2 of 3

২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে

অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে,
ধরণী সুদুর নয় আকাশের তলে ॥

গাড়ি থামার শব্দে চমকে গেছি। এখন গাড়ি মানে পুলিশের গাড়ি। দুটো দুর্বল জায়গায় এখনও আঘাত আসার সম্ভাবনা আছে। দিদি কীসের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন? ঘরে উঁচু কোনও জিনিস পাওয়া যায়নি। এইটা একটা লুজ-এন্ড। দ্বিতীয় দুর্বল জায়গা হল, ওই হার। যার কাছে অমন মূল্যবান একটা হার, তিনি কেন ভিক্ষা করতে বেরোবেন! হারটা বিক্রি করলেই তো রাজার হালে থাকা যেত! সদরের কড়া নড়ল। ভয়ে ভয়ে কাকাবাবুর দিকে তাকালুম। তিনি বললেন, দেখো, কে এলেন!

যদি পুলিশ আসে?

আসে আসবে। অত ভয়ের কী আছে!

এই ভয়ই তো আমাকে মেরেছে। সব ব্যাপারেই ভয়। আমার পিতাকে ভয় করতে করতে ভয়টা জীবনের সর্বস্তরে ছড়িয়ে গেছে। সদর দরজা খুলেই চমকে উঠলুম। ইনি কোথা থেকে এসে হাজির হলেন! আরও মোটা হয়েছেন। দুটো চোখের তলায় অতিরিক্ত মদ্যপানজনিত স্ফীত ভাব। খ্যাসখেসে গায়ের রং। এই সেই মেসোমশাই। সঙ্গে আর একজন ভদ্রলোক। দেখলেই মনে হয় অতিশয় চালিয়াত।

দরজার ভেতরে একটা পা, দরজার বাইরে একটা পা। মেসোমশাই থমকে আছেন, সেই ত্রিশঙ্কু অবস্থাতেই প্রশ্ন, মুকু কোথায়?

যেন আমি মুকুকে কিডন্যাপ করে এনেছি।

মুকু মুকুর হস্টেলে।

ধমকের সুরে মেসোমশাই বললেন, না, সেখানে নেই। এই বাড়িতেই আছে। হস্টেল ছেড়ে দিয়েছে।

আবার হস্টেলেই ফিরে গেছে।

না যায়নি। আমি জানতে চাই, কেন সে এখানে? হোয়্যার ইজ হরিশঙ্করবাবু?

তিনি নেই। বেশ কিছুদিন হল কলকাতার বাইরে।

অ্যাঁ, তার মানে তোমরা দু’জনে এই বাড়িতে সংসার পেতে ফেলেছ? টেরিবল!

আপনি ভেতরে আসুন না মেসোমশাই!

এখনও মেসোমশাই আছি না বাবা হয়ে গেছি? টেরিবল, টেরিবল। সুধন্য, হোয়াট ইউ সে! সঙ্গের সাথীটির নাম সুধন্য। কে জানে কে, কী সম্পর্ক!

গম্ভীর গলায় বললুম, মেসোমশাই, ওপরে চলুন।

সে তো যাবই। কিন্তু আমার দুটো মেয়েই কী বোকা, পারফেক্ট ফুল। আমার মেয়ে বলে মনেই হয় না। রোমান্টিক ফুল। ইডিয়টস, ইডিয়টস।

সিঁড়ি দিয়ে প্রথমে উঠছেন মেসোমশাই, পেছনে সুধন্য কাপ্তেন, তার পেছনে আমি। মিষ্টি একটা মদের গন্ধ নাকে আসছে। অবেলাতেই এক রাউন্ড চড়ে গেছে। সুধন্যবাবু এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বললেন, বনেদি বাড়ি, কিন্তু শ্রীহীন। মেন্টিনেন্স ভাল নয়। তেমন নজর নেই। খিলানের কাজ দেখেছেন? এসব কাজের মিস্ত্রি আর নেই।

মেসোমশাই বললেন, এসব কাজের আর দরকারও নেই। মার্টিন বার্নকে দিয়ে তোমাদের লেটেস্ট যে বাড়িটা করিয়েছ, সেটা এর চেয়ে ফাংশানাল। মডার্ন ইজ মডার্ন।

তা হলেও এসব বাড়ির ইজ্জত আলাদা।

তর্ক কোরো না সুধন্য। তর্ক কোরো না।

দু’জনেই ঘোঁত করে থেমে গেলেন। সামনেই পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কাকাবাবু। মেসোমশাই থতমত খেয়ে বললেন, ইনি কে?

কাকাবাবু বললেন, চিনতে পারছেন না! এরই মধ্যে ভুলে গেলেন!

চেনাচেনা মনে হচ্ছে।

কাকাবাবুর ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। বিশাল বুক। ভাল্লুকের মতো লোম। একসময় গোবরবাবুর আখড়ায় কুস্তি করতেন। গোপালবাবুর বন্ধু। রায়াটের সময় দু’জনে কলকাতা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। চেহারা দেখে যে-কোনও মানুষই থতমত খাবেন। সে একটা যুগ চলে গেছে এ দেশবাসীর জীবনের ওপর দিয়ে। আমার পিতৃদেব ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে নিত্য ব্যায়াম করতেন। মাতামহ ছিলেন মল্লবীর। পিতামহ যোগী। আমি নেংটি ইংদুর। পরের প্রজন্মের আমরা একেবারে ওয়ার্থলেস। আমার মাতুল ফিনফিনে পলতোলা গেলাস। আমাদের কোনও আয়তনই নেই। ডিসপেপটিক ইন্টেলেকচুয়াল। মেয়েছেলেরই পুং সংস্করণ। একালের নানা সাজসজ্জা দিয়ে রক-ক্লাইম্বিং শুরুর ঢের আগেই পিতা হরিশঙ্কর ক্লাইম্বিং শুরু করেন। মালকোঁচা মারা ধুতি। গায়ে টুইলের শার্ট। পায়ে কেডস। ডালপালা, গাছের শেকড়, পাথরের খাঁজ ধরে ধরে খাড়া পাহাড়ে উঠছেন। আমি নীচে দাঁড়িয়ে দেখছি। ভয়ে দমবন্ধ। কেউ কোথাও নেই। বাতাসের শনশন শব্দ। মজা নদীর বুকে বালি আর নুড়ি পাথর। গোরুর কঙ্কাল। হয়তো বাঘেই মেরেছিল। নীরব প্রার্থনা, হে ভগবান! ফেলে দিয়ো না। একসময় হারিয়ে গেলেন। আর দেখাই যাচ্ছে না। সময় যাচ্ছে। এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা। কিশোর কাঁদছে ভয়ে। একসময় পাহাড়চূড়ায় মানুষটিকে দেখা গেল। বিন্দু মতো। একটা সাদা। রুমাল নাড়ছেন। পিন্টু! এই ডাক ধ্বনি, প্রতিধ্বনি হয়ে সেই নিরালায় ভেসে বেড়াল। সূর্য অস্তে চলেছেন। নামছেন না কেন! এখুনি তো অন্ধকার হবে। আমি কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করছি, বাবা, নেমে আসুন। বাবা ডাকটাই, বা বা শব্দে সন্ধ্যার ঘরেফেরা পাখির মতো ঝটপট ঝটপট করে উড়তে লাগল। ছরছর শব্দে নেমে এল একটা পাথর। হঠাৎ একসময় তিনি আমার পেছনে এসে দাঁড়ালেন। কোন দিক থেকে কীভাবে নেমে এলেন কে জানে! হাতের পায়ের দু’-একটা জায়গা ছিঁড়ে, ঘেঁচে গেছে। সে ব্যাপারে কোনও মাথাব্যথাই নেই। মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত। রাজমহল পর্বতমালার অজানা এক শৃঙ্গে আরোহণের অপরিসীম আনন্দ। কোনও সংবাদ হবে না। গলায় মালা পরাবার জন্যে কেউ ছুটে আসবে না। কিশোর পুত্রকে সাক্ষী রেখে দুঃসাহসী পিতার ভয়ংকর অভিযান। মাতামহ যে-গানটি গাইতে গাইতে আত্মহারা হয়ে যেতেন, সেই গানের একটি কলি গেয়ে উঠলেন, পর্বত-সুমেরু ওহে হিমাচল গ্রীবা উন্নত করি কী দেখিছ বলো, দেখিছ কি সেই গুণাকর রূপ। কেউ কোথাও নেই। শুকনো নদী, উপত্যকার জঙ্গল, গোরুর আস্ত কঙ্কাল, পোড়া ইটের মতো লাল আকাশ। চারপাশে পাহাড়ের দেয়াল। তার সেই অক্ষত নেমে আসার আনন্দে একটি কিশোরের ক্রন্দন আরও প্রবল হত। বুঝে ফেলত, পৃথিবীতে পিতা ছাড়া কেউ নেই। তিনি এসে হাত না ধরলে সব মানুষই বড় অসহায়। মানবপিতাকে উপলক্ষ করে জগৎপিতার ধারণা মন স্পর্শ করে যেত। মাতামহের উদাত্ত সংগীত আরও অর্থবহ হত:

যিনি মহারাজা, বিশ্ব যাঁর প্রজা, জানো না রে মন আমি পুত্র তাঁর।

সন্ধ্যার ছায়ান্ধকারে, সেই অরণ্যপ্রান্তরে পর্বতরাজি ক্রমশ আকাশের গায়ে ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যেত। পিতা হরিশঙ্করের বর্ণনা তবু থামত না। শিখরে বাতাস কেমন মসলিনের মতো, সুরার মতো, কেমন তার ফিনফিনে শব্দ, কতটা শীতল। ঊর্ধ্ব থেকে অধের দৃশ্য কেমন খেলাঘরের মতো। কত বর্ণের রেখা টানা মসৃণ পাথর। ফাটলে ফাটলে তুলোঘাস। যেন কোনও ঋষির শ্বেতশ্মশ্রুমণ্ডিত বিশাল এক সমাহিত মুখ আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে। আবার নাকি একটা কালো কুচকুচে সাপও দেখেছেন। সিল্কের কর্ডের মতো মসৃণ আর সরু। এত সব দেখার বৃত্তান্ত দিতে দিতেই নেমে আসত ঘোর অন্ধকার। দূর দূর দেহাতি গ্রামে বলের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠত লণ্ঠনের আলো। চুলার ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠত অশরীরী প্রেতের মতো। বনভূমির মাথার ওপর ভেসে উঠত হালকা কুয়াশার রেখা। নাকে এসে লাগত বোটকা একটা গন্ধ। পিতা হরিশঙ্কর হঠাৎ অতিশয় সচকিত হতেন। বলতেন, চলো চলো, মনে হয় বাঘ বেরিয়েছে কাছাকাছি কোথাও। তাড়াতাড়ি পা চলবে। কী করে! তারার আলো ছাড়া তো আর কোনও আলো নেই। গাছগাছালির গন্ধ। ঝিল্লির রব। ভাসমান জোনাকির আলো। তিনি শক্ত করে আমার হাত ধরে বলতেন, কী ভয় করছে বুঝি! ভয় কীসের? আমি তো আছি। সেই হাত, সেই ধরার হাত খুলে গেছে, কিন্তু আমার সামনে উদার বুক মেলে দাঁড়িয়ে আছেন সেই একই ঘরানার আর এক মানুষ।

চটকা ভেঙে গেল। অতীত থেকে ফিরে এলুম বর্তমানে। কাকাবাবু বলছেন, আপনার কথা শুনে আমার একটা গল্প মনে পড়ছে। গল্পের নায়ক ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ। তার জীবনের ঘটনা। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে এক ব্রাহ্মণ আসা-যাওয়া করত। বাইরে বেশ বিনয়ী ছিল। কিছুদিন পরে ঠাকুর কোন্নগরে গেছেন। সঙ্গে রয়েছেন ভাগনে হৃদয়। নৌকো থেকে নামছেন, দেখলেন গঙ্গার ঘাটে সেই ব্রাহ্মণ বসে আছেন। বোধহয় হাওয়া খাচ্ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখে ব্রাহ্মণ বলছেন, কী ঠাকুর। বলি, আছ কেমন? তার কথার স্বর বলার ধরন দেখে ঠাকুর বললেন, ওরে হৃদে! এ লোকটার টাকা হয়েছে, তাই এইরকম কথা। তা মশাই, আপনার ধরন-ধারণ দেখে আমারও তাই মনে হচ্ছে, আপনার টাকা হয়েছে। অবেলায় মদ চড়িয়েছেন। সেই অবস্থায় এসেছেন মেয়ের খোঁজ নিতে!

ভদ্রলোক প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গেলেন। পরমুহূর্তেই সামলে নিয়ে বললেন, আমাদের সোসাইটিতে এটা কোনও ব্যাপার নয়। একে আমরা বলি, হেলথ ড্রিঙ্ক। আমি জানতে চাই আমার মেয়ে মুকু কোথায়?

কাকাবাবু ঠিক অনুরূপ ভঙ্গিতে বললেন, আমি জানাতে চাই মুকু এখানে নেই। ছিল, কিন্তু চলে গেছে।

হোয়াট ডু ইউ মিন! সে হস্টেলে নেই, সে এখানে নেই, তা হলে গেল কোথায়? কে তাকে হস্টেল থেকে ফুসলে এখানে এনেছিল! ফোঁসলানো একটা পেনাল অফেন্স। ভারতীয় দণ্ডবিধির কোন ধারায় পড়ে আপনি জানেন?

ঘোড়ার ডিম ধারায়। মেয়ে নিজের ইচ্ছেয় এসেছিল, নিজের ইচ্ছেয় চলে গেছে। ধারাপাত আপনি পড়ুন। আমাদের আর পড়ার বয়েস নেই।

জেনে রাখুন, আপনাদেরও পড়তে হবে। আমি লোকাল থানায় গিয়ে একটা ডায়েরি করে আসি। তখন পড়বেন। কত ধানে কত চাল তখন বুঝবেন!

আপনার মেয়ের বয়েস কত?

অ, আপনি ওই রাস্তায় যেতে চান? অ্যাডাল্ট! মাইনর নয়! তাকে যে ফ্লেশ মার্কেটে পাচার করা হয়নি কে বলতে পারে? আপনার যেরকম যমদূতের মতো চেহারা! খুন করলেও অবাক হবার কিছু নেই।

আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন থানাতে যান। সেইখানেই আবার দেখা হবে। কথা হবে। এমনি তো হবে না। সাক্ষীসাবুদ চাই। কী বলেন?

আমার ভেতরে আবার একটা ভয় গুড়গুড় করে উঠল। মনে পড়ে গেল, ছেলেবেলায় আমাদের ক্লাবের ক্যাপ্টেন দীনবন্ধুদাকে পুলিশ কীরকম নারীঘটিত ব্যাপারে কোমরে দড়ি বেঁধে প্রকাশ্য দিবালোকে নিয়ে গিয়েছিল। আমারও সেই একই অবস্থা হবে?

ভয়ে ভয়ে বললুম, আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আপনি তো আমাদের আত্মীয়!

সো হোয়াট! আমার সঙ্গে তোমার যা সম্পর্ক, তাতে আমার মেয়েকে বিয়ে করা যায়।

বিয়ের কথা আসছে কেন?

অ, তুমি বিয়ের নামে ফুর্তি করবে? আই বিয়িং এ ফাদার সেটা রেলিশ করব!

হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আপনি কী করছেন?

ভদ্রলোক স্তব্ধ হয়ে গেলেন। একেবারে ফিউজ। সঙ্গে সঙ্গে আমি আর এক ডোজ দিয়ে দিলুম, মুকু আপনাকে বাবা বলতে ঘৃণা করে। বড় মেয়েকে তো বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। সে তো পালাল। আজ হঠাৎ বোতল টেনে এখানে এসে বাবাগিরি ফলাচ্ছেন! মুকুকে সময়মতো টাকা পাঠান? চিঠি লেখেন? আপনি তো চরিত্রহীন। আমার কাকিমায়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। হাত

বলে থাবা বলাই ভাল।

কাকাবাবু এইবার একটা পাঞ্চ ঝাড়লেন, বাপ হয়ে কী করে বলতে পারলেন, মেয়েকে বেশ্যালয়ে বিক্রি করা হয়েছে? রাবিশ। ভালগার। জেনে রাখুন, এই পিন্টুর আর মুকুর বিয়ে হবে। হরিদা ফিরে এলেই হবে। কারও বাবার ক্ষমতা নেই আটকায়!

মেসোমশাই একটু টাল খেলেন। চোখদুটো কাতলা মাছের মত ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এমন একজন মানুষকে শ্বশুরমশাই বলে মেনে নিতে হবে ভাবলেই মন বিদ্রোহ করে! এমন একজন মানুষের অমন সুন্দর দুটি মেয়ে হল কী করে! মাসিমার রূপে। আমার জ্যাঠাইমার রূপ তো আমি দেখেছি। দুই ব্রাহ্মিকা। কোথায় লাগে একালের আধুনিকা!

সুধন্যবাবু মেসোমশাইকে ধরে টাল সামলাতে সাহায্য করলেন। ভদ্রলোক বললেন, জামাইবাবু, আপনি পুরো ব্যাপারটাকে এমন ঘুরপাক খাইয়ে দিচ্ছেন কেন? তিলকে তাল করছেন!

জামাইবাবু! তার মানে শ্যালক। কোন শ্যালক? দ্বিতীয়পক্ষের ভাই?

কাকাবাবু বললেন, আগেও দেখেছি, সমস্ত ব্যাপারটাকে উনি সবসময় একটা সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে চান। গ্রহ-বৈগুণ্য। মঙ্গলটা বেয়াড়া জায়গায় বসে আছে। মানুষের সব কথা বলতে আছে মৃত্যুর কথা বলতে নেই, কিন্তু আজ আমি সেই নীতিবিরুদ্ধ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি, এই তেঁটিয়া ভদ্রলোকের অপঘাতে মৃত্যু হবে। আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

সুধন্যবাবু বললেন, আপনি অ্যাস্ট্রোলজার?

ফুটপাথের নই। এই নিয়ে আমি রীতিমতো রিসার্চ করছি। আমার অবিশ্বাসকে আমি বিশ্বাসে নিয়ে আসছি। জীবনের কতভাগ ভাগ্যের দখলে আর কতভাগ পুরুষকারের দখলে, এই রেশিয়োটা আমি বার করতে চাই। রহস্যটা প্রায় ধরে ফেলেছি। মৃত্যু, অসুখ, এইটাই আমার রিসার্চের বিশেষ দিক।

মেসোমশাই চোখদুটো বড়বড় করে বললেন, আপনারা কি বলতে চাইছেন, আমার মেয়ে, আমার কোনও দুর্ভাবনা থাকবে না? এত বড় একটা শহর, মেয়েটা কোথায় গেল আমি জানতে চাইব না! আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই, আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন অপঘাতে মৃত্যু হবে। হয় হবে, সব মানুষকেই একদিন-না-একদিন মরতে হবে। আপনিও মরবেন আমিও মরব। আপনার মেয়ে থাকলে বুঝতেন মেয়ের বাপের কী দুশ্চিন্তা! এতটুকু একটা ছেলে আপনার সামনে আমাকে দুশ্চরিত্র বললে। আপনি শুনলেন, কিছু বললেন না!

ইকোয়াল জাস্টিস। আপনি প্রথমেই তাল ঠুকে বললেন, ফুসলে এনেছে, তারপরে বললেন ফ্লেশ-মার্কেটে বেচে দিয়েছে। কোনও ভদ্রলোক এমন কথা বলে?

তার মানে আমি ছোটলোক?

আপনি মেয়ে চান, না ঝগড়া চান?

হঠাৎ পিতা হরিশঙ্কর আমাকে ভর করলেন। কানের কাছে স্পষ্ট তার কণ্ঠস্বর, ফিনিশ ইট, ফিনিশ ইট। ডোন্ট ওয়েস্ট ইয়োর টাইম, সান। ট্যাকল ইট।

আমি সঙ্গে সঙ্গে হাত জোড় করে বললুম, আমাকে ক্ষমা করবেন। মুকুকে আমি খুঁজে বের করে দোব। নিশ্চয় কোনও বন্ধুর বাড়িতে আছে। কাল ক্লাসে গিয়ে ধরব। আপনার ঠিকানাটা আমাকে দিয়ে যান।

মিষ্টি কথায় কাজ হল। ভদ্রলোক কাঁপা কাঁপা হাতে ঠিকানা লিখলেন। মদ স্নায়ুকে ধরেছে। মদ এইবার মানুষটিকে খেতে শুরু করেছে। কাগজটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। ঢেলা ঢেলা। চোখদুটো জলে ভরে এসেছে। আবেগরুদ্ধ গলায় বললেন, দেখো বাবা, সিনসিয়ারলি একটু দেখো। সকলের ঘৃণা নিয়ে বেঁচে আছি। টাকাপয়সায় কী হয়! কেউ কেউ দু’বার বিয়ে করতে বাধ্য হয়, তাতে চরিত্র কেন খারাপ হবে? মায়ের আসনে আর-একটা মাকে বসাতে পারলে না ওরা, সে দোষ আমার! কীভাবে যে মেন্টাল টর্চার করছে আমাকে। আর তো সহ্য হচ্ছে না। আমার তো আর কোনও ছেলেমেয়ে হয়নি। কে দেখত আমাকে? তোমরা দেখতে! সন্ধের অন্ধকারে পাহাড়ি ভাল্লুকের মতো দু’হাত বাড়িয়ে বার্ধক্য এগিয়ে আসছে। মি লর্ড, আই অ্যাম কাস্টিগেটেড। আই অ্যাম ওলড়, এ হ্যাঁগার্ড হায়না, হাউলিং ইন দি ডাস্ক অফ মাই লাইফ। নো হোয়ার, নো রেসপাইট। মি লর্ড আপ ইন ইয়োর ডোম, ইউ আর এ সাইলেন্ট অবজার্ভার। ইউথ ইজ এ ব্লান্ডার। ম্যানহুড এ স্ট্রাগল। ওলড় এজ এ রিগ্রেট। আর আমি আসতে চাই না ইন ইয়োর কিংডম। মি লর্ড হ্যাং মি বাই দি নেক। আমি শুনেছি তার বাঁশি। বাঁশি বাজে দূর বনে। ভুল, ভুল। লাইফ ইজ অ্যান ইনকিয়োরেবল ডিজিজ। উই অল লেবার অ্যাগেনস্ট আওয়ার ওন কিয়োর, ফর ডেথ ইজ দি কিয়োর অফ অল ডিজিজেস।

নেশা চড়ছে। এজলাসে যেন সওয়াল করছেন এক প্রবীণ আইন ব্যবসায়ী।

আবেগের জগৎ থেকে কঠোর রুদ্র বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে আমার প্রস্তাব, চা খাবেন? পিতা হরিশঙ্করের এই সময়টাই ছিল টি-টাইম। নিজের তৈরি ধবধবে সাদা একটি লুঙ্গি পরে, গায়ে অনুরূপ সাদা গেঞ্জি, পায়ে ভবীচরণ দাসের দোকানের চপ্পল, ফটফট আওয়াজ তুলে এই বারান্দায় পায়চারি করতেন আর মাঝে মাঝে ফিনফিনে পাতলা চায়ের কাপে চুমুক দিতেন। পেছন পেছন ফিরত দার্জিলিং চায়ের বিশিষ্ট গন্ধ। দেখে মনে হত দক্ষিণ ভারতীয় মহাসাধক রমণমহর্ষি পায়চারি করছেন। সৎজীবনের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব মিলিয়ে পঞ্চাশটি মৃত্যুর চিতা জ্বলছে বুকে। বৃহৎ একটা আমগাছের মতো ছিল এই যৌথ পরিবার। ডালে ডালে প্রিয়। আম ঝুলছে। দক্ষিণের বাতায়ন খুলে এমন একটা ঝড় এল, সব আম ঝরে পড়ে গেল। একটি ডালে দুটি মাত্র আম। পিতা আর পুত্র। কে যায় কে থাকে! ভবে কে বলে কদর্য শ্মশান। পরম পবিত্র মহাযোগের স্থান। হেথা এলে পরে যায় মায়া সব।

চা খেয়ে ভেঙেপড়া কপিধ্বজের মতো মেসোমশাই চলে গেলেন শ্যালক সুধন্যর হাত ধরে। কাঠের কারবারি। আসামের বড় টিম্বারমার্চেন্ট। চলে যেতেই কাকাবাবু বসলেন আমাকে নিয়ে। বললেন, কেমন হল? তোমাকে আমি ওই কারণেই সাবধান করি। একেবারে অরক্ষিত। মেয়েদের থেকে শতহস্ত দূরে থাকাই উচিত। এই সেই বয়েস, ফিউম আর পারফিউম দুটোই তোমাকে আকর্ষণ করবে। একটা আদর্শ ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে বয়েসটা পার করে দাও। সামনে হ্যাপি-ভ্যালি। হরিদার জীবন থেকে কি কোনও শিক্ষাই নিতে পারলে না? কামজয়ী মহামানব। যে বয়সে তোমার মা মারা গেলেন, সেই বয়েসটা একবার ভাবোবা! আর দেখলে তো দ্বিতীয় পক্ষের অবস্থা! আর কোনও কথা নয়, এইবার কিছুদিনের জন্যে পালাও। অ্যাস্ট্রোলজিক্যালি এই সময়টা তোমার মোটেই ভাল নয়। ছ’টা বছর কোনওরকমে পার করে দাও। এইটাই হল যৌবনের টিথিং টাইম।

মুকুর কী হবে?

তুমি কি মুকুকে বিয়ে করে ফেলেছ?

তার মানে?

মানে, রেজিস্ট্রি।

আজ্ঞে না। মুকু আমার মতো মেয়েছেলেকে বিয়ে করবে না। মুকু হল শক্তি, মুকু ভৈরবী। মুকুকে খুঁজে দেবার দায়িত্ব আমি নিয়েছি।

আর হরিদাকে খোঁজার দায়িত্ব কার ওপর দিয়েছ?

স্তব্ধ হয়ে বসে রইলুম কিছুক্ষণ। সত্যিই তো। কী করেছি তার জন্যে! শুধুই জল্পনা।

কাকাবাবু বললেন, জেনে রাখো, ঠিক তিন দিনের মাথায় আবার একটা ঘোরতর সমস্যা আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *