১. আকাশ

১. আকাশ 

প্রিয় ক্যামিলা, 

তুমি যখন অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার পরের ছুটিতে আমাদের এখানে বেড়াতে আসবে, তখন তোমার জন্য একটা গল্প লিখব বলে কথা দিয়েছিলাম। বেশ, গল্পটা এরকম। 

আজ তোমাকে লিখতে বসেছি একটা বিশেষ কারণে। তোমার জন্মদিন প্রায় এসে গেছে, যে বয়সে আমার ছোট ভাইয়ের জন্মগ্রহণের প্রতীক্ষায় আছি, তোমার বয়স ঠিক তেমনটাই হতে যাচ্ছে। তাই ভাবলাম তোমাকে মিকার কথাই বলি। তাহলে সব বুঝবে। 

তুমি এখানে থাকতে আমরা যা কিছু করেছিলাম তা কি তোমার মনে আছে? খাড়িতে যেখানে আমরা নৌকা বেঁধে রেখেছিলাম সেখান থেকে কিভাবে কাঁকড়া ধরেছিলাম মনে পড়ে কি? কিভাবে আমাদের ঢাউস টেলিস্কোপের মধ্য দিয়ে তারা দেখতাম আর এক মেঘলা রাতে কেমন করে প্যানকেক বানাতাম? সেই সপ্তাহটার কথা প্রায়ই মনে পড়ে। কি দারুণ সময় ছিল সেটা! মিকাকে নিয়ে আমার অনেক কথাই মনে পড়ে সবকিছু গতকালই ঘটেছে এমন ভান করব না; অনেকটা গত সপ্তার মতো! আমি নিশ্চিত টুকরা-টাকরা হয়তো ভুলে গেছি, আর তার জায়গা দখল করেছে কল্পনা, বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিতে গেলে যেমনটা হয়। 

ব্যাপারটা কিভাবে শুরু হয় তা আমার স্পষ্ট মনে আছে। স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছিল; বলতে পার তোমার ছোট ভাই বা বোনের জন্য অপেক্ষা করার মতো, অর্থাৎ খুবই স্বাভাবিক। 

ওসব দিনে আমাদের ছিল গোটা দুই মুরগী যেগুলো বাগানের মধ্যে হাঁচড়ে বেড়াত, তুমি কি মনে কর, মুরগী জিনিসটা নিতান্তই মামুলী? তা বেশ, আমিও তাই করতাম, তবে সেটা মিকার সাথে দেখা হওয়ার আগে। 

কল্পনা কর, তুমি একজন নিঃসঙ্গ মহাকাশচারী মহাকাশে দিশাহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছ। তুমি যদি অনন্তকাল ধরে চষে বেড়াও তাহলেও একটা মুরগীর দেখা পাওয়াটা হবে মহাভাগ্যের ব্যাপার। 

মহাবিশ্বের বিশাল প্রান্তরে লক্ষকোটি তারকা রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এই তারকারাজির অল্প কয়েকটার চারপাশে একটা বা দুটো গ্রহ নির্দিষ্ট পথে আবর্তন করে ফিরছে যাকে বলি কক্ষপথ। শত শত হাজার হাজার বছর পরিভ্রমণের পর হয়তো একটা গ্রহ পেয়ে যাবে যেখানে রয়েছে প্রাণের অস্তিত্ব। যদি প্রাণধারী কোনো কিছু থেকেও থাকে, তাহলেও মুরগী থাকার সম্ভাবনা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। একটা আণ্ডা হয়তো পেতেও পার। তবে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোনোর সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। 

হয়তো আমাদের এই পৃথিবী ছাড়া মহাবিশ্বের আর কোথাও মুরগীর অস্তিত্ব নাই। আর মহাবিশ্বের বিস্তার অকল্পনীয়। কাজেই মুরগীকে আমরা মোটেই একটা মামুলি চীজ বলতে পারি না! আমরা যে সময়ে মুরগী নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি তোমরা কি জান ততক্ষণে সবখানেই এক একটা মুরগী ডিম পেড়ে বসে আছে? তুমি কি আর কোনো পাখি বা প্রাণীর এই কাজটা করার কথা শোননি? 

আমার গল্পের শুরুটা এভাবে করতে হলো কারণ মিকা আমাকে শিখিয়েছে কোনো কিছুই মামুলী নয়। কোনো কোনো লোককে বলতে শুনেছি, আজকের দিনটা নিতান্তই আটপৌরে, কথাটা শুনে আমার বিরক্তি লাগে, কারণ কোনো দুটি দিনই এক রকমের নয়, আর আমরা এও জানি না জীবনের আর কটা দিন বাকী আছে হয়তো মামুলী মুরগী বা মামুলী ডিম বলার চাইতেও বেশি খারাপ কথা মামুলী ছেলে বা ‘মামুলী মেয়ে’ কথাটা উচ্চারণ করা। আমরা এ ধরনের কথা বলে থাকি যখন আমরা মানুষকে ঠিকভাবে বুঝতে চাই না। 

আর এমনিভাবেই আমার এক ছোট বোন বা ছোট ভাইয়ের অপেক্ষায় কালক্ষেপণ করতে থাকি। আমাদের পরিবারের সবাই আলোচনা করে মেয়ে হবে না ছেলে হবে। আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা মায়ের স্ফিত উদরে যে লুকিয়ে আছে, সে একটা ছেলেই হবে। ঠিক জানি না কিভাবে এত নিশ্চিত হলাম হয়তো একারণে যে আমি একটা ভাইয়ের জন্যই হাপিত্যেশ করছিলাম। আমরা মানবজাতি তীব্রভাবে যা কামনা করি, তাই গভীরভাবে বিশ্বাস করি। একটা ছোট্ট ভাই পেলে অনুভূতিটা কেমন হবে সেটা কল্পনা করা খুবই কঠিন, তবে অন্তত এটুকু জানতাম, সে দেখতে অনেকটা আমার মতোই হবে। বোনের ছবি আঁকা অনেক বেশি শক্ত। 

মা বলে বাচ্চা নাকি উপর দিকে পা আর নিচ দিকে মাথা করে ঝুলে রয়েছে আর পেটের মধ্যে ধুপধাপ লাথি ছুড়ছে। কথাটা শুনে মনে মনে ভাবলাম আমার ক্ষুদে ভাইটার উচিত শান্ত হয়ে শুয়ে থাকা। মনে হলো এটাই ওকে দেয়া আমার প্রথম উপদেশবাণী- তবে এটাই শেষ নয়। আমরা দুনিয়াতে কোনো সভ্যতা ভব্যতা নিয়ে জন্মাই না। অন্যের প্রতি সামান্য সুবিচার করা শিখতে আমাদের বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। 

আমি জানতাম আমার ক্ষুদে ভাইটি সম্পূর্ণ নতুন এক দুনিয়াতে পদার্পণ করে হকচকিয়ে যাবে। ওকে আমি হিংসা করি না। পৃথিবীতে এসে ওকে হাজারো অজানা জিনিসের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। ছোট্ট এক অন্ধকার জগতের বাইরেটা কেমন সে সম্বন্ধে ওর মোটেই ধারণা নেই। 

ইতিমধ্যেই আমি খুটিনাটি ভাবতে শুরু করেছি কিভাবে ওর কাছে সবকিছু ব্যাখ্যা করে বোঝাব। ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে দুনিয়ার ব্যাপার-স্যাপারগুলোর ধরণ কী। 

আমার ক্ষুদে ভাইটি এর আগে কখনও পৃথিবীতে আসে নাই। ও দেখেনি সূর্য, তারা, আর মাঠঘাটে জীবজন্তু, আর সে জানেও না ওগুলোকে কী বলে ডাকা হয়। আমার নিজেরও অনেক কিছু শেখার বাকী আছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ জাগুয়ার আর লেপার্ডের পার্থক্য আমার জানা নাই। এখন পর্যন্ত শুধু এটুকুই জানি দুটোরই গায়ে চক্কর আছে তবে তাদের চক্করের প্যাটার্ন আলাদা। ওটাই আসল কথা নয়। এই গ্রহের বুকে হাজারো জাতের প্রাণী আছে, আমার ভাইটাকে কুকুর আর বিড়ালের পার্থক্য বোঝাতেই আমার অনেক দিন কেটে যাবে। পৃথিবীর বুকে বিচরণরত সব প্রাণীর নামকরণ করতে মানবজাতির হাজার হাজার বছর কেটে গেছে, আর কাজটা এখনও শেষ হয়নি। আমার ক্ষুদে ভাইটি যেন এক মহাশূন্যচারী যে পৃথিবীতে প্রথম আগন্তুক। এসব যখন ঘটছে তখন আমার বয়স সবে আট বছর। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম… 

‘উঠে পড়, জো, বাবা হাঁক ছাড়ে। ছোট্ট মণি এখন রাস্তায়!’

‘তবে এখন তো মাঝরাত’ বিছানায় সোজা হয়ে বসে বলি। ‘সে তো এখনও এসে পৌঁছেনি, চাচী হেলেনকেও দেখছি না।’ 

‘মাঝে মাঝে ছোট্টমণিরা আগেভাগে হাজির হতে চায়, বাবা বলে, তারা তো জানে না এখন দিন না রাত। আমি তোমার মাকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে যাব। চাচী হেলেন ফোন করেছিল, যত তাড়তাড়ি পারে সে এসে পড়বে, তবে আমার মনে হয় সে না আসা পর্যন্ত তোমাকে এখানে একাই থাকতে হবে।’ বাবা ঠিক করেছে বাচ্চা হওয়ার সময় চাচী হেলেন এসে আমার দেখভাল করবে, তবে তার আসার এখনও সপ্তাখানেক বাকী, এখন আর সেটা সম্ভব নয়, ক্যামিলা তোমার মা হাসপাতালে যাবে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে। তবে তোমার বয়সে বাবা- মা’রা বাইরে যেত আমাদেরকে বাড়িতে রেখে। আমি কিছু মনে করতাম না। বাড়িতে একা থাকার আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। আমি বলেছিলাম চাচী হেলেন না আসা পর্যন্ত একা থাকতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আমি কয়েকটা ঢাউস স্পেস রকেট বানিয়েছিলাম। আমার কল্পনাকে কাজে লাগাতে হয়েছিল, কারণ তখনকার দিনে খেলনা রকেটের খন্ডাংশ কিনতে পাওয়া যেত না। আমি ঝটপট পোশাক পরে নিলাম। আমার ক্ষুদে ভাইটির আগমনের অপেক্ষায় উন্মুখ ছিলাম আমি। এবার ওর পা ছোড়াছুড়ি বন্ধ হবে, আমি ভাবলাম। আর কতদিন হয়ে গেল মায়ের কোলে বসা হয় নাই। 

আমার মনে পড়ে জানালার কাছে গিয়ে ঘুলঘুলি টেনে দিয়েছিলাম। তারপর পাক খেতে শুরু করলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এত পরিষ্কার আকাশ এর আগে কখনও দেখি নাই। 

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম। মা বসে আছে একটা আর্মচেয়ারে, দুই হাতে পিঠ আঁকড়ে ধরা ওর। ওর দুই চোখ শক্ত করে বোজা আর মুখের পেশি টান টান। বাবার কাছে শুনেছি সন্তানের জন্ম দেয়া দারুণ কঠিন কাজ, কাজেই ওকে বিরক্ত করতে চাইলাম না। মনে মনে ভাবলাম ভাই বা বোন পাওয়াও শক্ত, তবে সেটা পরের কথা। মা-বাবা গাড়ি চালিয়ে চলে যায়, বাইরে তখনও পীচ কালো অন্ধকার। গাড়ির আলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। 

আমি জানতাম ওরা আমার কথা মোটেই ভাবছে না। খুব খারাপ ব্যাপারটা, যে ছোট্ট গ্যাদাটা মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যুদ্ধ করছে, তাদের সব ভাবনা শুধু ওকে নিয়েই, দীর্ঘ সময় দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম। বাইরের গেটটা লাগিয়ে দিয়ে যখন বাসায় ফিরলাম তখন বাড়িটা খোলা আকাশের মতোই শুনশান। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *