৬. পর্বত

৬. পর্বত

আমি এখনও ভাবি অন্য গ্রহে সত্যি জীবন থাকা সম্ভব। ভাবতে অবাক লাগে এক কোষী প্রাণী থেকে কথা বলা বুদ্ধিমান প্রাণীর বিকাশ লাভ করতে যে সব অনুসঙ্গ পৃথিবীতে বিরাজমান ছিল, তা কি মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহেও বিদ্যমান ছিল? যদি তাই হয়, তাহলে পরিবেশ পরিবর্তনের সাথে সাথে একই ধারায় প্রাণী ও উদ্ভিদের বিকাশ লাভ ঘটেছিল। 

কেউ কেউ ধারণা করে ডাইনোসররা লোপ পেয়েছিল পৃথিবীপৃষ্ঠে এক গ্রহকণিকার আঘাতে। ব্যাপারটা ঘটেছিল দৈবক্রমে, ঠিক যেন অনেকগুলি লটারীর মধ্যে একটা কিন্তু যদি এটা না ঘটত তাহলে ডাইনোসরদের মধ্যেও বিকাশের ধারা চলতে থাকত, হয়তো তাদের বংশধররাই শহর বানাত, বানাত মহাশূন্যযান, কম্প্যুটার, বিশ্ববিদ্যালয়, জিমনেসিয়াম। যখন গ্রহ কণিকার বিস্ফোরণ ঘটে তখন লক্ষ লক্ষ টন পাথর আর ধূলিকণা শূন্যে ছড়িয়ে পড়ে যা সূর্য কিরণকে রোধ করে ফেলে। ডাইনোসর সহ অনেক উদ্ভিদ আর প্রাণী মারা যায় কারণ তাপমাত্রা নেমে যায় শূন্যের নিচে। শুধু সেসব প্রাণীই বেঁচে যায়, যারা সেই ভীষণ ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে। সেই বেঁচে যাওয়া প্রাণীদের অধস্তন বংশধররাই একদিন চাঁদের বুকে পা রাখে। বেঁচে যাওয়া কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিকাশের মাধ্যমে মানুষের আবির্ভাব, আর সরীসৃপরা সেই দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে। 

‘অন্য কোনো গ্রহে ভ্রমণ করার সুবিধাটা হলো এই যে তা নিজের গ্রহটাকে ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে,’ মিকা বলে। ‘তুমি তো বুঝতে পারছ প্রত্যেক গ্রহেরই কিছু সুবিধা কিছু অসুবিধা আছে।’

ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন বাবার মুখের কথাই শুনছি, শুধু বাবা কথা বলার সময় আঙুল নাচায় না বা বুড়ো আঙুল চোষে না। 

‘যদি তুমি পাহাড়ে বাস কর, তাহলে তোমাকে ভালো আরোহী হতে হবে,’ মিকা বলে চলে। আর সমতল ভূমিতে তোমাকে ভালো দৌড়বিদ হতে হবে। যদি কোনো মাংসাশী প্রাণীর কাছাকাছি বাস কর তাহলে তোমার শরীরের ঘ্রাণ হতে হবে জঘন্য, তার চেয়েও ভালো যদি তুমি বিষাক্ত হও। তবে সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হলো চালাক হওয়া। 

আমি প্রবলভাবে মাথা দোলাই। তারপর ও বলে : ‘হয়তো এটা সব গ্রহের বেলায়ই খাটে। 

‘তুমি কী বোঝাতে চাও?’ আমি প্রশ্ন করি। 

‘আমরা বরং দেখতে একইরকম, তোমার কি তাই মনে হয় না?’

‘অবশ্যই,’ আমি ওকে আশ্বস্ত করি। ‘কিন্তু কেন?’ 

‘কারণ আমাদের ছেলেমেয়ে নাতি নাতনী হবে, আর এভাবেই মাম্বো আর মানুষরা টিকে থাকবে, সে ব্যাখ্যা করে।’ তাই আমরা একই কাজ একইভাবে করতে শিখি। 

‘কী কী কাজ?’ আমি জিজ্ঞেস করি।

‘বেশ, সুস্থ থাকার জন্য বেঁচে থাকার জন্য আমাদের দুজনেরই খাদ্য প্রয়োজন যাতে আমরা একদিন ডিম পাড়তে বা বাচ্চা জন্ম দিতে পারি। তবে সব রকমের খাবার আমাদের জন্য উপযুক্ত নয়। কাজেই প্রথমে আমাদের চেখে দেখতে হয়, আর তাই আমাদের দুজনেরই রয়েছে জিহ্বা।’ 

এরপর ও নিজের জিহ্বা বের করে চিৎকার করে। 

‘এবার বুঝলে আমরা দুজনে একরকম ক্যামিলা, আমরা এভাবেই দুজনা একরকমের। তুমি যা খাচ্ছ তার স্বাদ যদি তুমি নিতে না পারতে তাহলে প্যানকেক বা স্ট্রবেরি খাওয়াটা কেমন হতো? অথবা পচা ডিম। তুমি কি কখনও হিসাব করে দেখেছ, কত ধরনের জিনিসের স্বাদ তুমি নিয়েছ?’ 

মিকা তার বুড়ো আঙুল মুখে পোরে। আবার পরক্ষণেই মুখ থেকে টেনে বের করে কথা বলা শুরু করে। 

‘আচ্ছা, কোনো কিছুর স্বাদ খারাপ লাগার আগেই ধরো সেটার বিষক্রিয়া শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কাজেই স্বাদ নেওয়ার আগেই আমাদের গন্ধ নেয়া প্রয়োজন। এতে করে তোমার জীবন রক্ষা পেতে পারে।’ 

কিভাবে অনেক দূর থেকে কোনো জিনিষের গন্ধ নিতে পারি। তা এক মস্ত রহস্য। কিছুদিন আগে একদিন আঙ্গুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ নাকে ঘ্রাণ লাগায় বুঝতে পরি মা কেক তৈরি করছে। আমি ছুটতে ছুটতে সোজা গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ি 

কিন্তু অতটা রাস্তা বেয়ে রান্নাঘর থেকে কেকের গন্ধ কিভাবে হাওয়ার মধ্যে দিয়ে আঙ্গুর বাগানে আমার কাছে গিয়ে পৌঁছল? আর আমার নাকই বা কিভাবে আমাকে ইঙ্গিত দিল যে রান্নাঘরে কেকই তৈরি হচ্ছে, অন্য কিছু যেমন রুটি বা চকোলেট নয়? 

‘তুমি কি কেক খেতে পছন্দ কর?’ আমি জিজ্ঞেস করি। 

‘কেক?’ মিকা বুঝতে পারে না জিনিসটা কী। সে বলতে থাকে : 

‘আমরা হয়তো একই ধরনের জিনিস পছন্দ নাও করতে পারি, এমনকি আমরা কোনো জিনিসের গন্ধ একভাবে নাও নিতে পারি, তবে স্বাদ ও গন্ধ নেওয়াটা তোমার আর আমার ক্ষেত্রে একই।’ 

মিকা বসে বসে পাথরের ফাঁকে যে আগাছা জন্মেছে তা নিয়ে খেলা করে। এটা ওর আঙুলে যেভাবে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, সেটা নিশ্চয়ই ওর বেশ ভালো লাগছে। 

‘স্পর্শের দ্বারাও আমরা অনেক জিনিস বুঝতে পারি, তাই না?’ আমি বলি। 

‘হ্যাঁ, কারণ আমার শরীর চামড়া দিয়ে ঢাকা যেখানে অনেক স্নায়ুর প্রান্ত এসে মিলেছে। গরম কিছুকে স্পর্শ করলে জ্বালা বোধ করি, ধারাল কোনো কিছু দিয়ে কাটা গেলে তার সংকেত তৎক্ষণাৎ মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছায়। চোখের পলকে মস্তিষ্ক সংকেত পাঠায় গরম জিনিসটা থেকে তড়িৎ সরে আসতে।’ ঝট করে আগাছা থেকে ওর হাত সরিয়ে নেয় একথা বোঝাতে। ওর কড়ে আঙ্গুলে একটা ক্ষত দেখায়। 

‘সংকেত পাঠাবার মতো স্নায়ু যদি আমার আঙুলে না থাকত, তাহলে ক্ষতটা আরও গভীর হতে পারত,’ ও বলে। 

‘পারিপার্শ্বিক অবস্থা বোঝাটা আমাদের দুজনের জন্যই জরুরি!’ আমি ঝটপট মন্তব্য করি ওর কিছু বলার আগেই। 

মিকা গম্ভীরভাবে মাথা দোলায়। পর মুহূর্তে সে মুখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকায়। ওর মুখে ধূর্তের হাসি। 

‘আর আমাদের ঘাড়ে আঙুল বুলালে আমরা দুজনই মজা পাই,’ ও বলে। 

মাথার ওপর চক্কর দেওয়া কয়েকটা গাঙচিলের দিকে ও আঙুল তোলে। 

‘তোমার কী মনে হয়, ওরা ওভাবে চেঁচামেচি করছে কেন?’ ও জিজ্ঞেস করে। 

‘হয়তো তারা পরস্পরকে বলছে কোথায় খাবার পাওয়া যাবে।’ 

ও মাথা দোলায়। 

শুনতে পারাটা আমাদের উভয় গ্রহের প্রাণীদের জন্যই একটা বড় সুবিধা। উদাহরণ স্বরূপ কোনো বিপদ এগিয়ে আসছে, তার শব্দ যদি আগে ভাগে শুনতে পাওয়া যায় তাহলে সময় থাকতে লুকিয়ে পড়ার সুবিধা হবে। অথবা তোমার ছোট ভাই বা বোন কোনো বোকামী করতে যাচ্ছে দেখতে পেলে চেঁচিয়ে তাকে সাবধান করা যাবে। তবে তার জন্য আমাদের কান থাকা চাই।’ 

‘আমাদের দুটো করে কান আছে,’ আমি বলি। ‘একটা করে কান থাকলে কি চলত না?’ মিকা মাথা ঝাঁকায়। 

যদি আমাদের একটা কান থাকত, তাহলে বোঝা যেত না, শব্দটা কোনদিক থেকে আসছে। এটা বোঝা খুবই জরুরি, যাতে আমরা স্থির করতে পারি কোন দিকে দৌড় লাগাতে হবে। 

আমি মিকার কানের দিকে নজর দেই। ওগুলো আমার কানের থেকে একটু আলাদা, তবে খুব বেশি নয়। মিকার কান মাথার দুপাশে দুটো ছিদ্র, ঠিক আমাদের মতোই। 

‘তাহলে অন্য এক দিক থেকেও আমরা এক রকমের,’ আমি বলি। কিছুক্ষণের জন্য আমরা নীরবে বসে বসে গাঙচিলের ডাক শুনি। মাঝে মাঝে কানে আসছে পাথুরে উপকূলে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ। 

‘আমরা দুজনেই ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি,’ আমি বলি। পাথরের ফাঁকে গজানো আগাছায় ফোটা একটা ফ্যাকাশে লাল ফুল টেনে তোলে মিকা আর চোখের সামনে তুলে ধরে ওটা। 

‘সত্যিকারের বিস্ময়ের ব্যাপার হলো আমাদের চার পাশের সবকিছু দেখতে পাই আমরা,’ মিকা বলে। 

‘এসব দেখার জন্যই আমাদের চোখ,’ আমি যোগ করি, আর এদিক থেকেও আমরা দুজনে এক রকম। 

সূর্য পশ্চিম আকাশে অনেকটা ঢলে পড়েছে। মিকা সেদিকে আঙুল তোলে, ঠিক যেমনটা করেছিল উদীয়মান সূর্য দেখে। 

‘আমরা দেখতে পাই কোথায় খাদ্য আছে, বা কোনোদিক থেকে বিপদ আসছে,’ সে বলে চলে। ‘তবে সৌভাগ্যবশত এর চেয়েও বেশি কিছু দেখি। আমরা পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি অন্যে আমাকে নিয়ে কী ভাবছে। অথবা মহাশূন্যে চোখ মেলে দিয়ে অন্য গ্রহে জীবের নিবাস নিয়ে কল্পনা করি।’ মিকার কথাটা নিয়ে আমি বসে বসে ভাবি, এটা কি বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে এক জোড়া চোখ আছে বলেই সাগরের পাড়ে উঁচু পাথুরে ঢিবির ওপর বসে বসে সমুদ্রের শোভা উপভোগ করতে পারছি? 

দীর্ঘ সময় নীরবে বসে থেকে অবশেষে মিকা মুখ খোলে।

‘ডিম একটা বিস্ময়কর জিনিস…’ 

আগেও সে কথাটা বলেছে, তবে এখন সে আরও খোলসা করে বলে। 

‘ডিমের ভেতরেই একজোড়া চোখের বিকাশ ঘটে, একদিন যে আবিষ্কার করবে বিশাল এক বিশ্ব, যার এক অতি ক্ষুদ্র অংশ আমরা নিজে। ঠিক যেন ক্ষুদ্র এক ডিমের মধ্যেই গড়ে উঠছে এক বিপুল মহাবিশ্ব।’ 

অথবা মায়ের পেটের মধ্যে। আমি ভাবি, তবে মুখ ফুটে কথাটা বলি না।

‘অসংখ্য দিক দিয়েই আমরা এক রকমের, মিকা বলে। ‘আমরা দুজনেই স্বাদ নিতে, গন্ধ নিতে, অনুভব করতে, শুনতে আর দেখতে পাই।’ 

‘তবে অন্যান্য অসংখ্য জন্তুও এটা করতে পারে,’ আমি ফোড়ন কাটি। ‘আর তারা কিন্তু দেখতে আমাদের মতো নয়।’ 

‘বেশ, তোমার আমার কিন্তু হাঁটার জন্য চার পায়ের দরকার হয় না, ‘ মিকা বলে। ‘লাখ লাখ বছর আগে কোনো এক সময় তোমার আর আমার পূর্ব পুরুষরা দুই পায়ে দাঁড়িয়ে যায়, আর তাদের সামনের দুই পা ধীরে ধীরে বাহু আর হাতে রূপ নেয়।’ 

‘সে কথা ঠিক,’ আমি বলি। ‘আমাদের পূর্ব পুরুষ নর বানর জঙ্গলে 

বাস করত, তাদের হাতের দরকার হলো গাছ থেকে পাতা আর ফল পেড়ে খাওয়ার জন্য। আর হিংস্র জন্তুর হাত থেকে বাঁচার জন্য পাথর ছোঁড়ার কাজেও লাগল তাদের সেই হাত। অবশ্যই সেই হাত দিয়েই তারা নানান প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করতে শিখল।’ 

এসব কথা এর আগেও আমি আর বাবা একত্রে মিলে আলোচনা করেছি। বাবা বলেছিল প্রাণীরা যখন চার পায়ে চলাচল করত তখন তারা সামনের পা দিয়ে কোনো কাজ করতে পারত না। 

‘কিন্তু আমাদের চার পা আর দুই হাত থাকলে কী অসুবিধা ছিল?’ আমি জানতে চাই। ‘অথবা তিন পা, আর ছয় বাহু?’ আমি জানতে চাই। 

এই প্রশ্নের জবাবে মিকা সুললিতভাবে বার্ড করে।

‘কারণ আমাদের পূর্ব পুরুষদের মাত্র চারটে পা-ই ছিল,’ সে জবাব দেয়। 

এ নিয়ে আমি আগেও অনেকবার ভেবেছি। উভচরদের মাত্র চারটে পা আছে। তাই দুটো পা আর দুটো হাতই যথেষ্ট। 

এতেও কিন্তু আমি মিকার জবাবে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। ব্যাপারটা কি অদ্ভুত নয় যে সে আর আমি দুজনেই ছোট ছোট চার পেয়ে জন্তুদের অধস্তন পুরুষ? আমাদের দুজনের একজন কেন কোনো ছয় পেয়ে বা আট পেয়ে প্রাণী থেকে বিকশিত হলাম না? মনে হলো যেন ও আমার চিন্তাটা পড়তে পেরেছে। 

‘আমার মনে হয় না দুইয়ের বদলে চার হাত থাকলে আমরা আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারতাম।’ ও বলে।’ হাঁটার জন্য দুয়ের বেশি পা থাকারও দরকার নেই। যা আছে সেটা যথেষ্ট। অযথা বাড়তি হাত পা বয়ে বেড়াবার দরকার কী?’ 

তুমি কি আমাদের কথা বুঝতে পারছ, ক্যামিলা? উভচররা যখন পানি থেকে উঠে এলো তখন তাদের মধ্যে সব কিছুই বিদ্যমান ছিল, যা রূপান্তরের মাধ্যমে তাদের মানুষের দিকে নিয়ে যেতে পারে, ব্যাপারটা সত্যিই অসাধারণ। বেশিও না কমও না। মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে তারা কি জানত তারা কোন দিকে এগিয়ে চলেছে… 

‘কেন?’ 

সে আবার বাউ করে। 

আমাদের পূর্ব পুরুষরা হাত দিয়ে যন্ত্রপাতি বানাতে শিখেছিল, যা তাদের জীবনকে সহজতর করে। আর হাতকে ঠিকমত ব্যবহার করার জন্য তাদের মস্তিষ্ককেও উন্নততর হতে হয়েছিল। যারা হাতকে কাজে লাগিয়ে সুচতুর কোনো কিছু নির্মাণ করতে পেরেছিল আর যারা হাত দুটিকে শুধু দেহের দুপাশে ঝুলিয়ে রেখেছিল তাদের মধ্যে একটা পার্থক্য ছিল। 

‘এখন আমরা সবকিছুকে আরো বেশি করে সমভাবে মূল্যায়ন করতে পারছি।’ আমি বললাম। 

সে মাথা দোলায়, হ্যাঁ আমরা একই ভাবনা ভাবছি। 

‘সে জন্যই আমাদের এত বড় বড় মাথা, আমার মন্তব্য। 

সে জবাব দেয় না। কিছুক্ষণ পর সে আমার মুখের দিকে চেয়ে একটা প্রশ্ন করে যা নিয়ে সে হয়তো বিস্ময়বোধ করছে। 

‘তোমার কচি ভাইটি যখন তোমার মা’র পেট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য জোর করবে তখন কি তোমার মা’র কষ্ট হবে না?’ 

‘হ্যাঁ,’ আমি ঠোঁট কামড়ে বলি। কারণ আমি এ নিয়ে বেশি ভাবতে চাই না। 

‘প্রত্যেক গ্রহেই কিছু অসুবিধাজনক ব্যাপার আছে,’ মিকা বলে।

‘তবে তাকে সাহায্য করার জন্য হাসপাতালে লোকজন আছে,’ আমি চটপট যোগ করি।

‘ঠিক তাই?’ উচ্ছ্বসিতভাবে বলে ও আঙুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে। ‘ঠিক এই কথাটাই বলতে চাচ্ছিলাম, কোনটা?’ 

‘তোমার আর আমার মতো লোকদের উচিত পরস্পরকে সাহায্য করা। কাজেই আমাদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করাটাও জরুরি। এটা না করলে এক গ্রহের মানুষ অন্য গ্রহে যেতে পারবে না। সেদিক থেকেও আমরা একমত।’ 

আমিও প্রায় এক রকম জিনিসই ভাবছিলাম। 

একজন মানুষের ক্ষুদ্র এক পদক্ষেপ মানবজাতির জন্য বিরাট উল্লম্ফন। মহাশূন্যচারী আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা রাখার পর এই কথা বলেছিলেন। এই কথা বলে তিনি প্রায় গোটা মানবজাতিকে চাঁদে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে ভ্রমণ শুধু তার নিজের জন্য ছিল না। 

সেই একজন মানুষের ক্ষুদ্র পদক্ষেপ, মানবজাতির দানবীয় পদক্ষেপ, মিকা বিড় বিড় করে। 

‘আমি চমকে উঠি,’ তুমি কি করে জানলে আমি এ কথাই ভাবছি? আমি প্রশ্ন করি।

মিকা হাত দিয়ে ওর মুখ থাবড়ায়। ওর গাল লাল হয়ে ওঠে। 

‘দুঃখিত!’ ও বলে। 

আমি এর গভীরে যেতে চাই। আমি মনে মনে যেটা ভাবছিলাম মিকা কী করে তা জানল। মিকার সাক্ষাতে আমি কখনও চাঁদে অবতরণের কথা বলিনি। আমস্ট্রং যখন কথাগুলো বলে তখন নিশ্চয়ই ও চাঁদে ছিল না? 

‘দুঃখিত কি নিয়ে?’ 

‘তুমি যা ভাবছিলে তা আমি বলে ফেলেছি,’ সে কবুল করে। ‘এটা করা আমার জন্য ধৃষ্টতা, তবে তোমার চিন্তাটা এতই আকর্ষক যে আমি আত্মসংবরণ করতে পারিনি,’ সে বলে। ‘এলিওতে মাম্বোদের পরস্পরের চিন্তা পড়ে ফেলাটা একটা সাধারণ ব্যাপার। মাঝে মাঝে ওরা দীর্ঘ আলাপ চালিয়ে যেতে পারে একটাও শব্দ উচ্চারণ না করে।’ 

‘এটা খুবই কাজে আসে, সে বলে। 

‘আমি মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে এই গ্রহে এসেছি। তাহলে তুমি কি করে কল্পনা করলে যে তোমাদের ভাষা এত তাড়াতাড়ি শিখে ফেললাম যদি না তোমার চিন্তা পড়তে পারি? আর কি করে ভাবলে তোমাদের গ্রহের জীবন সম্বন্ধে এত কিছু বুঝে ফেললাম?’ 

‘এই দিক থেকে আমরা তোমাদের মতো নই,’ আমি বললাম। ‘আমরা অন্য লোকের চিন্তা পড়তে পারি না। 

‘তা ঠিক, তবে তোমরা হয়তো অন্য কিছু পার, এমন কিছু যা হয়তো মাম্বোরা পারে না, মিকা সহানুভূতির সুরে বলে। 

আমি বুদ্ধিমত্তার কোনো ব্যাপার ভাবতে চেষ্টা করি যেটা আমাদের বৈশিষ্ট্য হতে পারে। তারপর মনে পড়ল, টেলিফোন বাজলে মিকা কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিল। 

‘আমাদের টেলিফোন আছে যার সাহায্যে পৃথিবীর অপর প্রান্তের কোনো লোকের সাথে আমরা কথা বলতে পারি,’ আমি বলি। এই গোটা গ্রহটাই টেলিফোনের তার দিয়ে জড়ানো, যার সাহায্যে আমরা পরস্পরের সাথে কথা বলতে পারি । 

‘প্রত্যেক গ্রহেরই কিছু নিজস্ব সুবিধা আছে, ‘ ঈর্ষান্বিত কণ্ঠে মিকা বলে। 

ক্যামিলা, তুমি কি মনোযোগ দিচ্ছ? মিকা আমারভাবনা পড়তে পারে জেনে আমি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তবে আমাদের টেলিফোনের কথা শুনে সেও কম ঘাবড়ায় নাই। আমাদের যেহেতু টেলিফোন, কম্প্যুটার আর ইন্টারনেট আছে, তাই অন্যের ভাবনা পড়ার তেমন দরকার নাই। তবু খুব আশ্চর্যের ব্যাপার যে আমরা এতভাবে এক রকমের। আর তখনই ক্যামিলা, মিকা আমাকে পর্বতটার কথা বলল। সে ভূদৃশ্যের উপর দিয়ে তার দৃষ্টি প্রসারিত করে দিয়ে গম্ভীরভাবে সেই পাথরের স্তূপের ওপর হাত রাখে যে পাথর খণ্ডগুলো আমি আর বাবা মিলে জড়ো করেছিলাম। 

‘তুমি যদি একটা উপত্যকায় বাস কর আর আমি অন্য একটায় তাহলে আমরা দুই পর্বত শিখরে আরোহণ করে পরস্পরের হাত ধরতে পারি না?’ এটা ছিল এক প্রশ্নবোধক বাক্য, কাজেই আমি ঝটপট বাউ করি, তবে ওর কথার মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারি না। সে বলে চলে : 

‘পর্বতের শিখরে আরোহণ করার অনেক উপায় আছে, তবে পর্বত চিরকাল একই রকম থাকবে, আর আমাদেরকেও একই রকম থাকতে হবে, কারণ আমরা প্রত্যেকে এক একজন পবর্তারোহী। সেখানে পাহাড়ের চূড়ায় আমরা পাথরখণ্ড জড়ো করতে পারি। তারপর দীর্ঘ আরোহণের ক্লান্তি জুড়াতে ওখানে বসে পড়তে পারি। কিছুক্ষণের জন্য আমাদের ছোট বড় সব রকমের দুঃশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে পারি। আমরা ওগুলো উপত্যকায় ফেলে এসেছি।’ 

‘তার মানে তুমি বলতে চাইছ, যদিও তুমি এক গ্রহের বাসিন্দা আর আমি অন্য এক গ্রহের তবু এক পর্বত শীর্ষে আমরা মিলিত হতে পারি?’ আমি প্রশ্ন রাখি। 

সে মাথা দোলায়। 

‘আমরা কোথা থেকে এলাম সেটা বড় কথা নয়, আমরা কোথায় চলেছি সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। আমাদের পৃষ্ঠপট ভিন্ন। আমি একজন মাম্বো আর তুমি একজন স্তন্যপায়ী, তবে সময়ের গতিধারায় আমরা কাছাকাছি এসেছি। আমরা এমন সব জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি, আমি একটু আতংক বোধ করলাম। 

‘তোমার এবং আমার উভয়ের গ্রহ থেকে জীবন বিকশিত হয়েছিল সরল এককোষী জীব থেকে,’ মিকা বলে। অন্য আর কিভাবে এটা হতে পারত? জীবন বিকাশ লাভের সাথে সাথে বিভিন্নতাও আসতে থাকে। কোনো কোনো প্রাণীর অধিকতর ইন্দ্রিয় বিকশিত হতে থাকে, আর তাদের স্নায়ুতন্ত্রও উন্নততর হতে থাকে। মানুষের মস্তিষ্ক এখন অনেক উন্নত আর তারা পৃথিবীকে ভালো করে বুঝতে পারে, অন্যান্য প্রাণীদের চাইতে। অভিব্যক্তি আর কোন্ দিকে মোড় নিতে পারত? 

এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বাউ করলাম। কী উত্তর দেব তার কোনো ধারণা নেই। 

‘এসবের সূত্রপাত হয় সমুদ্রে, শুরুতে সেখানেই সবকিছু ছিল, সে বলে। ‘আর আজ আমরা পাথুরে উপকূলে বসে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছি।’ 

‘হয়তো সেজন্যই এত সব কিছু?’ 

মিকা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘একদিন এই গ্রহ ছিল ঘুমিয়ে,’ সে বলে। 

‘সমুদ্রে ঘূর্ণি উঠল, ঘাসের মধ্যে খসখস, পানির ওপর দিয়ে পাখা ঝাপটানী। তবে শুধু এখনই জেগে উঠেছে, অথবা প্রায় জেগেছে। তোমরা যারা এখানে বাস করছ, তারা ধীরে ধীরে এর ইতিহাস জানতে শুরু করেছ। তোমরা চাঁদে গিয়েছ, আর সেই যাদুর সীমান্ত আবিষ্কার করেছ, যেখানে নিচ হয়ে যায় ওপর আর উপর হয়ে যায় নিচ। আর তার চাইতেও বড় কথা : তোমরা মহাবিশ্বের দিকে দৃষ্টি দিয়েছ, বাইরে গিয়ে হয়তো তোমরা পূর্ণতার একটা ঝলক দেখতে পেয়েছ 

‘হ্যাঁ,’ ভীতি বিহ্বল কণ্ঠে বলি আয়ি। ‘তা পেয়েছি।’ 

কী বলতে হবে বুঝতে পারিনি, কারণ এখন আমরা পর্বতের শীর্ষে পৌঁছেছি। এবার আমরা কথা বলছি সেই পর্বতের শীর্ষ নিয়ে এখানে আরোহণের বিষয়ে নয়। 

‘হয়তো এমন এই ইন্দ্ৰিয় আছে যা আমাদের দেহে এখনও বিকশিত হয় নাই,’ অবশেষে আমি বলি। 

‘হ্যাঁ, তাই হয়তো’ মিকা সায় দেয়। আমরা মহাশূন্যে ভাসমান এক গ্রহে বসে আছি আর সবকিছু কিভাবে খাপে খাপে মিলে গেল তাই নিয়ে কথা বলছি। আমার যদি এমন একটা ইন্দ্ৰিয় থাকত, যা দিয়ে ঠিক ঠিক অনুধাবন করতে পারতাম কিভাবে কোথা থেকে সবকিছু এলো।’ 

ওর কথায় আমি আর বাউ করলাম না, তবে ওর বিজ্ঞোচিত কথা আমার অন্তরে গেথে নিলাম। কয়েক মুহূর্ত পরে ও আমাদের পায়ের কাছ থেকে একটা পাথরের টুকরা তুলে নিল। 

‘এটা কী?’ সে প্রশ্ন করে। 

‘এটা সাধারণ এক গ্রানাইটের টুকরা,’ আমি বলি। 

প্রশ্নটাকে আমি খুব সহজ ভেবেছিলাম, তবে মিকা আজ্ঞাভরে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে। 

পৃথিবীতে কোনো কিছুই সাধারণ নয়। যা কিছুর অস্তি ত্ব আছে তাই এই মহান রহস্যের একটা অংশ। তুমি আর আমিও। তুমি আমি এখন এক রহস্য যা কেউ অনুমান করতে পারবে না। সে পাথরটা হাতে তুলে ধরে যাতে আমি ভালো করে দেখতে পাই। ‘পাথরটা এলো কোত্থেকে? এটা একটা গ্রহেরই এক টুকরা অবশ্য। আর সেই গ্রহ ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র এক অংশ। কিন্তু ব্ৰহ্মাণ্ড কী?’ 

‘বিশ্ব এলো কোথা থেকে??’ 

এই প্রশ্নের কোনো জবাব নাই আমার কাছে। সবচেয়ে বড় যে রহস্য তা নিয়ে কোনো অনুমান করার সাহসও আমার নাই। 

মিকা পাথরটাকে স্তূপের মাথায় রেখে দেয়। সেও এখন স্তূপটা বানানোয় অংশ নিল, আমি ভাবলাম। 

‘তোমার কি বিশ্বাস যে এত সব কিছু এমনি এমনি এসেছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘নাকি একজন ঈশ্বর আছেন, যিনি এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন?’ 

‘আমি জানি না,’ সে বলে, ‘তবে আমার বিশ্বাস ডাইনোসর বা এলিয়োর মাম্বোরা কখনও এ ধরনের প্রশ্ন করে নাই।’ 

আমি হাসি। ‘তবে আমরা করি,’ আমি বলি, ‘কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা আমাদের উভয়েরই অভ্যাস।’ 

‘হয়তো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা, বিশেষ করে যে প্রশ্নের উত্তর নাই। সেটাই হলো আমাদের দুজনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ বৈশিষ্ট্য, ‘ প্রসন্ন হাসি দিয়ে মিকা কথাটা বলে। এরপর সে আরো দুটি প্রশ্ন করে, যা আমি কোনোদিন ভুলব না। 

‘যদি ঈশ্বর থেকে থাকেন, তাহলে তিনি কে? আর যদি না থাকেন, তাহলে বিশ্ব কী?’ 

প্রশ্নগুলি নিয়ে ভাবতে আমার অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। যদি একজন ঈশ্বর ছিলেন যিনি এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন, তাহলে কে তিনি? কী তিনি? তিনি ছিলেন কোথায়? আর ঈশ্বর যদি বিশ্বসৃষ্টি না করে থাকেন, তাহলে এটা কী? আর এটা এলোই বা কোথা থেকে? এর কেন্দ্র কোথায়? আর এর শেষই বা কোনখানে? 

‘তোমার কী বিশ্বাস?’ আমি আবার জিজ্ঞেস করি। 

মিকা নত হয়ে বাউ করে। 

‘আমি নিশ্চিত নই যে, মহাবিশ্ব নেহাৎ একটা দৈব দুর্ঘটনা।’ 

কিন্তু তুমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস কর, যিনি এ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন? সে আবার নত হয়ে বাউ করে। 

‘তুমি কি আমার উত্তরটাকে শুধুমাত্র উত্তরের উত্তর বলে ধরে নেবে?’ সে জানতে চায়। 

‘অবশ্যই,’ আমি বলি। সে বোঝাতে চায় ওর উত্তরটাকে শুধুমাত্র একটা উত্তর বলেই ধরে নেব। এর দ্বারা সে বোঝাতে চায় উত্তরটা যাই হোক না কেন, তা প্রশ্নের চাইতে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। 

ওর চোখ চকচক করে। 

‘মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তোমাদের গ্রহকে সূর্যের চারদিকে ঘোরায়, আর চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের টানে জোয়ারের পানি ফুলে ওঠে আর ভাটার টানে নেমে যায়। তোমার কি মনে হয় না তেমনি কোনো এক শক্তি সমুদ্র থেকে তোমাদের টেনে তুলেছে আর তোমাদের দান করেছে চোখ যা দিয়ে তোমরা সবকিছু দেখতে পাচ্ছ, আর দিয়েছে চিন্তা করার মস্তিষ্ক? 

কী বলতে হবে বুঝতে পারি না। 

‘মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি যদি মানুষ এটা ভাবতে না পারে তাহলে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়ের অভাব রয়েছে,’ অবশেষে মিকা বলে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *