন নিঝুম? এমন বিমর্ষ?

খাওয়াদাওয়ার পর সবাই ঘণ্টা দুই বিছানায় গড়িয়ে নিল। তারপর শীতের বেলা ঢলে পড়লে চা খেয়ে আনন্দ আর সুনীতি বেরিয়ে পড়ল। ওরা বাড়ি ফিরে যাবে। হিরণ এবং বিনয় ওদের এগিয়ে দিতে সঙ্গে সঙ্গে চলল।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আনন্দ বিনয়কে বলছিল, তোমার অফিসে জয়েন করার সময় কিন্তু হয়ে এসেছে। আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। মনে আছে তো?

বিনয় ঘাড় কাত করল, নিশ্চয়ই

 সেদিন সকালে এখানে এসে তোমাকে সঙ্গে করে অফিসে নিয়ে যাব। মানে প্রথম দিন

কলকাতার রাস্তাঘাট এর মধ্যেই অনেকটা সড়গড় হয়ে গেছে বিনয়ের। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে তাদের অফিসে চোখ বুজে সে চলে যেতে পারবে। টালিগঞ্জ থেকে ট্রাম বা বাসে ধর্মতলা, সেখান থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ ধরে যে বাসগুলো শ্যামবাজারের দিকে যায় তার কোনও একটা ধরলেই হল। তাদের অফিসের সামনেই স্টপেজ। তাছাড়া বিনয় নাবালক নয় যে তাকে অফিসে পৌঁছে। দিতে হবে। তবে আনন্দ যখন চাইছে তখন তার মুখের ওপর না বলল না সে।

কিছুক্ষণ নীরবতা।

তারপর গলা নামিয়ে বিব্রতভাবে আনন্দ বলল, বলার মুখ নেই, তবু বলছি। মা তোমাকে একবার আমাদের বাড়ি যেতে বলেছে।

চকিতে হেমনলিনীর চেহারাটা চোখের সামনে ফুটে ওঠে। নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন এক মহিলা। দাঁতে দাঁত চেপে থাকে বিনয়। উত্তর দেয় না।

ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল আনন্দর। সে বলে, জানি, আমাদের ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে। তবু বলছি, যদি তোমার ইচ্ছে হয়, একবার যেও।

বিনয় এবারও চুপ। এই জীবনে হেমনলিনীর মুখদর্শন করার ইচ্ছা তার নেই। বড় রাস্তায় এসে সুনীতি আর আনন্দকে একটা ফাঁকা ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে সে আর হিরণ বাড়ি ফিরে আসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *